শরতের নীল আকাশে এখন সাদা মেঘের আনাগোনা হলেও বর্ষা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি। কিন্তু বাঙালি মন নেচে উঠেছে আসন্ন শারদীয়া উপলক্ষে। শুরু হয়েছে অধীর আগ্রহে দিন গোনা, কবে আসবেন উমা! ইতিমধ্যে চন্দ্রযানের সফল অবতরণ ও সূর্যকে আরও জানবার জন্য আদিত্যর উৎক্ষেপণ আমাদের আনন্দকে বাড়িয়ে তুলেছে। কিন্তু চিন্তার ও উদ্বেগের ভাঁজ আরও বেড়েছে রাজ্যের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরীহ পড়ুয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুতে। মুজনাইয়ের ঘরেও মৃত্যুর আকস্মিক থাবা স্তব্ধ করেছে সবাইকে। আমাদের প্রিয় বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী দেবব্রত (পুটন) ঘোষকে হারিয়ে আমরা শোকবিহ্বল।
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
প্রচ্ছদ ছবি - আন্দামানের চাথাম দ্বীপ/ শৌভিক রায়
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪৩০
ক্রোড়পত্রে আছেন যাঁরা
গৌতমেন্দু নন্দী, জয়িতা সরকার, দেবর্ষি সরকার,
অরুণ কুমার, কবিতা বণিক, দেবাশিস ভট্টাচার্য
মুজনাই অনলাইন ভাদ্র সংখ্যা ১৪৩০
আদিমতার চিহ্ন
জয়িতা সরকার
স্থাপত্য-ভাস্কর্য কিংবা ক্ষয়িষ্ণু ঐতিহ্য যেমন ইতিহাসকে ছুঁয়ে থাকে, তেমনি প্রকৃতির মাঝেও আছে প্রাচীণতার হাতছানি। শুধুমাত্র রাজা-রাজ্যপাট কিংবা ইংরেজ রাজত্বকালের যুদ্ধ-চুক্তি-নির্মাণের সাক্ষ্য নয়, এই ইতিহাস আদিমতার,এই চিহ্ন প্রস্তর যুগের। নব্য প্রস্তর যুগের মানবতার এমনই এক সাক্ষরের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ হল আমাদের।
একদিকে নীল সমুদ্র, অন্যদিকে সবুজে মোড়া পাহাড়, তারই মাঝে জঙ্গল পাহাড়ে ঘেরা এক গুহাচিত্রের ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে সেজে উঠেছে ভগবানের নিজের দেশ কেরালা। আলেপ্পির ব্যাক ওয়াটার কিংবা মুন্নারের সবুজ গালিচার সঙ্গে রীতিমত টেক্কা দেবে প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য হয়ে থাকা এডাক্কাল গুহা। কেরালার ওয়ানাড জেলার অম্বুকুট্টিমালা পাহাড়ে অবস্থিত এই গুহা ক্রমেই পর্যটন মানচিত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করছে। গুহার গুরুত্ব বেড়েছে গুহাচিত্রের নিদর্শন মেলায়। যা প্রমাণ করে প্রায় আট হাজার বছর আগে এই গুহায় মানুষের বসবাস ছিল। গুহার দেওয়ালের বিভিন্ন চিহ্ন প্রমাণ করে সময় অনুক্রমে মানুষের বসবাস ছিল এখানে।
আদিমতা কিংবা ইতিহাস নয়, পৌরাণিক কাহিনীও জড়িয়ে রয়েছে এই গুহা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে। লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী হল, লব-কুশের ধনুকের ঘায়ে বিশালাকার পাথর দ্বিখণ্ডিত হয়ে এই গুহা তৈরি হয়েছে। সৃষ্টির ইতিহাস যাই হোক, পুরাতত্ত্ব বিভাগের কাছে বেশ গুরুত্ব রয়েছে এই এডাক্কাল কেভ-র। গুহার দেওয়ালে মানুষ-জীবজন্তুর খোদাই করা চিহ্ন যেমন প্রস্তর যুগের সাক্ষ্য বহন করছে, তেমনি সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সংযোগ রয়েছে ' A man with a jar cup' এর চিত্রও স্পষ্ট গুহার দেওয়ালে। এই চিত্র নিয়ে নানা মত রয়েছে পুরাতত্ত্ববিদদের মধ্যে। উত্তরের হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে দক্ষিণের দ্রাবিড় সভ্যতার সাংস্কৃতিক ব্যাপনই হয়ত এই চিত্রের প্রেক্ষাপট। তবে শুধুমাত্র এই সাংকেতিক চিহ্ন নয়, রয়েছে তামিল ও ব্রাহ্মী লিপিরও সাক্ষর রয়েছে কেরালার জঙ্গলে ঘেরা এই গুহার আড়ালে।
Fred Fawcett, ১৮৯০ সালে শিকার করতে এসে এই গুহার সন্ধান পান। পরবর্তীকালে বারবার গুহাচিত্র নিয়ে গবেষণা করেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে কেরালার অফবিট জায়গাগুলোর অন্যতম এই এডাক্কাল কেভ। ওয়ানাড ভ্রমণের তালিকায় অবশ্যই প্রথমসারিতে এই গুহা। তবে কেভে পৌঁছতে হলে বেশ খানিকটা পথ চড়াই পেড়িয়ে পৌঁছতে হবে। পার্কিং থেকে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে অনেকটা। তবে গুহায় প্রবেশের আগে পাহাড় থেকে নীচের প্রকৃতির যে রূপ তা এক নিমিষেই দূর করবে সব ক্লান্তি।
পরিচিত কেরালার ভ্রমণের সঙ্গে অবশ্যই জুড়ে নেওয়া যেতে পারে ওয়ানাডকে। মুন্নারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখানেও রয়েছে ধাপে ধাপে সাজানো চা বাগান। রয়েছে সূচিপাড়া ওয়াটারফলস, মীনমত্তু ওয়াটারফলস, বানাসুরা সাগর ড্যাম। পশ্চিমঘাট পেড়িয়ে সমুদ্র সৈকতে সময় কাটাতে চাইলে অবশ্যই সঙ্গে জুড়ে নেওয়া যেতে পারে কোজিকোড় এর বালুকাবেলা। পুজোর ছুটিতে ভিড় এড়িয়ে নতুন জায়গা বেড়াতে চাইলে পা বাড়াতেই পারেন ওয়ানাডের দিকে।
ন্যাওড়াভ্যালীর সবুজ নৈঃশব্দ্যে--- ছাঙ্গে ফলস্
গৌতমেন্দু নন্দী
গাড়ির উইন্ডস্ক্রীনের উপর ওয়াইপার দুটি বৃষ্টিভেজা কাঁচের উপর পরস্পর ক্লক ওয়াইজ ও অ্যান্টি ক্লক ওয়াইজ নিরলস মুভমেন্টে ক্রমাগত যেন অর্ধবৃত্ত আঁকছে আর মুছে চলেছে গাড়ির গতির সঙ্গে।গাড়ির সামনে মাঝখানে বনেটের উপর লাগানো তেরঙ্গা পতাকা বৃষ্টিস্নাত হয়ে পতপত উড়ছে। আর মিউজিক সিস্টেমে লতা মঙ্গেশকরের কন্ঠে বেজে চলেছে " বন্দে মা আ আ আ তারম বন্দেমাতরম....সুজলাং সুফলাং....."
