মুজনাই
অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩০
সম্পাদকের কথা
আবহাওয়া বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এই বর্ষায় এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়নি। বর্ষার আর যে ক`টি দিন বাকি রয়েছে তাতে সেই ঘাটতি মিটবে কিনা সন্দেহ রয়েছে! সঙ্গে এই বছর বর্ষা ঋতুর কোনও কোনও দিনে যে পরিমাণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে তাও অতীত রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বলা হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের দিন শেষে আমরা এখন গ্লোবাল বয়েলিংয়ের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সব কিছু মিলে পৃথিবী নামের গ্রহটির পরিবেশ এমন এক জায়গায় পৌঁছচ্ছে যা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। ভারতের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি আরও মারাত্মক কেননা পরিবেশ নিয়ে আমাদের নির্দিষ্ট কোনও নীতি নেই। আমরা চাঁদে মহাকাশযান পাঠাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু নানা বিষয়ে আমাদের সচেতনতা এখনও সেই তিমিরেই রয়েছে। অবিলম্বে আমরা যদি জাতীয় স্তরে কোনও নীতি নির্ধারণ ও রূপায়ণ করতে না পারি তবে অবস্থা আরও খারাপ হবে। তাই বর্ষার ঘাটতি মেটার সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা সেই সচেতনতার যা পরিবেশকে দূষিত করবে না। আর আমাদেরকেও নতুন দিশা দেখাবে নীল গ্রহকে সুন্দরতর করবার জন্য।
স্মরণ
সেদিনের সেই অন্ধকার দিনের শিকার যাঁরা
*****
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩০
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
প্রচ্ছদ ছবি - বাবুল মল্লিক
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩০
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
উমেশ শর্মা, বেলা দে, মাথুর দাস, চিত্রা পাল,
গৌতমেন্দু নন্দী, পার্থ বন্দোপাধ্যায় , দেবর্ষি সরকার,
বটু কৃষ্ণ হালদার, দেবযানী ভট্টাচার্য, লীনা রায়,
শ্রাবণী সেন, বুলবুল দে, ইন্দ্রানী চক্রবর্তী,
শ্রাবণী সেনগুপ্ত, রীনা মজুমদার, সুনন্দ মন্ডল,
অদ্রিজা বোস, জয়িতা সরকার, জনা বন্দোপাধ্যায়,
কবিতা সামন্ত, উৎপলেন্দু পাল, মৌসুমী চৌধুরী,
মজনু মিয়া, মৌমিতা চ্যাটার্জী, শেখ আব্বাসউদ্দিন,
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, সারণ ভাদুড়ী, প্রতিভা পাল,
মনোমিতা চক্রবর্তী, রাজর্ষি দত্ত, পূর্ণিমা বোস,
সৈকত দাম, আকাশলীনা ঢোল, দীপ মুখার্জী ( মগ্ননীল),
অলকানন্দা দে, সঞ্জয় সরকার, রেজাউল করিম রোমেল
ক্রোড়পত্র
বাইশে শ্রাবণ---শোক নয়, সৃষ্টি-সৃজন ও নবজীবনের উৎযাপন
গৌতমেন্দু নন্দী
রবীন্দ্র জন্মদিনের মতো প্রতিবছর আসে তাঁর মহাপ্রয়াণের দিন। দুটো দিনই আমাদের সমাজ
জীবন ও ব্যক্তিজীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাঙালি, বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে ততদিন আমাদের চেতনে ও মননে তিনি থাকবেন। তাঁর
জন্মদিন-- পঁচিশে বৈশাখ আমরা মহাসমারোহে পালন করি। তাঁর মৃত্যুদিন বাইশে শ্রাবণ, এই পৃথিবী
থেকে কবির চির বিচ্ছেদ ঘটলেও কবির কথায়---
" মৃত্যু না থাকলে জীবনের কোনও মানে নেই। আর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে জীবনকে না দেখলে অমৃতের সন্ধান মেলেনা। এই জীবন মরণের খেলা দিয়েই জগৎ সত্য হয়ে উঠেছে।"
তাই মৃত্যুর অনিবার্যতায় দিনটিতে কবির ভাবনা ও বাস্তবতায় শুধু শোক নয়, জীবনের চরম সত্যের
নান্দনিকতায় সৃষ্টির, সৃজনের দিন।
প্রথম জীবনে কবি "মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে" বলে শুরু করলেও মধ্য জীবনে "বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয় " এ কথাও ঘোষনা করেন। জীবনে তিনি বহু প্রিয়জনের মৃত্যু দেখেছেন তাই বোধহয় দৃপ্ত স্বরে বলতে পেরেছিলেন, "করিনা ভয় তোমারি জয় গাহিয়া যাব চলিয়া, দাঁড়াব আসি তব অমৃত দুয়ারে।"
মৃত্যুর অনিশ্চয় ভয়কে তিনি মনে আমল দেননি, বরং তাঁর কাব্যে,লেখায় মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি
বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আবির্ভাব আর তিরোভাব --দুইয়ের মাঝেই সত্তার বিকাশ ও পূর্ণতা। জন্ম ও মৃত্যু---সূচনা ও পরিসমাপ্তি। দুই আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মৃত্যুকে কবি তাই বলেছেন "জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা"
তাঁর জীবনব্যাপী সৃষ্টি শৈলীর সাধনার মধ্যে বারবার এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জীবন ও মৃত্যু--দুটি পর্যায়। মৃত্যু জীবনের শেষ নয়। জাগতিক নিয়মে কেবল এক রূপান্তর মাত্র। তাইবিষাদ,বিচ্ছেদ, দুঃখ, মৃত্যু ---সবকিছুর মধ্যে প্রাণস্পন্দনের ছন্দকেই রবীন্দ্রনাথ স্থান দিয়েছেন সবার উপরে। বহু মৃত্যুর সাক্ষী থেকে শোক, দুঃখ ছিল তাঁর নিত্য সহচর।তাই তাঁর জীবনের সাহিত্য, কবিতা- সৃষ্টি মৃত্যুর ছায়াকে সঙ্গী করেই। তাঁর বিভিন্ন লেখায় মৃত্যুর নির্মমতা, রহস্য ও মাধুর্য উপলব্ধ হয়।
কবি অমিয় চক্রবর্তীকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, " জীবনকে মৃত্যুর জানালার ভিতর থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায়না। মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্তরূপ প্রকাশ পায় প্রথমে তা যেন বড় দুঃসহ, কিন্তু তারপরে তার ঔদার্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে। তখন ব্যক্তিগত জীবনের সুখ দুঃখ অনন্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হালকা হয়ে দেখা দেয়। বিশ্বের রথ চলেছে--বাধাবিঘ্ন,বিপদ সম্পদের মধ্যে দিয়ে সে আপনার গতিবেগে আপনার পথ কাটছে। সেই পথ সৃষ্টির পথ। আমার জীবাত্মার যে যাত্রা সেও অমনিতর বিরাট----সেও ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে আপনাকে এবং আপনার পথকে সৃষ্টি করেছে---লোকে, লোকান্তরে, যুগে যুগান্তরে......।"
মৃত্যুর এই নির্ভয়,নিশ্চিন্ত রূপকে কীভাবে জীবনের পরম সম্পদ করে তোলা যায়, সেই শিক্ষা আমরা রবীন্দ্রনাথের কাছেই যথার্থভাবে পেয়েছি। মৃত্যু আমাদের মানবজীবনের অনেক অপূর্ণতার পরিপূরক। "মৃত্যুঞ্জয় " কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাই লিখেছেন, "আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়, এই শেষ কথা বলে যাব আমি চলে।"
তাই শ্রাবণে এই বৃষ্টি ঋতু বারবার মৃত্যুর ছায়া নিয়ে এলেও কবিরই দৃষ্টিভঙ্গিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাইশে শ্রাবণ দিনটিকে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতর্পনের দিন হিসেবে পালন করে আমরা তাঁর পথ ধরেই সৃষ্টি -সৃজনেরই উদযাপন করি।
ব্যাতিক্রমী পাক-প্রণালীদেবর্ষি সরকার
'রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' লক্ষাধিক প্রদীপের আলোক রশ্মিকে যে নিজের ব্যক্তিত্বে ধারণ করে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য তত্ত্বের জন্ম যে বাড়ি থেকে হয়েছিল সে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আনন্দের উপাদানের নিচে যে পঙ্কিল বিলাসের স্রোত ভেসে গিয়েছিল উনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর হাতছানিতে সেই স্রোতে আমার কলমকে ভাসিয়ে দিয়ে আজ এসে পড়েছি ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের পরিচিত কিন্তু সাধারন জনসাধারণের পক্ষে যা অপরিচিত সেই পাক প্রণালীর মরুভূমিতে।
কিছুটা সময় অতিবাহিত হবে ঠিকই কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখবার বিষয় সাধনায় সিদ্ধি লাভ হলো কিনা ! রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রতিভাময়ী নাতনিদের সংখ্যাও কম নয়। তৎকালীন সমাজে যাদের স্পর্শে কয়লাও সোনা হয়ে যেত সেই সমস্ত মানবীদের বাদ দিয়ে কোন গৃহস্ত বাড়ির পাক প্রণালীর আলোচনা গ্রীষ্মের দুপুরে কুয়াশার সমান।
উপযুক্ত পরিবেশে প্রতিভাবান পিতা-মাতার প্রভাবে ঠাকুর বাড়ির নারীরা নানান গুণের অধিকারিনী হয়ে উঠেছিলেন। ভিন্ন পরিবার থেকে আশা কয়েকজন নাতবউও যে কৃতিত্বের পরিচয় দেননি তা নয়। আসলে এই সময় বঙ্গ দেশে অভাবনীয় নারী জাগরণের উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল। মেয়েরা নিজেরাই ঠেলে ঠুলে বেরিয়ে এসেছিলেন বাইরে। প্রথম পর্যায়ে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কাজকর্ম দেখে যেমন মেয়েরা সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন এখন ঠিক সে অবস্থা রইল না। শিল্প সাহিত্যে ঠাকুর বাড়ির সংস্কৃতির একটা নিজস্ব ছাপ এখনও বিদ্যমান। ঠাকুর বাড়ির প্রত্যেক সদস্য যখন সংগীত চিন্তায় বিভোর, লুপ্ত সঙ্গীত শিল্পীদের পরিচয় উদ্ধারে তৎপর ঠিক সেই সময় মহর্ষির তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথের মেজো মেয়ে প্রজ্ঞাসুন্দরী ব্যস্ত ছিলেন আর একটা চিরপুরনো অথচ চিরনতুন জিনিস নিয়ে। দিদিদের মতো তিনিও লেখাপড়া শেখা, গান শেখা ,স্কুল যাওয়া ,ছবি আঁকা দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন কিন্তু নদী যেমন এক উৎস থেকে বেরিয়েও ভিন্নমুখী হতে পারে তেমনি প্রজ্ঞাও ধরলেন একটি নতুন পথ। ঠাকুরবাড়িতে সবরকম শিল্পচর্চার সুযোগ ছিল। মেয়েরাও শিখতেন নানা রকম কাজ কিন্তু প্রজ্ঞার মন টেনেছিল রান্নাঘর। এমন আর নতুন কী? ঠাকুরবাড়িতে সব মেয়ে বউই অল্পবিস্তর রাধঁতে শিখতেন। তার মধ্যে নম্বর পেয়েছেন নম্বর কাদম্বরী ও মৃণালিনী। শরৎকুমারী ও সরোজাসুন্দরীও এ ব্যাপারে সুনাম ছিল। সৌদামিনীদের প্রতিদিন একটা করে তরকারি রান্না শিখতে হতো। তবে আর প্রজ্ঞার নতুনত্ব কোথায়! বলতে গেলে উত্তরাধিকার সূত্রেই তিনি রান্না শিখেছিলেন। তা শিখেছিলেন ঠিকই। প্রজ্ঞার মা নীপময়ীও ভালো রাধতেন। মহর্ষিরও এ ব্যাপারে কম উৎসাহ ছিলনা। অথচ তাদের বাড়িতে রোজকার ব্যঞ্জন ছিল, 'ডাল মাছের ঝোল অম্বল, অম্বল মাছের ঝোল ডাল, বড়ি ভাজা, পোর ভাজা, আলু ভাতে ছিল ভোজের অঙ্গ। আসলে এ ব্যবস্থা ছিল বারোয়ারি। তবে তরকারিতে মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন হয় ঠাকুরবাড়ি থেকেই। মহর্ষি নিজেও মিষ্টি তরকারি খুব ভালবাসতেন। মেয়ে বউয়েরা ঘরে নানা রকম তরকারিও মিষ্টি তৈরি করতেন। প্রজ্ঞার বৈশিষ্ট্য এই যে তিনি শুধু নিজের হাতে রাধা খাবার প্রিয়জনদের মুখে তুলে দিয়ে নিরস্ত্র হননি ঠাকুরবাড়ির চিরকেলে রেওয়াজ ছেড়ে নিজেদের আবিষ্কার করা পিঠেপুলি পোলাও ব্যঞ্জন তুলে দিতে চেয়েছেন সকলের মুখে। এখানেই তার অনন্যতা।
