Saturday, April 23, 2022


 

মুজনাই সাপ্তাহিক 

বসুন্ধরা দিবস বিশেষ সংখ্যা ২০২২


।। সম্পাদকের কথা ।।

দিবস উদযাপনের সার্থকতা তখনই যখন তা বোধের জন্ম দেয়। আর বোধ সৃষ্টি করে দায়িত্ব ও কর্তব্য। একমাত্র এই নীল গ্রহেই রয়েছে প্রাণ। কিন্তু আমাদের লালসা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আজ সকলের জীবন বিপন্ন। যদি আমরা এখনও সচেতন না হই, তবে সেদিন আর খুব দূরে নয়, যেদিন পৃথিবীতে থাকবে শুধু স্যালামান্ডারের মতো আগুনজয়ী প্রাণীরা! বসুন্ধরা দিবস পালন তাই খাতায়-কলমে নয়, মন থেকে উদযাপিত হোক। কলুষিত এই পৃথিবী হেসে উঠুক নির্মল সবুজ হয়ে।
 


 মুজনাই সাপ্তাহিক 

মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই সাপ্তাহিক 



পরিচিতি  


বসুন্ধরা দিবস

শ্রাবণী সেনগুপ্ত


পরিবেশ-আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। আমাদের দ্বায়িত্ব এই সম্পদকে যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রেখে ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া।সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যেমন আর্থিক উন্নতি হচ্ছে ,তেমনই ভোগবাসনা পূরণ করার জন্য দৈনন্দিন চহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলিতে জনসংখ্যা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। বনাঞ্চল ধ্বংস,শিল্পজাত দূষণ,বন্যপ্রাণী বিলোপ,সঞ্চিত খনিজ পদার্থের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পরিবেশ বিপর্য্যস্ত হয়েছে। এই সমস্যার মোকাবিলার জন্য বিগত তিন দশক ধরে মানুষ পরিবেশ ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে।আমরা বুঝতে পেরেছি যে, পরিবেশকে দূষণমুক্ত ও নিরাপদ না রাখলে সুস্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছে। ধরিত্রী দিবস তার মধ্যে অন্যতম।

                                     ধরিত্রী দিবস একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান,যা পরিবেশ রক্ষার জন্য সমর্থন প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ২২ শে এপ্রিল পালিত হয়। এটি বর্তমানে আর্থ ডে নেটওয়ার্ক কর্তৃক বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৯৬৯ সালে সান্তা বারবারায় তেল উপচে পড়া থেকে। তার সঙ্গে ক্ষোভ পুঞ্জিভুত হয়েছিল বাতাসে ধোঁয়াশা ও দূষিত নদীর মতন ইস্যুগুলি নিয়েও। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সানফ্রানসিস্কোতে ইউনেস্কো সম্মেলনে শান্তিকর্মী জন ম্যাককিনলে পৃথিবী মায়ের সম্মানে একটি দিন উৎসর্গ করার প্রস্তাব করেন। শান্তির ধারণা থেকে উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিন হিসেবে ২১ শে মার্চ, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম এই দিনটি উদযাপিত হয়। এক মাস পরে একটি পরিবেশগত শিক্ষামূলক দিন হিসেবে একটি আলাদা ধরিত্রী দিবসের অবতারণা করেন যুক্তরাষ্ট্র সেনেটর গেলর্ড নেলসন,যেটি প্রথম সংঘটিত হয় ২২শে এপ্রিল, ১৯৭০ সালে। ইনি পরবর্তীকালে তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ  ফ্রিডম পুরস্কারে পুরস্কৃত হন।এই দিবস ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ধরিত্রী দিবসে যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং অন্যান্য ১২০ টি দেশ বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নিষ্কাশন কমাবার লক্ষ্যে প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত।এমন প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং পৃথিবীকে নিরাপদ ও বসবাসযোগ্য রাখতে নানান আয়োজনের মধ্যে দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ২২ শে এপ্রিল দিনটি পালন করা হয়। ২০২১ সালে এই বার্ষিক অনুষ্ঠানের ৫১ তম বর্ষ ছিল। এই বছরের থিম ছিল 'আমাদের পৃথিবীকে পুনরদ্ধার কর।'(Restore Our Earth)। ২০২২ এ ৫২ তম বর্ষে থিম হল- "Invest In Our Planet" এর তাৎপর্য্য হল -পরিবেশ রক্ষা করতে সহায়তা করা।

আসুন ,আমরা সকলে মিলে এই দিনটিকে সার্থক করে তুলি -শুধু কাগজে কলমে নয়,পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় কাজের মধ্যে দিয়ে।এই পরিবেশ সুরক্ষার কর্মকাণ্ড যেন  একটি দিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে সে দিকেও আমাদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করে সচেতন থাকতে হবে।সবাইকে হাতে হাত ধরে পরিবেশ সুরক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে।পৃথিবী আমাদের যে ভাবে রক্ষা করে,আমরাও যেন তাকে সেভাবেই রক্ষা করতে পারি।সার্থক হোক ধরিত্রী দিবস২০২২।ধরিত্রী মা হয়ে উঠুন দূষণমুক্ত,সকলের বাসযোগ্য।




বর্তমান 

World Earth Day

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

"আপনারা ভাগ্যবান,  আপনারা আকাশের তারা দেখতে পান,  আমরা বহুদিন হতে চলল দিল্লির আকাশে তারা দেখতে পাই না।"  নতুন দিল্লির আই টি ও তে কর্মরত,  যমুনা বিহারের বাসিন্দা  শ্রীমতী মুখার্জি খুব আক্ষেপের সাথে কথাগুলো বলেছিলেন।  সালটা ২০০৪,  উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ায়  একটা  সাহিত্য  বাসর   বসেছে। সেই সাহিত্য  অনুষ্ঠানের  শুরুতে  কবি বন্ধুর বাড়ির ছাদে এমনই একটা  আলোচনা উস্কে দিলেন ডঃ শিউলি মুখার্জি  কারণ সেই  দিনটা ছিল ২২ শে এপ্রিল। (World Earth Day) গোটা   সাহিত্য সভাটাই   পরিবর্তিত   হ'ল   বিজ্ঞান   মঞ্চের সচেতনতা মূলক সেমিনারে।

 তিনি বললেন,  "দিল্লির ITO  এলাকায় প্রদূষনের মাত্রা সর্বাধিক।  অটো পলিউশনের জন্য মাঝে মাঝেই মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিতে হয়। বেশির ভাগ মানুষই বিশেষ করে বাইক আরোহীরা মুখে  মাস্ক ব্যবহার করেন। দিল্লি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে DTC বাস  ডিজেলের পরিবর্তে CNG তে চালানো হবে। "
আমরা সচেতনতা শিবির ছাড়াও পথে ঘাটে বৃক্ষরোপন এর পক্ষে এবং অরণ্য বিনাশ বা বৃক্ষছেদনের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুনি। বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাগুলো ও এই বিষয় নিয়ে কাজ করে চলছে। মুখে বললেও আমরা আজও প্লাস্টিকের ব্যবহার করে চলেছি। যার ভবিষ্যত পরিনতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। 

সাম্প্রতিক কালে পৃথিবী একটা সাংঘাতিক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বন্যা, খরা ও ভুমিকম্পের মতো ঘটনাগুলোর পূর্বাভাসের সাথে কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে না।  বিশেষ একটা ভৌগলিক এলাকায় আবহাওয়ার তারতম্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবহাওয়ার এই রকমফের এর মূল কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন।  বেশ কিচ্ছু জায়গায় বাইকের তেলের ট্যাংক এ উষ্ণতার কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে।  এ জন্য এখন থেকে যে কোন গাড়ির পেট্রোল ট্যাংক পুরোপুরি ভর্তি না করবার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। যারা বাইক ব্যবহার করেন তাদের দিনের মধ্যে একবার তাদের তেলের ট্যাংক খুলে গ্যাস বের করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, বিশেষজ্ঞ মহল।

এয়ার কন্ডিশনারের এবং  রান্নার গ্যাস এর ব্যবহার কম করবার কথাও সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে।

বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী দের মধ্যে সচেতনতার প্রসার ঘটাতে World Earth Day তে এক পক্ষকাল সচেতনতা শিবির,  বসে আঁকো প্রতিযোগিতা,  পোস্টার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করা বিশেষ প্রয়োজন। 

কবিতার এই অভিনব আসরে উপস্থিত সবাই পরিবেশ বাঁচাতে গাছ লাগানোর ওপর নিজ নিজ মতামত ব্যাক্ত করলেন। পরিশেষে সকলে এক সাথে সমাপ্তি সংগীত পরিবেশন করলেন,  " এই পৃথিবীর থেকে ওই আকাশ বড়ো,  আকাশের  চেয়ে বড়ো সূর্য তারা, সূর্যের চেয়ে আরও অনেক বড়ো,  শাশ্বত মানুষের স্রোতের ধারা, সেই মানুষের গান মোরা গাই, মোরা জীবনের গান গেয়ে যাই।"

সেই দিনটার কথা স্মৃতির পাতা থেকে কখনো মুছতে পারব না।



আগামী 

বিশ্ব বসুন্ধরা দিবসে গাছ লাগিয়ে পরিবেশকে সতেজ করে তুলতে হবে
বটু কৃষ্ণ হালদার 

অক্সিজেন এই মুহূর্তে কতটা জরুরি তা বুঝিয়ে দিয়ে গেল অতিমারি করোনা। সুষ্ঠু সামাজিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে সবুজ সতেজ বন ময় একমাত্র বিকল্প। এই গাছ পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে আমাদেরকে প্রাণদায়ী অক্সিজেন দেয় এবং দূষিত কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে শোষণ করে। এই ভাষা টুকু সমাজে বাচ্চা থেকে বয়স্ক বোধহয় সবাই জানে। তবুও সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানব সভ্যতার দ্বারা জঙ্গল কেটে  চোরাপথে কাঠ বিক্রির ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠেছে।গাছ মারো। দামের লোভে। ঝরুক সবুজ রক্ত। শেষ হয়ে যাক অক্সিজেন। পরোয়া নেই। বহরমপুর শহরে তাই তো হচ্ছে! ইতিহাসের শহর। নবাবিয়ানা, ঐতিহ্য। প্রাচীন, অতি প্রাচীন গাছের আর ঠাঁই নেই সেখানে। খুল্লমখুল্লা চলছে এই খুনোখুনি। কী দোষ? জীবন দেওয়া? প্রাণভরে অক্সিজেনের যোগান যুগিয়ে যাওয়া? সভ্যতার আদালতে এর শাস্তি হবে না, হয় নাকি! ধীরে ধীরে মৃত্যু। স্লো পয়জন। এটাই নাকি এদের ভবিতব্য!ঐতিহ্যময়, সবুজ স্কোয়ার ফিল্ড গ্রাউন্ডেও তাই যেন ধূসর ছায়া।এসবই ঘটনা ঘটছে প্রশাসনের চোখের সামনে। প্রশাসন হাতগুটিয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। কারণ চোরাকারবারীদের থেকে একটা অংশ তাদের পকেটে ও তো আসে।তবে সবুজ সতেজ বনময় ধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ হলো মানব সভ্যতার আধুনিকীকরণ।বিজ্ঞান কে সঙ্গী করে মানুষ যত উন্নত হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, ততোই সবুজ সতেজ বনময় ধ্বংস করে তার উপর গড়ে তুলছে কংক্রিটের ইমারত। জনগণ তার পরিবেশকে যেমনভাবে সুন্দর করে সাজাচ্ছে, উল্টোদিকে সবুজ সতেজ বনময় গুলো দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে। মানব সভ্যতা যতই এগিয়ে চলেছে,সবুজ সতেজ পরিবেশ তাতে উলঙ্গ হচ্ছে। ধীরে ধীরে পরিবেশে অক্সিজেন কমছে, আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পাল্লা ভারী হচ্ছে। অগ্রগতির নামে আমরা ধীরে ধীরে ইতিমধ্যেই ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গেছি তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এর সুদুরপ্রসারি ফলাফল হল মানুষকে প্রাকৃতিক অক্সিজেন ছাড়াই, কৃত্তিম অক্সিজেনের উপর নির্ভর হতে হচ্ছে।এছাড়া সুন্দরবনের জঙ্গল ধস নেমে নদীর গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে।এর কারণ হলো চুরি করে গাছ কাটা,আর নদীর গর্ভ থেকে বালি চুরি করে নদীর মোহনাকে শূন্য করে দেওয়া।তবে সবথেকে ভয়ঙ্কর খবর হলো গতবছর পরিবেশে সবথেকে বেশি অক্সিজেন সরবরাহ দাতা অ্যামাজন ও অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।এবার জ্বলছে সুন্দরবন। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে মিজোরামের বন জঙ্গল। বিধ্বংসী দাবানল এর লকলকে শিখায় বহু বন্যপ্রাণী মারা গিয়েছে।পাখি পক্ষ থেকে শুরু করে বহু জীবজন্তু বর্তমানে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। এই জঙ্গলের সঙ্গে পতঙ্গদের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক। একটা সময় ছিল পৃথিবীতে শুধুই গাছ ছিল কিন্তু সেই গাছে কোন  ফুল ছিল না। এরপর যখন প্রকৃতির টানে গাছপালার শাখা-প্রশাখায় রং-বেরংয়ের ফুলে ভরে উঠলো, তাদের সঙ্গে পতঙ্গদের খুব ভাব হলো। এই সমস্ত উড়ন্ত কীটপতঙ্গ রা ফুলের রেণু হাতে পায়ে মেখে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করল। এর বিনিময়ে ওরা পেল মিষ্টি মধু।তাই জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার ফলে পরিবেশে যে শূন্যতার সৃষ্টি হল, তা পূরণ করব কি করে আমরা? এতে নষ্ট হতে পারে পরিবেশের ভারসাম্য।সব জেনে  প্রশাসন গাছ চুরি ঠেকাতে পারেনি।

জীবনের সাথে এক না জানা সম্পর্কের অনুভূতি। না দেখে ও তাকে স্পর্শের অনুভূতি মধ্যে দিয়েও আত্মার পরম পাওয়া। মানব জীবনে তার অবদানের ঋণ কখনোই শোধ করার নয়। তার না থাকা র যন্ত্রণা প্রতিটি মুহূর্তে অবদান করে মানব সমাজ। বর্তমান এই অতি মারি র সময়ে তার শূন্যতায় হাহাকার চলছে।হ্যাঁ, বলছি অক্সিজেনের কথা।বাংলায় যাকে অম্লজান বলা হয়। ১৭৭৪ সাল তখন। বিজ্ঞানী পি.বায়েন তার গবেষণাপত্রে ধাতু দাহ করলে তার ভর বৃদ্ধির কারণ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেন। তিনি বলেন বাতাস থেকে ভারী এক অদ্ভুত পদার্থ দাহ করার সময় ধাতুর সাথে যুক্ত হয়। পারদ্ঘটিত যৌগের তাপবিযোজনের মাধ্যমে এই গ্যাসটি উৎপন্ন হয়েছিল। বায়েন নিজের অজান্তেই কাজ করলেন অক্সিজেন নিয়ে এবং দুর্ভাগ্যবশত তার কাছে অজানাই থেকে গেল নিজের আবিষ্কার। একই বছর রসায়নবিদ জোসেফ প্রিস্টলি যৌগ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ইতোমধ্যে তিনি কার্বন-ডাই অক্সাইড এর মত গ্যাস আবিষ্কার করে ফেলেছেন। প্রিস্টলি একদিন নিজের ঘরে গবেষণা করতে গিয়ে পাত্রে কিছু সালফিউরিক এসিড নিয়ে উত্তপ্ত করছিলেন। কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলেন পাত্র থেকে এক ধরনের গ্যাসীয় পদার্থ বের হচ্ছে। প্রিস্টলি গ্যাসটি আলাদা পাত্রে সংরক্ষণ করলেন। পরীক্ষা করে দেখা গেল পাত্রের কাছে জলন্ত মোমবাতি নিয়ে আসলে তা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। শুধু তাই নয় তিনি পাত্রে একটি ইঁদুর ছানা আটকে পরীক্ষা করলেন। দেখলেন ছানাটির যতক্ষণে মারা যাওয়ার কথা তার চেয়ে বেশিক্ষণ সময় বেঁচে ছিল। জোসেফ প্রিস্টলি শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি বাতাসের উপাদান যা দাহ করতে এবং প্রাণীর নিঃস্বাস নিতে সাহায্য করে। পরবর্তিতে তিনি প্যারিসে গিয়ে বিভিন্ন ফরাসি বিজ্ঞানীদের সাথে এ নিয়ে বিশদ গবেষণা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বিজ্ঞানী ল্যাভয়সিয়ে বিষয়টি নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখান। তিনিই প্রথম গ্যাসটির অক্সিজেন বা অম্লজান নামকরণ করেন। কেননা তখন ধারণা ছিল এটি একটি জটিল পদার্থ। পরে গ্যাসটি নিয়ে অনেক গবেষণা করে জানা যায় ধারণাটি ভুল ছিল। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অক্সিজেন বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। তবে আজকের ব্যস্ত শহরে বিশুদ্ধ অক্সিজেন বিরল বস্তু।

আবিষ্কারের পর প্রিস্ট্‌লে প্যারিসে গিয়ে  সহ অন্যান্য ফরাসি বিজ্ঞানীদেরকে বিশদভাবে তার গবেষণার কথা বলেছিলেন। এই অংশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রিস্ট্‌লের চেয়ে ল্যাভয়সিয়েই এই আবিষ্কারটির মর্ম বেশি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রিস্ট্‌লে একসময় মনে করতেন তার এই আবিষ্কারটি একটি জটিল পদার্থ। কিন্তু ১৭৮৬ সালে ল্যাভয়সিয়ের ধারণা দ্বারা অণুপ্রাণিত হয়ে তিনি একে মৌল হিসেবে দেখতে শুরু করেন। এ হিসেবে অম্লজান আবিষ্কারের পিছনে মূল অবদান প্রিস্ট্‌লে এবং বায়েনের। এদের সাথে  নামক আরও একজন বিজ্ঞানীর নাম সংযোজন করা যেতে পারে। শিলে ১৭৭২ সালে;_Chemical Treatise About Air and Fire নামক একটি বই লেখার কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু প্রকাশকের দোষে বইটি ১৭৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইয়ে অক্সিজেনের বর্ণনা প্রিস্ট্‌লে বা বায়েনের দেয়া বর্ণনার চেয়েও নিখুঁত ছিল। কিন্তু প্রকাশক দেইতে প্রকাশ করাতে তিনি অক্সিজেনের আবিষ্কারক হিসেবে নিজের নাম প্রস্তাব করতে পারেননি। কারণ প্রিস্ট্‌লের আবিষ্কার প্রকাশিত হয় ১৭৭৪ সালে। শিলে অম্লজান উৎপন্ন করেছিলেন অজৈব যৌগের বিয়োজনের মাধ্যমে।
"বৃক্ষ নেই, প্রাণের অস্তিত্ব নেই,বৃক্ষহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন মহাশ্মশান।”অফুরন্ত সৌন্দর্যের এক মধুর নিকুঞ্জ আমাদের এ পৃথিবী। এই পৃথিবীকে সবুজে-শ্যামলে ভরে দিয়েছে প্রাণপ্রদায়ী বৃক্ষরাজি। এ বিশ্বকে সুশীতল ও বাসযোগ্য করে রাখার ক্ষেত্রে বৃক্ষের অবদান অনস্বীকার্য। আবার মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যে যেসব মৌলিক চাহিদা রয়েছে তার অধিকাংশই পূরণ করে বৃক্ষ। তাই মানবজীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরীসীম।মানুষ ও প্রাণীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৃক্ষের ব্যাপক আবশ্যকতা রয়েছে। তাই বৃক্ষকে মানবজীবনের ছায়াস্বরূপ বলা হয়। বৃক্ষ আমাদের নীরব বন্ধু, সে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত কত যে উপকার করছে তা একবার ভেবে দেখলে অনুধাবন করা যায়।এই মুহূর্তে সমাজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বান নাগরিক হিসাবে সচেতন হওয়া দরকার।পরিবেশে অক্সিজেন শূন্যতার ঘাটতি মেটানোর দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। স্কুল-কলেজ পঞ্চায়েত স্তর থেকে শুরু করে কর্পোরেশন স্তরে সামাজিক সচেতনতা উদ্দেশ্যে বনসৃজন প্রকল্পের উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে গাছ লাগানোর চেষ্টাকে সফল করে তুলতে হবে। যেখানে যেখানে গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেখানেই প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে। তাদেরকে গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে হবে।আর তার সঙ্গে এটা অবশ্যই বোঝাতে হবে গাছ আছে বলেই পরিবেশ বেঁচে আছে। আর পরিবেশ বেঁচে আছে বলেই আমরা বেঁচে আছি। গাছ কাটা নয়, একটি গাছ একটি প্রাণ এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সফল করে তুলতে হবে। আসুন জাত,ধর্ম নির্বিশেষে আমরা সবাই গাছ লাগানোর কর্মসূচিতে নিজেদেরকে নিয়োজিত করি। আর তাতেই বাঁচবে, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ। নইলে আগামী দিনে মৃত্যুর হার এমনভাবে বেড়ে চলবে, মৃতদেহ সৎকর করার মানুষ জন থাকবে না।শুধু তাই নয় একদিন হয়তো মানুষকে এই পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন ও পয়সা দিয়ে কিনতে হবে।তার সঙ্গে এটাও প্রমাণিত হয়ে যাবে সবুজ সতেজ পরিবেশ ধ্বংস করার জন্য দায়ী বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব সভ্যতা। সবুজ সতেজ পরিবেশ ধ্বংসের কর্মকান্ড, আমাদের কাছে গৌরবের নয়, অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। শুধু তাই নয় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা নিজেরাই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে যাচ্ছি। এর সাথে সাথে এটাও প্রমাণ হয়ে যাবে আমরা নিজেরাই আমাদের কফিনের গর্ত খুঁড়ে চলেছি।সেটা ভুলে গেলে চলবে না।