স্বাধীনতা দিবসের বৃষ্টিস্নাত সকালে মীনগ্লাস চা বাগানের মধ্যে দিয়ে গরুবাথান পেরিয়ে বাঁ দিকে বর্ষায় উচ্ছ্বল চেল নদীকে পাশে রেখে ছুটে চলেছি লাভার দিকে। আশপাশ দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটছে বাইক রাইডার, ব্লগাররাও। প্রতিটি বাইকের সামনে তেরঙ্গার উজ্জ্বল প্রর্দশন। "সেন্ট্রিফিউগাল আর সেন্ট্রিপেটাল" ফোর্সের টানাপোড়েনে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে অসংখ্য বাইক। চারপাশের দুর্দান্ত মেঘ-পাহাড়ের প্রাকৃতিক কোলাজ আর পাহাড়ি কালো ময়াল সাপের মতো সর্পিল পথে বাইক বাহিনীর দাপট দেখতে দেখতে গাড়ি এসে থামলো লাভা থেকে তিন কিঃমিঃ আগে রাস্তার গান দিকে একটু এগিয়ে। যেখানে থেকে রাস্তা চলে গেছে ন্যাওড়াভ্যালী ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে কোলাখামের দিকে।
ন্যাওড়াভ্যালী ফরেস্টে প্রবেশের (120 টাকা) টিকিট কেটে এবার গাড়ি লাভার পথ ছেড়ে ডান দিক দিয়ে ভাঙ্গাচোরা উৎরাই পথে চলতে শুরু করল। বন্ধুর পথে ঝাঁকুনির অস্বস্তি নিমেষেই উধাও দুই পাশের বার্চ,পাইন,ফারের ঘন সবুজতায়। পাইনের জঙ্গলের মাঝে মাঝে দুইপাশে ফার্নের শৃঙ্খলিত সবুজ বিন্যাসের মুগ্ধতা নিয়েই 9 কিঃমিঃ ভাঙ্গা, অমসৃণ পথ পেরিয়ে এলাম নেপালি "রাই" সম্প্রদায়ের মানুষের 50-60 টি পরিবার নিয়ে বসতি ও ২০/২২ টি হোটেল ও হোমস্টে নিয়ে গঠিত ন্যাওড়াভ্যালী উপত্যকায় মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত ছোট্ট জনপদ, "Paradise for birds wachers"----কোলাখামে। একপাশে সবুজ পাহাড়ি উপত্যকার নীচ থেকে তখন মেঘ কুয়াশার আস্তরন ক্রমশঃ ঊর্ধগামী।
কালিম্পং থেকে ৩৮ কিমি ও লাভা থেকে ১২ কিমি ৬৫০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কোলাখাম ছেড়ে এগিয়ে চললাম আরও ঘন সবুজের ঠিকানায় "ছাঙ্গে ফলস্"এর দিকে। ছোট ছোট ঝোরা পেরিয়ে বৃষ্টি ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে পথে নির্জন-নৈঃশব্দ্যে মিশে গিয়ে আরও ৫/৬ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করে যেখানে এলাম সেখান থেকে প্রায় ১৫০০ মিটার দূরে এবং খাড়া ৩০০ মিটার নিচে সশব্দে আছড়ে পড়ছে ছাঙ্গে ফলস্। চড়াই -উৎরাই এর এই কষ্টকর পথের মুখে এসে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম উৎরাই পথে নীচে পৌঁছতে পারব কিন্তু তারপর এতোটা চড়াই পথে উপরে উঠতে পারবতো? ট্রেক এর কিছুটা অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই আমাদের চারজনের দল নামতে শুরু করলাম। ফিরতি পথে হাঁপিয়ে ওঠা অল্পবয়সীদের মুখগুলোতে আমাদের মানসিক জোর বাধাপ্রাপ্ত হলেও "চরৈবেতি চরৈবেতি" মন্ত্র নিয়েই এগিয়ে চললাম। "ফলস্"এর প্রায় পাদদেশে পৌঁছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সেই বহুল প্রচারিত প্রবাদটি মনে মনে উচ্চারণ করেই ফেললাম ----
" কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে..."।
দীর্ঘ,বৃহৎ দুধসাদা সশব্দ জলপ্রপাতের বিস্তীর্ণ এলাকাকে বৃষ্টি ছাঁটের মতো জলকনায় সিক্ত করে ৩০০ মিটার উপর থেকে আছড়ে পড়ার দৃশ্যে মুগ্ধ যে হোতেই হয় এবং উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ ও সর্ববৃহৎ "ফলস্" কেন "ছাঙ্গে ফলস্" তাও বোধগম্য হয়ে যায়। জলোচ্ছ্বাসে কিছুটা স্নাত হয়ে পতনের গর্জনকে পিছনে ফেলে শ্বাসবায়ু আর প্রাণবায়ুর মধ্যে সমতা রাখার প্রচেষ্টা নিয়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের বুক চিরে অমসৃণ,বন্ধুর চড়াই পথে বেশ কষ্ট নিয়েই উপরে উঠে এলাম। তবে কষ্টার্জিত এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চাক্ষুষ দর্শনের মুগ্ধতার রেশ কিন্তু থেকেই যাবে।
(প্রয়োজনীয় তথ্য: সরাসরি ছাঙ্গে ফলস্দি নে দিনে দেখে ফিরে আসা যায়। আর কোলাখামে নাইট স্টে করেও ছাঙ্গে ফলস্ সহ আশেপাশে ঘুরে আসা যায়। কোলাখামে উল্লেখযোগ্য হোমস্টেগুলো হোল---পাইন উড রিসর্ট, সাইলেন্ট ভ্যালী রিসর্ট, আরোহী হোমস্টে।)
পুজোয় চলুন মঙ্গলকাব্যের গ্রামে
দেবর্ষি সরকার
কোচবিহার জেলার গোসানীমারী হাই স্কুলের উত্তর পশ্চিমদিকের ঝা পরিবারগুলোকে 'বড় দেহুরী পরিবার' বলা হয়। কোচবিহারের মহারাজা প্রাণনারায়ণের রাজত্বকালে এই পরিবারের পূর্বপুরুষদের সুদূর মিথিলা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়। মহারাজা প্রাণনারায়ন এই মৈথিলী ব্রাহ্মণ পরিবারকে অতিথি হিসেবে কামতেশ্বরী দেবীর পূজা, অর্চনা, শিক্ষা বিস্তার ও সংগীত চর্চার জন্য নিয়ে আসেন।
