রবিবার সকালে তিন বন্ধু মিলে আড্ডা দিতে বসেছে ভোম্বলের বাড়িতে। ছুটির দিন হওয়ায় কারোরই সেরকম কাজ নেই। তাই ভোম্বল ফোন করতেই বাইক নিয়ে বের হয়ে পড়েছে নিলু । চালতাতলা থেকে কাল্টুকে তুলে নিয়ে দুই বন্ধু মিলে সটান হাজির হাজরাপাড়ায় ভোম্বলের বাড়িতে।
ওরা তিন বন্ধু ছোটো থেকেই কোচবিহারে একসাথে পড়াশোনা করেছে। গ্র্যাজুয়েশনের পর কাজল ওরফে কাল্টু যোগ দিল বাবার ব্যাবসায়। আর নীলাঞ্জন মানে নিলু পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে একটি মাধ্যমিক স্কুলে পড়ানোর চাকরি পেয়ে গেল।এদিকে বিশ্বরূপ মানে ভোম্বল পেল সরকারি চাকরি। আর ওর পোস্টিং হল সেই কোচবিহারেই।বিভিন্ন জায়গায় কাজ করলেও তিনজনের বন্ধুত্ব প্রায় একই রকম রয়ে গেছে।
ভোম্বলের বাড়িটা পুরো দোতালা নয়। নিচতলায় ওর বাবা মা থাকেন। আর দোতালায় একটা ঘর ভোম্বলের জন্যে। আর সেখানেই ওদের আড্ডার জায়গা। ঘরে ঢুকে ওরা দেখতে পেল বিছানায় ভোম্বল বাবাজির ডায়েরি পেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ঘরে গিয়ে বসতে না বসতেই মনাদা ওদের জন্যে ঠাণ্ডা সরবত নিয়ে এলো। সরবত খেতে খেতে ওদের আড্ডা চলতে থাকলো।
নিলু জিজ্ঞাসা করলো, - কি রে আজ সকাল সকাল আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিস কেন?
ভোম্বল বলল, - বাবা তোদের সাথে কথা বলবেন বলেছেন।
ভোম্বলের বাবাকে ওরা একটু ভয়ই পায়। তিনি একসময় কড়া ধাঁচের মাস্টারমশাই ছিলেন। আর ছোটবেলায় ওদেরকে অংকও দেখাতেন।
তাই ভয়ে ভয়ে কাল্টু বলে উঠলো, - কেন রে?কি হয়েছে?
ভোম্বল হেসে বলল, - সেটা তোরা বাবার কাছেই শুনিস।
এরই মাঝে আবার ট্রেতে খাবারের প্লেট নিয়ে মনাদা এসে হাজির। চোখের সামনে প্লেটে গরম গরম ফুলকো লুচি, কষা মাংস ও লবঙ্গলতিকা দেখে কাল্টুর চোখটা যেন জ্বলজ্বল করে উঠলো।
আর মনাদার পিছু পিছু ঘরে এসে ঢুকল ভোম্বলের বাবা ও মা। ওদের হাতে খাবারের প্লেট তুলে দিতে দিতে কাকিমা বললেন,- নাও বাবা, খেতে খেতে তোমরা কথাবলো।
কাল্টুপ্লেট থেকেসটান লুচি মাংস মুখে পুরে বলে ওঠে, - স্বর্গীয়!
নিলু মাথা নেড়ে তাতে নীরব সম্মতি জানায়।
এরকম এক মোক্ষম মুহূর্তে ভোম্বলের বাবা বলে ওঠলেন, - তোরা শোন, ভোম্বলের বিয়ে ঠিক হয়েছে।
কথাটা শুনেইকাল্টু প্রচণ্ড বিষম খেলো। নিলু প্রায় চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিল। কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে সে আমতা আমতা করে বলল, - খুব ভালো খবর,কাকু। কার সাথে?
কাকু বলে চললেন, - ভেবেছিলাম অপদার্থটার এখন বিয়ে দেবনা। কিন্তুরিনিমা আর ওর বাবা দেবলবাবু এমন করে ধরলেন যে আর না করতে পারলাম না।
রিনিকে ওরা আগে থেকেই চিনতো। রিনি ওদের সাথে জীবন স্যারের কাছে এগারো বারো ক্লাসে কেমিস্ট্রি পড়ত। তাই ভোম্বল যখন রিনির সাথে প্রেম শুরু করলো তখন আর ওদের অজানা থাকল না।কতবার ওদের জন্যে ভোম্বলের বাড়িতে যে নিলুদের গুলগাপ্পা দিতে হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
নিলু বলল,-বিয়ের তারিখ কবে ঠিক করলেন?
