পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো শেষ হল। অবশ্য উৎসবের এখনও বাকি কিছুটা। আর কয়েকদিনের মধ্যে দীপাবলির আলো এই রাজ্য সহ সারা ভারতকেই আলোকিত করে তুলবে।
দুই বছর করোনা অতিমারির জন্য রাজ্যবাসী সেভাবে মেতে উঠতে পারেননি বলে এইবারের পুজো ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল দেখবার মতো। ইউনেস্কোর বিশেষ স্বীকৃতি পাওয়ার পর উন্মাদনাও ছিল তুঙ্গে। সরকারিভাবে ধন্যবাদ-জ্ঞাপন শোভাযাত্রা ও কার্নিভাল আয়োজন ছিল তারই অঙ্গ।
বিপুল আনন্দ অবশ্য শেষ হয়ে গেল জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজারে, দশমীর ভাসানে, অসংখ্য মৃত্যুতে। মাল নদীর হড়পা বান যে ভয়ঙ্কর দুর্যোগ নিয়ে এলো তাতে ম্লান হয়ে গেল সবকিছু। অবশ্য তারপরেও জীবন থেমে থাকেনি, উৎসব থেমে থাকেনি। `দা শো মাস্ট গো অন`-এর পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে কেবল জলপাইগুড়ি জেলা বাদে সর্বত্রই কার্নিভালে মেতে উঠলাম আমরা।
শোকের এই আবহে এরকম আনন্দ অনুষ্ঠান আয়োজন করা উচিত হল কিনা তার বিচার অবশ্য করবে মহাকাল। সব মিলে নিউ নর্মাল পরিস্থিতির প্রথম দুর্গোৎসব স্মরণীয় হয়ে রইল নানা কারণে।
মুজনাই তার অগণিত পাঠক-পাঠিকা, লেখক-লেখিকা ও শুভানুধ্যায়ীদের বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। সকলের মঙ্গল কামনা করছে।
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৯
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
সন্দীপ দেবনাথ, চিত্রা পাল, সীমা সাহা, বিনয় বর্মন,
সুজাতা কর, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, মৌসুমী চৌধুরী,
রীনা মজুমদার, সৈকত দাম, সারণ ভাদুড়ী, মজনু মিয়া, অঞ্জলী দেনন্দী,
বটু কৃষ্ণ হালদার, স্বপন কুমার দত্ত
শৌভিক কার্য্যি, চিত্রাক্ষী রায়
মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৯
দুর্গার সংসার
ছবি- শৌভিক রায়
বিদেশের চিঠি
ভ্রমণ
গোলাপি বালির অভিযান ও অন্যান্য
সন্দীপ দেবনাথ
লটসা মটসা পিজা । খুঁজে পেতে শেষে কি না পাওয়া গেল এই একটি দোকান। রাত পৌনে এগারোটা বাজে এখন। এই অজ পাড়াগাঁয়ে
এত রাতে কোন খাবারের দোকান যে খোলা আছে সেই বেশি। আলো আঁধারি একটা পার্কিং এসে গাড়িটা দাঁড় করালাম। টিম টিম করে একটা নিয়নের হলুদ আলো জ্বলছে। দোকানের নামটা ভাল করে বোঝাই যাচ্ছে না। শুধু ওই ওপেন লেখাটাই যা দেখা যাচ্ছে। সে নাম দেখা না যাক,
ওপেন থাকলেই হবে। তুমি বাবা
আমাদের ভরসা। এখানে আর কোথাও কিছুই খোলা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো পার্কিং জুড়ে শুধু দুটো গাড়ি, ওই যেখানে একটু আলো ওদিকটায়। মনে হয় দোকানের লোকজনেরই গাড়ি। আর তিনটে হারলে-ডেভিডসন-এর মোটর সাইকেল। আসে পাশে কেউ কোথাও নেই। একটু একটু ভয় করছে আমাদের। ইংরিজি সিনেমায় দেখা যায় এই সব জায়গায় খুন খারাবি হতে। হঠাৎ করে একটা ট্রাক এসে পড়বে আর শুরু হবে বন্দুকবাজি।
আপাতত সেসব চিন্তা এখন মাথাতে নিতে
পারছি না। পেটে ছুঁচো ডন
বৈঠক মারছে। অগত্যা দরজা ঠেলে ঢুকে পরলাম আমরা। পাঁচজন। চারজন গিয়েছি
সিয়াটেল থেকে। একজন শিকাগো। এই এত রাতে
পাঁচজন এশিয়ানদের দেখে দোকানের মেয়েটি বেশ অবাক। নিরামিষ পিজা অর্ডার দেওয়া হল।আমাদের মধ্যে একজন নিরামিষাশী। এবারে অপেক্ষার পালা।
এদিক ওদিক তাকাতেই চোখ পরে গেল এক
কোনের টেবিলে বসা চারজনের দিকে। পোশাক দেখেই
বোঝা গেল, বাইরের মোটর
সাইকেলগুলো এদেরই। এইসব মোটর বাইকারদের একটা বিশেষত্ব
থাকে। বেশ হোমড়াচোমড়া টাইপের হয় এইসব লোকজনরা। এরা আবার বিশেষ দলের হয়,
শিকাগো চ্যাপ্টার, ন্যাশভিল চ্যাপ্টার। কত কিছু। ইয়া বড় বড়
দাঁড়ি, গোঁফ। হাতের এক বিরাশি সিক্কার থাবা যদি বসায় আমি তো
সঙ্গে সঙ্গেই কুপোকাত হয়ে যাব। রোগা পাতলা
শিং মাছের ঝোল খেয়ে বড় হওয়া বাঙালি আমি। নেটফ্লিক্সের
দৌলতে এদের একটা ডকুমেন্টরি দেখে মোটামুটি একটা ধারনা হয়েছে আমাদের। এদের এক গ্যাং-এর সাথে আর এক গ্যাং-এর মতের মিল হয় না। মাইলের পর মাইল এরা বাইক চালিয়ে চলে যায় এক রাজ্য থেকে আর
এক। দুর থেকে দেখলেই
না দেখার ভান করে করে চলে যাই অন্যদিকে দ্রুত। মাথায় আমেরিকার জাতীয় পতাকার আদলে তৈরি রুমাল দিয়ে ফেট্টি
বাঁধা, চামড়ার জ্যাকেট,
হাতে চামড়ার গ্লাভস, পকেট থেকে বেরিয়ে আসছে
মোটা মোটা চেন, এসব দেখেই ভয় পেয়ে যাই আমি।
হঠাৎ চোখাচুখি হতেই ইশারায় ডাকলেন
একজন। আমি তো ভয়ে আত্মহারা। এই অজানা অচেনা জায়গায় এত রাতে ডাকলেই তো মুশকিল। লালমোহনবাবুর কথা মনে পরে গেল, সেই যে জয় বাবা ফেলুনাথ-এ বেনারস-এ
ভোজালির ম্যাজিক দেখার পর যেমনটা হয়েছিল, আমিও মনে মনে
প্রমাদ গুনছি। মনে তবু সাহস সঞ্চয় করে ভীরু পায়ে
এগোলাম। আমরা অন্তত পাঁচজন আছি। যা হবে দেখা যাবে। জিগ্যেস করলেন, তোমরা কোথা থেকে এসেছ ? আর এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছই বা কেন ?
