সম্পাদকের কথা
শ্রাবণ নিয়ে আমাদের রোমান্টিকতার শেষ নেই। কিন্তু এই বছর শ্রাবণ মাসে এমন কিছু ঘটনা ঘটল, যা আমাদের প্রত্যেককে নাড়িয়ে দিয়েছে। দেবাদিদেব মহাদেবকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বিদ্যুতের ঝটকায় একসঙ্গে দশ দশটি তরতাজা প্রাণের অকালে ঝরে যাওয়া কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। শ্রাবণ মাসের পুরোটা জুড়েই যেভাবে ধর্মের নামে তান্ডব ঘটে সেটি অকল্পনীয়। প্রশাসনের গাফিলতি থাকলেও, আমরা নিজেদের দায়িত্বও কিন্তু ভুলতে পারিনা। এই ঘটনার কয়েকদিন আগে, মহানগরের দুটি ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার ও তার সঙ্গে রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রীর জড়িয়ে পড়াও আমাদের বিস্মিত করেছে। এই রাজ্য এরকম ঘটনা এর আগে কোনও দিন দেখেনি। ফলে তার প্রভাব পড়েছে মারাত্মক। সবচেয়ে হতাশার, এই টাকার বেশিটাই ন্যায্য চাকরিপ্রার্থীদের বঞ্চিত করে ঘুরপথে চাকরি পাওয়াদের কাছ থেকে সংগৃহিত হয়েছে বলে অভিযোগ। এটি প্রমাণিত হলে, আমাদের লজ্জার শেষ থাকবে না। এই বাংলা আমরা চাইনি। চাইনি লক্ষ লক্ষ তরুণের স্বপ্নের ও জীবনের এই পরিণতি। দুঃখ একটাই, এর পরেও আমাদের বোধোদয় হবে না। সময় সবকিছুর ওপর প্রলেপ দিয়ে যাবে আর আমরা তখন মজে রইব অন্য কিছুতে!
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪২৯
মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪২৯
সূচি
কুমকুম ঘোষ, স্বপন কুমার দত্ত, চিত্রা পাল, শ্রাবণী সেন, সুধাংশুরঞ্জন সাহা, অশোক কুমার ঠাকুর, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, কৌস্তুভ দে সরকার, প্রান্তীক, পার্থ সারথি চক্রবর্তী, রাণু দেব শর্মা, স্বপন কুমার সরকার, রীনা মজুমদার, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, জয়িতা সরকার, দীপ্তিমান মোদক, মিরাজ হোসেন, মিষ্টু সরকার, বিজয়, সৈকত দাম, রাজশ্রী সেন (চৌধুরী), বিনয় বর্মন, চম্পা বিশ্বাস, সুপর্ণা চৌধুরী, সৌমী আচার্য্য, কাকলি ব্যানার্জী মোদক, প্রতিভা পাল, রীতা মোদক, মৌমিতা বর্মন, অলকানন্দা দে, সারণ ভাদুড়ী, মজনু মিয়া, সোমা দে, মনোমিতা চক্রবর্তী, দেবদত্তা বিশ্বাস, ঋতুপর্ণা রায় বর্মা
বিশেষ প্রবন্ধ
আনা ফ্র্যাংকের ডায়েরী
কুমকুম ঘোষ
দু' বছর গোপন কূঠুরীতে লুকিয়ে থেকেও ফ্র্যাঙ্ক পরিবার শেষ রক্ষা করতে পারেনি । আমস্টারডামের সেই "গুপ্ত মহলে" হানা দিল হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী। ১৯৪৪ এর ৪ঠা আগষ্ট টেনে হিঁচড়ে যখন আনা-সহ তার দিদি মার্গট ও মা এডিথ বাবা অটোকে পাঠানো হলো জার্মানির আউশ্ভিৎস বন্দীশিবিরে তখন রেহাই পায়নি তাদের সাথে লুকিয়ে থাকা সঙ্গী ফান্ ডান্ পরিবার। ঘরদোর জিনিসপত্র তছনছ করে টেনে নিয়ে গেছে আনাদের। কি ভাগ্যিস!! কাগজপত্রের দিকে নজর দেয়নি!! ফেলে ছড়িয়ে রেখে গেছিল আনার ডায়েরী আর দিদির কেমিস্ট্রি খাতার পাতায় লেখা দিনলিপির ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো ; যার মধ্যে আঁকা ছিল সদ্য কিশোরী এক কন্যার শব্দে গাঁথা জীবনবোধের কথা। জীবন মৃত্যুর টলমলে সাঁকোয় দাঁড়িয়ে লিখে যাওয়া স্বপ্ন, কল্পনা, ভালোবাসা এবং ভবিষ্যতের কথা।
"হেট আখ্ টেরহুইস" বা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনুবাদে যাকে "গুপ্ত মহল" বলেছেন, সেই সিক্রেট হাউসে যাবার ঠিক কয়েকদিন আগে ১৯৪২ সালের ১২ ই জুন আনা তেরো পূর্ণ করে চোদ্দ বছরের পরিপূর্ণ কিশোরী; বাবার কাছ থেকে উপহার পেল একটা ডায়েরী। পিতা জানতেন কন্যার সাহিত্য প্রেম , অনুভবী মন ও লেখার প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা র কথা। আনা নিজেও এই ডায়েরীটিকে প্রণয়ীরূপে কল্পনা করতো; পাতায় পাতায় লিখে গেছে লুকিয়ে থাকার সময়েও তার অদম্য জীবনভাবনার কথা,তার গোপন অনুভূতির কথা, মানুষ -প্রকৃতি-পৃথিবীর কথা। ভয়ানক যুদ্ধের মধ্যে, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েও লিখেছে বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছার কথা : সুন্দরের অমৃত - আস্বাদনের কথা।
১১ই মে, ১৯৪৪--আনা লিখছে ".... আমার সবচেয়ে বড়ো ইচ্ছে একদিন সাংবাদিক হওয়ার এবং পরে একজন নামকরা লেখক হওয়ার।মহত্ত্বের ( নাকি উন্মত্ততার ) দিকে এই ঝোঁক শেষ অবধি বাস্তবে দাঁড়ায় কিনা সেটা পরে দেখা যাবে, কিন্তু বিষয়গুলো নিশ্চিত ভাবেই আমার মনে গাঁথা আছে। যেভাবেই হোক 'হেট আখ্ টেরহুইস ' (গোপন মহল) নাম দিয়ে একটা বই আমি যুদ্ধের পর প্রকাশ করতে চাই। পারব কি পারব না বলতে পারছি না; তবে ডায়রীটা আমার খুব কাজে লাগবে।"
৪ঠা এপ্রিল,১৯৪৪--আনা লিখছে"----আমি জানি আমার লেখার হাত আছে ----আমার লেখার সবচেয়ে ভালো এবং তীব্রতম সমালোচক আমি নিজে।---যে নিজে লেখে না, সে জানে না লেখা জিনিস টা কী অপূর্ব একটা ব্যাপার।---মৃত্যুর পরেও আমি চাই বেঁচে থাকতে।"
ছোট ছোট গল্প , দিনলিপি আর অসমাপ্ত উপন্যাস " ক্যাডির স্বপ্ন" -- এক সদ্য কিশোরী র অসহনীয় বন্দী জীবনের প্রতিলিপি যেন। হিটলারের ঝটিকা পুলিশ বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে থাকার দিনগুলো অত সহজ ছিলনা যতটা সহজে আনা তার মনের ভাবনা গুলো স্বপ্নগুলো শব্দের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিল। সে ছিল এক দুর্বিষহ সময়। বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত ছিল যুদ্ধ।সেই যুদ্ধে আনা একজন সৃষ্টিশীল যোদ্ধা।
"ক্যাডির জীবন" , "ইভার স্বপ্ন" , "কিটি" ,"ক্যাথি" , "ফুলওয়ালি " , "প্রাজ্ঞ বৃদ্ধ বামনটি " বা ২৩ শে এপ্রিল ১৯৪৪ সালে লেখা " আবিষ্কারক ব্লারি" -- এইরকম ছোট ছোট গল্পের মধ্যে এক কিশোরী মেয়ের দেখা, উপলব্ধি ও জীবনের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে সাবলীল ভাবে।
উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার কিছুদিন পরেই আনাদের অন্তরীণ জীবন, লুকিয়ে থাকার জীবন শুরু হয়।স্কুলের বন্ধুদের কথা, অঙ্ক বা জ্যামিতির ক্লাসে র কথাও লিখে গেছে সে-- "আমার ইস্কুলের দিনগুলোর স্মৃতি"।
৭ই জুলাই ১৯৪৩ এ লিখেছে -- মনে পড়ে? এখানে বন্ধু লিস-এর সাথে ফরাসী ভাষার পরীক্ষার দিন কিভাবে ক্লাসের সকলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল সে তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। আছে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম দিনের কথা; যেটা লেখা হয়েছে ১১ ই আগস্ট, ১৯৪৩ । জীববিদ্যার ভাষণ বা জ্যামিতির ক্লাসে ছাই-রঙা স্যুট পড়া শিক্ষকমশাই-এর কথা লেখা আছে তার ডায়েরীতে।
আনা ফ্রাংকের ডায়েরী প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ২৫ শে জুন।তার ঠিক দুবছর আগে ১৯৪৫ এর ফেব্রুয়ারি - মার্চ মাসের কোনো একদিন জার্মানির বেরজেন -বেলসেন বন্দীশিবিরে দিদি মার্গটে র সাথে টাইফাস রোগে মারা যায় আনা। তার সঠিক মৃত্যুর দিন জানা যায়না। নেদারল্যান্ড সরকারের নথিতে সেটা ৩১ মার্চ ধার্য করা হয়েছে। তার ঠিক পরের মাসে অর্থাৎ এপ্রিলের ৩০শে বার্লিনের বাঙ্কারে আত্মহত্যা করলো অ্যাডলফ হিটলার; যার ইহুদী - নিধন যজ্ঞের বলি আনা সহ লক্ষলক্ষ অসহায় ইহুদী।
সব যুদ্ধই মানবতা এবং মানুষের প্রতি চরম যন্ত্রণা , বেদনা, রক্তপাত ও বিচ্ছেদ নিয়ে আসে। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম বহু যুদ্ধের উদাহরণ আছে কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিটলারের নাৎসী বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও ইহুদী বিদ্বেষ সে সব কিছুকেই ছাপিয়ে গিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ নিরীহ ইহুদী নরনরীকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অবর্ণনীয় খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে তিলে তিলে মারা বা গ্যাসচেম্বারে হত্যা করা এসবই ছিল বীভৎসতার নমুনা ; যা জানা গিয়েছিল বার্লিন পতনের পরে।
আনা'রা' ছিল জার্মান - ইহুদী। জার্মানি র ফ্রাঙ্কফুট শহরে জন্ম ১৯২৯ সালে ; তখনও হিটলারের নাৎসি পার্টি জার্মানির ক্ষমতা দখল করেনি কিন্তু জার্মানির রাজনীতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদ এর হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে, বিশেষ করে ইহুদী-বিদ্বেষ ও তাদের বিরুদ্ধাচরণ । সেই বিপন্ন সময়ে পরিবার নিয়ে মশলা ব্যবসায়ী আনা'র বাবা অটো ফ্রাঙ্ক,দিদি মার্গট , মা এডিথ ও আনা ' কে নিয়ে চলে এলেন নেদারল্যান্ডস এর রাজধানী আমস্টারডামে। সেখানেই আবার গড়লেন কারখানা।সালটা ১৯৩৩ : আনার বয়স চার ,দিদি মার্গট তখন সাত। দুই বোন পরের বছর মন্টেসরী স্কুলে ভর্তি হলো। ১৯৪১ সালে আনা ভর্তি হলো উচ্চ বিদ্যালয়ে।
একবছর সে পড়েছিল উচ্চ বিদ্যালয়ে তারপর ই আমস্টারডামের গেস্টাপো বাহিনীর সমন এলো তাদের ইহুদী পরিবারের কাছে। এতোদিন হিটলার অধীকৃত নেদারল্যান্ডস এ ইহুদী দের হাতে হলুদ তারা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো এবার সরাসরি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর বন্দোবস্ত। বুড়ি চাঁদ বেনোজলে ভেসে গেলো। অসহায় অথচ মরিয়া ফ্রাঙ্ক পরিবার "গোপনমহলে" লুকিয়ে থাকবে ঠিক করলো। সামনে অটো ফ্রাঙ্কের কারখানা আর তার পেছনে এক গোপন মহল তৈরী হলো কারখানার কর্মচারীদের সাহায্যে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
আউশ্ ভিৎস কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে একমাত্র জীবিত বেড়িয়ে আসতে পেরেছিল আনা ফ্রাঙ্কের বাবা অটো ফ্রাঙ্ক, হিটলারী অত্যাচারের দাপট সয়েও। সেও এক অদ্ভুত সমাপতন বটে; নাহলে ইউরোপের "হলোকাস্ট লিটারেচার"-এর একটা দিক অনাবিষ্কৃত থেকে যেত। আনাদের পড়শি ও অফিসবাড়ির সহায়িকা মিপ গিজ গোপনমহলের মাটিতে গেস্টাপো বাহিনীর ফেলে ছড়িয়ে যাওয়া আনার ডায়েরী ও লেখার পাতাগুলো সযত্নে তুলে রেখেছিলেন। তিনি সেগুলো তুলে দিলেন কন্যাহারা পিতার হাতে। ১৯৪৭ সালের ২৫ শে জুন ইংরেজি তে প্রকাশিত হলো "দ্য ডায়েরী অফ এ ইয়ং গার্ল"। সারা বিশ্বের নানান ভাষায় অনূদিত হলো সে বই। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলায় অনুবাদ করলেন "আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী"।
এবছর সেই বই প্রকাশের পঁচাত্তর বছর। বেঁচে থাকলে আনার বয়স এখন নব্বই পার হতো কিন্তু আনা চিরকিশোরী... মৃত্যুর পরেও সে বেঁচে আছে তার ডায়েরীর প্রতিটি শব্দে অক্ষরে এবং স্বপ্নিল বাক্যের মায়াজালে। আনা তো এটাই চেয়েছিল? ৪ঠা এপ্রিল ১৯৪৪ এ ডায়েরীর পাতায় লিখেছিল ---"মৃত্যুর পরেও আমি চাই বেঁচে থাকতে"।
উত্তর কথা
পঁচাত্তরে পা...