কাকু জানালেন, - বৈশাখের শুরুতেই ঠিক করেছি।
কাল্টু বলে উঠলো,- এই গরমে! তা আমাদের কি করতে হবে, কাকু?
কাকু বললেন - এই তোদের ভরসাতেই আছি।নাহলে এই অকর্মার ঢেকির পক্ষে কি বিয়ের মতো গুরুদায়িত্ব সামলানো সম্ভব? ভোম্বলের কাছে সব শুনে নে।
এরপর ভোম্বল একগাল হেসেবললো -দাঁড়া , সব বলছি তোদের।বৌভাতের হল বুকিং হয়ে গেছে। ডেকোরেটরের কাজ ওরাই করবে।
কাল্টু বলে উঠলো, - তা হলে তো ভালোই। আর গাড়ি?
ভোম্বল জানালো, - গাড়ির ব্যাপারে ঘোষপাড়ার বাপ্পাদাকেবলেছি।
নিলু জানতে চাইলো, - আর ক্যাটারার?
ভোম্বলের সোজা জবাব, - ভাবছি ক্যাটারিংটা নিজেরাই করবো।
একথা শুনেই দুই বন্ধু আঁতকেউঠল!নিলু বলল, - মানে?
ভোম্বল বলল,- কোনো প্রবলেমনেই। চাকরির যা দিনকাল, যে কোনদিন উল্টোপাল্টা জায়গায় ট্র্যান্সফার করে দিতে পারে। তখন কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে।
নিলু আমতা আমতা করে বলল, - কিন্তু ক্যাটারিং-এর তো কিছুই জানিনা আমরা।
ভোম্বল জবাব দিল, - কোনো চিন্তা নেই। কেষ্টদা সামলে নেবে।
কাল্টু অবাক হয়ে বলল, - কেষ্টদা আবার কে?
ভোম্বল বলল, - ঠিক সময়ে জানতে পারবি।
ওরা যখন কথাবার্তা বলছে তখন বাড়ির বেলটা আবার বেজে উঠলো। আর মনাদার সাথে ঘরে এসে ঢুকলো রোগা প্যাঁকাটি মার্কা চেহারার একটা লোক। ভোম্বলের থেকে জানা গেল ইনি সেই কেষ্টদা।
চা খেতে খেতে কেষ্টদা জানালো, - আমাকে যখন একবার বলেছ তখন তোমাদের কোনো চিন্তা নেই। রান্নার ঠাকুর থেকে আরম্ভ করে জোগানদার, সার্ভ করার লোক সব আমি জোগাড় করে নেব।ক্যাটারিং ইন্ডাস্ট্রিতে সুদীর্ঘ পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা আমার।
চেহারা দেখে অস্বস্তি হলেও কথা শুনে ওরা একটুভরসা পেল।
নিলু জানতে চাইলো, - আমাদের ঠিক কি কি করতে হবে, কেষ্টদা?
কেষ্টদা জানালো, - তোমাদের আমি সবকিছুর লিস্ট ধরিয়ে দেব। তোমরা শুধু লিস্ট মিলিয়ে আমাকে সব এনে দেবে।।
কাল্টু আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো,- আর মাছ মাংস?
কেষ্টদা বলল, - সেটাও তোমরা আনবে।
নিলু মনে মনে বলল, - তাহলে বাকি আর কি থাকলো?
কেষ্টদা একগাল হেসে বললো, - বিয়েবাড়ির ক্যাটারিং কি আর চাট্টিখানি কথা! তোমরা খালি সময়মত জিনিসগুলো এনে দেবে। তাহলেই সব হয়ে যাবে।
ভোম্বলবললো,- আমরা তাহলে বিয়ের দিন দুয়েক আগে মুদিখানা ও সব্জি বাজার করে রাখবো। মাছটা কে আনতে পারবি?
