Monday, October 2, 2023


 

সম্পাদকের কথা 

উৎসব প্রিয় এই রাজ্যের সেরা উৎসব আসন্ন। কমবেশি সবাই প্রস্তুত। কিছুদিনের জন্য সব গ্লানি ও কৌলিন্য পেছনে ফেলে মেতে উঠবে সকলে মাতৃ পুজোয়। প্রাত্যহিকতার থেকে এই মুক্তি অবশ্যই কাম্য। যদিও আমরা রয়ে যাই সেই তিমিরেই। এত প্রার্থনা, এত আরাধনাতেও মা তাকান না। কিংবা তাকান। আমরা হয়ত বুঝি না। বুঝি না বলেই নব উদ্যোমে আবার শুরু করি সব। মাতৃ পুজোর শিক্ষা এটাই। হাল ছাড়তে নেই। মা শিখিয়ে যান প্রতি বছর।   



মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩০

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন) 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদ ছবি - শৌভিক রায়  

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩০




সূচি 

সময় - মীরা সরকার
প্রবন্ধ - ডা তাপস চট্টোপাধ্যায়, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, বটু কৃষ্ণ হালদার, সঞ্জয় (এস. সাহা), অভিজিৎ দত্ত
কবিতা - উমেশ শর্মা, সুবীর সরকার, পার্থ সারথি চক্রবর্তী, প্রীতিলতা চাকী নন্দী, কিশোর মজুমদার, অসীম মালিক, পাপু মজুমদার
অন্ত্যমিলের সৃজন - লীনা রায়, দীপাঞ্জন দত্ত, লুবনা আখতার বানু, মজনু মিয়া
অনুবাদ কবিতা - বিলোক শর্মা
মুক্তগদ্য - প্রদীপ কুমার দে, দেবর্ষি সরকার
গল্প - অমলকৃষ্ণ রায়, বাসব বন্দোপাধ্যায়, সম্পা চ্যাটার্জী
অন্য কবিতা - শমিতা রাহা, সুশীল দাস, মিষ্টু সরকার, সৈকত দাম, রাহুল বর্মন
ক্রোড়পত্র - সৌরিক রায়, তমালী দাস, বিপ্লব গোস্বামী, বেলা দে, রীনা মজুমদার, সন্দীপন দাস, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, মাথুর দাস, অলকানন্দা দে, প্রতিভা পাল, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, অদ্রিজা বোস, অজয় অধিকারী, সুস্মিতা ঘোষ, সারণ ভাদুড়ী (পক্ষিরাজ), কবিতা বণিক, ছবি ধর, চন্দ্রানি চৌধুরী, কাকলি ব্যানার্জি মোদক, আকাশলীনা ঢোল, রাজা দেবরায়, চন্দ্রকান্ত সরকার, সুমন্ত সরকার
প্রচ্ছদ ছবি - শৌভিক রায়
স্মরণ ছবি - শৌভিক রায় 
পেন্সিল স্কেচ - রাজর্ষি দত্ত
ছবি - শমিতা রাহা 




স্মরণ 



গান্ধী পার্ক 

পোর্ট ব্লেয়ার 

ছবি- শৌভিক রায় 




সময় 


দিনরজনী কত অমৃত রস
মীরা সরকার

"আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠল আলোকমঞ্জরী- " এই অপূর্ব মন্দ্রমধুর উচ্চারণ যখন বেজে ওঠে শরতের এক কাকভোরে , তখন সারা পৃথিবীর যাবতীয় বাঙ্গালীর চেতনায়, হৃদয়ে জেগে ওঠে অপূর্ব এক শিহরণ। নবীন ঊষার আকাশের পানে সে অনিমেষে চায়। প্রথম আলোর চরণধ্বনি জেগে ওঠে পূর্বদিগন্তে। সে আলো ছড়িয়ে পড়ে আধাঁর আলোয় ভরা আকাশে। রাত্রি তখন এসে মেশে দিনের পারাবারে। শেষবর্ষার জলস্রোতে ধোয়া পবিত্র প্রকৃতিরাণী সেজে উঠেছেন ঘন সবুজ পত্র পল্লবে।নীল আকাশে জলহারা মেঘবালিকারা পালতোলা নাও খুলে যেন ইতঃস্তত ঘুরে বেড়ায়। শুরু হয় বাঙালীর উৎসবের দিন। সূচনা হয় এক অমোঘ আনন্দোৎসবের। রাত প্রভাতের শিশির ভেজা ঘাসের উপর ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য শিউলি। সৌরভে আমোদিত নম্র প্রভাত। উজাড় করা তার নিবেদনে মুগ্ধ প্রণত দশদিগন্ত। গেয়ে ওঠে কবির মন। "শিউলিতলার পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে শিশির ভেজা ঘাসে ঘাসে অরুন রাঙা চরণ ফেলে আমার নয়ন ভুলানো এলে। সেই অবাঙমানসগোচর নয়নভুলানোকে যায় না দেখা। কোন আলোকদীপ্ত প্রভাতে আপনি বয়ে আনে এক পূর্ণতার বাণী সে। ঝুলিভরে দেন শারদলক্ষ্মী ।ধরার খুশী যেন ধরে না। হাসি হয়ে ফুটে ওঠে দিগন্ত বিস্তৃত কাশফুলের বনে। এত আনন্দ কোথায় রাখি প্রভু। কি দেব তোমায় হে আনন্দ ময়? তুমি যা দিয়েছ তাই দেব। "আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ গেঁথেছি শেফালি মালা নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা ।" আসবেন বুঝি শারদলক্ষ্মী তাঁর শুভ্র মেঘের রথে ।নির্মল নীলপথে আমি কি হেরিনু নয়ন মেলে। উৎসব ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতির অন্দরে কন্দরে। ঐযে নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা ? সেই মেঘের ছায়া পড়েছে যেন সারা বনে প্রান্তরে ।মনে হয় এক অনন্ত ছুটির বার্তা এনেছে কেউ এই পৃথিবীর কাছে। এক পাগল বাউল নেচে উঠেছে। গেয়ে উঠেছে "ওরে আজ আমাদের ছুটি রে ভাই ,আজ আমাদের ছুটি।" জলভরা মন্থর নদীর গতি শ্লথ শান্ত ,তৃপ্ত। মেঘ ও রৌদ্রের খেলা চলে তার বুকের পরে , সুখের পরে। এক সাবলীলতায় বয়ে চলা তরী নিস্তরঙ্গ। ভাসে যেন অনন্তকাল।অবাক অন্তর ভাবে " দেখি নাই কভু দেখি নাই আমি এমন তরণী বাওয়া। " সে যেন এক সোনার ধানে ভরা সোনার তরী। মানুষের সব অতৃপ্তি যেন মুহূর্তের মধ্যে পূরণ করে দিতে পারে। কেউ জানে না কে সেই কান্ডারী বয়ে আনে কোন সুদূরের ধন।তার সঙ্গে ভেসে যেতে চায় মন। শান্ত সুন্দর কমনীয় এই আনন্দোৎসবকে মান্যতা দিতে দিক দিগন্তে ,খালে বিলে ,দূর দূরান্তে বেজে ওঠে ঢাক। উদাত্ত সুরে মন পৌঁছে যায় উৎসবের অঙ্গনে। ডাকি মাকে। যাকে দেখে দেখে আঁখি না ভরে। মা কখনো জগজ্জননী ,কখনো বিপদত্তারিণী মা। আবার কখনো রূপ যায় বদলে ।মা হয়ে যান "সা সুকেশা সুকন্যা "। পথ চেয়ে থাকা মা বাবার একান্ত আদরের কন্যাটি। যিনি বৎসরান্তে একবার আসেন পিত্রালয়ে খুশী র আলোয় বদলে দেন প্রতিদিনের ম্লান প্রাত্যহিকতাকে উৎসবের আলোয়। সমবেত অন্তরে গেয়ে ওঠে ধরণী "বাজলো তোমার আলোর বেণু"। আবার করুন আর্তি জানাই "তুমি জাগো।জাগো দুর্গা।" সবাকার মন হতে ভয় ,মালিন্য করো দূর । এই শারদোৎসব উৎস হোক নির্মল আনন্দের। অন্তর ভরে উঠুক আনন্দে। মনের সংকীর্ণতা , দীনতা দূর করো মা। বলতে দাও "বসিয়া আছ কেন আপন মনে স্বার্থ নিমগন কি কারণে" মনের মধ্যে কাঁপে অজানা পাপ।ডুবে যাব না।সেটা এই নম্র শরতের আনন্দের পথ নয়। ওই যে দূর দিগন্তে প্রকাশিত আলোকের ওই ঝরনা ধারা বিভাজিত হতেছে সাতটি রঙের সমুদ্রে। নিরানন্দ মন ,উঠে এসো আজ সবাই মিলে বলি আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে দিনরজনী কত অমৃত রস উথলিছে অনন্ত গগনে। 





প্রবন্ধ 


শিক্ষার মাধ্যম ও ভাষাশিক্ষা এবং সিবিএসই’র জুলাই ২০২৩ বিজ্ঞপ্তি
ডঃ তাপস চট্টোপাধ্যায়

কেন্দ্রীয় শিক্ষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন ( সিবিএসই ) অতি সম্প্রতি ২১শে জুলাই একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন ( CBSE/DIR(ACAD)/2023 July 21, 2023 Circular No: Acad-84/2023 )। সিবিএসই’র অধিকর্তা ড: যোশেফ ইমানুয়েল জানিয়েছেন যে তাদের অনুমোদিত সমস্ত স্কুলে এবং কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় ,নবোদয় বিদ্যালয় সহ দেশের সর্বত্র ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষাদান, পঠন-পাঠন ও মূল্যায়ণ, করতে হবে ভারতের সংবিধনের ৮ম শিডিউলে অন্তর্গত ২২টি ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে। একটা পেপার মাত্র নয় - পুরো শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা, অসমিয়া, ওড়িয়া সহ ২২টি জাতীয় ভাষা। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে এই ২২টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য এনসিইআরটি নির্দেশিত হয়েছে। এই নীতির রূপায়ণ হলে এই রাজ্যে সিবিএসই অনুমোদিত প্রতিটি বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ভাষায় পঠন-পাঠন হবে। খুবই আনন্দের কথা।
কিন্তু এই নীতির রূপায়ণ কি বাস্তবসন্মত ? সিবিএসই’র ২১/৭/২৩ তারিখের সার্কুলারটি পেয়ে এই রাজ্যের সিবিএসই বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ হতচকিত। এই বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞপ্তি পাঠ করে অভিভাবকদেরও মাথায় হাত।  
বর্তমানে ইংরেজী ও হিন্দি মাধ্যমে লেখাপড়া হয় এবং সেইমত শিক্ষক ও অন্য পরিকাঠামো থাকার কথা, কোথাও ভাল বা সন্তোষজনক, কোথাও দূর্বল। এনসিইআরটি রচিত পাঠ্যপুস্তক আছে ইংরেজী ভাষায়। ধরা যাক, ২২টি ভাষাতেই বই পাওয়া যাবে। কিন্তু শিক্ষক ? ভাষাশিক্ষার আধুনিক সরঞ্জাম ও পরিকাঠামো ? এছাড়া, জাতীয় শিক্ষানীতির ৪.১১ -৪.২২ ধারা ( শিক্ষার মাধ্যম ও ভাষা ) অনুসারে সার্কুলারটি আরো দুটি “ভারতীয় ভাষা” শিক্ষার নির্দেশ দিয়েছে এবং বহুভাষা (মাল্টিলিঙ্গুয়াল ) শিক্ষাদানের জন্য প্ররোচিত হতে আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে একটি ভাষা যে সংস্কৃত হতে হবে তা বুঝতে কষ্ট নেই কারন এনইপি ২০২০ এই ভাষার জয়গাঁথায় মুখর। সংস্কৃতকে আবশ্যিক হিসেবে আরোপিত করার অনেক ইঙ্গিত রয়েছে এই নীতিতে। 
হতেই পারে, একটি বিদ্যালয়ে ৫-৬ টি ভাষাভাষী পড়ুয়া আছে। তাঁরা বাধ্যতামূলকভাবে বাংলা ভাষা মাধ্যমে নূন্যতম ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পঠন-পাঠনে উৎসাহিত হবে তো ? অতিরিক্ত দুটি ভারতীয় ভাষা শিখতে হলে ঐ ৫-৬টি ভাষার যোগ্য শিক্ষক নিযুক্ত করতে পারবেন তো কর্তৃপক্ষ ? সংখ্যাটা বছর বছর নতুন ভর্তির ফলে বদলে যেতেই পারে । তার অর্থ, নতুন ভাষার জ্ন্য নতুন নতুন শিক্ষক প্রতি বছরই নিয়োগ করতে হবে। বলা বাহুল্য,মুনাফাগৃধুঁ বেসরকারি সিবিএসই বিদ্যালয়ে এমন অতিরিক্ত অর্থব্যয়ের দায় বর্তাবে সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের উপর – অনেক বেশি ফি ধার্য হবে যেটা বহনের ক্ষমতা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নেই। এক গভীর বিশৃঙ্খলার অশনি সংকেত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
একথা ঠিক, যারা আমরা ভারতে মাতৃভাষা তথা ভাষাগণতন্ত্রের জন্য লড়াই করি তারা একক ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সব জাতীয় ভাষা তথা সংবিধানের অষ্টম শিডিউলে ২২টি ভাষা ও সেই ভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষাদানের দাবি করে আসছিলাম বহুকাল ধরে। নানা অজুহাতে কর্তৃপক্ষ তা অমান্য করে আসছিল। এমন কি আন্দামান ও ঝাড়খন্ডের মতো যেসব রাজ্যের বিদ্যালয়ে এন সি ই আর টি-র বাংলা বই নেই বলে তাদের হিন্দি বই প’ড়ে বাংলায় উত্তর দিতে হত। সেই অভাগা ছাত্র ছাত্রীরা তাদের অপুষ্ট শিক্ষা জীবন শেষ করতে বাধ্য হচ্ছিল । জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতে ২য় মাতৃভাষা বাংলা ভাষার বইও এন সি ই আর টি ( NCERT) ছাপেনি। আর নানা সময়ে এক একটি আইনী অজুহাতে বহু বছরের আইনী পথে বে-আইনী কাজ কেন্দ্রীয় সরকার করে গেছে। কারণ আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের ছেলেমেয়েরা তো প্রধানত ইংরেজি মাধ্যমেই পড়াশুনা করে । নেতারা তাদের ভাষণে মাতৃভাষা প্রেম দেখিয়ে ভোটের বাক্সো ভরে। ফলে ভারতের মতো নানা ভাষা নানা জাতির সম্মেলনে গঠিত এই মহাজাতির সত্যিকার ভাষাগণতন্ত্রের টুঁটি চেপে চেপে এখন তার মৃত্যুর দশা । এই অভিশাপের মোচন যে এই আদেশ নামায় হওয়া উচিত, তা অবশ্য আপাতভাবে স্বীকার্য। কিন্তু উপরোক্ত বাস্তব সমস্যর নিরিখে এই ভাষাগণতন্ত্রের রূপায়ণ কি সম্ভব ?
  
  আমরা জানি, ভাষা শিক্ষার কিছু নির্ণায়ক সূ্র থাকে। যেমন (১) সেই ভাষাকে হতে হবে সজীব এবং একটি বড় অংশের মানুষ যেন সেই ভাষায় কথা বলে (২) সেই ভাষা হতে হবে বোধগম্য এবং বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারকে আয়ত্ত করতে সেই ভাষা সাহায্য করবে (৩) সেই ভাষা আমাদের চাকরি ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। যেহেতু সংস্কৃত আজকের সময়ে মূখ্যত একটি গবেষণার ভাষা, লোকে আর সে ভাষায় কথা বলে না, তাই সংস্কৃত শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার আয়ত্ত করা বা চাকরি ক্ষেত্রে সাহায্য– কোনওটাই সম্ভব নয় এবং সে কারণে এই ভাষার শিক্ষা সময় ও সম্পদ উভয়েরই অপচয়। এই অবস্থায়, কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকারের সংস্কৃত ভাষার প্রসারণের চেষ্টা নিন্দনীয় এবং সাধারণ মানুষের টাকার অপব্যবহার। ভাষা হিসেবে সংস্কৃত সমৃদ্ধ হলেও গ্রিক বা ল্যাটিনের মতো প্রাচীন ভাষাগুলির মতোই বিলুপ্ত। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে, সংস্কৃত ভাষা আরোপ এবং ‘শিক্ষানীতির ভারতীয়করণ’ আসলে রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রায় দু’শো বছর আগে ভারতীয় নবজাগরণের অন্যতম উদগাতা রাজা রামমোহন রায় সংস্কৃত সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘… আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে সরকার হিন্দু পণ্ডিতদের অন্তর্গত সংস্কৃত স্কুল স্থাপন করে জ্ঞান জ্ঞাপনের চেষ্টা করছে। এই ধরনের শিক্ষালয়গুলির বাস্তবিক ক্ষেত্রে সমাজে কোনও গ্রহণযোগ্যতা বা উপকারিতা থাকবেনা। সংস্কৃত শিক্ষা এই দেশকে অন্ধকারে নিমজ্জিত রাখার জন্য সর্বোত্তম উপায় হিসেবে গণ্য হবে’ 
(সূত্র : ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠি, ১১ ই ডিসেম্বর ১৮২৩)।
আমরা জানি ইংরেজী ভাষায় শিক্ষার পক্ষেই আপামর অভিভাবকদের আগ্রহ। লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অভিভাবকরাও বহু কষ্ট সহ্য করে তাদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করেন যেখানে ইংরেজি চর্চার সুযোগ রয়েছে প্রথম শ্রেণি থেকেই। অবাক করার মতো ঘটনা এই যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি আগের শিক্ষানীতির ( ১৯৮৬ /১৯৯২ ) ভাষাশিক্ষার সুপারিশ মেনে তো চলেইনি বরং মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়টিকেও তারা এড়িয়ে গেছে সরকারের নাকের ডগায় বসে। দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ে তারা এই ভাষানীতিকে ঠাট্টায় পর্যবসিত করেছে। ফলে পঠন-পাঠনের মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষা শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেই থেকে গেল যেখানে চূড়ন্ত অব্যবস্থা – শিক্ষক, পরিকাঠামো, পরিচালনা, সর্বব্যাপ্ত দূর্ণীতি ও বিশৃঙ্খলার পাঁকে নিমজ্জিত। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ সরকারি স্কুলগুলিতে প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষা চালুর বিরোধী। ২১শে জলাইয়ের বিজ্ঞপ্তি প্রকারান্তরে পুনরায় ত্রি-ভাষা ফর্মুলার পক্ষেই প্রস্তাব ।
মাতৃভাষা ও ইংরেজি নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত দ্বি-ভাষাতত্ত্বের সুপারিশ ১৯৮৬ থেকে, এমনকি তারও আগে থেকেই শিক্ষাবিদরা জানিয়ে আসছেন। এই ‘দ্বি-ভাষাতত্ত্ব’ অনুযায়ী প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পাঠদানের মাধ্যম হবে মাতৃভাষা এবং ইংরেজি ভাষাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রথম শ্রেণি থেকেই পড়াতে হবে। কারণ ইংরেজি ভাষা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং অবশ্যই তা বিশ্বের সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডারে বিচরণের মূল চাবিকাঠি। এছাড়াও বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। জনস্বার্থের কথা ভেবে এই ‘দ্বি-ভাষানীতি’ প্রবর্তনের পরিবর্তে এ পর্যন্ত সমস্ত ক্ষমতাসীন সরকারগুলি ‘ত্রি-ভাষাতত্ত্ব’ -কে জোর করে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। যে ‘ত্রি-ভাষানীতি’-র সুপারিশ জাতীয় শিক্ষানীতি করেছে, তা বৈষম্যমূলক এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি বঞ্চনার নামান্তর।
 কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি নিবেদন, আপনারা জাতীয় ভাষাগুলির শুকনো নদীতে যদি সত্যি জোয়ার আনতে চান তাহলে আপনাদের আয়ত্তাধীন কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে ও নবোদয় বিদ্যালয়ে এবং অনুমোদিত বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভাষাশিক্ষার পরিকাঠামোর উন্নয়নের বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিন। প্রথমে একটি মেজর ভাষা হিসেবে পড়ানোর জন্য উপযুক্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ, ক্লাশ ঘর সহ সার্বিক পরিকাঠামো প্রস্তুত করুন। তার সিলেবাস ও সেই অনুসারে উপযুক্ত পাঠ্যগ্রন্থাদির ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করুন। তার পর আকাশ থেকে লাফ দিলে শিক্ষামায়ের হাত পা অন্তত রক্ষা পাবে ।
  


বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান ভাবনা ও সমাজ চিন্তা
শ্রাবণী সেনগুপ্ত

এদেশের সমাজ ভাবনাকে আমূল পাল্টে দিতে হলে ধর্ম সংস্কার নয়, প্রাচীন ও অনুশাসন মূলক শিক্ষা পদ্ধতির অনুসরণ নয় ,শিক্ষা নীতির আধুনিকীকরণ জনমানসে  বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার প্রসারই যে একমাত্র পথ একথা উনিশ শতকের পরিবেশে সকলের চেয়ে বেশি অনুভব করেছিলেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৪১ থেকে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত তার কর্মজীবনকে সমগ্র ভাবে পর্যালোচনা করে দেখলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তার জীবনের সাধনা ছিল সমাজ মানুষকে তার প্রাচীন সংস্কার ও অন্ধতা থেকে মুক্ত করে আধুনিক বিজ্ঞাননিষ্ঠ চিন্তার আলোকে চলিষ্ণু করে তোলা। ভাবলে আশ্চর্য লাগে সংস্কৃত ভাষার ও সাহিত্যে যিনি বিদ্যাসাগর হিন্দু দর্শন ও ধর্মশাস্ত্র যিনি সুপন্ডিত, শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি গ্রহণ করেছেন পশ্চিমের আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে। সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যক্রমে তিনি এই বিজ্ঞান চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন। ছাত্রদের জন্য লেখা পাঠ্যপুস্তক 'বোধোদয় 'পদার্থবিদ্যা ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের উপর লেখা , তাঁর 'জীবনচরিত 'গ্রন্থে তিনি বিজ্ঞানীদের জীবনী লিপিবদ্ধ করেছেন সংস্কৃত কলেজের বৃত্তি পরীক্ষায় তিনিই প্রথম বিষয় নির্বাচন করেন- "পদার্থবিদ্যার অনুশীলনে কি কি উপকার দর্শিয়েছে তাহার বর্ণনা কর'। হর্সেলের জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ানোর উপরেও তিনি সমধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। 'জীবনচরিত' গ্রন্থ তিনি রচনা করেন ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে। বিদ্যাসাগর তার পুস্তকের জন্য র নির্বাচন করেছেন তার সব ক্ষেত্রেই প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আত্ম প্রতিষ্ঠার কাহিনী। প্রাচীন সংস্কার ও অন্ধকার বিরুদ্ধে যুক্তি ও বিজ্ঞানের জয়লাভের ইতিহাস।

বিদ্যাসাগরের মনে এই আধুনিক বিজ্ঞানের চিন্তাধারা কিভাবে এলো ১৮২৮খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সামনেই আলাদা একটি বাড়িতে ক্লাস আরম্ভ করেছিলেন ডক্টর টাইটলার অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে কৌতুহলী বালক ঈশ্বরচন্দ্র সুযোগ পেলেই এসব ক্লাসে উপস্থিত হতেন বিদ্যাসাগর দেবেন্দ্রনাথ ,কেশব চন্দ্র ,রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রেফারেন্ড লং,প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল 'দি বেঙ্গল সোশ্যাল সাইন্স অ্যাসোসিয়েশন'। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আকর্ষণের আরেকটি পরিচয় -ডক্টর মহেন্দ্রলাল সরকারের 'দি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশনাল সায়েন্স'স্থাপিত হলে সেখানে তিনি হাজার টাকা দান করেন।১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড পন্ডিত হয়ে এলেন ইংল্যান্ড থেকে যেসব শিক্ষিত ইংরেজ যুবক এদেশের প্রশাসনিক পদে যোগ দিতে আসতেন তাদের ট্রেনিং নিতে হতো। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ইংল্যান্ড ওই সময় সমগ্র ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র নবাগত ওই সিভিলিয়ানরা স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের তথ্য গুলি নিয়ে আসতেন আর বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাদের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল ।আরেকটি উল্লেখ্য ঘটনা হলো ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অত্যন্ত আধুনিক ও মূল্যবান গ্রন্থাগারটি বিদ্যাসাগর হাতে পেয়েছিলেন ।
                                
সংস্কারের প্রস্তাবগুলিতে যে বাদানুবাদের ঝড় বয়েছিল তার মধ্যে থেকে বিদ্যাসাগরের যুক্তির মধ্যে বিজ্ঞান ভাবনা কি পরিমানে উপস্থিত ছিল তার কিছু উদাহরণ-প্রথমেই ধরা যাক 'বাল্যবিবাহের দোষ 'প্রবন্ধটি। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে লেখায় প্রবন্ধে তিনি বাল্যবিবাহের তীব্র নিন্দা করেছেন। আর যুক্তি-
১) "সকল সুখের মূল যে শারীরিক স্বাস্থ্য তা বাল্য পরিণয় প্রযুক্ত ক্ষয় পায়।"
২) অস্মদ্দেশিয়েরা মন্ডলস্কৃত প্রায় সর্বজাতি অপেক্ষা ভীর ু ক্ষীণ দুর্বল স্বভাব এবং অল্প বয়সেই স্থবির দশা পণ্য হইয়া অবসন্ন হয়। বাল্যবিবাহই এ সমুদয়ের মুখ্য কারণ হইয়াছে পিতা মাতার শহর ও দৃঢ় শরীর না হইলে সন্তানেরা কখনো সফল হইতে পারে না।
৩)" বিংশতি বর্ষ অতীত হইলে যদ্যপি উদ্বাহকর্ম নির্বাহ হয় ,তবে বিধবার সংখ্যাও অধিক হইতে পারে না।"
                    
সবশেষে তিনি মানবিক চেতনা সঞ্চারের চেষ্টা করেছেন তাঁর নিবন্ধে- অল্প বয়সে যে বৈধব্য দশা উপস্থিত হয় বাল্যবিবাহিতার মুখ্য কারণ। বাল্যকালে বিবাহ দেওয়া অতিশয় নির্দয় ও নৃশংস কর্ম বিধবা বিবাহ স্বাস্থ্যসম্মত এ কথা শাস্ত্রীয় যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করার পর তিনি সমাজবিজ্ঞানের প্রশ্ন তুলে ধরেছেন,সকলের সামনে এনেছেন মানবতার আবেদন-
         "দুর্ভাগ্যক্রমে বাল্যকালে যাহারা বিধবা হইয়া থাকে তাহারা যাবজ্জীবন যে অসচ্ছ যন্ত্রণা ভোগ করে তাহা জাহাদের কন্যা ভগিনী পুত্রবধূ প্রভৃতি অল্পবয়সী বিধবা হইয়া আছেন তাঁহারা বিলক্ষণ অনুভব করিতেছেন ।কত শত বিধবারা ব্রহ্মচার্য নির্বাহী অসমর্থ হইয়া ব্যভিচার দোষে দূষিত পাপে লিপ্ত হইতেছে এবং প্রতিকূল ও মাতৃকুল কলঙ্কিত করিতেছে ।(হয় নিজের বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব)।
            "আপনারা অন্তত কিয়ৎক্ষণের নিমিত্ত স্থির চিত্তেবিবেচনা করিয়া বলুন... দেশাচারের দাস হইয়া শাস্ত্রের বিরুদ্ধে উপেক্ষা প্রদর্শনপূর্বক বিধবা বিবাহের প্রথা প্রচলিত না করিয়া হতভাগ্য বিধবা দিগকে যাবজ্জীবন অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণাদলে দগ্ধ করা এবং ব্যভিচার দোষের ও ভ্রুণ হত্যা পাপের স্রোত উত্তরোত্তর প্রবল হইতে দেওয়া উচিত, অথবা দেশাচারের অনুগত না হইয়া স্বাস্থ্যের বিধি অবলম্বনপূর্বক বিধবা বিবাহের প্রথা প্রচলিত করিয়া, হতভাগ্য বিধবাদিগের অসহ্য বৈধব্য যন্ত্রণা নিরাকরণ করা উচিত।"(বিধবা বিবাহ ইত্যাদি.... দ্বিতীয় পুস্তক)
                  
যুক্তিহীন প্রথা ও অন্ধবিশ্বাসজনিত লোকাচার সমাজকে যে দুর্গন্ধ বদ্ধ জলায়ে পরিণত করেছিল তা শাশ্বতকারী পরিবেশ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে চেয়েছেন বিদ্যাসাগর। বিধবা বৃদ্ধা ও  দুঃস্থা নারীদের জন্য হিন্দু ফ্যামিলি এনুইটি ফান্ডের প্রতিষ্ঠা ও তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি থেকে সঞ্জাত। সেকালের ভারতবর্ষে এনুইটি ফান্ডের পরিকল্পনার তিনিই পথিকৃৎ। সমাজ মনকে মুক্ত ও  চলিষ্ণু করার এবং ভারতবর্ষের মানুষকে বিশ্বজনীন চিন্তায় প্রাণিত করার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই তাঁর শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষা বিস্তারের কর্মসূচি। এ কথা পরিষ্কার যে ,বেদান্তবাদ বা ব্রম্ভ  চিন্তায় তিনি অভিভূত হননি। তিনি চেয়েছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে  প্রবিষ্ট করতে,বিজ্ঞানের সত্য তার মন থেকে সংস্কার কে দূর করবে। তাই একই সঙ্গে শিক্ষা সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারে কর্মসূচি তিনি গ্রহণ করেছেন। সাধারণ মানুষের মনে শিক্ষার উপযোগিতা কে বোধগম্য করে তোলার জন্য মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের পথকে সুগম করতে চেয়েছেন তিনি। গ্রামে গ্রামে স্থাপন করেছেন বিদ্যালয়। জাতিভেদ ভুলে সকলের জন্য শিক্ষার জগত উন্মুক্ত করেছেন। তাঁর ছাত্র পাঠ্য বইগুলি থেকে- বর্ণপরিচয় ,বোধোদয়, কথামালা, আখ্যান মঞ্জরী ও জীবনচরিতে এনেছেন বিজ্ঞান চর্চা ও আধুনিক ইউরোপের মানবতার দর্শন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের নবাগত সিভিলিয়ানদের কাছে তিনি জেনেছিলেন টম পেইনের যুক্তিবাদ ,বেন্থাম ,হিউম ও মিলের উপযোগবাদ এবং পজিটিভিজম ।বিদ্যাসাগর এদেশে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারার প্রবর্তক ।মানুষ তাঁর কাছে প্রত্যক্ষ এবং মানুষের সেবাই তাঁর কাছে ধর্ম ,মানুষের উন্নতি বিধানে আধুনিক বিজ্ঞান তাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। তাই তাঁর 'মানবতাবোধ ও বিজ্ঞানচেতনা 'একই খাতে প্রবাহিত হয়েছে।



আধুনিকতায় হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো দিনের পূজার গানগুলি 
বটু কৃষ্ণ হালদার

গ্রীষ্মের দাবদাহকে জুড়িয়ে আসে অতি মেদুর মেঘে মেঘ ছায়া বর্ষারানী। বর্ষার আগমনে শুষ্ক রুক্ষ ও পরিবেশ ভাষা খুঁজে পায় ।নতুন প্রাণের সঞ্চার উজ্জীবিত হয় শাখা প্রশাখা য় । শুষ্ক তৃণ নতুন প্রান সঞ্চারে আঁচলখানি মেলে দেয় পরিবেশে। আলো-আঁধারির খেলা মিলিয়ে বর্ষার বিদায়ী সুরে ফিরে আসে বাঙালি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রিয় ঋতু শরৎকাল।নীল সাদা মেঘের ভেলায় বাঙালি মনকে বিমোহিত করে। দখিন বাতাসে তালে তালে মাথা দোলায় সাদা কাশের ফুল ।উড়ন্ত সাদা বকের দল পথ হারায় দিগন্তের সীমানায়। শিউলি ফুলের সুবাস সাদা কাশবনের মৃদু মাথা নোয়ানো জানান দেয় মা আসছেন পূর্ণ ধরাধামে। দূর হতে ভেসে আসে পূজার গান। মহালয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয়ে যায় দেবীর আগমন।"বাজলো রে শানাই", গান দিয়ে শুরু হয় মহালয়া। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহালয়ার স্তব তে বিমোহিত হয়ে যেত উতলা মন। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র তিনি অধিক পরিচিতি লাভ করেন মহিষাসুরমর্দিনী নামক গীতিআলেখ্য গানটি রচনা করে।১৯৩১সাল হতে এখনো পর্যন্ত মহালয়ার ভোরে তারা গীতি আলেখ্য দিয়ে শুরু হয় দেবীর বন্দনা । আকাশবাণী তে যে স্তব শোনার জন্যে হৃদয় ব্যাকুল হয়ে থাকতো মহালয়ার ভোরে, সেই স্তব এর মহিমা এ সময়ে কিছুটা ম্লান। ব্যস্ততম ও কর্মময় জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে হারানো দিনের স্মৃতি গুলোকে।
"এক এক্কে এক,দুই এক্কে দুই, 
নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে
 চন্ডি বাড়ির আট চালাতে কুমোর ঠাকুর গড়ে, 
মন বসে কি আর"সত্যি তো পূজা এলে আর কি ভালো লাগে। গান শুনতে শুনতে পাঠশালাতে আনমনা হয় কত শিশু কান মলা খেয়েছে মাস্টারমশায়ের কাছে,যারা কান মলা খেয়েছে হয়তো সে কথা আজও তাদের মনে আছে। দূর হতে ভেসে আসত এমনই সব পূজার গান গুলো। দূর গ্রাম গ্রামান্তর হতে ঢাকি ভাইরা  ঢাক কাঁসা পাড়ি দেয় শহরে শহরে রুজি-রুটির টানে। এই ঢাক কাঁসা বাজিয়ে তাদের সারা বছর সংসার চলে না। তবুও যুগের পর যুগ প্রাচীন ঐতিহ্যকে তারা কাঁধে করে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে, সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা য় জর্জরিত, তবু ওমহালয়ার আগে থেকে শুরু হয় আগমনীর উৎসব বন্দনা।চারিদিকে সাজ সাজ রব। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মাতৃ সম দেবী দুর্গার আগমন হয় শরৎকাল কে ঘিরে। দীর্ঘ বছর ধরে বাঙালি পরম্পরা বৃত্তাকার ঘুরে চলেছে আপন কক্ষপথে। আশ্বিন কার্তিক মাস এই দুই মাস হলো বাঙালির কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাল । পদ্ম শিউলি কাশফুলের লাবণ্য ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। কোথাও কোথাও শুরু হয় ঢাকের বাদ্য। প্রতি বছরের ন্যায় এ সব কে সঙ্গী করে মা দুর্গা মর্ত্যে আসছেন সপরিবারে।
পদ্ম পিসির চালাতে পাঠশালায় পড়তে বসা শিশুর মন উড়ু উড়ু। এই বুঝি মায়ের চোখ আঁকা হয়ে গেল পুরানো জেটিঘাটের বারান্দায়। মাস্টারমশাই কাছে কান মলা খেয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে পড়ার শেষে দৌড় দেয় মূর্তি গড়ার কাছে। সেকালের পুরানো গান গুলো শুনলে মনে হয় দুর্গাপূজা এসে গেছে। পূজা আসার আগে দূর হতে ভেসে আসত পুরনো দিনের সেই স্মৃতি মেদুর সোনালী গানগুলি।পূজা কটা দিন ভরপুর আনন্দে মেতে উঠতো সবাই।পূজার ওই কটা দিন বাচ্চাদের বই খাতা সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে প্যান্ডেলে কেবল খেলা আর খেলা। তবে বর্তমান এবং অতীত কালের পূজার মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল। সেকালের কলের গান কবে অতীত হয়ে গেছে, তারপর এসেছে ক্যাসেট সিডি ডিভিডি।
রেল লাইন কিংবা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কাশফুলের দোল খাওয়া শিউলিরা জানান দেয় পূজা আর বেশি দূরে নেই। শরতের আলোর বাঁশি বেজে উঠলেই নতুন জামা কাপড়ের সঙ্গে বাজারে এসে যেত আনকোরা সব পূজার গান। হেমন্ত, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, পিন্টু ভট্টাচার্য্য, নির্মলেন্দু চৌধুরী, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকর, আরতি মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নির্মলা মিশ্র সহ স্বর্ণযুগের মত হোক না হোক শ্রীকান্ত আচার্য ও লোপামুদ্রা রাঘব চট্টোপাধ্যায় শুভমিতা নচিকেতার গানের ক্যাসেট বাজারে আসতো। পরিস্থিতি ও প্রযুক্তির ব্যাপক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই পাল্টে গেছে সামাজিক চাহিদা। এখন বাড়িতে বাড়িতে সেট পিস হিসাবে ঠাঁই পেয়েছে ক্যাসেট প্লেয়ার সিডি ডিভিডি প্লেয়ার,মাঝেমধ্যে সেই পুরানো দিনের গান গুলো বেজে উঠলে ও তার পরম আয়ু ফুরিয়ে এসেছে অনেকটাই। এই সময় পুজোর  নতুন গান তো দূরের কথা শারে দিও সিডি ডিভিডি প্রকাশের সংখ্যাও কমে গেছে।বর্তমান সময়ের শিল্পীরা বাংলা ছবিতে নামলেও বেসিক রেকর্ড যাকে বলে আমরা বাংলা আধুনিক গান বলে জানি সেই ধারা ক্রমশ শুকিয়ে আসছে। কেন এই হাল আধুনিক গানের?রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম,অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্তের গানের বাইরে বাংলা গানের ধারা হিমাংশু দত্ত, সুধীন দাশগুপ্ত, সলিল চৌধুরী, শচীন দেব বর্মন,এর হাত ধরে শিখর ছুঁয়েছিল। স্বর্ণযুগের শেষ প্রজন্মের শিল্পী জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এজন্য নতুন প্রযুক্তি কে দায়ী করেছেন।১৯৬৩ সালে সুধীন দাশগুপ্তের সুরে তিনি প্রথম পূজার গান রেকর্ড করেন। সলিল চৌধুরী সুরে গাওয়া "পাগলা হাওয়া" গানটি বাংলা আধুনিক গানের পাঁচ মুক্ত। পাঁচ দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তার জনপ্রিয়তা কমেনি এতটুকু। এই প্রবীণ শিল্পী বলেন আসলে প্রযুক্তির এত দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে যে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে বদলাতে পারছি না।এখন সবার হাতে স্মার্টফোন তাতেই ইউটিউবে গান শোনা যায়। ফলে রেকর্ড কোম্পানিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুরনো গানের সিডি যদি বিক্রি না হয় তাহলে নতুন গানের প্রকাশের ঝুঁকি কিভাবে নেবেন ব্যবসায়ীরা।বর্তমানে অনেক ভালো গান হচ্ছে তবে ব্যবসায়িক দিক দুর্বল হওয়ায় গানের চর্চা মার খাচ্ছে এইসব স্বর্ণযুগের গানের আকর আকাশবাণী কোম্পানিরা "অনুরোধের আসর" এর মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয়তা পেতে। আজ ডিজিটাল যুগেও এসময় নতুন গান প্রচারের জন্য আকাশবাণীর মতো কোনো বিকল্প মঞ্চ নেই। তাই মণ্ডপে বাজে মানবেন্দ্র,নির্মলেন্দু চৌধুরীদের সেই হারানো সুরের গান। এক সময়ে প্রিয় শিল্পীদের গান "অনুরোধের আসরে"শুনবো বলে ছুটির দিনে বেলা আড়াইটার সময় রেডী ওর সামনে গিয়ে বসতাম। বর্তমানে লাগামহীন, ব্যস্ততাময় দুরন্ত গতিতে ছুটছে সময়। তাই রেডিও এখন অতীত।
"পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবো কিরে হায়", সত্যি পুরনো দিনের কথা আজও ভোলা যায় না। এখন আর পূজা প্যান্ডেলে স্বর্ণালী যুগের সেই গানগুলো তেমন শুনতে পাওয়া যায় না। বর্তমানে হিপ পপ, বাংলা রক, বাংলা ব্যান্ড, গানের সাথে সাথে আমরা সবাই মেতে উঠেছি। স্বকীয়তা হারিয়েছে স্বর্ণালী যুগের স্বর্ণালী সৃষ্টিগুলো। তবে প্রয়োজনের তাগিদে সভ্যতা লেগেছে রং, তবে সেটা কি নির্ভেজাল।ভেজাল রং মেখে মেতে উঠেছি মিথ্যা নাটকের মহড়ায়। দিনে দিনে ক্লান্ত হয়ে পড়ছি সবাই।হারিয়ে ফেলেছি চিরাচরিত প্রাচীন রক্ষণশীল সভ্যতা-সংস্কৃতি গুলিকে। প্রাচীন সভ্যতা কে উপেক্ষা করে আমরা যেমন ভুলে গেছি শাড়ি,শাঁখা, সিঁদুরের কথা। সমাজ সভ্যতার মানসিকতায় ভাটায় টান পড়েছে। তাইতো আমরা বলে উঠি,বারো হাত কাপড়ে ও লেংটা। তবে চেষ্টা করলে কি না হয়? আমরা কী আগের মত সেই পূজা পূজা গন্ধ কে ফিরিয়ে আনতে পারি না চিরাচরিত সভ্যতা রক্ষণশীল সংস্কৃতির স্বার্থে।এই স্বার্থেই প্রতিটি পূজা প্যান্ডেলে সবার প্রথমে বাজানো হোক পুরানো দিনের সেই হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণালী গান গুলি কে।এই যুগের জেনারেশন রা তো জানতেই পারলেন না স্বর্ণযুগের মূল্যবান গান ,স্রষ্ঠা,সঙ্গীত শিল্পীদের কথা । পূজা প্যান্ডেল গুলোতে তেমনি গান বাজানো হোক যে গানগুলো শুনেই আবার ফিরে পাবো হারিয়ে যাওয়া পূজা পূজা গন্ধ। পূজার সময় নাই বা হল পূজার গান গুলো যে সমস্ত দিকপাল শিল্পীরা পূজার সময় গেয়েছিলেন একসময় আমাদের জন্য সেগুলি এসময় মণ্ডপে যদি বাজানো হয় তাহলে অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাবে। মায়ের হাতে ডাল ভাত, আলু সেদ্ধ, ঝিঙে আলু পোস্ত যেমন সারা জীবন মুখে লেগে থাকে তেমনি রেস্তোরাঁর বিরিয়ানি, চিকেন কাবাব,চিলি চিকেন, এসব ক্ষণিকের মোহ। তাই এসব ক্ষণিকের মোহ কাটিয়ে আমরা আগামী ভবিষ্যৎ এ ফিরে যাব পুরনো দিনের কথা ও গানে এমন আশা রাখছি এই সমাজের কাছে।



