Sunday, March 27, 2022


মুজনাই সাপ্তাহিক
বিশ্ব নাট্য দিবস বিশেষ সংখ্যা
(২৭ মার্চ, ২০২২)




সম্পাদকের কথা
 
নাটক এমন এক মাধ্যম যার আবেদন সর্বযুগে সর্বদেশে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে আমাদের দেশেও এই মাধ্যমটি এত জনপ্রিয় ছিল যে, তার কোনও তুলনা হয় না। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য কীর্তিগুলিও নাটকের মাধ্যমেই সৃষ্টি। মহাকবি কালিদাস বা শেক্সপীয়ার সহ কালজয়ী কবি সাহিত্যিকেরা তাঁদের প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই মাধ্যমটিকে। আজও নাটকের মাধ্যমে খুব সহজেই পৌঁছোনো যায় বৃহত্তর দর্শক শ্রোতার কাছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই ডিজিটাল যুগে নাট্য চর্চা কমে আসছে। ওটিটি নির্ভর বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজিতেশ বন্দোপাধ্যায় বা উৎপল দত্ত প্রমুখের নাম একেবারেই অজানা। পরিকাঠামোর অভাবে মহানগর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলের নাট্য দলগুলির বিপন্ন অবস্থা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দল কোনোমতে চললেও, স্বপ্নগুলি অধরাই থেকে যায়। তবু নাট্যকর্মীরা অনলস কাজ করে চলেছেন। 
মুজনাই সাপ্তাহিক বিশ্ব নাট্য দিবসে পৃথিবীর সকল নাট্যকর্মীকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানায়। খুব ছোট্ট আকারে এই বিশেষ দিনে মুজনাই সাপ্তাহিক 'সংলাপ' সংখ্যাটি প্রকাশ করতে পেরে গর্বিত ও আনন্দিত। 


মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  


মুজনাই সাপ্তাহিক বিশ্ব নাট্য দিবস বিশেষ সংখ্যা 



         

সংলাপ




স্যানিটাইজারের মৃত্যু
কল্যাণময় দাস

চরিত্র
বিপুল, রাজেন্দ্র, রামদুলাল (নেপথ্যে), সান্ত্রি (নেপথ্যে)
সময়ঃ অধিক রাত্রি
স্থানঃ রাজেন্দ্র দোতলা বাড়ির ছাদ

(বিপুল আর রাজেন্দ্র মুখোমুখি বসে আছে। বিপুল রাজেন্দ্রর খাতা দেখতে দেখতে কথা বলে।) 

বিপুল : আপনাকে যদি এখোনিই এনকাউন্টারে মেরে দেই তাহলে কি হয়, বলুন ? 
রাজেন্দ্র : সেটা আপনাদের বিষয়, তবে হ্যাঁ, স্বপক্ষে সওয়াল করলে আমাকে জিগ্যেস করতে হয় যে, আমার দোষ কি ? 
বিপুল : জনতাকে উত্তেজিত করা, দেশের বিরুদ্ধে কন্সপিরেসি ...
রাজেন্দ্র : চ্যাংড়ামো হচ্ছে না কি?
বিপুল : এতো রাতে, আপনার বাড়িতে, আমার বাড়ির বৌ বাচ্চা ছেড়ে, আপনার সাথে তো ছাদের চ্যাংড়ামো করতে এসেছি, তাই না? এই লেখাটা ছাপা যাবে না, আন্ডারস্ট্যান্ড? এই খাতায় যা লেখা আছে তা ছাপার অক্ষরে বই হিসেবে প্রকাশ করা যাবে না, আমি বোঝাতে পারলাম?
রাজেন্দ্র : মানে? আমার লেখা আমি ছাপাতে পারবো না?
বিপুল : সেরকমটাই নির্দেশ
রাজেন্দ্র : নির্দেশ? মানে কার নির্দেশ? কিসের নির্দেশ?
বিপুল : সব জেনেশুনেই তো লিখতে বসেছেন, এখন ন্যাকামো করছেন, অ্যাঁ?
রাজেন্দ্র : দেখুন, আপনার এই বিষয়ে আমার বলার কোন ভাষা নেই। 
বিপুল : (রাজেন্দ্রর খাতাটা আবার নেয়, পাতা ওল্টায়, একটা লেখা পড়তে থাকে) ‘পরদিন সকালে পিন্ডারির বাবা রামভক্ত হরিজনের দেহটা পাওয়া গেল রামমন্দিরের কাছে। তার পরনে একটা ধূতি, আর গায়ে পাঞ্জাবি, পকেটে একটা রুমাল, যার রংটা লাল’। গেল গেল গেল।‘অথচ সবাই দেখলো একজন হিন্দুর শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে আরও কিছু হিন্দুর ভয়ঙ্কর আঘাতে’।
রাজেন্দ্র : ইয়েস!
বিপুল : আই রিপিট, গেল।‘অথচ সবাই দেখলো একজন হিন্দুর শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে আরও কিছু হিন্দুর ভয়ঙ্কর আঘাতে’।
রাজেন্দ্র : ইয়াস!
বিপুল : মানেটা বুঝেছেন আপনি কি লিখেছেন? অতি জঘন্য, অতি নিম্নমানের লেখা।
রাজেন্দ্র : হ্যাঁ হতে পারে, কিন্তু সত্যিই একটা লকের শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছিল অনেকগুলো লোকের ভয়ঙ্কর আঘাতে। এটা নিয়ে আপনাদের এতো মাথাব্যাথা কেনো? 
বিপুল : লেখাটা তো সাধারণ পাবলিক পড়বে, তাই না?
রাজেন্দ্র : হ্যাঁ, পড়বে। মানে পড়তেই পারে, পড়ার জন্যই তো লেখা।
বিপুল : সাহিত্য ফাহিত্য আপনি বোঝেন? বাস্তবে যা হচ্ছে সেটাকে লিখে দিলেই সাহিত্য হয়ে গেলো? হউঃ
রাজেন্দ্র : আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না, হঠাৎ আপনারা আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেনো? ও ও ও, আই সী, আই সী, আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা, মানে আমার লেখাগুলো … এই যেমন ধরুন, ভারভারা রাও, কিম্বা রাহাত ইন্দরির শায়েরি অথবা অথবা সফদার হাসমির নাটকগুলোকে আপনারা টার্গেট করেন! মানে, এগুলোকে আপনাদের ক্রাইম বলে মনে হয়, এছাড়া দেশে আর কোন ক্রাইম নেই!... শুনুন রাজনীতি আশ্রিত অপরাধ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অপরাধ প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে এদেশে ঘটে চলেছে, সেগুলো দেখা কি আপনাদের বিষয় নয়? একটা লেখা ছাপা হবে, সাধারণ মানুষ পড়বে, এটা নিয়ে আপনাদের এতো ইনিশিয়েটিভ, কেনো? একটা মানুষকে হ্যারাজ করতে আপনাদের এতো স্পেস! অথচ, অথচ একটা দেশ দিনদিন অধঃপাতে যাচ্ছে সেদিকে আপনাদের কোন খেয়াল নেই! কী করছেন এসব, এসব কী শুরু হয়েছে? 
রাজেন্দ্র : অ্যাই বোস বোস বোস এখানে। দাদা? দাদা হয়ে উঠছেন? কে, কে দিয়েছে আপনাকে এই সাহস? শালা হাফ-টাউনের বিদ্রোহী নকশাল, … আমার মনটাকে না মানবিকতার বাইরে যেতে বাধ্য করবেন না, প্লিজ।

(দোতলা বাড়ির নিচ তোলা থেকে একটা আর্তনাদ পায় রাজেন্দ্র এবং বিপুল) 

