বাবার স্বপ্নপূরণ
-সুকন্যা সামন্ত
_______________
মেয়ে চেয়েছিলে তুমি,
মনের মত মানুষ করবে বলে-
তাই যখন প্রথম আমায় কোলে
নিলে,
দারুণ সুখী ছিলে তুমি,
আনন্দে তোমার চোখ
দিয়ে ঝরেছিলো অশ্রু,
ভগবানের কাছে তোমার
প্রণাম জানিয়েছিলে।
মনে পড়ে প্রথম যখন হাসপাতালে টীকা দিয়েছিলে-
কোকিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম আমি,
তুমি দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছিলে,
আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তোমার কোলে-
সেদিন সকলে প্রত্যক্ষ
করে ছিলো
আমাদের টান।
তুমি ছিলে সৎ,কর্মনিষ্ঠ,
মন ছিলো তোমার শিশুর মত
কোমল,
কিন্তু বাইরের কঠিন
চরিত্র দেখে –
তা বোঝার উপায় ছিল না।
ইচ্ছে ছিলো তোমার ছোট-
যদিও তখনকার গোঁড়া পরিবারের কাছে,
সেটা ছিলো বাহুল্য।
মেয়ে মানে যে শুধু অন্যের বাড়ির জন্য-
পিত্রালয়ে লালিত,পালিত
পুতুল নয়,
তা তুমি বোঝাতে চেয়েছিলে-
চেয়েছিলে গ্রামের ও শহরের ,
মধ্যবিত্ত আর পাঁচটা পরিবারের,
সাধারণ মেয়ের মত
বড় না
হয়ে
আমি যেন মানুষের মত মানুষ হয়ে উঠি।
তাই সামান্য অফিসের সেই চাকুরী,
করেও তোমার ইচ্ছে
হলো-
মেয়েকে কনভেন্ট ইস্কুলে পড়াবে।
হেসেছিলো সকলে তখন-
কাকা, জ্যাঠারা কটাক্ষ করেছিলো,
দিদিরা বলেছিলো,”পড়াশোনা তো আমরাও
শিখেছি-
কি হলো, সেই তো হেঁসেল ঠেলতে হচ্ছে”।
সহকর্মীরা বলেছিলো,”মেয়েকে সাহেবদের ইস্কুলে ভর্তি করেছে-
ইংরাজী শেখাবে বলে,
মেয়েছেলের অত বাড় কি ভালো?”
তুমি কারুর কথায় কান দাওনি
সেদিন,
এত দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো তোমার
নিজের প্রতি।
তোমার সে ইচ্ছার,
আর চেষ্টায়-
মাও সমান তালে সাহায্য করেছিলো
একদিনের তরেও আমাকে
বুঝে দাওনি-
কষ্ট করে দুপয়সা বাঁচিয়ে,
আমার জন্য ভালো খবার
এনে দিতে,
রিক্সা চাপার পয়সা বাঁচাতে-
আমাকে বই কিনে
দেবে বলে।
অফিসের সেই হাড়-ভাঙ্গা খাটুনির পর,
যখন তুমি পড়াতে বসতে,
ক্লান্তিতে ঘুম আসতো তোমার
চোখে,
তবুও তাকে অগ্রাহ্য করে
তুমি আমাকে শেখাতে।
তোমার একটাই ইচ্ছে ছিলো-
আমি যেন বড় হই, মানুষ
হই,
মনে মনে ঠাকুরকে ডাকতে-
যেন মা ভবতরিণী তোমার
সেই ইচ্ছা পূরণ করেন।
মা তোমার সেই প্রার্থনা শুনেছিলেন-
আমি পাশ করলাম,
তুমি তখন আরো উৎসাহ
দিলে-
আমি আরো পড়াশোনা করলম,
চাকরীর পরীক্ষা দিলাম এবং
পাশ করলাম,
তোমার সেই মনের আশা
পূর্ণ হলো।
জগৎকে তুমি দেখিয়ে দিলে
যে-
মেয়েকে জন্ম দেওয়া মানেই
জীবন বৃথা নয়,
ভালোভাবে মানুষ করলে মেয়েও,
দশটা ছেলের কাজ করে,
তোমার জীবনের আদর্শ হয়ে
উঠলো-
অন্যের পথের পাথেয়।
কত স্বপ্ন ছিলো তোমার-
যে মেয়েকে তার স্বপ্নের রাজপুত্রের হাতে তুলে দেবে,
কিন্তু ভাগ্য এখানে বিরূপ
হলো-
দূরাোগ্য ব্যাধিতে তুমি আক্রান্ত হলে,
আমাদের সেই বিপদের দিনে ,
পাশে দাঁড়ালো না কোনো
আত্মীয়-স্বজন,
তুমি আরো অসু্স্থ হয়ে
গেলে,
কোনো ডাক্তার পারেনি সেদিন
তোমায় সুস্থ করতে।
আজও মনে পড়ে শেষদিন –
হাসপাতালে তুমি আমার গায়ে ,
হাত বুলিয়ে দিয়েছিলে,
সেদিন শেষবারের মত পিতৃস্নেহ,
অনুভব করেছিলাম-
তোমার শেষ কথা এটা
ছিলো না,
যে তমি আমায় সংসার
জীবনে ,
প্রবেশ করাতে পারলে না,
শুধু বলেছিলে –
”মা তোকে
আদর করার আর কেউ
রইলো না।“
No comments:
Post a Comment