শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রীমতী শমিতা রাহার প্রীতি উপহার মুজনাইয়ের সকল লেখক, পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীকে.....
আমরা আপ্লুত
Sunday, October 15, 2023
Monday, October 2, 2023
সম্পাদকের কথা
উৎসব প্রিয় এই রাজ্যের সেরা উৎসব আসন্ন। কমবেশি সবাই প্রস্তুত। কিছুদিনের জন্য সব গ্লানি ও কৌলিন্য পেছনে ফেলে মেতে উঠবে সকলে মাতৃ পুজোয়। প্রাত্যহিকতার থেকে এই মুক্তি অবশ্যই কাম্য। যদিও আমরা রয়ে যাই সেই তিমিরেই। এত প্রার্থনা, এত আরাধনাতেও মা তাকান না। কিংবা তাকান। আমরা হয়ত বুঝি না। বুঝি না বলেই নব উদ্যোমে আবার শুরু করি সব। মাতৃ পুজোর শিক্ষা এটাই। হাল ছাড়তে নেই। মা শিখিয়ে যান প্রতি বছর।
মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩০
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
প্রকাশক- রীনা সাহা
প্রচ্ছদ ছবি - শৌভিক রায়
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩০
সূচি
স্মরণ
গান্ধী পার্ক
পোর্ট ব্লেয়ার
ছবি- শৌভিক রায়
শ্যাওলা
সুবীর সরকার
বর্ষা ফুরোয় না। তেঁতুলপাতা বৃষ্টি জলে ভেজে।
ঘুমিয়ে পড়ি হাইওয়ের পাশে।
নদীকে সমুদ্র ভাবি,নদীতে জলযান ভাসে
এদিকে মানুষের মিছিলে ঢুকে পড়ছে
উঠোন ও শ্যাওলা ডিঙিয়ে সেই কবে থেকেই তো
দিগন্ত পেরিয়ে
কিশোর মজুমদার
এ ফোর কাগজে টাঙানো ছিল ছবি
এ ফোর ও ফোর হয়েছে হৃদয় খানি
বদলের হাওয়া দোলায়নি'ক মন
শরীরী বাঁধনে দু'চোখের হয়রানি।
গন্ধগোকুল ছুঁয়ে গেছে মাঝ রাতে
জানালার পাশে নীরব গোপন হাওয়া
'কেমন আছো?' বোরিং প্রশ্ন এসে
অস্বস্তির পাশে নীরবে কাওয়ালী গাওয়া ।
দু'ধারে রেখেছো বন-গাছালির সারি
দু'কথা উঠোনে রিমিঝিমি অনুরাগে
দু'পাশে ঠেলেছি কথার ঢেউয়ের আঁচড়
দু'দিন শান্তি। বুঝে গেছি আগে ভাগে ;
একলা আকাশে ছড়ানো হয়েছে আবির
তোমারই মতন হাসতে পারিনি বলে
রেখে গেছো তুমি গাছ-গাছালির বারুদ
উপহার নামে বদলা সুকৌশলে ।
চুপ করে লেখা মন মাঝিকে চিঠি
নষ্ট আবিরে স্পষ্ট অতীত স্মৃতি
হাড় জিরজিরে অতীত আসেনি কেঁদে
অনুরাগে বীণা সেধেছিল মনবীথি।
সে বনে আমার বাস করে একতারা
সে বনে আজও চাঁদ একা গান গায়
সেখানে তবু জ্যোৎস্নার রূপরেখা
আজও পরবাসে কাঁদে ব্যথা বেদনায়।
লীনা রায়
দীপাঞ্জন দত্ত
তুমি যাকে আপন ভেবেছো
আজ সে হয়েছে পর।
আপন খেয়ালে গুছিয়ে নিয়েছে
নিজের ছোট্ট ঘর।
আজ যে নদী হারিয়ে স্রোত
কাল সে ভাঙবে বাঁধ।
নিজেকে বিলিয়ে দশের প্রতি
সব-ই করেছো বরবাদ।
তুমি যাকে আপন ভেবেছো
ভেঙেছ নিজের ঘর!
