সম্পাদকের কথা
এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা। সাক্ষী থাকছি পরিবর্তিত হতে চলা এক পৃথিবীর। বিগত কয়েকমাসে একের পর এক অঘটন তলিয়ে দিয়েছে আমাদের বিশ্বাসের ভিত। আমাদের সব অহংকার ধুলোয় মিতে গেছে আজ। নিজেদের অসহায় অবস্থায় নিজেরাই হতভম্ব হয়ে রয়েছি। হারিয়েছি স্বজন, প্রিয় নানা মানুষকে।
এবারের উৎসব তাই তাই প্রাণহীন। প্রান্তর সবুজ ধানে অপূর্ব সুন্দর সেজে উঠলেও, আকাশে মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ালেও, হিমের পরশ লাগলেও, শিউলি টুপটাপ খসে পড়া শুরু করলেও সেই আবহ নেই, নেই সেই আকুল প্রতীক্ষা।
তবু চলা। চলতে থাকা জীবনের নিয়মে। আশা একটাই- সুদিন দূরে নেই, সুদিন দেরি নেই....
মুজনাই অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪২৭
মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা-
গৌতম চক্রবর্তী, সুদীপ বসু, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, কুমকুম ঘোষ, শ্যামলী সেনগুপ্ত, সম্পা পাল, পার্থসারথি চক্রবর্তী, সজল কুমাল টিকাদার, ঝুটন দত্ত, কেয়া রায়, কাকলি ভদ্র, জয়দীপ বসু, মৌসুমী চৌধুরী, রকি মিত্র, নন্দিতা পাল, অমিতাভ সরকার, সুস্মিতা পাল কুন্ডু, মিতা বিশ্বাস বসু, অর্পিতা গুহমজুমদার, সুনন্দ মন্ডল, মনামী সরকার, নয়ন রায়, মহসিনা বেগম, নবনীতা, ঐশ্বর্য্য দাস, শিল্পাশ্রী রায়দে, মাথুর দাস, সুপ্রিয় ঘোষাল, মজনু মিয়া, চুমকি দাস, সার্বজনীন মাটি, বটু কৃষ্ণ হালদার, সংহিতা ভৌমিক, অপর্ণা ঘোষ, অনুরাগ সরকার, বাবুল মল্লিক, সায়ন ব্রক্ষ্ম, অভ্রদীপ ঘোষ, অনুস্মিতা বিশ্বাস, অর্চিসা ঘোষ
বিশেষ নিবন্ধ
জঙ্গলমহলে বুনোদের প্রেম বিরহের গল্প
গৌতম চক্রবর্তী
পশুপাখীদের
মনস্তত্ত্ব বুঝতে গেলে তাদেরকে নিয়ে রীতিমত চর্চা করা প্রয়োজন। জঙ্গলমহলের পশুদেরও
আছে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, হাসি,
গান, মান অভিমান। এসব অনুভব করতে গেলে জঙ্গলমহলে
ঘোরাফেরা করতে হবে। জানতে হবে বুনোদের জীবনযাপনের বিভিন্ন কাহিনী। বিভিন্নসময়ে
লেখালেখি এবং ভ্রমণের কারণে যতবার গরুমারা
এবং জলদাপাড়াতে এসেছি ততবার এখানকার গাইড, বনকর্মী,
জিপসি ড্রাইভার,
মাহুত, বিট অফিসারদের কাছ থেকে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছি লেখালেখির স্বার্থে। আজকে বুনোদের প্রেম বিরহ এবং
ভালোবাসার কিছু গল্পকথা নিয়েই এই লেখার অবতারণা।
জলদাপাড়া
অভয়ারণ্যের কালুর গল্প
জলদাপাড়া
অভয়ারণ্যের শালকুমার গেট লাগোয়া চত্বর থেকে মাদারিহাটমুখী গেটের দূরত্ব প্রায়
সাত কিলোমিটার। আকাশের মুখ ভার হলেই ময়ূর তার পাখনা
তুলে তাদের নৃত্যে তাক লাগিয়ে দেয় এই রাস্তাতে। কোথাও বা ময়ূর
ময়ূরী খুনসুটি করে এবং আমাদের মত বেরসিকেরা হাজির হলে তারা ডানা
ঝটপটিয়ে উড়ে যায়। ওই রাস্তাটিতে ময়ূরের আনাগোনা প্রায় সবসময় লেগেই থাকে বলে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের এই
রাস্তাটি পিকক এভেনিউ বা ময়ূর সরণি নামে পরিচিত। ওই পথ ধরেই কার
সাফারি সেরে যাচ্ছিলাম হলং বনবাংলোর
দিকে। জঙ্গল চিরে যাওয়া ওই
ময়ূর পথের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট নদী। নদীর ওপরে রয়েছে কাঠের সেতু। শুনেছিলাম সেই নদীতে
মাঝেমধ্যেই নেমে পড়ে গন্ডারেরা। গরমের সময়
ওই নদীতে গা ভিজিয়ে থাকতে দেখা যায়
গন্ডারদের। যদিও সেই বার আমরা গন্ডার দেখতে পারিনি কিন্তু কার সাফারি শেষ হবার পর হলং বনবাংলোতে বসে বিট অফিসারের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে তাঁর কাছ থেকে শুনেছিলাম গন্ডারের গ্রামবাসীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার কাহিনী। সেই কাহিনী দিয়েই শুরু করছি। জলদাপাড়ার সিধাবাড়ির বাসিন্দা বিদুর
বিশ্বাস। প্র্তিদিনের মত
সেদিনও সকালে ঘুম থেকে উঠে পুকুরের
পাড়ে গিয়ে তিনি দেখেন একটা গন্ডার জলে শুয়ে ছটফট করছে। বনদপ্তরের জলদাপাড়া পূর্ব রেঞ্জে খবর যায়।
জানা যায় দুটো পুরুষ গন্ডার এর
মধ্যে সঙ্গিনী দখলের লড়াইতে এই গন্ডারটিকে পেছন থেকে ফেড়ে দেওয়াতে গন্ডারটি ভয়ঙ্করভাবে জখম হয়েছিল। এরপরেই গন্ডারটি
আশ্রয় নিয়েছিল পুকুরে। বনকর্মীরা গন্ডারটিকে
নিয়ে গেলেও কয়েকদিন বাদে আবার সেটি চলে আসে। সেই থেকে পুকুর আর
সুপারি বাগানে আসা-যাওয়া শুরু হয়। কোনদিন ভোরে এসে
সারাদিন থেকে আবার সন্ধ্যায় চলে
যায়। আবার কখনো সন্ধ্যায় এসে ভোরে চলে যায়। অনেকদিন ধরে সেটাই ছিল গন্ডারটির রুটিন। কোন চোরাশিকারির নজর যাতে ওর ওপরে না পড়ে তার জন্য পালা
করে রাত জেগে পাহারা দিত গ্রামবাসীরা। তবে সবকিছু একদিনে
হয়নি। প্রথম দিকে সবসময় ভয় হতো কখন গন্ডারটি আক্রমণ করে বসে। স্নান করা, পুকুরে লুটোপুটি
খাওয়া ছিল গন্ডারটির প্রিয় অভ্যাস। বিদুরবাবুর সুপারি
বাগানকে গন্ডারটি শৌচালয় বানিয়ে ফেলে। তারপর থেকে ওকে কেউ আর বিরক্ত করত না। তবে সকলেই ওর প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখত। একদিন ওকে কালু নামে ডাকতে শুরু করার পর আশ্চর্য হয়ে গ্রামবাসীরা দেখে
গন্ডারটি কান খাড়া করে তাকাচ্ছে। কিছুদিন পর থেকে
সে বুঝে যায় তাকে ডাকা হচ্ছে। কালু বলে ডাকলেই
কান খাড়া করে মাথা দোলাতো। কয়েকবার ডাকার পর
পুকুর থেকে উঠে সোজা কাছাকাছি এসে
দাঁড়িয়ে থাকত। চলে যেতে বললেই পুকুরে গিয়ে লুটোপুটি
খেত। মাত্র ছয় মাসেই যে কালু তাদের কাছে এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাবে সেটা স্বপ্নেও ভাবেননি গ্রামবাসীরা। তাদের কাছ থেকে
ভালোবাসা এবং নিরাপত্তা পেয়ে কালুও যেন
আলাদা জগৎ খুঁজে পেয়েছিল। কালু যে এইভাবে তাদের বাধ্য হয়ে যাবে তা কল্পনাও করে নি
গ্রামবাসীরা। গন্ডারটি যখন দুলকিচালে জলদাপাড়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পুকুর এবং
সুপারি বাগানে আসত তখন তারা চারিদিকে সতর্ক নজর রাখত যাতে কেউ ওকে বাধা না দেয়। শৌচকর্ম সেরে
পুকুরটিতে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা সে আবার জঙ্গলে চলে যেত। সে ছিল যেন ওই গ্রামের
অতিথি। মাঝে মাঝে জলদাপাড়া বিটের বনকর্মীরা যেতেন গন্ডারটির শরীর ঠিক আছে কিনা তার খবর নিতে। আসলে বন্যপ্রাণীরা যে সবসময় ভয়ঙ্কর নয় সেটার প্রমাণ ছিল
কালুর চরিত্রে। ওদের কেউ অসুবিধা না করলে ওরা কাউকে কিছু করে না।
গরুমারায়
গন্ডারের অসম অনুপাত
গরুমারাতে
স্ত্রী এবং পুরুষ গন্ডারের অনুপাত
নিয়ে চিন্তিত বনদপ্তর। বনকর্তা উজ্জ্বল ঘোষের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেনেছিলাম পুরুষ গন্ডারের অনুপাতে স্ত্রী গন্ডারের সংখ্যা কম গরুমারাতে। জেনেছিলাম
গন্ডারের অনুপাতের নিয়ম
অনুসারে যেখানে একটি পুরুষ গন্ডার পিছু তিনটে অথবা খুব কম করে হলেও দুটো করে স্ত্রী গন্ডার প্রয়োজন সেখানে গরুমারাতে
সেই অনুপাতটি অনেকটাই কম। পরিবেশ কর্মীদের অনেকের মনেই আশঙ্কা
ছিল যে স্ত্রী গন্ডারের চাইতে পুরুষ
গন্ডারের সংখ্যা বৃদ্ধি হলে জঙ্গলে সঙ্গিনী দখলের লড়াই বাড়বে। সেক্ষেত্রে গরুমারাতে স্ত্রী গন্ডারের
সংখ্যা কম হবার ফলে সঙ্গিনী নিয়ে গরুমারার পুরুষ গন্ডারের লড়াই এর কাহিনী কারো
অজানা নয়।
সঙ্গিনী
দখলের লড়াই বেড়েই চলেছে। একশৃঙ্গ গন্ডারের জন্য পরিচিত ডুয়ার্সের গোরুমারা জাতীয় উদ্যান। গরুমারাতে বর্তমানে গন্ডারের
সংখ্যা পন্চাশ এর ওপর। জলদাপাড়ার পাশাপাশি নব্বইয়ের দশকে গরুমারা জাতীয় উদ্যানে
গন্ডারের সংখ্যা কমতে থাকার ফলে চিন্তায় পড়ে যায় বনদপ্তর। অসম থেকে দুটো পুরুষ গন্ডার এনে গন্ডারের সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টা চালানো হয়। তবে সেই চেষ্টা পুরোপুরি কাজে না আসলেও প্রাকৃতিকভাবেই
ধীরে ধীরে গন্ডারের সংখ্যা বাড়তে থাকে জলদাপাড়া এবং গরুমারার
জঙ্গলে। গরুমারার জঙ্গলে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গন্ডার গণনা করে বনদপ্তর এবং তাতেই সংখ্যাবৃদ্ধি নজরে আসে। ২০২০ সালের ১২ এবং ১৩ই ফেব্রুয়ারি গরুমারাতে গন্ডার সুমারি
হয়েছিল। এতদিন সরাসরি গরুমারাতে গন্ডার সুমারি হলেও
এই প্রথম সুমারিতে বিষ্ঠা পরীক্ষার
মাধ্যমে গন্ডার সুমারি হয়েছিল। গরুমারাতে গত মে মাসে গণ্ডার সুমারির যে রিপোর্ট
এসেছিল তাতে গরুমারাতে গন্ডারের সংখ্যা
দাঁড়িয়ে ছিল বাহান্নটি। গত ফেব্রুয়ারি মাসের পর নতুন করে তিনটি শাবকের জন্ম হয়েছে এবং তিনটে শাবকই যথেষ্ট সুস্থ এবং স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি স্ত্রী গন্ডার গর্ভবতী রয়েছে। ফলে বর্তমানে গরুমারাতে গন্ডারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে
পন্চান্নটি। নবজাতক গন্ডার শাবকদের আগমনে স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বসিত বনদপ্তর। নবজাতকসহ গরুমারার সমস্ত গন্ডারদের নিরাপত্তার জন্য চলছে
রাতদিন বিশেষ নজরদারি। গন্ডারের বাড়তি সংখ্যা নিয়ে বনদপ্তর উচ্ছ্বসিত হলেও তাদের
নিরাপত্তায় কোন খামতি রাখতে চাইছে না বনদপ্তর। নিরাপত্তার বলয় তৈরি করা হয়েছে গরুমারা জুড়ে।
গরুমারার
সঙ্গিনী দখলের লড়াই এর যোদ্ধা ঘাড়মোটা
গরুমারার
ঘাড়মোটার গল্প খুবই ট্র্যাজিক। গরুমারাতে এই অসম অনুপাতের জন্য সঙ্গিনী দখলের
লড়াইতে ঘাড়মোটাকে নিয়ে
বনদপ্তর পড়েছিল বড়ই সঙ্কটে। মাঝেমাঝেই সঙ্গিনী দখলের লড়াইতে হেরে গিয়ে গরুমারার
জঙ্গল ছেড়ে বিবাগী হয়ে যেত ঘাড়মোটা। লাটাগুড়িতে একত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক
পেরিয়ে গরুমারা ছেড়ে লাটাগুড়ির জঙ্গলে আশ্রয় নিত বিশালদেহী ঘাড়মোটা। আসলে বয়স হয়ে
যাওয়াতে আর বারেবারে প্রেমে ব্যর্থ হবার পরে প্রেস্টিজের খাতিরেই জঙ্গল ছড়তে হত
ঘাড়মোটাকে। পশু বলে ওদের কি মানসম্মান থাকতে নেই নাকি? তখন কুনকি হাতি দিয়েও ঘাড়মোটাকে তার গরুমারার আস্তানায় ফেরাতে ব্যর্থ হত বনকর্মীরা। বাধ্য হয়ে ঘাড়মোটার নিরাপত্তার জন্য লাটাগুড়ির জঙ্গলে
নিয়োগ করা হল বাড়তি বনকর্মী। ঘাড়মোটাকে গরুমারার জঙ্গলে ফেরত পাঠাতে বেশিসংখ্যক কুনকি নিয়ে ময়দানে নামা হত সেইসময়। ঘাড়মোটা
কি সহজে ধরা দিত নাকি?
বনকর্মীদের সঙ্গে যেন তার শুরু হত লুকোচুরি খেলা। কখনো ঝোপঝাড়ের পেছনে, আবার কখনো বা জঙ্গলে সে লুকিয়ে পড়ত। লাটাগুড়ির জঙ্গলে চলে এলে ঘাড়মোটাকে নিয়ে বনদপ্তরের
চিন্তা বেড়ে যেত। কারণ প্রথমত নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো নেই লাটাগুড়ির জঙ্গলে। তার ওপর লাটাগুড়ির জঙ্গল থেকে খানিকটা পথ এগোলে নেওড়া নদী
আর সেটা পেরোলেই লোকালয়। এই পথেই এর আগেও
একাধিকবার গন্ডার লোকালয়ে
বেড়িয়েছে। তাদের পুনরায় গরুমারায় ফেরাতে কালঘাম ছুটেছে বনদপ্তরের। পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ জুড়ে চোরাশিকারিদের একটা চক্র সক্রিয়
রয়েছে। চোরাকারবারীদের হাতে মৃত্যু
হয়েছে গরুমারার দুটি গন্ডারের। যাতে সেই ঘটনার
পুনরাবৃত্তি না হয় সেই উদ্দেশ্যে ঘাড়মোটাকে গরুমারায় ফেরাতে উঠে পড়ে লাগত
বনদপ্তর। বনকর্মীদের দিয়ে এবং গরুমারার দুই কুনকি হাতি রাজা এবং হিলারিকে দিয়ে
ঘাড়মোটাকে জঙ্গলে ফের ঢোকাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন বনকর্মীরা। একবার তো বেশি সংখ্যক কুনকি হাতি লাগিয়ে লাটাগুড়ির জঙ্গল থেকে তাড়িয়ে ঘাড়মোটাকে জাতীয় সড়কের
খুব কাছে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন বনকর্মীরা। তবে জাতীয় সড়ক পার করিয়ে গরুমারা ঢোকার কিছু আগেই
বনকর্মী এবং কুনকি হাতিদের নজর এড়িয়ে ফের লাটাগুড়ির জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে যায় সেটি। সন্ধ্যের পর বহু খোঁজাখুঁজি করে একঝলক দেখা মেলে গন্ডারটির। পরের দিন সকাল
থেকে ফের গন্ডারটিকে গরুমারা ফেরত আনতে আবার
উদ্যোগ নেওয়া হয়। অবশেষে সফল হয়
বনকর্মীরা এবং বনদপ্তর থেকে শুরু করে গ্রামবাসীরা সকলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তবে খুবই
দুঃখের কথা ডিসেম্বর মাসে জঙ্গলমহলের ডন টারজান
নামে এক গন্ডারের সঙ্গে লড়াইতে মৃত্যু হয় ঘাড়মোটার। তবে ত্রিকোণ প্রেমের লড়াইতে প্রতিপক্ষকে ছাড়েনি সে। সেই
যাত্রায় ওই লড়াইতে টারজানও সাংঘাতিক রকমের আহত হয়েছিল। তবে গরুমারাতে সঙ্গিনী দখলের লড়াই দিন দিন
বাড়ছে। ডিসেম্বর মাসে বোতল সিং নামে একটি গন্ডারের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তার মৃত্যুও সঙ্গিনী দখলের লড়াইয়ে হয়েছে বলে বনদপ্তরের
অনুমান। জানুয়ারি মাসে গরুমারাতে ডন নামে
আরেকটি গন্ডারও সঙ্গিনী দখলের
লড়াইতে আহত হয়। তার পেছনের পায়ে গুরুতর আঘাত
ছিল। গরুমারার জঙ্গলে ট্র্যাংকুলাইজার করে চিকিৎসা করা হয় ডনের।
লকডাউনে মহানন্দে বংশবিস্তার গন্ডারকুলের
রামসাই বাজার সংলগ্ন জলঢাকার চর। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ গরুমারা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দুটি গন্ডার চলে আসে জলঢাকার চরে। সেখানেই উদ্দাম
প্রেমে তারা মেতে ওঠে। দুই গন্ডারের
আওয়াজে আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এলাকার অনেক
বাসিন্দা রাতেই বাঁধের পাড়ে দাঁড়িয়ে রাখি পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় স্পষ্টই দুই গন্ডারের খুনসুটি দেখতে পায়। খবর যায় বনদপ্তরের রামসাই মোবাইল স্কোয়াডে। পরিস্থিতি সামাল দিতে মেদলা থেকে কুনকি হাতি শিলাবতীকে নিয়ে আসা হয়। প্রায় ঘন্টা দুয়েক ধরে সঙ্গমে মেতে ওঠে গরুমারার ওই গন্ডার যুগল। যাতে ওই দুই
গন্ডার লোকালয়ে বেরিয়ে না আসে তার জন্য
বাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে থাকেন বনকর্মীরা এবং কুনকি হাতি শিলাবতী। ঘন্টা দুয়েক পর
গরুমারার গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে গন্ডার যুগল। দীর্ঘদিন লকডাউন। লকডাউনের জন্য দীর্ঘ কয়েকমাস
ধরে বন্ধ জঙ্গলে পর্যটকদের প্রবেশ। তার মাঝেই প্রতিবারের মত জুন মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত গরুমারায়
পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ। বর্ষার সময় সমস্ত
অভয়ারণ্য বন্ধ থাকে বলে সেই সুযোগে নিজেদের বংশবিস্তারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে
চেয়েছে গন্ডারকুল।
জলদাপাড়ার
জঙ্গলমহলও এখন গন্ডারদের প্রেমকুঞ্জ। বর্ষার জঙ্গলে অফুরন্ত গন্ডারের প্রিয় ঘাস ঢাড্ডা, চেপ্টি, পুরুন্ডি, খাগড়া এবং একরা। কথায় বলে কারোর পৌষ
মাস তো কারো সর্বনাশ। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে তোর্সার নদীভাঙ্গন ভীষণভাবে কাজে লাগছে প্রতিবছর গন্ডারদের বংশবৃদ্ধিতে। প্রতিবছর এই
নদীর পাড় ভাঙ্গার পর যে পলিমাটি জমে থাকে সেখানে
গন্ডারের প্রিয় ঘাস জন্ম নিচ্ছে। নদী
ভাঙ্গনের ফলে বড় বড় গাছ ভেসে যায়। সেই সব জায়গায়
পলিমাটি জমে থাকে। ওই পলিমাটিতে প্রাকৃতিক উপায়ে
গন্ডারের প্রিয় ঘাস ঢাড্ডা, চেপ্টি, পুরুন্ডি, খাগড়া এবং একরা জন্মায়। কৃত্রিম উপায়ে ঘাসের প্ল্যান্টেশনে আর্থিক ব্যয় প্রচুর। আর এই নদী ভাঙ্গনের ফলে যে প্রাকৃতিকভাবে ঘাস হচ্ছে তাতে খরচের
ব্যাপার নেই। নদী ভাঙ্গনের ফলে যে ঘাস
জন্মায় তার সবটাই গন্ডারের উদরস্হ হয়। খাদ্যের খোঁজে গন্ডারদেরকে আর সেভাবে পরিশ্রম করতে হয় না। বংশবৃদ্ধিতে মন দিতে পারে তারা। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানে ২০১৫ সালে গন্ডার পাওয়া গিয়েছিল ২১৬ টি। ২০১৯ সালের সমীক্ষা অনুসারে
প্রায় ২৩৭টি গন্ডার রয়েছে। গন্ডারকুলের প্রেম নিবেদন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রীতিমতো তাদের
সামাল দিতে কুনকি হাতি দিয়ে পাহারা দিতে বনদপ্তর বাধ্য হয়েছে। গরুমারা এবং জলদাপাড়ার গন্ডারের এই প্রেম নিবেদনে আগামী
দিনে গরুমারাতে যে গন্ডারের সংখ্যা
বাড়বে সেই আশায় বুক বেঁধেছেন পশুপ্রেমী থেকে বনদপ্তরের কর্তারা।
স্মৃতি
আড্ডা
সুদীপ বসু
রেললাইন থেকে সূর্য নগর যাবার পথে বুড়া মন্ডলের বাড়ির সামনের কালভার্টটাই ছিল আমাদের আড্ডাস্হল। কে ছিল না সেই আড্ডায়। দীপক, অমিত,বটু,বিশ্বজিৎ,কালন,ভেটু,বা বু,বাবুন,শেখর,গৌতম,পলাশ,সৌমিত্ র আরও অনেকে।আমাদের পাড়ার ছেলেদের আবার বয়স অনুযায়ী আড্ডাস্হলও ভিন্ন ভিন্ন ছিল। যেমন দেবুদা(গাঙ্গুলী) ,স্বপনদা,ঘটুদা(কর) এরা আড্ডা মারত কলেজ হল্টে। জহরদা, কালুদা, টমদা, ভোম্বলদারা আড্ডা দিত মাধব মোড়ে। পিনি পোকনরাও মাধব মোড়েই আড্ডা মারত তবে ওদের ঠেক ছিল আলাদা তখন আমরা ছোট দিলদের বাড়ির সামনে সিনিয়াররা মানেচিরুদা, মোহিতদা, রন্জ্ঞুদা,শিবুদা ও আরও অনেকে মিলে কিছু একটা আলোচনা করছে আর হাসাহাসি করছে। বাবুয়াদা - চিরুদাদের নির্দেশে বারবার মন্ডপের পেছনের চৌমাথার দিকে কি যেন দেখছে। আমি, দিল, শোভন বড়দের জট্লার আসেপাশেই ঘুরঘুর করছিলাম ব্যপারটা জানার জন্য। কিছুক্ষন বাদে দেখলাম পাড়ার সব পিসিমা, মাসিমা,কাকিমারা বেশ সেজেগুজে পান চিবুতে চিবুতে পেছনে বৌমাদের বিরাট ফৌজ নিয়ে এই মোড়ের দিকেই আসছে। কাছে আসতেই মন্টুদা জিঞ্জেস করলেন, পিসিমা, মাসিমারা এই দুপুর বেলা কোথায় চললেন? পিসিমারা জবাব দিলেন, আর কইসনা, শিবু,চিরু, রন্জ্ঞুরা কইল অমর টকিজে ঠাকুরের বই (সিনেমা) লাগাইসে, "হরে কৃষ্ণ হরে রাম " ,তাই সবাই মিলা বই দেখতে যাইতাসি। পান চিবুতে চিবুতে পিসিমারা বই দেখতে চলে গেলেন। দাদারাও গল্পগুজব চালিয়ে যাচ্ছেন আর হাসাহাসি করছেন।ঘন্টাখানেকও হয়নি, পিসিমা মাসিমারা পেছনে বৌমাদের ফৌজ নিয়ে হনহন করে হেটে ফিরে আসছেন। পিসিমাদের ফিরতে দেখেই দাদারা এদিক ওদিক সরে পড়েছেন। একমাত্র বাবুয়াদা খবর জানার জন্য দাড়িয়ে আছে। পিসিমারা কাছে আসতেই বাবুয়াদা জিঞ্জেস করল, বই দেখলেন না?পিসিমা মাসিমারা রাগের সাথে জবাব দিলেন, হতচ্ছাড়া চিরু, মোহিত, শিবু, রন্জ্ঞূ ওরা কই গেল রে ? ঠাকুরের বই কইয়া , দম মারো দম দেখতে পাঠাইয়া দিসে। আইজ ঘরে ফিরুক, তারপর দেখামু ওদের একদিন কি আমাদের একদিন।
আমাদের ঘোতন আর শোভন তখনকার দিনের দুটি বিখ্যাত বাসের ড্রাইভার ছিল। ঘোতনের "বলাকা" শোভনের "সারথি"।ঘোতনের কোমরের সাইজের কোন হাফ প্যান্ট পাওয়া যেত না তাই বোতাম লাগানোর ফুটোর ভেতর যেটার মধ্যে বোতাম লাগান থাকত সেটা ঢুকিয়ে গিট দিয়ে দিত। ঘোতন আর শোভন মুখে খরং খর়ং করে বাসের আওয়াজ তুলে শোভনদের বাড়ির সামনে থেকে বাসের যাত্রা শুরু করত। প্রথম স্টপেজ ছিল আমাদের কালভার্ট। ঘোতন "জলপাইগুড়ি জলপাইগুড়ি " আর শোভন "শিলিগুড়ি শিলিগুড়ি " বলে চেচাত, দু-তিন মিনিট অপেক্ষা করে চার পাঁচ বার মুখে হর্ণ বাজিয়ে গিয়ার চেন্জ করে মুখে বাসের মত আওয়াজ তুলে বাবু সাহাদের বাড়ির দিকে ছুট লাগাত। অপু গাঙ্গুলীর ছিল ,Stamp collection এর নেশা। বেলা এগারোটার দিকে বুড়া মন্ডলের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। ডাকপিওনের সাইকেলের ঘন্টার আওয়াজ পেলেই ছুট লাগাত। পিওন কাকু যতক্ষন না অপুকে ডাকটিকিট দিত ততক্ষন অপু পিওন কাকুর পেছন পেছন ছুটতেই থাকত।
দিল অনেক দিন কলকাতায় থেকে আজই আড্ডায় যোগ দিল। বাবুন যথারীতি মোজার সাথে হাওয়াই চপ্পল পরে কান মাথা মাফলার দিয়ে ঢেকে আড্ডায় এসেছে ।দিল ছিল গন্ধরাজ লেবু। বায়ু দূষন হলেই সবাই দিলের খোজ করত। দিলও বায়ু দূষন করেই অন্য কোনায় দাড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসত। গৌতম আর কালন আসার সাথে সাথেই Wrestling শুরু করে দিত। দুজনেরই মহিষের মত শক্তি ছিল। তাই প্রথম দর্শনেই শক্তি পরীক্ষা করে নিত। দিল আসার পর থেকেই কলকাতায় থেকে আসার প্রমান দিতে কলকাতার ভাষায় কথা বলছিল। অনুপ আর অমিত অনেকক্ষন ধরে ব্যপারটা লক্ষ করছিল। শেষে অমিত দিলকে বলে কিরে এটা কোন ভাষায় কথা বলছিস। নারে অনেকদিন ওদিকে ছিলামতো তাই কলকাতার ভাষা বেরিয়ে যাচ্ছে। অনুপ এগিয়ে এসে বলে, এমন মার মারব না, তোর বেরিয়ে যাচ্ছে বেরিয়ে যাবে। পলাশ যথারীতি বাবামার বকুনি খেয়ে কাধে ব্যাগ ঝুলিয়ে "এ আন্ধা কানুন হ্যায় " বোলে বেশ কয়েকদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে আসত। যতদিন না ওর বাবা এসে কান ধরে নিয়ে নিয়ে যেত , ততদিন বাড়িমুখো হোত না। দুলু ভীষন গুল মারত। কোন কথা শুরু করলেই সবাই বলে উঠত, Percentage কত।
সিনেমা দেখতে যাবার সময় আমার সাইকেলের পার্মানেন্ট চালক ছিল পলাশ। ওর পা লম্বা ছিল তাই আমাকে সাইকেলের রডে বসিয়ে নিত। নতুন সিনেমা এলে প্রথম দিন প্রথম শো আমাদের দেখতেই হবে। অমর টকিজে নতুন ছবি এসেছে ।আড্ডার জায়গায় এক এক করে সবাই চলে এসেছে। সবারই পকেট খালি। শুধু বাবুনের পকেটে 10 পয়সা আছে। সিনেমা দেখার সময় কখোনো ওর পকেটে 10 পয়সার বেশি থাকত না। যাইহোক আমরা সবাই মিলেমিশেই সিনেমা দেখতে যেতাম। সেদিনও বাবুনের 10 পয়সা ছাড়া কারও পকেটে পয়সা ছিলোনা। এক এক করে সবাই চলে এসেছে। সিনেমা দেখা হবে না বলে সবারই মন খারাপ।হটাৎ বুড়াদার বাড়ির কোনা থেকে পলাশের চিৎকার শোনা গেল। তারাতারি চলে আয়, সিনেমা দেখার পয়সা হয়ে গেছে। আমরা সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখি, পলাশ এক কোনা থেকে মুরগির ডিম বের কোরছে আর ঘোতনদের বাড়ির কালো মুরগিটা দুর থেকে রাগত চোখে পলাশকে দেখছে।
