Monday, July 1, 2019




সম্পাদকের কথা



বর্ষা মানে সৃষ্টি। উর্বরা পৃথিবীতে বৃষ্টির জলই নিয়ে আসে জীবনের স্পন্দন। 
কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে অনাবৃষ্টি চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে সবার কপালেই। হু হু করে নেমে যাচ্ছে পৃথিবীর জলভাণ্ডার। আগামীদিনে কী হতে চলেছে সে ভাবনা বুঝতে খুব বেগ পেতে হয় না। 
আমাদের উত্তর থেকে বৃষ্টির সেই রাজকীয়তা হঠাৎ করেই উবে গেছে যেন। দিনরাত এক করা সেই বৃষ্টি আজ আর নেই। নেই টিনের চালে বৃষ্টিগান। হারিয়ে গেছে বর্ষার সুন্দর কালো মেঘ।
সৃষ্টির বৃষ্টি নেই আমাদের জীবনেও। পরিবর্তে এক অদ্ভুত অন্ধকার। নিত্যদিন হনন আর কুনাট্যে ভরপুর আমাদের জীবন। কখনো চিকিৎসক নিগৃহীত হচ্ছেন, কখনো সাধারণ মানুষ। গণতন্ত্রের পীঠস্থানে উঠছে নানা ধরণের ধর্মীয় স্লোগান। কেউ আবার ফতোয়া দিচ্ছেন নারীর ভূষণ নিয়ে। সঙ্গে রয়েছে অজস্র অকথা-কুকথা।
বৃষ্টির অভাবের সঙ্গে সঙ্গে অভাব ঘটেছে আমাদের বোধ ও বুদ্ধির। আগামীদিনে এর ফল কী হতে চলেছে সেটা বুঝতে পারছি স্পষ্ট। 
প্রবল বৃষ্টি যেমন রক্ষে করতে পারে প্রিয় পৃথিবীকে, তেমনি বোধ ও বুদ্ধির বৃষ্টি সমাজকে করুক কলুষ ও দূষণমুক্ত।    



মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা 


এই সংখ্যায় যাঁরা আছেন

ডক্টর ইন্দ্রানী বন্দোপাধ্যায়, তৈমুর খান, গীর্বানী চক্রবর্তী, কুমকুম ঘোষ, অপরাজিতা দেবনাথ

 কর্মকার, কাকলি ভদ্র, রাণা চ্যাটার্জী, সুব্রত নন্দী, রীনা মজুমদার, মিতা বিশ্বাস বসু,

 কৌশিক চক্রবর্তী, পারমিতা রাহা হালদার, সত্তাপ্রিয় বর্মন, প্রতিভা পাল সেন, সৈকত সেন,

 স্বপন চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়াঙ্কা ভুঁইয়া, মৈনাক ঘোষ, ইন্দ্রাণী সমাদ্দার, যূথিকা সাহা, দেবব্রত

 সেন, সুস্মিতা পাল কুন্ডু, মাথুর দাস, সঞ্চিতা দাস, রীতা মোদক, সঞ্জয় কুমার মল্লিক, মজনু

 মিয়া, লুবনা আখতার বানু, আশীষ দেব শর্মা, যীশু চক্রবর্তী, সফিকুজ্জামান

প্রচ্ছদ ছবি- শৌভিক রায় 

মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা 


প্রকাশক- রীনা সাহা 
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার 
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com


মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা 






বিশেষ প্রবন্ধ


পুষ্পক রথ ও শৌভ রথ


ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়




আত্মানং রথিনাং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু



বুদ্ধিংতু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগহমেব চ। 



রথের উৎপত্তি প্রসঙ্গে কঠোপনিষদে বলা হয়েছে এই মানবদেহ হল রথ, জীবাত্মা


 রথস্বামী,বুদ্ধি রথ চালক এবং মন ই রথের লাগাম। জ্ঞানী বুধ মন্ডলী মানবদেহের ইন্দ্রিয় 

গুলিকে ঘোড়ার মত পরিচালনা করেন।


দেহরূপ রথের চড়ে মানুষ সংসারী হয়।এই রথে অধিষ্ঠিত জগন্নাথ সৎ স্বরূপ ঈশ্বর, সুভদ্রা 


চিৎস্বরূপা ও বলরাম আনন্দস্বরূপ ।


রথের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন।রথ শব্দের ব্যুৎপত্তি তে রয়েছে সংস্কৃত রম্ ধাতু যার অর্থ আনন্দ


 করা । ঋগ্বেদসংহিতা,শতপথব্রাহ্মন,রামায়ন,মহাভারত,ভাগবৎ পুরাণ, হরিবংশ ,স্কন্দ

 পুরাণ প্রভৃতি  বৈদিক ও লৌকিক সংস্কৃত সাহিত্যে রথের গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ পাওয়া যায়।


বাংলা র কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তে রথ যাত্রা র গুরুত্ব প্রসঙ্গে রামায়নে বর্ণিত পুষ্পক রথ ও


 মহাভারতে উল্লেখিত শৌভিক বা দিব্য রথের আলোচনা র মূল উদ্দেশ্য হলো প্রাচীন কালের 

 এমন অনেক মূল্যবান তথ্য আছে যা এখনও আবিষ্কৃত হয় নি যদি বা কিছু হয়েছে তার 

আলোচনা  হয় তো ততখানি গুরুত্ব পায়নি সে বিষয়ে আলোকপাত করা এবং আর ও নতুন 

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তে বিষয় টি কে বিশ্লেষণ করে নতুন থেকে নতুনতর সিদ্ধান্ত  আবিষ্কারের 

 জন্য আগ্রহী পাঠক কে সচেতন করা।

রামায়ন মহাকাব্যের সঙ্গে রথের সম্বন্ধ খুব গভীর বলা যেতেই পারে ।

রাজা দশরথের আসল নাম ছিল নেমি  যেহেতু তিনি দশ দিকে রথ চালনা করে অস্ত্র বর্ষণ 

করতে পারতেন তাই তাঁর নাম দশরথ। রামায়নে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রথের প্রসঙ্গ  পুষ্পক 

রথের বর্ণনা ।এই পুষ্পক রথ একটি দিব্য রথ বা স্বর্গীয় বিমান। রামায়ণে সুন্দর কান্ডের নবম

 সর্গে  এর বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায় -- বিশ্বকর্মা ব্রহ্মা র জন্য মণিমুক্তা খচিত দিব্য গুণ যুক্ত 

রথ নির্মাণ করেছিলেন ---


'বিমানং পুষ্পকং নাম সর্ব রত্নভূষিতম্ ।'



কুবের কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মা র কাছ থেকে উপহার স্বরূপ সেই পুষ্পক রথ টি পেলেন।


 কুবেরের সৎ ভাই লঙ্কাপতি রাবণ তাঁকে পরাজিত করে রথ টি নিজের আয়ত্তে আনলেন ।

 তিনি ওই পুষ্পক রথে করে সীতা কে চুরি করে আনলেন । অবশেষে রামচন্দ্র রাবন কে যুদ্ধে

 পরাজিত করলেন । বিভীষণ তখন রামচন্দ্র কে রথ টি উপহার দিলেন ----


'পুষ্পকং নাম ভদ্রং তে বিমানং সূর্যসন্নিভং'



রামচন্দ্র সীতা ক নিয়ে রাজ্যে ফিরলেন এবং কুবের কে রথ টি ফেরৎ পাঠিয়ে দিলেন ।পরে


 কুবের খুশী হয়ে এটি আবার রামচন্দ্র কে পাঠিয়ে দিলেন।এখানে একটি বিষয় খুব ই আশ্চর্য 

জনক যে রথ টি কোন চালক ছাড়াই অযোধ্যা থেকে কুবেরের বাড়ি গেল ও ফিরে এল - এটি 

কিভাবে সম্ভব ? রামায়নের সময় সীমা  মোটামুটি ভাবে খ্রী.পূর্ব দ্বিতীয় থেকে খ্রী. দ্বিতীয় 

শতক তাহলে সেযুগ এটি কী শুধু কল্পনা না তখন সত্যিই কোনো উন্নত মানের বিমানের অস্তিত্ব

 ছিল !  এই তথ্য কে কল্পনা প্রসূত বলে ধরে নেওয়া যায় না কারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিষয়

 টি র সত্যতা র দিক নির্দেশ করে, আফগানিস্তানের (প্রাচীন ভারতের গান্ধার রাজ্য) গুহায়

  অন্ততঃ পাঁচ হাজার বছর পুরোনো একটি বিমানে র সন্ধান গবেষক যা পেয়েছেন। রাশিয়ার 

ফরেন ইন্টিলিজেন্স দপ্তরের দাবী এই বিমানের প্রাচীনত্ব মহাভারতের কালের । শুধু তাই নয় 

চীন সরকার তিব্বত থেকে কিছু প্রাচীন  সংস্কৃত পুঁথি  উদ্ধার করেছেন ইস্টার স্টেলার

 স্পেসশিপ নির্মাণের পদ্ধতি বর্ণিত আছে। চন্ডীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিত রুথ রেয়ানা জানান

 যে চীন সরকার  তিব্বতের লাসায় যে সংস্কৃত পুঁথি গুলি পেয়েছেন সেগুলি তে স্পেসশিপ 

নির্মাণের পদ্ধতি র বর্ণনা পাওয়া যায়।শল্ব সূত্র ও সমর সূত্র ধারা গ্রন্থে বিমান সম্পর্কে যে 

আলোচনা আছে রামায়নে পুষ্পক রথের প্রসঙ্গ অবতারণায় তাঁর প্রভাব থাকতে ও পারে।


মহাভারতের রাজাদের  শৌর্য ও বীর্য বর্ণনায়,পান্ডব ও কৌরবদের যুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের রথের


 প্রসঙ্গ লক্ষ্য করা যায়,শুধু প্রসঙ্গ নয় বিস্তারিত আলোচনা ও পাওয়া যায়।


কুরু পান্ডবের যুদ্ধে চতুরঙ্গ সেনার ভূমিকা ও লক্ষ্যনীয়। এদের মধ্যে রথীরাই সর্বশ্রেষ্ঠ।তার 


মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের রথ সবার সেরা। কৃষ্ণের  স্বর্ণ নির্মিত রথের নাম গরুড়ধ্বজ  । 

অর্জুনের রথের বিশেষত্ব ছিল তাঁর রথের গতি কেউ রোধ করতে পারতো না, তাঁর রথের চার

 টি দ্রুতগামী সাদা ঘোড়া র নাম শৈব, সুগ্রীব, মেঘ পুষ্প ও বলাহক।


তবে মহাভারতের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ রথ টি হল রাজা শল্যের  দিব্য রথ,এটির নাম শৌভ 


রথ। মহাভারতের শল্য পর্বে রাজা শল্যের শৌভ রথের সাহায্যে বৃষ্ণিদের সঙ্গে যুদ্ধের বিস্তৃত

বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। রাজা শল্য শিবের তপস্যা করে বর  পান যে এমন একটি রথ তিনি

 তৈরী করতে পারবেন সেই রথ টি দেব,দানব , মানুষ, গন্ধর্ব কেউ ধ্বংস করতে পারবে না ।

ময় নামক  দানব লোহা দিয়ে তখন একটি  মায়াময় আকাশ যান বা দিব্য রথ তৈরী করলেন

 -এই রথ টি র নাম শৌভ রথ।শুধু মহাভারত নয় ভাগবৎ  পুরাণের দশম স্কন্ধে শল্যের শৌভ

 রথের রোমাঞ্চকর বর্ণনা পাওয়া যায় --"এই মায়াময় শৌভযান টি কখন ও একরূপ কখন ও 

বহুরূপ , কখন ও দৃশ্য,কখন ও অদৃশ্য,কখন ও ভূমি তে কখন ও বা আকাশে, জলে, গিরিশৃঙ্গে

 অলাতচক্রের ন্যায় নিরন্তর পরিভ্রমণ শীল ।"এই অদ্ভুত আকাশযান নিয়ে মোট সাতাশ দিন

 যুদ্ধ করে অবশেষে কৃষ্ণের হাতে তিনি  শৌভ রথ সহ পরাজিত হন,যান টি কে ও কৃষ্ণ ধ্বংস 

 করলেন।গবেষক ও পন্ডিতেরা মনে করেন শল্যের শৌভ রথ হল অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু বা ফ্লাইং

 সসার (UFO ),শল্য হয়ত প‌্যারাস্যুট ব্যবহার জানতেন ,সেটি পরে রথ থেকে নেমে যুদ্ধ

 করে আবার অদৃশ্য হয়ে যেতেন । সাধারণ রথে বা বিমান যেরূপ যন্ত্র পাতি থাকে তা এখানে

 নেই,এটি সম্পূর্ণ নতুন ধরণের উড়ন্ত বায়ু যান ।


পরিশেষে বলা যেতে পারে সংস্কৃত বৈদিক ও লৌকিক  সাহিত্যে রথ ছিল রথীর শৌর্য,


 বীর্য,বাস্তশাস্ত্রে দক্ষতা, রুচি, শিল্প , ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও ক্ষমতা র  পরিচায়ক।যে কোন ধর্মীয়

 অনুষ্ঠানে, ক্রীড়া ও  প্রতিযোগিতায় রথের ব্যবহার ছিল বিশেষ ভাবে  গুরুত্বপূর্ণ। পৌরাণিক 

সাহিত্যে বিভিন্ন দেবতার  শোভাযাত্রায় রথের উল্লেখ পাওয়া যায়। রথযাত্রার প্রচলন নিয়ে

 পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও বুদ্ধদেবের জন্মোৎসব উপলক্ষে বৌদ্ধরা যে রথযাত্রার

 উৎসব করত তা থেকে হিন্দু রথযাত্রার উৎপত্তি বলা যেতে পারে  । বিখ্যাত চীনা পর্যটক

 ফা হিয়েন খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকে সেই সময় মধ্য এশিয়ার খোটানের বুদ্ধের রথযাত্রার যে বর্ণনা

 দিয়েছেন তার অনেকাংশে পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলার কৃষ্টি, 

সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে রথযাত্রার গুরুত্ব  প্রভূত তবু ও পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা এখন

 সবথেকে খ্যাতি লাভ করেছে  তার কারণ এখানে ভক্তি বাৎসল্য ও দেবতার মানবায়ন মিলে

 মিশেএক হয়ে আছে। চৈতন্য মহাপ্রভু এই নীলাচলে প্রেমময় ভক্তিবাদ প্রবর্তন করেছিলেন তাঁর

 আদর্শ 'মানবতা ই পরম ধর্ম' আর এই মন্ত্র ই হল রথযাত্রার মূলমন্ত্র।



বিশেষ কবিতা

রথযাত্রা

তৈমুর খান


বরং আমাদের রথযাত্রা হোক মানবতার দিকে
বরং আমরা হিংসা বিজয় করে ফিরি
আর একটি অহিংসার পৃথিবীর দিকে

আমি, তুমি, আমরা সবাই
আজ ও আগামীকাল এই শফথ নিতে থাকি!




 বৃষ্টি প্রিয় বৃষ্টি
গীর্বাণী চক্রবর্তী

আজ তুমুল বৃষ্টির রাত
শূন্য হাতে আমি একা
ভিজব বলে এসেছি----
ভেজাবে আমাকে হে পবিত্র বারিধারা ?
ভেজাও তবে সৃষ্টিসুখের আনন্দে,
ভেজাও তবে সকল মলিনতা দূর করে
ভীষণ বৃষ্টি ভেজা রাতে শুনেছ কি
নিশাচর পাখির ডানার ঝাপটানি?
রূপালী বিদ্যুতের চমকে চোখ যায় বুঁজে
তবুও ফুলেল বৃষ্টির হাত ধরে যেতে চাই
অনেক দূরে, ওই মেঘেরও পারে, ওই
আকাশেরও পারে, যেখানে স্বপ্নিল ইচ্ছেরা
ছড়িয়ে দেয়, উড়িয়ে দেয় রংমিলান্তি খুশি-----

অনেক দিন পর আমি আবার কান পেতে আছি
তোমার গান শুনব বলে, প্রিয় বৃষ্টি



ভ্রমণ 

ভূস্বর্গ-কাশ্মীরে কয়েকদিন
কুমকুম ঘোষ 


১৯শে মে রাত ১১.২০ র GoAir ফ্লাইট ধরে দিল্লি এয়ারপোর্ট নামলাম  রাত ১.৩৫ এ। শ্রীনগর এর ফ্লাইট সেই ভোর ৫.৪৫ মিনিট।অতএব আমরা ৬ জন ওয়েটিং প্লেসে রাতটুকু কাটিয়ে দিলাম অনায়াসে প্রথমবার ভূস্বর্গ দেখার উত্তেজনায়। সেই উত্তেজনা অপার বিস্ময়ে পরিণত হলো যখন( প্রায় সাড়ে ৬ টা নাগাদ) বরফঢাকা পীরপঞ্জাল পাহাড় শ্রেণী প্লেনের জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম।সে এক অসাধারণ দৃশ্য।
সূর্যদেব প্রকাশমান ও দৃশ্যমান উদ্বেলিত রক্তিম আভা।

দেশের লোকসভা নির্বাচনের উত্তাপ ও মে' মাসের তুমুল গরম পেরিয়ে মাত্র ১০ ঘন্টার মধ্যে ( বাড়ী থেকে রওয়ানা দিয়েছিলাম রাত ৯টায়) , সকাল ৭টায় পৌঁছে গেলাম দেশের উঃপশ্চিমের রাজ্য ভূস্বর্গ কাশ্মীরে। এয়ারপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়শ্রেণী আবহাওয়া মনোরম(হাল্কা ঠান্ডা) 
সবুজ চিনার ওক দেওদার গাছে ঘেরা ও সুনীল আকাশের নীচে সুন্দরের অনাবিল রূপ।না জানি আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে!!!