জলপাইগুড়ি রাষ্টীয় বালিকা বিদ্যালয়
জয়িতা সরকার
একঝাঁক লাল-সাদা প্রজাপতির জন্মদিন। আট থেকে আশি জলপরীদের জন্মদিন। ২৮ শে জুলাই, ২০২২ ছিল জলশহরের অনেক মেয়েবেলার পঁচাত্তর বছরের জন্মদিন। এক আবেগের, এক অনুভূতি, এক ভালবাসার পঁচাত্তর। জলপাইগুড়ি রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় এবার প্ল্যাটিনাম জুবিলির পতাকা উড়িয়ে অগ্রসর হচ্ছে আগামীতে।
পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। জলপাইগুড়ি জেলার একমাত্র সরকারি বালিকা বিদ্যালয় জন্মলগ্নে নূর মঞ্জিল - ভবন থেকেই শুরু করেছিল তার চলার পথ। পরবর্তীতে বর্তমান ভবনে স্থানান্তরিত হয় জলশহরের গর্বের এই স্কুলটি। দিদিমণি আর ছাত্রীদের মেলবন্ধনে শুধু ইট কাঠ পাথরের তিনতলা বাড়ি নয়, হৃদয়ে জড়ানো অমূল্য কোষাগার এই স্কুল। যার প্রতিটি শ্রেণীকক্ষে বন্ধক রাখা আছে প্রথম লাল ফিতে সাদা মোজার গল্পগুলো।
শহরের এক ঐতিহ্যের আদুরে নাম ' জিজিএইচএস'। পঁচাত্তরে পা দিয়ে ২৮শে জুলাইয়ে শহরের অলিগলিতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই' জিজিএইচএস'। কলরব কলতানে মুখরিত হয়েছিল জল শহরের পথঘাট। লাল-সাদায় মোড়া আট থেকে আশি সবার হৃদয়ে ছিল একটাই সুর' কোন পুরাতন প্রাণের টানে' কিংবা ' বাজিয়ে বাঁশি, গান গেয়েছি বকুলের তলায়'।
হ্যা আমাদের একটা মস্ত বকুল গাছ ছিল। মূল গেটের কাছে থাকা বকুলতলা কত হাসি ঠাট্টা, মান-অভিমান, শিশু থেকে কিশোরী হয়ে ওঠার গল্পগুলোর সাক্ষী। ছুটির পর ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথা হোক কিংবা ভ্যানের জন্য অপেক্ষা বকুল গাছ একটা নস্টালজিয়া। 'আমলকি বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরুদুরু' , বুক কাঁপেনি কোনদিনই, দাপটের সঙ্গে সাতসকালে হাজির হয়ে আমলকি কুড়োতে ব্যস্ত থাকা শৈশবগুলো স্কুল বাড়ির জন্মদিনে যেন আরও বেশি করে কড়া নাড়ছে মনের দরজায়।
এক্কা-দোক্কা কিংবা কাবাডির ছোটাছুটিতে শীতের মিঠে রোদে একঝাঁক লাল-সাদা কিশোরীবেলার নতুন মুখ গুলোতে নিজেদের খুঁজে নিতেই হাজির হয়েছিল দূর-দূরান্তের প্রাক্তনীরা। মাদলের তালে কোমড় দোলাতে সেদিন কোন বয়স বাঁধা দেয়নি। উচ্ছাসে, প্রাণচঞ্চলতায়, আদরে, আনন্দে ক্লাব রোডের স্কুলবাড়ি থেকে শহরের পথ জুড়ে ছিল রাষ্টীয় বালিকা বিদ্যালয়ের নবীন-প্রবীণ সকলে।
মাত্র বার বছর কাটিয়ে আসা স্কুলবাড়ি আর বন্ধুযাপন যে জীবনের সেরা সময় তা হয়ত সেসময় বুঝিনি। দিদিমণিদের কড়া চোখ, পড়াশুনো সবটা মিলিয়ে বড় হওয়ার বড্ড তাড়া ছিল। তবে স্মৃতি আছে একরাশ। ঐতিহ্যে মোড়া স্কুল আমাদের গর্ব। লাল-সাদা আমাদের পরিচিতি। দেশ বিদেশে অসংখ্য কৃতি ছাত্রীরা নাম উজ্জ্বল করেছে বিদ্যালয়ের।
স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসও। দেশভাগের সময় অবিভক্ত বাংলার তিনটি বালিকা বিদ্যালয়ই ওপাড় বাংলায় চলে যায়। স্বাধীনতার পর এপাড়ে বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠার প্রয়োজনেই আমাদের প্রিয় বিদ্যালয়ের জন্ম। প্রথমে নূরমঞ্জিল, পরে ১৯৫৮ সালে এই বর্তমান ভবন। যার দ্বার উদঘাটনে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। শিক্ষিকাদের পরম যত্নে, স্কুলের কর্মীদের তৎপরতায় এগিয়ে চলেছে আমাদের প্রিয় 'জিজিএইচএস'।
স্কুলের মাঠ-ক্লাসঘর জুড়ে থাকা লাল-সাদা প্রজাপতি কিংবা জলপরীদের এই পঁচাত্তরে আরও দায়িত্ব বেড়ে গেল। জলপাইগুড়ি আর রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় যে পরিপূরক সেই মান, সেই জৌলুস, সেই গরিমা যেন অক্ষুন্ন থাকে। স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সফলতার ব্যাটন এখন বর্তমান ছাত্রীদের হাতে। লাল-সাদা বাড়ির উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে তারা জ্বলজ্বল করবে দেশ বিদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, পঁচাত্তর থেকে শতবর্ষের পথে এই প্রতীক্ষায় থাকবে বিনি-সুতোয় গাঁথা হাজারও লাল-সাদা অষ্টাদশী থেকে অশীতিপর সকলেই।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে
বিরল পৈচাশিকতা
প্রায় ছত্রিশবছর আগেকার কথা। অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকের চাকরি নিয়ে প্রথম পোস্টিং-এ বালুরঘাটে কর্মরত হয়েছি । একেবারে তরতাজা যুবক, বিয়ে থার প্রশ্নই নেই মেসে থাকতাম। সাইকেলে চেপেই বিদ্যালয় পরিদর্শন করে বেড়াই। এছাড়াও নিজের একটা দপ্তর রয়েছে। শিক্ষক শিক্ষিকাদের নিয়মিত
বেতন প্রদান,অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা প্রদান ইত্যাদি কাজ করতে হয়।
শীতের সময়। এমনিতেই আগে আগে সন্ধ্যা হয়ে যায়। অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই সন্ধ্যে। সঙ্গী সাইকেলটা নিয়ে ঘাড়ে অফিসের ব্যাগটা ঝুলিয়ে রওনা দিলাম মেসের দিকে। প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা। যাওয়ার পথে পড়ে একটা শ্মশান। এছাড়াও রয়েছে একটা সুনসান বড় আমবাগান। অন্যদিন আমার সাথে আমার অন্য সহকর্মী বিকাশ রায় থাকে। ও আমার মেস মেট। কিন্তু তার দুদিন আগে ও কলকাতায় নিজের বাড়ি গেছে। তাই অনন্যোপায় হয়েই " একলা চলো রে।"
হঠাৎ একটু দূরেই বালিকা কণ্ঠের ভয়ঙ্কর আর্তনাদ। ":বাঁচাও বাঁচাও,আপনাকে ওরা মেরে ফেলছে।" আমিতো একেবারে হতচকিত। ভয়ে হাত পা শুকিয়ে যাবার যোগাড়। দেখি স্কুলের
ইউনিফর্ম পরা একটি তেরো/ চোদ্দ বছরের মেয়ে পিঠে স্কুল ব্যাগ ঝোলানো অবস্থায় অঝোরে কেঁদে চলেছে। আর চারজন ষন্ডা মার্কা ছেলে সবগুলোর মুখে গামছা বাঁধা, মেয়েটিকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে।
যুবক বয়স, রক্তের তেজও খুব রয়েছে। আগুপিছু চিন্তা না করে সাইকেলটা রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে ওদের পিছুপিছু ধাওয়া করলাম। ওদের হাতে অস্ত্রসস্ত্র থাকতে পারে, আমি নিরস্ত্র একা, কোন বোধই তখন কাজ করেনি।
শিকারীর হাত থেকে শিকার কেড়ে নিলে যা হয়, ছেলেগুলো আমার সঙ্গে তাই করলো । ওদের বক্তব্য,অনেকদিন থেকেই ওরা তক্কে তক্কে আছে। এই মেয়েটি আর ওর আর এক বান্ধবী স্কুল করেই এই রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। আজ একটাকে পাকড়াও করার সময় অন্যটা পালিয়েছে। মুখে আমাকে যা বললো," এই যে সাহেব, ভালো চানতো এখান থেকে চলে যান। কোনরকম লাফরার মধ্যে নিজেকে জড়াবেন না। আমাদের আটকাতে পারবেননা। অথচ নিজেই বেঘোরে প্রাণটা দেবেন।"
বুঝলাম, ওরা আমাকে চেনে। আঁধার না হয়ে গেলে হয়তো মুখ চেনা কেউ বেরিয়ে যেত। আমি বলি, " চোখের সামনে একটা অশালীন ঘটনা ঘটে যাবে, আর আমি কিছু করতে পারবোনা, এটা অসম্ভব।" ওদের মধ্যে একজন ছেলে জবাব দিলো, "অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত "আতঙ্ক" ছবির সেই ডায়লগটা শোনেননি? " মাষ্টারমশাই আপনি কিছু দেখেননি।" বুঝলাম, ওরা কী বলতে বা কী করতে চাইছে।
কিন্তু যৌবনের ধর্মই হল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া। আমি ছেলেটার হাতটা খামচে মেয়েটাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই দুজন গুণ্ডা ছেলে আমার হাতদুটো পিছনে মুড়ে গাছের সঙ্গে
বেঁধে দিয়ে একটা অশ্রাব্য খিস্তি দিয়ে বললো, "সারারাত এখানেই থাক।"
আমিতো আর কিছুই করতে পারছিনা। ছেলে চারটি মেয়েটিকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে একের পর এক পালা করে করলো বলাৎকার। মেয়েটার আর্তনাদ শুনে জল বেরোবে পাথরের ও।আমি নীরবে করে চলেছি অশ্রুপাত। সাক্ষী হয়ে রইলাম, এক চরম পৈচাশিকতার।
অগত্যা অনন্যোপায় হয়েই তারস্বরে শুরু করলাম চিৎকার করতে। সৌভাগ্যক্রমে বড়রাস্তায় পেট্রোলিং করা পুলিশের গাড়ির হেড লাইটের আলোতে আমার দিকে দৃষ্টিপাত হওয়ায় পুলিশের গাড়ি ঢোকে আমবাগানে। পুলিশের গাড়ি দেখে বীরপুঙ্গবরা পালানোর চেষ্টা করলেও দুজন ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।
পরবর্তীতে আমাকে এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী করে আদালতে পুলিশের রুজু হওয়া মামলায় করতে হয়েছিল সাক্ষ্যপ্রদান। অনেক বছর ধরে মামলা চলার পর পরবর্তীতে তাদের
হয়েছিল জবর সাজা।
সেই ঘটনার স্মৃতি মনে পড়লে আজও গায়ের রোম খাড়া হয়ে ওঠে।
কবিতা
সিন্ধুবার্তা
কৌস্তুভ দে সরকার
কৃষ্ণকমলী তুমি, উদ্ভিন্না, আদিম সৌরসুতা
জলের উদ্বাস্তু মেঘ, অগ্নিবর্ণা এবং সমর্পিতা ।
প্রধাননগর থেকে দেখে নেওয়া ওই নাভিদেশ
গাছ তার ফুটে ওঠা শ্মশানের কারুকার্য প্রলেপ
অতিমুগ্ধ আমি এই ভাষার কারিগর ত্রিফলা ফল
কৃষিগন্ধাতুর কোনো নতুন নৈবেদ্য যেন মাতৃবর্তিকা
হরগৌরি নাচ, পৃথিবীর কলরবে দেখলাম সব
পল্লবিত যমুনার হাসি মহীরুহে ঢেকে যাওয়া
শাস্তি দিয়ে লেখা আদিগন্ত প্রণয়কথিকা ।
খেলা
প্রান্তীক
ঘৃনায় লজ্জায় ভয় হয়
ভেঙেছে শিরদাঁড়া
অর্থহীন তোমার মেলা
হে রামপুরহাট,
কর খেলা, কর খেলা
শব্দ দুটো করো তুমি
তাকাও না বাহিরে আর
নিজের ঘর জ্বলছে
কর খেলা, কর খেলা
চিৎকার
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
বন্ধন-মুক্তির গান গাই উদাত্ত কন্ঠে
মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রতিবাদে মুখর হয়
গলি থেকে রাজপথ একাকার।
.
