Saturday, July 2, 2022



সম্পাদকের কথা 

গ্রীষ্মপ্রধান দেশে বর্ষা মানে অন্য আনন্দ। ঘন কালো মেঘ, বিদ্যুতের ঝলকানি, মেঘের প্রবল গর্জন, দিনরাত বৃষ্টি ইত্যাদি মিলে বর্ষার রূপ সবসময়ই অনন্য। তবে বর্ষার মূল গুরুত্ব কৃষিতে। যে দেশের অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল সে দেশে বর্ষার তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে এবারে বর্ষার শুরুতেই যেভাবে অসম থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বর্ষা তান্ডব শুরু করেছে তা অবশ্যই চিন্তার। ধস, বন্যা, হড়কা বান, ভূমিক্ষয় ইত্যাদির ফলে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক। আমাদের রাজ্যের উত্তর অংশও ইতিমধ্যে বিপদের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। তবু সবকিছু মিলে বর্ষাকে আহ্বান জানাতেই হয়। কেননা বর্ষা ছাড়া কোনোভাবেই আমরা ভাবতে পারি না। প্রার্থনা, বর্ষা হোক, বৃষ্টি ঝরুক আর সেই বৃষ্টি নিয়ে আসুক সৃজনের ধারা।     


মুজনাই অনলাইন আষাঢ়  সংখ্যা ১৪২৯

মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)

প্রচ্ছদ: বাবুল মল্লিক 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই অনলাইন আষাঢ়  সংখ্যা ১৪২৯



আছেন যাঁরা 

বিনয় বর্মন, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, বটু কৃষ্ণ হালদার, চিত্রা পাল, শ্রাবণী সেন, 

মনিরুজ্জামান প্রম‌উখ, চন্দন কুমার দাস, রূপক রায়, প্রনবরুদ্র কুণ্ডু, 

রমজান সরকার, মৌসুমী চৌধুরী, কাকলি ব্যানার্জী মোদক, সৈকত দাম, 

রীতা মোদক, অলকানন্দা দে, ঋতুপর্ণা রায় বর্মা, দেবার্ঘ সেন, সারণ ভাদুড়ী, 

রীনা মজুমদার, মজনু মিয়া, সুভাষ চন্দ্র রায়, বিজন বেপারী, অঞ্জলি দে নন্দী, 

অদ্রিজা বোস, অনুস্মিতা বিশ্বাস, সুজল সূত্রধর, সৌরিক রায়





বর্ষা 



বর্ষা যাপন 


আমার বর্ষা

বিনয় বর্মন


বর্ষা এলে মেঘের মতো এলোমেলো ভাবনাগুলোও আসা যাওয়া করতে থাকে মনের মধ্যে l ডুয়ার্সের বাসিন্দা হওয়ায় বর্ষা দেখে অভ্যস্ত l মনে পড়ে যায় , ছোটবেলার কথা l কামাখ্যাগুড়িতে একটা টিপিক্যাল ডুয়ার্সের কাঠের দোতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতামl টিনের চাল l বৃষ্টি নামলে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ে প্রচন্ড জোরে ঝমঝম করে জল তরঙ্গ বেজে উঠত l কখনো কখনো এত জোরে শব্দ হতো , যে ঘরের ভেতরে নিজেদের কথাও চাপা পড়ে যেত ! কাঠের বারান্দায় জলের ছাট এসে ভিজে যেত l তখন বারান্দার ঘরে ঢুকে যেতাম l আমাদের পাহাড়ি কুকুর 'ব্ল্যাকি'ও দৌড়ে ঘরে ঢুকে যেত l ঘরে বসে টানা বৃষ্টি দেখতে দেখতে মন উদাস হয়ে যেত l আমার পড়ার ঘরের পাশেই ছিল একটা বিলিতি গাব গাছ l বর্ষাতেই ফল ধরত l পাকা গাবের গন্ধে ম ম করতো সারা বাড়ি l এখন কাঠের দোতলা বাড়ি আর সেরকম চোখে পড়ে না l সর্বত্র কংক্রিটের জঙ্গল গড়ে উঠেছে ডুয়ার্স জুড়ে l বাড়ির একটু দূরেই ছিল মরা রায়ডাক নদী l বর্ষায় ফুলে উঠতো l কাঠের একটা সেতু ছিল l সেখানে দাঁড়িয়ে নদীর জল দেখতাম l সেই নদী আজ চুরি গেছে l নদী দখল হয়ে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর , দোকানপাট , কংক্রিটের জঙ্গল ! 

বর্ষার মেঘের মতো ভেসে আসে নানান স্মৃতি l দ্বাদশে পড়ার শেষ দিনে যারা শপথ নিয়েছিলাম , কেউ কাউকে ভুলবো না , সময়ের স্রোতে তারা আজ কে কোথায় ? মনে পড়ে সেই সহপাঠিনীটির কথা l টিউশন ফেরত প্রবল বৃষ্টির দিনে , যার সঙ্গে এক ছাতার নিচে ফিরছিলাম l হঠাৎ প্রবল বজ্রপাত l আর সে আমাকে ভয়ে জড়িয়ে ধরে সেকি চিৎকার ! তার সাথেও তো আর কোন যোগাযোগ নেই !

      কলেজে ( কোচবিহারের এ বি এন শীল ) হোস্টেলের পাশে ছিল বড় দিঘী l বেশি বৃষ্টি হলে তার জল উপচে ঢুকে যেত হোস্টেলের বারান্দায় l উঠে আসতো কৈ মাছ , কাঁকড়া , এমনকি সাপ ! হোস্টেলে জুনিয়ার ছিল মদন সিং তামাং l মনিপুরী l সাপ মেরে রান্না করতো ! সে খাইয়েছিল তোরসা থেকে ধরে আনা ঝিনুকের রেসিপি l

         বন্ধু সন্দীপ আসতো নিগমনগর থেকে l উচ্চমাধ্যমিকে বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ায় উপহার পেয়েছিল চমৎকার মিউজিক সিস্টেম l দারুন দারুন বই আর ক্যাসেটের সংগ্রহ ছিল ওর l এক বর্ষার দিনে ওর বাড়িতে গেছি l গাছপালা দিয়ে ঘেরা ছোট্ট সুন্দর বাড়ি l রঙ্গন , রজনীগন্ধা , পাতাবাহারে চমৎকার লাগছিলো l বর্ষার দিনে ওর ছোট্ট ঘরে সারাদিন কাটানো , গল্প , আড্ডা আর বৃষ্টি l এখনো মনে পড়ে l আজ কর্মসূত্রে অন্য মহাদেশবাসী l যোগাযোগ রয়ে গেছে l 

প্রায় দু'দশক আগে যখন শ্রীনাথপুর চা বাগানের পাশে কর্মস্থলে যোগ দেই , তখনকারও বর্ষার স্মৃতি ভেসে আসে l স্কুল বাড়ি ছিল কাঠ , বাঁশের চাটাই , টিনের বেড়া দিয়ে ঘেরা l টিনের চাল l বৃষ্টি এলে চালে এত ঝমঝমিয়ে শব্দ হতো , যে , কারো কথা শোনা যেত না l অতএব , "রেনি ডে " ! স্কুলের পাশে বয়ে যেত গদাধর l পাহাড়ে বৃষ্টি হলে নদী ফুলে উঠতো l নদীর কুল ছাপিয়ে সে জল স্কুলের মাঠে উঠে আসতো l দশ জন স্টাফ l টিফিন টাইমে , খবরের কাগজ পেতে মুড়ি মাখা হত l আশেপাশে দু একটা মাত্র দোকান ছিল l 

       বর্ষা আর বর্ষাবন --- দুটোই ডুয়ার্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত l বর্ষাবনে বসে বর্ষা দেখা l সেও এক অভিজ্ঞতা l বর্ষার দিনে রায়মাটাং l লালিগুরাস হোমস্টর কাঠের বারান্দায় বসে দেখেছি বর্ষার অপরূপ সৌন্দর্য l সকাল থেকে বৃষ্টি l খবর পেলাম রায়মাটাং নদী ফুলে উঠেছে l অতএব বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সারাদিন দেখতে থাকি বর্ষাবনের বর্ষা l খিচুড়ি সবজিতে স্মরণীয় হয়ে থাকে রায়মাটাং এর রাত l 