১৯৭০ সালের ২২ শে এপ্রিল এই পৃথিবী কে আরো সবুজ সতেজ করে তুলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসুন্ধরা দিবস পালন শুরু করে। একটি মা হাজারো কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও নিজের গর্ভে দশ মাস দশ দিন একটা সন্তানকে লালন পালন করে সুস্থভাবে তাকে এই পৃথিবীর আগেও দেখানোর চেষ্টা করেন। ঠিক তেমনই এই বসুন্ধরা, বিশ্বের উন্মুক্ত মঞ্চ যাই বলুন না কেন যুগের পর যুগ ধরে আমাদের জীব কুল কে লালন পালন করে আসছে। তাই জন্ম দেয়নি মায়ের প্রতি যেমন আমাদের কর্তব্য রয়েছে, ঠিক তেমনি এই বসুন্ধরার কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা। এই বসুন্ধরা আমাদের সঙ্গে বেইমানি করে নি কোনদিন। সবুজ সতেজ শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত সাহায্য করে চলেছে। অথচ দেওয়া আর নেওয়া এই পদ্ধতিতে আমরা শুধু প্রকৃতির থেকে নিয়ে চলেছি। তার প্রতি কোন দায় দায়িত্ব আমরা পালন করি না। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় কুলাঙ্গার সন্তানদের তারা গর্ভধারিনী হাজারো মা যেমন প্রতিনিয়ত চোখের জল ফেলছে, ঠিক তেমনি ধরিত্রীর বুকে আমরা ছুরি চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই একদিন প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে করতেই নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাবে সেটা মাথায় রাখতে হবে।এই সবুজ সতেজ প্রকৃতির না থাকলে আমরা কেউ বাঁচবো না। এই ধ্রুব সত্য জানার পরেও আমরা কিভাবে এত উদাসীন হয়ে পড়েছি তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব হলো মানব, সেই মানব সভ্যতার দ্বারা প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের নীল নকশা তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে আমাদের ছোট্ট ভুল, ভবিষ্যতে সন্তানদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। তাই সময় থাকতে থাকতে আমাদের সজাগ হতে হবে। বসুন্ধরা কি পুনরায় গাছ লাগিয়ে সবুজ সতেজ করে তুলতে হবে।এ দায়িত্ব শুধুমাত্র আমাদের, এড়িয়ে গেলে চলবেনা।


প্রার্থনা 

পৃথিবী তোমাকে

 চিত্রা পাল                                                                          

পৃথিবী আজ একান্তভাবে তোমার জন্য এই লেখা। প্রথমেই আমার একটা প্রশ্ন, তুমি আমাদের এত অবিবেচনা সহ্য কর কেমন করে? এই সৌরপরিবারের একমাত্র সবুজ গ্রহ যার কোন তুলনা নেই। আর সব গ্রহের এক এক জনের এক এক রকমের সমস্যা।  তোমারও যে সমস্যা ছিলোনা বা নেই তা নয়। সে সব  অতিক্রম করে তুমি সম্পূর্ণা। তবে সে সম্পূর্ণতা একদিনে আসেনি, কোটি কোটি বছরের অপেক্ষা ধীরতার পরে কত লক্ষ বছর কালক্ষেপের  পরে এই সৌরমন্ডলে প্রথম তুমি জাগালে প্রাণের স্পন্দন।সে প্রাণপ্রবাহের শেষ অভিব্যক্তি মানুষ।তাকে তুমি রাখলে বনচ্ছায়ার আচ্ছাদনে, পুণ্যতোয়া নদীনির্ঝরের সঙ্গ দানে। তারপরে ধীরে ধীরে বহু পথ অতিক্রম করে মানুষ আজ পৌঁছেচে এখানে, মানে শেষ সীমা কিনা জানিনা, তবে এই সীমায়।এই সীমায় এসে সে যে এমনতর রূপ ধারন করতে পারে তা তুমি কল্পনাও করতে পারোনি। তুমি দেখেছো মানুষের কত সুদূর প্রসারী কল্পনা বিজ্ঞানের হাত ধরে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।ওরা পাহাড় ভাঙ্গছে,নদীর চলার পথ পরিবর্তন করছে, সাগরে দ্বীপ বানাচ্ছে এসব কত কি। আসলে নতুনের পথে চলতে গিয়ে যে উলটে তোমাকেই শেষ করে দিতে চাইছে  সে দিকে হুঁশ নেই। যে সবুজ পৃথিবী প্রাণ দায়ী ছিলো সে ক্রমশঃ সবুজ হারিয়ে প্রাণ হরণকারী হয়ে উঠেছে।প্রাণের জয়বার্তা ক্রমশঃ চলেছে প্রাণহানির দিকে। পৃথিবী দিবসে আমাদের এই হোক অঙ্গীকার, পৃথিবীতে।আবার হোক শ্যামলের আসন পাতা, বন্যেরা বনে থাকুক নির্ভয়ে, জলে থাকুক জলচর, মানুষ হোক সব প্রাণীকুলের মঙ্গলাকাঙ্খী।পৃথিবী  তুমি আবার হও জীবপালিনী, প্রাণদায়িনী। 


কর্তব্য 

সবুজ প্রতিভা

অলকানন্দা দে

“..এই পৃথিবীর বিরাট খাতায় পাঠ্য যে-সব পাতায় পাতায়, শিখছি সে-সব কৌতূহলে সন্দেহ নাই মাত্র॥”

পৃথিবীকে পাঠ্য করার অভিপ্রায় নেভে না কখনো! যত্ন করে সাজিয়ে রাখা ধ্রুব যা কিছু তার প্রতি ন্যস্ত ভালোবাসা ডেকে যায় অহরহ। আর তখনই এক সামুদ্রিক দোলা লাগে বুকে! এই ধুলো এই মাটি বায়ু আকাশ স্থল জল পাহাড় সাগরের বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যের পর্যটন বন্ধ রাখা মানে তো মৃত্যু কে বেছে নেওয়া। প্রকৃতি মানুষের প্রেমের আঙিনায় দাঁড়িয়ে একে অপরের কথা শোনা, এই দীর্ঘ আলাপন, এরই নাম তো অনিঃশেষ ভালোবাসা! কোন আক্ষরিক শব্দে ধরা যায় না এই অভিব্যক্তিকে! তাকে শুধু অনুভব করা যায় স্নায়ুর কৌশলে! প্রকৃতিপ্রেমী হলে এরকমই হয়! যা যা ছবি ভাসে দু-চোখের আয়নায় সবই মনে হয় লিখে রাখি আন্তরিক খাতার পাতায়! প্রাকৃতিক অভিমানে দাঁড়িয়ে নিজেকে দুঃখহীন মনে হয়, মনে করি আমি নিষ্পাপ! তবেই তো প্রসন্ন হবার মন্ত্র শিখিয়েছে সে আমাকে! সমস্ত মন জুড়ে হাজার শিল্পী চঞ্চল হয় আঁকবে লিখবে গাইবে নাকি ধারাভাষ্য দেবে পরিমণ্ডলের। কল্পনার মতো বাস্তব যখন চোখের বিপরীতে দাঁড়ায় তখন সুখের থেকে সুখ নির্গত হয়! নিজস্ব ইচ্ছের মুখোমুখি হলে দলবদ্ধ উল্লাসের আবির্ভাব হওয়ার অর্থ প্রত্যাশার অমৃতপান! তার ঐতিহ্যের কীর্তন করা তখন অভ্যাসে দাঁড়ায়। মন তার পাপড়ি মেলে আহ্লাদে ওড়ে! ভালোবেসেছি তাই! ছুটে গেছি তার গালভরা খলখলে হাসির হীরক কুড়িয়ে নিতে কতশতবার!

আমি পরিবেশচারী! ঝাঁপ দিয়েছি তার অতলে! আমি স্বপ্নে দেখি, আমি বাস্তবে দেখি, আমি লিখি, আমি পড়ি, সবুজের সফলতার গল্প! ঠোঁট বেয়ে নামে শুধু তারই কথা! দুঃখের প্রতিষেধক বলে যদি কিছু থাকে তো সে আছে প্রাকৃতিক পাড়ায়! প্রাণের পরে নুয়ে থাকে যার সরলতাখানি! দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে থাকা ভালোবাসার রঙিন রোদ্দুরে বাঁচাকেই নিশ্চিত বাঁচা বলে মনে করি। প্রকৃতির সাথে মেলামেশা সবসময়তেই অর্থপূর্ণ। তার রক্ষণাবেক্ষণ অন্যতম জাগতিক কাজ। নিজের ছায়ার চেয়ে বেশি প্রত্যয় তার প্রতি! তাই তার কুশল চাই একথা বলি গঙ্গার জল ছুঁয়ে!




ভাবনা 


চিরমাতৃকা
শ্রাবণী সেন

আমি মাটির মেয়ে, পৃথিবীর কন্যা
আমার ওঠা পড়া, জীবন যাপন 
এই মাটিকেই ধরে!
নরম সবুজ ঘাস আমার আনন্দের গালিচা!
বর্ষার ময়ূরপাখায়,  বৃষ্টি শেষের আকাশে 
আমি রামধনু দেখে মন হারাই।
বৈশাখের বেলি, জুঁই, টগর আর গন্ধরাজে 
সেজে আমি ঠাকুরের কাছে প্রণত হই।
শ্রাবণের মেঘে দেখে আর রজনীগন্ধা ফুলের সৌরভে আমার চোখে জল আসে।
ফাল্গুনের অশোক আর পলাশফুল 
আমার আবীরগুলাল!
শরতের শিউলিতলায় ছেলেবেলা খুঁজে পাই
হেমন্তের  ফসল তোলা সারা হলে
 নবান্নের পার্বণ করি, 
দীপালি রাতে তোমায় সাজাই মা বসুধা... 
তুমি ধরিত্রী, তুমি বসুন্ধরা, 
 তুমি সর্বংসহা 
তোমায় প্রণাম করি, 
তুমি চিরমাতৃকা, 

চিরজননী ! 



পৃথিবী এখন

মাথুর দাস


বাড়ছে তাপ  বাপ্ রে বাপ্  কী গরম আজ বিশ্ব !

মাটির জল হারায় তল শস্যভূমি শুষ্ক এবং নিঃস্ব ।

বনজঙ্গল হচ্ছে সাফ, মাফ নেই কোনও পাহাড়ের,

দঙ্গল বেঁধে লোকালয়ে পশু খাদ্যের খোঁজে আহা রে !


বর্ষাও বেশ  চলে তার রেশ  কষ্টও বাড়ে ঢের,

ঝড় ঝঞ্ঝায়  কত প্রাণ যায়  যত নষ্ট সমূহের ।

নামছে ধ্বস নেই কারো বশ  পাহাড় হারায় ভারসাম্য,

ঢাকছে বরফ নানান তরফ এত বাড়াবাড়ি নয় কাম্য ।


ভাব নেই আজ আবহাওয়াতেও উপাদান নেই শুদ্ধ,

দূষণ-ভূষণ পরিবেশ জুড়ে  হয় জীবনের দম রুদ্ধ ।

কেউ নেই সুখে  রোগ-অসুখের দাপট পৃথিবী জুড়ে,

কবে যে মানুষ বুঝবে এ সব,  কবে যে দাঁড়াবে ঘুরে ?


আকাশের গল্প

 বনশ্রী মুখোপাধ্যায়


কাল ওই আকাশটার  বুক থেকে ঝরে পরলো
 একফোঁটা জল,
 মাঠের ওই গালচেটার ওপর। 
 লম্বা লম্বা চোঙগুলো কাল কালো করেছিল
 ওই আকাশটাকে ,
আর সাদা ইউক্যালিপটাস গুলোর ম্যাজিকে-
 সাদা হলো সেই কালোটা। 
 সকালের সূর্য টা - যে আলো ফেলেছিল 
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ,
তাতে লেগেছিল নীল রং। 
 উড়তে থাকা ম্যাকাওটা সেটা লাগিয়েছিল ,
আরো কোন  এক 
ম্যাকাও, তোতা ,মাছরাঙ্গা বা আর কারো বুকে। 
 তারপর সেই আলোটাও
 সোনাঝুরি গাছের ফাঁক দিয়ে যখন ছড়ালো
 ইউক্যালিপটাসের মাথার উপর ,
 তখন দেখলাম-
 এই আকাশটা হল নীল । 
রং লাগানো পাখিগুলো আরো নীল 
লাগিয়ে দিল তাতে,
 আর তারপর উড়লো তার বুকে -এখান থেকে
সেখানে ওখানে বা অন্য সবখানে । 
সে সময় চুপিসারে-গালচের ভেতর দিয়ে  
মাটির তল দিয়ে,
 ঐ জলটাই গড়াতে গড়াতে মিশে গেল 
ডোবাটার মধ্যে,
 পড়া - মড়া মুনিয়াটার বুকে।।



নির্ভেজাল পৃথিবী 
রীতা মোদক


এস আকাশ
তোমার শরীর থেকে ভেজাল ভরা কালো মেঘ
 সরিয়ে দিয়ে,
ভালোবাসার নরম চাদরে
তোমাকে মুড়িয়ে দেবো।
এসো তোমাকে নীল শাড়ি পরাই,
তোমার নীলে আর মহা সমুদ্রের নীলে
মিলে মিশে মহা নীল হয়ে যাক।

এস নদী
তোমার বুকে ঝাঁপ দিয়ে
নিজেকে পাপমুক্ত করি।
বহু বছরের সমস্ত  প্লাস্টিক জাত আবর্জনা
নগরবাসীর পারিত্যাক্ত মুহু মুহু জলের বোতল
কাপ, থালা,গ্লাস তোমার জল থেকে ছেঁকে নিয়ে 
তোমাকে পবিত্র করি।

এস বাতাস
তোমাকে বারুদ মুক্ত করি
তোমার শরীর থেকে বিষাক্ত নাগিনীর নিঃশ্বাস 
 আর কামানের বজ্র ছেকে নিয়ে,
তোমাকে নির্মল করি।

এস জন্মভূমি
তোমাকে পবিত্র করি।
তোমার বুক থেকে--
রাসায়নিক সার কীটনাশক সরিয়ে দিয়ে,
তোমার ফসলে জৈব সার ঢালি।
মুহু মুহু প্লাস্টিকের কঠিন আবর্জনা সরিয়ে
চটের থলি এবং  মাটির বাসন  ফিরিয়ে দিয়ে, 
তোমাকে প্লাস্টিক মুক্ত করি।
যারা তোমার বুকে আগাছা রূপে লুকিয়ে থেকে
তোমাকেই বিকলাঙ্গ করতে চায়
সেসব ভেজাল উগরে ফেলে,
তোমাকে সন্ত্রাস মুক্ত করি।
তোমার বুকের নরম মাটিতে
ভালোবাসার ফসল ফলাতে, 
আমি আজীবন  লড়াই করে যাবো।
সৃষ্টি করবো -- এক নির্ভেজাল পৃথিবী।
তারপর চলে যাবো -- দূর.... বহু দূর...
 



বসুন্ধরা দিবস 
সংগীতা মিশ্র 

অশান্ত মেদিনীর মন
দূষিত বায়ূর দোলায় 
দুলছে সর্বক্ষণ 
মিষ্ট ভাবনা ভুলে গিয়ে
ক্রমশ তিক্ত ভাবনায়
অবনী যাচ্ছ জড়িয়ে  
আজ বসুনধরা দিবসে 
এসো সকলে মিলে
সপৎ করি
সবুজের সতেজতায় 
দূষনমুকত বিশ্বভূবন গড়ি


ভূমিকান্না

কাকলি ব্যানার্জী মোদক 


চৈত্রের অবসানে ফুটিফাটা হয় মাটি
দীর্ঘ, দগ্ধ ,তাপে জল ,জল চায় ভূমি ,
ছেলে-বুড়ো কদ্দুর যাবে বারি সঞ্চিতে
বারিও আজ তৃষ্ণার্ত যায়, যায় বহু দূরে।

বাষ্পেরা ফাঁকি দিয়ে খুঁজে দিঘি টলটল
মুখ বুজে পড়ে আজ আ সমুদ্র হিমাচল,
সবুজের শাবদাহ শুধু মাঠ ,ধূ ধূ মাঠ
তাই ভূমি কাঁদে আজ প্রত্যাশা বারি তার।

বহু ক্রোশ ছুটে চলে হাতে ঘড়া গাড়ুটা
মিলবে তৃষার্ত জল একফোঁটা শিশুটার
সবুজে সবুজ আনো কাটো দীঘি,

বিলটা ফুটিফাটা কম হবে  মাতৃ  ভূমিটার।।

ভূমি আজ কাঁদছে জল, জল চাইছে
সবুজের রূপটা নে বড়ো ফিকে আজ যে,
গরদের সাদা থানে হিমালয় সাজে বেশ
আজ যেন মনমরা রুক্ষ ,ভগ্ন বেশে।

বিশ্ব ধরিত্রী সব মুখ বুজে সহিছে
হয়তো মুখফুটে কিছু কথা বলবেই,
অগ্নি পরীক্ষায় সারা দেহ দগ্ধ।

কালের আবর্তনে  আজ ভগ্নব্রম্ভান্ড ।।‌‌ 



প্রকাশ 

অদ্রিজা  বোস   


                   


মুজনাই সাপ্তাহিক বিশেষ সংখ্যা বসুন্ধরা দিবস ২০২২

Saturday, April 16, 2022


মুজনাই সাপ্তাহিক 

নতুন বছরের ভাবনা  


সম্পাদকের কথা 

নতুন 

Sunday, April 10, 2022


 

মুজনাই সাপ্তাহিক 


।। সম্পাদকের কথা ।।

মুজনাই সাপ্তাহিকের এই সংখ্যায় ভাই বা বোনকে লিখতে বলবার একটি বিশেষ কারণ ছিল। আসলে ১০ এপ্রিল দিনটি WORLD SIBLINGS DAY হিসেবে উদযাপিত হয়। ভারতে দিনটি সেভাবে পরিচিত না হলেও আমেরিকা সহ বিশ্বের নানা দেশে এই দিনটি খুব উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে দিনটি। ১৯৯৫ সালে এই দিনটি সৃষ্টি করেছিলেন ক্লডিয়া এভার্ট। তাঁর ভাই ও বোন খুব কম বয়সে মারা যান। তাঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখতেই এই উদ্যোগ। দিনটি উদযাপনের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল এপ্রিলের ১০ তারিখ, কেননা ক্লডিয়ার বোন লিসেটের জন্ম হয়েছিল এই তারিখেই। পাশাপাশি, ক্লডিয়া তৈরি করেছিলেন SIBLINGS DAY FOUNDATION। এই ফাউন্ডেশনের মূল কাজ হচ্ছে বিভিন্ন কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভাইবোনদের মিলন ঘটানো। 

মুজনাই আজ বিশ্বের সব সহোদর ভাই ও বোনকে শুভেচ্ছা জানায়। কামনা করে, পবিত্র এই সম্পর্ক সময়ের বয়ে চলার সঙ্গে আরও দৃঢ় হোক....


