ডেলিভারি বয়
মৌসুমী চৌধুরী
আজ একটু তাড়াতাড়িই কোর্ট থেকে ফিরে এসেছে রাই। খুব ইম্পর্টেন্ট একটা কেসের হিয়ারিং ছিল ফার্স্ট আওয়ারে। সকাল দশটা থেকে বেলা প্রায় একটা পর্যন্ত হিয়ারিং চলেছে। শেষ হয়ে যেতেই বেশ টায়ার্ড লাগছিল রাইয়ের। কেসটা নিয়ে একমাস ধরে খুব পড়াশোনা করতে হয়েছে। খাটতে হয়েছে। মাথাটা বেশ ধরেছিল। বলাইদাকে এককাপ কফি দিতে বলে ফাইলপত্র গোটানো শুরু করেছিল সে। সকাল থেকেই গাঢ় ছাইরঙা আঁচলে মুখ ঢেকে ছিল আকাশটা। আর মাঝে মাঝে টিপ টিপ সুরও সাধছিল সে গোমড়া- মুখী। তাই আলিপুর কোর্ট চত্তর থেকে গাড়িটাকে বের করবার আগেই ঝমঝম করে তুমুল বৃষ্টি নেমে যায়। গাড়িটা লালবাতি হয়ে এগিয়ে গিয়ে মাঝের হাট ব্রিজ ক্রস করে বেহালার দিকে আসতেই চোখে পড়ে মিনিট চল্লিশের তুমুল বৃষ্টিতেই ততক্ষণে চারদিকে জল জমতে শুরু করেছে। তাদের আবাসনের সামনেও বেশ জল জমেছে। গাড়িটা গ্যারেজে রেখে আসতে আসতে বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছিল রাই। ঘরে ঢুকেই সোজা বাথরুমে। হালকা উষ্ণ জলে স্নান করবার পর খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। আর তখনই মনেপড়ে আজ ঘরে কোন রান্না নেই। সকালে কাজে আসেনি মালতীদি। দুপুরে বলাইদাকে দিয়ে একটা ধোসা আনিয়ে কোর্টেই লাঞ্চ সেরেছে। আর এখন তো এই বৃষ্টিঝরা বিকেলে মালতীদি আসবার কোন সম্ভাবনাই নেই। অগত্যা এক কাপ কফি বানিয়ে, চানাচুর আর আচারের তেল দিয়ে এক বাটি মুড়ি মেখে নিয়ে জানালার ধরে এসে বসে রাই।
" আওগে যব তুম ও সাজনা /আঙ্গনা ফুল খিলেঙ্গে ..." — মিউজিক সিস্টেমে খুব লো ভলিউমে প্রিয় গানটা চালিয়েছে। সেই কলেজ জীবন থেকে এটা রাইয়ের প্রিয় গান। বাইরে এখনও তুমুল বৃষ্টি চলছে। যেন আকাশ একেবারে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। জালানা -র কাঁচে চলছে বৃষ্টির উদ্দাম নাচন। সামনের রাস্তা-ঘাট-দোকানপাট সব ঘোলাটে লাগছে। ঠিকমতো ঠাওর হচ্ছে না কিছু। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাই দেখল ঘড়িতে বিকেল তিনটে বাজে। তিনটেতেই চারদিকে যেন রাত ঘনিয়ে এসেছে। জ্বলে উঠেছে স্ট্রীট -লাইট। খুব কাছেই কোথাও বোধহয় কড়াৎ কড়াৎ করে বাজ পড়ল। দু'ঘন্টার তুমুল বৃষ্টিতে ড্রেন উপচে চারদিক একেবারে জলে ডুবে গেছে। আজ খুব খিঁচুড়ি আর মাছভাজা খেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে রাইয়ের। মা চলে যাওয়ার পর বৃষ্টি দিনের এই মেনু প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। ছোটবেলায় জলপাইগুড়িতে বৃষ্টি মানেই ছিল অন্তত টানা সাতদিনের প্রোগ্রাম। তাদের টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝমাঝম আওয়াজ উঠত। আর বৃষ্টি হলেই মা মুসুর ডালের খিঁচু্রি রাঁধতেন, সঙ্গে থাকত কড়কড়ে আলু ভাজা, পাঁপড় ভাজা, পিঁয়াজি ইতাদি। কখনও-সখনও থাকত মাছভাজা বা ডিমভাজা। ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির থালা ঘিরে হাপুসহুপুস আনন্দ করে খেত তারা ভাইবোনেরা।
