Friday, November 3, 2023


 

সম্পাদকের কথা

উৎসবের এই মরশুমে ঝলমলে চারধার। প্রকৃতিও গ্রীষ্ম ও বর্ষার দীর্ঘ বৈপরীত্য কাটিয়ে নিজের মতো শান্ত, সমাহিত। উৎসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার পরতে পরতে নতুন আলো। তবু আলো যদি কাটিয়ে তুলতো অশিক্ষা, অজ্ঞতা আর নির্ধনের অন্ধকার তবে আসতো পরম প্রশান্তি। আলোর উৎসবে প্রার্থনা এটাই। জীবন হোক আলোকিত। প্রকৃত জ্ঞানে।  

 

 

মুজনাই অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪৩০

 রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন) 

প্রকাশক- রীনা সাহা  

প্রচ্ছদ ছবি - রঙ্গত, আন্দামান/ শৌভিক রায়  

সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪৩০

 

 

 লেখক সূচি


উমেশ শর্মা, চিত্রা পাল, বেলা দে, গৌতমেন্দু নন্দী, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, মৌসুমী চৌধুরী, মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী, দেবর্ষি সরকার, দেবযানী ভট্টাচার্য, লীনা রায়, উদয় সাহা, শ্রাবণী সেন, সারণ ভাদুড়ী, রীনা মজুমদার, প্রতিভা পাল, মজনু মিয়া, মহম্মদ সামিম, সঞ্জয় (এস. সাহা), মনোমিতা চক্রবর্তী, বটু কৃষ্ণ হালদার, বিপ্লব গোস্বামী, উৎপলেন্দু পাল, দেবদত্তা লাহিড়ী, মৌমিতা বর্মন, রেজাউল করিম রোমেল, মিষ্টু সরকার, সুমন্ত সরকার, নিতাই দে, আশীষ কুমার বিশ্বাস, রীতা মোদক, মধুমিতা শীল

ছবি
 
আকাশলীনা ঢোল ও চিত্রাক্ষী রায়

 

 

 ছবি


 আকাশলীনা ঢোল

 

 

 

আলো আমার আলো ওগো

 

আলোকের ঐ ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও ----

গৌতমেন্দু নন্দী 

মনের অবদমিত অন্ধকার, অপরাধপ্রবনতা, পাপস্বার্থপরতা,লোভ, ক্ষমতা-লিপ্সা,ক্রোধ----এইসব অনাচার ,অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা এই যাপিত জীবনে মানবতার মুখোস পরে থাকে। অশুদ্ধ চিত্তের শুদ্ধিকরণ হয় উৎসব--উদযাপনে। মনের "নেতি" অন্ধকার দূর হয়ে আলোকিত হয় উৎসবের আলোয়।সেই আলো উৎসব--প্যান্ডেলের হাজার হাজার ওয়াটের নয়, প্যান্ডেল, প্যান্ডেলের চোখ ধাঁধানো লাইটিংএর নয়, সেই আলো উৎসব-তাৎপর্যের, সেই আলো সম্প্রীতি, সংহতির। সেই আলো নিয়ম -নিষ্ঠার শৃঙ্খলাবোধের। 

    প্রান্তিক কোন জনপদের  সেই আলো  অনেকসময় ছাপিয়ে যায় নগর-শহরের জৌলুসতাকেও।শরতের  অরুন আলোর অঞ্জলিতে নদী, জলাশয়ের চারপাশে স্নাত কাশফুলের শুভ্রতা, ভোরের আলোয় শিশির সিক্ত ঘাসের উপর শিউলির ছড়িয়ে থাকার শারদীয় দৃশ্য আমাদের আলোকিত
করে মনে ও প্রাণে। উৎসবের নিজস্ব আলো আছে। সেই আলো আমাদের উৎসব-ইতিহাস ও ঐতিহ্যের।
              সেই ঐতিহ্য--আলো নিয়েই তথাকথিত অনালোকিত প্রান্ত-জনপদও শারদোৎসবের সেই মুহূর্তগুলোতে আলোকিত হয়ে ওঠে যখন দেখি সপ্তমীর সকালে "নবপত্রিকা"কে স্নানের উদ্দেশ্যে পাল্কিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোন নদী, পুকুর বা জলাশয়ের দিকে। শরতের সোনালী রোদ্দুরের সঙ্গে তখন মিশে যায় সেই ঐতিহ্যের আলো। সেই আলোতে তখন আলোকিত হয়ে মনের যতো মলিনতাও ধুয়ে যায়। শুদ্ধ হয় চিত্ত, উন্মুক্ত হয় হৃদয়।
     শারদোৎসবের উৎসে ধর্ম থাকলেও তার তাৎপর্য ধর্মান্ধতার গন্ডি ছাড়িয়ে সম্প্রীতি ও মিলনেই।উৎসবের সেই আলোয় আলোকিত হয় সংহতি, দূর হয় জাতি, ধর্মের সংকীর্ণতার অন্ধকার। তাইতো দেবীর সাজে, প্যান্ডেল-মন্ডপের সজ্জায় বা আলোর শিল্পে স্পর্শ থাকে অন্য ধর্মের কিংবা সেই উৎসব কমিটির প্রধান সদস্য পদটিও কখনও কখনও আলোকিত করে রাখে অন্য ধর্মের কোন ব্যক্তি। এই "আলো"ই তো উৎসবের আলো, সার্থকতার আলো, বোধের আলো, জ্ঞানের আলো,
  ঐতিহ্যের আলো। 
      উৎসবের অরুণ আলোর সোনার--কাঠির স্পর্শে এইভাবেই বিকশিত হয় মানবতা,  নিখিলের আনন্দ-
ধারায় ধুয়ে যায় মনের কোণের সব দীনতা, মলিনতা। উৎসব-আলোকের ঝরনাধারায় এইভাবেই লুকিয়ে থাকা যাবতীয় অন্যায়, অপরাধের ধুলা ঢাকা  ধুয়ে যায়। বিশ্বকবির কথা-সুরে তখন উচ্চারণ করতেই হয়-

    " আলো আমার আলো ওগো,আলো ভুবন ভরা
   আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা।
    নাচে আলো নাচে,ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে--
    বাজে আলো বাজে,ও ভাই, হৃদয়বীণার মাঝে...."
 
 
 
শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি 
বেলা দে   

 শরৎ যেতে যেতে তার অরুণ আলোর অঞ্জলি মুঠো ভরে ছড়িয়ে যায় প্রকৃতির গায়, হিমেল আবহ নিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলা ক্যালেন্ডারের সপ্তম মাস ষঢ় ঋতুর চতুর্থ ঋতু। তাইতো পাতলা কুয়াশায় মাঠ ভরে সোনার ফসলে, বাজারে নবাগত শাক সবজিরা পসরা সাজিয়ে উপচে পড়ে সেখান থেকে  গৃহস্থের ঘরে ঘরে, কার্তিক মানে রসনার মুখবদল কার্তিক মানে চাষিবউ এর মুখের ভূগোলে নীরব  জ্যোৎস্নার আলো মাখা। সিঁদূরে আদরে শাখা হাত পেতে দেয় একথালা ফুলেল ভাত। ওদের চাহিদা মিশে আছে মাটির সাথে, তৃণসমান সহনশীলতায় তাদের জন্ম ও যাপন, অতি অল্পেই দাম্পত্য সুখ গৃহের আনাচেকানাচে, আগাম চাল উঠলে সে দিয়ে  কার্তিক পুজার বরের হাড়ি সাজে, লৌকিক আচার অনুযায়ী মাটির হাড়িতে চাল উঠলে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। ভোরের হাওয়ায় শিরশিরানি, হিমেল আস্তরণ প্রারম্ভিক শীতের জানান দিয়ে হেমন্ত আসে দ্বারে। হালকা শীতের ঢাকনা জড়িয়ে ঘুমবিলাসীর ঘুমের আমেজ আর ভ্রমণবিলাসী পায়ে চাকা লাগিয়ে নেবার মোক্ষম সময়। ঋতুরানী হেমন্তের রূপবৈচিত্র কবির কলমে ঝাঁপিয়ে নামে কাব্যবৃষ্টি। 



আলো 'আমার' আলো 'ওগো'
দেবর্ষি সরকার

রাত তখন বারোটা বেজে তিন মিনিট দেওয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে বেজে চলা মোরগটির কর্কশধ্বনির শান্ত শীতল মৃদুমন্দ ঢেউয়ের আঙ্গিনায় সামান্য দোলা চালের বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ যে নিতান্তই স্বাভাবিক অভিমান বর্ণিত পুরাকালের পরিপন্থা হবেনা সেই কথা গীতায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করে বলাও মহাপাপ বই কি পুণ্য হবেনা ? সহজ সরল আলোচনায় ফেরা যাক। ভাতের হাড়ির ঢাকনা সমেত, জ্বলন্ত দুধের ফুটন্ত ফেলা সমেত,নীল অপরাজিতার লাল গন্ধ সমেত একজন মানুষ দলিত শ্রেণীর পথ দিয়ে হেঁটে চলেছিল অমানবিকতার দীর্ঘ দেহীর সন্ধানে হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতই মানুষটির স্বার্থপরতার থলে থেকে সমগ্র মেদিনীকে ওলোটপালট করে জন্ম নিল 'আলো।' স্মৃতির আলো, উৎসবের আলো, মন খারাপের আলো, কবিতার আলো, উপন্যাসের আলো, মিলনের আলো, প্রেমের আলো।

ভাতের ফ্যানে চায়ের জল, মেঘের শরবতে ছাতুর পিন্ড মিশিয়ে সেই আলো আজ দীর্ঘ দেহী অষ্টাদশবর্ষী এক যুবা। সকালে দশ টাকার পুডিং দুপুরে পান্তার জল আর রাতের মদের ফোয়ারায় অবিশ্রান্ত কদর্যতার সামনে শিক্ষিত বালির মত ল্যাদ খেয়ে পড়ে থাকে। বারো মাসে তেরো পার্বণের ইচ্ছাময়ীর পুত্র অসীম সাহসী ননীর পুতুলের ইচ্ছে হয়েছিল বুকের পাটায় হাই কারেন্টের ভোল্টেজ বেঁধে নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা মাপবে। আলোর কোন কাজ নেই। ননীর পুতুলের প্রেমিকা সেই নুনের পুতুল আজও গভীর রাতে ছাতিম তলায় হাসির ফোয়ারায় নিজেকে নিয়ে মেতে থাকে। সেই দলের আংশিক প্রভাব পড়েছে আলোর দৃষ্টিভঙ্গিতে। শরতের এক বৃষ্টি ভেজা রাতে সেই আলো খুঁজে পেল তার 'আমিত্ব' কে। ভালোবাসার আমিত্ব, ভালো লাগার আমিত্ব, ভালো থাকার আমিত্ব, সবুজ ডালে লাল গোলাপের আমিত্ব, নিস্তব্ধ রাতের আমিত্ব, শপিং মলের আমিত্ব, উৎসবের আমিত্ব, স্বার্থপরতার জামা পড়ে থাকা আমিত্ব। প্রচুর আমিত্ব, আমিত্বর প্রচুরতা দীর্ঘমেয়াদি।

আলো আজ নিস্তব্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে আমিত্বের রঙের ফুল চাদরে মোরা কফিনে। আলো আজ মরে গেছে ! আলো হয় মৃত্যু পথযাত্রী ! আলো যে কদিন বেঁচে ছিল প্রত্যেকদিন চারবার হাতের কাজে মনোনিবেশ করেছে মনোনিবেশ করেছে রাতে খাওয়া আর দিনের সাংসারিক ল্যাদে কিন্তু কবিতা লেখবার কদর্যতায় সে নিজেকে জড়ায়নি। দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার সবুজ সোনালী ফসল আজও মাথা নুইয়ে বসে আছে আলো রঙের সেই জাফরানি উপন্যাসের পাতায়। ক'জন গেছে! ক'জন চুপ করে শুয়ে আছে কিন্তু জিলিপি খোরদের স্বাভিমান আজও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি আলোর সেই মৃতশরীর। আলোর সমাধিক্ষেত্রের সবুজ ভূমিতে ফুটে উঠেছে 'আমার তুমিত্বের' হলুদ গোলাপ।
 
 
 
 
 
বদ্ধ মনন 
উমেশ শর্মা

ইচ্ছে তুমি উড়তে পারো পায়ের মধ্যে শেকল পরো 
লাটাই ধরে সীমার মাঝে অসীম পানে ছুটতে পারো।
 মুক্ত মনে বন্দি তুমি
 দেশ ঘুরে বদ্ধ ভূমি 
বলতে গিয়ে স্বল্পকথায় বলার কথা কাটো ছেঁড়ো।
 
 
 
 
আলো আমার আলো
দেবযানী ভট্টাচার্য
 
যতবার এ জীবনে এসেছে অমাবস্যার ধূসর অন্ধকার,
ততবার আড়ালে জ্বেলেছ আগুন
জ্বালিয়েছ দীপ ভালোবাসার।
 
 
 
শেষ বিকালের বৃষ্টি
                 লীনা রায়

শেষ বিকালের ছন্নছাড়া রোদ
হঠাৎ লুকোয় মেঘ পরতের বুকে,
বেসামাল আজ জমাট জলের কুচি
ভিজছে সময় বৃষ্টি কথার সুখে।

জল আদরে অগুনতি পল পার
হাতছানি দেয় ধোঁয়াটে জলছবি,
কদম গন্ধা বৃষ্টি বিকেল জুড়ে
কথার পিঠে কথার আঁকিবুকি।

ডাক দেয় সাঁঝবাতি চুপ রাত্রিকে
অপেক্ষায় জেরবার ক্ষন অনুক্ষন,
বৃষ্টির জলে ধুয়ে পাটকিলে রং
রিমঝিম সুর তোলে সবুজাভ মন।
 
 
 
 
পরিযায়ী প্রেম
 উদয় সাহা

এরপর আলপথের দু'পাশে আলো-
সবুজ। সোনালী৷ 

ক্ষয়িষ্ণু দিনের দৈর্ঘ্যে যাবতীয় পাখপাখালি 
নিশ্চুপ বিকেল-পাখির ডানায় গলে যাচ্ছে সম্পর্কের লবণ 

নোনাধরা কৌটোকাটার পাশে 
ঘন হয়ে আসছে নতুন চাঁদ 

এ সময় বনফায়ারের আভায় নৌকাডুবির 
 
 
 
হৈমন্তী 
শ্রাবণী সেন
 
এখন সকাল, রোদ করে ঝলোমলো
হাতের মুঠোয় কুড়োনো শিউলি ফুলে
সিক্ত শিশির স্মৃতিমাখা টলোমলো 
হেমন্ত রোদ কঠোরতা গেছে ভুলে।

মুঠোয় ভরেছে কত দুখ সুখ যেন
বড় দূর তাই মনে মনে  কাছাকাছি 
শিউলি গন্ধ নস্টালজিক কেন!
ভুল ঠিক করে নেই কোনো বাছাবাছি।

হিম ধরা রাত, জোনাকির মত জ্বলে
আকাশের চোখে  গাঢ় হল মাসকারা
চেনা পথঘাটে সন্ধে নামল বলে 
নিবিড় আঁধারে তারাদের আসকারা। 

 এখন নিঝুম রাত্রি গভীরতর
কুয়াশা সামলে কোন তারা দেয় উঁকি!
 একলা নদীর স্রোত হলে খরতর
পার হয়ে এস, না হয় নিলেই ঝুঁকি!
 

