Wednesday, October 2, 2024


মুনা 

অনলাইন শারদ (আশ্বিন) সংখ্যা ১৪৩১


গল্প 


প্রতিবাদ-ঈ
শর্মিষ্ঠা


পিঠের ব্যাগটা আরও খানিকটা বুকের কাছে শক্ত করে চেপে ধরে বাসের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো মিতুল। কী জানি কেন এলোমেলো ঝাপটায় দৃষ্টিগোচরে বারবার আবছায়া নেমে আসছে। আজকাল রিভানও কেমন ওর সাথে অন্যরকম আচরণ করে। বয়সে দেড় বছরের ছোট হলেও চাউনিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে ছেলেটার। তিনবছর আগে যখন মিতুল মাসির বাড়ি এসেছিল, সবচাইতে বেশি রিভান খুশি হয়েছিল। মাত্র দেড় বছরের ফারাক হওয়ায় রিভান ছোট থেকে কখনই মিতুলকে দিদি বলে ডাকেনি। দু'জনের বেশ ভাব। বন্ধুর মতো। কলেজের থার্ড ইয়ারের আর কয়েকটা মাস বাকি। মিতুল মনস্থির করেই ফেলেছে যে ও এরপরে ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে চলে যাবে। মাঝের সময়টুকু তো স্টাডি-লিভ, অর্থাৎ বাড়ি! আজকাল রিভান বাড়িতেও লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অন্যরকম দৃষ্টিতে মিতুলের দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়ে গেলে মিতুলের গা শিরশির করে ওঠে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ও কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছে। নইলে তো উত্তরবঙ্গেও অনেক কলেজ আছে! রাজাবাজার দিয়ে বাসে পেরোতে পেরোতে বাবা ওকে সাইন্স কলেজটা দেখিয়েছিলেন। সেই থেকে ও মনের কোণে আশার দীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। একদিন ওই কলেজ থেকে মেডেল নিয়ে বাবার হাতে তুলে দেবে। বাবারও তো স্বপ্ন ছিল ওখানে পড়বার। সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মিতুল সেদিন ঠিকই বুঝতে পারছিল কতটা আবেগ বাবার গলায় জমা হচ্ছে। মেয়েকে কলেজ চেনাতে চেনাতে চোখ কতখানি চকচক করছে। কতটা যন্ত্রণা সেই আলোর নীচে থিতু হয়ে আছে। যেন প্রদীপের শিখার নীচের জমাট আঁধার। 

     'টিকিট...', সম্বিৎ ফিরলো মিতুলের। টিকিট কাটতেই নজরে এলো এরই মধ্যে কখন যেন বাসটা প্রায় টাবুটুবু ভরে উঠেছে। ওর পাশেই বাসের হ্যান্ডেল ধরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি বেশ লম্বা। হাল ফ্যাশানের ট্রাউজার আর গেঞ্জি পরা। কিন্তু হাতের কব্জি জড়িয়ে লাল-সাদা শাঁখা পলা নোয়া। দু'হাত ওপরে তুলে হ্যান্ডেল ধরলেও কাঁধ এবং কানের মাঝে মোবাইল শক্ত করে ধরে এই ভিড়েও গভীর কায়দায় নিচু স্বরে কথা বলছে। মিতুল ভাবলো একবার ওকে জিজ্ঞেস করে দেখবে যে, সে যদি নিজের ব্যাগটা মিতুলকে ধরতে দেয়, তাহলে হয়তো ওর দাঁড়াতে কিছুটা সুবিধা হবে। টিকিট ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে মিতুলের নজর গেল মেয়েটির পায়ে। এমন কেতাদুরস্ত পোশাকের সাথে আলতার ব্যতিক্রম তো চোখ কাড়বেই! চট করে ও বুঝে নিলো, মেয়েটি সদ্য বিবাহিত।
― হাতটা একটু ওদিকে করুন তো!
― আরে, কোথায় সরাবো?
― অফিস টাইমে এভাবে দাঁড়ালে হয়! একটু কাত হয়ে দাঁড়ান।
― আর সরার কোনও জায়গাই নেই।
অগত্যা মেয়েটি নিজেকেই আরেকটু গুটিয়ে মোবাইলের বাক্যালাপে মন দিলো।

     মিতুলের গতকালের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। সন্ধ্যায় চা নিয়ে ও ছাদে গিয়েছিল। প্রায় রোজই যায়। কিছুক্ষণ পরে ছাদে হাজির রিভান। তার হাতেও কফি মগ ধরা। ওতে কফি না, চা আছে। চায়ে দুবার চুমুক দিয়ে রিভান ওর বাঁ হাত মিতুলের পিঠের পেছনদিকে নিয়ে শক্ত করে ঝাঁকিয়ে দিলো মিতুলকে। 'তুই যদি আমার আত্মীয় না হতিস তোকে আমি শিওর প্রপোজ করতাম মিতুল। তোর অ্যাপিয়ারেন্সটা বেশ অ্যাট্রাক্টিভ। চোখ দুটো ভীষণ ব্রাইট...' মিতুল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে, 'ছিঃ! আমি তোর দিদি না! বলার আগে একটু তো ভাব! যখন যা মনে আসছে বলে দিচ্ছিস! ডাকবো মিমিকে!' হো হো করে হেসে ওঠে রিভান। 'সে তুই ডাকতেই পারিস। ওসব দু'তিন বছরের ফারাকটা কিছুই না। এটাই এখন ট্রেন্ড। কেউ একজন বড় হলে রিলেশনে ম্যাচিওরিটি আসে। তুই কিন্তু খাসা! আর এখন মাসতুতো, পিসতুতো খুব চলছে। কিছু বুঝলি...' এরপরেই রিভানের সেই শানিত বক্র দৃষ্টি মিতুলের একদমই ভালো লাগেনি। এটা যে ও ইয়ার্কি করছিলো না, সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল ওর কাছে। ছাদে সন্ধ্যার আঁধার যেন কাঁকড়ার মতো ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিল ওর দিকে। বাবার মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। ঘাড় থেকে মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে যাচ্ছিল নোনা স্রোত।

     এবার যেন আশেপাশের আওয়াজগুলো ধীরে ধীরে মিউট হতে লাগলো। মিতুল এখন ওই মেয়েটির মৃদু আড়ষ্ঠ ভারী হয়ে আসা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে। চোখের কোণ থেকে এক বাস লোকের সামনেই গড়িয়ে নামছে চিকন ধারা। একটা হাত হ্যান্ডেল থেকে ছাড়িয়ে নাকের ভাঁজটা তৎক্ষণাৎ রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছে সে। 
'আমি আর পারছি না। রোজ রোজ বাড়ি ফিরেই এক অশান্তি। শোনো, আমার বাড়িতে খুব প্রবলেম চলছে। আমার মামার খুবই ফিনান্সিয়াল সমস্যা হচ্ছে। আমি যথাসাধ্য সাহায্য করছি। মাও করছে। এই নিয়ে প্রত্যেকদিন বাবার অশান্তি। বাড়ি ফিরলেই সেই এক বিষয় লেবুচেপা। যেকোনো টপিকে কথা শুরু হলেও বাবা ওটাকে ঘুরিয়ে সেই এক জায়গায় নিয়ে দাঁড় করায়। বাবা নরমালি যখন কথা বলে তখনই পাশের বাড়ি থেকে শোনা যায়। আর এখন এই চিৎকার চেঁচামেচি পাড়ার সবাই জানতে পারছে। এরকম করলে আমি আর বাড়ি আসতে পারব না।' এক নিঃশ্বাসে এতটা বলার পরে মেয়েটি চুপ করলো। এরই ভেতরে তার গলা ধরে এসেছে। রুমাল দিয়ে বার চারেক চোখ মুছেছে। মিতুল অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, বাবারাও আবার এমন হয় নাকি! ওপাশের বক্তব্য চলছে। মাঝে বার দুয়েক মেয়েটি ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়েছে। মিতুল বুঝলো অকারণে ওর এই ড্যাবড্যাব করে তাকানোটা ভালো হচ্ছে না। এটা অসভ্যতা। ও চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জানালায় তাকালো। কিন্তু কান খাঁড়া অন্যদিকেই। মেয়েটি থেমে থেমে বলছে, 'না, না আমি আর ছুটি নেব না। এই শনিবারই শেষ। প্রমিস করছি।... কোথায় প্রত্যেক সপ্তাহে যাচ্ছি! শাশুড়িকে ফোন করব। যদি সোমবার জন্মাষ্টমীর পুজো করে তাহলে সোমবার সেকেন্ড হাফে যাব। ওই ফাইলের কাজ করে দেব। নাহলে ওই একটা দিন আমার ছুটি লাগবে।...' মিতুল বুঝলো, এ ফোন অফিসের বসকেই করা। কেউ কারও স্বামীকে অন্তত বলবে না যে সে শাশুড়িকে ফোন করবে। আবার কিছুক্ষণ চুপ। এখন আর চোখের জল পড়ছে না। বরং তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। 'আরে ওকে তো চেনোই! কোন জগতে থাকে কে জানে! না ফোনে পাই, না মেসেজ যায়! সারাদিনই নাকি মিটিং...তুমি প্লিজ এবারটা ম্যানেজ করে দাও। এ মাসে আর ছুটি নেব না। আচ্ছা আমি অফিসে পৌঁছে তোমায় ব্যাপারটা ক্লিয়ার করছি। রাজি হতেই হবে। আমার কিচ্ছু করার নেই। একটাবার। প্লিজ। নইলে মেডিকেল নিতে হবে…' মিতুলের কিছু বুঝতে আর বাকি থাকলো না। শুধু মনে মনে বলে উঠলো, 'তাহলে বিয়েটা করলি কেন!'

         নিজের ভাবনাগুলোর ঢেউ আবার এসে ধাক্কা দিতে লাগলো মিতুলকে। পুরুষের কত প্রকারভেদ হয়, তাই না! মিতুল ভাবলো একবার মেয়েটির দিকে তাকাবে। এখনও কি সে কাঁদছে! কিন্তু কেন! সে তো স্বনির্ভর! নিজের মর্জির মালিক! এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে তার তো কারও মতামতের দরকার নেই! তবু কেন! তাঁকে তো কেউ রিভানের মতো বিরক্ত করে না। আর করলেও সে তো তা বরদাস্ত করতে বাধ্য নয়! একবার আড়চোখে তাকালো বাঁ দিকে। মেয়েটি সেখানে নেই। অবাক হলো মিতুল। এই তো এখানেই ছিল! কোথায় সে! একটু ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক দেখতেই চোখে পড়লো তাকে। আস্তে আস্তে বাসের পেছনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে সে। ধীরে ধীরে নিজের দাঁড়ানোর জায়গাটিও সুন্দর বেছে গুছিয়ে নিয়েছে। আর মোবাইলে কথা বলছে না। দু'হাতে হ্যান্ডেল ধরে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঝকঝকে দৃষ্টি। মেঘ উধাও হয়েছে কোথাও। মিতুলের এক টুকরো আনন্দ হলো। 'তাহলে ও নিজের ওপরে ভরসা করছে। এবার ও জিতবেই...' মিতুল ঠিক করে নেয় আজই একটা মেস খুঁজতে হবে। আর একদিনও নয়, একমুহূর্তও নয়। কোনও অন্যায় অসভ্যতা মেনে নেওয়ার প্রশ্নই অবান্তর। তারপর বাড়িতে ফোন করে মেসে থাকার ব্যাপারটা বাবাকে জানাবে। তবে, ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগে মিমিকে সবটা জানিয়ে আসতে হবে। যতই হোক, রিভান তো ভাই! তাকে শুধরে দেওয়ার কর্তব্য কিছু অংশে ওর ওপরেও বর্তায়। সংশোধনের কাজটা ঘর থেকেই শুরু করা উচিৎ। ইউনিভার্সিটি স্টপেজ এসে গেছে। এবার নামতে হবে। ব্যাগটা বুকের কাছ থেকে সরিয়ে পিঠে পড়ে নিলো ও। মেয়েটি এখনও দাঁড়িয়ে। স্বপ্রতিভ। জানালা দিয়ে ঠাঁয় বাইরে তাকিয়ে। মিতুল মনে মনে বলে উঠলো, 'ভালো থেকো।'




ফোনে চার্জ ছিল না.. 

