সম্পাদকের কথা
এ এক অদ্ভুত দগ্ধবেলা। দক্ষিণায়ণের সূর্যও আনতে পারে না এরকম দহন। ফুটিফাটা প্রকৃতিও জানে সময়ের নিদারুণ হস্তক্ষেপে কেটে যাবে ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকা ভূমিভাগ, সবুজে সবুজে ভরে যাবে চারদিক নবসৃজনের সৌন্দর্যে।
কিন্তু যে ফাটল ধরেছে আজ আমাদের মননে, ভাবনায় তা কি আর পূরণ হবে? এক সংকীর্ণ সময় দগ্ধ করছে আমাদের। চৈত্রের শুকনো পাতার মতই শুষ্ক ভাবনা গ্রাস করেছে বিবেক, ভ্রষ্ট করেছে বুদ্ধি। বড় অস্থির এই সময়। অশান্তির-সাম্প্রদায়িকতার-অন্ ধকারের যে বীজ আমরা বপন করছি নিজেদের মনে তাতে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে চৈত্রদিনের ঝকঝকে আলো।
ইতিহাস নির্মম। ক্ষমা করে না সে স্বয়ং নিজেকেও। আজ এই চৈত্রদিনে যদি না আমরা শপথ নিই এমন এক আগামীর, এমন এক নূতনের যেখানে কেবল মানুষ থাকবে, থাকবে না ধর্ম-বর্ণ-বিভেদ, ক্ষমা পাব না আমরা। মুখ ঢেকে যাবে লজ্জার তমসায় আগামী প্রজন্মের কাছে।
বর্ষশেষের এই দিনগুলিতে আমাদের নিয়তি রচনা করতে হবে আমাদেরকেই। নিতে হবে নূতনের শপথ।
তবেই সার্থক এই চৈতালি দিনে নতুনের স্বপ্ন।
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা-
আমন্ত্রিত- সুতপা রায়
আমন্ত্রিত- সুতপা রায়
কবিতা প্রথম পর্যায়- শ্যামলী সেনগুপ্ত, গৌতম বিশ্বাস, শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্তী, কুমকুম ঘোষ, রাহুল, অর্চিতা দাস, সুদীপ ব্যানার্জী, কণিকা দাস
মুক্তগদ্য- নবনীতা স্যান্যাল, শর্মিষ্ঠা সিমলাই, পিয়াংকী মুখার্জী
কবিতা দ্বিতীয় পর্যায়- নরেশ রায়, ঝর্ণা মুখার্জী, কাকলি ভদ্র, গায়েত্রী দেবনাথ, সুব্রত নন্দী, রাজীব রায়, মহুয়া মুখোপাধ্যায়, রীনা মজুমদার, মৌসুমী চৌধুরী, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, দীপশিখা চক্রবর্তী, গৌতমী ভট্টাচার্য, নিশীথ বরণ চৌধুরী, দেবযানী সিনহা, পায়েল কর্মকার, সুস্মিতা পাল কুন্ডু
গল্প প্রথম পর্যায়- বেলা দে, প্রলয় নাগ, সপ্তক, সোমা বোস, অমৃতা মৌয়ার
কবিতা তৃতীয় পর্যায়- রবীন সাহানা, সঞ্চিতা দাস, মজনু মিয়া, সুপ্রীতি বর্মন, দিনেশ বর্মন, দেবযানী (মিঠু) দাস, অতনু, সুকন্যা সামন্ত, স্বর্ণালী ঘোষ, সৈকত বণিক, বটু কৃষ্ণ হালদার
গল্প দ্বিতীয় পর্যায়- প্রীতম সাহা, চয়ন মোদক, মমিদুল মিঞা, পিনাকী
কবিতা অন্তিম পর্যায়- অনিমেষ সরকার, মলয় চক্রবর্তী, দেবব্রত সেন, মাম্পি রায়, অমিত দে, রাহুল ঘোষ, আবু আরশাদ আয়ুব, শুভদীপ পাপলু, শৌভিক কার্য্যী
অঙ্কন- পথিক সাহা, শুভঙ্কর চক্রবর্তী, অন্বেষা ভট্টাচার্য, হৃদ মেডো
ছবি- শৌভিক রায়
সম্পাদনা-বিন্যাস-অলঙ্করণ- শৌভিক রায়
প্রকাশনা- রীনা সাহা
আমন্ত্রিত লেখা
।।কথাকলির অন্দরমহল।।
সুতপা রায়
ভরতনাট্যমের বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীর অন্যতম চিত্তাকর্ষক শাখা ' কথাকলি' জনমানসে চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে প্রয়াস হয়েছে।ছড়িয়ে পরেছে তার উৎপত্তি স্থল কেরালা থেকে সারা ভারতে। ভগবানের নিজের দেশ কেরালাতে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে এই নৃত্যশৈলীর ইতিহাস জানা যাচ্ছে।ঐশ্বরিক মহিমা ও অবতারদের দুষ্টের দমনের বৃত্যান্ত সঙ্গীত, নৃত্য ও বাদ্যের মাধ্যমে জনগনের সামনে তুলে ধরাই কথাকলি শিল্পীদের উদ্দ্যেশ্য।
পঞ্চাশ বছর আগেও কেরালার গ্রামগঞ্জে এই নৃত্যানুষ্ঠান সন্ধ্যেবেলা শুরু হয়ে পরের দিন ভোর পর্যন্ত চলত। পশ্চিমবঙ্গের ( পূর্ববঙ্গেও) গ্রামে যেমন যাত্রাপালা চলত রাতভোর। কথাকলির সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দিক হলো রূপসজ্জা। চরিত্রগুলোকে অতিমানবিক চেহারায় উপস্থাপিত করার জন্য প্রতিটি চরিত্রের বিশিষ্টতা অনুযায়ী রূপসজ্জার শ্রেণীবিভাগ নির্দিষ্ট আছে ও রঙের আলাদা ব্যবহার দেখা যায়। যেমন দেবতা বা নায়ক চরিত্রের জন্য সবুজ ( পাচ্চা), খল বা দুষ্টু চরিত্রের জন্য কালো ( কাত্তি), সাত্বিক চরিত্রের জন্য হলুদ (তাড়ি), সাধু ও সন্ন্যাসীদের জন্য সাদা ( মিনক্কু)। কথাকলি র রূপসজ্জা এক জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একজন শিল্পীকে যথাযথ রূপ দান করার জন্য সজ্জাকারকে তিন থেকে চার ঘন্টা ব্যায় করতে হয়।শিল্পী শুয়ে থাকেন আর সজ্জাকার ক্যানভাসের উপর ছবি আঁকার মতো তাকে রূপদান করতে থাকেন। কথাকলির পোষাক ও সাজসজ্জাওখুব সময়সাপেক্ষ ও জটিল প্রক্রিয়া। একএকটি চরিত্রের পোষাকে প্রায় আশিটি গিঁট দেওয়া থাকে। এই জটিল রূপসজ্জা, অলঙ্কার, মুকুট ধারণ করেও শিল্পীরা যে অনায়াস দক্ষতায় মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করেন তা অসাধারণ শারীরিক ক্ষমতার পরিচায়ক। বোধয় এই কারণেই মহিলা শিল্পীদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় না। মহিলা চরিত্রে পুরুষরাই অংশগ্রহণ করে থাকেন। মহিলা শিল্পীদের পোষাক বাহুল্য বর্জিত ও সাধারণ। এই প্রসঙ্গে সবার অবগতির জন্য জানাই প্রখ্যাত গুরু গোবিন্দন কুট্টি তাঁর যুব বয়সে সুদূর কেরালা থেকে কলকাতায় এসে এই কথাকলি নৃত্যের প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। গুরুজী এই জটিল রূপসজ্জা ও পোষাকে প্রভূত সরলীকরণ করেন ও ফল স্বরূপ পূর্বভারতে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
একজন কথাকলি শিল্পীকে প্রায় সাত আট বছর কঠোর অনুশীলন ও শারীরিক সক্ষমতার কষ্টকর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।শিল্পীদের মঞ্চে কোনো কথা বা শব্দ করা নিষেধ কেবলমাত্র খল, রাক্ষস চরিত্রের চিৎকার করার অনুমতি আছে। শিল্পীদের রপ্ত করতে ৬৪ টি হস্তমুদ্রা, ৮ টি চক্ষু ভঙ্গিমা, ৯ টি চোখের মনির সঞ্চালন, ৭টি ভ্রূ ভঙ্গিমা ও ৯টি অক্ষিপল্লবের চলনভঙ্গি। সঙ্গীত ও বাদ্য কথাকলি নৃত্যের অবিচ্ছদ্য অঙ্গ। গায়ক বাদ্যকাররা শিল্পীর পিছনে মঞ্চেই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে সঙ্গত করেন।সারা রাত তাঁদের বসার নিয়ম নেই, এমনই কঠোর নিয়মে বাঁধা এই অনবদ্য শাস্ত্রীয় নৃত্য কথাকলি।
কবিতা প্রথম পর্যায়
দুপুর:এপিসোড ২ অথবা চৈতি রোদ
শ্যামলী সেনগুপ্ত
১
নিজস্ব বলতে দুপুরের বুক জুড়ে
একটা সোনা-বৌ
ঠোঁটের কালো থেকে
মধু গড়িয়ে যায় অপেক্ষা-পত্রে
দুপুর আরও গভীর
আরও তীব্র
আরও বিষাদ-বিধুর
২
উঠোন ছায়া গুটিয়ে নিলেই
বুঝি, দুপুর এলো
উঠোন জুড়ে হলুদ জল
আর মরীচিকার অবভাষ
নিজের ছায়ার ওপর পা রেখে
আলুথালু হই---
অজগর বাসনায় গিলতে থাকি ছায়া
৩
গাজন সন্ন্যাসীর আগুনে
আর কাঁটার ঝাপটে
চৈত্র রূপবতী হয়।
দুপুর চুল এলিয়ে দেয়
চড়ক গাছে---
৪
দুপুর বললেই
একটা আশ্চর্য শব্দ খেলা করে
পেতলের কলস ডুবিয়ে জল ভরবার
না - শীৎকারের ধা নি সা
সে সব কাঁটাছেঁড়ার আগেই
উড়ালের শব্দ ভর করে
ছায়াটির ছোট্ট শরীরে
চৈত্র ঝড় খুলে দেয়--- --- ----
বিকেলের বক
গৌতম বিশ্বাস
জ্যোৎস্না শুয়েছে, তার চৈতালি স্রোতের আখর
খুব একাকী অরণ্যানী কাছের শরীর
ওই পাশ ফেরে তার নরম শিকল
গায়ে বেঁধে বড়ো।
এই যে দিগন্তস্নেহ গালে আর গলানো মালায়
এই সব রেখে তার শুয়ে আছে কিনারাকালের
শুধু ছুঁয়ে থাকি শব। সেটাই নিয়ম
বাকি সব, তুমি, তার কিছু বিভ্রম
বিকেলের বক নিয়ে গেছে।
ঘা
শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্ত্তী
এই পথে হাসিখুশি গাছগুলোকে
এখন আর দেখি না
বট সাহস জুগিয়ে
সামনে এসে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতো যারা
একদা আতুরে
এতটা খোলামেলা ছিল না তখন পথটিও
পথ তখন ঝলমলে নদী ছিল এক
পথের উপর ছিল না কোন পাথরকুচি
জুতোর ভেতর সেঁধিয়ে যাবার আতঙ্কে
ছিল না দম বন্ধ শৃগালের ডাক
এই পথে এখন পূঁজ গন্ধের ঝাঁঝ
আর হুইস্কির তরলে মিলে মিশে
যত্রতত্র কিলবিল করে কিছু পচা অঙ্গাণু
এই পথে কোন সংবেদী আঁড়াল দেখি না
আসতে ইচ্ছে করে না তাই
পাশ কেটে যাবার বেলায় মাঝে মধ্যে
ইচ্ছে করে একমুখ থুথুতে
স্মৃতির ঘা-টাকে মেরে দিয়ে যাই
বছরে এক আধবার
মধ্যবিত্ত জোয়ারে বছর গড়িয়ে যায়
তবু এতটা নামতে পারি কই -
শ্যামলেন্দ্র চক্রবর্ত্তী
এই পথে হাসিখুশি গাছগুলোকে
এখন আর দেখি না
বট সাহস জুগিয়ে
সামনে এসে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতো যারা
একদা আতুরে
এতটা খোলামেলা ছিল না তখন পথটিও
পথ তখন ঝলমলে নদী ছিল এক
পথের উপর ছিল না কোন পাথরকুচি
জুতোর ভেতর সেঁধিয়ে যাবার আতঙ্কে
ছিল না দম বন্ধ শৃগালের ডাক
এই পথে এখন পূঁজ গন্ধের ঝাঁঝ
আর হুইস্কির তরলে মিলে মিশে
যত্রতত্র কিলবিল করে কিছু পচা অঙ্গাণু
এই পথে কোন সংবেদী আঁড়াল দেখি না
আসতে ইচ্ছে করে না তাই
পাশ কেটে যাবার বেলায় মাঝে মধ্যে
ইচ্ছে করে একমুখ থুথুতে
স্মৃতির ঘা-টাকে মেরে দিয়ে যাই
বছরে এক আধবার
মধ্যবিত্ত জোয়ারে বছর গড়িয়ে যায়
তবু এতটা নামতে পারি কই -
একা শঙ্খচিল...
কুমকুম ঘোষ
পরিযায়ী পাখীরা একে একে নিয়েছে বিদায়
আন্তরিক পর্যটন শেষে, ডানা মেলে উড়ে গেছে নিজস্ব নীড়ে।
আজ শুধু শঙ্খচিল দু-ডানা মেলে
ভোরের শিশির কণা আহরণ করে, একাকী...কত যুগ আগে এসেছিল সেও
মৃত্তিকা ফুল ও নদীর সাথে।
বলেছিল কথা কিছু অবসন্ন ঝরা পাতাদের সাথে.. বসন্তের অন্তিমতায়.. কৃষ্ণচূড়া-সন্ধ্যায়।
বৃক্ষ স্থির হয় যদি হৃদি স্থির তাতে
নদী স্থির নয়, সেথা স্রোতধারা পথে।
অশান্ত বৈশাখ যদি আগমনী গায়
মধ্য-চৈত্র আজো তবে স্বপ্ন দেখায়;
ধুলো ওড়ে, বীজ ওড়ে , স্বপ্ন ওড়ে সাথে
অচঞ্চল হরিৎ পত্র ..জাগে মধ্যরাতে।
রাহুল < জরায়ু > রাহুল
শব্দরূপ : রাহুল
মেঘ ~
[] আড়াল []
শুকনো স্মৃতিপাতা
২
আমরা ~ মুখোমুখি
বিপরীত
বৃষ্টি।সৎকার
৩
[বোবা]
দৈনিক
সময় {✡} ছুটি
৪
সংক্রমণ ~ ফুসফুসজনিত
√(সময়) = ক্যানভাস
||
আগ্নেয়গিরি।ঠিকানা
৫
কবেকার '?' ~ তারাখসা মোহ
লোভ ও লালার কোষ
মুহূর্তটুকু ~ যেখানে শ্যাওলায় জীবন
নতুন পথের বাঁকে
অর্চিতা দাস
ফাগুন যেতে চাইছে..
যাক না, কোন তাড়াহুড়ো নেই-
আবীর খেলার পর দাঁড়িয়ে আছি
আর একজনের জন্য..
দমকা হাওয়ার পাশে রেখে দিই
কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া-এঞ্জেলিনাদের
টগর-মালতী-কাঞ্চনেরা দলে ভিড়ে গেলে
পথের ধারে আসন পেতে রাখি..
বুঝতে পারছি সে এসে গেছে..
চৈত্রদিনে তপ্ত বিকেলে
ঝরা পাতাদের ঝড়
জানলা দিয়ে ঢুকে এল,
রোদ ঢেউয়ের সিঁড়িতে
আকাশ আছড়ে পড়ছে,
নারকেল বনের পাশে ফুলকি করা চৈত্রমাস..।
মাঠের ভেতরটা হা-হা করে..
তেষ্টায় ফাটা বন-বাদাড়ের জীবন..
মানুষ কৃপাপ্রার্থী--
‘আল্লা মেঘ দে পানি দে’
মাটিকে চুম্বন করে বলে--
হে স্তব্ধ রাতের চৈত্রমাস
পৃথিবীকে সোনার ফসলে ভরিয়ে দাও।
কাক ডাকা ভোরে দেখি
রঙে রঙে ছবি এঁকে দিয়েছে কেউ,
নতুন পথের বাঁকে-
থরে থরে সাজানো হাসির মিলনমেলা
গাছেদের শাখা-প্রশাখায়
কিশলয় জেগেছে প্রচুর
নদীর পিঠ বেয়ে-
সবাই
বনে বনে ঝুড়ি কাঁখে বেরিয়ে পড়েছে
আলো হাতে অভিনন্দন জানাতে--
হে চৈত্রমাস,আমরা ঋণী তোমার কাছে।
গাজন মেতে ওঠে কার্নিভালের কাঁটায়
স্বপ্নরা ফিনিক্স ওড়ায় গান ধরেছে
ভেতরকার শেকড়-বাকড় বেরিয়ে এসেছে
মোহনার দিকে যাবে বলে..
দূর হরপ্পার খেজুরবীথি-আঙ্গুরলতা
এতদিন অপেক্ষায় ছিল
মিলিত হবার উৎসবে,
জিপসি মেয়েরা ভেসে যায় আবেগে
তারা শাল-পিয়ালের বনে হারায়-
কেউ শান্তিনিকেতনে
কেউ বা পুরুলিয়ার দিশাহীন টিলার প্রাঙ্গণে
লালের সমারোহে-।
নিজের ভেতরে যে বাতাস অবরুদ্ধ ছিল
সে ছুটি পেয়ে উড়ে যায়
দক্ষিণে-পূবে-পশ্চিমে-উত্তরের অরণ্যে-
দূরন্ত ছোটাছুটিতে জোছনায় নেমে আসে..
শব্দ-ছন্দরা বলে ওঠে—
‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’
ফাগুনের হাত ধরে-
চৈত্রের খর বাতাস
কখন যে হয়ে যায় ভালোবাসা
বুঝতে পারিনি..।
নীলাবতীকে
সুদীপ ব্যানার্জী
ঘাম বিন্দু বিন্দু। মুখ বেয়ে গড়িয়ে নামছে এক সুখ প্রতীক্ষার আলো।সূর্যের তেজের সাথেই আরোও ঝলসে উঠলো নীলাবতী।ঘরকন্নার আটপৌরে আমার প্রেমিকা--- তুমি এ চৈত্রে যখন দেবী হয়ে ওঠো লৌকিক গান মুখে, কোনও নিঝুম দুপুরে, শুকনো পলাশের পরিণতির মতোই --- বড্ড ভাবায় আমায়।এই ছলনার ঋতু বেজায় ভোগায় তোমায় জানি।বুকের ভেতর তো তোমার সেই শাপলা পুকুর,মেঠো পথ,মাটির বাড়ির দাওয়ায় এক চিলতে সুখ।চাওয়া বলতে এটুকুই।তবুও মেলে না ---তুমি সুখ হয়ে উড়ে গেছো শতকীয়া স্মৃতিতে।আমি ছাই মেখেছি আমার পরিচয়ে,ঝাঁপ দিচ্ছি কাঁটাভরা গভীরে।চামড়ায় আমার সব না পাওয়া ফুঁটো করে লোহার শিক্ বিঁধিয়ে চরকি নাচাচ্ছে। চড়কগাছ ঘোরা থামে নি আমার কষ্টের গ্রাফ বেড়ে গেলেও।নীলাবতী,আমি প্রেমিক তোমার।নীলাবতী আমি ভক্ত তোমার।নীলাবতী তোমার পুণ্যে আমার বড্ড লোভ।তোমার টুকরো শান্তিতে আমি ঘরোয়া কামুক।রোদ বাড়ছে।সামনে বোশেখের জ্বলন।এখনও জ্বলছি,তাও এ পোড়া মন ঠান্ডা মাখে এ চৈতে, স্বপ্নে পেলে তোর পেছল আদর।তোর গোল চাঁদপানা মুখ নিয়ে পানা পুকুরের পাড়ে একবার এসে দাঁড়া ঘোমটা তুলে --- সন্ন্যাসী সেজে ঢাক ঢোল নিয়ে আমি বিদায় নিতে দাঁড়িয়ে আমি বাউড়ি পাড়ার ঘাটে....শুধু তোর সহজকে ভালবেসে...
নতুনের আহ্বান
কণিকা দাস
কণিকা দাস
ছুঁয়ে যায় চরণরেখা,রেখে যায় কিছু প্রশ্ন
বসন্ত ফুরালেও শুকায়না অমলতাস
শীর্ণ নদীটির গা চুইয়ে এগিয়ে চলে সময়
অনেক কাজ যে এখনো আছে বাকী।
উদাস দুপুর শ্রান্ত মনন কোণে...
শালিকরবে ভাঙে দুশ্চিন্তার চমক্
লাল গুড়াসের নরম ছোঁয়ায় রাঙা মন
উতলা ফাগুন জানে তার প্রতিফলন।
এখনো বাতাসে কান পাতলেই শুনি
সময়ের প্রতিধ্বণি...
বসন্ত শেষে আরেক বসন্তের আবাহন।
নববর্ষ নবপত্র পল্লবে মোদিত...
এসো কোমল প্রেম নতুনের হাত ধরে
পুরোনোকে দাও ছুটি....
স্মৃতিময় হয়ে থাক মনের গহনে
ভুলে গিয়ে সব পুরানো তিক্ততা
এগোও সুমুখ পানে নতুনের আহ্বানে।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
চৈত্র সংখ্যা ১৪২৪
মুক্ত গদ্য
বৈশাখী দিন ও কিছু চৈতালি স্বপ্ন
নবনীতা স্যান্যাল
তখন ডিমের কুসুম কুসুম হলদে ভোরে লাল সবুজ ফ্রিল দেওয়া জামায় সকাল থেকেই শুরু হতো উত্তেজিত বৈশাখ , ডাকনামে সে আমার শৈশব । নতুন জুতোর ফোস্কা পায়ে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর সুখস্বপ্ন চোখের তারায় মেখে শুরু হতো যে নতুন দিনের সে আমাদের ফেলে আসা সুখ। লাল তরমুজ, দানাদার লাড্ডু, লাল গণেশ, ও তার পায়ের কাছে কুচো ইঁদুর -- তার পরেও প্রসাদী গন্ধ, কাসর ঘন্টা , ধূপধুনো এমনটা ছিল পুরো নামডাক ওয়ালা নতুন বছরের সকাল ।দুপুর গড়িয়ে যেতে জব্বর খাওয়া দাওয়া,-- তেতো থেকে টক থেকে ঝাল মিষ্টি একদিনেই সব --যেন পুরো বছরের সেরা সোয়াদ, . .
বিকেল নামত দোকানে দোকানে হালখাতা নিয়ে ।। এ দোকান ও দোকান, .প*কেট সজ্জিত মিষ্টির বাহার, কোলড ড্রিঙ্কসের অজস্র বুদবুদ, আনন্দ ঘন প্রহরে দ্বিধা বিজড়িত হাতছানি ... সোনালি Gold spot নাকি চিরতরুণ ডার্ক handsome Thums up. .. দ্বিধা বিভক্ত আলোক সন্ধ্যা ।
এসব কোলাজে ভরপুর সন্ধ্যের হাত ছাড়িয়ে অতঃপর মেজাজি রাত্রির নেমে পডা ।বচছরকার দিন তাই প্রচুর গল্পে রাত ভোর করা .এবং .বকাবকি না খাওয়া সোহাগি দিন শেষে রাতের পাশ ফেরা ।
প্রসঙ্গত Time spent করা নিয়ে গুমরানো যে দিনগুলো কাটে ছোট দের......হা হা মেট্রো পলির যে কমুনাল সেলিব্রেশন, আর কাগুজে গপ্পো আর ফরমায়েশি করপোরেট আডডা, . সেখান থেকে আর যাই থাক হারিয়ে গেছে প্রাণ খোলা নতুন বছরের গন্ধ , হারিয়ে গেছে অনেকদিন।
যদি রিল টা পিছানো যায়, যদি স্বপ্ন গুলো ভিন্ন পথে উড়াল দেয় , উকি দেওয়া যায় শৈশবে । ।কেমন হয তবে ?সাবালক হওয়ার আগে বেপরোয়া ভুল গুলো নিয়ে সাডমবরে নিয়ে ফিরে আসুক ছোট বেলা ।
গল্প বলুক চৈতালি দিন , ভার্চুয়াল জগত ছুড়ে দিযে আসুক বেপরোয়া দিন , পিছিয়ে যাক বড়ো হওয়া . দাপিয়ে নামুক কালবোশেখী ,। অপেক্ষায় অপেক্ষায় ...
সোনালী বসন্ত
শর্মিষ্ঠা সিমলাই
তোমার উষ্ণতায় তীব্র হয়েছিলো যাপন
নদীর পাড় ধরে গিয়েছিলাম অনেকদুর .....
স্রোতে স্রোতে ভাসছিলো খড়কুটো ....
দূরে গাভীর ডাক জানিয়েছিলো আসন্ন সন্ধ্যার সুঘ্রাণ ...
সেইদিনই এসেছিল সেই
সোনালী বসন্ত ...