আমাদের প্রথম গন্তব্য পহেলগাম। পুরো ট্যুর এর জন্য একটা Innova গাড়ী বুক করা ছিল জম্মু র এক ট্রাভেল এজেন্সি থেকে। ড্রাইভার নামলেখা প্ল্যাকার্ড হাতে এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।গাড়ীর মাথায় বাঁধাছাঁদা করে  যাত্রা শুরু করেই আবার বিস্ময়--- দশ হাত দূরে দূরে প্রায় প্রতিটি গাছের নীচে পুরো রাস্তায় অ্যাসল্ট রাইফেল কাঁধে সশস্ত্র সেনা সাহারা দিচ্ছে।অটো টোটো বাস ও যানজটে অভ্যস্ত জীবনে এ এক প্রবল ধাক্কা।ভয় তো একটু পেয়েছিলাম আমরা সবাই। বিশেষ করে সদ্য ঘটে যাওয়া পুলওয়ামা কান্ডের পর প্রায় সব শুভাকাঙ্ক্ষীই কাশ্মীর ভ্রমণ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর একজায়গায় গাড়ী দাঁড়িয়ে পরলো।সার সার মিলিটারি ট্রাক আসছে জম্মু-কাশ্মীর হাইওয়ে দিয়ে। প্রতিটি ট্রাকের মাথায় আধুনিক স্বয়ংক্রিয় বন্দুক হাতে কড়া চোখ ও কঠিন শারীরিক ভাষা নিয়ে পাহারারত সৈনিক সমেত।সেনা কনভয় চলে যাওয়ার পর ডানদিকে বাঁক নিতেই চোখে পরলো দূরের পাহাড় শ্রেণী,কিছুটা এগিয়ে সুন্দরী লীডার নদী আমাদের সঙ্গী হলো।
সঙ্গী ড্রাইভার ফারুক ভাই ন্যাশনাল হাইওয়ে-১ এর দুপাশে বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমি দেখালেন। এখানেই হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দামী মশলা #জাফরান এর চাষ। বছরের যত একমাস মাত্র বেগুনি রঙের ফুলে ভরে যায় এই উপত্যকা।বাকি এগারো মাস এই মাঠ এই ক্ষেত ফাঁকা পরে থাকে। প্রতিটা ফুলের থেকে তিনটি করে কেশর সংগ্রহ করা হয়। একারণেই এই জাফরাণ বা কেশর এতো দামী মশলা,যা একমাত্র কাশ্মীরেই পাওয়া যায়।



পহেলগাম কে বলা হয়--ল্যান্ড অফ শেফার্ডস, এই অঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রধান পেশা ভেড়া পালন ও চড়ানো।পথে বহুবার ভেড়ার পালের জন্য গাড়ী আটকে গেছে। হোটেল পাইন প্যালেস (বুক করাই ছিল কলকাতা থেকে)। পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গেল। কিন্তু হোটেলের ঘর থেকে যখন বরফঢাকা পীরপঞ্জাল দেখলাম তখন সারারাতের জাগরণের ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল।এ যেন ছবির দেশ।হোটেলের কর্মচারীদের অত্যন্ত মধুর ব্যবহার। ঝটপট গরম জলে স্নান ও লাঞ্চ সেরে বেড়িয়ে পরলাম কাছাকাছি দ্রষ্টব্য স্হানগুলো দেখে নিতে। কিন্তু সেজন্য আমাদের লোকাল গাড়ী ভাড়া করতে হোলো ,সেটাই নাকি এখানকার দস্তুর।
**********"***************
পহেলগাম কাশ্মীরের স্পর্শকাতর অনন্তনাগ জেলার একটি শহর। এখানেই অবস্হিত #চন্দনবাড়ী,যেখানে থেকে অমরনাথ যাত্রা শুরু হয়। প্রশস্ত রাস্তা র পুরোটাই বরফের পুরু আস্তরণে ঢাকা। সেখানে কাঠের লোকাল স্লেজ গাড়ীতে কয়েকজন বরফের ওপর ঘুরছে।আর কিছুদিন পরে বরফ গলে যাবে ও #অমরনাথ যাত্রা সূচনা হবে জুলাই মাসে।
 
পরের গন্তব্য #বেতাব ভ্যালি।আট এর দশকে ব্লকবাস্টার হিন্দী সিনেমা #বেতাব এর বেশ কিছু দৃশ্য এখানে শুটিং হয়েছিল। সেটাকে কেন্দ্র করে এই ট্যুরিস্ট স্পট টি বানানো হয়েছে। কাশ্মীরের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হিন্দি সিনেমার অন্যতম শুটিং প্রেফারেন্স ছিল একসময়।
পহেলগাম এর আরেকটা অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট হচ্ছে #আরু ভ্যালি। কিন্তু সেখানে ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে বেশ কিছুটা পথ। আমাদের সকলের ই ঘোড়ায় চড়তে অনীহা।অতএব ফিরে এলাম হোটেলে।পশ্চিমে সন্ধ্যে নামের দেরীতে,রাত পৌনে আটটার সময়েও বাইরে আলোর রেশ, চোখের সামনে বরফঢাকা পাহাড় তখনো আলো মেখে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে একরাত দুদিনের প্যাকেজ ছিল। পরদিন আমাদের গন্তব্য শ্রীনগর।

ঝিলম নদী, চিনার গাছ, জাফরান,কাশ্মীরি শাল ছাড়াও কাশ্মীরের আর একটি অবদান #ক্রিকেট ব্যাট। এখানেই আছে সেই #উইলো গাছ যার থেকে তৈরী হয় বিশ্বমানের ক্রিকেট ব্যাট। অনন্তনাগ জেলার ই সঙ্গম বিজবেহরা গ্রামের  প্রায় প্রতি বাড়িতে ব্যাট তৈরীর কারখানা আছে। শ্রীনগর- পহেলগাম রাস্তার ধারেই অনেক দোকান দেখালেন ড্রাইভার ফারুক ভাই।
পহেলগাম থেকে শ্রীনগরের দূরত্ব প্রায় ৯০ কিমি। ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পরলাম । দিনটা ২১/০৫/১৯। আকাশ নীল। প্রকৃতি অনাবিল। যেদিকে তাকাই সেদিকেই যেন ক্যালেন্ডার-চিত্র। আর একটা অনুভূতি হলো --- আর ভয়ানক লাগছে না গাছের নীচে, রাস্তার ধারে সদাসতর্ক সেনা দেখেও।



শ্রীনগর পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। শ্রীনগরের খ্যাতি "city of gardens" এই নামে।ডাল লেকের ধারে বরফঢাকা পাহাড়ের পটভূমিতে মোগল আমলে, বিশেষ করে বাদশাহ জাহাঙ্গীর এর আমলে এই "বাগ"বা বাগান গুলো প্রধানতঃ গড়ে উঠেছিল।যার মধ্যে অন্যতম #চশমে শাহী। এখানকার ঝর্ণা র জল বোতলবন্দী হয়ে দিল্লীতে জহরলাল নেহরুর জন্য পাঠানো হতো। তথ্য টি পেলাম ড্রাইভার ফারুক ভাইয়ের কাছ থেকে।কি আশ্চর্য! কত লোক ৩/৪ বোতল জল ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিন্তু ভাব নিয়ে আমরাও খেলাম। সত্যি অপূর্ব স্বাদ। পাহাড় কে ধাপে ধাপে কেটে,এই উদ্যান তৈরী হয়েছে। সামনে বিস্তীর্ণ ডাল লেক।পড়ন্ত আলোয় দেখলাম #নিশাত- বাগ। বাদশাহ জাহাঙ্গীর এর শ্যালক এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ফুলের বাহার কম এসময়। ফোয়ারা আছে ভেতরে। কিন্তু বিস্ময়ের কথা এটাই সপ্তদশ শতকের এক উদ্যান-প্রেমী এখনও হাজার হাজার মানুষকে টেনে আনে এখানে, এই প্রকৃতির মাঝে।

#শালিমার গার্ডেন ছিল বাদশাহ জাহাঙ্গীর এর গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল। এর ভেতরে দুটি মহল।একটি আম-আদমি দের জন্য অন্যটি বেগম নূরজাহানের জন্য খাস মহল। এখানে পৌঁছতে দেরী হলো কিন্তু আলাপ হলো স্হানীয় এক ব্যক্তির সাথে যিনি জীবনের বাইশ বছর কাটিয়েছেন কলকাতার বুকে কাশ্মিরী শাল বিক্রি করে। অনেক গল্প হলো তাঁর সাথে, ঘুরে দেখালেন খাস-মহল।তার পাথরে পার্শিয়ান ডিজাইনের কাজ মোগল আমলের রুচি সংস্কৃতি ও বৈভবের পরিচয় আজো বহন করে। 
#গুলমার্গ--বরফ,পাইন , দেওদার, স্কিয়িং, রোপ ওয়ে এবং প্রশস্ত তৃণভূমি; প্রথম দর্শনেই এই বর্ণনা মনে আসে। শুটিং স্পট হিসেবে ভীষণ বিখ্যাত।তবে বারামূলা জেলার অন্তর্গত এই বিখ্যাত স্পটটি প্রায়ই রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়। তবু এখানকার প্রকৃতি সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে দর্শনার্থীদের। এবছর কাশ্মীরে ট্যুরিস্ট ভীষণ কম।সেই আক্ষেপ করছিলেন শ্রীনগরের বাসিন্দা এক প্রবীণ ব্যক্তি। 
ইতিমধ্যে আমরা শিকারায় পুরো ডাললেক ভ্রমণ করেছি। পুরো লেক কেন্দ্র করে বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করে। কিন্তু সেই লেকের অনেক অংশই ঘাসে ভরা।অযত্ন ও সংস্কারের অভাবে খুব ই চোখে পড়ে। #শোনমার্গ--শ্রীনগর -লেহ র পথে শোনমার্গ কাশ্মীর ভ্রমণের আর একটি অপূর্ব দর্শনীয় ( ইংরেজি তে যেমন বলে mind-blowing)স্হান। উন্মুক্ত তৃণভূমি,নেমে আসা ঝর্ণা ও বরফের ঢালে অনির্বচনীয় সুন্দরের আবির্ভাব। সাম্প্রতিক কালে সুপার স্টার সলমন খান এর বজরঙ্গী ভাইজান এর শুটিং এখানেই হয়েছিল। ড্রাইভার ভাই খুব উৎসাহ ভরে দেখালেন আমাদের সেই জায়গাটি।                                অনেক হোটেল এখানে কিন্তু আমরা সেখানে থাকার সুযোগ পাইনি।
কারণটা এই যে "ভূস্বর্গ কাশ্মীরে" আমরা কয়েকদিন কাটিয়ে শোনমার্গের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিলাম দ্রাস-কার্গিল-জোজিলা পাস  হয়ে লেহ-লাদাখ এর উদ্দেশ্যে।
সে তো আর এক গল্প,সেও এক অনবদ্য ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা(ভাগ করে নেবো আগামী কোন এক সংখ্যায়)।


ছবি - লেখিকা 







নিবন্ধ





" পুরীর জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রার সারা বছরের নানান বেশ "

 অপরাজিতা দেবনাথ কর্মকার


উড়িষ্যার পুরীতে সারা বছরের বিভিন্ন তিথি,মাস,উৎসবের দিন ও ঋতুতে জগন্নাথ,বলরাম ও সুভদ্রার নানারকমের বেশ হয়।বছরের প্রথমে অর্থাৎ জানুয়ারি মাস থেকে শুরু করা যাক।জানুয়ারি মাসের পূর্ণিমা অর্থাৎ পৌষ পূর্ণিমায় জগন্নাথের রাজবেশ হয়।এই বেশে সোনার অলংকার,মূল্যবান পোশাকে দেবতার রাজকীয় রূপ প্রকাশিত হয়।স্বর্গ,মর্ত্য,পাতাল ত্রিলোকের রাজার রূপ।

ফেব্রুয়ারি মাসে হয় পদ্মবেশ।মাঘ মাসের অমাবস্যা আর শ্রীপঞ্চমী তিথির মধ্যে বুধবার আর শনিবারে এই বেশ হয়।এই সময় ত্রিদেবদেবীকে কালো পোশাক পরানো হয়।আর পদ্ম ফুল দিয়ে সাজানো হয়।মাঘ মাস শীতকাল।এ সময়ে পদ্ম ফুল পাওয়া যায় না।তাই শোলা আর জরি দিয়ে পদ্ম ফুল বানানো হয়।আর দুই ধারে থাকে হাঁস।দেখে মনে হয় জলে হাঁস ভাসছে আর পদ্ম ফুল ফুটেছে।এই দিনে সেখানে পদ্মক্ষীর নামে এক ধরনের পায়েস ভোগ দেওয়া হয়।

মার্চ মাসে দুটি বেশ হয়।ফাল্গুন মাসের দশমী তিথি থেকে চতুর্দশী পর্যন্ত যে বেশটি হয় তার নাম চাচারি বেশ।এই বেশটি ভালোবাসার প্রতীক।আর দোলপূর্ণিমায় হয় রাজবেশ।

এপ্রিলে রামনবমী।ওইদিন রামরাজা বেশ হয়।সাদা,লাল,গোলাপি,পদ্ম ফুলে দেবতাদের সাজানো হয়।বৈশাখী পূর্ণিমায় হয় রঘুনাথ বেশ।এই বেশ বড় সুন্দর।তবে তিথি নক্ষত্র মিলিয়ে এই বেশ প্রায় আশি বছর বাদে বাদে হয়।

মে মাসে,গরমের সময় রত্নবেদির ওপর ত্রিদেবদেবীকে চন্দন কর্পূর মাখানো হয়।সুগন্ধি ফুল দিয়ে সাজানো হয়।'আলাটা' নামে এক বিশেষ ধরনের পাখা দিয়ে বাতাস করা হয়। এই পাখা রুপো আর কাপড় দিয়ে তৈরি হয়।

জুন মাসে অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা স্নানপূর্ণিমা নামে পরিচিত।স্নানযাত্রাও বলা হয় একে।ওইদিন সকালে স্নানবেদিতে ত্রিদেবদেবীকে স্নান করানো হয়।স্নানের পর গজানন বেশ বা হাতি বেশ হয়।তখন জগন্নাথ বলরামকে ফুলমালা,কাপড় দিয়ে এমনভাবে সাজানো হয় যাতে মনে হয় গণেশ মূর্তি অথবা দুটি হাতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।আর মাঝখানে থাকে সুভদ্রা।

জুলাই মাসে রথযাত্রা।সেদিন জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রা পথে বার হন তিনখানি রথে চড়ে তিনজনে গুন্ডিচাবাড়ি অর্থাৎ জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি যান।আট দিন পর উল্টো রথে করে আবার শ্রীমন্দিরে ফিরে আসেন।উল্টো রথের পর একাদশী তিথিতে রথের ওপর দেবতাদের স্বর্ণবেশ হয়।বহুমূল্য সোনার অলংকার মুকুট,হস্ত-চরণ নিয়ে অপরূপ মূর্তি।বহু ভক্ত সমাগম হয় এই বেশ দেখার জন্য।

আগস্ট মাসে ঝুলন যাত্রা।বাংলা বছরের শ্রাবন মাসে হয় ঝুলন যাত্রা।সেদিন এই ত্রিদেবকে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলার নানা চিত্র সেই বেশের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।

সেপ্টেম্বর মাসে বলি-বামন বেশ হয়।ভাদ্র মাসের শুক্লা দ্বাদশীতে এই বেশ হয়।ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বামনাবতারের বামন রূপে জগন্নাথদেবকে সাজানো হয়।এমনভাবে সাজানো হয় জগন্নাথকে তখন বামনই মনে হয়।এক হাতে ছাতা,অন্য হাতে কমণ্ডলু,কপালে থাকে ত্রিপুন্ড্রক।এই বেশে জগন্নাথ বলরামের চরণ দেখা যায়।