শরতের প্রকৃতি / শিউলি বোঝে মনের মাধুরী কে ....
                  সঞ্জয় ( এস.সাহা )


"আজকে তোমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে " -----  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

শুনেছি, ভারতবর্ষের মুনিঋষিরা শত বৎসর আয়ু প্রার্থনা করতেন -- শুধু শরতের সৌন্দর্য দর্শনের অভিলাষী হয়ে । শরৎ প্রকৃতি অপরূপা, শরৎ ঋতু ষড়ৈশ্বর্য্যময়ী বর্ষণক্ষান্ত লঘু মেঘভার নীল আকাশের বুকে পাল তুলে পাড়ি জমিয়েছে কোন সুদূরের অভিসারে । অতি প্রত্যুষে নিদ্রা জড়ানো আঁখে মেলে শারদের বোধন লগ্নের রূপটি প্রত্যক্ষ করে অভিভূত আমি । নিজের অজানতেই সুর এসেছে কন্ঠে ---- " আমি শরৎ তপনে, প্রভাত স্বপনে, কী জানি পরান কি চায় ।"

শরতের মধ্যে ডুবে থাকে আশ্বিন। ভাদ্র আর  আশ্বিনের মধ্যেই শরতের বসবাস । ভাদ্র শরতের যেসব বিষয় সূচনা পর্বে এনে দেয়, আশ্বিন নিজে তার নিজস্ব আগমনের সময় থেকে তাকে পূর্ণতা দেয় । এই দিক থেকেই আশ্বিন শরতের পরিপূর্ণতার সুহৃদয় । আবার অন্য দিক দিয়ে শরতের জন্যও আশ্বিন বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। অর্থাৎ ভাদ্রের শরতের নিবষ্টতা প্রগাঢ় হওয়ার আগেই আশ্বিনের আগমন বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায় ভাদ্রের স্বপ্নকে আর নিজেকে নিবিড় করে তুলতে সদা সচেষ্ট থাকে আশ্বিন নিজেই । শরতের সুরভিকে জড়িয়ে নিতে ভাদ্র আশ্বিনের উদারতায় বিমুগ্ধ প্রকৃতি । 

নদীমাতৃক বাংলাদেশের সরস আবহাওয়ার গুণে বাঙালি অধিকমাত্রায় ভাবুক । ভাবের ঐশ্বর্যে অন্তর তার পূর্ণ । তাই আমরা "দেবতারে প্রিয় করি আর প্রিয়কে দেবতা" আগমনী গানের সুরে বাউল অভিব্যক্ত করে, "শঙ্খে শঙ্খে  মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে"। 

শিউলি ফুলের সুবাস, সবুজের চিকন শ্যামল সমারোহ, নদী নির্ঝরের তরঙ্গে তরঙ্গে আনন্দের কলগীতি, কাশফুলের শুভ্র চামোর ব্যঞ্জন -- বাঙালি সবচেয়ে বড় উৎসবটি কে সাজিয়ে দিয়েছে মনের মত করে । সরবরে শ্বেতবর্ণ, রক্তবর্ণের অজস্র উৎপল শরতের অরুণ আলোর অঞ্জলিতে চক্ষু মেলে দেবী দশভূজার চরণে আত্মনিবেদনের বাসনায় বুঝি অধীর হয়ে উঠেছে ।  অপরাজিতা ফুলে নীল রঙের অফুরন্ত দাক্ষিণ্য, অনন্ত নীল আকাশের রং বাহার আধুনিক কবির চিন্তায় আসে --- 
"কে দিয়েছে নীল রঙের গামলাটিকে আজ উলটে"।

প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতায় ঋতুর পরিবর্তনকে আমরা সত্যি ঠিকমতো ধরতে পারি না । কখন আশ্বিন আসে আবার কখন যায় শহরে বসে তা বোঝা আরোও কঠিন। তবু শরৎ আসে, আশ্বিন আসে । প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে শরৎ উন্মুখর হয়ে থাকে । শরতের শোভা বৃদ্ধির সাথে সাথে মনের শোভাও  বৃদ্ধি পেতে থাকে সমান তালে। অবশ্য তার জন্য মন থাকা চাই । দু চোখ মেলে দেখার দৃষ্টি থাকা চাই । দুটো ডানা মেলে উড়ে যাবার স্বপ্ন থাকা চাই ।  
কবির কথায় -----

"আজি শরৎ তপনে প্রভাত স্বপনে কি জানি পরান কি চায়"।
     "মন কেবলই চলি চলি করে,
বর্ষার মতো অভিসারে চলা নয়,
                                       তা অভিমানের চলা"


শরতের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য শিউলি ফুল । এ সময় শিউলি ফোটে, শিউলির গন্ধে ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতির ভেতর, প্রকৃতি মেতে ওঠে আনন্দে । শিউলির শরৎ নিয়ে কবিদের মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সবার মনেই শিউলি কম বেশি নাড়া দিয়ে যায় । আশ্বিনের শিউলি আরো প্রিয় হয়ে ওঠে । অসংখ্য উপমা উদ্ধৃতি পাওয়া যায় বাংলা সাহিত্যে । আশ্বিন যেন ব্যাকুল অস্থিরতায় শিউলিকে দিয়ে যায় চিত্তের সান্তনায়। কাজী নজরুল ইসলাম শরতের শাপলা শালুক শিউলিকে রোমান্টিক করে তোলেন--
"শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া,
শিউলি ছোপানো শাড়ি পরে আগমনী-গীত গাহিয়া"।   

শিউলি ফুলের গন্ধ, সাদা মেঘ, শান্ত সরবরে নদী, কাশফুল, ভাদ্রের তাল পাকা গরম সব মিলিয়ে শরতের অপরূপ শোভা সত্যিই মুগ্ধকর। আকাশের গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ আর শরতের পুরোদস্তুর নেমে পড়া প্রকৃতি আনন্দের সুর তোলে হৃদয়ে । এই পরিবেশকে যে যেভাবে উপভোগ করে নিতে পারে নিক ----

   শরৎ তোমার প্রথম শিউলি ফুল 
              ভরিয়ে দিয়েছো আমার দুটি হাত 
     তা দিয়েই আজ আমি গাঁথি  
                                   প্রেমের প্রথম মালা!

      রিম্ ঝিম্ নরম মায়াবি নিশীথে 
                            আঁকি জীবনের জলছবি!
     বাতাসে ভাসছে শিউলি ফুলের গন্ধ 
                    কাশফুলে ছেয়ে গেছে আকাশটা!

শিউলি,গোলাপ,বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী ফুলের সুরভিতে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। বিলে ঝিলে পদ্ম আর নদীর তীরে কাশফুল আশ্বিনের দুয়ারে প্রাণের বার্তা নিয়ে আসে। শরতের পরিবেশ কে নির্মল চোখে দেখে সবাই। বাতাসে শীতের স্পর্শ যেন পাওয়া যায় আশ্বিনের ভোরে । শরতের এই নির্মল প্রকৃতি কারই না ভালো লাগে । এই শরতের প্রত্যুষে অজান্তেই জেগে ওঠে মনের মাধুরীকে। প্রমদ নাথ বিশীর কবিতায় আমরা আশ্বিনের নির্মল রূপকে দেখি, ------
                         " আশ্বিনের নির্মল নদী  
দিগি! জয়ী সম্রাটের কোষনির্মুক্ত তরবারির মত,
                  পাশেই পড়ে আছে 
কাশের রূপালী কাজ করা তার খাপখানা 
                                       সে পদ্মা কবির! "




পরিবেশ দূষণ:কারণ ও প্রতিকার
অভিজিৎ দত্ত 

আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে  প্রিয় গ্রহ পৃথিবী।কেননা এখানেই একমাত্র প্রাণের স্পন্দন রয়েছে।আমাদের প্রাণপ্রিয় এই পৃথিবী আজ সংকটাপন্ন। পৃথিবীর এই সংকটের জন্য দায়ী তার শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। মানুষের চিন্তাহীন কাজ শুধু মানবসভ্যতাকে নয়,পৃথিবীর প্রাণীকুলকে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে।বৈদিক সভ্যতার সূচনায় আমরা যে সুন্দর প্রকৃতির বর্ণনা পাই (নির্মল আকাশ, পরিস্রুত বাতাস,স্বচ্ছ জল, পুষ্টিযুক্ত খাবার)।সেই প্রকৃতি আজ আমাদের উপর বিরূপ। মানুষের নির্বিচারে বৃক্ষছেদন, যত্রতত্র কলকারখানা স্হাপন, বিপুল পরিমাণ যানবাহনের আধিক্য দিনকে,দিন পৃথিবীর প্রাণীকুলের অস্তিত্বকে নষ্ট করে দিচ্ছি।অনেকে হয়তো পত্র পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে দেখে থাকবেন পৃথিবীতে যে জৈব বৈচিত্র্য বিরাজ করতো (অর্থাৎ নানারকম জীবজন্তু)তার অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে(অর্থাৎ অনেক প্রজাতির প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে)।আজকে মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় বিপদ দূষণ। জল দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, দৃশ্য দূষণ ইত্যাদি কতরকম দূষণই না আমাদেরকে প্রতিনিয়ত বিব্রত করছে।অথচ এইসব দূষণের হাত থেকে আমরা খুব সহজেই রক্ষা পেতে পারি।এরজন্য দরকার একটু সচেতনতা। হ্যাঁ পাঁচ অক্ষরের শব্দ সচেতনতা।এই শব্দটির আজ এতই গুরুত্ব রয়েছে যে এর উপর মানবসভ্যতার তথা জীবকুলের অস্তিত্ব নির্ভর করছে।

বর্তমান শিল্প বা কলকারখানার প্রয়োজন বর্ধিত মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য। কিন্ত সেই শিল্প বা কলকারখানা এমনভাবে স্হাপন করতে হবে যাতে পরিবেশের ক্ষতি না হয় অর্থাৎ শিল্প বা কলকারখানা হবে পরিবেশ বান্ধব। পরিবেশ বান্ধব, সাত অক্ষরের এই শব্দটি আজ খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।গাড়ি বা যানবাহনের প্রয়োজন যতদিন যাচ্ছে তত বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।তবে সেই যানবাহনের ক্ষেত্রেও দেখতে হবে তা যেন পরিবেশ বান্ধব হয়।কলকারখানার ধোঁয়া হোক কিংবা যানবাহনের তাকে পরিশোধন করতে হবে। পরিবেশের বিপদ কম হবে এমন জ্বালানী ব্যবহার করতে হবে।বর্তমানে বিদেশে এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে।সেখানে বিদ্যুৎ চালিত গাড়ি,সৌরশক্তি নির্ভর গাড়ি বেরিয়ে গেছে।বর্তমানে আমাদের দেশেও ইউরো বিধি (পরিবেশ অনুকূল ব্যবস্থা) মানার চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে।তবে এ ব্যাপারে বেশীরভাগ মানুষই উদাসীন বা অজ্ঞ। তাদের এই উদাসীনতাই আমার বহু নির্দোষ মানুষ তথা জীবকুলকে সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

হে প্রাজ্ঞ মানুষ, একটু চিন্তা করলেই আমার কথার গূঢ় অর্থ বুঝতে পারবেন। আজকে এই যে পরিবেশের খামখেয়ালীপনা, বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে এর মূলে মানুষের উদাসীন  কাজকর্ম বা অজ্ঞতা।তাই মানুষকে আজ প্রাজ্ঞ ও সচেতন হতে হবে।জমির ফলন বাড়ানোর জন্য যে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে তাই আমাদের শরীরে বিভিন্ন উপসর্গের সৃষ্টি করছে।পাশাপাশি জমির ধোয়া জল পুকুরে পড়ে জলজ প্রাণীদের অস্তিত্ব বিপন্ন করছে।বিকল্প চাষ বা জৈব চাষই (অর্থাৎ গোবর সার,পাতাপচা)ভালো ছিল। বিদেশে জৈব চাষ ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে গিয়েছে।

মূল কথা অতীত থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।ভারতের প্রাচীনতম সমৃদ্ধ নগর সভ‍্যতা হরপ্পা পরিবেশগত কারণেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন(পাকা ইট তৈরীর জন্য ব্যাপক বৃক্ষছেদন, ফল স্বরূপ অনাবৃষ্টি, মরুভূমির বৃদ্ধি ইত্যাদি)।বৃক্ষছেদনের পাশাপাশি বৃক্ষরোপণ ও করতে হবে।বলা হচ্ছে একটি গাছ কাটলে দশটি গাছ লাগাতে হবে।এইভাবেই মানুষ তার জ্ঞান ও  সচেতনতার মাধ্যমেই পরিবেশের সঙ্কটের হাত থেকে বাঁচতে পারে কিংবা আগামী প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে। কিন্ত উল্টোটা ঘটলে মানবসভ্যতার সঙ্কট অনিবার্য।



পেন্সিল স্কেচ 







 রাজর্ষি দত্ত 




কবিতা 


বয়সে বিকেল এলে 
উমেশ শর্মা 

বয়সে বিকেল এলে ধর্ষিতা আকাশ 
ইস্পাতের পাঁপড়ি মেলে দেয়
পতিতার দরজায় বসন্ত চলে গেলে কবরগুলো বাহারী ফুলে  ঝলমল করে 
পতিতারা কেবল ঘুমায়। 

ঈশ্বর পরিত্যক্ত একখণ্ড জমি ঘিরে 
স্বর্গ নরক, দেহ সঙ্গী দেখায় ভেলকি
ওকিড ওয়ারে ঘিরে শ্লীল অশ্লীলে
নো ম্যানস ল্যান্ড... 
প্রবাল দ্বীপ কি সদাই ঝলমল করে? 

বয়সে বিকেল এলে 
পতিতারা ছড়ায় দুর্গন্ধ নি:শ্বাস। 
বয়সে বিকেল এলে গেরুয়া আকাশ 
বয়স গেলে চলে যায় মস্তানের ত্রাস,
ধন চলে গেলে শোষকের হা হুতাশ 
পতিতার মতো তুলসীর মালা পরে।


শ্যাওলা
সুবীর সরকার

বর্ষা ফুরোয় না। তেঁতুলপাতা বৃষ্টি জলে ভেজে।
ঘুমিয়ে পড়ি হাইওয়ের পাশে।
নদীকে সমুদ্র ভাবি,নদীতে জলযান ভাসে
এদিকে মানুষের মিছিলে ঢুকে পড়ছে
                                                     হাঁস
উঠোন ও শ্যাওলা ডিঙিয়ে সেই কবে থেকেই তো
                                             বাড়ি ফিরছি আমরা


দিগন্ত পেরিয়ে

পার্থ সারথি চক্রবর্তী

দুরন্ত এক আকাশের গায়ে-
ফুঁটে উঠেছে আমাদের অবয়ব।
এক চেনা ভয় শিহরিত করে
অস্পষ্ট পথের দিশায়-
জলরঙা অনুভূতি বারবার পাল্টে যায়
পর্ণমোচী গাছের মতো।

কখনো সকাল,কখনো সন্ধ্যা-
সময় বন্ধাত্ব কাটিয়ে ওঠার
চেষ্টা করে যায় আপ্রাণ।
অন্তহীন নীলিমায় মিশে যায়-
কত জানা,অজানা কাহিনি।

পথচলতি মানুষের মতো
জীবনও বয়ে যেতে থাকে-
আকাশ পেরিয়ে দিগন্তের দিকে।



অন্তর্হিত
প্রীতিলতা চাকী নন্দী


স্বপ্নগুলো তোলা আছে 
কবিতার অ্যালবামে
রোদ-রঙা  ক্যানভাসে
বিগলিত জীবন স্রোত
নিরন্তর  খুঁজে চলি
মেঘ শিশিরের শরীর ছুঁয়ে
নিশ্চিন্ত বাতাস ছিল একদিন 
স্মৃতির অগোচরে শূন্যতার আয়োজনে
জীবন্ত লুকিয়ে থাকে।



ছড়ানো হৃদয়
কিশোর মজুমদার



এ ফোর কাগজে টাঙানো ছিল ছবি
এ ফোর ও ফোর হয়েছে হৃদয় খানি
বদলের হাওয়া দোলায়নি'ক মন
শরীরী বাঁধনে দু'চোখের হয়রানি।

গন্ধগোকুল ছুঁয়ে গেছে মাঝ রাতে
জানালার পাশে নীরব গোপন হাওয়া
'কেমন আছো?' বোরিং প্রশ্ন এসে
অস্বস্তির পাশে নীরবে কাওয়ালী গাওয়া ।

দু'ধারে রেখেছো বন-গাছালির সারি
দু'কথা উঠোনে রিমিঝিমি অনুরাগে
দু'পাশে ঠেলেছি কথার ঢেউয়ের আঁচড়
দু'দিন শান্তি। বুঝে গেছি আগে ভাগে ;

একলা আকাশে ছড়ানো হয়েছে আবির
তোমারই মতন হাসতে পারিনি বলে
রেখে গেছো তুমি গাছ-গাছালির বারুদ
উপহার নামে বদলা সুকৌশলে ।

চুপ করে লেখা মন মাঝিকে চিঠি
নষ্ট আবিরে স্পষ্ট অতীত স্মৃতি
হাড় জিরজিরে অতীত আসেনি কেঁদে
অনুরাগে বীণা সেধেছিল মনবীথি।

সে বনে আমার বাস করে একতারা
সে বনে আজও চাঁদ একা গান গায়
সেখানে তবু জ্যোৎস্নার রূপরেখা
আজও পরবাসে কাঁদে ব্যথা বেদনায়।


থুতু
অসীম মালিক

টেবিলের আলোচনায় বসে,
নিজেকে অতটা নিচে নামাতে পারবো না ।
এত মেপেজুকে, এত থুতু ঘিটে
অতি সচেতন হয়ে আত্মঘাতী হতে পারবো না ।
সামনাসামনি আলোচনায় মুখ আড়ালে চলে যায় ।
সামনে আসে মুখোশ ।

এর থেকে ঢের ভাল
বাস, ট্রাম, ট্রেন, প্ল্যাটফর্ম, চায়ের দোকান
অথবা ফুটপাতের আলোচনা ।
এখানে কেউ আমতা আমতা করে অত থুতু ঘেটেনা !
সময় থাকলে,
পাঁচ মিনিট চায়ের দোকানে বসতে পারো ।
তাহলেই দেখতে পাবে,
শাসকের রক্তচক্ষু  উপেক্ষা করে
কিভাবে থুতু উগড়ে দেয় মানুষ ।



মনের বয়ামে
পাপু মজুমদার

মনের বয়ামে 
অনেক বৃষ্টি ভরেছি
তোমায় কাছে পাওয়ার
কত গল্প, গান আর ছবি
আজ 
আমি ঠিকানা বিহীন
ফুলদানি, 
কবিতায় জমে আছে
শুধুই
তোমার শূন্যস্থান ! 