মুজনাই সাপ্তাহিক 

মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই সাপ্তাহিক 





প্রীতম কর 



বই-এর বাক্স
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

একটা  এলুমিনিয়ামের   বই এর  বাক্স,  আর সেই  বাক্সটাই  ছিল  তার  জগৎ।    বই খাতা পেন,পেন্সিল  ছাড়াও থাকত পাকা আতা, ডাঁসা পেয়ারা, বিলিতি কুল, কাঁচামেটে আম। পড়তে বসেই মুখের  মধ্যে কচ  করে একটা  শব্দ পেতাম।  জামরুল, খেজুর,  জাম, কিছু না কিছু থাকবেই তার সেই বাক্সে।  আমি আমার ঠিক ওপরের দিদি শ্যামলী'র কথা বলছি।  আমরা  ছয় ভাই বোন।  শ্যামলী ঠিক   আমার ওপরের ক্লাসেই পড়ত। তবে সে একবার শ্রেণিতে পাশ না করতে পারার কারণে,  আমি ও শ্যামলী একই ক্লাসে চলে এসেছিল। 

ওর  অভিজ্ঞতা  বেশি  বলে  পড়াশোনা  বেশি বুঝত।  অংকে আমার  থেকে বেশি নম্বর পেত। একবার  আমি ওর অংক খাতা দেখে না বুঝে, হোম ওয়ার্ক করে  ক্লাসে  জমা  দিয়েছিলাম। ক্লাসে  ও  সেকথা  বলে  দিয়েছিল।   অংকের মাস্টারমশাই,   গৌর স্যারের   কানে  সে কথা পৌছলে, স্যারের কাছে  আমাকে কানমলা খেতে হয়েছিল। 

একই ক্লাসে  পড়বার  কারণেই  হোক   বা যে কোন কারণে আমি কখনো শ্যামলী কে দিদি বলে ডাকিনি।  দুইজনের  মিলমিশ  থাকলেও দুই জনের মধ্যে দূরত্ব ছিল ওই এলুমিনিয়ামের বাক্স।  সেই বাক্সে হাত দিলে বা সে দিকে নজর দিলেই  রাগ  করত।  আমিও  পরে  আর  ওই বাক্সের প্রতি কোন আগ্রহ দেখাতাম না। 

ওর বিয়ের ঠিক হলে একদিন বলল,  "এখন থেকে এই বাক্সটা তোর। "  আমি  ওর সেই সিদ্ধান্তে   মনের  মধ্যে  একটা  অদ্ভুত  ব্যাথা অনুভব করেছিলাম ।   মনে মনে বলেছিলাম,     " এ বাক্স আমার চাই না,  এই বাক্স তুই ই রাখ। তুই যে  ওই বাক্স ছাড়া বড়ই বেমানান। 

অতি সম্প্রতি শ্যামলী চলে গেছে না ফেরার দেশে। আজও তার সেই  বাক্স ঘরের কোনো জায়গায় পড়ে আছে।  তার অনুপস্থিতিতে ছেলেবেলার  অনেক টুকরো টুকরো স্মৃতি,  মনকে কাঁদায়।




সেই সে শীতের রাতে
       মৌসুমী চৌধুরী 


— "অ্যাই দিদি, এই...কী ঘুম রে বাবা! ওঠ না। 
শোন না কে যেন ডাকছে।"
   চোখ কচলাতে কচলাতে ধড়মড় করে উঠে বসি বিছানায়। মাঘ মাসের প্রচন্ড শীতের রাত। বাইরে ঘন কুয়াশা। আমি ক্লাস টেনে পড়ি আর আমার বোন এইটে। সামনেই বোনের অ্যানু- য়াল পরীক্ষা আর আমার টেস্ট পরীক্ষা বলে আমরা দু'জনেই পড়াশোনা শেষ করে একটু রাত করেই শুতে গেছি। কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যেতে আমি বিরক্ত বোধ করি। এত রাতে এ আবার কী বিপত্তি রে বাবা! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ৩ টা বাজে। বোন আবার আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল,
— "ওই যে শোন, কে যেন বাবার নাম ধরে ডাকছেন।"
  মা-বাবা সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। পাশের ঘরে ঠাকুরদা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। বারান্দা লাগোয়া ছোট ঘরে সারাদিনে পরিশ্রম শেষে শুয়েছে আমাদের মীনাদি। যিনি আমাদের দেখাশোনা, রান্নাবান্না ইত্যাদি কাজকর্ম  করতেন। 
  এবার শুনলাম এক করুণ নারীকন্ঠ বলছে,
— " দরজাটা খোল না। আমার লিপির খুব জ্বর। এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। মেয়েটা আমার বাঁচবে না গো বোধহয়।" 
   জানালা সামান্য ফাঁক করে আমরা দেখি  পাড়ার পুতুলমাসি কাঁদতে কাঁদতে কাতর অনুরোধ জানাচ্ছেন।
   ছোট থেকেই দেখতাম পুতুলমাসি বিধবা৷ পরে শুনেছিলাম তিনি স্বামী পরিত্যক্তা। তাঁর বড় মেয়ে অলিদি ছিল বদ্ধ উন্মাদ। তিনি ও তার মেয়েরা পাড়ায় কারও সঙ্গে মিশতেন না। তাঁদের একটা কাঠের বাংলো প্যাটার্নের জঙ্গল ঘেরা বাড়ি ছিল। বাড়িটি দেখে দিনের বেলাতেও কেমন গা ছমছম করত আমাদের! এত রাতে সেই পুতুলমাসি এসেছেন বাবাকে ডাকতে! আমি বোনকে বললাম, 
 —" এত রাতে এখন বেরোস না। বলে দে বাবা
নেই। সকালে এস ।" 
          আমার বোন ছিল খুব ডানপিটে আর অসম সাহসী। ছোট থেকেই অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ত। সে জেন্ট'স সাইকেল চালাতে জানত। পুতুলমাসির কাতর অনুরোধ শুনে বোন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়।  ঠাকুদার সাইকেলটা বের করে পুতুলমাসির মেয়ে লিপিদিকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে গামছা দিয়ে নিজের কোমড়ের সঙ্গে বেঁধে নেয়। তারপর তীব্র শীতের সেই ঘুটঘুটে  অন্ধকার রাতে কুয়াশাজড়ানো রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়িতে তাকে নিয়ে পৌঁছায়। আমাদের পাড়া থেকে ডাক্তারবাবুর বাড়ি ছিল দু' কিলোমিটার দূরে। অনেক ডাকাডাকির পর ডাক্তারবাবু গেট খোলেন। ডাক্তারবাবু পারিবারিক সূত্রে আমাদের পরিচিত ছিলেন। তিনি তো অত রাতে বোনকে দেখে অবাক,
—" তুই এই পেসেন্টকে নিয়ে এত রাতে একা এসেছিস? একে তো এক্ষুনি হসপিটালে ভর্তি
করতে হবে। ম্যালিগনেন্ট ম্যালেরিয়ার লক্ষ্মণ
মনে হচ্ছে...। "
   সে যাত্রায় ডাক্তারবাবুর সহৃদয়তায় লিপিদিকে সেই মূহুর্তে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রাণে বেঁচে যায় সে। 
      সব কর্মকান্ড সেরে বোন বাড়িতে ফিরে এসেছিল সকালবেলায়। পুতুলমাসি হাত ধরে
তাকে বলেছিলেন,
—" এত ছোট বয়স থেকেই তোর মনে এমন মায়া-দয়া!  তুই যা করলি কোনদিন ভুলব না। ভগবান তোর ভালো করবেন, দেখিস।"
   ভগবান তার কতটা ভালো করেছিল জানি না। তবে মা-বাবার কানে কথাটা উঠলে বাবা তেমন কিছু না বললেও মায়ের কাছে বেশ বকুনি খেতে হয়েছিল তাকে। আতঙ্কিত হয়ে মা  বলেছিলেন,
— "শীতের অমন অন্ধকার রাতে কত কি বিপদ হতে পারত! কাউকে ডাকা উচিত ছিল তোর।"
    আমার বোনের সরল উত্তর, 
— " ডাকতে ডাকতে রোগীর ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যেত, তাই ডাকাডাকি করে সময়
নষ্ট করিনি।"



অটুট বন্ধন
শ্রাবণী সেনগুপ্ত

ভাই বোনের সম্পর্কের মতন সম্পর্ক এ জগতে আর একটিও নেই।এ হল গভীর থেকে গভীরতর  শেকড়ের টান,যা বহু টানাপোড়েনেও থাকে অমলিন।আমার ভাই আমার থেকে বেশ অনেকটাই ছোট।তবে একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হবার সুবাদে আমার বেশ কয়েকজন দাদা ছিলেন।মনে পরে ,আমি সে বছর পাঠভবনে ভর্তি হয়েছি-তৃতীয় শ্রেণী।আমাদের শ্রেণী শিক্ষিকা একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন আমাদের কার কার  ভাই বা বোন আছে?তাতে আমি সব তুতো ভাই বোনদের মিলিয়ে যে সংখ্যাটি বলেছিলাম, তাতে আগেকার মানুষেরা অবাক না হলেও তখনকার দিনে বেশ বিস্ময়ের।উনি আমাকে বলেছিলেন যে তোমার নিজের কয়জন ভাই বা বোন আছে সেটি বলো।তখনও নিজের,পরের বোধ হয়নি।যাইহোক,নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলেছিলাম যে আমার কোনো ভাই বোন নেই।সেই বছর ই গরমে ভাই হল।আমি স্কুলে গরমের ছুটি র পরে এসে প্রথমেই মিস কে সেইটি ঘোষণা করে নিজের ভুল সংশোধন করেছিলাম।
ভাই হবার সময় আমি মামার বাড়িতে ছিলাম। মাসিমনি হাসপাতাল থেকে এসে বললেন ভাই হবার কথা,আমার তো খুব আনন্দ,কিন্তু দেখলাম বাড়ির বড়দের মুখ গম্ভীর।আমি ছোট বলে আমাকে কেউ কিছু বললেন না।শুধু দিদিমা বলেছিলেন যে, তুমি এখন ঠাকুরকে  জল দিতে পারবে না,তোমার এখন শুভ অশৌচ।আমি তখন দিদিমার সঙ্গে ঠাকুরকে জল বাতাসা দিতামতো, তাই।আমিতো তখন বাড়ি যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি।শুনলাম ভাইকে আর মাকে আরো কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।পরে জেনেছিলাম ভাই সময়ের আগেই পৃথিবীর আলো দেখেছিল,তাই বেশ কিছুদিন ওকে ইনকিউবেটর এ রাখা হয়েছিল,এবং জন্মে নাকি কাঁদেনি।যাইহোক বেশ কয়েকদিন পরে ভাই বাড়ি এল।আমিও মামাবাড়ি থেকে ফিরলাম।খুব ছোট্ট ছিল ভাই,হাতের আঙুলগুলো খোলার ভিতরের মোচার মতন।খুব কমজোরি আর ফ্যাকাশে।আমরা তো অতো বুঝিনা তখন,আমি,আমার জ্যাঠতুতো,খুড়তুতো ভাইবোনেরা মিলে খুব লাফিয়েছিলাম বিছানার উপর,মনে আছে খুব বকুনি খেয়েছিলাম সেইজন্য।মা ভাইকে বুকের মধ্যে করে নিয়ে শুতেন ,ওই উত্তাপে ও ভাল থাকত।সেই প্রথম আমার মাকে কারোর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া।আমার একাধিপত্যে ছেদ পরাতে অখুশি হইনি, বরং সেই ছোট থেকেই সেইটিকে আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছি।এতদিন ছিলাম একা, তাই খালি আদর পেতাম,এখন আদর করার একজন পেলাম।সেই আমি দায়িত্ববান বড় দিদি হয়ে গেলাম।সেই ধারা আজও বহমান।এইভাবেই দিন কাটতে লাগল,আমরা বড় হতে লাগলাম।আমার বাবার ছিল রেলের চাকরি,তাই বেড়াতে যাবার জন্য  পাশ পেতাম। তখন রেলে ফার্স্টক্লাস কূপ থাকত,তাতে আমরা চারজন আর অন্য একজন থাকতে পারতেন।দরজা বন্ধ করে দিলেই পুরো ঘর।আমি নিচের সিটে, বাবা আমার কোনাকুনি উপরের সিটে আর মা ভাইকে আমার পাশের সিটে।মনে পড়ে ভাই একটু দেরিতে কথা বলতে শিখেছিল।তাজমহল দেখতে গিয়ে বলেছিল-"তাজমলল।"আগ্রাতে আমরা যেখানে উঠেছিলাম মা সেখানে প্রেসার কুকারে করে আমাদের ভাত করে দিতেন।যেহেতু বাবা একদম নিরামিশ খেতেন ,তাই আমরা বেশিরভাগ সময়েই হলিডে হোমে উঠতাম আর ওখানেই রান্না করে খাওয়া হত।ভাইয়ের জন্য মা স্পিরিট স্টোভ নিয়ে যেতেন।আমার উঁচু ক্লাসে র পড়াশুনার জন্য খুব বেড়ানো হয়নি।মনে পরে ভাই যখন ক্লাস ফোর এ পড়ে, তখন স্কুলে এক সহপাঠির ধাক্কায় ওর হাত ভেঙে যায়, সেই অবস্থাতেই আমরা গ্যাংটক বেড়াতে গিয়েছিলাম।
ভাই ছোটবেলায় আমাকে কোথাও একা যেতে দিতে চাইত না।যখন কলেজে পড়ি, তখনও বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাবার উপায় ছিলনা,আমি একা বেরোব জানতে পারলেই আমার শাড়ি পেঁচিয়ে বসে থাকত।আমার বন্ধুরা এলেও সবসময় কাছে বসে থাকত, আর বলত-"তোর বন্ধু আমারও বন্ধু।"আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের বাড়িতে ওর ছিল অবাধ যাতায়াত।আমি যদি কোথাও কিছু কিনতাম বা খেতাম সবসময় ওর জন্য নিয়ে যেতাম,সে সামান্য বাদাম হলেও।একা কিছু আনন্দও উপভোগ করতে পারতাম না।নাটক দেখা,সিনেমা দেখা সবসময় আমার সঙ্গী।ভাইয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় যে স্কুলে সিট পড়েছিল,সেই স্কুলের সামনে আমি পরীক্ষার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম।আর উচ্চ মাধ্যমিকের সময়তো বাবা খুব অসুস্থ,তখন আমিই টিফিন নিয়ে যেতাম,আর মুখে মুখে পড়াও বলে দিতাম।ওই স্কুলের দারোয়ান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল আপনি কে হন? ভাইয়ের উচ্চমাধ্যমিকের ফল বেরোবার সময় বাবা হাসপাতালে।তারপরতো বাবা চলেই গেলেন।আমার বিয়ের দিন সকাল থেকেই ওর চোখে জল।তাও সব কর্তব্য করেছিল।আর প্রথম জামাইষষ্ঠীর দিন সমস্ত বাজার নিজে করেছিল।মা খুব দুঃখ করছিলেন যে, আমার দাদু তাঁর বড়জামাই অর্থাৎ আমার বাবার জন্য নিজে যত্ন করে বাজার করতেন,আর নিজের একমাত্র জামাইয়ের সময়েই তোর বাবা রইলেন না।তবে খুব খুশি হয়েছিলেন যে, ভাই সবকিছু গুছিয়ে বাজার করে এনেছে বলে।
একসময় মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন আমার শাশুড়িও খুব অসুস্থ।আমি এই বাড়ি, ঐ বাড়ি স্কুল,উচ্চ মাধ্যমিকের খাতা দেখা সব নিয়ে নাজেহাল।আমি,আমার কর্তা আর ভাই প্রাণপাত করে এক অসম লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলাম।তখন যেমন কিছু জনকে পাশে পেয়েছি,সেইরকম বাড়ির মধ্যে থেকেও অসম্ভব নিষ্ঠুর ব্যবহার পেয়েছি,যা মানসিকভাবে অনেক বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল।হাসপাতালে আমার ভাইকে আর ওর জামাইবাবুকে সবাই ভেবেছিল দুই ভাই।মা চলে গেলেন।ভাই একা হয়ে গেল।আমি কিছুদিন ঐ বাড়িতে কাটিয়ে এই বাড়িতে ফিরে এলাম।খেয়ে ঘুমিয়ে কিছুতেই  শান্তি পেতাম না।ভাইয়ের রান্না করার জন্য যে ছিল সে প্রায়ই কামাই করত।তখন কয়েকবার ওকে পাইস হোটেলেও খেতে হয়েছে।আমরা এখানে ভালমন্দ কিছু খেতে পারতাম না।সবসময় ওর কথা মনে হত।আমার শাশুড়ি মা কিছু রান্না করলেই ওকে ডেকে পাঠাতেন।কালের নিয়মে আমাদের আদি বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হল।সেই সময় ভাড়া বাড়িতে সব কিছু নিয়ে যাওয়া, ভাইয়ের একা থাকা সে এক লড়াই।যাইহোক তারপর ভাইয়ের বিয়ে দেওয়া হল।আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম।কিন্তু সেই যে দিদি হয়ে ভাইয়ের প্রতি অপত্য স্নেহ অনুভব করেছিলাম,তা আজ একসন্তানের পিতার প্রতি সমান মাত্রায় বহমান।সুখে দুখে আজও আমরা পরস্পরের পাশে।এ অটুট বন্ধন অপার্থিব সৃষ্টি।




