মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা:
সম্পাদকের কথা
বসন্ত সুখের বার্তা নিয়ে আসে নি এবা...: সম্পাদকের কথা বসন্ত সুখের বার্তা নিয়ে আসে নি এবার। মধুমাস বদলে গেছে আর্তনাদে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হচ্ছে। প্রতিনি...
Monday, March 4, 2019
সম্পাদকের কথা
বসন্ত সুখের বার্তা নিয়ে আসে নি এবার। মধুমাস বদলে গেছে আর্তনাদে।
অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হচ্ছে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে। দেওয়ালে পিঠ থেকে যাচ্ছে আমাদের। মরিয়া হয়ে উঠছি আমরাও। ঝরছে রক্ত, হারাচ্ছে প্রাণ। ছিন্ন হচ্ছে বোধ, বিপন্ন হচ্ছে মানবিকতা।
তাই এই বসন্ত রক্তক্ষয়ী...স্বজন হারানোর বসন্ত মাত্র।
তবু আমরা স্বপ্ন দেখি। তবু আশা নিয়ে বেঁচে থাকি শুধু এই কথা ভেবে যে, একদিন সুদিন আসবে, একদিন বসন্ত আসবে, একদিন মধুমাস আসবে।
জীবন মানেই তো স্বপ্ন।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
তৈমুর খান, যাজ্ঞসেনী, শ্যামলী সেনগুপ্ত, মীরা সরকার, বেলা দে, লক্ষ্মী নন্দী, কুমকুম ঘোষ,
সিদ্ধার্থ সিংহ, মনোনীতা চক্রবর্তী, শিবু মন্ডল, বেলা দে, নীলাদ্রি বিশ্বাস, অর্চিতা দাস,
জ্যোতির্ময় মুখার্জি, কাকলি মুখোপাধ্যায়, মৃণালিনী, মিঠু অধিকারী, মৌসুমী চৌধুরী, রাখী
সরদার, রীনা মজুমদার, কাকলি ভদ্র, ফিরোজ আখতার, শক্তিপ্রসাদ ঘোষ, রুনা দত্ত,
পারমিতা ভট্টাচার্য, সুব্রত নন্দী, শশী বালা অধিকারী, কৌশিক চক্রবর্তী, সঞ্চিতা দাস, সুব্রত
কান্তি হোড়, মজনু মিয়া, পাপিয়া চক্রবর্তী, নবনীতা সেন, সোমা বোস, সৌরভ ঘোষাল, রাখি
ব্রক্ষ্ম, রাতুল দত্ত, সত্য মোদক, দীপ্তিমান মোদক, খোকন বর্মন, ডঃ সঞ্জয় মল্লিক, সপ্তর্ষি
বণিক, অভিজিৎ জানা, সুনীল কুমার মন্ডল, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, দেবব্রত রায়, মৈনাক ঘোষ,
সুকন্যা সামন্ত, রোমানুর রহমান, সব্যসাচী নজরুল, বটু কৃষ্ণ হালদার, আশীষ দেব শর্মা,
জয়শ্রী রায় মৈত্র, রাজা বিশ্বাস, শুভম রায়
প্রচ্ছদ ছবি - শৌভিক রায়
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
প্ৰকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
যোগাযোগ- হসপিটাল রোড, কোচবিহার
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
বসন্ত ও শান্তিনিকেতন
শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব ও এক বালক
কুমকুম ঘোষ
অশোকে পলাশে রাঙা হিল্লোল ছড়িয়ে , নবীন কিশলয়ে নতুনের বার্তা নিয়ে প্রতিবার ঋতুরাজ বসন্তের আগমন ঘটে প্রকৃতির আনাচেকানাচে। কোকিলের ডাকে আবাহনী সুর--আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। পূর্ণ চাঁদের মায়ায় রচিত হয় উৎসবের আবহ। পলাশের রক্তিম উচ্ছ্বাসের জয়গাথা রচিত হয় দোলপূর্ণিমার শুভ তিথিতে। শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব সেই প্রাণের পূর্ণতা ও হৃদয়ের রঙীন ভাবনাকে চাক্ষুষ করে তোলে প্রতিবছরই।
এই উৎসব এখন আর গন্ডীবদ্ধ নয় ,এক আন্তর্জাতিক রূপ ধরেছে।তার পরিচয় পাঠকমাত্রই খোঁজ রাখেন সোশ্যাল মিডিয়া বা দূরদর্শনের দৌলতে। ১৯২৫ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে শান্তিনিকেতন বসন্তোৎসব পালিত হয় মূলতঃ বিশ্বভারতী চত্বরেই।
---"ওরে গৃহবাসী,খোল্ দ্বার খোল্,লাগল যে দোল/জলে স্থলে বনতলে লাগল যে দোল...হলুদ শাড়ি ও পাঞ্জাবী শোভিত আশ্রমে পাঠরত কিশোর/ কিশোরী : তরুণ/তরুণী/যুবক/যুবতী ; শিক্ষক/শিক্ষিকা সহ শান্তিনিকেতনের প্রায় সমস্ত মানুষ এতে সামিল হন। রবীন্দ্রনাথ রচিত বসন্তের গান ই গীতবিতানে সংকলিত আছে ছিয়ানব্বই (৯৬)টি।সেসব গান ও নাটকের অভিনয়ে সকালে আশ্রম মাঠ ও সন্ধ্যায় গৌরপ্রাঙ্গন মুখরিত হয়ে ওঠে প্রতি দোল পূর্ণিমার দিন।দেশ বিদেশের নানান অতিথিদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ স্থানীয় আদিবাসীদের এই উৎসবে সামিল করে যে বিশ্বজনীন ভালোবাসা ও মানবহৃদয়ের সুচেতনার এর বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।আজো বিশ্বভারতী সেই ধারা বহন করে চলেছে। কিন্তু এই আন্তর্জাতিক রঙের উৎসবে এক নবীন কিশোর কিভাবে নিঃশব্দে বিরাজ করেন তার কথা আমরা খুব কমই জানি। তিনি রবীন্দ্রনাথের অকালপ্রয়াত কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই পুত্রটি কবির অন্তরের ছায়াস্বরূপ ছিলেন,পিতা রবীন্দ্রনাথ তাঁর মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতেন অনেকসময়ই।
মৃণালিনী দেবী র মৃত্যুর সময় শমীন্দ্রনাথ চার বছরের বালকমাত্র।(জীবনকাল:-১৮৯৬-১৯০৭) । শান্তিনিকেতনের আশ্রমেই তার বেড়ে ওঠা।নানান কাজে তার উৎসাহ ছিল।তার মধ্যে অন্যতম ছিল "ঋতুরঙ্গ উৎসব"। প্রধানতঃ বালক শমী'র উৎসাহ ও উদ্দীপনা য় প্রাককুঠির এর সামনে শুরু হয় এই উৎসব।এই প্রাককুঠির এখন শমীন্দ্র পাঠাগার বলেই পরিচিত। প্রখ্যাত রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ও মনে করেন পরবর্তীতে যে বসন্তোৎসব কবিগুরুর তত্বাবধানে সূচিত হয়েছিল তার সূচনাটি ঐ ঋতুরঙ্গ উৎসব থেকেই। তিনি লিখেছেন--"যাহাকে ঋতুউৎসব বলে তাহার প্রবর্তক হইতেছেন রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ।১৩১৩ সালের শ্রীপঞ্চমীর দিন তাহার উদ্যোগে এই ঋতু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।শমীন্দ্রনাথ ও আরো দুইজন ছাত্র বসন্ত,একজন বর্ষা, আর তিনজন ছাত্র সাজে শরৎ"।শমীন্দ্রনাথ "একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণে, --প্রাণেশ হে" গানটি গেয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে।
এখানে উল্লেখ্য বিষয় সেসময় রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে উপস্থিত ছিলেন না।সে বছরই (১৯০৭) অকালে মৃত্যু হয় শমীন্দ্রনাথের--কিন্ত এক বালক সূচনা করে গেলেন ঋতুকে কেন্দ্র করে উৎসবের আবহ। হৃদয়ে বসন্তের একটুকু ছোঁয়া নিয়ে বিদায় নিল এক নবীন কিশোর , শুধু দিয়ে গেল এক বর্ণময় ঋতুউৎসবের ভাবনাটি।
(ছবি- সংগৃহীত)
(ছবি- সংগৃহীত)
শান্তিনিকেতনে পূর্ণিমা
মীরা সরকার
তোমার ভাবনা আমি ছুঁতে পারি
সে তুমি বোঝেনি কোনদিন। সর্পিল
গমনের পথ অতিক্রান্ত বসন্ত সন্ধ্যায়,
এক রুক্ষ প্রান্তরের প্রান্তে পলাশের বনে;
এখনো দাঁড়ায়ে স্মৃতি।
কেন যে মোছে না।
টুপটাপ ঝরে পড়ে নিস্তরঙ্গ বুকে।
তুমি আছো আমি আছি
জীবনের কাছাকাছি শান্তিনিকেতনে।
একরাশ গান,এক অপূর্ব পূর্ণিমা ।
কেউ না জানলো আমি তো জেনেছি
ভাবনার কাছে ,এর চেয়ে বড় উপহার
চাইনি আমরা।
মুঠোভরা বসন্তমাখা পলাশের রাশি।
আবার বলো 'ভালোবাসি ভালোবাসি
ভালোবাসি।'
বসন্ত নিবন্ধ
বসন্ত মানেই দোল
সিদ্ধার্থ সিংহ
শ্রীকৃষ্ণ তখন একেবারেই বালক। সারা গোকুল তার দুষ্টুমিতে অস্থির। গোপিনীরা মাথায় হাঁড়ি করে ননি নিয়ে হাটে যেতে ভয় পায়, কখন দলবল নিয়ে সে হামলা চালায়! তবু সকলের কাছেই সে ছিল নয়নের মণি।
কিন্তু অন্যান্যদের তুলনায় গায়ের রং একটু চাপা হওয়ায় তার মনে নিশ্চয়ই একটা কষ্ট ছিল। তাই একদিন সে তার পালিকা মাকে বলেই ফেলল, মা, রাধা-সহ সব গোপিনীরাই এত ফরসা, কিন্তু আমার রং কালো কেন?
এ কথা শুনে মা যশোদা ঘর থেকে কিছুটা আবির এনে তার সারা গায়ে মাখিয়ে দিলেন এবং বললেন, যাও, এই আবির সবাইকে মাখিয়ে দাও। তা হলে কেউ আর কালো বা ফরসা থাকবে না। সবাই সমান হয়ে যাবে।
মায়ের কথা শুনে সে সঙ্গে সঙ্গে ছুটল গোপিনীদের আবির মাখাতে। ব্যাস, সবাই মজা পেয়ে গেল। আর সেই যে শুরু হল, তার পর থেকে সেই দিনটাই চিহ্নিত হয়ে গেল সবাই সবাইকে আবির মাখানোর দিন হিসেবে। আর সেই জায়গাটাও নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট হয়ে গেল দোলমঞ্চ হিসেবে। যত দিন গেল গ্রামে গ্রামে গজিয়ে উঠতে লাগল নতুন নতুন দোলমঞ্চ। যেহেতু সেই দিনটা ছিল পূর্ণিমা, তাই সবার কাছে সেটা হয়ে গেল দোল পূর্ণিমা। মানে ফাল্গুনি দোল পূর্ণিমা।
শুধু এ দেশেই নয়, এশিয়া মহাদেশের নেপাল, দক্ষিণ আমেরিকার সুরিনাম, উত্তর আমেরিকার ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, ওশেনিয়া অঞ্চলের ফিজি, আফ্রিকা মহাদেশের মরিশাস ছাড়াও যেখানেই ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা আছেন, সেখানেই জাঁকজমক করে প্রতি বছর পালন করা হয় দোল উৎসব। দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানাতে তো দোলটা আবার রীতিমত জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের সময়ে দোল অন্য মাত্রা পায়। নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক এই উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠে। আজও প্রতি বছর দোলের দিন সকালবেলায় প্রভাতফেরি বের করে আশ্রমিকেরা। তারা দল বেঁধে--- ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল' গানটি গেয়ে বসন্তোৎসবের সূচনা করে। সন্ধ্যাবেলায় গৌরপ্রাঙ্গণে কবিগুরুর কোনও না কোনও নাটক মঞ্চস্থ হয়।তা দেখতে শুধু এ দেশের নানা কোণ থেকেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ভিড় করে।
চোদ্দোশো এক সালে বাংলাদেশেও রঙের উৎসব শুরু হয়। সেই থেকে আজও ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’ প্রত্যেক বছর খুব ঘটা করেই আয়োজন করে এটা। যদিও এখন তার আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যত্রও।
এক সময় শুধু আবিরই ব্যবহার করা হত। বলা হত, আবির গায়ে মাখলে নাকি বসন্ত রোগের প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে, মানুষ ততই আবিরের বদলে ব্যবহার করতে শুরু করেছে বালতিতে গোলা রঙিন জল। ব্যবহার করা শুরু করেছে পিচকারি। যাতে কেউ রং দেখে ছুটে পালাতে গেলেও দূর থেকেই তাকে রাঙিয়ে দেওয়া যায়। যিনি রং মাখতে চান না, তাকে জোর করে রং মাখানোর আনন্দই যেন আলাদা। পাড়াতুতো দেওর বউদিদের খুনসুটি মাখানো রং খেলা তো সর্বজনবিদিত। স্কুল কলেজ বন্ধ থাকে বলে আগের দিনই রংচং নিয়ে ভূত সাজে ছাত্রছাত্রীরা। প্রচুর প্রেমের সূত্রপাতও হয় এই দিন।
তারও পরে রঙের পাশাপাশি দোলের অঙ্গ হয়ে ওঠে পঁচা ডিম, মোমের ফুচকা, মোবিল, এমনকী কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি অত্যন্ত বিপজ্জনক নানান রংও। যা হাজার চেষ্টা করেও এক-দু’দিনে ওঠানো তো দূরের কথা, এক সপ্তাহ পরে তোলাও প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। শুধু তা-ই নয়, ওই রং যে চামড়ার পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক, তা ব্যবহারকারীরাও জানেন।তবু ব্যবহার করেন। শোনা যায়, ওই রঙের জন্য কারও কারও চোখও নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।