মহারাজা এই পরিবারকে দেবোত্তর ও ব্রহ্মোত্তর ভূসম্পত্তি দান করেন। সে সময় থেকেই এই পরিবার কামতেশ্বরী দেবীর পূজারী ও সেবাইত হিসেবে কাজ করতে শুরু করে তবে পরবর্তীতে একটি বিশেষ অভিমানে এই পরিবার শুধুমাত্র সেবাইতের কার্যভার সামনে আসছে। বর্তমানে অন্য বেতনভোগী মৈথিলী পুরোহিত নিযুক্ত আছেন। এখন প্রশ্ন হল কেন বা কোন কারনে এই পরিবার পূজার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়! শ্রী প্রদীপ ঝা তার পূর্বপুরুষদের মুখে শোনা সে গল্পটিই বলেছিলেন। গল্পটি নিচে রইলো,
'বড় দেহুরী বংশে কন্যা সন্তান হতো না। বহু বছর পরে বংশে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয় এবং এই কন্যা সন্তান সকলের মধ্যমনি হয়ে বড় হতে থাকে। একদিন সেই কন্যা সন্তানের পিতা কন্যাকে নিয়ে পূজা করতে কামতেশ্বরী ঠাকুরবাড়িতে যান। মেয়েটির পরনে ছিল একটি চেলী। মেয়েটিকে মন্দিরের বাইরে বসিয়ে রেখে তিনি কামতেশ্বরী দেবীর পূজা করতে থাকেন কিন্তু পূজা শেষ করবার পর তিনি দেখেন তার আদরের মেয়েটি নিরুদ্দেশ। সে সময়ে প্রায় নির্জন গোসানীমারীতে বহু খোঁজাখুঁজি করেও আর তাকে পাওয়া যায়নি। তবে মেয়েটির পরনের চেলীটি মন্দিরের মায়ের সিংহাসনের কাছে পাওয়া যায়। এই ঘটনায় অভিমানী পুরোহিত কামতেশ্বরী মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে বলেন মা তোমার পূজা করতে গিয়ে আমি আমার মেয়েকে হারিয়ে ফেললাম তুমি একি করলে মা! আজ থেকে আমার বংশের কেউই আর তোমার পূজারী হিসেবে কাজ করবে না।
এই ঘটনার পর থেকে আমাদের পরিবার শুধুমাত্র সেবায়েত হিসেবে কাজ করে আসছে। পরবর্তীতে এই বড় দেহুরী বুঝতে পারেন যে এই মেয়েটি কোন সাধারণ মেয়ে ছিল না। এই মেয়ে কামতেশ্বরীর অংশ। কথিত আছে একনিষ্ঠ ও নিষ্ঠাচারী এই বড় দেহুরীরা কামতেশ্বরী মায়ের সাক্ষাৎ পেতেন ও মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন।
কামতেশ্বরী ছাড়াও মঙ্গলচন্ডী ও গোসানী দেবী (দুর্গা) এই পরিবারের অন্যতম আরাধ্যা দেবী। কথিত আছে এই গোসানী দেবীর নাম অনুসারেই গোসানীমারীর নামকরণ হয়। এছাড়াও গণেশ, মনসা, শিব, নারায়ন, রাধা কৃষ্ণ গোপাল, বলরাম, সূর্যদেব শুভচন্ডী ইত্যাদি দেবদেবীরও নিত্য পূজা করা হয়। গোসানীমারীর বৃহৎ এলাকা থেকে শুরু করে শীতলখুচির গোলেনাওহাটি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই জমিদারি এলাকা। প্রজাগন প্রতিবছর 'পুণ্যাহ' উৎসবে অংশগ্রহণ করতো এবং জমির খাজনা জমা দিয়ে যেত। এই দিনে বিশেষ ভোজে প্রজাগন খুবই আনন্দ পেত।
কোচবিহারের রাজপরিবারে বড় দেহুরীগণ বিশেষ অতিথির সম্মান পেতেন। তারা রাজসভায় অন্যতম ধর্মীয় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। রতিনাথ ঝা বড় দেহুরী রাজসভায় সংগীত পরিবেশন করতেন। আমাদের বাড়িতে রক্ষিত একাধিক ঐতিহাসিক উপাদান থেকে জানা যায় যে রাজবাড়ী থেকে বড় দেহুরীকে একটি ব্যাচ দেওয়া হতো এবং ওই ব্যাচ পরেই তিনি রাজবাড়ীতে প্রবেশ করতেন এবং রাজদরবারে বিশেষ আসন অলংকৃত করতেন। রাজপরিবারের চিঠি থেকে জানা যায় ডাঙ্গর আই(কামতেশ্বরী দেবী) মাতা বড় দেহুরীর স্ত্রীর জন্য কাপড় ও ফল উপহার হিসেবে পাঠাতেন এবং প্রাপ্তি স্বীকার করবার জন্য অনুরোধ করতেন। '
কোচবিহারের রাজপরিবার তথা কোচবিহারের মানুষের অতিথি এই মৈথিলী ব্রাহ্মণ পরিবার ধীরে ধীরে কোচবিহারের সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে। মৈথিল কবি বিদ্যাপতির ঘরানার আনার এই পরিবার বর্তমানে কোচবিহারকেই নিজেদের 'আপন ঘর' হিসেবে মনে করে এবং কোচবিহারের শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নতি কামনা করে।