Tuesday, September 5, 2023




 

সম্পাদকের কথা 

শরতের নীল আকাশে এখন সাদা মেঘের আনাগোনা হলেও বর্ষা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। কিন্তু বাঙালি মন নেচে উঠেছে আসন্ন শারদীয়া উপলক্ষে। শুরু হয়েছে অধীর আগ্রহে দিন গোনা, কবে আসবেন উমা! ইতিমধ্যে চন্দ্রযানের সফল অবতরণ ও সূর্যকে আরও জানবার জন্য আদিত্যর উৎক্ষেপণ আমাদের আনন্দকে বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু চিন্তার ও উদ্বেগের ভাঁজ আরও বেড়েছে রাজ্যের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ পড়ুয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুতে। মুজনাইয়ের ঘরেও মৃত্যুর আকস্মিক থাবা স্তব্ধ করেছে সবাইকে। আমাদের প্রিয় বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী দেবব্রত (পুটন) ঘোষকে হারিয়ে আমরা শোকবিহ্বল।


 স্মরণ 


দেবব্রত (পুটন) ঘোষ 

মুজনাই সাহিত্য পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে মুজনাইয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দেবব্রত (পুটন) ঘোষ। ডুয়ার্সের বর্ধিষ্ণু জনপদ ফালাকাটার অত্যন্ত পরিচিত চিরযুবক মানুষটি ছিলেন অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার নামী ফুটবল খেলোয়াড়। তাঁর প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যেত নাট্য মঞ্চেও। ঘোষক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল সুবিদিত। শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন সফল মানুষ। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা আজ ছড়িয়ে রয়েছে এই রাজ্যের সর্বত্র। 'ভাল মানুষ' বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই-ই। তাঁকে অনুসরণ করে বড় হয়েছে ফালাকাটার কয়েকটি প্রজন্ম। তাঁকে হারিয়ে আমরা মর্মাহত। শোকস্তব্ধ। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। আমরা মনে করি তিনি আমাদের মধ্যেই রয়েছেন। মুজনাই যতদিন থাকবে ততদিন তাঁকে বুকে করেই বয়ে চলবে। 


মুজনাই অনলাইন ভাদ্র  সংখ্যা ১৪৩০

শারদীয়া ভ্রমণ 

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদ ছবি - আন্দামানের চাথাম দ্বীপ/ শৌভিক রায়  

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন ভাদ্র  সংখ্যা ১৪৩০


ক্রোড়পত্রে আছেন যাঁরা 

গৌতমেন্দু নন্দী, জয়িতা সরকার,  দেবর্ষি সরকার, 

অরুণ কুমার, কবিতা বণিক, দেবাশিস ভট্টাচার্য


মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪৩০ 



আদিমতার চিহ্ন 
জয়িতা সরকার 

স্থাপত্য-ভাস্কর্য কিংবা ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য যেমন ইতিহাসকে ছুঁয়ে থাকে, তেমনি প্রকৃতির মাঝেও আছে প্রাচীণতার হাতছানি। শুধুমাত্র রাজা-রাজ্যপাট কিংবা ইংরেজ রাজত্বকালের যুদ্ধ-চুক্তি-নির্মাণের সাক্ষ্য নয়, এই ইতিহাস আদিমতার,এই চিহ্ন প্রস্তর যুগের। নব্য প্রস্তর যুগের  মানবতার এমনই এক সাক্ষরের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ হল আমাদের। 






একদিকে নীল সমুদ্র, অন্যদিকে সবুজে মোড়া পাহাড়, তারই মাঝে জঙ্গল পাহাড়ে ঘেরা এক গুহাচিত্রের ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে সেজে উঠেছে ভগবানের নিজের দেশ কেরালা। আলেপ্পির ব্যাক ওয়াটার কিংবা মুন্নারের সবুজ গালিচার সঙ্গে রীতিমত টেক্কা দেবে প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য হয়ে থাকা এডাক্কাল গুহা। কেরালার ওয়ানাড জেলার অম্বুকুট্টিমালা পাহাড়ে অবস্থিত এই গুহা ক্রমেই পর্যটন মানচিত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করছে। গুহার গুরুত্ব বেড়েছে গুহাচিত্রের নিদর্শন মেলায়। যা প্রমাণ করে প্রায় আট হাজার বছর আগে এই গুহায় মানুষের বসবাস ছিল। গুহার দেওয়ালের বিভিন্ন চিহ্ন প্রমাণ করে সময় অনুক্রমে মানুষের বসবাস ছিল এখানে। 





আদিমতা কিংবা ইতিহাস নয়, পৌরাণিক কাহিনীও জড়িয়ে রয়েছে এই গুহা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে। লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী হল, লব-কুশের ধনুকের ঘায়ে বিশালাকার পাথর দ্বিখণ্ডিত হয়ে এই গুহা তৈরি হয়েছে। সৃষ্টির ইতিহাস যাই হোক, পুরাতত্ত্ব  বিভাগের কাছে বেশ গুরুত্ব রয়েছে এই এডাক্কাল কেভ-র। গুহার দেওয়ালে মানুষ-জীবজন্তুর খোদাই করা চিহ্ন যেমন প্রস্তর যুগের সাক্ষ্য বহন করছে, তেমনি সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সংযোগ রয়েছে ' A man with a jar cup' এর চিত্রও স্পষ্ট গুহার দেওয়ালে। এই চিত্র নিয়ে নানা মত রয়েছে পুরাতত্ত্ববিদদের মধ্যে। উত্তরের হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে দক্ষিণের দ্রাবিড় সভ্যতার সাংস্কৃতিক ব্যাপনই হয়ত এই চিত্রের প্রেক্ষাপট। তবে শুধুমাত্র এই সাংকেতিক চিহ্ন নয়, রয়েছে তামিল ও ব্রাহ্মী লিপিরও সাক্ষর রয়েছে কেরালার জঙ্গলে ঘেরা এই গুহার আড়ালে। 





Fred Fawcett, ১৮৯০ সালে শিকার করতে এসে এই গুহার সন্ধান পান। পরবর্তীকালে বারবার গুহাচিত্র নিয়ে গবেষণা করেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে কেরালার অফবিট জায়গাগুলোর অন্যতম এই এডাক্কাল কেভ। ওয়ানাড ভ্রমণের তালিকায় অবশ্যই প্রথমসারিতে এই গুহা। তবে কেভে পৌঁছতে হলে বেশ খানিকটা পথ চড়াই পেড়িয়ে পৌঁছতে হবে। পার্কিং থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে অনেকটা। তবে গুহায় প্রবেশের আগে পাহাড় থেকে নীচের প্রকৃতির যে রূপ তা এক নিমিষেই দূর করবে সব ক্লান্তি। 




পরিচিত কেরালার ভ্রমণের সঙ্গে অবশ্যই জুড়ে নেওয়া যেতে পারে ওয়ানাডকে। মুন্নারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখানেও রয়েছে ধাপে ধাপে সাজানো চা বাগান। রয়েছে সূচিপাড়া ওয়াটারফলস, মীনমত্তু ওয়াটারফলস, বানাসুরা সাগর ড্যাম। পশ্চিমঘাট পেড়িয়ে সমুদ্র সৈকতে সময় কাটাতে চাইলে অবশ্যই সঙ্গে জুড়ে নেওয়া যেতে পারে কোজিকোড় এর বালুকাবেলা। পুজোর ছুটিতে ভিড় এড়িয়ে  নতুন জায়গা বেড়াতে চাইলে পা বাড়াতেই পারেন ওয়ানাডের দিকে।



ন্যাওড়াভ্যালীর সবুজ নৈঃশব্দ্যে--- ছাঙ্গে ফলস্
গৌতমেন্দু নন্দী 


গাড়ির উইন্ডস্ক্রীনের উপর ওয়াইপার দুটি বৃষ্টিভেজা কাঁচের উপর পরস্পর ক্লক ওয়াইজ ও অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ নিরলস মুভমেন্টে ক্রমাগত যেন অর্ধবৃত্ত আঁকছে আর মুছে চলেছে গাড়ির গতির সঙ্গে।গাড়ির সামনে মাঝখানে বনেটের উপর লাগানো তেরঙ্গা পতাকা বৃষ্টিস্নাত হয়ে পতপত উড়ছে। আর মিউজিক সিস্টেমে লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে বেজে চলেছে " বন্দে মা আ আ আ তারম বন্দেমাতরম....সুজলাং সুফলাং....." 









     স্বাধীনতা দিবসের বৃষ্টিস্নাত সকালে মীনগ্লাস চা বাগানের মধ্যে দিয়ে গরুবাথান পেরিয়ে বাঁ দিকে বর্ষায় উচ্ছ্বল চেল নদীকে পাশে রেখে ছুটে চলেছি লাভার দিকে। আশপাশ দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটছে বাইক রাইডার, ব্লগাররাও। প্রতিটি বাইকের সামনে তেরঙ্গার উজ্জ্বল প্রর্দশন। "সেন্ট্রিফিউগাল আর সেন্ট্রিপেটাল" ফোর্সের টানাপোড়েনে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে অসংখ্য বাইক।  চারপাশের  দুর্দান্ত  মেঘ-পাহাড়ের প্রাকৃতিক কোলাজ আর পাহাড়ি কালো ময়াল সাপের মতো সর্পিল পথে বাইক বাহিনীর দাপট দেখতে দেখতে গাড়ি এসে থামলো লাভা থেকে তিন কিঃমিঃ আগে রাস্তার গান দিকে একটু এগিয়ে। যেখানে থেকে রাস্তা চলে গেছে ন্যাওড়াভ্যালী ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে কোলাখামের দিকে। 



         ন্যাওড়াভ্যালী ফরেস্টে প্রবেশের (120 টাকা) টিকিট কেটে এবার গাড়ি লাভার পথ ছেড়ে ডান দিক দিয়ে ভাঙ্গাচোরা উৎরাই পথে চলতে শুরু করল। বন্ধুর পথে ঝাঁকুনির অস্বস্তি নিমেষেই উধাও দুই পাশের বার্চ,পাইন,ফারের ঘন সবুজতায়। পাইনের জঙ্গলের মাঝে মাঝে দুইপাশে ফার্নের শৃঙ্খলিত সবুজ বিন্যাসের মুগ্ধতা নিয়েই 9 কিঃমিঃ ভাঙ্গা, অমসৃণ পথ পেরিয়ে এলাম নেপালি "রাই" সম্প্রদায়ের মানুষের 50-60 টি পরিবার নিয়ে বসতি ও ২০/২২ টি হোটেল ও হোমস্টে নিয়ে গঠিত ন্যাওড়াভ্যালী উপত্যকায় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত ছোট্ট জনপদ, "Paradise for birds wachers"----কোলাখামে। একপাশে  সবুজ পাহাড়ি উপত্যকার নীচ থেকে তখন মেঘ কুয়াশার আস্তরন ক্রমশঃ ঊর্ধগামী। 





কালিম্পং থেকে ৩৮ কিমি ও লাভা থেকে ১২ কিমি ৬৫০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কোলাখাম ছেড়ে এগিয়ে চললাম আরও ঘন সবুজের ঠিকানায় "ছাঙ্গে ফলস্"এর দিকে। ছোট ছোট ঝোরা পেরিয়ে বৃষ্টি ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে পথে নির্জন-নৈঃশব্দ্যে মিশে গিয়ে আরও ৫/৬ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করে যেখানে এলাম সেখান থেকে প্রায় ১৫০০ মিটার দূরে এবং খাড়া ৩০০ মিটার নিচে সশব্দে আছড়ে পড়ছে ছাঙ্গে ফলস্। চড়াই -উৎরাই এর এই কষ্টকর পথের মুখে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম উৎরাই পথে নীচে পৌঁছতে পারব কিন্তু তারপর এতোটা চড়াই পথে উপরে উঠতে পারবতো?   ট্রেক এর কিছুটা অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই আমাদের চারজনের দল নামতে শুরু করলাম। ফিরতি পথে হাঁপিয়ে ওঠা অল্পবয়সীদের মুখগুলোতে আমাদের মানসিক জোর বাধাপ্রাপ্ত হলেও "চরৈবেতি চরৈবেতি" মন্ত্র নিয়েই এগিয়ে চললাম।  "ফলস্"এর প্রায় পাদদেশে পৌঁছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সেই বহুল প্রচারিত প্রবাদটি মনে মনে উচ্চারণ করেই ফেললাম ----
" কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে..."।




      
দীর্ঘ,বৃহৎ দুধসাদা সশব্দ জলপ্রপাতের বিস্তীর্ণ এলাকাকে বৃষ্টি ছাঁটের মতো জলকনায় সিক্ত করে ৩০০ মিটার উপর থেকে আছড়ে পড়ার দৃশ্যে মুগ্ধ যে হোতেই হয় এবং উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ ও সর্ববৃহৎ "ফলস্" কেন "ছাঙ্গে ফলস্" তাও বোধগম্য হয়ে যায়। জলোচ্ছ্বাসে কিছুটা স্নাত হয়ে পতনের গর্জনকে পিছনে ফেলে শ্বাসবায়ু আর প্রাণবায়ুর মধ্যে সমতা রাখার প্রচেষ্টা নিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের বুক চিরে অমসৃণ,বন্ধুর চড়াই পথে বেশ কষ্ট নিয়েই উপরে উঠে এলাম। তবে কষ্টার্জিত এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাক্ষুষ দর্শনের মুগ্ধতার রেশ কিন্তু থেকেই যাবে।
              
(প্রয়োজনীয় তথ্য: সরাসরি ছাঙ্গে ফলস্দি নে দিনে দেখে ফিরে আসা যায়। আর কোলাখামে নাইট স্টে করেও ছাঙ্গে ফলস্ সহ আশেপাশে ঘুরে আসা যায়। কোলাখামে উল্লেখযোগ্য হোমস্টেগুলো হোল---পাইন উড রিসর্ট, সাইলেন্ট ভ্যালী রিসর্ট, আরোহী হোমস্টে।)



পুজোয় চলুন মঙ্গলকাব্যের গ্রামে
দেবর্ষি সরকার

কোচবিহার জেলার গোসানীমারী হাই স্কুলের উত্তর পশ্চিমদিকের ঝা পরিবারগুলোকে 'বড় দেহুরী পরিবার' বলা হয়। কোচবিহারের মহারাজা প্রাণনারায়ণের রাজত্বকালে এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের সুদূর মিথিলা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়। মহারাজা প্রাণনারায়ন এই মৈথিলী ব্রাহ্মণ পরিবারকে অতিথি হিসেবে কামতেশ্বরী দেবীর পূজা, অর্চনা, শিক্ষা বিস্তার ও সংগীত চর্চার জন্য নিয়ে আসেন।





মহারাজা এই পরিবারকে দেবোত্তর ও ব্রহ্মোত্তর ভূসম্পত্তি দান করেন। সে সময় থেকেই এই পরিবার কামতেশ্বরী দেবীর পূজারী ও সেবাইত হিসেবে কাজ করতে শুরু করে তবে পরবর্তীতে একটি বিশেষ অভিমানে এই পরিবার শুধুমাত্র সেবাইতের কার্যভার সামনে আসছে। বর্তমানে অন্য বেতনভোগী মৈথিলী পুরোহিত নিযুক্ত আছেন। এখন প্রশ্ন হল কেন বা কোন কারনে এই পরিবার পূজার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়! শ্রী প্রদীপ ঝা তার পূর্বপুরুষদের মুখে শোনা সে গল্পটিই বলেছিলেন। গল্পটি নিচে রইলো,
'বড় দেহুরী বংশে কন্যা সন্তান হতো না। বহু বছর পরে বংশে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয় এবং এই কন্যা সন্তান সকলের মধ্যমনি হয়ে বড় হতে থাকে। একদিন সেই কন্যা সন্তানের পিতা কন্যাকে নিয়ে পূজা করতে কামতেশ্বরী ঠাকুরবাড়িতে যান। মেয়েটির পরনে ছিল একটি চেলী। মেয়েটিকে মন্দিরের বাইরে বসিয়ে রেখে তিনি কামতেশ্বরী দেবীর পূজা করতে থাকেন কিন্তু পূজা শেষ করবার পর তিনি দেখেন তার আদরের মেয়েটি নিরুদ্দেশ। সে সময়ে প্রায় নির্জন গোসানীমারীতে বহু খোঁজাখুঁজি করেও আর তাকে পাওয়া যায়নি। তবে মেয়েটির পরনের চেলীটি মন্দিরের মায়ের সিংহাসনের কাছে পাওয়া যায়। এই ঘটনায় অভিমানী পুরোহিত কামতেশ্বরী মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে বলেন মা তোমার পূজা করতে গিয়ে আমি আমার মেয়েকে হারিয়ে ফেললাম তুমি একি করলে মা! আজ থেকে আমার বংশের কেউই আর তোমার পূজারী হিসেবে কাজ করবে না।






এই ঘটনার পর থেকে আমাদের পরিবার শুধুমাত্র সেবায়েত হিসেবে কাজ করে আসছে। পরবর্তীতে এই বড় দেহুরী বুঝতে পারেন যে এই মেয়েটি কোন সাধারণ মেয়ে ছিল না। এই মেয়ে কামতেশ্বরীর অংশ। কথিত আছে একনিষ্ঠ ও নিষ্ঠাচারী এই বড় দেহুরীরা কামতেশ্বরী মায়ের সাক্ষাৎ পেতেন ও মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন।
কামতেশ্বরী ছাড়াও মঙ্গলচন্ডী ও গোসানী দেবী (দুর্গা) এই পরিবারের অন্যতম আরাধ্যা দেবী। কথিত আছে এই গোসানী দেবীর নাম অনুসারেই গোসানীমারীর নামকরণ হয়। এছাড়াও গণেশ, মনসা, শিব, নারায়ন, রাধা কৃষ্ণ গোপাল, বলরাম, সূর্যদেব শুভচন্ডী ইত্যাদি দেবদেবীরও নিত্য পূজা করা হয়। গোসানীমারীর বৃহৎ এলাকা থেকে শুরু করে শীতলখুচির গোলেনাওহাটি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই জমিদারি এলাকা। প্রজাগন প্রতিবছর 'পুণ্যাহ' উৎসবে অংশগ্রহণ করতো এবং জমির খাজনা জমা দিয়ে যেত। এই দিনে বিশেষ ভোজে প্রজাগন খুবই আনন্দ পেত।
কোচবিহারের রাজপরিবারে বড় দেহুরীগণ বিশেষ অতিথির সম্মান পেতেন। তারা রাজসভায় অন্যতম ধর্মীয় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। রতিনাথ ঝা বড় দেহুরী রাজসভায় সংগীত পরিবেশন করতেন। আমাদের বাড়িতে রক্ষিত একাধিক ঐতিহাসিক উপাদান থেকে জানা যায় যে রাজবাড়ী থেকে বড় দেহুরীকে একটি ব্যাচ দেওয়া হতো এবং ওই ব্যাচ পরেই তিনি রাজবাড়ীতে প্রবেশ করতেন এবং রাজদরবারে বিশেষ আসন অলংকৃত করতেন। রাজপরিবারের চিঠি থেকে জানা যায় ডাঙ্গর আই(কামতেশ্বরী দেবী) মাতা বড় দেহুরীর স্ত্রীর জন্য কাপড় ও ফল উপহার হিসেবে পাঠাতেন এবং প্রাপ্তি স্বীকার করবার জন্য অনুরোধ করতেন। '
কোচবিহারের রাজপরিবার তথা কোচবিহারের মানুষের অতিথি এই মৈথিলী ব্রাহ্মণ পরিবার ধীরে ধীরে কোচবিহারের সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে। মৈথিল কবি বিদ্যাপতির ঘরানার আনার এই পরিবার বর্তমানে কোচবিহারকেই নিজেদের 'আপন ঘর' হিসেবে মনে করে এবং কোচবিহারের শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নতি কামনা করে।