কাল্টুবললো, - গুড়িয়াহাটি রেলগেট বাজারের কার্তিকদাকে চিনি। ওকে বললেই কাতলা/আড়/চিংড়ি/চিতল যেরকম দরকার সেরকম মাছ এনে রাখবে। খালি বউভাতের দিন সকাল সকাল আমরা গিয়ে ওজন করে কাটিয়ে আনলেই হল।
ভোম্বল বললো,- তাহলে তো হয়েই গেল। খাসীর মাংসটা না হয় আমি মিন্টুমামার সাথে গিয়ে নুতুন বাজারের আসগর আলির দোকান থেকে নিয়ে আসবো।
কেষ্টদা অ্যাডভান্স নিয়ে চলে গেল।নিলুরাও প্লানিং শেষ করে মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরল।
দেখতে দেখতে ভোম্বলের বিয়ের দিন চলে এলো। বিয়ের দিন দুয়েক আগে কাল্টুকে নিয়ে নিলু বৌভাতের যাবতীয় মুদিখানা বাজার করে এসেছিল।তাই সকাল থেকেই একটু নিশ্চিন্তে ছিল।
হাতে সেরকম কাজ না থাকায় সকাল সকাল নিলু স্কুলে চলে এসেছিল। সবেপ্র থম ক্লাসটা শুরু হয়েছে ওমনি মোবাইলটা ভাইব্রেট উঠলো।মোবাইলস্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে সেইভোম্বল। কোনোমতে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে সে ফোনটা ধরল।
ভোম্বল প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, - এই নিলু, বিয়েটা প্রায় কেঁচে যেতেবসেছে|
নিলু অবাক হয়ে জানতে চাইল - কেন? কিহয়েছে?
ভোম্বল জবাব দিল, - বেলা বারোটার মধ্যে রিনিদের বাড়িতে গায়ে দেওয়ার হলুদ নিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু গাড়ি আসেনি|
নিলু বলল, - সেকিরে? বাপ্পাদাকে বলিসনি?
ভোম্বলজানালো - আরে গায়ে হলুদের সময়টা বলতে ভুলে গেছি।এখন বাপ্পাদা বলছে গাড়ি নেই।
ভোম্বল জানালো- ওদিকে রিনি ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে আছে।ওর বিউটি পারলার যাওয়ার দেরি হয়ে যাবে।ভাই তুই যদি একটু আসতে পারিস তাহলে খুব ভালো হয়!
অগত্যা নিলু আর কি করে । হেডস্যারকে বলে কোনোমতে স্কুল থেকে বাইকে বের হয়ে যখন হাজরাপাড়ায় পৌঁছয় তখন প্রায় বেলা সাড়ে বারোটা।
হন্তদন্ত হয়ে ভোম্বলের বাড়িতে ঢুকে নিলু দেখতে পেলকাকু, কাকিমা, রত্নাদি সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
সবাইকে একসঙ্গে বাইরে দেখে নিলু জানতে চাইল, - ভোম্বল কোথায়? আমাকে গায়ে হলুদের বাটি নিয়ে যেতে বলল।
কাকিমা বললেন, - আর বোলো না বাবা। বিয়ের দিন ছেলেটা কিনা বাইক চালিয়ে দক্ষিণ খাগড়াবাড়িতে মেয়ের বাড়িতে হলুদের বাটি নিয়ে গেল!বাপের জন্মে কোনো দিন দেখিনি এসব!
ভোম্বলের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার সময় নিলুর একটা কথাই মনে হল - ভোম্বল সব পারে!
সন্ধ্যাবেলায় বরযাত্রী যাওয়ার জন্যে কাল্টু ও নিলু যখন ভোম্বলের বাড়িতে এসে ঢুকল, তখন আত্মীয়স্বজনে বাড়ি প্রায় গমগম করছে। নানা আচার নিয়ম মেনে বরের গাড়ি যখন বের হলো তখন প্রায় সন্ধ্যা সাতটা।
হাজরাপাড়া থেকেদক্ষিণ খাগড়াবাড়ি যাওয়ার পথে কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি থামিয়ে ভোম্বলের বাথরুম করা ছাড়া বিশেষ কিছু ঘটলোনা। একটা জিনিস নিলুরা ভালোই বুঝল যে বিয়ের আগে বউ যতই চেনা হোক, বিয়ের করতে গেলে সবারই টেনশনহয়!