যাইহোক কলেজহল্টের মিলন দার দোকানে ডিম বিক্রি করে সাইকেলে Double carry করে অমর টকিজে পৌছালাম। সাইকেল স্ট্যান্ডে আমরা Due রাখতাম। স্ট্যান্ডের লোক সাইকেলের ব্রেক চিপে ছোট্ট একটা কাগজের Due slip ঢুকিয়ে দিত। আমরাও সাইকেল বের করার সময় প্রথমেই ব্রেক চিপে Due slip ফেলে দিয়ে Due clear করতাম।
কাউন্টারে প্রচন্ড ভিড়। গৌতম মহিষের মতো গুতো দিতে দিতে কাউন্টারে ঢুকে গেল, কিছুক্ষন পর গৌতম টিকিট কেটে বেরিয়ে এল, কিন্তু শরীরে জামা নেই শুধু জামার কলারটা গলায় ঝুলছে। ওই অবস্থাতেই আমরা সিনেমা দেখা শেষ করে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে সাইকেল স্ট্যান্ডের দিকে এগুচ্ছিলাম এমন সময় পেছন থেকে বাবুনের ডাকে সবাই ঘুরে দাড়াই। বাবুন পরবর্তী সিনেমার পোস্টারের সামনে দাড়িয়ে সবাইকে ডাকছে। আমরা সামনে যেতেই বাবুন চেচিয়ে বলে উঠল, তোরা বলিস সিনেমার নাম "বাতো বাতো মে" ,দেখ পোস্টারে লেখা আছে ব্যাটন ব্যাটন মেইন (BATON BATON MAIN) । আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।
প্রচন্ড শীত পরেছে। সেদিনের সান্ধ্য আড্ডায় আড্ডাবাজের সংখ্যা কম। আমি, দিল, বাবু সাহা, দীপক, গৌতম,দুলু,পলাশ এবং বাবুন। বাবুন যথারীতি মোজার সাথে হাওয়াই চপ্পল ,মাফলার আর মোটা একটা চাদর জড়িয়ে এসে এককোনে গুটিসুটি মেরে বসেছে। বাবুন আসার সাথে সাথেই দিল বাবুনের পিছনে লাগা শুরু করে দিল। আড্ডা খুব একটা জমছে না। যাই হোক আড্ডা চলছে, এমন সময় শোভন আর ঘোতন এসে খবর দিল পতু্লদির বাবা রমেশ সিংহ মারা গেছে। শ্মশানে যেতে হবে। পিনিদা, পোকনদা পুতুলদির বাড়িতে অপেক্ষা করছে। আমরা বাড়ি থেকে গামছা এনে কোমরে বেধে শ্মশান বন্ধুর সাজে পুতুলদির বাড়িতে হাজির হোলাম। বাবু সাহা গেল শ্মশানের মাটির কলসি টলসি কিনতে। পিনি বাড়ি থেকে এক কেতলি চা বানিয়ে এনেছে। বাবু সাহাও শ্মশানের বাজারের সাথে চায়ের সাথে খাওয়ার জন্য মুড়ি চানাচুরও নিয়ে এসেছে। আমরাও দেহ নিয়ে "বলো হরি হরি বোল" ধ্বনি দিতে দিতে শ্মশানের দিকে রওয়ানা দিলাম।
চিতাতে আগুন দেবার সময় একটা সমস্যা হোলো, মুখাগ্নি করবে কে? রমেশ সিংহের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। যাইহোক পিনি বড় ছেলে আর পোকন ছোট ছেলে সেজে মুখাগ্নি করল। প্রচন্ড ঠান্ডা। পিনি চিতার নিচ থেকে কাঠ কয়লা বের করে চায়ের কেতলিটা বসিয়ে দিল। বাবু মুড়ি চানাচুর মেখে সবাইকে ভাগ করে দিল। সবাই গামছার মধ্যে মুড়ি নিয়ে খাচ্ছে। হটাৎ বাবুন মুড়ি খেতে খেতে উফ করে চেচিয়ে উঠল। দিল শয়তানি করে কখন যে বাবুনের মুড়ির মধ্যে ছোট ছোট পাথর ফেলে দিয়েছিল বাবুন টেরই পায়নি। ওদিকে ঘোতন বাবুকে জিগ্যেস করছে,বাবুদা মুড়ি ঘি দিয়ে মেখেছিস নাকি? ঘি ঘি গন্ধ করছে। বাবু ফিক করে হেসে বলে নারে, ডেড বডিতে ঘি মাখানোর পর, হাত ধুতেই ভুলে গেছি।
বুড়াদার মাঠে পিকনিকের রান্না হচ্ছে। শীতকাল এলে আমাদের পিকনিক লেগেই থাকত। কড়াইতে মাংস ফুটছে। দিল কোথা থেকে এসে হাতা দিয়ে কড়াইয়ের মাংস নাড়াচাড়া শুরু করল। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়ার পর তেল কম হয়েছে বলে উনুনের পাশেরাখা কেরোসিনের বোতল থেকে কেরোসিন তেল ঢেলে দিল। তারপর কি হোলো বোলবো না।
আড্ডা ছিল, বন্ধুদের অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল। কালভার্টের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই।আড্ডা্র সেই সোনালি সকাল বিকেল সন্ধ্যা সব হারিয়ে গেছে। চিরঘুমের দেশে চলে গেছে অনেক প্রিয় বন্ধু। খুনসুটি ভরা মিষ্টি মধুর আড্ডার সেই দিনগুলি বার বার স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে।
মেয়েবেলার দিনগুলি
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
আমাদের জীবনে স্কুল জীবনের স্মৃতি কম-বেশি সবচেয়ে আনন্দের। আজ ও তাই মনে পড়ে যায় সেইসব দিনের কথা। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন থেকেই স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাটক, নাচ, কবিতা পাঠ করতাম । এইজন্য দিদিমনি আর বন্ধুদের কাছে প্রিয় ছিলাম। সেইসময় থেকেই আমরা তিন বন্ধু মিলে ছোটো ছোটো নাটক লিখে বাংলা ভাষার দিদিমনি কৃষ্ণা' দি আর রিনা'দির সহযোগিতায় গরমের ও পূজার ছুটির দিনে তা উপস্থাপন করতাম। ক্লাস নাইন ও টেনে টানা দু'বছর ক্লাসের প্রিফেক্ট থাকার সুবাদে সবাইকে প্যারেড-পিটি চর্চার দায়িত্ব বর্তায় আমার ওপর। সেসময় স্কুলে শরীরচর্চা, নাচ (ব্রতচারী) এসব বিষয়ের পরীক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো ছিলাম, কিন্তু বন্ধুদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলাম। ক্লাস টেনে এসে সেই বন্ধুত্ব পরিনত হয় আত্মীয়তায়। প্রিফেক্ট হওয়ার জন্য আমাকে বন্ধুদের মধ্যে বেশিরভাগ মা বলে ডাকত। কারণ অবাধ্য ক্লাসকে চুপ রাখার জন্য কখনো একটু শাসন ও প্রয়োজন ছিল। মিত্রা ছিল আমার নাচের পার্টনার, ওকে সবাই বলত বাবা। এভাবে কেউ আমাদের ছেলে কেউবা মেয়ে আরো নানান সম্পর্কে বেধে ছিলাম নিজেদের। আজ হাসি পায় সেসব কথা মনে পড়লে। চম্পা নামে এক বন্ধু সেসময় নতুন প্রেমে পড়েছে। আমারা কয়েকজন ছিলাম ওর সেইসব গল্প শোনার পার্টনার। জানিস কাল সুজয় আমাকে না এই বলেছিল । আমাকে এই গিফ্টটা দিল কাল ইত্যাদি।আমরাও বেশ মজা করে শুনতাম সেসব গল্প থুরি প্রেমকাহিনী। একসময় রোজ শুনতে শুনতে একঘেয়ে লাগতো তখন চম্পা ঘ্যান-ঘ্যান করত । ওর "আজব প্রেমকি গজব কাহানী" শোনানোর তাগিদে প্রায়ই টিফিনের সময় আমাদের স্কুলের ক্যান্টিন থেকে অনিতা মাসির তৈরি ঘুগনি, আমের আচার, কুলের আচার, পারুল মাসির বানানো ভেজিটেবল আর ডিমের চপ, কখনো স্কুল ছুটির পর উকিল'দার(যদিও ওকালতি পেশা নয় ! এহেন নামকরণের কারণ অজানা) হাতে আলুকাবলি, ঝালমুড়ি এসব খাবার ছিল ঘুষের উপঢৌকন। আহা জিভে এখনও জল চলে আসে মেয়েবেলার ফেলে আসা এসব খাবার কথা মনে করলেই। সেসময় আমাদের হাতে অত টাকা-পয়সা দেওয়া হত না । কিন্তু অবস্থাসম্পন্ন হওয়ায় চম্পার ব্যাগের জোর ছিল অনেক। টিফিনের সময় ক্যান্টিনে খুব ভিড় হত। বাড়ি থেকে টিফিন দিলেও মাসিদের তৈরি খাবার খেতে দারুণ লাগতো। ভিড় এড়াতে কেউ কেউ আমাদের কাছে টিফিন আনতে দিত, এনেও দিতাম। আমার বন্ধু মিত্রার বেশ দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় ঘুরতে। কম-বেশি আমাদের ও। একদিন অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে নাড়ু আর নিমকি কেনার পর মিত্রা বলে, চল আজ আমরা ওদের জন্য আনা টিফিন খেয়ে নি। প্রথমটায় আমরা কজন রাজি না হলেও পরে মিত্রার কথায় যুক্তি খুজে পেলাম। ও বলেছিল, "হুমম্ বড়ো লোকের বেটিলো. .. লাইনে দাঁড়িয়ে টিফিন আনবো আমরা, আর ওরা বসে-বসে খাবে ! রোজ এনে দেই আজ তার ভাড়া নেব "। আমরা মহানন্দে খাবার সাবার করে ওদের কাছে গিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বলি মাঠে খেলতে থাকা একটা মেয়ের ধাক্কায় তোদের টিফিন পড়ে গেছে। সরি রে। কাল তোদের টাকা আমরা দিয়ে দেব। ওরা বলেছিল,, ধুরর্ কি যে বলিস। আমরা না বন্ধু, আমাদের হাত থেকেও পড়ে যেতে পারতো। আমাদের তখন খুব হাসি পাচ্ছিল। পরে অবশ্য আমরা ঠিক করি না এভাবে আর কখনো না। আসলে মেয়েবেলার এই ছোট্ট-খাট্ট সরলতা, মজার মজার কান্ড কারখানাগুলো খুব মনে পড়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে বন্ধু কথার মানে অমলিন সম্পর্কের বন্ধন। যা আজীবন আমাদের বেচে থাকার রসদ।
কবিগুরুর গানের একটা লাইন ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে.......
" দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি "।
অনুরাগ সরকার
কবিতা
শস্যের পিপাসা আমার ফুরোয় না
কুমকুম ঘোষ
শস্যের পিপাসা আমার ফুরোয় না ;
খোলা মাঠে
অবনত হৃদয়ে খুঁটি তাই
দু- একটা শস্যদানা।
অবশিষ্ট নক্ষত্রের মত
যদি লুটিয়ে থাকে।
পিপাসার শেষ নেই;
ফুল - পাখি -আদিগন্ত
মাঠ কিংবা নরম মাংসের টুকরো,খসে
পড়া সেদ্ধ হাড়ের পাশ থেকে।
খুঁজে যাই, খুঁজে যাই কখনো শরীরে
কখনো বা আদিগন্ত প্রান্তরে।
কাঁসার থালার মতো রোদ পিঠে মেখে
কেটেছিল ধান, বিরহী কৃষক-সন্তান
ঘরে ফিরেছিল : পূর্বরাগ সেরে মড়াই এর কাছে
রেখেছিল কিছু তার: বাকি সব
মহাজন কেড়েছে।
তবু, আলপথে পড়ে আছে
দু- একটা শস্য কণা; খোঁজ তার করেছে
চড়াই,ঘুঘু : আর ইঁদুরের সাথে পাশাপাশি
খুঁজেছি আমি কিংবা জায়মান আত্মার সাথে
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হৃদয়ে নেমে আসি
ফাঁকা মাঠে।
শস্যের পিপাসা আমার ফুরোয়না সহজে।
পুনর্জন্ম
কৃষ্ণ কুমার মহান্তি
মূল কবিতা : ওডিআ
অনুসৃজন : শ্যামলী সেনগুপ্ত
তোমার বিচ্ছেদে
আমার ঠোঁটে মৃত্যুর চুম্বন
তোমার চুমুতে আমার
পুনর্জন্ম হয়
দ্বন্দ্ব
কৃষ্ণ কুমার মহান্তি
মূল কবিতা : ওডিআ
অনুবাদ : শ্যামলী সেনগুপ্ত
তোমাকে চিঠি লিখতে বসলেই
লোড শেডিং হয়
এতকিছু , এত এত কথা
অন্ধকারে বসে কি লেখা যায় !
আলো চলে আসে একসময়
তখন চোখ ভর্তি ঘুম আর স্বপ্ন
এমন ঘুম আর এমন স্বপ্ন
ছেড়ে এই অবেলায় চিঠি
আর লেখা হয় না !
রবিনসনের একা দ্বীপে
সম্পা পাল
শেষটা শেষ হয়নি
অমিলের হাওয়ায় হারিয়ে যাওয়া সেই খোঁজে এখনও
ভাবি জীবন আসলে পরিচয়ের আর এক নাম
ডেমিনের অনুভূতি সামনে দাঁড়িয়ে
যদিও আমি আমেরিকান হতে চাইনি কখনো
তবু বৃষ্টি এখনও হয়,করোগেটেড বেয়ে
আমার স্বপ্ন ভেজে
রবিনসনের একা দ্বীপে .......
অমিলের হাওয়ায় হারিয়ে যাওয়া সেই খোঁজে এখনও
ভাবি জীবন আসলে পরিচয়ের আর এক নাম
ডেমিনের অনুভূতি সামনে দাঁড়িয়ে
যদিও আমি আমেরিকান হতে চাইনি কখনো
তবু বৃষ্টি এখনও হয়,করোগেটেড বেয়ে
আমার স্বপ্ন ভেজে
রবিনসনের একা দ্বীপে .......
যাপিত জীবন
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
নিজেকে মেলে ধরি সূর্যের কাছে
রাশি রাশি আলো পথ ভুলে আমাতে হারায়;
দু'বাহু মেলি অদ্ভুত সোনালি সুখে
সবভার বয়ে নিয়ে যাই অক্লেশে ।
ঢেকে রাখি নির্ঘুম রাতগুলো সকালের ঘ্রাণে,
সমুদ্র মন্থন করি ঢোড়াঁ সাপ প্রাণে;
সন্ধি করে অশুভ আঁতাত,
উপত্যকা জুড়ে নামে জোৎস্নার খেলা ।
নিজেকে রুদ্ধ করি ঝিনুকের অন্তরালে
কালোমেঘ ডাকে ভয়ের আকাশে,
ঘুঘু নিয়ে যায় কঠিন সময়-
যাপিত জীবন উড়ে যায় পূবালি বাতাসে।
এফ এম-এর একটা গান
সজল কুমার টিকাদার
বুক পকেটে জমে থাকা দুঃখটুকু
সকালের এক গ্লাস নরম আলোর সঙ্গে
টপ করে গিলে ফেলি।
মনের শরীর তারপর থেকে ফুরফুরে...
যাক,দিনটাকে এবার সাইজমত কেটে-ছেঁটে
গায়ের জামা বানাব যখন ভাবছি,ঠিক তখন
এফ এম-এর একটা গান এসে
জড়িয়ে ধরে বলে,
'চলো,এক্ষুনি উড়ি!'
বাবুল মল্লিক
"একটা হঠাৎ দেখা আর…"
কেয়া রায়
সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামের বাইরে দেখা হল ওদের বছর পনেরো পর। ওরা কি এখন অন্য কারও ঘর?? সময় বলবে নাহয় সে প্রশ্নের উত্তর। থমকে দাঁড়াল স্মৃতিরা, থমকে দাঁড়াল মূহুর্তেরা। চেনা মানুষকে দেখল অচেনার ভীড়ে ওরা
কিংবা খানিকটা দোটানায় রইল পড়ে দুজনায়
বুঝি। ঠিক করে উঠতে পারছে না এখনও
সৌজন্যতা দেখিয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে কিনা !!