ধীরে ধীরে খুঁজে জোমাটোতে অর্ডার করল রাই । "ষোলোআনা বাঙালিয়ানা"-র সবজি- খিঁচুড়ি, আলুভাজা, পাঁপড় ভাজা, রুইমাছ- ভাজা। কিছুক্ষণ পর "ষোলআনা বাঙালিয়ানা" থেকে ফোন এল,
— " ম্যাডাম, এই বৃষ্টিতে আপনার ওয়ার্ডের সব রাস্তাঘাট তো জলে ডুবে গেছে। ডেলিভারি হবে কিনা এখুনি বলা যাচ্ছে না। স্টাফ কম। আর ডেলিভারি চার্জ কিন্তু অন্যদিনের চেয়ে বেশি লাগবে।"
ওদের সম্মতি জানিয়ে কফির কাপে চুমুক দিল রাই। আর মনে মনে ভাবল জোম্যাটো অর্ডারটা ক্যানসেল করলেও আজ নিজেই যেমন পারে খিঁচুড়ি রান্না করে খাবে।
"...বরষেগা শাওয়ান, বরষেগা শাওয়ান / ঝুম ঝুম কে/ দো দিল এ্যায়সে মিলেঙ্গে..."
বড় গভীরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে মিউজিক সিস্টেমে বেজে চলেছে গানটি। আষাঢ়ে বৃষ্টির এই গভীর বিকেল, এই উতল বর্ষা, গানের কলির এই জল আঁচড় রাইকে কেমন যেন বিহ্বল করে তুলছে!
— "রূপমায়াতে 'যব উই মেট' এসেছে। যাবি দেখতে?"
— "এই বৃষ্টিতে সিনেমায়? মাথা খারাপ! "
— " চল না আজ তো ক্লাসও তেমন হবে না। সকাল থেকেই যা নেমেছে। আকাশ যেন ফুটো হয়ে গেছে।
বিমর্ষ গলায় বলেছিল রাই। রাইয়ের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল জিষ্ণু, প্রিয়া, স্বপন, রুমকিরাও।
জলপাইগুড়ি ল-কলেজে পড়তে গিয়ে প্রথমদিন থেকেই মুখচোরা অমলের সঙ্গেই কেন যে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল, তা জানে না রাই। আশেপাশের কোন একটা চা-বাগান থেকে পড়তে এসেছিল সে। তার বাবা ছিলেন চা বাগানের ফ্যাক্ট্রির লেবার। খুব কষ্ট করেই তাকে পড়াতেন তার বাবা। তাদের বাগানের শ্রমিক বস্তির কেউ পড়াশোনা তেমন চালিয়ে যেতে পারত না। অমল পড়ায় খুব মনোযোগী ছিল বলে চেয়েচিন্তে টাকা পয়সা জোগাড় করে তার বাবা তাকে জলপাইগুড়ি ল কলেজে ভর্তি করেছিলেন। আর পড়াশোনায় ভালো ছিল বলেই রাইয়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। রাই কলেজে না গেলে অমল তাকে নোট লিখে দিত। তার মুক্তোর মতো ঝকঝকে হাতের লেখা আজও চোখে ভাসে রাইয়ের।
— " আমার পয়সা নেই রে। তোরা যা।"
সরল গলায় উত্তর দিয়েছিল অমল।
— " তোর টিকিটের দাম আমিই দেব। তুই চল তো।"
গাঢ় স্বরে বলেছিল প্রিয়া। হৈ হৈ করে উঠেছিল
অন্যেরাও,
— " যেতেই হবে তোকে..."