রাজেন্দ্র :  নিচে আমার স্ত্রী আমার ছেলের সঙ্গে আপনার কোলিগরা কি এইরকমই করছে? 
বিপুল : হ্যাঁ, করতে পারে, যদি ওরা আপনাকে সাপোর্ট করে ইন্টার্যা কশন করে তাহলে এতক্ষণ ওদের হয়তো
রাজেন্দ্র : হয়তো? কিন্তু ওরা আমার এই অবস্থা … (রাজেন্দ্র বিপুলের মুখোমুখি হতে যায়)
বিপুল : (হাত নেড়ে বিপুল পিছিয়ে যেতে যেতে রাজেন্দ্রকে দূরে থাকতে ইশারা করে।)
রাজেন্দ্র : (থেমে যায়) আমার এই অবস্থা ওরা জানতে পারলে ওরা ভীষণ কষ্ট পাবে! 
বিপুল : সেজন্যই তো বলছি, যাতে ওরা আর কোনদিনও কষ্ট না পায় (থামে) তারজন্য লেখাটা ছেড়ে দিন। আর এই খাতাটা আমরা পুড়িয়ে ফেলবো।
রাজেন্দ্র : পুড়িয়ে?
বিপুল : হ্যাঁ, আপনার ভালোর জন্য (বুক পকেট থেকে একটা স্যানিটাইজারের স্প্রেগান বের করে) আমাদের মানবিকতাকে আঘাত করবেন না, মিস্টার রাজেন্দ্র দাশগুপ্ত, একটু স্যানিটাইজার নেবেন নাকি? (ওর দিকে স্প্রে করে)
রাজেন্দ্র : (ছিটকে দূরে সরে যায়) 
বিপুল : সোসাইটিকে স্যানিটাইজ করা আমাদের কাজ, আপনার কাজ নয়, আপনি প্রেমের গান লিখুন।
রাজেন্দ্র :  হ্যাঁ, আমি প্রেমের গানই লিখি (টেবল থেকে খাতা নিয়ে দেখাতে যায়)
বিপুল : (খাতা কেড়ে নিয়ে আবার পড়ে) হ্যাঁ, এইতো এখানেই আছে একটা … ‘আমার বাড়ির পাশের বাড়ি, করিম চাচার ঘর / মাঝখানেতে খেলা করে’ 
রাজেন্দ্র : মাঝখানেতে খেলা করে দুজন প্রাণের দোসর / হঠাৎ কেনো উঠলো তুফান, আকাশ কালো করে / আবার আবার দেশে বর্গি এলো, রক্ত অগাধ ঝরে।
বিপুল : (হঠাৎ লাথি মারে রাজেন্দ্রকে) এটা প্রেমের গান? বাঞ্চোৎ! স্যরি স্যরি স্যরি, অফিশিয়াল টার্ম, হ্যাঁ। ডোন্ট মাইন্ড, কিছু মনে করবেন না। (ছাদ থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট রামদুলালকে ডাকে আর রাজেন্দ্রর লেখার খাতাটা নিচে ছুঁড়ে দেয়) রামদুলাল, রামদুলাল, ইসকো পকড়ো, হাঁ, মিস্টার রঘুকো দে দো ইয়ে খাতা, ইয়ে রাজেন্দ্র বাবুকা … 
রামদুলাল :  (নেপথ্যে) দে রাহা হুঁ, স্যার
বিপুল : (মোবাইলে কল আসে) হ্যালো, হাঁ, হাঁ বলিয়ে মিস্টার রঘু, খাতা মিলা? হাঁ ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়। আচ্ছা শোন, নিচের ঘরে ওদের ইন্টারোগেশন শেষ হয়ে গেলে ওদের ছেড়ে দাও। আর হ্যাঁ, শোন, ছাদে ফোর্স আর নার্স পাঠাও। নার্সকে পিপিই কিট পড়িয়ে পাঠাতে ভুলো না।হুঁ। (মোবাইল কাটে, পকেটে রাখে) আমার নাম বিপুল সরকার, বিপুল মানে বিশাল, বিরাট, এই দেশটার মতো বিরাট।
রাজেন্দ্র : এই দেশটায় কি সত্যিই কোন কথা বলার অধিকার আছে? 
বিপুল : এগুলো বলা বা লেখা যাবে না।আর তাছাড়া আপনি নিজেকে কি স্যানিটাইজার ভাবছেন, নাকি এই সরকারটাকে কোভিড-নাইনটিন ভাবছেন? শুনুন, মনে রাখবেন, আপনি, আমি, দেশের কোটি কোটি মানুষ একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের অধিনে।
রাজেন্দ্র : সংখ্যাগরিষ্ঠ? হাঃহাঃহাঃহাঃ … সরকার? হাঃহাঃহাঃহাঃ … মনে রাখবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানেই কিন্তু সব নয়, এই পৃথিবীতে ভাইরাসও কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রতিমুহূর্তে আমাদের আক্রমন করছে তারা, কিন্তু সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাইরাসের বিরুদ্ধে এই মানুষ, এই জীবজগৎ লড়াই করে বেঁচে থাকে, বেঁচে থেকেছে, বেঁচে আছে, এবং বাঁচবে। আমার মতো দু’একজন মারা গেলেও, শেষ অব্দি ভাইরাসের বিরুদ্ধে ইতিহাস সৃষ্টি করে মানুষ। 
বিপুল : তারমানে …
রাজেন্দ্র : তারমানে আমি আমার প্রতিবাদ আমার বিদ্রোহ করবই। হ্যাঁ হ্যাঁ, আর আমাকে সেটা করতে হবে আমার নিজের বাঁচার তাগিদে।এসবকে আমরা ভয় পাই না। 
বিপুল : কিসের প্রতিবাদ? কি কারণে বিদ্রোহ ? মনে রাখবেন, নিজেকে অ্যান্টিভাইরাস ভেবে প্রবল ইন্টেলেকচ্যুয়ালিপনা করতে যাবেন না, দেশে একটা মানবিক সরকার চলছে, চলবেও। পাবলিকের ভালোমন্দ সেই সরকারটাই দেখছে, আপনি বা আপনার মতো ফালতু প্রশ্নতোলা কিছু পাবলিক … আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, আপনাকে এইমুহূর্তে এর ব্যাখ্যা আমি না বললেও চলবে।
সেন্ট্রি : (যেন ছাদে এসেছে) স্যার
বিপুল : আপনাকে যেতে হবে।
রাজেন্দ্র : ওই সংখ্যাগরিষ্ঠ শক্তি দিয়ে, জোর করে?
বিপুল : নাঃ, আইনের হাত ধরে
রাজেন্দ্র : হোয়াট?
বিপুল : (দ্রুত দর্শকের মুখোমুখি দাঁড়ায় ডাউন স্টেজে)রাজেন্দ্রবাবু, মানে আপনাদের বিদ্রোহী বিপ্লবী লেখক কবি রাজেন্দ্র দাশগুপ্ত, আর লিখতে পারছেন না, তিনি করোনায় আক্রান্ত, তাঁকে সরকারি সহায়তায় সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার প্রবল শ্বাসকষ্টের কারণে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। (আর এককদম দর্শকের দিকে এগিয়ে আসে) আপনারা সবসময় মুখ বন্ধ রাখুন, ভীড় এড়িয়ে চলুন, আর মনে রাখবেন রুগির সাথে নয়, আমাদের রোগের সাথে লড়াই করতে হবে। (মোবাইল কল আসে) হ্যালো, ইয়েস স্যার। (মোবাইলে কথা শুনতে শুনতে বেরিয়ে যায়)

(রাজেন্দ্র বিপুলের যাওয়ার দিকে এবং সেন্ট্রির দিকে ভয়ে আতঙ্কে তাকাতে তাকাতে পিছোতে থাকে দর্শকের দিকে। তারপর আচমকা দর্শকের দিকে আতঙ্ক এবং প্রশ্ন নিয়ে তাকায়। আলো নেভে।)
 
(পর্দা নেমে আসে)





লাইন 
শঙ্খনাদ আচার্য

(শ্মশানে সারি-সারি মৃতদেহ পড়ে আছে। পাশাপাশি শায়িত করোনায় মৃত এক প্রখ্যাত অভিনেতা ও দুর্ঘটনায় মৃত এক পরিযায়ী শ্রমিকের দেহ)
 
- জীবনের বেশিরভাগ সময় যে মানুষটা 'স্পটলাইটের' নিচে কাটিয়ে গেল, যার নাম শুনলে অগণিত হৃদয়ে আজও বেপরোয়া ঢেউ ওঠে, যাকে পর্দায় দেখবার জন্য দিনের আলো ফুটতেই টিকিট কাউন্টারে লাইন পড়ে যেত, যে স্বপ্নের নায়ককে একবার দেখবার জন্য হাজার-হাজার মাইল পাড়ি দিয়েও ভক্তকুলের চোখে ক্লান্তি নামতো না, যাকে একবার ছোঁয়ার জন্য বাড়িয়ে থাকা হাতের সার অপেক্ষা করত ঘন্টার পর ঘন্টা - অন্তিমযাত্রায় তাঁকেই কিনা নির্জনপথে জৌলুসহীনভাবে 'একাকী' চলতে হলো! শুধু তাই নয়, শবদাহের পূর্বে তাঁকেই আবার অপরিচিতের ন্যায় দীর্ঘ প্রতীক্ষায় অনাদরে পড়ে থাকতেও হচ্ছে! হায় রে মরণ!......... (সামনে পড়ে থাকা দেহটিকে উদ্দেশ্য করে) আচ্ছা এই যে, শুনছেন! আমায় চিনতে পারছেন?

- আপনার কণ্ঠস্বরটি ভারী চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু আপনার দেহখানি তো কালো প্লাস্টিকে মোড়া তাই ঠিক চিনতে পারছিনা! আপনি কি আমার পূর্ব পরিচিত?

- আমি নিজেকেই ঠিক করে চিনতে পারছিনা, আর আপনাকে! কে আপনি?

- আমি সেই পরিযায়ী শ্রমিকের একজন যারা রেললাইনে বেঘোরে প্রাণ দিয়েছিল! যাদের না-খাওয়া পূর্ণিমার চাঁদের মত রুটিতে লেগেছে তাজা রক্তের দাগ! যেগুলো এখনো হয়তো পড়ে রয়েছে ওই দু-লাইনের মাঝখানে! যারা আর কোনদিনই অক্ষত শরীরে ফিরতে পারবে না তাদের প্রিয়জনদের কাছে! আর আপনি?

- সহস্র লোকের ভিড়েও যাকে এক ঝলকেই লোকে চিনে ফেলে রুপোলি পর্দার সেই বেতাজ বাদশা 'জয়'-কেও কিনা আত্মপরিচয় দিতে হচ্ছে! 'করোনার থাবা' বোধহয় একেই বলে ! বিশ্বাস করুন, শেষ কবে যে নিজের পরিচয় দিয়েছিলাম আজ আর মনে পড়ে না। তবে শেষযাত্রায় নিজের পরিচয় দিতে ভারী অদ্ভুত লাগছে বুঝলেন!

- ও আপনিই তাহলে সেই 'হাউসফুল' নায়ক জয়! জানেন, আপনার সিনেমা দেখবার জন্য কতবার টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে মারামারি করেছি এমনকি পুলিশের লাঠির বাড়িও খেয়েছি, তবুও সিনেমা দেখেই ফিরেছি। আর আপনি কিনা আজ 'লাইনে' আমার পেছনে! একেই বোধহয় অদৃষ্ট বলে! আর অদ্ভুত লাগবার তো কিছুই নেই, কারণ একমাত্র এখানেই এখনো 'সাম্য' শব্দটি অক্ষত আছে। একসময় আপনার অন্ধ ভক্ত ছিলাম। ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম! কিন্তু পরশুদিন থেকে আর কোনো নায়ক-নায়িকাকেই শ্রদ্ধা করিনা।

- কেন ? কেন?

- আমরা যেদিন মারা গেলাম সেদিন বিকেলে আপনাদের মত কিছু স্বনামধন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী ঠাণ্ডা ঘরে বসে সমাজ মাধ্যমে, টিভি চ্যানেলে তাচ্ছিল্যভরা বার্তা দিলেন আমরা নাকি আর 'শোবার জায়গা পাইনি'! আসলে আপনারা কোনদিন আমাদের মানুষ বলেই মনে করেননি! তাই আমাদের মত অতি সাধারন দেশবাসী বাঁচল না মরল তাতে আপনাদের কিচ্ছু যায় আসে না! আমরাই শুধু পাগলের মত আপনাদেরকে দেবতুল্য মনে করে ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখি। সাফল্য পেয়ে আপনারা ভুলেই যান যে আমরা আছি বলেই আপনাদের এত নাম-যশ-খ্যাতি। ওই দু-লাইনের মাঝে পড়ে থেকে এটুকু বুঝতে পেরেছি আপনাদের 'লাইন' আর আমাদের 'লাইন' সম্পূর্ণ ভিন্ন! যা কোনদিন এক ছিল না, হতেও পারবে না!