গল্পের ছেলেবেলা
অলকানন্দা দে

শৈশবকে উপলব্ধি করা যায় তাকে ছেড়ে দূরত্বে এসে দাঁড়ালে। তখন মনে হয় এমন সুশ্রী দিন এত আচমকা কেন ফুরিয়ে যায়!
আরও খানিকটা বিস্তারিত হতে পারতো! কিন্তু তেমন তো হবার নয়! যে বেলার যতখানি মুহূর্ত প্রাপ্য ততটাই মেনে নিতে হয় বিনা প্রশ্নে। তাই পিছন ফিরে তাকালে, শৈশবের স্মরণে ডুব দিলে রূপকাহিনীর মতো লাগে আজ! তার থেকে যত দূরেই গড়িয়ে যাই না কেন ফিরে তাকাবার সময়ের অমিল কিন্তু হয় না! দুই দাদার সাথে কাটানো মুহূর্তরা খেলা শেষে প্যাভিলিয়নে ফিরেছে সেই কবেই! কিন্তু হাততালির রেশ থামেনি যেন এখনো!শিলিগুড়ি শহরে কার্শিয়াঙ পাহাড়ের মুখোমুখি আবাসের উঠোনে ছড়িয়ে আছে সেই ছেলেবেলা! গল্পগুচ্ছ পুরনো হলেও তাকে পুনশ্চ বলার মধ্যে মধু নিঃসরণ অব্যাহত।
একটি বিরাট মাঠের মালিকানা ছিল আমাদের। রকমারি খেলা ও খেলোয়াড়ের অভাব ছিল না। সকালের পড়াশোনা, দুপুরের ইস্কুল শেষে খাওয়ার জন্য সময় দেওয়াটাও সময়ের অপব্যবহার বলে মনে হ’ত। কারণ খেলার সময়ে কোন কাটছাঁট চলবে না। সবে মিলে জড়ো হওয়া মাঠের বুকে, ঘড়ির কাঁটা ৪ টের ঘরেও পৌঁছয় না।থাকুক না গ্রীষ্ম দাহ, পরোয়া নেই।
খেলা হ’ত ক্রিকেট, যেখানে একটি নিম্ন সাধারণ বল জুটলেও ব্যাট বলতে ছিল একটি ভাঙা টেবিলের পায়া। তাতে কি। এতে সুনীল কপিলের থেকে কিছু কম দক্ষতা প্রকাশ পেত না কিন্তু। কারণ তখন এনারাই ছিলেন তুঙ্গে। আর ছিল ব্যাডমিন্টন পিট্টু ডাংগুলি কাবাডি ঘুড়ির প্যাঁচ আরও কত কি। একটি বিশেষ খেলা ছিল আমাদের যার নাম স্লিপচোর। মাঠের পরেই ছিল খেলার পার্ক। পার্কের সম্বল ছিল চারটি দোলনা, দুটি বড় স্লিপ দুটি ছোট স্লিপ, আর চারটে ঢেঁকি। এই স্লিপের ওপর ওঠানামা করে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলাটাই ছিল স্লিপচোর। বাড়ির নির্দেশ থাকতো বড় স্লিপে উঠে কিন্তু স্লিপচোর খেলা নয়। কিন্তু কে শোনে সেই সৎ উপদেশ। কথা না শোনাটাই যথাযথ ছেলেবেলা একথা পরিণত বয়স বলে। এরকমই একদিন স্লিপচোর খেলা চলছে আমি দাদা ও আরও সকলে। আমাদেরই বন্ধু মানিক পার্কের একটি খুলে যাওয়া মাঝারি মাপের গেট যা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ছিল সেটি কে হাতে ধরে দোলাচ্ছে। সকলে বারণ করছে কিন্তু ঐ যে, ছেলেবেলা বেপরোয়া,শোনে না কারও কথা। ওর দুষ্টুবুদ্ধি সংলাপ বলে যায়, “ফেলে দেব কিন্তু ফেলে দেব কিন্তু”। মুখের কথাও ফুরোয় না, মানিক আর টাল সামলাতে না পেরে দিল ফেলে সেটি আমারই পায়ে। দাদারা ও তাদের বন্ধুরা এবং আমার বন্ধুবর্গ সবে মিলে বোধহয় পঞ্চাশের অধিক হবে ছুটে এলো এবং মানিককে চেপে ধরলো। আমার অবস্থা তো কহতব্য নয়। কাটাছেঁড়া তো দেখা যাচ্ছে কিন্তু ভাঙাচোরা তো বোঝার উপায় নেই। সবাই মিলে ধরে তো আমাকে ঘরে নিয়ে এলো। সাথে বিরতিবিহীন কান্না অব্যাহত। একে তো ব্যাথা পাওয়া তায় সকলের সহানুভূতির পরিমণ্ডলে মন বলে আরও একটু কাঁদি। ওদিকে মানিক বেচারা মুখ চুন করে হতবুদ্ধি হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে ঝড়ের মতো তিরস্কার শুনছে দাদার বন্ধুদের থেকে। তারা সবাই আমাকে ‘বোন’ বলে সম্বোধন করতো। মাত্রাতিরিক্ত আহ্লাদ আগলে রাখত সুখের মধ্যে সুখ ঢেলে! যাইহোক, এবারে শুশ্রূষা পর্ব। প্রথমেই কথা উঠলো ইঞ্জেকশনের যা শোনার পর সমস্ত জখম একদিকে ও কান্না একদিকে। সান্ত্বনার তো অগাধতা বাড়ছে ক্রমশ। এ বলে ‘কিচ্ছু হবে না বোন’, তো ও বলে ‘পিঁপড়ে কামড়ের চেয়েও কম লাগে দেখবি’। কিন্তু সে কথায় আমি বিশ্বাসী হব কেন। আমার বিশ্বাস ইঞ্জেকশন দিয়ে আর কেউ বাড়ি ফেরে না। যথারীতি ওজর আপত্তির অবধি রইলো না। কিন্তু তারা জায়গা করতে পারল না সমস্যার তীরে।যেতেই হ’ল জন্মাবধি সেই ভয়ের মুখোমুখি হ’তে! বাবার কোলে আমি আর সাহসে যাতে কোনো ঘাটতি না পড়ে সেই প্রত্যয় যোগাতে দাদারা ও তাদের বন্ধু-সংসার! দাঁতে দাঁত চেপে নিষ্ঠুর চিকিৎসার ছুঁচ ফোটাতে হ’ল এবং এইটিই যে জীবনে চেঁচিয়ে ওঠবার শ্রেষ্ঠ সময় তা প্রমান করে দিলাম। অবশেষে যুদ্ধবিরতির পর মুখে নিয়ে মলিন হাসি ফিরে এলাম সদলবলে যখন বিখ্যাত দিবসের সূর্য নামে পাটে।

মানসিক পাড়ায় এই ছেলেবেলা দীর্ঘায়ু! বিস্মৃতির ধুলো মাখে না সে কখনো! পরিণত বয়সে হৃৎপিণ্ডে যখন বাস্তব ছেনি-হাতুড়ি  চালায় তখন প্রলেপের জন্যে আবেগ উড়ে যায় তারই কাছে এবং পেয়েও যায় আশানুরূপ বিশল্যকরণী! মিলন-ভাবনায় মোড়া অমোঘ অন্দর-মহলের নামই শৈশব যা আলো জ্বালে দীর্ণ পরাজয়ে! এ কথা অভিজ্ঞতা বলে!




ভাইয়ের সাথে কাটানো দিনগুলো 
                               বুলবুল দে

" এমা, ভাইটা লাল রঙের কেন?"
    "একদম ছোট্ট তো তাই,  তুই ও যখন এতটুকু ছিলি এরকমই লাল ছিলি "
     জেঠাতো দিদিদের সাথে ভাইকে প্রথম হাসপাতালে দেখতে গিয়ে আমার প্রশ্নের জবাবে দিদিরা একথা বলেছিল।  আমার আরও নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দিদিরা হেসে কুটিপাটি, মনে আছে এখনও। তার পর ভাইকে নিয়ে মা বাড়িতে আসলে মায়ের গায়ের গন্ধ টা কেমন যেন পাল্টে গিয়েছিল। মা আর ভাইয়ের গায়ে একই গন্ধ। মা বলেছিল হাসপাতাল থেকে এসেছি ওষুধ পত্র খাই তাই এই গন্ধ। এক দুদিন পরেই চলে যাবে  । সত্যিই তাই হয়েছিল। আস্তে আস্তে আমার জড়তা
কেটে গেল। ভাইকে আদর করতে শিখলাম। হামাগুড়ি দিতে শুরু করল যখন তখন তো ওকে সামলানোই যেত না এত দুষ্টু  হয়েছিল। স্নান করতে যাবার সময় মা ওকে খাটের পায়ায় দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখত তখন এমন চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিত আমি অনেক ভুলিয়েও থামাতে পারতাম না। ভীষণ কষ্ট লাগত আমার। একদিন তো কান্না সহ্য করতে না পেরে আমি দড়ির বাঁধন খুলে দিলাম ব্যাস আর যায় কোথায়, একেবারে তান্ডব লীলা শুরু করেদিল।ঘরের সমস্ত জিনিস তছনছ করে, ঠাকুর গুলোকে ছুড়ে ফেলে একেবারে সাংঘাতিক কান্ড! এসব করতে গিয়ে নিজেও বারবার ব্যাথা পেয়ে কেঁদে উঠছে পরক্ষণেই থেমে গিয়ে আবার হুলুস্থুলু বাধাচ্ছে। আমি নিজেই তখন এত ছোট যে ভাইকে ধরে রাখার ক্ষমতাই নেই। আমিও চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলাম। ভাই হওয়ার পর তখন আমরা আবার জলপাইগুড়ির ভাড়া বাড়িতে চলে এসছি। ঘরে কেউ নেই। চিৎকার শুনে মা তো আঁধা স্নানেই বাথরুম থেকে দৌড়ে এসে শেষমেশ সব সামাল দেয়।বাপরে তার পর থেকে হাজার কাঁদলেও, কষ্টে বুক ফেটে গেলেও আর একদিনও বাঁধন খুলিনি। শুধু ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি আমার সীমিত সাধ্যে। এরপর আমরা পাকাপাকি ভাবে কোচবিহারে চলে আসি। হাসি খেলা খুনসুটি করতে করতে দুজনেই বড় হতে থাকি। ভারি মজা
হত মাঝেমাঝে যখন ভাইকে লিপস্টিক,কাজল, টিপ, মেয়েদের জামা পরিয়ে মায়ের ফলস্ চুলদিয়ে বিনুনী ঝুলিয়ে মেয়ে সাজিয়ে সব জেঠুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতাম সবাই দেখে না বোঝার ভান করে বলত," ওমা এটা আবার কার মেয়েরে? " তখন নিজেই মনে মনে নিজের নিখুঁত সাজানোর তারিফ করে গর্বিত হয়ে উঠতাম।ভাই ও বোধ হয় মজা পেত তাই সাজানোর সময় চুপটিকরে থাকত। তবে
আর একটু বড় হলে আর সাজতে চাইত না।বোধ হয় পৌরুষে বাঁধত। একবার সুনীতিতে পড়তে, ক্লাসে বসে আছি হঠাৎ দেখি সব মেয়েরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জটলা পাকাচ্ছে আর গেটের কাছে দারোয়ানের ঘরের দিকে যেন কি দেখাচ্ছে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। তার পর একটা মেয়ে যখন ভাইকে দারোয়ানের ঘরথেকে নিয়ে আসল আমি তো হতবাক! আসলে ও তখন সামনেই বাংলা স্কুলে ক্লাস টু তে পড়ত। বাড়িতে খুব দুষ্টুমি করত বলে     চার বছরে ওকে ক্লাস ওয়ান এ ভর্তি করানো হয়েছিল।পরে ক্লাস থ্রি তে জেনকিন্স এ ভর্তি হয়। স্কুলের ছুটি হতেই আমার স্কুলে চলে
এসছে কারণ বাবা নাকি আমার সাথে বাড়ি যেতে বলেছে। এদিকে আমার তখনও দুটো ক্লাস বাকি।
টিচার ক্লাসে আসলে ভাই কে কোনও রকমে লুকিয়ে আমার পাশে বসালাম। কিন্ত টিচার তাও দেখেফেলেছিল।  ভেবেছিলাম খুব বকা খাব। কিন্ত টিচার বকলেন না, ভাইয়ের নাম, কোন ক্লাস ইত্যাদি
জিজ্ঞেস করার পর বললেন এইভাবে অন্য স্কুলে
ঢুকতে হয়না।আমি মুখ কাচুমাচু করে বসে থাকলাম। 
         রাখীর সময় ভাই ফোঁটার সময় ওর আগ্রহটাই
বেশি ছিল। নিজেই রাখি কিনে আনত। নয় বছর বয়সেই টুকটুক করে বাজারে চলে যেত। ও ই প্রথম বাড়িতে ইন্দ্রজাল কমিকস্ আনতে শুরু করে। আমি গো গ্রাসে সেগুলো পড়তাম।প্রথম ক্যাডবেরি চকলেট প্রথম ম্যাগি ভাই ই ওই ন দশ বছরে দাশ ব্রাদার্স থেকে এনেছিল। একবার ফেলুদার সিনেমা দেখে কোত্থেকে একটা বুমেরাং নিয়ে এল কিন্ত সেটাতো কিছুতেই আর ঢেল মারলে ফিরে আসেনা! আর একবার আনল সিলভার স্টার স্ট্যালনের হাতে যে হাতিয়ার থাকে নাম টা ভুলে গেছি , সেটাও কোত্থেকে জানি এনে কসরত করে শেখার চেষ্টা করল। আমার জমিয়ে লুকিয়ে রাখা পয়সাগুলো কখন যে চপ তেলেভাজা খেয়ে শেষ করে ফেলত  টেরই পেতাম না। যখন পেতাম তখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বেঁধে যেত। আবার যখন নতুন নতুন খাবার জিনিস, গল্পের বই আনত তখন খুব আনন্দ হত।এভাবেই আমাদের দুই ভাই বোনের বড় হয়ে ওঠা ।
কত কত ঘটনার ঘনঘটায় আনন্দ মুখর সেসব স্মৃতি সে তো আর বলে শেষ করা যায়না। খুব  ছোট বেলার এক দুটোতেই ইতি টানলাম।



আমার বোন
রীতা মোদক

আমার একটা নয় , দুটো নয় , তিন- তিনটে পিঠাপিঠি বোন । হাসিখুশি ,খুনসুটি লেগেই থাকতো সবসময়।আবার কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারতাম না।কাকে নিয়ে লিখবো আর কাকে ফেলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
আমার প্রথম বোন অজন্তা। পড়াশোনায় একটু কাঁচা হলেও খেলাধুলায় তার সাথে কেউ পেরে উঠত না।প্রতিবারই  বাড়িতে প্রাইজ আসতো। দৌড়, জং জাম্প, হাই জাম্প, ডিসকাস থ্রো, লৌহ বল নিক্ষেপ, সাইকেল রেস সবকিছুতেই ফাস্ট অথবা সেকেন্ড প্রাইজ।আমি স্কুলে পড়াশোনায় প্রথম হলেও খেলাধুলায় প্রাইজ আনা বড় কথা বেশিরভাগই  পেছন দিক থেকে প্রথম হতাম । আমাদের বাড়ির সামনে একটা পুকুর ছিল ।সেখানে ছোট - বড় সবাই স্নান করত।পুকুর পাড়ে কয়েকটা মাঝারি সাইজের শিশু গাছ ছিল। পাড়ার কিছু দুরন্ত ছেলে শিশু গাছের ডালে চড়ে সেখান থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিত।আমার বোন ও ওদের থেকে কম কিছু নয়।সেও তরতরিয়ে গাছে উঠে যেত এবং উচু ডাল থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিত।আমি তো ভয়ে সাত হাত দূরে।সাঁতার ও শিখেছে আমার থেকে অনেক আগে।ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার, পদ্মাসন করে সাতরে স্পিডে পুকুর পাড় হয়ে যেত।আমার তো  ভেতরে ভেতরে ভীষন লজ্জা-- বড় হয়েও সাঁতার জানিনা। কিন্তু সেটা সবাই জেনে গেলে আরো মুস্কিল হয়ে পরবে।আমিও হারবার পাত্র নই।তাই বুদ্ধি করে একটা বড় পাথর নিয়ে জলের নিজ দিয়ে হেঁটে হেঁটে প্রায়ই উপরে উঠে আসতাম ।সবাই ভাবে আমিও ভালো ডুব সাঁতার জানি।একদিন কি হলো আমি পাথর ধরে জলের নিচে চুপ করে বসে আছি,এমন সময় আমার বোন উপরের গাছ থেকে এমন জোরে ঝাঁপ দিল এক্কেবারে পরলো এসে আমার মাথায়। আমিতো জল খেতে খেতে কুপোকাত।আর একটু হলেই হয়তো আমার ডুব সাঁতারের কেরামতি জন্মের মত বেরিয়ে যেত।ছোটবেলায় বোনের জামাকাপড়ের উপর কোনো ভালোমন্দ অথবা কোনো প্রকার হিংসে ছিল না। ওর জামা  যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না পরি ততক্ষণ সে বুঝতেই পারতো না তার জামাটা ভালো কি মন্দ ।ওর জামা আমি পড়তাম,আমার জামা সে পড়ত।কোনটা আমার জামা,কোনটা বোনের জামা কেউ বুঝতেই পারতো না।

আমার দ্বিতীয় বোন সবিতা।ছোটবেলা থেকেই সে বেশ সৌখীন। কুকরানো চুল এবং দেখতে আমাদের থেকে অনেক সুন্দর ।খাওয়া দাওয়া এবং জামাকাপড়ের প্রতি পরিপাটি থাকতেই সে  পছন্দ করত।ওর জামা কাউকে পড়তে দিত না এবং সবচেয়ে দামী জামার প্রতি ওর আকর্ষণ ছিল একটু বেশি । মা সবাইকে সেরকম ভাবে দিতে পারতো না । তাই সে বাজারের সবচেয়ে বেশি দামী জামার জন্য মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করত।  মা চিন্তা করে কোনো পথ না পেয়ে শেষমেশ একটা বুদ্ধি বের করলো। বোনকে না নিয়ে দোকান থেকে একাই জামা জামা কিনে এনে বোনকে ডবল দাম বলতো।তাতে বোন বেজায় খুশি। আমার বাবা গোকসারডাঙ্গা একটা মিষ্টির দোকানে থাকতেন। তখন রাস্তায় এতো গড়ি ছিলো না।বোনের  তখন ক্লাস টু কিংবা থ্রী হবে। হাপ প্যাটেল এ সিতাইমোড় থেকে  বাড়ী পর্যন্ত বাবার সাইকেল  নিয়ে চালানো শিখত।একদিন দুপুরের দিকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে ,অনেকক্ষণ হয়ে গেলো ফিরে আসার নাম নেই। তখন মায়ের খুব চিন্তা হলো।মায়ের সাথে সাথে আমরাও পাগলের মত বোনকে খোঁজা শুরু করলাম।আশেপাশে জিজ্ঞেস করেও কোনো খবর পাওয়া গেলো না।কেউ কেউ বলছে ফাঁকা রাস্তায় একা পেয়ে ওকে হয়তো কেউ তুলে নিয়ে গেছে ।মা তো পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে,আমরাও কান্নাকাটি করে অস্থির।প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে এমন সময়  কাছে সাইকেলের দোকানের একটি ছেলে শ্যামল এসে মাকে বলল -- 'আপনার মেয়ে আমাদের দোকানের সামনে সাইকেল এক্সিডেন্ট করেছে,সাইকেলটা আমার কাছে আছে।'
মা ভেবেছেন বোনের হয়তো কোনোকিছু হয়ে গেছে।তাই  এ কথা শুনে আরো কান্নায় ভেঙে পড়ল।তখন শ্যামল মাকে জানায় -- আপনার মেয়ের সেরকম কিছু হয়নি, হাঁটুতে অল্প কেটে গেছে।আপনার ভয়ে বাড়ী আসেনি। ও কাকুর কাছে চলে গেছে ,আমি বাসে তুলে দিলাম।পরের দিন সকালে বাবা বোনকে নিয়ে বাড়ী আসে।

আমার তৃতীয় বোন অর্থাৎ সবার ছোটো আদরের বোন ঝুমুর।ডাক নাম ঝুমা। ছোটো বেলা থেকেই খুব আহ্লাদী এবং ন্যাকা ন্যাকা কথা বলত।তার বায়নার শেষ ছিলো না।অল্পতেই কেঁদে ফেলতো এবং মা এসে আমাদের খুব বকা দিত।অজন্তা আর আমি যদি কোথাও যেতাম সে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরত।নিয়ে গেলেও জ্বালা।হাত ধরতে বললে দুজনের হাত ধরে ঝুলে পড়ত,আবার হাত ছাড়তে বললে রাস্তা দিয়ে উল্টাপাল্টা দৌড়াতো।নদী দেখলে ভীষণ ভয় পেত।কোলে চড়ে ব্রীজ পাড় হতো।একবার পুজোতে লাছা নামে ঘাগরার মতো একধরনের পোশাক খুব বেরিয়েছিল।একদিন রাতে আমরা সবাই পড়াশুনা করছি তার মাঝে হঠাৎ করে ঝুমা বলে উঠল ---- বড়দি এবার পুজোতে আমাকে জালা কিনে দিবি।
আমিতো ওর কথা শুনেই কি চায় একবারে বুঝে গেছি।তবু না বোঝার ভান করে বারবার জিজ্ঞেস করছি -- জালা কি? কলসী নাকি বস্তা।মা , বোনরা সবাই হাসতে হাসতে প্রায় পেট ফাটার মত অবস্থা।আমরা যত হাসছি ঝুমা ততো জোরে কান্না করছে।শেষে হটাৎ করে আমার দিকে চটে গিয়ে সে কি লার্থি ঘুষি ।আর মুখে বলছে তুই জানিস। বোনের আবার অনেক গুণ ছিলো।মায়ের থেকে দেখে দেখে ছোটবেলাতেই সেলাই শিখে গিয়েছিল। সেলাই করে পুতুলের জামাকাপড় বানাতো।একবার আমার একটা নতুন হলুদ জামা দেখি পিঠের দিকে অনেকটা কাটা। ইদুরের কাটলে তো এমন চারকোনা করে কাটবে না।মা তো আমাকে বকছে জামার এই অবস্থা কেমন করে হলো।শেষে দেখা গেলো আমার জামার অংশ দিয়ে পুতুলের জামা বানানো হয়েছে । ঝুমা আর্টে ও খুব ভালো ছিলো।একা একা খুব সুন্দর ছবি আকত।একদিন আমি উঠোন সাইকেল বসে বলেছিলাম -- তোর ফোন থাকলে এরকম ভাবে আমার একটা ছবি এঁকে দেখতে পারবি?
বোন তখন আমার সাথে কোনো তর্ক না করে অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।দুদিন পরে দেখি সাইকেল বসা অবস্থায় হুবহু আমাকে এঁকে ফেলেছে ।
এখন  আর আমার বোনদের মধ্যে খুনসুটি, মারামারি হয় না।  ।কারণ আমরা সবাই এক সাথে নেই। প্রত্যেকের বিয়ে হয়ে একেক জায়গায় থাকে ।আমি খুব মিস করি সেই দিনগুলি।জামাই ষষ্ঠীর সময় অথবা কোনো পূজা - পার্বণে সবাই একসাথে হই।অনন্দ হৈচৈ করতে করতে কখন সময় শেষ হয়ে যায়।বড্ড মনে পড়ে শৈশবের দিনগুলি।