সময় মতো সে গিয়েছে দূরে
কোথাও অতঃপর।
ভাষা- নেপালি
কবি কৃষ্ণনীল কার্কীর কবিতা
অনুবাদ: বিলোক শর্মা
১. কেবল ইতিহাসের পাতায়
চোখে শুরু হয়েছে জলুসতার নৃত্য
মুক্ত রয়েছে হাতের বন্ধনগুলো
নিস্তব্ধতাকে দূরে সরিয়ে
পায়ে তালে তাল মেলাতে তৎপর সবাই
সময় বদলে যাওয়ার ভাবনায় বয়ে চলে যারা
আকাশ ও চাঁদের দিকে না তাকিয়েই
পূর্বানুমানের বীজ ছড়ায়
ঝঞ্ঝার তান্ডব নৃত্যে
সম্ভাবনার সব প্রবেশপথ বিক্ষিপ্ত হয় যখন
স্মৃতির অবশেষ মাত্রই থেকে যায় ভগ্নাবশেষরূপে
যা মাথা উঁচু করে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করে
কেবল ইতিহাসের পাতাগুলোতে।
২. ভিড়ের মধ্যে একটি কবিতা
মনের ভিতরে তরঙ্গিত ভাবনার অভিব্যক্তি
কবিতা সৃজনের একটি ইতিবাচক সংকেত
বয়ে চলা ঢেউ অনিয়ন্ত্রিতভাবে
এগিয়ে চলে সৃজনশীলতার বিন্দুর দিকে
হঠাৎ ঘন মেঘের ধাক্কায়
বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে একটি আশা
একত্রিত করার চেষ্টায় ফের মশগুল হলেও
এক করা যায় না আগের মতো
ভাবনার বিক্ষিপ্ততাকে
প্রতীক্ষায় রয়েছে একটা ভিড়
স্বপ্নগুলোর মূল্যায়ন করতে
ঈর্ষার বোঝা কাঁধে নিয়ে
বদলে যাওয়া সময়ে কাঁধের উপর হাতগুলো দেখা দেবে হয়ত
তবে, ততক্ষণে সমাধিস্থ হতে চাইছে ভাবনারা।
(অসমের কৃষ্ণনীল কার্কী একজন কবি ও নাট্যকার হিসেবে পরিচিত। কবির তিনটি কবিতা সঙ্কলন, দুইটি নাটক এবং একটি গল্প সঙ্কলন প্রকাশিত রয়েছে।)
মুক্তগদ্য
গল্প
গ্রীণ কার্ড
মিনি
শেষরাতে একটা অদ্ভুত আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। অন্ধকার ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা 'ফোঁফোঁ' আওয়াজ আর দরজায় আঁচড়ানোর শব্দ। দক্ষিনাবাবু প্রথমত ভীষণ চমকে গেলেও পরে বুঝতে পারলেন, এইটা মিনি’র কাজ। পাশে শয়নরতা স্ত্রী'কে আশ্বস্ত করলেন,"মিনি আওয়াজ করছে। তুমি শুয়ে থাকো, আমি দেখছি।"
-"এইরকম অদ্ভুত আওয়াজ তো ও কোনোদিনও করেনি!"
-" কি জানি কেন? মনেহয় বাইরে যেতে চাইছে।" দক্ষিণাবাবু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
মিনি একলাফে বারান্দায় তারপর বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে একলাফে উঠোনে গিয়ে নামলো। তারপর আবার ফিরে এসে বারান্দার গ্রিলে মুখ গলিয়ে দক্ষিণাবাবুর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আবার সেই 'ফোঁফোঁ' আওয়াজ করতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে তার পরিচিত সুরে 'মিঁউ-মিঁউ' করেও ডাকছিলো। কিন্তু মিনি'র ভাবভঙ্গীর অভিব্যক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে সে চরম মাত্রায় উত্তেজিত।
ষাটোর্ধ্বা পূরবীদেবীও কৌতূহলবশত উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাইরের বারান্দায় এলেন। ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে।
দক্ষিণাবাবু বিরক্ত হলেন,"তোমার ওই কোমর আর হাঁটু নিয়ে নড়তে পারোনা, অথচ......?"
