প্রথম পর্ব
(প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ব্যক্তিগত গদ্য )
সম্পাদকের কথা
শরতের আকাশে এখন সাদা মেঘের আনাগোনা। সবুজে ঢেকেছে চারদিক। সকালের বাতাসে শিউলি সুবাস। সূর্যের আলোতে মিঠে-কড়া ভাব। সব মিলে অদ্ভুত প্রশান্তি প্রকৃতিতে।
মা আসছেন।
দীর্ঘ উত্সব মরশুম। প্রকৃতি প্রশান্ত হলেও বর্ষার খামখেয়ালিপনায় জলমগ্ন দেশের নানা অঞ্চল। দুর্গতিতে মানুষ। পাশাপাশি নিজ দেশভূমে উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কায় বহু মানুষ। এদের কারো কাছে তাই এই উত্সব হয়তো আলাদা কোনো বার্তা আনছে না।
তবু মা আসছেন।
মা এভাবেই আসেন। সব ভুলে যাই আমরা তাঁর আগমনে। সরিয়ে রাখি আমাদের যাবতীয় সব বেদনা, কষ্ট। এভাবেই চলছি আমরা প্রতিনিয়ত। সমস্যার জীবনে ছোট ছোট টুকরো আনন্দ সম্বল করে আমাদের বেঁচে থাকা। আমাদের সব দুঃখের অবসান তাঁর চিন্ময়ী মূর্তি দর্শনে।
মা আসুন তাই বারবার। এভাবেই...
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৬
যোগাযোগ- হসপিটাল রোড, কোচবিহার
ইমেল ঠিকানা- mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস - শৌভিক রায়
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৬
এই পর্বে আছেন যাঁরা
তৈমুর খান, ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামলী সেনগুপ্ত, কুমকুম ঘোষ, যাজ্ঞসেনী,
মনোনীতা চক্রবর্তী, শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস, সুজাতা মিশ্র , সুস্মিতা পাল কুন্ডু,
বটু কৃষ্ণ হালদার, অন্বেষিকা দাস,
রীনা সাহা ও শৌভিক রায়
প্রচ্ছদ ছবি- ঋতভাষ রায়
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৬
বটু কৃষ্ণ হালদার, অন্বেষিকা দাস,
রীনা সাহা ও শৌভিক রায়
প্রচ্ছদ ছবি- ঋতভাষ রায়
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৬
প্রকাশিকার কলমে
পুজা সংখ্যার রম্যরচনা - হারিয়েছে আজ হাসির পরম্পরা
রীনা সাহা
"সার্কাসের ক্লাউন যেমন সব খেলাতেই ওস্তাদ, কিন্তু তার দক্ষতা হল দক্ষযজ্ঞ ভাঙার। সব খেলাই সে জানে, সব খেলাই সে পারে।কিন্তু পারতে গিয়ে কোথাও কি হয়ে যায়, খেলাটা হাসিল হয় না, হাসির হয়ে ওঠে। আর হাসির হলেই তার খেলা হাসিল হয়"---রম্যসাহিত্যের "হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা" শিবরাম চক্রবর্তীর চল্লিশতম প্রয়াণ দিবস প্রায় নিশ্চুপে গত হয়ে যাবার পরে খুব বেশি করে মনে পড়ছে পূজাসংখ্যাগুলির "রম্যরচনা বিভাগটির" উৎকর্ষতার কথা। কোথাও যেন হাসির শূন্যতা! হাসির হাহাকার! ইংরেজদের আগুনে অত্যাচারের ঘায়ে বাংলার মানুষের গায়ের জ্বালা জুড়োবার মলম ছিল দিলখোলা হাসি নিয়ে হাজির হওয়া হাস্যরসাত্মক সাহিত্যগুলি। যার প্রধান দুটি মাধ্যম ছিল "রম্যরচনা" এবং "কমিক্স"। হাসি আর প্রহসনের দীর্ঘ সে তালিকায় পরশুরাম, ত্রৈলোক্যনাথ, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায় এবং বহু বিশিষ্ট লেখক বাংলা সাহিত্যে রম্যরচনাকে উৎকর্ষতার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। "ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস-- ইয়াক ইয়াক"-- বললেই "হিপ্ হিপ্ হররে"র টেনিদার মুখ মনে করাতে হয় না। পটলডাঙায় চাটুজ্যেদের লিডার টেনিদা যেমন জাঁহাবাজ তেমনি তার ভূতের ভয়। সবসময়ই কিছু না কিছু চিবোয়---দেশলাইয়ের কাঠিও বাদ যায় না। একবার তো ট্রেনে পাশে বসা সহযাত্রীর দাড়ি চিবিয়ে দেওয়ারও বিপত্তি হয়েছিল। সেই চিবোনোতেই হেসে হেসে দাঁতকপাটি লাগবার জোগাড় হয় পাঠককূলের। সত্তরের দশক পর্যন্ত কলকাতায় ও আধা শহরগুলিতে রোয়াক আড্ডা ছিল এক অমোঘ আকর্ষণের জায়গা। তখন কম্পিউটার ছিল না। ছিল না ফেসবুক, টুইটার, চ্যাট সহ নানান ওয়েব সাইট। একদিন রকের আড্ডায় হাজির হতে না পারলে হজমের সমস্যা পর্যন্ত হত। সেইসব আড্ডার মুখ্য চরিত্ররা ছিল কমিক্সের বিমলচন্দ্র ঘোষের "চেঙা-বেঙা" , হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে এবং দি গ্রেট "বাঁটুল"। তার সঙ্গে জুড়ে থাকত বাংলায় অনুদিত সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, স্পাইডা রম্যান, ফ্যান্টম এবং অতি অবশ্যই টিনটিন। অতিমানবীয় ক্ষমতায় বলীয়ান এই কাল্পনিক চরিত্রগুলো ভাল মানুষের বন্ধু, খারাপ মানুষের যম।
কমিক্স বাদে রম্য-সাহিত্যের রসভান্ডার পূর্ণ ছিল শিবরাম চক্রবর্তীর হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের বড়মামা-মেজমামা, গৌরকিশোর ঘোষের ব্রজদা, বিধায়ক ভট্টাচার্যের অমরেশ ইত্যাদি আরও অনেক কালজয়ী, ক্যারিক্যাচার চরিত্রের সমাহারে। এই তালিকায় প্রেমেন্দ্র মিত্রের অদ্ভুতকর্মা চরিত্র ঘনাদা এবং নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বল্টুদা, তপন এবং ঘোড়ামামাও স্বমহিমায় বিরাজমান। তবে সব্বাইকে ছাপিয়ে হাসির-এভারেস্ট চূড়ায় আসীন আমাদের অতিবিজ্ঞ টেনিদা। পটলডাঙা অঞ্চলের যে ভদ্রলোকের চেহারার আদলে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় টেনিদাকে সৃষ্টি করেছিলেন সে বেচারী মনের দুঃখে বলেছিলেন---"দাদা, আপনি কি এমন গল্প লিখছেন যে মানুষ আমায় পাগল করে মারছে। আমার কি অপরাধ?" পাঠককে হাসাবার জন্য তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের বিবরণ বা সংলাপকে কখনোই আরোপিত বলে মনে হয় না। সবটাই যেন "ট্রামের টিকির" মতোই স্বাভাবিক একটি অঙ্গ।
বীররস থেকে সামান্য কৌতুকে মানুষকে হাসিয়ে খুন করবার কারসাজিতে রচয়িতাদের কাল্পনিক চরিত্রগুলিকে কখনোই বাস্তব চরিত্র থেকে আলাদা করা যায় না। প্রত্যেকেই হাসির পরমাণু বোমা যেন! এক্ষেত্রে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভূত-চরিত্রগুলির অবদানও কম নয়। মানুষ আর ভূতের এমন অদ্ভুত সহাবস্থান খুব কম লেখকের লেখাতেই পাওয়া যাবে।এছাড়াও আছে সত্যজিতের ফেলুদা। সূক্ষ্ম রসবোধ, বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ এবং ধাঁধা বা হেঁয়ালিতে পারদর্শী ফেলুদা সুশিক্ষিত এবং রুচিশীল পাঠকমহলে তাই আজও অমলিন। ভাঁড়ামি থেকে অনেকটাই দূরে থাকা ফেলুদার পেরিগাল রিপিটার, টিনটোরেটো, ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার, প্যারাসাইকোলজির ব্যাখ্যা তোপসে হয়ে জ্ঞানতৃষ্ণা চরিতার্থ করে পাঠকদেরও। এছাড়াও আপামর বাঙালির হৃদয় জুড়ে বসে থাকা পিটপিট চোখের, ভোঁতামুখো মুখের জটায়ু, যিনি সবসময়ই বোকা সেজে থেকে হাসিয়ে মারেন পাঠকদের।
যদি কখনও পশ্চিমবাংলার সাহিত্য ইতিহাসের হৃত গৌরব খোঁজা হয়, তখন কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস এবং শিশুসাহিত্য ইত্যাদির মধ্যে বাঙালির সুখ-দুঃখ-কৃষ্টি-সংস্কৃতির পাশাপাশি হাসির পার্সওয়ার্ড রেখে যাওয়া উল্লিখিত রম্যসাহিত্য এবং কমিক্সগুলির কথাও ফিরে ফিরে আসবে। ধর্ম, যুদ্ধ এবং আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগা বাঙালির হাসবার জন্য ওই চরিত্রগুলো আজও হাসির শারদ-সম্ভার নিয়ে হাজির হবে। ত্রৈলোক্যনাথের ডমরু ধর হাজির হবে অনিদ্রার ওষুধ "Rx ডমরু-চরিত" নিয়ে। রবিঠাকুরের হরিপদ কেরানির মতো চির-সংকুচিত, ভীরু বাঙালির মানসিক উত্তরণ হবে হরিপদরই মতো।
তাই লাফিং-ক্লাবে নয়---বাঙালি হাসুক রোজকার রম্যসাহিত্যে, শারদীয়া পূজাসংখ্যাগুলির রস-সাহিত্যের রস আস্বাদন করে। ত্রৈলোক্যনাথের বিচক্ষণ ভাঁড় ডমরু ধর সেকথা আগেভাগেই বুঝেছিল এবং বুঝেছিল বলেই রাশভারী নিদানও দিয়েছিল ----টাকা উপার্জন করলেই টাকা হয় না। টাকা খরচা করলেই টাকা হয়! পাঠকরাও তেমনটাই চায়। রম্যরচনাগুলি পড়ে যেন হাসি উপার্জন হয় এবং সে হাসি খরচ করে রোজকার হাসির ভাঁড় ভর্তি হয়! ডমরুধর নিজেও কম খুশি হত না একথা শুনলে--- "Money's a horrid thing to follow,but a charming thing to meet"! বাংলা সাহিত্যের সমুদ্র-প্রমাণ রসভান্ডার থেকে এক আঁজলা তুলে নিয়ে লেখা এ নিবন্ধটির একটাই উদ্দেশ্য---মানুষ হাসুক। অতি আধুনিকীকরণ এবং বিদেশীয়ানার খপ্পরে পড়ে হাসিপাগল, দিওয়ানা বাঙালির উদার হাসির সে স্বর্ণযুগ আজ আর নেই বললেই চলে। দেঁতো হাসির ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা পরনিন্দা,পরচর্চা এবং ঈর্ষার কথায় শুধুই যোগ-বিয়োগের অংক।এককালে হাসির গল্প বা কৌতুক রচনার মান যে উঁচুতারে বাঁধা ছিল,হালফিলের পূজাসংখ্যা গুলিতে তেমনটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ চিরকালের রসিক বাঙালি কখনোই কার্পণ্য করে নি হাস্যরসের সঞ্জীবনী সুধা আকন্ঠ পান করে হাসি-কন্ঠী হ'তে---কাঠ-খোট্টা জীবনযাপনে হেসে গলদঘর্ম হ'তে। শারীরিক এবং মানসিক রোগে জর্জরিত আপামর বাঙালি তাই আজও মুখিয়ে থাকে হাসির বিশল্যকরণীতে সেরে ওঠবার জন্য।বাঙালির হাসির হালে হাওয়া দিতে হালফিল পূজাসংখ্যাগুলির রম্যসাহিত্য বিভাগের দায় এবং দায়ভার তাই অনেকটাই।
হৃদয়বাউলের অনন্ত যাত্রা
তৈমুর খান
প্রতিটি কবিই বাউল আর বাউলই তো প্রেমিক।
এই বাউল সত্তাটি বেড়ে ওঠে হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে।
সে গান গায়
অথচ তার কণ্ঠস্বর অস্ফুট।
সে সুর তোলে
অথচ তার সুর বাইরে বেরিয়ে আসে না।
প্রাণের মরমিয়া বোধটি নীরবের ব্যাপ্তি রচনা করে। পার্থিবের কোনও মোহিনীর নূপুর কখনও তাকে আকৃষ্ট করে বইকি। কখনও কারও আঁচল উড়ে যায়। পালতোলা নৌকার ভাটিয়ালি হয়ে যায় প্রবল সুরের রাগিনী। আলতা পরা পায়ের সচকিত হেঁটে যাওয়া এক শূন্যতার দিগন্তে তাকে পৌঁছে দেয়। বৃষ্টি পতনের রাতে মন বড়ো উন্মন হয়ে ঘোরে। কার হাত ধরে মনে মনে ?