শহরের বাইরের ছবিটা অতটা ক্ষতিকারক না হলেও বেশ কদর্য। কাছাকাছি ডোবা না থাকলে শুধুমাত্র দোলের জন্যই রাতারাতি ছোট ছোট ডোবার মতো গর্ত করে তাতে আগে থেকেই গোবর জল গুলে রাখা হয়। সেখানে লোকজনকে ফেলে নাকানি চোবানি খাওয়ানোর মজাই নাকি আলাদা। কোথাও আবার বালতি করে নোংরা জল লুকিয়ে লুকিয়ে এনে পেছন দিক থেকে আচমকা কারও মাথায় ঢেলে দেয়। আর এ সব করতে গিয়ে কিছু ছেলেপুলে যে কোনও মেয়ের সঙ্গে অশালীন ব্যবহার করে ফেলে না, তাও নয়। আর তা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় গণ্ডগোলও কম হয় না। তার ওপরে, এই দিনে বেশ কিছু উঠতি ছেলেমেয়েদের মধ্যে মদ খাওয়ার প্রতি একটা প্রবল প্রবণতা দেখা যায়। তাই প্রশাসনের তরফ থেকে বারবার আগাম সতর্কবার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায় টহল দেয় সাদা পোশাকের পুলিশ। ধরপাকড় চালায় একই বাইকে তিন-চার জন মিলে হুল্লোড় করতে করতে যাওয়া উৎশৃঙ্খল বাইক আরোহীদের। ফলে এক সময় যা ছিল নিখাদ আনন্দের, রং মাখানোর পরে মিষ্টিমুখ করানোর সামাজিক রীতি, আস্তে আস্তে তা উধাও হয়ে যায়।
দোল আসলে হিন্দু সভ্যতার প্রাচীন উৎসব। তাই নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পূরাণ ও জৈমিনি মীমাংশা’তেও রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। তিনশো খ্রিস্টপূর্বাব্দের এক শিলালিপিতেও রাজা হর্ষবর্ধনের ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ দেখতে পাই।
অনেকেই এই দোলের সঙ্গে ‘হোলি’কে গুলিয়ে ফেলেন। আসলে হোলি আর দোল কিন্তু এক নয়। সম্পূর্ণ আলাদা।
স্কন্দ পুরাণ থেকে জানা যায়, দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর ভাই হিরণ্যাকের মৃত্যু হয় বিষ্ণুর হাতে। তখন ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শোকে মুহ্যমান হিরণ্যকশিপু কঠোর তপস্যায় বসেন। তাঁর সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে বর দেন--- না জলে, না স্থলে, না ঘরে, না বাইরে, না রাতে, না দিনে, না আকাশে, না মাটিতে, না অস্ত্রে, না শাস্ত্রে--- কোথাও, কোনও কিছুতেই তাঁর মৃত্যু হবে না। শুধু তা-ই নয়, নাগ, অসুর, দানব, গন্ধর্ব, দেবতা, পশু, মানুষ, যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর, দিকপাল, লোকপাল, প্রজাপতি--- এক কথায় ব্রহ্মার যত সৃষ্টি আছে, তারা কেউই তাঁকে হত্যা করতে পারবে না।
এই বরে হিরণ্যকশিপু এতটাই ঔদ্ধত্য হয়ে উঠেছিলেন যে, ক্রমশ দেবতাদেরই তিনি অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। বিশেষ করে বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন বিষ্ণুর। কারণ, এই বিষ্ণুর হাতেই বধ হয়েছিল তাঁর ভাই।
তাঁর ছেলে প্রহ্লাদ যেহেতু বেশ কিছু দিন নারদের হেফাজতে ছিল, তাই সে হয়ে উঠেছিল পরম বিষ্ণুভক্ত। সে এতটাই ভক্ত হয়ে উঠেছিল যে, সে জন্য তার নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ‘ভক্ত’ শব্দটা। তাই প্রহ্লাদ থেকে সে সবার কাছে হয়ে উঠেছিল---ভক্ত প্রহ্লাদ।
তাঁর চরম শত্রু বিষ্ণুর প্রতি ছেলের এই পরম ভক্তি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না হিরণ্যকশিপু। তাই সেই ভক্তি দূর করার জন্য ছেলেকে তিনি নানা ভাবে বোঝাতে লাগলেন। লোভ দেখাতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও কোনও ফল না হওয়ায় তাকে জব্দ করার জন্য তিনি নানা রকম শাস্তি দিতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও ছেলের কোনও হেলদোল না দেখে তিনি শেষ পর্যন্ত কঠিন কঠোরতম পথই বেছে নিতে বাধ্য হলেন। স্থির করলেন তার মৃত্যুদণ্ড।
কখনও ক্রুব্ধ দৈত্যরাজ মশানে গিয়ে প্রহ্লাদের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করার হুকুম দিলেন। কখনও বদ্ধঘরে বিষধর সাপ ছেড়ে দিতে বললেন। কখনও পাগলা হাতির পায়ের সামনে তাকে ছুড়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। কখনও আবার হাত-পা বেঁধে গলায় বিশাল বড় পাথরের চাঁই বেঁধে অতল সমুদ্রে ফেলে দিতে বললেন। আর প্রতিবারই একের পর এক নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে লাগল ভক্ত প্রহ্লাদ।
তখন একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে হিরণ্যকশিপু স্মরণাপন্ন হলেন তাঁর বোনের। তাঁর বোন ছিলেন হলিকা রাক্ষুসি। তিনি তপস্যা করে দেবতাদের কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন, আগুন তাঁকে কখনও পোড়াতে পারবে না। তাই হিরণ্যকশিপু তাঁকে পরামর্শ দেন, তাঁর ছেলেকে নিয়ে জলন্ত আগুনে প্রবেশ করার জন্য। যাতে তাঁর ছেলে আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যায়।
হিরণ্যকশিপুর নির্দেশে তাঁর লোকজনেরা প্রচুর কাঠকুঠো স্তূপীকৃত করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলেন। আগুন দাউদাউ করে জ্বলতেই দাদার কথা মতো ভক্ত প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে তিনি সেই আগুনের মধ্যে প্রবেশ করলেন।আগুনে ঢোকার সময় তাঁর স্মরণেই ছিল না, দেবতারা তাঁকে বর দেওয়ার সময় একটা শর্তও চাপিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুমি যদি কখনও এটাকে অপব্যবহার করো, তা হলে এই বরের যাবতীয় গুণ নষ্ট হয়ে যাবে এবং আগুন তোমাকে গ্রাস করবে।
যেহেতু একটা নিরাপরাধ নিষ্পাপ শিশুকে পুড়িয়ে মারার জন্য উনি আগুনে প্রবেশ করেছিলেন, সেই অপরাধে তাঁর সেই ‘বর' -এর গুণ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে যা হবার তা-ই হল।
হলিকা রাক্ষুসি আগুনের ভিতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেলেন। আর সেই আগুন থেকে হরিনাম করতে করতে একদম অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে এল একরত্তি বালক--- ভক্ত প্রহ্লাদ।
সেই থেকেই অশুভশক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির জয়ের দিন হিসেবে হলিকাদহন পালন করা হয়। হলিকা রাক্ষুসির নামেই। পরে ধীরে ধীরে অপভ্রংশ হয়ে লোকের মুখে মুখে সেটাই হয়ে যায় হলিকা দহন থেকে শুধু--- ‘হোলি'। কেউ কেউ অবশ্য ‘হোরি’ও বলে। সমস্ত ‘অপ’কে পুড়িয়ে শুদ্ধিকরণ করাই হল এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। তাই দোলের আগের রাত্রে খড়কুটো জড়ো করে আগুন লাগানো হয়। এটাকে কোথাও বলা হয় চাঁচড়, কোথাও নেড়া পোড়া। কিন্তু না, এখন আর কাউকেই বলতে শুনি না এর আর একটা কঠিন নাম--- ‘বহ্র্যুৎসব’।
যদিও এই দুই উৎসবের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এই নেড়া পোড়া বা চাঁচর পোড়ার অন্য আর একটা আধুনিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দোল বা হোলি যেহেতু ঋতুচক্রের শেষ উৎসব, তাই উৎসবের আগেই গাছপালা থেকে ঝরে পড়া ডালপাতা, জীর্ণ, ভাঙাচোরা, পুরনো জিনিসপত্র, যেখানে যা আছে, সব এক জায়গায় জড়ো করে পোড়ানোর উদ্দেশ্যই হল চারিদিক একেবারে সাফসুতরো করা। আবার নতুন ভাবে জীবন শুরু করা।এই নতুন ভাবে জীবন শুরু করাই হল নেড়া পোড়ার আসল লক্ষ্য।
লক্ষ্য যাই হোক, আমরা কিন্তু এই দোলকে রঙের উৎসব হিসেবেই বেছে নিয়েছি। কিন্তু রং যাতে আমাদের কোনও ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য আবির তৈরির আদিম ঘরানাকেই ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় চলছে বহু দিন ধরেই। ছোটখাটো বিভিন্ন সংস্থা হার্বাল আবির বানাতে শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন ফুলের পাঁপড়িকে বিশেষ পদ্ধতিতে গুঁড়ো করা হচ্ছে। তার পর তাতে নানান ফুলের নির্যাস মিশিয়ে একেবারে হান্ড্রেড পারসেন্ট নির্ভেজাল এবং নিরাপদ আবির বানানো হচ্ছে। সে জন্য তাদের উদ্যোগকে বাহবা দিতেই হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, সেগুলো বানাতে গিয়ে এতটাই ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে যে, সেটা আর সাধারণ লোকের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকছে না। ফলে উদ্যোগ ভাল হলেও তা মুখ থুবড়ে পড়ছে।
বসন্ত কবিতা
প্রথম পর্যায়
তৈমুর খানের দুটি কবিতা
১
হৃদয় এক শূন্য কুমুদ
______________________________ _____
স্মৃতির ঘাটে আজও কারা জল তুলতে আসে?
চেয়ে চেয়ে দেখি
জলের শীৎকার শুনি
পদশব্দের ঘ্রাণে জেগে উঠি
ঝরা আমলকী কুড়িয়েছি কত
বসন্ত গেছে
নিরুচ্ছ্বাস কোকিল এখনও অন্তরালে ডাকে
নীরবতার কাছে আজও আমি ৠণী
হৃদয় যদিও মৃত, তাকে কি জাগানো যায়?
তাকে কি বৃষ্টির রাতে একা একা জানালায়
ডেকে আনা যায়?
প্রাচীন বিস্ময় ঘিরে স্মৃতির আত্মারা ঘোরে
হৃদয় এক শূন্য কুমুদ হয়ে ফোটে
কিছুটা স্নিগ্ধ চাঁদ, স্বপ্নের ভ্রমরী
গুন গুন রেখে যায় তার নিবেদিত কম্পনে
২
উদ্যোগ
______________
আমার হাসি দুল পরেছে
আমার খুশি চুল বেঁধেছে
আমার ইশারা, আমার নীরব
একা একা আসছে যাচ্ছে
ভাবনারা ক্লান্তিবিহীন
দূরে দূরে বয়ে যাচ্ছে তরী
নিশীথ কোলাহলের কাছে
এ আমার আত্মদ্রোহ
বিজ্ঞাপন কোথাও রাখিনি
তবু জ্যোৎস্না নীল হল
নীলাশ্বের কাছে
দৈন্যরা স্ফুরিত ঘুম
কাজল পরেছে
আমি সেই মুগ্ধতার খোঁজে
এখনও নষ্ট হই
এখনও বিলম্ব হয়
এখন বিরহে আছি
শ্যমলী সেনগুপ্ত
দেখেছো কেমন রাঙা রাঙা ফুলদল
তুমিও তো সোনা এমনই বাহার চেয়েছিলে
সফেদ জামার নীচে
আমার লাল অন্তর্বাস
শিমূল-বীজের থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা
জমাটে নরম হয়ে কি বাহার ছড়িয়েছে দেখ
গ্রামীণ পথের থেকে রাজপথ ধরে
কি বিপুল শোভাযাত্রা !
ধুলোটে ভূমির ওপর থরে থরে লালের পরাগ
এমনই তো কোনওকালে
আমাদেরই যাচনা ছিল বসন্ত-বাহার
মনেআছে সোনা
একদিন , কতদিন বিরহ-যাপন শেষে
এমন বসন্ত এলে উন্মত্ত করীসম
পদ্মবনে আগুন জ্বেলেছি
সেদিন যখন রাজপথে উড়েছিল
শিমূল-পলাশ
সেদিনও বিরহানলে পুড়ে পুড়ে
অঙ্গার হয়েছি
সোনামন ! আমার ভাষায় যত
রক্তের কুঁড়ি আছে , সবটুকু ঘিরেরাখে
আমাদের শ্বাসাঘাত আলাপের ছাঁদ
বসন্তে বিরহ পেলে
রাজপথ মাঠ-ঘাট মেপেরাখি
আটপৌরে হাতে
আহ্লাদে বোকা-বোকা হেসে
এমন বসন্তদিন এসেছে আবার ভেবে
অ্যান্ড্রয়েডে সাপলুডো খেলি
সু-শ্বেত জামার নীচে লাল অন্তর্বাস
আর মঞ্জু মঞ্জু শিমূল পরাগ
লালশালু মোড়া ,
আপাতত কুলুঙ্গীতে তোলাথাক
আপাতত আমাদের বিরহ যাপন
আপাতত জোগাড়-যন্তরে
আগামীর রঙ বুনে রাখি
বধ্যভূমি
শিবু মণ্ডল
হিমশতাব্দীর কালো পিচ্ রাস্তা কুয়াশা পেরোলে
বধ্যভূমিতে এগোয় ভেড়ার পাল ঘণ্টা বাজিয়ে
চার দেয়ালের ভেতর থেকে জঞ্জাল সাড়া দেয়
ফুটে ওঠে বিষ-দানা স্বচ্ছতার অন্দর মহলে।
জল বয়ে চলে কাঁধে, চোখ জুড়ে এদিক-ওদিক
সনাতনী সুরে সুরে রক্ত লাগে ভোরের শরীরে
জলের বরফে রূপান্তরের সময়টুকুতেই
লীনতাপ ধার মেরে দেয় কাটারির ক্ষুধা পেটে।
হাআআ হাআআ রবে কে যেন রাস্তা দেখায় সাদাকালো
ভিড়ে
শুধু ধু ধু মরীচিকা, ঘাস, ঘাস, নেই কোনো মাঠে।
সেতুবন্ধন
বেলা দে
নবীন প্রজন্ম এখন
যাকে বলে ভ্যালেন্টাইন
সেদিন জীবনে আমার সেতুবন্ধন
সানাইয়ের সপ্তসুর বেঁধেছিল
রাগ -মালকোষ
ছাতনাতলায় আলোর রোশনাই
আত্মীয় অঅনাত্মীয়ের
মুখর কোলাহল
প্রেমরঙা ভ্যালেন্টাইন
তবুও বসন্ত...
অর্চিতা দাস
বসন্ত...
তুমি মুঠো মুঠো আবির খুশি ছড়িয়ে দিয়ে
ধরে রাখতে চাও মানুষের মন,
আকাশে ওঠে স্বপ্নমদির রামধনু-
সুখের গানে পলাশ শিমূলের ঘুম ভাঙ্গে
কেতকী চাঁপার গায়েও তোমার ছায়া পড়ে
কৃষ্ণচূড়া দেখলে মনে হয় স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে..
বসন্ত...
চারদিকে সন্ত্রাসের ধুলোবালি
কাঁটাতারের এপাশে-ওপাশে যত নদী
তারাও যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যায়-
নগ্ন প্রহরের থাবায়..ছিঁড়ে যায় নোনাসুখ..