-"কি জানি বাবা? মিনি তো সবসময় জানালা দিয়েই বাইরে আসা যাওয়া করে, হঠাৎ দরজা দিয়ে কেন বের হতে চাইলো !! ....."
মিনি এবার আবার উঠোনে গিয়ে নামলো তারপর উঠোনের ওপর দাঁড়িয়ে দক্ষিণাবাবু ও পূরবীদেবী'র দিকে তাকিয়ে অনবরত সেই অদ্ভুত আওয়াজটা করেই যাচ্ছে। এমনকি আশেপাশের বাড়ির কুকুরগুলোও আশ্চর্যভাবে 'উঁঊঊঊ" করে ডেকে উঠলো।
আচমকা দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার পায়ের নিচে জমি সরে গেলো। স্বভাবতই তাল সামলাতে না পেরে কোনোক্রমে মেঝেতে বসে পড়লেন। মাথার ওপর বারান্দার টিনের চাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে। একশো বছরের পুরোনো দোতালা বাড়িটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল। প্রলয়ঙ্কর ভূমিকম্পের আড়োলনে ধংসস্তূপের নিচে চাপা পড়লেও বারান্দা ঘেঁষা সুবিশাল কাঁঠালগাছের কল্যানে প্রাণে বেঁচে গেলেন।
পশুপাখিরা অনেক আগে থেকেই বিপদের আভাস পায়, তার হাতেনাতে প্রমান পাওয়া গেলো।
দুদিন বাদে হসপিটাল থেকে বাড়িতে এসে চোখের জল সামলাতে পারছিলেন না। বাপ-ঠাকুরদার তৈরি ভিটে একদম ধূলিসাৎ। আশেপাশে শুধু কান্নার রোল। কিন্তু তাদের প্রিয় মিনি'কে কোথাও দেখা গেলোনা। হাতেপায়ে খুব ব্যাথা থাকায় বেশি হাঁটাচলা করতে পারলেন না। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই এখন নিজের দুর্দশা নিয়েই অস্থির, তাই পোষা প্রাণীদের খবর কেউই রাখেনি। বিগত পাঁচ বছর ধরে ‘মিনি’ বুড়ো-বুড়ির সাথে এঁঠোকাঁটা খেয়েই কাটিয়েছে। ঘর থেকে বাইরে যাবার আগে জীবনটাও বাঁচিয়ে প্রতিদান দিয়ে গেছে। ঘরের ভেতরে থাকলে আজ তো চাপা পরেই শেষ হয়ে যেতেন। আজ তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলোনা ভেবেই দক্ষিণাবাবু খুব দুঃখী হয়ে পড়লেন।
খুব মোলায়েম আর মিহি একটা 'মিঁউ-মিঁউ' শব্দ বুকের ভেতরে বাজছিলো। মাঝে মাঝেই এদিক ওদিক তাকিয়ে চমকে উঠছিলেন। কিন্তু সবই মনের ভুল।
কলকাতা থেকে ছেলে এসে হাজির। আজকেই চলে যেতে হবে। আসবাবপত্রগুলো একটা ভাড়ার গুদামে রেখে এসে ছেলে তার মা'কে ধরে গাড়িতে তুললো।
-"চল, বাবা ট্রেনের সময় হয়ে যাচ্ছে।"
দক্ষিণাবাবু'র মন অন্যদিকে। আশেপাশে যাকেই পাচ্ছেন তাকেই মিনি’র কথা জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু কেউ বলতে পারলোনা। ভারাক্রান্ত মনে গাড়িতে এসে বসলেন।
-"মিনি সময়মত না ডাকলে আজ আমরা বেঁচেই থাকতাম না।"
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা'র চোখে প্রিয়জন হারানোর দুঃখের শোক। দরদর করে নামছে জলের ধারা।
-"দুঃখ করোনা বাবা, বিড়ালরা ওরকম চলে যায়। সাধারণতঃ বাড়িতে দেহত্যাগ করেনা।"