একটা অস্বস্তি একটা আড়ষ্টতা ঘিরে রয়েছে ওদের চারপাশ জুড়ে। তবুও এগিয়ে এল প্রাপ্তবয়স্ক লোকটা। সাথে বছর সাতেকের একটা ফুটফুটে মেয়ে, চেহারা ছবিতেও যেন ওরই প্রতিবিম্ব সে।
- কেমন আছ শ্রীতমা??
- ভালোই...তুমি??
- এই বেশ দিব্যি আছি।
- হুম, তা এখানে যে??
- প্রশ্নটা কিন্তু আমারও একই।
- হুম, ছেলের স্কুল থেকে সায়েন্স প্রোজেক্টের জন্য নিয়ে এসেছে এখানে, সাথে বাবা-মায়েরাও। তাই আর কি !!
- হুম বুঝেছি। আমারও ওই একই কারণ। তবে ওর মা আজ ছুটি নিতে পারেনি ; অগত্যা আমাকেই আসতে হল অফিস থেকে হাফছুটি নিয়ে।
- ভালোই। (স্মিত হাসির রেশ)
- অবাক হলে??
- কেন বলোতো?? অবাক হওয়ার কি কিছু আছে এতে??
- না মানে, আগে তো আমি কর্তব্য পালনের থেকে শুধু পিছু হটতাম। তাই আর কি...
- ও হ্যাঁ তা ঠিকই। তা বলে অবাক হইনি একদম। কারণ, সময়ের সাথে সাথে আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই পরিবর্তন আসে আর এটাই তো স্বাভাবিক প্রিয়ম।
- হুম তা ঠিক।
- (নীরবতা)
- একটা কথা বলব??
- হুম বলো...
- না থাক...
- মনের মধ্যে চেপে রেখেই বা কি লাভ?? সুতরাং বলে ফেলো।
- বলছি, বিয়ে করেছো??
- না, প্রয়োজন মনে করিনি।
- তবে??
- কি শুনতে চাও??
- কিছু না, ছাড়ো।
- প্রিয়ম, আমি চাই না কেউ এসে আমার সন্তানকে দয়ার নজরে দেখুক কিংবা আমি একটি অনাথ শিশুকে দত্তক নিয়েছি বলে সমাজের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া থেকে আমায় উদ্ধার করার জন্য আমার জীবনে কেউ আসুক সেটা আমি চাই না কোনওভাবেই।
- বেশ, বুঝলাম।
- তাড়াতাড়ি বুঝে নিলেই ভালো।
- তোমার ব্যক্তিত্বের কাছে যে আমি বারবার হেরে যাই শ্রীতমা !!
- জিতেই বা আমার কি লাভ হয়েছে এতদিন??
- (খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর প্রিয়ম মুখ খুলল) আমায় কি ক্ষমা করা যায় না একটিবার??
- ক্ষমা করে দিয়েছিলাম তো অনেক আগেই।
- মানে??
- সেদিন বাড়ি ফিরে এসে তোমায় ক্ষমা না করতে পারলে আমি হয়তো এতটা ভারমুক্তভাবে বাঁচতে পারতাম না।
বয়সের ভাঁজ পড়া দু'চোখের কোণটাতে কি কিছু চিকচিক করে উঠল প্রিয়মের?? না, দ্বিপ্রহরের রোদে চশমার ফাঁক দিয়ে শ্রীতমা ঠিক ঠাহর করতে পারল না। এমন সময় শ্রীতমার বছর আটেকের ছেলেটা পিছন থেকে ডেকে বলল, "মাম্মাম এদিকে এসো, ম্যাথস টিচার তোমার সাথে কথা বলবে।" শ্রীতমা বলল, "হ্যাঁ বাবান, আসছি। ওয়েট আ মিনিট।" এই বলে শ্রীতমা সানগ্লাসটা মাথার ওপর থেকে নামিয়ে ঠিক করে পরে নিতে নিতে যাওয়ার জন্য উদ্যত হল। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে শেষবারের মতো প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বলল, "আসছি। ভালো থেকো।" মনে মনে সেদিন হয়তো প্রিয়মও শ্রীতমার "ভালো থাকা"টুকু চেয়েছিল ; কিন্তু প্রকাশ করে উঠতে পারেনি আর।
এভাবেই আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কিছু অসমাপ্ত থেকে যাওয়া গল্পেরা আর উপন্যাসের আকার নিতে পারে না, ঠিক এভাবেই হয়তো কিছু অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়া গল্পেরা কোনও বাঁক পেলে দু'প্রান্তের মানুষের ভেতর আচমকা ঝড় বইয়ে দিয়ে একটা "ইউটার্ন" নিয়ে এক্কেবারে অজানা ভিন্নপথে পা বাড়ায়।।
লকডাউন আর মা
কাকলি ভদ্র
(১)
-না মাম্মা,এখন কিছুতেই যাব না।দেখছ না ট্রেন,ফ্লাইটে যাতায়াতেই যত রোগ ছড়াচ্ছে।
-যা অবস্থা শুরু হয়েছে চারিদিকে।তুই কাছে থাকলে একটু শান্তি পেতাম রে।
-চিন্তা করো না তুমি।আমি এখানে খুব সাবধানে থাকি।মাস্ক,স্যানিটাইজার নিয়ে বিন্দাস বন্দিনী।বুঝলে ভিতুরাম!ওহ্ সরি সরি ভিতুসীতা!
খলখলিয়ে হেসে ওঠে ফোনের ওপ্রান্তে।
-আমি ভিতুসীতা?মার খাবি তুই।মায়েদের জ্বালা বুঝবি না রে!যখন নিজে...
-থাক থাক।জানি কি বলবে তুমি।
মাঝপথেই কথা থামিয়ে দেয় মোহনা।
- ডোন্ট প্যানিক মাম্মা।স্টে কুল!এই তো ক'টাদিন।লকডাউন উঠলেই ফিরে যাব তোমার কাছে।সব টেনশন মেমরি থেকে ডিলিট করে দাও তো।মেথি জল খাচ্ছ তো রোজ?
-হমম।
-আর শোনো।মর্ণিং ওয়াকও তো এখন বন্ধ।এখন থেকে হলুদ,তেজপাতা ও অ্যালোভেরা জেল জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিনে দুবার খাও তো।সুগারটা কম থাকবে।বুঝলে?
-আমাকে নিয়ে ভাবিস না।তুই সাবধানে থাকিস।
ফোনটা রেখে দিতেই একরাশ দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরে জয়ীকে।
(২)
-হ্যালো স্যার...আমার মেয়েটা একলা আটকে আছে কলকাতায়,প্রায় একমাস হলো।ওকে কি বাড়ি আনার ব্যবস্থা করা যায় না?
-না না...এখন একদম আনবেন না।দেখছেন না সরকারী নির্দেশনামা?যে যেখানেই আছে সেখানেই থাকবে।
-কিন্তু স্যার মেয়েটা আমার...
অফিসার জয়ীর কথাটা না শুনেই ফোনটা রেখে দিলেন...
(৩)
-স্যার,ইন্টারডিস্ট্রিক্ট পাস চাই।মেয়েটা প্রায় দু'মাস আটকে আছে কলকাতায়।আমরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে আনতে চাই।
-দেখি কি করা যায়।ফর্মটা ফিলআপ করে জমা দিন।ফিরলে কিন্তু ওকে সরকারি কোয়ারান্টাইনেই থাকতে হবে...চৌদ্দদিন।
-হোম কোয়ারান্টাইনে থাকতে পারবে না স্যার? বাড়িতে আলাদা করেই রাখব ওকে।প্লিজ একটু দেখুন না?
-হোম কোয়ারান্টাইন এখানে আর এলাউ করা হচ্ছে না আমাদের জোনে।দেখতেই তো পাচ্ছেন বর্তমান পরিস্থিতি।জোনকে গ্রীন রাখাটা আমাদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ!
-সরকারী কোয়ারান্টাইন!তার মানে সবার সঙ্গে এক জায়গায়!না না...
ইম্পসিবল।ওখানে রাখলে মেয়েটা আমার অসুস্থ হয়ে পড়বে।
(৪)
বাড়ি ফিরল মোহনা।মেয়েকে বাড়ি ফেরানো নিয়ে জয়ীর দুঃশ্চিন্তার অন্ত ছিল না।দু'মাসের সব দৌড়ঝাঁপের যেন অনায়াস সমাধান হয়ে গেল হঠাৎই।
গাড়ি থেকে নেমে এক ছুটে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়াতেই কান্নায় ভেঙে পড়লো মোহনা।
সায়ন ব্রক্ষ্ম
করোনাকে--
জয়দীপ বসু
জানি আমার লাল টুকটুকে ফুসফুসকে তীরে বিদ্ধ করতে চাইছো তুমি
জানি আমার নরম তুলতুলে ঠোঁট আর গভীর নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আজ কঠিন লড়াইয়ে মুখোমুখি
প্রতি একশ বছর পর পর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজাতিকে গিলে খেতে আসো তোমরা
আর অদৃশ্য ছায়াসম শত্রুর সঙ্গে লড়তে নামি আমরা
যে অক্সিজেন প্রকৃতির এক নিরবচ্ছিন্ন উপহার হিসেবেই ছিল শুধু এতদিন
আজ তা সন্দেহ আর অবিশ্বাসের কাছে অসহায়
চুপসে যাওয়া ফুসফুস নিয়ে যখন শৈশব বিদায় জানায় বিশ্বকে
তখন কোনো এক প্রৌঢ়র লড়াইয়ে গান বাঁধি আমরা
তোমাকে হারিয়ে জিতবেই ভালবাসা নয়
ভয়ে এক হওয়া লক্ষ কোটি মানুষ
তাই আজ সে জংলি, হিংস্র, প্রতিশোধ পরায়ন
তোমার হাত ধরে যে নরম স্নিগ্ধতা পৃথিবীতে এসেছে
তোমার অজান্তেই আজ তা লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা
আদিম মানব জেগে উঠছে আদিম প্রকৃতির আহ্বানে
হয়ত নাও থাকতে পারি আমি
কিন্তু তোমার লাশের জন্য কবর খোঁড়া শুরু হয়েছে!
মৌসুমী চৌধুরী
জানালা জুড়ে মলিন শরৎ
সূর্য ধরে মুঠোয়,
বিষণ্ণ এই সময় ধারা
চোখের কোণে লুটোয়।
একলা ঘরে বুকের মাঝে
মুক্তোদানা বৃষ্টিচুর,
কাঁপিয়ে পাঁজর কখন যেন
বাজতে থাকে জীর্ণ সুর।
পৃথিবী আজ ঘরবন্দী
ফন্দীখানা কোভিডের
পজিটিভ আর নেগেটিভে
দুলছে জীবন মানুষের।
তবুও তুড়ি জীবন গানে
বৃষ্টি নুপূর ছন্দ প্রাণে।
অসমাপ্ত
রকি মিত্র
পূর্ণচ্ছেদের পরেই কি সব কথা বলা শেষ হয়ে যায়? তা তো নয়!
পুবের আকাশে চেয়ে থাকা ওই গাছটাকে দেখো,
কত হলুদ বসন্তের নেশা আর গ্রীষ্মের দাবদাহ পেরিয়ে,
এখনও যে দাঁড়িয়ে আছে সদর্পে।
ভালোবাসাও ঠিক তেমনি রয়ে গেছে আমার ভেতর।
আমার যন্ত্রনার প্রবল চিৎকার আর কল্পনার গহীন পৃথিবীতে-
সযত্নে গড়ে উঠেছে সেই টেথিস স্রোত-
যাকে কোনো আলোড়ন-ই সহজে ভরাট করতে পারে না।
তবুও তো গান আছে, স্বপ্ন আছে, কবিতা আছে, থাকবে।
মনে হয় একদিন তুমি ছিলে বলেই -
এখনো কেউ ডাকনাম ধরে বুঝে নিতে চায়-আমি কতটা বেঁচে আছি!
পুবের আকাশে চেয়ে থাকা ওই গাছটাকে দেখো,
কত হলুদ বসন্তের নেশা আর গ্রীষ্মের দাবদাহ পেরিয়ে,
এখনও যে দাঁড়িয়ে আছে সদর্পে।
ভালোবাসাও ঠিক তেমনি রয়ে গেছে আমার ভেতর।
আমার যন্ত্রনার প্রবল চিৎকার আর কল্পনার গহীন পৃথিবীতে-
সযত্নে গড়ে উঠেছে সেই টেথিস স্রোত-
যাকে কোনো আলোড়ন-ই সহজে ভরাট করতে পারে না।
তবুও তো গান আছে, স্বপ্ন আছে, কবিতা আছে, থাকবে।
মনে হয় একদিন তুমি ছিলে বলেই -
এখনো কেউ ডাকনাম ধরে বুঝে নিতে চায়-আমি কতটা বেঁচে আছি!
মনে হয় শুধু তুমি আছো বলেই,
এখনো দুবেলা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার "আমি"-কে মেপে নিতে বড়ো সাধ হয়।
উইলের পাহাড়পাড়ি
নন্দিতা পাল
লক ডাউন সবে খুলতেই ভারী ইচ্ছা বাইরে যাবার,
সেই পাখির ডাক, হাতে এসে বসে প্রজাপতি,
সবুজে সবুজ শীতের পাহাড়-উইলের বায়নায়
মাউন্ট ডিসঅ্যাপয়েন্টমেন্টে পাড়ি।
উইল চোদ্দ, কিন্তু বাদ সেধেছে অটিজম।
মনের বিকাশে সে এখন হয়ত দশ। পাহাড়ে এলে যেন
প্রান, নীল আকাশের কাছে, চারিদিকে সবুজ, কোথাও ঝরনার আওয়াজ।
বেশ দুর্গম পথ, তবু ছোট্ট ছোট্ট পায়ে উইল,
বাবা মা তাবু টাঙ্গিয়েছে, আজ এখানেই বিশ্রাম।
পাহাড়ের কোলে রোদ পরেছে ঢলে, বাড়ি ফেরা
পাখিদের কিচিরমিচিরে; উইল খালি পায়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে,
ওমা দূরে একটি হরিণ, মাথায় খোদাই করা শিং যেন।
পা টিপে উইল এগিয়ে যায়, হরিণের কাছে যাবে সে।
পড়ে রইল কানে শোনার যন্ত্র্, শীতের জামা-কিন্তু
ত্রস্ত হরিণ লুকিয়ে পড়ে ঝোপে।উইল হাসতে হাসতে এগোতে থাকে,
চলে তাদের লুকোচুরি খেলা, সন্ধে ঘনিয়ে আসে।
একটা পাথরের ওপর বসে উইল, ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে আকাশ দ্যাখে,
বিশাল চাঁদটার আলোর স্রোতের বন্যা, হরিণটা কখন যেন ওরই পাশে শুয়ে,
গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় উইল ধীরে ধীরে;
মায়ের ঘুম পাড়ানি গান মনে করে ঘুমিয়ে পড়ে।
উইলের বাবা মা পাগলের মত উইলকে খোঁজে পাহাড়ে;
চিৎকার করে সারা পাহাড়, কিন্তু উইলের কানে তা যায় না।
শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে, একদিন দু দিন পেরিয়ে যায়
বেস ক্যাম্প করে দলে দলে লোক উইলের খোঁজে পাহাড়ে।
একটি পাশের গ্রামের ছেলে, যার এই পাহাড়ে দৈনিক চলা তার।
পথের প্রতিটি বাঁক চেনা, ঝরনার জলের শব্দ, পাখির বাসা-
নতুন পাতায় কোন গাছ কি রঙ্গে সাজে সব জানা। সেই ছেলেটি একা
খোঁজে উইলকে, পাহাড়ী শিশ দিয়ে দিয়ে। ছেলেটি চলে যায় গভীর জঙ্গলে,
ঠাণ্ডায় গা শিউরে ওঠে। তবু চলে উইলের ছবি মনে, সেই রাতের অন্ধকারে।
দ্যাখে একদল হরিণ ঘাসে গা এলিয়ে, তাদের মাঝে উইল চুপটি করে বসে একটি পাথরে।
খালি পা, গায়ে নেই গরম জামা। হরিণদের আদরে ব্যস্ত।
ছেলেটি মুগ্ধ হয়ে যায় এ দৃশ্যে, বোঝে উইল ভালবাসে এ পাহাড়
অনেক বেশি। ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে যায় ছেলেটি, নিজের গরম জামা
উইলের গায়ে, চকলেট এগিয়ে দেয় উইলের হাতে।
রাতধরে নামে পাহাড় থেকে।
রাতধরে নামে পাহাড় থেকে।
সকালের আলো তখন গাছের পাতায়,
উইলের মায়ের মৃদু হাসির তরঙ্গে খুশি চতুর্দিকে ছড়িয়ে।
কান পেতে রই
অমিতাভ সরকার
কোথায় আছিস বন্ধু
মন তোকে খুঁজে বেড়ায়
দখিনা হাওয়ায় ।
তোর সাড়া পাবার আশায়
ইচ্ছেটাকে ভাসিয়ে দিলাম
পাগলা হাওয়ার ভেলায়।
কবে যে সে পৌঁছবে তোর আঙিনায়-
শুনলে সাড়া দিস,
আমি কান পেতে রইলাম বন্ধু ।
চিঠি
সুস্মিতা পাল কুন্ডু
প্রিয়
ভালোবাসা ,
প্রেম আপনি জন্মায়
তার উপর কারো কোনো হাত নেই
তবে অনুঘটকের কাজ কিছু থাকে
এই ধরো ঝিরঝিরে কিংবা রিমঝিম বৃষ্টি ,
হঠাৎ দেখা হওয়া
পলাশ বিছানো পথে বয় যদি অনুকূল হাওয়া
প্রেমার্দ্র মনে তখন কি যে হয় ...এমনি লেখা আছে কত যে কবির কথায় ;
প্রেম থেকে ভালোবাসা .... ইচ্ছেডানায় ভর করে কল্পনা
কত যে রঙ লাগে ...কতশত স্বপ্ন আর আশা !
