Sunday, January 15, 2017

ঘন কুয়াশা
শীলা ঘটক                      

দিল্লী থেকে ফেরার সময়  রাজধানী এক্সপ্রেস ধরার জন্য স্টেশনের দিকে রওনা হলাম, স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, ব্যাগটা নিয়ে ওঠার সময় এক ভদ্রলোক গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সিগারেট খেতে ব্যস্ত।  কিছুটা ধাক্কা দিয়েই উঠতে হোল। নিজের সিটটা খুঁজে নিয়ে বসলাম।   কিছুক্ষণ পর ট্রেন ছাড়ল।  গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ভদ্রলোকটির সিট আমার সিটের অপরদিকে। উনিও এসে বসলেন, ট্রেন ছেড়ে দিল----  বেশ লম্বা প্রায় ছয় ফিটের মতো, গায়ের রঙ মাঝারি, চোখ- নাক টানা টানা, বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি, একসময় বেশ সুপুরুষ ছিলেন বোঝা যায়। মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমিও দেখছিলাম ওনার দিকে। কতক্ষণ আর চুপ করে থাকা যায়! জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবেন? ঠোঁটে সিগারেট নিয়েই উত্তর দিলেন, কোলকাতা।  ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে--- জানলার দিকে তাকিয়ে  বাইরেটা দেখার চেষ্টা করছি। কালো কাঁচের ভেতর দিয়ে সেভাবে কিছুই দেখা যায় না। কি করা হয়?  অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন ছুটে এলো, তাকিয়ে বললাম, ব্যবসা।
কিসের ব্যবসা?   
মেডিসিনের----
ভদ্রলোক সিগারেট ধরিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন, লাভ কেমন?
সবে তো শুরু করেছি, দেখা যাক----
ভদ্রলোকের কেন জানিনা একটু বেশী কৌতুহল বলে মনে হোল। বেশী কথা আর না বলে একটা ম্যগাজিন খুলে পড়া শুরু করলাম। খুব ক্লান্ত ছিলাম তাই আর বেশী কথার উত্তর দিতে ভালো লাগছিল না।  খুব তীব্র গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে----- মনে হোল উনি আরও কিছু বলতে চান...... একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন আর গেটের দিকে যাচ্ছেন আবার এসে বসছেন। কিছুক্ষণ পর আমিই জানতে চাইলাম, আপনি কি করেন? উত্তর দিলেন, কিছু না---
কোলকাতার কোথায় থাকেন?
একবার আড়চোখে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। আমারও আর জানার ইচ্ছে হোল না। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ যে ঘুমালাম মনে নেই, ঘুম ভাঙতে  ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে  দেখলাম একই ভাবে বসে আছেন। কি আশ্চর্য! এতক্ষণ একভাবে বসে আছেন! বললাম, একটু ঘুমিয়ে নিতে পারতেন। আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলেন শুধু ---- কি আর বলি! খিদে পাচ্ছে,  ভদ্রলোককে কেমন যেন লাগছিল, নিজের মতো করে চলতে ভালবাসেন সেটা বুঝলাম। খেয়ে নিয়ে বাথরুমের দিকে গেলাম হাত-মুখ ধুতে।  ফিরে এসে আবার ম্যগাজিনটা খুলে পড়তে রইলাম।
বাড়িতে কে কে আছেন?  
আমি,আমার মা আর রাধেশ্যাম মানে----
মা কি এখনো চাকরি করেন?
হ্যাঁ করেন। কিন্তু আপনি কি আমার মাকে চেনেন?
আবার আড়চোখে তাকালেন, পকেটে সিগারেটের বাক্স আর লাইটারটা খুঁজছেন, যেন শুনতেই পাননি। আবার প্রশ্ন করলাম, আমার মা চাকরি করেন আপনি জানলেন কি করে?   উত্তর দিলেন না।  বাথরুমের দিকে চলে গেলেন।  কি আর বলি, কেউ যদি কথার উত্তর দিতে না চায় তাকে তো জোর করা যায় না--- বাথরুম থেকে এসে খাবার নিয়ে বসলেন খেতে। বার বার দেখছিলাম ওনাকে, কখনো দেখেছি কি না মনে করার চেষ্টা করতে লাগলাম, কিন্তু না কোনদিন দেখেছি বলে মনেপড়ে না।  ভাবলাম, মায়ের সঙ্গে হয়তো একসঙ্গে কাজ করেছেন তাই মা কে চেনেন। যাকগে এখন আর কোন কথা বলার দরকার নেই। ভদ্রলোক খাচ্ছেন----  

ম্যগাজিনটা পড়তে পড়তে কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।  ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি উনি ঘুমাছেন। মনের ভেতর প্রশ্নটা বার বার উঁকি দিতে লাগলো---- উনি আমার মাকে চেনেন, অথচ আমি তো চিনিনা ওনাকে----- দুরন্ত গতিতে ট্রেন এগিয়ে চলেছে......... হুইসেলের আওয়াজ বাইরের  বাতাসকে এফোঁড়ওফোঁড় করে ট্রেনটা সামনের  দিকে এগিয়ে চলেছে  .........
                                             .....................

আপনার নামটা জানা হয়নি, কি নাম? আমাকে প্রশ্ন করলেন----
আকাশ ভৌমিক , ডাকনাম শুভ।
থাকেন কোথায়?
সল্টলেক,
আপনি কোলকাতায়  কোথায় থাকেন?
ঠিকানা নেই, যেখানে জায়গা পাই সেখানে----
মানে?
মানে আর কিছু নয়, আমি আমেরিকাতে থাকি , কয়েক বছর পর পর আসি কিছু কাজ নিয়ে কোলকাতায়, তখন যেকোন হোটেল বা লজে থাকি। এই প্রথম ভদ্রলোক কথা বললেন,  ভাবলাম এবার জিজ্ঞেস করলে হয়তো বলবেন, আপনি আমার মায়ের পরিচিত?  আমার মাকে দেখেছেন?  ভদ্রলোক বললেন, আজ থাক----আবার যদি কোনদিন দেখা হয় তখন না হয়ে বলবো।
আর যদি কোনদিন দেখা না হয় তাহলে?
তাহলে আর জানার দরকার পড়বে না-----
খুব কৌতূহলী হয়ে উঠছি, খুব অদ্ভুত ধরনের মানুষ! মনটা অস্থির হয়ে উঠলো, বললাম, আপনার ঠিকানা, ফোন নং দিন আমিই যোগাযোগ করবো। ভদ্রলোক কথায় সায় দিলেন না,  চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন, আপনার অ্যাড্রেস আর ফোন নং টা দিন আমি যোগাযোগ করে নেবো।  অগত্যা ব্যাগ থেকে কার্ড বার করে দিয়ে দিলাম।  বয়স্ক মানুষ বিশেষ তো কিছু বলা যায় না।  ট্রেন ঢুকচ্ছে স্টেশনে---- ব্যাগপত্র গুছিয়ে নামার জন্য  তৎপর হলাম, উনিও ব্যস্ত নামার জন্য---- ট্রেন থামল, একে একে সবাই নামছে, আমরাও নামলাম, দেখি ভদ্রলোক কোনকিছু না বলে নিজের মতো এগিয়ে গেলেন, দূর থেকে বললাম ফোন করবেন---- শুনতে পেল কিনা জানিনা এগিয়ে যাচ্ছেন ---ভারি অদ্ভুত মানুষ তো!  মিলিয়ে গেলেন লোকারণ্যে......  হঠাৎ  দেখি রাধেশ্যাম পেছন থেকে ব্যাগটা ধরে টানছে, চলো চলো, কখন এসেছি তোমাকে নিতে আর তুমি দাঁড়িয়ে আছো---- চিরকাল রাধেশ্যাম একটু বেশী উৎসাহী হয়ে পড়ে আমাকে দেখলে...... চলো, ব্যাগপত্র নিয়ে ও এগিয়ে যেতে থাকলো, আর আমি বার বার পেছন ফিরে সেই মানুষটিকে খুঁজতে রইলাম।
 

ক্রমশঃ 

No comments:

Post a Comment