ছেলের কথাটা বুকের মধ্যে বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধলো। চোখটা ঝপ করে বুজতেই নোনাজলের ফোটা'র অনুভূতি।
দক্ষিণাবাবু কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলেন না। সারাটা জীবন বহু পশু-পাখি পুষেছেন। তাদের হারিয়ে অনেক দুঃখ পেয়েছেন কিন্তু নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। যেন এক নিদারুন হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি। কোথায় গেলো মিনি? কেমন আছে? খেতে পাচ্ছে কিনা, এইসব প্রশ্নের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়ে চলেছেন।
দক্ষিণাবাবু নিজের শহরে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন। বন্ধুর কাছেই খবর পেলেন ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে নির্দিষ্ট দিনে অফিসারের সামনে বসে ফর্মে সই করে জমা দিতে হবে। একাই দার্জিলিং মেল ধরে বেরিয়ে পড়লেন, সোজা নিউজলপাইগুড়ি।
সাত সকালেই বাস ধরে এলেন রাণীনগর শহরে। ভাবছিলেন হোটেলে উঠবেন কিন্তু বাল্যবন্ধু সমীররঞ্জনের একান্ত অনুরোধে তার বাড়িতেই উঠতে হলো।
-" বিডিও বলেছেন, ক্ষতিপূরণের দরখাস্তর ফর্ম টা সই করে আনার জন্য এই অফিসারের বাড়িতে যেতে হবে, উনি অসুস্থ তাই। বুঝলি?"
-"সে বুঝেছি। তবে যেখানে তার বাড়ি, একদম শহরের শেষপ্রান্তে ঐদিকে জীবনেও কোনোদিন যাইনি।"
-"আমিও ভালোভাবে চিনিনা। দেখি আমার ছেলেকে তোর সাথে যেতে বলবো। আমি তো প্রায় পঙ্গু।"
-"থাক থাক। ঠিক খুঁজে নেবো। একটা ফোন নম্বর তো দিয়েছে।"
পরদিন ফোনে সেই অফিসারের বাড়ির এলাকা বুঝে রিকশায় উঠলেন। রেললাইনের গা ঘেঁষে বেশ দূরে একদম শহরের বাইরে একটা পরিত্যক্ত গুমটির কাছে দাঁড়ালেন। তারপর আসেপাশে দু-একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ি খুঁজে পেলেন। ভদ্রলোক সত্যিই অসুস্থ। তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে ফর্ম সই করিয়ে জমা নিয়ে নিলেন।
-"দিন পনেরোর মধ্যেই একটা এসএমএস পেয়ে যাবেন। তারপর ব্যাংকে যোগাযোগ করবেন।“
ধন্যবাদ জানিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে এলেন। রেলগুমটির কাছে গেলেই রিকশা পাওয়া যাবে। চারদিকে ছোট ছোট টিনের চালা দেওয়া বাড়ি। বেশ খোলামেলা এলাকা। এদিকে ভূমিকম্পের তেমন কোনো প্রভাব হয়নি।
রাস্তার পাশেই হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গায় দৃষ্টি একদম আটকে গেলো। বুকের ভেতরে ধড়াস করে উঠেই প্রবল উত্তেজনায় হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। তিনটে বিড়াল রোদে শুয়ে আরাম করছিলো। তার মধ্যে একটা মুখ তুলে চেয়ে স্থির হয়ে আছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ অজান্তেই বেরিয়ে এলো,"মিনি!"
কিছুক্ষন অপলক চেয়ে থাকার পর সম্বিৎ ফিরে পেলেন। ধীরে ধীরে কাছে যেতেই অন্যান্য বিড়ালগুলো পালিয়ে গেলো। কিন্তু মিনির মতো দেখতে বিড়ালটা একটু ফারাকে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। একদম মিনির মতো, সারা শরীরে সাদা ধূসর রঙের প্রলেপ। লেজের মাথায় আর বাঁ চোখের উপর সেই কালো ছোপ। দক্ষিণাবাবু মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে একদম কাছে। বিড়ালটা পালালো না। দুইচোখ বড় বড় করে দক্ষিণাবাবু'র মুখের দিকে চেয়ে রইলো।
আবার আস্তে ডাকলেন,"মিনি!"
উত্তর এলো,"মিঁউ!"
একদম মিনির মতো আওয়াজ।
অজানা উত্তেজনায় বুকের ভেতরে স্নায়ুর আড়োলনে তোলপাড়। কপালে ফুটলো বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আশেপাশে কয়েকটা কৌতূহলী বখাটে ছেলেরা দাঁড়িয়ে গেলো।
-"আপনার বিড়াল নাকি?"
-"তা তো জানিনা দাদুভাই। দেখে তো ঐরকমই মনে হয়।"
-"আপনার অনেক বয়েস তো তাই ভুলভাল দেখেন।" অসভ্য ছেলেপেলে গুলো খিকখিক করে হেসে উঠলো।
সামনের বাড়ি থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। সব শুনে বললেন আমাদের এলাকায় প্রচুর কুকুর বেড়াল। ভূমিকম্পের পরেই কোথা থেকে সব এসে হাজির হয়েছে আমরাই জানিনা। আপনার লাগলে নিয়ে যেতে পারেন। তবে ওই বিড়ালটা যদি যেতে চায়। একদম জোরজার করবেন না কামড়ে দিতে পারে, সাবধান।
দক্ষিণাবাবু বিড়ালটার মাথায় হাত রাখলেন। খুব মিহি একটা 'মিঁউ ' শব্দ করলো।
উত্তেজিত দক্ষিণাবাবুর হঠাৎ মনে পড়ল মিনি'র কানের পেছনে একবার গরম তেল পড়ে ফোস্কা পড়েছিল। সেই ঘা'র চিকিৎসা মাসখানেক চলেছিল।
কানের পেছনে লোম সরাতেই বিস্ময়ে প্রচন্ড চমকে উঠলেন। এবারে যেন সারা জগৎ সেই ছয় রিখটারের ভূমিকম্পের চেয়ে কয়েকগুন বেশি জোরে দুলে উঠলো। চোখ ফেটে নামলো অবিরাম জলধারা। মুখ হাঁ হওয়া সত্বেও মুখ দিয়ে কোনো শব্দ করতে পারছিলেন না। আকস্মিক আনন্দে কাঁপা গলায় অনেক কষ্টে বললেন,"মিনি।"
মিনি কিন্তু আবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা তফাৎ হটলো।
দক্ষিণাবাবুর গলা দিয়ে সেই পুরোনো ধমকের সুর অজান্তেই বেরিয়ে এলো। মিনি রাস্তায় বের হয়ে দুস্টুমি করলেই বা স্নান করতে না চাইলেই তিনি বেশ জোরে বকতেন,"মি-নি!"
এবারে মিনি অস্বাভাবিক চমকে গেলো। কোনো বাধা দিলোনা। দক্ষিণাবাবু তাকে কোলে ওঠালেন। মিনি তার পুরোনো কায়দায় বাবুর বুকে নাক ঘষে বুঝিয়ে দিলো সে চিনতে পেরেছে। তারপর সে পরিচিত মিহি ডাক,"মিঁউ!"