চৈত্র দুহাতে সাজাচ্ছে বৈশাখী বরণডালা
পিয়াংকী মুখার্জী
প্রকৃতি একটা আস্ত উপন্যাস , প্রতি পাতায় তার আদুরে ঠোঁট , ভালোবাসার চোখ , আবদারের রংধনু । আমরা আলোর শিক্ষার্থী হয়ে কালিমাখা অক্ষর থেকে উপড়ে নিই কিছু সাত্ত্বিক সত্ত্বা প্রতিক্ষণ , ও উজাড় করা আকাশে ঠাঁই দেয় তোমায় আমায় নিঃস্বার্থে।
ষড়ঋতুর আলাপন যেন বীজ থেকে বৃক্ষের যাত্রাপথ , সেখানেই ঘাসের বিছানা এঁকে আমরা বিছিয়ে দিই জীবন নামের চাদর ! তপ্ত গ্রীষ্ম , বর্ষা শরত্ হেমন্ত শীত আর বসন্তকে আগলে হাঁটতে হাঁটতে প্রৌঢ়ত্বের দরজায় এসে দাঁড়ায় , শেষ হয় একটা বছর , কিন্তু জীবন যে থামতে শেখায় না তাই পুরোনোর বিদায়পর্বের সাথে বরনডালায় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালে নববধূ রূপী বৈশাখ !
আজ সোনালী স্বপ্ন লিখতে বসে ক্ষ্যাপাটে চৈত্রের শরীরে লেপ্টে দিলাম বৈশাখী দুচোখের অংক , ওরা ততক্ষণে মেলাতে চেষ্টা করুক বামপক্ষ = ডানপক্ষ আর আমরা সেই অবকাশে বরং সম্পর্কগুলোতে একটু কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির দুফোঁটা আদর বুলিয়ে দিই !
একটা আস্ত বছর ,,,বারো মাস তিনশো পয়ষট্টি দিন সম্পর্করা আমাদের শরীরে এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত চোখে ঘুম এঁকেছে ,
চলো নিঃশব্দে আঁজলা ভরে কুড়োই ওর সব মনখারাপিয়া , আঁচল দিয়ে মোছাই ওর ক্লান্তির নোনা জল ,,,,,
চলো , আজ এ নববর্ষে সোহাগের মশাল জ্বেলে কুঁকড়ে পড়া সম্পর্কগুলোতে একটু জীবনীশক্তি ঢালি আর সবাই মিলে কোরাসে গাই , "এসো হে বৈশাখ এসো হে ,
তাপস নিশ্বাস বায়ে.........."
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
চৈত্র সংখ্যা ১৪২৪
কবিতা দ্বিতীয় পর্যায়
পাতাঝরা পথ পেরিয়ে
নরেশ রায়
এক বিষণ্ন অতীতে
হাজার অভিমানে পাতাঝরা দিনে
এক গভীর শুন্যতার নিমন্ত্রণে
ক্রমশঃ পাতাল খুরে দুঃখের আরো গভীরে
জীবনকে টেনে নিয়ে গিয়ছিল ।
কাছেই মন খারাপের পাহাড়
নিশ্চল নিশ্তব্ধ মৌন কারাগার
আত্মহননের আদ্যপথ হতে
ফিরিয়ে এনেছ তুমি
বাকী পড়ে আছে উদ্দেশ্যহীন বিকেল ।
আমার আত্মাভিমান গতকাল
মিশেছিল বেড়েছিল ঋতু পরিবর্তনেও
তাই ভেঙে যাই ভেঙে দিই জীবনের সব
রৌদ্রছায়া ফুল তরুলতা ।
তোমার প্রখর দীপ্তির মাঝেও দেখি আঁধার ।
বিকেলের পর আর কিসের কার প্রতীক্ষা
জীবনকে যত আঘাত করি যেন বাজে
নানান রাগিণীর সুরে
আমিও যেন বেজে উঠি গেয়ে উঠি
“আমার শেষ পারানির কড়ি----------”
তোমারি অঙ্গুলী হেলনে যেন
আমার সময় খেলা করে জানালায়
যন্ত্রণা , বিষাদের , অবসাদের মধ্যেও
হেসে উঠি নবোদ্যমে আশার আলো
দেখি আমাতে তোমাতে বিশ্বাস রেখে ।
এমনি করেই যেন নীলাকাশের নিচে
তোমায় গান শুনিয়ে যাই নতুন করে
নবার্কের আলোয় ,নতুন স্বপ্নে
নতুন আশায় নতুন দিনে ।
''প্রতিক্ষা''
ঝর্ণা মুখার্জী
অসূর্য স্পশ্যা সুতনু অটবীর শ্যামলী ছায়া
রেশমী সুতোর স্বপ্নে বোনা অটবীর যত মায়া ।
নিয়ম ভাঙা বাউন্ডুলে হাওয়া ছুঁয়ে যায় অধরা দেহ , টুপটাপ ঝরে পড়ে অটবীর
স্বপ্ন গুলো ।
স্পর্শকাতর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অটবীর কামনার আকুতি , প্রভাতে শিশির হয়ে ঝরে পড়ে নিতি নিতি ।
অপেক্ষায় কাটে কাল আসে চৈতী হাওয়া
অটবীর মনে ভালবাসার দোলা লাগা ।
মনে তার দখিনা বাতাস বয়, বছরভর
তাহার ই প্রতিক্ষায় ।
কেঁপে কেঁপে ওঠে অটবীর বল্লরী দেহ খানি
পলাশ রাঙা অটবীর মুখ সোহাগে চুমে
ফাল্গুনী।
দু দন্ত রঙিন দিন ধিরে ধিরে হয় বিলীন
অটবী আবার একা ,বসে বিরহের সুর ভাঁজে
দিন যায় রাত নামে অটবী আঁধারে কাঁদে ।
রেশমী সুতোর স্বপ্নে বোনা অটবীর যত মায়া ।
নিয়ম ভাঙা বাউন্ডুলে হাওয়া ছুঁয়ে যায় অধরা দেহ , টুপটাপ ঝরে পড়ে অটবীর
স্বপ্ন গুলো ।
স্পর্শকাতর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অটবীর কামনার আকুতি , প্রভাতে শিশির হয়ে ঝরে পড়ে নিতি নিতি ।
অপেক্ষায় কাটে কাল আসে চৈতী হাওয়া
অটবীর মনে ভালবাসার দোলা লাগা ।
মনে তার দখিনা বাতাস বয়, বছরভর
তাহার ই প্রতিক্ষায় ।
কেঁপে কেঁপে ওঠে অটবীর বল্লরী দেহ খানি
পলাশ রাঙা অটবীর মুখ সোহাগে চুমে
ফাল্গুনী।
দু দন্ত রঙিন দিন ধিরে ধিরে হয় বিলীন
অটবী আবার একা ,বসে বিরহের সুর ভাঁজে
দিন যায় রাত নামে অটবী আঁধারে কাঁদে ।
গাজন উৎসব
কাকলি ভদ্র
"এসো মা সরস্বতী
বসো পাশে
কি বোলে বোলান গাইবো
বুড়ো শিবের কাছে।।।"
মারানবুরুর রুখাসুখা আঙিনায়
খঁকড়া পেটের ইকিড়মিকিড়!
ফুটিফাটা শরীরে বসন্ত চৌকাঠে
বাজে ঐ গাজন-সুর !
কাঁসর-ঢাকের বোলান আর
ধূপধূনোর রঙ-পাঁচালী
ধিনাক নাতিন তিনাক তা
নাক তিন তিন তিনাক তা
নেচে ওঠে মন
যেন লাঙলের সবুজ মঙ্গলকাব্য!
লিখে ফেলে মন
যেন দু'মুঠো সাদা ভাতের স্বপ্নকাব্য !
একতারা বেজে ওঠে দিনরাত...
দোতারা বেজে ওঠে দিনরাত...
চৈত্রজ্বালা অগ্নিদিন
গায়েত্রী দেবনাথ
চৈত্রজ্বালা অগ্নিদিন
স্বপ্নালু বাতাস
স্নিগ্ধ মোলায়েম রাত
সুরে জারিৎসিন
যন্ত্রনার প্রাসাদ ’‘ নিদ্রাহীন
অপরাজেয় প্রান
স্বপ্ন মুঠি মুঠি বৃষ্টির
শিল্পীর বৈচিত্রের
রাজ্যহীন সৃষ্টির
সূ্যে ঘরশর সন্ধান
অন্ধ অভিজান।
অধরা আবেগে কানে কানে
স্বপ্ন মূর্ছনায় ,স্রোতে,প্রানে । ।
চৈত্রজ্বালা অগ্নিদিন
স্বপ্নালু বাতাস
স্নিগ্ধ মোলায়েম রাত
সুরে জারিৎসিন
যন্ত্রনার প্রাসাদ ’‘ নিদ্রাহীন
অপরাজেয় প্রান
স্বপ্ন মুঠি মুঠি বৃষ্টির
শিল্পীর বৈচিত্রের
রাজ্যহীন সৃষ্টির
সূ্যে ঘরশর সন্ধান
অন্ধ অভিজান।
অধরা আবেগে কানে কানে
স্বপ্ন মূর্ছনায় ,স্রোতে,প্রানে । ।
চৈত্রের আশা
সুব্রত নন্দী
চৈত্রের দাবদাহ ঘরেবাইরে,
বসন্ত মুখ ফিরিয়েছে সমানুপাতিক হারে।
পাতাঝরা শুষ্ক প্রাচীন বট,
এখনো স্মৃতিলোপ হয়নি!
চৈত্রের শেষে স্নিগ্ধ সতেজ হতে চায়,শক্ত অবলম্বনের কাঁধে।
নববৈশাখে ফিরে যেতে চায়,
ভালোবাসার অন্দরমহলে!
আনন্দউদ্যানে যদি ফেরে নববৈশাখ!
কিন্তু হায়!সম্বিত ফেরে.....
সবুজপাতার ঘনিষ্ঠতা পেতে আপনজন বাদ!
বৃদ্ধাবাসের কুঠুরিতে বেজে ওঠে একাকীত্বের মূর্ছনা।
কিন্তু এমনটা কি হওয়ার ছিল?
প্রভাতফেরীতে হয়নি বিন্দুমাত্র সন্দেহ?
স্বপ্নঘোর কেটেছে ধীরে ধীরে।
বৃদ্ধাবাসই নিরাপদ আশ্রয়!
বৈশাখী উৎসব চলুক নবকলেবরে,
এই গহীন জীর্ণ চারদেওয়ালের অন্দরে!
মায়াচৈত্র
রাজীব রায়
কবেকার ঝরাগল্পের দুপুর ৷ বিষাদ রঙা পাতায়
তার মোহনচিহ্ন লেগে আছে
যে মেদুরতা বিগত কয়েক বসন্তের রঙ ছোঁঁয় নি
ভাবতেই পারো সমূহ ক্ষয় ও ক্ষরণ সত্ত্বেও
অপেক্ষা ভেঙ্গে ধরা দেবে মায়াচৈত্রের উঠোনে
এইমাত্র সুদূর মুছে দিয়ে শিমুল ফোটাবে,
খোলা হাওয়ায় ছড়িয়ে যাবে দিগ্বিদিক
ভাবতেই পারো মায়াবী দুপুরগুলো—
বুনোনদীতে ধুয়ে ফেলবে যাবতীয় মনখারাপ,
ঘুম-ঘুম রোদের পোশাকে দাঁঁড়াবে নৈর্ঋতের বারান্দায়
অথচ ঝরাপাতাটি মাটিতে কান পেতে
টের পায়— তার সহজ বিচরণ, অনায়াসে
রঙ আর প্রসাধন গুছিয়ে রাখা
এসব অনুমিতি-অনুভূতির আড়ালে
অতৃৃপ্তি আর দীর্ঘশ্বাসের আগুন খসে পড়ে
আরোএক ঝরাগল্পের দুপুরে
মায়াচৈত্রের অনুবাদ শিখে নিচ্ছে আগামী গল্পের সদ্য সবুজ পাতা
আজি এ বসন্তে -------
মহুয়া মুখোপাধ্যায়
নিজের কাছে নিজেকেই মেলে ধরতে হয় মাঝে মধ্যে একান্ত গোপনে,
বোঝা যায় যাবতীয় প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তিতে
বড়ই জটিল জীবনের সে অঙ্ক।
বোঝা যায় যাবতীয় প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তিতে
বড়ই জটিল জীবনের সে অঙ্ক।
নিরন্তর করে খেলা কী এক অতৃপ্তি মেধা ও মননে আমাদের,
দাঁড়িয়ে শান্তভূমিতে বিশ্বাসের
ছিঁড়তে হয় নিজেরই দু'হাতে যাবতীয় জমে ওঠা ক্ষোভ আর অবিশ্বাস।
অদৃশ্য এক সরু সুতোয় এভাবেই টালমাটাল
চলেছি কুশলী পৃথিবী আর আমিও।
দাঁড়িয়ে শান্তভূমিতে বিশ্বাসের
ছিঁড়তে হয় নিজেরই দু'হাতে যাবতীয় জমে ওঠা ক্ষোভ আর অবিশ্বাস।
অদৃশ্য এক সরু সুতোয় এভাবেই টালমাটাল
চলেছি কুশলী পৃথিবী আর আমিও।
অথচ সমস্ত আকাশ রাঙিয়ে এই নির্লজ বসন্তে
নিষ্ঠুর, নির্দয় পাথরের বুকে একপেয়ে পলাশ
চেয়ে দেখো, ফুলে ফুলে কেমন হাসছে।
নিষ্ঠুর, নির্দয় পাথরের বুকে একপেয়ে পলাশ
চেয়ে দেখো, ফুলে ফুলে কেমন হাসছে।
জাগো শৈশবরা
রীনা মজুমদার
চৈত্রের নিয়মে হাওয়ায়
পাতা গুলো ঝরে ঝরে পড়ে
বার্ধক্যের শেষ বেলায়..
জমে থাকা শ্যাওলা গুলো
স্রোতের জলে ভেসে চলি_
নতুনের পদধ্বনি শুনতে কি পাও?
এই পৃথিবীর নিজ নাগরিক করেছিল কেউ,
অন্যায়কে করেছি নীরবে হেলা
আক্ষেপে ছটফট করে সে যন্ত্রণায়,
সাঙ্গ হোক সব খেলা, জাগো নতুন শৈশবরা-
তোমাদেরই বিচ্ছুরিত আলোকচ্ছটায়..
তোমরা মানুষের পদধ্বনি শুনতে কি পাও ?
অনন্ত আগামীকে দেখি
নতুন শাখা-প্রশাখায়
আনন্দ অমৃত যেথা ঝরে
আবার আসি ফিরে ফিরে
শৈশবের কাছে....
নতুনের গান...
মৌসুমী চৌধুরী
দিন-পঞ্জীর পাতা উল্টায়
বয়স বাড়ে পৃথিবীর।
চৈতালী রুখু বাতাসে ওঠে তার পদধ্বনি।
পুরোনো-ভিতেই কড়া নাড়ে সে----
আমাদের "নতুন"...
বুকে তার সবুজের ঘ্রান,
মুঠো মুঠো আশাগীতি আঁচলে বেঁধে
পুরোনো-বুকের রক্ত-মন্হনে
তুলে আনে সে নব সঞ্জীবনী সুধা ...
পুরোনোর বুকে ঝলসে ওঠা অস্ত্র,
পুরোনোর বুকে ঝরে পড়া তাজা রক্ত,
পুরোনো অসংহতি, পুরোনো অসহিষ্ণুতা,
তুড়ি মেরে উড়িয়ে
জ্বেলে দাও মানবতার নতুন আলো
দশ দিগন্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে, হে নতুন!
গুঁড়িয়ে-যাওয়া-পাঁজরে
ক্ষতের শীতল প্রলেপে আনো
নতুন সংহতি-স্বপ্ন।
হে নতুন, চৈতালী দিনে
তোমারই স্বপ্নে আবিষ্ট মন
রক্তে তুলুক কৃষ্ণচূড়া-ঝড়।
বেদনার-বদ্ধ-জলাশয়
তোমারই ছোঁয়ায়, তোমারই মায়ায় যেন
শ্রাবণের-আনন্দিত-নদী হয়ে বয়।
"জ্যোতি পূর্ণ কর হে গগন, সুধা গন্ধে ভর হে পবন,
গড় চিত্ত ভবন শান্তি সদন,বাধা-বিঘ্ন তাড়ন হে..."
" শুধু তোরই জন্য "
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
তোর খুনসুটি প্রেমে খরস্রোতা বিতস্তা হতে পারি
তুই বললে একবুক কান্নাকে তোরসার জলে
দিতে পারি বিসর্জন !
ঝিঁঝিঁপোকা রাতে চাদর হতে পারি একটু
ছোঁয়ার অছিলায়,
রাতশেষে ভোরের লাজুক রোদ গায়ে মাখতে পারি তোর ইশারায় ।
মধ্যরাতের নির্জনতায় তোর রং-তুলির ক্যানভাসে হতে পারি মোহময়ী,,,,,
শুধু তোরই জন্য চৈত্র সেলে বিকোতে পারি প্রেম !!
তোর লাগাম- ছাড়া ভালবাসায় দিবানী হয়ে
খোঁপা সাজাবো আম্রমুকুলে ।
চৈত্রী-সাঝে কালবৈশাখী ঝঞ্ঝা হয়ে লন্ড-ভন্ড হতে পারি তোর প্রশ্রয়ে ,
তুই না চাইলে, তোর প্রাক্তনী বা পরকীয়া হয়ে কাটাতে পারি আমৃত্যু......
তোর কারণে ফাগুন শেষে চৈতালী- স্বপ্নের
ভেলায় ভাসবো বিদায়ী - বসন্তে ।
উদাসীন চৈত্র
দীপশিখা চক্রবর্তী
দিগন্তের ধার ঘেঁষে উত্তপ্ত উদাস বাতাস,
নদীর পাড়ে বসে বিবর্ণতা মাপি-শূণ্য দৃষ্টিতে!
চারপাশের জেগে ওঠা হলদে ঘাসে বিষণ্ণতা ;
অবলীলায় বয়ে চলা ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ,
নুড়ি পাথরের গায়ে শুকনো শ্যাওলার ছোপ,
দু'হাত বাড়াতেই অবাধ্য অকৃপণ রোদের আহ্লাদ,
প্রশ্রয়ের চোখে দেখতে থাকি রোদে পোড়া পিপাসিত গাছ;
অলীক বিষাদের আশ্চর্য আগুনে পোড়া শেকড়ের প্রাণ!
বৃষ্টির অপেক্ষায়...
চেনা চৈত্রের শুষ্কতার মাঝেও নতুনত্বের ছোঁয়া,
ধূসর গাছের ডালে কচি পাতাদের উঁকিঝুঁকি,
নদীর স্রোত পাথরে ধাক্কা খেয়ে তোলে ছলাৎছলাৎ সুর,
রুক্ষ বাতাসের কড়া শাসনে ঢেউয়ে নতুন দোলা,
কবিতা হয়ে আসা ভাবনাগুলো শব্দ আর ছন্দ দিয়ে আঁকে ছবি,
মুগ্ধ হয়ে মেতে উঠি প্রকৃতির ভাঙা-গড়ার খেলায়।
নব জাগরণ
গৌতমী ভট্টাচার্য
কাল একটা নতুন সূর্য দেখতে চাই আমি
বৈশাখের প্রথম সকালে ।
সেই সূর্যটা
আমার মায়ের কপালের টিপের মতো
উজ্জ্বল সৌম্য স্নিগ্ধ আবার তেজস্বীনী
সূর্যটার জ্যোতির কিরণ থেকে
ঝরে পড়বে প্রশান্তির ধারা ।
সূর্যের মুখমন্ডলে এখন যেন বিভীষিকা রূপ
অনেক ক্লান্তি আর গ্লানি শরীরে,
ঘুম জড়িয়েছে চোখের পাতায়।
অস্তে ঢলে পড়ার আগে
নিবু নিবু চোখে আর একবার
চৈত্রের শেষ গোধূলি লগ্নে
উঁকি মারে নির্যাতিতা পৃথিবীর দিকে ।
কাল সূর্যটা হবে নতুন করে পথ চলার
দিকদর্শন।
শক্তির উৎস দিয়ে নির্মূল হোক
রক্তলোভীর লুব্ধ আকর্ষণ ।
"কাল বৈশাখী ঝড় "
নিশীথ বরণ চৌধুরী
সুমধুর বসন্তে চৈতি হাওয়া নিভৃতে নীরবে
কখন শুনিয়েছিল?
বিদায়ের করুণ রাগিনী,
বিবর্ণ মাধবী লতার বনে।
অনুভব করেনি তা এখনও ,ফেরারী মন,
রুক্ষ পর্ণমোচী তলে শুনিয়ে মর্মর ধ্বনি
দাবদাহে হঠাৎ হয়ে গেছোচুপ--
একি তব অভিমান?
বন্ধ হৃদয়ে নৈশব্দের মাঝে,
মুর্খের মতো বুঝতে পারিনি।
আসা যাওয়ার নিত্য খেলায়
স্থবির হইবে জীবনের গভীর প্রত্যয়।
নতুন বৈশাখে করি আহ্বান---
তুলতে ঝড় কালবৈশাখী ঝড়
নতুন বৎসরে চারিদিকে চারিধার।
অন্যদিন
দেবযানী সিনহা
ঐ বিস্তীর্ণ আকাশশরীর জুড়ে নীলবসন্ত
রোদ্দুর মাখা চিঠি লিখি বৃষ্টিভেজা মন নিয়ে
সুকনো পাতার ঘুড়ী হাওয়ার সাথে দিয়েছে পারি
খুঁজে ফেরে হন্যে হয়ে ভাবতে ভাবতে পার হয়
সবুজমাঠ নদী পাহাড়ের ধাঁপ বিস্তীর্ণ মরুভূমি
খুব দূরে নয় কাছে কোথাও ঢাকের আওয়াজ
চৈত্র বিদায়ী সুরে শিব গৌরি সেজে নৃত্য করে
লালসালু কপালমাথা জড়িয়ে পীঠে বড়শি গেঁথে
চরক গাছে ঘোরে
আকাশে প্রান্তরে ভয়ংকর আত্মচিৎকার মিশে যায় ধুলোঝরে!
নির্ভীক সাহসী রক্তিম সাজগোছ কাঠফাটা রোদ্দুরে
নতুনবছরের উজ্জ্বল ঋতুরঙ আনন্দ খুশি আহ্বানে
ভাসিয়ে নিয়ে যাক সব দুঃখ কষ্ট বছরের শেষ দিনের অবসানে।
দেবযানী সিনহা
ঐ বিস্তীর্ণ আকাশশরীর জুড়ে নীলবসন্ত
রোদ্দুর মাখা চিঠি লিখি বৃষ্টিভেজা মন নিয়ে
সুকনো পাতার ঘুড়ী হাওয়ার সাথে দিয়েছে পারি
খুঁজে ফেরে হন্যে হয়ে ভাবতে ভাবতে পার হয়
সবুজমাঠ নদী পাহাড়ের ধাঁপ বিস্তীর্ণ মরুভূমি
খুব দূরে নয় কাছে কোথাও ঢাকের আওয়াজ
চৈত্র বিদায়ী সুরে শিব গৌরি সেজে নৃত্য করে
লালসালু কপালমাথা জড়িয়ে পীঠে বড়শি গেঁথে
চরক গাছে ঘোরে
আকাশে প্রান্তরে ভয়ংকর আত্মচিৎকার মিশে যায় ধুলোঝরে!
নির্ভীক সাহসী রক্তিম সাজগোছ কাঠফাটা রোদ্দুরে
নতুনবছরের উজ্জ্বল ঋতুরঙ আনন্দ খুশি আহ্বানে
ভাসিয়ে নিয়ে যাক সব দুঃখ কষ্ট বছরের শেষ দিনের অবসানে।
মনবসন্ত
পায়েল কর্মকার
ঝরাপাতার টুপটাপ শব্দ-
স্বপ্নের দোলাচল চৈত্রের অবসানে।
মাঠ ফাটা রোদ্দুরে
রিন রিন শব্দের অনুরণন।
কাঙ্ক্ষিত না পাওয়াগুলো
অকাল বর্ষনে সিক্ত।
রচিত হয় নূতন যৌবনের প্রেক্ষাপট।
" বিধির বিধান "
সুস্মিতা পাল কুন্ডু
মনে হল ঝাঁপির মাঝে
জাদু কাঠি আছে ,
স্বপ্ন গুলোয় ছুঁয়ে দিলে
উঠবে এবার হেসে ;
মিথ্যে সে তো প্রমাণ হল
অবাক ভীষণ হলাম না !
স্বপ্ন সত্যি করতে শুধু
চাই তো কেবল সাধনা ;
নিষ্ঠা আর একাগ্রতার
হাতটি ধরে পা বাড়ালে --
ইচ্ছে পূরণ গল্পগুলো
সত্যি হয়েও ফলতে পারে ৷
তবুও যদি স্বপ্ন কিছু
দূর দেশে অধরা !
মনকে তবে প্রবোধ পোষণ
যুক্তি কিছু করে খাড়া --
লড়াই আমার সাধ্যমত
এমনিতে মানি নি হার
ভাগ্য টা আমার এইরকমই
বিধির বিধান খণ্ডাবে কে আর !!
সুস্মিতা পাল কুন্ডু
মনে হল ঝাঁপির মাঝে
জাদু কাঠি আছে ,
স্বপ্ন গুলোয় ছুঁয়ে দিলে
উঠবে এবার হেসে ;
মিথ্যে সে তো প্রমাণ হল
অবাক ভীষণ হলাম না !