উনিশ শতকের প্রথম দিকে গোসানীদেবী এবং তার পীঠস্থান গোসানীমারীকে কেন্দ্র করে যে গোসানী মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে সে সম্পর্কে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে হয় তা হলো উনিশ শতকে আদৌ মঙ্গলকাব্য রচনা সম্ভব কিনা ? কেননা ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে প্রায় সমস্ত মঙ্গলকাব্যগুলো লেখা হয়েছে এবং উনিশ শতকে মঙ্গলসাহিত্যের চিরাচরিত ঐতিহ্য চাপা করে নতুন সম্ভাবনাময় সাহিত্য গড়ে উঠেছে। তবে এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ইতিহাসের কোন যুগ বিভাগই অংকের মত একেবারে সুনির্দিষ্ট নয় ফলে এক যুগের মধ্যে আরো একটি যুগ অনেক দূর অবধি মিশে থাকতে পারে। আসলে মধ্যযুগের কৃষিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম সমাজের গতানুগতিক জীবন পরিবেশ সেদিনের সেই যুদ্ধ সংকীর্ণ ক্ষুধা ভয়ের দুঃস্বপ্ন তাড়িত দৈবনির্ভর জীবনযাপন উনিশ শতকে আশা করা যায় না। ফলে যে বিশেষ ধরনের ভাবনা বেদনা মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছিল তা সাধারণভাবে উনিশ শতকে কল্পনা করাও অসম্ভব। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ কিংবা উনিশ শতকে কোচবিহার রাজ্যের অবস্থা অন্যরকম ছিল। এই অরাজক অবস্থার সম্বন্ধে কবি বলেছেন ,
হইল আকাশ বাণী, পূজা কর মা ভবানী,
                 পুনঃ হবে রাজ্যের ঈশ্বর।
গোসানী করহ পূজা, সুখে রবে যত প্রজা,
                 রাজা হবে নাম কান্তেশ্বর।। (পৃ ৭০)
রাজা কান্তেশ্বরের আবির্ভাবের পূর্বে কামতাপুর তথা কোচবিহার রাজ্যের জীবনযাত্রা এবং রাষ্ট্রীয় অবস্থা পর্যালোচনা করলে বিষয়বস্তুটির প্রকৃত তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমানতউল্লা লিখিত কোচবিহারের ইতিহাস দেশের অবস্থা বর্ণনায় বলেছেন -
' সেই সময়ের পার্শ্ববর্তী মুঘল অধিকারের তুলনায় কোচবিহারের অধিবাসীগণের অবস্থা অত্যন্ত হীন ছিল। বহিরাক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগে কোচবিহারবাসীগণ বিত্তহীন হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাদের প্রাণের কোন মূল্য ছিল না।' রাজাবিহীন দেশে অরাজক অবস্থায় গোসানীমঙ্গল রচনার ঐতিহাসিক ভিত্তি ভূমির চিত্রও সুস্থ ছিল না। সেই সময়ের যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তার ফলে প্রজাপুঞ্জের অভাব অভিযোগ শ্রবণের অবসর ও প্রবৃত্তি কারো ছিল না এমনকি প্রজারা রাজস্ব দানের অসমর্থ হলে কাজ কর্মচারীদের অত্যাচারের পরিমাণও বৃদ্ধি পেত। এইসব কারণে বহু প্রজা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। গৃহযুদ্ধ, অপশাসন ,অভ্যন্তরীণ ও বহিঃদেশে গোলযোগের এইসব কথা তৎকালীন বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থের পাতায় লেখা রয়েছে। এই কাহিনীর ভিত্তি হলো আঞ্চলিক ইতিহাস। এই কাহিনীর ঐতিহাসিক কাল যেমন অশান্ত, তেমনি কবি যখন মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণের রাজত্বকালে (১৭৮৩ - ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ) এই কাব্য লিখতে আরম্ভ করেন সেই সময় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক জীবন সুস্থ ছিল না। এই দুটি প্রেক্ষাপট গোসানীমঙ্গল কাব্য রচনায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে নিঃসন্দেহে। মানুষের প্রতিবাদের ভাষা সেখানে মৌন আত্মশক্তি ও যেখানে ক্ষীয়মান সেখানে এসেছে কাল্পনিক শক্তিশালী দেবতা বা ভগবান। স্বাভাবিকভাবেই দেবতার কাছে বাঞ্ছিত মঙ্গল প্রাপ্তির আশায় দেবমাহাত্ম্যও বর্ণিত হয়েছে যথেচ্ছ ভাবে। ফলে ,সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণেই এই সময়ে মঙ্গলকাব্য লেখা সম্ভব হয়েছে। গোসানীমঙ্গল কাব্যটিও যথার্থ মঙ্গলকাব্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য মন্ডিত বলে দাবি করা যায় এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক বিশেষত্ব উত্তরবঙ্গের সামাজিক ও সাংস্কৃতি ইতিহাসের বিশেষ উপাদান হিসাবে কাব্যটি একটি ভিন্ন গুরুত্ব দাবি করতে পারে।





কোচবিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ বিশ্বসিংহের রাজত্বকালে তার পুত্র সমর সিংহের (শুক্লধ্বজ) আদেশে পীতাম্বর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে যে মার্কন্ডেয় পুরান বাংলায় অনুবাদ করেন সেখানে কবি দেবী দুর্গার নামের পরিবর্তে বহুবার বিভিন্ন রূপে এই গোসানী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সেই সময়েও এই নামটি কবি মহলেও বিশেষ পরিচিত ছিল বলেই অনুমান করা যায়। আমি এখানে কেবলমাত্র একটি নমুনা তুলে ধরলাম -
' সৃষ্টি কালে তেহে সৃষ্টি কারিনী আপুনি।
সেহি সে জন্মায় ত্রিভুবনক গোষানী।।
স্থিতি কালে তেহে স্তিতি কারিনী গোষানী।
সম্প্রতি নরের ঘরে লক্ষ্মী স্বরূপিনী।।'
পদ্মাপুরাণ লেখক নারায়ণ দেবকে অনেকেই উত্তরবঙ্গের মানুষ বলে মনে করে থাকেন। তার লিখিত পদ্মাপুরানে আমরা গোসানী শব্দটির ব্যবহার দেখতে পাই। এখানে মাতা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন -
'সাসুড়ির স্থানে গিয়া মাগিল মেলানি।
মায়ের অধিক তুমি সাসুড়ি গোসানি।।'
গোসানী নামের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায় কোন বিশেষ দেবী অর্থে নয়, শুধুমাত্র লৌকিক মাতা অর্থে গোসানী শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। সপ্তদশ শতকের রাজা প্রাণনারায়ণের সভাকবি শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ অনূদিত মহাভারতের আদিপর্বে কুন্তিদেবীকে বলা হচ্ছে -
ক. হিড়িম্বা বদতি মাও সাসুড়ি গোসানি।
তুয় পুত্র মোক মারে কিছু এ না জানি।।
খ. এতকে গোসানি সবে পুত্রক পঠাউক।
রাক্ষষক মারি প্রাণনাথক আনুক।।
এই উদ্ধৃতি দেখে মনে হয় 'মাতা' অর্থেও শব্দটির এতৎ অঞ্চলে পূর্ব থেকেই প্রচলন ছিল। গোসানীমারীতে যে দেবী মন্দির রাজা প্রাণনারায়ন তার রাজত্বের শেষ বছরে নির্মাণ করেন তার দ্বারদেশে সংস্কৃত মিশ্রিত যে বাংলা শ্লোকটি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ১৫৮৭ শত অর্থাৎ ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ লেখা আছে। আর মন্দিরটিকে বলা হয়েছে 'ভবানী মঠ।' গোসানীমন্দির বলে তা কখনো পরিচিত হয়নি। হলে শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ তার অনুবাদে কোথাও না কোথাও দেরী বা মাতা রূপে গোসানীর উল্লেখ অবশ্যই করতেন। যেমন করেছেন অষ্টাদশ শতকে রাজা উপেন্দ্রনারায়ণের পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত কবি অপর এক শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ। তার মহাভারতের বিরাটপর্বের ভণিতায় তিনি লিখেছেন -
' হেন ভারতের কথা কেবা কৈতে পারে।
মুড় হয়া নিবন্ধিলো গোসানির বরে।।
ভারত সমুদ্র কথা জেন মধু ধার।
রচিল গোসানির বরে কামোতা বেহার।।'
এখানে তিনি স্পষ্ট ভাবেই গোসানী অর্থাৎ চন্ডী দেবীকে নির্দেশ করেছেন, ততদিনে চন্ডীদেবী গোসানীদেবী রূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়ে গেছেন।





কামতাপুরের খেন রাজাদের রাজত্বকাল বিষয়ে সঠিক কোন সন তারিখ পাওয়া যায় না তবে K.L Barua তাঁর Early history of Kamrup গ্রন্থে আনুমানিকভাবে পরপর তিনজন রাজার রাজত্বকালের নিম্নরূপ একটি চিত্র তুলে ধরেছেন।
             নীলধ্বজ - ১৪৪০ থেকে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ
             চক্রধ্বজ - ১৪৬০ থেকে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দ
             নীলাম্বর - ১৪৮০ থেকে ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দ
তিনি আরোও লিখেছেন যে নীলাম্বর ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দ হোসেন শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান এমনিভাবে রাজবংশের শেষ প্রদীপটিও নিভে যায়। এদের রাজ্যলাভ ও রাজ্যলোপ নিয়ে এই অঞ্চলে যেসব কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল সেগুলো নিয়েই গোসানীমঙ্গলের কাহিনীবৃত্ত গড়ে উঠেছে অথচ এই কাব্য পুরুষানুক্রমিক রাজকাহিনী নয়। কবির কাহিনী কল্পনার নৈপুণ্যে তিন রাজার কাহিনী নিয়ে মালা গাঁথা হয়েছে। প্রেম প্রতিহিংসা ও রাজ্য লোপের অখন্ড বৃত্তান্তে পরিণত হয়েছে। ধর্মাশ্রয়ী কাব্যের মধ্যেও অলৌকিকতা ইত্যাদি স্থান করে নিয়েছে। 

বর্তমান মূল মন্দিরের ভেতরে কষ্টিপাথরের নির্মিত পাল যুগের খুব সুন্দর একটি সূর্যমূর্তি আছে। তার মাথার কাছে দুজন অপ্সরা মালাহাতে করে রয়েছেন। সুন্দর শিরোভূষণ সূর্যের মাথায় শোভা পাচ্ছে। দুপাশে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল রয়েছে। দুহাত অভয় এবং বরদানের মুদ্রায় আছে। অঙ্গবস্ত্রহীন দেহে উপবীতটিও তার দেহে বিরাজমান। দু পায়ের মাঝখানে রয়েছে সারথি অরুণ। সপ্ত আশ্বযোজিত একচক্র রথের উপর তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। রথের সাতটি ঘোড়াই পাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। পায়ের কাছে দুপাশে রয়েছে সঙ্গী ছায়া, রাঙি, প্রভা নামা সূর্যের চার পত্নী। এছাড়াও দু পাশে রয়েছে তীর ধনুক এবং দন্ড হাতে দ্বারী। মূর্তি শিলার চারপাশ অলংকৃত। মূর্তি শিলার দৈর্ঘ্য ২৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ১১ ইঞ্চি। এরূপ একাধিক মূর্তি সিতাই শীতলখুচি অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে। কিভাবে এই মূর্তিগুলি এদিকে এলো বা বর্তমানে মন্দিরে এলো তার সঠিক কারণ এখনো উদ্ধার করা যায়নি।
শীতলখুচি অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত কষ্টিপাথরের সূর্যমূর্তি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতাত্ত্বিক গ্যালারিতে রক্ষিত।
মন্দিরের রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তির দৈর্ঘ্য ৩৮ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ১১ ইঞ্চি। সমপদ স্থাপক দন্ডায়মান এই মূর্তিটি পদ্মের উপরে রয়েছে। বিষ্ণুর চার হাতে রয়েছে শঙ্খ চক্র গদা এবং পদ্ম মাথায় অলঙ্কৃত মুকুট দেহে উপকৃত বিষ্ণুর মাথায় দু'পাশে অপ্সরাগন মালা হাতে করে রয়েছেন। পায়ের দুপাশে বড় আকারের লক্ষ্মী, সরস্বতী নামা দুই পত্নী থাকলেও আরো যে দুটি মূর্তি দেখা যায় তারাও কি বসুমতি এবং গঙ্গা, তাঁর স্ত্রী বলে বর্ণিত? মূর্তির পায়ের নিচে দুপাশে দুটি মূর্তি হাতজোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। এ দুটি কি গরুরের মূর্তি ? এছাড়াও একাধিক শিল্প কারুকার্য আছে।







উত্তরের হিলিং পর্যটন গ্রাম চুইখিম
অরুন কুমার

উত্তরের পর্যটনের মানচিত্রে আগামী দিনে নতুন দিশা দেখাতে চলেছে 'মডেল হিলিং ' গ্রাম চুইখিম’  যেখানে সবুজ প্রকৃতি আর মেঘেদের হাতছানি।  অপরূপ এক পাহাড়ী গ্রাম। উত্তরবঙ্গের প্রথম হিলিং ভিলেজ কালিম্পং জেলার  চুইখিম গ্রামের কথা  বলতে গিয়ে প্রথমে বলতে হয় অতীতের একসময়ে  সিল্করুটের ধারের গ্রাম ছিল । যারা এই রেশম পথ ধরে যাতায়াত করতো তারা রাত্রি যাপন করতো এই গ্রামে । অতীতের অজানা এই গ্রাম আজ ধীরে ধীরে তা ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে নানান ভাবে। স্থানীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এই গ্রামের মানুষেরা এগিয়ে চলেছে নতুন ধারায়। পর্যটনের ক্ষেত্রে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এই গ্রাম চুইখিম।  গরমের দাবদাহের প্রকোপ থেকে বাঁচতে অনেকেই উত্তরের পাহাড়ের ডেস্টিনেশনকে  বেছে নেন। আর হাতের কাছে হিমালয়ের কোলের গ্রাম থাকতে অন্য কোনও রাজ্যের কথা চট করে মাথায় আসে না। 







জানা গিয়েছে, রাষ্ট্র সঙ্ঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তরফে প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের একাধিক পর্যটন কেন্দ্রকে ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’-এর শিরোপা দেওয়া হয়। এ বছর অর্থাৎ  ২০২৩ এ সেই শিরোপার দৌড়ে রয়েছে কালিম্পংয়ের ৮টি গ্রাম। যার মধ্যে রয়েছে, নোকদারা,ইচ্ছেগাঁও সুন্দরবস্তি,মুলখাগাড়া, পানবুদাড়া, চুইখিম,  রিশপ ও পারেনটারকে ‘মডেল ভিলেজ’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে এমন অনেক পাহাড়ি গ্রাম রয়েছে, যা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো কালিম্পং জেলার চুইখিম  পাহাড়ি গ্রাম। এই চুইখিম- কালিম্পংয়ের কোলে অবস্থিত এই পাহাড়ি গ্রাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। প্রায় ২৫০টি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে এই পাহাড়ী গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে লিস নদী। সেখানে গেলেই দেখা যায় হিমালয়ের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতির ঝাঁক। তাছাড়া চুইখিম শান্ত একটি গ্রাম। 






নিউ জলপাইগুড়ি জংশন রেলস্টেশন থেকে প্রায় ৭৫কিলোমিটারের পথ চুইখিম। আবার অন্যদিক থেকে যদি যাওয়া যায় শিলিগুড়ি জংশন হয়ে নিউমাল জংশনে নেমে একটু পিছিয়ে আসতে হবে 
৩১নং জাতীয় সড়ক ধরে ওদলাবাড়ি বাগড়া কোট ও তারপর মীনা মোড়। সেখান থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে  করছে অবস্থিত এই চুইখিম গ্রাম।

রাস্ট্রসঙ্ঘের  বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তরফে   ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’-এর শিরোপা  পেতে চলেছে প্রকৃতির কোলে উত্তরের কালিম্পঙ জেলার এই পাহাড়ি গ্রাম চুইখিম। নানা রকম পাখির ডাকে ও লিস্ নদীর স্রোতের আওয়াজে এখানে ভোর হয় মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। হিমালয়  যেন এখানে তার নিজের আঁচল বিস্তার করেছে পাহাড়ী ঝর্নার  আওয়াজে। যারা বর্ষার ভালবাসেন তারা এখানে এলে রাতে শুনতে পাবেন টাপুর টুপুর বৃষ্টির  শব্দ।আর দুটি পাহাড়ে  এই গ্রামের বিস্তার যার মাঝে মাঝে দেখা দেয় সোনালী রোদের ছোঁয়া। সেই সঙ্গে দেখা মিলবে সবুজ গাছ গাছালির আস্তরণ যেন সবুজ কার্পেট ঢাকা প্রকৃতি। বেলা করালি দূরে চোখে পড়বে লিস্ট নদীর রুপোলি বাঁক। প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি পাহাড়ের গায়ে মেঘের আনাগোনা সোনালী রোদের লুকোচুরি খেলা আপনাকে নিয়ে যাবে প্রকৃতির প্রেমের মোহমায়ার জালে। পাহাড় ঘেরা এই গ্রামে দেখা মিলবেই ছোট ছোট বাড়ি ঘর, রাতে এই বাড়িগুলোর আলো মনে করিয়ে দেবে পাহাড়ের গায়ে যেন ওড়নার চুমকির ঝলকানির ছবি।

সকাল দুপুর বিকেলে উড়ে যাবে নানান রঙের নাম না জানা পাখি ডাক দিতে দিতে। এই গ্রামের আনাচে কানাচে উড়েবেড়ানো নানা বর্ণিল প্রজাপতি, নানান রঙের ফুলে ফুলে সেজে থাকা ছবির মতো বাড়িগুলোকে আপনাকে তাদের আকর্ষণে বেঁধে রাখবে প্রতি মুহূর্তে। এখানে রয়েছে মন্দির দেবী থান,
ক্রশ হিল পাহাড়, বৌদ্ধ মন্দির। গ্রামীণ কৃষি বৈচিত্র্যে ভরপুর দেখতে পাওয়া যাবে কোয়াশ,গুনদরুক,  কোদো সহ নানা ধরনের পাহাড়ী শাক, ব্লুম স্টিক,জারবেরা ফুলের বাগান, স্ট্রবেরি, রাসবেরি প্যাশন ফ্রুট জাতীয় পাহাড়ী ফসল। এইভাবে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে গ্রামীণ পর্যটনের আদর্শ গ্রাম চুইখিম ।

সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ নিশ্চিন্তে যাওয়া যেতে পারে চুইখিম। আর যাঁরা চ্যালেঞ্জ ভালোবাসেন তাঁরা বর্ষাতেও যেতে পারেন। গাছপালারা তখন স্নানসুখে ঝলমলে। মেঘ আর কুয়াশায় রহস্যঘন আকাশ-বাতাস। সারাদিন ধরে বাজে বৃষ্টির গান। বর্তমান নিয়ে এখানে তৈরি হচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের স্পর্শ করেছে। এই এশিয়ান হাইওয়ে যুক্ত হয়েছে কালিম্পং সিকিমের জেলেপলা চীন সীমান্তকে। এই চুইখিম গ্রাম বড় প্রাণবন্তময়। উত্তরবঙ্গের যে কোন গ্রামের থেকে চুইখিমের ইতিহাস তেমন আলাদা কিছু নয়। এখানকার প্রকৃতিতে আছে পর্যটক আকর্ষণ করার অসীম ক্ষমতা। একটি অঞ্চলের উন্নয়নে পঞ্চায়েতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 







ফুল ও অর্কিডের শোভা এখন চুইখিমের শরীর জুড়ে। প্রজাপতিরাও মেলেছে রঙিন ডানা। আছে মৌমাছির দল। মধু সংগ্রহে ব্যস্ত হবে তারা বসন্ত এলেই। তার থেকেই মৌচাক ও মধু আহরণ গ্রামবাসীর। প্রকৃতিরানি এখানে সৌন্দর্যের আলপনা এঁকেই ক্ষান্ত নন। মানুষের বেঁচে থাকার আয়োজনও তাঁর ঝুলিতে। বর্ষায় জল উপচে পড়ে ঝর্ণাগুলিতে, সেই জল গড়িয়ে যায় ফসলের খেতে। মাথার উপর নীল আকাশের সামিয়ানা, দূরদূরান্ত পর্যন্ত পাহাড়ের অহংকারী ঊর্ধ্বমুখ। এই ক্যানভাসেই প্রতিদিন লেখা হয় চুইখিমের মানুষের সুখদুঃখের গাথা। পর্যটকদের আগমনে সেই গাথায় বাড়তি রং লাগে।

সারাদিন প্রচুর ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত সবাই। হোমস্টের বারান্দায় জমিয়ে আড্ডা চলছে। একটু আগেই সূর্য অস্ত গেছে। কিছুক্ষণ নিঃসীম অন্ধকার । তারপর সেই অন্ধকার ভেদ করে রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠলো, পুরো আকাশকে জ্যোৎস্না মাখিয়ে। কী অপরূপ সেই অভিজ্ঞতা। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। অপার্থিব এক অনুভূতি ঘিরে ধরলো সকলকে। রাত কাটলো সেই অনুভবকে সাথী করেই। আর তারই রেশ নিয়ে প্রভাতের মুখ দেখা।

চুইখিম হল উত্তরের কালিম্পং জেলার এক নম্বর ব্লকের অন্তর্গত পারবিংটার গ্রাম পঞ্চায়েতেরএকটি গ্রাম। যার আশেপাশে রয়েছে ইয়েলবং বরবট নিমবং পুরনো সিল্করুট রাস্তা হয়ে চলে গেছে কালিম্পং সিকিম হয়ে চীন সীমান্তে পর্যন্ত। এখানে রয়েছে ২০০ টি পরিবারের প্রায় একহাজার জনসংখ্যার কৃষি প্রধান গ্রাম এটি ।এখানে বিভিন্ন ধরনের উৎকৃষ্ট মানের ধান আলু বিভিন্ন ধরনের সবজি যার মধ্যে রয়েছে ফুলকপি বাঁধাকপি কুয়াশ বিন্স রাইসাক বিভিন্ন ধরনের শাক বিন্স করলা  কুমড়া, টমেটো, আদা, হলুদ ,বড় এলাচ ব্রুমস্টিক  বা পাহাড়ি ঝাড়ু, তেজপাতা, দারুচিনি নানান ধরনের মসলা জাতীয় সামগ্রী উৎপাদিত হয়ে থাকে। এছাড়া রয়েছে স্থানীয় মুরগি হাঁস খরগোশ ভালো প্রজাতির ছাগল দুগ্ধ উৎপাদনে একসময় এই গ্রাম ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ উৎপাদন হয় কিন্তু সেটা ক্রমশ কমে গিয়েছে।। এখান থেকে বুদ্ধডাড়া থেকে লিস্ নদীর আঁকাবাঁকা দৃশ্য  কিংবা দেবী থান ফলস ঝরনা আপনাকে মোহিত করবে ।কফি গাঁও লিম্বু   ক্রসড দ্বারা এরকম কমলাপুর গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আশেপাশে।




বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ি সন্ধ্যায় ভ্রমণ
কবিতা বণিক 

          
                                                                                                  
বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি! মেঘেরা জলের ধারা ঢালছে নানান ছন্দে। ঝিরঝির, ঝমঝম! নাচের তালের কত না শব্দ।







পথ, ঘাট সব ভেজা। যেদিকে তাকাই সবই রসময়। গাছেরাও হাওয়ায় দোল খেয়ে তাদের সমস্ত পাতার ফোঁটা ফোঁটারসবিন্দু টুপটাপ ঝরিয়ে দেয়। সমতলের বৃষ্টি , মেঘ, হাওয়ার খেলা নানান ছন্দে হলেও মেঘেদের বড্ড অভিমান। তারানীচে নামবে না কিছুতেই। আবার পাহাড়ে , মেঘেরা ওপরে, নীচে সর্বত্র আনন্দে ভেসে বেড়ায়। সেখানে চলমান মেঘেদেরপাহাড়ের গায়ে গায়ে ভেসে বেড়ানোর যে স্বপ্নের পরীদের মত দেখায় তা দেখতেই গিয়েছিলাম এক বিকেলে পাহাড়ী পথেরবাঁকে বাঁকে কার্সিয়াং, ডাউহিল, চিমনি ইত্যাদি নাম না জানা গ্রামের মধ্য দিয়ে। শুধুই বৃষ্টি উপভোগ করতে। এরই মধ্যেসন্ধ্যের আলোয় জঙ্গলের মধ্যে দুটো হরিণ দেখে মনে হল এই বৃষ্টিতে জঙ্গলের পশুরা নিজেদের






কিভাবে রক্ষা করে? ঈশ্বরসবার জন্যই ব্যবস্হা করে রেখেছেন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে গাছেরাও যেন ঘেঁসাঘেঁসি করে বেড়ে উঠতে চায়। ফার্ণপাতাগুলোর লম্বা হাত যেন সবাইকে ছুঁতে চায়।এমন ঘন সবুজ বনের মধ্যে রাস্তাও নিজেকে হারিয়ে ফেলে। আর মেঘেরাঘন পাইনের বনে ঢুকে বৃষ্টি হয়ে ঝড়বার পথ খোঁজে।পাহাড়ীপথে এক এক বাঁকে এক এক সৌন্দর্য ধরা পড়ে। বৃষ্টি ভেজাপাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য , মেঘের মধ্যে দিয়ে হাঁটা যেখানে কিছুই দেখা যায় না এসব রোমাঞ্চকর অনুভূতি।নীচেরপাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে তো ওপরের পাহাড়ে বৃষ্টি নেই। নীচের পাহাড়ে মেঘ জমেছে , মনে হচ্ছে ইন্দ্রপুরীতে বিচরণ করছি। নারদমুনির আশীর্বাদে ঝর্ণার গানের দ্রুত লয়ের সুরের মুর্ছনায় যেন “ তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা” রূপ ধারণ করেছে। সে যে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা প্রেমদাত্রী! ঝর্ণার প্রেম প্লাবণেই না নদীগুলো পুষ্ট হয়! ধরণী শষ্যশ্যামলা হয়! মানুষেরক্ষুধা মেটাও তুমিই ‘তাপসী অপর্ণা!’ স্বর্গের সুধাকে মর্ত্যে এনে দাও তুমিই ঝর্ণা! বর্ষায় পাহাড় ভয়ঙ্কর হয় আমরা দেখি। 




স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখা অনায়াস লভ্য হয় না এটাও যেমন সত্য। তেমনি দেখার পরের সৌন্দর্যানুভূতি অব্যক্তভাবে মনেরগভীরে বর্ণময় হয়ে ধরা থাকে। বৃষ্টি কমতে আবার সদ্যস্নাতার মত দেখতে লাগছিল পাহাড়কে।জল হারিয়ে মেঘেরাওতাদের বৈঠকী আড্ডায় মেতেছে নীল আকাশে। এই সুযোগে সূর্যদেব অস্তাচলে যাওয়ার আগে তার লালিমা ছড়িয়ে দিলেআরও মোহময় করে তুলল সেদিনের সেই মনোরম সন্ধ্যা। পাহাড় জুড়েই কত আঁকাবাঁকা রাস্তা,ঘরবড়ি, একটু একটু করেপাহাড় জুড়ে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। সন্ধ্যারাণী বিদায় নিতেই দেখা গেল দূরেলোকমালায় সজ্জিত শিলিগুড়িশহর। এই সৌন্দর্য পাহাড় থেকেই দেখা যায়। নেমে আসলাম নীচে আমাদের ঠিকানায়।



বন্য মনে শারদ
দেবাশিস ভট্টাচার্য 

শারদ এলেই জলদাপাড়ায়
হাতিরা সব নাচে
বানর গুলো কাঠি বাজায় 
ঢোল বাদ্যের ধাঁচে

পূজোর ক'দিন আসর বসে
হলং নদীর পাশে
চিলাপাতার হাতি গুলোও 
ওই আসরে আসে

ল্যাজ নাড়িয়ে তিড়িং তিড়িং 
কাঠবেড়ালি যতো
শাল শিরিষে নাচতে থাকে 
চড়ুই পাখির মতো 

গন্ডারেরা জলদাপাড়া
শাসন করে বলে
উদযাপনের ক'দিন ওরা
বাবুর ঢঙে চলে

হরিণরা তো নাচে সদাই 
যখন খুশী তখন
পুলক জাগে দ্বিগুণ ওদের
দুগ্গা আসে যখন

মাথা মোটা বাইসনেরা
আসর মুখো হয় না
অসুর মনে ওদের নাকি 
শারদ খুশী সয় না 

ময়ূরীরা আসর সাজায়
পাখনা যাদের ভালো
সন্ধ্যা হলেই জ্বলতে থাকে 
জোনাক টুনির আলো

বন্য মনেও শারদ আসে
আগমনীর সুরে
অন্য রূপে দুর্গা আসে 
ওদের হৃদয়পুরে।








রসিক বিলের গান পাখিরা
দেবাশিস ভট্টাচার্য 

রসিকবিলের গান পাখিরা
ভাওয়াইয়া গান গায়
দোতরা ছাড়াই তুফান তোলে 
চটকা দরিয়ায় 

কদম বনের শান্ত ছায়ায়
দিনের অবকাসে
রসিকপাখি ময়নারা সব 
সুরের ভেলায় ভাসে 
 
রসিকবিলে প্রবাস তালুক 
পাহাড়ী ময়নার
ভীষন প্রিয় বনবাসী 
বালিকা নয়নার



 

সম্পাদকের কথা 

শরতের নীল আকাশে এখন সাদা মেঘের আনাগোনা হলেও বর্ষা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। কিন্তু বাঙালি মন নেচে উঠেছে আসন্ন শারদীয়া উপলক্ষে। শুরু হয়েছে অধীর আগ্রহে দিন গোনা, কবে আসবেন উমা! ইতিমধ্যে চন্দ্রযানের সফল অবতরণ ও সূর্যকে আরও জানবার জন্য আদিত্যর উৎক্ষেপণ আমাদের আনন্দকে বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু চিন্তার ও উদ্বেগের ভাঁজ আরও বেড়েছে রাজ্যের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ পড়ুয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুতে। মুজনাইয়ের ঘরেও মৃত্যুর আকস্মিক থাবা স্তব্ধ করেছে সবাইকে। আমাদের প্রিয় বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী দেবব্রত (পুটন) ঘোষকে হারিয়ে আমরা শোকবিহ্বল।


 স্মরণ 


দেবব্রত (পুটন) ঘোষ 

মুজনাই সাহিত্য পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে মুজনাইয়ের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দেবব্রত (পুটন) ঘোষ। ডুয়ার্সের বর্ধিষ্ণু জনপদ ফালাকাটার অত্যন্ত পরিচিত চিরযুবক মানুষটি ছিলেন অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলার নামী ফুটবল খেলোয়াড়। তাঁর প্রতিভার সন্ধান পাওয়া যেত নাট্য মঞ্চেও। ঘোষক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল সুবিদিত। শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন সফল মানুষ। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা আজ ছড়িয়ে রয়েছে এই রাজ্যের সর্বত্র। 'ভাল মানুষ' বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই-ই। তাঁকে অনুসরণ করে বড় হয়েছে ফালাকাটার কয়েকটি প্রজন্ম। তাঁকে হারিয়ে আমরা মর্মাহত। শোকস্তব্ধ। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। আমরা মনে করি তিনি আমাদের মধ্যেই রয়েছেন। মুজনাই যতদিন থাকবে ততদিন তাঁকে বুকে করেই বয়ে চলবে। 


মুজনাই অনলাইন ভাদ্র  সংখ্যা ১৪৩০

শারদীয়া ভ্রমণ 

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক) 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদ ছবি - রিশা দাস  

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন ভাদ্র  সংখ্যা ১৪৩০


সূচি 

উমেশ শর্মা, চিত্রা পাল, মাথুর দাস, শ্রাবণী সেন, 

পার্থ বন্দোপাধ্যায়, বাসব বন্দোপাধ্যায়, রীনা মজুমদার, 

সুজাতা কর,  প্রতিভা পাল, সুনন্দ মন্ডল, 

মজনু মিয়া, সঞ্জয় এস সাহা, দেবযানী ভট্টাচার্য, 

অলকানন্দা দে, রীতা মোদক, চন্দ্রানী চৌধুরী, 

আশীষ কুমার বিশ্বাস, সৌমেন দেবনাথ, সুব্রত দত্ত, 

অপর্ণা দেবনাথ, মৌমিতা চ্যাটার্জী, সারণ ভাদুড়ী (পক্ষিরাজ), 

দেবারতি দে, অসীম মালিক, সঞ্জয় সরকার, 

উজ্জ্বল পায়রা, বিরথ চন্দ্র মণ্ডল, বিপ্লব গোস্বামী, 

বিজন বেপারী, মৃত্যুঞ্জয় দাস শেখর, 

বাবুল মল্লিক, অদ্রিজা বোস, অনুস্মিতা বিশ্বাস


মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪৩০




বাবুল মল্লিক 





প্রবন্ধ 

ভাদু-উৎসব ও ভাদু-গানের লোককথা ও তার প্রেক্ষাপট ....
 সঞ্জয় / এস.সাহা


"কাছের মানুষ দূরে থুইয়া,
মরি আমি ধড় ফড়াইয়া রে"

ভাদ্র মাসে মেয়েরা ভাদুলি ব্রত করে থাকে। এই ব্রত সেদিনের কথা মনে করে দেয়, যখন এদেশে সওদাগররা সাতডিঙা ভাসিয়ে সমুদ্রে বাণিজ্য করে ঘরে ফিরে আসত । ব্রতের ছড়ায় আজও সেই ছবিগুলো ধরা পড়ে থাকে । অবশ্য আজ আর  সেই সওদাগর নেই । আজ সেই বাণিজ্যও নেই । কিন্তু এই ব্রতের ভেতর দিয়ে মনে পড়ে যায় সেই আপন জনের কথা যারা দূরে আছে । আর সেই সঙ্গে বাড়ির ঘরে অপেক্ষারত প্রেমিকার কথা ভেবে তার সাত সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া প্রেমিক হয়তো এটাই বলতো----

  "ওরে নীল দরিয়া, আমায় দেরে ছাড়িয়া,
একলা ঘরে মন বধুয়া আমার রইছে পন্থ চাইয়া" 

ভাদু উৎসব ভাদ্র মাসের উৎসব। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিনে ভাদু পুজো হয়ে থাকে। ব্রতের ক্ষেত্রে ভাদ্র মাসের প্রারম্ভেই শুরু হয় মেয়েলি ব্রত। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এবং লাগোয়া, বিহার, ঝাড়খণ্ডের দু-একটা জেলায় প্রধানত ভাদু উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
আদিবাসী, সাঁওতালদের মধ্যে করম গান ও উৎসবে পালন করার রীতি রয়েছে বর্ষাকালে। তা-ও বিশেষ ভাবে ভাদ্র মাসে। 
ভদ্রাবতী সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি পুরুলিয়ার রঘুনাথগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত কাশীপুরের রাজা নীলমণি সিং দেওয়ের কন্যা।
 ১৮৫৮ সালে বিয়ের আগের দিন কোনও এক আকস্মিক কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। ভদ্রাবতী ১৭ বছর বেঁচে ছিলেন। একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে রাজা শোকাহত হয়ে পড়েন। প্রজাকুলের ইচ্ছায় মিত্র-মন্ত্রীদের সহযোগিতায় শুরু হয় ভাদুর স্মৃতি তর্পণ।









এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভাল, ভাদুর জন্ম এবং মৃত্যু দুই-ই ভাদ্র মাসে। তাই ভাদ্র মাসে হিন্দুদের কোনও বিবাহ থাকে না।
ধর্মীয় মতে ভাদ্র মাসে যে রমণী লক্ষ্মীপুজো করেন তাঁর উপরে যশোলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মী প্রসন্ন হন। সেই সূত্রে মনে হয়, ভাদু আসলে শস্যদেবী। ধান ওঠার ফলে চাষিদের ঘরে শস্য বন্দনার যে রেওয়াজ ছিল, তা নানা বিবর্তনের ফলে গড়ে ওঠে ভাদুদেবী রূপে।

বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার পঞ্চকোট রাজ পরিবারের রাজা নীলমণি সিং দেও এর তৃতীয় কন্যা ভদ্রাবতীর বিবাহের দিন বিবাহ করতে আসা পাত্রসহ বরযাত্রীগণ ডাকাত দলের দ্বারা খুন হলে ভদ্রাবতী হবু স্বামীর চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেন । এই কাহিনী ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের "ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিসট্রিক গেজেটিয়ার পুরুলিয়া" গ্রন্থ প্রকাশিত হয় । প্রিয় কন্যাকে স্মরণীয় রাখতে রাজা নীলমণি ভাদু গানের প্রচলন করেন । যদিও রাজা তিন পত্নী ও দশ পুত্রের উল্লেখ থাকলেও কোন কন্যা সন্তানের উল্লেখ নেই রাজ পরিবারের বংশ তালিকায়। রাখাল চন্দ্র চক্রবর্তী রচিত "পঞ্চকোট ইতিহাস" নামক গ্রন্থেও এই ঘটনার উল্লেখ নেই । 

বীরভূম জেলায় আবার ভদ্রাবতীকে হেতমপুরের রাজার কন্যা বলা হয় । ভদ্রাবতীর সাথে বর্ধমানের রাজপুত্রের বিবাহ স্থির হয় । বিবাহ করতে আসা রাজপুত্র ও বরযাত্রীগণ ইমামবাজারের কাছে অবস্থিত "চৌপারির" শালবনে ডাকাতদের হাতে নিহত হন । বাগদত্ত রাজকুমারের মৃত্যুর সংবাদে ভদ্রাবতী শোকগ্রস্ত ও লগ্নভ্রস্টা হবার ভয়ে হবু স্বামীর সাথে সহমরণে যান । রাজকুমারীর এই ভালোবাসা ও আত্মত্যাগকে স্মরণীয় রাখতে রাজা ভাদু গানের প্রচলন করেন। যদিও এই ঘটনারও কোন ঐতিহাসিক তথ্য নেই । 

ভাদু গানের এবং উৎসবের প্রচলন সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে দেখা যায় । আর এখানেই প্রশ্ন জাগে ভদ্রাবতী রাজকন্যা এবং রাজা এই দরবারি গান শুরু করলে সাধারন মানুষের মধ্যে তা কিভাবে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো? এই প্রশ্ন থাকাটাও স্বাভাবিক । তবে ভদ্রাবতী সম্পর্কে আরও কয়েকটি কাহিনী প্রচলিত আছে যা ভাদু গান ও উৎসব সাধারন মানুষের মধ্যে কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার যথার্থ উত্তর দেয় ।  কাহিনীটি হল -----
পুরুলিয়া জেলার কাশীপুর অঞ্চলের একটি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক ভাদ্র মাসে তার জমির মধ্যে সদ্যজাত এক শিশুকন্যাকে কুড়িয়ে পান । কৃষক শিশু কন্যাটিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং সন্তান স্নেহে পালন করতে শুরু করেন । সে বছর বৃষ্টি না হওয়ায় চাষবাস করা যাচ্ছিল না। কিন্তু শিশুকন্যাটি বাড়িতে আনার দু-দিন পরে বৃষ্টি শুরু হল এবং খুব ভালো চাষাবাদ হল । শিশুকন্যা কি লক্ষীর স্বরূপ । রামায়ণে সীতাকে যেমন চাষের জমি থেকে পাওয়া গিয়েছিল সেই রকম এই কন্যাটিও । ভাদ্র মাসে কন্যাটিকে পাওয়ার জন্য নাম দেওয়া হল ভদ্রাবতী, অনেকের মতে ভদ্রেশ্বরী । সকলে আদর করে ভদ্রাবতীকে 'ভাদু' নামে ডাকতে শুরু করে । ভাদু বড় হবার সাথে সাথে রূপে-গুণে সাক্ষাৎ দেবী লক্ষীর মতো দেখতে হয় । লোকমুখে ভাদুর এই কথা শুনে পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিং দেও গ্রামে এসে হাজির হন । ভাদুকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং বলেন এই মেয়ে গ্রামের কোন সাধারণ কৃষকের মেয়ে হতে পারে না । তিনি ভাদুকে রাজকন্যা বলেন এবং রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেতে চান ।  কিন্তু ভাদু তার মা-বাবাকে ছেড়ে যেতে রাজি না হলে রাজা ঘোষণা করেন ভদ্রাবতী সেখানেই থাকুক সে রাজকন্যা । সখীদের সাথে খেলা করে ঘুরে আনন্দেই জীবন কাটছিল ভাদুর । জীবনের অনেকগুলি শরৎকাল অতিক্রম করে ভাদু যৌবনে পদার্পণ করেন । পাশের গ্রামের এক সুদর্শন যুবক অঞ্জনের সাথে ভাদুর পরিচয় হয়, ধীরে ধীরে মন দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কে পরিণত হয় । ভদ্রাবতী গান গাইতো আর অঞ্জন সেই গানের সুরে বাঁশি বাজাতো । 
এই সম্পর্কের কথা রাজা মানতে পারলেন না । তিনি চেয়েছিলেন তাঁর কন্যাকে উচ্চ-রাজবংশে বিবাহ দিতে। তাই অঞ্জনকে আটক করে কোন এক গুপ্ত স্থানে রাখা হয় । প্রাণের থেকে প্রিয় অঞ্জনকে দেখতে না পেয়ে ভাদু ঘুরে ঘুরে বেড়াতো আর গান গাইতো । যদি তার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে অঞ্জন ফিরে আসে তার কাছে । দীর্ঘদিন ধরে দিবারাত্রি ভালো গান করতে করতে দুঃখে-কষ্টে অঞ্জন কে সে খুঁজতে থাকে । রাজা নীলমণি কন্যার এরূপ অবস্থা দেখে প্রায় একপ্রকার বাধ্য হয়ে অঞ্জনকে মুক্তি দেন। মুক্ত অঞ্জন তার ভাদুর কাছে গেলে ভাদুকে আর দেখতে পায়নি । গ্রামের অনেকে বলেন ভাদু আকাশ থেকে এসেছিল আবার আকাশেই ফিরে গেছে । এই ঘটনায় রাজা নীলমণি অত্যন্ত কষ্ট পান এবং ভদ্রাবতীকে স্মরণীয় রাখতে ভাদু গানের সূচনা করেন । যদিও এই কাহিনীর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই ।   