দক্ষিণাবাবু আকাশের দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে, মুখ তুলে ঈশ্বরকে স্মরণ করলেন।
একান্তই নিজস্ব নির্জনতা
সুশীল দাস
অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে
জীবন থেকে, ধরে রাখতে পারিনি;
লাট্টু, পিট্টু, গুলতি, গল্পের বই, খেলার সাথী
আর ছোটবেলার সেই গল্প শোনার দিনগুলো!
সবই কোথায় হারিয়ে গেছে।
আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও তা পাবার নয়।
স্নেহ, আদর, ভালোবাসা
আস্থা, ভরসা, বিশ্বাস
তাও কেমন যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে।
জীবনসূর্য ধাবমান অস্তাচলের পথে -
জীবনের ছায়া ক্রমেই দীঘল হয়
জেঁকে বসে সব হারানোর ভয়।
এখন শুধু মধ্যাহ্নের অলস আলসেমিতে
হাতেধরা জীবনের বিবর্ণ খাতা,
শরীরে বয়ে যায় এলোমেলো হাওয়া,
উড়িয়ে নেয় স্মৃতির পাতা।
এ যেন একলা থাকার বিধুরতা,
একান্তই নিজস্ব নির্জনতা।
পূজা এখন
মাথুর দাস
পূজা বলতেই হই হুল্লোড়,
ঠাকুর উপলক্ষ্য ;
সাজুগুজু ঘোরাফেরা, আর
চর্ব্য চোষ্য ভক্ষ্য ।
মাইক ডি-জে বাজেই কী যে,
উচ্চস্বরের শব্দ !
কান ফেটে যায় জান কেটে যায়,
স্বরযন্ত্রও জব্দ ।
হই হই চই চতুর্দিকে,
রই কী করে মৌন ?
পূজা এখন সারা বছর-ই,
পঞ্জিকাটি গৌণ ।
বেঁচে থাকতে স্মৃতির সাহায্য লাগে
যাপিত সময়ের বাক্সটা খুলে আশ্বিনের রোদ খাওয়ানোটা জরুরী তাই
পিছুডাকা মমতাদের এক এক করে মেলে দিই রোদেলা মেলায়
উল্টেপাল্টে সেঁকে নিই যা আছে বুকের অতলে।
দৃশ্যের সারি থেকে তুলে নিলাম এক বিশেষ আহ্লাদকে
অঢেল রূপ নিয়ে আজও আছে জীবনের সেই সুধা
বর্ণনা দিলে হাসবে হয়তো পুরোনো আদলেই
সুস্মিতে ফিরে দেখাল সেই ছবি পুনরায়
ঘুঘু ডাকা গ্রাম্য দুপুরে ঠাকুমার কাজ ছিল পা ছড়িয়ে বসে কাঁথার গায়ে ফুল তোলা!
সুখের দুয়ারে বসে সাবেক বুনে যেত পোষা পাখির ছবি!
আলো ছায়া দিয়ে যেন পশমিনা বোনা হচ্ছে
আমি বলি, তিনিও তো কবি! যিনি কল্পনা আঁকেন মেধাবী সূঁচের শাণিত পরিকল্পনায়!
অঘ্রাণের হিম এলে গায়ে মুড়ে সে কবিতাখানি বলতাম,
ভালোবাসা দাও!
আলোকিত ওমে সুরক্ষিত স্পর্শে জমাট বাঁধা আবেগ!
স্তিমিত লন্ঠনের নীচে চিরচেনা হৃদয়ের সেই ঘরবাড়ি!
হীরক রৌদ্রে মাজা অলোকসুন্দর সকাল বিকেলবেলা
নিশীথের স্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে, ঘুমের ভেতর প্লাবন জাগায় আজ
কিন্তু কবে তার শেষ পরিচ্ছেদ লেখা হয়ে গেল জানলাম না!
একখানি নকশী কাঁথা ছিল জীবন একদিন
সোনার বরণ দিন নিভে গেলে হৃদয় তো থাকে কিন্তু স্পন্দন ভবঘুরে হয়ে ঘোরে!