অন্ত্যমিলের সৃজন  


স্বপ্ন- বাড়ি

লীনা রায় 


হাত বাড়িয়ে হয় নি তো হাত ধরা
মন উচাটন,ভাবনা লাগাম ছাড়া,
বইছে সময় সঙ্গে আলোর গতি
হিসেবী মন গুনছে তো লাভ ক্ষতি
মিথ্যে সকল নিত্য বোঝা পড়া ।

ছাড়ছে সুতো লাটাই হাতে তার-ই
চাঁদিয়ালের একলা আকাশ পাড়ি,
ভয় ডর সব এক্কেবারেই হাওয়া
ইচ্ছে ডানায় আকাশ নীলে ধাওয়া
মেঘের দেশেই মনের খোলা বাড়ি।

হাত ছাড়িয়ে স্বপ্ন-বাড়ি ঘুরে
মেঘের বুকে রঙিন আবির ছুড়ে
সুখ বিলাসী ভেঙে নিয়ম রীত
সাধের বাড়ির শক্ত ক'রে ভিত
রামধনু রং ছড়ায় সাতটি সুরে।



কাছে দূরে
দীপাঞ্জন দত্ত


তুমি যাকে আপন ভেবেছো
আজ সে হয়েছে পর।
আপন খেয়ালে গুছিয়ে নিয়েছে
নিজের ছোট্ট ঘর।

আজ যে নদী হারিয়ে স্রোত
কাল সে ভাঙবে বাঁধ।
নিজেকে বিলিয়ে দশের প্রতি
সব-ই করেছো বরবাদ।

তুমি যাকে আপন ভেবেছো
ভেঙেছ নিজের ঘর!
সময় মতো সে গিয়েছে দূরে
কোথাও অতঃপর।




সংসার
লুবনা আখতার বানু


সং-সাজা সংসারে নারী চলে হেসে-খেলে।
জ্বালা বুকে হাসি মুখে চলে সে যে ডানা মেলে-
কষ্টেও হাসিমুখে ভালোআছি বলে,
দায়িত্বের সাগরে তাঁর নৌকা যে চলে-
কর্তব‍্যের চাপে পড়ে করে সে যে হাসফাস,
এভাবেই চলে সে যে বারোমাস।
নারীদের হস্তেই নাকি দশজনের জীবন-
আনন্দপূর্ন ও সুস্থ রাখতে সব জীবন,
ফাঁকিতে তাঁর নিজেকে সুখী রাখার পন।
এভাবেই সং-সাজা সংসারে মাতারূপী নারী,
ডানা মেলে উড়ে চলে সব বাড়ী বাড়ী।




নাও দৌড়ানি
মজনু মিয়া 

আশ্বিন মাসে জলের ওপর 
নাও দৌড়ানি হয়,
কত্তো মজা করে লোকজন
ক্ষণ আনন্দময়।

কার নৌকা বা পিছে পড়ে 
কার নৌকা আগ যায়,
হৈ-হুল্লোড়ে মাতে লোকজন
খুবই মজা পায়।

শত শত নাও আসে আর
মাঝি মাল্লার গান,
দেখে শুনে ভারে দুচোখ 
জুড়িয়ে যায় প্রাণ। 

ঢাক বাজে ঢোল বাজে আহা
নাচে তালে তাল, 
সাজের বাহার চলার বাহার
বলায় বে-সামাল।



অনুবাদ কবিতা 


ভাষা- নেপালি 

কবি কৃষ্ণনীল কার্কীর কবিতা

  অনুবাদ: বিলোক শর্মা

 

১. কেবল ইতিহাসের পাতায়

 

চোখে শুরু হয়েছে জলুসতার নৃত্য

মুক্ত রয়েছে হাতের বন্ধনগুলো

নিস্তব্ধতাকে দূরে সরিয়ে

পায়ে তালে তাল মেলাতে তৎপর সবাই

 

সময় বদলে যাওয়ার ভাবনায় বয়ে চলে যারা

আকাশ ও চাঁদের দিকে না তাকিয়েই

পূর্বানুমানের বীজ ছড়ায়

 

ঝঞ্ঝার তান্ডব নৃত্যে

সম্ভাবনার সব প্রবেশপথ বিক্ষিপ্ত হয় যখন

স্মৃতির অবশেষ মাত্রই থেকে যায় ভগ্নাবশেষরূপে

যা মাথা উঁচু করে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করে

কেবল ইতিহাসের পাতাগুলোতে।

 

 

 

২. ভিড়ের মধ্যে একটি কবিতা

 

মনের ভিতরে তরঙ্গিত ভাবনার অভিব্যক্তি

কবিতা সৃজনের একটি ইতিবাচক সংকেত

 

বয়ে চলা ঢেউ অনিয়ন্ত্রিতভাবে

এগিয়ে চলে সৃজনশীলতার বিন্দুর দিকে

হঠাৎ ঘন মেঘের ধাক্কায়

বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে একটি আশা

 

একত্রিত করার চেষ্টায় ফের মশগুল হলেও

এক করা যায় না আগের মতো

ভাবনার বিক্ষিপ্ততাকে

 

প্রতীক্ষায় রয়েছে একটা ভিড়

স্বপ্নগুলোর মূল্যায়ন করতে

ঈর্ষার বোঝা কাঁধে নিয়ে

 

বদলে যাওয়া সময়ে কাঁধের উপর হাতগুলো দেখা দেবে হয়ত

তবেততক্ষণে সমাধিস্থ হতে চাইছে ভাবনারা।

 

(অসমের কৃষ্ণনীল‌ কার্কী একজন কবি ও নাট্যকার হিসেবে পরিচিত। কবির তিনটি কবিতা সঙ্কলনদুইটি নাটক এবং একটি গল্প সঙ্কলন প্রকাশিত রয়েছে।)





মুক্তগদ্য 


মা তুমি কোথায় 
প্রদীপ কুমার দে


সকাল বেলাতেই চেঁচামিচি, হৈচৈ--রৈরৈ, ব্যাপার--স্যাপার। ঘুম ঘুম অবস্থা থেকে পঁই--পঁই করে উঠে পড়া, আবার  বসা, তারপর ধড়ফড় করে বারান্দা--ঘর, ঘর--বারন্দা। রাস্তায়--ফাস্তায়, লোকে--লোকাকার। ভিড়ে ভিড়--ভিড়েছে, এসে--মিশেছে, একাকার-- আমাদের এই সেই তস্যগলির--কুমোরটুলির অলি-গলি, ঘুল-ঘুলিতে।

কুমোর পাড়ায় বাস, এর থেকে আর বেশী কি চাস? ঠাকুরে-বাকুরে, মাটিতে--কাদাতে একবারেই অবস্থা--ব্যাবস্থার, হাঁসফাঁস। খড়--কুটো, মুটো--মুটো, দঁড়ি--মরি, বাঁশ-ফাঁস, চলা--ফেরা, যাতায়াত কাজে-- অকাজে, ভিড়ে--ভরে, জটিল-- কুটিল আশ্বাস--বিশ্বাস,  প্রশ্বাস--নিঃশ্বাস হয়ে ওঠে একেবারে  নাভিশ্বাস!

তদন্ত--ফদন্ত, হন্তদন্ত--মন্ত্রফন্ত্র সব ধুলিষ্যাৎ।
পরে বলছি কেন লিখছি এই কথা, ব্যাঙের--মাথা আমার লেখা--চোকা, আকাঁ--জোকা , ক্লিক--ক্লিক, শব্দে-জব্দে কানের ভোঁতা--মাথা!

হলো না কিছু, রতনের ছেলেটারে কামড়ালো--আঁচড়ালো এক বড়-সড়, হাজি--পাজি বিছে! শুধু নয় তাই, শোনো ভাই, এখানে--সেখেনে,  মাছি--মশা, আরশোলা-- মারশালা, টিকটিকি-গিরগিটি, ইঁদুর-ছুচো, লেঙটা--লেঙটি, হাস-- মুরগী, গরু-- শুয়োর আর মানুষের--অমানুষের, আশ-- আবাস, নিবাস--সহবাস!

কথা ছিল, চলছিলো হবে--তবে, ভবে--সবে বড় কিছু, কিন্তু হয়ে আসু--শিশু, টেবিলে--টুলে, আসনে--বসনে, ফাইল চালা--চালি, খালি--খালি হেঁজরালি--হাঁতরালি, বিশ্বরানী হবে কুমারটুলির যতো সন্ধি--ফন্দি হলো শেষে ফাইলবন্দী!

তিন-- তিনটি তদন্তকারী দল বলে, চল--চল করে, দল--ঢল নামায়-পাড়ায়। উঁকি--ঝুঁকি , মারি--খালি, তবে কি উদ্ধারিবে, কোটি--কোটি, লাটঘাট নোটের, আন্ডিল--বান্ডিল ?

বারান্দায় যখন আমি আসি, তখন গিন্নি যায়,  গিন্নি এলেই আমি যাই, লুকোচুরি--ফুলঝুড়ি,   আনাই--বানাই, ইকির--মিকির, চামচিকির, নানান জলে-- কতুহলে, বলে- বলে, শুধরাই -জানতি চাই, নাড়ি --ভুড়ির খবরাখবর যদি-পাই, এর-ওর মুখে।

একজনই তায় বিশ্বাস--অবিশ্বাস মিলিয়ে বলে যায়, জানায় ওসব কিছু নয় তল্লাশি চলে মোষের তরে-- কুমারটুলির ঘরে--ঘরে, যদি পাওয়া যায় অমূল্য-- রতন, মনের-- মতোন।
উড়াইয়া দেখো--ছাই, তবে--তাই যদি কিছু পাই।

তেমন কিছুই নাই! অসুর আছে, কিন্তু মোষ নাই অথচ মহিষ থেইকেই অসুর ভাই, নাম মহিষাসুর ভাই! দুর্গা আছে, সিংহ--ফিংহ সব আছে, নাই -- তাই, মহিষ অথচ অসুর-ফসুর জলজ্যান্ত। তাইলে- নইলে, অসুর কোথা হইতে জুটলো--আসলো ? মানুষ-ফানুস মেরে--কেটে তো আর অসুর বার - ফার হয়নি--রয়নি। মানুষের মধ্য--সদ্য অসুর কি তালে--তলে--তলে কি করে জন্মে--কর্মে? 
গন্ডগোল-ফন্দোগোল তাহলে অন্যখানে-মাঝখানে আছে নিশ্চয়--ফিশ্চয়। কেন্দ্রীয় নামকরা-ঘুনধরা টিম বলে, ছলে-- বলে কৌশলে, চলে এসেছে - এখানে।
তন্য--তন্য করে এই অরন্য খোঁজা--খুঁজি করছে -- চলছে।
বাড়ি--বাড়ি, ঘর--দোর, তালা--খোলা, ভাংচুর--দূর --দূর,  কিছু নাই, বেকার তাই। খাট--আলমারি ছাদ--বাথরুম ডুম -ডুম, টাক--ডুম। কোথা গেল সেই মাথা--মাথা? মাথাদের পাচারে, বর্ডারে --খবরে, হাপিত্যেশ বদ্দিবুড়ো--ছোট থেকে--বড় খুড়ো, একেবারে  নাজেহাল--পয়গাল!

সারাদিন -- দিন দিন, রাত--দিন, বছর্--ফছর, কাটে--সপাটে, তাক্--ধিন, লাগ--লাগ ভেলকি লাগ -- চুলায় যাক অসুরের মোষ -- যত দোষ -- সবটাই ব্যাটা ওই --ভাই,  নন্দঘোষ!

মানহুষ--মানুষ, সর্বভূখ--পায় সুখ, খেয়ে--দেয়ে, ঢেকুর তোলে--গন্ধ ভুলে, হজমের--মহিষের, ফাঁকি দিয়ে--সবারে, মারে এক স্বপনের ঘুম -- বুমবুম, দেয় সুখটান --ভেঙে রহস্য, হয়ে-- যায়, খান--খান!




যে রাতে কারেন্ট ছিলোনা
দেবর্ষি সরকার 

আজ থেকে প্রায় বারো বছর পূর্বে যে রাতে কারেন্ট গিয়েছিল তার মামার বাড়ির আবদার রাখতে সেই রাতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কবিতা পুলিশ খুঁজে পেয়েছিল বারো ভরি স্বর্ণালঙ্কারে মোরা একটি কবিতার খাতা।

আজ থেকে প্রায় বারো বছর পূর্বে যে রাতে কারেন্ট গিয়েছিল তার মাসির বাড়ির ভাতের হাঁড়িতে ইঁদুর বোঝাই জাহাজ ছেরে আসতে সেই রাতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে উপন্যাস পুলিশ খুঁজে পেয়েছিল মৌলিক চাহিদাসম্পন্ন কিছু মানুষের ফসিল।

আজ থেকে প্রায় বারো বছর পূর্বে যে রাতে কারেন্ট চলে গিয়েছিল তার পিসির বাড়িতে গোলাপ চারা রোপণ করতে সেই রাতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছোটগল্প পুলিশ খুঁজে পেয়েছিল কতগুলো অসমাপ্ত আত্মজীবনী।

আজ থেকে প্রায় বারো বছর পূর্বে যে রাতে কারেন্ট তার প্রেমিকার বাড়িতে সিধকেটে ঢুকতে গিয়েছিল সেই রাতে নাটক পুলিশ শহরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে খুঁজে পেয়েছিল কিছু আধপোড়া অসামাজিক কার্যকলাপ।




ছবি 






শমিতা রাহা 



গল্প 



গ্রীণ কার্ড

অমলকৃষ্ণ রায়


অশক্ত শরীর। হাতে বাজারের ব্যাগ। চোখেমুখে শূন্যতা। শারীরিক ভাষায় সহায়সম্বলহীন ভাব। আমার স্কুলজীবনের মাস্টারমশায় নির্মলেন্দুবাবু ভাদ্রের দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে বাড়ির গেটটা ঠেলে বেরিয়ে এলেন। অসময়ে বাজারে স্যারকে যেতে দেখে স্যারের কুশল জানর জন্য দাঁড়ালাম। কিছু বলতে গিয়ে ভাবলাম, স্যার কী উত্তর দিতে পারেন, সেটা তো উনার শারীরিক ভাষাতেই ফুটে উঠেছে। তিনি হয়তো একরাশ কষ্টের কথা উগড়ে দিয়ে বলবেন, শরীরটা ভাল নেই রে। তাই সকালবেলায় বাজারে যেতে পারিনি। এদিকে তোর কাকিমা রান্নাঘরে বসে বলছে, কীযে রান্না করব, কিছুই তো ঘরে নেই। তাই আর কী, এখন একটু বাজারে না গেলেই নয়। এসব শুনতে আমার মোটেই ভাল লাগবে না। তাই স্যারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে বললাম, এরকম রোদে বাজারে গেলে শরীর খারাপ হবে। তাই আপনি বরং ব্যাগটা আমায় দিন। কী কী আনতে হবে বলুন, আমি নিয়ে আসছি।
স্যারের সাইকোলোজিটা অবশ্য আমার আগে থেকেই জানাই ছিল। আপাতমস্তক একজন ‘ভাঙবে তবু মচকাবে না’ স্বভাবের মানুষ কী আর বলতে পারেন। উনি যেমন কোনও গরীবদুঃখীকে দুপয়সা সাহায্য বা দানদক্ষিণাও করেন না, ক্লাবের ছেলেরা কোনও ব্যাপারে চাঁদা চাইলে গেলে সাতকথা শুনিয়ে দেন, ঠিক তেমনি তিনি কারওর সাহায্যও নিতেও রাজি নন। নিঃসঙ্গ মানুষটি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলে উঠলো, ‘দরকার নেই রে। আমি একাই যেতে পারব?’ আমি আর এ নিয়ে স্যাকে দ্বিতীয়বার পীড়াপীড়ি করলাম না। কারণ, আমি জানি তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে কিছুতেই সরে আসবেন না। 
ভাবতে লাগলাম, একমাত্র ছেলে সণ্টুকে নিয়ে স্যারের কত স্বপ্ন ছিল। আমায় বলতো, ও অঙ্কে যথেষ্ঠ ভাল। ভবিষ্যতে সায়েন্স পড়লে ভালকিছু করতে পারবে। একের পর এক ক্লাস ডিঙিয়ে ছেলেটি স্যারের স্বপ্নপূরণের লক্ষে এগিয়ে যেতে লাগলো। একসময় বারো ক্লাসে ভাল ফল করে ইঞ্জিনীয়ারিংয়ে ভর্তি হয়ে গেল। তার কয়েকবছর বাদে সণ্টু বিদেশি একটা কোম্পানিতে চাকরিও পেয়ে গেলে বাড়িতে এ নিয়ে কত আনন্দোচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে গেল। এরপর থেকে স্যারের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হলে শুধু সণ্টুর কথাই বলতেন। বিদেশে ও কেমন আছে, কী করছে এইসব। স্যারের কথাগুলোতে বেকারত্ব্রের যুগে একজন সন্তান মানুষ করার প্রতিযোগিতায় সফল হওয়া অভিভাবকের খুশির বহিঃপ্রকাশ খুঁজে পেতাম।
‘জানিসতো সণ্টু আমেরিকা গিয়ে চাকরিতে জয়েন করেছে। ওর এখানে খুব ভাল লাগছে। ও বলে, বাবা তুমি ভাবতে পারবে না, এখানকার লাইফস্টাইল কত উন্নত। ওকে নিয়ে আমার আর কোনও চিন্তা নেই। মনে হচ্ছে ও ওখানেই পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে।’
 ‘ওখানে থেকে গেলে আপনার কী লাভ হবে স্যার। আপনি তো নিশ্চয়ই ওর কাছে চলে যাবেন না। একসময় তো আপনি এখানে একা হয়ে যাবেন।’
‘আমার আবার একা আর দোকা। বুড়ো মানুষ, বয়স হলে একদিন তো মরেই যাব। ওর জীবনটা তো বিদেশের মাটিতে ভালভাবে কেটে যাবে।’
 সণ্টু এরপর থেকে কয়েকবছর বাদে বাদে আত্মীয়ের মতো করে ক’দিনের জন্য বাড়িতে এসে বাবামায়ের সঙ্গে দেখা করে আবার আমেরিকায় ফিরে যায়। একদিন স্যার আমায় বলল, 
‘জানিস তো, সণ্টু আমেরিকায় বাড়িঘর বানানোর পরিকল্পনা করছে।’ কথাটা শুনে আমি মোটেই খুশি হইনি। কিন্তু স্যারকে কথাটা খুশি খুশি ভাব করে বলতে দেখে নিরাশ করলাম না, 
‘খুব ভাল খবর স্যার। তবে বাড়িঘর করে ফেললে মনে হয় আপনার কাছে আসার মতো সময়সুযোগ আরও কমে যাবে।’
‘সেটাতো কিছুটা হবেই। ওতো আর সারাজীবন মায়ের আঁচলের তলায় বসে থাকবে না। তবে যাই বলিস, আমেরিকার মতো জায়গায় একটা বাড়ি বানানোটা চাট্টিখানি কথা নয়।’ 
‘তাতো বটেই। ক’জনার ভাগ্যে সেটা হয়।’
তারপর বহুদিন স্যারের সঙ্গে আর দেখা হয় না। একবার হুট করে সণ্টুর সঙ্গে শহরেই দেখা হয়ে গেল। ধবধবে ফর্সা, পোশাকাশাকে সাহেবি হাবভাব দেখে বুঝলাম, ও পুরোপুরি পালটে ফেলেছে। জানতে চাইলাম, 
‘কবে এলিরে?’
‘এইতো গত সপ্তাহে।’
‘অনেকদিন থাকবি নিশ্চয়ই।’ সণ্টু একরাশ ক্ষোভ উগড়ে বললো,
‘নাগো। বহু বলেকয়ে মাত্র দুই সপ্তাহের ছুটি ম্যানেজ করে এসেছি। খুব চাপে আছি।’
‘কী বলিস! স্যার তো একদিন বললো, ওখানে নাকি বাড়িঘর বানাচ্ছিস। নিশ্চয়ই মোটা মাইনে পাচ্ছিস।’
‘মাইনের কথা আর বলো না। টাকার অঙ্কটা আপাতভাবে বড় মনে হলেও ওখানকার খরচাপাতি আকাশছোঁয়া। তবুও কষ্ট করে একটা বাড়ি বানাবার চেষ্টা করছি।’
‘কী বলিস! তোদের মতো বিদেশী চাকুরেরা তো এখানকার বেকারদের কাছে আইকন। অনেকই তো এরকম একটা চাকরির স্বপ্ন দেখে।’
‘শোন, দূর থেকে কাশবন ঘনই মনে হয়। কাছে গেলে বোঝা যায় একেবারে ফাঁকা। একসময় আমিও ওরকম ভাবতাম। আমেরিকায় একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলে হয়তো আমার জীবনটা ধন্য হয়ে যাবে। কিন্তু ওখানে গিয়ে অন্যচিত্র দেখছি। সবসময় ম্যানেজমেণ্টের চাপের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। তাদের টার্গেট মতো কাজ সময়ের মধ্যে করতে না পারলে শোকজের নোটিশ ধরিয়ে দিচ্ছে। কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিচ্ছে।’ 
‘তাই নাকি! এই করুণ অবস্থা!’
‘হ্যাঁ দাদা। এখন না পারছি সইতে, না পারছি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। দয়া করে আমার কথাগুলো বাবার কানে দিও না দাদা। বাবা-মা জানতে পারলে ভীষণ কষ্ট পাবে।’
কদিন বাদে সণ্টু বিদেশে ফিরে গেল। স্যারকে এরপর থেকে বাজারঘাট করতে যখনই দেখি সেদিনের সণ্টুর কথাগুলো মনে পড়ে যায়। আর তখুনি মনটা খারাপ হয়ে যায়। মনে মনে ভাবি, কেউ ভাল নেই। ছেলে যেমন বিদেশে ভাল নেই, বাবাও তার বয়সজনিত কারণে এদেশে একা থাকতে গিয়ে ভাল নেই। অথচ স্যার চেয়েছিলেন, বিদেশের মাটিতে সণ্টু ভাল থাকবে। অনেক উন্নত মানের জীবনধারণ করবে। 
যদিও কথাটা স্যারকে কোনওদিনই জানাব না। সণ্টু আমাকে দিব্যি দিয়ে বলে গেছে। তার ভাল না থাকার খবরটা যেন তার বাবা কিছুতেই জানতে না পারে। স্যার তাই তার জীবদ্দশায় জেনে যাবেন, তার সন্তান বিদেশে ভাল আছে। তিনি বাবা হিসেবে তাকে সেই ভাল থাকার শিখরে পোঁছে দিতে পেরেছেন। 
কথাগুলো ভাবতে ভাবাতে চোখের সামনে ভেসে উঠলো, সণ্টু বিদেশের মাটিতে বসে কোম্পানির শোকজের জবাব লিখছে। লিখতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলছে। তাই কলম চিবোতে চিবোতে কিছু একটা লিখে আবার কেটে ফেলছে। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, একবার সণ্টু লিখে ফেলল, স্যার, আই ওয়েণ্ট টু ইণ্ডিয়া টু মিট মাই প্যারেণ্টস। দ্যাটসহোয়াই আই ক্যাণ্ট ফুলফিল ইয়োর টার্গেট। আই প্রমিজ স্যার, নেক্সট টাইম ইট উড নেভার বি...। চিঠিটা বসের টেবিলে দিয়ে সণ্টু ভারাক্রান্ত মনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।  
এসব দৃশ্যপট ভাবতে ভাবতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। স্যার ততক্ষণে বাজারের দিকে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। আমি ছুটে গিয়ে স্যারের পাশাপাশি হেঁটে যেতে যেতে বললাম, স্যার, সণ্টু বাড়িতে থাকলে তো আপনাকে এই বয়সে এতটা কষ্ট করতে হতো না। স্যার হাঁটার গতি ঠিক রেখে কাঁপা গলায় অস্ফুট স্বরে বললো, কী করে আসবে বল। ও তো এখন আমেরিকায় গ্রীণ কার্ড পেয়ে গেছে। 
স্যারের কথাগুলোর শেষে একটা দীর্ঘশ্বাসের রেশ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। মনে হলো যেন, নিঃশব্দ সেই শ্বাস বায়ুতে মিশে থাকা একরাশ দুঃখকষ্ট, আবসোস আমার কানের পাশ ঘেসে ভেসে যেতে যেতে দুপুরের তপ্ত বাতাসে মিলিয়ে গেল। 