ভোম্বলের বিয়ের লগ্ন মাঝ রাতে। তাই বিয়ে শুরু হতে হতে রাত বারোটা বেজে গেল।বিয়ে শেষ হতে হতে প্রায় শেষ রাত। তখন বাসর জাগার মতো ইচ্ছে আর কারো ছিলোনা।
এদিকে ভোম্বলের বৌভাত পড়েছে রবিবার। কদিন ধরেই কোচবিহারে খুব গরম পড়েছে। ঝড়বৃষ্টির কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
আগের দিন সন্ধ্যায় কাল্টুকে নিয়ে বৌভাতের সব্জিবাজার হয়ে গিয়েছিল। তাইনিলু একটু আরাম করে ঘুমোচ্ছিল। কিন্তু নটা বাজতে না বাজতেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল কাল্টুর ফোনে।
কাল্টু বলল, - এই নিলু তাড়াতাড়ি ওঠ। এদিকে কেলো করেছে।
নিলু চোখ কচলাতে কচলাতে বলল - কি হয়েছে রে?সকাল সকাল আর কাওকে পাসনি? আমাকে জ্বালাচ্ছিস কেন?
কাল্টু বলল - আরে বলিসনা, কার্তিকদার মা মারা গেছে।
ঘুমের চোখে নিলু বলে - তাতে আমাদের কি?
কাল্টু জানায় - আরে কার্তিকদার দোকানেই তো মাছের অর্ডার দেয়া আছে!আর মাছ আসবে সেই শিলিগুড়ি থেকে। মা মারা যাওয়ায় কার্তিকদা মাছ আনতে যেতে পারেনি।এদিকে অ্যাডভান্সও করা আছে।
কাল্টু জানায় - এত ভাবিস না। বাইক বের কর। চল যাই খাগড়াবাড়ি চৌপথী।
সুতরাং নিলু আর কি করে! তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে চাবিস্কুট খেয়েই বাইক নিয়ে বের হয়ে পড়ল।
খাগড়াবাড়ি চৌপথীতে ট্রাক দাড় করিয়ে দুই রকম মাছের পেটি নামিয়ে তা ছোটো ট্রাকে তুলতে তুলতে দুই বন্ধু গলদঘর্ম হয়ে গেল। সকালের এই যুদ্ধ শেষে খাগড়াবাড়ি থেকে মাছের
পেটিগুলো নিয়ে নিলুরা যখন অনুষ্ঠান বাড়িতে পৌঁছল তখন সূর্য প্রায় মধ্যগগনে।
কেষ্টদা ওদের দেখেই ক্ষেপে গিয়ে বলল, - বলি বেলা একটার সময় মাছ আনলেহবে?কাটাবো কখন আর ঠাকুর রান্না করবে কখন?
কাল্টুবলল - একটু ম্যানেজ করে নাও কেষ্টদা।সেই সকাল থেকে দুই বন্ধু না খেয়েদেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছি।
কেষ্টদা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বললো - ভোম্বলের পাল্লায় পড়লে এরকমই হবে।এই যেমন আমি ফেঁসে গেছি!
এরপর নিলুরা চলে এসেছে সোজা ভোম্বলের বাড়িতে। কাকিমা ওদের দেখেই দুই প্লেটলুচি তরকারী পাঠিয়ে দিলেন।কাকিমার পাঠানো সেই খাবার খেয়ে নিলুরা সবে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েছে, ওমনি কেষ্টদা এসে হাজির।
ভোম্বল বলে উঠলো - একি কেষ্টদা!তুমি এখানে!
কেষ্টদা বলে - বলি মাংস কোথায় রেখেছ?
এবার ভোম্বল আমতা আমতা করতে করতে বলে - এই যাহ! ভুলে গেছি।
মাংস কেনার দায়িত্ব ভোম্বল মিন্টুমামা ও নিজের উপর রেখেছিল|তার পরিণতি যে এরকম করুণ হবে তা নিলুরা আন্দাজ করতে পারেনি।
কেষ্টদা বলল - মানে? আর কখন কিনবে আর কখনই বা তা রান্নাহবে?
ভোম্বল জবাব দেয়, - না মানে! এই আনতে যাচ্ছি।
এবার কেষ্টদার গলা আস্তে আস্তে চড়তে থাকে - মাংসের দোকান কি তোমার শ্বশুরের যে এই ভরদুপুরে খোলা থাকবে?
