Saturday, May 8, 2021

মুজনাই সাপ্তাহিক 

বর্ষপূর্তি সংখ্যা 


সম্পাদকের কথা 

তাঁকে নিয়েই ও তাঁর জন্যই আমাদের যাপন। তাঁর জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে পারা মানে ধন্য হওয়া। মুজনাই সেই সুযোগ কোনভাবেই নষ্ট করতে চায় না। তাই মুজনাইয়ের সাপ্তাহিক সংখ্যায় এবার শুধুমাত্র তিনি। 

পাশাপাশি আর একটা কথা না বললেই নয়। মুজনাই সাপ্তাহিক এক বছরে পা দিল তাঁর জন্মদিনেই। গত শতকের আশির দশক থেকে বয়ে চলতে শুরু করেছিল যে ছোট্ট মুজনাই আজ তা পল্লবিত সারা বছর ধরে মুদ্রিত নানা সংখ্যায়, ফোল্ডারে, ট্যাবলয়েডে, অনলাইন মাসিক পত্রিকায়, এমনকি সাপ্তাহিকেও। এবাদেও, মুজনাইয়ের বন্ধুরা জানেন যে, বিশেষ বিশেষ দিনেও মুজনাইয়ের নানা কর্মকান্ড চলে। সকলের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া কোনভাবেই এই বিপুল কর্মযজ্ঞ সম্ভব ছিল না। ধন্যবাদ তাই সবাইকে। আর এই বিশেষ দিনে প্রণাম প্রাণের মানুষটিকে। 





যাঁরা আছেন এই সংখ্যায় 

মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী, শ্রাবণী সেন, গৌতম চক্রবর্তী, রীনা সাহা, 
কবিতা বণিক, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ মাজি,  রীনা মজুমদার, 
পার্থ সারথি চক্রবর্তী,  শ্রাবণী সেনগুপ্ত, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, মৌসুমী চৌধুরী, 
চন্দ্রাণী চৌধুরী, অশোক কুমার রায়, বিজয় বর্মন, 
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত, উমা শঙ্কর রায়, রীতা মোদক, 
সৌমেন দেবনাথ, মুহাম্মদ জাবেদ আলী, মজনু মিয়া, 
অভ্রদীপ ঘোষ, রেবন্ত সেন, প্রসেনজিৎ দাস, 
সোমনাথ বণিক, সম্প্রীত সরকার, দেবাঞ্জনা রুদ্র, 
অনুস্মিতা বিশ্বাস, সম্পূর্ণা নন্দী, সৃজা রায়, নীলাদৃতা বর্মন  
  

মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রচ্ছদ- পরেশ সাগ্নিক বেরা 

 প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৮




অভ্রদীপ ঘোষ 


 

মননে রবীন্দ্রনাথ  

একখানি পুরাতন  গল্প
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী

গ্রামের  নাম কুসুমপুর । এই গ্রামে একটি ক্ষুদ্র পোস্ট অফিস ও একখানি প্রাইমারী ইস্কুল আছে । অদ্য পোস্টমাস্টারের নামে  একখানি পোস্টকার্ড আসিয়াছে। তিনি বহুবার সেটি পাঠ করিবার পর এখন অন্যমনস্কভাবে উদাস হইয়া বসিয়া  আছেন। তাঁহার সাহায্যকারী পাঁচু একবার উঁকি মারিয়া পত্রখানি পড়িয়া লইলো।
শ্রীচরণেষু দাদাবাবু ,
তুমি উলাপুর ছেড়ে যাবার পর খুব মন খারাপ লাগতো। নতুন দাদাবাবুর কাজ করতুম। তিনি  দেবতার মতো একজন মানুষ।  আমাকে লেখাপড়া শেখালেন, আশ্রয় দিলেন, যেহেতু আমার বাবা-মা নেই, তাই যাবার আগে নিজের টাকা-পয়সা খরচ করে আমাকে  বিয়ে দিয়ে গেলেন! এখনও আমার খোঁজ নেন। শুনলাম তুমি কুসুমপুর গ্রামে পোস্টমাস্টার হয়ে এসেছো দাদাবাবু? পাশের গ্রামেই আমাদের বাড়ি, গ্রামের নাম মালিকাপুর! একদিন তোমার পায়ের ধুলো দিও  আর  খোকাকে আশীর্বাদ করে যেও। নিচে আমার ঠিকানা দিলুম । প্রণাম নিও । 
ইতি----
রতন । ( রতনমণি  পাল )
প্রযত্নে : রাখাল পাল
পালপাড়া , মালিকাপুর , জেলা : রংপুর 
এই সামান্য কথা কয়টি বুঝিবার জন্য পোস্টমাস্টারকে এই চিঠিখানি এতবার কেন পড়িতে হইল ইহা ভাবিয়া পাঁচু ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেল !




চেতনায় রবীন্দ্রনাথ 
 
"বহিরাগত রবীন্দ্রনাথ"
        রীনা সাহা 


          "মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক..."  পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের প্রাক্কালে বহিরাগত এক অবাঙালি রাজনীতিক তার জনমোহিনী ভাষণে ভুলে ভরা রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত ক'রে তার রবীন্দ্রপ্রেম এবং সংস্কৃতিমনস্কতা জাহির করে ভোট বৈতরণী উতরে যেতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।অন্যদিকে বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ পদে আসীন, রবীন্দ্র শিক্ষায় পরিপুষ্ট এক বাঙালি শিক্ষাবিদের করা অদূরদর্শী মন্তব্যে বিশ্ববন্দিত জাতি হিসেবে বাঙালিকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে যাওয়া বিস্মৃতপ্রায় রবীন্দ্রনাথ এ যুগের সংস্কৃতিক্ষয়িষ্ণু শিশু-কিশোর-যুবসমাজের চোখে "বহিরাগত" হয়ে গেলেন। সে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে সার্ধশতবর্ষ পেরোনো রবীন্দ্র উৎসবে মেতে ওঠবার আগে , বাঙালির আনন্দযজ্ঞে রবীন্দ্রনাথকে সামিল করবার আগে নীচের প্রশ্ন দুটি অতি অবশ্যই আলোচনার দাবী রাখে---
কোন মানুষগুলির সঙ্গে মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বহিরাগত বলা হল ? তাদের কোন কাজের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বহিরাগত ?
               
               আলোকবর্ষ দূর থেকেও যাঁর কলমের প্রজ্ঞা ঝলসে দিতে পারে পরমাণুুসম পৃথিবীর মানুষের বোধ, বুদ্ধি এবং শিক্ষা---সেই তিনি,স্থিতধী তিনি, রবীন্দ্রনাথ তিনি, বিবেকহীন পরাকাষ্ঠায় সজ্জিত মননের "বহিরাগত" তকমায় সামান্য হলেও কলঙ্কিত । পৃথিবীর অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয় গুলির পাশে স্থান করে নেওয়া, তাঁর যাবতীয় জীবনসঞ্চয় এবং সুকৃতি ব্যয়ে নির্মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কি তবে এক বহিরাগতর স্বপ্ন ফানুস? শিক্ষাকে সংকীর্ণতার শেকলমুক্ত,  শাশ্বত ফিনিক্স বানাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ঋণ জর্জরিত এক শিক্ষাব্রতী কি তবে সত্যিই বহিরাগত? বহিরাগত একজন মানুষের ছত্রছায়ায় লালিত কৃষ্টিশীল বাঙালি, কালের বিকাশ এবং প্রগতির জোয়ারে আত্মম্ভর  রোবটীয় রূপান্তরে এক লহমায় ভুলে গেল  "Our culture,their culture" ? সত্যিই কি তবে আমরা বাঙালি হয়েই থেকে গেলাম , রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ হলাম না ?

              রাতের চেয়েও দুর্ভেদ্য এক অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নন এমন এক ব্যক্তির জন্মদিনে, তাঁর সৃষ্টিসুধায় ভিজে জয়ধ্বনির নিনাদে আকাশ-বাতাস মুখরিত করবার আগে, তাঁর আসমুদ্র-হিমাচল প্রমাণ সৃষ্টি এবং অবিনশ্বর আত্মার কালিমালিপ্ত হওয়ার বিষয়টি বড় ভাবনার এবং এ যুগের নিরিখে তাঁর গুরুত্ব অথবা প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা খতিয়ে দেখবার আবেদনেই এ বিষয়টির অবতারণা।

             বাংলা বা ইংরেজি, কোনও মাধ্যমেই পড়াশোনা না করা রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের যে কোনও শাখা, বিজ্ঞান, ইংরেজি,চারুকলা, সঙ্গীত,ভাস্কর্য সব বিষয়ে বাগাড়ম্বর প্রদর্শনীর এ যুগের থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন , তা জানতে  অতি বড় ডুবুরীও হাবুডুবু খেয়ে তলিয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। ঠিক এ জায়গাটিতেই আমাদের উচ্চমার্গীয় রবীন্দ্রানুরাগী ব্যক্তিত্বদের দায়বদ্ধতা থেকে যায় তাঁকে খুঁজে আনবার কিংবা যায় না। হাইটেক প্রজন্মের শিশু-কিশোর-যুবকদের চেতনার রাজ্যে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিতি দেবার এবং জানাবার, নতুবা অতি কুরুচিকর "বহিরাগত" শব্দে ভূষিত করে তাঁকে পুরোপুরি ডিলিট করবার দায়ভারও তাই আমাদের। আমরা কোনটা করবো তা ভেবে দেখবার অনুরোধে এ বিষয়টির উপস্থাপনা।

          Digitally, scientifically, technically nurtured and nourished যান্ত্রিক শিশুদের অযান্ত্রিক উৎকর্ষতা বাড়াতে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানমনস্কতা, অর্থনীতির জ্ঞান এবং জাতীয়তাবোধের সুস্পষ্ট ধারণা কতটা কাজের কিংবা অকাজের সেকথা আইনস্টাইন প্রসঙ্গে তাঁর লেখা article টিতে খানিকটা আন্দাজ করা যায়। আমরা আমাদের সন্তানদের সেটি পড়ে দেখতে বলবো কি না, অবশ্যই ভেবে দেখবার অবকাশ রয়েছে। আজকের মারিবিদ্ধস্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ  মানবসম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ । আগামীদিনে এদের শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রয়োজন আছে কি না , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলির অপরিহার্যতা থাকবে কি না , তৃতীয় বিশ্বের এই আমাদের গরীব দেশ , ভোগবাদী রাজনীতি এবং ধার্মিক কুসংস্কারে খোকলা এই আমাদের দেশ , চূড়ান্ত pandemonium পরিবৃত এই আমাদের দেশ এবং দেশের সুচতুর মাথারা কি ভাবছেন তা পুরোপুরি ধোঁয়াশায়। কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস boost up করতে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া বহিরাগত রবীন্দ্রনাথের উপমা আপাতত দেওয়া যায় কি না, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেবার কাজটি রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর পুণ্য লগ্নে মনে রাখবার জন্য এ বিষয়টির অবতারণা। জমিদার রবীন্দ্রনাথের যুগে আইফোন, ট্যাব , স্মার্টফোন ছিল না , ছিল না আরও অনেক প্রমোদবিলাস, না থাকার সে তালিকা দীর্ঘ। তবু ছিল কিছু। ছিল "চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে" দেখবার চোখ, তুলি হাতে তেপান্তরের মাঠ এবং পক্ষীরাজ ঘোড়া আঁকবার কিশলয় আঙ্গুল, "জল পড়ে পাতা নড়ে" বুঝবার বোধ, ভৃত্যদের সাহচর্য এবং পরিচর্যায় সাবালক হয়ে ওঠা "পুরাতন ভৃত্য" কবিতায় স্বনির্ভর অক্ষর জ্বালাবার স্পর্ধা। এতসব অলঙ্কার এবং অহংকার ভূষিত  রবীন্দ্রনাথ কেন বলবেন আজ  " ....আমি তোমাদেরই লোক"? কেন তাঁকে বলতে হবে "আমি শুচি আসন টেনে টেনে বেড়াব না বিধান মেনে/ যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারি ছাপ বক্ষে মাগি/ আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী "?

          আজ থেকে শতবছর পরে কোনও এক E-Book পড়া কিশোর বা কিশোরী তাদের প্রপিতামহের ঘুণধরা কাঠের আলমারির তাকে অতি বৃদ্ধ, ন্যুব্জ, ন্যাবা রোগাক্রান্ত 'গীতবিতান' অথবা নোবেলজয়ী 'গীতাঞ্জলি' খুঁজে পেয়ে নিজেদের বাবা-মায়ের কাছে সমগ্রদুটির লেখক, আদিকথা এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে যদি জানতে চায় বা বুঝতে চায়? তবে তাকে জানানো বা বোঝানোর কাজটি রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয়ে থাকা এই আমরা সার্থকভাবে করতে পারবো তো? যদি না পারি তবে? প্রযুক্তির আত্মম্ভরিতায় flatulent, তাঁকে স্বীকার বা অস্বীকার করবার দ্বিধায় দোদুল্যমান এই আমাদের দেখে "মহাবিশ্বে, মহাকাশে,মহাকাল..." থেকে দীর্ঘকেশী, শুভ্র শশ্রূগুম্ফ শোভিত, জোব্বা পরিহিত একাকী ভ্রাম্যমাণ এক "বহিরাগত" অতিমানব মুচকি হাসবেন নাকি বিষাদে মূহ্যমান হয়ে আমাদেরই অদূরদর্শিতায় বেড়ে ওঠা ধর্ম এবং মহামারী বিষে বিষাক্ত বিষবৃক্ষ এক দেশের সামনে নতশির হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে বলবেন--- 

"... I bitterly wept and wished that I had had the heart to give thee my all" !! 





নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ  

রসময় রবি ঠাকুর
   কবিতা বণিক

রবি ঠাকুরের রসবোধ ও তার তাৎক্ষণিক  প্রয়োগ মানুষের মনে এক অনাবিল আনন্দ যোগাত। সে আনন্দ মানুষকে উৎসাহ দিত। অন্তরের  কোন ঘাটতি যেন মূহুর্তে উড়ে যেত। মানুষের মনের মেঘ কেটে রবিকরোজ্জ্বল হয়ে উঠত।  এমনি  দু একটা  ঘটনার উল্লেখ করছি।
একবার গ্রীষ্মকালে কবি শুয়ে আছেন। মহাদেবকে ডেকে  বললেন " ওরে চাঁদ টা ঢেকে দে তো! ঘুম আসছে না।" মহাদেব ভেবে অস্হির। কবি বললেন " পারছিস না তো! আচ্ছা  এক কাজ কর আমার মাথার কাছের জানলাটা বন্ধ করে দে।" মহাদেব কবির কথায়  জানলা বন্ধ করতে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। কবি বললেন " কি রে? হল  এবার? চাঁদ ঢাকা পড়ল?"

শান্তিনিকেতনে এক মহিলা রবি ঠাকুরকে পিঠে বানিয়ে খাওয়াতেন। একদিন সেই মহিলা রবি ঠাকুরকে  বললেন পিঠে কেমন হয়েছে তার এক সার্টিফিকেট চাই। রবি ঠাকুর বললেন-
নেহাৎ যদি শুনতে চাও বলি
লোহা কঠিন পাথর কঠিন
তাহার কঠিন ইষ্টক
তাহার অধিক কঠিন কন্যে,
তোমার হাতের পিষ্টক।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটক বা উপন্যাস সর্বদা শান্তিনিকেতনে গুণীজনের সমাবেশে পড়ে শোনাতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও এই আসরে আসতেন।  একবার জুতো চুরির ঘটনা শুনে  তিনি তাঁর নুতন জুতোজোড়া কাগজে মুড়ে বগল দাবা করে আসরে আসলেন। রবি ঠাকুর তাকে বললেন- " শরৎ তোমার বগলে এটা কি? পাদুকা পুরাণ?" এ কথা শুনে আসরের মধ্যে শুরু হল প্রচণ্ড হাসাহাসি।

এমন মহামানবের জীবনের এত ঘটনা, এত দিক আছে তার একাংশও তুলে ধরা খুবই কঠিন ব্যাপার। এমন রসালো  মহাজীবনের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।



রবীন্দ্রনাথের লোকসাহিত্য প্রীতি 
শ্রাবনী সেনগুপ্ত 


রবীন্দ্রনাথ দেশ ও লোকসমাজ কে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।তাই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে,দেশের ভাষা ও ভাবকে,ব্রাত্যজনের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা না করলে,তাকে ভালো করে না জানলে দেশকে জানা যায়না।রবীন্দ্রনাথ বাংলার গ্রামসমাজকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন,সেখানকার লোকসমাজকে অন্তরঙ্গভাবে জেনেছিলেন।তাই তাঁর মনের মধ্যে এই উপলব্ধির জাগরণ ঘটেছিল।এই গ্রামসমাজকে তিনি ভালোবেসেছিলেন,দেশ অর্থে তিনি বুঝেছিলেন গ্রামীণ ভারতবর্ষকে।তাঁর সংবেদনশীল মন দিয়ে তিনি লোকসমাজের সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গ্রাম গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে লোকমানসের পরিচয় পেলেন, তাদের মানসিক সম্পদের পরিচয় পেয়ে বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন।গ্রামীণ জীবনে উন্নত লোকসাহিত্যের পরিচয় পেয়ে তিনি সেগুলি সংগ্রহ করে নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি তে বিশ্লষণ করলেন।তাঁর বিপুল সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে আমরা লোকঐতিহ্যের অসংখ্য উপাদান সংগ্রহ করতে পারি।তাঁর রক্তে-চিন্তায়-মননে শিশুকাল থেকে লৌকিক ভাবনা সক্রিয় ছিলো,যা পরবর্তীকালে গ্রামীণ মানুষের সাহচর্যে আরও বাস্তবায়িত হয়।
                        ১৩১৪ সালের ২০শে ভাদ্র  দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের 'ঠাকুরমার ঝুলি'গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন-'স্বদেশের দিদিমা কোম্পানি একেবারে দেউলে'।কোথায় গেল রাজপুত্র পাত্তরের পুত্র,কোথায় বেঙ্গমা,বেঙ্গমী,কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের সাত রাজার ধন মাণিক।বিলাতের রূপকথায় সেদিনের শিশুদের মন ভরাতে হয় বলে তিনি দুঃখ করেছিলেন। ছেলেবেলার স্মৃতি উজ্জ্বল ছিল বলেই তিনি জানতেন যে,বাঙালি শিশুরা যখন রূপকথা শোনে,তখন শুধু গল্প শুনেই সে সুখী হয়না,সমস্ত বাংলাদেশের চিরন্তন স্নেহের সুর তার তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে বাংলার রসে উজ্জীবিত করে।১৩৪৪ সালের আষাঢ় মাসে কবির লেখা 'বালক'কবিতায় কবি তাঁর ছেলেবেলার মানসিকতা প্রকাশ করেছেন।লোকসাহিত্য র ভাবনা এর মধ্যে বিধৃত রয়েছে।রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন সাত আট বছর,অন্যের মুখে শোনা ছড়া আওড়াতেন তার মধ্যে নিজের তৈরি দু 'একটি শব্দও জুড়ে দিতেন।১৩২৮ সালে র আশ্বিন মাসে 'রাজপুত্তুর'-এ লিখলেন-পৃথিবীতে আর সকলে টাকা খুঁজছে, নাম খুঁজছে,আরাম খুঁজছে-আর যে আমাদের রাজপুত্তুর সে দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছে।তুফান উঠলো,নৌকা মিলল না,তবু সে পথ খুঁজছে।এইটেই হচ্ছে মানুষের সব গোড়াকার রূপকথা আর সব শেষের।পৃথিবীতে যারা নতুন জন্মেছে দিদিমার কাছে তাদের এই চিরকালের খবরটি পাওয়া চাই যে,রাজকন্যা বন্দিনী,সমুদ্র  দুর্গম,দৈত্য দুর্জয়,আর ছোট মানুষ টি একলা দাঁড়িয়ে  পণ করছে-'বন্দিনীকে উদ্ধার করে আনব। 'ছিন্নপত্রাবলীর ১৮০ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলার এই অনুভূতির কথা আবার প্রকাশ করেছেন।জ্যোৎস্না রাতে যখন চরে বেরান,তখন তিনকড়ি দাসীর কথা তাঁর মনে পড়ে। "ছেলেবেলায় সেই রাত্রে তিনকড়ির এই একটি কথায় আমার মনটা ভারি চঞ্চল হয়ে উঠেছিল-প্রকাণ্ড মাঠ ধূ ধূ করছে,তারই মধ্যে ধবধবে জ্যোৎস্না হয়েছে, আর রাজপুত্র অনির্দেশ্য কারণে ঘোড়ায় চড়ে ভ্রমণে বেরিয়েছে-শুনে মনটা এমনি উতলা হয়েছিলো।"ছোটবেলায় যে ভালবাসা শোনার মধ্যে দিয়ে এতোদিন বয়ে এসেছিল,যা শুধু কল্পনার জগৎকেই গড়ে তুলেছিল,তার বাস্তব প্রকাশ ঘটল তাঁর বাইশ বছর বয়সে।১২৯০ সালের বৈশাখ মাসের 'ভারতী 'পত্রিকায় 'বাউলের গান 'নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।লোকসাহিত্য সম্পর্কে সচেতনভাবে লেখা এটাই তাঁর প্রথম প্রবন্ধ।এই প্রবন্ধে কবি একটি বিষয়ে যে মন্তব্য করেন তা  তাঁর পরবর্তীকালের লোকসাহিত্য সংগ্রহ প্রীতির পূর্বাভাষ বলে মনে হয়-'বাঙ্গলা ভাব ও ভাবের ভাষা যতই সংগ্রহ করা যাইবে, ততই যে আমাদের সাহিত্যের উপকার হইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাই।"লোকসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বৈজ্ঞানিক উপলব্ধিই তাঁকে এই বিশেষ ক্ষেত্রে অমর করে রাখবে।