বাস্তবিকই রান্না এবং রান্নাঘর নিয়ে কেতাবি ভাষায় রন্ধনতত্ত্ব ও রন্ধনবিদ্যা নিয়ে তিনি যত মাথা ঘামিয়েছেন তত চিন্তা আর কোন মহিলা করেছেন বলে মনে হয় না। ঘরের কোণে বসে রান্নার পরীক্ষা চালাবার সময় তিনি সেগুলো লিখে লিখেছিলেন ভাবীকালের আগন্তুকদের জন্য। তাই তার 'আমিষ ও নিরামিষ আহার' এর বইগুলি এত নতুন হয়ে দেখা দিয়েছিল। আধুনিক যুগের গার্হস্থ্যবিজ্ঞান এর বহু বই লেখা হয়েছে ও হচ্ছে কিন্তু প্রায় একশো বছর আগে লেখা প্রজ্ঞার বইগুলি হাতেনিলে অবাক হয়ে যেতে হয়। অবশ্য এ ব্যাপারে আরো দু একজনের নাম করা যায়, কিরণলেখা রায়ের 'বরেন্দ্ররন্ধন' ও 'জলখাবার', নিহার বালা দেবীর 'আদর্শ রন্ধন শিক্ষা', বনলতা দেবীর 'লক্ষ্মীশ্রী' ও রান্নার বই হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে সে পরের কথা। পুরুষেরাও এ ব্যাপারে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। সংস্কৃত 'পাকরাজেশ্বর' অনুবাদ করিয়েছিলেন বর্ধমান রাজ। বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের রান্নার বইও অনেক আগেই প্রকাশিত হয়েছিল কিন্তু প্রজ্ঞা ভেবেছিলেন বেশি। তার রান্নার বই দুটির ভূমিকা কে আমরা একাধারে রন্ধনতত্ত্ব ও গার্হস্থ্যবিদ্যার আকর বলে ধরে নিতে পারি। বিয়ের পরে বেশ গিন্নিবান্নি হয়েই প্রজ্ঞা এ কাজে হাত দিয়েছিলেন। প্রতিভার মতো প্রজ্ঞারও বিয়ে হয়েছিল এক বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে অসমীয়া সাহিত্যের জনক লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার সঙ্গে ।তার স্বামী বিয়ের আগে লক্ষ্মীনাথের সঙ্গে তার কোনো রকম সাক্ষাৎ হয়নি, লক্ষ্মীনাথ তার আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন যে ঠাকুরবাড়ির এই গুণবতী, শিক্ষিতা, সুশীলা ও ধর্মপ্রান মেয়েটির ছবি দেখেই তিনি তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বিবাহে সম্মত হন যদিও তার নিজের বাড়ি থেকে এসেছিল প্রচন্ড বাধা কারণ তখনকার দিনে ঠাকুরবাড়িতে বিয়ে হওয়া মানেই ছেলেকে হারানো। তাই এক মাসের মধ্যে বহু টেলিগ্রাম ও কলকাতা ও গৌহাটিতে আসা যাওয়া করলেও বিধির লিখন বদলালো না। ১৮৯১ সালের ১১ই মার্চ স্বপ্নরঙিন বাসন্তী সন্ধ্যায় সপ্তপদী গমনের পর শুভদৃষ্টি। লক্ষ্মীনাথ দেখলেন প্রজ্ঞা তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন হাসি ফুটল লক্ষ্মীনাথেরও ঠোঁটের কোণে, পরে অবশ্য তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন প্রজ্ঞাকে 'শুভদৃষ্টির সময় ঐরকম ভাবে হেসেছিলে কেন?' প্রজ্ঞার উত্তর, ' বিয়ের অনেকদিন আগেই তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম।' স্বপ্নে দেখা মুখটার সঙ্গে লক্ষ্মীনাথের মুখের হুবহু মিল দেখে হেসেছিলেন প্রজ্ঞা। লক্ষ্মীনাথের আঁকা এইসব ছোট ছোট কথার ছবি দেখে ধরে নিতে অসুবিধে হয় না দাম্পত্য জীবনে প্রজ্ঞা কতখানি সুখী ছিলেন। নিজের জীবনে পর্যাপ্ত সুখের সন্ধান পেয়ে তিনি বুঝেছিলেন গৃহকে সুখের আগার করে তুলতে হলে গৃহিণীকে কোন দিকে নজর দিতে হবে। তাকে 'মায়ার খেলাতে' অভিনয় করতেও দেখা দিয়েছে, ছবি আঁকতেও দেখা গিয়েছে কিন্তু সব ছেড়ে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন আপাতত অবহেলিত রান্নাঘরখানি কে। হেমেন্দ্রনাথ রান্নাকে মনে করতেন কলাবিদ্যা। ইচ্ছে ছিল একখানি রান্নার বই লিখবেন। মেয়েদেরও রান্না শিখিয়েছিলেন কিংবা বলা যায় প্রবল উৎসাহ দিতেন। প্রজ্ঞা রান্না এবং আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলে লক্ষীনাথও তাকে উৎসাহ দিলেন।
রান্নাঘর নিয়ে প্রজ্ঞা ভাবতে শুরু করেন 'পুন্য' পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে। হেমেন্দ্রনাথের পুত্রকন্যাদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই প্রকাশিত হতো 'পুণ্য' পত্রিকা। লিখতেন প্রজ্ঞার ভাই-বোনেরা। প্রথম সম্পাদিকা ছিলেন প্রজ্ঞা নিজে। প্রথম থেকেই এর পাতায় পাতায় হরেক রকম আমিষ ও নিরামিষ ব্যঞ্জন এর প্রাক প্রণালী ছাপা হতে থাকে। সুগৃহিহিনীর মতো তিনি আবার তৎকালীন বাজারদরটিও পাঠকদের জানিয়ে দিতেন যাতে কেউ অসুবিধেয় না পড়েন। কালের সীমানা পার হয়ে আজ সে বাজার দর আমাদের মনে সুখস্মৃতি জাগায়। মাছের দাম ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা - আধসের পাকা রুই তিন বা চার আনা, চিতল মাছ তিন পোয়া ছয় আনা, বড় ডিমওয়ালা কই আট নয় টাকার দাম নয় দশ আনা, একটি ডিম একটা পয়সা, ঘি এক সের এক টাকা, দই এক সের চার আনা,টমেটো কুড়িটা দুই আনা। অকারণে মন খারাপ করে লাভ কি শুধু ! এটুকু মনে রাখলেই হবে এই দামগুলো সঠিক বাজারদর কিনা ধনী গৃহিনী প্রজ্ঞা যাচিয়ে নিতেন। দরদাম করলে জিনিসপত্রের দাম হয়তো আরও একটু কমতো।
'আমিষ ও নিরামিষ আহার' এর তিনটি খন্ড বেরিয়েছিল। প্রজ্ঞা ভেবেছিলেন পাক প্রণালীর পরে লিখবেন গৃহবিজ্ঞানের বই। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। এর ফলে অপূরণীয় ক্ষতি রয়ে গেল গৃহবিজ্ঞানের। প্রজ্ঞার মত এত যত্নে রান্নার বই লেখার কথা গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের শিক্ষিকারা ভাবেন বলে মনে হয় না। তিনি বইয়ের প্রথম দিকে খাদ্য, পথ্য, ওজন ,মাপ, দাসদাসীদের ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতা সব ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন সেই সঙ্গে তৈরি করেছেন রান্নাঘরে ব্যবহৃত শব্দের পরিভাষা। হয়তো শব্দগুলো আমাদের অজানা নয় তবু এই ধরনের শব্দের সংকলন এবং পরিভাষা থাকা প্রয়োজনীয় তাতে সন্দেহ নেই । কতখানি উৎসাহ এবং নিষ্ঠা থাকলে এ কাজ করা সম্ভব পরিভাষার দীর্ঘ তালিকা দেখলেই বোঝা যাবে। প্রজ্ঞা চলিত এবং অপ্রচলিত কোন শব্দকেই অবহেলা করেননি। পড়তে মজা লাগে যখন কচি লেবু হয় 'কড়াই লেবু' কিন্তু কচি আম হয় 'কড়ুই আম'। 'দাগ দেওয়া' শব্দটির অর্থ রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ায় 'ঘিয়ে গরম মসলা ছাড়িয়া পাক করা ।' রয়েছে আরো কত চেনা অচেনা শব্দ। যেমন,
বাখরা= পাপড়ি
চুটপূট= ফোড়ন ফাটার শব্দ
হাসলে= কাচাঁটে বিস্বাদ গন্ধ
রুটিতোষ= সেঁকা পাঁউরুটি
পিটনী= যাহার দ্বারা মাংসাদি পেটানো হয়
বালিখোলা= কাঠ খোলায় বালি দিয়া জিনিস ভাজা
সিনা= বুক
চমকান= শুকনা খোলায় অল্প ভাজা
তৈ= মালপোয়া ভাজিবার মাটির পাত্র
তিজেল হাড়ি= ডাল রাধিবার চওড়া মুখ হাড়ি
তোলো হাড়ি= ভাত রাধিবার বড় হাড়ি
খন্ড কাটা= ডুমা ডুমা টুকরো কাটা
চির কাটা= লম্বা ভাবে ঠিক অর্ধেক করিয়া কাটা
ছুঁকা= ফোড়ন দেওয়া
রান্না ঘরে যে এত রকম শব্দ প্রচলিত আছে প্রজ্ঞার আগে তাকে জানতো? বাংলা রন্ধন শিল্পকে যদি লোকশিল্পের মর্যাদা দেওয়া হয় তা হলে প্রজ্ঞার নাম সবার আগে উচ্চারিত হবে। তার দেশী রান্নাগুলির অধিকাংশই গ্রাম বাংলার লোকজীবন থেকে কুড়িয়ে পাওয়া আর রান্নাঘরে ব্যবহৃত শব্দের পরিভাষা সংকলনে লুকিয়ে আছে বঙ্গ নারীর নিজস্ব ভাষা যা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে আছে নানা রকম বাসনের কথা সেগুলির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। গার্হস্থ্য বিজ্ঞান এর সঙ্গে লোকসংস্কৃতি চর্চায়ও প্রজ্ঞার ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
এছাড়াও আছে নানারকম 'প্রয়োজনীয় কথা।'
গৃহিণীদের জ্ঞাতব্য নানা রকম তথ্য। 'বিনা পেঁয়াজে পেঁয়াজের গন্ধ করা' অথবা 'ধরা গন্ধ যাওয়ার' মত আরও অনেক কথা আছে। কজন আর জানে আদার রসে হিং ভিজিয়ে রেখে সেই হিংগোলা জল নিরামিষ তরকারিতে দিলে পেঁয়াজের গন্ধ হয় কিংবা ডাল তরকারি হাড়িতে লেগে গেলে তাতে কয়েকটা আস্ত পান ফেলে দিলে পোড়া গন্ধ কমে যায় ? মাছ-মাংসের যত্ন বাসি তাজা চেনার উপায় সব আছে,' গঙ্গা হইতে সদ্য ধরা ইলিশ মাছটি দেখিবে নৌকার মতো বাঁকা, যত বেলা বাড়িয়ে ক্রমশ সোজা হইতে থাকিবে।' তরিতরকারি রোদে শুকিয়ে কিভাবে অনেক দিন রেখে দেওয়া যায় সে কথা জানাতেও প্রজ্ঞা ভোলেননি। এমনকি কবিরাজি 'আলুইয়ের বড়ি' বা নানা উপকরণ দিয়ে শিশুদের জন্য ওষুধের বড়ি প্রস্তুতির কথাও প্রজ্ঞা জানতেন। একসময়ে যে পথ্য প্রস্তুত করা ছাড়াও শিশুকে ওষুধ দেবার কাজের মহিলাদের প্রধান ভূমিকা ছিল আলুইয়ের বরি তার প্রমাণ।
প্রজ্ঞা আরো একটি নতুন জিনিস বাংলার ভোজসভায় এনেছিলেন সেটি হল বাংলা মেনু কার্ড বা তার নিজের ভাষায় 'ক্রমনি।' বিলেতি ধরনের রাজকীয় ভোজে মেনু কার্ডের ব্যবস্থা আছে। প্রজ্ঞা স্থির করলেন তিনিও নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের জন্য ক্রমনির ব্যবস্থা করবেন। ছাপা ক্রমণি যদি হাতে হাতে বিলি করা না যায় তাহলে সুন্দর করে লিখে খাওয়ার ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলেও চলবে। শুধু নামকরণ করেই প্রজ্ঞা কর্তব্য শেষ করেননি বাংলা ক্রমনি কেমন হবে এক একবারের ভোজে কি কি পদ থাকবে কোন পদের পরে কোনটা আসবে কিংবা কেমন করে লিখলে শিল্প-সম্মত হয়ে উঠবে সেকথাও ভেবেছেন। কয়েকটা প্রমাণ দেখলেই বোঝা যাবে ব্যাপারটা। প্রথমে একটা নিরামিষ ক্রোমনি,
' জাফরানি ভুনি খিচুড়ি
ধুঁধুল পোড়া শিম বরবটি ভাতে
পাকা আম ভাতে
পটলের নোনা মালপোয়া
পাখা কাঁঠালের ভূর্তি ভাজা
কাকরোল ভাজা
ভাত
অড়হর ডালের খাজা
লাউয়ের ডালনা
বেগুন ও বড়ির সুরুয়া
ছোলার ডালের ধোঁকা
বেগুনের দোল্মা
আলুবখরা বা আমচুর দিয়ে মুগের ডাল
পাকা পটলের ঝুরঝুরে অম্বল
ঘোলের কাঁঢ়ি
রামমোহন দোল্মা পোলাও
নীচুর পায়েস
নারিকেলের বরফি। '
যেন একটা আস্ত কবিতা। হঠাৎ চোখে পড়লে সে রকম ভুল হবারই সম্ভাবনা, যদিও নিরামিষ তবু সরস হয়ে ওঠে রসনা। সেকালের ভোজ সভা সম্বন্ধেও একটা ধারণা গড়ে ওঠে। প্রজ্ঞা প্রতিটি রান্না নিজের হাতে রেঁধে তবে সেগুলি খাদ্য তালিকাভুক্ত করতেন। অনেক রান্নার আবিষ্কর্তী তিনি নিজেই। মাঝে মাঝে সেগুলোর সঙ্গে যোগ করে দিতেন প্রিয়জনের নাম। যেমন, 'রামমোহন দোল্মা পোলাও', 'দ্বারকানাথ ফির্ণী পোলাও', 'সুরভী পায়েস' তার অকাল মৃতা মেয়ের নামে। রবীন্দ্রনাথের ৫০ তম জন্মদিনে ফুলকপি, খোওয়া ক্ষীর, বাদাম, কিসমিস জাফরানপাতা, সোনা রুপোর তবক দিয়ে বরফি তৈরি করে নাম দিয়েছিলেন 'কবি সংবর্ধনা বরফি।' কেউ খেয়ে বুঝতে পারেনি সেটা ফুলকপি দিয়ে তৈরি।
আবার অনেক রকম উদ্ভট ও নতুন ব্যঞ্জন আছে। খেজুরের পোলাও, লঙ্কাপাতার চচ্চড়ি, রসগোল্লার অম্বল, বিটের হিঙ্গি, তেতুলের সরস্বতী অম্বল, আমলকি ভাতে, পেঁয়াজের পরমান্ন, কইমাছের পাততোলা, কাঁকড়ার খোলা পিঠে, মাংসের বোম্বাইকারী, আরও কত কি! ক্লাসে ওঠার মতো রান্না শেখারও ক্লাস আছে। 'হিঙ্গি করতে শিখিলেই বুঝিতে পারিবে ইহা যেন ঠিক ডালনার এক ধাপ উপরে উঠিয়াছে অথচ কালিয়াতে উঠিতে পারে নাই।' আরো দু একটা ক্রমনী দেখা যাক। আমিষ ক্রমনীর আকার খুব বড় নয়। যেমন,
' এম্পারোগাস স্যান্ডুইচ
শসার স্যান্ডুইচ
মাংসের স্যান্ডুইচ
মাছের স্যান্ডুইচ
পাউন্ড কেক
স্পঞ্জ কেক
বিস্কুট
সিংয়াড়া
ডালমোট
ঝুরিভাজা
আইসক্রিম।'
আরেকটি আমিষ ক্রমণি দেওয়া হল,
' পাতলা পাউরুটির ক্রুটোঁ
জারক নেবু
বাদামের সুপ
ভেটকি মাছের মেওনিজ
মুরগীর হাড়ি কাবাব
মটনের গ্রেভি কাটলেট
শবজি ও বিলেতি বেগুনের স্যালাড
স্নাইপ রোস্ট
আলুর সিপেট
উপস আলানিজ
ডেজার্ট
কফি।'
সে তুলনায় নিরামিষ ক্রমনীর আকার বেশ বড়। আর গৃহিণীর কৃতিত্বও যেন বেশি,
' ভাত
আলুপোড়া, দুধ দিয়ে বেগুন ভর্তা, মুলা সিদ্ধ, আনারস ভাজা
মোচা দিয়া আলুর চপ
মুগের ফাঁপড়া
ডুমুরের ছেঁচকি
মোচা ছেঁচকি
কুমড়া দিয়া মুগের ডালের ঘন্ট
পালম শাকের ঘন্ট
উচ্ছা দিয়া মসুর ডাল
ওলার ডালনা
ঢ্যাঁড়সের ঝোল
ছানার ফুপু পোলাও
নিরামিষ ডিমের বড়ার কারী
করলার দোল্মা আচার
আলুর দমপোক্ত
কচি কাঁচা তেতুলের ফটকিরি ঝোল
নারিকেলের অম্বল
পাকৌড়ী
খইয়ের পরমান্ন
কমলী।'
আজকাল খুব বড় ভোজসভাতেও পদের সংখ্যা এত বেশি হয় না। নিরামিষ ভোজসভা তো আজকের দিনে অচল। যতরকম তরকারি, পিঠে, পায়েস থালার পাশে সাজিয়ে দেওয়া যেত ততই সুগৃহিণীর দক্ষতা প্রমাণিত হত। বাঙালি জীবনের শান্তনিরোধ স্বচ্ছলতার প্রতিক এইসব ভোজসভা। বাঙালি কোনদিনওই ভোজনবীর ছিলনা। ছিল ভোজন রসিক।তাদের শিল্পবোধ স্থায়ী জিনিসগুলোকে ছাড়িয়ে অস্থায়ী তাৎক্ষণিকতার মধ্যেও রসের সন্ধান করেছে। আর বাঙালি মেয়েরা রান্নাঘর কে করে তুলেছে শিল্পমন্দির। প্রজ্ঞা যেসব রান্নার কথা বলেছেন এত না হলেও অধিকাংশের সঙ্গেই তখনকার গৃহিণীরা পরিচিত ছিলেন এবং নিজেরাও রাধঁতেন তবে তারা কেউ সে সব পাক প্রণালী প্রজ্ঞার মত লিখে অন্যের রান্না শেখার পথ সুগম করে জাননি। এক একটি বড় ক্রমাণীতে ফুটে উঠেছে প্রজ্ঞার শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যরুচি,
' কলাইশুঁটি দিয়া ফেনসা খিচুড়ি
পলতার ফুলুড়ি
বেশন দিয়া ফুলকপি ভাজা
কাঁচা কলাইশুঁটির ফুলুড়ি
পেঁয়াজ কলি ভাজা
ভাত
ছোলার ডালের দুধে মালাইকারী
বাঁধাকপির ছেঁচকি
তেওড়া শাকের চচ্চড়ি
কচি মুলার ঘন্ট
লাল শাকের ঘন্ট
বাঁধাকপির ঘন্ট
গাছ ছোলার ডালনা
মটর ডালের ধোঁকা
কমলানেবুর কালিয়া
ওলকপির কারী
পেঁয়াজের দোল্মা আচার
ফুলকপির দমপোক্ত
বেগুন দিয়া কাঁচা কুলের অম্বল
আনারসী মালাই পোলাও
ফুলিয়া। '
কিন্তু সবসময়ই কি এত বড় মাপের আয়োজন হত ? ছোটখাটো ক্রমণীও আছে। এখনকার তুলনায় সে খুব ছোট নয়,
' ডিম দিয়া মুলুকতানী সূপ
ভাত
আলু ফ্রেঞ্চ স্টু
চঁওচঁও, বড় রুইমাছের ফ্রাই
মাংসের হুশনী কারী
পোলাও
ফ্রুট স্যালাড
ফল ।'
কিংবা
' অলিভ রুটি
নারিকেলের সূপ
ধূম পক্ক ইলিশ
মুরগী বয়েল, হ্যাম।
মটনের কলার
ঠান্ডা জেলী ও ব্লাঁমজ
নারিকেল টফি
আদার মোরব্বা
কফি। '
আর নিরামিষ
' ভাত
মাখন মারা ঘি
নেবু , নুন
নিমে শিমে ছেঁচকি
ছোলার ডাল ভাত
বেগুন দিয়া শুলফা শাক ভাজি
ছোলার ডালের কারী
কুমড়ো এঁতোর ফুলুরি
পুনকো শাকের শশশরি
ভর্তাপুরী
পালম শাকের চচ্চড়ি
থোড়ের ঘন্ট
তিলে খিচুড়ি
ছানার ডালনা
পাকা শসার কারী
পটলের দোল্মা
তিল বাটা দিয়ে কচি আমড়ার অম্বল
পাকা পেঁপের অম্বল
লক্ষ্মৌ কড়ুই
কাঁচা আমের পায়স।'