ভোম্বল আমতা আমতা করে বলে, - না, মানে, ইয়ে…
কেষ্টদা সবশেষে তার ব্রহ্মাস্ত্রটা ছেড়ে দেয়, - এই আমি চললাম।এরপর নিজের বউভাতের রান্নার ব্যবস্থা নিজেই করো।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিলুরা প্রায় হাতেপায়ে ধরে কেষ্টদাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।
ঘরে চেঁচামেচি শুনে ভোম্বলের বাবা আর মিন্টুমামা এসে হাজির হন।
কাকু বলে ওঠেন, - অকালকুষ্মান্ড! অপদার্থ| সারা জীবন কিছুই তো নিজে করতে পারলি না। বিয়েটা অন্তত ঠিকঠাক কর।
কাকু আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মিন্টুমামা কোনোমতে সামাল দিলেন।
নিলুরা তখন ভাবতে বসেছে যে বেলা দুটোর সময় কোথায় মাংস পাওয়া যাবে।মিন্টুমামা তখন বললেন, - তোমরা সোজা পাওয়ার হাউসের মোড়ে রহিম চাচার দোকানে চলে যাও। ওই খাসীর দোকানটি সারাদিন খোলা থাকে।
অতএব কাল্টু আর নিলু গজগজ করতে করতে বের হয়ে পড়ল।ওরা ভেবেছিল বন্ধুর বিয়েতে একটু হৈহৈ করবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি!
পাওয়ার হাউসের মোড়ে রহিম চাচার দোকান খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হোলো না। কিন্তু এত পরিমান খাসির মাংস কেনার পর কাটাতে গিয়ে সেই বিকেল হয়ে গেল।
তারপর মাংস নিয়ে ঘেমে নেয়ে নিলুরা যখন হাজরাপাড়ায় পৌঁছল তখন প্রায় সন্ধ্যা হব হব করছে। অনুষ্ঠানবাড়ির রান্না ঘরে গিয়ে নিলু বলল - এই নাও মাংস, কেষ্টদা|
নিলুদের দেখেই ঠিক যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল কেষ্টদা - এই ভর সন্ধ্যা বেলায় মাংস নিয়ে আমি কি নাচবো না গাইবো?
কাল্টু তাও মেকআপ দেওয়ার চেষ্টা করলো, - না না, এখুনি গিয়ে রান্নার ঠাকুরকে বসিয়ে দিতে বলো। তাহলেই হয়ে যাবে।
কেষ্টদার গলা খেঁকরে বলে উঠলো, - তোমার মুন্ডু হবে!এই মাংস ভালো করে ধুয়ে বসাতে বসাতেই সাড়ে সাতটা বেজেযাবে। তারপর কষিয়ে রান্না হতে হতে কম সে কম রাত নয়টা। শুরুতে খেতে বসা ব্যাচগুলো কি মাছি তাড়াবে?
সারাদিন গরমে ঘুরে ঘুরে নিলুরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো - সে তুমি একটু ম্যানেজ করে নাও, কেষ্টদা|
আর বলেই কাল্টুকে নিয়ে সে সটান কেটে পড়ল।
বাড়ি ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে হেলতে দুলতে কাল্টু আর নিলু যখন অনুষ্ঠান বাড়িতে পৌঁছল তখন রাত প্রায় রাত সাড়ে আটটা। ভোম্বলের বিয়ে উপলক্ষ্যে কেনা নতুন কুর্তা পাঞ্জাবি পড়ে দুজনে অনুষ্ঠান বাড়িতে এসেছে।
তবে বাইরে বেশ গরম। বিকেলে একটু ঝড়ো হাওয়া দিলেও বৃষ্টি হয়নি। তাই অনুষ্ঠান বাড়িতে ঢুকে অত লোকের মাঝে ওদের আরও গরম লাগতে লাগলো।
বন্ধুদের দেখেই ভোম্বল চলে এলো। ও বেশ জম্পেশ পোশাক পড়েছে|ওকে দেখতে একটু মোটাসোটা রাজপুত্রের মতো লাগছে।
ভোম্বল জানালো, - ভাই, খাওয়ার ওখানে একটু সমস্যা হয়েছে!
নিলু বলল, - কি হয়েছে রে, ভোম্বল?