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে গোসানীদেবী এবং তার পীঠস্থান গোসানীমারীকে কেন্দ্র করে যে গোসানী মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে সে সম্পর্কে প্রথমেই যে প্রশ্নটি মনে হয় তা হলো উনিশ শতকে আদৌ মঙ্গলকাব্য রচনা সম্ভব কিনা ? কেননা ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে প্রায় সমস্ত মঙ্গলকাব্যগুলো লেখা হয়েছে এবং উনিশ শতকে মঙ্গলসাহিত্যের চিরাচরিত ঐতিহ্য চাপা করে নতুন সম্ভাবনাময় সাহিত্য গড়ে উঠেছে। তবে এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ইতিহাসের কোন যুগ বিভাগই অংকের মত একেবারে সুনির্দিষ্ট নয় ফলে এক যুগের মধ্যে আরো একটি যুগ অনেক দূর অবধি মিশে থাকতে পারে। আসলে মধ্যযুগের কৃষিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম সমাজের গতানুগতিক জীবন পরিবেশ সেদিনের সেই যুদ্ধ সংকীর্ণ ক্ষুধা ভয়ের দুঃস্বপ্ন তাড়িত দৈবনির্ভর জীবনযাপন উনিশ শতকে আশা করা যায় না। ফলে যে বিশেষ ধরনের ভাবনা বেদনা মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্য সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছিল তা সাধারণভাবে উনিশ শতকে কল্পনা করাও অসম্ভব। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ কিংবা উনিশ শতকে কোচবিহার রাজ্যের অবস্থা অন্যরকম ছিল। এই অরাজক অবস্থার সম্বন্ধে কবি বলেছেন ,
হইল আকাশ বাণী, পূজা কর মা ভবানী,
পুনঃ হবে রাজ্যের ঈশ্বর।
গোসানী করহ পূজা, সুখে রবে যত প্রজা,
রাজা হবে নাম কান্তেশ্বর।। (পৃ ৭০)
রাজা কান্তেশ্বরের আবির্ভাবের পূর্বে কামতাপুর তথা কোচবিহার রাজ্যের জীবনযাত্রা এবং রাষ্ট্রীয় অবস্থা পর্যালোচনা করলে বিষয়বস্তুটির প্রকৃত তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমানতউল্লা লিখিত কোচবিহারের ইতিহাস দেশের অবস্থা বর্ণনায় বলেছেন -
' সেই সময়ের পার্শ্ববর্তী মুঘল অধিকারের তুলনায় কোচবিহারের অধিবাসীগণের অবস্থা অত্যন্ত হীন ছিল। বহিরাক্রমণ এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগে কোচবিহারবাসীগণ বিত্তহীন হইয়া পড়িয়াছিল, তাহাদের প্রাণের কোন মূল্য ছিল না।' রাজাবিহীন দেশে অরাজক অবস্থায় গোসানীমঙ্গল রচনার ঐতিহাসিক ভিত্তি ভূমির চিত্রও সুস্থ ছিল না। সেই সময়ের যে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তার ফলে প্রজাপুঞ্জের অভাব অভিযোগ শ্রবণের অবসর ও প্রবৃত্তি কারো ছিল না এমনকি প্রজারা রাজস্ব দানের অসমর্থ হলে কাজ কর্মচারীদের অত্যাচারের পরিমাণও বৃদ্ধি পেত। এইসব কারণে বহু প্রজা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। গৃহযুদ্ধ, অপশাসন ,অভ্যন্তরীণ ও বহিঃদেশে গোলযোগের এইসব কথা তৎকালীন বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থের পাতায় লেখা রয়েছে। এই কাহিনীর ভিত্তি হলো আঞ্চলিক ইতিহাস। এই কাহিনীর ঐতিহাসিক কাল যেমন অশান্ত, তেমনি কবি যখন মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণের রাজত্বকালে (১৭৮৩ - ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ) এই কাব্য লিখতে আরম্ভ করেন সেই সময় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক জীবন সুস্থ ছিল না। এই দুটি প্রেক্ষাপট গোসানীমঙ্গল কাব্য রচনায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছে নিঃসন্দেহে। মানুষের প্রতিবাদের ভাষা সেখানে মৌন আত্মশক্তি ও যেখানে ক্ষীয়মান সেখানে এসেছে কাল্পনিক শক্তিশালী দেবতা বা ভগবান। স্বাভাবিকভাবেই দেবতার কাছে বাঞ্ছিত মঙ্গল প্রাপ্তির আশায় দেবমাহাত্ম্যও বর্ণিত হয়েছে যথেচ্ছ ভাবে। ফলে ,সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণেই এই সময়ে মঙ্গলকাব্য লেখা সম্ভব হয়েছে। গোসানীমঙ্গল কাব্যটিও যথার্থ মঙ্গলকাব্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য মন্ডিত বলে দাবি করা যায় এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক বিশেষত্ব উত্তরবঙ্গের সামাজিক ও সাংস্কৃতি ইতিহাসের বিশেষ উপাদান হিসাবে কাব্যটি একটি ভিন্ন গুরুত্ব দাবি করতে পারে।
কোচবিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ বিশ্বসিংহের রাজত্বকালে তার পুত্র সমর সিংহের (শুক্লধ্বজ) আদেশে পীতাম্বর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে যে মার্কন্ডেয় পুরান বাংলায় অনুবাদ করেন সেখানে কবি দেবী দুর্গার নামের পরিবর্তে বহুবার বিভিন্ন রূপে এই গোসানী শব্দটি ব্যবহার করেছেন। সেই সময়েও এই নামটি কবি মহলেও বিশেষ পরিচিত ছিল বলেই অনুমান করা যায়। আমি এখানে কেবলমাত্র একটি নমুনা তুলে ধরলাম -
' সৃষ্টি কালে তেহে সৃষ্টি কারিনী আপুনি।
সেহি সে জন্মায় ত্রিভুবনক গোষানী।।
স্থিতি কালে তেহে স্তিতি কারিনী গোষানী।
সম্প্রতি নরের ঘরে লক্ষ্মী স্বরূপিনী।।'
পদ্মাপুরাণ লেখক নারায়ণ দেবকে অনেকেই উত্তরবঙ্গের মানুষ বলে মনে করে থাকেন। তার লিখিত পদ্মাপুরানে আমরা গোসানী শব্দটির ব্যবহার দেখতে পাই। এখানে মাতা অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন -
'সাসুড়ির স্থানে গিয়া মাগিল মেলানি।
মায়ের অধিক তুমি সাসুড়ি গোসানি।।'
গোসানী নামের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেখা যায় কোন বিশেষ দেবী অর্থে নয়, শুধুমাত্র লৌকিক মাতা অর্থে গোসানী শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। সপ্তদশ শতকের রাজা প্রাণনারায়ণের সভাকবি শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ অনূদিত মহাভারতের আদিপর্বে কুন্তিদেবীকে বলা হচ্ছে -
ক. হিড়িম্বা বদতি মাও সাসুড়ি গোসানি।
তুয় পুত্র মোক মারে কিছু এ না জানি।।
খ. এতকে গোসানি সবে পুত্রক পঠাউক।
রাক্ষষক মারি প্রাণনাথক আনুক।।
এই উদ্ধৃতি দেখে মনে হয় 'মাতা' অর্থেও শব্দটির এতৎ অঞ্চলে পূর্ব থেকেই প্রচলন ছিল। গোসানীমারীতে যে দেবী মন্দির রাজা প্রাণনারায়ন তার রাজত্বের শেষ বছরে নির্মাণ করেন তার দ্বারদেশে সংস্কৃত মিশ্রিত যে বাংলা শ্লোকটি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ১৫৮৭ শত অর্থাৎ ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দ লেখা আছে। আর মন্দিরটিকে বলা হয়েছে 'ভবানী মঠ।' গোসানীমন্দির বলে তা কখনো পরিচিত হয়নি। হলে শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ তার অনুবাদে কোথাও না কোথাও দেরী বা মাতা রূপে গোসানীর উল্লেখ অবশ্যই করতেন। যেমন করেছেন অষ্টাদশ শতকে রাজা উপেন্দ্রনারায়ণের পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত কবি অপর এক শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ। তার মহাভারতের বিরাটপর্বের ভণিতায় তিনি লিখেছেন -
' হেন ভারতের কথা কেবা কৈতে পারে।
মুড় হয়া নিবন্ধিলো গোসানির বরে।।
ভারত সমুদ্র কথা জেন মধু ধার।
রচিল গোসানির বরে কামোতা বেহার।।'
এখানে তিনি স্পষ্ট ভাবেই গোসানী অর্থাৎ চন্ডী দেবীকে নির্দেশ করেছেন, ততদিনে চন্ডীদেবী গোসানীদেবী রূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়ে গেছেন।
কামতাপুরের খেন রাজাদের রাজত্বকাল বিষয়ে সঠিক কোন সন তারিখ পাওয়া যায় না তবে K.L Barua তাঁর Early history of Kamrup গ্রন্থে আনুমানিকভাবে পরপর তিনজন রাজার রাজত্বকালের নিম্নরূপ একটি চিত্র তুলে ধরেছেন।
নীলধ্বজ - ১৪৪০ থেকে ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দ
চক্রধ্বজ - ১৪৬০ থেকে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দ
নীলাম্বর - ১৪৮০ থেকে ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দ
তিনি আরোও লিখেছেন যে নীলাম্বর ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দ হোসেন শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান এমনিভাবে রাজবংশের শেষ প্রদীপটিও নিভে যায়। এদের রাজ্যলাভ ও রাজ্যলোপ নিয়ে এই অঞ্চলে যেসব কিংবদন্তি প্রচলিত ছিল সেগুলো নিয়েই গোসানীমঙ্গলের কাহিনীবৃত্ত গড়ে উঠেছে অথচ এই কাব্য পুরুষানুক্রমিক রাজকাহিনী নয়। কবির কাহিনী কল্পনার নৈপুণ্যে তিন রাজার কাহিনী নিয়ে মালা গাঁথা হয়েছে। প্রেম প্রতিহিংসা ও রাজ্য লোপের অখন্ড বৃত্তান্তে পরিণত হয়েছে। ধর্মাশ্রয়ী কাব্যের মধ্যেও অলৌকিকতা ইত্যাদি স্থান করে নিয়েছে।
বর্তমান মূল মন্দিরের ভেতরে কষ্টিপাথরের নির্মিত পাল যুগের খুব সুন্দর একটি সূর্যমূর্তি আছে। তার মাথার কাছে দুজন অপ্সরা মালাহাতে করে রয়েছেন। সুন্দর শিরোভূষণ সূর্যের মাথায় শোভা পাচ্ছে। দুপাশে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল রয়েছে। দুহাত অভয় এবং বরদানের মুদ্রায় আছে। অঙ্গবস্ত্রহীন দেহে উপবীতটিও তার দেহে বিরাজমান। দু পায়ের মাঝখানে রয়েছে সারথি অরুণ। সপ্ত আশ্বযোজিত একচক্র রথের উপর তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। রথের সাতটি ঘোড়াই পাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে। পায়ের কাছে দুপাশে রয়েছে সঙ্গী ছায়া, রাঙি, প্রভা নামা সূর্যের চার পত্নী। এছাড়াও দু পাশে রয়েছে তীর ধনুক এবং দন্ড হাতে দ্বারী। মূর্তি শিলার চারপাশ অলংকৃত। মূর্তি শিলার দৈর্ঘ্য ২৯ ইঞ্চি, প্রস্থ ১১ ইঞ্চি। এরূপ একাধিক মূর্তি সিতাই শীতলখুচি অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে। কিভাবে এই মূর্তিগুলি এদিকে এলো বা বর্তমানে মন্দিরে এলো তার সঠিক কারণ এখনো উদ্ধার করা যায়নি।
শীতলখুচি অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত কষ্টিপাথরের সূর্যমূর্তি বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতাত্ত্বিক গ্যালারিতে রক্ষিত।
মন্দিরের রক্ষিত বিষ্ণু মূর্তির দৈর্ঘ্য ৩৮ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ১১ ইঞ্চি। সমপদ স্থাপক দন্ডায়মান এই মূর্তিটি পদ্মের উপরে রয়েছে। বিষ্ণুর চার হাতে রয়েছে শঙ্খ চক্র গদা এবং পদ্ম মাথায় অলঙ্কৃত মুকুট দেহে উপকৃত বিষ্ণুর মাথায় দু'পাশে অপ্সরাগন মালা হাতে করে রয়েছেন। পায়ের দুপাশে বড় আকারের লক্ষ্মী, সরস্বতী নামা দুই পত্নী থাকলেও আরো যে দুটি মূর্তি দেখা যায় তারাও কি বসুমতি এবং গঙ্গা, তাঁর স্ত্রী বলে বর্ণিত? মূর্তির পায়ের নিচে দুপাশে দুটি মূর্তি হাতজোড় করে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। এ দুটি কি গরুরের মূর্তি ? এছাড়াও একাধিক শিল্প কারুকার্য আছে।
উত্তরের হিলিং পর্যটন গ্রাম চুইখিম
অরুন কুমার
উত্তরের পর্যটনের মানচিত্রে আগামী দিনে নতুন দিশা দেখাতে চলেছে 'মডেল হিলিং ' গ্রাম চুইখিম’ যেখানে সবুজ প্রকৃতি আর মেঘেদের হাতছানি। অপরূপ এক পাহাড়ী গ্রাম। উত্তরবঙ্গের প্রথম হিলিং ভিলেজ কালিম্পং জেলার চুইখিম গ্রামের কথা বলতে গিয়ে প্রথমে বলতে হয় অতীতের একসময়ে সিল্করুটের ধারের গ্রাম ছিল । যারা এই রেশম পথ ধরে যাতায়াত করতো তারা রাত্রি যাপন করতো এই গ্রামে । অতীতের অজানা এই গ্রাম আজ ধীরে ধীরে তা ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে নানান ভাবে। স্থানীয় সম্পদকে কাজে লাগিয়ে এই গ্রামের মানুষেরা এগিয়ে চলেছে নতুন ধারায়। পর্যটনের ক্ষেত্রে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এই গ্রাম চুইখিম। গরমের দাবদাহের প্রকোপ থেকে বাঁচতে অনেকেই উত্তরের পাহাড়ের ডেস্টিনেশনকে বেছে নেন। আর হাতের কাছে হিমালয়ের কোলের গ্রাম থাকতে অন্য কোনও রাজ্যের কথা চট করে মাথায় আসে না।
জানা গিয়েছে, রাষ্ট্র সঙ্ঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তরফে প্রতি বছর বিভিন্ন দেশের একাধিক পর্যটন কেন্দ্রকে ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’-এর শিরোপা দেওয়া হয়। এ বছর অর্থাৎ ২০২৩ এ সেই শিরোপার দৌড়ে রয়েছে কালিম্পংয়ের ৮টি গ্রাম। যার মধ্যে রয়েছে, নোকদারা,ইচ্ছেগাঁও সুন্দরবস্তি,মুলখাগাড়া, পানবুদাড়া, চুইখিম, রিশপ ও পারেনটারকে ‘মডেল ভিলেজ’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে এমন অনেক পাহাড়ি গ্রাম রয়েছে, যা পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো কালিম্পং জেলার চুইখিম পাহাড়ি গ্রাম। এই চুইখিম- কালিম্পংয়ের কোলে অবস্থিত এই পাহাড়ি গ্রাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। প্রায় ২৫০টি পরিবার নিয়ে গড়ে উঠেছে এই পাহাড়ী গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে লিস নদী। সেখানে গেলেই দেখা যায় হিমালয়ের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রজাপতির ঝাঁক। তাছাড়া চুইখিম শান্ত একটি গ্রাম।
নিউ জলপাইগুড়ি জংশন রেলস্টেশন থেকে প্রায় ৭৫কিলোমিটারের পথ চুইখিম। আবার অন্যদিক থেকে যদি যাওয়া যায় শিলিগুড়ি জংশন হয়ে নিউমাল জংশনে নেমে একটু পিছিয়ে আসতে হবে
৩১নং জাতীয় সড়ক ধরে ওদলাবাড়ি বাগড়া কোট ও তারপর মীনা মোড়। সেখান থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরত্বে করছে অবস্থিত এই চুইখিম গ্রাম।
রাস্ট্রসঙ্ঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তরফে ‘সেরা পর্যটন গ্রাম’-এর শিরোপা পেতে চলেছে প্রকৃতির কোলে উত্তরের কালিম্পঙ জেলার এই পাহাড়ি গ্রাম চুইখিম। নানা রকম পাখির ডাকে ও লিস্ নদীর স্রোতের আওয়াজে এখানে ভোর হয় মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। হিমালয় যেন এখানে তার নিজের আঁচল বিস্তার করেছে পাহাড়ী ঝর্নার আওয়াজে। যারা বর্ষার ভালবাসেন তারা এখানে এলে রাতে শুনতে পাবেন টাপুর টুপুর বৃষ্টির শব্দ।আর দুটি পাহাড়ে এই গ্রামের বিস্তার যার মাঝে মাঝে দেখা দেয় সোনালী রোদের ছোঁয়া। সেই সঙ্গে দেখা মিলবে সবুজ গাছ গাছালির আস্তরণ যেন সবুজ কার্পেট ঢাকা প্রকৃতি। বেলা করালি দূরে চোখে পড়বে লিস্ট নদীর রুপোলি বাঁক। প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি পাহাড়ের গায়ে মেঘের আনাগোনা সোনালী রোদের লুকোচুরি খেলা আপনাকে নিয়ে যাবে প্রকৃতির প্রেমের মোহমায়ার জালে। পাহাড় ঘেরা এই গ্রামে দেখা মিলবেই ছোট ছোট বাড়ি ঘর, রাতে এই বাড়িগুলোর আলো মনে করিয়ে দেবে পাহাড়ের গায়ে যেন ওড়নার চুমকির ঝলকানির ছবি।