 

 সারণ ভাদুড়ী 

হেমন্ত এখানে সংখ্যালঘু,
হেমন্ত এখানে হারিয়ে যায়

রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরের দীর্ঘশ্বাসে;

আর অবশিষ্ট টা উঁকি দেয় ন্যাড়া জিগা গাছে ।দীপান্বিতার যোগ আসলেও
কৃষ্ণপক্ষের আকাশে দেখা যায় কালপুরুষ
দীপান্বিতার প্রদীপ জ্বলে
সোলতা পোড়ে না
পুড়ে যাই আমি
পুড়ে আমার বিবেক;  পুড়ে আমার চেতনা ।
আমার ভালোবাসার ফানুস উড়ে না,
জলে নিচে নেমে যায়।
আমি তবুও হারাতে চাই না
বাঁচতে চাই প্রদীপের জোৎস্নায়
টুনি বাল্বের আলোয় আত্মঘাতী আমি

 

  আলোর কারিগর

 রীনা মজুমদার


যে পথশিশু রোদে জলে ভাসে
 তাকে দিতে পার না একটুকরো চাঁদ?
তবে বুঝি তুমি আলোর কারিগর

 যে নারী শরীরে এক সুতো কাপড় হীন 
    তাজা রক্তে জলে নদীতে ভাসে
 সেই অমানুষ কে দিতে পার না 
 মোমবাতি নিভিয়ে প্রেমের আলো? 
 তবে বুঝি তুমি আলোর কারিগর 

আলো অন্ধকারে মধ্যেই বেঁচে থাকা
 তবুও আঁধার ছেয়েছে মননে বাতাসে 
  ক্ষণিকের রোশনাইয়ে ভরে ভুবন 
 উৎসব শেষে আঁধারেই জীবন ভাসে

বন্ধ করো না তোমার সেই আলোর কারখানা
     হে কারিগর..
 যে একটি প্রদীপ থেকে শতসহস্র আলো জ্বলবে
    সেই জীবন পথের আলো জ্বালাও 
  জানি, তুমিই সেই আলোর কারিগর।
 
 
 
 

হেমন্তর খোলা চিঠি…

প্রতিভা পাল 


শরতের বালুকাবেলায় হেমন্তর খোলা চিঠি -

ভালবাসার অশ্রুত শব্দ সম্ভারে আঁকে

শীতের অরূপ সজ্জা ! 

শিশির-ভেজা ঘুমন্ত ভোরের চোখে 

অনুভব আলতো রোদ ছুঁয়ে রোজ

রঙিন এক-একটি দিন লিখে দেয় সংক্ষেপে ! 

পাকা ধানের ঘ্রাণ কানাকানি করে, ঘুরপাক খায়

শিরশির বাতাসে, সুখের হাসি মেখে

স্বপ্নগুলো শিহরণ তোলে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতে!

ঝুপ করে সন্ধ্যা নামা আঁধারের মলাটে 

আকাশ প্রদীপ জ্বালায় অনন্ত আলোর অভিসার!

কুয়াশার টুপটাপ ছন্দে নিঃস্ব হলে রাত 

জোরাল হয় শীত শিরায়-শিরায়, অচিরেই ;

পাতা ঝরার মরসুমে স্তূপীকৃত অভিযোগের খামে

উষ্ণতা মাখে এই খোলা চিঠির স্মৃতি !

হেমন্তর অনুরাগে উচ্চারিত হয় 

শরৎ-শীতের অনন্য সন্ধিক্ষণের 

মায়াময় এক স্নিগ্ধ অনুভূতির আবৃত্তি…… 

 

 

ডোল পাকা ধানের খেত

মজনু মিয়া 

হে ধরণী তোমার বুকে,ডোল পাকা ধানের খেত ;
মৃদু বায়ে দোলে কৃষকের মন ভরে,চোখ জুড়ায়।
তুমি কী অপরূপে সাজিয়েছো ধরা! মুগ্ধ তাতে-
বিমোহিত মাধুর্যে, ভালোবাসায় ভরে যায় বুক।

চারিদিকে ধান সরস ভূমির বুকে, আলোলিত প্রাণ
কার্তিকের মাঠ,ঘরের সুখ ফিরিয়ে আনে;নবরূপে।
পাকা ধান কাটে কোথাও কোথাও, কিছু কাটার মত;
যৌবনের গাঙে জোয়ার খেলা করে, ভরা কার্তিকে।


 বন্দর

মহম্মদ সামিম

জোনাকি জানে, মুঠোয় ধরে রাখা যায় না তুমুল আলোর স্রোত 
অন্ধকারেও থোকা ফুলের বীজ ছড়িয়ে
সমুদ্রকন্যা হয়ে ওঠে এই সন্ধ্যা 
জন্মে ও জাগরণে সন্ধিস্বর, নতজানু হয়ে বসি
প্রদীপের নীরবতার কাছে 
শিখাটি দেবস্মিতা, ঠিক ছেড়ে চলে যাবে একদিন 
পৃথিবী — অন্নের সুহাসিনী আধার 
মাটিতে বিছিয়ে রাখে পুরনো ধান,
ঘুমের ভিতর মরে যাওয়ার আগে, পাশে গিয়ে দাঁড়াই
দেখি, সমস্ত সীমা ভেঙে গেছে
শিশিরের বেদনা দিয়ে নিজেকে শুদ্ধ করি
অভিমানে সম্পৃক্ত জীবন, বিচ্ছেদে ঢেউ পুষে রাখা।

 

 

 

 
 প্রবন্ধ
 
জলপাইগুড়ি :দুর্গাপূজার দর্শনার্থীদের এক মনোরম গন্তব্যস্থল
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

তিস্তা বঙ্গের বিভাগীয় শহর জলপাইগুড়ি,  গোটা উত্তরবঙ্গের শিল্প সংস্কৃতির পীঠস্থান।  কোলকাতা থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহর, শারদোৎসবের প্রাক্কালে বর্ণময় শোভায় সেজে ওঠে। সুন্দরী  তিস্তা নদী ও শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া করলা নদীর ঘেরাটোপে এই জনপদে, আনন্দময়ীর আগমনে, আনন্দে দশদিক  ছেয়ে যায়। 

কোলকাতা থেকে দার্জিলিং মেল,  পদাতিক এক্সপ্রেস, উত্তর বঙ্গ এক্সপ্রেস বা তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে  রাতের ট্রেনে চেপে বসলেই পরদিন সকালেই  পৌছে যাওয়া যায় বঙ্গ সংস্কৃতির পীঠস্থান এই শহরে।
পশ্চিম বঙ্গে সরকারের টুরিজম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের অতিথি নিবাস" তিস্তা আবাস " ছাড়াও গোটা কুড়ি হোটেল রয়েছে শহরজুড়ে। আগেভাগে বুকিং করা থাকলে তো ভালোই। না থাকলেও এ শহর অত্যন্ত অতিথিবৎসল। এখানে সবারই জন্য আশ্রয় রয়েছে। ১৫ কিলোমিটার দূরে তিস্তা নদীর পার করলেই গরুমারা, লাটাগুড়ি, বাতাবাড়ি, চালসা, মেটেলি, মালবাজার, ওদলাবাড়িতে শ'য়ে শ'য়ে রিসর্ট ও হোম স্টে রয়েছে। 

পঞ্চমী তিথি বা দেবীর বোধনের আগেই মন্ডপ গুলোতে প্রতিমা এসে যায়। বর্ণময় আলোক সজ্জায় সেজে ওঠে মন্ডপ সহ গোটা শহর।  এই শহরের একটা বিষয় লক্ষণীয় সেটা হল, এই শহরের প্রবেশ পথগুলোতে প্রথম মন্ডপের আলোক সজ্জা শেষ হতে না হতেই আর একটা মন্ডপের আলোক সজ্জা শুরু হয়ে যায়।
শহরের সব পূজোগুলোতে আড়ম্বরপূর্ণ উদবোধনের ঘটা না থাকলেও, 'তরুণদল', 'দিশারি ', 'জাগ্রত সংঘ','অরবিন্দ ব্যায়ামাগার পাঠাগার ও ক্লাব', 'শহরতলী' 'শান্তিপাড়া নেতাজী মর্ডান ক্লাব', ' রায়কত পাড়া বারোয়ারী ',  ' নরেন ভিলা"  পান্ডাপাড়া সার্বজনীন ", 'পান্ডাপাড়া কালীবাড়ি দূর্গাপজা কমিটি ' প্রভৃতি পুজো গুলোতে স্থানীয় মন্ত্রী বিধায়করা ফিতে কেটে উদবোধন করে থাকেন।

আদরপাড়ায় "রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের " দুর্গাপূজার দিকে সব দর্শনার্থীদের আগ্রহ বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়।অষ্টমী তে কুমারী পুজো এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া রোজ সন্ধ্যায় সুবিশাল মাঠ জুড়ে খিচুড়ি ভোগ খাওয়ানোর বিষয়টা ধারাবাহিক ভাবে শহরবাসীকে মুগ্ধ করে। 

বৈচিত্রপূর্ণ আদরপাড়া ক্লাব ও পাঠাগার এবং প্রগতি ব্যামাগারের  বনদূর্গা খুবই দর্শনার্থীদের মনকে টানে

জলপাইগুড়ির প্রাচীন বাড়ির  পুজোগুলোর মধ্যে, 'নিয়োগী বাড়ির দুর্গাপুজো', ' কল্যাণী হাউসের দুর্গাপুজো  '  এবং 'ভুঁইয়া বাড়ির ' দুর্গাপূজার বিশেষ  নাম আছে।  

"নিয়োগী বাড়ির দুর্গাপুজোয়" সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়। 

"ভুঁইয়া বাড়ির দুর্গাপুজো " তে সাত সাগরের জল মা'কে দান করা হয়। একবার এই বাড়ির  পুজো চলাকালীন মায়ের মূর্তির সামনে জীবন্ত সাপ এসে উপস্থিত হয়েছিল। 

জলপাইগুড়ি শহর ছাড়াও ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, মালবাজারেও মহা সাড়ম্বরে দেবী দূর্গার আরাধনা হয়। কথিত আছে নিষ্ঠার সাথে দেবী দূর্গার পুজো করলে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়।

জলপাইগুড়ির রাজবাড়ীর দুর্গাপূজারও এক ঐতিহাসিক পটভূমি আছে।  রাজবাড়ীর মৃম্ময়ী মূর্তির কিছু বিশেষত্ব আছে।প্রাচীন কাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে জলপাইগুড়ি র  রাজবাড়ী সংলগ্ন মন্দিরে মহা সাড়ম্বরে দূর্গা পুজো অনুষ্ঠিত হয়। আরও ২৫ /৩০ টি পুজোর সাথে সাথে এই পুজোর আকর্ষণ একদমই আলাদা। সাধারণত মা দূর্গার ডান পাশে লক্ষী ও গনেশ এর মূর্তি এবং বাম পাশে সরস্বতী ও কার্তিকের মূর্তি থাকে।  কিন্তু জলপাইগুড়ি রাজবাড়ীর ক্ষেত্রে মা দূর্গার ডান পাশে প্রথমে গনেশ পরে লক্ষীর মূর্তি থাকে। লক্ষী এবং বিজয়ার মূর্তির মাঝে একজন পুরুষ দেবতার মূর্তি থাকে।  কেউ কেউ এই মূর্তিকে ব্রহ্মা 'র মূর্তি বলে থাকেন। অনুরূপ ভাবে দেবী দূর্গার বাম পাশে সাধারণত সরস্বতী ও কার্তিক এর মূর্তি দেখা গেলেও রাজবাড়ীর প্রতিমায় বাম পাশে সরস্বতী ও পরে কার্তিকের মূর্তি দেখা যায়।  কার্তিকের পাশে  দেবী জয়া পূজিত হন। প্রতিমার বর্ণ, গঠন ছাড়াও এই মন্দিরে,  লক্ষী,গনেশ,কার্তিক, সরস্বতী ছাড়াও জয়া ও বিজয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।  জয়া কে উৎকর্ষতার প্রতীক অর্থাৎ সরস্বতী হিসাবে পূজিত হন। বিজয়া তিনি যাকে ছাড়া বিজয়  অসম্ভব।  শ্রীহীন বা লক্ষীর উপস্থিতি ছাড়া বিজয় সম্ভব নয়,  তাই বিজয়া লক্ষী হিসেবে পূজিত হন। 
দুর্গোৎসবের সময়ে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে পূজিত হন দূর্গারূপিনী চামুন্ডা অর্থাৎ মহাকালী।  ইনি কালরাত্রি কৌশিকী। কালরাত্রির ললাট থেকে করালবদনা চামুন্ডার জন্ম। চামুণ্ডা হলেন মহামায়া। মহামায়া দ্বার না ছাড়লে প্রকৃতির দর্শন হয় না।

জলপাইগুড়ি রাজবাড়ীর গৃহদেবতা বৈকুন্ঠনাথ  ও দশভুজা ভগবতী একই আসনে অধিষ্ঠিতা। দশভুজার দশটি হাতে শূল,শর, শক্তি, চক্র  ডান দিকের হাত গুলিতে শোভা পায়।  বাম দিকের হাত গুলিতে শোভিত পাশ, খেটক, ধনু, কুঠার এবং অঙ্কুশ শোভা পায়।  দেবী ডান হাতে শুল ধারণ করে অসুরের বুকে বিধিঁয়েছেন। মহিষের কাটা গলা থেকে অসুরের জন্ম। অসুরের বামবাহু কামড়ে ধরেছে একটি বাঘ। বাঘ এবং সিংহের উপর স্থাপিত দেবীর ডান পা। দেবী নানা অলংকারে সজ্জিত।  দেবীর মুখ ডিম্বাকৃতি। চোখ দুটি কোটরগত এবং ভীষনা। তৃতীয় নেত্রটি ও খুবই স্পষ্ট। 

আজও নবমী পুজোর রাতে গোপনে কি যেন বলি দেওয়া হয়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক উমেশ শর্মা মহাশয়ের " উত্তরবঙ্গের মূল নিবাসীদের সংস্কৃতি,  ইতিহাসের আলোকে  বৈকুন্ঠপুরের  পূজা পার্বণ  ও লোকাচারের ধারা  বইটিতে তার উল্লেখ আছে। কেউ কেউ বলেন প্রাচীন কালে এখানে নরবলির প্রচলন ছিল। কিন্তু আসলে এটি একটি কুলোর উপর কুশ ও আতপচালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষের রূপ দিয়ে তাকে বলি দিয়ে করলায় বিসর্জন দেওয়া হয়।

এই পূজো দেখতে দেশ বিদেশের বহু দর্শনার্থীরা জলপাইগুড়িতে  আসেন। বিজয়া দশমীতে রাজবাড়ী সংলগ্ন পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়।  বিসর্জনের ঘাটে প্রচুর দর্শনার্থীদের সমাগম হয়।
 
 
 
শতবর্ষের আলোকে মৃণাল সেন / তাঁর চলচ্চিত্রে মানবতাবাদের প্রভাব।
সঞ্জয় (এস.সাহা)


ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও লেখক মৃণাল সেন,নিয়ম ভেঙ্গে চলচ্চিত্র বানাতেই তিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন । তাঁর চলচ্চিত্র পাল্টে দিয়েছিল বাংলা ছবির ধারাকে। বলাবাহুল্য বাংলা চলচ্চিত্রের আধুনিক রুপরেখা  দিয়েছিলেন তিনি । আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই পরিচালকের প্রতিটি ছবিতে ক্ষুদ্র গলি থেকে রাজপথ আর বস্তি থেকে অট্টালিকায় যে চিত্র তিনি তুলে ধরেছিলেন তাতে ফুটে উঠেছিল  মানবতার চিত্র।  যা আর শেষ পর্যন্ত শুধু কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে অর্থাৎ বিশ্বমানবে। আর সেখানেই মিণাল সেন নির্মাতা হিসেবে অনন্য আর সবার থেকে আলাদা ।

