মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
প্রচ্ছদ- অঞ্জলি অধিকারী
মুজনাই অনলাইন কার্তিক সংখ্যা
সূচি
শ্যামলী সেনগুপ্ত, চিত্রা পাল, গৌতম চক্রবর্তী, নন্দিতা পাল, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, শ্রাবণী সেন, কৌশিক মিত্র, মিতা বিশ্বাস বসু, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, রীতা মোদক, রাজেশ প্রামানিক, মাথুর দাস, রীনা মজুমদার, মৌসুমী চৌধুরী, স্বপন কুমার চট্টোপাধ্যায়, আকাশলীনা ঢোল, উমা শঙ্কর রায়, অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত, অলকানন্দা দে, শতাব্দী সাহা, সুদীপ দাস, বিজয় বর্মন, নিত্য রঞ্জন মণ্ডল, কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণ, মজনু মিয়া, সৃজা রায়, অদ্রিজা বোস, তানভি দাম
দীপাবলি ভাবনা
পাদপূরণ কে করবে?
শ্যামলী সেনগুপ্ত
আলোর উৎসবে
চিত্রা পাল
এসে গেল আলোর উৎসব
দীপাবলি।ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে তামসী জয় করবার উৎসবই দীপাবলি উৎসব।তার সঙ্গে যুক্ত
হোক আপন অন্তরের আলো জ্বালারও উৎসব।জীবন সদাই আলোক অভিসারী। সেই কোন অতীতে বৈদিক
যুগে মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে আমাদের প্রার্থনা ছিল অসতো মা সদ্গময়/তমসো মা
জ্যোতির্গময় /মৃত্যোর্মামৃতং গময়।এ কোন সাধারণ কথা নয়, একেবারে মানব মনের অন্তরের
কথা। গতানুগতিক মানুষ সে আলোক অভিসারী হয়
না,বরং প্রাত্যহিক জীবনের হিংসা, দ্বেষ, দ্বন্দ্ব আর কলুষতার আঁধারে হয়
ক্লীন্ন,খিন্ন সম্বলহীন রিক্ত।আজকের দিনকাল যেন সেই বার্তাই বহন করে। সূর্যগ্রহণের
অন্ধকারে ক্রমশঃ আচ্ছন্ন দিনের মতো আজ সারা পৃথিবী জুড়ে যেন চলেছে সেই অশুভ শক্তির
ছায়া।সব মানুষই যেন উৎকন্ঠিত, ভীত এই করাল ছায়ায় যেখানে মনুষ্যত্ব হতেছে
পীড়িত,অবনমিত দলিত।হিংসায় উন্মত্ত পৃথী আজ নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্বে জর্জরিত। সে
অভিঘাতে আহত শিশু থেকে বৃদ্ধ সবমানবকুল।হিংসা,দ্বেষ,ঈর্ষা ধ্বংস করছে সমস্ত মানবিক
গুণ,যা যুগ যুগ ধরে মানব আহরণ করেছে,তার
ঐকান্তিক চেষ্টায়,ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছে নিজেকে পৃথিবীর সব প্রাণীদের ওপরে।
কারণ মানুষ বুঝেছে সে আলোর পথযাত্রী,সে
করবে অনাগত পুর্ণতাকে বাস্তবতর সত্য।লোভের চাঞ্চল্য সর্বত্রই পীড়ন করে চলেছে
আমাদের সমাজকে বিভিন্নভাবে। কোথায় হারিয়ে
যাচ্ছে মনের শক্তি যা মানুষের নিজস্ব হাতিয়ার।যুগে যুগে কখনো কখনো আমাদের মাঝে
মানুষের বেশে মহামানবের আবির্ভাব হয়,যিনি এই সর্বব্যাপী অন্ধকারকে ছিন্ন করে আলোক
বর্তিকা প্রজ্জ্বলন করেন দৃপ্ত প্রতাপে আপন