(এঞ্জেলস ল্যান্ডিং, জিয়ন ন্যাশনাল পার্ক )
দিন পনেরো আগে একদিন এক বিকেলবেলায়
অফিসের চূড়ান্ত বোর হয়ে আনমনে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল একটা লেখায়। কানাবের কাছাকাছি একটা জায়গায় কাইবাব মালভূমির মধ্যে একটা
বালিয়াড়ির ছবি দেখলাম যেন। বালির রঙ নাকি
গোলাপি।ছবিতে অবশ্য অনেক সময় এডিট করে রঙ পালটে দেওয়া যায়। তাই নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস নেই। আগে কখনও দেখিনি। আঁচাতে হবে
মনে হচ্ছে। একটু আধটু নাড়াচাড়া করতে করতে বুঝলাম এই জায়গাটার আশেপাশে
অদ্ভুত সুন্দর কিছু জায়গা আছে। ট্রেকিং করার জন্য একেবারে উপযুক্ত। বেলে পাথরের প্রাকৃতিক সব নির্মাণ চোখকে তাক লাগিয়ে দেয়। কাছাকাছি বড় এয়ারপোর্ট হল লাস ভেগাস। বাস, সাথে সাথেই গুগলে টিকিট দেখতে শুরু করলাম। সপ্তাহান্তের প্লেনের টিকিটের দাম একশ ডলারের মধ্যেই পাওয়া
গেল। যদিও খুব কম পয়সার স্পিরিট এয়ারলাইন্স। কিন্তু নিয়ে তো যাবে শেষ পর্যন্ত। দাঁড়িয়ে তো আর যেতে হবে না,
তাহলেই হবে। বিকেলে টেবিল
টেনিস খেলতে গিয়ে কথাটা পারলাম তিনজন বন্ধুদের মধ্যে। শুক্রবার রাতে বেরিয়ে রোববার রাতে ফেরা। অফিসে ছুটি নেবার দরকার নেই। থাকব ওই কোথাও একটা ক্যাম্প করে ওই বালিয়াড়ির কাছেই। উঠলো বাই তো কটক যাই। যে কোথা সেই কাজ। রাতে যোগাযোগ
করা হল শিকাগোর বন্ধুর সঙ্গে। সে তো
একবাক্যেই রাজি।ব্যাস বুক হয়ে গেল টিকিট। আমাদের গন্তব্যস্থল লাস ভেগাস।
লাস ভেগাস এর কথা শুনেই তো অফিসের সব
বন্ধুদের উৎসাহ চরমে। কিন্তু আমাদের পাঁচজনের সেরকম কোন
উত্তেজনা নেই। আমাদের লক্ষ্য অন্য। লাস ভেগাস আমাদের জাস্ট ফ্লাই-ইন ফ্লাই-আউট এয়ারপোর্ট।
শিকাগোর বন্ধু পৌছবে আমাদের আগেই। তাই ওর ওপর দায়িত্ব পড়ল একটা ভাল 4X4 গাড়ি ভাড়া করার। আমরা পৌছব রাত ২টোয়। পৌঁছে একটা
হোটেলে কোনমতে গড়িয়ে নিয়ে সকালে উঠেই আমাদের যাত্রা । এতদিন পর শিকাগোর বন্ধুর সাথে দেখা। ফলে যা হবার তাই হল। শিকেয় উঠলো আমাদের রাতের ঘুম। রাত ভর আড্ডা আর আড্ডা। দেখতে দেখতে কখন যে পুব আকাশ রঙ হতে শুরু করেছে বুঝতেই
পারিনি। তড়িঘড়ি রেডি হয়ে নিলাম সবাই। অনেক বড়দিন আজ। সিয়াটেল থেকে
বেরনোর আগেই ওই কোরাল পিংক স্যান্ড ডিউন স্টেট পার্কের মধ্যেই একটা ক্যাম্প
গ্রাউন্ড বুক করেছি। রাতে থাকা হবে ওখানেই । তাঁবু টাঙিয়ে। রাতের
তাপমাত্রা শূন্যের নিচেই ঘোরাফেরা করবে বলে দেখে নিয়েছি। সেরকম ব্যাবস্থাও আছে। স্লিপিং ব্যাগ,
জ্যাকেট সব ব্যাকপ্যাকে ভরে নেওয়া হয়েছে। দরকার সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর সরঞ্জাম। ঠিক হয়েছে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হবে ফ্রাইং প্যান, তেল, ডিম, ম্যাগি, চা পাতা ইত্যাদি। ক্যাম্প গ্রাউন্ডেই আগুন জ্বালাবার কাঠ পাওয়ার কথা।দেখা যাক।প্রস্তুতি
সম্পূর্ণ।
******
গাড়ি ছুটছে প্রবল গতিতে, হাইওয়ে ১৫ ধরে। মুহূর্তের মধ্যে পেরিয়ে গেলাম লাস ভেগাস স্ট্রিপ। ওই তো ম্যান্দালয় বে,
এক্সক্যালিবার, বেলাজ্জিও, সিজারস প্যালেস, ফ্লেমিঙ্গো, স্ট্রাটোস্ফিয়ার। একে একে পার হয়ে যাচ্ছি লাস ভেগাসের বিখ্যাত সব হোটেল আর
ক্যাসিনো। এদিকটায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাইরের দৃশ্য। তাল মেলানো খুব কঠিন। মসৃণকালো পিচ ঢালা রাস্তায় আমাদের গাড়ি চলছে লাস ভেগাসকে
পিছনে ফেলে। মাঝে মাঝে ওই বড় বড় সেমি ট্রাক গুলো বিশাল দৈত্যের মত
ছুটে আসছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি গিলে ফেলবে ছোট ছোট গাড়ি গুলোকে বুঝি। বন্ধুরা অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। বিশেষ করে বেলে পাথরের নানা রকম কারুকার্যে , যা শত শত বছর ধরে জল আর বাতাসের ক্ষয়ের
মাধ্যমে ভাস্কর্যের মত তৈরি হয়েছে। দেখলে মনে
পাথর গুলো কীরকম ঢেউয়ের মত হয়ে থমকে গেছে এক জায়গায়। চিরায়ত একটি দৃশ্য। এদিকের
দৃশ্যপট ওয়াশিংটনের থেকে একদম আলাদা। এখানে সবুজের
সমারোহ। ওখানে লালের খেলা।
আমি অ্যারিজোনায় ছিলাম অনেকদিন।এইরকম প্রাকৃতিক দৃশ্য আমার কাছে একদন চেনা। সোনোরান আর মোহাবে মরুভূমিতে ঘুরে বেরিয়েছি অনেক। বিখ্যাত, অল্প খ্যাত অনেক জায়গায় ট্রেক করেছি আগেও। আমার মনে তখন চলছে নস্টালজিক আনাগোনা। পার হয়ে যাচ্ছি
ধুধু মরুপ্রান্তর। আবার কোথাও দুরে মালভূমির মত চ্যাপ্টা পাহাড়ের দিগন্তরেখা। শিরশির করে হাওয়া দিচ্ছে বাইরে। গাড়ির জানালাটা
খুলে দিলাম। নভেম্বর মাস। বাতাসে
ঠাণ্ডার ছোঁয়া। এদিকে বৃষ্টি হয়না তেমন সিয়াটেল-এর মত। ঝকঝকে রোদ্দুর
চারিদিকে। হাওয়াটা বেশ ভাল
লাগছে সবারই । আমাদের পরবর্তী
গন্তব্য সেন্ট জর্জ।
উটার প্রান্তিক এই শহরটি ট্রেকারদের স্বর্গ। এখান থেকেই
একঘণ্টার দূরত্বে বিখ্যাত সব ট্রেকিং-এর জায়গা। সর্বোপরি আছে জিয়ন ন্যাশনাল পার্ক। এখানে আমরা থামব। দুপুরের খাবার, ক্যাম্পিং-এর বিভিন্ন সামগ্রী কিনতে হবে। জল নিতে হবে,
কিছু শুকনো খাবার, এনার্জি বার নেব ।তারপর ছুটব স্প্রিংডেল-এ। গেটওয়ে অফ জিয়ন । এখনও অনেক পথ
বাকি।
(গোলাপি বালি, কোরাল পিঙ্ক স্যান্ড ডিউন পার্ক)
যেমনটা ভাবা হয় তেমন হয় না। কোনদিন হয় নি। এই যেমন একবার
দিল্লি গেলাম। সকালের ফ্লাইট ।ভাবলাম হাতে
বেশ কিছুটা সময় আছে , ঘুরে দেখব একটু
পুরনো দিল্লি, দেখব চাঁদনি চক , ধূলা
কুয়া, কুতুব মিনার বা হুমায়ুন সৌধ। কিন্তু না,
সেবার এরোপ্লেন এত দেরিতে পৌঁছল যে হাতে একটুও সময় রইল না। আবার এই যেমন গতবছর,
ভাবলাম আপার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ৯৯ রুটের যে লুপটা হয় চিলিয়াক হয়ে
হোপ আর তারপর লিলোএট হয়ে পেম্বারটন আর শেষ মেষ ভাঙ্ক্যুবার।ইচ্ছে ছিল একদিনে একটা রোড ট্রিপ করব। বাদ সাধল আমার গাড়ি। হোপ-এ
পৌঁছনোর আগেই টায়ার পাঙ্কচার।ব্যাস। রোড ট্রিপের
ইতি সেখানেই। আবার যেমন এই সরস্বতী পুজোয়,
আইফোনে মেয়ের নাচের একটা ভিডিও রেকর্ডিং করব ঠিক করলাম। ও হরি। সারাক্ষণ ফোনের স্ক্রিনে
নাচ দেখেই গেলাম, রেকর্ডিং যে হচ্ছে
না বুঝতেই পারি নি। নাচ শেষ হল, আমি ভাবলাম রেকর্ডিং বন্ধ করি এবারে। দেখলাম তখন শুরু হল রেকর্ডিং। তো এই হল অবস্থা। প্ল্যান করে
কিছুই হয় না। যত বেশি পরিকল্পনা ,
তত বেশি প্ল্যান ফেল।
স্প্রিংডেলের ২২ মাইল আগে সে বিশাল
এক ট্র্যাফিক জ্যাম। রাস্তায় কোথায় একটা কাজ হচ্ছে , একটা লেন দিয়ে আপ আর ডাউনের গাড়ি চলছে।বুঝতে পারলাম সময় হাতে খুব অল্প। আমাদের যে কোনো একটা হাইক ঠিক করতে হবে। এঞ্জেলস ল্যান্ডিং নাকি জিয়ন নার্যো। ওদিকে আবার ন্যাশনাল পার্কের ভিজিটর সেন্টারে গাড়ি রেখে
আমাদের যেতে হবে পার্কের শাটল বাসে করে। টস করা হল। সবার এক রায়,
এঞ্জেলস ল্যান্ডিং হাইক করা হবে। আমরা মোটামুটি সব ধরনের পড়াশোনা আর রিসার্চ করেই এসেছি। এঞ্জেলস ল্যান্ডিং,
পৃথিবীর সবথেকে ভয়ঙ্কর হাইকের মধ্যে একটি। শুধু দুটো পা রাখা যায় এরকম একটা সরু ব্লেডের মত রিজ, যার দুপাশেই ১৪০০ ফুট সোজা ক্যানিয়ন-এর
দেয়াল। পা পিছলে পড়লেই একেবারে ১৪০০ ফুট নিচে। অক্কা। আবার সবথেকে
সুন্দরের মধ্যেও এক।।সেজন্যই সাধ করে নাম রাখা এঞ্জেলস
ল্যান্ডিং। স্বর্গ থেকে পরী এসে এখানে নেমে বিশ্রাম নেবে বলে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে ধার করে একেই বলা যায় ভয়ঙ্কর
সুন্দর।
ভার্জিন নদী পার হয়েই সামনে বিশাল
দৈত্যাকৃতি সেই এঞ্জেলস ল্যান্ডিং। নিচ থেকে
দেখলে মনে হয় ক্যাথিড্রালের মত গগনচুম্বী একটা পাহাড়ের চুড়ো । ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলে ঘাড় ব্যাথা হয়ে যায় এতটাই বড়। আমাদের গন্তব্য ওই চুড়ো। মাঝে অনেক চড়াই উৎরাই পেরতে হবে। আমাদের হাতে সময় কম। বাস থেকে যখন নামলাম তখন অলরেডি সাড়ে চারটে বেজে গেছে। এখানে সন্ধ্যে নামে ঝুপ করে। আমাদের শেষ বাস আটটায়। তার মধ্যেই আমাদের নিচে নেমে আসতে হবে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবে না।
পা চালিয়ে চল ভায়া। হাঁক দিলাম আমি। আমাদের সাথে
হেড ল্যাম্প রয়েছে যদি দরকার হয়। যখন সেই বহু
প্রতীক্ষিত জায়গায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন সবাই ফিরছে। আমরা বোধহয় শেষ দল যারা তখন ট্রেক করে ওপরে ওঠার চেষ্টা
করছিল। কিছু কিছু জায়গায় পাথর এত মসৃণ যে পা রাখাই যায় না। কিছু কিছু জায়গায় ইস্পাতের চেন লাগানো রয়েছে যাতে চেন ধরে
ওপরে ওঠা যায়। প্রতিপদে বিপদ। কিন্তু
আমাদের একটা অদম্য ইচ্ছের কাছে সেসব কিছু মনে হচ্ছিল না। যাইহোক, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিকেলের সূর্যাস্ত। পড়ন্ত বিকেলের আলোতে জিয়ন ক্যানিয়ন এক অদ্ভুত মায়াবী
আলোতে ভেসে যাচ্ছিল। আমরা ওপর থেকে দেখলাম ভার্জিন নদী
সূর্যাস্তের প্রতিফলনে রুপোর মত চিকচিক করছে।। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য। আমাদের মনে তখন এক পরম প্রাপ্তি। সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর ল্যান্ডিং এ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই
দৃশ্য দেখা সবার ভাগ্যে হয় না।সারাদিনের
ক্লান্তি, রাস্তার ট্র্যাফিক
জ্যাম সব যেন উধাও হয়ে গেল এক মুহূর্তে।ইচ্ছে হচ্ছিল অনেকক্ষণ বসে থাকি ওখানে। কিন্তু জানি ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে হঠাৎ। শেষ শাটল বাস মিস
হয়ে গেলে কি করব জানি না। অতঃপর মন না চাইলেও নেমে আসবার জন্য
পা বাড়ালাম। শেষ বারের জন্য দেখে নিলাম এই পরম সুন্দরীকে। শেষ অবধি হেড ল্যাম্পের সাহায্যে নেমে এলাম পুরো পথ। চারিদিকে অন্ধকার। আকাশে তারা
ফুটেছে কত।একসাথে এত তারা
বোধহয় শেষ দেখেছিলাম ডেথ ভ্যালিতে ।
(মরুর দেশে নাম না জানা হলুদ ফুল)
ক্যাম্প গ্রাউন্ডে যখন পৌঁছলাম তখন
প্রায় রাত বারোটা। পিজা খেয়ে এসেছি শেষমেশ। এত রাতে বোধহয় কেউ ক্যাম্প গ্রাউন্ডে চেক-ইন করে না। গাড়ির হেড লাইটের আলোতে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে আমাদের
নির্দিষ্ট স্পটে পৌঁছলাম। আশেপাশে কারো কোন সারা শব্দ নেই। থাকার কথাও নয়। এত রাতে সবাই
নিশ্চয়ই নিজেদের তাঁবুতে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তড়িঘড়ি করে
দুটো তাঁবু টাঙিয়ে ফেললাম দ্রুত। রাতে এখানে
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। উষ্ণতা এতক্ষণে শূন্যের নিচে নেমে গেছে। সারাদিন প্রচুর খাটুনি গেছে। স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়লেই নিশ্চিত ঘুম। গুড নাইট।
রাত তখন প্রায় দুটো বাজে। হঠাৎ বাইরের একটা খচখচ আওয়াজে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । মনে হল তাঁবুর আশেপাশেই কিছু একটা যেন চলাফেরা করছে। ভয়ে শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল। নীতিশ পাশেই ঘুমচ্ছে। ডেকে তোলা প্রায় অসম্ভব। অথচ বুঝতে পারছি না কি করব। পাশের তাবুতে রোহিত আর মন। আমাদের থেকে প্রায় ১০ ফুট দুরে। ওদিক থেকে নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। আমরা তো কোন খাবার বাইরে রাখিনি বা খাবার তৈরিও করিনি। ভাল্লুক যদি আসে তাহলে সাধারণত খাবারের গন্ধেই আসে। কিন্তু এখানে তো কোন খাবারই নেই, তাহলে কি ? শুনেছি
ভাল্লুক এলে মড়ার মত করে পড়ে থাকতে হয়। আমি একদম চুপ। কোন নড়াচড়া
করছি না। অথচ বুঝতে পারছি পাশেই কিছু একটা ঘোরাফেরা করছে। এত ঠাণ্ডা তবু ভয়ে শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। এইরকম ঠাণ্ডাতে তো ভাল্লুক নিশ্চয়ই শীতঘুমে গিয়েছে। তাহলে কি ঘোরাফেরা করছে ?
আচ্ছা আশেপাশের তাঁবুতে যারা আছে তারা কি কিছু টের পাচ্ছে না?
এত রাতে নিকষ কালো অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কোথায় আছি তাও জানি না। আশেপাশে কাউকে দেখিও নি যখন ক্যাম্প গ্রাউন্ডে ঢুকি। মনে মনে ভাবছি কখন ভোরের আলো দেখব।
সাহস করে উঠে বসলাম। তাঁবুর জানালাটা একটু ফাঁক করে বাইরে তাকিয়েই শরীর হিম হয়ে
গেল। আমাদের স্পটেই দু দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে।আর কিছুই দেখতে পেলাম না।বুঝলাম আমাদের কেউ একজন নজর রাখছে। সারারাত আর আমার ঘুম এলো না। গতকাল রাতেও ঘুম হয় নি একফোঁটা। কালকে আবার আর একটা বড়দিন।ভোরের আলো ফুতেই বাইরে বেরিয়ে এলাম।সূর্য ওঠেনি তখন কিন্তু পুব আকাশে রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা আছে ভালই। জ্যাকেটটা
গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। সামনে বালিয়াড়ির পাহাড়। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই। সকালের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম মিষ্টি গোলাপি রঙ ওই
বালির। মনে হল, এই ক্লান্তি, ঘুমহীন রাত, জ্বলজ্বলে
চোখের শাসন, ঠাণ্ডা হাওয়া সব যেন ভুলে গেলাম। এত অপূর্ব দৃশ্য মনে হয় দেখিনি আগে কখনও।এই জন্যই তো শতবার জন্ম নেওয়া যায়। লক্ষ্য করলাম এই ক্যাম্প গ্রাউন্ডে আমরা ছাড়া আর কোন
মানুষ ছিলনা রাত্রিবেলা। বন্ধুরা সবাই তখন ঘুমে মগ্ন। আমি একা পিকনিক চেয়ারে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। এই অপূর্ব রূপ যেন শুধু আমারই জন্য।
সম্বিত ফিরল রোহিতের ডাকে।! স্যান্ডি,
চা রেডি।!
(বাকস্কিন গালচ ক্যানিয়নের ওই পাথর, ১২৭ ঘন্টার সিনেমার মতো)
বাকস্কিন গালচ। তর্কাতীতভাবে পৃথিবীর দীর্ঘতম সরু স্লট ক্যানিয়ন। লম্বায় পনেরো মাইল মত।কিছু কিছু জায়গায় পাথরের উপর দিয়ে যেতে হবে, কিছু কিছু জায়গায় এত সরু যে পিঠে
ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাইক করা কঠিন। অথচ এত সুন্দর
স্লট ক্যানিয়ন খুব কমই আছে। গোলাপি, বেগুনি, লাল,
কমলা কত ধরনের রঙের খেলা এই ক্যানিয়নে। ড্যানি বয়েলের ১২৭ আওয়ার সিনেমার কথা মনে পড়ে ? সেই
যে ছেলেটার একটা হাত স্লট ক্যানিয়নের
মধ্যে আটকে গিয়েছিল। আর তারপর ১২৭
ঘণ্টা থাকতে হয়েছিল ওই ক্যানিয়নের মধ্যে! আর শেষমেশ হাত কেটে বেরিয়ে এসেছিল। ওটা ছিল ব্লু জন ক্যানিয়ন। বাকস্কিন গালচ অনেকটা এইরকমই। অয়্যার পাস ট্রেল হেড থেকে শুরু করতে হবে আমাদের ট্রেকিং। সেই যে বিখ্যাত ওয়েভ এর ছবি আমরা দেখি, ইন্টারনেট-এ, উইন্ডোজ-এর ওয়ালপেপারে, সেই ওয়েভ-এ যেতে গেলেও এই ট্রেল হেড থেকেই
যেতে হয়। তার জন্য দরকার পারমিট। সে পারমিট পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। আমরা এবারে লটারিতে নাম দিই নি। তাই ওদিকটা যাওয়া যাবে না। কিন্তু এই জায়গায়টাও কোন অংশে কম সুন্দর নয়। মেঠো রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে আমাদের গাড়ি চলছে অ্যারিজোনা-উটা
সীমান্ত বরারর। এদিকটা বেশ রুক্ষ। ছোট ছোট
টাম্বলউইড গাছ এদিক ওদিক চোখে পড়ছে। একটা শুকনো
নদীর বুক পার হয়ে এলাম গাড়ি চালিয়ে। ট্রেল হেডে
দেখলাম লেখা আছে, ক্যানিয়নে ঢোকার আগে
আকাশ দেখে নিতে হবে। দূরদূরান্তেও
যেন কোন কালো মেঘ না দেখা যায়। হঠাৎ বৃষ্টি
হলে এইসব নদীতে হড়কা বান এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু। আর এই হড়কা বান যদি একটা স্লট ক্যানিয়ন এ ঢোকে তবে আর রক্ষে নেই। এখান থেকে বেরনো খুব কঠিন। বলা আছে ১০০ মাইল দুরেও যদি কোথাও বৃষ্টি হয়, ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে সব কিছুই এবং খুব
দ্রুত।
জয় মা বলে ঢুকে পরলাম ক্যানিয়ন-এ। যারা অ্যান্টিলোপ ক্যানিয়নে গেছেন তারা দেখেছেন
ক্যানিয়নের অপূর্ব সৌন্দর্য। এই ক্যানিয়ন
ও কোন অংশে কম যায় না। শুধু এখানে লোকজনের ভিড় নেই, বাণিজ্যিকতা এখনও এখানে ছুঁতে পারেনি। শুধুই প্রকৃতির অকৃপণ উদারতা এখানে। এ এক অন্য গ্রহ যেন। হঠাৎ চোখে পড়ল
পাথরের ওপর হলুদ রঙের ছোট্ট ফুল ফুটে আছে। না মঙ্গল
গ্রহ নয়, এ আমাদেরই পৃথিবী। এখানেই তো
প্রাণের ছোঁয়া ।
কেমন যেন ঝাপসা দেখছি মনে হচ্ছে। গাল বেয়ে দু
ফোঁটা জল পড়ল শুকনো লাল মাটির ওপরে। নত হয়ে এলো আমার
মাথা।
****
লাস ভেগাস এ গিয়ে ফ্রেমন্ট স্ট্রিট এ
যাব না তাই কি হয়। রাত দশটায় ফ্লাইট। হাতে কিছুটা
সময় আছে এবারে।দিল্লির মত অবস্থা হয়নি। শরীর খুব ক্লান্ত কিন্তু মন ভরপুর।নিয়ে যাচ্ছি এক আকাশ অভিজ্ঞতা। সবে মাত্র মার্গারিটায়
চুমুক দিয়েছি একবার, হঠাৎ করে কেউ যেন
কানে ফিসফিসয়ে বলল, সিয়াটেল ? নিয়ে
যাবে, আমায় ?
চকিতে ঘুরে তাকিয়ে দেখি এক লাস্যময়ী। হাতে ওই মার্গারিটা । চোখে দুষ্টুমি খেলা করছে। মৃদু হাসলাম।
ফুলের জলসায়
চিত্রা পাল
কবি বলেছিলেন ফুলের জলসায়
নীরব কেন কবি, কিন্তু এখানে এই ফুলের জলসায় কেউ নীরব নয়, সবাই সরব। সবাই এক বাক্যে
বলছে, বাঃ,কি সুন্দর। সত্যিই এমন মন পাগল
করা সুন্দর পুষ্পবনে যেদিন বিহার করেছিলাম, সেদিন মনে হয়েছিলো আমার চক্ষু সার্থক
,আমার জীবন সার্থক। এমন সুন্দর ফুলের বাগান এর নাম কুকেনহট গার্ডেন।(kukenhot Garden)অনেকে বলে
গার্ডেন অফ ইউরোপ।এই বাগান আছে হল্যান্ডের আর্মস্টারডাম শহরের কাছে।
আমরা ইংল্যান্ডের হারউইচ বন্দর থেকে জাহাজে
উত্তরসাগর পাড়ি দিয়ে হল্যান্ডে এসে পৌঁছোলাম মে মাসের এক সুন্দর সকালে। সেদিন
দুপুরের কিছু আগে চলে এলাম এই রাজকীয় উদ্যানে যেখানে শুধুইফুল, যেদিকে চোখ যায়
যতদূরে চোখ যায় শুধুই ফুলের মেলা।
আর্মস্টারডাম থেকে ১৫ মাইল দূরে
ছোট্ট শহর লিস্। সেখানেই এই বাগান।এই বাগান টিউলিপ ফুলের জন্য বিখ্যাত। প্রত্যেক
বছর এখানে ৭০,০০,০০০/- লক্ষ বাল্ব বা গোড়া
পোঁতা হয় মাটিতে। এত রকমের এত বিচিত্র রঙের টিউলিপ যে
ফোটে তা জানতাম না। আমরা বিশেষ করে বাঙ্গালীরা সাধারণভাবে টিউলিপের সঙ্গে পরিচিত
নই। এখানে এসে এমন মাইলের পর মাইল টিউলিপবাগান দেখে আমরা অবাক আবার মুগ্ধও। তবে
আমাদের ভাগ্যে ছিলো তাই দেখা হয়ে গেলো, কারণ বছরে মাত্র আট সপ্তাহ মার্চ থেকে মে
মাসের আদ্ধেক অবধি খোলা থাকে। আমরা বাগান খোলা থাকার সময়েই এসে ছিলাম বলে দেখতে
পেয়েছি।বাগান দেখার সবচেয়ে ভালো সময় সকালে সাড়ে দশটার আগে অথবা বিকেলে চারটের পরে।
তো তা আমাদের হয়ে ওঠেনি। আমরা দুপুরেই বাগানে ঘুরে বেড়ালাম। অবশ্য ওখানে মে মাসের দুপুর আমাদের কাছে খুব আরামদায়ক।
এই বাগান যা আমরা দেখছি তা
আগে কুকেনহাম ক্যাসেলের ফল ও সব্জি বাগান ছিলো।
১৯৪৯ সালে এভাবে ফুল চাষ শুরু হয়, আর জনসাধারণের জন্য ১৯৫০ সালে খুলে দেওয়া হয়।
ব্ল্যাক টিউলিপ যা খুব কম দেখা যায়,যারবাজারে মূল্যও খুব বেশি, তাকেও প্রচুর দেখলাম।
এখান থেকে সারা পৃথিবীতে দূর-দূরান্তে
টিউলিপ চালান যায়। সিলসিলা ছবিতে যে ফুলের বাগান দেখা গেছে তা এই বাগানটাই। এমন
অপরূপ পুষ্পোদ্যান আজও আমার স্মৃতিতে ভাস্বর। যখনই মনে পড়ে দেখি সেই ফুলের জলসা,একরাশ
অসামান্য উজ্জ্বল টিউলিপ যা আজও আনন্দদায়ক।
মুক্তগদ্য
চা বাগানের পুজোর আনন্দ
সীমা সাহা
পুজোর ছুটিতে অরুন, মধু শৌভিক, মুনমুন, ওরা বাগানে চলে এসেছে।ওদের বাবা বাগানেই চাকরি করে,তাই ছুটি পেলেই বাগানে চলে আসে।পড়াশোনার জন্য জলপাইগুড়ির একটি স্কুলের হোস্টেলে থাকে।
বাড়িতে এসে়ই মাকে জিজ্ঞেস করে, "মা বোনাস হয়ে গেছে ?" " বাগানে বোনাস হওয়া " মানে আলাদা একটা আনন্দের জোয়ার বয়ে চলে।বোনাসের একদিন আগের সন্ধ্যা থেকেই শ্রমিক লাইনে মাদল বাজিয়ে, আদিবাসী ভাষায় গানের তালে তালে নাচের আসর বসে যায়। বাবুদের বাড়িতেও খুশির জোয়ার চলে। কার কার বাড়িতে এবার নতুন কি কি জিনিস কেনা হবে এটা নিয়েই বিকেলে বাড়ি বাড়ি আলোচনা চলে। সব বাড়ির ছেলে মেয়েরা পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসেছে। ওরাও সবাই মাঠে খেলতে নেমে যায়। এমন খেলার মাঠ শহরের কোথাও সাধারণত পাওয়া যায় না।বাগানের চারিদিকে সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘেরা ।সবার বাড়ির সামনেই শৌখিন সব বিভিন্ন রকম বাহারী ফুলের বাগান।
বোনাস দেবার দিন সব বাড়ির মহিলারা তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করেই সবাই মিলে কারো বাড়িতে বসে গল্প আড্ডায় মেতে যায়।শ্রমিকরা়ও ওই দিনটিতে সেজেগুজে বাগানের অফিসে যায় বোনাস আনতে। সেদিন ওরা কাজ থেকে ছুটি পায় । সবাইকে ম্যানেজার নিজে ছুটি দিয়েছে। তাই সবার মধ্যেই সেদিন খুশির জোয়ার। সব মিলিয়ে বাগানে উৎসব এর মেজাজ শুরু হয়ে যায়।চা বাগানের কাছেই বীরপাড়া বাজার। ওখানে হাটও বসে।তবে তাদের কেউ কেউ জলপাইগুড়িতেও বাজার করতে আসে । দলমোড় চা বাগানে শ্রমিক লাইনে ঘটা করে দুর্গাপুজা হয়। বাবুরা এবং ম্যানেজারেরা ক্লাস বিভাজনের জন্য সে পুজোতে বড় একটা আসে না। পুজা দেখতে যাওয়ার জন্য বাবুদের জন্য বাগান কর্তৃপক্ষ গাড়ি দেয় । সবাই দল বেধে সব বাড়ির স্ত্রী, কন্যা, ছেলে, মেয়েরা সেজেগুজে গাড়িতে গিয়ে বসে। অবশ্য সবার বাড়ি থেকেই চেয়ার টুল নিয়ে গাড়িতে বসার জন্য তোলা হতো। লরি গাড়ি কিনা, তাই। সবাই গল্প , গুজব, হৈহুল্লোড় করতে করতে বানারহাটে অনুষ্ঠিত পুজো উপলক্ষে মেলায় যায়। মেলায় যাওয়ার প্রতি ছেলে মেয়েদের আলাদা আকর্ষণ । ফালাকাটায় বিসর্জনে যাওয়া দিয়ে পুজো শেষ হয় ।
এবার লক্ষীপুজোয় সব বাড়ি ঘুরে ঘুরে খিচুড়ি ভোগ খাওয়া, আবার কোনো বাড়িতে পোলাও ভোগ খাওয়া মজাটাই আলাদা। তারপর আবার কালীপুজো। বাবুরা কালিপুজো করে তাদের নিজেদের কোয়াটারের সামনের মাঠে। সেই পুজো কে ঘিরে বাগানের ছেলমেয়দর মধ্যে এক অন্যরকম উন্মাদনা শুরু হয়ে যায় । মন্ডপ তৈরি করা ,প্রতিমা আনা,পুজোর আয়োজন সবকিছুইতেই মিশে থাকে আনন্দ। সারারাত ধরে পুজো হয়।ছোটো বড়ো সবাই রাত জেগে পুজো উপভোগ করে ।সেইসময় নানা রকম ভুতের গল্প, গানের অন্তাক্ষরী লড়াই, চুটকি সহ বিভিন্ন মজার মজার অনুষ্ঠান নিয়ে সময় কেটে যায়। ভোরবেলা পুজা শেষ হয় পুজো । সাত সকালে সবাই যে যার বাড়ি ফিরে যায় ।
বেলা ১০/১১থেকে প্রসাদ বিতরণ, ছোট ছেলে মেয়েরাই সেই দায়িত্ব পালন করে। প্রতি বছরই পুজো শেষে পিকনিক হয় ঐ বাগানের মাঠে ।
এবার তো স্কুল খোলার পালা। ফিরতে হবে সবাইকে স্কুলের হোস্টেলে। সবাই অধীর আগ্রহে থাকে পরের বছরের ছুটির অপেক্ষায়।
আশ্বিনের আশা- আশঙ্কা- আকাঙ্ক্ষা
বিনয় বর্মন
আশ্বিন মানে আনন্দ , আশ্বিন মানে আশা , আশ্বিন মানে আশঙ্কা ! বাতাসে হিমেল ভাব , পুজো পুজো গন্ধ ! নতুন পোশাক হবে , তাই ছোটদের আনন্দ l সঠিক সময়ে ন্যায্য বোনাস হবে কিনা , বা আদৌ হবে কিনা , তা নিয়ে সংগঠিত শ্রমিকের আশঙ্কা l অসংগঠিতদের সে আশাও নেই , আশঙ্কাও নেই !
ছোটবেলায় পুজোর গন্ধ পেতাম কাশফুল আর চাষীদের রাস্তা জুড়ে পাট শুকানো দেখে l চাষির বাড়ির ছেলে হওয়ায় জানতাম শিল্পবিহীন কোচবিহার , দিনহাটায় পাটের মূল্য কতখানি কৃষকের কাছে। অর্থকরী ফসল বলতে তামাক আর পাট l প্লাস্টিকের সর্বগ্রাশি আক্রমণে পাটেরও সুদিন গেছে চাষিরও l এখন চাষির ছেলে অনঅভ্যস্ত হাতে কারখানার মেশিন চালাচ্ছে গুজরাট , হরিয়ানায় ....
আশ্বিন মানে মধ্যবিত্ত গৃহকর্তার কপালে ভাঁজ l এখন আর আগের মত থানের কাপড় কিনে স্থানীয় দর্জিকে দিয়ে পোশাক বানানোর রীতি বিলুপ্তপ্রায়। সব কিছুই রেডিমেড l অনলাইন আর মল সংস্কৃতির আগ্রাসনে স্থানীয় ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস উঠেছে l সময়ের নিয়ম l কালের বিবর্তনে যেমন রিকশা উধাও হয়ে " টোটো " বা "ই রিক্সা" এসেছে , তেমনি ছোটখাটো দোকানদাররাও পেশা পরিবর্তন করছে , অথবা বৃহৎ পুজির বিরুদ্ধে অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আশ্বিন এদেরও আশা আর আশঙ্কার মাস l
উত্তরবঙ্গের টি , টিম্বার , ট্যুরিজম নির্ভর জীবনে প্রথম দুটির সুদিন অনেক আগেই অস্তমিত হয়েছে। সবেধন নীলমণি ট্যুরিজম এ চাপ বাড়ছে। প্রতিযোগিতা বাড়ছে l বাড়ছে দালাল বা ফড়েদের দাপট l বড় সংখ্যক হোমস্টের মালিকানা স্বনামে বা বেনামে বহিরাগত ব্যবসায়ীদের হাতে l ব্যবসা করা দোষের নয় l কিন্তু ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির যে মূল ভাবনা : স্থানীয় কর্মসংস্থান ও সংরক্ষণ , তা এতে বিঘ্নিত হয় l আর বঞ্চনা কিন্তু বিচ্ছিন্নতার ভাবনাকে উসকে দেয় l
তবুও লাভ নেই জেনেও চাষী যেমন চাষ করে যায় , নিয়ম মেনে ফুটে ওঠে কাশফুল , কৈশোর উত্তীর্ণ যৌবনও পূজোর আনন্দে কদিন মাতোয়ারা হওয়ার আশায় তাকিয়ে থাকে আশ্বিনের দিকে। সব না পাওয়া বঞ্চনা গুলো ভুলে থাকতে চায় পুজোর কদিন l বেকারত্ব , উপযুক্ত কাজ না পাওয়া , দুর্নীতি , রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে যৌবনের অপচয়... আশাহত করে অসংখ্য হৃদয়। কোন পেশাই অসম্মানের নয় , কিন্তু কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নেওয়া তরুণ বা তরুণীকে যখন চপ , ঘুগনি , চা বিক্রির উপদেশ দেওয়া হয় , তখন তো এই প্রশ্ন উঠবেই : এই সমস্ত কাজের জন্য এত এত পড়াশোনার কি দরকার ?! এই আশ্বিন কি কোন আশার বার্তা বয়ে আনতে পারবে সেইসব হতাশ যৌবনের জন্য ? বরাবর চমৎকার রেজাল্ট , তুখোর বাগ্মী , সপ্রতিভ ইংরেজি বলতে পারা তরুণ বা তরুণীটি যখন ৩/৪/৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অমানুষিক পরিশ্রম করে মালিকের মুনাফা যুগিয়ে চলে , এই আশ্বিন কি কোন সুবাতাস বয়ে আনবে তার জন্য ?
আশ্বিন মাতৃ বন্দনার মাস ! মাতৃরূপেন ও সংস্থিতা l কেরিয়ারের পেছনে দৌড়ে , মা-বাবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য , প্রিয় মানুষটিকে আগলে রাখার জন্য , স্বেচ্ছায় সন্তানের মুখ দেখেনি যে মেয়েটি... নিঃসন্তান বলে তার দিকে তির্যক মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে মাতৃ বন্দনা করার ভন্ডামি বন্ধ হবে কি এই আশ্বিনে?!
গল্প
মমতা
সুজাতা কর
বিয়ে বাড়িতে সানাই বাজছে।চারিদিকে ব্যস্ততা।সবাই সেজেগুজে ঘুরছে।এইমাত্র বর-বউ বিয়ে সম্পন্ন করে ঘরে ঢুকেছে।আভা গয়না,বেনারসি পরে বসে আছে কিন্তু মনটা ঘুরছে তার বাবার পেছন পেছন।সারাদিন উদভ্রান্ত বৃদ্ধর মুখ যতবার চোখে পড়েছে আভার মনটা হু হু করে উঠেছে।তার বিয়ের জন্য বাবা তাঁর জমানো সব টাকা মায় বাড়ির লাগোয়া পাঁচ কাঠা জমি বিক্রি করেছে।আভা জানেনা সে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে বৃদ্ধ সংসার চালাবে কী করে! বাসর শেষ হল একসময়।সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।গরমে নতুন বর পাঞ্জাবি খুলে গেঞ্জি গায়ে শুয়ে পড়ল।মাঝরাত।আভা পা টিপে টিপে পাঞ্জাবির কাছে গেল।পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল।দেখল টাকায় ঠাসা মানিব্যাগ।আভার মনে ঝড় চলল।কী করবে,একটা দু হাজার টাকার নোট বের করে নেবে?কাল দুপুরে বরের খাওয়াটা হয়ে যাবে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী ভেবে টাকাটা নিলনা।শুধু চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল পড়ল মাটিতে।
গল্প দাদু
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
একটা গোটা হাঁসের মাংস ছিল তার পথ্য। এমনই আদেশ করেছিলেন বদ হজমের বিশেষজ্ঞ হুসলুরডাঙার কবিরাজ মশাই। আজ কোনা ভট্টাচার্য বেঁচে নেই, কিন্তু বামুন পাড়ার কোনা ঠাকুরের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা কাহিনি এভাবেই সবার মুখে মুখে ফেরে।
এসব গল্প অবশ্য আমরা গল্প দাদুর মুখেই শুনেছি। গল্প দাদুর সব গল্পই ছিল সত্যি। তিনি বলতেন," রূপকথার গল্প তেপান্তরের রূপকথায় গোটা কাহিনিই সাজানো। সেসব গল্প শৈশবেই শোনা মানায়। আসল কাহিনিই তো মানুষের জীবন। আর সেসব গল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে পারি। "
কস্মিনকালে শরৎকালে দুর্গাপূজার আগে ঘর ঝাড়াঝাড়ির সময় হস্তরেখাবিদ কিরো'র "হস্তরেখা দর্পন" হাতে এসেছিল। একদিন আমাকে সেটা পড়তে দেখে গল্প দাদু তার দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন। খুব সুন্দর হাতের রঙ, সব রেখা গুলো ও খুব সুন্দর। গল্পদাদু কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে কাজ করেন। হাত দেখে যা বলি সব মিলে যায়। গল্পদাদুও নাছড়বান্দা, "আমার হাতে আর কি কি আছে বলো"
...আপনার রাগটা একটু বেশি, রাগ সংবরণ না করতে পারলে, যে কোন সময় দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়া অসম্ভব নয়।
গল্পদাদুর সাথে পরের শনিবার বাড়ি ফিরবার পথে দেখা। হাতে প্লাসার,বুকে ডায়নাপ্লাস্টের ব্যান্ডেজ নিয়ে বাড়ির সামনে পায়চারি করছে।আমাকে দেখে যেন ঈশ্বর দর্শনের মতো বসবার ঘরে নিয়ে গেলেন। চা পর্বে একথায় সেকথায় বললাম, " শুনেছি দোমহনী রেলস্টেশনে সন্ধ্যা হলেই ভুতের উপদ্রব ছিল। ভুত পেত্নীর ভয়ে কেউ সেখানে যেতে চাইত না। আপনি কখনো ভুত দেখেছেন? "
"....হ্যাঁ একবার সত্যি সত্যিই ভুতের কবলে পড়েছিলাম।" গল্পদাদু বললেন, "তিস্তা নদীর বাঁধে থাকতেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু স্বপন সোম। একদিন বিকেলে স্বপন দা ফোন করলেন, "মা পিঠে বানিয়েছে, সন্ধ্যায় চলে এস।"
গল্পদাদু ইয়া মোটা গোঁফ আর বড় বড় চোখ করে বলে চললেন, "আমি স্বপন দা'র বাড়িতে পিঠে খাচ্ছি আর ৬৮ সালের বন্যার গল্প শুনছি। বন্যায় চারিদিকে যখন জলে জলাকার তখন পানীয় জলের সংকট হয়েছিল। বন্যায় বহু গবাদি পশুর সাথে অনেক মানুষও মারা গিয়েছিল। একই বাড়িতে ছয় জন মারা গিয়েছিল। তাদের বডি তোলার সময় দেহ থেকে হাত, পা খুলে খুলে আসছিল, নিয়ম মেনে শ্রাদ্ধ শান্তি কারও হয় নি, হয় নি পারলৌকিক ক্রিয়া কর্ম। সে সব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন স্বপন দা।
ফেরার সময় স্বপন দা'র মা বাড়ির জন্য পিঠে দিয়ে দিলেন। দোমহনী রেলস্টেশনের কাছে আসতেই আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মিটিমিটি জোনাকি জ্বলছে। অন্ধকারের মধ্যেই এক সুবিশাল ছায়ামূর্তি। যত কাছে যাই ছায়ামূর্তি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। তার পর একটা সময়ের পরে আমার আর কিছু মনে নেই। সকালে যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি বাড়ির বিছানায়। আমার তখন ধুম জ্বর, মা মাথায় জলপট্টি দিচ্ছেন। সকালে তন্য তন্য করে খুঁজেও বাড়ির লোকজন টিফিন বক্স,আমার পায়ের জুতো জোড়া পিঠে কোনকিছুরই হদিশ করতে পারেন নি।"
মাঝে মাঝেই গল্পদাদু 'র ফোন আসে। আমি ও অবসর পেলেই চলে যাই গল্পদাদুর অফিসে। কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসে সবাই কাজে ব্যাস্ত। আমি গিয়েছি তেলের বিলের চেক আনতে। গল্পদাদু দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। আর বললেন " সেবার তো জীবনের মতো বেঁচে গেলাম। আগে তোমার কাছে আমার হাতটা দেখালে, কুনুই বুকের পাঁজর ভাঙত না। অত বড় দূর্ঘটনা থেকে বাঁচতে পারতাম।"
.....কি যে করেন, চারিদিকে সিসি ক্যামেরা চলছে আর আামি হাত দেখব?
গল্প দাদু নাছোড়বান্দা। সাথে তার প্রায় সব অফিসের স্টাফ। সেকেন্ড রাউন্ড চা এর কাপ নামিয়ে দিয়ে চাপরাশি বলে গেল,' যাবার সময় চিফ ইন্জিনিয়ার সাহেবের হাতটা একটু দেখে দিয়েন।'
তারপর অফিসে তেলের বিলের তাগাদা করতে গেলেই একঝাঁক হাত আমার সামনে আসত। তাদের হাত দেখার ভয়ে পরে ওই অফিসে যাওয়াই কমিয়ে দিয়েছিলাম।
অপারেশন সাকসেসফুল
মৌসুমী চৌধুরী
প্রথম দিন অয়নদের বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে করে ফিরে গিয়েছিল সুরভি। অয়নকে একবার দেখবার জন্য অনেক কাকুতি মিনতি জানিয়েছিল সে। কিন্তু তাদের বাড়ির দারোয়ানেরা সুরভিকে ঢুকতে দেয় নি।
কিছুদিন থেকে ডায়ালিসিস চলছে অয়নের। গত সপ্তাহে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন তার দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে ! প্রাণ বাঁচাতে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তাই হন্যে হয়ে তাঁর একমাত্র সন্তানের জন্য কিডনি ডোনার খুঁজে চলেছেন বিজনেস টাইকুন অর্ণব রায়।
তাই আজকের ছবিটা এক্কেবারে আলাদা। অর্ণব রায়ের কেয়ারি করা সুইমিং- পুলের ধারে ঘাড় বাঁকিয়ে বসে আছে সুরভি। পরনে হলুদ রঙের ওপর বেগুনি ফুলছাপ সস্তার সালোয়ার-কুর্তা। এইসব গ্রাসরুট লেভেলের লোকেদের সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, এদের দিকে তাকাতেও ঘৃণা বোধ করেন অর্ণব রায়। কিন্তু বিধি বাম! ছেলে অয়ন বিজনেস ম্যানেজমেন্ট না পড়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সোস্যাল ওয়ার্কে ব্যাচেলর এবং মাষ্টার ডিগ্রি করল। তারপর থেকে তাঁদের "রায় অ্যান্ড সন্স ফার্মাসিউটিক্যাল" মেডিসিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সোস্যাল ওয়ার্ক বিভাগটা অয়নই দেখাশোনা করে। আসলে সোস্যাল ওয়ার্ক বিভাগটা তো শিখন্ডি মাত্র। সরকারকে দেয়-ট্যাক্স বাঁচাবার ফিকির মাত্র। কিন্তু কে শোনে কার কথা, ছেলে তার সত্যি সত্যি দেশোদ্ধার করে বেড়াচ্ছে। সেই সুবাদেই বস্তির মেয়ে সুরভির সঙ্গে অয়নের পরিচয় আর ভাব-ভালোবাসা! যত্তসব!!!
মিঃ রায়ের চোখের দিকে সোজাসাপটা তাকিয়ে সুরভি বলে,
—" দেখুন, আমি অয়নকে ভালোবাসি। আমার আর অয়নের ব্লাড গ্রুপ এক, আমি জানি। অনেকবার আমরা একসঙ্গে রক্তদান করেছি। আমি একটি কিডনি অয়নকে দেব। তাহলে আমরা দু'জনেই বেঁচে থাকতে পারব এ পৃথিবীতে । তা বাদে আপনি বা আপনার সম্পত্তি বিষয়ে আমার কোন রকম আগ্রহ নেই।"
— " হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার কথা তো খুব শুনেছি, মা। তোমার তো মা-বাবা নেই। আমার ছেলে সুস্থ হয়ে উঠলে তোমাদের চারহাত এক করে দেব আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। আমার বাড়িতে বৌ নয়, মেয়ে হয়ে আসবে তুমি।"
প্রায় সাত ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের লাল আলোটা নিভে গেল। বেরিয়ে এলেন ডঃ সেন। হাসি মুখে বললেন,
—" অপারেশন সাকসেসফুল। দুটো কিডনিই ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়ে গেছে। আপনি বডিটার ব্যবস্থা করুন।"
স্মিত মুখে মিঃ রায় বললেন,
— " চিন্তা করবেন না। বাকী সবটা আমি সামলে নেব।"
তারপর অর্ণব রায়ের অ্যাকাউন্ট থেকে একটা মোটা অঙ্কের টাকা ট্রান্সফার হল ডঃ সেনের অ্যাকাউন্টে। আর একটা বড় দুর্ঘটনায় বাসের চাকার তলায় খুঁজে পাওয়া গেল সুরভির মৃতদেহ!
কবিতা
শরতের ক্যানভাসে মায়ের পরশ রীনা মজুমদার
অষ্টমীর চাঁদকে টোকা দিয়ে
দেখেছ কখন?
দুঃখের সাগরকে শান্ত করে, কেমন
ছড়িয়ে পড়া সে জোছনা!
আঁধারে দেবীর নাকছাবি দ্যুতির পরশ
পেয়েছ কখন?
অন্তরের প্রেমকে মানবিক করে, কেমন
ছড়িয়ে পড়া সে আলো!
শরতের আকাশকে তুলিতে এঁকে
নিয়েছ কখন?
রিক্ত হৃদয়কে সিক্ত করে, কেমন
ছড়িয়ে পড়া সে রঙ!
সন্তানপিঠে রমনীর হাতে বীজধান
কুড়িয়েছ কখন?
মেদিনীর বুককে বিকশিত করে, কেমন
ছড়িয়ে পড়া সে দানা!
দশমীর পান্তাভাতেই তো থাকে
বিজয়ার আশিস গাঁথা...
জীবনের ক্যানভাসে থাকে সব ঋতুই
তবু শরতের আঁচলে যেন
নিজের মা'য়েরই পরশ।
আবাহন
সৈকত দাম
" যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তি রূপেণ সংস্থিতা "
ফারজানার বুকে তখনো জ্বলছে
নবমী নিশির সন্ধ্যা প্রদীপ .....
তখনো ধোঁয়ার উদ্গীরণ জ্বালিয়ে দিচ্ছে চোখ ,
সুগন্ধি ধুনোর আবেশ ভীষণ জড়িয়ে রয়েছে তাকে ...
ফারজানা আকাশের দিকে দেখে নেয় এক ফাঁকে ......
একটা মুক্ত আকাশে খেলছে মেঘের শাবক ....
" হ্যালো ফারজানা, কোথায় তুমি ?
চলে এসো, আমি এখন শ্রীভূমি ....... "
দেবী প্রিন্টের শাড়ি পরে দাড়ায় এসে কাছে ,
এতোটা কাছে, যতোটা কাছে উপগ্রহের ধুলো .....
এতটা কাছে, যতোটা কাছে নিশ্বাস রাখা আছে .....
বেরহেম পৃথিবী তবে শেষ করেনি তাকে ,
আগের মতোই ফারজানাকে বেশ সুন্দর লাগে .....
ফারজানা এভাবেই তুমি কাঁটাতার ভেঙ্গে এসো,
ফারজানা এভাবেই তুমি ব্যারিকেড ভেঙ্গে এসো,
শক্তি এসো, সত্যি এসো,
এসো ভিনদেশি তারা হয়ে ......
বিসর্জিত হৃদয়ের জলে দেখবো তোমার মুখ ....
দুরন্ত এক কিশোরীর মতো বুকে ,
আমাকে পাবার সুখ .......
হয়তো অন্য মাটিতে মূর্তি গড়েছি আমি ......
বেনকাব সেই চোখের কালোতে আটকে রয়েছে মন ,
বটের পাতায় করিনি আমি শক্তির আবাহন ........
স্মৃতি আঙিনায় - স্বপ্ন গোলাপ সারণ ভাদুড়ী
স্মৃতি আঙিনায় আজ ফুটেছে আমার স্বপ্নের গোলাপ,
বেরঙিন জীবনকে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যই
আজ তা ফুটেছে।
স্মৃতির আঙিনায় আজ ডানা মেলেছে কত প্রজাপতি
অথচ ক্ষণিক আগেই এটা ছিল
এক ধ্বংসস্তূপ !
হ্যাঁ বিস্মৃতি- বেদনা- বিমূঢ়তার স্তুপ
যেখানে আজকের ফোটা স্বপ্নের গোলাপ
পড়ে ছিল শুকনো হয়ে.....
বন্ধু পরস্পর জীবনঘনিষ্ঠ
মজনু মিয়া
লোহা কাষ্ঠ বন্ধু হয়ে গভীর জলে ভাসে
আশা নিরাশায় তারা পাশাপাশি হাসে।
জলের সাথে মাছের পিরিত জনম জনম হয়
জল বিনে যে মাছের মরণ সর্ব লোকে কয়।
গাছের সাথে লতার বন্ধু জড়িয়ে থাকে বুকে
ঝড় তুফানেও আগলে রাখে সুখে কিংবা দুখে।
বন্ধু তুমি আমার বন্ধু হৃদ আসনে থেকো
আপদ বিপদ সুখ, সুখে কাছে পাশে ডেকো।
গীতিকার্নী
অঞ্জলি দেনন্দী
বাংলার নদীর তীরে
জন্মে জন্মে জন্মে আসি
ফিরে ফিরে ফিরে।
বাংলার মাটি
আমি বড় ভালোবাসি।
বাংলার বায়ু চির খাঁটি।
এর শুদ্ধ জল
দেয় অনন্ত বল।
আলো এর অশেষ।
এ আমার প্রিয় দেশ।
বাংলায় গান গাই।
অমরত্ব পাই।
কত কত কত
দেশে দেশে দেশে যাই।
এ দেশের মত
এমন দেশটি আর নাই।
সেরা দেশ এ দেশ তাই।
আমি বাংলার প্রাণ।
আমার এ জীবন বাংলারই দান।
বাংলা আমার আত্মসম্মান।
এই বাংলাতে জন্মেছি আমি।
প্রার্থনা করি, হে অন্তর্যামী!
বাংলার বুকে
মরণ হয় যেন সুখে!
আমার বাংলা গান যেন থাকে
সকলের মুখে মুখে মুখে।
মৃত্যুর পরেও যেন
এ বাংলা আমায়
নিজেদের অন্তরে রাখে!
আমার বাংলা গান যেন
কেউ না থামায়!
আমার সৃষ্টি যেন
যুগে যুগে যুগে প্রেমাশ্রু নামায়!
প্রবন্ধ
শিশুশ্রম বর্তমান আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় চরম লজ্জারবটু কৃষ্ণ হালদার
সাল ২০২২,স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত,দেশ আধুনিক সভ্যতার আঙিনায় পা রেখেছে।অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যাবহারে ভারত বর্ষ ডিজিটাল ইন্ডিয়া তে রূপান্তরিত হয়েছে।কিন্তু আদপে ভারত বর্ষ কি সত্যিই সভ্য হয়ে উঠেছে? কারণ যে আধুনিকতার রঙে আমরা সবাই রঙিন হয়ে উঠেছি সেই সভ্য সমাজের মুখোশের পেছনে রয়েছে আরও একটি অন্ধকারের বিভীষিকা ময় রূপ। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং সেটি হল আমাদের সমাজের জ্বলন্ত সমস্যা গুলির মধ্যে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ।সেই জ্বলন্ত সমস্যার নাম শিশু শ্রম।দেশ স্বাধীন তার প্রায় ৭৫ বছর অতিক্রান্ত, দেশের সরকার বারবার এই জীবন্ত সমস্যার উপর আলোকপাত করলেও রাস্তার পাশের ছোট ছোট দোকান ,ইটভাটা ,হোটেল চাষের ক্ষেত বিড়ি বাধা, বোতল কুড়ানো, গৃহভিত্তিক কর্ম,রাজমিস্ত্রি জোগাড়ে,এমনকি ভিক্ষা করতে ছোট ছোট শিশু দের ব্যাবহার করা হচ্ছে। ছোট ছোট শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করানোটা আজকাল ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তাতে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাজনৈতিক অনেক রথি মহারথীরা যুক্ত রয়েছেন। বিটিশা প্রায় ২০০ বছর যাবত আমাদের ভারতবর্ষকে লুণ্ঠন করে তাদের সন্তানদের মুখে তুলে দিয়েছে সোনার চামচ, আর আমাদের দেশের সন্তানরা জন্ম নিচ্ছে মাথায় ঋণের বোঝা নিয়ে।তবে স্বাধীনতার পরে শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে নানা আইন তৈরি হলেও তার হয়ে গেছে খাতা কলমে। ব্রিটিশরা যেটুকু ভারতবর্ষে রেখেছিল তা বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা লুটেপুটে খাচ্ছে। তাতে ভারত বর্ষ আরো গরীব দেশে পরিণত হচ্ছে।বেড়ে চলেছে শিশু শ্রমের সংখ্যা।শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে নানান আইন তৈরি হলে তা খাতা কলমে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
মানব জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে শৈশবের অবস্থান।এই বয়সে তাদের হাসি খেলা এবং পড়াশোনা নিয়ে থাকার কথা সেই বয়সে তারা হয়ে উঠছে কর্মমুখী। অথচ এই শিশুদেরকে বলা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যৎ।কর্মমুখী হওয়ার ফলে বহু শিশুদের প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঠিকঠাক মতো ভাবে পরিচর্যা করলে হয়তো দেখা যেত ওই সমস্ত শিশুগুলোর মধ্যে দিয়ে কেউ কেউ দেশের মুখ উজ্জ্বলকারী সন্তান হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু
সমাজের বুকে জায়গা করে নিচ্ছে শিশু শ্রমিক হিসেবে। আর এইসব শিশু শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে মুনাফা লুটছে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ। তারা তাদের কম পয়সা দিয়ে অথবা দুবেলার খাবার দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে নিচ্ছে।
২০১৯ এর করানো মহামাড়িতে দেশে লকডাউন চলতে থাকায় বন্ধ ছিল সমস্ত মানুষের রোজগার। উল্লেখযোগ্যভাবে বন্ধ ছিল স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়।
যার ফলে অনেক ছোট ছোট পড়ুয়ায় পড়াশোনার ব্যাগ কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে শিশু শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয় বিশেষত ফুটপাতের দোকানগুলিতে। পরবর্তীকালে বিদ্যালয়ে খুললেও আর বিদ্যালয় মুখী হয়নি সেই সব ছেলেমেয়েরা। তারা শিশু শ্রমিক হিসেবে থেকে গেছে সমাজের বুকে।শিশুদের দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করার জন্য আমাদের দেশে রয়েছে বিভিন্ন আইন, রয়েছে শিশু সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কমিটি।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সরকার এই শিশুশ্রমকে বন্ধ করার জন্য আইন করে ১৪ বছর বয়সের কম শিশুদের দিয়ে কাজ করানো বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে।তাতে ও চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ,র তথ্য অনুযায়ী শিশু শ্রমিকদের যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত লজ্জাজনক।সমগ্র ভারতে ৫_১৮ বছরের প্রতি ১১ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু শ্রমিক।১৫_১৮ বছরের শিশুদের পাঁচ জনে একজন শ্রমিক।২০০১_২০১১ সালের মধ্যে শহরের শিশু শ্রমিক বেড়েছে ৫০ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে সেই পরিসংখ্যান আরো ভয়ংকর, প্রায় ৮০ শতাংশ।২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ থেকে চোদ্দ বছরের শিশু শ্রমিক ছিল প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ।কিন্তু তবুও আইন লঙ্ঘন করে এই কাজ করে চলেছে অনেকে।যার ফলে নষ্ট হচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ ভেঙে পড়ছে আমাদের জাতির মেরুদন্ড।
আমাদের সকলেরই জানা ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই সমস্যা সমাধান করা অত্যন্ত কঠিন একটা কাজ।কিন্তু কোন কাজই কঠিন হবে না যদি আমরা সকলে মিলে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এবং এই বিষয়ে সচেতন হওয়াটা খুবই জরুরী।কিন্তু আমরা যদি এখন থেকে শিশুশ্রম এর মত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ছোট ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে থাকি তবে ভবিষ্যতে এর জন্য আমাদেরকে বড় মূল্য দিতে হবে। পঙ্গু হয়ে পড়বে আমাদের ভারত বর্ষ।কারণ শিশুরাই হল জাতির ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎকে আমরা যদি ঠিকমতো সুরক্ষা দিতে না পারি তবে ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বড় অভিশাপ অপেক্ষা করছে।তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমাদের উচিত এই জঘন্য ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো বন্ধ করা। তবেই ভবিষ্যতে আমরা সোনার ভারতবর্ষ গড়তে পারব।এখন ই করো,শিশুশ্রমের সমাপ্তি এই সংকল্প নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আর যারা শিশুদেরকে দিয়ে শ্রম করানোর চেষ্টা করছে তাদের বুঝতে হবে তাদের ঘরের সন্তান আর যারা শ্রম করছে তারাও এই ভারতবর্ষের সন্তান। আর বুঝতে হবে যতদিন শিশু শ্রমের মত সামাজিক ব্যাধি এই দেশ থেকে ধ্বংস না হচ্ছে ততদিন ভারতবর্ষ কখনোই সোনার ভারতবর্ষ হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না।
দা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন ২০০২ সালে বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস হিসেবে আজ অর্থাৎ ১২ই জুন কে বেছে নিয়েছিল।সেই থেকে পালিত হয় আসছে আজকের এই দিন।এখনো সারা বিশ্বে প্রায় ১৫২মিলিয়ন শিশু শ্রম করে ।আন্তর্জাতিক স্তরে তাই ক্যাম্পেন করে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো টা যে অপরাধ তার প্রচার ও প্রসার হয়ে চলেছে সারা বিশ্ব জুড়ে। আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার জন্য অসংখ্য বাবা মা তাঁদের শিশুদের কাজ করতে পাঠায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে।যা একেবারেই প্রযোজ্য নয় ।শিশুদের দ্বারা শ্রম দণ্ডনীয় অপরাধ জেনে ও আজ ও চলছে এই শিশুদের নিয়ে কাজ করানোর প্রবণতা।আইনের ঊর্ধ্বে ফাঁক ,তাই এই ধরনের সমস্যা আজও দেখতে পাওয়া যায় সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিতে নজর রাখলেই অনুমেয়।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা এখনো শিশুদের খাটনি চায়ের দোকানে,হোটেল রেস্টুরেন্টে, চলচ্চিত্রে প্রমুখ স্থানে শিশুদের পরিশ্রম করতে দেখতে পেলেও প্রতিবাদ করতে পারি না।এই প্রতিবাদ যেদিন কলরবে উচ্চারিত হবে সেদিন আমরা হয়ত আমাদের লজ্জা কে ঢাকতে পারবো।এই বিশ্বে মন ভালো করার সবথেকে সুন্দর জিনিস হল শিশুর হাসি।তাদের কে প্রাণ খুলে খেলতে,হাসতে দিন।ওরা ও এই ধরিত্রীর অমূল্য সম্পদ।ওদেরকে প্রাণ খুলে বাঁচার সুযোগ করে দিন।বিশ্বের সকল শিশু শ্রমের সাথে যুক্ত ক্ষুদেদের প্রতি সমবেদনা জানাই,আর এর পরিবর্তনের উদিত সূর্য্যের অপেক্ষায় রইলাম।
সর্ব ধর্ম সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশে ১২ মাসে ১৩ পার্বণের উৎসব রেশ সর্বদা বজায় থাকে। এই উৎসবগুলো পালন করতে লক্ষাধিক টাকা এমনকি কোটি কোটি টাকা ও ব্যয় করা হয়। যে দেশে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে উৎসব পালন হয় সেই দেশে শিশু শ্রমিকের হার বেড়ে চলা, কিংবা ছোট ছোট শিশুরা দুই হাত পেতে ভিক্ষা করার চিত্র কি সামাজিক লজ্জা নয়? এ সমস্ত ঘটনাগুলো কি আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না? মনে রাখবেন এই সামাজিক লজ্জা শুধু আমার আপনার নয় সমগ্র ভারতবাসীর? তবে যে যার মত করে উৎসব পালন করুন, সেই উৎসবে ওই অসহায় শিশুগুলোকে আলোর রোশনাই ও প্রাণোচ্ছল জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন না। তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিন।
রম্যরচনা
রসিক চোর
স্বপন কুমার দত্ত
সেদিন ছিল পূর্ণিমার রাত। সমস্ত চরাচর ভেসে যাচ্ছে, চাঁদের শুভ্র আলোয়। ঘরে সবাই ব্যস্ত ধন সম্পদের দেবী লক্ষ্মী দেবীর পূজা অর্চনায়।
এদিকে হয়েছে কি, এক চোর সুযোগ বুঝে বেরিয়েছে চুরি করতে। ও চিন্তা করেছে, এখন তো সবাই ব্যস্ত, এই সুযোগে হাতানো যাক বেশ কিছু মাল। যেমন ভাবা তেমন কাজ।ঢুকে পড়েছে,এক গেরস্থের রান্নাঘরে। একটা বস্তায় বেশ কিছু বাসনপত্র ভরার সময় হাত ফসকে একটা কাঁসার বাটি পড়ে গিয়ে ঝন ঝন করে শব্দ হওয়ায় " কে রে" " কে রে" করায় বাড়ির লোকজন তেড়ে আসে। আর কপাল খারাপ থাকায় একেবারে ধরা পড়ে ' বামাল অবস্থায়' ।
এমন সময়, ওই বাড়ির এক কিশোরী আপন মনে গেয়ে ওঠে, " মার ঝাড়ু মার, ঝাড়ু মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় কর"। মনে হয়, কিছুদিন ধরে ও ঐ গানটাই করছিল রেওয়াজ।
কিন্তু এদিকে তো চোর বাবাজীও একাধারে রসিক ও সঙ্গীত প্রেমিক তা জানা ছিল না।আড়ঙ্গ ধোলাই খাবার ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে সে গেয়ে ওঠে, " পাখিটার বুকে যেন তির
মেরোনা, ওকে পালাতে দাও".......
এবার এগিয়ে এলেন, স্বয়ং গৃহকর্তী। এগিয়ে এসে বললেন, " বহুদিন ধরে তক্কে তক্কে
ছিলাম। এবার তোকে পেয়েছি, হাতেনাতে ধরেছি ।সুর করে গাইলেন, " আর কি আমি
ছাড়বো তোরে ..... জোর করে রাখিব ধরে।"
রসিক চোর আবার আশ্রয় নেয় গানের। " যদি আমায় তুমি বাঁচাও, তবে তোমার নিখিল ভুবন ধন্য হবে।"
ইতিমধ্যেই জমায়েত হয়েছে, অনেক লোকের।এক একজনের মন্তব্য এক একরকম।
" বেঁধে রাখো সারারাত গাছের সঙ্গে", কেউবা " না না পুলিশে খবর দাও" আবার কেউ বলে, " ওসবে লাভ নেই। কিছুইতো নিতে পারেনি,বরং দুচার ঘা মেরে করে নাও হাতের সুখ।"
এবার চোর দেখলো বেগতিক। যেভাবে বাক্য বান তার দিকে ছুটে ছুটে আসছে, তাতে কতক্ষণ আস্ত থাকা যাবে, তার কোন ঠিক নেই। এখন একমাত্র ভরসা, সেই সুর সাধক রবীন্দ্রনাথ। তাই নিরুপায় হয়েই আবার আশ্রয় করতে হল তাকে । " এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসি খেলায়, আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।"
এবার গৃহকর্তার পালা। সেতো ভীষণ ক্রুদ্ধ। হাতে গরম জিনিষ যখন পাওয়া গেছে, তখন ছাড়ার প্রশ্ন কেন? তিনিও গেয়ে উঠলেন, " যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়বোনা।"
রসিক চোর শেষ চেষ্টায় আবার শুরু করে গাইতে, " বাঁচাও কে আছ, মরেছি যে চুরি করে।" কিন্তু না, এইসব সুরেলা গানেও টললো না কারোর মন।ডাকা হল, মুঠোফোনে পুলিশকে। সেই এসব ঝামেলা সামলাক।
অল্পক্ষণের মধ্যেই হাজির হল পুলিশ । পুলিশ বাড়ির কম্পাউন্ডের বাইরে তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে দাঁড়িয়ে। অনুমতি না পেলে কিভাবে ঢুকে ভেতরে । তাই সেও চাইল গানের মাধ্যমে অনুমতি। " খোলো খোলো দ্বার, রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে/ দাও সাড়া দাও, এইদিকে চাও,এসো দুই বাহু বাড়ায়ে।"
পুলিশ তার গতানুগতিক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন।তারপর বামাল ধরা পড়ায় আর অন্য কিছু চিন্তা না করে সেই রাতে লকআপে রেখে পরদিন চোরকে চালান করলেন--- আদালতে।
সঙ্গীতানুরাগী চোর পরদিন আদালতের কাঠগড়ায়।
বিচারক ----- তুমি চুরি করেছ?
চোর ----- না হুজুর, চেষ্টা করেছি, সফল হইনি। আর সেও কবিগুরুর নির্দেশ পালন করেছি শুধু।
বিচারক __ তার মানে ?
চোর ----- গতকাল মাঝরাতে একটা গান ভেসে আসছিল,---- " আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।" তাই ভাবলাম, আমিই বা বসে থাকি কেন? আমিও যাই, তাই বেরিয়ে পড়লাম।
বিচারক --- তারপর?
চোর ---- একটি গেরস্তর বাড়ি থেকে আওয়াজ এলো,-- " এসো এসো আমার ঘরে,এসো আমার ঘরে" আর কী, সাথে সাথে ঢুকে পড়লাম।
বিচারক -- বটে তারপর ?
চোর ----- ঘরে ঢুকে শুনেছিলাম, --- " ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে"। খানিকটা পেলুম আনন্দ। তারপর ভেসে এলো--- " এবার উজাড় করে লও হে আমার যা কিছু সম্বল।" কবিগুরুর নির্দেশ অমান্য করা যায় না। সব মালপত্র বেঁধেছি। সঙ্গে সঙ্গে কানে ভেসে এলো,--- " আজ দখিন দুয়ার খোলা।'
বিচারক ---- তুমি তো খুব ধুরন্ধর হে। তারপর?
চোর ---- তারপর আর কী! হুজুর কত অনুরোধ করলাম, আমায় আটকে রেখোনা।আমিতো চুরি করতে পারিনি। গাইলাম," ছেড়ে দাও আমায় ধরোনা"। কিন্তু না: ,ওরা শুনলনা, তুলে দিল পুলিশের
হাতে।
বিচারক -- তা তোমাকে পুলিশে না দিয়ে কী করবে ?তুমি কী চেয়েছিল জামাই আদর?
চোর -- না হুজুর, আমি পুলিশকে কত বোঝাবার চেষ্টা করলাম, আমি তো চুরি করিনি।শুধুমাত্র
রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ পালন করতে চেষ্টা করেছি। তো ব্যাটা বোধহয়, নামই শোনেনি রবীন্দ্রনাথের। সোজা আপনার কাছে নিয়ে এসেছে।
বিচারক ---- ঠিক আছে, তোমাকে ছয় মাসের সাজা দিলাম চুরির চেষ্টার অপরাধে । এই বিষয়ে তোমার
রবীন্দ্রনাথ কিছু বলেছেন?
চোর ---- '" এ পথে আমি যে গেছি বারে বার, ভুলিনি তো একদিনও।"
বিচারক --- তোমার কোন পরিবর্তন নাই। এই সাজা ঘোষণার পরও তুমি নির্বিকার!
চোর -- হুজুর " এই করেছ, ভালো নিঠুর হে, এই করেছ ভালো।";
বিচারক --- জেলে যখন থাকবে, তখন তোমার রবীন্দ্রনাথ কী বলবে?
চোর --- কেন ? " ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে?"
ছবি
শৌভিক কার্য্যি
চিত্রাক্ষী রায়
মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪২৯
No comments:
Post a Comment