এই ক্রমণী দেখে বোঝা যায় ভোজসভায় ফরাসি কায়দায় নির্বাচনের সুযোগ সবসময়ই ছিল না হলে এত ব্যঞ্জন এবং একই সঙ্গে ভাত খিচুড়ি ও পোলাওয়ের ব্যবস্থা থাকত না। খাওয়ার পরেই আসে পান এবং মসলার কথা। প্রজ্ঞা বারো রকম পান সাজার কথা বলেছেন। তার মধ্যে 'মিঠা পান পোলাও' তার নিজস্ব আবিষ্কার বলে লিখেছেন, ' সুহৃদসমিতিতে যখন খাওয়াইয়াছিলাম ইহার নাম এই নামে অভিহিত করিয়াছিলাম।' এছাড়াও জানিয়েছেন নানারকম চুন খয়ের মসলা তৈরির গোপন কথা। প্রজ্ঞার রান্নার বই দুটি আমাদের মনে যে কৌতূহল জাগায় সেটি হল ভাইজির এই রন্ধননৈপুণ্যে রবীন্দ্রনাথ কত খুশি হয়েছিলেন! 'কবি সংবর্ধনা' বরফি দেখে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন। রান্না এবং নতুন খাদ্যদ্রব্য সম্বন্ধে তার উৎসাহ তো কম ছিল না। বহু মহিলাই তাদের স্মৃতি কথায় এ কথা বলেছেন। কবি তাদের কাছে কখনো প্রজ্ঞার রান্নার গল্প করেননি, যদিও তাঁর গ্রন্থাগারে প্রজ্ঞা সুন্দরীর 'আমিষ ও নিরামিষ আহার' বইগুলি ছিল। মাধুরীলতা এই বই বাবার কাছে চেয়ে পাঠালে তিনি সুবোধচন্দ্র মজুমদারকে লেখেন, 'বেলা প্রজ্ঞার আমিষ আহারের (দ্বিতীয় খন্ড) চেয়ে পাঠিয়েছে। সেটা আমাদের লাইব্রেরীতে আছে। খোঁজ করে নিশ্চয় তাকে পাঠিয়ে দিও।' প্রজ্ঞার 'ক্রমণী' আবিষ্কাররে কাকার উৎসাহ ছিল কিনা তাও জানা গেল না। রুটিতোষ শব্দটি তিনি ব্যবহার করতেন। সেঁকা পাঁউরুটিকে তিনিই এই নামটি দিয়েছিলেন, না , প্রজ্ঞার নামটিকে সন্সেহে ব্যবহার করেছেন, সে কৌতূহলো রয়ে গেল।
' গন্ধে অর্ধভোজন' এই প্রাচীন প্রবাদ বাক্যটি যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী পাঠককূলের উদর হয়তো এতক্ষণে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। পরিশেষে দাঁড়িয়ে এইটুকুই বলতে পারি রাবীন্দ্রিকতার চক্রব্যূহে আবদ্ধ থেকেই রবির মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির পঙ্কিল বাতাবরণ যেই বাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সেই বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের উদরপূরণের নিমিত্তে তৈরি নিত্যনতুন পাকদ্রব্যের উৎপত্তির পটভূমি ও উৎপত্তিকার কে পরিচয় করিয়ে দিলাম আপামর রবীন্দ্র অনুরাগী পাঠক কুলের সঙ্গে কিছুটা ব্যতিক্রমী প্রয়াসে।
তথ্যসূত্র:
১. নিরামিষ ও আমিষ আহার, প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী ( প্রথম খন্ড)
২. নিরামিষ ও আমিষ আহার, প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী
( দ্বিতীয় খন্ড)
৩. নিরামিষ ও আমিষ আহার, প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী
( তৃতীয় খন্ড)
৪. ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব
৫. Culinary culture in colonial India, Utsa Roy
৬. Aestheticizing labour: An affective discourse of cooking in colonial Bengal, Utsa Roy
৭. Cooking with pragyasundari : A women of the Tagore household tells you how to make 'bhapa ilish.'
৮. Women of the Tagore household : Chitra Deb
বাইশে শ্রাবণ এক মহামানবের মহাপ্রস্থান ঘটেছিল
বটু কৃষ্ণ হালদার
একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারত বর্ষ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও ভাষাভাষী র দেশ। সেইসঙ্গে ভিন্ন সংস্কৃতির দেশ। ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সীমানা বুঝিয়ে দেয় ভাষা সংস্কৃতির বহুত্ব ভৌগোলিক সীমাকে পরোয়া করে নাসম্প্রদায় কেন্দ্রিক ধর্মকে। বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সীমায় হিন্দু,ইসলামবৌদ্ধ খ্রিস্টান ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ বসবাস করে। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য আলাদা আলাদা দেবদেবী। কারো সাকার কারো আবার নির্বিকার। যেখানে সমগ্র ভারতবর্ষ আপন আপন ধর্মের অহংকারে বলিয়ান হয়ে উঠছে সেখানে বলার অপেক্ষা রাখে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব সময়ই মানব ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মানুষের সভ্যতা সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতি ধর্মতত্ত্ব সবকিছুকে তিনি সত্যের আদর্শে বিচার করার কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন আমাদের একটাই দেশ তা হল বিশ্ব। একটাই জাতি তা হল মানব জাতি আর একটাই ভাষা তা হল মানব ভাষা।একটাই ধর্ম তা হল মানব ধর্ম। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্ন সবার সম্মুখে আসে তা হল:_তবে পৃথিবীতে কেন ভাষার জন্য ক্ষমতার জন্য ধর্মের জন্য এত হানাহানি?এত রক্তপাত? এই কথার উত্তর খুঁজতে গিয়ে যা প্রথমে আসে তা হল ভারতের প্রধান দুটি সমস্যা হল ভাষাগত এবং ধর্মগত। আমরা কখনোই ভাবতে পারিনা যে মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা আমাদের ভাষা কখনোই ভাবতে পারি না যে নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য মানুষের ধর্ম ও আমাদের ধর্ম। আমাদের মূলে রয়েছে সমতার অভাব সমস্যার সমাধানের প্রতি অনিহা। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেছেন সকল মানুষের উপলব্ধি সমান নয় মানুষের মনের বিকৃতি কাজ করছে রক্তপাত হানাহানির মূলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে ভারতের ভৌগোলিক সীমানা হল সমতল। অসামঞ্জস্য ভেদাভেদের কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। তাই সকল ধর্মের কথা মাথায় রেখে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপন করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। একথা হয়তো অনেকেই জানি তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ গিয়েছিলেন এবং সেটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় বার ইউরোপ ভ্রমণ। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি একটি সভা ডেকেছিলেন। সেই সবার সভাপতি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল গুরুদেবের আসল উদ্দেশ্য র কথা সম্মু খে এনেছিলেন। বিশ্বভারত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ে ঠাকুরের ভাবনাটা ছিল ঠিক এইরকম:_"বিশ্বভারতীর আক্ষরিক অর্থের দ্বারা আমরা বুঝি যে "ভারতী" একদিন অলক্ষিত হয়ে কাজ করেছিলেন। আজ তিনি প্রকট হলেন কিন্তু এর মধ্যে আরেকটি ধনী গত অর্থ আছে_বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌঁছবে সেই বিশ্বকে ভারতীয় করে নিয়ে আমাদের রক্তরাগে অনুরঞ্জিত করে ভারতের মহা প্রাণে অনুপ্রাণিত করে আবার সেই প্রাণকে বিশ্বের কাছে উপস্থিত করবো"।
ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় গুরুদেব এই রকম কথা বলতে কোন দর্শনের পৌঁছে গিয়েছিলেন তা কল্পনার অতীত। কারণ তিনি মনে করতেন যে সমগ্র বিশ্ব ভারতের কাজে এসে পৌঁছাবে আর ভারত থেকে প্রাণ বায়ু নেবে।অনুরঞ্জিত ভারতের শুদ্ধ বায়ু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে বিশ্বভারতী পরিচালনা করেছিলেন। তিনি হিন্দু সংহিতার বিরোধিতা করে বিশ্বভারতীতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের বিদ্যা চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। তিনি ধর্মীয় ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করেন মনুষ্যত্বের মধ্যে।
"মনুষ্যত্ব" প্রবন্ধের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক একই রকম করে মানুষের আত্মসৃজনের ব্যাখ্যা করেছেন। তবে অনেকেই বলেছেন বেদের অনগমনই হল ধর্ম। তবে এই কথা যদি সত্যি হয় নিশ্চিত রূপে ইসলাম,খ্রিস্টান,বৌদ্ধ,জৈন এরা কোনটাই ধর্মের সংজ্ঞায় পড়ে না।কিন্তু সমগ্র বিশ্বের মানুষ জানে এগুলোই প্রকৃত ধর্ম। এইসব ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যাও পৃথিবীতে বহু আছে। আসলে পৃথিবী বেশিরভাগ মানুষই ধর্মের সঙ্গে রিলিজিয়নকে একাকার করেছেন।"আমাদের ধর্ম রিলিজিয়ন নহে",রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "ধর্মপ্রচার" প্রবন্ধে দীপ্ত কণ্ঠে এ কথা ঘোষণা করেছেন।তাঁর মতে ধর্ম হলো মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্বেচ্ছাচারিতার কোন জায়গা নেই ধর্মের মধ্যে।ধর্ম আনন্দের সঙ্গে যুক্ত অনুভূতি।নিভৃত সাধনার মধ্য দিয়ে ধর্ম সার্থকতা লাভ করে।আর রিলিজিয়নের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা আস্থার সমষ্টি যা কিনা বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে অসহিষ্ণুতার ইতিহাস গড়ে তোলে। সেহেতু আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না পৃথিবীতে আজ মানুষের যে বিরোধ হানাহানি যুদ্ধ তা শুধু রিলিজিয়নের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। ধর্মের মহৎ উদ্দেশ্য না বুঝতে পারার কারণে ধর্ম গভীর সংকটের মধ্যে পড়ছে। বৃহৎ অর্থে না দেখে ধর্মকে দেখানো হয়েছে সংকীর্ণ অর্থে রিলিজিয়নের সঙ্গে এক করে। গুরুদেব কখনোই ওই সংকীর্ণ অর্থকে ধর্ম হিসেবে দেখেননি। তিনি বুঝিয়েছিলেন ধর্ম হলো ঐহ্যিক ও পারমার্থিক প্রাপ্তির মাধ্যম।
তবে এক্ষেত্রে বলতে বাধা নেই রবীন্দ্রনাথের পূর্বেই রামমোহন রায় প্রথম রিলিজিয়নের সঙ্গে ধর্মের পার্থক্য সূচনা করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথ সেই ধারণাকে আরো পূর্ণতার রূপ দেন। তবে শুধু রামমোহন রায় নয়,রবীন্দ্রনাথের মনে ধর্ম বোধ জাগাতে বাংলার মহান মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,অক্ষয় কুমার দত্ত,বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব স্পষ্ট। সত্যেন্দ্রনাথ রায় তাঁর ধর্মচিন্তা রবীন্দ্র রচনার সংকলন গ্রন্থের ভূমিকায় জানিয়েছেন যে:_"রামমোহনের স্বাধীন বুদ্ধি,নব্যবঙ্গের তরুণদের প্রখর যুক্তি,উদ্ধত অবিশ্বাস, বিদ্যাসাগর,অক্ষয় কুমার দত্তের মুক্ত বুদ্ধি, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ অনুভূতি,বঙ্কিমচন্দ্রের যুক্তিবাদ,দেশী ধ্রুববাদ, বিজ্ঞান মুখিতা_ এই শতসমুদ্র ধারার পরিমণ্ডলের রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তার উন্মেষ"।
রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্মের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব হল ঔপনিষদ ভিত্তিক।এই সাধনাতেই তিনি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যা সম্প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৃতীয় পর্বের রয়েছে ব্রহ্ম ভাবনা উপলব্ধির বিষয়।যার ফলে তিনি লিখলেন "শান্তিনিকেতন" গ্রন্থ। চতুর্থ পর্বে রয়েছে মগ্নতা। এখানেই তার ধর্ম ভাবনায় যুক্ত হয়েছে বহির্বিশ্ব। এই পর্বে তিনি অনুভব করেছেন বাইরের কোন কিছুর মধ্যে মনের মানুষ নেই। যা আছে নিজে নিজে অন্তরে।অর্থাৎ মন্দির, মসজিদ, গির্জা নয় মনের মানুষের অবস্থান মনে। বলা যায় এখান থেকেই তিনি ধর্মবোধে যাবার চূড়ান্ত পথ খুঁজে পেয়েছিলেন।"গীতাঞ্জলি"র গান তো তিনি এই পর্বে লিখেছিলেন। নোবেল পাওয়ার সময় থেকেই রবীন্দ্র মরণে বিশ্ববোধের সমন্বয় হয়েছিল। আর পঞ্চম পর্বের দেখা গেল মানব ধর্মের (দা রিলিজিয়ন অফ ম্যান) কথা। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যে হীবার্ট বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার থেকেই এই ভাবনার সূচনা হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন। ষষ্ঠ ও শেষ পর্বের কথা হল মানব ধর্মের সাধনা।হিন্দু,ইসলাম,বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান নয় মানুষের ধর্ম হলো মানব ধর্ম যা এক কথায় শুভ কল্যাণকর মঙ্গলময়। একদিকে মানুষ অন্যদিকে মানুষের ধর্ম, একটি ছাড়া অন্যটির কোন অস্তিত্ব নেই। নিঃশ্বাস ছাড়া মানব দেহ যেমন অস্তিত্বহীন জল ছাড়া মাছ যেমন অচল তিনি সেই বাণী শুনিয়ে গেছেন। এই পর্বে অনেক আগেই আত্মপরিচয় গ্রন্থে তিনি স্পষ্ট বলেছেন_"মানুষের আর একটি প্রাণ আছে,সেটা শরীর প্রাণের চেয়ে বড়। এই প্রাণের ভেতরকার সৃজনী শক্তি হচ্ছে তাঁর ধর্ম। মানুষের ধর্মটি হচ্ছে তার অন্তরতম সত্য"।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসীম সসীমের মিলনক্ষেত্র। পার্থিব ইহা জগতের অন্যতম মহামানব।যিনি বিশ্বকবি রবি ঠাকুর নামে পরিচিত হয়েছিলেন আছেন এবং আগামী ভবিষ্যতেও থাকবেন।