অক্টোবর মাসে দুর্গাপুজো।বিজয়া দশমী বা দশেরার দিন দেবতাদের রাজবেশ হয়।জগন্নাথের হাতে তখন তির ধনুক দেওয়া হয় রাবন বধের প্রতীক হিসাবে।
কার্তিক মাসের শেষ পাঁচ দিন পঞ্চকী হয়।অর্থাৎ এক এক দিনে দেবতাদের এক এক রকম বেশ হয়,যেমন লক্ষ্মী-নারায়ণ বেশ,থিয়াকিয়া বেশ,বাঙ্কচুড়ো বেশ,আড়াকিয়া বেশ আর ডালিকিয়া বেশ।

নভেম্বর মাস।শীত আসছে।জগন্নাথেরও শীত লাগে।তাই গোরলাগী বেশ।সুতি,সিল্ক,ভেলভেট-এই সাত রকমের কাপড় দিয়ে পা পর্যন্ত লম্বা জামা, মাথায় লম্বা ঝুলের টুপি দিয়ে দেবতাদের সাজানো হয়।অগ্রহায়ন মাসের ওড়োন ষষ্ঠীতে এই বেশ পরানো হয় এবং তা মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে খোলা হয়।

ডিসেম্বরে প্রভু জগন্নাথ সব বেশ খুলে ফেলে সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট অনুভব করেন।মকর সংক্রান্তির দিন মকর চৌরাশি বেশ হয়।মাথায় মকরমুখী চূড়া, গাদা ফুলের সাজ।এর পর বসন্তের আগমনের সূচনায় পদ্ম বেশ হয়।

এমনভাবে সারা বছর ধরে চলে জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রার বেশ ধারণ,বেশ পরিবর্তন।তবে তাঁদের যে কোনও বেশে সাজানো হোক না কেন,লক্ষ্য-কোটি ভক্তের হৃদয়ে তিনি প্রভু জগন্নাথ।তাঁর অপলক দৃষ্টি নিয়ে তিনি অন্তরে সদাজাগ্রত।





 গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা

    কাকলি ভদ্র


           "রথে চ বামনং দৃষ্ট,
          পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।"
অর্থাৎ, রথের রশি একবার ছুঁতে পারলেই কেল্লা ফতে, পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি।
   কথায় আছে বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ।আর এই তেরো পার্বণের তালিকায়  অন্যতম  উৎসব হল রথযাত্রা। বৃষ্টিভেজা আষাঢ়ের বাতাসে পাঁপড় ভাজার গন্ধ জানিয়ে দেয় আজ রথযাত্রা।প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে হয় রথযাত্রা আর একাদশী তিথিতে হয় উল্টো বা ফিরতি রথ।ওড়িশার পুরীর রথযাত্রা সারা বিশ্বে  সুপরিচিত।তবে পশ্চিমবঙ্গেও রথযাত্রা কম জনপ্রিয় নয়।মাহেশ, মহিষাদল, গুপ্তিপাড়া কিম্বা মায়াপুরের রথের রশির টানে মেতে ওঠেন আট থেকে আশি।ওড়িশার পুরী, শ্রীরামপুরের মাহেশ ও পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের পর  হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা দেশের চতুর্থ প্রাচীন রথযাত্রা।গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।পুরীর রথের সঙ্গে এখানকার রথের পার্থক্য হল, পুরীর রথকে "জগন্নাথ দেবের রথ " বলে। আর গুপ্তিপাড়ার রথকে বলে "বৃন্দাবন জীউর রথ"।অনেকে গুপ্তিপাড়াকে গুপ্তবৃন্দাবন মনে করেন।এখানে রয়েছে শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির। বৃন্দাবন জিউর মন্দিরেই থাকেন জগন্নাথ। শোনা যায়, ১৭৮৪ সালে স্বপ্নাদেশ পেয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বামী মধুসূদনানন্দ। সেই থেকেই এখানে রথযাত্রার প্রচলন।ঐতিহ্যপূর্ণ বৃন্দাবন মন্দিরের পাশে বছরভর সেই রথ পেল্লাই টিনের খাঁচায় ভরা থাকে। প্রায় ২৮০ বছরের পুরনো চার তলা এই রথ। নয়টি চূড়াবিশিষ্ট এই রথে থাকে নানা রঙের আকর্ষণীয় পতাকা। একটি সাদা ও নীল ঘোড়া ছা়ড়াও থাকে সারথি এবং আরও কয়েকটি কাঠের পুতুল।এখনও অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয় এই উপলক্ষ্যে। 
    গুপ্তিপাড়ার রথের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, উল্টো রথের আগের দিন এখানে "ভান্ডারা লুঠ" হয়। কথিত আছে,মা লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ায় প্রভু জগন্নাথ লুকিয়ে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেন। মা লক্ষ্মী ভাবলেন, স্বামী হয়তো পরকিয়ার টানে পালিয়েছেন। শ্রী বৃন্দাবনের কাছে জানতে পারলেন প্রভু জগন্নাথ রয়েছেন মাসির বাড়িতে। স্বামীর মতিগতি স্থির করাতে লক্ষ্মী লুকিয়ে ওই বাড়িতে ‘সর্ষে পোড়া’ ছিটিয়ে আসেন, পরে জানতে পারেন মাসির বাড়ীর সুস্বাদু খাবারের জন্যেই প্রভু জগন্নাথ নাকি আসতে পারছেন না। তখন মা লক্ষ্মীর অনুরোধে শ্রী বৃন্দাবন লোকজন নিয়ে যান মাসির বাড়ি।সেখানে গিয়ে দেখেন তিনটি দরজাই বন্ধ। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে দেখেন সেখানে  সারি সারি মালসা খাবার।সেগুলো তারা লুঠ করে নেন। শেষে প্রভু জগন্নাথ মনের দুঃখে মা লক্ষ্মীর কাছে ফিরে আসেন....
 “লন্ডভন্ড হয়ে যায় ভোগ উপাচার।
 তাতে জগন্নাথে হয় চেতনা সঞ্চার।”ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয় স্বামী স্ত্রীর মধ্যে।এই ঘটনাকে স্মরণ করেই পালন করা হয় "ভাণ্ডারা লুঠ"।
       উল্টোরথের আগের দিন এই কর্ম যজ্ঞের জন্য ১০ জন রাঁধুনি ও ১০ জন হেল্পার সহ মােট ২০ জন রান্নার কাজ করেন। নিয়ম মেনে দুপুর দুটোর আগেই সমস্ত খাবার তৈরি করে মালসায় সাজিয়ে মাসির বাড়িতে রাখা হয়। বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ একসঙ্গে খোলে মাসির বাড়ির তিনটি দরজা।ভিতরে রাখা থাকে উপাদেয়  সাড়ে পাঁচশোরও বেশি মালসা ভোগগুলো। মাটির এক-একটা মালসায় প্রায় পাঁচ থেকে আট কিলো খাবার, থুড়ি, জগন্নাথের প্রসাদ। লুঠ করতে হবে সে সব! প্রাচীন প্রথামতো উল্টোরথের আগের দিন হয় ‘ভাণ্ডারা লুঠ’। ৫২টি লোভনীয় পদে প্রায় ৪০ কুইন্টাল খাবারের ''ভাণ্ডারা লুঠ'' পালন হয়।সেই মালসাগুলোয় থাকে হরেক রকম মুখরোচক খাবার। গোবিন্দভোগ চালের খিচুড়ি, , বেগুন-কুমড়ো ভাজা, পনিরের তরকারি, লাবড়া থেকে পায়েস, মালপোয়া। থাকে নানা রকম ফল, ক্ষীর-ছানা-মিষ্টি। ওই তল্লাটের বেশ কিছু বাড়িতে সে রাতে, এমনকী, পরদিনও রান্নার পাটই থাকে না।খাবার তৈরি, মালসায় ভরা, তদারকি সব মিলিয়ে হুলুস্থুলু ব্যাপার।দুপুর থেকেই  এই মালসা ভোগ দখল করার জন্য দূরদূরান্ত করে কয়েক হাজার মানুষ গুপ্তিপাড়া হাজির হন। সে দিক থেকে এই রথযাত্রায় আকর্ষণের উপাদান কম নয়। ভারতের আর কোথাও রথযাত্রায়  এই "ভান্ডারা লুঠ"  হয়না।এখানেই আর পাঁচটা রথযাত্রা উৎসবের থেকে গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা আলাদা।
     দেবতাকে এমন মানবায়িত স্তরে আর কোথাও দেখা যায় কিনা সন্দেহ। রথযাত্রার উৎসবের সঙ্গে ভক্তি, বাৎসল্য এবং দেবতার মানবায়ণ একত্র হয়ে রয়েছে।বাংলার জলহাওয়ায় সাধারণ মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে আছে জগন্নাথের রথযাত্রা।পুরীর রথযাত্রা ঘিরে প্রচারের আলো যতই উজ্জ্বল হোক না কেন বাংলার এই সকল ঐতিহ্যকেও অস্বীকার করা যাবে না কোনদিন।






বাংলা,বাঙালি বাস্তবতা
                          
   রাণা চ্যাটার্জী


এক চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে চলেছি আমরা। রাস্তাঘাটে কান পেতে শুনলেই বোঝা যাবে এ বাঙালি যুব সমাজ,কাঁধ মাথা ঝাঁকিয়ে যত না স্টাইলে ইংরেজি, হিন্দি বলতে আগ্রহী ,বাংলা বলতে একেবারেই নয়।বাংলা বলতে,লিখতে কোথায় যেন অনীহা,কুন্ঠাবোধ কাজ করে।
তারা  মনের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বসে আছে, "এ বাবা বাংলায় কথা বলছি,দেখে ফেললে কি হবে !আরে বাপরে,বলে কি এরা,বাংলা কি তবে অচ্ছুৎ ভাষা হয়ে গেল নাকি!"

ফেসবুকে তো কেউ কেউ দেখি বাচ্চাকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তির সাথে সাথে এক ঘেরাটোপ জীবনের পর্দা ঝুলিয়ে দেয় যেন! বাংলা বলা সন্তানের আগের সব পুঁচকু বন্ধুগুলো থেকে নিজের সন্তানকে "না মিশতে দেবো না,বাজে কিছু শিখবে"এই ভয় মিশ্রিত ভাবনা আদতে বাজে মানসিকতাকে সমর্থন করে।সিদ্ধান্ত তারা নিয়েই ফেলে যে আর বাংলায় কথা বলা, লেখা পোস্ট করলে বুঝি সম্মান থাকবে না। এইভাবে  এ যেন এক ঘেরাটোপের প্রাচীর,একাকিত্বের মূর্ছনা!

সব ভুলে কেবল নিজের বাচ্চার স্কুলের বন্ধুদের অভিভাবকদের সাথে মেলামেশায় আবদ্ধতার পরিমণ্ডল  তৈরি করে বসবাসে নিজের স্ট্যাটাস জাহির ,।"এ তুমি কেমন তুমি"  বড় অপরিচিত হয়ে চেনা মানুষের অবয়বে অবস্থান করো,"পাছে লোকে কিছু বলে" র ভয়ে শুদ্ধ বাংলা জেনেও ভুলভাল ইংরেজি লিখে ফেসবুকে পোস্ট না করলে কি তবে মান সম্মান থাকে না!কিন্তু এ যে নিজেকে আরো লোক হাসির নানান্তর!

পৃথিবীর বহু দেশে,বহু উচ্চ পদে কত যে বাঙালি যোগ্যতা অর্জনে সেরা হয়ে অবস্থান করছেন তা গুনে শেষ করা যাবে না।সময় সুযোগ পেলেই এনারা, বাংলা ভাষায় পুরানো বন্ধুদের সাথে কথোপকথনে মেতে ওঠেন,বাংলার কৃষ্টি,সংস্কৃতি,সাহিত্যের রস আস্বাদনে মুখর হন।আর সাধারণ আমরা একটুতেই বাংলাকে সরিয়ে দেখনদারির মুখোশে ইংরেজিকে আঁকড়ে ধরে থাকি,"পাছে লোকে কিছু বলে"এই ভাবনায় জারিত  রাখি নিজেদের।

কিন্তু আমরা বাঙালি,বাংলা সাহিত্য,বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের ভাবাবেগ সময় সুযোগে ভীষণ ভাবে কাজ করে।প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটি কে ভাষা শহীদ দিবস হিসাবে যে আলোড়ণের মধ্য দিয়ে পালন করি,কে বলবে আমরা বাংলা সাহিত্য,ভাষা কে  এগিয়ে  নিয়ে চলতে আগ্রহী নই,এ কেবল একদিনের দেখন দারী!বাংলা ভাষা শ্রুতিমধুর,মিষ্টি ভাষা হিসাবে বিশ্বে পরিগণিত ।বলা হয় এই ভাষা বিশ্বের মধুরতম ভাষা,দি সুইটেস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিসাবে কদর পেয়ে আসছে এই ভাষায় যে পরিমান জনসংখ্যার মানুষ কথা বলে সেই দিক থেকে বাংলা তৃতীয় স্থান দখলে।

তবু বাংলা ভাষা কে সংরক্ষণ,ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে রক্ষা করার তাগিদ খুব কম।অভিভাবক চাইছেন,বাংলা নয়,ইংরাজি শিখুক সন্তান নইলে যেন পিছিয়ে পড়বে।দক্ষিণ ভারত যদি পারে,কেন আমরা পারবো না বাংলা কে অফিসিয়াল ভাষায় আনতে এ কোটি টাকার প্রশ্ন।তবু নিজেদের সচেষ্ট হতে হবে বাংলা সাহিত্যের বিপুল গভীরতাকে সন্তান দের পড়তে আগ্রহী করে বাঁচিয়ে রাখতে,
তবেই না ভাষা আন্দোলনে শহীদ দের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। 








কবিতা (প্রথম পর্যায়)






মেঘের কোলে কিছুক্ষণ 

সুব্রত নন্দী 


আষাঢ়ের মেঘে ছিল অফুরন্ত প্লাবনের সংকেত,
জলের তোড়ে ধুয়েমুছে ফেলার সহস্র চেষ্টা,
এখনও ঘনীভূত বাষ্পায়নের অবশিষ্টাংশ  অন্দরমহলে;
শত ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা ক'রে এইটুকুই সম্বল।

পুঞ্জীভূত অনুরাগে মেঘমল্লার রাগের মূর্চ্ছনা,
তাই মেঘপিওনের ডাকবাক্সে কিছুক্ষণ।
নিজের রাগ-অনুরাগকে ফিরে দেখার লিপ্সা,
এখনও জলকণায় লুকিয়ে আছে স্বচ্ছতা।

ফেলে আসা দিনলিপির স্মৃতি রোমন্থন, 
যদি জলের মাঝেই স্নিগ্ধতা ফিরে পাই!
কিছুটা হালকা হওয়ার অবকাশের সুযোগ,
জবাবদিহির বয়স ও ঐশ্বর্য আজ অপ্রাসঙ্গিক!