ভালোবাসা নাকি দখল !!
দেবযানী ভট্টাচার্য


ভালোবাসা নাকি দখল? প্রশ্নটি কয়েকদিন ধরে আঘাত করছে ক্রমাগত।নিজেকেই ক্রমাগত প্রশ্ন করি,কিছু ঘটনা নাড়া দিয়ে যায় এই চেতনাকে।কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি, ৩৭০ ধারা উঠিয়ে দেওয়া হলো রাতারাতি,ওখানকার মানুষের মতামত না নিয়েই।রাষ্ট্র চায় তাই,ভালবাসলাম না,মতামত নিলাম না,মর্য্যাদা দিতে অক্ষম ,চাপিয়ে দিলাম,এতে করে ওখানকার মানুষের ভালোবাসা কি পাওয়া যাবে?প্রতিবাদ,বিক্ষোভ তাই থেকেই যাবে।রাষ্ট্র বা শাসক তাই ভালোবাসা নয় প্রশ্নবোধক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিরুত্তর থেকে যায়।
                    সমাজ ও এই একই কাজ করে,সমাজ অর্থাৎ মানুষ,কিছু নিয়ম শৃঙ্খলা নিজেদের সুবিধা মতো তৈরী করে চাপিয়ে দিয়েছিলো মানুষের ওপর,অতীতে উচ্চবর্ণের গুরুমশাইরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য দখল নিয়েছিলো নিম্ন বর্গের আনুগত্য।ভালোবেসে তা গ্রহণ করেনি সমাজ,তাই প্রতিবাদ উঠেছিলো,এবং ধর্ম সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো,মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব নিচু শ্রেণীর মানুষকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন , ভালোবেসে মর্য্যাদা দিয়েছেন এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যক্তিত্ব হয়ে আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন।পরবর্তী কালে রামমোহন,বিদ্যাসাগরের হাত ধরে লোপ পেলো কিছু কুসংস্কার সম্পন্ন প্রথা,লোপ পেলো কারণ তা চাপিয়ে দেওয়া হয় নি, মানুষ ভালোবেসে গ্রহণ করেছিল, ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যায় না।
                ব্রিটিশ এবং ফরাসী রা বাণিজ্য করতে এসে,ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপন করেআধিপত্য বা দখল নিয়ে নিলো এই ভারতবর্ষের।ভালোবাসেনি ভারতবাসীকে,নীল চাষীরা নিপীড়িত হলো,ধর্মান্তরিত হলো প্রচুর মানুষ,পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে এক অনুগত কেরানী শ্রেণী তৈরী করলো,হৃদয় দখল করার চেষ্টা করেছিলো,ভালোবেসে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে সমকক্ষ?তৈরী করেনি।তাই প্রতিবাদ এলো এবং স্বাধীনতা আন্দোলন।বিতাড়িত তো হতেই হতো।
             নারী পুরুষের সম্পর্ক এর ক্ষেত্রেও তাই,দখল,পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চাপিয়ে দিলো কিছু নিয়ম এবং অনুশাসন,এতে করে নারী হৃদয়কে দখল করেছে হয়তো,ভালোবাসা পায় নি,কারন ভালোবাসা ই একমাত্র অস্ত্র জিতে নেবার।তাই এসেছে ক্ষোভ,প্রতিবাদ,নারী স্বাধীনতা মূলক আন্দোলন,গর্ভ নিরোধক পিল আবিষ্কার নারীর মুক্তি আন্দলনের সহায়ক হলো।পুরুষ নারীর দেহ কে দখল যতটা নিতে চেয়েছে,হৃদয় দখল অর্থাৎ ভালোবাসা দিয়ে জিতে নিতে পেরেছে কি?বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে দেহকে দখল করতে চেয়েছে,হৃদয় নয়।তাই পরকীয়া আজও বেঁচে আছে।

নারীও কিছু উন্নত দৃষ্টান্ত দেখাতে পারে নি,সব সম্পর্কেই দখলদারি মানসিকতা নিয়ে অগ্রাসনের হাত বাড়িয়েছে, ভালোবাসার পুরুষটিকে আঁকড়ে ধরে বিভিন্ন বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ করে একান্ত নিজের করে পেতে চেয়েছে।পুরুষটি আমার ,অতএব আমার দখলে থাকবেন,হৃদয় ও আমি দখল নিয়েছি,এক চিলতে বসন্ত বাতাস যেন সেখানে প্রবেশ করতে না পারে !! ফাঁকি টা সেখানেই,অপর প্রান্তের হৃদয়টি যে বজ্র ফাঁসে হাসফাঁস করছে তা বোধগম্য হয় না,অতএব দখল নয় ভালোবাসুন,দখল নিতে চেষ্টা করলে প্রতিবাদ অবসম্ভাবী।ভাঙ্গন আসবে তার হাত ধরে।রাষ্ট্র, সমাজ,নারী ,পুরুষ সকলেই যেন আমরা এটুকু স্মরণ রাখতে পারি দখল নয়,ভালোবাসা।উড়তে দিন উন্মুক্ত আকাশে,ভালোবাসুন,ভালোবাসলে একসময় নিজেই অবনত হবেন এবং এক সুদৃঢ় বন্ধন রচিত হবে।যা অস্বীকার করার ক্ষমতা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়।




গুলজার যাঁর নাম
অলকানন্দা দে
তিনি ৮৯ কে ছুঁয়ে দিলেন কবিতার সাথে ঘর করতে করতে। যাঁর সাধারণ কথাই এক একটি গোটা কবিতা তিনি আসলে চলে ফিরে বেড়ানো পরম আবেগ, গুলজার যাঁর নাম! ধ্রুবতারাকে ধরে আনা হয়েছে যেন মর্ত্যে! আকাশ আলো করে আছে যে সুদূরে সে তো অধরা, কিন্তু এই ধ্রুবকে ছোঁয়া যায় বোধের আকাঙ্ক্ষা থাকলে। ঐকান্তিক কবিতার প্রতি আগ্রহ, চিন্তার ধৈর্যশীলতা এবং আমার মতো গুলজার অন্ধ হলে তাঁকে স্পর্শ করা জলের মতই সহজ। তাঁর অনেক কথা অনেক পংক্তি অনেক শব্দ আমার চেতনার নাগাল বহির্ভূত হতেই পারে, কিন্তু সে যে গুলজারের সৃষ্টি এই ছুঁয়ে থাকাটাই উত্তরহীন উত্তরের মতো মন ভালো করা প্রশান্তি। কবিতা বলে কবিরা নাকি অন্তর্যামী। ভুল বলে না। যেটুকু পড়ে উঠতে পারি, বুঝে উঠতে পারি তাঁর সৃষ্টিকে তাতে মনে হয়, এত গহীনভাবে অনুভূতিকে স্পর্শ করা অন্তর্যামী না হলে কিভাবে সম্ভব! যে অনুভবকে আমরা কথায় প্রকাশ করতে পারি না, তাঁর হাতে পড়লে সে অনুচ্চারিত ভাষা পূর্ণ হয়ে ফুটে বেরোয় ফুল রূপে। গুলজারের কথাসমৃদ্ধ গান এক একটি আস্ত অলঙ্কারে মতো যা শুধু অন্তরকে সাজিয়ে তোলে রাজন্যা সাজে। বিভোর হতে হয় গভীরে ডুব দিলে। কখনো খুশি কখনো প্রেম কখনো ভালোবাসার তুমুল তুফানে মিলিয়ে যেতে হয় অজান্তেই। বিরহকে তিনি মায়া দিয়ে সাজান! সে ভাষ্য, অবিশ্বাস্য! যেমন- “মেরা কুছ সমান..” এ গানের একটি লাইন `গিলা  মন সায়েদ  বিস্তর কে পাস পরা হো`.. যেন ফিসফিস্ করে জানায় এ অনুভূতি জগতে আর কারও নেই, গুলজার ছাড়া! গানটা যেন নিজেই নিজের কথায় ধন্য, আপ্লুত! তিনি ছুঁলেই কবিতার নবান্ন! তাঁর ছোঁয়াতেই সুরের সুখ! গোলাভরা রকমারি উপলব্ধি, প্রেম বিরহ দুঃখ হাসি পাশাপাশি বসে সে এক তরঙ্গিত মজলিস্, কখনো করে উদাসীন কখনো বাঁধে আবেশ ডোরে!

তাঁর মতো রসিকও তো দেখিনি। বিভিন্ন আসরে কবিতার পাশাপাশি তাঁর রসিকতারও আকুল তিয়াসী হয় মানুষ। একযোগে হো হো শব্দটা শুনলে মনে হয় যেন কতদিন হাসেন নি তাঁরা। এই আনন্দ মুহূর্তের জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিলেন প্রহর গুনে গুনে। উর্দু তাঁর মাতৃভাষা। ঊর্দু পড়েন এবং ঊর্দুতেই লেখেন।
তাঁর সার্থক নামকরণ “গুলজার” যার অর্থ জমজমাট ফুলবাগান এতটাই যথাযথ বলে মনে হয় যে, সত্যিই তো কত রকমারি কথার ফুলে সাজে সে বাগান যা আমাদের বাগানবিলাসী করে। তাঁর মুখ থেকে শোনা দেশভাগের গল্প গায়ে কাঁটা তোলে। জীবিকার তাগিদে একসময় তিনি মোটর গ্যারাজে কাজ করতেন..ভাবা যায়! রবীন্দ্রনাথকে জানতে চিনতে এবং পড়তে তিনি বাংলা শিখেছেন। অনুবাদ করেছেন তাঁর বেশ কিছু কবিতা। শরৎচন্দ্রও তাঁর অনন্য ভালোলাগা, এ কথা জানালেন কথায় কথায়।

অমায়িক মানুষ! ঐ যে বললাম বুঝি বা কম বুঝি এক আশ্চর্য নেশা জাগায় তাঁর লেখারা! কণ্ঠস্বর নিঃসন্দেহে প্রেমে ফেলে দেয়! অনেকের মনের পিয়ালে তমালে আছেন তিনি “গুলজার”হয়ে, আমারও! রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি, কিন্তু গুলজারকে দেখলাম যুগ হাঁটতে কলমের সাথে! এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার মত তাঁর ধবধবে চেহারা এক আশ্চর্যতম কবিতা নিজেই! এই গ্রহের প্রেমের সঙ্গে বাঁচার ফুরসৎ কে রাতদিন। 


শরতের কবিতা 


শারদ প্রাতে
উমেশ শর্মা 

উপেক্ষিতা  বন্যকুসুম  মালায়  গেঁথে   নিয়ে 
কিশোরী প্রেম ভোরবেলার আকাশ ছুঁতে চায়, 
সোনালী মেঘ কার যে বাণী শুনলো  ইশারায় 
উথাল পাথাল  অশ্রু গেল  কাশের  হাসি হয়ে। 

কান্না আমার কান্না তো নয়, পান্না হীরে মোতি
সৃষ্টি আমার দৃষ্টি প্রদীপ আলোরই রোশনাই, 
শারদ  প্রাতে   মাঠের  পথে  যত  দূরেই   যাই
বাংলা মায়ের চোখে দেখি অরুপ প্রেমের জ্যোতি। 

যে ফুল  দিয়ে গাঁথলে  মালা, মা  পরবে গলায়
সেই প্রণতা বিনম্রতা গৃহবধু তুলসীদীপের তলায়,
শারদ  আকাশ  নিবিড়  হয়ে  অর্ঘ   দিতে   চায়
ঝিলিক, মিলিক, ঝিলিক হানে আশ্বিনী জোছনায়।



ঝুলনখেলা
শ্রাবণী সেন

আজ বুঝি সব ভুলে গেছে সে!
সব প্রিয় নাম, সব ফুল, সব গান!
সব নদী, সব লোকালয়, সব বৃষ্টি 
সব স্মৃতি স্নান, সবটুকু ম্লান!

তবু আকাশের বুকে পূর্ণিমায়
সেই চাঁদ সেই জোৎস্নায়
সব অভিমান ভুলে  সখি
এসো আজ ফুল ঝুলনায়!



শরতের  জলতরঙ্গ 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

নীল  আকাশে  উড়ে  যায় ঝাঁকে ঝাঁকে   সাদা সাদা মেঘ
ঠিকানা বদলে দলে দলে ওরা কোথায় চলছে তা ঠিক  বলতে পারি নে।
এই ঘনঘটাময়  শরৎ যেন শুধুই স্তব্ধতা গ্রাস করে। 

নীল সাদা  সারেঙ্গী তে শুধুই বেজে ওঠে শরতের  জলতরঙ্গ
রঙের বাহারে আজ  খুব সেজেছে শিউলি  গাছটা
পাগল হাওয়া কড়া নেড়ে যায় দুয়ারে দুয়ারে
এ যেন চারপাশজুড়ে   শুধুই মন খারাপের বাতাস 
এ তল্লাটের আনাচে কানাচে  পথে ও প্রান্তরে
দূরে কোথাও বেজে ওঠে নীল দিগন্তের  টুকরো টুকরো রবিগান।

কাশবনের গা ঘেসে ঝোড়ো উতলা হাওয়া 
বনে বনে শিস দিয়ে ফেরে পরিযায়ী পাখিদের দল
নিমেষে নেমে আসে আনন্দময়ীর আগমন বার্তা।

যেখানে আলো নেই ?  শুধুই আঁধার ? 
সেখানেও আবির মাখা মেঘ 
দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করে অবিরত
কারো অস্ফুট কান্না বেজে ওঠে  বুকের গভীরে।




শরতের সূচনা
প্রতিভা পাল 

আগমনীর পদধ্বনি শারদীয় চৌকাঠে,
ভাদ্রবেলার খররোদ আকাশের নরম নীল ছুঁয়ে 
তুলোমেঘের মলাট আঁকে 
ছেঁড়া পালকের অবয়বে!

স্মৃতির মতো ফিরে ফিরে আসে, শ্রাবণ সহসা
নব শরতের ঘ্রাণে
অঝোর অভিমান মেখে মেঘে মেঘে,
ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ির মুগ্ধ আবেশে !

দিগন্তে হারায় কাশফুলের কিশোরবেলা, 
সবুজ শালুক পাতায় ভেসে যায় মন,
জোনাকি রাতের নক্সীকাঁথায় জ্যোৎস্নার রূপকথা,
শিউলির বৃন্তে শিশিরের সমর্পণ !

ভাদ্র লেখে শরতের ভূমিকা ভোরের মতন….



ভাদ্র শেষের খেয়ায়
        সুনন্দ মন্ডল

ভাদ্র এলেই মনে পড়ে
শরৎ খুশির গান।
কাশ ফুলের গন্ধে ভরে
সব বাঙালির উঠান।

ভাদ্র এলেই চাতাল জুড়ে
শিউলি বসায় মেলা।
পুজোর আমেজ হৃদয়ে মেশে
দিগন্ত জুড়ে খেলা।

বিশ্বলোকে উৎসবের খই
ঝরুক বাঙালির মাথায়।
পুজো পুজো গন্ধে মাতুক
ভাদ্র শেষের খেয়ায়।



কী যে সুন্দর নীলাকাশ ও কাশফুল
মজনু মিয়া 

নীল আকাশের বুকে
মেঘগুলো মুখ রেখে
দূরের পথে ছুটছে দ্রুত 
আলোর রশ্মি মুখে।

শুষ্ক বায়ুর গতি 
বুঝা দায় তার মতি
ঝিরিঝিরি মন কেড়ে নেয়
শরৎ ঋতুর প্রতি।

শুভ্র কাশের ফুলে
ঐ বাতাস যায় দোলে
তালে তালে দোলে কাশফুল 
নদীর সুন্দর কূলে।

লম্বা তালের গাছে
গোল গোল তাল আছে
তালের পিঠা খেতে মজা
ঋণী ভাদ্রের কাছে।



অনুগল্প 

স্টেটাস
সুজাতা কর


উত্তরের সুদৃশ্য ব্যালকনিতে বসে অবিনাশ চায়ের কাপে চুমুক দেন। সকাল আটটা এখন। ব্যালকনির সামনে পাল পাড়া। নিম্নবিত্ত মানুষের বাস। কেউ রিকশা চালায়, কেউ অফিসের গার্ড, কেউ বা ছোটখাটো কারখানার চাকুরে। অবিনাশ তার সকালটা কাটান এইখানে ঘন্টা তিনেক বসে। খবরের কাগজ পড়েন, দু'বার চা খান। জলখাবারও এইখানে বসে খান।

সাড়ে আটটা নাগাদ আসে সুইপার। বাড়ি বাড়ি হুইসেল বাজিয়ে নোংরা সংগ্রহ করে। তারপর আসে সব্জিওলা, মাছওলা। একের পর এক মানুষের আনাগোনায় পালপাড়া জমজমাট হয়ে ওঠে। পালপাড়ার প্রতিটি পরিবারকে অবিনাশ চেনেন। ওই যে ফর্সা, লম্বা মহিলাটি টাইম কলে জল ভরছে, সে এ পাড়ার কুকুরদের মা। পাড়ার সাত-আটটা কুকুরের দুপুরের ভাত ওই মহিলার বাড়িতে বাঁধা। অসুখ হলে ওষুধ, ঘা হলে মলম, সস্তার টোটকা সবকিছুর দায়িত্ব ওই মহিলার। ওই যে লোকটি, বেশ সুপুরুষ, ন'টা বাজলে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ে, কোন অফিসে যায় অবিনাশ জানেন না। তবে বেশ টিপটপ হয়ে ছোট একটি মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে যায়। সামনের বাড়িতে থাকে শেফালি। চার বাড়ি কাজ করে। মাঝে মাঝেই একটি ভিখিরি মতন ছেলেকে দেখতে পান তিনি বাড়ির সামনে বসে ভাত খাচ্ছে। শেফালি ছেলেটি ভিক্ষে করতে এলেই খাইয়ে দেয়। অনেকদিন পর অবিনাশ জানতে পেরেছিলেন ছেলেটি বোবা। শেফালির স্বামী বেশ ষন্ডামার্কা। অবিনাশ বুঝতে পারেন না সে কী কাজ করে। মাঝে মাঝে রাতে সে খুব নেশা করে আসে। তখন শেফালির চিৎকারে তার ঘুম ভেঙে যায়। শেফালির ছেলে-মেয়ে নেই। রাতে শেফালি যখন চেঁচায় তখন একটা কথা অবিনাশ প্রায়ই শুনতে পান, "চুপ বাঁজা মেয়েমানুষ।" কথাটা শেফালির বর বললেই শেফালি চুপ হয়ে যায়। অবিনাশের অস্বস্তি হয়। বিছানায় তিনি ছটফট করে ওঠেন। বিয়ের দশ বছর পরও যখন তার আর বৃন্দার কোন ছেলে- মেয়ে হলো না, তিনি হতাশায় ভুগতে শুরু করেন। অফিসের পর বাড়ি ফিরতে তার ভালো লাগত না। এদিক- সেদিক চলে যেতেন। বন্ধু বরুণ একদিন নিয়ে গেলেন রয়াল ব্লু বার-এ। তিনি প্রথম বার মদ স্পর্শ করলেন। তারপর প্রায়ই। নেশার মাত্রা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। বৃন্দা প্রথমে চুপ করে থাকত। যেদিন ট্যাক্সি থেকে নেমে টলতে টলতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন, সেদিন বৃন্দা আর চুপ থাকতে পারল না। চেঁচিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলল,"তুমি এটা  কী শুরু করেছ?" অবিনাশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন," চুপ বাঁজা মেয়েমানুষ।" বৃন্দা উত্তর দেয়নি। পরদিন সকালে বৃন্দা একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। আশি লাখের সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে বসে থাকা অবিনাশ সেন আসলে পাল পাড়ারই একজন।



স্বাধীন হয়েছি যখন 
চিত্রা পাল 

নতুন স্কুলে স্বাধীনতা দিবস পালন হবে শুনেই অবাক চার বছরের তুতুস।জিনিসটা কি? বাড়ি ফিরেই দাদুর ঘরে দে ছুট। স্বাধীনতার মানে কি গো? ওর দাদু তখন সবে খবরের কাগজটাতে মনোনিবেশ করেছে, কাজেই ঠিক মতো না শুনেই বলছে,হুঁ। তখন ও দাদুর খবরের কাগজ ধরা হাতটাকে নাড়িয়ে দিয়ে বলে, বলো না। এবার দাদুর হুঁশ ফিরেছে, বলে,কি বললি? ও আবার বলে, স্বাধীনতার মানে কি? তুই এই কথাটা আবার কোথা থেকে শিখলি? ওই যে স্কুলে বললো। ওর দাদু সবে শুরু করতে যাচ্ছে, এমন সময়ে ওর মা এসে ওকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেলো ওর স্নান খাওয়া করাতে।

সন্ধ্যাবেলায় দাদুর কাছে আবার জানতে চাইলো যখন,তখন ওর দাদু বলে, তোর পক্ষে বোঝা মুশকিল রে। তুতুস বলে, কি? তখন ওর দাদুর মন চলে গেছে সেই ছোটবেলায়, যখন সত্যিই স্বাধীনতার মানে ছিলো আজকের থেকে অন্যরকম। ওনার বাবা একেবারে সক্রিয় স্বদেশী করতেন। সেটার একটা কারণ হলো ওনার মামারাও স্বদেশী করতেন। মামার বাড়ির পাশেই ছিলো শিবমন্দির সংলগ্ন বিশাল ময়দান। সেখানে অন্য সময় যাত্রাপালা কথকতা হতো।আর  প্রায়ই হতো রাজনৈতিক পার্টির মিটিং।একবার এমন সমাবেশে পুলিশ এলো ধরপাকড় করতে। ছোট মামা বাড়ির পেছনে একটা নোংরা জায়গায় বাঁশঝাড়ের ভেতরে লুকিয়ে ছিলো। সেই রাত্তিরে ছোটমামাকে চান করে ঘরে ঢুকতে হয়ে ছিলো। বিকেলে আবার পুলিশ এলো বাড়ি সার্চ করতে। ওদের কাছে খবর আছেএ বাড়িতেই লুকোনো আছে আগ্নেয়াশ্ত্র। সব দেখেশুনে বলে গেলো, ওরা আবার আসবে,আর আপত্তিকর কিছু পেলে অবধারিত শাস্তি।