শুধু গোপন রাখি নিজের কাছে-
আত্মশ্লাঘা আর মূর্খ অহংকার!
আগাগোড়া শেকলে বাঁধা-
গোঁড়ামির কালো অন্ধকার।
তবু কন্ঠে সেই ভন্ড চিৎকার!
ডুয়ার্স বিলাস
রাণু দেব শর্মা
তোমার মনে পড়ে সুপ্রিয়?
যুবতী ডুয়ার্স জুড়ে ঝর্ণার গান।
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি চা সুন্দরীর হাতছানি,
পাথুরে নদীর শরীর জুড়ে চাঁদ করে স্নান,
পাখি, ঝিঁঝিঁ আদর ছরিয়ে দেয় রোদে কুয়াশায়,
গহীন অরণ্যে ওঠে ফিসফাস গুঞ্জন,
আদিম প্রকৃতির সোঁদা গন্ধে মদিরতা জাগে,
বনজ ঘ্রাণ ফুসফুস ভরে দেয় অপার শান্তি,
সুপ্রিয়, যদি তুমি ফিরে আসো....
আবারো দু'জনে হবো মুসাফির, ডুয়ার্স বিলাসী।
নারী প্রগতি
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
মির্জা গালিব স্ট্রিট ধরে হাঁটাপথে পার্কস্ট্রিট
বহুতল গুলো জানান দিচ্ছে প্রগতির, উন্নয়নের
সমানে চলেছে নারী উন্নয়ন, প্রগতির সেমিনার
ক'দিন আগেই তো দীর্ঘ ভাষনে শুনে এলাম
তাদেরই ব্যাথা, কথা, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত হলঘরে
গেটের ব্যানারটা খোলা হয়নি, এখনো তার
হাওয়ায় একটা কোনা ছিঁড়ে প্রতিবাদী সেও
বড়ো সভায় ডাক পাই, কেন বলতে পারি না
রাস্তার রুটির থালায়? আলু আর কালো ছোলা
কাঁচা তেল ভাসা প্লেটের ঝোলে কত কথা !
ঝিলিক মারে ওয়েষ্টসাইডের গোল্ডেন গ্লোসাইন।
তার নিচেই রাতজাগা ক্লান্ত শিশু কন্যা শুয়ে
পড়বার চেষ্টা করে যায়, কোনা ছিঁড়ে যাওয়া
নারী ক্ষমতায়নের সেই সেমিনারের ব্যানার।
সরে দাঁড়াওদীপ্তিমান মোদক
সরে দাঁড়াও।
টানাটানি করো না আর,
আমি নেই কোনো পক্ষে কিংবা বিপক্ষে।
আমি বরাবরই আমার পায়ে হাঁটি।
দিন এনে দিন খাই,
কপালের ফুটোতে তালি দিতে দিতে,
এই অবধি এসেছি,জানা নেই আগামীতে
সুখ লেখা আছে কিনা,না থাকুক
তবু হেঁটে যাব,যেভাবে যাচ্ছি রোজ।
হ্যাঁ,মাঝে মাঝে কচি হরিণের মৃত্যুশোক
আমায় যন্ত্রণা দেয়।
কিন্তু বাঘের থাবার সাথে কিভাবে লড়তে হয়,
আমার শেখা নেই।
সরে দাঁড়াও।
আমায় যেতে হবে দূর থেকে অনেক দূরে,
পিছু ডেকো না আর,প্রশ্ন করো না আর
কাদা ছোড়াছুড়ির বয়স পেরিয়ে গেছে আমার।
ভুলের চোরাবালিতে
স্বপন কুমার সরকার
ভুলের চোরাবালিতে লুকিয়ে কয়েকটা
ক্রুশের আলপিন চিকচিক করছে
লাশকাটা ঘরের কি প্রয়োজন!
এখন তো পথে ঘাটে লাশ।
অনুতাপে প্রায়শ্চিত্ত নেই আজকাল আর
অন্তর্দ্বন্দ্বে নিজেরাই ভুলের শিকার
বোমা বাঁধার ঘরে আগুন কি আর
হিরণ্যকসিপু এসে লাগায়?
প্রহ্লাদেরা যেখানে সেখানে এখন নৃসিংহ
দেখাতে পারে না বলেই বোধ হয়
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুরন্ত অন্তর্ঘাত
ভুলের মাশুল দিতেই হবে।
ওই যে টেনে হিঁচড়ে আটকাচ্ছে যৌবন
বেহিসাবিপনা তীক্ষ্ণ শান দিচ্ছে
ভুলের চোরাবালিতে রোজ রোজ
সেখানেই জন্মায় রক্তবীজ।
প্রার্থনা থেমে যাও
মিরাজ হোসেন
প্রার্থনা থেমে যাও
পাথরে মুখচ্ছবি দেখে লাভ নেই
জলোচ্ছ্বাসে পাথর নেমে যাবে সমুদ্দুর।
আসো,একসাথে হাঁটি
সীমান্ত হোক পদক্ষেপে বিভ্রম।
ভালবাসা নিয়ে রোড পারাপার হতে
আঁটকে গেছে রোড সিগন্যালে পুরুষ।
বুঝবে না?
অতটা অবুঝ কেন?
থেমে যাও- সবুজ বাতিটা জ্বলুক।
ঠিকানা
মিষ্টু সরকার
শুদ্ধতার রেশটুকু দেখে
আমি ঠিক পৌঁছে যাব
তোমার ঠিকানায়
আমার আমাকে দেবার জন্য রেখো
হাতের ওপর একটা হাত
সব সূর্য অস্তগামী হলেও
কাঁধের ওপর মাথা রেখে
এলিয়ে দেবো ক্লান্তি
নিঃশ্বাস ঘন হয়ে
ছুঁয়ে দেবে তোমার
সবটুকু শুদ্ধ
অক্লান্ত বিস্ময়
অপার প্রশ্রয়ে
মনের ঘুলঘুলিতে
বাসা বেধেছে যে নৈরাজ্য
মুঠো ভর্তি করো তাকে
অবাধ শাসনে
যেন এক জন্ম থেকে
জন্মান্তরে
পৌঁছে যেতে পারে
নিরন্তর
আর তো কিছু নেই
শ্রাবণ
শুধু এইটুকু চাওয়া
কেতা দুরস্ত খোলস খুলে
অবগাহন মর্মে
সহজ হয়ে যাওয়া
আবেগ বড় বালাই
বিজয়
একটা ফুল একবারই ফোটে,
সুরভীত বাতায়ন, সৌরভময়,
একটা ভুল কতবার ভাবাবে, এমন অবক্ষয়,
জিহ্বার ঘষায় ক্ষয়ে গেছে,
জ্বলে যাচ্ছে জীবন, দুঃসহ জ্বালাময়
মনে হয় এমন বদল , বড় দুঃসময়,
মনস্থির করে ফেলেছো যখন,
কোন অন্তরায় নেই,
তোমার চলে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষাতেই।
আগুন জ্বালিয়েছো,
উদ্ভাসিত সব লেলিহান শিখায়,
সে তো পোড়াবেই সব, তোমায় আমায়।
লোভাতুর লিপ্সা, জীবন্ত ইতিহাস,
তবু সৃষ্টির পাখি উড়ন্ত হবে,
এই ধ্বংসের উপত্যকা পেরিয়ে যাবে।
আবেগ বড় বালাই,
কঠিন পথ এই ভরা সংসারে,
প্রতিটি পদক্ষেপ হোক, অশুভ সংহারে।
আঁধারের ঈশ্বর
সৈকত দাম
ব্যঘ্র চক্ষু নিয়ে উঠে আসে মহাকাশে,
যেন সদ্য উঠে এলো ধ্যান মগ্ন মহাদেব ....
কাঁধ চুম্বন করে শ্রাবণ মাখা কেশ ....
হ্যাঁ সে পুরুষ ,
আদি অনন্তকাল থেকে যার কামনা করেছে নারী ..
যে বুকে নিলাভ আগুনের ছটা ধারী .....
অথচ যে শুয়ে আছে পাশে ,
সে বিষ মদ খেয়ে মরে যাওয়া ভগবান .....
রোজ সকালে বাসন কোশনে
জেগে ওঠে গাজনের গান ....
কি বা করার আছে ,
যখন রাত দশটা দশের লাস্ট লোকালে
লেবু লজেন্সের মতো গড়িয়ে পড়ে হিসেবি স্বাদ ....
ধাতব বাতাসে অভ্যস্ত শরীর শ্রাবণ হোতে পারেনি ,
ভগবান তো দুরের কথা .....
এক চামচ পৃথিবী চাওয়া লোকটার জন্য
কেউ জল রাখেনি সীমানায় ....
বরং সীমাহীন স্তব্ধতা গ্রাস করেছে
বাড়ী ফেরার পথে .....
সেই পথ মনে হয়েছে মহাকাশ .....
মনে হয়েছে মরীচিকার মতো দূরে কোথাও ,
জ্বলছে নীলচে আগুন .....
সেই আগুনে দেখা যায় মুখ তার ,
আঁধারের ঈশ্বর .....
ছড়া
মেলা
সুধাংশুরঞ্জন সাহা
বিকেলবেলা ঘুরছি মেলা
পাঁপড় হাতে হাতে,
ভিড়ের মাঝে ক'জন মিলে
জিলিপি নিয়ে সাথে।
মেলায় আছে হরেক কিছু
ভাজা বাদাম,ছোলা,
উপর নিচ খাচ্ছে দোল
পাড়ার মেয়ে দোলা।
মাটির ঘড়া, কলসি হাঁড়ি
ছড়ানো পথে পথে,
মামা বাড়ির কাছেই মেলা
চড়ে এলাম রথে।
স্রষ্টা ও ভ্রষ্টা
অশোক কুমার ঠাকুর
সবাই যদি সাহিত্যিক সবাই যদি স্রষ্টা
কে তবে চাটুকার, সুবিধাভোগী ভ্রষ্টা !
'সাহিত্য' সমাজেরই চালচিত্র আয়না
দুর্নীতির দৃশ্যপট এড়িয়ে যাওয়া যায়না।
সাহিত্যিক নামে আছে বেশ কিছু চাটুকার
'জীবিকা'র দুর্নীতি দেয়না চোখে ধরা তার
ওরা ই এখন সমাজচোখে কবিশ্রী জাত
সকল বোধে বোধ জয়ে কবি নামে খ্যাত ।
ওরা যদি 'স্রষ্টা' হয় ,'ভ্রষ্টাচারী' কে?
সমাজ বুকে খুঁজে ফিরি, মহৎ স্রষ্টা কে।
সৎ স্রষ্টা তাকেই বলি সমাজ ছবি আঁকে যে
মান অপমান সহ্য করে, সবার পাশে থাকে যে।
তেমন লেখক শিল্পী কবি, সমাজে দুর্লভ
চাটুকার শিল্পী কবির, আকাশচুম্বি লোভ
সৎ সাহসী শিল্পী কবি, সংসারে কি নেই আজ?