আষাঢ় যায় আষাঢ় আসে 

          রীনা মজুমদার
 

আষাঢ় আসে, আকাশচুম্বী ইঁটপাথরে 
      ইচ্ছে বৃষ্টির সোহাগ ভরে কাচের ঘরে l
আষাঢ় আসে, মরা নদীর চরে খড়ের বেড়ায় 
      ভেজা উনুন বর্ষারাতে চোখের ধোঁয়ায় l

আষাঢ় আসে, জেলের জালে চাষীর আশায় 
        চাতক ছুঁয়ে সবুজ পাতায়  l

আষাঢ় আসে, কিচিরমিচির চড়ুই জীবন 
          ভাঙছে চর বালির ঘর 
   খড়কুটো , কুটো খড়, যাযাবর l
আষাঢ় আসে, বইশূন্য ইস্কুল বারান্দায় 
    লাইনে ন্যাংটো শিশুর ভাতের থালায় l 

       আষাঢ় আসে আষাঢ় যায় 
       সুখ-দুঃখের আপন ভেলায় l





প্রতিশ্রুতি ছিলো

মিতা বিশ্বাস বসু


বর্ষা সেদিন বলেছিলো
বৃষ্টি হয়ে অঝোর ঝরে ঝরবে বলে।
প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে এনেছিলো 
টলটলে এক পাগল হাওয়া,
মেঘের কাছে বায়না ধরে।

আয় টুপটুপ মাঠ ভিজিয়ে 
বন-বাদাড় আর শহর ঘিরে, প্রবলভাবে
আমার হৃদয় দে ভিজিয়ে, তেমনি করেই।
ঐ যে বারে, মেঘ-রোদেতে ঝগড়া হলো,
ভূমির পরের পুকুর-জলা সোঁ সোঁ করে
রোদের তেজে-মেঘের থলে ভর্তি হলো।

তখন বর্ষারানি, ঝরঝরিয়ে নামলো বেগে
আকাশ-বাতাস উজার করে আমার পরে।

ঠিক সেভাবেই বর্ষা আমায় দে ভিজিয়ে 
আজ চুপ-চুপিয়ে, আপন মনে। 




তুমি না আসলে

কৌশিক চক্রবর্ত্তী

তুমি না আসলে
তপ্ত ফুটপাত উষ্ণতা মাখে পায়ে
তুমি না আসলে
ক্লান্ত কফিশপ লবনাক্ত ভেজা গায়ে

তুমি না আসলে
রাজপথ কাঁপে বাড়তি সেলসিয়াসে
তুমি না আসলে
বিনিদ্র রাত করুণ হাসিতে হাসে


তোমার আশাতে
অহল্যা শুধু পথ চেয়ে থাকে মাঠে
তোমার আশাতে
পেখম সাজিয়ে ময়ূর চাতক সাজে

তোমার ছোঁয়াতে
তপ্ত পাষাণ প্রেমের কবিতা বলে
তোমার ছোঁয়াতে
মোরামের পথে পুটুশের হাসি খেলে।।




সেই মেঘবালিকা 

পারমিতা রাহা হালদার


ক্লান্তির দেশের সন্ধানে তপ্ত শরীর ;
জীবনের রঙ খুঁজে ফেরে মনের বারিধারা, 
মেঘ এসে হাত বাড়ায় বর্ষার পথে।
আষাঢ়ের ঘন সন্ধ্যায় ভালবাসার 
চরম আসকারা পেয়েছিল এক মেয়ে, 
নেচেছিল তার মন ময়ূর!
সারা শরীর আকাশি আর সাদা কাপড়ে লেপ্টানো, 

হ্যাঁ সেই, সেই আমার মেঘবালিকা।

সে যে আসে কখনো গহন ঘন ঘনিয়ে,
আবার মিষ্টি সুরে ভেসে। 
মুঠোয় ধরি চুপিসারে প্রাণের সেই ধারা;
আজ বর্ষা হাতে মেঘ খোঁজে মেঘবালিকা।
প্রিয় মানুষের জন্য পাঠিয়ে দেয় প্রেয়সী নাম দিয়ে। 
সিক্ত হয়ে আবেগে বর্ষার সাথে মাতে কলতানে। 

এই তো সেদিন কোন এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় ;
মেঘের সাথে লুকোচুরির  খেলার মাঝে, 
মেতেছিল সুগভীর হৃদয় অন্তহীন ভালবাসায়!
বর্ষার তালে কামনায় এলিয়ে ছিল শরীর তার বুকে।

আজও পুঞ্জিভূত মেঘবালিকার ভীড়;
আকাশপথে রামধনুর সাতরঙ ,
রোদ, ভিজে যায় বৃষ্টির সাথে মিশে।
বিলিন হয় ক্ষত বিক্ষত ভালবাসার প্রতিটি দাম!
সে আসে আজও বর্ষার রঙ নিয়ে,
কেমন যেন আঁধার নামে মনে, 
প্রেমের জোয়ারে ডুবে আত্মহারা মেঘ, তাই
সাগরের বুকে বানভাসি মেঘবালিকা।
তবুও ভাবনায় মিশে যাওয়া প্রেয়সী রূপে মেঘবালিকা,
মিলনের আবেগ জড়ানো সেই মধুমাস ।




বর্ষা কালের গান 

সত্তাপ্রিয় বর্মন 


এখানে মেঘের মতো, গাভীর মতো, 
ছড়ার মতো বর্ষা কালের বাড়ি
ও মেয়ে, আয় না তাড়াতাড়ি ।

এখানে ইচ্ছে মতো বৃষ্টি ফোটা
আলতো ছোঁয়ায় ভেজায় পাতা
ওমনি আমি স্বাধীন হতে পারি
ও মেয়ে, তোর সাথে আজ আড়ি।

এখানে বৃষ্টি এলে কান্না পেলে
রোজ বিকেলে মন কেমনের বাড়ি
ও মেয়ে, তোর আঙুল ছুঁতে পারি?

এখানে আম পাতাতে জাম পাতাতে
 সব কথাতেই ইতস্তত দাড়ি
ও মেয়ে, করিস না মুখ হাঁড়ি। 

এখানে রাত বিরাতে 
বনলতা আর নীরাতে 
যেখানেই শেষ নিশ্বাস ছাড়ি, 
মেয়ে তুই থাকিস বেঁচে 
একলাই থাকিস বেঁচে 
কবিতা হয়না বারোয়ারি। 

এখানে পিঁপড়ে দলের 
যোগাযোগ বর্ষা জলের 
কবিতা আর অতলের যেমন আড়াআড়ি, 
মেয়ে তুই বান্ধবী হ 
কবিতায় ছন্দ দেব 
হয়ে যা মানস লোকের নারী। 





  'বর্ষার ছোঁয়ায়'

        প্রতিভা পাল সেন 

আষাঢ়ের ঘন বরষায়,
     ভিজে  গিয়েছে ক্লান্ত চরাচর;
স্নাত  প্রকৃতিকে ছুঁয়ে  আছে, 
     মায়াময়  মমতার ছোঁয়া।

আষাঢ়ের সদ্য বরষায়, 
    তরুণী এখন  তরু-লতারা,
আকাশের  নৈঋত কোণে, 
    ছায়া ফেলে  মায়ার ছায়া।

আষাঢ়ে বরষা গভীরে
    প্রকৃতি-মন ব্যাকুল সহসা,
পূর্ণ  হয়েও অপেক্ষারত যেন-
     প্রতীক্ষার  ব্যাকুল সময়ে।

শ্রাবণে  শ্রাবণে, ভাবে মন মনে-
 বৃষ্টি হয়ে ভেজাব আকাশ,
  ঘটবে কিছু নতুন, মুহূর্তের 
প্রতিটি  দিন যাপনে।

আষাঢ়-শ্রাবণে সেজে ওঠে মন,
বর্ষা-রঙে রাঙানো জীবন;
আজ নেমে আসে বরষা,
মনের হারানো কোণে সহসা।।






এমন একটা বৃষ্টি আসুক

সৈকত সেন


এই আষাঢ়ে এমন একটা বৃষ্টি আসুক
ধুয়ে যাক যত রক্ত,আগুন,ধুলো,বালী,
মুছে যাক সব দুঃখ,অসুখ,চোখের কালি 
বৃষ্টি জলে অতীতের সব কষ্ট ভাসুক ।


এই শ্রাবণে এমন একটা ঝড় উঠুক
মুছে যাক যত জীর্ণ,জরা,হিংসা,বিভেদ
উড়ে যাক সব দূষণ,মলিন,ক্লান্তি সমেত 
স্নিগ্ধ ধরায় নতুন উষার আলো ফুটুক।


নতুন কবি এঁকো না আর বিষণ্ণতার কোনো ছবি
তোমার লেখায় উদয় হোক নতুন আশার নতুন রবি।





মৌসুমী

স্বপন চট্টোপাধ্যায়


মৌসুমী তোর ত্রস্ত পদে ভেসে যাওয়া
দূর দেশে ওই অচিন পুরে
যে খানে সেই পাহাড় ঘুমায়
চুপটি করে,
চপল মেয়ের ছল করে চাওয়া
বারেক তাকাস ফিরে।
কুমারী মেয়ে প্রথম হবে ঋতু বতী
প্রথম পরশ পাবে।
ঝরে এসে পড়বে বারি
ধরার শূন্য বুকে,
ফসলের গান হবে শুরু।
মৌসুমী তুই আয়না ফিরে
আষাঢ় দিনের বেলা শেষে
কৃষক ভায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে।




         
ধারাপাত 

 প্রিয়াঙ্কা ভুঁইয়া



টুপটাপ জলছবিদের ভিড় জমে আষাঢ়ের ক্যানভাসে,
মনের ঘরে অবেলার ধারাপাত আস্কারা পায় অনায়াসে;
মৌসুমী আদর মাখছে দেখো এই বৃষ্টিভেজা শহরতলি,
আবেগী বিকেলরা গল্পে সাজায় মন কেমনের অলিগলি।

স্মৃতির কোলাজ জুড়ে ফেলে আসা শৈশবের হাতছানি,
অনাবিল এ আনন্দধারায় ভাসুক কাগজের নৌকোখানি;
মেঘের মলাটের ভাঁজে জমে থাকা অভিমানের পরিমাপ,
অভ্যস্ত একলা দিনের সঙ্গী কেবল ধোঁয়া ওঠা কফিকাপ।

বৃষ্টি বোঝাই খাম হাতে দিনভর মেঘপিওনের আনাগোনা,
উদাসী মেঘমল্লারে বৃষ্টিকণাদের অভিসারের প্রহর বোনা;
ঝাপসা কাঁচে দুই চোখ রেখে আবার অতীতে ফেরা যাক,
কবিতা, তুই সাক্ষী থাকিস, অনুভূতি জুড়ে শব্দেরা নির্বাক।।




বর্ষা মুখর

মৈনাক ঘোষ 



জরাজীর্ণ গ্রীষ্মকালে প্রকৃতি আজ ক্লান্ত,
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য গিয়ে এখন উত্তাপ অতিক্রান্ত।
প্রকৃতিতে বর্ষা এসেছে মুখরিত শ্রাবণে,
আপন প্রেমপেয়ালার পবিত্র অবগাহনে...
বারিধারায় সিক্ত মনে প্রকৃতি হয়েছে প্রাণবন্ত।

মানব জীবনে সৃজিত হয় প্রকৃতির যত আশা,
বর্ষা মঙ্গল উৎসবে করি উজার সব ভালোবাসা।
গোধুলী বেলায় স্নিগ্ধ বাতাস মেঘেরা পুঞ্জীভূত,
বর্ষা দিয়ে যায় প্রাণের অন্তরে জীবনামৃত।






গল্প 


ছাতা
               
 ইন্দ্রাণী সমাদ্দার


বাইরে অঝরে বৃষ্টি পড়ছে। কাল মাঝরাত থেকে টিপ্ টিপ্ করে  বৃষ্টির সুত্রপাত। এই কদিন গরমে মানুষ যেন হাঁসফাঁস করছিল। গরমকালে গরমতো  হবেই কিন্তু এত গরম বহুবছর পর পড়ল। সুমি এমনিতে  বৃষ্টি চায়না। বৃষ্টি হলে তাদের মত মানুষের কষ্টের শেষ নেই। সুমিরা যেখানে  থাকে একটু বৃষ্টি হলেই জল জমে যায়। শুধু জল জমেনা, টালির ছাদ বেয়ে জল পড়ে। বেশি বৃষ্টি হলে এক হাটু জলে থপ্ থপ্ করতে করতে  পাড়ার  টিউবওয়েল থেকে  খাবার জল আনতে হয়। আজ কাজের বাড়ি যেতে দেরী হয়ে যাবে। একটা- দুটোতো নয় সুমি দশটা বাড়িতে কাজ করে। তার মধ্যে তিন বাড়ি রান্নার কাজ।  টাকার লোভে রান্নার কাজ সে নিয়ে  ফেলেছিল ঠিকি কিন্তু এই কাজে বড্ড হ্যাপা। শুধু ঠিকে কাজ থাকলে আজ সে কাজেই যেতোনা। রান্নার কাজ নেবার সময় দাস বৌদি বলেছিল, ‘অন্য রান্নার লোকের থেকে তিন -চারশ টাকা বেশী দেব কিন্তু আগের থেকে না বলে কামাই করা চলবে না আর সময়ে কাজে আসতে হবে। ’ 
মনে মনে বিড়বিড় করে সুমি ঝড় বৃষ্টি কী বলে কয়ে আসে। ছোট মেয়েটা গতকাল খিচুড়ি খেতে চেয়েছিল। আজ বৃষ্টিতে দুই মেয়ে স্কুলে যেতে পারেনি। রান্নাঘরে কৌটো  খুলে তলানিরে পরে থাকা গোবিন্দ ভোগের চাল দেখে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কয়েক মাস আগে বড় মেয়ের জন্মদিনে পায়েস করেছিল। অল্প চাল পরে আছে। সেই চালের সঙ্গে সিদ্ধ চাল মিশিয়ে খিচুড়ি বসায়। রোজ এই সময় কাজে বেড়িয়ে পরে। ভোর বেলায় উঠে রান্না করে। আজ ঝড় বৃষ্টি সব কাজের গণ্ডগোল করে দিয়েছে। একটা আধ শুকনো বেগুন গতকাল এনেছিল , সেটা ভেজে দেবে। আজ ঘরে ডিমও নেই । সুমির বর রিক্সা চালায়। এই ঝড় -বাদলের দিনে রিক্সা নিয়ে বেরোলে দুপয়সা বেশী   রোজগার হবে কিন্তু সে দিকে তাঁর হুঁশ নেই। সে এখনো ঘুমোচ্ছে। সংসার চালানোর দায় যেন সুমির একার। কিছু বললে সুমির বরের এককথা –“মেয়েদের পড়াশুনো ছাড়িয়ে দাও”।   সুমির যত কষ্ট হোক মেয়েদের পড়াশুনো সে বেঁচে থাকতে ছাড়াবে না। খিচুড়ি বসিয়ে আরেক দিকে বেগুন ভাজতে থাকে। এবার তাকে তাড়াতাড়ি কাজে বেরোতে হবে। 
ভাঙ্গা ছাতার ভরসায় সুমি কাজে বেরোয়। খানিকটা যাবার পর  ছাতাটা  উলটে যায়। শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে সে চলে কাজের বাড়ি। প্রথমে কয়েক বাড়ি ঠিকে  কাজ করে তারপর সে যায় একে একে  রান্নার বাড়ি কাজ সারতে। সেনবৌদির বাড়ি প্রথমে যায়।  রান্নাঘরে  ভাতের হাঁড়ি বসাতে  যাবে সেই সময় বৌদি বলে ওঠেন “ আজ ভাত নয় খিচুড়ি হবে সঙ্গে বেগুনি, ডিম ভাজা ও ইলিশমাছ ভাজা, পাঁচ তরকারি ও হবে । সব রান্নার শেষে পাঁপড় ভাজবে। আজ তোমার দাদা অফিসে যায়নি । বাচ্চাও স্কুলে যায়নি। ” আজ জমিয়ে খাবে বলেছে দাদা । বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে গিয়ে মাছ, পাঁপড়, এত সব সব্জি নিয়ে এসেছে।      
একদিকে খিচুড়ি বসিয়ে সব্জি কাটতে কাটতে  সুমি ভাবে শীত থেকে বর্ষা  সব কিছুই বড়লোকদের জন্য। তাদের মত নুন আনতে যাদের শুধু পান্তা ফুরোয় তাদের জীবনে শুধুই দুঃখ। ইচ্ছে থাকলেও আনন্দ তাদের কাছে এসে  ধরা দেয়না। ডিম ভাজার জন্য পেয়াজ কাটতে গিয়ে চোখে জল এসে যায়। বাবুদের বাড়ি ভালো ভালো রান্না করে। এত খেটে  বছরে একদিনো মেয়েদের এত কিছু রান্না করে খাওয়াতে পারেনা। চোখ মুছে ভাবে তবুও কাজের বাড়ির সব বৌদিরাই ভালো।মেয়েদের পড়াশুনোয়,  অসুখবিসুখে কত সাহায্য করে। এরা না থাকলে দুটো মেয়েকে মানুষ করতে  সে পারত না। রান্না শেষ করে যখন  সেন বৌদির বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে তখন বৌদি বলে 'সুমি বাড়ির যাওয়ার আগে একবার এসো। তোমার মেয়েদের জন্য খাবার নিয়ে যেও '।  খুশিতে মাথা নাড়িয়ে  মনে মনে বৌদিকে আশীর্বাদ করতে  করতে বলে 'এই ভাবেই তোমারা আমার ছাতা হয়ে থেকো'।