রেবন্ত সেন





অতীতে ও বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ  

অবহেলার শিকার রবীন্দ্র স্মৃতিবিজরিত গৌরীপুর ভবন

গৌতম চক্রবর্তী


রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য গৌরীপুর ভবনে

না, নিছক বেড়ানো নয়। অভিমান আর অহংকার নিয়ে ইতিহাসের ভগ্নস্তূপে এসে পৌঁছলাম একটা হেরিটেজ সফর এবং ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। হেরিটেজ গৌরীপুর ভবন দিনে দিনে ভগ্নস্তূপে পরিণত হচ্ছে। সরকার মাঝেমাঝে কিছু অনুদান দিলেও রাঘববোয়াল ঠিকাদারদের উদরস্থ হচ্ছে তার সিংহ ভাগটাই। অথচ মানুষের কোন বাদ প্রতিবাদ নেই। তাই অবলুপ্ত ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্টাংশকে চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করার মানসিক অনুপ্রেরণাতেই এই সফর। কালিম্পংয়ে রায়চৌধুরি পরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাস গৌরীপুর হাউস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য৷ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই স্মৃতি আজ ধূলাচ্ছন্ন৷ আত্মবিস্মৃত বাঙালি নিজের ইতিহাস, নিজের ঐতিহ্য আর গর্বকে যথাযোগ্য মর্যাদায় রক্ষণাবেক্ষণ করতে জানে না৷ নয়ত কালিম্পংয়ের ঐতিহাসিক গৌরীপুর হাউস আজ পোড়ো বাড়ির চেহারা নিত না। সে নিয়ে কারও কোনো দায় নেই, দায়িত্বও নেই৷ গৌরীপুর হাউসের যাঁরা মালিক, কলকাতার সেই রায়চৌধুরী পরিবার কিন্তু বহুবার জানিয়েছেন, আজকের দিনে কালিম্পংয়ের মতো জায়গায় প্রায় প্রাসাদতুল্য ওই দোতলা বাংলো বাড়ির সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে তাঁরা অপারগ৷ সরকার যদি চায়, অথবা অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি আগ্রহী থাকে গৌরীপুর হাউসকে একটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালায় পরিণত করতে, তা হলে তাঁরা সাগ্রহে রাজি আছেন৷ অথবা বাড়িটি একটি হেরিটেজ হোটেলেও রূপান্তরিত করা যায়৷ তা হলেও অন্তত রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত ইমারতটি রক্ষা পায়। কিন্তু কিছুই হয়নি৷ ইতিহাসের নির্মম রসিকতাই বলতে হবে, গৌরীপুর হাউসের গায়ে এক খণ্ড মর্মর ফলকে বলা আছে – ‘‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে জন্মদিন কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন৷'' অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৭৮ তম জন্মদিন কাটিয়েছিলেন এই বাড়িতে এবং তথ্য বলছে, নিজের লেখা জন্মদিন কবিতাটি তিনি টেলিফোনে আবৃত্তি করেছিলেন, যা সরাসরি সম্প্রচার করে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কলকাতা দপ্তর ‘‘আকাশবাণী''৷ কালিম্পংয়ের সঙ্গে কলকাতার টেলিফোন যোগাযোগেরও নাকি সূচনা হয়েছিল সেই সঙ্গে৷ সেই ইতিহাস, সেই গুরুত্ব স্বীকৃতি পেয়েছে ধূলামলিন এক মর্মর ফলকে৷ দায়িত্ববোধের সেখানেই ইতি৷

ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ গৌরীপুর ভবনে 

আপাতত আমাদের গন্তব্য দূরপিনদাঁড়া রোড। মঙ্গলধাম পেরিয়ে অবশেষে রাস্তার এক প্রান্তে একটা উতরাই দেখা গেল। কদিন আগে যে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে, সেটা এবার বোঝা গেল ঢালের মুখে দাঁড়িয়ে। কাদায় ছপ ছপ করছে এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা। গাড়ি থেকে নামলাম। একটা সরু পায়েচলা পথ নেমে গেছে ঢাল বেয়ে। এই যে সরু রাস্তাটা সেটা কী এই সামনের এবড়োখেবড়ো রাস্তাটাই? যেটার মুখে আমাদের কোয়ালিশ দাঁড়িয়ে গেল! তাইই হবে হয়তো। এখন এখান দিয়ে গাড়ি নামবার কোনও উপায় নেই অথচ তখন প্রকাণ্ড মোটর নামত দিব্যি। তার মানে এখন যা সরু, তার চেয়ে বেশ খানিক চওড়া ছিল তখন। অবশ্য রাস্তাটাকে দেখলেই মনে হবে, ডানদিকের অংশটা ধ্বসে গেছে বহুদিন। সাবধানে নামছি। এবার দেখতে পাচ্ছি প্রাসাদোপম অট্টালিকাকে। ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ। অভিমান আর অহংকার একসাথে প্রতিফলিত হচ্ছে সেখান থেকে। গৌরীপুর লজ। বিশাল এলাকা জুড়ে বাগান এবং তার গাছগাছালির মাঝে অপরূপ বাড়িটিকে দূর থেকে পুরো ভূতের বাড়ির মতো মনে হয়৷ পিচ বাঁধানো পাকা রাস্তা থেকে গৌরিপুর হাউস পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তাটিও এবড়োখেবড়ো, রাশি রাশি শুকনো পাতায় ঢাকা৷ চতুর্দিকে এমন আগাছা যে দিনের বেলাতেও সে রাস্তায় হাঁটতে গা ছমছম করে৷ আর বাড়ির সামনে পৌঁছে তার চেহারা দেখলে চোখে জল আসার উপক্রম হয়৷ সদর দরজা বন্ধ কিন্তু বাড়ির প্রায় সব জানালা হয় ভাঙা, নয় দু হাট করে খোলা৷ তার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি মারলে দেখা যায় একেবারে বেবাক খালি, আসবাবহীন, ধুলোয় ঢাকা ঘর৷ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কোনো সামগ্রী, কোনো আসবাবপত্র সেখানে থাকার স্রেফ কোনো সম্ভাবনাই নেই। বাড়ির অনেকাংশই ভেঙে পড়েছে। ঘরের বেশিরভাগ জানলাতেই কাচ নেই। যেগুলোতে আছে, সেগুলোও দেখলাম ভাঙা। অনায়াসে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। দেওয়াল মেঝের কিছু অংশে খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা। রবীন্দ্র-গবেষক রতন বিশ্বাসের নিবন্ধ থেকে জেনেছি, একসময় নীচের দিকে ধাপ কেটে ৬৪টি সিঁড়ি ছিল। সেসবই বা কোথায়? বাড়ির চত্বরেই চলছে কনস্ট্রাকশনের কাজ। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হবে সামনেই। কনস্ট্রাকশনের কাজের কারণেই চারিদিকে আরও বেশি জলকাদা হয়ে জায়গাটা হাঁটার অযোগ্য হয়ে গিয়েছে। আসলে ইতিহাসের সমাধি-খনন। কতবছর আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কে জানে! বাড়ির দুরবস্থা নিয়ে কাগজে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। সরকার বা প্রশাসন কারোরই হেলদোল নেই। 

গৌরীপুর হাউসের বর্তমান বাসিন্দা

বাড়ির এখনকার বাসিন্দা এক মাঝবয়েসী মহিলা আর তাঁর তিনটি ফুটফুটে মেয়ে। ভাড়াটে। এছাড়া রয়েছে কতকগুলো মোরগ-মুরগি। একতলার যে অংশটা এখন মাটিতে মিশে গিয়েছে, ঠিক তারই ওপরের অংশে একটা ঘর নিয়ে থাকেন তিনি। নাম, সঞ্জিতা শর্মা। জলপাইগুড়ি থেকে এই বাড়িটি নিয়ে লিখব বলে এসেছি শুনে একাধারে বিস্ময় এবং আনন্দের অভিব্যাক্তি ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। তাঁর মুখে জানলাম, এখানে তাঁরা রয়েছেন চার পুরুষ ধরে। তাঁর মাতামহ এই বাড়ির চৌকিদার ছিলেন। তাঁর মা তখন খুব ছোট, সেসময় রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছেন। মায়ের নাম ছিল কৃষ্ণা। ছোট্ট কৃষ্ণা নাকি দাড়িওয়ালা বৃদ্ধকে রীতিমত ভয় পেতেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি এসে হাঁক দিতেন-‘বিটি, মিঠাই লে আ’। পরবর্তীকালে সঞ্জিতার বাবা পদমলালও চৌকিদারি সামলেছেন। পদমলাল, কৃষ্ণা কেউই আর বেঁচে নেই এখন। বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে সঞ্জিতার গলায় যথেষ্ট উৎকণ্ঠা। সন্দীপ রায়ের ‘যেখানে ভূতের ভয়’-এর ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-র শুটিং এ বাড়িতেই হয়েছিল। সঞ্জিতা তখন সন্দীপকে অনুরোধ করেছিলেন, যদি বাড়িটার কিছু ব্যবস্থা করা যায়। ফল হয়নি। তাই বাড়ির সাথে সাথে সঞ্জিতাও কেবল দিনই গোনেন। এই বুঝি বিপজ্জনক নোটিশ পড়ল বাড়িতে। প্রতিটা ঘরেই ফায়ারপ্লেস। সাদা দেওয়ালে অনবরত শ্যাওলা জমে তা আর সাদার পর্যায়ে নেই। স্থানীয় মানুষের কাছে এই বাড়ি ‘ভূতের বাড়ি’ বলেই বেশি পরিচিত। গৌরীপুর লজ বললে কেউই বুঝবেন না। বেশ কসরত করে নেমে একতলার দিকটায় যেতে হয়। সব ঘরে তালা ঝুলছে। একটা ফলক। ‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে “জন্মদিন” কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন’। কে করিয়েছিলেন, সেসব কিছু লেখা নেই। তবে যিনিই করিয়ে থাকুন, ভারতীয় গণমাধ্যমের ইতিহাসে যে প্রথম লাইভ টেলিকাস্টের ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল এই বাড়ি, অন্তত সেই স্বীকৃতিটুকুর লিখিত খোদাইটি করিয়েছেন।

গৌরীপুর এস্টেটের নামে নামকরণ

প্রবাদপ্রতিম সেতারবাদক পণ্ডিত বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির হাত ধরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠা। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ওপর লেখা ‘ইন্ডিয়ান মিউজিক অ্যান্ড মিয়াঁ তানসেন’ তাঁর একটি সমৃদ্ধশালী কাজ। তানসেনের কন্যা সরস্বতী দেবীর শেষ বংশধর মহম্মদ ওয়াজির খাঁয়ের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। বিলায়েত খাঁয়ের পিতামহ ইমদাদ খাঁ, উস্তাদ আলাউদ্দিনের মতো মানুষ ছিলেন তাঁর গুরু। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, শ্যামাসঙ্গীতের পান্নালাল ঘোষ তাঁর ছাত্র ছিলেন। বীরেন্দ্রকিশোরের বাবা ব্রজেন্দ্রকিশোরও ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড় পৃষ্ঠপোষক। স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসাবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের পত্তন যখন হয়, সেই কাজেও অর্থসাহায্য করেছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। এই সংস্থাই বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ও বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে, পরবর্তীকালে যে দুটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান একত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দিয়েছে। এই ব্রজেন্দ্র এবং বীরেন্দ্ররা ছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর এস্টেটের জমিদার। সেখানে তাঁদের প্রাসাদোপম বাড়িটির নাম ছিল গৌরীপুর হাউস। সেই অনুকরণেই কালিম্পঙের বাড়িটিরও এই নাম। এখানে ব্রজেন্দ্রের পরিবার গ্রীষ্মাবকাশ যাপনে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরির নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে সেখানে গিয়েছিলেন, তখন রায়চৌধুরি পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয়তা হয়। তবে কালিম্পঙে রায়চৌধুরিদের বাড়িটি কবে তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। বাড়ির মালিকানা বদলের চিত্রনাট্যটি কিন্তু বেশ মজার।

রবীন্দ্র স্মৃতি বিজরিত গৌরীপুর ভবনে

গৌরীপুর ভবনের খোলা হাওয়ার পরিবেশ, চারিদিকের বাগান, নির্জনতা দেখে কবি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে যান। ব্রজেন্দ্রকিশোর বাগানের মালি বিষ্ণুলাল শর্মাকে দৈনন্দিন কাজের ভার দিয়েছিলেন। এই বিষ্ণুলালই সম্ভবত সঞ্জিতার দাদু। সঞ্জিতার সহায়তায় বাড়ির ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিল। দোতলার যে ছোট বারান্দাটায় রবীন্দ্রনাথ বিশ্রামের জন্য এসে বসতেন, একসময় সেখান থেকে দেখা যেত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাথুলা। এখন বসতি হয়ে গেছে। দূষণের পর্দা ভেদ করে শুভ্র হিমশিখরের দৃশ্যমানতা আর সম্ভব হয় না। তবে সামনের গাছ দুটি আজও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকবে, আরও কতদিন। এরকম ইতিহাসের স্মৃতি-বিজাড়িত জায়গায় এসে এই গাছেদের দেখে মনে হয়, যদি ওরা কথা বলতে পারত, কোনোভাবে! গৌরীপুর লজ ‘আসবাবশূন্য নিরলঙ্কার। এখানে কেউ কোনো দিন বাস করেছে বলে মনে হয় না। এখন মানুষ বাস করে। রবীন্দ্রনাথ এখানে এলে বেশ অনেকগুলো ঘর ব্যবহার করতেন। সুবিশাল অট্টালিকায় ঘরের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। কিন্তু কোন ঘরগুলো ব্যবহার করতেন তিনি? প্রতিমা দেবীই বা কোন ঘরে থাকতেন? কবির একটি আলাদা বসবার ঘর ছিল। মৈত্রেয়ী দেবীরা এলে সেই ঘরের পাশের ঘরে থাকতেন। সেগুলোই বা কোনগুলো? সঞ্জিতা দেখাতে পারেননি। এজন্য তাঁকে দোষ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এত খুঁটিনাটি কথা তাঁর জানার কথা নয়। যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়েরই ভেঙে পড়বার উপক্রম, সেখানে একসময়ে রবীন্দ্রনাথ এসে কোন ঘরে থাকতেন, এসব জেনে তাঁর লাভ কী! কবির সম্বন্ধে যতটুকু পড়েছি, তাতে জেনেছি, তাঁর দৃষ্টি চলে যেত বহুদূর। সুদূরের পিয়াসী মানুষটি যে সুদূরকেও অতিক্রম করে গেছেন। শুধু সাদা চোখের দৃষ্টিতে নয়, অন্তর্দৃষ্টিতেও। সামনের গাছ থেকে শুকনো পাতা ঝরে এসে পড়েছে বারান্দায়। আমার জুতোর চাপে মর্মরধ্বনি উঠছে তাদের। যেন একটা দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিয়ে মারতে চাইছে কেউ। সঞ্জিতার কথা আর কানে ঢুকছে না তখন। আমি যেন ফিরে গিয়েছি সেই অদেখা সময়ে। সময়টা যে বড় প্রিয় আমার।


 

 

প্রসেনজিৎ দাস



গল্পে রবীন্দ্রনাথ  

 অন্তরতম
 অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

উলের কাটা জানান দিল কেক হয়ে এসেছে.. পায়েসও সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে প্রস্তুতির শেষ পর্বে। অদিতির  'জিয়ন কাঠি'র বাইরে একটি আলোকোজ্জ্বল মন ভালো করা সকাল। সব ঘরের দরজা জানলা গুলো একে একে খুলে দিল অদিতি। তারপর বসবার ঘরের টেবিলের ওপর রাখা ছবিটির সামনে এসে দাঁড়ালো। এই ঘরটা কাল রাতেই ওরা নিজেদের আঁকা ছবি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। সকালে বাগান থেকে নিজের হাতে ফুল তুলে এনেছে অদিতি। সেগুলো ফুলদানিতে রাখা হয়েছে,  যথাস্থানে। ভাস্কর চলে যাওয়ার পর থেকে বড়ো ফাঁকা লাগতো এই বাড়িটা। একসময়ের একান্নবর্তী সংসারের কেউ কেউ গত হয়ে, কেউ চাকরি বা বিয়ের সূত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে অদিতি একটা সময় একেবারে একা হয়ে পড়েছিল। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলো ছেলেও দেশের বাইরে। 
                             কিচির মিচির করতে করতে একঝাঁক আনন্দ এসে ঘিরে ধরলো অদিতিকে। অদিতিই ওদের সাজিয়ে দিয়েছে আজ সুন্দর করে। কোনার দিকের ঘরটায় এতোক্ষণ এরা নাচ গানের শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চন্দনের ফোঁটায় সাজানো টেবিলের ছবিকে প্রণাম জানালো ওরা একে একে..  সকলের হাতেই অদিতির বাগানের কোনো না কোনো ফুল। ওদের ইচ্ছেমতোই গত কয়েকটা বছর ধরে এই দিনটি পালন করে অদিতি। ওদের শিশুমনের নির্ভেজাল আনন্দের সঙ্গী হতে ওরও মন চায়। একে একে কবিতায়, নাচে,  গানে ওরা ভরে তুলল অদিতির সকালকে। এরপর অদিতির পালা। সকলের আবদারে গান গাইলো..  আবৃত্তি করলো সমস্বরে....... 
'ভয় হতে তব অভয় মাঝারে--
নূতন জনম দাও হে! 
দীনতা হইতে অক্ষয় ধনে, 
সংশয় হতে সত্য সদনে
জড়তা হইতে নবীন জীবনে
নূতন জনম দাও হে!....... 
                            এদের সাথেই তো দিন কাটে অদিতির সারাটা বছর। এদের পড়াশোনা,  আঁকা,  হাতের কাজ,  খেলাধুলোই তো বর্ণময় করে তোলে অদিতির নিঃসঙ্গ যাপনকে। আর অদিতি ওদের নিয়ে থাকে আরেকজনের আগলে নেওয়া দুহাতের আশ্রয়ে। সেই একজনই তো সঙ্গ দিয়ে চলেন অবিরত ওর মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে। ভাস্করের চলে যাওয়ার পরের ওর একলা থাকার দিনগুলোতে উনিই তো সাহস যুগিয়েছেন ,  এগিয়ে এসে হাত ধরেছেন অদিতির,  এই বাড়িটিকে 'জিয়ন কাঠি' করে গড়ে তুলে বাপ মা হারা ছেলে মেয়ে গুলোকে ঠাঁই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে। 
                                 ছেলে মেয়ে গুলোর হাতে হাত মিলিয়ে গরম কেক - এ ছুরি ডোবালো অদিতি। ছবিতে ওর প্রাণের মানুষ, ওর চিরসখা রবীন্দ্রনাথ উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। বড়ো সুন্দর,  বড়ো আপনার সেই চেয়ে থাকা। সেই চেয়ে থাকায় যেন ধ্বনিত হচ্ছে..... 
'জন্মদিন আসে বারে বারে 
মনে করাবারে --
এ জীবন নিত্যই নতুন
প্রতি প্রাতে আলোকিত
পুলকিত
দিনের মতন ' 