সেদিন সিনেমা হলে লোক খুব কমই ছিল। দু'টো-রো জুড়ে একসঙ্গে বসেছিল রাইদের বন্ধুদলটা। রাই লক্ষ করল তার ঠিক পাশেই এসে বসেছে অমল। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি নেমেছিল। সিনেমা হলের টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ, সিনেমার পর্দায় রোমান্টিক দৃশ্য সেদিন যেন যেন চারিয়ে গিয়েছিল দুই কিশোর-কিশোরীর মনেও৷ কখন যে অমলের হাত উঠে এসেছিল রাইয়ের হাতের উপর দু'জনের কারও খেয়াল নেই। ইন্টারভেলে লাইট জ্বলে উঠলে লজ্জা পেয়ে হাত সরিয়ে নেয় দু'জনেই। সেদিন ফেরার পথে বৃষ্টিটা একটু ধরেছিল। নিঃশব্দে রাইয়ের পাশে হাঁটতে হাঁটতে পাড়ার গলির মুখ পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিয়েছিল অমল।
রাইয়ের ফোনটি হঠাৎ সুরেলা ঝংকারে জানান দিলে বর্তমানে আছড়ে পড়ল সে।
— " হ্যালো ম্যাডাম। আপনার খিঁচুড়ি ডেলিভারি হয়ে যাবে আটটার মধ্যে। কিন্তু ডেলিভারি চার্জ কিন্তু একটু বেশিই লাগবে। এই দুর্যোগে ডেলিভারি বয়রা কেউ যেতেই চাইছিল না। বহু কষ্টে আমাদের হোটেলের একজন স্টাফ রাজি হয়েছেন।"
— " ঠিক আছে। পাঠান। আমি এক্সট্রা ডেলিভারি চার্জটা পে করে দিচ্ছি।"
ফোন রেখে জানালার বাইরে তাকিয়ে রাই দেখে পথ-ঘাট, বাড়ি-ঘর, দোকানপাট সব কেমন বাঁধনহারা বৃষ্টির সাদা আদর মেখে যেন গলে গলে জল হয়ে ঝরে যাচ্ছে ! রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো অকাতরে মাথা নীচু করে ভিজছে অপরাধীর মতো। এই রূপোরঙা বৃষ্টির সঙ্গে কোনভাবে তাদের ছোটবেলাকার জলপাইগুড়ির সেই বৃষ্টির কি কোন আত্মীয়তা আছে? হারিয়ে যাওয়া মুখেরা জলপাইগুড়ি থেকে ভেসে ভেসে কেন এসে মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে?
তারা নিজেরা পরস্পরকে মুখ ফুটে কোনদিন কিছু বলেনি। কিন্তু রাই জানত Somebody is there — ঝকঝকে হাতের লেখায় নোট লিখে দিতে। কঠিন বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতে। লক্ষ্য করত অমলের নীরব চোখের পাতায় জেগে আছে হাজার কথার সুনামী ঢেউ আর বিষন্ন মেঘ।
সময়টা ছিল কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি। প্রায় সপ্তাহ খানেক অমলের কোন দেখা নেই। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছিল রাই। তার মেসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারল বাড়িতে গেছে সে। বাড়ি থেকে যেদিন ফিরে এল অমলের চুল উসকো খুসকো, চোখ লাল, মুখে না কামানো খোঁচ খোঁচা দাড়ি,
— " আমি আর পড়াটা চালাতে পারব না রে, রাই। কলেজ ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের বাগান লক-আউট হয়ে গেছে। বাবার চাকরিটা আর নেই। বাবা আমাকে আর পড়াতে পারবেন না। আমি কালই চলে যাব ব্যাঙ্গালোরে। একটা হোটেলে কাজ পেয়েছি। ভাইবোনেরা সব ছোট ছোট সংসারের হালটা আমাকেই ধরতে হবে রে।"
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে রাই। গাল বেয়ে জল নামতে থাকে। তারপর আর কখনও, আর কোনদিনও অমলের সঙ্গে দেখা হয়নি তার। ল পাশ করবার পর জলপাইগুড়ি কোর্টে সে প্রাকটিস করত কিছুদিন। অরিণের সঙ্গে বিয়ে হতে কলকাতায় চলে এসেছিল। আলিপুর কোর্টে প্রাকটিস শুরু করেছিল তখন থেকেই। কিন্তু তার নিজের জীবনের গতিটাও ঠিকঠাক খাতে বইল না। বিয়ের পর পরই একদিন রাই জানতে পারে অরিণ বহুদিন থেকে অন্য একটি সম্পর্কে জড়িত। তার প্রেমিকা ডিভোর্স না পাওয়ায় বিয়ে করতে পারেনি তারা। বিয়ের পরও সেই সম্পর্কে থাকতে চায় সে। অরিণের নিজের মুখে এ রকম স্বীকারোক্তি শুনে একদিনও আর সে বাড়িতে থাকেনি রাই, মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল। বাবা চলে যাওয়ার পর মাও ততদিনে জলপাইগুড়ি ছেড়ে কলকাতায়। গত বছর তো মাও চলে গেলেন। এখন কলকাতায় মায়ের এই ফ্ল্যাটে রাই একাই থাকে।
ফোনের রিংটোনে চমক ভাঙে রাইয়ের। ডেলিভারি বয়ের কল। কল রিসিভ করে রাই বলে,
— " আসুন। থার্ড ফ্লোর, অ্যাপার্টমেন্ট ৪/২।"
কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দেয় রাই। দেখে ছেলেটি একদম কাকভেজা ভিজে গেছে। পরনে নীল জীনসের প্যান্ট আর হলদে টি-শার্ট। ইস! তাকে খাওয়ানোর জন্য একজন লোক এই ভারী বৃষ্টির মধ্যে এত কষ্ট করে খাবার নিয়ে এসেছে! ভাবতেই নিজেকে বড় অপরাধী লাগে। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়।
খাবারটা নিতে গিয়ে এক লহমায় ডেলিভারি বয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে ওঠে রাই! চিনতে একটুও ভুল হয় না ... অমল!!!
বাইরে তখন নিচ্ছিদ্র ধারাপাত! মিউজিক সিস্টেমে বাজছে — "...বরষেগা শাওয়ান, বরষেগা শাওয়ান / ঝুম ঝুম কে/ দো দিল এ্যায়সে মিলেঙ্গে..."। ঘরের মধ্যে খেলে যেতে থাকে "রূপমায়া " সিনেমাহলের সেই আধো অন্ধকার!
বহুদিন পরে বিহ্বল চোখে পরস্পরকে দেখতে থাকে অমল আর রাই!
ঈশ্বরের বিচার
কাকলি ব্যানার্জী মোদক
কথা ছিল ভালো থাকবো.......
কথা ছিলো ভালো রাখবো......
কথা ছিল ভালোবাসবো......
নন্দনের চত্বরে দাঁড়িয়ে আমি, শ্রাবনের ধারা আজ বাঁধ মানছে না,ছাতা থেকে উপচে পড়া জলধারা বেনী স্পর্শ করে, আঁচল ছুঁয়ে মাটিতে মিশছে। ঝড়ের গতিতে চলে যাচ্ছে বাধা না মানা গাড়ি গুলো, তাদের তীব্র আলো আর চারিদিক অন্ধকার মিলেমিশেএকটা অদ্ভুতপরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে,পাশে কেউ দাঁড়ালে বোঝা মুশকিল, এই আলো আঁধারিতে। দাঁড়িয়ে থাকতে, থাকতে অন্য জগতে ভেসে যাচ্ছি আমি, অবশ্য এটা আমার একটা রোগ, মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতি কে হাতরাই। আজ শনিবার একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছি বৃষ্টির দিন বলে, ব্যাগটাকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ একটা পুরুষ কন্ঠস্বর এসকিউসমি একটু রাস্তাটা পা করে দেবেন, বুকের মধ্যে হাতুড়ির মতন যেন কে একঘা দিলো, মনে হলো কন্ঠস্বর যেন খুব পরিচিত, নিজের মনেই হেসে উঠলাম।সবসময় হাতড়ে বেড়াই আমার উজান কে, ছাতাটা হেলিয়ে দিলাম যতটা সম্ভব। মুখ ঢাকা দেয়া আমার একটা অভ্যেস। বাসে, ট্রামে উঠলে আমাকে সবাই করুনার চোখে দেখে, ছোট ছেলে ,মেয়েরা ভয়ে মায়ের আঁচলে মুখ ঢাকে, আজকাল কেউ করুনার চোখে দেখালে মনে মনে খুব রাগ হয়, এটা তো হবার কথা ছিল না, তবে কেন? কেন প্রশ্ন জাগে বারবার?
সেদিন ও ছিল এমন ই বর্ষার রাত, গাঁয়ের মেঠো পথ, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, পথ সংকুল ঝোড়ো হাওয়ায় দুধারের গাছ মাটি স্পর্শ করছে,আমার বুকে ধরা রবীন্দ্রনাথ, আর কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, আলো আঁধারির রাস্তা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ভয়ে -আতঙ্কে দ্রুত গতিতে চলছিলাম। হঠাৎ অনুভব করলাম তরল পদার্থ মুখ স্পর্শ করে শরীর ছুঁয়ে নেমে যাচ্ছে ফুটন্ত লাভার মতন। আমার চিৎকারে পাশের লতাপাতা,বাঁশবন কেঁপে উঠছিল। গগনভেদি চিৎকারে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম, পরিচিত একটি কন্ঠস্বর কানে এলো "খুব অহংকার তোর, এবার সারাজীবন ভোগ কর।"
যখন জ্ঞান এলো কোলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অ্যসিডে ঝলসে গেছে আমার মুখের ডান অংশ। ধীরে ধীরে সুস্থ হলাম বুঝতে পারলাম কিশোরীর স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। দ্বীপের-শিখাটা নিজের অজান্তেই নিভে গেলো। প্রশ্ন জেগেছিল মনে বারবার কেন কেন উজান
এই কাজ করলো?
ইদানিং বাউন্ডুলে উজানের আমার রূপ নিয়ে ওর সন্দেহের দানা দিনে, দিনে ক্রোধে পরিনত হতে থাকে। নামি কলেজে র ছাত্রী দ্বীপশিখা ওর কাছে ঈর্ষার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেনে নিতে পারিনি আমার অবাধ বিচরণ। হয়তো তাই এই পরিনতি। আবার ওই ভদ্রলোকের কন্ঠস্বরে তাকালাম এবার আর চিন্তে দেরি হলোনা, এই সেই উজান যে আমার জীবনটা এক লহমায় অন্ধকার জগতে ঠেলে দিয়েছিল, রাগে প্রতি হিংসায় সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল ,মনে হচ্ছিল চলন্ত বাসের সামনে ঠেলে দি, এই আলো আঁধারিতে কেউ, কেউ আমাকে চিন্তে পারবেনা প্রতিশোধ নেয়ার এই সুবর্ণ সুযোগ। হাত বাড়াতে গিয়ে দৃষ্টি পড়ল তার চোখের উপর-- এই আলো, আঁধারিতে ঘন সন্ধ্যায় কালো কাঁচ ঢাকা তার দুটি চোখ ,হাতে অন্ধ লাঠি। শুনেছিলাম ছোঁড়া অ্যসিডে দুই এক ফোঁটা তার চোখেতে পড়েছিল। ঠাকুর কে জানালাম, ঈশ্বর তুমি করুণাময়ী, ডান হাতটা চেপে ধরে নিশ্চিহ্ন পৌঁছে দিলাম উজানের গন্তব্যস্থলে।। বাস ধরার জন্য।
বর্ষা কবিতা
বৃষ্টি ছায়ার ভেতর
সৈকত দাম
একটু একটু করে সরে যাচ্ছে মৌসুমী ....
ভেতরের বৃষ্টি টা ধরে আসছে ক্রমশ .....
শুকোতে দেওয়া অনুভূতি গুলো ,
আরও খানিকটা শুকিয়ে এলো .....
আমিও তুলে রাখলাম ঘরের এক কোণে ,
তারপর আমার বৃষ্টি শরীর এলিয়ে দেই ভেজা কাঠের মতো ....
যেন জীবিত নেই আর .....
একদিন যে বৃষ্টি নেমে এসেছিলো হিরন্যগর্ভের দেওয়াল বেঁয়ে ....
একদিন যে বৃষ্টির নাম দিয়েছিলাম নিরুপমা ....
একদিন যে বৃষ্টি নায়িকার মতো নেমে এসেছিলো বুকের লোকেশনে .....
আজ সে আলোর গন্ধ পেলে প্রহর গোনে .....
আমার সাথে শুয়ে আছে শেষ বৃষ্টি কণা ....
তার মধ্যে শুয়ে আছে ক্ষণজন্মা পৃথিবী .....
আষাঢ়ের পরে শ্রাবণের শেষে
এমন করেই পৃথিবী ক্ষণ জন্মা হয় ,
হয়তো সবার নয় .....
কে কতো বৃষ্টি মেখেছিলো সেদিন ,
তা সন্নিবিষ্ট ধোয়াশাই বলে দেয় .....
আর তারপর সমস্ত অনাদি দৃশ্য ডুবে যায়
বৃষ্টি ছায়ার ভেতর .....