দাদুর বাবা তার দিদাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, এর মানে কি? দিদা বলেছিলো, ওই যে ওদের রাজত্বে আছি কিনা, তাই ওদের সব কথামত চলতে হবে।মানে? দাদুর একথার উত্তরে দিদা বলেছিলো, ওরা হাত তুলতে বললে হাত তুলবে। মাথা নাড়তে বললে মাথা নাড়বে, মানে দম দেওয়া পুতুল আর কি। যদি না করে?তাহলে যেকোন ভাবে জেলে ভরা, তারপরে চলে শাস্তি। দাদুর বাবা ওই টুকু বুঝেই চুপ করে গিয়েছিলো। আবার শাস্তি শুনে ভয়ও পেয়েছিলো। স্কুলে দেখেছে শাস্তি পেতে অন্য ছেলেদের তাই আর কি।

একদিন ছোটমামা ওকে একটা চিরকুট দিয়ে বললো, এইটা উমাকে দিয়ে আসতে পারবি, কেউ যেন জানতে না পারে, একেবারে লুকিয়ে। চারটে বাড়ির পরেই ওদের বাড়ি। উমা মাসীকে পেছনের বাগানে ফুল তোলার সময়ে একা পেয়ে হাতে দিয়ে বলেছিলো, মামা এর উত্তর দিতে বলেছে। সন্ধ্যে বেলায় আসতে পারবি একবার?  সন্ধ্যে বেলায় মাঠ থেকে খেলা শেষে বাড়ি ফেরার পথে উত্তর নিয়ে টুক করে ছোটমামার হাতে দিয়ে বলেছিলো, আর পারবে না। ছোটমামার মুখটা কেমন বিসন্নহয়ে গিয়েছিলো। এর কদিন পরে এক রাতে খেয়েদেয়ে শুতে যাচ্ছে, তখন শুনেছিলো,দিদা বলছে, আগে নিজের পায়ে দাঁড়া তবে ওসব ভাববি। এই জন্যে লেখাপড়া শেখাচ্ছি? এরপরে বেশ কিছুদিন আর কিছু চালাচালি হয়নি। ছোটমামাও কিসব গুপ্ত মিটিং এ ব্যস্ত। এদিকে শুনতে পাচ্ছে উমা মাসীর বাড়ি নাকি কিছুটা নিমরাজি হয়ে মত দিয়েছে। তারমানে বাড়িতে একটা বিয়ে লাগতে যাচ্ছে। ছোটরা বেশ উত্‌সাহী হয়ে কত কি ভেবে  ফেলেছিলো।

ব্যাপারটা সবে গুটি পেকেছে,সবাই ফলের আশায় আছে। ছোটমামাকেও বেশ খুশি খুশি  দেখাচ্ছে। এমন সময়ে হঠাত্‌  বাড়িতে পুলিশ রেড হলো। ছোটমামার ঘর সার্চ করে  অনেক আপত্তিকর কাগজপত্র পাওয়াতে পুলিশ একেবারে হাতকড়া পরিয়ে সোজা জেলে।  

  দেশ স্বাধীন হবার পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মামা বাড়িতে এলো ততদিনে দাদু গত হয়েছেন। দিদা অসুস্থ।উমা মাসি বিয়ের পরে বোম্বেতে। ছোটমামা একটা স্কুলে কাজ পেয়ে বেঁচে  গেলেন। অশরীরী হয়ে থেকে গেলো তাদের না বলা কথা,স্বাধীনতার আলো না পেয়ে।     

তুতুস আবার জিজ্ঞেস করলে,স্বাধীনতার মানে তাহলে কি আসলে? ঘুম ভাঙ্গা গলায় দাদু বলে, তুই তোর মতো চলতে পারছিস্‌,তোর অনুভূতির কথা বলতে পারছিস,কোথাও কোন বাধা নেই,   এইতো স্বাধীনতা। স্বাধীনতার মানেওনেক বড়, আকাশের মতো মুক্ত, এইটে যতো বড় হবি বুঝতে পারবি।




এই সময়ের কবিতা 

চাঁদে

মাথুর দাস


চাঁদের মাটি হয়তো খাঁটি,

নয়া বসতি করতে

মুখিয়ে আছে লাখো মানুষ

মরণ-বাঁচন শর্তে ।


বাসযোগ্য হলেই চাঁদ

মিটবে সে মনের সাধ,

কীসের জন্যে থাকবে প'ড়ে

লোক-গিজগিজ মর্ত্যে !



আদর্শ শিক্ষক

রীতা মোদক

সবার অধিক সন্মান জানি
ইস্কুলের মাষ্টারমশাই,
সাদা ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া 
ছিলনা অন্য পোশাকের বালাই।

চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করলে ---
মাথায় উঠতো আশীর্বাদের হাত,
পড়ানোর সময় ----গভীর মনোযোগ 
অন্যমনস্ক হলেই, পড়ত বেত্রাঘাত।

শিক্ষা দিতেন উজাড় করে
বোঝাতেন সহজ গল্পের মতো,
সঠিক পথে চলার মন্ত্র শিখে
ছাত্র ছাত্রীরা ----মানুষ হতো।

অজ্ঞানেরে তুলে এনে
ছড়িয়ে দিতেন জ্ঞানের আলো ,
সদাচার জানতেন তারা
মানুষেরে বাসতেন ভালো।

কোথায় এখন মাষ্টারমশাই?
কোথায় গেলো হাতের লাঠি?
হারিয়ে গেলো শাসন ভার
তৈরী হলো--- উশৃঙ্খলতার ঘাঁটি।

প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে যাই....
 কুলুপআটা এই সমাজের কাছে,
অধম সন্তানদের মানুষ করতে
আদর্শ শিক্ষকের কি দরকার আছে?

কু-শিক্ষাতে ভরলো সমাজ
দেশ জুড়ে শুধু দূর্নীতি আর হাহাকার
আসবেন কি ফিরে সেই শিক্ষক শিক্ষিকা ?
 নেবেন কি তারা মানুষ করার ভার?





এগারোই আগস্ট

বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

আগস্ট এগারো' এক মঙ্গলবারপৃথিবী থমকে দাঁড়ায়।

দেশপ্রেমে পণতোলে আড়োলনবাসুকি মস্তক নাড়ায়।

অসিত জলদ বুকে তার খেদ নেমে ছুঁয়েছিল ধরা 

শোকার্ত মেদিনীনয়ন মেলেনিদেয়নাই কোনো সাড়া।

 

 

জনম লগনেবাধা অলক্ষুনেমায়ের আকুল প্রাণ 

তিন মুঠো 'খুদেবিনিময়ে শোধেনাম তাই ক্ষুদিরাম।

তুমি বিশ্বমাতা ধন্য জন্মদাতা গর্ভে অমূল্য রতন।

পুত্র অষ্টাদশকি অসীম সাহসহেলায় অসাধ্য সাধন।

ছোট সাদা ধুতিসাধারণ অতিমুখায়ব অমলিন।

বিপ্লবে প্রচন্ডঋজু মেরুদণ্ডভয়ডর শঙ্কাহীন।

 

 

 

অভিশপ্ত দিনে ভিড় অকারণ নীরব দর্শক সেজে।

ভীত নরাধমজীবনে প্রথমশহীদের অর্থ খোঁজে।

ভারত জননীক্ষোভে অভিমানীঅকালে পুত্রশোকে।

মেরুদন্ডহীনসহস্র সন্তাননির্বাক হয়ে দেখে।

 

 

ইংরেজি পেয়াদাতার হাত বাঁধেদর্শকের সমাগম।

দর্পে মাথা তুলেগলা ছেড়ে বলে, "বন্দেমাতরম"

“ফাঁসির রশিতে মোম কেন ঘষা”শুধায় বিস্ময়ে যুবক।

উপস্থিত জনেকাঁপে অকারণেচেয়ে থাকে অপলক।

“মোমের ঘষায়শহীদের গলায়হবেকি মৃত্যু মসৃন?

জন্ম জন্মান্তরেযাবো শোধ করেদেশের মাটির ঋণ।“

 

 

 

ইংরেজ শাসনভয়ে কম্পমানদেখে স্মিত মুখায়ব।

কালো আচ্ছাদনে ঢাকে হাসি মুখ,

শিহরিত মায়ের কেঁপে ওঠে বুক,

---                                           --- নিস্তব্ধ হয় রব।

 

 

"পরাধীনতার ভাঙবো শৃঙ্খল",শেষ হুঙ্কারে দৃঢ়বদ্ধ।

তার অন্তিম ধ্বনি “বন্দেমাতরম !

একটা মুহূর্তে শিহরিত 'যম' !

---                                     ---   কালচক্র হয় স্তব্ধ।

 

 

 বাংলার মাটিভালোবেসে খাঁটিকরেছ অকাট্য প্রমান।

এই স্বাধীনতাশুধু মহানতাশহীদের অবদান।

শুদ্ধ দেশপ্রেমেসার্থক জনমেবঙ্গ হৃদয়ে শাশ্বত।

শহীদ ক্ষুদিরামঅনন্ত সেলামচিরশ্রদ্ধায় শির নত।





সোনার ছেলে 
 চন্দ্রানী চৌধুরী

সোনার ছেলে বর্শা হাতে স্বপ্ন ফেরি করে
সোনার ছেলে বর্শা দিয়ে আলো আনে ঘরে

সোনার ছেলে অসম বীর দেশবিদেশে ছোটে
সোনার ছেলে অসম সাহস ভয় পায় না মোটে

সোনার ছেলে জড়িয়ে রাখে আকাশ কুসুম স্বপ্ন 
সোনার ছেলে জড়িয়ে মনে হতেই হবে রত্ন

সোনার ছেলের বুকে থাকে ভারত দেশমাতা 
সোনার ছেলে বুকে রাখে জাতীয় পতাকা 

সোনার ছেলের মুকুট জুড়ে সোনার পালক 
সোনার ছেলের মুকুটে আজ বিস্ময় বালক 

সোনার ছেলের স্বপ্নগুলো আগুন দিয়ে গড়া
সোনার ছেলের স্বপ্ন উড়ান সোনা দিয়ে মোড়া

সোনার ছেলে এনে দিল সম্মান এবং সোনা ।
তাই সোনার ছেলে পেলো আজ সবার বন্দনা ।



বিপন্ন শৈশব ও পঞ্চায়েত ভোট
আশীষ   কুমার   বিশ্বাস


ওরা ছোটরা !
ওরা আম বাগানে খেলছিল ।
বোমাকে বল ভেবে ওঁরা ভুল করেছিল ।

বড়রা বা তাঁর পূর্বসূরি বোমা বেঁধে ছিল
ভোট যুদ্ধে বোমা নিয়ে খেলা-
এখন এটাই বড় উৎসব !

তার -ই  কয়েক টা রাখাছিলো আম বাগানে ।
বিপন্ন শৈশব , বল ভেবে লাথি মারে বোমে ,
বোমা ফেঁটে রক্তাক্ত দেহ ।

কিছু গুণীজন , কিছু প্রতিবাদি মন আর তার
পরিবার , সোচ্চার বোমা খেলা নিয়ে !
শৈশব নিরাপদ নয় ।

কিছু দিনের মধ্যেই ভুলে যায় গুণীজন ,
প্রতিবাদি মন ।
ভুলেও ভোলে না তার শোকার্ত পরিবার ।

নিরাপদ নয় আমজনতা !
বোমার বল ঝোপে-ঝাড়ে আছে
সুযোগ বুঝলে বেরিয়ে পরে লোকালয়ে ।

তখন শৈশব নয় , বড়োরাও মারা পড়ে ,
অঘোরে প্রাণ যায় তাঁর ।
গণভোটে নাম জড়ায় জনগনের !

গণ ভোটে বোমা ফাটে বাজির রূপে
উল্লাস বাড়ে মাসলম্যান দের ,
এরাই হিরো ।
ভয় পায় আমজনতা ।


বড় গল্প 


কালো ও কালে কালে বহমান জরা 

সৌমেন দেবনাথ 

তাকে সে ভীষণ পছন্দ করে কারণ তার ভেতর হাজারটা গুণ না থাকলেও এমন কিছু গুণ আছে যা তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু মানুষজন মানতে পারেন না তাদের ভেতর এত মিল হয় কি করে! কেউ না কেউ তোমাকে পছন্দ করবেই কারণ কিছু গুণ তোমার ভেতরও আছে যা অন্যের চোখে পড়বে না, তোমার চোখেই পড়বে। প্রথম প্রথম বিভা এড়িয়ে চলতো, কিন্তু যখন সে বুঝতে পারলো মানুষটার হৃদয় অনেক বড়ো, তখন সে কাছে এসেছে, অনেক কাছে। কাউকে পেতে হলে, একান্ত করে কাছে পেতে হলে তাকে আগে বুঝতে হয়। এজন্য কেউ দ্রুত সন্নিকটে না এলে মন খারাপ করতে নেই, তাকে বুঝতে সময় দিতে হয়, তাকে বুঝতে নিজেরও সময় নিতে হয়।

অফিস থেকেই ফোন করে মৃদুল জানালো, চুলে বেণি করো, দুটি বেণি। 
বিভা মৃদুলের কথাতে হ্যাঁ সম্মতি জানালো। অথচ আজ দুপুরে স্নানের সময় সে চুলে স্যাম্পু করেছে। খোলা চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ে উড়ে তাকে বিশেষ বিরক্ত করছে তখনও৷ স্বামীর খুশির জন্য সে এলোকেশে বেণি করতে বসে গেলো। নিজের পছন্দকে বিসর্জন দিলো স্বামীর খুশির জন্য। মানুষটি তাকে বিরক্ত করে, কিন্তু কখনো বিরক্ত হয় না। এই কারণে নিজের ভেতর বিরক্তিবোধ জাগলেও প্রকাশ করে না। সারাটা জীবন ভেবে ভেবে বড়ো হয়েছে, বিরক্ত কারবো, কিন্তু বিরক্ত হবে না এমন একজন মানুষ জীবনে চাই।
তেমন মানুষটি সে পেয়েছেও। একটু পরে ফোন করে জানালো, আসার সময় বাদাম আনবে।
মৃদুল বাসার কাছে চলে এলেও বুঝতে দিলো না, সে আবার স্থানীয় বাজারে গেলো। বাদাম কিনলো। বাদাম পেলেই যে সন্তুষ্ট হয় তাকে অসন্তুষ্ট করার জন্য ন্যূনতম অজুহাতও ব্যক্ত করা ঠিক না।

দিনশেষে মৃদুল বাড়ি এলে নিষ্পলকে চেয়ে থাকে বিভা। মৃদুল বলে, বিভার আভায় হারাবো আমি। নিকষে বিভা কী খোঁজে?
উত্তরে বিভা বলে, চরিত্রের সাথে সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। সৌন্দর্য কখনো চরিত্রের চেয়ে দামি হতে পারে না। আর সৌন্দর্য আচরণে, ব্যবহারে; অঙ্গে না।
ঠোঁটে একটু হেসে মৃদুল বলে, কিন্তু নিষ্পলকে চেয়ে আছো কেন? মনে হয় প্রথম দেখছো! প্রথম দেখার মতো কি আশ্চর্য লাগছে আমাকে? আর আমাকে দেখে কি আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে?
বিভা বলে, চোখ থাকলেই হয় না, দৃষ্টিশক্তি থাকতে হয়। সুদৃষ্টিশক্তি। সোনা চেনা সহজ কাজ নয়। চোখ থাকার পরও চোখে দৃষ্টিশক্তির অভাবে মানুষ সোনাকে কাচ ভেবে ফেলে দেন। মানুষটা তুমি খাঁটি। অপেক্ষা করা সুন্দর হয় যখন যার জন্য অপেক্ষা করা হয় সে খাঁটি হয়। একজন খাঁটি মানুষ জীবনে আছে। খাঁটি মানুষের জন্য আশ্চর্যতা ফুরায় না।
মৃদুল বলে, চোখের দিকে অনন্তকাল তাকালেও কি মানুষ চেনা যায়? 
বিভা বলে, মনের কথা বুঝতে মন লাগে। না বলা কথাগুলো অনুভব দিয়ে বুঝে নিতে জানলে আপন মানুষ চেনা যায়। কারণে-অকারণে যে খোঁজ নেয়, আমি জানি সে আমাকেই চায়।

মৃদুল হাসে। প্রাপ্তির হাসি, মিষ্টি হাসি। হেসে নিয়ে বলে, সুযোগ দাও, ফ্রেশ হই। ঘামের গন্ধে আমি নিজেই থাকতে পারছি না। 
বিভা নিষ্পলকে চেয়ে বলে, তোমার ঘামগন্ধ আমার মুখস্ত। আমি তোমার ঘামগন্ধে কোনো দুর্গন্ধ পাই না। আমাদের জন্য তোমার ঘাম ঝরে, তোমার ঘামের দাম আমার কাছে অনেক। অমূল্য স্বর্ণ দিয়ে আমি কী করবো? আমার কাছে অমূল্য তুমি।
মৃদুল এবার বিভার চোখ বরাবর নিষ্পলকে না চেয়ে থেকে পারলো না। হৃদয়ের ভেতর থেকে একটি কথা বের হয়ে এলো, এত ভালোবাসো কেন?
উত্তরে বিভা বলে, শত ব্যস্ততার মাঝে থেকেও যে মানুষটা আমাকে আগলে রাখে তাকে ভালো না বেসে থাকা যায়! 
মৃদুল বলে, আমি যে মাঝে-মধ্যে তোমার উপর রেগে যাই!
বিভা বলে, অতিরিক্ত রাগি মানুষের ভালোবাসাটাও অতিরিক্ত হয়। যে অল্পে রাগে সে অল্পে হাসেও। যে অল্পে রাগে সে অল্পে ব্যথা-বেদনাও ভুলে যায়। 
মৃদুল অবাক হয়ে বলে, যখন রেগে যাই তখন দুঃখ লাগে না?
বিভা না-বোধক মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার সময়ে দুঃখকে প্রশ্রয়ই দিই না।
মৃদুল বলে, তবে কেন চোখে জল আসে?
বিভা বলে, হৃদয় দিয়ে ভালোবাসলে চোখ দিয়ে জল ঝরবেই।
মৃদুল বিস্ময় ভরা চোখে বিভাকে দেখে আর বলে, আমি কালো, তোমার কোনো আক্ষেপ নেই?
বিভা দৃঢ়চিত্তে বলে, চেহারা কদিনই থাকে! মনের লাবণ্যই স্থায়ী। যার কাছে আমার মূল্য অনেক সেই তো আমার কাছে অমূল্য। যে আমাকে গুরুত্ব দেয়, আমি তার কাছে সুখ পাবোই। তুমি কালো সবার চোখে, কিন্তু  আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ।

একটু হেসে মৃদুল বিভার বাধা ডিঙালো। তারপর ফ্রেশ হতে স্নানাগারে গেলো। টেবিলে খাদ্য-খাবার তরে তরে সাজালো বিভা। খেতে বসে মৃদুল বললো, ইলিশ মাছ তোমার পছন্দ বলে গতকাল ইলিশ মাছ নিয়ে আসতে বললে। অথচ ইলিশ মাছ রান্না করোনি কেন?
বিভা বললো, ইলিশ মাছে তোমার এলার্জি আছে আমাকে তো বলোনি, মা বলেছেন। তুমি খাবে না সেই খাবার আমি খাবো কী করে!
মৃদুল আশ্চর্য হয়ে বলে, বলো কী! আমার কারণে একটা প্রিয় খাবার ত্যাগ করবে? 
বিভা বলে, প্রিয় মানুষের জন্য অনেক প্রিয় বিষয় ত্যাগ করতে হয়। তোমার পথের পথিক আমি। তোমার শখের ভেতরই আমার শখ নিহিত।

মৃদুল দ্রুত উঠে গেলো খাওয়ার টেবিল থেকে। ফ্রিজ থেকে মাছ নিয়ে নিজেই ভাজতে গেলো। বিভা পেছন পেছন এলো আর বললো, এভাবে আমার পছন্দ যার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সে কেন আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হবে না? পুরো পৃথিবী লাগে না, সাথে এমন সঙ্গী থাকলে গণ্ডিও যথেষ্ট। 
মৃদুল মাছ ভাজতে ভাজতে বলে, বাইরে আগে অনেক কিছু খেতাম, এখন কিছু খেতে গেলেই তোমার কথা মনে পড়ে। তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। তোমাকে নিয়ে তাই অনেক ভাবনাজাল আঁকি।
বিভা বলে, আমাকে যে ভাবনা জুড়ে এতটা রাখতে পারে, সে কেন আমার ভাবনা জুড়ে থাকবে না? সেই তো আমার সকল সুখের কারণ। তুমিই তো আমার সকল সুখের কারণ। তাই তোমাকে খুশি করার কারণ খুঁজি। নিজেকে খুশি রাখার কারণ খুঁজি না। তোমার খুশিতে আমার মনে খুশির জোয়ার সৃষ্টি হয়। 

এই বলে বিভা মৃদুলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মৃদুল বলে, এত আদরকাড়া কেন তুমি? এত আদর জানা কেন তুমি? আমি তো আদর দিতে জানি না!
বিভা বলে, এতটা যে যত্নে রাখে আলাদা করে তাকে আর আদর করা জানতে শিখতে হয় না। আমার প্রতি যার এতটা টান একদিন সে আদর দেওয়ার শিক্ষক হয়ে যাবে। প্রকৃত জীবনসঙ্গী প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে পৃথিবীর সব সুখ খোঁজে।