বুকুনের সহজপাঠ
           মৌসুমী চৌধুরী 

       ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে   থাকে বুকুনের। একে একে খুব ধীরে ধীরে ছবিগুলো নেমে আসে বুকুনের খুব কাছা- কাছি...! আজ একমাস হয়ে গেল দাদাই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু সেই ছবিগুলো রয়ে গেছে বুকুনের বুকে। 
        যেদিন করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য প্রথম স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য, সেইদিন ভারী মন খারাপ হয়েছিল বকু- নের। বুকের ভিতরটা কেমন খাঁ খাঁ করছিল। বাড়িতে থাকতে তার ভালোলাগে না। বাবা আর মা তো অনেক রাত্তির করে অফিস থেকে ফেরেন। সবসময় সে তো বীনামাসীর কাছেই থাকে। একদম ভালোলাগে না।
               ছোট্ট বুকুনের সবে পাঁচ বছরের জন্মদিন পেরিয়েছে। কেজি-টুতে পড়ে সে। বন্ধুদের দেখতে পাবে না, তাদের সঙ্গে খেলতে পারবে না বলে খুব কান্নাকাটি করছিল। আর তখনই দাদাই এসে হাত রেখেছিলেন তার মাথায়। সেসময় কৃষ্ণনগর থেকে দাদাই এসে থাকছি -লেন তাদের বাড়িতে। সারাদিন ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে মোটা মোটা বই পড়তেন তিনি। দাদাই তাকে পড়তে দিয়েছিলেন বইটা — "সহজ পাঠ"।
—   "এই বইটির সব ভাগগুলোই দিলাম তোমায়। পড়ে দেখ দাদুভাই। খুব আনন্দ পাবে।"
 ব্যাজার মুখে পড়তে শুরু করেছিল বুকুন। প্রথম কয়েক পাতা পড়ার পর সত্যিই ভালোলেগেছিল তার। দাদাইয়ের মুখে শোনা তাঁর ছোটবেলার মাঠঘাট, হাট, নদী, পাড়া, হিজল গাছ, ফলসা বন, মৌচাক, জেলে ডিঙি সব যেন কেমন নেচে নেচে ছবি হয়ে ফুটে উঠছিল বুকুনের চোখের সামনে।
       বুকুনের স্কুল আর খুলল না গোটা বছর। অন-লাইনেই ক্লাস চলতে লাগল। বাবা-মায়ের চলতে লাগল "ওয়ার্ক ফ্রম হোম"। তার ভিতরে -ই ঘটল দুর্ঘটনাটি। দ্বিতীয় ফেজে করোনা ভাই -রাস সংক্রমণের জেরে কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট হয়ে হঠাৎই মারা গেলেন দাদাই। তার পরপরই হঠাৎ বাবা আর মা দু'জনেই কোভিড-পজিটি -ভ হয়ে পড়লেন। বাবা আর মায়ের কাছাকাছি যেতে পারে না ছোট্ট বুকুন। তারা আইসোলে- শানে আছেন। বীনামাসীও তো কাজে আসছে না। এখন সারা দিন-রাত একা একা বুকুন নিজের ঘর আর বারান্দাটুকুতেই কাটায় সেই সহজপাঠ হাতে নিয়ে। তাঁদের আবাসনের প্রতিবেশীরা পালা করে তিনবেলা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন বুকুনদের। দড়ি দিয়ে বারান্দার গ্রিল থেকে ঝোলান আছে ব্যাগ, তাতেই তারা টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার রেখে  যান। কখনও কখনও ব্যাগে টিফিন ক্যারিয়ার রেখে তাদের ওপরতলার বোস কাকীমা হাঁক পাড়েন, 
—"বুকু-উ-উ-উ-ন কই গেলি বাবা...খাবারটা নিয়ে যা।"
ঠিক তখুনি কেন যেন বুকুনের মনেপড়ে, 
— "ডাক পাড়ে ও ঔ/ভাত আনো বড়ো বৌ"।
নিস্তব্ধ দুপুরে যখন তাদের আবাসন চত্ত্বরটা ঝিমোয়, তখন দূরের রাস্তা থেকে একটা দুটো কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক ভেসে আসে। বুকের ভিতরে একটা ছন্দের ঢুলুনি লাগে বুকুনের,  
—" হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ/ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ।"
সকালে বারান্দায় বসে আউট হাউসের দিকে চোখ গেলে বুকুন দেখে তাদের আবাসনের দারোয়ান কয়লার উনুনে চা বসিয়েছে পাকিয়ে
পাকিয়ে কালো ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে আকাশে। ছবিটা দোলা দেয় বুকুনের মনে,
"চরে বসে রাঁধে ঙ, /চোখে তার লাগে ধোঁয়া।"
        সহজপাঠের পাতায় বুকুন সহজেই দেখ- তে পায় দাদাইয়ের মুখ। ওই দ্যাখো বুকুন,
— "মাছ জলে খেলা করে। /ডালে ডালে কাক ডাকে।/ খালে বক মাছ ধরে..." 
বুকুনের শোবার ঘরটা পুবমুখী। এখন নিজের ঘরে একাই ঘুমায় বুকুন। সকালে আবাসনের মাথায় সূর্য উঁকি দেবার সঙ্গে সঙ্গে আলোয় ভেসে যায় বিছানা। কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে, 
"কালো রাতি গেল ঘুচে, /আলো তারে দিল মুছে।/পুব দিকে ঘুমভাঙা হাসে উষা চোখ- রাঙা।"
              দাদাইয়ের হাত ধরে কৃষ্ণনগরে তাদের বাড়ির পাড়ার পথ ধরে হাঁটছে বুকুন। কত বড় বড় সবুজ ঝাঁকড়া গাছ, গভীর দিঘি এখানে! কী মিষ্টি ছায়ায় ঢাকা পথ,
—" ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি /আছে আমাদের পাড়াখানি। / দিঘি তার মাঝখানটিতে/ তালবন তারি চারি ভিতে।"
দাদাইয়ের সঙ্গে বৈশাখ মাসের নদীতে হাঁটুজল
ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে বুকুন। দূরে কারা যেন গামছায় জল ভরে সেই জল গায়ে ঢালছে। আাঁচলে ছেঁকে ছোট ছোট মাছ ধরছে,
—" বু-কু-উ-উ-উ ন আর এগিও না সামনে ঘোর বর্ষার ঘোলা জল... বুকুন...বুকুন...
     হঠাৎ ঘুম ভেঙে বুকুন দেখে সে শুয়ে আছে তার বিছানায়। বাইরে রোদ ঝলমল করছে। দরজদায় মা দুমদুম শব্দ করছেন,
—" বুকুন ওঠ। এখুনি অন-লাইন ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তোমার। ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেছেন সেন আঙ্কেলরা। খেতে নিয়ে পড়তে বস।"
    বুকুন দেখে কোথায় নদী?... কোথায় ছায়ার ঘোমটা?... সে শুয়ে আছে ইঁট-কাঠ-পাথরের মাঝখানে ! কোথায় হারিয়ে গেল অত সুন্দর  ছবিগুলো? ওই তো... ওই তো... সহজপাঠের পাতায়! ভারী মন খারাপ হয়ে গেল বুকুনের। খুব অভিমানও হল তাঁর ওপর। সব লেখা শুধু ওই বাচ্চাগুলোর জন্যই ? বুকুনদের মতো শহুরে বাচ্চাগুলোর জন্য কি কিছু লিখতে নেই? হঠাৎ মনে পড়ে যায় দাদাই পড়িয়েছিলে -ন,
—..."চেয়ে দেখি, ঠোকাঠুকি বরগা কড়িতে,/
কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।/ ইঁটে-গড়া গণ্ডার বাড়িগুলো সোজা/ চলিয়াছে দুদ্দাড় জানালা দরজা।/ রাস্তা চলেচে যত অজগর সাপ,/ পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপ্‌ ধাপ্‌..."
          এক মুখ দাঁড়িওয়ালা তার দাদাই আর রবি ঠাকুর বুকুনের চোখে ধীরে ধীরে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে।






সোমনাথ বনিক



কবিতায় রবীন্দ্রনাথ 

চির সখা হে
শ্রাবণী সেন

হাওয়ায়  ওড়ে কালো মেঘের দল
গোধূলি আলো ম্লান হয়নি বটে
তোমার চোখে আকাশ দেখা যায় 
এমন শুধু ভাগ্য হলেই ঘটে।

হঠাৎ এলো কালবোশেখী ধেয়ে
ঝড়ের মুখে আড়াল রাখা দায়
বেণীতে বাঁধা বেলির মালাখানি 
ডাক দিয়েছে এমনই সন্ধ্যায়।

আরকি মনে আগল রাখা চলে!
এবার মন দুয়ার খোলা থাক
আশিরনখ ভিজল  আকাশজলে
ডাক দিল যে পঁচিশে বৈশাখ! 

আমার ডালি  ভরেছি ফুলে ফুলে
শিরিষ, বকুল, অমলতাসের গান
বেলি ফুলের গোড়ে মালায় সেজে
প্রাণের ঠাকুর, জুড়াও এবার প্রাণ!

পায়ের কাছে বসেছি এই এসে
গীতবিতান খোলা কোলের পরে
চোখের কাজল চোখের জলে মোছে 
এবার এসো মনের বিজন ঘরে।

আজকে পথ আঁধার হয়ে আছে
প্রাণের প্রদীপ জ্বেলে নিজের হাতে
পরম প্রিয় এসো আমার ঘরে
বন্ধ দুয়ার খুলো আপন হাতে।

পথ কেটেছি হৃদয় বরাবর
শঙ্কা যত যাবেই দূরের পানে
আঁধার রাতে যদিই পাই ভয়
পরশমণি জ্বালিও আমার প্রাণে।



তুমি আছ
পার্থ সারথি চক্রবর্তী

কত পথ পার হয়েছি-
আর কত পথ গেলে তোমায় পাব
জানি না, তবে তোমার ছায়া আছে
যাপন জুড়ে আমার, আশৈশব

অশান্ত সময়, টালমাটাল মন-
বেদনায় নীল আকাশ-
তবু তুমি জ্বালবেই জানি
শান্তির প্রদীপ, জীবনে সবার

আশা আর নৈরাশ্যের দ্বন্দ্বে-
রুদ্রবীণা বাজাও তুমি,
ধ্বনিত হোক মানবতার জয়গান
পূণ্যতীর্থের সাগরতীরে, নির্মল প্রভাতে

তুমি আছ জানি, সমুদ্র থেকে হিমালয়
সকাল থেকে রাত, আত্মা থেকে হৃদয়



রবীন্দ্র জয়ন্তী
 চন্দ্রানী চৌধুরী 

আমার অনুভূতির আকাশ জুড়ে 
আজ জ্যোৎস্না প্লাবন
কায়াহীন  অদৃশ্য দেবতার জন্মদিনে 
কেবল জ্যোৎস্না কুড়োই আমি ।
রবির কিরণে হীরকদ্যুতি ছড়িয়ে
ভালবাসার বর্ণমালায় গাঁথি কুন্দহার।
আজ পঁচিশে বৈশাখ
ফুলের সাজে সেজে উঠেছে 
রোদেলা স্বপ্ন সকাল 
প্রকৃতি হয়েছে রঙিন 
পাখিদের ঠোঁটে বেজে ওঠে 
উল্লাসী কলতান
বাতাসে বহিছে  প্রেম 
মনের গহীনে উপচে পরা শব্দেরা
ছুঁতে চায় আরাধ্যকে
রজনীগন্ধাময় বৈশাখে 
গানে গানে মুখরিত হয় দিন 
বিশেষ দিনে গুরুদেবের ছায়ায়, তারই আলোতে,
বর্ণে,ছন্দে,সুরে,গীতিতে
বরণ করি হৃদয়দেবতাকেই । 


প্রাণের আরাম
অশোক কুমার রায় 

রবিঠাকুর তোমার আলোয় 
সারা পাড়া আনন্দময়
মন নিঃসঙ্গ নয় জানি, 
সারাক্ষণ তোমার 'গীতবিতান 'পাশে !
বৈশাখী বৃষ্টি ফোঁটা ছাতিমপাতায় এখনও জমে, 
পঁচিশে বৈশাখে নেচে উঠবে 
আবার তালে আর ছন্দে! 
'বকুলবীথি' তোমার পাঠের অপেক্ষায়! 
শালবনিতে বসে,
এখনও গল্প হয়'বেলা শেষে'র! 
ভয়ঙ্কর আর্তনাদের কণ্ঠ শুনে জেগে উঠে, 
...তোমার ছবির পাশে বসি!
মন খারাপে 'সহজ পাঠ'এর এখনও পাতা উল্টাই, 
'ছিন্নপত্র' পাশে রেখে খাতায় কত চিঠি কাটাকুটি করি, 
 একটা মুখ খুঁজতে খুঁজতে! 


  কবি এলেন
     রীনা মজুমদার

সব কবিতায় প্রাণ থাকে না
কোন কবিতায় থাকে, রক্ত ঝরায়
আপন করে ভালোবাসতে শেখায়।

সব কবিতা কী ছোঁয়া যায় ?
কবিতায় আসবে তীব্র বান, সে 
  বান সরে গেলে
জমা হবে উর্বর পলি,
কবিতার মাটি ভরে যাবে শব্দ-অক্ষরে
সময়ে আগাছা নিংড়ে দিয়ে
চারা গাছে হাত রেখো মাতৃস্নেহে
সন্তানসম কবিতারা প্রাণস্পর্শ নিয়ে
  দেখবে একটু একটু করে
    বড় হচ্ছে...  

স্বপ্নটা ভেঙে যায়, আমি চমকে উঠি
  পরম মায়াময় তৃপ্তিতে।
 বুকে রাখা আমার, রাতের 
 আধ খোলা সঞ্চয়িতা... 



প্রাণের ঠাকুর
বিজয় বর্মন

(০১)

প্রতিদিন আমার এই খেলাঘর সাজে,
মান অভিমান,শত অনুভবে,
আপন আপনে কত গঞ্জনা।

একলা চলার গানে,
প্রেম বিরহ ভাসাই,তিস্তা তোর্ষার জলে,
কে আর বুঝিবে আমায়,
যতটা,বুঝেছো গো তুমি।

                (০২)

এই মধুমাসে, ফুলের খবর পাই,
দুহাত ভরে ফুল যে কুড়াই,
সব ভালো হবে, আশায় আশায়,
একটি রেখেছি, শুধু তোমায় দেবার।

পাহাড় নদী বনে,
তোমার প্রেম কুঞ্জে আমি যে মাধবীলতা,
যতনে সাজি,তোমার আভরণে।

                     (০৩)

মৃদু বাতাসের ঢেউ খেলে,পাহাড়ের গায়,
গীতবিতানের সুরে,
সিঙ্কোনা বাগিচার নিরবতায় যেন,
ভাঙনের গান।

আঁকড়ে থাকা, এপার ওপার,
দহন সুখে, বৈশাখী আমন্ত্রণ,
দুহাত তুলে নৃত্য মালঞ্চে তোমার পদাবলী।

                    (০৪)

এ জীবন টিকিয়ে রাখে,
আম কাঁঠালের পথ ধরে গ্রাম ছেড়ে গ্রামান্তর,
রাঙ্গামাটির পথে তোমার সুবাসিত ভাবনা,
স্পর্শ করে মনের উদাস বাউল।

পথ ভুলে যাই পথিক বেশে,
এ মাথা ঠেকায় শান্তি নিকেতনে,
কোচরে ভরি সোনা ঝুড়ির মাটি,
লেপিয়া রাখিবো,পদ ধূলি রূপে আমার দূয়ারে।



আমার রবীন্দ্রনাথ 
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত 


আমার পরমারাধ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 
কোলকাতা কিংবা শান্তিনিকেতন, ইংল্যান্ড কিংবা মংপু 
সর্বত্রেই রয়েছে তোমার ছোঁয়া ভরপুর।
তুমিই আমার প্রাত্যহিক সকল কর্মের অনুপ্রেরণা, 
তোমার সকল সৃষ্টির দ্বারা জাগে মনে-প্রাণে নতুন ভাবনা।। 

উপনিষদের ঋষিসুলভ প্রত্যয় তোমার কবিতায় হয় উচ্চারিত, 
তোমার সাহিত্য কর্ম করায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে পরিচিত। 
কেবলই পঁচিশে বৈশাখে বা বাইশে শ্রাবণের আড়ম্বরে নয়, 
তুমি সর্বদাই আছো বেঁচে, থাকবে বেঁচে, তুমি জ্যোতির্ময়।।



মধ্যাহ্নের রবি
         উমা শঙ্কর রায় 

গঙ্গার পার ধরে পদ্মার পার আমি খুঁজি -
একদিকে আগ্রাসন আর একদিকে রূপান্তরি নেশা! 
বাদ পড়ে নি জোড়াসাঁকো, বিশ্বভারতী 
                                             গীতবিতান -
কে বাঁধবে আজ সাত কোটি উত্তরসূরির হাতে
                                          হলদে মৈত্রী সুতো 
তোমার মিলন মন্ত্র সুরে বসন্ত রোদ্দুর! 
মধ্যাহ্নের রবি আজ 
                             মননে না চিন্তনে-
পঁচিশেই বেঁচে থাকো 
                              ফুল  মালা  চন্দনে !




রবির সুর
রীতা মোদক 

এসো শান্তি 
এসো স্বস্তি
এসো আনন্দময় ২৫ শে বৈশাখ 

কদম কেতকি ছড়িয়ে 
ফুলের ডালি নিয়ে
দিকে দিকে বেজে উঠুক  শাঁখ।

মনের যাতনা
যত দুঃখ বেদনা 
দূরে যাক,  বহুদুর.....

অমৃত  সন্ধ্যানে
প্রানের টানে
বাতাসে ভাসে রবির সুর।


পঁচিশে বৈশাখ
অরবিন্দ মাজী


আজ বলতে খুব ইচ্ছে করছে
এসো,এসো হে বৈশাখ, 
কিন্তু এখন আর চাইনা বলতে 
ঐ কটা না বলাটাই থাক্। 

ইতিমধ্যেই যে আসতে চলেছে 
বৈশাখের সেই শুভ ক্ষনটি, 
মাত্র একটাই দিন বাকি এখন
রবি ঠাকুরের জন্ম দিনটি। 

ফুলের মালা, ধূপকাঠি ও শঙ্খ
রেখেছি এনে ঘরে সযতনে, 
দিনটিকে পালন  করবার তরে
কবির স্মরণ নিতে নিজ মনে।





সম্প্রীত সরকার 



ছড়ায় রবীন্দ্রনাথ 

আহ্বান 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

এস তুমি  রবিদাদু  আমাদের  পাড়াতে,
আমাদের সাথে নিয়ে চল তুমি বেড়াতে। 
ছড়া আর কবিতা যে সাথী সেই ভুবনে, 
গল্পে  জুড়াবে প্রাণ, কত  কথা ও গানে। 

ট্রয় ট্রেনে চড়ে মোরা উঠবো যে পাহাড়ে,
নৌকায়  ভাসব  যে, কতো ছবি দু'পাড়ে। 
ঝকঝকে দিন গুলো বেছে নেব সেদিনে,
ছড়া অার কবিতা যে সাথী সেই  ভুবনে। 

এস এস  রবি  দাদু,  আামাদের  গাঁয়েতে, 
তোমার সে কথা, ধ্বনি, একবার শোনাতে।
তোমাকে শোনাতে কতো কথা আছে এ প্রাণে,
বলবো  তা  সব  খুলে , চুপিসারে  সেখানে। 

অরণ্যে বসবো গিয়ে,  সবার যে গালে হাত,
তোমার  গল্প  শুনে,  ভাত  খাব পেড়ে পাত। 
বনভোজনের  শেষে, পথ  যেথা  থামবে , 
সোনার তরীর গাঁয়ে,  আঁধার যে  নামবে। 

দিনের শেষেতে যাব ঘুমের সে দেশেতে, 
একবার এস তুমি,  আমাদের গাঁয়েতে । 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মরণে
সৌমেন দেবনাথ

কলমের কি মহাশক্তি
শক্তি অবিশ্বাস্য,
যে শাখাতেই দিয়েছেন হাত
ফলেছে স্বর্ণ শস্য।

শব্দের পরে শব্দ গেঁথে
অপূর্ব সব সৃষ্টি,
এমন নির্ভীক শব্দ সৈনিক
কাড়েন বিশ্ব দৃষ্টি।

মনটা ভরা প্রেমময়তায়
কি মোহ সুর গানে,
গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস
হাতটা নাই কোনখানে?

পক্ব হাত নাটকে কিংবা
কবিতার ছন্দে ছন্দে,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনি
সাহিত্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।



সেই ছেলেটা
মুহাম্মদ জাবেদ আলী

ঠাকুর বাড়ির কাকুর ছেলে,
শিক্ষক মশাই পড়াতে এলে,
সাঁঝের বেলা,
মায়ের গলায় বলত ঝুলে,
পেটের ব্যামোয় বইটি খুলে,
হয়নি পড়া ।
আজকে মাগো পড়বো না আর,
এমন ভুলও করবো না আর,
দাদা পড়ুক,
মা-মনিটাও বুঝতো খোকা,
আজকে আবার দিচ্ছে ধোকা ।
কী আর হবে ?
সেই ছেলেটা ছড়ার-কবি,
ঠাকুর বাড়ির ছোট্ট রবি,
সবাই চেনো,
সেই সে কবি নোবেল নিয়ে,
তাক লাগালো লেখন দিয়ে,
বিশ্ব কবি,
গানের দেশে প্রাণের দেশে,
সোনার বাংলা গানটি মেশে,
সূরয ওঠে ।


বিশ্বকবির ছড়া
মজনু মিয়া 

বাংলা ভারত বাস করেছেন
কর্ম কাজের জন্য, 
অসংখ্য গান গল্প ছড়া
কবিতাতে ধন্য। 

কম অর্জনে হয়নি তিনি
বিশ্বকবি রবি,
ধ্যানে জ্ঞানে সর্বক্ষণে
ভালো লাগার ছবি।

আমাদের সেই ছোট নদী
পড়ালেখায় পাঠে, 
শেষের কবিতার কথা তো
জানে রাখাল মাঠে।

ধন্য কবি ধন্য আপনি
মরেও অমর আজকে,
অবহেলা কখনো নয়
করেননি তো কাজ কে।
 


ছোটদের রবীন্দ্রনাথ  



দেবাঞ্জনা রুদ্র 



অনুস্মিতা বিশ্বাস




সম্পূর্ণা নন্দী





সৃজা রায় 






নীলাদৃতা বর্মন 



মুজনাই সাপ্তাহিক বর্ষপূর্তি সংখ্যা 

Tuesday, May 4, 2021


 

সম্পাদকের কথা 

অবশেষে গণতন্ত্র রক্ষা পেল। 

হাজার হাজার মানুষ মারা গেল, তাতে কি আর এসে গেল!

অবশেষে কারও স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনও এক ভিস্তা বানাতে।অক্সিজেন রইল না, আম-আদমি হাসপাতালে বেড পেল না, তাতে কি আর এসে গেল!

অবশেষে নতুন সরকার গঠন হতে চলেছে। 

নির্বাচনের পরে মানুষ গৃহহীন হল, নিহত হল, তাতে কি আর এসে গেল!


এক অদ্ভুত রাষ্ট্রে অদ্ভুত সময়ে রয়েছি আমরা। 

এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের পথ কীভাবে পাওয়া যাবে কেউ জানিনা। 

শুধু চারদিকের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে, এই নষ্টভূমি আমার নয়, আপনার নয়, 

আমাদের সন্তানদের নয়। 

যা রেখে যাচ্ছি, তার জন্য আগামী আমাদের ক্ষমা করবে না।  



এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা


কুমকুম ঘোষ, দিব্যেন্দু ভৌমিক, বটু কৃষ্ণ হালদার, শৌভিক রায়, পরেশ সাগ্নিক বেরা, ছবি ধর, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, চিত্রা পাল, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, সৈকত সাহা, 
অদিতি মুখার্জি সেনগুপ্ত, উত্তম রাজবংশী, সুবীর, সম্পা পাল, পার্থ সারথি চক্রবর্তী, নবনীতা, দীপ্তিমান মোদক, রীনা মজুমদার, মহাসিজ মন্ডল, শিল্পাশ্রী রায়দে, মধুমালা বিশ্বাস (নূপুর), সম্পূর্ণা নন্দী, কবিতা বণিক, ফিরোজ হক্, চন্দ্রানী চৌধুরী, সৌমেন দেবনাথ, মজনু মিয়া, শাহীন রায়হান, বাসেদ সরকার, নয়ন রায়



মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)

 

 প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৮





স্মরণ 




শূন্যতায় শঙ্খ- শব্দ
                               কুমকুম ঘোষ


  অপসৃয়মান ভারাক্রান্ত আত্মায়
  পাঁজরের শব্দ:
  ছপ্ ছপ্---
 নির্বাণ চরিতার্থতায় ।

       "লাইনেই ছিলাম বাবা"
     বাতাসে হৃদয়ের  গন্ধ: চন্দনের সুবাস;
    শব্দহীন পাতালছায়ায়।
আগুন দুয়ারে,
দাউ দাউ।

      সর্বগ্রাসী চিতায়--
 পুড়ে যায়-- পুড়ে যায়--
হাড়-মাংস- মজ্জা
 কাব্যগাথা এবং  পুষ্প-পত্র ।

তবু, কত শব্দ লুকিয়ে থাকে জলের নীচে, গভীর হৃদয়- রূপকথায় : 
ধুলোমুঠো ছাই বিন্দু বিন্দু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দিগন্ত থেকে দিগন্তে : মেঘ থেকে আরেক মেঘের গর্ভে।

একদিন বৃষ্টি নামবে।



কোচবিহারের ' পঞ্চশহীদ' ও যমুনাবতীর কবি শঙ্খ ঘোষ  

দিব্যেণ্দু ভৌমিক

দিনটি ছিল ২১ এপ্রিল । ১৯৫১ সাল । গর্জে উঠেছিল বিধান চন্দ্র রায় সরকারের পুলিশের বন্দুক । কোচবিহারের সাগর দীঘির চত্ত্বরে লুটিয়ে পড়েছিল পাঁচটি তাজা প্রাণ ! ওরা খাদ্য আন্দোলনের পঞ্চ শহীদ । পরক্ষণেই গর্জে উঠেছিল কবির কলমও। " যমুনাবতী সরস্বতী , কাল যমুনার বিয়ে,

যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে।
বিষের টোপর নিয়ে।
যমুনাবতী সরস্বতী গেছে এ পথ দিয়ে
দিয়েছে পথ, গিয়ে।
নিভন্ত এই চুল্লীতে বোন আগুন ফলেছে।" -লিখেলেন কবি শঙ্খ ঘোষ । কোচবিহারের খাদ্য আন্দোলনের ' পঞ্চ শহীদ ' কে নিয়ে তার বিখ্যাত কবিতা । ' দিনগুলি রাত ছিল কাব্য গ্রন্থে' ঠাই পায় কবিতাটি । সেই ২১ শেই কবিও গেলেন অনন্ত লোকে ।

        আর সেই সঙ্গে রাজনগর কোচবিহারকে খাদ্য আন্দোলনে শহীদ দিবসে আজ এবার নাড়া দিয়ে গেল কবির প্রয়াণ ।

          খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৫১ সালের ২১ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন কবিতা বসু, বকুল তালুকদার, বন্দনা তালুকদার, বাদল বিশ্বাস, সতীশ দেবনাথ।

         সেবার জেলায় চালের দাম সেসময় প্রায় ৭০ টাকা মন। যা ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাই‍‌রে। কিন্তু চূড়ান্ত নির্বিকার ভূ‍‌মিকা নিয়েছিল সে সময়কার সরকার।অন্যদিকে মানুষের দুয়ারে নিত্য হাহাকার । ১৯৫১ সালের ২১ এপ্রিল । সেদিন কোচবিহারের সাগরদিঘির পাড়ে নারী, ‍‌শিশু, ছাত্রছাত্রীরা একত্রিত হয়েছিল ভুখা মানুষের খাদ্যের দাবি নিয়ে। ওই ঐক্যবদ্ধ মিছিলের উপর তৎকালীন জেলাশাসক এইচ এন রায় এবং পুলিশ সুপার জীবনানন্দ মুখার্জির নেতৃত্বে চলে নির্বিচারে লাঠি ও গুলি। উন্মত্ত পুলিশের বুলেটে শহীদের মৃত্যুবরণ করেন পাঁচজন। গুরুতর জখম হন ৪২ জন। এর প্রতিবাদে সরব হয়েছিল রাজ্য -দেশ । কলম তুলে নিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ । এবার একই দিনে না ফেরার দেশে কবি । একুশ সালের এপ্রিলের একুশ , মিলিয়ে দিল কোচবিহার ও কবি শঙ্খ ঘোষকে । রাজনগর কোচবিহার যুগ্ম ব্যাথায় দীর্ণ হলো ! 




অতিমারী করোনার প্রভাবে আমরা হারালাম প্রিয় প্রবাদ প্রতিম সাহিত্যিক  শঙ্খ ঘোষ কে
বটু কৃষ্ণ হালদার

সাল ২০২০, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি নাগাদ মিডিয়ার দৌলতে সমগ্র বিশ্বে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে যে এক ভয়ঙ্কর অতি মারি বিশ্বের সাজানো বাগান কে তছনছ করে দিতে আসছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম গুলো নড়েচড়ে বসে। শোনা যায় যার মালিক হচ্ছে চীন। যাই হোক, চীনে দেশ থেকে সর্ব প্রথম খবর পাচার কারি অনেক ডাক্তার,সাংবাদিক হটাৎ হারিয়ে যায়।তাদের মধ্যে একজন সাংবাদিকের নাম লি। এর পর পর এই মিডিয়ার দৌলতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মৃত্যু মিছিলের ছবি ভেসে আসতে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বিশ্ব বাসি। ভারতের কিছু কাণ্ডজ্ঞানহীন বহিরাগতদের কারণে ভারত বর্ষ প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে।ফেব্রুয়ারি মার্চ মাস নাগাদ বিশ্বের অন্যান্য তাবড় তাবড় দেশগুলো যখন মৃত্যুর মিছিলে হাঁটছে, ভারতবর্ষের কাছে এই রোগ ছিল তখনও অজানা। সংবাদমাধ্যম গুলোর পাশে এই প্রতিমার ই-কর্নার খবরের কথা শুনেও ভারতবর্ষের বিদ্বান ব্যক্তি রা তোয়াক্কা করেনি।২০২০ মার্চ মাস নাগাদ ভারতবর্ষে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সরকার বাধ্য হয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের লকডাউন ঘোষণা করেন। লকডাউন ঘোষণা করার পর থেকেই শুরু হয় নানান বিপত্তি। অনেকে নিয়ম মেনে যে অনেকে মানেনি। তবে সরকারের তৎপরতায় অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতবর্ষের অবস্থা কিছুটা হলেও ভালো ছিল। এই লকডাউন এর সময় সমাজের নানান চিত্র আমাদের সামনে উঠে এসেছিল। কখনোবা মৃত্যুর মিছিল, লাশের পাহাড়, কখনোবা হাসপাতালের পরিবারবর্গের সামনে প্রিয়জনের মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেছে। কান পাতলেই শোনা যেত প্রিয়জন হারানোর কান্না।করোনা মানবসমাজকে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে গেছে।চেনা পরিবেশ অচেনা হয়ে উঠেছিল, বিপদের সময় বন্ধু কে চিনতে শিখিয়েছিল। দেশের একাংশ মানুষ ভালো ভাবে জীবন যাপন করেছে, অন্যদিকে একাংশ জনগণ দু'মুঠো অন্নের জন্য হাপিত্যেশ হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল। বহু মানুষ হয়েছে কর্মহারা। পরিযায়ী শ্রমিক দের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে উঠেছিল। এই পর্যায়ে শ্রমিকরা লকডাউন এর সময় হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরেছিলেন। রাস্তায় প্রিয়জনের কোলে মাথা রেখে অনেকেই মারা গিয়েছিলেন। এমন করুণ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছিল জনগণ। লাশের মিছিল দেখে মনে হয়েছিল পৃথিবীর বুক মৃত্যু উপত্যকায় ভরে গেছে। করোনার সাথে বুক চিতিয়ে লড়াই করা বহু ডাক্তার,নার্স,স্বাস্থ্যকর্মী,পুলিশকর্মী, সাফাই কর্মী এ পৃথিবীর বুক থেকে নিজেদের দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে করতে নিঃশব্দে ছেড়ে চলে গেছেন।এই পরিস্থিতি থেকে মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বের বৈজ্ঞানিকরা দিনরাত এক করে ভ্যাকসিন তৈরীর কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে করোনার  সঙ্গে লড়াই করে সমাজ অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরতে শুরু করেছিল।দীর্ঘ এক বছর লড়াই করার পর ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই অনেকেই তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। এই করোনা তে মারা গেছেন বহু ব্যক্তিত্ববান ও গুণ সম্পন্ন ব্যক্তিরা। তবুও আমরা বিচলিত হই নি। কঠিন বাস্তবটা মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলে ছিলাম। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে মহাসমুদ্র তে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউতে একই মর্মান্তিক দৃশ্য।ইতিমধ্যেই বহু মানুষ মারাা গেছেন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে ছন্দ পতন ঘটল সাহিত্যয জগতে। আমরা হারালাম বাংলাা সাহিত্য জগতের অভিভাবক ও জনপ্রিয় সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ কে  । আবারো বাংলা হারালেন সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের উজ্জ্বল ধ্রুবতারাা কে।বাংলা সাহিত্য মুকুটহীন হয়ে পড়ল।
রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ পরবর্তী সময়ে বাংলা আধুনিক কবিতার পঞ্চপাণ্ডব ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু এবং শঙ্খ ঘোষ। প্রথম চারজনকেই আমরা আগেই হারিয়েছি। এবারেও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো না বিন্দুমাত্র। কালজয়ী কলম থামিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।উনিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলা সাহিত্য মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,নজরুল ইসলাম,জীবনানন্দ দাশ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর মত বাংলা সাহিত্যের স্রষ্টা কে উত্থান। ধীরে ধীরে সমাজ যতই এগিয়ে চলেছিল লাগাম কিন্তু এই সমস্ত সাহিত্যিকদের সৃষ্টি দিয়ে প্রতিটা স্তর সাজানো ছিল। বাংলা সাহিত্যের এই বাঁধভাঙ্গা সব ভেঙে বেরিয়ে আশাটাই ছিল খুবই দুরূহ ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের মতো সাহিত্যিকদের মতাদর্শকে প্রাধান্য দিয়ে একদল আধুনিক কবি সমাজের ধারা নিয়ম-কানুনকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাহিত্যিক শঙ্খ ঘোষ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার কলম অন্যরকম স্বাক্ষর রেখে গেছেন।তিনি নিজেই একটা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, দলের অন্যায় কে কখনোই প্রশ্রয় দেননি। বরাবরই রাজনৈতিক দলের অন্যায়র বিরুদ্ধে তিনি কলম চালিয়ে গেছেন নির্ভয়ে।দীর্ঘ কর্মজীবনে শঙ্খ ঘোষ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর লেখার মাধ্যমেই তিনি বারবার সতর্ক করেছেন রাজনৈতিক দলগুলোকে। পরিবর্তনের সময়েও অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন তিনি। কিন্তু বারবার চোখে আঙুল দিয়ে ভুলও দেখিয়েছেন। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনমত বার্তাও দিয়েছেন। বছর দুয়েক আগে ‘মাটি’ নামের একটি কবিতায় কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকতা সংশোধন আইনের বিরুদ্ধেও গর্জে উঠেছিল তাঁর কলম। নির্ভীক ভাবে চোখে চোখ রেখে মেরুদন্ড সোজা করে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যায় তুলে ধরেছেন।
অবিভক্ত বাংলার চাঁদপুরে ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্ম  হয় কবির।কবির আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ।পিতা সুশিক্ষক বাংলা ভাষার সম্মানিত বিশেষজ্ঞ মনীন্দ্র কুমার ঘোষ ও মাতা অমলা বালা দেবী।বংশানুক্রমিক ভাবে পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারি পাড়া গ্রামে। তিনি বড় হয়েছেন পাবনায়। পিতার কর্মস্থল হয় তিনি বেশ কয়েক বছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তিনি ছিলেন গুয়াহাটিতে তার লেখায় বেশির ভাগ সময় এসেছে দেশভাগের যন্ত্রণা। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপনাকে। শিয়ালদহের বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের প্রিয় ছিলেন শঙ্খবাবু। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইটার্স ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, শিমলাতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ আডভান্স স্টাডিজ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন।দেশভাগের সময় গর্জে উঠেছিল কবির কলম। তারপর বাংলা যখন ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে তখনও থেমে থাকেনি তা। একটার পর একটা কালজয়ী কবিতা উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। মধ্যবিত্ত বাঙালির মনন তাঁর মতো করে আর কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। সাধারণের নিজেকে নিয়ে দ্বন্দ্ব, আলো-অন্ধকারে ঘেরা জীবন, প্রবঞ্চনা-ভালোবাসার চেনা ছকই অচেনা হয়ে ধরা দিত তাঁর সৃষ্টিতে। এই মুহূর্তে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ জন অভিভাবক হারিয়ে শোকে বিহ্বল। আজ সমাজের শোকের দিন। বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের যুগ অবসান হয়ে গেল। তিনি এক  ধারে ছিলেন গদ্যকার ও প্রাবন্ধিক। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে তার অবাধ বিচরণ হলো কবিতা।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল "দিনগুলি রাতগুলি" প্রকাশিত হয়১৯৫৬ সালে। এরপর একে একে এখন সময় নয়,নিহিত পাতালছায়াশঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতা,মূর্খ বড় সামাজিক নয়,বাবরের প্রার্থনা,মিনিবুক,তুমি তেমন গৌরী নও,আযানের শব্দ,কবিতা সংগ্রহ_১, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, নির্বাচিত প্রেমের কবিতা,সবের উপরে সামিয়ানা, সহ বহু কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন। গদ্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কালের মাত্রা ও রবীন্দ্র নাটক, ছন্দের বারান্দা,উর্বশীর হাসি,শব্দ আর সত্য, জার্নাল,ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম,কবিতা লেখা কবিতা পড়া, ছন্দময় ময় জীবন,সময়ের জলছবি,ইছামতীর মশা: ভ্রমণ,দামিনীর গান সহ একাধিক গদ্যগ্রন্থ লিখেছেন। ছোট কিশোরদের জন্য রেখে গেছে বিশেষ অবদান।তাদের জন্য লিখেছেন বিদ্যাসাগর,সকাল বেলার আলো, সবকিছুতেই খেলনা হয়,সুপারি বনের সারি, আমন ধানের ছড়া,কথা নিয়ে খেলা,সেরা ছড়া, আমন যাবে লাট্টু পাহাড়,ওরে ও বায়না বতি, অল্পবয়স কল্প বয়স, আমায় তুমি লক্ষী বল,ছড়া সংগ্রহ,ইচ্ছে প্রদিপ সহ একাধিক সৃষ্টি। লিখেছেন বক্তিতা/সাক্ষাৎকার ভিত্তিক সংকলন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অন্ধের স্পর্শের মতো, এক বক্তার বৈঠক: শম্ভু মিত্র, কথার পিঠে কথা,জানার বোধ,হওয়ার দুঃখ। অগ্রন্থিত রচনা সংকলন গুলি হল মুখ জোড়া  লাবণ্য,অগ্রন্থিত শঙ্খ ঘোষ।২০১৯ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয় "সন্ধ্যা নদীর জলে: বাংলাদেশ"।সন্ধ্যা নদীর জলে বইটি মূলত বাংলাদেশ প্রসঙ্গে নানা সময়ে লেখা তার স্মৃতিকথা ভ্রমণ পঞ্জি অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ লেখা গুচ্ছের সংকলন।একুশে, একাত্তর ও নববর্ষ, ব্যক্তি,প্রতিষ্ঠান,গানের ভিতর দিয়ে,শিক্ষা আন্দোলন,ও স্মৃতি,ভ্রমণ এই পাঁচটি পর্বে বিভক্ত হয়েছে বইটি। কবিতার পাশাপাশি রবীন্দ্রচর্চা তেও প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ।
তাঁর সাহিত্যজীবনে একাধিক পুরস্কারের সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন।১৯৭৭ সালে"মূর্খ বড় সামাজিক নয়" নরসিংহ দাস পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে "বাবরের প্রার্থনা"র জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার,১৯৮৯ সালে"ধুম লেগেছে হৃদ কমলে"র জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার,"গান্ধর্ব কবিতা গুচ্ছের"জন্য সরস্বতী পুরস্কার,১৯৯৯ সালে "রক্ত কল্যাণ" অনুবাদের জন্য সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতী দ্বারা দেশিকোত্তম পুরস্কার, ২০১১ সালে ভারত সরকারের দ্বারা পদ্মভূষণ পুরস্কার। ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন।
গত প্রায় সাত বছর ধরে তিনি নিরলস সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন।চিরকালীন এক উত্তরাধিকার একজন কবিকে ইতিহাসের চোখে অন্যান্য এবং স্বতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে দেয় অন্ধকারের দিনগুলো আজও খুঁজে নিতে এগিয়ে দেয় নতুন প্রজন্মকে।মিনিট হয়ে যাওয়া অসংখ্য কবিতার লাইন যেমন বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে তেমনি থাকবে তার সামগ্রিক জীবনবোধ।যেখানে ছোট্ট ছোট্ট হীনতা ব্যর্থতা অনায়াসেই অতিক্রম করে কবিতার দশকের পর দশক ডুবে থেকেছেন রবীন্দ্রনাথকে নতুন নতুন আবিষ্কার করে পৌঁছে গিয়েছেন আমাদের দরবারে। তিনি ছিলেন সবার কাছেই শঙ্খ বাবু বা স্যার। তিনি বহু কবি ও কবিতা দেন ভাষা জুগিয়েছিলেন।তিনি না থাকলে সমাজের বিবেক কাকে বলে সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারতাম না।আত্মবিক্রয়ের যুগের শঙ্খ ঘোষ ছিলেন আকাশের মতো সহজ, মহৎ,বিশাল। শঙ্খ ঘোষ একমাত্র কবি ছিলেন যিনি অলৌকিক কবিতার জগতে সঙ্গে বাস্তবের সংযোগ ঘটিয়েছেন।
তিনি সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি ছিলেন সংকটের মহা ঔষধ।দেশের চরম সংকটে অস্থির মনের প্রধান আশ্রয়স্থল তিনি। তিনি বার বার রাজ্যের প্রতি অন্যায় হলে মিছিল ডেকেছিলেন।২০১১ জানুয়ারির ঘটনা। নেতাই গণহত্যা প্রতিবাদে উত্তাল রাজ্য।কলকাতায় তার একমাত্র ভরকেন্দ্র ছিল কলেজ স্ট্রিত প্রেসিডেন্সি কলেজ। টিভি ক্যামেরার সামনে এক কিশোরীর" মা গো-----বলে কান্নার ছবি সবার সামনে মনে গেঁথে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের একদল পড়ুয়া মিছিল করার আগে ক্যাম্পাসে একটি বড় পোস্ট রাখলেন। যেখানে ছিল সেই কিশোরীর অসহায় ও লাঞ্ছনার অবয়ব। আর তার পাশে লেখা কবিতার দুটি লাইন_"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে/আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি বাঁচার আনন্দে"।এর প্রতিবাদে আবার সিপিএম সমর্থক পড়ুয়ারাও একটি প্রস্তাব দিলেন সেখানে আঁকা মাওবাদী গণহত্যার বলি এক কমরেড এর ছবি। সেখানেও কবিতার পংক্তি_"পেটের কাছে উঁচিয়ে আছো চুরি/কাজেই এখন স্বাধীন মত ঘুরি"। প্রতিবাদ ও পাল্টা প্রতিবাদের ভাষায় সেইদিন দুটি পোস্টারে লেখা দিয়ে প্রতিবাদের ভাষায় প্রাণ যুগিয়েছিলেন যে কবি তার নাম শঙ্খ ঘোষ।বাবরি মসজিদ ধ্বংস হোক বা বামফ্রন্ট আমলে বন্দী মুক্তির দাবি,গুজরাট দাঙ্গা থেকে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের মিছিল-মিটিং সমাবেশের আয়োজন তালিকা একেবারে পহেলা নম্বরে তার নাম থাকত।২০১১ সালে সামিল হয়েছেন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোল নে। এই সময় পরিবর্তনের অন্যতম উজ্জ্বল নাম ছিল শঙ্খ ঘোষ। পরিবর্তনের পরেও তার প্রতিবাদ থেমে যায়নি।পাক স্টিট,কামদুনি গণধর্ষণ থেকে ভোটের হিংসার বিরুদ্ধে মিছিলে সামিল হয়েছেন।পরে কালবুর্গি,গৌরী লঙ্কেশ হত্যা এবং এন আর সি,সি এ  বিরুদ্ধে গেরুয়া শিবিরের সমালোচনায় মুখর ছিলেন কবি।২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে দাবিতে শঙ্খ ঘোষের নেতৃত্বে রাজ্যের বৃদ্ধ জনের একাংশ নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের নানা পদক্ষেপ এবং তাদের শাসনকালে বিভিন্ন ঘটনাতেও শঙ্খ ঘোষের প্রতিবাদী কলম সত্তা একইভাবে গর্জে উঠেছিল। বর্তমানে প্রতিবাদীদের প্রশ্ন এবার মিছিল ডাকবে কে? কবি শঙ্খ ঘোষের অকাল প্রয়াণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে যাওয়া কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু তাই নয় বাংলা সাহিত্যজগতে যা অভাবনীয় ক্ষতি হলো তা আর পূরণ হবার নয়। কবি লিখেছিলেন"এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো শব্দহীন হও"। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম স্তম্ভ শঙ্খ ঘোষ মোটেই  আড়ম্বর পছন্দ করতেন না।তাই কোভিদ ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে বিদায় বেলায় কেউ সব দিন রাখার সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য প্রশাসন। তার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য হলেও ছিলনা কোন গান স্যালুট বা তো প ধ্বনি।"শূন্যতায় জানো শুধু? শূন্যের ভিতর এত ঢেউ আছে/সে কথা জানো না"।