পলাশ তলায়
শ্রাবণী সেন

দুটি নরনারী, স্বামী স্ত্রী তারা...ব্যক্তিগতভাবে দুজনেরই সামাজিক অবস্থান এবং পশ্চাৎপট অতি আকর্ষণীয়। কোনো একটি পলাশে ছাওয়া গাছের তলায়  নারীটি বসে আছে, একটি পলাশ বনে।

নর - পৃথু মিত্র 
নারী- সোমশুক্লা বসু মিত্র

মিষ্টি সুরে রিনরিন করে শব্দ...  মেসেজ নয়, ফোন কল নয় সোমা অর্থাৎ সোমশুক্লা  অনর্গল কথা বলে চলেছে।

সোমাঃ পৃথু, কতদিন পরে এই পলাশ তলায় এলাম বল, তোমার প্রিয় জায়গা, আমারও।
পৃথুঃ  হুঁ, তা এত জায়গা থাকতে এখানে কেন, সোমা?
সোমাঃ দেখছ না, পলাশে পলাশে লাল হয়ে আছে চারিপাশ!  আমি কলেজে পড়ার সময় তুমি কতবার আনতে  এখানে, মনে আছে?
( পৃথু হাতের ক্যামেরায় পলাশ ডালে বসা পাখির ছবি তুলতে তুলতে এগিয়ে যায়, দূর থেকে)
পৃথুঃ মনে আছে। 
দুটো পলাশফুল এনে সোমার হাতে দেয় পৃথু।
সোমাঃ আগে হলে তুমি বিনুনিতে লাগিয়ে দিতে, তাইনা! এখন পুরোনো হয়ে গেছি, পৃথু। 
পৃথুঃ আজ এখানে আসতে চাইলে কেন সোমা?
সোমাঃ তোমার কাছে ক্ষমা চাইব বলে! 
পৃথুঃ আমি বুঝতে পারছিনা  ঠিক কী বলছ! তুমি ক্ষমা চাইবে কেন?
সোমাঃ আমি তোমার কাছে অপরাধী পৃৃথু, আমি তোমায় অহেতুক সন্দেহ করেছি।  শ্রীজাতা আর ওর বর প্রীতম তোমার ছোটবেলার বন্ধু আমি জানি। তাও তো শ্রীজাতাকে আমি সব সময় সন্দেহ করে এসেছি,  তোমাকেও।
পৃথুঃ আমি তো বলেছি তোমায়,ওরা দুজনেই আমার স্কুল বেলার বন্ধু। পরে আলাদাভাবে পড়াশোনা করলেও তিনজনেই একই  রকম বন্ধুই আছি। তোমায় কত ভালোবাসে ওরা।
সোমাঃ হ্যাঁ, তোমার অসুখের সময় ওরা  আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল পরমাত্মীয়র মতই। প্রীতমদার মত ডাক্তার ছিল বলেই তোমায় এ যাত্রায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছি পৃথু। আর শ্রীজাতা দি বড় দিদির মত আমায় সস্নেহে জড়িয়ে রেখেছিল ওইদিনগুলো। সন্দেহের বশে তোমায় আমি কতদূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি আমায় মাফ কর পৃথু। শ্রীজাতাদির কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি গো।
পৃথুঃ পলাশ ফুল  বিনুনিতে গেঁথে দিই সোমা, আগের মত? আমার দিকে ফেরো তো, চোখ মুছিয়ে দিই।

পরম আস্থায় পৃথুর কাঁধে মাথা রাখে সোমশুক্লা। 




এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

...এই যে শুনুন কিং সাহেব এর ঘাটটা কোন দিকে বলতে পারবেন? 
...হ্যাঁ, চলুন আমি কিং সাহেবের ঘাটেই যাচ্ছি। 
...আপনি কি এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে চাকরি করেন ? 
...না, করি না, কিন্তু এ কথা কেন?  
...আমি এমপ্লয়মেন্ট  এক্সচেঞ্জেই যাব কি না, তাই।
...আচ্ছা, সেখানে কি কাজ? আপনার?  কারো সাথে দেখা করবেন? 
...না আমি আমার ছেলের এক্সচেঞ্জের কার্ডটি রিনিউ করব।
...তা আপনি কেন?  আপনার ছেলে এল না কেন? 
...ছেলে বাড়িতে নেই।  সেই কবে বন্ধুদের সাথে কেরলায় গিয়েছিল।  সেখানেই ইঁট ভাঁটায় কাজ করে। মাসে মাসে টাকা পাঠায়,  ওর টাকাতেই সংসার চলে, আমার ডাক্তার খরচ, অসুখ বিসুখ এর ওষুধ....  আমরা বুড়োবুড়ি বেঁচে আছি।  ১৯৯৭ সালে মাধ্যমিক পাশ করার পর এক্সচেঞ্জে কার্ড করেছিল,  ২০ বছর হয়ে গেল এখনো ছেলেটা কোন চাকরির কল পেল না। তবুও মাঝে মাঝে আশায় বুক বাঁধি হয়তো একদিন ও এক্সচেঞ্জের  থেকে চাকরির কল পাবে। ছেলেটা আমার  বাড়ি ফিরবে। 
...তাও তো  আপনি শান্তিতে আছেন,  আমি দশ লক্ষ টাকা ঘুঁস দিয়ে ছেলেকে  কোলকাতা পুলিশের চাকরিতে ঢুকিয়েছিলাম।  ওর চাকরিতে অনেক পয়সা। মাইনের টাকায় হাত দিতে হয় না।  এই অগাধ টাকা আমাদের পরিবারটাকে ছারখার করে দিল। ছেলেটা আমার মদের নেশায়  অমানুষ হয়ে গেল। হোলির ছুটিতে বাড়িতে এসেছে ঠিক ই,  চব্বিশ ঘন্টাই করলার পাড়ে কিং সাহেবের ঘাটে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে।  ওর খোঁজ নিতেই সেখানে  যাচ্ছি....হ্যাঁ ভালো কথা, ওই সামনের বাঁদিকের বড় বাড়িটাই এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ।




আয়নার ভাঙা টুকরো
সুদীপা দেব


(পাড়ার মোড়ে একটি চায়ের দোকানে বসে আছেন লেখক রমেন দত্ত। পথচলতি সুগত রায় রমেন দত্তর জুনিয়র এবং বন্ধু স্থানীয়। তাঁদের দুজনের কথোপকথন)


―রমেনদা ভালো আছো? কোথাও যাচ্ছ না আসছো?
রমেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয় 
―দুনিয়াটা জালিয়াতে ভরে গেছে বুঝলি। সব শালা চোর! 
―কার ওপর চটলে আবার? বসন্তের পড়ন্ত বেলায় সাথে কেউ নেই!
―রমেন দত্ত এসবের ধার ধারে না বুঝলি! কলমের জোর এখনো আছে! এইটুকু সৎসাহস রাখি।
সুগত চা এগিয়ে দিয়ে বলে 
―এই নাও, আর এক কাপ ধরো। এবার বলতো কি হয়েছে?
―কি আর হবে! গোটা বাংলা একেবারে সাহিত্যিকে ভরে গেছে। 
―ভালোই তো। মায়ের মাটিতে সংস্কৃতি বাড়ছে। উর্বর মাটিতে ফসল তো ফলবেই।  
―ধুস। আগাছায় ভরে গেছে। কার কথা বলবো বল? এখন তো হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া, নীল মুখোবই। কারো মুখটি বাদ নেই। যত্তসব! রাবিশ! ওই রাজদীপকে চিনিস নিশ্চয়ই। এমন ধান্দাবাজ যে কি বলবো তোকে। এখান থেকে এক খাবলা ওখান থেকে এক খাবলা তুলে পর পর বই ছাপাচ্ছে। একটা ফেসবুক পেজ খুলে গুচ্ছের মেয়েদের জন্য ন্যাপকিন ফেলার জায়গা করে দিয়েছে। ওটা ওদের খুব প্রয়োজন বুঝলি। এই মেয়েগুলো রাতে খেলা বাদ দিয়ে পাশ ফিরে এমন সব কবিতা আর গল্প লিখছে, চারলাইন পড়তেই পোয়াতির মতো বমি পায়। এদের না আছে পড়াশোনা না জানে সামান্য বানানটুকু। রাজদীপের মতো সাহিত্যিকের সাথে ইন্টুমিন্টু করে বিভিন্ন সাহিত্য সভা আলোচনা এমনকি বইমেলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
―তোমার লাগছে কেন এত? উৎসাহ দিতে না পার, চেষ্টাকে ছোট করতে পারনা। আমাকে বলছো তুমি ঠিক আছে। প্রকাশ্যে সেসব বলতে যেও না। সাবধান করে দিলাম। তুমি যা ঠোঁট কাটা!
―ওই সাহিত্যিকরা গলায় দড়ি কড়ি গামছার মালা গলায় স্লিভলেসে যখন কবিতা গল্প পাঠ করে খুব অসুস্থ মনে হয় নিজেকে।
―আরে তোমার এই ফ্যাসিবাদী কথার সমর্থন করতে পারছি না। পুরুষ সাহিত্যিকরা সবাই ভালো লেখেন! আঁতেলমার্কার তো অভাব নেই কোন কালে। সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে কত সুবিধা হয়েছে বলো! সবইতো খারাপ না। কিছু ভালো লেখাও থাকে। কত প্রতিভা প্রকাশ পাচ্ছে! বই ছাপানোর ব্যাপারটা আগের মতো ততটা নেই। অনেক বেশী প্রফেশনাল, টাকার ব্যাপার। সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। যুগের সাথে প্রেসেন্টেশনও বদলে যাচ্ছে। তোমাকে তা মানতে হবে। শুধু রাজদীপ কেন, যুগযুগ ধরে ইন্টুমিন্টু শিল্পীর একটা ইউনিভার্সাল ক্যারেক্টারাইস্টিক্স। ভালো করে ভেবে দেখ।
―তুইও তাই বলিস! সেজন্য রমরমা সাহিত্যিকের বাজারে পাঠকের চারগুণ লেখক।
―শোন রমেনদা, এই চুরিচামারী আগেও ছিল। নেহাত সোশ্যাল মিডিয়ার ডানার জোর কম ছিল বলে বেশি দূর খবর উড়তে পারেনি। কলকাতা শহরের বিখ্যাত এক লেখকের নামটা মনে আছে বোধহয় তোমার। একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট রেখেছিলেন। সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ছেলেটি গরীব এবং সাহিত্যপ্রেমী। বিভিন্ন সাহিত্যসংস্থা, সাহিত্যসভায় সাহিত্য-আলোচনাতে হাজিরা দিয়ে সেখান থেকে আইডিয়া টুকে নিত। সেই আইডিয়া ওনাকে দেবার বদলে টাকা পেত। সাহিত্যিকের নাম আর বাজারদর ক্রমশ উজ্জ্বল হয়েছে। মনে নেই!
―ভালো খবর রাখিস তো!
―আমাকে উঠতে হবে এবার রমেনদা। তুমি বসবে? ওই দেখ তোমার ডার্লিং আসছে। আমি চললাম।



নতুন ভোরের স্বপ্ন
ডালিয়া রায় চৌধুরী 

(প্রবাসে থাকা একমাত্র মেয়ের সাথে মায়ের সংলাপ)

মা- হ্যাঁ রে,কতদিন তোর সাথে কথা হয় না,দু দিন ছুটি কি পাবি আমার কাছে আসার জন্য?
 
মেয়ে- না মা,শুধু দুদিনের জন্য যাওয়ার কোন অর্থই নেই,মনটা আরও খারাপ হয়ে যাবে।তাছাড়া জানোই তো ,প্রাইভেট কোম্পানী ছুটি নিলেই স্যালারি কেটে নেবে।

মা- সবই বুঝি,কিন্তু মন মানে না।

মেয়ে- একটু কষ্ট কর মা,আমরা খুব তাড়াতাড়ি এক সাথে থাকবো।

মা- আমি বোধহয় সেই ভাগ্য করে আসিনি ।তোর বাবা চলে যাবার পর থেকে একটাই চিন্তা,আমার কিছু হয়ে গেলে তুই একা হয়ে যাবি যে।

মেয়ে- তোমার কিছুই হবে না দেখো,তোমাকে সবাই ভালোবাসে।তোমার হাসি মুখটা সব কিছুকে জয় করে নেবে।নেগেটিভ তিন্তা একদম নয়।

মা-চিন্তা কি শুধু হয়।এক সময় মনে হয়,তোকে যদি একটা সৎ পাত্রের হাতে সপে দিতে পারতাম।

মেয়ে- (জোরে হাসি )হা..হা.হা,খাসা বলেছো।আচ্ছা মা কোন পাত্রটা সৎ কি করে বুঝবে?আর যদি সপেই দাও তবে সমাজের উপযুক্ত করে গড়ে তুললে কেন?