ছিঁড়ে যায় মায়ের আঁচল-
স্বপ্নেরা গড়িয়ে পড়ে চোরাবালিতে..
তবুও বসন্ত...
আমরা ছুঁয়ে আছি
পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি
বিপন্ন চারিদিকে ঘন কুয়াশায়-
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি
স্থির বিশ্বাসের নির্বাক ঢালে
আমাদের স্বপ্নের দেশে..
প্রাণিত হৃদয় নিয়ে জ্বলে উঠবই আমরা
শত্রুর বিরুদ্ধে...।।
লুনাটিক্ ইন্টারকম্
জ্যোতির্ময় মুখার্জি
শ্যাওলা ও পাখি আসলে একই
বসন্ত উড়ে এলে
কারো ঘুম ভাঙে
কারো শরীরে আড়বাঁশি
পাউডার মেখে মেয়েছেলেগুলো
খসে যাওয়া ভাঁজ খুলে
শিশিরের আশেপাশে বা পুঁইশাকে
সোহাগে জড়ালে
সবাই কৃষ্ণ সাজে
বাঁশি বাজে দোফসলি রাতে
বসন্ত বিলাপ
কাকলি মুখোপাধ্যায়
বাসন্তিক ভুলচুকে,
রাঙা পলাশের কান্না আঁকা রইল-
কৃষ্ণচূড়া আভরণে।
ফাগুনের আগুন চোখের ইশারায়,
উত্তর না মেলা প্রশ্নচিহ্নের
ক্রমাগত দ্বন্দ্বে,
বর্ণিল প্রজাপতি রঙ হারিয়ে,
খুঁজে নিল পরবাস।
যেখানে বসন্ত বিলাপ নেই,
বাতাসে আবিরীয় আবেলা নেই।
আম্রমুকুলের ভ্রুণ নেই।
আছে শুধু ব্যর্থতার পরিসংখ্যানে
নিজেকে সনাক্তকরণের পালা।
অবশেষে
মৃণালিনী
অবশেষে দুরু দুরু বুকে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম
সোনা গলা রোদে মিষ্টি ডাক, হাওয়ায় বসন্ত উষ্ণ
রোম্যান্টিকতায় বললাম, 'এই ধূলোয় একটু প্রেম আবির খেলা!
অবশ্য যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে?'
ওয়াইন ঠোঁটের কোণে চিয়ার- আপ বললেন, 'রামধনু রঙে
মেখে ও মাখিয়ে দিতে আমারও কোন আপত্তি নেই।'
গহন অরণ্যে দেবদারু পাইন ওক শাল শেগুন
সবুজের শেড, অর্কিড, টিউলিপ চিরআপনার গোলাপ
কিছুই বাদ পড়ল না। সলজ্জিত আকাশে নীল সাদা
রঙিন মনে ধূলোবসন্ত রঙ গায়ে মাখব ও মাখাব বলেই
হঠাৎ পাশে এসেই ধাক্কা দিলেন শতাব্দী
হুশ করে বেরিয়ে গেল অকল্পনীয় রোমান্টিকতার টাওয়ার
ক্লান্ত বাঘের চোখে নেশাঘোর,
রঙিন বিকেলে মায়াজলের হাতছানি
রামধনু চোখে সাদা, লাল খয়েরি লালচে বাদামি।
দু'ঢোকে সতেজ বাঘ সান্ত্বনায় পিঠ চাপড়ে জানালেন,
বসন্ত ঢুকে গিয়েছে আর এক শতাব্দী আগে। সুতরাং...
নো পার্কিং জোনে অবশেষে বাঘ প্রবেশ করলেন না
বসন্ত আবহাওয়ায় বিষণ্ণতারর রঙ উড়িয়ে চলে গেলেন
নিজস্ব অরণ্যে... এর পরের গল্পে বসন্তচোখে রে- ব্যান্ড সানগ্লাস।
এই বসন্ত
মিঠু অধিকারী
বসন্ত শুধু প্রেম নয়,
নিয়ে আসে বিরহেরও সুর
বেদনায় ভেসে যায়
হৃদয়ের অন্তঃপুর
পলাশের আগুন নিয়ে
মিলন খেলায় মাতল যারা ,
তারা কি জানেনা
কবি বলেগেছেন
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
বসন্ত গদ্য
বসন্তকথা
যাজ্ঞসেনী
বসন্তর এমনও পলাশপলে প্রেম আসে চুপিচুপি চুপকথায়। রুমঝুম রুপকথায়। বাতাসে উড়ে যাওয়া বাসন্তীরঙা উতল আবীর ছুঁয়ে যায় আমার লজ্জামাখা রক্তিম মুখ। এক নিমেষ সময়ে রাঙিয়ে দেয় আমার উত্তরীয়র চূড়ো পেরিয়ে কুসুমকোমল হৃদয়ে রাখা মুখখানিকে।
সেই মুখ নিকষ কৃষ্ণবর্ণ। সমস্ত আঁধার শোষন করে স্বেচ্ছায় সে আঁধার মেখেছে অনন্তকাল ধরে। আমার দুগ্ধধবল তনুলতা তার দগ্ধ নির্মম ওষ্ঠের ছোঁয়া পেতে চেয়েছে কত- কতবার। কত- কতবার সে আমার বিভাজিকায় রেখেছে সবুজ শষ্যক্ষেত্র। আমি তাকে একটা ফসলও দিতে পারিনি। স্তনজাতক অমৃতর যে অনাদি উৎস- একজন নবজাতককেও দিতে পারিনি তার সন্ধান। অথচ, এমনও বসন্তদিনে প্রেম আসে অমোঘ নিয়মে। ঝরাপাতার ঝরঝর শব্দে ভেঙে যায় সংযম যাবতীয়। আমার পাপড়িসম কোমল ওষ্ঠ নিষ্পেষিত হয়না বসন্তর দখিনা বাতাসে। সেই নির্মম ওষ্ঠ একটা চুম্বনচিহ্নও এঁকে দেয়না আমার সলাজ আনত আঁখিপল্লবে। তার শরীরের রেণু এই উছল বসন্তেও আমার শরীরে নদীগান শোনায় না।
বসন্ত থেকে বসন্ত-- প্রতীক্ষার প্রহর গুনি অবিরাম অবিরত। আসেনা, সে আসেনা। হৃদয়ে প্রোথিত সেই কৃষ্ণমুখ তখনও অন্বেষণ করে ফেরে অবশিষ্ট আঁধার।
যে যজ্ঞ থেকে আমি জাত হয়েছিলাম, একদিন সেই যজ্ঞেই তাকে সমগ্র আঁধার আহূতি দিতে হবে যে!
পলাশ বদল
লক্ষ্মী নন্দী
প্রফেসর শুভ্রকান্তির পড়াতে পড়াতে বারবার চোখ এসে থেমে যায় ফাষ্ট বেঞ্চে বসা রিমলির দিকে। কখনো কখনো উদাস হয়ে যায় রিমলির শান্ত স্নিগ্ধ চোখে চোখ রেখে। পিছন থেকে একদিন এক ছাত্র অাওয়াজই দিয়ে ফেলে, স্যার মাত্র কয়েক মাস হলো তো এসেছেন একটু রয়ে সয়ে। সম্মিলিত দংশনের মত সকলেই হেসে ওঠে। শুভ্রকান্তি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। ঘাবরেও যায়। নিজেকে স্বভাবিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু কেন এমন হলো - স্কুল কলেজ ইউনির্ভাসিটি সব কিছু পার করে শেষে কিনা এক ছাত্রির জন্য! কত মেয়ে শান্ত সুদর্শন শুভ্রকান্তিকে পাবার জন্য কত কিছুই না করেছে কিন্তু শুভ্রকান্তি অামল দেয়নি। বড় ক্লান্ত শুভ্রকান্তি বেশ কয়েক রাত হল সে ঘুমাতে পারেনা। শুভ্র রিমলি অাচ্ছন্ন চোখে অার শুয়ে থাকতে পারলনা উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। অাকাশে একাদশির চাঁদের ছড়িয়ে দেওয়া জ্যোছনার অালোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে ওঠা বসন্তের প্রকৃতি। গাছের ডালে কোকিলের মধুর কুহুকুহু ডাক,ভালোবাসার মধুরতায় অারো তীব্র ব্যাকুল প্রেমিক করে তোলে শুভ্রর বিরহী মনকে। যা রিমলির অভাব বোধ অারো যেন বাড়িয়ে দেয়। শুভ্র নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে অামি পাগল হয়ে যাবোনা তো? না অার ভাবোনা কিছু। অামাকে অাজ ঘুমাতেই হবে। এক -পা দু-পা করে ঘরে ফিরে জোর করে ঘুমের বন্দনা করে সে।
রিমলিদের ক্লাসে ঢোকে প্রফেসর শুভ্র। কিন্তু রিমলি নেই কেন? চারিদিকে চোখের মণি ঘোরাফেরা করতে থাকে দ্রুত । বুকের ভিতরটা খাঁখাঁ করে ওঠে। এমন সময় সবাই মিলে চিৎকার করে বলে প্রফেসর অাপনার ভেনাসের অাজ বিয়ে। দুই কানে চাপা দিয়ে তারচেয়েও বেশি চিৎকার করে বলে শুভ্রকান্তি না না এ হতে পারেনা। শুভ্র অবাক হয় তারা কিভাবে জানলো যে রিমলি তার কল্পরাজ্যের ভেনাস। এই ডট. কমের যুগে কি কল্পনাও কি চিট হয়ে যায়? শুভ্রকান্তি অাঠারো, উনিষ বছরের উন্মাদ প্রেমিকের মতোন দৌড়ে চলে যায় রিমলিদের বাড়ি। রিমলি লাল বেনারসিতে সেজে বসে অাছে। সে ছলছলে চোখে রিমলির দিকে এগিয়ে যায়। আচমকা উদ্ভ্রান্ত শুভ্রকান্তিকে দেখে রিমলি অবাক হয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে প্রশ্ন করে স্যার অাপনি? কোনো দিকে না তাকিয়েই রিমলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। প্রবাল পাশের বিছানার থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসে ধাক্কা দিয়ে বলে কিরে - শরীর খারাপ লাগছে এতো কাঁদছিস কেন? স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, হয় সকাল। পরপর দু-দিন কলেজ বন্ধ ছিল। অবশ্য রিমলি তার অাগেও দু -দিন অাসেনি।রিমলিদের ক্লাসে গিয়ে একদম থাকতে ইচ্ছে করছিলনা। কেউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারেনি। শুভ্র ভাবে অাজও যদি রিমলি না অাসে! কলেজের গেট দিয়ে ঢোকার অাগেই ফুলে ভর্তী বড় পলাশ গাছটার নিচে দাড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায় শুভ্র। না অার দেড়ি নয় রিমলিকে সব বলে দিতে হবে। ঠিক সে সময় স্বপ্নের রেশ শুভ্রর সামনে বাস্তব হয়ে যেন ধরা দেয়। রিক্সার থেকে নামছে রিমলি। লালটুকটুকে সিঁথি পড়নে বাসন্তী রংঙ্গের পোশাক।রিমলির সিঁথিতে সিঁদুর না লাল অাবির এই প্রশ্নের দোলাচালের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাতের থেকে সিগারেট ফেলে দিয়ে বেখেয়ালি হয়ে দুটো পলাশ ফুল তুলে নেয় শুভ্র। রিমলি মাথা নিচু করে কলেজের গেট দিয়ে যখন ঢুকতে যায় ঠিক তখনই রিমলি বলে ডেকে ফেলে স্বভাবিকের থেকে বেশ একটু জোরেই। রিমলি দাঁড়িয়ে পড়ে, নিচে তাকিয়ে দেখে কতো পলাশ পড়ে অাছে। টপাটপ বেশ কয়েকটি পলাশ কুড়িয়ে ব্যাগে রাখে । তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে দেখতে রিমলি। রিমলি লজ্জা পেয়ে কুঁকড়ে যায়। অাবার শুভ্র বলে অামার তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিল । মিডিল ক্লাস কালচারের মেয়ে রিমলি ওখানে দাঁড়িয়েই ব্যাগের থেকে অাবির বের করে বলে স্যার অাপনার পায়ে একটু অাবির দেই। তুমি অাবির নিয়ে এসেছো? হ্যাঁ স্যার অামরা ছোটো বেলার থেকে দোলের পর প্রথম যে - দিন স্কুল খুলতো অাবির নিয়ে যেতাম শিক্ষকদের পায়ে দিয়ে প্রণাম করার জন্য। গত বছর কলেজেও তাই করেছি। ততক্ষণে শুভ্র বুঝে ফেলেছে লাল সিঁথির বৃত্তান্ত । শুভ্রকান্তির ভীষণ ইচ্ছে করছে তাকে স্বপ্নের মতোন বুকে জড়িয়ে ধরতে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের গায়ে কথা জড়িয়ে বলে শুভ্র, অামি তোমাদের বাড়ি যাব রিমলি। কারণ অামি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। বলেই পলাশ দুটো রিমলিকে দেয়। রিমলি তোমার কাছেও তো পলাশ অাছে। রিমলিও পলাশ দেয় স্যারকে অার মনে মনে বলে অামি বামন অাপনি তো চাঁদ। হঠাৎ শুভ্রর সম্বিত ফেরে পিছনে তাঁকিয়ে দেখে কলেজ গেটের হরিদা টুলে বসে ওদের পলাশ বদলের সাক্ষী হয়ে রইলেন। শুভ্র নিজেই অবাক হয় , ভাবে, প্রেম বোধহয় সব মানুষকেই খুব সহজেই বোকা আর সাহসী করে ফেলতে পারে। তানাহলে এই ভিড়ের মাঝে বোকার মত কত পাগলামিই না করলাম। তবুও ফুরফুরে লাগছে। এখন যাকিছু সব সংগোপনে।
এক ঢোক স্বপ্ন
মনোনীতা চক্রবর্তী
শেষেরও কয়েকবার আগের পথের ক্লান্তি খুলে রাখার আগে সে দেখেছিল বিবিধ আলোর রাত্রিবেলা। দেখেছিল লাল হয়ে গেছে কী অদ্ভুত সাদা চাদর। লালের ভেতর গাঢ় লাল। বয়ে যায় ধারাবাহিক উঁচু-নীচু অগাধ। যা-কিছু সর্বস্ব তার সমস্ত উজাড় করতে-করতে রাতফুল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে আলোর ঝুমঝুম ও বাঁকা নথ। ঘুঙুর আইব্রুফেন ছেড়ে, ঠোঁটে লাগায় টাকিলার প্রিয়তম শট। সারাদুপুর উপুড়-হওয়া পাণ্ডুলিপি ছেয়ে জল-বসন্ত। আজীবন একটা ঘোরের ভেতর পিপাসা লিখতে-লিখতে একটা হেস্তনেস্ত করবে ভেবে অদ্ভুত এক ঈশ্বর লিখে ফেলল।লিখে ফেলল স্তব্ধতা।লিখে ফেলল দ্বিতীয় চিৎকার অথবা তৃতীয় কিংবা চতুর্থ-পঞ্চমও হতেই পারে। কিন্তু একটা ম’ম’গন্ধ মোষের বাঁকা শিং হয়ে ওঠে। সে-বার সে দেখেছিল উঠে যাওয়া আর নেমে আসার মাঝের দলদলে আলপথ। দেখেছিল ভিখিরি-রং। দেখেছিল একবার জন্মে ছুটে যাওয়া আর-একবার মৃত্যুতে ছুটে ফেরা। এক গলির ভেতর গলা পর্যন্ত থাকা সমস্ত আদর ঝুলছিল । বাঁধনির দোপাট্টা। অমলতাস বন ঢুকে পড়ছিল স্বর্গের দিকে। ছায়া ফেলে অর্ধেক দাঁড়িয়ে থাকা লালবাড়িটির ভেতর না-মানুষের শোকগাথা কী অদ্ভুত মায়াবৃক্ষ হয়ে গেল, কেউ তা জানলো না। প্রয়োজনও নেই। বাড়ির শরীর থেকে অসংখ্য রঙিন পাতা। বড়শি বিঁধে দেখছে বুক। ছলাতছল জল-বসন্ত। মরে যাওয়া উচিত ছিল জন্মানোর আগেই। কিন্তু আধপোড়া সিগারেটটা তা হতে দিল না। মাঝরাতের যে-ছুটোছুটি তার কাছে বন্ধক অমলতাস বন। বনবেড়াল।বন মোরগ। তাকে বকতে চেয়ে, বুঝতে চেয়ে ,মাখতে চেয়ে আড়াল কেন্নোর মতো গুটিয়ে ঢুকিয়ে পড়ে পার্সের ভেতর। ব্লক-হিলে এগিয়ে যায় নগরকীর্তন। ওলোট-পালোট শুয়ে থাকাগুলো ছলাতছল জল-বসন্ত। জলকে ঘিরে আছে স্বজন-বসন্ত... সুজন-বসন্ত...