মিনি  

বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়


শেষরাতে একটা অদ্ভুত আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। অন্ধকার ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা 'ফোঁফোঁ' আওয়াজ আর দরজায় আঁচড়ানোর শব্দ। দক্ষিনাবাবু প্রথমত ভীষণ চমকে গেলেও পরে বুঝতে পারলেন, এইটা মিনি’র কাজ। পাশে শয়নরতা স্ত্রী'কে আশ্বস্ত করলেন,"মিনি আওয়াজ করছে। তুমি শুয়ে থাকো, আমি দেখছি।"
-"এইরকম অদ্ভুত আওয়াজ তো ও কোনোদিনও করেনি!"
-" কি জানি কেন? মনেহয় বাইরে যেতে চাইছে।" দক্ষিণাবাবু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
মিনি একলাফে বারান্দায় তারপর বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একলাফে উঠোনে গিয়ে নামলো। তারপর আবার ফিরে এসে বারান্দার গ্রিলে মুখ গলিয়ে দক্ষিণাবাবুর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আবার সেই 'ফোঁফোঁ' আওয়াজ করতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে তার পরিচিত সুরে 'মিঁউ-মিঁউ' করেও ডাকছিলো। কিন্তু মিনি'র ভাবভঙ্গীর অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে সে চরম মাত্রায় উত্তেজিত।

ষাটোর্ধ্বা পূরবীদেবীও কৌতূহলবশত উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরের বারান্দায় এলেন। ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে।
দক্ষিণাবাবু বিরক্ত হলেন,"তোমার ওই কোমর আর হাঁটু নিয়ে নড়তে পারোনা, অথচ......?"
-"কি জানি বাবা? মিনি তো সবসময় জানালা দিয়েই বাইরে আসা যাওয়া করে, হঠাৎ দরজা দিয়ে কেন বের হতে চাইলো !! ....."
মিনি এবার আবার উঠোনে গিয়ে নামলো তারপর উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে দক্ষিণাবাবু ও পূরবীদেবী'র দিকে তাকিয়ে অনবরত সেই অদ্ভুত আওয়াজটা করেই যাচ্ছে। এমনকি আশেপাশের বাড়ির কুকুরগুলোও আশ্চর্যভাবে 'উঁঊঊঊ" করে ডেকে উঠলো।
আচমকা দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার পায়ের নিচে জমি সরে গেলো। স্বভাবতই তাল সামলাতে না পেরে কোনোক্রমে মেঝেতে বসে পড়লেন। মাথার ওপর বারান্দার টিনের চাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে। একশো বছরের পুরোনো দোতালা বাড়িটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। প্রলয়ঙ্কর ভূমিকম্পের আড়োলনে ধংসস্তূপের নিচে চাপা পড়লেও বারান্দা ঘেঁষা সুবিশাল  কাঁঠালগাছের কল্যানে প্রাণে বেঁচে গেলেন।
পশুপাখিরা অনেক আগে থেকেই বিপদের আভাস পায়, তার হাতেনাতে প্রমান পাওয়া গেলো।

দুদিন বাদে হসপিটাল থেকে বাড়িতে এসে চোখের জল সামলাতে পারছিলেন না। বাপ-ঠাকুরদার তৈরি ভিটে একদম ধূলিসাৎ। আশেপাশে শুধু কান্নার রোল। কিন্তু তাদের প্রিয় মিনি'কে কোথাও দেখা গেলোনা। হাতেপায়ে খুব ব্যাথা থাকায় বেশি হাঁটাচলা করতে পারলেন না। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই এখন নিজের দুর্দশা নিয়েই অস্থির, তাই পোষা প্রাণীদের খবর কেউই রাখেনি। বিগত পাঁচ বছর ধরে ‘মিনি’ বুড়ো-বুড়ির সাথে এঁঠোকাঁটা খেয়েই কাটিয়েছে। ঘর থেকে বাইরে যাবার আগে জীবনটাও বাঁচিয়ে প্রতিদান দিয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে থাকলে আজ তো চাপা পরেই শেষ হয়ে যেতেন। আজ তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলোনা ভেবেই দক্ষিণাবাবু খুব দুঃখী হয়ে পড়লেন।  

খুব মোলায়েম আর মিহি একটা 'মিঁউ-মিঁউ' শব্দ বুকের ভেতরে বাজছিলো। মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক তাকিয়ে চমকে উঠছিলেন। কিন্তু সবই মনের ভুল।  

কলকাতা থেকে ছেলে এসে হাজির। আজকেই চলে যেতে হবে। আসবাবপত্রগুলো একটা ভাড়ার গুদামে রেখে এসে ছেলে তার মা'কে ধরে গাড়িতে তুললো।
-"চল, বাবা ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে।"
দক্ষিণাবাবু'র মন অন্যদিকে। আশেপাশে যাকেই পাচ্ছেন তাকেই মিনি’র কথা জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু কেউ বলতে পারলোনা। ভারাক্রান্ত মনে গাড়িতে এসে বসলেন।
-"মিনি সময়মত না ডাকলে আজ আমরা বেঁচেই থাকতাম না।"
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা'র চোখে প্রিয়জন হারানোর দুঃখের শোক। দরদর করে নামছে জলের ধারা।
-"দুঃখ করোনা বাবা, বিড়ালরা ওরকম চলে যায়। সাধারণতঃ বাড়িতে দেহত্যাগ করেনা।"
ছেলের কথাটা বুকের মধ্যে বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধলো। চোখটা ঝপ করে বুজতেই নোনাজলের ফোটা'র অনুভূতি।

দক্ষিণাবাবু কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না। সারাটা জীবন বহু পশু-পাখি পুষেছেন। তাদের হারিয়ে অনেক দুঃখ পেয়েছেন কিন্তু নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। যেন এক নিদারুন হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি। কোথায় গেলো মিনি? কেমন আছে? খেতে পাচ্ছে কিনা, এইসব প্রশ্নের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে চলেছেন।
দক্ষিণাবাবু নিজের শহরে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। বন্ধুর কাছেই খবর পেলেন ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে নির্দিষ্ট দিনে অফিসারের সামনে বসে ফর্মে সই করে জমা দিতে হবে। একাই দার্জিলিং মেল ধরে বেরিয়ে পড়লেন, সোজা নিউজলপাইগুড়ি।

সাত সকালেই বাস ধরে এলেন রাণীনগর শহরে। ভাবছিলেন হোটেলে উঠবেন কিন্তু বাল্যবন্ধু সমীররঞ্জনের একান্ত অনুরোধে তার বাড়িতেই উঠতে হলো।

-" বিডিও বলেছেন, ক্ষতিপূরণের দরখাস্তর ফর্ম টা সই করে আনার জন্য এই অফিসারের বাড়িতে যেতে হবে, উনি অসুস্থ তাই। বুঝলি?"
-"সে বুঝেছি। তবে যেখানে তার বাড়ি, একদম শহরের শেষপ্রান্তে ঐদিকে জীবনেও কোনোদিন যাইনি।"
-"আমিও ভালোভাবে চিনিনা। দেখি আমার ছেলেকে তোর সাথে যেতে বলবো। আমি তো প্রায় পঙ্গু।"
-"থাক থাক। ঠিক খুঁজে নেবো। একটা ফোন নম্বর তো দিয়েছে।"
পরদিন ফোনে সেই অফিসারের বাড়ির এলাকা বুঝে রিকশায় উঠলেন। রেললাইনের গা ঘেঁষে বেশ দূরে একদম শহরের বাইরে একটা পরিত্যক্ত গুমটির কাছে দাঁড়ালেন। তারপর আসেপাশে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ি খুঁজে পেলেন। ভদ্রলোক সত্যিই অসুস্থ। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে ফর্ম সই করিয়ে জমা নিয়ে নিলেন।
-"দিন পনেরোর মধ্যেই একটা এসএমএস পেয়ে যাবেন। তারপর ব্যাংকে যোগাযোগ করবেন।“
ধন্যবাদ জানিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে এলেন। রেলগুমটির কাছে গেলেই রিকশা পাওয়া যাবে। চারদিকে ছোট ছোট টিনের চালা দেওয়া বাড়ি। বেশ খোলামেলা এলাকা। এদিকে ভূমিকম্পের তেমন কোনো প্রভাব হয়নি।
রাস্তার পাশেই হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গায় দৃষ্টি একদম আটকে গেলো। বুকের ভেতরে ধড়াস করে উঠেই প্রবল উত্তেজনায় হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। তিনটে বিড়াল রোদে শুয়ে আরাম করছিলো। তার মধ্যে একটা মুখ তুলে চেয়ে স্থির হয়ে আছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ অজান্তেই বেরিয়ে এলো,"মিনি!"
কিছুক্ষন অপলক চেয়ে থাকার পর সম্বিৎ ফিরে পেলেন। ধীরে ধীরে কাছে যেতেই অন্যান্য বিড়ালগুলো পালিয়ে গেলো। কিন্তু মিনির মতো দেখতে বিড়ালটা একটু ফারাকে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। একদম মিনির মতো, সারা শরীরে সাদা ধূসর রঙের প্রলেপ। লেজের মাথায় আর বাঁ চোখের উপর সেই কালো ছোপ। দক্ষিণাবাবু মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে একদম কাছে। বিড়ালটা পালালো না। দুইচোখ বড় বড় করে দক্ষিণাবাবু'র মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

আবার আস্তে ডাকলেন,"মিনি!"
উত্তর এলো,"মিঁউ!"
একদম মিনির মতো আওয়াজ।
অজানা উত্তেজনায় বুকের ভেতরে স্নায়ুর আড়োলনে তোলপাড়। কপালে ফুটলো বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আশেপাশে কয়েকটা কৌতূহলী বখাটে ছেলেরা দাঁড়িয়ে গেলো।
-"আপনার বিড়াল নাকি?"
-"তা তো জানিনা দাদুভাই। দেখে তো ঐরকমই মনে হয়।"
-"আপনার অনেক বয়েস তো তাই ভুলভাল দেখেন।" অসভ্য ছেলেপেলে গুলো খিকখিক করে হেসে উঠলো।
সামনের বাড়ি থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। সব শুনে বললেন আমাদের এলাকায় প্রচুর কুকুর বেড়াল। ভূমিকম্পের পরেই কোথা থেকে সব এসে হাজির হয়েছে আমরাই জানিনা। আপনার লাগলে নিয়ে যেতে পারেন। তবে ওই বিড়ালটা যদি যেতে চায়। একদম জোরজার করবেন না কামড়ে দিতে পারে, সাবধান।
দক্ষিণাবাবু বিড়ালটার মাথায় হাত রাখলেন। খুব মিহি একটা 'মিঁউ ' শব্দ করলো।
উত্তেজিত দক্ষিণাবাবুর হঠাৎ মনে পড়ল মিনি'র কানের পেছনে একবার গরম তেল পড়ে ফোস্কা পড়েছিল। সেই  ঘা'র চিকিৎসা মাসখানেক চলেছিল।
কানের পেছনে লোম সরাতেই বিস্ময়ে প্রচন্ড চমকে উঠলেন। এবারে যেন সারা জগৎ সেই ছয় রিখটারের ভূমিকম্পের চেয়ে কয়েকগুন বেশি জোরে দুলে উঠলো। চোখ ফেটে নামলো অবিরাম জলধারা। মুখ হাঁ হওয়া সত্বেও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করতে পারছিলেন না। আকস্মিক আনন্দে কাঁপা গলায় অনেক কষ্টে বললেন,"মিনি।"
মিনি কিন্তু আবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা তফাৎ হটলো।
দক্ষিণাবাবুর গলা দিয়ে সেই পুরোনো ধমকের সুর অজান্তেই বেরিয়ে এলো। মিনি রাস্তায় বের হয়ে দুস্টুমি করলেই বা স্নান করতে না চাইলেই তিনি বেশ জোরে বকতেন,"মি-নি!"
এবারে মিনি অস্বাভাবিক চমকে গেলো। কোনো বাধা দিলোনা। দক্ষিণাবাবু তাকে কোলে ওঠালেন। মিনি তার পুরোনো কায়দায় বাবুর বুকে নাক ঘষে বুঝিয়ে দিলো সে চিনতে পেরেছে। তারপর সে পরিচিত মিহি ডাক,"মিঁউ!"
দক্ষিণাবাবু আকাশের দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে, মুখ তুলে ঈশ্বরকে স্মরণ করলেন।