বর্ষালী গান
রীতা মোদক
একটা খোলা ছাদ
আর
একটা আকাশ ।
দুটোই মুক্ত
মাঝখানে বিশাল ব্যবধান ----
হঠাৎ আকাশের বুকে জমে ওঠে
বিষণ্ণতার কালো মেঘ।
মেঘের পাহাড় জমতে জমতে---
একসময় গর্জে ওঠে
আগুন জ্বলে গহীন আকাশে ।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে ---
ভিজে যায় ছাদ বাগান,
ভিজে যায় রুক্ষ মাটি ।
বৃষ্টি নামের মেয়েটি---
খোলা ছাদ আর আকাশের মাঝে
এখন বর্ষালি গান গায় ।
বৈতালিক সুর
অলকানন্দা দে
তখন আমার ছেঁড়া ঘুমের ভোর
পাহাড় আড়ে প্রেমিক মেঘের বাসা
বৃষ্টি এলো ভিতর ঘরে ছুটে
পাইন বনে ভিজছে ভালোবাসা!
নদীর মুখে নতুন বুলি ফোটে
পাতায় পাতায় কথা বলে জল
মেঘে মেঘে আত্মদানের কর্ম
ভোর-বরণে ফোঁটাই সম্বল!
মনের ভিতর আদরগুলো কাঁপে
বুকের উনুন দিচ্ছে সরল তাপ
উড়ে যাওয়া অসংযমী হাওয়া
বলে গেল প্রেমের দৈর্ঘ্য মাপ!
মাপতে গেলে বহর বাড়ে শুধু
ইচ্ছে ভেজে মেঘবৃষ্টির ভাঁজে
দিব্যি করে বলছি আমি শ্রাবণ
আবেশ ঋণে ঋণী তোমার কাছে!
লক্ষ লক্ষ দরাজ বারি বিন্দু
চা বাগানে তীর্থযাত্রী সব
প্রেম সাধনা দেখছি জানলা জুড়ে
আকাশ ভাঙা জলের বিপ্লব!
সে ও কবিতাঋতুপর্ণা রায় বর্মা
শেষ বিকেলের ছড়ানো রোদ চলে যায় যেই,
নিভু নিভু হয়ে আসে সন্ধ্যালোকের আলো যেই,
অতর্কিতে নেমে আসে বিষাদ মাখানো রাত।
বিরস দিনগুলিতে কাজে ও অকাজে
যেহেতু মুহূর্তের ফুরসত থাকেনা,
তাই রাতে বিশ্রাম নিতে চায় মগজের পাঠশালা।
অথচ তক্ষুণি উধাও হয়ে যায় রাজ্যের ঘুম,
আর তিমির রাতের গভীর মায়া!
অসাবধানতায় স্মৃতির ভয়াল অরণ্যে___
দু'চোখ চলে যায় যেই,
মানসিক দ্বন্দে,প্রহারের চিহ্নে
শুরু হয়ে যায় নির্নিমিখ প্রহরের ক্রন্দন।
আর স্তিমিত অবয়বে নেমে আসে
অশান্ত বিষণ্ণতার ছায়া!
এলোমেলো দীর্ঘশ্বাস আর অস্বস্তিতে__
অতীত সরণীর যাবতীয় ভিড় ঠেলে
দেয়ালে দেয়ালে নিজের নতুন রূপের ছায়া আঁকে,
শব্দে-ছন্দে নীরবতা ভাঙার স্পর্ধা দেখিয়ে
ভোরের রক্তিম আশা নিয়ে,
সুখের ডংকা বাজায় সে।
এভাবেই পীড়িত আকাশে
তারারা যত অস্পষ্ট হয়ে আসে__
অলস ব্যথাদের বুকে নিয়ে,
ভালোবাসাহীনতার নাছোড় জ্বরে
কবিতার কোলে নেতিয়ে পড়ে সে।
মেঘ বনেদি
দেবার্ঘ সেন
বিতানে আজ, কান্না মেঘে
ভরা আষাঢ়, টেনে নেবে
সহস্রতার, গুরু বায়না।
জুঁইয়ের গন্ধে, নি মন ধুয়ে
দেখাটুকু, আলগা হলে
ভালো থাকতে, মন চায়না।
আষাঢ় ভালো, এ জমকালো
মনের মধ্যে, জল ছেটালো
ভরসা পেলে, বর্ষা ভেদি।
ভুলবশত, মনের ক্ষত
বন্দী থেকে, শুকনো যত
তাদেরকে আজ, ছড়িয়ে দিই।
এক অন্য বর্ষা
সারণ ভাদুড়ী
আমি চাই বৃষ্টি পড়ুক,
আমি চাই এই বৃষ্টি মুছে দিক,
মানবিকতার ওপর সেই বর্বর অমানবিকতার চাদর।
নিঝুম শহরে নেমে আসুক এক অন্য বর্ষা,
যে বর্ষা নিয়ে আসে মানবিকতা,
নিয়ে আসে মানুষে মানুষে ভালোবাসা।
বৃষ্টির জল সেই সব গর্ত গুলো ভরে দিক,
সহানুভূতির জলে,
মুছে দিক সকল বিদ্বেষ।
আবার এই শহরেই নেমে আসুক
সেই বর্ষা,
যেখানে থাকবে শুধুই সারল্য।
টর্নেডোর ওই ঘূর্ণনের মত
থাকবে না কোনো জটিলতা।।
বর্ষা ছড়া
বর্ষাদিনে রীনা মজুমদার
বর্ষাদিনে বর্ষা ছিল সবুজ পাতায়
সুখ দুঃখের ছেলেবেলার খাতায়
নিভছে আগুন উনুনে ভেজা খড়ি
মায়ের ওমে ফুটছে ভাতের হাঁড়ি
এ ঘর ওঘর যেতে কোথায় ছিল ছাতা?
ছিল মাথায় মায়ের আঁচল পাতা
বর্ষা এলে যখন গ্রামের ছবি আঁকি
ইচ্ছেগুলো বুকের মাঝে রাখি
মেঘ বাতাসের কত কথা হয় যে বর্ষায়
কোন এক ছলে চাঁদের হাসি পড়ে আঙিনায়
তখন আমি মানস চোখে জলছবি আঁকি!
মায়ের হাতের প্রদীপখানির সেই যে ছায়া দেখি।
মেঘের খেয়ায় ভাসিমজনু মিয়া
আজকে আকাশ মেঘলা অতি দারুণ লাগে দেখে
চলো না যাই রঙ লাগিয়ে সাথে কাদা মেখে
তুমুল বেগে বৃষ্টি ঝরছে জল থইথই যে করে
অমুক সুখে খুশি খুশি মন বসে না ঘরে।
ঐ যে দূরে নদীর জলে খেয়া নায়ে চড়ে
ভাসি দুজন ভিজি দুজন আলিঙ্গনের ঘরে
মেঘের খেয়া সাজাই দেবে বৃষ্টি রানি এসে
পাশাপাশি বসবো দুজন আলতো একটু হেসে।
এই জনমে সাধ পূরবে না পূরবে বলো কবে?
আর জনম পেলে তখন ভাববো নতুন তবে
পড়ুক জলের ধারা মুষলধারে থেকো পাশে
বাঁচা মরা একসাথে যেন্ রবো তেমন আশে।
বৃষ্টির দিনেসুভাষ চন্দ্র রায়
আষাঢ় শ্রাবণ বর্ষাকালে,
ভিজছে পাখি গাছের ডালে।
ঝম ঝমা ঝম বৃষ্টি ধারা,
আয় না ভিজি পাগল পারা।
জল জমেছে ডোবায় মাঠে,
মাছ ধরতে বেলা কাটে।
সোনাব্যাঙ ফুলিয়ে গলা,
গানের গুঁতোয় কানে তালা!
বিদ্যালয়ে যাবার বেলা,
জল ছিটিয়ে করি খেলা।
ভেজা প্যান্ট ভেজা জামায়,
গুরুমশায় ধমক লাগায়।
ধমক খেয়ে বসে থাকি,
বাদলধারার ছবি আঁকি।
ফেরার পথে ক্ষেতের জলে,
জল ছিটানো আবার চলে।
দৌড়ে তাড়াই সোনাব্যাঙ,
লাফিয়ে পালায় লম্বা ঠ্যাং।
বান এলো বৃষ্টি এলো বিজন বেপারী
বান যে এলো বৃষ্টি নিয়ে
আকাশ কাঁপিয়ে,
বর্ষা জলে ভরলো নদী
দু'কূল ছাপিয়ে।
টইটম্বুরে নদী-খালে
কত মাছের খেলা!
দলে দলে ভেসে চলে
যত হাঁসের মেলা।
পূর্ণ গাঙের ঘোলা জলে
গ্রাম্য শিশুর দল,
কতনা খেলায় মেতে ওঠে
ফুর্তির কোলাহল।
ভরা জলে নাও ভাসিয়ে
চলে আলাপন,
সঙ্গী থাকে গরম গরম
সিংগারা লবণ।