স্মৃতি ও স্মরণ 


মুজনাই সুহৃদ কবি বিবেক কবিরাজ গত ৩রা মে, ২০২১ শিলিগুড়িতে কোভিড আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত। তাঁর স্মৃতিতে মুজনাই সম্পাদক শৌভিক রায়ের স্মৃতিচারণ, যা তাঁর নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইলে প্রকাশিত, তুলে দেওয়া হচ্ছে। 





বছর তিন/চারেক আগের ১লা বৈশাখ। লক্ষ্মীদির আমন্ত্রণে তিনবিঘায় আমরা। আমরা বলতে রীনা, সুবীর (কবি সুবীর সরকার), মিঠুদা (শ্রী লক্ষজিত ভদ্র) আর আমি। শিলিগুড়ি, ইসলামপুর থেকে একদল অক্ষরকর্মী হাজির। তাঁদের মধ্যে বিবেকও ছিল।
ওর সঙ্গে ঠিক কবে পরিচয় মনে নেই আর। শুধু এটুকু মনে করতে পারছি যে, মুজনাইয়ের সূত্র ধরেই গতানুগতিক হাই হ্যালো কবে যেন প্রগাঢ় সম্পর্কে পাল্টে গেছিল। না...খুব বেশি কথা হত এমনটি নয়। কিন্তু জানতাম যে, বিবেক আছে, ঠিক নজর রাখছে আমার সবকিছুর ওপর। হয়ত ওর দিক থেকেও এরকম ব্যাপারটা ছিল বা ছিল না।
যাহোক, তিনবিঘায় সেই অনুষ্ঠানে সারাদিন হৈ হৈ। আর একটু পর পর বিবেকের সেই আবদার, 'আমার ছবি কিন্তু তুলে দেবেন।' দিলাম। আমাদের তিনজনের ছবি তুলে দিলেন মিঠুদা।
এর কিছু দিন পর শিলিগুড়ির 'ইচ্ছেবাড়ি'তে আর একবার দেখা। আমাকে দেখা মাত্র আমার কাছে এসে বসল। সেলফি নিল। পরে ফেসবুকে পোস্ট করল দ্বিজস্বীতে অনুপম খের আর আমজাদ খান বা এই জাতীয় কিছু লিখে। বেশ মজা লাগল।
আসলে এত প্রাণবন্ত, হাসিখুশি আর শিশুমনের অধিকারী খুব কম জন হয়। তাই ওকে আপন ভাবতে সময় লাগত না কারও! সঙ্গে ওর প্রবল জীবনীশক্তি ওকে আরও আকর্ষণীয় করেছিল যেন। এক অদ্ভুত উদারতার জন্য সকলেই ওকে ভালবাসত। আজ কতজন যে ওর জন্য কাঁদছে তার হিসেব নেই! মানুষ হিসেবে এখানেই ওর সার্থকতা।
দিন পাঁচেক আগে ওর ২৫ বছর বয়সের পোস্ট করা ছবিতে মন্তব্য করলাম, 'তুমি আমার কাছে সবসময় ২৫ বছরের থাকবে।' সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল' 'হ্যাঁ দাদা'। আবার ওকেই হাউ হাউ করে কাঁদতে শুনলাম ১লা নভেম্বর, যেদিন লক্ষ্মীদি চলে গেলেন। ছয় মাসের ব্যবধানে ও যে আমাদের এভাবে কাঁদাবে কে ভেবেছিল!
মৃত্যু অমোঘ জেনেও অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই যে, এরকম চলে যাওয়া মানা যায় না। তবু মানতে হচ্ছে। আসলে বিবেকের মতো মানুষদের মৃত্যু হয় না। ওরা বুকে থাকে।
কবি, সংগঠক হিসেবে বিবেকের মূল্যায়ন করবে আগামী। আমার মূল্যায়নে বিবেক শুধু কবি বা অক্ষরকর্মী নয়, একজন প্রকৃত মানুষ যাঁর কাছে শেখার ছিল অনেক। ওর আকস্মিক চলে যাওয়ায় ক্ষতি হল বড্ড!
বিবেক বুকেই থাক।
ওকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচি আমৃত্যু....





শিল্পী- পরেশ সাগ্নিক বেরা







নিবন্ধ

পিতা মাতা ও বাৎসল্য  ----
ছবি ধর

   পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও গভীর সম্পর্ক পিতা মাতা আর সন্তানের। অত্যন্ত গর্বের বিষয়, পিতা মাতার কাছে সন্তান মূল্যবান সম্পদ। সন্তানের সুখে পিতামাতা সুখী। সন্তানই দেশের ও সমাজের ভবিষ্যত। 
 সন্তান আর পিতা মাতার প্রাসঙ্গিক ও উপযুক্ত কিছু মতামত --- 
 
আলোকায়ন -- সন্তানকে আলোকিত হতে দিন । 
শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর একটা সময় সন্তানদের নিজস্ব মতামত তৈরী হয়ে যায়। গুরুত্ব পূর্ণ সময় হলো সেটাই। আপনার সন্তান কিন্তু আপনার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। সে এই পৃথিবীর সম্পদ। তার প্রতি জোর করে আপনার ইচ্ছে অনিচ্ছে চাপিয়ে দিতে পারবেন না। এতে সফলতা পাবেন না। 
সব সময় সত্যি বলতে শেখান। উন্নত সংস্কার দিন সন্তানকে। মানবিক হতে দিন। টিফিন পিরিয়ডে ভাগ করে খেতে দিন খাবার। সুযোগ সন্ধানী নয় উপকার করতে শেখান। মনে রাখবেন অন্যের সন্তানও ততোটাই প্রিয় তার পিতা মাতার কাছে।
     আমরা যদি আমাদের সন্তানদের আলোকিত ভবিষ্যতের কথা ভাবি, তবে আলোর পথের যাত্রীদের কথা ভাববো। যেমন বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর  এঁদের অস্তিত্ব ও চিন্তা-চেতনা পৃষ্ঠপোষণ, শীর্ষায়নের কথাও চিন্তায় রাখবো। তারা পরীক্ষিত আলোর দুঃসাহসী অভিযাত্রী। গভীর আঁধারের বুক চিরে তারা আলো হাতে এগিয়ে যায় আত্মস্বার্থ ভুলে। নিজের স্বার্থে, নিজেদের স্বার্থে  সন্তানের পাাশে  থাাকার দায় আমরা কেউ কি এড়াতে পারি? পারি না। ভয়হীন হৃদয়ে বাস করে বীরের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে অন্তরে পুষে রেখে আলোর আসা যাওয়ার পথকে কন্টকহীন করতে হয়। হাজার দিন ভেড়ার মতন বেঁচে থাকার চেয়ে একদিন সিংহের মত তীব্র আলোয় বেঁচে থাকার ভিতরে বাস করে বীরের ইচ্ছা। বিজয়ীদের মুখেও শুনি সেই একই কথার প্রতিধ্বনি। ওদের সাহসী ভূমিকা পালন করতে দিন।

ভিন্ন স্বত্তা ---
তুলনা নয় এক সন্তানের সঙ্গে কখনোই আরেক সন্তানের তুলনা করা যাবে না। কেউ কারো মতো হয়না। প্রতিটি মানুষই আলাদা স্বত্তা নিয়ে আসে ।তার ধ্যান জ্ঞান চিন্তা ভাবনা ও ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় নিজের মতো করে। দুই সন্তানের মধ্যে দুরকম কথা বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবেন না।
শুনতে হবে সন্তানদের কথা।মন দিয়ে শুনতে হবে, তা যতই তুচ্ছ হোক না কেন। 

 সন্তানদের বিরোধ ---  
ছোট থেকে বড় সববয়সী সন্তানের মাঝেই লড়াই বা বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে।
কোনো কারণে দুই সন্তানের মধ্যে মতবিরোধ লড়াই বা খুনসুটি হলে বাবা-মা কখনোই কোনো পক্ষ নেবেন না। সন্তানদের সমস্যা সমাধান করতে শেখান। একজন নালিশ করতেই পারে, এই নালিশকে উত্সাহিত করা উচিৎ নয়। একজনকে পক্ষপাতিত্ব করলে অপর জনের মনে ক্ষোভ আসবে। ক্ষোভ তৈরী হতে দেবেন না ওদের মনে। এর ফলে বিরোধ বাড়বে।

পর্যবেক্ষণ ----
ক্রমাগত উপদেশ দিয়ে যাবেন না। তারা দেখে শিখবে, পর্যবেক্ষণ করে শিখবে।পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে মা বাবা কে বিশেষ ভাবে ভাবতে হবে। প্রত্যেক সন্তানের জন্য পিতা মাতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।তাই কোনো সন্তানের আচরনে পিতা মাতা বিমুখ হলে সন্তানকে নির্যাতন করা হবে।
সন্তান অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে সেক্ষেত্রে।
হঠাৎ করেই রেগে গিয়ে ভুলও করতে পারে। তার ভুল গুলো আলাদা করে বুঝিয়ে ভালবেসে প্রশংসা করে বরং উৎসাহিত করুন । জড়িয়ে ধরুন সন্তান আপ্লুত হবে।
 সন্তানের মধ্যে মতবিরোধ হলে ওদের মনের আবেগ প্রকাশ করতে দিন, ওদের বলতে দিন, ধমক দিয়ে থামিয়ে দেবেন না। তবে কটুবাক্য ব্যবহার করলে শাসন করুন। 

পরিবার তন্ত্র ---

পারিবারিক সম্প্রীতি বজায় রাখুন শিশুদের সামনে পারিবারিক কলহ করবেন না, অপরের সমালোচনা করবেন না। অপরকে সম্মান করতে শেখান। বাবা-মা নিজেদের ভাইবোনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখবেন, যা শিশুদের জন্য দৃষ্টান্ত হবে।
 শিশুকে ছোট ছোট সমস্যা সমাধানের কৌশল, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো সামাজিক দক্ষতা শেখান। সমাজ আছে থাকবে তাই আত্মম্ভরিতা নয় ভব্যতা শেখান। নিজেদের ঝামেলা বন্ধ দরজার ভেতরে মিটিয়ে নিন। অপ্রিয় প্রসঙ্গ নিয়ে বারবার একই কথা বলবেন না।
 প্রত্যেকের সাফল্যকে আলাদাভাবে উদযাপন করতে হবে। প্রশংসা করতে হবে, একজনকে দিয়ে আরেকজনের প্রশংসা করাতে হবে, উপহার দেওয়াতে হবে। 
সন্তানও মা বাবার ভুল গুলো ধরতে পারে সে ক্ষেত্রে এক জন সাপোর্ট করতে পারে তবে সেই জনকে বেশি ভালোবাসতে গিয়ে মা বাবার আর এক সন্তানের প্রতি অবিচার করা উচিৎ নয়। মনে রাখতে হবে যে সন্তান আপনার ভুল গুলো ধরিয়ে দিল সেই সন্তানই আপনাকে বেশি সন্মান করে। পিতা মাতার সঠিক ব্যবহার ও সুস্থ সংস্কৃতি কিন্তু সন্তানের আচরনে প্রকাশ পাবে।আপনার সন্তান উন্নত মানের মনন শক্তির অধিকারী হবে।

‘সিবলিং রাইভালরি’---
  ‘সিবলিং রাইভালরি’র কোনো লক্ষণ কোনো সন্তানের মধ্যে দেখা দিলে বাবা-মাকে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সন্তানদের বিষয়ে দুজনের অভিন্ন মতামত থাকতে হবে। প্রতিটি মানুষ আলাদা। কোনো মানুষই পারফেক্ট নয় ।তার রুচি ,বোধ বুদ্ধি, ধারণা যোগ্যতা সব কিছুই আলাদা তাই মা বাবার উচিৎ দুই সন্তানকে আলাদা ভাবে বুঝতে চেষ্টা করা।
নির্দিষ্ট কয়েক দিন পর পর পারিবারিক সময় নির্ধারণ করে সবাই একসঙ্গে গুণগত সময় (quality time) কাটাতে হবে। একটা সময় একসাথে খেতে পারেন। মুভি দেখতে পারেন। ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব দিতে হবে সন্তানকেও । কাউকে বাদ দিয়ে আনন্দ উৎসব করা চলবে না। আবার পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সবার মতামত নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি দুজনকেই আলাদা করে কিছুটা সময় দিতে হবে, যাতে দুজনেই মনে করে যে তারা বাবা-মাকে বিশেষভাবে পাচ্ছে। ভুলে যাবেন না যোগ্য সন্তান দেশের ভবিষ্যত। ভারতের বাইরেও বহু দেশে একাধিক সন্তানের মাতা পিতা আছেন। তারা তাদের সন্তানদের সুপরিকল্পিত ভাবে পরিচর্যা করছেন ও তারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে সুখে দিন যাপন করছেন। মনে রাখতে হবে সে সব দেশে বৃদ্ধ পিতা মাতার স্থান কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম নয়। 

সুখী দেশ ---
ভারতবর্ষের লোকজন সুখী নয় । World happiness report অনুযায়ী 149 টি সুখী দেশের মধ্যে ভারতের স্থান 139তম। প্রথম স্থান ফিনল্যাণ্ডের তারপরে সুইজারল্যান্ড ,নরওয়ের শেষতম স্থান আফগানিস্তানের। ফিনল্যাণ্ডের প্রায় ত্রিশ শতাংশ মানুষ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না। 
অথচ এই আমাদের দেশে এত ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ আর বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভুরি ভুরি প্রতিষ্ঠান সে দেশেই এমন হাল। ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষের তো অল্পেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। তাদের বস্তুকেন্দ্রিক মনোভাব থাকা উচিত না। যা পেয়েছি তাই যথেষ্ট। আমরা সবাই জানি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষের মনে অসন্তুষ্টি আনে যা তার মনের সুখ কেড়ে নেয়। হিংসা ও পরস্রীকাতরতা জন্ম নেয়। যার ফলাফল ভয়ঙ্কর।

আধ্যাত্মিকতা ---
 সন্তান বড়ো হয়েছে বলে অনেক পিতা মাতা নিজেদেরকে ধার্মিকতার আড়ালে দূরে সরিয়ে রাখেন। আনন্দ অবসরে সন্তানরা পিতা মাতাকেই খোঁজে তখন পিতা মাতার উচিৎ তাদের সাথে থেকে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তান একাকীত্বে ভোগে ও ভুল বন্ধু বান্ধবের মাঝে নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে নিজেকে বদলে ফেলে।
 বন্ধুত্ব পূর্ণ ব্যবহার করবেন তবেই সন্তানও সহজে সামান্য বিষয়ে আপনার মতামত চাইবে। মন খুলে কথা বলবে।
ভারতে আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শের অভাব নেই। কুলগুরু, কুলদেবতা, অমুক বাবাজির শিষ্য তমুক বাবাজির শিষ্যা , নিরামিষ আমিষের বিচার, অষ্টপ্রহর নামগান , নিত্যপূজো , বারোমাস পূজা পার্বন, , প্রার্থনা, দৈনিক আশ্রম কিংবা মন্দিরে পাঠ শোনা, ঘরে ঘরে নিত্যপূজা, বিভিন্ন ধরনের ঈশ্বর ভিত্তিক লোকাচার, হাতে সুখী থাকার জন্য আংটি, বার , ব্রত আরও কত কি। তবুও আত্মহত্যা থেকে যুব সমাজ কে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। যুব সমাজ কে সঠিক গুণগত মানের সংস্কার দিতে হবে। নইলে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়বে। এজন্য কি সন্তানই দায়ী ? গাছ ও জমি যতই ভালো হোক সঠিক পরিচর্যা না পেলে সঠিক ফসল হবে কি ?

 শিক্ষকের ভূমিকা--- 
      পিতা মাতার পর শিশুর দায়িত্ব পালনে আসেন শিক্ষক। শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল তো
সেখানেও অবহেলা।পূজো পাঠ নিয়ে ব্যস্ত আবার স্কুলে ফাঁকিও দিচ্ছে। স্কুলে ছুটির হিসাব কড়ায় গণ্ডায় অসুল করে নিচ্ছে। শরীর সুস্থ মেডিক্যাল লিভ পাওনা আছে, ছাড়ব কেন? নিয়ে চলে আসছে মিথ্যা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট।চেয়ারে বসে ছেলে পড়ানোর বাহানায় ভাতঘুম সেরে বাড়ী ফিরছেন।
একজন প্রকৃত শিক্ষক আজকের সমাজে বিরল। শিক্ষকের সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব কার?
আধ্যাত্মিকতার মতাদর্শ ভারতবর্ষে আজ ভূলুণ্ঠিত।
সচেতনতা ও দায়িত্বের পরিচয় দিয়ে নিজের ও সমাজের ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতি আমাদের আরো অনেক বেশি যত্নশীল হওয়া উচিত।


রম্যরচনা

থার্টি সেভেন কোভিড লেন
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

খামের ওপর ঠিকানাটা দেখেই চমকে উঠলাম। কিড লেন, থিয়েটার রোড,বিধান সরণি  এগুলো সবই  চেনা রাস্তা। চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে গোটা কলকাতা টাই হাতের তালুর মতো চেনা। কিন্তু কোভিড লেন?  কিছুতেই মনে করতে পারছি না।  চাকরির ইন্টারভিউ এর চিঠি  আসলে বাড়িতে একটা খুশির আবহাওয়া লক্ষ্য  করতাম। চোখে কতো স্বপ্ন!  আগের দিন কোলকাতা গিয়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটি র পাশে, কখনও সায়েন্স কলেজ বা আলীপুর চিড়িয়াখানার পাশে গিয়ে  পরীক্ষার সেন্টার দেখে আসতাম, যাতে করে পর দিন সকাল দশটা'র মধ্যে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌছুতে পারি।

যদি জানতাম পরীক্ষার আগেই সব পদ নেতা-মন্ত্রীদের আত্মীয় স্বজন দের  দিয়ে ভর্তি হয়ে যাবে,  তাহলে  এ ভাবে চাকরির পরীক্ষায় বসতাম না। পরে পোস্টম্যান রা দয়াপরবশ হয়ে আমাকে পোস্টম্যানের চাকরি দিয়েছেলো বলেই বেঁচে আছি।