আন্তরিক শক্তিতে আপনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে, সে আলোক ছড়িয়ে যায় দেশ হতে দেশান্তরে
কাল হতে কালান্তরে।হিংসা, দ্বেষ যেভাবে মানুষকে দুর্বল করে তার থেকে সহস্র গুণ
শক্তি ধরে অহিংসা, প্রেম তার আপন ক্ষমতায়.।মানবের ইতিহাসে এই আলোকাভিসারই আমাদের চিরস্থায়ী সম্পদ। দীপাবলী যেন আমাদের সেই
আলোকের পথেই এগিয়ে দেয়।
আলোর উৎসব দীপাবলি
গৌতম
চক্রবর্তী
কেউ
বলেন চোদ্দ বছর বনবাস কাল কাটিয়ে যেদিন সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরেছিলেন, সেই আনন্দে গোটা অযোধ্যাতে আলোর বন্যা
বয়ে গিয়েছিল। সরযু নদীতেওভেসেছিল প্রদীপের আলো। সেই থেকেঅযোধ্যাতে
পালিত হয় দেওয়ালি উৎসব।রাজস্থানীরা
কিন্তু প্রদীপ জ্বালায় রাজা বিক্রমাদিত্যের এই দিনে রাজ্যাভিষেক-এর কথা মনে রেখে। দক্ষিণ ভারতের
লোকেরা এই উৎসবকে বলে দীপাবলি। তাদের প্রচলিত বিশ্বাস হল ভগবান বিষ্ণু
বামন অবতার হয়ে বলীকে নিধন করেন এই দিনটিতেই। আবার কৃষ্ণের
হাতে দেওয়ালির দিনে নরকাসুর বধ এর উপাখ্যানও চালু রয়েছে।আসলে ভারতীয় সব ধর্মেই
কার্তিকী অমাবস্যায় দেওয়ালি উৎসবের প্রথা চালু আছে। যদিও উপলক্ষ বিভিন্ন।এই দিনে বুদ্ধদেব গৃহত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর শিষ্য
মহামোগলায়নের পরিনির্বাণ হয় বলে বৌদ্ধরা দীপ প্রজ্জ্বলন করে। এই দিনে মহাবীরের নির্বাণ লাভ উপলক্ষে জৈনরা যেমন তাঁর
স্মরণে প্রদীপ জ্বালায়, তেমনি শিখ গুরু স্বামী রামতীর্থের এই দিনে জন্ম এবং
মৃত্যুদিন হওয়াতে শিখেরা বিভিন্ন গুরুদ্বার এবং বাড়িতে আলো জ্বালায়। কেউ কেউ মনে করেন এই দিনেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ লক্ষ্মী
দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। গীতা অনুযায়ী এদিন গোবর্ধন পর্বতকে আঙ্গুলে ধরে নিজ বাসভূমিকে ভয়াবহ
বন্যার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাই এই আলো এবং বাজির আনন্দ উৎসব।বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে দীপাবলীর তাৎপর্য অনেক
গভীর। কারণ এই দিনে সম্রাট
অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিনে নরক চতুর্দশীতে নরকাসুর বধ হয়েছিল। এই নরকাসুরের রাজপাট ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর বা বর্তমান
আসামে।
পিতৃপক্ষেযমলোক থেকে পিতৃপুরুষের আত্মারা
শ্রাদ্ধ গ্রহণের পরে তাদের প্রত্যাবর্তনের পথটি আলোকিত করার জন্য আলো জ্বালানোর
একটি প্রথা ছিল। আজকের দীপাবলীর
উৎসসম্ভবত সেখান থেকেই হয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। আল-বেরুনীরভ্রমণকাহিনীতে অথবা আবুল ফজলের
আইন-ই-আকবরীতে প্রাচীন ভারতের দীপাবলিউৎসবের বর্ণনা পাওয়াযায়। এদেশের দীপাবলিতে চিরাচরিতমোম আর প্রদীপের আলোর উৎসবের