ছাত্র রাজনীতিতে বেশ দাপটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মৃণাল সেন । ছাত্রাঅবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । এরপর তিনি সমাজবাদী সংস্থা "ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন" এর সঙ্গে যুক্ত হন । এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি সমভাবাপন্ন মানুষের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হন । কিংবদন্তি এই চলচ্চিত্র পরিচালকের শততম জন্মবার্ষিকী । ১৯২৩ সালের ১৪ই মে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন । বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও লেখক মৃণাল সেনের জন্ম বার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা । 

"আমি দুর্ঘটনাবশত চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করি,
    আর বাধ্য হয়ে লেখালেখি করি "।
                                     ------    মৃণাল সেন 

লেখালেখি তে বোধ হয় বেশ হতাশ হয়েই তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন । কারণ লেখার মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য বা মনের ভাব কোনটাই যথাযথভাবে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না । ১৯৫৬ সালে নির্মিত 'রাত ভোর' ছিল তার প্রথম চলচ্চিত্র । আর এই ছবিটি নিয়ে পরবর্তীকালে তিনি বেশ হতাশ ছিলেন । এরপর ১৯৫৯ সালে এল  'নীল আকাশের নিচে' আর 'বাইশে শ্রাবণ'।
পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত' 'বাইশে শ্রাবণ ' সেই অর্থে কোনো ঐতিহাসিক দলিল নয়, ইতিহাস এখানে অনুঘটকের কাজ করেছে মাত্র । ব্যক্তি মানুষের পারস্পারিক সম্পর্কের রসায়ন, সংকটকালীন পরিস্থিতিতে মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অপরিহার্য মানবতাবাদই এই ছবির মূল উপজীব্য ।  

মৃণাল সেন বরাবরই মানবতাবাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন । তাঁর চলচ্চিত্রের মূল বিষয় ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় । মানুষের কথা দর্শকদের দৈনন্দিন হাঁফ ধরার জীবনে একটুখানি বিনোদনের ব্যবস্থা করা তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজে বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরে বিবেককে জাগ্রত করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য ।

তাঁর চলচ্চিত্র ছিল বিশ্ব মানবতার প্রভাব । তার গল্প প্রকাশের মূল প্রক্রিয়াটি বুঝতে হলে গল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে একে একে অতিক্রম করতে হবে। এতে তৎকালীন বঞ্চিত শ্রেণীর প্রতি তাঁর সহানুভূতি ও মধ্যবিত্ত সমাজের মিথ্যা জীবনযাপনের প্রতি কটাক্ষ সহজেই নজরে পড়বে। তাঁর নির্মাণ কৌশলে তৎকালীন বামপন্থী সমাজ ব্যবস্থা ও শ্রেণীর বৈষম্য দূরীকরণে এর  ব্যর্থতার প্রতি তীব্র সমালোচনা লক্ষনীয়। 

১৯৬৫ সালে 'আকাশ কুসুম' সিনেমাটি নির্মাণের মাধ্যমে তাঁর মানবতাবাদী রূপটি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছিল । একজন মধ্যবিত্তের উচ্চাভিলাষ ও তা প্রাপ্তির জন্য যেকোনো পন্থা অবলম্বনের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিটি মধ্যবিত্তের মনে সুপ্ত রয়েছে তাকেই তিনি তুলে ধরেছিলেন । 
তৎকালীন চলচ্চিত্র জগতের প্রথাগত গল্পের বাইরে গিয়ে সমাজের বাস্তবতার গল্প এবং স্বকীয় নির্মাণ শৈলীর কারণেই মৃণাল নির্মিত 'ভুবন সোম' (১৯৬৯) তথাকথিত বিনোদনমূলক চলচ্চিত্রের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ছিল। এই চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্যের মাধ্যমে 'নিউ ইন্ডিয়ান' সিনেমা নামে সমসাময়িক ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে বিপ্লব ঘটিয়েছিল । এই বিপ্লবের অনুসারী নির্মাতাদের সকলের চলচ্চিত্র ভিন্নধর্মী হলেও, প্রকাশ্যে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত নির্মাণ শৈলীর কারণে মৃণাল সেন তাদের মধ্যেও স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন । তৎকালীন কলকাতা রাজনৈতিক পরিবেশ বিভিন্নভাবে সমাজের শ্রেণী বৈষম্যকে আরো প্রকট করে তুলেছিল. যার বহিঃপ্রকাশ মহাদেবী বর্মা, কালিন্দি চরণ পানিগ্রাহী , প্রেমচাঁদ ও সমরেশ বসুর মত লেখকের সাহিত্যে ফুটে উঠেছিল এবং এসবই মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। এর ফলস্বরূপ দর্শকের সামনে উপস্থাপিত হয় কলকাতা ৭১ (১৯৭১), ইন্টারভিউ( ১৯৭১ ) ও পদাতিক ( ১৯৭৩ ) মৃণাল সেন নির্মিত তিন পর্বের চলচ্চিত্র সমগ্র, যেখানে কলকাতার আবেগময় পরিবেশের পাশাপাশি তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যভিচারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছিল । সেই সাথে নির্মাতার ব্যক্তিগত অবস্থান স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল তাঁর মানবতাবোধে। তবে সামাজিক বাস্তবতা নির্ভর চলচ্চিত্রে মৃণাল সেনের সবচেয়ে স্মরণীয় ও আলোকিত সৃষ্টি ছিল ১৯৭৯ সালে নির্মিত 'একদিন প্রতিদিন' সিনেমাটি । এই গল্পের বিষয়বস্তু ছিল তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজের এক কর্মজীবী নারীর বাড়ি না ফেরার আকস্মিক দুর্ঘটনা এবং তার পরিবার ও অন্যান্যদের ওপর এই দুর্ঘটনার প্রভাব । গল্পে মেয়েটি ঐ নির্দিষ্ট দিনে ঠিক কোথায় গিয়েছিল তা স্পষ্ট জানা ছিল না । কিন্তু সমাজের কুসংস্কারচ্ছন্ন মনোভাব ও আমাদের আশেপাশের শত্রুদের প্রতি ছিল সুস্পষ্ট ইঙ্গিত । মৃণাল সেন নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে এটি প্রথম ''কান চলচ্চিত্র উৎসবে" প্রদর্শিত হয় । 

"একদিন প্রতিদিন" সিনেমাটির মাধ্যমে আমি আমার আশেপাশে থাকা শত্রুদের দিকেই আঙ্গুল তুলেছিলাম । কিন্তু এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমার মাঝে আত্মোনুসন্ধান শুরু হয় । আর এই আত্মোনুসন্ধানই আমাকে আমার শত্রুদের মোকাবেলা করতে শেখায় । 
_____ 
           মৃণাল সেন  ( ২০০০ সালে rediff.com নামক ভারতীয় ওয়েবসাইটে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের অংশ)

১৯৮২ সালে নির্মিত 'খারিজ' এর মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চারিত্রিক বৈচিত্র্য ও শ্রেণী বৈষম্যকে তিনি আরো প্রকট করে তুলে ধরেছিলেন । এই চলচ্চিত্রটি ১৯৮৩ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'বিশেষ জুরি' পুরস্কারে ভূষিত হয় । 

১৯৮৬ সালে নির্মিত 'জেনেসিস' ছিল মৃণাল সেনের আরেক অমর কীর্তি । এতে একজন তাঁতি  ও  কৃষকের স্বকীয়ভাবে যাপিত শান্ত জীবনে একজন নারীর আগমনে তৈরি অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতাকে প্রকাশ্যে তুলে ধরার মাধ্যমে, তিনি মানব চরিত্রের এক অদ্ভুত কিন্তু সদা বিরাজমান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছিলেন ।     

মৃণাল সেন ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ৩০ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। দিনটি ছিল রবিবার, সেদিন সকালে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।

"মৃণাল সেন ছিলেন সেকালের মুষ্টিমেয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন যার কাজের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কোন রকম আপোষ করতেন না । তাঁর সাথে আমার দুবার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল । 'খান্ডার' এর অভিজ্ঞতা বেশ আনন্দ দিয়েছিল কিন্তু 'জেনেসিস" এর বেলায় তেমনটা হয়নি" । 

                    -------- অভিনেতা নাসির উদ্দিন শাহ 
               (মৃণাল সেনের মৃত্যুতে অনুভূতি প্রকাশে)
 
 
 
 
 
 
গল্প

 

 খুঁজে পাওয়া
মৌসুমী চৌধুরী 
       
     "প্রিয় বান্ধবী" নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে হঠাৎই তার এক সময়ের পত্রবান্ধবী সুমিতাকে খু্ঁজে পেয়ে গেল ছাতিম। লাল-কালো ঢাকাই জামদানী পরা, মোমবাতির থালা হাতে একটি ছবি গ্রুপে পোস্ট করেছিল সুমিতা। আর দেখেই ঠিক চিনতে পেরেছে সে! এত বছর পরেও সেই সুন্দরীই রয়ে গেছে সুমিতা! 
বুকখানি জুড়ে আনন্দ তো আর ধরে না ছতিমের! এক সময় মনের সব কথা, একেবারে সবটাই সে সুমিতাকে চিঠিতে লিখে ফেলত! সুখ-দুঃখ-মান-অভিমান সবকিছুর কথা, মনের গহীনে জমে থাকা টুকরো টাকরা সব গোপন কথাও সে চিঠিতে উগড়ে দিত সুমিতার কাছে। এমনকি শিরীষের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা সে শুধু সুমিতাকেই জানিয়ে- ছিল। সুমিতাও তাকে মনের কথা জানাত ওই চিঠিতেই। তাদের এই পত্রালি সম্পর্ক তখন বেশ গভীর হয়ে উঠেছিল। অথচ ছবিতে ছাড়া সুমিতা আর ছাতিম পরস্পরকে কখনও দেখেইনি। ভাবতে ভারী অদ্ভুত লাগে! 
        সুমিতাকে আজও বলা হয়নি যে, তারা ছন্দা আর অভীক, ভালোবেসে পরস্পরকে তারা ছাতিম আর শিরীষ নামে ডাকত। দুটো গাছ শিরীষ আর ছাতিম সময়ের তোড়ে কবেই পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে গেছে! জীবনের নানা চাপে সুমিতার সঙ্গে চিঠির যোগাযোগটাও ছিঁড়ে গিয়েছিল বহুদিন। তবে শিরীষকে আর খুঁজে পাওয়া না গেলেও, সুমিতাকে কিন্তু ছাতিম খুঁজে পেয়েছে সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তির হাত ধরে। গত এক সপ্তাহ ধরে তাই ভারী আনন্দ হচ্ছে তার। কথা যেন আর ফুরোতেই চায় না! এই সাতদিনে তাদের মেসেজ বক্স একেবারে উপচে পড়েছে।
  — " এবার তো তোর একটা ছবি দে। কু্ড়ি বছর আগেকার লাল শাড়ি পরা তোর সেই ছবিখানা বন্যার জলে নষ্ট হয়ে গেছে। বন্যায় বহু বইপত্র আর ডাইরির সঙ্গে পলির তলায় চলে গেছে তোর 
চিঠিগুলোও ..."
    আক্ষেপ করছিল সুমিতা।
   — " উহু , আর ছবি নয়। আগামী শনিবার একেবারে সরাসরি তোর মুখোমুখি হচ্ছি। স্কুল
থেকে সো-ও-জা যাব তোর বাড়ি..."
    উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিল ছাতিম। 
      
        আজ শনিবার। ছাতিম তার স্কুল থেকে বেরিয়ে সোজা যাচ্ছে সুমিতার বাড়িতে। কুড়ি বছর আগে মায়ের লাল পিওরসিল্ক পরা তার একটা ছবি শিরিষ তুলে দিয়েছিল নিজের শৌখিন ক্যামেরায়। সেই ছবিটা সে সুমিতাকে পাঠিয়েছিল। কুড়ি বছর আগের মায়ের সেই শাড়িটাই আজ সে পরেছে।   
      অটোতে উঠে বসতেই ফোন আসে সুমিতার, 
— " আমার বর আর ছেলে বাড়িতে আছে। ওদের আজ ছুটি। তুই গিয়ে একটুখানি বস। আমি এক্ষুনি পৌঁছে যাচ্ছি। অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছি।"
       সুমিতার বাড়িতে পৌঁছে কলিং বেল টিপতেই ওর বর নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন ...

              জলভরা চোখে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ছাতিম। সুমিতার মুখোমুখি হতে তার আর মন চায়নি। অনেক বছর বাদে আজ সে খুঁজে পেয়েছে তার প্রিয় সেই শিরীষ গাছটিকে। সে আজ সুমিতার বাড়ির জল হাওয়ায় বেশ সবুজ লকলকে মাথাটি তুলেছে সুনীল আকাশে!
 