স্বপ্ন সত্যি করতে শুধু
চাই তো কেবল সাধনা ;
নিষ্ঠা আর একাগ্রতার
হাতটি ধরে পা বাড়ালে --
ইচ্ছে পূরণ গল্পগুলো
সত্যি হয়েও ফলতে পারে ৷
তবুও যদি স্বপ্ন কিছু
দূর দেশে অধরা !
মনকে তবে প্রবোধ পোষণ
যুক্তি কিছু করে খাড়া --
লড়াই আমার সাধ্যমত
এমনিতে মানি নি হার
ভাগ্য টা আমার এইরকমই
বিধির বিধান খণ্ডাবে কে আর !!
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
চৈত্র সংখ্যা ১৪২৪
গল্প প্রথম পর্যায়
নামকরণ
বেলা দে
আমাদের বুড়ি বহুদিনের পরিচারিকা,সবার অজান্তেই কবে যেন স্থায়ী সদস্যার জায়গা করে নিয়েছে। তিন ভাইয়ের যৌথ পরিবারে বড় ভাই হিসাবে শশুরমশাই গৃহকর্তা,তার কথা বেদবাক্য সংসারে, আদেশ বা নির্দেশ শেষকথা। বাড়ির কোন সদস্য ভুলক্রমেও বুড়িকে
কর্মজীবন থেকে অবসর নিতে বললে বজ্রকন্ঠ শ্বশুরের বাড়ির কোন সদস্য অসুস্থ হলে তাকে
কী বাইরে ফেলে দিয়ে আসবে? একথা অনস্বীকার্য ছোটখাটো হাল্কা চেহারার মানুষটি কিন্তু 'একম অদ্বিতীয়ম'।হেন কাজ নেই যা বুড়িকে দিয়ে সম্ভব নয়, এজন্য শ্বশুরমশাই নামকরণ করেছেন 'সব্যসাচী 'আর আমি 'ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল'।এসব নামের অর্থ বোধগম্য না হওয়ায় ফ্যালফ্যাল করে খানিক সময় তাকিয়ে থেকে কালো মুখে ঝকঝকে দাঁতের পাটি বের করে সরল একটা হাসি দিত।আমার এই নামকরণের যথাযথ কারণ তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সেবাপরায়ণতা। গৃহ সদস্য কেউ অসুস্থ হলে উপযাচক হয়ে তার সেবায় লেগে থাকা। একবার বাড়িতে লাগাতার পক্সের প্রকোপ, একজন উঠছে তো আরেকজন পড়ছে। শত নিষেধ সত্বেও অক্লান্ত সেবিকাকে রোধ করা গেল না,অত্যন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে বলছে 'জানুইন বড়বাবু সেবা করণ ভাল,মা শীতলা করুণা করে তারে'। সত্যি মা শীতলা সেবাইত কন্যাকে তার রোষ থেকে ছার দিয়েছে। কালক্রমে সংসারে নবাগতার সংখ্যা বেড়েছে,বাড়ির মানচিত্র পালটে গেছে,গৃহকর্তাও বেচে নেই, এক পরিবার ভেঙে ত্রিখন্ডিত।বুড়ির ভিতর দেখা দিল কাজে অনীহা, জনে জনে বুঝিয়েছে 'এক আটি লাঠি ভাঙন যায় না দা বাবু,একটা ভাঙা খুব সহজ আসলে একান্নবর্তী পরিবারটা জড়িয়ে ও আনন্দ ভাগ করে বাচতে চেয়েছিল, নিরুপায় বুড়ি আপাত শান্তির খোঁজে ফিরে গেল গ্রামে ছেলের কাছে। মাত্র দু সপ্তাহ ব্যবধান, একদিন চৈত্রদুপুর বুড়ির ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে দ্বারে,সাহায্যের হাত পেতে,ওর পোষাকে বুঝতে বাকী রইল না বুড়ি আর নেই।অতলস্পর্শী ব্যাথায় মুচড়ে উঠছে কেবল বুকটা তিল তিল করে ভালবাসায় গড়া বড়বাবুর দীর্ঘদিনের পরিবার বিশ্বাসের ভিতটা বিভাজন বেচারি মেনে নিতে পারে নি কোনমতেই।
গোরু-মানুষের জীবন
প্রলয় নাগ
১.
চৈত্রের দাব-দাহ। সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিচ্ছে। সূর্যের কিরণে কোনও রকম কিপ্টেমি নেই। চারদিকে ধুলোর ঘূর্ণিপাক চোখমুখে ধান্দা লাগিয়ে দেয়। আজ শুক্রবার, নিশিগঞ্জের হাটবার। হালের বলদ, গাভী, ছোট ছোট বাছুর সব যে যার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ বড়ো গোরুর হাট। শ'তিনেক গোরু তো আমদানি হবেই! কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সব বিক্রিবাট্টা হয়ে যাবে। দালালেরা গোরু দেখছে, কেউ লেজে হাত দিয়ে, কেউ পিঠের মেরুদণ্ডের ওপর চামড়াকে শক্ত করে মুঠিতে ধরে মুখে এক রকম-- হেট্ হেট্ শব্দ করছে। দু'হাতে গোরুর মুখটা খুলে দেখে নিচ্ছে বলদ দুই চার ছয় নাকি আট দাঁতের। চার আর ছয় দাঁতের গোরু জোয়ান। যারা গাভী কিনতে এসেছে তারা গাভীর ওলানে হাত দিয়ে দেখে নিচ্ছে ওলান কত বড়ো বা কতটা নেমেছে, ক'সের দুধ দেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
কালু তাঁর দু'দাঁতের দামড়াখানি নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ দেখনদার গোরু হয়েছে। তারওপর কালো রঙটা যেন বাড়তি পাওয়া। দামড়াখানিও বেশ বজ্জাত, শুধু অন্য গোরুর সঙ্গে নতুন গজিয়ে ওঠা শিং নিয়েই লড়তে যায়। অনেক দালালই দামড়াটি দেখছে, কিন্তু দাম-দর কিছু করছে না। সবাই অপেক্ষা করে আছে হাট-টা আরও একটু জমার আপেক্ষায়। এরই মধ্যে রহমত নামে এক দালাল এসে ষাঁড়টিকে বেশ ভালো করেই দেখছে।
--- দামড়াখান তো সেই চোখা বানাছিস রে! কত চাইস ক?
--- কত আর চাইম! বিশ দিস! মানে কুড়ি হাজার টাকা দাম চাইল কালু।
--- হাতটা ধর ক্যানে! বলেই রহমত কালুর লুঙ্গির নীচে হাত ঢুকিয়ে দিল। কালু রহমতের হাতের আঙুল ক'টা আন্দাজে ধরে নিল। রহমত বলল,
--- হইবে?
--- না হইবে!
---এইটায় হইবে?
--- না -রে!
--- এইটায়? ভাবি দ্যাখ?
--- দাম আরও বেশি কয় রে!
--- আ-রে দে রে। বলে রহমত লুঙির নীচ থেকে হাতটা বের করে নিল। তাদের দর-দাম এভাবেই শেষ হল। দর-দামের এই পদ্ধতি অন্য কেউ বুঝতে পারার উপায় নেই। তারপর কালো দামড়া গোরুখানি হাটের মাঝখানে বুড়ো মানুষের পাঁজরের হাড়ের মতো কাঁঠাল গাছের গোড়া থেকে বের হয়ে যাওয়া একটা শেকড়ে বেঁধে কচ্-কচে নতুন পাঁচশ' টাকার নোটগুলি বার তিনেক গুণে কালুর পকেটে ঢুকিয়ে দিল। বলল,
--- যা, ছাওয়ার জন্যে মিটাই ধরি বাড়ি যা!
কালু পকেট থেকে টাকাগুলি বের করে একবার গুনে রহমতে দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
--- আর দুইশোটা টাকা দে ক্যানে! আবদার করলুং।
রহমত পকেট থেকে আরও একশো টাকা বের করে দিয়ে বলল,
--- এই নেক, যা এলা!
কালু টাকাগুলি আরও এবার গুনে নিয়ে একটা পাঁচশ' টাকার নোট আলাদা করে বাকি টাকাগুলো কোমরের লুঙ্গির কোছায় গুঁজে রাখল। তারপর হাটাই কে ডেকে ত্রিশটি টাকা দিয়ে গোরুর হাট থেকে বিদায় নিল।
২.
বিন্দেশ্বরেরর বীজের দোকানটি সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ। সব রকম বীজই পাওয়া যায়। বিন্দেশ্বর নতুন পুরনো সব বীজই রাখে। আর সে মানুষও চেনে। সবাইকে সে ঠকায় না। অনেক সময় নিজের ব্যবসার কথা ভেবে কিছু নতুন বীজের সঙ্গে পুরনো বীজ মিশিয়ে বিক্রি করে দেয়। সীম, ধনে, দেশি মুলো, চীনা মুলো, লাফা, পালঙ, শসা, টমেটো, মাসকলাই মোটামুটি সব বীজ তাঁর ওখানে পাওয়া যায়। বড়ো বটগাছের পাকা করা বেদির ওপর সে দোকান সাজিয়ে বসেছে। খদ্দেরদের সাথের হেসে হেসে কথা বলে বীজ বিক্রি করছে। কারও সাথে করে চরম রসিকতাও। কালু বিন্দেশ্বরের কাছ থেকে প্রতি বছর বীজ কিনে নিয়ে যায়। লাল ডাটা, পুঁই শাক, মুলো, লাফা, পালঙ বেশ যত্ন নিয়ে সে বোনে। রোজ সকালে কিছু না কিছু সে হাটে নিয়ে যাবেই। কালুর বৌয়ের হাতও যেন মা লক্ষ্মীর হাত। টুকে টুকে সমস্ত বাড়িটায় শাকসব্জিতে ভরিয়ে তুলেছে। গোয়াল ঘরের চালে উঠিয়ে দিয়েছে শীতকালীন লাউ গাছ। প্রচুর লাউও হয়, কালু বাজারে নিয়ে তা বিক্রি করে। বিন্দেশ্বর কালুকে কোনও দিন খারাপ বীজ দেয়নি। কিন্তু কালু এসে বিন্দেশ্বরকে প্রতিবারই বলবে,
--- কী বীচি দিলেন বায়, গাজায় না ক্যানে!
বিন্দেশ্বরও রসিকতায় কম যায় না। সেও বলে,
--- এলা কী আর গাজাইবে! এলা তো পাকার সময়!
--- মাইয়া ভাল আছে? মাইয়াক তো সাথত নিয়া আসির পালু হয় ! মাইয়াটা বুড়ুি হইছে নাকি?
--- মোর মাইয়া তো এলাং চ্যাংড়ি নাখান-এ! তোমার মাইয়ার খবর কন?
--- আছে! তবে আগের মতো আর পায় না।
--- পাইবে ক্যামন করি। মাইয়াক কিছু ভাল- ভাল খোয়ান!
--- ভাল আর কোটে পাইম। ভাত কয়টা জোগার করির পাং না। একটা দামড়া ছিল তাও আজি বেটির বিয়ার জন্যে ব্যাচে দিলুং। বেটির বিয়াও নাইগছে।
--- ও..! তা বিয়াও কোটে ঠিক হইল?
--- দূরত নোমায়। এই চান্দামারীত।
--- বেটি জামাই কী করে ?
--- ইস্কুল মাস্টার!
---ও..! ভালে। কিছু নাইগবে না?
--- না, আজি নিম না কিছু! ঠিক আছে, এলা যাং। পরে কতা হইবে। বেলা গেইল-কে।
কালু আজ আর কিছু নিল না। এমনিতেই চলে গেল। বিন্দেশ্বর অন্য খদ্দেরের দিকে মন দিলেন।
৩.
কালুর জন্ম এদেশেই। তাঁর বাবা ঢাকার লোক।। কালুর বাবা অনেকে কষ্টে-শিষ্টে বড় করেছে কালু-কে। জমিজমা তেমন কিছুই নেই। বাম সরকারের দৌলতে বিঘা তিনেক খাস জমির পাট্টা পেয়েছিল। তারপর জানা যায় সব পাট্টাই ছিল ভুয়ো। যারা জমি পেয়েছে তাদের জমির দাগ নম্বরের সঙ্গে জমির মিল নেই বা একজনের পাট্টার জমি অন্যে ভোগ করছে-- এসব আর কী! কালুরা যে জায়গাটাতে বাড়ি করে আছে সেটাও ওঠে রয়েছে অন্যের নামে। আর যে দাগ নম্বরে জমি পেয়েছিল সে দাগ নম্বর আবার অন্যের নামে খতিয়ান হয়ে রয়েছে। কালুর বাবা ছিলেন শাঁখারী। পুরনো ব্যবসাটাও এদেশে এসেও জিয়িয়ে রেখে ছিলেন। জীবন ও জীবিকার টানে শিখতে হয়েছে এদেশের বুলিও। কালুও বাবার পথেই গেছে, তবে বাড়ির পাশে যে এক টুকরো জমি আছে তাতে সে শাক-সব্জিও ফলায়। কালুর বাবার দূর-দূর থেকে ডাক আসতো শাঁখা পরানোর জন্য। কালুর বাবা এত যত্ন করে শাঁখা পরাতেন যে কেউ কোনদিন হাতে ব্যথা টেরই পেত না। কালু বাবার এই গুণটি রপ্ত করতে না পারলেও চাষাবাসের দিকটা ভালোই পারে। কালু শহরের যায় শাকসব্জি ফেরি করতে যায়। সাইকেলের পেছনে মস্ত একটা বাঁশের খাচায় বারো জাতের টাটকা শাক সব্জি নিয়ে শহরের গলিগুলোতে ঘুরে বেড়ায়। শহরের বাবুদের কাছে কালুর সব্জির কদর বেশ। গলির ভেতর ঢুকেই কালু চিৎকার করে,
--- সব্জি লাগবে!.. সব্জি..!
আর সদ্য গজিয়ে ওঠা নতুন পাড়ার ফ্ল্যাট বাড়িগুলো থেকে লোকজন নেমে আসে শাক-সব্জি কিনতে। আজকাল অন্তর্জালের দুনিয়ায় সব কিছুই ঘরে বসে পাওয়া যায়। জামা-কাপড়, মাছ-মাংস, রকমারি প্রসাধনী সমস্ত কিছুই বাড়ি এসে পৌঁছে দিয়ে যায়। কিন্তু এসব থাকা সত্ত্বেও কালুর শাক সব্জির চাহিদা একটু অন্যরকম। দু-তিনটে গলি ঘুরতেই তাঁর সব্জির খাঁচা খালি হয়ে যায়।
সপ্তাহে দুটো হাটে কালু শাঁখা নিয়ে বসে। সোনারপুর ও মধুপুর। দু'এক জোড়া বিক্রি করতে পারলেই তাঁর হাজিরা উঠে যায়। প্রত্যেক হাটে আবার বিক্রিও হয় না। কোনও কোনও হাটে তাঁকে খালি হাতেও ফিরতে হয়। মেয়ে জয়া, এবারে উচ্চ-মাধ্যমিক দিয়েছে, ফল বের হয়নি এখনও। কালু চাইছে যে করেই হোক এবছরের মধ্যেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেবে। পড়াশুনোয় তেমন ভালো না হলেও মেয়েটির বেশ আগ্রহ আছে। কালুও মনে করেছিল মেয়েটিকে বি.এ পাশ করিয়েই বিয়ে দেবে। তাছাড়া পড়াশুনার খরচও এখন আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। আর লোকের মুখে শুনেছে কলেজে গেলে নাকি মেয়েরা খারাপ হয়ে যায়। কালুর গ্রামের দু'একটি মেয়ে এর আগে কলেজে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু পড়াশুনার বদলে অন্যকিছু বেশি হওয়ায় মেয়েগুলোর নামে গ্রামে খারাপ রটনা রটে।
জয়ার অমতেই তাঁর বিয়ের কথা হচ্ছে। ছেলেটার চরিত্রদোষ না থাকলেও শারীরিক কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় ছেলেটির বাঁ-পা একটু ছোটো। কিছুটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে। লোকে ডাকে খোড়া গোবিন্দ। এই খোড়া গোবিন্দের নাম শুনেই জয়ার সখীরা হাসাহাসি করে। একদিন জয়া তাঁর দল বল নিয়ে গোবিন্দকে শাসিয়ে আসে। বলে,
--- বিয়ে করার শখ হয়েছে তো অন্য কোথাও যা। আমার পেছনে পড়লি কেন? আবার যদি ঘটক পাঠাস তো তোর আরেক পা খোড়া করে দিয়ে যাবো!
কিছুদিন পরে জগা ঘটক আরেক পাত্রকে নিয়ে হাজির হয়। পাত্র স্কুল শিক্ষক। জয়ার বিয়েতে মত না থাকলেও সেজেগুজে পাত্রের সামনে হাজির হয়। জগার মুখে ফুলঝুরি ছোটে জয়ার রূপ-গুণের বর্ণনায়।
---মেয়ে লক্ষ্মী, ঘর-বাহির একহাতে সামলায়। কোনো কাজে না-নেই।
ছেলেটির কাকা জয়াকে দেখে এক এক করে প্রশ্ন শুরু করলেন।
---কি নাম তোমার মা?
---জয়া দত্ত!
---বাবার নাম?
--- কালু দত্ত
---কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়ছো?
--- উচ্চ-মাধ্যমিক দিয়েছি!
--- ভালো!
কাকাবাবু একটা খাতা ও কলম চেয়ে পাঠালেন। তারপর জয়ার হাতে দিয়ে বললেন,
--- তোমার নাম ঠিকানাটা লেখো তো মা?
জয়ার হাত কাঁপছিল, কী কঠিন পরীক্ষা! কম্পিত হাতে জয়া লিখে যাচ্ছে। জয়া দশ মিনিট পরে খাতাটি বাড়িয়ে দিল। কাকাবাবু ভালো করে দেখে নিলেন খাতাটি। আবার শুরু হল একপালা প্রশ্ন,
--- তোমার এই হাতটা দেখি মা?
জয়া হাত বাড়িয়ে দিল। কাকাবাবু আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করে দেখে বলল,
---রাক্ষসগণ!
---তোমার চুলটা একটু খুলো দেখি?
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জয়ার মা খোপা খুলে দেখালেন।
---একটু হাঁটো তো দেখি মা?
জয়া ঘরের মেঝেতে এপাশ-ওপাশ হাঁটল।
কাকাবাবু এবার অন্যদের উদ্দেশে বললেন,
---তোমাদের কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে করো !
শিক্ষক ছেলেটি জিজ্ঞেস করল,
--- তুমি রান্নাটান্না কিছু জানো?
---ঠিক-ঠাক জানে না তবে শিখতে ক'দিন? পেছন থেকে জয়ার মা বললেন।
কনে দেখা শেষ করে জয়ার হাতে একশটি টাকা গুজে দিয়ে সবাই ফিরে গেলেন। সপ্তাহ খানেক পরে ঘটক শোনালেন একরাশ দাবি দাওয়ার কথা। জয়াকেও পছন্দ হয়েছে কিন্তু স্কুল মাস্টারের সাথে বিয়ে দিতে হলে একটি দামী মোটর সাইকেল সহ লাখ তিনেক টাকা নগত দিতে হবে। কালু বিয়ের পণ হিসেবে লাখখানি টাকা জমিয়ে রেখেছিল। কিন্তু বিয়ের পণ হিসেবে এতো টাকা চেয়ে বসবে ধারণা করতে পারেনি। কিছুটা বিপাকে পড়ে গেল কালু। বাড়িতে বিক্রি করার মতো ওই জমিটুুকুই। আর কালো রঙের একটি আদরের ষাঁড় গোরু। ভেবে ছিল ষাঁড় বড়ো হলে আরও একটা কিনে হালের জোড়া করবে সে। কিন্তু জমি বা ষাঁড়টা বিক্রি করে দিলে পরবর্তীতে কিভাবে চলবে, এসব নিয়েও সে ভাবছে। আবার পাত্রটিও হাত-ছাড়া করতে চাইছে না। অনেক ভেবে-চিন্তে কালু একটা ঝুঁকি নিয়ে বসল। দর কষাকষিতে হাজার পঞ্চাশেক কমানো গেলেও বিয়ের আগেই সমস্ত টাকা দিয়ে দিতে হবে - এ হল শর্ত। কালু জমিটুকু বিক্রি করল, তারপর আজ ষাঁড় গোরুটিও।
কালু জমি-গোরু বিক্রি করে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হলেও জয়া রাণীর আচরণে কোনও প্রস্তুতি নেই। সে খোড়া গোবিন্দকে যেমন ভাবে শাসিয়ে ছিল ঠিক তেমনি ভাবেই সে তাঁর স্কুল শিক্ষক হবু বরটির সঙ্গে গোপনে দেখা করে। ছেলেটির মুখে ওপর বলে দেয়,
--- আপনি না শিক্ষক? এই মুখটা দেখাতে লজ্জা করে না। এতো কারি কারি টাকা নিয়ে বিয়ে করতে চাইছেন! কি শেখাবেন আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের!
তারপর জয়ার বিয়েটা ভেঙে যায়। কেন বিয়ে ভেঙে যায় কেউ বুঝতে পারে না, ঘটকও না। পাত্রের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, সে এখন বিয়ে করতে রাজি নয়।
কালু তাঁর জমিটা ফিরে পেলেও ষাঁড়টিকে আর ফিরে পেল না। তারপর কিছুদিন পর থেকে জয়া কালো ছাতা মাথায় দিয়ে বান্ধবীদের সাথে সবুজ সাথীর সাইকেল চালিয়ে কলেজ যেতে শুরু করল। কালু ষাঁড় বিক্রির টাকা নিয়ে হাটে গিয়ে অনেক দেখেশুনে একটা গাভী পছন্দ করে। গাভীর ওলানে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে লাথি দেয় কি-না? তারপর আবার গাভীর মালিককে বলে,
--- গাই খান পছন্দ হইছে! কত চাইস ক ক্যানে?
--- দিস পঁচিশ। পঁচিশ হাজার দাম চাইল লোকটি। কালু গলার গামোছাটা কিছুটা বড় করে নিয়ে গামোছার নিচে লোকটির হাতটি টেনে নিয়ে দর-দাম শুরু করল,
--- হইবে?
--- না-রে!
--- এইটায়?
