Sunday, May 1, 2022


 

সম্পাদকের কথা 

নতুন বছর শুরু হল আবার। নতুন বছরে নতুন উদ্দীপনায় শুরু হবে সব প্রত্যাশা এটাই। জীর্ণ পুরোনো যা মুছে যাক সব কামনা সেটাই। বছরের শুরুতে কোচবিহারের মারাত্মক ঝড় এবং রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রবল দাবদাহ দেখে বলতে হচ্ছে এই নতুন আমরা চাই না। প্রকৃতির এই তান্ডব ও অচেনা মেজাজ আমাদের কাছে নতুন হলেও এই নতুনকে বরণ করতে পারছি না। নতুন আসুক ভাবনায়, মননে ও কর্মে। তাহলেই সার্থক হবে নতুন বছর।   


মুজনাই অনলাইন বৈশাখ  সংখ্যা ১৪২৮

বর্ষশেষে 

মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)

প্রচ্ছদ- প্রীতম কর 

প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৮


বৈশাখ ১৪২৯

লেখক ও শিল্পী- 

পার্থ বন্দোপাধ্যায়, দেবদত্তা বিশ্বাস, কাকলি ব্যানার্জী মোদক, 

জয়িতা সরকার, শ্রাবণী সেন, উৎপলেন্দু পাল, মৌমিতা বর্মন, 

বিজয় বর্মন, রীনা মজুমদার, কবিতা বণিক, 

চিত্রা পাল,  বুলবুল দে, বটু কৃষ্ণ হালদার, স্বপন কুমার দত্ত, 

অলকানন্দা দে, সৈকত দাম, বনশ্রী মুখোপাধ্যায়, 

সারণ ভাদুড়ী, মজনু মিয়া, মনিরুজ্জামান প্রমউখ, অদ্রিজা বোস

বৈশাখ ১৪২৯





অন্য বৈশাখ 

অসময়
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

সত্যি সত্যিই আজ বড়ই অসময়।আমাদের আর ভালো লাগছে না।  মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস-এর লজ্জা  ভুলে  গিয়ে  বেশ  ভালোই  কাটছিল দিনগুলো। ভুলে যাওয়া মানুষের স্বভাবগত ধর্ম, বীরভূমের বগটুই-এর  দগদগে ঘা  এখনো  ঠিক মতো না শুকালেও,  সেই নারকীয়  ঘটনা  মানুষ ভূলতে  বসেছে ।মানুষের   মূল্যবোধ তলানিতে এসে  ঠেকেছে।  অবক্ষয়ের ঢল নেমেছে দিকে দিকে।   এরই  মধ্যে আবারও   ধর্ষণ, আত্মহত্যা, খুন,আগুনে  পুড়িয়ে মারার মতো  নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনাগুলো   কোন ভাবেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না।  এসময় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সবকিছুরই অভিমুখ একই দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আমি কিছু বলবার আগেই প্রতিবেশী সুকুমার বাবু বলে উঠলেন, "আর বলবেন না, দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে বসবাস করছি  ময়নাগুড়িতে। বাবা প্রথম উত্তরবঙ্গে বেড়াতে এসে দেবীনগরে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আজও সেই অনুষ্ঠানের কথা প্রসঙ্গক্রমে আমাদের বাড়ির আলোচনায়  উঠে আসে। বাবা বলতেন গোটা উত্তরবঙ্গের শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান জলপাইগুড়ি শহর হলেও, কখনো কখনো মনে হয় ময়নাগুড়ি আয়তনে ছোট হলেও এখানে সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের সংখ্যা বেশি।  সেই বিষয়কেই প্রাধান্য দিয়ে বাবা জমি কিনলেন ময়নাগুড়িতে। এখানে পাড়ায় পাড়ায় খুব  মিলমিশ।  সন্ধ্যার পর যে পাড়াতেই যাই লেখাপড়ার বিষয়টা নজরে আসে।  রাস্তা দিয়ে হেঁটে, বাইকে বা সাইকেল চালিয়ে গেলে হারমনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে শোনা যায়। সেই প্রিয় শহরের পরিচয় দিতে এখন  লজ্জা হয়।  সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া ঘটনায় পরিচিত অপরিচিত  সবাই  আজকাল  ছি ছি করছে।  এসব আর ভালো লাগছে না। কিছু মানুষ তো ধর্মতলা থেকে শুরু করে  কদমতলা অবধি,   এখানে সেখানে মিছিল, মিটিং  প্রতিবাদ সভা করছে।  কি হবে এই প্রতিবাদ আন্দোলনে?  অবিলম্বে যদি এই অন্ধকার দূর না করা যায় তাহলে,  গল্প, কবিতা, নাটক,  প্রবন্ধ লেখাই বলুন আর প্রতিবাদ আন্দোলনই বলুন, সব কিছুই বৃথা।"

একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন,  সুকুমার  বাবু।

অতিমারির আগে অর্থাৎ ঠিক দু'বছর আগে "উত্তরবঙ্গ সংবাদ"- এর শারদ সম্মান অর্পণ কমিটির পক্ষ থেকে দুর্গাপূজার  বিচারক হিসেবে গোটা জেলার দুর্গাপূজা দেখবার সুযোগ হয়েছিল। ময়নাগুড়িতে গোটা দশেক পুজাকমিটির আয়োজন, উপস্থাপন, মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা,প্রতিমা, বিচারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছিল। কেন না গোটা জেলার প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সব পুরস্কার হিসেবে ময়নাগুড়িকেই দিতে হয়। এতটাই সুন্দর এবং মনোরম ছিল সেই সব পরিবেশ।

সুকুমার বাবু, মানে সুকুমার  সাহা, পেশায় ব্যবসায়ী হলেও আদ্যোপান্ত সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ। নিজে বাংলা কবিতার পাঠক।  নিয়মিত দেশ পত্রিকা  পড়েন। মেয়ে সঙ্গিতজ্ঞা ও কবি। এই আক্ষেপ শুধু সুকুমার  সাহার নয়।  ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি,  ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার,  জলপাইগুড়ি  সহ  গোটা  উত্তরবঙ্গের।

ক'দিন  যাবৎ  ময়নাগুড়ি সংবাদের শিরোনামে। আজ এই খবর, তো কাল সেই খবর। মানবিক অধিকার রক্ষা বিষয়ক  একটি  সংগঠনের এক প্রতিনিধিদল  ঘটনাস্থলে যেতে গিয়েও ফিরে আসেন। অপরাধীকে দিয়ে পুলিশ ঘটনার পুনর্নির্মাণ করতে ব্যস্ত। সবার একটাই  প্রশ্ন কি হবে ঘটনার  পুনর্নির্মাণ করে?  পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা সহ দেশের সর্বত্র মেয়েদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। ধর্ষণ, খুন, মলেষ্টেশন, এসিড ছুঁড়ে মারবার  ঘটনা ঘটছে।  একটা ভালো না লাগা বিষয়কে কেন্দ্র করে সকালবেলার সংবাদপত্রের ভাঁজ খোলবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সাধারণ মানুষ।  আজ বড়ই অসময়।

দিবারাত্রি অন্তরের অন্তস্থল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে,  " এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়।"




সত্যি এক আপদ বটে! 
               দেবদত্তা বিশ্বাস

বাড়ির ছোট ছেলেটিকে বিরক্ত হয়ে যেদিন বাবা বললেন "উফ! এক আপদ বটে",সেদিন থেকে ছেলেটির চলতি নাম আপদই হয়ে গেল লোক মুখে।হবে নাই বা কেন? ছেলে জন্মের পরে মা চোখ বুঝল, বাবা নতুন দু চাকার গাড়িতে ছেলেকে নিয়ে চড়ে বসতে সে গাড়ি গিয়ে ধাক্কা খেল বট গাছের গোড়ায়। আর যেদিন ছেলে নিজে চাকরির পরীক্ষায় এম্পানেলড হল পরীক্ষা ব্যবস্থায় নিয়মভঙ্গের অভিযোগে পুরো প্যানেলটাই হল ক্যান্সেল। এ কথা যেন খানিকটা প্রবাদ প্রবচনের মত কুতুবখানা গ্রামে প্রচারিত হলো আপদে বিপদ।
                  হঠাৎই পৃথিবীব্যাপী মহামারীর দাপটে হাজার হাজার প্রাণ যেতে লাগলো মানুষের। রোগটার নাম নাকি করোনা। কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখেনা ,কেউ কারো বাড়ি যায় না। এই রোগে আত্মীয় ও অনাত্মীয় পার্থক্য বোঝা দায়। বুড়ো ভট্টাচার্য দম্পতি সাতদিন শয্যাশায়ী। প্রবল শ্বাসকষ্টে দম যায় যায়। কিন্তু গ্রামের কোন ছেলেপুলে ওদের কাছে ঘেঁষে না। দূর থেকে উঁকি দিয়ে পালায় আবালবৃদ্ধবনিতা। এক ফোঁটা জলের জন্য যখন হাহাকার করে ভট্টাচার্য বুড়ো মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস এঁটে দাঁড়ায় আপদ। সকলকে তাক লাগিয়ে ছুতমার্গের পরোয়া না করে সময় মত হসপিটালে নিয়ে গিয়ে জীবন বাঁচায় ভট্টাচার্য মশায়ের। মাস যেতে না যেতেই গুপ্তদের বাড়ির দুই বাচ্চা অনাথ হয়। করোনায় প্রাণ যায় তাদের বাপ মায়ের। এখানেও বাচ্চাদের মাথার ছাদ হয়ে দাঁড়ায় আপদ। আপদের কথা উঠলেই আজকাল লোকজন একটু মিনমিনে গলায় সমঝে কথা বলে। আপদের বাপ চোখের জল ফেলে দু ফোঁটা। মা মরা ছেলেটার ভেতরের দয়ালু মনটার এতদিন খোঁজ করে উঠতে পারেনি বলে আফসোস করে তার বাপ।
                আপদ আজকাল অনাথ ছেলেমেয়ে গুলোর জন্য তৈরি করেছে রেসকিউ সেন্টার। বাড়ির নাম দিয়েছে ছাদ। যেখানে যখন বাপ মা হারা ছেলেপুলের খবর পায় ছুটে গিয়ে তুলে নিয়ে আসে নিজের কাছে। গ্রামে ইদানিং প্রবাদ প্রবচনটার ও একটু পরিবর্তন হয়েছে। ইদানিং লোকমুখে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কথাটা। আপদে বিপদ নয় বরং বিপদেই আপদ।



নীরব ভালোবাসা
কাকলি ব্যানার্জী মোদক

হ্যালো ম্যাডাম --অ্যাটেনডেন্স এর সইটা , শ্রীলেখার হাতের কলমে  তখন কম্পনের ছোঁয়া, পরক্ষণে বয় এসে জমা দিল দুটো ফাইল শরীর ও মন জুড়ে শ্রীলেখার হৃদ - কম্পন। স্বামীর মৃত্যুর পর ,এখনো দুটো মাস অতিক্রম হয়নি তার উপরে গৃহবধূ বাইরের জগৎ সেভাবে জেনে উঠতে পারিনি শ্রীলেখা, দু বছরে সন্তান কে পালন করতে করতে সময় অনেকটা কেটে গেছে। বেনারসি শাড়ি টা এখনো বোধহয় রজনীগন্ধার সুবাস পাওয়া যায়।

অনেক কিছু এলোমেলো ভাবতে থাকি অফিসের চেয়ারে বসে  শ্রীলেখা, হঠাৎ করে নিঃশ্বাস এসেই ঘাড়ে পড়ল, কি খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে? শ্রীলেখা হালকা করে হেসে বলল না তো,পলাশ ততক্ষনে বুঝে ফেলেছে  আগত মহিলারা শ্রীলেখার আচরন, শ্রীলেখা ঘামর্ত স্বরে বলল আসলে ঘরোয়া তো তাই বুঝে উঠতে পারছি না, পলাশ এসে বলল ভয় নেই ম্যাডাম আমরা তো আছি সব সময় সাহায্যের হাত এগিয়ে দেবো। সত্যি ধীরে ধীরে শ্রীলেখার মনের মানুষ হয়ে উঠলো পলাশ,অফিসের  যাবতীয় সুবিধা অসুবিধা পলাশ তাকে শিখিয়ে দিয়েছে নিজের হাতে। অফিসের ব্যস্ততার মধ্যেই মাঝে মাঝে কফি শপে কিংবা দুপুরের লাঞ্চে একসঙ্গে সময় কাটিয়েছে। সাহায্যের হাত তো দূরের কথা এক সময় শ্রী অনুভব করল পলাশের উপরে সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে ।

         আজও মনে পড়ে সেই দিনটার কথা ফাগুন মাস পলাশ এক গোছা গোলাপ এনে জানালো আমি যদি তোমাকে জীবন সঙ্গিনী করতে চাই তুমি কি রাজি আছো শ্রী? নীরবে ভালোবাসার আবেগ টুকু ছড়িয়ে দিলো শ্রী পলাশের ঠোঁটে ভালোবাসার স্পর্শ অবগাহন করল পলাশ শরীর ও মন জুড়ে শ্রী চায় তার একজন জীবনসঙ্গী অনেকটা পথ চলা তো বাকি আছে একা কি করে অতিক্রম করবে, তাছাড়া তার সন্তানের পাবে পিতৃপরিচয় সেই ইচ্ছাটা দমন করতে পারিনি  শ্রীলেখা,মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল।

বাধ সাধলো বংশ রক্ষার্থে তার সন্তানকে তার শাশুড়ি কিছুতেই ছাড়তে রাজি নয় মেনে নেবে না তার ইচ্ছাকে, মানসিক দ্বন্দে  এখানেই ইতি টানতে হলো শ্রীলেখা কে, পলাশ ট্রান্সফার নিয়ে চলে গেল অন্য জায়গায় ।
   ফাগুনের শেষ বেলা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো শ্রীলেখা বসন্তের মৃদু বাতাসে আজ উৎসবের ছোঁয়া , বৃদ্ধাশ্রমের  বেতের চেয়ারে বসে অশ্রুসজল  চোখে গুনগুন করে গেয়ে উঠলো "তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম" রক্তিম আলো বেলা শেষে শুধুই  হাতের লাঠিটাই আজ শেষ সম্বল।।





বৈশাখের উত্তর ভ্রমণ 

উত্তরের এক অনামি জঙ্গলে 
জয়িতা সরকার 

ছক ভাঙ্গা জীবনের প্রতি আমার একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। যেমন ধরুণ সবাই যখন লক্ষ্মীমন্ত হয়ে পড়াশুনো করছিল আমি তখন সাইকেল চালিয়ে এপাড়া-ওপাড়া টইটই করছি। বাউন্ডুলে বিশেষণটা আমার যদিও খুব বেশি খারাপ লাগত না। বরং আমার ওই উড়ে বেড়ানোর জন্য  বিশেষণটি বেশ অনুঘটকের কাজ করেছিল। এই স্বীকারোক্তির থেকে ভেবে নেবেন না, আমি লেখাপড়াতে গোল্লা, ওটা আমার হিসেবে ঠিকঠাকই করেছিলাম। মা-এর হিসেবে নয়। যাক এসব গৌরচন্দ্রিকা, আসল কথায় ফিরি তবে- সেই টইটই -এর অভ্যেস গিন্নি হয়েও যায়নি। স্কুলজীবনে সাইকেল, আর সংসার জীবনে পদোন্নতি হয়ে গাড়ি। তবে স্বভাব আর সঙ্গী দু'টোই এক আছে। 

সংসারী হয়ে ছোটবেলার সফরসঙ্গীর সঙ্গে দূরুত্ব বেড়েছে অনেকটা, তবে মনের নয়। তাই তো দেখা-অদেখার মাঝে প্রথম কথা হল 'কোথায় যাওয়া যায় বলতো' যেই বলা সেই কাজ। আমার সেই ডাকাবুকো সঙ্গীটি এখন আবার পাকা ড্রাইভার। তাই আর দেরি কেন? গাড়ি ড্রাইভার সব তৈরি, জুটে গেল আরেক বাউন্ডুলে আর দুই ছানা। গাড়ি ছুটছে একটু অনামি জায়গার দিকে। 





উত্তরটা আমাদের বড্ড কাছের, বড্ড প্রাণের। নদী, পাহাড়, গাছ, পাখি সব যেন আপন এখানে। জন্মস্থান বলে নয়, একটা বিশেষ আকর্ষণের ক্ষমতা আছে উত্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাতাসে মিশে আছে ভালবাসার অনুভূতি। একটা আদুরে ডাক রয়েছে জঙ্গল চিঁড়ে চলে যাওয়া সেই পিচ রাস্তাটায়। এমন ডাক-কে উপেক্ষা করে কার সাধ্যি। লাগামহীন তিন গিন্নির বেড়িয়ে পড়া এমনই এক জঙ্গল পথে। গন্তব্য চতুর্থ গিন্নির বন বাংলো। 

স্কুলজীবন-কে ছুটি দিয়েছি সেই কত বছর আগে। তবুও বন্ধুত্বগুলো আজও সবুজ, ওই উত্তরের গাছেদের মত। আমরা চলছি ডুয়ার্সের দক্ষিণ পথ ধরে। ময়নাগুড়ি-ধূপগুড়ি ছাড়িয়ে একের পর এক চা বাগান পেড়িয়ে পৌঁছলাম গয়েরকাটা। সেখান থেকে নাথুয়া রোড ধরে গাড়ি এগোচ্ছে আমাদের। আমরা চলছি খুঁটিমারি জঙ্গলের পথে। উত্তরের পর্যটন মানচিত্রে তেমন করে নিজের জায়গা করে নিতে পারেনি এই জঙ্গল। তবে সম্পদে কিন্তু খুব একটা পিছিয়ে নেই। 

আমরা যখন জঙ্গল পথে ঢুকি, তখন সন্ধ্যে নেমেছে, আলো আঁধারি ঘেরা এক মায়াবি সবুজ। বেশ কয়েকটা ছোট ছোট নদী বয়ে চলেছে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে। আমরা একটু ফাঁকা জায়গা দেখে গাড়ি থেকে নামতেই, আমাদের সব থেকে ছোট সদস্যটি বলে উঠল ' মা ওই দেখ হাতি' আমরাও অত্যুৎসাহী হয়ে একটু এগিয়ে যেতেই দেখি হাতিটি বেশ হেলতে দুলতে বনবস্তির দিকে চলে গেল। জঙ্গল জুড়ে ময়ূরের ডাক, কিন্তু দেখা মিলল না। গাড়ি ঘুরিয়ে এবার আমরা যার জন্য এই জঙ্গলে রাত্রিনিবাসের বন্দোবস্ত তার আস্তানার দিকে রওনা হলাম। ফিরতি পথে নোনাই নদীর ব্রিজে দাঁড়িয়ে চলল ফটোসেশন। ছোট্ট নদী, সবুজের মাঝে বেশ তিরতির করে বয়ে চলেছে। 





উত্তরের এই খুঁটিমারি জঙ্গলটি নামডাকের দিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। তেমন ভাবে কোন সাফারি নেই এখানে, তাই হয়ত প্রকৃতির একটা আদিম আবছায়া রয়েছে জঙ্গল জুড়ে। আর সেই আদিমতাকে আরও উপলদ্ধির ব্যবস্থা করল আমাদের সেই বন্ধুটি, যে বেশ কিছু বছর ধরে এই জঙ্গলে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ত্ব পালন করছে। ওর দৌলতে আমাদের নাইট সাফারি পাকা। আগে থেকেই ছাড়পত্র নিয়ে রেখেছিল ও। আমাদের গিন্নি ড্রাইভার গাড়ি ছোটাল জঙ্গল পথে। খুঁটিমারি জঙ্গল থেকে ডানদিকে গাড়ি ঘুরল তোতাপাড়ার দিকে। জল-কাদায় ভরা রাস্তা, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আমাদের চোখগুলো শুধু এদিক ওদিক খুঁজছে অন্ধকারে দুটো জ্বলজ্বলে চোখের যদি দেখা মেলে। না, খুব হতাশা নিয়েই ফিরছি আমরা, কিছুই মিলল না। তবে এমন গভীর জঙ্গলে এতো রাতে যাওয়ার বিষয়টিই ছিল আমাদের সেরা পাওনা। সেই কারণে যদিও বন্ধুকে একবারও ধন্যবাদ বলিনি, বন্ধুত্বে আবার এসব কেন? 

 মনটা একটু খচখচ করছিল, এতদূর এলাম, এমন নাইট সাফারির সুযোগ পেলাম, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। ' আরে সামনে কী? এতো হাতির পাল, গাড়ি দাঁড় করিয়ে দে, অভিজ্ঞ বনকর্মী আমাদের সেই বন্ধুটির নির্দেশে গাড়ি দাঁড়াল প্রায় দু'শ মিটার আগে। মা-সন্তান সহযোগে এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছে তারা। মন কিছুটা শান্ত হল, এমন রাতে জঙ্গল পথে মহাকাল দর্শন। এমন প্রাপ্তি ক'জনের হয়। 

এতো বছর পর চার বন্ধু একসঙ্গে, রাতভর গল্প হবে না, তা কেমন করে হয়? চিকেন যোগে ডিনার সেরে স্কুল জীবন থেকে সংসার জীবন কিছুই বাকি রইল না সে রাতে। একটু ঘুমোতেই হবে, না হলে ভোরের সাফারিতে যেতে পারব না। অগত্যা ওই একটু গা এলিয়ে দেওয়া। ভোর হতেই আবার সেই পথ ধরে। এমন এক সকাল ছিল, যা জীবনের ভ্রমণপুঁথিতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মাটির পথ ধরে গাড়ি এগোচ্ছে খুব ধীরে, আর আমাদের স্বাগতম জানাতে পেখম মেলে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ময়ূর। যতদূর চোখ যায়, ততদূর ওদের বিস্তার। এতো ময়ূর একসঙ্গে পেখম মেলেছে এমন দৃশ্য আগে কোনদিন দেখিনি। এবার সত্যি ধন্যবাদ দিতে হবে বন্ধুটিকে। যার জন্য এমন এক সকালের সাক্ষী হলাম আমরা। 

জঙ্গল হিসেবে খ্যাতি না পেলেও আমাদের মন ভরেছে কানায় কানায়। মরঘাট রেঞ্জের এই খুঁটিমারি জঙ্গলে বাইসন, হাতি, ময়ূর, হরিণের দেখা মিলবে। শীতকালে বেশ কিছু পরিযায়ী পাখি আর ধনেশ-এর দেখা পাবেন পর্যটকরা। কাছেই রয়েছে গোসাইপুর ইকোপার্ক। ইচ্ছে করলে একদিনের সফরে দেখে যেতেই পারেন এই সবুজকে। এবার আমাদের ফেরার পালা। বাউন্ডুলে গিন্নিরা এবার চতুর্থ জনকে রেখে বাড়ির পথে।


বৈশাখের কবিতা 
 
বৈশাখ হে
শ্রাবণী সেন

কোথায় বুঝি মেঘ করেছে 
কোন পাড়াতে জল
কোন সে পাড়ায় কাঠফাটা রোদ
শুকোয় ফুল আর ফল।

কখন বুঝি মেঘ ঘনাবে
তারই আশাতেই শুধু 
আকাশ পানে তাকিয়ে থাকা
নীলাকাশ তো ধূ ধূ...

বৃষ্টি এসো বৃষ্টি এসো
শুকনো মাটি ডাকে
বৃষ্টি কণায় সৃষ্টি জাগে
মাটি ধারণ করে তাকে।


দহনকাল 
উৎপলেন্দু পাল 

আগুন জ্বলছে 
আমার ঘরের চাল ছুঁয়ে 
আকাশ রাঙিয়ে দিচ্ছে লেলিহান শিখা 

পুড়ে যাচ্ছে 
আমার আত্মা আত্মজেরা 
সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে শুধু অবিশ্বাসের ছাই 

গলে পড়ছে 
বিশ্বাসের সুদৃঢ় লাক্ষাগৃহ 
চেটে নিচ্ছে সুবিধাবাদের লকলকে জিভ 

জ্বলন্ত অঙ্গারে 
মিশে গেছে ঈশ্বরের অস্থি 
সাদা ছাই শুঁকছে অস্তিত্বলোভী শয়তান।


 আঘাত
 মৌমিতা  বর্মন
    
ভেবেছিলাম  অক্ষরে অক্ষরে রেখাপাত  করে  যাবো l
কী আছে  আমার?
যার জন্য  মূল্যায়ন হবে!

বুকের খাঁচায়  স্বপ্ন পাখি  পুষে রাখি
ঘর, বাড়ি, টাকা, পয়সা কিছুই  তো নেই -
হাজার অভাবেও স্বপ্ন বিক্রি করি  না।
কী দিয়ে হবে  আমার মূল্যায়ন?

শূন্যতা, হাতাশা, একাকীত্ব এসব  আজ ক্লীশে
মৃত্যুর গভীর  তল  ছুঁয়ে দেখি
কোথাও  কেউ নেই -
সব অচেনা  এক এক টা কালো অক্ষর l

শুধু  দিয়ে যেতে হবে নিজেকে নিঃস্ব করে
চিতায়  জ্বলবে ভালোবাসার  চরম  আঘাত l

 
... এবং সময়

বিজয় বর্মন 

নগর উত্তুরে হাওয়ার দক্ষিণে, যেতে মানা,
পথের ধারে বুনোফুল, ভ্রমর রাতকানা,
শরীর জুড়ে যত শিহরণ, বিজলীর চমকে,
উড়ে যায় ঘুরে আসে ছন্দ, জীবন খমোকে।

এ নদী দিক মানে না উত্তর কিংবা দক্ষিণ,
জল ভরে ভরে নিজেতে, হারায় প্রদক্ষিণ,
ধুলো মাখা পথ, অবরুদ্ধ হতে চায় না,
যতদূর দেখা যায়, ততদূর যাবার বায়না।

কবে কার হিমের পরশ লেগে আছে বুকে,
কলস হারিয়ে অলস নদী, আছে কত সুখে,
পাথর ঠোকাঠুকি আহা, আগুন হাসিলো,
অন্ধকার ঠেলে যেন, কাকে ভালোবাসিলো।

জীবন নদী চায়না এমন, অশুভ প্রণয় ,
সময়ের তাল একই ছন্দে,একই পরিচয়।


মাতৃরূপা মা

রীনা মজুমদার


 এক গোধূলিতে, শেষ নীরবতায়
 নীরবে শত চুম্বন এঁকে দিলাম!
 থাকতে কি কখনও দিয়েছিলাম? 

 কালবৈশাখী এসে ধুয়ে দিয়ে যায়
 তোমার সাজানো তুলসী বেদী 
 বৃষ্টি ভেজা টগর নিবিড় পরশ চায়  
 তোমার আদর্শের বাণী বেজে ওঠে
 দিবানিশি বন্ধ দুয়ারে আজও

সে কথা চিরসত্য জেনেও, 

খুঁজে ফিরি রাতের আকাশেতে
   নিভে গেছে সব তারাদল
   শুধু একটিই তারা উজ্জ্বল, 
খোলা জানালায় ভোর হতে
শরীরের প্রতিটি শেকড়ে নোনাস্বাদ
মনে হয় এ জীবন তুচ্ছ, সব শেষ! 
   তবুও ফিরে ফিরে,

  প্রাপ্তির খাতায় ভরে রাখি
হৃদয়ের আঙিনায় অন্তরের উর্বরতায় 
       মা'র স্নেহ ও শাসন
         বড় আপন...


ভ্রমণের বৈশাখ  

নাসিক ভ্রমণ
কবিতা বণিক

সকাল তখন সাতটা বাজে।  মুম্বাই  গামী ট্রেন থেকে একরকম জোর করেই আমাদের নামিয়ে নিল নাসিকে আমাদের অতিপ্রিয় ভাবিজি শ্রীমতি ভারতী  পন্ডিত ও তার স্বামী গিরিশ পন্ডিত। দুজনের আন্তরিকতা মুগ্ধ করে আমাদের। তারা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন স্টেশনে।  ঈশ্বরের কৃপা বোধহয় এমনি করেই হয়।  এখানে না নামলে নাসিকের মাহাত্ম্য ও সৌন্দর্য অদেখা  রয়ে যেত। 

   নাসিকের গোদাবরী বোধহয় বরাবরই ক্ষীণতোয়া।  রামায়ণে রামের চৌদ্দ বছর বনবাস কালের পঞ্চবটী অঞ্চল এখন নাসিক হয়েছে। কোথাও পড়েছিলাম-- "গোদাবরী তীরে আছে কমল-কানন  / সেথা কি কমলমুখী করেন ভ্রমণ?" এখন গোদাবরী তটে কোথাও পদ্মবন দেখলাম না। শ্রী রামচন্দ্রের সময় নিশ্চয় ছিল আর ক্ষীণতোয়া বলেই হয়তো ছিল  পদ্মবন। অন্য জায়গায় গোদাবরী অনেক বড় নদী। নাসিকে দেখলাম নদীর দুদিকে পাড় বাঁধানো।  নদীর ওপর  অহল্যা বাই হোলকার  কার সেতু।  ১৭৫৬ সালে গঙ্গাধর যশোবন্ত, সুন্দর নারায়ন মন্দির নির্মাণ করেন।  এই মন্দিরের একটা উপাখ্যান আছে। বিষ্ণু ভগবান একবার বৃন্দা দেবীর ব্রত ভঙ্গ করে তার স্বামীর রূপ ধরে ছল করেছিলেন। তখন বৃন্দা দেবীর অভিশাপে শ্রীবিষ্ণু কুরূপ  প্রাপ্ত হন। এবার শ্রীবিষ্ণু শিবের আরাধনা করে শিবের কথায় পঞ্চ বটির রাম কুন্ডে স্নান করে নিজের সুরূপ  ফিরে পেলেন। সেসময় জলন্ধার নামে এক রাক্ষসের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ।  শ্রীবিষ্ণুর কথায় ভোলেনাথ সেই রাক্ষস বধ করেন ও শ্রীবিষ্ণু তার মুক্তি করে দেন। এখানে সুন্দর নারায়ন এর সাথে শ্রী বৃন্দা ও শ্রী লক্ষী দেবী পূজিতা হন। এই মন্দিরের আরেকটি বিশেষত্ব হলো প্রতিবছর ২০ ও ২১ মার্চ সূর্যের প্রথম কিরণ শ্রী বিষ্ণুর চরণ স্পর্শ করে। এখানে শ্রী বিষ্ণু ও শিবের মিল হয় দেখে এই মন্দির কে হরিহর মিলাপ মন্দির বলে। 



পঞ্চবটী  ঘাটের পাশে হনুমানজির শান্ত ও রুদ্রমূর্তি এক জায়গায় দেখা যায়। হনুমান  রুদ্রমূর্তি  ধরে জম্বুতালি রাক্ষস  বধ করেছিলেন। এখানকার গঙ্গা- গোদাবরী মন্দির যা 12 বছর পর পর একবার  এখানকার কুম্ভ মেলার সময় খোলে। এবার আসি কপালেশ্বর শিব মন্দিরের কথায়। শিব ও ব্রহ্মা কথোপকথনের সময় ব্রহ্মার  কিছু কথা শুনে শিব ব্রহ্মার  একটা মুন্ডু কেটে ব্রহ্মহত্যা জনিত পাপে লিপ্ত হন।  নন্দী কে গুরু স্বীকার করে গোদাবরী নদীর রাম কুন্ডে স্নান করে পাপ মুক্ত হন। সে কারণে এখানে নন্দী নেই। এছাড়াও বানেশ্বর, নীলকণ্ঠেশ্বর, নারো শংকর ইত্যাদি অনেক শিব মন্দির আছে।
 
        পঞ্চবটী থেকে তিন কিলোমিটার দূরে তপোবন।  হাজার হাজার বছর ধরে ঋষি মুনিরা  সেখানে তপস্যা করেছেন। এই জায়গাটা সেই কারণে রাম সীতা লক্ষণ ও অগস্ত্য মুনির চরণ স্পর্শ ধন্য।  মনে মনে এই শহরের আধুনিকীকরণ সরিয়ে  শ্রীরাম লক্ষণ সীতার উপস্হিতি লক্ষ্য করা যায়।  এখানে সুদৃশ্য কালারাম মন্দির আছে। এই অঞ্চলে রাক্ষস দের উৎপাতে অতিষ্ঠ ঋষিরা শ্রী রামের কাছে প্রার্থনা করেন।  শ্রীরামচন্দ্র কালো রূপ ধরে ঋষিদের রক্ষা করেছিলেন। পঞ্চ বঁটিতে চৌদ্দ বছর বনবাসকালে রাম লক্ষণ সীতার যেখানে  কুটির ছিল সেখানেই কালা রাম মন্দির তৈরি হয়েছে। রাম লক্ষণ সীতার মূর্তি ও কালো পাথরের তৈরি। এখানে আছে পাঁচটি বটগাছ। প্রত্যেক গাছের গায়ে নম্বর দেওয়া আছে। বট বৃক্ষের মধ্যে আছে সীতা গুম্ফা। পাথরের পথ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে হয়। নিচে একটি শিবলিঙ্গ আছে এখানে মাতা সীতা শিব পূজা করতেন।  এখান থেকেই রাবণ সীতাকে চুরি করেন।  অদূরে  খোদাই করা আছে  লক্ষণের হাতে সূর্পণখার নাক কাটার দৃশ্য। সে কারণেই শহরের নাম  নাসিক হয়েছে। অগস্ত্য মুনির আশ্রম আছে,কুণ্ড ও আছে গোদাবরী তটে। আর আছে কয়েকটি কুণ্ড-- ব্রহ্মদেব, বিষ্ণুদেব,অগ্নিদেব,রুদ্রদেব, মুক্তি দেব,ও সৌভাগ্য দেব কুণ্ড। কথিত আছে এই অগ্নিদেবের কাছেই মাতা সীতা ছিলেন। তাঁর ছায়া মূর্তি বা ক্লোন-সীতাকেই রাবণ চুরি করেছিল। 




ব্রহ্মগিরি পাহাড়  গোদাবরী নদীর উৎস স্থল । এই অঞ্চল ঋষি গৌতম ও তার স্ত্রী অহল্যার তপঃস্থল। ঋষি গৌতম তপস্যার দ্বারা  মা গঙ্গাকে এখানে গোদাবরী রূপে নিয়ে আসেন।  মা গোদাবরী বারবার অদৃশ্য হচ্ছিলেন বলে ঋষি গৌতম গোদাবরী কে  কুশ দিয়ে সমতলে বন্ধন করেন। এটি কুশাবর্ত তীর্থ নামে প্রসিদ্ধ। ব্রহ্ম গিরি পর্বতের নিচে কুশাবর্ত তীর্থের  পাশেই ত্রম্বকেশ্বর মন্দিরের অবস্থান। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় আর মধ্যখানে এই মন্দিরের শোভা খুব সুন্দর। মূল মন্দিরে ঢোকার জন্য তিনটি দরজা পার হতে হয়।  তারপর মধ্যেখানে গোলাকার জায়গায় বড় একটা কচ্ছপের মূর্তি। মন্দিরের গর্ভগৃহে জ্যোতির্লিঙ্গ ভগবান শিব বাস করেন। এখানে শিবলিঙ্গ একটা গর্ত আকারের।  যেখানে বৃদ্ধাঙ্গুল মধ্যমা অনামিকা একসাথে স্পর্শ করে প্রণাম করতে হয়। গর্তের ভিতর  ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এর অবস্থান। মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢোকা অনেক বছর আগে থেকেই নিষেধ। জ্যোতির্লিঙ্গের  সামনে আয়নার মধ্যে প্রতিফলন দেখেই সাধ মেটাতে হয়।  মন্দিরের বাইরে অনুরূপ মূর্তি আছে। সেখানে পূজারীরা দেখিয়ে বুঝিয়ে দেন মন্দিরের  ত্রম্ব্যকেশ্বরের  আসল মূর্তির চেহারা। ত্রম্ব্যকেশ্বর  মন্দির প্রাঙ্গনে কুশাবর্ত তীর্থের  পাশেই অশ্বথবৃক্ষের নিচে ত্রিপিণ্ডি শ্রাদ্ধের  কাজ হয়। এছাড়া নাগবলী , নারায়ন বলী ,কালসর্প দোষ দূরীকরণ কাজও এই  মন্দিরের শ্রেষ্ঠ পুরোহিতগন করে থাকেন।



ব্রহ্ম গিরি পর্বতের পূর্ব দিকে অঞ্জনেরি পর্বত। এখানে মহাবীর হনুমানের জন্ম স্থান। মাতা অঞ্জনার কোলে যেমন বালক হনুমানের মন্দির আছে তেমনি এই পর্বতের নিচে বিশাল হনুমানের মূর্তি আছে। রামায়নে বর্ণিত এইসব স্থান দর্শনে সত্যিই ভাবের  সঞ্চার হয় দেহে মনে।

         নাসিকের আরও এক দর্শনীয় স্থান হল বিস্তৃত আঙ্গুর বাগান। ১৬০ একর জুড়ে আঙ্গুর ক্ষেত আছে।  ভাবিজী বললেন এখানকার কালো কিসমিস নিয়ে যেতে। স্যালাডে খেতে খুব ভালো লাগবে। এবারে গিরীশ ভাইজী নিয়ে গেলেন তার হবি সেন্টারে। অর্থাৎ ভাইজী  মুদ্রা  সংরক্ষণ করেন।   সত্যিই অভিনব জিনিস। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় মুদ্রা সংগ্রহালয়। অল্প সময়ের জন্য যেহেতু নাসিকে চলে আসা, সে জন্য সবকিছু দেখা সম্ভব হল না। ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল অন্যান্য সব জায়গা দর্শনের ইচ্ছেগুলো।



বৈশাখের গল্প 

প্রতিদান
চিত্রা পাল

বৃষ্টিটা আরও ঝেঁপে এলো। কি করবে বুঝতে পারছে না রত্না। বার বার বারান্দায় গিয়ে গিয়ে দেখে আসছে কমছে কিনা, না ঝর ঝর করে পড়েই চলেছে। আকাশের রঙটাও কেমন ছাই ছাই ঘোলাটে। অন্য সময়ে এমন বর্ষা ভালোই লাগে, আজ তেমন লাগছে তো নাই, উলটে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে।আসলে পরিবেশ পরিস্থিতি যে মনে ছায়া ফ্যালে, তার প্রকাশও  ঘটে বাইরে।অসীম আজ কয়েকদিন ধরে জ্বরে ভুগছে, আজই সকালে দেখলো জ্বর কমের দিকে। কিন্তু এই জ্বরে ও বেশ কাহিল, দুর্বল। বাড়িতে বাজার বলতে কিছু নেই। রত্নাকেই যেতে হবে বাজারে, এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে তো হচ্ছেই। আজও কাজের মাসী আসবে বলে মনে হচ্ছে না। দরকারে অদরকারে কত সাহায্য পায়, অথচ ওর অসময়ে সে নেই।দুদিন ধরেই আসছে না। কাল বিকেলে বৃষ্টি একটু কমের দিকে এলে ছাতা নিয়ে কাছের স্টেশনারি দোকানটা কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে বেরিয়ে ছিলো, মাসীর বোনের সঙ্গে দেখা।ওকে বারবার বলে দিয়েছিলো, বাড়িতে দাদাবাবু অসুস্থ, শুয়ে আছে। কাল যেন অবশ্যই আসে। কিন্তু আজ কোথায় কি।তার পাত্তাই নেই। রাগে আপনমনেই গজগজ করে,ওদের দরকারে যতই করো ,তার কোন প্রতিদান  নেই।এদিকেওষুধগুলোও আনতে হবে, বাজারে যাওয়াটাও জরুরি।  বৃষ্টি একটু কমতেই বেরিয়ে পড়লো,ছাতা আর ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে।  

      ফেরার সময়ে আবার জোরে বৃষ্টি এলো। ছাতা আর ব্যাগ নিয়ে ওর নাজেহাল অবস্থা। সবচেয়ে যেটা খারাপ যে আজ রিক্সা টোটো  কারোরই দেখা নেই। ওদিকে বাড়ীর কর্তাও অসুস্থ। কোথায় তাড়াতাড়ি পৌঁছবে  তা নয় , এখন  কি করে যাবে সেটাই চিন্তার। কোন রকমে দু পা এগোতে যাবে, এমনসময়ে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে একটা টোটো একেবারে ঘ্যাঁচ করে ওর সামনে থামলো। ও  যাবে কিনা জিজ্ঞেস  করলে, চালক মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বললে,কোনরকমে ব্যাগগুলো রেখে একেবারে হুড়মুড় করে উঠে পড়লো গাড়িতে। ওদিকে তখনও যে  এসেছে সে নামেনি।  সে তখন পকেট থেকে টাকা বের করছে ভাড়া দেবে বলে। সে নেমে যেতে রত্না ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে ভাল করে বসে দ্যাখে,  প্যাসেঞ্জার নেমে গ্যাছে ঠিকই, কিন্তু  ভাড়া দেবার সময়ে সিটে পড়ে গ্যাছে রবারব্যান্ড দিয়ে গোছা করা বেশ কিছু  টাকা। আসলে বৃষ্টিতে গাড়ি থেকে ছাতা খুলে নামার দিকে মনোযোগ থাকায় এই বিপত্তি।

   রত্না ত্রিপলের পর্দা সরিয়ে চিৎ্‌কার করে, ও দাদা,ও ভাই কিন্তু কে শোনে কার কথা। উনি তখন বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে একটা ছাদের আশ্রয় খুঁজচ্ছেন, কোন দিকে দৃকপাত না করে।টোটোওলার হাতে টাকাকটা দিয়ে বললো, যাও তো,দেখতো, ওনাকে পাও কিনা। টোটোওলাও এই বৃষ্টিতে ভিজে দৌড়লো তাকে  খুঁজতে। পরক্ষণেই ফিরে এসে  টাকা গুলো রত্নার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলে ‘না,কোথাও দেখতে পেলুম না’।

 টোটোওলা গাড়ি চালাতে চালাতে বললো উনি স্টেশন রোডে উঠেছিলেন। আমি এ লাইনে গাড়ি চালাই, দেখতে পেলে বলে দেবো। শুনে  টাকাগুলো ওর হাতে দিয়ে বলে,তুমি ওনাকে দিয়ে দিও, না হলে থানায় জমা করো।

 বাড়ির গলির সামনে গাড়ি থামলে রত্না নেমে পড়ে,তবে  বাজারের বড় ব্যাগ নিয়ে ছাতা নিয়ে চলতে বেশ  অসুবিধে।  তখনও বৃষ্টি পড়ছে, থামেনি।  ওর   বাড়িটা আবার গলির ভেতরে। ওরা থাকে দোতলায়।  সেখান অবধি এগুলোকে বয়ে নিয়ে যেতে  হবে।রত্না ইতস্তত করে বাড়ির দিকে ফিরেছে,এরমধ্যে টোটোওলা গাড়ি থেকে নেমে কাঁচুমাচু মুখে ওর সামনে আসে। রত্না বলে, তোমাকে ভাড়াতো দিয়ে দিয়েছি। না,মানে একটা কথা ছিলো।টোটোওলা ইতস্তত করে বলে, ঘরে বাচ্ছাটার খুব জ্বর,ওর মা ওকে নিয়েই আছে। এই বৃষ্টির জন্য আমিও তেমন গাড়ি চালাতে পারিনি।এই টাকাগুলোয় যদি  চিকিচ্ছে করাতে পারতাম---। রত্না একটু ভাবনা চিন্তা করে টাকা গুলো ওকে দিয়েই দিলো। একটা ব্যাপার ভালো লাগলো যে  টোটোওলা ওকে না বলে নিয়ে নেয়নি। তার যথেষ্ট সুযোগ ও ছিলো। ও পুলিশ স্টেশনে না গিয়ে কিছু না বলেই আত্মসাত্‌ করতে পারতো। তার বদলে ওর কাছে অনুনয় করেই আবেদন করলো। এটা  রত্নার  ভালো লাগলো। নিজের  মনো ভাব প্রকাশ না করে  গম্ভীর গলায় বললো,ঠিক আছে, আজই তোমার বাচ্ছাকে ভালো ডাক্তার দেখাবে। এবার বাজারের ব্যাগ নিয়ে এগোতে যাবে কি টোটোওলা ওকে একেবারে সাষ্টাঙ্গে প্রণ্মম  করে দুহাতে ওর ব্যাগ  নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলে রত্না বললো,আরে একি করছো?আমি নিয়ে যাচ্ছি, রাখোরাখো। কাতরকন্ঠে  ‘আমাকে এটুকু করতে দিন’ বলে  ভিজতে ভিজতে  এগিয়ে চললো ঘরের দিকে।এই প্রতিদানের উত্তর কি দেওয়া যায় তখনি ও ভেবে পেলো না।               

 

ছেলেটি 

বুলবুল দে 

" মাষ্টার মশাই, মাষ্টার মশাই?"
"কে?"

একটা স্নিগ্ধ গম্ভীর গলায় মাষ্টার মশাই ডাকটা শুনে সুমনা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখে, লম্বা ছিপছিপে চেহারার দারুণ সুন্দর একটা ছেলে ওদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি আবার জিজ্ঞেস করল--
"মাষ্টার মশাই আছেন?"
"না বাবাতো টিউশনিতে গেছেন।" সুমনা উত্তর দেয়।
"কোথায়?"
"টিউশনিতে।"
"কোথায় গেছেন?"
"আরে বাবা টিউশনিতে, টিউশনিতে।"
"বুঝলাম না"
"ইস্ কি হাঁদা রে" মনে মনে ভেবে হাসি চাপতে না পেরে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল সুমনা।ততক্ষণে ঘর থেকে ওর বান্ধবীর দীপা বেরিয়ে এসেছে।

"দীপা তুই বলত।" দীপাকে হাসতে হাসতেই বলে সুমনা।
"কাকু পড়াতে গেছেন।"
দীপার কথা শুনে ছেলেটির আবার প্রশ্ন---
"কার বাড়িতে গেছেন?"
"তাতো জানিনা।" সুমনা বলে।
"কখন আসবেন?"
"সঠিক বলতে পারবনা,আটটা সারে আটটা হবে হয়ত।"
"ঠিক আছে,মাষ্টার মশাই এলে বলে দিও দীপাঞ্জন এসেছিল।"
"আচ্ছা"

ছেলেটি ধীর পায়ে চলে গেল। 
"বাপরে বাপ্ কি প্রশ্ন কি প্রশ্ন!"   দুই বন্ধু হাসিতে ফেটে পড়ল। 
বাড়ি ফিরে আসার পর হই হই করে বাবাকে বলল সুমনা----
"জানো বাবা দীপাঞ্জন বলে একটা ছেলে এসেছিল, কোন ক্লাসে পড়েগো? কি হাঁদা ছেলেরে বাবা!"
"না রে মা,ওতো টুয়েলভের ফার্স্ট বয়। পড়াশোনা খেলাধূলা সবেতেই চৌকস,আর কি ভদ্র নম্র!"
"ও"  বলে চুপ করে যায় সুমনা।

সেদিন সারাদিন কেন জানিনা ছেলেটার মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল ওর মনে। লক্ষ্য করেছিল তার সাথে কথা বলার সময় ছেলেটার চোখে মুখে একটা খুশির, ভাললাগার আভাস ফুটে উঠেছিল। এরকম তো অনেকের মুখেই দেখেছে,কিন্ত এটা যেন অন্য রকম। কি স্নিগ্ধ আর পবিত্র! সুমনারও যে বুকের ভেতরটা দুলে ওঠেনি তাই বা অস্বীকার করে কি করে। আর একদিন এল সে। সেদিনও এক কান্ড! বৃষ্টি ভেজা উঠোনে পা দিয়েই ধপাস্ করে পড়ে গেল পিছলে। সুমনার বাবা দৌড়ে তাকে টেনে তুলে বললেন---
 "আহারে! কি কান্ড দেখত, লাগেনিতো দীপাঞ্জন?"
 "না না স্যার, লাগেনি ঠিক আছি আমি।"
তবু সুমনার বাবা তাকে বারান্দায় এনে জল দিয়ে প্যান্ট হাত সব ধুয়ে মুছে দিলেন। সুমনা ঘরের ভেতর থেকে সমস্ত কান্ড কারখানা দেখছিল আর লক্ষ্য করছিল ছেলেটা বারবার লাজুক চোখে ঘরের দিকে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। সুমনার বুকে তখন হাজার বীণার ঝংকার!  সেদিন সুমনার সাথিরা কেউ আসেনি তাই সে স্কুল থেকে একাই বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ দেখে উল্টো দিক থেকে একদল ছেলে সাইকেল চেপে আসছে। লাজুক সুমনা তো কুঁকড়ে গিয়েছে! পাশ দিয়ে যেতে যেতে একটা ছেলে হঠাৎই মুখ বাড়িয়ে বলে উঠল----
       "মাষ্টার মশাই যা পড়ান না দারুণ!"
সুমনা তাকিয়ে দেখে আরে, এ তো সেই দীপাঞ্জন!
এক বৃষ্টি মুখর দিনে ছেলেটা আবারও এল।সেদিনও সুমনা একা স্কুল থেকে ফিরছে। হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি সাথে দমকা হাওয়া। ছাতা পুরো উল্টে গেছে। অগত্যা ভিজতে ভিজতেই হাঁটছে সে।
        "এই সুমনা দাঁড়াও। "
ডাকটা শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে, হায় ভগবান আবার দীপাঞ্জন! তার নামটাও জেনে গেছে! দাঁড়াবে কি আরও জোড়ে হাঁটা দেয় সে। কিন্তু লম্বুর  সাথে পেরে ওঠা কি অতই সহজ! খুব তারাতারি ই ওর পাশে চলে আসে সে।
       "এতো ভিজলে শরীর খারাপ হবে তো!এই নাও আমার ছাতাটা নাও।" বলে ব্যাগ থেকে আর একটা ছাতা বের করল। 
    "না না লাগবেনা। তাছাড়া আপনি আমাকে চেনেন না শোনেন না হঠাৎ ছাতা দিতে চাইছেন কেন?"
শুনেই হো হো করে হেসে উঠল সে।
"সত্যি হাসালে বটে! মাষ্টার মশাই এর মেয়ে তুমি। এতবার তোমাকে দেখেছি তুমিও আমাকে কতবার 
দেখেছ আর বলছ যে তোমাকে চিনিনা?"  বলে জোর করে ছাতাটা হাতে গুঁজে দিয়ে চলে গেল। 
স্বল্প চেনা কোন ছেলের সাথে কথা বলায় অনভ্যস্ত  সুমনাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। খুব ভয় পেয়েছিল
পাশে পাশে আবার হাঁটতে না শুরু করে দেয়! কি সভ্য ভব্য আর উদার প্রকৃতির ছেলে। ছেলেটার প্রতি ভাললাগা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল। একদিন এসে ছাতাটা ফেরত নিয়েও গেল।  তার পর ছেলেটার সাথে অনেক দিন দেখা নেই। হয়ত ফাইনাল পরীক্ষায় ব্যস্ত ছিল। বেশ কয়েক মাস পরে এল ছেলেটি, সাথে আরও বন্ধুবান্ধব। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে, মাষ্টার মশাইকেপ্রণাম করতে এসেছে সবাই। পাশের ঘর থেকে ওদের কথাবার্তায় সুমনা বুঝতে পারল দীপাঞ্জন দারুণ রেজাল্ট করেছে,এক নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েছে। একসময় অন্য ছেলেরা সব বেরিয়ে গেল। সে কিন্তু তখনও দাঁড়িয়ে। বলল---
        "মাষ্টার মশাই একটু জল খাব।"
        " মামনি এক গ্লাস জল নিয়ে আয়তো।"
সুমনার বাবা হাঁক পাড়লেন । সুমনা ধীর পায়ে ঘরে  ঢুকে মাথা নীচু করে দীপাঞ্জনের হাতে জলের গ্লাস টা দিয়ে বেশ বুঝতে পারল ছেলেটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
     "স্যার আমি তো কলকাতা চলে যাচ্ছি,বাবাও কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে গেছেন, আর হয়ত এই শহরে আসা হবে না।"
যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সুমনা চকিতে ওর দিকে তাকাল আর স্পষ্ট দেখল ওর চোখের কোণে জল  চিকচিক করছে। কি যেন একটা কথা বলেও বলতে পারছে না। সুমনার পায়ের তলার মাটিটা ভীষণ ভাবে টলে উঠল, তীব্র একটা যন্ত্রণা আর অভিমানে সে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। 
          এর পর বেশ কয়েক বার তার কলেজ, পড়াশোনা সম্বন্ধে জানিয়ে ছেলেটি সুমনার বাবাকে  চিঠি লিখেছিল তাতে বড় বড় মোটা হরফে নিজের ঠিকানা লিখত, হয়ত কোনও একটা ক্ষীণ আশায়। লুকিয়ে চিঠিগুলো পড়তে পড়তে চোখের জলে ভেসে যেত সুমনা। ভাবত ঐ ঠিকানায় সে একটা চিঠি লিখে দেবে------
       "দীপাঞ্জনদা,আমি না হয় লাজুক মুখ চোরা মেয়ে। তুমিতো একবার মুখ ফুটে মনের কথাটা বলতে পারতে! আমার মধ্যে কি ভালবাসার কোন চোরা আভাসও তুমি লক্ষ্য করনি? নাকি মাষ্টার মশাই এর মেয়ে বলে সাহস পাওনি?"  
কিন্তু চিঠি লেখার সাহস কোনও দিনই সুমনার আর হয়নি। সুমনার বাবা চিঠির উত্তর দিতনা বলে  পরে আস্তে আস্তে চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। একটা নিরব প্রেম কাচের টুকরোর মত খান খান হয়ে ভেঙ্গে গেল। 
        কয়েক বছরের মধ্যেই খুব তাড়াতাড়ি সুমনার বিয়ে হয়ে গেল। একদিন শুনল ওর বাপের বাড়ির পাড়ার এক রাজমিস্ত্রি ওর বাবার কাছে এসে বলেছে, "বাবু আমাদের পি ডব্লিউ ডি অফিসে এক সাহেব এসেছে, আপনার কথা আপনার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছে। আমি বললাম যে ওনার মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমার কথা কিছুতেই  বিশ্বাস করেনা। খালি বলছে যে না না তুমি ঠিক জাননা, ওঁর বাড়িতে গিয়ে তুমি জিজ্ঞেস করে এস। সেই জন্যই বাবু আপনার কাছে আসছি।"
সুমনার বাবা মিস্ত্রিকে বলেছিল, "ওকে একদিন আমাদের বাড়িতে আসতে বোলো।"
     এসেছিল একদিন সে।  সুমনা তখন তার শ্বশুর বাড়িতে ভালবাসা হীন নিষ্ঠুর এক সংসারের তীব্র দাবানলে ঝলসে যেতে যেতেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।


              
বৈশাখের ব্যক্তিত্ব 

সমাজে অবহেলিত ও বঞ্চিত জনতার একমাত্র মুক্তিদাতা ডঃ বি আর আম্বেদকর
বটু কৃষ্ণ হালদার

সবার প্রথমে ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর এর সম্বন্ধে জানতে হলে, আগে অবশ্যই স্বাধীনতার ইতিহাস আমাদের ভালোভাবে জানতে হবে বা পড়তে হবে। বহু তথ্য ও ইতিহাসভিত্তিক অনুসারে ১৯৪৬ সালে এক ভয়াবহ গণহত্যা'র মধ্য দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ গঠন হয়। সেই গণহত্যার জন্য অবশ্যই আমরা ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে দায়ী করবো। কারণ ক্ষমতা লাভের জন্য এই দুই রাজনৈতিক দল সাধারণ জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলেছিল। অবশেষে স্বাধীনতা অংশগ্রহণ করার জন্য পুরস্কার স্বরূপ মুসলিমরা পাকিস্তান লাভ করেছিল। আর ভারত বর্ষ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বাধীন হয়। বিশাল ভূখণ্ডের সীমারেখার বিস্তৃত বিভিন্ন জনজাতি,_ "নানা ভাষা,নানা মত,নানা পরিধান/বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান"এই বিখ্যাত উক্তির মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সর্বধর্ম সমন্বয় দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর দেশবাসীর হয়ে উঠল দেশের সংবিধান। এই সংবিধান দেশবাসীর জন্য অবশ্যই আশীর্বাদ স্বরূপ। নিরপেক্ষ সংবিধানে সম অধিকার আইন প্রযোজ্য হওয়া অবশ্যই বাঞ্ছনীয়। এই সংবিধান হলো দেশের মূল নিষ্ঠা তার প্রতি জনগণ আনুগত্য স্বীকার করবে এটাই নিয়ম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের ভারতবর্ষের সংবিধান খাতা-কলমের প্রচলিত। ক্ষমতা ও টাকার জোরে একশ্রেণীর জনগণ দুর্নীতি করে খোলা আকাশের নিচে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।আর সাধারণ, মেহেনতি খেটে খাওয়া নিরীহ জনগণের কাছে অবশ্যই মাকড়সার জাল। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে আইনি ব্যবস্থা প্রভাবশালীদের দাসে পরিণত হয়েছে। আবার এই সংবিধান সমাজের ভিন্ন জাতির জন্য ভিন্ন নিয়ম-রক্ষার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সমাজ আষ্টেপিষ্টে বাধা পড়েছে নিয়মনিষ্ঠা বেড়াজালে। আমাদের দেশে সংবিধান তথা আইন ব্যবস্থা বড্ড অনমনীয় তার প্রমাণ আমরা পদে-পদে পাই। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যদিও অপরাধী কিংবা সন্ত্রাসবাদি ধরা পড়ে তবুও তার বিচার চলতে থাকে যুগের পর যুগ। আর অর্থহীন ব্যক্তি বিনা অপরাধে জেলের কাল কুঠুরিতে  জীবনযাপন করতে থাকে। আর এ কথা বলতে বাধ্য হতে হয়, স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত তবুও ভারত বর্ষ শ্রেণীবিভাজনে শোষিত এবং শাসিত।

ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ভারত মাতার অন্যতম সুযোগ্য বীর সন্তান, ভারতরত্ন তথা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার অবহেলিত বঞ্চিত জনতার একমাত্র মুক্তিদাতা ভীমরাও রামজি আম্বেদকর এক অবিস্মরণীয় নাম। আমরা জানি আমাদের ভারত বর্ষ শুধুমাত্র নামে স্বাধীনতা লাভ করেছে। যার কারণে স্বাধীনতার ৭৫ বছ রে এসে ও শ্রেণী বৈষম্যের চূড়ান্ত পার্থক্য এখনও আমাদের সমাজে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আজও ভারত জননীর দেশে শত শত শতাব্দী শেষে যারা অবনত অবদমিত, দাসত্বের মলিন, ব্রাত্য ও মন্ত্রহীন সেইসব শূদ্র ও অতি শুদ্ধ দেব মূঢ় ম্লান মূক বেদনার অন্তহীন অন্ধকারের গর্ভে এক মুক্তিদাতা হয়ে ভারত মায়ের কোলে এসেছিলেন তিনি আর কেউ নন,সবার প্রিয় বাবাসাহেব ভিমরাও আম্বেদকার। এই ভারতের সম্পদ সৃষ্টিকারী বঞ্চিত-শোষিত জনগণ যারা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল তাদের সত্তিকারের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা মহান সংগ্রামী নেতা আম্বেদকর এর জীবনী তার সংগ্রাম কাহিনী তারা আদর্শ এবং মতাদর্শ, পথ জানার আগ্রহ সমগ্র দেশব্যাপী দিন দিন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠছে। আর হবেই না বা কেন, দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে এক শ্রেণীর জনগন নিঃস্বার্থ দেশসেরায় মত্ত হয়ে নিজেদের জীবনকে বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি।তাদের বেশিরভাগ ইতিহাসে স্থান পায়নি, আর যারা স্বাধীনতার পরেও বেঁচে ছিল, জীবনধারণের জন্য যোগ্য সম্মান টুকু পায় নি।এমনকি বহু শহীদ জীবদ্দশায় ভিক্ষা করে জীবন যাপন করেছে।অথচ সেই ভারতবর্ষের বুকে এক শ্রেণীর স্বার্থবাদীরা অন্যের মাথায় কাঁঠাল রেখে কোয়া খেয়ে যাচ্ছে।এমনকি তাদের পরিবাররা মহা সুখে জীবন যাপন করছে।ভারত বর্ষ হল বর্ণাশ্রম প্রথা র এক কদর্য নরক ভূমি। এই বর্ণাশ্রম প্রথা সমাজে স্তরবিন্যাস  হল চারটি ভাগে, তা হল:_ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য,শূদ্র। বর্তমান আধুনিক ও সভ্য সমাজ ব্যবস্থায় এখনো নিকৃষ্টতম  জাতি হিসাবে আমাদের সমাজে পরিগণিত তারা হলেন শূদ্র। এই সোনার ভারতবর্ষে ক্ষুদ্রজাতি নাকি জন্মায় গোলামী করার জন্য। এ পৃথিবীতে এরাও অন্যান্য জাতির মত কোন মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেয়। তবুও ভাগ্যের নিষ্ঠুর পড়িয়াছে সমাজের নিয়়ম-কানুনের বেড়াজালে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত তিন শ্রেণীর দাসে পরিণত হয়। এই যুগেে দাঁড়িয়ে ভারত বর্ষ জাতপাত ব্যবস্থার বিষাক্ত আঁতুড়ঘর হিসাবে পরিচিতি লাভ করে আছে।তার থেকেও বড় লজ্জার বিষয় যে বর্তমান সভ্যতার বিকাশ ক্ষেত্র, সমাজের আনাচে-কানাচে উঁকি দিচ্ছে, হাতের তালুতে বন্দী বিশ্ব তবু আজও কুসংস্কার দূর হয়নি। জাতপাত ভেদাভেদ ধর্মীয় নীতিতে চলে নোংরা রাজনীতির স্বার্থ অভি সন্ধির খেলা। এই খেলায় দলিত সম্প্রদায়ের অর্থাৎ রোহিত ভেমুলার দের মত উদীয়মান তরুন প্রতিভাকে হারিয়ে যেতে হয়।
বর্তমান সময়ে প্রগতিশীল চিন্তাধারার একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চোখে সেই দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তিসংগ্রামকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন এবং বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত জনগণের মুক্তিযোদ্ধাদের মহান নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। তিনি হলেন সমগ্র ভারতের সম্ভবত অপ্রতিদ্বন্দ্বী ডঃ আম্বেদকর। মহারাষ্ট্রের এক অখ্যাত অবহেলিত অত্যন্ত নিম্ন "মহর" সম্প্রদায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু অপার শক্তি বলে ও প্রতিভার  জোরে বিদ্যা বুদ্ধি ও নেতৃত্বের চূড়ান্ত শিখর তিনি স্পর্শ করেছিলেন। তাঁর জীবনযাত্রা আজও সমাজের বুকে বিস্ময়কর। বাল্য জীবন ছিল অত্যন্ত দুঃখময়। নিম্নবর্ণের জন্ম হতে তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন সীমাহীন ঘৃণা, বঞ্চনা ও অবজ্ঞা। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষকে প্রচলিত কু-সংস্কার ধারার বাইরে থেকে তিনি দেখেছিলেন এবং চিনেছিলেন এবং তা সংস্কারের চেষ্টা করে গেছেন। অন্ধকার ও সামাজিক অচলায়তনে প্রমিথিউসের মত অথচ স্পার্টাকাসের মত আলো জ্বালাতে চেয়ে ছিলেন।তিনি দাসত্ব প্রথার মুক্তি চেয়েছেন। উন্মত্ত ভারতবর্ষের বুকে জ্বালাতে চেয়েছিলেন' শিক্ষা সংহতি ও শান্তির আলো। সমাজের অবাঞ্চিত লাঞ্ছিত পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর জন্য বরাবর তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। যে মানুষগুলো প্রতিনিয়ত জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ভদ্র সমাজের মুখোশধারী মানুষ গুলো মিথ্যে কাছে হার মেনে চলেছিল। সংকীর্ণ জাতপাত হিংসা সামাজিক অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে তার আগ্রাসী  হয়েছে দাসত্ব শ্রেণীদের বেঁচে থাকার একমাত্র মহামন্ত্র। এর সঙ্গে ধর্ম সমাজ,রাজনীতি,শিক্ষা,সাহিত্য,নারী প্রভৃতি নানা বিষয়ে তার সুচিন্তিত অভিমত সমকালের ভাবুকদের তুলনায় ছিল স্বতন্ত্র ও ভাবনার প্রতিবিম্ব।
শিশু আম্বেদকর তথা ভীমের যখন মাত্র দুই বছর বয়স তখন পিতা মিলিটারি বিভাগের প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।এরপর তাঁর পিতা রামজি দাপোনিতে চলে যান। সেখানে গিয়ে তাঁর পিতা পি ডব্লিউ ডি তে একটি চাকরি জোগাড় করেন। সেই সূত্রে পুরো পরিবার সাতারায়  চলে যান। আনুষ্ঠানিকভাবে ভীম একটি স্কুলে ভর্তি হলেন।তাঁর ছয় বছর বয়সে মাতা ভিমা বাই মারা যান। জীবিত পাঁচ সন্তানকে দেখাশোনা করার জন্য পিসিমা মীরা বাই কে তার বাবা নিয়ে আসেন। কিন্তু তাঁর পিতা কিছুদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বৈ মাতা জিজা বাইকে তিনি কখনোই মনেপ্রাণে মা হিসাবে মেনে নিতে পারেননি। তার শৈশবের সমস্ত অভাব পুরন করতে থাকেন পিসিমা মীরাবাঈ।পিসি মাকে ঘিরেই তার স্বপ্নের জগৎ শুরু হয়। এরপর থেকে তাঁর জীবনে লেখা হয়ে যায় ক্যা করুন ও নির্মম ইতিহাস। সীতা রায় শৈশবে স্কুল জীবন ছিল খুবই অল্প দিনের। সেই সময়ে প্রতি পদে পদে লেখা হতে থাকে বঞ্চনার ইতিহাস। তিনি সেখানেই উপলব্ধি করলেন সমাজের বাস্তব চরিত্র কে। সেখানেই লক্ষ্য করলেন সমাজের অমানবিক, হিংস্র,নিষ্ঠুর পাশবিক রূপ। ঈশ্বরের নিয়ম অনুসারে একটি জীবনের এ পৃথিবীতে আগমন হয় মাতৃগর্ভ থেকেই। এই আকাশ বাতাস ফল-ফুল পাখির কলতান মাটির ছোঁয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ও স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিটি জীবের থাকে। সেই শিক্ষা আমাদের দেওয়া হয়। কিন্তু সমাজের ললাট লিখন অন্য বিধান বেঁধে দিয়েছে ন। জন্মের পর কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ যারা ধর্মের গণ্ডিকেও বেঁধে দিয়ে জাতপাত বৈষম্যের তকমার লেভেলটা গায়ে সাঁটিয়ে দেয়। স্কুলে তাঁকে ভর্তি করানো হয় সত্য কিন্তু অন্য ছাত্রদের সঙ্গে একসঙ্গে বেঞ্চে বসতে দেওয়া হতো না। দূরে চটের আসনের তাকে বসতে দেওয়া হতো, এই আসনটিও তাকে বয়ে নিয়ে আসতে হতো। মুখের বাষ্পে শ্রেণীকক্ষ অপবিত্র হবে সেই কারণে ছিল না  বাক স্বাধীনতা। তাঁর বইপত্র খাতা শিক্ষকরা হাত দিয়ে স্পর্শ করতেন না দূর থেকে দেখে দিতেন এমনকি সংস্কৃত পরার অধিকার টুকুও দেওয়া হয়নি। এছাড়াও স্কুলে যতক্ষণ ক্লাস চলত তেষ্টা নিবারণের কোন ব্যবস্থা তাঁর জন্য ছিল না। মুখ দিয়ে জল চাওয়ার অধিকার টুকু ছিল না। উপরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হতো চাতক পাখির মতো। তা দেখে কোন ছাত্রের যদি তার উপর করুণা  হয় তখন সেই উপর থেকে জল ঢেলে দিতেন। এমন সব শরশয্যায় তার ছাত্র জীবন কেটেছে।এর ফলে এক অন্য ভারতের নাগরিক তথা নির্যাতিত,ভারতাত্মা,শিশুর মধ্যে জেগে উঠেছিল।যে প্রতিজ্ঞা দৃড় ও সাধনায় অটল। তবে কেবল শুষ্ক মরূভূমির উষ্ণ বালুরাশি নয়,তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার এই পথে দুই একটি মরুদ্যানের দেখা পেয়েছেন।বঞ্চিত, অবহেলিত হয় প্রাথমিক স্কুল শেষ করার পর হাই স্কুলের শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। একইসঙ্গে যাতায়াত শুরু করেছিলেন অগ্রজ বলরাম রাও। বাবা সেসময় গোরেগাঁও তে খাজাঞ্চির কাজ শুরু করেন। বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন দুই ভাই প্রথমে পাদানি স্টেশন থেকে মন্তুর পর্যন্ত গেলেন। বাবাকে আগে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন স্টেশনে আসার জন্য কিন্তু চিঠি না পাওয়ায় তিনি আসেননি। কোনমতে গরুর গাড়ি ভাড়া করে গ্রীষ্মের দুপুরে পথে নামল গাড়ি। কিছুক্ষণ গাড়ি চালানোর পর গাড়োয়াল জানতে পারেন তারা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত, ঘাড় ধরে নামিয়ে দেয়া হলো তাদের, মালপত্র ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল। অবশেষে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো তবে তারা দুই ভাই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে আর গাড়োয়াল পায়ে হেঁটে যাবে এই শর্তে। এই দীর্ঘ পথে দুই অস্পৃশ্য বালক দের জন্য জুটলোনা একফোঁটা পিপাসার জল কিংবা সামান্য আহার। প্রতিপদে সমাজ ব্যবস্থার কুলসিত নিয়ম থেকে তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হন। হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা তথা অস্পৃশ্যতা যে কি সাংঘাতিক মানসিক ও দৈহিক পীড়ন মূলক ব্যবস্থা সেই সময় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। ছাত্রজীবনে এহেন অপমানজনক দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার সমূহ তার সংবেদনশীল মনের উপর একটা গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে যা পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল।
আম্বেদকর বাল্য ও কৈশোরে অভিজ্ঞতায় বর্ণনা করেছেন যে সমাজের মধ্যে তিনি লালন-পালন হয়েছিলেন সেখানে অস্পৃশ্য মানুষদের কোন অধিকার ছিল না। জলাশয় নলকূপ বা কুয়ো এমনকি সর্বসাধারণের ব্যবস্থা যোগ্য কোন জলাশয় থেকে জল সংগ্রহ র অধিকার ছিল না। মন্দিরে ঢুকে পূজা দেওয়ার কথা তো স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না। ভগবান কারণ নিজস্ব হতে পারে সে বিষয়ে ধারণা পায় তখন পাল্টে গেছে। অস্পৃশ্যরা চাষবাস,ময়লা,পরিষ্কার,কাজ করবে কিছুতেই পড়াশোনা করতে পারবে না।তাদের সমাজের সবথেকে নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর আর খারাপ জায়গায় বসবাস করতে হবে, এটাই তৎকালীন সমাজের নিয়ম ছিল। নানান প্রথা এবং ঋণ দাদনের নামে একাংশ গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ সমাজের নিয়ম নিষ্ঠা জালে এদেরকে পিষে মারতে হবে দিনের পর দিন। একথা বলা শ্রেয় উচ্চশ্রেণীর নিয়মের যাঁতাকলে তখনো এবং আজও দলিত শ্রেণীর লাঞ্ছনা-বঞ্চনা অত্যাচারের জীবন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে রয়ে গেছে।
তাই ডঃ আম্বেদকর এর জীবনের প্রথম প্রয়াস ছিল মূলত হিন্দু ধর্মকে একশ্রেণীর স্বার্থপরতা গোঁড়া অন্ধ মানববিরোধী বর্ণহিন্দুদের হাত থেকে উদ্ধার করে প্রতিটি হিন্দুর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এই মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য তারা সত্যাগ্রহ পরিচালনা করবেন এমনটাই ঠিক করলেন। এই সত্যাগ্রহের তিনি প্রত্যেকটি মানবতাবাদী হিন্দুকে যোগদানের জন্য আহ্বান জানালেন। তিনি তাঁর অনুগামীদের বললেন:_"মহতী উদ্দেশ্যে প্রাণ উৎসর্গ প্রকৃত মানুষের কাজ, অধিকারী অবস্থায় পশুর মতো জীবন যাপন করার চেয়ে অধিকার অর্জনের জন্য প্রাণদান অনেক গৌরবের"। তিনি আরো বলেন:_সত্যাগ্রহ  অহিংসা কিছু প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অস্পৃশ্যতা দাসত্বের ই নামান্তর এবং তা ধর্মের মূলনীতি বিরোধী যেকোনো মূল্যে তা দূর করা দরকার। এরপর আম্বেদকর শিখ সম্মেলনে যোগদানের পর হিন্দু সমাজের আম্বেদকর বিরোধী আন্দোলন আরও প্রবল আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত জাতপাত তোভক মণ্ডল ডঃ আম্বেদকর কে জানিয়ে দিলেন তাদের আসন্ন সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার অনুরোধ প্রত্যাহার করা হলো। উক্ত সম্মেলনের জন্য লিখিত সভাপতির ভাবনাটি তিনি পুস্তক আকারে প্রকাশ করলেন। এই পুস্তকটি পরবর্তীকালে"জাত ব্যবস্থা উচ্ছেদ" নামক খ্যাতি লাভ করল। এই বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু সমাজে চিন্তাজগতে গুরুতর আলোড়ন সৃষ্টি করল। দুই মাসের মধ্যে প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, ভারতীয় প্রত্যেকটা ভাষায় বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হল। তার মুখ্য বক্তব্য হল:_ প্রথমদিকে সমাজব্যবস্থা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার কর্মভিত্তিক ছিল কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই ব্রাহ্মণ শ্রেণীর স্বার্থে তাকে জন্ম ভিত্তিক করা হয়। ফলে বর্ণাশ্রম সমাজের বিভেদ না হয়ে শ্রমিক বিভাগে পরিণত হল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পৈত্রিক পেশার মধ্যে নিবন্ধ  হতে বাধ্য করানো হতো। এতে মানুষের স্বাধীন কর্ম প্রবৃত্তি উপর আঘাত হানা হলো।সমাজে বৃহত্তর সংখ্যক মানুষকে সূর্য শ্রেণীর অর্থনীতিও অস্ত্রবিদ্যা থেকে তাদের কৌশলকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যবস্থা, এবং সর্বপ্রকার ক্ষমতার উৎস থেকে বঞ্চিত করে তাদের চিরন্তন দাসত্বকে পাঁকে পুতে রাখার ব্যবস্থা করা হলো।
এই সমস্ত প্রথা থেকে মুক্তি দিতে তিনি বিভিন্ন সম্মেলন এর ব্যবস্থা করেন। তাই তিনি মাসুরে নির্যাতিত শ্রেণীর একটি সম্মেলনে শ্রেণী সম্পর্কে গান্ধীজীর মনোভাবের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ডঃ আম্বেদকর বলেন যে:_গান্ধীজী হলেন বণিক স্বার্থের তল্পিবাহক। গান্ধীজী কখন ও খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থরক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারতেন না। তাঁর পরিচালিত কংগ্রেস পার্টি যদি প্রকৃতপক্ষে প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনৈতিক দল হতো তবে তাকে নতুন করে রাজনৈতিক দল গঠন করতে হতো না। তিনি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে একথা ঘোষণা করেন যে গান্ধীজিকে তিনি যতটা মেনেছে বা বুঝেছেন যে, দেশের কৃষকদের গান্ধীজী চাষের নিমিত্ত জোড়া বলদের সঙ্গী, তৃতীয় বলদের অতিরিক্ত কিছু মনে করেন না। তবে গান্ধীজী সম্পর্কে আমাদের ভারতবর্ষের যেমন মনোভাব পোষণ করুক না কেন তিনি যে স্বার্থন্বেষী ক্ষমতালোভী ছিলেন তার প্রমাণ আমরা পাই।
শুধু কংগ্রেস নয় কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তিনি ভিন্ন মতাদর্শের পোষণ করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান যে, ভারতীয় কমিউনিস্টের তিনি শ্রমজীবী মানুষদের ঘোর শত্রু বলে মনে করেন। কমিউনিস্টরা শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করে তার উদ্দেশ্য শ্রমিকদের কল্যাণ সাধন নয়।এ কথার অর্থ হলো ধর্ম স্থানে গেলেই ধার্মিক হওয়া যায় না। কমিউনিস্টের আসল উদ্দেশ্য হলো খেটে খাওয়া দিনমজুরদের আশা-ভরসা সাথে মিথ্যা নাটক করে যাওয়া। শ্রমিক শ্রেণী দের সহায়তায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা। তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো মালিক শ্রেণী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক শোষণ করেছে সত্য কিন্তু কমিউনিস্টরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবিধ ভাবে শাসন করেছেন। তাই ডঃ আম্বেদকর তার নবগঠিত পার্টির মাধ্যমে শ্রমিক এবং কৃষকদের স্বার্থে দুই ফন্টের লড়াইও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কঠিন সংকল্পর কথা ব্যক্ত করেছেন।
১৯৩২ সালের ২১ মে পুনা চুক্তির বিতর্কমূলক কূটনৈতিক আবহের ডঃ আম্বেদকর অকথ্য ভাষায় বলেছেন:_"At present i am the most hated man in hindu India"। ইতিমধ্যে তিনি কয়েকটি সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। চৌদা পুকুর অভিযান (১৯২৭),কালাবাস মন্দির প্রবেশ, মনুবাদ এর কালাকানুন সম্বলিত মনুস্মৃতি দহন।সমাজের উচ্চবর্ণের জন্য সবকিছু থেকেই নিম্নবর্ণের দলিতরা  সমাজের কোন থাসায় পরিণত হয়েছিল। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন একদল স্বার্থন্বেষী রক্ত শোষকদের শোষণ যন্ত্র ছিলেন এই নিম্নবর্ণের মানুষরা। ধর্মের গন্ডিতে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ভাগ্য।অন্ধবিশ্বাস,কুসংস্কার আর ধর্ম,দেবদেবীর নামে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ভয় দেখিয়ে তাদের থেকে লুট করা হতো অর্থ ধনসম্পত্তি। জীবনের শেষ গচ্ছিত অর্থ দিও তারা এ সবের থেকে মুক্তি পেতেন না। 
ডঃ আম্বেদকর সমাজতন্ত্র বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে সমাজতন্ত্র ব্যতীত ভারতের পূর্ণ শিল্পন্নতি ঘটা অসম্ভব। কারণ ব্যক্তিমালিকানায় মালিক তার মুনাফার স্বার্থে শিল্প কে ব্যবহার করেন, সমাজ কিংবা শ্রমিকদের স্বার্থে নয়। তার ফলে গড়ে ওঠে পুঁজিবাদ। এই পুঁজিবাদী সমগ্র পৃথিবীতে সাধারণ মানুষকে কৃত দাসে পরিণত করেছে। মানব সভ্যতা ও মানব সমাজের ধ্বংসকে আসন্ন করে তুলেছে। তিনি মনেপ্রাণে দেশের স্বাধীনতা চেয়ে ছিলেন। স্বাধীনতা সম্পর্কে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা করলেন আমরা স্বাধীনতা চাই, কিন্তু কথা হল কেমন সরকার দেশের শাসন ব্যবস্থা চালাবে?তাঁর মতে স্বাধীনতা লাভ করলে যদি মানুষ পুনরায় দাস হয়ে থাকে সরকার যদি বঞ্চিত,দরিদ্র জনগণের কথা না ভাবেন তবে সাধারণ মানুষের সেই স্বাধীনতায় কোন লাভ নেই। স্বার্থান্বেষী সমাজব্যবস্থায় যদি ধ্যান ধারণা, মানসিকতায় পরিবর্তন না আসে তাহলে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর দুর্দশা কোনদিন মোচন হবে না।
স্বাধীন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলিত আদিবাসী মহিলা সহ জনসাধারণ প্রতিবছর বিশ্ববরেণ্য পন্ডিত  ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের জন্মদিবস ও মৃত্যু দিবস গভীর সামাজিক ও সংস্কারের স্তরে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে পালন করে থাকেন। দলিত সম্প্রদায়ের আযম ও অসাম্য শোষণ ও অমর্যাদা অমানবিক বিভাজনের বিরুদ্ধে তাঁর মরন পথের সংগ্রাম ও সাংবিধানিক অধিকারের জন্য তিনি প্রাণপণ লড়াই করেছিলেন। আজো আমরা ভুলিনি তার কথা। একটি অখণ্ড জাতি গঠনে আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে বাবা সাহেবের ভূমিকা কি ছিল, তা উপলব্ধি করতে গেলে গৌতম বুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে আলোকপাত করতে হবে। অতি বড় সত্য কথা, ভারত বর্ষ সত্যিই এক বিচিত্র ময় দেশ। যে মানুষটি ছাত্রাবস্থায় বিদ্যালয় কক্ষে প্রবেশের অধিকার পায়নি, নিচু জাত বলে গরুর গাড়িতে চড়ার অপরাধে যাকে লাথি মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে,তৃষ্ণার জল পান করতে গিয়ে পুকুরের জল না পাওয়ার জন্য আপত্তি করার, মারের চোটে বাল্যকালে প্রাণ সংকট দেখা দিয়েছিল, উচ্চ পদস্থ অফিসার হয়েও যাকে পিয়ন কর্তৃক ঘৃণিত হতে হয়েছিল, কলেজের সম্মানিত অতিথি অধ্যাপক হয়েও যিনি উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাত্র দের দ্বারা চরম অপমানিত হয়েছিলেন, নিম্নবর্ণে জন্ম হওয়ার অপরাধে যাকে হোস্টেল থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বিতাড়িত করা হয়েছিল, যিনি চিরকাল গান্ধী বিদ্বেষী বলে কংগ্রেসের দ্বারা হিন্দু সমাজের শত্রু বলে বিবেচিত হয়েছে, তিনি সেই আম্বেদকর যিনি স্বাধীন ভারতের সংবিধান তৈরি করার জন্য কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ গণপরিষদ কর্তৃক সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। এ কথার অর্থ হল যোগ্যতার মাপকাঠি এর কাছে জাতীয় কংগ্রেস মাথা নিচু করলেন। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল জাতীয় কংগ্রেস থুথু ফেলে আবার চেটে নিলেন। কারণ যাকে জাতীয় কংগ্রেসের বিদ্বেষী বলে মনে করে এসেছেন তাকি কংগ্রেসের যোগ্য ও উত্তম ব্যক্তি বলে মনে করলেন। এই সমাজে কেমন নির্লজ্জ বেহায়া যাকে উচ্চবর্ণের সাজানো গুটির  চালে কোণঠাসা করে ফেলতে চেয়েছিলেন', সেই ব্যক্তির তারাই নির্ধারিত হলো ভারতবর্ষের ললাট লিখন। সেই ভারত রানীর ভবিষ্যৎ রূপরেখা অঙ্কনের দায়িত্ব অর্পিত হলো বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর তথা তপশিলি সমাজের কাছে এক বিশেষ গৌরবের দিন। 
এক সময়ে একটার পর একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা হত্যা করে দেশের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু হয়ে উঠলেন সর্ব সর্বা। তিনি স্বীকার করলেন সারা দেশ স্বাধীনতা লাভের পরেও রক্তও অশ্রুর সাগরে নিমজ্জিত। এর সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারবো যদি কেউ নোয়াখালী দাঙ্গার ইতিহাস সম্বন্ধে একটু পড়াশোনা করে। স্বাধীনতার আগে দেশকে মুক্তি দিতে গিয়ে দেশের লক্ষ লক্ষ দেশপ্রেমিকরা প্রাণ দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে সবার প্রিয় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু লুকালেন আর স্বাধীনতা লাভের ঠিক এক বছর পূর্বে ১৯৪৬ সালে তখন ভারতের মুক্তি সূর্য দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। ক্ষমতার লোভের অভিবাসনের মুসলিম লীগ আর জাতীয় কংগ্রেসের স্বার্থন্বেষী গতির লড়াই কে কেন্দ্র করে ঘটে যায় এক ভয়াবহ দাঙ্গা। যাতে প্রায় লক্ষ লক্ষ নিরীহ জনসাধারণ মারা যায়। মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা নীতির কুফল সম্পর্কে দেশবাসীর তিক্ত অভিজ্ঞতা বেশ জমে উঠলো। এমনকি তৎকালীন সময়ে কংগ্রেস নেতাদের গান্ধীবাদের প্রতি আস্থা যেন মোহভঙ্গ হয়ে গেল। তৎকালীন সময়ে জাতীয় কংগ্রেসের এক নেতা রাজশ্রী ট্যান্ডন জনসভাতে এক বক্তৃতায় বললেন যে:_ভারত বিভাজনের জন্য গান্ধীজির অহিংস নীতি সবথেকে বেশি দায়ী"।১৯৪৮ সালের ১৩ ই জানুয়ারি দিল্লিতে মুসলমানদের পুনর্বাসন এবং ক্ষতিগ্রস্ত মসজিদের সংস্কারের দাবিতে গান্ধী  অনশন শুরু করায় সাম্প্রদায়িক সমস্যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয় উঠলো। যার ফলে মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে দেশবাসীর ক্ষোভ বাড়তে থাকলো। উক্ত অনশনে ভারত সরকার প্রায় ৫০ কোটি টাকা দিতে বাধ্য হন।যদিও এই টাকা দেওয়ার বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রবল আন্দোলন চলেছিল। মহাত্মা গান্ধীর এমন অসহনীয় কার্যাবলী তে বিরক্ত বোধ করছিল দেশবাসী। যার ফলে নাথুরাম নামক সৎসাহসী জনৈক হিন্দু মহাসভার সমর্থক ৩০ শে জানুয়ারি গান্ধী স্থলে প্রার্থনা সভার মধ্যে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করে। ভারতকে এক ভান্ত ও মুহূর্ত রাজনীতিকের হাত থেকে চিরতরে মুক্তি দিলো। এক্ষেত্রে দেশের অগণিত জনগণ স্বীকার করলেন যে শহীদ নাথুরাম নিজের প্রাণ দিয়ে ভারত বর্ষকে রক্ষা করে গেলেন। গান্ধীজীর আকস্মিক মৃত্যুতে সারা বিশ্ববাসীকে চমকে উঠলো। এতে সবথেকে বেশি মর্মাহত হলেন পাকিস্তানের ধুরন্ধর সম্প্রদায়ের নেতৃত্ববৃন্দ। কিন্তু মজার বিষয় ডঃ আম্বেদকরের মধ্যে এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। গান্ধীজীর মৃত্যুতে তিনি প্রকাশ্যে কোনো বিবৃতি দিলেন না। শোনা যায় তিনি নাকি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে গান্ধীজীর মৃত্যু প্রসঙ্গে জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর সিসেরোর বিখ্যাত উক্তি:_"মুক্তির প্রভাত এসে গেল" শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন।
এতকিছুর পরেও দেশের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যিনি নির্বাচিত হয়েছে ন, তারও কিছু কারণ ছিল। বাবাসাহেব আম্বেদকরের কাছে ৩২ টি পাস ডিগ্রি ধারী সার্টিফিকেট আছে, যা অন্য কারো কাছে নেই, এবং প্রায় ১৫ থেকে ১৬ টি ভাষা জানতেন।তিনি একমাত্র সেই ব্যক্তি নিউইয়র্কে দুই হাজার  প্রাচীন গ্রন্থ কিনেছিলেন লন্ডনে দ্বিতীয় গোল গোলটেবিল সম্মেলনের সময়, যার জন্য ৩২ টা সিন্দুকের দরকার পড়ে। শুধু তাই নয় লন্ডনের এক লাইব্রেরীতে ১০০০ দিনে ১৬০০০ বই পড়ার রেকর্ড তাঁর ঝুলিত আছে। যখন সমগ্র বিশ্বে সবথেকে বেশি বিদ্বান ব্যক্তির নাম নেওয়া হয়, সবার প্রথমে আসে বাবা সাহেবের ডঃ আম্বেদকর এর নাম।যা ভারতের কাছে অত্যন্ত গর্বের বিষয়।শুধু তাই নয় ভারতবর্ষের সবথেকে বড় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংকের স্থাপনাতে তাঁর কৃতিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। তাঁর লিখিত সিদ্ধান্তকে মান্যতা দেওয়া হয়েছিল রিজার্ভ ব্যাংকের পরিষেবায়। রিজার্ভ ব্যাংকের কার্য পদ্ধতি কার্যপদ্ধতি ও দৃষ্টিকোণ বাবাসাহেব হিল্টন ইয়ং কমিশনের সামনে রেখেছিলেন যা:_"The problem of the Rupee its origin it's solution".The bank was set up based on the recommendation of the ,1926 royal commission on Indian currency and finance,also known as the Hilton _ young commission.it was ambedkar tireless efforts due which the reserved bank of India came into existence.বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সম্পর্কে মিস্টার জন মাথুর তাঁর "ইনসাইড এশিয়া"(১৯৩৮) বইতে লিখেছেন:_ ডঃ আম্বেদকর নিজের লাইব্রেরীতে বইপত্রের সংখ্যা তৎকালীন সময়ে সবথেকে বেশি ছিল,লোক থাকার জন্য বাড়ি বানায় কিন্তু আম্বেদকর বইয়ের জন্য  রাজগৃহ বানিয়েছিলেন।১৯৩৮ সালে তাঁর লাইব্রেরীতে বইয়ের সংগ্রহ সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ হাজার,এই সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছিল।১৯৫৬ সেই সংগ্রহ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার। ইংরেজরা তাকে চলতি ফিরতি বিশ্ববিদ্যালয় বলতেন। একদিকে যদি ৫০০ জন স্নাতক , আর একদিকে শুধু বাবা আম্বেদকর আলোচনায় বসছেন তবুও তাকে হারানো সম্ভব ছিল না।
দেশের জনগণ যদি ডঃ আম্বেদকর এর হুঁশিয়ারি গুলোকে মূল্য দিতেন তাহলে হয়তো দেশবাসীকে আজও স্বাধীনতার কুফল ভোগ করতে হত না। বর্তমান সময়ে এসে তা দেশের জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। দেশের স্বাধীনতা বড় কথা নয়, সমাজ ব্যবস্থা ও সরকারের চরিত্র জনগণের মুক্তির প্রকৃত নিয়ামক। ডঃ আম্বেদকর এর এই উক্তি গুলো যদি কর্ণপাত করে কংগ্রেস শ্রেণীর চরিত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন তাহলে স্বাধীনতা লাভের এত বছর পরেও দেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর বঞ্চনার ঘানিতে এমন করে নিষ্পেষিত হতে হতো না। দেশের জনগণের ধ্যানধারণা তখনও অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল আজও একই রকম আছে। একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে স্বাধীনতা আমরা খাতা-কলমে পেয়েছি কিন্তু দাসত্ব আমাদের রক্তে মিশে আছে।



বৈশাখের রম্য রচনা 

ভোরের স্বপ্ন
স্বপন কুমার দত্ত 

সেদিন ভোররাতেই গেল ঘুমটা ভেঙে। ইচ্ছে করেই আর ঘুমোলাম না। প্রাত:কৃত্য সেরেই বেড়োলাম মর্নিংওয়াকে। আসলে কথায় আছে, ' ভোরের স্বপ্ন নাকী সত্যি হয়। তবে স্বপ্ন দেখে ঘুমিয়ে পড়লে সেটা কোন কাজেই আসেনা।
            আসলে যে স্বপ্নটা দেখলাম, সেটা কিন্তু একেবারে পরতে পরতে সত্যি। পুরুষ মানুষ হল, এক একটি খেজুরগাছ। নীচ থেকে উপর পর্যন্ত সর্বাঙ্গে শুধু কাঁটা আর কাঁটা। সারাজীবন ভোগ করতে হয় কাঁটার খোঁচার যন্ত্রণা। বিয়ের পর থেকে সাধের বউয়ের আবদার মেটাতে মেটাতে একেবারে বস্ত্রহীণ হতে হতে একসময় ত্রৈলঙ্গ স্বামী। কোলে কাঁখে নয়, পারলে বউ ঘাড়ে ওঠে। স্বয়ং মহাদেব মৃত পার্বতীকে ঘাড়ে নিয়ে ত্রিভুবন করেছিলেন তোলপাড়। তখন থেকেই মনে হয়, স্বামীদের স্ত্রীকে ঘাড়ে পিঠে নেওয়া শুরু। খেজুর গাছের দুর্দশা লক্ষ্য করেই মনে হয় পুরুষ  জাতির প্রতিনিধি হয়ে মহাভারতের ভীষ্মদেব মেনে নিয়েছিলেন শরশয্যার দুর্বিষহ যন্ত্রণা এবং তারপরেই ইচ্ছামৃত্যু বরণ। এভাবেই তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন জ্বালাযন্ত্রণার হাত থেকে।
           খেজুরগাছ জন্মায় যেখানে সেখানে,বনে বাদারে। পায়না কোন আদর, মেলেনা যত্ন,কেউ দেয় না জল, সার দেওয়াতো দূরস্থান। গাছের গোড়ায় কস্মিনকালেও কেউ মাটি দেয়না।অথচ সবাই দেয় বড় বড় উপদেশ, তাও সারাজীবন ধরে। নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করো। জীবনে উন্নতি করতে গেলে নিজের পায়েই ভর করে দাঁড়াতে হবে। অযত্নে অবহেলায় ক্রমাগত বেড়ে ওঠার পরও সবাই তার কাছে প্রত্যাশা করে অনেক অনেক কিছু। এমনকী সাধের গিন্নির চাহিদা আরও আরও। বোমকাই এর দাম শুনে চমকালেও নেই রেহাই। চোখে পটি বাঁধা বলদের ঘাড়ে কলুর ঘানি চাপানো রয়েছে পুরুষদের ঘাড়ে। বাছাধন তুমি যাবে কোথায়? সাধে কী আর সাধক রামপ্রসাদ মনের দুঃখে গেয়েছিলেন, " মা আমায় ঘুরাবি কত, কলুর চোখ ঢাকা বলদের মত।" 
            মায়েরা সর্বদাই ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যের দিকটা দেখে থাকেন। তাঁদের কাছে ছেলের পেট কখনই ভরেনা। কিসে ছেলের পেট ভরবে,সেটা নজর দিয়ে থাকেন। অন্যদিকে গিন্নিরাও নজর
দেন, তবে সেটা স্বামীর পেটের দিকে নয়,পকেটের দিকে। আসলে ওটাইতো মধুর ভান্ড। তাই মাঝে মাঝেই 'পিক পকেট '।
             এর উপর আবার টিভি সিরিয়াল এসে তো সাড়ে সর্বনাশ। এখনতো স্বামীদের খাওয়ার সুখ কবেই গেছে মরে হেজে। হেঁসেলে যা খুশি হোক,শাশুড়ি, স্বামী, ননদ,ভাসুরকে সিরিয়ালে টাইট দেওয়ার কোন এপিসোড ছাড়া যাবেনা। স্বামীতো দূর ছাই, প্রয়োজনে নিজের বাবা মা টেশে গেলেও নৈব নৈব চ। তাই রান্নাও এখন সর্টকাট। থোর বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোর।মুখে
স্বাদ না পেলে নির্ঘাত শুনতে হবে, " নিজেরটা নিজে করে নাও নতুবা হোম ডেলিভারি।" আর সেটাও না শুনলে ধরে বেঁধে পাঠিয়ে দেবে টেস্ট করাতে।
           খেজুরের ফলও মিষ্টি, কিন্তু তার মধুর রসের জন্য পরিত্রাহি হাহাকার। রসের পাটালি গুড়তো একমেবাদ্বিতীয়ম। কত স্বাদের পিঠাপুলি পায়েসের মূল উপাদান এই গুড়। খেজুরগাছ যতদিন বেঁচে থাকে, তাকে করা হয় ক্ষতবিক্ষত। জীবনের অন্তিমদিন পর্য্যন্ত তার রস একফোঁটা একফোঁটা করে নেওয়া হয় নিংড়ে। যতক্ষণ রস বেরোয়, ততক্ষণ পুরুষের দাম, ততক্ষণ তার পুরো কদর। তারপর আর তার কোন দাম থাকেনা। পড়ে থাকে পথের ধারে অযত্নে, অযত্নে অবহেলায়। পুরুষের শেষ জীবনটাও একেবারে তদ্রুপ। রস নিংড়ে নেওয়ার পর থাকে শুধু ছোবড়া।
              কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার মতো বিষয় হলো, খেজুরগাছ কখনো করেনা কোন অভিযোগ। তার নেই কোন প্রত্যাশা, চায়না কোন ভালোবাসা। তার কর্তব্য শুধু সেবা প্রদান করে যাওয়া। সারাজীবন ধরে শুধু ফল দিয়ে যায়, রস প্রদান করে যায় আর ঝড় বৃষ্টি জলকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকে নি:স্বার্থভাবে আমাদের পরিবারে পুরুষ মানুষটির মতো।
              যখন ফল দেওয়া, রস প্রদানের সামর্থ্য হারিয়ে শুকনো কাষ্ঠদণ্ডের মতো হয়ে যায়, খেজুর গাছের তখনও শেষ হয়না কাজ। তখন তাকে চেরাই করে টালি বা টিনের ঘরের বিম বরগা হিসেবে লাগানো হয়। আর কোন কাজে না লাগলে ভবিতব্য অবশ্যই জ্বালানী। শেষ পর্য্যন্ত পুরুষ মানুষটিকে ধূপের মতো জ্বলে জ্বলে নি:শেষে শেষ হয়ে যেতে হয়।
             তবে বাড়ির পুরুষ মানুষটি পটল তুললে বেশ কিছু লোকদেখানো কাজকর্ম করা হয়ে থাকে। পাড়া মাথায় করা কান্নাকাটি করে জানান  দেওয়া মানে এরকম খেজুরগাছ আর মিলবে কোথায়? তারপর শ্রাদ্ধে ছাতা, লাঠি, সত্ রঞ্জি, লেপ তোষক, খাট বিছানা প্রদান করে দেখানো হয়, ওনাকে পরিবারের সবাই কীরকম ভালোবাসতেন। অথচ উদ্দিষ্ট ব্যক্তির নিজের ভোগে লাগেনা কিছুই, সবই জোটে পুরোহিতের কপালে।
             এই প্রসঙ্গে একটা মজার কৌতুক ঘটনায় শেষ করবো আজকের রম্যাখ্যান। এক বৃদ্ধ মৃত্যু শয্যায়। সারাজীবন সংসারের জন্য করেছেন প্রাণপাত। এহেন বৃদ্ধের মৃত্যুকালে  সাধ হলো, চিতলমাছ খাওয়ার। মানে ওই, " চিতলমাছের মুইঠা, গরমভাতে দুইটা।" কিন্তু তিনছেলের কেউই তাতে কর্নপাত করতে রাজী নয়। ছেলেরা চাইলেও তাদের খান্ডারনী বউরা স্বামীদের বেঁধে রেখেছেন শাড়ীর আঁচলে।
" বুড়োতো এমনিতেই মারা যাবেন। তা মরণ কালে এতো লোলা কেন? তাও আবার এতো মহার্ঘ্য মাছ!" শেষে বুড়ো বিনা চিতলভোগেই করলেন দেহত্যাগ। এবার মেছোভূতের ভয়ে শ্রাদ্ধের দিন তিন বউই তিনরকম চিতলমাছ রেঁধে হাজির। মুইঠা, কালিয়া, ভাজা বেড়ে --- " ও বাবা খাও খাও, রাগ কোরোনা। না খেলে যে হবে অমঙ্গল ,বিশেষ করে তোমার ছেলেদের। কী করবো বলো, ভুল হয়ে গেছে।"
           বলা বাহুল্য, পুরোহিতের উদর পূর্তি ছাড়া তখন আর কী হবার আছে। এই হল খেজুরগাছ থুড়ি পুরুষমানুষের অন্তিম ভবিতব্য।