চিঠির বদলে সিগারেটের জ্বলন্ত আগুনে বসন্ত-জল তার গলা জড়িয়ে দুলিয়ে যায় দুটি-পা ...
দেহ কুঁকড়ে যায়,ক্রমশ দীর্ঘ হয় আত্মা
ঢোক গিলতে-গিলতে হেঁটে যায় সে ও সিরাজ...
বন্ধু যখন ভাষা...
মৌসুমী চৌধুরী
তখন জীবনটা ছিলো প্রজাপতির ঝিলমিলে রঙিন ডানায় আঁকা। তখন মনটা ছিলো নরম কাদার তালের মতো। তখন অকারণেও খুব হাসতে ইচ্ছে হোতো। যখন তখন গাইতে ইচ্ছে হোতো... "মোর স্বপন-তরীর কে তুই নেয়ে।/ লাগলো পালে নেশার হাওয়া, পাগল পরান চলে গেয়ে।।..."
হঠাৎ অবাক করা জীবনের দাবী নিয়ে এসেছিলো প্রেম। চার হাত এক হয়ে যাওয়ার পর টোনাটুনির নতুন সংসারে তখন ডালে হলুদ বেশি, মাংসে নুন কম...। বাড়ি থেকে বহুদূরে অন্য রাজ্যে তখন পরিজনহীন নতুন পরিবেশে নতুন সুগন্ধি সংসার, আর আমার পাশে আদ্যন্ত একটি সাহিত্য-অপ্রেমী মানুষ। আর, এদিকে যখন তখন কবিতারা ঝাপটা দিচ্ছে আমার বুকে। সক্কালে উঠে ব্রেকফাস্ট বানাতে বানাতে, ডাল-তরকারি ফোটাতে ফোটাতে বুকের মাঝে প্রেমের কবিতার সুনামি জলোচ্ছ্বাস। আর চটপট চিরকুট লিখে তাঁর ব্রেকফাস্টের প্লেটের তলায় চালান..." তোমাকে দিলাম রাতের জড়ায়ু ছিঁড়ে জন্ম নেওয়া / আঁজলা ভরা নরম আলো /তোমার-আমার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকুক কিছু শব্দ ঋণ"...
তিনি দেখে বলতেন, " পাগল!... যাই আমি। ছোট ছোট বিকলাঙ্গ বাচ্চাদের নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে এক ঘর বাবা-মা। তারপর এক ঘন্টা অ্যানাটমির ক্লাস নিতে হবে। কবিত্ব আমাদের জন্য নয়, বুঝলে? চারদিকে ঝলসালো পূর্ণিমার চাঁদ...হা হা হা। তবে তুমি চালিয়ে যাও।" অফিসের মস্ত গাড়িটা এসে তাঁকে পেটে ভরে নিয়ে চলে যেত। আর আমি সজল চোখে হাত নাড়তাম। তারপর তো সারাদিন মুখ বুজে থাকা। প্রতিবেশীরা ভিন্ ভাষী। বাংলা বলে না। নিজের ভাষা শোনার জন্য প্রাণ বড় আকুলি বিকুলি করতো । বন্ধু হয়ে উঠল পৃষ্ঠায় আঁকা অক্ষর শ্বাস। বাংলা বইও পাওয়া যেতো না। বাড়ি থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া কিছু বই, বিয়েতে উপহার পাওয়া বই-ই ছিলো ভরসা...
সেবারই এসেছিলো প্রথম রোদন-ভরা-বসন্ত। ইট-কংক্রীটের সেই দেশে না ছিলো শিমূল, না ছিলো পলাশ, না মাদার, না কৃষ্ণচূড়া...কিন্তু বাতাসে ছিল শীত শেষের গান। সন্ধ্যের আকাশে চাঁদটা প্রতিদিন আস্তে আস্তে একটু একটু করে গোলাকার রূপ নিচ্ছিলো ...। শনি রবিবার তাঁর ছুটি। কোন এক শনিবারে রোগীদের হাত থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে তাঁর হিরো-হুন্ডা বাইকের পিছনে আমি। বসন্ত-গন্ধী হয়ে উঠেছিলো মন। হাওয়ায় উড়ছিলো চুল....! আহা!...জীবন কত সবুজ! সকালের নরম আলোয় কটক-ভুবনেশ্বর রোড দিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটছিলো বাইক....
"আরে আরে, ওই তো, ওই তো। একটু থামো না..... ধুর!" আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।
গাড়ির গতি না কমিয়েই তিনি জিজ্ঞেস করেন, " কি হল আবার? আবার কী পোকা নেড়ে উঠলো মাথায়? কবিতার লাইন কি ? ...."
"আরে না না... থামো না, ওই তো পলাশ গাছ। ইস! কী সুন্দর! ঝেঁপে ফুল এসেছে, দ্যাখো!"
"পলাশ গাছ দেখে আবার থামতে হবে! এ কার পাল্লায় পড়লাম , হে ঈশ্বর!"
বিশাল এক ছায়চ্ছন্ন পলাশ-তলা। পাশাপাশি রয়েছে আরও অনেক গাছ-গাছালিও। পথিমধ্যে কাদের যেন বাগান। হঠাৎ পেছন থেকে কানে ভেসে আসে, "তিতাস, আর নয় সোনা। এবার চলে এসো মা । অনেক ফুল কুড়িয়েছো..."। চমকে উঠলাম! তিতাস? সে তো একটি নদীর নাম! এখানে কিভাবে? কে এখানে বাংলা বলছে ? "আ মরি বাংলা ভাষা"। আহা! কত্তদিন পরে শুনলাম! আহ্বানকারিনী ছিলেন তিতাসের মা বেলাবৌদি। এক ছুট্টে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম তাঁকে। যেন তিনি কত দিনের চেনা, কত আপনজন আমার! সেই প্রথমবার বুঝেছিলাম, "মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ" ...
সেই দোল পূর্ণিমায় আর তারপর আরও আরও অনেক দোলপূর্ণিমায়ই আমাদের কেটেছিলো বেলবৌদি আর প্রবীরদার সান্নিধ্যে --- যাঁরা হয়ে উঠেছিলেন আমাদের প্রবাস জীবনের পরম বন্ধু। বাংলা ভাষা আমাদের একই সূত্রে বেঁধে দিয়েছিলো, বেঁধে দিয়েছিলো পরম আত্মীয়তার বন্ধনে।
প্রগাঢ় নম্রতায় বসন্ত
রাখী সরদার
আকাশের মাঝবরার একটা রেখা উঠছে --মনে হচ্ছে ধূসর শীতের কষ্টের দাগ।ফিরে যাওয়ার আগে
নিঃশব্দ ছাপ এঁকে দিয়েছে,দক্ষিণা বাতাস গুন গুন
করে উড়ে এলো সাথে অনেক রঙেরবাক্স ।
গাছের কচিপাতা গুলো গ্বালিবের গজলের মতো
নিমেষ গাঁথছে প্রাণে। কেমন একটা ঝিম ধরা সুরে
বুঁদ হয়ে আছি।হঠাৎ বনঝাউয়ের ডালে হন্যে হাওয়ার নাচন শুরু হয়ে গেল।দেখি একটা আবির রাঙা পাখি উড়ে এলো।ডানায় ডানায় ছড়িয়ে পড়ছে শান্তিনিকেতনী দুপুর।রোদ লাগা ফিনফিনে পালকে বসন্তের শাঁস লেগে। গ্রীবাটি যেন পলাশের
মগ্ন লাল।চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।বুঝলাম আমার
চোখের কোণে নষ্ট জড়ো হচ্ছে ---
নাছোড়বান্দা প্রজাপতি উড়ছে
চিবুকের লালচে তিলফুলের মধু
বড় প্রিয় ওর...
অকস্মাৎ আমার রক্তে কে যেন ঝাঁকি দেয়।সূর্য
তরল হতে হতে ফুরিয়ে আসলেও আমি উগ্রতেজে
জ্বলে উঠি।গোধূলির গন্ধ ক্রমশ তীব্র হতে থাকে।রাঙিয়ে দেওয়ার আহ্বান আসছে ভিতর থেকে।
মৌমাছি আমের মুকুল পাহারা দিতে দিতে ঝড়ের গন্ধ পায়।আস্তে আস্তে সন্ধে গুছিয়ে নেয় লাজুক
আলো।কিন্তু আমার বুকের মধ্যে বাসা বাঁধছে
এলোমেলো সংলাপ।পাঁজরে কৃষ্ণচূড়ার উন্মত্ততা।ঝুলন্ত জিভ প্রিয় অভিসারের স্বাদ চায়।এমন মারাত্মক সময়ে ঝুপ করে বসন্তরাত ঢুকে পড়ে
আমার ঘরে। গভীরে পিয়ানো বাজছে।তোমার
হলুদ পাঞ্জাবি র মতো চাঁদ উঠেছে।পূর্ণিমার আলোর কুচি ছড়িয়ে পড়ছে । বনজ ফুলেল গন্ধে আমি দিশেহারা। কার যেন ঘন নিঃশ্বাস শুনি।অনুভব করি তুমি গভীর প্রত্যয়ে অপেক্ষা করছোসেই পাগল নদীর ধারে ।মনে পড়ে গত মার্চমাসের কথা...
নদীর নৈশ অনুরোধে
জলের কানায় কানায় জ্বালছি আগুন
ফুটন্ত স্তনের মতো চাঁদ হেসে উঠলে
জঙ্ঘা বেয়ে উঠে আসছো
ভরপুর বসন্তে দুজন বেপরোয়া...
ছুটে বেরিয়ে পড়ি। টিপ টিপ নক্ষত্র পথ দেখায়।দেখো ভোর নুয়ে পড়ার আগেই এসেছি।উড়ে যাচ্ছে
নরম জ্যোৎস্না, গাছেরা কেমন অচিন ভাষায় বকবক করছে।নিমফুল জেগে আছে তোমার আমার শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যলিপি দেখবে বলে,এসো ,সমস্ত
রাত তোমার নখের খোলে মুনসুমারি আদর জমিয়ে রাখো...
জানোই তো
বসন্ত বেথেলহেম না জাহান্নাম
বুঝতে পারিনা ...তবে প্রণয়ের মাটি
সুরগুঞ্জার গন্ধে বাদামি
থেকে লালচে হয়ে ওঠে...
একি!আমি কি এতক্ষণ স্বপ্ন ভাষায় ডুবেছিলাম!
ভোরে বিনু বোস্টমীর মধুর পদাবলী আমার চৈতন্যের তৃষ্ণায় পরশ বুলিয়ে দিলো ..."লাখ লাখ যুগ/হিয়ে হিয়ে রাখলূ/তব হিয়া জুড়ন না গেল..."
ভিতরের দহন পাল্টে যাচ্ছে এ মধুমাসে।ভোররাতের
অর্ধনগ্ন চাঁদ নীরব ভাঙনে তাকিয়ে।পরজ বসন্ত অনেক টা খাজুরাহের মন্দিরগাত্রের সহচরী দের মতো ---বাইরের কামার্ত শরীর পেরিয়ে গেলে তবেই
ভিতরের প্রগাঢ় নম্রতাকে খুঁজে পাওয়া যায়।তুমিতো আমার বসন্তরাগ।সুরে সুরে তোমাকে পেতে হয়।এতক্ষণ আমার বেহদ্দ মাতাল মন মহুয়ার টুংটাং নেশায় অস্থির ছিল।তুমি তো জানো তোমার
ছন্দেই তোমাকে প্রতি বসন্তে খুঁজি।ভাঙার নেশা
ধুয়ে সবুজ হয়ে উঠি...
দুটো শারীরিক চাঁদ এই
রেখে গেলাম
কোয়েল নদীর জলে
বসন্ত কবিতা
মধ্যম পর্যায়
ভালবাসার রোদ্দুর
নীলাদ্রি বিশ্বাস
ভালবাসা ছিল হলুদশাড়ির ছোঁয়ায়
ভালবাসা ছিল রোদ্দুরে মাখামাখি,
ভালবাসা আজ যত্নে লালিত শিশু
ভালবাসা তবু তোমাতেই শুধু শিখি।
ভালবাসা যত গোলাপ গন্ধ বিলোয়
ভালবাসাবাসি চোরকাঁটাদের ভীড়ে,
টিউনিকখানা যত্নে আছে তো রাখা
ভালবাসা তুমি থাকবে আজকে ঘিরে।
অঙ্কবইটা আজোতো তেমনি আছে
অনেক যত্নে নোংরা করানো পাতা,
ভালবাসা তুমি প্রোথিত রাস্তামাঝে
ভালবাসা যেন কবিতা লেখার খাতা।
ভালবাসা সেই ঝড়ের দিনের কথা
ব্যালকনি থেকে শেষ বিদায়ের ধ্বনি,
ভালবাসা তবু ফিরেছে স্বপ্ন মাঝে
ভালবাসা দিয়ে গড়েছি নয়নমণি।
আজ ভালবাসা বাঁচিয়ে রাখার শপথ
ভালবাসা দিয়ে শুধু নিয়ে নিতে চাই,
ভালবাসা এসো শব্দহীনের দ্বীপে
তবু ভালবাসা তোমাতেই খুঁজে পাই।
বসন্তের ফেরিওয়ালা
রীনা মজুমদার
থাকতো যদি তোর
আম, পলাশের বাগান !
জলন্ত হাউই
ছুটে গিয়ে.. মুকুল ঝরার গন্ধ জড়াই
আঁচল ভরে পলাশ ওড়াই
সে ফাগে ! বাঁধে আমায় কে ?
থাকতো যদি তোর
দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ !
ছুটে গিয়ে .. সবুজ ঢেউয়ে , ধামসা নাচে
সুরের তালে ,খোঁপার সাজে
একটি ফুলেই বেশ
সে স্বর্গছেঁড়া দেশে ! বাঁধে আমায় কে ?
থাকতো যদি তোর
আগুন-ফাগুন , মণিহারী দোকান !
ছুটে গিয়ে.. নোলক পড়ে , তুলির টানে
আগুন রঙে মাথা রাঙাই
সে আগুনে ! বাঁধে আমায় কে ?
বসন্ত যে আছে খোদাই
দুই হৃদ-বেদীতে,
বিশ্ববাসী পারবে কেন
তোমার আমার রঙ ভোলাতে !!
আবার বসন্ত!
কাকলি ভদ্র
কয়েকটাই ছিল পলাশ,
কামরাঙা বিকেল রোদে
তবু রঙ ছুঁয়ে ছিল,
আবির আর আসমানি...
নিকোনো সাঁঝ পেরিয়ে
ঝিলম চৌকাঠে
উঠে ছিল চাঁদ !
শিমূল জারুলে আজ
সোমত্ত সিঁদুরের হাহাকার!
উথাল-পাথাল মায়ের আঁচলে
যুদ্ধ- মৃত্যু- লাশের আঁকিবুকি ।
এখন ফিরতি মধুমাস,
উদাসী পাখিদের পিছুটান
ঘরে ফেরার .....
প্রমেথেউস দহনে ভিজুক
যত রক্ত ফসিল,
ঘরের ভেতরে ঘর খুঁজে নিক
পথ হারানো মানচিত্র!!!
বসন্ত বিলাপ
ফিরোজ আখতার
পলাশ-শিমূল ফোটে কই আমার শহরে ?
যানজট আর ধুলোতে তাই
অন্তহীন বিষাদের ছোঁয়া
প্রতিবছর মাধ্যমিক পরীক্ষা এলে
বুঝতে পারি বসন্ত এসেছে
ব্যাস, ঐটুকু-ই...
শপিং মলের শীততাপনিয়ন্ত্রিত আরামে
হারিয়ে যায় বসন্তবিলাস
মানুষের মনেও ফাগুনের রং লাগে না
সেখানে এক হিংস্র দৈত্য বাস করে
ভিস্যুয়াল বসন্ত
শক্তিপ্রসাদ ঘোষ
খুব কেঁদেছিলাম
ভরে ছিল জল
আড় চোখে গভীর ভালোবাসা
ফলেনি কোন ফল
এক চোখ খুব চিকচিক
হারিয়ে নির্মল হাসি
তবু খুব ভালোবাসি
বেঁজেছিল বাঁশি
কোন কোন ইতিহাসে
নেই মোর জানা
চেয়ে ছিল চাঁদে
কোন মুখপানে
আজো অজানা
বসন্তে ফুটে আছে
পলাশ,শিমূল
আবির মেখে ছিল গায়
হয়নিতো কোন ভুল
ভুল নয়, ভুল নয়
ফুঁটেছে ফুল
ফুল
ফুল
ফুল।
অনাহূত বসন্ত
রুনা দত্ত
একটা সময়ের পর----
একটু উষ্ণতা একটু প্রেম
গোলাপ টেডি চকলেট কার্ড
বসন্ত ফাগুন পলাশ আবীর...
ভালোবাসার এই ছোট্ট ছোট্ট ছোঁয়া
জীবন থেকে হঠাৎ যেন হারিয়ে যেতে থাকে।
হিসাব নিকাশ দেনা পাওনা
দায়িত্ববোধ এতো কিছু নিয়ে
চলতে চলতে জীবন থেকে প্রেমটাই
যেন অদৃশ্য হয়ে যায় ।
মুখোমুখি দুটো ছায়া কফির কাপে
চুমুক দিতে দিতেই শূন্যতায়
খুঁজে ফেরে পুরোনো সময় ।
কিন্তু কফির কাপের ওঠা
ধোঁয়ার মতোই বড় দ্রুততায়
মিলিয়ে যায় সবকিছু।
আসলে জীবনটা চক্রবূহ্যে পড়ে
একটা সমান্তরাল রেখায় দাঁড়িয়ে থাকে
যেন কোন আবাহনও নেই
যেন কোন বিসর্জনও নেই ।
এইভাবেই চলতে চলতে একদিন
জীবনের সীমা ছাড়িয়ে
পৌঁছে যায় জীবনের ওপারে
যেখান থেকে ফিরে আসার কোন
পথ আর থাকে না ।
আসলে অনাহূত বসন্ত সবার জীবনে
নতুন ঝড় নিয়ে আসে না
বা বসন্তর সংস্পর্শে সব ঝরা পাতার জীবনও
ফাগুন বা পলাশের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে না ।
বসন্তে
পারমিতা ভট্টাচার্য
উড়োঝুরো কাঁধছাপা চুল,
জোড়া ভুরু সদ্য কিশোরীটি
বাসন্তী আলোয় এসে দাঁড়িয়েছে
এইমাত্র যে,
সকালে সে কু(হ্)-ডাক শুনেছে
বাগানের আমগাছ থেকে..
তারপর থেকে তার অজানা ব্যথা,
আনমনে নখ খুঁটছে পায়ের মাটিতে―
"অয়ি প্রথম প্রণয়ভীতে..."
স্কুলের স্কার্টের ভাঁজে
যত্ন করে রাখা চিরকুট;
পাঠিয়েছে, মনকেমনিয়া কোনো
ঝাঁকড়া় শিমুল ―
এখন আগুন ছুঁয়ে লাল
প্রতিদিন অভাবী থালায়
ভাতডাল, সামান্য নুন
বসন্ত এসে গেলে, সেই
কৃষ্ণচূড়ার ন্যাড়া ডাল ―
উৎসবে সবুজ ফাল্গুন!
ফিরে দেখা বসন্ত
সুব্রত নন্দী
বসন্তের পাদদেশে ফিরে বসন্তের দেখা,
শিমূল পলাশকে সাক্ষী রেখে নব সাম্পান শেখা।
বসন্তেরকোকিল বহুকাল আগে ডাক দিয়ে গেছে,
নিঃস্বার্থ প্রেম ভালবাসার অন্তিম স্মারকটুকুর কাছে।
উচিত অনুচিত অনুচ্চারিত অনুচ্ছেদগুলি স্মৃতির মণিকোঠায়,
নিভৃতে যাপনচিত্র পরিবর্তিত বসন্তের নকল খেলায়।
দশমিক শতাংশ ভগ্নাংশ শুধু সময়ের অপেক্ষা,
সাপ লুডোর খেলায় লুকোচুরি আর উপেক্ষা।
বসন্তের পাদদেশে আবার প্রকৃত বসন্ত ফিরে আসুক,
স্নিগ্ধতার পরিবেশে নিকষকালো নিকোটিন মনটি বাঁচুক।
পুরুষ তুমি
শশী বালা অধিকারী
পুরুষ তুমি লজ্জা পাও ?
যখন আমার যৌবনে রাখো হাত
আমি তখন আধো ঘুমে চাঁদ ধরে যাই
তুমি চিল শকুনের অবিকল দূরন্ত উন্মাদ !
পুরুষ তুমি আঘাত পাও?
যখন আমার মাথায় রাখো হাত
আমি তখন চন্ডীমায়ের স্মরণ করি
তুমি দস্যুরাজার অবিকল দূরন্ত উন্মাদ !
পুরুষ তুমি ভয় পাও ?
যখন আমার বাহুতে রাখো হাত
আমি তখন ছোবলে ছোবলে রক্ত ঝরাই
তুমি পাগল প্রেমী অবিকল দূরন্ত উন্মাদ
আচ্ছা পুরুষ কি খাও ?
রক্তমাংস নারীর দেহ আর চামচিকেটা ?
কোথায় ঘুমায় ?মায়ের পাড়ার তলপেটেতে ?
সেথায় থাকে নয়না তোমার দুষ্টু শ্যাম রাধে রাধে ।
বসন্ত সমাগত
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
রাতের তারার নিদ্রা যাবার আগে
আরশিনগর যদি
স্বপ্ন দেখায় তন্দ্রা চোখের মাঝে
মায়াজালের নদী।
কুহক যদি এমনি করেই এসে
স্ফটিক নগর ’পরে
রাত চাদরের ওম-কে গায়ে মেখে
ক্যাসা লোমা গড়ে।
তবেই যেন আঁতুড় ভাঙ্গা মনে
প্রশ্ন করে খেলা
এ কোন প্রভাত অপেক্ষাতে আসীন
এ কোন ভোরের বেলা?
হাজার প্রশ্ন বুকে, দাঁড়াই এসে
আগল মুক্ত দ্বারে
দু’চোখ যেন পুনর্জীবন পেয়ে
দিক্ সীমানা ছাড়ে।
দে দোল-দোল, দে দোল-দোল, বুকের মাঝে
রক্ত-পলাশ জমে
আগুন লেগেছে আজ দিকে দিকে
বসন্ত সমাগমে ।।
বার্তাবাহক
সঞ্চিতা
দাস
যখন তুমি এসেছিলে দখিন হাওয়ার সাথে,
আনন্দেরই
বার্তা নিয়ে বসনত্ সুপ্রভাতে।
লাল-হলুদে পলাশ গাছে বার্তা দিলে তুমি,
ধন্য হল আমার দেশে আমার মাতৃভূমি।
পলাশ-শিমূল-বকুল ফুলে সজ্জা হল সারা,
মাতৃভূমি
তুমি মাগো সবার নজরকাড়া।
কিন্তু
তুমি থাক কোথায় কোন পাতারি ফাঁকে,
কুহুরবে
বার্তা পাঠাও সকল অজানাকে।
চলতে পথিক খোঁজে ফেরে এদিক ওদিক চায়,
তোমার সাথে সুর মিলিয়ে আনন্দ যে পায়।
ঝরা পাতার গাছগুলোতে নতুন পাতা ঢাকে,
উল্লসিত
তারা সবাই তোমার কুহু ডাকে।
বাসন্তিকা
সুব্রত কান্তি হোড়
নব চেতনা হৃদয়ে জাগে
নিবিড় বিজন বীথি প্রান্তরে,
পুঞ্জীভূত স্মৃতি-বিস্মৃতি অব্যক্ত সুরে
নির্বাক মনের নির্বাক মুখে।
বিধাতার প্রকৃতি হিয়ার মাঝারে
পাখা দোলায় মুক্ত আবহে;
সৃজন করে নব নব ভুবন,
বাঁধার প্রাচীর ভাঙে মত্ত যৌবন।
হৃদয়ের অনুরণন পত্ররাজির উচ্ছ্বাসে...
মন ছুটে যায় রঙিন কৃষ্ণচূড়ার শাখে,
কাকলির কূজনে সৃষ্টির নীরবতা ভাঙে;
রূপের আগুন পলাশ, শিমুলের রক্তবসনে।
জীবন গীতি লেখা হয় কোকিলের কুহুতানে;
দোয়েল, পাপিয়ার সুরে প্রেমের বাঁশি বাজে।
দখিণা বাতাসের মৃদু পরশে
বাসন্তিকার তনুমন জেগে ওঠে,
এক অজানা আবেশে।
দেহবল্লরী কাঁপে
নৃত্যরত প্রজাপতির ছন্দে,
আবীরের আভায় রোদকণা গায়ে মেখে।
হানাদারের আক্রমণে
রক্তের ছিটে লাগে
বাসন্তিকার নীল আঁচলে।
দ্রোহের আগুন জ্বেলে
ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে
মহাসাম্যের গানে, সৃষ্টি বাঁচে স্রষ্টার হাতে।
এই বসন্তে
মজনু মিয়া
এই বসন্তে মনের কোকিল ডাকে সুরে সুরে,
পাষাণ বন্ধু কেনো আজো থাকো দূরে দূরে?
দেখো কত ফুল ফুটেছে গাছের ডালে ডালে,
তার উপরে নাচছে পাখি গানের তালে তালে।
তুমি যদি পাষাণ হয়ে দূরে গিয়ে থাকো,
মন ভরে কি? বলো আমার কেনো দূরে রাখো?
মাঠ ময়দানে চেয়ে দেখো রাখাল বাজায় বাঁশি,
চাও কি তুমি তোমার বিরহে যাই গায়া কাশি?
উতলা এই মন গগণটা তুমি বিনে শূণ্য,
কোথায় আছো দাও দেখা দাও করো এসে পূর্ণ।
এ কোন বসন্ত
পাপিয়া চক্রবর্তী
অশোক ফুটুক শিমুল জুটুক
গাছ ভরে যাক কৃষ্ণচূড়ায়
আমের বউল মাতাল মউল
বসন্তের গুজব ছড়াক -
মন , সে তো মানছে না গো
বসন্ত ; এ কোন বসন্ত !
আবীর উড়ুক কুহূ জুড়ুক
উঁচু গলায় সব কোকিল,
নতুন পাতায় ঠোঁট ছুঁয়ে যাক
দক্ষিণ হাওয়া কবোষ্ণ
ক্যালেন্ডারও দেখায় তারিখ
চৈত্র ফাগুন বসন্ত,
মন মানে না , মানে না গো
বসন্ত ; এ কোন বসন্ত !
পলাশ - লাশ
অশোক - শোক
বুকের ক্ষত দুরন্ত
অশান্ত এ মন মানছে না গো
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
বসন্ত গল্প
অলীকস্বপ্ন
নবনীতা সেন
আজ বসন্ত উৎসব।ফাগুন রঙে রঙীন হয়ে উঠেছে সব মুখ।অনিন্দিতা দেখছে মিনিটে মিনিটে পাল্টে যাচ্ছে ওর ফেসবুক হোয়াটস্যাপ বন্ধুদের ডি.পি।এই বসন্তে অনিন্দিতার ও ইচ্ছা করছে লাল আবিরের ছটায় আলোকিত বহ্নি হয়ে উঠতে। শিমূল পলাশের রঙে রঙীন দাবানল হয়ে জ্বলতে। কিন্তু সে তো নিরুপায়।
নার্সিংহোমের কেবিনে সে এখন বন্দী।দুদিন আগেই ওর একটা সার্জারি হয়েছে।ডাক্তার বলেছিলেন ইমিডিয়েট অপারেশনটা না করালে বড় ব্লান্ডার হয়ে যেতে পারে।আজ দোলের দিনে অরিনের কথা খুব মনে পড়ছে।ওদের আর কোনো যোগাযোগ নেই।তবু ভাবতে ইচ্ছা করছে
আজ অরিন আসবে নার্সিংহোমে অনিন্দিতাকে দেখতে।কথা বলতে বলতে অরিন হঠাৎই একটু আবির ছুঁয়ে দেবে গালে।আর তাতেই এক ধাক্কায় অনেকটা সেরে উঠবে অনিন্দিতা।হোক না অলীকস্বপ্ন তবু ভাবতে ভালো লাগছে।রোজ কত স্বপ্নই তো মানুষ দেখে সব কি আর পূরণ হয় তাই বলে কি স্বপ্ন দেখা ছাড়তে আছে!
বসন্ত-সমাগমে
সোমা বোস
রোজকার
মতোই টোটোতে যেতে যেতে গঙ্গা আজ দেখতে পেলো দীনেশকে… রাস্তার ধারের ওই ভাঙ্গাচোরা
বাড়িটার এক ভাঙ্গা দেওয়ালের ওপরে উঠে বসে আছে… শূন্য দৃষ্টিতে একরাশ বিমর্ষতা… দেখে মূহুর্তে নিজের
চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে।
ঠিক দেখলো
কি তবে?
কতো বছর
পরে! বারাবার টোটো থেকে মাথা
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে সে,
আর নিশ্চিত
হয় যে নাহ্,
তার দেখায়
কোনো ভুল নেই।
বুকটা টনটন
করে উঠলো এক অজানা মায়ায়…
কেন কে
জানে! আজ মৌটুসীদিদির মেয়ের
জন্মদিনের পার্টি,
তাই ওখানে
তার সাধ্যমতো এক খেলনা কিনে নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া আজ সেই উপলক্ষে কতো লোকের
আনাগোনা হবে,
তাই ও বাড়িতে
আজ তার অনেক কাজ।
আর একটুও
দেরী করলে চলবে না।
নইলে একঝলক
মনে হয়েছিলো যেন টোটো থেকে নেমে দীনেশ নামে ওই লোকটার পাশে গিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে “কেন কিছু কামকাজ করে
খেতে পারো না?
এভাবে নিজের
হাতে নিজের জীবনটা শেষ করতে আছে কি?”
কিন্তু
নাহ্, থাক…….। একবুক ভরা প্রচন্ড অভিমান
তাকে সে কাজ করতে নিরস্ত করলো।
বাজারের
সামনে টোটো তার শেষ গন্তব্যে তাকে নামিয়ে দেওয়ার পর কোনওমতে তাড়াহুড়ো করে ভাড়া মিটিয়ে
সে ঢুকলো এক খেলনার দোকানে।
বাপরে, খেলনাপাতির কি দাম! যেটাই পছন্দ হচ্ছে সেটারই
আগুনের মতো দাম।
তার সাধ্যে
কুলোবে না বলে বেছে বেছে তার সাধ ও সাধ্যের মধ্যে একটা সমঝোতা করে নিয়ে একটাকে বেছে
নিতে হল তাকে।
তারপর দৌড়
আর দৌড়।
মৌটুসীদিদি
যেন তার দেরী দেখে অহেতুক চিন্তায় না পড়ে যায়। তাই তার এই দৌড়।
অবশেষে
এই পোর্ট কমিশনার্সের কোয়ার্টারের দরজায় বেল বাজিয়ে তার সেই দৌড় শেষ হল। এখানে রাতে থাকার জন্যে
তার একটা ঘর আছে।
এখানে মিশি’মায়ের দেখভাল করার জন্যে
তার চব্বিশ ঘন্টার ডিউটি।
তার মা
মৌটুসীদিদি প্রচন্ড কাজের চাপে ভারাক্রান্ত থাকে সবসময়। দিদি আসলে পুলিশের এক
বড় অফিসার,
আর তার
বর মানে মিশি’মায়ের বাবা হল পোর্ট
কমিশনার্সের ওই ইঞ্জিনিয়ার না কি বলে যেন… তাই। মিশি'মা'কে তাই দেখার জন্যে তাদের কারোরই
সময় নেই।
সে দায়িত্ব
তাই এই গঙ্গার।
চব্বিশ
ঘন্টাই তার এখানে থেকে ডিউটি করার কথা। কিন্তু তার নিজেরও যে পাঁচ পাঁচটা
ছেলেমেয়ে।
যদিও তাদের
বিহারীদের মধ্যে অল্পবয়সেই বিয়ে দেওয়ার নিয়ম বলে তার দুই ছেলে আর এক মেয়ের বিয়ে সে
একা নিজে হাতে কোনওমতে দিতে পেরেছে।
কিন্তু
এখনো তার মাথায় রয়েছে ছোট দুই মেয়ের বিয়ে। তারা তো এখনও বড়ই ছোট। তার দুই ছেলের বিয়ে তারা
নিজেরাই পছন্দ করে করেছে অবশ্য।
কিন্তু
গঙ্গা তাতে কোনও আপত্তি করেনি,
কারণ সে
ভেবেছিলো যে তার ছোট দুই মেয়ের দেখভাল করার জন্যে ঘরে তাদের দুই বৌদি এসে গেলে আর কোনও
চিন্তা থাকবে না।
কিন্তু
মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক।
এই দুই
বৌ তো নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লো যে অল্পদিন পরেই তারা যে যার মতো আলাদা
আলাদা সংসার পাতার জন্যে ঘর থেকে বেরিয়েই গেলো। মা তার ছোট দুই মেয়ে
নিয়ে কি করে থাকবে,
কী খাবে… তার কোনও চিন্তা একবারের
জন্যেও এলো না তাদের মাথায়।
অবশ্য তাদের
কাছে গঙ্গা এনিয়ে কোনো আশাও রাখে না।
কারণ স্বামী
তাকে পাঁচটি সন্তানসমেত রেখে যখন ছেড়ে চলে গেলো, তখনকার পরিস্থিতি যদি সে সামলে
উঠতে পারে,
তবে সে
এখন আর কোনো পরিস্থিতিকেই ভয় পায় না।
সে এই মৌটুসীদিদির
বাড়ির কাজের ফাঁকে রোজ বিকেলে নিজের ভাড়াবাড়িতে
গিয়ে নিজের দুই কন্যাসন্তানের সাথে একটু দেখা করে আবার ফিরে আসে এখানে। এটাই তার রোজনামচা।
দেখতে
শুনতে বেশ সুন্দরী গঙ্গার বাপের বাড়ি ছিলো বিহারের এক অজ পাড়াগ্রামে, বিয়ে
হয়েছিল মাত্র দশ বছর বয়সে।
তার স্বামীর
বয়স তখন কুড়ি বছর।
সে কাজ
করতো এক কাপড়ের কারখানায়।
কিন্তু
তার ছিলো অতিরিক্ত মদের নেশা...
তাই কাজেকর্মে
ক্রমাগত ভুল করতে থাকা,
কাজে কামাই
করা… এসবের দরুণ পাটনা শহরের
যে কারখানায় সে কাজ করতো,
সেখানে
তাকে একদিন ছাঁটাই করে বসিয়ে দেওয়া হয়। সে বেকার হয়ে যায় এবং আবার কাজ
খুঁজতে থাকে।
কিন্তু
ক্রমশ তার মদের নেশা এতো সর্বজনবিদিত হয়ে ওঠে যে সেখানে তার পক্ষে আর কোনও কাজ জোটানোই
মুশকিল হয়ে যায়।
এদিকে এর
মধ্যে তার আর সুন্দরী গঙ্গার মাঝে দু দু'টি
পুত্রসন্তান এসে গেছে।
এমতাবস্থায়
তার স্বামী সপরিবারে এই কলকাতা শহরে এসে হাজির হল কাজের সন্ধানে। একজন তাকে খবর দিয়েছিল
এই পোর্ট কমিশনার্সে কিছু লেবার নেওয়া হবে। সেইসূত্রেই এখানে আসা। এখানে আসার পরে সেই কাজে
যোগ দেয় সে।
তার দেশোয়ালি
ভাই রাজু একটা মাথা গোঁজার ঠাঁইও জোগাড় করে দেয়। এরপর তাদের পরপর
আরো তিনটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।
গঙ্গার
স্বামীর বেশ ভালোই রোজগার হচ্ছিলো এখানে। কিন্তু আচমকা একদিন সে কাজের
শেষে আর বাড়ি ফেরে না।
না, তার পরদিনও না, তার পরের দিনও না। কাজের জায়গায় খোঁজ নিয়ে
জানা যায়,
সেখানেও
যায় নি।
যে রাজু
এতদিন সাহায্য করেছিলো,
অগত্যা
গঙ্গা তারই শরণাপন্ন হয় তার স্বামীর খোঁজ পাওয়ার ব্যাপারে। কিন্তু কোনো খোঁজ মেলে
না।
এই রাজু
এরপর গঙ্গাকে প্রস্তাব দেয় যে প্রতি সপ্তাহে দু'চারদিন করে সে যদি তার সাথে রাত্রে
থাকতে রাজি থাকে,
তবে সে
তার এবং তার সন্তানদের সব দায়িত্ব নিয়ে নেবে। গঙ্গা শুনে শিউড়ে ওঠে। কিন্তু তার মতো আনপড়
গ্রাম্য মেয়ের মাথায় এটুকু বুদ্ধি আসে যে তাকে এখন ঠান্ডা মাথায় থাকতে হবে। সে তখুনি তাকে এব্যাপারে
কোনো উত্তর দেয় না।
পরে সেই
রাজুর বৌয়ের সাথে রাতারাতি ভাব জমিয়ে এক ভালো বাড়িওয়ালির সন্ধান পেয়ে সেই রাতেই ছেলেমেয়েসমেত
সেখানে গিয়ে চুপিচুপি উঠে পড়ে।
এব্যাপারে
রাজুর বৌয়ের ঋণ সে কোনোদিন ভুলবে না।
এরপর ওই
বাড়িওয়ালি মাসীই তাকে এই বাচ্চা দেখাশোনার নানা কাজ জুটিয়ে দেয়, আর তার বাচ্চাদের মানুষ
করার রাস্তা সে খুঁজে পায়।
রাজুর বৌয়ের
কাছে বলা ছিলো যে গঙ্গার স্বামী সেখানে কোনোদিন তাদের খোঁজ করতে এলে সে তাকে এই বাড়ির
সন্ধান দিয়ে দেবে।
কিন্তু
রাজুই নাকি আচমকা এই কাজ ছেড়ে এই জায়গা ছেড়ে তার দেশ বিহারে ফিরে যায় বলে গঙ্গা পরে
লোকমারফৎ খবর পায়।
সেদিনের
পরে আজ আবার,
আবার দীনেশকে
দেখতে পায় গঙ্গা।
সেই একইভাবে
একইজায়গায় বসে আছে।
অবাক হয়ে
যায়, তাহলে কি আর কাজকাম কিছুই
নেই লোকটার?
চলে কি
করে তাহলে?
কে জানে! সে কি টোটো থেকে নামবে? গিয়ে দেখা করে এসব কথা
তাকে শুধোবে?
নাকি থাক… ভেবে পায়না। মৌটুসীদিদিকে কি বলবে
সব কথা?
যদি দিদি
পুলিশ দিয়ে কিছু করতে পারে!
তার বুকের
মধ্যেটা যে টনটন করে ওঠে…
কী করবে
সে! আজ সুযোগ বুঝে নাহয় মৌটুসীদিদির
সাথে এনিয়ে কথা বলবে।
কিন্তু
ওকি! ভাঙা দেওয়ালটা যে ধ্বসে
পড়ছে মনে হচ্ছে তার...
সাথে যে
উনিও পড়ে যাবেন।
হাড়গোড়
ভেঙে একসা হবে যে।
“এই দাঁড়াও, দাঁড়াও… আমি এখানেই নামবো”।
-
এখানে? তুমি তো রোজ একদম শেষে
বাজারে নামো দিদি।
-
হ্যাঁ, কিন্তু আজ আমি এখানে
নামবো।
একছুট্টে
সে গেলো দীনেশের কাছে,
ইতিমধ্যেই
সে দেওয়াল থেকে টুপ করে নীচে পড়ে গিয়ে রাস্তায় বিছনো পাশের শিমূল গাছটা থেকে ঝরা ফুল
ও পাতার বিছানায় পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। তার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে চকিতে
গঙ্গার মনে হল যে কে বলবে এই মানুষটাই তাকে পাঁচটি সন্তানসমেত এক অনিশ্চিত জীবনের মুখে
ফেলে রেখে মদের নেশার ঘোরে কোথায় চলে গিয়েছিলো! পরম মমতায় সে দীনেশের মাথা তুলে
নেয় তার কোলে,
চোখের জলে
তার সমস্ত অভিমান যেন ধুয়ে যায়।
তাদের মাথার
ওপর আশীর্বাদস্বরূপ ঝরে পড়ে লাল শিমূল ফুল…….। পথচলতি পথচারীরা বা টোটোচারীরা
দৃশ্যত মুগ্ধনয়নে চেয়ে থাকে তাদের প্রতি…….। একেই
বোধহয় বলে বসন্ত-সমাগমে… একইসঙ্গে মনেও বটে, আবার প্রকৃতিতেও বটে!
অনুভূতি
সৌরভ ঘোষাল
‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল’... রবীন্দ্র সংগীত বিভাগের
পড়ুয়ারা মাঠের এক কোণে বসে এই গানটি প্রায় বার চারেক গেয়ে ফেলেছে। মাঠের অন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মুকুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিয়াসার দিকে। হারমনিয়ম নিয়ে
একেবারে সামনের লাইনে বসে বাকিদের সঙ্গে গান গাইছে সে। তিয়াসা আজ হলুদ শাড়ি, খোপায়
পলাশ ফুল লাগিয়ে এসেছে। ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেই এক দৃষ্টিতে তাকে খুঁজে নিয়েছে
মুকুল। তারপর আর চোখ সরায়নি তার ওপর থেকে। ইউনিভার্সিটির আকাশ, বাতাস আবীরের রংয়ে রঙিন হয়ে উঠেছে আজ। সেই রংয়ে মিশে গিয়েছে প্রেম, গান, বিষাদ,
রিক্ততা। এত সব কিছুর মধ্যে চৈতি মেঘের মতন মন খারাপের কালো মেঘ উড়ে এসে জমাট
বাঁধল মুকুলের মনে। আর কিছুদিন পরেই এমএ কমপ্লিট হয়ে যাবে তাদের। এটাই হয়তো ইউনিভার্সিটিতে তাদের শেষ দোল। বন্ধুরা এরপর যে যার মতন চলে যাবে। তিয়াসাও হয়তো চলে যাবে। তার সঙ্গে আর হয়ত কখনও দেখা হবে না। মুকুলকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তানিয়া
এসে তার গালে আবির লাগিয়ে ‘কিরে একা দাঁড়িয়ে কী করছিস। রং খেলবি না।’ বলে প্রায়
টানতে টানতে বন্ধুদের মাঝে নিয়ে গেল।
প্রায় পাঁচ বছর একসঙ্গে রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে পড়ছে তারা। তিয়াসার প্রতি
মুকুলের একটা দুর্বলতা আছে। কিন্তু কখনো সে বুঝতে দেয়নি। একসঙ্গে অনেক দিন পড়াশুনো করলেও বাকি বন্ধুদের মত তিয়াসার সঙ্গে খুব একটা
মেলামেশা কখনই করা হয়নি মুকুলের। তাকে দেখলে বুকের ভেতর চাপা অনুভূতিটা নাড়া দেয়
ঠিকই কিন্তু তিয়াসার দৃঢ় চরিত্রের কাছে তা ফের ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু আজ আর
অনুভূতিটা চাপিয়ে রাখতে পারছে না সে। রাধা-কৃষ্ণর বাঁধনছেড়া প্রেম যাপনের দিনে তিয়াসার
জন্য মনটা বড্ড আকুল হয়ে গিয়েছে তার। এই বসন্তেই
নাকি স্বয়ং মহাদেব বৈরাগ্য ভুলে পার্বতীর প্রতি মাতোয়ারা হয়ে পড়েছিলেন। বসন্ত বাতাসের জন্য
তিয়াসার মনে কি কোন জানালা খোলা নেই? নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকে মুকুল। তবে সে এটাও জানে এটাই শেষ সুযোগ, এরপর তিয়াসার কাছে
যাওয়ার কোন সুযোগ থাকবে না তার। রং মাখানোর আছিলায় নিজের মনের কথাটা বলে ফেলতেই হবে এবার।
একদিকে, ‘চল পলায়ে যাই’ অন্যদিকে ‘নূতন যৌবনের দূত’ এই
কম্বিনেসনের মাঝে মুকুলের মনে নাড়া দিচ্ছে, ‘তোমাকে চাই’। তবে কিছুতেই তিয়াসার কাছে
যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না সে। লাল আবীরে আরও রাঙা হয়ে উঠেছে তিয়াসা। চুল খুলে বন্ধুদের সঙ্গে মেতে উঠেছে রং
খেলায়। তিমির কালো চুলে আবীর মিশে আরও রূপসী হয়ে উঠেছে সে। ‘আর কতো দিন শুধু
এভাবেই দেখে যাবি? এবার গিয়ে বল।’-
শান্তনুর কথায় ঘোর কাটল মুকুলের। ‘ঠিকই বলেছিস, আজ বলেই দেই’ বলে এগিয়ে গেলো মুকুল। সে এত সিরিয়াসলি ব্যাপারটাকে নেবে ভাবতে পারেনি শান্তনু। মুকুলের এগিয়ে যাওয়া দেখে নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘শাবাশ
ব্যাটা।’
বসন্তের
বাতাসে আবীরের ঘ্রাণ আরও জোড়াল হয়ে উঠেছে। অস্তগামী সূর্যরশ্মি রং মেখে ঢলে পোড়ছে ইউনিভার্সিটির মাঠে। তিয়াসা বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করছিল। তাকে একা দেখে ডান হাতে একমুঠ আবীর নিয়ে এগিয়ে গেল মুকুল। তিয়াসা প্রথমে
লক্ষ্য করেনি মুকুলকে। সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতে শাড়ির আঁচল সামলে বলল, ‘কি রে, কোথায়
ছিলি দেখতেই পেলাম না তোকে। রং লাগাবি না আমাকে।’
‘এ না হলে বসন্ত কিসের? দোলা চাই অভ্যন্তরে,
মনের ভিতর জুড়ে আরো এক মনের মর্মর,
পাতা ঝরা, স্বচক্ষে স্বকর্ণে দেখা
চাঁদ, জ্যোৎস্নাময়
রাতের উল্লাসে কালো বিষ। এ না হলে বসন্ত কিসের?’
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
বসন্ত কবিতা
অন্তিম পর্যায়
এিরঙা বসন্ত
রাখি ব্রম্ম
কৃষ্ণচূড়ার রঙে আঁচল উড়িয়েছে একনারী
পলাশ প্রেমের অভিমানে উদাস মনের কোণ
শেষ বিকেলের লেপটে যাওয়া সূর্যের লাল সিঁদুর
লেগেছে আকাশের বুকে লাল টিপ হয়ে।
একদিন
রাতুল দত্ত
একদিন ঘুম ভেঙে গেলে
বিস্তীর্ন আকাশ জাগে
দূর দূরে...
আলো মাখা পথ---
খুলির ফোঁকরে হঠাৎ
প্রদীপ জ্বলে,
নোনা ইট খসে গেলে
পোড়ো কাঠ ইতিহাস লেখে,
নাটকের অন্তিম পর্বে
নতুন মুখ আসে
স্পট লাইট জ্বলে
নাট্যকারের কলম জাগে
নতুন মুখে
একদিন ঘুম ভেঙে গেলে।
স্রোত
সত্য মোদক
আছি—নিজেকে ছাড়া
কষ্ট অনেক দিয়েছি নিজেকে,
খুশী—থাকতে——
খুশী—হ'তে——
ভুলেই....গেছি৷
বিশ্বাস কর——
কখনো মেঘ হ'তে চাইনি
চোখে...চোখ রেখেই——
নীল আকাশের বুকে
উড়তে চেয়েছি......,
ভাষতে চেয়েছি ——
প্রবাহমান স্রোতে৷
বিশ্বাস কর——
নয়ন ভরাতে চেয়েছি —
ঐ অগোছালো চুলের আঁধারে,
আপ্লুত হ'তে চেয়েছি—
ঐ মায়াময় চোখের শ্বাসনে৷
স্বপ্নগুলো আজ——
আঘাতে আঘাতে বিদীর্ণ৷
স্মৃতিগুলো ——
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে৷
লিখেছি চিঠি—ঝড়ের কাছে——
নীড়ের.........
অসুখী বসন্ত
দীপ্তিমান মোদক
বিকেলের ছায়া দীর্ঘ হলে
অভিমান বাড়ে।
কথা হয়েছিল এই বসন্ত
রঙিন হব।
হঠাৎ রঙিন কাঁচে চেয়ে দেখি,
তুমি!
তিনটি রঙ জড়িয়ে
মায়ের কোলে।
অভিমানের ওড়না সড়ে যায়।
আমাদের চারবছরের শিশু প্রশ্ন করে
তুমি কেন ঘুমিয়ে?
ভাষা হারিয়ে যায়।
শুধু বিরহের সুর শুনি
এই বসন্ত জুড়ে।
মৃত্যু এবং আমি:
খোকন বর্মন
পাহাড় থেকে পড়ে ঝর্ণার জলরাশি
প্রচন্ড খরতাপ হতে একবিন্দু শিশির আগলে রাখি চেষ্টাপূর্বক।
এপারে বহুবসন্ত কাটিয়েছি।
জানি তুমি স্পষ্টবক্তা।
রোজ দ্বারে এসে কড়া তুমি নাড়ো না।
হাতে তোমার পারিজাত ফুল
রাতের আধারে রোজ কিছু প্রশ্ন পেয়ে বসে
তুমি আমার অপেক্ষায় থাকো নাকি আমি তোমার?
ওপারেই ফিরব নিশ্চিত।
একটা শেষ অনুরোধ রাখবে -
জীবনের শেষ উপসংহারটা দেখতে দেবে?
বসন্ত এসে গেছে
ডঃ সঞ্জয় কুমার মল্লিক
মৃদুমন্দ দখিনা গরম বাতাস জানান দেয়,বসন্ত এসে গেছে।
উত্তরে ঠান্ডা হওয়া ক্লান্ত হয়ে হারিয়ে ফেলে তার গতি।
ঠান্ডা-গরমের লুকোচুরি খেলায় প্রকৃতি সেজে ওঠে তার নতুনন্তে।
এ এক হৃদয় জুড়ানো সন্ধিক্ষন।
এ এক মন হারানো সময়ের সন্ধিক্ষন।
মাতোয়ারা হয় প্রকৃতি
মাতোয়ারা হয় মানুষ
ব্যাস্ত সবাই সাজিয়ে নিতে চায় নতুন সুন্দরতম সাজে।
নব পল্লবে সেজে ওঠে নিম,শাল, আমলকি,ধূসর বাঁশের বন ,আরো কতকিছু।
সজনের ডাল সেজে ওঠে সাদা ফুলের মেলায়।
আমের মুকুল ঝরিয়ে উঁকি দেয় সবুজ আমের ঝাঁক।
পলাশের বন-যতদূর চোখ যায় লালে লাল,গাছের ওপর আগুনের জলন্ত শিখা,
শিমুলের ডাল আজ লালে লাল,
চারিদিকে যেন লাল আবিরের মেলা।
এ মোহে আজ মাতোয়ারা রাধা-কৃষ্ণের ঝুলন দোলা,
দে দোল দে দোল।
প্রেম আজ স্বর্গ ছেড়ে আমার ভুবনে অতিথি।
কোকিলের কুহু কুহু ডাক-পূর্ণতা দেয়,
ওগো ওঠো ভুবনবাসী দেখ দেখ, বসন্ত এসে গেছে।
বসন্ত-১
সপ্তর্ষি বণিক
শীতের দেশে এক বসন্ত আসুক
বরফগুলো গলুক উষ্ণতায় ছোঁয়ায়
নেমে পড়ুক ঝর্ণা হয়ে এই বসন্তের দেশে।
নীল সাদা শাড়িতে এক বসন্ত আসুক
এই বসন্তের নাম দেব ভালোবাসা।
বা বীণা হস্তে দেবী নেমে আসুক
আমি এ বসন্তেরও নাম দেব ভালোবাসা।
কোকিল কণ্ঠে বসন্ত নেমে আসুক আমার শহরে
সমস্ত প্রেমিকদের আটকে দিক তারা
বা যে সম্পর্কটি ভেঙেছে
সে সম্পর্ক তৈরি হোক আবার।
আমার দেশে বসন্ত নামুক
এক ঝড় হয়ে,এক রোদ হয়ে
একফালি চাঁদ হয়ে
বসন্তদিন
অভিজিৎ জানা
বসন্তদিন, ঢেউয়ের দোলা সবুজ মাঠে,
কোন প্রেমিকের দিনগুলো হায় দারুন দিনেএকলাকাটে!
বসন্তদিন কাঁচা বয়স্ তোমায় দেখে বুক চিনচিন্
তোমার উপেক্ষারই শুষ্কবাতাস, আমি ময়শ্চারাইজিং লেপনবিহীন্!!
বসন্তদিন বসন্তদিন, মনটা বড় খারাপ করাও,
হঠাৎ হাওয়ায় কেনো বলো আশার যতো পাতা ঝরাও?
বসন্তদিন,মনজানালায় ঝাপসামুখের খেয়ালউঁকি,
কলজেছিঁড়ে আনমনে কেউ কাটছে কেবল আঁকিবুঁকি!!
বসন্তদিন বসন্তদিন— রেডিওতে পুরানোগান,
অজানা এতো কষ্ট কেনোদুঃখ সুখে ভরাচ্ছে প্রান?
বসন্তদিন মনের আকাশ সকালথেকে মেঘলাকালো!
কেবা জানে দূর থেকে কেউবাসছে তোমায় ভিষন ভালো!!
জানিনা আজ কোথায় থাকো,কাছেই নাকি অনেকদূরে!!
মাথার কসম্ সত্যি বলো - আমাকে তোমার মনে পড়ে!!!?
দখিনা বাতাস
সুনীল কুমার মণ্ডল
সুনীল কুমার মণ্ডল
শিশিরের প্রেমে সিক্ত তৃণেরা হতাশ,
শুকনো পাতায় ওঠে নূপুর নিক্বণ।
দখিনা বাতাসে খেলে শান্ত অনুরাগ,
রোমন্থনে জাগে বিষ, ওঠে দীর্ঘশ্বাস ।।
ছলাৎ ছলাৎ নদী বিরহীর গীত,
নীলাকাশে নীলাম্বরী খোঁপায় পলাশ।
কৃষ্ণচূড়া ঝুমকো হয়ে তালে ছন্দে দোলে,
মৃত্যুর বারতা পেয়ে কেঁদে ওঠে শীত।।
উতলা যুবতী এক যেন প্রজাপতি,
মুকুল সুবাস মেখে অভিসারে যায়।
কবরীতে পুষ্পজাল বাগিচা বাহার,
তপনের রক্তচোখে পদে মন্দ গতি।।
নিপাট সংসারী মনে দখিনের বাণী,
যুবতীর চপলতা রক্তে বাড়ে গতি।
করজোড়ে নত হই,নারী শক্তি পদে,
দখিনা বাতাসে খেলে প্রিয় ঋতু রানী।।
বসন্তগান
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
রিমঝিম পাতারনূপুর তানপুরায় তান দেয়
রাতদিনের ফন্দি বা ফিকিরে কে জানে! বয়ঃসন্ধির
সূর্যের এড্রিনালিন প্রকট হয়েছে বেশ বুঝি।
অভিপ্রেত আয়নায় প্রিয়মুখ ঘিরে আছে
কয়েকটি ডিলিটেড ছবি।
হরমোনাল ম্যালফাংশনে জর্জরিত হাওয়া।
সময়ের আকুপাংচারে বসন্তবেদনা।
পথের ভিড়ে প্রপিতামহের হৃদয়মোচড় দেয়া
নাকিসুর এখনো অম্লান।
নিম্নচাপের উগ্রতার ঘূর্ণি অকৃপণ হাতে
মেলায় রঙ আর আগুন ফুল ও আবির
মন এবং সুরের ছন্দিত তরঙ্গগুলি
দহনদাহনে।
প্রিয় বসন্ত
দেবব্রত রায়
নীল কুয়াশায় ভিজে যাচ্ছে শরীর,ক্রমশ
বোধের গভীরে তৈরী হচ্ছে ক্ষত
তবুও,জীবন তোমার প্রেমে বিমোহিত--
প্রিয় বসন্ত!
প্রত্যয়ী প্রাণে অহরহ
হিমালয়সম সন্দেহ
দানা বাঁধছে,ক্রমাগত রক্ত ঝরছে
বুকের ভিতর তথাপি,জীবন আজও বহমান
তোমার জন্য প্রিয় বসন্ত!
ত্যাগের ট্র্যাজিকে পিতামহ বিপর্যস্ত,দুর্যোধনও
গরল- ভাষ্যে আচমন করে অহর্নিশ
অভিশম্পাত-ধ্বস্ত জীবন ------অসহনীয়
তথাপি,বৃদ্ধ ইচ্ছামৃত্যু চায়নি এখনও,
তোমার জন্য প্রিয় বসন্ত!
হিম-ঘুম ভেঙ্গে মহেন্জোদরো
মিশরের মমি দিবস-রাত্রি ক্রোমোজম স্রোতে
ক্রোমোদ্বত
তথাপি, আত্মঘাতী হইনি এখনও
রবীন্দ্রনাথ,জীননানন্দ--------
বসন্ত এলো রে
মৈনাক ঘোষ
আবার ভরবে শাখা নব কিশলয়ে
ফুলেরা হাসবে, পাখিরা গাইবে
নব - নব তানে ।
পুষ্প ডাল ডালে
ভ্রমরের গুঞ্জন
কোকিলের কুহু তান ,
তৃপ্ত অন্তর, মুগ্ধ নয়ন ।
কৃষ্ণচূড়ার লালে - লালে
ছড়াল আগুন ডালে - ডালে।
অশোক, পলাশ আর শিমুলে
চপলা পাখিরা এলো দলে দলে।
প্রজাপতির রঙিলা পাখায়
বসন্ত হয় আরও প্রাণময় ।
আম্র মুকুল সুবাস ছড়ায়
দখিনা বাতাস পরাণ জুড়ায়।
মিলন গীতি বাজে প্রাণে প্রাণে
দুষ্ট অলি ফুলের কানে,
কি যে বলে গানে গানে।
বসন্তের আগমন
সুকন্যা সামন্ত
বসন্ত বুঝি এল দ্বারে ,
আয়রে আয় তোরা ,
আয় সবে ত্বরা
,
পরবি যদি ফুলের মালা –
আপন গলে ।
গন্ধে তাহার ভরিবে ভুবন ,
মাতিবে চিত্ত নূতন
গানে ,
ভরিবে দুঃখ ,পুরিবে আশা ,
আসিবে হিল্লোল –
নূতন তানে ।
ছন্দে ,ছন্দে , নব
আনন্দে –
আসিবে চেতন ধরার বক্ষে ,
লাগিবে তাহার পরশ ,
আপন কর্মে ,
মনে, প্রাণে ।।
এই শহরের ফাগুন
রোমানুর রোমান
এই ফাগুনে নেই তো শিমুল
শহর জুড়ে নারী,
নারীর মাথায় মিশ্র প্রতীক
গায়ে রঙের শাড়ী।
ময়দা মেখে চুড়ি হাতে
পায়ে পরে হাই-হিল,
রিকশা করে শহর ঘুরে
মুখে হাসে খিল-খিল।
পোলাগুলো দেখতে ছুটে
কোথায় মেয়ের ঢং,
ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ
সবার মনেই রং।
" একুশ আমার "
সব্যসাচী নজরুল
একুশ আমার রাষ্ট্রভাষা
দেশ জনতার গর্ব
একুশ আমার বোলে ঠাসা
কে করে তা খর্ব।
একুশ আমার ভাইয়ের লাশে
রক্তে রাঙানো মাস
একুশ আমার সারা বিশ্বে
নির্মম এক ইতিহাস।
একুশ আমার মায়ের বুকে
ছেলে হারানো শোক
একুশ আমার বাবার চোখে
আজন্ম লেখা দুঃখ।
একুশ আমার স্বাধীনতার
প্রথম ফোটা ফুল ই
একুশ আমার শিশুর মুখে
মা ডাকা মধুর বুলি।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
বসন্ত অভিমত
রক্তাক্ত সিরিয়া :লাশের মিছিল
বটু কৃষ্ণ হাল দার
বর্তমান জনসমক্ষে সিরিয়া সংকট টি গোটা দুনিয়ার গনতন্ত্রমনা মুক্তি কামি মানুষদের অসহায় জীবনের প্রতিচ্ছবি. এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম কসাই খানা বললে ও ভুল হবে না সিরিয়া কে. অচিরেই আকাশ পথে বোমা হামলা য় ওলোট পালোট সিরিয়া শহরের মানচিত্র. ফল স্বরূপ রক্তাক্ত, মৃত, পোড়া, আধপোড়া, লাশের মিছিল. কার্যত সেই লাশের উপর গদি পেতে বসে আছেন কসাই খানার মালিক সিরিয়ার রাষ্ট্র নায়ক বাসার আল আসাদ. ২০১১ সালে শুরু হওয়া ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ এ বlস্তুহারা হয় সিরিয়ার মানুষজন. আসাদের আমলে গৃহযুদ্ধ সিরিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রইলো না তা আজ আন্তর্জাতিক রূপ নেয়. আসাদের অপ:শাসন বেকারত্ব দুর্নীতি এবং গনতন্ত্র প্রেমি জনগণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে নেয়. যার ফলে তার প্রতি সাধারণ মানুষ জন ক্ষিপ্ত হন. রাষ্ট্র নেতা নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে বিদেশী শক্তির মদত নেয় যা জন গণ ভালো দৃষ্টিতে নেয় নি. তাই বর্বর আসাদ কে উৎখাত করতে আন্তর্জাতিক দেশী শক্তিগুলি উঠে পড়ে লাগে. তার উপর ছিল শিয়া ও শুননি দুটি ইসলাম ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই. শিয়া সাম্প্রদায়িক শাসিত দেশ গুলি প্রেসিডেন্ট আসাদ কে সমর্থন করত পেছন থেকে. রাষ্ট্র নায়ক নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বশেষ পন্থা অবলম্বন এর চেষ্টা করতে থাকেন. শেষ মেষ সিরিয়ার মহিলারা ও তার বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্যে পথে নেমে আসে. পরিস্থিতি ক্রোমশ জটিল হতে থাকে. রাষ্ট্রসংঘ যুদ্ধ বিরতি র সমাধান সূত্রের প্রয়াস চালিয়ে ও ব্যর্থ হোন. পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে র বাহিরে চলে যায়. এমত অবস্থায় আসাদ পরিস্থিতি তে লাগাম দিতে জাতি সঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবনা উপেক্ষা করে গোটা এলাকায় বিমান থেকে বোমা হামলা চালায়. সর্বশেষ খবর অনুযায়ী বি. ডি ডেস্ক কয়েকদিন ধরে ব্যাপক হামলা চালায়. ফল স্বরূপ সিরিয়া য় রক্ত গঙ্গা বইছে, লাশের ছোড়া ছড়ি সর্বত্র. এর উপর আছে ইসলামিক স্টেট এর অস্ত্রধারিরা, আছে জেহাদ দলের অত্যাচার. এক কথায় সিরিয়া আজ বিধ্বস্ত. এই হত্যা লীলা য় বেশি ক্ষতি গ্রন্থ অসহায় সুবোধ ভবিষ্যৎ পন্থা নিরীহ শিশুরা.
প্রশ্ন একটাই কি হবে সিরিয়ার আগামী ভবিষ্যৎ? সিরিয়ার ভয়াবহ পরিস্থিতি বিশ্বের ইতিহাস কে কলঙ্কিত করে তুলেছে. রাষ্ট্র নায়ক আসাদ কে না সরালে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবে তা জেনে শুনে আন্তর্জাতিক দেশ গুলি এখনও চুপ করে আছে তা হলো সব থেকে বড় প্রশ্ন. অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই এ চরম মুল্য দিতে হয়েছে শিশু দের. বোমার আঘাত হতে যারা বেঁচে ফিরেছে তারা হাসপাতাল নয় তো খাবার, জলের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে অসহায় মানুষের দল ও নিরপরাধ শিশুরা.
সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে যারা বেঁচে আছেন তাদের মাটির নিচে থাকতে হচ্ছে না খাবার না জল বাইরের আলো বাতাস আজ তাদের কাছে দূষিত. এটা নরক যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই নয় তাদের কাছে. সবার চোখে মুখে আজ একটাই প্রশ্ন তাদের অপরাধ কি? এর থেকে মুক্তির উপায় আছে কি? সিরিয়া আবার কবে শান্ত হবে?
রক্তাক্ত হোলি
আশীষ দেব শর্মা
বসন্তের প্রারম্ভে ধরিত্রীদেবীর রক্তস্নান, এ যেনো বিধবা মায়ের সন্মানহানী,বড়ো বিচিত্র এই দেশ, মায়ের সন্মান নিলামে নাগরিকের মুখোশধারী দেশদ্রোহীর বেশ। কোথায় আমাদের বসবাস - নি:শ্বাসে বিশ্বাসে আজ আতঙ্ক , কথায় আছে " যার জন্য করি চুরি সে বলে চোর" একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখা দরকারও দেশবাসীর "ঘর সংসার ছেড়ে রাত জেগে যারা করছে মোদের হিত,শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে নাগরিক বেশে করাচ্ছে তাদেরকেই শহীদ ।" বড়ো লজ্জাজনক ও ঘৃন্য বিষয় কি করে তাদের মাথায় আসে ?এরা তো নিজের কোলের কন্যা শিশুকেও টাকার লোভে পতিতা পল্লীতে বিক্রি করে দিবে।
কি পেলো তারা বুকফাটা কান্না,আর্তনাদ,পিতা হারা নিষ্পাপ দুধের শিশুর সজল চোখ ,নব বধূর লাল টুকটুকে বস্ত্রহরণ ! এক নিমিষেই নব বধূর কপালে জুটিয়ে দেওয়া সাদা বসন ,এই বেদনাদায়ক স্মৃতিচারন করলে ঘৃণ্য কাজে জড়িত পুংসমাজকে নপুংসক বলে মনে হয় । কেনই বা যুব সমাজ - সমাজের মূলস্রোত থেকে বেড়িয়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করছে ! কোথাও কোনভাবে যুবসমাজ আগাগোড়া অবহেলিত নয়তো,নাকি শিশুমনে কারোর মনের অজান্তে ভয়ানক আচর পেয়েছে । ভাবতেই অবাগ লাগে আজকের শিশু দুদিন বাদে রূপান্তরিত হচ্ছে হিংস্র পশুতে--, হরমোন inbalence নয়তো ! হয়তো যৌবনে পারি দিতে বেরোজগারীর করাল ছায়ায় মনের মানসী কে হারিয়ে বসা,যা নিজের ভয়ানক মৃত্যুর মুখে ধাবিত করছে । তারাও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, তাদের পেশা নির্বাচনে কিংকর্তত্ববিমূঢ় পরিস্থিতিকে - হয়তো লোকসমাজ মজা,বিদ্রুপ,অবহেলা করে ফানুস ওরাচ্ছে।
ভাল ভাবে বাঁচতে কে না চায় বড়ো মায়াবি এই সংসার । কবির কথায় "মরিতে চাইনা আমি সুন্দর ভুবনে মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই । " যে মানুষ আদিম কালে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে সঙ্গবদ্ধ জীবন যাপন করতো, যা "বনমানুষের জীবন যাত্রা" হিসাবে ইতিহাস সাক্ষ বহন করে । পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের ভাবধারা স্বার্থপরোতায় রূপান্তরিত হয়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হচ্ছে । পৌঢ় পিতামাতা আজ অবহেলিত, বিদ্ধ্যাশ্রমে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করছে । এটাই কি আমাদের উচ্চশিক্ষা,যে শিক্ষা পিতা মাতার নিরাপত্তা প্রদানে বিঘ্ন ঘটায় । যেখানে অল্প শিক্ষিত মজদুর শ্রেনীর পিতামাতা অর্ধভুক্ত অবস্থায় নিরাপদে নিজের গৃহে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করে , এ সত্বেও মৃত্যুটা তাদের কাছে অতন্ত শান্তির ।
যুবসমাজের এই অধঃপতন সমাজের মূলস্রোত থেকে বেড়িয়ে আসার পেছনে কোন দিকটা কে বেশি করে দায়ী বলে মনে করা যেতে পারে,দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় পূর্বের চেয়ে এদানিং এতটা নোংরা রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে যা সতীর্থদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ খর্ব করছে । যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ভাইকে ভাই খুন করা শেখাচ্ছে, সেখানে ভাল কি আসা করা যেতে পারে ? রাজনৈতিক ফয়দা ফলপ্রসূ করার জন্য তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্ব বক্তিতা বা ভাষণে একে অপরকে কটাক্ষ, হিংসায় মদ জুগিয়ে চলছে । প্রকাশ্যে মারপিটের হুমকি দিচ্ছে, এতেও কোনো ভাবে যুবসমাজ হিংস্র হবার অনুপ্রেরণা পাচ্ছে নাতো!
আকাশে বাতাসে নি:শ্বাসে আজ হিংস্র পরিস্থিতি, যা দেখছে সেখানেই হিংস্র প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে । চলচিত্র সেখানেও একি , কি টিভি সিরিয়াল কি সিনেমা, সেখানেও হিংস্র প্রতিবাদ অবহেলিত ভাবে কিশোর মনে জায়গা করে নিচ্ছে নাতো ! আর এই সুযোগে জঙ্গীসম্প্রদায় অবহেলিত যুবসমাজকে অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া হিসাবে ব্যবহার করছে । ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস জিন্দালাশ ভাবাপন্ন যুব সমাজকে একটি বীজমন্ত্রে দিক্ষিত করা হয় " মরার আগে দশ জনকে নিয়ে মর । "
শিক্ষিত অল্প শিক্ষিত যুবসমাজের brainwash করে করে সুকৌশলী জোঙ্গীসমাজ সদস্য সংখ্যা একের পর এক বাড়িয়ে চলছে । হায়রে সমাজ প্রতিবাদের ভাষায় কত না কবিতা লিখেছেন কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য,বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তবুও দেশের যুবসমাজের পরিকাঠামো মেরুদণ্ডহীন । যে শিক্ষাব্যবস্থা একমুঠো অন্নের জোগাড়ে রজমিস্ত্রি,টোটোচালক,রাস্তার শ্রমিক হতে বাধ্য করে সেখানে বিগত ২১ বছরের স্কুল কলেজের নীতিজ্ঞান পেটে লাথি মারা ছাড়া তাদের কাছে আর কি সঙ্গা পাবে । কিংকর্তত্ববিমূঢ় যুব সমাজ কোথায় বসন্তের হোলী খেলবে কোথায় ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে তা না করে রক্তের হোলী খেলছে,পৌঢ়দের অকাল মৃত্যু মিছিলে শামিল করছে । চলছে লুঠতরাজ,ATM হ্যাকিং,চলছে CYBER ক্রাইম,বিদেশী বর্বর শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে ঘটাচ্ছে আত্মঘাতী হামলা ।
এটাই কি আমাদের আধুনিক সভ্যতা ! কোন এক সময় বনমানুষ রুপী মোদের পূর্বপুরুষরা হিংস্র জীব জন্তুদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য আগুন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আত্মরক্ষা মুলক হাতিয়ার আবিষ্কার করেছিল এবং সঙ্গবদ্ধ জীবন যাপনের সাথে সাথে পশু শিকার করে ক্ষুধার নিবারণ করেছিলো। যতদুর সম্ভব মানুষে মানুষে লড়াই করে জীবন কেড়ে নিত কিনা তা জানার বিষয় , তাদের লড়াই ছিলো আত্মরক্ষার লড়াই যা হিংস্র জীবজন্তুদের সাথে । মানুষ যত আধুনিকের ছোয়া পাচ্ছে , মানুষ নিজেরাই হিংস্র পশুতে পরিণত হচ্ছে । বর্তমানের সভ্যতা মানুষ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে,আধুনিক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ মানুষকে বলি দিচ্ছে । ছিলো গোটা পৃথিবী ভেঙে খণ্ড খণ্ড রূপে হয়েছে বিভিন্ন দেশের মানচিত্রের ছবি । পরিচয় আমাদের একটাই- আমরা মানুষ ।
বসন্ত ছবি
শিল্পী- জয়শ্রী রায় মৈত্র
শিল্পী- রাজা বিশ্বাস
শিল্পী- শুভম রায়
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা ফাল্গুন সংখ্যা ১৪২৫