সকাল দুপুর বিকেলে উড়ে যাবে নানান রঙের নাম না জানা পাখি ডাক দিতে দিতে। এই গ্রামের আনাচে কানাচে উড়েবেড়ানো নানা বর্ণিল প্রজাপতি, নানান রঙের ফুলে ফুলে সেজে থাকা ছবির মতো বাড়িগুলোকে আপনাকে তাদের আকর্ষণে বেঁধে রাখবে প্রতি মুহূর্তে। এখানে রয়েছে মন্দির দেবী থান,
ক্রশ হিল পাহাড়, বৌদ্ধ মন্দির। গ্রামীণ কৃষি বৈচিত্র্যে ভরপুর দেখতে পাওয়া যাবে কোয়াশ,গুনদরুক, কোদো সহ নানা ধরনের পাহাড়ী শাক, ব্লুম স্টিক,জারবেরা ফুলের বাগান, স্ট্রবেরি, রাসবেরি প্যাশন ফ্রুট জাতীয় পাহাড়ী ফসল। এইভাবে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে গ্রামীণ পর্যটনের আদর্শ গ্রাম চুইখিম ।
সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ নিশ্চিন্তে যাওয়া যেতে পারে চুইখিম। আর যাঁরা চ্যালেঞ্জ ভালোবাসেন তাঁরা বর্ষাতেও যেতে পারেন। গাছপালারা তখন স্নানসুখে ঝলমলে। মেঘ আর কুয়াশায় রহস্যঘন আকাশ-বাতাস। সারাদিন ধরে বাজে বৃষ্টির গান। বর্তমান নিয়ে এখানে তৈরি হচ্ছে এশিয়ান হাইওয়ে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের স্পর্শ করেছে। এই এশিয়ান হাইওয়ে যুক্ত হয়েছে কালিম্পং সিকিমের জেলেপলা চীন সীমান্তকে। এই চুইখিম গ্রাম বড় প্রাণবন্তময়। উত্তরবঙ্গের যে কোন গ্রামের থেকে চুইখিমের ইতিহাস তেমন আলাদা কিছু নয়। এখানকার প্রকৃতিতে আছে পর্যটক আকর্ষণ করার অসীম ক্ষমতা। একটি অঞ্চলের উন্নয়নে পঞ্চায়েতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ফুল ও অর্কিডের শোভা এখন চুইখিমের শরীর জুড়ে। প্রজাপতিরাও মেলেছে রঙিন ডানা। আছে মৌমাছির দল। মধু সংগ্রহে ব্যস্ত হবে তারা বসন্ত এলেই। তার থেকেই মৌচাক ও মধু আহরণ গ্রামবাসীর। প্রকৃতিরানি এখানে সৌন্দর্যের আলপনা এঁকেই ক্ষান্ত নন। মানুষের বেঁচে থাকার আয়োজনও তাঁর ঝুলিতে। বর্ষায় জল উপচে পড়ে ঝর্ণাগুলিতে, সেই জল গড়িয়ে যায় ফসলের খেতে। মাথার উপর নীল আকাশের সামিয়ানা, দূরদূরান্ত পর্যন্ত পাহাড়ের অহংকারী ঊর্ধ্বমুখ। এই ক্যানভাসেই প্রতিদিন লেখা হয় চুইখিমের মানুষের সুখদুঃখের গাথা। পর্যটকদের আগমনে সেই গাথায় বাড়তি রং লাগে।
সারাদিন প্রচুর ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত সবাই। হোমস্টের বারান্দায় জমিয়ে আড্ডা চলছে। একটু আগেই সূর্য অস্ত গেছে। কিছুক্ষণ নিঃসীম অন্ধকার । তারপর সেই অন্ধকার ভেদ করে রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠলো, পুরো আকাশকে জ্যোৎস্না মাখিয়ে। কী অপরূপ সেই অভিজ্ঞতা। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। অপার্থিব এক অনুভূতি ঘিরে ধরলো সকলকে। রাত কাটলো সেই অনুভবকে সাথী করেই। আর তারই রেশ নিয়ে প্রভাতের মুখ দেখা।
চুইখিম হল উত্তরের কালিম্পং জেলার এক নম্বর ব্লকের অন্তর্গত পারবিংটার গ্রাম পঞ্চায়েতেরএকটি গ্রাম। যার আশেপাশে রয়েছে ইয়েলবং বরবট নিমবং পুরনো সিল্করুট রাস্তা হয়ে চলে গেছে কালিম্পং সিকিম হয়ে চীন সীমান্তে পর্যন্ত। এখানে রয়েছে ২০০ টি পরিবারের প্রায় একহাজার জনসংখ্যার কৃষি প্রধান গ্রাম এটি ।এখানে বিভিন্ন ধরনের উৎকৃষ্ট মানের ধান আলু বিভিন্ন ধরনের সবজি যার মধ্যে রয়েছে ফুলকপি বাঁধাকপি কুয়াশ বিন্স রাইসাক বিভিন্ন ধরনের শাক বিন্স করলা কুমড়া, টমেটো, আদা, হলুদ ,বড় এলাচ ব্রুমস্টিক বা পাহাড়ি ঝাড়ু, তেজপাতা, দারুচিনি নানান ধরনের মসলা জাতীয় সামগ্রী উৎপাদিত হয়ে থাকে। এছাড়া রয়েছে স্থানীয় মুরগি হাঁস খরগোশ ভালো প্রজাতির ছাগল দুগ্ধ উৎপাদনে একসময় এই গ্রাম ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ উৎপাদন হয় কিন্তু সেটা ক্রমশ কমে গিয়েছে।। এখান থেকে বুদ্ধডাড়া থেকে লিস্ নদীর আঁকাবাঁকা দৃশ্য কিংবা দেবী থান ফলস ঝরনা আপনাকে মোহিত করবে ।কফি গাঁও লিম্বু ক্রসড দ্বারা এরকম কমলাপুর গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আশেপাশে।
বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ি সন্ধ্যায় ভ্রমণ
কবিতা বণিক
বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি! মেঘেরা জলের ধারা ঢালছে নানান ছন্দে। ঝিরঝির, ঝমঝম! নাচের তালের কত না শব্দ।
পথ, ঘাট সব ভেজা। যেদিকে তাকাই সবই রসময়। গাছেরাও হাওয়ায় দোল খেয়ে তাদের সমস্ত পাতার ফোঁটা ফোঁটারসবিন্দু টুপটাপ ঝরিয়ে দেয়। সমতলের বৃষ্টি , মেঘ, হাওয়ার খেলা নানান ছন্দে হলেও মেঘেদের বড্ড অভিমান। তারানীচে নামবে না কিছুতেই। আবার পাহাড়ে , মেঘেরা ওপরে, নীচে সর্বত্র আনন্দে ভেসে বেড়ায়। সেখানে চলমান মেঘেদেরপাহাড়ের গায়ে গায়ে ভেসে বেড়ানোর যে স্বপ্নের পরীদের মত দেখায় তা দেখতেই গিয়েছিলাম এক বিকেলে পাহাড়ী পথেরবাঁকে বাঁকে কার্সিয়াং, ডাউহিল, চিমনি ইত্যাদি নাম না জানা গ্রামের মধ্য দিয়ে। শুধুই বৃষ্টি উপভোগ করতে। এরই মধ্যেসন্ধ্যের আলোয় জঙ্গলের মধ্যে দুটো হরিণ দেখে মনে হল এই বৃষ্টিতে জঙ্গলের পশুরা নিজেদের
কিভাবে রক্ষা করে? ঈশ্বরসবার জন্যই ব্যবস্হা করে রেখেছেন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে গাছেরাও যেন ঘেঁসাঘেঁসি করে বেড়ে উঠতে চায়। ফার্ণপাতাগুলোর লম্বা হাত যেন সবাইকে ছুঁতে চায়।এমন ঘন সবুজ বনের মধ্যে রাস্তাও নিজেকে হারিয়ে ফেলে। আর মেঘেরাঘন পাইনের বনে ঢুকে বৃষ্টি হয়ে ঝড়বার পথ খোঁজে।পাহাড়ীপথে এক এক বাঁকে এক এক সৌন্দর্য ধরা পড়ে। বৃষ্টি ভেজাপাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য , মেঘের মধ্যে দিয়ে হাঁটা যেখানে কিছুই দেখা যায় না এসব রোমাঞ্চকর অনুভূতি।নীচেরপাহাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে তো ওপরের পাহাড়ে বৃষ্টি নেই। নীচের পাহাড়ে মেঘ জমেছে , মনে হচ্ছে ইন্দ্রপুরীতে বিচরণ করছি। নারদমুনির আশীর্বাদে ঝর্ণার গানের দ্রুত লয়ের সুরের মুর্ছনায় যেন “ তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা” রূপ ধারণ করেছে। সে যে পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা প্রেমদাত্রী! ঝর্ণার প্রেম প্লাবণেই না নদীগুলো পুষ্ট হয়! ধরণী শষ্যশ্যামলা হয়! মানুষেরক্ষুধা মেটাও তুমিই ‘তাপসী অপর্ণা!’ স্বর্গের সুধাকে মর্ত্যে এনে দাও তুমিই ঝর্ণা! বর্ষায় পাহাড় ভয়ঙ্কর হয় আমরা দেখি।
স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখা অনায়াস লভ্য হয় না এটাও যেমন সত্য। তেমনি দেখার পরের সৌন্দর্যানুভূতি অব্যক্তভাবে মনেরগভীরে বর্ণময় হয়ে ধরা থাকে। বৃষ্টি কমতে আবার সদ্যস্নাতার মত দেখতে লাগছিল পাহাড়কে।জল হারিয়ে মেঘেরাওতাদের বৈঠকী আড্ডায় মেতেছে নীল আকাশে। এই সুযোগে সূর্যদেব অস্তাচলে যাওয়ার আগে তার লালিমা ছড়িয়ে দিলেআরও মোহময় করে তুলল সেদিনের সেই মনোরম সন্ধ্যা। পাহাড় জুড়েই কত আঁকাবাঁকা রাস্তা,ঘরবড়ি, একটু একটু করেপাহাড় জুড়ে আলো জ্বলতে শুরু করেছে। সন্ধ্যারাণী বিদায় নিতেই দেখা গেল দূরেলোকমালায় সজ্জিত শিলিগুড়িশহর। এই সৌন্দর্য পাহাড় থেকেই দেখা যায়। নেমে আসলাম নীচে আমাদের ঠিকানায়।
বন্য মনে শারদদেবাশিস ভট্টাচার্য
শারদ এলেই জলদাপাড়ায়
হাতিরা সব নাচে
বানর গুলো কাঠি বাজায়
ঢোল বাদ্যের ধাঁচে
পূজোর ক'দিন আসর বসে
হলং নদীর পাশে
চিলাপাতার হাতি গুলোও
ওই আসরে আসে
ল্যাজ নাড়িয়ে তিড়িং তিড়িং
কাঠবেড়ালি যতো
শাল শিরিষে নাচতে থাকে
চড়ুই পাখির মতো
গন্ডারেরা জলদাপাড়া
শাসন করে বলে
উদযাপনের ক'দিন ওরা
বাবুর ঢঙে চলে
হরিণরা তো নাচে সদাই
যখন খুশী তখন
পুলক জাগে দ্বিগুণ ওদের
দুগ্গা আসে যখন
মাথা মোটা বাইসনেরা
আসর মুখো হয় না
অসুর মনে ওদের নাকি
শারদ খুশী সয় না
ময়ূরীরা আসর সাজায়
পাখনা যাদের ভালো
সন্ধ্যা হলেই জ্বলতে থাকে
জোনাক টুনির আলো
বন্য মনেও শারদ আসে
আগমনীর সুরে
অন্য রূপে দুর্গা আসে
ওদের হৃদয়পুরে।
রসিক বিলের গান পাখিরাদেবাশিস ভট্টাচার্য
রসিকবিলের গান পাখিরা
ভাওয়াইয়া গান গায়
দোতরা ছাড়াই তুফান তোলে
চটকা দরিয়ায়
কদম বনের শান্ত ছায়ায়
দিনের অবকাসে
রসিকপাখি ময়নারা সব
সুরের ভেলায় ভাসে
রসিকবিলে প্রবাস তালুক
পাহাড়ী ময়নার
ভীষন প্রিয় বনবাসী
বালিকা নয়নার
No comments:
Post a Comment