আছেন তারা ব্রাত্য হয়ে, করছে তবু মহৎ কাজ।
গল্প
বন্ধনহীন ভালোবাসা
রাজশ্রী সেন (চৌধুরী)
শুষ্ক শীতের পর হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হলদে হওয়া ঘাস গুলোকে বাঁচার মন্ত্র দিয়েছে যেন। ধুলো মাখা গাছের পাতাগুলি বৃষ্টির ছোঁয়ায় ফিরে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া রং। বসন্তের জাদু কাঠি ছুঁয়ে দিয়েছে প্রকৃতিকে। বসন্তকালীন ফুলগুলি ঋতুমতী হয়ে রঙীন করে তুলেছে দশদিক। গ্রীল আর কাঁচ ঢাকা বারান্দার বাইরে গোলাপী আর সাদা চেরী ফুলের গাছ দুটি অলস বিকেলে আপন মনে নিজেদের মধ্যে দুলে দুলে কি কথা কইছে কে জানে! হঠাৎ সেই গাছের ডালে দুটো হলুদ পাখি এসে বড্ড কিচির মিচির শুরু করলো। যেন গাছ দুটির বৈকালিক ভালোবাসার গল্পে ছেদ পড়লো খানিক। কাবেরী আপন মনেই বলে উঠলো "দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর্ , ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।" কাবেরী, ত্রিশোর্ধ এক গৃহবঁধু।বড্ড বেশীই সাধারণ। তার না আছে রূপ না আছে গুন। আছে শুধু এক আকাশ অভিমান। আর আছে এক কল্পনার জগৎ। ছোটো থেকেই যে জগতে তার বাস। সে বসত আজও তেমনই আছে। সংসারের জাঁতাকল পিষে ফেলতে পারেনি সেই জগত কে। এ যাবৎ যত গল্প, কবিতা,উপন্যাস পড়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ট্র্যাজিক নায়িকার চরিত্রে নিজেকে ভেবেছে। হাপুস নয়নে কেঁদেছে। যেন আর জন্মের বিরহ নিয়েই জন্মেছে সে। পাঠককুলের কাছে অনুরোধ এজন্য চ্যাপটা নাকের সাদামাটা কাবেরীকে দুষবেন না যেন। সে দোষ সবটুকুই রবি ঠাকুরের। অমিত লাবণ্য-র অমন চিরন্তন ভালোবাসার উপন্যাস খানা না লিখলেই হত না! বিচ্ছেদেই যে ভালোবাসা নিখাদ হয় তা তো ওই উপন্যাসটি পড়েই কাবেরীর মনে হয়েছে। তাই তো কল্পিত বিরহে সে আজো ভালোবাসা খোঁজে। তাই তো কবিতার প্রতি অমন অমোঘ টান। কিন্তু জীবন তো কল্পনা নয়, চরম বাস্তব। সেই বাস্তবকে সঙ্গী করেই জীবন চলছিল তার আপন খেয়ালে। কাবেরী তার মধ্যবিত্ত সংসারের নকশীকাঁথায় দিন যাপনের প্রতিটি ক্ষণ যেন যতনে ফোঁড় তুলছিল।শুধু তার একান্ত জানালায় যে বেগুনী সাদা ফুলের গাছটি আছে সেখানে কাবেরী সেই অভিমানী মেয়েটি হয়েই রয়ে গেছে আজও।
আজকাল সময় পাল্টেছে। পুরোনো সবকিছু কে পেছনে ফেলে সময় এগিয়ে চলেছে। চিঠির জায়গা নিয়েছে টেলিফোন, টেলিফোনের জায়গায় মোবাইল। এখন তো আবার ইন্টারনেটের জগৎ। মুখপুস্তিকার জগৎ। সে জগতে কত কবি,কত লেখক, তাদের কত কবিতা, কত গল্প!! ফেসবুকে অনায়েসেই কত গল্প কবিতা পড়া যায়। সে গুলো পড়তে গিয়ে কাবেরী এখনও ভাবে আহা এমন করে যদি একটি বার তাকে নিয়েও কেউ দুটি লাইন লিখতো। অথবা মস্ত একটা গল্পের প্রধান চরিত্র যদি কাবেরী হত। বড় ছেলেমানুষী ভাবনা। যদিও এ ভাবনাকে বেশী ক্ষণ স্থায়ী করার সময় নেই । ভীষণ ব্যস্ততা। সংসার এখন তাকে লাটিমের মত ঘোরায়।
হঠাৎ এমন এক ব্যস্ত বসন্ত দুপুরে কাবেরীর নতুন ফেসবুক এ্যাকাউন্টের ম্যাসেঞ্জারে টুং শব্দ। নতুন ফেসবুক এ্যাকাউন্ট তাই তার একটু আগ্রহ হয়েছে বৈকি। হাতের কাজ টুকু সেরে মেসেজ অন করে দেখে এক খানা কবিতা।
"কাবেরী,তুমি পাহাড় হবে?
ঝরণার মত ঝরবে?
চপলা হরিণী হয়ে ছুঁয়ে যাবে সবুজ বনানী?"
কাবেরী মনে মনে হেসে ফেলল। উত্তরে শুধু পাঠালো, "কাবেরী তো নদী, পাহাড় হবে কি করে?" পরদিন আবার একখানা কবিতা। এবার তার প্রোফাইলের ছবি নিয়ে। যার প্রথম লাইনটি --
"এই ছবিটিই মনের আয়নায় ........"""
কি জ্বালা রে বাবা! আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে ভয়ে। উহু সে তো ছাড়ার পাত্রটি নয়। আবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। আবার কবিতা। প্রতিদিন একটি করে কবিতা। কবিতার প্রতি কাবেরীর দূর্বলতার গোপন কথাটি কেউ বলে দিয়েছে নাকি! এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই আবার মেসেঞ্জারে টুং শব্দ। না এবারে কবিতা নয়। সাধারণ কথা। কাবেরী বিরক্ত কি না জানতে চেয়ে মেসেজ। কবিতার প্রসঙ্গ উঠতেই জানালো মজা করেই সে এমন ছড়া কাটে। নিছক আপন মনেই সে এসব লিখেছে। আশ্চর্য হয় কাবেরী! মনটা একটু খারাপ হয় বৈকি। এমনটা তো মনের ভীষণ ইচ্ছে ছিল। কেউ তাকে নিয়ে লিখুক। যদিও বা কেউ লিখলো তাও এমন করে! যাই হোক কবিতার মাধ্যমে কথা এগিয়ে চলে। কাবেরীর ভালোবাসা কবিতা। মনের খুব ইচ্ছে যদি দু কলম লিখতে পারতো। নাহ্ সে ক্ষমতা তার নেই ।তাই এই সৃজনশীল মানুষটির প্রতি আলাদা টান অনুভব করে সে। মানুষটির প্রতি, না তার সৃষ্টির প্রতি সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা আজকাল। কিন্তু সে টান যে কারণেই হোক তা এক হিমেল পরশ নিয়ে এসেছে। যেন রুক্ষ শীতের পর এক রঙীন বসন্ত। যেদিন এমন অনুভূতির ছোঁয়া বুঝেছে সেদিনই কাবেরী আবার ফিরে গেছে নিজের কল্পনার জগতে। যে জগতে বিরহ বা ভালোবাসা সবটুকুই কল্পিত, কোনো অবলম্বন নিয়ে বেড়ে ওঠেনা। নিজেকে বুঝিয়েছে সব ভালোবাসাকে নিত্য দিনে বাঁধতে নেই। কিছু ভালোবাসাকে নদীর মত বইতে দিতে হয়। নদীকে কখনো ঘরে এনে বাঁধা যায়না। নদীর জল আজলা ভরে সংসারে জল সিঞ্চন করতে হয়। কাবেরীও তাই করেছে।ভালোবাসার নিত্যবহ নদীতে যে জোয়ার এসেছিল তাকে বইতে দিয়েছে সময় প্রবাহে। আর নদীর তীরে দাঁড়িয়ে সে দেখেছে তার গতিময়তা।
আজ বহু বছর পার করে সংসারের নকশী কাঁথায় এখনও তেমনি ফোঁড় তুলে চলেছে সে। দশ হাত কাপড়ের মত মধ্যবিত্তের আটপৌরে সংসার। সেই দশহাতি কাপড় দিয়েই সংসারের সবটুকু সামলে চলেছে সে। তবুও সব কাজের ফাঁকে হঠাৎ করেই এখনও কোনো উদাস বসন্তে শিমূল পলাশের দিকে তাকিয়ে অথবা নিজের রূপোলি চুল বা মেচেতা পরা কোনো ছবির দিকে তাকিয়ে কাবেরীর মন আপন খেয়ালেই বলে ওঠে .... "কাবেরী তুমি পাহাড় হবে?" অথবা "এই ছবিটিই মনের আয়নায়"।
বিকল্প
বিনয় বর্মন
আরো একজন নতুন অধ্যাপক আসবেন শুনে পারমিতার একটু কৌতূহল হল l যদিও আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের ব্যবসার খোঁজ নেওয়ার কোন উৎসাহ নেই ওর l কিন্তু মেয়েদের স্বাভাবিক ইন্টিউশান ওকে বলল যে একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার l আসলে ছাত্রী কাল থেকে ছেলেদের জ্বালায় নাজেহাল ও l স্কুলে পড়ার সময় থেকেই বুঝে গেছিল যে ও যথেষ্ট সুন্দরী l ফলে গায়ে পড়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করা ছেলেদের এড়াতে এড়াতে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি পার করতে হয়েছে l পুরানো ধারণায় বিশ্বাসী l মনের মত কাউকে যখন পছন্দ হবে তখনই প্রেম, বিয়ে, এসব নিয়ে ভাববেl আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগে তো নয়ই l
এমএসসি করার পর নেট কোয়ালিফাই করার পর এই কলেজে পার্টটাইম করছে l সরকারি কলেজ হওয়ায় এখানে অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের চাকরি বদলিযোগ্য l কেউ যাচ্ছেন, কেউ আসছেন l এরকমই স্বাভাবিকl তাদের মধ্যে অনেকেই তরুণl বিবাহযোগ্য l ফলে স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই সুন্দরী শিক্ষিতা পারমিতার জন্য বিবাহ প্রস্তাব দেয় l তখন হয় মহা মুশকিল। রাজি না হলে ভাবে এনগেজড l কাউকে বিশ্বাস করানো যায় না যে, এমন সুন্দরী মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নেই ! আর মুখের উপর সেভাবে না বলার মত ব্যক্তিত্বও ওর নয় l ফলে সমস্যা l তারপর যাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল , তার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করাও অস্বস্তিকর l কিন্তু পার্টটাইম হলেও চাকরিটা খুব প্রয়োজন পারমিতার l আর্থিকভাবে ততটা না হলেও , মানসিক সাপোর্টের জন্য l এটা তার আত্মমর্যাদা , স্বাভিমানের পরিচয় l
আরো কিছু সহকর্মী নানান আছে ডিপার্টমেন্টেরl পার্ট টাইমাররা একসঙ্গে বসে সাধারণত l মেয়েরা আবার একটা আলাদা গ্রুপl সবাই সমবয়সী না হলেও বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে l তবে মহিলা সহকর্মীরা পারমিতাকে একটু ঈর্ষা করে ওর ভালো অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার আর সৌন্দর্যের জন্য l সুন্দরী হলেও পারমিতার মধ্যে উগ্রতা নেই l প্রদর্শনকামিতা নেই l বরং আছে এক স্নিগ্ধ শান্ত সরলতা l
মল্লিকাদি খবর এনেছে, যিনি আসছেন তিনি তরুণ l সম্ভবত অবিবাহিত l চাকরির দ্বিতীয় পোস্টিংl আগে দক্ষিণবঙ্গের কোন কলেজে ছিলেন l আদতে উত্তরবঙ্গেরই ছেলে l পারমিতা শঙ্কিত হল l আবার কি এক দফা বিড়ম্বনা ....
জয়েনিংয়ের দিন সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রিন্সিপাল স্যার l তখনই দেখল কিংশুককে l রোগা, সাধারণ চেহারা l তবে চোখ দুটো নজর কেড়ে নেয় l কিন্তু একটু অন্যমনস্ক l সবসময় কিছু যেন ভাবছে l
পরদিন ডিপার্টমেন্টের রুটিন কাজ বুঝিয়ে দিলেন বিভাগীয় প্রধান l ক্লাস , পরীক্ষা , ফল প্রকাশ - চলতে লাগলো। এরপরই এলো এসকারশন l ডিপার্টমেন্টের ২৫ জন ছেলে মেয়ে , আর পাঁচজন শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে যাবে নামথিং পোখরি l মেয়েদের দায়িত্বে পারমিতা ও আরো দুজন ম্যাডাম l একজন অধ্যাপিকা ও একজন অস্থায়ী শিক্ষিকা। ছেলেদের দায়িত্বে কিংশুক ও আরও একজন অস্থায়ী শিক্ষক l নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছে গেল গন্তব্যে l পাশাপাশি দুটো হোমস্টেতে ছেলেরা ও মেয়েরা উঠল। পরবর্তী চারদিন এখানকার ফ্লোরা, ফনা ও ইকোলজি নিয়ে হাতে কলমে জ্ঞান অর্জন করবে ছাত্র-ছাত্রীরা l
সকালবেলা ব্রেকফাস্ট এর পর শুরু হয় ফিল্ড সারভে l দুপুরে লাঞ্চ একসঙ্গে। সন্ধ্যায় চায়ের সঙ্গে সারাদিনের অভিজ্ঞতার বিনিময় l রাতে ডিনার সেরে যে যার ঘরে যাওয়া l
প্রথম দিন রুটিনে থিতু হতে সারাদিন গেল l ক্লান্তও ছিল সবাই l দ্বিতীয় দিনে আবার সেই রুটিন l যে যার দল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল l পারমিতা দেখল কিংশুক বসে আছে হোমস্টের বারান্দায় l কাউকে যেন খুঁজছে l
পারমিতাকে দেখে খুশি হয়ে উঠলো l তাকে ডাকলো নাম ধরে। পারমিতা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল l ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনার ব্যাপারে টুকটাক আলোচনা ছাড়া খুব একটা কথা হয়নি। কিন্তু তার ইনটিউশন দিয়ে সে বুঝতে পারতো তার প্রতি কিংশুক এর একটা সচেতন নজর আছে l সব সময় তাকে সতর্ক পাহারা দিচ্ছে যেন l তবে অন্য পুরুষদের মতও নয় সেটা l আজকে একটু চিন্তায় পড়ে গেল l যাহোক কিন্তু কিন্তু করে তার হোমস্টের বারান্দায় উঠলো l কিংশুক তাকিয়ে হাসলো l আন্তরিকভাবে হাসলো l বলল বোসো l একটা চৌকো খাম বের করল l পারমিতা উত্তেজনার শেষ সীমানায় l তবে কি উনিও ? ... খামে কি আছে ? গোলাপ ?
কিংশুক ধীরে ধীরে বলতে লাগলো l শোনো পারমিতা তোমাকে প্রথম দেখেই চমকে উঠেছিলাম l তুমি আমার এক প্রিয়জনের লুক অ্যালাইক l কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি l শুধু একজনের মত দেখতে হলেই তার মত হওয়া যায় না l কিন্তু এতদিন লক্ষ্য করে প্রত্যয় হয়েছে তুমি যেন তারই প্রতিরূপ l পারমিতার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল সে কি ওর কোন প্রাক্তনের কথা বলছে? ইতিমধ্যে কিংশুক তার স্মার্টফোনের গ্যালারি খুলেছে l সেখান থেকে একটা ছবি বের করল l তার মতই অনেকটা দেখতে একটি মেয়ে l কিংশুক বলল , আমার বোন l দুবছর হল না ফেরার দেশে চলে গেছে l প্রত্যেক রাখিতে সে যেখানেই থাকুক, রাখি আমাকে পড়াতই l ... আজ কিন্তু রাখি পূর্ণিমা l তুমি কি পড়াবে আমায় রাখি ? বলে সেই খাম থেকে বের করল একটা সুন্দর রাখি। পারমিতার চোখে প্রায় জল চলে এসেছে l দ্রুত সেটা খুলে কিংশুক এর হাতে পরিয়ে দিলl দূরে তাকিয়ে দেখলো কাঞ্চনজঙ্ঘাও হাসছে।
অবসর
চম্পা বিশ্বাস
" বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী। "
মহাভারতের এই প্রবাদটি আজ বারংবার মনের কোণে উঁকি দিয়ে চলে প্রমিলা দেবীর। দোতলায় তার ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আপন মনে সারমেয়দের কান্ডকারখানা দেখছে আর ভাবছে এতদিন আগের কথাগুলো আজ বড়োই বাস্তবসম্মত ।
দোতলায় ঘরের জানালার সামনেটাই হল প্রমিলাদেবীর অবসর যাপনের জায়গা। স্বামী গত হওয়ার আজ প্রায় সাত বছর হল। তখন থেকেই দিনের অনেকটা সময় তার এই জানালার ধারে বসেই কেটে যায়। বহু লোকের চলাচল, কথাবার্তা তার এই নিঃসঙ্গ জীবনে কিছুটা আলোর সঞ্চার করে।
রোজ রাত নটা নাগাদ ঘটা একটি ঘটনা তাকে বেশ বিহ্বল করে। প্রমিলাদেবীর জানালার সোজাসুজি রাস্তার অপর পাশের বাড়িতে সাত-আটটি সারমেয় আছে। বাড়িটির সামনে কিছুটা জায়গা আছে যা গ্রিল দিয়ে আটকানো। সারমেয়গুলি ঐ জায়গায় আপন মনে ঘুরে বেড়ায়। আর রাস্তার কিছু সারমেয় যারা আপন মনে চারপাশের পুরো এলাকায় ঘুরে বেড়ায়, রোজ রাত ঠিক নয়টা নাগাদ বিপরীত বাড়ির গ্রিলের কাছে চলে আসে আর তখন বাড়ির ভেতরের সারমেয়দের শুরু হয় প্রবল চিৎকার। ওরা গ্রিলের কাছে এসে তীব্র চিৎকার ও দৌড়াদৌড়িতে তাদের অধিকারের জানান দেয়। যেন বলে এই রাস্তাটায় আমাদের অধিকার, তোমরা বাইরের, এখানে আসার কোনো অধিকার তোমাদের নেই। কিন্ত রাস্তার সারমেয়রাও ছাড়বার পাত্র নয়। তাই তারাও প্রবল চিৎকারে এগিয়ে আসতে চায় কিন্ত গ্রিলের ভেতরের সারমেয়দের দেখে তারাও প্রবল চিৎকার করে পিছিয়ে যেতে থাকে । গ্রিলের সামনে আসবার সাহস তারা সঞ্চয় করতে পারে না। প্রায় রোজ এইরূপ ঘটনা অনেকক্ষণ ধরে চলার পর কেউ না কেউ এসে রাস্তার সারমেয়দের তাড়িয়ে দেয়। ফলে সব আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
প্রবল চিৎকারে প্রমিলাদেবীর একটু অসুবিধা হলেও দেখার আগ্রহ কিছুতেই কমে না। রোজই ভাবেন " দেখি না এরপর কি হয় ! " কিন্ত কেউ না কেউ এসে ঠিক ওদের থামিয়ে দেয় কিছুক্ষণ পরেই। তাও রোজ রাত নয়টা নাগাদ প্রমিলাদেবীর জানালার সামনে আসা চাই। এভাবে পনেরো কুড়ি দিন চলার পর একদিন রাত প্রায় নয়টা নাগাদ প্রমিলাদেবী জানালার সামনে বসে থাকেন অপেক্ষায়। কিন্ত ঘড়ির কাঁটা নয়টা পেরিয়ে দশটার ঘরে গড়িয়ে যায় কিন্ত রাস্তার সারমেয়দের আর দেখা পাওয়া যায় না। এভাবে বেশ কয়েক দিন কেটে যায় কিন্ত ওদের আর দেখা পাওয়া যায় না। প্রমিলাদেবীর নিঃসঙ্গ জীবন যেন আরও নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। আর রাত ঠিক নয়টা নাগাদ তার চোখদুটো যেন রোজই সারমেয়দের খুঁজে বেড়ায়।
লাল আলো
সুপর্ণা চৌধুরী
দোতলা ওই বাড়িটাই রহস্যময় ও কৌতুহলজনক হয়ে উঠছে সুমনার কাছে। নতুন বাড়ি এবং নতুন পাড়ায় বাড়ি করে এসেছে সোমেশ ও সুমনা। পাড়ার সবকিছু স্বাভাবিক লাগলেও ওই বাড়িটা যেন অস্বাভাবিক। বাড়িটা বেশীর ভাগ সময়েই তালাবন্ধ থাকে। কখনো সখনো মানুষের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় তারা। তবে সেই মানুষদের পাড়ার কেউ নাকি কোনদিনও দেখেনি। আসা ইস্তক সুমনারাও দেখেনি। পাড়ায় বাড়িটা ভূতের বাড়ি বলে পরিচিত।
সে দিন ভোরে উঠে খোলা জানলা দিয়ে অভ্যাসমত বাড়িটার দিকে তাকাল সুমনা। হঠাৎ একটা তীব্র লাল আলো বাড়িটার জানলা থেকে এসে সুমনাকে যেন ভেদ করে ঘরটা ভরিয়ে দিল। সুমনার স্বতঃস্ফূর্ত আর্তনাদে ঘুমন্ত সোমেশ এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে পতনের হাত থেকে তাকে কোনক্রমে রক্ষা করল। লাল আলোটা দেখে অবাক হয়ে গেল দু'জনেই।
কিছুক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হলে
দু'জনে দৌড়ে সেই ভূতের বাড়িটির সামনে গিয়ে উপস্থিত হল। কলিংবেল টিপতেই দরজা আপনা আপনি খুলে গেল। মানুষ নয়, দরজা- টা খুলে দিল সেই লাল আলো। আলোর ভেতর থেকেই শোনা গেল আওয়াজ,
—"আলোটা ফলো করে ভিতরে চলে আসুন। "
আলোর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে থেকে কেউ যেন সুমনাদের হাত ধরে দোতলায় পৌছে দিল। সেখানে তারা দেখে এক ভদ্রলোক অচেনা একটি যন্ত্র নিয়ে কাজ করে চলেছেন ।
— "নমস্কার। আসুন আসুন।"
বলে সুমনা আর সোমেন কে সাদরে সম্ভাষণ জানালেন ভদ্রলোক। তারপর জানালেন তাঁর গবেষণার কথা:
—"এই লাল আলোর সাহায্যে ঘরে বা বাইরের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা, বিভিন্ন ব্যাক্তি সম্পর্কে জানা, দৈনন্দিন কাজকর্ম করা সম্ভব। অনেকটা রোবটের মতো কাজ করবে এই লাল আলো। এই এই গবেষণার কাজেই আমি ব্যস্ত। তাই সামাজিক যোগাযোগ রাখবার সময় পাই না। আজ এই লাল আলোর সাহায্যেই একপ্রকার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম আপনাদের।
আপনারা এ পাড়ায় নতুন এসেছেন, আপনা -দের সঙ্গে আলাপ করবার লোভ সামলাতে পারলাম না।"
সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত ও নির্বাক হয়ে গেল সোমেশ ও সুমনা।
সত্যি মিথ্যে
সৌমী আচার্য্য
বিকাশ ভালো করে গজের মুখের দিকে চেয়ে রইল। কালো রেখার ভিতর অজস্র আঁকিবুঁকি। শীতের খড়ি, ঘুমের আদর আর থুথু পিচুটি মিলিয়ে ঘেন্না পাবার যথেষ্ট কারণ তবু মৃদু হেসে বলল, 'আজ তাহলে পায়েস খাবে বলেছে?'
-আর বলিস্ কেনে বাবু তুর বিটির লোভ লকলকায় বাড়ছে বটে। তবে আঁশ যখন হইছে। আর একটু খাওয়া ছাড়া কিছু তো লয়।
-আচ্ছা এখন যা সন্ধ্যায় নিয়ে যাস।
সন্ধ্যায় তিন তিনটে ছেলেমেয়ে নিয়ে গজ হাপুস হুপুস শব্দে পায়েস চাটে। শুধু ওর বৌটা মারাংবুরুর থানে চুপ করে দাঁড়ায়। চোখে জল। বিকাশের স্ত্রী বিষন্ন মুখে বলে, 'হ্যাঁ গো মেয়েটা সত্যি খায়!' বিকাশ বলে, 'খায় মানে আঙুল চেটে চেটে খায়। আমি অবশ্য আওয়াজ শুনেছি। আমার মুখের কথা বিশ্বাস করো না যখন একবার গিয়ে দেখতে পারতে। আসলে কী জানো রমি, এই জায়গায় মানুষগুলো এখনো বড্ড সৎ। অপরের দুঃখে ওরা আকাশ ফাটিয়ে কাঁদে। গত দুই বছর এই পাহাড় জঙ্গলে পোস্টিং নিয়ে রয়েছি সেকি আর এমনি। শহুরে মানুষের সবই মেকি, সে কান্নাই হোক কী ভালোবাসা।' রমি আশা নিরাশার দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে।
কুসুম রঙা সকালে গজের বউ উরমা কতগুলো বেগুন আর মহুয়া ফল কোঁচড়ে করে এনে দাঁড়িয়ে থাকে। রমি বলে, 'কেন এনেছিস?' কিছু না বলেই বারান্দায় সব নামিয়ে চলে যেতে নেয় উরমা। আবার জিজ্ঞাসা করে রমি, 'কোথায় পেলি এসব? বনে?' ওর কালো পেটানো চেহারায় কিসের যেন কান্না। ফিসফিস করে বলল, 'তুর বিটি বলল, তুকে খেতে।' রমি মহুয়া ফল আর বেগুন কয়েকটা নিয়ে ঘরে এসে একটা ছবির সামনে দাঁড়ায়। ছবির গলায় টাটকা মালা।
-কেন তুই আমার কাছে আসিসনা মিতুল! ঐ গজের বউয়ের শরীরে কেন আসিস? আমার যে তোকে কত কী বলতে ইচ্ছা করে! জ্বরের ঘোরে, আজ দুবছর হল, কোথায় চলে গেলি মিতুল!
বিকাশ নিঃশব্দে চোখের জল মোছে। অপেক্ষা করে গজের একটা নতুন মিথ্যের জন্য।
শান্তির নীড় (বৃহন্নলা)
কাকলি ব্যানার্জী মোদক
ভোরের সূর্য তখন ভালো করে ফোটেনি । সুরবালা তার মুখটা আপাদমস্তক ঢেকে রাজাবাজারের পটুয়া পাড়া দিয়ে হনহন করে হেঁটে পৌঁছালো ঝাঁ চকচকে বাড়িটার সামনে, তাকিয়ে নিলো চারিদিকে, সামনের দরজার কড়াটা নাড়তেই ভিতর থেকে শব্দ এলো কে? সুরবালা মৃদু স্বরে বলল আমি। দরজা খুলে দিলো সেই পরিচিত মুখটি । ভিতরের মানুষ টি মমতা ভরা স্বরে বলল মা তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আসো কেন? সন্তানের পরিচয় দিতে এতো দ্বিধা ? এতো লজ্জা ? দোষ সন্তানের না সমাজের ? মা আর পাঁচটা সন্তানের মতন আমি তোমার আকাঙ্ক্ষা সন্তান , কতো মায়া মমতা দিয়ে তোমার গর্ভের সন্তানকে তুমি পালন করেছিলে ,আর ভুমিষ্ঠ হবার পর সেই সন্তানই হয়ে উঠলো তোমার পথের কাঁটা? সন্তান .........সন্তানই তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আমি দায়ী নয়, তবে কেন?....কেন বলতে পারো এই গোপনীয়তা । নিরুত্তর সুরবালা তাকিয়ে থাকলো তার সন্তানের দিকে ।
ভিতরের সুপ্ত ভালোবাসার টানে বারবার ছুটে আসে গোপনে একান্ত গোপনে ,কেন আসে তার উত্তর সুরবালা জানে না । তবে আজ এসেছে মাতৃত্বের অধিকারে , তার মাথার উপরের বটবৃক্ষের পাতাগুলো আজ অকারনেই ঝরে পড়েছে, আর যে কচি কিশলয় যাকে জোর করে উপড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে, আজ তাকে, সুরবালার খুব প্রয়োজন তার ছায়ায় এক টুকরো শান্তির জন্য । অভিমানী সন্তানের প্রত্যাখান ফিরে এলে সুরবালা চম্পা এখন প্রতিষ্ঠিত।নামি কম্পানির কর্মরতা সমাজের বেড়া টপকে প্রমান করেছে আমিও মানুষ ।যতই তোমরা হিজড়ার তকমা লাগাও আমাদের কপালে ।
কন্যা সন্তান বা পুত্র সন্তান কি কদর এই সমাজে, বেশি করে পুত্র সন্তানকে এখনো মানুষ বংশের প্রদীপ বলে মনে করে কিন্তু মানুষের শরীর থেকে সৃষ্টি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষটিকে আজও লুকিয়ে রাখে, গোপন করার চেষ্টা করে মা থেকে ....সমাজ।
বৃহন্ননা শব্দটা সঙ্গে পরিচিত সুরবালা দেবীর ছোট থেকেই শুনে আসছিল , কিন্তু যখন নিজের শরীরের ঘটে গেল অঘটন তখন তার গভীরতা আরো মোচড় দিয়ে উঠলো সন্তানের দর্শনে পর সুরবালা দেবীর ।
সুরবালা দেবী বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দার সেই চেনা চেয়ারটা তার শেষ জীবনের সঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েছিল কালের আবর্তনে আজ তার আশ্রয় এই বৃদ্ধাশ্রমে । একাকীত্ব সুরবালা র কাঁধে ভর করে আছে। সন্তানরা একে একে ত্যাগ করেছে সুরবালা দেবী কে। তাই সমাজের কাছে যে সন্তান অপয়া তার তৃতীয় লিঙ্গ সন্তানের কাছে এসেছিল একটুকরো শান্তির আশায় , তার অভিমানের কাছে ভালোবাসা আজ পরাস্ত ।
এসব ভাবতে ভাবতে ক্রমশঃ চোখ বুজে আসছে সুরবালা দেবীর, হঠাৎ মা শব্দটা শুনে নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলনা কিন্তু হঠাৎই মা শব্দটি তার মন নাড়া দিয়ে উঠল তাকিয়ে দেখল সেই চেনা পরিচিত মুখ, মাস ছয়েক আগেও ছুটে গিয়েছিল তার কাছে মাতৃত্বের অধিকারে। চম্পা এসে বসলো মমতা মাখা মায়ের পায়ের কাছে , চম্পা বলল মা তুমি যাবে আমার কাছে এই সমাজে র অবহেলিত সন্তানের কাছে । আজ লুকিয়ে নয় জনসমক্ষে তোমাকে বরণ করে নিয়ে যাবো আমার ঘরে ।
মা আমার পরিচয় পোষাকের অন্তরালে নয় পরিচয় মনুষ্যত্বের , যাবে মা যাবে । সুরবালা শক্ত করে চম্পার হাতটা ধরলো আজ বড়ো প্রয়োজন এই সন্তানের যারা সমাজের চোখে মহান তারাই মাতৃত্বকে অস্বীকার করে নিজের সুখে ব্যস্ত । সুরবালা আজ বিদায় জানালো বৃদ্ধাশ্রম কে আজ মুখ ঢেকে নয়, সুরবালার মনে আজ মুক্তির আনন্দে বৃহন্নলা হাত ধরলো শান্তিনীড়ের আশায় ।।
ক্রোড়পত্র: শ্রাবণ
মুক্তগদ্য
এই শ্রাবণের বুকের ভিতর
চিত্রা পাল
সকাল থেকেই বৃষ্টি শুরু, কখনও রিমঝিম কখনও ঝমঝম। এই বাঁধন হারা জলধারায় প্রাণের আনন্দ ফিরে পায় ধরিত্রী। মেঘের দুন্দুভি বেজে ওঠে দিক হতে দিগন্তরে। সেই মেঘ মন্দ্রিত ছন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে শ্রাবণের বর্ষণগীত। দহনশয়নে পিপাসার্তা তপ্ত ধরণী ইন্দ্রলোকেরঅমৃতবারি আকন্ঠ পান করে তৃপ্ত। বসুন্ধরার তপ্ত প্রাণে বিপুল শিহরণ জাগে। পুলকিত পৃথিবীর মাটির কঠিন বাধা দীর্ণ করে নব-অঙ্কুর-জয়-পতাকায় ধরাতল হয় সমাকীর্ণ। যেন ছিন্ন হয়েছে বন্দীর বন্ধন। উতলা হিয়া দোলে সজল হাওয়ায়। তার সে দোলায়িত নৃত্যছন্দে মুখরিত দিকবিদিগ। শ্যামলের অভিষেকে অরণ্যে অরণ্যে নৃত্যের আয়োজন। সে নৃত্যের তালে ধরিত্রীর অঞ্চল লুটিয়ে পড়ে অঙ্গনেতে নব শ্যামল প্রাণের নিকেতনে। কদম্ববনের প্রথম মুকুলের আনন্দঘন গন্ধ ভাসে পবনে। উচ্ছ্বসিত মল্লার তান মিশে যায় প্রবল লাবণ্যে, অবগুন্ঠন উড়ে যায়, মন চলে যায় সুদূর শূন্যে হাওয়ায় হাওয়ায়। এই শ্রাবণের বুকের ভিতর শতেক যুগের কবির শতেক যুগের কবিতা মুখরিত হয়ে ওঠে।আর শ্রাবণের মত্ত মদির বাতাস কদম্বঘন সুবাসে যেন সেই কথা কয়ে যায় আপন মনে।।
জানলার জলছবি
জয়িতা সরকার
জানলার কাঁচে বৃষ্টি ফোটায় শব্দমিল খেলাটা ছিল ভীষণ প্রিয়। লিখতে লিখতেই কেমন মিলিয়ে যেত। বৃষ্টিকে তখন দুষ্টু বলে ডাকতাম দুজনে। এক ঝাপটায় খেলা দিত পণ্ড করে। আবার লিখতাম নতুন ভাবে। ঝমঝমিয়ে শ্রাবণ ধারায় কাঁচের জানলা ছেড়ে এক ছাতায় অর্ধভেজা বর্ষাটা মন ভিজিয়ে পাড়ি দিল অজানা কোন মেঘের দেশে। দূর আকাশের মেঘটায় কি বৃষ্টি আসে? নতুন শব্দছন্দে আজও কি বর্ষা নামে খেলার মাঠে ?
নতুন গল্প লিখব বলে ডাইরির পাতায় রং-বেরং-এর কালিতে মাখামাখি করা লাইনগুলো কবে যে আবছা হয়ে এলো, হয়ত কোন বর্ষার জলে নিজেকে ভিজিয়ে দিয়েছিল। হৃদয় জুড়ে প্রথম বৃষ্টির অনুভূতি গুলোর টাপুরটুপুর শব্দে জপজপে ডাইরির পাতা ভেজার শব্দটা শোনা হয়নি। মন কেমন করা বর্ষাটা এলে আজও ফিরে যাই ওই জানলার কাঁচে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বৃষ্টিবেলার যাপনটা আজ শুধুই বান ডাকে মনের কোণে। বিকেলের বৃষ্টি শেষে রোদের ঝলকে রামধনুর অপেক্ষায় থাকা চোখ দুটোতে কালো মেঘের ঘনঘটা। শ্রাবণ এলে বেপরোয়া চোখ অঝোরে আড়ালে ঝরে নিয়ম করে। হৃদয় স্মৃতির বর্ষাদিনের লেখা চিঠিগুলো আরও একবার খুলে দেখার সময় আসে। অপেক্ষা করে নতুন বর্ষায় কোন ডাকপিয়নের হাঁক আসবে বলে।
নদীতে ভেসে যাওয়া ভেলায় বিরহ সুর তোলা বর্ষাগানে উথালপাতাল হওয়া অবুঝ মনটা আকুল হয়ে থাকে। সবুজ মাঠে কাদা পায়ে ছুটে যাওয়া শৈশব এসবের খবর রাখে না। আদরের নৌকোতে ভাসবে বলে ওরা বৃষ্টি ডাকে। কালো মেঘের গভীরে থাকা বৃষ্টিগুলো নতুন কোন শ্রাবণ দাগের জন্য নিজেদের আরও একবার গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত। এই ভেজা মনের খবর কোন মেঘদূতই পৌঁছে দেয় না তার প্রেয়সীর কাছে। সবটা কেমন গল্প হয়ে বর্ষা সিন্দুকে বন্ধক রেখে চুপটি করে জানলায় জলছবিতে ঝাপসা হয়ে আসে।
কবিতা/ছড়া
এই শ্রাবণেই
শ্রাবণী সেন
এখনও বৃষ্টি হলে খুব ভিজতে ইচ্ছে করে।
এই শ্রাবণেই ঠিক ভিজে নেব,
যদি আর সময় না পাই!
নরম ঘাসে ঢাকা ছোট এই মাঠ পার হয়ে
ওই যে ওই নদীটির নরম জলে যেখানে
অবিরাম অন্তহীন বৃষ্টি গীতবিতানের গানের মত সহস্রধারায় ঝরে
সেখানেই প্রকৃতি পর্যায়ের গান খুঁজে পাব।
দুপুরের ক্লান্ত মেঘ ছুটির ঘন্টা বাজালেই
মুক্তধারার স্রোতে স্রোতে হাওয়ার
ময়ূরপঙ্খী নৌকো ভাসে
পাল আছে তার? কেন যেন খবর রাখিনি!
দূরে মেঘ আর কাছের বনস্পতির
অক্লান্ত রংমিলান্তি খেলা চলে
বর্ণ থেকে বর্ণান্তরে।
আমি সহজ সবুজ বড় ভালোবাসি!
সেখানেই ঠিক মিশে যাব, এই শ্রাবণেই।
যদি আর সময় না পাই....
বৃষ্টিবিকেল
প্রতিভা পাল
দুপুরের রোদ পেরিয়ে বৃষ্টিবিকেল ;
মধ্য শ্রাবণের চোখে, জল-থইথই অভিমান !
ফোঁটায় ফোঁটায় অঝোর ধারায়
নিঝুম, নীরব চুপকথারা
শূন্যতা মাপে শূন্যের ভিতর !
অভিযোগের আঁজলা ভ'রে
দূরে কোথাও অভ্যাসেরাও নিশ্চুপ!
সোঁদা গন্ধে ভেজা মাটির মন কেমনগুলো
বুদ্বুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে উঠোন-জুড়ে!
জানালার ঘষা কাচে আঁকিবুঁকি কাটা জলছবি
নিঃস্ব হয়ে অবসর বোনে বারবার
ছেঁড়া ছেঁড়া প্রহরে-
ঠিক বৃষ্টিমেঘের মতো, নিকষ রাতের মতো !
আর তারপর,
অদৃশ্য হয় গুটিগুটি পায়ে দিগন্তে কোথাও !
কখনও কখনও এভাবেই হয়তো
বিষণ্ণতার একতারা বাজায় বাউলমন,
স্রোতহীন অনুভবে….
আয়না
রীনা মজুমদার
আম, জাম, শিমুল, কদম, কৃষ্ণচূড়া
গাছে গাছে যেন জলসা বসেছে!
কোকিল তার নিজস্বীতে ডাকছে কু..উ
ময়ূর তার রূপের শোভায় ডানা ঝাপটায়
বাবুই খড়কুটোয় নিজের শিল্প সাজায়
জোড়া শালিক কিচিরমিচির সভা কাঁপায়
-তোদের দেমাক দেখে, আর বাঁচি নে !!
পেয়ারার ডালে সবুজ মৌটুসী শিশ্ তোলে
-আজীবন ঝগড়ুটি নাম তোর, কেন রে?
হলদেমাখা বেনেবউ বিষম খায় লাজে
পাতার আড়ালে মুচকি মুচকি হাসে
ঈগল তার আভিজাত্য নিয়ে আকাশ
থেকে নেমে এসে মুখ ঘুরিয়ে বসে
কাজললতা কাকের এসব বালাই নেই
সব কাজেতে বেশ ঝাঁপিয়ে পড়ে
যেন, মোড়ের মাথায় আড্ডা বসেছে!
এক আকাশে শ্রাবণধারায় ভেজে
এক আকাশে সবাই ওড়ে..
চলার পথে পথে দৃষ্টির জানালা
যেন, জীবনের আয়না।
পিছু -ডাক
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
শ্রাবণ মেঘের গুরুগুরু
আকাশভাঙা বৃষ্টি শুরু।
ছুটল নেতাই স্কুলের পরে
পাতার ছাতা মাথায় ধরে,
পথের জল আর কাদা ঠেলে
ছোট্ট পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে।
বাড়ির কাছে উঠোন ধারে
জল থৈ থৈ পুকুরপাড়ে -
চৈ চৈ হাঁস দল বেঁধে চড়ে।
তাড়াতাড়ি ঘরে বইখাতা ফেলে
ছুটে যোগ দেয় বন্ধুর দলে।
মা পিছু ডাকে-"খেয়ে যারে কিছু-"
ব্যস্ত নেতাই,তাকায়না পিছু।
আজ বহুদিন হয়ে গেছে পার,
নেতাই এর এখন শহরে কারবার।
আজ সে বাবু-নিতাইচন্দ্র
কাজ কারবারে প্রহরা অতন্দ্র।
আসা যাওয়া তার ঝকঝকে কারে
ধুলোকাদা সব অতীত-ওপারে।
তবু কোনোদিন -মেঘলা বিকেলে
মন বাঁধা আর থাকেনা শিকলে,
থৈ থৈ জল,কাদাকাদা মাঠ
"নেতাই"-বলে মায়ের সে ডাক-
বুকের খাঁচায় পাখসাট মারে,
একফোঁটা জল মোছে চুপিসারে।
বৃষ্টি- আমি রীতা মোদক
বৃষ্টি স্নাত প্রকৃতি আজ
নৃত্য করে শাওন ছন্দে ।
ছাঁদের কার্নিশ বেয়ে
ছম্ ছম্ ঝম ঝম তালে
রিমঝিম সুরে
বৃষ্টি পড়ে , বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে গাছের পাতায়
বৃষ্টি পড়ে রঙিন ছাতায়
ছাতা ঘুরানোর অপূর্ব ছটায়।
বৃষ্টি পড়ে আমার মাথায়
বৃষ্টি পড়ে চোখে মুখে ।
গাল বেয়ে যায় নোনা জল
দুঃখগুলো মিশে যায়
জলধারায় ঝর্ণায়।
কি জানি কখন বৃষ্টি আর আমি
এক হয়ে যাই দোদুল ছন্দে,
কখনো জমে থাকা জলের দোলায়
কাগজের নৌকো হয়ে ভেসে যাই ।
নৌকো শরীর ভিজে গেলে
আবার, বৃষ্টির সাথে মিশে গিয়ে---
বৃষ্টি- আমি এক হয়ে যাই।
মনের জানালা
মৌমিতা বর্মন
যদি চলে যাবে প্রিয়, তবে এলে কেন কাছে।
তুমি কী বোঝোনি এ মনে কত রং লেগে আছে।
শ্রাবনের ধারা বয়ে যায় এ দুচোখে
ভুলে গেলে তুমি! ছিলে সুখে ও দুঃখে।
এই ক্ষনিকের সাথী হতে, কেন বাড়িয়েছো হাত
কেন বোঝোনি তোমার শুন্যতা আমার আঘাত।
আমি তো চেয়েছিলাম বিস্তীর্ণ ওই বুকে মাথা রাখি
একটু সোহাগে, একটু আদরে সব গ্লানি ভুলে থাকি।
সেটুকু সময় যদি নাই ছিল, তবে কাছে কেন নিলে ডাকি।
উত্তর নাই বা দিলে।
বুঝে গেছি আমি।
আমায় যে দিয়েছো ফাঁকি। আমায় যে দিয়েছো ফাঁকি।
মেঘজীবী
অলকানন্দা দে
মান করেছে বৃষ্টিবাদল
সুনীল দেখায় খুব দেমাক
নীল নিখিলে স্নান সেরে নে
অকাল শরৎ একটু মাখ।
মানাচ্ছে না রূপের এ নীল
কীর্তনীয়া শ্রাবণ কই
মেঘমালা মাটির স্নেহ
কেমন করে মত্ত হই!
সবার নিখিল সাজবে শুধু
কৃষক মনে ভরাট ভয়
শ্রাবণ মাঠে শারদ জীবন
আমন ধানের কাম্য নয়।
মাঠের দেহে খিদের জ্বালা
জীবনমুখী শ্রাবণজল
অন্যমনা আকাশটাকে
উদার হতে একটু বল!
শারদীয়ায় এসো শরৎ
মেঘের কৃষি এই বেলা
ধানের ভাতে কলাপাতে
চিরন্তনের পথ চলা!
শ্রাবণের বৃষ্টি
সারণ ভাদুড়ী
শ্রাবণের বৃষ্টিতে আগে ছিল অনেক গল্প,
ছিল অনেক আশা, অনেক প্রাণ।
কিন্তু এখন সেই বৃষ্টি শুধুমাত্র মানবিকতার হাহাকার!
অশ্রুমিশ্রিত হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা ক্রন্দন।
এই বৃষ্টিতে নেই কোনো সারল্য,
কেবল আছে এক - একটা বিভৎস প্যাঁচ!
আগে শ্রাবণের বৃষ্টি বলতো, ছেলে ভুলোনো অনেক গল্প
কিন্তু এখন এই বৃষ্টি হারিয়ে দেয় মনের সারল্য, মনের ভালোবাসা।
অ্যাসিডের মতই নেমে আসে ফোঁটা গুলো,
পুড়িয়ে দেয় সকল মানবিকতা
ধ্বংস করে সমস্ত ভালোবাসা।
হয়তো আবার একদিন আসবে যেদিন হয়তো,
অ্যাসিডের কালো মেঘ সরে যাবে,
উঠবে আবার সেই সূর্য........
মাটি ফুঁড়ে আবার উঠবে, মানবিকতার চারা গাছ।।
শ্রাবণ ধারা বইছেমজনু মিয়া
আজ দু’তিন দিন লাগাতারে
ঝরছে বৃষ্টি অঝোরে,
বাহির যাওয়া যায় না কাজে
ছাতা মাথায় সয় না রে।
সেদিন হাটে কিনছি যে ধান
সিদ্ধ শুকনা করতে হয়,
রোদের দেখা নাই কপালে
না খেয়ে যে মরতে হয়!
জলে জলে ভরে গেছে
খাল নদী বিল জলাশয়,
চোখের দেখাও পাই না রোদের
হইছে এমন জ্বালাময়!
কদম কেয়ার ফুল ভেসে যায়
মনে একটুও সুখ যে নেই,
সুখের ঘরে জ্বলছে আগুন
হারাই ফেলছি তাই তো খেই।
এমন নির্দয় হইস না রে রোদ
বৃষ্টি আমি তোরে কই,
আমার ঘরে না খাওয়া মুখ
এই দুঃখ বা কেমনে সই?
গল্প
লক্ষীছাড়া ধরাধাম
সোমা দে
~ বেশ কিছুদিন ধরেই বড্ড গরম পড়েছে। শ্রাবণ মাস কোথায় তুমুল বৃষ্টি হবে চারদিকে জল থৈ থৈ করবে গাছপালা গাঢ় সবুজ দেখাবে, তা নাহ্ কাঠফাটা রোদে চরম দাবদাহের সৃষ্টি করেছে মাঠঘাট গাছপালা থেকে শুরু করে সমস্ত প্রাণীকুল অবদি অস্থির হয়ে যাচ্ছে।
~ গলদঘর্ম হয়ে ফ্যানের গরম হাওয়া গায়ে মেখে খবরের কাগজটায় চোখ বোলাচ্ছিলাম তখন সবে সকাল সাড়ে আটটা কিন্তু বাইরের পরিবেশ বলছে মধ্য দুপুর। কত জায়গায় স্কুলের বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে গেছে , তাপমাত্রার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুও হয়েছে কলেজ ছাত্রী সহ অনেক সাধারণ মানুষের। এসব দেখছি আর মনে মনে বলছি 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে'।
~ হঠাৎই মনে পরে গেল , বাড়ির কাছের ধান ক্ষেতটার কি পরিস্থিতি এখন ! কদিন আগেই তো বীজ বপন করতে দেখেছিলাম। মায়ের বারণ অমান্য করে ছাতা মাথায় দিয়ে ছুটলাম ওদিকে।
~ ক্ষেতের সামনে এগোতেই বুকের ভেতরটা মুচরে উঠলো এ কোন অলক্ষীর ছায়া পড়েছে এখানে , সূর্যের প্রখর তাপে ধানগাছের ছোট্ট চারাগুলো প্রায় ফ্যাকাসে হয়ে প্রাণহীন শলাকার আকার ধারণ করেছে , কাঁদামাটি রুক্ষ হতে হতে ফেটে চৌচির।
~ খানিকটা দূরে করিম কাকাকে দেখলাম গাছের ছায়ায় হতাশ হয়ে বসে আপনমনে কি যেন বিড়বিড় করছেন আর একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন তো আরো একবার নিজের জমির দিকে।
~ এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে , উনি আমায় শৈশবকাল থেকেই চেনেন এবং খুব স্নেহ করেন। আমাকে দেখতেই অন্যদিনের মতো সরল হাসিটা হাসলেন না তার বদলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন , ওনার চোখের কোনটাও কেমন চিকচিক করে উঠলো । আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে ওনার মুখের ঘামের সাথে মিশে গেল।
~ জলের বোতলটা সঙ্গে এনেছিলাম ওটা ওনার হাতে এগিয়ে দিয়ে , মাটির ওপরে বসে পড়লাম। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতেই বললেন সামনের অগ্রহায়ণ মাসে ওনার মেয়ের বিয়ের দিন স্থির করেছেন , ভেবে রেখেছিলেন নতুন ধান তার আগে ঘরে উঠে যাবে ওতে সমস্ত লোকজন অনুষ্ঠানের কদিন খেয়েও যেটুকু থাকবে তাতে করে প্রায় আধা বছর অন্নের কষ্ট হবে না , জমি লাগোয়া পুকুরটাতেও এবারে মাছের পোনা ছেড়েছিলেন কিন্তু সবকিছু খরার কারণে শেষ হয়ে গেল, আবাদ করার জন্যে তিনি বেশ খানিকটা ঋণের কবলেও পড়েছেন।
~ মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত হয়ে এলো মানুষটার জন্যে , উনি দুচোখে যেন আর কোন আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না আগামী বর্ষা আসার আগে সব ঠিক হয়ে যাবে তো নাকি কিছুই থাকবে না তা শুধু ওপরওয়ালার হাতে এখন। সত্যিই তো সোনার ফসল ফলানো যদি সম্ভব না হয় তবে মানুষের থালায় পৌঁছবে কি, তাহলে কি হাহাকারের কয়েক ক্রোশ দূরে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি !
~ নিজের অজান্তেই মনে মনে বলে উঠলাম , 'আল্লাহ মেঘ দে পানি দে' এভাবেই হয়তো একটা প্রার্থনা সুপার পাওয়ারের কাছে এ যাত্রায় বাঁচিয়ে নাও , বেঁচে থাকতে দাও সহ্যের আর পরীক্ষা নিও না প্রভু প্রবল বর্ষণ হোক , প্রাণ ফিরে পাক ধরাভূমি। কৃষক পিতার পরিশ্রম স্বার্থকতা পাক অনেক সোনার ফসল ফলুক ...