মন তো সেই মনই খোঁজে, যাকে পেয়েও হারায়, যাকে হারিয়েও পায়। কবিতা সেই সাধনারই রহস্য হয়ে ফিরে আসে শব্দের নৈঃশাব্দিক অভীপ্সায় ।তাকে বলা যায় না, বর্ণনা করাও যায় না। পার্থিব আলোয় কখনও তার নাম দিই “আলপনা”; তখন কবিতায় লিখি :
আলপনা, হাত ধরো যদি
তোমাকে সঙ্গে নিয়ে পার হই নদী।
এই “যদি” অব্যয়টির শেষ নেই। কতবার ফিরে ফিরে এসে কথার মাঝখানে বসে। “আলপনা” নামের মেয়েটি যুবতী হয়। কখনও তার মুখে অলৌকিক জ্যোৎস্না পড়ে। সে-ও তখন রূপ বদল করে “ঊর্মি” হয়। “ঝরনা” হয়। “কাকলি” হয়। পার্থিব আসক্তির মোহময় প্রতিটি দৃশ্যে যৌবনের সাপ ছোবল দিতে থাকে। রক্তক্ষরণের মহিমময় সময়গুলি পার হতে হতে ভেঙে পড়ে পার্থিবের শরীরী উচ্ছ্বাস। আড়ালে বিরাজ করে সেই নিঃস্বার্থ সমর্পণ। এই সমর্পণে কোনও কার্পণ্য নেই। ছলনা নেই। যা আছে তা স্বপ্নিল উত্তাপের মোহন কৃচ্ছ্রসাধনা। সব সর্বনামেই তখন তাকে ডাকা যায় :
তুমি শুধু তুমি
অনন্ত প্রেমের বিজ্ঞাপন
আবহমান চৈতন্যের সর্বনাম
এই সর্বনাম থেকে যায়। বিশেষ্যগুলি সবাই “রাধা” হয়ে মর্তলীলা সম্পন্ন করে তারপর অনন্ত সর্বনাম হয়। কবিতা তারই হৃদয়পদ । শূন্যতা থেকে মহাশূন্যতায় জীবন পূর্ণ। এই শূন্যতাই প্রেম। সন্তোষ কাল্ওয়ার বলেছেন :“Life is an empty bottle filled with love.” সুতরাং শূন্যও শূন্য নয়, তা পূর্ণেরই অভিমুখ।
এই বোধই প্রবহমান প্রেম হয়ে জন্ম-জন্মান্তরে ফিরে ফিরে আসে। মানুষ থাকে না, ব্যাক্তি থাকে না, কিন্তু প্রেমের বোধ থেকে যায়। সঞ্চারিত হয় আবহমান অনন্তের হৃদয়ে। এই বাউলকেই ডাকতে হয়, বলতে হয় :
ভাষাহীন এবং ভাষার পথিক
মাঝখানে তার অথই বিলাপ
শূন্যতা এঁকে ফিরে যায়
অস্তিত্ব তবুও কোথাও ফুটে ওঠে
কেঁপে ওঠে মহিমার ভার
ভাষাহীন ভাষার পথিককেও নীরবের পর্যটনে শূন্যতার বিস্তার করে ফিরে যেতে হয়। তবু তো অস্তিত্ব থাকে মানুষের মানবব্যাপ্তির পরিচয়ে, আর সেখানেই এই মহিমা। জ্যাকসন পীয়ারস্ (Jackson Pearce) এই জন্যই বলেছেন : “It is beautiful, it is endless, it is full and yet seems empty. It hurts us.”
এই “hurts”কে নিয়েই মহাসঙ্গমের সন্ধানে স্রষ্টার সাধনা চলতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন :
“আমার যা হবার তা হবে
যে আমাকে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে যাবে?”
এখানেও সেই বেদনার অনন্ত ইশতাহারটিই বাউলের মহালোকে জেগে উঠেছে। কবির হৃদয়বাউলকে আমরা চিনতে পেরেছি। আর আমাদের হৃদয়েও এই বাউলের মর্মর প্রজ্ঞাটি প্রতিনিয়ত এক ক্ষত ও ক্ষরণে শব্দের বারান্দা নির্মাণ করে চলেছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা মহাকালের তরঙ্গে নিজেদের ভাসাবার অপেক্ষায় আছি।
দেবী দুর্গার অকাল বোধন
ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
তত্রৈবচ বধিষ্যামি দুর্গামাখ্যং মহাসুরম্
দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং জন্মে নাম ভবিষ্যতি
মার্কন্ডেয় পুরাণে শাকম্ভরী অবতারে যুদ্ধপ্রিয়া দেবী দুর্গম নামক অসুর কে বধ করেন বলে ই তিনি দুর্গা দেবী নামে অভিহিত হন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে তাঁকে বলা হয়েছে দুর্গি, মহাভারতে দুর্গতিনাশিনী,দেবী পুরাণে দুর্গেশ্বরী,দেবী ভাগবতে নগরক্ষয়িত্রী ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তিনি অপরাজিতা দেবী রূপে আখ্যাত হন।
একটি ঋতুচক্রে বা বছরের মধ্যে দুবার দুর্গা পূজার বিধান শাস্ত্রে লেখা আছে।একটি বসন্ত কালে অন্য টি শরৎকালে। এই শারদীয়া দুর্গোৎসব কে ই অকাল বোধন বলে।অকালে দেবীকে উদ্বোধিত করে আরাধনা করা হয় তাই এই নাম।রামায়নের ঘটনার সঙ্গে অকাল বোধনের সম্পর্ক আছে ঠিক ই কিন্তু মূল সংস্কৃত রামায়নে এই ঘটনা নেই।এটি কৃত্তিবাসের রামায়নে পাওয়া যায় , এই আখ্যান কবি কৃত্তিবাসের সম্পূর্ণ কল্পনা প্রসূত। বাল্মীকি র মূল রামায়নে দুর্গাপূজা র কোন বিধান নেই ,রাবণ বধের আগে ঋষির উপদেশে রামচন্দ্র আদিত্য হৃদয় স্তোত্র পাঠ করেছিলেন। বৈদিক চিন্তনে দুর্গা সূর্যজ্যোতি তাই রামায়নে আদিত্য হৃদয় স্তোত্র পাঠের বিধান পরবর্তী কালে বিবর্তিত হলো দেবী পূজায়। এক্ষেত্রে শাক্ত দর্শনের প্রভাব ও অস্বীকার করা যায় না।
মহাকবি কৃত্তিবাস তাঁর রামায়নে রামচন্দ্রের অকাল বোধনের বিস্তৃত বর্ণনা করেছেন। রামচন্দ্র রাবণ কে বধ করার জন্য রাবণের রক্ষাকর্ত্রী দেবী কে অকালে উদ্বোধিত করে পুজো করলেন--'অকালে শরতে কৈল চন্ডী র বোধন'।পরে যুদ্ধ করে বিজয়া দশমী তে রাবণকে হত্যা করলেন। রাম যেহেতু এই তিথি তে রাবণ বিজয় সম্পূর্ণ করেছিলেন তাই এই তিথি কে বলা হয় বিজয়া। কৃত্তিবাস লোকশ্রুতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটি চিত্তাকর্ষক কাহিনী ও সংযোজিত করেছিলেন। দেবীর বোধনের পর সপ্তমী,অষ্টমী ও নবমী তিথিতে রামচন্দ্র মহাপূজার আয়োজন করেছিলেন। সন্ধি পুজোর সময় রাম একশো আট টি নীল পদ্ম উৎসর্গ করে দেবী কে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন।তিনি সঠিক সংখ্যার পদ্ম নিয়ে পুজো শুরু করলে দেবী একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন।তখন একশো আট সংখ্যা পূরণের জন্য তাঁর নিজের পদ্মের মতো চোখ উপড়ে এনে দেবীর চরণে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হলেন তৎক্ষণাৎ দেবী তাঁকে লুকিয়ে রাখা পদ্ম টি দিলেন ও রামচন্দ্রের আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দিলেন।
মূল সংস্কৃত রামায়নে রামচন্দ্রের দুর্গা পূজার এই বর্ণনা টি না থাকলেও মহাভাগবতম্ নামক শাক্ত উপপুরাণে রামচন্দ্রের দুর্গাপূজা র বিষয় টি পাওয়া যায় -- 'অকালে বার্ষিকীং পূজাং যাং চকার রঘুদ্বহঃ ।' কিন্তু একশ আট নীল পদ্ম দিয়ে পুজো র কোন উল্লেখ নেই।
পরবর্তী কালে বৃহদ্ধর্ম পুরাণে ও কালিকা পুরাণে অকাল বোধনের বর্ণনা আছে ঠিক ই তবে দেবী র পুজো করেছিলেন ব্রহ্মা , রাজা রাম নন।
শরৎ কালকে স্মৃতি শাস্ত্রের ব্যাখ্যানুসারে অকাল বললেও সত্য ই অকাল কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছ। বৈদিক ভারতে শরৎ কাল থেকে বৎসর গণনা র রীতি ছিল।এমন কি ব্রাহ্মণসাহিত্যে ও শরৎ কে সম্বৎসরের মুখ বলা হয়।তাই দেবী দুর্গার পূজা র জন্য শরৎ অকাল হতে পারে না। শ্রী শ্রী চন্ডী তে শারদীয়া দুর্গাপূজা কে অকাল বোধন বলা হয় নি,বলা হয়েছে এই ঋতু তে দেবীর আরাধনা করলে মানুষ ধনধান্য লাভ করে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি মেধস ঋষির আশ্রমে রাজা সুরথ ও বৈশ্য প্রথম দুর্গা পূজা করেছিলেন।তবে বর্তমানে যে দুর্গা পূজার প্রচলন তা শুরু করেছিলেন ষোড়শ শতকে রাজা কংস নারায়ণ।সন্ধ্যার নন্দীর রামপাল চরিত থেকে জানা যায় পাল রাজাদের সময় ধূমধাম করে দুর্গা পূজা হত। তবে লেখক এই দেবীর নাম দুর্গা বলেননি বলেছেন 'উমা' ।
কালিদাস কুমার সম্ভব কাব্যে এই উমার কথা ই বলেছেন।অসুর দলনী চন্ডী রূপের চেয়ে ঘরোয়া মেয়ে উমা রূপটি বাঙালি দের বেশি পছন্দ।সাধক উপাসক নিজের মনের মাধুরী দিয়ে তৈরি করে বিগ্রহ প্রতিমা আর শত দুঃখ দুর্দিনে ও মঙ্গলঘট সাজিয়ে করে তার ই আরাধনা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাবনা তাই পরিশেষে উচ্চারণ করি - আমাদের এই ঘরের স্নেহ,ঘরের দুঃখ ,বাঙালির গৃহের এই চিরন্তন বেদনা হইতে অশ্রু জল আকর্ষণ করিয়া বাঙালি হৃদয়ের মাঝখানে শারদোৎসব পল্লবে ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ।ইহা বাঙালি র অম্বিকা পূজা এবং কন্যা পূজা ও বটে।
তাই কাল বা অকালের মতান্তর বড় কথা নয় আসল কথা হল আগমনি গানের সুরে শিউলির আল্পনা য় দেবীকে মনের ভক্তি অর্পণ করা কারণ মানব সভ্যতা ও কৃষ্টি র মেলবন্ধন এই দুর্গোৎসব । শুধু তাই নয় বাঙালি মানসে এই দুর্গোৎসব যেন মহাশক্তির উদ্বোধন ও অন্ধকার কে বিনাশ করে মঙ্গল আলোকের প্রজ্জ্বলন।
শিউলি কুড়নো বেলা
শ্যামলী সেনগুপ্ত
' আশ্বিনের শারদ প্রাতে---'
আহা ! এই বাণী কানের কুহর ছুঁয়ে দিলেই বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়। কী যেন
ছিল কীই যেন নেই এরকম শব্দের আসাযাওয়া চলতে থাকে। সাদা কমলার মিশেলে
শিউলিতলা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। দু'হাত দিয়ে তাকে ঠেলতে থাকি, সরিয়ে দিতে
থাকি, অবাধ্য বালকের মতো সে ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়ায় আর রাশি রাশি ফুল ঝরে পড়ে
তার বুকের ভেতর থেকে। ওদিকে উঠোন জুড়ে ড্যাড্ডানাকুর ড্যাড্ডানাকুর। উঃ! থামবি
তোরা। আমি দৌড়ে যাই , ব্যালকনির রেলিংএ ভর দিয়ে দেখি গুঞ্জরীলাল আর ওর দুই ছেলে
চামর দুলিয়ে নেচে চলেছে--গিজতা গিজাং গিজতা গিজাং। দু'হাতে চোখ কচলাই , নাঃ কেউ
নেই , তবে ঐ যে ঢাকের বোল! রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ি। রাস্তার কালো পীচের ওপর ধুলো
জমেছে , সেই ধুলোয় পায়ের ছাপ, পাঁইপাঁই ঘুরে যাচ্ছে ছাপগুলো আর সামনের শিশু গাছের
অজস্র সবুজ থেকে দুলে উঠছে ঢাকের চামর , সাদালালবেগুনীহলুদ পালক উড়ছে। আমার
পাগল পাগল লাগে। দরজা বন্ধ করি , জানলা বন্ধ করি, পর্দা টেনেদিই। সদ্য কাচা ইস্তিরি
করা ফুলেল পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দেয় তেপায়া বেতের ঝুড়ি। কবে যেন কেনা হয়েছিল
বেনারস থেকে,দেড় হাত উঁচু ঐ ঝুড়ি ভরা ফুল। কলকে, লালচাঁপা আর নানারকম
নানারঙের জবা। অপরাজিতা আর টগরের জন্য আলাদা ঝুড়ি। পর্দার ফাঁক থেকে একে একে
বেরিয়ে পড়ে রঞ্জু রিণু খোকন লালু মনা মিলু--মার্চ করতে করতে চলেছে , যেন যুদ্ধে চলেছে
সব,তেমনই হাবভাব , হাতে লম্বা আঁকশি। আমি ঝুলঝাড়ু নিয়ে আসি , ঝকঝকে ঘর
কোথাও এক লেত্তি ঝুল নেই। চোখ ঝাপসা হয়। কিচেনে ঢুকি , ওমা! লাল মেঝের সিমেন্টের
ওপর গেঁতে বসে নারকেল কুরোচ্ছে কে? কে যেন কয়লার উনুনের নরম আঁচের ধারে বসে
কাঠের হাতা দিয়ে নেড়ে চলেছে পেতলের কড়াই। আমি দিব্যি নারকেলনাড়ুর গন্ধ পাই
, আমার দেরাদুন রাইস পুড়ে কাঠ হয়। কলিংবেল বাজে। কে এল! মা মণিমা ! খোলা দরজা
দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে প্রীতি বলে , কী পুড়ছে কাকীমা! সারা ফ্ল্যাটে গন্ধ
ছড়িয়ে গেছে।সলাজ হেসে বলি , সময়। প্রীতি, আমার নেবার,সসন্দেহে আমার দিকে তাকায়
,আমার গ্রে হেয়ারে অবাক হাত বুলিয়ে চলে যায়। দরজা বন্ধ করি, চোখ চলে যায় টিপয়ের
ওপরে রাখা কাগজের দিকে--ভিটে হারানোর ভয়ে ভিড় ডাক্তারের চেম্বারে।
বীজ এসে পড়ে মাটিতে , অনুকূল পরিবেশ পেলে মাটি ফুঁড়ে বীজপত্র আলোকরশ্মিতে
স্নান করে , চারাগাছ একদিন বৃক্ষে রূপান্তরিত হয় , ডালপালা মেলে ধরে , পাতায় ফুলে
ফলে সেজে ওঠে, যেন একটা ঘর। সে ছায়া দেয় মানুষকে।ঘরও মানুষের মাথায় তুলে ধরে
ছত্র, সেই ছত্রছায়ায় লালিত হয় দুইপুরুষ , তিনপুরুষ , চার পাঁচ ছয়। লোকে বলে
পাঁচ পুরুষের বাস এখানে , সেইই কবে দেশভাগের আগে এয়েছিল বাপ-ঠাকুদ্দার ঠাকুদ্দা।
পাঁচ পুরুষের বাস এখানে , সেইই কবে দেশভাগের আগে এয়েছিল বাপ-ঠাকুদ্দার ঠাকুদ্দা।
আমাদের ভিটে কেড়ে নিলে আমরা যাই কোথায়। বৃক্ষের শেকড় ছড়িয়ে যায়, গেঁথে বসে মাটির ভেতরে , আরও গভীরে। বৃক্ষের ছানাপোনারাও বৃক্ষ রূপে সংস্থিত হয়। দাদাঠাকুর বৃক্ষ এখন মহীরুহ। তবুও কাটা পড়ে বিশাল বিশাল মহীরুহ , কেন না রাস্তা হবে ,
রাজপথ তৈরি হবে। গাছ কিছু বলে না , তাদের হয়ে কতিপয় মানুষ বলে,রুখে দাঁড়ায় ,
তারপর একদিন রাষ্ট্রের আদেশ মেনে নিতে হয়। মানুষ কাঁদে,পাগলপারা মানুষের ভিড় উপচে
পড়ে মনোবিদের চেম্বারে। এন.আর.সি. গণহিস্টিরিয়া তৈরি করে গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বাজারে।
'না গো পাইরব নাই, ভিটেমাটি ছাইড়্যা চলি যাওয়া যায়।'রাষ্ট্র যেন মহিষাসুর ! আমার হাতে খুন্তি,একহাতে
রাজপথ তৈরি হবে। গাছ কিছু বলে না , তাদের হয়ে কতিপয় মানুষ বলে,রুখে দাঁড়ায় ,
তারপর একদিন রাষ্ট্রের আদেশ মেনে নিতে হয়। মানুষ কাঁদে,পাগলপারা মানুষের ভিড় উপচে
পড়ে মনোবিদের চেম্বারে। এন.আর.সি. গণহিস্টিরিয়া তৈরি করে গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বাজারে।
'না গো পাইরব নাই, ভিটেমাটি ছাইড়্যা চলি যাওয়া যায়।'রাষ্ট্র যেন মহিষাসুর ! আমার হাতে খুন্তি,একহাতে
সাঁড়াশী , চোখের মণিতে আগুনের রিফ্লেকশন। সব ভুলে যাই।'গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় , মধুম্
যাবত্ পিবাম্যহম্।' আমরা সারি বেঁধে দাঁড়াই। মা মণিমা ঠাক্মা দিদি বোন আমি ,
ডেকে নিই পাড়াতুতো লক্ষ্মী সরস্বতীদের। কলাবৌ ঘোমটার আঁচল কোমরে বেড় দিয়ে
দাঁড়ায়। আমাদের দশ হাতে শত অস্ত্রের ঝঙ্কার ওঠে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কোমরে দড়ি পরিয়ে টেনে আনি দুর্গা মন্ডপে,ছেঁচড়ে আনি সেইসব নরাধমকে যারা উলঙ্গ করে পিটিয়েছে তিন কন্যাকে, যারা নিজের শিষ্ণকে ত্রিশূল ভেবে গেঁথে দেয় আটমাসের বাচ্চা যোনি থেকে আশির শুকনো চুপসানো যোনিদ্বারে। অস্ত্র শূন্যে ওঠে আর কান শুনতে পায় 'বাজলো তোমার আলোর বেণু।'
আমার ঠাকুরের আসনে একটি একচালার দুর্গা পরিবার। সবার ওপরে শিব তার
সদাশিব ভঙ্গী নিয়ে বসে আছে। বরাভয় মুদ্রায় আশ্বাস , বিশ্বাস। টের পাই আমার মাথার
ওপর আশীর্বাদী একটা হাত, বাবা। পানের বোঁটা চুনের ডিব্বায় ডুবিয়ে মুখে পুরছে কাকু।
দুই দু গুণে চার হাত আমার বাড়ির চারটি দেওয়াল, তাদের ঝাঁকড়াচুলো মাথা আমাদের
ছাদ। অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে রেখে ছাদের আড়ালে মাথা রাখি। আমার একলা ঘরে অণুরণন হতে
থাকে ' যশো দেহী, দ্বিষো জয়ী"
ড্যাক্কুনাকুর ড্যাক্কুনাকুর ট্যাং ট্যাটাং ট্যাং ট্যাটাং---নাঃ!এরা আমাকে মেরে
ফেলবে। যত ভাবি এদের সঙ্গে থাকব না , যত ভাবি পালাব সব ছেড়ে , ততো এরা টেনে
ধরে।
শব্দটা রাস্তার দিক থেকে এসেছিল। আবার দৌড়ে আসি ব্যালকনিতে, ওটাই আমার
বারান্দা, ওটাই আমার বাগান। এক ভবঘুরে , আপনমনে ধীর পায়ে হেঁটে চলেছে, কাঁধে
একটা ঝোলা ; চিরকুটে ময়লা। মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে , বোল
উঠছে ট্যাং ট্যাটাং। কী আছে ঐ ঝোলায় ? প্যানকার্ড ভোটারকার্ড আধারকার্ড না কি
ডিজিটাল রেশনকার্ড ! নাগরিকত্বের সবরকম পরিচয় পত্র নিয়ে চালচুলোহীন একটা মানুষ,
দুটো মানুষ, চারটে মানুষ---ভবঘুরের সংখ্যা বাড়ছে। দৃশ্যান্তর ঘটে ; মহিলারা সেজেগুজে
বেরিয়েছে চাঁদা তুলতে। মহিলা পরিচালিত পুজো। কোথাও বদল ঘটেছে তবে,না কি নিছক
আনন্দ। ওরা উঠে এসেছে দোতলায় , আমার দরজা খোলা , চায়ের কাপ,বিস্কুটের ট্রে।কথা
হয় , কথার পিঠে কথা হয় , কথা বদলায়। সানস্ক্রীন মাখা , গ্ল্যামআপ লাগানো মুখে
দৃঢ়তার ছবি দেখি , অন্য ছবি।ওরা এখন আবার রাস্তায়। ওদের চটিজুতোর শব্দে রাস্তার
অ্যাসফল্টে কি বদল হলো কিছু!
চিত্তরঞ্জনে রিভারসাইডের কোয়ার্টারে আমাদের বাড়ির পুজো হত,আদি বাড়ি
যশোর। কোয়ার্টারের পাশে একটা পুজো হতো,বারোয়ারি।বড় সুন্দর সব গান ভেসে আসতো
ঐ প্যান্ডেল থেকে। শিউলি কুড়োতে কুড়োতে আমি ঐ গান শুনতে পাই
' তুমি হও একজন তাদেরই
কাঁধে আজ তার ভার
তুলে নাও তুলে নাও তুলে নাও '
মহালয়ার ভোর ও মন্ত্রমুগ্ধ বাঙালি
কুমকুম ঘোষ
বিনামেঘে বজ্রপাত যাকে বলে, সেদিনের ভোরে সেটাই ঘটেছিল। দিনটা ছিল ১৯৭৬ সালের মহালয়ার ভোর। বাঙালীর অভ্যস্ত কানে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র র "ইয়া দেবি সর্বভূতেষু" র অনুরণন সেই স্বাধীনতার আগে থেকেই অনুরণিত হয়েছে। বাঙালীর পুজোর আমেজ ও আবেগের সাথে এই বিশিষ্ট কন্ঠটির বিশেষ ভূমিকা আছে।তার বদলে কিনা উত্তমকুমার!! আঁৎকে উঠলো আপামর জনসাধারণ। ছিঃ ছিঃ পড়ে গেল চারদিকে, অনেক প্রাচীন ও প্রবীণ তো অমঙ্গলের আশঙ্কাও করতে লাগলেন। সেদিন কলকাতা আকাশবাণী ভবনের সামনে দলে দলে মানুষ জমায়েত হয়ে প্রবল প্রতিবাদ জানাতে থাকলেন; শুধু ঢিল ছোঁড়া ই বাকি ছিল বলে জানা যায়।
সেবছর আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অধিকর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন চিরাচরিত "মহিষাসুরমর্দিনী" অনুষ্ঠানের বদলে "দেবীং দুর্গতিহারিণিম্" নামে একটি নতুন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবেন।সেইমত অনুষ্ঠান তৈরী করা শুরু হয়েছিল।এই প্রযোজনার সাথে সেসময়ের প্রথিতযশা মানুষেরা যুক্ত হয়েছিলেন। বিখ্যাত সংস্কৃত পন্ডিত ধ্যানেশ নারায়ণ চক্রবর্তী ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় তৈরী করলেন এর মূল ভাবনা।গানে সুরারোপ করলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।তিনি গান তো গাইলেন, সঙ্গে থাকলেন লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সহ একঝাঁক তারকা শিল্পী। আর ভাষ্যপাঠে ছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার, প্রথিতযশা অভিনেতা বসন্ত চৌধুরী, বিখ্যাত কবিতা পাঠক পার্থ ঘোষ প্রমুখ। কিন্তু জনগণের সমস্ত ক্ষোভ যেন মহানায়কের ওপর আছড়ে পড়লো।
আসলে আকাশবাণীর কর্তারা চেয়েছিলেন নতুন কিছু করতে বা চমক দিতে কিন্তু বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্র পাঠের আবেগ ও মহিষাসুরমর্দিনী নামক এক গীতিআলেখ্য এতকাল ধরে বাঙালীর হৃদয়কে যে কি বিপুল বিক্রমে অধিকার করে বসে আছে তার আঁচ উপলব্ধি করতে পারেনি।ফলতঃ সেই বিপুল ক্ষোভ ও নিন্দার ভাগীদার হতে হয়েছিল মহানায়ক ও শিল্পী দের। ক্ষমাপ্রার্থী কর্তৃপক্ষ এজন্য পুনরায় সেবছর ষষ্ঠীর ভোরে "মহিষাসুরমর্দিনী" অনুষ্ঠানটি পুনঃপ্রচারিত করতে বাধ্য হন।
এও এক অদ্ভুত সমাপতন।১৯৩২ সালে বেতারের শিল্পীত্রয়ী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণী কুমার ও পঙ্কজ মল্লিক এই অনুষ্ঠানটি "লাইভ" করেছিলেন প্রথমবার, সেটাও ছিল ষষ্ঠীর ভোরে। কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর মত এই অনুষ্ঠানের একটা প্রাক্-প্রস্তুতি হয়েছিল তার আগের বছর ১৯৩১ সালে।সে বছর আকাশবাণী- খ্যাত বাণী কুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য) শ্রী শ্রী চন্ডীর বিষয়বস্তু নিয়ে "বসন্তেশ্বরী" নামে একটি অনুষ্ঠান করেন।এখানে সুরারোপ করেন পন্ডিত হরিশচন্দ্র বালী এবং এর সাথে যুক্ত ছিলেন স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। সেবছরই চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজোর সময় সেটি প্রচারিত হয়।এই অনুষ্ঠানটি সকলের সমাদর কুড়িয়েছিল।
সে ছিল রেডিও র প্রথম যুগের কথা।তখন রেডিও কে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য নতুন নতুন মৌলিক ভাবনা চিন্তা করা হতো।বসন্তেশ্বরী অনুষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা বিচার করে এটিকে আরও একটু পরিমার্জন করে পরের বছর ষষ্ঠীর দিন করার কথা হয়। সেই কাজে সংকলক বাণী কুমার পন্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর সহায়তা পেলেন। গানে সুরারোপ করলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ -বাণীকুমার -পঙ্কজ কুমার ত্রয়ী বাঙালীর শারদোৎসবে এক অন্য মাত্রা যোগ করলেন।
এই মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানটি ঘিরে খুব চমকপ্রদ কিছু গল্প আছে। প্রথমদিকে "লাইভ" অনুষ্ঠান হতো। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র আগেরদিন রাতে স্টুডিও য় আসতেন।অন্য শিল্পীরা রাত দুটো নাগাদ বেতারকেন্দ্রের নিজস্ব গাড়িতে আসতেন। স্টুডিও র ভেতরে পুজোর আমেজ বয়ে যেত। অনুষ্ঠানের শুরুতে শাঁখ বেজে উঠতো।ধুতি - গরদে সেজে উঠতেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ।
তিনি ব্রাহ্মণ নন,তাই তাঁকে দিয়ে স্তোত্র পাঠের আপত্তি তুলেছিলেন কেউ কেউ কিন্তু স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেন্দ্র মজুমদার সটান সেসব কথা বাতিল করে দেন। যন্ত্রীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের শিল্পী। তাদের নিয়েই শুরু হলো পথচলা।
প্রথম বছর অনুষ্ঠানের নাম ছিল "প্রত্যুষ প্রোগ্রাম"। পরের বছর থেকে নাম দেওয়া হলো "প্রভাতী অনুষ্ঠান"। মহালয়ার পুণ্য প্রভাতটি সম্প্রচারের জন্য বেছে নেওয়া হয় ১৯৩৪ সালে; তখন "মহিষাসুর বধ" নামে অনুষ্ঠান হতো।"মহিষাসুরমর্দিনী" নামটি তার কয়েকবছর পর থেকে চালু হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় , বিশেষ করে ১৯৪৬ সালে কলকাতার পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক ছিল। বিশেষকরে সেবছর ১৬ই আগষ্ট কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয় বলে "লাইভ" প্রোগ্রাম হয়নি কারণ অত রাতে শিল্পীদের নিয়ে আসাটা নিরাপদ ছিল না।সেবার রেকর্ডেড প্রোগ্রাম সম্প্রচারিত হয়েছিল।তা বাদ দিয়ে ১৯৩২-১৯৬২ সাল পর্যন্ত " লাইভ" অনুষ্ঠান ই প্রচারিত হতে থাকে। পরবর্তী কালে অনুষ্ঠান রেকর্ড করে বাজানো হতো এবং স্হায়ীভাবে রেকর্ড হয় ১৯৭২ সালে।
প্রথমদিকে পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সাথে সুর পরিচালক ছিলেন শ্রদ্ধেয় রাইচাঁদ বড়াল যদিও পঙ্কজ কুমারের সুরারোপিত গানের সংখ্যা ছিল বেশী।১৯৪৪-৪৫ সালে আকাশবাণী কর্তৃপক্ষের সাথে মনোমালিন্য হলে তিনি এই অনুষ্ঠানে অংশ নেননি ,তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।পঙ্কজ কুমার ফিরে আসেন পরের বছর। প্রথমদিকের শিল্পীরা ছিলেন-- কৃষ্ণ ঘোষ, আভাবতী দেবী,প্রফুল্ল বালা, বীণাপাণি দেবী,পঙ্কজ কুমার মল্লিক প্রমুখ।এদের মধ্যে পঙ্কজ কুমার ছাড়া বাকিদের নাম এযুগের শ্রোতারা জানেন না। নানা সময়ে শিল্পী পরিবর্তন হয়েছে।হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯৫১ সাল পর্যন্ত টানা গেয়েছেন। জগন্ময় মিত্র, রাধারাণী দেবী, সাবিত্রী ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য,বাঁশরী লাহিড়ী,অখিলবন্ধু ঘোষের মত সেযুগের নামীদামী শিল্পীরা ও এই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন আবার সেসময়ের যেসব নামী সঙ্গীতশিল্পী এই "মহিষাসুরমর্দিনী" গীতিআলেখ্যে কোনদিনও গান নি তাঁরা হলেন কে এর সায়গল, সুধীরলাল চক্রবর্তী,রবীন মজুমদার,কানন দেবী, মান্না দে প্রমুখ।
কিন্তু মাঝের দুটি বছর বাদ দিলে পঙ্কজ কুমার মল্লিক এই অনুষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন শেষ পর্যন্ত। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্হায়ীভাবে বোম্বাই(তখন মুম্বাই নয়) থাকার জন্য তাঁর গাওয়া " জাগো দুর্গা,জাগো দশপ্রহরণধারিণী" গানটি শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় রেকর্ড করেন। শ্রদ্ধেয়া সুপ্রীতি ঘোষের কন্ঠে অনুষ্ঠানের প্রথম প্রভাতী সঙ্গীত" বাজল তোমার আলোর বেণু/ মাতল রে ভুবন" শোনা যায়।
"মহিষাসুরমর্দিনী" অনুষ্ঠানে এভাবেই বার বার শিল্পী বদল হয়েছে, বদলায়নি শুধু গ্রন্হণা ও শ্লোক আবৃত্তির অনন্য শিল্পী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র।তাঁর মোহময় সুরেলা কন্ঠের জাদুতে বঙ্গবাসী আচ্ছন্ন হয়ে আছে কয়েক প্রজন্ম ধরে।
ট্রানজিস্টর রেডিও র স্বর্ণ যুগকে ছুঁড়ে ফেলে সবাই যখন ডিজিটাল যুগে বুঁদ হয়ে আছে তখনও প্রতি মহালয়ার ভোরে আধো অন্ধকারে এফ. এম রেডিও র কল্যাণে বাতাসে ভেসে আসে সেই আবেগদীপ্ত কন্ঠস্বর -- -----
"আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আনন্দ বার্তা".....................
ঠিক তখনই ঘাসের ওপর টুপটুপ করে ঝরে পড়ে শিউলি ফুল---- বাঙালীর পুজো শুরু হয়ে যায়।
মুক্তগদ্য
যাজ্ঞসেনী
পুজোতে একসময়ে শিউলি ফুলের গন্ধ লেগে থাকত।
শরতের নীল আকাশে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের খেলা তখন জানান দিত পুজো আসছে, পুজো আসছে। পুজো আসলে কতকিছু যে হয়! বছরের আগুপিছু বাকি দিনগুলো হঠাৎ কেমন বদলে যায় না? মনে হয়না যে, উৎসবের এমন ঝলমলে আবহ যদি সারা বছর ধরে থাকত?
পুজোর আগে মহালয়া। রেডিওতে কান পেতে মহালয়া শোনা এখন অাষাঢ়ে গল্পের মতো। রাতদুপুর পর্যন্ত অনলাইন থেকে অত ভোরে ওঠার দায় কেনই বা থাকবে? তাছাড়া রেডিওটাইতো এখন আর নেই। এবং, দিনটা ছুটির। সুতরাং, তেমন হলে ইউ টিউবে শুনে নিলেই হয়।
সবার যেমন দুটো বেলা থাকে, তেমনি পুজোরও আছে। ছোটবেলা মুছে দিয়ে পুজোও এখন পা রেখেছে বড়বেলায়।
এই বেলা আড়ম্বর থাকে আবেগ থাকেনা। মান থাকে টান থাকেনা। বৈভব থাকে ব্যাকুলতা থাকেনা। প্রাচুর্য থাকে প্রাণ থাকেনা। বিসর্জন থাকে বিষণ্ণতা থাকেনা।
এই বেলা থিমের জৌলুশে যেন ফিকে হয়ে আসে অপরূপ এক মা আর তার সন্তানদের মুখ। আলোর এত রোশনাই অথচ, ঘামে ভেজা প্রান্তিক মুখগুলো কেন ঝলসে ওঠেনা আনন্দদীপে? এত মানুষের ভীড়ে প্রবাসী পুত্রকে খুঁজে ফেরেন এক বৃদ্ধ। অষ্টমীর হলুদ দুপুরে আর একটাও ভালোবাসার চিঠি লেখা হয়না। কেউ বলেনা যে, নবমীর নিশি কিছুতেই তোমাকে আজ যেতে দেবনা।
বিজয়ার দিন আজও কারও দুচোখ ছলছল করে ওঠেকি? মানুষের এত ভীড়ে কোথায় যে হারিয়ে যায় পুজোর ছোটবেলা!
সেই বেলায় কতকিছুই না ছিল! প্রতীক্ষার প্রহর গোণা, নতুন জামার গন্ধ নেওয়া, পুজোসংখ্যার ভাঁজ ভাঙা, অষ্টমীতে আবেশ মাখা, বাবার হাত ধরে ঠাকুর দেখা, তিন চারদিনের জন্যে হঠাৎ বড় হয়ে যাবার ক্ষণিক স্বাদ -- আরও কত কী!
সেই বেলা এখন পাড়ি দিয়েছে অস্তাচলে। সেই আবেগ এখন মুখ লুকোয় ঝলসে ওঠা পুজোমন্ডপে। সেই মুক্ত দিনগুলোও এখন কী ভীষন বদ্ধ।
তখন পরিধি ছিল অন্তহীন। এখন পরিধি সীমানা ঘেরা। আমি আর পুজো, দুজনই তখন ছোটবেলায়। এখন বেলা বদল দুজনারই।
আমরা দুজন, দুজনকে বলি খুব দরকার ছিল বড় হয়ে যাবার? বড় হয়ে গেলে কতকিছু হারিয়ে যায়না? সেই শিউলিফুলের গন্ধটাই তো হারিয়ে গেল।
পুজোর বড়বেলা তো আদতে অকালবোধনই।
ফিতেওয়ালা ফ্রক ছুঁয়ে থাকা জ্বর
মনোনীতা চক্রবর্তী
শরীরের ভিতর আজও বেয়ে চলে একটা হিম স্রোত। এখনও চৌকাঠে , বাঁধানো উঠোনের কলপাড় থেকে ভেসে আসে অস্পষ্ট কিছু বর্ণমালা। ইটে ঘেরা বাইরের জবাগাছটার কথা ভুলিনি আজও। আমরা ঈশ্বর দেখেছিলাম ওর পাতার সবুজে, শিরা-উপশিরায়..। কিছু-কিছু জীব ,কিছু-কিছু জড়ো বড্ড তাড়াতাড়ি দেবত্ব পেয়ে যায়! আমরা বানিয়ে ফেলি আর-কী।সে-সৌভাগ্য থাকে কারও-কারও। ছোট্ট সামনের বারান্দায় সমর্পণের মতো সেটে আছে আম কাঠের দু'পাল্লার কাঠের দুটো দরজা। একটা পুবদিকে ,অন্যটি দক্ষিনে। দরজার ভেতরই ছিল যাবতীয় । দরজার ভেতরটাই আসলে গোপন মন, আমরা যা সকলে দিনের একবার নয় একবার, শত ব্যস্ততায়ও অন্তত ঢুকিই। ঢুকতে হয়। না-ঢুকে পারাই যায় না ! সামনের ঘর---- গোলাপি দেওয়াল । দেয়ালে তখনও ছবি। ভুল হল একটু ,দেওয়ালে নয়। দেওয়ালের তাকে। কখনও উত্তরে সে আবার কখনও দক্ষিনে। সানমাইকার গোলাপি চেয়ার, আকাশি টেবিল আরও কিছু আসবাব। মনে আছে , ওই পায়রাটা মাটি আর সোনা-রুপো পেয়েছিল ,উঠোনের কাছেই প্রাচীরের গা-ঘেঁষে পুতুলের মাটির দালানের পাশে। তেমন কান্না যে ফ্রকের ফিতে ছুঁয়ে আজও থেকে যাবে, জানেনি বন্ধ-দরজার বাইরের মানুষটি! ভেতরে হ্যাঁ ভেতরেই আসলে থেকে যায় রেওয়াজি-বিষাদ। থেকে যায় চুলের পাতালে নরম আঙুল... দুলছাড়া কানের লতি... চুড়ির মিহি শব্দ... চোখে জল আসা ধোঁযারা। ধোঁয়ার এত ঝাপসা হয় বুঝিনি! এত তার রেশ! থেকে যায় ছেড়ে থাকার তোমার শেষ কষ্ট। তুমি বঁটিতে তখন রাখছিলে পেঁয়াজের বুক । আত্মার নরম সেদিন হেসেছিল এক-রঙা থান-সিল্ক-এর বোকা গল্পে, ম্যাচিং নেইলপলিশ-এ। জবাগাছটার কোণ, যেখানে বারান্দা শেষ হয়ে গেছে ডোয়ারফিজম শরীরের মতো। যে-দূরত্ব দৈত্যের মতো হাত নিয়ে খুব সহজে ছুঁয়ে ফেলতো গোলঘর... পাগলপারা সে-ডাক আর তোমার অপেক্ষা... মশারির ভেতর থেকে হুহু করে ভেসে আসে অলৌকিক কুচকুচে কালো হাত! দীর্ঘ ছায়ার মতো শুনশান। ক্রিকেটের মাঠ থেকে ফিরল-ফিরে আসা সাদা-আলো শেষরাতে পরাজিত সৈনিকের সাজে বাদামি আয়নায় অদৃশ্য লেখে। আমি আর আয়না রোজ দেখি অক্ষত বেঁচে থাকায় কত নুন,কত রক্তের ফিনকি! ভেতর ঘর। হ্যাঁ, ভেতর ঘর আসলে শিশুর সহজ-মুখ। বিশ্বাসের পরম। অনিন্দ্য আশ্রয়।প্রিয়তম মুখেরা। বুলবুলি ধান খেয়ে নিলেও যেখানে খাজনা জোটানোর কোনো দুর্ভাবনা থাকে না... বর্গী - টরগি দেশে এল বা না-এল তাতে তার কিছ এসে-যায় না ! সে তার প্রিয় কানের লতির স্পর্শে রোজ সকাল দেখে। সকাল দেখে কিন্তু এই প্রতিটা সকালের ভেতর কত আশ্চর্য ,শিকারির লক্ষ্যের মতো তাক করে আছে তা দেখে না। বাইরের আলো দেখে। রোদ্দুর মাপে। হাতের চামড়া দেখে। ফাঁকি লেখে। কিন্তু বুকের ভেতর ফকিরি। বাসা বাঁধে তীব্র। কড়ি-মা আলাদিনের খুশি নিয়ে তবু তুলে আনে ইমন,রোজ সন্ধ্যায়...'পিয়া কি নজরিয়া যাদুভরি...' যথার্থই যাদুভরি ! যাদু লিখতে থাকে সন্ধ্যাসুর... বিপন্ন হামাগুড়ি দিয়ে লুকোতে থাকে ট্রাঙ্কে র ভেতর... ট্রাঙ্ক ফুটো করে ঢুকে যায় মেঝেতে। মেঝে ফুটো করে আরও ভেতরে ক্রমশ ভেতরে ...
ভেতর থেকে আরও আরও ভেতরে... সেদিন হঠাৎ একটা সাদা আলো আমাকে ছুঁয়েই মিলিয়ে গেল আর কানের লতি জুড়ে এখন সামন্তপ্রভুদের ছড়ানো ভূমির মতো কান পাশা! পুব আর দক্ষিণ, দুটো দিক ... দুটো দেওয়াল আজও একইভাবে বন্ধ দরজা দুটো আঁকড়ে আছে... ভেতরে নেই আর ধোঁয়া ওঠা ভাতের মতো সাজানো শীতের দুপুর... ন্যাশনাল চ্যানেলের শুরু আর শেষের সুর... মুঙ্গেরিলালের হাসিন স্বপ্ন... খোলা জানালার এপার-ওপার শিস ও খুঁজেফেরা চোখ... মাঝের সিংহাসন...
ঘর এখন ঘুমে। ছবি হেঁটে-হেঁটে বেরিয়ে গেছে সদর দরজা থেকে! বহুকাল হল...
ভেতর ঘরে ঘর... ঘরের ভেতর ঝড়.... ঝড়ের ভেতর জ্বর...
রূপং দেহি ,বলং দেহি ,যশো দেহি বিশালাক্ষী ..
সুস্মিতা পাল কুন্ডু
পুজো এলেই মনের মধ্যে সেই ছোট্ট আমিটা নড়েচড়ে বসে ৷ মহালয়ার আগের দিন থেকেই মোটামুটি ভাবে সেই আবেগ, উন্মাদনার রূপ নেয় এখনো ৷ তবে সেই শিশুমনে পুজো মানে ছুটি এই বোধ কিছুটা থাকলেও , স্কুল যে একমাস বন্ধ থাকবে এটা মন মানতে পারত না কখনোই ৷ কারণ স্কুলের আঙ্গিনায় মন পড়ে থাকত বলে খুব অসুস্থ না হলে কোনোদিন স্কুল কামাই করিনি ৷ যাইহোক মা আসছেন ....তিনি মহিষাসুর মর্দিনী ৷ সীতাকে উদ্ধার করার জন্য রামচন্দ্র অকাল বোধন করেছিলেন দেবীর ৷ মা দুর্গার আশীর্বাদেই তো লঙ্কা জয় করতে পেরেছিলেন .... মায়ের কাছেই গল্প শোনা ৷ তাই শ্রদ্ধা -ভক্তিতে মন উজাড় করে তাকে প্রণাম করতাম ৷ পুজো শেষ হলেই আবার নতুন ক্লাসে উঠার পরীক্ষা যে ! তাছাড়া নতুন জামা পড়ার একটা আনন্দ তো থাকেই ৷ কারো নতুন জামা কেনা হলেই দল বেঁধে দেখতে যাওয়া , দাম নয় রঙের বাহার আর নকশার বৈচিত্র্যে নিজের জামাটা সুন্দর মনে হলে ,বেশ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করা ...এইটুকুই ৷ আর অফুরন্ত মজা ৷ পাড়ার কালীবাড়িতে মায়ের মূর্তি আনার সময় সবার সাথে লরীতে যেতে চেয়ে প্রতিবার বাবার কাছে বায়না করে নিরাশ হতাম ৷ না যেতে পারার জন্য কিছু সময় মন খারাপ হলেও দুর্গামা সপরিবারে প্যান্ডেলে ঢোকা মাত্রই অপূর্ব এক ভালোলাগায় মন ভরে উঠত ৷ সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী পাড়ার সবাই মিলে অঞ্জলী দেওয়া ,ভোগ খাওয়া ,ধুনুচি নৃত্যে অংশ গ্রহণ করা ....দারুণ লাগত ৷ নবমীর রাতে বাড়ি ফেরার পর বুকের ভিতর থেকে উঠে আসা একটা যন্ত্রণা ঠিক গলার কাছটায় কেমন যেন দলা পাকিয়ে থাকত ৷ আগামীকাল মা চলে যাবেন ...আবার এক বছর পর ৷ এক মায়ের আঁচলের তলায় থেকে আর এক মায়ের জন্য এই যে মন কেমন করা .... এটাই চিরন্তন ৷
এখনো তেমন আছি , বয়স বাড়লেও আমার আমিটাকে সযত্নে আগলে রাখি ৷ তবে এখন ছুটির আনন্দটা মনকে মাতিয়ে রাখে বেশি ৷ সংসারের ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে অনাবিল একটু মুক্তির স্বাদ অনুভব করতে এই বয়সে বেশ ভালোলাগে ৷ ছেলেমেয়ের পড়াশোনার চাপ থেকে ছুটি মিলেছে বলেই কিছুটা সময় একান্তই নিজের ৷ তবুও কিছু ভাবনা ,কিছু কষ্ট যে কোনো আনন্দকেই ফিকে করে দেয় ৷ কেউ নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেল , হঠাৎ করেই মাথার উপর ছাদ হারিয়ে ফেলল কেউ কেউ , অসুস্থ সন্তানের জন্য মায়ের চোখের জল , স্বামীহারা বিধবার অসহয়তা... আনন্দের মাঝে নিরানন্দের রেশ মনকে বড়ো অস্থির করে তোলে ৷ চারপাশে হানাহানি ,মারামারি ,দলাদলি দেখতে দেখতে মনে হয় , কবে মানুষ বুঝবে হিংসা নয় ভালোবাসাই বেঁচে থাকার একমাত্র শক্তি ৷ জলের জন্য হাহাকার , দিনের পর দিন বৃক্ষ নিধন ; নীল গ্রহটি ধীরে ধীরে একদিন হারিয়ে যাবে মহাশূণ্যের মাঝে ৷ অজানা একটা আশঙ্কায় মন ভীত হয়ে পড়ে ৷ তবুও মা যে আসছেন ৷ তাকে তো বরণ করার জন্য ডালা সাজাতেই হবে --
নীল আকাশে মেঘের খেলা
শিউলি ফুলের পাপড়ি মেলা
নদীর পাড়ে রাশি রাশি
শুভ্র কাশের দোলা .... প্রকৃতি জানান দেয় মায়ের আগমনী বার্তা ৷ ছোটো-বড়ো সবাই সাগ্রহে অধীর চিত্তে অপেক্ষারত ৷ শুধু আনন্দ নয় , অনেকেই সংসার চালানোর রসদ সংগ্রহ করে উৎসবের আঙিনা থেকে ৷ তাই উৎসবের মধ্যেই ধরা পড়ে সমাজ জীবনের শাশ্বত রূপ ৷ উৎসবের আনন্দ সবার সাথে ভাগ করে নিতে পারলেই উৎসব সত্যি সত্যি সার্থক হয়ে উঠে ..... ৷৷
অমরাবতী
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস
ভাসানের সুর ভেসে আসছে বাতাসে। একটু আগের ভ্যাপসানো গরমটা কম লাগছে। শীত কেন, অসময়ে ? তবে কি জ্বর হলো? গাঙুর কাঁদতে কাঁদতে চলেছে। কলার মান্দাস কাঁদছে। যে ভিটরে শিয়াল চিৎকার করে জানান দিলো- লক্ষীন্দরের ব্যাথার ডিঙা কে কালিন্দীর কালো জলের শরীর ধারণ করেছে, তখন জঙ্গলকে ছাপিয়ে আওয়াজ উঠলো -" হুক্কাহুয়া "!
আরে দোস্ত, ক্যায়া হুয়া? হুয়া কেয়া, মুঝসে তো বোলো!!
ভাগ আর ভাগের ধমনিতে বইছে নদী। চরের ওপরে গজানো নালী ঘাস আমার শহরকে একটি বেহুলা নদী উপহার দিলে, ভুলেই গেলাম, ভিনরাজ্যে কাজ করতে গিয়ে আবদুস মিঞা ফিরে আসেনি। জনাব শুকুর আলি যখন বেহুলাকে বেহেশতে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনার কথা মাইকে বলছে, তখন ভিটরে শিয়ালের জ্বলজ্বলে অধ্যায়ে উঠে আসছে কত নামের রাতকথা।
রাতের গাম্ভীর্যের চিরন্তন সারবস্তুর মধ্যে একটি মস্ত উঠোন! চারিদিক নিস্তব্ধ হলে, নিশাচরী বাতাসের তোড়ে উল্টোপাল্টা ছুটতে থাকে স্রোতহীন জলাশয়ের মতো বেহুলা। পচন তো লক্ষীন্দরের সর্পাঘাতগ্রস্ত মৃত শরীরে ধরেনি! গলে তো যায়নি জলজ বিষে জর্জরিত একটি বহমানতা!
ভাসানের সুর ভেসে আসছে বাতাসে। কার ভাসান? কিসের ভাসান? ভাসানী, টিকে থাকা একটি নাম বলেই গৌ-রোড থেকে যে পথ রামকেলীমুখী, তাঁর বাঁয়ের ধারে কাছে একটি উন্মাদিনী আছাড়িবিছাড়ি করতে করতে কালের সীমা পেরিয়ে এই সেপ্টেম্বরেও ভালোবাসা ও যত্নের সঙ্গে মনসাগাছে লাল কাপড় জরিয়ে, গুজে নেয় তলয়ারের মত করে বুকের তলায়- ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা'কে।
এরপর সবটাই উপাখ্যানের মনসামঙ্গলের বেহুলাকে যেমন দেখেছি, ঠিক তেমনই !
মেয়েরা, আজকাল বুকের ভেতরে সুগন্ধীর বদলে গুঁজে রাখে লক্ষীন্দরের পেনড্রাইভ, যার একদিকে লেখা -" অমরাবতী "।
শারদীয়ার রূপকথা
সুজাতা মিশ্র (সুজান মিঠি)
ঘাসে পাতায় যখন সবুজের উপর শিশির ছুঁয়েছে তার শরীর, তখন সেই ভেজা সবুজে জমে উঠেছে আনন্দ। আর আমি সেই আনন্দকে চোখে ঠেসে হেসে উঠেছি জোরে। বাতাস থমকেছে, পেঁজা মেঘ থেমেছে, ফুলগুলো দোলা বন্ধ করেছে, আর আমার হাতে পায়ের বেড়ি শক্ত হয়ে উঠেছে আরও।
রাতের ঝিমঝিমানো বৃষ্টির শব্দে যখন সিঁড়ির নীচের অন্ধকারে ঘুম ভাঙে আচমকা, কানের পাশে একটানা মশার গুঞ্জন প্রবেশ করেনা আর কুহরে, বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে ভেসে আসে, 'বাজলো তোমার আলোর বেনু…'
আমি শিকল টেনে টেনে বারান্দায় এসে বসি, আমার সামনে এসে বসে গ্রহ, তারা, চাঁদ। সারারাত কত গল্প করি আমরা, আলোর গল্প। হঠাৎ মাঝখানে কোত্থেকে অন্ধকারটা ফের সিঁড়ির নীচের ছানা-পোনাদের নিয়ে এসে হাজির হয় চোখের সামনে। ভয়ে আলোরা কালো মেঘ হয়ে আকাশে চলে যায়, ঝমঝম করে নামে কালো বৃষ্টি। আমি চিৎকার করে ঠেলে দিই অন্ধকারকে, সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে জ্বলে ওঠে আলো, আর আমার হাত পায়ের বেড়ি শক্ত হয় আরও।
চারদিকে বাজনা বাজছে, ঢাক ঢোল কাঁসি। আমার সামনে দিয়ে মানুষগুলো কি সুন্দর সেজেগুজে চলে যাচ্ছে। শারদীয়া সকাল ভরে উঠেছে নরম রোদে আর কাশ ফুলের শুভ্রতায়। আমি একতাল মাটি এনে আমার সামনের জানলায় রেখে মা দুর্গার মূর্তি তৈরি করলাম। সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষী, সরস্বতী সবাইকেই। অসুরের বুকের উপর মায়ের ত্রিশূলটাকে ভীষণ তীক্ষ্ণ করে দিলাম। অসুরের শরীরটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলাম। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী মায়ের আরাধনা করলাম। মা এসে আমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে গেল। অসুরটাকে বারবার তীক্ষ্ণ ত্রিশূল দিয়ে আঘাত করলো মা আমার সামনেই। দশমীর দিন বিসর্জন করলাম মাকে আমার জানলার বাইরের রাস্তায়।
আমার হাত পায়ের বেড়ি খুলে ফেলা হলো। স্নান করানো হলো। দুহাত দিয়ে পেট ভরে খাওয়ানো হলো আমার পছন্দের খাবার। তারপর কালো কাপড় মাথায় মুড়িয়ে আমাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো একদিন সকালে।
আমার দমবন্ধ হয়ে এলো। তারপর শরীরটা হালকা হয়ে ভাসলো বাতাসে। আলো হয়ে ঝরলো মাটিতে।
আমি এতক্ষণে বুঝলাম, ঠিক এক বছর আগে এমনই এক দুর্গাপুজোর রাতে ঠাকুর দেখে ফিরছিলাম যে বন্ধুদের সঙ্গে, তারাই ফাঁকা অন্ধকারে চিবিয়ে খেতে চেয়েছিল আমায়, আমার কাছে সব সময়ের জন্য লুকিয়ে রাখা অস্ত্র বের করে বসিয়ে দিয়েছিলাম ওই চারজন বন্ধুর নামে অসুরদের বুকে। বড়লোক বাবাগুলো এসে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে থানায়, মৃতদেহ দেখে পুলিশও চমকে উঠে বলেছে, 'উফফ! তুই এত হিংস্র!' আমার সারা গায়ে রক্তের দাগ, পুলিশের রডের বাড়িতে যেইমাত্র ফেটেছে মাথা, আমি তারপরেই কামড়ে ধরেছি পুলিশের লোলুপ চোখ। এক কামড়ে উপড়ে নিয়েছি তা।
অন্ধকার সিঁড়ির নীচের ঘরে আমার হাত পায়ের বেড়ি শক্ত হয়েছে বারবার, যতবার হিঁচড়ে টেনে বেরিয়ে আসতে চেয়েছি।
শরতের শিশির ধোয়া সকালে আমার পাগলামি বেড়ে গিয়েছিল আরো। চোখের সামনে দেবী মাকে দেখে পুজো করেছি চারদিন, তারপর আমাকে পাহারা দিতে থাকা প্রহরী, যে রাতের পর রাত চটকাতো আমার বন্দী শরীর, দশমীর বিসর্জনে আমার হাতের শিকল দিয়ে চুপিচুপি মুন্ডু ফাঁক করেছি তার। ঠিক তখনই দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল, 'বলো দুর্গা মাইকি…
আসছে বছর আবার হবে।'
ফাঁসি দিল আমার শরীরটাকে ওরা। আমি এখন ভীষণ হালকা একটা মাটির তাল। নিজেকে ইচ্ছেমত বানাতে পারি যা খুশি।
একবছর ঘোরাফেরা করার পর শরৎ এলো শিউলির ডালে, পেঁজা মেঘে। আমিও সেজে নিলাম খুব। চুপিচুপি মা দুর্গার মাটির শরীরে ঠেসে দিলাম নিজেকে।
মাইকে মন্ত্রের রেকর্ড বাজছে, 'ইয়া দেবী, সর্বভূতেষু, শক্তিরূপেন সংস্থিতা…'
আর আমি আমার তীক্ষ্ণ ত্রিশূল দিয়ে ঝপাঝপ কোপ মারছি অসুরগুলোর গলায়। ধঞ্চে ক্ষেতের মধ্যে পাঁচ বছরের মেয়ের উপর শোয়া তার বুড়ো দাদু, একলা প্যাসেঞ্জার মেয়ের গাড়ির ড্রাইভারের লোলুপ চোখ, আর বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া একলা মেয়ের বন্ধুদের।
বিজয়ার পরদিন সকালের সংবাদপত্রের হেডলাইন ভাসছে আমার বাতাসে, উড়ছে লেখাগুলো,
'মা দুর্গা অস্ত্র হাতে হত্যা করেছেন অসুরদের, যাদের কোনো বাঁচার অধিকার আদতে ছিল না সমাজে। মা, মাগো তুমি বারবার ফিরে ফিরে এসো আমাদের জীবনে।'
ভাববাদী কবি কবিতার শিরোনাম দিলেন, 'শারদীয়া রূপকথা'
হারিয়ে যাওয়া পুরনো দিনের পূজার গানগুলি
বটু কৃষ্ণ হালদার
গ্রীষ্মের দাবদাহকে জুড়িয়ে আসে অতি মেদুর মেঘে মেঘ ছায়া বর্ষারানী। বর্ষার আগমনে শুষ্ক রুক্ষ ও পরিবেশ ভাষা খুঁজে পায় ।নতুন প্রাণের সঞ্চার উজ্জীবিত হয় শাখা প্রশাখা য় । শুষ্ক তৃণ নতুন প্রান সঞ্চারে আঁচলখানি মেলে দেয় পরিবেশে। আলো-আঁধারির খেলা মিলিয়ে বর্ষার বিদায়ী সুরে ফিরে আসে বাঙালি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রিয় ঋতু শরৎকাল।নীল সাদা মেঘের ভেলায় বাঙালি মনকে বিমোহিত করে। দখিন বাতাসে তালে তালে মাথা দোলায় সাদা কাশের ফুল ।উড়ন্ত সাদা বকের দল পথ হারায় দিগন্তের সীমানায়। শিউলি ফুলের সুবাস সাদা কাশবনের মৃদু মাথা নোয়ানো জানান দেয় মা আসছেন পূর্ণ ধরাধামে। দূর হতে ভেসে আসে পূজার গান। মহালয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয়ে যায় দেবীর আগমন।"বাজলো রে শানাই", গান দিয়ে শুরু হয় মহালয়া। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহালয়ার স্তব তে বিমোহিত হয়ে যেত উতলা মন। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র তিনি অধিক পরিচিতি লাভ করেন মহিষাসুরমর্দিনী নামক গীতিআলেখ্য গানটি রচনা করে।১৯৩১সাল হতে এখনো পর্যন্ত মহালয়ার ভোরে তারা গীতি আলেখ্য দিয়ে শুরু হয় দেবীর বন্দনা । আকাশবাণী তে যে স্তব শোনার জন্যে হৃদয় ব্যাকুল হয়ে থাকতো মহালয়ার ভোরে, সেই স্তব এর মহিমা এ সময়ে কিছুটা ম্লান। ব্যস্ততম ও কর্মময় জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে হারানো দিনের স্মৃতি গুলোকে।
"এক এক্কে এক,দুই এক্কে দুই,
নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে
চন্ডি বাড়ির আট চালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে,
মন বসে কি আর"সত্যি তো পূজা এলে আর কি ভালো লাগে। গান শুনতে শুনতে পাঠশালাতে আনমনা হয় কত শিশু কান মলা খেয়েছে মাস্টারমশায়ের কাছে,যারা কান মলা খেয়েছে হয়তো সে কথা আজও তাদের মনে আছে। দূর হতে ভেসে আসত এমনই সব পূজার গান গুলো। দূর গ্রাম গ্রামান্তর হতে ঢাকি ভাইরা ঢাক কাঁসা পাড়ি দেয় শহরে শহরে রুজি-রুটির টানে। এই ঢাক কাঁসা বাজিয়ে তাদের সারা বছর সংসার চলে না। তবুও যুগের পর যুগ প্রাচীন ঐতিহ্যকে তারা কাঁধে করে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে, সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা য় জর্জরিত, তবু ওমহালয়ার আগে থেকে শুরু হয় আগমনীর উৎসব বন্দনা।চারিদিকে সাজ সাজ রব। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মাতৃ সম দেবী দুর্গার আগমন হয় শরৎকাল কে ঘিরে। দীর্ঘ বছর ধরে বাঙালি পরম্পরা বৃত্তাকার ঘুরে চলেছে আপন কক্ষপথে। আশ্বিন কার্তিক মাস এই দুই মাস হলো বাঙালির কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাল । পদ্ম শিউলি কাশফুলের লাবণ্য ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। কোথাও কোথাও শুরু হয় ঢাকের বাদ্য। প্রতি বছরের ন্যায় এ সব কে সঙ্গী করে মা দুর্গা মর্ত্যে আসছেন সপরিবারে।
পদ্ম পিসির চালাতে পাঠশালায় পড়তে বসা শিশুর মন উড়ু উড়ু। এই বুঝি মায়ের চোখ আঁকা হয়ে গেল পুরানো জেটিঘাটের বারান্দায়। মাস্টারমশাই কাছে কান মলা খেয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে পড়ার শেষে দৌড় দেয় মূর্তি গড়ার কাছে। সেকালের পুরানো গান গুলো শুনলে মনে হয় দুর্গাপূজা এসে গেছে। পূজা আসার আগে দূর হতে ভেসে আসত পুরনো দিনের সেই স্মৃতি মেদুর সোনালী গানগুলি।পূজা কটা দিন ভরপুর আনন্দে মেতে উঠতো সবাই।পূজার ওই কটা দিন বাচ্চাদের বই খাতা সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে প্যান্ডেলে কেবল খেলা আর খেলা। তবে বর্তমান এবং অতীত কালের পূজার মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল। সেকালের কলের গান কবে অতীত হয়ে গেছে, তারপর এসেছে ক্যাসেট সিডি ডিভিডি।
রেল লাইন কিংবা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কাশফুলের দোল খাওয়া শিউলিরা জানান দেয় পূজা আর বেশি দূরে নেই। শরতের আলোর বাঁশি বেজে উঠলেই নতুন জামা কাপড়ের সঙ্গে বাজারে এসে যেত আনকোরা সব পূজার গান। হেমন্ত, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, পিন্টু ভট্টাচার্য্য, নির্মলেন্দু চৌধুরী, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর, আরতি মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নির্মলা মিশ্র সহ স্বর্ণযুগের মত হোক না হোক শ্রীকান্ত আচার্য ও লোপামুদ্রা রাঘব চট্টোপাধ্যায় শুভমিতা নচিকেতার গানের ক্যাসেট বাজারে আসতো। পরিস্থিতি ও প্রযুক্তির ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই পাল্টে গেছে সামাজিক চাহিদা। এখন বাড়িতে বাড়িতে সেট পিস হিসাবে ঠাঁই পেয়েছে ক্যাসেট প্লেয়ার সিডি ডিভিডি প্লেয়ার,মাঝেমধ্যে সেই পুরানো দিনের গান গুলো বেজে উঠলে ও তার পরম আয়ু ফুরিয়ে এসেছে অনেকটাই। এই সময় পুজোর নতুন গান তো দূরের কথা শারে দিও সিডি ডিভিডি প্রকাশের সংখ্যাও কমে গেছে।বর্তমান সময়ের শিল্পীরা বাংলা ছবিতে নামলেও বেসিক রেকর্ড যাকে বলে আমরা বাংলা আধুনিক গান বলে জানি সেই ধারা ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। কেন এই হাল আধুনিক গানের?রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম,অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তের গানের বাইরে বাংলা গানের ধারা হিমাংশু দত্ত, সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, শচীন দেব বর্মন,এর হাত ধরে শিখর ছুঁয়েছিল। স্বর্ণযুগের শেষ প্রজন্মের শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এজন্য নতুন প্রযুক্তি কে দায়ী করেছেন।১৯৬৩ সালে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে তিনি প্রথম পূজার গান রেকর্ড করেন। সলিল চৌধুরী সুরে গাওয়া "পাগলা হাওয়া" গানটি বাংলা আধুনিক গানের পাঁচ মুক্ত। পাঁচ দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তার জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু। এই প্রবীণ শিল্পী বলেন আসলে প্রযুক্তির এত দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে যে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বদলাতে পারছি না।এখন সবার হাতে স্মার্টফোন তাতেই ইউটিউবে গান শোনা যায়। ফলে রেকর্ড কোম্পানিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুরনো গানের সিডি যদি বিক্রি না হয় তাহলে নতুন গানের প্রকাশের ঝুঁকি কিভাবে নেবেন ব্যবসায়ীরা।বর্তমানে অনেক ভালো গান হচ্ছে তবে ব্যবসায়িক দিক দুর্বল হওয়ায় গানের চর্চা মার খাচ্ছে এইসব স্বর্ণযুগের গানের আকর আকাশবাণী কোম্পানিরা "অনুরোধের আসর" এর মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা পেতে। আজ ডিজিটাল যুগেও এসময় নতুন গান প্রচারের জন্য আকাশবাণীর মতো কোনো বিকল্প মঞ্চ নেই। তাই মণ্ডপে বাজে মানবেন্দ্র,নির্মলেন্দু চৌধুরীদের সেই হারানো সুরের গান। এক সময়ে প্রিয় শিল্পীদের গান "অনুরোধের আসরে"শুনবো বলে ছুটির দিনে বেলা আড়াইটার সময় রেডী ওর সামনে গিয়ে বসতাম। বর্তমানে লাগামহীন, ব্যস্ততাময় দুরন্ত গতিতে ছুটছে সময়। তাই রেডিও এখন অতীত।
"পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবো কিরে হায়", সত্যি পুরনো দিনের কথা আজও ভোলা যায় না। এখন আর পূজা প্যান্ডেলে স্বর্ণালী যুগের সেই গানগুলো তেমন শুনতে পাওয়া যায় না। বর্তমানে হিপ পপ, বাংলা রক, বাংলা ব্যান্ড, গানের সাথে সাথে আমরা সবাই মেতে উঠেছি। স্বকীয়তা হারিয়েছে স্বর্ণালী যুগের স্বর্ণালী সৃষ্টিগুলো। তবে প্রয়োজনের তাগিদে সভ্যতা লেগেছে রং, তবে সেটা কি নির্ভেজাল।ভেজাল রং মেখে মেতে উঠেছি মিথ্যা নাটকের মহড়ায়। দিনে দিনে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি সবাই।হারিয়ে ফেলেছি চিরাচরিত প্রাচীন রক্ষণশীল সভ্যতা-সংস্কৃতি গুলিকে। প্রাচীন সভ্যতা কে উপেক্ষা করে আমরা যেমন ভুলে গেছি শাড়ি,শাঁখা, সিঁদুরের কথা। সমাজ সভ্যতার মানসিকতায় ভাটায় টান পড়েছে। তাইতো আমরা বলে উঠি,বারো হাত কাপড়ে ও লেংটা। তবে চেষ্টা করলে কি না হয়? আমরা কী আগের মত সেই পূজা পূজা গন্ধ কে ফিরিয়ে আনতে পারি না চিরাচরিত সভ্যতা রক্ষণশীল সংস্কৃতির স্বার্থে।এই স্বার্থেই প্রতিটি পূজা প্যান্ডেলে সবার প্রথমে বাজানো হোক পুরানো দিনের সেই হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণালী গান গুলি কে।এই যুগের জেনারেশন রা তো জানতেই পারলেন না স্বর্ণযুগের মূল্যবান গান ,স্রষ্ঠা,সঙ্গীত শিল্পীদের কথা । পূজা প্যান্ডেল গুলোতে তেমনি গান বাজানো হোক যে গানগুলো শুনেই আবার ফিরে পাবো হারিয়ে যাওয়া পূজা পূজা গন্ধ। পূজার সময় নাই বা হল পূজার গান গুলো যে সমস্ত দিকপাল শিল্পীরা পূজার সময় গেয়েছিলেন একসময় আমাদের জন্য সেগুলি এসময় মণ্ডপে যদি বাজানো হয় তাহলে অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাবে। মায়ের হাতে ডাল ভাত, আলু সেদ্ধ, ঝিঙে আলু পোস্ত যেমন সারা জীবন মুখে লেগে থাকে তেমনি রেস্তোরাঁর বিরিয়ানি, চিকেন কাবাব,চিলি চিকেন, এসব ক্ষণিকের মোহ। তাই এসব ক্ষণিকের মোহ কাটিয়ে আমরা আগামী ভবিষ্যৎ এ ফিরে যাব পুরনো দিনের কথা ও গানে এমন আশা রাখছি এ সমাজের কাছে।
আগমন
অন্বেষিকা দাস
কিনে দেবে একটা হলুদ পাঞ্জাবী?খুব ইচ্ছে অষ্টমীতে তোমার হাত ধরে যাব মদনমোহনবাড়িতে।অঞ্জলি দেবো দুজনে একসাথে।কত ভাবনা ঘুরছে মনে কিন্তু কে তুমি? প্রেম না প্রকৃতি।প্রকৃতির টানে ঘুরে বেড়ালাম দেশ-বিদেশ,রণে বনে জঙ্গলে।তবুও তো দেখা হল না।উপরন্তু প্রেম এসে ধরা দিল সপ্তমীতে।গৌরচন্দ্রিকা হতে হতেই সময় হল অষ্টমী পূজার। কে এসে যেন কানে কানে বলে গেল " এই নে তোর পাঞ্জাবী,তৈরী হয়ে নে আমি বাইরে অপেক্ষা করছি"।আমি অতি শীঘ্রই তার মতো করে সাজিয়ে তুললাম নিজেকে।বাইরে বেড়িয়ে অট্টহাসিতে যেই হাতটা ধরতে গেলাম অমনি যেন সব শূন্য হয়ে গেল।তাহলে কে ছিলে তুমি? প্রেমিকারূপে দেবী দুর্গা!!
সম্পাদকের কলমে
রবিবারের চিঠি
শৌভিক রায়
ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম আর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ সেই সকালেই। টুঁটিফুটি মেঘের ফাঁকে ফালি ফালি আকাশ। এক আকাশ পেরিয়ে যেন আর এক আকাশ পোঁছে যাওয়া হাওয়া গাড়ি চেপে। রোদ ঠিকরোয় জানলায়। বন্ধ বলে যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না কেবল। ছোটখাট ফুটো পেলেই তা দিয়ে এসে নাটকের স্পটলাইটের মতো ঢুকে পরে ঘরের মাঝে। তারপর মশারীর ভেতর দিয়ে সোজা চোখে একদম।হঠাৎ ঘুম ভাঙলে বোঝা যায় না ঠিক আছি কোথায়। বিনবিনে ঘাম মুখে ছড়িয়ে প'রেছে। ঋতু পরিবর্তন,তাই বাবা ফ্যানের স্যুইচ বন্ধ করে গেছে কোন রাতে কে জানে! কোলবালিশ জড়িয়ে এপাশ ওপাশ করেও আর আসবে না ঘুম। তার চাইতে উঠে পড়াটাই ভালো। জানলা খুলতেই রোদ, রোদ, রোদ।এমন কী বইয়ের আলমারীর পেছনেও পৌঁছে যায় সেই রোদ।মাকড়সার জালে সেই রোদের আনাগোনায় হকচকায় সে রোদ! জানলার বাইরে তার সেই সুন্দর জালে রোদ পরে রূপোলী ঝালর যেন।বাইরে শুধুই রোদের বন্যা।ধাঁধিয়ে দেওয়া আলোতে চোখ চলে যায় অপলক তাকিয়ে থাকা সবুজ মাঠে। সবুজ সবুজ সবুজ।বরষার টাটকা জলপানে চারধার সবুজ কেবল।গাঢ় সবুজের সেই বিস্তারে হঠাৎ মুখ তোলা সাদা কাশের একটা দুটো মাত্র। আর ক'দিন মাত্র! গুচ্ছ গুচ্ছ কাশ ঢেকে দেবে মাঠঘাট, আলপথ, নদীর ধার।মুজনাই এখন শান্ত তবে টইটম্বুর। কিন্তু সেই খরস্রোত আর নেই। বদলে সুখী সুখী ভাব একটা। সাপটানাতেও জল নেমে গেছে।এদিকওদিক হোগলা উঁকি দিচ্ছে। আর বুকে দুজনেরই নানা মেঘের সহবাস। বোঝা যায়না আকাশটা ঠিক কোথায় আর কিভাবেই বা নেমে এলো নদীর বুকে! সন্ধ্যেটাও নামবে ঝপ করে। দিন ছোট হয়ে আসছে যে।পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। দোকানীরাও আশায় আশায়।কুমোর পাড়ার এঁটেল মাটিতে অদ্ভূত সেই মোহময়ী,চিরন্তনী,শাশ্বতা। দাঁড়ি য়ে থাকে সেই ছোট্ট ছেলেটি অবাক হয়ে। তার নিজেরও মা আসবেন আর ক'দিন বাদে তার কাছে। মায়ের গায়ের সেই চেনা গন্ধ। স্নেহ আর অকরুণ মমতা।মা তুমি কত কাছে তাও কত দূরে আমার কাছ থেকে। কেন থাকো না মা বছর ধরে আমার কাছে?
শরত আসে। শরত যায়।পরশ তার মনেপ্রাণে। আনচান করে মন। মেঘ রোদের খুনসুটিতে,ঝলমলে দিনের শুরুতে আর ঘন সন্ধ্যার স্তব্ধ আঁধারে শুধুই এক আহ্বান। কান পেতে থাকি সে ডাক শোনার।
আজও...এই মাঝবয়সে...