কথন


শুধু তোমাকে চাই

  যুথিকা সাহা 
             
                 
আজ মেঘ করেছে 
বৃষ্টি বুঝি এলো ওই ,
কিন্ত আসছে না তো !
ওর মনে ও জমেছে অভিমান !
না না বন্ধু এটা তোমার ঠিক নয় ..
মেঘ কে ডেকে বললাম ছাদে উঠে ,ও মেঘ শুনতে পাচ্ছো ,আমি তোমার সই বলছি ....এসোনা গো কাছে ,কথা কও ..অনেকদিন তোমার ছোঁওয়াও পাইনি ..এসো না আমার কাছে ..
মেঘ বললে ,এই তো আমি যাচ্ছি ভেসে ভেসে ..দূরে ওই পাহাড়ের দেশে --
কেন ?তুমি কি আমাকে ভালোবাসোনা !
না বন্ধু তোমার ওখানে যেতে বড় ভয় হয় .....পাহাড় খুব ভালো ওখানে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বো ,পাহাড়ের গা বেয়ে ,আমার সব যন্ত্রনার কান্নাগুলো ওই বোঝে ,তারপর ঝর্ণা হয়ে নদীতে মিশে যাবো ভালোবাসার মোহনায় ..
কত আনন্দ বলো তো !
আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে? তোমার সাথে আমিও যাবো দূর থেকে দূরে ..
এসো আমার কাছে ,শক্ত করে আমার হাতটা ধরো ..কোথায়? তোমার হাতের নাগাল তো পাচ্ছিনা !
বড্ড কষ্ট হচ্ছে আমার ..তুমি যেওনা বন্ধু ..যেওনা ..
এসো না আমার কাছে ,দেখো ছাদে কত গাছ পাখিরাও আছে ..ওরাও তোমাকে দেখবে বলেছে ..
এতো কেন তোমার অভিমান ?
আমার খুব কষ্ট বন্ধু ..আমি যে ওখানেই হয়েছিলাম বলাৎকার ..
এক রাতে বিভীসিকার অন্ধকারে ..
ঈস্ দেখো আমি জানিই না ..তোমার হৃদয়ের কষ্টগুলো শুনে ,আমার কান্নাগুলো গুমরে মরছে গো!
তবুও বলছি আয়না মেঘ আমার কাছে ,তোর যত জমানো অভিমানগুলো ভেঙ্গে, কান্না হয়ে বৃষ্টি হয়েই ঝরে পড়ুক আমার গায়ে ..
গাছেরাও ভিজবে ,ভিজবে প্রকৃতি 
পাখিরা গাইবে গান ,ভ্রমর গুঞ্জন করে ফুলেদের কানে কানে কথা কইবে ..
আজ তাই বৃষ্টি  নামুক ঝমঝমিয়ে 
ভিজবো আমি তোমাকে নিয়ে,আমার চুলের ডগা বেয়ে.. তোমার পরশ নেমে যাবে আমার সারা শরীরে ..মন হবে শান্ত --
তখনি নুপূর পড়ে নাচবো হৃদয় ভরে গান গাইবো শুনবে ..গাইছি তবে শুধু তোমার জন্য..
"আজ মন হলো বড়ই চঞ্চল ,উচ্ছল প্রান ঢেউয়ের মতো হতে চাইছে ,মেঘের অভিমান কান্না হয়ে ঝরে পড়লো ,বৃষ্টি হয়েই . ..এ
বৃষ্টি দিলো মন ভরিয়ে ,বন্দী আমি ছিলাম একলা ঘরে--- ফিরে পেলাম তোমায় আবার নতুন করে ..
তাই দিলাম সবই উজাড় করে 
এমন ভাবে তোমায় কখনো পাইনি 
 নিবিড় করে --জড়িয়ে নিলাম দুজন-দুজনাতে হৃদয়ের মাঝে.."
    থাকিনা আরো কিছুক্ষন দুজনে একসাথে।




ধারাবাহিক উপন্যাস


অপরাজিতা
দেবব্রত সেন

প্রথম পর্ব 


বেলাটা পশ্চিমে পড়ে গেল, সন্ধ্যে হয়েছে। হাসিখুশি মেজাজের সূর্যটা পশ্চিমে ডুবে পড়ল। বোঝাই যাচ্ছে রোজকার মতো সে তার গন্তব্যে। সুতরাং সন্ধ্যে হয়েছে । তুলশী তলায় প্রদীপ জ্বলছে।ঘরে ঘরে মা বোনদের শঙ্খ ধ্বনি, উলুউলু ধ্বনি চলছে, মন্দিরে কাসর ঘন্টার আওয়াজ  এ পাড়া থেকে ওপাড়া ভেসে যাচ্ছে  । ধূপ ধূনার সুগন্ধও কম যায় না ,ছড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপন প্রক্রিয়ায়  সারা বাতাসময় ,ভেসে যাচ্ছে স্রোত । সুগন্ধিতে ভরে যাচ্ছে  সন্ধ্যার পরিবেশ ।
গোরুমোষ ঘরে দিয়ে ,কিছু ছেলে আর মাঝ বয়সি লোক দলবেঁধে কোচা, জাল সঙ্গে টর্চলাইট নিয়ে তামাক হাতের তালুতে মলতে মলতে চলল নদীর দিকে। রাতের আঁধারে  মাছ ধরার জন্য।টর্চলাইটের আলোয় সন্ধ্যার পর মাছ ভালো দেখা যায়, কোচা দিয়ে গাঁথতে সুবিধা হয়। আর সঙ্গে  জাল তো আছেই। তাছাড়া আর কি করবে? হয়তো মাছ ধরাই ওদের পেশা।
পুজার মা! মালতি ,শহরে গিয়েছে ,রোজকার মতো ।  এখনও ফেরেনি বাড়ি,হয়তো আর কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরবে!  বাড়িতে রয়েছে  পূজা আর শিবু। অসহায় পরিবার! শহরে বাবুদের বাড়িতে থালাবাসন মাজা, কাপড় কাচা  ও ভাতা তরকারি রান্না, হয়তো কারও বাড়িতে আবার বাচ্চার দেখাশোনাও করে। এই করে তো সংসারটার হাল ধরে রেখেছে মালতি। শিবুর বাবা মারা যাওয়ার পর তার হাতেই তো সংসারের হাল। বলা যায় মালতীর সংসার সংগ্রাম, সে লড়াই করে চলছে।
পূর্ণিমার জ্যোৎস্না উঠেছে, চাঁদ যেন হাসি হাসি ভাব, তবে গরমটা পিছু ছাড়ছে না।  গরমের তাপদাহতে শিবু বই নিয়ে বসছে বারান্দায়, বইয়ের ফাঁকে সে কি যেন আঁকছে, সে আঁকছে তার  বাবা মা দিদি ও নিজেকে! যেন পরিবারের কেউ বাদ নেই!  তবে সে তার বাবাকে দেখেছে সেই দেড় বছর বয়সে, আর সেই দেড় বছরে যখন বাবাকে দেখে, আজ তার মনে নেই, বাড়িতে ছবিও নেই,থাকলে হয়তো সে চোখ ভরে দেখবে! স্কুলের সহপাঠীরা ওরই বন্ধু বান্ধবীরা শিশু সাথী থেকে হাই স্কুলে তাদের বাবারা যায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে হাতেহাত ধরে, কিংবা স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানেও, আর ওরা বাবা ডাক দেয়, শিবুর ভাগ্যে কখনও এই দিনটা আসেনি।সে ভাবছে ইস যদি আমার বাবা থাকত,  মাকে শহরে বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে যেতে হত না, বাবা সব ম্যানেজ করত। বাবা থাকলে আমি বাবা ডাকটা বলতে পারতাম, হাতে আঙ্গুল ধরে দুপায়ে হেটে হেটে, গল্পে গল্পে স্কুলে যেতাম, আর বৃষ্টির দিনে বাবাকে ছাতাসহ বইয়ের ব্যাগটা দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতাম! বাবা বকুনি দিত দিক না! বেশ মজা হত।
  অন্যদিকে পুজাও তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে রান্না ঘরে যাবে, তাঁর চোখ এড়ানো গেল না,দেখেই ফেলল  শিবুর বই পড়া ছেড়ে  ছবি আঁকায় মগ্নতা! সোজা গিয়ে কান ধরল শিবুর বলল, পড়া ছেড়ে কি আঁকছো কাগজটা দাও দেখি!
----- শিবু বলল ,দিদি কান ছাড় তারপর বলছি, এই বলে ছবির কাগজটা লুকিয়ে রাখল শিবু চোখের নিমেষে।অবশেষে পুজা ছবি দেখে ফেলল!  দুইভাইবোন ছবি টানা টানি করছে। এই পুজা ,এই শিবু ডাকতে ডাকতে  সুলেমান পুজাদের বাড়ির ভেতরে এসে পড়ল। সুলেমান কাকুকে দেখে এখন চুপচাপ পুজা ওশিবু। সুলেমান অবশ্যই তাদের ছবির সব কথা শুনতে পেয়েছে, পুজা একটা চেয়ার টেনে বলল, কাকু বসো!শিবুর হাতে তখন ছবির সেই কাগজটি! শিবু দেখি কাগজটা, আমি কিন্তু সব শুনেছি বাবা। সে ছিল পুজার বাবার ছেলেবেলার বন্ধু। জাতে মুসলিম হলেও সে সব সময় এই পরিবারটাকে সাহায্য করেছে নানা ভাবে। অন্য কেউ হলে হয়তো সুযোগ নিত।  এসে ছবি হাতে নিয়ে বলতে শুরু করল, এক্কেবারে তোর বাপের মতন হাত পাইছে পোলাডা! পুজা ওর কান ছার, আমি দেখছি! ওর বিষয়ে বেশি নাক গলাস না! সবার তো নিজস্বতা আছে, ওর স্বাভাবিক গতিকে বাধা নয় বরং সাহায্য আর উৎসাহ দিয়ে চলতে হবে মা, জানি দারিদ্র্য তা পিছু আছে! তবেও মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হবে।  ও যেহেতু লেখাপড়ায় ততটা ভালো না, আর লেখা পড়া চলছে চলুক, তার সাথে আঁকাটাও করুক, একদিন বড় শিল্পী হতে পারে! ওর সদ্ভাবনা দেখছি সৃজনশীলতার মধ্যে। আর বিশ্ব বিখ্যাত কিছু ব্যাক্তি এই দারিদ্র্যের মধ্যে আজ বড়ো জায়গা করে আছে!

ভালো মনের আর খাঁটি  মানুষ ছিল রে শিবু তোর বাপটা!  এরকম মানুষ এই গেরামে হাতে গোনা কয়ডা পাবি কও নে? মানুৃষটার মইধ্যে জাতপাত বলে কিছু ছিল না। আগে কোনো হিন্দু বাড়িত যদি কেউ মুসলমান বা মেথর আইত বইতে দিত ঠিকই কিন্তু পরে আবার পিড়ি কিংবা চেয়ার গঙ্গা জল তুলশিপাতা আর দুগ্ধ দিয়া ধুইয়া দিত, অশুচি নাকি  শুদ্ধ করত,,, আর তোর বাপটা কিন্তু একেবারে আলাদা মানষি !এই যে কয়েকটা দিন আগে আমাদের ইদ গেল, সে হলে গিয়া সোমাই খায়া আইত, ও বলে মানুষের আবার জাত?? শালার গুষ্ঠির পিন্ডিমারি!!!জীবনটা মরে গেলে সবই পরে রইব।  সে বলত, যার যার ধর্ম সে সে পালন করুক  আর মনে রাখতে হইব, মানুষের  মনুষ্য ধর্ম অর্থাৎ কিনা মানবতার ধর্ম কইরত হইব। আজ মানুষটা নেই,, খুব দুঃখ লাগছে।
গল্পের ফাঁকে পুজা কখন যে চা, ভাত চাপিয়েছে কেউ টু শব্দও পেল না। চা নিয়ে এল পুজা। পুজা বলল,,  থাক কাকু সেসব কথা। এই নাও চা। খেতে খেতে শুনি,  বাবার কথা তোমার মুখে।
পুজা মা তুই আবার কোন সময়, চা করলি টেরিই পেলাম না!
-----ভাতও হয়ে যাচ্ছে কাকু। আজ কিন্তু খেয়ে যেতে হবে! অনেক দিন পর এলে যে, তাই। 
----- কি যে বলিশ বুড়ি মা! সময় হয় না রে বলে চা 'য়ের কাপে চুমুক পড়ল সুলেমানের।  আনন্দের ঢংয়ে বলল, ওমা! কি সুন্দর চা হয়েছে রে!!বাহ দারুণ। এবার এলে এরকমই চা বানাতে আবদার কইরব।

পুজা শিবুকে বলল, এই শিবু তুই চা খাবিরে ভাই? তোকে খেতে হবে না। 
---- শিবু প্রথমে হুম বলল।পরে বলল,  খাবো না।। 
-----আচ্ছা বেশ!   ঠিক আছে। পুজা বলল। 
শিবু এবার নিজের কাজ করতে লাগল! সুলেমান কাকুর গল্প অবশ্য সে শুনছে।

সুলেমান আবার বলা শুরু করল,  তোর বাপ আমাদের বোঝাতে  মানুষ শব্দটা কি? দুটো হাত আর দুটো পা একটা মাথা দুটো কান দুটো চোখ থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না! প্রত্যেকটি জীবের এগুলো থাকে, তবে তারা কি মানুষ?  ! মনুষ্যত্ব না থাকলে মানুষ হওয়া যায়না! তুমি যাই কর মানুষের উপকারে ও মানুষের কাজে না এলে মানুষের কর্মত্ত্ব ফুরিয়ে যায়,  হুম থাকে একটাই নিজে বাঁচা আর কিছু নয়! আর আমরা মানুষ হলাম কই, হে  আল্লাহ! কার কাজে লাগি বল?
সুলেমান অবশ্য পড়াশোনা করছে পুজার বাবার মতই। তখনকার সময় উচ্চমাধ্যমিক পাশ, তাছাড়া স্কুলে দুজনেই ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় হওয়া ছাত্র। চাকরি দুজনেই পেয়েছিল কিন্তু তাদের দুজনেরই বাড়ির আর্থিক অবস্থা স্বচল থাকায় সে সময় দুটি অসহায় পরিবার বাচাতে এবং  পিছিয়ে পড়া দুজন গরীব ছেলের হাত চাকরি ছেড়ে দেয় দুজনেই।

সুলেমান উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুবাদে মাঝে মাঝে এলাকার কিছু সমস্যা তুলে ধরেন সংবাদপত্রে। প্রবন্ধ আকারে। এছাড়াও ভালো ভালো লেখক ও কবির লেখা পড়ে, মতামত দিত। আজকে মনে পড়ছে তার কবি শ্রীজাত  বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই লাইন দুটো ----
            মানুষ হতে মানুষ আসে 
                বিরুদ্ধতার হাতবাড়ায়
             আমিও মানুষ তুমিও মানুষ
                 তফাৎ শুধু  শিরদাড়ায়।।

এটাই ভাবছে সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ।  পরে সুলেমান উঠে দাঁড়াল, দুহাতের আঙ্গুল গুলো সংযোগ করে ঘারটা দুপাশে ঘুরিয়ে ফুটিয়ে নিল, বলল,, আচ্ছা শিবু  পুজা মা উঠিরে আইজ, কাইল দেখা করবাম তর মা 'য়ের লগে! বলতে বলতে উঠোন পেরবে এমন সময় পুজার মা মালতি বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল।আরে সুলেমান যে, কখন এয়েছো? সুলেমান বলল, প্রায় আধ ঘন্টারও বেশি হবে বৌদি।
আর বলিস না সুলেমান , মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যানের ছোটো মেয়েটার জন্মদিন,তাই আর ছাড়ল না, একটু যোগাড়টোগারে সাহায্য করতে হলো।কি করব শহরে বাবু কথা শুনতেই হবে! আর কাজ করেই তো খাই।
বউদি একটা কতাকই? রাগের কিছুই নাই কিন্তু? যেইডা মানবিক হেইডাই কমু! এর বেশি কমু না?
----কি বলবি সুলেমান বলেই ফেল? আমি হাত পা চোখ মুখে জল দিয়ে আসি আগে কেমন!
----- ঠিক আছে বউদি! আহ আগে! তারপর