গল্প নয়

মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী

পুজোর পরেপরে ট্রেনে করে ফিরছি। এক তরুণ দম্পতি উল্টোদিকের বার্থটায় বসে। ওদের কথা বুঝতে পারছি না, এণ্ড্রু-পেণ্ড্রু-তন্ত্র-মন্ত্র --এ ধরণের কঠিন কঠিন শব্দবন্ধে সাজানো তাদের ভাষা। আমাদের বাড়ির কর্তা বরাবরের মতই কিছু না বলেকয়ে আমাকে বসিয়েই তুড়ুক করে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছেন। সুদীর্ঘ সংসারজীবনে এসব দেখে-শুনে আমি অভ্যস্ত। ফলে মোটেই উদ্বিগ্ন হলাম না, বরং শান্তভাবে একে-তাকে ফোন করতে লাগলাম।
একটু পরে সামনের ছেলেটিও কাঁধের ব্যাগটি নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল। খানিকক্ষণ পর সে ফিরে এলো। তার মুখে দেখি পাউডারের প্রলেপ, বেশ স্পষ্টভাবে, আর ঠোঁটে চকচকে কিছু লাগানো। বলতে নেই, তার রঙটি বেশ কালোর দিকেই, তাতে পাউডারের ছোঁয়ায় একটু অশোভন দেখাচ্ছে। দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতে বলতে একটু পরে সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল এবং ক্রমান্বয়ে কাঁধের গামছায় আর তরুণী বধূটির ওড়নায় মুখ মুছতে লাগল। কারণ কি বুঝতে পারলাম না। কথা না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম তরুণীটি বরকে কিছু বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, আড়চোখে লজ্জিতভাবে আমাকেও দেখছে।
কিছুক্ষণ পর ছেলেটি ক্রন্দনরত অবস্থায় ওপরের বার্থে উঠে গেল, সঙ্গে তার স্ত্রী। স্বামীর মাথাটি কোলে নিয়ে স্ত্রী সেই দুরূহ কঠিন ভাষায় অনেক কিছু বোঝাতে লাগল তাকে আবার। ছেলেটিও অবশেষে তার কান্না থামালো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর ব্যাগ নিয়ে নেমে মুখে পাউডার আর ঠোঁটে গ্লিসারিন মাখাটা অব্যাহত রাখল। ওই ব্যাগটি সম্ভবত তার প্রসাধনের ব্যাগ। একটা সময়ে ছেলেটি যখন পঞ্চমবারের পাউডার মাখতে গেছে, আমি আর থাকতে না পেরে হিন্দিতে বধূটিকে বললাম,
তুমি জল খাও, বিস্কিট খাও, আমার কাছে আছে, দেব? খিদে পায়নি তোমার?
সে শান্তভাবে মাথা নেড়ে জানালো তার কাছে সব আছে, আর সেসব সে মালদহতে পৌঁছলে খাবে। এখন কিচ্ছু খাবে না।
মেয়েটির সান্ত্বনায় ওর বর একটু হলেও স্বাভাবিক হল যে তাতে আমি বিস্তর স্বস্তি পেলাম। ওর ভাবগতিক দেখে ভয়ই করছিল আমার, এত দুঃখে কিছু করে না বসে! দুঃখটা যে কি বুঝতে পারিনি। যিনি আমাদের চাদর-কম্বল সরবরাহ করছিলেন, বেশ সদালাপী-সুপুরুষ মানুষটি, সবার কাছে তাঁদের গন্তব্য জানতে চাইছিলেন। সকলেই সহাস্যে তাঁদের গন্তব্য জানালেও পাউডারপ্রিয় মানুষটি কিন্তু ফুঁপিয়ে উত্তর দিয়েছিল, যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাব। কোথায় যাব জানি না!
আমি ভয় পাচ্ছিলাম খুব। কিন্তু গোবেচারা বধূটি বিষয়টিকে বেশ সামলে নিতে পেরেছিল। অনেক রাতে তারা খেল, বোধহয় মালদহ থেকে কিছু কিনে। সেই কেনাকাটাও বউটিই করল। সামান্য যে দু-চারটি কথা বলেছিলাম মেয়েটির সাথে তাতে জেনেছিলাম, তাদের মূল নিবাস অন্ধ্রপ্রদেশে। এখন থাকে উত্তরবঙ্গে, স্বামীর কর্মসূত্রে। এখানকার ঠিকানাও মেয়েটি জানিয়েছিল, ওর নামও। সেটা না হয় নাই বা বললাম! ছেলেটির কর্মস্থলে জীবনের ঝুঁকি আছে, সুবিধেও আছে অবশ্যই। সেই ঝুঁকির কথা ভেবে, তার নিজের বাড়ি ছেড়ে এতদূরে আসার কারণে, নিশ্চয়ই অর্থোপার্জনের তাগিদে এই অনিচ্ছের আসা, তাই কি এমন কান্না? হলেও হতে পারে! কিন্তু এই অকারণ সাজুগুজুর অভ্যেসটা এত বিরক্তিকর যে সহানুভূতি দেখাতে পারিনি। অদ্ভুত আচরণ! মানুষ যে কত বিচিত্র হতে পারে! এখন নববধূটির ওপর দায়িত্ব বর্তেছে একে সামলে রাখার।
রাত্তিরে শোবার পরও ছেলেটি বারচারেক ওপরের বার্থ থেকে নেমেছে, সম্ভবত পাউডার আর গ্লিসারিন মাখতেই। ঠিক নীচেই আমার বার্থ। প্রত্যেকবারই নামার সময় আমার বিছানাটা মাড়িয়ে দিয়েছে সে। একবার অজান্তে চুলে পা দিয়ে আমার চুলও ছিঁড়ে ফেলেছে ক'টি। ব্যথা পেলেও আমি শব্দ করিনি, সে ওই কৃষ্ণা শীর্ণকায়া ক্লান্ত বধূটির মায়ায়।
আমাদের আগে ওরা নামল। বড়ো বড়ো দু'টি ট্রলিব্যাগ বার্থের নীচ থেকে বউটিই টেনে বের করল। যাবার আগে চোখের দৃষ্টিতে ও স্মিত হাসিতে সে আমাকে নীরবে জানিয়ে গেল আমার মায়া সে অনুভব করেছে।
আমার মনে সারাজীবনের জন্য ধরা রইল এক সর্বংসহা রমণীর ছবি, যার সঙ্গে আর কখনোই আমার দেখা হবে না।
 
 
 

 রমার সঙ্গে সেদিন

 চিত্রা পাল 

 

আজ বহুদিন পরে রমার সঙ্গে দেখা হলো শিপ্রার। বহুদিন নয় বলা ভালো বহুকাল। বিয়ের পরে একবারই দেখা হয়েছিলো রমার সঙ্গে। তারপরে রমারও বিয়ে হয়ে দূরে চলে যাওয়া, শিপ্রারও তাই। প্রথম প্রথম চিঠি চাপাটি চলতো, পরে বার বার ঠিকানা বদল আর নিজের সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় দুজনেই যেন সেতুভেঙ্গে যাওয়া দুপারের মতো দূরে সরে গেলো। তখন এতো মোবাইলের চলন ছিলো না, তাই যোগাযোগের গ্রন্থিও দেওয়া যায়নি। দুজনের মধ্যেই দুজনে ছিলো ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবির মতো। অথচ আগে একদিন দেখা না হলে একে অপরের বাড়িতে ছুটে যেতো।কিন্তু ওই যে চলমান যন্ত্র ওই যে আবার কাছে এনে দেয়। সেভাবেই কাছে এলো। কি ভাবে যে এলো সেটাও বেশ মজার।  

 আসলে সেদিন একটু আনমনা হয়েই মোবাইল সার্ফ করছিলো। আনমনা, কারণ বিকেলেই ছেলের বউ রিমির সঙ্গে  কথা কাটাকাটি হয়েছে। কথা কাটা কাটি তো কত সময়েই হয়, আবার মিটেও যায়, কিন্তু না, সেদিন সহজে মেটেনি, বেশ জবরদস্তির গা ঘেঁসেই হয়েছিলো বলা যায়।পরে রিমি জুতো মসমসিয়ে ঘরের দরজাটা টেনেদিয়ে বেরিয়ে যায়,শিপ্রাও যেমন দরজার লক দেওয়ার কথা তেমন লক দিয়ে বসে। তবে সেদিন দুজনেরই মনে হয়েছিলো দুজনেই যেন বেশ সশব্দে দিয়েছে।এবার হঠাত্‌ একটা চেনা চেনা মুখের ছবিতে চোখটা আটকে গেলো। আরে, এটা রমা নয়? হ্যাঁ, তাই তো।  ফেসবুকে রমাকে দেখে শিপ্রার খুব মন খারাপ হয়ে গেলো।কত দিন দেখা হয় না। এতদিন পরে বন্ধুকে দেখে তাই একটু মন খারাপ হতে পারে ,এতটা হবার কথা নয়, তাও খুবই মনখারাপে ছেয়ে গেলো তার মন। এবারে ভাবলো, না,আর নয়।

   বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে অলস সময়ে বন্ধুর দেখা পেয়ে কেন যেন সেই মনখারাপটা চট করে আবার  ভালোর দিকে চলে গেলো। হয়তো চট করে যেতো না, কিন্তু শিপ্রা ভাবলো,বেশী ক্ষণ এই এই রাগ রাগ ভাবটা রাখা ঠিক নয় তাইরমার ছবি দেখে মনে হচ্ছিলো যেন চেনা চেনা। ওর প্রোফাইল খুলতেই পেয়ে গেলো স্কুলের নাম আর পেয়ে গেলো বন্ধুকে। শিপ্রার মনে হলো,  দেখি না একটা বার্তা পাঠিয়ে সাড়া দেয় কি না। ওমা, কিছু পরেই দেখে রমার বার্তা, এ কি সেই শিপ্রা নাকি, যে আনন্দ নিকেতন বিদ্যাপীঠে পড়তো, রমির পাশে না বসতে পেলে একেবারে পেছনের বেঞ্চে চলে যেতো?

হ্যাঁ রে আমি সেই শিপু। তুই এখন কোথায়? আমি এখন গুরগাঁওতে,তুই? আরে , আমিও তো ।  

ওমা কি কান্ড, আমিও তো এইখানে। এই শুরু ওদের কথা চালাচালি  ফেসবুক থেকে হোয়াটসায়াপে  আসতে বেশি সময় লাগলো না। এর মধ্যে দেখা গেলো রমাও বেশ উদ্‌গ্রীব হয়েছিলো বন্ধুর মতো কাঊকে পাবার জন্যে। ফোন নম্বর চালাচালি হতে বেশ জমিয়ে চলতে লাগলো দুজনের গল্পো।

আজকাল শিপ্রার দুপুরটা বেশ ভালোই কাটে, তার সংগে রমারও। আগে শিপ্রা দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে একটু গড়িয়ে নিয়ে বসত যত রাজ্যের ম্যাগাজিন নিয়ে। এখন সব জড়ো করে রেখে দিয়েছে একপাশে। কারণ রমার সঙ্গে ফোনালাপ।বেশিরভাগ দিনেই কাজের লোক এসে বেল দিলে তবে থামে।   একদিনতো এসি চালিয়ে দরজা বন্ধ করে এতো মশগুল হয়ে গল্প করছে, যে কাজের লোক বেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে ফিরে গেছে। পরেরদিন ওর থেকে শুনে রিমি জিজ্ঞেস করতে বলেছিলো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম বোধ হয়, এই নিয়ে আর কেউ কথা বাড়ায়নি বলে ব্যাপারটা ওখানেই স্টপ হয়ে গিয়েছিলো।

এবার শিপ্রা বারবার বলছে একবার আয় এখানে, মানে শিপ্রার বাড়িতে কিন্তু রমার আর সময় হয় না। সেদিন সবে ফোনটা নিয়ে বসেছে, একটা টিং করে কোন ম্যাসেজ ঢোকার শব্দ হলো। হোয়াটসয়াপ খুলে দেখে রমার ম্যাসেজ। ও যেখানে থাকে তার ঠিকানা ডিটেলস এ দিয়েছে। তার পরেই বেজে ওঠে ফোন। ফোন ধরে প্রথম কথাই হলো, এই হোয়াটস য়াপে আমার এখানকার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি, একদিন তোরা চলে আয়।

 আজ এখন রমার বাড়িতে এসেছে শিপ্রা। কত কতদিন পরে দেখা, রমা একেবারে জড়িয়ে ধরেছে  শিপ্রাকে একেবারে আন্তরিক আলিংগনে। শিপ্রার সঙ্গে এসেছে রিমি। আসলে ও এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক। ও নাহলে শিপ্রার আসাই হতো না।

এখানে এসে শিপ্রা একেবারে হকচকিয়ে গেছে। প্রথমে তো সিকিউরিটির ঝামেলা। ওদেরও সিকিউরিটি আছে। তবে এতোটা প্রবলভাবে নয়। ওরা আসার পরে সিকিউরিটি ওদের ফোন করে জেনে তবে যাবার পারমিশন দিলো। তারপরে একেবারে চোদ্দ তলায়। রমা এরকম জায়গায় থাকবে শিপ্রা ভাবতে পারেনি। তারপরে ঘরের সাজসজ্জা দেখে সমঝে নিলো, যে বেশ ওপরে ওর বসবাস। তবে ও শিপ্রার মতোই স্বামীহীনা।এটা শিপ্রা জানতো না, জেনে দুঃখো পেলো।

একবার যেন ভেসে উঠলো, সেই ক্লাসঘর, যেখানে চুপি চুপি ব্যাগ থেকে কুল বের করে রমা শিপ্রার হাতে চালান দিচ্ছে। কিংবা বোর্ডের লেখা ঠিকমতো খাতায় লিখতে পারেনি, শিপ্রা রমার খাতায় লিখে দিচ্ছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে খানিকটা ঘুরে তাল সুপুরি গাছের তলায় দেখছে তাল সুপুরি পড়ে আছে কিনা। সব অতীত সরিয়ে জেগে উঠলো এখনকার সময়। দেখে রমা চা নিয়ে আসছে। শিপ্রা তাড়াতাড়ি উঠে ওর হাত থেকে ট্রে খানাকে নিয়ে টেবিলে রাখে।

রমা নিজেই বলে, এ বাড়ি আমার ছেলের শ্বশুর বাড়ী ঠিক নায়, আমার ছেলের বউ এর দাদার বাড়ি।আমার ছেলে থাকে আমেরিকায়, বছর তিনেক হলো ওর মানে আমার হাসব্যান্ডের চলে যাবার পরে একবার ছেলের কাছে একবার এখানে এই ঘোরাঘুরি হচ্ছে। কেন, তোর বাড়ি নেই? তোর তো শ্রীরামপুরে বিয়ে হয়েছিলো, তবে?শিপ্রা বলে।    

আরে, আছে তো। তবে কি জানিস্‌, উনি যতদিন ছিলেন, ততদিন এদিক ওদিক ঘুরেছি, আবার বাড়িতে মানে শ্রীরামপুরের বাড়িতে থেকেছি, এভাবেই চলছিলো।ও চলেযাবার পরে ছেলে নিয়ে চলে গেলো, ওখানে চার পাঁচমাস থেকে ফিরে এসে ওখানেই থেকেছি। এবার হয়েছে কি জানিস্‌ তো, এরা খুব আসতে বলাতে আমি দিন পনেরোর জন্য এসেছিলাম, কিন্তু আমাকে এখন আর ছাড়তে চাইছে না।যখনই বলি,এবার বাড়িতে যাব,  তখনই এরা বলে আর কদিন থেকে যাও। তাই ওই রয়েই গেছি। তোর খবর কি? তুই এখন কি এখানেই থাকিস্‌’? শিপ্রা বলে,ওই তোর মতো আর কি। ছেলে বউ দুজনেই কাজ করে,বার বার বলাতে আসি। এবারেও তাই। তবে পুজোর আগে চলে যাব। কারণ,পুজোর সময় আমার নিজের বাড়িতে থাকতেই ভাল  লাগেরে।

রমার সঙ্গে সেদিন সুখ দুঃখের আনেক কথা হলো। আলাপ হলো ওর ছেলের শাশুড়ির সঙ্গে। বিত্তশালী পরিবারের লোক জন যেমন হয় আর কি। শুনলাম ওনার ছেলে বউ এর কানাডাতেও ব্যবসা আছে।তবে উনি নিজে শিপ্রার মতোই বাতে ভোগেন কম বেশি। শিপ্রা বললো, আমার যা অবস্থা কি যে করি। উনি বললেন, আমার নি রিপ্লেসমেন্ট হয়েছে। এখন হাঁটাচলা অনেকটা সুবিধে হয়েছে। কথা বলতে বলতে শিপ্রা লক্ষ্য করলো ওনার হাতের আঙুলগুলো সোজা নয়,  কেমন বাঁকা। মনে হয়, বাত থেকেই হয়েছে হয়তো। কিছু বলতে যাচ্ছিলো, উনি চট করে রান্নাঘরে চলে গেলেন

রমা রিমির সঙ্গে খুব খানিক গল্প করলো। তারপরে জমিয়ে চা টা খেয়ে ওরা উঠে পড়েআসার সময় একান্তে রমা শিপ্রাকে বলে, আমি যেতে চাইছি, এরা কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না। দুবার টিকিট রিফান্ড করা হয়েছেআসার সময়ে শিপ্রা বারবার বলে, এবার তোর আসা চাই। চল, আমরা দুজনেই আমাদের সেই পিতৃগৃহে যাই, তাহলে খুব মজা হবে বল। পাশ থেকে ওই ভদ্রমহিলা বললেন, আমাদেরতো ট্যুর প্ল্যান  রয়েছে।  শিপ্রা বুঝলো ওকে কিছুতেই এখান থেকে যেতে দিতে চাইছে না।  

পরেরদিন ফোনে উচ্ছ্বসিত রমাওরা আসাতে ওর খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু এ কথা সেকথার পরে  আবার বলে, আমার খুব বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে রে। এবার শিপ্রা বলে, শোন, তুই বল, দুর্গা পুজোয় না যাই লক্ষী পুজোয় যেতেই হবে।  বাড়িতে মা লক্ষীর আসন দিতে হবে যে। এই বলে জোরজার করে তুই যাবার ব্যবস্থা কর।

এরপরে বেশ কদিন কেটে গেছে। হঠাত্‌ একদিন রমা ফোন করে বলে, লক্ষীপুজোর দুদিন আগে যাচ্ছি বাড়িতে। এখন পুজো এসে গেছে। এখানে কিছু কিছু কাজ আছে,বাড়িতে পৌঁছেও প্রচুর কাজ। এখন কিছুদিন যোগাযোগ থাকবে না রে। সব মিটে গেলে তোকে সব কথা বলবো। তবে একটা কথা বলে রাখি, তোর ওই লক্ষীপুজোয় বাড়িতে যাব, এটা বেশ লেগে গেলো দেখছি। 

আসলে শিপ্রার ভাবনাটা হঠাত্‌ই এসেছিলো। কথা বলতে বলতে ও যখন লক্ষ্য করলো,ওই ভদ্রমহিলার হাতের আঙুলগুলো বাঁকা, তখনই ব্যাপারটা অনুমান করে নিয়েছিলো । ওনার ছেলে বউ অসুস্থ মাকে একা রেখে  কোথাও যেতে পারে না। ঝাড়া হাত পা এমন কাজিনকে এখানে রেখে দিলে মায়েরও বেশ সংগ হবে, আবার ওরা এদিক সেদিক দরকারে যেতেও পারবে,বাড়ি ঘাড়ের ওপরে ঝুলে থাকবে না। এভাবেওরা গ্যাছেও বেশ কবার। তাই নিজেদের স্বার্থেই ওনাকে রেখে দিয়েছিলো। এখন লক্ষীপুজো বাড়িতে করতে যখন  হবে, তখন যেতে দিতেই হবে, না হলে ব্যাপারটা খারাপ হতে পারে, হয়তো সম্পর্কটাই নষ্ট হয়ে যাবে,সেই সব ভেবেই এবারে আর না করতে পারেনি।শিপ্রা ভাবে, ভাগ্যিস্‌  রমার   সঙ্গে দেখা হয়ে ছিলো সেদিন।  

  

ভূতের ভয় কে না পায়

মনোমিতা চক্রবর্তী 

আমার ছোট পিসির মাস তিনেক মতো হলো কলকাতায় বিয়ে হয়েছে ।ছোট পিসেমশাই স্কুলের বড়দিনের ছুটিতে ছোট পিসিকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন ।সাথে এসেছে পিসেমশাইয়ের ভাইপো। আমাদেরই বয়সী ক্লাস নাইনে পড়ে ।আমাদের বাড়িতে পিসেমশাইয়ের ভাইপো মানে সৌমিক এসেছে থেকে দেখছি বাড়ি শুদ্ধ সবার আকর্ষণ নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছে। কলকাতা শহরের ছেলে সৌমিক, ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে বলে ভাবটা এমন দেখায় যে সে আমাদের মতো মাছে ভাতে বাঙালি নয়। সে যেন মস্ত এক সাহেব। ভীষণ সাহেবী ঠাট বাট ওই সৌমিকের । 
তোমরা ভাবছো আমি সৌমিককে ঈর্ষা করি? আসলে তা নয়। একে নতুন কুটুম তাতে আবার শহরে থাকে ।গ্রামের বাড়িতে হয়তো কষ্ট হচ্ছে তার, এই ভেবে বাড়ি শুধু সবাই তটস্থ হয়ে আছে ওর জন্য যাতে কোন অসুবিধা সৌমিকের না হয় ।এখানেই আমার আপত্তি। 

সৌমিক আমাদের কুটুম ,তা কুটুম কুটুমের মত থাক! তা না,ভাবখানা এমন যেন সে মহারাজ আর আমরা তার প্রজা আর কি।
 সারাক্ষণ মুখে শুধু বড় বড় কথা সৌমিকের। ওর কথায় বাড়ি শুদ্ধ সবাই মুগ্ধ ।তবে দুদিনেই আমি বুঝে গিয়েছি শহুরে ননীর পুতুল সৌমিক মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক ও আসলে একটা ভীতুর ডিম ।
কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে যে,ও যে ভয় পায় এটা ও কিছুতেই স্বীকার করবে না ।
সেদিন কথায় কথায় বললাম আমাদের বাড়িতে তো তোমাদের বাড়ির মত ইলেকট্রিসিটি নেই ।অজপাড়া গায়ের মানুষ আমরা ,আমাদের এখানে আলো বলতে শুধু হারিকেনের আলো। তোমার ভয় করেনা আমাদের বাড়িতে।
সৌমিক _কিসের ভয়?
আমি _ভূতের ভয়!
সৌমিক হাসতে হাসতে একপ্রকার ব্যঙ্গ করে বলে - ভূত বলে কিছু হয় নাকি ?ওটা তো আসলে একটা কুসংস্কার ।বড় হয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে বলছ তুমি ,আর ভুতে বিশ্বাস করো ?
তুমি ভূতে ভয় পাও এটা আমার জানা ছিল না বলে সে কি অট্টহাসি সৌমিকের সে আর দেখে কে !
কি অবস্থা উল্টো আমাকেই সবার সামনে ভীতু বানিয়ে দিল সৌমিক!
কিন্তু আমি জানি ব্যাটা মুখে যতই বাহাদুরি দেখাক আসলে ও একটা ভীতুর ডিম ।ব্যাটা সবার সামনে আমাকে তুই ভীতু বানালি তো? আমায় নিয়ে ঠাট্টা করলি, হাসাহাসি করলি। দাঁড়া, তোর মুখ দিয়েই সত্যিটা বলাবো। যে তুই ভূতে বিশ্বাস করিস আর তুইও ভূতে ভয় পাস।
দেখছি ব্যাটা তখনো মুচকি মুচকি হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে ।

তাই রেগে গিয়ে বললাম - আচ্ছা সৌমিক গতকাল যে দেখলাম রাত্রে তুমি বাথরুমে যাবে বলে পিসেমশাইকে বাথরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছো। কেন গো? 
তুমি তো ভূতের ভয় পাও না ,তাহলে পিসেমশাই কে বাথরুমের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলে কেন?
সৌমিক - আরে ভূতে আমি বিশ্বাসও করিনা তাই ভূতে আমি মোটেও ভয় পাই না ।
আসলে তোমাদের বাড়িতে ইলেকট্রিসিটি নেই ।তার ওপর রাতে গাঢ় অন্ধকার ।গ্রামের বাড়ি বলে কথা ,যদি বিষাক্ত পোকামাকড় বা হিংস্র জীবজন্তু চলে আসে তাই কাকাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম বুঝলে ?
আমার মনে আসলে কোন কুসংস্কারই নেই। বড় হয়ে বিজ্ঞানী হব যে আমি।

এমন সময় আমার ছোট বোন মৌলি বলে - কিন্তু সৌমিক দাদা তুমি দেখেছো আমাদের বাড়িটা কত পুরনো বাড়ি! পুরো বাড়াটাই তো গাছপালা ,ঝোপঝাড়েই ভর্তি। আমাদের রান্নাঘর বাথরুম দেখেছো কত দূরে দূরে ।আলো বলতে শুধু হারিকেন ।বাড়ির সীমানার বাইরেও শুধু বড় বড় ঘন গাছপালা। আর তুমি জানো সৌমিক দাদা গ্রামের অনেকেই বিশ্বাস করে আমাদের বাড়ির অনেকগুলো গাছে নাকি ভূত-প্রেতের বাস। বিশেষ করে বাড়ির পেছন দিকটার ছাতিম গাছটায় ।তুমি সত্যি বলছো তুমি ভুতে ভয় পাও না? আমরা কিন্তু ভীষণ ভূতের ভয় পাই ।

সৌমিক নারে মৌলি এক্কেবারেই না । ভূত বলে আসলে কিছুই হয় না বুঝলি?
মৌলি - তবে তুমি ঠাম্মির কাছে ভূতের গল্প শুনবে? আমরা আজ শুনবো ।
সৌমিক - অবশ্যই শুনবো।

মৌলি - চল দাদা আমরা ঠাম্মির কাছে যাই চল। ঠাম্মি কে বলব সৌমিক দাদা ভুতে ভয় পায় না ।তাহলে নিশ্চয়ই ঠাম্মি ভূতের গল্প শোনাবে। 
মৌলির কথা শুনে মনটা আমার একপ্রকার আনন্দে লাফিয়ে উঠলো প্রায়। রাতের অন্ধকারে গা ছমছম পরিবেশে, ঠাম্মি এমন করে ভূতের গল্প বলে যে আমার মত সাহসী ছেলেরও ভয়ে প্যান্ট প্রায় ভিজে যাবার উপক্রম হয় ।দেখি ঠাম্মির গল্প শুনে এই সবজান্তা ,সাহসী ,বীরপুরুষের ঠিক কি অবস্থা হয় ?
চরম উৎসাহে আমি ,মৌলি ,কুটুন ,ছোটকু ,দিদিভাই আর সৌমিক চললাম ঠাম্মির কাছে গল্প শুনতে।
ঠাম্মি উঠানের কোনায় কয়লার উনুনে ঠান্ডার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য হাত পা সেকে নিচ্ছিল। যদিও উনুনের আগুন অনেকটা নিবু নিবু হয়ে এসেছে, আমরা ভাই বোনেরা ঠাম্মিকে ঘিরে বসলাম। উনুনের চারপাশে একপ্রকার গোল করে বসে পড়লাম একে একে। আমাদের সাথে সৌমিক ও এসে বসলো । সবাই মিলে ঠাম্মির কাছে বায়না জুড়লাম ভূতের গল্প শুনবো।সৌমিক কে দেখে ঠাম্মি বলল
সৌমিক দাদুভাই তুমি ভূতের গল্পে ভয় পাও না তো?
সৌমিক -- না না একদম না ।
কিন্তু আমি সৌমিকের কথা বলার সুরেই বুঝলাম আগের মত আত্মবিশ্বাস এখন ওর নেই। একটু হলেও ভয় ভয় ভাব লক্ষ্য করলাম ওর মধ্যে ।কিন্তু সৌমিক বীরপুরুষ বলে কথা!ভয়ের কথা তো বলা যাবে না। তাই মুখে বললাম -- ঠাম্মি ও নাকি ভূতে বিশ্বাসই করে না। তুমি শুরু করো।
ঠাম্মি এবার গল্প শুরু করল।
আমাদের বাড়ির পাশেই একটা ছোট বন আছে। আর বনের পেছনে আছে একটা বাড়ি। সেই বাড়িতে কেউ থাকেনা। ভয়ানক ভয়ানক সব গল্প চালু আছে ওই বাড়ি ঘিরে। ঠাম্মি ওই বাড়ি নিয়েই গল্প শুরু করল ।
আহা আজ ভূতের গল্পের এক্কেবারে আদর্শ পরিবেশ দেখে মনটা বেশ খুশি হয়ে গেল আমার। 
অমাবস্যার রাত, আকাশে চাঁদ ছিল না। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার ।সন্ধেতেই ঘন কুয়াশায় চারপাশটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে ।মিট মিট করে জ্বলছে একটা হারিকেন। কেমন যেনো একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আগেই বলেছি কয়লার উনুনটাও নিভু নিভু হয়ে আছে, আর তাতেই ঠাম্মি হাত,পা সেকে নিচ্ছে আর গল্প করছে।
ঠাম্মির মুখের ভুতের গল্প শুনে আমাদের সারা গায়ে কাটা দিতে লাগলো পারলে একে অন্যের সঙ্গে জড়াজড়ি করে বসে থাকি আর কি। গল্পের মাঝে হঠাৎ খুব জোরে বাতাস বইতে লাগলো। হারিকেন টাও গেল নিভে ঠিক সে সময়েই হঠাৎ করে ছোটকা নাকি সুরে বলে উঠলো হাউ মাউ মানুষের গন্ধ পাউ। যেই বলেছে অমনি সৌমিক মা গো বলে আঁতকে উঠল প্রায় ।এটা দেখে ছোটরা সবাই হো হো করে হেসে উঠল দেখে সৌমিক বলে আসলে সে নাকি ভয় পায়নি। এক মনে ঠাম্মার গল্প শুনছিল আচমকাই ছোটকার এমন বিকট গলার আওয়াজে মা শব্দটা মুখ ফসকে নাকি বেরিয়ে গেছে । তবে সে যে ভয় পায়নি এক বিন্দু এই কথাটা সবাইকে বিশ্বাস করাতে লাগলো। আমি তো বুঝে গেছি সৌমিককে, ব্যাটা ভাঙবে তবু মচকাবে না।
 ভয় পেয়েছে তবু স্বীকার করবেই না ।
এমন সময় মা ডাকলেন আমাদের ছোটদের রাতের খাবার খেতে। সবাই আমরা ছোটরা রান্না ঘরের বারান্দায় খেতে বসেছি।
 মাংস টা যা রাধে না জেঠিমা উম অসাধারণ !
আমরা মায়ের কাছে, জেঠিমার কাছে চেয়ে চিন্তে আর একবার দুপিস করে মাংস নিলাম । 
অন্যদিকে সৌমিকে মাংস চাইতেই হচ্ছে না , ও না চাইতেই মা ,জেঠিমারা বাটি ভরে ভরে সৌমিককে মাংস দিচ্ছে আর সৌমিকও আঙুল চেটে চেটে মাংস ভাত সাবার করছে, আর জেঠিমা রান্নার প্রশংসা করছে ।
মাংসের পর খেলো ও এক বাটি পায়েস আর গোটা কত পাটিসাপটা।খাবার ধরন দেখেই বুঝে গেলাম যে হারে আজ খাচ্ছে ও তাতে ওকে রাতে বাথরুমে যেতেই হবে। 
যেমন কথা অমনি কাজ। আমরা ঠাম্মির সাথে শুয়ে পড়েছি। বড়রা তখনও কেউ শোয়নি ।পিসি পিসেমশাই এর সাথে সবাই গল্প করছেন । শোবার কিছুক্ষণ পরেই সৌমিক উঠে পড়ল। তাকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেই হবে । এদিকে একা একা বাথরুমে যেতেও পারছেনা, পিসেমশাই গল্প করছে বলে সবার মাঝখান থেকে পিসেমশাই কেও ডাকতে পারছেনা। 
আবার মুখেও বলতে পারছে না যে আমায় ওর সাথে যেতে । পাছে প্রমাণ হয়ে যায় ও ভীতু। কারণ ঠাম্মি আজ পোড়ো বাড়ির এমন গল্প আমাদের শুনিয়েছেন যে আমরা সব কটা ভয়ে জড়োসড় হয়ে গিয়েছিলাম ।আমি খেয়াল করে দেখলাম যে সৌমিকও ভয় পাচ্ছে। তবে সে স্বীকার করবে না, যে সে ভয় পাচ্ছে ।
এত্ত ওর ইগো।
 আমি বললাম সৌমিক বড়রা তো গল্প করছে পিসেমশাই এর সাথে তাই পিসেমশাই কে ডাকবার দরকার নেই বুঝলে?
সৌমিক - তবে কি আমি অন্ধকারে একা একা বাথরুমে যাবো নাকি?
আমি - কেনো ভয় পাচ্ছ নাকি?
সৌমিক - আরে নানা ভয় কেনো পাবো আমি।ভূতে তো বিশ্বাসই করিনা আমি ,কতবার তোমায় বোলব বলতো?
আমি বললাম- দাড়াও সৌমিক হারাধন কাকাকে তোমার সাথে যেতে বলি।
 হারাধন কাকার কথা শুনে সৌমিকের মুখটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।
বললো- বেশ ডাক হারাধন কাকাকে আমি আর পারছি না তো!

হারাধন কাকাকে ডাকলে উনি একটা টর্চ আর মোম নিয়ে সৌমিককে নিয়ে বাথরুমের দিকে গেলেন ।
সৌমিকের হাতে মোমবাতিটা দিয়ে হারাধন কাকা টর্চ নিয়ে দূরে দাড়ালেন। 
আমাদের বাড়ির বাথরুমটা শোবার ঘর থেকে বেশ অনেকটা দূরেই,আর বাথরুমের কাছটা ছিল ঝোপঝাড়ে ভরা।
শৌমিক যেমনি বাথরুম থেকে বেরিয়েছে অমনি আবারও খুব জোরে হঠাৎই বাতাস বইতে শুরু করল।
 সৌমিকের হাতের মোমবাতি গেল নিভে । চারদিকটা তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার । কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।ভয়ে তখন ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো সৌমিক।এমন সময় হঠাৎই ঝোপের ভেতর থেকে এলো এক অদ্ভুত শব্দ। ততক্ষণে হারাধন কাকা ঝোপের ওদিকটায় টর্চের আলো ফেলেছেন।ঝোপের আড়ালে আলো ফেলতেই ঝোপের ভিতরে কি যেন জ্বলে উঠলো ।
ঝোপের ভেতর থেকে ওই জ্বলে ওঠা আলোটা ক্রমশ সৌমিকের দিকে এগিয়ে আসছিল আর ঠিক তখনই ঝোপের ডান দিক থেকে নাকি সুরে আওয়াজ এল - কে রে রাত জাগে ? ঘাড়টা ব্যাটার মটকেই দেব আজ।
সৌমিকের তখন চূড়ান্ত রকম খারাপ অবস্থা। দাঁতের দাঁত লেগে যাবার দশা। এমন সময় সৌমিক পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে হারাধন কাকা সেখানে নেই,তিনি উধাও ।
কোনমতে এক চিৎকারে সৌমিক বলে ওঠে - ভুতরে ,আমাকে খেলো রে , বলেই ছুটতে গিয়ে বেচারা উঠানে পড়েই অজ্ঞান হয়ে গেল। 
সৌমিকের মাথায় জল ঢালা হলো। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেওয়া হলো ।তারপর তার জ্ঞান ফিরলো। 
সেদিন রাতে বাবা ,কাকারা আমার টিকিটি খুঁজে পায়নি।কারণ পিঠ বাঁচাতে আমি গা ঢাকা দিয়ে ছিলাম যে।
এদিকে বাবার আর জেঠুর ধমকে হারাধন কাকা থতমত খেয়ে স্বীকার করেছিল যে আমিই বাড়ির বাচ্চা কুকুর ছানাটিকে ঝোপের আড়ালে রেখেছিলাম । আর হারাধন কাকাকে ওই বাচ্চা কুকুরটির চোখের উপর টর্চের আলো ফেলতে বলেছিলাম। যাতে টর্চের আলো কুকুরছানা টির চোখে পড়লে তার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলে ওঠে।
হারাধন কাকাও তাই করেছিল। টর্চের আলো কুকুর ছানার চোখে পড়াতে তার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে জ্বলে উঠেছিল। তাই দেখে সৌমিক ভয় পেয়ে যায়। আর তার সাথে আমারই বলা নাকি সুরে কথা শুনে ভয় পালাতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় সে।
বাবা - তা হারাধন তখন তুই ওখানে ছিলি না কেনো?
হারাধন কাকা- আজ্ঞে নন্দন বাবু ইশারায় আমায় ওখান থেকে চলে যেতে বলেছিলেন যে বাবু।
 সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো সৌমিককে ভূতের ভয় দেখিয়ে ওকে অজ্ঞান করার পেছনে আমারই হাত রয়েছে। ততক্ষণে বাবা, কাকাদের হাত থেকে পিঠ বাঁচানোর জন্য আমি গা ঢাকা দিয়েছি আর কি।
সেদিন রাতে বাবা,কাকারা শত খুঁজেও আমার টিকিটি পায়নি। কিন্তু কতক্ষন আর লুকিয়ে থাকা যায়।সকাল আটটা নাগাদ পড়লাম ধরা ।জেঠু আর বাবার উত্তম মধ্যমে আমার তখন যা তা অবস্থা। 
এত মার খেয়েও আমার মনে কিন্তু কোনো দুঃক্ষ হচ্ছিলনা বরং আনন্দ হচ্ছিল। কারণ ওই শহুরে বাবুকে কাবু করতে পেরেছি যে ।সবার কাছে আজ প্রমাণিত সৌমিকও ভূতের ভয় পায় ।আসলে, ভূতের ভয় কেনা পায় বলতো?

 

ইদানিং 

জীবন্ত দুর্গা বিসর্জনে সবাই নীরব দর্শক কেন?
বটু কৃষ্ণ হালদার
 
বিসর্জন কথার অর্থ হল বিষণ্নতা,একরাশ নীরবতা। এই শব্দটার সঙ্গে একদিকে জড়িয়ে রয়েছে বাঙালির আবেগ।দুর্গাপূজার বিসর্জনে একদিকে যেমন নেমে আসে নীরবতা,বিষন্নতার কালো মেঘ। তেমনি অপরদিকে সমাজে নারীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনায় জীবন্ত প্রতিমার বিসর্জন হলেও বর্তমান সমাজের একাংশ পাথর কিংবা মাটির মূর্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যান। দুটি বিসর্জনের ক্ষেত্রে দুটি চিত্র ফুটে ওঠে বাস্তবের আঙিনায়।
"নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান/বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান" এই মহান উক্তির মাঝে আমাদের ভারত বর্ষ বিশ্বের দরবারে নিজেকে মেলে ধরেছে।ভিন্ন ভাষা,সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষেই এর জন্যই সারা বছর ধরে কোন না কোন উৎসব পালিত হয়।এর মধ্যে অন্যতম উৎসব হোল বাঙ্গালীদের অন্যতম প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা।সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশে জাত ধর্ম নির্বিশেষে দুর্গাপূজার চার পাঁচ দিন সবাই উৎসবে মেতে ওঠে এটাই ভারতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।
গ্রীষ্মের দাবদাহকে জুড়িয়ে আসে অতিমেদুর  মেঘছায়া বর্ষারানী।বর্ষার আগমনে শুষ্ক রুক্ষ ও পরিবেশ ভাষা খুঁজে পায়।নতুন প্রাণের সঞ্চার উজ্জীবিত হয় শাখা প্রশাখায়।শুষ্ক তৃণ নতুন প্রান সঞ্চারে আঁচলখানি মেলে দেয় পরিবেশে।আলো-আঁধারির খেলা মিলিয়ে বর্ষার বিদায়ী সুরে ফিরে আসে বাঙালি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রিয় ঋতু শরৎকাল।নীল সাদা মেঘের ভেলায় বাঙালি মনকে বিমোহিত করে।দখিনা বাতাসে তালে তালে মাথা দোলায় সাদা কাশের ফুল ।উড়ন্ত সাদা বকের দল পথ হারায় দিগন্তের সীমানা। শিউলি ফুলের সুবাস সাদা কাশবনের মৃদু মাথা নোয়ানো জানান দেয় মা আসছেন পূর্ণ ধরাধামে।দূর হতে ভেসে আসে পূজার গান। মহালয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয়ে যায় দেবীর আগমন।"বাজলো তোমার আলোর বেনু",গান দিয়ে শুরু হয় মহালয়া।বছরের ওই কয়েকটা দিনের জন্যে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকি।
একদিকে যেমন মানুষের হাহাকার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠে অন্যদিকে কোটি টাকা ব্যয় বিলাসবহুল প্যান্ডেল সমাহারে উৎসবে মেতে উঠি, এ ধারণা অনেকেইকরে থাকেন।তবে সেই সঙ্গে আরো জানতে হবে যে কোটি কোটি টাকার পূজার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে রয়েছে আবেগ ও প্রাচীন সংস্কৃতি ঠিক তেমনই এই পূজার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে জীবনের একঘেঁয়েমি,অবসাদ, অবিচ্ছন্নতার অবসান আর নানান কর্মের সংস্থান। প্রতিমা তৈরি করা থেকে শুরু করে প্যান্ডেলের উপকরণ এমনকি বিসর্জন পর্যন্ত একের সঙ্গে রয়েছে ব্যবসার যোগসূত্র।প্রতিটি উপকরণ কেনাকাটি করতে হয়। মাইক জেনারেটর,লাইটিং এর ব্যবস্থাও  করতে হয়।পূজার সঙ্গে সঙ্গে বহু দোকানপাট,গাড়ি ঘোড়া,জামা প্যান্ট থেকে শুরু করে বহু জায়গায় ব্যবসা মুখরিত হয়ে ওঠে। পূজার ওই কটা দিন বহু গরীব মানুষ ব্যবসা করে নিজেদের  রুজি রুটির  সংস্থান করেন।বহু অসহায় পরিবারের সদস্যদ ও ছোট ছোট উলঙ্গ শিশুদের মুখে হাসি ফোটে তা ভুলে গেলে চলবে না।
যে সংস্কৃতি যুগের পর যুগ একই ধারা প্রবাহমান।কলকাতা তথা বাংলার প্রধান ও প্রাণের এই উৎসব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থান করে নিয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা- ইউনেস্কো বাঙালি হিন্দুদের এই উৎসবকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ তথা মানবতার জন্য আবহমান অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২০২১ সালে আবহমান বিশ্ব সংস্কৃতি রক্ষা সংক্রান্ত ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারি কমিটির ষোড়শ সম্মেলনে (১৫ই ডিসেম্বর) কলকাতার দুর্গাপূজা তালিকাভুক্তির স্বীকৃতি লাভ করে। যা বাঙ্গালীদের কাছে অত্যন্ত গৌরবে।
বাঙালির অতি প্রিয় দুর্গোৎসব মানে বছরের ওই কটা দিন জন্মভূমিতে ফিরে আসার প্রবল ইচ্ছা। বাবা মা আত্মীয় পরিজন পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কয়েকটা দিন সময় কাটানো, চুটিয়ে আড্ডা,প্রাণের কথা বলা আর খাওয়া দাওয়া। নতুন জামা প্যান্ট পরে কচিকাচাদের হইহুল্লোড়,দৌড়ঝাপ,কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে প্যান্ডেলের মন্ডপ।দুর্গাপূজা মানেই একটু বেহিসাবি  হয়ে ওঠা।নতুন করে প্রেমে পড়া।কাউকে প্রথম ভালোবাসি বলা। নতুন নতুন সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া আবার অনেক ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের অশ্রুসিক্ত চিৎকার চাপা পড়ে যায় পূজার উচ্ছ্বাসে। কয়েকটা দিন আমোদ প্রমোদ ইহুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে বেজে ওঠে করুণ সানাইয়ের সুর।বিসর্জনের পালা মানে মন খারাপের শুভারম্ভ। ঘরের মেয়ে উমা তার বাড়িতে ফিরে যাবে যেন আনন্দের মধ্যেই যেন বিষাদের কালো মেঘ গ্রাস করে নেয় উচ্ছ্বাসের মুহূর্তগুলো। ঠিক যেন চরম সুখ পাওয়ার মাঝে বেদনার অবারিত ধারা জড়িয়ে ধরে হৃদয়কে।
একটা ফুলের কুঁড়ি ধীরে ধীরে সময় অনুসারে ফুলে পরিণত হয়। কয়েকদিন গাছে থাকার পর আপনার থেকেই ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে যেতে বৃন্ত দিয়ে ঝরে মাটিতে মিশে যায়।ঠিক তেমনই সবার প্রথমে কাঠের ফ্রেমের উপর কাদা মাটির প্রলেপের মধ্যে নানান উপকরণ মিশিয়ে  সেই প্রলেপ দিয়ে মূর্তি গঠনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয় এরপর রং করে শাড়ি,গয়না পরিয়ে মায়ের মাটির মূর্তি কে পূর্ণতার রূপ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়। বিভিন্ন আলোর রশ্মাইতে ঝলমল করে ওঠে পূজার প্যান্ডেল। কয়েকদিন পর সেই আলো ঝলমল উৎসবের রেওয়াজ শেষ হয়ে যায়। পূজার ওই কটা দিন হইচই করে কিভাবে শেষ হয়ে যায় তা বুঝতে পারা যায় না।এরপরে বিসর্জনের পালা। বিসর্জনের পালা মানে বিষন্নতার পরিবেশ। অশ্রুসিক্ত হয়ে সিঁদুর মাখিয়ে ঘরের মেয়েকে বরণ করে শেষ বিদায় জানায়। ভাসানের কয়েক দিন পর বিভিন্ন নদী বড় বড় পুকুরে শুধু কাঠের ফ্রেম পড়ে থাকতে দেখা যায়।মাটির সঙ্গে সঙ্গে শরীরের নানা উপকরণ ও জলের স্রোতে ভেসে যায়।পরিবেশ ফিরে আসে তার চেনার রূপে।আর সেটাই হলো বিসর্জন।মানব সমাজে এই নিয়ম একই ধারায় প্রবাহমান।
বিসর্জন মানেই তো শেষ হয়ে যাওয়া।আমাদের ছোটবেলায়, মানে প্রায় আড়াই দশক আগের কলকাতা সংলগ্ন আধা মফস্সল পাড়ায় যখন প্রতিমা নিরঞ্জন শেষে পুকুরের জল আঁজলা ভরে জল ছিটিয়ে দিত বড়রা,সেই জলের ফোঁটায় বিষাদ লগ্ন হয়ে থাকত। তখন দশমীর দিনই ভাসান হত।ফেরার পথে মন্দিরের মাঠের খাঁ খাঁ মণ্ডপের দিকে তাকালে মনখারাপ বাঁধা। আলো-ঝলমল ভাল লাগার দিন শেষ হয়ে যাওয়ার মনখারাপ। বিসর্জন মানেই ছিল শেষ হয়ে যাওয়া।
অথবা, বিসর্জনই একমাত্র, যেখানে এই শেষ আর এক শুরুর জন্মমুহূর্ত।যেখানে ভাসানের পরের দিনই কোলাকুলি দেখতে ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়বে পুকুরে, আঁকশি দিয়ে টেনে আনবে কাঠামো। সেই কাঠামোর ওপর পরের বার ফের মাটি চাপবে, ফের প্রতিমা তৈরি হবে, ফের কুমোরটুলি থেকে ম্যাটাডোরে চাপিয়ে সেই প্রতিমা নিয়ে আসা হবে মণ্ডপে। পুজোই একমাত্র, যেখানে শেষ হওয়ার সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধা থাকে পরের বারের সূচনা। দশমীর মনখারাপও, তাই, খানিক সুখের মধ্যে ব্যথা। যা হারিয়ে গেল, তা ফিরে পাওয়া যেখানে অনিবার্য বালিশের পাশে নতুন জুতো রেখে ঘুমিয়ে পড়ার মতোই,শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা তা বলা বাহুল্য।
বিংশ শতাব্দীর দোরগোড়া এসে জল,স্থল,অন্তরীক্ষে নারীরা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমানতালে পাল্লা দিয়ে চলেছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পিছনে শুধুমাত্র পুরুষদের নয় নারীর অবদান অনঅস্বীকার্য সেই নারী সমাজ আজও কি সঠিক সম্মান পেয়েছে?
আমরা গত বছর দেখে ছিলাম স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির উৎসবের আমেজ।বহু নেতা-মন্ত্রীরা নারীদের নিয়ে নানানভাবে আলোচনা,ভাষণ,চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছে।সোনা জয়ী নারীদেরকে দেশের মাটিতে সম্মান জানিয়েছেন।সোনা জয়ী নারীরা সমগ্র বিশ্বের দরবারে উজ্জ্বলতম নজির সৃষ্টি করলে ও  ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থায় নারীদের সম্মানের বিষয়ে বহু প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পাওয়া যায় না।কারণ প্রাচীন পৌরাণিক যুগ সমাজ হতে সুবিচারের আশায় নারী ন্যায়ের দরজার কড়া নেড়ে আসছে।তাঁর জীবন্ত উদাহরণ হোল সীতা ও দ্রৌপদী। প্রাচীন যুগে নানান কুসংস্কারগুলো যেমন সতীদাহ প্রথা,বাল্য বিবাহ, বিধবাদের একাদশী উপবাস,গঙ্গাতে কন্যা সন্তান ভাসিয়ে দেওয়ার মত বহু অযৌক্তিক প্রথাগুলো বিসর্জনের ন্যায় প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসছিল। 
প্রাচীন ইতিহাসে,অপালা, ঘোষা, লোপামুদ্রা,মৈত্রী,গার্গী কিছু নারীর নাম পাওয়া গেলেও, নারী সমাজ ব্যবস্থা তেমন ভাবে দাগ কাটতে পারেনি আজ। ইতিহাসের পাতায় নামটুকু আবদ্ধ হয়ে রয়ে গেছে।স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসটা একটু পড়ে দেখলে বেশ বোঝা যায় নারীরাও সশস্ত্র আন্দোলনে যোগদান করেছিল। নিজেদের জীবনের কথা না ভেবে, সংসার ধর্মের কথা চিন্তা না করে নিজেদের জীবনকে সঁপে দিয়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে।অথচ বহু নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হলেও ৮০ শতাংশ রয়ে গেছে অন্ধকারে। দেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বহু নারীদের জীবন  অবাঞ্ছিত, অবহেলায়,বিসর্জন হয়েছে।বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় নারী আজও ভোগ্য ,আমদানি ,রপ্তানি,বিলাস,বৈভব,সংসারের যাঁতা কলে পিষে মরা, আর সন্তান উৎপাদনের মেশিন হিসেবে পরিহার্য।পণ্য পরিবহনের মত কেনাবেচা চলছে ছোট কন্যা সন্তানদের জীবন। বেশ কয়েক মাস আগে  হাওড়ার এক হোমে নারী পাচার কাণ্ডে জড়িত ছিলেন রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা।এ ঘটনা তো ভারত বর্ষ তথা পশ্চিমবাংলায় নতুন কিছু নয়।"লিঙ্গ নির্ধারণ আইনা তো অপরাধ", তাতে অপরাধীর জেল ও জরিমানা দুই হতে পারে তা সত্ত্বেও কন্যা ভ্রূণ হত্যা বন্ধ করা গেছে কি? আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়ায় সভ্য সমাজের সুষম বিকাশ ঘটেছে।অথচ উত্তরাখণ্ডের এক গ্রামে গত ছয় মাসে একটা শিশুকন্যা জন্মায়নি।কন্যাভ্রূণ নির্মূলন যজ্ঞে যোগ দিয়েছেন অজাত শিশুর পরিবার,শিক্ষিত ডাক্তারবাবুরা এবং আইনের মুখে ছাই দেওয়া প্রশাসন। জন্মাবার আগেই গর্ভপাতের প্রবণতা বেড়েছে।অথচ জন্মের লগ্নেই ১০০০ শিশুপুত্রের তুলনায় ১০৪ জন মেয়ে কম জন্মায় আমাদের দেশে। পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ফুলের কলিরা। জন্ম থেকে ছয় বছর পর্যন্ত কন্যা ও পুত্র সন্তান অনুবাদ কমে চলেছে ১৯৪১ সাল থেকে। কন্যাভ্রূণ নির্মূলনে চলে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা। পিছিয়ে নেই কলকাতার শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত অঞ্চল গুলো।
এই যুগে দাঁড়িয়ে সমীক্ষায় বলছে পুরুষ শিশুর তুলনায় কন্যা শিশুর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বর্তমান এই আধুনিক সুসভ্য সমাজেও শুধুমাত্র কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ার অপরাধে বহু নারীকে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হতে হয়,এমনকি অত্যাচার করতে করতে মেরেও ফেলা হয়।আজও আইনের চোখের সামনে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে অবাধে চলছে পণ প্রথা। সংবাদ মাধ্যমের পাতা খুললেই  দেখতে পাওয়া যায়,পণ দিতে না পারার জন্য  সদ্য গৃহ বধূকে পুড়িয়ে নয়তো হত্যা করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। নির্দোষ এক ফুলের মত নিষ্পাপ জীবনকে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যেতে হয় সমাজের কলুষিত প্রথায়। বহু মা ইতিমধ্যে তাদের সন্তানকে হারিয়েছে।অনেক ছোট শিশু জন্মের পরে মাতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।পরবর্তীকালে বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে এমন সন্তানরা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন।আজও আমাদের সমাজে ঘটা করে কুমারী পূজা করা হয়।অথচ দিনের স্বচ্ছ আলোয় দুধের শিশু থেকে মাঝ বয়সী এমনকি ষাট ঊর্ধ্ব নারী। এটা কি জীবন্ত দুর্গার অপমান নয়? এটা কি বিসর্জন নয়?সমাজের বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ মোমবাতি  জ্বালিয়ে মৌন মিছিল করে রামলীলাময়দানে,মনুমেন্টের পাদদেশে কিংবা ধর্মতলার মোড়ে। কিন্তু বুঝতে হবে লেলিহান শিখার মাঝে লুকিয়ে থাকে শিকারি হায়নার নীল চোখ। সমস্যা গোড়া থেকে নির্মূল হওয়ার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয়।তবে লজ্জার কথা হল এমন ভ্রষ্টাচার,যা কিছু ঘটছে সবই লোক চক্ষুর সম্মুখে।
আদালতের দরজায় গিয়ে খোঁজ করে দেখুন নারী নির্যাতনের  ফাইল পাহাড়সম জমে আছে।তার মধ্যে সবথেকে ভয়ঙ্কর খবর হল ইতিমধ্যে ফ্রিতে রেশন,বিদ্যুৎ,জল দেওয়া দিল্লী রাজ্যে নারী নির্যাতনের সংখ্যা নির্দ্বিধায় বেড়ে চলেছে।আমার,আপনার কথা নয়,সমীক্ষা বলছে দৈনিক গড় সংখ্যা ৬।তার পিছনের সারিতে একই পথে হাঁটছে রাজস্থান,বাদ যায়নি পশ্চিম বাংলা।।তার থেকে আরো ভয়ংকর খবর হলো স্বাধীনতার ৭৫ বছর মহোৎসব পূর্তি উপলক্ষে গুজরাটে কিলবিস বানু ধর্ষণকাণ্ডে ১১ জন ধর্ষককে সাজার সমাপ্তি হওয়ার আগেই মুক্তি দেওয়া হয়েছে।যে সংবাদ সমাজের ভিত নড়িয়ে দেওয়ার মতো।পশ্চিমবাংলায় বানতলা কামদুনি,নদীয়ার হাঁসখালি,ধুলাগড় সহ বহু জায়গায় নারী নির্যাতনকারী অপরাধীরা সমাজের বুকে অবাধে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা কি আমাদের সামাজিক লজ্জা নয়? ধর্ষক মানেই অপরাধী। আর রাজনৈতিক প্রশ্রয় তাদের মুক্তি দেওয়া মানেই দেশের আইন ব্যবস্থার ওপরে সাধারণ জনগণের আস্থা কমে যাওয়া।ধর্ষকরা কখনোই সংস্কারগামী বা মানবতার আদর্শ হতে পারেনা। যে ঘটনা আগামী ভবিষ্যতে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়ে হাজারো প্রশ্ন রেখে যায়? একথা অস্বীকার করার উপায় নেই কোটি কোটি টাকা খরচা করে মাটির প্রতিমাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস আবেগে মেতে উঠি, ভক্তি শ্রদ্ধা দেখান, বিসর্জনের সময় আবেগপ্রবণ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে দুটি নয়ন অথচ সেই সমাজেই রোজ রোজ জীবন্ত দুর্গা বিসর্জন হয় সে কথা আমরা কেউ খেয়াল করি না।
তবে সমাজ পরিবর্তন শীল,কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকার নারীদের জন্য বহু প্রকল্প চালু করেছে।কিন্তু আমাদের দেশে নারী নিরাপত্তা একেবারে বিশ বাঁও জলে।নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেখলে তা জলের মত, পরিষ্কার।ভিক্ষা বা অনুদান নয় কর্মসংস্থান হল দেশের সার্বিক উন্নয়ন, ঠিক তেমনি নারী প্রকল্প নয়,সুরক্ষাটা বিশেষ জরুরি।কারণ পুরুষ আর নারী এই সমাজে একে অপরের পরিপূরক।যেমন জীবন,মৃত্যু_আলো, অন্ধকার।শুধু পুরুষ দিয়ে সমাজের সচল প্রক্রিয়া চলে না। তাইতো নারী মা, জগত জননী জগদম্বা।তাই তো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অমর সৃষ্টি তে আমাদের কে বার্তা দিয়ে গেছেন:_"বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি  চির কল্যাণ কর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর।` যেন আমরা ভুলে না যাই।
 