ভোম্বল বলল, - ফার্স্ট ব্যাচ শেষ করে সেকেন্ড ব্যাচ চলছে।কিন্তু মাংস নাকি টেনেও ছেড়া যাচ্ছেনা!
কাল্টু বিজ্ঞের মতন বলল, - ও নিয়ে চিন্তা করিস না। থার্ড ব্যাচ থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভোম্বল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো|
নিলু আর একটু খুলে বলল, - বুঝলি না? মাংস ততক্ষণে সিদ্ধ হয়ে যাবে।
এরমধ্যে শ্বশুরবাড়ীর লোকজন চলে আসায় ভোম্বল একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লো।আর নিলুরাও সেই সুযোগে স্ন্যাকসের স্টলের সামনে চলে এল।
ওরা ফুচকা দিয়ে শুরু করল।তারপর বেবীকর্ন, ফিশফিংগার, চিকেন ড্রামস্টিক কিছুই বাকি রাখলো না। মাঝে মধ্যে মেয়ে দেখলে অবশ্য একটুআধটু লাইন মারাও চলছিল।
দেখতে দেখতে রাত এগারোটা বেজে গেছে।বাইরের নিমন্ত্রিত অতিথিরা খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফিরে গেছে। তখন পড়ে রয়েছে ভোম্বল আর রিনির আত্মীয়স্বজনেরা।
সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে নিলুরাও বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ওদের বেশ খিদে খিদেও পাচ্ছে। কিন্তু ভোম্বলদের ছেড়ে তো আর ওরা খেতে বসতে পারেনা।
এরকম একটা সময় ভোম্বলের ডাক এলো - চল ভাই সবাই খেতে বসি।
শুনে কাল্টুর ধরে যেন প্রাণ ফিরে এলো। যাইহোক, নির্বিঘ্নে ওদের খাওয়া শেষ হলো।খাওয়াদাওয়ার পরে ভোম্বল ও রিনিকে শোবার ঘরে পৌঁছে দিয়ে নিলুদের কাজ শেষ।
আর ঘরে ঢুকে ওরা দেখে আরেক কান্ড। ভোম্বল ফুলশয্যার খাট সাজাতে বলেছিল পাড়ার মোড়ের ফুলের দোকানের বগাদাকে।আর রোববার রজনীগন্ধা ভালো না পাওয়ায় গাঁদা ফুলের মালা ও কুচো ফুল দিয়ে খাট সাজিয়েছে সে।আর তা দেখে ঘরে ঢুকেই রিনির মাথা গরম। এমনি তে ভোম্বলের সারাদিনের কান্ড দেখে সে একটু রেগেই ছিলো। কিন্তু ফুলসজ্জার এমন বাহার দেখে আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি সে।
ঘটনাটা আরো বাড়ার আগেই রত্নাদি এসে কোনোরকমে রিনিকে অন্য ঘরে নিয়ে গেল।আর ভোম্বল কাঁচুমাচু মুখ করে বন্ধুদের সামনে এসে দাঁড়ালো|
আর কি করা যায়! চোখের সামনে নিলুরা তো আর বন্ধুর প্রেস্টিজ কিচাইন হতে দিতে পারে না! রত্নাদির সাথে কথা বলে কাল্টুকে নিয়ে নিলু ফের বের হল হাসপাতাল পাড়ার উদ্দেশ্যে।
তারপর এক পরিচিত দোকানদারকে ঘুম থেকে তুলে নিলুরা কিছু রজনীগন্ধার স্টিকও গোলাপ ফুল জোগাড় করল। সেসব নিয়েওরা যখন ভোম্বলের বাড়ি আবার পৌঁছল তখন রাত প্রায় দুটো।
খাট পরিস্কার করে আবার রজনীগন্ধা ও গোলাপ দিয়ে সাজাতে সময় লাগলো আরো ঘন্টা দেড়েক। অবশ্য রত্নাদি, রিনি আর ভোম্বল ও তাতে হাত লাগালো। খাট সাজানো যখন শেষ হল, তখন সবাই প্রায় ঘেমে নেয়ে একশেষ।
তারপর ভোম্বল ও রিনিকে ঘরে ছেড়ে কাল্টু ও নিলু যখন বাড়ি থেকে বের হল তখন ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন চৈত্র সংখ্যা ১৪২৫