সে যাই হোক,  আমি কোভিড লেনের ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে একটা চা-এর দোকানে গেলাম। যিনি দোকানী এবং যারা চা খেতে এসেছে, তাদের সবারই চুল দাড়ি সাদা কেউই কলপ করেন না সবার ই গলায় মোটা সোনার চেন। চেন-এর লকেট গুলো  ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় ওটা পেন ড্রাইভ কাম অক্সিমিটার কাম সিটিজেনশিপ ডিভাইস।   কিন্তু লক্ষনীয় বিষয় হ'ল কোন লকেটে  ইংরেজি বর্ণমালার C এবং  কোনটাতে D লেখা রয়েছে।
একজন উৎসাহি যুবক এগিয়ে  এসে বলল " ওই নিউটাউনের কোভিড সংঘের পাশের গলিটাই  কোভিড লেন। চলুন আপনাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিই।"
কোভিড সংঘের সাথে যুবকটির যোগাযোগ অাছে বোঝাতে আমাকে প্রায় জোর করেই ক্লাবঘরের মধ্যে নিয়ে গেল। ক্লাবের দেওয়ালে বেশ কয়েকটি ওয়াটস এপ ইউনিভার্সিটির সংশাপত্র টাঙানো রয়েছে। সই এর জায়গায়  MJ... এবং তারিখ  এর জায়গায় ৬/৭/২০২৬। নিজের চোখ কে নিজে বিশ্বাস করতে পারলাম না।
আমার চিঠি র ঠিকানার পাশে  মোটা অক্ষরে A লেখা দেখে যুবকটি উত্তেজিত হয়ে বল্ল,  "নাহ!  আপনার সময় নষ্ট করা যাবে না।  আপনার চিঠি টা একজন ভি, আই পি' র।"
জানলাম এখানে চার প্রকারের নাগরিক। ABCD,  যারা A  তারা ভি আই পি। তাঁদের কোন কাজ করতে হয় না।  তাদের জীবনযাত্রা খুব সুখের।  মনে মনে  বেশ লোভ হ'লো।
 যারা বদমায়েশ  এবং দালাল  গোছের তারা B, ক্যাটাগরিতে পড়েন  সবাই তাদের ভয় পায় এবং সমীহ করে চলে। 
 C ক্যাটাগরিতে তারাই যারা Conventional প্রকৃতির।  এরা সংস্কার মেনে চলেন এবং পরোপকারী। তাদের খেটে  খেতে হয়।
 D মানে Digital. জিজিটাল ক্যাটাগরি। যারা D শ্রেণীর নাগরিক, তারা ডিজিটাল মানুষ।   তারা ভয়ংকর রকমের ব্যাস্ত। নিজের টা বাদ দিয়ে আর কোন বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। সদাই 6G Tab  এর মধ্যে মুখ গুঁজে কি সব করছে।  কখনো আপন মনে হেসে উঠছে, কখনো শেয়ার বাজারের পতন হ'লে হাঊ হাউ করে কেঁদে উঠছে। কেউ বালিগঞ্জের বাসের নম্বর জানতে চাইলে,  বেহালার বাসের নম্বর বলে দিচ্ছে। 

 মিডিয়া বলে কোন বস্তু নেই। খাদ্য সামগ্রী নেই বললেই হয়।সবাই ট্যাবলেট খেয়েই বেঁচে আছে। ডাক্তার বলে কোনো কিছু নেই। সোনার বিনিময়ে পানীয় জল পাওয়া যায়। ওই ট্যাবলেট গলাধকরন করতে যে টুকু প্রয়োজন। 

জলের প্রসঙ্গে পিপাসায় আমার ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম হওয়ায় আমার বন্ধু টি ড্রপারে করে কয়েক ফোটা জল আমার জিভে দেওয়াতে ধিরে ধিরে আমার জ্ঞান ফিরতে শুরু করল। ক্ষীন দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম আমি প্রসুতি সদনের বেডে শুয়ে আছি। একজন মাথায় কলপ করা নকল ডাক্তার আমার নাড়ি টিপে প্রেশার মাপছে, আর রক্তচাপ নিয়ে  না না রকম ভুল তথ্য দিয়ে যাচ্ছে।

ঘাড় ঘোরাতেই উকিল পাড়ার তিস্তা গ্যাস সার্ভিসের  সাউনবোর্ড দেখতে পেলাম, যেখানে  গ্যাস সিলিন্ডারের দাম শুনে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।



গল্প

ফুলেশ্বরী

চিত্রা পাল

বারান্দায় থামটায় ঠেস দিয়ে বসে আছে ফুলেশ্বরী উদাস নয়নে সামনের দিকে চেয়ে।  ভোর হলেই দুয়ারের আগলখানা খুলে এমন করে বাইরেএসে বসে। ওর দৃষ্টি যেন পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়ে কোন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। আজ তিন চারদিন হলো এভাবেই ও চিন্তা ভাবনা করে চলেছে, এখনও কোন কিনারায় আসতে পারেনি। বিষেণের প্রস্তাবটাতেও কোন সম্ভাবনা সূচক ইঙ্গিত দেয়নি। কি বলবে ও, এখনও বিষেণের সঙ্গে সামান্য সাধারণ কথা বলার পর্যায়েইসতেপারছে না। ওরসামনে বাড়ি থেকে কিছু দূরে বেশ বড়সড় এক বাঁশঝাড়। সে বাঁশঝাড়ের কচি আগা বসন্তের মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে। সেদিকে দেখতে দেখতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুই বালক বালিকার ছুটোছুটি। দুজনেই বাসক ফুলের ডগা থেকে মধু খাচ্ছে। মা ভেতর থেকে ডাকে ফুলু ও ফুলু উঠেছিস্‌। মায়ের ডাকে যেন সম্বিৎ্‌ ফিরে পায়। মা বলে ‘যা না মা, গইলে থেকে রাঙিটাকে বের করে বাইরের খুঁটিতে বেঁধে দে না’। ধীরে ধীরে উঠে গোয়ালের বেড়ার  বাঁধন খোলে।  

ফুলেশ্বরী নাম রেখে ছিলো ওর ছোটকাকা। এমন বসন্তদিনেই ওর জন্ম।  যেদিন জন্মেছে সেদিন ওদের বাড়ির চারপাশ ঘিরে এত ফুল ফুটেছে, উছলে ওঠা চাঁদের আলোয় জ্যোৎস্নার ফিনিক ছুটেছে, ফুলের গন্ধে চারদিক ম ম করছে, তার মধ্যেই ওর আগমন এবাড়িতে। ফুটফুটে পরী যেন। পথ ভুলে এখানে এসে পড়েছে।এত ফোটা ফুলের মাঝে ফুলের মতো কন্যে দেখে ওর কাকা নাম রাখলো ফুলেশ্বরী।ফুলেশ্বরী একটু একটু করে শশীকলার মতো সকলের আদরে বড়হতে লাগলো। বসন্তে বসন্তে ও যেন হয়ে উঠলো আরও সুন্দর। ফুলেশ্বরীকে আদর করে কেউ ডাকে ফুল, কেউ ফুলু। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ওর বড় ভাব।তবে সবচেয়ে বেশী ভাব মালতী আর বিষেণের সঙ্গে। কখন থেকে যেন   শুধু বিষেণই হয়ে উঠলো ওর সব খেলার সাথী। ফাগুন চৈত মাসে যখন মাঠ গুলো ঘেঁটু গাছে ছেয়ে যায়, সেই ঘেঁটু ফুলে ও পেয়েছিলো মধুর সন্ধান। কোন আম গাছে আগে গুটি বাঁধে, কোন ঝোপে এই এত্ত বড় বড় পাকা নোনা পাওয়া যায়, মিষ্টি যেন গুড়, সব ওদের নখদর্পণে। আসলে বাইরের অনন্ত প্রসারিত জগৎ্‌ ছিলো ওদের দু'হাতের বৃত্তে। ওরা অনায়াসে দেখেছিলো, কেমন করে টুনটুনি পাখি ঠোঁটে করে পাতা সেলাই করে তাতে নরম শুকনো ঘাস পাতা বিছিয়ে রাখে ওর আগত বাচ্ছার জন্য। ডিম ফুটে বাচ্ছা বড় হয়ে কেমন করে উড়তে শিখে আর একটা ডালে গিয়ে বসে। এসবই ওদের কাছে অভাবনীয় আর অবাক করা। বসন্তে আমের বোল যেমন প্রচুর ঝরে পড়ে গাছের তলায়, তেমন কত স্মৃতি যে ছেয়ে ফেলছে মনের গহনে তার শেষ নেই। তখন সেই আনন্দ-আঘাতে চঞ্চল হয়ে উঠতো প্রাণমন। আজ শুধুই বিষাদবিষেণকে ফুলেশ্বরী বারণ করেছে আসতে, তবু আসে,শুধু একটা আর্জি নিয়ে, আমরা কি আবার শুরু করতে পারি না’? ডাস্টার দিয়ে একেবারে ঝেড়ে মুছে দিয়ে আবার নতুন করে  ব্ল্যাক বোর্ডে  লেখা যায়, হয়তো বা তেমনি বলতে চেয়েছে। সকালের নির্জনতা ওর মনকে এই ভাবনা যেন অধিকার করে নিয়েছে।বিষেণের আবেদন এখন ওকে এক কুহক, এক জটিলতায়  নিয়ে যাচ্ছে। আজ যে ও সেই স্বপ্নযুগের অসম্ভবের কাল  পেরিয়ে দিবালোকের স্পষ্টতায় বসে আছে, এখন বিশেষ করে  ওর এই নিদারুণ অবস্থায় কি উত্তর দিয়ে কোন দিকে যাবে? ফুলেশ্বরী আর বিষেণ যখন পুতুল খেলা থেকে জীবনখেলার সন্ধিক্ষণে সে এক বসন্তের দুপুরে ওদের ঘরে পাশের ছোট্টনদী করলাতে নেমে দুজনে হাতে হাত রেখে নদীকে সাক্ষী মেনে, সে নদীর জলছুঁয়ে কথা দিয়েছিলো ওরা সারা জীবন একসাথে চলবে, এক মনপ্রাণহয়ে। বাতাসে ছিলো ঘেঁটু ফুলের গন্ধ। ওদের বাড়ির সামনের কাঁঠালগাছে দেখেছিলো মুকুলিত ফুল থেকে ফলের আভাস। ওদের প্রাণধারা ছিলো প্রসারিত।  কিন্তু জীবনধারা চললো উলটো পথে।ওরা যে চেনেনি এ সংসারকে। তাই সুন্দর ফুলকে ছিঁড়ে নিয়ে  ওর পরিবার ওকে দিলো ব্যবসায়ী পরিবারকে। আর বিষেণ এ গ্রাম ত্যাগ করে শহরে ব্যকুল মনকে জড়িয়ে নিলো  নিবিড় কাজের মধ্যে। বেশ চলছিলো দুটি পথ দুটি দিকে বেঁকে। কিন্তু না জীবনধারা যে বাঁধা গতে  বয় না। ফুলেশ্বরীও ওই সংসারে জুড়ে গিয়েছিলো। কোল আলো করে এলো ফুটফুটে কন্যাসন্তান। মেয়ের  যখন চার বছর বয়স, সেবার শীতে ওর বর আর তার চারবন্ধু গেল পিকনিক করতে পাহাড়ে। ফিরেও আসছিলো ঠিকঠাক, কিন্তু না কার্শিয়াং এর কাছে চাকা পিছলিয়ে গাড়ি পড়লো খাদে। দুজনেরওখানেই মৃত্যু, তারমধ্যে  একজন ওর বর।একবছর পরে মেয়েও চলে গেলো ওকে ছেড়ে, অনেক ওপর থেকে পড়ে গিয়ে আঘাতের জেরেএর পরে আর আর দ্বিরুক্তি করেনি। সব ছেড়ে চলে এলো এইখানে সেই ছোটবেলার ঘরবাড়িতে। ক্যান্সার ধরা পড়া পরে  বেশি সময় নেয়নি বিষেণের বৌ। লাঙ ক্যানসারে সময়ও বেশি নেয় না।    দুবছরের শিশু পুত্রকে নিয়ে নাজেহাল বিষেণ ওর বাড়িতে এলো বাবা মায়ের কাছে। এসে শোনে ফুলির কথা। এতদিন এতো কথা বাড়ির লোকের সঙ্গে হয়েছে, ফুলির প্রসঙ্গ ওঠেনি। প্রথম দিকে ছিলো অভিমান পরের দিকে নিজের পরিবারের সমস্যা, সব নিয়ে তাতেই নিমজ্জিত ছিলো ও।

ফুলি এখানে আছে শুনেই বিষেণ ছুটে এসেছে ফুলির কাছে। কিন্তু এ কাকে দেখছে ও। এ তো সেই ফুলি নয়, এ যে ওর প্রেত। একজন মানুষের এইভাবে ক্ষয়? বাইরে বসন্তের আগমনে প্রাণময়ী ধরণী। তার আদরের নাম লেখা গাছে পালায় পত্র পুষ্পে। পলাশ শিমুল লালে লাল। মালতী লতার পাতা ঢাকা পড়েছে ফুলের  সাজেআগে দুবার এসেছিলো  বিষেণ।আজ ও একা আসেনি, আবার এসেছে ফুলির কাছে আবেদন নিয়ে সঙ্গে ছেলে। দুরন্ত ছেলে দৌড়ে যেতে বাগানে ইঁটে ঠোক্কর খেয়ে ব্যাথায় জোরে কেঁদে ওঠে। ফুলি তাড়াতাড়ি ওকেকোলে জড়িয়ে ধরে। বিষেণও ছুটে এসেছে ছেলের কাছে। আজ এই উৎফুল্ল বসন্ত মাধুর্য্যে পাখির কলরবে ফুলি বোধ হয়  কিছু খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। বিষেণ প্রত্যাশা ভরা চোখে কিছু পাবার চেষ্টা করে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে। ফুলি কি সত্যিই আবার ফুলের মতো ফুটে উঠবে,তা ও জানে না,কিন্তু  এই আশায় বিষেণ এখন চঞ্চল ।     


                             

শুভক্ষণ

অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

ইন্সটিটিউশনের দরজাটার সামনে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল লাবণ্য। বাইরে থেকেই ছেলেমেয়ে গুলোর কথা, হাসি,  টুকরো টুকরো গানের সুর,  ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে মিনিকে নামালো যত্ন করে। শাড়ি পরে,  ফুলের সাজে সেজে ছটফটে মিনি আজ একেবারে শান্ত হয়ে আছে..  সারা গাড়িতে একবার শুধু প্রশ্ন করেছে, 'আমার লিপস্টিক উঠে যায়নি তো? '....  এখনও ঠোঁট টিপে আছে চুপটি করে..  ওকে দেখে আবারও হাসি পেলো লাবণ্যর। এই সাত সকালে উঠে মায়ের সবকিছু গুছিয়ে ঠিক করে রেখে, গীতাদিকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে,  অপূর্বর সবকিছু হাতের কাছে রেখে,  মিনিকে সাজিয়ে,  নিজে সেজে রওনা দেওয়া.. 
                              অবশ্য এভাবেই দিনগুলো কাটে লাবণ্যর।  হাউজ ওয়াইফ হলেও সংসারের সাথে সাথে বাইরের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজকর্ম গুলোও লাবণ্যকেই সামলাতে হয় প্রায় একা হাতেই। বাড়ির কাজে সাহায্য করবার লোক আছে যেটুকু নিতান্তই প্রয়োজন.. তাছাড়া গত একবছর ধরে গীতাদি আছেন মাকে দেখাশোনা ও একটু সঙ্গ দেওয়ার জন্য..  অপূর্বর সকাল আটটায় বেরিয়ে রাত ন'টা সাড়ে ন'টায় ফেরা। মিনির তো সেই সকাল থেকেই স্কুল দিয়ে দিন শুরু হয়ে সপ্তাহের নানান দিনে নানান কিছু লেগেই রয়েছে। ওকে নিয়ে ছুটোছুটি করেই দিনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় লাবণ্যর। এসবের মাঝেই দুবছর আগে ওর এই ইন্সটিটিউশন.. 'সোনার তরী'..  লাবণ্যর ইচ্ছে,  ভালোবাসা আর অপূর্বর সহযোগিতা.. এর সবটা মিলেই 'সোনার তরী'। এখানে আবৃত্তি শেখায় লাবণ্য। গত দু'বছরে বেশ অনেক কচিকাঁচার ভিড় হয়েছে এখানে। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে এখানে আবৃত্তি ছাড়াও নাচ,  গান,  নাটক সবকিছুই করায় ও। তবে সেগুলোর সবটাই থাকে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে। আজ পঁচিশে বৈশাখ। পাঁচ বছরের ছোট্টো মিনিও আজ মায়ের এখানে নাচতে এসেছে,  মায়ের হাত ধরে..... 
'মা'.... লাবণ্যর বুকটা মুচড়ে ওঠে..  চাপা একটা কান্না গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে যায়..  ও নিজেওতো এভাবেই মায়ের হাত ধরে কতো জায়গায় গেছে অনুষ্ঠান করতে। মায়ের হাত ধরেই তো ওর এই প্রাণের পুরুষের সাথে পরিচয়....  মিনির হাত ধরে 'সোনার তরী'র ভেতরে পা বাড়ায়...  
ছবির রবীন্দ্রনাথ চন্দনে,  ফুলের মালায় সেজে উঠেছেন.. ছোটোরা,  তাদের চাইতে একটু বড়োরা একে একে একক,  সমবেত আবৃত্তি,  গানে,  নাচে শ্রদ্ধা জানালো রবি ঠাকুরের জন্মদিনের দিনটিকে..  শুরুতেই লাবণ্য ওনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ওনার সম্পর্কে ছোটো ছোটো গল্প শোনালো সকলকে।লাবণ্যর ভরাট গলার মনকাড়া আবৃত্তির শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হলো। এবার বাড়ি ফেরার পালা..... 
                              এই দিনগুলোতে লাবণ্য পিছিয়ে যায় আরও অনেকগুলো বছর..  ছবির মতো সবকিছু ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে। ছোটো বেলার একেকটা দিন ওর কাছে হাজির হয় অনেক গল্প নিয়ে..  মায়ের পিঠময় ছড়িয়ে থাকা থাক থাক চুলগুলো,  মায়াবী মুখ আর কাজল কালো চোখের সেই চেয়ে থাকা ওর মনে ছায়া ফেলে বারবার। মায়ের কাছে 'জন্মকথা' শিখবার পর,  ও যখন তখন ছুটে এসে মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে উঠতো,
                               'এলেম আমি কোথা থেকে
            কোনখেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে? '..
একগাল হেসে মা বলতো 'ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে। '
এভাবেই তো কবিতা পড়া,  কবিতা শেখা,  কবিতাকে ভালোবাসতে শেখা। রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসতে শেখা। সেবার যখন ওদের বাড়ির কোণের  কাঁঠালচাঁপা গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গিয়ে গন্ধে মাতোয়ারা করে তুলেছিল,  টুনটুনি পাখিগুলো ভিড় জমিয়েছিল ওখানে,  লাবণ্য দুষ্টুমি করে মাকে বলেছিল, 
'আমি যদি দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি
ভোরের বেলা মাগো ডালের পরে কচিপাতায় করি লুটোপুটি..... 'মা কেমন আকুল হয়ে ওকে আগলে নিয়ে বলেছিল, 'আমায় ছেড়ে কোথাও যাসনা সোনা..  কোথাও না.. '
                               খুব ছোটো বয়স থেকেই লাবণ্য বুঝেছিল ওদের এই সংসারে মায়ের খুব কষ্ট। কেউ এখানে মায়ের সুন্দর মনটাকে একটুও বুঝতে চায়না। মাকে আড়ালে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখতো ও। ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই অনেক লোক আসতো। অনেক খাবার দাবারের গন্ধ ছড়াতো। সেদিন গুলোয় মা খুব সুন্দর করে সাজতো,  কিন্তু মায়ের মুখ কেমন থমথম করতো..  লাবণ্য তখন ভয় পেত মায়ের কাছে যেতে। বাবা খুব মিষ্টি করে কথা বলতো তখন মায়ের সাথে.. অন্য দিনগুলোতে বাবা খুব কমই কথা বলতো..  বাড়িতেও থাকতো কম। চোখে কাজল,  ঠোঁটে রঙ মেখে খাবার দাবার গুলোর ট্রে হাতে করে বিন্তি মাসির বদলে মা- ই সেই দিনগুলোতে বাবার ঘরে ঐ লোকগুলোর কাছে যেত..  খুব হাসাহাসির আওয়াজ আসতো ঐ ঘর থেকে। সেদিন রাতে মা আর ওকে খাইয়ে দিতনা। বিন্তি মাসির কাছে খেয়ে ও ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতো বিছানায়। অনেক্ষণ ধরে লোকগুলোর জড়ানো জড়ানো গলা কানে ভাসতো। অনেক পরে মা এসে ওর পাশটিতে শুতো। ডুকরে ডুকরে কাঁদতো মা। কিন্তু কেনো যেন মাকে ছুঁতে তখন খুব ভয় করতো ওর..  তার পর পর ক'দিন মা কারোর সাথে কথা বলতোনা। মনমরা হয়ে থাকতো কেমন। লাবণ্য তখন শুধু দূর থেকে মাকে দেখে দেখে চলে যেতো। হঠাৎ হঠাৎ করে হাজির হওয়া ঐ পাজি লোকগুলোকে ওর মনে হোতো 'বীরপুরুষ' কবিতার সেই 'হা রে রে রে রে' করে ডাক ছেড়ে তেড়ে আসা ডাকাতগুলো। ও ভাবতো ওর কাছেও যদি একটা তলোয়ার থাকতো,  ঐ দুষ্টু লোকগুলোকে ও টুকরো টুকরো করে ফেলতো। আবার যখন মায়ের মন ভালো হয়ে যেতো,  তখন ওরা একসাথে কবিতা বলতো,  গান করতো,  গল্প করতো,  খেলা করতো। 
                              একটু বড়ো হতেই লাবণ্যকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল বাবা। মায়ের প্রতিবাদ,  আপত্তি,  চোখের জল সবকিছুই বাবার জেদের কাছে পরাজিত হয়েছিল।  আর লাবণ্য?  মাকে নিয়েই তো ওর গোটা পৃথিবী। যাবার আগে মা 'সঞ্চয়িতা',  গীতবিতান',  'গীতাঞ্জলি'....  সাথে রবিঠাকুরের ছোটো গল্পের একটি বই দিয়েছিলেন লাবণ্যকে। বলেছিলেন, 'রবিঠাকুর তোর সাথে থাকবেন এখন থেকে..  দেখবি,  জীবনে কখনো একা হবি না'....  সত্যিই তাই,  রবীন্দ্রনাথ সেই তবে থেকেই তো ওর আপনার জন..  ওর আনন্দ,  দুঃখ,  ব্যথা,  বেদনার সঙ্গী। ছোটো থেকে বড়ো হয়ে উঠবার ধাপগুলোতে ওনার লেখা কবিতা,  গল্প,  উপন্যাস,  গান কেমন অর্থ বদলে বদলে ওর জীবনে ধরা দিয়েছে। মায়ের সাথে একসাথে কবিতা বলার দিনগুলো বড়ো বেশি করে মনে পড়ে লাবণ্যর। হোস্টেল থেকে বাড়িতে এসে গরমের বা পুজোর সময় টানা একমাস থাকতো যখন,  মা ওকে আঁকড়ে থাকতো সবসময়। অলস দুপুর গুলো ওদের কেটে যেতো একসাথে কতো কতো কবিতা বলে.... 
আমাদের ঐ গ্রামের গলি পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন
তাদের ক্ষেতে যখন তিসি ধরে
মোদের ক্ষেতে তখন ফোটে শন। 
তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণ- ধারা, 
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে..... 
                         মোটামুটি উঁচু দিকের ক্লাস গুলোতে পড়াকালীন লাবণ্য বাড়িতে এসে বুঝতো তাদের বাড়ির পরিবেশ এতোটুকুও পাল্টায়নি। মা তখন আগের চাইতে বেশ কিছুটা কঠোর,  প্রতিবাদী। তাই বাবার অত্যাচারও মাত্রা ছাড়িয়েছিল আরও.. ব্যবসা আরও বেড়েছে ততোদিনে..  উচ্চাকাঙ্ক্ষাও..  মক্কেলদের খুশি করবার জন্য মাকে প্রতিদিন মরতে হোতো আত্ম মর্যাদা বোধের কাছে,  বিবেকের কাছে। 
                                    লাবণ্য কলেজে পড়াকালীন হঠাৎ করেই মায়ের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল..  খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল মা। পরিচিত লোকজনকে চিনতে পারছিল না ঠিকঠাক। আবার হঠাৎ কোনো সময় অনেক পুরোনো কোনো কথা অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে উঠছিল। ধীরে ধীরে সকলকে চেনার ক্ষমতাই মা হারিয়ে ফেলছিল। হোস্টেল থেকে বাড়িতে এসে সেই অপরিচিত মাকে দেখে ভয়ানক এক কষ্টে বিবশ হয়ে পড়েছিল লাবণ্য। সকলের আড়ালে মাকে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন সৃষ্টি পড়ে পড়ে শুনিয়েছিল ও..  কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি মায়ের। চোখের জলে মাকে বিদায় জানিয়ে বাবার ঠিক করা রিহ্যাবে পাঠাতে হয়েছিল। সেই সময়েও রবীন্দ্রনাথ ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই অতল সৃষ্টিতে ডুবে থেকে মনকে শক্ত করতে পেরেছিল লাবণ্য.. কিছুটা হলেও.. বিশ্বকবির একের পর এক প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা গভীর ভাবে ওকেও স্পর্শ করেছিল, মাকে সাময়িক না পাওয়ার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছিল। 

