সম্পাদকের কথা- শীত প্রায় শেষের দিকে। সাময়িক জড়তা যেন গ্রাস করেছিল প্রকৃতির সাথে সাথে আমাদেরকেও। আসলে শীত মানেই তো স্থবিরতা! যদিও আমাদের মত দেশে শীত সবসময়ই উপভোগ্য। তবু বিপুল সংখ্যক নিরাশ্রয়, নিরন্ন মানুষের কাছে শীতের তীব্রতা কখনোই কাম্য নয়। শীত শেষে প্রকৃতিতে এখন নতুনের আহ্বান। সেজে উঠছে প্রকৃতি বসন্ত সমাগমে। এই আগমন তখনই সার্থক যখন মনের জড়তাকে ঝেড়ে ফেলে নতুনের সাথে মেলাতে পারবো পা। নতুনকে আহ্বানে মিশে যেতে পারবো পুরোনকে নিয়ে নব সৃষ্টিতে নব আনন্দে।
এই সংখ্যায় লিখেছেন যাঁরা- মীরা সরকার, আবদুস সালাম, বেলা দে, নরেশ রায়, লক্ষ্মী নন্দী, ঝর্ণা মুখার্জী, কুমকুম ঘোষ, শিউলি চক্রবর্তী, রাহুল গাঙ্গুলী, নীপবীথি ভৌমিক, আনিসুর রহমান খান, মন্দিরা ঘোষ, বর্ণালী সেন ভট্টাচার্য, ফিরোজ আখতার, মৌসুমী চৌধুরী, সোমা বোস, সপ্তক, অপর্ণা দেবনাথ, পিনাকি, শিবু মন্ডল, দেবার্ঘ সেন, মাধবী দাস, সুদীপ ব্যানার্জী, সোমনাথ গুহ, উদয় সাহা, দীপশিখা চক্রবর্তী, কৌশিক চক্রবর্তী, বিপ্লব সরকার, অসীম ভুঁইয়া, শম্পা চক্রবর্তী, অমলেন্দু বিশ্বাস, দেবারতি চক্রবর্তী, শুভদীপ চক্রবর্তী, রুবাইয়া জেসমিন, দেবপ্রিয়া সরকার, শিপ্রা পাল, দেবশ্রী চক্রবর্তী, সন্দীপা নন্দী গোস্বামী, বর্ণালী সেন, সুজাতা মিথিলা, সুস্মিতা কুন্ডু, রীনা মজুমদার, সম্পা দত্ত, শান্তনু দাস, দেবযানী সিনহা, সুপ্রীতি বর্মন, মজনু মিয়া, শ্রাবণী সরকার সেনগুপ্ত, জয় চক্রবর্তী, সঞ্চিতা দাস, নিশীথ বরণ চৌধুরী, অনিন্দিতা চক্রবর্তী, জয়ন্ত চ্যাটার্জী, গৌতম ভৌমিক, শৌভিক কার্য্যী, বিশ্বনাথ সাহা, রাহুল ঘোষ, দেবদর্শন চন্দ, ননীগোপাল সরকার, অনিমেষ, নীলকন্ঠ মিশ্র, তাপস দাস, রাজেশ, রবীন সাহানা, স্বরূপ মুখার্জী, সুকন্যা সামন্ত, মাম্পি রায়, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
সম্পাদনা, বিন্যাস ও অলঙ্করণ- শৌভিক রায়
কবিতা- প্রথম পর্যায়
অবসাদ
মীরা সরকার
এত প্রচার চায় কেন জীবন আমার?
চালচিত্র সরে গেলেই দেখি অন্ধকার।
যেন আদিগন্ত প্রসারিত ধূ ধূ মরুভূমি;
এর কাছে বারিবিন্দু যাচি নি তো আমি।
শব্দহীন ভ্যান গখ বিশাল 'চিৎকার ';
শুনি নি মন দিয়ে ধূর্ত নির্বিকার ।
তৌলদন্ডে মাপা আছে ব্যয়িত সেদিন;
স্বীকারে গোপন লজ্জা যাপনের ঋণ ।
ভাষা শহিদ স্মরণে
আবদুস সালাম
ভাষার সমুদ্র উথাল পাতাল
ঢেউ এর তালে বর্ণমালার অমোঘ কথন
ঝুম ঝুম চলে রাণারের মতো জল ঝড় মাথায়
পার হয় তেপান্তর
ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমীর দেশে ফুল ফোটায়
ঝরে সুরের আলাপ
মায়ার টানে জেগে ওঠে আসঙ্গ প্রত্যাশা
অসম শক্তি মুছে দিতে চায় দিক চিহ্ন
মুছে দিতে চায় স্বপ্ন
হে প্রিয় আমার মাতৃভাষা
পথের দুপাশে পড়ে আছে তোমার আলিঙ্গন
পরতে পরতে সাজানো রামধনুর অবিমিশ্র রংবাসর
আক্রোশের বেলাভূমিতে আছড়ে পড়লো তাজা প্রাণ
মেডিক্যাল চত্তর ভাসলো রক্তের বন্যায়
হতবম্ভের মতো চরম মূর্ততায় গেয়ে উঠি
( আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি) ------
সিদ্ধ আমি
বেলা দে
সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে
জীবন উঠছে তড়তড়িয়ে
রাস্তার ধুলো ঝেড়ে
রৌদ্রজ্জ্বল সময়কে নিয়ে বাঁচতে
তট ছুঁয়ে প্রতিরোজ নৈ:শব্দিক পদচারণ
সেখানে অমোঘ স্বীকৃতির
অনাবিল বিশ্বাসী আহ্বান
আমার অস্তিত্বকে আলো মাখে
ভরিয়ে রাখে ভুবন
ঋদ্ধ আমি সিদ্ধ আমি
জলচোখ মুছে
জ্যোৎস্না কুড়াই।
তোমার জন্য
নরেশ রায়
এই যে শব্দ নিয়ে খেলা
শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে তৈরী সেতু ভেলা
কখনো শব্দের নুপুর নিক্কন শোনায়
ঘন কুয়াশার ওপারে তুমি এপারে একরাশ উৎকন্ঠায় ।
ফুল পাখি বসন্ত বাতাস কার অপেক্ষায়
এই যে বইমেলা শীতের নানা মেলা উৎসব
কিসের জন্য কার জন্য ।
কথার পরে সাজিয়ে কথা কিসের মালা গাঁথা
নব্য কবির নতুন খাতায় তুমিই কি লুকিয়ে পাতায়
কখন যে জানালা খুলে তাকাবে চোখ তুলে
বেচারা ঠায় দাঁড়িয়ে ঘন কুয়াশায় কখন থেকে
লাল গোলাপ লুকিয়ে হাতে দারুণ শীতে কেঁপে কেঁপে
কিসের জন্য কার জন্য ।
থেমে গেছে ট্রেন , ফিরে গেছে প্লেন না নেমে
শুধু কি ঘন কুয়াশায় না কি তোমার আশায় ।
কার জন্য কিসের জন্য ,শুধু তোমারই জন্য ।
কথা ও কাহিনী
লক্ষ্মী নন্দী
( দীর্ঘ ত্রিপদী ৮ /৮/১০)
কোন এক উষালোকে- প্রাণ উদাসী ঝলকে
রৌদ্র হাসির দিবা অালোকে
সুদূরের অানমনে বসে অাছি বাতায়নে
ওগো কেন খোঁজো প্রিয়জনে।
অামি ভাবি খেলা ঘরে--অাছ তুমি কার তরে
কোন বিদেশিনী দেখিবারে
একি তব ব্যাকুলতা--কেন এই অাকুলতা
অামি অরণ্যের ঝরা পাতা।
অামি অাছি ধুলি তলে--অামি অাছি তৃণে জলে
অামি অাছি বিশ্বের হিল্লোলে
অামি যে লীলার ছল--অামি যে অাঁখির জল
ফিরিতে চাহিনা ধরাতল।
কেন মোরে তবু ডাকো--কেন মোর ছবি অাঁকো
কেন পথ পানে চেয়ে থাকো
অামি অাশার অতীত--নয় পরশ চকিত
অামি শুধু ইন্দ্রিয় কম্পিত।
সে-দিন সেই অঙ্গনে--জ্যোছনারই চন্দনে
বিদায় নিয়েছিনু প্রাঙ্গনে
তুমি কত হয়রানি--কত বলেছিলে বাণী
ললাটে কত করিছ হানি।
অনাগত সুখ সাথে--অামি যে ঘুরিয়া পথে
উঠে ছিলুম বিজয় রথে
তুমি মোরে তপ্ত প্রাণে--অবসাদে অবসানে
বিদায় দিয়েছিলে অশ্রুজলে।
সব কিছু ভুলে গেলে?--বিজয়ের মালাগলে
মুক্ত কেশে এসেছিনু চলে
অামি অাছি সযতনে--অাভাসের শূন্য প্রানে
নিশ্বাসে উচ্ছ্বাসের গুঞ্জনে।
যদি অাসিবে দেখিতে-- তবে এসো স্বপনেতে
অামি থাকিব পরশ পেতে
তুমি এসো গো বিজনে--ছায়া ঘনায় নয়নে
তুষার ধবল কুঞ্জবনে।
দেখিবে মেঘের খেলা-দেখিবে সুখের মেলা
দেখিবে বিশ্ববিধাতার ভেলা
চরিয়া ভেলায় তুমি--নামিবে গগন চুমি
জাগিয়া দেখিবে ঐ ধরণী।।।
''স্বপ্ন ''
ঝর্ণা মুখার্জী
চোখের দরজার আড়ালে অনেক স্বপ্ন
স্বপ্ন ই থেকে গেল ।
নীল নদের পাড় ,দু চোখে স্বপ্ন অপার
আমাজন এর মোহনা, দু চোখের কোণায় ।
ভোলগা আর ডণ এর জল না দেখায়
দু চোখ ছলছল ।
প্রকৃতির পান্না সবুজ সাজ ,
সবুজ বনানী র সৌন্দর্য অপার
কিশলয় পাতার মাতামাতি
জাফরানি রোদের ঝিকিমিকি
প্রজাপতি রঙের ফুলকি
নক্ষত্রের রূপালী আলো
পৃথিবীর যা কিছু ভাল
সবই গাঢ় কালো
দু চোখ ভরে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন
অন্ধকার ভরা দু চোখের মধ্যে আজ মগ্ন ।
স্বপ্ন ই থেকে গেল ।
নীল নদের পাড় ,দু চোখে স্বপ্ন অপার
আমাজন এর মোহনা, দু চোখের কোণায় ।
ভোলগা আর ডণ এর জল না দেখায়
দু চোখ ছলছল ।
প্রকৃতির পান্না সবুজ সাজ ,
সবুজ বনানী র সৌন্দর্য অপার
কিশলয় পাতার মাতামাতি
জাফরানি রোদের ঝিকিমিকি
প্রজাপতি রঙের ফুলকি
নক্ষত্রের রূপালী আলো
পৃথিবীর যা কিছু ভাল
সবই গাঢ় কালো
দু চোখ ভরে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন
অন্ধকার ভরা দু চোখের মধ্যে আজ মগ্ন ।
তবু ফিরে আসা ---
কুমকুম ঘোষ
তবু ফিরে আসা :
পুরনো অভ্যেসে
রৌদ্রবিলাসের সমারোহে ;
অথবা ভেতর চুঁইয়ে আসা
গাঢ়তর কুয়াশা -সংরাগে।
তবু ফিরে আসা :
জরায়ু -আঁধার চিরে
যেমন আসে উষার আলো ;
দীপিত জীবনের পাশটিতে ।
তবু ফিরে আসা :
ক্লান্তিতে , ক্ষয়াটে সময়ের ক্লিন্নতায় দর-দামের মাংসমজ্জায়--মৃতপ্রায় ;
অথচ-- অবশিষ্ট আশা
যাপিত জীবনের ছায়ায় ।
তবু ফিরে আসা :
ত্রয়োদশীর চাঁদের বুকে
জমে থাকা পূর্ণিমা-আশ্বাসে ;
গোল্লাছুট্ - এক্কাদোক্কা-রঙমিলন্তির সাদা-কালোয় পূনর্বার ডুব দিতে;
কিংবা শাড়ীর ভাঁজে
চোরকাঁটার গোপন বিলাসে।
তবু ফিরে আসা--
তবু ফিরে আসা।
অসম্পূর্ণ ছবি
শিউলি চক্রবর্তী
বিষণ্ণ বিকেলে শীতমাখা পড়ন্ত রোদ
ভাবের মাঝে রূপের অধরা অবয়ব
গড়িয়ে যায় বিকেল---
রাত নামে জোনাকির আবছায়া অন্ধকারে।
ছবি আঁকব ব'লে
ইজেলে সেঁটেছি নতুন কাগজ
খুঁজে নিয়েছি তুলি---
ছোট বড় মাঝারি।
প্যাস্টেলের গায়ে রঙ নানা রকম।
বিষণ্ণ গোধূলির আগুন রঙে
কালো মেঘের অবয়ব ফুটে ওঠে---
সূর্যাস্তের ছবি বসন্তের ভাষা বোঝে না।
কোকিলের কনসার্টে বিপন্ন ক্যানভাস।
রঙমাখা তুলি, প্যাস্টেল
তবু অধরা অবয়ব।
কবিতা
রাহুল গাঙ্গুলী
অপা ~ ১ অদৃশ্য দৃশ্যকল্প
[১] জতুগৃহ সমাকলন _____
তোমারই গভীরতা
মাথা গুঁজে ঘুমিয়ে পড়তে চায় সে
তোমারিই : অহংকার।অলংকার
যাবতীয় ব-দ্বীপের আড়াল
বেলুনের স্তন : গিলে ফেলে গোলাপি অজগর
[২] ইথারের বিছানায় _______
যতোটা শয়তান ভাবো।ততোটা ঈশ্বরীয়
কৃষ্ণপক্ষের জানলায় : চাঁদবীত ক্ষত
আঘাত।লাঙল।নোঙর।ডাকটিকিট
বেসামাল পর্দা তুললে : নিষিদ্ধ অনুপ্রবেশ
কবরীয় যোনিপথে জমাই : সোঁদাগন্ধের মাটি
[৩] অকালবৃষ্টি _______
কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল : সামুদ্রিক শৃঙ্গার
অবিকল ঝিনুকের মেঘ
বিদ্যুৎ চমকায়।রেখাচিত্রে কম্পনের সংকেত
সংবেগী ঠোঁট : তিরতিরে জলময়
কাগজের চৌকাঠ পেরিয়ে : অশ্লীল ঘূর্ণাবর্ত
এলোভিজে চুল তোমার : মাখাচ্ছে চশমার গতিপথ
[৪] বিচ্যুতিরেখা _______
অবশেষে পশমি নখের আঁচড়
লালপাড় শাড়ি : রেলগাড়ি মুছে ফেলে
শীৎকারে কে বেশী ঘনো : রাত বড়ো।দুপুর ছোটো
কম্পাস মাখামাখি লালায়
≠
লালায় মাখামাখি কম্পাস
জ্যামিতিবাক্সে দেখি প্রজাপতির হিমদেহ
নষ্ট ফাঁকতালে : তুমি আদরের চিঠি লেখা শেখাও
আবছায়া
নীপবীথি ভৌমিক
ছাদ থেকে একটা শহর শেষ হয়ে গেলে কেমন হয় জানো
?
এক মাঘ থেকে আর এক হেমন্ত
এক পাতার দেশ থেকে অন্য
কোথাও আর এক লবণাক্ত হ্রদের পারে !
চির হরিৎ বৃক্ষ চিনতে পারিনি সেদিন ।
আর চিনতে পারিনি বলেই
আজও আমার আকাশ দেখা হলো না ।
মায়াবী স্বপ্নে নামে আগুন স্যাঁকা মেয়ে মাংস
,ঘরে যখন খলখলিয়ে যায়
কারোর স্ত্রী, বোন অথবা কিশোরী মেয়ে রক্ত ।
বিব্রত সময়
আনিসুর রহমান খান
আজকাল মানুষের বোধ কমে গেছে
চিরল চিরল পাতাদের বিশ্বাস আছে
ডাল পালা মজবুত ওই বৃক্ষের শরীর
কেবল মনুষ্য আত্মা নড়বড়ে আজ।
ডানা ভাঙা পাখির মতোই ছটফট দেহ
মন উড়ে যায় পাখির স্বভাবে নিয়তই
সমাজে ধরেছে কেবল ভাঙ্গন বিশ্বাসে
বিশ্বাস নেই আর মানুষের মননেও।
গজালে উঁইয়ের পাখা শেষ পরিনতি
তাপ পেলে গলে যায় বরফের চাঁই
এমন করেই সভ্যতা হারাবে মানুষ
বিব্রত সময় অপেক্ষমান দেশ দেশে।
আনিসুর রহমান খান
আজকাল মানুষের বোধ কমে গেছে
চিরল চিরল পাতাদের বিশ্বাস আছে
ডাল পালা মজবুত ওই বৃক্ষের শরীর
কেবল মনুষ্য আত্মা নড়বড়ে আজ।
ডানা ভাঙা পাখির মতোই ছটফট দেহ
মন উড়ে যায় পাখির স্বভাবে নিয়তই
সমাজে ধরেছে কেবল ভাঙ্গন বিশ্বাসে
বিশ্বাস নেই আর মানুষের মননেও।
গজালে উঁইয়ের পাখা শেষ পরিনতি
তাপ পেলে গলে যায় বরফের চাঁই
এমন করেই সভ্যতা হারাবে মানুষ
বিব্রত সময় অপেক্ষমান দেশ দেশে।
ফিরে আসি বার বার
মন্দিরা ঘোষ
স্যাঁতালো বিবর্ণ জন্মদাগ দেওয়াল জুড়ে
উঠোনের শ্যাওলায় ঘুমঘরে গত জন্মের কথারা
ভাঙ্গা ইঁটের সম্ভারে বাস্তুসাপের খোলস
ভ্রুণের কান্নাজলে জ্যোৎস্নাযোনি ভিজে যায়
কথা বলি ফিসফাস নিদ্রিত কথার গায়ে
কিছু অশরীরী স্নেহ ছায়ার পালক রাখে
ফিরে আসি বার বার
বৈদেহীর শব্দিত অভিমানে
পুরু লেন্সের আলো উঠোনের কোণে
হাতপাখায় ভিজে আঁচলের সুখ
ভুঁইচাপার মত জমি ফুঁড়ে ওঠে
তুলসীতলার হলুদ মায়ারা এক্কাদোক্কায়
মন্দিরা ঘোষ
স্যাঁতালো বিবর্ণ জন্মদাগ দেওয়াল জুড়ে
উঠোনের শ্যাওলায় ঘুমঘরে গত জন্মের কথারা
ভাঙ্গা ইঁটের সম্ভারে বাস্তুসাপের খোলস
ভ্রুণের কান্নাজলে জ্যোৎস্নাযোনি ভিজে যায়
কথা বলি ফিসফাস নিদ্রিত কথার গায়ে
কিছু অশরীরী স্নেহ ছায়ার পালক রাখে
ফিরে আসি বার বার
বৈদেহীর শব্দিত অভিমানে
পুরু লেন্সের আলো উঠোনের কোণে
হাতপাখায় ভিজে আঁচলের সুখ
ভুঁইচাপার মত জমি ফুঁড়ে ওঠে
তুলসীতলার হলুদ মায়ারা এক্কাদোক্কায়
মেতে ওঠে
পুকুরের কালো জলে হেঁটে ফিরি যেখানে
যাওয়া হল না কোনদিন
ফিরে আসি বার বার এই ধূলোর সরলরেখায়
পুকুরের কালো জলে হেঁটে ফিরি যেখানে
যাওয়া হল না কোনদিন
ফিরে আসি বার বার এই ধূলোর সরলরেখায়
সমিধ
বর্ণালী সেন ভট্টাচার্য
এবার আমায় হাঁটতে হবে নগ্ন পায়ে
ঝড়ের ঝাপটা সইতে হবে আদুল গায়ে ,
থামিয়ে রাখি কালি কলম আর কবিতা
উড়িয়ে দিলাম সব অনুভব বিষণ্ণতা।
এবার মাঝি ফেরাও তোমার নৌকোটাকে
ঐ দ্যাখো , কেউ দাঁড়িয়ে আছে নদীর ঘাটে।
বন্ধ করো পাখি তোমার উড়াল ডানা
অনেক বাকি জীবন বোঝার জীবন জানার।
খুঁজতে হবে কোথায় থেমে গানের কলি
চলতে হবে শহর ছেড়ে গ্রাম্য গলি
বন্ধ হলে চোখের পাতা নেভে আলো
খুঁজবো এবার শিশুর চোখের স্বপ্নগুলো।
থাক না পড়ে পুঁথির পাতা ধ্বস্ত সকাল!
যত্ন করি ভালোবাসার অনন্তকাল
আর কিছু না , আর কিছু নেই , কেউ থাকে না
বুঝতে পারি অনেক বাকি জীবন চেনার।
গল্প
ডাইনি
ফিরোজ আখতার
গল্পটি ঝাড়খন্ড জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের । রাঁচি
থেকে প্রায় এক’শ কিমি পশ্চিমের একটি গ্রাম, নাম শাঁখভূম
। গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা চাষবাস ও খেতমজুরী । গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে
বেশ কয়েকঘর আদিবাসী বাস করতো । তারা মূলত অন্যের ক্ষেতে মজদুর খাটত বা আশেপাশের
গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি করে নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদন করতো । সকলের সঙ্গে মেলামেশা করার
অধিকারও তাদের ছিল না । এমনকি তাদের জন্য একটা আলাদা কুয়ো ছিল । তার থেকেই জল
সংগ্রহ করতো তারা । গ্রামের একেবারে শেষ বাড়িটি
ছিল মানু বুড়ির । সাতকুলে তার কেউ ছিল না । আশেপাশের গ্রামে
ভিক্ষাবৃত্তি করে সে তার গ্রাসাচ্ছাদন করতো । তার নিজের অবশ্য একটা খড়ের ছাওয়া
দোচালা ঘর আর আধ বিঘে জমিও ছিল । জমির বেশির ভাগ জায়গা পোড়ো অবস্থায় পড়ে ছিল ।
কিছু অংশে মানু নিজেই শাকসব্জি চাষ করতো । আর হ্যাঁ, বুড়ির প্রাণে ভয়ডর বলে কিছু
ছিল না । তার জমিতে কেউ উঠেছে জানতে পারলে লাঠি নিয়ে তেড়ে যেত আর গাল দিয়ে মাত করে
দিত । যখের মত আগলে রেখেছিল সে তার সম্পত্তিকে ।
এ হেন গ্রামেই একদিন ঘটে গেলো মারাত্মক এক দুর্ঘটনা ।
গ্রামের তিনটি ছেলেকে একদিন সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া গেলো না । স্কুলে যাবে বলে
অন্যান্যদিনের মত তারা বেরিয়েছিল সকালবেলা । প্রত্যেকের বয়সই আনুমানিক পনেরো বছরের
কাছকাছি হবে । তিনজনেই ক্লাস নাইনে পড়তো । সকলে
অবস্থাপন্ন চাষিবাড়ির ছেলে । সন্ধ্যের সময়ও যখন তারা ফিরল না, তখন টনক নড়ল তাদের
বাড়ির লোকের । কিন্তু সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে খুঁজেও ছেলেগুলোর টিকিটি খুঁজে পাওয়া গেল না । শেষমেশ গ্রামের মোড়লকে গিয়ে ধরল তারা ।
মোড়ল পূর্ব থেকেই ঘটনাটা জানতেন । তিনি স্থানীয়
‘জানগুরু’ আর ওঝাদের নিয়ে আলোচনাতে বসলেন । গ্রামের অলিখিত নিয়মই ছিল যে, গ্রামে
কোন সমস্যা দেখা দিলে ওঝারাই তার সমাধান করে দিত ।
এমনকি ওঝাদের সম্মতি ছাড়া গ্রামে বিয়ে পর্যন্ত হত না । ওঝাদের প্রধানকে গ্রামের
সকলে ‘জানগুরু’ বলে ডাকতো ।
সব শুনে ‘জানগুরু’
রায় দিলেন যে এ নির্ঘাত কোন ডাইনি বা ডাইনেরই কাজ । নিশ্চয়ই ছেলেগুলোকে সে-ই গুম করে রেখেছে । অমাবস্যা আর দু-দিন বাকি । ঐ অমাবস্যার দিনেই ছেলেতিনটিকে
বলি দেবে শয়তানটা ! শুনে সকলেই মহা চিন্তায় পড়লো । ডাইনিকে ধরার উপায়ও বলে দিলেন
‘জানগুরু’ । তাঁর কথামত সেদিন রাতেই তিন-চারটে পুঁটুলিতে সমান পরিমাণ চাল ভর্তি
করে গ্রামের সবথেকে বড় বটগাছের সবচেয়ে মোটা ডালটায় ঝুলিয়ে রাখা হল । পুটুলিগুলোর
প্রত্যেকটায় এক একজনের নাম লেখা হল । তার মধ্যে একটা নাম মানু বুড়িরও ছিল । কেননা
প্রথম থেকেই মানু বুড়ির উপর সন্দেহ ছিল গ্রামের মোড়লের । এভাবে সারারাত অপেক্ষা
করার পর ভোরের বেলায় পুঁটুলিগুলো গাছ থেকে নামানো হল ‘জানগুরু’ আর ওঝাদের তত্ত্বাবধানে
। দেখা গেল যে মানু লেখা পুঁটুলিতেই পিঁপড়ে বেশি ধরেছে । আর ঐ পুঁটুলির চালের
পরিমাণও সবথেকে কমে গেছে । পিঁপড়ে সবথেকে বেশি চাল নিয়ে গেছে মানুর পুঁটুলি থেকেই
।
‘জানগুরু’ ঘোষণা করলেন,
‘যেহেতু পিঁপড়েরা সবথেকে বেশি চাল মানু বুড়ির পুঁটুলি থেকেই নিয়ে গেছে, সেহেতু ঐ
মানু শয়তানটাই ডাইনি । কেননা পিঁপড়েরা সব খবর রাখে ।
গ্রামের মোড়লও
‘জানগুরু’কে সমর্থন করলেন । ‘ঐ মানু ডাইনিকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে’ । বিধান
দিলেন মোড়ল ।
এই ঘোষণায় যেন আগুনে ঘি
পড়লো । গ্রামের অনেকেই খাপ্পা ছিল মানুর উপর । সকলে মিলে চড়াও হল মানু বুড়ির
দোচালা ঘরটায় । মানুর জমির কোণাকোণা তন্নতন্ন করে খোঁজা হল । ঘরখানিও লণ্ডভণ্ড করা
হল । কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না ছেলেতিনটেকে । ক্ষিপ্ত গ্রামবাসী তখন মানুকে
তার ঘরে পুরে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল ঘরটায় । মানু চিৎকার করে বলতে থাকলো ‘সে কিছু
করে নি, সে কিছু জানে না’; কিন্তু সেই কথা গ্রামের কেউই বিশ্বাস করলো না । সকালে
ছাই হয়ে যাওয়া বাঁশ আর খড়ের স্তূপে মানুডাইনির সম্পূর্ণ দগ্ধ লাশটাকে উদ্ধার করে
নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল শিয়াল-কুকুরদের উদ্দেশ্যে ।
আরও দুদিন পরের কথা ।
ছেলেতিনটি ফিরে এসেছিল গ্রামে । কাউকে কিছু না বলেই তারা রাঁচি চলে গেছিলো প্রমোদ
ভ্রমণের উদ্দেশ্যে । সঙ্গের টাকাপয়সা শেষ হয়ে যেতে তারা ফিরে আসে
গ্রামে । আর হ্যাঁ, একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, এখন কিন্তু গ্রামটায় গেলে আর মানুর
পোড়ো জমি বা তার ভগ্নঘর দেখতে পাওয়া যাবে না । গ্রামের মোড়ল আর ‘জানগুরু’ পুরো
জমিটাকে দুভাগে ভাগ করে নিয়েছেন । এখন সেখানে গমের ক্ষেতে গমের সোনালী শিষগুলি
হাল্কা হাওয়ায় নাচতে থাকে ।
গয়না
মৌসুমী চৌধুরী
অফিস ফেরত দ্রুত বাড়ির দিকে হাঁটছিলো পৃথা। হঠাৎ কানে আসে, "অ্যাই যে গো,অ্যাই দিকে একবার শুনবা, মা। অ মা গো...", এক বৃদ্ধা,অশক্ত, অসুস্হ। পরনে মলিন পোষাক। কোলের কাছে রাখা ময়লা একটা পুটুলি।পৃথা জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে বুড়ি মা?" তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে না পেরে হাঁপাতে থাকে অর্ধ-অচৈতন্য বৃদ্ধা । পৃথা জিজ্ঞেস করে, "আপনার নাম কি? থাকেন কোথায়? " উত্তরে খুব ক্ষীণ স্বরে বৃদ্ধা বলেন, "ঠাকমায় নাম থুইছিলো গীতা। অহন সবায় বুড়ি ডাহে। আমারে একটু অসপাতাল থুইয়া আইবা, মা। এক বাড়িত কাম করতাম। অসুক হওনে তাড়ায়া দিলো। এই পুটলায় কয়খান সোনার গয়না আছে। বেইচ্যা আমার চিকিৎসা করবা?" বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বৃদ্ধা। বৃদ্ধার কথায় ঠাম্মার মতো পূর্ববঙ্গীয় টান। মনটা হু-হু করে ওঠে পৃথার............ পথচারীদের সাহায্যে হসপিটালে ভর্তি করার সঙ্গে সঙ্গেই বৃদ্ধাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন ডাক্তাররা। তার পুটুলির ভেতর থেকে পৃথা পায় সোনার হার, আংটি, কানের দুল আর একটা ছোট্ট ডাইরী। তার প্রথম পাতায় লেখা, আমার খোকা-- পাশে একটা ফোন নাম্বার...। হসপিটাল কর্তৃপক্ষ সেই নাম্বারে ফোন করলে উত্তর মেলে,"এমন কোন বৃদ্ধার সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না।" গয়নাগুলো যাদবপুর থানার 'সেফ কাস্টডি'তে জমা দিয়ে সেই নাম্বারে ফোন করে পৃথা। উত্তর আসে, "হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি আমার মা। গয়নাগুলো কোথায় রেখেছেন? বডি কি মর্গে?......"
উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেয় পৃথা।
তুলির টান
সোমা বোস
-
দি’ভাই, তুই আজ সকালে জগিং এ
গেলি না কেন রে?
-
জগিং এ আমি যাই না যাই, তাতে তোর কী?
-
আরে, তুই না যাওয়াতে আমাকে কতজনের কাছে জবাবদিহি করতে হল জানিস?
-
জবাবদিহি?
-
ও বাবা, সে কি এমনি সেমনি জবাবদিহি? “তোমার দিদিকে দেখতে পাচ্ছিনা কেন?” “তোমার দিদির কি শরীর খারাপ?”, “তোমার দিদি কি আজ ঠান্ডায় ঘুম থেকে উঠতে পারেনি”, “তোমার দিদি কি একটু বাদে আসবে?” উফফফ্, এরপর থেকে তুই না গেলে আমিও যাব না। বাবা এখানে তোর এতো ভক্ত আছে, জানা ছিল না তো! তোর ভক্তকূলের এতো কোয়্যারীজের ঝক্কি কে সামলাবে?
-
ওয়ে, কে তোকে সামলানোর দায়িত্ব দিয়েছে? যা, বেরো এখান থেকে।
সেই ঝাঁঝের তেজে ত্রিশের যুবক মনো ওরফে মনসিজ প্রায় উড়েই যায় আর কি! কোনক্রমে দরজার বাইরে বেরিয়ে এসে স্বস্তি। বত্রিশ বছরের ঝকঝকে তরুণী মন্দা ওরফে মন্দাক্রান্তা বাগচী একজন সফল হার্ট-স্পেশালিস্ট হওয়ার সাথে সাথে একজন সফল চিত্রশিল্পীও বটে। নানা জায়গায় তার চিত্রপ্রদর্শনী হয়ে থাকে। তার আঁকা ছবি বেশ চড়াদামে বিকোয় নানা চিত্রগ্রাহকের কাছে। কিন্তু এহেন ব্যস্ত শিড্যুলের মধ্যেও তার দৈনন্দিন শরীরচর্চার রুটিনে খুব একটা হেরফের হতে দেয় না সে। গতকাল অ্যাকাডেমিতে তার চিত্রপ্রদর্শনী ছিল। আবার কবে হবে সেব্যাপারে দিনক্ষণ এখনো স্থির হয়নি। তবে আগেই সে স্থির করে রেখেছিল আজ দাদানকে সঙ্গে করে বিকেলের দিকে বেলুড়মঠে যাবে। দাদান অবশ্য জানেনা, সে নিজেই মনেমনে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু কাল রাতের একটা ফোন তার সব প্ল্যান ভেস্তে দিল। যাক সে কথা।
তিন’বছর আগের এক গাড়ি-দুর্ঘটনায় মা আর বাবার একসঙ্গে মৃত্যুটা দাদান এতদিনে বোধহয় স্বাভাবিকভাবে নিতে পেরেছে। সেই ঘটনায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে গিয়েছিলো। লন্ডনে এমডি’র পড়াশোনার পাট চুকোনোর পর মন্দা তখন সেখানে রীতিমতো প্র্যাকটিস জমিয়ে ওয়েল সেটলড। এদিকে ভাই মনো জাপানে সদ্য সেটলড। এসময়ে এই দুঃসংবাদ। দু’জনের বডি তাদের বাড়িতে এসে আছে আর দাদান তাদের বালিগঞ্জের বাড়িতে একা। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি ভাইবোন দু’জনেই যে যার জায়গা থেকে উড়ে এলো সেখানে। কাকুনও এসেছিল। সেসব দিনের কথা ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। সব অনুষ্ঠান শেষ হলে পরে মনো ফিরে গেলেও মন্দা আর যেতে পারেনি তার দাদানকে ছেড়ে। একবার গিয়ে সেখানকার সব পাট চুকিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিল। কিন্তু সত্যিই কি এতো সহজে সব পাট চুকোনো সম্ভব? সেই ঘটনার পর মনো আর এদেশে আসার সুযোগ পায়নি। এই এবারই এসেছে তিনমাসের ছুটি নিয়ে। তারও একটা কারণ আছে। এবারে তাকে সস্ত্রীক করে ওদেশে ফেরানোর প্ল্যানটা দাদানের মাথায় ছিলই। তাতে তিনি একদম সফল। সামনের মাসেই মনসিজের বাল্যবান্ধবীর সাথে বিয়ের তারিখ একরকম
পাকা।
মন্দা’র চিন্তায় ছেদ পড়লো যখন দাদান এসে মনোর কান টেনে ধরলো “দি’ভায়ের ঘরে উড়ন্ত তুবড়ির মতো না ঢুকলে চলছিল না?”
-
আহ্...। কেন, তাতে কি এমন দোষের হল শুনি?
-
ঘুম থেকে উঠেই জগিং-এ না গিয়ে ছবি আঁকতে বসেছে মানে সামথিং ইজ গড়বড়, তা তুমি বোঝোনা?
-
দাদান, তুমি না দি’ভাইকে বড্ড বেশি মাথায় তুলে রাখো। তোমার কাছে আমার তো কোনো দামই নেই! দিস ইজ নট ফেয়ার!
-
ওরে হিংসুটে! মেয়েরা হল অতিথি। দু’দিন বাদে অন্য বাড়িতে চলে যাবে। তখন এই তুইই এসে এ
বাড়িতে দি’ভাইকে না দেখে কেমন করে থাকিস দেখবো।
-
উহ্হ্হ্, কোথায়? দি’ভাই তো বিয়েই করবে না বলেছে। তাহলে যাবে আবার কোথায়? এখানেই চিরকাল থাকবে আর আমাকে এসে সেকেন্ড সিটিজেনের মতো হয়ে থাকতে হবে। এটাই আমার ফ্রাস্ট্রেশনের জন্যে যথেষ্ট!
-
এ আরেক পাগল! দাঁড়া দাঁড়া। তোর যখন একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি, তখন ওরটাও হবে।
একটু বাদে মনো কোথাও একটা বেরিয়ে গেলে পরে দাদান স্কাইপে তার লন্ডনপ্রবাসী ছোটছেলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই কাকুনের বাড়িতে থেকেই মন্দাক্রান্তা লন্ডনে এমডি’র পড়াশোনা কমপ্লিট করেছিল। সে এবারে তার আঁকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলো। তার এলোমেলো তুলির টানে কি যে ফুটে উঠছে, সে নিজেই জানেনা। নিজের কাছেই নিজের ছবি দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে যেন। ছবিটা নষ্ট করে ফেলবে কিনা ভাবছে, ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে কাকুন ও দাদানের খুব উচ্চকিত হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। হাসুক, হাসুক, তার দাদান প্রাণভরে হাসুক। সে আবার আঁকায় মন দিলো। তবে সে বুঝতে পারছে তার মননের ছবির সাথে এ ছবি ঠিক মিলছে না। যত তা অন্যরূপ নিচ্ছে ততো তার জেদ বেড়ে যাচ্ছে। আবার নতুন ক্যানভাসে নতুন করে শুরু করছে।
তার কানে কালকের কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া কথা কেবলই বেজে চলেছে। দীপন আজও তারই অপেক্ষায় সেদেশে দিন গুণছে। কিন্তু সে এও জানে তার পক্ষে দাদানকে একা কলকাতায় রেখে সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার দীপনদের ওখানে তিনপুরুষের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। অতএব তার পক্ষেও সেদেশ ছেড়ে চলে আসা সম্ভব নয়। তাই তিনবছর যাবৎ তাদের প্রতিটি বার্তালাপের শেষের দিকে নীরব ভাববিনিময়ই মূখ্য হয়ে ওঠে। চিন্তায় ছেদ পড়লো, দাদান তাকে ওঘরে ডাকছে। কিন্তু সে যাবেনা। এই মূহুর্তে তার মননের ছবিকে ক্যানভাসে মূর্ত করে তোলা তার কাছে বেশি ইমপর্ট্যান্ট। না, সে কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কারোর কোনো ডাক তার কানে পৌঁছচ্ছে না। তুলির টানে মগ্ন হয়ে রইলো সে। অকস্মাৎ কাঁধের পেছনে দাদানের হাতের স্পর্শে বুঝি বা সে সম্বিৎ ফিরে পেলো “কি রে, এতো করে ডাকলাম। গেলি না কেন? কাকুন একবার তোকে দেখতে চাইছিল যে!”
-
তুমি ডাকছিলে? কই, আমি শুনতে পাইনি তো?
-
আঁকায় এমন মগ্ন হয়ে থাকলে শুনবি কি করে? তা, কিসের ছবি আঁকলি দেখি...।
-
জানিনা, হচ্ছেনা। বুঝতে পারছি না। দ্যাখো তো কিসের বলে মনে হচ্ছে?
-
হুমমম, দেখি দাঁড়া। হৃদয়ের ডাক্তার হৃদয়ের ছবিই আঁকবে। কিন্তু এতে এতো রক্তক্ষরণ হচ্ছে কেন রে?
-
হৃদয়? রক্তক্ষরণ?
কোথায়? ভালো করে দেখে বলো।
-
ওরে তাই তো মনে হচ্ছে! কাকুন তোকে কেন ডাকছিল জানিস? ওখানে কাকুনের সাথে আরেকজন হাজির ছিল। যাক তুই যাস নি, এ একদিকে ভালোই হয়েছে। আমার শত্তুরের ইন্টারভিউটা নিশ্চিন্তে নিতে পারলাম। হা হা হা হা। সে এদেশে তাদের পৈতৃক ব্যবসার একটি শাখা অফিস খোলার জন্যে একেবারে পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। তাহলে এবারে তুলির টানে অন্য কিছু ফুটে উঠুক।
বাড়ি
সপ্তক
বর্ধমান লোকাল ঢুকছে তিন নম্বরে। ধনঞ্জয় পা চালালো। ট্রেন ঢোকার আগেই দুই নম্বর লাইন টপকে উঠে পড়ল তিন নম্বরে। এত দৌড়াদৌড়ি আজকাল আর সহ্য হয় না। লম্বা অজগরের মত ট্রেনটার পেট থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে লোক। যত না বেরোচ্ছে, তার থেকে ঢুকছে বেশি। ধনঞ্জয় কোনোক্রমে নিজেকে সেঁধিয়ে দিল ভেতরে। চারদিক দেখে নিয়ে একতারায় সুর ধরলো, "আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম........"। নির্বিকার মুখগুলো দেখে ধনঞ্জয় আজকাল বুঝে উঠতে পারে না গানটা মানুষের ভালো লাগছে কিনা, তবু না গেয়ে তার উপায় নেই। অল্প বয়সে গাড়িতে খালাসীর কাজ করত ধনঞ্জয়, তারপর একসিডেন্ট হল, বাঁচার আশা ছিল না, তবু বেঁচে গেল। ডাক্তার জানিয়ে দিল, কোনদিন ভারী কোনো কাজ করতে পারবে না সে। কিছু দিন এক দিদির বাড়িতে থাকার পর সে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াত । লোকে তাকে দেখে দশ হাত দূর দিয়ে যেত। কোনোদিন কিছু জুটত, কোনোদিন বৃথা আশা। অবশেষে এক ফকিরের সঙ্গ পেল। গানের গলা মন্দ ছিল না ধনঞ্জয়ের। সেই ফকিরই তাকে শিখিয়ে দিল একতারার পাঠ। আজ তেইশ বছর ধরে একতারাই তার জীবন।
কখনও কখনও মানুষের জীবনে এমন কিছু মূহুর্ত আসে যখন সে যা দেখছে, চোখ যা দেখাচ্ছে তাঁকে, বোধ যা দৃঢ় ভাবে বোঝাতে চাইছে, সেটা সে বুঝতে চায় না। মন বিশ্বাস করতে চায় না। বিশ্বাস করার জ্বলন্ত দলিল সামনে জ্বলতে থাকে কিন্তু মন জ্বলে উঠে না। সে নেতানো ন্যাকড়ার মত এক কোণে পড়ে থাকতে চায়। সে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চায় অবিশ্বাসের মোড়কে। ঠিক এমনটাই হচ্ছে সুবাসের সাথে। গত মাস দু'য়েক থেকে। আর বিশেষ করে যখন বৌদির মতন নরম সরম সরল মনের মানুষ টি ও তাঁকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছে তখন মন আর ঠুলি পরা চোখে থাকতে পারে? আজ সুবাস হাটে যাওয়ার পথে মনে মনে নিজেকে তৈরি করতে থাকে। নাহ্। আজ ই সুলেখা কে বলতে হবে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। সত্য যত কঠিন ই হোক না কেন তার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা তাঁর রাখতে হবে।************************** ************ ঠিক তেইশ বছরে বিয়ে করেছিল সুবাস। সুলেখা তখন আঠেরো র পূর্ণ শশী। ভালবাসার বিয়ে নয়। বাপ দাদার পছন্দ করা মেয়ে। সুবাসের ও পছন্দ হয়েছিল খুব। সুন্দরী না হলেও সুলেখা'র একটা আকর্ষণীয় শ্রী আছে। মায়াভরা দু'টো চোখ। একটু লালচে উজ্জ্বল রং। এক কোমর চুল। লম্বায় সুবাসের কাছাকাছি। সুবাস দের থেকেও ওদের সাংসারিক অবস্থা একটু পড়তির দিকে। বাবা প্যারালিসিস এ শয্যাশায়ী। দাদা'রা ছোটখাটো ব্যবসা পাতি চালিয়ে দিন গুজরান করছে। আর সুবাস তখন শহরে ভাল ব্যবসা করছে। আখের রস বিক্রি করে ভাল রোজগার করছে। যদি ও মেশিন টা মালিকের তবু ও রোজগার ভাল হত। এক কামরার একটা ঘর ভাড়া নিয়েছে সে। বাড়িতে দাদা বৌদি বাবা মা। "বাবা, ও বাবা, আজ জুতো কিনবে তো ? তুমি বলেছ, আজ কিনে দেবে"। ছেলের ডাকে সম্বিত ফেরে সুবাসের। ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওর কেডস লাগবে। বেশ ক'দিন ধরে বলছিল। সুবাস বলেছে বুধবার হাটের দিন কিনে দেবে। আজ মহাজনের কাছে দুধের টাকা নিয়ে কেনার কথা। সুবাসের দু'টো দুধেল গাই আছে। প্রায় আট ন কিলো দুধ হয় রোজ। দু'টোই ক্রস। সুবাস চিন্তা মুলতুবি রেখে হেসে বলে "হ্যাঁ বাবা কিনে দেব।" ছেলের মুখ সুন্দর নিঃশব্দ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। বাবা ছেলে আবার হাঁটতে থাকে পাকা রাস্তা ধরে। সুবাসের গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে হাট বসে সপ্তাহে দু’দিন। বুধ আর শনিবার। মহাজন প্রতি শনিবার আর বুধবার দুধের টাকা দেয়। ****************************** ***********সুবাসের শহর ছেড়ে আসার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। বিয়ের পর সুলেখা কে নিয়ে শহরে পাড়ি দেয়। এক কামরা থেকে দু'কামরা ঘর ভাড়া নেয় শহরের উপকণ্ঠে। ছোট্ট সংসার। ছোট ছোট দু'টো রুম। অনেক পুরনো। কোথাও কোথাও পলেস্তারা উঠে গেছে। ছোট বারান্দায় একদিকে রান্নার সরঞ্জাম। আর একদিক খোলা। নিচে নেমে একটু টুকরো উঠোন। একদিকে কলতলা বাথরুম। বাড়ির মালিক সামনের জমিতে দো'তলা বানিয়েছেন। এটা কিছুটা পিছনে । তাই ভাড়া ও কম। সুবাসের দুই মেয়ে আর ছেলে এ বাড়িতেই হাঁটতে শিখেছে। বড় হয়েছে। হঠাৎ সুবাসের চোখ দু'টো জ্বালা করতে থাকে। কি সুখ, কি সুখ ছিল তখন ! সুলেখা কে মনে মনে ভালবাসার সঙ্গে শ্রদ্ধা ও করত সুবাস। কি সুন্দর অল্প অল্প করে সংসার টা কে বড় করে তুলেছিল সুলেখা ! ছেলেমেয়েরা ভাল ভাবেই মানুষ হতে লাগল। দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে যখন বাড়ি ফিরত তখন শান্তি যেন দু হাতে সুবাস কে কোলে টেনে নিত। পাড়ার সবাই সুলেখা বলতে অজ্ঞান। সুলেখা খুব মিশতে জানত। সবার দরকারে পাশে থাকত। টাকাপয়সা না দিতে পারলে ও প্রয়োজনে লোকের জন্য খেটে দিতে পারত। বাড়িতে বাবা মা'র জন্য প্রত্যেক মাসেই কিছু করে টাকা পাঠাত। সুবাস কে বলত "দেখ, সংসারে আজ এটা চাই কাল ওটা চাই থাকবেই। তার জন্য পরিশ্রম কর, কিন্তু কাউকে ঠকিয়ো না। সৎ ভাবে বাঁচতে গেলে একটু কম ভাল থাকলে ও দেখবে ভেতর টা বেশ শান্তির টলটল দিঘি। রোজ মালিকের পয়সা দিয়ে যা আয় করবে সেটা আমাদের।" হঠাৎ 'সৎ ' শব্দ টা টং করে কানে বাজল সুবাসের। আজ সততা কি সত্যি ই আছে সুলেখা'র ? না কি ওঁকে ছেড়ে চলে গেছে? সুবাস জানে না। বোঝে না। ঠিক বোঝেনা নয়, সুবাসের মন বুঝতে চায় না। আর এই বোঝা আর বুঝতে না চাওয়ার আগুনে ধিকিধিকি পুড়ছে সুবাস তুষের মত ! ****************************** *********** বছর দুই হল সুবাস গ্রামে ফিরে এসেছে। বাবা মা গত হয়েছেন বছর আট নয়। সুবাসের দুই মেয়ে ও বড় হয়ে গেছে। আখের রস বিক্রি ও আর আগের মতন হচ্ছিল না। চলে যাচ্ছিল কোনওরকম। এমন সময় দাদা এল। দাদার তখন মুখে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সারাক্ষণ সুপুরি মুখে রাখার মতন খৈনি থাকত মুখে। সঙ্গে কম বয়েস থেকে বিড়ি খাওয়া ! মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কিন্তু ছেলেটি সুবাসের ছেলের থেকে বছর দু'য়েকের বড়। সুবাস কে হাল ধরতে হল। দাদা খোঁজ দিল ওদের জমির লাগোয়া সরকার দের বিঘা তিনেক জমি বিক্রি হচ্ছে জলের দরে। গ্রামে সেই বর্ষায় তেমন খরিদ্দার জুটছে না। অগত্যা সুবাস ফিরে এল। এখানে আসার পর বড় মেয়ের বিয়ে ও দিয়ে দিল। জামাইয়ের ছবি তোলার দোকান। কম্পিউটার আছে। বি এ পর্যন্ত পড়েছে। তার মাস দু'য়েক পরে দাদা চলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে সুবাসের। এখন ছোট মেয়ে শহরের কলেজে যায় বাড়ি থেকেই। শহর বেশি দূরে নয়। বারো তেরো কিলোমিটার। ছোট মেয়ে টা সুলেখা'র ধাত পেয়েছে। এখনও আঠেরো হয় নি। কিন্তু চেহারায় বেড়ে গেছে। একটা বাৎসল্য রসের স্রোত বয়ে গেল সুবাসের শরীরে। সুলেখা ! নিজের অজান্তেই নামটা স্পষ্ট উচ্চারিত হল ঠোঁটে। ছেলে হাঁটা থামিয়ে বাবার হাত ধরে বলল "মা'কে ডাকছ কেন ? বাবা, ও বাবা ?" সুবাস ঈষৎ লজ্জা পায়। " চল্ । পা চালা । নয় তো মহাজন চলে যাবে। জুতো কেনা হবে না।" "আমি কি এত হাঁটতে পারি ? তুমি সাইকেল টা সারাচ্ছ না কেন ? ও বাবা ?" "সারাব সারাব । কাল পরশু ই সারাব।" সুবাস জানে কাল পরশু করতে করতে দিন পনেরো হয়ে গেল সাইকেল টা বিকল হয়ে পড়ে আছে। সুলেখা ও অনুযোগ করেছিল। কিন্তু সুবাস মনের অশান্তির জেরে কিছুই করে উঠতে পারছিল না। ****************************** ***********অশান্তি টা ঠিক কবে থেকে মনে চাগাড় দিয়েছে সুবাসের মনে নেই। তবে মাস দু'য়েক তো হবেই। যবে থেকে দু' বাড়ি সামনের দীনেন হালদার ঘন ঘন এ বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। প্রথম প্রথম দিনে একবার। এখন সকাল বিকাল। সন্দেহ যে হচ্ছিল তা নয়! কারণ সন্দেহের মানুষ টা তার সুলেখা ! বাইশ বছরের বিবাহিত জীবন। সুখ দুঃখের সাথী। অত্যন্ত সৎ। নির্ভীক। সাদা কে সাদা, কালো কে কালো বলতে পারে যে নারী। তার তিন সন্তান কে বুক দিয়ে আগলে বড় করেছে যে। খারাপ কিছু চোখে পড়ে নি। সবার সামনে বারান্দায় বসে দীনেন হালদার। সুলেখা একটু দূরে মোড়ায়।সুবাস ও প্রথম প্রথম সঙ্গ দিত। সুলেখা শুধু কথার উত্তর দিত। এখন সুলেখা দীনেন হালদার কে চা করে দেয়। হাসাহাসি করে নানান কথায়। এই দীনেন হালদার এই অঞ্চলের মাথা। আগে এলাকার পঞ্চায়েত ও পরে প্রধান হয়েছিল। এখন কিছু নন। কিন্তু দাপট প্রচুর। গ্রামের প্রায় অর্ধেক জমি ওনার । বছর বাহান্ন হবে। সবার বিপদে সবার আগে গিয়ে পৌঁছয় সে। তাই বেশিরভাগ নিম্ন বিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ গুলো উঁকে ঘাটানোর সাহস পায় না। যদি ও প্রাথমিক সাহায্যের উশুল কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেয় সে। অথবা উশুল দ্বিগুণ হয়। তবু ও! কেউ টুঁ শব্দ টি করে না। নয় তো করার মতন অনেক কিছু আছে। বিপত্নীক দীনেন হালদার। স্ত্রী গত হয়েছে বছর পাঁচেক। বাড়ির রান্নার লোক মিনতি ওঁর বাড়ি আছে যুবতী বেলা থেকে। বেচারা সংসারের জোয়াল সামলাতে আর দীনেন হালদারের নিদারুণ উপকার সামলাতে বুড়িয়ে গেছে অকালে ! পাশের বাড়ির নিতুরা গ্রাম ছেড়ে উঠে গেছে। সবাই জানে কারণ দীনেন হালদার। নিতুর স্ত্রী সুন্দরী। দীনেন হালদার তাঁর থাবা গাড়তে পারে নি। আর আজ যেটা বৌদি বলল সেটা আরও কুরে খাচ্ছে। কোথা থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। সকালে চা দেওয়ার সময় সুবাস বৌদি কে বলল" বিলু টা ঠিক ঠাক স্কুলে যাচ্ছে তো এখন ? " হ্যাঁ, যাচ্ছে। তোমার সাথে দু'টি কথা ছিল ভাই।" "কি কথা ? " " কিছু মনে কর না। জান তো আমি কাজ নিয়ে পড়ে থাকি। আমি কূটকচালি করি না কখনও। আর ছোট ওরকম মেয়েমানুষ ও নয় ওঁকে নিয়ে কেউ কিছু বলবে।" সুবাসের হৃৎপিণ্ড লাফাতে লাগল। কি বলবে বৌদি সুলেখা কে নিয়ে ? স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। বৌদি বলল "লোকের মুখ তো চামড়ার। কখন কি বলবে পাঁচজনে পাঁচ কথা। তাই বলছি ঠাকুরপো ছোট কে সাবধান করে দাও। ঐ মুখোশধারী কালসাপ যে কোনও সময় ছোবল দেবে। দীনেন হালদার কে বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়। ছোটো জানে না। ও ওঁর ছেলে বৌ কে ও রেয়াত করে নি। আধ পাগলা ছেলে কে হা ঘরের সুন্দরী মেয়ে এনে দিয়েছিল। ভেবেছিল দালান কোঠায় ভুলে যাবে ! যেদিন রাতে ছেলে বৌয়ের ঘরে ঢুকেছিল সেদিন ই এই বর্বর টার মাথায় আয়না ছুড়ে মেরে বৌ রাতেই পালিয়ে গেছে। ওঁর হাত লম্বা। তাই মেয়ের বাড়ির লোক কোর্ট কাছারির সুযোগ পায় নি।" একদমে কথা গুলো বলে হাঁপাচ্ছিল বৌদি!
****************************** **********
সুবাস বাজারে পৌঁছে জুতো কেনে ছেলের। আরও কিছু কেনাকাটা করার ছিল। কিন্তু সকালের পর থেকে সুবাস অপেক্ষা করছিল কখন রাত হবে। আজ সুলেখা'র সাথে কথা বলতেই হবে। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। সুবাস নিজেকে জিজ্ঞেস করেছে বার বার, সে কি সুলেখা কে সন্দেহ করে ? ঠিক উওর পায় নি। সুলেখা ! যে তাঁর সদ্য যুবতী বেলায় বিয়ে করে এসে কাটিয়ে দিয়েছে বাইশ টা বছর! সুবাস কে ভরিয়ে তুলেছে সুখে। শরীরে মনে। এখনও যে মাঝে মাঝে ঘোরতর সংসারী চল্লিশোর্ধ্ব সুবাস কে ভরিয়ে রাখে তার উত্তাপের চাদরে ! সে কি করে দ্বিচারিণী হতে পারে ? কিন্তু চোখের দেখা ও তো মিথ্যে নয়। সুলেখা'র গদগদ দীনেন দা ডাক, চকিতে কটাক্ষ। সবটা তো সুবাস সামনে থেকেই দেখেছে। তবে ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফেরার আগেই চলে যায়। কিছু দিন আগে লোকটা তার ফাইভে পড়া বোন ঝি কে পড়াতে বলছিল তাঁর ছোট মেয়ে কে। সুবাস কে বেশ কিছু দিন বলেছিল। সুবাস না হ্যাঁ কিছু ই বলেনি। এখন আর ও কথা বলে না দীনেন হালদার। কেন ? সুবাস ভাবে।
****************************** **********রাতে খাওয়া দাওয়ার পর সুলেখা পান দিতে আসে সুবাসের ঘরে। সুলেখা ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাশের রুমে শোয়। মাঝে মাঝে সুবাস যেদিন বলে শরীর টা ঠিক নেই সেদিন সুবাসের কাছে শোয়। তাঁরা একান্তে এই ছলনা টুকু শুধু নিজেরাই জানে ! সুবাস কিছু বলার আগেই সুলেখা বলে "সারাদিন মুখ শুকনো করে ঘুরছ কেন ? রাতে ও খেলে না, দুপুরে ভাত ফেলে রেখে চলে গেছ। কি হয়েছে ? শরীর খারাপ ?"
সুবাসের ভেতরে যে অন্তর্দাহ টা হচ্ছিল সে এই মায়া মায়া চোখের দিকে চেয়ে নিভে যেতে থাকে। নাহ্। সুলেখা কোনও খারাপ কিছু করতে পারে না! কিন্তু বৌদির কথা টা ? তাছাড়া নিজের চোখ ? সুবাস অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের পেন্ডুলামে অস্থির মন! হঠাৎ একটু হাল্কা হাসির আওয়াজে সুবাস দেখে সুলেখা চেয়ে হাসছে তাঁর দিকে। মূহুর্তে আবার গম্ভীর হয়ে যায়। বলে "তোমায় নিয়ে খুব মুস্কিল ! আচ্ছা, এত ভালবাসো কেন আমাকে ?"
"মানে? "
" মানে তো তুমি বলবে। তারজন্য তো অপেক্ষা করছি। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি বুঝতে পারি নি তুমি এত কষ্ট পাচ্ছ। সংসারের নানান দিকে নজর দিতে দিতে, সব দিক সামলাতে গিয়ে নিজের মানুষ টার দিকেই নজর দিতে পারি নি। আমাকে ক্ষমা কর। "
" কিসের ক্ষমা?"
দিদি'র কথা আমি শুনে ফেলেছি। শুনতে চাই নি ইচ্ছে করে, ওই বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলাম। দাঁড়িয়ে গেছিলাম তোমাদের কথা শুনে, অজান্তেই। "
" তুমি সংসারের সব দিক সামলানোর কথা কি বলছিলে ?" তবুও সুবাস একবারের জন্য দীনেন হালদারের নাম উচ্চারণ করতে পারছে না। তাঁর সারাদিনের নিজেকে তৈরি করা বালির বাঁধের মতন ভেসে যাচ্ছে সুলেখা'র সামনে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুলেখা বলল "তুমি কি জানতে চাও, বল ? তার আগে শুধু এটুকু বল, তুমি কি বিশ্বাস কর আমি খারাপ কাজ করতে পারি ?"
"নাহ্। আমি জানি তুমি খারাপ কিছু করতে পার না। "
" আমি জানি। তাই তোমার চোখের সামনে, বাড়ির সবার সামনেই আমি এই মুখোশধারী শয়তানের সাথে হেসে কথা বলার সাহস করি! "
" মানে ? প্রায় ভাষা হীন হয়ে যায় সুবাস। সুলেখা উঠে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ফিরে এসে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। সুবাস প্রশ্ন চোখে চেয়ে থাকে। সুলেখা নীরবতা ভাঙ্গে..." আজ বিনয় এসেছিল। ওঁকে ডেকেছিলাম। তাড়া আছে বলে চলে গেল। সামনের সপ্তাহে পুনম কে নিয়ে আসবে "। বিনয় সুবাসের বড় মেয়ে পুনমের বর। সে কেন এসেছিল ? তার সাথে এই নিভৃত একান্ত গূঢ় সমস্যার সংযোগ ঠিক বুঝতে পারে না সুবাস। সুলেখা বলে" এই বুড়ো শকুনের সাথে আমি কেন এত তোষামোদ করে কথা বলি জান ? "
" কেন ?"
ওঁর নজর পড়েছিল তোমার মেয়ের উপর। মাস দু'য়েক আগে একদিন ভরদুপুরে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। মেয়ে স্নান সেরে উঠোনে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে চুল ঝাড়ছিল, শকুন টা গো গ্রাসে গিলছে সেটা, উঠোনের কোণার রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আমি প্রথমে হতভম্ব হয়ে যাই। তারপর পরিস্থিতি সামলে নিই "।
" ক.. কি বলছ ?" রাগে বিস্ময়ে প্রায় তোতলা হয়ে যায় সুবাস। সুলেখা বলে "তারপর থেকেই মাঝে মাঝে এসে মেয়ে কে বলে মা, আমার ভাগ্নে টা কে একটু দেখিয়ে দিবি পড়া ? ওই কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যে নাগাদ যাস। ভাল মাইনে পাবি।"
সুবাসের রক্ত টগবগ করে উঠে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে "আমার কাছে ও বেশ ক'দিন ঘ্যান ঘ্যান করেছিল। ওঁকে তো আর মুখের উপর না করতে পারি না।" সুলেখা বলে আমি এই কাল সাপ কে দুধ কলা দেব আর একটা মাস। " চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে সুলেখা'র।বলে " বিনয় একটা ভাল ছেলের সম্বন্ধ এনেছে। এ মাসে ও আঠেরোয় পড়েছে। কথা এগোলে বিয়ে টা দিয়ে দিতে হবে। পড়াশোনায় ভাল হলে না হয় বাইরে রেখে পড়াতাম। বাড়ির পাশেই বিষধর সাপ। চারপাশে যে ভাবে খুন ধর্ষণ হচ্ছে। আমরা তো আর নিতুদের মতন চলে যেতে পারব না। আর চলেই বা যাব কেন ? এই বুড়ো লম্পটের জন্য? "
" এটাই ভাল হবে। আমি কাল ই ফোন করব বিনয়ের কে। কিন্তু.... তুমি ? "
" তোমার এই খেলা যদি ও টের পেয়ে যায় ?"
"পাবে না। এখন তো মেয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকব। ও কিছু ধরতে পারবে না। "
কিন্তু পরে ? সুবাসের মুখে দুর্ভাবনা খেলা করে।
সুলেখা বলে" চিন্তা কর না। শয়তান যত বেশি শক্তিশালী তত বেশি দুর্বল। পাপী নিজে জানে সে পাপী ! আর আমার আঁশবঁটি ধারে কাছেই থাকে ! "
কতদিন ছোঁয়াছুঁয়ি হয়নি তোমার সাথে
আজ এই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধলে
একটিবার ছুঁয়ে মেপে যেও উষ্ণতার তারতম্যতা।
জিভের নীচে তোমার অবস্থানে
আমি বড়ো তৃপ্ত হই গো
থার্মোমিটার।
হাতপাখা
দেবযানী সিনহা
হাতপাখা শব্দের উচ্চারণে মনে শীতল ভাব বিরাজ করে।
গরমে হাসফাস জীবন,
দুবার হাতপাখা নাড়ালেই জুড়াবে প্রান।
পাখা শব্দের উৎপত্তি পাখির পাখনা থেকে।হাতপাখা প্রয়োজনে,ব্যবহারে,ঘর সাজাতে আভিজাত্যে,ধর্মীয় কাজে বহুল প্রচলিত।
হাতপাখার ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকে। ষষ্ঠী ঠাকুরের পূজোতে হাতপাখাই প্রধান উপকরণ,পূজোর পর প্রথমে শিশুদের তারপর বাড়ির সব সদস্যদের এবং বাড়িতে আগত অতিথিদেরও হাওয়া করে সুস্থ্যতা ও দীর্ঘজীবন কামনা করা হয়।
পৃথিবীর সব দেশেই বিশেষ করে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে হাতপাখার কদর খুব বেশি।রাজরাজাদের শাসনকালে বড় বড় হাতপাখার ব্যবহারের রীতি ছিল।রাজার দরবারে,বৈঠকখানায়,রানীমহলে,অন্ যান্য ঘরগুলোতে সব সময় দুজন কর্মচারী রাজার দুপাশে রানীর দুপাশে বড় বড় দুটো পাখা নাড়াত।
আগেকারদিনে অর্থাৎ যখন বিদ্যুৎ এর ব্যবহার ছিলোনা, সেইসময় পরিশ্রান্ত গৃহকর্তা বাড়ি ফিরলে স্ত্রী হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করে তার কষ্ট লাঘব করতেন।মা ঠাকুমারা সারা গরমকালে দিনরাত শিশুদের হাতপাখার হাওয়া করে পরম আদর যত্নে ভালোবাসা মমতায় কষ্ট দূর করতেন। জ্বর হলে হাতপাখার হাওয়া এখনো সুখকর। মা, কাকিমা যখন ঘুটে দিয়ে উনুন জ্বালাতে নাকাল তখন এই হাতপাখাই একমাত্র ভরসা। আবার মা ঠাকুমার শাসনেও হাতপাখার জুড়ি মেলা ভার।তারপর ঠাকুরদাদার ঝিমুনিতেও হাতপাখা তটস্থ, এই হাবু বাতাস লাগেনা কেন্ ঘুমাস নাকি, শুধু ফাঁকি মাছি কামরায় মশা কামরায় জোরেজোরে বাতাস কর।স্কুলে চৈত্র বৈশাখ মাসে খুব গরমে পন্ডিত স্যারের হাতপাখার ডান্ডার মার, কিরে কালু পড়া শেখস নাই ক্যান আর ভুল করবি ক কেমন লাগে দ্যাক অহন আর ভুল করবি!!!
নতুন মেয়ে জামাই নায়র এলে শাশুড়ি পদে পদে রান্না করে মাটিতে আসন পেতে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে জামাই আদর সে এক মধুর দৃশ্য।
আর এখন এই যন্ত্রসভ্যতার যুগেও আমাদের স্কুলের কৃষ্ণাদি ক্লাসে পড়াতে পড়াতে, ইস্ এই গরম আর সহ্য হয়না কারেক্ট ও যে কি সেই যে গেলো আর আসার নাম নেই!!এই সীমা কোমনরুম থেকে একটা হাত পাখা নিয়ে আসোতো।
একসময় বহুদেশের মেয়েদের রেওয়াজ ছিলো বেড়াতে যাওয়ার সময় সুগন্ধিযুক্ত কারুকার্য করা হাতপাখা রাখার।এখনো ব্যবহার করে তারা তবে বেড়ানো এবং কর্মস্থলে যাতায়াতে খুব গরমের হাত থেকে স্বস্তি পেতে।
জাপানীদের কাছে হাতপাখা সৌভাগ্য ও সুখের প্রতীক। তারা বিশ্বাস করে হাতপাখার ডাঁটিটা জীবনের সূচনা নির্দেশ করে,আর পাতার শিরাগুলো জীবন চর্চার নানা দিক। "লাভ ইন টোকিও " এর কথা নিশ্চয় মনে আছে "সায়োনারা সায়োনারা বাদা নিভায়ুঙ্গি সায়োনারা ইথলাতি অর বলখাতি কাল ফির আয়ুঙ্গি সায়োনারা" আশা পারেখের হাতে সেই সুন্দর হাতপাখাটি আজও মন কারে।দেশেবিদেশে বিভিন্ন মন্দিরে এমনকি অফিস আদালতেও বিশালাকৃতির হাতপাখার ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
অতীত থেকে বর্তমানে তালপাতার হাতপাখার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তবে পাশাপাশি সুতো, উল,কাপড়, গম ও ধান গাছের শুকনো কান্ড, সুপারি গাছের পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরি করা হয়।ময়ুরের পেখম দিয়ে তৈরি হাতপাখা খুবই মনোমোহিনী। পাখা শিল্পীরা হাত পাখার নামকরণও করেন যেমন-ধানছড়ি, কামরাঙ্গা ফুল,চালতা ফুল, শঙ্খলতা,কেঁচিকাটা।কাপড়ের তৈরী হাতপাখায় সুতো দিতে সেলাই করে নানারকমের ফুল, ছবি, কল্কা, ছড়া বানাতেন। হাতপাখায় বিভিন্ন কারুকার্য করে ঘর সাজানোর জন্য সুন্দর করে ওয়াল হ্যাঙিং বানানো হয়।
"হাতপাখার হাওয়া মস্ত ভারী,
সৌন্দর্য্য আর শীতল গুনে কদর তারি "।
নীলাভ নাম টি মনে পরে?যে তরঙ্গে স্বপ্ন বুনেছিলে,
অশ্লীল-অভব্য-উদ্ধত-কুৎসিত অভিধায় ডেকেও,
সোহাগের সমস্ত বন্যা যার উপর উজার করে দিতে।
জলাধিপতির রত্নাকর আচরণের কথা শুনে
শাস্তি হিসেবে ফিরিয়ে দিলে মা নিষাদের ও অভিশাপ।
নতশিরে মহাসমুদ্রের কিনারায় ফিরে আসা,
আর আমি, আছি আজও তোমার প্রতিক্ষায়।
আমি যেমন ছিলাম,আজও ঠিক তেমনই আছি,
আমায় নিয়ে যতসব দূর্ভাবনা,তোর মিছিমিছি l
যতই ব্যস্ত থাকি,প্রভাতে তোর সামনে আসি,
এসেই তোরে ডেকেই বলি,এবার তো ওঠ !
সারাদিন তোরে কাজে রেখে,সাঁঝে আমি ডেরায় ফিরি l
আবার যখন রাতে দেই দেখা,হওস তো তখন বেশ খুশি,
না এলেই হয় শুরু তোর,যতো মন কষাকষি l
আরও বলছি,দেখ চিনতে পারছিস কি !
আসি যদি গ্রীষ্মে,তখন বলিস এই তো বেশবেশ,
পরক্ষনেই বলিস এবারে হবে সব নিঃশেষ l
আসি যদি বরষায়,চাষীরা সব উল্লাসে ছুটে বেড়ায়,
ভারী মুখে তখন,বসিস তু্ই ঐ পাশের জানালায়l
আসি যদি শরৎ-এ,চারিদিকে ঐ সাদাকাশের ঢেউ,
তখন মোরে মন্দ বলিস নাতো কেউ l
আসি যদি হেমন্তে, বলিস তাড়াতাড়ি ভাই জানা ওরে,
সারাবছরের আনন্দটাই তো ওড়ালি ফুরুৎকারে,
আসি যদি শীতে,তখন তো তোর সবই লাগে মিঠে,
ভাবিস কি!গরিব-দুঃখীদের তখন কেমনে কাটে l
আসি যদি বসন্তে,মেতে তো উঠিস সব্বেই দোলানন্দে,
তবে খারাপ কি আমি! থাকতে তো হয়,সব্বেরই ভালো-মন্দে l
যত্ন করে গান শেষ করে ধনঞ্জয় হাঁক পাড়ল, "দেবে গো কিছু দাদারা, দিদিমনিরা!" নির্বিকার মুখগুলো আরো নির্বিকার করে অন্যদিকে তাকিয়ে। তবু দুটো তিনটে খুচরো উড়ে আসে তার দিকে। এক মধ্যবয়সী মহিলা, ঠোঁটে চড়া লিপস্টিক, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলছে অনেকক্ষণ, "আরে, তারপর শোন না, তোর বিজয়দা তো কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না, আমি বলেছি বাড়ি করেছি মনের মত, তা যদি সুন্দর করে সাজাতেই না পারলাম তাহলে আর কি হল! শেষে প্রীতম ভাটিয়াকে দিয়ে পুরো ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনটা করানো হল। তুই তো আসলি না গৃহপ্রবেশে, সবাই কত তারিফ করল!" ধনঞ্জয় এগিয়ে যেতেই মহিলার ধমক, "ধুর বাবা! সর না, দেখছ না ফোনে কথা বলছি!" ধনঞ্জয় এগিয়ে গেল অন্য বগির দিকে। দুটো অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে মোবাইলের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। মাঝখানে একদল আজকের মাছের দর নিয়ে জোর আলোচনায় ব্যস্ত। ওদিকে তিনজন আড্ডা জুড়েছে সেই বাড়ি নিয়ে, "বুঝলেন মুখুজ্জেদা, শুরু যখন করেই দিয়েছ পাথরটা এখনই বসিয়ে নাও, ঝক্কি অনেক কম হবে। আর হ্যাঁ, দোতলায় ব্যালকনি রাখছো তো? হ্যাঁ, ওটাকেই বৈঠকখানা করে নেবে, দেখবে অতিথিরা কিরকম সুনাম করছে আর জায়গার অভাবও মিটবে।" ধনঞ্জয় একপাশে সরে এসে গান ধরল, " মিলন হবে কত দিনে.....।"
ফেরার পথে ধনঞ্জয় আটা কিনল খানিকটা, দুটো লজেন্স কিনল এক টাকা দিয়ে, 'বাড়ি' নামক আশ্রয়টির মোহময় আকর্ষণ তার মনটাকে আজ বিষণ্ন করে তুলেছে। না এই শহরে তার কোনো বাড়ি নেই, হবে না কোনদিন।এমনকি ঝুপড়িও নেই কোনো। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বউ সাধনাকে নিয়ে তার বাস। দুবছর আগে পটলা ছেলেকে রেখে টুপ করে মরে গেল। সেই থেকে চার বছরের বল্টু তাদের সঙ্গেই রয়েছে। ধনঞ্জয়কে দেখে সাধনা পেতে রাখা ছেঁড়া বিছানাটা একটু ঝেড়ে দিল। ঝোলার থেকে আটা নামিয়ে রাখল, তারপর কলসি থেকে জল গড়িয়ে দিল ধনঞ্জয়কে। জল খেয়ে আরাম করে বসল ধনঞ্জয়। বল্টু একমুখ হাসি নিয়ে কোথা থেকে হাজির। রোজকার মত ঝোলায় খুঁজতে লাগল চকোলেট। অবশেষে পেয়ে শান্তি। ধনঞ্জয় তাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল, "আয়, তোকে আজ একতারা শেখাই"। সাধনা গলা তুলল, "বাপ ব্যাটাতে আগে খেয়ে নাও, সোহাগ পরে করো।" কিন্তু সে কথা বল্টু শুনলে তো! একতারা নামক রহস্যে তার চিরদিনের আগ্রহ। সে একতারা নিয়ে বাবু হয়ে বসল ধনঞ্জয়ের সামনে। কে বলে বাড়ি শুধু চার দেয়ালের হয়? সে সস্নেহে বল্টুর চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, "চল, আগে খেয়ে নি, নইলে তোর মা আবার বকুনি দেবে।"
সুলেখা
অপর্ণা দেবনাথ
অপর্ণা দেবনাথ
কখনও কখনও মানুষের জীবনে এমন কিছু মূহুর্ত আসে যখন সে যা দেখছে, চোখ যা দেখাচ্ছে তাঁকে, বোধ যা দৃঢ় ভাবে বোঝাতে চাইছে, সেটা সে বুঝতে চায় না। মন বিশ্বাস করতে চায় না। বিশ্বাস করার জ্বলন্ত দলিল সামনে জ্বলতে থাকে কিন্তু মন জ্বলে উঠে না। সে নেতানো ন্যাকড়ার মত এক কোণে পড়ে থাকতে চায়। সে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চায় অবিশ্বাসের মোড়কে। ঠিক এমনটাই হচ্ছে সুবাসের সাথে। গত মাস দু'য়েক থেকে। আর বিশেষ করে যখন বৌদির মতন নরম সরম সরল মনের মানুষ টি ও তাঁকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছে তখন মন আর ঠুলি পরা চোখে থাকতে পারে? আজ সুবাস হাটে যাওয়ার পথে মনে মনে নিজেকে তৈরি করতে থাকে। নাহ্। আজ ই সুলেখা কে বলতে হবে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। সত্য যত কঠিন ই হোক না কেন তার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা তাঁর রাখতে হবে।**************************
******************************
সুবাস বাজারে পৌঁছে জুতো কেনে ছেলের। আরও কিছু কেনাকাটা করার ছিল। কিন্তু সকালের পর থেকে সুবাস অপেক্ষা করছিল কখন রাত হবে। আজ সুলেখা'র সাথে কথা বলতেই হবে। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে। সুবাস নিজেকে জিজ্ঞেস করেছে বার বার, সে কি সুলেখা কে সন্দেহ করে ? ঠিক উওর পায় নি। সুলেখা ! যে তাঁর সদ্য যুবতী বেলায় বিয়ে করে এসে কাটিয়ে দিয়েছে বাইশ টা বছর! সুবাস কে ভরিয়ে তুলেছে সুখে। শরীরে মনে। এখনও যে মাঝে মাঝে ঘোরতর সংসারী চল্লিশোর্ধ্ব সুবাস কে ভরিয়ে রাখে তার উত্তাপের চাদরে ! সে কি করে দ্বিচারিণী হতে পারে ? কিন্তু চোখের দেখা ও তো মিথ্যে নয়। সুলেখা'র গদগদ দীনেন দা ডাক, চকিতে কটাক্ষ। সবটা তো সুবাস সামনে থেকেই দেখেছে। তবে ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফেরার আগেই চলে যায়। কিছু দিন আগে লোকটা তার ফাইভে পড়া বোন ঝি কে পড়াতে বলছিল তাঁর ছোট মেয়ে কে। সুবাস কে বেশ কিছু দিন বলেছিল। সুবাস না হ্যাঁ কিছু ই বলেনি। এখন আর ও কথা বলে না দীনেন হালদার। কেন ? সুবাস ভাবে।
******************************
সুবাসের ভেতরে যে অন্তর্দাহ টা হচ্ছিল সে এই মায়া মায়া চোখের দিকে চেয়ে নিভে যেতে থাকে। নাহ্। সুলেখা কোনও খারাপ কিছু করতে পারে না! কিন্তু বৌদির কথা টা ? তাছাড়া নিজের চোখ ? সুবাস অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের পেন্ডুলামে অস্থির মন! হঠাৎ একটু হাল্কা হাসির আওয়াজে সুবাস দেখে সুলেখা চেয়ে হাসছে তাঁর দিকে। মূহুর্তে আবার গম্ভীর হয়ে যায়। বলে "তোমায় নিয়ে খুব মুস্কিল ! আচ্ছা, এত ভালবাসো কেন আমাকে ?"
"মানে? "
" মানে তো তুমি বলবে। তারজন্য তো অপেক্ষা করছি। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি বুঝতে পারি নি তুমি এত কষ্ট পাচ্ছ। সংসারের নানান দিকে নজর দিতে দিতে, সব দিক সামলাতে গিয়ে নিজের মানুষ টার দিকেই নজর দিতে পারি নি। আমাকে ক্ষমা কর। "
" কিসের ক্ষমা?"
দিদি'র কথা আমি শুনে ফেলেছি। শুনতে চাই নি ইচ্ছে করে, ওই বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলাম। দাঁড়িয়ে গেছিলাম তোমাদের কথা শুনে, অজান্তেই। "
" তুমি সংসারের সব দিক সামলানোর কথা কি বলছিলে ?" তবুও সুবাস একবারের জন্য দীনেন হালদারের নাম উচ্চারণ করতে পারছে না। তাঁর সারাদিনের নিজেকে তৈরি করা বালির বাঁধের মতন ভেসে যাচ্ছে সুলেখা'র সামনে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুলেখা বলল "তুমি কি জানতে চাও, বল ? তার আগে শুধু এটুকু বল, তুমি কি বিশ্বাস কর আমি খারাপ কাজ করতে পারি ?"
"নাহ্। আমি জানি তুমি খারাপ কিছু করতে পার না। "
" আমি জানি। তাই তোমার চোখের সামনে, বাড়ির সবার সামনেই আমি এই মুখোশধারী শয়তানের সাথে হেসে কথা বলার সাহস করি! "
" মানে ? প্রায় ভাষা হীন হয়ে যায় সুবাস। সুলেখা উঠে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। ফিরে এসে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। সুবাস প্রশ্ন চোখে চেয়ে থাকে। সুলেখা নীরবতা ভাঙ্গে..." আজ বিনয় এসেছিল। ওঁকে ডেকেছিলাম। তাড়া আছে বলে চলে গেল। সামনের সপ্তাহে পুনম কে নিয়ে আসবে "। বিনয় সুবাসের বড় মেয়ে পুনমের বর। সে কেন এসেছিল ? তার সাথে এই নিভৃত একান্ত গূঢ় সমস্যার সংযোগ ঠিক বুঝতে পারে না সুবাস। সুলেখা বলে" এই বুড়ো শকুনের সাথে আমি কেন এত তোষামোদ করে কথা বলি জান ? "
" কেন ?"
ওঁর নজর পড়েছিল তোমার মেয়ের উপর। মাস দু'য়েক আগে একদিন ভরদুপুরে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। মেয়ে স্নান সেরে উঠোনে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে চুল ঝাড়ছিল, শকুন টা গো গ্রাসে গিলছে সেটা, উঠোনের কোণার রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আমি প্রথমে হতভম্ব হয়ে যাই। তারপর পরিস্থিতি সামলে নিই "।
" ক.. কি বলছ ?" রাগে বিস্ময়ে প্রায় তোতলা হয়ে যায় সুবাস। সুলেখা বলে "তারপর থেকেই মাঝে মাঝে এসে মেয়ে কে বলে মা, আমার ভাগ্নে টা কে একটু দেখিয়ে দিবি পড়া ? ওই কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যে নাগাদ যাস। ভাল মাইনে পাবি।"
সুবাসের রক্ত টগবগ করে উঠে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে "আমার কাছে ও বেশ ক'দিন ঘ্যান ঘ্যান করেছিল। ওঁকে তো আর মুখের উপর না করতে পারি না।" সুলেখা বলে আমি এই কাল সাপ কে দুধ কলা দেব আর একটা মাস। " চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে সুলেখা'র।বলে " বিনয় একটা ভাল ছেলের সম্বন্ধ এনেছে। এ মাসে ও আঠেরোয় পড়েছে। কথা এগোলে বিয়ে টা দিয়ে দিতে হবে। পড়াশোনায় ভাল হলে না হয় বাইরে রেখে পড়াতাম। বাড়ির পাশেই বিষধর সাপ। চারপাশে যে ভাবে খুন ধর্ষণ হচ্ছে। আমরা তো আর নিতুদের মতন চলে যেতে পারব না। আর চলেই বা যাব কেন ? এই বুড়ো লম্পটের জন্য? "
" এটাই ভাল হবে। আমি কাল ই ফোন করব বিনয়ের কে। কিন্তু.... তুমি ? "
" তোমার এই খেলা যদি ও টের পেয়ে যায় ?"
"পাবে না। এখন তো মেয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত থাকব। ও কিছু ধরতে পারবে না। "
কিন্তু পরে ? সুবাসের মুখে দুর্ভাবনা খেলা করে।
সুলেখা বলে" চিন্তা কর না। শয়তান যত বেশি শক্তিশালী তত বেশি দুর্বল। পাপী নিজে জানে সে পাপী ! আর আমার আঁশবঁটি ধারে কাছেই থাকে ! "
মানুষ – মানুষ খেলা
পিনাকি
১
-মেঘে মেঘে বিদ্যুৎ
খেলে গিয়েছে ! মনে হচ্ছে
আজ খুব বৃষ্টি
হবে ।
-হলে আপনার খুব মজা
হয় না ?
- বর্ষায় যখন বৃষ্টির
ফোঁটা গাছেদের পত্র পল্লবে বিচ্ছুরিত হয় , তা
আপন খেয়ালে গড়িয়ে
চলে , ঘাসেদের ভিতর
বিভাজিত হয় জল রেখা , তোমার ভালো লাগেনা ?
-খুব ভালো লাগে ।
মন খারাপ
হয় ।
-বর্ষা , প্রেমিক যুগলের
মন ভালো করা ঋতু । যৌবনা
, তুমি এত প্রেম
বিমুখ ! আমি প্রথম দিন ভেবেছিলাম , মেনকা শুধুই নাম করা
অপ্সরা নয় । আপাদ মস্তক এক
খণ্ড প্রেম । মানলাম তুমি ইন্দ্রগামী
, তাই বলে পৃথিবীর
এই সৌন্দর্য কে
অবজ্ঞা করবে !
-আপনি সত্যিই গন্ধর্ব রাজ !
বিশ্বাবসু , আপনার
কথা শুনে যে
কেউ প্রেমে পড়বে । এক সামান্য অপ্সরাকে এত সম্মান দিচ্ছেন !
-সামান্য !
পৃথিবীতে নারী কখনো সামান্য
হতেই পারেনা । তোমার মন রাখবার
জন্য আমি বলছিনা ...
কথাটুকু বলেই , বিশ্বাবসু , মেনকার গভীর
গহন চোখের দিকে
তাকিয়ে রইল । শিশুর মত্ন মতন সেই দৃষ্টিতে , এতটাই নীরব
আত্ম সমর্পণ রয়েছে , মেনকার
মুখ রক্তিম হয়ে
উঠছে । অনেক পুরুষই
তাঁর কাছে সর্বস্ব হারিয়েছে ।
মেনকা এই পুরুষের
চোখে নিজের অকৃত্রিম
গ্রহণযোগ্যতা দেখে , লজ্জাই
পেয়েছে ।
-অমন ভাবে তাকিয়েছেন
?
-আমি তোমাকে দেখছিলাম
। আমাদের আলাপ মাত্র
তিন দিনের । আমি আর আপনিতে নিজেকে আবদ্ধ
রাখতে পারলাম না ।
-আমি কিন্তু আমার
শিষ্টতা লঙ্ঘন করতে পারব
না ।
-আমি শিষ্টাচার জানিনা নই , তাই
বলতে চাইছ ?
-এমা ! আমি
তাই বললাম নাকি । আপনার
মুখে , তুমি শুনতে ভালো লাগছে ।
-তাই বলো , মেনকা
আমার মুখে তুমি সম্বোধন
শুনতে চায় । উফঃ যাকে
পাওয়ার জন্য , পুরুষের মধ্যে চঞ্চলতা
শুরু হয়ে যায় , সে
আমাকে এত প্রাধান্য দিচ্ছে !
-আমাকে পাওয়ার জন্য
নয় , আমার রূপকে উপভোগ করার
জন্য বলুন ।
মেনকা চুপ করে
মাথা নিচু করে
রয়েছে । বিশ্বাবসু এগিয়ে আসছে
। চিবুক
স্পর্শ করে , মেনকার মুখ
নিজের মুখের কাছে ধরল । নরম
ভেজা ঠোঁট , নিজের মুখের ভিতর নিয়ে নিল। মেনকার নরম ঠোঁট চুষছিল । গন্ধর্ব রাজের
এমন আচরণে , বিন্দুমাত্র হতচকিত হয়নি ,
শুধু নারীর হৃদস্পন্দন বেড়ে
গিয়েছে । বৃষ্টির কোমল ধারায় যখন সিক্ত হচ্ছিল বনভূমি , তপ্ত নিঃশ্বাস
ত্যাগ করে শান্ত হচ্ছে , দুই মানব – মানবী
শরীর রোমন্থনে , রোমাঞ্চিত হয়ে
উঠেছে। বর্ষার প্রথম মিলনে , মিলিত মুহূর্তে যেন কাব্য রচিত হচ্ছিল ! আকাশের কোণে জমেছে কালো মেঘ , বৃষ্টি ঝরছে । পল্লবিত বনভূমিতে স্নিগ্ধ কামুকতা হিস হিস করা
সাপের মতনই দুই
দেহকে গিলে নিচ্ছে ।
বিশ্বাবসু মাথা
তুলে নিল । মেনকার নরম
বুকে , ভারী মোলায়েম দুটো
স্তনের মাঝে , চন্দনের গন্ধ । দুজনের শরীরে কোন কাপড় নেই ।
-তুমি খুব সুন্দর ।
তাদের সঙ্গম শেষ
হয়েছে । বৃষ্টি গিয়েছে
থেমে , অনেক আগেই । আকাশে
অরুণোদয় প্রাপ্তি ঘটেনি । চারিপাশে স্নিগ্ধ বাতাস , বনভূমিকে আচ্ছাদিত
করে রেখেছে । গন্ধর্বরাজ
পাশ ফিরে শুয়েছে । পাশে
মেনকা , গালে হাত দিয়ে
একপাশে কাত হয়ে
হাসছে । সোনালী কোমর ছুঁয়ে থাকা
কেশ রাশি , ভরাট বুকের স্তন ভার , যেন ঘাস
আচ্ছাদিত ভূমিকে উষ্ণতা
দিচ্ছে ।
রাজা বলল – হাসছ ?
মেনকার হাসি গাছের
তলায় ছড়িয়ে থাকা সাদা ফুলের মতনই
কমনীয় – আপনাকে দেখে। আপনার অবস্থা
দেখে ।
-কেন ?
-কিছুক্ষণ আগে শিশুর
মতনই , আপনি সুড়সুড়ি দিচ্ছিলেন
। খুব অবুঝ হয়ে
উঠেছিলেন । এখন আবার
সেই রাশ ভারী পুরুষ ।
-মেনকা , সকল পুরুষই
নিকট সঙ্গিনীর কাছে
শিশু । সেখানেই তার সঙ্গমের পূর্ণতা ।
তোমার কাছে যে কোন
পুরুষই শিশু ।
-আমি কেন , আপনারা
যতই পুরুষত্ব করুন , আমাদের ছাড়িয়ে যেতে
পারবেন না। নারী বোঝে , এক জন
পুরুষের অক্ষমতা । ব্যর্থতা । ভঙ্গুরতা
। আপনারা , নারীর
দেহ ছাড়া কিছুই বোঝেন না ।
তাদের মননের কাছাকাছিও
আসতে পারেন নি !
মেনকার মুখে সামান্য
মলিনতা । রাজা বলল ,
-মেনে নিয়েছি ।
আমি নিজেকে ভাগ্যবান
মনে করেছি । পর্বতের
পাদদেশে , হিমালয় আচ্ছাদিত বনতলে
, আমার মতন ঈর্ষাম্বিত পুরুষ
আর কেউ আছে ?
মেনকার বুকের গভীরতা
যে দেখেছে । তার আবেগ ঘন
ক্ষণের উষ্ণতায় যে
উষ্ণ হয়েছে । আমি এত দিন
যে সুখ কল্পনায়
কল্পিত করতেও ভয় পেয়েছিলাম , আজ তার
সম্পূর্ণতা আমাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে ! বিস্ময় কাটছে
না । আরও দীর্ঘ সময়
এই অতীন্দ্রিয় সুখ
চাইনি। যা দুর্লভ , তাই আকর্ষণীয় ।
এটাই জীবনের বেঁচে থাকবার রহস্য ।
গন্ধর্ব রাজা দেখল , এত
কথাতেও মেনকা মাথা নিচু করে আছে ।
তার উন্মুক্ত বুকে , গাছেদের ছায়া
অন্তর্বাসের মতন জড়িয়ে । মুখে
এখন মলিনতা , রাজা বলল
-আমি তোমায় আঘাত
করেছি ? আমি কোন ভুল করলাম ?
-না রাজা , কেন বললেন ?
-মানুষের মন ,
অন্তরের কথা বলে ।
-আপনি ঠিক ধরেছেন , আমি
আপনার কাছে কিছু
চাইব বলে মনস্থির
করেছিলাম ।
-সংকোচ না করে ,
চেয়ে নাও । গন্ধর্ব রাজ বিশ্বাবসু মেনকাকে
কি বা দিতে পারে ? ইন্দ্র যার মালিক , সে
আর কোন ঐশ্বর্য পেতে চায় !
-আপনি আমার প্রেমিক
। আমি আপনার সন্তানের
মা হতে চাই ।
-মানে ?
- শুনেছি
নারীর গর্ভ সভ্যতার
সৃষ্টি করে । সমাজে গর্ভবতী নারী সম্মানের অধিকারী । এই যে মেনকা , যাকে
নিয়ে স্বর্গ – মর্ত্যে তৈরী
হয়েছে মিথ । সে খুব
অসহায় । আমার অসহায়তার নিবারণ করুন ।
-সন্তান , মায়ের
পরিচয় । তুমি তোমার দায়িত্ব
পালন করতে পারবে ?
-না । তাকে
আপনি নিজের দায়িত্বে পালন
করবেন । তারপর সময় এলে আমি
তার কাছে
আসব । পরিচয় দেব । ভবিষ্যতের ফসল ।
গল্প থেমে গেল । এখন সূর্যের
আলো ততটা নেই । অস্ত উদ্যোগি মুহূর্তে , দুই ভিন্ন
বয়সী পুরুষ খোলা
আকাশের নিচে মুখোমুখি
রয়েছে বসে । একজন বিগত
মধ্য বসন্ত পেরিয়েছে , সেই
নিজের অতীত কীর্তন
করছিল । সামনের
যুবকটি শুনছে ।
-আপনি আর
মেনকা যদি সন্তান
উৎপাদনে সম্মত ছিলেন
, তাহলে সন্তানের দায়িত্ব
নিলেন না
কেন ? মেনকার সামাজিক অবস্থান
, তাঁর মাতৃত্বে কর্তব্যকে অবরুদ্ধ
করে রেখেছিল । আপনি ? আপনার
দায়িত্ব ছিল না
বুঝি ?
-ছিল পুত্র । যদি
সে পুত্র সন্তান হত । আমি
নিজের দায়িত্ব থেকে
পালাতাম না। মানুষ স্বার্থপর , নিজের
প্রয়োজন সবচেয়ে গুরুত্ব পায় । কন্যা
সন্তানের কোন ভূমিকা
এই গন্ধর্ব রাজ বিশ্বাবসুর
জীবনে ছিলনা । তাই মুখ
ফিরিয়ে ছিলাম।
-আজ , আচমকাই কেন ?
-পিতৃত্ব ।
বলতে পারো , এই ব্রিদ্ধ বৃদ্ধ বয়সে নিজের
কন্যার প্রতি অবিচারের যন্ত্রণা থেকে
মুক্তির জন্য তোমার
নিকট এসেছি । তুমিই উদ্ধার করতে
পারো । আমি তোমাকে আমার
কন্যাকে বাঁচিয়ে তুলবার
পথ বলেছি । সেখানে পৌঁছাতে হবে
তোমাকেই । আমার সন্তান ফিরিয়ে দাও
ঋষি কুমার ।
-আমি চেষ্টা করব ।
-পুত্র , এই
সমস্যার গুপ্ত খোঁজ তোমাকেই
করতে হবে
। তুমি তরুণ । জ্ঞানী । প্রেমিক আর
সাহসী । আমার মেয়ের
জীবন এখন তোমার হাতে ।
যুবকটি , মধ্য বয়সী
লোকটির হাত ধরে
বলল- চেষ্টার ত্রুটি রাখব না। আপনি ভালো করেই জানেন , তার সাথে আমার
সম্পর্ক ...
২
আকশে মেখে থাকা খণ্ড – খণ্ড মেঘের গায়ে
ফালা – ফালা আলো মেখেছে । খুব নরম আর শান্ত সেই আলোয় , পৃথিবীটাকে সরল মনে হয় ।
বাস্তব সহজ হয়না , মানুষ নিজের মতনই তার
চারপাশের বাস্তবকে গ্রহণ করে । রুরু এই সব
ভাবছিল , জানলার বাইরে যতদূর চোখ যাচ্ছে , শুধুই সবুজ জঙ্গল , পাহাড় আর কুয়াশা ভেজা
পাতলা আলোর আস্তরণ । এই পর্ব ভোরের
প্রথম ভাগ । সব কিছু দুই চোখ
দিয়ে দেখছে , দূরের ঝর্ণার জলোচ্ছ্বাস ভেসে আসছে , ধ্বনির মূর্ছনা
। এখন প্রমদ্ বরার ঘুম ভাঙত । রুরু নিজেই তাকে
ডেকে তুলে দিত । আশ্রমে অনেক
কাজ থাকে । সদ্য বিবাহিতা নববধূকে সকলের আগে
উঠতে হয় । উঠান গোবরে লেপে
দিতে হয় । আশ্রম ঝাড় দিয়ে
পরিষ্কার করতে হয় । এরপর শুরু
হবে আশ্রমিক পর্ব ।
রুরুর চোখ জলে
ঝাপসা হয়ে গিয়েছে ।
তাদের বয়স খুব
অল্প । সবে সংসার জীবনে
প্রবেশ করেছে । তাদের এই সুন্দর
সময় পাখিদের সাথে
কথা বলে কাটত । একান্তে ভ্রমণে
কাটত । আচমকাই বিগত এক মাসে
, সব কিছু পরিবর্তন হয়ে
গিয়েছে ! নিজেকে এমন অবস্থায়
দেখে , রুরু একটা
সত্য উপলব্ধি করেছে । উচ্চ
বংশ পরিচয় মানুষকে সমাজে অবস্থান
দিতে পারে , নিরাপত্তা দিতে
অসমর্থ । এই সময় , পরিস্থিতি পরিবর্তনমুখী , তাই লড়াই
করার মানসিকতাই মানুষকে
বাঁচিয়ে রাখে । যে
কোন প্রতিকূলতা দেখে পালিয়ে
, সমাধান পাওয়া যায়
না। লড়াই করতে হয় , এই
যুদ্ধে বংশ পরিচয় পাশে থাকেনা ।
মানুষের পাশে থাকে তার
নিজের মানসিকতা , সংযমটা
আর মানসিকতা । রুরু হারতে রাজী
হয় । শেষ লড়াই লড়বেই ।
ভৃগুপুত্র চব্যনের
পত্নীর নাম সুকন্যা । সুকন্যার গর্ভে জন্ম নেয় প্রমতি । ঘৃতাচীকে
বিয়ে করে প্রমতি । তাদের দু’জনের
সৃষ্টি রুরু । এক উদীয়মান তরুণ ঋষি ।
রুরু এতটুকু বুঝে
গিয়েছে , তার বংশ পর্যচয় , তাকে উৎসের কাছে নিয়ে যাবে না । খুঁজতে হবে লড়তে হবে ।
নিজের প্রেয়সীকে
বাঁচাবার জন্য অনেক দূর অব্দি যেতে হবে । এত কষ্টের পরেও সফলতা অনিশ্চিত ! নিজেকে আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার
মধ্যে রাখতে চাইল না। শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়েছে । আজই বেড়িয়ে পরতে হবে ।
আশ্রম পেরিয়ে , ঢালু হয়ে
যাওয়া পথ ধরল । আরো দূর
হাঁটতে হবে । সোজা গিয়ে
খানিক বাঁ দিকে পাহাড় । তারপর
একদিনের পথ । সাথে ঝোলায় ।
খাবার আছে । সাথে আত্মরক্ষার করবার
জন্য অস্ত্র ।
রুরু নির্জন স্থানে
, শ্যাওলা মাখা টিলার উপর বসল । মাথার
উপরে আকাশ তখন মধ্যাহ্ন
পেরিয়ে , বিকেলের কাছাকাছি আসবার চেষ্টা
করছে । এমন সময়
মন অতীতের স্মৃতিতে ফিয়ে যাচ্ছে ।
সেই দিন দিন , বিকেলের উপান্তে অপেক্ষারত ছিল । মহর্ষি স্থূলকেশের
আশ্রমের কাছাকাছি এসেও , রুরু
ভাবছিল ---- দেখা না হলে ! পিতার
আদেশে মহর্ষিকে আমন্ত্রণ
জানাতে এসেছে । যজ্ঞের জন্য । একরাত এখানে
থাকতে পারবে না। মহর্ষি রাগ
করতে পারে । সেই চিন্তায় আচ্ছাদিত হয়ে ,
আশ্রমে প্রবেশ করল ।
সামনেই অপরূপ কিশোরী । সমবয়স্কা । দেবী তুল্য । চঞ্চলা । অনেকের
মাঝে অনন্য । প্রথম দেখাতেই
রুরু মন দিয়ে
ফেলেছে , প্রমদ্ বরা কে । সেই দিন
থেকেই অনুরাগের প্রহর শুরু ।
সময় তখন রঙিন স্বপ্ন
বুনছিল । জীবনে স্বপ্ন দরকার ।
তেমন ভাবেই , ওদের হৃদয় বিনিময়
ঘটল ।
বিবাহের আগেই প্রমদ্ বরা
নিজের মুখেই
, নিজের জন্ম পরিচয় জানায় । মহর্ষি স্থূলকেশের পালিত
কন্যা হিসেবেই সে ,
শ্বশুর বাড়ি আসবে । এই
অভিমান তার একদিনের
নয় । বছরের পর বছর জন্মদাতার
অবজ্ঞা আর উপেক্ষায় , আবেগ অন্তঃসার শূন্য হয়ে
গিয়েছে । মায়ের উপর টান তার কম । বাবাকেই খুব ভালোবাসে । সে আশা করেছিল , অন্তত বিয়ের
সময় বাবা আসবে । সে এলনা ! ঋষি আশ্রমে , ছোট্ট সদ্যজাত সন্তানকে দিয়ে
চলে যায় । তারপরেও বাবার প্রতি এত টান । পালিত পিতাকেও সে সম্মান করে । এই
কারণটি শুনে , প্রমদ্ বরার প্রতি প্রেম রূপান্তরিত হয়েছে শ্রদ্ধায় ।
রুরু বহুদিন ভেবেছে
নির্জনে , মেয়ে
সন্তানকে ত্যাগ করবার
কারণ । সে জানেও না , এই কারণ এর
উত্তর একদিন তার
সামনে এসে উপস্থিত হবে
। যে পিতা গন্ধর্ব রাজ
বিশ্বাবসু নিজের দায়িত্ব
পালনে অক্ষম , সেই একদিন
এসে নিজের মেয়ের
প্রাণ ভিক্ষা চাইবে
! বিচিত্র এই পৃথিবী , আমরা সকলেই ভাগ্য বিড়ম্বিত । প্রমদ্ বরা শৈশবের দীর্ঘ
সময় কাটিয়েছে সন্তান
স্নেহ বঞ্চিতা হয়ে , তার পালক পিতা
নিজের স্নেহের খামতি রাখেনি । মেয়েটি নিজেও
নিজের সন্তান কর্তব্যে দায়বদ্ধ । এত
কিছু সত্ত্বেও জন্মদাতার
প্রতি দুর্বলতা রয়েই গিয়েছিল ।
নির্জন দুপুরে , নিজের
জন্মদাতার কথা ভাবত । চোখের জল
শুকিয়ে গিয়েছে , তাও দেখা মেলেনি
নিজের পিতার ; আজ সেই
পিতাই এসেছে মেয়ের
জীবনের ভিক্ষা চাইতে।! যে
দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করেছে
, এমন ভাবে এসেছে যা
কাম্য নয় । মেয়েটার তেমন অবস্থাও
নেই , পিতার স্নেহে
ভিজতে পারে ।
রুরু উঠে পড়ল ।
অনেক সময় কেটে গিয়েছে ।
সামনের প্রান্তর পেড়িয়ে
যেতে হবে ।
রাত নামবে । পাথর মুদ্রিত
গুহার বক্ষ পিঞ্জরে , আশ্রয় নিয়ে , সকালের আলোর অপেক্ষা ।
বেশ কিছুক্ষণ
হাঁটবার বাদেই , দেখল চারপাশে
অন্ধকার ভরে গিয়েছে ! এখন
নিরাপদ হচ্ছে , গুহায় রাত
কাটানো । তেমনই এক গুহায় গিয়ে
বসল ।
কিছু ফলাহার করে , রুরু পুরানো দিনের
কথা ভাবতে লাগল । তার দেহমন
জুড়ে শুধুই , প্রমদ্ বার বিগত স্বর্ণ অতীত । প্রেম । এই শক্তিই
তাকে লক্ষ্যের খুব কাছে নিয়ে
যাবে । পত্নী নয় , প্রেয়সী রুরুর
অন্তরের অন্তরতম অভিপ্রায় ।
সেই দিন
গুলো ভালই কাটছিল । মানুষের জীবন
ঋতুর মতনই পরিবর্তনকামী । প্রথম
প্রেম । গুরুজনদের সম্মতি । দুই
তরুণ – তরুণীর প্রথম প্রেম
, বাঁধ ভাঙা ঢেউ হয়েছিল । সদ্য
পাখা পাওয়া প্রজাপতি ।
হৈমন্তিক বিকেলের শেষ আলোর মতনই
স্বর্গীয় । তারা একান্তে দেখা করত
। উষ্ণতা বিনিময় হত । স্বপ্ন
দেখেছে , ভবিষ্যতের ।
প্রমদ্ বরা নিজের সাথী
নিয়ে , এমনই বৃষ্টিস্নাত দিনে ,
আশ্রমের জন্য ফল
সংগ্রহে বেড়িয়েছিল । আচমকা বজ্র
পাতের মতনই , বিচিত্র এক
রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ল ! এই খবর দু’ দিন
বাদে রুরু পেয়েছে ।
আশ্রমে গিয়ে দেখল , প্রমদ্ বরা গায়ের রং
ফিকে হয়ে গিয়েছে । সে
কথা বলতে পাচ্ছে না।
শুধু তাই নয় , তার
হুঁশ কখনো আসছে , আবার
চলে যাচ্ছে । যেন
শুকনো কাঠ ,মৃতপ্রায় স্বপ্নের মতনই
শায়িত । দুই চোখ দিয়ে দেখা
যায় না।
বৈদ্যরা এই রোগের ওষুধ
জানেনা । রুরু বুঝতে পারল , এক
স্বপ্ন শুরুর আগেই
অন্তিম প্রহর গুনছে ।
এমনই
সন্ধ্যাবেলায় , মধ্য বয়স অতিক্রান্ত প্রায় বৃদ্ধ মানুষ দেখা
করতে চায়। আশ্রমে রুরুর সাথে আলাপ
হল , গন্ধর্ব রাজ বিশ্বাবসুর
সাথে ।
প্রথমে রুরু
দেখা করতে চায়নি । প্রমদ্ বরা সুস্থ থাকতে
যার ভালোবাসা পেলনা , সে এই অন্তিম
সময়ে চোখের দেখা দেখতে
এসেছে ! অসহ্য । ফিরিয়েই দিত ,
অনুচর এসে বলল – প্রমদ্ বরা জীবনের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে ।
রুরু সেই দিনই
জানতে পারল , এই বিরল রোগের চিকিৎসার জন্য
বিশেষ ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে
। সে
জানে কোন ব্যাক্তি , এই
গুপ্ত ঔষধের সন্ধান
দিতে পারে । সেই
পথেই এগিয়ে চলেছে
রুরু............
বাইরে রাত , পাত্র বন্দী
গরলের মতনই থেমে আছে । রুরুর বুকে
দপদপ স্পন্দিত তরঙ্গ । দিনের আলো অর্থ , প্রমদ্
বরা জন্য নতুন সম্ভাবনার চেষ্টা ।
৩
ডুণ্ডুভ সব কিছু
শুনে বলল – ব্রাক্ষ্মণ কুমার আপনার
কথা শুনলাম । এখানে আসতে
যে পরিশ্রম করেছেন
তাও শুনলাম । গত কাল আপনি যখন
গুহায় রাত্রিবাস করেছিলেন , তখনই আমি খবর পেয়েছি । এই এলাকা
আমার । এখানকার আগন্তুকের
গতিবিধি নখদর্পণে । চাইলেই ,
আপনাকে গুপ্ত হত্যা করতে পারতাম । বিশ্বাস করুন , এক তরুণের
স্বপ্ন ভাঙতে চাইনি ।
প্রেমকে অপমান করতে
চাইনি । আপনি আপনার প্রেমিকার
জন্য এতদূর এসেছেন । এখানে সচরাচর
কেউ আসেনা। কেননা সাপেদের বশ করে , তাদের বিষ
ব্যবহারের কৌশল আমরাই
জানি । আমাদের সম্প্রদায় এই
নিয়ে দীর্ঘ সময়
ধরে চর্চা করে চলেছে ।
-আমি জানি ।
তোমাদের জন্যই , আমার এই
দুর্ভোগ ।
-কুমার , নতুন জ্ঞান
কখনই বিরক্তির কারণ হতে পারেনা ।
আপনাদের অজ্ঞনতাই , আপনাদের দুঃখের জন্য দায়ী
।
-তোমরা সাপ
সংরক্ষণ করছ । এই সাপের জন্য আমার পত্নী আজ
মৃত্যু মুখে শায়িত ।
-কুমার , আপনি ব্রাক্ষ্মণ
। আপনার
কাছে , মূর্খের
মতন কথা আশা করিনি !
রুরু আচমকাই যেন তড়িদাহত হল । এই বৃদ্ধ , অন্তজ শ্রেণির লোকটির এত সাহস !
-কি বলতে চাও ?
-রুরু , আপনি
বিবেচনা করুণ । যে পিতা
নিজের দায়িত্ব পালন করল না ,
অথচ মেয়ের রোগ গ্রস্থতা
দেখে , আপনার কাছে ছুটে
এসেছে কেন ? সাপে কামড়ালে
রুগীর মৃত্যু অনিবার্য , অথচ প্রমদ্ বরা
ধীরে – ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে
চলেছে ! আপনি সত্য থেকে দূরে চলে যাচ্ছেন
নাতো ?
রুরু কঠিন কণ্ঠ স্বরে বলল – খুলে বলও ...
-এই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো আপনারা উদ্ধার করতে পারেন নি
। এই রোগ আচমকাই প্রকাশিত হয় । তা দীর্ঘ
সময় ধরে শরীরকে নষ্ট করতে থাকে ।
চিকিৎসা বলতে , সাপের বিষ । একমাত্র আমাদের কাছেই রয়েছে সেই সাপের সন্ধান ।
-আপনি জানেন !
এই প্রথম , রুরুর মনে হচ্ছে , সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ
সম্মানের যোগ্য । বৃদ্ধ বলল
-গন্ধর্ব রাজের ছেলে নিজেই তিন মাস হয়েছে ,এই বিরল রোগে আক্রান্ত । এই রোগ বংশ বাহিত । প্রমদ্ বরা সেই
কারণের আজ শয্যাশায়ী । নিজের বংশ আর প্রতিপত্তির
উত্তরাধিকারী , নিজের পুত্র সন্তানের
রোগক্রান্ত শরীর দেখে সে ভেঙে পড়েছে । আগেও ,
আমার খোঁজ করেছিল । আমি তার ডাকে যাইনি । আমি ওষুধ দিতে
রাজী , শুধু উৎসের সন্ধান দিতে চাইনি । রাজা চেয়েছিল , আমার
দ্বারা ওষুধের ব্যবহার শিখে নিয়ে , সে নিজেই এই
শিক্ষার মালিক হয়ে
উঠবে । অর্থ উপার্জন করবে । এটাই
আসল কারণ , বহু বছর ধরে আমাকে
বন্দী বানানোর চেষ্টা করে চলেছে । আমি এত সহজে
আত্ম সমর্পণ করব না । আমরা
ভূমির আদি জনজাতি । নিজেদের
শিক্ষা কখনই অন্যের কাছে বিকিয়ে দেব না । আপনি
দেবেন আপনার ব্রাক্ষ্মণত্ব ?
-গন্ধর্ব রাজ আমার কাছে
, মেয়ের প্রাণ ভিক্ষা
চেয়েছেন ...
-না । সুযোগের সদ্ব্য।বহার
বলতে
পারেন । যেই মেয়েকে সে স্বীকৃতি
দেয় নি । যখন জানতে পেরেছে ,
আপনার মতন বীর তরুণ
ঋষি পুত্র প্রমদ্ বরার জন্য
ওষুধ খুঁজছেন , তখনই এই পিতৃত্বের
মোক্ষম চাল টি দিল ! আমি
ওষুধ দিতে প্রস্তুত । তবে আমার বিদ্যা
কখনই শেখাবো না । কেননা আমার জাতিকে
আপনাদের সাথেই লড়াই করে
বাঁচতে হবে। এই কৌশল
তাদের অস্ত্র । আপনি আমাকে হত্যা
করতেই পারেন...
রুরু দেখল , মধ্য
আকাশ পেড়িয়ে , সূর্য পশ্চিমের
খুব কাছেই । এক তীব্র সাহসী
আলোয় ঝলসে যাচ্ছে বৃদ্ধ ডুণ্ডুভের
মুখ ।
রুরু ভাবছিল
কে বেশি ক্ষতিকারক এই
অন্তজ বৃদ্ধ , নাকি চক্রান্তকারী
অকৃতজ্ঞ পিতা ? এই মানুষটা মৃত্যুর
মুখে দাঁড়িয়েও , নিজের জাতির প্রতি ন্যায় বিচার করতে অঙ্গীকারবদ্ধ । আর গন্ধর্ব রাজা নিজের মৃত্যুমুখী
মেয়েকে অন্তিম মুহূর্তেও
ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয়নি !
স্বার্থ অনেকটা
বংশগত পাপের মতনই , সুযোগ সন্ধানী । সঠিক
সময়ে সাপের মতনই
ফণা তোলে ।
কবিতা- দ্বিতীয় পর্যায়
ছিন্নমূলের অভিযোজন
কাব্য নয় লিখছি যেন নীরব মৃত্যুভয়ের নিরাময়
বাণী
পাঁজরের হাড়ে কলম বানিয়ে।
অশ্বত্থ গাছের তলার বেদীতে পূর্ব-পুরুষের
কল্পিত
ছায়া পড়ে আছে সন-তারিখ নিয়ে।
শুকনো পাতা হয়ে ঝরে পড়ার আগে বসন্তের সাথে
শুধু একটি ঋতুউৎসব-যাপন।
আর তার আগে সমগ্র বিষণ্ণ-গাথা লেখা ফলকের
করে যেতে হবে আয়োজন।
একলা যে জীবন তার ঘর ছিল না, না থাকবে আর
থাকবে শুধু একরেখা পথচলা।
ছিন্নমূলের অভিযোজন থাকবে; খুঁজবে বায়বীয় পথে
জলকণা পেলে বন্ধ হবে কথা বলা ।
তারতম্য
দেবার্ঘ সেন
কতদিন ছোঁয়াছুঁয়ি হয়নি তোমার সাথে
আজ এই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধলে
একটিবার ছুঁয়ে মেপে যেও উষ্ণতার তারতম্যতা।
জিভের নীচে তোমার অবস্থানে
আমি বড়ো তৃপ্ত হই গো
থার্মোমিটার।
হারিয়ে যেও না
মাধবী দাস
দম বন্ধ হয়ে আসছে নিশ্বাসে আতঙ্ক
বুকে জমা ডিপ্রেশন জানলা খুলে দাও
সংক্রামিত কুয়াশায় আদিম আবেগ
আবার নীরব হব জিভের ম্যাজিকে
বাঁচার ইচ্ছে নিয়ত আগুন স্ফুলিঙ্গ
জিভে রাখা সঞ্জীবনী সর্বিটেট বন্ধু
অদৃশ্য প্রিয়মুখের রঙিন দুনিয়া
কুণ্ডলী পাকিয়ে আসে সমস্ত দরজা
ঘুম ভাঙেনি সূর্যের জাগেনি ছেলেটি
সৃষ্টিতত্ত্ব উপেক্ষিত বিচলিত আমি
বুকফাটার চিৎকার একাকিত্বে ভয়
অকাল প্রয়াত বন্ধু জড়িয়ে ধরছে
বাতায়নে হরেকৃষ্ণ মনে রবিকবি. ..
যন্ত্রণার মধ্যিখানে জ্বলে ওঠে আলো
পাণ্ডুলিপি নিরূপায় উড়িয়ে দিয়ো না
আদিগন্ত ভালোবাসো আশ্বাসিত করো
জন্ম নেব জীবনের মৌল রসায়নে
কথকথা হয়ে থাকি হারিয়ে যেও না।
"দেখুক পাড়া-পড়শিতে"
সুদীপ ব্যানার্জী
পাগলি পাখিটা!
প্রজাপতির পোকা জীবন ওড়ে না...
রোমশ্ বডি... তুলতুলে... ঠুকরে খেলে,
ফুলদানি বড় একা!ফুলহীন ফাঁকা...
তুলি আর ব্রাশ উদ্বায়ী দেহ দ্যাখে...
টুকরো দেহাংশ গসগসে গরম!
রক্তসঞ্চালন বেড়ে গেলে,
সান্দ্রতাঘণ অজাচার।
ফিলামেন্টে হলুদ বিকার, রশ্মি...
লালারস শক্ত হলে,গুটিবদ্ধ,আনমনা...
আসন্ন মুক্তি রূপটান বুলোচ্ছে গালে!
ভেঙেচুরে আকার আকাশে উড়লে,
পরাগ আগলে একবাগান ফুল...
পাগলি পাখির ঠোঁটে ভেজা মাটি, নরম...
অবিকল আরও গাছে
পোকা রেখে যায় পড়শিরা ...
জীবন
সোমনাথ গুহ
একটি চরম মুহূর্ত
সব পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে থাকে
সব হারানো
মুহূর্তের ছেঁড়া কাটা লাশের পাশে
এই যে হারিয়ে
যেতে যেতে পাওয়া
স্রোতে তলিয়ে
যাওয়ার আগের খড়কুটো
এই বেশ ভালো ভুলে
যাওয়া ভুলে যাওয়া গন্ধ
আবহমান কালের
চাওয়া পাওয়ার দড়িকলসি
ব্যবধানহীন
সম্পর্কের জলে দাঁড়িয়ে থাকে
আকাশে একদিকের
রোদ খেলে অন্য আকাশে
এই তো বেশ
বেহিসাবি জীবন্ত প্রাণ
একটু একটু করে
আমকে তুলে ধরে।
সকাল
উদয় সাহা
নিম্নগামী পারদ।ঘূর্ণাবর্ত।
বাঁকে বাঁকে জোলো হাওয়া।
মনের মেঠোপথ ধরে এগিয়ে যায়
কুয়াশার ব্যাগ কাঁধে ডাকহরকরা ...
জেগে থাকি---
আকাশের নতুন পোশাকে দেখব
তোমার অবয়ব
অরণ্যকথা
দীপশিখা চক্রবর্তী
রাংতা গোধূলি আলোয় সাজে গভীর অরণ্য,
শূণ্য দিগন্ত,হিমের পরশ,বুনো ঘাসের গন্ধ,
ছেলেবেলার মতন লুকোচুরি খেলতে গিয়ে হারাই পথ,
ধুলো আর জোৎস্না মেখে এগিয়ে চলি ধ্বনিময় সরলরেখায়,
এক নিঁখুত অন্ধকারের কোলে বসে শ্যাওলায় আঁচর কেটে লিখি কবিতা।
গাছের পাতার জমা মেঘে একাই ভেজে মনের পাখি,
লাল নীল গোলাপীর উষ্ণতার ওম মেখে খুঁজে চলে প্রাণবন্ত আকাশ।
গাছের ডালে মাকড়শার জালে জমে থাকে রাত্রের শিশির,
নির্জনতার কোরাস থেকে কুড়িয়ে নিতে পারি চোখের ভেতরের লবণাক্ত আলো,
ঝরা পাতার শব্দের মাঝেও কানে আসে ঝিঁঝিঁপোকাদের ঠুমরীর আসর,
ঘাসেদের সবুজ নমনীয়তায় পায়ে জাগে নূপুরের ছন্দ।
এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় জড়ানো চোখজুড়ে নামে শান্তি,
চোখ আসে বুজে,
লিখতে না পারা কবিতার ওপর নামে ঘোর রাত্রি।
তুমি নিরুদ্দেশ
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
কবি সুভাষ থেকে একটা মেট্রোরেল ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে শহর কলকাতার দিকে।
একে একে পুরনো হচ্ছে রবীন্দ্র সরোবর, কালীঘাট, রবীন্দ্রসদন,
এবার আসছে পার্কস্ট্রিট, প্ল্যাটফর্ম বাঁদিকে,
তোমার সামনে আর কোন বিকল্প নেই-
এবার তোমায় নেমে যেতে হবে শহরের গায়ে।
কারণ বাঁদিকে দরজা খুললে তোমার খিদে বাড়ে,
বাঁদিকেই তোমার গন্তব্য।
প্রতি ডানদিকের দরজা যেন যৌথপরিবার;
তোমার জন্য তারা ঝুলিয়ে রেখেছে জন্ম মৃত্যু আর বিবাহ নির্ঘণ্ট,
তুমি প্রতিদিন বাঁদিক চেপে লেডিস সিটে প্রথাগত জ্যামিতি আঁকো। মিথ্যেসার।
দুটো দরজার মধ্যে কার্যত এক মহাদেশ তফাত-
স্বভাবতই তোমার নামা হয় নি পার্কস্ট্রিটে।
প্রতিপদেই ডানদিকের অভিকর্ষজ টান অনেক বেশি!
এবার ট্রেন ঢুকছে শোভাবাজার, শ্যামবাজার, বেলগাছিয়া-
কলকাতা পিছিয়ে পড়ছে।
পরবর্তী ও প্রান্তিক স্টেশন দমদম, প্ল্যাটফর্ম বাঁদিকে,
এবার তোমায় নামতেই হবে কচি ঘাস মাড়িয়ে।
আবার বাঁদিক-
শহরকেন্দ্রিক দেশে কিছুটা গা ভাসানোর দিক,
তুমি নেমে গেছো এবার-
ট্রেন চলে গেছে
তারপর থেকে আর কেউ তোমার খবর দেয় নি;
তুমি নিরুদ্দেশ।
ব্যঞ্জনধ্বনি
-- বিপ্লব সরকার
-- বিপ্লব সরকার
ভরা ঘাসে হরিণের পাল দেখে শাণিত হয়
বাঘনখ
বাঘনখ
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার -- একটি ব্রান্ড!
ব্রান্ড শব্দে বড় ভয়
ব্রান্ড শব্দে বড় ভয়
বারান্দায় দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছাড়লে--
শূন্যমুহুর্তে খালি হয় উঠোন
শূন্যমুহুর্তে খালি হয় উঠোন
অর্থাৎ পরাজিত সৈন্যদল ছুটছে
সুযোগ বুঝে গর্বিত বাঘনখ
পাল থেকে টুকে নেয় --
নরম মাংস
পাল থেকে টুকে নেয় --
ধারালো নখের কাছে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকে
হা-মুখ ব্যাঞ্জনধ্বনি!
কালশিটে চাঁদ
অসীম ভুঁইয়া
সন্ধ্যালাপে নীলচে মেঘ বিছানায় যায় ঘুম
ঘুমের ভেতর একলা ভাসে ভেলা
#
আমার বুকের কালশিটে চাঁদ কেটেই ফালাফালা ।
সেই নির্জনে
শম্পা চক্রবর্তী
বর্ষার শহুরে প্রেক্ষাপটে,
ভেজা ভেজা বাতাসের
অপার্থিব শিহরণে ফিরে আসে কৈশোর প্রেম।
সে এক ভারী মস্ত গাছের নিচে
ছোট্ট ছাতার অপরিসরে-
দুই আধভেজা অচেনা শরীর মুখোমুখি ।
আড়ষ্ট কিছু মুহূর্ত—
বৃষ্টির খেয়ালি আলাপ থেমে যায় ।
তৃষ্ণার্ত ঠোঁট সময়ের শাসনে
নিজেকে সামলে নেয়।
শরীরের ক্ষনিক দোলাচলেও
শান্ত স্থির ,অদ্ভুত মায়াময় চারপাশ—
শুধু মন কে বোঝানো গেল না।
কার সাধ্য ,সংযমের শিকলে
তাকে বেঁধে রাখে হৃদয়ের
গোপন মহলে।
শেষ হয় বরাদ্দ সময়-
বিদায়ের বেলা, একের দ্বিধাহীন হাত
আলতো ছুঁয়ে নেয় অন্যকে।
এরপর চলে যায় যে যার পথে—
মন শুধু থেকে যায় সে গাছের নীচে
সিমেন্টের বাঁধানো বেদীতে।
এ পৃথিবী আমার নয়
অমলেন্দু বিশ্বাস
এখানে সারি সারি বিবেক শুয়ে আছে
মৃত আগ্নেয়গিরির মত
এ শয্যা আমার নয়, এ ঘরও আমার নয়।
এই যে মৃত্যু মশালে তুমি চোখ ঝলসাও
বুকে বুলেট পুঁতে তুমি আমাকে বানাও ভীষ্ম
ধর্মের রঙে তুমি আকাশ ঢাকো
রাজনীতির আগুনে আমাকে করো ভষ্ম
এ জন্ম আমার নয়, এ দেশও আমার নয়!
দেশ আমি তো তোমায় মানচিত্রের রক্তক্ষরণে নয়
উড়ন্ত সাদা পায়রার ডানায় চাই
এ মাটি আমার নয়, এ আকাশও আমার নয়
মাটি, আমি তোমায় ভালোবাসার অঙ্কুরোদগমে চাই
ধর্ষিত মায়ের ভূমিতে তো নয়
হে নির্ভীক আকাশ, তোমাকে চাই দিগন্তহীন নীল নীলিমায়
বারুদ ভরা জ্বালাময়ী কোনও ক্ষেপণাস্ত্রে নয়
এ সবুজ আমার নয় এ নদীও আমার নয়
সবুজ, আমি যে তোমায় জীবনানন্দে চাই
কৃষকের হাসিতে চাই,শিশুর কলরবে চাই
বঁধুয়ার খুশিতে চাই
ধান ক্ষেতে পড়ে থাকা লাশেতে নয়,
ফিকে স্বপ্নের ভাষাতেও নয়
নদী, তোমায় আজীবন স্রোতস্বিনী গঙ্গার মত করে চাই
বিবাদমান ব্রহ্মপুত্রের মত নয়
এ শহর আমার নয়, এ শিক্ষাও আমার নয়
শহর,আমি তোমায় পথ শিশু
কিম্বা হাইড্রেনের ভ্রূণতে নয়,
তোমায় তো ভালোবাসার আশ্রয়ে চাই,
সহমর্মিতায় চাই, সহানুভূতিতে চাই
শিক্ষা, তোমায় ধ্বংসের মত নয়
তোমায় সৃষ্টির মিছিলে চাই, চির আনন্দে চাই ,
সার্বজনীন উৎসবে চাই
আজ এখানে এক রাত নেমেছে
কেউ হাস্নুহানায় বিষ ঢেলেছে
এ যন্ত্রণা আমার একার নয়
এ আন্তর্জাতিক দুঃখও কেবল আমার নয়!
না! এ জন্ম আজ আমার নয়, এ পৃথিবীও আমার নয়!
এই সময়
দেবারতি চক্রবর্তী
সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলে পাতাল
প্রবেশে একঝাঁক ইঁদুর কামড়ে ধরে
বাদুড়ের পাল উল্টো ঝুলে
বড়ো বড়ো চোখে তাকায়
মৃত্যু মৃত্যু গন্ধ
পিপড়েরা লাইন ধরে শ্মশান যাচ্ছে
বুড়ো ইঁদুর দেহত্যাগ করেছেন
আজ তার শেষ কৃত্ত
সাদা সভায় সাদা পোশাকে
আমন্ত্রিতরা বসে
সাদাকালো
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
দিন আর রাতের দাবার ছকে
আমাদের সাদা আর কালো ঘুটির
চাল চলছে নিরন্তর।
এক পা, দু'পা বা বেশ কতকে
আমাদের অভিসার।
সে অভিসারের রঙ নেই,
আছে সাদাকালোর নিশ্চুপ আবরণ।
দুই দিগন্ত থেকে আমাদের-
এগিয়ে আসা,
পরস্পরের দিকে।
কাছে এসে ফের হারিয়ে যাওয়া,
বুকে পাথর আর অস্তিত্ব -
এই দুয়ের সহাবস্থানে থেকে যায়
আমাদের একজন;
কোন তৃতীয় বিধাতার ইচ্ছা অনিচ্ছায়।
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী
দিন আর রাতের দাবার ছকে
আমাদের সাদা আর কালো ঘুটির
চাল চলছে নিরন্তর।
এক পা, দু'পা বা বেশ কতকে
আমাদের অভিসার।
সে অভিসারের রঙ নেই,
আছে সাদাকালোর নিশ্চুপ আবরণ।
দুই দিগন্ত থেকে আমাদের-
এগিয়ে আসা,
পরস্পরের দিকে।
কাছে এসে ফের হারিয়ে যাওয়া,
বুকে পাথর আর অস্তিত্ব -
এই দুয়ের সহাবস্থানে থেকে যায়
আমাদের একজন;
কোন তৃতীয় বিধাতার ইচ্ছা অনিচ্ছায়।
এক অচেনা তুমি
রুবাইয়া জেসমিন (জুঁই)
শহরটা তো অচেনা ছিলই
রাস্তাগুলো শাখার মতো বেড়ে
ল্যাম্পপোস্ট গুলোই শুধু চেনা চেনা
কফিহাউস এর দোতলার সিঁড়ির মুখে ওই ভিক্ষুকটা মুখ থুবড়ে
সময় বদলের অপেক্ষায় সেও
শহরটাও সময় বদলের অপেক্ষায়
কতকাল পুরোনো জানালা গুলো বন্দ
আমিও বাদ যাই না অপেক্ষার তালিকা থেকে
অচেনা শহর গিলেছে তোমায়
এক অচেনা তুমির জন্ম..........!
সুখ স্মৃতি
দেবপ্রিয়া সরকার
মনের আরশী জুড়ে নিত্য হরেক চিত্র আঁকা হয়
তার মধ্যে কতক মধুর স্মৃতি হয়ে রয়।
এইতো সেদিন সকাল সকাল গন্তব্যের পথে
শীর্ণকায়া বৃদ্ধা সহযাত্রী এক,
পাশে এসে বসে।
প্রবল শীতে সম্বল তাঁর একখন্ড থান
ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে তাই ওষ্ঠাগত প্রাণ!
জিজ্ঞেস করলাম,
"পড়েননি কেন গরম কোনো কাপড়?
"
বললেন করুণ স্বরে,
"আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়ে গেছে একমাত্র চাদর। "
"বাড়িতে কী নেই কেউ?
" জানতে চাইলাম যেই
উত্তরে বললেন তিনি,
"ছেলে, বউ, নাতি আছে সকলেই। "
দয়া করে খেতে দেয় রোজ দুবেলা দুমুঠো
সংসারের এককোণে তিনি নেহাতই অবহেলিত খড়কুটো!
দুচোখের দৃষ্টিও হারাচ্ছেন কালে কালে
একাকী চলেছেন তাই সরকারি হাসপাতালে।
এলোমেলো ভাবনায় ক্ষাণিক ডুবেছিলাম মনে
হঠাৎ চোখ চলে গেল সামনের দোকানে।
শীতের পশরা সাজাতে ব্যস্ত দোকানি
ইচ্ছে হল একটুকরো শীতবস্ত্র ছুট্টে কিনে আনি।
নতুন চাদর খানি যেইনা পেলেন হাতে
আনন্দিত বৃদ্ধার কন্ঠ হল রুদ্ধপ্রায় আঁখি বাষ্পতে
অরণ্য সাধক
শিপ্রা পাল
অরণ্য সাধক দাঁড়িয়ে রয়েছে
একটা আলোক বিন্দু ছোটো হতে হতে মিলিয়ে যায়
ঐ পাহাড়ের ওপাশের শূন্যতার হাত ধরে।
ধূলো বালি গাছের বৈরিতাকে মুঠো করে
এগিয়ে যায় বুনো গন্ধের সাথে উল্লাসে
কিছু নির্জনতার খাঁজে এঁকে রাখা পাথরে মাথা রাখে।
বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
একটা প্রবল ভূমিকম্প কেঁপে উঠেছে মানবের পৃথিবী
তছনছ করে দেয়া সমাজ সংসার দেশ থেকে দেশান্তরে।
আলগা হয় সম্পর্কের সুক্ষ্ম স্পর্শেন্দ্রি়
শুধু ভাঙ্গন —— ভেঙে পড়া নৈতিকতার হৃদয়হীন পতন
মানুষের সাথে অমানুষিকতার সংঘাত।
অরণ্য সাধক একাকী গান গেয়ে ওঠে
সমস্ত জগৎ চরাচর উত্তোলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে
আজ ভালোবাসার বড্ড অভাব ———।
সূর্য্য স্নান
দেবশ্রী চক্রবর্তী
দেবশ্রী চক্রবর্তী
অর্ক তোমার একমুঠো
আলো নিলাম,
নিজের শরীরে ওটাকে
ক'রি অনুভব।
ছোট্ট দুটি হাতে
কতখানি আলো সাজে?
তার থেকে নিয়ে -
একমুঠো আলো
যতবার দিই ছড়িয়ে-
অবাক কিছু সৃষ্টি
হাসি দিয়ে ততবার
গেল এড়িয়ে।
আলো নিলাম,
নিজের শরীরে ওটাকে
ক'রি অনুভব।
ছোট্ট দুটি হাতে
কতখানি আলো সাজে?
তার থেকে নিয়ে -
একমুঠো আলো
যতবার দিই ছড়িয়ে-
অবাক কিছু সৃষ্টি
হাসি দিয়ে ততবার
গেল এড়িয়ে।
হাসি পায়, যতবার ভাবি
তোর কথা ক্ষণিক দাঁড়িয়ে।
আলো তো আলোই হয়,
তা থেকে কিছু
অবাক সৃষ্টি-
অহরহ করে ভয়।
কখনও নারী, কখনও পুরুষ বেশে
অন্ধকারে তলিয়ে পরে শেষে
মৃদু হেসে ভাবি, অর্ক তোমার আলো
এড়িয়েই থাকে কিছু 'কীট' ভালো
না পাক তারা তোমার
ওমের স্পর্শ
'না-পাক' হয়েই
মিশে যাক
ফেরে না যেন
বরষ কোটি সহস্র।
তোর কথা ক্ষণিক দাঁড়িয়ে।
আলো তো আলোই হয়,
তা থেকে কিছু
অবাক সৃষ্টি-
অহরহ করে ভয়।
কখনও নারী, কখনও পুরুষ বেশে
অন্ধকারে তলিয়ে পরে শেষে
মৃদু হেসে ভাবি, অর্ক তোমার আলো
এড়িয়েই থাকে কিছু 'কীট' ভালো
না পাক তারা তোমার
ওমের স্পর্শ
'না-পাক' হয়েই
মিশে যাক
ফেরে না যেন
বরষ কোটি সহস্র।
তোর জন্য
সন্দীপা নন্দী গোস্বামী
তোর জন্য আমার এবেলা
শান্ত, একলা ঘরে
নিষ্পলক রাত্রি
ঘুমহীন,একরাশ দীর্ঘশ্বাসে
হঠাৎ কাঁপুনি শরীর জুড়ে
এই বুঝি হবে ভোর
কাটবে অপেক্ষার প্রহর
কাজল চোখ হতে চিবুকে
চিবুক হতে ক্রমশ .....
তবু তোর জন্য
সেই নীল শাড়ি পরনে
দিয়েছি কপালে বিন্দি
আসবি ভেবে তুই
মন আজ সেজেছে নায়িকার বেশ।
রন্ধ্রে রন্ধ্রে উন্মাদনা
তোর স্পর্শ পাবার,
আয় একবার বন্ধু আমার !
জানিস কি তুই?
কেটেছে পাঁচটি বছর
হয়েছি জীবন বিমুখ
জেনেছি আজ তুই
বিলেত ফেরত ডাক্তার।
মনে কি রেখেছিস আমায়?
আমার শেষ লগ্নে একবার ,
একবার না হয় সাথী হয়ে
হাত দুটি ধরিস
হতে দিস তোর উষ্ণতার অংশ
নেই ভয় জীবন আমার
নিভন্ত বাতি .....
শুধু তোর জন্য।।।
ভালবাসি
বর্ণালী সেন
আমার খুব ভাললাগে
ভালবাসাকে ভালবাসি বলতে,
ভাললাগে তার প্রতি মুহুর্তের হিসেব রাখতে গিয়ে
যখন নিজের সারাবেলা শেষ হয়ে যায়,
পড়ে থাকে কিছু ব্যস্ততা
আর কিছু ব্যস্ত অবান্তর কথারা,
যাক গে,ও সব নিয়ে ভাবিনা আমি
যেটুকু আতিথেয়তা মন থেকে মন পায়
তার সবটাই খরচ করিনা,
কিছুটা আবেগ বাচিয়ে রাখি পরকাল বলে কি একটা আছে - তার জন্য।
যদিও আমি বরাবরই একটু বেপরোয়া
অবাধ্য প্রেমিকের কাছে,
তবুও ঠিক চলে যায় সুখী গৃহকোণ।
কথায় কথায় যখন বলতে শুনি -
"আমি তোমাকে পুরোটা চিনি,
হাজার হোক এতদিনের সংসার আমাদের"
মনের দেওয়ালে কোথাও যেন একটা আদুরে আভিজাত্য অনুভব হয়।
তুমি বলবে, এটা অভ্যেস
আমি বলি আমার অনেক দিনের চেষ্টায় কেউ একজন ভালবাসা পাওয়ার জন্য
যোগ্য প্রেমিক হয়ে উঠেছে।
আশ্রয়
সুজাতা মিথিলা
খুব যখন শীত করে
শূন্যতা এসে চেপে বসতে
চায় বুকের অলিন্দ ও নিলয়ে ,
ফেলে আসা সুখ স্মৃতি থাবা
বসাতে চায় খোলস হীন মননে,
চলে দিশাহীন আলোড়ন --
বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে
চেনা মুখ অচেনা রঙে ।
আমি খুঁজি , খুঁজে ফিরি
আমার পিছিয়ে পড়া মনোভূমের
খড়কুটোর মতো নিজের বিপন্ন
মূল্যবোধের অস্তিত্বদের
প্রতিটি মুখের রেখায় ,
চোখের ভাষায় ,
অক্ষরের আলপনায় ।।
শেষ রক্ষার আশ্রয় জোটে
এই ছায়াহীন বহুরূপী বসুধার
একমাত্র প্রতিনিধি নিষ্পাপ শিশুর আদুল মুখে।।
" তবু ভালোবাসা "
সুস্মিতা কুন্ডু
সাগর ডাকে , 'আয় '
এতো ভালোবাসি , তবু ভয়
দূর থেকে মন হারায়....
অফুরান প্রাণ ,হৃদয় বিহীন
মাঝে মাঝে কেন মনে হয়
ভয়ঙ্কর , কঠিন !
বেহিসেবী উত্তাল , সুন্দর
বড়ো উচ্ছ্বাস !
কাছে ডেকে করে অক্লেশে আঘাত ...
নিঃস্ব প্রাণহীন
করে দিতে জানে
বোঝে না শুধু সে ভালোবাসার মানে ....
বদ্ধমাতাল
রীনা মজুমদার
বদ্ধমাতাল!
মাতাল হতে বেশ লাগে-
শব্দ খোঁজার নেশায়।
কাঁচের গ্লাসে যখন
এক পেগ ঢালি
ওরা হাসে, ওরা হাততালি দেয়
বলে...মাথাটা গেছে! শালা বদ্ধ মাতাল
আমার শব্দরা গ্লাসে তখন
ছটফট করে প্রসব যন্ত্রণায়,
দশমাসের যন্ত্রণা সভ্যতার বুকে
প্রতিবাদী কবিতার জন্ম
পৃথিবীর আলো দেখবে বলে।
ওরা হাসে, বিদ্রুপের হাততালি দেয় যত
মনের আকরে যৌবনের বুক চিরে
গ্লাসে গ্লাসে শব্দ ঢেলে
আমিও বদ্ধমাতাল হই তত।
সত্যি ঘটনা
ঝড়ের খেয়ায় মৃত্যুর মুখে--
সম্পা দত্ত
ভুসুয়ালে টানারিকা রিসোর্টে পরপর দুদিন থেকে,ঔরঙ্গাবাদে অজন্তা ইলোরার সৌন্দর্য ও আর চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসছে পাপিয়ার,
সেদিনের পর থেকে পাপিয়া দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। ফোনে আমাকে বাড়ির সবাইকে ডিটেল্স জানিয়েছে, মনে করতেও চায় না, সেই বিভৎস দৃশ্য।
গোয়া ঘুরে বোম্বে গিয়ে তাজ হোটেল মুম্বাই গেট কাছাকাছি ওদের হোটেল।সব ঘুরে সেদিন ছিল অ্যালিফ্যান্টা কেভে যাবার সময়। লঞ্চে ওঠার কিছুক্ষন পর পরই আকাশ ঘনকালো হয়ে আসছে। মেঘের আড়ালে বোম্বে শহর ঢেকে যাচ্ছে। চারিদিক জল আর জল। দিকশূন্য। আকাশে বজ্রগর্ভ মেঘ, বিদ্যুতের আলোর ঝিলিক। সামনের লঞ্চে আগুন জ্বলছে। দুজন মারা গেছেন। পাপিয়াদের লঞ্চে শিশু কিশোর বৃদ্ধ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আর বুঝি হোটেলে ফেরা হল না। বাড়ির সবার মুখ ভেসে উঠছে ওর চোখে।
বাচ্ছাগুলো ছিটকে পড়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ অবস্থা। বিদেশিনী মহিলা রা ঠাকুরের নাম করছেন। পাপিয়া মাথা নীচু ক'রে বসে চোখ বন্ধ । ভাবছে আর বুঝি জীবন নেই, এইবেলায় শেষ হবে। চারিদিক থৈ থৈ সমুদ্রের জল। লঞ্চের মারাত্মক দুলুনি।
চালক অভয় দিচ্ছেন। তবুও নতুন অভিজ্ঞতা। কোনোমতে কেভের সামনে গিয়ে, কোনো কিছু না দেখে ওরা আবার অন্য একটি লঞ্চে করে ফিরে এসেছিল। মাঝ সমুদ্রে ভরা ঝড়ের তান্ডব থেকে কোনোরকমে বেঁচে ফিরল। এখনো পাপিয়া সেকথা ভুলতে পারেনি। চোখ বুজলেই সেই দৃশ্য বার বার দেখতে পায়।
ওর ভীষন ভয় করে আজও----ঝড়ের কবলে মৃত্যুভয়!!"
রম্যরচনা
IQ বনাম
EQ
শান্তনু দাস
আমাদের ভাবের ঘরে সারাক্ষণই একজনের সাথে আরেকজন লড়াই করে চলে। চারপাশে
এই লড়িয়ে দেওয়াটা বহুকাল ধরেই একটা বেশ চালু ব্যাপার। লক্ষ্মীর সঙ্গে লড়েন সরস্বতী,
উত্তমের সঙ্গে সৌমিত্র, মোহনবাগানের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল, শাহরুখের সঙ্গে আমীর কিংবা কলকাতার
নাইটদের সঙ্গে ব্যাঙ্গালরের রাজকীয় চ্যালেঞ্জাররা – বঙ্গমনের গলিঘুঁজি যেন গাজা স্ট্রীপের মতোই চিরকালের যুদ্ধবিদ্ধস্ত
অঞ্চল। ফিলহাল লড়াইয়ের ময়দানে তাল ঠুকছে IQ আর EQ ।
প্রথমটার কথা আমরা মোটামুটি সবাই জানি অর্থাৎ ইন্টেলিজেন্ট কোশেন্ট যা
কিনা মানুষের বুদ্ধি মাপার গজফিতে। এই IQ–এর একটা অতি যাচ্ছেতাই বাংলা প্রতিশব্দ আছে, ‘বুদ্ধ্যঙ্ক’।সাধারণ
ভাবে উচ্চ IQ –ওয়ালা ব্যক্তি মানে
বোঝায় তীক্ষ্ণ, চটপটে স্মৃতি,প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও দ্রুত অগ্রপশ্চাৎ ভাবনার সংযোগের
পটুত্বে নানাধরনের আঙ্কিক ও তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান ও বিভিন্ন ধরণের জটিল ধাঁধার
উত্তর নিমেষে করে দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন একজন মানুষকে। অফিস হোক বা বাড়ি, চায়ের আড্ডা,
ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন বা দাম্পত্যজীবন প্রায় সব পরিস্থিতিতেই আমরা কিছু না কিছু বাধাবিপত্তির
মুখোমুখি হই, রোজ। কিন্তু আপনি দেখবেন যে আপনার অত্যুচ্চ মানের বুদ্ধ্যঙ্ক দিয়ে সেইসব
বাধাবিপত্তিগুলো ঠিক পেরিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। যত চেষ্টা করছেন সমস্যাগুলো যেন পাঁকাল
মাছের মতো ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক এখানেই EQ বা Emotional Quotient –এর কেরামতি। এটাকে অনেক সময় Emotional Intelligence
Quotient নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। তা EQ বা EIQ বস্তুটি
ঠিক কি ? খায় না মাথায় দেয়? বহুল প্রচলিত একটি সজ্ঞায় পাচ্ছি,’Emotional
Intelligence Quotient describes a self-perceived ability, capacity and skill to
identify, asses and manage the emotions of one’s self, of others or of groups.’
সহজ ভাষায় বললে, ‘ইমোশনাল
ইন্টেলিজেন্স’ আচার আচরণ, ব্যবহার
ও কথাবার্তার বাঁধা জগৎ থেকে বেরিয়ে আমাদের অন্যভাবে চিন্তা করার প্রেরণা যোগায়। আবেগ
দিয়ে কোনও কাজ হয় না, একথা যাঁরা বলেন তাঁরা যে অভ্রান্ত নন EQ
সেটাই প্রমান করতে চায়। আমি ভেবে দেখেছি EQ-এর বাংলা হতে পারে ‘বোধাঙ্ক’। ‘বোধ’ বা
‘বুদ্ধি’ এক
নয়।‘বোধ’ আর
‘আবেগ’ও এক
নয়। খানিক বুদ্ধি, খানিক আবেগ, খানিক জ্ঞান এইসব মিলিয়ে মিশিয়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের এক
অনামা কর্মোদ্যোগের নাম ‘বোধ’। এই বোধই আমাদের সমঞ্জস রাখে।
একজন মানুষ যার IQ খুব
ভালো, সে যুক্তি দিয়ে তার কাজের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে বক্তব্য পেশ করতে পারে, তার বিশ্লেষণ
ক্ষমতা ভালো, সে তর্কে পারঙ্গম, সে যে কোনও বিষয় চটপট ধরে নেয়। কিন্তু সে চায় কাজটা
শুধু করতে হবে তাই নয়, তার মতো করেই করতে হবে। এবং দেখা যায় যে কাজটা তার মতো করে না
হলেই তাদের মেজাজ বিগড়ে যায় এবং কাজটি আর ঠিকঠাক ভাবে হয়ে ওঠে না বা আকাঙ্খিত মানে
পৌঁছোয় না। অন্যদিকে ঊচ্চ EQ সম্পন্ন
একজন মানুষ যার রেজাল্ট হয়তো সোনা ছেলেদের মতো নয়, সে কিন্তু শুধু বুদ্ধি আর কেতাবি
বিদ্যেতে আটকে না থেকে বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী কোনও সমস্যা সমাধানে একাধিক রাস্তা
বাতলাতে পারে।সহকর্মীদের বুঝিয়ে বলতে পারে সে কি চাইছে। সে কাজটার মধ্যে বুনে দেয় একটা
স্বপ্ন,সদিচ্ছা, আবেগ – পরিষ্কার
বুঝিয়ে দেয়, এটা করলে এই লাভ হবে। IQ বলে আমি’র কথা,ব্যক্তিগত
উন্নতির কথা। EQ চায় সমষ্টিগত ঊন্নয়ন,
আবেগের নিয়ন্ত্রিত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে অন্যকে ঊদ্বুদ্ধ করতে।
আজকাল মনোবিজ্ঞানী, সমাজতত্ববিদ্ ও ব্যবহারিক শিক্ষার গুরুরা বলছেন ইন্টেলিজেন্স
হল জ্ঞান কিন্তু সেটাই পৃথিবীর শেষ স্টেশন নয়। এমনকী ইন্টেলিজেন্স একটু কম হলেও চলবে
তাতে করে জীবনে সাফল্য পেতে, নামযশ কিনতে অসুবিধে হবে না, যদি আপনার-আমার চরিত্রে পর্যা্প্ত
ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স থাকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন EQ-ই ব্যবহারিক দক্ষতা ও শেখার সম্ভাবনা কার কতটা তা যাচাই করার নির্ধারক
শক্তি। এতে আছে পাঁচটি উপাদান –
আত্মসচেতনতা,লক্ষ্য সচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহমর্মিতা ও অভিযোজন ক্ষমতা। কর্মক্ষেত্রে
আবেগকে দক্ষতার সঙ্গে কতটা কাজে লাগানো সম্ভব তা নির্ভর করে এই পাঁচটি ঊপাদানের ওপর
। একই IQ সম্পন্ন একাধিক কর্মপ্রার্থীর মধ্য থেকে নিয়াগকর্তা কিন্তু বেছে নেবেন
এই পাঁচটি মাত্রা বেশি থাকা প্রার্থীটিকে।
EQ-এর কাজ আবেগ নিয়ে। এতে মানুষের আবেগের জায়গাটা বোঝা, কোনও সমস্যা সমাধানে
আবেগকে কাজে লাগানো বা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।অবশ্য এর থেকে যদি কেঊ এ জাতীয় সরল সত্যে উপনীত
হন যে EQ-বেশী মানে আবেগ বেশি তা হলে সেটা একেবারে ভুল। EQ বলতে আমরা আবেগগত বিচক্ষণতা বা ম্যাচিওরিটির কথা বলছি। সাফল্যে বা সঙ্কটে
যিনি বেলুনের মতো ফুলবেন না বা তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বেন না। আজকের কাজের বাজারের
দিকে তাকালেই প্রমাণ হবে EQ-এর
গুরুত্ব কেন বাড়ছে। কারিগরী দক্ষতা ও পেশাগত প্রশিক্ষণ আজ কাজ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত। শিক্ষাগত যোগ্যতা
যেটা মূলত IQ-এর ব্যাপার, সেটা
কম গুরুত্বপূর্ণ বলছি না, কিন্তু আজকের কাজের জায়গা চাইছে IQ-এর চেয়ে আরও কিছু বেশি। এটাই EQ। আপনাকে
এগোতে হবে EQ-এর ওপর ভর করেই।
ছোট-বড়-মাঝারি আজকের দিনের সব প্রতিষ্ঠানই চাইছে সৃজনশীলতা, টিমওয়ার্ক, ঊদ্ভাবনী ক্ষমতা
ও আত্মবিশ্বাসী কর্মী। এটা পরিষ্কার করা ভালো, IQ কিস্যু না, এমন উগ্রপন্থার কথা কিন্তু একবারও বলছি না। বলছি যেটা, বেশি
IQ আছে এমন লোকজনই ক্যাম্পাস, অফিস, ময়দান কাঁপাবে এটা ভুলে যাওয়াই ভালো।
এই সামান্য লেখাটি যাঁরা পড়ছেন, তাদের অনেকেই হয়তো ফেলে-আসা স্কুল কলেজের
দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করছেন। বহু মিছিলের এক ট্রেলার চালু হয়ে গিয়েছে মনের পর্দায়।
যারা ছিল অসম্ভব মেধাবী, টপার; কিন্তু কর্মজীবনে তারা খুব একটা সফল হতে পারেনি। আবার
ঊল্টোটাও আছে, অনেক বন্ধুবান্ধবকেই স্কুল কলেজে তেমন কিছু মনে হয়নি, পরে দেখেছি কর্মজীবনে
তারা দারুণ সফল।। মিশুকে সপ্রতিভ, বলিয়ে-কইয়ে, লোকের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানো সেইসব
বন্ধুদের কর্মজীবনে সিঁড়ি টপকে যেতে খুব একটা কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।মনোবিদরা হিসেব করে
দেখাচ্ছেন, ছোটবেলায় স্কুলের পরীক্ষায় সফল হওয়ার সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের সাফল্যের
কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা বলছেন –
সুখ, সাফল্য, চলার পথে একটার পর একটা শিখর টপকানো এমন কিছু বৌদ্ধিক সামর্থের কম্মো
নয়। এরজন্য লাগে কিছু নির্দিষ্ট আবেগসঞ্জাত দক্ষতা। যা ছড়িয়ে থাকে আপনারদের ব্যক্তিগত
ও সামাজিক জীবনে। যেমন আত্মবিশ্বাস ও আত্মসচেতনতা না থাকলে আপনার পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া
বা নিজেকে মোটিভেট করা অসম্ভব। অন্যদিকে সহমর্মিতা, দলবেঁধে কাজ করার মানসিকতা না থাকলে
সহকর্মীদের নিয়ে কাজ করা অসম্ভব। আবেগ না থাকলে বেগ আসবে কোথা থেকে।
ডারঊইন বলেছিলেন, বিবর্তনের ইতিহাসে যেসব প্রাণী টিকে গিয়েছে, তার কারণ
এই নয় যে তারা সবচেয়ে শক্তিশালী বা বুদ্ধিমান ছিল, বরং রহস্যটা এই যে তারা পরিবর্তনগুলোর
সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের বদলাতে পেরেছে, ধরে রেখেছে অভিযোজনের ক্ষমতা। ডারঊইনের তত্ত্বকে
একটু খতিয়ে বিচার করলেই বোঝা যাবে IQ-এর চেয়ে EQ কেন
এগিয়ে। একজন ঊচ্চ IQ সম্পন্ন
মানুষ সবাইকে এক ছাঁচে ফেলে দেখতে চায়। এভাবে ঢালাই করে নেওয়াটাই কোন বিশেষ সমস্যাকে
দেখা বা বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আর দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে মেরুকরণ অনিবার্যভাবেই
আমাদের ঠেলে দিচ্ছে নিরন্তর সংঘাতের দিকে। সহজভাবে কোনও কিছু দেখতে যেন আমরা ভুলে গিয়েছি।
আমাদের IQ
কেও নিয়ন্ত্রণ করছে দৃষ্টিভঙ্গি। ক্রমাগত বদলে
যাওয়া এই সময়ই IQ কে পিছনে ফেলে EQ-এর গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। IQ নয়, সফল ও ইতিবাচক সম্পর্ক বাড়াতে তাই EQ-এর দ্বারস্থ হচ্ছে সব্বাই। EQ-এমন একটা ব্যাপার যা বারবার ঘুরে ফিরে আসা হিংসার চক্রটাকে ভাঙ্গতে
সাহায্য করে। সাহায্য করে জীবনের দিকে ইতিবাচক
চোখে তাকাতে।
বাংলার সহজিয়া সাধকদের ঢঙ্গে EQ চর্চাকে এককথায় বলা যায়,’মানবজমিন চষা’।ওর
ওপর গুরুত্ব দিলে আর যাই হোক, ‘এমন
মানবজমিন রইল পতিত,আবাদ করলে ফলত সোনা’–বলে গাইতে হবে না । IQ বাড়ার একটা নির্দিষ্ট বয়স আছে। মূলত স্কুল স্তরেই IQ
বাড়ে। কিন্তু EQ বাড়ানো যায় জীবনভর। IQ বহাল তবিয়তে থাক তাকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নই নেই। কিন্তু EQ এখন আমাদের পক্ষে আরও দরকার।
কমিঊনিকেশন স্কিল, সংযোগ দক্ষতা, লোককে ঊদ্বুদ্ধ করা, বোঝানো, বিপক্ষকে
বুঝিয়ে স্বপক্ষে নিয়ে আসা সাফল্যের একটা বড় শর্ত। এর জোরেই নেতৃত্ব অর্জন করা যায়।
আবার নেতৃত্বে টিকেও থাকা যায়। এককথায় বলতে গেলে EQ হল লোককে বোঝা, তাকে স্বীকৃতি দেওয়া আর কিভাবে ভাবলে-বুঝলে,কাজ করলে
আরও এগোনো যাবে তা বেছে নেওয়ার একটা পদ্ধতি যা রোজকার জীবনে আমরা কাজে লাগাতে পারি।
নেতৃত্বের কথাই যখন এলো তখন একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করি। কিছুদিন আগেই আই আই এম, কোলকাতা
সৌরভ গাঙ্গুলিকে বলতে ডেকেছিল ‘নেতৃত্ব’ বা ‘Leadership’ নিয়ে। আর কিছুদিন পরে যারা কর্পোরেট কর্তা হিসেবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে
যাবেন তাদের ক্লাস নেওয়ার ডাক পড়েছিল তাঁর। তিনি বলেন নেতা হওয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে
দলের বিশ্বাস আদায় করা। নেতার গুন সম্পর্কে বলতে গিয়ে জোর দিলেন সহকর্মীদের পাশে থাকার
ওপর, বিশেষ করে বিপদের দিনে। বললেন, প্রবল চাপের মুখে সব টেনশন শুষে নিয়ে বাকিদের জন্য
পরিস্থিতি সহজ করে দেওয়ার কথা। তাঁর মতে আসল
নেতা তিনিই, যিনি বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, বাকিদের কাজ
সহজ করতে সবকিছুর সঙ্গে যুঝে যাওয়ার মানসিক কাঠিন্য আছে যার। ‘দাদা’র পরামর্শ
‘বিশ্বাস’ হারিও
না। প্রথমেই সেঞ্চুরির কথা না ভেবে বরং জীবনের পিচেও রান কুড়োও একটু একটু করে। বিশ্বাস
কর বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযগিতায়।একটু মিলিয়ে দেখুন যে সৌরভ যা বলেছেন তা কিন্তু আদপে
EQ এরই কথা। যা একসময় ছিল নেতা হিসেবে তাঁর সাফল্যের রসায়ন।
পরিশেষে বলি, আমি নিজে একজন মধ্যমেধার ছাত্র ছিলাম। ‘সোনা’ ছাত্র
ছিলাম না কোনও দিনই। তবুও কিন্তু আমি আমার কর্মজীবনে বেশ সফল এবং সচ্ছল। এখন সামান্য
পড়াশোনায় বুঝি তা হয়তো ওই EQ-এরই
কারসাজি। প্রবীনদের ঊপদেশ দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই, তাঁদের সঙ্গে শুধু ভাগ করে নিতে
পারি নিজের ভাবনা, কিন্তু যারা বয়সে নবীন, যারা বর্তমানে ছাত্র, ভবিষ্যতের কর্মপ্রার্থী
তাদের বলি, মধ্য মেধার হলেও, টপার না হলেও ভয় নেই, শুধু আবেগটাকে বাঁচিয়ে রাখো, কিছু
করার জেদটাকে বাঁচিয়ে রাখো, তুমিই জিতবে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বললাম। মনে রাখবে ’Between
the idea/And reality/Between the motion/And the fact/Falls the shadow’ । সেই ছায়ারই নাম ‘ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স’।
হাতপাখা শব্দের উচ্চারণে মনে শীতল ভাব বিরাজ করে।
গরমে হাসফাস জীবন,
দুবার হাতপাখা নাড়ালেই জুড়াবে প্রান।
পাখা শব্দের উৎপত্তি পাখির পাখনা থেকে।হাতপাখা প্রয়োজনে,ব্যবহারে,ঘর সাজাতে আভিজাত্যে,ধর্মীয় কাজে বহুল প্রচলিত।
হাতপাখার ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকে। ষষ্ঠী ঠাকুরের পূজোতে হাতপাখাই প্রধান উপকরণ,পূজোর পর প্রথমে শিশুদের তারপর বাড়ির সব সদস্যদের এবং বাড়িতে আগত অতিথিদেরও হাওয়া করে সুস্থ্যতা ও দীর্ঘজীবন কামনা করা হয়।
পৃথিবীর সব দেশেই বিশেষ করে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে হাতপাখার কদর খুব বেশি।রাজরাজাদের শাসনকালে বড় বড় হাতপাখার ব্যবহারের রীতি ছিল।রাজার দরবারে,বৈঠকখানায়,রানীমহলে,অন্
আগেকারদিনে অর্থাৎ যখন বিদ্যুৎ এর ব্যবহার ছিলোনা, সেইসময় পরিশ্রান্ত গৃহকর্তা বাড়ি ফিরলে স্ত্রী হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করে তার কষ্ট লাঘব করতেন।মা ঠাকুমারা সারা গরমকালে দিনরাত শিশুদের হাতপাখার হাওয়া করে পরম আদর যত্নে ভালোবাসা মমতায় কষ্ট দূর করতেন। জ্বর হলে হাতপাখার হাওয়া এখনো সুখকর। মা, কাকিমা যখন ঘুটে দিয়ে উনুন জ্বালাতে নাকাল তখন এই হাতপাখাই একমাত্র ভরসা। আবার মা ঠাকুমার শাসনেও হাতপাখার জুড়ি মেলা ভার।তারপর ঠাকুরদাদার ঝিমুনিতেও হাতপাখা তটস্থ, এই হাবু বাতাস লাগেনা কেন্ ঘুমাস নাকি, শুধু ফাঁকি মাছি কামরায় মশা কামরায় জোরেজোরে বাতাস কর।স্কুলে চৈত্র বৈশাখ মাসে খুব গরমে পন্ডিত স্যারের হাতপাখার ডান্ডার মার, কিরে কালু পড়া শেখস নাই ক্যান আর ভুল করবি ক কেমন লাগে দ্যাক অহন আর ভুল করবি!!!
নতুন মেয়ে জামাই নায়র এলে শাশুড়ি পদে পদে রান্না করে মাটিতে আসন পেতে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে জামাই আদর সে এক মধুর দৃশ্য।
আর এখন এই যন্ত্রসভ্যতার যুগেও আমাদের স্কুলের কৃষ্ণাদি ক্লাসে পড়াতে পড়াতে, ইস্ এই গরম আর সহ্য হয়না কারেক্ট ও যে কি সেই যে গেলো আর আসার নাম নেই!!এই সীমা কোমনরুম থেকে একটা হাত পাখা নিয়ে আসোতো।
একসময় বহুদেশের মেয়েদের রেওয়াজ ছিলো বেড়াতে যাওয়ার সময় সুগন্ধিযুক্ত কারুকার্য করা হাতপাখা রাখার।এখনো ব্যবহার করে তারা তবে বেড়ানো এবং কর্মস্থলে যাতায়াতে খুব গরমের হাত থেকে স্বস্তি পেতে।
জাপানীদের কাছে হাতপাখা সৌভাগ্য ও সুখের প্রতীক। তারা বিশ্বাস করে হাতপাখার ডাঁটিটা জীবনের সূচনা নির্দেশ করে,আর পাতার শিরাগুলো জীবন চর্চার নানা দিক। "লাভ ইন টোকিও " এর কথা নিশ্চয় মনে আছে "সায়োনারা সায়োনারা বাদা নিভায়ুঙ্গি সায়োনারা ইথলাতি অর বলখাতি কাল ফির আয়ুঙ্গি সায়োনারা" আশা পারেখের হাতে সেই সুন্দর হাতপাখাটি আজও মন কারে।দেশেবিদেশে বিভিন্ন মন্দিরে এমনকি অফিস আদালতেও বিশালাকৃতির হাতপাখার ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
অতীত থেকে বর্তমানে তালপাতার হাতপাখার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তবে পাশাপাশি সুতো, উল,কাপড়, গম ও ধান গাছের শুকনো কান্ড, সুপারি গাছের পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরি করা হয়।ময়ুরের পেখম দিয়ে তৈরি হাতপাখা খুবই মনোমোহিনী। পাখা শিল্পীরা হাত পাখার নামকরণও করেন যেমন-ধানছড়ি, কামরাঙ্গা ফুল,চালতা ফুল, শঙ্খলতা,কেঁচিকাটা।কাপড়ের তৈরী হাতপাখায় সুতো দিতে সেলাই করে নানারকমের ফুল, ছবি, কল্কা, ছড়া বানাতেন। হাতপাখায় বিভিন্ন কারুকার্য করে ঘর সাজানোর জন্য সুন্দর করে ওয়াল হ্যাঙিং বানানো হয়।
"হাতপাখার হাওয়া মস্ত ভারী,
সৌন্দর্য্য আর শীতল গুনে কদর তারি "।
শীতের সকাল
সুপ্রীতি বর্মন
সারাসন্ধ্যে অফিসের ধকল লুকানো আস্তিনে আমার মুখভার। ভারি বয়েই গেছে তার আমি আসা মাত্র শীতের সন্ধ্যেতে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশুতি হয়ে বসে আছো, আমার আদরের শুধু আবদার তার। অনুরোধের আসরে বেজে উঠে রোম্যান্টিক সুরের মূর্চ্ছনা, সার্থক হয়েছে শীতের জমাট বাঁধা রাত শুধু তোমার আমার।।
হাড় কাঁপানো এক দারুন শীতের কাকভোরে প্রাত্যহিকের সম্পর্ক ফিকে করতে চাই। আমার মেঘরোদ্দুর তাইতো অনুভূতির সম্পর্কের আঁচ ধিকিধিকি আমাকে তোমার কাছে টানে। একটু মধুর আলাপনে উল্লাসী ধোঁয়ায় চায়ের কাপে তোমার রিক্ত ওষ্ঠের চুমুকে অনর্গল আকুতির বিভ্রান্ত প্রলাপ। আজ আর অফিস যেওনা ভালোলাগেনা দুদন্ড সময় দাও তোমার পাশে ঘুমোতে চাই আরেকবার এই সাতসকালে।।
ভিড়ভাট্টার স্টেশন ধ্বস্তাধস্তি ঝক্কি ঝঞ্ঝাট সহ কানে আঙুল।একফালি আমার সংসার, আভিজাত্য সেখানে অচেনা অভিশাপ, শাপগ্রস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রবীণের চোখে ধাঁধা দূর থেকে দেখছি আর শীতঘুমে চতুর্পাশ নিঝুম তবুও ঐকান্তিক আমার প্রচেষ্টা সামনের উজ্জ্বল দিনগুলোর আশায়।।
গোলকধাঁধায় পাক খাওয়া হতোদ্যম আমার প্রচেষ্টা শীতের অসহ্য সূঁচফোটানো যন্ত্রনা আর অক্ষমতা সরিয়ে ট্রেন জার্নির ধকলে তোমাকে সঙ্গে না নিয়েও নিলাম সঙ্গে।।
অফুরাণ সন্ধানে তোমার প্রেমের হাত ধরে শীতের সকালে সজীব তারুণ্যের স্পন্দন জিইয়ে রেখেছে আমার আমিকে। তোমাকে নিয়ে রোজ ভালোবেসে ভালোবাসায় সাত পাঁকে হাঁটি। হেসে একসা রাইকিশোরী তুমি এসেছিলে, আমার পাথরে আদর প্রত্যাশী। তোমার সংলগ্নে কেমন যেন শিরশির হাওয়া রোম ওঠা আমার শিহরণ। ভিজে ভিজে চারপাশ কুয়াশায় কড়া নাড়া রাতের এবার জাগো শীতের সকালে প্রিয়া।।
রাতে পরাতে গিয়েছিলাম ভাবনার নোলক সটান চলে গেছো দৌরাত্ম্যে ছটফট, ডুবে যাওয়ার আগে তোমার ভরাকোটালে আমার আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার খড়কুঁটো শুধু তুমি শুধু তুমি। তোমার এহেন রূপে সৌন্দর্য্যের সন্ধ্যার চাঁদ, মনেতে হালকা জটলা তোমাকে চাই। ভাবতে ভাবতে কখন মুখ রাখলাম ট্রেনের জানলায় শীতের সকালে।
শেষপাতে শীতঘুমে বড়সড় পাহারটার হাড় পাঁজর আর ভেতরে থৈ থৈ ঝর্নার জল।।
ভাঁড়ারে আমার টান তাইতো শীতে জবুথুবু আমার নীরস নিষ্প্রান শরীরে অকর্মন্য মাকড়সার জাল। মধ্যবিত্ত দাবী চাহিদা মানানসই টানাপোড়েনে সামঞ্জস্য, বুঝে যাওয়া চাইনা বলে নিরুত্তাপ শীতের রুক্ষতা তবুও ক্রীমের রেশমটুকু পেলব মসৃনতায় তোমার স্পর্শতার সুখ। ঐটুকুই তোমাকে ঘিরে আমার বেঁচে থাকার স্বভাবদোষ। স্পর্ধা আমার হাত দেওয়া তবুও দামাল প্রকৃতির খেয়ালীপনায় তোমাকে নিয়ে খালি জংলীপনা। কোথায় তখন ধনী, দরিদ্র আর মধ্যবিত্ত নিরক্ষরেখার ছোঁয়ায় খুঁজে পাক ফিরে প্রান তোমার আমার প্রনয়ের ফলশ্রুতি শীতের সকাল। জীবন নামক পানীয়ের তলানিতে পড়ে আছে অবুঝ অভিমান, কে জানে কবে তোমার শীতঘুম ভাঙ্গবে।।
আর ঘোরলাগা চোখে শীতের সকালে দেখবো চাবির গোছা কোমরে আঁচলে বেঁধে করবে তোমার দেখনদারির দৌরাত্ম্য। তুমিই হবে আমার ছাপোষা সংসারের হর্তাকর্তা। ভালোবাসার অভিমানে ঋণী শীতের সকালের চুপকথা। শব্দব্রহ্মের কান্ডারী হয়ে গড়বে তুমি রূপকথা। আমার তোমার অসময়ে নিভে যাওয়া সূর্যের উদাসীন অবসরে এই শীতের সকালে।।
ছড়া
বছর কাটুক ভালো
মজনু মিয়া
ইচ্ছে যত হয় না পূরণ
তবু ইচ্ছে জাগে,
এই বছরটা কাটুক ভালো
বলছি আগেভাগে।
সুখ আসুক শান্তি নিয়ে আর
দুঃখ যাগগে দূরে,
মন পবণের নাও ভাসিয়ে
বেড়াব যে ঘুরে।
যেথায় যাব পাই যেন এই
আশার বাণী শুধু,
কোথাও কোনো দুরগটনা
গটবে না হায় ধূধূ!
ভালোবাসায় জড়িয়ে রই
এমন আশা করি,
হিংসা বিদ্বেশ ভুলে গিয়ে
সুখের স্বপ্ন গড়ি।
শুভ হোক বছরটা যেন
পণ করেছি মনে,
এই আহ্বান করি সবাই
মিলি একই সনে।
ছবি
পাথরের গনেশ
শ্রাবণী সরকার সেনগুপ্ত
কবিতা- অন্তিম পর্যায়
তোর বাড়ি
জয় চক্রবর্তী
তোর বাড়িতে বুঝি ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে,
পড়েছিলাম কোনো কবিতায়
দেখা হল না, আবার কবে হবে জানিনা।
তোর সঙ্গে থাকবো ভেবেও পারলাম কি?
বড় বিপরীত টান এই দুনিয়ার।
তোর সঙ্গে সেই বৃষ্টিভেজা,
সে নেহাতই ছেলেখেলা বলে
ক্রমশ রাশভারী হচ্ছে বয়স,
অন্ধকারের কত ঢেউ পেরিয়ে
রাত আসে আমার বিছানায়...
ক্লান্ত, রুগ্ন, আহত
আছড়ে পড়ে আমার শরীরে।
পড়েছিলাম কোনো কবিতায়
দেখা হল না, আবার কবে হবে জানিনা।
তোর সঙ্গে থাকবো ভেবেও পারলাম কি?
বড় বিপরীত টান এই দুনিয়ার।
তোর সঙ্গে সেই বৃষ্টিভেজা,
সে নেহাতই ছেলেখেলা বলে
ক্রমশ রাশভারী হচ্ছে বয়স,
অন্ধকারের কত ঢেউ পেরিয়ে
রাত আসে আমার বিছানায়...
ক্লান্ত, রুগ্ন, আহত
আছড়ে পড়ে আমার শরীরে।
তোর চোখের কালোয় সত্যি-মিথ্যা আড়াল করে,
স্বপ্নের আলো জ্বেলে,
বুঝি রাত আসে তোর বাড়িতে,
লিখেছিলাম কোনো কবিতায়
দেখা হল না, আবার কবে হবে জানিনা।
তোর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম কি?
ঘুমিয়ে পড়ার রীতি এই দুনিয়ার।
তোর আঙুলে আঙুল জড়িয়ে খেলা,
সে নেহাতই বোকামি বলে
ক্রমশ লেখা হয় জীবনের ইতিহাস,
কত ভুল সঠিকের পাতা উল্টে
সূর্য ওঠে আমার আকাশে...
তীব্র, একঘেয়ে
ঝলসে ওঠে আমার চোখ।
স্বপ্নের আলো জ্বেলে,
বুঝি রাত আসে তোর বাড়িতে,
লিখেছিলাম কোনো কবিতায়
দেখা হল না, আবার কবে হবে জানিনা।
তোর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম কি?
ঘুমিয়ে পড়ার রীতি এই দুনিয়ার।
তোর আঙুলে আঙুল জড়িয়ে খেলা,
সে নেহাতই বোকামি বলে
ক্রমশ লেখা হয় জীবনের ইতিহাস,
কত ভুল সঠিকের পাতা উল্টে
সূর্য ওঠে আমার আকাশে...
তীব্র, একঘেয়ে
ঝলসে ওঠে আমার চোখ।
তোর হাতের ছোয়ায় ফুল ফুটিয়ে,
নতুন পাতার মালা গেঁথে
বুঝি সকাল আসে তোর বাড়িতে,
দেখা হল না, আবার কবে হবে জানিনা।
নতুন পাতার মালা গেঁথে
বুঝি সকাল আসে তোর বাড়িতে,
দেখা হল না, আবার কবে হবে জানিনা।
নিয়ম-নীতি
সঞ্চিতা দাস
কত কাজ যেন বাকী রয়ে
গেল
হল নাকো কিছু করা-
জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে
আফশোষ বুক ভরা।
নিয়ম-নীতির বেড়াজালে বাঁধা
হাঁসফাঁস এই মন,
কবে যে কোথায় তলিয়ে গেছে
খুঁজিনিকো অকারণ।
জ্ঞানের আলোর ঝলকানি এসে
নিয়মের ফাঁস খোলে-
সরব হওয়ার হয়নি সময়
শেষ বিকেলের কোলে।
নিয়ম-নীতির ফাঁকা বুলিগুলি
রেখেছিল মন ঢেকে-
জ্ঞান ভোমরা মেলেনিকো পাখা
চুপিসারে গেছে দেখে।
শেষ বিকালের সন্ধ্যেবেলায়
মন হয় উচাটন,
নিয়ম-নীতি আলগা হয়েছে
ছিঁড়ে গেছে বন্ধন।
অদৃশ্য ইশারায়
নিশীথ বরণ চৌধুরী
বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ গর্বের ভারতবর্ষ,
ক্ষমতার অলিন্দে অন্তর্ঘাত, রক্তক্ষরণ,
চলছে ইশারায় ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়ন।
গণতন্ত্রে শেষ কথা, এক দুরন্ত সংখ্যা,
দুষ্কৃতী দুর্বৃত্তায়নে ক্ষমতা ধরে থাকা।
তমসাবৃত পথে নেমে আসে সংকট অদৃশ্য ইশারায়।
সাধারণ মানুষ বড়ো নির্বোধ,
নুব্জ মেরুদণ্ড, আপন সুখে গৃহ কোণে শিথিল করেছে প্রতিরোধ।
মেয়েটা কলেজ থেকে ফিরে একা একা,
ফেরেনি এখনো,বাবার কপালে চিন্তার বলিরেখা,
টিভির পর্দায় শ্লীলতাহানির সংবাদ---
আতঙ্কে ভেসে ওঠা মেয়ের মুখ,মনে অজানা প্রমাদ।
নৈশব্দের জ্যান্ত কারাগারে আমরা নির্বাক বন্দি, অদৃশ্য ইশারায়।
ছেলেটা নির্ভীক, সাহসী,এলাকায় জনপ্রিয়
এক প্রতিবাদী নাম, অজেয়।
বলতো দেখো একদিন এদেশ শোষণ থেকে,
দারিদ্র্য থেকে,অশিক্ষা থেকে মুক্তি পাবে।
হঠাৎ একদিন ব্যস্ত ভিড়ের রাস্তায়,
চলন্ত গাড়ির ধাক্কায় সবশেষ,অদৃশ্য ইশারায়।
পাড়ার লোক সব চুপচাপ বললো,
এর নাম রাজনীতি,কতো কথা চললো।
আমারা সাধারণ মানুষ প্রতিবাদী,প্রতিরোধের শিথিল হাওয়াই,
মোম বাতি হাতে সকলে পায়ে পা মিলায়।
বেশ্যা
অনিন্দিতা চক্রবর্তী
কাঁচ পোকা টিপ কপাল জুড়ে ,শরীর জুড়ে নগ্নতা
চোখের কোনে রোজ নোনা জল,প্রতি রাতে ভগ্ন-তা,
বেশ্যা বলে ডাকে যখন, মুখোশ পড়া ভদ্রলোক
বুক ফাটে যে বন্দী মুখে, পাথর কঠিন স্তব্ধ শোক ।
আগুন পোড়া ষোল বছর ,বিশ্বাসী প্রেম হাতে
বুকের মাঝে উতল নদী, উপোসী রাত কাঁদে
এমনি কখন সিঁদুর সাজে, বাপের ঘর ছেড়ে
সবুজ বনের স্বপ্ন বুনে নতুন এক হাত ধরে,,,, ।
হঠাৎ জীবন বাতলে দিল গিরগিটি রূপ প্রেম
ভালোবাসা শব্দটা ,আসলে এক গেম
জীবন দ্বীপ খুঁজতে গিয়ে মৃত্যু তাপ মাখে
প্রেমিক দিল বেচে , লোকে বেশ্যা বলে ডাকে।।
প্রতিক্ষা
জয়ন্ত চ্যাটার্জী
জয়ন্ত চ্যাটার্জী
নীলাভ নাম টি মনে পরে?যে তরঙ্গে স্বপ্ন বুনেছিলে,
অশ্লীল-অভব্য-উদ্ধত-কুৎসিত অভিধায় ডেকেও,
সোহাগের সমস্ত বন্যা যার উপর উজার করে দিতে।
জলাধিপতির রত্নাকর আচরণের কথা শুনে
শাস্তি হিসেবে ফিরিয়ে দিলে মা নিষাদের ও অভিশাপ।
নতশিরে মহাসমুদ্রের কিনারায় ফিরে আসা,
আর আমি, আছি আজও তোমার প্রতিক্ষায়।
তুই আর আমি
গৌতম ভৌমিক
গৌতম ভৌমিক
আমি যেমন ছিলাম,আজও ঠিক তেমনই আছি,
আমায় নিয়ে যতসব দূর্ভাবনা,তোর মিছিমিছি l
যতই ব্যস্ত থাকি,প্রভাতে তোর সামনে আসি,
এসেই তোরে ডেকেই বলি,এবার তো ওঠ !