এই সময় মনে পড়ে গেল, পুজার কলেজে ভর্তির সময় চেয়ারম্যান সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার কথা। সেটাই ভাবতে লাগল সুলেমান। সেইদিন যখন পুজার কলেজে ভর্তির জন্য, কিছু সাহায্য চাইতে গেলাম চেয়ারম্যানের বাড়ি, চেয়ারম্যান সাহেব  যা নয় তাই বলল, আর দেখা করতে বলল,  মিউনিসিপালিটি অফিসে, সেখানও ঠেসা ঠেসি করছে, কখনও এর দিকে,,  কখনও আবার ওর দিকে দেখিয়ে দিয়ে বিষয়টা এরিয়ে যেতে চাইছে! মনে হয় চেনেও নাচেনার ভান ! আরে বাবা দিবি কিনা সেটাতো বল, সেটা বলছে না! না দিলে, না বলে দিলেই হত। আর গরীব অসহায় মানুষগুলানরে ওরকম করাই ওদের স্বভাব ! আসলে গরীব মানুষদের বলার লোক নাই, তাই এরম। শালার বিরোধি নেতারাও তো ওরকমই, তোর হয়ে কতা বলে ঠিকই যখন ভোটে জিতে ক্ষমতার গদিতে বসে, তখন তাড়াও একই পইন্থা করে বসে। মনে হচ্ছিল। একটা নিশ্বাস নিল সুলেমান, মনে মনে বলল, আর কারে ভালো কমু? কারেই বা বিশ্বাস করমু? এই দুনিয়ায় ভাল মাইনষি নাই কেন আছে, তবে হাতে গোনা শত করার অংকের মতন। হাজারে দশটা মিলে।
  সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতই হতে লাগল। ফাঁকা তিস্তা চরে মাঠে কিছু কুকুর শেয়াল তাড়া করছে। ঘেউঘেউ করে পিছু নিল কুকুরের একটি দল। ঘেউঘেউ আওয়াজে তা বোঝা গেল।
হাত-পা চোখেমুখে জলদিল পুজার মা মালতি। মুছতে মুছতে  হাই তুলছে , আহ্বা..... করে উঠল।আর বলছে, কি যেন বলছিলি সুলেমান। এবার বলো। চা, দিয়েছে পুজারা?  এই পুজা কাকুকে চা দিয়েছিস তো, মা?
পুজা রান্না ঘর থেকে বলল, হুম, মা। সে তখন কড়াইএ খুন্তি  নাড়ছে। পটল ভাজা করছে। ডাল একটু আগে হয়েছে! ডাল আর পটল ভাজা ভাত করছে পুজা! পুজার মা পুজাকে বলল, রান্না শেষ হয়েছে তো মা,! তোর কাকুটা আছে একসাথে খাই।
সুলেমান বলল,  না না বৌদি আমি কিন্তু খাব না!  তোমরা খাও। মালতি বলল, খাও কিরে এটা তো তোমার বাড়ি তাই না! বন্ধু থাকলে হয়তো, কত কত আনন্দ করতিস, গল্প করতিস! আর বলতিস বৌদি ভালো করে দুকাপ চা দিয়ে যাও তো! নাহলে কষা কষা খাসির মাংসের কথা! বলতিস আজ কবজি ডুবিয়ে খেয়ে যাব। তোর মনে আছে সুলেমান, একবার বিজয়াদশমীর হালযাত্রায়, তুমি বললে না আজ বৌদি কবজি ডুবিয়ে খেয়েছি, জীবনে স্মরণীয় থাকবে। এমনভাবে বলছে মালতি যেন তাদের পাশে বসেই গল্প শুনছে তার স্বামীও! আসলে কিন্তু তা নয়। এই সময় সুলেমান বলল, বৌদি ওসব থাক। ,। আসল কথায় আসি।কি জন্য ডাকছিলা হেই কথা কও। আসলে সুলেমানের মন এখনও কাঁদে বন্ধুর জন্য।
সুলেমান জাতে মুসলমান ঠিকই,  অন্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল রয়েছে! তার কাছে পুজার বাপের মতো  মনুষ্য ধর্ম ও কর্তব্যবোধ সমান ভাবে মেনে চলে। পুজাদের মতো অসহায় পরিবারটা পাশে সব সময় দাড়িয়েছে, শুধু আপন বন্ধু বলে নয়। শৈশব থেকে তিস্তা পাড়েই পুজার বাপ আর সে খেলা ধূলা, বড় হওয়া স্কুল জীবন কেটেছে!!
অস্বস্তির মধ্যে স্বস্তির বোধ আইতাছে বৌদি, দ্যাওয়াটাত মেঘ ভীড় করতাছে,  ঝর বৃষ্টি নামবে বুঝি , আইজ যাই বৌদি! অন্য একদিন আইমু। এহন তো আর সময় কম, জমিনে জল জমলে,  কাইল থেকে আবার রোয়া রোপন লাগবো, বিচন তুলতে হইব, জমি চাষ দেওনের লাগব। কি করব! সারা বছরের খাওয়া তো জোগাড় করন লাগব এইডাই সময় ! ও কত্তদিন হইল বৃষ্টি নাই!মাটি যারা যারা রোপন করছিল, তাদের জমিন মাটি ফাটা ফাটা হইছে!  আইলে ভালাই হয়।
----হুম! তাই তো রে সুলেমান। জীবনটা একটা চক্রকার, ঠিক যেমন গরমকাল পেরিয়ে বর্ষা, শরৎ যাবে হেমন্ত আসবে! শীত আসবে তারপর আবার বসন্ত, তারপর আবারও গ্রীষ্ম পেরিয়ে বরষা। কখনও জোয়ার, কখনও ভাটার!  জীবন চক্রে সবই থাকে আর যে মানুষ গুলো চলে যায়, সে আর আসে না ফিরে।  শুধু এটুকুই পার্থক্য।
....বৌদি হক কথা কইছ। এইটাই আল্লাহর বিধান।
......আল্লাহ আর ভগবান যাইহোক,  সবাই যেন বিধিবাম। এত দিন থেকে ভেসে সংসারটা আগলাচ্ছি, কই আছে? আহা করে হাই তুলে, চোখে জল পড়া আঁচলে মুছতে মুছতে বলল। বলল, আর ভগবান? আছে ওই বড়লোকের ঘরে!ওর  যা চায় তাই করতে পারে টাকার জোরে। বাদ দেয় সে সব সুলেমান।
আগে পুজা শিবুকে দেখল মালতি ! কারণ তাদের আড়াল করে আলোচনা হবে মনে হয়, শিবু তখন বিছানায় ঘুমিয়েছে,বেচারার খাওয়া হয়নি তখনও! মা আর সুলেমান কাকু গল্প করছে, তাই সে বিছানায় । পুজা কল পারে, হা পা ধুতে গেল। 
মাসদুয়েক আগে একটা ছেলে এসেছিল, ছেলেটা সংবাদ পত্রে কাজ করে! আমার মনে হয় পেরেম টেরেম আছে, তুই একটু খোজ করে দেখিস তো সুলেমান! আমি মেয়ে মানুষ, আমার দ্বারা ওসব হবে নারে।
-----ও! হেই কথা। আমি একদিন শহরে গিয়েছিলাম, কি কাজে ঠিক মনে কইরতে পাচ্ছি  না! তবে, সে দিন ওরা রাজবাড়ী দীঘির পাশে বসে গল্প কইরছে। ভাবলাম থাক! এ বয়সে ছেলে মেয়েরা এরকমই করে। তারপর একদিন  ছেলেটার সঙ্গে দেখা কইরলাম৷ আলোচনা হল, বুজলাম ওরা দুজন দুইজনকে ভালোবাসে। তোমাকে বলাই হয়নি বৌদি। ওর বাড়ি গিয়েছি, বাড়ি শিলিগুড়ি, শিবমন্দিরের ওইদিক।

-----আমার ঠিক এই জায়গাটায় ভয় হচ্ছিল রে সুলেমান।
----ভয়ের কি আছে বৌদি? কওনে! বিয়ের কথাই আলোচনা কইরত  হইব।তোমার কি মত বৌদি?
----- আমি কিছু বুজে উঠতে পারছি নারে সুলেমান। ভাবছিলাম একটা ভালো মাস্টারি চাকরি ছেলে দেখে বিয়ে দেব! কি হল! আর কি ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।
-----আমার মইতে বিয়ে ঠিক কইরা ফালাই ভালো। ভালোবাসা আছে ওদের মইধ্যে! তখন আবার কি না কি হয়!
......ঠিক আছে সুলেমান! তোর হেফাজতে দিলাম মেয়েটাকে। তুই যেটা ভালো বুজিস, সেটাই করিস।
----আমি আর কি বৌদি? সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আইজ উঠি। দ্যেওয়াটাত মেঘ ছড়াইতেছে! যাই! বৃষ্টি আইবো।
বিয়ে তে মত দিল মালতিও। শুধু আলোচনা দুপক্ষের অর্থাৎ দুবাড়ির সময়ের অপেক্ষা। তারপর বিয়ে। চারহাতের ফার্স্ট ব্র্যাকেটক্লোস। পুজা তার বিয়ের ব্যাপারটা কলপাড় থেকে সব শুনল।পুজার মা মালতি পুজাকে ডাকল,  এই পুজা, পুজা তোর ভাইকে ডাক নারে মা। আয় রান্না ঘরে আয় খাওয়া দাওয়া  সেরে নিই।বৃষ্টি আসার আসার উপক্রম হয়েছে, তাড়াতাড়ি আয়। 
শিবু ও পুজা রান্না ঘরে এল, পুজার মা থালা ভরা ভাত সাজিয়েছে তিনটে থালায়। খাওয়া হল সবার।

জোরদার বৃষ্টি শুরু হল, এদিকে আকাশটা ফুটছে চারাং চারাং করে, কোথাও হয়তো উল্কা পিন্ড খোসে পড়ল বুঝি। যে দিকটা পড়ে সেখানে কয়ে বলে যায়, একে বারে পুড়ে ঝলছে যায়! গতবছর এক বিকেলে সুলেমান দের নারকেল গাছটায় পড়েছিল, পোয়াল পুজিটা একবারে ছাই হয়ে গিয়েছিল, গোরু রাখার জায়গাটা ছিন্ন ভিন্ন হয়েছিল! সুলেমানদের কালো গাইটা তো সেই উল্কা পাতের শকে মারা যায়,,ও গাভীটা কি না ভালো ছিল। দিনে লিটার চারেক দুধ দিত! এখন দুধের যা অবস্থা গোয়ালরা অর্ধেক দুধে অর্ধেক জল মেশায়। ও শ্বশুর মশাই থাকতে আমাদের তিনটে বড়ো বড়ো জার্সি গোরু ছিল, সেই ভহাবহ বন্যায় দুটো গোরু কোথায় চলে গেল, ভেসে গিয়ে হয়তো কোথাও আশ্রয় পেয়েছে, কিংবা মারাও যেতে পারে! তবে বাড়ি  যে গাভীটা ছিল, সে অবশ্য ঠিক অবস্থায় ছিল, বেচারাটারও আমাদের সঙ্গে বাধে দিন কেটে ছিল,  না খাওয়া অবস্থায়! আর বাছুরটা জলে ভিজে জ্বরের দাপটে মারা গেল। কি কান্না? ও ।সে ভাবা যায়। ওরাও মায়াবি জীব। পরে কিন্তু বাছুর ছাড়াই দুধ দিত। ওই গোরু গুলো নাকি বাছুর ছাড়াই দুধ দেয়!
পুজার মা রা শুয়ে পড়ল! পুজার মালতি ভাবছে
সেদিনের কথা! পুজার বাবা থাকলে হয়তো বলত পুজার মা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়! কালকে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গতে লাগবে! শশীবাবুদের বাড়ি গিয়ে জমিতে হাল দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে লাগবে! জমিতে ধান বুনতে হবে। এখন আর জমি কই? মানুষটা বেচে থাকলেও খেটে খেতেই হত। যা হয়, জমিদার বাড়ির দূর্দিন। আহ্া........।।

৪// পূজার প্রেমের ইতিবৃত্ত
পূজার প্রথম ও শেষ প্রেম। আর প্রেম বা ভালোবাসা শব্দটা সেখানেই মাননসই " পিরিতি কাঠালের আঠা, লাগলে ছাড়ে না ",। কলেজের আঙিনায় পা রাখতেই শুরু হল প্রেম পর্ব,, এত তাড়াতাড়ি যে মেয়েটা ডাগর চেহারা নেবে ভাবতেই পারল না কেউই। এই তো ক' দিন আগে হেসে খেলে বেড়াত , নাক দিয়ে নোংরা জল পড়ত, আজকে চেহারা অন্যরকম,  যেন গোলাপের চেয়ে কৃষ্ণচূড়ার আকর্ষণ বেশি! যে কেউ দেখলেই প্রেমে না পড়লে থাকতেই পারবে না।  মেয়ে মানুষ কিনা ছেলেদের থেকে তাড়াতাড়ি ডাগর হয়ই। এটা সাচা কথা। এ বিষয়ে হয়তো সকলেই এক মত হবে।
সে বছর কি হয়েছে, দেশের সাধারণ নির্বাচন চলছে, তাই উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট একটু দেরিতে হল। জুনমাসের শেষ সপ্তাহ নাগাদ । কলেজ গুলিতে ছাত্র ছাত্রী ভর্তিকে কেন্দ্র করে ছাত্রগোষ্ঠী গুলির মধ্যে সংঘর্ষ প্রায়ই লেগেই রয়েছে। জলশহরের পিডি ওমেন কলেজ কিন্তু তার ব্যাতিক্রম নয়। হতেই পারে। ছাত্র রাজনীতি তো,  পরবর্তীতে ভালো দেশনেতা গঠনের প্রথম ধাপ । আর রাজনীতি, সে তো নীতি আদর্শ।??? 
সে যাইহোক গত সোমবারের ঘটনাই ধরা যাক, দুটো রাজনৈতিক ছাত্রগোষ্ঠীর কথা কাটাকাটি শেষ পর্যন্ত কলেজে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। শেষে পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশাল পুলিশ বাহিনীর আসে। তবে আজকের দিনে কিছুটা  থমথমে। সবাই আসছে আর যাচ্ছে।  শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজ করছে,   আর কালকের পর আজকে কেমন আছে কলেজের পরিস্থিতি সে সমন্ধে খবর সংগ্রহে এসেছিল দৈনিক  জনজাগরনের সংবাদ কর্মি শচীন । সেদিনই কলেজে ভর্তি নিতে আসা নবাগত পূজাকে দেখেই মনে ধরে ছিল শচীনের। সেদিন অবশ্য সে তাকে কিছু বলেনি।

শ্রাবণ মাস।।  এ তো কবিদের মাস!  শুধু কবি কেন?  যে কোনো মানুষের রোমান্টিকতার মাস। বৃষ্টিভেজা ঘাস গাছপালা। আকাশ মেঘ ভাসা ভাসা আর ঝিরিঝিরি বর্ষন।  মানুষ জীবনে কারও প্রেম আসে না,  সেটা হতেই পারে না । চারদিকে শুধু প্রেম প্রেম গন্ধ, কাদা মাটির গন্ধ, চারদিকে থৈ থৈ জল আর বাতাসের গন্ধ। আকাশে বাতাসে মাটিতে বৃষ্টিতে সর্বত্রই  প্রেমের কাহিনী! প্রেম যেন সীমানাহীন।   আর ফাঁকা জমি গুলিতেও কৃষকের প্রেম, এমাসে কৃষক বন্ধু জমি লাঙল দেয়,রোয়া রোপন করে, পাট কাটে দলবেঁধে,।কাদামাটি বৃষ্টি তবুও হাসিখুশি মুখ তাদের।  সুর তালহীন মন করা  গান, মাটিজমির হৃদয় আত্মা  আঞ্চলিকতার মেল বন্ধন।   গান ধরে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাউল কখন মন শিক্ষা গান। মন শিক্ষা গানটা একবার আালদা কোনকিছুর সাথে মনেকে জোড়ানো।
"একবার উত্তর বাঙ্গালা আসিয়া যাও, আমার জায়গাখান দেখিয়া যাও, ও বৈদেশিয়া বন্ধু রে
মনের কথা কয়া যাও রে ",

কখনও "মইসাল বন্ধু রে",
কখনও। " যদি বন্ধু যাবার চান ",
কখনও! ও জীবন,  জীবন রে
              তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে। আদর করবে কে আমারে রে।

"কখনও।। চাম্পাগে চাম্পা ধরত কনেক ছাওয়াটা"
                   ভন্দা বিলাইটা ঘরত সন্ধ্যাইছে।

কখনও।। বন্ধু পীরিত  কাক কয় 
                    দুইটা মনে এক না ইহলে
                                       পিরিতি না হয়।

আবার কখনও।   ও তিস্তা নদী রে ......
যেন এ মাস কাদাজল মাটি অনুভূতি, দলে দলে কৃষক মহানন্দে গান আবার কখনও,
একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর
       রে মন আমার
কেন বান্ধ দালান ঘর, রে মন আমার।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখিরে,কেমনে আসে যায়....
ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি, বাউলা গান। মাটির টানের গান
কেউ আবার দরবেশি গান,চরচুন্নি, ফকিরি, তিস্তাবুড়ি গান। গান ধরে মহানন্দে মাঠে কাজ করে! রসদ জোগায়, তাতেই খুশি ওরা।

আর প্রেমিক প্রেমিকার স্পর্শ এ মাসেই অন্তরঙ্গতা একদম কাছে পৌছায়। বলাই যায় প্রেমের মাস।
শ্রাবণ মাস,  ইংরেজি জুলাই। সেদিন পুজা সেজে গুজে কলেজে যাচ্ছে,  সেটা হল গিয়ে প্রথম দিন।

ধুর বাবা ডানচোখটা একটু লাফাচ্ছে রে পিংকি সাইকেলটা থামা, চোখে জল দিয়ে নিই! পিঙ্কি সাইকেল থামিয়ে হাঁসা শুরু করল,  হা -হা -হা করে। পরে হাসতে হাসতে বলল, কি চোখ লাফাচ্ছে উম? বুঝেছি!আজ সকালে ঠাম্মার কাছে শুনেছি ডানচোখ লাফানো নাকি শুভ ইঙ্গিত বহন করে ম্যাডাম। কি জানি বাবু কি শুভ ফল আসে।
পূজা মুখটা একটু ভেঙ্গচিয়ে বলল, উম মরন হাসার সময় পায়না। বন্ধ করবি, যত সব ন্যাকামি। আমার এসব একদম ভাল লাগ না, বলতে বলতে চোখে জলের ঝাপটা মেরে রুমাল দিয়ে মুছে নিল পূজা। একটু হয়তো কম পড়ল। পুজা বলল,  এবার চলরে হাঁসুলি বুড়ি। বন্ধু বান্ধবীর মধ্যে যে রকমটা হয় আর কি, পূজা অবশ্য তাই করল।

পিঙ্কি পুজার ক্লোজ ফ্রেন্ড । ছোটোবেলা থেকে একই স্কুলে পড়েছে, এখন কলেজেও তাই। পিঙ্কির একটা দোষ আছে  সে অল্পেতে হেসে ওঠে, এমনকি মাঝে মধ্যে পুজার সাথে যুক্তির খন্ডন করে,  এমন মেয়ে যে যতই বলুক সে কারও কথায় আজ পর্যন্ত রেগেছে বলে পুজা দেখেনি। আসলে পিঙ্কি সদা হাসি খুশি স্বভাব, রাগ টাগ হয়তো ভগবান ওকে দেয়ইনি বোধহয়।
পূজা মনে মনে বলছে, নেহাতই বললাম, কষ্ট পাচ্ছে পিংকি। গল্প করতে করতেই  দুই বান্ধবী সাইকেল চালিয়ে চলছে   কলেজে। পুজা ভাবছে, আজকে কলেজের প্রথম দিনটা কেমন হতে পারে?  সে অবশ্য কলেজ নিয়ে একটু এক্সাইটেড,  নতুন নতুন ওরকম সবাই হয়, পড়ে তখন অন্য রকম লাগে। কে জানে হয়তো এটা তার জীবনে সেরা দিন। ইংরেজিতে একটা কথা আছে   every where the first day and lastday very interesting moment of anybody 's। is a memorable in life .......