পর্ণা চক্রবর্তী


বাইরেটা যত নিস্তব্ধ হয়ে উঠছিল  তত বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করছিল ওদের দুজনের। একজন জানলায় দাঁড়ায়, অন্যজন ফোন দেখে । দুজন উৎকর্ণ হয়ে শোনে  রাস্তা থেকে আসা বিভিন্ন শব্দ।  কেউ কি গেটটা খুলল? ওই তো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । গেটের ধার ঘেঁষে  ফুটপাতে দাঁড়ানো  বিরাট ঝাঁকড়া গাছটা শীত আসছে বলে রোজ  অজস্র পাতা ঝরিয়ে  রাখে। হীমকালে ও সমর্পণে থাকে রিক্ত ,নিঃস্ব হয়ে।  আগামী মধুমাসে  আরো সবুজ সুগন্ধিত হয়ে ওঠার জন্য গাছটার যেন  নিঃশ্চুপ  এক সাধনা।

ঝরা পাতার ওপর  দিয়ে কে যেন   হেঁটে আসছে না  আলতো পায়ে …?

দুটো মানুষ ছুটে যায় , দরজা খোলে, না কেউ নেই তো, শুনশান রাস্তা।  আশেপাশের বাড়িগুলো  ঝিমোচ্ছে।

আকাশে আজ  অনেক তারা ।  অন্যদিন হলে ছাদে উঠে নতুন কোনো তারা খুঁজত  দুজনে মিলে  কিন্তু আসল সঙ্গীই তো নেই,একজন মাথা হেলিয়ে আকাশ দেখে আর ভাবে। অন্যজন তাঁকে ডাকে,”ভেতরে চলো ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”

আবার একজন  জানলায় মুখ ঠেকিয়ে বাইরে দেখে আর অপর জন মোবাইল। ক্লান্তি শরীরকে জাপটে ধরেছে। বুড়ো চোখে ঘুম নামতে গিয়েও নামতে পারেনা। বুকটা আবার ধড়াস করে ওঠে একটা আওয়াজে।  রিকশা এসে  থেমেছে।তবে কি এলো এতক্ষণে?  আবার দরজা খোলে, নাহ্ পাশের বাড়ি। 


রাত আরেকটু বেড়েছে।ছোটো শহর তলী, রাত এখানে তাড়াতাড়ি নামে।

দুটো প্রৌঢ় মানুষ বোবা হয়ে দুজনের  মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। একজন বাবা আর আরেকজন মা।  ওদের বুকের ভেতরে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা একটা ভয় হাত পা ছড়িয়ে  উঠে দাঁড়িয়ে  বিশাল  হতে থাকে  ক্রমশ। উৎকণ্ঠায় ওদের গলা শুকিয়ে আসছে । রাত হলেই  ইদানিং একটু করে  ঠান্ডা পড়া শুরু হয়েছে। তবুও বাবার কপালে ঘাম জমছে। মা মনে করার চেষ্টা করেন ,”আজকে সব ওষুধ গুলো ঠিক করে খেয়েছি

 তো ?” বুকটাতে কেমন চাপ লাগে,  ভালো করে  যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা  শরীরটা।

“ তুমি খাবে চল।”

বাবা মাথা নাড়ছেন,  “না না  আগে বাড়ি ফিরুক  তারপর। তুমি বরং একটু শোয় গিয়ে ,ও ফিরল পরে ডেকে  দেব।”

“আর ঘুম! “ মা  আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ান।

বাবা লাস্ট পাঠানো মেসেজটা ভালো করে পড়েন। মেয়ে লিখছে ট্রেনের কি গণ্ডগোল ,কোথায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।অনেক ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। লিখেছে,ফিরতে দেরি  হবে চিন্তা করোনা।  

আবার পড়েন। চিন্তা হবে না?  দু ঘন্টার বেশি হয়ে গেল ফোনটা সুইচ অফ বলছে 

“ হ্যাঁ গো ফোনের সুইচ  তো অফ বলছে , চার্জ নেই না কি?” মা  জানলা থেকে একটু সোফায় গিয়ে বসেছেন বাবার কথা শুনে  কি একটা ভাবলেন তারপর বললেন

“ লাস্ট যখন কথা হলো ,চার্জ কম এমন একটা কি বলেছিল।সেতো অনেকক্ষণ  হয়ে গেছে।” দুজনে আবার  দুজনের দিকে তাকায়।কেমন লাগে শরীরটা। কিচ্ছু ভালো কথা মনেই আসে না।

বড্ড ভয় করে ,মাথা ঘোরে। সেই কখন বিকেলে দুটি মুড়ি আর চা খেয়েছিলেন দুজনে। বারোটা বাজতে চলল,পেট খালি। বাবা উঠে এক গ্লাস জল খান, টিভিটা  চালিয়ে, আওয়াজ আস্তে করে খানিক দেখেন আবার উঠে পড়েন। 

“একটু শান্ত হয়ে বসো তো। 

অসুবিধা কিছু  হয়েছে,ঠিক চলে আসবে।” ভীষণ অস্থির মনটাকে সামলাতে সামলাতে মা বলে ওঠেন। “কিন্তু এত রাতে স্টেশনে রিকশা অটো কিছু পাবে? হেঁটে আসবে?” 

প্রশ্নটা  নিবিড় অন্ধকারের মতো ওদের মুখের সামনে ঝুলে থাকে। পরস্পরকে  কি বলবে, কি বললে একটু স্বস্তি পাওয়া যায় সে সব খুঁজতে খুজতে মা কেঁদে ওঠেন।

“ বড্ড চিন্তা হচ্ছে ,এত রাতে কাকে ফোন করব?” বাবা মাথা নাড়েন, “আরেকটু দেখি।”

“কী দেখব?  বললাম তো,” বাবা ভাবছেন, “পুলিশের কাছে যেতে হবে। কী করবে ওরা ? যদি অ্যাক্সিডেন্ট কিছু হয় …আর যদি একলা মেয়েটাকে এত রাতে কেউ  ….”।

চোখের সামনে  একটা  রক্তাক্ত  দুমড়ে যাওয়া চেহারা  ভেসে ওঠে। বাবা ধড়ফড়িয়ে উঠে বসেন।

“ কী সব ভাবছি  দূর!”

“কত বললাম, তুই অফিসের কাছে ভাড়া নিয়ে থাক। রোজ এতটা যাতায়াত.?” মার গলাটা কাঁপছে।

মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ।  নামকরা  কলেজে কম্পিউটার সাইন্স  নিয়ে পড়ল ,ভালো রেজাল্ট করল। আইটি সেক্টরে  ওর অফিস।  বহুজাতিক কোম্পানি,তাদের ভালো মাইনে। মেয়েটা যে কি খুশি। কত কষ্ট করে বাবা ওকে পড়িয়েছেন। প্রথম দিকে জমি, মায়ের গহনা এসব বেচতে হয়েছে। পরে মেয়ে লোন  নিয়ে আরো পড়ল। চাকরি করে  একটু একটু করে  লোনও শোধ  করছে।  বাবা মাও খুব খুশি। অতি সাধারণ  অবস্থা ,সাধারণ  চাকরি  বাবার। পৈতৃক বাড়িটা ছিল তাই। বাবার  ইচ্ছা অবসর নেওয়ার  পর আরো কোনো কাজ করবেন । ওই টুকু মেয়ে কত পারবে। মেয়ে বলল “না,আর না। এবার আরাম করবে অনেক কষ্ট করেছ।”  বাবার মুখটা আলোয় ভরে যায় ,”আমার মেয়ে,বড্ড ভালো।” বাবা মাকে সব আনন্দ দিতে চাইবে, নিজেদের যেসব শখ আহ্লাদ  মেটাতে পারেন নি ওরা, সেগুলো উজাড় করে দেবে। 

“তুই বিয়ে করবি না ?”

“এখন কি, দাঁড়াও, আগে একটু জমিয়ে নি।”

“আর জমিয়েছিস, যা তোর খরচের বহর।”

মা হাসেন। রোগা,যত্নহীন ফ্যাকাশে চেহারা স্বর্গীয় সুষমায় ঝলমল করে ওঠে। 


রাত আরো নিশুত হলো।

মা মরিয়া হয়ে বলেন,”চলো স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াই ,না হলে পুলিশের কাছে চলো।  আর পারছি না।” ডুকরে কান্না আসে।  সেক্টরে ফাইভে  সেদিনকে একটা লোক এক তরুণীর সাথে..

কাগজে খবর বেরিয়েছিল। 

“আচ্ছা ও যখন মেসেজ করল তখন কি  ট্রেনে উঠে পড়েছে?” 

 বাবা তাকিয়ে আছেন…বলতে পারছেন না ।

“ আর তোমাকে তো তার আগে ফোন করেছিল তখন কি ও ট্রেনে ?” 

“না,না ট্রেনের গণ্ডগোলের  কথা তো পরে জেনেছে। চার্জ নেই  তেমনই বলল মনে হয় … কি জানি মনে পড়ছে না কিছু।” খুব  অসহায় লাগে মায়ের।

 পাশের ঘরে এক অসুস্থ বৃদ্ধা ঘুমোচ্ছেন বলে ,মা  চিৎকার করে কাঁদতে  পারছেন না। চোখ বুঁজলে  কালো, কালো কতগুলো এলোমেলো ছবি আসছে।

আচ্ছা যদি ফাঁকা ট্রেনে মেয়েটা কে  একলা পেয়ে… এমন তো চারপাশে কত হচ্ছে।একের পর এক সার দিয়ে আসতে থাকে ভয়াবহ সব ছবি। মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন ।বাবা  দরজা খুলে   একফালি বারান্দাতে বসে থাকেন চুপ করে । আকাশে জ্বলজ্বল করছে একটা তারা। আজকে কোন একটা গ্রহের  যেন পৃথিবীর খুব কাছে আসার কথা। নামটা কিছুতেই মনে পড়ে না বাবার । ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। গেটের পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকা গাছটাকে বড্ড রোগা দেখাচ্ছে।  সেই  ছোটো থেকে  কেমন ধীরে ধীরে বড় হলো। কত ফুল ফুটতো । এখন কেমন  ন্যাড়া হয়ে গেছে। গাছটাকে দেখে মায়া লাগে বাবার। কি যেন নামটা .…..গাছের নামটাও বাবার মনে পড়ে না।” সব কেমন  ভুলে যাচ্ছি,, বয়স হচ্ছে বলে?” মেয়েটাও খুব গাছ ভালোবাসে। ছাদে কত গাছ  রাস্তার কুকুরগুলোকে কত সেবা,যত্ন করে। আমার মেয়েটার  শেষে……

হে ভগবান …  বাবার বুকের ভেতরটা ফুঁপিয়ে ওঠে ।

 শীত নামছে। ক্লান্তিতে  বাবার চোখ দুটো খালি  বুঁজে আসে। মা মাটিতে বসে,  মাথা বুকের কাছে ঝুঁকে পড়েছে। সারাদিন খাটনির শেষ নেই।অসুস্থ বৃদ্ধার সেবা, রান্না। মেয়েটা রোজ বলে ,”একটা লোক রাখো।  আমি এখন চাকরি করি মা।”

 রাজী হন না মা। কত কষ্ট করে রোজগার করে মেয়েটা।কোন সকালে উঠে  ট্রেন ধরতে ছোটে । চোখদুটো লেগে আসে।আবছা ঘুমের মধ্যে 

মেয়েটা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, কাছে আসে, গালে হাত রাখে। মা ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন।  কটকট করে টিউব লাইট জ্বলছে, দরজা হাট করে খোলা । বারান্দার  চেয়ারে বসে  আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন বাবা, অপলক।


“ওঠো ওঠো একটা বাজে।

আমি আর অপেক্ষা করব না। ফোনের সুইচ এখনো অফ। পুলিশে চল, গ্রিলে তালা দাও। মা ঘুমোচ্ছেন, ডেকোনা।” এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে মা হাঁপান। বাবা চটি পড়ছেন ভাবছেন এত রাতে  পুলিশে না গিয়ে যদি ফোন করলে …,কি জানি  ফোন নাও ধরতে পারে, আর কাউকে বিশ্বাস হয় না।  

“এত রাতে   হেঁটে যাবে? পারবে?”