ইত্যাদি ইত্যাদি।
শেষটায় কালু গাভীটিকে নিয়ে বাড়ি আসে।
বুদ্ধিজীবী
সপ্তক
পরদিন সকালে রোজকার মত বিছানাতেই খবরের ব্রিফগুলো অনলাইনে একবার দেখে নিচ্ছিল প্রদীপ্ত, প্রথমেই মন হতাশ করা খবর 'শহরে আবার গণধর্ষণ : কলেজ পড়ুয়া তরুণীর রক্তাক্ত দেহ'। খবরটা ডিটেলে পড়তে গিয়ে যেন ইলেকট্রিক শক খেল সে। লেখা রয়েছে, "বছর না ঘুরতেই আবার শহরে গণধর্ষণ। শনিবার মধ্যরাতে প্রধান সড়ক লাগোয়া ড্রেনের ধারে এক তরুণীকে রক্তাক্ত দেহে পড়ে থাকতে দেখলে এক পথচারী টহলদারি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখনো তরুণীর দেহে সংজ্ঞা ছিল। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে পুলিশ। হাসপাতালে যাওয়ার পথে যেটুকু সে কথা বলতে পেরেছিল তা থেকে পুলিশ জানতে পেরেছে সে এক অসুস্থ আত্মীয় কে দেখে বাড়ি ফিরছিল বাসে করে। বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রীরা নামতে থাকলে একসময়ে সে ছাড়া আর মাত্র চারটি ছেলে গাড়িতে ছিল। তাকে একা পেয়ে ঐ চারটি ছেলে তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করতে থাকে, ড্রাইভারও তাতে সঙ্গ দিয়েছিল। তার নামার সময় হলে নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস না থামিয়ে বাসের গতি বাড়িয়ে দেয় ওরা। বাসের মধ্যে ধর্ষিতা হয় সে। তরুণীটি জানাতে পেরেছে যে, ঐ বাসে লেখক প্রদীপ্তশেখর মুখার্জীর সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল এবং ঘটনার কিছু আগে তিনি গন্তব্যস্থলে নেমে গিয়েছিলেন, ঐ মদ্যপগুলোকে তিনি দেখেছেন বলে তরুণীর দাবী।" উত্তেজিত প্রদীপ্ত টিভি চালিয়ে দিলো। প্রত্যেকটা চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ ঐ একটাই খবর। প্রদীপ্ত চ্যানেল ঘোরাতে থাকল। একটি চ্যানেলে বলছে, "হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই সংজ্ঞা হারায় তরুণীটি। তবে পুলিশকে সে যেটুকু জানিয়েছে তার ভিত্তিতেই তদন্তপ্রক্রিয়া শুরু করবে পুলিশ। উল্লেখ্য, তরুণীটি জানিয়েছে ওই বাসে লেখক প্রদীপ্তশেখর মুখার্জি ঘটনার কিছুক্ষণ আগপর্যন্ত তার সহযাত্রী ছিলেন এবং তিনি অপরাধীদের দেখেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এ ব্যাপারে প্রদীপ্ত শেখর মুখার্জীর সঙ্গে শীঘ্রই যোগাযোগ করা হবে এবং তাদের আশা, প্রদীপ্তশেখরের বিবৃতি তদন্তপ্রক্রিয়ায় অনেকটাই সাহায্য করতে পারে। চ্যানেলের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই প্রদীপ্তশেখর মুখার্জীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু হয়েছে , এ ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা চলছে।" টিভি বন্ধ করে দিল সে। সে এখন যাই বলুক না কেন তার প্রতিটা বক্তব্যের ব্যাখ্যা করবে চ্যানেলগুলো, তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ পাবলিকলি নিউজ হয়ে যাবে। তাই যথেষ্ট ভেবে পা ফেলতে হবে। সে মনে করার চেষ্টা করল, সে বাস থেকে নামার আগেই নবদম্পতিটি নেমে গিয়েছিল কোনো এক জায়গায়। নামার সময় লক্ষ্য করেছে ঐ চার যুবক তাস খেলা বন্ধ করে একটি মোবাইলে কিছু দেখছিল এবং বিশ্রী ভঙ্গিতে হেসে উঠছিল, বসার ভঙ্গিতে যথেষ্ট উদ্ধত ভাব, ওদের চেহারার বিবরণ হয়তো সে কিছুটা দিতে পারবে। ঘড়িতে এখন ছ'টা বাজতে দশ। হয়তো এখনই থানা থেকে ফোন আসবে বা চ্যানেল থেকে লোক আসবে। দিশা আর টুকটুক এখনো ঘুমোচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি দিশাকে ডাকল।সাতসকালে স্বামীর মুখে এহেন বিড়ম্বনার খবর শুনে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো সে। দেখতে দেখতে বেজে উঠলো মোবাইল। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে একটা কঠিন কন্ঠস্বর বলে উঠলো, "মুখ খুললে ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। শুধু বলবেন আপনি কাউকে লক্ষ্য করতে পারেননি। জেনে রাখবেন, অনেকগুলো চোখ কিন্তু আপনাকে নজরে রাখছে। এই ফোনের কথা পুলিশকে বা কাউকে জানিয়ে বিপদ বাড়াবেন না।" ধাতস্থ হয়ে প্রদীপ্ত কোনোরকমে জিজ্ঞেস করল, "আপনি কে বলছেন?" "বেশি সাহস দেখানোর চেষ্টা করবেন না" ওপাশের ফোন ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। রাখতেই আবার বেজে উঠলো ফোন, "আমাদের খবর' চ্যানেল থেকে চিফ এডিটর বলছি, প্রদীপ্তশেখর মুখার্জীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।" বিরক্ত হয়ে "এখন বলা যাবে না" বলে সে ফোন রেখে দিল। আবার ফোন, এবার থানা থেকে, জানিয়ে দিল, সকাল ন'টার সময় স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ প্রদীপ্তর সঙ্গে বসতে চায়, প্রদীপ্ত যেন সহযোগিতা করে। দু মিনিটের মধ্যেই আবার বেজে উঠল মোবাইল, একটা ঠান্ডা কন্ঠ বলে উঠল, "বেশি চালাকি করলে লাশ হতে দু ঘন্টা সময় লাগবে না। থানায় গিয়ে কি বলছিস সে খবর সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাব। তোর পরিবারের প্রাণ এখন আমাদের হাতে। তোর মেয়েটারও কিছু হয়ে যেতে পারে।" ফোন সুইচ অফ করে দিল প্রদীপ্ত। কিন্তু দিশার ফোনে ফোন আসতে থাকল অনবরত, কখনো চ্যানেল থেকে, আবার কখনো সেই হাড় হিম করা গলায় হুমকি।
ঘটনার পরম্পরায় বিধ্বস্ত প্রদীপ্ত অসুস্থ হয়ে পড়ল। দিশার ভাই ফোনে জানতে পেরে চলে এলো, প্রদীপ্তকে ভর্তি করানো হল নার্সিংহোমে। ডাক্তার বলল, "মাইল্ড স্ট্রোক"। বিকেলে আই সি ইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হল তাঁকে। থানার ওসি দেখা করতে এলেন, তাঁর শরীরের খোঁজখবর নিলেন, তারপর বললেন, "ভিক্টিমের এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ওর মা ও ভাই আপনার সাথে কথা বলতে চায়। যদিও আমি এখুনি ওদের আসতে বারন করেছি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে, কাল বিকেলের মধ্যে আপনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে যাবেন বলে মনে হয়। দুজন স্পেশাল দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসবেন। আশা করি আপনি আমাদের হতাশ করবেন না।" একটু হেসে যোগ করলেন, "পুলিশের কাজের চুলচেরা বিশ্লেষণ তো অনেক হয়েছে, কিন্তু এবার বুদ্ধিজীবীদের মূল্যায়নের দিন এসে গেছে প্রদীপ্তবাবু, কথাটা মাথায় রাখবেন।"
অফিসার চলে গেলে সে দেখল, দিশা আর টুকটুক দাঁড়িয়ে আছে। উৎকন্ঠায় দিশার মুখ শুকনো, কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল। দিশা এগিয়ে এসে বলল, "তোমার ভালোটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে প্রদীপ্ত, মেয়েটির পরিবারের পাশে কিন্তু সবাই আছে, পুলিশ, সরকার সবাই, মুখ্যমন্ত্রী পাঁচলাখ টাকা সাহায্যের ঘোষণা করে দিয়েছে। সমস্ত মানবাধিকার সংগঠন এগিয়ে এসেছে। তোমার পাশে কিন্তু কেউ নেই। তোমার কিছু হলে আমাদের কে দেখবে? মেয়েটার কথা অন্ততঃ একটু ভাবো!" দিশা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে টুকটুক বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, "তুমি মায়ের কথায় কান দিও না বাবা, তুমি ভয় পেয়ো না, পুলিশকে সত্যি কথা বলো, আমি তোমার পাশে আছি বাবা।" টুকটুক এবার মাধ্যমিক দেবে। এই সরল নিষ্পাপ মেয়েটার বাইরের জগৎ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। টুকটুক তো বড় হচ্ছে, সত্যিই যদি ওরা কোনো ক্ষতি করে দেয় সে কি করে সহ্য করবে! প্রদীপ্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় সে পুলিশকে জানিয়ে দেবে সে কাউকে লক্ষ্য করেনি।
চৈত্রশেষের বৈশাখী
সোমা বোস
চৈত্রের
কাঠফাটা দুপুরে রৌদ্রের প্রখর তেজের ফলস্বরূপ আজ বিকেলে এই প্রবল দমকা হাওয়ার ঝাপটা
যেন অবধারিতই ছিল।
ধুলোবালি
উড়িয়ে তা সকলের দহনজ্বালাকে নিমেষে শান্ত করে দিল। বৈশালীর বিরহজ্বালারও
অবসান হবে যে আজ!
তাই সন্ধ্যের
মিষ্টি শীতল হাওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে আজ অনেক কেনাকাটা করে নিলো সে। এই প্রথম তারা দু’জনে বাংলা নববর্ষ একসাথে
কাটাবে।
গতকাল খড়গপুরে
সাইটে থাকা অনিন্দ্যর মেসেজ এসেছে যে, সে তিনদিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পেরেছে। অতএব এই উইকএন্ডে সে
নিশ্চিন্তে তাদের সাথে বাড়িতে ছুটি কাটাতে পারবে। এদিকে ইয়ার এন্ডিং এর
পর তার কাজও এখন একটু হাল্কা আছে।
আগামী পরশু
পয়লা বৈশাখ,
বাংলা নতুন
বছর এবং তাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী।
এসময়ে অনিন্দ্য
বাড়িতে থাকবে বলে আসছে,
তাই আনন্দের
আতিশয্য আর চেপে রাখতে পারছে না সে।
একটু বেশীই
কেনাকাটা হয়ে গেলো।
অনিন্দ্য
যা যা খেতে ভালোবাসে,
মনে করে
করে দু’হাত ভরে বাজার করে খুশিতে
পাখনা মেলে দিলো তার মন।
বিয়ের পর
থেকে প্রতিমাসের শুরুতেই মনে হত এ মাসে অন্তত একটা উইকএন্ড তারা একসাথে কাটাবে। মনের মধ্যে ওই একসাথে
কাটানোর ভাবনাটা বেশ লাগতো।
দিনগুলো
নিয়ে অজস্র স্বপ্ন রচিত হওয়া,
অজস্র কল্পনার
জাল বুনতে থাকা…
ব্যস, ওই পর্যন্তই। একসময় খেয়াল হল যে এভাবে
একের পর এক মাস পার হতে হতে বিয়ের পর বারোটা মাস প্রায় অতিক্রান্ত। অনেক অনুসন্ধান করে দেখা
গেছে যে এব্যাপারে একমাত্র মূল আসামী হল তাদের দু’জনের কর্মব্যস্ততা। এ বলে আমায় দ্যাখ, তো ও বলে আমায়। অনিন্দ্য একজন মেকানিক্যাল
ইঞ্জিনীয়র এবং ভারতীয় রেলের একজন আধিকারিক। তাই প্রায়ই তাকে নানা ট্যুরে
এদিক ওদিক যেতে হয়।
ছুটি মোটেই
সহজলভ্য নয়।
এদিকে বৈশালীর
ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার।
সে একজন
সফল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
প্রায় সারাবছর
তাকেও অডিট সংক্রান্ত কাজে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে হয়।
দক্ষিণ
কলকাতার পঁচিশের স্মার্ট তরুণী বৈশালী ও উত্তর কলকাতার আঠাশের ঝকঝকে তরুণ অনিন্দ্যর
পরিচয় হয় ট্রেনের এক এসি টু টায়ারের কামরায়। যার যার প্রফেশনাল ট্যুরের উদ্দেশ্যে
দুজনেরই যাত্রা করার ছিল।
ট্রেন ছাড়ার
ঠিক শেষ মূহুর্তে সেই সন্ধ্যায় সেই কামরায় দু’জনেরই প্রায় একসাথে হন্তদন্ত
হয়ে প্রবেশ।
সীট খুঁজে
লাগেজ ঠিকঠাক করে রেখে মুখোমুখি জানালায় বসে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা। ট্রেন ছাড়ার পরমূহুর্ত
থেকে দু’জনেরই নিজ নিজ মোবাইল
ফোনে কথোপকথনে প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়া…।
একে অপরের
জোরে জোরে করা ফোনালাপের দরুণ নিজের নিজের ফোনালাপে অসুবিধে অনুভব করা এবং পরস্পরের
দিকে বিরক্তিসূচক দৃষ্টি হানা....
এপর্যন্ত
সবই ঠিকঠাক ছিল।
কিন্তু
একরাত ও অর্ধদিনের সেই আলাপচারিতা কখন যে ক্রমশ বাড়তি মাত্রা পেয়েছিল তা বোধকরি নিজেরাও
কেউ টের পায়নি।
মদনদেবতা
বুঝিবা গোপনে তাদের প্রতি তাঁর শর নিক্ষেপ করে দিয়ে অলক্ষ্যে মুচকি হেসেছিলেন। তাই বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময়
দিয়ে শুরু হয়ে সেযাত্রা যাত্রা শেষ হয় মোবাইল-নম্বর বিনিময় দিয়ে। তারপর ওই যা হয় আর কি। শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়
প্রচুর ভাববিনিময়।
তারপর তাদের
সেই অনুরাগের পরশ পৌঁছে যায় বাড়ির লোকেদের ভাবনায়।
দু’জনেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে
প্রতিষ্ঠিত ও স্বাধীন।
তাই কারোর
বাড়ি থেকেই কোনো আপত্তির প্রশ্ন নেই।
তবে বাঙাল-ঘটির ফারাক একটা ছিল
দুই পরিবারের মধ্যে,
কিন্তু
ও ফারাক ধোপে টেঁকেনি কারোর মনে।
তাই দু'পরিবারের সকলে সানন্দে
রাজী ও প্রস্তুত ছিল তাদের মধ্যে পাকাপাকি সম্পর্ক স্থাপনে। কিন্তু এহেন অনুকূল পরিস্থিতি
থাকা সত্ত্বেও সেই পরিণতি পেতে সময় লাগে পাক্কা আরও তিন তিন’টি বছর। প্রথমে অবশ্য অনিন্দ্যর
বাবা অনিমেষ সান্যাল গত হন,
তার জন্যে
একবছর সময় বাদ যায়।
কিন্তু
তারপরের দু’বছরেও তারা বিন্দুমাত্র
সময় বের করে উঠতে পারেনি।
সেখানেও
একমাত্র মূল আসামী কিন্তু ছিল সেই কর্মব্যস্ততা। না, সময় বা অদর্শন কিন্তু
তা বলে তাদের অনুরাগে থাবা বসাতে পারেনি। বরং তা উত্তরোত্তর সুদে-আসলে বৃদ্ধি পেয়েছে। দু’পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও
যাতায়াত এবং ভাববিনিময় ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ কলকাতার মধ্যকার
তীব্র যানজটসম্বলিত স্থানিক দূরত্ব ক্ষীয়মাণ হয়ে গিয়েছিল আত্মীয়তার মেলবন্ধনে। কর্মব্যস্ত এই দুই পাত্র-পাত্রী যে তাদের শুভপরিণয়ের
জন্যে শেষপর্যন্ত সময় বের করতে পেরেছিল এতেই তাঁরা নিজেদেরকে ধন্য মনে করে আজও। আর এসব কথা মনে পড়লে
বৈশালী ও অনিন্দ্য এখনও হেসে ওঠে।
-
মা, ও তো এখনো এলো না গো! রাত ৯টা বেজে গেলো
যে!
-
আসবে
আসবে।
তোকে বলেছে
যখন, ঠিক আসবে। কোনো কাজে ফেঁসে গেছে
হয়তো।
-
হুমমম...।
-
আচ্ছা তুই একটা ফোন করে দেখনা এখন কোথায় আছে!
-
সন্ধ্যে
থেকে অনেকবার করেছি মা,
কিন্তু “নট রিচেবল” বলছে।
-
তাহলে
মেট্রোয় আছে নিশ্চয়ই।
এখুনি এসে
যাবে।
চিন্তা
করিস না।
-
এতক্ষণ ধরে মেট্রোয়!
এমনসময় বৈশালীর ফোন বেজে উঠলো…
-
দ্যাখ
নিশ্চয়ই বাবাইয়ের ফোন।
ধর, কথা বল...।
-
হ্যাঁ
মা, ওরই ফোন। হ্যালো, তুমি কোথায়? এতো দেরী হচ্ছে কেন আসতে? বলেছিলে সন্ধ্যের সময়
আসবে।
আমি আর
মা চিন্তা করছি তো!
হ্যালো, শুনতে পাচ্ছো? হ্যালো…
(এরপর অনেকক্ষণ চুপ)
-
কী
হল? তোর কথা শুনতে পাচ্ছে
না? দে আমায় দে ফোনটা। ওকি! তুই ওরকম করছিস কেন? কী হল তোর? আরে!
কোথা
দিয়ে যে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা গোটা দিন পার হয়ে গেলো, তা টেরই পেলো না নীলিমা। হাওড়া স্টেশন থেকে বেরনোর
সময় আচমকা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় অনিন্দ্য, রেলওয়ে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ। সঙ্গে থাকা সহকর্মীই
ওর ফোন থেকে বৈশালীকে ফোনে সব জানায়।
ছেলের নিথর
দেহ বাড়িতে এলে পরে সকলকে খবরাখবর দেওয়া, তারপর তাকে দাহ করার ব্যবস্থা করা, এদিকে অচৈতন্য বৈশালীকে
রেলওয়ে হসপিটালে হসপিটালাইজ করা...। বৈশালীর বাবা, মা, ভাই খবর পেয়ে একমূহুর্তও
দেরী করেন নি।
পাশে থাকা
দেওর অনুতোষ,
তার স্ত্রী
ও ছেলে এবং অবশ্যই প্রতিবেশী সকলে পাশে থাকায় শেষমেশ সবদিক সামলে ওঠা সম্ভব হয়। নীলিমার জীবনে যেন আচমকা
যবনিকাপাত হলো।
স্বামীর
মৃত্যুর চার’বছরের মাথায় তরতাজা পুত্রকেও
হারাতে হবে,
এ তিনি
কল্পনাও করেন নি।
একমাত্র
পুত্রবধূ হাসপাতালে।
চৈত্রসংক্রান্তির
কালবৈশাখী ঝড় তাঁর সব অবলম্বনকে যেন উড়িয়ে নিয়ে গেলো! বৈশালী কি সুস্থ হয়ে উঠবে? সুস্থ হলেও কি তাঁর সাথে
আর থাকবে?
সুন্দরী
প্রতিষ্ঠিত এক মেয়ে।
এই অল্পবয়সের
বৈধব্য আজকালকার দিনে কে’ই বা আর মানে? আর কেনই বা মানবে! সে মানতে চাইলেও তিনি
তাকে মানতে দেবেন না।
আজ পয়লা বৈশাখ। মেয়েটা কত সাধ করে তার
বাবাইয়ের জন্যে কত কিই না বাজার করে এনেছিল। বৈশালীর ভাই জানিয়েছে তাকে আজ
বিকেলে হসপিটাল থেকে ছেড়ে দেবে।
সে কোন
বাড়িতে ফিরবে তিনি জানেন না।
ভাই যাচ্ছে
যখন তখন হয়তো...। তবু তিনি যাবেন তাকে
আনতে।
কিন্তু
মেয়েটা কিসের টানে আর ফিরবে তাঁর কাছে! তবু তিনি যাবেন, কন্যাসন্তান ছিল না বলে এই মেয়েটাকেই
যে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলেন।
হসপিটালে
একটু তাড়াতাড়িই কি চলে এলেন?
কই, আর কাউকে দেখতে পাচ্ছেন
না তো।
দ্যাওর
অনুতোষ ও তার স্ত্রী তাকে সযত্নে নিয়ে এসেছে। অনুতোষ অনেকবার বারণ
করেছিল তাঁকে আসতে।
তাঁর শরীর
ও মনের এই অবস্থায় ছোট’জা শেফালীও বারবার বলছিল “মেয়েটাকে আমরাই এবাড়িতে
ঠিক নিয়ে আসবো দিদি,
তুমি চিন্তা
কোরো না”। কিন্তু তাঁর মন মানেনি। যদি তাঁকে দেখতে না পেয়ে
অভিমানী মেয়েটা ভাবে
“ছেলে নেই
বলে মায়ের কাছে আমার আর দাম নেই!”
তাতে যদি
আর না আসে!
তবে না
আসতে চাইলেও আর কি জোর করার অধিকার থাকবে তাঁর? তবু আসলেন মেয়েটাকে একটু চোখের
দেখা তো দেখতে পাবেন,
তাই...। একটু পরেই বৈশালীর ভাই
এসে ডাক্তারের সাথে কথাবার্তা বলে আর বিলটিল সব মিটিয়ে ওর রিলিজ অর্ডার নিয়ে এলো…….
-
আন্টি, তুমি ভেতরে এসো। দিভ্ভাই তোমাকে খুঁজছে। ডাক্তার নাকি বলেছে তুমি
ঠাম্মা হতে যাচ্ছ!
তাই নববর্ষের
প্রথম প্রণামটা সেই ঠাম্মাকেই ও করতে চাইছে। এসো, এসো...।
নববর্ষ
অমৃতা মৌয়ার
জুলুজুলু চোখে ঘরে ঢুকেই প্রশ্নটা করে ফেলল সে-
"দিদি,তুই কার সাথেরে?বাবা না মা?"
স্কুলের মোজাটা পায়ে গলাতে গলাতে অরুণিমা বলল-
"কেন রে,তোর কি দরকার শুনি?
"বল না,তুই কার সাথে?"