কয়েকটা মিনিট সময়ের মধ্যে একটা প্রজাপতি উড়ে এসে বসল পুজার মাথায়,  দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটি প্রজাপতি ক্লীব দিয়ে চুল আটকেছে পুজা। আসলে কিন্তু তা নয়, ভারী খুব সুন্দর লাগছে। এ এক প্রাকৃতিক মহিমা।  সূদৃশ্য।। পুজা অবশ্য দেখেইনি। পিঙ্কির চোখে পড়তে সে বলে উঠল, পূজা তোর মাথায় দেখ কি?
---পুজা বলল,  কি? 
------পিঙ্কি বলল, প্রজাপতি।

পুজা হাত দিয়ে সরিয়ে দিল,  প্রজাপতি আবার এসে বসল,  আবার দিল, ফিরে এসে আরও বসল। আবার সরিয়ে দিল আবার এসে বসল,  এবার আর সরালো না। এটাকে নিয়েও পিঙ্কির যুক্তি খন্ডন শুরু হল। পিংকি বলতে শুরু করল, জানিস তো পুজা তুই আমার কথা মানো আর নাই মানো ঠাকুরদা  বেচেঁছিল তখন, ঠাকুরমার কাছে প্রজাপতি নিয়ে গল্প শুনেছি। প্রজাপতি নাকি সৃ‌ষ্টি কর্তা ব্রম্মার শান্তির প্রতীক ,  শুভ ও ভালোবাসার প্রতিক। শুভপরিনয় মানে দুটো জীবনের মিলন অর্থাৎ কিনা বিয়ে! দেখিস না বিয়ের নেমন্তন্ন  কার্ডগুলিতে লেখা থাকে "ঋষি প্রজাপতির ।   একটু ফাজলামি করে পিঙ্কি বলল,  এবার বুঝি তোর পালা করে রেখেছেন স্বয়ং ভগবান।
এবার পুজা একটু রেগে গেল!  বলল  তুই থামবি, যা নয় তাই নিয়ে বকবক করছিস। সাইকেল থেকে নেমে পুজা সাইকেল হাতে নিয়ে পায়ে হেটে চলা শুরু করল, কলেজ অবশ্য বেশি দুরে নেই, হাটা পথে মিনিট দুয়েক হবে। আর পিঙ্কি সাইকেলই, দুজনে আগপাছ করে যাচ্ছে।  পিঙ্কি একটু আগে কলেজের গেটে পৌছায় আর পুজা পৌছানো মাত্র দুজনই একসাথে হল। কলেজে তার বইপত্র রেখে বাইরে এল, দেখল একটা দৈনিকের সাক্ষাৎকার হচ্ছে, পুজা পিঙ্কিরা এগিয়ে গেল। 
----------- এই সময় সাংবাদিক শচীন বলল,  আচ্ছা আপনারা কি নিউ কমার?
-----------পুজা বলল, হুম।
শচীন একটু হাসল কিন্তু কেউ টেরই পেল না!কথা বলছিল তোতলামো ভঙ্গিতে, মানুষ প্রেমে পড়লে যায় হয়।  শচীনের অবস্থাও একদম। বলল, আমি দৈনিক জনজাগরন সংবাদ থেকে।  তোমাদের কিছু ইন্টারভিউ নিচ্ছি, এগুলো সংবাদে ছাপা হবে। 
এই যে ধরুন ছাত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে!  কলেজের ছাত্রী হিসেবে কেমন লাগছে তোমার ?

-------পুজা।। সব থেকে আগে যেটা বলার দরকার সেটা বলি।
--------শচীন।।  হুম নিশ্চয়ই, বলুন। 
-------পুজা ।।  ছাত্র রাজনীতি, এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ। 
-------শচীন।।       কেন?
--------পুজা।। আমাদের ভারতবর্ষে ছাত্র রাজনীতির গুরুত্ব অপরিসীম।! ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও!
------শচীন।।  আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন! তুমি ছোটো তবুও করছি,, ছাত্ররাজনীতি কি উচিত? 
-------- পুজা!!  অবকোস।। এর সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থ আছে! আমি সংক্ষিপ্ত আকারে বলছি! পোলাইট ভাবে ইয়াং জেনারেশন যেমনটা  ভালো বক্তা চায় , ঠিক যেন কোনো সিনেমার নাইকা,  প্রেসের সামনে পুজা  বলল, রাজনীতি প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার। জন্ম থেকেই শুরু হয় রাজনীতি। সুতরাং যে সমাজে বাস করি সেখানে আমরা কেউ রাজনীতির উর্ধ্বে থাকতেই পারি না। আর রাজনীতি মুক্ত জীবন থাকাও  হয়তো কারও পক্ষে সম্ভব হবে না। তবে একথাও ঠিক "ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব, সমগ্র বিশ্ব তথা ভারতীয় আন্দোলন গুলিতে ছাত্র যুবদের ভূমিকা। সুভাষ চন্দ্র বোস একটি বিশ্বনন্দিত অধ্যায়, যাকে নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। তার মতে অধ্যায়ন হল ছাত্র জীবনে তপস্যা,, তবে সেই তপস্যা যখন দেশ ও জাতির কাজে লাগবে, অর্থাৎ দেশ ও জাতির মানোন্নয়, মুক্তি  ও স্বাধীনতা বিরাজমান করবে তখন তার তপস্যা  সফল। আমরা সুভাষের গুরু চিত্তরঞ্জনের দিকে তাকালে দেখতে পাব, একমাত্র শিক্ষাই পারে স্বরাজ এনে দিতে,। ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম এদের কথা ভুললে চলবে না। চট্টগ্রামের সূর্য সেন!  নিজেই একজন শিক্ষক, তিনি ছাত্রদের রাজনীতিতে এনে ঝাপিয়ে পড়েছেন, দেশমাতৃকা রক্ষায়।।

আমাদের আধুনিক পুরুষ ও নবজাগরণ উৎগিরনের প্রানপুরুষেরা  রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরওজিও যুগবতার মনিষী স্বামী বিবেকানন্দ !জোতিবাফুলে!  চিত্তরঞ্জন সুভাষ, লাল -বাল -পাল এর ভাবাদর্শের ধ্বজার বাহক এই ছাত্র যুবকরাই। সত্য ও অহিংসার পূজারী গান্ধীজির ভাবাদর্শ কথা।  আমরা যদি আরও আগে যাই তবে দেখতে পাব চৈতন্য, বুদ্ধ, যীশু, হজরৎ  এদের ইতিহাস ছোটোবেলা থেকেই। বিশ্বের বড় বড় বিপ্লব যেমন আমেরিকার স্বাধীনতার আন্দোলন, ফরাসি বিপ্লব, সোভিয়েত বিপ্লব, চায়নার বিপ্লব, ভিয়েতনাম, একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তির যুদ্ধের বহমান স্রোতের বাহক এর ছাত্র যুবকরাই। বাংলাদেশ ও আমাদের আসামের শিলচরের  সেই বিশ্বখ্যাত    ভাষা আন্দোলনও সেই ছাত্রযুবারাই অগ্রণী।। আর আমাদের দেশের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন গুলি বয়কট ও স্বদেশী, আইন অমান্য ও ভারতছাড়ো, নৌসেনা বিদ্রোহ ও নেতাজির আজাদ হিন্দ সংগ্রাম, ছাত্র যুবরা অসীমতার পরিচয় দিয়েছেন।
উত্তরবঙ্গের ভারত ছাড় আন্দোলনে আমাদের ছাত্র সমাজ অগ্রণী, যেমন ------ভারতছাড়ো আন্দোলনে শিলিগুড়ি বয়েস, রায়গঞ্জের করোনেশন স্কুলের ছাত্রদের যোগদান যা ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম জায়গা,, এছাড়া ((আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক রনজিৎ গুহের ))
সুভাষের দেশ প্রেমে ও গান্ধীজি দেশ ভক্তি ও অহিংস আন্দোলনে ছাত্রযুবদের আলোড়ন ছিল চোখে পড়ার মতো।

শুধু এখানেই শেষ!  না! বাকি আছে আরও
রবীন্দ্রনাথ - নজরুল - শরৎচন্দ্র - বমঙকিম -সুকান্তের কাব্য সাহিত্য,  গল্প  উপন্যাসও।

.-----------শচীন।।  তুমি তুমি এতো সব গড়গড় করে বলছে! সবই ঠিক আছে তবে, জানলে এবং মনে রাখছো কিভাবে??
------------পুজা।।  হুম, একচুয়ালি আমার ইতিহাস ফেবারিট সাবজেক্ট ছিল, ওই  সিলেবাসেই পড়া , এই আর কি!
------------শচীন।।  তোমার বাবা মারা মনে হয় শিক্ষক শিক্ষিকা?
-------------পুজা।। না , বলেই থেমে যাচ্ছে কথা,  পুজার চোখে জল এল, বাবা নেই!মা আছে সে শহরে বাবুদের বাড়িতে পরিচাইকার কাজ করে এটা ভাবছে পুজা।
-------------শচীন।। -কাঁদছো কেন?

ততক্ষণে, অনেক ছাত্র ছাত্রী জড়ো হল। সকলেই বলছে কি হয়েছে! দুয়েক ছাত্র বলে উঠল, পুজা দৈনিক সংবাদটিতে কমেন্ট দিচ্ছে। কয়েকজন বলল, এক্সেলেন্ট কমেট। বলে যাও। 
-------------পুজা।। রুমালে চোখ মুছে নিল পুজা আর বলল, আমার বাবা নেই! আমার প্রেরণা, বড়ো করে তোলা মায়ের ভুমিকা।। মা " ই আমাদের সংসারের প্রধান ! আর এই সব আউট  নলেজ আমার নেই,

এই সময় চুপচাপ হল পুজা। পুজা  আসলে মনে করছে কোথায় জানি সে পড়েছে। হুম মনে পড়েছে, ওহ  সুলেমানকাকুদের বাড়িতে একদিন যে মায়ের সাথে গেলাম, তখন দেখি কাকুর ঘরের টেবিলে একটা ডায়েরি! আর ডায়েরিতে  প্রবন্ধ আকারে ছিল,ছাত্র রাজনীতি "কথাটা। দেখলাম প্রায় আধ ঘন্টা ধরে তারপর কি লেখা আছে??। এতক্ষন   তার চুপ করা থেকে বেরিয়ে এল সেই ডায়রি রহস্য। আর কিছু বলল না, সে সমন্ধে।
-----------শচীন।। আচ্ছা, এবার এই কলেজ প্রসঙ্গে আসা যাক, তুমি ছাত্র গোষ্ঠীগুলির মধ্যে কি বার্তা দেবে।
---------  পুজা।। বুজলাম না?
--------- শচীন।। কলেজের রাজনীতিতে তুমি কি আসা করবে?
-----------পুজা।। পুজা একটু ভাবল, বলল! উম আমি আশা করছি, যাতে কলেজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে, ছাত্র গোষ্ঠী গুলির  দিদিরা নিজ আদর্শ ও নীতিমালা নিয়ে লড়াই করে সে বাম হোক, ডান হোক কিংবা মধ্যপন্থা যার যেটা ভালো লাগে এবং  ছাত্রীদের সবরকম সাহায্যে এগিয়ে যায়! কলেজের ভোটও সুস্থভাবে হবে এটাই।
-----------শচীন।।  অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমায়, কিছুটা সময় ব্যায় করার জন্য। 
-----------পুজা।। আপনাকে ধন্যবাদ।

পুজাকে তখন খুব সুন্দর লাগছে।  মেঘলা আকাশ। কলেজের ভেতরে সবুজ ঘাসের স্বচ্ছতা চোখে পড়ছে!খোলা গেটদিয়ে মাঠের প্রবেশ করেছে হয়তো!  দুটো সাদা গোরু ঘাস খাচ্ছে। আগের দিন রাত্রে বৃষ্টি হয়েছে। মাঠ ভিজে নেই। তবুও স্যাৎ স্যাৎ করছে। ছাত্রোরা ছুটোছুটি করছে, যে যার রুমে যাচ্ছে। কারও ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষক শিক্ষিকারাও ব্যাস্ত! স্টাফ রুম থেকে ক্লাসে যাচ্ছে!  পুজার ক্লাস ঘরের সামনে আমলকি গাছ, বাতাস এসে বয়ে যাচ্ছে ঠিক ঢেউ খেলানোর মতো। পুজা আর শচীন দাড়িয়ে আছে। দুজনে একজন! কে যেন কার ভালোবাসার হৃৎপিন্ডের ঘন্টা বেজেছে। বোঝা দায়, তবে কার এমনটা হচ্ছে?প্রথম দেখেও ভালোবাসার ঢেউ সাগরে দুলছে? বাতাসে ঝরে পড়ছে আমলকির পাতা গুলো। চোখ জোরানো দৃশ্য চোখে পড়ল। আসলে বিষয় ছিল অন্য,  সাক্ষাৎকার।
ভাব ভাব মন তখন! কে জানে কার? 
শেষটা এমনভাবে হল,তাদের দেখে মনে হল দুজনের ভাববিনিময় চলছে। কোনো এক দুপুরে বৃষ্টি পরছে। একটা মেয়ে ছাতা নিয়ে আসে নি ছেলেটি অপেক্ষা করছে ছাতা নিয়েএ, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েটির দিকে,।। আর মেয়েটার মনে হচ্ছে  সে ছাতা নিয়ে দাড়িয়েছে! বৃষ্টি পড়ছে ঝনঝনিয়ে, ছেলেটি ভিজে ভিজে রাস্তা হাটছে!মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে !! দুজন যুবক - যুবতি।এটা মনে হচ্ছিল।।

সেই দিন ভোরবেলায় শচীন স্বপ্ন দেখেছে। বারবার খালি পুজার কথাই আওড়াচ্ছিল, ঠিক যেমনটা কোন এক রুপসী রাজপুত্তুরের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে,  উকি দেয়, ঠিক সেরকম! হৃদয়ে কড়া নাড়ছে শচীনের।
তার কেন জানি মনে হচ্ছিল একান্ত কোন এক নারী তার জন্য পাঠিয়েছে ভগবান। চোখ বন্ধ কিংবা খোলা, সে দেখতে পাচ্ছে সামনে সেই পুজা দাড়িয়ে আছে রুপালি চাঁদোয়ারের হাস্যরসে ভরপুর মুখখানি নিয়ে।

ঠিক কয়েকটা দিন পর .........
কলেজ টাইম। শচীন আবার সেই পুজাকে এক ঝলক দেখার অপেক্ষায়! দাড়িয়েছে আছে সেই বুড়ো শিরিশ গাছটার নীচে! কলেজ গেটের একটু আগে। তাকে দেখলেই যেন তার মনের অস্থিরতা জুড়িয়ে যায়!কিন্তু কি এমন হল? খাওয়াদাওয়া ছেড়ে, সে নিজেই বুজতে পারছে না!  তার মনও বুজতে চাইছে না । আগের সন্ধ্যায় অবশ্যই খেয়ে! আজ সে এখনও খায়নি!সে প্রতিজ্ঞা করেছে যতক্ষণ না পুজার দেখা পায়, ততক্ষণ সে খাবে না। কি জানে, কতক্ষন থেকে আছে সে। কিন্তু সে দিন পুজা কলেজে এল না,  শচীনের ভেতরে জ্বালা ভেতরেই থেকে গেল! সে চলল বাড়ির দিকে। আসলে প্রেমে পড়লে যা হয়। মন ভরকে গেছে পুজার জন্য।

পরের দিন.....
গতরাতে শচীন সিনেমা দেখেছে, সেই বিখ্যাত সেক্সপিয়ারের "রোমিও জুলিয়েট ", অবলম্বনে তৈরি সিনেমা " রোমিও জুলিয়েট ",রোমান্টিক ভালোবাসা নিয়ে সাজানো,, একদিকে রোমিও ও জুলিয়েটের ভালোবাসা অন্য দিকে রাজপরিবার আর দুটো প্রজাগোষ্ঠীর চিরশত্রুতা।। এখানে রোমিও জুলিয়েটের ভালোবাসাই ভালো লেগেছে শচীনের। ভালোবাসা ছিল জীবনমরন, বলা যায় অমর ভালোবাসা । শচীন বলল,  ভালোবাসা কাকে বলে?? এদের দেখে শেখা উচিত। ও! দারুণ, দারুণ।।