প্রাপ্তি
সম্পা চ্যাটার্জী

আজকে নুপুর এর নাচের স্কুলের উদ্বোধন l নাচের স্কুল, যেটা নুপুর এর কাছে একটা স্বপ্ন l ছোটবেলায় যখন নাচ শিখতো, তখন থেকেই সে স্বপ্ন দেখতো যে বড়ো হয়ে নাচের স্কুল খুলবে l আর সেই স্কুলে অনেক ছেলেমেয়ে নাচ শিখতে আসবে l আজ এতদিন পরে নুপুর এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে l
     নুপুর এর মা খুব ভালো নাচ করতো l নুপুর বাবা -মায়ের একমাত্র সন্তান l মা শখ করে তার নাম রেখেছিলো নুপুর l ছোটবেলার নুপুর মায়ের কাছে নাচ শিখতো l নুপুর এর মা চেয়েছিলেন একটা নাচের স্কুল খুলতে l নুপুর এর বাবা সব সময় তার মায়ের সমস্ত কাজে সাপোর্ট করতেন l নুপুর তখন বছর পাঁচ এর ছোট্ট মেয়ে l কিন্তু এতটুকু বয়স এই মা আর বাবার মধ্যে যে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিলো সেটা সে বুঝতে পারতো l
কিন্তু নুপুর এর মায়ের নাচের স্কুল খোলার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই ঘটে যায় বিপদ l একটা রোড একসিডেন্ট এ তার মা -বাবা দুজনেই নুপুর কে একা করে দিয়ে হটাৎ হারিয়ে যায় l নুপুর এর সাজানো গোছানো পৃথিবীটা এক নিমিষেই ওলোটপালট হয়ে যায় l তারপর থেকে নুপুর তার দিদান এর কাছে থাকে l নিজের মেয়ে -জামাই কে হারিয়ে নাতনিকে বুকে আগলে দিদান ও কিছুটা বাঁচতে শেখে l নুপুর এর প্রথম প্রথম নাচ করতে ইচ্ছা করতো না l নাচ করতে গেলেই মায়ের কথা, বাবার কথা আরো বেশি করে মনে পড়তো, কান্না পেতো l কিন্তু দিদান এর সহযোগিতায় আস্তে আস্তে এই নাচকেই আবার সে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে শিখলো l
আর তখন থেকেই সে ভাবতো বড়ো হয়ে একটা নাচের স্কুল খুলবে l তার মায়ের অপূর্ন ইচ্ছাটা সে পূরণ করবে l আর স্কুলটার নাম ও রাখবে মায়ের নামে “অনন্যার নাচঘর “l আজ সেই বিশেষ দিনটা সত্যিই এসেছে নুপুর এর জীবন এ l আজকে “অনন্যার নাচঘর “ এর উদ্বোধন l
কিন্তু আজকের এই দিনটা পেতে নুপুরকে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে l অনেক কিছু হারাতে হয়েছে l হারাতে হয়েছে তার সংসার, আর আকাশকে l সেই আকাশ যাকে নুপুর একসময় তার পৃথিবী মনে করতো l আকাশ এর সাথে নুপুর এর পরিচয় শান্তিনিকেতন এ, দোল উৎসবে l নুপুর এর নাচ দেখে আকাশ নিজে থেকেই নুপুর এর সাথে পরিচয় করেছিলো l আকাশ কলকাতায় একটা বড়ো কোম্পানিতে চাকরি করে l দোল উৎসবে বন্ধুদের সাথে শান্তিনিকেতনে ঘুরতে এসেছিলো l আর নুপুর ও শিলিগুড়ি থেকে নাচের গ্রুপ এর সাথে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলো l
নুপুর এমনিতেই খুব সুন্দরী, তার মধ্যে আবার এতো ভালো নাচ করে, তাই প্রথম দেখাতেই আকাশ নুপুর এর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো l প্রেম থেকে বিয়েতে পৌঁছাতে বেশিদিন সময় লাগেনি l যেহেতু দিদান ছাড়া নুপুর এর আর কেউ নেই, তাই নুপুর এর দিক থেকে বাঁধার কোনো ব্যাপার থাকলো না l যদিও দিদানকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে ভেবে দিদানকে অনেকবার কলকাতায় তার সাথে থাকার কথাও বলেছে নুপুর l কিন্তু দিদান কিছুতেই নিজের জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকতে চাননি l অগত্যা ছন্দামাসির ওপর দিদান এর ভাড় দিয়ে নুপুর বিয়ে করতে রাজি হয় l ছন্দামাসি ছোটবেলা থেকেই এই বাড়িতেই থাকে l নিজের মাসি না হলেও, নিজের মাসির থেকেও অনেক বেশি সে l
এদিকে আকাশ এর পরিবারও সুন্দরী বৌমা পেয়ে খুবই খুশি l আকাশ আর নুপুর এর বিয়ে হয়ে যায় l সবকিছু যেনো নুপুর এর কাছে একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো l বিয়ের পর প্রথম প্রথম খুবই ভালো কেটেছিলো দিনগুলো l আকাশ খুবই কেয়ারিং আর নুপুর কে খুব ভালোও বাসে l আর তাছাড়া শ্বশুর -শ্বাশুড়ি দুজনেই খুব ভালো l
এইভাবে প্রায় ছয়-সাত মাস একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেলো l এইসময় নুপুর শুধুই সংসার করেছে l নিজের নাচের জগৎ থেকে সে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো l সারাক্ষন আকাশ কি পছন্দ করবে, আকাশ কিসে খুশি হবে সেটা ভাবতে ভাবতেই তার দিন শেষ হয়ে যাচ্ছিলো l অন্য কোনোকিছু ভাবার সময়ই তার ছিলো না l
এরকমই একদিন আকাশের সাথে পুজোর শপিং করতে গিয়ে, নুপুর এর তার পুরোনো বান্ধবী মিথিলার সাথে দেখা হয়ে যায় l তারপর দুজনে নানারকম কথা হয় l নুপুর বিয়ের পর থেকে নাচ করেনি শুনে মিথিলা অবাক হয়ে যায় l সে বলে, যে তুই একদিন নাচ ছাড়া থাকতে পারতিস না, এতগুলো মাস কিভাবে নাচকে ছাড়া আছিস? নাচ তোর পরিচয়, তোর স্বপ্ন l বিয়ে হয়েছে মানে তুই তোর স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে দিবি এটা তো ঠিক না l মিথিলার কথায় নুপুর এর বোধোদয় হয় l সত্যি সে কি করছে? স্বামী, সংসার, শ্বশুরবাড়ি এসব নিয়েই দিন কাটিয়ে দিচ্ছে? কিন্তু তার স্বপ্ন? সে যে ভেবেছিলো বড়ো হয়ে নাচের স্কুল খুলবে l মায়ের অপূর্ন ইচ্ছাটা সে পূরণ করবে, সেটা ভুলে গেলো কিকরে? এটা ভেবে নিজের কাছে নিজের অনুশোচনা হতে থাকে l সে ঠিক করে রাতে আকাশকে কথাটা বলবে l আর পুজোর পরেই সে নাচকে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাববে l
এদিকে আকাশকে আজকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে l পুজোর মধ্যে চারদিনের ছুটি পেয়েছে, তাই কোথায় ঘুরতে যাবে সেটা নিয়েই চিন্তাভাবনা করছে l কিন্তু নুপুর আজ একটু অন্যমনস্ক হয়ে আছে l সে নাচের জগৎ এ কিভাবে এগিয়ে যাবে, কিভাবে মায়ের স্বপ্নপূরণ করবে সেই চিন্তাই করে যাচ্ছে l বিষয়টা আকাশ এর ও নজর এড়ায় নি l আকাশ জিজ্ঞাসা করে -তুমি কি কিছু ভাবছো? তখন নুপুর আকাশকে সবটা খুলে বলে l সবটা শুনে আকাশ বলে –দেখো তুমি আগে যা করেছো করেছো, এখন তুমি আমার স্ত্রী, এই বাড়ির বৌ l এখন কি তোমার স্টেজ এ উঠে নাচ করা মানায়? আর তোমার নাচের স্কুল খোলারই বা কি দরকার আছে? আমাদের তো কোনোকিছুর অভাব নেই l তোমার সমস্ত দায়িত্ব তো আমি পালন করতে সক্ষম l তুমি শুধু গুছিয়ে সংসার করো l আর তাছাড়া আমি চাই না যে আমার সুন্দরী বৌকে আমি ছাড়া আর অন্যকেউ দেখুক, বুঝলে!
কথাগুলো খুব সহজে বলে যায় আকাশ l কিন্তু নুপুর কিছুতেই আকাশকে বোঝাতে পারে না যে, টাকাপয়সার জন্য নয়, সে মায়ের ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য নাচের স্কুলটা খুলতে চায় l আর তাছাড়া নাচকে সে ভালোবাসে l আকাশকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নুপুর চুপ করে থাকে l সারারাত ঘুমাতে পারে না l সে কি করবে কিছুই ভেবে পায় না l
পরেরদিন দিদানকে ফোন এ সব কথা বলে l সব শুনে দিদান বলে, দেখ মা, আমার বয়স হয়েছে, আমি আজকে আছি, কালকে নেই l কিন্তু তোর সামনে পুরো জীবন পরে আছে l ওরা যদি পছন্দ না করে তুই আর নাচ করিস না l আর তাছাড়া আকাশ তো খারাপ ছেলে না l তোকে খুব ভালোও বাসে l তুই নাচের স্বপ্নকে ছেড়ে দিয়ে মন দিয়ে সংসার কর মা l দিদান এর কথা শুনে নুপুর এর খুব কষ্ট হয় l তবুও দিদান এর কথা মতো সে নাচ নিয়ে আর কোনো কথা তোলে না l
দেখতে দেখতে পাঁচবছর কেটে যায় l আজকে অনন্যার জন্মদিন l অনন্যা নুপুর আর আকাশ এর তিন বছর এর মেয়ে l নিজের মায়ের নামেই মেয়ের নাম রেখেছে নুপুর l অনন্যার জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে অনেক গেস্ট আসবে l অনন্যার বন্ধুরা, তাদের মায়েরা, আকাশ এর অফিস এর কলিগরা, আকাশ এর বন্ধুবান্ধব, তাদের ফ্যামিলি, এছাড়া আত্মীয়স্বজনরা তো আছেই l সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত ছিলো নুপুর l কোথায় কি হবে না হবে, কি কি খাবার বানানো হবে সব কিছুই একা হাতে সামলাতে হয়েছে l সন্ধ্যাবেলায় মেয়েকে রেডি করিয়ে নিজে যখন আয়নার সামনে গেছে, তখন দেখছে আকাশ রেডি হচ্ছে l আকাশকে তাড়াতাড়ি করতে বললে সে বলে, দেখছো তো সারাদিন পরে এখন আমি রেডি হওয়ার সময় পেলাম, তাতেও তোমার আপত্তি l সারাদিন যে কি করো l শুয়ে বসে থাকতে থাকতে যে দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছ একটু সেদিকে খেয়াল করো l
আকাশ আজকাল নুপুর এর সাথে এরকমই খারাপ ভাবে কথা বলে l নুপুর আগের থেকে অনেকটা মোটা হয়ে গেছে l কিন্তু সেটা সে শুয়ে বসে থেকে হয়নি, আগের থেকে বরং আরো বেশি পরিশ্রম সে এখন করে l নাচ ছেড়ে দেওয়া আর কিছুটা পোস্ট প্রেগনেন্সির কারণে সে মোটা হয়ে যাচ্ছে l কিন্তু সেই কথাটা আকাশকে সে কিছুতেই বোঝাতে পারে না l আকাশ এর ধারণা নুপুর সারাদিন শুয়ে বসে থেকেই মোটা হয়ে যাচ্ছে l সে নিয়ে নুপুরকে যখন তখন খোঁটাও দেয় l
বৌমা তাড়াতাড়ি নিচে এসো, সবাই চলে এসেছে l সুমনাদেবীর ডাকে সম্বিত ফেরে নুপুরের l তাড়াতাড়ি একটা পিওরসিল্ক শাড়ি পরে সে নিচে নেমে আসে l পার্টিতে যারা যারা এসেছে সবাই খুব সেজেগুঁজে এসেছে l নুপুর ও আগে যেকোনো অনুষ্ঠানে গেলে সেজেগুঁজে ফিটফাট হয়ে যেতো l
কিন্তু এখন কেমন যেনো হিনমান্যতায় ভোগে l মনে হয় যেনো কোনোকিছুই তাকে মানাবে না l পার্টিতে সবাই একবার করে নুপুরের মোটা হয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলতে থাকে, আর আকাশ সবাইকে একই কথা বোঝায় যে, সারাদিন কোনো কাজ না করে শুয়ে বসে থেকেই নুপুর মোটা হয়ে যাচ্ছে l নুপুরের আর সহ্য হয় না, সে পার্টি ছেড়ে নিজের ঘরে চলে আসে l নিজের কিছু পুরোনো ছবি বের করে দেখে l সবই পাঁচ -ছয় বছর আগের l কিছু নিজের নাচের প্রোগ্রামের আর কিছু আকাশ এর সাথে তোলা l
নুপুর মনে মনে ঠিক করে অনেক হয়েছে আর নয় l এবার নিজের জন্য একটু সময় সে দেবেই l নিজেকে আবার আগের মতো তাকে করে তুলতেই হবে l সবার সামনে নাচ করলে বা এক্সারসাইজ করলে কেউ যদি কিছু মনে করে, তাই রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে আর সকালে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে নুপুর নাচ আর এক্সারসাইজ করতে শুরু করলো l তাছাড়া ডায়েটিং ও করতে শুরু করলো, সেটাও সবাইকে লুকিয়েই l
এভাবে কিছুদিন চললো, নুপুরের পরিশ্রম আগের থেকে অনেক বেশি হচ্ছিলো ঠিকই কিন্তু তবুও নিজের মধ্যে একটা পসিটিভ চেঞ্জ সে অনুভব করছিলো l কিন্তু একদিন রাতে নাচ করতে গিয়ে আকাশ এর কাছে হটাৎ ধরা পরে যায় l আকাশ তাকে চুড়ান্ত অসম্মান করে l পরের দিন ভোরে নুপুর কাওকে কিছু না বলে অনন্যাকে নিয়ে শিলিগুড়ি চলে আসে l
সব শুনে দিদানও নুপুরের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে মনে করে l এবার নুপুরের লড়াই করে নিজেকে প্রমান করার সময় l পাঁচ বছর আগে নাচের জগৎ এ যে জায়গাটা সে ছেড়ে গিয়েছিলো, সেই জায়গায় এখন নতুন অনেক মুখ l সেখানে নুপুরের কোনো জায়গা নেই l সেই জায়গায় পৌঁছাতে গেলে নুপুরকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে l একদিকে অনন্যার দায়িত্ব, একদিকে নিজেকে প্রমান করা, আর একদিকে মায়ের স্বপ্নপূরণ –এই তিনটি জিনিসকে একসাথে নিয়েই নুপুরকে এগোতে হবে l
সামনের দুর্গাপুজায় যেভাবেই হোক একটা পারফরমেন্স নুপুরকে দিতেই হবে l পুরোনো কিছু চেনা লোকের সাথে যোগাযোগ করে বহু কষ্টে একটা সুযোগ সে পেয়েছে l সকাল থেকে টিউশন পড়ানো, ঘরের কাজ, মেয়েকে সামলানো সব করেও সে নাচের জন্য প্রচন্ড পরিশ্রম করে যাচ্ছে l যতো প্রাকটিস করছে নিজের মধ্যে যেনো একটু একটু করে কনফিডেন্স বাড়ছে l এক মাসে প্রায় ছয় -সাত কেজি ওজনও কমিয়ে ফেলেছে l একদিন অনন্যা বলছে মামমাম তোমাকে এখন অনেক বেশি বিউটিফুল লাগে l কথাটা শুনে নুপুরের চোখে জল চলে আসে l
আজকে নুপুরের পাঁচ বছর পরে আবার স্টেজ পারফরমেন্স l খুব ঘাবড়ে আছে সে l কিন্তু ঘাবড়ালে চলবে না, তাকে এবার নিজেকে প্রমান করতে হবে –দেখাতে হবে সে শেষ হয়ে যায়নি l স্টেজে পা দিয়ে প্রথমে কিছুটা নার্ভাস থাকলেও পরে একটা দুর্দান্ত পারফরমেন্স দেয় নুপুর l সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, হাততালির আওয়াজে ফেটে পরে স্টেজ l ব্যাস, এরপর থেকে নুপুরকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি l একের পর এক স্টেজ পারফরমেন্স, দেশে -বিদেশে সব জায়গায় l এভাবে প্রায় তিন বছর চলে যায় l এখন নুপুর এর অনেক নামডাক, খ্যাতি l
কি রে আর কতক্ষন লাগবে? সুমনাদেবীর ডাকে নুপুর ফিরে তাকায় l নুপুর ওই বাড়ি থেকে চলে আসার পরে সুমনাদেবী নুপুরের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন l বলতে গেলে এই তিন বছরে শ্বাশুড়ি -বৌমার সম্পর্ককে পেছনে ফেলে তারা মা -মেয়েতে পরিণত হয়েছে l নুপুরের প্রত্যেকটা কাজকে সুমনাদেবী সমর্থন করেছেন l তাই আজকে যখন নুপুরের স্বপ্নপূরণ এর দিন, তখন তিনি না এসে থাকতে পারেননি l সুমনাদেবী নুপুরকে বলেন –তুই যখন এতটা লড়াই করতে পেরেছিস, আর কিছুদিন অপেক্ষা কর, তোর সবকিছু তুই আবার ফিরে পাবি l কিন্তু ফিরে পেলেই তুই সেটাকে গ্রহণ করবি কিনা সেটা তোর নিজস্ব ব্যাপার l আমি কখনোই বলবো না তুই তোর আত্মসন্মানকে বিসর্জন দিয়ে আবার সংসারে ফিরে যা l নুপুর সুমনাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে –মা আমার জীবনে আর কোনো অপূর্নতা নেই l আমি যা প্রমান করতে চেয়েছিলাম, সবটাই প্রমান করতে পেরেছি l আর আকাশ এর ওপর এও কোনো অভিযোগ আমার নেই l আমি তাকে মাপ করে দিয়েছি l সে চাইলে আবার নতুন করে সংসার করতে পারে, আমার তরফ থেকে কোনো বাঁধা থাকবে না l এখন আমি বুঝে গেছি আকাশ আর নুপুর এর মধ্যে দূরত্বটা l তারা চাইলেও কখনো এক হতে পারে না l
আজকে আমার অনেক খুশির দিন l আমি চাই যে এই নাচের স্কুলের উদ্বোধন তোমার হাতে হোক l আজকে আমার এক মায়ের নামের নাচের স্কুল, তার ই মায়ের বাড়িতে তৈরি হয়েছে, আর সেই নাচের স্কুল উদ্বোধন করছে আমার আরেক মা l এটাই আমার জীবনের সব থেকে সেরা প্রাপ্তি l




অন্য কবিতা 


জীবনপাতার দিনগুলো
শমিতা রাহা 


মেঘের আড়ালে আবছা চাঁদ 
ঘুম আসেনা .. ..গভীর রাত।
জীবনখাতার পৃষ্ঠা গুলো
বাতাসে হয় এলোমেলো।
বাবার হাত ধরে স্কুলের গলি
ছুটির বেলায় হজমি গুলি।
টং টং ট্রাম সবুজ ঘাসে 
লেডিস সীটে বন্ধু পাশে।
লোডশেডিং এ মোমের আলো
রেডিও নাটক লাগতো ভালো।
মায়ের হাতের নকসি পাখা
বাতাস যেন আদরে মাখা।
সকাল হতো স্বপ্ন দেখে 
মুখে হাসির আবীর মেখে।
ধূপছায়া আর বৃষ্টি মেদুর 
মিষ্টি দিন সব ধাইলো সুদূর।
গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে 
যাচ্ছে যে দিন ঝড়ের বেগে।
এখন ফ্যাশন ,চুলের রঙে 
দিন বদলের বার্তা আনে।
জীবন দৌড়ে ব্যস্ত সবাই
করতে হবে পয়সা কামাই।
অফিসে না মিটালে কাজের চাপ
হবে না কখনও সাত খুন মাফ।
জীবনমুখী গানে আঁকতে ছবি
নতুন ভোরে আবার উঠুক রবি।



একান্তই নিজস্ব নির্জনতা

সুশীল দাস

অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে

জীবন থেকে, ধরে রাখতে পারিনি;

লাট্টু, পিট্টু, গুলতি, গল্পের বই, খেলার সাথী

আর ছোটবেলার সেই গল্প শোনার দিনগুলো!

সবই কোথায় হারিয়ে গেছে।

আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও তা পাবার নয়।

 

স্নেহ, আদর, ভালোবাসা

আস্থা, ভরসা, বিশ্বাস

তাও কেমন যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে।

জীবনসূর্য ধাবমান অস্তাচলের পথে -

জীবনের ছায়া ক্রমেই দীঘল হয়

জেঁকে বসে সব হারানোর ভয়।

 

এখন শুধু মধ্যাহ্নের অলস আলসেমিতে

হাতেধরা জীবনের বিবর্ণ খাতা,

শরীরে বয়ে যায় এলোমেলো হাওয়া,

উড়িয়ে নেয় স্মৃতির পাতা।

এ যেন একলা থাকার বিধুরতা,

একান্তই নিজস্ব নির্জনতা।




মেয়ে 
মিষ্টু সরকার

দেবতা আশীর্বাদ করলেন মেয়েকে        
ঋতুমতী হও !                                                           
ফুলে ফুলে ভরে তুলে                                                
এই পৃথিবীকে করো স্বর্গরাজ্য ;                                    
এই একমাত্র বর দ্বারা তুমি হবে সেরার সেরা ।             
মেয়ে ভাবলে কথা খারাপ নয় ।                                 
সৃষ্টির অংশীদার হতে , কার না ভালো লাগে !       
সাজালো পরম যত্নে তার পাথির্ব উদ্যান !          
জানতেও পারল না সে ;                                             
প্রতি ক্ষণে তার নিঃশ্বাসে যার জন্ম                               
মা- না-ভেবে সে তাকে ভাবলো                                 
প্রমোদ উদ্যানের সাধিকা !!                                       
কাল কেটে গেলো যোনি-প্রপাতে......                    
স্বয়ংবরা হয়ে দিগম্বরা                                                 
কাল বিশেষে অর্জুন! কৃষ্ণ! যে এলো না তাও নয় ! 
এখন উল্কি আঁকা গায়ে তার ;ঋতুমতী -র !!             
একটা প্রশ্ন সে বই বেড়ায় এ যাবৎ   ?                         
কেন শুধু !! কেনো !!                                                
"আমি শুধু মেয়ে"                                                       
মানুষ নই কখনো ?                                                       
কেন হয় না পুরুষ ঋতুর মতো                                  
কেন  ঋজুতায় সম্পূর্ণ পুরুষ প্রতিভা ?                          
কেন শুধু মিথ্যের এ যাপন !!                                     
একটা গোটা জীবন অবধি ভোর থেকে সংকল্পে ভোররাত ...........                                                    
কুমোর পাড়ার হই হট্টগোল পারকরে যখন মা আসেন বাড়িতে, পাড়ার মণ্ডপে --                                         
আমরা বেশ ধরে রাখি নান্দনিকতায়।                             
ডাল ভাতের হিসেব বড় লজ্জা দেয় ওই চার দিন   !!    
কিন্তু মা তো মধু বিধুর ও মা ;                                          
সবভার বয়ে চলেন অলক্ষে                                 
অবচেতন বিমূর্ত জীবন                                            
আর চেতন-মূর্ত সংকল্পে                                               
ঠিক যেনো ঝাঁপতালে ধরা পড়ে                               
মাতৃ-মন্ত্রি সাধনার ফসল - "সকলি তোমারি ইচ্ছা" 
বারবার এই লোভেই ; "ভোরের কাক হয়ে" ফেরা..... ইচ্ছারা মূর্ত থেকে হয় বিমূর্ত ;                               
সূর্যোদয় থেকে প্রখর তীব্রতায় !!                                                                                                     
আঁচ
 সৈকত দাম

তিরতির করে বয়ে চলেছে ,
তিতিরের বুকে নদী .....
নদীর নাম মরা কোপাই হোলে ,
আমিও সোনাঝুরী হয়ে যাই .....
সেদিন সে শুনেছিলো ,
কোপাই নাকি বুঁজে গেছে ,
চোখের পাতার মতো .....
শরীরে নদী বয়ে যায় ,
নাকি নদীতে শরীর ,
বোঝা দায় .......
তারপরেও তিতির দেবী হোতে চায় ,
একবার কাশে মাথা রেখে ,
আকাশে শুতে চায় ......
খুব কি বড় চেয়েছে সে ?
এখন তো অনন্যা ,
যে কোনো মেয়ে ......
হলুদ ট্যাক্সি , বাসন কোশন ,
আর চিরাচরিত চিঁড়ে ভাজা পেড়িয়ে ....
তিতিরের চোখ উঠে আসে ওপরে ,
যেখানে লিভ ইন করে স্বপ্নেরা .....
যেখানে দু কামরার ফ্ল্যাটে ভেঙ্গে যায় ,
অযাচিত অপমানের কাঁচ .......
যেখানে তিতিরও পাবে এই শরতে ,
দেবী হওয়ার আঁচ ......
ভরা কোটালে ভরে ওঠে কোপাই‌ ,
তিতিরের বুকে চাঁদ ওঠে ,
টেবিলে আলোকিত বনসাই .......