 
 
 দুর্গাপুজোয়  মানবতা জাগাতে হবে
বিপ্লব গোস্বামী


শরতের আকাশ জুড়া সাদা মেঘের ভেলা আর রৌদ্র ছায়ায় জানান দেয় এসেছে শারদীয় দুর্গোৎসব।বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গোৎসব।মা দূর্গার অন‍্য এক নাম আনন্দময়ী।দুর্গোৎসব হচ্ছে আনন্দের উৎসব।আনন্দময়ীর আগমনে সবাই মেতে উঠে মহানন্দে।আনন্দের জোয়ারে মেতে উঠে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা।সবার আনন্দ সাগরে ভাসারই কথা। কেননা এই দিনটির জন‍্যই তো সবাই একটা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে।তবে আগেকার দিনের পূজো আর এখনকার দিনের পূজোর মধ‍্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়।আগেকার দিনের পূজোর দিন গুলোতে ঘুম থেকে উঠে মায়ের অঞ্জলির জন‍্য ফুল তোলা আর পূজা শেষে মায়ের অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ খাওয়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা।বিকেলে পরিবারের সবার সাথে ঘুরে ঘুরে পূজো দেখা আর ঢাকের তালে তালে ধুনুচি নৃত‍্য এসব যেন ছিল আগেকার দিনের পূজোর এক বিশেষ রেওয়াজ।বিজয়া দশমীর দিন মহিলারা মায়ের চরণে সিঁদুর দিয়ে সেই সিঁদুর নিজের সিঁথিতে মেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে মাকে বিদায় জানতেন।তখন মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জন শেষে গুরুজনদের প্রণাম ও সমবয়সীদের সঙ্গে কোলাকুলি করা হত।এক কথায় বলতে গেলে আগেকার পূজো ছিল সাত্ত্বিকতার পূজো ।
    কিন্তু এখনকার পূজোয় প্রবেশ করেছে আধুনিকতা।আজ সবাই আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক হতে চলেছে।আর সেই সঙ্গে গ্ৰহণ করছে বিদেশী সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি।বিদেশী সংস্কৃতি গ্ৰহণ করা কোন অন‍্যায় বা অপরাধ নয় কিন্তু কোন অপসংস্কৃতি গ্ৰহণ করা একদম কাম‍্য নয়।কারণ অপসংস্কৃতি সব সময় বিনাশকারী হয়ে থাকে।আজকাল তরুণ তরুণীরা উৎসবের নামে শোভাযাত্রাকে  অবাদ মেলামেশার উপলক্ষ বানিয়েছে।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উন্মত্ততা ও অশ্লীলতায় মেতে ওঠে তারা।সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের দেশের যুব সমাজ আধুনিকতায় ডিজিটাল হতে চলেছে।আধুনিক ডিজিটাল হতে গিয়ে নিজ সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলী দিয়ে গ্ৰহণ করছে মদ সংস্কৃতি-ডিজে সংস্কৃতি আর বিদেশী সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি।
 বাঙালিদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গোৎসব বা দূর্গা পূজো।আজকাল দূর্গা পূজোও হতে চলেছে ডিজিটাল।হারিয়ে যাচ্ছে সাত্ত্বিকতা।পূজো মণ্ডপে ধর্মীয় গানের পরিবর্তে চলছে ডিজে গান।আজকাল দূর্গা পূজোতে বা যে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যুবক যুবতীরা যেভাবে যে অঙ্গভঙ্গিতে নৃত‍্য রত হয়  বা দিয়ে শোভা যাত্রার নামে রাস্তা যায় তাতে যে ভাবে পাশ্চাত‍্য আধুনিকতা আমদানি হচ্ছে তাতে ভারতীয় সংস্কৃতিকে তারা শুধু লজ্জা নত করছে তা নয় অপমানিতও করছে।
           আজ হারিয়ে যাচ্ছে মানবতা। লক্ষ টাকা ব‍্যয় করে মাটির দূর্গার পূজো করা হচ্ছে।অথচ গর্ভের দূর্গাকে ভ্রুণেই হত‍্যা করা হচ্ছে।রাস্তায় একা দূর্গা পেলে ধর্ষণ করা হচ্ছে।বিয়ের দূর্গার কাছে পণ চাওয়া হচ্ছে।বড় বিচিত্র এ জিজিটাল যুগ ! আমাদের ডিজিটাল  হতে হবে ঠিকই কিন্তু নিজের সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলী দিয়ে নয়‌,মানবতাকে জলাঞ্জলী দিয়ে নয়।যত দিন পর্যন্ত আমাদের মনে মানবতা জাগ্ৰত হচ্ছে না ততদিন প্রকৃত অর্থে জিজিটাল হওয়া সম্ভব নয়।প্রকৃত অর্থে আধুনিক ডিজিটাল হতে হলে আগে অপসংস্কৃতি ত‍্যাগ করে মানবতাকে জাগাতে হবে।

 

 কবিতা
 
 রাত্রি যাপন 
উৎপলেন্দু পাল  


প্রতি রাতে 
আমি শুয়ে থাকি 
এক কালনাগিনীর পাশে 
নির্লিপ্ত নিরাসক্ত ভাবে , 

আমার একটু 
অসাবধান নড়াচড়ায় 
ফোঁস করে ওঠে সে 
তীব্র বিষ মাখা ঠোঁটে , 

প্রতি রাতে 
আতঙ্কের প্রহর গুনি 
মূহূর্তে ছোবলের ভয় 
মেরুদন্ডে শীতল স্রোত , 

সতর্ক ভাবে 
পাশ ফিরে থাকি 
তবুও তীব্র ভালোবাসা 
গিলে খেতে চায় , 

প্রতি রাতে 
স্বর্গ মর্ত‍্য নরক 
পাক খেতে থাকে 
আমার বিছানার চারপাশে , 

রাত কাটে 
প্রতিটি ভোরের লোভে 
আবার বিছানায় যাই 
আরেকটি ছোবলের আশঙ্কায় । 
 
 
 
 এভাবে একদিন
দেবদত্তা লাহিড়ী 

দুস্তর মরুভূমি আর নোনাজলের স্বাদ পেরিয়ে
একদিন আমি ঠিক আমার হবো
সেদিন নাই বা ঝলসে উঠলো আয়না
জানলার ধারে পারাবতের ডানা ঝটপটানি 
ক্রমে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে
একসময় খোলা আকাশে।...
আর শেক কবির হ্যামলেট মুচকি হেসে
জানবে বিদায় সম্ভাষণ।
এভাবেই, এভাবেই 
আমি একদিন ঠিক আমার হবো ।
 


অলিন্দ
মৌমিতা বর্মন

হয়তো একদিন তুমি হবে আমার প্ৰিয় অলিন্দ
চাঁদের নরম আলো পড়বে পায়ের পাতায়।
হয়তো একদিন ক্লান্ত আমি এলিয়ে মাথা খানি,
রাখবো তোমার বুকের মাঝে আনি।