মা-বুঝতে পেরেছি অনেক বুদ্ধি  হয়ে গিয়েছে আমার মেয়ের।

মেয়ে- আমি খুব স্পষ্ট বাদি মা,কেউ হয়তো আমাকে মানিয়ে নিতে নাও পারে।তোমার মত মানিয়ে চলার শক্তি আমার  নেই মা। 

মা- আমার সাথে তুই নিজেকে গুলিয়ে ফেলিস না।তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন।।

মেয়ে- আমার স্বপ্ন গুলো আমাকেই সার্থক করে তুলতে হবে তো,নাকি?তার সাথে তো তুমিও জড়িত।তুমি তোমার স্বপ্ন গুলো নতুন করে সাজাও,অন্য কাউকে আমাদের মধ্যে জড়িয়ে ফেলো না।দুজন মিলে নতুন একটা আলোর ভোর দেখি,যা আমরা আগে দেখি নি।

মা- নতুন ভোর,ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে!নতুন ভোরের স্বপ্ন তোর জীবনে বয়ে আনুক নতুন আলোর দিশা।আমি সেই অপেক্ষায় রইলাম।

মেয়ে- আমার মত প্রতিটি মেয়ে মাকে নিয়ে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখুক তাই আমি চাই। এগিয়ে চলুক নতুন যুগের ভোরের আলোর পথে......।
মা ,স্বপ্নের ভোর টা খুব কাছেই।বহু দেশ ভ্রমণ করবো এক সাথে,হাতটা শক্ত করে ধরে রেখো,ছেড়ে দিও না বাবার মত....।
(মেয়ের কথা শেষ হতে না হতেই মায়ের চোখ জলে ভরে যায়, রিসিভারটা নামিয়ে রাখেন।)




সেল না শেল!
স্বপন কুমার দত্ত 

স্ত্রী :-  কিগো, শুনতে পাচ্ছো?  খবরের কাগজটা একেবারে মুখস্থ করে ফেললে।
স্বামী:- বলতে থাকো। দুটো কানইতো খোলা আছে। তোমার বাজখাই গলাতেও যখন এখন পর্যন্ত বধির হইনি, তখন যাওয়ার দিন পর্য্যন্ত ঠিক থাকবো। মানে একেবারে হিয়ারিং প্রুভড।
স্ত্রী:-    আমার বাজখাই গলা? একবার বললে তো উত্তর দাওনা । বুঝতে পারিনা, শুনলে না শুনেই ভুলে গেলে! 
স্বামী: (স্বগোতক্তি) সব কিছু শুনে ফরমায়েশ মেনে চলতে গেলে তো পকেট গড়ের মাঠ হতে বেশীদিন লাগবেনা। (প্রকাশ্যে) না না, বলো বলো। হরিণের মতো দুকান খাড়া করে রেখেছি। কী ফরমায়েশ আছে ম্যাডাম?
স্ত্রী:-     ন্যাকামি দেখে মরে যাই। বলি চৈত্রমাস সে খেয়াল আছে? দোকানে দোকানে শুরু হয়েছে সেল। বলি, এখনো তো কোন হেলদোল দেখছিনা । 
স্বামী:-  সাধে কী আর কবি লিখেছিলেন, "তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ"!  বলি, আবার সেলের চক্করে পড়তে চলেছো? ওটা সেল নয়, লক্ষণের শক্তিশেলের থেকেও ভয়ঙ্কর। গতবারের কথা কী ভুলে গেলে?
স্ত্রী :-  ম্যালা ফ্যাচফ্যাচ কোরোনা। একবার ঠকেছি বলে কী বারংবার ঠকবো নাকী? তোমার কিপটেমির জন্য সেলের বাজারে শেষমেশ হাজির হলে তো ওরকম বস্তাপচা মালই নিতে হবে।
স্বামী :- তা তোমাদের মতো  অত বিচক্ষণ কাস্টমারকে যে নাকের জলে চোখের জলে এক করে ছাড়লে। আহারে এক কাচাতেই গামছা। রঙতো আগেই উঠে গেল, মাছ ধরার জালও এর থেকে ছিল ভালো। 
স্ত্রী :-    ছাড়োতো, পাঁচ হাজার টাকা ছাড়ো। সারা বছরের কাপড় চোপড় তুলবো।  নিজেদের ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রেজেন্টেশান দিতে কত লাগে। টেরতো  পাওনা, কত সস্তায় এখন মার্কেটিং হয়ে যাবে।
স্বামী:-  তা আমি টের না পেলে আর কী কেউ আছে নাকী টের পাওয়ার। যত্ত সব! এখন টাকাপয়সা নাই, মাসের শেষ। নাসিকে বড় নোট ছাপানো বন্ধ হয়ে গেছে শুনেছি। আবার যদি ......
স্ত্রী :-  ও এখন মাসের শেষ দেখাচ্ছো। মাসের প্রথমেই কী তুমি হড়পা বান দেখাও নাকী? তাড়াতাড়ি টাকা বার করো। তা না হলে অনর্থ ঘটিয়ে ছাড়বো।
স্বামী:- অর্থই নাই,আর আবার অনর্থ ! কেউ আমার রক্ত কিনবে কিনা খোঁজ নিয়ে জানাও, এবার রক্ত বিক্রী করে টাকার যোগান দেবো।
( ইতিমধ্যে কন্যারত্নটিও এসে হাজির)
কন্যা :- বাবা আমার কিন্তু এবার একটা সুন্দর পালাজো চাই। মার সাথে সেলের বাজারে গিয়ে নিয়ে আসবো।
স্বামী অর্থাৎ কন্যার বাবা স্বগোতক্তি করতে থাকে, ' একা রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর।'
স্বামী/ বাবা:- তা মা, প্যালাজোটা কী জিনিষ? শুনেইতো আমার বাড়ি ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে। না, মা,  এই বয়সে পালিয়ে আর যাবো কোথায়?
স্ত্রী/ মা:- শুন্ ছিস, তোর বাপের কথা। সাতটা না পাঁচটা না, একটাই মেয়ে তুই। তোর সামান্য আবদারটাও কোন দাম দিলনা। আমি সেই কোন সকাল থেকেই ঘ্যান ঘ্যান করছি, মাত্র পাঁচহাজার টাকা চেয়েছি, সেটাই বার করছেনা।
স্বামী :-  তোমার কাছে পাঁচহাজার সামান্য আমার কাছেই সেটা অসামান্য। আমার ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, সেগুলো আনতে হবে।  
স্ত্রী :-  (চোখ মুছতে মুছতে) বছরে একবার মাত্র সাধ আহ্লাদ পূরণ করবার জন্য টাকা চেয়েছিলাম সেটাও পেলামনা। অথচ ভাতকাপড়ের সময় কী সুন্দর বলেছিলে, " তোমার সারা জীবনের জন্য ভাত কাপড়ের দায়িত্ব আজ থেকে নিচ্ছি।" এখন সেসব কোথায় গেল?
স্বামী:-  সে তো অনেক যুগ আগের কথা। কী বলেছি না বলেছি ভুলে গেছি। আর যদি বলেও থাকি, ভাত কাপড়ের বোঝা যে এতো ভারী ,সেটা জানতাম না। জানলে হাঁড়িকাঠে মাথা দিতাম না।
  ( এবার বীর দর্পে ছেলেরও ময়দানে প্রবেশ)            
পুত্র:-  অনেকক্ষণ ধরেই তোমাদের সেলের বাজার করা নিয়ে ক্যাচাল শুনে শুনে আমার কাঁচা ঘুমটা চটকে গেল। মাত্র সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। যাকগে,কখন মার্কেটিং এ যাচ্ছো? মা আমার সাইজ তো তোমার জানাই আছে।একটা ফেড জিন্স আর একটা টি  শার্ট নিয়ে এসো। পয়লা বৈশাখে বন্ধুদের নিয়ে ডুয়ার্স ঘুরতে যাবো।
স্বামী/বাবা:-  তা বাবা তোমার ফেড জিনসের কথা শুনে আমার মুখই ফেড হয়ে গেল তা পাশ করেতো বসে আছো অনেক   দিন। কিছু রোজগারের চেষ্টা করো।
স্ত্রী :-  আমার বাছাধনকে এরকম খোঁটা দিয়ে কথা বললে? ওর কী এখন রোজগারের বয়স?
স্বামী:-   না না, আমার বুড়ো বয়সেই তো রোজগারের কথা। দেখো আমার এখন একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি কিছু  দিতে পারবনা।
স্ত্রী :- তাহলে আমিও আজ কর্মবিরতি ঘোষণা করছি। কোথায় খাবে, কি খাবে  বুঝে নাও।
স্বামী:-   দেখো কী আর করবো? " পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে।"  ওই ওষুধ কেনার জন্য চার হাজার টাকা তোষকের নিচে রাখা আছে। সেলের বাজারে গিয়ে আমার শ্রাদ্ধানূষ্ঠানে পিন্ড দেবার ব্যবস্থা করে এসো।
স্ত্রী :-  ছি: ছি: কী কথার ছিরি! পথে এসো বাছা, ভারীতো চারহাজার টাকা দিচ্ছ। তার জন্য এতো কথা। যাক, আজ ওটা নিয়েই সেলের বাজারে যাবো।




চন্দ্রাবতী ও রাজা
সাগরিকা কর্মকার

চন্দ্রাবতী  :    রাজা,  আপনি কি নিষ্ঠুর! যুদ্ধজয়ের নেশা আপনার রক্তে বইছে,  শুধুমাত্র রাজ্য জয়েৱ  লোভে শত শত প্রাণ অনায়াসে কেড়ে নিচ্ছেন।

 রাজা :   সাধারণ নারী তুমি  শুধুমাত্র কিভাবে বুঝবে যুদ্ধজয়ের উদ্দেশ্য ও  একজন রাজার ক্ষমতা ।

 চন্দ্রাবতী :  ভুল  আপনি রাজা ,  একজন নারীকে অতটাও সাধারণ  ভাববেন না ,  আপনি যে শক্তির আরাধনা করেন, সে একজন নারী ,  এ কথা ভুলে যাবেন না  ।

 রাজা  : হাহাহা !  তোমার কথায়  অবাক হলাম, শুধু সৌন্দর্যতায়  পুরুষকে আকৃষ্ট করা , তার সংসার ও সন্তান নিয়ে থাকাই নারীর ধর্ম । এটা তুমিও ভুলে যেও না ।

চন্দ্রাবতী : আপনাকে প্রণাম ,  আপনার  প্রতিটি কথায়  আজ খুব হাসি আসছে।  আমাকে ক্ষমা  করবেন ।

রাজা  :  হাসি!  ঠিক তোমার ঐ ঠোঁটে  হাসিটা মানায় ,  তবে  এই ভাবনার জন্যে আমি তোমাকে শাস্তি দিতে পারি ।

চন্দ্রাবতী  :  শাস্তি !  আপনার সব শাস্তি আমি মেনে নিতে পারি, এমনকি  মৃত্যুদণ্ডও।  কিন্তু আমার  অপরাধ ?