মাছ ভাজা শেষ হলে ওরা আবার খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলো। তারপর মৃদুল নিজেও এক টুকরো ইলিশ মাছ নিলো। তা দেখে বিভা বললো, ইলিশ খাবে? দেখো এই খাদ্যই ওষুধ, এই খাদ্যই বিষ।
মৃদুল বলে, পছন্দের মানুষের পছন্দ অপছন্দের হলেও পছন্দের করে নিতে জানতে হয়। শুধু নিজের পছন্দের কথা প্রকাশ করতে থাকলে পছন্দের মানুষের কাছে অপছন্দ হয়ে যেতে হয়।
বিভা বাধা দিয়ে বলে, যা খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে তা না খাওয়ায় শ্রেয়। তুমি তোমার তাই তুমি তোমাকেই আগে ভালোবাসবে। সম্পর্কে মধুরতা আনতে স্বাস্থ্যঝুঁকি ডেকে নেওয়া ঠিক না। আমার খুশির কারণ হতে গিয়ে তুমি তো তোমার দুখের কারণ ডাকতে পারো না।
মৃদুল বলে, যার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত তার জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি খুবই সামান্য। আর অসুস্থ হলে শুশ্রূষা দেওয়ার মানুষ তো আছে আমার। তোমার সেবায় হবো আমি বলীয়ান।
বিভা দ্বিমত পোষণ করে বলে, সেবা দেওয়ার মানুষ থাকলেই রোগ ডেকে আনতে হবে? কোনো রোগকেই আমন্ত্রণ জানানো ঠিক না।
মৃদুল খেতে খেতে বলে, মন ভালো থাকলে রোগ হয় না। পৃথিবীর সব মানুষ কল্পনাতেই বেশি সুখী। আমি বাস্তবে সুখী।
বিভা গদগদকণ্ঠে বললো, তোমার মন ভালো রাখার সেই শক্তি কি আমার আছে? আমি শুধু তোমার ভালো চাই, কিন্তু নিজের ভালো তো নিজেকেই রাখতে হয়। সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে মুখে যে হাসি তুমি রাখো তা মূলত মিথ্যা হাসি।
খাওয়া বন্ধ করে মৃদুল বললো, ভালোবাসার প্রত্যেকটি মানুষই জীবনের জন্য জরুরি। সবার ভালো থাকার উপর নিজের ভালো থাকা নির্ভর করে। হাজার কষ্টে থেকেও কাছের মানুষের সুখে রাখার চেষ্টাটাই আসল ভালোবাসা। একা ভালো থাকা যায় না, একা ভালো থাকার চেষ্টা করলে একাই হয়ে পড়তে হয়। অনেকের অনেক ত্রুটিই চোখে পড়ে, সব দেখেও না দেখার ভান করা হয় শুধু সম্পর্ক রক্ষার জন্য। কারণ সম্পর্কটা জীবনের জন্য জরুরি। অনাদরে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
বিভা বললো, আমার ভেতর ত্রুটি পেলে জানাবে, নিজের ভুল নিজে ধরা যায় না। আমার আচরণ তোমার মনের বিরুদ্ধে গেলে জানাবে। আমি ভুল করেই যাবো, তুমি ক্ষমা করেই যাবে এটা ঠিক না। তোমার আমার সম্পর্কে কেন অসুস্থতা থাকবে?
মৃদুল বলে, তোমার নিজস্বতা আছে। আমার প্রভাবে কেন তুমি তোমাকে পরিবর্তন করবে? কোনো একটি বিষয়ে তোমার ধারণা আমার সাথে নাও মিলতে পারে, আমার অযাচিত চাওয়া থাকবেই বা কেন? আর আমার অযাচিত চাওয়ার কাছে কেন নিজেকে ভাঙবে? 
বিভা জানায়, আমার জীবনে তুমি বিশ্বস্ত মানুষ। তুমি আমার খারাপ কখনোই চাইবে না। তাই তোমার উপর আমার এত বেশি নির্ভরতা। জানি আমি তোমার প্রয়োজন ও প্রিয়জন।

পরেরদিন অফিস থেকে ফেরার পথে একটি শাড়ি কিনে এনেছে মৃদুল। অন্যান্য নারীরা শাড়ি দেখলে যেমন পুলকিত হয় বিভা তেমনটি পুলকিত হলো না। বললো, বলেছি তো আমাকে শাড়ি দিলে তুমি শার্ট নেবে। তুমি শার্ট না নিলে আমি শাড়ি নেবো না। আমি সাজবো তুমি দেখবে আমি তা বুঝি না।
শুনে মৃদুল বলে, তোমাদের জন্যই আমি পরিশ্রম করি। তোমায় ভালো রাখা, ভালো থাকতে সহয়তা করা আমার দায়িত্ব। তোমার চোখের কাজল কেনার দায়িত্বও আমার, তোমার চোখে জল যেন না আসে সে দায়িত্বও আমার।
বিভা না-সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, তোমার ঘাড়ে ভারবোঝা হয়ে থাকা কি আমার দায়িত্ব? দুটি মানুষ পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটলে অনেক পথ যেতে পারে। আমায় কাঁধে নিয়ে বেশি দূর যেতে পারবে? আমি তো তোমার কাঁধের বোঝা নই, আমি তোমার সহযাত্রিনী। আমাকে মূল্যবান উপহার দিতে হবে না, কেবল সময়টুকু দিও। তোমার দেওয়া প্রত্যেকটি ক্ষণ আমার জন্য মহামূল্যবান।
অন্যমনস্ক হয়ে মৃদুল বললো, শাড়িটা তবে ফেরত দিয়ে আসবো? খুব পছন্দ হয়েছিলো বলেই এনেছিলাম। তুমি কত খুশি হবে ভাবতে ভাবতে এসেছি, হলে অখুশি। 
শাড়িটা বিভা বুকে চেপে নিলো আর বললো, না ফেরত দিতে হবে না। তবে নতুন শার্ট না কিনলে এ শাড়ি আমি পরবো না। ক্রমাগত ত্যাগ করে যাবে তুমি আর আমি ক্রমাগত সুবিধা নিয়ে যাবো ভালোবাসার দলিলে তা লেখা নেই।

এমন সময় মৃদুলের মা মৃদুলকে ডেকে নিলেন। পারিবারিক ব্যাপারে কথা চললে বিভা সেখানে যুক্ত হয়ে নিজের মত পেশ করে না। আজ বিভাকে জোর করে ডেকে নিলো মৃদুল। কিন্তু বিভা চুপ থাকলো। কোনো কথা কেউ জিজ্ঞাসা না করলে সে নিশ্চুপই থাকে। নিজের ঘরে ফিরে মৃদুল বললো, পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তুমি কথা বলো না। তুমি কি পরিবারের সদস্য না?
উত্তরে বিভা বলে, তোমাদের কত ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে এই সংসার দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ এই বাড়ি এসে আমার কথা বলা আমার কাছে অনধিকার চর্চার মতো মনে হয়।
মৃদুল বলে, লক্ষ্মীর মতো কথা বলো। লক্ষ্মীরাই লক্ষ্মী থাকে। রগচটা, বদমেজাজিরা কখনো লক্ষ্মী হয়ে উঠতে পারে না। শুধু ভাগ্যের কারণেই তোমাকে জীবনে পেয়েছি। 
বিভা মৃদুলের চোখ বরাবর চেয়ে বলে, হৃদয় মাঝে ডুব দিতে জানো, ডুব দিতে জানো বলেই ঝিনুক পাও, ঝিনুক না পেলে কি কেউ মুক্তো পায়? 
মৃদুল বলে, চারিদিকে মুক্তোর ছড়াছড়ি থেকে একটি মুক্তো কি করে বাছাই করবো ভাবতাম। কিন্তু মুক্তো বাছাই করতে হয় না, মুক্তো জীবনে চলে আসে। হৃদয় থেকে যারা চায় তারা মুক্তোই পায়। মন থেকে চাইলে মন মনের মতো মানুষ পাবেই পাবে।

বিভা মৃদৃলের বুকে মুখ লুকায়। বড়ো নির্ভরতার আশ্রয় এই বুকের সন্ধিস্থল। বলে, তোমাকে কত যে ভালো লাগে তুমি জানো না, আমি জানাতেও পারবো না। কেন এত ভালো লাগে জানি না। ভালো লাগার কারণ থাকে না। এখন একা থাকলে ভয় করে, একা বাইরে গেলে ভয় লাগে। একটু সময় কথা না বললেই খারাপ লাগে। অন্যদের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। কেবলই তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে। কাজের মধ্যেও মনের চোখে শুধু তোমার চোখ ভাসে। যে যাকে ভাবে তার মনশ্চক্ষে সে সব সময় থাকে। তুমি আমার তৃষ্ণা জুড়ে।
মৃদুল বলে, এভাবে মায়া জাগানো কথা আর বলো না। এত মায়া দিলে বাইরে যেতে পারবো না, বাইরে গেলেও থাকতে পারবো না। এত মায়া জাগাতে জানো তুমি ভাবতেই পারি না। যে মানুষটা এভাবে মায়া জাগাতে পারে সে মানুষটা খুব ভালো মনের হয়। 
বিভা ঠোঁটে হেসে বলে, তুমি কত ভালো মানুষ তুমি জানো না। তোমাকে আমি চিনে নিয়েছি, তুমি মিষ্টি হৃদয়ের একজন মানুষ। তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে কাতর হয়ে থাকি। তুমি এখন আমার প্রয়োজন না, তুমি আমার ভালোবাসা; প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়, ভালোবাসা শেষ হয় না। তুমি আমার নিজের মানুষ। একান্তই নিজের মানুষ। নিজের মানুষ সেই যার কারণে নিশ্চিন্তে শান্তির ঘুম হয়।
মৃদুল বলে, কাচ খুঁজতে খুঁজতে মানুষ হিরা পেলে মানুষ আর কাচ খোঁজে না। তুমি আমার হিরা, অমূল্যের চেয়ে অমূল্য। কাচ না পেয়ে পেয়েছি হিরা, আমার ভাগ্য বড়ো সৌভাগ্যের। কতক্ষণ এভাবে বুকটা দখল করে রাখবে? একটু তো চাও আমার দিকে?
বিভা বলে, তোমার বুকে যে প্রশান্তি পাই কোথায় গেলে পাবো আমি? তোমার বুকের মধ্যখানে থাকলে আমি স্বর্গসুখ পাই।
মৃদুল বলে, আমার ঘরে আসার আগে কখনো কি মনে হয়নি মানুষটা ভালো হবে তো? কখনো কি মনে হয়নি যার ঘরে যাচ্ছি তার মন মানসিকতা কেমন হবে?
বিভা উত্তরে বলে, না তেমন মনে হয়নি। আমি ভেবেছি যে মানুষটা আমাকে গ্রহণ করছে আমাকে জেনে-বুঝেই গ্রহণ করছে। কেউ অসুখী হওয়ার জন্য সংসার গড়তে যায় না। মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো, আমার মানুষটা আমাকে অনেক ভালোবাসবে। তাছাড়া স্বামী কখনো স্ত্রীকে ঠকায়? কখনো কেউ কাউকে ঠকিয়ে নিজে জিততে পারে না। তুমি আমার হাত ধরেছো শুধুমাত্র তো মুহূর্তটুকু উপভোগ করার জন্য না। কোনো পুরুষই তার সঙ্গিনীকে কষ্টে রাখে না, এটাই সত্য। 

মৃদুল বিভার কথা শোনে আর আশ্চর্য হয়। মনের অনুভূতিগুলো কত সুন্দর করে প্রকাশ করতে জানে সে। অথচ সে নিজে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না বলে গুমড়ে মরে। বিভাকে বললো, এত ভালোবাসো কেন? মানুষকে অতিরিক্ত ভালোবাসতে নেই। অতিরিক্ত যত্ন করতে নেই। বেশি বেশি গুরুত্ব দিতে নেই। ভালোবাসা বেশি প্রকাশও করতে নেই। মানুষ অতিরিক্ত পেয়ে গেলে বদলে যায়। মানুষ বদলে গেলে মানুষ ভুলে যেতে চায়। বদলে গেলে দীর্ঘদিনের সম্পর্কও ঠুনকো হয়ে যায়। মানুষ অতিরিক্ত পেয়ে গেলে গুরুত্ব দিতে ভুলে যায়। বেশি ভালোবাসা পেলে ভালোবাসার মর্যাদা রাখে না। 
শুনে বিভা বলে, যে সত্যিকারে ভালোবাসে সে বদলে যায় না। যে সত্যিকার ভালোবাসে সে গুরুত্ব দিতে কার্পণ্য করে না। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ কখনো ছেড়ে যায় না। ভুলে থাকে না। ভুল বোঝে না।হাজারও কষ্টের মাঝে আগলে রাখে। জীবনে যাকে পেয়েছি আমি জানি আমিই তার কাছে পুরো পৃথিবী। হাজারও ব্যস্ততার মাঝে আমি তাই তোমাকেই স্মরণে রাখি, রাখি মনের কোঠরে। 
মৃদুল বলে, কত ভালো তুমি। এমন একজন জীবনসঙ্গীই আমি মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম যে আমাকে পাওয়ার পর আমার ভেতরেই পৃথিবীর সব সুখ খুঁজে পাবে। সৌন্দর্যের মাঝে ভালোবাসা না খুঁজে তুমি ভালোবাসার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজেছো, আর তাই আমার মতো একজন কালো ছেলেকেও কত অনায়াসে গ্রহণ করেছো। কালে বলে সারাটাক্ষণ ভাবতাম হয়তো আমার একজন ভালোবাসার মানুষ জুটবে না। রূপের সৌন্দর্যের অহংকারের কাছে গুণের সৌন্দর্যের পতন। 
বিভা বলে, মনের মানুষটা মনের মতো হতে হয়। সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসা ভুল সিদ্ধান্ত। ভালোবাসার মধ্যেই সৌন্দর্য খুঁজলে জীবনটা রঙিন হয়। পরস্পর পরস্পরের বিশ্বাসে থাকলে আর কিছু লাগে না। প্রত্যেকই জীবনে একজন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি চায়। ব্যক্তিত্ব আর ব্যক্তি মানুষটা ভালো হলে আর কিছু লাগে না। আর আমি কখনো আমার রূপ নিয়ে ভাবিনি। পুরুষ মানুষকে রূপ দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য আটকানো যায়। এজন্য গুণ দিয়ে আটকাতে হয়, মায়া দিয়ে জড়াতে হয়।

দুইদিন পরে বিভার বাবা বিভাকে নিয়ে বাড়ি গেলেন। বাসায় পৌঁছেই মৃদুলকে ফোন করে কান্না করলো বিভা। মৃদুল বললো, এক পাক্ষিক সময়কালের সংসার জীবন আমাদের মাত্র অতিক্রান্ত হলো। এত মায়া আমার জন্য? এত কান্না আমার জন্য।
বিভা বললো, তোমার জন্য মনের মধ্যে খুব মায়া জন্মেছেগো। এক পাক্ষিক অনেক সময়, একদিন হলেও বন্ধন যদি বন্ধনের মতোই হয় তবুও মায়া জন্মে। এ মায়া ঈশ্বর প্রদত্ত।
মুদুল বলে, হয়তো আমার চাওয়াটা পবিত্র ছিলো, তাই তোমাকে পাওয়া। চাওয়াটা পবিত্র হলে পাওয়াটা অনিবার্য। জীবনে সব কিছু ভুলে থাকা গেলেও তোমার মায়া ভরা মুখের কথা ভুলে থাকা যাবে না। থেকো তুমি আমার সাথে ছায়ার মতো লেগে লেগে।

একটু পরেই পাশের বাসা থেকে জেঠিমা এলেন। এসেই বিভার সামনে বিভার মাকে বললেন, জগতে কি আর ছেলে ছিলো না? ওমন একজন কালো ছেলের সাথে তোমার এমন লক্ষ্মীর মতো সুন্দর মেয়েটাকে কেন বিয়ে দিলে? জুড়ে দিলেই জোড়া লাগে?
জেঠিমাকে সমর্থন করে পাশের বাড়ির শ্যামলের বৌ বললো, পয়সার লোভ করেছে বিভার বাবা-মা। ছেলে চাকরি করে, আর কোনো কিছু না ভেবে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিয়েছে। পয়সা তো মেথররেও আছে।
বিভার মা বললেন, নায়কোচিত চেহারার কত ছেলে আছে রিক্সা চালাচ্ছে। মেয়েকে সুন্দর চেহারার রিক্সা চালকের কাছে বিয়ে দেবো? ছেলেটির কর্মগুণ আছে বলেই তার কাছে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। শ্যামলের বৌ বাড়ি যাও, রাত-দিন শ্যামলের সাথে ঝঞ্জাট করো, তুমি এসেছো জ্ঞান দিতে। জগৎ চলে মেধায়, রূপে না। মানুষ কর্মের কারণে মহামানুষও হয়, অমানুষও হয়। সফল মানুষরাই সত্য আর সুন্দর। তোমরা চেহারা দেখো বলে ঠকো, চরিত্র দেখলে জিততে। চেহারা দেখো, আচরণ দেখো না।
শ্যামলের বৌ চলে গেলেও জেঠিমা গেলেন না। বললেন, বুঝলাম ছেলেটির রোজগার ভালো। কিন্তু ওদের কি মানাচ্ছে? কালো, কিন্তু কত কালো! ফরসা আর কালোই কি কখনো মানিক-জোড় হয়? মানিক-জোড় শব্দযুগল কিন্তু অকারণে আসেনি! জুড়ি বা জুটি মানানোর ব্যাপারও আছে। তাছাড়া পরবর্তী প্রজন্মও যদি ওমন কালো হয় কেমন হবে? আগাম না ভেবে কেউ সিদ্ধান্ত নেয়?
বিভার মা জবাবে বললেন, মৃদুল শিক্ষিত, তার সন্তান শিক্ষিত হবেই। আপনার কোন সন্তানটা শিক্ষিত হয়েছে? কালো সন্তানও ভালো, মূর্খ আর বখাটে সন্তানের চেয়ে।
জবাব শুনে মনোক্ষুণ্ণ হয়ে জেঠিমা চলে গেলেন। বিভার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মন এমনই, চারিপাশ দ্বারা প্রভাবিত হয়, আর ভারাক্রান্ত হয়। যার কাছে যাকে ভালো লাগে তার কাছে সেই সুন্দর, নিজেকে শান্ত করে ঘরে গেলো সে।

বিভা এসেছে জেনে বিভার তিনটি বান্ধবী চলে এলো। রজনী উৎসাহের সাথে বললো, এই দেখ্ তোদের বিয়ের ছবি। তোর বরকে চেনায় যাচ্ছে না, রাতের আঁধারের সাথে যেন মিশে গিয়েছে। আর তোর ছবি দেখ্, মনে হচ্ছে আঁধারের মাঝে পূর্ণিমার আলোর বিচ্ছুরণ। এই মানুষটার সাথে থাকলে তোর আত্মসম্মান থাকবে? আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে কারো সাথে থাকার চেয়ে একা থাকাও সম্মানের।
রজনীর কথার সাথে কথা মিলিয়ে দিনা বললো, ঈশ্বর তার সাথে তারই মিলিয়ে দেন যার সাথে যার মিলবে, কথাটি তোর ক্ষেত্রে মিললো না। দাদাবাবুর সাথে থাকতে থাকতে হয়তো ভালো লেগে যাবে, কারণ প্রতিটি হৃদয়েই ভালোবাসা প্রগাঢ় থাকে। কিন্তু তিনি এই যে এত কালো ব্যাপারটা মানা যায় না। ভালোতে ভালোত্ব নাও থাকতে পারে, কিন্তু কালোতে কালোত্ব কমই থাকে। তবুও তোদের জুটিটা মানানসই হলো না।
স্মারণি বললো, তুই সুন্দর ও লম্বা। তোকে অপছন্দ 
করবে এমন পাগল সমাজে নেই। কোথা থেকে এক কৃষ্ণকালো এলো চিল হয়ে, আর তোকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো, মানা যায় না। তোর কপালটা খারাপ। আসলে সুন্দরীদের কপাল সুপ্রসন্ন হয় না। সৌদামিনীর বিয়েও হলো এক কালো ছেলের সাথে। কালো ছেলেগুলোর সুন্দরী মেয়েদের প্রতি এত লোভ কেন?

বান্ধবীরা চলে গেলে বিভা মন খারাপ করে বসে থাকলো। মৃদুল ফোন দিলে বিভা রাগতস্বরে বললো, মন ভালো নেই পরে কথা বলবো।
মৃদুল বললো, আমার সাথে কথা বলে যদি মন ভালো না হয় আর কারো সাথে কথা বলে কভু তোমার মন ভালো হবে না।
বিভা কর্কশকণ্ঠে উত্তর দিলো, তুমি কি মন ভালো করার মেশিন? তুমি আর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাকে বিভ্রান্ত করবে না।

হঠাৎ এমন কথা শুনে মৃদুল হতবাক হয়। সর্পিণীদের খোলস আছে, তাই বদলায়। বিভাকে তাই মনে হচ্ছে।  তাই সে বলে, তোমার কথার ভেতর আমার জন্য কেমন যেন বিতৃষ্ণা। একদিন চোখের আড়ালে না যেতেই ভুলে গেলে সব ভালোবাসা? একদিন না যেতেই বদলে ফেললে নিজেকে? পাল্টে ফেললে বোল? হালকা হাওয়াতেও বদলে ফেলো নিজেকে? ভুলে যাও সব কথা দেওয়া?
বিভা বললো, তুমি তো একজন যোগ্য মানুষ। আমাকে নিজের সাথে জড়াতে কেন এসেছিলে? চেহারা কি যোগ্যতার মাপকাঠি? তুমি নিজেকে কেন একজন যোগ্য নারী থেকে বঞ্চিত করেছো? রূপ ছাড়া তো আমার মাঝে কিছু নেই, অথচ মানুষ তোমাকে ছোটো করছেন। আমার ভাগ্যকে মানুষ দুর্ভাগ্য বলছেন। তুমি নাকি আমার উপযুক্ত নও।

শেষের কথাগুলো শুনে মৃদুল চমকে গেলো। একটু আগেও চেনা মানুষটার আচরণ অচেনা লাগছিলো, কিন্তু এখন চেনা মানুষটার আচরণ চেনার চেয়ে আরও চেনা লাগছে। সে বললো, আমি কখনোই কারো কাছে স্পেশাল ছিলাম না। একমাত্র তুমিই তোমার জীবনে আমাকে স্পেশাল করে নিয়েছো। তোমার কাছে আমি বিশেষ কিছু না হলে তুমি আমার কাছে থাকতে না। তুমি কষ্ট দিলে সহ্য করতে পারবো না।
বিভা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, ওরা সব রূপ দেখে; তোমার গুণ দেখে না, মন বোঝে না। ওরা তোমার বাইরটা দেখে, তোমার ভেতরটা জানে না। আবরণে সুন্দর মানুষ দিয়ে আমি কি করবো যদি মানুষটার ভেতরটা সুন্দর না হয়? নায়কোচিত চেহারা দিয়ে আমি কি করবো, যদি সে নায়কই না হয়! তুমি তো আমার জীবনের নায়ক।
মৃদুল বললো, এজন্য তোমাকে চোখের আড়াল করতে চাই না। নানা মানুষ কুমন্ত্রণা দেন কানে। কবে না জানি এই কুমন্ত্রণায় তুমি ভুলে যাও। সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা আসেন যত্ন করে মন ভেঙে দিতে। অন্যের সুখ যখন সহ্যের বাইরে চলে যায় তখনই এমন করেন তাঁরা। একজনের সুখ অন্যজনের অসুখ, সহ্যাতীত। অন্যের সুখ দেখলেই আসল অসুখ জাগে।

এভাবে একটি দিন আসে সে দিনটাও চলে যায়। প্রতিবেশিনীরা আসেন আর মন ভাঙা কথা বলেন। মন্দ কথা বলতে কেউ কৃপণতা করেন না। ভালো নেই যারা তাঁরাই এমন মন্দ কথা বলতে জানেন। ভালো থাকবেন না তারা যারা এমন অন্যের সম্পর্কে বিষ ঢালেন। 

তিন দিনের মাথায় মৃদুল বিভাকে নিতে এলো। প্রতিশিনীরা জাদুঘরের আশ্চর্য জীব দেখার মতো উৎসুকের সাথে বিভাদের বাড়ি ঝাঁকে ঝাঁকে আসছেন মৃদুলকে দেখতে। যেমন করে নতুন বৌকে দেখতে আসেন গ্রাম্য গৃহিণীরা।  মৃদুলকে দেখেন আর মিটিমিটি হাসেন আর হাত দিয়ে মুখ ঢেকে একে অন্যের কানে কানে কী কী বলেন! বোঝায় যায় কালো ব্যাপারটি নিয়ে সবাই গুঞ্জণরত।

কেশবের মা যুগলের মায়ের উপর রেগে গিয়ে বললেন, পৃথিবীতে কালো রং আছে বলেই সাদা রং এত শোভা পায়। কালো তাতে কী! মনে কালি না থাকলেই হলো। পুরুষের রূপ কি সম্পদ! পুরুষের গুণ হচ্ছে সম্পদ। শরীরের রং দিয়ে কখনো সৌন্দর্য বর্ণনা করা ঠিক না। চেহারা যেমনই হোক মন যেন সুন্দর হয়।
যুগলের মা বললেন, কালো বলেই তো দেরি করেনি, দেখতে এসেই বিয়ে করেছে। কোনো প্রকার মত পরিবর্তনের সুযোগ দেয়নি। বিভার বরের বুদ্ধি আছে। যাহোক, যেটা হয়ে গিয়েছে এখন সেটা মানতে হবে৷ বাবা-মায়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সন্তানকে মনোদুর্ভোগ নিয়ে বাঁচতে হবে।

মানুষের এমন সমালোচনা, কানাঘুষা মৃদুল দেখে। ব্যাপারটা দিনভর এবং প্রতিদিন হচ্ছে। তার খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। যে কালোত্বের কারণে তার প্রতি পরীক্ষার লেখাতে পর্যাপ্ত নম্বর উঠলেও ভাইভায় নম্বর কম উঠেছে, যে কালোত্বের কারণে জব না হতে হতেও একটা জব হয়েছে, যে কালোত্বের কারণে কর্মক্ষেত্রে ফ্রন্টলাইনের কাজে যুক্ত হতে পারে না, যে কালোত্বের কারণে অনেক মেয়েপক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে একটা বিয়ে করতে পেরেছে, সেই কালোত্বের কারণেই সে শ্বশুরবাড়ি অপমানের পর অপমান হচ্ছে। সে আর সহ্য করতে পারলো না। কাউকে কিছু না বলে সন্ধ্যাবেলাতেই শ্বশুরালয় থেকে বের হয়ে পড়লো।

মৃদুলকে না দেখতে পেয়ে বিভা ফোন করলো। ফোন বন্ধ। বাড়ির সবাই জেনে গেলেন মৃদুল কোথাও চলে গিয়েছে। বিভার মা রেগে গেলেন, বিভাকে বললেন, মানুষ দেখতে সুন্দর হলেই সুন্দর আর ভালো হয় না, মানুষের বড়ো পরিচয় তার কর্মে, আচরণে। কারো কথা শুনে মৃদুলকে যদি আঘাত করে থাকিস ভুল করেছিস। পৃথিবীতে আমাদের পর যদি কেউ তোর ভালো চায়, তবে সে মৃদুল। তোর কষ্টে আমাদের পর যদি কেউ কষ্ট পায়, তবে সে মৃদুল। আমাদের পর যদি কেউ তোকে নিরাপত্তা দেয়, তবে সে মৃদুল। মৃদুল ভালো ছেলে। সংসার করতে একজন ভালো মানুষের খুব প্রয়োজন।
বড়দি এসে বললো, মৃদুলের চেহারা নিয়ে কখনো আক্ষেপ করবি না। যার মন যত সুন্দর সে তত বেশি সুন্দর। মৃদুলকে আমরা চিনেছি। সুন্দর মনের মানুষ চিনতে আঁতশ কাচ লাগে না।
বড়দা বললো, ফরসা চেহারার চেয়ে সুন্দর মন অনেক দামি। মনের সৌন্দর্য সুপ্ত থাকে না, স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায়। মৃদুল নম্র আর ভদ্র। তার কথাবার্তা পরিচ্ছন্ন। যার যত সুন্দর ভাবনা সে তত সুন্দর মানুষ, চেহারা তো আবরণ মাত্র। মানুষের সৌন্দর্য চেহারায় থাকে না, থাকে মনে। চেহারার ফোয়ারার চেয়ে ব্যক্তিত্বের মায়া দামি।
বড়দি আবার বললো, মানুষের বড়ো সৌন্দর্য হলো তার চরিত্র। চেহারার অহংকারে মাটিতে পা না পড়লে এক সময় পায়ের নিচে মাটি থাকে না। চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, ব্যাক্তিত্ব থেকে যায়; মৃদুল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। ব্যক্তিত্ব দেখে ভালোবাসতে হয়।

যাকে তাকে ভালোবাসার কথা বলা যায় না। বিভা মাকে, দাদা-বৌদিকে বোঝাতেই পারলো না মৃদুলকে সে কত ভালোবাসে। মৃদুলের হৃদয়টা কত বেশি পরিষ্কার আর সুন্দর সে ছাড়া তো আর কেউ বেশি জানে না। কাউকে ভালোবাসলে রূপ দেখে ভালোবাসতে হয় না, মন বুঝে ভালোবাসতে হয়, সে জানে। যারা সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসে তারা মূলত সৌন্দর্যের পাগল হয়, মানুষটার মনকে বোঝে না। রূপ, টাকা আর ক্ষমতার বাহারকে গুরুত্ব না দিয়ে ভালো মনের জীবনসঙ্গীকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। চেহারা যেমনই হোক, ভালোবাসাটায় আসল। মানুষ মন মানসিকতায় উন্নত আর আচরণে সুন্দর এমন খোঁজে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মনে মনে চেহারায় সুন্দরকেই লালন করে। মনের বা গুণের সৌন্দর্যের খোঁজ কেউ রাখতে চায় না। বেশিরভাগ মানুষ বোকা তাই বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই খোঁজে। কিন্তু বিভা তেমন নয়, সে জানে সৌন্দর্য মুখের আবরণে না, মনে। সুন্দর ব্যবহারই আভরণ। আর তাই পারিপার্শ্বিকতার কারণে যে দিনের আলোতেই বাইরে যেত না, সে সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতেই বের হয়ে পড়লো মৃদুলের উদ্দেশ্যে। বিভার অন্তরের টান দেখে বোঝা যায়, পুরুষ মানুষের সৌন্দর্যে নারী আটকে যায় না, আটকে যায় পুরুষের দায়িত্বে। 

বাড়ি এসে দেখে শুকনো মুখে বসে আছে মৃদুল। বিভাকে দেখতেই দৌঁড়ে এসে বুকে চেপে ধরে বললো, এত রাতে বের হয়েছিলে কেন বাসা থেকে?
বিভা বললো, তুমি যেখানে সম্মান পাও না, সেখানে আমি থাকি কী করে? আর সেখানে যাবো না আমি।
মৃদুল প্রতিউত্তরে বলতে থাকে, বিভা, সবাই আমাকে কালো বলে এতে আমার কষ্ট নেই। সত্যকে মেনে নিতে শিখেছি অনেক আগেই। তুমি সুন্দর বলে তোমাকে বিয়ে করেছি, এটা সত্য। আমি চাইনি আমার সন্তানও কালো হোক, আর সারাটা জীবন আমার মতো নির্যাতিত হোক পরিবেশ দ্বারা। তোমাকে হঠাৎ এবং দ্রুত সিদ্ধান্তে সময়ক্ষেপণ না করে বিয়ে করেছি, এটাও সত্য। যাতে নানা মতের প্রভাবে তোমাদের মত পরিবর্তন না হয়। কী করবো বলো? আমার আচরণ সবার কাছে ভালো লাগে, আবার সবাই-ই বলে কালো হলে কী হবে কথাবার্তা ভালো। আমার দ্বারা আমার মহল্লার অনেকেই উপকৃত হয়, সেই তারাই আবার বলে, কালো হলে কী হবে উপকার করার ইচ্ছা আছে। আমার রেজাল্ট ভালো, সেই দিকে কারো নজর নেই, আমি কালো সেই দিকে সবার ভ্রূক্ষেপ। ভালো চাকরি করি, ভালো রোজগার করি তবুও সেদিকে মানুষের নজর নেই, বলে ইনকাম ভালো তাতে কী কালো তো। ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বড়ো হয়েছি বলেই তোমাকে বিয়ে করেছি আমি। সন্তান মানুষ না হলেও আক্ষেপ করবো না, তবুও আমার সন্তান যেন পরিষ্কার হয়। অবিবেচক সমাজে যোগ্যতার চেয়ে রূপের মূল্য অনেক। রূপদম্ভের কাছে কর্মগুণের পতন এই সমাজ বাস্তবতায়। আমার খুব খারাপ লাগে যেখানে আমি আমার অধস্তনদের আত্মবিশ্বাস জোগাবো, সেখানে আমার নিজেরই আত্মবিশ্বাস শূন্যের কোঠায়, শুধু কালো বলে। মানুষ সৌন্দর্য দেখে, চরিত্র দেখে না। সুন্দর মানসিকতা কেউ দেখে না, সবাই সৌন্দর্যের পাগল। মানুষের মন সদা ছুটে চলে ফরসাপানে। ব্যক্তিত্বের মাধুর্য দিয়েও যে মানুষকে কাছে টানা যায় অধিকাংশই তা বুঝতে চান না। শুধু চেহারায় ভালো বলে তার হাতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বাবা-মা, তবুও আমার কাছে বিয়ে দেননি। কালো টাকা রোজগার করে তার হাতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন, তবুও আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দেননি। কালো যেন রং না, কালো যেন অভিশাপ। কালো বাজারিকে মানুষ পছন্দ করেন, কিন্তু নির্ভেজাল কালো মানুষকে মানুষ অবজ্ঞা করেন। 

বিভা কোনো কথা না বলে মৃদুলের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। সে মৃদুলকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পায় না। মৃদুলও এখন কোনো সান্ত্বনায় ভোলে না। প্রকৃতপক্ষে একজন কালো মানুষ জানে পৃথিবীর নিয়ম আর বাস্তবতা কত কঠিন।



একটু দেখা
   সুব্রত দত্ত

শিলিগুড়ি জংশন স্টেশনে "কাঞ্চন কন্যা এক্সপ্রেস" এসে দাঁড়িয়েছে। নির্দিষ্ট সংরক্ষিত আসন খুঁজে নিয়ে বসে পড়ে দিব্যেন্দু। ট্রেন ছাড়তে কিছুটা সময় নেবে, ইঞ্জিনটাকে ঘুরিয়ে নিতে হবে বলে। সকালবেলায় গাড়ি ধরা তার ক্ষেত্রে ভীষণ ঝকমারি। বেশি রাতে ঘুমোয়। তাই লেট রাইজার। "চায়ে" - "চায়ে" হাঁক শুনে দিব্যেন্দু নিচে নেমে চা-বিস্কুট খায়। তাড়াহুড়োয় বাড়িতে কিছুই খাওয়া হয় নি। ট্রেন হুইসল দিতেই সে নিজের আসনে বসে। এবার সে সহযাত্রীদের দেখে নেয় এক ঝলক। মহিলাদের দিকে সে সরাসরি তাকাতে অনভ্যস্ত। ভদ্রলোকই মনে হলো সবাইকে। আসলে এভাবে অচেনা লোকের সাথে সখ্যতায় সে তার লেখার অনেক রসদ খুঁজে পায়। পাশেই একটা বাচ্চা ছেলে বসেছে বাবা মায়ের সঙ্গে। ছেলেটি জানালা দিয়ে গোগ্রাসে দু'দিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে। লোভ সামলাতে না পেরে দিব্যেন্দু কথা শুরু করে,
-তোমার নাম কি?
-শুভ, শুভদীপ ব্যানার্জী।
-বাড়ি কোথায়?
-শিলিগুড়ির আশ্রমপাড়ায়।
-কোন ক্লাস?
-নাইন।
-বাঃ, ভালো। কোথায় চললে?
-নিউ মাল জংশনে নেমে ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে  
  ত্রিবেনীতে যাবো ঘুরতে।
-এত ঘুরে যাচ্ছো কেন?
  এবার শুভদীপের মা উত্তর দিলেন,
-এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে। অন্য ট্রেনের ভিড় এড়িয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে জার্নি করতে এই ট্রেনে আসা। 
শুভ বলে, তাছাড়া সেবকে যদি স্টপেজ দেয়, তাহলে নেমে যাবো। গাড়ির ড্রাইভারকে করোনেশন ব্রিজে আসতে বলবো। সেই সময়টুকু সেবকেশ্বরী কালি মন্দিরটা ঘুরে নেবো।
-বাঃ, সুন্দর প্ল্যান বানিয়ে নিয়েছো। অবসর সময়ে কী করো?
-গল্পের বই পড়ি।
-তাই? বাঃ! 
  
 গুলমা স্টেশন পেরিয়ে গভীর সবুজ অরণ্যের বুক চিরে বিশালকায় এক কেন্নোর মতো গাড়ি ছুটে চলে। বাঁদরগুলো মনে হয় দিব্যেন্দুকেই ভেংচি কাটছে। কয়েকটা ময়ূরের দেখা মিললো। মাঝে মাঝে হাতিরাও রেলপথে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ হয়তো এখনো তাদের ঘুম ভাঙে নি! দিব্যেন্দু বলে,
-কোন ধরনের লেখা ভালো লাগে?
-গোয়েন্দা আর এডভেঞ্চার। ফেলুদা আমার প্রিয়।
-হুঁ। মৃগাঙ্ক গুপ্তের বই পড়েছো?
-হ্যাঁ, গোয়েন্দা দেবেশ আর তার সহকারী পার্থ! 
-দেবেশ আর কার নাম বলতে পারবে?
-হ্যাঁ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।
-তুমিও এসব বই পড়ো? 
   
ইতিমধ্যে গাড়ি সেবক স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ে। শুভ "আসি" বলে বাবা মায়ের সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে নেমে যায়। দিব্যেন্দুও আর উত্তর দেওয়ার সময় পেলো না। সেবকে তো এলাহি কারবার চলছে। বাঁ দিকের পাহাড়ে টানেল খুঁড়ে সিকিমে যাওয়ার রেলপথের কাজ চলছে। তিস্তা সেতু পেরিয়ে পরপর দু'টো অন্ধকার টানেল। সেখান থেকে বেরোতেই আলোর ঝলকানিতে সামনের আসনে বসা ভদ্রমহিলার চোখে চোখ পড়ে যায়। হাল্কা সবুজ রঙের ঢাকাই জামদানী শাড়ি পরনে। প্রসাধনীর আধিক্য নেই। কপালে ছোট্ট লাল টিপ। মার্জিত লিপস্টিকের আভা। স্বচ্ছন্দ আভিজাত্যের প্রকাশ। দিব্যেন্দু বেশ কিছুক্ষণ থেকে তার সহজাত রিফ্লেক্সে বুঝতে পারছিল কেউ তাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। এবার সেই ভদ্রমহিলা বলে ওঠেন,
-আপনি কি দিব্যেন্দু সেন?
-হ্যাঁ, কিন্তু ...
   চন্দ্রানী অতি উৎসাহী হয়ে বলে,
-আমি চন্দ্রানী।
-খুব চেনা চেনা লাগছে। চন্দ্রা...
-সেই যে, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ - ভুলে গে...
-ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আসলে এতদিন পর তো! তা এদিকে কোথায়?
-হাসিমারায় যাবো। স্বামী এয়ারফোর্সের অফিসার। কলকাতায় বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি ছুঁয়ে এলাম রুটিন মাফিক। আর তু...!
 -কি হলো, থামলে কেন?
 -তুমি কোথায় যাচ্ছো?
 -আলিপুরদুয়ারে একটা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে।
-লেখালেখি করো বুঝি?
-ওই একটু আধটু। 

চন্দ্রানী একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে দেখে দিব্যেন্দু মুচকি হেসে বলে,
-ওভাবে কি দেখছো?
-নাঃ, কিছু নয়।
-উঁহু, কিছু তো বটেই!
-দেখছি, তোমার হাসিটা। একই রকম রয়ে গেছে।  ওটা দিয়েই  আমাকে জখম করেছিলে। মনের ভেতরে এখনো সে দাগ রয়ে গেছে।
-কেমন আছো?
-কেউই বোধহয় কোথাও ভালো নেই! তুমি?
-ওই, চলে যাচ্ছে আর কি। তোমার তো খারাপ থাকার কথা নয়!
-হুঁ, মনের বাইরের পাওয়ায় কোনো অভাব নেই।কিন্তু ছোট্ট এক টুকরো খুব মিষ্টি অতীতের আলোটাকে আজও মনে মনে খুঁজে বেড়াই। আজ  পেলাম, কিন্তু অন্য রূপে। আসলে, আমি অতিরিক্ত ভালোবাসা প্রকাশ করে ফেলেছিলাম। তাই এমন অবহেলাই হয়তো আমার প্রাপ্য ছিল!