বৃষ্টি নামবে যখন! হয়তো ডাকবে আদর করে
ছুটে যাবো তোমার কাছে, সকল পাহাড় ঠেলে।
শীতের দুপুর আসবে যখন-গরম চাদর পেতে
তোমার সাথেই হারিয়ে যাবো গল্প বলার স্রোতে।


তীব্র গরম বইবে যখন, রাখবো শীতল পাটি
ঠোঁটের কোনে জড়িয়ে দেবে প্রবল খুনসুটি।
ওই যে দূরে সবুজ গাছে গাইবে পাখি সুরে
তোমার হাতে হাতটি রেখে নাচবো ঘুরে ঘুরে।

হয়তো তুমি থাকবে কাছে, আমার হৃদয় মাঝে
প্রথম প্রেমের রূপক হয়ে জাগবে আঁধার রাতে।।
 
 
 
কাশফুল
রেজাউল করিম রোমেল

শরতের আগমনে
ফুটেছে কাশফুল,
ফুলে ফুলে ভরে গেছে
অপূর্ব কুল।

তোমাকে দিলাম
আমার প্রিয় কাশফুল,
যত্ন করে রেখ
কোরো নাকো ভুল।

পথ ঘাট মাঠে প্রান্তরে
ফুটেছে কাশফুল,
শরতের এই অপূর্ব ফুল
দেখতে কোরো না ভুল।


 

                

কাঠ বাক্সের দেওয়াল ঘড়ি

মিষ্টু সরকার 


পেল্লাই দেয়াল ঘড়িটা জায়গা করে নিয়েছিল
আমাদের বাড়ীতে
সেই কোন প্রাচীণ এক বিকেলে
বাবার হাতে উঠে এসেছিলো দোতলার ঘরে
দিনান্তে ইয়া লম্বা চাবি ঘুরিয়ে দম দিতে হতো, না হলে অভিমান করে বসে থাকতো;
সারাদিন চুপটি করে থাকতো, কথা না বলে ।
তার নির্দিষ্ট জায়গা হলো টিভি টেবিলের ঠিক ওপরে
সেই থেকে যে আসতো সেই ওর কথা জিজ্ঞাসা করতো
ওর ইতিহাস জানতে চাইতো
ওর অহঙ্কারে মাটিতে পা পড়তো না !!
সেই থেকে সময় বুঝিয়ে দেবার 
দ্বায়িত্ব ছিলো তার ওপরে ।।

আমি তখনও প্রায় নতুন 
অতএব প্রাচীনত্বের দাবীতে
সে খেয়াল রাখতো আমার গতিবিধির
একটা মনের কথা বলাও , কখনও যেনো তার
 ভালো ঠেকতো না ;
কারণে অকারণে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে উঠতো সে !
মিছি মিছি শত্রুতায় আমার রাগ হতো, 
কিন্তু সে তোয়াক্কা তার থাকলে তো !
দিন নেই ! রাত নেই ! শুধু ঢং ঢং !!

দেয়াল ঘড়িটা আমায় আটকে দেবে বলেই
হঠাৎ হঠাৎ এসে উপস্থিত হয়ে যায় পাহারায়
আমি যখন ব্যস্ত কোনো কাজে 
মনোসংযোগের তুঙ্গে
ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজাতো
আমি কাজ ভুলে গিয়ে বকা লাগাতাম ওকে
যেনো সব দোষ ওরই ছিলো ।
ও মুখ টিপে হাসতো, এভাবেই বেড়ে উঠেছিলো আমাদের অসম বয়সীবন্ধুত্ব।
কখনো সখনো ওই আমার ভুলো মনের 
ভুলে যাওয়া কাজ গুলো মনে করিয়ে দিতো ঢং ঢং ঘণ্টা বাজিয়ে।
তখন ওর সাথে সখ্যতা বিনিময় হতো হাসির মাধ্যমে।
মাঝে মধ্যেই ওকে ধুলো মুছে পরিষ্কার করে দিতাম 
পরম মমতায় , 
ও কৃতজ্ঞতা জানাতো !

রান্নাবান্না, টি.ভি. টাইম , বাইরে বেরোনো থেকে ঘরোয়া যাবতীয় কাজের এক অলিখিত
যাপন সঙ্গী হয়ে ' টিকটিক' শব্দে 
কথা বলে যেতো আত্মিকতায় ।
কালের নিয়মে বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে
যারা বলে ওরা প্রাণহীন; তারা জানে না, 
আমাদের প্রতিদিনের চলার সাথীরা 
তাদের ভালবাসার কথা প্রাণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয় ।
সেই শোকে !
হঠাৎ ওর একদিন অসুখ করলো 
প্রাথমিক চিকিৎসা কাজে লাগলো না
সমস্ত বাড়ী জুড়ে গভীর নীরবতা
জানিনা, সেদিন বন্ধু না ; অভিভাবক !
কাজ করেছিলো কোন স্বত্ত্বা ! 


জোর দাবীদার হলাম ওর জীবনের জন্য ;
যে কোনো মূল্যে !
আমরা তার দেহ কোলে তুলে চললাম সেখানে ,
যেখানে হলুদ বাল্বের আলোয় জর্জর দোকান 
তার দোকানী জহুরীর চোখে তার মানবসত্তার শেষ বিকিরণ টুকু দিয়ে 
লড়বে বলে দিলো কথা ;
মাসখানেক পর শয্যা ত্যাগ করলো ,
নতুন প্রাণ পেলো '' ঘড়িটা"
নতুন ভাবে জীবনে পড়লো বাঁধা ।।
জীবনের অর্থ , আত্মীয়তার অর্থ নতুন করে ভাবা
একসাথে নতুন করে বাঁচা 
প্রাচীনে নবীনে সখ্যতা ।।
 
 
 
 
শ্যামা
সুমন্ত সরকার

শরত শেষে স্নিগ্ধ শীতে
মাঠের সোনালী ধান,
মনযে কেমন করে ওঠে
উমা ফিরে গেছে শ্বশুর ধাম।
কার্তিকের এই দারুন রাতে
আলো জ্বালো সব,
শ্যামা আসছে আবার ফিরে
শুরু করো নতুন রব।
গাছে গাছে ধরেছে ওই
সুন্দর লাল জবা,
মাঠে মাঠে ক্লাবে ক্লাবে
জমে উঠেছে শ্যামার পূজা।
উমা গেছে ফিরে তাই
মনে দুঃখের রেশ,
শ্যামা এলো বলেই তো
সব কষ্টের হলো শেষ।
ঘরে ঘরে দীপ জ্বলে
মণ্ডপেতে শ্যামা,
বাজি পটকা ফানুসে
মেতে ওঠে সব কচিকাচা।
উৎসবের এই মহানন্দ 
রইলো এবার গাঁথা,
আসছে বছর এই কার্তিকে
আসবে আবার আনন্দিনী শ্যামা।

                                 

 শুভ বিজয়া

 নিতাই দে


এই তো সেদিন সবে এলে
আজই যাবে ফিরে!
আবার তো আসবে সেই
একটি বছর পরে।
নিজের চোখেই দেখে গেলে
এবার ঘুরে ঘুরে,
মর্ত্যে বড়ই অস্থিরতা
দানবে গেছে ভরে।
বাহুবলীর দখলদারি
অবোধ শিশু মরে।
সত্য-বিশ্বাস রুদ্ধ নিঃশ্বাস
টুঁটি চেপে ধরে!
সুখ -শান্তি শ্মশানবাসি
অতিষ্ঠ অনাচারে।
আজব কলে বেড়েই চলে
পণ্যের দাম রোজ-
কত মানুষ অনাহারে
বলে, কপাল দোষ।
ভোলানাথ কে বলো গিয়ে
বিহিত যেন করে-
হে মহাকাল আর কতকাল
থাকবে নেশা ঘোরে।

                                                 

জ্বালায় জীবন

 আশীষ  কুমার   বিশ্বাস

       
ছোট্ট ভাঙা কুড়ে ঘর
অন্ধ এক মেয়ে
সারা দারিদ্রের ছায়া
সংসার ছেয়ে ।

কি যে জ্বালা সারাজীবন
সইবো কতো ?
এই ভাবে কুড়ি বৎসর
হইলো গত !

চোখে সে অন্ধ হলেও
মনে কিন্তু নয়
যৌবন এসেছে দেহে
লোক চক্ষুর ভয় !

কি যে হবে এই মেয়ের ?
কি বা আছে ভালে ?
দুঃচিন্তা  , দূরভাবনা
প্রতি পলে পলে ।

ভগবান কে  ডাকি আমি
কাকুতি মিনতি
একটু পাই যেন
মানুষের সহানুভূতি ।

সুখ যদি নাও আসে
দিয়ো সহনশক্তি
তোমার পদতলে যেন
থাকে হৃদয়ের ভক্তি ।
 
 


আমি নারী 
 রীতা মোদক

পুরুষ:  এসো নারী
            করজোরে তোমার বন্দনা করি
            তুমি কালী,তুমি দুর্গা
            তুমি জগৎ সৃষ্টকারিনী ।

নারী:  একি শুনি আমি !
          একি শুনি আমি !
          যুগে যুগে আমি -হয়েছি কলঙ্কিনী
          জানেন শুধু অন্তর্যামী।

পুরুষ: একি বলো তুমি---
          শোনো ওগো  কন্যা--
          তুমি মাতা, তুমি স্ত্রী
          তুমি অনন্যা।

নারী:  আমি ছিলাম মহালক্ষ্মী
          আমি ধরিত্রী কন্যা সীতা,
          দস্যু রাবণের জন্য
          আমি হয়েছি কলঙ্কিতা।

পুরুষ:  তুমি প্রেয়সী,তুমি সুন্দরী
            তুমি অপ্সরা মেনকা।
            তুমি রাধিকা
            কৃষ্ণ প্রানাধিকা।

নারী : আমি রাধিকা
          কৃষ্ণ আরাধিকা
          আমার এই দেহে শুধু---
          কলঙ্কের ছবি আঁকা


পুরুষ:  তুমি কখনও দুর্গা
            কখনো করাল গ্রাসিনীকালীমাতা
            কখনো খড়্গ হাতে অসুর মারো,
            কখনো সৃষ্টির কাজে নিমজ্জিতা।

নারী:  আমি কালো মেয়ে,
          আমি অবলা নারী
          আমি এক আকাশ চিন্তার বিষয়
          আমি সকল দুঃখ সহ্য করি।


পুরুষ:  তুমি মহীয়সী নারী!
            তুমি সম্পূর্ণা
            রন্ধনশালায় তুমি
            স্বয়ং অন্নপূর্ণা।

নারী:   আমি যুবতী নারী
           আমি ধর্ষিতা হই বার বার...
           আমি বিক্রি হই অন্ধ গলিতে
           আমার ঠাঁই হয় নিষিদ্ধ কারাগার।

পুরুষ :  ক্ষমা কর আমাদের
             ক্ষমা করো,
             কঠোর হাতে দাঁড়াও তুমি
             তুমি প্রতিবাদ কর।

নারী:  আমি নারী
          আমি সকল বাঁধার পাহাড় ভেঙ্গে চলি...
          আমি পড়াশুনা খেলাধূলার সাথে
          আমি ক্যারাটে কুস্তি করি
          আমি দেশের জন্য বন্দুক ধরি
          আমি ধারণ করি
          আমি পালন করি
          আমি  অন্যায়ের প্রতিবাদ করি
          আমি নারী---
          আমি সব পারি।।
 
 
 
 
 ভ্রমণ

রবির ছোঁয়া
 মধুমিতা শীল
   

বিশ্বভারতী একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়।  এটি ওয়েস্ট বেঙ্গল এর বীরভূম জেলার বোলপুর, শান্তিনিকেতনে অবস্থিত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।মনে পড়ে যায় কবি গুরুর গানের ভাষা 
"তব দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুঁতে" । এক অনাবিল আনন্দে অবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম গন্তব্য স্থল শান্তিনিকেতনে । পৌঁছলাম শান্তবিতান, পর্যটন দপ্তরের আবাস। সেখানে বসবার ঘরে চারিদিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি, চিত্রকার এর সুনিপুণ হাতের তৈরী। মূল ফটকের বাঁ পাশে অপূর্ব শিল্প কলার নিদর্শন।সবুজের গালিচায় ভরা মাঠ, বিভিন্ন গাছ রয়েছে। বসবার আসন তৈরি। সেখান থেকে পরদিন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাস ম্যাপ দেখে প্রবেশ করলাম। সবুজ নিবিড় পরিবেশ কে আবাহন করে আপ্লুত হলাম। একে একে বিভিন্ন ভবন  ঘুরে ঘুরে দেখলাম।সঙ্গীত ভবন, কলা ভবন, শিক্ষা ভবন, বিনয় ভবন, পল্লীশিক্ষা ভবন, ভাষা ভবন,শিক্ষা সত্র । ঘুরে দেখলাম তিনপাহাড়, ছাতিমতলা,পল্লী সমাগথনা বিভাগ। দেখলাম আশ্রমিক স্কুল পাঠভবন। সেখানে গুরুদেবেরস্মৃতি তে মন প্রাণ আবেগে ভরে ওঠে। দেখলাম বহু পুরোনো বটবৃক্ষ, উপাসনা গৃহ, মিউজিয়াম, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, বিপুল সব ভাস্কর্য আরো কত কি।  আমার উদ্ভাসিত মন কুর্নিশ জানায়  সৃষ্টি ও স্রষ্টাদের। চলে গেলাম কোপাই নদীর তীরে। এই নদীর কথা আমরা ছোটবেলায় কবিতায় পড়েছি।কোনো বাড়ীর নাম সেঁজুতি, কোনটা পূরবী বা খেয়া বা চিত্রা। প্রাণের ঠাকুরের ছোঁয়া প্রতিটি গাছের, প্রতিটি পাতায়। "চিত্ত যেথা ভয়শুন্য উচ্চ যেথা শির"।গিয়েছিলাম সোনাঝুরি হাট। যেখানে ক্রেতা, বিক্রেতার এক মিলন উৎসব। হাতের কাজের এক শৈল্পিক সমারোহ। দেখেছিলাম লোক নৃত্য। তাল, লয়ের এক অপূর্ব মিশ্রণ। দর্শন করলাম কঙ্কালিতলা। মায়ের একপীঠ।ভৌগোলিক বিচারে, দুটো যমজ শহর শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন।  অজানাকে জানার আনন্দ, যেখানে খোলা আকাশের নীচে। প্রকৃতির কোলে শিক্ষা, রয়েছে শিক্ষার্থীর সৃষ্টিশীলতার আনন্দ। মনের চোখকে খোলা আকাশের মুক্ত আবহে ছড়িয়ে দেওয়া যা আমাদের জীবনকে ছন্দময় করে তোলে সমস্ত কিছুর সাথে। গুরুদেবের শিক্ষা পদ্ধতিকে মনের চোখে দেখা যায়।১৯৫১সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর মর্যাদা লাভ করেছে। গুরুদেব, যিনি ছিলেন কবি, লেখক, দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক ও গীতিকার। যিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় এর নামকরণ করেছেন বিশ্বভারতী।যার অর্থ the communion of the world with India, শান্তিনিকেতনকে World Heritage Site হিসেবে ঘোষনা করেছে গত ১৭ই সেপ্টেম্বর UNESCO.১৯০১সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আবাসিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন।১৯২১সালে বিশ্ব ভারতীর যাত্রার সূচনা।১৯৫১সালে বিশ্ব ভারতীর স্বীকৃতিলাভ। তারপর ইউনেস্কোর স্বীকৃতিলাভ।সব মিলিয়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলার গর্ব। বাঙালির গর্ব।
 
 
 

ছবি




চিত্রাক্ষী রায়

No comments:

Post a Comment