            তারপর কেটে গেছে বেশ কতোগুলো বছর। অপূর্ব ওর জীবনে এসেছে স্বর্গের দূত হয়ে..  সে এক অন্য গল্প। বাবা চলে গেছেন বেশ কয়েক বছর হলো। মায়ের সাথে যোগাযোগ সবসময়ই ছিল লাবণ্যর। মা কোনোসময় ওকে চিনতো, কোনোসময় আবার সম্পূর্ণ অপরিচিতের মতো ব্যবহার করতো ওর সাথে। গত বছর রিহ্যাব থেকে ছাড়া পেল মা। তখন থেকে মা লাবণ্যর কাছেই..  এখনও খুব চুপচাপ থাকে,  কাউকেই বিশেষ চিনতে পারেনা। তবে সেসময় যেমন উত্তেজিত হয়ে পড়তো,  সেটা আর নেই। সেই হারিয়ে যাওয়া মাকে খোঁজে লাবণ্য সবসময়... 
                                 কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুলে, গীতাদি লাবণ্যকে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করবার ইঙ্গিত করলো। মিনিকে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকলো লাবণ্য। সেন্টার টেবিলে রবীন্দ্রনাথ চন্দনে,  ফুলের মালায় সেজে উঠেছেন। সামনে সুগন্ধি ধূপকাঠি সুবাস ছড়াচ্ছে। মা নতজানু হয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে এক মনে বলে চলেছেন..... 
'রাত্রি হলো ভোর। 
আজি মোর
জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী, 
প্রভাতের রৌদ্রে লেখা লিপিখানি
হাতে করে আনি
দ্বারে আসি দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ...... 
বিস্ময়ের ঘোর কাটছিল না লাবণ্যর। দু'কান ভরে শুনে যাচ্ছিল সুন্দর উচ্চারণ গুলোকে। ওর সেই চেনা মাকে দু'চোখ ভরে দেখছিল ও। আর প্রাণভরে দেখছিল ওর প্রাণপুরুষকে..  যার জন্মদিনের সুন্দর সকাল ওর হারিয়ে যাওয়া মাকে ফিরিয়ে দিল আবার নতুন করে.. 
মায়ের গাল বেয়ে জলের ধারা..  সব বিস্মৃতির অতলেও রবীন্দ্রনাথ থেকে গেছেন মনের কোন অতলে। মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের সাথে কান্না ভেজা গলায় একসাথে বলে চলল.... 
'আর সে একান্তে আসে
মোর পাশে
পীত উত্তরীয় তলে নিয়ে মোর
প্রাণদেবতার
স্বহস্তে সজ্জিত উপহার _
নীলকান্ত আকাশের থালা, 
তারি'পরে ভুবনের উচ্ছলিত সুধার
পিয়ালা...... 



উত্তরাধিকার

 সৈকত সাহা


"এই শুনছ, আজ একটু দেখবে না।"


"আজ একটু দেখায় যায়, অসুবিধা কি, ও তো নিজে থেকে কিছু চাইছে না" অসীম মনে মনে ভাবল।

" অনেকেই তো মিষ্টি খেতে দিতে চাই, ও এতদিন নিত না, আজ তো নেওয়াই যায়।" 

অভয় মাস্টার কোনদিন রেকর্ড বার করতে পারতো না, যদি পিয়ন অসীম এত সাহায্য না করতো।

ফরম ফিলাপ থেকে জমা দেওয়া পর্যন্ত, এবং বাবু দের দিয়ে সই সাবুদ, সব ও দায়িত্ব নিয়ে করেছে।

রজত বাবু, দীনেশ বাবু ওকে ঠিক পছন্দ করে না, কারণ ও যে কেস গুলো নিয়ে আসে, তাতে একটা টাকাও পাওয়া যায় না। কিন্তু ও গেলে নাও করতে পারে না। কারণ অংকে মাস্টার্স করা অসীম এর শিক্ষাগত যোগ্যতাই শুধু নয়, ওর বাবার  প্রবাদ  প্রতিম সততাও ওদের ভয়ের কারণ। লোকে বলে অমিয় বাবুর মতো সৎ লোক আজ পর্যন্ত কোনো ভূমি দফতরে পাওয়া যাবে না।

কিন্তু আর না, সততা দিয়ে, ছ হাজার টাকার টেম্পোরারি চাকরি দিয়ে কষ্টে পেট হয়তো ভরে, কিন্তু.....

বাবাই বা কি করেছে , এত সততা দিয়ে।

বাবার সাথে যারা কাজ করতেন, তাদের তিন চার তলা বিশাল বাড়ি,  গাড়ি, সবাই তো বেশ সুখে আছে।

আর ওর বাবা, অবসরের দু বছরের মাথায়, ক্যান্সার হয়ে মারা গেলেন। এমন স্টেজ এ ধরা পড়লো চিকিৎসার সুযোগ পর্যন্ত দিলেন না। 

ভাবতে ভাবতে চোখ টা ভিজে গেল অসীমের।


না আর না, আর কোনো দ্বিধা না, বিনিতার সকালের কথাটা ভাবতেই হবে। ওই মেয়েটাই বা কি পেয়েছে ওকে বিয়ে করে। না সুখ, না গয়না, বাবার সময় নিজের মেয়েদের থেকেও বেশি করেছে। ওর কী দোষ? অসীম শিক্ষিত হয়েও কিছু করতে পারেনি, বাবার দয়াতে একটা টেম্পোরারি চাকরি করছে।

একটাই শখ বিনুর, ছেলেটা যেন ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। তাও অসীম পারছে না। 

ধূর আজ ও দেখবেই, আজ ও টাকা নেবেই। নিজে চাইবে না, যা মিষ্টি খেতো দেয়, তাই নেবে।


নিজের মনে যুদ্ধে জিতে, অসীম অফিসে আসে।


সামনেই অভয় মাস্টার দাঁড়িয়ে আছে, ওই ডেকেছিল সকাল সকাল।

অভয় মাস্টারের হাতে রেকর্ডের কাগজটা তুলে দিয়ে, অসীম চেয়ার টেবিল পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়লো, আর আড় চোখে মাস্টারের কাজ কারবার দেখতে লাগলো।

মাস্টারের চোখে জল।

"জানো বাবা, এই রেকর্ডের জন্য এতদিন জমি বেচতে পারিনি, এই অফিস, ওই অফিস, কতদিন। ধার দেনা করে মেয়েটাকে বিদেশ পাঠালাম। টাকার জন্য কী ওর পড়া আটকে থাকতে পারে?"

"আমাকে ওরা বলেছিল, এ কাজ শুধু আমিয়দার ছেলেই করতে পারবে, যেমন বাবা সেরকম ছেলে।"

"না না একি বলছেন স্যার, কোথায় বাবা আর কোথায় আমি"

অভয় মাস্টার পকেট থেকে দুটো 500 টাকার নোট বার করে অসীমের হাতে দিয়ে বললো, "বাবা, এটা দিয়ে নাতিটার জন্য কিছু নিয়ে যেও, আমার নিজেই যাওয়া উচিত ছিল।"

"স্যার, কি বলছেন, আমি আমার বাবার ছেলে স্যার, আপনাদের আশীর্বাদে নাতির কোনোকিছুর অভাব নেই। এটা নিতে বলবেন না।"

সকাল থেকে নিজের মনের সাথে এত যুদ্ধ, সব শেষ। 

পরাজিত সৈনিক অসীম মাথা নিচু করে বাড়ি ফিরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

 জানলা দিয়ে অসীম কে আসতে দেখে বিনিতার বুক থেকে পাথরটা নেমে গেছে। অসীমের মুখ দেখেই ও বুঝে গেছে, আজও ও পারে নি। 

দরজা খুলতেই অসীম বললো, "পারলাম না গো"।

" ভালো হয়েছে, পারোনি। আমাদের কিছু না থাক, ওই গর্বটা তো আছে। আমার, আমার ছেলের কিছু লাগবে না। আমায় তুমি ক্ষমা করো। "

সকাল থেকে এই প্রথম অসীমের মুখে হাসি ফুটলো, বিনিতাকে জড়িয়ে ধরলো। আর ঠিক তক্ষুনি একটা ঠান্ডা হাওয়া ওদের মাথায় যেন আশীর্বাদের মতো হাত বুলিয়ে গেল।






অন্য নববর্ষ 
 অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত 


পয়লা বৈশাখ ,বাংলা সনের প্রথম দিন,তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দিপনার সাথে পালিত হয়।সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন লোকউৎসব হিসাবে বিবেচিত।

এই পুণ্য তিথিতে একসাথে আনন্দে মেতে ওঠাটাই সুছন্দা আর রিয়াজের বহু বছরের অভ্যাস। কিন্তু এই বছরের পয়লা বৈশাখ যেন অন্যই এক বার্তা বয়ে এনেছিল ওদের জীবনে।

সেই এগারো ক্লাসের কোচিং এর দিন থেকে আরম্ভ করে একসাথে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ওঠা আর তারপর একই অফিসে চাকরিতে জয়েন করা যেন মনে হচ্ছিল, এই যেন কয়েক দিনের আগের ঘটনা। 

সুছন্দা ওদের প্রিয় সেই কফি সপে ঢুকেই এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিল।আজ পয়লা বৈশাখ হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা ভীড় ছিলনা। শহরের এই কফি সপে কোনোদিনই খুব একটা ভীড় হয়না, আর আজ তো পয়লা বৈশাখ, একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। সবাই হৈহুল্লোড় করতে শহরের বড় বড় রেস্তোরাঁ তে, প্রিন্সেপ ঘাটে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে, নন্দনে ইত্যাদি জায়গায় ভীড় করে থাকে। 

সুছন্দা অবশ্য চাইছিল একটা নিরিবিলি জায়গা যেখানে ও নিবিড় ভাবে ওর সবচাইতে প্রিয় বন্ধু রিয়াজের সাথে সময় কাটাতে পারবে। ও ঢুকেই দেখল রিয়াজ ওদের পছন্দের টেবিলে বসে কফি সপের বাইরের সুন্দর লেকটার দিকে একপানে চেয়ে বসে আছে। কী জানি কী এত ভাবছে।

প্রত্যেক বারের মত সুছন্দা পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে রিয়াজের চোখটা চেপে ধরল, কিন্তু আগের মত রিয়াজ আজ অন্যদের নাম না নিয়ে সরাসরি সুছন্দার নাম নিতেই, সুছন্দা একটূ অবাক হল। ও বলেই ফেলল, "তুই এরকম করলি কেন? তুই কী ঠিকই করে নিয়েছিস, পুরনো সব অভ্যাস ত্যাগ করবি?" রিয়াজ ঠিক আগের মতই কিছু বলল না, শুধুই মুচকি হাসল। তারপর প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল, "কি রে, সু কি খাবি বল?" দুজনেই হো-হো করে হেসে উঠল। এরপর দুজনে মিলে সুমধুর স্মৃতি গুলোকে রোমন্থন করতে লাগলো। কত না আনন্দ করতো, কত স্বপ্ন বুনতো।

এবার স্বপ্ন ভঙ্গের পালা। রিয়াজ ওর গালে আর কপালে মিষ্টি করে চুমু খাওয়ার পর বলল,"পাগলী, আজকের পর আমাদের আর কোনোদিন দেখা হবেনা। আমরা নিরুপায়, তাই না। তোকে তোর মরণাপন্ন মায়ের শেষ ইচ্ছে রক্ষার্থে  সিদ্ধার্থ কে বিয়ে করতে হবে। তুই এই সিদ্ধান্তে সুখি হবি, এটাই আমি চাই।" 

এই কথাগুলো শোনামাত্রই সুছন্দার মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল, চোখের কোনায় জল চিকচিক করে উঠল। দুজনেই জানত ধ্রুবসত্যটা, কিন্তু রিয়াজের এভাবে আবার মনে করিয়ে দেওয়াটা ওর কষ্টটা যেন দ্বিগুন বাড়িয়ে দিল। ওর চোখের জল বাঁধ মানলনা। ও রিয়াজের হাতটা চেপে ধরল আর ওর চোখ দিয়ে অবিরল জল বয়ে চলল। 

এই নববর্ষে শুধু যে বছরের দিনগুলো পাল্টাচ্ছে তা নয়, সুছন্দা আর রিয়াজের জীবনেও আমুল পরিবর্তন আসতে চলেছে। এক মাসের মধ্যেই সুছন্দার বিয়ে হয়ে যাবে সিদ্ধার্থর সাথে আর রিয়াজ পারি দেবে সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে এক নতুন চাকরিতে, সুছন্দার থেকে অনেক অনেক দূরে।

শেষবারের মত একে অপরকে আলিঙ্গন করে, পয়লা বৈশাখে একে অপরের সাথে দেখা করার চিরাচরিত প্রথাকে আর না এগানোর প্রতিজ্ঞা করে কফি সপ থেকে বেড়িয়ে পড়ল। সজল নয়নে সুছন্দা, রিয়াজের দিকে ফিরে চাইল একবার, তারপর হনহন করে বাড়ির পথে রওনা দিল। দুরে কোথাও গান বাজছিল, "দাও রাঙ্গিয়ে দাও গো এবার যাওয়ার বেলায়।"



কবিতা 


প্রতিশোধ
উত্তম রাজবংশী

এরপরেও বেঁচে আছি কি করে , ভাবছিস ?
 হ্যাঁ , বাঁচিয়েছেন  মৃত্যুর দেবতা অ্যানোভিস ।

পাঁজর খুলে , কলিজা চিবিয়ে 
নিম্নাঙ্গ জ্বেলেছিলি অনেকক্ষণ ,
প্রতিবিধিৎসিতে ভেঙে এসেছি দেখ্  
প্লেস অফ পিউরিফিকেসন ।

রণংদেহী ক্ষিপ্রতায় , পুড়ে মফেটিস এই বেশ 
ঘটাবেই বিস্ফোরণ , হবে  ক্ষমতার অবশেষ ।



বটের ঝুরি
সুবীর

অসংখ্য বটের ঝুরি  পাকিয়ে পাকিয়ে নামে গহেরি মনের ভিতর। ঠিক যেন তপোক্লান্ত ঋষির মস্তকবাহিত পিঙ্গল জটারাশি। বহু জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে খুঁজে অচেতন বনমাঝে স্থবিরতা বা নিরাসক্তি লাভ করেছে। অথবা অনুভুতিহীন  সময় থেকে সময়ান্তর পাড় হয়ে যাওয়া। না হয়তো সব স্থির বিশ্বাস অবিশ্বাস ধুলো বালিকণা রোদবাতাসে জড়িয়ে মড়িয়ে একাকার হয়ে একটি স্থানুবৎ সত্ত্বায় মিশে যাওয়া। 
পাকানো ঝুরি কখনো যেন ধুনকর-বাতাসের বাড়ি খেয়ে মাঝপথে থেমে গিয়ে উল্টো ঘূর্ণিতে পাক খুলতে খুলতে চিন্তাসূত্র ধরে ছড়িয়ে প'ড়ে বিচিত্রিতা ভাবনার আকার পায়, ঠিক নিউরোণের শরীরি গঠনতন্ত্রের মতো অজস্র সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সূত্ররূপ খোলা আকাশের ক্যানভাসে প্রতিরূপ পায়। অথবা তাঁতযন্ত্রের টানাপোরেনে কী অদ্ভূত দৃশ্যাবলির মুগ্ধ অভিনয়। অসম্ভব জোরালো ইম্প্রেশান জমে জমে আরণ্যক বট হয়ে যায়। অরণ্যছোঁয়া বাতাসে বয়ে আসে ভাবনার আশ্বাস। অথবা নিরবয়ব কাহিনিকুল মৃত্যুনদী পাড় হয়ে জন্ম হয়ে ফিরে ফিরে যায় ইথার তররঙ্গ বেয়ে যাপনের সুর তাল ছন্দ রক্তচলাচল ওঠাপড়ার মধ্যে... 
বটের ঝুরি জট পাকায় দিনের নিঃসঙ্গতায় মধ্যরাতের তৃতীয় যামে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে পর্বত সানুদেশে অচেনা নদীর শীত শীত সোতায় স্তব্ধ রক্তবাহের ধারে ... সব অন্ধকারের অতলান্তে বটের ঝুরি নামে .... 




আমাদের কোনো আকাশ ছিল না
সম্পা পাল


তুমি বড়ো বিপন্ন
এই যে আমি কথা বলছি তার কোনো শব্দ পাচ্ছোনা
অথচ উঁচুতে ওঠার সিঁড়ি খুঁজছো দৈনিক

কখনো শব্দের ধাক্কা, কখনো জীবন হারাবার সংশয়
বেঁচে থাকার কী দারুণ মানে ....
তবে ভয় নেই এই সিঁড়িতেই আছে পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া নরকের গেট

অসুস্থ ফ্ল্যাটের নেমপ্লেটে বহুদিন হাত রাখিনি
জানিনা তোমার বাড়িটাও গভীর অসুখ থেকে সেরে উঠেছে কিনা

সৌজন্যবোধটা হয়নি বহুদিন
আসলে আমাদের কোনো আকাশ ছিল না
কিন্তু সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাওয়ার অনেকটা রাস্তা ছিল




শিকড়
পার্থ সারথি চক্রবর্তী 

এক ঝটকায় উপড়ে ফেলেছি শিকড় 
মুড়িয়ে দিয়েছি ডালপালা,
ভুলে যেতে বসেছি সবকিছু যা ছিল-
বৃষ্টির জন্য আকুল 
মাটির গন্ধে ব্যাকুল।
বানিয়েছি পাতার ঘর। পাতা দিয়ে মোড়া।
লিখেছি আত্মবিস্মরণের কাহিনী
পড়া গেলে পাঠ্য, না গেলে জঞ্জাল,
ধুলো ঝেড়ে ফুলদানি সাজাই না-
বরং নতজানু হই প্রিয় ঘুমের কাছে।
পাখিরা যখন ডানা মেলে দিগন্তে
তখন জোৎস্না খুঁজি আঁধার রাতে।


মনখারাপের গল্প 
নবনীতা

কিছু গল্প এমনই হয় 
ঠিক এমনই..
সে গল্প জুড়ে বয়ে চলে বিরহের লোনা এক নদী
তার আশপাশে পড়ে থাকে ধূ ধূ বালি 
কোথাও আর কিছু নেই 
না কিচ্ছু না ...