 রাজা :  রাজার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, যা একজন সাধারণ নারীর কোন অধিকার নেই।

 চন্দ্রাবতী :  আমি আপনাকে ভালোবাসি রাজা,  তাই অন্যায় করতে বারণ করছি , পাপ বাড়াবেন না । 
 রাজা  :  যুদ্ধ কোন অন্যায় নয় ।

 চন্দ্রাবতী:  মায়েদের বুকফাটা আর্তনাদ শুনেছেন কখনো ?   কাছ থেকে দেখেছেন অনাথ শিশুদের মুখ ,  সদ্যবিবাহিতা নারীদের  বৈধব্য যন্ত্রনা অনুভব করেছেন কখনো ? রাজা , একটা যুদ্ধ মানে  সেই দেশের  পশুপাখি,  বনভূমি  সবকিছু ধ্বংস করা।  এই যুদ্ধ বন্ধ করুন রাজা।  সাধারণ প্রজাদের বাঁচতে দিন। 

 রাজা  : ( অবাক চোখে চন্দ্রাবতীর দিকে তাকিয়ে) কি বলতে চাইছো ?

 চন্দ্রাবতী  : আজ আমি আপনার ভালোবাসার প্রিয়তমাটি নই ,  একজন সাধারন প্রজা হয়ে প্রার্থনা রাখছি,  আর রক্তবন্যা নয়,  শুধু শান্তি  চাই।  এই আকাশ- বাতাস শুধু ভালবাসায় ভরে থাকুক,  পাখিদের সুরে ;  ভ্রমরের গুঞ্জনে ; ফুলেদের হাসিতে আর সূর্যের সাত রঙে  লেখা থাক আমার-আপনার একটি প্রেমকথা ।।



মুজনাই সাপ্তাহিক বিশ্ব নাট্য দিবস বিশেষ সংখ্যা 

Saturday, March 19, 2022


 

মুনা সাপ্তাহি 

বিশেষ সংখ্যা 

দোল পূর্ণিমা ২০২২


সম্পাদকের কথা 

উৎসবমুখর আর্যাবর্ত। আসমুদ্রহিমাচল রঙে মাতোয়ারা। রং প্রকৃতিতেও। একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি ভুলে সবার সঙ্গে মেতে ওঠা বসন্ত উদযাপনে। কোনও বিভেদ, কোনও বিতর্ক দূরে থাক এই দুদিন অন্তত। মিশে যাই সকলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে। শুধু যেন ভুলে না যাই, দোল বা রং খেলা বা হোলি যে সম্প্রীতির বার্তা প্রকাশ করে, তা যেন মনেপ্রাণে আমরা বহন করে চলি সবসময়। তবেই এই উৎসব সার্থক। সার্থক আমাদের মনুষ্য-জীবন। 


মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রচ্ছদ- অভ্রদীপ ঘোষ 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,   অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  



ভাবনা 

বসন্তদিন এবং বসন্তদিন
শৌভিক রায়

উত্তরায়ণের এই সূর্যের আলো গায়ে লাগলেই সোনা ঝরে যেন! কিছুদিন আগেও সরষে ফুলের খেতে ছিল হলুদের বন্যা। এখনও যে নেই তা নয়। বরং হলুদের সঙ্গে শিমুলের লাল মিশে সে এক অসামান্য রূপটান! আর ওদিকে দাউদাউ আগুনে-হলুদ পলাশের সখ্যতা মাদারের সঙ্গে। সেই টানেই বোধহয় উড়ে আসে কালো ফিঙে, সাদা বক, গর্বিত টিয়ে। শিমুল, পলাশ, মাদার, চিকরাশিও খুশি সবাইকে কাছে পেয়ে। হাওয়ায় ডাল নাচিয়ে জানান দেয় নিজেদের অস্তিত্ব। ঝরিয়ে ফেলে বাসি ফুল আর পুরোনো পাতা। 

অদূরেই শাল বাগান। ঝরা পাতা  আর গাছের গোড়ায় নরম বিছানা এক। তুলতুলে। পা পড়লেই মচমচ আওয়াজ। নবীন কিশোর হেঁটে যায় আনমনে ঝরা পাতা পথে। চোখে তার স্বপ্ন কত! দেখেও দেখে না যে, আড়চোখে তাকে দেখে গেল কোনও এক মেয়ে। মুখ তার রাঙা, যেন মেখেছে অজানা আবির তারই হাত থেকে।

শস্য উঠে গেছে অনেক খেতেই। বিস্তীর্ণ প্রান্তর ফাঁকা পড়ে আছে নানা জায়গায়। সেই খেতে পাখিদের আনাগোনা আর খুঁটে খুঁটে শস্যদানা খুঁজে ফেরা অব্যাহত। কিচিরমিচির ঝগড়া আর তারপর দল বেঁধে এ খেত থেকে ও খেত উড়ে যাওয়া, পড়ন্ত রোদ ডানায় মেখে। মাঝে মাঝে জলে ঝাঁপ, রোদে বসে পাখা ঝাপটানো আর গা শুকিয়ে নেওয়া।

গাছগুলো বড্ড ন্যাড়া। শুকনো ডালপালা ছড়িয়ে আকাশকে ধরবার আপ্রাণ চেষ্টায় শূন্যে আরও উঠে গেছে। কিছু গাছ নিদারুণ অভিমানে শুকিয়ে গেছে নিজেদের মতো। কিছু গাছে সবুজের আভা। আসছে কচি পাতা। ঋতুটাই এমন...যা যায়, তা যায়। যা থাকে তা আবার নতুন ক'রে আসে ফিরে ফিরে। উন্মেষ তাই আবারও, নব কিশলয়ে।


শীত চলে গেলেও কিন্তু শীত রয়ে গেছে আমাদের মনে।  প্রকৃতি বসন্ত নিয়ে এলেও, জীবনের বসন্ত আজ আর আসে না। আসে না সেই প্রাণের বসন্ত যেখানে জীবনের গানে ধ্বনিত হয় প্রেমের কথা, ভালবাসার কথা। 

আমরা সত্যিই কি ভালবাসতে ভুলে গেলাম এই বসন্ত সমীর দিনে? রাজপথে শ্লোগান তুলি তাই বোধহয় মেরে ফেলো একে তাকে। অভুক্ত জনতার মৌনমিছিল দেখে তাই হয়তো ছড় টানি বেহালার। দাউদাউ জ্বলতে থাকা নগরী নিয়ে খেলি রক্তের হোলি।

বসন্ত দিন এমন নয়। মধুক্ষরা পৃথিবীর এই মধুমাসে রঙ শুধু চারদিকেই নয়, রং তো নেমে আসে সমাজজীবনে। যূথবদ্ধতায় বাঁচি বলেই এতদিন রাঙিয়েছি সবাইকে। তবু কেন জানি ভাটা পড়েছে আজ সেই উৎসবে। বিষন্নতায় উদযাপন হয় না, পালন হতে পারে হয়ত। রঙিন সেসব দিন মুছে গিয়ে আজ বসন্তদিন বড় দুঃসহ। তবু রঙ উড়বে, উড়বে ফাগ। কিন্তু তা যদি মনের অলিন্দকে রঙিন না করে, না জাগিয়ে তোলে বর্ণময় জীবনসত্বা, তবে কি লাভ এই বসন্তে? বসন্ত মানেই তো প্রাণের কথা, জীবনের দুর্বার সংগীত। সে তো বলে শুধু মিলনের কথা। এ কোন বসন্ত আজ! 

উত্তর খুঁজি বারবার তাই...




আওল ঋতুপতি রাজ বসন্ত্
সুবীর 

বসন্ত আওল রে... !  রুক্ষ দুঃখ জরাগ্রস্ত  ঘুমকাতুরে শীতবুড়ীকে জাগিয়ে ভাগিয়ে আনন্দবার্তা নিয়ে এল রে সবার জন্য , উল্লাসে চিতরোল সমস্ত  প্রকৃতি, মন্দ পবনে শিহরণ, ফিস্ ফিস্ কানাকানি, রং বিরঙ্গে কুদরত্ ঝলমল, ফুলের বাহার সুগন্ধ হিল্লোল ,  ডাক দেয় পরস্পরে --- আয় তোরা যূঁথি যাতি  মল্লিকা..  আয় তোরা এই বেলা সবাই , কুমার বসন্তকে সাজাই , সাড়া দিয়েছে একে একে...  অশোকমঞ্জরী পুঞ্জভার ব্যাকুল বকুল সুগন্ধ, সজনেফুল ডালি ভরে, আম্রপালি  চ্যূতবল্লরী গুঞ্জামালা গাঁথে কুমার বরণে ....      

              
 গাছে গাছে নব কিশলয়ের উঁকিঝুঁকি... ক্রমশ সাবালক হয়ে আবছা সবুজ কচিকলাপাতা রং, হল্দে গাঢ় সবুজে একাকার করে দিচ্ছে, মেতে উঠেছে ওরা বসন্তবায়ে...
রক্তকিংশুক ভারী হিংসুক,ও তার পলাশনেত্র নিয়ে খুব অহংকার, ফাগুনবনে আগুন লাগাতে সে ওস্তাদ -- এ কথা অবশ্য অস্বীকার  করা যায় না,ও ভেবেছে একাই আসর মাত করবে, প্রকৃতির  রূপসজ্জায় সব ক্রেডিট ও ই নেবে ।  মধুমালতীরা চুপি চুপি প্রসাধন সারছে, সে খেয়াল হয়নি। ওরে ওই দিকে তাকিয়ে দেখ, প্রেমিক কৃষ্ণচূড়ার  জমজম্ রয়্যাল কস্টিউমস -- লালে লাল হলো কৃষ্ণ মোহনবেশে রে... 
হ্যা হ্যা, বসন্তদূতেরাও ( কোকিল )  ওদের সুমধুর কন্ঠস্বরে প্রকৃতি বন্দনাগীত শুরু করেছে, বসন্ত্ বাহারে বিলম্বিত্ আলাপ খরোজ থেকে মধ্যপঞ্চম ছুঁয়ে একেবারে তার সপ্তকে... রাগালাপে সংযোগ রেখে গুনগুন্ গুনগুন্
 তানপুরা ছাড়ছে মধুকরের দল (মৌমাছি)  

আরে, আরে, সা রা রা রা...  এসেছে হোলি এসেছে, এসেছে হোলি এসেছে  ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় ... পুরোনো প্রম এবার জেগে উঠলো রে... ওরে আয়রে ,  আয় আয় সবাই ! লাগলো যে দোল , দখিন দুয়ার খুলে গেছে...  মাতন লেগেছে  বাতাসে, পাল উড়িয়ে দে রে...  কবি বলে - চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি -- হুম্ সে তো দেখছি টানাটানি  মাখামাখি গলাগলি ঢলাঢলি...  অব্ খেলা হোলি জী, পিলে রংগো ঘাগরো গুলাবি মারো জী...  মেতেছে সবাই লাল নীল হলুদের দুরন্ত খেলায়...  মত্ত মাতাল তাল বেতাল..  হাঃ হাঃহাঃ 

কিন্তু এই মিলনউৎসবের দিনে অশান্তির আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে ওরা, মাটি করে দেবে হাসিখুসির মেলা, হ্যা রুশইউক্রেনীয় উত্তপ্ত বারুদহাওয়া দুনিয়ার আকাশ অমানবিক রক্তরঙে লাল করে দিচ্ছে, ওরা জানে না প্রেমের মাহাত্ম্য, হিংসার আয়ুধ শানায় ক্ষমতা দম্ভ প্রকাশের জন্য,রক্তচোখ ওরা মানবাধিকারের মর্যাদা  বোঝে না, ওদের প্রাণে কি দোলা লাগে মধুমাধবীতে, গন্ধ  লাগে কি ঝরা বকুলের, আসে কি প্রেমের বসন্ত কখনো...ওরা মগ্ন নোংরা মারণখেলায়.... 
 এসো, এসো আজ আপামর জনা, আমামরা মাতি আনন্দখেলায় প্রেম প্রীতি ভাব ভালোবাসা জাগিয়ে তুলি দুয়ারে দুয়ারে, ছড়িয়ে দিই কবোষ্ণ বাতাস  দিকে দিকে সুস্থ সুন্দর  জীবন, সব হিংসা ভুলে...  ওগো ওর সাথে মোর প্রাণের কথা নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে...  আজ সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে....  




"ফাগুন লেগেছে বনে বনে "
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

"...ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে, আড়ালে আড়ালে বনে বনে।" বহুত্ববাদী এই দেশের নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান এর মধ্যেও এক মিলন ক্ষেত্র।  দেশের কোনো প্রান্তে বিহু উৎসব তো কোথায় পোঙ্গল। কোথাও মকর সংক্রান্তি, তো কোথাও হোলি উৎসব। 

হিন্দু মাইথোলজি অনুসারে রাধা কৃষ্ণের প্রেম ই হোলি উৎসবের একমাত্র উৎস হলেও কেউ কেউ হোলিকা দহন ও রঙ্গোলী র বিষয় টিতে নানা ভাবে বর্ণনা করে থাকেন। সে যাই হোক আমাদের জীবনের অতি প্রয়োজনীয় জল থেকে আমরা শিক্ষা পাই সবত্র মিশে  যাবার। সব জাতী, সব ধর্মের মিলন ঘটানোর যেমন আবশ্যকীয়, ঠিক সবার রঙে রঙ মেশানো এবং রেঙে ওঠা বা অন্তরআত্মা কে বসন্ত রাঙিয়ে নেওয়াও অতি প্রয়োজনীয় বিষয়। 

হোলি বা রঙের উৎসব অবশ্য অতি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে শান্তিনিকেতনে র " বসন্ত উৎসব " থেকে।  কবির অতি আদরের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। এ কথা বলবার কোন অবকাশই নেই শান্তিনিকেতন ই ভারত ভূমির সেই তীর্থ ক্ষেত্র যেখান থেকে রাখি পূর্ণিমা,  পৌষমেলা এবং বসন্ত উৎসব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।



বসন্তে আজ ধরার চিত্ত

চিত্রা পাল

 নবীন বসন্ত এসেছে তার রঙের বাহার নিয়ে।  সে রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশে বাতাসে।হরষে রাঙা কপোলে ঘুম ভাঙা চোখে পুষ্প কোরক পুলকিত, পাতায় পাতায়  দলে দলে সে আনন্দের শিহরণ। রাঙা রঙের লালিমা লাগে শিরিষ পলাশের কোরকে। বনে বনে নব নব মুকুলে  দখিনা পবনের ছন্দ।নবীন পাতায় আজ রাঙা হিল্লোল। বসন্তের অভিনন্দনে আজ ধরার চিত্ত উতলা। কম্পিত নব কিশলয়  শিহরে মলয়ের  চুম্বনে।গাছের সবুজ, আকাশের নীল,সন্ধ্যার সূর্যাস্ত এখন বসন্তের রঙে রঙীন। নবীন রঙের তানে বনে বনে যে ঢেউ জেগেছে, সে রঙের দোলা যে আমাদের জন জীবনকেও দুলিয়ে দিয়েছে। এসেছে রঙে রঙে রঙীন দোল মহোৎসব। সকল আকাশ সকল বাতাস বসন্তের আগমনে চল চঞ্চল। জনম-ভরা অতলা ব্যথা দুলিয়ে বসন্তে ধরার চিত্ত যে আজ বড়ই উতলা। মৃত্যু আবেশ হারিয়ে সেই সুরে সুর মিলিয়ে বেজে উঠুক আমাদের আনন্দগান এই নবীনবর্ণা ধরণীতে। 


প্রবন্ধ 

লাল পলাশের আগুন ঝরানো বাহার দেখলে মনটা ভরে ওঠে

বটু কৃষ্ণ হালদার

গত এক বছর ধরে সমগ্র সভ্যতার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল।২০২০ সাল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব সভ্যতার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।চেনা পরিবেশ মানুষজন,রাস্তাঘাট,বড্ড অচেনা হয়ে উঠেছিল। লক ডাউনের সময় জনগণ সংবাদমাধ্যমগুলো তে নজর রেখেছিল আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলেছিল। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিলে হাঁটছিলো বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলো। ভারত বর্ষ সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি।সেলফোন বেজে উঠলে হৃদপিণ্ড ছটফট করে উঠত। কারণ প্রতি সেকেন্ড কেউ-না-কেউ হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে, সেই খবর শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত।চোখের সামনে মা সন্তান হারিয়েছে, স্ত্রী স্বামী হারিয়েছে, আবার কেউ কেউ হারিয়েছে তাদের প্রিয়জনকে। অগণিত মানুষ কর্মহারা হয়েছে। প্রায় এক বছর যাবত সাধারন জনগন নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখেছিল শামুকের খোলস এর মধ্যে। মানবজাতির কাছে এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।মানুষ এই এক বছর উৎসব বিহীন জীবনযাপন কাটিয়েছে।ধীরে ধীরে বিভীষিকাময় আধারের কালো মেঘ সরে গিয়ে আবার একটু একটু করে আলোর মুখ দেখতে চলেছে। 
আমাদের ভারত বর্ষ এক ঋতু বৈচিত্র্যময় দেশ। ৬ টি ঋতুর সমাহার এ ভারতবর্ষকে বিশ্বের দরবারে শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে। ভারত বর্ষ শুধু ঋতু সমাহার দেশ নয়, ভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র বটে। তাই ভারতবর্ষে প্রতিনিয়ত কোন না কোন সংস্কৃতি উৎসব লেগেই থাকে। এরই জন্য বিদেশীরা পবিত্র ভারত ভূমির টানে ঘর ছাড়া হয়। তেমনি এই ভারতের এক অন্যতম জনপ্রিয় লোকো উৎসব হলো দোল। যাকে পাতি বাংলা ভাষায় বলা হয় বসন্ত উৎসব।এই বসন্ত উৎসবের সঙ্গে গ্রাম বাংলার মানুষদের নাড়ির সম্পর্ক। বসন্ত উৎসব হলো বাঙ্গালীদের প্রাণের উৎসব। এ সময় বনময় নতুন বৃন্তে আচ্ছাদিত হয়ে সবুজ সতেজ হয়ে উঠে। কোকিলের মন মাতানো কুহু কন্ঠে মুখরিত হয়ে ওঠে পরিবেশ।বসন্তের রঙে রঙিন। হয়ে ওঠে উৎসব মুখরিত বাঙালির হৃদয়।বসন্ত মানেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। নতুন বর্ণে সেজে ওঠে শান্তিনিকেতন।বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ কখন রঙের খেলা চালু করেছিলেন, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু শান্তিনিকেতনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ যে বসন্তোৎসব চালু করেছিলেন, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। ১৯২৫ সালে প্রথম পথ চলা শুরু হয় এই বসন্ত উৎসবের। উৎসবের মূল সুর যেন তখন থেকেই বেঁধে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল।
বসন্ত উৎসবের একদম প্রাচীনতম রুপ প্রোথিত আছে দোলযাত্রার মাঝে। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা।এর প্রাণকেন্দ্রে থাকেন রাধা-কৃষ্ণ। তাদেরকে দোলায় বসিয়ে পূজা করা হয়। উত্তর ভারতে যেটিকে বলা হয় হোলি, বাংলায় সেটিই পরিচিত দোল হিসেবে।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের প্রাচীন আর্য জাতির হাত ধরে এই উৎসবের জন্ম। খ্রিস্টের জন্মেরও বেশ কয়েকশো বছর আগে থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে এই উৎসবটি। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে পাথরের উপর খোদাই করা এক পাথরে পাওয়া গেছে এই উৎসবের নমুনা। এছাড়া হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ বেদ ও পুরাণেও রয়েছে এই উৎসবের উল্লেখ।
এছাড়াও এই উৎসবের ফিরিস্তি রয়েছে আরো বহু জায়গায়। তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎস্যায়ন রচনা করেছিলেন তার জগদ্বিখ্যাত 'কামসূত্র'। সেখানে দেখা যায় দোলায় বসে নর-নারীর আমোদ-প্রমোদের বিবরণ। সপ্তম শতকের দিকে রাজা হর্ষবর্ধনের শাসনামলে সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল একটি প্রেমের নাটিকা, সেখানেও ছিল হোলির বর্ণনা। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের 'রত্নাবলী' এবং অষ্টম শতকের 'মালতী-মাধব' - এই দুই নাটকেও দেখা মেলে এই উৎসবের। তালিকা থেকে বাদ দেয়া যাবে না জীমূতবাহনের 'কালবিবেক' ও ষোড়শ শতকের 'রঘুনন্দন' গ্রন্থের কথাও। পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষজুড়ে অনেক মন্দিরের গায়েও হোলি খেলার নমুনা বিভিন্নভাবে ফুটে উঠতে দেখা যায়।প্রথমদিকে ভারতবর্ষে এসে ইংরেজরা এই উৎসবকে রোমান উৎসব 'ল্যুপেরক্যালিয়া'র সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। অনেকেই আবার একে গ্রিকদের উৎসব 'ব্যাকানালিয়া'র সাথেও তুলনা করত।
কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ।পহেলা বৈশাখের পর অন্যতম জনপ্রিয় লোক উৎসব হলো দোল উৎসব। নীল সাদা মেঘের ভেলা ও দখিনা বাতাসের তালে তালে কাশফুলের মাথা দোলালো যেমন জানান দেয় ঘরের মেয়ে উমার আগমন ঘটতে চলেছে। ঠিক তেমনই ,পলাশ,শিমুল, কৃষ্ণচূড়া কেশর উঁচিয়ে জানান দেয় বসন্ত এসে গেছে।এ সময় বহু প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে আকুতি র দুয়ার খুলে যায়। প্রেমিকের বুকে প্রেমিকা মাথা রেখে স্বপ্নের মায়াজাল বুনতে থাকে। এসময় তরতাজা হয়ে ওঠে আমাদের শৈশব। আমাদের শৈশবে দোল খেলা ছিল একটু অন্যরকম।কারণ আমার শৈশব কেটেছে সুন্দর বনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।গ্রামের নাম গোসাবা ব্লকের পাঠান খালি নামক জায়গার কামার পাড়া গ্রামে। গ্রামের মানুষ জন মাটির সাথে মিশে গিয়ে উৎসব পালন করেন।তখন আমাদের কাছে টাকা পয়সা ছিল না কিন্তু অনাবিল সুখের ঢেউ উপছে পড়ত সহজ সরল জীবনে। দোল উৎসবের আগের দিন গ্রামে ন্যাড়াপোড়া চালু আছে। যুগ যুগ ধরে বাংলার মানুষ এই সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে।অশুভকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জয় উদযাপনই হোলি উৎসব। রঙের পাশাপাশি তাই ন্যাড়া পোড়াকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়। যা নিয়ে বাংলায় মজার ছড়াও প্রচলিত, 'আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরি বোল।' হোলির একদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় হলিকা দহন। তার জন্য আগে থেকে শুকনো ডাল, কাঠ এবং শুকনো পাতা জোগাড় করা হয়। তারপরে ফাগুন পূর্ণিমার সন্ধ্যায় পোড়ানো হয় সমস্ত স্তূপাকার করে। এই দহন অশুভ শক্তি বিনাশের প্রতীক।
তখন কার সময়ে গ্রাম বাংলার জনগণ বাজার দিয়ে কেনা পিচকারি আনা হতো না।দোল উৎসব এর কয়েক দিন আগে পিচকারীর বানানোর জন্য বাড়ির গুরুজন রা বাঁশ কেটে জলে ফেলে রাখতেন।তার পর দোলের দিন সেই বাঁশ জল থেকে তুলে সুন্দর করে পিচকারি বানিয়ে দিতেন।রং বলতে বাজার দিয়ে ১/২ টাকা দিয়ে আবির কেনা হতো।সেই রং বালতি করে গুলে তার সাথে জবা ফুল বেটে মিশিয়ে নেওয়া হতো।রং ফুরিয়ে গেলে কাদা জল গুলে দোল উৎসব পালন করা হতো। রঙ ও কাদা জল মেখে এমন অবস্থা হতো কেউ কাউকে চিনতে পারতো না। রং খেলার পরে শুরু হতো জল স্নান।পুকুরে নেমে সাবান দিয়ে রং তুলতে তুলতে নাজেহাল হয়ে যেতাম। অনেকের সেই রঙের দাগ চোখে মুখের সাথেই হৃদয়ে লেগে যেত।তার পর চলত বাঙালির খাওয়া দাওয়া।আমরা সবাই জানি বাঙালি খাদ্য রসিক।নানান বাঙালি পদ রান্নার সুগন্ধে পরিবেশ ভরে যেত।গ্রামের মানুষ গ্রামে ফিরে আসেন।আবার কারো বাড়িতে আসেন অতিথি,আত্মীয়।সারাদিন সারারাত হৈ-হুল্লোড় গল্প আড্ডায় মজায় দিন কাটতো।
বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতার পাল্লা বেড়ে চলেছে। সময় কাঁধের উপর ফেলছে দীর্ঘশ্বাস। একে অন্যের কাঁধে পা রেখে আকাশ ছুঁয়ে ফেলার প্রয়াস। প্রতিযোগিতার ভারে ঝুঁকে গেছে বিবর্ণ মুখ। বাংলার কর্মচ্যুত,শিক্ষিত,বেকার,যুবকরা হয়ে পড়ছে পরিযায়ী শ্রমিক। তাই এই সময়কে লাগাম দিতে গিয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে উৎসব আনন্দের কথা। বর্তমানে এই দোল উৎসবের সাথে সাথে বহু লোকসংস্কৃতি বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এমন ভাবে চলতে থাকলে এই বসন্ত উৎসব একদিন অতীতের স্মৃতিতে পরিণত হবে।


রম্য রচনা 

আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে

স্বপন দত্ত             

হিন্দু বৈদিক ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত একজন অসুরা অর্থাৎ নারী অসুর হোলিকা যিনি রাজা হিরণ্যকশিপুর বোন ও প্রহ্লাদের পিসিকে বিষ্ণুর সহায়তায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। অগ্নিতে প্রহ্লাদকে দগ্ধ করতে চেয়ে সে নিজেই দগ্ধ হয়। এই হোলিকা দহন থেকেই বহি:বঙ্গে হোলি উৎসব এবং বাঙলায় দোলযাত্রা বা বসন্ত উৎসব। আজও কুঁড়েঘর বানিয়ে ন্যাড়া পুড়িয়ে হোলিকাদহন প্রতীকী হিসাবে পালিত হয়। 
             " দলে দলে রং দিন, পারলে রং বদলে দিন"। এটা শুধু আওয়াজ নয় বরং রেওয়াজ। দোল হ'ল রঙের খেলা, সঙ্গে সঙ্গে রঙ পাল্টানোরও। পাড়ায় পাড়ায় মাস্তানরা আস্তিন গুটিয়ে তোলা আদায়ের জন্য রঙ দেখানোর পরও জনতা ওই একদিন বা দুদিন নানা রঙ ভরা বালতি নিয়ে রঙে অবগাহন করে মহাজোটের রঙিন সমুদ্রে।
             বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলের দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবীর বা গুলাল নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীনিগনের সঙ্গে রঙ খেলায় মেতে ওঠেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল উৎসবের উৎপত্তি।
             বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্সডের মতো দোলের দিনটিও কিশোর কিশোরী,যুবক যুবতীদের কাছে আর একটি খুল্লাম খুল্লা দিন। ঘর থেকে না বেরোলে হতে পারে রঙের অনা কাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ। তাইতো শুনি," খেলবো হোলি রঙ দেবোনা, তাই কখনো হয়, এসো এসো বাইরে এসো, ভয় পেয়োনা ভাই।" তবে রঙের প্রথাগত সঙ্ঘ্যা হারিয়ে সবাই নিজের মনের মত অন্যকে রাঙাতে হয় ব্যস্ত। খুণ না হয়েও খুন  খারাপি রঙের গুণে লাল রঙের বন্যা। বাঁদরের সাথে সাযুজ্য সৃষ্টির বাসনায় বাঁদুরে রঙ। এক দিনের জন্য হলেও পূর্বপুরুষের উপস্থিতি স্মরণ করে একাত্মতা লাভের প্রচেষ্টা। হাজারো চেষ্টায় গালের চামড়া উঠে গেলেও বাঁদুরের আদুরে চিন্হ থাকে বিদ্যমান। গাইতে ইচ্ছে করে," রঙ শুধু দিয়েই গেলে, আড়াল থেকে অগোচরে, দেখেও তুমি দেখলে নাতো, সে রঙ কখন লাগলো এসে মনে, গেলো জীবন মরণ ধন্য করে শুধু রঙ দিয়েই গেলে।" 
            এরপরও আছে বার্নিশ ছাপাখানার কালি, পরিশেষে নর্দমার সুগন্ধী জলে ফেস পাউডার, রুজ ক্রিম মাখা মুখ হ' তে পারে একে বারে ছয়লাপ। এককথায়, ঠিক শিল্পীর হাতে পড়লে সাক্ষাৎ " বেগুন ক্ষেতের কাক তাড়ুয়া".। মনে মনে রাগ হলেও মুখে কিছু বলবার নেই উপায়। রঙ খেলার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে মানিকজোড় হল, --" রঙ বাজি"! সেজন্য বোধহয় রয়েছে, অঞ্জন দত্তের বিখ্যাত গান,-- " পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো"....। তাই ধমকির ঝক্কিতে না পড়ে অম্লানবদনে মেনে নেওয়া ভালো , দোলের মেকআপে। তবে ওই বিচিত্র মেকআপে অর্ধাঙ্গিনী কর্তৃক গলাধাক্কা খেলে,সেকথা স্বতন্ত্র। তবে এখন " রঙ বরষে ভিগে চুনরিওয়ালা রঙ বরষে" র সাথে সংযোজিত হয়েছে -- " সুরা বরষে ভিগে চুনরিওয়ালা" । অনাহারে, অর্ধাহারে ভি আচ্ছা হ্যায় লেকিন পানাহার বন্ধ কভি নহী।
            দোলযাত্রা উৎসব শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব । পূর্বরাত্রে হয় বৈতালিক। দোলের দিন সকালে, " ওরে গৃহবাসী, খোল্ দ্বার খোল্, লাগলো যে দোল"--- উদাত্ত কণ্ঠে হয় গীত।সন্ধ্যায় নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের থাকে আয়োজন। কিন্তু এখন সেখানেও দল বদলের হাওয়া। প্রেম,ফুর্তি,রঙ খেলার আয়োজন,শুধু ভেজ নয়, অবশ্যই প্রয়োজন ননভেজ। দোলের দিন একটু বিলিতিতে  আচ্মন,এখন স্ট্যাটাস সিম্বল, সমাজেরই সাজবদলের ইঙ্গিত। নেশার মৌতাতটা ঠিকমত জমে
উঠলে সুরতালহীন ব্যক্তিত্ব গাইতে পারে, " নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলো।"
             তা আগুন লাগুক একশোবার,ক্ষতি নেই যদি থাকে ফায়ার ব্রিগেড। কচি পাঁঠার খোঁজে গিয়ে বাজারে, নিজেই বোকাপাঁঠা। অগত্যা গাছপাঁঠা এঁচোরের খচরামিতে হতে হয় তুষ্ট। বাকি রইলো, মালপোয়া। তবে সামাজিক নৈকট্য বর্জনের যে খুড়োর কল সামনে রয়েছে টাঙানো, তাতে মালপোয়ার টাল সামলানো ভারী মুশকিল।ক্রমশ: অসামাজিক জীবে পরিণত হতে হতে এখন স্বতন্ত্র থাকা ছেলে বৌমার ফ্ল্যাটে যেতেও অনুমতি নিতে হয় মুঠোফোনে, নচেৎ গিয়ে দেখতে হবে বড়ো তালা লাগানো। পাড়াপড়শীদের বাড়িতে আবীর দিতে যাওয়াতো আরো দূরে। মনে পড়ে, ছোট বেলার কথা। ইজেরের উপর একটা ফতুয়া চাপিয়ে দুটো থলের একটাতে আবীর নিয়ে পাড়ায় বাড়ি বাড়ি আবীর দিয়ে বেড়ানো আর অন্য ব্যাগে মালপোয়া জমা করার কথা এখনকার ছেলে মেয়েরা শুনলে বলবে," ছ্যা ছ্যা, কী হ্যাংলা ছিলে গো তোমরা?" 
             যাকগে, বিখ্যাত কমেডিয়ান ভানু  বন্দোপাধ্যায় যেভাবে --- " মাসিমা মালপোয়া খামু" -- বলে মাসিমার ঘরে হামলে পড়ে মালপোয়া খেয়েছিলেন, এখন সেগুড়ে বালি। কারণ চিনি আর সর্ষের তেলের যাঁতাকলে পড়ে মালপোয়ার এখন পোয়াবারো, এখন শুধুই নির্বাক ছবি। আর কাজু কিসমিসের কিস্, সত্যিই মিস। তাই মালপোয়ার মোহমায়ায় ভুলেও ওর চিন্তা
না করাই ভালো। 
             তবে একটি দিন," যেমন খুশী সাজো'র বিভাগে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নস্টালজিকতায় গা ভাসানোর সুযোগ দোলের দৌলতে পাওয়া গেলেও রঙ বদলের বিপাকে বাঙালি এখন দিশেহারা। স্বেচ্ছায় রঙ না বদলালে তোমার রঙও বদলে দিতে পারে, একথা এখন বোঝে পাগলেও। তাই এখন, --- " ছাতা ধর হে দেওড়া, যেদিক পানে বৃষ্টি আসিছে" গানটিই উপযুক্ত। দল বদলের কলরোলে নিজেকে মেলাতে না পারলে বিনা প্লাস্টিক সার্জারিতে বদলে যেতে পারে শ্রীবদনের চালচিত্র। তাইতো এখন শুরু হয়ে গেছে,সত্যিকারের রঙ দেখানোর প্রতিযোগিতা। একই লোক হরেক মিছিলে, মিটিংয়ে বাস, টেম্পোয় আসছে অবলীলায়। কারণ বিনে পয়সায় রঙ এর রঙ্গ দেখবার এমন সুযোগ আসে ক' বার? এরপরও রঙ পাল্টানোর জন্য নিজেকে এগিয়ে না দিলে জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে ঘটবে মাহাপ্রস্থান । তাই এখন পিচকিরি থেকে রঙের ফুলঝুরি না বেরিয়ে ছড়ড়ার 
ফুলঝুরি। তাই রঙের বদলে রক্তের হোলিখেলা। কিন্ত একটা অশুভ পরিনামেই যে চলে গেল, তার জীবনতো আর কোনদিনই হবেনা রঙিন।
             তাই ছাপোষা বাঙালি আজ ভীত সন্ত্রস্ত। দোলের আহ্বানে হৃদয় হয়না পুলকিত বা রোমাঞ্চিত। বরং সদাই ভয়ঙ্কর শঙ্কিত।রঙবদলের এই নিষ্ঠুর খুনোখুনি বন্ধ হবে কবে?
           তাই বলতে ইচ্ছে হয়, " রঙ বদল জাগ্রত দ্বারে, বুঝছি মোরা হাড়ে হাড়ে।"



কবিতা 

রাঙিয়ে দিয়ে 
শ্রাবণী সেন

সবার রঙে মিশিয়ে নিতে রঙ
এই তো এল আবার হোলিখেলা 
সাতটি রঙে ভরিও তোমার মুঠি 
রঙিন হয়েই কাটুক না হয় বেলা!

আকাশ পাঠায়  অনন্ত নীল তার
উষা ছড়ায় আবীর এমন করে 
পলাশ শিমূল  মাখল তনু মনে 
অশোকফুলের সাজিও ওঠে ভরে।

তোমার রঙে মিলিয়ে আমার রঙ
এবার তবে মনেই আবীর লাল
সবার রঙে মিশিয়ে নিয়ে রঙ
ভালোবাসার ছড়িও গুলাল।



দোল

মাথুর দাস


দোল বা হোলি   যাই বা বলি,  উৎসব !

রঙ মাখিয়ে   রঙ মেখে হই   ভূত সব ।

রঙিন দিনে পার হয়ে যাই সঙ্গীন বাধা,

আজ এ দিনে  সব যুগলই  কৃষ্ণ-রাধা ।



সবার রঙে

সাগরিকা  কর্মকার


 আমার তো কোন রঙ নেই চিত্রকুমার,
 কোন এক মন খারাপের চৈত্রের দিনে
 প্রজাপতির পাখায় ; কৃষ্ণচূড়ায়
 যত রঙ ছিল সেদিন
 মিলিয়ে ছিলে তোমার রঙ তুলির পাতায়
 আর এঁকেছিলে আমার ছবি, অনুরাগের ছোঁয়ায়
 আবিরের নেশা আজ আকাশে-বাতাসে
 তবুও ঝাপসা কেন?
 থাক না, আমাদের যত রঙ মনের গোপনে
 এসো, মিলে যাই সবার রঙে।।



আনন্দছবি
অলকানন্দা দে

নয়নাভিরাম রোদের কলরবে
যুগে যুগে অর্জিত যে সুখ,
ঊষার বাগানে সুহৃদ বসন্ত
আসন পাতে রঙিন অদ্ভুত!

বন্ধনহারা একাকার উল্লাসে
ছড়ায় শূন্যে অনন্য রামধনু,
উৎসবনাটে সেতু বাঁধে ফাল্গুন 
আবীরগুলাল ঐকতানে তনু।

প্রতিটি সুরে ফোটে আনন্দমীড়
পথ পেয়ে যায় রঙিন বিচিত্র ভাষা,
আলিঙ্গনে বিশ্বাস ওড়ে তীব্র
আকাশ মাটিতে রঙ খেলে ভালোবাসা!

প্রিয় যৌবন শোভাযাত্রী আজ
সুখরেশ শুধু শিশুর জয়রোলে,
নারকেল ফাঁকে চাঁদের সাম্পান
পূর্ণতা পায় হৃদয় দিঘির জলে!

প্রাকৃত সাজে অলঙ্কারী ঋতু
প্রতিটি দিনের আরতি স্বভাবজাত, 
স্বপ্নে পোষা অপার প্রেমের নামে
সার্বিক সুখী অনন্য গান বাঁধো।



ছবি 

অনুস্মিতা বিশ্বাস 
























অদ্রিজা বোস






















তানভি দাম























মুজনাই সাপ্তাহিক বিশেষ সংখ্যা দোল পূর্ণিমা ২০২২

Friday, March 18, 2022


 

চা-ডুবুরি

সুকান্ত নাহা 

(অন্বয়/ ৫০০টাকা)


'প্রাজ্ঞ সত্যপ্রিয় সেই অনন্ত আড়ালকে একসময় মেনে নেন জীবনের আরেকটি নির্মম সত্য বলে জেনে। মেনে না নিলে জীবনের চাকায় যে ঘুরবে না। 'চক্রবৎ পরিবর্তন্তে'-র শ্লোকও যে বড় মিথ্যে হয়ে যাবে!'


জীবন সত্যিই বড় নির্মম। কিন্তু সেই নির্মমতাকে ঘিরে ফুটে ওঠে এমন কিছু ফুল, যখন ব্যক্তি মাত্রেই বলতে বাধ্য হয়, নির্মম সত্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে জীবনের আসল সৌন্দর্য। ক্রমাগত সব হারিয়েও জীবন যুদ্ধে ভেঙে না পড়ে, জীবনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, অনন্ত আড়ালকে সঙ্গী করে যে যাপন তা সত্যিই মহান। আর সেই মহান জীবনের ছবি এঁকেছেন লেখক সুকান্ত নাহা তাঁর 'চা-ডুবুরি' উপন্যাসে। 

জনপ্রিয় সমাজ মাধ্যমের একটি গ্ৰুপে যখন ধারাবাহিকভাবে 'চা-ডুবুরি' প্রকাশিত হচ্ছিল, তখনই চিনতে পেরেছিলাম মূল চরিত্র সত্যপ্রিয়কে। বাস্তবের সত্যপ্রিয়কে বহুদিন থেকে জানি, চিনি। তাঁর কর্মকান্ডের সঙ্গে পরিচয় থাকবার সুবাদে নির্দ্বিধায় বলতে পারি লেখক সুকান্ত নাহা যথার্থভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন মানুষটিকে। সত্যি বলতে, উত্তরবঙ্গের চা-বলয়কে ঘিরে এর আগে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও, লেখক সুকান্ত নাহা যেভাবে চা-বাগান ও তার যাপনকে উপস্থাপন করেছেন, সেটি অত্যন্ত বাস্তব। নিজে চা-বাগানের মানুষ হওয়ার সুবাদে তিনি এই সুবিধে পেয়েছেন। ফলে, চরিত্রায়ণ ও বর্ণনা হয়ে উঠেছে সাবলীল ও সুচারু। এর পূর্ণ কৃতিত্ব লেখকের প্রাপ্য। নাকি বলব সুবর্ণের? অথবা দুজনেরই? কেননা সুবর্ণ আর লেখক সুকান্ত নাহা যে অভিন্ন মানুষ তা বুঝতে সচেতন পাঠকের দেরি হয় না। 

উপন্যাসের সময়সীমা দীর্ঘ কাল ধরে পরিব্যাপ্ত। তাই স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে বর্তমান ঘুরে ফায়ার এসেছে উপন্যাসে। আর তার মাঝে মাঝে চা-বলয়ের জীবন, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, ইতিহাস ইত্যাদি সবকিছুই চলেছে হাত ধরাধরি করে। বলতে দ্বিধা নেই, এই উপন্যাস চা-বলয় সম্পর্কে একেবারেই অনভিজ্ঞ মানুষকে সাহায্য করবে সবুজ সোনার দেশকে চিনতে ও জানতে। লেখকের লেখার গুণে সত্যপ্রিয়-সহ অন্যান্য চরিত্রগুলিও, যেমন সুনয়নী, বিনয়ভূষণ, কুমুদ মাস্টার, ফজলুল সুধাময় প্রমুখেরা, জীবন্ত হয়ে ওঠে। মন খারাপ হয়ে যায় সত্যপ্রিয়র বেদনাতে। অনেকক্ষেত্রেই একাত্ম হতে হয় চা-বাগিচার যাপনের সঙ্গে। 

'চা -ডুবুরি' সময়ের  একটি দলিল হয়ে রইল। লেখকের হাত ধরে পাঠকের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিলেন সত্যপ্রিয়। এ যেন, অতীতের কাছে পরবর্তী সময়ের ঋণ স্বীকার। আমরা যেটা করতে পারি নি, লেখক আমাদের হয়ে সেটা করলেন। স্বীকৃতি দিলেন এমন এক ব্যক্তিত্বকে যিনি চা-বলয়কে নিজের হাতের তালুর মতো জানেন। তাঁকে ঘিরে যে ঘটনাপ্রবাহ তাতে সত্যের সঙ্গে সঙ্গে কল্পনার এমন এক বুনন সৃষ্টি হয়েছে যা অত্যন্ত সুখপাঠ্য। 

বাস্তবের সত্যপ্রিয় এক এক করে জীবনে হারিয়েছেন প্রিয়জনদের। প্রায় অন্ধত্বের পর্যায়ে চলে যাওয়া মানুষটি বাস করেন যে বাড়িতে তার পাশে বাড়িতেই জন্মেছিলেন সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার। তাঁর বিখ্যাত `উত্তরাধিকার' শুরু হয়েছিল এখান থেকেই। এ যেন এক অদ্ভুত সমাপতন। `অন্বয়' প্রকাশনার ৫০০ টাকা মূল্যের গ্রন্থটির প্রচ্ছদ শিল্পী হলেন প্রবীর আচার্য। বইয়ের বাঁধাই ও কাগজ যথেষ্ট ভাল। 

(আলোচনা- শৌভিক রায়)