Tuesday, April 5, 2022


 

সম্পাদকের কথা 

আর একটি নতুন বছরের দাঁড়িয়ে আমরা। বছরের এই সময় মানেই গাজনের বাজনা আর চরকের রহস্যময় হাতছানি। ওদিকে শুরু হয়ে গেছে পবিত্র রমজান। অন্যদিকে এই সময়েই  সবাইকে কাঁদিয়ে ঈশ্বরপুত্র জিশু কোনও এক শুক্রবারে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন। 

সব দিক থেকেই তাই এই সময়ের, এই ঋতুর তাৎপর্য ভিন্ন। করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে সেই তাৎপর্য যে  অন্য মাত্রা পাবে, সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই। 

তবে সামাজিক জীবনে বোধহয় আমরা কেউ সেভাবে ভাল নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম ক্রমাগত বেড়ে চলা, ছাত্রদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে আসীন শিক্ষাকর্তার হেনস্থা হওয়া, খুনের বদলা নিতে গিয়ে নিরীহ সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারা, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া  ইত্যাদি সবকিছু দেখে মনে হয় অন্ধকার একটি বছর বিদায় নিতে চলল। কিন্তু একই সঙ্গে এই প্রশ্নও জেগে উঠছে মনে, নতুন বছর আদৌ কোনও আলো নিয়ে আসবে? নাকি এই বছরের মতো সে-ও গাঢ় অন্ধকারকে গাঢ়তর করবে!   



মুজনাই অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৮

বর্ষশেষে 

মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)

প্রচ্ছদ- প্রীতম কর 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই অনলাইন চৈত্র   সংখ্যা ১৪২৮


বর্ষশেষে 

আছেন যাঁরা 

শিবির, মাথুর দাস,  চিত্রা পাল, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, বুল্বুল দে, শ্রাবণী সেন, সম্পা পাল,

রীনা মজুমদার, প্রতিভা পাল, সৈকত দাম, অর্পিতা মুখার্জি চক্রবর্তী,

বটু কৃষ্ণ হালদার, কাকলি বিশ্বাস সরকার, বিজয় বর্মন, অলকানন্দা দে, 

বনশ্রী মুখোপাধ্যায়, স্বপন কুমার চট্টাপাধ্যায়, সারণ ভাদুড়ী,

মজনু মিয়া, শৌভিক কার্য্যী, সংগীতা মিশ্র, স্বপন কুমার দত্ত, রীতা মোদক, 

তপন বসাক, নিলুফা ইসলাম, অদ্রিজা বোস, অনুস্মিতা বিশ্বাস


বর্ষশেষে    



বর্ষশেষে বিদায়...


চলে যায় মরি হায়... 

শিবির 


ঝরাপাতাগো ! চৈত্রবেলা শেষ হয়ে এলো ,  এবার তোমার যাবার পালা, নিদাঘের খরতাপ বয়ে আসে বুঝি ঐ দুরন্ত বৈশাখ ! পত্ ঝর্ শুরু তপ্ত ঘুর্ণি হাওয়া বনে বনে দাবানল উঠবে জ্বলে অনেক হাসি অশ্রুজলে তোমার বিদায়মন্ত্র এনেছে পড়ন্ত ফাগুন, এবার যে যেতে হবে...  
এসেছে চিরনূতনের ডাক ! 

দক্ষিণ দুয়ার খুলে এসেছিলে রঙিনবার্তা নিয়ে
পত্রে পত্রে চঞ্চলিয়া উঠেছিল অশোক কানন 
মধুমঞ্জরী পুঞ্জ পুঞ্জ আমের ডালে ডালে
রঙের বিন্যাস , আল্পনা আঁকে ফুলেরা সব
কী অপরূপ শোভা  বনান্ত ছেয়ে অরণ্যহাসি
মিলনবাঁশির সুর পাতায় পাতায় বসন্ত্ রাগে 
বিচলিত চিত্ চোর উচ্ছাস লতাবিতান ঘেরা
সরোবর পাড়ে দুষ্টু চাঁদের হাসি পাতার আড়াল সরিয়ে...  
ঝরাপাতা তখন তোমার যৌবন উদ্বেল
সূর্য আলোয় ঝিকমিক, ঠমকে গমকে প্রেমের গজল 
মন্দ বাতাস সঙ্গী মিলন আকাংখা শরীর জুড়ে  
কতো খেলা কতো রঙ্গ সবাই জানে... 

ঝরাপাতা , ওগো ঝরাপাতা !  আমিও তো তোমারই দলে, কত স্মৃতির শৈশব, বসন্তযৌবন  পার হলো দুঃখ সুখের দোলায়, এ মাটি জল এ আকাশ  বিশাল আলো হাওয়া প্রাণ ভ'রে শ্বাস প্রেম বিরহদিনের সুখের ব্যথা -- সব কিছু ফেলে  চলে যেতে হবে অচীন দেশে, সময় বলছে সে কথা ,  শুকনো পাতার মর্মর শব্দ শুনতে পাই সৃষ্টির পথ দিয়ে যেতে যেতে... 

দুঃখ কী তোর ঝরাপাতা !  নূতনের টানে টানে 
আবার ফিরে আসবি রঙের খবর নিয়ে,  মধুমাধবীতে উল্লাস পাতায় পাতায় মুগ্ধহাসি হেসে হেসে ! 

                         

বর্ষশেষ 


বর্ষ হয়ে আসে শেষ

চিত্রা পাল

 চলে যায় বসন্তের দিন, চৈত্র অবসান।উত্তপ্ত দিন আর মনোরম রাত, বেল মল্লিকা চাঁপা ফুলের সুবাসে মত্ত বাতাস। বসন্তের সঙ্গে এদেরও সঙ্গ পাওয়া যায়। কতকগুলো জিনিস কখনো পুরনো হয় না।কেবল অন্য  পারিপার্শ্বিকের চাপে পুরনো হয়ে যায়। আমার সামনে থেকে যখন সরে যায়, তখন তার ঝকঝকে উপস্থিতি  হ্রাস হয়ে যায়, কিন্তু  ফিরে যেই সামনে আসে, আবার পুরনো ভাব নতুন হয়ে ওঠে।

 বর্ষশেষের বেলায়ও তাই হয়।চৈত্র অবসানে মনে পড়ে আমার ছোটবেলার কথা। আমাদের বাড়ির সামনে বহতা পুণ্যসলিলা গঙ্গা নদী। সেই নদী তীরে দ্বাদশ শিব মন্দিরে চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন নীল ষষ্ঠি  পুজোর দিন থেকেই সাধারণের শিব পুজো শুরু। সেদিন থেকেই বেশ মেলা বসে যায়। সারাদিন শিব পুজো হয় আর মন্দিরের ঘন্টা বেজেই  চলে অবিরত ঢংঢং।সন্ধ্যায় শিবের ঘরে প্রদীপ জ্বেলে  হয় পুজো সমাপন।

পরেরদিন ওখানে মন্দির চত্বরে বসে চড়কের মেলা। চত্বরের মাঝখানে পোঁতা হয় চড়ক গাছ। বিকেলে সেই চড়ক গাছ পুজো করার পরে চলে তাকে ঘোরানো আর তার সঙ্গে নানান খেলার কসরত্‌। কি করে যে ওরা করতো বাবা কে জানে।বাণ ফুঁড়ে নিয়ে চড়কগাছটাকে চরকির মতো ঘোরানো হতো, আমরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে  ফেলতাম। কোন কোন বার সব আয়োজন করা হয়েছে, হঠাত্‌ কাল বোশেখির ঝড় এসে সব তচনচ করেছে এমনও হয়েছে। একএক বার যখন খুব ভালো থাকে সব দিক, মেলা বেশ জমে ওঠে। একবার ওই মেলা থেকে শখ করে  আমার মা আমাকে একজোড়া সুন্দর কাঁচের বালা কিনে পরিয়ে দিয়েছিলো। হাত  ঘোরালেই সে বালায় নানা  রকমের রঙ চলকে উঠতো। মাত্র দুদিন পরেছিলাম। জানলা খুলতে গিয়ে ধাক্কা লেগে ডান হাতেরটা একেবারে টুকরো টুকরো  হয়ে ভেঙে গেলো। বাঁহাতেরটাও কদিন পরে গেলো। এখনও ওই বালাদুটোর  কথা মনে পড়ে।

       চড়ক সংক্রান্তির পরের দিন ১লা বৈশাখ, নতুন বছরের শুরু।নতুন বছরের কত সমাদর। তবু বছরের  বিদায় বেলায় এখনো সেই স্মৃতি মনে ভেসে আসে। মনে হয় এইতো সেদিন। আর তার সঙ্গে মনে হয়  এই তো আবার বর্ষ হয়ে আসে শেষ, আবার আসবে নতুন, এ চলা যে অশেষ।  

  


বর্ষশেষের স্মৃতি      

                      

বর্ষশেষের দিন গুলো

      বুলবুল দে

বছরের শেষ ঋতু বসন্তের দুটি মাস ফাল্গুন চৈত্র  পরস্পর যেন একটু হলেও আলাদা রকম। ফাল্গুনের খা খা রোদ্দুরের ধূ ধূ দুপুরটাতে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হু হু করা শূন্যতায় ভরে ওঠে। যখন কনকনে শীতের কাঁপুনী নেই, গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপের হাঁসফাঁস করা উৎপাত নেই, অবিরাম বর্ষার নিত্যদিনের সিক্ততা নেই। চারিদিকে কেমন যেন কি নেই -কেন নেই -কোথায় নেই, এই নেই নেই ভাব মনটাকে আচ্ছন্ন করে রাখে।জীর্ণ, মৃত্যুপথযাত্রী পাতারা বৃক্ষলোক ত্যাগ করে  মৃত্তিকা লোকে আছড়ে পড়তে থাকে আর বৃক্ষলোকের আনাচে কানাচে উঁকি ঝুঁকি মারে তাদের উত্তরসূরী নব প্রজন্ম। বিস্মিত বিস্ফারিত চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে নতুন পৃথিবীকে। কলকাকলীর সুরমুর্ছনায়, ফুলদলের বর্ণময়তায় শান্ত স্নিগ্ধ সমাহিত ফাল্গুন কে যেন ঝটকা মেরে ধ্যানভঙ্গ করে দামাল কিছুটা রুক্ষ কিছুটা সরস দুষ্টু মিষ্টি চৈত্র। দমকা হাওয়ায় অবশিষ্ট পুরাতনকেও জানায় পত্র পাঠ বিদায় সম্ভাষণ। মেঘের কলস থেকে অল্প অল্প করে ঢেলে দেয় তৃষ্ণার জল। ডালে ডালে সবুজ নব প্রজন্মের সংশয়িত চোখে দেখা দেয় সস্তির ছায়া । তারা নির্ভয়ে বাইরের জগতে বেরিয়ে এসে প্রবল উৎসাহে উল্লসিত হয়ে বেড়ে ওঠে। চৈত্রের হালকা ঝোড়ো হাওয়া মাঝে সাঝে কয়েক পশলা বৃষ্টি অন্তিম বছরের শেষ কটা দিন পৃথিবীকে যেন সবুজ সতেজ করে রাখতে চায়। এমন দিনেই উদ্দাম হাওয়ায় বাড়ির পিছনের উঠোনে বিশাল প্রাচীন সৌধের মত আম গাছটার তলে দৌড়ে যাওয়া, যেখানে ঝরে পড়া শুকনো পাতা,আমের মুকুল, আর ছোট্ট আমের কুঁড়ি গুলো কেমন যেন অসহায়ের মত পড়ে থাকে। আর ধেয়ে আসা হাওয়া,"এই তোরা সর সর সর " বলে তাদের দুরে সরিয়ে দেয়। তা দেখে বুকের ভেতরটাও যেন কেমন সির সির করে উঠে। মাঝে মধ্যেই বড় ডাসা কাঁচা আম পেলে খুশির সীমা থাকেনা। দৌড়ে রান্নাঘর থেকে হাতের চেটোয় লবন নিয়ে উঠোনে পাঁজা করে রাখা ইটের ওপর বসে পা দোলাতে দোলাতে রসনা তৃপ্তির রসে ডুবে যাওয়া । চৈত্রের দুপুরে ঢাক বাজিয়ে চরক পূজার মাগন নিতে আসা, মা উঠোনে জল ঢেলে দিলে লাল কাপড়ে প্যাচানো সিঁদুর লেপা একটা কাঠ উঠোনে রেখে তাকে ঘিরে শিব পার্বতীর নাচ, আর আমাদেরই খুব ছোট বেলায় গভীর রাতে সবার ঘুম ভাঙিয়ে একদল লোক শিব পার্বতী ও নানারকম সং সেজে বাড়িতে ঢুকত। তারা নেচে নেচে নানারকম মজার গান করত দুটো গানের একটা করে লাইন মনে আছে--- "বৈরাগীর টিক্কি ফাঁটা মাথায় জিগার আঠা ! ", "জয় রে জগ্গন কাশীমের নন্দন গরু ভাইঙ্গা বেড়া নিল চুরে! " এই রকম একেক বছর একেকটা গান। কি মজা যে লাগত! প্রতিবছর চৈত্র মাসে এই রাতের অপেক্ষা থাকত। তার পর আরও বড় হওয়ার সাথে সাথে রাতের এই মজাটা বন্ধ হয়ে গেল। চৈত্র সংক্রান্তির সকালে নদীতে স্নান করে সেখানকার মেলায় দৈ চিড়া খাওয়া, সন্ধ্যায় পাড়ার মাঠে চড়ক ঘোরানো দেখতে গিয়ে বুকে পিঠে মুখে বড়শি ফোঁটানো লোক গুলোকে দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ করে দেওয়া। তার পর পাপড় ভাজা খেতে খেতে পরদিন নববর্ষের নতুন জামা আর হালখাতার সুখ স্বপ্নে ভাসতে ভাসতে বাড়ি ফেরা। আগেকার দিনে কত ছোট ছোট জিনিস থেকেই আনন্দ আর সুখ খুঁজে পাওয়া যেত! বর্ষশেষের দিন থেকেই নববর্ষের আনন্দোৎসব শুরু হয়ে যেত।


জলেশ্বরের স্মৃতি 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

কলেজ জীবনে  চৈত্র সংক্রান্তিতে জলেশ্বরের মেলার অপেক্ষায় থাকতাম,  সারা বছর ধরে।  ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি চৈত্র মাস এর পয়লা তারিখ থেকে তুলসীমঞ্চের তুলসীগাছের উপর ,  বাঁশের   ভারা বেঁধে,   মাটির   ভাঁড় বা কলসি   টাঙিয়ে, তাতে  ছিদ্র করে এমন ভাবে জল  রাখা   হত যে, চৈত্রের  কাঠফাটা  রোদে, সারাদিন ধরে তুলসীগাছের মাথায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ত।    দিনের   মধ্যে   ১৫/২০ জন সন্ন্যাসী, ও সন্ন্যাসীনি বাড়ির উঠোনে আসতেন।  গেরুয়া  বসন   ছিল    তাঁদের।  তাঁদের     কেউ,  " তারকেশ্বরের শিবো মহাদেব " কেউ কেউ,  বাবা জলেশ্বরের শিবো মহাদেব " বলে ভিক্ষা প্রার্থনা করতেন। তাঁরা  কেউ ই অর্থনৈতিক দিক থেকে কমজোর তা নয়। তাঁরা বাবা বুড়ো শিবের কাছে মানত করতেন যে  ভিক্ষা করে (বাড়ি বাড়ি চাল, ডাল  অর্থ সংগ্রহ করে) সেই অর্থে তারকেশ্বর বা জলেশ্বরে চৈত্র সংক্রান্তিতে শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢালতে যাবেন।

উত্তর চব্বিশ পরগণা র গাইঘাটা ব্লকে প্রায় চার একর জমির উঁচু ঢিপি র উপর,  বট, অশ্বত্থের গাছের সংলগ্ন সুবিশাল দুধপুকুরের ধারে বাবা জলেশ্বরের মন্দির। শুরুতে সেখানে পর্বত প্রমাণ  উঁচু ঢিপি ছিল না। দুধপুকুর ও ছিল না।  কথিত আছে একবার চৈত্র সংক্রান্তিতে সন্ন্যাসীরা যখন তারাপাঠ ভাঙছেন তখন সেই খানে একজন অশ্বারূঢ় ইংরেজ  সাহেব এসে, সব শুনে অবিশ্বাস প্রকাশ করেছিলেন।  বলেছিলেন, " তোমরা অস্ত্রের উপর ঝাঁপ দিতেছ সেগুলি ভোঁতা।  তোমরা যদি আমার তরবারির উপরে ঝাঁপ দিতে পার, তাহা হইলে আমি তোমাদের   শিব ঠাকুর আছেন বলিয়া  বিশ্বাস করিব।" 

 বাবা বুড়ো শিবের উপর সব  সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস থাকলেও,  কারো কারো কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। অবশেষে মূল সন্ন্যাসী লক্ষ্য করলেন, একটি বড় ডাঁস মাছি ইংরেজ সিপাহির তরবারির উপর অনেক সময় ধরে  বসে আছে। বাবা বুড়ো   শিবের নাম করে,  মূল সন্ন্যাসী সেই তরবারির উপর ঝাঁপ দিলে, তরবারিটি ভেঙে গেল, কিন্তু মূল সন্ন্যাসীর কোন রক্তপাত বা কিছুই হলনা। তখন ইংরেজ সিপাহি ঘোড়া ছুটিয়ে পালাতে গেলে, কয়েক হাজার মানুষ এক মুঠো করে মাটি ছুঁড়ে মেরে দুধপুকুরের ও পর্বত প্রমাণ উঁচু ঢিপির  সৃষ্টি করেন। 

বাবা জলেশ্বর সারা বছর দুধপুকুরেই থাকেন। সন্ন্যাসীরা নীলপুজোর দিন  তাঁকে খুঁজে নিয়ে এসে, তাঁকে রাজবেশ পরিয়ে, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করান। বছরের এই শেষ দিনটি উপলক্ষে সাত দিন ধরে মেলা বসে। মেলায় খাবার, দাবার, খেলনা ছাড়াও  সংসারের নানা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পসরা বসে। সার্কাসের মাইকের গান,  নাগরদোলার শব্দ, বাঁশের বাঁশী  উথাল-পাতাল বাতাসে বট অশ্বত্থের পাতা উড়ে এসে পড়ে।  গবাদি পশু আনন্দে লেজ তুলে খেলা করে।   ছোট বড় বহু প্রজাতির পাখি ও আনন্দে গান গায়। দর্শনার্থীরা  মন্দিরের সংলগ্ন গাছের গায়ে, লাল কার দিয়ে, মানষিক করে ইঁট বেঁধে যান। মনস্কামনা পূর্ণ হলে, মন্দিরে পুজো দিয়ে, বট অশ্বত্থ এর ডাল থেকে ইঁট খুলে ফেলেন। অনেকে দুধপুকুরে স্নান করে ভিজে শরীরে দন্ডি কেটে উঁচু নিচু, কাঁকর বিছানো পথে, মন্দিরে আসেন। পুজো দেন, ধামা ধামা লাল বাতাসার হরির লুঠ হয়। 

শৈশব  থেকে কলেজ জীবন অবধি নিয়ম করে সপরিবারে আমরা জলেশ্বরের মন্দিরে যেতাম।  পুজো দিতাম  এখন  কর্মসূত্রে বিদেশ বিভুইয়ে থাকার ফলে  আর জলেশ্বরের মেলায় যাওয়া না হলেও,  মন টা সব সময়  জলেশ্বরেই পড়ে থাকে।




বর্ষশেষের কবিতা প্রথম পর্যায় 


এই চৈত্র দিন
শ্রাবণী সেন

চৈত্র মাস, ভরা চৈত্র এই ... 
  এখন কি বসন্ত আছে!
কচি কচি পাতাভরা 
ফুলভারে আনত যৌবনবতী গাছ
স্পষ্টতর সাক্ষ্য তার কত,  তবু সে আছে তো!
বসন্ত আছে তো!
মাটির আকন্ঠ পিপাসা, 
এই ভরা চৈত্রে, সে ও তো  কঠিন সত্য! 
চৈত্র যায়, বর্ষ যায়!
  নতজানু  বিস্মৃত প্রেমিক,
শেষ কৈশোরের প্রেমিকার কাছে
অসমাপ্ত চুম্বন প্রার্থনায়!
জীবনের চৈত্র বেলায়!
নাকি কোনদিন  ছিল না প্রেমিকা সে
প্রেমিকের চৈতালি পিপাসা শুধু!
শুষ্ক নদী বড় অসহায়!
বর্ষ শেষ...  বর্ষ যায়....  নতুনের অপেক্ষায়! 



