শহুরে আলাপ
জয়িতা সরকার
ঠিক দিক বুঝতে পারছি না, পূর্ব না উত্তর, আরে দরজা তো উত্তরমুখীই ছিল, কেনার সময় তেমনটাই বলেছিল, তবে তো ডান হাতের দিকে পূর্ব। দিক তো আর ঘুরে যায়নি, সময়টা শুধু এগিয়েছে। কতটা এগিয়েছে বলতে পারিস? ঠিক যতটা এগোলে দিক বোঝা যায় না। ভোর হতেই হলের জানলা দিয়ে প্রথম নরম আলো বলত বিছানা ছাড়ার সময় হয়েছে, শহরের ঘুম ভেঙেছে। সেসব দিন কি হারিয়ে গেল? না না, হারায়শহুরে আলাপনি, চোখ বুঝলেই দিব্যি আসে।
নতুন দিনের প্রথম আলো, সেসব ভুলে যাওয়াই ভালো, কবিতা কিংবা গল্পের পাতায় ঠাই নিয়েছে ওসব ভোলো। এমনটা হলো কেন? ওই যে ওরা এলো দলে দলে, ভিড় জমাল তোমার বুকে। উফফ ভীমড়ি খাই রোজ দিনে দুপুরে। অপেক্ষা করো আরও অনেক আছে বাকি, যেমন করে দিয়েছ ফাঁকি, সবটার হিসেব রেখেছে নাকি?
হো হো স্বরে হাসছে কারা? ওই ইমারতের দখলি যারা। থামাও এবার রসিকতা, বলো তোমার শহুরে কথা।
এলাম নতুন দেশে, রাত নামলেও রাস্তাঘাটে যেন দীপাবলি, হুমম, প্রথম যখন প্লেনটা রানওয়ে ছুঁল এমন চকচকে জায়গা আমার তল্লাটে ছিল না, আরে এয়ারপোর্ট এমনই হয়, সে যা হোক, আমার মত সাদাসিধে মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা একটা ছেলে মেয়েরা অবশ্যই অবাক হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুরু হল নতুন শহরে, নতুন জীবন। একটা ব্যস্ত শহর, যার সবটা নতুন আমার কাছে। ঘুম ভেঙে বাইরে যেতেই দেখছি, উল্টো দিকের বাড়ির সদর দরজায় সকাল সকাল কী সুন্দর আলপনা, বহু বছর আগে বিশাখাপত্তনম বেড়াতে গিয়ে এমনটা দেখেছিলাম, বুঝলাম এটা দক্ষিণের একটা প্রথা, আলপনার নকশার ধরনও অন্য। প্রথম সকালে আর তেমন পার্থক্য চোখে পড়েনি। তবে সময়ের গতিতে সকালে রুটি কিংবা লুচি বাঙালি কখন ইডলি দোসাতে অভ্যস্ত হয়ে গেল ধরতে পারিনি। ওই যস্মিন দেশে যদাচার।
তবে কি ভাবছেন, অন্য রাজ্যে বাসা বেঁধেছে বলে গুটিয়ে থাকবে বাঙালি, এসব ভুল ধারণা, দিব্যি গ্যাটের কড়ি খরচা করে বেশ উদ্যম - উদ্দীপনায় উদ্যান নগরীতে কোন এক কুড়ি তলায় হাজার স্কয়ার ফুটের মালিক হয়েছেন। নীচের দিকে বড্ড ধূলো, আলো বাতাস খেলে না, টপ ভিউটা বাড়ির কনিষ্ঠটির ভীষণ প্রিয়, তাই তো শেষমেশ ওর কথাই রইল। ই এম আই টা পড়ছে বেশি, তবুও কী এ শহরে নিজের বাড়ি, উফফ, মা বাবা তো আহ্লাদিত। ছেলে-মেয়ের মস্ত বাড়ি, ধমকে দিলাম হালকা করে, মা, এসব প্রচার বাড়াবাড়ি।
মস্ত বাড়ির পার্কিংটা কি থাকবে খালি? এমন গল্প এ শহরে মেলা ভারি। দু- চাকা, চার চাকা মিলে বেশ রয়েছে, নেই কোন মারামারি। কি ভাবছেন দিব্যি সবাই বেড়িয়ে পড়ি, এমন স্বপ্ন চক্ষু জুড়ি। তবে এবার পথের গল্পে ফিরি।
মানুষ-গাড়ি-রাস্তা একটা ঘিঞ্জি ব্যাপার। মূল শহর ছাড়িয়ে অফিস বাড়ি সব ছড়িয়ে পড়েছে এদিক ওদিক, যাতায়াতের জন্য বাস কিংবা নিজস্ব গাড়ি, ক্যাবের দাপট আছে স্বমহিমায়। মেট্রো নতুন সংযোজন। তবে নিজের গাড়িতেই ভরসা রাখছেন মানুষ। আর তাতেই বিপত্তি, বাড়ি থেকে গন্তব্যের দূরত্ব ১০ কিলোমিটার, কিন্তু হাতে দেড় ঘন্টা সময় নিয়ে বের হওয়া বাঞ্ছনীয়। ট্রাফিকের বেড়াজালে নাভিশ্বাস ওঠে। না না এখানেই ক্ষান্ত নয়, রাস্তাঘাট জবাব দিয়েছে। এত পেষাই এর চাপ সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। নিজের বুকে গর্ত করে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মানুষকে ফেলেছে বিপাকে। বৃষ্টি হলে রাস্তা- পুকুর সমনাম, চেনা পথ না হলে গভীরতা মাপা দুঃসাধ্য। আর বৃষ্টিহীন হলে তো বিনা বাতাসে ধূলোর ঝড়। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।
সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়া - বর্হিবিশ্বের বড় বড় এম এন সি র এদেশীয় প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু এ শহরের প্রাণ হাসফাস করছে। মূল শহরের কাছাকাছি নেই কোন নদী। শহর তৈরির প্রাথমিক উপকরণের ব্যবস্থা করতে জন্মলগ্নে কাটা হয়েছিল লেক। কায়- কলেবরে বড় হতে শুরু করতেই কোপ পড়ল ওই লেকেই। বুজিয়ে তৈরি হল ইমারত, প্রকৃতিও হিসেব নিকেশ করে বুঝিয়ে দিচ্ছে জলকষ্ট কাকে বলে? টানা ২৪ ঘন্টা জল ছাড়া থাকার অভ্যেসও মানুষ রপ্ত করে ফেলেছে। জলের জন্য হোটেল - শপিং মল কিংবা অফিসে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। তবুও চলছে সবটা, থামেনি কোন অট্টালিকা বানানোর কাজ কিংবা কোন নতুন টেক পার্ক। আসলে থামালে অনেক কিছু থমকে যাবে। তবুও মনে প্রশ্ন জাগে এই অগ্রগতি কি আর কোন শহরে ছড়িয়ে দেওয়া যেত না?
সব কিছুতেই একটা বেপরোয়া লাগামহীন প্রতিযোগিতা। বাড়ির ছোট সদস্যের জন্য বরাদ্দ সব থেকে বেশি। সেটাই যদিও স্বাভাবিক, তাকে গড়ে তোলার সময় এখন। কিন্তু স্কুল খরচ মাত্রা ছাড়িয়েছে। স্কুল এখানে ব্যবসার অন্যতম ভিত্তি। ঝা চকচকে ক্যাম্পাস, বাতানুকূল বাস থেকে ক্লাসরুম, সপ্তাহে হরেকরকম ড্রেস, অপ্রয়োজনীয় রঙিন অনুষ্ঠান, সব মিলিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার বারো বছরের প্যাকেজ। এমনকি স্কুল দেখতে গেলেও গ্যাটের কড়ি খরচ করতে হবে। আর এসব কর্মকান্ডে আপনি আমি না চাইলেও সামিল হয়ে যাব, সবটা ভাল নিজের হবে এই মনোভাব নিয়ে গড়ে ওঠা মানুষের মন কেমন করে নিজের সন্তানকে এমন সাজানো পৃথিবী থেকে বঞ্চিত করতে পারে?
তবে কি এমন বিদেশিয়ানা চালচলন শেখা অন্যায়, এগিয়ে যাওয়া তো প্রয়োজন, অবশ্যই দরকার, কিন্তু সীমাহীন এক খরচের বহর নিয়ে হাঁপিয়ে যাওয়া ক্লান্ত পরিবারগুলো মাঝে মাঝেই ঘরোয়া আড্ডায় বলে ওঠে যদি নিজের শহরে ফেরার সুযোগ থাকত, এসব ভেবে আসরের সুর ভারি হয়, অসহায় অবসন্ন লাগে। কেন আসতে হল এত দূরে তা নিয়ে তর্ক বির্তক ওঠে, এমন আড্ডার নির্যাস নিয়ে নতুন সপ্তাহ শুরু করে এই শহর।
এখনও অনেকটা পথ চলা বাকি এই শহরের। শুরুর কথাই সত্যি হবে হলফ করে বলতে পারি। জানলা দিয়ে দেওয়াল ছাড়া কিছুই চোখে পড়বে না আগামীতে। সকালের সূর্য কেমন হয়, কিংবা বেলাশেষের আকাশ নতুবা বৃষ্টির পর রামধনুর দেখা পেতে ভিড় ঠেলে যেতে হবে শ'মাইল দূরে। তবুও এ শহরে বসন্ত আসে। গোলাপি আভায় রঙিন হয় অলিগলি থেকে রাজপথ। মূল শহরে আছে আভিজাত্যের ছোঁয়া, আছে টিপু সুলতান থেকে ওয়াদিয়ার বিজড়িত ইতিহাস। আর সবকিছুর উর্ধ্বে আছে লক্ষাধিক মানুষের অন্ন সংস্থান। আর সব জায়গায় মানিয়ে নিতে পারা বাঙালি পরবাসে নিজভূম বানিয়ে নেওয়ার দক্ষতায় পয়লা বৈশাখ থেকে বসন্ত উৎসব সবটা নিয়ে নিজেদের একটা পরিচয় বানিয়ে নিয়েছেন নিজস্ব দক্ষতায়। ডিম আলু সহযোগে বাঙালি বিরিয়ানির সঙ্গে কারি পাতা যোগে বিরিয়ানিও সমান তৃপ্তিতে উদরস্থ করার মত উদারতা আমরা আত্মস্থ করেছি অবলীলায়।