সঙ্গে আতশবাজিও যুক্ত হয়ে যায়। এখানকার দক্ষ বাজিকরেরাবাজি দিয়ে বানাতেন নানা ধরনের দেবীমূর্তি, গাছপালা এবং জন্তু জানোয়ার। কলকাতায় লাটুবাবু ছাতুবাবুর মত অনেকবাবুই নানান
ধরনের বাজিপুড়িয়ে তাদের ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতা প্রদর্শন করে গেছেন।জানবাজার,খিদিরপুর এবং উত্তর কলকাতার অনেক স্থানেই হত বাজি পোড়ানোর উৎসব।সেইকালে বাজি তৈরি করার ব্যাপারে চীনাদের দারুণ
দক্ষতা ছিল।নানান ধরনের মূর্তি
তাদের বাজিতে জীবন্ত হয়ে উঠত। কালক্রমে বৈদ্যুতিক আলোর রোশনাই আর ভেলকি এই দীপাবলিতেও চলে আসে।
আশ্বিন মাসের অমাবস্যায়মহালয়ার মাধ্যমে মা
দুর্গার আগমনের উৎসব সূচিত হয়। অন্যদিকে কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে শ্যামা মায়ের আরাধনার মাধ্যমে আমরা
পালন করি দীপাবলিউৎসব। দীপাবলী আলোর উৎসব। বাংলারপ্রাঙ্গণ জুড়ে আলোর উৎসবে মেতে ওঠেআট থেকে
আশির আপামর মানুষ জন। নিজেদের বাসগৃহ, দোকান এবং অফিস সুসজ্জিত হয় আলোকসজ্জায়। স্কেল,ফিতা এবং শব্দদূষণ যন্ত্র দিয়ে মাপামাপির নাটক হলেও বিধি-নিষেধকে
থোড়াই পরোয়া করে শব্দ বাজির দাপট দেখা যায় শহরের আনাচে কানাচে। দীপাবলির ঠিক দু'দিন আগে থেকে ধনতেরাসউৎসব উদযাপনের
মধ্য দিয়েদিপাবলীউৎসবের প্রকৃত সূচনা। প্রথম দিন ধনতেরাস। পরের দিন যম দীপদান তথা নরক চতুর্দশী বা ছোট দেওয়ালি,তৃতীয় দিন দীপাবলীর প্রধান উৎসব এবং চতুর্থ
দিন গোবর্ধন পূজা। ধনতেরাস হয় কার্তিক
মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশ দিনে। তাই এর অপর নাম ধন ত্রয়োদশী। ধন কথার অর্থ সম্পত্তি এবং ত্রয়োদশী কথাটির অর্থ তের। অর্থাৎ ত্রয়োদশীতে সমৃদ্ধির দেবী মা লক্ষ্মীর
আরাধনা।চোদ্দপুরুষের
উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সংস্কার হিসেবে চোদ্দ শাক খাওয়া হয়এবংচোদ্দ প্রদীপ
প্রজ্বলিত করা হয়। দীপাবলীর বাংলাতে
প্রত্যেক বাড়িতেবাড়িতে নিয়ম-রক্ষার মাটির প্রদীপের সঙ্গে বৈদ্যুতিক আলোর
সংমিশ্রণে প্রজ্বলিতহয় দীপাবলীর আলোক।এই আলোকসজ্জায় সজ্জিত শহর প্রাণোচ্ছল আনন্দ প্রকাশ এবং মানসিক সুস্থতার
বিকাশের সহায়ক।
জলপাইগুড়িতেকালীপুজোর বিশেষ ঐতিহ্য অথবা পরম্পরা হিসাবে আজও অম্লান। কতদিন আগে জলপাইগুড়ির মানুষ পাহাড় বানিয়েছিল তার
ইতিহাস বা উদ্দেশ্য গবেষণার বিষয়। দাদু ঠাকুমাদের অনুসৃত পন্থাকে পাথেয় করে কচিকাঁচা নাতিপুতিরা একুশ শতকেও
বানায় রকমারি পাহাড়।পাহাড় আকৃতিতে ছোট
হলেও আধুনিক কিছু জিনিসপত্র বাজার থেকে
কিনে পাহাড় সাজাতে হয় বলে যেখানে যত বড় পাহাড় সেখানে ততোই খরচ। কিন্তু খরচ সত্ত্বেও নিষ্ঠার অভাব নেই কচিকাঁচাদেরপাহাড়