বৈশাখের কবিতা/ছড়া 

কৃষ্ণকলি
অলকানন্দা দে

এই তো, এই তো প্রায় এসেই গেছি আমার অন্তঃশীলা অপেক্ষার তীরে!
আর একটু ধুলো উড়িয়ে চল মন!
ঐ যে দেখা যায় গাছে গাছে সবুজের স্রোত,
তার পাশে ঐ যে ভালোবাসা প্রান্তর জাগে সারা রাত্রি সারা দিন,
ওটাই তো ময়নাপাড়ার মাঠ!
ঐ আলোর বাগানেই তো থাকে  কবির ছলছলে কালো ভূমিকন্যা কৃষ্ণকলি!
যার অদেখায় এ মাঠের বুক কাঁপে আজও!
হাওয়ার ছোঁয়ায় আমরা এগিয়ে চলি চল।রোমাঞ্চ দোলে বুকে!
পায়ের নিচের লাল কাঁকর খিলখিল ক’রে ঠাট্টা ছড়ায় আমার অস্থির অবস্থার সুযোগে।কি দেখবো আমি আর একটু পরেই!
পিঠের পরে মুক্ত বেণী লোটা কৃষ্ণকলিকে?
দুদিকে দিগন্ত ছোঁয়া মাঠের বুকে অম্লান যে কুটির দেখি, কৃষ্ণকলি কি করে এখন সেখানে?
একটি লাজুক পাখি গাইছে শুনি এক ফুলপাগল গাছের শাখে।
এই নিটোল নিস্তব্ধতায় সে কী অমিয় মধুর  বার্তা দেয় অতিথি আসার?
কঠিন প্রহেলিকা বুঝেও বুঝি না যেন!
বাতাসের স্পর্শে পাই আর্দ্র কোমলতা।
এ বাতাস নির্ঘাত কৃষ্ণকলিকে ছুঁয়ে এসেছে, না হলে এত সুগন্ধি কেন সে!
আকাশটা বড় হয়ে ছড়াতে ছড়াতে স্বাগত জানায়!
সত্যি মন, কৃষ্ণকলির দেশে কত আয়োজনে ক্লান্তপদ আতিথ্য-প্রত্যাশী কোন পর্যটকের হয় অভিবাদন দেখো তুমি!
ধুয়ে মুছে দেয় যত সত্তার ক্ষত!
শুভ্র সন্তোষের ভাষা খুঁজে আনে হৃদয়ের আহ্লাদ!
কিন্তু এতটুকু পথ পেরোতে এত সময় লাগে যে কেন আমার কে জানে!
কিছু কি ভুল চুক হল? না না তা কেন হবে।আমি জানি এটাই সঠিক পথ।
আসলে বশে আনতে পারছি না উৎসাহে আবৃত মনকে।
স্পন্দিত হচ্ছে এক অচেনা হৃদয়, সেই মেয়ের টানে!
কালো হরিণ-চোখের ইন্দ্রজালের কথা তো জেনেছি কবির গানে কত!
দীর্ঘ প্রতীক্ষায় সেই দারুণ স্ফটিক আভা কি গান,কি সুর,কি নিষ্কম্প আলোর মাধুরী ছড়াবে যার মায়ায় পরাজিত হবে পৃথিবী দেখব তাই!
যুগল ভুরু কি আজও ছড়ায় কালো মেঘের ঘটা আকাশ- মনে?
এই অর্ধবৃত্তাকার মেঠো পথে তার শ্যামল গাই কি ফেরে বাঁধনহারা আজও?
রুদ্ধশ্বাস এইসব জিজ্ঞাসার দুরু দুরু চলছে শুধু বুকে।
আচ্ছা, এত উতলা কেন হয়ে চলেছি?
এভাবে কেন ভাবছি হবহু দেখবো সবটা!
দূর তেপান্তরে ফেলে আসা কবির কৃষ্ণকলির কি স্ব-ছন্দে বাড়ে নি বয়স?
পৃথিবীর নিয়ম বিরুদ্ধ হয়ে সে কি করে ছটফটে আয়ুকে বেঁধে রাখবে সময়ের পাটাতনে?
তবে কি শিকারী সময়ের কারসাজিতে ক্ষয়ে গেছে তার সেই রূপ!
অনেক পুরোনো এক পৃথিবীর নারী সে?
নাকি স্নিগ্ধ লঘু যৌবন প্রান্তে আজও দাঁড়িয়ে আছে অবিকল, কবির সৃষ্টির যাদু গুনে!

তখন হঠাৎ বুঝি, আমি কাকে খুঁজতে চলেছি মানবচক্ষে! সে যে কেবল মানসনেত্রের মাধুরী!
ওগো কৃষ্ণকলি! তুমি যে সেই কল্যাণী মায়া যাকে টেনে আনা যায় না দৃষ্টির দরবারে!
যাকে শুধু বেঁধে রাখা যায় অনুভবের আঁচলে এই কোমল অন্তর ভুবন তীরে!
তুমি তো দু-চোখ বিভোর করা সেই প্রেম কবির, যে শুধু আরাম দেয় মনকে মধুর দুপুরে শীতলপাটিতে ক্ষণ-বিশ্রাম সম!
তুমি আষাঢ়ের বনজ্যোৎস্না! শ্রাবণের আকুল করা প্রেমের নির্ঝর!
তুমি এক ও অবিকল্প থাকবে নিঃসন্দেহে!
যুগে যুগে মানুষ এসে চিনে নেবে তোমাকে আত্মার গহিনে!
সময় যতই ধাবিত হোক,
তবুও কবির প্রেমের বয়স বাড়ে না যে!



যাওয়া আসা 
সৈকত দাম


তুমি লাল শাড়ি পড়ে এসো অশনি সংকেতের মতো .....
তুমি বাঁশদ্রাণী হয়ে এসো কোপাই এর ক্ষত .....

ধূ ধূ  প্রান্তর জুড়ে তুমি আর আমি ,
প্রেম প্রেম বেঁচে থাকা ....
বাঁশের কলমদানিতে শুধু একটি গোলাপ রাখা ....
শনিবারের মগরা হাঁটে তুমিই " বৃষ্টিলেখা " ....

কালকের ঝড়ে উড়ে গেছে সব ,
উড়ে গেছে লাল টিপ .....
উড়ন্ত আগুনের কাছে বিছানা বালিশ আছে ,
তুমি শুধু নিয়ে এসো মাছ ধরা ছিপ .....

তুমি কাচের চুড়ি পরে এসো , কৃষ্ণচূড়ার মতো .....
বেজে ওঠে চন্দ্র রাতে সাঁওতালি বাঁশি যতো .....

তুমি বৈশাখী ধুলোয় পায়ের ছাপ ফেলে এসো ,
স্মৃতি বিজড়িতো সেই ছাপ মুছে গেলে যাবে ....
বেলা শেষে তুমি তো আমারই হবে ....

তুমি তাকিয়ে থেকো আমার দিকে ,
আমি তাকিয়ে দেখি বিচ্ছুরণ ....
খোলা চুলের ফাঁকে দেদীপ্যমান ভালোবাসা .....
খুঁজে ফেরে খুব জাগতিক কোনো নিভৃত বাসা ....

তুমি ঠোঁটে লাল মেখে এসো পুরনো সেতু ধারে ,
আমি ঝড় এঁকে দেবো আজ অগোচরে ....


তুমি লাল শাড়ি পড়ে এসো ,
অশনি সংকেতের মতো ...
তুমি বাঁশেদ্রাণী হয়ে এসো কোপাই এর ক্ষত .....



আশার বছর
 বনশ্রী মুখোপাধ্যায়

নতুন বছর ,নতুন দিন
 উঠল বেজে প্রাণের বীণ । 
মলিন প্রাণের বেদনা ভুলে 
নবীন-প্রবীণ মাতে সকলে। 
 নামালো তালা যে মহামারী 
ভুলবোনা তাকে খুব তাড়াতাড়ি। 
 এ যুদ্ধের সৈনিক যারা 
ফিরিয়ে খুশি হারিয়েছে তারা । 
খসে গেছে যত প্রাণ
 ভুলিনি মোরা সেই বলিদান। 
 ফুটলো আবার বকুল ,বেলী 
গাঁথলো মালা কচি হাতগুলি । 
বিকিয়ে মালা খাবেনা আম?
 ভাতের চালের সেটাইতো দাম!
পেলোব পায়ে ফুটেছে কাঁটা,
 মাইল পেরিয়ে চলছে হাঁটা । 
কাজ হারিয়েছে, আর নেই গুণ;
 জুটছে না তাই ভাত আর নুন । 
আম্ফান ঝড় উড়েছে ছাদ 
তাদের কাছে আসেনা চাঁদ। 
 স্কুল ছেড়েছে ,চালায় ভ্যান ,
অংক ভুলেছে, কাটছে ধান। 
 বিনুনি ,ফ্রকের বদলে শাড়ি ,
বউ হয়েছে মেয়ে তাড়াতাড়ি। 
 যতই পুড়ুক মায়ের মন -
পেট কমেছে ,নেই একজন । 
চাইনা দেখতে এসব ছবি -
নতুন বছরে এটাই দাবি। 
 ছোট ছোট সুখ বানাক বাসা ,
নববর্ষে এটাই আশা।।


আমায় নতুন পথচলা 
সারণ ভাদুড়ী

অলসতার কাঁচ আমি ভেঙে দিলাম
নতুন সূর্যোদয় হচ্ছে,
এই নতুন বছর, নতুন রাজপথ
শুধুই আমার।
আমি এখন অসহায়তাকে আর নিজের সম্বল করি না
পর পর লক্ষ্যের কাঠের মাঝে ,
আমি দৃঢ়তার পেরেক গেথেছি, 
সেই অস্ত্রই আমার সম্বল।
কুরকরে লুকিয়ে থাকার সময় এটা না,
নিজের আয়নার সামনে আমি নিজেই দাঁড়িয়ে আছি,
নববর্ষের রাজপথেই শুরু হলো আমার পথ চলা।।


 বৈশাখে
মজনু মিয়া 

কচিপাতার চিকচিকে রূপ বাতাস ফরফর করে
কচি আমের নাচন দেখি কাঠবিড়ালি ধরে। 
সনাতন ধর্মাবলম্বী পূজায় মেতে আছে
চরক গূঢ়ায় মেলা বসে উঁচু চরক গাছে।

মেলার রইরই হইহই ধ্বনি আনন্দ ক্ষণ হয়ে
বৈশাখী ঝড় কখনো বা আসে তুমুল হয়ে।
মহাজনের হিসাব নিকাশ হালখাতা হয় ঘরে
আশা বুকে নতুন বছর খুশিতে যেন্ ভরে।

সবুজ ধানের চারা খেতে মৃদু বাতাস দোলে
মন গগনে আশার তরী ভিড়ে আপন কূলে।  


মিশে থাকে তৃষা 
মনিরুজ্জামান প্রমউখ 

কচিপাতার শিশির ভেজায় 
ভিজে যায় কবিতা 
মাসিকের দুই গ্রাম ভোর দিয়ে 
শুরু হয় সন্ধ্যা।  

রাতের নিরব পরবাসে 
আমরা পূণরায় একা 
বিজ্ঞাপনের অক্ষরে অক্ষরে  
মিশে থাকে তৃষা।  

আগুন ঝরা ঋতুবাসে 
মিলন মোহনার অভিলাষা 
প্রকাশের ঘরে দেহবাদে 
নামের শিলালিপি আঁকা।  
 


বৈশাখের ছবি 

অদ্রিজা  বোস   


     
মুজনাই অনলাইন বৈশাখ ১৪২৯ সংখ্যা