চাকুরি কি জরুরী 
রাহুল বর্মন

আমরা সকলেই মধ্যবিও
মানসিক দিক থেকে,
চাকুরি করতে হবে এই কথাটা 
শিখছি ছোটো থেকে।
 যদি বলি বাবা আমি
বড়ো হয়ে করব মস্ত এক চাকরি, 
বাবা তার জন্য করেও দিতে পারে
ঘর বাড়ি সব বিক্রি।
যদি বলি বাবা আমি
ব্যবসায়ী হবো বড় হয়ে,
বাবা বলে কী হল তোকে
 এত পড়াশোনা করিয়ে।
 শিক্ষিতরা সবাই চাকরি করে
এই হয়ে আসছে প্রথম থেকে,
আর যদি তোকে ব্যবসাই করতে হয় 
 দোকানে বসবি কাল থেকে।
মধ্যবিত্ত ছেলের ব্যবসায়ীর স্বপ্ন
এইভাবে হয় চুরমার,
সবাই বলে এই স্বপ্ন
 জোড়া লাগানোর নেই দরকার।
কেউ আর বলেনা,
 ভাই তুই এগিয়ে যা,আমি আছি তোর সাথে,
জীবনে ভালো হোক বা খারাপ
আমি আছি সবসময় তোর পাশে।
মধ্যবিত্তের পাশে থাকেনা কেউ
 লড়তে হয় নিজেকে, 
যদি তার উন্নতি হয় কোনোভাবে
লোকে বলবে, হয়েছে তার ভাগ্যে।







ক্রোড়পত্র 






   রঙ করা একটি ছবি:  সৌরিক রায়  (ক্লাস: নার্সারি)




দেবীর আত্মকথন 
তমালী দাস

এই তো,বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে এল।প্রত্যেক বছর এই চারটে দিনের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করি। কিন্তু গিয়েও কি শান্তি আছে!আরে বাবা,আমিও তো সংসার করি।সারা বছর সংসারের উনকোটি চৌষট্টি কাজ,বাচ্চাকাচ্চার ঝামেলা,ভোলেবাবা বর..সব একা হাতে সামাল দিয়ে  বাপের বাড়ি যাই একটু শান্তির জন্য।তা সেখানে গিয়েও এমন ঢ্যাংকুনাকুড় বাজনা,মানুষের উন্মত্ত উন্মাদনায় শান্তি পাওয়ার উপায় আছে!!নিজেরা আনন্দ করবি কর,আমার চারপাশে এমন হাল্লাবোল করার মানে টা কি?কিছুদিন পর থেকেই দেখব,কাশবন থেকে আমার এক একটা রেপ্লিকা বেরিয়ে আসছে!মহালয়ায় তো কথাই নেই। আমি কবে অসুর মারতে গিয়ে এমন জগঝম্প নেচে ছিলাম রে!!অদ্ভুত কেত্তনের বাজনা বাজিয়ে, নেচে কুৃঁদে অসুর বধ করা!!তারপর শুরু হবে কার দুর্গা  কোথায় কি করল..মাঠে ঘাটে,বাজারে শপিংমলে,উনুনের ধারে দুর্গার সাতকাহন। ওরে শোন,তোরা সবাই দুর্গা।সবার ভেতরে সেই শক্তি থাকে।তোরা সেই শক্তিকে গ্লোরিফাই করা বন্ধ কর..শক্তির প্রয়োগ কর।তাকে চিনে নে,বুঝে নে।শক্তির সার্থক ও সদর্থক প্রয়োগ ছাড়া তা মূল্যহীন।একটা কথা জানিস তো?..অহম্ ব্রহ্মাস্মি।নিজের ভেতরের ব্রহ্মকে অবহেলা করা পাপ।তাকে চিনতে,প্রয়োগ করতে..বছরের চারটে দিন যথেষ্ট নয়।জীবনভর তার আবাহন কর।আর হ্যাঁ,এসব করতে গিয়ে আমার মাথা নষ্ট করিস না।আমি বাপের বাড়ি যাই, মায়ের কাছে একটু বসব বলে।ডাল ভাত দুটো খেয়ে মায়ের পাশে শুয়ে দু চারটি  সুখ দুঃখের গল্প করব..মাটির বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসব,পাড়ার লোকের খবর নেব,তাদের বাড়ি গিয়ে নাড়ু মোয়া খেয়ে আসব।দিঘির জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকব,গাছের ছায়া থেকে মায়া জড়াবো।প্রানে আরাম আসবে।ফেরার সময় মায়ের পুরোনো শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে, কষ্ট চেপে বাপ মা কে বিদায় জানিয়ে আসব।এর মধ্যে এত উন্মাদনা ভালো লাগে?বল তো?তোদের ঘরে আলো জ্বলুক,উৎসব আসুক,তোরা খুব ভালো থাক।আমাকেও একটু আমার মত করে ভালো থাকতে দে..তাই না??




দুর্গাপুজোয় মানবতা জাগাতে হবে
বিপ্লব গোস্বামী

শরতের আকাশ জুড়া সাদা মেঘের ভেলা আর রৌদ্র ছায়ায় জানান দেয় এসেছে শারদীয় দুর্গোৎসব।বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গোৎসব।মা দুর্গার অন‍্য এক নাম আনন্দময়ী।দুর্গোৎসব হচ্ছে আনন্দের উৎসব।আনন্দময়ীর আগমনে সবাই মেতে উঠে মহানন্দে।আনন্দের জোয়ারে মেতে উঠে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।সবাই আনন্দ সাগরে ভাসারই কথা কেননা এই দিনটির জন‍্যই তো সবাই একটা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে।তবে আগেকার দিনের পূজো আর এখনকার দিনের পূজোর মধ‍্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।আগেকার দিনের পূজোর দিন গুলোতে ঘুম থেকে উঠে মায়ের অঞ্জলির জন‍্য ফুল তোলা আর পূজা শেষে মায়ের অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ খাওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা।বিকেলে পরিবারের সবার সাথে ঘুরে ঘুরে পূজো দেখা আর ঢাকের তালে তালে ধুনুচি নৃত‍্য এযেন ছিল আগেকার দিনের পূজোর এক বিশেষ রেওয়াজ।বিজয়া দশমীর দিন মহিলারা মায়ের চরণে সিঁদুর দিয়ে সেই সিঁদুর নিজের সিঁথিতে মেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে মাকে বিদায় জানতেন।মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জন শেষে গুরুজনদের প্রণাম ও সমবয়সীদের সঙ্গে কোলাকুলি করা হত।এক কথায় বলতে গেলে আগেকার পূজো ছিল সাত্ত্বিকতার পূজো ।
    কিন্তু এখনকার পূজোয় প্রবেশ করেছে আধুনিকতা।আজ সবাই আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক হতে চলেছে।আর সেই সঙ্গে গ্ৰহণ করছে বিদেশী অপসংস্কৃতি।বিদেশী সংস্কৃতি গ্ৰহণ করা কোন অন‍্যায় বা অপরাধ নয় কিন্তু কোন অপসংস্কৃতি গ্ৰহণ করা একদম কাম‍্য নয়।কারণ অপসংস্কৃতি সব সময় বিনাশকারী হয়ে থাকে।আজকাল তরুণ তরুণীরা উৎসবের নামে শোভাযাত্রাকে  অবাদ মেলামেশার উপলক্ষ বানিয়েছে।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উন্মত্ততা ও অশ্লীলতায় মেতে ওঠে তারা।সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের দেশের যুব সমাজ আধুনিকতায় ডিজিটাল হতে চলেছে।আধুনিক ডিজিটাল হতে গিয়ে নিজ সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলী দিয়ে গ্ৰহণ করছে মদ সংস্কৃতি-ডিজে সংস্কৃতি আর বিদেশী অপসংস্কৃতি।
 বাঙালিদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গোৎসব বা দুর্গাপুজো।আজকাল দুর্গাপুজোও হতে চলেছে ডিজিটাল। হারিয়ে যাচ্ছে সাত্ত্বিকতা। পুজো মণ্ডপে ধর্মীয় গানের পরিবর্তে চলছে ডিজে গান।আজকাল দুর্গাপুজো বা যে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যুবক যুবতীরা যেভাবে যে অঙ্গভঙ্গিতে নৃত‍্য রত হয়  কিংবা রাজপথ দিয়ে শোভা যাত্রা নিয়ে যায় তাতে পাশ্চাত‍্য আধুনিকতা আমদানিতে ভারতীয় সংস্কৃতিকে তারা শুধু লজ্জা নত করছে তা নয় অপমানিতও করছে।
           আজ হারিয়ে যাচ্ছে মানবতা। লক্ষ টাকা ব‍্যয় করে মাটির দুর্গাপুজো করা হচ্ছে।অথচ গর্ভের দুর্গাকে  ভ্রুণেই হত‍্যা করা হচ্ছে।রাস্তায় একা দূর্গা পেলে ধর্ষণ করা হচ্ছে।বিয়ের দুর্গার কাছে পণ চাওয়া হচ্ছে।বড় বিচিত্র এ জিজিটাল যুগ ! আমাদের ডিজিটাল  হতে হবে ঠিকই কিন্তু নিজের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলী দিয়ে নয়‌,মানবতাকে জলাঞ্জলী দিয়ে নয়।যত দিন পর্যন্ত আমাদের মনে মানবতা জাগ্ৰত হচ্ছে না ততদিন প্রকৃত অর্থে জিজিটাল হওয়া সম্ভব নয়।প্রকৃত অর্থে আধুনিক ডিজিটাল হতে হলে অপসংস্কৃতি ত‍্যাগ করে মানবতাকে জাগাতে হবে।




বাজিয়ে দাও পাঞ্চজন্য 
     বেলা দে 

দৈত্যদলনী মা--
নারীশক্তির আঁধার যদি হও
কৃষ্ণ অবতার রূপে এসো এবার,
দুখিনী কন্যার সম্ভ্রম বাঁচাতে 
লজ্জ্বাবস্ত্র এনো সাথে।
নারীর বুকে জমে থাকা
দীর্ঘ যন্ত্রণার নুড়িপাথর 
অক্লেশে শেষ করে দিতে
কামার্তের মস্তক ছেদনে--
বিষ্ণুচক্র ছেড়ে দিও সেইসাথে। 
 জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া কন্যাসন্তান, 
 প্রতিরোজ একটু একটু করে মরে যাওয়া সন্তান, 
  আর মরতে চায় না, 
 চায় না, মোমবাতির প্রতিবাদ,
 এক ফুঁয়ে বিশ্বনারী বাজিয়ে দেবে
   পাঞ্চজন্য শঙ্খনিনাদ।



তবুও আসুক শরত 
      রীনা মজুমদার

শোক কতটা পোড়ায়
   যতটা পোড়ায় এই শরতে!
বুকে চাপা কষ্ট, জেগে ওঠে হারানো প্রিয়জন নিঃশব্দে,
এই ঋতু আসে, শিউলিরা হাসে 
বেদনায় কাঁদে, তর্পণ ভেসে যায় জলে 
  ফিরে যাই ম্মৃতির অতলে
 প্রিয়মুখ হাত ধরে, আমরই কাছে
আমাকেই ঋণী করে

   তবুও শরত আসুক
খুলে দিই মিলন উৎসবের দুয়ার 
সামনে তাকিয়ে, আশার পুষ্পাঞ্জলি ভরি
অশ্রু শিশিরে ভেজা একশ আটটি পদ্মে
মহামায়া , জীবনের কলতান
 শরতের সুরে খুশির ঐক্যতান

   তবুও আসুক শরত...



আগমনী
সন্দীপন দাস

"কাশবন ঘিরে আসে
 শুভ্র, মধুর সুবাস,
 সোনালী রোদের কিরণে'
 ভেসে আসে নয়নের 
কিনারায় ,প্রকৃতির শোভা।
পেঁজাতুলোর মেঘে স্বপ্ন 
আকেঁ মন শরতের ঠিকানায় ;
পুজোর গন্ধে মেতে উঠেছে সমগ্র মর্ত্য।।
মুক্ত হাতের করে গোনা মাত্র;
কয়েকটা দিন বাকি, দুগ্গা আসছে 
 দুগ্গা আসছে, শরৎ এসেছে 
  হে মন।।"




শরতের  জলতরঙ্গ 
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

নীল  আকাশে  উড়ে  যায় ঝাঁকে ঝাঁকে   সাদা সাদা মেঘ
ঠিকানা বদলে দলে দলে ওরা কোথায় চলছে তা ঠিক  বলতে পারি নে।
এক অস্থির বেদনা ছেয়ে আছে দশদিক, 
এই শরৎ যেন শুধুই স্তব্ধতা গ্রাস করে। 

নীল সাদা  সারেঙ্গী তে বেজে ওঠে শরতের  জলতরঙ্গ
রঙের বাহারে খুব সেজেছে শিউলি  গাছটা
পাগল হাওয়া কড়া নেড়ে যায় দুয়ারে দুয়ারে
এ যেন অবিরাম বয়ে চলে  শুধুই মন খারাপের বাতাস। 
এ তল্লাটের আনাচে কানাচে  পথে প্রান্তরে
কখনো বা প্রাণের পরশ মেলে, 
দূরে কোথাও বেজে ওঠে নীল দিগন্তের  টুকরো টুকরো রবিগান।

কাশবনের গা ঘেসে ঝোড়ো উতলা হাওয়া 
বনে বনে শিস দিয়ে ফেরে পরিযায়ী পাখিদের দল
নিমেষে নেমে আসে আনন্দময়ীর আগমন বার্তা।

যেখানে আলো নেই ?  শুধুই আঁধার ? 
সেখানেও আবির মাখা মেঘ, আলো মাখা মুখ
দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করে প্রহরে প্রহরে , 
শরতের জলতরঙ্গ মাঝে,  আবারও নতুন করে 
কারো অস্ফুট কান্না বেজে ওঠে  বুকের গভীরে।



পূজা এখন

মাথুর দাস


পূজা বলতেই হই হুল্লোড়,

ঠাকুর উপলক্ষ্য ;

সাজুগুজু ঘোরাফেরা, আর

চর্ব্য চোষ্য ভক্ষ্য ।


মাইক ডি-জে বাজেই কী যে,

উচ্চস্বরের শব্দ !

কান ফেটে যায় জান কেটে যায়,

স্বরযন্ত্রও জব্দ ।


হই হই চই চতুর্দিকে,

রই কী করে মৌন ?

পূজা এখন সারা বছর-ই,

পঞ্জিকাটি গৌণ ।




মেদুরতা
অলকানন্দা দে

বেঁচে থাকতে স্মৃতির সাহায্য লাগে
যাপিত সময়ের বাক্সটা খুলে আশ্বিনের রোদ খাওয়ানোটা জরুরী তাই
পিছুডাকা মমতাদের এক এক করে মেলে দিই রোদেলা মেলায়
উল্টেপাল্টে সেঁকে নিই যা আছে বুকের অতলে।
দৃশ্যের সারি থেকে তুলে নিলাম এক বিশেষ আহ্লাদকে
অঢেল রূপ নিয়ে আজও আছে জীবনের সেই সুধা
বর্ণনা দিলে হাসবে হয়তো পুরোনো আদলেই
সুস্মিতে ফিরে দেখাল সেই ছবি পুনরায়
ঘুঘু ডাকা গ্রাম্য দুপুরে ঠাকুমার কাজ ছিল পা ছড়িয়ে বসে কাঁথার গায়ে ফুল তোলা!
সুখের দুয়ারে বসে সাবেক বুনে যেত পোষা পাখির ছবি!
আলো ছায়া দিয়ে যেন পশমিনা বোনা হচ্ছে
আমি বলি, তিনিও তো কবি! যিনি কল্পনা আঁকেন মেধাবী সূঁচের শাণিত পরিকল্পনায়!
অঘ্রাণের হিম এলে গায়ে মুড়ে সে কবিতাখানি বলতাম,
ভালোবাসা দাও!
আলোকিত ওমে সুরক্ষিত স্পর্শে জমাট বাঁধা আবেগ!
স্তিমিত লন্ঠনের নীচে চিরচেনা হৃদয়ের সেই ঘরবাড়ি!
হীরক রৌদ্রে মাজা অলোকসুন্দর সকাল বিকেলবেলা
নিশীথের স্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে, ঘুমের ভেতর প্লাবন জাগায় আজ
কিন্তু কবে তার শেষ পরিচ্ছেদ লেখা হয়ে গেল জানলাম না!
একখানি নকশী কাঁথা ছিল জীবন একদিন
সোনার বরণ দিন নিভে গেলে হৃদয় তো থাকে কিন্তু স্পন্দন ভবঘুরে হয়ে ঘোরে!
খুঁজে মরে আকুল শৈশবকে!
আশ্বিনের ধবধবে রোদে হয়তো তুলো হয়ে ওড়া স্মৃতি আরও আসে কাছে
প্রবাসী ভিড়ে কোজাগর স্বদেশকে এনে দেয় উন্মনার কাছে।



রোদবৃষ্টির আগমনী  

প্রতিভা পাল 


আশ্বিনের শরতে এবার বৃষ্টি-রোদের খন্ড জন্ম রচিত, 

সমস্ত আকাশ যেন ধূসর-সাদা মেঘের শহর !

দূর কোনও নিরুদ্দেশে দিশেহারা নীল নীরব,

নিঃশব্দে মুঠো রোদ মেখে 

প্রকাশিত কখনও বা আশ্লেষী হেসে !

জানালার ঘষা কাচে প্রলম্বিত বৃষ্টি বুদ্বুদ

বিস্মৃত গতজন্মের মতো বাষ্পীভূত হঠাৎ !

খর রোদের দিনলিপি লেখে অবসর,পড়ন্ত দুপুরে!

দমকা হাওয়ায় এলোমেলো কাশফুল 

অপেক্ষারত প্রেমিকার অবিন্যস্ত খোলাচুল যেন ! 

শিউলির বৃন্তে শিশিরের বোঝাপড়ায় সামিল-

ঝরে পড়া অবুঝ অঝোর ধারা, অবাধ্য ভীষণ এখন !

মহামায়ার পদধ্বনি এবার জলনূপুরের আয়োজনে!

চণ্ডীপাঠ, ঢাকের আওয়াজ, শঙ্খধ্বনির উচ্চারণে 

আবহমানের সুর স্পষ্ট তবু ! 

চরাচর জুড়ে স্তূপীকৃত অপেক্ষারত অপেক্ষারা

আগমনী গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় আনমনে…..






শরত সমগ্র
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী 

দীপ্ত এক চিরকুট আসে নিসর্গের দরবারে।
প্রেরকের প্রাণোচ্ছল কলমে লেখা থাকে,
'এবার আমার পালা।
কবিতা লিখব এক আশমানি নীল পংক্তিতে।
দুধসাদা ওড়নার মেঘ মেঘ গুচ্ছ কবিতাদের
ভাসিয়ে দেব খেয়ালখুশির ইচ্ছেডানায়।
শিশির ফোঁটার টুপটাপ হবে এক উপাখ্যান।
এক টুকরো রোদ্দুর ছুঁইয়ে 
দ্যুতির আলেখ্য আঁকবো সেই মনভেজা বৃত্তান্তে।
ঝরা শিউলির উপন্যাসের লেখক পরিচিতির
পাতায় রাখবো মাটির নাম।
কাশবনের আলোড়নের গল্প 
সাদা পাতায় লিখবে ওরা নিজেরাই।
শেষটানটুকু দিয়ে গল্পে দোলা লাগাবো আমি।
পদ্মপুকুরের কথকতায় পাঁপড়ি মেলবে ঝিলকমল।
কিছু রহস্য আর অনেকটা রোমাঞ্চ জড়িয়ে 
নাট্যরূপ লিখব রাতজাগা শালুকের গল্পের।
সোনারঙের গোধূলি আর দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠের
কথোপকথন লিখব হাসনুহানার মনকেমনে।
নীল সাদা সবুজের ঐক্যতানে
লিখব সেরা সেই ভ্রমনকাহিনীটি।
অণুগল্প হয়ে রয়ে যাবে
বিলের ধারে বকের বিষন্ন বিধুর নিঃসঙ্গতা বা
পানকৌড়ির ডুবসাঁতারের ছন্দ....'
অভ্যাগত তার পান্ডুলিপিগুলি নিয়ে
 আসন পাতে নিসর্গের মুগ্ধ আমন্ত্রণে।
আয়োজনের পরিপূর্ণতার পরেও 
প্রচ্ছদে ত্রিনয়নী বিষাদমেদুর।
সেই রমনীয় মুখখানি জুড়ে
অগুন্তি সন্তান হারানোর ব্যথা।
মেঘের পালকিতে,শিশিরের অবগাহনে,
শিউলির রূপসজ্জায়
 সমকাল ছুঁয়ে সূচিপত্রে সিক্ত বিষন্নতা।
শারদীয়ার মুক্তগদ্য হয়ে মায়ের যে হাসি 
আলো ছড়াবে ভেবেছিল,
শরতের উজ্জ্বীবিত কলমেও তা ম্লান।
 গ্রন্থটির উৎসর্গে তাই শরত লেখে 
হারিয়ে যাওয়া সেই অনামী নামগুলি 
এবারের শরত সমগ্র যাদের আর পড়া হলোনা।



পুজো পরিক্রমা 
অজয় অধিকারী 

মা, পুজোয় এবার নতুন জামা দেবেনা?
ইস্কুলের সবার হয়েছে, আমার হবেনা?
সেদিন বাবা বলেছিলো,
হাটের থেকে ফিরবে যখন,
নতুন জামা আনবে তখন,
বাবা সেদিন কথা রাখেনি...
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো যখন,
ফিরলো বাবা খালি হাতে, ছেঁড়া জামার ছেঁড়া পকেট থেকে একটা লজেন্স দিয়ে বলেছিলো, " আজ বিক্রি কম ",...
জানো মা, বাবা খুব মিথ্যুক, আমি জানি!!
আমি জানি বাবার বানানো মাটির প্রদীপ এখন কেউ কেনেনা, বিক্রি হবে কিভাবে..
ও মা, বাবাকে বলোনা, অন্য কিছু বানাতে,
প্রদীপ নাহয় বাড়িতেই জ্বালাবো...
আলোর রোশনাই এ ঝকমক করবে,
মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে দীপাবলি কাটবে এবার...

জামা টা এবার বাদ দাও নাহয়," বাবারও তো জামা ছিঁড়ে গেছে, তোমার শাড়িও গেছে ফেঁসে"...

এবার পুজোয় নাহয় পুরোনো তেই কাটুক,
কত মানুষেরই তো এভাবেই চলে,

তবে পুজোয় এত হাঁটতে মাগো পায়ে হয় ব্যাথা,
পারলে আমায় তোমরা একটু নিও কোলে....





শরৎ ও শৈশব
সুস্মিতা ঘোষ 

শরৎ...
তোমার কাছে শৈশব চেয়ে নেব।
আউশের গন্ধ লেগে থাকা ক্ষেতের পাশের পুকুর থেকে
লাল, সাদা শালুক তুলে নেব।
শরৎ, তোমার কাছে শৈশব চেয়ে নেব।

শিশির ভেজা ঘাস, মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যাবে 
আমি দুই মুঠো ভরে শিউলি কুড়িয়ে নেব।
কাশে ঢাকা মাঠ নতুন আলোয় চেয়ে দেখবে
কিশোরীর পায়ের লাল আলতা আলতো মিশে গেছে অদূরে...
ঢাকের কাঠি, খেলনা বাটি, নতুন জামার আনন্দ
সবটুকু ফেরত চেয়ে নেব।
শরৎ, তোমার কাছে শৈশব চেয়ে নেব।

যে শরৎ হারিয়ে গেছে অতীতে,
তোমার কাছে আবার আমার সেই রঙিন শৈশব ,শরৎ চেয়ে নেব।
শরৎ তোমার কাছেই ।





তাদের ঘরেও উমা আসবে 
সারণ ভাদুড়ী (পক্ষিরাজ)

কাশবনে সূর্যোদয়,
উমার আগমন।।
দেবীপক্ষের প্রথম সূর্যে তুমি তাঁকে দেখতে পাওনি?
মহালয়ায় শুনতে পাওনি তাঁর স্তুতি?
মহামুনি স্তব করেছেন তাঁর।
তা কি মিথ্যে ?
উমা ঘরে ফেরেনি?
ষষ্ঠীর বোধনে কিংবা অষ্টমীর অঞ্জলিতে উমা ছিল না?
দশমীর সিঁদুর খেলায় দ্যাখনি মা'কে ? 
দেখেছি।।
নদীর পাড়ে একটা ছোট্ট মেয়েকে 
 মূর্তির মুখে ঠাসা মিষ্টি চুরি করছে।
 পরনে একটা ন্যাকড়া; সঙ্গী নেই তার।
 ক্ষুধার জ্বালায় পারছে না আর ।
হে সমাজ ,
মৃন্ময়ীকে সাজাও তোমরা
দাও তাকে ভোগ
 আমার উমার বেহাল দশা
 নাও না কেন খোঁজ?
 কবে যে বুঝবে হে,
 পুজোর আসল মর্ম?
 চিন্ময়ী কে করবে তুমি শ্রদ্ধা।
 সেদিন ই তবে সূচনা হবে আসল দেবী পক্ষের
 তাদের ঘরেও উমা আসবে হবে শিবের অভিষেক।।



শরত এলেই উমা আসে
          কবিতা বণিক

পদ্মের দল পাপড়ি মেলে
উমা আসবে শরৎকালে। 
মেঘের দল নিয়েছে ছুটি
কদম্ব সব ধূলায় লুটি। 
শিউলি যত পথের ধারে
আগমনী রচে আলপনা আঁকি। 
কাশের বনের দোলা 
যেন ঢাকের বাজনার তাল তোলে। 
বাউলেরা যত নাচে ঘিরি ঘিরি
 'যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী। '
শরৎ রানীর সোনার আলোয়- 
উমার আসার আভাস  জানায়।      
 শরৎ এলেই  উমা আসে  ,    
মা মা বলে ডাকে প্রতি ঘরে। 
আকাশে বাতাসে আগমনী সুর বাজে।



অলৌকিক উপমা 
ছবি ধর

ভোরের শিশির বার্তা দিলো
কৈলাস থেকে আসছেন উমা ।
দুঃখ ভুলে সকলে মাতলো উৎসবে,
বিপুল পসারের অলৌকিক উপমা। 

প্রকৃতির কোলে নানা আয়োজন 
সুসজ্জিত বাদ্য যন্ত্রের অণুরণন।
মান অভিমানের পালা শেষে ,
মেলবন্ধনের স্বতঃস্ফূর্ত  অনুপ্রাণন ।

সংসারের মঙ্গল কামনায় অধীর
মজদুর অভাগী দুর্গারা আজ।
সদলবলে চললো বাপের বাড়ি ,
পরনে নতুন বস্ত্র, মনোহারী সাজ।

শিশিরে ঢাকা ঘাসের গালিচা, 
কাশ,পঙ্কজ শিউলি ফুলের বাহার ।
শরতে মহেন্দ্রক্ষণ এলো বুঝি ওই,
দুর্গার বরণ ডালায় অর্ঘ্য সমাহার।




মহালয়ার ভোরে 

চন্দ্রানী চৌধুরী 


পেঁজা তুলো নীল আকাশে মহালয়ার ভোরে 

রেডিওতে বীরেন্দ্র গান বাজে সবা ঘরে 


আলোর বেণু উঠল বেজে উথাল হল মন 

দশভুজার আগমনে উঠল সেজে ভুবন 


উঠোনেতে হাসি রাশি শিউলি ফুলের দল 

শাপলা পদ্মে মালা গাঁথে ওরা যে চঞ্চল 


ঘাসের ওপর শিশির ঝরে শিরশিরানি গান

কাশের বনে রূপোলী আলো বাজায় মধু তান 


কুমোর টুলি ব্যস্ত ভারি দিচ্ছে তুলির টান 

রঙের প্রলেপ দিয়ে হবে দেবীর চক্ষু দান 


ঢাকে কাঠি পড়ল যেই পুলক জাগে নে 

ছেলে বুড়ো উঠল মেতে মায়ের আগমনে 


পিতৃপক্ষ শেষ হল মহালয়ার ভোরে 

মাতৃপক্ষ শুরু হলে দুর্গা এলো দোরে। 





বিসর্জন
কাকলি ব্যানার্জি মোদক

সবার প্রিয় পাগলা দুঃখী বটতলা তার বাস 
গাজন আসুক,চড়ক আসুক সদাই তাহার নাচ।
শীর্ণদেহ জীর্ন বসন  পেল্লায় জটাধারী
গায়ের রং তামাটে তার ধুলোয় মাখা মাখি।

হাতে তাহার জপের মালা জপের নেই বালাই 
গলায় আছে রুদ্রাক্ষ, ভক্তিগীতি সদাই ।
শিব ঠাকুরের আপন দেশে,পাগলা দুঃখী সুখেই থাকে ,
মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে সদাই আছে ফূর্তি নিয়ে । 


পোটো পাড়ার ভবেন  খুড়ো হঠাৎ কালাজ্বরে 
একদিনেরই নোটিশ সে তে গেলেন পরলোকে।
থানের পুজোর দুর্গা মায়ের চোখ হয়নি আঁকা 
কেমন করে বোধন হবে মূর্তি  হবে গড়া ।

চলো সবাই দুঃখের কাছে  কাজটা করো শেষ 
কাচুমাচু পাগলা দুঃখী   ‌ভয়েই হলো শেষ।
চাপিয়ে ঘাড়ে চলল সবাই একলা ভাবে দুঃখী
জপের মালা জপতে থাকে মাকে স্মরণ করি।

দিনরাত্রি ভাবতে থাকে ঘুম নেই তার চোখে 
খাওয়া-দাওয়া বন্ধ দুঃখীর,বোধন দুদিন পরে।
 

গা ছমছম মধ্যরাত ‌‌পাখিরা সব চুপ
শিউলি ফোঁটার হয়নি সময়  নিঝুম নিঃশ্চুপ।
জোনাকিরা জ্বালিয়ে দেহ রাতের বেলায় দিচ্ছে আলো 
পাগলা দুঃখী একটি কোনে নির্বাক নিঃশ্চুপ।
গা ছমছম মধ্যরাত  পাখীরা সব চুপ।

গা ছমছম মধ্যরাত আলোয় ভরা ঘরে 
আটচালা তে দাঁড়িয়ে আছেন দশভুজা মা যে।
বলল ওরে দেখ না আমায় চোখ খানা নে গড়ে
হাতের উপর হাতখানা রাখ  রং তুলি নে হাতে।

দুঃখীর চোখে অশ্রুধারা হাতে রং আর তুলি 
মায়ের দিকে একপলক চায়, টান দেয় সে তুলির।
এমনি করেই আঁকতে থাকে যত্ন করে চোখ 
দুঃখীর চোখে অশ্রু ধারা মায়ের চোখে চোখ
চক্ষুদান পূর্ণ হলো  মিলিয়ে গেলেন মা
ভোরের আলোয় জানান দিল ষষ্ঠী হলো আজ। ।

পাড়ার ছেলে ভোর হতেই  হাজির চালাঘরে 
ধন্য ধন্য বলল সবাই মায়ের ও রূপ দেখে ।
মা যে গেলেন থানতলাতে বোধনের দিনে 
ঢাক বাজে ঢোল বাজে আত্মহারা সবে। 

ষষ্ঠী গেল সন্ধিপূজা এবার বিসর্জন। 
পাগলা দুঃখী একটি ধারে বসে সারাক্ষণ 
চারদিনের এই একটি দিনও ভাত নেই তার পেটে ,
সবাই তখন ব্যস্ত  ছিল পুজো পুজো নিয়ে ।

পাগলা দুঃখী অবাক হয়ে তাকিয়ে মায়ের মুখে 
অনেক দিনের পরে মা যে আজ এসেছে ঘরে। 
বিসর্জনের ঘন্টা বাজে ,মায়ের বরণ হল সারা 
হঠাৎ দুঃখী জাপটে ধরে মায়ের চরণ খানা ।

দেবো না মা যেতে তোকে রাখবো ঘরে ধরে
যত্ন করে খাইয়ে দিবি,রাখবো মাথা কোলে।

চোখের জলে পা ভিজে যায় মাটিতে গড়াগড়ি।
চরণ খানা জাপটে মায়ের গঙ্গা জলে পড়ি।
 
হ্যঁচকা টানে টানছে সবাই  ঠ্যাৎ,হাত পা ধরে  
কেউ দিচ্ছে চড় থাপ্পর পাগলা দুঃখী বলে।  
ঘন্টা আধেক যুদ্ধ পরে দেখল সবাই  মিলে
নিথর দেহ পাগলা দুঃখী বির্সাজনের আগে। 

মাকে যেই  নিরঞ্জনের ঘন্টা হলো শেষ 
হঠাৎ আকাশ বাতাস জুড়ে গর্জে ওঠে মেঘ।
গঙ্গা মাও উঠল ফুঁসে পঞ্চ ফনার নাচন
গঙ্গা মাও উঠল খেপে উথাল, পাথাল তখন।

আছড়ে পড়ে দুঃখী উপর ভাসিয়ে নিয়ে চলে    
চোখের পলকে মিলিয়ে গেল গঙ্গা মায়ের বুকে।
ভোরের আলোয় দেখল সবাই অবাক করা দৃশ্য
দুর্গা মায়ের কাঠামোতে ঝুলছে দুঃখীর দেহ।।




নিরঞ্জন 
আকাশলীনা ঢোল 

মণ্ডপে মণ্ডপে সিঁদুরের হোলিখেলা,
ঢাকের বাদ্যে মিশেছে বিষণ্ণতার সুর-
মৃণ্ময়ী মাকে শেষ দর্শনের উচ্ছ্বাস 
যেন, নগরের আনাচে-কানাচে,
মিষ্টিমুখ, দর্পণে প্রতিবিম্ব, শুভেচ্ছাবার্তা,
এসব নিয়েই দশমী সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। 
অগুন্তি মানুষের জলসা বসেছে 
নদীর ঘাটে ঘাটে,
খানিক বাদেই নিরঞ্জিত হতে থাকবেন 
একের পর এক 'মৃণ্ময়ী'।
সেই দৃশ্য দেখবার জন্য, লালায়িত 
যেন গোটা সমাজ-
শুধু দশমীর সন্ধ্যায় নয়, এমন হাজারও 
নিরঞ্জন প্রতি মুহূর্তে দেখতেই 
অভ্যস্ত অত্যাধুনিক সভ্যতা। 
হাজারও চিন্ময়ীর নিরঞ্জনের পর 
রক্তস্রোতে হোলি খেলাতেই 
তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস-
চিন্ময়ীর পরিত্যক্ত ভ্রূণেই যেন তৈরি হবে 
মৃণ্ময়ীর নূতন কলেবর। 




দুর্গা পূজা
রাজা দেবরায়

দুর্গাপূজা এখন দুর্গোৎসব।
দেবী দুর্গার পুজোৎসব!
ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব।
আশ্বিন বা চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে
দুইবার দুর্গাপূজা করা হয়।
আশ্বিন মাসের দুর্গাপূজা
শারদীয়া দুর্গাপূজা হয়।
চৈত্র মাসের দুর্গাপূজা
বাসন্তী দুর্গাপূজা কয়।
শারদীয়া দুর্গাপুজোর
জনপ্রিয়তা খুব বেশি।
বাসন্তী দুর্গাপুজোতে
কয়েকটি পরিবার থাকে খুশি!




দুর্গাপূজা 
চন্দ্রকান্ত সরকার


দুর্গাপূজা  মহাপূজা, ভরা রমরমা
বাঙালির আনন্দের, নাইকো সীমা।

      কাশবনে, পূজোর হাওয়া
শরৎ আকাশে, খুশির ছোঁয়া।

 ঢাক-কাশি-শঙ্খ ধ্বনি, ছড়িয়ে
পূজোর আবেগ, মন যায় রঙিয়ে।

 বছর পর আসিছে মা, সাথে সন্তান
সেই আনন্দে বাঙালি গান, আগমনী গান।

মহাষষ্ঠীর দেবী বোধন, অধিবাস এবং আমন্ত্রন
মহাসপ্তমীর কলাবউ স্নান, নবপত্রিকা স্থাপন।

মহাষ্টমী পূজোয় সর্বসাধারণ দেন অঞ্জলি
দেবীতে সমর্পণ, কামনা-বাসনা-আকাঙ্ক্ষা ডালি।

মহাষ্টমীর পশুবলি, এককালে ছিল চলন
চালকুমড়া, আঁখ বলিতে, নিয়ম হচ্ছে পালন।

সন্ধিপূজো সম্পন্ন, অষ্টমী-নবমী সন্ধিক্ষণে
       অশুভ শক্তির বিনাশ বিশেষ লগ্নে।

নবমীর পর দশমী, পূজোর অবসান
কয়টি দিনের আনন্দে, ভরে না প্রাণ।

দশমীর মিষ্টি বিতরণ, সিঁদুর খেলা, কোলাকুলি
মাকে নিয়ে শেষ আনন্দ, করেন বাঙালি।

সবশেষে বিসর্জন, মন দুঃখে ভরে
আবার আসিবে মা, একটি বছর পরে।



বিজয়া 
 সুমন্ত সরকার

বাতাসে বহিছে বিজয়ার সুর
কৈলাশে যাবে ফিরে দুগ্গা ঠাকুর,
ঘরে ঘরে মায়েরা বলে 
বরণডালা সাজা,
শশুরঘরে ফিরে যাবে
জগৎজননী উমা।
ফিরে যাবে শশুরঘরে 
যে পথ ধরে উমা,
সেই পথ ধরেই আবার 
আসবে ফিরে শ্যামা।
বিদায়বেলায় সবার মনে
দুঃখের নেই শেষ, 
শ্যামা এলেই কেটে যাবে 
সব কষ্টের রেশ।
মেঘের ওই বুক চিরে
দেবাদীদেব বলে,
অনেক তো হলো উমা এবার
ফিরে এসো ঘরে। 
তুমি এলেই যাবে আবার
আমার মা লক্ষ্মী,
সবাই আবার মেতে উঠবে
করবে শুধু ধন্যি ধন্যি।
সবাই বলে মাগো তুই
যাবি যখন যা,
আসছে বছর এই শরতে 
আবার আসিস উমা।





অদ্রিজা বোস 
 


মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩০ 

No comments:

Post a Comment