বানানোর কলা-কৌশলে। আসলে জৌলুসনয়,নিষ্ঠার
প্রতি অবিচলতাই মানুষের ঐতিহ্য হওয়া উচিত।উৎসব আর উৎসাহ শব্দদুটি যেভাবে আপামর বাঙালি তথা
ভারতবাসীর সঙ্গে জড়িয়ে আছেতার সর্বোত্তম প্রকাশ শারদীয়া থেকে শুভ দীপাবলীর এই
সুদীর্ঘ মরসুমে।প্রাদেশিকতার সীমারেখা
লুপ্ত প্রায় বলেই দক্ষিণ ভারতীয়দের ধনতেরাসে সোনার কয়েন কেনা আমাদের জীবনের
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। দুর্গাপুজোর মতোই দীপাবলীরও সর্বভারতীয় রূপ পূর্ণতা পায় যখন স্থান-কাল-পাত্রর
বিভাজন ভুলে শুভশক্তির আগমনে অশুভ শক্তির বিনাশ এর ভাবনায় সমগ্র দেশবাসীসামিল হয়
তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক উপাচার আর ধর্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে।বলাই বাহুল্য, শুধু দীপাবলি বা ভাইফোঁটা নয়, ধনতেরাসকে ঘিরে বাঙালি বা আসমুদ্রহিমাচল আমজনতার উৎসাহ
এবং উদ্দীপনা যেভাবে বাড়ছে তাতে বলা যায় ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাদেশিকতার মেলবন্ধন এবং
বিশ্বাসের সঙ্গে শ্রদ্ধা এ যেন আক্ষরিক অর্থেই বিবিধের মাঝে মহামিলন।
আশ্বিন মাসের অমাবস্যাতে কালীপুজোর অপর নাম
দীপান্বিতা কালীপূজা।পুরাকালে যে কালীপুজোর
উল্লেখ পাওয়াযায় তার নাম চামুণ্ডাচর্চিতা কালী পূজা।বাংলায় বর্তমান কালীমূর্তি এবং কালীপুজোর প্রবর্তক
ছিলেন নবদ্বীপের পন্ডিত কৃষ্ণানন্দআগমবাগীশ।এই পুজোকেজনপ্রিয় করে তুলেছিলেন নদীয়ার রাজা
কৃষ্ণচন্দ্র।বর্তমান কালীমূর্তি
প্রবর্তন এর আগে তামার পাত্রের উপর কালীর অস্ত্র এঁকে অথবা খোদাই করে কালীপুজোহত। কলকাতার কালীঘাটে এদিন কালীকে লক্ষ্মী রূপেও পূজা করা
হয়।অনেক জায়গাতেই মা কালীর সঙ্গে সাধক বামাক্ষ্যাপা
এবং রামকৃষ্ণকেও পুজো করা হয়।দীপাবলি উৎসব মূলত পাঁচদিনের।এর শুরু হয় ধনতেরাস দিয়ে এবং শেষ হয় ভাতৃদ্বিতীয়া উৎসব দিয়ে।ভারতীয় তন্ত্র এবং পুরাণে শক্তির প্রতীক হিসেবে যে
রাত্রি দেবীর কল্পনা করা হয়েছে তাইপরবর্তীকালে কালীর রূপ প্রকাশ বলে অনেকেই
অনুমান করে। কালিদাসের
পরবর্তীকালে সংস্কৃত সাহিত্যে কৃষ্ণবর্ণা এক ভয়ংকরী উন্মাদিনী রক্তলোলুপা দেবীর
উল্লেখ মাঝেমধ্যেই পাওয়া গেছে। মার্কন্ডেয়পুরাণে কালীর আবির্ভাব রহস্য বর্ণিত হয়ে মহাদেবী চন্ডীকার
সঙ্গে তাঁকে যুক্ত করা হয়েছে। অনুমান করা হয় সেই সময় থেকেই কালী ব্রাহ্মসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
বিজয়া দশমীর পর বিষন্ন বাংলা আবার নতুন করে আলোর মালায় সেজে আনন্দে মেতে ওঠে কালীপুজো এবং দীপাবলিকেঘিরে। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক অসুরের অত্যাচারে দেবগণ যখন দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হন, তখনই দেবী দুর্গার অঙ্গ থেকে জন্ম হয় কালীর। তখন তার নাম ছিল কালভৈনাশিনী। তিনি যুদ্ধে অসুর নিধন করেন। কিন্তু হত্যার নেশায় মত্ত দেবী যুদ্ধ শেষ হবার পরেও সেই নেশায় বুঁদ হয়ে সামনে যাকে পান তাঁকে হত্যা করতে থাকেন। এই অবস্থায় জীবজগতকে দেবীর কোপ থেকে রক্ষা করতে দেবীর যাত্রাপথে মাটিতে শুয়ে পড়েন দেবাদিদেব মহাদেব। নর মুন্ডমালায় সজ্জিততাণ্ডবে মত্ত দেবী অজান্তে ইশিবের বুকে পা তুলে ফেলতেই সম্বিত ফিরে পান আর এই অপরাধের জন্য লজ্জা এবং ক্ষমা প্রার্থনায় নিজের জিভ বের করে ফেলেন। পরবর্তীকালে এইভাবেই দেবী কালীকে শত্রু বিনাশিনী হিসাবে পুজো করা শুরু হয়।
আকাশে কার ব্যাকুলতা
কৌশিক মিত্র
মাথার ভিতর লাল হলুদ আগুনের ফুলকি, শরীরের প্রতিটি কোষে অপার আলস্য আর
বিচ্ছিনতার বীজ। একটি কৃষ্ণ সর্প শ্লথ এবং বঙ্কিম ভঙ্গিমায় সত্তায় নিবেশিত হইতেছে।
ইহা কুন্ডলিনীর চলনের ঋজুপথ নহে।
বিপুলা এ পৃথিবী গভীর সুষুপ্তিতে আচ্ছন্ন।
-“অবসাদ তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?”
-“তোমার পিতৃপুরুষের ক্রোমোজোম হইতে”
-“সুপ্ত থাকিতে পারিতে। না হয় বাহক
হইতাম। কিন্তু আক্রমণ কেন?”
-“যদি বলি বধার্থ। শব্দখানিতে রুচি হইবে
কি? তোমার
এ প্রশ্নখানি মূঢ়ের নায় সন্দেহের তিলমাত্র নাই। আমি তোমাতে উপগত হইয়াছি এক ভয়ানক
সাধনার নিমিত্ত। তোমার চেতনা এবং আমার সত্তার মিলিত সাধনায় আমরা বিলীন হইব
শূন্যতায়। আমি পুরুষ ,তুমি প্রকৃতি-এইরূপে নিজেকে কল্পনা করিও-শান্তি লাভ করিবে।”
-“আমি কিছুই বুঝিতেছি না। এক করাল
দংষ্ট্রাল তমিস্রা আমাকে গ্রাস করিয়া লইতেছে। তুমি আমাকে মুক্তি দাও অবসাদ”
-“নির্বোধ বালক। মূঢ়ের ন্যায় আচরণে
নিবৃত্ত হও। বহু জন্মের সাধনায় তুমি আমাকে লাভ করিয়াছ। হাজার বছর ধরিয়া আমি তোমার
পিতৃপুরুষ দিগের জিনে ফিরিয়া আসিতেছি শুধুমাত্র আধারের সন্ধানে। মেলে নাই। ব্যর্থ
সাধকের দল শমন সদনে প্রেরিত হইয়াছে। স্মরণে রাখিও এই সংসার কটাহে সকল প্রাণী মার
উদ্দেশ্যে বলিপ্রদত্ত, অতএব বৃথা কালক্ষয় না করিয়া আমার শরণে আসিয়া শূন্যতার সাধনা কর।
সাংখ্যের কথা ভুলিও না। এই সাধনায় নিবৃত্তি নাই আছে মুক্তি, হয় তুমি সিদ্ধ হইবে নয়
পূর্বপুরুষদিগের ন্যায় কৃতান্ত সদনে প্রেরিত হইবে।”
“আমি ক্লান্ত, আজ মুক্তি দাও।“
“বেশ সাধনার্থ নিজেকে প্রস্তুত করিতে
থাক! আমি পুনঃ আসিব। আমি বারংবার আসিয়াছি। তুমি চিনিতে পার নাই।”
স্তব্ধতা খানখান হইয়া কক্ষে ছড়াইয়া পড়িল।
বিঃদ্রঃ- রামকৃষ্ণদেব বলতেন-"ওরে
মোড় ঘুরিয়ে দে।" সত্যিই ত, ধ্বংসকামী শক্তিকে মাঙ্গলিক করে তোলার চেয়ে মহত্তর
সাধনা এই মানবজন্মে আর কিছু আছে কি?
দীপাবলি গল্প
ছবি: লেখক
রীতা মোদক
ঠক ঠক শব্দ কানে আসতেই লতা ধরপর করে বিছানা থেকে নামে l দরজা খুলে শাশুড়িকে দেখে মনে পরল আজ তো ভুত চতুর্দশী,শাশুড়ি- বউ মিলে চোদ্দশাক খুঁজতে যাওয়ার কথা l তাই বলে ভোর পাঁচটায়? ঘুমে চোখ যে খুলতেই ইচ্ছে করছে না l আবার শাক খোঁজার বাহানায় বনে জঙ্গলে ঘোরার লোভটা ও লতা সামলাতে পারছে না। সবুজ ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু, ঘাসে ঘাসে ঘাস ফড়িং আর প্রজাপতির খেলা ,মাঠ ভরা পাকা ধান--- কতদিন দেখা হয়নি l তাই দেরি না করে কোনোরকমে একটা শাড়ি পড়ে লতা বেরিয়ে পরলো তার প্রিয় ক্যামেরাটা নিয়ে l শাশুড়ি চোদ্দ শাক খুঁজে বেড়ায় আর লতা অবাক চোখে দেখে --- কচু পাতায় জমে থাকা শিশিরের দিকে।রাস্তার পাশের দিঘিতে শালুক ফুটেছে প্রচুর।
দেখতে দেখতে কালী পূজা চলে এল।লতা সান্ধায় শ্বাশুড়িকে নিয়ে কলা গাছের খোল দিয়ে ডোঙ্গা বানিয়ে করে সুটুঙ্গার জলে প্রদিপ ভাসিয়ে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় প্রদিপ জ্বালল।ননদকে কলা গাছের ডান্টায় তেল মাখিয়ে কাজল পাততে দেখে লতার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পরছে।লতার বর বিষয়টা বুঝতে পেরে চুপচাপ সরে গেল।
ভাইফোঁটার দিন লতার বর আর ভাসুর পাঞ্জাবি পরে আসনে বসলো। ননদ সুন্দর করে দুই ভাইকে ফোঁটা দিল,উপহার পেল।লতা কেবল কেঁদে চলছে...। হঠাৎ বরের ডাকে লতার চমক ভাঙলো, -----
এই লতা শুনতে পারছ না?
--- অ তুমি?কিছু বলবে?
--- এই নাও।
কি আছে এতে?
লতা তো ঢাকনা তুলতেই অবাক---
একটা বাটার মধ্যে ধান -দুব্বা, মিষ্টি ,নারকেল নাড়ু পাঞ্জাবী। কিন্তু কাকে ফোটা দেবে লতা? তার তো কোন ভাই বা দাদা নেই?
---কি ব্যাপার, আর কতক্ষণ বসে থাকব বোন?
লতা আবার ও চমকে উঠে।
আরে বোন বলে কে ডাকলো?
----ভাসুর- টাসুর ভেবে আর লজ্জা পেতে হবে না।আজ থেকে আমি তোমার দাদা হলাম।
লতা বাটা নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোয়। হাতে ভাইফোটা দেয় আর মনে মনে বলে,
ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা
যমুনা দ্যায় জমকে ফোঁটা
আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা।
লতার দু'চোখ বেয়ে আমার জল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এ জল দুখের নয়,আনন্দের।
দীপাবলি
মাথুর দাস
জ্বালিয়ে প্রদীপ চতুর্দিকে, জ্বালিয়ে আলো বাতি,
হিন্দু পরিবার করে লক্ষ্মীপুজো নানা উপচারে ;
আলোর ঝলক পলক ক্ষণে ঘোচায় আঁধার রাতি,
তারই মধ্যে হয় কালীপূজা পালিত আড়ম্বরে ।
ধনতেরাসে শুরু হয়ে ভাইফোঁটাতে শেষ,
পাঁচ দিনের এ আলোর উৎসব হলে হবে কি ;
আশ্বিন-কার্তিক জুড়েই থাকে যে তার রেশ,
স্বর্গবাতি সারা রাতই জ্বলতে থাকে ঠিকই ।
দীপাবলি দীপ-আবলি, যা বলি তা তুচ্ছ নয়,
বিজয়ীর আখ্যান তো ধরেই রাখে শাস্ত্র পুরাণ ;
আলোয় আলোর রশ্মিচ্ছটা উদ্ভাসিত পুচ্ছময়,
মন-কালিমা দূরীভূত, উজ্জীবনের স্বপ্ন-উড়ান ।
এক দীপান্বিতার রাতে
আকাশলীনা ঢোল
বাতাস জুড়ে পোড়া বারুদের
ঝাঁঝালো গন্ধ,
গৃহস্থের প্রাঙ্গণে দীপমালা-
মন্দিরে-মণ্ডপে কাঁসর-বাদ্য,
অমানিশার রাত, শক্তির আরাধনা।
এমনই এক দীপান্বিতার রাতে
হেঁটে দেখেছিলাম নগরের পথে পথে।
দেখেছিলাম, সেখানে মহামায়ার
মৃন্ময়ী রূপ পূজিত হয়-
চিন্ময়ী হয় অপসৃত।
একদিকে আদ্যাশক্তি-এলোকেশী,
তাঁর পায়ের তলায় আলোর নাচন,
আর অপরদিকে রুক্ষ চেহারার চিন্ময়ী-
তার কোলের কাছে অভুক্ত শিশুর ক্রন্দন।
একদিকে প্রার্থনা শ্যামার কাছে
আলোকোজ্জ্বল দিনের,
অপরদিকে রয়েছে, শ্যামাঙ্গীর
গহন আঁধারে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।
একদিকে দীপাবলির আলোর রোশনাই,
অপরদিকে, অমানিশার গাঢ় অন্ধকার।
একদিকে শিল্পীর হাতে গড়া
আদ্যাশক্তির পূজার্চনা,
অপরদিকে, রক্ত-মাংসে গড়া দেবীর
চির অবহেলা ।
এমন কিছু দৃশ্যই দেখেছিলাম,
নগরের রাজপথে-
সে এক দীপান্বিতার রাতে।
দীপ জ্বেলে যাই
হীরক রাত্রি
অলকানন্দা দে
খেয়ালের খেয়া বেয়ে
কেবল আকাশ দেখা,
সুহাসি উড়াল মেঘে
প্রাচীন গরিমা আঁকা!
হাস্যচপল হাওয়া
শারদীয়া মিতালি,
কোজাগরী সমাধায়
আলাদিন দীপালি!
দ্বিধাহীন দীপমালা
চৌদ্দটি প্রদীপে,
একমনে দেয় আলো
মরমের সমীপে!
পুরানো রাত্রি পরে
আতসবাজির হার,
হেমন্ত জানালায়
বিনিদ্র সংসার!
মেদুর আকাশকোণে
শুকতারা ধরে গান,
স্মৃতিপটে বেহিসেবী
শরতের সম্মান!
শেষহীন দীপাবলি
ভূলোকের উঠোনে,
গর্বের দিনকাল
ভালোবাসা গঠনে!
বিভেদের ছিঁড়ি জাল
একতার করি স্তব,
একান্ত মৈত্রীর
শতাব্দী সাহা
নিস্তব্ধের অতলান্ত গহ্বরে
শব্দ প্রস্ফুটনের আলোড়ন
যুগযুগান্ত হতে শোনা
ঘুমপাড়ানি গানের সুরে
চিরনতুন খুশির ঢেউ বয়ে বেড়ায়,
বেড়াতে ভালোবাসে।
আলো আঁধারে
খুলে রাখা ঝাঁপির মুখ উপচে
মান অভিমান
কুয়াশার ভোর
মাঠের দুপুর
শীতের সন্ধ্যে
খেলার সাথী
এক লম্বা তালিকা...
গোঁত্তা খাওয়া ঘুড়ির সাথে ঘুরে বেড়ায়,
বেড়াতে ভালোবাসে।
খরচের খাতা থেকে
বেঁচে যাওয়া দিনে
আবার কথার ডালি
থেকে নতুন গল্পের স্ফুলিঙ্গে
আলোর শামিয়ানা টানিয়ে নিয়ে,
দুঃখ বোঝাই বাক্সপ্যাঁটরা
রংবেরঙ ফানুস সাথে উড়ে বেড়ায়,
বেড়াতে ভালোবাসে।
নেপথ্য
সুদীপ দাস
নি:শব্দ বৃষ্টি অবিরাম, কিন্তু
বাইরে না তাকালে বোঝা দায়
রাস্তা ভেজা, ভেজা গাছ,পাতা,ঘাস
আরও কত কি?
সেদিন আমারও চোখ ভেজা ছিল, আজ শুকিয়ে গেছে,
সেদিনের চৌচির হয়ে যাওয়া মনটা,
আজ বোধহয় শিরা উপশিরা গুলির
মেরামত করে উঠতে পেরেছে, কিংবা পারেনি!
তা আজ আমি আর পরখ্ করতে পারিনা।
সেদিন যখন মুষলধারা নেমেছিল
যখন তুমি আমার অশ্রুধারা দেখতে পাওনি
শুধু আরও সুন্দর এর নেশায় মেতে,
আমায় একলা ফেলে দিয়ে চলে গেলে
সেই আমি আজও বেঁচে আছি।
হ্যা, ক্ষনে ক্ষনে আমার আশা,
আমার বিশ্বাস এর মৃত্যু হতে আমি দেখেছি
কিন্তু দ্যাখো আমার মৃত্যু এখনও হয়নি,
আমি আজও বেঁচে আছি।
একসময় সাঁঝ আকাশে যখন চাঁদ উঠত,
আমি চাঁদ উদয়ের শব্দ পেতাম,
চাঁদের দেখা পেয়ে আমার কবিতার খাতায়
মন খুলে হিজিবিজি লিখতাম তোমার জন্য,
এখন নিঃশব্দে চাঁদ ওঠে ওই মুক্ত আকাশে
নিঃশব্দে নিশি রাতে জ্যোৎস্না বিলি করে,
আমি জানতেই পারি না, কিন্তু দ্যাখো
আজও আমি বেঁচে আছি,
আজ আর আমি হিজিবিজি লিখি না,
আর আমি শব্দ সাজাতে পারি না, আগের মতো করে,
আমার কবিতার খাতাটি এখন
নিস্তব্ধতা আর নিঃশব্দতায় ভরা এক জীর্ণ পান্ডুলিপি।
যেমন জীর্ণ পোষাকে আজ আমি ঘোরা ফেরা করি
একা একা হাসি, বিড় বিড় করি
আজকাল কাউকে চিনতে পারিনা,
হয়তো বা চেনার চেষ্টাও করি না আর,
দ্যাখো তবুও আমি বেঁচে আছি,
আমি আজ বুঝতে শিখেগেছি
সব ভুলে থেকেও বেঁচে থাকা যায়,
তোমাকেও ?
আমাকে সবাই এখন পাগল বলে ডাকে,
ওদের কী দোষ বলো?
আমি তবুও বেঁচে আছি।
রাস্তায় কত ভবঘুরে পাগল ঘুরে বেড়ায়
আমরা কী খোঁজ রাখি নেপথ্য?
এই ভাবে এই ভরা নদীর জোয়ার মাখা শরীরে ;
রোগ যন্ত্রণা বড়ো যন্ত্রণা, রাত কাটে না গভীর অন্ধকার
মনের অন্ধকারে বাজে, এ সুর আমি কখনো চায়নি।
কখনো চায়নি, আমি কখনো ত চায়নি
চৈত্রের দুপুর বেলা তোমার বুকের উপরে গীতবিতান খোলা
স্বপ্নখানি এলোমেলো ভয় ভরা শরীর
নীল শিখা ঘূর্ণিবাতাসে খেলা করে অজানা খেলা,
চলে গেলে বুঝতে পারি তার অনুপস্থিতি তার গভীরতা।
বাঁধন
কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণ
No comments:
Post a Comment