এই ধর্মচিন্তার বিবরণীতে প্রশ্ন জাগতেই পারে রবি ঠাকুরের মনে কে বা কারা এই ধর্মের সূচনা করেছিলেন?উত্তরে বলা যায় অবশ্যই বিদেশি মানবতাবাদ কাজ করেছিল। কারণ তিনি কোনখানে মহর্ষি,শ্রীরামকৃষ্ণ বা শ্রী অরবিন্দের মত সাধক ছিলেন না।তাঁদের ধর্ম বোধ রবীন্দ্রনাথকে নাড়া দেয়নি। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না তাঁর ধর্ম জুড়ে ছিল হৃদয় অনুভূতি উপলব্ধি ইত্যাদি। এই বিশ্বাস তাঁকে মানবক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করিয়েছিল। ফলস্বরূপ তিনি পেয়েছিলেন অখন্ড চেতনা অনুসন্ধান করার এক অমোঘ শক্তি।তাছাড়াও রাজারামমোহন রায়ের মানবককেন্দ্রিক দর্শন রবীন্দ্র মানুষের যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল তৎকালীন সময়ে।রামমোহনই তো সর্বপ্রথম গতানুগতিক ধারণাতে নাড়া দিয়েছিলেন।কুসংস্কার ময় অন্ধকার জগত থেকে মানুষকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন।থেমে যাওয়া নয় এগিয়ে চলার মধ্যেই রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততা। তাইতো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:_যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে/যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়/পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকচার"।
বাইশে শ্রাবণ সমগ্র ভারতবর্ষের নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। শুধু ভারতবর্ষে বলা হয় তো ভুল হবে।সমগ্র বিশ্ববাসীর হৃদ স্পন্দন সেদিন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কারণ জাগতিক নিয়ম অনুসারে মৃত্যু নাম ক সত্যবাদের কাছে ধরা দিয়েছিল নশ্বর দেহটা। বাইশে শ্রাবণ বেলা বারোটা বেজে দশ মিনিটে বিদায় ঘন্টা বেজে উঠেছিল কলকাতার বিশ্ব বিখ্যাত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে।ছন্দপতন ঘটেছিল মহা ধুমকেতর। সবার প্রিয় গুরুদেব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমৃত লোকে পাড়ি দিয়েছিলেন ইহা লোকের মায়া ত্যাগ করে।সেই সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা সাহিত্য অভিভাবকহারা হয়েছিলেন।তাই ক্যালেন্ডারে বাইশে শ্রাবণ শুধু মাত্র একটা দিবস হলেও সমগ্র ভারত বর্ষ তথা বিশ্বের কাছে এই দিনটা অত্যন্ত দুঃখের।ওই দিনে এক মহামানবের মহাপ্রস্থান ঘটেছিল। যা মেনে নেওয়া আর বুকের উপর পাথর চাপিয়ে রাখা দুটোই সমান। কিন্তু সময় তো সময়ের পথ ধরে চলবে।আর মৃত্যু হল চিরন্তন সত্য যাকে উপেক্ষা করার মত সাহস কারও নেই।
বাঙালির প্রাণের কবি নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও অসামান্য রচনা ও কাজের মধ্যে আজো বেঁচে আছেন তিনি প্রেরণা-দাতা হয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী সৃজনশীলতা বাংলা সাহিত্য ও শিল্পের প্রায় সব কটি শাখাকে স্পর্শ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। তার লেখা গান বাঙালির হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয় আজো। আনন্দে, বেদনায় এমনকি দ্রোহে এখনও রবীন্দ্রনাথ বাঙালির প্রেরণার উৎস। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মন-মানসিকতা গঠনের, চেতনার উন্মেষের প্রধান অবলম্বন। তিনি কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় নন্দিত। ঊন-বিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে পৌঁছে দিয়েছে।তাই তাঁকে নিয়ে অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও গবেষণা চলতে থাকবে এটাই চরম সত্য। কারণ তিনি শুধু বাহ্যিক রবি নন তিনি তো অন্তরের।
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইবো না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে-গো’— কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ের চিহ্ন না রইলেও তার রচনায় ভর করে খেয়াতরী বাওয়া ছাড়েননি কবি।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে নজরুলের বিষণ্ণ গলার গান শুনিয়েছিলে—"‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’, মনে পড়ে তাঁর অজস্র কবিতার বিনম্র পঙক্তিমালা"।
‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত-পথের কোলে
শ্রাবণের মেঘ ছুটে’ এল দলে দলে
উদাস গগন-তলে,
বিশ্বের রবি, ভারতের কবি;
শ্যাম বাঙ্লার হৃদয়ের ছবি
তুমি চলে যাবে বলে।’
নজরুল মনে করেন, ধরিত্রী মাতার কান্না শুনেই যেন রোগের ছলনা করে রবীন্দ্রনাথ আঁখি মুদে তাঁর কাছে চলে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্য বাংলার সর্বত্র ব্যথা জেগে উঠেছে। বাংলার সাগর, নদী, অরণ্য, সব তাঁর জন্য কাঁদছে। রবীন্দ্রনাথের লেখনী ধারণ করেছিলেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী, ধ্যানের আসনে ছিলেন শিব, হৃদয়ে ছিলেন প্রেমের দেবতা মদন। যে আনন্দময়ী রবীন্দ্রনাথের সাথে নিত্য কথা বলতেন, তিনি বা তাঁদের কেউ বঞ্চিত মানুষের ব্যথা বুঝলেন না। অথচ তাঁদের কৃপার দান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলার আশা-প্রদীপ, চির অম্লান, চির উজ্জ্বল। নজরুলের প্রশ্ন, কেমন করে তাঁরা তাঁদের কৃপার দানকে দিয়ে আবার নিয়ে গেলেন। নজরুল রবীন্দ্রনাথের গর্বে গর্বিত ছিলেন, তাই পৃথিবীকে মৃৎপাত্রের ঢাকনা বা সরার মতো তুচ্ছ মনে করতেন, ক্লৈব্য-দীনতা-ক্ষুধা-জরা সব ভুলে থাকতেন। মাথার ওপরে সূর্যরশ্মির মতো রবীন্দ্রনাথ নিত্য জ্বলতেন। রবীন্দ্রনাথের গর্বে নজরুল ও অন্যরা এমনই গর্বিত ছিলেন যে, তাঁরা যে ভাগ্যাহত তা কখনো ভাবতেই পারেননি।
তাইতো আবার যেন নতুন করে প্রাণ খুলে বলতে ইছে করে:_আজ বাইশে শ্রাবণ/মানে না তো মন/ঝিরিঝিরি বারিধারার সাথে তুমি ফিরে এসো/স্পর্শ করো আমার প্রানের দুয়ারে"।
বাইশে শ্রাবন
বেলা দে
শ্রাবণধারার নির্মম ক্রূর হাসির মধ্যেই মিশে আছে এক চরম বিষাদের ছায়া, ২২শের শ্রাবণ দিনে এক
আলোকিত জীবনকে হারিয়ে ফেলার ব্যথা, যেন মহাবিশ্বের মহাকাশ হতে চিরতরে হারিয়ে গেছে বিরাটকায় এক আলোর জ্যোতি শব্দের গতি। সে জ্যোতি বন্ধ করা যায়নি তার জীবনকাল অব্দি। মৃত্যুশয্যাও থামাতে পারেনি সেই গতি।জীবের ডগায় আটকে থাকা শব্দতরঙ্গ গন্ডুষ ভরে পান করে গেছেন ঈশ্বরের আশির্বাদ ধন্য প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ। সমগ্র বিশ্ব তথা বাংলাকে করেগেছেন ঋণী। তিনি শুধু ক্ষুরধার কবিই নন শিল্পী গায়ক, নাট্যকারও ছিলেন। গ্রাম থেকে গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছেন গল্প, কাব্যসৃষ্টির সন্ধানে। সীমা ও অসীমে মেলাতে চেয়েছিলেন বহুবার ব্যর্থতাও পেয়েছেন। ছুটে গিয়েছেন শিলাইদহে, পদ্মাপাড়ে গঙ্গায় ভেসে ভেসে বোট লাগিয়েছেন গ্রামের ঘাটেঘাটে সেখানে খোলা আকাশ ভোরের বাতাস চন্দ্রালোকিত সন্ধ্যা আর গ্রাম্যজীবনগুলি আকৃষ্ট করেছে তাকে। এমনই এক ঘাটের নাম "গোপাল শা", সেখানে বোট লাগিয়ে দেখতে পান লম্বাচওড়া পুরুষালি চেহারার এক অনমনীয় গ্রাম্যবালাকে ঘিরে প্রতিবেশীরা কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছে হয়তো বা শ্বশুরঘরে ফিরে যাবার। সে রাতেই কোঠাবাড়িতে বসে রচনা করেন সমাপ্তি গল্পের মৃন্ময়ী চরিত্র।
জমিদারি অহংকার লঙ্ঘন করে চোখ মেলে দেখেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, উদাস প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে পেয়েছেন তার গল্পের চরিত্র, অতিথির তারাপদকে আটকে রাখতে পারেনি তার ঘর। ছুটি গল্পের দুরন্ত ফটিককে অসীমের প্রবল আকর্ষণ টেনে নিয়ে গেছে গ্রাম থেকে গ্রাম, মামাবাড়ি কলকাতায় গিয়ে মানিয়ে নিতে না পেরে প্রাণ চলে গেল উড়ুক্কু বালকের। শিলাইদহের বাড়িতে বসে তার সোনার তরী রচনা। পদ্মার ঢেউ থেকে শুরু জীবন দর্শন। নৌকার মাঝি কে দেখেন মহাকালের প্রতীক আর বাঁকা জল কালের স্রোত, গভীর জীবন দর্শন ব্যাখ্যা করে ফেলেন সেই রাতেই। অসীম নারী চরিত্র সীমায় বেঁধে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন শুধু। তাই শেষের কবিতার লাবণ্য আর অমিত র প্রেম সার্থকতা পায়নি। বিবাহ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারেনি। কেতকীর সাথে সাক্ষাতের পরে তাকে বেঁধে নিয়েছে সাংসারিক সীমায়, লাবণ্য তার চোখে ছিল অসীম। সেই অসীমকে ভালবেসেছেন তিনি। শেষাংশে লাবন্যর সাথে শোভনলালের বিয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলে লাবণ্য একটা চিঠি লিখেছে অমিতকে -
হে নিরুপম
"তোমায় যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান,
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।"
জীবনে একটা সময় এসে তিনি বুঝতে পারলেন
সীমার গন্ডীতে হারিয়ে যায় অসীম, এবার মানুষকে
দেখলেন সীমার মধ্যে।
বাইশে শ্রাবণ একটি স্বজনের বিয়োগব্যথার নামদেবযানী ভট্টাচার্য
সম্পর্করা যখন দিশাহীন, ভাসমান,পতনোন্মুখ, অস্থায়ী ,দোদুল্যমান,তখনই গভীর অনুভবের আলোয় উদ্ভাসিত স্বতন্ত্র চিরকালীন নির্ভরতার নাম।
আহ বাইশে শ্রাবণ !হে পথপ্রদর্শক, হে চিরসখা, তবুও বাইশে শ্রাবণ ! একটি স্বজনের বিয়োগ ব্যথার নাম।
আত্ম আবিষ্কারের মুহূর্তে, দ্বিধা - দ্বন্দ্বের যন্ত্রণায়,মিলনান্তে - বিরহান্তে ,
উপেক্ষার তীব্র শাশাঘাতে , ভালোবাসা - বিষাদে,
খুঁজেছি যখনই আশ্রয় ,
নিমজ্জিত করেছি হৃদয় তোমার সৃজনে।
আহ বাইশে শ্রাবণ ! হে প্রণম্য কবি, হে চিরনতুন, তবুও বাইশে শ্রাবণ ! আজও একটি স্বজনের বিয়োগ ব্যথার নাম।
শেষ খেয়ার ঘন্টা লীনা রায়
সময় সে তো মরীচিকা
হাতছানিতে নিশির ডাক,
পাড়ের টানেই বাইছে তরী
মিথ্যে স্বপন তফাৎ যাক।
পাওনা গন্ডা বুঝিয়ে দিয়ে
ফেরির মাঝি নৌকা ভেরাও ,
পাড়ের নাগাল হাতের মুঠোয়
এক এক পল মিথ্যে দাঁড়াও।
গুনছো শুধু পাড়ের কড়ি
চেনা অচেনার ভীড়ের মাঝে,
খুচরো গুনেই হিসাব মেলাও
শেষ খেয়ার ওই ঘন্টা বাজে।
শ্রাবণ তুমি
শ্রাবণী সেন
শ্রাবণ তুমি ভালোবাসায় ভরা
মায়ায় গড়া তোমার হৃদয় খানি
কৃষ্ণ মেঘের ছায়ায় ঢাকা মন
সব কী জানি! চিনি একটু খানি!
শ্রাবণ তোমার সবুজ জীবন জুড়ে
সবুজ পাতায় লেখ জীবন গাথা
অঝোর ঝরে বৃষ্টিধারা শুধু
জল আখরে লেখ মনের কথা।
শ্রাবণ তোমার বৃষ্টি ভেজা ফুলে
মধুর আবেশ ছড়ায় অনুভবে
কদমফুলের ছড়িয়ে পড়া রেণু
অঞ্জলিতে ভরেই নিলাম তবে।
এই শ্রাবণে
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
একটা গানের কলি যেন ভাসিয়ে দিল এই শ্রাবণে
বৃষ্টিঝরা শ্রাবণ প্রাতেও হাসেন রবি দূর গগনে।
সকল মনের কান্না হাসি পদ্য ছড়া গল্প গাথা
সহজ পাঠের মধুর স্মৃতি গীতবিতান আর সঞ্চয়িতা।
বর্ষা এলেই অঝোর ধারায় শ্রাবণ কাঁদে অন্তরেতে
ফুলগুলো সব নুইয়ে পড়ে বর্ষাস্নাত ভোরবেলাতে।
এই শ্রাবণেই ভাঙলো যে ঘুম গান শোনালো ভোরের পাখি
মাঝ গগনে চোখ মেলে চাই
দেখতে যে পাই তোমার আঁখি।
মিলনমালা
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
সেদিনও এক বাইশে শ্রাবণ
ঘন বাদল ধারা
মনের ভিতর উথাল পাথাল
শোকস্তব্ধ ধরা।
স্বর্ন চাঁপার কোলের পরে
শুয়ে আছেন মা
ভোরের আঁচল উঠছে ভরে
স্বর্ণচাঁপার ফুলের ভারে
দেখছেনা মা চোখটি মেলে।
রবি ঠাকুর তুমিও এমন
প্রানের পরে সকল ফেলে
মায়ার বাঁধন ধূলোর পরে
সাথী করে বাইশে শ্রাবণ
বক পাতিটির ডানায় উড়ে
পাড়ি দিলে কোন সুদূরে।
মিলেমিশে এক হল দুই
বিদায়বেলার মিলনমালা।
গল্পে গানে তোমার পানে
ধেয়ে যাওয়া ভালবাসা
শিখেছিলাম যাঁর সমীপে
সেও তোমার যাবার দিনে
মিটিয়ে দিল সকল চাওয়া।
আমি খুঁজি সেই প্রাণের ঠাকুরকে রীনা মজুমদার
ঈশ্বর বা ধর্মের নামে মানুষকে
অবহেলা না করার কথা বলেছেন যিনি
খুঁজি তাঁকে....
উৎপীড়িত, মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত
অর্ধমৃত সমাজের নারী এই আমি
নিঃস্ব হাতে খুঁজি
প্রতিবাদী মানুষটিকে
খুঁজে বেড়াই 'পল্লীপ্রকৃতি' 'চিত্রা' 'চৈতালি'তে
'মানসী' 'সোনারতরী'
'ঘরে বাইরে'তে
গোরা উপন্যাসের 'আনন্দময়ী'
'চতুরঙ্গে'র 'জ্যাঠামশাই'
খুঁজি সেই বলিষ্ঠ প্রতিবাদী মুখ..
আজ বাইশে শ্রাবনে আকাশ কাঁদে
অশ্রু জলে সাজাই পুষ্পার্ঘ্য, অন্তর খোঁজে
ন্যায়-অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সচেতন
সেই ব্যাতিক্রমী মহান মানুষটিকে,
যাঁর লেখনীতে উঠেছে মানুষের কথা
মানুষের অধিকারের কথা
খুঁজি সেই প্রাণের ঠাকুরকে...
বাইশে এলেই
সুনন্দ মন্ডল
আর নেই বর্ষা
নেই তেমন শ্রাবণ।
শ্রাবণীর প্রেম নেই
প্রতিস্পর্ধাও নেই।
আছে শুধু রবীন্দ্রনাথ
কখানা বইয়ের ভাঁজ
আর গীতবিতান মঞ্জরী
—ফল্গুধারা নদী।
দুপাশে খরা
বন্যার কোনও ঝাঁজ নেই,
নেই কল্লোল!
ব্যস্ত সূর্য ওঠে, ডোবে ব্যস্ততায়।
শুধু বাইশে এলেই
মনে পড়ে
সে এক প্রাণপুরুষ।
মহাপুরুষ ছিল কেও!