দেখেছি বর্ষার রুদ্র রূপও ! এক বর্ষার দিনে শিলিগুড়ি থেকে ফিরছি l ৩১ নং জাতীয় সড়ক ধরে l হাসিমারার আগে হঠাৎ ব্রীজের এক পাশের রাস্তা উধাও l চা বাগানের মধ্য দিয়ে পায়ে চলা হাঁটাপথে ঘুরপথে পৌঁছাই হাসিমারা l দেখেছি ৯৩-এর বন্যার পর আলিপুরদুয়ার ও সংলগ্ন অঞ্চলের বিধ্বস্ত দশা l মনে পড়ে যায় নাগাড়ে বৃষ্টিতে দিনহাটার লাউচাপড়া, খামার বক্সী গ্রামগুলোর অবিচারী , সাপখাওয়া ( অধুনা মৃতপ্রায় ) নদীর উপচে পড়া জলে দুকুল ছাপানো বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি l

    আমার বর্ষা মনে পড়ায় সেই অকালে চলে যাওয়া নিষ্পাপ ছাত্রটির কথা , যে এমনি বর্ষার দিনে , মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছিল l বর্ষায় মনে ভাসে , সেই শিশু পরিবহন শ্রমিক যে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছোট গাড়ির পিছনে ঝুলতে ঝুলতে যাত্রী তুলতে তুলতে যেত l বর্ষায় মনে পড়ে , সেই ফিরিয়ে দেওয়া কিশোরীটির কথা , যে আমার সঙ্গে ছিপরার অরণ্যে জংলি কুল তুলতে যেতে চেয়েছিল! বর্ষার দিনে মনে পড়ে তাকে , যার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টিতে রিকশয় যেতে যেতে অনেকদিনের ভাবনার কথাটা কখনোই বলে ওঠা হয়নি !

     এখন বয়স বেড়ে অনেক সাবধানী l বৃষ্টিতে আর ভিজিনা l জলে নামি না l কিন্তু বর্ষা এলে , ঘরে থাকতে মন চায় না l বেরিয়ে পড়ি সবুজ ডুয়ার্সের এদিক সেদিক l খুঁজি ছোটবেলার ডুয়ার্সকে l আমার ডুয়ার্সকে l খুঁজি সেই শিশুদের , তুমুল বৃষ্টিতে যারা মাঠে কাদায় ফুটবল খেলছে , যারা অকারনে জল ছিটিয়ে হুল্লোড় করছে , মাছ ভেবে গামছা দিয়ে ব্যাঙাচি ধরছে' ! তাদের আর পাইনা l অনেক কমে গেলেও মাঠ-ঘাট উন্মুক্ত প্রান্তর অনেকই আছে আমাদের ডুয়ার্সে l সেখানে শিশুদের দেখিনা l শিশুরা থাকে তারই পাশে কোন যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে , বন্ধ ঘরের বারান্দায় , কোন " চৌতারায় " l তাদের চোখ বৃষ্টিতে নয় , মাঠে নয় , স্মার্টফোনে !

      আসলে কৃষি , পর্যটন , আর চা নির্ভর ডুয়ার্সের জনজীবনে বর্ষা যেন রান্নায় লবণের মতো l থাকাটা স্বাভাবিক l কিন্তু পরিমিত l কম বা বেশি হলেই সমস্যা l পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে ডুয়ার্সের বর্ষাও আজ খামখেয়ালী l কখনো কম , কখনো বেশি l বর্ষা হলেই মনে সংশয় হয় l এইযে প্রকৃতির অশেষ আশীর্বাদ , ডুয়ার্সে বসে উপভোগ করছি , তা আর কতদিন ? যে হারে বৃক্ষনিধন , চোরাশিকার , জলা দখল চলছে , তাতে এই বর্ষা আর কতদিন থাকবে ? পরের প্রজন্ম কি শুধু গল্প কথাতেই শুনবে কেমন ছিল ডুয়ার্সের বর্ষা ? তারা কি সুযোগ পাবে এমন বর্ষা যাপনের ?

(ছবি- শৌভিক রায়)



বর্ষা উৎসব 

ঝাঁপান
শ্রাবণী সেনগুপ্ত 

এই ঝাঁপান লোক উৎসবটি সাপ সম্পর্কিত একটি বিশেষ অনুষঠান। ভারতবর্ষের সর্বত্র সাপ দেবতারূপে পূজিত। মনসার সঙ্গে সাপের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকায় কখনো সাপ মনসার বাহন বা আলঙ্কার রূপে ভূষিত। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূম,মেদিনীপুর,মুর্শিদাবাদ 'মনসার ঝাঁপানে' তিনি জীবন্ত সাপ।বিষ্ণুপুরের ঝাঁপান অনুষ্ঠানটি  একটি ঐতিহ্যপূর্ণ জীবন্ত সর্প বিষয়ক অনুষ্ঠান।

                           ঝাঁপান হয় ভরা বর্ষায়, শ্রাবণ সংক্রান্তিতে। ভরা বর্ষায় বসুন্ধরা শস্য উৎপাদনে রত-এই সময়ে  ঝাঁপনের মূল উপাদান সাপ নবজন্মের প্রতীকরূপে দেখা দিয়েছে কৃষিনির্ভর লোকমানসে।সাপ কোন কোন জন গোষঠীর 'টোটেম'। কোন বিশেষ দিনক্ষণে তাঁদের সর্প দর্শনের রীতি আছে।বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা নাগ বংশীয়। তাঁরা সর্প দর্শন করেন শ্রাবণ সংক্রান্তিতে,ঝাঁপান উৎসবের সূচনালগ্নে।ঝাঁপান অনুষঠিত হয় মল্ল রাজবাড়ির সামনের প্রাঙ্গণে। এই ঝাঁপান উত্সবের বর্ণনা মূলত মল্ল রাজধানী বিষ্ণুপুরের ঝাঁপান উৎসবের  বর্ণনা। সমগ্র রাঢ় অঞ্চলের মধ্যে বিষ্ণুপুরের ঝাঁপান শ্রেষ্ঠ।

        ঝাঁপান যেহেতু সর্বসমক্ষে,অনেক দর্শকের মাঝখানে হয়,তাই এর নেপথ্যে থাকে দীর্ঘ প্রস্তুতি।সবার আগে হয় 'খইধারা'।শ্রাবণ মাসের শেষ নাগাদ মাঠের কাজ,ধান রোঁয়ার কাজ, শেষ হয়ে যায়,তাই 'খইধারা"।ঐ দিন নতুন হাঁড়ি কড়ায় রান্না হবে নিরামিষ,আর ভাজা,পোড়া এবং ফলার খাওয়া হবে।তারপর শ্রাবণ সংক্রান্তির আগেরদিন হবে 'বার পালন 'বা 'বার কমানো'। দাড়ি,নখ কেটে শুদ্ধ হয়ে স্নান করতে হয় এবং উপোস করতে হয়।শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন 'মাখাল দিন'। ঐ দিন সকাল থেকে সর্প গুনী নেরা পুজো দেন মনসা মন্দিরে।সর্বসাধারণের পুজো শেষ হলে প্রধান গুনীন অনেকগুলি সাপের ঝাঁপি এবং শিষ্যদের নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন।দরজা বন্ধ করে মা মনসাকে সাপ খেলা দেখান। গানে গানে চাপা স্বরে বর্ণনা করেন অতীতে কোন সময়ে বনের সব রাখালদের মা মনসাকে পুজো করার কাহিনী।তার সঙ্গে বাজে 'বিষম ঢাকি '। আগের দিন থেকে করা উপবাস তাঁরা মা মনসার আশীর্বাদ প্রার্থনা অনুমতি লাভের পর ভঙ্গ করেন। এরপর স্নান খাওয়া সেরে প্রস্তুত হন ঝাঁপান উৎসবের জন্য।

                     খুব রোদে সাপ ফণা তুলে দাঁড়াবে না ,তাই গুনীনেরা একটু দেরীতেই আসেন।ততক্ষণে লোকেলোকারণ্য উৎসব প্রাঙ্গণ। বসে মেলা। সাজানো মনসা মূর্তি আসে গাড়ীর পিঠে ।গরুর গাড়িতে বা ছোট মোটরচালিত গাড়ীতে আসেন গুনীনের দল।কোনো কোনো মাচানের উপর থাকে বাঘের মূর্তি।তবে এই বাঘ ঝাঁপান বড়ো গুনীন ছাড়া কেউ পারেননা-খুব কঠিন। বাঘের পিঠে সেই দলের প্রধান গুনীন গুরু বসে থাকেন।পুরুষ গুনীনদের সঙ্গে মহিলা গুনীনরাও মাচায় ওঠেন, সাপ খেলা দেখান,মন্ত্র পড়েন,বান মারেন।অন্য দলের সাপকে বান মেরে,ধুলো পড়া ছুঁড়ে নিস্তেজ করে দেওয়া হয়।জোড় ঢাক, নানারকম বাজ্না বাজে,সঙ্গে মাচানের গুনীনদের হাতে হাতে বাজে 'বিষম ঢাকি'।মল্লরাজ বংশতিলক ঝাঁপান তলায় এসে দাঁড়ান। তিনি ঝাঁপি খোলা ফণা তোলা সাপ দূর থেকে দেখে রাজবাড়ির ভিতরে চলে যান। রাজার সর্প দর্শন শেষ হলে চলতে থাকে ঝাঁপান। গোখরো, কেউটে খরিস, শিয়রচাঁদা- এইসব তেজী, ফণা তুলে দাঁড়ানো সাপই আনা হয়। তার সঙ্গে আরো অন্যান্য সাপও আসে।একদল ঝাঁপির ঢাকনা খুলে সাপগুলিকে দাঁড় করায় মাচানের উপর। সাপগুলি ফণা তুলে দুলতে থাকে।অন্য দলেরাও মাচানের উপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখাত থাকে। প্রতিযোগিতা শুরু হয়।নীচু গলায় আন্তরিক আবেগে কাঁপা গলায় গান চলে-"এসো এসো গো মা জয় বিষহরি।' এক রুদ্ধশ্বাস বাতাবরণর সৃষ্টি হয়।এই আকুল প্রার্থনা গীতের সঙ্গে ধুয়া ধরেন দলের গুনীনেরা-"নমো নমো নমো মাগো,নমো নারায়ণী।"গানের সঙ্গে চলে গালিগালাজও। যাঁদের সাপ ফণা তুলে দাঁড়াতে পারে না,অন্য দল ব্যঙ্গ করেন তাঁদের।মন্ত্র পড়া ধূলি মুঠি ছুঁড়ে মারেন এক দলের গুনীন অন্য দলের গুনীনের দিকে,সাপের দিকে।'বাণ 'মারেন।কেউ কেউ মন্ত্র বাণের ফলে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কোনো মাচান থেকে গুনীন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন অন্য মাচানের দিকে গানের মাধ্যমে- "শুন শুন গুনী ভাই,ইতিহাস বল, কোথায় গরুড়ের দর্প চূর্ণ হয়েছিল।" আবার এই গানের মধ্যে দিয়েই চলে তাঁদের নিজেদের পরিচয় দেবার পালা। যে দল সাপ খেলায়,সাপের সৌন্দর্যে ও বৈচিত্রে শ্রেষঠ বলে বিবেচিত হন, সেই দলকে রাজা পুরস্কৃত করেন।মেলা শেষে একেক দল রাজ অন্তঃপুরে ঢুকে খেলা দেখান।



বর্ষা প্রেম 

প্রিয় বর্ষা ঋতু আমার চোখের তারায় ভাসে
বটু কৃষ্ণ হালদার

নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে /ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে ।বর্ষা ঋতুর আগমনই কবি সুনির্মল বসু এঁকেছেন প্রকৃতির মায়াবী রূপের ছবি। বর্ষা সবচেয়ে আদরের ঋতু। সজল মেঘ মেদুরের অপরূপ বর্ষার সঙ্গে রয়েছে বাঙালি জাতির আজন্ম কাল হৃদয়ের বন্ধন ।কৃষিপ্রধান ভাইদের জীবনে এনে দেয় অর্থনৈতিক সচ্ছলতা । বজ্রবিদ্যুৎ ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে রুক্ষ অবক্ষয় শুষ্ক মরু প্রান্তরে এনে দেয় সবুজ সতেজ প্রাণের সঞ্চার । রৌদ্র জলের মাখামাখি তে প্রকৃতি রানী সেজে ওঠে নবরূপে। শস্য শিশুর কল কল উচ্ছ্বাসে তার চোখে লাগে অনাগত দিনের বিভোর স্বপ্নের নেশা ।প্রকৃতি রানীর আঁচলভরে ওঠে নতুন দিনের স্বপ্ন বিভোর হয়ে । বর্ষাকাল শস্য-শ্যামলা আনন্দঘন নবান্ন উৎসব এর নেপথ্য মঞ্চ । আবার তারই অপ্রসন্ন অভিমানী দৃষ্টিতে ঘরে ঘরে অন্তহীন সংহার রূপে মানুষ আতঙ্কিত ভীতসন্ত্রস্ত । শ্যাম ঘন বরষা একদিকে যেমন গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে আশীর্বাদ, অন্যদিকে আবার দরিদ্র পল্লীবাসী অনাহারী ফুটপাতবাসী দের কাছে দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।তবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ জীবন প্রবাহের এক অপরিহার্য কল্যাণী ঋতু।

কবিগুরু লিখেছেন "এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়"কবির দৃষ্টিতে বর্ষা গভীর অর্থ ব্যঞ্জনাময় বিস্তৃত । বর্ষাকাল হলো অবকাশের নিষ্প্রয়োজন ঋতু। ঋতু শুধু অর্থনৈতিক জীবনে নয় সাংস্কৃতিক ভাগবত জীবনের ও বর্ষা ঋতু রয়েছে এক অনন্য ভূমিকায় । বর্ষার সরস সজল স্পর্শ শুধু রুক্ষ ধূসর প্রান্তকে অসীম কানে স্পন্দিত করে নি প্রেমিক মনকে দুর্বল করে তোলে। প্রেমিকার নিঠুর ঠোঁটের ভাজে উর্বর ভাষা য় উন্মাদনার চেতনা সঞ্চারিত হয় ক্ষণে ক্ষণে । বর্ষা উৎসব আনন্দে রচিত হয়েছে কাব্য, গান ,উপন্যাস ও অজস্র প্রেমের কবিতা  আলো আঁধারের খেলা অনুষ্ঠিত হয়  বিমোহিত করে প্রকৃতি রানী কে। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৮০ ভাগের অধিক বর্ষাকাল সংঘটিত হয়। নদী নালা খাল বিল পুকুর ডোবা কানায় কানায় ভরে ওঠে। বিলে বিলে হেলেঞ্চা, কলমি লতা, শাপলাদের সমাবেশে সেজে ওঠে প্রকৃতি কন্যা।

বর্তমানে আমাদের দেশে ঋতুচক্র আবর্তিত হয়। ছয়টি ঋতুর সমাহার। দ্বিতীয় এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঋতু হলো বর্ষাকাল। গ্রীষ্মের দাবদাহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাতক পাখির মতো এক পশলা বৃষ্টির জন্য তাকিয়ে থাকে ঐ দূর আকাশের দিকে ।বর্ষার আগমনী গান "আমি বর্ষা অমলিন গ্রীস্মের প্রদাহ শেষ করি, মায়ার কাজল চোখে, মমতার বর্ম পুট ভরি"।প্রকৃতি যেন নিজের তিস্নার্ত বুক ভরানোর জন্য বর্ষাকে আহবান করে।জেলেদের মাতান উল্লাসে জাল ফেলে নদীতে । জল ভরে উঠে আসে রুপালি মাছ । জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, কলা গাছ কেটে ভেলা বানায় ছোট্ট শিশুর। কলার ভেলায় চড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে শৈশব। ডুব দিয়ে হার মানায় পানকৌড়িকে। এই বর্ষা প্রকৃতিকে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলে বৃষ্টির । ফলে সতেজ হয়ে ওঠে গাছপালা। এ সময় নানা ধরনের ফুলের ফুল ও ফলের সমারোহ সেজে ওঠে প্রকৃতি রানীর প্রাণের ডালা। কদম ,রজনীগন্ধা ,কেয়া ,জুই ,গন্ধরাজ, হাসনুহানার গন্ধে প্রকৃতিকে বিমোহিত করে তোলে। আম, জাম ,কাঁঠাল পেয়ারা সহ বিভিন্ন হলে সম্মোহিত হয় প্রকৃতি।বাংলা মাস অনুযায়ী আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। 
 
যতদূর দৃষ্টি যায় পাংশুটে আকাশে মেঘের জাল বোনা ।প্রকৃতির নিথর নিস্তব্ধ তৃণভূমিতে জেগে ওঠে প্রাণের হিল্লোল।আকাশ দিগন্ত বিস্তার ধূসর মেঘ পুঞ্জিতে।সজল দিগন্ত ভেসে চলে বলাকার সারি ।কুলায় কাঁপিছে কাতর কপোত। আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় জনহীন পথঘাট ক্ষুদ্র পবনের মত্ততা ভবনে ভবনে রুদ্ধ দুয়ার।থেকে থেকে দীপ্ত দামিনীর চমক উদ্ভাস কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে চারিদিক গতিময় আর্তিকার মহা উল্লাস। বর্ষাকাল রূপ-বৈচিত্র্যে তুলনাহীন মানুষের মনে সঞ্চয় করে অনন্ত বিরাজময় বেদনা । বর্ষার এক হাতে বরাভয় অন্য হাতে ধ্বংসের প্রলয় ডমরু। এক পদপাতে সৃজনের প্রাচুর্য অন্য পাতে ধ্বংসের তাণ্ডব। এক চোখে অশ্রু অন্য চোখে হাসি । বর্ষা আমাদের কাছে অতি আদরের ও অনন্ত বেদনার ঋতু রূপে পরিচিত। তাইতো বর্ষা হলো প্রেম কবিতা, কবির ভাষায় বলা যায়- 
ওরে বন্ধু জীবন সাথী,আয় ফিরে আয় ঘরে
তুই যে আমার বৃষ্টি রানী,রাঙা মাটির পরে"
মুখখানি তোর লুকিয়ে রাখিস,কিসের অভিমান? 
তুই না এলে তুলবে চাষী,গোলায় পোড়া ধান"
একে একে যাচ্ছে ফিরে,যাদের আয়ু অল্প 
খাপরার চাল হচ্ছে খালি,শুনে যা সেই গল্প "
জল জোয়ারে শূণ্য উনূন,শিশুর শুকনো মুখ 
অশ্রুধারায় চলছে ভিজে,শূন্য মায়ের বুক " 
পথের পথিক যায়নি হাটে,ফিরছে অভিমানে 
উষ্ণ বায়ুর ভীষণ দাপট,ক্লান্তি মনও প্রাণে"
ওই পাহাড়েরে চূড়ায় খেলিস, লুকোচুরি খেলা
মাঠ ঘাট সব ভরিয়ে দে,যেথা ভাসবে রঙিন ভেলা "



বর্ষা ভাবনা 

উতল ধারা বাদল ঝরে
চিত্রা পাল

আজ কদিন হলো, মেঘেদের কাজের যেন  শেষ নেই। সারাদিন সারাবেলা সে ঝরঝর শব্দে বৃষ্টি দিয়েই চলেছে। ঘন মেঘের আবরণে বৃষ্টি দিয়ে  দিনের শুরু।তারপরে কখন যে বেলা গড়িয়ে যায় বোঝা যায় না। আকাশ ঘেরা কাজলমেঘে বিদ্যুতের ঝলক জেগে ওঠে, তারপরে শোনা যায় সেই বজ্র নির্ঘোষ। তার আলোর আভার কাঁপন দেখা যায়, ওই আমগাছের মাথায়, কাঁঠাল গাছের ছায়ায়। আকাশ থেকে আকাশে শোনা যায় গুরু গুরু ধ্বনি। নারকেল গাছেরা সুপুরি গাছেরা অবিরত মাথা দোলায়।  এখন সমস্ত আকাশ বাতাস জুড়ে  জল স্থল অন্তরীক্ষে  শুধু মেঘ বৃষ্টির খেলা। এরই মাঝে আমাদের চমকে দিয়ে হঠাত্‌ পাওয়ার মতো রোদ জেগে  ওঠে।তখন আমরাও জেগে উঠি। মনে হয় এইতো আমরা আছি। এতদিন মেঘবৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। কোন কল্পলোকের ছায়া ছবিতে। এখন শুধু খবর আসে বাণভাসির। অবাধ্য দুরন্ত বাঁধনহারা নদী নিজের সীমা পেরিয়ে ঢুকে পড়ছে হাটে বাজারে,ঘরের উঠোনে। উতলধারা বাদল ধারার সঙ্গে  এদের সম্পর্কও যে  বাঁধা।

এখন সমস্ত আকাশ বাতাস জুড়ে যে মেঘবৃষ্টির খেলা, সে খেলা কিন্তু সামান্য নয়। প্রবহমান জীবনেও চলেছে তারই প্রতিচ্ছবি। কত হাসি কান্নার যে জীবনব্যাপী সুখ দুঃখের জাল বোনা  চলেছে এই মেঘ বৃষ্টির মধ্যে সেও তুচ্ছ নয়। কত অকারণ অভিমান, কত ব্যথা বেদনা,কত স্নেহ কত কল্পনা এই বর্ষণের  বারিধারায়  অঙ্কুরিত হচ্ছে, তার লেখা জোকা নেই। তবু এই উতল ধারা বাদলে আমরা চলে যেতে পারি সেই কল্পজগতে,যার ছায়াপ্রলেপে আমরা চলে যেতে পারি তেপান্তরের পাথার পেরিয়ে রুপকথার জগতে তার আকর্ষণও বা কম কি।                 



বর্ষা কবিতা 

বৃষ্টি আসে
শ্রাবণী সেন

বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি নামে শালের বনে ঝড়
বৃষ্টি স্রোতে ভাঙছে দেওয়াল, কাঁপছে থরোথর।

বৃষ্টি নামে আষাঢ় মাসের সন্ধ্যা ঘনায় কালো
অন্ধকারের আড়াল টেনে জোনাকজ্বলা আলো!

 আলোয় কালোয় মিলেমিশে রাত ঘনিয়ে আসে
চোখের তারায় বার্তা চলে মধুর হাসির ভাষে।

গাছের পাতায় লুটিয়ে পড়ে বৃষ্টি অবিরল
ঘুমের আবেশ পরম প্রিয় স্বপ্ন দেখার ছল!



বরিষণ 
মনিরুজ্জামান প্রমউখ 

দুনিয়ার সোরগোল সুমন্তর করে হাওয়ার শরীরে পড়িয়ে দেয় 
বরিষণ, বছরঘূর্ণি বর্ষা তার একমাত্র লালিত্য নুপুর নিক্কণ। 
প্রবর্তীত ঝংকার ব্যতীত নির্জনতার সাথে মানুষের যুথসন্ধি 
মিলন, ঘর খোঁজে তখন সকল প্রাণ গাঁও নগর বন্দর সব থান। 




 অভিমানিনী মেঘপর্নার কথা
               চন্দন কুমার দাস 

পাহাড়ে বৃষ্টি হলে ----গাছেরা সবুজ হয়
 স্রোতস্বিনীর বুক ভরে ওঠে আনন্দে।
 সবুজ পাহাড় মেঘের আড়ালে থাকা সূর্যকে ডাকলে, 
সূর্য একগাল হাসি দিয়ে ঝিকমিক করে ওঠে।

 কিন্তু এখানে বৃষ্টি নেই ;
বর্ষা আসে,মেঘ-পর্ণাকে ডাকে__" তুমি ঘুমিয়ে আছো?"
 মেঘ পর্না নিশ্চুপ ।
মেঘপর্ণার আসলে বৃষ্টি হবার কথা ছিল।
 বৃষ্টি হলে হয়তো গাছেরা সবুজ হয়ে উঠত, বাগানে ফুল ফুটত ; 
জমে উঠত প্রজাপতিদের ভিড় ।
অভিমানিনী মেয়ে মেঘপর্ণা ;আসলে তার বৃষ্টি হবার কথা ছিল।


তিলোত্তমা 
রূপক রায়

কালো মেঘের বৃষ্টি নামে রৌদ্র ওঠে বনে
তখন থেকেই হিসেবে গুলো তোলা ছিল মনে
যাওয়ার বেলা শর্ত গুলো জড়িয়ে যদি ধরে
স্বপ্নগুলি চেঁচিয়ে ওঠে নন্দন চত্ত্বরে
ঘাসের গন্ধ ভিজে মাটির 
ক্লান্তি থেকে ছুটি
হাত ধরে শুয়ে আছে
দু'টি-প্রাণ, এই আকাশের নীচে 
উষ্ণ অন্ধকার রাতগুলি 
ভোর হয় ট্রামের শব্দে, স্টেশনে
এই সময়ে বৃষ্টি নামুক 
তোমার ভিক্টোরিয়া ময়দানে
শরীর জুড়িয়ে 
নেমে আসুক তোমার শীতলতা
ভরে যাক সমস্ত চিঠির পাতা
যা কিছু শূন্য-সীমাহীন ।