খুঁজে মরে আকুল শৈশবকে!
আশ্বিনের ধবধবে রোদে হয়তো তুলো হয়ে ওড়া স্মৃতি আরও আসে কাছে
প্রবাসী ভিড়ে কোজাগর স্বদেশকে এনে দেয় উন্মনার কাছে।
প্রতিভা পাল
আশ্বিনের শরতে এবার বৃষ্টি-রোদের খন্ড জন্ম রচিত,
সমস্ত আকাশ যেন ধূসর-সাদা মেঘের শহর !
দূর কোনও নিরুদ্দেশে দিশেহারা নীল নীরব,
নিঃশব্দে মুঠো রোদ মেখে
প্রকাশিত কখনও বা আশ্লেষী হেসে !
জানালার ঘষা কাচে প্রলম্বিত বৃষ্টি বুদ্বুদ
বিস্মৃত গতজন্মের মতো বাষ্পীভূত হঠাৎ !
খর রোদের দিনলিপি লেখে অবসর,পড়ন্ত দুপুরে!
দমকা হাওয়ায় এলোমেলো কাশফুল
অপেক্ষারত প্রেমিকার অবিন্যস্ত খোলাচুল যেন !
শিউলির বৃন্তে শিশিরের বোঝাপড়ায় সামিল-
ঝরে পড়া অবুঝ অঝোর ধারা, অবাধ্য ভীষণ এখন !
মহামায়ার পদধ্বনি এবার জলনূপুরের আয়োজনে!
চণ্ডীপাঠ, ঢাকের আওয়াজ, শঙ্খধ্বনির উচ্চারণে
আবহমানের সুর স্পষ্ট তবু !
চরাচর জুড়ে স্তূপীকৃত অপেক্ষারত অপেক্ষারা
আগমনী গান ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় আনমনে…..
সুস্মিতা ঘোষ
তোমার কাছে শৈশব চেয়ে নেব।
আউশের গন্ধ লেগে থাকা ক্ষেতের পাশের পুকুর থেকে
লাল, সাদা শালুক তুলে নেব।
শরৎ, তোমার কাছে শৈশব চেয়ে নেব।
শিশির ভেজা ঘাস, মৃদু বাতাস ছুঁয়ে যাবে
আমি দুই মুঠো ভরে শিউলি কুড়িয়ে নেব।
কাশে ঢাকা মাঠ নতুন আলোয় চেয়ে দেখবে—
ঢাকের কাঠি, খেলনা বাটি, নতুন জামার আনন্দ
সবটুকু ফেরত চেয়ে নেব।
শরৎ, তোমার কাছে শৈশব চেয়ে নেব।
যে শরৎ হারিয়ে গেছে অতীতে,
তোমার কাছে আবার আমার সেই রঙিন শৈশব ,শরৎ চেয়ে নেব।
মহালয়ার ভোরে
চন্দ্রানী চৌধুরী
পেঁজা তুলো নীল আকাশে মহালয়ার ভো
রেডিওতে বীরেন্দ্র গান বাজে সবা
আলোর বেণু উঠল বেজে উথাল হল মন
দশভুজার আগমনে উঠল সেজে ভুবন
উঠোনেতে হাসি রাশি শিউলি ফুলের
শাপলা পদ্মে মালা গাঁথে ওরা যে
ঘাসের ওপর শিশির ঝরে শিরশিরানি
কাশের বনে রূপোলী আলো বাজায় মধু
কুমোর টুলি ব্যস্ত ভারি দিচ্ছে
রঙের প্রলেপ দিয়ে হবে দেবীর চক্
ঢাকে কাঠি পড়ল যেই পুলক জাগে ম
ছেলে বুড়ো উঠল মেতে মায়ের আগমনে
পিতৃপক্ষ শেষ হল মহালয়ার ভোরে
মাতৃপক্ষ শুরু হলে দুর্গা এলো দো
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন আশ্বিন সংখ্যা ১৪৩০