সারাদিন তোরে কাজে রেখে,সাঁঝে আমি ডেরায় ফিরি l
আবার যখন রাতে দেই দেখা,হওস তো তখন বেশ খুশি,
না এলেই হয় শুরু তোর,যতো মন কষাকষি l
আরও বলছি,দেখ চিনতে পারছিস কি !
আসি যদি গ্রীষ্মে,তখন বলিস এই তো বেশবেশ,
পরক্ষনেই বলিস এবারে হবে সব নিঃশেষ l
আসি যদি বরষায়,চাষীরা সব উল্লাসে ছুটে বেড়ায়,
ভারী মুখে তখন,বসিস তু্ই ঐ পাশের জানালায়l
আসি যদি শরৎ-এ,চারিদিকে ঐ সাদাকাশের ঢেউ,
তখন মোরে মন্দ বলিস নাতো কেউ l
আসি যদি হেমন্তে, বলিস তাড়াতাড়ি ভাই জানা ওরে,
সারাবছরের আনন্দটাই তো ওড়ালি ফুরুৎকারে,
আসি যদি শীতে,তখন তো তোর সবই লাগে মিঠে,
ভাবিস কি!গরিব-দুঃখীদের তখন কেমনে কাটে l
আসি যদি বসন্তে,মেতে তো উঠিস সব্বেই দোলানন্দে,
তবে খারাপ কি আমি! থাকতে তো হয়,সব্বেরই ভালো-মন্দে l
কোথায়_স্বাধীনতা
শৌভিক কার্য্যী
দেশ জুড়ে হিংসা যত
মারকাটারি লড়াই ।
একে অপরের নিন্দুকেরা
করছে নিজের বড়াই ।
উন্নয়নের বুজরুকিতে
দাপিয়ে বেড়ায় রং ।
দলের বোঝা ভারী দেখে
সেজে থাকে সং ।
যে দেশেতে বিভেদ আজও
হিন্দু মুসলমানে ।
বিপদ আপদে আসেনা কেউ
একে অপরের টানে ।
যে দেশেতে টাকার স্বার্থে
নামাবলী জড়িয়ে গায়ে ।
কুসংস্কার কে আকড়ে ধরে
লুটিয়ে মানুষ তাদের পায়ে ।
যে দেশেতে ধর্মের নামে
জলাঞ্জলি মানবতা ।
সে দেশতে কোথায় তুমি
খুঁজছো স্বাধীনতা ।
যে দেশেতে পণের বোঝা
সইতে পারে না পিতা ।
বাল্যবিবাহের অগ্নিকুণ্ডে
শিশুসমা সীতা ।
যে দেশেতে পুত্রের আশায়
মাতার কন্যাবিসর্জন ।
সেই দেশেতেই কন্যারূপী
দেবী পূজিত হন ।
যে দেশেতে দিনের আলোয়
শিশু হচ্ছে ধর্ষণ ।
পারেনি দমাতে মৃত্যুমিছিল
আর প্রতিবাদের বর্ষণ ।
অন্যায়ীরা ঘুরছে আলোয়
করছে নতুন অভিসন্ধি ।
অন্যায়ের শিকার হয়ে নারী
আজ ঘরের ভেতর প্রতিবন্ধী ।
বদ্ধ খাঁচায় আজ কোথায়
দেখছো তুমি স্বাধীনতা ।
যে দেশেতে অসুরক্ষিত
নিজেই ভারতমাতা ।
সমীকরণ
বিশ্বনাথ সাহা
বিশ্বনাথ সাহা
উচ্চাশার আগ্রাসী বীর্য,
সাফল্যের ভিড়ে-
শপথের রসায়ন ভুলে,
ব্যার্থতার মনোনয়নে-
স্বীকৃত অভিযুক্তের,
ক্ষুদ্র পরিসরে আমৃত্যু-
দাসত্বের শৃঙ্খল বুকে
নিয়েও স্বপ্ন দেখে,
জীবনের লোভে।
সাফল্যের ভিড়ে-
শপথের রসায়ন ভুলে,
ব্যার্থতার মনোনয়নে-
স্বীকৃত অভিযুক্তের,
ক্ষুদ্র পরিসরে আমৃত্যু-
দাসত্বের শৃঙ্খল বুকে
নিয়েও স্বপ্ন দেখে,
জীবনের লোভে।
জিঞ্জাসা
রাহুল ঘোষ
তুমি ছুটে চল আমার লেখার আঙিনায়,
এক অজানা অচেনা গন্তব্যে।
তোমায় কোন দিন প্রশ্ন করতে পারিনি ;
প্রশ্ন করব ভেবে শুধু তোমার ছবি এঁকেছি অবচেতনে।
তোমায় লেখা পএগুলি বন্দি আমার লেখার কারাগারে।
অনেকে হেঁটেছে হাজার হাজার বছর ধরে ,সেই পথের যাত্রী আমি বর্তমানে ;
কিন্তু সত্যিই তুমি আজও পাল্টাওনি নিজেকে।
তোমার যৌবনের জোয়ার আজও সমীচীন ;
তোমার ভাটায় অনেকের হয়েছে ছন্দ পতন।
তবে সময়ের দাবানলে তুমিও জ্বলেছ সাবেকী হয়ে;
একথা সকলের অজানা।
আমার শব্দ যে ছুঁতে চায় তোমার অবয়বকে;
যা চেতনে থেকেও অবচেতনে লুপ্ত।
যে প্রশ্ন করব, তুমি উওরদিবে তো!!
সর্ম্পক কি শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ??
আমার সাথে তোমার কোন সর্ম্পক আছে কি!!
থাক্, একটি কথা সত্যিই করে বলবে;
কেউ কি আমার মত করে তোমার অবচেতন অবয়বকে ছুঁতে চায়?
কেউ কি তোমায় আমার মত ভালোবাসে?
আজও তুমি নিঃশব্দে চলে গেলে আমার লেখায় দাঁড়ি বসিয়ে।
তোমার স্মৃতি গুলো থাক্ কাঁচের ঘরে বন্দি;
তা উষ্ণ স্পর্শে যেন হয়ে উঠবে অালোর রশ্মি।
বাতাস কথা কয়
দেবদর্শন চন্দ
১
শীতোষ্ণতা তুঙ্গে,
কথা বলতে বলতেই চলা অভ্যেস।
২
আয়নায় মুখ দেখা,
চাপদাড়িতে হাত।
৩
মুখ নিঃসৃত বায়ু,
কাঁচকে করে দেয় আবছা।
৪
লিখতে শিখি,'ভালোবাসি'।
দুর্লভ পারিজাত
ননীগোপাল সরকার
প্রবাদবাক্য বিছিয়ে বসে আছি আবেগের উপরে ।
কচি ধানের দুধের মতো স্বপ্নের পরিণতির আশায় ।
কল্পনার বালিয়াড়িতে চিকচিক করে ভাঙা চাঁদের আলো ।
নিরাশার আর্তচিৎকারে ধ্যান ভেঙে যায় সপ্তর্ষির ।
প্রতিদিন শুকতারার আলোতে পুড়ে যায় মন।
তবুও ইচ্ছেদের কুড়িয়ে নিয়ে বুকে বেঁধে রাখি
অনাগত অভিসারের লক্ষ্যে ।
শুক্রানুর দৌড়ে জিতে আজ কি করে হার মানি
রূপময় অসুখের কাছে!
ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো যেদিন
হারিয়ে যাব নীল আকাশে,
সেদিন না হয় ভুলে যাব সব ।
যার প্রতীক্ষায় ধ্রুবতারার প্রতিচ্ছবি পড়ে নোনাজলে
হয়তো নিরবতার শৈবালে ঢাকা তার হৃদয়েই
ফুটে আছে আমার
স্বর্গসুখের দুর্লভ পারিজাত ।
কবিতা তোমায় খুঁজি
-------ননীগোপাল সরকার
আঁধারের কণা খুঁটে খেয়ে বেঁচে আছে
আমার মনোপাখি।
মায়ের কোলে প্রথম চোখ খুলে দেখা
আলোটা যেন ম্লান হতে হতে
ঘুমিয়ে পড়েছে গোধূলির কোলে।
গাছের পাতা ঝরা শব্দে
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠার আনন্দটা
আজ
হারিয়ে গেছে ভাবনার কাশবনে।
না পাওয়ার ব্যথাটা বার্ধক্যজনিত
রোগের মতো হয়েছে আমরন সঙ্গী ।
মনটা পরিযায়ী পাখির মতো উড়তে চেয়েও
পারে না বিবেকের খাঁচায় বন্দি বলে ।
রাতের গভীরতার সঙ্গে সমানুপাতে
বেড়ে চলে কল্পনার পরিধি।
বালিশের উপর আছড়ে পড়া
জলপ্রপাতের ঘুর্ণিতে খুঁজে ফিরে
আমার হারিয়ে যাওয়া কবিতা।
চন্দ্রিমা
অনিমেষ
প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যে ডালপালাগুলো আগাছায় ভরে উঠল;
অবসরে সন্নিহিত কাগজের মালা জ্যোৎস্নায় চাঁদের গালে চুমু এঁটে দেয়;
তার বুকে দগ্ধ কত রজনী বিক্ষিপ্তভাবে এজল পেঁজল ভাবনায়...
চাঁদের পানে চেয়ে অদৃশ্য সিঁথি সিঁদুরে রাঙ্গানো হলো;
তার সাথে মিলনের ইচ্ছে কি শুধুই নেশাত্বক মহড়া?
জীবাশ্ম বহন করে নিয়ে আসে আবেগের ছোঁয়া ,
শুধুমাত্র চাঁদের উত্তপ্ত হৃদয়ে আর ও এক বার কলঙ্ক লেপটে কলঙ্কিত হয়৷
অনিমেষ
প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যে ডালপালাগুলো আগাছায় ভরে উঠল;
অবসরে সন্নিহিত কাগজের মালা জ্যোৎস্নায় চাঁদের গালে চুমু এঁটে দেয়;
তার বুকে দগ্ধ কত রজনী বিক্ষিপ্তভাবে এজল পেঁজল ভাবনায়...
চাঁদের পানে চেয়ে অদৃশ্য সিঁথি সিঁদুরে রাঙ্গানো হলো;
তার সাথে মিলনের ইচ্ছে কি শুধুই নেশাত্বক মহড়া?
জীবাশ্ম বহন করে নিয়ে আসে আবেগের ছোঁয়া ,
শুধুমাত্র চাঁদের উত্তপ্ত হৃদয়ে আর ও এক বার কলঙ্ক লেপটে কলঙ্কিত হয়৷
পাতার পৃথিবী
নীলকণ্ঠ মিশ্র
পাতার ভেতর হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ
বাতাসে পাতার পোষাক খুলে উড়ে যাচ্ছে
পাখির দল।
ঝিঁঝিঁদের একটানা সুরতরঙ্গ মাদকতা ছড়িয়ে
এক রহস্যাবৃত পৃথিবীর সন্মোহনে
পাতার ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আদিম
অন্ধকার।
ছেঁড়াফাটা গেঞ্জির ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকা
আকাস শরীরে ভেসে থাকা চাঁদ
তারাদের মুক্ত প্রাঙ্গনে রুপোলি ঢেউ
পাতার পর পাতা ঠেলে ছড়িয়ে পড়ছে
কোথাকার অজানা বাতাসে এখানের নিজস্ব সিম্ফনি
নগ্ন শরীরে গলিয়ে নিয়েছি পাতার পোষাক
আজ আমি পাতার
এখন শুধু পাতারই পৃথিবী।
বিপরীত শব্দ
তাপস দাস
তুমি তোমার যোগফল আমি আমার বিয়োগ
দ্বিমেরু শব্দঋণ এক ঐশর্য রোগ
তবু আমাদের ভালোবাসা আছে
নিজস্ব নিয়মের আকাশে বাতাসে....
দ্বিমেরু শব্দঋণ এক ঐশর্য রোগ
তবু আমাদের ভালোবাসা আছে
নিজস্ব নিয়মের আকাশে বাতাসে....
তুমি খুলে দাও আমি পরি
আমাদের সাজের পোশাক এখনো পাতারই
সালোকসংশ্লেষ উভয় শরীরই....
আমাদের সাজের পোশাক এখনো পাতারই
সালোকসংশ্লেষ উভয় শরীরই....
আমার অর্থে ভবিতব্য কবিতা এক বাগান
তুমি চাও রাতপাখি আশ্চর্য উড়ান
পাবে কি আমায়, অসমান....
তুমি চাও রাতপাখি আশ্চর্য উড়ান
পাবে কি আমায়, অসমান....
আমি এক আশ্চর্য মরা মাটিতে গভীরে বাঁচি
প্রতিদিন খুঁজে ফিরি নিত্যানন্দে গান
স্রোতে কাঁপি একজন্ম অভিযান....
প্রতিদিন খুঁজে ফিরি নিত্যানন্দে গান
স্রোতে কাঁপি একজন্ম অভিযান....
তুমি ভুলে ভালে আঁচলি চুল খুলে শরিরী প্রান
প্রেমে চাও মনে চাও আমাকে একা
কি করি আমিতো কবিতায় লেখা....
প্রেমে চাও মনে চাও আমাকে একা
কি করি আমিতো কবিতায় লেখা....
আমি একা,খুব এখা, শুধু এক লেখা।
একদিন সময় করেএসো
রাজেশ
দূরত্ব বাড়িয়েছো অনেক দিনই
শেষ বাস ছাড়ার আগেই।
কিন্তু তোমার ঘোড়া গুলো আজও আমার আস্তাবলে বাঁধা।
একদিন সময় করে এসো আমি না থাকলে,
দেখো কেমন হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে তারা।
রজনী তোমার কোলে
রবীন সাহানা
আলতা রাঙা স্মৃতির পাতা উলটে বিষম সুখে,
নয়ন পরে পলক ফেলি কোমল আবেশে |
পাঁজর খাঁচার খিলান তুলে মুক্ত হৃদয় পাখি,
মেলল ডানা আকাশ বুকে কল্পেতে একাকী |
জোছনা চাঁদ বিকায় শরীর কোদাল কাটা মেঘে,
নিঝুম রাতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শক্ত পাহারাতে |
গগন হতে ঝরায় শিশির বিকুলি পৌষ মনি,
রজনী আজ স্নিগ্ধ সরস বসন্ত ফাল্গুনী |
মনটা উড়ে গহন স্রোতে উজান স্মৃতির টানে,
শিকড় ছেঁড়ায় ভালোবাসা আকূলী পরানে |
কানের কুহর ভরায়ে আছি নিষ্প্রান হেডফোনে ,
আমাদেরি প্রেমের কথা বলছে গানে গানে |
গহন রাতে লেপের বুকে ঘুমায় পরাণ পাখি,
মোর হতে হাতেক দূরে নন্দিনী আলগিরী |
মননয়ন দেখছে স্বপন তুমি ঘুমন্ত ঘরে ,
পরশ বিহীন ভালোবাসা সুখি অন্তরালে |
আমার মনে অতীত পাতায় নুতন কাব্য লেখা ,
প্রানদে ,তালহীন স্রোতে ,আজযে বড়ো একা |
ভালোবাসা কেবলই আশা ঠুনকো ফুলেরদানি-
বাদলা আঁখি আশার সুখে দিচ্ছে হাতছানি |
নিঃশব্দের উচ্চারণ
স্বরূপ মুখার্জ্জী
শ্বাস আটকে গেছে জীভের তলায়
বুকের মাঝে জমাটি অভিমান
আকাশের মাঝে লেগে থাকা আগুন আজও জ্বলছে
বানান ভুলে কবিতারা মারা যায় ৷
বুকের মাঝে জমাটি অভিমান
আকাশের মাঝে লেগে থাকা আগুন আজও জ্বলছে
বানান ভুলে কবিতারা মারা যায় ৷
বুকের ভিতর প্রেম নীলাকাশ চায়
কথা বলতে যে যন্ত্রের প্রয়োজন
তা তোমার আছে , ষড়যন্ত্র
আমারও আছে , স্বরযন্ত্র
অধিক কী ?
চিঠিতে কবিতা শেষ করলাম ...
তা তোমার আছে , ষড়যন্ত্র
আমারও আছে , স্বরযন্ত্র
অধিক কী ?
চিঠিতে কবিতা শেষ করলাম ...
পিতা –পুত্র
সুকন্যা সামন্ত
“বুঝেও বোঝো
না আমাকে –
করো যত ছেলেখেলা
,
দাও আমাকে যাতনা ।
পেয়েছো কি তাতে শান্তির হদিশ ?
পুরেছে কি তোমার যত আশা ?
আজ যাকে করো হেলা ,
বুঝবে একদিন তার মূল্যখানি –
যেদিন যাবো চলে ,
এ পৃথিবী ছেড়ে ।
সেদিন করবে ক্রন্দন
,
তবু পারবে না তারে রাখতে
ধরে ,
বিধির এমনই লিখন ।“
শুনে ছেলে হেসে ওঠে ।
তবু বৃদ্ধ পিতাকে করে অছেদ্ধা ।
মনোকষ্টে পিতা ছাড়ে –
বাঁচার সামান্য সুখ
।
ভারাক্রান্ত মনে –
একলা থাকে গৃহকোণে ।
কর্মব্যস্ত পুত্র –পুত্রবধূ –
তাতে করে না দৃষ্টিপাত ।
বৃদ্ধ পিতার দীর্ঘশ্বাস
পড়ে –
স্ত্রীর দেওয়ালে ঝোলানো ছবিটির উপর
।
‘হায় রে!
এর জন্যই
কি আমরা –
তিল তিল করে বড়ো করেছিলাম ওদের ?
এর তরেই কি করেছিম স্বার্থত্যাগ ?
এর জন্যই কি দিয়েছিলাম নিজেদের –
ছোট ছোট শখ আহ্লাদকে বিসর্জণ ?”
হায় রে! বিধাতা!
কি নিষ্ঠুর মায়ায় বাঁধলে তুমি ?
সংসার ধর্ম যদি হয় শ্রেষ্ঠ ধর্ম –
তবে কি এই সেই ধর্মের সারমর্ম ?
যে সন্তানকে এত শখে , এত
যত্নে –
করলাম লালন পালন ,
সেই করলো হেলা ?
ফেলে গেলো একলা ?
“তুমি তো
বেশ গেলে
চলে ,
সংসারের সব দায় –
আমার উপর ফেলে ।
পেরেছো কি তুমি –
নিজ দায় মুক্ত হতে ?”
“পারোনি।
সে বিশ্বাস আমি করি ।
নিজ স্বামীকে কষ্ট পেতে দেখে –
পারবে না তুমি স্বর্গেও সুখী
হতে ।
যে যত্নে সাজিয়েছিলে
তুমি সংসার !
সে সংসার এখন আর আমার নয় ,
ওটা যে ওদের !”
“হাসালে তুমি ,
ছেলে যদিও আমার বটে ,
কিন্তু বৌমা ?
সে তো পরের মেয়ে ,
সে কেন করবে আমাকে যতন ?
তোমার ছেলেকে করেছে সে পর ।
আজ খোকা আমায় ‘বুড়ো’ –
বলে সম্বোধন করে ।“
বলে আমরা যা করেছি –
সে ছিলো আমাদের দায়িত্ব ,
আমরা নাকি নিজেদের জন্যই –
করেছি তাদের যত্ন !
স্ত্রীর ছবি থাকে
নিরুত্তর ,
শুধু দমকা হাওয়ায় দোলে –
তাতে লাগানো শুকনো ফুলের মালাখানি ।
ধীরে ধীরে বিমর্ষ পিতা –
অসুস্থ হয়ে পড়ে
।
ডাক্তার ?কে ডাকবে
?
সময় কই ?
আর তাছাড়া এই ‘বুড়োগুলোকেও’ তো
বুঝতে হবে –
কত ঝামেলা তরুণ ছেলে – বৌদের
পোহাতে হয়
।
সব থাকতেও যদি সুস্থ না
থাকতে পারেন ,
সে দোষ কি হবে পুত্র – বৌমার ?
কখনো নয় ।
ম্লান হাসি হেসে ওঠে বৃদ্ধ ,
নেই প্রাণ সেই হাসিতে ।
একদিন বাড়িতে শোরগোলে
–
প্রতিবেশীরা জানতে পারলেন ,
সেনবাবু আর নেই।
পুত্র ও বধুমাতা তখন –
ব্যস্ত ক্রিয়াকলাপে ।
একফোঁটাও কি চোখে জল থাকতে নেই ?
অবশেষে চোখে জল
দেখা গেলো ,
একেবারে অঝোরে কান্না ,
যখন শোনা গেলো উকিলবাবুর কাছ
থেকে ,
সেন মশাই সব সম্পত্তি –
ছেলে –বৌমার নামে
করে গেছেন ,
দেননি কোন অনাথালয়ে ।।
"বধূয়া"
মাম্পি রায়
পদ্মদিঘি, কুমুদবতী
যেথায় মেলে ঘাট;
কলসি কাঁখে মা, দিদিরা
জলকে চলে যায়,।
সেদিনের ওই গোধূলি লগন,
মিঠেল রোদের নবীন গড়ন,
গ্রাম্য পথের আলটি ধরে,
নববধূর শুভাগমন।
হৃদ_মাঝারে শাঁখেরকরাত ;
করত ভারি মন চুরি,
আজ কেন হায় ঃ কথার তুবড়ি,
ধুঁকছে মনের ঘর_দোরে,?..
এক যে ছিল লাল টুকটুক
বেনারসির ভাজ;
লাগত সে যে চোখের কোলে,
বাহারিয়া সাজ।
আজ যে হায় ঃ নুয়ে পড়ে,
ব্যাথার কাগজ।
উপলব্ধি
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
আমার কবিতার প্রতি পাতায় ঘুনপোকার বাস
ভাষা হারানোর রোগে আক্রান্ত কলমে জমেছে ভাইরাস ।
অক্ষমতার ইতিবৃত্তে কবিতা আজ অসহায় মূক-বধির,
কবিতার মৌনমিছিলে হোক কলোরব ক্লান্ত কবির ।
আমার বুকচেরা কবিতার হয় অযাচিত রক্তক্ষরণ,
হীনমন্যতার গ্লানিতে কবিতার আত্মদহন ।
স্বপ্নচারিনী কবিতার অন্বেষণে বিক্ষিপ্ত বিবাগী মন
কবিতামৃতের সন্ধানে হোক কবিতার মন্থন
রাতপরীদের ছোঁয়ায় ঘুমে অচেতন কবিতার হোক জাগরণ,
কলমে উঠুক ঝড়,কবির কল্পনায় মুক্তধারার আলোড়ন ।
মুক্তিযোদ্ধার মত কলমের হাতিয়ারে ঘুচে যাক ভয়,
বুলেটবিদ্ধ নিথর দেহে শেষবাক্য..............
"ভারতমাতা কি জয় " ।