    দু'দিকের সবুজ নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে বাগরাকোট, ওদলাবাড়ি, ডামডিম স্টেশন এবং  উচ্ছল  লিস, ঘিস, চেল প্রভৃতি পাহাড়ি নদী পেরিয়ে ট্রেন থেমেছে নিউ মাল জংশনে। কামরা অনেকটা খালি হলো। কথা ঘোরাতে দিব্যেন্দু বলে,
-সিঙ্গারা খাবে?
- না, তুমি খেতে পারো। 
-না, ঠিক আছে।
-প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলে?
-নাঃ, এড়িয়ে যাওয়ার কি আছে।
-রবি ঠাকুরের "হঠাৎ দেখা"-য় তবু একটা উত্তর ছিল। "রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।" কিন্তু আমি তোমার মনে না রাখা এক অনামি তারা। "মেঘে ঢাকা তারা।" উত্তর দেওয়ার কেউ নেই!
-উঁহু, ঠিক বললে না। মনে থাকবে না কেন? তবে হ্যাঁ,
  আমাদেরও এই লৌহপথগামিনী শকটে হঠাৎ দেখা হলো!
-লৌহপথগা... বাব্বাঃ, এত কঠিন বাংলা! এর মানে...
-রেলগাড়ি।
  
  চন্দ্রানী খিলখিল করে হেসে ওঠে। আজ এই প্রথম তাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখা গেলো। সেই হাসির যাদুতে দিব্যেন্দুর বুকে চেপে বসা জগদ্দল পাথরটা যেন এক লহমায় সরে গেলো। অনেকটা হালকা বোধ হচ্ছে এখন। দিব্যেন্দু জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবে, সেই চনমনে চঞ্চল মেয়েটি আজ যেন বড়ই শান্ত। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে চন্দ্রানী মাথা নেড়ে বলে,
-তুমি এরকম লাজুক না হলে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো।
-এভাবে বলছো কেন? মাত্র তিন দিন আমাদের দেখা আর কথা হয়েছিল।
-(বিদ্রুপের হাসি মেখে) দেখা! হ্যাঁ, তুমি শুধুই চোখের দেখা দেখেছিলে। আর আমি দেখেছিলামদেখার চোখ দিয়ে। তবু অবহেলায় না ফোটা কুঁড়ির মত ঝরে পড়েছি ধুলোয়।
-তুমি অবশ্য আগেও সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে।
-তাই? তোমার মনে আছে সেসব?

    চন্দ্রানী জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। গাছ, গরু, ছাগল মানুষেরা সব একে একে দূরে সরে যাচ্ছে। সেই পুরোন দিনের কথা, দিব্যেন্দুর জন্য প্রতীক্ষার দিন গুনে যাওয়া - তার মনটাকে তোলপাড় করে তোলে। আর দিব্যেন্দু সেই পুরোন দিনের স্মৃতির জাল হাতড়ে বেড়ায়। সত্যিই সেদিন সেভাবে ভাবেনি সে। তখন সদ্য আশুতোষ কলেজে সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়েছে। শিলিগুড়ির বাড়িতে এসেছে গরমের ছুটি কাটাতে। কলকাতায় ফেরার আগের দিন তার দাদার বন্ধু রঞ্জনদা তার স্ত্রী আর শ্যালিকা চন্দ্রানীকে নিয়ে হাজির। আকাশি রঙের স্কার্ট পরেছে। দু'টো বিনুনিতে তার গোছা চুল বিভক্ত। অসাধারণ ভাবে সাধারণ সাজ। তবে বেশ ছটফটে মনে হলো। আকর্ষণ করার ক্ষমতা রয়েছে। রঞ্জনদার শ্বশুরমশাই প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টেড ছিলেন শিলিগুড়িতে। একসাথে লাঞ্চ সারা হলো। অনেক গল্প শেষে বিকেলে চা-পর্বের পর রঞ্জনদা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি। হঠাৎ চন্দ্রানীর পীড়াপীড়িতে তার বাবার কোয়ার্টারে দিব্যেন্দুকে যেতেই হলো। প্রচুর মিষ্টি আর স্ন্যাক্স প্লেটে সাজানো দিব্যেন্দুর সামনে। মিষ্টিতে তার অভক্তি। চন্দ্রানী তার সঙ্গে এঁটুলীর মতো লেগে রইলো। কলকল করে কত কথা বলে গেলো মহানন্দার স্রোতের মত। স্বল্পভাষী দিব্যেন্দু "হুঁ","হ্যাঁ" বলে কাটিয়ে দেয়। পরের দিন দিব্যেন্দু দার্জিলিং মেইলে ফিরবে শুনে চন্দ্রানীর চোখে আনন্দের বিদ্যুৎ রেখা খেলে যায়। কারণ, একই ট্রেনে তাদেরও কলকাতার টিকিট কাটা! ফেরার সময় চন্দ্রানী তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে হঠাৎ একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল, 
-তুমি গান জানো?
-নাঃ!
-তুমি সত্যিটা বলছো না। তোমাকে দেখলেই বোঝা যায় যে তুমি একজন ভালো গায়ক।

  দিব্যেন্দুর কথা চন্দ্রানী সেদিন বিশ্বাস করে নি। পরের দিন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে মিলিত হয় তারা। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত চন্দ্রানী দিব্যেন্দুর নন-এসি কামড়ার জানালায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বারবার বলেছিল, শেয়ালদায় নেমে দেখা না করে যেন সে না বেরোয়। সকালে পৌঁছে দিব্যেন্দু প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিলো। দেখা হতেই কথার যেন শেষ নেই চন্দ্রানীর। যেন তাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না। দিদি জামাইবাবু তাড়া দিতে থাকে। সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে দিব্যেন্দুর কাছ থেকে কথা আদায় করে নেয় যে, তার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের হস্টেলে সে দেখা করতে যাবে। কিন্তু দিব্যেন্দু ভীষণ লাজুক ছিল বলে মেয়েদের হস্টেলে গিয়ে দেখা করতে যাওয়ার ক্ষমতা হয় নি। তবে মনের খাঁচায় একটা অপরাধবোধ যেন ঘিরে রেখেছিলো বেশ কিছুদিন। তারপর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই সামলাতে গিয়ে ধীরে ধীরে চন্দ্রানী আবছা হতে হতে নদীর স্রোতের মতো দূর থেকে আরো দূরে বিলীন হয়ে যায়।

-কি ভাবছো?
হঠাৎ প্রশ্নে দিব্যেন্দু সম্বিৎ ফিরে পায়।  বলে,
-না, তেমন কিছু নয়।
-এত করে অনুরোধ করার পরেও কেন আমার সাথে দেখা করতে যেতে পারলে না?
-আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি যে...
-বুঝতে পারো নি যে, প্রথম দেখায় কারোর মনে এমন গভীর ভালোবাসা জন্মাতে পারে। তাই না? কি করবো বলো? ভীষণ ভালো লেগেছিল  তোমায়। বিশ্বাস করেছিলাম খুব। তখন যদিএখনকার মত মোবাইল ফোন থাকতো, তাহলে কিন্তু তোমাকে পালিয়ে যেতে দিতাম না।  
-আসলে বিষয়টা এত গভীর ভাবে ভাবার অবকাশ ছিল না। ভবিষ্যৎ তৈরি করাটাই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য।
-কেন, ভালোবাসলে কি ভবিষ্যৎ তৈরি করা যায় না? আমি যে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করে নিয়েছিলাম! সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গিয়েছে। কিন্তু সেই  ভাঙ্গা স্বপ্ন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারি নি। যাকগে, থাক এসব কথা। আজ তোমার দেখা পাওয়াটাই আমার কাছে এক বড় পুরস্কার। আমার এতদিনের উত্তর না পাওয়া প্রশ্নের মুক্তি হলো আজ। আর হয়তো দেখা হবে না কোনদিন! এই দেখো, কথা বলতে বলতে বানারহাট, জলঢাকা ব্রীজ, দলগাঁও স্টেশনও পেরিয়ে এলাম। এরপর মুজনাই স্টেশন, তারপর তোর্ষা নদীর পরেই  হাসিমারায় আমার নামার পালা। ভালো থেকো।
 -দাঁড়াও, তোমাকে একটা উপহার দেবো। নেবে তো?
 -উপহার?
 -হ্যাঁ। আশা করি খারাপ লাগবে না।
 -তুমি কিছু দিলে আমি নেবো না, তা কি হয়?
    
   দিব্যেন্দু তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে লিখে দেয়, "চন্দ্রানীকে - সৌজন্যে মৃগাঙ্ক গুপ্ত
(দিব্যেন্দু সেন)। তারপর বইটা এগিয়ে দেয়। চন্দ্রানী সেটা হাতে নিয়ে বইয়ের নাম দেখে, 
                  মিতালী
                মৃগাঙ্ক গুপ্ত
তারপর মলাট উল্টে টাইটেল পেজে দিব্যেন্দুর কলম দিয়ে লেখাটা পড়ে তার চোখে বিস্ময়ের স্ফুরণ! সে বলে ওঠে,
-তুমিই মৃগাঙ্ক...!
-হুঁ, আমার ছদ্মনাম।
-তুমি এত ভালো লেখো! আমার বাড়িতে তোমার বেশ কিছু বই আছে। আমি পড়ি তো! এটা অবশ্য নেই। সাম্প্রতিক প্রকাশিত, তাই না? ছদ্মনামের মত নিজেকে আমার কাছ থেকেও লুকিয়ে রেখেছিলে!
-ছদ্মনামটা বিশেষ কারণে...
-থাক, আর কারণ দর্শাতে হবে না। একটা অনুরোধ করবো? এবার রাখবে তো?
-ঠিক আছে বলো, অবশ্যই রাখবো। তোমার
  হাসিমারা স্টেশন চলে এলো। তাড়াতাড়ি বলো।
-হুঁ। বলছি, আমাদের নিয়ে একটা গল্প লিখবে? 
-উঁ?
-মানে, তোমাকে আর আমাকে নিয়ে গল্প? সত্যি
  ঘটনাই লিখবে! কি, লিখবে তো?
-আচ্ছা, ঠিক আছে। এবার নিশ্চয়ই কথা
  রাখবো। আর তুমিও ভালো থেকো। সাবধানে
  নেমো।
-অনেক বাজে কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করো
  না।
-না না, মনে করার কি আছে। সময়টা খুব সুন্দর 
  কাটালাম!
-তাই? জানি তুমি আমার কেউ না, তবুও কোনো একটা অবয়বে আমার মনের ঘরে তোমার চলাচল অনুভব করি। তুমি অবশ্য এসব বুঝবে না। ঠিক আছে, আসি। 
  
  চন্দ্রানীর দু'চোখের কোণে মনে হলো স্ফটিকের বিন্দু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সে দরজার দিকে এগোয়। দিব্যেন্দু তার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ট্রেন থামে। চন্দ্রানী নেমে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ায়। ট্রেন ছাড়লে সে হাত আর মাথা নেড়ে বিদায় জানায়। হ্যাঁ, বিদায়! এবার সেটা নতুন করে, জেনে শুনে আর দায়শূন্য ভাবে। দিব্যেন্দু অবশ্য নতুন একটা গল্প লেখার রসদ পেয়ে গেলো। চন্দ্রানী হয়তো মুক্তি পেলো, কিন্তু সে দিব্যেন্দুকে যেন স্মৃতির খাঁচায় নতুন করে বন্দি করে রেখে গেলো। নাঃ, গল্পটা লিখতেই হবে, চন্দ্রানীর জন্য। পাঠকের কেমন অনুভূতি হবে তা সে জানে না। তবে তার নিজের মনটা আজ বেশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। এর থেকে কবে মুক্তি পাবে, কে জানে! রেলগাড়ি ছুটে চলে তার গন্তব্যে, নিয়ম মেনে।






কবিতা 


একটি দীর্ঘ-বেলার গান 
অপর্ণা দেবনাথ

ইষৎ কুয়াশায় সাদা চারপাশ। চারপাশ বলতে কোনো ভৌগোলিক অবস্থান নয়। মন-জমিন। ধূসর সময়ের কাটাকুটি খেলা
এক দীর্ঘ বেলা।

অতীতের কতকত চলমান ছবির মিছিল। স্বাদে, বর্ণে,দৃশ্যে, জীবন্ত। উদার। অকৃপণ। সময়ের ধূলোয় যাবতীয় মালিন্য গেছে ঘুচে। সময় সে যে রহস্যময়!
বড় মোহময়।


উঠোনের এককোণে মাটি-মুখে শিশু। আদুল-গায়ে শৈশব মাখে। মায়ের মুখ যেন সহস্র ঝাড়বাতি!
উনুনে টগবগিয়ে ফুটছে ভাত। সুঘ্রাণ।
অনাগত সময়ের আহ্বান...



দেখা
মৌমিতা চ্যাটার্জী

একদিন তাদের দেখা হল অনন্ত অপেক্ষার পর।
শান্ত বিকেলে তখন নদীর জলে লালের আলতো ছোঁয়া ধরেছে।
ওরা নদীর ধারে, ঘাটের কিনারে জায়গা করে নিল।
সব সুখ অসুখ সরিয়ে মেয়েটির কপাল ছুঁল ছেলেটির বুক,
ছেলেটির ঠোঁট ছুল মেয়েটির কপাল।
জন অরণ্য থেকে অনেক দূরে, 
জীবন থেকে কিছুটা সময়কে থামিয়ে দিল নিজেদের জন্য।
তার অনেকক্ষণ পর…….
মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল - "ফিরে গিয়ে কি করবে?"
ছেলেটি বলল- "এক আকাশ গড়ব তোমার জন্য"।



 জীবনের জলরঙ
    রীনা মজুমদার

ছোট্ট বেলার শখের মোম পেন্সিল
সাদা খাতায় কাটতো আঁকিবুঁকি
 জলরঙে জলছবির স্বপ্ন দেখি 

পাখির দুটি ডানা জয়ের নিশানা
 ইচ্ছে পূরণের উড়ান,
নিবিড় বিশ্বাস ভরে রঙতুলিতে
 এঁকে নিই নীল দিগন্তে উড়ন্ত ডানা

কাঠের ধোঁয়ায় চালের হাঁড়ি
মা'র চোখে সাদা ভাতের আত্মবিশ্বাস 
ধূসর রঙে স্নেহ মায়ায় রঙিন করি
সে ছবি।  মা দেখে বলে, সাবাস !!
আনন্দ যে ঝরে পড়ে, রামধনু রঙ
   মিলিয়ে অশ্রু জলে..

সেই জলরঙে স্বপ্ন আঁকি, দেখি
দুর্গাপ্রতিমার সামনে মা, কাকিমার
সিঁদুর খেলা, প্রবাল রাঙা
  মায়ের তৃপ্ত সুখের মুখ
 
আমার কাছে এই আঁকিবুঁকি-ই 
      জলরঙে আঁকা শ্রেষ্ঠ জলছবি...



তিন
সারণ ভাদুড়ী (পক্ষিরাজ)



নিঃশব্দরা ক্লান্ত আজ
তারা আজ নিশ্চুপ...
পলাশ বনে আগুন লেগেছে ;
ছাই হয়ে পড়েছে আমার হৃদয়।
মৃত্যু উপত্যকায় আমি দাঁড়িয়ে
রক্তের তরবারি নিয়ে লিখছি জীবন কাব্য...
জানি আমি ঝড়ে যাবো এখানে
সমাধি নেবো উপত্যকায়।
মিশে যাবো তোমার মাটিতে
জন্ম নেব তোমার আঙিনায়,
ফুটবো গোলাপ হয়ে...। 




দুটি কবিতা 
দেবারতি দে 

জলাশয় 

ঠিক ভুল না ভেবেই মাটি কাটি
কাটতে কাটতে নেমে যাই নিচে 
মগজ ঝরাই নেশা ঝরাই
ঙ হয়ে ডিগবাজি খায় দেহের খনিজ 
মনটা মাছের মতো একপাক ঘুরে আসে আকাশে 
কয়েকহাত উপরেই আকাশ 
চাইলে নেমে আসে গভীর এই বুকে 
ধীরে ধীরে এভাবেই ভেতরে গড়ে তুলি
একটা জলাশয় 
যেখানে অক্ষর ঋষি সাঁতার কাটে
টলটলে মৌনতায়।


পলাতক রাত

তোমার আমার মাঝখানে নক্ষত্র পরিস্থিতি 
গল্প এগোয় ক্যাটওয়াক ভঙ্গিতে 
বাঁক ঘুরে ঘুরে ঘন্টা জাগে
ঘুমের মধ্যে বাড়ে গাছ
হাঁসের ডানা থেকে সূর্য উঁকি দিতেই 
একলাফে তুমি সোনার হরিণ 
প্যাঁচার ক্ষুধা নিয়ে আমি পড়ে থাকি ঘাসেদের পাতে।



আড়াল 
অসীম  মালিক 

পাঁচিল ঘেরা ঘরের ভেতর , 
জ্বলছে আত্মঅহংকারী মোমবাতি । 
গলন্ত মোম যেন 
তার যাপিত সময়ের লাভা । 
যার আঁচটুকু আড়াল করতেই 
সে বন্ধ রেখেছে ঘরের দরজা , জানলা । 

আসলে সে কৌশলে আড়াল করেছে 
নিজেরই আকাশ । 
আড়াল করতে পারেনি 
                 অন্যের আকাশ ।





সংস্করণ
 সঞ্জয় সরকার                                          

সমাজ সমুদ্র মন্থিত গরল
পান করে নীলকণ্ঠ  সম তুমি।
নীচ ভীরুতার সাধনা? কী সাধে আহ্লাদে আহ্লাদিত? 
তোমাকেও পান করছি
তিক্তবিষন্নতায় ঐ গরলসম।
আশীবিষ দংশিবে জানি,  
কুটিল বিষাক্ত বাষ্প খরজীহ্বায় প্রকাশ তোমার।
তবুও সমাজ বক্ষ হতে হলাহল পান করবো আমি, 
মনুষ্যত্বের আচরণ চাষ করে, 
সোনার ফসল ফলাবো,  কিংবা 
চার পায়ে গৃহবলিভুক গুলিকে
দুপায়ে দাঁড়া করে সুমিষ্ট সন্দেশে 
রুপান্তর করবো।।





পাখি এবং কবি
        উজ্জ্বল পায়রা



কবিদের পাখি হতে হয়---
মুক্ত আকাশ চষে না বেড়ালে হাওয়ায় শব্দ ভাসেনা
পৃথিবীর পরতে পরতে যে আলোর লহর ভাসে,
তাকে গায়ে মাখবে কি করে যদি ডানা না মেলে কবি!

কবিরা যদি পাখি হতে না পারে,
যদি ডানায় স্বাধীন অঙ্ক কষতে না পারে,
তবে তার শব্দ বিহ্বল হয় না
পাখি খাঁচায় বন্দী হলে শুধু শেখা বুলিই আওড়ায়... 





 তোমাকে চাই

 বিরথ চন্দ্র মণ্ডল

তোমার জন্য ছুটতে ছুটতে পিচ্টা গলে জল
তোমার জন্য গ্রামের সকাল বড্ড কোলা হল
দিনের রোদে কেউ বেরোয় না পথে
পুকুর পাড়ে কচ্ছপ খোকা খাবার খোঁজে মরে

তোমার জন্য ফড়িং দাঁড়িয়ে চুড়চুড়িটার ডালে 

তোমার জন্য লাল পিঁপড়ে কামড় দিয়েছে গালে 

একটু অন্যমনস্কতায় বদলে গেছে হাওয়া
হাওয়ার স্রোতে খই উড়ছে চোখটা গেছে খোয়া

আমার স্বপ্ন স্বপ্ন আছে তোমার আছে গাড়ি 

তোমার বাড়ি অট্টালিকা শিফন গাড়ি।





শ্রাবণ দিনে
বিপ্লব গোস্বামী


আজও মনে পড়ে
বৃষ্টি ভেজা ঐ শ্রাবণের দিনে
তোমাকে কিছু একটা দিয়েছিলাম।
একদম জোর করে নয়
তুমি চেয়েছিলে তাই।
আমিও সেদিন খালি হাতে ফিরিনি
তুমি আমায় কিছু একটা দিয়েছিলে।
কিন্তু কবে কখন তুমি
তোমারটা নিয়ে গেলে 
সহজ সরল আমি বুঝতেও পারিনি।
তাই বলে আমারটা যে ফিরিয়ে দেবে
তা নয়।
যদিও তোমার কাছে তা মূল‍্যহীন !
তবু রেখে দিও অচ্ছিষ্টের মত
মনের একটা কোণে।





বৃষ্টি তুমি
বিজন বেপারী

আজকে আবার নদীর কাছে
কীর্তনখোলার তীরে,
তোমার মুখটা খুঁজছি শুধু
জনস্রোতের ভিরে।

বসে ছিলাম বিকেল বেলা
দেখছি স্রোতধারা,
হঠাৎ এসে গোলাপ দিলে
আমি আত্মহারা।

নামটি তোমার বৃষ্টি ছিলো
দেখতে ভারি মিষ্টি,
তোমার হাসি, আঁখি যুগল
অপরূপ এক সৃষ্টি।

আজকে ভীষণ হৃদয় জুড়ে
ভাবছি তোমায় মনে,
বৃষ্টি তুমি কোথায় আছো
কোন হৃদয়ের কোনে?



তুমি নিজেই কবিতা
মৃত্যুঞ্জয় দাশ শেখর


তুমি নিজেই  কবিতা।
কারও কাছে প্রেমের,
কারও কাছে বিরহের।

তুমি নিজেই  কবিতা।
 রাঙা সবিতা ভোরের 
রূপালি চাঁদ রাতের।

 ঠোঁট গোলাপের পাপড়ি
হাসি বড্ডই মায়াবী 
তোমাতেই  মুগ্ধ কবি।

তুমি নিজেই কবিতা। 
ছলাকলা বুঝি আমি
কষ্টতে  গম্ভীর  তুমি।

 রূপ তো বহতা নদী, 
চোখ তো মনের মাঝি,
দেহের ভাষা তো বুঝি।

তুমি নিজেই কবিতা। 
মনে আসলে জোয়ার,
ছোঁয়া পেতে চাও তার






ছবি



অদ্রিজা বোস  








অনুস্মিতা বিশ্বাস






মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪৩০