সম্পাদকের কথা
ছোট দিন , দীর্ঘ রাত। ত্বকে চড়চড়ে টান। দক্ষিণায়নের সূর্যের তেজেও ভাটা পড়েছে। কয়েকটি দিন কাটবে শীতের ওম উষ্ণতায়।
যদি এমনটিই হত আমাদের জীবনভ`র! জীবনের উষ্ণতা যদি ঢেকে রাখত আমাদের সারা জীবন! যদি না খালি পায়ে হাঁটতে হত কৃষকদের, যদি না পৃথিবীতে আসবার আগেই কন্যাভ্রুণদের জায়গা না নিতে হত আস্তাকুঁড়ে, যদি না কিশোরী ধর্ষিতা মা তার সন্তানকে অনাথ আশ্রমে রাখতে বাধ্য হত, যদি না খাবার না পেয়ে মরতে হত না প্রান্তিক মানুষদের, যদি না একবিংশ শতকে এসেও নানা 'যাত্রা' পালা দেখতে না হত, যদি না ....
থাকে... দীর্ঘ করে লাভ নেই এই তালিকা।
ইংরেজি বছর শেষ মানেই আনন্দ, মজা, নানা অনুষ্ঠান। নতুন বছর কি বার্তা আনবে জানি না, তবে আশা করা যায় নতুনের আনন্দে মুখের হয়ে উঠবে আমাদের সবার জীবন, না পাওয়ার পাল্লা ক্রমশ কমবে, পূর্ণ হবে প্রত্যাশা।
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
বাণীপ্রসাদ নাগ, কুমকুম ঘোষ, বিপ্লব তালুকদার, সুব্রত কান্তি হোড়, বেলা দে , নিপা বিশ্বাস ,
সুমন্ত সিকদার, রীনা মজুমদার, সব্যসাচী নজরুল, সুদীপ বাগ, রীতা মোদক, রোমানুর
রোমান, সঞ্জয় মল্লিক, সুব্রত নন্দী, সুতপা মিশ্র, মৌসুমী চৌধুরী , মজনু মিয়া,
সুপর্ণা চৌধুরী , শুভাশিস দাস, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, সব্যসাচী সাহা, দীপ্তিমান মোদক,
দীপান্বিতা মুখার্জী, সঞ্চিতা দাস, সুনন্দ মণ্ডল, শৌভিক কার্য্যী, প্রসেনজিৎ রায়, শুভম রায়
সুপর্ণা চৌধুরী , শুভাশিস দাস, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, সব্যসাচী সাহা, দীপ্তিমান মোদক,
দীপান্বিতা মুখার্জী, সঞ্চিতা দাস, সুনন্দ মণ্ডল, শৌভিক কার্য্যী, প্রসেনজিৎ রায়, শুভম রায়
ফটো ও প্রচ্ছদ ছবি - শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা, অগ্রহায়ন ১৪২৫
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা
অলঙ্করণ, বিন্যাস ও সম্পাদনা- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা, অগ্রহায়ন ১৪২৫
জীবন আলেখ্য
“ফিরে দেখা”
সেকাল একাল
বাণী প্রসাদ নাগ
জীবনের বারবেলায় এসে ফিরে দেখি ফেলে আসা দিনগুলোকে। স্মৃতি রোমন্থনে ভেসে ওঠে সেই হারানো দিনগুলি। জন্মেছিলাম অষ্টম গর্ভে স্বাধীনতার এক বছর আগে তারাপীঠ সংলগ্ন বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রাম বড় তুড়িগ্রামে। জন্ম নিলেও বড় হয়েছি বিহারের কাটিহারে। বাবা রামকৃষ্ণ মিশনের নর্মাল পাশ শিক্ষক। বাবারা দুই ভাই ও চার বোন। তিন বোন বিধবা হয়ে ফিরে আসে দাদাদের আশ্রয়ে। আগের সমাজ ব্যবস্থায় ঘরে ঘরে এমনই চল ছিল। আজ যে হয় না সেকথা বলি না। তবে সংখ্যায় কম। বাপ ঠাকু্রদার সামান্য পৈতৃক সম্পত্তি থাকলেও একান্নবর্তী পরিবারে অভাব,অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। আর এখন যৌথ পরিবার নাই বললেই চলে।
গরমের বন্ধে মাঝেমধ্যে যেতাম। বাড়িতে পুরুষ বলতে কেউ ছিল না। বড় পিসিমা ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমভাবে অত্যন্ত কর্মঠ। পরিবারের সদস্য সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। ভাইবোন মিলিয়ে মোট ৮ জন। বড়বাবা আগেই মারা যান। জমির সামান্য আয় সাথে বড়পিসিমার পাপড়ের ব্যবসায়ে সংসার চলত। পাপড় হাতে তৈরি হত। কখনো সখনো তাঁকে বেলতে সাহায্য করেছি। নিজেই বেসন জাঁতায় তৈরি করতেন। মেশিনের মত মোলায়েম হত না। মেলায় বিক্রি হত বেশি।
সালটা ৬১ বা ৬২। বাড়িতে গেলে পিসিমা মুদিখানা পাঠাতেন। তখন নয়া পয়সার যুগ। বরাদ্দ ছিল হয় ৩০পয়সা নতুবা তিন মুষ্টি ঢেঁকি ছাঁটা চাল। আজও মনে আছে নিতাম আধ পয়সার দেশলাই কাঠি,আড়াই পয়সার সরষের তেল। এছাড়া মসুর ডাল,পোস্ত,মশলা, কাপড় কাচার সোডা। সেই ৩০ পয়সার মধ্যে।
সোম ও শুক্রবার গ্রামে হাট বসত রাস্তার পাশে ডালপালায় ছাওয়া বটগাছের নিচে। তাও ঘন্টা খানেকের জন্য। পাশেই ছোট্ট একটা পচা ডোবা। কাকভোরে উঠে ছুটতাম। বৃষ্টির দিনে একহাঁটু কাদা সঙ্গী হত। লাল এঁটেল মাটি ছাড়াতে দিকদারিতে পড়তাম। এখানেও হাতে পেতাম সেই ৩০ পয়সা। ১০ পয়সায় ১কেজি পুঁই শাক,১০পয়সায় লাউ ও ১০পয়সায় আস্ত কুমড়ো। যেদিন হাট করতে ১টাকা পেতাম সেদিন আনন্দ আর দেখে কে। একটা ঝোলায় ধরত না। সাথে কাউকে নিয়ে যেতে হত। এখন গেলে সেই এঁদো পুকুরের লেশমাত্র নেই। তিনতলা অট্টালিকায় হারিয়ে গিয়েছে।পঞ্চায়েতের দৌলতে রাস্তায় হেঁটে আর চটি জলে ভিজিয়ে কাদা ছাড়াতে হয় না। অধিকাংশই কংক্রীটের রাস্তা। স্মৃতি ঘেরা পাতাঝরা বটগাছের কঙ্কালসার দেহের অবশিষ্ট দাঁড়িয়ে আছে। আর হাট? ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। তার কলেবর কমেছে। আজ মাইল দুয়েকের মধ্যে বুধ ও শনি বড় হাট বসে। গ্রামবাসী সেখান থেকে সব ধরনের জিনিসপত্র পেয়ে যান।
পিসতুতো ভাই ও আমি বলতে গেলে প্রায় সমবয়স্ক ছিলাম। আজ মনে হয় প্রকৃতির সাথে লড়ে বড় হয়েছি। বিকালে ফাঁকা মাঠে বেড়াতে যেতাম। সঙ্গে থাকত স্নানের গামছায় বাঁধা মুড়ি,ছোলাভাজা,লঙ্কাও পিঁয়াজ। মাটি প্রচন্ড টান তাছাড়া জলের অভাব অনুভব করে পূর্ব পুরুষেরা এখানে ওখানে পুকুরের ব্যবস্থা করেছিলেন। স্নান এমন কী খাওয়ার জলের একমাত্র ভরসা ছিল এই পুকুরগুলি। ১২০/১২৫ ফিটের নিচে জল। তাই সরকারী চাপা কল ছিল খুবই সীমিত।মহিলারা কাঁখে করে জল বয়ে আনতেন। পুকুরের পাড়গুলি ছিল ৫/৬ ফুট উঁচু। চারিদিকে ঘুটিং (এঁটেল মাটির রাসায়নিক বিকৃতি) ছড়ানো। পাথরের সমতুল। কয়েকটা বটপাকুরের গাছ। রাখাল বালকদের বিশ্রামস্থল। সেখানে দুই ভাই গল্প জুড়তাম। জল ছিল সাদা টলটলে। বাড়ি ফেরার আগে গামছায় বাঁধা মুড়ি জলে চুবিয়ে নিতাম। দুজনে খেয়ে আকন্ঠ জলপান করতাম। তবু পেট খারাপ ধারেকাছে ঘেঁষেনি।
আর এখন? উঁচু পাড় নেই। গাছ নেই। একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনে পাড় কেটে চাষযোগ্য জমি করা হয়েছে। পুকুর আছে ঠিকই কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ায় বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে স্নানেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অর্থনৈতিক পরিবর্তনে প্রায় ঘরেই চাপা কলে পাম্প মেশিন বসানোর চেষ্টা চলছে।
কারোও বাড়িতে বাথরুম ছিল না। মহিলা পুরুষ সকলকেই বাইরে যেতে হত। রাতবিরাতে অসুবিধা কম ছিল না। অসুস্থতায় বাড়িতেই ব্যবস্থা করতে হত। বিজলি বাতি ছিল না। এখন রাস্তায় আলো। ঘরে ঘরে আলো। তখন ছিল রেডিও-র যুগ। গ্রামে একজনেরই বাড়িতে ব্যাটারি চালিত রেডিও। আমরা অনুরোধের আসর শুনতে যেতাম। আর এখন ঘরে ঘরে টি ভি। সেই আমলে মনোরঞ্জনের তেমন কোনো মাধ্যম ছিল না। দেখতাম ডুগডুগি বাজিয়ে কাঠের বাক্সের সিনেমা আসতে। ছোটরা হাঁটু মুড়ে গোল গোল ফুটোতে চোখ লাগিয়ে একমনে সিনেমা দেখত। হ্যান্ডেল ঘোরাতে ঘোরাতে সুর করে বলতে শুনতাম----
দিল্লী কা কুতুব মিনার দেখো
বম্বই শহর কা বহার দেখো।।
কচিৎ কখনো দেখতাম কৌটোতে একতারা বেঁধে “মা মনসার গান” গেয়ে ভিক্ষা করতে।
“লোহার বাসর ঘরে কেহ না সেঁধাতে নারে
কী করে সেঁধাল কালী নাগ রে”।
এন্ডি গেন্ডিরা গোল করে ঘিরে মন দিয়ে শুনত। কিছুক্ষণের জন্য যেন সব কিছু ভুলে যেত। ছোটদের দেখতাম একজন তাল পাতায় বসে থাকত অন্যজন ডাল ধরে টেনে নিয়ে যেত। কচি কাঁচাদের নিষ্পাপ মনের আনন্দটুকু আজও ভুলিনি। স্কুল থাকলেও তেমন যেতে দেখতাম না। মিড ডে মিলের হাতছানি তখনও শুরু হয়নি। সারাটি দিন এক্কাদোক্কা,লুডো,১৬গুটি ও বল কিনতে না পেরে বাতাবি লেবু দিয়ে বলের অভাব পুষিয়ে নিতে দেখেছি। লুকোচুরি,গুলি,ডাং,গুলি,ছিল তাদের প্রিয়। মনোরঞ্জনের অঙ্গ ছিল যাত্রা গম্ভীরা,মেলা ও নানাবিধ পূজা পার্বন। গ্রামীন অনুষ্ঠানে হ্যাজাক, ঝোলানো হ্যাজাক ব্যবহার হতো।
আজ মনোরঞ্জনের নানান সুবিধা। টি ভি তে লাগাতার হিন্দি ও বাংলা সিনেমা। সাথে নতুন সংযোজন মোবাইল। খেলা,গান,সিনেমা ছাড়া আরও কত কী। তখন শহরে সিনেমা থাকলেও গ্রামে ছিল না। সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রজেক্টর দিয়ে মাঝেমধ্যে শিক্ষামূলক ছবি দেখানো হত। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির জমানায় এসব আর প্রয়োজন পড়ে না।
সে সময় আমি কলেজে পড়ি। তখন গ্রামে একটিই মাধ্যমিক স্কুল। বসার ব্যবস্থা ছিল না। তালপাতা বা চটের আসন বগল দাবা করে যেতে হত। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ঘর না থাকায় স্কুলের পাশে ষষ্ঠীতলায় গাছের নিচে সকালে পড়ানো হত। ১১টায় ৫ম-১০ম পর্যন্ত ক্লাশ হত। শিক্ষকের সংখ্যা নেহাতই কম। ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে আসা যাওয়ার নিয়ম নীতি ছিল না। সেজন্য স্কুলের গন্ডি পেরোতে কমই দেখা যেত। বিয়ের জন্য মেয়েদের নাম লিখতে পারাটাই যথেষ্ট ছিল। “ক” লিখতে কলম ভাঙার সংখ্যাই বেশি। মহিলারা তার চেয়েও। ফাইনাল পরীক্ষা ময়ূরেশ্বর বা মল্লারপুরে দিতে যেতে হত। বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছেলেরা পায়ে হেঁটে আসত। মেয়েদের আসার প্রশ্নই ছিল না। রাস্তাঘাট তেমন ছিল না। জমির আল ধরে আসলে রাস্তা কম হত। এঁটেল মাটির সরানে চলা ছিল দায়। বর্ষায় সাইকেল চলতই না। অনেকটাই দূরে রাম-পুরহাটে কলেজ ছিল।
পণপ্রথা জগদ্দল পাথরের মত সমাজের বুকে চেপে বসেছিল। এখন কমলেও মুছে যায়নি। সাধারণ পরিবারের বিয়েতে প্যান্ডেল বা জাঁকজমক হতে দেখা যেত না। এক দঙ্গল বরযাত্রী বা কন্যাযাত্রী আসত না। আশেপাশের বাড়িতে বরযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা হত। বরযাত্রীরা ছই দেওয়া সাজানো গরুর গাড়িতে, বর ও কোলেবর পাল্কীতে আসত। আপ্যায়নে থাকত মুড়ি,ঘুঘনি,তেলেভাজা ও বুদিয়া। অবস্থা বিশেষে লুচি,সব্জীও মিষ্টি। এখন সে রামও নেই, নেই অযোধ্যাও।
দিন বদলেছে। এখন সব রাস্তাই পাকা। বাস ট্যাক্সি,ম্যাক্সি,অটো ও টোটোর ছড়াছড়ি। চটকদার প্যান্ডেল, চোখ ধাঁধান ইলেকট্রিক ডেকোরেশন,ক্যাটারিং,ব্যান্ড পার্টি, ভিডিও আরও কত কী।
সে সময় পোশাক পরিচ্ছদে তেমন মাতামাতি ছিল না। না পরলে নয় তাই পরা। ইংলিশ কাট প্যান্ট কম দেখা যেত। ছেলেমেয়ে উভয়ে দড়ি ভরা প্যান্ট পরত। ছেলেদের শার্ট ও ছোট মেয়েদের ফ্রক পরতে দেখা যেত। বড় মেয়েরা শাড়ি ও মুরগি হাতা ব্লাউজ পরত। বয়স্কদের ধুতি ও ফতুয়া, বয়স্কাদের সেমিজ সাথে শাড়ি পরার চল ছিল।
সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। আর্থিক অবস্থা বদলে গেছে। ছোট-বড় ছেলেরা জিন্সের প্যান্ট পরতে অভ্যস্ত। বড়দের হাঁটু বা বিভিন্ন জায়গায় ছেঁড়া (রিপড জিন্স)প্যান্ট পরতে দেখা যায়। মেয়েদের টপও শর্টস পরার জোয়ার এসেছে। এছাড়া “প্লাজো” ব্যবহারে এসেছে।
বীরভূমে শীতের প্রকোপ উত্তরবঙ্গের মত নয়। জুতো মোজার চল খুব একটা দেখা যেত না। শোয়েটারের বদলে গায়ে চাদর দিলেই চলত। চাদরের অভাবে ছোটদের বাবামায়ের ধুতি বা শাড়ি মাথা ও শরীর ঢেকে ঘাড়ের কাছে গিঁট দিয়ে দেওয়া হত। তাদের অন্য গ্রহের লোক বলে ভাবাটা অমূলক ছিল না।
আর্থিক অবস্থার অদলবদল,যুগধর্ম সর্বোপরি পাশ্চাত্য প্রভাব ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কারে আমূল পরিবর্তন এনেছে। বাঙালীয়ানার আর কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। তবে স্বামী বিবেকানন্দ,কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও ঈশ্বর চন্দ্রের দেশ যেন অসম্মানিত না হন সেদিকে আমাদের দৃষ্টি রাখা একান্ত কর্ত্তব্য বলে মনে করি।
অগ্রহায়ণের বিশেষ আলেখ্য
শ্রীপাট খড়দহের রাস উৎসব : ঐতিহ্য ও স্মৃতি
কুমকুম ঘোষ
দক্ষিণবাহী গঙ্গা নদীর পূর্ব পাড়ে খড়দহ গ্রামটি এখন উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার অন্যতম প্রাচীন শহর। বৈষ্ণব আন্দোলনের ধারায় নদীয়া শান্তিপুরের পরে খড়দহ ও পানিহাটি , পাশাপাশি অবস্হিত দুটি অঞ্চল বিশেষ স্হান অধিকার করে। বিশেষত পানিহাটি যেমন স্বয়ং চৈতন্যদেবের পদস্পর্শে ধন্য তেমনি খড়দহ গ্রামটি প্রভুপাদ শ্রী নিত্যানন্দের স্পর্শ ধন্য।
আনুমানিক ১৫০০খ্রীষ্টাব্দে নিত্যানন্দ স্ত্রী জাহ্নবী দেবীকে নিয়ে খড়দহ গ্রামে আসেন করেন বসবাস করবেন বলে। এই ঘটনার উল্লেখ আছে "চৈতন্য ভাগবতে"-
--"তবে আইলেন প্রভু খড়দহ গ্রামে।
পুরন্দর পন্ডিতের দেবালয় স্হানে।।
খড়দহ গ্রামে প্রভু নিত্যানন্দ রায়।
যত নৃত্য করিলেন--কথন না যায়।''
এইভাবে বৈষ্ণবীয় ধারার এক অন্যতম ও প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল খড়দহ গ্রামে।উনিশ শতকের বিখ্যাত রসগায়ক রূপচাঁদ পক্ষীর" গানেও কলকাতার উত্তরে অবস্থিত খড়দহ গ্রামকে"গুপ্ত বৃন্দাবন" বলে উল্লেখ করা হয়েছে ও সেখানকার--"ঝুলন দোল নিত্যরাস শ্রীকৃষ্ণ বিলাস" সঙ্গীত রূপে এসেছে। এই সব উৎসব ই অনুষ্ঠিত হতো এবং বর্তমানে ও প্রচলিত এই অঞ্চলের প্রধান দেববিগ্রহ শ্যামসুন্দর কে কেন্দ্র করে।
নিত্যানন্দ পুত্র বীরভদ্র গোস্বামী ১৫৭৫ খ্রীষ্টানদের মাঘী পূর্ণিমার দিন এই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে একটি মাত্র পাথর থেকে তিনটি মূর্তি নির্মাণ করা হয় : খড়দহের (উঃ২৪পরগণা) শ্যামসুন্দর, বল্লভপুরের(হুগলি) বল্লভজী ও সাঁইবোনা(উঃ২৪পরগণা)র নন্দদুলাল রাঢ়বঙ্গের প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ তিন বিগ্রহ। খড়দহের রাস উৎসব তাই ঐতিহ্য ও গরিমায় বাংলার অন্য অঞ্চলের রাস উৎসব (শান্তিপুর, কোচবিহার) এর মত ই তাৎপর্যপূর্ণ ও আপন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
প্রতি রাসপূর্ণিমার গোধূলি লগ্নে ফানুশ উড়িয়ে রাস উৎসবের সূচনা হয় এবং গোস্বামী পাড়ার শ্যামের মন্দির থেকে শ্যাম-রাধার যুগল মূর্তি সুসজ্জিত চতুর্দোলায় করে ভক্তবৃন্দ রাসখোলা ঘাট(গঙ্গার তীরবর্তী) এর রাসমন্দিরে নিয়ে যান।পুরো পথটি সেসময় ভক্ত দর্শক ও কীর্তনীয়াদের ভিড়ে ছয়লাপ হয়ে যায়। আজ ও তার বিরাম নেই। প্রতিদিন রাসলীলা সেরে পরদিন ভোর ৪টে নাগাদ (সূর্য ওঠার আগেই) আবার পাল্কিতে করে শ্যামসুন্দর ফিরে আসেন নিজের মন্দিরে।
চারদিন শ্যামসুন্দরের চার বেশ। প্রথমদিন তিনি "নটবর" বেশে , দ্বিতীয় দিন " রাজবেশ" এ এবং তৃতীয় ও চতুর্থ দিনে তিনি " রাখাল বেশ" ধারণ করে ভক্তবৃন্দ কে রসপ্লাবনে আপ্লুত করেন। চতুর্থ দিনে শ্যামসুন্দর ভোরবেলা র পরিবর্তে দুপুরে বের হন রাসমন্দির থেকে এবং ঠিক গোধূলির সময়ে মন্দিরে ফিরে আসেন।এই ফেরার সময় পথের দুপাশে র সমস্ত বাড়ী থেকে শ্যামসুন্দর কে ফল মিষ্টি নিবেদন করা হয়।এই শেষ দিনের আর একটি বিশেষত্ব "বিরাট ভোগ"।
শ্যামসুন্দর মন্দিরের মূল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার পর মন্দিরের দরজাটি বন্ধ করে দেওয়া হয় কিন্তু মন্দিরের প্রবেশ পথের মূল ফটকটি খুলে দেওয়া হয়। নাটমন্দরে রাখা থাকে একটি "বিরাট" লোহার গাড়ি,যেটি পরিপূর্ণ থাকে "খিচুড়ি ভোগ।স্হানীয় যুবক ও ভ7ক্তবৃন্দ বালতি করে "খিচুড়ি লুট" করেন এবং সেই ভোগের খিচুড়ি অত্যন্ত ভক্তিসহকারে বাড়িতে নিয়ে যান।
এইভাবে শেষ হয় চারদিনের রাস উৎসব কিন্তু বৃত্তাকার রাসমঞ্চকে ঘিরে হরেক পসরা সাজিয়ে মেলা চলে প্রায় একমাস ব্যাপী।
কাঁচের চুড়ি,নকল গহনা, ছেলেভোলানো খেলনা, কাঠের নাগরদোলা, ঘোড়ার দোলনা, গ্যাস বেলুন, ছুড়ি কাটারি দা হাতা খুন্তি থেকে "জামাই" এর জিলিপি আর "জয়দেবদা" র আলুর চপ, চিংড়ির চপ, ঘুগনি,গঙ্গার ধার ঘেঁষে বসা খোসাসুদ্ধ বাদাম ভাজা ভুট্টা ভাজার সুবাস ও স্মৃতি আজ ও ভোলে না এক বালিকা হৃদয়।
অ্যানুয়াল পরীক্ষার ফাঁকে অভিভাবকদের থেকে অনুমতি নিয়ে একটু রাসের মেলা থেকে ঘুরে আসার ফাঁকে চট করে কাঠের নাগরদোলা চেপে নেওয়ার দুরন্ত মজা, দরদাম করে চুড়ি কেনা কিংবা পুতুল খেলার সংসারের জন্য ছোট্ট ছোট্ট অ্যালুমিনিয়াম এর হাঁড়ি কড়াই কেনার বায়না ও বিক্রেতার "লে লে বাবু ছ'আনা' ডাকটা আজো হেমন্তের সন্ধ্যায় স্মৃতি পথে ভিড় করে আসে।
(ছবি- লেখিকা )
রাসমেলা ....স্মৃতিচারণ..
বিপ্লব তালুকদার
হেমন্তের শেষে যখন সব উৎসব প্রায় শেষ, তখন কোচবিহার, নবদ্বীপ সহ সারা রাজ্যে পালিত হয় এই রাসমেলা। মেলা তো নয় এক মিলন মেলা।
আমাদের এদিকে রাসমেলা বলতে আমরা সবাই কোচবিহারের রাসমেলাকেই বুঝি। এতো বড়, এতো বিপুল সম্ভার আর কোনো মেলায় দেখিনি।
আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন আমরা ফালাকাটা থাকতাম। রাসমেলা শুরু হলেই বাবা আমাদের কল্যানী বাসে করে কোচবিহার নিয়ে যেতেন। ওখানে আমার মামাবাড়ি। কাজেই একটা আলাদা আনন্দ ছিলো। পৌঁছে যেতাম বিকেল নাগাদ। রাস্তায় যেতে যেতে তাকিয়ে দেখতাম এবার কোন সার্কাস এসেছে। মেলার অন্যতম আকর্ষণ এই সার্কাস। মামাতো ভাইদের সাথে মামার সাথে রাতের শো দেখতে হাজির হতাম সার্কাসের তাঁবুর সামনে। কারণ রাতে নানান রঙিন আলোয় সার্কাসের এরিনা মায়াবি আলোয় ভরে উঠতো। এই মেলায় একবার দুটো সার্কাস এসেছিলো। একটা ইন্দিরা সার্কাস, অপরটি ছিলো অলিম্পিক সার্কাস। মেলায় আকর্ষণীয় ছিলো জেমিনি পুতুল নাচ। এটা ভীষণ আনন্দ দায়ক ছিলো। এই পুতুল নাচে মুজিবর হত্যা পালা দেখেছিলাম। তাছাড়া এরা সবসময়ই তৎকালীন দিনে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী তুলে ধরতো। এখন আর এসব আসে না। আর ছিলো মদনমোহন ঠাকুর বাড়ির পুতনা রাক্ষসী সহ নানা পুতুল দেখা এবং রাস চক্র ঘোরানো। ওই চক্র না ঘোরালে মেলা দেখা সম্পুর্ণ হতোনা। ছোট ছিলাম বলে হাত পেতাম না, তাই বাবার কাধে চড়ে ঘোরাতাম। এছাড়াও ছিলো নাগরদোলা, চরকি সহ নানান চড়ার জিনিস। আমাদের মামাবাড়ির পাশেই ছিলো মেলা। তাই দুপুরেই আমরা ছোটরা একা ঘুরে আসতাম। সঙ্গে ছিলো জিলিপি খাওয়া। ওহ্ জিলিপি নিয়ে চলতো কারিগরদের প্রতিযোগিতা। আর একটা জিনিস মেলায় ছিলো, যা গতবছর গিয়ে পাই নি। তা হলো মদনমোহন বাড়ির রাস্তায় একটা ধুমপান কোম্পানির গেট ছিলো, তাতে একটা সিংহের মুখ ছিলো। যেটা একবার ভিতরে ঢুকে যেতো আবার বাইরে বেড়িয়ে আসতো।
এটাই সম্ভবতঃ এক মেলা যেখানে শীতের পোশাক, কাঠের আসবাব সহ গৃহস্থালীর নানান জিনিস পাওয়া যায়। এখন তো দেখি গাড়ির শোরুম আছে। সকাল থেকে সারা রাত মেলা চলে। একটা সময় প্রায় প্রত্যেক বছর যেতাম। তারপর সময়াভাবে আর যাওয়া হয়নি। গতবছর বন্ধু শৌভিকের আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। ভীষণ ভালো লেগেছে। দুই বন্ধু গলা ধরে সারা মেলা বেড়িয়েছি।
রাসমেলা এক অমোঘ আকর্ষণীয়। আবার আসছে মেলা।
রাসের চাঁদ
সুব্রত কান্তি হোড়
কার্তিক পূর্ণিমার রাতে বৈষ্ণবেরা রাধাকৃষ্ঞের যুগল মূর্তির আরাধনা করে।আলপনা রাঙানো উঠোনের পূর্বকোণে চাঁদোয়ার নীচে মঞ্জরীভরা তুলসী গাছের ঝাড়ে। জ্যোৎস্নার শুভ্র মায়াবী আলোয় ভজনপ্রেম অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে, মধুর রসের ঘনীভূত আধারে। অষ্টসখী জমকালো পোশাকে 'হল্লীবক নৃত্যে' মাতে রাধাকৃষ্ঞের সাথে। বৈষ্ণবের শান্ত চোখে ব্রহ্মের হ্লাদ ভক্ত ও ভগবানের মিলনোৎসবে। ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া কেদার রাগে আলাপ জমায় আঁড়বাঁশিতে সুগন্ধী ধূপ আর রঙিন ফুলে ভগবানও বুঁদ হয়ে যায় ভক্তের ডাকে। শত্রুও মিত্র হয়ে যায় রাস পূর্ণিমার উজ্জ্বল চাঁদের হাতছানিতে।বৈষ্ণবীয় রাসের মূর্তিরাজানুগ্রহে পরিবর্তিত শাক্ত আরাধনার পটে। চৈতন্যজন্মভূমি নবদ্বীপের চাঁদরাসের রাতে আনন্দে বিগলিত বহুমতের মিলনক্ষেত্রে।
রাস পূর্ণিমায় গোল দুধসাদা চাঁদের আলোয় আলোকিত নীলাকাশের ছায়ায় বিশ্বের বৈষ্ণবেরা রাধাকৃষ্ঞের প্রেমে ভজন আরাধনায় মেতে ওঠে। শান্তিপুরে রাস পর্বে দেশ-বিদেশ থেকে বৈষ্ণবীয় মতের ভক্তের সাথে সাধারণ মানুষেরও সমাগম হয়, রঙ্গতামাসায় মেতে ওঠে।নবদ্বীপেও পটপূজা উপলক্ষে সেইরকম বহু লোকের সমাগম হয়। পটপূজা আদতে নানারকম মূর্তির পূজা—জগদ্ধাত্রী, বিন্ধ্যবাসিনী,কালী, দশভুজা, অন্নপূর্ণা প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্তি। নদীয়া, বুইচপাড়া ও তেঘরির প্রায় প্রত্যেক পল্লীতেই এক একখানি করিয়া প্রতিমা হয়। প্রতিমাগুলি অত্যন্ত হালকা এমন কি ৫/৬ জন মজুরে তাহা স্কন্ধে করিয়া নাচাইতে পারে।
পটপূজার বিসর্জনের দিন সকল প্রতিমা নির্দিষ্ট স্থানে আনা হয়। এরপর দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য শোভাযাত্রা বের হয় দ্বিপ্রহর থেকে সব প্রতিমাকে একত্রিত করে।কৃষ্ণনগরে একে আড়ঙ্গ বলে।
গুরু নানক
বেলা দে
গুরুনানক মধ্যযুগের সমস্ত ভক্তসাধকদের মধ্যে অন্যতম কোনরকম উচ্চনীচ ভেদাভেদ
না করে সমস্ত মানুষকে আপন করে নিয়েছেন তিনি, মানবসেবায় চালু করেছেন লঙ্গরখানা,
সকল ধর্মের মানুষের একসাথে বসে খাওয়ার রীতি তিনিই প্রচলন করেছে, পাঞ্জাবের অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির আজও সে দৃষ্টান্ত বহন করে করছে, পরিবারসহ আমিও সেখানকার
সেবায়েতদের নিষ্টাভরা অক্লান্ত পরিসেবা কয়েকটা দিন পেয়ে কতটা আপ্লুত হয়েছি সে
আর বলার ভাষা নেই, ওদের দিনরাতের সেবাকর্ম কোনও ঐশ্বরিক ক্ষমতা আর গুরুজির আশির্বাদ ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়.
অন্ততঃ এটাই আমার বিশ্বাস। বাংলা ও কামরূপ(তৎকালীন আসাম) তখন মুসলিম
শাসকদের আক্রমনে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিদ্ধস্ত,হিন্দুদের মধ্যেও শৈবও বৈষ্ণবদের
দ্বৈরথ সৃষ্টি হয়েছিল, ক্রমশ ইসলামের প্রভাবে বৌদ্ধ আর হিন্দুধর্ম কোণঠাসা এমতবস্থায় গুরু নানক বাংলায় এসে মালদা এবং মুর্শিদাবাদ কিছুকাল অবস্থান করেন পরে ঢাকা যাবার পথে গোদাগিরি,গোপালপুর,কৃষ্ণগঞ্জ, এবং পাবনায় যাবার পথে রামদেব নামক এক সিদ্ধযোগীর
সাক্ষাৎ পান, তিনি গুরুজির পায়ে হাত দিয়ে শ্রদ্ধা জানান,কয়েকটা দিন দুজনে একসাথে
থেকে অধুনা বাংলাদেশ রওনা হলেন। গুরুনানক নিজে কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে যাননি। তার দর্শন ও বানীর উপর নির্ভর করে পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে শিখধর্ম। এই ধর্মে দশজন গুরুর উল্লেখ রয়েছে, তাদের মধ্যে গুরু নানক প্রথম। এদের সর্বপ্রকার বানী লিপিবদ্ধ রয়েছে শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে,যার নাম গুরুগ্রন্থসাহিব'। গ্রন্থটি গুরুমুখি লিপিতে লেখা।
ছবিতে কোচবিহার রাস মেলা
ফটো - শৌভিক রায়
(২০১২ থেকে তোলা ছবির কয়েকটি )
অগ্রহায়ণের বিশেষ অঙ্কন
শিল্পী - নিপা বিশ্বাস
শিল্পী- সুমন্ত সিকদার
অগ্রহায়ণের বিশেষ কবিতা
বড়দিন
রীনা মজুমদার
অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া সহজ নয়
সবাই হাঁটে না, পারেও না !
আঁধারের অবুঝ উন্মাদ হিংস্র জীবানু
এক বুক সত্যের রক্তমাংসে পেরেক ঠুকতে
পেরেছিল উল্লাসে মাততে l
আমি কেউ নই l আমি পৃথিবীর কেউ নই l
আমি নিঃস্ব l আমি মানুষের
স্বার্থপরতার জালে বন্দী !
পৃথিবীর জন্য , মানুষের জন্য সত্যের দ্বার
খুলে দেওয়া কি কোন অপরাধ ?
পোকা-কাটা শেকড় নিয়েও
উদ্ভিদের মতো
আমি, আমি বেঁচে আছি..
গীর্জায় কাকে খোঁজো !
মৃত্যুতেও , আমি বেঁচে আছি ..
ক্ষমার মাঝে , মানুষের মাঝে
সত্যকে করো জয় l
হে রাসূল
সব্যসাচী নজরুল
আইয়েমেজাহেলিয়াতে মানবতার আলোকবর্তিকা হাতে
হে রাসূল নূরের তাজাল্লীতে তুমি এলে এই ধরাতে।
নূর নবীজী তোমার আগমনে মৌবনে ফুলেল সুঘ্রাণ
পাখির কণ্ঠে প্রাণে প্রাণে গানে সূরলিত সারাজাহান।
পাপিতাপিরা দলে দলে হাত রেখে পুতপবিত্র হাতে
ইসলামের বাণীতে পরম শান্তি পেলো অমিয় সুধাতে।
শতত শুভ্রফুল মদিনার বুলবুল সৃষ্টির সেরা হে রাসূল
জানে অন্তর্যামী অধম আমি তোমার প্রেমেতে মশগুল।
হে রাসূল তুমি অকূলের কূল সৃষ্টিকুলসৃষ্ট তোমা কারণে
মানবজাতির মুক্তি নাই যে তোমার শাফায়াত বিহনে।
আমাদের বড়দিন
সুদীপ বাগ
সুমিষ্ট কেকের অচেনা স্বাদের শিশিরভেজা ভোর,
বাতাসে আজ শীতের শিহরণ, পরিযায়ী মন দোর।
রাস্তার যীশুর দল উলঙ্গ, কৌতূহলী চোখ,
মনে আশা - তোমাদের , আমাদের সবার দিন বড় হোক।
নিশি ভরা রঙিন খামে মদিরা ভরপুর,
আমরা খুঁজি ভরা পেটের আশ্রা, ক্ষিদে বড়ো অসুর।
নয়ন ভরে সিক্ত জলে দু-হাত ভরা অসুখ,
আমাদেরও কি বড়দিন আজ আশায় ভরা বুক ।
পথের যীশুর পথের ধারে রাস্তা জুড়ে নিয়ন,
পেট দুটু যে ভরলো না মা!
শুধুই রঙিন আলোয় শয়ন !
রাস উৎসব
রীতা মোদক
হেমন্তের শিশির ভেজা রাতে যখন
পূর্ণিমার আলোয় সেজে ওঠে নিধুবণ
গোপিনীরা তখন মেতে ওঠে,
তাদের চাঁদ বদন কৃষ্ণকে ঘীরে।
ললিতা বিশাখার নূপুরের আওয়াজ
আর কৃষ্ণের বংশী ধ্বনি
আজও ভেসে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে...
ওদিকে অভিমানীনি রাধিকার চোখের জলে
যমুনার জল আরো কালো হয়।
কানাই তখন সব সখীদের ফেলে
ফিরে আসে প্রিয়তমা রাধিকার কাছে।
সখীরা তাদের সাজায় ফুল চন্দন দিয়ে।
আজ যুগল চড়েছে ফুলের দোলায়
ময়ূর নাচে পেখম তুলে
রাধা কৃষ্ণকে ঘীরে গোপিনীদের নৃত্য গীতে
পরিপূর্ণতা পায় রাস উৎসব।
রাসূল মুহাম্মাদ
রোমানুর রোমান
আমার নবী শ্রেষ্ঠ তুমি
রাসূল মুহম্মদ,
স্মরণ করি ভালোবেসে
দিলেতে নাই খাদ।
তোমার থেকে আমরা জানি
স্রষ্টা হলেন এক,
শেষ বাণী তোমার দ্বারা
হয় রাসূলের থাক।
আল্লাহ স্বয়ং বন্ধু তোমার
শ্রেষ্ঠ তুমি তাই,
আমরা তোমার শেষ উম্মত
তাই সুপারিশ চাই।
বড়দিন
সঞ্জয় মল্লিক
প্রভু যীশু ,তোমার জন্ম কোথায়?
তোমার ধর্ম কি?
এ ভারত ভূমিতে তা সবার জানা নাই।
তবু এ ভারত তোমার জন্মদিনের আনন্দে মেতে ওঠে।
আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে।
মাতোয়ারা হয়ে বেরিয়ে পড়ে তোমার গীর্জাতে।
মাতোয়ারা হয়ে বেরিয়ে পড়ে চড়ুইভাতিতে।
এতটা মাতোয়ারা আর - বছরে হয়না,
ভারত বলে, বড়দিন পালন করছে।
হা,তারা মানে-প্রভু রাম,কৃষ্ণ,রামকৃষ্ণ,চৈতন্যদেবের
মতো যীশুও জন্ম নিয়েছিল মানুষের জন্য;মানুষের কাছে।
দেখতো এ ভারত তোমায় কত আপন করেছে।
একবার যদি দেখে যাও তুমি,যাবে অবাক হয়ে ,
এ পৃথিবীতে আর কোথাও তোমায় কি এমন আপন করেছে?
এ ভারত যুগযুগ গুনিজন দের সন্মান করেছে।
এ ভুবনের সবাইকে আপন করেছে।
এ ভারত ঈশ্বরের লীলা ভূমি,
আর তুমি তো বিশ্বপিতার প্রিয় সন্তান।
এ ভারত তোমায় দিয়েছে "বড়দিন"এর সম্মান!
উৎসব বাঙালির গর্ব
সুব্রত নন্দী
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ,
বাঙালির মননে জড়িয়ে আছে উৎসবের রঙ-বেরঙ।
কর্ম বিমুখ উৎসব মুখর বাঙালি জাতি,
এই লজ্জাজনক বদনাম ঘুঁচবে কবে?
উৎসবের শহর বলে কলকাতার সুনাম বিশ্বময়,
সত্যিই কী বাঙলা মেতে আছে শুধুই বাঙালির পার্বণে?
বাঙালিরা তো যে কোনো উৎসবেই মেতে থাকে,
জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নেয়।
বড়োদিনের উৎসবকেও আপন করেছে বাঙালি,
এখানেই যিশু মহম্মদ নানক একসাথে বন্দিত হয়।
আমরা সবাই এই এক জাতি এক প্রাণ হয়ে বাঁচতে চাই,
এটাই থাক না উৎসব মুখর বাঙালির গর্বের তিলক।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা, অগ্রহায়ণ, ১৪২৫
মুক্তগদ্য
ভাবনা
সুতপা মিশ্র
বাংলা শব্দ ভান্ডারে কত শব্দ, কত অক্ষর। সব শব্দের বিভিন্ন অর্থ, বিভিন্ন প্রয়োগ। আমি হঠাৎ করেই ক 'দিনের জন্য সারাদিন একা হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু অনুভব করলাম, যতটা আমি ভাবছি একা হয়েছি, কিন্তু সে অর্থে ততটা একা হতে পারিনি। আর ভালোবাসা কথাটা অত্যন্ত গুঢ় ও তাৎপর্য পূর্ণ। অতীব সত্যি, সেটার যে বিভিন্ন রূপ তাও যেন নতুন করে, নতুন ভাবে আমার ভাবনায় এলো। সেই ভাবনার কথাই এখানে আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই।
একা
বিশ্ব কবি সেই কবেই উৎসাহ দিয়েছিলেন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে 'বলে। এখনো আমাদের একলা চলার পথে ওই কথা গুলো আমাদের শক্তি জোগায়। আমরা কি সবাই একা? 'একা এসেছি, একা যাবো কেউ কারও নই 'এ ধরনের কথা প্রায়শঃই শোনা যায়। কিন্তু সত্যিই কি আমরা কেউ একা? বন্ধু বান্ধব, পরিবার, এমনকি অচেনা অজানা লোকেদের মাঝে কি করে একা হওয়া যায়! পথ চলতি লোক বেড়ানোর সাথে আলাপ হয়, সহোযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয় - একই পথে হেঁটে একই গন্তব্যে গেলে তবে কি আর একা থাকা হয়? পুজোর আসনে বসে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করার সময় কত ভাবনা যে মনের মধ্যে আসে তা হয়তো নিজেরাও জানিনা। মন নানা রকমের ভাবনা দিয়ে আমাদের এতো ব্যাস্ত রাখে যে কখনোই একা হওয়া যায় না। সমাজ সংসারে থেকে আমরা কেউই একা নই।
ভালোবাসা
'ভালোবাসা মানে আর্চিজ গ্যালারি ....'বহুল প্রচারিত একটি জনপ্রিয় বাংলা গান। তার কত অর্থ। মনের মধ্যে ভালোবাসা শব্দটি একটি অদ্ভুত মানে তৈরী করে। প্রতিটি মানুষ এই চার অক্ষরের শব্দটিকে শুনতে খুব ভালোবাসে। শব্দটিকে আমরা কতরকম ভাবে ব্যাবহার করি। নিজেদের শখ বোঝাতে আমরা বলে থাকি, আমরা গান শুনতে, ছবি আঁকতে, বেড়াতে, বই পড়তে ভালোবাসি। যে কোনো বাঝ্যিক বস্তুকে ব্যাবহার করাকে আমরা ভালোবাসা কথাটা দিয়েই বোঝাই। শব্দটি বড়ই কঠিন। ভালোবাসি বলতে সহজ সন্তানের প্রতি ভালোবাসা বাৎসল্য রসে, অপত্য স্নেহে পরিপূর্ণ।
বড়দের প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও সম্মান। বন্ধুদের ভালোবাসা সহজ সরল ও সুন্দর। স্বামী -স্ত্রীর ভালোবাসা নির্ভরতা, বিশ্বাস ও পারস্পরিক বোঝাপড়া। ভালোবাসা হীন জীবন বড়ই বেদনাদায়ক ও বিষন্ন। তাই বলি জীবনে কখনোই একা হওয়া যায়না, আর নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে পারলে জীবন আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।
গল্প
বখাটে
মৌসুমী চৌধুরী
সূর্য্য তখন সবে পশ্চিম আকাশে কমলা আলোর মায়া ছড়িয়ে সন্ধ্যের বুকে মুখ লুকোচ্ছে। চায়ের কাপ হাতে মনোরমা দেবী প্রতিদিনই এই সময়টা বারান্দায় এসে একান্তে বসেন। দিগন্তের দিকে চেয়ে একটা উজ্জ্বল দিনের ধীরে ধীরে ফুরিয়ে
যাওয়া দেখেন তিনি। কেমন যেন একটা
বিষন্নতা গ্রাস করে, বড়ই দ্রুত যেন ফুরিয়ে আসছে এ জীবন... এটাই তাঁর
একান্ত নৈমিত্তিক যাপন। এই সময়টা বাড়িতেও কেউ থাকে না। মা-মরা একমাত্র
নাতনী চার বছরের ঝিলিককে পার্কে খেলতে নিয়ে যায় বাড়ির রাত-দিনের কাজের মেয়ে মালতী। সূর্যাস্তের পরই ফেরে তারাও। ফলে এই সময়টা নিজের
মধ্যে নিজেকেই যেন হাতড়ে বেড়ান তিনি।
ভয়ানক মোটর দুর্ঘটনায় বছর তিনেক আগে বৌমা চলে যাবার পর ছেলেটা যেন কেমন হয়ে গেলো। কারও সাথে কথা বলতো না, নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিল কাজের মধ্যে। তারপর কোম্পানি ওকে একটা প্রজেক্টের ইনচার্জ করে পাঁচ বছরের জন্য পাঠিয়ে দিলো টেক্সাসে। সেই সময় থেকে এক বছরের নাতনী ঝিলিক তাঁর হাতেই মানুষ।।উঁনি চলে যাবার শোক অনেকটাই কেটেছিলো ছেলে-বৌমা-নাতনীকে নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ বৌমার অকাল-প্রয়াণটা যেন উপড়ে দিলো সংসারের শেকড়টা। অগত্যা এই বয়সে সংসারের হাল ধরতে হল তাঁকেই। এখন ঝিলিকই তাঁর জীবনের একমাত্র অবলম্বন। হঠাৎ খ্যাক্ খ্যাক্ করে বিশ্রী হাসির আওয়াজে চিন্তাজাল ছিন্ন হয় মনোরমা দেবীর। আবার সেই বখাটে ছেলেগুলো! এই হয়েছে এক বিপত্তি, কয়েকদিন হল চার পাঁচটা বখাটে ছেলে তাঁর বাড়ির চাতালে বসে গাঁজা টানে আর খিস্তি খেউড় করে। ওদের দলের পান্ডা ঝন্টু আবার এলাকার কাউন্সিলরের ডান হাত। কাল এত গালাগালি করার পর আজ আবারও এসেছে ছোড়াগুলো। তীব্র বিরক্তির ভাঁজ পড়লো মনোরমা দেবীর কপালে, " কি রে তোদের না বলেছি আমার বাড়ির চাতালে বসে গাঁজা টানবি না। বেরো বেরো...যত্ত সব মায়ে-তাড়ানো, বাপে-খেদানো অকাল কুষ্মান্ডের দল....!" গজ গজ শুনে এগিয়ে এলো দলের পান্ডা ঝন্টু, " বুড়িমা, বেশি ফ্যাচোর ফ্যাচোর কোরো না । একটু শান্তিতে টানতে দাও তো, সারাদিন শালা বড্ড ধকল গেছে।" তারপর, খ্যাক্ খ্যাক্ করে হেসে গলার স্বর চড়িয়ে বলে, "বাপ-মা আর কি খ্যাদাবে গো বুড়িমা! তারা তো
শালা দু'জনেই আমায় ফেলে কবেই সটকেছেন...শালা, লাঠি ঝ্যাঁটা খেয়ে খেয়ে, স্টেশন চত্বরে ঘুরে ঘুরে বড় হতেই দেখলুম এই দুনিয়ায় কেউ ভালোবাসে না। শুুধু শালা রাজনৈতিক দাদদের কাছে
আমাদের হেব্বি ডিমান্ড! হ্যাঃ, হ্যাঃ হ্যাঃ!"
সবাই একযোগে বিশ্রি গা-জ্বালানো হাসি
হাসতে লাগলো। তাড়াতাড়ি ঘরে চলে গেলেন মনোরমা দেবী। মনে মনে ভাবলেন, পাড়ার সবাইকে জানিয়ে এর একটা হেস্ত নেস্ত করতে হবে। তার বাড়ির চাতালটা পাড়ার রক নয়। যত্তসব....!
পরদিন ঝিলিকের জন্মদিন। সকাল থেকে বেশ ব্যস্ততায় কাটলো মনোরমা দেবীর। মা-মরা মেয়েটার হাজার আবদার- বয়নাক্কা সামলালেন সকাল থেকে। তারপর একটু বেলার দিকে ঝিলিককে নিয়ে রওনা হলেন কালীঘাটে পুজো দিতে। বৌমা থাকতেও ঝিলিকের জন্মদিনে কালীঘাটে পুজো দিতে যেতো।
স্টেশন তাঁর বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়, হেঁটেই যাওয়া যায়। বেলা বারো টা হলেও স্টেশন চত্বরে বেশ ভীড়। টিকিট কেটে রানাঘাট-শিয়ালদহ লোকালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ চোখ গেলো, রেল লাইনের পাশে গামলায় জল রেখে খালি গায়ে স্নান করছে সেই বখাটে ছোড়া ঝন্টুটা। তীব্র বিরক্তিতে ভরে উঠলো মনোরমা দেবীর মন। মনে মনে
ভাবলেন, পালের গোদাটাকে শায়েস্তা করতে পারলে সব কটা বখাটেকে জব্দ করা যাবে। ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। হঠাৎ
"গেল গেল " রব শুনে তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর নজর এড়িয়ে ছটফটে ঝিলিক কখন যেন নেমে গেছে রেললাইনে, আর তক্ষুনি প্রায় কাছে চলে এসেছে দ্রুতগামী দূর পাল্লার এক্সপ্রেস ট্রেনটি!... গোটা পৃথিবী যেন টলে উঠলো মনোরমা দেবীর চোখের সামনে... হঠাৎ দেখলেন ঝিলিককে বাঁচাতে চলন্ত ট্রেনের সামনে ক্ষিপ্র গতিতে
ঝাঁপাচ্ছে সেই বখাটে ঝন্টু। ঝিলিককে ধাক্কা দিয়ে লাইন থেকে সরিয়ে বাঁচাতে পারলেও ট্রেনের ধাক্কায় মুহূর্তে ছিটকে পড়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঝন্টু। দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটে গেলেন মনোরমা দেবী। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ঝন্টুর তখন শেষ নিঃশ্বাস পড়ছে... তাঁকে দেখেই রক্তাক্ত হাতটি তুলে কোনক্রমে বলে ওঠে, " আমাকে কেউ কোনদিন ভালোবাসেনি ঠাম্মা। বাসলে এমন বখাটে হতাম না গো আমি..."
ধানের ক্ষেতে ইঁদুর রাজা
মজনু মিয়া
কৃষক ধান ক্ষেত দেখে,মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো! বাতাসে ধান গাছ শুয়িয়ে দিয়েছে,এ সুযোগে ইঁদুর একটা ধানের ছরাও রাখেনি কেটে কেটে সব গর্তে নিয়ে গেছে।
দাদা গল্প বলতো,ইঁদুর ধানের সময় হলে সাতটা বিয়ে করে,তার পর তাদের সাথে নিয়ে গর্ত করতে থাকে।গর্ত একেক দিকে একেকটা করতে থাকে এরপর উপরে নিচে গর্ত করে কিছু দূর যায় আর ঢেরা বানায় তা থেকে আবার ছোট ছোট গর্ত করে তাতে কয়েকটা করে মুখ করে প্রতি মুখ দিয়ে ধানের ছরা কেটে নিয়ে ঢেরায় ভরতে থাকে এরপর নালগুলো পুরা করে ভরে গেলে ইঁদুর সাত ঢেরায় সাত বৌয়ের পেটে বাচ্চা দেয় তাতে ঢেরা ভরে যায় বাচ্চায় কিলবিল করে ঢেরা।ইঁদুর আনন্দে লাফায় আর বলে আমি রাজা দেখ আমার গোলা ভারা ধান ঢেরা ভরা পোলাপান।
এ গুলো শোনতাম আর হাসতাম,কিন্তু এখন যা বাস্তবে দেখি তাতে মনে হয় কথা সঠিক।
একদিন ধান কাটা দেখে কৃষক রাগে ক্ষোবে কুদাল নিয়ে এলো, কাটতে লাগলো মাটি বের হতে লাগলো একে একে গর্ত। কিছু দূর যায় আর ঢেরা বের হয়,প্রতি ঢেরায় চার পাঁচটা করে বাচ্চা আর ধান পুরতে পুরতে সাজিয়ে রাখছে সবাই মিলে খায় তাতে ধানের খোসা পরে আছে, এমনি করে যত গুলো গর্ত কাটা হলো অনেক গর্তের ঢেরায় বাচ্চা আর ধান। সব গর্ত খুড়া শেষে অনতত এক মণ হবে বের করলো, বাচ্চা মারলো পঁচিশ ত্রিশ টা হবে বুড়া ইঁদুর বের হয়ে বাঁচার জন্য দৌড়াদৌড়ি করলো কিন্তু দু চারটে ছাড়া বাকি সব ক'টা মারলো।তখন কৃষক রাগে ক্ষোভে বলে খাচ্ছর ইঁদুর, আমার ক্ষেতের ধান খাও আর রাজা সাজো আঃ!
সোনার প্রদীপ
সুপর্না চৌধুরী
তিনি বাল্যবিধবা, অশীতিপর বৃদ্ধা শান্তিলতা মুখোপাধ্যায়। বাল্যবিধবা হলেও হরা-ভরা সংসার তাঁর। দুই দাদা ও বৌদিরা গত হবার পর ভাইপো-ভাইঝি, তাদের ছেলে-মেয়ে, পাড়া-পড়শী নিয়ে বেশ জমজমাট সংসার তাঁর। বাবা ছিলেন এলাকার দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার। বসত বাড়িটি তাঁদের দুই শতাব্দীর ভারে জরাজীর্ণ। মাঝে মাঝে মেরামত করান শান্তিদেবী। ভাইপো-ভাইঝিরা কর্মসূত্রে ও বিবাহসূত্রে দু'একজন ছাড়া প্রায় সবাই বাইরে থাকে। যদিও প্রতিদিনই কি বোস্টন থেকে, কি পুনে থেকে ভাইপো-ভাইঝিরা ফোন করবেই। শান্তিদেবীর জীবনে পড়শীদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। পড়শীরাও যেকোন কাজেই তাঁকে পান। রাত-বিরেতে কারও অসুখ হলে তার পাশে দাঁড়ানো, কারও মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করা ইত্যাদি কাজ তিনি হামেশাই করে থাকেন। তাঁর কাছে জীবন এক উৎসব।
প্রায় দু'শো বছরের পুরোনো দূর্গাপুজো হয়ে আসছে শান্তিদেবীর বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে। প্রতি বছর তাঁর ভাইপো-ভাইঝি, নাতি-নাতনীরা যে যেখানেই থাকুক পুজোর সময় ঠিক এসে
হাজির হয় বাড়িতে। এ বছরও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। তারা সকলে পঞ্চমীর দিনই চলে এসেছে। এ বছর সকলে মিলে
সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বাড়িটার একাটা বন্দোবস্ত করে শান্তিদেবীকে তার নিজের কাছে পুনেতে নিয়ে যাবে বড়দার ছেলে মানিক।
তাঁদের একটি পারিবারিক সোনার প্রদীপ আছে। সেটিও প্রায় দুটো বছরের পুরোনো। ব্যবসার কাজে দুবাইতে
গিয়েছিলেন তাঁর ঠাকুর্দা স্বর্গীয় নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। সেখান থেকেই
পাঁচ কেজি ওজনের সোনার প্রদীপটি কেনেন তিনি। তাঁদের বাড়ির পারিবারিক প্রথা হল, সপ্তমীরর দিন সকালে ওই সোনার প্রদীপটিকে বয়ে এনে বাড়ির সবচেয়ে সাম্প্রতিকতম নতুন বৌ দূর্গা প্রতিমার সামনে রাখবে। বর্তমানে প্রদীপটি অবশ্য আর জ্বালানো হয় না।
ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বোধনের পর শান্তিদেবী মুখে ভুবনমোহিনী স্নেহের হাসি
ছড়িয়ে তাঁর নাত-বৌ তোর্ষাকে বললেন, "এবার তো প্রদীপ বয়ে নিয়ে আসার পালা তোর রে দিদিভাই। পারবি তো? যা ভারী প্রদীপটা।" তোর্ষা তাঁর এক ভাই-পোর ছেলের বৌ। নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের। বেশ উৎসাহ নিয়ে তোর্ষা বলে ওঠে, "নিশ্চয়ই পারবো পিসি- ঠাম্মা। পারবারিক প্রথা বলে কথা।" ওদের কথার মাঝে ভাইপো সুমিত বলে ওঠে, "প্রদীপটা
তো বাড়িতেই থাকে। আজকাল যা চুরি ডাকাতির ভয়। দিনকাল কি আর আগের মতো আছে? ওটার একটা ব্যবস্থা করলে হয় না?..." শান্তিদেবী তৎক্ষণাৎ বলে ওঠেন, "হ্যাঁ বাবা। আমারও তাই মনে হয়েছে। যদি প্রদীপটা কোন ভালো কাজে লাগানো যায়।" হঠাৎ তোর্ষা জিজ্ঞেস করে, "পিসিঠাম্মা, কুমারী পুজো হবে না? কুমারী কে গো?" শান্তিদেবী বলেন,"হ্যাঁ রে, হবে কুমারী পুজো। ওর নাম কুসুমিতা ঘোষ, ন' বছর বয়স। ওর বাবাটা একটা অটো চালাতো। শুনেছিলাম ওর বাবা নাকি খুব অসুস্হ। কে জানে কেমন আছে!"
এদিকে সপ্তমীর দিন সোনার প্রদীপটি বয়ে আনতে গিয়ে তোর্ষার হাত থেকে পড়ে গেলো। বুক কেঁপে উঠলো শন্তিদেবীর। এ তো কু লক্ষণ! সঙ্গে সঙ্গে
মনে মনে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এ প্রদীপ তিনি কোন ভালো কাজে ব্যয় করবেন।
মহাষ্টমীর দিন কুমারী পুজো। কুসুমিতা এলো ওর মায়ের সঙ্গে। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। শান্তিদেবী জিজ্ঞেস করেন, "তোর বাবা কেমন আছেন রে, কুসুমী?" কান্নাভেজা গলায় কুসুমীর মা
বলে, " না পিসীমা, একদম ভালো নেই। দুটো কিডনীই ওর খারাপ হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি কিডনী বদল করতে হবে। ডায়সলিসিস করে করে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের তো তেমন সামর্থ্যও নেই..."। শান্তিদেবীর চোখ ছলছল করে উঠলো। "আচ্ছা একটু অপেক্ষা কর। আমি আসছি," বলে তিনি ভেতরে গেলেন। পরিবারের সকলকে ডেকে পরামর্শ করলেন। তারপর সোনার প্রদীপখানা এনে কুসুমীর মায়ের হাতে তুলে দিলেন, " আমাদের পারিবারিক ঐতিত্যবাহী প্রদীপটি আজ আমি সর্বসম্মতিক্রমে তোমার হাতে তুলে দিলাম মা। এ দিয়ে তুমি তোমার স্বামীর চিকিৎসা করো। বাঁচাও ওকে..."। হা করে চেয়ে রইলেন কুসুমীর মা। উৎসবের আলোয় ঝলমল করে উঠলো কুমারী মা কুসুমীর মুখ...।
কবিতা
আমার শব্দ আমার প্রেম
শুভাশিস দাশ
গোলা ভরার এই মাসে আমি শব্দ তুলে রাখি
মাঠের ছড়ানো ধানে শব্দ পাই
দুধ সাদা বকের পালকে শব্দ পাই
কৃষাণ রমনীর ধান তোলা হাসিতে শব্দ পাই
এই অঘ্রাণ আমার কবিতার খাতা ভরিয়ে তোলে l
শিশির আর রোদের আলিঙ্গনে যে প্রেম ছুঁয়ে থাকে
আমি তাকে কুর্নিশ করি
শ্বাশত ভালবাসার জন্য সূর্যও নেমে আসে
ধানের শীষে l
প্রেমহীন
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
দুর্নিবার গতিতে ছুটে আসা প্রেম
ধাক্কা খায় অপরপ্রান্তের প্রেমহীন প্রাচীরে,
অবজ্ঞার অণু-পরমাণুগুলি ভাঙতে থাকে
হৃদয়ের আনাচে-কানাচে হয় কোষ-বিভাজন ।
শব্দেরা করে কানাকানি কথা জমে বুকের গভীরে
মন কেমনের পালা বদলায় নদীর স্রোতের বিপরীতে
কিছু কথা বুকের পাঁজরে ঘটায় বিস্ফোরণ,
এতদিনকার জীবনবোধ নিমেষে তালগোল পাঁকায় ।
শব্দেরা রাক্ষুসে ডানায় ভর করে
বাতাসে ওড়ে এলোপাথারি,লাগামছাড়া
পৃথিবীর মত মঙ্গল গ্রহেও মিলেছে প্রাণের সন্ধান
তবে সেখানকার প্রাণে প্রেম-সঞ্চার হয় কি ?
প্রেমিকা ২
সব্যসাচী সাহা
অনামিকা তোমায় প্রেমিকা বলে ডেকেছি।
বৃষ্টি ভেজা ঘাসে যে রোদ ফিরে আসে,
আমি একদিন তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাবো।
সে তোমায়, আমার পুরনো প্রেমিকার কথা বলে দেবে।
আমার শহরে রেখে এসেছি তাকে যত্ন করে
ছোটবেলার
সে আমার খুব ছোটবেলার।
বড় হয়ে গেলে গোপন জানালা থাকে না।
বড় হয়ে গেলে শিলিগুড়ি গার্লসের ছুটির ঘন্টা থাকে না।
বড় হয়ে গেলে সবাই কফিতে চুমুক দেয়
আমিও দিয়েছিলাম,
মেনুকার্ড ছাড়াই।
হংকং মার্কেট- খেলনা ঘড়ি, পেন, সবই রেখে এসেছি আজ।
কত সিক্রেট লাভ কোড। দার্জিলিং মেলের টিকিট।
উড়ন্ত শাটল কক এ কত জ্যোৎস্নাময়ী.......
এসব কথা কাউকে বোলো না
সাইলেন্ট..... কাউকে না।
শুধুই মেলা দেখি
দীপ্তিমান মোদক
তাদের কিছু স্বপ্ন শিশির ভেজা ঘাসে
কিছু স্বপ্ন জীর্ণ তাঁবুতে।
তাদের শীর্ণ দেহ বেড়ে ওঠে না
পোড়া ভাতের জন্য।
কিছু শব্দ,অপেক্ষার পোড়া বাটিতে।
কিন্তু খুচরো আজ প্রায় অচল।
তবুও স্বপ্ন দেখা মূল্যবান কাগজের।
বাঁশির সুরে স্বপ্ন দেখা
কেউ রাজকুমার, কেউ রাজকন্যা
নাগরদোলার পঙ্খীরাজে।
রঙিন রঙিন আলোর মাঝে।
শুধুই স্বপ্ন দেখা।
কেউ তাদের গায়ের পোড়া রং মুছতে পারে না।
আমিও পারি না।
নবান্নের স্বপ্ন
দীপান্বিতা মুখার্জী
যে পাখিরা উড়েছিলো নিরুদ্দেশে
আজ হঠাৎ মেঘের সিড়ি বেয়ে
নেমে এলো দলেদলে,
ভোরের শিশিরে স্নান সেরে ।
উঠোন জুড়ে ধান ,
মনে হয় সোনা ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ ।
আজ ওদেরও বলে এসেছি ,
যারা খাবার স্বপ্ন চোখে , ঘুমোতে যায়
প্রতিরাতে ।
এসো এই নবান্ন উৎসবে , মেখে নেব
ভালোবাসার ওম।
তোমায় দেখি
সঞ্চিতা
দাস
মেঘলা দিনে বাজিয়ে বাঁশী
যখন তোলো সুর,
পাইনে হদিশ কোথাও তোমার
তুমি যে অনেক দূর।
মেঘের মাঝে যখন তুমি
মূর্তি
ধরে দাও দেখা,
ওইটুকুতেই
শান্তি পেয়ে
ভুলি সকল দুঃখ-ব্যথা।
ঝলমলানি
ফুটলে আলো
তুমি হাস সেখান থেকে,
চোখ পায় না দেখতে তোমায়
মনটা তবু তোমায় দেখে।
তুমি যখন হাত বাড়িয়ে
আদর ভরে আমায় ডাক,
মেঘের মাঝে তোমায় খুঁজি
সত্যি তুমি সেথায় থাক?
ভুল যত কাজ শুধরে দিয়ে
করতে তুমি মানা,
তুমি ছিলে ছাতার মত
আগলে জীবন খানা।
তুমি রয়েছ মেঘের মাঝে
মাও কি তোমার কাছে?
বলনা বাবা কোন মেঘেতে
মা লুকিয়ে আছে?
জ্যান্তশব-৩
সুনন্দ মন্ডল
সবুজ ক্রমশ হলুদ
ঈষৎ পাণ্ডুর ঝলসানো পাতা....
হৃদয় তন্ত্রীতে সুরহীন গানের কথা
বিচ্ছিন্নতাবাদী মুখচোরা স্বরলিপি
বুড়ো হয়ে যাওয়া সমাজ
দেহের চামড়ায় ঝুলছে মানবিকতা।
দুম-দাম হুড়-মুড় সব বিস্ফোরণে
কালো ধোঁয়া ঢাকে মুখোশের মুখ
রোষের দহনে পুড়ছে কালো পিচ
জোড়াতারা হয়ে পড়ে থাকে খড়কুটো।
বুড়ো হয়ে যাওয়া মানুষ
অথর্ব সমাজের বুকে
জীর্ণ কাপড় তারের এককোনে ঝোলে
নগ্ন হলে তাকায়না কেউ নগ্নতা ভুলে।
অজানা প্রান্তে
শৌভিক কার্য্যী
কলমের কালি রোজ অশ্রু ঝরায়
মাঝে ব্যবধান এপার ও অন্তর ।
কাটাকুটির মাঝেও সৃষ্টির রচনায়
খুঁজে ফিরি তোকে নিরন্তর ।।
একটিবার ধরা দিয়ে যা এসে
হাত ছেড়ে ছুটে যাওয়া যেখান থেকে ।
অজানা প্রান্তে রোজ চিঠি লিখি আকাশে
অলিগলি কুড়িয়ে ফিরে আয় দেখে ।।
আজো প্রতিক্ষায় মেলা মাঠে
আঁচল টেনে ধরবি হাতে --
"মা ফিরেছি আমি"।
দাম
প্রসেনজিত রায়
রক্তের সাদা চামড়া নিংড়ে শেষ নির্যাসটুকু দিয়ে যাব
তবু যদি এই বেহায়া মনটা মানুষ হয়,
এত চায় কেন?
দেখতে পায় না--- ওদের তলপেটে নাভির ক্ষতচিহ্ন,
ওদের জল মেশানো হাড়
আর কাঁচা লংকা পান্তাভাতের মাখামাখি ভালোবাসা?
জলে-নুনে আমাদের ভালোবাসাটা পরিপূরক হোক না,
একদিন না হয় মিছিলে হাঁটি
একদিন শুই খরের বিছানায়
ঝোপের অন্ধকারে দুটো মোমবাতি জ্বালাই
ঝকঝকে আলোর দাম হবে।
সমুদ্রের সুখ বোতলে কেন ভরি?
ভাতের লড়াই থেমে ওদের শুকনো পাকস্থলীটা ভরুক,
কী হবে ও টাকায়?--- 'দাম' তো মায়ের একফোঁটা দুধে।
কচি হাতে