সে নদীর দিকে তাকালে
বিষাদের গভীর ছায়ায় ডুবে যায় গল্প পাঠকের মন 
মনের আনাচ কানাচে ভেসে ওঠে 
অবসাদের কালো মেঘ ...

সে গল্পে কখনও লেখা হয় না 
ভালো থাকার কথা ,
লেখা হয় না ভালোবাসার কথা ,
কাগজ কলম ছুঁয়ে 
শুধু গুমরে গুমরে বেরিয়ে আসে
একবুক অভিমান আর দীর্ঘশ্বাস ৷

কিছু গল্প এমনই হয় 
ঠিক এমনই...




এই সময় 
দীপ্তিমান মোদক  

এই সময়, কারো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দানা।
কারোর ঘরে উপবাস..... 
রক্তাক্ত মাটি থেকে আঘাত কুড়িয়ে আনা,
সাথে ফেরে বিষাক্ত নিশ্বাস। 

অসহ্যকর সাইরেন বাজিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে রাত
কত প্রিয়জন নিদ্রাহীন। 
কত 'মা' সন্তানের কপালে ছোঁয়াতে পারেনি হাত,
শ্মশানে কাটে বসন্তের দিন।

এখনো তো অনেক পথ বাকি, সহজ নয়
আগামীর পথ,এই লড়াই। 
থেকে যায় প্রতিদিন দুঃস্বপ্নের ভয়
শোকের থেকে বুঝি নিস্তার নাই ?       

এক নতুন ভোরের অপেক্ষায় সবাই চেয়ে
যেখানে থাকবে না ক্ষুধিত দিন। 
পৃথিবী হাসবে আলোর ছোঁয়া পেয়ে, 
মিটে যাবে যাবতীয় ঋণ। 



একতা
রীনা মজুমদার

আমরা সবাই শীর্ণ গাছের নিচে
    দাঁড়িয়ে আছি--
কখনো খড়কুটো জমা করি,
হয়তো বা আছে চাল, নেই চুলো
মৃত্যুর উপর দাঁড়িয়ে মৃত্যু কে দেখছি
হিংসার দাবানলে পুড়ছি বারবার
শরীরের ভিতর শীত জমে আছে,
আমরা সবাই লড়াই করতে ভুলে গেছি
হাতে হাত মেলাতে আমাদের
বড় বাধে, কোথায় যেন একটু লাগে ?
কিন্তু আমরা সন্তানকে বলতে ভুলি না-
"মানুষ হও, বড় মনের হও" 
লোভের আঁধারে ডুবে বড় মন'কে খুঁজছি ।

আমরা মরে যায়নি, শীর্ণ হয়েও
বেঁচে আছি-- আশা নিয়ে
কত বিষ লুকিয়ে, তবুও আমরা 
হাসি মুখে বলি, "শুভ নববর্ষ" 
আমরা শুভ'র মানে বুঝতে চাই না
এই শুভ সত্যের ভিতরে কত রক্তের ইতিহাস গাঁথা হয়ে আছে ;
শুভ কে ধরে রাখতে শিখিনি
শুধু গলা মেলাই, শুভ হোক শুভ হোক
কে করবে সব শুভ ?

ছায়া দীর্ঘতর হয় শেষ বেলায়
কিছু আলো এখনো দরজায়
কড়া নাড়ছে- শুনেও শুনছি না 
দেখো, যেন ফিরে না যায় ! 
আমরাই পারি ভালো কে আনতে
    শুধু চাই একতা...।



বৃষ্টিগান
       মহাজিস মণ্ডল

অবিরাম দেখছি।সপ্তপর্ণা পাতাদের আঁকিবুকি 
দু'চোখের পাতায়।অবিশ্রান্ত যাপনের কথামালায়
কখনও জমেছে মেঘ কখনও বা জোছনা।
রাত্রির গভীরে যে শিকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিধারে গোপনে
আমি তার উদ্ধত ফণা জাপটে ধরে
উজাড় করে ফেলি সমস্ত করাল অন্ধকারের থাবা।
আর রক্তক্ষরণ নয়, অবারিত আকাশের দিগন্তে
এবার ঝরুক মানবতার বৃষ্টিগান...



বড্ড অসহায় 
শিল্পাশ্রী রায়দে 

ভালোবাসি খুব 
তাই ভয় হয় -
আজ কত বছর পর কাছে এলে
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুম পাড়াবে বলে 
চোখ বুজে আসে আদরে
তুমি চুমু খেলে কপাল ছুঁয়ে। 
মায়ের আদরে আফিমের চেয়ে বেশি নেশা থাকে,
বুঝলাম, প্রথমবার-
আমি ঘুমিয়ে যাচ্ছি-
যদিও আমি ঘুমোতে চাই না ।
আমি ঘুমোলে তুমি চলে যাবে জানি--
তোমায় ভালোবাসি খুব, তাই ভয় হয়-আবার যদি হারিয়ে ফেলি-
যেওনা মা,মা ছাড়া, ধরিত্রী মাও যে বড্ড অসহায়--



যদি
মধুমালা বিশ্বাস (নুপুর)

জীবনটা যদি সিলেবাসের মতো 
জানা বিষয়েই আবদ্ধ থাকতো
হতো কোনো মিষ্ট‌ স্বপ্ন ঘেরা ঘুম
বা কবির কবিতা,
কিন্তু নির্মম পরিহাসে জীবন হয়ে গেল
দেশ বিভাজনের কাঁটাতার।
সমুদ্রের শান্ত নীল আভার মতো জীবন
শান্তি খুঁজে বেড়ায় আকাশে-বাতাসে...




                        




শিল্পী- সম্পূর্ণা নন্দী





সাম্প্রতিক 

ছোট্ট রবির সুখ দুঃখ
                  কবিতা বণিক

রবি ঠাকুরের বাড়ির দর্জি নেয়ামৎ খলিফা।
পকেট ছাড়া জামা বানালে রবিকে  দুঃখ দিত তা।
ছোট্ট রবির দুঃখের কথা কেউ বুঝত না।

শ্যাম চাকরের গণ্ডী ছিল বড় কঠিন।
গণ্ডী পেরোলেই বিপদ, রবি ছিলেন  সদা সাবধান।
মনে পড়ত সীতার গণ্ডী। পেরোনোর  পর।
এসেছিল বিপদ হয়ে রাক্ষস রাবণ!

পণ্ডিত মশায়কে ঠাণ্ডা রাখতে, তার  প্রিয় আমসত্ত্ব আর কেয়া খয়ের চুরি করা হতো, ভাগ্নে সত্যর সাহায‌্য নিয়ে।

দীনবন্ধু মিত্রের " জামাই বারিক প্রহসন" 
ছোট্ট রবির সে বই পড়া বারণ।
বই থাকত বাক্সে তালাবন্ধ অবস্হায়।
অগত্যা বই চুরির  ফন্দি, প্রথম অসফল।
পরে পান , দোক্তা সামনে রেখে চুরির কৌশল।
আঁচল থেকে চাবির গোছা হল চুরি, বই পড়া শেষে চাবির গোছা ফেরত।
চুরির কাণ্ড শুনে  হাসাহাসিই ছিল অধিক।

সন্ধ্যেবেলার পড়া ছিল  মকলকস  কোর্স অফ রীডিং।
কালো মোটা বইএর শক্ত ভাষার নির্দয় ফিডিং।
না আছে ছবি বইটায়, না কোন ভাললাগার কারণ।
ছিল মাষ্টারের ধিক্কার আর কঠিন বানানের উচ্চারণ।
ভাল না লাগার জেরেই হত ঢুলু ঢুলু চোখে ঘুমে অচেতন।




আলোচনা 


কাব্যগ্রন্থ- ধ্রুপদী শূন্যতা
কবি- পার্থ সারথি চক্রবর্তী
আলোচক- ফিরোজ হক্
প্রকাশনা- বিরক্তিকর
প্রচ্ছদ- শ্রীহরি দত্ত
মূল্য- ৩৫ টাকা

সম্প্রতি হাতে পেয়েছি কবি পার্থ সারথি চক্রবর্তীর 'ধ্রুপদী শূন্যতা' কাব্যগ্রন্থটি। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থের নামকরণেই রয়েছে বেশ গভীর ও ব্যঞ্জনাময় অর্থ। আসলে বর্তমান সময়, সমাজ ও বেকারত্ব নামক অভিশাপের কবলে পড়ে অধিকাংশ মানুষের জীবনকেই গ্রাস করে একরাশ তিক্ততা ও শূন্যতা। এমন ভাবনাকে আশ্রিত করেই হয়তো কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ করা হয়েছে।

প্রথমেই কাব্যগ্রন্থের বহিরঙ্গের দিকটি আলোচনা করা যাক। শ্রীহরি দত্তের প্রচ্ছদটি কাব্যগ্রন্থটিকে আলাদা মাত্রা দান করেছে তা বলাই যায়।

যে কোনো ব‌ই, পত্রিকা, কাব্যগ্রন্থ বা গল্পগ্রন্থ‌ই হোক না কেন পাতার মান সেই ব‌ইটিকে আলাদা মাত্রায় উন্নীত করে। আলোচ্য ব‌ইটির পাতার মান যথেষ্ট ভালো ও মুদ্রণ বেশ ঝকঝকে যেখানে কাব্যগ্রন্থটি পড়ার সময় পাঠককে হোঁচট খেতে হবে না এ কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি।

এবার ধীরে ধীরে ব‌ইটির অন্দরমহলে প্রবেশ করা যাক। ব‌ইটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবির স্বর্গীয় পিতা সত্যরঞ্জন চক্রবর্তীকে। যেখানে কবি লিখেছেন- তিনি সবসময় কবির পাশেই রয়েছেন। সাথে রয়েছেন। হ্যাঁ, একজন পিতা হোক বা মাতা তাদের হাত সবসময় সন্তানদের মাথায় আশীর্বাদের বৃষ্টি হয়েই ঝড়ে পড়ে। এখানে দাঁড়িয়ে কবির ভাবনায় বিন্দুমাত্রও খুঁদ রয়েছে একথা বলা যাবেনা। 

এবার ফিরে আসি ব‌ইটির মূল স্রোতে। যেই স্রোতে রয়েছে কাব্যগ্রন্থটির গতিময়তা, গতিশীলতা ও কবির চিন্তা, ভাবনা ও সমাজ সম্পর্কে কবির কিছু প্রশ্ন ও বার্তা। কাব্যগ্রন্থটির প্রথম কবিতা 'মুখোশ'। যেখানে কবির পক্ষে প্রকৃত মুখ ও মুখোশ চিনে ওঠা সম্ভব হয়নি।

কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় কবিতা 'ঈশ্বরী'। যেখানে কবি প্রকৃত ঈশ্বরীকেই আরাধনা করতে চেয়েছেন অথচ সেই ঈশ্বরীকেই সমাজ অন্য চোখে দেখে। যিনি সমাজে লাঞ্ছিত ও অবহেলিত। অর্থাৎ এই কবিতায় নারীর বর্তমান অবস্থা ও চিরকালীন প্রশ্ন সমাজের জন্য ছুঁড়ে দিয়েছেন। কবি এই উপেক্ষিত সমাজে থেকে বুঝতে পেরেছেন, নারীদের সফলতার পথ দেখাতে পারে একমাত্র নারীরাই। অথচ সমাজ নারীকে এতরকম প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে যে, অধিকাংশ নারীই লড়াই করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু কবি বুঝেছেন, সমাজ থেকে 'নিম্ন মানসিকতার কলঙ্ক' মুছে ফেলতে হলে এগিয়ে আসতে হবে নারী অর্থাৎ ঈশ্বরীকেই। তাই কবি বলেছেন-
"জানি, তোমার‌ও সীমাবদ্ধতা আছে,
তাই বলে ঈশ্বরী হবার চেষ্টা ছাড়বে না;
নাকি জনমদুখী নারী হয়েই থাকবে!"

কাব্যগ্রন্থের তৃতীয় কবিতা 'আহুতি' -তে কবি বলেছেন, সময় দৈত্যের মতো আগুন নিয়ে ধেয়ে আসছে আমাদের দিকে অথচ আমরা ঘৃণা ও দ্বেষকে অবলম্বন করে নিজেদেরকে চিতায় জ্বালিয়ে তুলছি। কবি এই জায়গায় দাঁড়িয়ে 'ঘৃণা ও দ্বেষ' -কে 'পবিত্র আগুনে আহুতি' দেওয়ার কথা বলেছেন।

কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কবিতায় কবি 'পরকীয়া' নামক অবৈধ প্রেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কলম তুলেছেন। একসময় আমরা ভালোবাসায় জড়ানো বিশ্বাসের বাহু ছেড়ে দিয়ে ভুল তারার ইশারায় নাচি এবং যখন বুঝতে পারি তখন অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। কবির কথায়- 
"এককালের ভালোবাসা জড়ানো বিশ্বাসের বাহু,
ভুল তারার ইশারায় বন্ধনের কানাগলি হয়ে গেলে,
প্রাপ্তির জানালায় উঁকি দেয় অবৈধ পরকীয়া রোদ।"

কাব্যগ্রন্থের পঞ্চম কবিতায় কবি এক মায়াবি অতীত চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। একটি গাছতলার নিচেও যে হাজারো সংসার পাতানো থাকে, পাশাপাশি সেই গাছতলা না থাকলে কতকিছু যে হারিয়ে যায় তা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন 'গাছতলার মায়া' কবিতায়।

'রক্তক্ষরণ' কবিতায় হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যা সর্বসম্মক্ষে গোপন করা সম্ভব হলেও নিজের কাছ থেকে গোপন করা অসম্ভব। তাই কবি লিখেছেন-
"হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হতে থাকে
মুখের কপট হাসির অন্তরালে"





'দ্বিধাবিভক্ত' কবিতায় কবি খুব সুন্দরভাবে সমকালীন রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন যেখানে একটা 'লেভেল ক্রসিং' ভাগ করে দিয়েছে দুটি গ্রামকে। পাশাপাশি কবি ব্যঞ্জনা মিশ্রিত শব্দে বলেছেন-
"এভাবে মানুষের হৃদয়‌ও কেন ভাগ হয়ে যায়!" এই কেন চিরকালীন প্রশ্ন যার উত্তর কেউ দিতে পারেনা।

'আবর্তন' কবিতায় জীবনজুড়ে যন্ত্রণার ছবি তুলে ধরেছেন কবি। 'কবিতার বনবাস' কবিতায় কবিতার সঙ্গে মান-অভিমানের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন কবি। কবিতাকে ঠিক কতটা ভালোবাসেন কবি, তা এই কবিতা থেকেই বোঝা যায়। সবশেষে সকল কবির মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বিস্মিতভাবে কবি বলে ওঠেন-
"দুঃখকেই ভালো না বাসলে কি-
                               কবিতা হয়!"

কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ কবিতায় হয়তো কবির মেজাজের আবহাওয়া ধরা পড়েছে। আলোচ্য কবিতায় প্রশ্নের মিলিয়ে যাওয়া, পরিকল্পনা মাফিক জীবন, আবেগ ভেঙে বিশৃঙ্খলা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার বলিদান দেওয়াকে তুলে ধরেছেন কবি। সবশেষে কবি বলেছেন-
"হাওয়া অফিসের রোজকার বুলেটিনে-
কোন আভাস থাকেনা কোনদিন‌ই‌।" কবির লেখা এই দুটি পঙক্তির সঙ্গে জীবন মিলে যায়। হ্যা, আবহাওয়া দপ্তরের রোজকার বুলেটিনের যেমন কোনো আভাস থাকেনা তেমনি মানুষের রোজকার মেজাজের‌ও কোনো ঠিক থাকেনা।

কিন্তু এতকিছুর পর‌ও কাব্যগ্রন্থটি বেশ কিছু দিক থেকে আর‌ও উন্নত করা যেত বলে আমার মনে হয়। কবিকে আরো সংযমী হতে হতো। এছাড়াও বেশ কিছু কবিতার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণতা কবিতাগুলিকে একটু অপরিণত করেছে অর্থাৎ আবেগে বেশি বলে ফেলেছেন বলে আমার মত। পাশাপাশি কবির অধিকাংশ কবিতায় আশার বন্ধন দেখা যায়নি। কিছুটা হলেও আশা ও মুক্তির পথ দেখাতেই পারতেন কবি।

তবে, বর্তমানের অরাজকর সময়ে দাঁড়িয়ে কবির পক্ষেও হয়তো আশার বৃথা গান গাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কাব্যগ্রন্থের নামকরণ হিসাবে কবিতাগুলি যথার্থ।




কবিতা/ছড়া 

শিক্ষা 
চন্দ্রানী চৌধুরী 

তোমার মতো উদার হবার 
স্বপ্ন জীবনভর 
আগলে রেখো হে আকাশ 
দিও আমায় বর ।
তোমার মতো হিমালয়
হব উচ্চশির
আশা জাগে মনের কোণে 
হতে হবে বীর ।
গাছ মায়ের মতোই হব
সরল মন-প্রাণ 
অন্তরেতে উথলে ওঠে 
জমাট বাঁধা গান ।
চাঁদের মিঠে আলো হব 
কলঙ্ক না ছুঁয়ে 
জীবন গড়ার শিক্ষা দিও 
ভালোবাসা নিয়ে । 


হাসি 
সৌমেন দেবনাথ

প্রাণটা খুলে দুঃখ ভুলে 
হাসতে হবে হাসি, 
প্রাণের আরাম মনের আরাম 
দুটোই বাড়বে বেশি। 

হাসলে কভু হয় না খরচ 
ঝরুক হাসির বৃষ্টি, 
হাসিটা হোক নির্মল হাসি 
হাসিতে সুখ সৃষ্টি। 

হাসিতে হোক বিশ্বটা জয় 
নয় কটাক্ষ হাসি, 
হাসি হোক বন্ধুত্বের চিহ্ন 
হাসি হয় না বাসি। 

হাসিতে দূর কর্ম ক্লান্তি 
গৃহে আসবে সুখ ভোগ, 
হাসির মূল্য যে অমূল্য 
দূর করে রোগ বা শোক।

সোনা রাঙা বৈশাখ 
মজনু মিয়া 

বৃষ্টি বাদল হলে মাটি ভিজে নরম উর্বর হয়
নানান রকম ফসলের বীজ বুনে কৃষক তখন
শুদ্ধ বীজে সঠিক ফসল কৃষক জানে নিশ্চয় 
বৈশাখের লাগিয়া পুষ্টুবীজ পোষে রতন।
ইরি ধানের সোনালি রূপ বাতাস করে খেলা
আঙিনাতে উঠতে ব্যাস্ত কৃষক মুখে সুখছবি
কাজে কর্মে উপযুক্ত সময় ফুরিয়ে যায় বেলা
আবার গৃহ কর্মে ফিরে পূবে যখন উঠে রবি।

সুখে দুখে মিলেমিশে নয়া বছর বৈশাখ সাজায় 
হাজার আনন্দ উল্লাস দিয়ে মনে ধরা বাঁচায়।



বৈশাখ নামা
শাহীন রায়হান


প্যাঁপো প্যাঁপো বেজে যায় বাঁশি
চারদিকে উৎসব আলো রাশিরাশি
হাতপাখা সেজেগুজে হেসে যায় খুব
নাগরদোলা নেই একটুও চুপ।

লাল নীল বেলুনের কিযে মাতামাতি
হেঁটে যায় হনহন পথিকের ছাতি
মুখোশের তোড়জোড় চোখে নেই ঘুম
ইলিশ পানতায় আজ পরে গেছে ধুম।

দমকা হাওয়ার নেই একটুও লাজ
উড়ায় খুকুর চুল আলপনা সাজ
আকাশের দুই ঠোঁটে গুড়গুড় ডাক
তাক ডুম তাক ডুম এলো বৈশাখ।


রাজা বাবু  
বাসেদ সরকার

আমাদের রাজা, দেয় যে থাবা
ভাতের থালে ‌।
দেখেনা কভু, আছে বিড়ালবাবু
টেবিলের তলে ।।
বেস্ত খেতে, রোজার পরে
তাকানোর জো নেই  ।
বিড়াল তবু যে, দেখে রাজাবাবুকে
 ভাতের  আশাতেই ।।


মাটি মহান
নয়ন রায় 

মাটি রে ,
 তুই এত কষ্ট সহ‍্য করিস কী করে ?
ব‍্যথা করে না তোর দেহ ?
মোরা ,ওষুধ তো দেইনা কেউ !
দৈনিক কোটি -কোটি বৃদ্ধি ভার
সহস্র -সহস্র ইঞ্জিনের অত‍্যাচার
তবু যে সহ‍্য করিস বারংবার ;
ব‍্যথা করে না তোর দেহ ?

আর মানুষ ,
একটি পিঁপড়েও যদি কাটে
তৎক্ষণাৎ তাঁর প্রাণহানে !
একটিবারও ভাবেনা সেও বাঁচে প্রাণে !

মাটি তুই বড় মহান।
বাস করিতে জায়গা দিস
খিদে মিটাতে ফসল ;
গর্ভ হইতে জল খাইয়ে 
 বাঁচিয়ে রাখিস জীবন ।
এত দানের প্রতিদানে, মানুষ পাপী 
কষ্ট দেয় প্রতিক্ষণে ; করুণাময়ী তোর প্রাণে !
কৃষকের ফসল ঘাটে
তিরুষ্কারে আঘাত হানে ,
হতভাগি মাটির প্রাণে !
মাটি করুণাময়ী তুই ,শান্তি পাবি তুই ।
যত তোর দান দেখছে ভগবান ,
মাটি তুই বড় মহান !


মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৮