ভালোবাসা স্বপ্ন দেখায় , কিন্তু স্বপ্নরা যখন বাস্তবে রূপ নেয়
প্রতিশ্রুতি আর দেওয়া নেওয়ার আশ্বাসে...মন অবরুদ্ধ হয় ;
তখন হয়তো রাগ অভিমান দুঃখ কষ্টে ক্ষোভগুলো বেশীই হয়
প্রয়োজনের তুলনায় যত্নের অভাবে কিছুটা হতাশায় ....
তোমার জন্মদিন ...নিদেনপক্ষে কি আশা করো ভেবে দেখো একবার
ভালোবাসার মানুষটির মিষ্টি সুবাসে জন্মদিনের শুভকামনায় প্রীতি উপহার
সেখানে নাই বা থাকল আত্মম্ভরিতার বাহার
আন্তরিকতা ভরা হৃদয়ের উপচানো খুশীতে
ইচ্ছে থাকে যদি তার সময়কে ধরে রাখার প্রয়াস
তখনি তো মিটে যায় সব কিছুর অভাব ....৷
এ তো একটা উদাহরণ মাত্র
সম্পর্কে বাহানা দেওয়া বারণ ...মানো তো ?
সবসময় মনকে বোঝানো হয় না সহজ
সে আর কত সইবে রোজ রোজ কতশত প্রতীক্ষার বহর ...
অপেক্ষার ঝুলির রঙবেরঙের বেলুনরা এভাবেই যায় চুপসে
ভালোবাসা মরে না ...কিন্তু সম্পর্ক পাততাড়ি গুটোয় অবহেলার আভাসে ...
প্রয়োজন থাক বা না থাক ভালোবাসা চায় একটু শুধু care
আর এখানেই হয়তো ভালোবাসার বারবার হার ;
ইগো নয় ...সম্পর্ক নষ্ট হয় প্রতিশ্রুতির খেলাপে
কথার প্রত্যুত্তরে কথায় ....
মিটিয়ে নিলেই হয় কিন্তু একপক্ষ যদি অনড় মনোভাবের হয়
তার কাছে সম্পর্কের মানেটা হয়তো স্পষ্ট নয়....বা না থাকে যেখানে যদি আর অন্য কোনো দায় ...
সম্পর্ক শেষ করা সবাই পারে না সহজে
কত স্মৃতি উপচে ভরা থাকে যে হৃদয়ের গোপন ভাঁজে ভাঁজে...
হয়তো কোনো নিস্তব্ধ শীতার্ত দুপুরে বা এক ফাল্গুনী পূর্ণিমায়
একা একা বাতায়নে দু'চোখে জল বয় কি এক গভীর যন্ত্রণায় ....
যে ভুল গুলো হয় ,সে জমা থাক জীবনের খাতায় দিন তো কেটেই যায় ...তবু হার না মানা হারে কষ্টরা নিভৃতে দোলায়...
" তাই তোমার দেবার কিছু থাকলে
উজাড় করেই দিও ..
নচেৎ স্বপ্ন আঁকড়ে বাঁচি আমি ... অবহেলায় মনের শান্তি নষ্ট
দিন শেষে বাঁচতে হবে জানি জড়িয়ে সেই একরাশ কষ্ট ...."
ইতি
প্রত্যাশা
পাঁক
মিতা বিশ্বাস বসু
গাঢ় আসমানী রঙেতে আঁচল লুটিয়ে
মেঘের বুকে হাল্কা ধস্তাধস্তি,
বেশ রঙের ঘূর্ণি তৈরী হচ্ছিল আকাশে
শুধু একমুঠো গাঢ়রঙ নিয়ে গায়ে মেখে
মেঘবর্ণী হবার চেষ্টা করে ছিলাম সেদিন
উজ্জ্বল রাঙা দের গর্বকে ধূলিসাৎ করতে।
মেঘ রঙে পায়ের পাতার ছাপ ফেলে
পৃথিবীর মাটি, জলে হেঁটে বেরালাম অনেক্ক্ষণ।
সে দাগ লেগেও মিলিয়ে গেলো কর্পূরের মতন।
মন মানলো না, হেঁটে চললাম পাঁকের খোঁজে,
পাঁক মিললো অফুরন্ত -
সেই পাঁক ঘষে ঘষে মাখলাম সারা অঙ্গে।
আবার হাঁটলাম পৃথিবীর মাটিতে,
এবার সারাটা পথ কলঙ্কের ছাপে ভরে গেলো -
মনে ছিলো না,পাঁকে পদ্ম ফোটে!
লোফালুফি
অর্পিতা গুহ মজুমদার
না,গঙ্গাম্মা বা রণবীর বাড়ি ফিরতে পারে নি ----
পথেই মৃত্যু ওদের লুফে নিয়েছে।
সকালে সবুজ চায়ের চুমুকে এসব
ঘোলাটে মৃত্যুর খবরে মনে ধূসর আস্তরণ,
দ্রুত মনকে সরিয়ে নিতে হয় অন্য তাজা সংবাদে।
বিরাটের নতুন চুলের ছাঁট, ডালগোনা কফি আরো কতরকম।
তবু কেন যেন ছাইচাপা প্রশ্নেরা মনে আঁকিবুঁকি কাটে ?
দেশের রাজধানী থেকে পায়ে হেঁটে সুদূর অভাবী গ্রামে কেন ফিরে যেতে চায় রণবীর ?
গঙ্গাম্মা কোন্ মনের জোরে হাঁটতে শুরু করে তিনশো কি.মি পথ ?
রাস্ট্রের কাছে ওরা কোনদিন কোন প্রশ্ন করেনি।
এভাবেই গ্রাম থেকে শহর আর শহর থেকে গ্রামে ওদের নিয়ে লোফালুফি খেলা চলে নিরন্তর ---
আর আয়েশি জনগণ জেগে ঘুমায়,
কু ঝিক্ ঝিক্ করে এগোয় জীবন।
পথেই মৃত্যু ওদের লুফে নিয়েছে।
সকালে সবুজ চায়ের চুমুকে এসব
ঘোলাটে মৃত্যুর খবরে মনে ধূসর আস্তরণ,
দ্রুত মনকে সরিয়ে নিতে হয় অন্য তাজা সংবাদে।
বিরাটের নতুন চুলের ছাঁট, ডালগোনা কফি আরো কতরকম।
তবু কেন যেন ছাইচাপা প্রশ্নেরা মনে আঁকিবুঁকি কাটে ?
দেশের রাজধানী থেকে পায়ে হেঁটে সুদূর অভাবী গ্রামে কেন ফিরে যেতে চায় রণবীর ?
গঙ্গাম্মা কোন্ মনের জোরে হাঁটতে শুরু করে তিনশো কি.মি পথ ?
রাস্ট্রের কাছে ওরা কোনদিন কোন প্রশ্ন করেনি।
এভাবেই গ্রাম থেকে শহর আর শহর থেকে গ্রামে ওদের নিয়ে লোফালুফি খেলা চলে নিরন্তর ---
আর আয়েশি জনগণ জেগে ঘুমায়,
কু ঝিক্ ঝিক্ করে এগোয় জীবন।
কাঁচের গায়ে জলের ফোঁটা
সুনন্দ মন্ডল
মেয়েটি আল্পনা আঁকে দেয়ালে
নানা রঙে সাজিয়ে তোলে নানা ফুল,
চৌকাঠের গায়ে রঙিন চিহ্ন
কপালে দইয়ের ফোঁটার মতো সজ্জিত!
নানা রঙে সাজিয়ে তোলে নানা ফুল,
চৌকাঠের গায়ে রঙিন চিহ্ন
কপালে দইয়ের ফোঁটার মতো সজ্জিত!
সুখের জীবন গাথা আর পারদের তীব্রতা
বেড়ে ওঠে প্রতি বাষ্পমোচনে,
ক্যালোরি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে
অবস্থান্তর ঘটে কলাপাতার শয্যায়।
বেড়ে ওঠে প্রতি বাষ্পমোচনে,
ক্যালোরি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে
অবস্থান্তর ঘটে কলাপাতার শয্যায়।
গরম ভাতে একফোঁটা ঘি
স্বাদ বাড়ায়,
দৈহিক ফ্যাটও।
পেটে একটু চর্বি জমলেই
জিমে যেতে হয় কিংবা ডায়েট করতে হয়।
স্বাদ বাড়ায়,
দৈহিক ফ্যাটও।
পেটে একটু চর্বি জমলেই
জিমে যেতে হয় কিংবা ডায়েট করতে হয়।
আর কাঁচের গায়ে একফোঁটা জলের প্রতিবিম্ব!
সে তো পরপুরুষের ছোঁয়া!
বিবাহিত মেয়েটির চরিত্রের কালোদিকই ফুটিয়ে তোলে।
একটি ফুটন্ত ফুলের গায়ে প্রজাপতির বদলে বোলতার সংরাগ যেমন অশুদ্ধ।
সে তো পরপুরুষের ছোঁয়া!
বিবাহিত মেয়েটির চরিত্রের কালোদিকই ফুটিয়ে তোলে।
একটি ফুটন্ত ফুলের গায়ে প্রজাপতির বদলে বোলতার সংরাগ যেমন অশুদ্ধ।
মায়ের রুটিন
মনামী সরকার
দিনশেষে দিগন্ত পরে,সূর্যি তখন অস্তাচলে|
কাজ শেষে,সবার তখন বাড়ি ফেরার তাড়া|
ঠিক তখনই তুলসী তলায় সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বেলে,
মা ছুটছে রান্নাঘরে,জলখাবার করবে বলে|
মা ছুটছে রান্নাঘরে,জলখাবার করবে বলে|
যখন সবাই যে যার ঘরে বিশ্রাম কিংবা বিনোদনে
মা তখনো রান্নাঘরে, রাতের খাবার জোগাড় করে|
মা তখনো রান্নাঘরে, রাতের খাবার জোগাড় করে|
অনেক রাতে সবাই যখন ঘুমের দেশে,
মা তখনো জেগে বসে,খোকার জামার বোতাম সেলাই করে|
মা তখনো জেগে বসে,খোকার জামার বোতাম সেলাই করে|
ভোরের প্রথম আলো সাথে মাও আমার উঠে|
গৃহকোণে নিজের ছোঁয়া রাখে|
গৃহকোণে নিজের ছোঁয়া রাখে|
ছুটির দিনে সবার ছুটি,মায়ের চলে একই রুটিন
নিয়তি
নয়ন রায়
ডানা তো পেয়েছি আমি,-
দেওয়াল ঘেরা আকাশে উড়ার।
দূরন্ত দুনিয়ায় শ্বাস নেওয়ার আশায়
অপেক্ষায় আমি,-
তোমারি দেওয়া অন্নে আহার।
আজ ভুলেছি আমি আমার ঠিকানা,
হারিয়েছি খোলা আকাশ।
জোগাড়ের তাড়নায় ছিলাম আমি
সুযোগে ভরেছ খাঁচায়!
আজ তোমারি সখে,-
আমার সব হারিয়েছি কোথায়?
ভুলেছি যত পুরনো স্মৃতি -
তোমারি খাঁচার কোণাই!
বেঁচে তো আছি আমি,
তোমার নজরে!
মরেছি তো কবেই-
তোমারি খাঁচার কোণে!
স্বাধীনতা বলে যা ছিলো আমার
সব নিয়ে গড়েছ দেওয়াল!
আর,-
খোলা আকাশে উড়ার চিন্তায় আসে না
পারব কি ছাড়াতে আমি?
অভাবে পরেছি ধড়া,
আজ বুঝেছি -
তোমার ধনীত্বের অহংকারের
অভাবও আমিই।।
বিষন্নতা
মহসিনা বেগম
বিষন্নতা মনকে ঝাকড়ে ধরে,
অথর্ব করে দেয় মস্তিষ্কের ক্ষুরধার।
শুদ্ধ, খাঁটি সম্পর্কগুলো অচেনা লাগে,
বিষন্নতা হয়ে উঠে ধোঁয়াশার আধার।
অন্য মনের শান্ত, মধুর বহিঃপ্রকাশ,
তীক্ষ্ণ আর্তনাদ মনে হয়।
বিষাদে তিক্ত হয়ে উঠে মন,
বিস্মৃতির অন্ধকারে সমস্ত মধুর স্মৃতি ডুবে যায়।
মনের যুদ্ধে প্রায় বিষন্নতা জয়ী হয়।
মৃত্যু ভয়
নবনীতা
আজকাল, রাতে ঘুম আসে না ৷
আসে খালি মৃত্যু চিন্তারা
আমি জেগে বসে থাকি ,
আর...মনে মনে,
হাজারো চিন্তার আঁকিবুকি আঁকি৷
চোখ বন্ধ করি না ,
ভয় হয় ৷
ঘুমালে যে মৃত্যুর মিছিল হানা দেয় !
ঘুমালে যে দেখি
সারি সারি কফিন-বন্দি লাশ
চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়
কোন এক গন্তব্যহীন ভিনদেশী গাঁয়
পরজন্মের ঠিকানায় ৷
কি এক বিভীষিকায় গায়ে কাঁটা দেয় ৷
চমকে উঠি , চোখ বন্ধ করতে ভয় হয়
পাছে , মৃত্যুপুরী আবার জেগে ওঠে ... !
পাশে শুয়ে থাকা মানুষেরা কি
আদৌ ঘুমায় ?
নাকি জোর করে অবচেতন হতে চায়?
যে যেভাবে পারে পরিস্থিতির থেকে পালিয়ে যায় ৷
ওরা ভালো আছে , এভাবে পালাতে পারে ৷
আমি যে কেন পারিনা !!
চুপ করে জেগে বসে থাকি ৷
টিকটিক করা দেওয়াল ঘড়িটা
প্রতি মুহুর্তে হয়ে ওঠে মূর্ত ৷
রাত জাগা পাখিরা
আমার নির্ঘুম রাতের সঙ্গী হয় ৷
দু একটা সারমেয়
সারারাত অবলীলায় চেঁচিয়ে যায় ৷
কি জানি ,মানুষের প্রতি ওদের কী দায় বর্তায় !
এভাবেই কালো রাত ,ধীরে ধীরে,হেঁটে যায়...
একটা নতুন সকালের দিকে ৷
আমি বসে থাকি আলোর অপেক্ষায় ৷
আর ঠিক এভাবেই আজকাল
প্রতি রাতে বেঁচে যেতে চাই ৷
মনে মনে ভাবি ,
মৃত্যু ভয় থেকে তো আগে নিষ্কৃতি পাই ৷৷
সদ্যজাত
ঐশ্বর্য্য দাশ
সদ্য জন্মানো শিশুর কান্না,
মায়ের বুকের গভীরে খাঁজ এঁকে দেয়।
হাতে নিয়ে তৃপ্ত হয় মাতৃত্বের সাধ,
গায়ে তখন লেগে থাকে নতুন জন্মের গন্ধ।
গুটি গুটি চোখ পাখা মেলে ধরে
পেতে চায় এক স্বাভাবিক পরিবার।
দুহাতে আঁকড়ে ধরে মায়ের আঁচল,
একটা আস্ত স্বপ্নের গাছ বোনে মা।
অভ্রদীপ ঘোষ
কবিতা/ ছড়া
কালরাত্রির পরে
শিল্পাশ্রী রায়দে
হাতুড়ির ঘায়ে পা ভেঙে গেছে
তবু হাঁটতে পাওয়ার চেষ্টা-
এ সমাজকে গড়বে নতুন
এই আমাদের তেষ্টা ।
চুড়ি পড়া হাতে হাতকড়া পরেছ
তারপরেও স্বপ্ন দেখি
বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে নেবার হুমকি এসেছে
তারপরেও কবিতা লিখি ।
পুলিশের লাঠিঘায়ে
আমাকে দাবানল যাবেনা বলে
'বেশ্যা ' বলে আখ্যা দিল
নির্ভুল কৌশলে ।
আমার মাথার দাম লক্ষ টাকা
তাই দিয়ে নাকি ফুটবল খেলা হবে
মাঠটা যতক্ষণ না সাফ হচ্ছে
একটু দাবা খেলে নিই তবে!
মহানগরীর মাঝখানে ওই
ফাঁসির মঞ্চটায়
উঠেছেন আমি সহাস্য মুখে
সত্যের উজালায়-
আমার কন্ঠস্বর শুনে
যাদের গায়ে আজও আসে জ্বর
আমিও দেখতে চাই
তারা কত মাতব্বর-
কয়লার ভীড়ে হীরে জন্মাবে
ফসিলস্ কেঁদে মরে,
আবার নতুন সূর্য উঠবে
কালরাত্রির পরে।
করোনায়
মাথুর দাস
করোনা-করুণ কিছু পরিবার হারালো যে প্রিয়জন,
আতুর লোকের ফতুর হওয়ার চতুর আয়োজন ;
লুটেপুটে নিলো কেউ চাল ডাল ভুলভাল বুঝিয়ে,
লাল হোলো ঢিমেতাল ব্যবসায়ী কানা গলিঘুঁজিতে ।
সুযোগেরও সন্ধানী ওৎ পেতে বসে থাকা হায়না,
হালচাল চিরকাল একই তার, বদলানো যায় না ;
শেষ নেই তবুও, দেখা যায় লোক কিছু দু'চারও,
করোনার করুণায় ফোকটে পেয়ে গেল প্রচারও ।
নিয়ম নিগড় নীতি সততই ভালো রাখে স্বাস্থ্য,
জীবনের সনাতনী শৈলীও বুকভরা শ্বাস তো ;
মানুষেই ভাঙে সেই শৃঙ্খলা, শোধ নেয় প্রকৃতি,
গরমিল মিলে গেলে মানুষও ভোলে তার কু-কৃতি ।
'করোনায় করো ন্যায়', বলেছিল যমও,
'যাকে তাকে মেরো না, ধরো আরও কমও' ;
কার কথা কে বা শোনে ! বেয়াড়া সে ভাইরাস,
পটাপট লোক মারে, কারো হাতে নাই রাশ ।
কোভিড নাইন্টিন
সুপ্রিয় ঘোষাল
অ্যাই করোনা বেশ তো ছিলি
ঘাপটি মেরে পড়ে,
আবার কেনো দারুণ রোষে
পড়লি এসে ঘাড়ে।
সার্স হয়ে তুই দিলি হানা
এই আমাদের মর্ত্যে,
গন্ধগোকুল থেকে গেলি
কুক্কুটদের গাত্রে।
চুপটি করে ঢুকলি গিয়ে
উট বাবাজীর কুঁজে,
মার্স হয়ে তুই এলি ফিরে
রাস্তা খুঁজে খুঁজে।
আবার এলি মুকুট পরে
উৎস ভূমি চীন,
গালভরা তুই নামটি পেলি
কোভিড নাইন্টিন।
তোর দাপটে অসংখ্য লোক
মরছে দেশে দেশে,
অর্থনীতির দুর্গ গুলো
পড়ছে শুধু ধসে।
ভাবিস না তুই পারপাবিরে
থাকবে না এইদিন,
লাম্বা দেবার পথ পাবিনা
এই এলো ভ্যাক্সিন।
নিশাচর মন
মজনু মিয়া
নিশাচর পাখি নয় নিশাচর দু' আঁখি
পৃথিবীর সব কিছু নিশাচরে মাখামাখি
রাতের নেশা দিনের -দিনের নেশা রাতের
পাখির নেশা উড়ার মানুষের নেশা ভাতের
প্রেমিক প্রেমের নেশায় ডুবে থাকে
ধার্মিক ধর্মের নেশায় প্রভু নাম ডাকে
নিশাচর মন সব বিষয়ে তৎপর রয়
ভাবুক কামুক ধার্মিক প্রেমিক সৎজন
আসলে নিশাচর হৃদ আসনে বসে মন।
" ধ্যান"
চুমকি দাস
বন্দীদশায় কাটছিল বেশ,
বহুদিন পর পরিবার মাঝে।
খুঁটির টাকাও হতে শেষ-
বলিরেখা ভাসলো মুখে।
ঝাঁপ পরেছে দোকানপাটে,
তালা পরেছে আপিস দ্বারে।
পকেট এবার শূন্য তাই,
কর্তার চোখে ঘুম নেই ।
সর্দি জ্বর ভাব হলে-
ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে ওঠে।
দুর্দিনের আহাজারি!
সার্বজনীন মাটি
মানুষের যখন দুঃসময় যায়…
দুঃখ কষ্ট লেগে থাকে গায়পায়!
দুঃখের আগুন যবে-
জ্বলে উঠে মোর গায়,
নিভাতে আর কে আসে
ফু দিয়ে সবে বাড়ায়!
চাকুরিটা কোনদিন হারিয়েছি
আদরের পত্নীটাও আজ নাই,
এহেন দুর্দিনে আমি দিশাহারা…
ভ্রান্তিরলগ্নে কোত্থেকে কই যাই!
দিন মোর ভালোকালে-
বাপ মা কি বোন ভাই,
সবাইতে ছিলো কাছে
আজ মোর কেউ নাই!
শুয়ে বসে চলে ফিরে
ভুলভাল করে যাই,
প্রেমের বদলে জোটে
খরবাক্য ঘৃণা ছাই!
পদে পদে জ্ঞান…সবাই তো দেন-
মিতালি, দিলিপ, রিতা কি নরেন,
কিন্তু এই অমানুষ পশুটারে…
দুর্দিনে কে একটু হেল্প করেন?
দিন মাস যায়…ভাবে কে আমায়
কেউ হাই হেলো… নমস্কার ফোনে,
কে জানে আজ কতটা ভালো আছি
শহরের এ…ছোটো ঘরটির কোণে?
ক'শো টাকা ধারে চাই
কাজল মাসির কাছে,
চিল্লাইয়া বলে কিনা-
তোর কি আক্কেল আছে!
সামনে যে দিতে হবে
অনন্যা মনির বিয়ে,
এই দুর্বৎসরে তোকে
হেল্প করবো কি দিয়ে?
টাকা চাইলাম আরো
অঞ্জলি পিসির কাছে,
পিসিও নাকি দিবেনা
অনেক সমস্যা আছে!
করোনার কালে নাকি
বাসা ভাড়াও পাননা,
এক টাকা দানে তাই
মন্দিরেতেও যাননা!
আজ এই অশ্রুসিক্ত আহাজারি
যদি না'ই পৌঁছে পৃথিবীর কানে,
সকল দুঃখের গীত গেয়ে যাবো-
আমার ঈশ্বর স্রষ্টা ভগবানে!
অনুস্মিতা বিশ্বাস
প্রবন্ধ
বাংলার প্রথম রাজবন্দী ননীবালা দেবীর দুর্দশাময় জীবন দর্শন
বটু কৃষ্ণ হালদার
ইতিহাস হল মানব জীবনের অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ।এক কথায় বলতে গেলে ইতিহাস হল মানব সভ্যতার কাছে এক জীবন্ত দলিল। সময় দিনপঞ্জি, জীবন দর্শন ঘটনা প্রবাহমান অতীত গুলো ঐতিহাসিকরা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করে গেছে আমাদের সুবিধার্থে। সত্যের আলোকে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ ঘটনাগুলোকে পড়ে আমরা সমৃদ্ধ হই। ইতিহাস থেকে আমরা দেশ-বিদেশের জানা অজানা কাহিনী জানতে পারি। বিশ্বের বহুদেশের স্বাধীনতা লাভের ইতিহাস,নানান যুদ্ধের কাহিনী, বিভিন্ন মনীষীদের জীবন দর্পণ গুলো সুন্দর ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে ভারতীয় ইতিহাসে বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে রয়েছে দেশের রক্ত ঝরানো স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। দেশের স্বাধীনতা আনতে গিয়ে বহু নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমী হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে ছিল জীবনের জয়গান, নয়তো অকথ্য অত্যাচারে তার প্রাণ দিয়েছিল। আবার বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী স্বাধীনতার পরে যোগ্য সম্মান পাননি।সময় যত বয়ে চলেছে, ইতিহাসের তথ্য নিয়ে নানান প্রশ্ন উঠছে।আমরা এযাবৎকাল যা পড়ে এসেছি তা সঠিক তো? কারণ ইতিহাসে পাতায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে বহু সত্য ঘটনা। এই ইতিহাসের পাতায় স্থান হয়নি বহু নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমীদের। বহু সত্য ঘটনা চাপা পড়ে গেছে কালের আধারে।স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বহু সংগ্রামী উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। কারণ সে সময় একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ঐতিহাসিকদের ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়েছিল।কিন্তু কেন?
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের একদল বণিক রানী এলিজাবেথের কাছে এক আর্জি নিয়ে হাজির হন। তারা রাণীর কাছে পূর্ব এশিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসা করার জন্য সম্মতি ও রাজ সনদ প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন। ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে ভারতে এলে ও তারা প্রায় দুইশত বছর এ ভারতবর্ষকে নির্মমভাবে শাসন-শোষণ করেন।চারিদিকে চলছে তখন ব্রিটিশদের প্রচন্ড আক্রমণ নির্মম অত্যাচার। দিনে দিনে ভারতীয় নাগরিকদের ওপর অত্যাচারের সীমা চরমে পৌঁছে ছিল।ফাঁসি দেওয়া দ্বীপান্তর মলদ্বারে রুল ঢুকানো,কমোড থেকে মলমূত্র এনে মাথায় ঢেলে দেওয়া, চোখের মনিতে সুচ ফোটানো, গরম লোহা হাতের তালু ও পায়ের চেপে ধরা, কয়েক দিন উপোস করিয়ে পিছনে হাত কড়া অবস্থায় ঠা ঠা রোদে বন্দিকে দাঁড় করিয়ে রেখে লাথি ও রূলের মার, প্রকাশ্যে গুলি করা,হাতুড়ির ঘা মেরে দাঁত ভেঙে দেওয়া, নাক মুখ ফাটিয়ে দেওয়া, সাঁড়াশি দিয়ে হাত পায়ের নখ উপড়ে নেওয়া এসব ছিল ব্রিটিশদের কাছে জলভাত। এমনভাবে দেশের সন্তানদের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে ব্রিটিশরা। নারীদের ক্ষেত্রে অত্যাচারের মাত্রা ছিল অন্যরকম। বহু বন্দী নারীকে দিয়ে জোর করে তাদের কাম চরিতার্থ করত। দিনের পর দিন লাগাতার ধর্ষণ করতো। চলত মানসিক অত্যাচার, এমনকি শরীরের বস্ত্র ঘুরে যৌনাঙ্গে দুই বাটি লঙ্কা বাটা ঢোকানো হয়েছিল। হ্যাঁ, এমনটাই সত্যি। এমন নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন বহু নারী ।কিন্তু সেই ইতিহাস রয়ে গেছে আড়ালে। ইতিহাসের পাতায় তাদের ঠাঁই হয়নি। এমন বহু বীর সন্তানদের কথা আমরা জানিনা। এমনই এক নির্মম ও নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী ননীবালা দেবী। জেনে রাখা দরকার কে এই ননীবালা দেবী?
ননীবালা দেবী ছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দী। তাঁর জন্ম ১৮৮৮ সালে হাওড়া জেলার বালিতে। পিতার নাম সূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়ের নাম গিরিবালা দেবী। তৎকালীন সময়ে আমাদের সমাজে মহিলাদের খুব অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হতো। নারীদের জন্য শিক্ষার কোন ব্যবস্থা তেমন ছিল না। নিয়মের গণ্ডি শিখরে ননীবালা দেবীর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হল না। ১৮৯৯ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে তার বিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের ৫ বছরের মাথায় ১৯০৪ সালে তাঁর স্বামী মারা যান। ননীবালা দেবীর বয়স মাত্র ষোল। স্বামীহারা নাবালিকা ননীবালা দেবীর জায়গা হল বাপের বাড়িতে। উনিশ শতকের সময়ে বিধবা মহিলা হওয়া সত্ত্বেও নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা শিখেছিলেন।সে সময় চারিদিকে চলছে অরাজকতা, ব্রিটিশদের চরম অত্যাচার। চোখের সামনে এমন নির্মম অত্যাচার দেখে গোপনে নাম লেখালেন বিপ্লবী দলে। বিপ্লবী অমরেন্দ্র চ্যাটার্জির কাছে বিপ্লবের দীক্ষা নিলেন। অমলেন্দু চ্যাটার্জি ছিলেন ননীবালা দেবীর সম্পর্কে ভাইয়ের ছেলে। বিপ্লবের দীক্ষা মন্ত্র মাথায় নিয়ে দেশকে ভালোবেসে বিপ্লবীদের হয়ে তিনি নানান ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিতে শুরু করে। শুধু তাই নয় দক্ষতার সাথে সেই কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু তার আচার ব্যবহারে এতটুকুও বোঝার জো নেই যে তিনি একজন বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্যা। বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য তিনি ছিলেন ভায়া, বা মিডিয়া।বহু অস্ত্রশস্ত্র নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতেন আবার গোপনে বিপ্লবীদের কাছে পৌঁছে দিতেন। ইতিমধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। বাঘাযতীন ও রাসবিহারী বসুর মতো বাঘা বিপ্লবীদের মিলিত চেষ্টায় দ্বিতীয় সিপাই বিদ্রোহের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।বিপ্লবী রাস বিহারী বসু ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন। এদিকে ১০ সেপ্টম্বর ১৯১৫ সালে বালেশ্বরের যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘাযতীন শহীদ হন।বাংলার মুক্তি সূর্য যেন অচিরেই অস্তমিত হতে লাগলো। তার মৃত্যুতে বাংলার বৈপ্লবিক কর্মসূচিতে অভাবনীয় ক্ষতি পূরণ হয়ে গেল। তবে তার সাথীরা শহীদ বাঘা যতীনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য সেই গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন।
১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত জার্মান যোগাযোগ এবং তারপর পর বিভিন্ন ঘটনার খবর পেয়ে সেই সম্পর্কে পুলিশ কলকাতার শ্রমজীবী সমবায় নামে এক প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি করতে যায়। তল্লাশির সময় এই প্রতিষ্ঠান এক সক্রিয় বিপ্লবী অমর চ্যাটার্জী পলাতক হন, কিন্তু সঙ্গী রামচন্দ্র মজুমদার গ্রেফতার হন। বৈপ্লবিক শিক্ষা গুরু অমর চ্যাটার্জী ও তার কয়েকজন সহকর্মীকে প্রায় দুই মাস হুগলির রিষড়াতে আশ্রয় দিয়ে রাখলেন ননীবালা দেবী। রামচন্দ্র মজুমদার গ্রেফতারের সময় "মাউজার" পিস্তল কোথায় রেখে গেছেন সে কথা দলকে জানিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু সে সময় পিস্তলটা খুব জরুরি ছিল। কিন্তু কিভাবে এর সন্ধান জানা যাবে, তা নিয়ে চলল বিপ্লবীদের মধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ। আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সুস্থ সমাধানের পথ বেরিয়ে এলো। জেলে ঢুকিয়ে রামচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে পিস্তলের কথা জানতে চললেন বাংলার দুঃসাহসী এক বিধবা ননীবালা দেবী। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার রক্তচক্ষু কে উপেক্ষা করার মত দুঃসাহস কোথায় ছিল নারীদের ছিল না। কিন্তু বিধবা ননীবালা দেবী সমাজের নিয়মের গণ্ডি শিকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মাথায় সিঁদুর পরে রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে প্রেসিডেন্সি জেলে দেখা করতে এলেন।১৯১৫_১৬ সাল নাগাদ এক বিধবা মহিলার ক্ষেত্রে এমনভাবে সিঁদুর পরাটা ছিল মৃত্যুর সমান। তিনি জানতেন যদি ধরা পড়েন, সমাজ তাকে মেনে নেবে না। কারণ তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার সাথে বর্তমান সমাজের মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক।সে ভয় কে তিনি আমল দেননি। বিধবা ননীবালা শতবার সাজে সিঁদুর পরে এক গলা ঘোমটা দিয়ে রামচন্দ্রের স্ত্রী সেজে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন জেলে। পুলিশের চোখ এড়িয়ে পিস্তলের সন্ধানে নিয়ে বেরিয়ে এলেন প্রেসিডেন্সি জেল থেকে। এমন দু সাহসিক কাজ বর্তমান সময়ের নারীরা করতে পারবে? তিনি সেখানের বিধবা মহিলা হয়েও করেছিলেন শুধুমাত্র দেশের জনগণের স্বার্থে। তবে এ মিথ্যা বেশিদিন চেপে রইল না। সত্য সামনে এলো। পুলিশ অনেক পরে জানতে পারল যে ননীবালা দেবী রাম চন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী নন। কিন্তু এটা জানতে পারেননি যে তিনি রিষড়া তে আশ্রয় দিয়েছিলেন। পুলিশের নজর এড়াতে ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চন্দননগরে পুনরায় বাড়ি ভাড়া নেয়া হয়েছিল। তবে এখানেও বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে মহিলা না থাকলে ভাড়া পাওয়া যেত না। অগত্যা আবার ডাক পড়লো ননীবালা দেবীর। শুধু তাই নয় বিপ্লবী ভোলানাথ চ্যাটার্জী সাথে করে এনেছিলেন তার বড় পিসি কে। এই বড় পিসি ও ননীবালা দেবী দুটো আলাদা আলাদা বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে রেখেছিলেন পলাতক বিপ্লবীদের। গোপনে সেই বাড়ি দুটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন পলাতক বিপ্লবী নেতা যদু গোপাল মুখার্জি,অমর চ্যাটার্জী,অতুল ঘোষ,ভোলা চ্যাটার্জী,নলিনীকান্ত কর বিনয় ভূষণ দত্ত ও বিজয় চক্রবর্তীরা।এঁদের প্রত্যেকের মাথার দাম হাজার টাকা করে ঘোষণা হয়েছিল। সারাদিন দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকতেন, আর রাতে নিশাচরের মত বেরিয়ে পড়তেন। পুলিশ এসে পড়ল এই পলাতক বিপ্লবীরা নিমেষেই ভ্যানিশ হয়ে যেতেন। এইভাবে চন্দননগরের বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি ও বিপ্লবীদের নিমেষে পালাবার পর ননীবালা দেবীকে চন্দননগরে রাখা নিরাপদ হলো না। কারণ সেই মুহূর্তে পুলিশ তৎপর হয়ে উঠেছিল ননীবালা দেবী কে গ্রেফতার করার জন্য। তার বাবার সূর্যকান্ত ব্যানার্জিকে পুলিশ বালি থানাতে নিয়ে গিয়ে ১০ টা থেকে ৫ টা অব্দি বসিয়ে রেখে জেরা কত। ননীবালা দেবী কোথায় আছেন সেই খবর জানতে। একবার এদিক তো আবার অন্যদিক, এইভাবে পালিয়ে পালিয়ে চলতে থাকলো ননীবালা দেবীর জীবন। কিন্তু এবার সুযোগ এলো একটু অন্যভাবে। তাঁর এক বাল্যবন্ধুর দাদা প্রবোধ মিত্র কাজের জন্য যাচ্ছিলেন পেশোয়ার। সেই বাল্য বন্ধু দাদাকে অনেক অনুনয় করে রাজি করালেন বিপ্লবী ননীবালাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।পলাতক ননীবালা দেবী প্রবোধ মিত্রর সঙ্গে পেশোয়া তে চলে গেলেন।এক বিধবার জীবনে এটা ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযান। কারণ যে সময় নারীরা ঘোমটা টেনে শুধুমাত্র সংসারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো, সে সময় এক বাঙালি বিধবা অচেনা এক পুরুষের সাথে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে চলে গেলেন লুকিয়ে থাকতে।
তিনি বেশিদিন এভাবে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারলেন না। প্রায় ২৬_১৭ দিন পরে পুলিশ সন্ধান পেয়ে যখন ননীবালা দেবী কে গ্রেপ্তার করতে গেছে পেশোয়ার, তখন তিনি অসুস্থ।এভাবে দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কলেরাতে আক্রান্ত হন। দুই থেকে তিন দিন সে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। পুলিশ প্রথমে তার বাড়ি ঘিরে রাখে,পরদিন পুলিশি হেফাজতে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হয়।কয়েকদিন পেশোয়ার হাজতে রাখার পর একটু সুস্থ অবস্থায় তাকে নিয়ে আসা হয় কাশির জেলে। এরপর ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে।
কাশিতে নিয়ে আসার কয়েক দিন পরে জেলগেটের অফিসে এনে কাশির ডেপুটি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট জিতেন ব্যানার্জি তাকে জেরা করত। কিন্তু ননীবালা দেবী কিছুতেই মুখ খুললেন না। সব অস্বীকার করতেন, বলতেন তিনি কাউকে চেনেন না কিছুই জানেন না। এরপর শুরু হতো জিতেন ব্যানার্জীর তুই_তু কারীর অসভ্য ভাষায় গালিগালাজ। ননীবালা দেবী চুপচাপ। এতদিনে পুলিশ সুপারেনটেনডেন্ট বুঝতে পেরে গেছে এই মহিলা অতি সহজেই দমবার পাত্রী নয়। একদিন দুইজন জমাদারনী ননীবালা দেবী কে একটা আলাদা সেলে নিয়ে গেল। দুজনে মিলে তাকে জোর করে ধরে মাটিতে ফেলে দিলো। তারপর শরীরের সমস্ত কাপড় খুলে দু বাটি লঙ্কা বাটা যৌনাঙ্গে প্রবেশ করানো হয়েছিল।তিনি চিৎকার করতে লাগলেন এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারতে লাগলেন।এক পাষণ্ড,নির্মম,ভাষাহীন অত্যাচার করা হলো তার সঙ্গে। যা বর্ণনা করার ভাষা বোধহয় নেই বললেই চলে।এরপর আবার তাকে নিয়ে আসা হতো জেলগেটের অফিসে জিতেন ব্যানার্জির কাছে। শুরু হতো আবার জেরা করা। এমন অকথ্য অত্যাচার,শরীরের ভেতর লঙ্কার জ্বালা, তবুও তার মুখ থেকে একটা কথা জানতে পারলেন না।এরপর কাশির জেলে যেখানে মাটির নিচে একটা খুবই ছোট্ট পানিশমেন্ট সেল অর্থাৎ শাস্তি কুঠুরি ছিল। তাতে দরজা ছিল একটাই কিন্তু আলো-বাতাস প্রবেশ করার জন্য সামান্য ঘুলঘুলি ও ছিল না। সুপারিনটেনডেন্ট জিতেন ব্যানার্জি নির্দেশে তিন দিন প্রায় আধঘন্টা সময় ধরে ননীবালা দেবী কে ওই আলো-বাতাসে অন্ধকার ছেড়ে তালা বন্ধ করে আটকে রাখত। যা ছিল জীবন্ত অবস্থায় কবরখানার যন্ত্রণা ভোগ করার সমান। তবুও তার মুখ খোলাতে পারল না। কিছুদিন পর ওই বন্ধ ঘরে আধ ঘন্টারও বেশি প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তাকে বন্ধ করে রাখা হল। শুরু হলো নির্মম মানসিক অত্যাচার, স্নায়ু শক্তিকে চূর্ণ করে দেওয়ার চূড়ান্ত প্রচেষ্টা। তালা খুলে দেখা গেল ননীবালা দেবী জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে আছেন মাটিতে
অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে পুলিশ ননীবালা দেবী কে কাশি থেকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে এলেন।১৮১৮ সালের তিন নম্বর রেগুলেশ নের ধারা প্রয়োগ হলো তার বিরুদ্ধে। প্রথম মহিলা রাজবন্দী হিসেবে তিনি এলেন প্রেসিডেন্সি জেলে সেখানে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিলেন জেল কর্তৃপক্ষ এমনকি জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও তাকে অনুরোধ করে খাওয়াতে পারলেন না। ননীবালা দেবী বললেন বাইরে গেলে খাবেন তাই সেই মত প্রতিদিন সকাল ন'টায় তাকে নিয়ে যাওয়া হতো গোয়েন্দা অফিসে।সেখানে আই.বি পুলিশের স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট গোল্ডি তাকে জেরা করত।
জেরা ঠিক যেমনভাবে চলত_আপনাকে এখানেই থাকতে হবে তাই বলুন কি করলে খাবেন?
_যা চাইবো তাই করবেন?
_করব।
_আমাকে বাগবাজারে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের স্ত্রী সারদা মায়ের কাছে রেখে দিন তাহলে খাবো।
গোল্ডি শয়তানি হাসি লুকিয়ে বলে আপনি দরখাস্ত লিখে দিন।
ননীবালা দেবী তৎক্ষণাৎ একটা দরখাস্ত লিখে দিলেন। আইবি পুলিশের স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট গোল্ডি কাগজের টুকরো ছিঁড়ে দলা পাকিয়ে কাগজের টুকরিতে ফেলে দিল।সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ আহত পাখির মতো লাফিয়ে ওঠে ননীবালা দেবী ,সজোরে এক চড় বসিয়ে দিলেন গোল্ডির মুখে। বললেন_ছিঁড়ে ফেলবে তো আমায় দরখাস্ত লিখতে বলেছিলেন কেন? আমাদের দেশের মানুষের কোন মান সম্মান থাকতে নেই? দ্বিতীয় চড় মারার আগেই অন্য সিআইডি-র তাকে ধরে ফেলে। ভাবতে অবাক লাগে প্রায় ১০০ বছর আগের এক বাল্য বিধবা মহিলার দুঃসাহস দেখে। কারণ বর্তমানে সভ্য শিক্ষিত সমাজের অর্জুন আজ নির্বিকার,অবিচল। অন্যায় দেখেও নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ থাকে।
জেলে থাকাকালীন একদিন সিউড়ির দুকড়িবালা দেবীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সকলের কাছে তিনি মাসিমা নামে পরিচিত ছিলেন। দুকড়িবালা দেবী ছিলেন ভারতে অস্ত্র আইনের সাজা প্রাপ্ত প্রথম মহিলা বন্দি। ননীবালা দেবী জানতে পারলেন সিউড়িতে দুকড়িবালা দেবী বাড়িতে সাতটা মাউজার পিস্তল পাওয়ার অপরাধী দুকড়িবালা দেবী দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড সাজা ঘোষণা হয়েছে। রাখা হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদিদের সঙ্গে যার অর্থ হলো চোর ডাকাতের সাথে একি সেলে। অথচ রাজবন্দী হলে আলাদা সেলে রাখা হয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হয়নি, অসম্ভব খাটানো হত। প্রতিদিন প্রায় আধ মণ ডাল ভাঙতে দেওয়া হতো। এভাবে যে কোন মত এই সমস্যার সমাধান হবে না সেটা বুঝতে পারলেন ননীবালা দেবী। তাই মতলব স্থির করে ফেললেন অনশন করবেন। অনশনের ১৯_২০ দিন চলছে, আবার ম্যাজিস্ট্রেট অনুরোধ করতে
এলেন।
ম্যাজিস্ট্রেট বললেন_আপনাকে তো এখানেই থাকতে হবে। কি করলে খাবেন বলুন?
ননীবালা দেবী জবাব দেন_আমার ইচ্ছা মত হবে?
_হ্যাঁ হবে।
_তাহলে আমার রান্না করবার জন্য একজন ব্রাহ্মণকন্যা চাই,দুজন ঝি চাই।
ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করলেন_ব্রাহ্মণ কন্যার কেউ আছেন এখানে?
ননীবালা দেবী বললেন_আছেন দুকড়িবালা দেবী।
_আচ্ছা তাই হবে।
এরপরের সমস্ত নতুন বাসন-হাঁড়িকুড়ি। ২১ দিনের পর ভাত খেলেন সেই অসামান্য দৃঢ়চেতা রাজবন্দী ননীবালা দেবী। সেই সাথে দুকড়িবালা দেবী কে ও পরিশ্রম এর হাত থেকে মুক্তি দিলেন। এই ভাবে দুই বছর বন্দী জীবন কাটিয়ে দিলেন। ১৯১৯ সালে অবশেষে ননীবালা দেবীর মুক্তির আদেশ এল। জেল থেকে ফিরে এলেন তাঁর পৈতৃক বাড়িতে। অথচ সেখানে ঠাঁই পেল না দেশের অন্যতম বিদ্রোহিনী নারী ননীবালা দেবী। প্রথমেই ছিল পুলিশের ভয়, দ্বিতীয় ছিল সামাজিক। তৎকালীন সমাজের এক বিধবা হয়ে শাঁখা-সিঁদুর পরে পর স্ত্রীর সাজা, এরপর পর পুরুষের সাথে এক ঘরে থাকা বা পেশোয়া তে যাওয়া, এসব কারণেই সমাজ তাকে মেনে নেয় নি। শুধু সমাজ নয়, তাকে গ্রহন করেনি নিজের বাড়ির লোকজন আত্মীয় পরিজনরা।অন্যদিকে তার নিজস্ব বিপ্লবী সংগঠন বা চেনাচেনা সবই ব্রিটিশ পুলিশের অত্যাচারে শেষ হয়ে গেছে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এমত অবস্থায় উত্তর কলকাতার এক বস্তিতে তাকে আশ্রয় নিতে হয়। আবার কারও মতে কোন পূর্ব পরিচিত অনুগ্রহে একটি কুঁড়ে ভাড়া করেছিলেন হুগলিতে। সুতো কেটে রান্নার কাজ করে কোনমতে আধপেটা খেয়ে দিন কেটে ছিল এক নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমী র।সমাজ এবং নিজের আত্মীয় স্বজনদের উপরে রাগে দুঃখে অপমানে তিনি সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, নিজেকে একপ্রকার লুকিয়ে রাখলেন। পরবর্তীকালে কোন দেশ নেতাদের কাছে গেলেন না। যে মহিলা নিজের জীবনের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে দেশের কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন, তিনি কোথায় গেলেন সে ব্যাপারে কেউ কোনো খোঁজখবর করল না।
সবথেকে দুঃখজনক ব্যাপার হল দেশ স্বাধীন হওয়ার কুড়ি বছর পরে ১৯৬৭ সালের মে মাসে তিনি মারা যান।যে দেশের জন্য তিনি এমন নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছিলেন,স্বাধীনতার ৭৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও তিনি বঞ্চিত রয়ে গেলেন। বেঁচে থাকাকালীন ও এমন দেশ প্রেমের খোঁজখবর নেয়ার প্রয়োজন টুকরো কেউ মনে করল না। ইতিহাস তো দূরের কথা, তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে মনে রাখেনি। একটা তথ্য সূত্র থেকে জানা যায়, কোন এক বিপ্লবী সাথীর চেষ্টায় অথবা পরাধীন জেলের খাতায় নাম থাকায় বেঁচে থাকা অবস্থায় পঞ্চাশের দশকে ৫০ টাকা পেনশন পেয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে, যদিও তার নির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই। তবে স্বদেশীদের নিয়ে তৈরি একটি বাংলা সিনেমায় (সিনেমার নাম ৪২) তাকে নিয়ে কিছু দৃশ্য ছিল, পাওনা বলতে শুধু এই টুকুই। বিধবাদের সধবা সাজতে নেই, দেশের স্বার্থে সধবা সেজেছিলেন, ছোট্ট কুঠুরি পানিশমেন্ট ছেলে শ্বাস নিতে না পেরে বহুবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, দুই বাটি লঙ্কা বাটা তার শরীরের গোপন অঙ্গে প্রবেশ করানো হয়েছিল,কেমন নির্মম অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেও বাংলার কোথাও তিনি সম্মানের সাথে জায়গা পেলেন না। স্বাধীন ভারতের বুকে এক নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমিকে অনাহারে কাটাতে হয়েছিল বহুদিন। যে দেশের মানুষ স্বাধীনতা প্রেমীদের সম্মান দিতে শিখেনি, স্বাধীনতা প্রেমীদের দুঃখ কষ্ট উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেনি, সে দেশের ভাগ্যে চরম দুর্দশা ছাড়আর কিছুই থাকতে পারেনা। যে দেশের রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের স্বার্থে এমন বহু নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমীদের কে ইতিহাসের পাতা থেকে বঞ্চিত করেছে সে দেশের ইতিহাস শুধুমাত্র মিথ্যা ছাড়া আর কি বা শিক্ষা দিতে পারে। আমরা যদি ইতিহাসকে একটু উপলব্ধি করার চেষ্টা করি, তাহলে বুঝতে পারবো প্রকৃত ইতিহাস ইতিহাস থেকে এতদিন আমরা বঞ্চিত হয়েছি। আমরা এমন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমীদের দেশপ্রেমের ইতিহাস জানার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ইতিহাসের পাতায়়় তাদের এতটুকুু সম্মান প্রদর্শন করার প্রয়োজনটুকুও বোধ করেননি কেউ।
এরই কারণে স্বাধীনতা লাভের ৭৪ বছর পরেও ভাবতে বাধ্য হই,সত্যিই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম তো?কারণ স্বাধীনতার এত বছর পরেও এ ভারতবর্ষের এক শ্রেণীর বর্বর মানুষ আজও সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি,দেশপ্রেমীদের সম্মান করতে শেখেনি,দেশের পতাকাকে অবমাননা করতে শিখেছি, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমীদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে।আজও ভারতবর্ষে উলঙ্গ জারোয়াদের দেখতে বাইরে থেকে লোকজন আসে।যে ভারতবর্ষের বুকে মানুষ এখনও অসভ্য ও উলঙ্গ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেই ভারত কে কিভাবে বলবেন,সভ্য দেশ।
অথচ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রী জেল খাটে।শুধু তাই নয়,জেল খেটে আসা নেতা মন্ত্রীদের জন্য ফুলের মালা নিয়ে বহু মানুষ জেলের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে। তাদের নামে স্লোগান দেওয়া হয়,জয়ধ্বনী দেওয়া হয়। মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিরা নেতা মন্ত্রী হয়ে যায়।গুন্ডা মস্তানদের হাতে চলে যায় সমাজের লাগাম। বিবেকবান,বুদ্ধিজীবী,শিক্ষিত যুব সমাজ মূর্খের মিছিলে রাজনৈতিক পতাকা নিয়ে পা মেলায়। মৃত্যুর পরে ও সেই সব অযোগ্য নেতা-মন্ত্রীদের মূর্তি স্থাপন করা হয়।এখন তো আবার পশ্চিমবাংলায় ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব করে, কিংবা পরকীয়ায় ধরা পড়ে গণপিটুনিতে মৃত্যু হলে আঞ্চলিক দলগুলির কৃপায় তাদের কপালে ও শহীদ তকমা জুটে যায়। মোড়ের মাথায় বেশ ঘটা করে তাদের মূর্তি ও বানানো হয়।এসব নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করেনা।অথচ প্রকৃত দেশপ্রেমীদের মূর্তি বা একটা ফুলের মালা তো দূরের কথা, জীবিত অবস্থায় দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান কেউ করে দেয় না। এভাবেই অবহেলায়,নীরব অভিমানে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী পৃথিবী ছেড়ে ছিল। তবে সমাজব্যবস্থা চলবে কালের নিয়মে,স্বার্থবাদী মানুষ থাকবে,আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গকারি নেতা মন্ত্রী থাকবে, ধর্ষক বিধায়ক থাকবে,তবুও তাদের মধ্যে থেকে খুঁজে নিতে হবে,নেতাজি,বিবেকানন্দ,বিদ্যাসা গর, ভগৎ সিং,ক্ষুদিরাম বসু, মাতঙ্গিনী হাজরা,ননীবালা দেবী'দের।যাঁরা সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত শুধুমাত্র দেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরে স্বপ্ন দেখতে থাকবে।
(তথ্য সংগৃহীত)
অর্চিসা ঘোষ
মুক্তগদ্য
ভালোবাসার সুর
সংহিতা ভৌমিক
"আমার ভিতরও বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে"রবি ঠাকুরের গানের এই লাইনগুলি যেন ওদের চোখে ভেসে উঠতো। হ্যাঁ অনিকেত আর সমৃদ্ধি মুখে কোনোদিন খোলাখুলি বলতে না পারলেও চোখে চোখে ওদের মন দেওয়া-নেওয়ার পালা শুরু হয়েছিলো অনেক দিন আগেই। চার মাস আগে এক গানের অনুষ্ঠানে ওদের পরিচয়। দুজনের কাছে গানই ছিলো দুজনের প্রাণ, আর তাই এই গানই অস্থির দুটি নিঃসঙ্গ মনকে কাছে এনেছিলো। সমৃদ্ধি শুনছিলো প্রেম হঠাৎ এসে যায় জীবনে কখন,কোথায়,কিভাবে ভালোবাসার বাঁধনে মন বেঁধে যায় তা রোমিও-জুলিয়েটও বলতে পারে নি, সেও বলতে পারবে না। নদী যে পথেই বয়ে চলুক সাগরের টানে তাকে মোহনায় এসে মিশতেই হবে। ভালোবাসার মধুর লয়ে তাল মিলিয়ে চলতে লাগলো ওরা। ভালোবাসায় মত্ত হয়ে ভুলেই গিয়েছিলো ভালোবাসা ছাড়াও এক জগৎ আছে,সমালোচনায় বিদ্ধ রূঢ় মনুষ্য জগৎ,যে জগৎ ওদের কাছে অপরিচিত।পরিচয় হলো সেদিন, যেদিন সমৃদ্ধির বাবা ওদের গোপন ভালোবাসার কথা জানতে পেরে সমৃদ্ধির গায়ে প্রথম হাত তুলেছিলো। সোনার চাদরে যে মেয়েকে জড়িয়ে রেখেছিলো তার বাবা, ভালোবাসা কি তা বুঝতে পারলো না সেই বাবা।ভালো লাগে তাই ভালোবেসেছি এই কথাটা বোঝাতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো সমৃদ্ধির।অনিকেতের সাথে যোগাযোগের সমস্ত উপায় বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো, তাই সমৃদ্ধি বোঝাতে পারলো না অনিকেতকে ওদের অপরাধ কোথায়,উচ্চ নীচের ভেদাভেদ কেনো ওদের ভালোবাসার প্রাচীর হলো। কয়েক দিন পর এক ধনী উচ্চ শিক্ষিত সরকারি চাকুরিজীবী ছেলের সাথে সমৃদ্ধির বিয়ে হয়ে গেলো। নিজের ভালোবাসার পছন্দ করা মানুষটিকে বিয়ে না করে বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করেছিলো সমৃদ্ধি। অনিকেত বোঝেনি সমৃদ্ধিকে, সে ভাবেছিলো ধনী বাবার একমাত্র মেয়ের হঠাৎ কিছু সময়ের জন্য পুতুল খেলার ইচ্ছে হয়েছিলো, তাই ভালো খেলনা পেতেই মাটির খেলনাকে ছুঁড়ে ভেঙ্গে ফেলেছে। অনিকেত সেদিন হারিয়ে ফেলেছিলো তার প্রেমকে আর গানকে,
হ্যাঁ সেই গানের সুরকে, যে সুরে তারা খুঁজে পেয়েছিলো তাদের ভালোবাসার সুর ।।
ভ্রমণ
দার্জিলিং - এর পথে
অপর্না ঘোষ
সে বছর পুজো কাটতে না কাটতেই হেমন্ত এসে গিয়েছিল।সন্ধ্যের বাতাসে হিমের স্পর্শ যেন মনের সুপ্ত বাসনা কে আন্দোলিত করে।আর সেই মুহূর্তে দার্জিলিং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।তড়িঘড়ি করে পরের দিন বেরিয়ে পড়ি সেই সুদূরের পিয়াসী মন নিয়ে অধরা প্রকৃতির বুকে সৌন্দর্য সন্ধানে দার্জিলিঙে।
প্রথমে আমরা শিলিগুড়ি রওনা দিই ,তারপর ছোট গাড়িতে জানালার ধারে বসে বাইরের দিকে চোখ রেখে অসীম অনন্ত নীল আকাশের নীচে প্রকৃতি সুষমার এই পাহাড়ের সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল।আমাদের গাড়ি পাহাড় ঘেঁষে যত উঁচুতে উড়তে থাকে ততই মনের মধ্যে শিহরণ জাগে।অপরদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্য দর্শনের আনন্দে দিশাহারা হয়ে পড়ি। সবথেকে আনন্দের মুহূর্ত ছিল সেই সময়টা যখন পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে আর অপরদিকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে এগিয়ে চলছে এঁকেবেঁকে ট্রয় ট্রেন। কি দারুণ দৃশ্য ! একেবারে মন কেড়ে নেয়। চোখে পড়ে না না রংবেরঙের অজানা ফুল ,নানা প্রজাতির পাখি কোথাও দেবদারু ও পাইন ঘেরা বনানী।তারপর আবার পাহাড়ের ময়দানে ভেসে বেড়ানো সাদা কালো থোকা থোকা মেঘ যেন পরিবেশকে একেবারে রোমাঞ্চকর করে তুলেছে। এই মুহূর্তে মনে পড়ে যায় "বলাকা কোন গগনে উড়ে চলে"।এর কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছালাম কার্শিয়াং-এ। সেখানে প্রথমেই চোখে পড়ে সুদূরের রেডিও স্টেশন ।তারপর পৌঁছালাম দার্জিলিং-এ। সেখানে এক হোটেলে থাকার বন্দোবস্ত করলাম ।যথাস্থানে স্নান খাওয়া সারার পর আরামে এক হয়ে গিয়েছিল বিরামহীন দুচোখের পাতা। তারপর বিকেলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ক্লান্তির অবসান ঘটিয়ে খাড়া ঢাল -এর উপর পা টিপে টিপে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম প্রসিদ্ধ স্থান ম্যালে ।এই স্থানে অনেক পর্যটকেরা আসেন । বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যখন টিফিন করছি তখন মাথার উপর মহাশূন্যে আসমানী রঙে মিশে যাচ্ছে বিদায়ী সূর্যের রাঙ্গা আলো, জ্বলে উঠলো পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য বিজলিবাতি আর পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট কাষ্ঠ নির্মিত কুটির পাহাড় কে আরও সৌন্দর্য্য সুষমামন্ডিত করে তুলেছে ।এরপর হোটেলের দিকে রওনা দিই। হোটেলে পৌঁছে খাওয়া-দাওয়া সেরে কোনরকম বিলম্ব না করে নিদ্রাদেবীর শরণাপন্ন হলাম ।পরদিন যথাসময়ে টাইগার হিলে সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য দেখলাম। তখন মনে হচ্ছিল যদি মেঘ থাকে, যদি কুয়াশা থাকে, কিন্তু ভাগ্য আমাদেরকে বঞ্চিত করে নি ,প্রকৃতি আমাদের পক্ষেই ছিল। যখন সূর্য উদয় হচ্ছে তখন মনে হচ্ছিল টাইগার হিলের গর্ভ থেকে ডিমের কুসুমের ন্যায় জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড রক্তিম আভায় চারিদিকে যেন বিচ্ছুরিত করে তুলেছে ,যা জন্ম জন্মান্তরেও ভুলব না। এরপর আমরা এগুলাম বাতাসিয়া লুপে সেখানে নানান ধরনের রংবেরঙের পাহাড়ি ফুলের বাগান।তারপর দূরবীন এর সাহায্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখলাম মনে হচ্ছিল যেন সাদা বরফের চাদর দ্বারা আবৃত এই কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়। পরদিন রওনা হলাম চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পশু পাখি দেখলাম। তবে সবচেয়ে নীল গাই ও বলগা হরিণ আমাকে আকর্ষণ করেছিল। এই চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছিল আমাদের। পরের দিন মহাকাল মন্দিরে মাকে দর্শন করে পুজো দিয়ে রক গার্ডেন দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হই ।সেখানে তরঙ্গায়িত জলোচ্ছ্বাস ও ঝর্ণাধারা দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি। মনে হচ্ছিলো এখনই যদি সেই ঝর্ণাধারায় শরীরটাকে একটু ভিজে নিতে পারতাম তাহলে জীবনটা ধন্য হয়ে যেত। এরপর বুদ্ধ মন্দিরে বুদ্ধদেবকে অনুসরণ করে রাস্তায় নেমে পড়ি রোপওয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ সার্থক হতে দেয়নি। এর কিছুক্ষণ বাদে ম্যালে গিয়ে পৌঁছালাম । তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এলো আমাদের কাছে এক ঘোড়সওয়ার ।ঘোড়ায় চড়ে অনেকটা সময় কাটালাম। তারপর পৌঁছালাম আমরা আমাদের গন্তব্য স্থানে ।সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তির অবসান ঘটিয়েছে পাহাড়ি এলাকার সৌন্দর্য দর্শনে ।কিন্তু সবচেয়ে বড় বেদনাদায়ক করে তুলেছে সেখানকার মানুষের কষ্টকর জীবন যাত্রা দেখে। পাহাড় দূর থেকেই সুন্দর লাগে কিন্তু নিকটে যে কি ভয়ংকর তা এই পাহাড়ি বাসিন্দাদের দেখলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এই পাহাড় কে সুন্দর গরিমায় গড়ে তোলার কৃতিত্ব শুধুমাত্র পাহাড়ি বাসিন্দাদের ।
যদিও এই ভ্রমণের সৌন্দর্য ভাষায় ব্যাখ্যা করা খুবই কঠিন তবুও মনের মধ্যে যে চিন্তন শক্তি পাহাড়ের সৌন্দর্যকে স্থান দিয়েছিল ,তাই আমার লেখনিতে প্রকাশ।
No comments:
Post a Comment