এবার অরুণিমা একটু মুচকি হেসে তাকাল ভাই-এর দিকে। বলল,"যা,আমি মায়ের দিকে। এবার তোর জন্য ছেড়ে দিলাম বাবাকে।" আর সাথে সাথেই ঠোঁটের দুই কোণ থেকে একরাশ হাসি ছড়িয়ে পড়ল ছোট্ট অভীর চোখে। আগের বছর অভী ছোট ছিল বলে, মা বলেছিল- "অভী নববর্ষের দিন তুই আমার সাথে যাবি আর দিদি যাবে বাবার সাথে বাইকে।" তখন কী আর জানত অভী! বাড়ি ফিরে দিদিইতো বলল,বাবার দোকানগুলোতে দিদিকে নাকি চারটে আইসক্রিম খাইয়েছে। ওইদিকে মায়ের দোকানগুলোতে তো ছিল শুধু লস্যি। আর লস্যি অভীর একদম ভালোলাগেনা। কিন্তু এবছরতো অভী বড় হয়েগিয়েছে। এখন সে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। তাই বাবার সাথে এবার সেই-ই যাবে বাইকে করে। ভাবতে ভাবতেই ছোট্ট ছোট্ট পা নিয়ে দৌড় দিল সে মায়ের কাছে রান্নাঘরে- "মা মা,কালকে আমি কোন জামাটা পরব?"...টেবিলে রাখা মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠতেই ডাইনিং-র জানালা থেকে সরে দাঁড়াল অভী। নাজানি কতক্ষণ যে সে ওই ছেলেবেলার দিনগুলোতে ডুবেছিল! দেখল স্ক্রীনে ভাসছে ওর ছোটবেলার বন্ধু মৈনাকের নাম। এই একটা স্বভাব মৈনাকের। জন্মদিন হোক কি নববর্ষ বা বিজয়া দশমী সমস্ত ওকেসনে ও ঠিক ফোন করবেই। কিন্তু এখন আর ফোনে কথা বলতে ইচ্ছা করছেনা অভীর। পরে দুপুরের দিকে কলব্যাক করে নেবে নাহয়। মোবাইলে টাইমটা চেক্ করে কিচেনে ঢুকল অভী। ঝট্পট্ ভাত আর একটা কিছু সব্জী বানিয়ে ফেলবে। কালকের ডাল আর মাছ আছে ফ্রীজে। নাহ্ অন্য দিনগুলোর জন্য এক 'আক্কা' মানে দিদি আছে রান্নার। কিন্তু রবিবার করে তার আবার ছুটি। তাই এই একটা দিন অভী নিজেই কিছু রান্না করে ফেলে। আর সত্যি বলতে টুকটাক্ রান্না করতে ভালোই লাগে ওর। সেই ছোট থেকেই মায়ের সাথে সাথে রান্নাঘরে ঘুর ঘুর করত অভী। কখনো একটু খুন্তি নাড়ছে বা মটরশুটি ছাড়াচ্ছে আবার কখনো বা ডিম ফেটাচ্ছে এসব করতে বেশ ভালোই লাগত তখন। তাই এখনো সময় পেলেই কিছু না কিছু বানিয়ে ফেলে সে। তেলে গরম মশলা ফোড়ন দিতেই সেই চেনা গন্ধটা লাগল এসে নাকে। আজকের দিনে কতকি রান্না হত তাদের বাড়িতে। সেই সকালবেলা পূজা সেরে মা ঢুকত রান্নাঘরে। তারপর নববর্ষ শুরু হত লুচি আর ছোলার ডাল সহযোগে। দুপুরে আরও কতকিছু বানাত মা। কতরকমের ভাজা,তরকারি,মিষ্টি। হ্যাঁ সেদিন নিরামিষই হত তাদের বাড়িতে। বাবাও সেদিন মায়ের সাথে থাকত রান্নাঘরে। বলত ,"দেখো আজ তোমাদের কেমন আমার হাতের ফুলকো লুচি খাওয়াই। মুখে দিতেই যেন এক্কেবারে গলে যাবে।" শুনে মা শুধু মুচকি হাসত। অভী আর দিদির উপর দায়িত্ব থাকত লুচির ময়দাকে গোল গোল করা। কী ভাল লাগত অভীর! কেমন সাদা সাদা। আর কত্ত নরম। ফ্রিজ থেকে মাছটা বের করতে করতে শুনতে পেল অভী। কোন একটা বাংলা চ্যানেলে কিছু অনুষ্ঠান হচ্ছে নববর্ষের। মাঝে মাঝে গান আর কিছু কথাবার্তা ভেসে আসছে কানে। এইতো বছর কয়েক আগে অভীদের বাড়িতেও তো ঠিক এরমই আসর বসতনা বসার ঘরটাতে! বাবা আর দিদি হারমোনিয়াম নিয়ে কত কত গান গাইত সেদিন। খুব ভালো লাগত অভীর সেইসব গানগুলো। বিশেষ করে ওই গানটা- "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।" যখন বাবা আর দিদি দু'জনে একসাথে গানটা গাইত অভী অবাক হয়ে শুনত তাদের গান। তারপরে মা পড়ে যেত কত কত কবিতা। আদো আদো স্বরে ছোট্ট অভীও গলা মেলাত মায়ের সাথে- "হাঁ রে রে রে রে রে,ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে। তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে, ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে।" ছোট্ট অভীকে কোলে জড়িয়ে মা বলত- "ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল!কী দুর্দশাই হত তা না হলে।'...."ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল...ভাগ্যে খোকা"...কিন্তু অভী সঙ্গে ছিল কোথায়? ইন্জিনিয়ারিং তারপর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি নিয়ে দিল্লী পরে ব্যাঙ্গালোর। মা-বাবাকে কতটুকু সময় দিত সে।সারাদিনে ওই একটা ফোন। তাওতো কতদিন সেই ফোনটাও ভুলে যেত অভী। মা বাবা বা দিদি কেউ তখন ফোন করত ওকে। সেদিনও তো বাবার আসা ফোনটা বারবার কেটে দিচ্ছিল সে। ভেবেছিল সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে ফোনটা করবে। তারপর হল থেকেই ক্যাব নিয়ে ডিরেক্ট ছুটে গিয়েছিল এয়ারপোর্ট। বন্ধুদের যার কাছে যা টাকা ছিল তাই জোর করে দিয়ে দিয়েছিল অভীর হাতে। শেষ পর্যন্ত যখন বাড়ি পৌঁছল অভী বাড়িটা তখন শ'য়ে শ'য়ে লোকে ছেয়ে গেছে। বাবা দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে চেয়ারের এককোণে। বড় ঘরের বিছানাটায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে মা। আচ্ছা শেষ কবে মাকে এরমভাবে ঘুমোতে দেখেছিল অভী। সকালে যখন সে ঘুম থেকে উঠত মাকে দেখত রান্নাঘরে। আবার রাতে নিজের ঘরে যাওয়ার সময়ও দেখত মা রান্নাঘরে। একটা লাল রঙের শাড়ি পরে শুয়ে আছে মা। ঠোঁটে লেগে আছে মায়ের সেই মিষ্টি হাসিটা। আচ্ছা তার মাকে দেখতে ঠিক দুর্গা প্রতিমার মতো তাই না! দিদি কখন যেন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, হাতটা ধরে বলেছিল- "ভাই,মাকে একবার জড়িয়ে ধরবিনা?" আর সাথে সাথে অভীর দুই চোখ একেবারে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। স্নান সেরে খাওয়ারগুলো টেবিলে গুছিয়ে বাবাকে খেতে ডাকল অভী। মা মারা যাওয়ার পরে দিদি চেয়েছিল বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। কিন্তু দিদির তখন সাত মাস প্রেগনেন্সি। তাও ক্রিটিকাল। তাই কিছুটা জোর করেই বাবাকে নিয়ে এসেছিল সে নিজের কাছে ব্যাঙ্গালোরে। খেতে খেতে বাবা জিজ্ঞেস করল- "তুইতো আজ কোথায় যাবি বলেছিলিস বন্ধুদের সাথে।"..."ওই একটা হলে। মুভি দেখতে", বলল অভী।..."হুম্ যা একটু ঘুরে আয়। সেই তো সারা সপ্তাহ তোর অফিস আর কাজ। নিজের জন্য একটু সময় পাস কোথায়।"কিছু না বলে আবার মুখ নিচু করে খেতে থাকে অভী। সত্যি সারা সপ্তাহ সে নাহয় অফিস নিয়ে থাকে,কিন্তু বাবা! মানুষটাতো সারাদিন এই চারদেওয়ালে বন্দী। ওই সকালে একটু বাজার আর সন্ধ্যাবেলা বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটা। আর অভীই বা কতটুকু সময় কাটায় বাবার সাথে। অফিস থেকে ফিরে শুধু খেয়েছ কিনা আর শরীর কেমন আছে, এইতো। তারপর অভী ডুবে যায় তার হোয়াটস্অ্যাপ্ আর ফেসবুকের জগতে, আর বাবা আবার টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে কখন যেন ঘুমিয়ে পরে। হাতমুখ ধুয়ে রুমের ভিতর ঢুকতে গিয়ে অভীকে বলল বাবা, "ওহ্ দিদি ফোন করেছিল তোকে। তুই স্নানে গিয়েছিলি তখন। আজ নববর্ষ তো। একটা ফোন করিস দিদিকে।" একটু থেমে ফের বলল, "আর হ্যাঁ, আজ একটা নতুন জামা পরিস। তোর মা থাকলেও আজ এটাই বলত।" আচ্ছা আজ বাবারও নিশ্চয় মাকে খুব মনে পড়ছে। এত এত বছরে এই প্রথম নববর্ষে বাবা একা। মা মারা যাওয়ার পর বাবা হঠাৎ করেই যেন বুড়ো হয়েগিয়েছে। সবসবয় চুপ্, কেমন যেন মুষড়ে পড়েছে। কিন্তু এই বাবাই একসময় কত প্রাণবন্ত ছিল। কত মজা করত। বাবা মানেই ছিল হৈ হুল্লোর। আজ এই ফুচকা খাওয়ার প্ল্যান তো কাল দার্জিলিং যাওয়া। কিছু না কিছু নিয়ে মেতেই আছে বাবা। এখনও মনে আছে ওর,সেদিন জয়েন্টের রেজাল্ট বেরিয়েছে। অভী পারেনি ক্লিয়ার করতে। এদিকে প্রবাল,মৈনাক,সুস্নাত মোটামুটি ভালোই র্যাঙ্ক করেছে। সারাদিন নিজের রুম বন্ধ করে কেঁদেছিল অভী। দুপুরের খাওয়ারটাও খায়নি। সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে জোর করেই ওকে রুম থেকে বের করে ছাদে নিয়ে গেল বাবা। ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলল, "জানিস,তিনবারেও চাকরির পরীক্ষা ক্লিয়ার করতে পারিনি। বাবা বলেদিল ওসব ছেড়ে বাবার ব্যাবসা দেখতে। তবু জেদ ছাড়লামনা। আরও দু'বার চেষ্টা করতে ঠিক লাগিয়ে দিলাম ব্যাঙ্কে। তাই বলছি এভাবে ভেঙ্গে না পড়ে চেষ্টা কর। আর এখন চল্ তো নীচে। তোর জন্য গরম গরম কাটলেট এনেছি, তোর ফেভারিট্।" নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় বসে ইন্টারনেটটা অন্ করল অভী। সাথে সাথে স্ক্রীন ভরে উঠল নোটিফিকেশনে। বেশীরভাগই নববর্ষের শুভেচ্ছা আর কী। হোয়াটসঅ্যাপ অন্ করতেই দিদির মেসেজটা চোখে পড়ল অভীর। সেকেন্ডে স্ক্রীনে ফুটে উঠল একটি ফোটো। কোন একটা পার্কে। একটা সুন্দর ফুলের গাছের পাশে তোলা। বাবার কোলে অভী আর মায়ের কোলে দিদি। ঠিক কবে তোলা হয়েছিল ফটোটা মনে পড়ছেনা এই মুহূর্তে। কিন্তু বুকের ভিতরে একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে অভীর। ভারী কোনকিছু চেপে থাকার কষ্ট। গলার মধ্যে কিছু যেন একটা দলা পাকিয়ে আসছে ওর। কললিস্ট থেকে একটা নাম্বার ডায়াল করতেই ওপাশে রিং বেজে উঠল। অভীর দু'চোখ ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে উঠছে। ওপারের গলার আওয়াজটা পেতেই কাঁপাকাঁপা গলায় বলল অভী,"দিদি,এবার তুই কার দলেরে, বাবা না মা?" শুনতে পাচ্ছে অভী, দিদির বুক ভাঙ্গা কান্নার আওয়াজ। অভীর দু'চোখ দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে জল। দলা পাকানো কষ্টটা যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে গলা দিয়ে। ফোনটা কেটে দিল অভী। বালিশে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করল সে। কোথাও দূর থেকে ভেসে আসছে একটা খুব পরিচিত গান- "চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি, ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি, প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে,আনন্দধারা বহিছে ভুবনে।"...ফিরুকনা আবার একটা হারিয়ে যাওয়া সন্ধ্যা। আইসক্রিমের হাতছানি। বাবার সাথে অভী।...হোকনা এবার এক নতুন নববর্ষ।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
চৈত্র সংখ্যা ১৪২৪
কবিতা তৃতীয় পর্যায়
চৈতি
রবীন সাহানা
বাজুক বীনা সুরের ধ্যানে
কন্ঠে ভরুক আলোড়নে
কোমল পাতা ঝাঁকুক মাথা
কন্ঠ গাহুক আপন মনে।
ঝলকে ওঠা সকালবেলা
বজ্রনিনাদ সরল হাওয়ায়
ঢেউয়ের দোলা কঠিন হয়ে
আনুক তোমার আবেগ চিঠি।
স্নিগ্ধবতা শিখন সুরভ
সৃষ্টি সুখের মাতোয়ারা।
সাঁঝের রসিক চা-ওয়ালার
কাঁপবে না আর কাপের থালা।
গন্ধ ছড়াক শিরিষ ফুলে ,
গন্ধ শুকি কাঁচা আমে।
চৈত্র মাসে তালের রসে,
বক্ষ জুড়াক নিমেষ পানে।
কচি ছেলে গাছের ডালে
লাফ মারে সে খাদের জলে।
থাকবে কী তার লজ্জা শরম !
করবে দুফাল ঠান্ডা জলে।
কুলকুরানী কোকিল মণি
গাইছে প্রেমের অভূত বাণী
গাইছে কী সে আগমনী ?
দুপুর রোদে ঝোঁপের আড়ে।
এলো যে ডাক চড়ক পূজার
এলো গো ডাক শিব গাজনের ,
বাঁধব মরাই গম আর বোরোয়
সোনালী এই চৈতের দিনে।
চব্বিশে-পঁচিশে
সঞ্চিতা দাস
চৈতালি সুখ উড়িয়ে
ধ্বজা
কালবোশেখীর ঝড়-
শান্ত ধরা গুমোট করা
মনগুলো নড়বড়।
যাচ্ছে উড়ে পুরাতনের
যা কিছু সঞ্চয়,
নবীন জীবন আবার এসে
গড়বে পরিচয়।
চৈতালি সুখ সাতসকালে
শীতল শীতল বাতাস,
ভর দুপুরে তপ্ত তপন
ফেলে দীর্ঘশ্বাস।
ঘর্মাক্ত এই কলেবরে
চৈতালি সুখ শেষ,
আসবে নতুন বছরখানি
চলবে তারই রেশ।
প্রবীণ-নবীন দুই জনেতেই
থাকনা মিলেমিশে-
ঝগড়া-ঝাঁটি আদান-প্রদান
চব্বিশে-পঁচিশে।
আর কত দিন
মজনু মিয়া
বিষাদের আগুন পুড়েছে, আমার তনুমন এই ভরা ফাগুনে;
ইচ্ছে করলে একটি গোলাপই পারত,
আমার সকল দুঃখ অবসান করে দিতে,
আশায় থাকতে থাকতে পুড়া চৈত্র এসে গেলো আমার নিদয় দুয়ারে!
একটা গাছের নিচে দাঁড়ালাম 'একটু আশ্রায়ের আশায়, পেলাম না তার দেখা;
ঝরে ঝরে পড়ে গেছে পাতারা,কংকাল সার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
বৈশাখের বৃষ্টি হবে কবে তার প্রতীক্ষায় আছে শাখা প্রশাখারা।
একটু শান্তির প্রত্যাশা করা,এবার বোধহয়
ভুল হবে না আর;
বৈশাখ আমার চৈত্রের তীব্রতা দূরে দিবে,
এ আমার বিশ্বাস মনে।
গাজন সন্ন্যাসী
সুপ্রীতি বর্মন
চৈত্রের কাঠফাটা রোদে ঢাকের বাদ্যির সাথে হনহন যাত্রী সন্ন্যাসীর উপোস,
দিগন্তজোড়া হৈ হুল্লোড় চ্যাঁ প্যাঁ আস্কারায় কচিকাচার মুখে ফুটেছে বোল,
মেলা এসেছে, মেলা এসেছে।
ঢাকাই জামদানী কিংবা বঙ্গ ললনার গরাদের পাড় উঁচু মনের তীব্র বাসনা।
সন্ন্যাসীর রক্তভেজা শুষ্ক চাহিদার চোখে আতঙ্কের ধর্ষকাম সরলতা,
নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মাথার উপর ভিটের দেনা।
তার উপর নির্জলা উপবাসে উঠে পড়ে মহাদেবকে করতে লেগেছে উপাসনা,
ভক্তির পরাকাষ্ঠা ফুটানো ভাতে ভাত পোড়া হাঁড়ি আমার জড়ানো মর্মব্যাথা।
ফোটেনা কথা অনর্গল শুধু প্রতীক্ষায় আঁখি।
কখন তীব্র জর্জরিত যন্ত্রনায় মেলবে আঁখি,
পড়বে ফুল মাথার শিরোমনি।
রাখবে হাত আমাদের ঐকান্তিক আশীষ।
দিন যায় যায় জলে আগুনে পড়ি ঝাঁপ,
বান দগ্ধ হাত নেই কারোর দৃষ্টিপাত।
মহাকালের অনুপস্থিতির শোক অপরিমেয়,
তাই খোলা কাপাল পেতে ভিক্ষার্থীর চাহিদা।
শুকনো ঝরঝরে পাতার খসে পড়া অন্ধকার।
একান্তে নিজমনে কাষ্ঠাগ্নির তীব্র দহন।
ছাইচাপা প্রত্যাশা অপপ্রচার আমি সন্ন্যাসী,
তাই চোখের কোলে একরাশ অন্ধকার,
হাহাকারের প্রথার পর্দা ভেদে,
তুমি তো চির সত্য সুন্দরম।
কেন তবে আত্মদগ্ধ ধূপে জ্বালাও নিজেকে তোমাকে একমাত্র তোমাকেই খুঁজতে থেকে।
আহ্বান
দিনেশ বর্মন
বসন্ত সমীরণে ঝংকার ধ্বনি
বেজে গেছে নতুনের আহ্বানে
ফুরে গেছে দিন আর পাখি
গেছে নীড়ে কুহেলিকা সুরে
আজ নব বর্ষের আহ্বানে ফুটছে মালতি ফুল সৌরভ নিয়ে
দিক্ দিগন্ত ছুয়ে গেছে নতুনের
রং গায়ে মেখে।
প্রজাপতির গুঞ্জন সুরে
মাতিল ভুবনসুরাকার নিয়ে
ধরনীর পারে নব ঘণ্টা
ধ্বনি বেজে উঠল নতুন আলোকে
আজ বর্ষ বরন হবে আলোর
ঝলকানিতে
সেজে আছে নর নারী নতুনের
সমাগমে প্রশান্ত চিত্তে।
পুরাতন বিদায় কালে যত
বিস্মৃতি যাক অতলে
গভীর অরন্যের আবছা ছায়া
গা হতে যাক সরে
নতুনের আলোক শিখা জ্বলুক
প্রাণে প্রাণে রং মশাল নিয়ে
শুভ দৃষ্টি হোক নতুন
বছরের যাত্রা দিয়ে।
চাই না আমি নিজের জিনিস, থাকতে চাই মিলে মিশে
ভালোবাসার চেয়ে বড়
জিনিসকখনো দেখি নাই রে
সবারসাথে থাকব আমিদেখব
দুনিয়ার খুঁটিনাটি
সবার করি মঙ্গল কামনা সবাই
থাকো সুখে।
চৈতালী
দেবলীনা ( মিঠু) দাস
চৈতালী তোমাতেই বাংলা বর্ষ হয় শেষ
প্রাচীনতাকে দূরীভূত করে আনো নূতনের আবেশ।
শীতের কুয়াশায় আবৃত আলসে বংগ প্রকৃতি
তোমার স্পর্শতেই সে পায় তার নব আকৃতি।
পাতাঝরা বসুন্ধরা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে
শূন্যতাকে পূর্ণ করতে এগোয় নূতনের পথে।
শত আশা,কল্পনার সঞ্চার হয় প্রাণে
মন রাঙিত হয় নূতন স্বপ্নের রঙএ।
দেবলীনা ( মিঠু) দাস
চৈতালী তোমাতেই বাংলা বর্ষ হয় শেষ
প্রাচীনতাকে দূরীভূত করে আনো নূতনের আবেশ।
শীতের কুয়াশায় আবৃত আলসে বংগ প্রকৃতি
তোমার স্পর্শতেই সে পায় তার নব আকৃতি।
পাতাঝরা বসুন্ধরা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে
শূন্যতাকে পূর্ণ করতে এগোয় নূতনের পথে।
শত আশা,কল্পনার সঞ্চার হয় প্রাণে
মন রাঙিত হয় নূতন স্বপ্নের রঙএ।
জীবন যেমন কাটছে
অতনু
অতনু
দিনগুলো ছেঁড়া চপ্পলে পা গলিয়ে একা একা হেঁটে চলে গেল
বিবর্ণ দুপুরে সুখী কুকুর নরম রোদে গা এলিয়ে দেয়
ফটোফ্রেমে অস্পষ্ট বাবার মুখ
চিঠি লিখবো বলেছিলাম মাকে
চেয়ে দেখি, ডাকপিওন ধুলো রাস্তা দিয়ে ফিরবে না কোনোদিনই I
সমস্ত জীবন পরগাছার মতো আঁকড়ে ধরেছে ভয়,
বিয়ের সাজে শ্যামলা মেয়েটিকে শশুরবাড়ি যেতে দেখলে ভাবি 'সুখে থাকবে তো'?
লক্ষ করি খুব সন্তর্পনে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে যৌথ পরিবার I
রান্নাঘরে পায়েসের গন্ধ বাতাস ভরিয়ে দেয়,
শুভ জন্মদিন- জানি, তোমার সঙ্গে দেখা হবে না আর I
বাগ্দীবৌয়ের শখের শাক-সবজি বাগানে সন্ধ্যা নেমে এলে
রিপু করা জামা পড়ে ছেলেবেলা সামনে এসে দাঁড়ায়,
মায়ের সোনার চুরি বন্দক রেখে আমার আঠারোকে কলেজে যেতে দেখি
অগোছালো পড়ার টেবিলে আঁকিবুকি কাটে ছোট বোন
মনে পড়ে, নিরুদ্দিষ্ট যৌবন কালবৈশাখী হয়ে আছড়ে পড়েছিল ভাঙা ঘরের চালে
আমি লিখেছিলাম বৃষ্টি ভেজা মাঠে দলছুট ছেলেটার কথা, আর
সেই মেয়েটির কথা, যাকে কোনোদিন বলা হবে না 'ভালোবেসেছিলাম তোমাকে' I
এসবের থেকে দূরে, আরও দূরে চলে যেতে যেতে, নিঃসঙ্গতার উপস্থিতি টের পায় রক্তে
মনে পড়ে, কোনোকালে বেনে পুকুরে ভেসে উঠেছিল ঠিক আমারই মতো একটা মৃতদেহ
শিউরে উঠি, দেখি সিগেরেটের ছাই পলেস্তারা খসা দেওয়াল ফাটিয়ে হাসছে
জানি অধিকাংশ ভালোবাসা আম কুড়োতে গিয়ে আর ফেরে না,
বুঝতে পারি কবিতারাও একদিন আমাকে একা ফেলে চলে যাবে I
প্রভাত
সুকন্যা সামন্ত
নূতন প্রাতে , নূতন দিনে ,
নূতন সাজে সাজিবো যতনে ,
নূতন আশা , নূতন ভরসা ,
নূতন পথের নূতন দিশায় ,
আপনাকে ঠিক লইবো
চিনে ।
এই চেনার মাঝেই অজানাকে –
জানবো নূতন করে ।
দেব যত আপনাকে উজাড় করে ,
করবো যত বেচাকেনা
–
এ ভূবনের হাটে ,
লাগবে তত প্রাণের পরশ ,
আপন হিয়ার মাঝে ।
ঘুচবে তত বেদন ,
আপনাকে লয়ে যত
।
করবো যত সমর্পণ
–
বিশ্বমাতার চরণে ,
দেব যত আপনাকে বিলায়ে ,
এ বিশ্ব মাঝে ,
মিটবে তত সাধ –
অপূর্ণ যত ,
বিশ্বমাতা দেবে তত
–
অশ্রু মুছায়ে ।।
বর্ষবরণ
স্বর্ণালী ঘোষ
সূচনাতেই 'শুরু 'জানে
'শেষ'ই তার পরিণতি,
তবু কেন সময় এলেও
ধরে রাখার আঁকুতি?
'শেষ'ই তার পরিণতি,
তবু কেন সময় এলেও
ধরে রাখার আঁকুতি?
'উল্লাস' চঞ্চল হয়
'স্থিরতা'র অপেক্ষায়,
'মুক্তি' আরাম পায়
' বন্ধন'-এর সুরক্ষায়।
'স্থিরতা'র অপেক্ষায়,
'মুক্তি' আরাম পায়
' বন্ধন'-এর সুরক্ষায়।
উজ্জ্বল আলোকের...
সহায়ক অন্ধকার।সেভাবেই,
'ভূমিকা'র প্রকাশ হলো --
সাঙ্গ হলো ' উপসংহার ' ॥
সহায়ক অন্ধকার।সেভাবেই,
'ভূমিকা'র প্রকাশ হলো --
সাঙ্গ হলো ' উপসংহার ' ॥
বর্ষা নামে চোখে
সৈকত বণিক
আজ আবার বৃষ্টিতে ভিজেছি আবছা সকাল থেকে
আজ আবার তুলি টেনেছি বৃষ্টির ফোঁটা দিয়ে
আজ তোমাকে মোনালিসা ভেবে, ছোট্ট ঢোঁক গিলিনি
আকাশ থেকে কালো নিয়েছি, নীল খুঁজেও মেলেনি
চোখের টানে সাদা নিয়েছি, নৈঋত থেকে নিয়ে
তোমার প্রিয় ম্যাজেন্টা জানি, জন্ম থেকে বিয়ে
সাম্যবাদের লাল নিয়েছি,রক্ত দেবো বলে,
সাম্রাজ্য স্নাতক হয়েছে, বুকের বোতাম খুলে...
ক্যালেন্ডারে গোল এঁকেছি, গোলাপ আনবো তাই,
চোখের বালি গুঁড়িয়ে গেছে, কঠিন থেকে ছাই,
ঘুমের পাশে কলম রেখেছি, কবিতা বন্ধক তোকে,
জলের খোঁজে শুকনো নদী, ঝাঁপ দিয়েছি চোখে।
আবার যদি পাহাড় হই, বকুল থাকবে বাঁধা,
ইন্দ্রজিৎ রাম হবে, পাঞ্চালী শ্রীরাধা...
আজ আবার তুলি টেনেছি বৃষ্টির ফোঁটা দিয়ে
আজ তোমাকে মোনালিসা ভেবে, ছোট্ট ঢোঁক গিলিনি
আকাশ থেকে কালো নিয়েছি, নীল খুঁজেও মেলেনি
চোখের টানে সাদা নিয়েছি, নৈঋত থেকে নিয়ে
তোমার প্রিয় ম্যাজেন্টা জানি, জন্ম থেকে বিয়ে
সাম্যবাদের লাল নিয়েছি,রক্ত দেবো বলে,
সাম্রাজ্য স্নাতক হয়েছে, বুকের বোতাম খুলে...
ক্যালেন্ডারে গোল এঁকেছি, গোলাপ আনবো তাই,
চোখের বালি গুঁড়িয়ে গেছে, কঠিন থেকে ছাই,
ঘুমের পাশে কলম রেখেছি, কবিতা বন্ধক তোকে,
জলের খোঁজে শুকনো নদী, ঝাঁপ দিয়েছি চোখে।
আবার যদি পাহাড় হই, বকুল থাকবে বাঁধা,
ইন্দ্রজিৎ রাম হবে, পাঞ্চালী শ্রীরাধা...
বিশ্ব কবি
বটু কৃষ্ণ হালদার
বটু কৃষ্ণ হালদার
তুমি আজও সবার প্রিয়
সেই ছোট্ট রবি
শ্রেষ্ঠ উপাধি শিরোপায়
হয়েছ বিশ্ব কবি
সেই ছোট্ট রবি
শ্রেষ্ঠ উপাধি শিরোপায়
হয়েছ বিশ্ব কবি
লক্ষণ রেখার সীমান্ত ছাড়িয়ে
মহা বিশ্বে তোমার নাম
বিনি সুতার গাঁথা মন্ত্র মালা
জপিছে রহিম রাম
মহা বিশ্বে তোমার নাম
বিনি সুতার গাঁথা মন্ত্র মালা
জপিছে রহিম রাম
25 বৈশাখ হৃদয়ের বাণী
এ ভারতের শিল্প কলা
উদিত সূর্য আজও প্রজ্জলিত
শান্তি নিকেতনের পথে চলা
এ ভারতের শিল্প কলা
উদিত সূর্য আজও প্রজ্জলিত
শান্তি নিকেতনের পথে চলা
মায়েদের ঘুম পাড়ানি গানে
তোমার সুরের ছোঁয়া য়
পুর্নিমা চাঁদ দিয়েছিল ধরা
বালু চরের মিলন মায়া য়
তোমার সুরের ছোঁয়া য়
পুর্নিমা চাঁদ দিয়েছিল ধরা
বালু চরের মিলন মায়া য়
পুজোর পরশে আসছে ভেসে
গীত বিতানের সুর
দিগন্ত হতে সীমান্ত পেরিয়ে
দূর হতে বহু দূর
গীত বিতানের সুর
দিগন্ত হতে সীমান্ত পেরিয়ে
দূর হতে বহু দূর
জালিয়ানওয়lলাবাগ হত্যাকাণ্ডে
ভূলে যাওনি রক্তের দাগ
নাইট উপাধি আজও উপেক্ষিত
দেশ শত্রু রা পায় নি মাপ
ভূলে যাওনি রক্তের দাগ
নাইট উপাধি আজও উপেক্ষিত
দেশ শত্রু রা পায় নি মাপ
মহা সমুদ্রের মতো অগভীর
তুমি তো বিশ্ব পিতা য়
22 শে শ্রাবণ অকাল প্রয়াণ
শান্ত মহাস্মশানের চিতা য়
তুমি তো বিশ্ব পিতা য়
22 শে শ্রাবণ অকাল প্রয়াণ
শান্ত মহাস্মশানের চিতা য়
তোমার মহিমা জগত জোড়া
আঁখি পটের ছবি
তুমি আজও সবার প্রিয়
বঙ্গ বিশ্বের কবি
আঁখি পটের ছবি
তুমি আজও সবার প্রিয়
বঙ্গ বিশ্বের কবি
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
চৈত্র সংখ্যা ১৪২৪
গল্প দ্বিতীয় পর্যায়
নারী স্বাধীনতা
প্রীতম সাহা
ভোর হয়েছে... সূর্যের আলো টা চোখে এসে পড়েছে ঘুম টা ভেঙে গেল। বাইরের জানালা দিয়ে আমার বাড়ির একটা অংশ দেখা যায়। সেখানেই সিলিং এর একটা অংশে অনেক দিন আগে ফেলে দেওয়া একটি বাক্সের ভিতর থেকে একটি পাখি উড়ে গেল আকাশে। পাশে শুয়ে থাকা মেয়ে বলে উঠল - দেখেছ বাবা পাখি টা কেমন উরে গেল আকাশে। আমি বললাম - হ্যাঁ মা ওরা কি স্বাধীন তাই না। ব্যঙ্গের ছাতা। ও মোটেই স্বাধীন না। কেন মা? তুমি দেখলে না ও কেমন উরে গেল আকাশ এ স্বাধীন ভাবে। ছাই স্বাধীন। ওকে আবার ফিরে আসতে হয় সন্ধ্যায়। তবে কেমন স্বাধীন। সন্তান স্নেহ। ও তুমি বুঝবে না মা। না। ওই bird টির কোন ছানা নেই। আমি ওর বাসা টা দেখছি। ও একা।
মেয়ের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম - তবে ও ফিরে আসে কেন?