ফার্স্ট ফ্ল্যাশ ,সেকেন্ড ফ্ল্যাশ
সম্পা পাল


সাড়া আছে
শব্দ আছে
শোক আছে
তারপরও বিজ্ঞাপন আসে গ্ৰীষ্মের উঠোনে
তুমি ঘুমিয়ে পড়ো , একগুচ্ছ স্বপ্ন ওড়ে

টিভির পর্দায় একে একে টেলিকাস্ট হয় নতুন নতুন ধারাভাষ্য
আশ্চর্য মেয়েটি কাল রাতে মারা গেছে
শনাক্তকরণ এখনও হয়নি

উত্তরবঙ্গ জানেনা চা বাগানের হারিয়ে যাওয়া
সেই মেয়েগুলো আর কেন ফেরেনা...

শুধু ফার্স্ট ফ্ল্যাশ,সেকেন্ড ফ্ল্যাশ এখনও ফেরে...



যায় বচ্ছর

মাথুর দাস


আয় বচ্ছর   যায় বচ্ছর   গয় গচ্ছ   দিন

যা-ই দিচ্ছ    তা-ই নিচ্ছ   নয় স্বচ্ছ   সীন্

চোখ ন্যাবা   চ্যাকাভ্যাবা   পায় কেবা   থই

লাগে যুদ্ধ     বোকা বুদ্ধ    হয়ে শুদ্ধ     রই


যত গিলছি   তত মিলছি   ক্ষত ঠিলছি   বেশ

পারি সইতে  বোঝা বইতে  হই চইতে      শেষ

শেষ বর্ষ   কই হর্ষ     হই মর্ষ    না-ছোড়

গাল গল্প   নয় অল্প   খাড়া বড়ি   বা থোড়






বর্ষশেষের ক্যানভাসে...
প্রতিভা পাল

বৃষ্টিভেজা চৈতী হাওয়ায় বর্ষার সাজ আজ;
জলভরা মেঘ ঘন আরও রাত-ছোঁয়া ছাই রঙে!
বছর ভর হিসেব কষে সস্তা যত কান্নার দ্রবণ,
অধঃক্ষেপে গল্প লেখে স্মৃতির খেয়ালি-খাম
অনন্ত আশার আবছা আগামীর ক্যানভাসে!

নিঝুম দুপুর, আলতো রোদের খুনসুটি;
শূন্য জুড়ে শূন্যতা আঁকে ক্লান্ত কলমের নিব,
দিগন্তে হঠাৎ কালবৈশাখীর প্রবল ঝড়ে
খড়কুটো হয় চালচুলোহীন কত শৈশব
জীবনের পাড়ে….  



লাল মাটির পাপ থেকে 
সৈকত দাম

তোমার চোখে মুখে ভালোবাসার ছাপ ,
আমার বুকের শুষ্ক মরূতে লাল মাটির পাপ .....
তোমার শরীরের রোমকূপে আদরের মাদকতা ,
আমার দেওয়ালে জলন্ত রোমান্টিসিজম ,
পুড়তে থাকা কবিতা .....

এভাবেই তুলনামূলক জীবন চলে আজীবন ....
কারো কিছু যায় আসে না ,
তুমি পাহাড়ের বুকে মাথা রাখো যখন ....

ঠান্ডা ঘর তোমায় ভালোই রেখেছে জানি ,
তুমি ভালো আছো সে আমিও মানি .....
Dressing Table এ সমুদ্র আছড়ে পড়ে ,
আলো নিভে যায় হঠাৎ .....
হঠাৎ কেঁপে ওঠে Laptop screen ,
সুখ বাড়াচ্ছে হাত .....

ভালোবাসা অগ্নিমুল্য ,
তবু জ্বরের আভাস পাই ....
পরিবাহি তারের ভেতর সোহাগ খেলে যায় 
এমনি হঠাৎ .....
এমনি হঠাৎ বন্ধ ঘরে পুড়ে ছাই .....

না না আমি চাইছি না কিছু ,
আমার কবিতারা চাইছে ....
ওরা নিস্তার চায় উত্তাপ থেকে ,
লাল মাটির পাপ থেকে .....




স্বপ্ন দেখি
  রীনা মজুমদার

বছর যায়, নতুন রূপে বছর আসে

 বহুদিন দেখা হয় না বর্ষ হয় শুভ
চৈত্রের শেষ রাতে স্বপ্ন দেখি,
  নেই কোন নাশকতা নেই ধর্মের
ভেদাভেদ নেই হিংসার বলি..
মনুষ্যত্বের বিকাশ, সচেতন মজবুত
নিঃস্বার্থ ভালোবাসার হাতে হাত! 

আমাদের দেবভূমিকে সব ভুলে
আমরাই কলুষিত করি,
বুকের ভেতর হয় রক্তক্ষরণ...
  মা, জাগিয়ে দিও না আমায়
ভোরের আলোয় এক বুলি
  শুভ নববর্ষ শুভ নববর্ষ!

   পারি না কেন মা?
 প্রতিটি ভোর প্রতিটি দিনকে
আপন করে মানবিক হতে!!

 তবুও তো মা শুভ দীপ জ্বেলে
 শঙ্খ ধ্বনিতে বর্ষকে বরণ করে
     বলে, শুভ নববর্ষ... 




পিছুটান
 অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

চৈত্র দিনের দহনবেলায়
বার্তা এল যাত্রা শেষের
আনমনা মন উতল হলো
বইল সমীর বিধুর রেশের। 

চৌচির মাঠ, তপ্ত চাতাল
টান ধরানো দিনের মেজাজ
এমনি দিনেই উন্মীলিত
মন-মধুপের বন্ধ দেরাজ। 

মন কেমনের হলুদ বিষাদ
বন্দী যত স্মৃতির জালে
আশ্লেষে আর অনুরাগে
মধুমাসেই কথা বলে। 

ফুলেল বেলার শেষ প্রহরে
গুলমোহর আর রুদ্রপলাশ
আসছে দিনের শপথ নিল, 
'আবির হয়ে মনকে মাতাস।'

ধীর চলা ওই দখিন বাতাস
সজনে ফুলের সুবাস নিয়ে
ঝরা পাতার কানে কানে
বসন্তরাগ শোনায় গিয়ে। 

জোনাকিরা স্বপ্ন নিয়ে
তারা হয়ে উঠলো জ্বলে
চৈতি রাতের দীপ্ত আকাশ
নতুন দিনের গল্প বলে। 

যাবার বেলায় বর্ষ তুমি
জীর্ণতাকে সাঙ্গ করে
মন- মুকুলে প্রস্ফুটিত
বসন্ত- ফুল দাও গো ভরে। 

রেশ থেকে যাক সুবাতাসের
বর্ষ জুড়ে সকল কাজে
মিলন বীণার মূর্ছনাতে
আনন্দ- গান উঠুক বেজে। 




বর্ষশেষের গল্প 

ফিরে দেখা
কাকলি বিশ্বাস সরকার

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন বিড়বিড়  করছিল মোনালিসা...

সকালের সূর্যটা এইমাত্র রঙীন কিরণ ছড়িয়েছে। পাখিরা কাক ভোরেই বাসা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছে খাবারের সন্ধানে, পরিবেশ ব্যস্ততায় পরিপূর্ণ। মনে হয় সূর্যটা ওঠার সাথে সাথেই অস্তাচলে যায়। সারাটা দিন কিভাবে কেটে যায় তারই হিসাবের অঙ্কটা কষছিল মোনালিসা এই সাধ সকালে। ও ঘর থেকে আওয়াজ এল, 'আজ বুঝি সকালের চা বুঝি জুটবে না!` তারপরেই, 'মা খিদে পেয়েছে।`

মোনালিসা নড়ে বসল, কত বেলা হল হিসেবটা পরে কষতে হবে। সংসারে সমস্ত কাজকর্ম মেটাতে দুপুর গড়িয়েছে এবারে ঠান্ডা মাথায় জীবনের সঙ্গে সারাটা দিন মেলাতে গিয়ে দেখল প্রতিদিনের ব্যালেন্সটা যদি মিলিয়ে রাখা যেত, তাহলে চলার পথটা কত না মসৃণ হত। সামনেই ১লা বৈশাখ ব্যাবসায়ীরা ,নিজ প্রতিষ্ঠানের হিসেবটা মিলিয়ে রাখে, কথাটা ভাবতেই, এরই মধ্যে আকাশ টা গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেল। ছাদ থেকে কাপড় গুলো তুলতে হবে, অঙ্কটা পরে কষবো। 

সন্ধ্যা নেমে আসতেই সাঁঝের প্রদীপ জ্বেলে সন্ধ্যা-আরতি করে সন্ধ্যার জলযোগ সেরে বাচ্চাদের পড়ানো সম্পূর্ণ করতেই রাত অনেক হয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে, গৃহকর্ম সেরে উঠতেই ক্লান্ত শরীরে নিন্দ্রার আগমন, চোখ তন্দ্রাছন্ন হয়ে ঘুমের জগতে ।

মোনালিসার জীবনের ব্যালেন্সটা অগোছালো  অবস্থায় পড়ে থাকে। জীবনযাপনের টানে ফিরে দেখা সম্ভব হয় না। একই চিত্র বাস্তব চরিত্রে।




বর্ষশেষের প্রবন্ধ 

বর্ষশেষে এক রক্তাক্ত ইতিহাসের মুখোমুখি রাশিয়া ও ইউক্রেনে
বটু কৃষ্ণ হালদার

অতি মারী করোনার করাল গ্রাসে একপ্রকার বিধ্বস্ত পৃথিবীর হৃদপিন্ড।সেই আগুনের ক্ষত এখন দগদগে।এখনও পৃথিবীর মানুষ আতঙ্কের প্রহর গুনছে।না জানি কখন হায়নার মত হানা দেবে করোনা।তবে যত সামান্য স্বস্থির হওয়ায় পাল লাগিয়ে বিধ্বস্ত জনজীবন এক গহীন আঁধার কাটিয়ে আলোর বিন্দু খুঁজে পেয়েছে,ঠিক সেই মুহূর্তে এই ঠান্ডা লড়াই এর যুগে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিলো রাশিয়া।তবে রাশিয়া প্রসঙ্গে যাবার আগে এখানে আফগানিস্তানের কথা,না বললেই নয়।মাত্র কয়েক মাস আগেই করোনা আবহে, বিশ্বের ত্রাস সৃষ্টিকারী, রক্তপিপাসু তালিবান জঙ্গি গোষ্ঠী আফগানিস্তান দখল করেছে। আফগানিস্তান দখলের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তাদের দ্বারা সাধারণ নিরীহ জনগণ হত্যার খেলা।একের পর এক প্রাচীন স্থাপত্য শিল্প সহ ধর্মস্থান ও বিমানবন্দর ধ্বংস করা হয়েছিল। এই অতি মারি করোনার ফলে, কোথাও গণ চিতা গণকবর দেওয়া হয়েছে।ঠিক এই মুহূর্তে ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার অতর্কিত হামলা সমগ্র বিশ্বের উপর এক ভয়ঙ্কর আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। রাশিয়া বিশ্বের এক অতি শক্তিশালী উন্নত ও ত্রাস সৃষ্টিকারী দেশ,একথা আমাদের সকলের জানা। এই দেশের কাছে ইউক্রেন নস্যি র মত।রাশিয়ার হামলার জেরে এক সুন্দর ফুলের মত দেশ বিধ্বস্ত নগ্ন রূপ ধারণ করেছে। ইতিমধ্যেই উভয় পক্ষের বহু সৈন্যবাহিনী সহ সাধারন জনগন নিহত হয়েছে। রক্তাক্ত হয়ে উঠছে ইউক্রেনের মাটি।সেই সঙ্গে সঙ্গে এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে সমগ্র বিশ্বে।কিন্তু প্রশ্ন হল রাশিয়া হঠাৎ করে ইউক্রেনকে কেন এমন ভাবে হামলা করল,তা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার।১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকি তে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পর থেকেই সমগ্র বিশ্বে শুরু হয়ে যায় আগ্রাসন নীতি। কে বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী দেশ তা নিয়ে শুরু হয় জল্পনা,চর্চা।ফলে দুটি প্রধান শক্তি ভাগ হয়ে যায় একদিকে রাশিয়া অন্যদিকে আমেরিকা। সূত্রপাত তা শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। এর পরেই আমেরিকা বিভিন্ন কূটনৈতিক চাল দিয়ে রাশিয়াকে টুকরো টুকরো করতে শুরু করে।১৯৯১ সালে প্রায় ১৫ টি নতুন দেশ সৃষ্টি হয়।সেই দেশগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়।১৯৪৯ সালে এই গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইউরোপের পুঁজিবাদী ও গণতান্ত্রিক দেশ নিয়ে।যার প্রধান কাজ ছিল সোভিয়েত আগ্রাসনকে রোধ করা।এর প্রধান হলো আমেরিকা।রাশিয়া তাতে বুঝতে পারে যে ,বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দৌড়ে তাঁকে পিছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা চলছে।তাতে ও রাশিয়ার মাথা ব্যাথা ছিল না। সেই মাথা যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল ইউক্রেন।রাশিয়ার দীর্ঘদিন যাবত ন্যাটোএবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে ইউক্রেনের পদক্ষেপকে ঠেকিয়ে আসছে। গত জানুয়ারি মাসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এর কাছে আবেদন জানান  ইউক্রেনকে যেন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। তাতে রাশিয়ার আত্মমর্যাদা ঘা লাগে। রুশ নাগরিকদের কথায়,এমনটা তো হওয়ারই ছিল, ন্যাটো ঘাড়ের কাছে  নিশ্বাস ফেলবে এটা রাশিয়া কেন কোন দেশ মেনে নেবে না।ইউক্রেন যদি নেটে ঢুকে  তাহলে ওরা রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ওয়ারহেডস বসিয়ে দেবে। 
 প্রধানত এই বিষয়টি রাশিয়াকে আরো বিক্ষুব্ধধ করে তোলে। যার ফলে রাশিয়া আচমকা প্রশিক্ষণ মহড়া র নামে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে সৈন্য পাঠানোর শুরু করে এবং পরবর্তী সময়ে তা আরো বাড়ানো হয়। এরপর ডিসেম্বর নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীর উপর প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন সতর্ক করে দিয়ে বলেন রাশিয়া-ইউক্রেন আক্রমণ করলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে। তৎকালীন পরিস্থিতিতে রাশিয়া দাবী করে যে পশ্চিমের তরফে আইনত এই গ্যারান্টি দেওয়া হোক যে ন্যাটো পূর্ব ইউরোপ এবং ইউক্রেনে কোন সামরিক ক্রিয়া-কলাপ করবে না। পাশাপাশি পুতিন দাবি করেন ইউক্রেন হলো পশ্চিমের পুতুল এবং কখনোই তার সঠিক রাষ্ট্র ছিল না। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে উত্তেজনা এটা প্রথমবার নয়। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে  জেলেনস্কি রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু আগাগোড়া ইউক্রেনের নব্বই শতাংশ  মানুষ হলেন রাশিয়াপন্থী। ওই বছরেই রাষ্ট্রপতি পুতিনের সমর্থিত বিদ্রোহীরা পূর্ব ইউক্রেনের বিশাল অংশ দখল করে নেয়।সেই সময় থেকেই রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে।ক্রিমিয়া ও দখল করে নেয়।এভাবেই ঠান্ডা লড়াই চলতে চলতেই, বিশ্বযুদ্ধের আকার ধারণ করে। রাশিয়া ধীরে ধীরে পারমাণবিক বোমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে একসময় ইউক্রেনের কাছে পারমানবক বোমা ছিল
। রাষ্ট্রসঙ্ঘের তৎপরতায় সেই বোমা তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। আর তাতে আমেরিকা ও রাশিয়া সম্পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছিল ইউক্রেনের কোন সমস্যা হলেই তারা সাহায্য করবে। অথচ বর্তমান সময়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া একটি দেশ ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছে অন্য একটি দেশ তার হাত-পা গুটিয়ে নিয়েছে।
তবে এই ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যেও ভারতবর্ষের পতাকা ইতিমধ্যেই বহু প্রাণ বাঁচিয়েছে।
হয় দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন, নইলে স্বাধীনতা যুদ্ধ কিভাবে হয়েছিল তা হৃদয় দিয়ে অনুভব চেষ্টা করুন তাহলে বুঝতে পারবেন একটি স্বাধীন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার মানচিত্রে পতাকা তুলতে গিয়ে কত রক্ত ঝরেছিল? তবে স্বাধীনতার ইতিহাস প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলেই সবার আগে যে প্রশ্ন আসে তা হল, কিভাবে ব্রিটিশরা সাধারণভাবে ব্যবসা করতে এসে প্রায় ২০০ বছর ভারত কে শাসন ও শোষণ করে গেল ? এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা কি বলতে পারি না যে আমাদের দেশের একশ্রেণীর স্বার্থবাদী ও সুবিধাভোগীদের লোভ লালসার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দেশের বহু জনগন গুলি খেয়েছিলো ফাঁসিকাঠে ঝুলে ছিল নয়তো দেশত্যাগী হয়েছিল। শুধু তাই নয় বিপ্লবীদের অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছিল। বাদ যায়নি স্বাধীনতাপ্রেমী নারীরা।এমনকি নারীদের গোপন অঙ্গ অঙ্গে বাটি করে লঙ্কার গুঁড়ো প্রবেশ করানো হয়েছিল।"ঝান্ডা উঁচা রহে হামারা"এই স্বপ্নটুকু পূরণ করতেই দেশের বীর সন্তানরা নিজেদের জীবন বলিদান দিয়েছিল। মনে পড়ে মাতঙ্গিনী হাজরার কথা। যাকে ইতিহাসে গান্ধী বুড়ি নামে আমরা জানি। ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর গুলিতে বুক ঝাঁঝরা হয়ে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে,কিন্তু তাঁর হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল দেশের পতাকা।অবশেষে রক্তের পিচ্ছিল পথে স্বাধীনতা আসার পর সবার প্রথমে দিল্লির লাল কেল্লার দেশের পতাকা তোলা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় স্বাধীন ভারতে দেশের পতাকা যখন পুড়ছিল তখন বহু দেশপ্রেমিকরা ভারত ছাড়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে ইতিহাসের পাতায় স্থান দেওয়া হয়নি প্রকৃত দেশ প্রেমিক দের। বহু স্বাধীনতা প্রেমীদের কপালে জোটেনি ভাতা।অনাহারে লোকচক্ষুর আড়ালে, ভিক্ষা করতে করতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল।আর যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণের নামে নাটক করেছিল,তাদের কপালে জুটেছিল রাজপ্রাসাদ।আর মুখে রাজভোগ। এ কথা আমরা সবাই জানি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যা নিয়ে উত্তাল বিশ্ব রাজনীতি। একের পর এক রক্তগঙ্গা বয়ে চলেছে ইউক্রেনে। বলতে গেলে এই মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ভারত তথা বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো থেকে বহু ছাত্র-ছাত্রী ইউক্রেনে রয়েছে পড়াশোনা বা কর্মসূত্রে। সেই সমস্যাটা দিনে দিনে আরও গুরুতর হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এবং ইউক্রেন থেকে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সাহায্য চাইছে এবং নিজের দেশে ফিরে যেতে।কারণ মৃত্যু শিয়রে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে এমন অবস্থা। ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষের দুজন ছাত্র মারা গেছেন। বিশ্বের অন্যান্য তাবড় তাবড় দেশগুলো তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের করুণ দৃশ্য দেখার পরেও হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ভারত বর্ষ চুপ করে বসে থাকেনি। বহুৎ ছাত্র-ছাত্রী ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের ফিরে এসেছেন শুধুমাত্র ভারতবর্ষের তিরঙ্গা কে সঙ্গী করে। বিনা বাধায় তারা সুস্থভাবে ফিরে এসেছে ভারতস্বা।স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এসে ভারতবর্ষের তিরঙ্গা পতাকা প্রাণ ফিরিয়ে দিলো বহু ছাত্র-ছাত্রীদের। তবে বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের ফিরে আসা নিয়ে ইউ কেনো ভারতের পুরনো সমস্যাটা পুনরায় নাড়া চাড়া দিয়ে বসেছে। তবে ভারত বর্ষ নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার। ভারতবর্ষের পতাকার শুধুমাত্র ভারতীয়দের নিরাপত্তা মূল কারণ হয়ে ওঠেনি। এই মুহূর্তে জীবন বাঁচানোর তাগিদে পাকিস্তান এবং পোল্যান্ডের ছাত্র ছাত্রীরা ভারতবর্ষের পতাকা কে সঙ্গী করে নিজেদের দেশে ফিরে এসেছেন।ভারতবর্ষের তিরঙ্গা র কতটা ক্ষমতা রয়েছে তা এই মুহূর্তে তার সাক্ষী হয়ে রইল ভারত বর্ষ তথা বিশ্বের সমগ্র জনগণ। এর আগে এমন দুঃসাহস কখনো দেখা যায়নি, তবে পরিস্থিতি বদল হয়েছে। আর তাতে ভারত বিশ্বের দরবারে অন্যতম ক্ষমতাশীল দেশ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে,সে বিষয়টা নিশ্চিত হবে বোঝা যাচ্ছে। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান রাশিয়াতে গিয়েছিলেন এবং ফিরেও এসেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো পাকিস্তান সহ আরো কয়েকটি দেশ এই ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে কসুর করেন না। বারবার ভারতের থেকে সুযোগ সুবিধা নিয়েও এই সমস্ত দেশ গুলো ভারত বিদ্বেষী মত পোষণ করে বিশ্বের দরবারে।শুধু তাই নয় ভারতবর্ষের পতাকা পুড়িয়ে ফেলার মত জঘন্যতম কাজ করে থাকেন। তবে এই ভারতবর্ষের বুকে থেকে ভারতবর্ষের পতাকা পুড়িয়ে ফেলার মতো জঘন্য কাজ করলে  ও অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করা হয়।
এই ভারত বর্ষ আমার, প্রত্যেক জনগণের এই বিশ্বাসটা হওয়া উচিত নিজের মধ্যে।আজও শহীদ দের মৃত্যুতে দেশের পতাকা দিয়ে ঢাকা থাকে। সেই পতাকাকে মর্যাদা দিতে শিখুন।কারণ আমাদের দেশের পতাকা যতই উঁচুতে উঠবে ততই ভারতবর্ষের জনগণ হিসেবে আমরাও গর্বিত হব। সমগ্র বিশ্বের জনগণ যেখানে ভারতবর্ষের পতাকা কে সম্মান দেন, সেখানে সেই পতাকা আমাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হওয়া উচিত বলে মনে করি। তবে একটা বিষয় আমাদের বিশেষভাবে অনুধাবন করতে হবে যে শুরু থেকে ভারত বর্ষ ক্ষমতাশীল দেশ ছিল, সেই গরিমা ধ্বংস করেছে আমাদের দেশের কিছু স্বার্থবাদী দেশ নেতারা।
 তবে,এই যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার আমজনতার মধ্যে যে দারুণ উন্মাদনা শুরু হয়েছে, তেমনটাও বলা যাবে না।কারণ,রাশিয়ার ডিএনএ-তে যেটা ঢুকে গিয়েছে, সেটা হল সরকারের কাজে সমালোচনা না করা।এরা খুব স্পষ্ট বাদী।ইতিহাস প্রমাণ দেয় তাদের পূর্ব পুরুষরা আগে অনেক যুদ্ধ করেছে।আরো একটা হলো বা তাতে ক্ষতি কি?জনগণের ভাবনাটা হচ্ছে,সরকারের সামনে এটাই ছিল পথ। কাজেই যা হচ্ছে ভাল হচ্ছে। তবে এ সময় যুদ্ধ টা অতন্ত্য সঙ্গা হীন,কারণ এই যুদ্ধ শুধু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলবে না সেইসঙ্গে সামাজিক ও ব্যাপকভাবে ক্ষতি হচ্ছে শিশুদের মনে। বিগত দুই বছর যাবত লকডাউনে সমগ্র বিশ্বে কিছু একটা অঘটন ঘটছে সেটা তারা বুঝতে পেরেছিল। পরিস্থিতির কিছুটা বদল হলে ও তা ইউক্রেন রাশিয়ার ক্ষমতালোভী রক্তাক্ত যুদ্ধে র বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের জীবনে। আমরা ছোট ছোট শিশুদের শৈশব শিক্ষা দিয়ে থাকি এই সুন্দর পৃথিবী প্রতিটা জীবের জন্য উন্মুক্ত। স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সিরিয়া, মিশর,ইরাক,ইরান,ভারত,পাকিস্তান বাংলাদেশ, আফগানিস্তান,রাশিয়া-ইউক্রেন এ যে সমস্ত রক্ত ক্ষয় ঘটনাগুলো ঘটছে,তাতে কি শিশুরা প্রশ্ন তুলবে না, জঞ্জাল সরিয়ে যে পৃথিবীতে শিশুদের বাসযোগ্য করে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছে সেই পৃথিবী  কিভাবে  শিশুদের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে?




বর্ষশেষের কবিতা দ্বিতীয় পর্যায় 

প্রত্যয়
বিজয় বর্মন

সেদিনও ভাবিনি,
আজও ভাবি না,মন বলে,সই যাবো যাবো,
দখিনা হাওয়ায়।

বেঁচে থাকবো আমৃত্যু,
এ জীবন জানে ভালোবাসা,
আগুন দিও, সঙ্গে আমার ফাগুন হাওয়া।

আগুন রঙ ম্লান হবে,
কৃষ্ণচূড়া দেখেছো, সাজানো ডালে ডালে,
বসন্ত জানে রঙ মিলান্তি মেলা।

প্রেমান্ধ কোকিলের কুহু,বাসনা অন্তহীন, 
চঞ্চলতা দ্বিগুন হোক না,প্রত্যয় টুকু থাকুক,
বর্ষ শেষে ভালো থাকার গান।




   

জরুরী কথাটা
অলকানন্দা দে

যেমন বিদায়ী মানুষ যায়
চলে যায় চৈত্র অতীতের পথে।
দ্বিধাহীন প্রস্থান, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সময়ের কাছে।
দক্ষিণের ঘরের বাতাসে ডুব দিলে
পাঁজরের ফাঁকে বৈশাখী খুটখাট!
যে গেল তাকে বাঁধে কবি কবিতার বুকে!
বর্ষশেষের শুধু পাতাঝরাই প্রাপ্য!
পাশে তার শুধুই সদ্য-নির্জনতা!
স্মৃতি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলে টের পাই
বারোমাসে কত পোড়ে কাঠখড়।
দুঃখ যায় খবরের কাগজে ছবি তুলতে,
বারুদের গন্ধে দম বন্ধ হয় মিনিটের,
সুখের কপালে কালো নজর টিকা।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে আত্মা।
বর্ষশেষে মন জুড়ে বাতিল হচ্ছে দিনের দল।
আহত নিজেকে পুনরুজ্জীবনের দিকে
ঠেলে দেব। বেঁধে নেব ছড়ানো অক্ষরদের!
হে বৈশাখ! তবু এরই মধ্যে তিয়াস জাগে!
একটিই তো শর্ত রেখেছি তোমার আগে
পয়া রোদ্দুরে আপ্লুত পাটাতন!
যা আসলে জন্ম দেবে চিরজীবী কবিতাদের!
ঝড়কে শাসন করে দিতে পারো
বর্ষশেষে ঠোঁটের কোণে হাসি?
হাহাকার যে ছাড়িয়ে গেছে পূর্বের সকল মাত্রা!



যাবে নাকি ?
বনশ্রী মুখোপাধ্যায়  

স্রোতের পরে স্রোত চলেছে,
 ঢেউয়ের পরে ঢেউ । 
বিজন ঘরে একলা আমি ,
ডাকছে না তো কেউ। 
 

গুর গুর গুর গর্জে ওঠে 
জলধি পাগল পারা । 
ঝরা পাতায় জ্বালিয়ে আগুন 
 ফুঁ দেয় মা - হারা । 


দোকান সহ ডুবল যে ,
ওই স্রোতেরই বুকে ,
আমার আমি কবে থেকে 
ফিরছে খুঁজে তাকে। 


 বালি ভরা সাদা ফেনা
 দুটো খালি পা ,
দোকানে রাখার ঝিনুক খোঁজে
 পেটটা আছে না !


ঝুর ঝুর ঝুর - ঝরছে পাতা 
আমার ঘরের পাশে । 
উঠবে বুঝি ওই ঝড়টা ;
ভাদ্র বা যে কোন মাসে। 




চৈত্র বেলায়
স্বপন কুমার চট্টোপাধ্যায়

সকল পাতা ঝরিয়ে দিয়ে
চৈত্র শেষের গাছ
করুন চোখে তাকিয়ে দেখে
উলঙ্গ রাজার নাচ।
নাচ  নয় সে প্রলয় নৃত্য
ধ্বংস লীলার শুরু
অশ্রুসজল মেঘের মাঝে
বিজলী হানায় বুক দুরুদুরু।
তারই মধ্যে আশার আলো
নতুন রবির আহবান
ভোরের কোকিল উঠলো জেগে
গাইতে নতুন দিনের গান




আবার নতুন আশা
 সারণ ভাদুড়ী

আবার সেই এগারোটা মাস কেটে গেল তোমার অপেক্ষায়,
 তুমি কিন্তু আসোনি ..
গ্রীষ্ম- বর্ষা - শীত দেখতে দেখতে বসন্তও ইতি টেনে দিল,
 আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আসবে 
সে বিশ্বাস কি ভেঙে গেল ??
উত্তর নেই আমার কাছে ,আমার পাতা ফাঁকা ,
 এতো কান্না , এতো যন্ত্রনা নিয়ে হারবো না আমি।
 এইতো নতুন বছরের সূর্যোদয়,
 আমার মনে হচ্ছে তুমি আসবে।
 কাটালাম তো এত বছর ,যদি এবার তুমি আসো... নতুন বছরের সূর্যোদয় থেকে, 
আবার শুরু হবে আমার সেই অপেক্ষার ঘড়ি।। 



ভাসা মেঘ
মজনু মিয়া 

কখনো সখনো হঠাৎই নীল আকাশ মেঘে ঢেকে যায়
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝরে মায়াবী কান্নার মতো। 
দমকা হাওয়া এসে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, অন্য কোথাও 
তখন কিছুটা ভার বোজা কমে হৃদয়ের।
তুমি আমার জীবনে তেমনি ভাসা মেঘ হয়ে এসেছিলে
কোনো এক দমকা হাওয়ায় দূরে গেছো।
হয়তো বা আবার কোনো দেশ থেকে আসবে
কোনো ভাসা মেঘ সুখ হয়ে জীবনে। 

আমি চৈত্রের খড়তায় পুড়ে গেলেও 
তুমি মেঘ হয়ে ভিজিয়ে দেবে আমাকে।




"নারী","দেবী" ও "মা"
শৌভিক কার্য্যী


হে নারী,
তুমি দেবী নও মায়ের জাত,
রক্ত মাংসে গড়া দেহ মন।
পাষাণ সমাজ শিখায় ঠেলে,
চরিত্র আঁকে ছাঁচে ঢেলে।
ওরা বুঝবে কি আর দুঃখ তোমার,
ফুলে ঢেকে যায় আসন।
ওরা শিল্পী বটে, গল্প রটে, গন্ডি কাঁটে, 
সমাজটাকে রাখে নিজের হাতে। 
আজও পণের দায়ে, বেতের ঘায়ে,
কতো নারীর প্রাণ সংশয়ে।
একি!
তোমার চোখেও জল কেনো মা?
আড়াল করে আর কেঁদো না।
চলার পথে আর একলা যে নও,
শত নারীর শক্তি জোগাও।।



দুই টি ফুল 
সংগীতা মিশ্র 

মান অভিমান ভুলে
পার্থিব জগতের 
কোলাহলের কল্লোলে 
দুটি ফুল রয়েছে ফুটে 
সময় নামক 
একটি স্তবকে 
দিবস ও রজনী নামে 
আলো আঁধারে
আচ্ছাদিত হয়ে
অসীম সৌন্দর্যের 
ছন্দের ছান্দিক লয়ে




বর্ষশেষের রম্য রচনা 


বর্ষশেষে
স্বপন কুমার দত্ত  

সারাবছরে সুখদুঃখের নানাস্মতি বুকে নিয়ে চৈত্রের দামাল বাতাসে ঝরে পড়ে গাছের যত শুকনো পাতা। এর সাথে বয়ে চলা উদাসী ঝোড়ো হাওয়ায় বুকটা করে ওঠে হুহু। তখন বারংবার মনে হয়, ভরা শীতে উঁহু উঁহু করাও ছিল,এর চেয়ে ঢের বেশী ভালো। মাঝে ধুলোর ঘূর্ণিঝড়ে ধাঁধিয়ে যায় দুচোখ, অনেকটা ঠিক বাজারদরের গনগনে আঁচে ফাউতে চোখে সর্ষে ফুল দেখবার মতো। তবে এখন অবশ্য অবশ্য ধারনীয় মুখাবরনী থাকায় নাকেমুখে বিনিপয়সায় ধুলোর ভুঁড়িভোজ খাওয়া থেকে মিলেছে রেহাই ধন্যবাদ জানাই,সেই বিশেষ রোগটির বিশেষ ভাইরাসের কল্যাণেই ঘটেছে
সবকিছু।
             যাকগে, এসময় নির্মেঘ সূর্যের প্রখর উত্তাপে পৃথিবী তপ্ত আগুনের গোলা। চাঁদিফাটা রোদ্দুরে পাঁপড়ভাজা না পাঁপড়পোড়া বুঝতে পারছিনা। তেষ্টায় প্রাণ আইঢাই,শুধু জল চাই। মহিলারা ঘরে থেকেও মুখে, গালে,গলায় মেখে রয়েছে সানস্কিন লোশন। কিন্তু এই কলুর বলদ পুরুষদের? রোদে পুড়ে প্রথমে বাদামি,তারপর তামাটে,সবশেষে ঘোর কৃষ্ণবর্ণের রূপ ধারণ করে গিরগিটির মতো রঙ বদলানো। আরে পেটের ভাতের তাগিদে বাজারহাট, কর্মক্ষেত্রে যাওয়া,ডাক্তার কবিরাজ, ওষুধপত্রের আমদানি কোনটাও কী আছে বাদ দেওয়ার উপায়?
            এদিকে বর্ষশেষের বাজনা বাজতেই তার অনুষঙ্গ গাজনের বাজনা বাজতে থাকে সমান তালে। ঢাক, ঢোল, কাঁসর বাজিয়ে বহুরূপীর মতো নানা সাজে বেরোয় গাজনের ভক্তবৃন্দ। চড়ক কাঠ মাথায় নিয়ে লালচেলি পড়ে কালী,শিব ইত্যাদি সেজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চল, ডাল,টাকা পয়সা জোগাড় করা শুরু হয়ে যায়। এটাও অনেকটা প্রতীকী। সম্বৎসর আমরা যেমন মুখোশ পরে কখনো ভালো বাবা, ভালো কাকা, ভালো দাদার অভিনয় করে যাই, তেমনি বর্ষ শেষেও নানারকম সাজে চরিত্রাভিনয় করে
সেই ট্র্যাডিশন বজায় রাখি।
            বছরের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও আমরা অতীত চর্বণ করতে ভালোবাসি। তবে এবছরের স্মৃতিমালঞ্চের অধিকাংশই দুঃখের। আমরা বহু কৃতবিদ্য জ্ঞানীগুণী, গায়ক গায়িকা,সুরকার, অভিনেতা অভিনেত্রীদের অকালে হারিয়েছি। সেই সমস্ত শূণ্য জায়গা কদাপি পূরণ হবার নয়। বিদায় দিতে হয়েছে, তাঁদের চোখের জলে। এছাড়াও বহু সাধারণ মানুষ মারণ রোগে, দুর্ঘটনার শিকার হয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সেইসব হতভাগ্যদের পরিবারগুলোর প্রতি সমবেদনা জানানোর নেই ভাষা।
              তবে বাংলা ১৪২৮ সন আমজনতাকে বাজারে স্বস্তি দেওয়া দূরে থাক, সংসারে অশান্তি লাগাতে কাজ করেছে বারুদের স্তুপে অগ্নিসংযোগের মতো। যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে জিনিসপত্রের দাম, তাতে বাজার করতে যাওয়া ছেলেকে বাপ বিশ্বেস করেনা, ছেলে নয় বাপকে। এ নিয়েই নিত্য বচসা। বাজার থেকে কে কত হাপিস করলো, এ নিয়েই চুলচেরা তর্ক। তবে সবচেয়ে কমিডি, --- গ্যাসেই শুরু আর গ্যাস দিয়েই শেষ।
            এরপর বর্ষশেষের দিন হাজির হয়, চৈত্রসংক্রান্তি। পার্শ্ববর্তি প্রতিবেশী রাজ্যের কল্যাণে কিনা জানিনা,সেদিন কেউ কেউ পালন করেন, " ছাতু পরব"। দরজার পাশে ছাতু উড়িয়ে, ছাতু খেয়ে সেদিন নাকি কাটাতে হয়। জানিনা,এই পরবের গুঢ় তাৎপর্য। তবে মনে হয়, বছরের বিগত দিনগুলোকে দুরছাই করে উড়িয়ে দিয়ে নতুন বর্ষে পদার্পণের এটা বোধহয় ইঙ্গিত।
            বছর শেষে আবার রয়েছে,আর একটা নতুন উৎপাত। এটা গোদের উপর বিষফোঁড়ার চেয়ে বিন্দুমাত্র কম নয়। শুরু হয়, দোকানে দোকানে সেল। আমার মতে লক্ষ্মণের শক্তি শেলের থেকেও এর বিষ তীব্রতর।  সারাবছরের অবিক্রীত, রদ্দিমাল দোকানদাররা দামের লেবেল তুলে সেলের মোড়কে দেয় গছিয়ে। এর খরিদ্দার কিন্তু অধিকাংশই মহিলা। সবাই ছুটে চলেছে,--- " ঝাঁকের কই এর মতো"! যেন কিছুতেই সেলের মাল, হয়না পয়মাল। সাধে কী আর বলে, " দশ হাত কাপড়েও কাছা দিতে পারেনা।" গৃহে অবাঞ্ছিত অশান্তির ভয়ে গিন্নিকেও করা যায়না নিবৃত্ত। অথচ সেল যে শেল হয়ে গোবেচারা স্বামীকে বিঁধতে থাকে অহরহ,সেটা কে বুঝবে? সারাবছর প্রেজেন্টেশান, কর্তব্যরক্ষা ইত্যাদি যে কত সহজে হয়ে যায় সমাধান, তা এই অধমের গবেট মস্তিষ্কে নয় এতটুকু বোধগম্য। গিন্নির আবদার, চাই তার মালাইশাড়ি। দাম শুনেতো আমার নিজের মালাইচাকি খুলে যাওয়ার যোগাড়। কন্যার স্বর্নকাতান বায়না মানে কর্তাকে কাত করবার পাকাপাকি ব্যবস্থা। অথচ আমারতো একটাই জাতীয় পোষাক -- একখানি লুঙ্গি আর কাঁধকাটা গেঞ্জি। এরপর কাটছাঁট করলেতো একেবারে তৈলঙ্গ
স্বামী। 
         যাহোক বিকেলে চড়ক বা গাজনের মেলা। চড়ক একটা বড় বাঁশ বেঁধে দুজনের পিঠে বড়শি গেঁথে দেওয়া হয় দুদিকে ঝুলিয়ে। তারপর দড়ি ধরে শুরু হয় ঘোরানো, সঙ্গে " হর হর বোম বোম" আওয়াজ। এর সঙ্গে মেলা ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সারাবছর আমজনতা যেভাবে ঝুলে রয়েছে আর একটু পরিষ্কার করে বলতে গেলে ফাটা বাঁশে ইঁদুরের মতো আটকে রয়েছে, চড়ক দোলাও এর প্রতীকী। সারাবছর ফ্যাক্খা টার পরও কী আর এর প্রয়োজন আছে?
           বছর শেষে সেলের মৌতাতে বুঁদ হতে বন্ধুর শাড়ীর দোকানে বসে আছি। হটাৎ এক মহিলা একটা শাড়ির প্যাকেট বন্ধুর হাতে তুলে দিয়ে বলে, " এটা শাড়ি না গামছা! রঙতো উঠেই গেল, তারপর একেবারে মশারী। আমার শাড়ি চাইনা, টাকা ফেরত দিন।" বন্ধুর সহাস্য উত্তর, " সস্তায় শাড়ি নেবেন সেলে, ভালো কাপড় কী মেলে,? টাকা ফেরততো হবেনা, কথায় আছে, -- এর নাম সেল, ভানুমতির খেল।" মহিলা রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। বন্ধুর যে দোকানদারি করেও রসবোধ শেষ হয়নি, তাতো বোঝাই গেল। এক কাচাতেই একেবারে মাছ ধরার জাল। তবুও জমে ক্ষীর হয়ে যায়
সেলের বাজার।
         চৈত্র সেলের বাজার নিয়ে একটা রম্য আখ্যানে শেষ করবো, আজকের রম্যাখ্যান। অনেকদিন পর মামার বাড়ি গিয়েছি। জলখাবার পর্ব মিটলে মামী একটা ঢাউস কাপড়ের প্যাকেট আমার সামনে ধরে বললেন, " দেখতো ভাগ্নে, সেলে অনেকগুলো শাড়ি কিনেছি। সারাবছর তো লাগে। কেমন হয়েছে বল্?" আমি শাড়ীর আবার কি বুঝি। তবুও কথা রাখতে বললাম, " চমৎকার হয়েছে। কতটাকা সাশ্রয় হলো ।" মামীর জবাব," দেখ, তুই সুন্দর বুঝলি,কিন্তু তোর মামা বোঝেনা।" এবার মামীকে মামার কথা জিজ্ঞেস করায় বললো, " ঐতো পাশের ঘরে আছে। ঋতু পরিবর্তনে একটু ঠাণ্ডা লেগেছে। সর্দি কাশিতে ভুগছে। ডাক্তার দেখানো হলে ডাক্তার অনেকগুলো টেস্ট করতে বলেছে। ওসব করে কী হবে বল্আ দা,তুলসিপাতা ছেঁচে খেতে বলেছি ।" পাশের ঘরে ঢুকে দেখি, মামা ডাঙায় তোলা কাতলা মাছের মতো কাশির দমকে খাচ্ছে খাবি। " হায়রে চৈত্র সেল!"  আধুনিকা মামী সেলের বাজার করতে গিয়ে মামাকে চিকিৎসা বাদ দিয়ে শিলনোড়ায় ছেঁচ্ছে। মুখে শুধু বললাম, " মামী মামার হেঁশেল ঠেলে ঠেলে তোমার সব বুদ্ধিগুলো বৃথায় নষ্ট হয়ে গেল । অন্য জায়গায় লাগাতে পারলে নিদেনপক্ষে তুমি হয়তো এম.এল. এ হতে ।" মামীর সহাস্য জবাব, " যা: ভাগ্নে, তুই না .."
         তবুও বছর শেষে নতুন বছরের আবাহনই তো পয়লা বৈশাখ। গাছে গাছে পুরোনো প্রকৃতি জানান দেয় নববর্ষের। হাজারো সমস্যায় দীর্ন দমবন্ধ করা আটবাই দশের কুঠুরির ঘুলঘুলি দিয়ে আমজনতাকে স্বস্তি দিতে নববর্ষ জোগায় একটু হলেও অক্সিজেন। বছর শেষের গাজনের বাজনায় শোনা যায় তারই প্রতিধ্বনি।




বর্ষশেষের নাট্য ভাবনা 

আমি ধর্ষিতার মা নই 
রীতা মোদক 

১]

(বছর দশেক এর কন্যা শিশু ।  স্কুল থেকে বাড়ির দিকে যাচ্ছে গুনগুন গান করতে করতে । পথে হটাৎ একদল দস্যু শিশুটিকে আক্রমণ করল ।)

 শিশু : তোমরা কারা ? আমার কাছে আসছ কেনো ? আমাকে ছেড়ে দাও । 
দস্যু : হা হা হা ছেড়ে দেবো বলে কী তোমায় ধরেছি খুকি ? খবরদার একদম চিত্কার করবি না ? চেচালে একবারে খেলাশ করে দেবো । হা হা হা । 
শিশু : মা ... বাবা ..... বাঁচাও ..মা ....
(দস্যুরা শিশুটিকে মুখে রুমাল বেঁধে নিয়ে  চলে যায় )


২]

মা : কীগো শিউলীর বাবা , পাঁচটা  বাইজা  গেলো শিউলী অহন ও  যে আইলো  না । আমার যে চিন্তা হইতছে  ..
বাবা : হাছাই তো ,  মাইয়াডা অহন ও  যে আইলো  না  ... এজন্যই তোমাকে না করছিলাম । মাইয়ারে  আর পড়াশুনা করাইতে লাগবো  না । চার পাঁচ বছর পর বিয়া  দিলে আপদ ফুরাইয়া যাইত । এখন বুঝ ঠ্যালা । আমি কিছু খুজতে পারুম না , তুমরা যা খুশি করো গা । 
মা : কী কইলা শিউলীর বাবা ? এই কথা কৈতে তোমার জিভে আটকাই ল  না ?  এখন তো শুধু আমার মাইয়া । আমি দেইখা রাখুম শ্যাষ বয়সে পোলা কেমন খাওযাযতোমারে  । (শিউলী কাদতে কাদতে চলে যায় )


৩]

(মা পথে দুজনকে শিউলীর কথা জিগ্গেস করে উত্তর পায় না । 
তখন এক স্বনির্ভর দলের বাড়ি যায় । )
শিউলীর মা :দিদি বাড়ি আছেন ? 
দিদি : আরে শিউলীর মা যে , তো সন্ধ্যা সময় কী মনে কইরা ? 
মা : দিদি , আমার শিউলী অহনও ইস্কুল থাইক্কা বাড়ি ফিরে নাই । ডরে আমার শরীর কাঁপতাছে .. আমার লগে যাইব্যান শিউলীরে খুজতে ..
দিদি : জামু না ক্যান ? আপনের মাইয়া আর আমার মাইয়া তো সমান বয়সী । আগে চলেন সংঘ সমবায় এর কাছে খবরটা জানাই । এই সুমী সংঘের সেক্রেটরী কাকিমারে ফোনটা ধইরা দে তো ...
সুমী :(ফোন করে )হ্যালো কাকিমা আমি সুমী বলছি । আমার মা তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবে ..
সুমীর মা : হ্যালো দিদি , খুব বিপদে পইড়া ফুন করলাম 
সেক্রেটারি : কী হয়েছে বলুন । 
সুমীর মা : শেফালী দি রে চিনেন তো । স্বনির্ভর দলে নতুন নাম লেখাইছে । 
সেক্রেটারি: চিনলাম , তো কী হলো ? তিনি কী আর দল করবেন না ? 
সুমীর না : সেইটা নাগো , উনার মাইয়াড়ে খুইজা পাইতাছে না । আইজ ইস্কুল থাইকা আর বাড়ি ফিরে নাই । 
সেক্রেটারি: শেফালী দিকে বসিয়ে রাখেন , আমরা দশ মিনিটের মধ্যে আপনার বাড়ি আসছি । 

সুমীর মা : ঠিক আছে রাখলাম । শিউলীর মা চিন্তা কইর না ওরা আসতাছে । 
(সেক্রেটারি পাঁচ সাত জন মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে আসেন । )
সেক্রেটারি: আমরা এসে গেছি । আপনার মেয়ে কোন পথ দিয়ে বাড়ি আসে বলেন তো , চলুন সবাই মিলে অ্যাটাক করতে হবে। 



৪]

শিউলীর মা : (পথে যেতে  যেতে  ) .. শিউলী রে ... শিউলী...মা আমার ... তুই ফিইরা আয় ...
সেক্রেটরী : চুপ । একদম চুপ । ওরা শুনে ফেলবে যে , 
শিউলীর মা: ঠিক আছে আমি আর কথা কমু  না । 

সেক্রেটরী:ওই যে  জঙ্গলের মধ্যে একটা ঘর দেখা যাচেছ ,  তোমরা সবাই  ধীরে ধীরে ওই ঘরের চারদিক ঘিরে দাড়িয়ে পর । আমি ইশারা দিলেই সবাই একসাথে ঝাপিয়ে পড়তে হবে । 
সকলে : ঠিক আছে, ঠিক আছে। 


৫]

(শিউলীএকটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে , দস্যুরা ফিস ফিস করে কথা বলছে ,মহিলারা চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে ভেতরের কথাবার্তা শুনছে )
শিউলী : তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও...। আমি মার কাছে যাবো । আমাকে বাঁধন খুলে দাও ...
দস্যু : ঠিক আছে সোনামণি খুলে দিচ্ছি , সবাই মিলে আগে তোমাকে একটু পরখ করে নেই , তরা সবাই আয় , আমার সোনামণি কাঁদছে যে , একটু আদর করে দে ..
( সেক্রেটারি এমন সময় ইশারা দিকে সব মহিলা লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে । )
সেক্রেটারি : বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের তুলে এনে ফুর্তি করবি , দেখ কেমন লাগে । 
দস্যু : সরি ম্যাডাম ভুল হয়ে গেছে (হাত জোর করে )আমাদের ক্ষমা করে দিন । 
সেক্রেটারি : ক্ষমা ? তোদের কোনো ক্ষমা নেই । আমরা ও তোদের আদর করবো , তবে হাত দিয়ে না , লাঠি দিয়ে (মার )
( একজন মহিলা বাঁধন খুলে শিউলীকে তার মায়ের হাতে তুলে দেয় ,  মা শিউলীকে জড়িয়ে ধরে । )
সেক্রেটারি : চলো আধমড়াগুলোকে পুলিশের হাতে তুলে দেই । 



৬]

(শিউলীর মা শিউলীকে নিয়ে বাড়ি যায় , কিন্তু তার স্বামী ঘরে ঢুকতে দেয় না )
শিউলীর স্বামী : খবরদার ! আর এক পা ও আগাইবি না । আমার ঘরে তোদের কুন জায়গা নাই । সারা রাইত বাইরে কাটাইয়া কলঙ্ক লাগাইয়া এইখানে কোনো জায়গা নাই । 
শিউলীর মা : তুমি কী মানুষ না , না পশু ? কত কষ্ট কইরা আমরা মাইয়াডারে উদ্ধার করলাম , আর একটু হইলেই তো মাইয়াডা শ্যাষ হইয়া যাইতো । ঘরে যাইতে দ্যও , মাইয়াডারে একটু রেস্ট নিতে লাগব। 
শিউলীর বাবা : শরীরে কলঙ্কের দাগ লাগাইয়া রেস্ট ? বাইরো বাড়ির থাইকা, ধর্ষিতা আর ধর্ষিতার মায়ের কুন জায়গা নাই  (চুলের মুঠি ধরে ঘর দুজনকেই বের করে দেয় )
শিউলীর মা : হ্যা আমি ধর্ষিতার মা । চল মা আমরা ফিইরা যাই । এই অপমানের জবাব তোকে দিতেই লাগব। 


৭]

(দুজনে সেক্রেটারির বাড়ি যায় )
সেক্রেটারি : কী ব্যাপার তোমরা ফিরে এলে যে ---
শিউলীর মা : ম্যাডাম ,আমাদের তাড়াইয়া দিছে , আমরা আর ওই বাড়ি যামু না । আপনের বাড়িতে  আমাদের আশ্রয় দিবেন ? আমরা যে নিরুপায় । ওর বাবা আমারে নতুন নাম দিছে --- ধর্ষিতার মা (কান্না )।
সেক্রেটারি : কান্না থামাও । এর প্রতিশোধ নিতেই হবে । ছয় মাস হলো আমার শাশুড়ি মারা গেছে । ঘরটা আপাতত ফাঁকাই পরে আছে । তোমরা এখানে থাকতে পার । কিন্ত একটা সত্ব  আছে । 
শিউলীর মা :  কী  সত্ব ম্যাডাম ? আমরা যে এক্ক্যেবারে নিঃস । 
সেক্রেটারি :না না  কোনো টাকা -পইসা লাগবে না , শিউলীকে ভালো করে পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । ক্যারাটে শিখতে হবে । তোমাকে ও দাড়াতে হবে । 
শিউলীর মা : কিন্তু আমি তো লেখা পড়া জানিনা ...
সেক্রেটারি : আমাদের সংঘ সমবায় এ সেলাই এর ট্রেইনিং হবে , তুমি সেলাই কাজ শিখবে 
শিউলীর মা : ঠিক আছে ম্যাডাম , আমি বুঝতে পারছি । আমি শিখব । 


৮]

(এভাবেই বেশ কয়েক বছর কেটে যায় । শিউলীর মা সেলাই কাজ শিখে SVSKP লোন নিয়ে স্কুল ইউনিফর্ম এর কাজ করছে , তার মেয়ে পড়াশুনা করছে )

৯]

15 বছর পর ...
শিউলি এখন মেখলিগঞ্জ ব্লকের বিডিও । তার বাবা বয়স্ক ভাতার জন্য বিডিওর কাছে অনুনয় করছে । 
শিউলীর বাবা : ম্যাডাম আমার কেউ নাই । আমাকে একটা ভাতার ব্যবস্থা কইরা দেন । 
শিউলী : কেনো আপনার তো একটা ছেলে আছে । ছেলে দেখে না ? 
শিউলীর বাবা : ছেলে যে বাড়ির থেইকা বাইর কইরা দিছে। আপনি কী কইরা জানেন ? 
শিউলী : আমার যে সবই মনে আছে । ওই যে বসে স্বনির্ভর দলকে সেলাই কাজ শেখাচ্ছেন  ,  তিনিই ধর্ষিতার মা । 
শিউলীর বাবা :  ধর্ষিতার মা ? ( মাথা চুলকাতে থাকে ) আমি যে কিছুই বুঝতে পারতাছি না ম্যাডাম ।তুমি কে মা ? আমার শিউলী ? আমাকে ক্ষমা করে দাও মা , মা আমি আমি খুব অন্যয় করছিলাম ।

শিউলী : হ্যা তুমি খুব অন্যায় করছিলে । মেয়েদের মানুষ বলেই মনে করোনি । যদি ক্ষমার কথা আসে উনিই বিচার করবেন । 


১০]

শিউলীর বাবা :(দৌড়ে গিয়ে তার স্ত্রীর পায়ে ধরে ) আমাকে ক্ষমা করে দ্যও । তোমাদের তাড়াইয়া দিযা আমি  খুব অন্যায় করছিলাম । আমারে ক্ষমা কইরা দ্যও । 
শিউলীর মা  :(দৌড়ে  পিছিয়ে যায় ) ছাড়ো,  ছাড়ো...আমার পা ছাড়ো। আমি যে ধর্ষিতার মা , তুমি আমাকে স্পর্শ করে অপবিত্র হয়ে যাবে যে । 
শিউলীর বাবা :(দু হাত জোর করে ) আমাকে ক্ষমা করে দ্যাও । 
শিউলীর মা : বেরিয়ে যাও । কোন ক্ষমা নেই । এখন আর আমি ধর্ষিতার মা নই , আমি বিডিও এস দাসের মা । যে ধর্ষন করে আর , যে ধর্ষককে সমর্থন করে -- তারা দুজনই সমান অপরাধী । তাদের কখনোই ক্ষমা করা যায় না । মনে আছে ? সেদিন বিনা দোষে আমাদের বের করে দিয়েছো । এখন আর আমি অবলা নই , আমাকে এক ঘা দিলে আমিও তিন ঘা মারতে পারি । (ধাক্কা দিয়ে ) বেরিয়ে যাও বলছি । আমি কখনোই ধর্ষিতার মা ছিলাম না , আমি শিউলীর মা। (শিউলী কে জড়িয়ে ধরে) শিউলীর মা হতে  পেরে আজ আমি গর্বিত । আমি ধর্ষিতার মা নই।





বর্ষশেষের ছড়া 

খোকার বর্তমান 
      তপন বসাক  

খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো,
                                      বর্গী এলো দেশে।
মায়েদের মুখে যায় না শোনা,
                                আজকের পরিবেশে।
মোবাইলেতে কার্টুন দেখে,
                           ঘুমায় আজকের খোকা।
এগিয়ে চলছে সমাজ ব্যবস্থা,
                               অতীত হয়েছে বোকা।
গোল্লার ছুট, সোনার টিয়া,
                             নেইতো খোকার জানা।
হারিয়ে গেছে মায়ের মুখে,
                            আয় রে আয়  চাঁদমামা।
পাড়া বলতে কি বা বোঝায়,
                              প্রতিবেশী বলে কাকে।
খোকার সেসব নেইকো জানা,
                                   থাকে সবার ফাঁকে।
আঙ্গুলের ব্যায়াম হচ্ছে খোকার,
                                 চোখ দুটো পরিশ্রান্ত।
নেই দৌড় ঝাঁপ, থাকে চুপচাপ,
                                    তবুও বড়ই ক্লান্ত।।




রূপের জাদু
নিলুফা ইসলাম


তোমার রূপে পাগল আমি
বুকে লাগে টান
আড়াল হলে প্রাণে মরি
মারছো বুঝি বান।

লোকে বলে বেজায় কালো
আমার চাঁদ তারা
বাঁচতে চাইনা একটি দিনও
বন্ধু তোমায় ছাড়া।

কালো চোখে যায় হারিয়ে
রূপের নেইকো শেষ
তোমার রূপের জাদুর ছোঁয়ায়
ছাড়লাম নিজের দেশ।

কালো রূপে যেই মজেছে
সেই তো জানে সুখ
যেখানে যাই সেই খানেতে
দেখি বন্ধুর মুখ।



বর্ষশেষের ছবি 


অদ্রিজা বোস


















অনুস্মিতা বিশ্বাস 












মুজনাই অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৮