শিল্পী- অদ্রিজা বোস
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩০
ভ্রমণ
নির্জন মারারি-র সমুদ্রবেলায় জয়িতা সরকার
সবুজে মোড়া পাহাড়কে যেমন যত্নে সাজিয়েছে, ঠিক তেমন আদরে রয়েছে নীল-সমুদ্র আর বালুকাবেলাও। আরব সাগরের নীলচে ঢেউয়ের শান্ত-মৃদু স্বভাবে এক প্রশান্তি রয়েছে মালাবার উপকূল জুড়ে। তবে পর্যটন তালিকায় কেরালার এক বিশেষ পরিচিতি রয়েছে ব্যাক ওয়াটার-এর জন্য। ব্যাক ওয়াটার বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চেনা এক ছবি 'হাউসবোট', আর হাউসবোট মানেই আলেপ্পি। আমাদের এবারের গন্তব্য সেই আলেপ্পি।
যাত্রাপথটা একটু সংক্ষেপে সেরে রাখি, আলেপ্পির উদ্দ্যেশ্যে আমাদের চলা শুরু হয় মুন্নার থেকে, দু'রাত মুন্নারে কাটিয়ে ভোরবেলায় আমরা বেড়িয়ে পড়ি সমুদ্র সন্মুখে। তার আগে মুন্নার বিখ্যাত গ্যাপ রোডকে গুড-বাই জানাতে উল্টো পথে যেতে হয় আমাদের, আসলে রাস্তার প্রতি যে এমন টান হতে পারে, গ্যাপ রোড তার এক প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমাদের গাড়ি পাহাড় ছাড়িয়ে সমতলের দিকে নামছে, সঙ্গে তাপমাত্রার পারদও চড়ছে। মুন্নার থেকে আলেপ্পির রাস্তা খুব সরু, তাই সময় লেগেছে বেশ খানিকটা। আলেপ্পির ঝলক দেখতে পেলাম প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার আগে থেকেই, গ্রামের ভেতরে ভেতরে ছোট ক্যানেল ঢুকে গিয়েছে, এগুলো সবই ব্যাক-ওয়াটার। পাঁচ জোড়া উৎসুক চোখ এদিক ওদিক করছে।
ব্যাক-ওয়াটার দেখব, কিন্তু আলেপ্পি শহরের ওই ভিড় আমাদের কিছুতেই পছন্দ নয়, বেশ কিছু বছর আগে কেরালার অফবিট জায়গা হিসেবে উঠে এসেছিল এক সমুদ্রতটের নাম, আলেপ্পি শহর থেকে মাত্র 10কিলোমিটার দূরে , নির্জন এক বালুকাবেলাতে রাত্রিযাপনের ইচ্ছে বাস্তব হবে এবার। নীল সমুদ্র, পড়ন্ত বিকেল, নিস্তব্ধতা যার একমাত্র সঙ্গী, সেই মারারি বিচে পৌঁছলাম আমরা। আমাদের দু'রাত্রির ঠিকানা হল মারারি-লা-ভিস্তা। নামটা যতটা গুরুগম্ভীর , মানুষ গুলো ঠিক ততটাই নরম আর আদুরে। আসলে এটা হোটেল নয়, হোম-স্টে। গিন্নির উষ্ণ অভ্যর্থনা প্রথমেই মন কেড়েছে আমাদের। হোম-স্টে-এর গেটে ঢুকতেই এক ঝলক সাক্ষাৎ হয়েছে আরব সুন্দরী নীল সমুদ্রের সঙ্গে।
সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমিষে উধাও হল নীলচে জলের প্রথম স্পর্শে। ঢেউয়ের পর ঢেউ আসছে, তীরে আসতেই ভেঙ্গে যাচ্ছে, ঢেউয়ের এই ভাঙ্গা-গড়ার খেলা আমার খুব প্রিয়। নির্জন এমন এক বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে বিদায় জানালাম সেদিনের সূর্যকে। কেরালার এই নিস্তব্ধ সমুদ্র দর্শন সত্যি অবর্ণনীয়। হাতে গোনা দশ জন লোক হবে, যারা এই পার্থিব সৌন্দর্য উপভোগ করেছে সেদিন, এখনও মানুষের কাছে তেমন পরিচিত হয়নি এই মারারি বিচ। সমুদ্রে এসেছি আর লবণাক্ত না হয়ে ফিরে যাব, এমনটা আবার হয় না কি? বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় জলে বেশ খানিকটা দাপাদাপি করে ফিরে এলাম।
ফ্রেশ হতেই, কেক-চা-পাকোড়া হাজির হল, গল্পে মশগুল আমরা। কিছুক্ষণ পর হোম-স্টে এর কর্তা অভিলাষ এলো, ফোনে কথা হয়েছিল বুকিং সংক্রান্ত বিষয়ে, সামনাসামনি পরিচয় হল সেই সন্ধ্যেতে। অসম্ভব নম্র একজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল আমাদের। গল্পে-কথায় বলে উঠল-' আমরাই জানতাম না, আমাদের ঘরের বিচ এতো সুন্দর, আপনাদের মত কিছু মানুষ আছে যারা এর খোঁজ রেখেছেন, আমাদেরও উপার্জন বেড়েছে।' আগামী কালের একটা প্ল্যান আমাদের মাথায় ছিল, তাও একবার ঝালিয়ে নিলাম ওনার থেকে, স্থানীয় লোকের অভিজ্ঞতা অবশ্যই বেশি। হোম-স্টে হলেও রাতের খাওয়া-দাওয়া আমরা বাইরেই সেরেছি। হোটেল খুবই কম এখানে, প্রায় 500 মিটার হেঁটে যেতে হয়েছিল আমাদের।
সকাল হতেই তৈরি হলাম আমরা, চললাম আলেপ্পির দিকে। আগেরদিন রাতেই আমরা বোট রাইডের জন্য কথা বলে রেখেছিলাম। নির্দিষ্ট জায়গাতে পৌঁছতেই তিনি এসে হাজির, ক্যানেলে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি শিকারা বোট। কেরালা বলতে যেই বোট চোখে ভেসে ওঠে আমরা সেই বোটে চড়ছি না। সেটার ভাড়া খানিকটা বেশি, আর আমরা রাতে বোটে থাকব না, সেটা যেহেতু আগে থেকে ঠিক ছিল, তাই আমরা শিকারা বোটেই ব্যাক-ওয়াটার ভ্রমণ করব। হাউসবোট বুক করতে হলে ওই ক্যানেল ধরে একটু এগিয়ে যেতে হবে, কিংবা আগে থেকে বুকিং করা থাকলে ওই একই পথে গিয়ে বোটে উঠতে হবে। আমরা পাঁচমূর্তি খানিকটা লাফ দিয়েই উঠে পড়লাম শিকারাতে। ক্যানেলে ধরে চলতে শুরু করল শিকারা। কাশ্মীরের শিকারার অনুকরণেই কেরালার এই বোটের প্রচলন।
ক্যানেল ছাড়িয়ে কিছুটা যেতেই, চোখ স্থির, এতো প্রকৃতির বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিভিন্ন আকৃতির হাউসবোট, চারিদিকে অথৈ জল, এমন দৃশ্য যা কোন শব্দেই বর্ণনা করা যায় না। আসলে জলবেষ্টিত আলেপ্পির এক সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার ছিল এই হাউসবোটের। এখন যেন সেসব এক রাজকীয় ব্যাপার। হাউসবোটের যে চেনা ছবি আমাদের চোখে ভাসে, সেগুলো হার মানাবে পাঁচতারা হোটেলকেও। হাউসবোটে রাত্রিযাপনের পরিকল্পনা থাকলে অবশ্যই এই হাউসবোটকেই বেছে নিতে হবে। আর যদি দিনেই ভ্রমণ সারতে চান, তবে শিকারা বেছে নিন, চারিদিক খোলা, মাথার ওপর ছাউনি, বেশ সুসজ্জিত। ক্যানেল থেকে কিছুটা এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ছে দু'ধারে ছোট ছোট জনবসতি। দূরের দিকে তাকালে চোখে পড়ছে ধান ক্ষেত। এক ছবির মত গল্প বলছে বাস্তবের এই জলচিত্র। হঠাৎই চোখে পড়ল স্টপেজ, আরে এটা কি? বুঝতে পারলাম আমাদের বাসের স্টপেজের মত এটা বোট-স্টপেজ। স্থানীয় লোকেদের যাতায়তের জন্য।
হাউসবোট কিংবা শিকারা ছাড়াও রয়েছে মোটরবোট। প্রায় 50-60 জন একসঙ্গে উঠতে পারেন এই বোটে। ঘন্টা হিসেবে ভাড়া হয় এই মোটরবোট। এছাড়া আছে ছোট ক্যানয় বোট, যা স্থানীয় মানুষেরা ব্যবহার করে মাছ ধরা বা জিনিস আনা-নেওয়ার কাজে। পর্যটকদের জন্যও এই বোট চালু আছে।
এবার ফিরি আমাদের শিকারা রাইডে। জলঘেরা মানুষজনের সঙ্গ ছেড়ে আমাদের শিকারা পৌঁছল যেখানে দু' পাশে কূল দেখা যাচ্ছে না। আন্দাজ করছিলাম কোন জলে পড়েছি, তাও একবার জানতে চাইলাম আমাদের সারথির কাছে, জানিয়ে দিলেন হ্যা, আপনি ঠিক বলেছেন এটা ভেম্বানাদ লেক। একটু শিউরে উঠলাম, আসলে ভূগোলের ছাত্রী হওয়ায় শিরায় উপশিরায় গেঁথে রয়েছে প্রকৃতির বিভিন্নতা, তাই কোথাও বেড়াতে গেলে বইয়ের পাতার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার একটা বাড়তি আগ্রহ থাকে। দীর্ঘকায় এই লেক কোট্টায়ামে ভেম্বানাদ নামে পরিচিত তবে আলেপ্পিতে এর পরিচয় পুন্নামাদা লেক হিসেবে। অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে কেরালার বিখ্যাত উৎসব ওনামের সময় কোট্টায়ামেই বসে স্নেক বোট রেসের আসর। লেকের জলে ভাসতেই এসব মনে পড়ছিল বারবার। প্রকৃতি যেন একটু বেশিই যত্নে সাজিয়েছে কেরালাকে। পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল, হ্রদ সবকিছুকে এক সুতোয় গেঁথে উপহার হিসেবে দিয়েছে আমাদেরকে। প্রায় ছ'ঘন্টার শিকারাবিহারে উপরি পাওনা ছিল ব্যাক ওয়াটারের ধারে এক হোটেলে কেরালিয়ান থালির স্বাদ, সঙ্গে পমফ্রেট ভাজা।
শিকারা ভ্রমণ শেষে এবারে আমাদের গন্তব্য আলেপ্পি বিচ। স্থানীয় মানুষজন সপ্তাহান্তে বিচে ভিড় জমান সে ছবি স্পষ্ট। আকাশের মুখ ছিল ভার, তাই সূর্যাস্তের যে চিত্র আলেপ্পিকে আলাদা করেছে আর পাঁচটা বিচ থেকে সেই ছবি অধরাই থেকে গেল। প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা জেটির অবশিষ্টাংশ এ ঢেউয়ের আনাগোনায় আনমনা হতে চাইলেও বারবার বিভ্রাট ঘটালো হকারের হাঁকাহাঁকি আর অযথা মানুষের হুল্লোড়। ভিড়ের জোয়ারে কিছুটা হলেও ভাঁটা পড়েছে আলেপ্পি বিচের নিজস্বতায়। সন্ধ্যে গোড়াতেই আলো জ্বলে উঠেছে বিচের ধারে দোকানগুলিতে, ঝলমল করছে সমুদ্রতট। আমরা ভিড় ছাড়িয়ে ফিরছি নীল নির্জন মারারিকুলম এর দিকে।
(ছবি - কিংশুক সরকার)
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩০
গল্প
পরিবর্তন
চিত্রা পাল
গরমের ছুটিতে হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরেছে কুশল।
কিন্তু ফিরেই সমস্যা। এই ক’দিনের জন্য কোথথেকে এক কড়া অঙ্কের মাস্টার ধরে এনেছে
বাবা! বাড়িতে ফিরেছে, বিকেলে। গরমের দিন বলে এখনও দিনের আলো । জুতো মোজা খুলে
মায়ের কথা অনুসারে সব কাচতে দিয়ে চান সেরে খেতে বসে।ওর বাবাও খাবার নিয়ে বসে ওর
সঙ্গে। মা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,আজ সকালে কখন বেরিয়েছস্, কি খেয়েছিস
এসব। বাবা পাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলে, আজ
একটু আরাম করে নাও, কাল থেকে বিভূতিস্যর আসবেন অংক করাতে। কুশল ভয়ে ভয়ে বলে, ‘কাল
থেকে?’কুশল এমনিতে পড়া শোনায় ভালো, কিন্তু অংক বিষয়টাকে ভয় পায়। ওর বাবা সেটা ভালো
করে জানে বলেই ছুটির সময়ে সেটাকে একটু ধার পালিশ, মাজা ঘসা করার ব্যবস্থা করে
রেখেছে আর কি।
মাস্টারমশাই এলেন
একেবারেপাক্কা আট টায়।তাও যাই হোক সকাল আটটা। কুশল তার পড়ার টেবিলে অংকের বইখাতা
জ্যামিতিবক্স পেন পেন্সিল ইরেজার সব গুছিয়ে রেখাছিলো। আজ মাষ্টারমশাই পাটিগণিত
বীজগণিত জ্যামিতি সবই একটু একটু করে দেখালেন, পুরনো করা চ্যাপ্টার থেকে কিছু
বাড়িতে করার কাজ দিয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন আগামীকালও এই সময়েই আসবেন।
মাষ্টারমশাই কড়া হলেও
বোঝাবার সময়ে বেশ ধৈর্যশীল। এক সপ্তাহ পেরিয়ে দু সপ্তাহ চলছে। এখন কুশলের
পাটিগণিতের সুদকষা শতকরা একটু যেন ধাতে
এসেছে।নামতা ঝরঝরে মুখস্ত চাই ওনার সব সময়, বলেই রেখেছেন। আসলে তাহলে অংক কষতে
সুবিধে হয়, এগিয়ে যেতে পারবে তাড়াতাড়ি। সেটা কুশল বোঝে বলে সেখানে গাফিলতি নেই। এর
মধ্যে একদিন কুশলের বাবা প্ল্যান করে দার্জিলিং যাবার।মাষ্টারমশাইকে বলে কদিন
থাকবো না, উনি বললেন ঠিক আছে,দু তিনদিনের ব্যাপার ভালভাবে ঘুরে আসুন আপনারা।
কুশলের বাবা এমনি বলেন ওনাকে, আপনিও যাবেন নাকি চলুন না,বেশ যাওয়া যাবে একসঙ্গে।
মাষ্টারমশাই এককথায় একেবারে রাজী হয়ে গেলেন।
শুনে কুশলের মা রাগারাগি
করে, বলে, একে ছেলেটা কদিনের ছুটিতেএসেছে,তাকে এক্ষুনি পড়ায় জুতে দিলে।এখন আবার তাকে নিয়ে বেড়াতেও
যাবে। ছেলেটা আর বেড়াবে কি,ভয়ে ভয়েই কাঁটা
হয়ে দিন কাটাবে। আর ওখানে যদি পড়াতে বসে, তাহলে তো হয়ে গেলো। শুনে ওর বাবা বলে আরে, অত চিন্তা করছো ক্যানো, কিচ্ছু
হবে না। বরং বেড়াতে গিয়ে ওরা বন্ধুই হয়ে যাবে। আর জানতো, একজন ছাত্রের সবচেয়ে ভালো বন্ধু তার
মাষ্টারমশাই। ওরা যদি বন্ধু হয়ে যায় তাহলেতো ছাত্রেরই ভালো । সত্যি কথা বলতে কি,
বাবার কথাটা মনে ধরেনি, বরং মার কথাটাই ঠিক ওর মনে হয়েছিলো। এখন বেড়ানোর চেয়ে ওর
মনে হচ্ছে না যাওয়াই ভালো ছিলো।
কিন্তু হয়ে গেলো একেবারে
বিপরীত । কড়া মাষ্টারমশাই যে দার্জিলিংএ এসে এমন পালটে যাবেন কুশল ভাবতেও পারেনি।
শেষরাতের হিম ঠান্ডায় যখন আকাশের তারা গুলো
ঝকঝকে, আর সবাই গাদা গাদা গরম জামা কাপড়ে ঘুম ঘুম ভাবে গাবদা গোবদা হয়ে গাড়িতে
যাচ্ছে টাইগারহিল,সূর্যোদয়ে কাঞ্চনজ্ঞঙ্ঘা দেখার জন্যে, তখন মাষ্টারমশাই
বললেন,কুশল, শুনে রাখ, কাঞ্চনজ্ঞঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ, যার অবস্থান
নেপাল আর সিকিমের মাঝখানে।এর পাঁচটি চুড়ো,যার
তিনটি এই সীমানায়, আর দুটো নেপালের তাপলেজাঙে’। কুশল এটা জানতো না, শুনে মনে রাখার চেষ্টা করে।টাইগারহিলে
যত আঁধার সাদা হয়ে এলো, সময় ঘনিয়ে এলো তত
কুশলের বুক ঢিব ঢিব করে, কি জানি ঠিকঠাক
দেখা হবেতো।কে য্যানো বলে উঠলো, ওই তো। বলা মাত্র সামনের দিগন্তের রংবাহারের
মাঝখানে ছোট্টোএকটা লালদানা। কোন এক জাদুকরের ছোঁয়ায় সেটা পলকে নাকের হিরের মতো
ঝিকিয়ে উঠলো। সে লাল ক্রমশঃ চিলতে সিঁদুর হয়ে ছড়াতেই ওপাশের বরফের মুকুট লাল। কুশল কোন দিক তাকাবে ভেবে পায় না। একবার এদিক একবার ওদিক করতে
থাকে।
ফেরার সময় কুশলের বাবা মাষ্টারমশাইকে বলে, এবার
আপনি এসেছেন বলে বোধহয় এতভালো সানরাইজ দেখলাম। মাষ্টারমশাই হেসে বললেন, কুশল যে এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে
পেয়েছে তাতেই আমি খুশি। পরে ওরাই যে এসব সৌন্দর্যের ধারক বাহক কিনা। মাষ্টারমশাই
এর এমন হাসি হাসি মুখে ভালো বেসে কথা বলায়
ও অবাক। অপার্থিব
সৌন্দর্যের কাছে এসে এত কড়া মাষ্টারমশাই এর এতো পরিবর্তন হয়ে যায়? হবে হয়তো বা।আসলে ও নিজে অংক বিষয়টাকে ঠিক নিজের বলে
মনে করতো না বলে বোধহয় স্যরকেও কড়া মনে হয়েছিলো, এখন স্যরকে খুব ভালো কাছের মানুষ
মনে হয়েছে ওর। এখন থেকে ওই ভীতিটা সূর্য ওঠার পরে কুয়াশা সরে যাওয়ার মতোই সয়ে গেলো
হয়তো।
ছায়া ভুত
বুল্বুল দে
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মেয়ের সাথে দেখা করতে গিয়ে সেখানকারই এক গেস্ট হাউজে উঠেছি, সুবিশাল এরিয়া জুড়ে কলেজ। চারিদিকে বিশাল বিশাল গাছপালা,বাগান আর ছোট ছোট ঝোপঝাড় দিয়ে ঘেরা কলেজের ভেতর প্রবেশ করলেই কেমন যেন অন্য একটা দুনিয়ায় ঢুকে পড়ি, যেন বন জঙ্গলে ঘেরা বিরাট এক রিসর্ট। শাপলা ফুলে ভরা স্বচ্ছ পুকুরগুলো, যেখানে পানকৌড়ি টুপ টুপ ডুব দিয়ে মাছ ধরছে, ডাঙ্গায় গা শুকোচ্ছে। ডাহুক তার লম্বা ঠ্যাং নিয়ে শালুক পাতার উপর দিয়ে তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। বক একপায়ে খাড়া হয়ে ধ্যানে মগ্ন, গাছে গাছে দুষ্টু মিষ্টি কাঠবেড়ালীর ছুটোছুটি হুটোপুটি। হাজারো পাখির কলতানে মুখর এখানে শুধু দিনেই নয় রাতেও কোকিলের গান যেন থামতেই চায়না।
গেস্ট হাউজটা সুন্দর ছিমছাম পরিচ্ছন্ন। ভেতরেই খাবার ব্যবস্থা। দুটো বড় ডাইনিং হলের
একটাতে বিশাল বিশাল কাচের আর একটাতে মার্বেলের ডাইনিং টেবিল। বেশ যত্ন করে খাওয়ায়।
যাইহোক রুমে ঢুকে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে এসিটা বন্ধ করে বাইরের প্রাকৃতিক হাওয়া আর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য দেয়াল জুড়ে থাকা কাচের জানলাটা খুলে দিতেই চমকে উঠলাম। ঠিক পেছনে একটু জায়গা বাদ দিয়েই বিরাট এক গ্রেভইয়ার্ড মানে কবরস্থান! ছিটকে পিছিয়ে এলাম----
"এই তাড়াতাড়ি জানলাটা বন্ধ কর বন্ধ কর! ওই দেখ ওখানে একটা কবরস্থান! আমি ভয়ার্ত স্বরে আমার বর কে কথাটা বলতে ও জানলাটা বন্ধ করতে করতে বলল, " হুম খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই ভুত এখন তোমার ঘাড় মটকাটে আসবে!"
কিছুক্ষণ পরেই হস্টেল থেকে এসে মেয়ে আমাদের সাথেই লাঞ্চ করল। গ্রেভইয়ার্ডের কথাটা ওকে বলতেই ও বলল যে ওদের হস্টেলটা নাকি ওটার ওই পাশেই, রাত দশটা এগারোটাতেও
নাকি ওটার পাশ দিয়েই ওরা খাবার পরে হাঁটা হাঁটি করে কোনও ভয়ই নেই, কোনও দিনও কিছু হয়নি। একটু আশ্বস্ত হলেও মনের কোণে ভয় ভাবটা থেকেই গেল। বিকালে গ্রেভইয়ার্ডের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম ওটা বহুবছরের পুরনো, সেই বৃটিশ আমলের। বেশিরভাগ সিমেন্টের ফলক ভেঙে গেলেও কতগুলি এখনও খাড়া হয়ে আছে। তাতে বিদেশীদের নামগুলোও দেখা যাচ্ছে। কতগুলো কফিন তো মাটির তল থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, সেগুলোর ঢাকনা আবার আধখোলা। আমার গা টা কেমন ছম্ ছম্ করে উঠল!
যাই হোক রাতে খাওয়া সেরে মেয়েকে নিয়ে ঐ গেস্ট হাউজের ঘরে লাইট নিভিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। বাইরের নিয়ন বাতির আলো জানলার কাঁচ আর পর্দা ভেদ করে অল্প অল্প ঘরে প্রবেশ করায় ঘরটা আবছা আলোয় ভরে উঠেছে। মেয়ে আর ওর বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমে কাদা হয়ে পড়লেও আমার আর ঘুম আসছেনা। বারবার জানলার দিকে তাকাচ্ছি আর যত রাজ্যের বিদেশী ভুতের গল্প মনের মধ্যে ভেসে উঠছে।
কখন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎই একটা তীক্ষ্ণ সোঁ সোঁ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা যেন জানলার দিক থেকেই আসছে। আমি তো ভয়ে কাঠ! হঠাৎ ওকি! কি ওটা ! কিসের ছায়া পর্দায়?
মাথায় হ্যাট, লম্বা কোট পরা একটা ছায়া মূর্তি! মাঝে মাঝে সামনে ঝুঁকে এগিয়ে আসছে আবার সোজা হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় ক্যাঁ--য়া--চ্ করে কাঁচের জানলাটা বোধহয় খুলে গেল ! ওমাগো, ছায়াটা যে পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে চাইছে !! হঠাৎ ঘরের ডানদিকে তাকাতেই আমার হার্টফেল হবার যোগাড় । ও- ওখানেও যে একই রকম আর একটা ছায়া ! তার মানে ভুত ঘরে ঢুকে পড়েছে! এখন কি হবে? মেয়েদের যে ডাকব, পারছিনা। গলাটা যেন কেউ চেপে ধরেছে! সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে!! হে ভগবান বাঁচাও!! মনে মনে রামনাম জপ শুরু করে দিলাম।
মুখ দিয়ে হয়ত গোঁ গোঁ আওয়াজ হচ্ছিল, তাতেই ধরমর করে ঘুম ভেঙে উঠে মেয়ে বলে উঠল, "কিগো মা এমন করছ কেন, কি হয়েছে তোমার?"
আমার মুখ দিয়েতো কথা বেরোচ্ছেই না আর নড়তেও পারছিনা। আমার চোখ লক্ষ্য করে জানলার দিকে তাকিয়ে মেয়েও ভয়ে চিৎকার করে উঠল !
মেয়ে আবার ভয়টয় পেলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, আমার মত তব্দা মেরে যায় না এটাই রক্ষে। চিৎকার শুনে মেয়ের বাবা হুরমুর করে উঠে বেডসুইচটা অন করাতে ডাবল রডের আলোয় ঘরটা ঝলমল করে উঠল, সাথে সাথেই ছায়াটাও গায়েব। উফ্! আমার দেহেও যেন প্রাণ ফিরে এল। সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে, "যত্ত সব!" বলে আমার অসম সাহসী বর দরজা খুলে বাইরেটা দেখে বললো যে খুব ঝড় হচ্ছে তাই সোঁ সোঁ শব্দ, আর জানলার বাইরে নিশ্চয়ই কোনও গাছের ডাল ভেঙে ঝুলছে, তার ছায়াই নাকি আমাদের সাহেে ভুত!
পর্দাটা সরিয়ে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখল সত্যিই জানলার বাইরে একটা পেয়ারা গাছের ডাল ভেঙে ঝুলছে। "এইযে তোমার সাহেব ভুত!" বলে দরাম করে জানলাটা বন্ধ করে দিল।
" কিন্ত আমিতো ঘরের ঐ কোণাতেও দেখেছি সেই ছায়াটা!" ভয়ে আমতা আমতা করে বলি আমি।
"এদের নিয়ে তো আচ্ছা মুশকিল, এখানে ড্রেসিংটেবিলটা চোখে পড়ছেনা? এর আয়নাতেও যে জানলার ঐ ছায়াটার প্রতিফলন হয়েছিল, বুঝতে পারছনা?"
কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় রাগে গজ গজ করতে করতে ও শুয়ে পড়ল।
"উফ্ মা তোমার জন্য আমিও বোকা বনে গেলাম ! নাও ঘুমাওতো এবার। " মেয়েও রেগে মেগে শুয়ে পড়ল।
আত্মশুদ্ধি
ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী
এ এক নতুন অসুখে ভুগছে জয়ী। মাঝে মাঝেই মাথা টা কেমন বনবন করে ঘুরতে থাকে। মাথা চেপে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। শুয়ে শুয়েই সে পরিষ্কার বুঝতে পারে পৃথিবীটা কেমন অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ ঘুরছে। সময় টা কেমন যেন পিছিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ভাবে সে সত্যিই যদি এমন হতো! জীবনে যা যা ভুল করেছে, সব শুধরে নেওয়া যেত।
জয়ীর জীবনে ভুলভ্রান্তির লিস্টি টা অনেক লম্বা। যেমন মায়ের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করা, কলেজ জীবনে স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া, স্কুলের ছোট বাচ্চা কে সজোরে চড় মারা, আরও অনেক কিছু।
আজ আবারও ওর প্রচন্ড মাথা ঘুরতে লাগলো। মাথাটা হাত দিয়ে সজোরে চেপে ধরে শুয়ে পড়লো সে। অচেতন এ পরিষ্কার দেখতে পেলো সে, সময়ের কাঁটা আজ সত্যি সত্যিই উল্টো দিকে ঘুরছে, ঘুরছে.... ঘু...র... ছে...
ওর চাকরিজীবনে প্রথম স্কুলবাড়িটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ও। গ্রামের ঠিক মধ্যিখানে একতলা বাড়ি, সামনের সবুজ মাঠ টা জলে থই থই করছে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জলে। কতো কতো সবুজ জলেভেজা গাছ, সেই পুরোনো দিনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।
জয়ী বসে আছে তৃতীয় শ্রেণী তে। সামনে সব ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। যেনো পাখির কিচিরমিচির। সবাইকে চুপ করিয়ে সে একজন একজন করে কাছে ডাকছে আর গতদিনের বাড়ির কাজ দেখে নিচ্ছে, ভুলভ্রান্তি শুধরে দিচ্ছে। ক্রমে ক্রমে সেই মেয়েটির ডাক পড়লো। "চম্পা"! ভীরু মেয়েটি কেমন জড়োসড়ো হয়ে উঠে দাঁড়ালো। উজালা র নীল ছোপ ছোপ দাগ ধরা সাদা স্কুল ড্রেস পরিহিতা itফর্সা মেয়েটি।জয়ী জোর ধমক দেওয়া তে সে আস্তে আস্তে হেঁটে টেবিলের কাছে এলো। একটু ইতস্তত করে খাতা খুলে জয়ী কে দিল। খাতাটা দেখেই জয়ী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। "প্রতিবারের মত এবারও সাদা খাতা! কিচ্ছু লেখনি!" বিড়বিড় করে কি যেন বলতে চাইল মেয়েটি। জয়ী কিছু বুঝতে পারলনা, ডানহাত দিয়ে সপাটে একটা চড় কষালো। মুহূর্তে চম্পার বাঁ গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেলো।কানের কাছে নখের খোঁচায় একটু কেটেও গেলো।মেয়েটি কোনক্রমে কান্না টাকে গিলে পরদিন সব অঙ্ক করে আনবে, এই প্রতিজ্ঞা করে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। জয়ী কেমন অপরাধবোধে ভুগতে লাগলো। " ইস্ এতো জোড়ে মারা ঠিক হয়নি," আড়চোখে দেখলো জয়ী, গাল টা লাল হয়ে আছে। সে মনে মনে ঠিক করলো পরেরদিন কিছু একটা বলে এক বাক্স চকোলেট এনে ওদের দেবে। পরদিন স্কুলে এসে ও দেখলো চম্পা সেদিন আসেনি। ওর বন্ধুদের জিজ্ঞেস করতেই, তারা সমস্বরে জানালো যে ওর আরও দুটো ভাই বোন আছে। ওদেরকে দেখাশোনা করতে হয়। জয়ী জিজ্ঞাসা করলো " কেন! ওর বাবা মা নেই! তারা কি করে"! জানা গেলো যে ওর বাবা মা ভোরের ট্রেন ধরে কাজে যায়। সন্ধ্যে বেলায় ফেরে। তাই ওকে সব কাজ করতে হয়, ঘর ঝার দিতে হয়, রান্না করতে হয়,ভাইবোনদের খাওয়াতে হয়। থম মেরে যায় জয়ী। বুক টা ব্যথা করে ওঠে। আরও দু দিন পর স্কুলের প্রার্থনা সভায় জয়ী খেয়াল করে , চম্পা কে দেখতে পায়। সেদিন সে ক্লাসে গিয়ে একজন একজন করে কাছে ডাকে আর চকোলেট গুঁজে দেয়। চম্পার ডাক পড়তেই সে আবারও ইতস্তত ভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়। জয়ী খুব ভালো করে দেখে নেয় মুখখানি। নাহ্ আর লাল দাগ নেই।
কাটা দাগটাও শুকিয়ে গেছে। স্বস্তি বোধ করে সে। চকোলেট নেবার জন্য হাত টা বাড়াতেই আঁতকে ওঠে জয়ী। চিৎকার করে বলে "কি হয়েছে! কেমন করে হলো!" চম্পার ডানহাতের আঙ্গুলগুলো ব্যান্ডেজে জড়ানো। হাতে ফোস্কার দাগ। চম্পা অস্ফুটে বলে ভাতের মাড়....বন্ধুরা বলে ওঠে ভাত রান্না করতে গিয়ে মাড় হাতে পড়ে গেছে দিদিমণি! জয়ী নির্বাক
মাথা ঘোরা আস্তে আস্তে কমে আসে। জয়ী চেতনায় ফেরে। অন্যান্য বারের মত নিজেকে অত ক্লান্ত বিদ্ধস্ত মনে হয়না। ভোর হয়ে আসছে। নিজেকে অনেক ফুরফুরে লাগে। মুক্ত বিহঙ্গের মত।
আশা
জনা বন্দোপাধ্যায়
স্টেশনের ধারে বসে প্রায়ই বৃদ্ধ প্রতাপ মল্লিক উদাত্ত গলায় পুরোনো দিনের গান ধরেন, "এমন আমি গান বেঁধেছি আহারে যার ঠিকানা নাই স্বপনের সিঁড়ি দিয়ে যেখানে পৌঁছে আমি যাই।" বাংলাদেশের জমি বাড়ি হারিয়ে এ দেশে এসে কারখানায় চাকরী নেন তিনি। সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মুদির দোকানে কাজ করতেন। প্রতাপবাবুর একমাত্র ছেলে সোমনাথ পড়াশোনায় ভালো ছিল। বি. এস. সি পাশ করে সোমনাথ কলকাতায় ওষুধের কোম্পানিতে চাকরি পায়। এরপর নিজের পছন্দ মতো মেয়েকে বিয়ে করে সোমনাথ আর মা বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি।
বছর খানেক আগে বিনা চিকিৎসায় স্ত্রী মারা যাবার পর প্রতাপবাবু দিশা হারা হয়ে পড়েন। চোখে ভালো দেখেননা। কেউ কেউ গান শুনে অর্থ সাহায্য করে। দুবছরের বাড়ি ভাড়া বাকি। অনেকে প্রতাপবাবুকে বৃদ্ধাশ্রমে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু সোমনাথ একদিন ঠিক তার ভুল বুঝে ফিরে আসবে এই আশায় তিনি যেতে রাজী হন না।
দুমাস পর প্রতাপবাবুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান শহরের পি ডবলু ডি অফিসার আমিনুল রহমান। তিনি সোমনাথের কলেজের ব্যাচমেট ছিলেন।প্রতাপবাবু প্রথমে রাজী হননি। আমিনুল সবিনয়ে জানান,"আব্বাকে টাকার অভাবে বাঁচাতে পারিনি। ছোট বয়সে ইঁট বয়ে আম্মির সংসারে টাকা দিতাম। স্কুল পাশ করে কলেজে পড়ে আম্মির স্বপ্ন পূরণ করেছি। আল্লার দোয়ায় আজ চাকরী, বাড়ি কিছুরই অভাব নেই। আপনি আমাদের সঙ্গে থাকলে আমার মেয়েটা তার দাদুকে পাবে। আপনি আর অমত করবেন না।"
আমিনুলের বাড়িতে গিয়ে প্রতাপবাবুর দ্বিতীয় জীবন শুরু হয়। আমিনুলের স্ত্রী তাঁকে নিজের বাবার মতো যত্ন করে। আমিনুল ভালো ডাক্তার দেখিয়ে প্রতাপবাবুর চিকিৎসা করান। আমিনুলের মেয়ে পাঁচ বছরের ছোট্ট কদম নেচে গেয়ে তার নতুন দাদু অর্থাৎ প্রতাপবাবুকে ভরিয়ে রাখে। আমিনুল প্রায়ই তাঁর ছোটবেলার অভাবের কথা বলেন। কি ভীষণ প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে তাঁর বড় হয়ে ওঠা--সে কাহিনী বড়ই মর্মস্পর্শী। একবার আমিনুলের অক্ষমতার কথা শুনে প্রতাপবাবু নিজের ছেলে সোমনাথের হাত দিয়ে আমিনুলের পরীক্ষার ফি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সে কথা আমিনুল মনে রেখেছেন।
একদিন হঠাৎ করেই আমিনুল এক মুখ হাসি নিয়ে প্রতাপবাবুকে বলেন, "সোমনাথের বর্তমান ঠিকানা এক পুরোনো বন্ধুর থেকে পেয়েছি। আমি নিজে গিয়ে যোগাযোগ করব।"
বয়সের ভারে শরীর শিথিল, একটি চোখে প্রায় দেখতে পান না প্রতাপবাবু। তবু দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, "না আমিনুল,তুমিই আমার ছেলে। আমি মরলে তুমিই মুখাগ্নি কোরো।"
প্রতাপবাবু আর বেশী দিন বাঁচেননি। আমিনুল তাঁর সব কথাই মেনে চলেছেন।
প্রকৃতির নিয়মে পেরিয়ে যায় দিন, মাস, বছর। প্রায় কুড়ি বছর পর আমিনুলের সোমনাথের সঙ্গে দেখা হয় এক বৃদ্ধাশ্রমে। রোগে ভারাক্রান্ত। প্রথমে দেখে সোমনাথকে চিনতে পারেননি আমিনুল। সোমনাথেরও স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। আমিনুল ওই বৃদ্ধাশ্রমে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসে সোমনাথকে দেখতে পান। সোমনাথের সঙ্গে কথা বলে তিনি বোঝেন সোমনাথেরও মনে আশা তাঁর ছেলে তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সোমনাথের মধ্যে আমিনুল প্রতাপবাবুর ছায়া দেখতে পান। অবিন্যস্ত পাকা চুল, মুখে উস্কোখুশকো দাড়ি নিয়ে বিড় বিড় করে আধপাগলা সোমনাথ বলেন, " খোকা আসবে এই আশা নিয়েই তো আছি।"
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩০
মুক্তগদ্য
স্বপ্ন
কবিতা সামন্ত
কোন কিছুর স্পর্শে শামুকের খোলের ভেতর গুটিয়ে যাওয়ার মতোই অন্ধকারের স্পর্শের আভাস পেয়ে ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাচ্ছে বিকেলের রোদ।
বৈভব মাঠে চাষের কাজ করতে করতে ভাবছে যদি আরও খানিকটা বেলা থাকত কত কাজটাই না এগিয়ে যেতো।
চাষা মানুষের একটাই দোষ...
সকাল থেকে কলুর বলদের মতো যতই কাজ করুক তারপরও পশ্চিমাকাশের ক্লান্তি ভরা সন্ধ্যার বুকে এলিয়ে দেওয়া গা আর বন্ধ হয়ে আসা চোখে ঘুম নেমে এলে তখনও যেন বিষাদের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
যদিও এটা একান্তই নিজের গায়ে গতরে চাষে খেটে সংসারে জোয়াল টানা বৈভবদের গল্প কথা।
সন্ধ্যায় মোড়ের মাথায় খানিকক্ষণ চায়ের আড্ডার সঙ্গে দেশ দুনিয়ায় হালহকিকত জেনে নেওয়া।আসলে পড়াশোনার তেমন সুযোগ পায়নি বলে খবরের কাগজে চোখটুকুও বোলাতে পারেনা।
তাছাড়া নুন আন্তে পান্তা ফুরায় যার সংসারে তার কি আর বাবুয়ানি চাল দেখালে চলে!
খবরের কাগজ পড়তো নগেন মাস্টার।সরকারি ইসকুলের চাকরি মাস গেলে বাঁধা মাসমাইনে।বাবুয়ানি চাল উনি দেখাবেন নাতো আর কে দেখাবেন!
রাতে চাট্টি গরম গরম ভাত আর আলু মাখা খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে বৈভব।রাতের ঝুজকো আলোয় ঝিঁঝিঁদের ফেরারি গান শুনতে শুনতে কোদাল কাঁধে আবার মাঠের দিকে পা বাড়ায় বৈভব।
কিসের যেন তাড়া! পূবে ভোরের আলো ফোটাকে বৈভবের কিসের এতো ভয় কে জানে!
একবার আলো ফুটে গেলে নাকি সময় তরতর করে পা বাড়ায় বিকেলের আকাশের দিকে আর বৈভবের কাজ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
বৌ ছেলের মুখে দুমুঠো অন্ন কাপড় তুলে দেওয়া ছাড়াও ছেলেটাকে একটা ভালো ইসকুলে ভর্তি করতে হবে।ছেলেটার কমসেকম দু-অক্ষর পেটে পড়লে খবরের কাগজখানা পড়তে পারবে।জানতে পারবে দেশ দুনিয়ার খবর।
পশু জন্তুর মতো শুধু উদরপূর্তি করা খাওয়া আর মলত্যাগ করা ছাড়াও অনেক কিছু জানতে হয় খবরাখবর রাখতে হয়।
দেশে বাস করে অথচ দেশের কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে না জানলে মানুষ হয়ে লাভ কি?তা নাহলে তো পশু জন্তুরাও তো খায়দায় ঘুমায় পৃথিবীতে আসে আর যায় তাদেরকে কেউ মানুষ বলে কখনো বলেনি আর বলবেও না।
অশিক্ষিত বৈভব মানুষের দলে গণ্য হয়না বলেই তার চোখের ঘুম হারিয়ে গেছে ছেলেকে মানুষের দলে গণ্য করার স্বপ্নে।
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩০
কবিতা/ছড়া
লিমেরিক
উমেশ শর্মা
শ্রীনিবাস ভোরে মিনিবাস চড়ে
যাচ্ছিল জোরে থানাতে
ভাবছো তো খুড়ো যাচ্ছে তো বুড়ো
খুনের কথা টা জানতে।
খুন নয় খুন, বেজায় আগুন
কাল জ্বলেছিল ঘরেতে
বাজেট সংবাদে বুড়ী কেঁদে কেঁদে
আগুন দিয়েছে ধড়েতে।
বাজেটে আগুন মাসটাও ফাগুন
জল ছিল নাকো ঘরেতে।
বাহাত্তুরে
মৌসুমী চৌধুরী
অদৃশ্য শ্রাবণের আড়ালে লিখে রাখি
জটিল সময় এক চমড়ার চাকচিক্যে।
কুচি কুচি হয়ে যাচ্ছে দেহজ নারীজন্ম
পদ্ম পাতায় টলমল করে সম্ভ্রম।
দহলিজ পেরিয়ে আসে জোনাক জ্বলা সন্ধে
খড়কুটো থেকে জাঁকিয়ে ওঠে শ্রাবণ অন্ধকার।
ঘন বন আর ফাঁকা মাঠে তামাশা জমে
বাহাত্তুরে বৃদ্ধা দেশ এক
লাজে ঢাকে মুখ।
কিছু দূরে পড়ে আছে তার
সাদা ফুলিয়া তাঁতের শাড়িটি
আর এ খাবলা ভাতের গন্ধ।
সোনালী ক্রেতা
মাথুর দাস
চকমকে সোনা কিনি ঝকমকে হীরে,
আসল কি নকল তা দেখি না তো ফিরে ;
হীরে কাঁচ সোনা খাদ
সব যেন বরবাদ,
টের পাই যদি যাই বিক্রীর ভীড়ে ।
সাধারণ গল্প
মৌমিতা চ্যাটার্জী
দৃশ্যপট ১
—-----------
দুটো শীর্ণ কাঁপা কাঁপা হাত,
খাবারের শেষদানাটুকু বেড়ে দেয় সন্তানের থালায়, অকৃত্রিম মমতায়।
কোটরাগত দুই চোখ।
আশা, স্বপ্নের তিনকাল ঠেকেছে এককালে।
সংসারের জোয়াল টানার জ্বলন্ত উদাহরণ তোবড়ানো,অসময়ের বলিরেখাপুষ্ট দুই গাল।
তবু , মুখের হাসিটুকুতে মলিনতার লেশমাত্রও নেই।
সন্তান খেলেই মায়ের খাওয়া।
পেট ভরাতে এক গ্লাস জল কি কম নাকি?
দৃশ্যপট ২
—------------
ঘর্মাক্ত কলেবর, দুহাত নুইয়ে পড়ে,
দৈনিক রসদের ভারে।
কয়েকশ রিফুও ঢাকতে অক্ষম শতছিন্ন চটিটার নগ্ন হাঁ।
রংচটা জামাটার কলার, পকেটের শক্ত সেলাইও এবার জবাব দিচ্ছে।
তবুও আর কটা দিন ভালই চলে যাবে।
খোকার এ মাসের সেমিস্টারের ফী বাকী আছে।
পরের মাসে ল্যাপটপটা না দিলে ছেলেটার বড় সমস্যা হচ্ছে।
নিজস্ব প্রয়োজনটুকুর কপালে জোটে অ-দরকারী বিলাসিতার তকমা।
মাছের বড় পিস্, দুধের সর, মটনের রান।
সবেতেই লেখা খোকনের একচ্ছত্র নাম।
দুধেভাতে থাকুন সন্তান, এই প্রার্থনায়,
দিন চলে যায়।
ভুল হয়ে যায় নিজেদের অন্নসংস্থান।
ছায়া বিতরণ করে দুটো বটগাছ।
ছোট্ট চারা পায় না বিধ্বংসী ঝড়ের আঁচ।
ছায়া দিতে দিতে,
ভুলে যায় নিজেদের জীবনে কিছুটা ছায়া বাঁচিয়ে রাখতে।
বহুক্লেশে সঞ্চিত ফোঁটা ফোঁটা রক্ত,
প্রায়নিঃশেষিত চারাটুকু পালনের সাধনায়।
অতঃপর,
শেষের বেলা ভরে ওঠে ভর্ৎসনার উপহারে, অশ্রদ্ধা আর উপেক্ষায়।
দুটো অসহায় অবয়ব ঠাঁই খোঁজে পথের বাঁকে, বৃদ্ধাশ্রমের আঙিনায়।
অফিসের দক্ষ হিসাবরক্ষকের, জীবনের হিসেবেই-বড় গরমিল থেকে যায়।
শ্রাবণধারায়
উৎপলেন্দু পাল
মেঘলা সময়েরা ছুঁয়ে যায়
হৃদয়ের কাঁচের জানালায়
ভেজা বাতাসে ভিজে যায়
মনের মখমলি লহরী পর্দা
শ্রাবণের ধারায় ধুয়ে যায়
কালিমাখা হৃদয়ের বিষাদ
ধুলোমাখা জীবনের পথে
স্নিগ্ধ স্বর্গীয় সোঁদা সুবাস
অহমিকার মেঘগুলো চিরে
উড়ে যায় গাঙচিলের ঝাঁক
মননের বৃহত্তর ক্যানভাসে
আঁকা হয় সময়ের জলছাপ
তৃষ্ণার্ত চাতকের রসনাতলে
ঢেলে দেয় অমৃতের জলঘট
ভেজা জানালার ওপারে
নগরীর প্রেমের জলকেলি
হৃদকন্দরে সুরের বাসরে
দাদুরির মহামিলন সঙ্গীত
নবযৌবনা মেদিনীর সাথে
মেঘদূতের প্রেম আলিঙ্গন
শ্রাবণ ধারায় নেমে আসে
অমৃতের অঝোর ধারাপাত
অঝোর বর্ষণের রাত শেষে
ঝিলমিল সাতরঙা রোদ ।
শ্রাবণ যেমন
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
শ্রাবণ চিঠি পাঠায় আকাশ
মেঘলা দিনের কাছে,
আশমানী নীল উধাও তখন
ভয়াল তড়িৎ নাচে।
ত্রস্ত পাখির ডানায় আঁকা
আকাশজোড়া কালো,
কাছে- দূরে গাছের শাখায়
বাতাস এলোমেলো।
ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি
মেঘ ঠিকানা থেকে,
ঝুরঝুরঝুর পড়ছে ঝরে
মৌসুমী দিন এঁকে।
বৃষ্টিমুখর প্রহর ক্রমে
ঝর্ণা হয়ে ঝরে,
টিনের চালে জলতরঙ্গ
পুকুর উঠোন জুড়ে।
জারুল,কদম থরথর
শ্রাবণ ঢাকাই গায়ে,
পাতায় পাতায় বৃষ্টি সোহাগ
আকুল বাদল বায়ে।
দূর গাঁয়ে কোন এলোকেশী
কাকে বা মন দিয়ে,
বৃষ্টি গানের টুপটাপ গায়
শ্রাবণ চুলে নিয়ে।
হাঁটুজলে ছলাৎ ছলাৎ
জল থৈ থৈ খেলা,
জলার ধারে ব্যাঙের ডাকে
ভরা বাদল বেলা।
খোলা জানলার দৃষ্টিসুখে
শ্রাবণ ঝরে বেগে,
ফেলে আসা স্মৃতির শ্রাবণ
উন্মন মনমেঘে।
কলমে তার পদ্য লিখে
পদ্ম ফোঁটায় মালি,
শ্রাবণ দোয়াত,শ্রাবণ কলম
ভরায় ফুলের ডালি।
সরব শ্রাবণ স্তব্ধ এবার
অঝোর ঝরার শেষে,
দূর আকাশের একফালি রোদ
উঠোন বিলে মেশে।
চড়ুই হঠাৎ মগ্ন তখন
গায়ে চঞ্চল স্নান,
গাছের পাতায় শ্রাবণদানা
বৃষ্টিমেদুর ঘ্রাণ।
শ্রাবণ আসে,শ্রাবণ ভাসে
শ্রাবণ যায় চলে,
নিরুচ্চারের গহীন শ্রাবণ
অনেক গল্প বলে।
রাতজাগা ওই মন শালুকের
ফুটে ওঠার টানে,
মনদরিয়ার ইচ্ছেবারি
অযুত শ্রাবণ আনে।।
বর্ষা মজনু মিয়া
বৃষ্টি বাদল মেঘের দিনে আকাশ থাকে ভার
অঝরে মেঘ ঝরে দিন রাত নীলাকাশ আঁধার।
চারিদিকে জল জলাকার জল করে থইথই
শিশু কিশোর নামে জলে খেলে যে হইচই।
ব্যাঙে করে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর লাফালাফি খুব
বেরিয়ে আসে হরেক ব্যাঙ বাহারি তার রূপ।
মাছেরা সব মহাখুশি পেয়ে নয়া জল
উজান ভাটি করে জলে করে যে কলকল।
ছোট বড় নৌকা চলে উড়িয়ে দেয় পাল
ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নেমে পড়ে খাল।
অধিক হলে মেঘের ঘোমটা নানান মুশকিল হয়
বর্ষা ঋতু এমনি করেই তুলে নেয় তার জয়।
অবসন্ন অবসর
প্রতিভা পাল
একান্ত অবসরে অবসন্ন হয় সময়,
পায়ে পায়ে পিছিয়ে যায় ধুপছায়া মনে,
নিরিবিলি স্মৃতির চৌকাঠে তখন
শ্রাবণের স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলার প্রলেপ
পিচ্ছিল ভীষণ, ব্যক্তিগত কারণে !
ইচ্ছেদের মেহফিল সাজে
শব্দর নিঃশব্দ উচ্চারণে অতঃপর !
ভুল-ভ্রান্তি সব ভবঘুরে বৃষ্টির দলে
ফোঁটায় ফোঁটায় ছন্দ সাজায় ভাবনার কাপ্লেটে !
বোঝে না, জলের বৃত্তর কেন্দ্রমুখী কল্পনা এসব,
বোঝে না, বোঝা না-বোঝার মধ্যেও
জীবন্ত হয় মাঝেমধ্যে এক অস্থায়ী, অবুঝ শহর
একান্ত অবসরে,
অবসন্ন সময়ের আবদারে…..
দুই
সারণ ভাদুড়ী
সত্য কি কখনো কাঁদিয়েছে তোমায় ?
নিজের প্রতিবিম্বের সামনে কখনো কি তাকাতে ঘৃণা করেছ ?
প্রতিক্ষণে কি মুছে যেতে চেয়েছো তুমি ?
আমিও চেয়েছিলাম !
আজও চাই ।।
কিন্তু পারি না ....
অন্তরের বাঁধন খুলে গেলেও পারিনা
হয়তো কোন মায়ায় বেঁধেছ তুমি,
রেখেছো নিজের বক্ষ মাঝে
দীর্ঘশ্বাসে খুঁজি আমি তাই তোমাকে আমার কাছে.....
রাতের প্রকৃতি
মনোমিতা চক্রবর্তী
গাছ গাছালি, লতায় ঘেরা ঝোপের কোণে,
নেচে চলেছে জোনাকির দল আপন মনে।
ক্রমশ একটু একটু করে বেড়ে চলেছে রাত,
ঠিক সে সময় জানালা দিয়ে, দেখতে পেলাম,
আকাশের বুকে জেগে থাকা,গোলগাল ঐ সুন্দর চাঁদ।
দূর থেকে তাকিয়ে উপভোগ করছি রাতের এই মায়াবী রূপ,
কোন ভয়,হতাশা কিছুই নেই আজ মনে,
শুধু মনে হচ্ছে এত সৌন্দর্য নিয়েও রাতের প্রকৃতি কি রকম চুপ!
অবাক হয়ে দেখছি প্রকৃতির মোহময়ী অপরূপ রূপ,
ভাবছি মনে ,এই রূপ এক মুহূর্তে কেড়ে নিতে পারে -
দুঃখ - বেদনা, বিরহ কিংবা শোক।
চারপাশ কেমন যেন আজ নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ!
যদিও রাতের এই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে দূরে বাজছে ঝিঁঝির মিষ্টি সুর,
সে সুরেই রাতের প্রকৃতি হয়েছে আজ বড় মধুর।
সিলিংয়ের রঙ
শেখ আব্বাস উদ্দিন
খোলা মাঠে আকাশের নিচে দাঁড়াও
দেখতো আকাশের শেষ দেখা পাও কি না
কত দুর গেলে আর ফিরতে পারবেনা তুমি,
তা কি তুমি জান?
তাহলে কি তুমি,
হাঁটবে না পথ!
থেমে যাবে নাকি মাঝপথে
ছড়ানো শুকনো পাতার নীচে জমে আছে
ভবিষ্যতের আলো আকাশ এবং অন্ধকার;
পর পর সাজানো আছে তোমার আমার গল্প কথা
হারানো দিন, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব
কাটাকুটি ডায়রির সন তারিখ;
দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে আমাদের আয়ুষ্কাল
ভাগ্য রেখা প্রতিদিন অগভীর হয়
স্বপনের দানা গুলো ভেসে যায় অশ্রু স্রোতে,
বিপন্ন ভোর দেখতে দেখতে
গড়ে উঠেছিল যেসব ইমারত
গৃহমুখী হাওয়া পাখিদের ডাক
যেমন ভেসে যায়;
শত চেষ্টা করেও তুমি
বুঝতে ব্যর্থ হও তারতম্যের এপিঠ ওপিঠ,
মুদি দোকানের মত যন্ত্রণা ভর্তি দগ্ধ জীবন
সিলিংয়ের সাদা রং
চিরস্থায়ী নয়।
পাখি
পূর্ণিমা বোস
পাখিরাও স্বপ্ন দেখে রাতে।
মাঝে মাঝে জেগে ওঠে কলরব করে
ওদেরও সুখ দুঃখ আছে
প্রেম ভালোবাসা বিচ্ছেদ সাথে।
বেঁচে থাকে পৃথিবীর ঘ্রাণটূকু নিয়ে,
মনে হয় বসবাসের সীমারেখা নেই;
তবুও বন্ধন ওরা গড়ে বৃত্ত আঁকে নিজে।
যার যার এলাকা মানুষের ঘর বাড়ি
চারদিকের গাছপালা নিয়ে।
নিজেরাই নিজেদের গন্ডি তৈরি করে,
কিন্তু খাদ্যের ভান্ডার ওরা গড়ে না,
যুদ্ধের অস্ত্র রাখেনা বাঁচার তাগিদে।
পরিমিত খাদ্য আর সঙ্গী খুঁজে পেলে
মহাসুখে সঙ্গীতে ভাসে।
মেঘপিয়নের ডাকে
আকাশলীনা ঢোল
মুখের ওপর ভিজে ভিজে হাওয়ার ঝাপটা,
জানলার কাঁচে বিন্দু বিন্দু জমে
রয়েছে বৃষ্টির জলকণা-
যেমন বাষ্পকণা জমে রয়েছে
ধূমায়িত চায়ের কাপের আনাচে-কানাচে-
রাস্তায় দু-একটি রঙিন ছাতার আনাগোনা,
আকাশের বুকে বিদ্যুৎ আর মেঘের
গল্প শোনার আসর।
অন্তর্জালে একটানা চোখ আবহাওয়া দপ্তরের,
বোধহয়, নতুন কোনও চিঠি এসেছে
মেঘপিয়নের ডাকে।
কোথাও একটা শৈলৎক্ষেপ, কিংবা
একটা নিম্নচাপ-
অথবা কোনও মেঘদূতের আগমন
বিরহবার্তা নিয়ে-
দু-একটা বৃষ্টিকণা চোখের পাতা
ছুঁয়ে যায়,
শ্রান্ত মনে হঠাৎ যেন নোনা
বাতাসের ঘূর্ণি-
চেতন-অবচেতন জুড়ে মেঘ ঘনিয়ে আসে,
মেঘ আসে, চিঠি আসে,
নতুন কোনও চিঠিও আসে
মেঘপিয়নের ডাকে।
দ্বিধা
রাজর্ষি দত্ত
দ্বিধা সাগরের নোনাজলে
হাবুডুবু খেতে খেতে বুঝি
অ্যানোড আর ক্যাথোডে
দু-টুকরো এ পৃথিবী।
সিদ্ধান্তের প্রাক্কালে
পৌঁছে খালি মনে হয় –
যেন বসে আছি পাহাড়চূড়োয়
–‘কিরে ? ঝাঁপ দিবি?’
(এমন অনেকেরই প্রতি...)
আকাঙ্ক্ষা তাই বর্ণচোরা
আম ;
খেয়ালগুলি মটকানো
ভ্যারেণ্ডা ডালের বুদবুদ।
ডান-পা অবিরত খুঁজে
চলে চোরাবালি –
বুকে জমা একমণ ভেজা
বারুদ।
(কি দুর্গতি !)
প্রশ্নের সপ্তর্ষিরা
শুষে নেয় কণ্ঠনালী,
নির্ধার প্রতিক্রিয়া
ভাসে পলকা পেঁজাতুলায়;
মিডিয়া নাচে খোক্কশদের
উল্লাসে, লাথ আর রক্তে-
অন্তর্গত স্পৃহা
কাঁপে; তবু বাস অখণ্ড নীরবতায় !
(কার কিবা ক্ষতি ?)
অন্তিম সব হিসেবের,
ধারাপাতে দিন গোণা ব্যর্থ নিকেশের-
পার্থিব স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ
জড়ানো হৃদয়ের সন্দিগ্ধ কম্পনে।
দ্বিধাহীন, উদ্দীপ্ত,
একক স্পার্মের সাফল্য যে মহাজীবণ-
ফুরাতে থাকে দুশ্চিন্তায়,
নৈশ-বিহঙ্গের সংযত তানে।
(সুতরাং ইতি ।।)
শিল্প হচ্ছে
সৈকত দাম
শিল্প হচ্চে কাকু, শিল্প .....
কতগুলো নোংরা হাত আঁকছে কালো রাত ....
তারকাখচিত রাত .....
ভ্যান গগ হওয়ার চেষ্টায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে শরীরে ,
নখের আঁচড় ছিঁড়ে নিচ্ছে ক্যানভাস .....
রাতের আঁধারে দেখা যাচ্ছে না রূপ ,
ওদের শিল্পী হওয়ার শখ খুব .....
আমি শুধু কাকু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি বৃষ্টি তে ,
আর ওরা শিল্প দেখায় আমাকে ,
রবি ঠাকুরের পায়ের কাছে এসে পরে রক্তাক্ত ফুল ,
ভেসে যাচ্ছে নদীর কুল .....
নজরুল তীর্থের দিকে হেঁটে যাচ্ছে শিল্প .....
বিদ্রোহী কবি বিদ্রোহ ঘোষণা করছে কবর থেকে ,
তবু আমি নিরুপায় কাকু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি বৃষ্টি তে .....
ওদের হাতে রক্ত জবা , নিয়ে যাচ্ছে .....
সেই জবার থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত ,
গড়িয়ে পড়ছে ইউনিফর্মে ......
ফাদার্স নেমে সই করছি স্কুলের ফর্মে ,
দেখতে পাচ্ছি ......
তারা বোনা শেষ হোলে ঢেকে দেই অনাচ্ছাদিত শরীর ,
মেয়ের বাপের যে কতো জ্বালা তোরা কি বুঝবি ?
তোরা তো শুধু বৃষ্টি হোলে, নগ্ন শরীরে শিল্প খুঁজবি ....
অপূর্ন আশা
দীপ মুখার্জী (মগ্ননীল)
অনেকটা পথ হেঁটে আসার পর,
ছেলে বললো-'বাবা চলো না কোথাও বসি'
আমি বললাম কোথায় বসবি?
ও বললো..কেনো ওই যে যেখানে বসলে
একসাথে অনেকটা আকাশ দেখা যায়,
যেখানে বসলে ঠিক মাথার ওপর
সন্ধ্যতারা ঝলমল করে,
যেখানে বসলে সন্ধ্যার হালকা আলোয়
পাখির দলকে ঘরে ফিরতে দেখা যায়।
বাবা তোমার মনে আছে-
বাঁধের ওপর সেই জায়গাটা,
যেখানে গেলে শ্রাবনের ভরা নদীর
জলের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়-
বাঁধের ধারে ওই গাছটা
যাকে দেখিয়ে তুমি বলতে -'এটা হলো প্রকৃতি মা'
চলো না বাবা..একবার সেখানে যাই,
চলো না একবার খোঁজ নিয়ে আসি প্রকৃতি মার
একবার গিয়ে বলি..মা তুমি ভালো আছো??
গাছ টি আর নেই।
তার জায়গায় বাড়ি হয়েছে।
ছেলের সাধ অপূর্ণই থেকে গেলো।
মা কে হারিয়ে সন্তানরা ভালো থাকবে তো??
মন আজ বিষণ্ন।
দুর্বলতা
অলকানন্দা দে
সবকিছু তো যায় না লেখা নিজের সাথে কথোপকথন
অনুভূতির রামধনু রঙ, ভাবনা মুগ্ধ না দেখা বন!
অস্তসূর্য আলাপচারী ভিতর ছুঁয়ে বলছে কথা
প্রতিধ্বনির ধারাবাহিক মনের কোণে দুর্বলতা!
ভাবাবেগে পূর্ণ নদী তরঙ্গ কি নেই সেখানে?
নূপুর পরা নদী জানে দুর্বলতার আসল মানে।
ভূবনজোড়া দুর্বলতা নিশান নাড়ে এই তো আমি
বক্ষতলে ঘরটি সাজায়, অন্তঃপুর ভীষণ দামী!
দুর্বলতাই আস্ত জগৎ স্মৃতির প্লাবন দিচ্ছে সায়
না বলাতেই আটকে থাকা দুর্বলতার অভিপ্রায়!
সংকোচ আর নিঃশব্দের আবরণের তলায় বাস
দুর্বলতা আড়াল খোঁজে হৃৎপিণ্ডেই প্রহর মাস!
প্রশ্রয় দিই আদর করি চলার পথে রাখি পাশে
শিউলি বকুল আমের মুকুল দুর্বলতাই ভালোবাসে!
ঝগড়া লড়াই ভালোবাসা ভিজে চোখের ছলাৎ-ছল
চিরকালীন যত্নে রাখা প্রবীণ প্রেমও নাবালক!
দুর্বলতার জ্যোৎস্নালোকে আকুল সন্ধ্যা অনিঃশেষ
যে সত্যে প্রতিষ্ঠা হয় উপন্যাসের অসীম রেশ!
অলীক সে নয় সত্যঝরা বোধের ভেতর প্রবাহ তার
মহাজীবন আকুল করা দুর্বলতাই সারাৎসার!
সপ্তপদী পরিক্রমায় যুগল জীবন পা বাড়ালে
দুর্বলতার গাঁটছড়াতে জীবন বাঁধা নিপুণ তালে!
মা
সঞ্জয় সরকার
শ্রাবণের মেঘ ভাঙা অশ্রু বৃষ্টি ধারা তোমার বুকের উপর,
জেগে ওঠো তুমি--!
যার রসে সিক্ত হয়ে
বেড়ে উঠেছিলে!
কোন পাপে, কার দোষে
গেলে তারে ভুলে?
কেন তোর প্রাণ হীন দেহ?
গণতন্ত্র!!
কীসের?
মানুষের জন্য?
মানুষের অধিকার?
তাজা প্রাণ এফোঁড় ওফোঁড়!!
ওহ! হায়! হায়!
কী পেলে বাছা?
মৃত্যু!!
বাঁচার অধিকার ছিল তোর
ওরা কেড়ে নিল।
নিজের আখের গোছাতে
উপরের ওরা
সংখ্যায় রেখেছে বেঁধে,
এই তো মাত্র কটা! এমন আর কী।
শোন বাছা -
তোরা লাল, সবুজ গেরুয়া নোস
কিংবা নীল।
আবারও জন্ম নিবি
সংঘবদ্ধ, দৃঢ় মুষ্টি নব বিপ্লব নিয়ে একদিন,
সেদিন ওদের সব অস্ত্র ভোঁতা হয়ে যাবে,
রাস্তায় লুটোপুটি যাবে অহংকার।
আপনার কৃতকর্মের ক্ষমা চাওয়ার অধিকার
ফেলবে হারিয়ে ;
আর বেশিদিন নেই
দু:খিনি মায়ের বুক জুড়বে সেদিনই।
ঈদ এলোরে
রেজাউল করিম রোমেল
ঈদ এলোরে ঈদ এলো
লাগলো মনে দোলা,
ধনী গরিব সবার মাঝে
খুশির দুয়ার খোলা।
আত্মীয় স্বজন আসবে এখন
ঈদের খুশি ক্ষণে,
গোমরা মুখে থেকো না আর
এমন একটি দিনে।
ঈদের খুশি বয়ে যাক
সবার জীবনে,
সেমায় পায়েস খেয়ে সবাই
ঘুরতে যাব রে।
মুজনাই অনলাইন শ্রাবণ সংখ্যা ১৪৩০