বর্ষা ও মেঘদূত
প্রনবরুদ্র কুন্ডু

কাজল নীরবতা ভেঙে পথ নামে স্মৃতি
গোপন চিঠি
কান্নার চেয়ে প্রিয়তর অপেক্ষা-
আনন্দ ও ব্যথা তুমি:
নীল আঁধার আবেগী আবদার;
মন কেমনের চাঁদ দূরবর্তী নদী পাঠ

নেমে এসো মাটির ভিতর
প্রতিদিন যক্ষের ধন ভিখারি জীবন, এসো 
প্রেমস্রোতে নিত্য ভালোবাসা শিখি।
নানা গল্প ধরে বিরহ ও অন্ধকার
পরস্পর মেশে মেঘলা আকুলতা; ও মেয়ে 
একাকী ঘুম এপাশ ওপাশ, জাগে বাঁশিওয়ালা…

সুর তুলে মেঘও হয় জলবতী আনমনা
আকাশের বুকে বারোমাস নদীর আনাগোনা 



বর্ষা যাপন
      রমজান সরকার 

আমি যতবার তোমায়
রবীন্দ্র সংগীতে খুঁজে নিই
তুমি ততবার শহর পরিবর্তন করো

হয়ত ভুলে যাও প্রথম সকাল
বাজারের মোড়ের বৃষ্টিভেজা অদেখা
পাশাপাশি না বসা -
ইশারায় দুচোখের কৌমার্য ভাঙা
ঘাসের মেঝেতে হাটা
একটু বিশ্রাম; আঙুলে আঙুল রাখা
হাতে হাত, প্রতিজ্ঞা প্রথম দিনেই...

তুমি বর্ষা; জাল বুনতে সক্ষম মাকড়সা
বর্ষপঞ্জি পরিবর্তনে ব্যাপৃত ভেজা ঋতু
যাকে আমি যাপন করি প্রতি রাতে




বর্ষা  গল্প 

ডেলিভারি বয়
মৌসুমী চৌধুরী 


আজ একটু তাড়াতাড়িই কোর্ট থেকে ফিরে এসেছে রাই। খুব ইম্পর্টেন্ট একটা কেসের হিয়ারিং ছিল ফার্স্ট আওয়ারে। সকাল দশটা থেকে বেলা প্রায় একটা পর্যন্ত হিয়ারিং চলেছে। শেষ হয়ে যেতেই বেশ টায়ার্ড লাগছিল রাইয়ের। কেসটা নিয়ে একমাস ধরে খুব পড়াশোনা করতে হয়েছে। খাটতে হয়েছে।  মাথাটা বেশ ধরেছিল। বলাইদাকে এককাপ কফি দিতে বলে ফাইলপত্র গোটানো শুরু করেছিল সে। সকাল থেকেই গাঢ় ছাইরঙা আঁচলে মুখ ঢেকে ছিল আকাশটা। আর মাঝে মাঝে টিপ টিপ সুরও সাধছিল সে গোমড়া- মুখী। তাই আলিপুর কোর্ট চত্তর থেকে গাড়িটাকে বের করবার আগেই ঝমঝম করে তুমুল বৃষ্টি নেমে যায়। গাড়িটা লালবাতি হয়ে এগিয়ে গিয়ে মাঝের হাট ব্রিজ ক্রস করে বেহালার দিকে আসতেই চোখে পড়ে মিনিট চল্লিশের তুমুল বৃষ্টিতেই ততক্ষণে চারদিকে জল জমতে শুরু করেছে। তাদের আবাসনের সামনেও বেশ জল জমেছে। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে আসতে আসতে বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছিল রাই। ঘরে ঢুকেই সোজা বাথরুমে। হালকা উষ্ণ জলে স্নান করবার পর খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। আর তখনই মনেপড়ে আজ ঘরে কোন রান্না নেই। সকালে কাজে আসেনি মালতীদি। দুপুরে বলাইদাকে দিয়ে একটা ধোসা আনিয়ে কোর্টেই লাঞ্চ সেরেছে। আর এখন তো এই বৃষ্টিঝরা বিকেলে মালতীদি আসবার কোন সম্ভাবনাই নেই। অগত্যা এক কাপ কফি বানিয়ে, চানাচুর আর আচারের তেল দিয়ে এক বাটি মুড়ি মেখে নিয়ে জানালার ধরে এসে বসে রাই।  
     " আওগে যব তুম ও সাজনা /আঙ্গনা ফুল খিলেঙ্গে ..." — মিউজিক সিস্টেমে খুব লো ভলিউমে প্রিয় গানটা চালিয়েছে। সেই কলেজ জীবন থেকে এটা রাইয়ের প্রিয় গান। বাইরে এখনও তুমুল বৃষ্টি চলছে। যেন আকাশ একেবারে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। জালানা -র কাঁচে চলছে বৃষ্টির উদ্দাম নাচন। সামনের রাস্তা-ঘাট-দোকানপাট সব ঘোলাটে লাগছে। ঠিকমতো ঠাওর হচ্ছে না কিছু। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাই দেখল ঘড়িতে বিকেল তিনটে বাজে। তিনটেতেই  চারদিকে যেন রাত ঘনিয়ে এসেছে। জ্বলে উঠেছে স্ট্রীট -লাইট। খুব কাছেই কোথাও বোধহয় কড়াৎ কড়াৎ করে বাজ পড়ল। দু'ঘন্টার তুমুল বৃষ্টিতে ড্রেন উপচে চারদিক একেবারে জলে ডুবে গেছে। আজ খুব খিঁচুড়ি আর মাছভাজা খেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে রাইয়ের। মা চলে যাওয়ার পর বৃষ্টি দিনের এই মেনু প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। ছোটবেলায় জলপাইগুড়িতে বৃষ্টি  মানেই ছিল অন্তত টানা সাতদিনের প্রোগ্রাম। তাদের টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝমাঝম আওয়াজ উঠত। আর বৃষ্টি হলেই মা মুসুর ডালের খিঁচু্রি রাঁধতেন, সঙ্গে থাকত কড়কড়ে আলু ভাজা, পাঁপড় ভাজা, পিঁয়াজি ইতাদি। কখনও-সখনও থাকত মাছভাজা বা ডিমভাজা। ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির থালা ঘিরে হাপুসহুপুস আনন্দ করে খেত তারা ভাইবোনেরা। 
   ধীরে ধীরে খুঁজে জোমাটোতে অর্ডার করল রাই । "ষোলোআনা বাঙালিয়ানা"-র সবজি- খিঁচুড়ি, আলুভাজা, পাঁপড় ভাজা, রুইমাছ- ভাজা। কিছুক্ষণ পর "ষোলআনা বাঙালিয়ানা" থেকে ফোন এল,
— " ম্যাডাম, এই বৃষ্টিতে আপনার ওয়ার্ডের সব রাস্তাঘাট তো জলে ডুবে গেছে। ডেলিভারি হবে কিনা এখুনি বলা যাচ্ছে না। স্টাফ কম। আর ডেলিভারি চার্জ কিন্তু অন্যদিনের চেয়ে বেশি লাগবে।" 
ওদের সম্মতি জানিয়ে কফির কাপে চুমুক দিল রাই। আর মনে মনে ভাবল জোম্যাটো অর্ডারটা ক্যানসেল করলেও আজ নিজেই যেমন পারে খিঁচুড়ি রান্না করে খাবে।  
   "...বরষেগা শাওয়ান, বরষেগা শাওয়ান / ঝুম ঝুম কে/ দো দিল এ্যায়সে মিলেঙ্গে..." 
বড় গভীরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে মিউজিক সিস্টেমে বেজে চলেছে গানটি। আষাঢ়ে বৃষ্টির এই গভীর বিকেল, এই উতল বর্ষা, গানের কলির এই জল আঁচড় রাইকে কেমন যেন বিহ্বল করে তুলছে!  
— "রূপমায়াতে 'যব উই মেট' এসেছে।  যাবি দেখতে?"
— "এই বৃষ্টিতে সিনেমায়? মাথা খারাপ! "
— " চল না আজ তো ক্লাসও তেমন হবে না। সকাল থেকেই যা নেমেছে। আকাশ যেন ফুটো হয়ে গেছে। 
বিমর্ষ গলায় বলেছিল রাই। রাইয়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল জিষ্ণু, প্রিয়া, স্বপন, রুমকিরাও।
     জলপাইগুড়ি ল-কলেজে পড়তে গিয়ে প্রথমদিন থেকেই মুখচোরা অমলের সঙ্গেই কেন যে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল, তা জানে না রাই। আশেপাশের কোন একটা চা-বাগান থেকে পড়তে এসেছিল সে। তার বাবা ছিলেন চা বাগানের ফ্যাক্ট্রির লেবার। খুব কষ্ট করেই তাকে পড়াতেন তার বাবা। তাদের বাগানের শ্রমিক বস্তির কেউ পড়াশোনা তেমন চালিয়ে যেতে পারত না। অমল পড়ায় খুব মনোযোগী ছিল বলে চেয়েচিন্তে টাকা পয়সা জোগাড় করে তার বাবা তাকে জলপাইগুড়ি ল কলেজে ভর্তি করেছিলেন। আর পড়াশোনায় ভালো ছিল বলেই রাইয়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। রাই কলেজে না গেলে অমল তাকে নোট লিখে দিত। তার মুক্তোর মতো ঝকঝকে হাতের লেখা আজও চোখে ভাসে রাইয়ের। 
— " আমার পয়সা নেই রে। তোরা যা।"
সরল গলায় উত্তর দিয়েছিল অমল।
— " তোর টিকিটের দাম আমিই দেব। তুই চল তো।"
গাঢ় স্বরে বলেছিল প্রিয়া। হৈ হৈ করে উঠেছিল 
অন্যেরাও,
— " যেতেই হবে তোকে..."
    সেদিন সিনেমা হলে লোক খুব কমই ছিল। দু'টো-রো জুড়ে একসঙ্গে বসেছিল রাইদের বন্ধুদলটা। রাই লক্ষ করল তার ঠিক পাশেই এসে বসেছে অমল। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি নেমেছিল। সিনেমা হলের টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ, সিনেমার পর্দায় রোমান্টিক দৃশ্য সেদিন যেন যেন চারিয়ে গিয়েছিল দুই কিশোর-কিশোরীর মনেও৷ কখন যে অমলের হাত উঠে এসেছিল রাইয়ের হাতের উপর দু'জনের কারও খেয়াল নেই। ইন্টারভেলে লাইট জ্বলে উঠলে লজ্জা পেয়ে হাত সরিয়ে নেয় দু'জনেই। সেদিন ফেরার পথে বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল। নিঃশব্দে রাইয়ের পাশে হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার গলির মুখ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়েছিল অমল।

        রাইয়ের ফোনটি হঠাৎ সুরেলা ঝংকারে জানান দিলে বর্তমানে আছড়ে পড়ল সে।
— " হ্যালো ম্যাডাম। আপনার খিঁচুড়ি ডেলিভারি হয়ে যাবে আটটার মধ্যে। কিন্তু  ডেলিভারি চার্জ কিন্তু একটু বেশিই লাগবে। এই দুর্যোগে ডেলিভারি বয়রা কেউ যেতেই চাইছিল না। বহু কষ্টে আমাদের হোটেলের  একজন স্টাফ রাজি হয়েছেন।"
— " ঠিক আছে। পাঠান। আমি এক্সট্রা ডেলিভারি চার্জটা পে করে দিচ্ছি।"

ফোন রেখে  জানালার বাইরে তাকিয়ে রাই দেখে পথ-ঘাট, বাড়ি-ঘর, দোকানপাট সব কেমন বাঁধনহারা বৃষ্টির সাদা আদর মেখে যেন গলে গলে জল হয়ে ঝরে যাচ্ছে ! রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো অকাতরে মাথা নীচু করে ভিজছে অপরাধীর মতো। এই রূপোরঙা বৃষ্টির সঙ্গে কোনভাবে তাদের ছোটবেলাকার  জলপাইগুড়ির সেই  বৃষ্টির কি কোন আত্মীয়তা আছে? হারিয়ে যাওয়া মুখেরা জলপাইগুড়ি থেকে ভেসে ভেসে কেন এসে মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে? 
       তারা নিজেরা পরস্পরকে মুখ ফুটে কোনদিন কিছু বলেনি। কিন্তু রাই জানত Somebody is there — ঝকঝকে হাতের লেখায় নোট লিখে দিতে। কঠিন বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতে। লক্ষ্য করত অমলের নীরব চোখের পাতায় জেগে আছে  হাজার কথার সুনামী ঢেউ আর বিষন্ন মেঘ। 
      সময়টা ছিল কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি। প্রায় সপ্তাহ খানেক অমলের কোন দেখা নেই। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছিল রাই। তার মেসে খোঁজ নিয়ে  জানতে পারল  বাড়িতে গেছে সে। বাড়ি থেকে যেদিন  ফিরে এল অমলের চুল উসকো খুসকো, চোখ লাল, মুখে না কামানো খোঁচ খোঁচা দাড়ি,
— " আমি আর পড়াটা চালাতে পারব না রে, রাই। কলেজ ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের বাগান লক-আউট হয়ে গেছে। বাবার চাকরিটা আর নেই। বাবা আমাকে আর পড়াতে পারবেন না। আমি কালই চলে যাব ব্যাঙ্গালোরে।  একটা হোটেলে কাজ পেয়েছি। ভাইবোনেরা সব ছোট ছোট সংসারের হালটা আমাকেই ধরতে হবে রে।"
      স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রাই। গাল বেয়ে জল নামতে থাকে। তারপর আর কখনও, আর কোনদিনও অমলের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। ল পাশ  করবার পর জলপাইগুড়ি কোর্টে সে প্রাকটিস করত কিছুদিন। অরিণের সঙ্গে বিয়ে হতে  কলকাতায় চলে এসেছিল। আলিপুর কোর্টে প্রাকটিস শুরু করেছিল তখন থেকেই। কিন্তু তার নিজের জীবনের গতিটাও ঠিকঠাক খাতে বইল না। বিয়ের পর পরই একদিন রাই জানতে পারে অরিণ বহুদিন থেকে অন্য একটি সম্পর্কে জড়িত। তার প্রেমিকা ডিভোর্স না পাওয়ায় বিয়ে করতে পারেনি তারা। বিয়ের পরও সেই সম্পর্কে থাকতে চায় সে। অরিণের নিজের মুখে এ রকম স্বীকারোক্তি শুনে একদিনও আর সে বাড়িতে থাকেনি রাই, মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল। বাবা চলে যাওয়ার পর মাও ততদিনে জলপাইগুড়ি ছেড়ে কলকাতায়। গত বছর তো মাও চলে গেলেন। এখন কলকাতায় মায়ের এই ফ্ল্যাটে রাই একাই থাকে। 
          ফোনের রিংটোনে চমক ভাঙে রাইয়ের। ডেলিভারি বয়ের কল। কল রিসিভ করে রাই বলে,
— " আসুন। থার্ড ফ্লোর, অ্যাপার্টমেন্ট  ৪/২।"

   কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দেয় রাই। দেখে ছেলেটি একদম কাকভেজা ভিজে গেছে। পরনে নীল জীনসের প্যান্ট আর হলদে টি-শার্ট। ইস! তাকে খাওয়ানোর জন্য একজন লোক এই ভারী বৃষ্টির মধ্যে এত কষ্ট করে খাবার নিয়ে এসেছে! ভাবতেই নিজেকে বড় অপরাধী লাগে। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়।

   খাবারটা নিতে গিয়ে এক লহমায় ডেলিভারি বয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে ওঠে রাই! চিনতে একটুও ভুল হয় না ... অমল!!!
  বাইরে তখন নিচ্ছিদ্র ধারাপাত!  মিউজিক সিস্টেমে বাজছে — "...বরষেগা শাওয়ান, বরষেগা শাওয়ান / ঝুম ঝুম কে/ দো দিল এ্যায়সে মিলেঙ্গে..."। ঘরের মধ্যে খেলে যেতে থাকে  "রূপমায়া " সিনেমাহলের সেই আধো অন্ধকার! 

     বহুদিন পরে বিহ্বল চোখে পরস্পরকে দেখতে থাকে অমল আর রাই! 



ঈশ্বরের বিচার

কাকলি ব্যানার্জী মোদক 


কথা ছিল ভালো থাকবো.......
        কথা ছিলো ভালো রাখবো......
                   কথা ছিল ভালোবাসবো......

‌নন্দনের চত্বরে দাঁড়িয়ে আমি, শ্রাবনের ধারা আজ বাঁধ মানছে না,ছাতা থেকে উপচে পড়া জলধারা বেনী স্পর্শ করে, আঁচল ছুঁয়ে মাটিতে মিশছে।  ঝড়ের গতিতে  চলে যাচ্ছে বাধা না মানা গাড়ি গুলো, তাদের তীব্র আলো আর  চারিদিক অন্ধকার মিলেমিশেএকটা অদ্ভুতপরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে,পাশে কেউ দাঁড়ালে বোঝা মুশকিল, এই আলো আঁধারিতে। দাঁড়িয়ে থাকতে, থাকতে  অন্য জগতে ভেসে যাচ্ছি আমি, অবশ্য এটা আমার একটা রোগ,  মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতি কে হাতরাই।  আজ শনিবার একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছি বৃষ্টির দিন বলে, ব্যাগটাকে  বুকের কাছে জড়িয়ে  ধরে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ একটা পুরুষ কন্ঠস্বর এসকিউসমি  একটু রাস্তাটা পা করে দেবেন, বুকের মধ্যে হাতুড়ির মতন যেন কে একঘা দিলো, মনে হলো কন্ঠস্বর যেন খুব পরিচিত, নিজের মনেই হেসে উঠলাম।সবসময় হাতড়ে বেড়াই আমার উজান কে, ছাতাটা হেলিয়ে দিলাম যতটা সম্ভব। মুখ ঢাকা দেয়া আমার একটা অভ্যেস। বাসে, ট্রামে উঠলে আমাকে সবাই করুনার চোখে দেখে, ছোট ছেলে ,মেয়েরা ভয়ে মায়ের আঁচলে মুখ ঢাকে,  আজকাল কেউ করুনার চোখে দেখালে মনে মনে খুব রাগ হয়, এটা তো হবার কথা ছিল না, তবে কেন? কেন প্রশ্ন জাগে বারবার?  
     
সেদিন ও ছিল এমন ই বর্ষার রাত, গাঁয়ের মেঠো পথ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, পথ সংকুল ঝোড়ো হাওয়ায় দুধারের গাছ মাটি স্পর্শ করছে,আমার বুকে ধরা রবীন্দ্রনাথ, আর কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, আলো আঁধারির  রাস্তা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ভয়ে -আতঙ্কে দ্রুত গতিতে  চলছিলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম তরল পদার্থ মুখ স্পর্শ করে শরীর ছুঁয়ে নেমে যাচ্ছে ফুটন্ত লাভার মতন। আমার চিৎকারে পাশের লতাপাতা,বাঁশবন কেঁপে উঠছিল। গগনভেদি চিৎকারে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম, পরিচিত একটি কন্ঠস্বর কানে এলো "খুব অহংকার তোর, এবার সারাজীবন ভোগ কর।" 

যখন জ্ঞান এলো কোলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অ্যসিডে ঝলসে গেছে আমার মুখের ডান অংশ। ধীরে ধীরে সুস্থ হলাম বুঝতে পারলাম কিশোরীর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। দ্বীপের-শিখাটা নিজের অজান্তেই নিভে গেলো। প্রশ্ন জেগেছিল মনে বারবার কেন কেন উজান
এই কাজ করলো?

              ইদানিং বাউন্ডুলে উজানের আমার রূপ নিয়ে ওর সন্দেহের দানা দিনে, দিনে  ক্রোধে   পরিনত হতে থাকে। নামি কলেজে র ছাত্রী দ্বীপশিখা ওর কাছে ঈর্ষার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।  মেনে নিতে পারিনি আমার অবাধ বিচরণ।  হয়তো তাই এই পরিনতি। আবার ওই ভদ্রলোকের কন্ঠস্বরে তাকালাম এবার আর চিন্তে দেরি হলোনা, এই সেই উজান যে আমার জীবনটা এক লহমায়  অন্ধকার জগতে ঠেলে দিয়েছিল, রাগে প্রতি হিংসায় সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল ,মনে হচ্ছিল চলন্ত বাসের সামনে ঠেলে দি, এই আলো আঁধারিতে কেউ, কেউ আমাকে চিন্তে পারবেনা প্রতিশোধ নেয়ার  এই সুবর্ণ সুযোগ।  হাত বাড়াতে গিয়ে দৃষ্টি পড়ল তার চোখের উপর-- এই আলো, আঁধারিতে ঘন সন্ধ্যায় কালো কাঁচ ঢাকা  তার দুটি চোখ  ,হাতে অন্ধ লাঠি।  শুনেছিলাম ছোঁড়া অ্যসিডে দুই এক ফোঁটা তার চোখেতে  পড়েছিল। ঠাকুর কে  জানালাম, ঈশ্বর তুমি করুণাময়ী, ডান হাতটা  চেপে ধরে  নিশ্চিহ্ন পৌঁছে দিলাম  উজানের গন্তব্যস্থলে।। বাস ধরার জন্য।




বর্ষা কবিতা 

বৃষ্টি ছায়ার ভেতর 
সৈকত দাম

একটু একটু করে সরে যাচ্ছে মৌসুমী ....
ভেতরের বৃষ্টি টা ধরে আসছে ক্রমশ .....
শুকোতে দেওয়া অনুভূতি গুলো ,
আরও খানিকটা শুকিয়ে এলো .....
আমিও তুলে রাখলাম ঘরের এক কোণে ,
তারপর আমার বৃষ্টি শরীর এলিয়ে দেই ভেজা কাঠের মতো ....
যেন জীবিত নেই আর .....
একদিন যে বৃষ্টি নেমে এসেছিলো হিরন্যগর্ভের দেওয়াল বেঁয়ে ....
একদিন যে বৃষ্টির নাম দিয়েছিলাম নিরুপমা ....
একদিন যে বৃষ্টি নায়িকার মতো নেমে এসেছিলো বুকের লোকেশনে .....
আজ সে আলোর গন্ধ পেলে প্রহর গোনে .....
আমার সাথে শুয়ে আছে শেষ বৃষ্টি কণা ....
তার মধ্যে শুয়ে আছে ক্ষণজন্মা পৃথিবী .....
আষাঢ়ের পরে শ্রাবণের শেষে 
এমন করেই পৃথিবী ক্ষণ জন্মা হয় ,
হয়তো সবার নয় .....
কে কতো বৃষ্টি মেখেছিলো সেদিন ,
তা সন্নিবিষ্ট ধোয়াশাই বলে দেয় .....
আর তারপর সমস্ত অনাদি দৃশ্য ডুবে যায় 
বৃষ্টি ছায়ার ভেতর .....




বর্ষালী গান
রীতা মোদক

একটা খোলা ছাদ
আর
একটা আকাশ ।
দুটোই মুক্ত
মাঝখানে বিশাল ব্যবধান ----

হঠাৎ আকাশের বুকে জমে ওঠে
বিষণ্ণতার কালো মেঘ।

মেঘের পাহাড় জমতে জমতে---
একসময় গর্জে ওঠে 
আগুন জ্বলে গহীন আকাশে ।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে ---
ভিজে যায় ছাদ বাগান,
ভিজে যায় রুক্ষ মাটি ।
বৃষ্টি নামের মেয়েটি---
খোলা ছাদ আর আকাশের মাঝে
এখন বর্ষালি গান গায় ।


বৈতালিক সুর
অলকানন্দা দে 

তখন আমার ছেঁড়া ঘুমের ভোর
পাহাড় আড়ে প্রেমিক মেঘের বাসা
বৃষ্টি এলো ভিতর ঘরে ছুটে
পাইন বনে ভিজছে ভালোবাসা!

নদীর মুখে নতুন বুলি ফোটে
পাতায় পাতায় কথা বলে জল
মেঘে মেঘে আত্মদানের কর্ম
ভোর-বরণে ফোঁটাই সম্বল!

মনের ভিতর আদরগুলো কাঁপে
বুকের উনুন দিচ্ছে সরল তাপ
উড়ে যাওয়া অসংযমী হাওয়া
বলে গেল প্রেমের দৈর্ঘ্য মাপ!

মাপতে গেলে বহর বাড়ে শুধু
ইচ্ছে ভেজে মেঘবৃষ্টির ভাঁজে
দিব্যি করে বলছি আমি শ্রাবণ
আবেশ ঋণে ঋণী তোমার কাছে!

লক্ষ লক্ষ দরাজ বারি বিন্দু
চা বাগানে তীর্থযাত্রী সব
প্রেম সাধনা দেখছি জানলা জুড়ে
আকাশ ভাঙা জলের বিপ্লব!



সে ও কবিতা
ঋতুপর্ণা রায় বর্মা

শেষ বিকেলের ছড়ানো রোদ চলে যায় যেই,
নিভু নিভু হয়ে আসে সন্ধ্যালোকের আলো যেই, 
অতর্কিতে নেমে আসে বিষাদ মাখানো রাত।
বিরস দিনগুলিতে কাজে ও অকাজে
যেহেতু মুহূর্তের ফুরসত থাকেনা,
তাই রাতে বিশ্রাম নিতে চায় মগজের পাঠশালা।
অথচ তক্ষুণি উধাও হয়ে যায় রাজ্যের ঘুম, 
আর তিমির রাতের গভীর মায়া!
অসাবধানতায় স্মৃতির ভয়াল অরণ্যে___
দু'চোখ চলে যায় যেই,
মানসিক দ্বন্দে,প্রহারের চিহ্নে
শুরু হয়ে যায় নির্নিমিখ প্রহরের ক্রন্দন। 
আর স্তিমিত অবয়বে নেমে আসে 
অশান্ত বিষণ্ণতার ছায়া!

এলোমেলো দীর্ঘশ্বাস আর অস্বস্তিতে__
অতীত সরণীর যাবতীয় ভিড় ঠেলে 
দেয়ালে দেয়ালে নিজের নতুন রূপের ছায়া আঁকে,
শব্দে-ছন্দে নীরবতা ভাঙার স্পর্ধা দেখিয়ে 
ভোরের রক্তিম আশা নিয়ে,
সুখের ডংকা বাজায় সে।
এভাবেই পীড়িত আকাশে 
তারারা যত অস্পষ্ট হয়ে আসে__
অলস ব্যথাদের বুকে নিয়ে, 
ভালোবাসাহীনতার নাছোড় জ্বরে 
কবিতার কোলে নেতিয়ে পড়ে সে। 


মেঘ বনেদি
দেবার্ঘ সেন

বিতানে আজ, কান্না মেঘে
ভরা আষাঢ়,  টেনে নেবে
সহস্রতার, গুরু বায়না।

জুঁইয়ের গন্ধে, নি মন ধুয়ে
দেখাটুকু, আলগা হলে
ভালো থাকতে, মন চায়না।

আষাঢ় ভালো, এ জমকালো
মনের মধ্যে, জল ছেটালো
ভরসা পেলে, বর্ষা ভেদি।

ভুলবশত, মনের ক্ষত
বন্দী থেকে, শুকনো যত
তাদেরকে আজ, ছড়িয়ে দিই। 


এক অন্য বর্ষা 
সারণ ভাদুড়ী

আমি চাই বৃষ্টি পড়ুক,
আমি চাই এই বৃষ্টি মুছে দিক,
মানবিকতার ওপর সেই বর্বর অমানবিকতার চাদর।
নিঝুম শহরে নেমে আসুক এক অন্য বর্ষা,
যে বর্ষা নিয়ে আসে মানবিকতা,
নিয়ে আসে মানুষে মানুষে ভালোবাসা।
বৃষ্টির জল সেই সব গর্ত গুলো ভরে দিক,
সহানুভূতির জলে,
মুছে দিক সকল বিদ্বেষ।
আবার এই শহরেই নেমে আসুক
সেই বর্ষা,
যেখানে থাকবে শুধুই সারল্য।
টর্নেডোর ওই ঘূর্ণনের মত
থাকবে না কোনো জটিলতা।।



বর্ষা ছড়া 

বর্ষাদিনে 
রীনা মজুমদার

বর্ষাদিনে বর্ষা ছিল সবুজ পাতায়
সুখ দুঃখের ছেলেবেলার খাতায়

নিভছে আগুন উনুনে ভেজা খড়ি
মায়ের ওমে ফুটছে ভাতের হাঁড়ি

এ ঘর ওঘর যেতে কোথায় ছিল ছাতা?
ছিল মাথায় মায়ের  আঁচল পাতা

বর্ষা এলে যখন গ্রামের ছবি আঁকি
ইচ্ছেগুলো বুকের মাঝে  রাখি 

মেঘ বাতাসের কত কথা হয়  যে বর্ষায়
কোন এক ছলে চাঁদের হাসি পড়ে আঙিনায়

তখন আমি মানস চোখে জলছবি আঁকি!
মায়ের হাতের প্রদীপখানির সেই যে ছায়া দেখি।


মেঘের খেয়ায় ভাসি
মজনু মিয়া 

আজকে আকাশ মেঘলা অতি দারুণ লাগে দেখে
চলো না যাই রঙ লাগিয়ে সাথে কাদা মেখে
তুমুল বেগে বৃষ্টি ঝরছে জল থইথই যে করে
অমুক সুখে খুশি খুশি মন বসে না ঘরে।

ঐ যে দূরে নদীর জলে খেয়া নায়ে চড়ে
ভাসি দুজন ভিজি দুজন আলিঙ্গনের ঘরে
মেঘের খেয়া সাজাই দেবে বৃষ্টি রানি এসে
পাশাপাশি বসবো দুজন আলতো একটু হেসে।

এই জনমে সাধ পূরবে না পূরবে বলো কবে?
আর জনম পেলে তখন ভাববো নতুন তবে
পড়ুক জলের ধারা মুষলধারে থেকো পাশে
বাঁচা মরা একসাথে যেন্ রবো তেমন আশে।


বৃষ্টির দিনে
সুভাষ চন্দ্র রায়

আষাঢ় শ্রাবণ বর্ষাকালে,
ভিজছে পাখি গাছের ডালে।
ঝম ঝমা ঝম বৃষ্টি ধারা,
আয় না ভিজি পাগল পারা।
জল জমেছে ডোবায় মাঠে,
মাছ ধরতে বেলা কাটে।
সোনাব্যাঙ ফুলিয়ে গলা,
গানের গুঁতোয় কানে তালা!
বিদ্যালয়ে যাবার বেলা,
জল ছিটিয়ে করি খেলা।
ভেজা প্যান্ট ভেজা জামায়,
গুরুমশায় ধমক লাগায়।
ধমক খেয়ে বসে থাকি,
বাদলধারার ছবি আঁকি।
ফেরার পথে ক্ষেতের জলে,
জল ছিটানো আবার চলে।
দৌড়ে তাড়াই সোনাব্যাঙ,
লাফিয়ে পালায় লম্বা ঠ্যাং।


বান এলো বৃষ্টি এলো
 বিজন বেপারী

বান যে এলো বৃষ্টি নিয়ে
আকাশ কাঁপিয়ে,
বর্ষা জলে ভরলো নদী
দু'কূল ছাপিয়ে।

ট‌ইটম্বুরে নদী-খালে
কত মাছের খেলা!
দলে দলে ভেসে চলে
যত হাঁসের মেলা।

পূর্ণ গাঙের ঘোলা জলে
গ্রাম্য শিশুর দল,
কতনা খেলায় মেতে ওঠে
ফুর্তির কোলাহল।

ভরা জলে নাও ভাসিয়ে
চলে আলাপন,
সঙ্গী থাকে গরম গরম
সিংগারা লবণ।


বুবুন ও ব্যাঙ
অঞ্জলি দে নন্দী

মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে।
মাছগুলো নাচানাচি করছে।
গান ধরেছে ব্যাঙ।
গ্যাঙর গ্যাঙর গ্যাঙ।
মান পাতা দিয়ে মাথায় বুবুন চলে ঐ।
রাস্তায় যত বালিকা করছে হৈ হৈ হৈ।
হাঁস আর হাঁসির দল
জলে বড় চঞ্চল।
পথের এদিক থেকে ওদিকে ছুটছে ব্যাঙ কত।
বুবুন ওদের পিছে পিছে দৌড়োচ্ছে সাবধানে,
কাদায় পিচ্ছিল যে পথ ও।
শিহরণ জেগেছে জমির গাছের ধানে।
নারকোল পাতায় বসে ভেজে পাখি যত।
নড়াচড়াহীন পাথরের মূর্তির মত।



বর্ষা ছবি 

অদ্রিজা বোস




















অনুস্মিতা বিশ্বাস



















সুজল সূত্রধর



















সৌরিক রায়