সেদিন ছিল স্বাধীনতা দিবস। ১৫ই আগস্ট।।  স্বাধীনতা দিবস ও নবীন বরন দুটোই একই দিনে,  সে উপলক্ষে ছিল একটি অনুষ্ঠান  । তাতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী, তাই সেদিন খবর তো শিরোনামে দেওয়া লাগবেই!বর্তমানে বিভাগীয় মন্ত্রী জলশহরের একটি কলেজে , বিভিন্ন মিডিয়া চ্যানেলের সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবী থেকে স্বনামধন্য গুনিজন সকলেই উপস্থিত। শচীন ছিল দৈনিক জনজাগরনের প্রতিনিধি। যথা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হল, প্রথমের অতিথি বরন, পুস্পস্তবকে বরন করলেন স্থানীয় বিধায়ক ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রধান। কলেজে ছাত্রীদের নৃত্যে হল দেশমাতৃকার গান বিখ্যাত সংগীত শিল্পী এআর রহমানের গানে। যদিও গান ছিল অডিও। এর পর কলেজের  একজন ছাত্রী শিল্পী রবীন্দ্র সংগীত এবং একজন লোকগীতি গান পরিবেশন করেন। সভাপতির ভাষন দিলে বিধায়ক, পরে কলেজের প্রধান।। পুস্প ও একটি করে কলেজের নামাঙ্কিত ডায়েরি দিয়ে বরন করে নিল কলেজের সিনিয়র দিদিরা। এরপর অতিথি ভাষন দিলেন বিভাগীয়  মন্ত্রী মহদোয়। পরে কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের হাতে তুলে দেওয়া হল অনুষ্ঠান। না জানি, সন্ধ্যা সময় আরও অনেক প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। 
পুজা দাড়িয়ে আছে প্যান্ডেলের শেষের দিকে। অনুষ্ঠান মঞ্চের মুলস্টেজ থেকে সোজা স্পষ্ট লক্ষ্য করল শচীন, মনে মনে বলল, ও! থ্যাঙ্ক  গড। আজ তুমি দেখালে! ওই যে সে, যে আমার মন চুরি করেছে। যার জন্য আমি পাগোল। আজ আমি বলবই। পৃথিবীর কেউ আটকাতে পারবে না আমায়! বলব  যে, আমি তোমায় ভালোবাসি। আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ পুজা! আমি আসছি। ওয়েট এন্ড সী, হোয়াট হ্যাপেন্ড! ও গড। আরেকবার বলল শচীন।

শচীন অবশ্য   অনুষ্ঠান হলেও আসত! আর না হলেও আসত! কারণ হিসেবে ধরলে পুজাকে দেখা,  আর না বলা কথা বলার জন্য। রহস্যটা "প্রেমের ম ন্দিরে মজিসে মন, কি হারি কিবা জন ",। শচীন চলে গেল প্যান্ডেলের  কর্নারে, পুজা যেখানে দাড়িয়ে আছে! সেই সময় মঞ্চে পায়েল (জি.এস)ভাষন দিচ্ছিল,ভেসে যাচ্ছে মাইক্রোফোনে আমরা ছাত্র! সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য খুবই গুরুত্ব পূর্ণ, নবীন বোনেদের উদ্দেশ্য বলছি আমাদের শপথ নিতে হবে,  মন্ত্র হবে" আমরা এই প্রতিষ্ঠানের মান ও  মর্যাদা রক্ষা করিয়া চলিব,কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটানায় জরাবো না! শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে দেশ ও জাতি গঠনে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত করিব ",  । ভেসেই যাচছে মাইকের আওয়াজ।
শচীন পুজার কাছে এল ! পুজা অবশ্য শচীনকে  দেখতে  পায়নি ! পুজা পড়েছে একটা নীল রঙের স্যালোয়ারকমিউস, তাতে অবশ্য দারুণ মানিয়েছে তাকে। খুব সুন্দর লাগছে তাকে। এই পুজা শচীন বলল, ঘুরতে দেখতে পেল, সেইদিনের সাংবাদিক! ও হে বলুন! পুজা বলল। শচীন একটা চিরুনি বের করল পকেট থেকে! মাথা আছড়ে আছড়ে বলছে, পুজা কেমন আছিস?
----- পুজা একটু চিকন গলা স্বর  বলল,ভালো ।আপনি কেমন আছেন?
------ ভালো। শচীন বলল।তোমাকে একটা কথা বলব পুজা?
------- হুম! বলুন,
--------তুমি আমাকে দাদাই বলো! কেমন, আর আমি তুই করে বলছি তোমায়! রাগ করবে না তো?
---------ঠিক আছে! না না, এতে রাগের কি আছে?পুজা বলল,
-------- তোমায় ভারী সুন্দর লাগছে, পুজা! তোমার বোনও নিশ্চয়ই সুন্দর।
---------- কি যে বলো না! ধ্যাৎ আমি আর সুন্দর কই? না গো আমার বোন নেই।
---------- যে এডমিশন নিতে এলে কলেজে, তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছিল। শচীন আসলে, সেদিন থেকেই মনে মনে ভালো বাসা শুরু করে দিয়েছে। ওই যে কি যেন গান করলে দাড়ায় ...........

তোমার নামটি লিখি আমার হৃদয়রেখায়,
মনের মনিকোঠা প্রেমের আঁচল ছোঁয়ায় 
আমি!! ভালোবাসি, ভালোবাসি তারে 
জীবন দিয়ে আখি ভরিয়ে অন্তরে অন্তরে

এটা শচীন ভাবছে!! , বলল, তোমার সাথে একান্ত কথা আছে, এসো রাধাচূড়া গাছটার নিচে। 
দুজনই গিয়ে দাঁড়াল গাছের নীচে। পুজা বলল, কি কথা? শচীন বলব, বলব না, বলব না বলব করে আছে চুপ করে। শেষমেষ একটা গোলাপ বের করে পুজার হাতে গুজাল আর বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি পুজা। পুজা বলল, কি???
শচীন বলল, হুম একদম পুজা আইলাভ ইউ। পুজা অবশ্য ভালোবাসা গ্রহণ করল শচীনের! বলল, ঠিক আছে। তখন গাছের নীচে সবুজ ঘাস যেন তাদের ভালোবাসার দর্শক আর রাধা গাছটার হলুদ হলুদ ফুল ফেলে দিল ওদের মাথার ওপর। গাছটা যেন হাসছে! দুটো শালিক ডালো।  তখন ঠোঁটের  মর্দন করছিল।

শচীনের মুখ দিয়ে ছোট্ট করে গানের সূর বিরবির করছে!
তোমার নামটি লিখি আমি, আমার হৃদয়রেখায়
ভালোবাসি ভালোবাসি শোনো  গো আমায়
ওগো মন হরিনী, ......  ।।



কবিতা (দ্বিতীয় পর্যায়)/ ছড়া

রিমঝিম রিমঝিম 

সুস্মিতা পাল কুন্ডু



আজ সারাদিন
অবিশ্রান্ত
বৃষ্টি মুষলধারে ,
রাত নেমেছে
আগেভাগেই
দিনের আলো মরে ;
এমন দিনে খুঁজছি যাকে
যায় রে তাকে বলা .....
" আজ অকারণ খুশির জোয়ার
উছল বাঁধন হারা --
মন চাইছে মাতাল হতে
সোহাগ মাখা আদর ,
বাদল দিনে জল থৈ থৈ
অকাল ঘুমে শহর ;
বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে
চলো ভেসে যাই ,
ভালোবাসার স্নিগ্ধ ছোঁয়ায়
সুখের দেশে হারাই ..."
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
ভিজছে এই মন
ভালোলাগা ভালোবেসে
জড়িয়ে অনুক্ষণ ...
এমন দিনে হয়না বৃথা 
বৃষ্টি ভেজার গান ,
কিশোরী মেয়ে মনের মাঝে
তোলে কলতান ; 
বয়সটা যায় না বেড়ে 
চাও না তুমি যদি ,
কিশোর মন বুকের মাঝে 
বইয়ে দেয় নদী  ৷৷ 





 
আশা বর্ষা      
মাথুর দাস   


‘বর্ষা  এলে  ফর্সা  হব’,  বললো  চাষীর  বৌ,  
‘প্যাচপ্যাচিয়ে ঘামঝরানো গ্রীষ্মদিনের শেষে
স্নিগ্ধ-শীতল  বৃষ্টি   শরীর  ধুইয়ে দেবে এসে’,
চিকচিকিয়ে দুচোখে তার ঝরলো খুশির মৌ ।  

বললো চাষী, ‘এখন আসি, বীজতলাতে ধান,
শুকনো  মাটি  ফাটাফাটি  হয়েছে  খান খান ;
বৃষ্টি বাদল  মেঘের মাদল  সবই যে  শুনশান,  
বর্ষা আসুক  বর্ষা আসুক  বাঁচুক চাষীর প্রাণ’ ।   
       
পশু  পাখি   গাছপালা  মাঠ  তীব্র   হাহা রব
সবাই  যেন   চাতক  পাখি    উধাও  কলরব,    
বর্ষা আসার আশা জোগায় ভরসা সবার মনে  
জুড়োবে  সব  দহন  জ্বালা  কখন  সঙ্গোপনে !
                   
কিন্তু  যদি  না  আসে  এই  আষাঢ়ে  আসার়,
কি জানি কী  হবে যে তখন  চাষাড়ে আশার !!   



এক জীবন
সঞ্চিতা দাস

গ্রীষ্মে ওরা ভালই ছিল
বর্ষা এলেই দুর্ভোগ,
সংসারটা জল কাদাতে
কষ্টে ছাড়ে সুখভোগ
রাস্তার ধারে বাস যে ওদের
নেইকো কোনো আশ্রয়,
খোলা জায়গায় ঘরবাড়ী সব
আর কিছু নেই সাশ্রয়
বৃষ্টি পড়ে ভেজায় সৃষ্টি
জিনিসপত্র পাঁচিলে-
নিজেরা কোথাও বাঁচিয়ে মাথা
ফেরে বর্ষা শেষ হলে



বৃষ্টি

রীতা মোদক 


মেঘের পাশে মেঘ জমেছে,আকাশ কালো হলো , 
যন্ত্রণার ভার সয় না যে আর--বুঝি বৃষ্টি নেমে এলো।

আমার সকল কষ্ট জ্বালা, বৃষ্টি রূপে গড়াক বুকে
মিঠবে যে হৃদয়ের জ্বালা বাচঁবো মাটির  গন্ধ সুখে। 

মন নদীতে ভেলা ভাসাবো আয় নেমে আয় বৃষ্টি 
আমার ক্লান্ত ধূসর  বুকে হোক সবুজের সৃষ্টি। 

আয়রে বৃষ্টি আয়রে তুই ভোর বাতাসে পশলা হয়ে,
ছাই চাপা আগুনে জল ঢাল,দে না  শুষ্ক হৃদয় ধুয়ে।

আয় রে বৃষ্টি আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পর বাঁধন হারা
দূর করে দে সকল যুদ্ধ, গড়িয়ে পরুক শান্তি ধারা।

বৃষ্টি নামুক গাছের পাতায় বৃষ্টি নামুক আমার গানে
বৃষ্টি  নামুক ক্ষত আঘাতে , বৃষ্টি নামুক আমার প্রাণে।




বাদল দিনে
সঞ্জয় কুমার মল্লিক

ঝিমঝিমিয়ে বৃষ্টি পড়ে
নদীতে আসে বান।
পশু,পাখি,দামাল ছেলে বৃষ্টিতে করে স্নান।।
বাঁশের বনে পাতা নড়ে।
টুপুর-টাপুর ছন্দ নিয়ে পাতা থেকে বৃষ্টি পড়ে।।
দুস্টু খোকা ভিজবে বলে
মায়ের কাছে মার খেয়েছে।
তবু খোকা ভিজবে বলে,এক ছুটে পালিয়ে গেছে।।
কাদা মেখে গান ধরেছে,পাড়ার দুস্টু ছেলের দল,
আয় জল ঝেপে।
ধান দেব মেপে।।
ধানের ভেতর পোকা।
জামাই শালা বোকা।।



বর্ষার আগমন

     মজনু মিয়া


রিমঝিম বর্ষায় বান্দার এক কোণে বসে
চুল এলিয়ে দিয়ে ভাবছি,
তুমি পাশে থাকলে,কদম ফুল দিতে 
বাঁধা চুলের খোঁপায়। 

জালটা হাতে তুলে বলতে নতুন জলে
শাড়ী পরা ছোট ছোট মাছ,
ভিজা শরীরে বাড়ি আসতে কই গো বলে
দেখো মাছের হাঁড়ি।

দাঁড়িয়ে দেখতান স্নান করা কত লমশ দেহ
ছোট মাছের তরকারি ভাত,
নিজের হাতে মুখে তুলে দিতে কত ভালোবাসা 
আজ বর্ষার জল আর চোখের জল এক।





 বর্ষা

লুবনা আখতার বানু

                

বর্ষার আগমনে মনটা ভীষণ    
                   আনন্দিত আজ-
গ্ৰীস্মের প্রখর রোদে তপ্ত 
                         প্রকৃতিটাকে,
বৃষ্টির জলে ভিজতে দেখে
      শান্তি বোধ করছে মনটা।     
প্রকৃতিটাও যেন ভীষণ
                  আনন্দিত আজ!
বর্ষার জন‍্য অপেক্ষারত 
                               প্রকৃতির,
অপেক্ষার অবসান হলো
                                   আজ-
কিন্তু তারপরই হঠাৎ মনটা 
              কেমন করে উঠলো!
মনে হলো এই বর্ষায়,
অনেক কিছুই নেই আজ-
পূর্বের ন‍্যায় বর্ষাকালে ব‍্যাঙের 
                                     ডাক,
কোথায় যেন হারিয়ে গেছে
                                   আজ!
বর্ষাকালে পাতা দ্বারা ছাতা 
                  বানানোর আনন্দ,
আজ বড্ড সেকেলে!
জলে কাগজে তৈরী ছোট
           ছোট নৌকো ভাসানো,
কোথায় যেন হারিয়ে গেছে
                                  আজ!





বিদ্রুপ বর্ষার হাসি
                     
আশীষ দেব শর্মা 


 অঙ্কুরোদ্গম হতে না হতেই কষ্টের পারদ,
   স্মৃতির আকাশ মিলায় কৃষক,এ যেন শরৎ !

মাতৃ দুগ্ধের স্বাদ  মেলেনি আজন্ম,
 বিদ্রুপ বর্ষার হাসি দেখছে নুতন প্রজন্ম ।

বর্ষার কবিতা যেন সাজানো ঢপ,
বিভ্রান্তির ভাবনায়, শিশু উগরে দিচ্ছে কোপ  !

মেঠো গন্ধ আর ব্যাঙের সম্মেলন আজ বিলীন,
জটাধারী রাক্ষুসে মেঘ বর্ষার আকাশে মলিন ।

অসাম্নযস্য  বিরক্তকর যন্ত্রনার নিশ্বাস, 
প্রকৃতির খামখেয়ালীতে ভগ্ন লব্ধ বিশ্বাস ।

কলুষিত ঐ স্মৃতিগোচর প্রাকৃতিক সুখ,
তুচ্ছ প্রকৃতি  চলে এসেছে যান্ত্রিক যুগ।





অন্য বৃষ্টি 
যীশু চক্রবর্তী

বহুদিন ধরে কংক্রিটের দেওয়াল শুকনো,
জানলারা কঠিন অসুখে অভুক্ত 
কবিতার তাপে গোত্তা খাওয়া ঘুড়ি ভস্মীভূত 
সঙ্গ দেয় সবজির রাজনীতি।। 

আর সারি সারি মেঘ নামে শহরের চোখে,
দগদগে ক্ষত শুকোয় 
গায়ে মাখি টুপ-টাপ ঝরে পড়া মুক্তো
কাদা থেকে কবিতা বেড়ে ওঠে।।

কুয়াশার ঘুম ধরে মাঝির গানে 
নিরাবরণ কার্নিশে প্রতিসৃত হীরে, 
কাছে গিয়ে দেখি তার গায়েও দু এক ফোঁটা।।

রথের দড়ি আর জিলিপির প্যাচে জড়িয়ে শীত,
দেখায় জগৎ  অন্য বৃষ্টি।। 



পরশ

সফিকুজ্জামান


এই আষাঢ়ের মাসে আমি
আকাশে আকাশে খুঁজি মেঘদূত
আর শ্বেত বলাকার ডানা।
যদি বয়ে নিয়ে যায় কেউ
বেদনার অশ্রুধারা রাশি
অথবা তার উষ্ণ বাতাস;
প্রিয়ার মাথার পরে নেমে-
ছুঁয়ে দেবে কমল চিবুক
সুনন্দিত হরিণীর দেহ।
শীতল শরীর জুড়ে পাবে-
অলক্ষ্য মিস্টি ঠোঁটের হাসি
আর আমার ব্যর্থ পরশ।



মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা