Wednesday, October 2, 2019



দ্বিতীয় পর্ব
(গল্প, ধারাবাহিক উপন্যাস )





সম্পাদকের কথা

শরতের আকাশে এখন সাদা মেঘের আনাগোনা। সবুজে ঢেকেছে চারদিক। সকালের বাতাসে শিউলি সুবাস। সূর্যের আলোতে মিঠে-কড়া ভাব। সব মিলে অদ্ভুত প্রশান্তি প্রকৃতিতে। 

মা আসছেন। 

দীর্ঘ উত্সব মরশুম। প্রকৃতি প্রশান্ত হলেও বর্ষার খামখেয়ালিপনায় জলমগ্ন দেশের নানা অঞ্চল। দুর্গতিতে মানুষ। পাশাপাশি নিজ দেশভূমে উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কায় বহু মানুষ। এদের কারো কাছে তাই এই উত্সব হয়তো আলাদা কোনো বার্তা আনছে না। 

তবু মা আসছেন। 

মা এভাবেই আসেন। সব ভুলে যাই আমরা তাঁর আগমনে। সরিয়ে রাখি আমাদের যাবতীয় সব বেদনা, কষ্ট। এভাবেই চলছি আমরা প্রতিনিয়ত। সমস্যার জীবনে ছোট ছোট টুকরো আনন্দ সম্বল করে আমাদের বেঁচে থাকা। আমাদের সব দুঃখের অবসান তাঁর চিন্ময়ী মূর্তি দর্শনে। 

মা আসুন তাই বারবার। এভাবেই... 



মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৬


যোগাযোগ- হসপিটাল রোড, কোচবিহার 
ইমেল ঠিকানা- mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা 
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস - শৌভিক রায় 


মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৬





এই পর্বে আছেন যাঁরা  


বীরু বর্মণ, রুনা দত্ত, রানা চ্যাটার্জি, ডাঃ সঞ্জয় কুমার মল্লিক, যুথিকা সাহা,


 সুশান্ত পাল , দেবব্রত সেন 


প্রচ্ছদ ছবি- ঋতভাষ রায় 


মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৬







মিঠু

বীরু বর্মণ




“ শোন মিঠু ! ফুটবল খেলার মাঠে নেমে ক্যারম খেলতে চাইলে হবে না,ফুটবল খেলার 


কেরামতি শিখতে হবে ......পাসিং..ড্রিবলিং..জসলিং.. করে বেড়িয়ে আসতে হবে। এভাবেই

 গোল দিতে শিখতে হবে তোমাকে ,কিছু করার নেই আমাদের ......স্মার্ট মিঠু দের সবাই

 সমঝে চলে .....।’’ ___ সেদিন কথাগুলো নির্লিপ্ত গলায় গুছিয়ে বলে নিজেকে অপারগ

ঘোষণা করেছিল সুমন।



মিঠুর শূন্য দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসছিল। শরীর বেয়ে বিন্দু বিন্দু নোনাজল মেঝেতে পড়ে


 চলেছিল তখনও। পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল, প্রতিদিন একটু একটু করে খোদাই হওয়ার

 অপেক্ষায়। অসহায়তা কে আপসে পরিণত করে জীবনধারণ সহজ নয় ,সাংঘাতিক কঠিন !!





সুমনের সাথে যেদিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আসে মিঠু , রোমান্টিক গল্প টা এতটা পানসে মনে


 হয়নি তখনও। একজন আমাজন ডেলিভারি বয়-এর দশ হাজার টাকা মাস মাইনেতে ভালো

 থাকা আর ভালোবাসার নিরন্তর বিরোধ বাধে। বাধাটাই স্বাভাবিক। দুটো স্ট্র দিয়ে একটি

 মাত্র ডাবের তরল ভাগাভাগি করে চুষে খেলে রোমান্টিকতা গর্ভবতী হতে পারে। কিন্তু রুটি 

ছিঁড়ে সংখ্যা বাড়ালে পাকস্থলী বিদ্রোহ করে। রাস্তায় চোখ রাখলে কমবয়সী আবেগ তাড়িত

 বিবাহিত যুগলের অভাব হয় না।


চরম বাস্তবটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল মিঠু। মরিয়া হয়ে একটি কাজ খুঁজছিল। 



মেয়েদের দেখতে সুন্দর হলে কাজ পেতে সুবিধা হয়।জুটেও যায়। ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের 


কাজ।আমাজন হাবে-এর অফিসেই। মিঠুকে অনায়াসেই কাজে নিয়ে নিয়েছিল হাবের 

ফ্রাঁন্চাইজি মালিক, হাব-এর বস্। খুব অবাক হয়েছিল মিঠু। একটু স্বস্তির মাঝেই কেমন যেন 

একটা খোঁচা দিচ্ছিল বুকের ভেতরটা। বাইকের বেপরোয়া হাওয়ায় থরে থরে সাজানো ভাবনা

 গুলো সব এলোমেলো করে দিচ্ছিল।

মিঠু ভীষণ লাজুক। নিপাট ভালো মেয়েরা যেমন হয়। অশ্লীল শব্দে কান গরম লাল হয়ে খসে 


পড়তে চায়। মেয়েদের শারীরবৃত্তীয় গুরুত্ব খুব বেড়ে যায় যখন সে সুন্দর চেহারার অধিকারী 

হয় এবং কেবল পরুষ দ্বারা বেষ্টিত হয় যেখানে অন্য কোনো নজরদার নারীর উপস্থিতির 

কোনও সম্ভাবনা নেই। সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা থাকে যদি মহিলা সহকর্মী কেতাদুরস্ত না হয়ে 

অতি সহজ সরল হয়।



ছোট্ট একটা অফিসে অন্তত দশ দশটি সম বয়সী পুরুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু একটি চব্বিশ


 বছরের তরুণী।প্রতিনিয়ত প্রদক্ষিত হতে থাকে তার সুন্দর কোমল অবয়ব।চলে মাংস পেশীর 

তারতম্যের বিশ্লেষণ ,নির্লজ্জ অ্যানাটমি এবংতাতে পারস্পরিক সঙ্গত প্রদান করে তারা উল্লাসে

গলা মেলায় কাওয়ালি দলের মত।


উপর থেকে জরিপ করলে অনেক সূক্ষ্ম ভূমিরূপ নজরবন্দি করা যায়। কারণে অকারণে হঠাৎ


 কোনও ছায়া তার পাশে দাঁড়ানো দেখে চমকে উঠত। কমপিউটার স্ক্রিনের সাথে সাথে ওড়না

 টাকে খেয়াল রাখতে পারত না মিঠু।



এর পর শুরু হয় কিছু বেলাগাম "পর্ন-ভোজী" ইঙ্গিত--



-"আপনার মেশিনে একটু পেন ড্রাইভ টা ঢোকানো যাবে মাডাম !?"



সরু করিডোরে চলার সময় অসতর্ক মিঠু লোলুপ কনুঁইয়ের স্পর্শ এড়াতে পারত না। প্রিন্ট 



আউট নেওয়ার অছিলায় বেয়ারা রামদীন নিয়মিত ওর হাত ছুঁতে চাইত। সঙ্গে সশব্দে চলত


 হোটাসঅ্যাপ এ প্রচারিত সস্তা ভালগার ভিডিও জোক্স। সুমনকে এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি

কখনও।জানায়নি বস কেও।মল মুত্র ইত্যাদির মতই নোংরা জিনিস এসব।দুর্গন্ধ ছড়ায়। মুখে

রুমাল চাপা দেওয়াই শ্রেয় । 


সেদিন ,মাইনের টাকাটা নেওয়ার সময়টাকে আদর্শ মনে করে বসের কাছে অস্বস্তির অভিযোগ 


সরাসরি জানিয়ে ফেলেছিল। আচমকাই ওর কানের খুব কাছে দুর্গন্ধযুক্ত নিশ্বাসে ফিসফিসিয়ে 

বলেছিল --"পরের মাসে আরও হাজার খানেক বাড়িয়ে দেবো, প্লিজ অ্যাডজাস্ট"। হতচকিত 

মিঠু থ্যাংক ইউ বলতে গিয়েও পারে নি।




তারপর প্রতিদিন ক্রমশ লম্বা হতে চেয়েছিল মালিকের লোলুপ হাতের স্পর্শ। সেদিন হঠাৎ 




 অযথা অনেক কাজের চাপ পড়েছিল। ফাঁকা অফিসে গুটখার উৎকট গন্ধে বমি আসছিল

 ওর। 


হঠাৎ, মালিকের ক্রমবর্ধমান লম্বা হাত তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। পুরুষ মনের গভীরে


 অভিসন্ধি গুলো অজগর সাপের মত। ধীরে ধীরে পেঁচিয়ে স্পর্ধা উলঙ্ঘন করতে চায়।নির্মম

 ঘড়িটার কাঁটার দিকে তাকিয়ে ওই ব্যাভিচারী সময় টুকু স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে ছিল মিঠু।


পালানোর চেষ্টা করেনি মিঠু। বরং নিজের হাতটা বাড়িয়ে বসের হাতটা শক্ত করে ধরে নিল।


আসলে সাহস টাকেই ধরে ফেলে বলে ফেলেছিল-


—“ স্যার আমার বাবাও অনেকটা আপনার মতন দেখতে !! খুব শ্রদ্ধা করি আপনাকে!"





রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গা গুলিয়ে উঠছিল বারবার।একরাশ ঘেন্না নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল।


 কোন কথা না বলে সোজা বাথরুমে ঢুকে গা-এ জল ঢালতে লেগেছিল পাগলের মত।


বাথরুম থেকে বেরিয়ে চুপচুপে ভেজা গা-এ সুমনের বুকে গা ছেড়ে দিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে


 ফেলেছিল সুমনকে।



আজ, মিঠু পাকা কেতাদুরস্ত …ব্যালেন্সড ডীভা। বাথরুমে ঢুকে স্নান সেরে রিল্যাক্সড হওয়া 


টা অনেক সহজ মিঠুর কাছে। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে লেপটে থাকা আঁশটে গন্ধটা জলের তোড়ে

 এখন সহজেই চলে যায় ।


এখন , খাপ খাইয়ে পাল্টে নিয়েছে নিজেকে।



সরু করিডোরে চলার সময় সদা সতর্ক থাকে।



বেশ ড্রিবলিং করে লোলুপ কনুইয়ের অবাঞ্ছিত স্পর্শ অনায়াসে এড়িয়ে যেতে পারে।এমনকি


 নিয়মিত ওর নরম আঙুল ছুঁ তে চাওয়া বেহায়া বেয়ারার আঙুলের খাঁজে কাগজের ডগা গুঁজে

 দিতে জানে। ওর পাশে দাঁড়ানো নজরদারকে অফসাইড ঘোষণা করে দিতে জানে। 

ওড়নাটাকে বর্ম হিসেবে পরতে জানে। বস ডাকলে মাপা পাস দিয়ে মিহি হাসিমুখে পজিশন 

নিতে জানে।দরকারে রেড কার্ড দেখায় সরাসরি। কিম্বা নিজেই টাইম আউট ঘোষণা করে 

তারাতারি বাড়ি ফিরে আসতে জানে। স্নানে যায়। ফ্রেশ হয়। এভাবেই প্রতিদিন একটু একটু 

করে ট্যাকটিক্যাল হয়ে ক্রমে সোফিস্টিকেটেড হয়ে ওঠে হাজার হাজার মিঠুরা।




............ ঘরের এক কোনে রাখা ছোট্ট টিভিতে আজও অনবরত চলে হ্যাশটাগ খবরের 


লাইভ সম্প্রচার। প্রতিদিন সন্ধ্যে থেকে সুমন ঠায় বসে রয়েছে টিভির সামনে , নিয়মিত 

উৎকন্ঠার ব্যামো নিয়ে।বাথরুম থেকে ভেসে আসা অনবরত জলের ঝাপটার শব্দ নিউজ

 চ্যানেলের ওই কেতাদুরস্ত নারী কন্ঠকে পরাস্ত করে সুমনের কান অবধি পৌঁছতে পারে না। 




দৃশ্যান্তরে 

রুনা দত্ত



দৃশ্য ১-

ঋতমা কফিশপে বসে কফির কাপে চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বারবার ঘড়ি দেখছে । প্রাক চল্লিশের ঋতমা কলেজের অধ্যাপক সিঙ্গল মাদার , এখন লাল কুর্তি সাদা লেগিনস,  কোমর ছোঁয়া স্টেপস কাট চুল , নাকে হীরের নাকফুল , ঘন কাজল ও ছোট্ট টিপে সবসময়ের মতোই স্মার্ট ও ঝকঝকে । ঋতমা মায়াঙ্ক এর জন্য অপেক্ষা করছে । মায়াঙ্ক ও কলেজে পড়ায় , ফেসবুক থেকেই দুজনের আলাপ , সুখ দুঃখর ছোট ছোট অনুভূতি ভালো লাগা মন্দ লাগা এসব মতের আদানপ্রদান করতে করতেই ঋতমার মায়াঙ্ককে একজন ভালো মনের মানুষ বলেই মনে হয়েছে। তাই ফেসবুকে এক বছরের বন্ধুত্বের পর ওরা দুজনেই আজ একে অপরের সাথে সামনাসামনি এসে কথা বলবে ও কিছু সময় কাটাবে ঠিক করেছে তাই এই আসা এবং অপেক্ষা করা । 

দৃশ্য -২

মায়াঙ্ক  ঠিক ৫ টা বেজে পাঁচ মিনিটে এসে ঢোকে , ব্ল্যাক টি শার্ট , ব্লু জিনস এ ৫'১০'' হাইট এর মায়াঙ্ক যথেষ্টই আকর্ষণীয়। মায়াঙ্ক একগুচ্ছ লাল গোলাপ ও একটা ডার্ক চকলেট ঋতমার হাতে দেয় , দুটোই ঋতমার খুব পছন্দের । এরপর ঋতমার মুখোমুখি চেয়ারে বসে। দুজনে মিলে কোল্ড কফি , চিকেন হট ডগ ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই অর্ডার করে । টুকটাক কথা বলতে বলতে দুজনেই দুজনের জীবনের আরো অজানা কথা জেনে নেয় । দুজনের পছন্দ অপছন্দ কিছু মেলে  কিছু মেলে না । এইভাবে কথায় গল্পে কখন যেন তিন ঘণ্টা কেটে যায় । এরপর দুজনেই উঠবার প্রস্তুতি নিতে থাকে।  ঋতমা মায়াঙ্ক কে বাড়ি আসতে বলে , একমাত্র মেয়ে রিয়া, ক্লাস নাইন এর ছাত্রী  সাথে অর  পরিচয় করিয়ে দেবেও বলে। মায়াঙ্ক ও ঋতমা ও রিয়া ওর বাড়িতে আসতে বলে। একই বয়সী হলেও মায়াঙ্ক এখনো ব্যচেলর। 

দৃশ্য -৩

মায়াঙ্ক ঋতমা ওলা ক্যাবে বসে আছে , সুইফট ডিসাযার নিজের গতিতে ছুটছে । আসলে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি আসাতে মায়াঙ্ক বলে যে সেই ঋতমাকে ড্রপ করে তারপর নিজের বাড়ি যাবে । প্রায় রাত 9 টা বেজে যাওয়াতে ঋতমা আর আপত্তি করেনি । চারদিকে অন্ধকার , ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে , মাঝে মাঝে বিদুৎ চমক দিচ্ছে ।  ঋতমার রিয়ার জন্য ভীষণ চিন্তা হতে থাকে । ঋতমা র মা সাথে থাকলেও ঋতমা মা বাবা দুজনের ভালোবাসা দিয়েই রিয়া কে বড়ো করে তুলেছে । তাই রিয়ার ও ঋতমা ছাড়া একমুহূর্ত ও চলে না । আর তা ছাড়া বিদুৎ চমকালে মেয়েটা খুব ভয় ও পায় । এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঋতমা রিয়াকে ফোন করবে বলে ব্যাগ থেকে ফোন করতে যাবেই , দেখে অন্ধকারের মধ্যে মায়াঙ্ক দু হাতে ঋতমা র কোমর জড়িয়ে ঋতমাকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরেছে । মায়াঙ্ক এর পুরু কামুক ঠোঁট দুটো ঋতমার ঠোঁট ছুঁয়ে বুকের দিকে নামছে । ঋতমা বৃষ্টির মধ্যেও দরদর করে ঘামতে থাকে । রাগে ঘৃণায় গলা ঠেলে বমি আসতে থাকে । ঋতমা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে মায়াঙ্ক কে সজোরে  ধাক্কা মারে । তারপর ড্রাইভার কে গাড়ি থামাতে বলে । মায়াঙ্ক কিছু একটা বলার চেষ্টা করে , ঋতমার কানেও  যায় না । ঋতমা গাড়ি থেকে নেমে আসে । 

দৃশ্য -৪

ঋতমা শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে প্রায় অনেকক্ষণ হলো । গাড়ি থেকে নেমেই চকলেট ফুল সব ছুঁড়ে ফেলে দেয়।  সাথে সাথে একটা রিক্সা পেয়ে যাওয়ায় বাড়ির দিকে রওনা দেয় । বাড়িতে এসে চটি খুলে ব্যাগ রেখেই প্রায় ছুটে বাথরুমে আসে । বেসিনে সব রাগ ঘৃণাগুলো বমি হয়ে বেড়িয়ে আসে, ঋতমা শাওয়ার খুলে স্নান করতেই থাকে । শাওয়ারের জলে ঋতমার শরীর থেকে  মায়াঙ্কের কামুক স্পর্শের অনুভূতিরা যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকে । ঋতমা ফ্রেশ হয়ে রাতের পোশাক পড়ে মেয়ের জন্য হট চকলেট ও নিজের জন্য এককাপ কড়া কফি বানিয়ে নিয়ে বেডরুমে আসে । দেখে রিয়া বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে । মা পাশে রাখা সোফায় বসে বই পড়ছে । ঋতমা মাকে খেয়ে নিয়ে শুতে যেতে বলে। তারপর হট চকলেটটা মেয়ের মাথার কাছে সাইড টেবল এ রেখে রিয়ার পাশে বসে মাথায় আসতে আসতে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে । মায়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে রিয়া হঠাৎ উঠে বসে এবং ঋতমাকে দু হাতে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ওঠে এবং বলে , মা , তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে আমার যে ভীষণ ভয় করছিল । ঋতমা কিছুই বলে না , চুপচাপ মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে মেয়েকে বুকের মাঝে টেনে নেয় । এবং মনে মনে ভাবে , না আর কোনোদিনই বন্ধুত্বের নামে হায়নাদের লোলুপ ফাঁদে সে পা দেবে না । আর রিয়ার সাথে সাথে কাল থেকে সেও ক্যারাটের ক্লাস জয়েন করবে। কারণ এর পর থেকে আর কাউকে বিশ্বাস করা তো দূরের কথা একটা নিরাপত্তার অভাব বোধ হতে থাকবে। কিন্তু এ অন্যায় সুযোগ ঋতমা আর কাঊকে দেবে না পরিবর্তে রুখে দাঁড়াবে শক্ত হাতে । 

দৃশ্য -৪

ঋতমা রিয়াকে হট চকলেট টা যত্ন করে খাইয়ে দেয় তারপর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে মা এবার ঘুমিয়ে পড়ো , দেখো আমি তোমার কাছেই আছি আর কক্ষনো এভাবে একা রেখে যাবো না , বলে পরম মমতায় রিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে ভাবতে থাকে না আর কোন বন্ধুত্ব বা অন্য কোন রকম সম্পর্কে সে আর বিশ্বাস করবে না বা জড়াবেও না । সবার আগে সে এখন একজন মা যাকে মা এবং বাবা দুটো দায়িত্বই পালন করতে হবে এবং রিয়ার মনে কোন কষ্ট না দিয়ে রিয়ার জীবনকে যতটা সম্ভব সুন্দর এবং মজবুত  করে তৈরী করে দিতে হবে  যাতে ভবিষৎ এ কোন রক্তলোলুপ হায়নাই তার বা রিয়ার জীবনে আর দাঁত ফোটাতে না পারে ॥






দূরত্ব

    মৌসুমী চৌধুরী


     প্লেনটা ধীরে ধীরে দেশের মাটি ছুঁলে একটা শিরশিরে অনুভূতি হতে লাগলো সুকুমারের।  বাতাসে যেন আত্মীয় স্পর্শ। চারিদিকে শরতের কাঁচা সোনা রোদ গলে গলে পড়ছে----"রোদ্দুরে লেগেছে চাঁপা ফুলের রঙ/হাওয়া উঠছে শিশিরে শিরশিরিয়ে/শিউলির গন্ধ এসে লাগে।/যেন কার ঠাণ্ডা হাতের কোমল সেবা।/ আকাশের কোণে সাদা মেঘের আলস্য/দেখে মন লাগে না কাজে।/মাষ্টারমশাই পড়িয়ে চলেন/ পাথুরে কয়লার আদিম কথা / ছেলেটা বেঞ্চিতে পা দোলায়".......আহা! রবীন্দ্রনাথ! দেশের অনুষঙ্গে তিনি আজও মিলেমিশে একাকার সুকুমারের মনে। যদিও যন্ত্র নিয়ে কাজ তার, তবু কবিতা আজও সুকুমারের দুর্বলতা।
       ছেলেটা আর বেঞ্চিতে পা দোলায় না। হা করে আকাশও দেখে না। এখন মেঘেদের মিনার ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্লেন চলায় সে। "আমেরিকান এয়ারলাইন্স"-এর সিনিয়ার পাইলট ক্যাপটেন সুকুমার ঘোষ।
       সাত বছর বাদে দেশের মাটিতে পা রাখল সুকুমার। বাবা-মা তো গত হয়েছিলেন সেই ছেলেবেলাতেই। নিসঃন্তান বিধবা পিসীমার আদরে আহ্লাদে মানুষ সে। আর তার আদরে ভাগ বসাত পাড়ার সেই দস্যি মেয়ে শিউলিটা। গরীব পুরোহিতের  মা-মরা একমাত্র মেয়ে। শিউলির বাবা সুধাংশু কাকু ছিলেন তাদের রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের বাঁধা পুরোহিত। আর পিসীমা অলকাসুন্দরী দেবী চোখ মুছতে মুছতে আজও শেওড়াফুলির চাঁপাতলি গ্রামে তাঁর বাপের ভিটে আর জমি-জমা আগলে বসে আছেন। শুধু মাঝে মাঝে ফোনে সুকুমারকে সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে কাশীবাসী হবার হুমকি দেন।
        দেশে রওনা হওয়ার আগের দিন সহকর্মী জনসন মরিস এসেছিল সুকুমারের সাথে দেখা করতে। সুকুমারের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে হাসতে হাসতে জনসন বলেছিল, " অ্যাট দ্য ফার্স্ট সাইট, তোম্যার শিউলি ফ্লাওয়া- তোমাকে দেখে কী যে ক্যরবে কে জানে সুকুম্যার!... হা হা।" তারপর চোখ টিপে বলে, "আই অ্যাম অলসো সো এক্সাইটেড টু সী ইয়োর শিউলি ফ্লাওয়া... " প্রথম এসে জনসনের সঙ্গে সখ্যতা হতে সুকুমারই তাকে জানিয়েছিল শিউলির কথা। তার দস্যিপনার কথা। গ্রামে তাদেরগন জীবনের কথা।
           কিন্তু কেউ জানে না, শিউলি জানে না, পিসীমা জানে না, এমন কি জনসনও নয়..... নিউজার্সির এডিসন শহরের এক গীর্জায় আইরিশ তরুণী এমিলির সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হবে অঙ্গীকার করেছে সুকুমার। এমিলি সুকুমারের সহকর্মী। এডিসন শহরের একাকী যাপনে এমিলি সুকুমারের জীবনে এসেছিল বটের শান্ত ছায়ার মতো। যে ছায়া বলতে চায়,  "এতদিন কোথায় ছিলেন ছিলেন?"
            শিউলি সুকুমারের সাথী, বন্ধু, বহু
দুষ্টুমির চ্যালা। কাদের গাছে কুল পেকেছে, কাদের গাছে লিচু, ঝড়ে কোথায় বাবুই পাখির
বাসা ভেঙে পড়েছে ---- এসব খবর শিউলিই
প্রথম তাকে দিত। ছেলেবেলায় শিউলি ছিল তার আম পাড়া, জাম পাড়া, লিচু চুরির বিশ্বস্ত
দোসর। বাজি রেখে শিউলি আর সে ডুব সাঁতারে গাঁয়ের শিমূল দিঘি এপাড়-ওপাড় করত। আর  যৌবন সমাগমে সেই শিউলিই ছিল মিষ্টি গন্ধে ম'ম' করা তার একান্ত নিজস্ব শিউলিতলা।
            শিউলির কথা মনে হলেই মনটা অপরাধ বোধে বড়ই ভারী হয়ে ওঠে সুকুমারের। কিভাবে দাঁড়াবে শিউলির মুখোমুখি! কিভাবে বলবে, "শিউলি তোমাকে আর ভালোবাসি না আমি। আমাকে ক্ষমা করে
দাও।"... নাহ্! একটি ভালো পাত্র দেখে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শিউলির বিয়ে দিতে হবে। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল সুকুমার। 
     বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল।  তার আসার উপলক্ষে বাড়িতে যেন সাজো সাজো রব!  পৌঁছানো মাত্র পিসীমার আনন্দাশ্রুতে ভেসে গেল সুকুমার। পিসীমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে সে বলল, "কই দাও দেখি, খেতে দাও। কতদিন তোমার হাতের রান্না খাই না।" পিসীমা তড়িঘড়ি খাবার বাড়তে গেলেন। আর তার চোখ খুঁজতে লাগলো শিউলিকে। দস্যিটা তাহলে আসে নি! এক অনামী পাষাণ ভার সুকুমারের বুকে চেপে বসে রইল !
           খেতে বসলে পিসীমা তার ভাইপোর ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে আক্ষেপ করতে লাগলেন। সাথে যোগ করলেন ভাইপোকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করতে না পারলে তিনি স্বর্গত দাদা-বৌদিকে মুখ দেখাবেন কি করে? ইত্যাদি ইত্যাদি...। মুখ নীচু করে খেতে থাকে সুকুমার। 
             বিড়বিড় করে পিসীমা বলে  চলেন,  "শিলুটাকে তার বাপ মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দিলে। মোটে শুনলে না আমার কথা। আহা! মা মরা মেয়েটা! দস্যি হলেও মনটা বড় সাদা গো! আমিই বা আটকাব কীসের দাবীতে?"
       চোখ মুছতে মুছতে তার কোমল হৃদয়া পিসীমা বলে চলেন, "কে জানে পুজোতে মেয়েটাকে বাড়িতে পাঠাবে কিনা মামারা! পুজো পেরোলে সুধাংশু র সাথে কথা বলতে হবে। সেই শিশুকাল থেকে মনে মনে আমি তোমাদের দুটির জোড় বেঁধে রেখেছি... তোমরা আজকালকার ছেলে ছোকড়া, তোমাদের বিশ্বেস নেই। কোন দিন মেম ধরে এনে আমার বাপের বংশের মুখে চুনকালি মাখাবে!"  মনে মনে প্রমাদ গোনে সুকুমার! বাপের বংশের ঐতিহ্য আর কৌলিন্যে বড়ই গর্ব পিসীমার।  এমিলির কথা পিসীমাকে বললে তিনি তো তুলকালাম করবেন! মহা ফাঁপড়ে পড়া গেল! মনে মনে ভাবল এ সঙ্কট থেকে বাঁচতে শিউলির দারস্থ হতে হবে।
         পুজোর আগেই মামাবাড়ি থেকে ফিরে এল শিউলি।  দু'তিন দিন কেটে গেলেও সে পিসীর সাথে দেখা করতে এল না। অভিমান- ভরা বুকে ঘুরে বেড়াতে লাগল সুকুমার  গাঁয়ের হরিসভা, চণ্ডী মন্দির, শিমূল দিঘি , নদীর ধারে আর কাশ বনে----তার আর শিউলির সব প্রিয় বিচরণস্থানগুলোতে। যদি দেখা যায়। যদি...            

        একদিন হঠাৎ দেখতে পেল দুর্গাপুজোর মন্ডপে। দূর থেকে শিউলিকে দেখে চমকে গেল । এ কোন্ শউলি! কোথায় সেই স্রোত- স্বিনী নদী-মেয়ে। এ যে ত্রয়োবিংশ বর্ষীয়া তন্বী নারী --- চোখে বিদ্যুৎগর্ভ, এক ঢাল কালো চুলে বন্দীশ গায় মেঘ-মল্লার, মোহিনী হাসিতে ছড়ায় গুলাল, মৃদু চলনে যেন এক অপার রহস্য! এক রহস্যময় দূরত্ব ঘনিয়েছে শিউলির চারপাশে। আগের মতো তার কাছাকাছি যাওয়া যায় না।
         অগত্যা শিউলির বাবার শরীরের খবর
নিতে তাদের বাড়িতে যাওয়াই মনস্থির করল
সুকুমার। শিউলির বিয়ের কথাটাও পাড়া যাবে। তার কর্মস্থলে সুপাত্রের অভাব তো নেই।
           বহুদিন পর সুকুমারকে দেখে খুব খুশি
হলেন সুধাংশু কাকু। শরীর ভেঙে পড়েছে তাঁর। অশক্ত শরীরে, কাঁপা কাঁপা হাতে তাকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর চলতে লাগল সাংসারিক কথপোকথন। চোরা চোখে সুকুমার খুঁজতে লাগল শিউলিকে। দেখতে না পেয়ে হতাশ হল সে। সুধাংশু কাকু বিবাহযোগ্যা মেয়ে নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করলে সুকুমার উপযাচক হয়ে সুপাত্র ঠিক করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শিউলির বিয়ে দেবার আশ্বাস দিল। 
         বাবা হাঁক দিতে শিউলি প্লেটে করে নারকেলের নাড়ু, মুড়কি আর কাঁচের গ্লাসে জল এনে তার হাতে দিল। মুখ বেশ থমুথমে। ভাবখানা এমন জীবনে কখনও দেখে নি সুকুমারকে। মনে হচ্ছিল ছোটবেলার মতো ঠাস করে এক থাপ্পড় কষায়। মর্মান্তিক এক গুরুদণ্ডভার পাথর হয়ে চেপে রইল তার বুকে। 
        শিউলির বাবাকে মেয়ের জন্য ভালো পাত্র ঠিক করে দেবার আশ্বাস দিয়ে ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সুকুমার। বুকের মাঝে সমুদ্র হয়ে আছড়ে পড়ছে কষ্ট। কিসের কষ্ট, কোথায় কষ্ট তার ব্যাখ্যা নেই! ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায় শিমূল দীঘির পাড়ে। টলটলে দিঘির জলে ক্রমশ প্রলম্বিত হচ্ছে ছায়ারা। সুকুমারের ভেতর ঘরেও পড়ছে সেই স্লেট রঙা ছায়ার রেশ। টুপ করে মিলিয়ে গেল আস্ত একটি দিন।
সন্ধ্যেতারার টিপটি পরে সেজে নিল পশ্চিম আকাশ। দূরে পুজো মন্ডপ থেকে মাইকে ভেসে আসছে সন্ধিপুজোর মন্ত্র। নবমীর সন্ধ্যে বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষণ্ণতা। 
        হঠাৎ পেছন থেকে দৃঢ় মেয়েলি কন্ঠের ডাক, " শোনো, কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে।"
    শিউলি!!!
"তুই এখানে? বাড়িতেই তো বলতে পারতিস!"
         ঘাড় বাঁকিয়ে শিউলি বলে, "কথাটা তোমাকে একান্তে বলার দরকার ছিল, তাই।"
      সেই দস্যি শিউলিকে হঠাৎ মেয়েদের স্কুলের কাড়া দিদিমণি মনে হল সুকুমারের।
গলাটা কেমন শুকিয়ে উঠল তার।
     কোনক্রমে বলল, " বল, কি বলবি।"
     কোন রকম ভনিতা না করে শিউলি বলল, "শোন, তুমি মেম বিয়ে করে আনতে চাও, বেশ ভালো কথা। নিশ্চয়ই আনবে । আমিই না হয় বরণ করে ঘরে তুলব। কিন্তু দোহাই তোমার, আমার জন্য বর খুঁজতে হবে না তোমাকে। বিয়ে আমি করব না। বাকী জীবনটা তোমার পিসিমার সাথেই কাটাব ভাবছি।" কথাগুলো বলেই ঝমঝম করে মল বাজিয়ে চলে গেল শিউলি।
     এ শিউলি সুকুমারের অচেনা। এ শিউলির সাথে ঝগড়া করা যায় না, থাপ্পড় কষানো যায় না, অভিমান করা যায় না, মনের কথাটা বলাও যেন দুষ্কর! তার সঙ্গে যোজন দূরত্ব তৈরি করে দিয়ে দূরের অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে শিউলি। ফ্যালফ্যাল করে শিউলির চলে যাওয়া দেখতে থাকে সুকুমার। আর বহুদিন আগে পড়া কবি মণীশ ঘটকের লেখা
"কুড়ানি" কবিতার লাইনগুলো ডানা ঝাপটাতে থাকে  সুকুমারের বুকে ---  " হঠাৎ শুনিনু হাসি। / তীক্ষ্ণ সকৌতুকে কে কহিছে 'মা তোমার বুদ্ধি তো জবর/ নিজের বৌয়ের লাইগা কে বিসরায় বর'। "


 কাঞ্জিবরণ
           ডাঃ সঞ্জয় কুমার মল্লিক

বাম হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে হাঁটাচলা করতে খুব অসুবিধা তার সাথে ডানদিকের কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত টানটান বোধ ব্যথা নিয়ে হাজির প্রায় পঞ্চান্ন বছরের এক ভদ্রমহিলা।
        সমস্ত কেস ডিটেলস নিয়ে যখন প্রেসক্রিপশন করতে যাব তখন ভদ্রমহিলা জিগ্যেস করলেন, ডাক্তারবাবু,দূর্গা পূজাতে ভালো করে হেঁটে ঠাকুর দেখতে পারবো তো?
         আমি একটু থেমে গেলাম,বাঙালীর সেরা উৎসব দূর্গাপূজা সত্যি এ আবেগকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।তাই একটু থেমে বললাম, আশা করি আপনি আরো সুন্দর করে হাঁটতে পারবেন,আমি যতটা সম্ভব দ্রুত সুস্থ করতে পারি তার চেষ্টা করছি।
          ভদ্রমহিলা খুব আনন্দ প্রকাশ করলেন।
পাস থেকে ওনার স্বামী বলে উঠলেন,একটু ধীরে ধীরেই সুস্থ করুন না,না হলে আমার চার হাজার আবার বেরিয়ে যাবে,একে রোজগার কম তার ওপর এ এক সমস্যা।
             আমি বললাম, এমন বলছেন কেন?
            -শুনুন আমাকে ও বলে রেখেছে, ঠাকুর দেখতে বেরোলে চারহাজার টাকার কাঞ্জিবরণ শাড়ি চাই।কোথায় পাই বলুন তো এত টাকা?
          ভদ্রমহিলা থামিয়ে বললেন, না,আমাকে ওটাই কিনে দিতে হবে।
          -এত ভারী শাড়ি পরে তুমি হাটতে পারবে না,তার চেয়ে হালকা শাড়ি কিনবে।ডাক্তারবাবু কিছু বলুন!
            আমি এতো শাড়ি বিশেষজ্ঞ নয় তবু বললাম,কাকিমা এত দামি শাড়ি কিনে কি করবেন?পূজা পেরোলেই তো আলমারিতে পড়ে থাকবে।তার চেয়ে আপনি একটি ভালো তাঁতের শাড়ি কিনুন সব জায়গায় পরে যেতে পারবেন।
            ওনার স্বামীর মুখে হাসি ফুটল, উনি বললেন, ডাক্তারবাবু যেটা বলল সেটা ভেবে দেখ তা হলে আমার উপকার হয়।
            -তুমি চুপ কর?পরে দেখা যাবে।
            এদিকে আমারও প্রেসক্রিপশন রেডি হয়েছে।প্রেসক্রিপশনটি হাতে দিয়ে বললাম।আশা করি আপনার পূজাটা মাটি হবে না।তবে দেখে হাঁটাচলা করবেন।
             হাতে প্রেসক্রিপশন নিয়ে দুজনেই হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন।
             দোষ -গুন কারো খুঁজে পেলাম না, তবে এটা বুঝতে পারলাম,এত দামি শাড়ি কিনলে এক জনের পকেট ও মনে কষ্ট হবে আর না কিনলে আর একজনের মনে কষ্ট হবে।মাঝামাঝি হলে দুজনেরই কষ্ট কিছুটা কম হবে।
              এটা আমিও বুঝি মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের
বাড়ীর পূজাটা এভাবেই শেষ হয়।আমাদেরও এমন দিন গেছে নতুন পোশাক তো দূরের কথা,পূজা দেখতে বেরোনোর হাত খরচটুকু জোগাড় করতেই খুব কষ্ট হত।তবু মনে কষ্ট হত না,কারন বাস্তবতা চোখের সামনে দেখতে পেতাম।তবু দূর্গাপূজার আনন্দ মানুষের অনেক কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়।যে যেমন করে পারে চারটা দিন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে থাকে।



নিষ্পাপ
রাণা চ্যাটার্জী




"আরে, ঈশিতা,তুমি চুপ করবে,এবার না হয় দান ধ্যান করা একটু ছাড়ো । তোমার প্রশ্রয়ে দিন কে দিন কাজের মেয়ে গুলো কিন্তু মাত্রা ছাড়াচ্ছে।"কথা গুলো গজ গজ করে রণিত বলার মাঝেই তেলে বেগুনে জ্বলে "আঃ, এতো চেঁচাচ্ছ কেন বলোতো,রাত কটা বাজে ,সে খেয়াল আছে তোমার" বলে ,তিতলির পিঠ চাপড়ে  ঈশিতা ঘুম পাড়াতে লাগলো।



রনিত তখনও একনাগাড়ে রাগের তুবড়ি ,চরকি পোড়াতেই ব্যস্ত।একবার শুরু করলে নিজেকে সহজে থামাতে পারে না জেনেও, আবার জের টেনে ,"না ঈশিতা এত আস্কারা ওদের দিও না ,জানবে ওরা কাজের মেয়ে। এই তো কিছুদিন আগে পুজোর বোনাস দিলে । আবার কি না বাজি কেনার জন্য টাকা দিতে বলছো!আমি ভেবে পাই না কি আশ্চর্য্য মানসিকতা ওদের! জানে বৌদি নরম মনের,হাত পাতলেই,ঠিক জুটিয়ে যাবে। "



"এই ওপাশ ফিরে তুমি ঘুমাও তো যাও, আমি বুঝে নেব "! "কি সেই তুমি দেবে বলছো" রনিতের উৎকণ্ঠা গুগলি শচীন স্টাইলে দুর্দান্ত সামলে আর সাড়া দিলো না ঈশিতা। আগে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে ঠিক এভাবে লঙ্কাকান্ড করতো রণিত।ইদানিং যেন আরো বেশি খিট খিটে হয়ে গেছে!

তিতলির চার  বছর বয়স টা পার হতেই ,যখন সে অন্তত নিজের হাতে খেতে শিখেছে,ঈশিতা আবার বইয়ের ধুলো ঝেড়ে একটু একটু করে  নিজেকে প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার জন্য তৈরি করেছে। সংসারের মধ্যে থেকে আসল সত্যটি সে বুঝে গেছে,মেয়েদের অর্থ নৈতিক স্বাধীনতাটাই হলো আসল স্বাধীনতা। এটা খুব সত্যি যে ,টাকা রোজগার করে স্বামীর পাশে থেকে হাল ধরলে পতিদেব রা খুশিই হয়,সংসারের শ্রীও ফেরে, নিজের ও কিছু ইচ্ছে মতো কেনা কাটা,শখ আহ্লাদ মেটানো সম্ভব হয়। ঈশিতার আপ্রাণ প্রচেষ্টা ওকে সাফল্যের মুখ দেখিয়ে ছিল দু বছরের মধ্যে বলেই সে স্কুল শিক্ষিকা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ।পাড়া প্রতিবেশী এমনকি আপন কিছু আত্মীয়স্বজনের আচার আচরণও সে পাল্টে যেতে দেখেছে কিন্তু রণিত সেই একই তালে বইছে। 

খুব আক্ষেপ হয় মাঝে মাঝে ঈশিতার ।নিজের মেয়ের জন্য এতো প্যাকেট প্যাকেট ফটকা,ফুল ঝরি,রংমশাল কিনে আনতে পারলো রণিত আর কাজের দিদির ওই টুকু বাচ্ছা মুন্নির জন্য কিছু দিতে গেলেই দাঁত নখ বের করলো ওই ভাবে!  বাচ্ছাটার কত আর বয়স,আমাদের তিতলির ই সমবয়সী ,কি সুন্দর দুটো বাচ্ছা এক সাথে খেলে যখন ওর মা ওকে সঙ্গে আনে। আর কিনা ওই টুকু বাচ্ছা কে খানিক মোমবাতি,আতশবাজি কেনার পয়সা, দেবে  তা নয়,চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে।

এই সব চিন্তায় ভীষণ মাথা ধরা নিয়ে কাল দেরিতে শুতে গেছিলো সে।যখন ঘুম ভাঙলো,ওরে বাপরে একদম ঘড়িতে পৌনে নটা। কানে এলো রনিতের গলা,তিতলি কে ডাকছে কেন ওভাবে! তবে কি তিতলি কোথাও গেল!এই সব প্রশ্নের ভিড় ঈশিতাকে দৌড়ে ছুট কাটালো।

"কি করছিস রে তিতলি,কৈ রে,গেলি কোথায়,তিতলি "হাঁকতে হাঁকতে রণিত দেখে তিতলি বারান্দার এক কোণে চুপটি করে বসে।"একি রে , তুই এখানে আর আমি হেঁকে ডেকে  হয়রান "। বাবার গলা শুনে কেমন একটা ভয়,আড়ষ্টতা জড়ানো সাত বছরের তিতলি প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম । যেন সে কিছু অন্যায় করতে গিয়ে বাবার কাছে ধরা পড়ে গেছে !পেছনে দৌড়ে  ততক্ষনে," কি হলো মা,কই দেখি তোমার হাতে ওটা কি সোনা" বলে ঈশিতা দেখলো ছোট্ট হাতে আঁকড়ে ধরা একটা ছোট্ট প্লাস্টিক ধরে তিতলি চোখে মুখে, চরম উৎকণ্ঠায় ।তার নরম গাল বেয়ে , হড়হড় করে চোখ দিয়ে জল ঝরছে  দেখে,রণিত মেয়েকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিলো। আলতো করে প্লাস্টিকটা খুলে ঈশিতা,রণিত দুজনেই দেখলো,তিতলি ওর আতশবাজি,
রংমশাল থেকে, দুটো দুটো করে সরিয়ে রেখেছে ।আর ভেতরে একটা ছোট কাগজে,পেন্সিল দিয়ে অপটু হাতে লিখেছে,"মুন্নি, শুভ দীপাবলি,সাবধানে আতশবাজি পুড়িও কেমন "।খানিক মুখ চাওয়া চাওয়ি করে রণিত চুপ হয়ে গেল।



দুগ্গা

যুথিকা সাহা 


এ এক অন্য দুগ্গা ---গাঁয়ের ওই যে পুকুর পাড়ের ধারে চালাঘর ,ওইখানে দুগ্গা থাকে ।ও তোমাদের মাটির প্রিতিমে দশভূজা দুগ্গা নয় গো ,ও হল গে রক্ত মাংসের দুগ্গা ,তবে হ্যাঁ দশভূজাই দুগ্গা বটে ।এ দুগ্গার কোন সজ্জিত মন্ডপ নাই ,নাই কোন আলোর রোশনাই ,আবাহন ও নাই ঘটা করে বিসসর্জন ও হয় না ।,এই দুগ্গাদের বোধনের আগেই বিসর্জন হয়ে যায়। কথা কয় হেঁটে চলে বেড়ায় চালচুলোহীন দুগ্গা ,পাঁচবাড়ি ঘুরে ঘুরে কাজ করে বেড়ায় ,ভোর হলেই নিজের ঘরের কাজকম্ম সেরে ছোটে  সে বাবুদের বাড়ির কাজ করতে ।গাঁ থেকে অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয় বাবুদের বাড়ি----/মল্লিক বাড়ি ,চৌধুরী বাড়ি ,রায় বাড়ি এই সব বাড়িতেই তার কাজ ।কোন বাড়ির বাসন মাজা,কাপড় কাঁচাআবার কোন বাড়ির বাচ্চাদের সময় মত টিফিন তৈরী করা,আবার হুকুম হলে বাবুদের গরম গরম ফুলকো লুচি ভেজে দেওয়া ,যেন দুহাতে দশহাত কাজ করে ।কত কাজ তার ,তার কি আর দু দন্ড সময় আছে বসবার গা !! কোন বাড়ি থেকে খাওয়া জোটে আবার জোটেও না ।তবে হাঁক পরে যায় ----এই দুগ্গা এই দুগ্গি কোথায় গেলিরে ??এটা করতো ,এটা দে হাতের কাছে ,ওটা আন ,একটু বাজার থেকে ধনে পাতা নিয়ে আয় রে এখুনি লাগবে ,কেউ বলে বড় বাবুর জুতো পালিশ করেছিস তো ?বাবুর তাড়া আছে  এখুনি বেরোবে ।এই সব সেরে সে ঢোকে মল্লিক বাড়ি ,সেখানে গিয়ে যেন একটু শরীর জুড়ায় ,কারন দুগ্গাকে মল্লিক গিন্নী একটু সুনজরেই দেখেন ,ভালোবেসে কথা কন -----এই সব কথা কইছিল পাঁড়ার ওই বিন্তি পিসি ।পুকুর ঘাটেই তো যত কথা বলা কওয়া।বিন্তি পিসির আবার তার ওপর একটু মায়া আছে ।বলে কি কপাল দেখ !!বে হোতে না হতেই স্বোয়ামী দিলে খেদিয়ে ,বাপ পনের টাকা দিতে পারেনি কিনা তাই ।শ্বশুরবাড়ির লাঞ্ছনা গঞ্জনা ভোগ করে তাদের সংসারে খেঁটে ,শরীর শেষ করিয়ে ছাড়লে মাগো !বাপের ঘরে এলো একেবারে হাড় জিরজিরে হয়ে ।মা তো কবেই মরেছে ,বাপ আবার দ্বিতীয় পক্ষ ঘরে তুলেছেন ।তার আবার তিনখানা ছেলেপুলে ,অভাবের সংসার ,তাই এখন দুগ্গাকেই পয়সা রোজগার করতে হয় কারন বাপ তো আর দ্বিতীয় পক্ষের ওপর কথা কইতে পারে না ,বলে অত বড় ধিঙ্গি মেয়ে ঘরে বসিয়ে এমনি এমনি গেলাবো ,পয়সা আনুক ঘরে তবেই এ সংসারে ঠাঁই ।অগত্যাই তো এই কাজ করে ।স্বামীর সোহাগ সুখ তার কপালে জুটলো কোথায় ??তবে হ্যাঁ বিন্তি পিসি আদর করে ডাকতো শালুক বলে ,দুগ্গা কে ডেকে গালে আদর করে বলতো ,ওরে মেয়ে তুই হলি ওই পুকুরের শালুক ফুল ,ওইখানে তোর শোভা রে মা ,কিন্ত হায় কপালের কি লেখন !!
বাবুদের বাড়ি কাজ করে ঠিকই কিন্ত কেউ একটা ভালো কাপড় ও দেয়না,তবে হ্যাঁ মল্লিক গিন্নী একখানা দেন ভালো ছাপা  শাড়ি ,এবারে কি দেবেন কে জানে ?কাজ করতে ঢুকল মল্লিক বাড়িতে গিন্নী মা বললেন ,হ্যাঁ রে দুগ্গা আজ এত দেরী কেন রে ?বলল ও বাড়ির কাজ ছিল অনেক মা ,পুজো আসছে সব ঝাড়পোছ করলো তো তাই দেরী ....তা ওরা তোকে পুজোয় কাপড় দেবে গিন্নীমা শুধোলেন,দুগ্গায়বললো না মা ওরা তো কাপড় দেয় না আর আমিও চাইনে ।ঠিক আছে আজ এখানে দুটো খেয় নিস ,ও বেলা আবার আমার মাসি আসবে ,ভাবছি এবারে কিছু নাড়ু  মোয়ার পাঁক দেবো ।আচ্ছা মা বলে দুগ্গা কাজ করতে লাগল 
পরদিন কাজে আসলে মল্লিক গিন্নী বললো এই নে এই লাল পাড় শাড়িটা পুজোতে পরিস কেমন ,আলতা আর একখানা সিঁন্দুরের থান দিল তার সাথে ১০টাকা ।বলল মা এবার এক্কেবারে এতো দামী শাড়ি !!আর বলিস কেন তোর দাদাবাবুর চাকরীর উন্নতি হয়েছে তাই তোকে একখানা আর ওই চন্ডীমন্ডপের দুর্গার জন্য রেখেছি ।ওমা সেকি !!ওই দশহাত ঠাকুরের শাড়ি আমাকে দিলে !!তাতে কি,এটা তোর বড়দাদাবাবুর হুকুম ,সে বলে মানুষ দুগ্গা আর মাটির দুগ্গার মধ্যে কোন তফাৎ নেই বুঝলি ,পাগল ছেলে আমার ।আসবে পুজোতে দেখিস ।ও বাবা উনি তো দেবতা মানুষ গো !!তা যা বলেছিস ও কারো কষ্ট দুঃখু দেখতে পারেনা ,অনেক নেকাপড়া শিখেচে কিনা তাই ,বাড়ি এলেই তো সব মোটা মোটা বইয়ের মধ্যেই মুখ গুঁজে বসে থাকে ।দুগ্গার খুব আনন্দ হল ।পুজো হবে  গ্ৰামে খুব ধূম চন্ডীমন্ডপে ঢাক বাজছে ,মাইকে মন্ত্রপাঠ শোনা যাচ্ছে ,আজ মহালয়া কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে ---
যা দেবী স্বর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা 
নমস্তসে নমস্তসে নমস্তসে নমো নমঃ।।

এবার দুগ্গার খুব ইচ্ছে সে চন্ডীমন্ডপে সিঁদুর খেলতে যাবে ।পুজোর দিন এসে গেল যথারীতি দশমীর দিনে নতুন শাড়ি পড়ে আঁচলের খুটে দুগ্গার বিঁয়ের সময় যে কৌটোটার সিঁদুরে  সিঁথি রাঙিয়েছিল সেটাকেই বেঁধে নিল ।সে বিন্তি পিসির কাছে শুনেছিল দশমীর দিনে ঠাকুরকে সিঁদুর পরিয়ে এঁয়োতি মেয়েদের সাথে সিঁদুর খেললে স্বামীর সোহাগ ফিরে আসে ,আর শাঁখায় প্রনাম করলে স্বামীর দীর্ঘায়ু হয় ।স্বামী তাকে যে  খেদিয়েছে ,তার চেয়েও দেখেনি অথচ তার মঙ্গলকামনা ভাবা যায় !!! আমাদের দেশ হল গে সীতা-সাবিত্রীর দেশ হাজার ঝাঁটা লাথি মারলেও তারা সংসার আগলে রাখতে সব সইতে পারে ।অনেক আশা নিয়ে গেল সে চন্ডীমন্ডপের উদ্দেশ্যে ,সেখানে তো সিঁদুর খেলার হাট বসেছে ।মাকে প্রনাম করে সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে মা দুর্গাকে দেখছিল ।তারপর এগিয়ে গেল মায়ের কাছে ,কিন্ত সবাই বলতে লাগল ,ওই ওরে ছুঁসনে ,ও কুলোটা স্বামী খেদানো বাপে তাড়ানো মেয়ে মানুষ ,দেখগে চরিত্রের ঠিক আছে কিনা !! চিনিসনা ওই যে ও পাড়াতে কাজ করে আরে ওইয়যে গো মল্লিক বাড়িয়,সে গিন্নী নাকি তাকে খুব সোহাগ করে নাকি শুনেছি ----কে জানে বাপু তার এত দরদ কেনো কিছু ব্যাপার আছে নাকি !!ছোট জাতের মেয়ে শখ দেখ ঢ‍্যেঁমনীর এসেছে সিঁদুর খেলতে ! দুগ্গার শরীরে কথাগুলো যেন কাঁটার মত বিঁধছিল ,সরে গিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো খাকিকক্ষন ,চোখ দুটো ছলছল করছে জলে ,প্রণাম করে আঁচল থেকে সিঁদুরের কৌটোটা মন্ডপের কোনে রেখে দিল আর মাটিতে যে সিঁদুর পড়েছিল তা হাতে নিয়ে সিঁথিতে বুলিয়ে নিল।এই হল গে তাই সিঁদুর খেলা ------তবুও সে কি যেন মনে মনে বিড়বিড় করে বলছিল মায়ের উদ্দেশ্যে তাকিয়ে ,বোধহয় স্বামীর জন্য প্রার্থনা করছিল,আঁচলখানা কোমরে গুঁজে চলে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকাতেই যেন তার মনে হল ,মা যেন বলছে ,"তোর দেওয়া সিঁদুর নিলাম রে '"-----নিলাম দুগ্গা!!
দুগ্গা যেন নতুন জীবন পেল ,খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে  দুহাত মেলে চিৎকার করে বলতে লাগল ----আমি নষ্ট মেয়ে মানুষ নই গো মা ,আমি কুলোটা নই ,আমিও এঁয়োতি মেয়েমানুষ ,শাঁখা ,সিঁদুরকে শরীরে পরে সংসারের সক্কলের মঙ্গলকামনা করি গো .......কাঁদছে আর বলে চলেছে ।
শুভবিজয়ার সিঁদুর খেলায় দুগ্গা কি হেরে গেল না পরজন্মের জন্য তোলা থাকল তার ওই সিঁদুর --------
আমাদের গ্ৰামে গঞ্জে এমন অনেক দুগ্গা আছে ,যারা সত্যিই দুহাতের মানুষ অথচ দশহাতের কাজ করে দশভূজার মতই অথচ তাদের কাজের দাম আমাদের সমাজের মানুষ দেয় না ।বিন্তি পিসির কথা বলি ----তিনি কিছু দিতে পারুক আর না পারুক আদর করে আদর করে ভালোবেসে নামটা দিয়েছিল শালুক ,গাল ধরে আদর করে বলত তুই যে ওই পুকুরের ফোটা শালুক ফুলের মত কোমল সত্যি শালুকের মতই  সুন্দর হয়ে ফুটেছিস ।আমাদের গ্ৰামে এরকম তো কত শালুক ফোটে আবার অকালেই ঝরে যায় ,কেউ তার খোঁজ রাখেনা ,তারা অচ্ছুত হয়ে বেঁচে থাকে সকলের কথা মনে করে ।তারা বেঁচে থাকে চিরদিন ,তা না হলে আমাদের দেশের পুরুষ স্বোয়ামীদের জন্যে প্রার্থনা হবে না,কে করবে শুনি ?তার জন্য মঙ্গল  কামনা করে যাবে যুগযুগ ধরে  ,যতই লাঞ্ছনা গঞ্জনা থাক তা বুকে চেপেই মাকে আহ্বান জানাবে , শুভকামনা করবে সংসারের জন্য আর বলবে -----ওমা দুর্গা তুমি আসছে বছর আবার এসো গো মা আমাদের এই ধরনীতে ।




মধ্যবিত্ত 
       সুশান্ত পাল 

সবে অনার্স শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে শীর্ষেন্দু | বেশ গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে সে, বন্ধু বান্ধব নেই বললেই চলে |মেধাবী কিন্তু একটু একগুঁয়ে | কলেজের দেয়াল পত্রিকায় প্রতিবার প্রথম হয়েছে সে | আজ থেকে কলেজ শেষ ভীষণ মন খারাপ হয় তার |একটা সিগারেট কিনে ফুটপাত দিয়ে হাটতে  হাঁটতে স্টেশনে যায় সে |কয়েকটা ট্রেন কানফাটা শব্দ করে বেরিয়ে গেল একটাতেও উঠতে ইচ্ছে করলো না তার | কতো বিচিত্র চিন্তায় আচ্ছন্ন সে, মাথা ভোঁভোঁ করতে লাগলো শীর্ষেন্দুর | তার ক্যারিয়ার, শখ, সংসার, ইউনিভার্সিটি কোনটি সঠিক রাস্তা? কালকেই তাকে একটি  বাছাই করে সময়ের হাতে সব ছেড়ে দিতে হবে | কিন্তু তাহলে কি হবে তার গল্পের খাতার, কলেজের ম্যাগাজিনতো আর তাকে জায়গা দিবে না একটি কোনে |
কষ্ট হয় তার, গরিবের জীবন যন্ত্রনার সূত্রপাতের ভয়ংকর আভাস পায় সে  | কতো সুন্দর কবিতা লিখতে পারে সে কিন্তু কি লাভ এসবের,  কি গুরুত্ব আছে মিথ্যা কবিত্বের |

বিকেল গড়িয়ে রাত হয়, খিদে পায় প্রচন্ড | পকেটে পঁচিশ টাকা, দশ টাকা সে খেতেই পারে আজ | ভোলার দোকানে দুটি পরোটা আর অনেকটা তরকারি বার বার চেয়ে বেশ ভালোই পেট ভরে তার | এখন বেশ ঝর ঝরে লাগছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত এখনো বাকি |এবার নয় টার ট্রেনটায় উঠে জানালার পাশে বসে সবে ভাবতে শুরু করবে তখনি উল্টো দিকের একজন বলে উঠলো 'এত চিন্তিত কেন বাপু? 'শীর্ষেন্দু মাথা তুললো, তার পর যা বললো তার সারমর্ম এই যে সে কলেজ শেষ করে পরিবারের পাশে থাকবে নাকি তার ভবিষ্যতের  স্বপ্নের উজানে পারি দিবে? তার ইচ্ছে অনেক, তবে সব রাস্তা খোলা হলেও যাওয়া নিষেধ |উল্টো দিকের লোকটি বেশ কিছুক্ষন ভাবলেন তারপর একটু গলা খাকরে বললেন 'বেশ অলংকার তোমার কথায়, ভাষাও বেশ পরিপাটি, সাহিত্য চৰ্চা হয় নাকি?' এই শুনে শীর্ষেন্দু প্রায় কাঁদো কাঁদো, বলে উঠলো ওতেই তো অনেকটা সময় নস্ট করেছি যদি না করতাম অতো কষ্ট থাকতো না |লোকটি সহানুভূতির সুরে বললো আমি একটা ছোটো খাটো পত্রিকার সম্পাদক তুমি চাইলে কিছু রোজগার করতে পারো |
শীর্ষেন্দু আনন্দে, আবেগে কেঁদে ফেলল |অন্ধকারেও তার মুখটা চিক চিক করে জলে উঠলো |ট্রেনটা তখন কোনো এক ছোটো স্টেশনে দাঁড়িয়ে, বাইরে হকারদের  চিৎকার |লোকটি সত্যি তাকে বাঁচিয়ে দিলো, ভালোই হয়েছে দেরি করে বাড়ি ফিরলেও একটা কাজে লাগলো দিনটা |কতো মধুর চিন্তা করতে লাগলো সে |হটাৎ লোকটি একটি কার্ড দিয়ে বললো 'তোমার কিছু লেখা থাকলে দিতে পারো, সঙ্গে নিয়ে যাবো, আর তোমার ঠিকানাটাও একটু লিখে দাও' |সানন্দে শীর্ষেন্দু তার ডাইরির পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিতে লাগলো |খাতাটা প্রায় ছেড়া শেষ তখন একজন এসে বললো বাবু এসব ছিঁড়ে কাকে দিচ্ছেন |শীর্ষেন্দু পাগলের মতো লোকটাকে খুঁজতে থাকে |সারা কামরা জুড়ে তার ছেড়া পাতা গুলো তাল পাকিয়ে উড়ছে |কি ভয়ানক তবে কি শীর্ষেন্দু পাগল হয়ে গেলো নাকি |
এরপর রাস্তায় রোজ দেখা যায় তাকে |বদ্ধ উন্মাদ সে সারাদিন শুধু প্রলাপ বকে আর নাম না জানা সেই লোককে খোঁজে | বির বির করে কবিতা বলে, ইটের গুঁড়ো দিয়ে ছবি আঁকে |বসন্ত গিয়ে গরম পরে,  কতো কবিতা, কতো গান, কতো থিয়েটার সব মূল্যহীন তার কাছে |হায়রে কবি মন একটা ধাক্কা না সামলে কবি হওয়ার চেষ্টা যে বড়োই কষ্টের |তার মধ্যে তুই মধ্যবিত্ত, তোর আসা গুলো ছোটো থেকে গুটিয়ে রাখাই অনেক শ্রেয় |তবে স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই কিন্তু স্বপ্নের অতল মায়াতে নিজেকে সামলে নিয়ে এগোনোর নাম মধ্যবিত্ত |
একবছর পর স্টেশনের সেই ভোলার দোকানে মাসিক পত্রিকার একটা কবিতা এক ভদ্রলোক বেশ মন দিয়ে পড়ছিলেন |বেশ তারিফও করলেন "লেখার এলেম আছে বলতে হবে "|বলেই কবির নামটা জোরেই বললেন শীর্ষেন্দু মল্লিক |পাগলটি তখন অদূরেই, কুকুরের সঙ্গে রুটি ভাগা ভাগি নিয়ে ব্যাস্ত |
ঘুম ভেঙে গেলো শীর্ষেন্দুর, সে এখনো বসে আছে প্লাটফর্ম এ তবে শেষ ট্রেনটা এখনো মিস হয় নি |ভাগ্গিস সে স্বপ্ন দেখছিলো মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়ে ডাইরিটা চলন্ত ট্রেন থেকে ছুড়ে মারলো |


ধারাবাহিক  উপন্যাস 

অপরাজিতা
দেবব্রত সেন


পরবর্তী অংশ

খানিক পরে কিছুটা সুস্থ হল মালতি। সে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছে!  বলবে হয়তো, পুজার কাকুদের কথা। বলবে,  ওদের বলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।        বরঞ্চ ওরাই আবার দুইভাই মিলে উল্টে বাড়ি ভিটে টুকু নিয়ে চক্রান্ত করছে! শেষ সম্বল বাড়িভিটের অবশিষ্ট টুকুর ভাগ চেয়ে ফোন করেছিল গত কয়েকদিন আগে! এই কথা গুলোই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর এতেই বোধহয় মালতির গা জড়িয়ে এসে হার্ট এটাকের রুপ নিল। পুজার বুজতে অসুবিধে হল না।
পুজা বলল,দাঁড়াও মা!" যা বলার পরে বলো। আগে আরেকটু বিশ্রাম নাও তো ", । মালতি মুখ চেয়ে রইল পুজার দিকে! কিছু বলা হল না তার।
পুজার অশ্রু জল অবস্থা। এই সময় সে রুবিনাকে বলল,  "কাকিমা তুমি একটু মা'য়ের পাশে বসো তো? হাতপাখাটা নিয়ে বাতাস করো  , পরে মায়ের কথা শুনব, এখন একটু বিশ্রাম নিক মা। কাকুর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।
রুবিনা শাড়ির আচঁলে মাথায় একটা ঘোমটা দিল, ঠিক  পুর্ববঙীয় কায়দায়। তারপর বলল, ঠিক আছে মা!  তুমি  যাও,  কাকুর সঙ্গে কি  বলার আছে বলো। আমি এদিক সামলাচ্ছি।মা'য়ের কথা চিন্তা করো না! ঠিক হয়ে যাবে।উপরে  আল্লাহ আছেন, তিনি সব দেখতে পাচ্ছেন।
পুজা সুলেমানের কাছে গিয়ে বসল।এমন ভাব যেন বুঝে উঠতে পারছে না, কি যে বলবে। সে ভাবছে, কি যে বলি! বলা শুরু করল পূজা, "হাতে গোনা দিনকয়েক আগে বড়কাকু ফোন করেছিল,  বলেছে ওনার নাকি ছেলের স্কুলের এডমিশনের জন্য টাকা কম পড়েছে।তাই বাড়ি ভিটের তার ভাগের কিছু টাকা চেয়ে পাঠিয়েছেন!  বলোতো কাকু, মা এমনিতেই কত কষ্ট করে সংসারটা আগলাচ্ছেন! কেউ সাহায্য করছেন না। তার উপর কাকুদের এই কথা গুলো মা 'য়ের মনে আঘাত লাগার মতো।
সুলেমান বলল, ও হ্যাঁ !! তোর কাকা দুইটার সম্পত্তি এখন মেলা রে মা! কিন্তু  ওদের বউডি মানুষ না, এক্কেরে বাজে স্বভাবের । ওদের বউডির বুদ্ধুর কারনে ওরাও আজ বজ্জাতে পরিনত হয়েছে।  ওনারা যখন এই তোমাগো বাড়িতে  নতুন বউ হইয়া আইল,  তখন সব ঠিকঠাক! পরে যখন তোর বাপটা মারা গেল, সেই থেইকা  খাওয়া পড়া নিয়া এই তো আলাদা, তারা ভাগের জমিজমা বেইচা(বিক্রি) দিয়া পালাল। কারণ কি, ওই তোদের ভরনপোষনের ভয়ে। তোমরাই ওদের কাছে বোঝা হইসস। এদিকে তোমার মা' টা তোমাদের নিয়া খুব অসহায়।আজো লড়াই করে চলছে। একটু হাই তুলল সুলেমান। আহাঃ! হাঃ।   আর কি।।
এর পর কি যে হল সুলেমানের, মনে হচ্ছে খুব চটেছেন।  গাল থেকে হাত সড়াল সুলেমান , পাটির নেতারা যেমন হাত নাড়িয়ে নানান ভঙিতে ভাষণ মারে! ঠিক সে কায়দায় উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল! হুম,  শালারডিও খায়দায় আর কাজ পায়না । দেখতেই পাচ্ছে, একজন অসহায় মহিলা ছাওয়া পুলা নিয়া জীবনযাপন করতাছে! তার উপর ওই শালারডির বাড়িটার উপর নজর!  একদম বলছি ওরা খালি আহুক, তারপর দেখছি। ভালার ভালা, না হইলে কাঠারি কলার কান্ড  বাধাইয়া দিমু।
এই মুহূর্তে সুলেমানের  আরেরকটা জিনিস মাথায় এলো। সে ভাবছে এটাও তো ঠিক!  পৌত্রীক সম্পত্তির অধিকার, সে তো পাবেই । সুতরাং তার চিৎকার মেরেও কোনো লাভ নেই। অন্য দিকে,  ভেসে যাওয়া অসহায় মহিলার সংসার! সুলেমানের মনে উভয় দ্বন্দ্ব??  তবে হ্যাঁ সুলেমান যদি পুজার কাকুদের বলে তো বোধহয় ফেলতে পারবে না ।
সুলেমানের একটা আজ বড় মনে পড়ছে।  সেদিন  তাকে দাড়িয়ে থেকে তার মাসিদের সম্পত্তি ভাগের মধ্যমনির ভুকিমা পালন করতে হয়েছে । তাই সুলেমান মনে মনে বলছে,  সে কথা আজও ভুলছি না । মেসো মশাই গত হয়েছে প্রায় পনের কুড়ি বছর আগে। , দুইভাই আলাদা থাকে! তাই তারা মায়ের জীবিত থাকাকালীনে সম্পত্তি ভাগা ভাগি করে নিতে চায়! এ জন্যই ডেকেছে মাসিমা।
একভাই আমেরিকা, আরেকভাই কোলকাতায় মা'কে নিয়ে!  কোলকাতায় তার মাসির বাড়িতে একদিন দুজনের তাদের পৌত্রীক বাাড়িটা আর কিছু জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব। উকিল ড.সুধাকর বাবুও সেদিন আমাকে বলল, বুঝলি সুলেমান ওরা ভাইয়েরা যখন সম্পতির ভাগ চাইছে। সে কিন্তু পাবেই,আর আইনত পাবার যোগ্য। তোর আমার এতে কিছু নেই। যেহেতু বাপের  সম্পত্তি সেহেতু সমান দুভাগ হবে। আর বড় ভাই এমনিতেই যদি খুশি করে কিছু দেয় ব্যাস তবে সমস্যার আর কিছুই নেই।
এদিকে পুজার মা মালতি সব শুনছে, পুজা না বললে হয়তো সে এই কথা গুলোই শোনাতো সুলেমানকে! সে মনে মনে ভাবছে, পুজার বাপ নাই ঠিকই সুলেমান সেই সাহায্যকারীর ভুমিকা পালন করছে! আজ অবধি হয়তো নিজ জাতের কেউ এরকম সাহায্য করেছে বলে তার মনে পড়ছে না।সে মনে মনে বলছে, সুলেমান আমাদের সংসারের বিষয়ে অনেক ভেবেছে, আজও ভেবে যা করার দরকার তাই করছে। হে প্রভু তুই ওর মঙল করিস, মঙল করিস।

ভগবানটা এমন যে ওকে একটা ছাওয়াপুলা দিলে কেমন হত?আজকে সারা বাড়িময় বাবা বাবা ডাকটায় বাড়িটা ভরে যেত।সবই বিধির বিধান, আমি বলে কি হবে।

হঠাৎ কেন জানি মাটিতে বসে পড়ল সুলেমান,  দুচোখ ভরা জল গড়িয়ে পড়ছে তার। যেন তার কপালে দুঃখ লেখেছে বিধাতা। আসলে আমার জীবনে এরকম একটা মেয়ে থাকত আজ। চোখ দিয়ে অঝোর ঝরা জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে! মনে হচ্ছে যেন কিছু  একটা পাওয়ার আনন্দে অশ্রু ঝরা নদী ফুঁসে উঠছে। আসলেই সে পূজাকে মেয়ে বলে মনে জায়গা করেছে। তাই সে ডাকছে  মা, মা করে।
কাকে মা ডাকছে, পুজা বুঝে উঠতে পারল না প্রথমে। কিন্তু তার দিকেই চোখ ফিরে ডাকছে যে, তাই পুজা একটু এগিয়ে গেল সুলেমানের দিকে। সুলেমান বলল, তোকেই(পুজাকে)  আমি আমার মেয়ে মনে করছি। 

এই পুজা মা, শোননা মা শোন।  একটা কতা কই, আমি যদি মারা যাই!  কবরের মধ্যে বছরে একবার হইলেও জামাইরে লইয়া আইবি কও! কওনে কও। আইস্যা একটু হইলেও নামাজ পড়বে যাতে আমার আত্মার শান্তি পায়। কও করবে তো?এই করে পুজার পা ধরে গড়াগড়ি করছে সুলেমান।

.....পুজা বলল, পাগল হয়ে গেলে নাকি কাকু ? কি করছ এসব? পা ছাড়ো। তুমি না আমার গুরুজন? আমি তো তোমার মেয়েই। বাবা নেই, কাকুরাও আমাদের দেখাশোনার ভয়ে পালিয়েছে!কে দেখেছ?  তুমিই তো দেখেছ, তাই না।
--- সুলেমান বলল,  বলছ! তুমি আমার মেয়ে?  ঠিক। ঠিক তো। 

---- হুম কাকু! হুম একদম ঠিক। বলো আর কাঁদবে না?চোখের জল মুছো।এই বলে, পুজা একটা গামছা টেনে সুলেমানের চোখের জল মুছে দিল। এই মুহূর্তে পুজাকে    দেখে মনে হচ্ছে , সে যেন তার এক সন্তানের চোখের জল মুছে শান্ত করল।

--- সুলেমান কাঁদতে কাঁদতে হাসছে! হা - হা - হা। আর রুবিনাকে ডেকে বলছে। দেখিছো রুবিনা, দেখিছো! আমার মেয়ে আমাকে শাসন করছে।
রুবিনার চোখে জল এলো। বলল, হ দেখতে পাইসি। দেখতে পাইছি। এই বলে মুখে শাড়ির আঁচল কামড় বসিয়ে চলে গেল সোজা ঘরে।
সুলেমান বলল, হ মা! হ' আমি ত'গোর লেইগা আল্লার নিকট দোয়া কবুল করুম! আসিস কিন্তু। আমার তো মেয়া টেয়া নাই, তুইই আমার মেয়া! তুইই আমার মা।
হুম কাকু আসব! তুমি আশির্বাদ করো যেন বড়ো হই, সুখের সাথে ঘর -সংসার করি!
হ 'মা তাই হইব!! এই বলে সুলেমানও ঘরে প্রবেশ করল।
।।৬।।
মাঘ মাস! শুক্লা পঞ্চমীর  ঠিক সরস্বতী পূজোর দিন। বিয়ে হয়ে গেল পূজার, তাও একটা রহস্যের মধ্য দিয়ে! সবাই সেজে গুজে এই বিশেষ দিনটিতে  স্কুল কলেজে শাড়ি পড়ে, গায়ে হলুদ দুর্বাঘাসের রসে তেল সংমিশ্রণ মেখে যায়। অবশ্য ছেলেরাও আবার কম কিসে। এই দিনটিতে শিক্ষার্থী শিক্ষক ও শিক্ষিকা জ্ঞান গরিমা ও বাক বিদ্যা বুদ্ধির দেবী সরস্বতীকে প্রনাম করে  অঞ্জলি দেয়। মনোস্কামনা প্রার্থনা করে।
পুজার খুব আনন্দময় লাগছে।। পুজা চায় এই দিনটি জীবনে বারবার আসুক! সেও ফুরফুরে মেজাজে চলছে কলেজের দিকে।  তবে, একটা কথা! কথা হচ্ছে একবারে যদি তার ভালোবাসার জায়গাটা যদি এরকম রুপ পায়। তারপর না হয় ভাই আর মা য়ের সংসার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা যাবে।
চলবে ..................



No comments:

Post a Comment