মেয়ে ও মা হয়ে উত্তর দিল-ও আসলে বাসা বাঁধতে জানেনা তাই।
ফোন টা বেজে উঠল - ক্রিং ক্রিং...
সুবোধ কলিং। সময় কত দ্রুত এগিয়ে যায়। এই সেদিন ওর জন্য মেয়ে দেখতে গেলাম। আমি সদ্য বিবাহিত। 1 বছর ও হয় নি। ফলে আমাকেই বিশ্বাস করে নিয়ে গেল সুবোধ অনান্য বন্ধু দের মধ্যে কেননা চোখের বালি উপন্যাসের মহেন্দ্র ও বিহারি ওর ও পরা। আমি সদ্য বিবাহিত। ফলে সেরকম বা অন্য কোনো রকম সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
সুমিতা র সঙ্গে ওই টুকো সময় কথা বলে যা বুঝলাম শিক্ষিতা ও নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় মানে এক কথায় উগ্র নারী স্বাধীনতায না হলেও কিছু টা নারী স্বাধীনতায বিশ্বাসী। সুবোধ ও নারী স্বাধীনতা দিতে আগ্রহী। ফলে সমস্যা হল না। সেদিন গাড়ি করে ফিরবার পথে সুবোধ আমায় বলল-কনিকা কি কাজ টাজ শুরু করল?
আমি বললাম - না। বিয়ের আগেই কথা বলে নিয়েছি সংসারের সরকার হয়ে সংবিধান রচনা করে বা না করে একনাযকতন্ত্র বা গনতন্ত্র যা ইচ্ছা কর আমি তোমার প্রজা। বাকিটা আমার উপর ছেড়ে দাও। নাক গলিও না।
সুবোধ বিরক্ত হয়ে বলল - তোদের জন্য আমাদের দেশের নারী রা আজ অবধি তেমন ভাবে এগোতে পারল না... (সঙ্গে বিবেকানন্দ র বানী আরও কত কি ঝেড়ে দিল)।
ক্রিং ক্রিং ফোন টা তুললাম। হ্যাঁ বল সুবোধ।
কিরে কখন আসবি?...
11 টায় ঢুকে যাব...
আজ নারী দিবস। মেয়ে র স্কুল এ অনুষ্ঠানে যেতে হবে। কনিকার শরীর টা তেমন ভালো না তাই যাবে না । সুবোধ ও মেয়ে কে নিয়ে যাবে। সুমিতার নাকি নরী দিবস উপলক্ষে office থেকে কিসব সমাজ কল্যাণ মূলক কাজের যাবতীয় দায়িত্ব পরেছে। ফলে সুমিতাও মেয়ের স্কুল এ যেতে পারবে না। তাই একসঙ্গে প্ল্যান।
আমি ও মেয়ে 10 মিনিট ধরে সুবোধ এর বারির নীচে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর সুবোধ মেয়ে নিয়ে হাজির হল।
সুবোধ এর মেয়ে রুনু এসেই বলল-কি uncle এত দেরি কেন হল
আমি হেসে বললাম - 10 মিনিট ধরে অপেক্ষা আমরা করছি। তোমরা নও।
রুনু খালি "ঈসসস" শব্দ করল।
আমি বললাম রুনু তোমায় তো আজ দারুন মিষ্টি দেখাচ্ছে।
রুনু বলল- জান uncle এই চূরিগুলো মা এইবার মেলা থেকে কিনে দিয়েছে... এই শারি টা বাবা আমায় এই বার birthday তে gift করেছে... জান uncle মার একটা গলার হার আছে সোনার যেটা মা র বিয়ের যৌতুক। মা বলেছে আমি বড় হলে পরতে দেবে। তখন আমায় আর মিষ্টি লাগবে...
সুবোধের আওয়াজ অস্পষ্ট ভাবে আসল -তোরা তো সামনে। আমরা পিছনের সিটে বসলাম। দরাম্ দরজা বন্ধ হল গাড়ি র।
নারী স্বাধীনতা - যৌতুক... মাথার যন্ত্রণা টা আবার শুরু হল বুঝি।
পাখি টা কি আজ বাসায় ফিরবে!! সন্ধ্যা তো হয় নি এখনো । যদি আজ প্রতি দিনের অভ্যাস ভেঙ্গে ব্যতিক্রম ঘটে। হর্নের আওয়াজ - পিপ্ পিপ্... প্রতিদিনের জ্যাম।
দূষ্কৃতির কবলে...
চয়ন মোদক
আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে ভাল করে দেখছিল মৃধা। গত দুদিন চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে।চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ বছর তেইশের মৃধাকে আজ অনেকটাই বিধ্বস্ত করে দিয়েছে।তার মা সুপর্ণা এসে তাড়া না দিলে হয়তো আরও কিছুক্ষণ বিছানাতেই শুয়ে থাকত।কাঁদত কিছুক্ষণ। সুপর্ণার ঘরে ঢোকার শব্দ বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে নিয়েছিল সে।কিন্তু একজন মা তার মেয়ের মানসিক যন্ত্রনা বুঝবেনা তাও আবার হয় কখনও।মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল-ওঠ এখন।রাজেশ এলো বলে।তোর পিসিরাও এসে পড়বে এখুনি।মার স্নেহের পরশ পেয়ে বিছানায় শুয়েই মাকে জড়িয়ে ধরেছিল।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরেছিল দুফোটা।মেয়েকে শান্তনা দিয়ে সুপর্ণা বলেছিল-সবকিছু একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা।সময়ের সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।নে ওঠ তো-বলে জোর করে মেয়েকে তুলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
অলস হাতে চুল আছড়াতে আছড়াতে নিজের মায়ের কথাই ভাবছিল মৃধা। ছোটো থেকেই মাকে দেখে আসছে সে।কত অপমান,কত লান্ছনা সহ্য করেও কি নির্লিপ্ত থাকতে পারে তার মা।
মৃধার বাবারা তিন ভাইবোন।পিসিরা বাবার বড়।পেশায় কলেজের অধ্যাপক তার বাবাকে মৃধার কোনোকালেই একজন সম্পূর্ণ পুরুষ বলে মনে হয়নি।ঠাকুরদার মৃত্যুর পর থেকে ঠাকুমা ও দুই পিসিই এ বাড়ির সব।পিসিদের কথার উপর একটি কথাও বলতে পারেনা তার বাবা।ঠাকুমা এখন শয্যাশায়ী।পিসিদেরও সুখের সংসার।শুধু বড়পিসি নিঃসন্তান এই যা।ছোটোবেলা থেকেই মৃধা দেখে আসছে তার মা নিজের সংসারেই কেমন জানি দূয়োরাণী হয়ে পড়ে আছে।সব ব্যাপারে পিসিদের মতামতই শেষ কথা।সুপর্ণা চেয়েছিল ছোটোবেলায় হারানো তার মায়ের নামেই মেয়ের নাম রাখবে চারুলতা।কিন্তু পিসিরা বাধ সেধেছিল।বলেছিল-এমন গেয়ো নাম এখন কেউ রাখে নাকি।মৃধার স্কুল,কলেজ এমনকি অনার্স নির্বাচনেও পিসিদের মতই প্রাধান্য পেয়েছে। মৃধা বুঝতে পারেনা এটা পিসিদের অভিভাবকত্ব নাকি খবরদারি।
রাজেশের সংগে মৃধার বিয়ের সম্বন্ধটা তার বড়পিসিই এনেছে।রাজেশ তার বড় পিসেমশায়ের কলিগের ছেলে।রাজেশ এম বি এ।বর্তমানে ব্যাঙালোরে চাকরি করে।সামনের বছর কোম্পানি ওকে বিদেশ পাঠাবে বলে ঠিক হয়ে আছে।মৃধার মা মেয়েকে বিদেশে পাঠাতে রাজি না হলেও মুখফুটে কথাটি তাদের বলতে পারেনি।শুধু একবার মৃধার বাবাকে বলেছিল,একটিমাএ মেয়ে..বিদেশে থাকবে..দেশেই কোনো ভালো সম্বন্ধ দেখলে হতো না।মৃধার বাবা বলেছিল-এত ভালো সম্বন্ধ হাতছাড়া করা যাবে না।তাছাড়া এখুনি তো আর যাচ্ছে না।মায়ের এই অনিচ্ছা পিসিদের কানেও পৌছেছিল।এ নিয়ে সুপর্ণাকে অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছে।কিন্তু সুপর্ণা কোনো উত্তর দেয়নি।চুপ করে ছিল।মৃধা জানে তার মায়ের মধ্যে এই বিশেষ ক্ষমতাটা আছে।শত অপমান সহ্য করেও চুপ করে থাকতে পারে।সবকিছু ভুলে থাকতে পারে অনায়াসে।কিন্তু সেই মায়ের মেয়ে হয়ে মৃধা কেন ভুলতে পারছে না সবকিছু।কেন বারবার তার মনে পড়ছে পরশু রাতের ঘটনা।
রাজেশকে প্রথমবার দেখেই পছন্দ হয়েছে মৃধার।গত একমাস ধরে তারা ফোনে কথাও বলছে দুজনে।আজ রাজেশ আসবে তার ব্লাড টেষ্টের রিপোর্টগুলি নিয়ে।মৃধার রিপোর্টগুলিও নিয়ে যাবে।রাজেশের বাবা চেয়েছিল দুতরফেই যেন থ্যালাসেমিয়া ও এইচ আই ভি পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হয়।সেদিন রাজেশই বলেছিল আজ রিপোর্টটা দিতে এসে বিকেলের পর মৃধাকে নিয়ে একটু বেরোবে।কিন্তু মৃধার ইচ্ছা থাকলেও হ্যা করেনি। ফোনের মধ্যেই নানা অজুহাত দিয়েছিল রাজেশকে।সম্পর্কের এই পর্যায়ে নিজেকে যে এতটা সস্তা করে দিতে নেই তা মৃধা খুব ভাল করেই জানে।বড়পিসিই পরে মৃধাকে ফোন করে বলেছিল রাজেশের সংগে যেতে।
মুখে ক্রিম লাগাতে গিয়ে মৃধা অনুভব করল কব্জির উপর ব্যাথাটা এখনও আছে।টিপে দেখল একবার।তখনই মনে পড়ল অর্পিতারর কথা।পরশু রাতের পর আর ওকে ফোন করা হয়নি।বিছানা থেকে মোবাইলটা তুলে ফোন করতে যাবে ঠিক তখনই বড়পিসি ঘরে ঢুকে বলে-কিরে,তুই এখনও রেডি হোস নি।তাড়াতাড়ি কর।আর হ্যা, রাজেশের দেওয়া শাড়িটাই পড়ে যাস।পিসির কথায় মৃধা শুধু ঘাড় নাড়ল।
ব্লাউজটা পড়ে আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল মৃধা। ঠিকঠাকই হয়েছে ব্লাউজটা।পরশু রাতে বাড়ি ফিরে ব্লাউজটা আর পড়ে দেখা হয়নি তার।দরজির দোকানদারটা সেদিন অর্পিতা ও তাকে প্রায় এক ঘন্টা বসিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি করে ব্লাউজটা বানিয়ে দিয়েছিল।এ নিয়ে সে অনেকগুলি কথাও শুনিয়েছে দোকানদারকে।আর দোকানদারটা বারবার অপরাধীর মতো বলছিল-দিদি আর দশ মিনিট।এক্ষুনি হয়ে যাবে।
ক্লিনিক থেকে রিপোর্টগুলি নিয়ে যখন তারা দরজির দোকানে গেল তখন রাত আটটা।দোকানে বসেই রিপোর্টগুলি আরেকবার খুলে দেখেছিল মৃধা। দুটোই নেগেটিভ।অর্পিতা ইয়ার্কি করে বলেছিল -কিরে এইচ আই ভি টা পজেটিভ নাকি।অর্পিতারর কথা শুনে দোকানদারটা একবার তাকিয়েছিল মৃধার দিকে।মৃধা সেটা লক্ষ্য করেছে।অর্পিতার কাছে ঘেষে মৃধা ফিসফিস করে বলেছিল- হ্যা,পজেটিভ।তোমার নতুন জামাইবাবুটিকে বলো না যেন।বলেই দুজন হেসে উঠল।
থাক থাক প্রনাম করতে হবে না।তুমি বোসো বাবা।মৃধা রেডি হচ্ছে-বড়পিসির গলার আওয়াজ কানে আসে মৃধার।বুঝল,রাজেশ এসে গেছে।বড়পিসি মৃধাকে বারবার করে বলে দিয়েছে রাজেশের সামনে একদম মনমরা হয়ে না থাকতে।মৃধা জানেনা এই নাটকটা ও করতে পারবে কিনা।ও ভিতরে একরকম আর বাইরে অন্যরকম হয়ে থাকতে পারে না।
শাড়িটা পিসিদের পছন্দ নাহলেও মৃধার বেশ ভালোই লেগেছে।আজ অনেকদিন পর নিজেকে শাড়িতে দেখছে সে।শাড়িটা তাকে মানিয়েছে বেশ।সেদিন দোকানদারটাও বলছিল -এই শাড়িতে আপনাকে খুব সুন্দর লাগবে দিদি।মৃধা জানে এই অযাচিত প্রসংসা শুধুমাত্র তার রাগ প্রশমনের উদ্দেশ্যে।তবু মৃধার ভালো লেগেছিল।সব মেয়েরাই নিজের সৌন্দর্যের তারিফ দারুনভাবে উপভোগ করে।
দোকান থেকে বেরিয়ে বাসস্টপে আসতে আসতে রাত নটা বেজে গিয়েছিল সেদিন।চারদিকে দোকানপাট সব বন্ধ করতে শুরু করেছিল আকাশের ভাবগতিক দেখে।দরজির দোকানে বসে তারা বুঝতেই পারেনি বাইরে আকাশটা এত খারাপ হয়ে আছে।আধঘন্টা বাসস্টপে দাড়িয়ে থেকে একটি গাড়িও পায়নি তারা।ঝোড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গিয়েছিল এক মুহূর্তে।
বিছানার উপর ফোনটা হঠাত বেজে ওঠায় চমকে ওঠে মৃধা। অর্পিতার ফোন।
-ফোন করেছিলি? শুকনো গলা অর্পিতার।মৃধা বুঝল পিসিকে দেখে ফোনটা কাটলেও মিসড কল হয়তো চলে গিয়েছিল ওর ফোনে।
-হ্যা,কেমন আছিস?
-ভাল,বাড়ির সবাই কি বলল? পুলিশে ডায়রি করবি?
-জানি না।
-রাজুদা জানে?
-না।তুই বাড়িতে বলেছিস?
-হ্যা,মাকে বলেছি।মা বলল...
-ঠিক আছে রাখি।ঘরে কারও ঢোকার শব্দে ফোনটা তাড়াতাড়ি কেটে দেয় মৃধা।মা ও তার দুই পিসি ঘরে ঢুকলে মৃধা ঘুরে তাকায় ওদের দিকে।ছোটোপিসি মৃধার চিবুক ধরে বলে-কি সুন্দর লাগছে রে তোকে।বড়পিসি শাড়ির আচল ঠিক করতে করতে বলে-মুখে একটু হাসি তো আন।অত মনমরা হয়ে থাকলে চলে।সবাই এমন একটা ভাব করছিল যেন মৃধাকে আজ প্রথমবার দেখতে এসেছে রাজেশ।মৃধা তার মায়ের দিকে তাকাল একবার।ম ইষত হাসল।কিন্তু সেই হাসির মধ্যে কোথাও যেন একটা বিষাদ লেগেছিল।
সেদিন বাসস্টপে দাড়িয়ে মাকেই ফোন করেছিল মৃধা। একে তো ঝোড়ো হাওয়া তার উপর বৃষ্টির জলে ভিজে একসা হয়েছিল দুজনে।মা বলেছিল-যেখানে লোকজনের ভিড় দেখবি সেখানে দুজনে দাড়িয়ে থাক।গাড়ি পাঠাচ্ছি।কিন্তু ভিড় তো দূরঅস্ত রাস্তাঘাট যে একেবারে জনশূন্য। মাকে ভয়ার্ত গলায় বলেছিল মৃধা।দূরে একটা গাড়ির লাইট এগিয়ে আসতে দেখে মাকে বলেছিল-ঠিক আছে রাখ।একটা গাড়ি আসছে বোধহয়।
গাড়িটি কাছে এলে তারা দুজনে বৃষ্টি মাথায় রাস্তায় নেমে আসে।গাড়িটি তাদের সামনে এসে দাড়ালে গাড়ির ভিতরের লাইট জ্বলে ওঠে।গাড়ির ভিতর দুজন বসে আছে।মৃধা লক্ষ্য করল একজনের হাতে একটি বোতল।তাদের দেখে ছেলেটি বোতলটিকে সিটের নীচে লুকিয়ে ফেলল।জানলার কাচ নামিয়ে সামনের সিটের ছেলেটা বলল-কোথায় যাবে? মৃধা অর্পিতার হাত ধরে পিছিয়ে আসে।বলে-না,আমাদের গাড়ি আসছে।হঠাত পিছনে বসা ছেলেটি বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে এসে মৃধার সামনে এসে দাড়ায়।ছেলেটির মুখ দিয়ে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে।মাতাল কন্ঠে ছেলেটি বলে-চলো এগিয়ে দি।তারা দুজনে আরও একটু পিছিয়ে গেলে ছেলেটি মৃধার হাত শক্ত করে টেনে ধরে জোর করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে।ভয়ে চিত্কার করে মৃধা বলে ওঠে-বাচাও,বাচাও।অর্পিতাওও ছেলেটিকে ঘুষি মারতে থাকে দুর্বল হাতে।ততক্ষনে অন্য ছেলেটিও গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে।অর্পিতাকে এক ধাক্কায় ফেলে দেয় মাটিতে।হঠাত ড্রাইভারটা বলে ওঠে-পালা, পালা।ছেড়ে দে।উল্টোদিক থেকে আরেকটা গাড়িকে আসতে দেখে দুটি ছেলেই ওদের গাড়িতে ঢুকে পরে।নিমেষে বেরিয়ে যায় গাড়িটি।
বাড়িতে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মৃধা। অর্পিতাই কাঁদতে কাঁদতে সব ঘটনা বলছিল।খবর শুনে সেই রাতেই পিসিরা চলে এসেছিল বাড়িতে।সুপর্ণাই বলেছিল পুলিশে কেস করার কথা।মৃধার বাবাও বড় পিসেমশায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল-রাতেই থানায় যাওয়া দরকার।বৃষ্টিটাও তো কমে এসেছে।বড়পিসি সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলে-দাড়া,সব ব্যাপারে এত তাড়াহুড়ো করিস না।একটু ভেবেচিন্তে কাজ কর।এখন পুলিশে কেস করে কি হবে।দূষ্কৃতিদের এখন কি আর খুজে পাবে পুলিশ? অর্পিতার দিকে চেয়ে বলে-ওদের মুখগুলো মনে আছে তোদের? আগে দেখেছিস কখনও ওদের? অর্পিতা নীচু গলায় বলে- না।পিসি বলতে থাকে-কেস করলে বাড়িতে পুলিশ আসবে।পাড়া প্রতিবেশী জানাজানি হবে।ভুলে যাচ্ছিস কেন মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।ওর শ্বশূড়বাড়ির কানে কি কথাগুলো যাবেনা ভেবেছিস? ওরা কেন এই উটকো ঝামেলায় পড়তে যাবে? বিয়েতে বেকে বসলে তখন কি হবে? তাই বলি চুপচাপ থাক,যা হবার হয়েছে।
মায়ের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখের সাদাটায় জল ভরে উঠছিল মৃধার।বড়পিসি সেটা লক্ষ্য করে বলল-কিরে,কি হোলো তোর? গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে-ভুলে যা তো সব।যা,রাজেশ বসে আছে।
মৃধা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেযেতে শুনল পিসি ভগবানের উদ্দেশ্যে বলছেন-ঠাকুরের অশেষ কৃপা দূষ্কৃতির কবল থেকে আমাদের মেয়েকে তিনি রক্ষা করেছেন।দরজাটা টেনে বাইরে বেরিয়ে গেল মৃধা।
“শেষ চিঠি’’
মমিদুল মিঞা
ক্লান্ত শরীরে রবির মধ্যাহ্নে বোধ করি একটু ঝিমিয়ে পড়েছি, নশ্বরদেহের অলসতা কাটল বাইরের হাকাহাকিতে ।
বেরিয়ে আসতেই পোস্টমাস্টার বলল- এটা কি অবনী ঘোষ বাবুর বাড়ি? সদুত্তর পেয়ে জানালেন,
চিঠি আছে কলকাতা থেকে। চিঠি, তাও আবার সেই কলকাতা! একটু অবাক হয়নি যে তা নয়, তবুও হাজিরার খাতাটায় সই করে
ভিতরে এসে বসে পড়লাম। প্রথম ভাঁজটা খুলেই দেখতে
পেলাম ‘‘YOU
FORGET ME, BONDHU’’। একটু ভাবলাম! সংসারে পা দেওয়ার আজ প্রায় দশ-দশটা বছর
হল, কেউ তো একটি বারের জন্যেও খোঁজ খবর নেয়নি – তবে আজ কোন বন্ধু ? যাই হোক কেউ তো মনে রেখেছে ভেবেই
মনটা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠল।
বাড়িতেও কেউ নেই,চিঠিটা পেয়ে অবসর সময়টা ভালই কাটবে ভেবে আর একটু এগিয়ে যেতেই
দেখলাম- আছে শুধু হিজিবিজিতে কাটা একখানি কাগজ, তাতে বড় বড় অক্ষরে লেখা-“ মনটা আজ
তোমায় দিলাম, আর কিছু নেই দেওয়ার মত”। বেশ ছুঁয়ে গেল হৃদয়ে হাতের লেখাটাও।
শেষ ভাঁজটা খুলতেই পেলাম বেশ বড় একখানি চিঠি-শুরু সম্বোধন ছাড়াই- মনটা বড়ই
রোমাঞ্চকর হয়ে উঠল। দরজাটা এটে দিয়ে জাঁকিয়ে বসে পড়তে শুরু করলাম-‘অনেকদিন হল তোমার
সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আশা করি ভালো আছো ভুলে গিয়ে- আজ হয়তো আর মনেও নেই, হয়তো পড়ছো
আর ভাবছ কে আমি-তাই না??’
সত্যি মনে পড়ছে না। কে লিখছে আমায় এভাবে!! পড়ব না ভেবেও আবার শুরু করলাম।
দেখি না শেষ অবধি যদি বুঝতে পারি—‘অনেক ভেবেও পেলে না খুঁজে,কে আমি ? পারলে না তো আজ চিনতে- জানি। আজ আমি অনেক দূরে একাকী কাটাচ্ছি। তবুও
মনের কোণে এক টুকরো আশা নিয়ে লিখছি। মনে পড়ছে বিদায়ের আগের সেই দিন-রাতগুলো,কত না
কথা ছিল আমাদের,কত না খুশি হতাম দুজনে একসাথে পথ চললে-তাই না। এবারও মনে পড়ছে না
তো আমি কে? জানি সময় সাপেক্ষে আজ আমিও তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি; যাকে
ভালোবেসে তোমার বাড়ানো হাতটা আঁকড়ে ধরিনি- ঠিক তার মতনই। সেদিন তুমি আমায় থামাতে
চেয়েছিলে অনেক আশা নিয়ে- আমি কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আজ যদি দু’হাত বাড়িয়ে তোমায়
ডাকি,তোমার কাছে যেতে চাই! কি করবে তুমি বলো?? জানি তুমি ফেরাতে পারবে না- আমায়
বড্ড বেশি ভালোবেসেছো যে; জানি এখনো বাসো ঠিক আগের মতই।।
সেদিন মনটা দিতে পারিনি কিন্তু বলেছিলাম আমি একদিন তোমার কাছেই ফিরবো-
পরজন্ম হলেও ; মনে আছে তো?
আজ এতদিন পর আমার মনটাই তোমায় উপহার দিলাম-এই মন এখন থেকে শুধুই তোমার ।
তুমি এসে একে গ্রহন করো-কি করবে তো নাকি?
অপেক্ষায় রইলাম...জানিও।।
ইতি
তোমার প্রণয়িনী
এমন সময় বাইরে মেয়ের চিৎকার-তাড়াতাড়ি চিঠিটা ছিঁড়ে বেরিয়ে এলাম।।
মধ্যপন্থী
পিনাকি
১
রাতের ভোজনের শেষে
, ওরা সবাই গোল
হয়ে বসল । পর্ণকুটিরের ভিতর মাটির প্রদীপ
জ্বলছে । হলুদ শিখার সকল অতিথিদের দেহে আলো
, প্রলেপ দিয়েছে ! এত
ছোট্ট ঘরে , ভারতবর্ষের সেরা
মহারথীরা বসে আছেন । তাঁদের মুখে বালকের মতন সারল্যের
অভিব্যাক্তি । সব মানুষের ভিতরেই
, একজন বালক থাকে , একান্ত
অবসরেই -- সেই বালকটি
প্রকাশিত হয় । ভারতের চিরন্তন সত্য গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে -- এক জায়গায় একত্রিত হলেই নানা
রকমের গল্প শুরু
হয়ে যায় ।
পাণ্ডবরা এখন বনে
বাস করছে । দ্রাবিড়
দেশে সবকিছুই তাদের কাছে
নতুন মনে হল । গোদাবরীর
স্নিগ্ধ জলে স্নান
করেছে । খুব বেশী দিন হয়ত এখানে
থাকা হবেনা ।
চারপাশ প্রকৃতির শীতল ছায়ায়
ঢেকে গিয়েছে । এখানকার মানুষেরা খুব স্বাধীন । পাখিদের সুর
প্রতিমুহূর্তে পাণ্ডবদের কাছে প্রেরণার
মতন মনে হয় । এত
অন্যায় , অবিচার , আর অপমানের পরেও... এমন একটা পৃথিবী রয়ে গিয়েছে ! ----- এমন বিস্ময় নিয়ে
, পাণ্ডবরা পদযাত্রা করে
চলেছে ।
অগস্ত্য তীর্থ ,
সূর্পারক তীর্থ ভ্রমণ করে , এই
প্রভাস তীর্থে এসেছে । তাদের এখানে
আসবার কয়েকদিনের মধ্যেই আজ
সকালে , কৃষ্ণ নিজের
বন্ধুবান্ধব নিয়ে উপস্থিত হল ।
অনেক দিনবাদে আবার একসাথে দেখা হল
!
অনেকটা পথ
নিজেরা ভ্রমণ করল , বহু
কাহিনীর সংগ্রাহক হয়েছে । যুধিষ্ঠির
নিজেও চাইছিল , পুরানো মুখের সাথে
দেখা হলে মন্দ হয় না। নতুন মুখ
তার কাছে ক্লান্তিকর নয় , তবে
পুরানো মুখের আচমকা দেখা
পাওয়া , অনেকটা তৃষ্ণাতুরের জল সন্ধানের
সময়কালে পরিচিত পানীয়ের দেখা
পাওয়ার মতনই আশাব্যঞ্জক ।
কৃষ্ণকে পঞ্চপাণ্ডব
, রাতে একসাথে থাকবার প্রস্তাব দিলেন । অবশ্য , পাণ্ডবদের কেও
বদলে একটা শর্তে সম্মত
হতে হয়েছে ।
তাদের নতুন করে
আর কিছুই দেওয়ার
নেই ।
পাণ্ডবরা
হাসছিল ! কৃষ্ণ বললেন –
এটা দিনের প্রথম
ভাগ , খেয়াল রেখো । রাতের শেষ ভাগ
পর্যন্ত আমাদের ঘুমানো যাবেনা
। নিদ্রাহীন থেকে
গল্প করব ...
বাইরে ঘন রাত
। বন্য
জন্তুদের ডাক কানে আসছে
। কুটিরের ভিতর
নিদ্রাহীন চোখ গল্প
খুঁজছে । এখানে সকলের চোখেই নতুন ভোরের সরলতা । গল্প খুব আদিম পদ্ধতি ,গুহামানবেরা গোল হয়ে
বসে গল্প করত । সভ্যতা
এগিয়েছে । নগরের
সাথে জটিলটা এসেছে ।
মানুষের কিছু চাহিদার পরিবর্তন
হয়নি । এই কুটিরের ভিতর
এই সব মানুষদের মুখে সেই
চাহিদার ছায়া দেখা যাচ্ছে ।
সকলেই গোল
হয়ে বসেছেন , বাঁদিক থেকে
যুধিষ্ঠির আর পঞ্চপাণ্ডব , তারপর দ্রোপদী
তারপর কৃষ্ণ , বলরাম । প্রদ্যুম্ন, শাম্ব , সাত্যকি ...
কৃষ্ণ বললেন– আমাদের
মধ্যে গল্প শুরু
করবে কে ?
দ্রোপদী কৃষ্ণের দিকে
তাকিয়ে হাসল ।-আপনার বুঝি নতুন
গল্প ঝুলিতে নেই !
একান্তে তুমি বললেও
, সকলের সামনে কৃষ্ণকে
সে এমন ভাবেই সম্বোধন করে ।
কৃষ্ণ হাসতে – হাসতে
বললেন– আছে , আমার ঝুলিতে
অনেক রঙের গল্প
আছে । আমি আজ গল্প শুনতে
চাইছিলাম । আমি অনেক গল্প বলেছি , পরেও
বলতে হবে । এখন শোনা যাক ।
ঘরের মধ্যে
নীরবতা নেমে এসেছে ! এখন
তাহলে কে দায়িত্ব নেবে
? শুধু গল্প বললেই হবে না , তা এতটাই
টানটান হতে হবে , যাতে
সারারাত কেউ দুটো
চোখের পাতা মিলিয়ে
দিতে না পারে ! যদি শ্রোতা গল্প
শুনতে - শুনতে ঘুমিয়ে
যায় , বক্তা হেরে
যাবে।
কৃষ্ণ বেশ মজা
পাচ্ছিলেন , এইরকম পরিস্থিতি
হবে সে বুঝতে পেরেছিল । পাণ্ডবরা নিজেরা আর
নিজেদের বুদ্ধি , মেধার
উপর খুব ভরসা করতে পারেছে না । তাদের কাছে
এইসবই হচ্ছে কৃষ্ণের উপদেশ
অনুসারি । এমন বাকীরা
ঠিক ঠাওর করতে পারল না । দ্রোপদী অবশ্য মন
থেকে চাইছে কৃষ্ণের মুখে
কোন গল্প শুনতে
। কেননা এই গল্প
পরিবেশনা বেশ সুন্দর হয় । প্রদীপের
হলুদ আলো , সকলের
মুখে ছায়ার মতন
মেখে রয়েছে । এমন
সময় দরজায় আওয়াজ...
২
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে
আছেন লোমশ ; রোগা
চেহারার মধ্যবয়স্ক, দেহ
ভর্তি লোম । আগন্তুক পূর্ব পরিচিত , তবে তার আগমন
নেহাতই আচমকা ! কৃষ্ণ ছাড়া উপস্থিত সকলের মুখে , সেই
অভিব্যাক্তি ফুটে উঠেছে ।
লোমশকে দেখে যুধিষ্ঠির বললেন – আপনি !
লোমশ হাত জোর করে বললেন – কৃষ্ণ এখানে আছেন শুনে
আগেই চলে এলাম । ক্ষমা চাইছি ,
আমি দেরী করে ফেললাম । বেশ কিছু কাজ ছিল , সেইগুলো শেষ হতে অনেক সময় নিল । আপনারা দেখছি গল্প করছেন !
কৃষ্ণ হাসতে –
হাসতে বললেন – আসুন , এখানে বসুন । আমরা
গল্প করছিলাম । ভালোই হয়েছে ,
আপনি এসেছেন ।
লোমশ বসে পড়লেন ,অর্জুনের পাশে
- কাল খুব ভোরেই আমি
অর্জুনকে এক সুন্দর জায়গায়
নিয়ে যাব । খুব ভোরে না বেড়িয়ে পড়তে পারলে
, পৌঁছাতে দেরী হয়ে
যাবে !
কৃষ্ণ বললেন – আজ রাতে আমরা একটা খেলা খেলব ।
লোমশ – খেলা ?
কৃষ্ণ – হ্যাঁ । এমন একজন
গল্পকার যে সাররাত নিজের শ্রোতাদের
জাগিয়ে রাখতে পারবে । লোমশ ,
আপনিই প্রথম শুরু
করুন । এমনিতেই এইখানে আমার মনে
হচ্ছে আমি বাদে আর কেউ এই প্রতিযোগিতায়
আগ্রহী নয় । অগত্যা , আপনিই কোন
গল্প শোনান ।
লোমশ হাত জোর করে
বললেন– আপনি থাকতে আমি !
-কেন না ? জঙ্গল
আপনার থেকে কেউ ভালো চেনেনা ।
অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছেন । কোন গল্প শোনান ।
লোমশ কিছুক্ষণ চুপ
থেকে শুরু করলেন
গল্প ।
নর্মদার খুব কাছেই ,
বৈদূর্য পর্বতের ঢালু একখণ্ড
সবুজ বনভূমি থেকে কাহিনী
শুরু হচ্ছে । তখন ভোরের
সারল্য মিশে গিয়েছিল ,
সকালের ব্যস্ত আলোয় । কিছুটা দূরে
তাবু ফেলে , রাজা শর্যাতি
বিশ্রাম নিচ্ছেন । এই স্থান থেকে
কিছুটা দক্ষিণে গেলেই
বনভূমি গভীর । রাজার একমাত্র কন্যা সুকন্যা
নিজের বান্ধবীদের নিয়ে
ভ্রমণে বেড়িয়েছে ।
মেয়েটা একা
আছে না সাথে অন্য কেউ – রাজা
কথাটা বলেই পা দুটো
ভাঁজ করে বেশ আরামে বসলেন । এতক্ষণ
ঝুলিয়ে রেখেছিলেন ।
সামনে রাণী দাঁড়িয়ে
রয়েছেন । বললেন – জুম্লি
গিয়েছে আশা করছি , কোন
অসুবিধা হবে না।
রাজা বললেন –
মেয়েটা ভীষণ অস্থির । কিছু না বুঝেই
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ! এই বনে আমরা কয়েকদিনের জন্য এসেছি , এখানকার প্রাণীদের যেন বিরক্ত না করি ।
প্রহরী , তাবুর বাইরে থেকে বলল – প্রভু , একজন বৃদ্ধ ব্রাক্ষ্মণ
আপনার
সাথে দেখা করতে চাইছেন ।
রাজা বললেন – ভিতরে
আসতে বলো।
রাজার সামনে , দাঁড়িয়ে রয়েছে বৃদ্ধ আর রুগ্ন এক ব্রাক্ষ্মণ । মানুষটিকে দেখে ,
রাজার প্রথমে ঘেন্না করল । চেহারা দেখে
মনে হচ্ছে দীর্ঘ রোগে ভুগেছেন । একচোখ ক্ষততে ভরা , এই ঘা খুব তাজা , এখনো শুকিয়ে যায়নি !
-আপনার বাঁ –চোখে ক্ষত ?
-রাজা , আমার চোখে এক ভিনদেশী পাখি আঘাত করেছে । আমি আসলে
এই জঙ্গলে থাকি । বলতে পারেন বনবাসী ব্রাক্ষ্মণ । আমার হাতের রান্না খারাপ নয় । আমি পাচক । জঙ্গলে থেকে নানা রকমের নতুন
নতুন মশলা আবিষ্কার করেছি । সেই মশলার ব্যবহার শিখছি ।
-আপনার নাম ?
-চব্যন । এই নামেই আমাকে চেনে সকলে ।
-আপনি আমার কাছে
কেন এসেছেন ?
-রাজা , আমি এক
বৃদ্ধ পাচক । আমি চাইছি আপনি
আমাকে কিছু কাজ দিন।
-আপনার কাজের দরকার
নেই । আমি আপনার দায়িত্ব নেব ।
চব্যন হাত জোর
করে বলল - রাজন , ব্রাক্ষ্মণকে দান দেওয়া
আপনার মহানুভবতার পরিচয় । আমি সেই দান নাও নিতে
পারি । আমি চাইছি আমার রান্নার স্বীকৃতি । রাজা আপনাকে খাওয়াতে
পারলেই লোকে আমার
রান্নার প্রতি আস্থা
পোষণ করবে । আমি সেইটুকু উপকার
চাইছি ।
-আপনি কি রান্না
করতে পারেন ? আমার কাছে
রাঁধুনি অনেক আছে ।
তাদের হাতের রান্না খেতে অভ্যস্থ ।
-রাজন , তারা
সকলেই ধরাবাঁধা রান্না
করেন । আমি বনের পাতা
, কাণ্ড , মূল দিয়ে
সুস্বাদু রান্না করতে
পারব । আপনি খেয়ে দেখবেন ।
স্বাস্থ্য উন্নত হবে আর জিহ্বার স্বাদ
ভুলতে পারবেন না ।
রাজা কিছুক্ষণ
থেমে বললেন – আপনি তিনদিন
রান্না করুন । আমাদের ভালো লাগলে , আমি সাথে করে
নিয়ে যাব । আপাতত
আমরা তিনদিন রয়েছি । ইচ্ছা
আছে বেশ কয়েকদিন
থাকবার । এখানে এসে
কোন কিছুতেই স্বাদ পাচ্ছি না । আপনার
হাতের জাদু দেখতে চাই ।
চ্যবন হাত দুটো
কচলাতে – কচলাতে বললেন –
আপনার ইচ্ছা ।
রক্ষী এসে বললেন – প্রভু , রাজকন্যা এসেছেন ।
৩
দু’দিনের মধ্যে চ্যবন পাচকের
বেশ নাম হয়ে গেল ! অনেক রান্নাই সামান্য
গাছের পাতা , কিম্বা
কাণ্ড কেটে তৈরী ; স্বাদ অদ্ভুত ! সকলেই
ভেবে পায় না , এমন সুস্বাদু
হাতের জাদু সে
রপ্ত করেছে কেমন করে ? রাজা
ঠিক করে ফেলল , বৃদ্ধকে নিয়ে যাবে ।
রাজা দুপুরের খাবার
খেয়ে , বিশ্রাম নিচ্ছে । তার
খেয়াল হল , নাভির উপরে প্রচণ্ড
ব্যাথা! শুধু তাই নয় , একটা
বিষয় এড়িয়ে গিয়েছে ,
আজ নিয়ে তিন দিন হল , সে একবারের জন্য
মল ত্যাগ করতে যায়নি !
এমন সময় মন্ত্রী
, তাবুর ভিতর
এসে বললেন – মহারাজ , চ্যবন শত্রু
শিবিরের গুপ্ত ঘাতক মনে হচ্ছে
।
রাজা অবাক হয়ে বললেন
– মানে ?
মন্ত্রী হাত জোর
করে বললেন – মহারাজ , রান্নায় নির্ঘাত
এমন মশলা ব্যবহার করেছে , আমাদের সেনাদের
মলদ্বারে ঘা হয়ে
গিয়েছে । তাদের কষ্ট শুরু
হয়েছে । আমার আমারও তাই অবস্থা । এতদিন যারা রান্না
করতেন তারা বিশ্বাস
যোগ্য । চ্যবন কিছু এখনো কোন
প্রমান দেয়নি । তাছাড়া
আপনি অকে এক্ষুনি ডাকুন । জিজ্ঞেস করুন ।
রাজা শর্যাতি
ভাবলেন – এই অবস্থা
আমারও । চ্যবন নিশ্চই কোন রহস্য
লুকিয়ে যাচ্ছে !
চ্যবন সকলের সামনেই
বললেন – রাজা শর্যাতি আমি ঋষি চ্যবন । উইয়ের ঢিপির মধ্যে
আমি বসে ধ্যান করছিলাম , ঠিক
সেই এক সুন্দরী রাজকন্যা
এসে , নিজের আত্ম খুশির জন্য আমার এই
চোখ আহত করেছে ! রাজা আমার
কাছে বিশেষ মশলা রয়েছে । এই রোগ
আমার ওষুধ মশলার
ব্যবহারেই ঠিক হবে ।
আপনার হাতেই আপনার সেনা , নিকট জনের প্রাণ ।
-মানে ? আপনি
কী চাইছেন ?
-সরাসরি বলছি
, আমি চাইছি আপনার
কন্যার সাথে আপনি আমার বিয়ে
দিন । সুকন্যা আমার সাথে এই
বনেই থেকে যাবে । রাজা
আমি বৃদ্ধ নই , এক বিরল
রোগে আক্রান্ত । এই রোগের
চিকিৎসা আছে । আমি চাইছি , আপনার
কন্যা কৌতূহল আমার চোখে
আঘাত করেছিল । তাকেই আমি আমার সেবার জন্য
বিয়ে করব ।
রাজা বুঝে গিয়েছে , এই
বৃদ্ধ দুর্বল ঋষি
বেশ ক্ষমতাবান । তার মেয়ের নিস্তার
নেই ।
রাজা রাজী হয়ে
গেল ।
৪
সুকন্যা অতীতের কথা
এখন আর ভাবেও না । মানুষ যখন ভেবে
নেয় , অতীত তাকে যন্ত্রণা দেবে আর সেই যন্ত্রনা থেকে
বাঁচবার উপায় নেই , তখন সে একরকম আত্মসমর্পণ করতে অভ্যস্থ হয়ে যায় । শেষ
একবছর এমন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়েই যাচ্ছে । বৃদ্ধ আর দুর্বল স্বাস্থ্যের মালিক চ্যবন ,
নিজের দেখভালের জন্য মেয়েটির ইচ্ছার
বিরুদ্ধে নিজের পত্নী করেছে ।
বাবার মুখের দিকে
চেয়েছিল , নিরুপায় রাজা
জানতেন – মেয়েকে না দিলে চ্যবন
কখনই তাদের সুস্থ করে
তুলবার প্রতিশ্রুতি দেবে না
। সুকন্যা দেখল - কাঁপা –কাঁপা
ঠোঁটে দু ‘ হাত জোর করে
দাঁড়িয়ে আছে ! বলল – আমার মেয়েটা
খুব ছোট । আপনার সেবার দায়িত্ব
নিতে পারবে না ।
চ্যবনের মুখে হাসি ।
পরবর্তী একবছর ,
ঋতুস্রাব মুখরিত রাতে , সুকন্যা
অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে
অনেক রাত পর্যন্ত
জেগে ছিল । ঘুম হারিয়ে
গিয়েছে । চোখে ভেসে উঠেছে , চ্যবনের হাসি । নিজেকে নিয়ে
যখন সবচেয়ে বেশী
স্বপ্ন দেখবার বয়স , তখন
ক্লান্ত আর পীড়িত
চোখে রাত জাগা পাখি
হয়ে , শূন্য আকাশের
দিকে তাকিয়ে থাকে । তার
সাথে জেগে রয়েছে
সাদা চাঁদ । এই চাঁদের স্থির স্নিগ্ধ
আলো শান্তি দেয় ।
সুকন্যা আস্ত চাঁদের
দিকে তাকিয়ে কেঁদে
ফেলেছিল , অনেক রাত তার এই কান্না হারিয়ে
গিয়েছে অরণ্যের পশুদের উল্লাসে ।
পৃথিবীর কেউ কখনই
সুকন্যাদের চোখের জলের
হদিশ পেল না ! তাদের যন্ত্রণা ,
ত্যাগ --- অন্যের ইচ্ছাধীন
বস্তু হয়ে গিয়েছে ।
জলের প্রতিবিম্বে নিজের
মুখ দেখে , সে
নিজেকে বাহবা দেয় ।
আর বেশী নয় । চেহারা
এমন ভাবে ভাঙছে ,
খুব দ্রুতই এই
জীবন থেকে মুক্তি পাবে ।
এইসব ভাবছিল । কুটিরের
জানালায়
হাত রেখে , বাইরের পাতায়
ঢেকে যাওয়া পথের
দিকে তাকিয়ে রয়েছে ।
দিনের মধ্যভাব । সে এখানে
একাই । চব্যন দূরের পাহাড়ে গিয়েছে একান্তে নতুন ঔষধি গাছের সন্ধানের
জন্য । ফিরতে তিনদিন
।
কুটিরের সামনে
, পাথুরে রাস্তা , সেখানেই দাঁড়িয়ে
সমবয়সী যুবকেরা । সুকন্যা দেখল
। এই
লোক দুটো অন্য জায়গা
থেকে এসেছেন । পোশাক দেখেই বোঝা
যাচ্ছে বিত্তশালী । তারা কিছু খুঁজছে , জানালার ধারে সুকন্যা মাথা
হেলিয়ে দাঁড়িয়ে , দেখল ওদের
উদ্বিগ্ন মুখে চিন্তার
ছায়া । সে নিজে গিয়ে
জিজ্ঞেস করবে না , এমন কাজ তাকে শোভা
পায়না ।ছেলে দুটো এই দিকেই আসছে !
সুকন্যা নিজের
অগোছালো কাপড় ঠিক করে নিচ্ছে ।
-কেউ আছেন ?
অনেক দিন বাদে কোন
পুরুষের কণ্ঠ , সুকন্যা শুনতে পেয়েছে ! তার
দেহে বিদ্যুৎ খেলেছে ! অনেক দিন
বাদে এই
পরিত্যক্ত জঙ্গলে যৌবনের
প্রাদুর্ভাব ঘটল ।
-কাকে চাই ?
-এই বনপ্রান্তরে
থাকবার জায়গা খুঁজছিলাম ।
সুকন্যা হাত জোর করে
বলল - আপনারা কোত্থেকে
এসেছেন ?
-অনেক দূর থেকে । আমরা
চিকিৎসক । অনেক জটিল রোগের
চিকিৎসা করে থাকি । আধুনিক উন্নতমানের
ওষুধের ব্যবহারের জন্য , সবসময়
সন্ধান করতে থাকি । এখানেও এসেছি
নতুন এক বিশেষ রকমের
গাছের সন্ধানে । ফিরবার মুখে আপনাদের এই
কুটির দেখলাম । একটু
বিশ্রাম নিতে পারলে উপকার হত ।
দুই যুবকের
গায়ের রং দুধ সাদা । চেহারায় আরামের ছাপ
। এরা যোদ্ধা নন । সুকন্যা বুঝতে পেরেছে , এরা বৈদ্য ।
বাবার কাছেও কত বৈদ্য আসতেন । সকলেই বয়স্ক । তখন থেকেই মনে হয়েছিল , চুলে পাক না ধরলে বৈদ্য হওয়া যায়না ।
আজ এই দুই সুন্দর তরুণদের
দেখে --- আধুনিক চিকিৎসার প্রতি সুকন্যার
বিশ্বাস দৃঢ় হতে শুরু
করেছে ।
নিজের ভাগ্য ফিরবে
কি ? এখন এই চিন্তায়
আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল । সুকন্যা
ভাবছিল – চব্যনকে কোন ভাবেই সুস্থ
করা যাবে না ?
-আমার নাম সুকন্যা । আমার স্বামী ঋষি
চ্যবন ।
কুটিরের সামনে
শুকনো পাতায় ভরে
থাকা উঠোনে ,
দাঁড়িয়ে আছে সুকন্যা । তার সামনে দুইজন
অপরিচিত যুবক । এখন
দিনের মধ্যভাগ ক্রমশই
অন্তিম লগ্নের দিকে এগিয়ে চলেছে । সন্ধ্যা নামতে আর দেরী
নেই ।
-আমাদের নাম , অশ্বিনীকুমার দ্বয় । ইন্দ্রের চিকিৎসা করি ।
-ইন্দ্র ! আমি আমার বাবার মুখে আপনাদের
নাম শুনেছি । আপনারা সু –প্রসিদ্ধ চিকিৎসক । বহু জটিল রোগে ওষুধ রয়েছে্ ...
-আরে ... না । না । অত কিছু নয় । তবে হ্যাঁ এটা ঠিক আমাদের
চিকিৎসা বিজ্ঞান অন্যদের থেকে আলাদা
।
-আপনারা অনুগ্রহ
করে আজ রাতে আমার অতিথি কুটিরে বিশ্রাম
নিন ।
অশ্বিনী ভাইয়েরা কিছুক্ষণ ভাবল । বলল – আপনার অসুবিধা হবে
না ? আমরা অপরিচিত ।
-কুমার , আমি আপনাদের চিনেছি । ঋষি নিজে এখানে উপস্থিত নেই । তিনি থাকলে ,
আমাকে বলতে হত না । তিনিই আপনাদের আপ্যায়ন করতেন
৫
চ্যবনের অনুপস্থিতিতে ,
তিন সমবয়সী যুবক – যুবতীর
মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী
হয়েছে । অনেকে মনে করে গভীর বন্ধুত্বের জন্য সময়
দরকার , আসলে সময় নয় – অবকাশ দরকার । চ্যবনের হাতে সময় থাকলেও ,
সুকন্যাকে বুঝবার মতন অবকাশ ছিল না !
এটাই প্রকৃত কারণ , তাদের ভিতরের দূরত্বের ।
সন্ধ্যার অপসৃয়মান
আলোয় , তিন প্রেমিক প্রতিনিধি মুখোমুখি বসে রয়েছে । অশ্বিনী দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন বলল – তোমার রুপ , যৌবন
এখন অনাস্বাদিত ফলের
মতন । তুমি চ্যবনের কাছে কিছুই পাওনি । আমরা তোমাকে আমাদের সাথী করতে চাই ।
তুমি রাজী থাকলে , এসো আমাদের সাথে ।
সুকন্যা লজ্জা পেয়ে গেল । এই প্রথম কেউ তার রূপের বর্ণনা করল । কোন যুবক তাকে প্রেম নিবেদন করল । তার নিঃশ্বাস
যেন থেমে গিয়েছে ! সুকন্যা বলল – একজন
অসুস্থ রুগীকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া দুর্বলতার
পরিচয় । আমি চাইনা , আমার বাবাকে
কেউ অপমান করুক । তার মুখের কথা ছিল অসুস্থ চ্যবনের সেবার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন ।
যদি চ্যবন সুস্থ হয়ে যায় , আমি তাকে জানিয়ে তোমাদের সাথে যাব ।
-কাল চ্যবন আসবেন । তিনমাস তার চিকিৎসা করব । তারপর তুমি আমাদের তিন জনের মধ্যে একজনকে বেছে
নেবে...
গল্প থামিয়ে
দিল লোমশ । এমন টানটান সময়ে
যদি বক্তা থেমে যায় , শ্রোতার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে পড়ে । ভীম বিরক্ত প্রকাশ করে বলল – লোমশ ,
এই শেষ রাতে আর মজা করবেন না । কিছুক্ষণের মধ্যেই দিগন্তে আলো ছড়িয়ে পড়বে । গল্পটি অনুগ্রহ করে শেষ করুন ।
অর্জুন বলল – সুকন্যা
শেষ অব্দি কার পক্ষে ছিলেন ?
যুধিষ্ঠির বললেন – প্রচলিত সমাজের অনুসরণ করাটাই ধর্মীয় কাজ
।
দ্রোপদি
কিছুটা অভিযোগের সুরে বলল –
ধর্মরাজ , সমাজ ঠিক রাখবার দায়িত্ব আপনারা মেয়েদের উপরই দিয়েছেন ? তাদের ব্যক্তিগত
চাহিদা বলে কিছু নেই ? তারা শুধুই সমাজের সম্পত্তি ! ......
লোমশ চুপ করে বললেন – আমি তিনমাস পরের ঘটনায় চলে যাচ্ছি । চ্যবন তখন অশ্বিনী ভাইদের চিকিৎসার প্রভাবে সুস্থ যুবক । তারা
তিনজনে দাঁড়িয়ে রয়েছে
সুকন্যার সামনে । এখন একজনকে
বেছে নিতে হবে ।
চ্যবনের সাথে থাকলে খুব নিরাপদ
জীবন । অশ্বিনী ভাইদের হাত
ধরলেই সমাজের বিপরীত
স্রোতে ভেসে যাওয়ার যুদ্ধ শুরু
হবে ।
-তা হলে
মেয়েটা কোন পথ বেছে
নিল !
দ্রোপদী উদ্বিগ্ন
। কথাটা
বলেই সে যুধিষ্ঠিরের দিকে
তাকিয়ে বলল – মহারাজ , আপনি আর
সুকন্যাকে অধার্মিক বলবেন না । মনে রাখবেন , চ্যবন নিজের
বার্ধক্যের লাঠি হিসেবে সুকন্যাকে
গ্রহণ করেছিল । এটা বিয়ে
ছিল না । একটা চূক্তি ছিল ।
ধর্মরাজ বললেন – অসহায়
মানুষকে সেবা করাটা গুরুত্বপূর্ণ
দায়িত্ব । চ্যবনের চোখের
ক্ষতি করেছে । সুকন্যাকে সে নিজের
সেবার জন্য নিতেই পারে ।
-এটা কেমন হল ?
নীতির অজুহাতে নিজের
মতন করে আমরা নিয়ম
বানিয়ে চলেছি ! অন্যায়ের শাস্তি
দিচ্ছি , অথচ নিজে স্বামী হয়ে
স্ত্রীয়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করব না !
দ্রোপদী কথা গুলো
বলে লোমশের দিকে
তাকিয়েছে । লোমশ বললেন – সুকন্যা ,
চ্যবনের সাথেই রইল । খালি হাতে ফিরতে
হয়েছিল , চিকিৎসক ভাইদের !
এমন একটা উপসংহারই আশা করেছিলেন
যুধিষ্ঠির । বললেন – ধর্মের জয় ...
৬
ভোর হতে আর
কিছুক্ষণ , আকাশের পূর্ব
দিকটা হাল্কা লাল হয়ে রয়েছে ।
রক্তাভ মুখ । আর
কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য
উঠবে ।
দ্রোপদী বাগানের
এক নির্জন স্থানে
একা দাঁড়িয়ে । পূর্ব দিকে তাকিয়ে
। সে খেয়াল
করেনি কখন কৃষ্ণ পিছনে
এসে দাঁড়িয়েছে । মাথায় হাত
বুলিয়ে বললেন - মন
খারাপ করছ ? রাগ হচ্ছে না ? চ্যবনের পক্ষ না
, সুকন্যা সংসার ত্যাগ
করে জেতেই পারত । যে চ্যবন তার
খেয়াল করেনি , তাকে কি মেয়েটা
ভালোবেসেছিল ?
-না কেশব ,
যদি ভালোবাসে , তাহলে যায়নি ঠিকই
আছে । আমি একটু
অন্য ভাবে ভাবছিলাম ...
কৃষ্ণ হাসতে –
হাসতে বললেন - তুমি ভুল
ভাবছ । প্রতিটা মানুষ
নিজের জায়গা থেকে
প্রতিবাদী হতে চায় । প্রতিবাদ
খুব কঠিন কাজ । সবাই সেই কাজে
দক্ষ নয় । সুকন্যা
চ্যবনকে ভালোবাসেনি , আবার সে
নিজের উপর ঘটে চলা
অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ করেনি ।
আমরা অনেকেই মধ্যপন্থী
, তাই এই রকম পন্থা অবলম্বনকারীরা মধ্যবিত্ত
। সমাজে এই মানসিকতার কোন প্রভাব থাকে না । সুকন্যারা নিজেদের
কথা কাউকে বলতে পারবে না
। তাই ভারতবর্ষের ইতিহাসে
, তাদের হয়ে কেউ কথা
বলবে না । দ্রোপদী তুমিই থেকে
যাবে নারী প্রতিবাদী হয়ে ,
কেননা তুমি প্রতিবাদ করেছো । মধ্যপন্থী নও । যারা মধ্যপন্থায় বিশ্বাস করেন , তারা
নিরাপদ জীবন পেয়েছেন । সেই জীবন দ্বিতীয় কোন ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে না ।
দ্রোপদী সদ্য
প্রকাশিত সূর্যের দিকে চেয়ে
রয়েছে । তার চোখে
উজ্জ্বলতার প্রতিবিম্ব ।
অনলাইন মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা
চৈত্র সংখ্যা ১৪২৪
কবিতা অন্তিম পর্যায়
অবসন্ন রজনী
অনিমেষ সরকার
আমার আনমনা বিকেলের মোহোনায় সূর্যের রঙ লালচে,
ছোট টিলার উপর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চা বাগানের
ছায়াটাকে গাঢ় লাগে ভীষনভাবে;
দূরে একচালার ঘরে 40ওয়াটের একটি বাল্ব জ্বলছে,
ডিস টিভির অ্যানটেনা তখন ও ফ্রীতে চ্যানেল করছে ডিসট্রিবিউশন;
টিভিতে কতগুলো মুখ দেখা যায় খবরের অবকাশে!
ধীর পায়ে এগোনো সহযাত্রীর পেছনে আসছে তেড়ে,
নাম গৌত্রহীন সারমেয়!
মোবাইলের ফ্ল্যাসে আঁধারময় বিকেল পথ করে মসৃণ,
দিশা দেখিয়ে দেয় এগোনোর!
স্তব্ধ গুমড়ে কাঁদা স্বপ্নগুলো আর একবার ঝিলিক দিয়ে
ওঠে জ্বলে;
স্যাতস্যাতে কাঁদার পাঁকে পা ডোবানো কর্দমাক্ত পা দুটি,
সন্তুপর্নে দাঁড়ায় ওঠে -হাঁটতে থাকি!
কিলোমিটারের পর কিলোমিটার আলোর দিকে,
ভোরের অবসন্নে পেছনে ফেলে আসা ইশ্বর আর মায়ের আদর;
ফেরাতে চায় নতুন দিগন্তে,
কখন যে সূর্যের রঙ হলদে হয়ে উঠেছে, পাতার ক্লোরোফিল
রন্ধনকার্য শুরু দিয়েছে করে, অবশ পায়ের সীমারেখা
অবচেতনে কুকিয়ে ওঠে দেয় ডাক -
আসন্ন অতীতের বিচ্ছিন্ন যুদ্ধের৷
অনিমেষ সরকার
আমার আনমনা বিকেলের মোহোনায় সূর্যের রঙ লালচে,
ছোট টিলার উপর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চা বাগানের
ছায়াটাকে গাঢ় লাগে ভীষনভাবে;
দূরে একচালার ঘরে 40ওয়াটের একটি বাল্ব জ্বলছে,
ডিস টিভির অ্যানটেনা তখন ও ফ্রীতে চ্যানেল করছে ডিসট্রিবিউশন;
টিভিতে কতগুলো মুখ দেখা যায় খবরের অবকাশে!
ধীর পায়ে এগোনো সহযাত্রীর পেছনে আসছে তেড়ে,
নাম গৌত্রহীন সারমেয়!
মোবাইলের ফ্ল্যাসে আঁধারময় বিকেল পথ করে মসৃণ,
দিশা দেখিয়ে দেয় এগোনোর!
স্তব্ধ গুমড়ে কাঁদা স্বপ্নগুলো আর একবার ঝিলিক দিয়ে
ওঠে জ্বলে;
স্যাতস্যাতে কাঁদার পাঁকে পা ডোবানো কর্দমাক্ত পা দুটি,
সন্তুপর্নে দাঁড়ায় ওঠে -হাঁটতে থাকি!
কিলোমিটারের পর কিলোমিটার আলোর দিকে,
ভোরের অবসন্নে পেছনে ফেলে আসা ইশ্বর আর মায়ের আদর;
ফেরাতে চায় নতুন দিগন্তে,
কখন যে সূর্যের রঙ হলদে হয়ে উঠেছে, পাতার ক্লোরোফিল
রন্ধনকার্য শুরু দিয়েছে করে, অবশ পায়ের সীমারেখা
অবচেতনে কুকিয়ে ওঠে দেয় ডাক -
আসন্ন অতীতের বিচ্ছিন্ন যুদ্ধের৷
সুকান্তের প্রতি
মলয় চক্রবর্তী
হে চিরকিশোর, এক মহাবিস্ময়,
উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, তুমি আমার প্রতি লহমায়,
শানিত ভাষার সৃষ্টি, মেশায় রক্তে আগুন
উদয় হোক আবার বিশ্বযুদ্ধে, গর্বিত ভারতের অস্তমিত অরুণ।
তোমার আনা কঠোর গদ্যের কড়া হাতুড়িতে
ধিক্কার জানাই এই বিভীষিকাময় নগ্ন সমাজের ভগ্ন নীতিকে।
প্রতিবাদী কলমের সব ছত্রে দীপ্ত কণ্ঠ তুমি আবহমান,
সর্বনাশা নাগের নাগপাশে ক্রম বিষাক্ত আমরা তোমার ভারতের সন্তান।
অভিশপ্ত কাল, চারিদিকে লাশের পাহাড়, অজস্র রক্তের বন্যা,
আতঙ্কিত রাত, নিদ্রাহীন চোখে শুধুই সাম্যের বন্দনা।
এই ধ্বংসের যজ্ঞে চলেছে আজ একশ কোটির রক্তাহুতি,
শেষ নিশ্বাসেও শুনবে আমার, তুমি--- ফিরে এসো সাম্যবাদী।
মলয় চক্রবর্তী
হে চিরকিশোর, এক মহাবিস্ময়,
উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, তুমি আমার প্রতি লহমায়,
শানিত ভাষার সৃষ্টি, মেশায় রক্তে আগুন
উদয় হোক আবার বিশ্বযুদ্ধে, গর্বিত ভারতের অস্তমিত অরুণ।
তোমার আনা কঠোর গদ্যের কড়া হাতুড়িতে
ধিক্কার জানাই এই বিভীষিকাময় নগ্ন সমাজের ভগ্ন নীতিকে।
প্রতিবাদী কলমের সব ছত্রে দীপ্ত কণ্ঠ তুমি আবহমান,
সর্বনাশা নাগের নাগপাশে ক্রম বিষাক্ত আমরা তোমার ভারতের সন্তান।
অভিশপ্ত কাল, চারিদিকে লাশের পাহাড়, অজস্র রক্তের বন্যা,
আতঙ্কিত রাত, নিদ্রাহীন চোখে শুধুই সাম্যের বন্দনা।
এই ধ্বংসের যজ্ঞে চলেছে আজ একশ কোটির রক্তাহুতি,
শেষ নিশ্বাসেও শুনবে আমার, তুমি--- ফিরে এসো সাম্যবাদী।
তোমার জন্য লেখা সেই চিঠি
দেবব্রত সেন
দেবব্রত সেন
জানো প্রিয়তমা,
তোমার জন্য লেখা সেই চিঠি
আজও পরে আছে।
টেবিলের স্তুপিকৃত পুরোনো বইখাতার ঢিবির ওপর
তোমায় দেব দেব করে দেওয়াই হয়ে ওঠেনি আর
স্কুল পেরল কলেজ তারপর উচ্চ শিক্ষাও
বয়স তো প্রহর গুনছে নদীর স্রোতের ধারায় মুক্ত বিহঙ্গের মতো।
তোমার জন্য লেখা সেই চিঠি
আজও পরে আছে।
টেবিলের স্তুপিকৃত পুরোনো বইখাতার ঢিবির ওপর
তোমায় দেব দেব করে দেওয়াই হয়ে ওঠেনি আর
স্কুল পেরল কলেজ তারপর উচ্চ শিক্ষাও
বয়স তো প্রহর গুনছে নদীর স্রোতের ধারায় মুক্ত বিহঙ্গের মতো।
একদিন পুরোনো ডায়েরিটা নারতে গিয়ে দেখতে পেলাম
একটা ভাজ করা কাগজ। ভাবলাম খুলে দেখি
ভাজ করা কাগজে কি আছে?
খুলেইই দেখলাম, তোমার জন্য লেখা সেই চিঠি।
একটা ভাজ করা কাগজ। ভাবলাম খুলে দেখি
ভাজ করা কাগজে কি আছে?
খুলেইই দেখলাম, তোমার জন্য লেখা সেই চিঠি।
লেখা ছিল, তোমার প্রেমের ইতিকথা
লেখা ছিল, ভালোবাসার প্রস্তাবের কথা
তোমার রুপের কথা। যা আমাকে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাইয়ে ছিল।
লেখা ছিল, ভালোবাসার প্রস্তাবের কথা
তোমার রুপের কথা। যা আমাকে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাইয়ে ছিল।
অনন্ত প্রহরী প্রকৃতি দিবস রজনী
সেই পলাশ শিমূল বনে দুজনের গল্প আড্ডার
তিস্তা উদ্যানে ঘারে ঘারে হাত রেখে কথা বলা
টিউশনির ফাকে মাঝে কত অভিমানী
পা চলত সারি সারি হেলে দুলে দুজনের যুগল বন্দী।
সেই পলাশ শিমূল বনে দুজনের গল্প আড্ডার
তিস্তা উদ্যানে ঘারে ঘারে হাত রেখে কথা বলা
টিউশনির ফাকে মাঝে কত অভিমানী
পা চলত সারি সারি হেলে দুলে দুজনের যুগল বন্দী।
মনে আছে তোমার,
যুগপরাম্পরার পবিত্র করোতোয়া ব্রীজের ওপর
সপ্তাহে অত্যন্ত একদিন সাক্ষাৎ হতো দুজনের
আবহমান স্রোতস্বিনী নদী কিছু বলত কল্লোল সূরে আমাদের ...
যুগপরাম্পরার পবিত্র করোতোয়া ব্রীজের ওপর
সপ্তাহে অত্যন্ত একদিন সাক্ষাৎ হতো দুজনের
আবহমান স্রোতস্বিনী নদী কিছু বলত কল্লোল সূরে আমাদের ...
বলত, তোরা প্রেম কর, ভালোবাসা কর
ভেসে যাও প্রেম সাগরের জোয়ারে
তোরা চুম্বন কর, আলিঙ্গন কর, আমার চোরাবালির ওপর
কৃষ্ণা দ্বাদশী যখন মধু চন্দ্রিমায় মগ্ন,
যখন সব কিছু যেন রুপালি হয়ে গেছে
আমি সাক্ষী আমি প্রহরী তোমাদের
চিন্তনের কিছুই নেই, আমি আছি দুজনেরই সারথি
হাসি ভরা গাল, চিৎকার স্বরে বল "বড় ভালোবাসি "।
ভেসে যাও প্রেম সাগরের জোয়ারে
তোরা চুম্বন কর, আলিঙ্গন কর, আমার চোরাবালির ওপর
কৃষ্ণা দ্বাদশী যখন মধু চন্দ্রিমায় মগ্ন,
যখন সব কিছু যেন রুপালি হয়ে গেছে
আমি সাক্ষী আমি প্রহরী তোমাদের
চিন্তনের কিছুই নেই, আমি আছি দুজনেরই সারথি
হাসি ভরা গাল, চিৎকার স্বরে বল "বড় ভালোবাসি "।
চৈত্ররথ
মাম্পি রায়
চৈতি মাসের শুষ্ক কালে
ফাগুন হাওয়া গায়ে,
আলতোভাবে অলস দুপুর,
আগুন জ্বেলে যায়!
অগ্নি মাসের ঝিঙে পোকা,
ঝিঁ_ঝিঁ রব ছাড়ে,
আম,কাঁঠাল,লিচুর মোলে
শাখা ভরে যায়।
শাপলা,শিমূল, রাঙা লালি,
কোকিল কুহু ভাসে,
বাঁশরি হাতে গোঁঠের রাখাল;
চড়তে ভালবাসে।
মল্লিকা বন, মঞ্জরিত;
সুবাস রেণুর ভাজে,
মৌমাছির তার উড়ান ভরে
সুধারস খোঁজে।
পাগল পবন মন মাতিয়ে,
জানান দিয়ে যায়,
তৃষ্ণ আকাশ বারির আশায়
কাতর প্রাণে চায়।
দৃশ্য
অমিত দে
নেহাত আমি ছোটো হয়ে আছি
ইহাই আমার ত্যাগ
কাক ছাদ থেকে আমাকে দেখে
বয়ঃপ্রাপ্ত আমিও অভিজ্ঞ হয়ে যাই
বসন্তের কোকিল বলি তাকে
এইমাত্র এমনি এক কাক
ঘর-দালান, দিব্য-দৃষ্টি পেরিয়ে
আনন্দধনি পেরিয়ে
চোখের সীমার দূরে চলে গেল
আমি তখনই ছাদে উঠে
দেখলাম চারপাশ—
কোনো পাঁচিল নেই
ছোটো হতেছি দ্রুত
বসন্তের বিদায়বেলা
রাহুল ঘোষ
বসন্তের শেষে সকলে মও ফুল ফোটাতে ।
আম গাছ মুকুল ভরা, দূরে রাংচিওিরের বেড়া;
সজনে গাছে কচি ডালগুলো যেন আগুনের স্ফূর্লিঙ্গ।
কৃষ্ণচূড়া সাজিয়েছে নিজেকে আপাদমস্তকে।
রিক্তভারণ বসন্তের বিদায়লগ্নে চারিদিক মাদকতায় পূর্ন ,
দোয়েলের গানে বিষাদের সুর ধ্বনিত ; কোকিলের নয়নে আকুলিত রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাত।
বুলবুলের কথা সত্যিই স্পর্শ করেছে আকাশকে,
তাতে ফিকে হয়ে উঠে নীলপ্রবাহ।
বসন্তের আগুনে প্রদীপ্ত আলোক থমকে দাঁড়িয়েছে।
পুরাতনের কোমল করে বার্তা নবীনের
বসন্ত লুপ্ত হবে খানিক ক্ষন পরে।
বৈশাখী আবদার
আবু আরশাদ আয়ুব
এসো হে বৈশাখ
নিয়ে স্বপ্নপূরনের অফুরান উচ্ছ্বাস
আশা ভরসা ভালোবাসা একরাশ।
কত শত ভুল বেঁধে আছে ঝুল,
সঠিক দিশার আশায়
বিষাক্ত সব বিশুদ্ধ কর নবপ্রচেষ্টায়।
নিয়ে এসো মিলনের বৈশাখী ঝড়,
মিটিয়ে বিভেদ কে আপন কে পর।
ভুবনে যত ব্যভিচার ছিল নিমেষে দাও উড়িয়ে,
তোমার দাপটে দাও সংস্কার ছড়িয়ে।
নতুন ছোঁয়াতে পরাতন কাটিয়ে ক্লেদ,
তীব্র দাবদহে দাও ঘন কালো মেঘ।
হাসি মুখে জানাই বৈশাখী শুভকামনা,
সারাটি বছর সুন্দর থাক সকলের সব ভাবনা।
কথা বলো মোম
শুভদীপ পাপলু
মগধ রাজ্যের জ্যান্ত ছানা লুটোপুটি খাচ্ছে জন্মবদলের প্রশ্নপত্রে;
তারপর মৃত রেলিং জুড়ে
ফোঁটা ফোঁটা ভঙ্গী ধরার পালা,
রেসের ঘোড়া বা দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার পর
তিলক উঠেছে কপালে,
পরিচ্ছন্ন স্বপ্নে মুখ ফিরিয়ে থাকা
গীতা'র নিষ্কাম বাস্তুসাপ,
বিড়বিড় করে বকেই চলে ব্রাত্য সূঁচের ব্যথায়!
বুকপকেটে ঘুম ভেঙ্গে যায় লেলিহান শিখায়-
মিথ্যে শহরের মাঝে আমার আসা যাওয়া
ব্যারিকেড নামক বর্ণ...
অনাথ ক্ষিধে দক্ষিন মেরুর অভিজাত মধ্যযুগ,
চাদর জড়িয়ে ময়ূরকে জাতীয় করেছি সহজপাঠের জানালায়,
রক্ত মাখা অশ্রু দিয়ে কলঙ্ক ধুয়েছি সোনাগাছি'র!
হীরের ছটায় অগুনতি প্রতিকূল নাম,
নামের হাসাহাসি-
বান ডেকেছে ইতিহাসের ছাউনি ঘেরা
নরম উত্তেজনা,
সভ্যতা'র চামড়া পোড়া গন্ধে
ত্রিশূলের সবুজ ভূমিকা,
অরন্যস্রোতের বিষাক্ত ডানা'য় দেবী দর্শন-
খেটো ধূতি'র পানশালা,
এখানেই বছর চারশো পূর্বে
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করতো!
দ্যাখো;তার তালুতে নির্লজ্জ বনবাসের ছায়া,
লীনতাপ মিশে গেছে বেদুইন বেশ্যা'র
ছলিত সংকীর্তনে,
পালিয়ে এসেছি অন্য বাংলায়
উলঙ্গ ডাইনি দেখার লোভে...
মজুরি জমতে জমতে অসহ্য দূরত্ব ছেড়েছে
কয়লাখনি'র সুখ-
মরচে ধরা সিলিং পাখা'র ব্লেড,
আবার দেখা হবে সহস্রাব্দের দরজায়!!
আগামীর_স্বপ্ন
শৌভিক কার্য্যী
1.
দিনমজুরির কাজে গেলে
বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে
কুপি বাতি বা লণ্ঠন ।
দিব্বি কাটাই বইয়ের সাথে
পড়ার মাঝেই করি তাদের
ফেরার প্রতিক্ষণ ।
2.
বাবা যখন সকাল থেকে
ঝালমুড়ির পসরা সাজে
ফেরি করে রাস্তা ঘুরে ।
বাবার চোখে স্বপ্নগুলো
জ্বলতে দেখেছি আগুন হয়ে
দারিদ্রতা স্পর্শ করে ।
3.
ঘরের কাজ গুছিয়ে নিয়ে
ছুটে যান সকালবেলা
কাজ করতে বাসা বাড়ি ।
খাবার শেষে সবার পরে
মায়ের জন্য দেখেছি রাতে
পড়ে থাকে ফাঁকা হাড়ি ।
4.
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
সারাদিন কত ওজন বহন করে
রিক্সাটাকে আকড়ে ধরে ।
হাসি মুখে ঘরে ফিরে
বাবাকে দেখেছি পড়ার কাজে
উৎসাহ দিত মন ভরে ।
আমরা বড়ো হয়েছি কষ্ট করে
বাবা মায়ের অশ্রু জলে ।
আমরা শক্ত হয়েছি তাদের দেখে
বাচাতে শিখেছি নিজের বলে ।
আমরা স্বপ্ন বুনি চাঁদের আলোয়
খুঁজে ফিরি সুখের মন্ত্র ।
আমরা হবো অনুপ্রেরণা
আগামীর বেচে থাকার যন্ত্র ।
অঙ্কন
পথিক সাহা
No comments:
Post a Comment