“পারব ,পারব।” মা গেটটা খুলে  ফুটপাতে দাঁড়ালেন। 

কারা যেন আসছে না এদিকে?   রাস্তার টিমটিমে আলোয় খানিক দূরে থাকা  চেহারাগুলো  স্পষ্ট নয়। “শুনছো  এদিকে এসো তো, তাড়াতাড়ি,”

বাবা ছুটে এলেন।

চেহারাগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে। 

চারটে ছেলে মনে হচ্ছে, সাথে  দুটো মেয়েও আছে বোধ হয়। ওদের মধ্যে কে একজন খুব দ্রুত পায়ে  প্রায় ছুটে আসছে বাবা মাকে দেখে।  ছিপছিপে,লম্বা ,পিঠে ব্যাগ প্যাক, চশমার  কাঁচে  আলোর প্রতিফলন। 

 মা ….জড়িয়ে ধরেছে মাকে। মা বসে পড়েছেন  গেটের সামনেই। থরথর করে কাঁপছেন। 


“আমার চার্জ ছিল না ।” 

অন্য কারুর ফোন থেকে তো একটু  জানাবে, বাবার গলাটা খুব দূর্বল শোনায়।

“মুখস্থ নেই যে।”  অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। চারটে ছেলে,ওরা ওকে পৌঁছে দিতে এসেছে। সঙ্গে আরেকটি মেয়ে,সামনেই  বাজারের কাছে থাকে ,ওকে পৌঁছে  তারপর ওরা আরেকটু দূরে নিজেদের বাড়ি ফিরবে। ছেলেগুলো  কেউ প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে, কেউ ব্যবসার কাজে কলকাতায় যায়, কেউ কলেজের স্টুডেন্ট। এক সাথে রোজ যাতায়াত করতে গিয়ে বন্ধু হয়ে গেছে। মা বলছেন,” এসো না বাবা একটু জল অন্তত খেয়ে যাও।” “আরেক দিন আসব মাসীমা।

দিদিকে পৌঁছে দিলাম। এত রাতে  একা ,যা দিনকাল। আসলে এতটা যে দেরী হবে বুঝতে পারিনি।এই দিদিকে পৌঁছতে হবে। আরেকদিন আসব।” ছেলেগুলো  চলে যাচ্ছে ।ওদের ছায়ারা নেচে নেচে চলেছে ওদের সাথে।একটু সামনে হাঁটছে অন্য  মেয়েটা। বাবা দাঁড়িয়ে দেখছেন একটা আশ্চর্য্য  সুন্দর  দৃশ্য । গভীর রাতে  আলোআঁধারি পথ ধরে হাঁটছে যেন চারটে আলোক শিখা। আকাশে  সেই তারাটা একা একা খুব উজ্জ্বল হয়ে আছে। হট  করে নামটা মনে পড়ে গেল  বাবার,  বুধ, হ্যাঁ বুধ গ্রহই তো।  আবার কত হাজার  বছর পর এমন ভাবে কাছ থেকে ওকে দেখা যাবে।   গেটের কাছের গাছটা থেকে  দমকা হাওয়ায় কতগুলো পাতা ঝরে পড়ল। ঘরের ভেতর থেকে মা আর মেয়ের গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। গাছটার  ডালপালাগুলো দুলছে, কটকট, খসখস শব্দ হচ্ছে, কী যেন বলছে। বাবা গাছটার গায়ে হাত রাখলেন। “সামনের শীতটাতে একটু কষ্ট কর। তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।” মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বাবার পাশে। 

“কি করছ বাবা ?”  বাবা হাসছেন, গাছটার গায়ে হাত বোলাচ্ছেন।  

“একটু ভালোবাসছি মা।”



গেস্ট
সোমনাথ ভট্টাচার্য
 
       সন্ধ্যেবাতি দিয়ে ঘরে ঢুকে মিতুলকে ঘুম থেকে ওঠাবার জন্য অনেক রকমের কায়দা কসরত করতে হয় ঝিমলির। এটা রোজকার অভ্যেস হয়ে গেছে, সেই ভোরে উঠে স্কুলের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে যাওয়া। তারপর ফিরতে ফিরতে বিকেল চারটে বেজে যায়, কোনোরকমে একটু কিছু খেয়েই ঘুমিয়ে পরে বেচারি।
-ওঠ্ মা ওঠ্ তাড়াতাড়ি, একটু পরেই তো ম্যাম চলে আসবে তো, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।
-আর অল্প একটু পরে মা, তুমি এসো আমার পাশে। আদুরে গলায় বলে ওঠে মিতুল।
ঝিমলি মুচকি হেসে ওর পাশে আধশোয়া অবস্থায় ওর চুলে বিলি কেটে দেয়। মিতুল মায়ের দিকে তাকায় তারপর হেসে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে মাকে। উইক ডেগুলো এই সময়টা শুধুমাত্র মা আর মেয়ের, কোনো টেনশন, তাড়াহুড়ো বা অন্য কারুর সঙ্গ নয়, শুধু ওদের। দিনের বাকি সময়টা নানা রকম কাজে কেটে যায় ওদের।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ শুনে অবাক হয় ঝিমলি, এখনও তো ম্যামের আসার সময় হয়নি। আর শুভদীপের আরও ঘন্টাখানেক পর আসবার কথা, তাহলে কে এলো! মিতুল কে তাড়া লাগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে এই অসময়ে কে এলো চিন্তা করে দরজাটা খুলে দিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে ঝিমলি। তার অবাক হবার পালা, ওর মাসতুতো বোন সুমি আর মেয়ে বুলি হাসিহাসি মুখে সামনে দাঁড়িয়ে।
-কিরে, ভেতরে আসতে বলবি, নাকি বাইরে থেকেই চলে যাবো।
-কি যে বলিস সুমি, প্রায় দু'বছর পর দেখা, শিগগির ভেতরে আয়। আয় মা বুলি, কি মিষ্টি দেখতে হয়েছিস রে তুই, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। একটা চুমু খেয়ে নিয়ে বলে উঠল ঝিমলি।
সকলকে নিয়ে উপরে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রান্নাঘরে চলে এলো ঝিমলি, চায়ের জলটা গ্যাসে বসিয়ে দিল চট্ করে। কিছু খেতে দিতে হবে ওদের, তবে ফ্রিজে কিছু না কিছু খাবার থাকেই চিন্তা নেই সেজন্য।
ইতিমধ্যেই মিতুল এসে জুটেছে ড্রয়িং রুমে, প্রায় এক বয়েসী দুটো বকবক করেই চলেছে।
-হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে সুমি। একটু পরে শুভ ফিরবে অফিস থেকে,আর শ্যালিকাকে দেখেই উচ্ছাসে মেতে উঠবে। এই পোশাকটা পাল্টে নে, দাঁড়া আমি দিচ্ছি।
-লাগবেনা রে, আমি এনেছি ব্যাগে করে। বুলি- শিগগির আয়, জামাটা চেঞ্জ করে দিই তোর।
রান্নাঘর থেকে চা আর সঙ্গে কিছু স্ন্যাকস নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো ঝিমলি, ফ্রিজে মিষ্টি তো ছিলই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে অল্প সময়ের মধ্যেই মিতুলের ম্যাম চলে আসবে। আজকে তো ওকে পড়তে বসাতে মহা ঝঞ্ঝাট বাঁধবে বুঝতে পারে সে, এতদিন পর বুলিকে পেয়েছে সঙ্গে। কিন্তু হোম ওয়ার্ক না হলে আগামীকাল স্কুলে বকুনি খেতে হবে,কি করা উচিত বুঝতে পারে না ঝিমলি। 
 ছেলেবেলার কত কথা জমে আছে দুজনের মনে, সুমির সঙ্গে ওর বন্ডিংটা সবসময়ই ছিল মজবুত। ঠাট্টা করে আত্মীয় প্রতিবেশীরা সকলে ওদের বলতো 'ফেভিকল কি জোরি'। কথা বলতে বলতে কতটা সময় কেটে গেছে খেয়াল নেই,হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে বুঝতে পারে ম্যাম এসেছে।
বহু সাধ্যসাধনা করে মাত্র আধঘণ্টার জন্য মিতুলকে পড়তে বসতে রাজি করাতে পেরেছে সে , শুধুমাত্র হোম ওয়ার্কগুলো করবার তাগিদে।
শুভ ঘরে আসার পর তো গল্পের ফোয়ারা উঠলো তিনজনের মধ্যে। ওদিকে ওরা দুই বোন মজা করে নানা খেলায় মত্ত।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আবার নানান গল্পে কেটে যায় অনেকটা সময়।
-কাল কিন্তু আবার সকাল থেকে আবার সেই রুটিন শুরু হয়ে যাবে, এখন শুয়ে পড়াই ভালো, কি বলো?
শুভদীপের কথায় সম্বিত ফেরে ঝিমলির, সত্যিই তো কাল ভোরবেলা উঠে মিতুলকে ঘুম থেকে তুলে রেডি করা। দুজনের খাবার- টিফিন, জলের বোতল ব্যাগপত্তর গুছিয়ে দেওয়া অনেক কাজ করতে হয় ঘড়ি ধরে। আড্ডায় ইতি টেনে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে সকলে শুয়ে পড়বার জন্য, মিতুল কে কিছুতেই বুলির কাছ থেকে আনা গেল না,ও ওদের কাছেই শোবে আজ। এটা নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করলো না কেউ। ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পরল দুজনে।
-শোনো, ওরা কতদিন থাকবে কিছু বলেছে?
শুভদীপের কথায় উত্তর দিতে দেরি করে না ঝিমলি।
-আমিও তো সে কথাই ভাবছিলাম।নেক্সট উইকে মিতুর স্কুলের এক্সাম, ওরা থাকলে ওকে পড়তে বসানো ভারি ঝকমারি হবে। 
-কাল সকালে আমরা বেড়িয়ে গেলে কায়দা করে কথাটা সুমির কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
ভোরবেলায় উঠে ঝিমলি অনেক চেষ্টা করেও মিতুল কে রাজি করাতে পারল না স্কুলে পাঠাতে।
-থাক নারে আজকে স্কুলে যাওয়া,বুলির সঙ্গে খেলা করুক না মিতুল, আমরা দুজন সারাটা দিন গল্প করবো।
সুমির কথায় রাগ হয় কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না,কান মাথা গরম হয়ে গেলেও মুখে কিছু বলতে পারলো না ঝিমলি। সব কাজ শেষ হলে দু'জনে বসলো গল্প করতে,সুমি অবশ্য নানা কাজে গল্প করতে করতে ঝিমলিকে সাহায্য করে গেছে সবসময়।
-মেয়েটা যে আজ স্কুলে গেলনা,জানিস এজন্য কালকে এপ্লিকেশন দিতেই হবে। ওদের স্কুলে ভীষণ ডিসিপ্লিন, অকারণে স্কুলে ছুটি দেয়না। বিকেলে অন্য গার্জেনদের কাছ থেকে পড়া জেনে সেই কাজ আজকে সন্ধ্যায় ওকে দিয়ে করাতেই হবে, নাহলে শাস্তি হবে।
-আমার বাবা এসবের ঝামেলা নেই বললেই চলে, ওকে আমার স্কুলেই দিয়েছি ।আর সরকারি স্কুলে চাপটা কম , আমি একা একা কতটা সামলাতে পারব বল্ ?
-আচ্ছা সুমি , তোদের কেসটা তো অনেকদিন হয়ে গেল, এখনও ডিভোর্সের অর্ডার হচ্ছে না কেন?
-কি আর বলবো তোকে, ডিভোর্সের কেসে অনেক হাঙ্গামা রে। দু'পক্ষের সম্মতি থাকলেও অনেকগুলো ডেট পড়ে। তবে শুনেছি খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে,আর একটা দুটো হিয়ারিং হলেই সেপারেশনের রায় ঘোষণা হবে।
-জানিস ,আমিও মিতুলকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শুভ কিছুতেই দেবে না। বলে 'ওখানে পড়বে কি, বছরভর নানা ধরনের অনুষ্ঠান আর ছুটি। মিডডে মিল আর মেলা খেলা,এসব নিয়েই তো কেটে যায় অর্ধেক বছর।' কথাটা খুব একটা ভুল বলে নি,কি বলিস সুমি? তুই তো নিজেই জানিস ভালো।
সুমি উত্তর না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে আসে, 
-জানিস ঝিমলি আমাদের ছোটবেলার কথাগুলো খুব মনে পড়ে। সেই যে কে কার বাড়িতে গিয়ে কত বেশিদিন কাটিয়ে আসতে পারবে। আত্মীয়-স্বজন কেউ বাড়িতে এলেই আনন্দ আর ধরে না।
-হ্যা রে, আমারও মনে হয় খুব সেইসব দিনগুলোর কথা।কত রঙিন ছিল আমাদের শৈশব। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসা মানেই তো, ভালো ভালো খাওয়া দাওয়া, পড়তে বসার নাম গন্ধ ছিল না। কেউ এলে নানা ছুতোয় আটকে রাখতে কি না করতাম আমরা। ব্যাগ,জুতো লুকিয়ে রাখতে হতো।
দু'জনেই হেসে ওঠে প্রাণ খুলে।
সুমি হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
-আর এখন সকলের বাড়িতে এমনভাবে নিজেদের দৈনন্দিন রুটিন তৈরি, যে কেউ কারও বাড়িতে কোনো জরুরি কাজ ছাড়া যায় না। সবাই মনে মনে আশঙ্কা করে, কারো বাসায় গিয়ে অন্যকে বিব্রত করে তুলবো নাতো? নিদেনপক্ষে ফোন করে তারপর কারো বাড়িতে যেতে হয়।
ঝিমলি এই কথায় এবার চুপ করে যায়, প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য কথায় চলে আসে সে।
ছেলেবেলার আত্মীয় বন্ধুদের খবরাখবর ও নানান গল্পে ঘুচে যায় দিনের আলো। সন্ধ্যের পর মিতুলের বন্ধুর মাকে ফোন করে ওর হোম ওয়ার্কগুলো জেনে নিয়েছে সে। অনেক কষ্ট করে ম্যাম এলে ওকে পড়তে বসিয়েছে। সেই সময়টাতে বুলির সঙ্গে নানা গল্প করতে ওর বেশ মজা লাগে। মেয়েটার গুণও কম নয়,নাচ, আবৃত্তি ও ক্যারাটেতে বেশ সপ্রতিভ। পুরস্কারও পেয়েছে নানা বিষয়ে। মনটা একটু বিষন্ন হয় তার, কারণ অনেক চেষ্টা করেও মিতুলকে গান শেখাতে পারেনি ঝিমলি। শুভ বলে,
-ওর সময় কোথায় এসবের প্র্যাকটিস করবার।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ওরা তিনজন বসে গল্প করছে, আর ও দুটো মত্ত খেলা গল্পে।
-শুভদীপদা তোমরা তো ভোরবেলায় ওঠো,কাল আমাকে ভোরে একটা টোটো ডেকে দিও। সাড়ে ছটার বাসটা ধরতে হবে।
-সেকি?কেন? অত সকালে উঠে কোথায় যাবে?
-নারে সুমি কাল তোদের যাওয়া হবে না। আরও দুটো দিন থেকে যেতে হবে, খুব ভালো লাগছে। কতদিন পর দেখা হলো।
-উপায় নেই রে ঝিমলি। আমায় দুটো দিন স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে আসতে হয়েছে। আসলে তোদের কথা খুব মনে পড়ে মাঝেমাঝেই, তাইতো চলে এলাম অযাচিত ভাবে। ফোন না করেই, সারপ্রাইজ দিতে।
কথাটা বলেই হোহো করে হেসে উঠল সুমি।
হঠাৎ করে এক স্তব্ধতা নেমে আসে ব্যালকনি জুড়ে। ঝিমলির মনটা একটু খচখচ করছে, সুমি কি বুঝতে পেরেছে যে ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু সে তো যথাসম্ভব আপ্যায়ন করবার চেষ্টা করেছে।
অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কাটাতে ঝিমলি বলে ওঠে,
-জানো তো সুমির মেয়ে এতটুকু বয়সে কত কি শিখে গেছে।নাচ, আবৃত্তি, ক্যারাটে। অনেক পুরস্কারও পেয়েছে নানা জায়গায়।
-তাই নাকি!ডাকো ওকে একটু নাচ দেখি,আর আবৃত্তি তো আমার প্রিয় বিষয়। কলেজ লাইফ পর্যন্ত কত জায়গায় কত প্রাইজ পেয়েছি। এখন অবশ্য সবকিছুর গঙ্গা প্রাপ্তি ঘটেছে সময়াভাবে। মেয়েকে শেখাবো যে তার ফুরসৎ নেই দুজনেরই।
সুমির একডাকেই চলে আসে দুজন। অনেক বললেও বুলি কিছুতেই নাচ করতে রাজি হলো না, ঝিমলি অনেক করে বোঝাতে বলল একটা আবৃত্তি করবে। সকলে চুপচাপ বসে পড়ল ,বুলি শুরু করল আবৃত্তি রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে মিষ্টি কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠলো -
"মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে, কেউবা বাসতে পারে না যে, কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ সিকি পয়সা ধারে না যে ---
-বোঝাপড়া, কবিগুরুর এই কবিতা আজও এমন করে মনকে ছুঁয়ে যায়। স্বগোতক্তি শুভদীপের।
আবৃত্তি শেষ হলে কারো মুখে কোন কথা নেই অনেকক্ষণ।
 শুভদীপ ওকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে ,
-অসাধারণ হয়েছে, একটা প্রাইজ দেবো তোকে কালকে। দারুন বলেছিস, সত্যকে সহজভাবে মেনে নিতে হবে, সর্বক্ষেত্রে, অনেক দামি কথা।
সুমি বলে ওঠে, -ঝিমলি অনেক রাত হলো এবারে শুতে যাই চলো,কাল আবার ভোরবেলায় উঠতে হবে,বাস ধরতে হবে।
-মা, গেস্টরা কি কালই চলে যাবে? তুমি বলো না আরও দু'টো দিন থেকে যেতে। 
বিস্মিত হয়ে সুমি তাকালো ওদের দিকে। খুব লজ্জা লাগছে ঝিমলির, ছিঃ ছিঃ, শেষটা একি হলো তার নিজের দোষে।
   মিতুলের কথায় কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না ঝিমলি। কারণ মিতুলের কাছে ওদের পরিচয় আত্মীয় না দিয়ে সেই তো ওকে গেস্ট বলেছিল। 
স্তব্ধতা নেমে আসায় 
ছোটোরা কি বুঝলো কে জানে,বুলিকে জড়িয়ে ধরে ঘরে ঢুকে যায় মিতুল। 
বাকরুদ্ধ হয়ে তিনজন বসে ব্যালকনিতে।রবি ঠাকুরের কবিতা সকলের কানে বাজছে, 'সত্যরে ল ও সহজে।'




ছিয়াশি বছর আগে 

  চিত্রা পাল


আজ এ বাড়িতে সকাল থেকে পুজোর আয়োজন। দীপ্তিময়ী ভালোই বুঝতে পারছেন। সদ্য বিয়ে হওয়া নাতনী নাতজামাই আসবে, তারই তোড়জোড় চলছে। দীপ্তিময়ী খুব ধীরে ধীরে নিজের কাজ কর্ম সেরে একখানা পাটভাঙ্গা শাড়ি পরে ঠাকুর ঘরে নমস্কার সেরে নিজের ঘরে এসে বসেছেন । এর মধ্যে আবার কখন যে বিছানায় একটু শুয়ে পড়েছেন, চোখে তন্দ্রাও এসে গেছে তা টের পাননি।

দীপু ও দীপু দ্যাখতো, ভাইটা কোথায় গেলো। দীপু খাওয়া ফেলে দৌড়লো, ও দিকে ঠাকমা সমানে ডেকে চলেছে ,দীপু কোথায় গেলি রে, রান্নাঘর থেকে শাকের চুবড়ি খানা নিয়ে আয় তো ;শাক কটা বেছে দিই। নাহলে তো রান্নাই হবে না, ও চুবড়িতেই শুকুবে।“এই হলো দীপুর ঝকমারি। হাজার জনের হাজারটা কাজের যোগান দিতে হয়। আর বাড়িতে আছে একমাত্র ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো ওই। যার যেমন কপাল। ও যে এমন কপাল নিয়েই জন্মেছে।এই সব ভাবলেই ওর চোখে জল গড়িয়ে পড়ে।আর এসব ভাবতেও চায় না। 

 আসলে  ও একজন ব্যাতিক্রমী জীবনের।নাহলে এরকম কেন হবে। সবই শোনা কথা। ও তখন ছয় মাসের শিশু, দাদার বয়স আড়াই বছর ,শীত পড়েছে সবে।সবার বাড়ির দরজা জানালা বিকেল থেকেই বন্ধ, আর রাতের প্রথম প্রহরেই সব খাওয়া দাওয়া সাঙ্গ করে লেপ কাঁথারতলায়, দালানে একখানা কুপি জ্বলছে টিমটিম করে।কেননা, তখন কেরোসিন তেল পাওয়া তেমন সহজ নয়। তাই হারিকেন সবাই নিভিয়ে রাখে। এমন সময় বাইরে পড়শীদের  চীত্‌কার। তোমাদের বাড়ির ছাদে আগুন লেগেছে গো , শীগগির দ্যাখো। তখন ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিলো কাঠের,আর কোন রকম ধরার হাতল ছিলো না।  তাই ঘুম থেকে উঠে ছাদে পৌঁছতেও সময় নিলো। গিয়ে দ্যাখে,এবাড়ির ছোট বউ মানে , আমার মা সারা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, তার জ্বালায় সে চীত্‌কার করছে। যাই হোক সবাই মিলে উদ্ধার করলেও তাকে সে যাত্রায় বাঁচাতে পারেনি। এগুলো সব ঠাকুমার মুখে শোনা। পরে বড় হয়ে  পাড়ার মানুষের কাছে শুনেছি যে বাবা চিরকাল রগচটা , অল্পতেই খেপে ওঠার মতো,বাবাই নাকি মাকে পুড়িয়ে মেরেছে।তবে ও গুলো সব কথার কথা। কোনটা ধোপে টেঁকেনি।

 যাইহোক, ঠাকমার কাছেই বড় হওয়া আমাদের দু ভাইবোনের। দাদা খুব দুষ্টু ছিলো।ঠাকুমা ওকে সামাল দিতে পারতো না। মাঝে মাঝে বাবার কানে তুলে দিলে বাবা দারুণ পিটুনি দিতো।তখন কয়েকদিন শান্ত থাকতো, আবার যে কে সেই। একবার কালীপূজোর সময় ছুঁচোবাজি ছেড়ে ওপাড়ার মান্নাদের খড়ের গাদা পুড়িয়ে ফেলেছিলো। তারা তো সোজা  বাবাকে এসে বললো, আমরা ওকে পুলিশে দোবো, তারপরে ওরা যখন বেধড়ক পিটুনি তে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে তখন সোজা হবে। বাপ যেমন বউটার গায়ে আগুন দেচে,তার বেটা তো তেমনই হবে। বাবার মাথায় আগুন ধরে গেল এই কথা শুনে। ওরা চলে যেতেই বেধড়ক ঠেঙানি খেলো দাদা। কিন্তু আমার মনে প্রশ্নটা থেকেই গেল,সত্যিই কি তাই?

 এরপরে একটা কান্ড ঘটলো। কি জানি কি মনে করে ঠাকুমা আমাকে এখানকার পাঠশালায় ভর্তি করে দিলো। আমার ওখানে পড়তে বেশ ভালই লাগতো। তার ওপরে ঠাকুমা বলে দিয়েছিলো,দাদারদিকে নজর রাখতে।আমার হয়ে গেলো দুদিকে চাপ। এদিকে ঠাকুমা বলে, দাদাকে দেখতে, ওদিকে দাদা বলে, বাড়িতে বললে মাথা ফাটিয়ে দোবো,। একদিন দাদা ডাংগুলি খেলতে গিয়ে মধুদার মাথায় এমন গুলি মারলো, যে কপাল কেটে চৌচির। মধুদার বাবা এসে বাবাকে কি সব বলে গেলো। তবে বাবাকে তখন সব সহজ ভাবেই  নিতে দেখেছি। বাড়িতে কথাবার্তা শুনছিলুম, কদিন পরেই বাবা নতুন মাকে নিয়ে এলো। 

নতুন মা  আসাতে কদিন একটু ভাসা ভাসা খুশির  আভাস বাড়িতে, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ভাল রান্নার  হালকা সুগন্ধের মতো।আমি ইস্কুল থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম,বৃত্তিপেয়ে পাশ করেছি দেখে ঠাকুমা বাবা সবাই খুশি। আমি দুমাইল দূরের বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। কিন্তু পড়াশোনায় বাধা এলো অনেক। এক তো স্কুল্টা দূরে বলে হেঁটে যেতে আসতে সময় লাগতো, আর ভাই আসার পরে আরও অসুবিধে। প্রায়ই মা বলতো, আজকে ইস্কুলে যেতে হবে না। আমার আজ রান্না বাকি আছে,তুই বরং ভাইকে দ্যাখ,কোলে নিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়,” আমিও তাই করতুম। প্রায়ই যাওয়া হতোনা।কি কাজে বাবা  ও পাড়ার দিকে গিয়েছিলো ,ওখানে গীতার সঙ্গে দ্যাখা।ওর কাছেই শুনেছে আমি স্কুলে যাই না ঠিকমতো। বাবা বাড়িতে এসেঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে, ও ক্যানো স্কুলেযায় না। ঠাকুমা বললো সেটা ওর মাকে জিগা,বলে ঠাকুমা বাবার সামনে থেকে সরে গেলো।  

 বাবা মাতে ভাল তর্ক শুরু হলো। এর মধ্যে ঠাকুমা যেই একবার বলেছে, আজ ওর মা থাকলে কি এমনধারা হতো ? সেই শুরু হলো আরও বাগবিতন্ডা।শেষে এক কথায় এসে থামলো, নিজেরাই গায়ে আগুন দে পুড়িয়ে মারলে আবার কতা।  আমার মনে ধক করে আবার সেই কথাটাই মনে হলো, সত্যিই কি বাবা মেরে ফেলেছে, না, মা নিজেই--- কেজানে।

ঠাম্মা, ও ঠাম্মা তুমি আর কত ঘুমুবে, একটানা ডেকে চলেছে, ছোট নাতনী। এই তো দালানে হ্যারিকেন ল্যাম্পও গুনো পুঁছে রাখছিলুম, ওরা আবার ধাক্কা দেয়,কি পরিষ্কার করছিলে? দীপ্তিময়ী বলে ওঠে,”হেরকেন”।সেটা কি? তখন সজাগ হয়ে আবার ভাবতে থাকেন, কে যেন ডাকছিলো ? ঠাম্মি, দ্যাখো, দিদি, এসেছে সঙ্গে জর্জদা।বড় নাতনী এসে প্রণাম করে। দীপ্তিময়ী বলে, ‘শাড়িতে কি সুন্দর দ্যাখাচ্ছেরে। তোকে খুব ভাল লাগছে।‘ বলে দীপ্তিময়ী আবার শুয়ে পড়ে। 

জর্জ এসে দ্যাখে,ঠাম্মি আবার নিদ্রায়। কিন্তু আর ওরা ডাকে না। ওরা বলাবলি করে, বয়স হয়েছে,হয়তো শরীর ঠিক নিতে পারছে না।এখন এমনভাবেই যাবে। কিন্তু বলো,ও কত কিছু দেখেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,রবীন্দ্রনাথের জীবিতকাল, ষোলআনা দিয়ে টাকা, পালকি থেকে প্লেন কত পরিবর্তন।কত সমস্যা আর তার কত বৈজ্ঞানিক সমাধান যে এলো,আর মানুষ তা নিয়েও নিলো। এত পরিবর্তন জীবনের কম সময়ে কমই হয়।

  দীপ্তিময়ীর আবার সেই দালানে ফিরে আসা।   লেখাপড়া স্কুলে যাওয়া সবই এক জায়গায় এসে থেমে যেতো বাড়ির কাজ করবে কে? ঠাকুমার কথা, পড়া যদি না হয়, তাহলে বে দিয়ে দাও। সেখানেও নানান বাধা। এক দীপ্তিময়ীর রোগা কালো শীর্ণ চেহারা,তারওপরে মুখে গুটি বসন্তের দাগ, গর্ত। সকলেই আসে, খায় দায় চলে যায়,কেউ পাকা কথা দেয় না।তখন বাবা দোজবর এসব খুঁজতে শুরু করলো। আর মা বিয়ে কথাতেই আগুন হয়েযায়। তখন বুঝিনি,পরে বুঝতে পারলুম,আমার মায়ের, বেশ খানিক সোনার গয়না ছিলো, সে গুলো মা হাতছাড়া করতে চাইছিলো না। বিয়ে দিলে সেগুলো আমার প্রাপ্য হয়ে যায়। কাজেই বিরোধিতা করাই বুদ্ধির কাজ।    

 

আমার খুব ইচ্ছে ছিলো স্কুলের শেষ পরীক্ষাটা দেবার। কিন্তু সে আর হলোনা। পাশের গ্রামেই বিয়ে হলো আমার। ভাসা ভাসা শুনলুম ওদের কিছু ধারকর্জ ছিলো মহাজনের ঘরে। বাবা সেগুলো মিটিয়ে দিতে রাজি হওয়ায় ওরাও রাজি হলো। আমার আরও মনে হলো, বাবা বোধ হয় ওদের বাড়ির সব দায়িত্ব মেটালেন নিজে কিছু ধার কর্জ করে। আর আমার রূপ যাই হোক, আমার গয়না গুলো সবাই ভালো বলেছে। আর একটা কথা চুপি চুপি বলি, আমার আসল মানুষটা ভালো ছিলো।এটা আমার কপাল বলতে পারো। আমি যে সেকেন্ড ক্লাস অব্দি পড়েছি, ইংরেজি পড়তে পারি, বাংলা নাটক নভেল বেশ পড়া আছে, সেটা ওর ভালো লেগেছিলো, আর সত্যি বলতে কি, লুকিয়ে চুরিয়ে যেটুকু বইপত্র পড়েছি, সেটা ওর কারণেই। আর খারাপ লাগতো, যখন যে কেউ মায়ের চলে যাবার কারণ জিজ্ঞেস করতো। 

  কে য্যানো ডাকছে আমায়। কি যে বলে কে জানে। একবার ঠাকুমার গলা শুনতে পেলুম  য্যানো।শুনলুম বলছে ,পুরনোরা চলে যায়, নতুনরা আসে,গাছের পাতার মতো। সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু ছিয়াশি বছর আগে যে কথাটা উঠেছিলো, মা যে কি করে চলে গেলো, নিজেই চলে গ্যালো না,কেউ মানে, --- কি যে বলি, সেটা  কেউ বলবে কি,কেজানে। 






ফ্লাইওভারের নিচে 
মৌসুমী চৌধুরী 
  
             
রাত তখনও ফুরিয়ে যায়নি। ঘুমন্ত  বাড়িটি থেকে বেরিয়ে এসেছেন বিভাবতী। পুকুরের জলে তখনও দুলছে আষাঢ়ের নরম দুধেল জোছনা। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। নাতি-নাতনী- দুটো তাঁর সঙ্গেই ঘুমোয়। তারা যদি কোনভাবে জানতে পারত তুলকালাম বাধাত। সঙ্গে আসবার জন্য কান্নাকাটি জুড়ে দিত। হনহনিয়ে হাঁটছেন বিভাবতী। হাঁটতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে খুব। বয়স যত বেড়েছে সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাতের ব্যথা, শ্বাসকষ্ট আর হাইপ্রেসার। পা-টা প্রায় অচল তাঁর। অথচ একটা সময় ছিল একা হাতে সংসারের সব কাজ , বিপুলের বাপের সঙ্গে চাষবাসের কাজ দক্ষতার সঙ্গে সামলাতেন। বিয়ের পর থেকেই তাঁর কর্মঠ হিসেবে সুনাম হয়ে গিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে বিভাবতীর। হঠাৎ বড় বাবার কথা মনেপড়ে যায়। প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক বাবা সাধ্যমতো তাঁদের চার চারটি ভাইবোনকে শিক্ষিত করে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। বিভাবতীই শুধু আট ক্লাসের পর আর পড়েননি...পা চালিয়ে হাঁটতে থাকেন বিভাবতী। তিনটে চল্লিশের শিয়ালদা লোকালটা আজ তাঁকে ধরতেই হবে। আঁচলের খুঁটে রেলের টিকিটটুকুর জন্য টাকাটা বেঁধে এনেছেন। সঙ্গে একটা নোংরা ঝোলা ছাড়া কিচ্ছু নেই। ঝোলায় রয়েছে একটা ছেঁড়া কাপড়, পুরোনো ব্লাউজ আর ছোট্ট একটা মুড়ির কৌটো। বাঁ-হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে হাঁটতে থাকেন বিভাবতী। চাঁপার মা তাঁর জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে...

    সত্যি বলতে আর একদম পারছিলেন না বিভাবতী। দেওয়ালে একেবারে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। দু'দিন থেকে ছেলে নাতি-নাতনীদের গরম ভাত খেতে দেবার পর বৌমা আর তিনি ভাতের মাড়ে নুন মিশিয়ে খাচ্ছিলেনন। চাঁপার মায়ের মারফত বিভাবতী বহু কাজ খুঁজেছিলেন। বাবুদের বাড়িতে বাড়িতে রান্না-বাসনমাজার কাজ। কিন্তু বয়স্ক বেতো রোগীকে কেউ যে কাজে রাখতে চায় না। অনেকদিন থেকেই  টেনে হিঁচড়ে কোনক্রমে চলছিল তাঁদের  সংসারটা। কিন্তু যবে থেকে অজয়দের বিস্কুটের কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেছে, তবে থেকে একেবারে যেন চিতা হয়ে উঠেছে গোটা বাড়িটাই। হাতে কাজ নেই অজয়ের। গুণধর ছেলে তাঁর, রোজ মদ খেয়ে এসে মাঝরাত্তিরে হৈ-হল্লা করছে; আর বৌ, ছেলে-মেয়েকে ধরে বেধড়ক ঠ্যাঙ্গাচ্ছে! 

— " আমার ঘাড়ে বসে খাওয়া, না? যা যা গতর আছে যখন বাবু ধরে খা গে..."

 দৌড়ে গিয়ে অজয়ের মুখ চেপে ধরেন বিভাবতী,
— " চুপ কর!  চুপ কর! ছেলেমেয়েদের সামনে এসব কি যা তা বলছিস, হতচ্ছাড়া?" 

  অল্প বয়সী বৌটা ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে। ঠোঙা বানায়, বিড়ি বাঁধে। চোখের জল মুছতে মুছতে ভাত বেড়ে দেয়। নতুন কোন কাজ পাচ্ছে না ছেলে, তাই রোজ এই একই রুটিনে চলছে সে। গতকাল তা একেবারে  চরমে গিয়ে পৌঁছায়। অজু ধার বটি হাতে ছুটে এসেছিল বিভাবতীর দিকে,
— " আমার ঘাড়ে বসে অন্ন ধ্বংস করছিস? যাহ্... দূর হয়ে যা। চুরি করে, ভিক্ষে করে...যা হোক করে খা গে যা... যাহ্।"
    আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি বিভাবতী। চাঁপার মা বহুদিন থেকেই বলছিল এই একটি রাস্তায় রোজগার নাকি মন্দ হয় না। বয়স হয়ে যাবার পর আজকাল সেও এই কাজই ধরেছে এখন। চাঁপার মায়ের সঙ্গে ভীড়ে ঠাসা স্টেশনে নামল বিভাবতী৷ চেঞ্জ করবার জন্য পাবলিক  টয়লেটে ঢুকল দু'জনেই। টয়লেটের পাহারাদার কুন্তিদিদি চাঁপার মায়ের বহুদিনের চেনা৷ তিনি পয়সা গুণে নিয়ে মুখ টিপে হাসলেন।
  তারপর ... 

 ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা একটা নতুন বু্ড়ি ভিখিরি ফ্লাইওভারের নিচে বসে  তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে,
— " ও বাবা-ও মা আমার,  দু'পয়সা দিয়ে যাও না ... তিনদিন থেকে কিছুই খাই না ... ও বাবু গো। বাঁচাও গো..."
তাঁর টাটকা আর্তনাদ যেন গলে গলে মিশে যেতে থাকে শরতের গাঢ় নীল আকাশে...!

        বিরক্ততে নাক-মুখ কুঁচকে তাকায় ফ্লাইওভারের নিচে বসে থাকা অন্যান্য সব পুরোনো অভিজ্ঞ ভিখিরিরা। আর ফ্লাইওভারের নিচে নির্বিকার সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল ছড়িয়ে পড়তে থাকে... 



নিপু 
নিতাই দে 

     যাদবপুর ফাঁড়ি বাস স্টপেজের কাছে এসে নিপুর বাইকটি দাঁড়ালো। পিঠের উপর চাপানো ভারি ব্যাগ। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সে একজন ডেলিভারি বয়। চৌরাস্তার মোড়ে নিত্য যাত্রীর ভিড়। বিভিন্ন রুটের বাস এসে দাঁড়ায়, যাত্রীরা ওঠানামা করে, আবার ছেড়ে যায়। নিপুর অনুসন্ধিৎসু চোখ কাউকে যেনো খুঁজে বেড়াচ্ছে।

    কয়েক বছর আগের কথা। নিপু রোজ এ পথেই যাতায়াত করতো। নিপুর প্রকৃত নাম নৃপেন্দ্র। নামের বিবর্তনে নিপেন থেকে এখন নিপু। সুঠাম চেহারা। নয়টা-দশটা সুর্যের মতো তেজদীপ্ত। স্বপ্নে ভরা দুটি চোখ। একটি ছোটো কারখানার শ্রমিক। যাদবপুর ফাঁড়ি থেকে বাস ধরে কর্মস্থল তারাতলা যায়। এই বাস স্টপেজেই লীলার সাথে দেখা হতো। লীলা ও একটি কারখানায় কাজ করে। ছিপছিপে চেহারা। সাঁজ গোছের বালাই নেই। পড়েনি নেইলপলিশ, ঠোঁটে নেই লিপষ্টিক। তাসত্ত্বেও গালে লেগেছে গোলাপের ছোঁয়া। দীঘল কালো চুলে বইছে ফাগুনের হাওয়া। আঁধার পথে জোনাকি যেন আলো ফেলে ছুটে যায়। নিপু র আলো ছুঁতে খুব ইচ্ছে হয়। আবার মনে জাগে সংশয়, আলো ছুঁলেই যদি নিভে যায়!

      দেশে শিল্প ও বানিজ্য ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের পন্য সরাসরি বিক্রি করার সুযোগ পেয়েছে। বৃহৎ পুঁজি এবং অতি আধুনিক প্রযুক্তির সাথে দেশের ছোট -মাঝারি শিল্প প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। ফলে রুগ্ন হতে হতে একসময় এই ছোট কারখানা গুলো বন্ধ হতে থাকে।। নিপু যেখানে কর্মরত সেখানেও একই অবস্থা। পুজোতে বোনাস নেই,পি, এফের টাকা বকেয়া, এমনকি এক বছরের উপরে মাস মাইনে বকেয়া। এমতাবস্থায় কোম্পানি লক আউট ঘোষণা করলো। শ্রমিক -কর্মচারিদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কারখানা খোলার দাবিতে আন্দোলন শুরু হলো। নিপু ও এই আন্দোলনের একজন সৈনিক। কতো মিছিল, মিটিং, লেবার দপ্তরে আলোচনা হলো। তবুও কিছুতেই লক‌‌‌ আউটের তালা খোলার চাবি খুঁজে পাওয়া গেল না।

      অবশেষে হতাশ হয়ে কৃষি থেকে উৎখাত হয়ে যারা শহরে কাজে এসেছিল, তারা আবার গ্রামে ফিরে গেল। স্থানীয়রা বাঁচার তাগিদে কেউ রিকশা চালানো,কেউ হকারি, কেউবা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করলো। আবার কেউ পথ খুঁজে না পেয়ে অভাবের তাড়নায় অকালেই ঝরে গেল। নিপু পেটে আগুন নিয়েই দিন কাটাতে লাগলো। অবশেষে এক বন্ধুর সহযোগিতায় ডেলিভারি বয়ের কাজ পেল। তবে সে আর সর্বহারা শ্রমিক রইলো না। তার মাথার উপর ছাউনী চলে গেল। কোনো নির্দিষ্ট কাজের স্থান রইলো না। রইলো না আট ঘণ্টা নির্দিষ্ট কাজের সময়। মোবাইল অ্যাপস এর আড়ালে মালিক কাজ তদারকি করে। দিনে রাতে যখন যেখানে অর্ডার হয়, নিপু কেবল ছুটে চলে।

         ডেলিভারি দেবার পথে যাদবপুর ফাঁড়ির কাছে এলেই নিপু-র মনটা ভারি চঞ্চল হয়ে ওঠে। খোঁজে সেই হারিয়ে যাওয়া চোখ। যে চোখে চোখ পড়লেই বিজলী চমকাতো চোখের তারায়। সে দেখেছিল পাকা ধানের বাঁকা শীষের মতো একফালি হাসি। যে হাসিতে আজীবন ডুবে থাকার স্বপ্ন দেখেছিল। তাইতো পুরোনো সেই বাস স্টপেজে এলেই নিপু বিষন্ন চিত্তে কেবল লীলাকে খুঁজতে থাকে।



মন কেমনের গল্প
     লীনা রায়

শহরের একটি অভিজাত পাড়া। পাশাপাশি দুটো বাড়ি। একটির রং পেস্তা সবুজ,অপরটি গোলাপি।পেস্তা সবুজ বাড়ির দরজা খুললেই রাস্তায় পা। আর গোলাপি বাড়ির গেট আর বারান্দার মাঝে এক ফালি সাজানো গোছানো বাগান। সেই বাড়ির মেয়ে তানি। পোশাকি নাম তানিয়া। দুধে আলতা গায়ের রং।পিঠ ছাপানো কোঁকড়া চুল। এই তানির সহপাঠী পেস্তা সবুজ বাড়ির ছেলে বাবান ওরফে দেবপ্ৰিয়।

বাবানের জন্মদিন পনের ফেব্রুয়ারী। তানির জুনের ছয়। সালটা এক।দুজনে এক স্কুলে পড়ে।এক ক্লাস, এক স্কুল বাসেই যাতায়াত। খুব ছোটবেলায় বাবা মেয়েরা স্কুল বাসে তুলে দিতেন। একটু বড় হবার ওরা একসঙ্গে পাড়ার মোড় থেকে বাসে ওঠে।

তানি বড্ড চঞ্চল। মুখে কথার খই। বাবান শান্ত, কম কথা বলে। ক্লাসে মাঝে মাঝেই বাবানের দিকে চোখ চলে যায় তানির। চেষ্টা করেও নিজেকে আটকাতে পারে না।তানির মনে হয় বাবানও ওকে লুকিয়ে দেখে।

কথায় কথায় তানি হাসে। হাসির দমকে গালে গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়ে।বাবান মুগ্ধ হয়। আজকাল তানির বন্ধু বৃত্তে রাহুল, রাজদীপ আর প্রিয়ম যোগ হয়েছে। এই ত্রিমূর্তি যেভাবে তানিকে দেখে বাবানের ভাল লাগে না। তানির ওপর কেমন একটা টান অনুভব করে ও। বাবান বুঝতে পারে ওর সারাদিনের বেশিরভাগ ভাবনা তানিকে নিয়েই।

আজ স্কুল থেকে ওরা পিকনিকে যাচ্ছে।তানি বসেছে বাসের বাঁদিকে, আর বাবান ডানদিকে।এক সারিতে। আড় চোখে বাবান তানিকে দেখছিল বার বার। কাঁচা হলুদ কুর্তিতে ওকে চমৎকার লাগছিল।মাঝে মাঝেই তানির চোখে চোখ পড়ছিল। লজ্জা পায় বাবান। তবে কি তানি ওর মনের কথা টের পেয়েছে?

পিকনিক স্পটে পৌঁছাতে বেলা দশটা।অনেক গাছ আর পাশে নদী। ছবির মত সুন্দর জায়গাটা।শর্মা স্যারের কাছ থেকে টিফিন প্যাকেট নিয়ে সবাই যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল। বাবান খানিকটা তফাতে কৃষ্ণচুড়া গাছের নিচে এলো।

বেশ মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছিল বাবান। তানি এসে একটা কচুরি ওর প্যাকেটে দিলে চমকে ওঠে।
ধপ করে বাবানের পাশে বসে পা ছড়িয়ে। সাদা মাখনের মত পা তানির। নখে লাল নেল পলিশ।মুগ্ধ হয়ে দেখছিল বাবান। হঠাৎ তানি পা গুটিয়ে নেয়। লজ্জা পায় বাবান। তানি কি ওকে বাজে ভাবছে?

গল্পবাজ তানি আজ চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। বাবান তানির দেওয়া কচুরির গায়ে আঙ্গুল বুলোয়। কচুরি ওর খুব প্রিয়। আলতো করে কামড় দেয় কচুরিতে। আয়েশ করে তানির দেওয়া কচুরির স্বাদ নেয়। বাতাসে তানির পারফিউমের মিষ্টি সুগন্ধ। বাবান আচ্ছন্ন হয়।

ঘোর কাটে ত্রিমূর্তির চিৎকারে। ওরা তানিকে ডাকছে নদী দেখতে যাবার জন্য। তানির চোখে মুখে খুশি।ও বাবানকে ডাকে। বাবান মাথা নাড়ে। তানি কি মনোঃক্ষুন্ন  হল? বাবান বুঝতে পারে না।

কৃষ্ণচুড়া ফুলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তানি। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাবানকে দেখে। বাবানের ইচ্ছে করে চিৎকার করে তানিকে ডাকতে। একটা খারাপ লাগার মোচড়ে তোলপাড় হচ্ছে মন। হঠাৎ বাবানের জাদুকর হতে ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল নদীটাকে ভ্যানিশ করে দিতে।





ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান

পিনাকী


জল জল জল। পরাশর মন্ডল, রাতের শেষে ,চারদিকে শুধু জল দেখছে, নির্বিকার, স্থির, জেদি জলস্তর , নামছে কই! বরং বেড়েই চলেছে, পোয়াতির পেটের মতন হাবভাব। হুগলির শ্রীপুর বলাগড় গ্রাম পঞ্চায়েতের মিলনগড় গ্রাম, এলাকা দেখতে নিজে আসছেন সাংসদ, জনপ্রতিনিধি, দেশ চালানোর জন্য  দিল্লীতে, লোকসভা আছে,  সেখানে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে একটা  জোরদার ভাষণ দিতে হবে। জনপ্রতিনিধির পাশে পাশে থাকবে পরাশর মন্ডল, এতে লাভ হবে, সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামবাসীদের কাছে ভরসার লোক হয়ে উঠবে, অবশ্য সে এই গ্রামেরই ,মানুষের আপদে বিপদে পাশে থাকে। 


নদীর পাড়ে গ্রাম, মাটির বস্তা দিয়েও ভাঙন আটকানো যাচ্ছে না। ডিভিসি জল ছাড়লেই বন্যায় ভাসে গ্রাম গুলি, প্রতিবছর এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠে ল্যাংটো শৈশব। 


পরাশর মন্ডল মনে মনে বলল - দিদি আসছে, সুরাহা হবে? তবে কিছুতো মাস্টার প্ল্যান হবে।



দুপুর একটায়, জনপ্রতিনিধির গাড়ি থামল, গ্রামের উঁচু ঢিপিটার। উপর, নিরাপদ জায়গায়; দিদি  গাড়িতে বসেই কেঁদে ফেললেন! 


পরাশর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির কাঁচ খোলা, ভিতরে দেখছে, দিদি রুমাল দিয়ে নাকের জল মুছছে।


দিদির কান্না দেখে, পরাশর মনে মনে বলল - দিদি বুঝতে পারেননি,ক্যামেরা নিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারছে,ওগুলো  হালফিলের ছোকরা, গ্রামবাসীদের ভাষায়  “ইটুইবার”,  দিদি ওদের সাংবাদিক ভেবে, আগেই কেঁদে ফেলেছেন, মেকাপ নষ্ট হয়ে গেলো! 

দিদি বললেন -” ইটিউবার!! এই একজ্বালা, ফোন থাকলেই , ইউটিউব নিয়ে নেমে যাও। এদের আটকানো যায়না, কোত্থেকে কী হয়, কে জানে! “


পরাশর, গাড়ির  বাইরে থেকে, জানালার ভিতর, মুখ ঢুকিয়ে ,কানে  ফিস ফিস করে বলল - “দিদি, আগেরবার জলের পরিমাণ কিউসেক থেকে কুইন্টাল হয়ে গিয়েছিল, আপনার মুখে। “


দিদি দাঁত বের করে বললেন - “ মনে আছে ভাই। আমি আর কী বলবো, কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়া এই সমস্যা সমাধান হবে না।ভয় নেই, আমি এইবার ওল কিনবো। তোমাদের এখানকার ওলে গলা ধরবে না তো?”


ডিভিসি প্রতিবছর বৃষ্টি হলেই, হাজার হাজার কিউসেক জল ছাড়ে, বন্যা হয়, ক্ষতি হয়, মানুষ ভাসে, মানুষের চোখের জল ,জমা জলের মধ্যে মিশে যায়, মানুষ প্রতিবার  ভোট দেয়, সুরাহা হয় না। 


পরাশর জানে, জনপ্রতিনিধির ওল কিনে, কলকাতায় নিয়ে যাওয়া ছাড়া, আর কোন কাজ নেই। 


পরাশর মনে মনে বলল - সেটাই ভালো। চাষীদের থেকে ওল কিনছে, সেটাও তো উন্নয়ন।


এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে ,দিদি বললেন - “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের আদলে, বলাগড় মাস্টার প্ল্যান করতে হবে।” 


পরাশর মন্ডল ডুবতে থাকা গ্রামের দিকে তাকিয়ে, মনে মনে বলল- ভগবান মুখ তুলে চেয়েছে।আমরা জাতে উঠলাম! 


কলকাতার খবরের কাগজে আরেকটা মাস্টার প্ল্যান আসতে চলেছে। 


পরাশর, কপালে  হাত   ঠেকিয়ে বলল - বেঁচে বর্তে থাকুক, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান।




বিচার 
রুদ্র

কলকাতা শহরের অন্যতম সেরা মেডিক্যাল কলেজে পড়ত তৃষা দত্ত। মেধাবী ও প্রাণবন্ত তৃষা সবসময় হাসিখুশি থাকত। পড়াশোনার পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবের মধ্যে ছিলো জনপ্রিয়, আর শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও প্রিয় ছিল। বাবা-মায়ের চোখের মণি তৃষা তাদের গর্ব, ভালোবাসা। কিন্তু একদিন, হঠাৎ করেই সে নিখোঁজ হয়ে যায়। তার এই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া যেন এক বজ্রপাতের মতো আঘাত হানে পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের ওপর। তাদের উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের শেষ থাকে না। 

কয়েকটি নিদ্রাহীন রাত কাটানোর পর, তৃষার মৃতদেহ পাওয়া যায় শহরের এক পরিত্যক্ত এলাকায়। তার শরীরে স্পষ্টভাবে দেখা যায় নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন, চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। যে দৃশ্য দেখে পুলিশ ও তদন্তকারী কর্মকর্তারাও স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার নিথর দেহের অবস্থা এতটাই বীভৎস ছিল যে তা দেখলে যেকোনো মানুষের হৃদয় কেঁপে উঠবে। খবরটি বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ে, পুরো শহর স্তব্ধ হয়ে যায়। তৃষার পরিবারের কাছে পৃথিবী যেন এক মুহূর্তে অন্ধকারে ঢেকে যায়, তাদের আনন্দময় জীবনে নেমে আসে গভীর শোকের ছায়া। 

এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের তদন্তের দায়িত্ব পান গোয়েন্দা অভিজিৎ সেন। অভিজিৎ ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ও অভিজ্ঞ গোয়েন্দা কর্মকর্তা, যিনি আগে বহু জটিল মামলা সফলভাবে সমাধান করেছেন। কিন্তু তৃষার ঘটনায় তিনি বিশেষভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি তার মনকে নাড়িয়ে দেয়। তদন্তের শুরুতেই অভিজিৎ তৃষার বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, এবং সহপাঠীদের সাথে কথা বলেন। তবে কোনো বিশেষ সূত্র পাওয়া যায় না। 

তৃষার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে অভিজিৎ সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। ফুটেজে দেখা যায়, তৃষাকে শেষবারের মতো কথা বলতে দেখা গেছে এক জুনিয়র ছাত্র, অরূপের সাথে। অরূপ দেখতে শান্ত এবং নিরীহ, কিন্তু অভিজিৎ তার মধ্যে কিছু একটা অসঙ্গতি খুঁজে পান। অরূপকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, কিন্তু সে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে, এবং প্রথমে তেমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় না। তবুও অভিজিৎ অরূপের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকেন এবং তদন্ত চালিয়ে যান।

কিছুদিন পর অভিজিৎ জানতে পারেন যে, অরূপ প্রায়ই শহরের এক কুখ্যাত গ্যাংস্টার বিনয় ঘোষের সাথে দেখা করে। বিনয় ঘোষ অপরাধ জগতের অন্যতম কুখ্যাত নাম, এবং সে যে কোনো খারাপ কাজে জড়িত থাকতে পারে। তদন্তে দেখা যায়, বিনয় ঘোষ অরূপকে তৃষার প্রতি তার দীর্ঘদিনের শত্রুতা থেকে প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করেছিল। অভিজিৎ বুঝতে পারেন, এই হত্যার পেছনে আরও কিছু গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। সন্দেহ আরও গভীর হয় এবং তিনি তার টিমকে নিয়ে অরূপের ওপর নজরদারি বাড়িয়ে দেন।

এক রাতে, অরূপকে শহরের এক নির্জন এলাকায় বিনয় ঘোষের সাথে কিছু গোপন আলোচনা করতে দেখা যায়। সন্দেহ নিশ্চিত হওয়ার পর, অভিজিৎ অরূপকে গ্রেপ্তার করেন এবং বিনয় ঘোষকেও আটক করেন। থানায় কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের মুখে অরূপ ভেঙে পড়ে। সে স্বীকার করে, বিনয় ঘোষের প্ররোচনায় এবং নিজের পুরনো শত্রুতার জের ধরে তৃষাকে অপহরণ ও নির্মমভাবে নির্যাতন করে খুন করেছে। তবে এখানেই শেষ নয়—তৃষার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরেও, বিনয় ঘোষ এবং তার সঙ্গীরা তৃষার মৃতদেহকে ধর্ষণ করে। এই নৃশংসতা কল্পনার অতীত, যা এক অসহনীয় ট্র্যাজেডির রূপ নিয়েছে। 

আদালতে অভিজিৎ নিখুঁতভাবে প্রমাণ উপস্থাপন করেন—সিসিটিভি ফুটেজ, অরূপের স্বীকারোক্তি, বিনয় ঘোষের সাথে তার গোপন যোগাযোগের রেকর্ড এবং তৃষার দেহে পাওয়া শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন। তৃষার মা-বাবার সামনে প্রমাণগুলি তুলে ধরা হয়, তারা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। অপরাধের সমস্ত প্রমাণ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, আদালত রায় দিতে দেরি করেনি। অরূপ এবং বিনয় ঘোষের কঠোর শাস্তি হয়। তাদের শাস্তি দেখে শহরের মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পায়। 

তৃষার পরিবার ন্যায়বিচার পেলেও তাদের মেয়ে হারানোর শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হবে না। তৃষার মা-বাবা চোখের জলে বিচারকের রায় শোনেন, তারা অনুভব করেন যে, তাদের মেয়ের আত্মা এবার শান্তি পাবে। অভিজিৎ সেন তার সাহসিকতা এবং বিচক্ষণতার জন্য শহরের মানুষের প্রশংসা অর্জন করেন। অপরাধীদের কাছে পৌঁছে যায় এক কঠিন বার্তা—ন্যায়বিচার সব সময় বিজয়ী হয়, এবং অপরাধের কোনো স্থান নেই।





স্যার

পার্থসারথি মহাপাত্র 

রুপাই সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে। মাস খানেক ক্লাস হয়েছে। এর মধ্যে ওর ভিতরে একটা দাদা দাদা ভাব চলে এসেছে। টি-শার্টের কলার তুলে বেপরোয়া আদব কায়দা বেশ আয়ত্ত করেছে। 


 সেই রুপাই একদিন মামাবাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাকে নিয়ে একটা বাসে উঠল। বেশ ভীড় বাস। রুপাই ভাবছে মায়ের জন্য একটা সিটের ব্যবস্থা করতে না পারলে সে কলেজ স্টুডেন্ট হলো কি করে! ভীড়ের মাঝে ঠেলাঠেলি করে শুরু হলো সিট খোঁজা। 


- 'দাদা কোথায় নামবেন?.....

- মাসিমা আপনি কি কাছাকাছি কোথাও নামবেন?.....

- কাকু কোথায় যাবেন?' বলতেই একজনের কাছ থেকে উত্তর এল,'ব্রজপুর।' সাথে সাথে রুপাইয়ের মুখে বিশ্বকাপ জয় করার মত অভিব্যক্তি ঝলক। আরেকটা স্টপেজ পেরোলেই ব্রজপুর। রুপাই সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। রুপাইয়ের সামনে মানে সিটটির পাশে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাই রুপাই এগিয়ে যেতে পারছে না। ব্রজপুর স্টপেজ আসতেই সিটে বসে থাকা লোকটা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে সিটটি ছেড়ে দিয়ে বলল, 'বসুন।' 


রুপাইকে যেন কেউ আগুনের ছ্যাঁকা দিল। উত্তেজিত হয়ে বলল, 'এটা কি হল? আমি আপনাকে সিটের কথা বললাম আর আপনি ওনাকে বসতে বলছেন।' 


- 'না বাবা তুমি সিট রাখতে বলোনি। জিজ্ঞেস করলে আমি কোথায় যাবো, আমি সেটার উত্তরে বলেছি, ব্রজপুর। উনি অনেক আগের থেকে এই সিটটা বলে রেখেছেন। তাই এই সিটটিতে উনি বসবেন।'


তর্ক শুনে কন্ডাক্টর ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে এল। ঐ ভদ্রলোককে বলল, 'স্যার আপনি বসুন।'


'রুপাই বলল, 'না স্যার, ওই সিটটা আমি বলে রেখেছি। ওটা আমি পাব। 


কন্ডাক্টর বলল, 'তুমি কি ওনাকে চেনো? উনি পাঠমন্দির হাই স্কুলের হেডমাস্টার মশাই। প্রতিদিন এই বাসে যাতায়াত করেন। আর তুমি তো ছোকরা ছেলে, দাঁড়িয়েও যেতে পারবে।' 

হেডমাস্টারের উদ্দেশ্যে কন্ডাক্টর বলল, 'আপনি বসুন স্যার।'


রুপাইও হার মানতে রাজি নয়, ও

কন্ডাক্টরকে বলল 'শুনুন আমি ছোকরা ছেলে সেটা আমিও জানি। সিটে বসার জন্য আমার কোন আকুতি নেই।' হেডমাস্টারকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'স্যার, আসলে সিটটা আমি আমার মায়ের জন্য বলেছিলাম।'


হেডমাস্টার মহাশয় সিটটিতে বসতে গিয়েও উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুস্বরে বললেন, 'নাও, মাকে ডেকে এনে বসাও।' হয়তো রুপাইয়ের বিবেক জাগ্রত হল। বলল, 'না স্যার আপনিই বসুন, আমি মায়ের জন্য অন্য সিট খুঁজে দেখছি।'


- না বাবা তুমি আমাকে 'স্যার' বলেছ। স্যার মানে মহাশয়। তোমার এই সম্বোধনকে সম্মান দিতে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কষ্ট টুকু আমাকে সহ্য করতেই হবে। মাকে ডাকো।




রাধারানী  
সম্রাট দাস

তাতাই... ওই তাতাই, তাতাই আমি ঠাম্মা... ওঠ এবার। উচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলে যেভাবে প্রতিধ্বনি শোনা যায় ঠিক সেভাবেই যেন প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে...তাতাই... ওই তাতাই, তাতাই আমি ঠাম্মা... ওঠ এবার।
            আমার ঠাম্মা হলেন রাধারানী। আমি ঘুমিয়ে থাকলে ঠিক এভাবেই ডাকতো সে। তিনি আটপৌরে সাদা শাড়ি পড়তেন,কপালে পড়তেন তিলক এবং গলায় তুলসির মালা। গোলগাল মুখখানা, তিনি ছিলেন শিক্ষিত ,সুশ্রী ও গৌরবর্ণা। তিনি বৈষ্ণবী। তিনি শৈশব থেকে বৃদ্ধকাল, সারা জীবনব্যাপী শ্রীকৃষ্ণকে ব্রহ্ম জ্ঞানে পুজো করেছেন।ঠাকুরঘর সুন্দর করে লেপে পুছে ভক্তি সহকারে শ্রীকৃষ্ণের পুজো করতেন। ঠাকুর ঘরটি বেশ সুন্দর ও শীতল ; কারণ ঠাকুর ঘরের উপরে আতা গাছটি যেন ছাতা মেলে রয়েছে।সেই আতা গাছের সাথে বেয়ে বেয়ে উঠেছে মাধবীলতা ফুলের গাছ; ঝোপা ঝোপা ফুল ফুটেছে, সুন্দর গন্ধে ঠাকুর ঘরটি যেন ভোরে উঠেছে। রাধারানী মাধবীলতা এবং অন্যান্য ফুল সংগ্রহ করে, স্নান করে , পবিত্র ভাবে পূজো দিতে বসেছে। ধুপকাঠির ধোঁয়া গুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ধূপকাঠির সুগন্ধ, ফুল-ফল, জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা, জল শঙ্খ, কাশি-ঘন্টার আওয়াজ সবমিলিয়ে ঠাকুর ঘর স্বর্গে পরিণত হয়েছে।আর রাধারানী একাকী বসে আপন মনে পুজো করে যাচ্ছে। ঠাকুর ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বয়ে চলা নদী ও গাছপালা।

        আমি জ্যোতি। রাধারানী হলেন আমার ঠাম্মা, আমাকে তাতাই বলেই ডাকতো। তিনি আর নেই; পরলোক গমন করেছেন। আমি দেখেছি তার নিথর দেহ , পঞ্চভূতের একটি ভূত অগ্নিতে,জ্বলন্ত চিতায় কিভাবে দগ্ধ হয়েছে। তার বাঁচার বড় শখ ছিল, কিন্তু কালের নিয়মকে কে অগ্রাহ্য করতে পারে..??? বৃদ্ধ হয়ে নিথর দেহেই তার মৃত্যু ঘটে।
       ঠাম্মার কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে কার্তিক মাসে তার আকাশ প্রদীপ দেওয়া; দুর্গা পুজো কালীপুজোতে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, লক্ষ্মী পূজোর শেষে একসাথে খই নাড়ু খাওয়া, মনে পড়ে পৌষ পার্বণে একসাথে পাটিসাপটা, পিঠে- পুলি খাওয়া। সবই আজ নস্টালজিয়া।পার্টিকুলার কোন বস্তু বা ব্যক্তির প্রতি প্রীতিই হলো মোহ এবং সবার প্রতি একই দৃষ্টিভঙ্গি হলো প্রেম। রাধারানীর কোন মোহ ছিল না ,পিছুটান ছিল না; তিনি বাড়ির লোক এবং পাড়া -প্রতিবেশী সবাইকে একই দৃষ্টিতে দেখবেন। তিনি প্রেমী। আমিও অনেকটা সেরকম, প্রেমী, মোহে আক্রান্ত নই। আমি শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব , মাতা সারদা এবং স্বামী বিবেকানন্দ কে অনেকটাই অনুসরণ করি। তাই আমিও অনেকটা প্রেমী। বাহ্য জগতের কোলাহল নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যথা নেই, আছে শান্তি। তবুও মৃতা ঠাম্মার কথা মনে পড়লে মনটা বেশ ভার হয়ে যায়।
         সেই প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি,তাতাই... ওই তাতাই, তাতাই আমি ঠাম্মা... ওঠ এবার। ঠাম্মাকে দেখতে পেলাম ঘরে। আটপৌরে সাদা শাড়ি পড়া, ঘর থেকে বেরিয়ে ;গেট খুলে রাস্তা দিয়ে সোজা হাটতে লাগলো । হাঁটতে হাঁটতে দিগন্তে মিলিয়ে গেল তার সাদা শাড়ি ।
         আমি উঠে পড়লাম ।হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম ঠাম্মাকে কোথাও পেলাম না।আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম । কিছুক্ষণ বসে রইলাম। চারিদিকে নিস্তব্ধ ও মৃদু শীতল পরিবেশ। ভোর হয়েছে পাখিরা ডাকছে। আমি বললাম, ঠাম্মা (রাধারানী) মরে গেছে তো কি হয়েছে..?!স্বপ্নে না হয় তাকে অনুভব করব, স্বপ্নতেই না হয় তার সাথে কথা বলবো, স্বপ্নতেই না হয় তার পুজো দেখব, বাহ্য জগতে সে নাই থাকতে পারে , স্বপ্নে তো তার সাথে দেখা হয়, এটাই তো অনেক, স্বপ্নেই থাকুক সে।
          তারপর তাতাই মনে মনে বলতে লাগলো , ঠাকুমার মৃত্যুর পর বুঝতে পেরেছি দাদু-দিদিমা-ঠাকুমাদের ভালোবাসা কি জিনিস! তাই শুধু গড্ডলিকা প্রবাহে নিজেকে না ভাসিয়ে, সময় থাকতে প্রিয় মানুষগুলোর পাশে থাকবো , প্রিয় মানুষগুলোকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করব, এটাই  আনন্দ; নচেৎ তাদের মৃত্যুর পর হাজার চেষ্টা করলেও তাদের আর কাছে পাব না......








মুনা 

অনলাইন শারদ (আশ্বিন) সংখ্যা ১৪৩১


ভ্রমণ 




বৃন্দাবনের পথে

সুতপা সোঽহং


সকাল সকাল শরতের পুজো পুজো আমেজ নিয়ে ভাবছিলাম পুজোর ছুটিতে এবার কোথায় যাওয়া যায়। প্রতিবার পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গলে ঘুরতে গেলেও এবার সেসব দিকে যেতে চাইছিলাম না। এমনসময় বান্ধবীর কল এলো।এটা সেটা নানা কথার শেষে ওকেও ঘোরার কথা বলাতে বলল চল 'এবার বৃন্দাবন যাই।' ওর শ্বশুরবাড়ি বৃন্দাবনে। ফলে থাকা খাওয়ার সমস্যা নেই। উপরন্তু চেনা জানা ঘোরানোর লোক ও গাড়ি আছে। এককথায় রাজী হয়ে গেলাম। তৎকালে টিকিট কাটা হলো। NJP থেকে মথুরা স্টেশন। যাওয়ার দিন যথারীতি চেপে বসলাম ট্রেনে। আড়াই দিনের ট্রেন জার্নি।ট্রেনের দুলকি চালে দুলতে দুলতে আর বান্ধবীর সাথে গল্প গল্প করতে সময় ভালোই পার হচ্ছিল।ট্রেনের রুট পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে বিহার হয়ে উত্তরপ্রদেশ। ফলে স্টেশনে স্টেশনে স্থানীয় খাবার, লোক, ভাষা পরিবর্তিত হচ্ছিল। ট্রেন যত মথুরার কাছে আসছিল তত দেখছিলাম কামরাগুলোতে হরিনাম কীর্তন হচ্ছে। কেউ হয়তো কাউকে চেনে না কিন্তু তাতে সবাই গলা মেলাচ্ছিল। অনেককে দেখলাম ঘরের গোপালের প্রতিমূর্তি নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে বৃন্দাবন দর্শনে। মথুরাতে যখন পৌঁছলাম সবাই ট্রেন থেকে নেমেই সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন মথুরার মাটিকে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করা হলো বৃন্দাবনের রাধা কুন্ডের উদ্দেশ্য। বান্ধবীর শ্বশুরবাড়ি রাধাকুন্ডে। আমরা যাবো বলে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল। তারা সবরকম ব্যবস্থা করেই রেখেছিলেন। আমরা পৌঁছেই আগে স্নান, খাওয়া দাওয়া সারলাম। একবেলা রেস্ট নিয়ে বিকেলে বেরোলাম রাধাকুন্ড পরিক্রমায়। অসংখ্য মন্দির এবং প্রত্যেক মন্দিরেই রাধাকৃষ্ণের কিছু না কিছু লীলার ঘটনা জড়িত। ঘুরতেই ঘুরতেই সন্ধ্যায় এক মন্দিরে দর্শন হলো প্রাণকৃষ্ণ দাস বাবাজীর সাথে। উনিও রাধাকুন্ড পরিক্রমায় এসেছেন। ওঁনার আশীর্বাদ নিয়ে ও ভাগ্য সুপ্রসন্ন দেখে আমরা পরিক্রমা শেষে প্রফুল্ল চিত্তে সেদিন বাড়ি ফিরলাম। পরেরদিন সকাল সকাল টিফিন করে বেরিয়ে পড়লাম বাঁকে বিহারী মন্দিরের উদ্দেশ্য।প্রচুর ভিড় ঠেলে যখন মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম মন একেবারে শান্ত হয়ে গেল। কী এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে উঠল। এখানে বাঁকে বিহারীজী রাধা ও কৃষ্ণের মিলিত রূপ ত্রিভঙ্গ মূর্তিতে পূজিত হন। স্বামী হরিদাস ঠাকুরের ঐকান্তিক আকুতিতে এই অভিনব রূপটিতে কৃষ্ণের হাতে বাঁশি থাকে না বছরের অন্যান্য দিনে। একমাত্র অক্ষয় দ্বিতীয়ার দিন হাতে বাঁশি দেওয়া হয়। এখানে ভক্ত অন্তপ্রাণ বাঁকে বিহারীজী যাতে ভক্তের ডাকে মন্দিরের বাইরে না যেতে পারেন সেজন্য ঝোঁকা দর্শন বা পলক দর্শন করানো হয়।সেখানে আমরা পুজো দিয়ে, আশে পাশের আরো কিছু মন্দির দর্শন করে বাড়ি ফিরলাম। পরেরদিন গাড়ি রিজার্ভ করে গেলাম বরসানা অর্থাৎ রাধারাণীর জন্মস্থান। শ্রীজীর মন্দিরটি ৫০০০ বছরের পুরানো ও ভানুগড় নামক পাহাড়ে অবস্থিত। আমরা গোলাপ ফুলের মালা, প্রসাদী ও পটবস্ত্র নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। অপরূপা রাধারাণী গোটা বৃন্দাবনের ঈশ্বরী। কথিত আছে মালকিন রাধারাণীর ইচ্ছা বিনা বৃন্দাবনের মাটিতে পাও রাখা যায় না।ওখানে বসে বসে অনেকক্ষণ কীর্তন করলাম। মনে যে কী এক প্রকার প্রশান্তি ও প্রেম অনুভব করলাম তা বর্ণনাতীত! হ্লাদিনী শক্তি রাধারানীকে প্রণাম করে বেরোচ্ছি দেখি হঠাৎ এক পন্ডিতজী রাধারাণীর গলা থেকে মালা খুলে আমার হাতে দিলেন।এই অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে আমার চোখে জল এলো। অপার করুণাময়ীর এই অযাচিত ভালোবাসায় মন একেবারে বিগলিত হয়ে গেল। 'রাধে রাধে' বলতে বলতে তারপর সেখান থেকে গেলাম মথুরায় কংসের কারাগার, দ্বারকাধীশ মন্দিরে ও রমণরেতীতে।সেখানে দর্শন ও পুজো করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এল। আমরাও সেদিনের মত ফিরে এলাম। তার পরেরদিন অটো রিজার্ভ করে গেলাম নিধুবনে। সেখানে এখনো রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা হয় বলে ভক্তদের বিশ্বাস। রং মহলে রাধা ও কৃষ্ণকে সিঁদুর, চুড়ি, আলতা, পান, ইত্যাদি দিয়ে শৃঙ্গার করানো হয়।সন্ধ্যা থেকে পুরো নিধুবন বেরিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কথিত আছে নিধুবনের সমস্ত গাছরা রাতে রাধারাণীর সখিতে পরিণত হন এবং কৃষ্ণের সাথে লীলা করেন। নিধুবন দর্শনের পরে গেলাম দশরথ ঘাটে। সেখানে যমুনায় স্নান করে আরো অন্যান্য মন্দির যেমন রাধাবল্লভ মন্দির, রাধামাধব মন্দির, ইস্কন মন্দির ইত্যাদি দর্শন করে বাড়ি ফিরলাম। পরেরদিন গোবর্ধন পরিক্রমা, গোকুল, প্রেম মন্দির, কাঁচ মন্দির, সোনার তালগাছ ও আরো নানা লীলাক্ষেত্র দর্শন করে শেষে রাধাকুন্ড ও শ্যামকুন্ডে স্নান সেরে ফিরলাম। বৃন্দাবনের সমস্ত মন্দির দেখতে একমাস সময়ও কম পড়ে যায়। কিন্তু সময়ের অভাবে প্রধান প্রধান লীলাক্ষেত্র দর্শন করেই বৃন্দাবনের অপূর্ব সব স্মৃতি সাথে নিয়ে আমাদের শিলিগুড়িতে ফিরতে হলো।





মুনা 

অনলাইন শারদ (আশ্বিন) সংখ্যা ১৪৩১


No comments:

Post a Comment