নুপুরের ইচ্ছেমনোমিতা চক্রবর্তী
স্কুল থেকে ফেরার সময় হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল মুষলধারে ।নুপুর তার বন্ধুদের সাথে ছাতা মাথায় দিয়ে একটা দোকানের শেডের নিচে দাঁড়ালো ।কিছুতেই বৃষ্টি থামছে না ।হঠাৎই কি মনে করে বইয়ের ব্যাগটাকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে পুড়ে ,ছাতা বন্ধ করে বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল নুপুর।
তার বন্ধুরা কত বাধা দিল বৃষ্টিতে না ভেজার জন্য, কিন্তু কারোর কোন কথাই শুনলো না নুপুর ।
অগত্যা যা হবার তাই হল । ওই রকম বৃষ্টিতে ভেজার ফলে সন্ধ্যে নামতে না নামতে ই জ্বরে কাবু হয়ে শুয়ে আছে নূপুর । আটটা নাগাদ নুপুরের মা ঘরে ঢুকেই দেখে নুপুর পড়তে বসেনি,শুয়ে আছে। নুপুরের পাশে বসে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে নুপুরের ঠাকুমা। নুপুরের মা দৌড়ে গিয়ে মেয়ের কপালে হাত দিয়ে দেখে; জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
শাশুড়ির কাছে শুনলো স্কুল থেকে ফিরে কিছুই খায়নি নুপুর। তাড়াতাড়ি ওষুধ কিনে আনলো নুপুরের জন্য তার মা কল্পনা, আর সাথে মাংস ।
ঘরে এসে তাড়াতাড়ি করে কষা কষা মাংস আর রুটি করে নুপুরকে খাওয়াতে গেল কল্পনা। রুটি মাংস যে খুব পছন্দের খাবার নুপুরের। কল্পনা -"মা নুপুর ওঠ মা ওঠ। এই দেখ তোর পছন্দের খাবার কষাকষা মাংস আর রুটি করেছি ।খেয়ে নে মা । ওঠ মা খেয়ে ওষুধটা খেতে হবে যে।কেন যে খামোখা বৃষ্টিতে ভিজতে গেলি ?তোর বন্ধু সোনা আমায় সবটা বলেছে ।কেন তুই শুধু শুধু ভিজলি বল তো ?এই যে তুই বিছানায় পড়ে আছিস কার ভালো লাগে বলতো? ঠাকুমার তো বয়স হয়েছে। চিন্তা করে তোকে নিয়ে। আমিও সারাদিন বাড়িতে থাকি না। শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছিস এখন।"
নুপুর -"বেশ করেছি ,বৃষ্টিতে ভিজেছি। আর বেশ হয়েছে আমার জ্বর হয়েছে ।"
কল্পনা -"কেন ?কেন এরকম বলছিস তুই?"
নুপুর -"বলবো না, সবার মা বাড়িতে থাকে। যখন ইচ্ছে মাকে কাছে পায় তারা। আর তুমি সেই যে কোন ভোরে ,আমি ঘুম থেকে ওঠার আগে বের হয়ে যাও কাজে। ফেরো রাত আটটায় । সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ তোমার ।আমার বুঝি ইচ্ছে করে না, তোমার আদর পেতে ।তাছাড়া জ্বর হয়েছে বলেই তুমি আদর করে আমায় মাথার হাত বুলিয়ে দিচ্ছো,আমার পছন্দের খাবার রেঁধেছো। নইলে তো তোমার সময়ই হয় না আমায় আদর করার। ভালো-মন্দ তো তেমন কিছু রাঁধই না।রোজ রোজ শুধু ভাতে ভাত। ভালো লাগে না আমার।"
মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে নুপুর বলে -"বল মা কাল তুমি কাজে যাবে না। সারাদিন আমার সাথে থাকবে।তাহলেই আমি ওষুধ খাব, নইলে ওষুধ খাব না।।"
কল্পনা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে-" বেশ তাই সই। কাল যাবনা আমি কাজে। ঠিক আছে? "
কল্পনা মনে মনে বলে-" পোড়া কপাল আমার, সাধে কি আর কাজের পেছনে ছুটতে হয় আমায়।কাজ না করলে তিন তিনটে পেট চলবে কি করে । তিন তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ করি। রোজিই ঐ বাড়িগুলোতে কত ভালো ভালো খাবার রান্না করতে হয় আমায়। অথচ ,বাড়িতে শুধু ভাতে ভাত ই করতে হয় । ইচ্ছে থাকলেও কোনো উপায় নেই আমার ।যাইহোক তবু তো ওই তিনটে বাড়িতে কাজ করি বলে, সেই কাজের টাকায় আমাদের সংসারটা চলে ।আমাদের মত মানুষের জন্য ভাতে ভাতই ঠিক । ভালো ভালো খাবার কি আর আমরা খেতে পারি রোজ রোজ ?বড় হ মা ,সব বুঝবি!"
জীবন গেলে সাধন হবে না
দেবদত্তা বিশ্বাস
সারারাত ধরে ঝমঝমিয়ে চলা বৃষ্টির দাপটে উঠানের এক কোণে শেফালি গাছের ডাল ভেঙেছে।সদ্য গজানো নয়নতারা কোমর ভেঙে মাথা ছুঁইয়েছে মাটির সাথে। কচু পাতা বিন্দু বিন্দু জল ধরে ক্লান্ত, সবুজ কান্ডগুলো আর বেশিক্ষণ বোধহয় জলের ভার বইতে পারবে না। তবু এক সংসারী বাউন্ডুলের মনে আজ রোয়া গাড়ার আনন্দ। বর্ষা আসুক আরো ঝেঁপে। ঘরের এক কোণে টিন ফুটো হয়ে জল ঢুকছে চুঁইয়ে। তা হোক, কোন তাপ্পি দিতে রাজি নয় সে। দিনের প্রথম সূর্য রশ্মি সে পথেই তো তার কানে এসে ঘুম ভাঙানিয়া গান গায় রোজ। গান বড় ভালোবাসে সে। জীবনের গান, ভালোবাসার গান,মন কেমনের গান। তার জীবনের রোজনামচায় ভাটিয়ালি দোতারা আর ঝুমুর নিয়ে হাজির হয় আপন খেয়ালে। তবু কখনো কখনো হারমোনিয়াম বড় বেসুরে আওয়াজ তোলে। পাশের ঘর থেকে জীবন সঙ্গিনী গুমোর করে ফাঁকা হাঁড়ির শব্দ শোনায়। এই বর্ষায় আর কিছু না হোক চাল ডালটা তো ঘরে মজুত রাখতে হয় বেশি করে। একবেলা না হয় আলু সিদ্ধ তেল নুন মেখেও চলে। আর কিছু না হোক কচু পোড়া বা কচুর তরকারি। বাউন্ডুলে বলে গিন্নি তোমার চোখ শুধু মাটির নিচে। চোখটা উপরে তুলে দেখ দরমার বেড়ার পাশে একটা অমলতাস কেমন পসরা সাজিয়ে বসেছে। থোকা থোকা হলুদ ফুলের ঝুড়ি নিচে নেমে তোমার হাতে হাত রাখতে চাইছে। তুমি না হয় একটু রং চেয়ে মাখো। আর তার উপরে রয়েছে এত বড় আকাশ। আকাশটাকে বুকে নেই আমি। বাউন্ডুলে খিলখিলিয়ে ওঠে ছোট ছেলের মত।
ঝমঝমে বৃষ্টি কখনো টিপটিপে হয়ে মাটি ছোঁয়। পাশে আধবোজা ডোবাটায় ব্যাং সুর তোলে এক নাগারে। ছাতা মাথায় বড়শি হাতে তখন তিনকাঁটা, মৌরালা গুলোকে টোপ গেলাতে ব্যস্ত পাড়ার ছেলেপুলে। বাউন্ডুলের মনে পড়ে নিজের ছোট দুটো ছেলেমেয়ের কথা। এই বর্ষায় এত অসুবিধায় ক'দিন মাছ খায়নি ছেলেমেয়ে দুটো। ছাতা মাথায় ঝিরঝিরি বৃষ্টিতে বড়শি হাতে ডোবার ধারে গিয়ে বসে সে। সামনের মাঠে পাট গাছগুলো বর্ষার জল পেয়ে বেশ চাগিয়ে উঠেছে। পাট পচা গন্ধে চারপাশটায় ঝিম ধরেছে বেশ। দূরে পাট গাছের পাশে ফাঁকা মাঠে ওর ছেলেমেয়ে দুটো হুটোপুটি খাচ্ছে বৃষ্টিতে। বাউন্ডুলে তৃপ্ত নয়নে দেখে ওদের। কাদামাটি মেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুটো। উঠছে আর পড়ছে, আবার উঠছে আবার ঝাঁপ দিচ্ছে। পিছনের পাটগাছ গুলো ঝমঝমিয়ে আসা বৃষ্টিতে আরো পুষ্ট হয়ে মাথা তুলে দৈর্ঘ্যে বাড়ে খানিকটা। ওদেরকে পাল্লা দিয়ে লম্বায় বাড়ে ছেলেমেয়ে দুটোও। পাট গাছ আর ওদের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় বাড়তে থাকে দুপক্ষই। বাউন্ডুলে শুধুই তন্ময় হয়ে দেখে। একটা মৌরালা মাছ এসে কুটুস করে কামড়ে ধরে টোপটাকে। সম্বিত ফিরে পায় সে। বড় প্রশান্তির হাসি হাসি। গোঁফের রেখায় দু একটা পাকা চুল চিক্ চিক্ করে উঠে তার।
অন্য শ্রাবণের কথা
ভিন্ন উদযাপন
ঋতুপর্ণা রায় বর্মা
একগাল হাসিমুখ নিয়ে
সোফায় বসে আছে তোমার বাবা।
কোমল দু'হাতে তুমি তার গলা জড়িয়ে আছো।
কিংবা আদুরে ঠোঁটে তুমি তোমার
বাবার দাড়ি ভরতি গালে এঁকে দিচ্ছ একটা স্নেহচুম্বন।
কিংবা তুমি নতমাথায় বসে আছো
আর তোমার বাবা তোমার জন্মতিথীতে
ধান দুব্বো সহ তোমার মাথায়
আশীর্বাদের হাত দু'খানা রেখেছেন__
এরকম নানানরকমফের ছবি সামাজিক মাধ্যমে
পোস্ট করে তুমি নিয়ম করে প্রতিবছর
তোমার বাবাকে সম্মান জানাচ্ছ,
কিংবা তুমি এই দিবস উপলক্ষে
বাবার জন্য হাতঘড়ি,পেন,ডায়েরী,রেইনকোট, কিংবা একটা পাঞ্জাবী নিয়ে এসে
এই দিনটাতে বাবাকে চমকে দিচ্ছ।
চলে যাচ্ছ অতীত সরণীতে,
লিখে ফেলছো স্মৃতিচারণের কবিতা।
বাবা'র ত্যাগকে অকপটে প্রকাশ করে
বাবা'র মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে
নানান উপায়ে বাবাকে খাস অনুভব করাচ্ছ এবং বাবার সাথে বাইরে ঘুরতে গিয়ে,
কেক কেটে, লাঞ্চ কিংবা ডিনার সেরে
হাসি মজায় দিনটাকে উদযাপন করছো।
কিন্তু আমার উদযাপনটা তেমনতর নয় ;
একটু ভিন্নতা আছে।
এই দিনে সাততাড়াতাড়ি উঠে রোজকার মতো দেওয়ালে টাঙানো বাবার ছবিতে
আগে আমি চোখ রাখি।
তারপর দুহাত জোর করে
বাবাকে প্রণাম জানাই।
এরপর যাবতীয় কাজ সেড়ে দোকানে ছুটি,
ঘুরে ঘুরে পছন্দ মতো নতুন মালা আর
সুগন্ধী ধূপ কিনে আনি।
স্নানাদি সেরে ছবির পুরোনো মালা খুলি,
জমে থাকা ধূলো মুছি,মালা দিই,
ধূপ জ্বালি,একা একা প্রশ্ন করি,উত্তর দিই
আর সবশেষে আলমিরা খুলি।
বাবার চশমা,হাতঘড়ি,ছাতা,রেইনকোট,কলম,
ববইপত্র,কাপড়জামা সব বের করে
বাবার উপস্থিতিকে আরও বেশি করে
অনুভব করার মুহূর্ত তৈরী করি,
বাবাদিবসে বাবাহীনতার কষ্ট লাঘব করি৷
আমার বাবাদিবস এমন করেই
উদযাপিত হয়___
অতীত স্মরণ করে,
বাবার ছবিতে চোখ রেখে,
ন্যাপথলিন দিয়ে যত্নে রাখা
বাবার ব্যবহৃত সমস্তকিছুকে স্পর্শ করে।
বছর বছর এই গোটা দিনটা আমার
এভাবেই কেটে যায়__
জানালার ধারঘেষা পিছলে পড়া
রোদের আলোর দিকে মুখ করে
বোবা কান্না আর জন্মান্তরের অপেক্ষাতে!
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪২৯