Thursday, March 15, 2018
।। পুস্তক পর্যালোচনা।।
কাব্যগ্রন্থ- জলজ্যোৎস্নার মেয়ে
কবি- মানিক সাহা
প্রকাশনা- উত্তর শিলালিপি
মূল্য- আশি টাকা
কবি- মানিক সাহা
প্রকাশনা- উত্তর শিলালিপি
মূল্য- আশি টাকা
আলোচক: শৌভিক রায়
কবিতা সাহিত্যের প্রাচীনতম ধারা। দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের সব ভাষার সাহিত্যেই কবিতা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে আসছে। কবিতার জগতে নানাবিধ আন্দোলন কবিতাকে নিঃসন্দেহে অন্য মাত্রা দিয়েছে। কবিতার ব্যাপ্তি এতটাই যে দেশ-কালের গন্ডী পেরিয়ে কবিতা যাত্রা করে এমন এক অসীম অনন্তে যেখানে পাঠকের বোধ ও চেতনার বন্ধ দরজা খুলতে শুরু করে তার নিজস্ব অর্গল।
কবিতার বিষয় ও কবিতার ভাষা কি হবে তা নিয়ে আপাত বিরোধের মধ্যেও একথা সত্য যে কবিতার বিষয় সেভাবে না পালটালেও কবিতার ভাষায় বাঁকবদল হয়ে গেছে অনেক আগেই। বিষয়ের ক্ষেত্রেও যে তা হয় নি, এমনটা কিন্তু নয়। দীর্ঘদিন বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যে কেন্দ্রিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল তা এই শতকের খানিকটা আগে থেকেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের বিখ্যাত কবিদের কথা মাথায় রেখেই বলছি কবিতা আজ আর কারো মুখাপেক্ষি নয়। নিত্য নতুন প্রক্ষেপে, নব আঙ্গিকে স্থানীয় থেকে শুরু করে সার্বজনীন বিষয়ে নব নব ভাষায় কবিতা লিখবার প্রয়াস অবশ্যই কবিতাকে দিচ্ছে নতুন পরিচয়।
কবি মানিক সাহা তাঁর কাব্যগ্রন্থে বেশীর ভাগ কবিতার ক্ষেত্রেই বিষয় নির্বাচনে 'প্রেম'কে বেছে নিলেও তাঁর শব্দ ও ভাষার ব্যবহারে কবিতাগুলিকে অন্য মাত্রা দিতে পেরেছেন। এখানেই তাঁর সার্থকতা। এর আগেও বলেছি বিষয় হিসেবে 'প্রেম' এতটাই ব্যবহৃত যে এই বিষয়ক কবিতা তখনই পাঠককে আকৃষ্ট করে যখন তা নতুনভাবে ধরা দেয়। আর সেরকমটি করতে গেলে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন তা হল শব্দ ব্যবহারের মুনসিয়ানা। কবি মানিক সাহা অত্যন্ত সুচারুভাবে সেটি করতে পেরেছেন বলেই পাঠকের ভাললাগা তৈরী হয় কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে। প্রেম প্রকাশে অনায়াসে কবি বলতে পারেন ' তুমি চুল আঁচড়ে নেবার সময় নক্ষত্র/ সাজিয়ে নিচ্ছ অলঙ্কারে' (পালক) অথবা 'একটি ঝুলবারান্দায় পড়ে থাকা বিকেলের রোদ/তাতে তোমার চুলের গন্ধ লেগে আছে' (ঝুলবারান্দা) বা 'তোমার চলে যাওয়া রাস্তায়/আমি ছায়াগুলি গুছিয়ে রেখেছি...' (মাথুর/প্রেম পদাবলি)। এরকম অজস্র শব্দবন্ধ অবশ্যই প্রেমকে উপস্থাপন করে নতুনভাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রেমের সাথে বিরহের সম্পর্ক অনেকটা যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মত। বিরহকথাও প্রবল নানা কবিতার পরতে পরতে। প্রেমের আনুসঙ্গিকে যেন হাত ধরেই এসেছে যৌনতা। এখানে একটা কথা পরিষ্কার বোঝা দরকার যে যৌনতা মানে শুধুই শারীরীক মিলন নয়। শারীরীক মিলন যৌনতার একটি অংশ হতে পারে কিন্তু তা সামগ্রিক না। সেই অখন্ড যৌনচেতনাই পরিলক্ষিত কবি মানিক সাহার কবিতাই। 'হিরণ্যগর্ভজাত ধান', 'মেঘের যোনি' চুঁইয়ে নেমে আসা শিশির, দেবদারুপাতার 'মৈথুনের ছবি', 'যৌনগন্ধী মাছ', 'চাঁদ কামড়ে খেতে চাওয়া দুটি ঠোঁট', 'মগ্নতায় ঘোড়া ডাক', 'রমণের ছায়া', 'শঙ্খলাগা প্রেম' ইত্যাদি নানা শব্দে লুকিয়ে থাকা চোরা যৌনতা কবিতাগুলিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে, চিনিয়েছে নতুন দিক, শব্দ ব্যবহারের।
'কবিতা ও কার্তিকের মাঠ', 'প্রেমিক বা দেবতা', 'নির্বাণ', 'চরনদাসের গান', 'আত্মহত্যার পর যা যা লিখব ভেবেছি', 'মেঘ ও মৃত্যু বিষয়ক', 'বীজচোর' এবং 'কবি' ইত্যাদি কবিতায় কবি তাঁর প্রিয় বিষয় ছেড়ে যাত্রা করেছেন অন্য পথে। যে অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে কবিতাগুলি রচিত হয়েছে তাতে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি প্রেমের স্তর উত্তীর্ণ হয়ে কবির নতুন কথা বলার সময় এসেছে। চেতনার এক গভীর স্তর থেকে জীবনকে দেখা হয়েছে এই কবিতাগুলিতে। নিজের ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে কবি যেন নিজের শরীরটিকেই 'গুপ্তমন্ত্রে' কাঁচ বানিয়েছেন 'কবি' শীর্ষক কবিতাটিতে। শরীর ও মননের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এমন এক মনুষ্যজীবন এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি মানিক সাহা যা যথার্থ অর্থেই 'জীবন'। মৃত্যু চেতনার বেশ কয়েকটি স্তরকে ছুঁতে পেরেছেন তিনি 'আত্মহত্যার পর যা যা লিখব ভেবেছি' এবং 'মেঘ ও মৃত্যু বিষয়ক' কবিতা দুটিতে। মৃত্যু এমন একটি ভাবনা যা সমস্ত ধরণের মানুষকেই ভাবায়। কিন্তু সেই ভাবনা সূক্ষ ও বিরামহীন হয় কবির মনোজগতে। বস্তুতঃ কবির চ্যালেঞ্জ থাকে মৃত্যুর সাথেই যদিও তা অবশ্যম্ভাবী তা জেনেও। কিন্তু মৃত্যুও হেরে যায় কবির কলমের জোরে। কবির মৃত্যু হয় না। নশ্বর শরীর সময়ের আঘাতে জীর্ণ হয়, বিদীর্ণ হয় লুকিয়ে থাকা প্রাণ। থেকে যায় কবির ভাবনা, তার শব্দেরা। এই দুটি ব্যাপারে কবি মানিক সাহা অন্ততঃ এই দুটি কবিতায় সসম্মানে উত্তীর্ণ। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতির ও তার সাথে এখানকার লোকেদের একাত্মতার ছবি চলমান 'চরণদাসের গান', 'বীজ চোর', 'গান' ইত্যাদি কবিতায়। সাথে যোগ হয়েছে না পাওয়ার বেদনাও। এই বেদনা বোধ বোধহয় উত্তরের মানুষদের মজ্জাগত দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলস্বরূপ। কবি মানিক সাহা তাঁর অসামান্য দ্যুতিময়তায়ও নিজের শেকড়ের সাথে প্রোথিত আছেন একথা ভাবতেও ভাল লাগে। এখানেই উত্তরণ হয় একজন সত্যিকারের মানুষের, একজন কবির। খন্ড চেতনাকে কবি যখন অখন্ডতার রূপ দেন তখনই সার্থক হয় তাঁর সৃষ্টি। কবি মানিক সাহা ধাবমান যেন সেই লক্ষ্যেই। অপেক্ষায় থাকলাম পরবর্তীতে কবি মানিক সাহা নতুন ভাবনায় ও শব্দচয়নে চমৎকৃত করবেন যেভাবে এই কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় করেছেন।
আপত্তি করছি 'ভূমিকা'র বক্তব্য নিয়ে। কবি নিজে যদি তাঁর কবিতার বিষয় বলে দেন তবে পড়ার মজা ক্ষুণ্ন হয় বলে আমার ধারণা। কবিতা তো পেঁয়াজের মতো। খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে যেমন পেঁয়াজের অভ্যন্তরভাগ পাওয়া যায়, কবিতার নির্যাসটুকুও সেভাবেই পায় পাঠক তার নিজস্ব ভাবনার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে। সাংকেতিকতা যদি কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয় তবে ভূমিকাতে কবি মানিক সাহা কবিতার বিষয়বস্তু বলে দিয়ে কবিতাগুলি পড়বার আমেজ একটু হলেও নষ্ট করেছেন। অবশ্য এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত।
সুন্দর প্রচ্ছদ, ভাল কাগজ ও ঝকঝকে ছাপা বইটির অন্যতম সম্পদ।
তবে সেরা সম্পদ অবশ্যই চল্লিশটি কবিতা যা মলাটবন্দী হয়েছে বইটিতে।
কবিতার বিষয় ও কবিতার ভাষা কি হবে তা নিয়ে আপাত বিরোধের মধ্যেও একথা সত্য যে কবিতার বিষয় সেভাবে না পালটালেও কবিতার ভাষায় বাঁকবদল হয়ে গেছে অনেক আগেই। বিষয়ের ক্ষেত্রেও যে তা হয় নি, এমনটা কিন্তু নয়। দীর্ঘদিন বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যে কেন্দ্রিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল তা এই শতকের খানিকটা আগে থেকেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের বিখ্যাত কবিদের কথা মাথায় রেখেই বলছি কবিতা আজ আর কারো মুখাপেক্ষি নয়। নিত্য নতুন প্রক্ষেপে, নব আঙ্গিকে স্থানীয় থেকে শুরু করে সার্বজনীন বিষয়ে নব নব ভাষায় কবিতা লিখবার প্রয়াস অবশ্যই কবিতাকে দিচ্ছে নতুন পরিচয়।
কবি মানিক সাহা তাঁর কাব্যগ্রন্থে বেশীর ভাগ কবিতার ক্ষেত্রেই বিষয় নির্বাচনে 'প্রেম'কে বেছে নিলেও তাঁর শব্দ ও ভাষার ব্যবহারে কবিতাগুলিকে অন্য মাত্রা দিতে পেরেছেন। এখানেই তাঁর সার্থকতা। এর আগেও বলেছি বিষয় হিসেবে 'প্রেম' এতটাই ব্যবহৃত যে এই বিষয়ক কবিতা তখনই পাঠককে আকৃষ্ট করে যখন তা নতুনভাবে ধরা দেয়। আর সেরকমটি করতে গেলে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন তা হল শব্দ ব্যবহারের মুনসিয়ানা। কবি মানিক সাহা অত্যন্ত সুচারুভাবে সেটি করতে পেরেছেন বলেই পাঠকের ভাললাগা তৈরী হয় কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে। প্রেম প্রকাশে অনায়াসে কবি বলতে পারেন ' তুমি চুল আঁচড়ে নেবার সময় নক্ষত্র/ সাজিয়ে নিচ্ছ অলঙ্কারে' (পালক) অথবা 'একটি ঝুলবারান্দায় পড়ে থাকা বিকেলের রোদ/তাতে তোমার চুলের গন্ধ লেগে আছে' (ঝুলবারান্দা) বা 'তোমার চলে যাওয়া রাস্তায়/আমি ছায়াগুলি গুছিয়ে রেখেছি...' (মাথুর/প্রেম পদাবলি)। এরকম অজস্র শব্দবন্ধ অবশ্যই প্রেমকে উপস্থাপন করে নতুনভাবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রেমের সাথে বিরহের সম্পর্ক অনেকটা যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মত। বিরহকথাও প্রবল নানা কবিতার পরতে পরতে। প্রেমের আনুসঙ্গিকে যেন হাত ধরেই এসেছে যৌনতা। এখানে একটা কথা পরিষ্কার বোঝা দরকার যে যৌনতা মানে শুধুই শারীরীক মিলন নয়। শারীরীক মিলন যৌনতার একটি অংশ হতে পারে কিন্তু তা সামগ্রিক না। সেই অখন্ড যৌনচেতনাই পরিলক্ষিত কবি মানিক সাহার কবিতাই। 'হিরণ্যগর্ভজাত ধান', 'মেঘের যোনি' চুঁইয়ে নেমে আসা শিশির, দেবদারুপাতার 'মৈথুনের ছবি', 'যৌনগন্ধী মাছ', 'চাঁদ কামড়ে খেতে চাওয়া দুটি ঠোঁট', 'মগ্নতায় ঘোড়া ডাক', 'রমণের ছায়া', 'শঙ্খলাগা প্রেম' ইত্যাদি নানা শব্দে লুকিয়ে থাকা চোরা যৌনতা কবিতাগুলিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে, চিনিয়েছে নতুন দিক, শব্দ ব্যবহারের।
'কবিতা ও কার্তিকের মাঠ', 'প্রেমিক বা দেবতা', 'নির্বাণ', 'চরনদাসের গান', 'আত্মহত্যার পর যা যা লিখব ভেবেছি', 'মেঘ ও মৃত্যু বিষয়ক', 'বীজচোর' এবং 'কবি' ইত্যাদি কবিতায় কবি তাঁর প্রিয় বিষয় ছেড়ে যাত্রা করেছেন অন্য পথে। যে অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে কবিতাগুলি রচিত হয়েছে তাতে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি প্রেমের স্তর উত্তীর্ণ হয়ে কবির নতুন কথা বলার সময় এসেছে। চেতনার এক গভীর স্তর থেকে জীবনকে দেখা হয়েছে এই কবিতাগুলিতে। নিজের ব্যবচ্ছেদ করতে গিয়ে কবি যেন নিজের শরীরটিকেই 'গুপ্তমন্ত্রে' কাঁচ বানিয়েছেন 'কবি' শীর্ষক কবিতাটিতে। শরীর ও মননের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এমন এক মনুষ্যজীবন এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি মানিক সাহা যা যথার্থ অর্থেই 'জীবন'। মৃত্যু চেতনার বেশ কয়েকটি স্তরকে ছুঁতে পেরেছেন তিনি 'আত্মহত্যার পর যা যা লিখব ভেবেছি' এবং 'মেঘ ও মৃত্যু বিষয়ক' কবিতা দুটিতে। মৃত্যু এমন একটি ভাবনা যা সমস্ত ধরণের মানুষকেই ভাবায়। কিন্তু সেই ভাবনা সূক্ষ ও বিরামহীন হয় কবির মনোজগতে। বস্তুতঃ কবির চ্যালেঞ্জ থাকে মৃত্যুর সাথেই যদিও তা অবশ্যম্ভাবী তা জেনেও। কিন্তু মৃত্যুও হেরে যায় কবির কলমের জোরে। কবির মৃত্যু হয় না। নশ্বর শরীর সময়ের আঘাতে জীর্ণ হয়, বিদীর্ণ হয় লুকিয়ে থাকা প্রাণ। থেকে যায় কবির ভাবনা, তার শব্দেরা। এই দুটি ব্যাপারে কবি মানিক সাহা অন্ততঃ এই দুটি কবিতায় সসম্মানে উত্তীর্ণ। উত্তরবঙ্গের প্রকৃতির ও তার সাথে এখানকার লোকেদের একাত্মতার ছবি চলমান 'চরণদাসের গান', 'বীজ চোর', 'গান' ইত্যাদি কবিতায়। সাথে যোগ হয়েছে না পাওয়ার বেদনাও। এই বেদনা বোধ বোধহয় উত্তরের মানুষদের মজ্জাগত দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলস্বরূপ। কবি মানিক সাহা তাঁর অসামান্য দ্যুতিময়তায়ও নিজের শেকড়ের সাথে প্রোথিত আছেন একথা ভাবতেও ভাল লাগে। এখানেই উত্তরণ হয় একজন সত্যিকারের মানুষের, একজন কবির। খন্ড চেতনাকে কবি যখন অখন্ডতার রূপ দেন তখনই সার্থক হয় তাঁর সৃষ্টি। কবি মানিক সাহা ধাবমান যেন সেই লক্ষ্যেই। অপেক্ষায় থাকলাম পরবর্তীতে কবি মানিক সাহা নতুন ভাবনায় ও শব্দচয়নে চমৎকৃত করবেন যেভাবে এই কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় করেছেন।
আপত্তি করছি 'ভূমিকা'র বক্তব্য নিয়ে। কবি নিজে যদি তাঁর কবিতার বিষয় বলে দেন তবে পড়ার মজা ক্ষুণ্ন হয় বলে আমার ধারণা। কবিতা তো পেঁয়াজের মতো। খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে যেমন পেঁয়াজের অভ্যন্তরভাগ পাওয়া যায়, কবিতার নির্যাসটুকুও সেভাবেই পায় পাঠক তার নিজস্ব ভাবনার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে। সাংকেতিকতা যদি কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয় তবে ভূমিকাতে কবি মানিক সাহা কবিতার বিষয়বস্তু বলে দিয়ে কবিতাগুলি পড়বার আমেজ একটু হলেও নষ্ট করেছেন। অবশ্য এটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত।
সুন্দর প্রচ্ছদ, ভাল কাগজ ও ঝকঝকে ছাপা বইটির অন্যতম সম্পদ।
তবে সেরা সম্পদ অবশ্যই চল্লিশটি কবিতা যা মলাটবন্দী হয়েছে বইটিতে।
Wednesday, March 14, 2018
সুনয়না স্বাতী -----
মহুয়া মুখোপাধ্যায়
চোখ নিয়ে যে এতো ভালো ভালো কথা বলা যায় তা অনুশ্রীদির কাছ থেকে শিখতে হয়। চোখ মানুষের অমূল্য সম্পদ। না থাকলে সারা বিশ্বই তার কাছে অন্ধকার। সূর্যের এতো আলো সবই অন্ধদের কাছে অন্ধকার নয়। শুধু আলোর তেজ অনুভব করে মাত্র। অনুশ্রীদির মুখেই সব শোনা।
অনুশ্রীদি অবশ্য অন্ধ নন, হরিণচোখ-ই সুনয়নী, চঞ্চলা হরিণী সুন্দরী। বোঝাই যায়না মাঝবয়েসী, সৌন্দর্যের লালিত্যে।পড়নে রেশমী ঢাকাই শাড়ী, চওড়া লাল পাড়।কাঁধে ঝোলানো রঙীন শান্তিনিকতনী ব্যাগ। কপালে বড়ো লাল টিপ,সিঁথি ভর্তি রাঙা সিঁদুর। হাতে সোনাবাঁধানো শাঁখা,পলা, সোনার বালা,পাঁচ আঙুলে পাঁচ পাঁচটি সোনার আংটি । গলায় সোনার চেনে ঝোলে ল্যামিনেশন করা পরিচয় পত্র। শরীরের প্রতিটি অঙ্গজুড়ে যেন ত্রিশ বছরের যুবতীর ছাপ।
বিশেষ বিশেষ দিনে বর্দ্ধমান থেকে হাওড়া অবধি সুপার এক্সপ্রেস ট্রেনে যাতায়াত তার। ট্রেনের যাত্রীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন অন্ধত্বের যন্ত্রণা। সাহিত্যের ভাষায় বর্ণনা করে বুঝিয়ে দেন চোখ কতো অমূল্য সম্পদ।চোখা চোখা গানের কলিও গেয়ে শোনান সুরেলা কন্ঠে। সুপার ফার্স্ট ট্রেনের যাত্রীরাও মুগ্ধ হয় ওনার আন্তরিক ব্যবহারে। মহিলার বাচনভঙ্গি ও সুরেলা কণ্ঠ মনে নাড়া দেয়।সুযোগ বুঝে ঝোলা থেকে বের করেন বিখ্যাত মিশন মার্কা অন্ধস্কুলের রসিদ।মোটা টাকা সাহায্যের পরিমাণ লিখে ধরিয়ে দেন যাত্রীদের হাতে। সবাই যে যার সাধ্যমত সাহায্য তুলে দেন মহিলার হাতে। ময়ূরীদি দুহাত ভরে টাকা সংগ্রহ করেন।আকর্ষণ বাড়াতে নরম হাত দিয়ে করমর্দন করে ধন্যবাদ জানান।সুপার ফার্স্ট ট্রেনের ৫/৬ টি এ.সি. কামরায় অনুশ্রীদি চালান এই একই কারবার। ব্যবসার টাকা ঢোকে পেটে।
বেশ কিছুদিন খেয়াল করার পরে চোখে পড়ে রুদ্রবাবুর। তাঁর মনে কৌতুহলের পাহাড়-"কে এই ভদ্রমহিলা?কি তার পরিচয়?কিই বা করেন? রুদ্রবাবুর কৌতুহল ক্রমশ বেড়েই চলেছে।মহিলার দৈহিক লালিত্যের টানে নয়।জানার আগ্রহ মাত্র।প্রায় প্রত্যেক রেল স্টেশনের রেলকর্মী,নিত্যযাত্রী, হকার সবাই চেনে অনুশ্রীদিকে।হাস্যলাস্যময়ী,সদা লাপী, অপরূপ সুন্দরী মহিলা ভীষণ রসিকও বটে।ফেরার ট্রেন দেরী করলে জমিয়ে আড্ডা মারেন।রসিয়ে আসর জমান।রসের খই ফোটান।হাসির জলসা বসান।সময় ভালোই কেটে যায়।
রুদ্রবাবু অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। শিক্ষকতা জীবনের অনেক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। অভিজ্ঞতার অনেক বিড়াল তাঁর ঝুলিতে। পরিচয় জমিয়ে ফেলেন ময়ূরীদির সাথে। ঘনিষ্ঠ হতে বেশী সময় লাগেনা। নজর পড়ে অনুশ্রীদির বুকের উপর। রুদ্রবাবু চমকে ওঠেন।অপলক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন বুকের দিকে।আরো কাছাকাছি হন।দৃষ্টি স্থির রাখেন।স্পষ্ট দেখেন আকর্ষণীয় বস্তুটি।বুকে ঝুলন্ত নকল পরিচয়পত্র। বড়ো বড়ো করে তাতে লেখা- স্বাতী মিত্র। বাংলার শিক্ষিকা "নজরুল বালিকা বিদ্যাপীঠ"। রুদ্রবাবুর লেন্সে ধরা পড়ে স্বাতীর আসলরূপ। ভীষণ রেগে ওঠেন রুদ্রবাবু।চীৎকার করে বলে ওঠেন, "শয়তানী, মিথ্যেবাদী, ধাপ্পাবাজ!লোক ঠকানো ব্যবসা চালাচ্ছে অন্ধদের নামে,,,,,,,,
Tuesday, March 13, 2018
আজগুবি আলো
উজান উপাধ্যায়
ঘর গুলো চামচ চামচ মিলনান্তক অস্পষ্ট অসুখ জলে গুলে ধারাবাহিকে মশগুল।
আসন্ন প্রসবা শালিক চড়াই চুম্বনের দাগ
মুছে নেয় গহ্বরের আলতো প্রশ্রয়ে---
এখানে আসন পেতে ধ্যানে ব'সে অসহায় গনিতের ছক।
কাটাকুটি খেলা গিঁটে গিঁটে সংকেত ছড়ায় ।অবিন্যস্ত সম্প্রদান কৌশলে জেনে রাখে স্থানীয় বলয় ।মানুষ হনন আজ লাল শালু মুড়ে রাখা বাসি
পবিত্রতা।
আজগুবি আলো দিয়ে মিথ্যে
উজ্জ্বলতা কৃপণ ছায়ায় দৃশ্যপটে তাজা অন্তরালে।
ভিতরের ঘূর্ণিঝড় সাজানো ছবির আবছায়াবিম্বে রাখে সফল ভড়ং ।
দেহবৃন্তে ঝুলে থাকে ঋজুতার অকাল প্রয়াণ।
কুচক্রী মেঘ ডানা মেলেছে রাস্তায়
রক্ত বৃষ্টি ঝরে পড়ছে অজান্তে
ধর্মবেদী ভিজে যায়
পাড়া মহল্লায় চলে ধর্মের চাষ
আছাড়ি -পাছাড়ি রঙে রঙীন হয় মানব জীবন
ধর্মপুঁথি মুখ বন্ধ করে আছে
ধর্মগুরুর আস্ফালনে কেঁপে ওঠে বাসভূমি!
বিনাশ গাথায় প্লাবিত হয় মানব বসত
মহাকাব্যের বীরগাথা হাহাকারে মগ্ন
কুচক্রী মেঘ কার প্ররোচনায় বজ্রপাত ঘটায় কে জানে
ধর্মবেদী খুঁড়ে দেখি জড়ো হয়ে আছে সভ্যতার গোঙানী
কুচক্রী মেঘ ডানা মেলে পাহারা দিচ্ছে সভ্য মানুষের অসভ্য আচার
সূর্যের ইচ্ছে
শিবু
সারাদিন ধরে পলাশীরে দেখে ঠারে ঠারে
চৈত্রের প্রখর সূর্যেরও ইচ্ছে হয় বসন্তের রঙে
নিজেকে রাঙিয়ে নিয়ে গোধূলিরে করিবে
আলিঙ্গন। বেলা গড়ালে শুরু হয় লকোচুরি
একে একে ঝরে পড়ে বিরহী পাপড়িগুলি।
ক্ষণিকের গোধূলিরে আদরে ডুবিয়ে রেখে
ঠেলে দেয় অন্ধকারে, সূর্যের কি এসে যায় তাতে
বিরহ কাকে বলে সে কী জানে ? গ্রহণও যার
কেড়ে নিতে পারে না আলোর বাহার। ভরসা শুধু
ডুবে যায় কৃষ্ণঅন্ধকারে আলোকবর্ষ দূরে।
Wednesday, March 7, 2018
বসন্ত সংখ্যা
সম্পাদকের কথা
প্রকৃতিতে রঙবাহার। নতুনের আর রঙের মেলায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। দীর্ঘ শীত শেষে দীর্ঘ গ্রীষ্মের আগের এই সময় অনন্য সবসময়ই। নব কিশলয় যেমন ঢেকে দিচ্ছে ঝরা পাতা বৃক্ষকে, তেমনি রঙে ভাসছে শিমুল, পলাশ, মাদার, ছাতিম সকলেই। সৃজনের এই রঙিন সময় যেন দূরে রাখে সকল বৈরিতাকে। ইচ্ছে করে কেবল মেতে উঠতে সুন্দরের আরাধনায়।
কিন্তু সৃজনের, ভালবাসার, প্রেমের, ছন্দের, আলোর সেই বসন্ত আজ কোথায়? যদি শিশুমুখ কোথাও খেলে রক্তহোলি তবে কোথাও ভূপতিত কোন মূর্তি বা গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব বা অনৃত ভাষণ ও কর্ম মনে করায় আমাদের এই বসন্ত আনেনি কোন সুস্থ বার্তা। কুকথা-অকথা, কুকাজ-অকাজ গ্রাস করেছে সৃজনকে, প্রেমকে, ছন্দকে, ভালবাসাকে।
তবুও বসন্তের শুকিয়ে যাওয়া নদীর সামান্য প্রবাহে যেমন থাকে জীবনের কথা, তেমনি আশার আলো নিয়েই চলতে থাকা।
আসবে, সু-বসন্ত আসবে।
নিশ্চয়ই আসবে।
মন্দ মেঘ আর যাই হ'ক ঢাকতে পারে না প্রাণশক্তিতে ভরপুর প্রখর আলোকে।
এই সংখ্যায় লিখেছেন যাঁরা-
এই সংখ্যায় লিখেছেন যাঁরা-
বসন্ত-কবিতা (প্রথম পর্যায়)- তৈমুর খান, শ্যামলী সেনগুপ্ত, বেলা দে, লক্ষ্মী নন্দী, নীপবীথি ভৌমিক, আনিসুর রহমান খান, মন্দিরা ঘোষ, আবদুস সালাম, বর্ণালী সেন ভট্টাচার্য, নরেশ রায়, কণিকা দাস, গায়ত্রী দেবনাথ, অনুরূপা পালচৌধুরী, রাহুল গাঙ্গুলী, সুদীপ ব্যানার্জী, শিবু
বসন্ত-ছন্দ কবিতা/ বসন্ত-ছড়া- সাহানুকা হাসান শিখা, সমীরণ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন সাহা, সঞ্চিতা দাস, মজনু মিয়া, দেবযানী সিনহা, মাম্পি রায়, অঞ্জলী দেনন্দী
বসন্ত-গদ্য- সুবীর সরকার, রূপক স্যান্যাল, মীরা সরকার, মৌসুমী চৌধুরী, দীপশিখা চক্রবর্তী, উজান উপাধ্যায়, সুপর্ণা চৌধুরী, প্রশান্ত কুমার ঘোষ
বসন্ত-ভ্রমণ- কুমকুম ঘোষ
বসন্ত-কোলাজ- নিপা বিশ্বাস দাস
বসন্ত-গল্প- রবীন বসু, সোমা বোস, সপ্তক, পিনাকি, মমিদুল মিঞা
বসন্ত-কবিতা (অন্তিম পর্যায়)- জয়ন্ত চ্যাটার্জী, পিয়াংকী মুখার্জী, নমিতা বসু, সব্যসাচী ঘোষ, দেবারতি চক্রবর্তী, জয়শ্রী চ্যাটার্জী, সুব্রত নন্দী, তৃপ্তি মিত্র, মহাজিস মন্ডল, শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী, সোনালী সিং, শক্তিপ্রসাদ ঘোষ, তাপস দাস, অনিমেষ সরকার, সুপ্রীতি বর্মন, কৌশিক কুমার রায়, সুকন্যা সামন্ত, শৌভিক কার্য্যী, সুপম রায়, আবু আরশাদ আয়ুব, ননীগোপাল সরকার
বসন্ত-ভ্রমণ ছবি- দেবাশিস ঘোষ
প্রচ্ছদ ও বসন্ত-ছবি- শৌভিক রায়
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলঙ্করণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
বসন্ত-কবিতা (প্রথম পর্যায়)
জলেই মুদ্রিত
তৈমুর খান
তৈমুর খান
বৃষ্টির ভেতর ঘুম পায়
কোন্ অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি
একাকী নৈঃশব্দ্যের ডাকে সমস্ত চৈতন্য হারাই
আর ঘুরে ঘুরে আসে সেই মুখ
যে মুখে সহস্র চুমু লেগে আছে
যে মুখ চাঁদের আলোয় ধোয়া
শরীর উজ্জ্বল মাছ
বাঁশিটি কোথায় গেল ?
বাজাতে পারি না, কলমটি নিজেই লিখে চলে
একটি নিজস্ব বাগান এই জলের অতলে
যেখানে পাঠশালার ঘন্টা বাজে
ছুটি হয়
অথবা চেয়ে থাকি সেই অনাবৃত মুখে
চেয়ে থেকে থেকে মুখ পাপড়ি হয়ে যায়
লাল পদ্মের মতো
আরও গভীর জলাশয়
পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেলে সব মুখে সেই মুখ হাসে
সব ছোটবেলা দৌড়ে যায় আমার ছোটবেলায়
তারপর ফুটবল মাঠ, বৃষ্টি আসে, মেঘ হয়
ছোট্ট চায়ের দোকানে বর্ষার জলে ভেজা মাছ
আমাদের গায়ে লেপ্টে থাকে আঁশটে গন্ধ
অস্ফুট ছোঁয়ার
ঘুমের ভেতরে জলের কল্লোল ঢোকে
ভাসায়
এখনও ভাসায় জীবনের নদী
নৌকাও খুঁজি না আর
জ্বর ছেড়ে গেলে, বিহ্বল রাতে ফুটেছে সোহাগ
আত্মকেন্দ্রিক নীরবতা পেয়েছে গভীর চোখ
যে চোখে দেখা যায় নিজেরই মৃত্যু এবং বেঁচে ওঠা
মগ্ন পায়চারি
যত ইচ্ছে হাওয়া ওঠে আজ
জলের ভাষাকে হাওয়া মুদ্রিত করে
সমুদ্রে সমুদ্রে জলাশয়ে লিখে যায় তরঙ্গ পুস্তক
মুদ্রণ প্রমাদ নেই, কণ্ঠরোধ নেই
ট্রাভেলর হারায় না পথ
ঘুরে ঘুরে মুখ আসে, মুখে মুখে নিথর বিশ্বাস
জেগে ওঠে
গাছে গাছে পাতা ঝরে ৠতুও পরিবর্তন চায়
পাথরও গড়িয়ে নামে, পাথরে গড়ায় যুগভার
পাতায় পাতায় নাম লেখা, যদিও অদৃশ্য সব
যদিও ভাবনার কথা, তবু কষ্ট লেগে থাকে তাতে
কষ্ট সব নিরুচ্চার গান
সহমত হবে না যদিও, তবু বিতর্কে যাব না
জলের অতলে ঘুম, ঘুমেও মিশেছে চেতনা
আলোর প্রয়োজন নেই, অন্ধকারে সমস্ত বন্দনা
জল জানে , মেঘের করুণা নয়
করুণায় নয়কো বসবাস —
দীর্ঘ দীর্ঘ সময়ের মুহূর্তগুলি থেকে পাওয়া
কয়েক ঝলক সহবাস
একটি অ-কবিতা
শ্যামলী সেনগুপ্ত
আরেকবার গুলাল
একটা কার্তুজ
সমস্ত অ-শোক
পলাশে পলাশে বর্ণময়
আধ-ফোটা কান্না
সুর পাওয়ার আগেই দুরন্ত ঘোড়ার মতো
ছুটেগেল একবালতি রঙিনের দিকে
আরেকবার গুলাল
একটা কার্তুজ
সমস্ত অ-শোক
পলাশে পলাশে বর্ণময়
আধ-ফোটা কান্না
সুর পাওয়ার আগেই দুরন্ত ঘোড়ার মতো
ছুটেগেল একবালতি রঙিনের দিকে
একটা পিচকারি থেকে
ছিটকে পড়ছে গুলাল
ছিটকে পড়ছে চটচটে গরম শৈশব
আরও রঙিন হচ্ছে পলাশ-অশোকের গুলদস্তা
ছিটকে পড়ছে গুলাল
ছিটকে পড়ছে চটচটে গরম শৈশব
আরও রঙিন হচ্ছে পলাশ-অশোকের গুলদস্তা
মানুষ এখনও আবীর-প্রলাপে----
স্রোত
বেলা দে
বসন্ত তোমার-
বিশুদ্ধ ধমনী রক্ত যৌবন বিভোর
রক্তপলাশ বুকের উষ্ণতায়
সমর্পণের প্লাবন
অবসৃত সত্ত্বায়,
সেদিনের চৈতালি দুপুর
খেলাঘর প্রলোভন, অনুভুতির মদিরা
উপোসী ফল্গুধারায়
অলক্ষে পাতাঝরা শব্দ
তবু, যুবতী প্রেমের শিলালিপি লেখ
বসন্ত দেওয়ালে,
কনক্রিটে যদি ভাঙে ঢেউ ভাঙুক
সৃষ্টি থেকে নিও স্রোত।
বসন্ত না বসন্ত (?)
নীপবীথি ভৌমিক
বসন্ত ভুবন
লক্ষী নন্দী
এখন ঋতু- বসন্ত।
সে-বর্ণে গন্ধে -উন্মীলনে
কোরকে কোরকে
জাগায় সংরাগ।
কখনও অরন্য
সরণির উন্মাদ
স্ফুর্তিতে -
কখনো রোদালা শহরে
উনমোচনে -উৎসবে
ফুটন্ত ফুলের চায়
করস্পর্শ।
অাহরণে-বিহরণে,
কবিদের কুঞ্জনে -বিজনে
গোপনে গোপনে দেয় -
হৃদয়বারতা। কখনও
রোমান্টিক কখনও -
নৃত্যরত উন্মাদ
কখনও - বিরোধাভাসে
বসন্তবিলাপ।
ভালো থাকুক
অাদিম বসন্ত
জীবন্ত হয়ে -
মুকুলে মুকুলে
বৃক্ষদের ডালে ডালে
পাখির ডানায়।
উদ্যানে,ভবনে -
ধ্যানে -মুগ্ধ অনুভবে।
ভালো থাকুক বসন্ত
তৃষ্ণানিবারণী সুধায়।
বসন্ত না বসন্ত (?)
নীপবীথি ভৌমিক
চৈত্রেও
বসন্ত জেনে আমরা ফাল্গুন প্রিয় !
ভাত শুকিয়ে যায় থালায় থালায়। যখন উদর শুকোয় তারও বেশী
থালা
বাজানোর হাহাকারে।
অর্থনীতি উদার জেনেও কিছু দু’পেয়র ঘরে শাকও অভাবী আজ ;
রুটি
আর পাউরুটির ভিতর পার্থক্য করতে না পারা মানুষগুলো
বরাবরই
তাই ডাস্টবিন খোঁজে উদার জোয়ারে ভেসে যাওয়া
দরজায় ।
টুকরো কবিতা
আনিসুর রহমান খান
০১
একটি স্বপ্নের কাছে
একটি গল্পের কাছে
জীবনের বোধ খুঁজে খুঁজে
ব্যকুল তৃষ্ণায় হাঁটি পথ।
০২
ফুল পাখি প্রজাপতি
নিমগ্নতায় লুফে নেয়
নির্মল হাওয়া পৃথিবীর রূপ
এবং কিছু বর্ববর হাতছানি।
০৩
ভূমির পার ভেঙে ভেঙে
ক্রমাগত প্রশস্ত করে
উদাসী নদীর মোহ ভরা বুক
ভূমির এই আজন্ম অসুখ।
০৪
পর্বত ছুঁতে চায় কেবলই আকাশ
আকাশ নিতে চায় মাটির ঘ্রাণ
এই দৈরথের নিবিড় বন্ধনে
আকাশ কেঁদে বৃষ্টি নামায়।
০৫
কেবল পুড়ছে অন্তরীক্ষ চারপাশ
চলছে মননে বিকার
শুদ্ধ চেতনা উড়ে গেছে হাওয়ায়
অপাললিক বোধের স্বীকার।
০৬
পথে -প্রান্তরে পাতকের শানানো চোখ
রিরংসায় ডুব দেয় রমনীর দেহের ভাজে
আগামীর স্বপ্ন নিয়ে তামাশা খেলে
জীবনের স্বর্ণালী সময় ফেলে।
আমার অক্ষরসাজ
মন্দিরা ঘোষ
খুব কাছাকাছি প্রবাহ গুলি বয়ে যায়
মন্দিরা ঘোষ
খুব কাছাকাছি প্রবাহ গুলি বয়ে যায়
শব্দের ভিড় সামলে নীচু হওয়ার ভেতর
সচেতন উপপাদ্য
সীমান্তপথ শুষে নেয় সব বৃষ্টিজল
বিষণ্ণ চুল ছুঁয়ে বিরহী স্বভাব
টের না পাওয়া অগ্নিসুখের রসদে
আরো আরো বর্ণময় পরিবেশন
কোন গভীর ঘুমজীবন থেকে
উঠে আসা আলেয়ার কুয়াশামুখ
ঢেকে দেয় সব অপচয়ের ব্যথাজল
চাঁদের গা থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো বোধজন্ম
স্পন্দনের জীবন্ত সত্ত্বায়
বরফের ভেতর স্পষ্ট রেখাগুলি
আরো ক্ষিদের মত জেগে ওঠে
আগুনআলোয় তোমার একরাশ চুল
ঝাউশাখা মুড়ে রাখে ক্লান্ত কথাভিড়
তোমার মেঘম্লান উদাসীনতায়
ছিঁড়ে পড়ে আমার অক্ষরের সাজ
তোমায় চিনি নি বলে আজ
অন্তরবাসে শুধু পোড়া ছাই
সীমান্তপথ শুষে নেয় সব বৃষ্টিজল
বিষণ্ণ চুল ছুঁয়ে বিরহী স্বভাব
টের না পাওয়া অগ্নিসুখের রসদে
আরো আরো বর্ণময় পরিবেশন
কোন গভীর ঘুমজীবন থেকে
উঠে আসা আলেয়ার কুয়াশামুখ
ঢেকে দেয় সব অপচয়ের ব্যথাজল
চাঁদের গা থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো বোধজন্ম
স্পন্দনের জীবন্ত সত্ত্বায়
বরফের ভেতর স্পষ্ট রেখাগুলি
আরো ক্ষিদের মত জেগে ওঠে
আগুনআলোয় তোমার একরাশ চুল
ঝাউশাখা মুড়ে রাখে ক্লান্ত কথাভিড়
তোমার মেঘম্লান উদাসীনতায়
ছিঁড়ে পড়ে আমার অক্ষরের সাজ
তোমায় চিনি নি বলে আজ
অন্তরবাসে শুধু পোড়া ছাই
বিবর্ণ বর্ণমালা --
আবদুস সালাম
তাকিয়ে দেখি অন্ধকার ডানা মেলে উড়ছে
পোশাক খুলে পড়ছে রাতের
দিব্যি অনাবিল সময় মাতছে অন্ধকারের রঙে
ধেয়ে আসছে পরকাল
পরকালের ভাবনা নিংড়ে ইহকাল মরনাপন্ন
রাতের ভবিষ্যত্ দিচ্ছে মাথা চাড়া
ঘরে ঘরে আজ জন্মদিন পালনের হিড়িক
নিত্য জন্ম নিচ্ছে বেহায়া বাস্তব
বেহায়ার খোলশ মেখে অন্ধকার শুয়ে আছে বিবর্ণ বিছানায়
ফানুস উড়ছে মরা বিবেকের বনে
ডানা ভেঙে গেছে প্রজাপতির
সভ্যতার মান ভাঙাতে ছড়িয়ে দিলাম অন্ধকারের ইস্তাহার
মেলে ধরলাম বিবর্ণ বর্ণমালা
ফাগ
বর্ণালী সেন ভট্টাচার্য
আবীর দিও না মুখে
যদিও নদীর বাঁকে ঢেউ উচাটন
বাতাস কোথাও দেখো
ছুঁয়েছে রোদন।
সুবাস ঢেলো না ফুল
যদিও মনে ও বনে
দ্রিমি দ্রিমি বোল
কোথাও বর্ণহীন
আড়ালে অশ্রু মোছে
বিষাদ আঁচল।
কাকলি নম্র হও
জানি আজ বসন্ত দিন
যে পাখি স্বজনহারা
বেঁচে থাকা অসহন --
বসন্ত মানে আজ
নির্বাক বিরহের দিন।
বিশ্বাস করো
নরেশ রায়
বিশ্বাস করো এই শীতেও
পাতারা আলস্য ত্যাগ ও
জীর্ণ আভরণ ত্যাগ করে
উন্মুখ নবসাজে সজ্জিত
হবার জন্য বসন্তের আমন্ত্রণে ।
আলস্যের আড়মোড়া ভেঙে
পলাশের রঙে রঙিন হয়ে
আম্রমঞ্জরীর গন্ধে মদির
কুহুতানে বসন্তের ভৈরবী তান
আকুলহৃদয়ে তোমারজন্যে বসে আছি পথপানে ।
বসন্ত এসে গেছে । প্রকৃতি জানিয়ে গেল ।
কিশলয়ে পাখির কলতান
আকুল হ'ল মনপ্রাণ ।
ভরাবসন্তে বিরহি যক্ষের ভূমিকায়
অভিনয় কভু নয় কভু নয় কভু নয় ।
বিশ্বাস করো জীবনের
শীত কাটিয়ে আড়মোড়া ভেঙে
বসন্তসংগীতের সরগম সাধনা
তুমি না এলে , সকলি বিফল ।
বিশ্বাস করো বসন্ত এসে গেছে
তুমি তৈরি তো ?
এমন বসন্ত দিনে
কণিকা দাস
পাতাঝরা দিনের শেষে বসন্ত এসে গেছে
বাউলবাঁশির কোকিল কণ্ঠে বাস
ফাগুনে ফাগের রঙে সাজলো নতুন ঢঙে
রাঙিয়ে দিল প্রকৃতির ক্যানভাস।
আজ রঙিন ফুলদলে মালা হবে বলে
আশায় বাঁধে স্বপ্নভরা বুক
এমন বসন্ত বেলায় জড়াবে কার গলায়
যাকে প্রাণ সমর্পিয়াও সুখ।
মহুয়ামাতাল বায়ু বয় মন যে উদাস হয়
চোখেতে নতুন স্বপ্ন জাগে
বধূয়ার সরল হাসি আনন্দ রাশি রাশি
মনেতে রঙের দোলা লাগে।
কণিকা দাস
পাতাঝরা দিনের শেষে বসন্ত এসে গেছে
বাউলবাঁশির কোকিল কণ্ঠে বাস
ফাগুনে ফাগের রঙে সাজলো নতুন ঢঙে
রাঙিয়ে দিল প্রকৃতির ক্যানভাস।
আজ রঙিন ফুলদলে মালা হবে বলে
আশায় বাঁধে স্বপ্নভরা বুক
এমন বসন্ত বেলায় জড়াবে কার গলায়
যাকে প্রাণ সমর্পিয়াও সুখ।
মহুয়ামাতাল বায়ু বয় মন যে উদাস হয়
চোখেতে নতুন স্বপ্ন জাগে
বধূয়ার সরল হাসি আনন্দ রাশি রাশি
মনেতে রঙের দোলা লাগে।
দ্বন্দ
গায়ত্রী দেবনাথ
স্থিতির গতির অনন্ত দ্বন্দে
ঘনসবুজের অরন্যের ঘ্রাণে
অগ্নি কণা জ্বলে
বন্য অন্ধকারে
প্রান্তিক ঊষা
চোখ মেলে
সোনালি নদী তীরে
নিকষ পাহাড় কোলে
বীণার তারে তারে
মীড় তোলে, সুর ছেড়ে
অশ্রু শুকনো কান্না
জয়পরাজয়ের দ্বন্দে
ইথার বর্ণের স্নায়ু থেকে
শব্দশ্রুতিরূপ :
অনুরূপা পালচৌধুরি
রাহুল গাঙ্গুলী
১
বালিশব্দের অবসন্ন গলিতে অনিয়মিত নিষেক
প্রতিনিয়ত নিয়ম ভেজে
আঁচলের এলোমেলো ভাটায়
তোমার কথায় ভরসা পাই না
তাই কাটা ঘুড়িও ঠিকানা হারিয়ে ফেলে
খড়খুটো জ্বেলেও সন্ধান করি পথ
২
তোমার অসুখে দেওয়ালের কান্না পায়
মরুভূমিতে কতখানি ক্যাকটাসের জন্ম হলো?
আর কত চাঁদ অসুখের ঋনে ঋণী
উপসংহারে ওষুধের উপশম
বুকের মাঝে মরিচীকার বাস
অজগরের যৌনতা কেটে নদীর জন্ম দিলাম
৩
হ্যারিকেনের বর্ষায় উন্মাদ পথিক
আগুনের ঘুঙরু খোঁজে
জলসাঘর গলে গেলো : তরলমাটি
জরায়ু তুলসীতে দেখি সূর্যের ঝলসানো ভ্রূণ
ঔরসে ছায়া নামে। শীত করে।শীৎকার দাও
তোমার চুমু তুচ্ছতার মাটি ভেদ করে
দিনের খেলনা ভাঙে। রাত নামে। রাতের উপছায়া
৪
বালিশের হাসি থেকে তোমার আনুবিক ক্ষরণ
প্রত্নতাত্ত্বিক মিশে যায় মাটির সাথে
খুন হলে পদ্মদরজার এপারওপার
বদ্বীপের জৌলুসে সাদা ঝিনুকের মিছিল
গভীরতার জ্যোস্নায় জানালা পুড়িয়ে ব্যাসার্ধ
তুলে নিলে জেসমিন্ নিঃশ্বাস
আলোর বৃষ্টি ভাঙে শিকড়েরো ~ মৃত্যু হয়
পোড়া স্বপ্নে বিদ্যুৎরেখা।কাচ পৃথিবীর দ্রাঘিমাংশ
৫
পাঁপড়ি খুলে দিলে নৌকা পরবর্তী কল্পনা
কল্পনায় ভাসে অফুরন্ত আদরের পরাগরেনু
বুনো গন্ধে ভেঙে যায় বাঘনখের তুমুল আবেদন
চোখের বিস্ফারণে ঘটে যায় প্রদীপ লার্ভাঘাস
পিয়াস সন্ন্যাসী : জলের সাথে সঙ্গম।
কেটে যায় দোষ
গোপনীয়তা খুন :
ছায়াগাছের যৌন সীমানায় অনির্দিষ্ট নোনা সংলাপ
সুপারনোভা
সুদীপ ব্যানার্জী
কতো যে মায়া লেগেছিল ফোলা ঠোঁটে...
আর, কালশিটে পড়া গ্রেটা গার্বো চিবুক!
ছবিরা হাসছেই প্রোফাইলে...হাসুক...
ডোরবেল বাজলে ছুটে আসি রোদ ভেবে...
আর কালপুরুষের পাশে
সূর্য উঠছে আরও বড়...
ওপাশে মৃত মেয়েটা আজও চেনা চেনা লাগে...
এভাবেই ছু্ঁয়ে দেখি তারাদের নামা ওঠা...
কিছু উশখুশ নিশানার তাগিদে...
বেহিসেবী ফাগুন
শিবু
পুরানো সময় ভেঙে সে সাজিয়েছে বীজতলা
পুরাতনী দেওয়ালে রোপণ করেছে নতুন বীজ
ডানা গোটাবে বলেই না তার এত কথা বলা।
ছায়াটানা বসন্তরোদ শরীর বিছিয়ে দিলে
সব শীত সরিয়ে চুমু খাই উঠন্ত বহ্নি
নতুন করে ভালোবাসি দখিনা বাতাস
কান পেতে শুনি শুকনো পাতার দাউদাউ ধ্বনি।
তবুও গরমিল থাকে দেনা পাওনাতে। সবশেষে
শিশির ভুলে বউল গেয়ে ওঠে ফাগুন অভ্যেসে।
বসন্ত-ছন্দ কবিতা/ বসন্ত-ছড়া
বাসন্তী উপাখ্যান
সাহানুকা হাসান শিখা
বসন্ত আজ এলো দ্বারে,
কোকিল ডাকে মধুর স্বরে।
পলাশ,শিমুল , কৃষ্ণচূড়া,
বনে বনে যায় ঝরে।
ডাগর চোখে কাজল পরা!!
ঠোঁটের কোনে হাসির ছোঁয়া।
ভ্রমরের ডাকে দেয় সে সাড়া,
হৃদয় মাঝে প্রেমের মায়া।
বাসন্তী রং শাড়ীর ভাঁজে,
আঁকা প্রেমের আল্পনা
গাঁদা ফুলটি খোঁপায় দিয়ে,
হয়ে আছি আনমনা।
দক্ষিণা হাওয়া মন ভোলা,
নাচের তালে দেয় দোলা।
আলতা পায়ে পথচলা,
আগুনঝরা ফাগুনের মেলা।
ঋতুরাজ
সমীরণ চক্রবর্ত্তী
আগুন লেগেছে আজ
পলাশের বনে,
মনে জাগে শিহরণ
কোকিলের তানে।
কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে
ফাগুনের সাজ,
ফাগ মেখে লাল হোলো
বসন্ত রাজ।
দোলা লাগে গাছে গাছে
শিহরণ ডালে,
বসন্ত এসে গেছে
ধরণীর কোলে।
কিশলয় গাছে গাছে
সবুজে সবুজ,
মন আজ পুলকিত
রঙিন, অবুঝ ।।
তোমার আগমন
ম হা জী ব ন
ভেসে বেড়ানো অক্ষর গুলো শব্দ হতে চেয়েছিলো,
আনন্দের এই বসন্তে পর্ণমোচীর শাখাগুলি দাবী রেখেছিলো
তোমার-আমার কাছে প্রাণ খোলা প্রশ্বাসের।
বসন্তবিলাপের আর্তি নিয়ে মেরুদণ্ডহীন দেহগুলি,
এযাবৎকাল যারা দারিদ্রতার চরমতায় পৌঁছেছে,
শ্মশানআলোয় জ্বলে উঠে মৃত্যুভয়কে তারাই পরাভূত করেছিলো।
বিলীন
সে দিন আকাশে
উড়ছিল স্মৃতিভরা মেঘ
রাধিকাপুরের বালা
ফুটেছিল লাল পলাশ,শিমূল
গোবিন্দপুরের কালা
উঠেছিল যমুনায় জোয়ার
স্রোতে ছিল বয়সের দোষ
বেঁজে ছিল বাঁশি
ধরে ছিল আগুন
রাধিকার বুকে ফাগুন
বাতাসে ছিল আবীরের
ঘ্রাণ
কালার আকাশ ভরা তারা
পালতোলা আকাশে
রাধিকার ডুব
অবশ বাতাস দরিয়ে দেখে
চারদিক নিশ্চুপ।
আজ বসন্ত
তাপস দাস
চুম্বনে ঘন রাত
আমিই ধোঁয়া - ধুলো সম্রাট
ফিরেছি...
বুকে টেবিল পেতে বসেছে ফুল লাল লাল
মদে মৌমাছি চোখের সকাল
পলাশ দেয়াল...
সমীরণ চক্রবর্ত্তী
আগুন লেগেছে আজ
পলাশের বনে,
মনে জাগে শিহরণ
কোকিলের তানে।
কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে
ফাগুনের সাজ,
ফাগ মেখে লাল হোলো
বসন্ত রাজ।
দোলা লাগে গাছে গাছে
শিহরণ ডালে,
বসন্ত এসে গেছে
ধরণীর কোলে।
কিশলয় গাছে গাছে
সবুজে সবুজ,
মন আজ পুলকিত
রঙিন, অবুঝ ।।
ভাষার জন্য
চিত্তরঞ্জন সাহা
চিত্তরঞ্জন সাহা
বাংলা ভাষার জন্য সেদিন
উঠলো তুমুল ঝড়
ঝড়ের জোরে পশ্চিমাদের
ঘর হলো নড়বড়।
উঠলো তুমুল ঝড়
ঝড়ের জোরে পশ্চিমাদের
ঘর হলো নড়বড়।
উর্দু হবে রাষ্ট্র ভাষা
কেউ কখন মানে,
খবরখানা সারা দেশে
ছড়ায় কানে কানে।
কেউ কখন মানে,
খবরখানা সারা দেশে
ছড়ায় কানে কানে।
ক্ষেপলো মানুষ রাজপথে তাই
রক্ত তাদের ফোটে,
দলে দলে প্রাণের টানে
মিছিলে সব ছোটে।
রক্ত তাদের ফোটে,
দলে দলে প্রাণের টানে
মিছিলে সব ছোটে।
পিচঢালা পথ রক্তে ভাসে
দামাল ছেলের কত লাশে
তাও থামেনি তারা,
বাংলা ভাষা আনলো সেদিন
রক্ত পলাশ যারা।
দামাল ছেলের কত লাশে
তাও থামেনি তারা,
বাংলা ভাষা আনলো সেদিন
রক্ত পলাশ যারা।
সেদিন থেকে শহীদ মিনার
সাজাই ফুলে ফুলে,
বীর সেনানীর ত্যাগের কথা
যাইনি আজও ভুলে।
সাজাই ফুলে ফুলে,
বীর সেনানীর ত্যাগের কথা
যাইনি আজও ভুলে।
ফাগুনে অাগুন ছড়ায়
আবাহন
সঞ্চিতা দাস
ধরণীর মাঝে এসেছ আজিকে
সজ্জা নিয়েছ ফুলে ফলে,
প্রেমের বারতা দিয়েছ
সবারে
তোমার নানান কৌশলে ।
দখিনা বাতাস সাথে আনিয়াছ
উড়ায়ে দিয়েছ উত্তরী,
শাখা-প্রশাখায় ভরে গেছে পাতা
সুগন্ধ ফুলে কস্তুরী ।
তোমার ছোঁয়ায় ধরিত্রী হয়েছে
রঙে রঙে আজ রঞ্জিত-
বিগত আগত নব বসন্ত
করেছে সবই সঞ্চিত ।
দিন কেটে যায় শয়নে স্বপনে
কুহুর তানেতে আছি বিভোর,
আকাশে বাতাসে ছড়িয়েছে রং
দুয়ার প্রান্তে নতুন ভোর ।
তোমার আগমন
মজনু মিয়া
তোমার আগমন টের পাইয়ে দিচ্ছে
শিমূল পলাশ বাহারী ফুল;
মাতাল হাওয়া ফুরফরে মেজাজ আর
অজানা সুন্দর সুন্দর ভুল।
মিষ্টি পরিবেশ কুহু কেকার ডাক
কোকিলের মধুর মধুর গান,
সবুজ প্রকৃতি তরতাজা ডগা
মৃত প্রায় গাছে সজীব প্রাণ।
হৃদয় বটমূলে প্রাণের রাখাল
বাজাচ্ছে তার সু-বাশুরী;
ক্ষণে বাজে তালে ক্ষণে বে-তাল
কি যেন্ টানে মন হয় চোরি।
বাহারী পশরা তার সাজে জীবন
বদলে যৌবন প্রাণবন্ত,
পদে পদে খোঁজে ফিরছে
চঞ্চল সে ফাগুন বসন্ত।
ফাগুন বেলা
দেবযানী সিনহা
বসন্ত আহ্বানে আবর্তীত আনন্দ মম,
বনানীর বাঘনখ অগ্নিশিখা রূপ দাবানল সম।
হাসনুহানা জুই চামেলি মাদার শিমূলে,
ভ্রমর প্রেমিক মাতোয়ারা ভাঁটফুলে।
নাগকেশর সুগন্ধ আতর মেখেছে,
পয়সাফুল সাদা গোলাপি নীল রঙে সেজেছে।
চির সবুজ মনপাতা স্নিগ্ধ চাঁপা হলুদ সোনালী,
শুভ্র থোকায়থোকায় সাজানো লতানো বেলী।
পাতাহীন আমরাডালে বসন্ত বৌউরি,
পরেছে লাল সিঁদুর কলাপাতা রঙের শাড়ি।
মর্মর সরগম ঔ জলশূন্য পাতার আওয়াজ,
কৃষ্ণচূড়ার রূপসাগরে ভাসছে ঋতুরাজ।
রঙে রঙে ফাগুন খুশিতে রঙিন আনন্দ ভাবনা,
ভালোবেসে কাঞ্চন খোঁজে ঘন লালচে বেগুনি ঠিকানা।
কালো গড়ন লুকিয়ে কত রাখবে,
কন্ঠের কুহুধ্বনি সুর সাধনায় জাগবে।
ঝরাপাতা সঙ্গীহারা দুরন্ত বাতাসে,
ফাল্গুনী মন ধায় চৈত্রের উচ্ছাসে।
দেবযানী সিনহা
বসন্ত আহ্বানে আবর্তীত আনন্দ মম,
বনানীর বাঘনখ অগ্নিশিখা রূপ দাবানল সম।
হাসনুহানা জুই চামেলি মাদার শিমূলে,
ভ্রমর প্রেমিক মাতোয়ারা ভাঁটফুলে।
নাগকেশর সুগন্ধ আতর মেখেছে,
পয়সাফুল সাদা গোলাপি নীল রঙে সেজেছে।
চির সবুজ মনপাতা স্নিগ্ধ চাঁপা হলুদ সোনালী,
শুভ্র থোকায়থোকায় সাজানো লতানো বেলী।
পাতাহীন আমরাডালে বসন্ত বৌউরি,
পরেছে লাল সিঁদুর কলাপাতা রঙের শাড়ি।
মর্মর সরগম ঔ জলশূন্য পাতার আওয়াজ,
কৃষ্ণচূড়ার রূপসাগরে ভাসছে ঋতুরাজ।
রঙে রঙে ফাগুন খুশিতে রঙিন আনন্দ ভাবনা,
ভালোবেসে কাঞ্চন খোঁজে ঘন লালচে বেগুনি ঠিকানা।
কালো গড়ন লুকিয়ে কত রাখবে,
কন্ঠের কুহুধ্বনি সুর সাধনায় জাগবে।
ঝরাপাতা সঙ্গীহারা দুরন্ত বাতাসে,
ফাল্গুনী মন ধায় চৈত্রের উচ্ছাসে।
ফাগুন
মাম্পি রায়
পলাশীরবন লাল টুকটুক,
আভাস এল সবে,
বসন্তদূত কুহেলিকার
কুহু_কুহু রবে।।
আভার লালি পড়ছে ঝড়ে,
ফাগুর তালে তালে;
রাগ, অভিমান, ঝগড়াঝাটি,
আবালবৃদ্ধ, বাঙাল _ ঘটি; রামধনু রং গায়ে মেখে ;
মাতল ভূবন মাদলা সুরে।।
পলাশবনের রাঙা পলাশ,
শালপিয়ালের মৌ,
আবিরখেলা, পিচকারী আর,
নানান রঙের ঢেউ।।
ফাল্গুন
অঞ্জলি দেনন্দী
ফাল্গুন। ফাগুন। ......
এনেছে হৃদয়ে, প্রেমের আগুন।
বসন্ত।
ভালোবাসায়, সে, অনন্ত........
সে প্রকৃতিরে কয়,
"প্রতি মনের কোণেকোণে জাগুন!
হৃদস্পন্দন যে বর্ধিত হয়!"
কোকিলের আহ্বান।
গাওয়া মিলনের গান।
আম-মুকুলের মৃদু-ঘ্রাণ!
অলির হিয়ায় দেয় টান।
আকুল হয় তার প্রাণ।
ব্যকুল-কলির ভরে কান।
তার গুনগুন গান।
আমার জীবন তো চিরফাল্গুনী!
আমার অন্তর তো, প্রেমদহনের অনন্ত আগুনই!
বসন্ত-গদ্য
সু বী
র স
র কা
র
ক।
ধারাবাহিকতা থাকে
না। ধারাবাহিক
হয়ে উঠবার
তীব্র আর্তিতে
ধারাবাহিকতার ধারাবর্ণনার
মধ্য দিয়ে
একধরণের ধারাবাহিকতাই
হয়তো এসে
যায়। ঝাঁপসা
সব গোলোকধাঁধার
বৃত্তায়নে কবেকার
এক কাঠপুল
আর পুল
থেকে নেমে
এসে হাটগঞ্জের
ভিতর যাওয়া।
ধুলো ওঠার
ব্যঞ্জনাময়তায় আটকে
থাকা বিষণ্ণ
বিবর্ণ ইটচাপা
ঘাসের মায়াবন
থেকে ভেসে
আসে
মোরগলড়াই পর্ব।
এইসব ঘটনাক্রম
থেকে জটজটিল
ধাঁধার মতো
এক পৃথিবী
আবহমানের কালখণ্ড
হয়ে জেগে
উঠতে থাকে।
মোরগলড়াই শেষ
হয় তবে
মোরগডাক থামে
না। হাটের
বিস্তার পেরিয়েও
বিস্তারময়তার অচেনা
কুয়াশাঘোরে বহু
দূর থেকে
দূরাগত হাওয়ার
অনন্য নকসার
সাজে সেজে
ওঠে সবকিছু।
ডুবে যাওয়ার
অবকাশটুকুও দেয়
না,কেবল
জলজলায় কোরাসের
অনবদ্যতায় সন্ধেগুলি
রাত্রিগুলি ভোরগুলি
হাতড়ে হাতড়ে
তুলে আনতে
চাওয়া ব্যাঁকুল
সব পুঁথিপত্র,কথকথা।
কথকথাগুলি তুলোবীজ
ফেটে উড়তে
থাকে আকাশময়।
আঞ্চলিক ইতিহাসের
অনুসন্ধান করতে
গিয়ে ধানমাঠ
এলুয়া কাশিয়ার
ফুল লোকগাথার
পুতুল ভগ্নসব
হর্ম্য অট্টালিকা
দালানকোঠার বহুস্বরিক
এক ভুবনায়ন
বর্ণময় হাটগঞ্জকোরাসের
উষ্ণতর উত্তাপের
ওম পোহাতে
পোহাতে বসন্ত
মালির ঢোল
ও বাঁশিতে
ঢেউ তুলতে
থাকে।এইভাবে গানসমগ্রের
মধ্যে এসে
দাঁড়াতে হয়।
পথঘাট জুড়ে
অনন্যতার ধুলো
ওড়ে। ধুলোতে
ঢেকে যাওয়া
স্মৃতিসকল ধুলো
ঝাড়তে ঝাড়তে
অংশত দৃশ্যমানতা
অর্জন করতেই
কৌম সমাজের
যৌথতার লীনতাপটুকু
অন্তত টের
পাওয়া যায়।
রাতের পাখিরা
ডেকে ওঠে
বন্ধ চোখের
ভিতর। বাঁশবনে
সংখ্যাতীত জোনাক
জ্বলে। মোমবাতি
জ্বেলে কারা
যেন খুলে
বসে কবেকার
সব ধারাবাহিকতা
হারিয়ে বসা
মেঘনদীবাজনার গান।
খ।
হেরম্ব হেঁটে
যাচ্ছে শূণ্য
সব মাঠপ্রান্তরের
মধ্য দিয়ে।
হেঁটে যাওয়াটা
তার নেশা,জীবনের
সাথে তীব্র
জড়িয়ে থাকা;
যেন অন্তহীন
এক ভবিতব্য।
হেরম্বর ঝাঁকড়া
চুল সুপারিগাছের
মতো পেশীবহুল
নির্মেদ শরীর।
ধারালো বল্লমচোখ।
মঙ্গোলয়েড মুখ।
দু’চোখে
ঢের মগ্নতা
আপাতবিষাদছোঁয়ানো। হেরম্ব
হেঁটে যেতে
থাকে মাইলের
পর মাইল
হেলাপাকড়ি বাঁকালী
রামসাই জোড়পাকড়ি
ভোটবাড়ি রাজারহাট
চূড়াভাণ্ডার পদমতীর
চর বরুয়াপাড়া
জল্পেশ ছুঁয়ে
ছুঁয়ে ধানপাটতামাকের
অত্যাশ্চর্য জনপদগুলির
মধ্য দিয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে
ধরলা জর্দা
বালাসন সানিয়াজান
এইসব আঞ্চলিক
নদীর জলে
নেমে পড়ে
সাঁতার কাটে,
আবার কখনো
ঘোড়াহাগা বিলে
দু’দন্ড
নিজের মুখ
দেখে আবারো
হাঁটতে থাকে
হাওড় বিল
কুড়া দহের
দিকে। হাঁটাই
হেরম্বের নিয়তি,যেন
নিশিডাক। হাঁটা
শেষ হয়
না তবে
একসময় হাঁটাটাই
যেন এসে
ঢোকে বিষহরা
গানের আসর
জল্পেশ মেলা
কিংবা ভান্ডানী
ঠাকুরের থানে।
এইভাবে উত্তরের
এক ভূমিপুত্র
শ্রী হেরম্বচন্দ্র
বর্মন তার
আত্মপরিচয় ও
উৎস খুঁজতে
শুরু করে
একধরণের ঘুমঘোরের
বাধ্যবাধকতাহীন অনিবার্যতায়।
তখন পাটখেত
গমখেতে বৃষ্টির
জমা জলে
কিলবিল করে
হেলেসাপ জলঢোড়া
সোনাব্যাঙ কোলাব্যাঙ
আর লোকজসুরের
বহতায় বেজে
ওঠে আদিঅন্তহীন
সব গান।
তিস্তাপাড়ের গ্রামে
গ্রামে তিস্তার
চরে চরে
সারাটা বৈশাখ
মাস জুড়ে
তিস্তাবুড়ির গান
জাগে,মেচেনী
খেলায় মেতে
ওঠে মেয়ে
বউয়ের দল।
অলংকৃত ছাতা
মঙ্গলকলস দলবদ্ধ
নাচের মোহগ্রস্থতায়
সীমাহীনতায় হাই
তুলতে তুলতে
এগিয়ে আসে
নদীজলবাহিত চিরায়ত
কুয়াশার দলাপাকানো
শূণ্যতারা। এতকিছু
ঘটে যায়
হেরম্বের আপাত
নিরীহ পদযাত্রার
প্রায় পুরোটা
জুড়েই।
গ।
হাট বসে
হাটের মতো।
হাটের পরিসর
এসে, স্পর্শ
করে মন্দির,বৃহৎ
জলাশয়। হাতের
মধ্য দিয়ে
মেচেনী খেলতে
যায় মেচেনী
দল। ঢাক
বাজে। মুখাবাঁশি।
সানাই। হাটের
নিজস্বতায় মিশে
যেতে থাকে
লোকবাজনার সমগ্রটুকু।
এতসবের যথাযথ
হেরম্ব এসে
পড়ে। দু’দশ
বিশ পঞ্চাশ
হাটগঞ্জ ঘোরা
হেরম্ব হাটের
রকমফের ও
বদলটুকু অনেক
অনেক আগে
কিছু কিছু
হাটে সে
দেখেছিল কোচবিহারের
মহারাজার শিকারযাত্রার
মিছিল, কামতাপুরের
জুলুস, রাণী
অশ্রুমতীর জলসত্র
উদ্বোধন, নুরুদ্দিন
জোতদারের সফেদ
হাতি, ঝামপুরা
কুশানীর কুশাণযাত্রা
আরো আরো
অনেক কিছু।
আবার হেরম্বের
সাথে জলধোয়া
বসুনিয়ার প্রথম
দেখাসাক্ষাত এরকমই
কোন হাটে।
হাটের খন্ড
অনুখন্ড উপখন্ড
জুড়ে কতরকমের
মানুষজন কথাবার্তা
খোসপাঁচালি। হাটের
নিজস্ব ভাষায়
হাট কথা
বলে যায়।
কথাবার্তার সূত্র
ধরে না
দিলেও কথাবার্তা
গড়াতে থাকে
যেভাবে রাত
গড়ায়। সকালের
হাট বিকেলের
হাট সন্ধ্যের
হাট সব
ছাপিয়ে মুখ্য
হয়ে ওঠে
ভাঙা হাট।
হাট ভাঙার
অবসরে কূপির
ছড়ানো ছড়ানো
খন্ড আলোর
দোলাচলে হেরম্বর
মনে পড়ে
জলধোয়া বসুনিয়ার
গরুর গাড়িতে
চড়ে আরো
আরো পাইকার
ব্যাপারীর সাথে
ভাঙা হাটের
ধুলো ও
বিষাদ মেখে
গন্তব্যহীন কোন
গন্তব্যের দিকে
চলে যাওয়া।
হেরম্ব বসে
থাকে না;
দাঁড়িয়েও ন।
আসলে থিতু
হতে না
পারবার অনাবশ্যকতায়
সমগ্র অস্তিত্ব
দিয়ে শরীরময়
শ্যাওলার বহুবর্ণতা
নিয়ে আবহমান
জীবনের দিকে
পা বাড়ায়
হেরম্ব। তখন
তার কোন
অতীত বর্তমান
থাকে না,
ভাবনাস্রোত লুপ্ত
হয়ে যায়।
হাটের চারপাশে
ধানমাঠসরসেবাগিচা পুকুরদহ
সবই গ্রাস
করতে এগিয়ে
আসে গাঢ়
এক অন্ধকার,
যা চিরায়ত।
হাট থাকে
হাটের মতো।
হাটের গভীর
থেকে গহন
এক হাটই
যেন উঠে
আসে।
ঘ।
হেরম্ব হেঁটে যায়।কান্নার পর কান্না পেরিয়ে শীত বর্ষা বজ্র ঝড় সবকিছু সঙ্গে
নিয়ে মাইলের পর মাইল।যাত্রাকালীন সময়পর্বে কত কত লোকমানুষের সঙ্গে তার দেখা
হয়।দেখা হওয়াটা বড় নয়।দেখা তো হতেই পারে।দেখা হওয়ার মধ্যে আবশ্যিক সুত্রসংযোগ
অতিজরুরী ভাষ্যপাঠের মতো সংগত হয়ে উঠতে থাকে।একেক হাট থেকে গোলকধাঁধার বৃত্তায়ন
ভেঙে ভেঙে বিচিত্রতর সব হাট হেরম্বর উল্লম্ফন ধ্বনিপ্রতিধ্বনির চিরন্তনতার মতো ঘোর
তৈরী করে।জলধোয়া বসুনিয়া আব্রাহাম মিনজ অথবা মেচেনীবুড়ি বুধেশ্বরীর উষ্ণতায়
আন্তরিক হয়ে উঠতে থাকবার এক রসায়নে নদীমাঠ প্রান্তর গঞ্জহাট টাট্টুঘোড়া গরুর গাড়ির
হ্যাঁচোর প্যাঁচোড় সমস্ত আবডাল টপকে পুনরাবৃত্তির মধ্যে ডুবে যেতে চায়
বারংবার।হেরম্ব হাঁটতে থাকে,সর্বঅঙ্গে মাখতে চায় কেবল জীবন আর জীবন।নদীর শুকনো
খাতে ভাবনাকাশিয়ার বনের মধ্যে মানুষের পায়ে পায়ে জেগে ওঠা নতুন নতুন সব পথ ধরে ধরে
তার হেঁটে যাওয়া অন্তহীন ও অতিজীবন্ত ছবির মতো আবশ্যিক হয়ে ওঠে।আবশ্যিকতার বাঁকানো
অংশগুলিতে কুশাণ পালার মেয়েরা কখনো নেচে ওঠে গানের সুরে সুরে।নদীর কিংবা নদীখাতের
খুব গোপনতা থেকে দোতারা বাঁশিও বেজে উঠতে পারে।বেজে ওঠার সাবালকত্বের জন্য অপেক্ষা
না করে হেরম্ব এগিয়ে যেতে থাকে হাঁটাপথে।জলধোয়া বসুনিয়ার সখ্যতাকে অস্বীকার করা
যায়;উপস্থিতিকেও।এইমতন ভাবনাকে প্রামাণ্যতার সহজিয়ায় ভাসিয়ে দেবার সুযোগ কখনো
আসলেও সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করবার আগ্রহকে সামগ্রিক এক জলবর্ষায় মিশিয়ে দিতে চাইবার
প্রাণপন আকুতিটুকু বুকের খুব নিজস্ব নিভৃতিতে ক্রমাগত আগলে রাখতে চায়
হেরম্ব।আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে রহস্যময় জীবনকথার জালে প্রবেশ করতে গিয়ে সে কিন্তু
তার সততাটুকু হারায় না।হেরম্ব হেঁটে যায় অতিবিরল এক দৃশ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে।
ঙ।
জেগে থাকা হাটগুলি নদীনালার কোলে।হাট ঘুমোয় না।হাটতলা শান্ত হয় তবে ঘুমোয়
না।না ঘুমোবার তত্ত্বতালাস দু’একটা বেড়াল কুকুর গরু ছাগলের সযত্ন রচিত
বিশ্রামাগারে পরিণত হয়ে উঠতে পারে।তখন হাটতলায় বেড়াতে বেরোয় মহাকালের ষাড়।বাইসনের
মতো বাঁকানো শিং-এর গাম্ভীর্যতায় মহামহীম দৃশ্যের মতো দৃশ্যান্তর যেন।শাকের আঁটি
বিক্রি করতে আসা ধনবালা বর্মন,খইচালু দাস বিভ্রম ভেঙে দৌড়তে পুনর্বার বিভ্রমেই
ফিরে আসে তারা।হাট ঘুমোয় না,তবে আড়মোড়া ভাঙ্গে,পাশ ফিরে শুয়েও পড়তে পারে
খানিকক্ষন।মাইক বাজিয়ে জড়িবুটির কবিরাজি ঔষধ বিক্রি করতে থাকে নিয়ামত
কবিরাজ।কবিরাজের কিসসাকথন থামতে না চাওয়া ফুরোতে না চাওয়া গল্পগুলিকে প্রসারিত করে
পল্লবিত করে।কবিরাজের গলার শিরা ফুলে ওঠে, কাঁপুনি কম্পন এসে যায় খানিকটা।তার
শাকরেদরা চা খায়,ঢোল বাজায়,জমায়েতকে সংগঠিত হতে দেবার সুযোগ দেয়।হাট ঘুমোয় না,হাটে
হাটে গড়াতে থাকে দাঁতব্যথার ঔষধ যৌবনবর্ধক টনিক বাতব্যাধির মালিশমলম।জমায়েত
হাসে।হাসিরলহর ওঠে।যেন ধানখেতে হলখল,বাতাসফেরি।জমায়েত শুনতে থাকে মিঞা-বিবির
কিসসা,আলাদিন দেউনিয়ার চার নম্বর বিবির নিশিযাপন বৃত্তান্ত,চোরচুরনীর গান আরো আরো
কত কি।হাটের মূল অংশ বলে তো কিছু নেই,গলি তস্য গলি গলিপথের যোগবিয়োগ প্রশাখার মতোন
ছড়ানো অংশগুলির অধঃক্ষেপ জড়ো হতে হতে একসময় হাট মূলগত ঐক্যের রূপধারণ করে।তখন কালো
কালো মাথার জনসমাবেশ থেকে বোঝাই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে যে কোনটা হাটমুখি আর কোনটাই বা
হাটফেরত।কৌতুকপ্রবণ এক সমাবেশ থেকে প্রবেশ প্রস্থানের লোকপুরাণের মাথা তুলে
দাঁড়ানো।লোকপুরাণ কী তবে অনিবার্য অংশ রূপে হাটকে স্বীকৃতি দেয় নাকি স্বীকৃতির অপেক্ষায়
না থেকে হাটই হাটপুরাণে রূপান্তরিত হয়ে লোকপুরাণের অভিনব ভাষ্য রচনা করে।
চ।
এইভাবে জঙ্গলঘেরা এক জনপদের ভিতর এসে পরে হেরম্ব।ভয়াবহ সব জঙ্গল।দূরে দূরে
ভূটান পাহাড়ের দৃশ্যঘের। জঙ্গল সন্নিহিত অনেক অনেক জলাভূমি।বড় বড় মহিষের পাল শরীর
ডুবিয়ে বসে থাকে।এসব জঙ্গলের অনেকটাই কোচবিহারের রাজাদের রিজার্ভ ফরেষ্ট ছিল, একদা
স্বাধীন পরে করদ মিত্র রাজ্য।রাজা মহারাজা জমিদার ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা শিকার
খেলতেন।বাঘ বাইসন হরিণ শুকর মারতেন।আগুন জ্বালিয়ে বিদেশী মদের গ্লাসের সহযোগে
‘ক্যাম্প ফায়ার’ হত।শিকারের হাঁকোয়ালী করানো হত স্থানীয় গ্রামবাসীদের দিয়ে।হেরম্বর
স্মৃতিতে আছে এক রাজার শিকারযাত্রার বর্ণময় দৃশ্য।কাছেই ছিল রাজার
দীঘি।শুটিংক্যাম্প।সাহেবপোতা।
চিলারাজা বা নলরাজার গড়।মহারাজার শিকারতাঁবু পড়তো শুটিং ক্যাম্পে।রাজারদিঘিতে
স্নান সারতো রাজাবাবুর যত হাতি ও ঘোড়াদল।কোচবিহার রাজবাড়িও হেরম্বর দেখা।সে এক
আলোয় আলোয় আতসবাজিতে জেগে থাকা রাজনগর।উৎসবমুখর।
রাজাবাহাদুরের ছোটবোনের বিয়ে বলে কথা।সেই পাঁচশো বৎসরের জৌলুসময় রাজতন্ত্র আর
নেই।রাজরাজেরাও কবে উধাও।হেরম্ব কি সামান্য স্মৃতিকাতরতা টের পায়!স্মৃতিকাতর হয়ে
পড়বার জন্য
বিশেষ কোন আন্তরিকতা আছে বলে মনে হয় না।তবু জীবন্ত,মৃত,
অতিজীবিত স্মৃতিসমগ্রতা বিস্তৃত এক স্মৃতিখন্ডে হাত বোলাতে থাকে
সদাতৎপরতায়।হেরম্ব তার সুপারীগাছের মতো মেদহীন সতেজ শরীর নিয়ে স্মৃতিকাতরতার এ
এমনই সংযোগসমাধানসূত্রহীন জটিলতাময়তা যার কোন প্রতিশব্দ হয় না; আর খেই হারানো
মানুষের স্মৃতিমুখরতার আশ্রয়ের নিবিড় নৈকট্যে হেরম্বচন্দ্র তার
ভবিষ্যতকে বুঝি ভবিষ্যতহীনতায় যুক্ত করে দেয়।
ছ।
হাট আবহমানের। হাট চিরন্তন। হাটের কোলাহল থেকে সরে এসে হেরম্ব নেমে যাচ্ছে মাঠঘাটের ভিতর।দোলাজমি অতিক্রম করছে সে।অতিক্রমণের নির্দিষ্ট কোন মাপকাঠি না থাকলেও দ্রুতগামী হবার সমূহতর সম্ভাবনা হেরম্বকে তাড়িত করে।একা হতে হতে একসময় সে একাকীত্ব সংশয় ঝড়জল ও ঘামের নোলকঝোলানো মদিরতায় মেদুর সত্যকথনের পাশে গলা ঝাড়ে।ফাঁকা ফাঁকা পাথারবাড়ির পথ ভাঙতে ভাঙতে কাশিয়াঝোপ ভাবনাবন আল আলি গলিপথ সরাতে সরাতে একসময় জাতীয় সড়কের মসৃণ ঝকঝকে পিচপথে উঠে পড়ে।এইভাবে ঘটনার কালপরিসীমা দ্রুততায় অতিক্রম করতে করতে হেরম্ব হাওয়ার বিরুদ্ধে নিজস্ব এক শোকসংগীত রচনা করতে চায়।যদিও জলাভূমির আবেষ্টনী তাকে আটকে রাখতে চায়।অথচ অবিচল নির্বীকার হেরম্ব জলাভূমির পাশে পাশে,একদা মহিষেরা গা ডুবিয়ে থাকতো যেখানে আশ্চর্যতায় হেঁটে যেতে থাকে।হাটপর্ব অতিক্রান্ত না হলেও আগামীর কোন আসন্ন ঝড়জলক্লান্ত হাটের অভিমুখেই হয়তো অনির্দিষ্ট এই যাত্রাপথ।পথ পথের মতো,পথের টানেই এগিয়ে যাওয়া।সাবলীল হতে পারাটা অসম্ভব তবু হেরম্ব মাদকতাময় হেঁটে যেতেই থাকে।হেঁটে যাবার ভঙ্গীতে আদ্যন্ত এক জীবন ধরা থাকে,তবু নদীতীরবর্তী অঞ্চলগাঁথায় সুরতাললয়হীন ব্যপ্ততায় কবেকার সব হাটবন্দরের প্রচ্ছায়া এসে জড়ো হয়।জমাট বাঁধে,যদিও নদীমাতৃকায় পলিমাটিপীড়িত এক সমাহার এসে যাবতীয় অন্ত্যজ উপকরণের ঢেউভাঙা আবিলতা এসে আবহমানতা লিখে রেখে যায় আর নকশাচাদরের অনবদ্যতা এড়িয়ে দিনের পিঠে দিন যায়,অতিক্রান্ত হয়।যদিও কাদামাটিলেপা জীবনের গভীরে স্পর্শযোগ্য বিভ্রম এসে যুক্ত হতে থাকে আর দ্বিধাদ্বন্দ এড়িয়ে পুনর্বার আকাশমাটিজলের তীব্র সহাবস্থান নিয়ে সংহত হতে থাকে কতরকমের সব হাট।
জ।
হেরম্ব কি উপকথা মিথ ভেঙে আসা মানুষ?তবে কেন সে হাটে হাটে নদী নালা মাঠে মাঠে ঝোপঝাড়ে ঘুরে বেড়াবে!আত্মপরিচয় খুঁজতে খুঁজতে ক্রমশ সে এক সংকটের আবর্তে জড়িয়ে যাবে।কত কত মানুষ,প্রান্তিক ধানপথ,রোদবৃষ্টির কোরাসের মধ্য দিয়ে তার ধারাবাহিকতা না থাকা ধারাবাহিক আত্মভ্রমণ।একটা পর্বে সে চরাঞ্চল পেরিয়ে যায়।মোল্লাবাড়ির দিকে এগোতে থাকে।চাষাবাদে ব্যস্ত সব মানুষজন তাকে চোখ তুলে দেখলেও দেখার ভিতর ব্যস্ততা বা বিভ্রম থাকে না,যেন চিরচেনা দৃশ্য।যেরকমটা কাছেপিঠের সব হাটেই হয়।অভিজ্ঞতার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকাটা বড় কথা নয়।অভিজ্ঞতার দিকে ভেসে যাওয়াটাই সারসত্য।ভিতরবাড়ির এগিনা হোক,বাহিরের খোলান হোক সে সব মুখ্য নয়;মেয়ে বউরা ধান ঝাড়ে ঢেকিপাড় দেয় চিড়া কোটে,ধান সেদ্ধ করে গুনগুণ বা সমবেত গানও গাইতে থাকে কখনো প্রান্তসীমায় আকাশ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টির মতো এসবই চিরকালীন,প্রদীপ্ত।প্রদীপ্ততার আবেশটুকুও লুপ্ত হয়ে গেলে আর কিছুই ধারেকাছে থাকে না।হেরম্বের যাত্রাপথে কিছুই কি আলোড়ন তোলে না?দ্বিধাহীন নির্বিকার হেঁটে যাওয়াটুকু থাকে তার।মসজিদ,বনভূমি,হাইরোড,কবরখানা,চা-বলয়,আদিবাসী পাড়া,পূর্ববঙ্গ কলোনি,বর্মণটাড়ি,পর্যটক,কাঠের বাড়ি,জোড়াশিমুলগাছ সব,সবকিছু সে অতিক্রমণ করতে থাকে দু’দশ একশ দুশ বৎসরের কালখন্ডে সে তার সমগ্র অতিক্রমণটুকু ধরে রাখতে চায়।হেরম্ব কি ক্লান্ত হয় না!খেঁজুরপাতার চাটাই বিছিয়ে তার কি জিরিয়ে নেবার সাধও জাগে না!বিষাদের বিষন্নতার,অবসর থাকা না থাকার পৌনঃপুনিকতায় মেঘগর্জনসম বর্ষানদীর প্লাবনপর্ব স্মৃতিবিস্মৃতি হয়ে জেগে থাকতে চায়। উপকথা মিথ ভেঙে হেরম্ব কেবল হেঁটে যেতে থাকে বাঁশবাড়ি লাইন,কলাবাগান,পাইকারকুঠি,ধানকল,কামতাপুরের মিছিল ওঠা কোন এক হাটগঞ্জের দিকে।
ঝ।
সমস্ত কিছুর ভেতর হেরম্ব থাকে।থাকা না থাকবার উপকথার শূণ্য এক বৃত্ত রচিত হয়।যেন বাস্তব থেকে পরাবাস্তবতার দিকে চলে যাওয়া।যাওয়া বলে কিছু হয় না,হতে পারে না।অনেক অনেক নদী অনেক অনেক মানুষজন মিলে একধরণের যাদুবাস্তবতা তৈরী করে।হেরম্বকে কিঞ্চিত উঠে দাঁড়াতে হয়।দাঁড়াবার ভঙ্গিটা ঠিকঠাক হয় না,এটা সে বুঝতে পারে।আর অতিসত্বর হাঁটা শুরু করে।গন্তব্য ঠিক না থাকলেও আসলে সে কিন্তু একধরণের গন্তব্যই প্রত্যাশা করে।উপকথা ভেঙে ভেঙে মিথের ভিতর আত্মগোপন করা আর ইচ্ছে সত্বেও হয় না।কেবল মাঠঘাট,ঘরবাড়ি,গাছপালা,ঝোপঝাড় এসবের সম্মিলনে জীবন খোঁজবার চেষ্টা।জীবন আদতে কি?আদিঅন্তহীন এক ভ্রমণসংগীত!হেরম্ব হেঁটে যায়,হেঁটে যেতে থাকে।এটা কি আত্মভ্রমণ!জীবনের অর্থ খোঁজার আপ্রাণ প্রয়াস।পুরোনো সময় থেকে ঘোড়াদল ছুটে আসে,বিরতিপর্ব শেষ হতেই বিস্তৃতি ফুরিয়ে বিস্তৃতির ঢালেই নেমে যাওয়া।গন্তব্যহীন অফুরান সময়যাত্রায় তালগোলপাকানো পরিপার্শ্বটুকু উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে পারে এমন সম্ভাবনা দুঃখকষ্ট ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসে।অগণন পাখি ওড়ে।গান ভাসে বাতাসের ভিতর।উপকথা দুমড়ে মুচড়ে খাবি খাওয়া মাছেদের মতো মৃতপ্রায় হয় আর আকাশ ভেঙে উপচানো আলো তার সময়যাত্রার প্রাথমিকটুকু সীমায়নে বাঁধা পড়ে;তবু মশামাছির দুর্গন্ধময় উপকথায় ধারালো অংশটুকু কখন যে ধারালো বল্লম হয়ে হত্যাকান্ডের মতো উদ্যত হতে চায় সেকথা হেরম্ব জানে না।সে কেবল পারিপার্শ্বীকতায় হাতড়ে বেড়ায় মহামহিম এক জীবনগাথা।স্বপ্নবৃত্তান্তের পর্ব থেকে পর্বান্তরে বৃত্তান্তের হাঁসগুলি মেঠোপথে নেমে আসে,মেঠো ইঁদুরের সাথে এক আবশ্যিক সান্নিধ্যতায়।এরকমভাবে বৃত্ত ভাঙা,বৃত্তরচনার খেলা চলতে থাকে।সমস্ত কিছুর ভেতর হেরম্ব থাকে,তাকে থাকতেই হয়;সে থেকেই যায়।
ঞ।
বদলে যাওয়া
নদী কিংবা
বদলানো নদীখাত
সংযোগসূত্র হিসাবে
যুক্ত হতে
পারে, সংযুক্তির
অধঃক্ষেপটুকু দোলাচলে
থেকে যায়;
এমনটা হয়
হতে থাকে,
তবু আকাশের
নেমে আসা
নদীবুকে আশ্চর্য
এক সুবর্ণ
ক্যানভাস। নদীখাতের
উর্বরতায় পলিসঞ্চিত
শষ্যহিন্দোল নদী
নদী দিয়ে
বয়ে যাওয়া
আবহমানের ইতিহাস
হয়ে কিংবা
ইতিহাসের গর্ভ
থেকে নতুনতর
নবীকৃত স্তরে
স্তরে সাজানো
আঞ্চলিকতায় ডুবে
যেতে চায়।
খাত বদলানো
নদী হাট
ঘাট বদলে
দেয়। মানুষের
চলাচল থেকে
জেগে ওঠা
চরাঞ্চল আদি
ও অন্তের
অদ্ভূত এক
সহাবস্থানই রচিত
হয় হয়তো।
গোপন গানের
মতো নিজস্ব
মন্ত্রের মতো
গতিহীন হয়ে
যাওয়া না
যাওয়ার প্রাসঙ্গিকতায়
আলোআধাঁরি কুয়াশাকুহক
কেটে হেঁটে
যেতে থাকে
খুটুরাম প্রধানী
আব্রাহাম মিনজ
এতোয়ারী এক্কা
জঙ্গলে পাতা
কুড়োতে থাকা
পুষনী রাভার
দল। এক
খাত ছেড়ে
নতুনতর সদ্যরচিত
নদীখাতে নাব্যতায়
দাঁড়িয়ে অপলক
দেখে যাওয়া
নতুন নতুন
জনপদ চা-খেত
গরু মোষ
হাঁস মুরগী
উঠোনের কইতর
এতসবের সাবলীল
গার্হস্থ্যযাপনচিত্র। ছবির
মধ্য দিয়ে
হাসি হুল্লোড়
ও শব্দাবলী
গড়িয়ে নামে,
স্থিরতর না
হতে পেরে
দৈনন্দিনতায় মিলিয়ে
যায়। রহস্যমতার
বিন্যাসটুকু জমে
যাওয়ার অবকাশই
হয়তো পায়
না, কেবল
সর্টকাটে ঝাড়ঝোপজঙ্গল
পেরোয়। নদীর
ব্যপ্ততার গড়ানে
আবশ্যিক এক
ভবিতব্যের অমোঘ
সম্ভাবনা স্ফূরিত
হতে থাকলেও
নদীর দু’পাশে
তালনারকেলসুপারীর অন্তরঙ্গতায়
জনপদটাই প্রাধান্য
পেয়ে যেতে
থাকে। এরকমভাবে
হয় না,হবে
না জেনেও
সাহেববাড়ির প্রাচীনতায়
প্রবীণ কোন
গ্রন্থের মতো
জাপটে ধরতে
চায়। অথবা
মাইল মাইল
বেতবাঁশবন থেকে
অপ্রাকৃত সব
সুর ও
স্বর ধেয়ে
আস্তে চায়
সম্ভাবনাকে উস্কে
দিতে চেয়ে।
সমূহতার ধারাবর্ষণে
যুক্ত হতে
গিয়ে শেষপর্যন্ত
বদলে যাওয়া
নদীখাতগুলিই অনিবার্য
হয়ে জেগে
থাকে দূরবর্তীতায়
চেয়ে থেকে
থেকে।
ট।
কান্না কি
গানের মতো!
মহিষের দুলুনি
সওয়ারী চালের
বিষণ্ণ এক
গান অনেক
অনেক গানটুকরোর ছড়িয়ে
পড়া চারপাশের
নৈঃশব্দে। নিশি
পাওয়া ভূতগ্রস্থ
মতো গান
প্রসারিত হয়,আবর্তিত
হয়,পাক
খায় আর
ধুলো ওড়াতে
ওড়াতে প্রবল
ঢুকে পড়ে
জমজমাট হাটের
বৃত্তে। হেরম্ব
দাঁড়িয়ে থাকে
সবজিহাটা ও
গরুহাটির সংযোগরেখায়।
তার সাথে
খুটুরাম প্রধানীর
দেখা হয়।
খানেক কথাবার্তা,
মুচকি হাসির
বিনিময়ও হয়। বিনিময়পর্ব
সমাপ্তীর আগেই
ঘটনাস্থলে দলবল
সহ এসে
পড়ে খড়ম
জোতদার তার
অতিকায় মাথা
কচুপাতের মাথাল
কাঁঠালকাঠের সর্পমুখী
জোড়া খড়ম
সমেত। এখন
জোতদারী নেই
তবু খড়ম
জোতদারের জোতজমি
ও পঞ্চায়েতি
আছে। আছে
কুষাণ লোকগানের
দল। হাটগুলোতে
জনসংযোগ,লোকসংস্কৃতি
ও বিনোদন
সবই একযোগে
সেরে নেওয়া
যায়। দোতারার
ডোল ডোল
ডোল ডং
সুরটুকু আবহবিস্তারকারী
উপকরণ হয়ে
তীব্রভাবে থেকে
যায় গোটা
হাটেই; কুশাণের
সুর ভাসে,হাটকে
জড়িয়ে রাখে,জমজমাটও! এভাবে
হাটে হাটে
আলোড়ন জাগে।
হাটের শ্রেণীচরিত্র
বিভাজিত হতে
গিয়েও নতুন
এক কার্যকারণের
পাকেচক্রে অস্থির
প্রতিপন্ন হয়,হয়ে
পড়ে। হাটের
পাশে হাট।
হাটের মধ্যে
কতরকমের হাট।
সবজিহাটির কোণাকোণী
হেরম্ব ও
খুটুরাম দাঁড়িয়ে
থাকতে না
চাইলেও ঘটনাক্রমের
প্রাসঙ্গিকতায় তাদেরকে
দাঁড়িয়েই থাকতে
হয় যতক্ষণ
না জলধোয়া
বসুনিয়া গামছাবান্ধা
দই শালিধানের
চিড়া নদীখাতের
খই নিয়ে
হাজির না
হয়। বিকেলের
আকাশ সমস্ত
প্রাকৃত রঙ
মুছে ফেলতে
ফেলতে সমূহ
সম্ভাবনার সম্ভাব্যতায়
অপরূপ নশ্বরতাময়
সকরুণ এক
দিনাবসান চিরকালীন
জলছবির মহার্ঘ্য
ও সংরক্ষণযোগ্য
এক স্মৃতিজাগানিয়া
মহাজগৎকথার আলিসায়
হাটের বিষাদের
পরতে পরতে
গানের মতো
মহামহিম হয়ে
উঠতে থাকে।
ঠ।
সব হাটই
কি একই
রকম! বর্ণ
গন্ধ রূপ
রস আলাদা
আলাদা হলেও
আসলে একেক
হাট একেক
রকম। কিছু
কিছু বড়
গাঙ অতিক্রম
করে যেতে
হয়। অথবা
বড় বড়
নদী ঘেরা
সেই সব
হাট। ছোট
নদী বাঁশের
সাঁকোই ডিঙিয়েও
কোন কোন
হাট। চা-বাগান
বনাঞ্চল চরাঞ্চল
সর্বত্রই হাট
আর হাট।
আবার পাট
তামাকের নির্দিষ্ট
হাট ভাঙতেই,
সবজিহাটা বসে
যায়। সবজিহাটা
দুপুর গড়িয়ে
বিকেল অব্দি
চললেও সন্ধ্যেবেলাগুলি
অবশ্যই গরু
ছাগল হাঁস
মুরগির। দোদুল্যমানতার
ফোঁকড়ে অসামান্যে
এক নিশ্চিন্ততায়
নির্দিষ্ট গন্তব্যহীন
মহাজীবনের দোলায়
দূরন্ততর গতিময়
রংবেরং মানুষেরা
হেঁটে যেতে
থাকে। তখন
নাথুয়ার হাটে
মথুরার হাটে
আব্রাহাম কিসকু
মোহন দেউনিয়া
হাড়িয়ার তালে
ধামসা মাদলের
বোলে সুনিশ্চিত
নাচতে থাকে,
গাইতে থাকে
গান_ ‘হাওয়া
লাগাই দে/সাইয়া
হাওয়া লাগাই
দে’।
নাচগানের
সমস্বরে অপার্থিব এক জীবন তার যাবতীয় আহ্বান আমন্ত্রণ মেলে ধরে,ছড়িয়ে দেয় দিক ও
দিগরের অথৈ শূণ্যতায়। জড়িবুটি বিক্রি করতে এসে হাড়িয়াহাটার দিকে আকুলি বিকুলি এক
হাঁটা শুরু করে নাথুরাম পাইকার। হাঁটাটা এক্সময় মান্যতা পেয়ে যায় জাড্য ভেঙ্গে
ফেলে উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে যখন একে একে জড়ো হয় বিলপুক নার্জিনারি, খোকা বর্মন,
মন্দাদর মল্লিক, জার্মান রাভার দল। হাট থাকবে হাট গড়াবে, হাট হাটেরই বৃহত্তর
সীমানাপ্রহর টপকে অন্যরকম হাটবাজার নির্মাণ বিনির্মাণ করবে না এটা তো হতে পারে না!
যে কোন হাট থেকে গান ভেসে আস্তে পারে। গানের পর গান। গানের পিঠে গান। গানের ভিতর
গান। গানের মন্দমন্থরতায় সুরতাললহরের খুব গহন থেকে জীবনের সব বিচিত্রতর নকসা
গাঁথাতত্বমোড়কে হাজির হতে থাকে। যে কোন হাটেই এমনটা হয়,হতে পারে। সে নাথুয়া হোক
মরিচবাড়ি হোক গোঁসাইহাট হোক, টাকোয়ামারি নিশিগঞ্জ ভবেরটাড়ি প্রেমচাঁদ যে কোন
হাটেই। সব হাটই কি একইরকম!
ড।
ভুলে যাওয়ারও তো
একটা ইতিহাস থাকে।ইতিহাস থেকে ভুলে যাওয়া চাপা পড়া অংশগুলি অংশত আংশিক এক ভুলে
যাওয়ার রদবদল এনে দেয়।হেরম্ব কি ইতিহাসের কেউ হতে পারে!হতে পারাটা সম্ভব নয় কারণ
নিম্নবর্গের কোন ইতিহাস হয় না,হলেও মান্যতা পায় না।নদী নালা জঙ্গল জলা জনজাতি ভাষা
বিভাষা কথা উপকথার প্রান্ত প্রান্তরের গানবাজনা পূজা লোকাচার সবকিছু নিয়ে অন্য ও
অনন্য এক ইতিহাস মান্য ইতিহাসের সমান্তরালে তীব্রভাবে রচিত বিনির্মিত হয়ে উঠতে
থাকে।মান্যতা এখানে গৌণ।মানুষের অংশগ্রহণ আবার অংশগ্রহণের
সম্প্রসারণযোগ্য পটভূমির মধ্যে চিরকালীন ভোরবেলার মতো ইতিহাসের ভুলে যাওয়াটাকেই
বিদ্রুপ করে; নির্মাণ বিনির্মাণ নিয়ে ইতিহাসেরই ইতিহাস রচিত হতে থাকে
শব্দ-নৈঃশব্দে।নৈঃশব্দ খান খান করে কাঁচ ভাঙবার যুদ্ধযাত্রার চক্রান্তকারীদের
দরবারী ঝাড়লণ্ঠন ব্রাত্যমানুষের বিক্ষোভ-সংহত হতে হতে ইতিহাসের সংযোজিত অংশ হয়ে
প্রাচীন প্রবীণ বৃক্ষশাখার হাওয়াবাতাসে সংকেতময়তার পরিসরটুকুতে ঠোক্কর দিতে
থাকে।হাতিডোবার খাল কাজলীকুড়া সাহেবেরহাট দইভাঙ্গির দহ আশ্চর্য আঞ্চলিকতার মিথ ও
গন্ধে প্লুত হতে হতে হেরম্ব নদীর সকল অংশগুলিই অতিক্রম করতে থাকে।অতিক্রমণের
আবহমানতাটাই চিরসত্যি সূর্য ওঠা চাঁদ ডোবার মতো।ইতিহাসের চিরচেনা পথের প্রান্তরেখা
ছুঁয়ে ইতিহাস চলতে চায়।অথচ আঞ্চলিকতার চোরা টানে চোরাবালির ভিতর ইতিহাসের আবশ্যিক
নিয়মটুকুই বড় হয়ে ওঠে। যেন নিয়তিতাড়িত মানুষের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন খোয়াব
ইতিহাসেরই মহাবৃত্তান্তের রূপ ধরে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।প্রলোভনের ফাঁদ এড়িয়ে
হেরম্ব জলধোয়া খড়ম জোতদার নিয়ামত কবিরাজ ধনবালা খইচালু সবাই মহার্ঘ্য এক ছবির
ফ্রেমে গিয়ে ঢোকে মহাকালের চূড়ান্ততম কথাছবির মতো।ভুলে যাবার ইতিহাসটা যেমন সত্যি
ঠিক ততটাই ইতিহাস ভুলে যাওয়াটাও।
ঢ।
এত সব ইতিহাস
অঞ্চলকথা প্রান্তজনের আঞ্চলিক হয়ে উঠতে চাওয়ার মধ্যে কোথাও কি হেরম্ব ছিল?না কি
তাকে খুঁজে আনতে হবে?সেই যে এক বনাঞ্চল পর্বতরেখাবেষ্টিত জলাভূমির উপকথায় হেরম্ব
দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে সকল আলস্য ভেঙে হেরম্ব আবার তার একক যাত্রা শুরু করে।শুরুর
স্থবিরতা বাঁক নেবার অপ্রচলিতে আলস্যের আংশিকতার ঘনত্ব এনে দিতে চাইলেও তাকে
অগ্রাহ্য করে জঙ্গলপথই হেরম্বর পূর্বনির্ধারিত।হেরম্বকে এভাবেই পেরিয়ে যেতে হবে
দিবালোকের জঙ্গল আদিবাসীদের গ্রাম ঝোরা নালা চা-ফ্যাক্টারী হাসপাতাল নদী নদীপারের
কুলবন,উঁচু উঁচু বাঁধ শেয়ালকাঁটার ঝাড় ঘন্টাফুল লতানো গাছলতা বুনো ফল_সব,সবকিছু।এই
যাত্রাপথে হয়তো জলধোয়া বসুনিয়া থাকবে না,তবে আরো আরো নতুন নতুন মানুষেরা তাকে সঙ্গ
দেবে;সখ্যতাও।সখ্যতায় ঘনত্ব সেভাবে থাকবে না।অনন্ত এক উদাসীনতা তাহলে কি জড়ানো
থাকবে হেরম্বর শরীরমনে!উদাসীনতা পাকেচক্রে শরীরে শ্যাওলাজড়ানো অনুভূতির দিকে
আকাশমাটির বাস্তবতার বাস্তবতাটুকুই মেলে ধরবে।বৈশাখ আষাঢ় কার্তিক বর্ষা হিম
বারমাস্যার গান হয়ে পথে পথে পাকাধানের খেতখামারে মাছধরার জালজালকের কৃষিকর্ষণ
আদিবাসীদের করমপুজা নাচগান জঙ্গলের হাতি বাইসনের আগুনচোখ হরিণশাবকের নিঃসঙ্গ
দাঁড়িয়ে পড়া মেঘের ডাকে পেখমমেলা ময়ূরের নাচের অনবদ্যতায় জীবনের আপাতসরল সরলীকৃত
ধারাবাহিক গতিময়তায় সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে থাকে।থাকাটাও আঞ্চলিক হয়ে
উঠতে পারবে কি না সেটা অনুধাবনের প্রয়োজনীয়তা অগ্রাহ্য করে হেরম্ব চলতে থাকে।তাকে
ঘিরে ধরে বনবাদাড়ের যত পাখপাখালি হাতির মাহুত মাহুতের স্মৃতিজড়ানো সব
হাতিগান;মহিষের পিঠে শুয়ে থাকা কিশোর,নদী পেরিয়ে নদী সাঁতরে জঙ্গলের নিশ্চিন্তিতে
ঢুকে পড়া দশ কুড়ি বরাহ,বাইসন।থাকতে না চাইলেও সমস্তকিছুর হেরম্বকে কিন্তু থেকে
যেতেই হয়,কেননা থেকে যাওয়া ব্যাতীত তার আর কোন উপায় নেই।
ণ।
প্রাত্যহিকতায়
দৈনন্দিনে ভোরের ভেতর জেগে উঠতে চাওয়া ভোরগুলির ভাঁজে ভাঁজে কেমনতর দেহতত্ব এসে
পড়ে।তখন ফজরের নামাজ ভাঙে মোল্লাবাড়ির মসজিদে।জামাতের জমায়েত ভেঙে গেলে ভাঙা
জমায়েতের টুকরোগুলির বিভ্রম থেকে ভ্রমবশত ভ্রামণিক লোকজতা বিনির্মিত হতে
থাকে।কবেকার আভিজাত্য বনেদীয়ানা প্রাচীনতা নিয়ে মোল্লাবাড়ি যেন তার প্রবীণত্বকেই
প্রতিধ্বনি ধ্বনির আবর্তে টেনে আনে।তামাকের হাট বল পাটাহাট বল গরুহাটি বল সব
সবকিছুকেই মোল্লাবাড়ির চৌহদ্দীতে এনে ফেলতে হয়।কথিত আছে সেই কবেকার ওয়াহাবী ফরাজী
খিলাফতের দিনগুলিতে মোল্লাবাড়ির রুকনুদ্দিন জয়নাব ইলিয়াস মইনুদ্দিনেরা দুধসফেদ
ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যেতেন দিকদিগন্তের পানে।মোল্লাবাড়ির ফরিদা ফুপু আঞ্জুমা নানীর
‘বিয়ের গীতের’ নিজস্ব দল ছিল যার কথা ৫০/৭০ মেইল ব্যাসার্ধের গ্রামগুলির পুরোন
নতুন মানুষেরা প্রায় সকলেই জানে।জানা অজানার পর্ব পর্বান্তর পেরিয়ে যেতে যেতে
পটভূমির ভিতর মোল্লাবাড়ি ঢুকে পড়তে চায়;ঢুকে পড়ার পর্যাপ্ত অনুষঙ্গ প্রামান্যতা
উপযোগী কিনা সেটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে যখন মোল্লাবাড়িই প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতজনের এক
পটভূমি হয়ে উঠতে থাকে।পটভূমি কি স্থিরচিত্র হয়ে পটভূমির ভিতর বসে থাকতে পারে!বসবাস
করলেই কিংবা বসতি বসালেই তো আর হবে না;তাকে চলমানতা দিতে হবে।হাটবাজারের
ব্যাস্ততাও;লোকাচার লোকবৃত্ত কাঁথাসেলাইয়ের দিনগুলি বসতির প্রান্তিক রেখার
স্পর্শযোগ্যতা স্বত্বেও স্পর্শযোগ্য মনে না করবার দ্বিধা দোলাচলে ভিন্নমুখি
পটভূমির কথাই পটভূমির নতুন জেগে ওঠা অংশরূপে বিবেচ্য বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে
থাকে;গড়ানো বেলার আকাশের গুটিয়ে নেয়া আলোর নিঃসঙ্গতায় জল জলা জনভূমির বিষাদের
মহাশুণ্যতায় বিলীয়মান সামগ্রিকতাটা লুপ্ত হতে হতে বিলুপ্তির সান্নিধ্যটুকু
বেলা-অবেলার দিনবদলের ধরতাইটুকুই জাগিয়ে রাখতে চায়।জাগৃতির প্রাণময়তায় জলে ভাসা
নুড়িপাথরের মতো চিরকালের সত্যিকথন হয়ে মোল্লাবাড়ি নামাজ জামাতের বহুস্বরিকতায় জেগে
থাকে তীব্র এক জমায়েত হয়ে।
উপসংহারের বদলে
হেরম্বের কোন শেষ
নেই।ফুরিয়ে যাওয়া নেই।উপসংহার নেই।হাটগঞ্জলোকজীবনের আবহমানতায় মিশে গিয়ে হেরম্বের
চলাচল চলতে থাকে।মিথ ও ইতিহাসের শিকড়বাকড় জড়িয়ে নিয়ে প্রান্তবাসীর ইতিহাস লিখতে
লিখতে বাড়িটাড়ির পাশ দিয়ে আঞ্চলিক নদীটদী টপকে টপকে হেরম্বের অন্তহীন এক কথকথার
ইতিবৃত্ত।
বসন্ত পিছিয়ে যায়
রূপক সান্যাল
শীত এখনো ছুঁয়ে আছে আমলকী গাছটাকে। তুমি শীত
ভালোবাসো না, ঠোঁট ফেটে যায়। তোমার লিপ-গার্ড মাখা ঠোঁট, তবু বারবার চেটে নাও জিভ দিয়ে। আমি যদি বলি, ‘জল খাবে?’ তুমি
বাঁকা দৃষ্টিতে বলবে, ‘না ... পান করবো ... তোমাকে!’
কিন্তু তোমার ওই অর্থপূর্ণ দৃষ্টির
দিকে আমার দৃষ্টি নেই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। কে যেন পেছনে টেনে ধরছে আমাকে। বসন্ত
দূরে সরে যাচ্ছে আমার থেকে ... দূরে, আরও দূরে ... ক্রমশ আরও আরও দূরে ...
আমাদের পাশের বাড়ির মেয়েটা কাল ঝুলে ছিল সিলিং
ফ্যান থেকে। প্রায় পাকা হয়ে আসা ওর বিয়েটাও পুরোপুরি ঝুলে গেছে ওর সাথে। ওর হবু বর বেশ মোটা টাকা পণ চেয়েছিল বিয়েতে। রাজিও হয়েছিল খারাপ দেখতে মেয়েটার বাপ। হবু শ্বশুরের সেই প্রাপ্তিটাও ঝুলে গেল মেয়েটার সাথে, ... বেচারা!
এত শীত করছে কেন? শীত কি অক্টোপাস? আমাকে জাপটে ধরছে, চুষে
খাবে হয়তো। স্টেশনে পৌঁছনর আগেই যেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে গেল ট্রেন। হাতকে দীর্ঘ
থেকে দীর্ঘতর প্রসারিত করেও ছুঁতে পারি না ধাবমান রেলগাড়ি। সারা গায়ে বসন্ত মেখে
একদল সুখি লোক কলধ্বনি তুলে ছুটে যায় আমার সামনে দিয়ে। আমি অসহায় তাকিয়ে
থাকি।
কোথায় যেন বরফ পড়েছে কাল রাতে। একজন খবর দিয়েছিল। কিন্তু এই ফাল্গুনে বরফ! তাও আবার এখানে? ওরা যত্তসব বাজে খবর দেয় আজকাল। আমি এগিয়ে চলেছি আমলকী গাছটার দিকে, অন্য দিক
থেকে তুমিও। জানি,আমলকী নয়, এখন শিমুল পলাশের সময়। এখন
কৃষ্ণচুড়ার আগুনের সময়। কিন্তু আগুন তো নেই, কোথাও আগুন নেই। বরফ জমে আছে শুধু। রঙের দিনে যে মেয়েটাকে জোর
কোরে ওর বুকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে খুনী রঙ দিয়েছিল ছেলেগুলো, তখনও বরফ পড়েছিল। আসেপাশের সব
লোক শীতের মারে দরজা জানালা বন্ধ কোরে, লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে ব্যস্ত
থেকেছে নিজস্ব উষ্ণতার খোঁজে। আমরা কেউই শীত পছন্দ করি না,
তবু আমাদের জন্য বরাদ্দ হয় আমলকী বৃক্ষ।
এত শীত করছে কেন? বসন্ত কি আসেনি?
আমাদের রান্নার মাসি কাল জলে ডুবে মরেছে। বুড়িটা নদীতে স্নান
করতে যাবার আগে আমাদের জন্য রেঁধে রেখে গিয়েছিল বোরলি মাছের ঝোল। ওর ছেলে দিল্লিতে থাকে ... ... আসেনি।
কিন্তু এসব নানান কথার মধ্যে পড়ে আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি
হয়তো এতক্ষণ পৌঁছে গেছে ওই গাছটার নিচে। আমি পা চালাই। আমরা আজই যাত্রা শুরু করবো।
ওরা আমাদের আর দেরি করিয়ে দিতে পারবে না। আমি এই বরফ থেকে, এই অদ্ভুত নীরবতা থেকে দূরে চলে যেতে চাই। আমি
পা চালাই, জোরে ... আরও জোরে।
কিন্তু তবু এত শীত করছে কেন? ... বসন্ত পিছিয়ে যায়, আমার
বসন্ত পিছিয়ে যায়।
অন্যরকম বসন্ত
মীরা সরকার
সকাল থেকে মনটা খুব খারাপ । সাগর পার থেকে উড়ে আসা একটি দুঃসংবাদ সারা ভারতবর্ষের মন খারাপ করে দিয়েছে। লাস্যময়ী অভিনেত্রীর অকালমৃত্যু । প্রিয় নায়িকার আচমকা মৃত্যু সব ফ্যানদের অন্তরে আহত করেছে।পুরুষ ফ্যানদের খানিক মোহ খানিক স্বপ্ন কিছুমাত্র সম্মোহনের উৎস এই নারী । নারী ফ্যানদের ফ্যাসান, লাস্য, উন্মাদনার পথ পরিচায়ক শ্রীদেবী।এই ভালোলাগা টুকুই ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের সম্বল । একজন বেচে আর একজন কেনে।দুজনেই জেতে।মদিরেক্ষণার বিলোল চাহনি স্বপ্নে ভাসে।
আমিও আবিষ্ট ছিলাম তার হাস্যে লাস্যে।সেই কবে 'জুলি' দেখেছিলাম ওতে জুলির বোনের ভূমিকায় ছিল একটি ছোট্ট মেয়ে তখনি ওর নাচের একটু ভঙ্গি দেখে মনে মনে প্রশংসা করেছিলাম । বুঝেছিলাম ও একটু আলাদা।দৈনিক পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে এসব ভাবছি। ভাবছি মৃত্যু দরজার পাশে চুপিসাড়ে দাঁড়িয়ে আছে । ধনী দরিদ্র কাউকে রেয়াৎ করে না। একটি প্রাণবন্ত মেয়ে হঠাৎ নেই হয়ে গেল ?
- কি গো তোমার চা যে ঠান্ডা হয়ে গেল । আর এক কাপ বানাইয়া দিমু?
আমার রান্নার মাসি যমুনা ।অনেকদিন ধরে কাজ করছে ।ভালো রান্নার সাথে সাথে আমার উপর কিঞ্চিৎ গার্জেন গিরি ও করে।
বললাম 'না থাক খেতে ইচ্ছে করছে না।'
যমুনা থপ্ করে বসে পড়ল আমার সামনে। একটু অবাক হয়ে চাইলাম ওর দিকে।নিশ্চয়ই কিছু বলবে ।ওর কাছে আমি বিশ্বদুনিয়ার সব খবর পাই এবং তা একেবারে বিশ্বস্ত ।
- কী হল?
-আর কইয়েন না। শুনছেন শ্রীদেবী মইরা গেছে।তাও নাকি কুন দূরদেশে গিয়া। যভুনার মুখ আনন্দে ঝলমলে । আমি জানি ও সিনেমার পোকা। তাহলে শ্রীদেবী মারা গেলে ওর খুশি র কারনটা বুঝতে পারলাম না ।
-তুমি দেখেছ শ্রীদেবীর সিনেমা?
-দেখি নাই মানে? 'তোফা''মিঃ ইন্ডিয়া 'দেখছি। নাম মনে নাই আরও কতগুলা দেখছি।একদম হলে গিয়া ।
-ভালো লাগে নি?
- হ্যাঁ । বাব্বা কী সুন্দর দেখতে। আমার তো খুব ভালো লাগে। অর চোখ দুইখানা দেখছেন কী ঝকঝক করতেছে।কী তার নাচ।শরীলখান কেমুন মাখমের তৈরি যেন।ধরলেই গইলা যাইব।
- তাহলে মরে গেছে শুনে তোমাকে খুশি খুশি লাগছে কেন?
- দুঃখ হয় নাই কে কইল। ওই রকম সুন্দর । তবে বিয়ার পর সিনেমা কম করতো।
- তা অভিনয় ও তো ভালো করতো তাই না। রূপের সাথে গুনও ছিল।
- অভিনয় মানে পাট তো? হে জানি না তবে শ্রীদেবীর বই শুনলে আমি টি.ভির সামনে থিকা নড়ুম না। অরে দেখতে দেখতে কখন বই শেষ হঅ্যা যায়।
- ঠিক বলেছো । ওই জন্যই মনটা খুব খারাপ। দেখ না অনেকে বলছে দোল খেলবেনা।কে আবার শুনলাম শ্রীদেবীর জন্য বিয়েই করেনি। তার মানে কত লোক ওকে ভালবাসে।
যমুনা উঠে গেল রান্না র কাজে। কিন্তু ওর চাল চলনে দুঃখের কোন ছাপ দেখা গেল না। ভাবলাম ওরা তো মোটা দাগের মানুষ, সিনেমার মানুষের জন্য এর চাইতে বেশি দুঃখ ব্যয় করা যায় না।বরং গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রান্না সেরে ফেলল।
সব রান্না শেষ করে আবার একদফা আড্ডা দিতে বসে পড়ল যমুনা।
-হ্যাঁগো দিদি একখানা কথা শুনলাম সত্যি নাকি?
- কী কথা? আনমনে বললাম মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে বললাম ।
- পেপারে নাকি লিখছে শ্রীদেবী যারে বিয়া করছে তার নাকি আগের পক্ষের বউ ছিল। ছেলে মেয়ে ছিল?
আচ্ছা এই তবে যমুনার খুশির রহস্য ।যেই কেচ্ছা র গন্ধ পেয়েছে অমনি-।
- হতে পারে। তা ওরা তো করেই। সিনেমার লোকরা ওরকম হয় । আজ একে কাল ওকে বিয়ে করে ।করতেও দেরি নেই ছাড়তেও দেরি নেই।
- আপনি এটাকে ভালো বলেন?
-ভালো হবে কেন?তবে--
-বাঃ আগের বউটারে যখন বিনা দোষে ত্যাগ দিলো তখন তার কত খারাপ লাগছিলো কনতো? তার বুকটা হয়তো ফাইটা গেছে।ছেলেমেয়ে নিয়া-।
- আরে না না ওদের অনেক টাকা । ওরা এত ভাবে না।
- কেমনে জানেন? যমুনার চোখে জল টলমল করে ওঠে । -যার স্বামী অন্য মেয়েমানুষের লগে নতুন সংসার পাতে তার জীবন কেমনে কাটে জানেন নাকি?জানেন না।তার মরণ পর্যন্ত অভিশাপ লাইগা থাকে। তার অভাগা ছেলেমেয়ে দুইটা সারাজীবন মাথা উঁচু করতে পারে না।
হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে যমুনা।
- একি তুমি কাঁদছো কেন? আরে কোথাকার কে । আর সেই বউটাও তো মরে গেছে।
-শুনছি।তার নাকি ক্যানসার হইছিল। হইবই তো। কিছু না কিছু তো হইব ই। সে যে মরণেরে ডাইক্যা আনছে। তার ভাইগ্য ভাল দিদি।
তবু দেখলেন তো পাপ কারো বাপেরে ছাড়ে না। সেই আঘাত কেমুন ফিরা আসছে দেখলেন।সুখী হয় নাই। হতি পারে না।শ্রীদেবী ও সুখী হয় নাই। মরছে অপঘাতে। অভিশাপ অভিশাপ । হা হা হা হা । যমুনার দুচোখে জল হাসছে হা হা করে ।
আমি অবাক । এভাবে ভাবিনি তো। যমুনাও তো--
-যাই দিদি। চোখ মুছে যমুনা বলল।মনে রাইখেন দিদি এখনো সিন্দুর পরতেছি যে তা কারোর আয়ু বাড়াইবার জন্য না। নিজের রক্ষার জন্য । তারও ভালো হইব না। আমার সতীনের ও না।
ধাঁ করে যমুনার জীবনের সব মনে পড়ে গেল।
- বোঝলেন দিদি শুনছি আমার সেই সতীনের নাকি দুই পা'ই অচল। হাঁটতেও পারে না। আর সেই লোকটা, মানে আমার ছেলে মেয়ের বাপটা গো সে খবর পাঠাইছে এইখানে আইসতে চায়।
-তাই? তুমি কী বললে?
-আমি কিছু কই নাই। ছেলে মেয়েদের জিজ্ঞাসা করছি 'কীরে কি করুম?' ওরা পস্ট কইল আমাদের কোন বাবা নাই তুমি বাবা তুমিই মা। তবে ওই লোক যদি উইড়া আইসা জুইড়া বসে আমরা ঘর থিকা বাইর হইয়া যামু। বড় হইছে তো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল যমুনা।
ওর জীবন দর্শন আমাকে স্তব্ধ করে দিল। তবু বললাম- তোমার কী ইচ্ছে ছিলো ?
- কী যে কন, কত কষ্টের দিন ,কষ্টের রাত ,কতো না খাওয়া ,কতো লোকের দুয়োরে দুয়োরে ঘোরা কাজের খোঁজে সব ভুইলা যামু? না দিদি আমি ভালো আছি খুব ভালো।তবে বেইমান শাস্তি পাক মন দিয়া চাই। পাইবেই। আজ হউক বা কাল।
যমুনা চলে গেল। ওর অনুভূতি ,ওর বঞ্চনা ক্লিষ্ট মুখে একটা অন্যরকম আলো। নব বসন্তের রক্তলাল রঙের চাইতে কম নয়। স্বাধীনতা র রঙ তো।
" মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী"...
মৌসুমী চৌধুরী
আমাদের ইউনিভার্সিটির দর্শন সদনের অধ্যাপক ডঃ সুশান্ত সেন বলতেন,
"পৃথিবীর মধ্যে বোধহয় এই একটি জায়গাই আছে, যেখানে প্রতিটি ঋতুই তাদের রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ উজার করে দেয়। প্রতিটি ঋতুই বেশ স্পষ্ট ফুটে ওঠে
এখানকার আকাশে-বাতাসে-পল্লী-প্রান্তরে। সেজন্যই গুরুদেব বোধহয় ভেদিয়ায় নয়, ঠিক নেমে গিয়েছিলেন এখানেই ---"আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন..."
আমাদের তখন উড়নকাল। শান্তিনিকেতনের বকুল বীথি, আম্রকুঞ্জ, ছাতিমতলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মন প্রকৃতই বসন্তগন্ধী হয়ে উঠতো। মাতাল করা বসন্ত- আবহে মনটা বড়ই আবেগময়
আর উদাস উদাস হয়ে যেতো। প্রকৃতি যেন তার বুক থেকে গাছে গাছে ঢেলে দিতো অপূর্ব সব রঙ। সাদা,হলুদ,লাল,
গোলাপী কত রঙ-বেরঙের বোগেনভেলিয়া যে ফুটতো তার ইয়ত্তা নেই। হৃদপিন্ড- উপড়ে-বের-করা রঙে সাজতো কৃষ্ণচূড়া-শিমূল, পথের পাশে সবুজ পাতার ফাঁকে আগুন ঝরাতো রাধাচূড়া, পলাশ, গাঢ় গোলাপী রঙের মোরগ-ঝুঁটি ফুলে ভরে যেতো আমাদের ডিপার্টমেন্টের বাগান...হাঁ করে প্রকৃতির এই রঙ-রূপ গিলে নিতাম আমি আর আমার বন্ধু মিতালী। আর শান্তিনিকেতনের অলিতে-গলিতে সাইকেল চলিয়ে ঘুরে বেড়াতে
বেড়াতে বসন্ত বাতাসে একটা বিশেষ ককটেল-সুবাস নাকে আসতো। আমের মুকুলের নেশাধরা ঘ্রাণের সাথে মিলে মিশে থাকতো ছাতিমফুলের বুনো গন্ধ, বকুল-কামিনীর সুমিষ্ট গন্ধ আর আরও কত নাম-না-জানা ফুলের সুবাস।
বসন্ত এলেই "স্হলে-জলে-বনতলে"
ছড়িয়ে যেতো দোল উৎসবের ছোঁয়া। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস হতো সকালে। আর বসন্ত পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিকেলে শুরু হয়ে যেতো "বসন্তোৎসব"এর
প্রস্তুতি। আমরা, অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিদিন বিকেলে ডান্ডিয়া
হাতে নিয়ে নাচের মহড়ায় যেতাম সঙ্গীত ভবনে..."ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল.."
যাইহোক, তখন বসন্ত এলেই শুরু হয়ে যেতো আমাদের "বসন্ত-প্রস্তুতি"। চলতো হলুদ শাড়ি জোগাড় করার
হিড়িক। হলুদ শাড়িটা দোলের অনুষঙ্গে মিলেমিশে এতটাই একাকার হয়ে গিয়েছিলো যে, অন্য সময় হলুদ শাড়ি পড়লে সবাই বলতো,"দোলের শাড়ি পড়েছিস?" সে ছিলো এক অনুপম, আবেগময় অপেক্ষার দোলায় দোলা... বুকের মাঝে যেন এক আকুল প্রতীক্ষা, "আসছে ফাগুন মাস, কি হয়... কি হয়..."
দোলের আগের দিন পর্যটকে ভরে যেতো বোলপুর-শান্তিনিকেতন। আর সেদিন দেখা দিতো পলাশ ফুলের আকাল। আমরা অনেক দাম দিয়ে পলাশ ফুল কিনে তার হার-দুল-চুরি বানিয়ে পড়তাম। আমার বান্ধবীদের বয়-ফ্রেন্ডরা তাদের জন্য পলাশ জোগাড় করে আনতো। তার থেকেও অবশ্য ভাগ পেতাম আমি। দোলের দিন ভোরবেলায় হলুদ শাড়িতে আর পলাশের মালায় সেজে চলে যেতাম নাচের লাইনে। বকুল বীথি থেকে শুরু হোত লাইন। ঠিক সাতটায় আরম্ভ হোতো অনুষ্ঠান.... "ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল..." নেচে নেচে আমরা গিয়ে বসতাম গৌরপ্রাঙ্গনে, বাঁশের ঘেরা দেওয়া জায়গায়টায়, যেখানে থাকতো মূল মঞ্চ। তারপর শুরু হোতো মূল মঞ্চে বসন্ত- গানের ওপর নৃত্যানুষ্ঠান। নৃত্যানুষ্ঠান শেষ হোতো "রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে---- রাঙিয়ে দিয়ে যাও" এই গানটির মধ্যে দিয়ে। আর তখনই শুরু হয়ে যেত আমাদের আবীর খেলা। তরপর আমরা ভাগ ভাগ হয়ে নিজের নিজের ডিপার্টমেন্টে নাচ গানে মেতে উঠতাম..... সে ছিল আমাদের এক চরম আনন্দঘন উৎসব-যাপন।
দলবেঁধে আমরা --- আমি, কাকলী,মিতালী, চিন্ময়ী যেতাম সুশান্তদার বাড়িতে। শান্তিনিকেতনে শিক্ষিক- শিক্ষিকাদের দাদা-দিদি বলার রেওয়াজ ছিলো। সুশান্তদার বাড়িতে সেদিন সপরিবারে আসতেন লক্ষন বাউল। অনেক গান শোনাতেন তাঁরা----ওঁর গলায় " একবার মধুমাখা হরিনাম বলো রে,/ ওই নামের গুণে শোলা ডোবে / শিলা ভাসে জলে রে"... আজও যেন কানে ভেসে আসে।
অদ্ভুত রূপ নিয়ে আসতো সন্ধ্যের
শান্তিনিকেতন। গোল থালার মতো দোল
পূর্ণিমার চাঁদটা তার বুকের সবটুকু রূপো যেন গলিয়ে ছড়িয়ে দিত গোটা আশ্রম চত্তরে। বকুল বীথি, আম্রকুঞ্জ, শালবীথি, ছাতিমতলা, আশ্রমমাঠ, পৌষ মেলার মাঠ সব ধুয়ে যেত দুধ সাদা জ্যোৎস্নায়। আর ঠিক সেই সময় কেন জানি না, অদ্ভূত এক বিষন্নতা গ্রাস করতো আমাদের। নিস্তব্ধ বকুল বীথিতে চুপচাপ বসতাম আমি আর মিতালী। বকুলের ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না চুঁইয়ে পড়তো। দূরে গৌরপ্রাঙ্গন থেকে ভেসে আসতো "রোদন-ভরা এ বসন্ত সখী, কখনো আসে নি বুঝি আগে।..." চিত্রাঙ্গদার বিরহ-বেদনা যেন বড়ই বাজতো বুকে। নিস্তব্ধ বকুল বীথিতে
তখন জোড়ায় জোড়ায় প্রেমিক-প্রেমিকাদের ছায়ামূর্তি.....
এভাবেই সেসময় আকাশে-বাতাসে-অশোকে-শিমূলে-পলা শে তুমুল বসন্ত আসতো আমার বা আমাদের জীবনে। বসন্ত আজও আসে ,আসে ইঁট-কংক্রীটে, মহানগরীর অস্হির-যাপনে, দিনগত-পাপক্ষয়ে। আর, "ভবানী ভবন" থেকে একটি কলে আমার ফোনে আসে "বসন্ত"। ফোনের ও প্রান্তে বসন্ত-দূতী, "Additional Director General of police" - এর পি.এ, আমার সেই বন্ধু মিতালীর গলা, "মৌসুমী, বসন্ত এসে গেছে। কেমন যেন হু-হু করছে মন। মন-কেমনের বিষাদ-সুর ঝাপটা মারছে বুকে... চল না একবার অতীত ফিরিয়ে এনে সেই-বসন্ত-বাতাস খুঁজি। চল না, একদিন তুমুল গল্প করি 'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে' ঠিক সেই আগের মতোই..."
"সখী, ওই বুঝি বাঁশি বাজে---- বনমাঝে কি মনোমাঝে।।/বসন্তবায় বহিছে কোথায়,/ কোথায় ফুটেছে ফুল......."
আমার বসন্ত
দীপশিখা চক্রবর্তী
অনেকক্ষণ ধরেই ভাবছি বসন্ত নিয়ে কিছু লিখি,কিন্তু কি লিখি!হঠাৎ সেলফোনের এফ.এম এ বেজে ওঠে কবিগুরুর গান,লোপামুদ্রার কণ্ঠে-
"ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান,
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান"
শুনেই মনে লাগে ফাগুনের রঙিন ছোঁয়া।সত্যিই কবিগুরু ছাড়া বসন্ত অসম্পূর্ণ।নজরুলও বসন্তের প্রেম তুলে ধরেছেন অনেক কবিতা ও গানে।তাঁর লেখায় প্রকৃতি সাজে বাসন্তী সাজে-
"এলো বনান্তে পাগল বসন্ত,বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে"।
বসন্ত মানেই মনে এক নিবিড় দোলা,স্নিগ্ধ হিমেল বাতাসের স্পর্শে শরীরজুড়ে নতুন আলোর জোয়ার।বসন্ত আসলেই নিসর্গে নির্মেঘ রোদ্দুরের খেলা।বসন্তের গহীন সুর বারবার ছুঁয়ে যায় আমার সত্ত্বাকে,উঁকি দেয় পলাশ কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙ।ঝরা পাতার আস্তরণ সরিয়ে নীরবে নিভৃতে নিগূঢ় বসন্ত আসে প্রেম নিয়ে।
আমার কাছে বসন্ত মানে পূর্ণতা,নতুন প্রাণের পরশ,পাশাপাশি হাতে হাত রেখে চলা।গাছে গাছে নতুন সবুজ কচি পাতায় স্নিগ্ধ বাতাসের ধীর গতিতে বয়ে চলা জানান দেয় -আজ বসন্ত।নীল আকাশের নীচে লাল সবুজের গালিচা।রুদ্রপলাশের ওপর চুঁইয়ে পড়া রোদে গাছে আজ আগুনের রক্তিম আভা।এত সুন্দরের মাঝেও বসন্ত আনে বিলাপ,বিষাদ।আমার অচ্ছ্যুত শব্দাবলীকে বারবার ছুঁয়ে যায় বিলাসী বসন্তের মিষ্টি ঘ্রাণ। শব্দের পিপাসা মেটাতে পারেনা বিরহী কোকিলের কুহুতান।ঘাসের ওপর ঝরে পড়া বিন্দু বিন্দু শিশির আর বর্ণিল প্রজাপতির ডানা আরো বেশি ব্যাকুল করে তোলে।
সাহিত্যপ্রেম আর মিলনের ঋতু বলেই বসন্ত সাজে রাজকীয় পোশাকে।শীতের জীর্ণতা শেষে প্রকৃতিতে উপমাহীন সৌন্দর্যের উষ্ণতা আনে বসন্ত।মনেও পাল্লা দিয়ে জাগে ঋতুরাজ বসন্তের নতুনত্বের ছোঁয়া।
সাপলুডো খেলা
উজান উপাধ্যায়
তোমাকে এখন আর কাছে চাইছিনা । বারান্দায় গুটিসুটি মেরে যতই করুণ ভাবে চেয়ে থেকে আহ্লাদের প্রত্যাশা কর, উপেক্ষা করছি তোমায়, জেনে রাখো । চুল আঁচড়িয়ে তেল মাখিয়ে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিতে যা যা লাগে রুমালের ভাঁজে সেসব রেখেছো যত্নে মুড়িয়ে-আমি জানি ।বাদামী রঙের গাঢ় এক শৈশব বোতামের ঘর কেটে সুতোর ঘূর্ণিপাকে নিষ্পাপ তাকিয়ে থেকেছে।যদিও এসব সরলমতি মোহে আমি ভুলছি না আর।কোমল প্রাণোচ্ছল হাসি মায়ালু কুসুম স্নেহ রসে আশ্লিষ্ট ত্বক আমাকে মুদ্রা-বিকল্পের স্বস্তি দেবেনা।আমি তো নাগরদোলা খুঁজেই নিয়েছি।উল্লম্ব বৃত্তের ভিতরে তুমি ঢুকে পড়তে পারো, জেনো একটি হ্যাঁচকা টানে তোমার আদুরে আঙ্গুল মট্ করে ভেঙে দেবো প্রবল ঈর্ষাদের একপাত্রে ঢেলে।এইভাবে ফাঁদ পেতে পেতে... ধাপে ধাপে-- রোদের ভিতরে রোদ,মেঘের ভিতরে মেঘ,বৃষ্টিচোখে কাজলের রেখা ,রাতের গভীরে রাত মিশিয়ে দিয়েছি আজ হলদে বিষাদ আঁকা বিপন্ন মলাটে। আহত নিবিড় বোধ ঝুঁকেছে আমার ভিতরে তবু ঝুপ করে চরম সতর্কতা জারি করা আছে।পুরনো খামের গায়ে স্যাঁতসেঁতে ঘাম সুহৃদ অবয়বে বারবার ছুঁয়ে যেতে চাও অষ্টাদশী তন্বীর রূপান্তরিত আত্মার জলবিভাজনে ।জেনে রাখো তবু আর কাছে চাইছিনা নরম বালিশ-- বিছানা প্রশ্রয়।কুটিল গ্রন্থির পাকা ছকে সিঁধে করে দেবো গায়ের জামায় রাখা সহজ পাঠের মুখ। হরফে হরফে।তোমাকে এড়িয়ে চলার বাণী আমি যে নিপুণ ভাবে রপ্ত করেছি।আমাকে হতেই হবে রাজরাজেশ্বর----এইবেলা গোটা পৃথিবীর মালিকানা বুঝে নিতে হবে ।
নব আনন্দে
সুপর্ণা চৌধুরী
দোলের আগের দিন সকালে হোষ্টেল থেকে বাড়ি এলো নেহা। আনন্দের তিরতিরে স্রোতটা বাড়ির সামনে আসার
পর যেন জলপ্রপাতের মতো উদ্ধত গতিতে ঝরে পড়ল।
বাড়ির সামনের লনটাতে বিভিন্ন রঙের সমাবেশ। হলুদ ডালিয়া, সাদা ও গোলাপী পিটুনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, বেগুনি নয়নতারা প্রভৃতি ফুল ফুটে আছে। মা ফোনে বলেছিলেন সব। এখন এ নয়ানাভিরাম দৃশ্য দেখে নেহার মনটা যেন এক অপরূপ স্বর্গীয় আনন্দে ভরে গেলো।
দাদু থাকতে নিজের হাতে এসব গাছ লাগাতেন ও যত্ন করতেন। সে সময় ছোট্ট নেহা ছিলো তাঁর সহকারী। দাদু চলে যাবার পর প্রতি বছর বসন্ত এসেছে, আর
দাদুর বাসন্তী রোদেলা চাদরটা বিছিয়ে দিয়ে গেছে শূণ্য লনে।
এ বছর যেন একটু বেশিই ফুলের
সমাহার, ফুলের রঙের কত বিচিত্রতা! সঙ্গে বসন্ত সকালের দিক্-ভোলা বাতাসে
যেন বিদায়ী শীত ও আসন্ন গ্রীষ্মের মধুর
স্পর্শ। কোকিলের মিষ্টি ডাকে নেহা বিভোর হয়ে গেলো। বাড়ির সকলে তাকে ডাকছে, নেহা সে ডাক যেন শুনতেই পেলো না। গুন গুন রবে তার হৃদয়-
তন্ত্রীতে বেজে যেতে লাগলো বসন্ত গান,
" আহা! আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,
এত বাঁশি বাজে, এত পাখী গায়..."
"গুড মর্ণিং নেহা!" পরিচিত এক স্বর
কানের কাছে। চমকে তাকিয়ে নেহা দেখে
অর্ণব এগিয়ে আসছে, "আরে অর্ণব যে!
কবে এসেছো? কৈ জানি না তো!"
"তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে বলি নি " হাসল অর্ণব। নেহার মুখেও হাসি।
"নেহা, আমি ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টে
চাকরিটা পেয়ে গেছি। সুতরাং, আার আমাদের বিয়েতে বাধা নেই", বাঁধভাঙ্গা
বাসন্তিক হাসি অর্ণবের মুখে।
কথা জোগালো না নেহার মুখেও। গান হয়ে বেরিয়ে এলো তার প্রাণের কথা, "বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা..."
নিষ্ঠীবন
প্রশান্ত কুমার ঘোষ
সাত সকালে বাড়ি থেকে টিউশন পড়তে চলে এসেছি।শিলু,টুকি,পেঁঙি,পুঁটি , -আগেই এসে মাছের মতো ঝাঁক লাগিয়ে ঘুরাঘুরি করছে।ওরা দরজার চাবি খুলতে গিয়ে খাবি খেয়ে বসে আছে।আমি যেতেই শিলু জল হস্তীর মতো থপথপ করে আমার কাছে ছুটে এসে বলে,আরে বকুদা ঘুম কি তোকে জাপটে ধরেছিল।পেঁঙি নিজ স্বভাবে বলে,আহারে দেখ ঘুমপরি কেমন চোখ গুলো লাল করে মুখ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে চলে গেছে।সকলে হাসতে থাকে।আমি ভদ্র-নম্র-সৌম্য তাই ওদের কথায় পাত্তা টাত্তা না দিয়ে চাবি খুলে উপরে এসে বসে গেলুম।
স্যারের আসতে দেরি হচ্ছে।স্যারের বাড়ির সুউচ্চ আলমারির থেকে কয়েকটা বই আমার মনের দরজায় কড়া নাড়ছে।চার ফুট টুলে উঠে দাঁড়ালাম,কোন বইটা নেয়া যায়?ঠোঁটে আলতো করে আঙুল তোলা-নামানো করছি,দেখছি আর ভাবছি।ও বাবা একি!ভূ-ভূ-ভূ -মিকম্প নাকি আমি গড়িয়ে পড়ছি যে।দেখতে দেখতে উল্টে পড়লাম।পেছনটা পুরো জ্বলছে।ভাবলাম পেছনের কোষ স্নায়ু বলে কি ওদের সম্মান টম্মান নাই।সোহাগী হাতটা নিয়ে যেতে শুরু করতেই শিলু,টুকি,পেঁঙি,পুঁটি-হাসির রঙে রাঙিয়ে দিল।ওদের হাসি আমার লজ্জার মাথায় ঘোমটা পরিয়ে দিল।আমার যন্ত্রণাটা আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলছে কিন্তু ঔযে বললুম লজ্জা।শিলুর মাথায় চাঁই চাঁই ঘিলু আছে নাহলে বুদ্ধির বেগুনী ভাজা বের হয়!
শিলু বলে ওরে তুই উঠে পড়লি আমরাতো ভাবলাম চারদিনে লুচি ছিঁড়তে যাব।
পুঁটি বলে,আমার জিভে কষা খাসি মাংসের সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
টুকি বলে,আরে আগেতো অশুপাতের তালিম নিতে হবে,তারপরে মানে একদম মিষ্টি দই আরো সব কতকিছু বাড়ির ছোট ছেলের শেষকৃত্য বলে কথা।
আমি বলির পাঠাঁর মতো মুখ করে বসে আছি।
শিলু বলে,বকুদা কিছু খায়ানা মাইরি।সকাল থেকে কিছুই খায়নি।আমি বললাম কি খাবি বল?
পেঁঙি বলে,তুই যেটি নিয়ে আসবি।আমি বললাম লুচি আর বাঁধাকপির ঝোল খাবি?কথাটি খসা শেষ হবার সাথে সাথেই পন্টিং,লটর পটর পিচকারী,হেঁচকি হায়,মাঝু আর পৃথা এসে হাজির।হেঁচকি মুখটা ধানের বস্তার মতো বেঁধে রেখেছে।
আমি বললাম,মুখটা বাঁধা কেনরে?
লটর পটর বলে,তোর খাবার লিস্ট শুনে লোভে ওর মুখে ঝর্না আড়ি পেতেছে।
পেঁঙি বলে,জানিস আমি সব কাজ পারি শুধু রুটি বেলা ছাড়া।
হেঁচকি বলে,মাঝু-ঝু-ঝু-ঝু-ঝু এসবে পা-পা -পাকা।কথা বলতে বলতেই হেঁচকির নিষ্ঠীবন ঝরে চলেছে।
পন্টিং বলে,পি-রি-রি-রি-থা দশ সেকেন্ডে দশশ বানিয়ে দেয়।
লটর পটর বলে,কিভাবে রে?
পৃথা বলে,আরে লেচি পাকিয়ে পিচ রাস্তায় গাড়ির চাকায় দিয়ে দিলে কত সময় আর লাগবে বল?
হেঁচকি বলে,অ-হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ
শিলু বলে,বাঁধাকপির ঝোল কি করে বানায়রে বকুদা?
আমি বললাম,প্রথমে বাঁধাকপি টুকরো টুকরো করে কেটে ক্লিন জলে ক্লিন করতে হবে,পরিমাণমত আলু,আদা,পেঁয়াজ, রসুন,টমেটো ইত্যদি টুকরোটাকরা করে হাতের সামনে রাখতে হবে।আদা রসুন মর্দন করলেই ভালো হয়।
পেঁঙি বলে,তাহলে বাঁধাকপিটা চার টুকরো করলেই ভালো হবেতো?
পুঁটি বলে,দুভাগ করলেই বেস্ট টেস্ট হবে।
শিলু বলে তোদের মাথায় সেন পার্সেন্ট গোবর,ডিমের মতো গোটা গোটা করলে মন্দ হবেনা।
মাঝু বালতির মত মুখ করে কাটা চেরির উপর জিভটা চরকির মত ঘুরছে।
হেঁচকির নিষ্ঠীবনের রাজত্বে আমাদের ব্যাককভার তেলতেলে হয়ে গেছে।
ভোঁ ভোঁ করে বাইক এসে হাজির।আমরা সবাই হেঁচকির মুখটা ডাস্টারে করে মুছে দিয়ে চক গুঁড়ি ছড়িয়ে অনুকূল পরিবেশ গড়াতেই হাত লাগালাম।
স্যারের আসতে দেরি হচ্ছে।স্যারের বাড়ির সুউচ্চ আলমারির থেকে কয়েকটা বই আমার মনের দরজায় কড়া নাড়ছে।চার ফুট টুলে উঠে দাঁড়ালাম,কোন বইটা নেয়া যায়?ঠোঁটে আলতো করে আঙুল তোলা-নামানো করছি,দেখছি আর ভাবছি।ও বাবা একি!ভূ-ভূ-ভূ -মিকম্প নাকি আমি গড়িয়ে পড়ছি যে।দেখতে দেখতে উল্টে পড়লাম।পেছনটা পুরো জ্বলছে।ভাবলাম পেছনের কোষ স্নায়ু বলে কি ওদের সম্মান টম্মান নাই।সোহাগী হাতটা নিয়ে যেতে শুরু করতেই শিলু,টুকি,পেঁঙি,পুঁটি-হাসির রঙে রাঙিয়ে দিল।ওদের হাসি আমার লজ্জার মাথায় ঘোমটা পরিয়ে দিল।আমার যন্ত্রণাটা আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলছে কিন্তু ঔযে বললুম লজ্জা।শিলুর মাথায় চাঁই চাঁই ঘিলু আছে নাহলে বুদ্ধির বেগুনী ভাজা বের হয়!
শিলু বলে ওরে তুই উঠে পড়লি আমরাতো ভাবলাম চারদিনে লুচি ছিঁড়তে যাব।
পুঁটি বলে,আমার জিভে কষা খাসি মাংসের সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
টুকি বলে,আরে আগেতো অশুপাতের তালিম নিতে হবে,তারপরে মানে একদম মিষ্টি দই আরো সব কতকিছু বাড়ির ছোট ছেলের শেষকৃত্য বলে কথা।
আমি বলির পাঠাঁর মতো মুখ করে বসে আছি।
শিলু বলে,বকুদা কিছু খায়ানা মাইরি।সকাল থেকে কিছুই খায়নি।আমি বললাম কি খাবি বল?
পেঁঙি বলে,তুই যেটি নিয়ে আসবি।আমি বললাম লুচি আর বাঁধাকপির ঝোল খাবি?কথাটি খসা শেষ হবার সাথে সাথেই পন্টিং,লটর পটর পিচকারী,হেঁচকি হায়,মাঝু আর পৃথা এসে হাজির।হেঁচকি মুখটা ধানের বস্তার মতো বেঁধে রেখেছে।
আমি বললাম,মুখটা বাঁধা কেনরে?
লটর পটর বলে,তোর খাবার লিস্ট শুনে লোভে ওর মুখে ঝর্না আড়ি পেতেছে।
পেঁঙি বলে,জানিস আমি সব কাজ পারি শুধু রুটি বেলা ছাড়া।
হেঁচকি বলে,মাঝু-ঝু-ঝু-ঝু-ঝু এসবে পা-পা -পাকা।কথা বলতে বলতেই হেঁচকির নিষ্ঠীবন ঝরে চলেছে।
পন্টিং বলে,পি-রি-রি-রি-থা দশ সেকেন্ডে দশশ বানিয়ে দেয়।
লটর পটর বলে,কিভাবে রে?
পৃথা বলে,আরে লেচি পাকিয়ে পিচ রাস্তায় গাড়ির চাকায় দিয়ে দিলে কত সময় আর লাগবে বল?
হেঁচকি বলে,অ-হুঁ-হুঁ-হুঁ-হুঁ
শিলু বলে,বাঁধাকপির ঝোল কি করে বানায়রে বকুদা?
আমি বললাম,প্রথমে বাঁধাকপি টুকরো টুকরো করে কেটে ক্লিন জলে ক্লিন করতে হবে,পরিমাণমত আলু,আদা,পেঁয়াজ, রসুন,টমেটো ইত্যদি টুকরোটাকরা করে হাতের সামনে রাখতে হবে।আদা রসুন মর্দন করলেই ভালো হয়।
পেঁঙি বলে,তাহলে বাঁধাকপিটা চার টুকরো করলেই ভালো হবেতো?
পুঁটি বলে,দুভাগ করলেই বেস্ট টেস্ট হবে।
শিলু বলে তোদের মাথায় সেন পার্সেন্ট গোবর,ডিমের মতো গোটা গোটা করলে মন্দ হবেনা।
মাঝু বালতির মত মুখ করে কাটা চেরির উপর জিভটা চরকির মত ঘুরছে।
হেঁচকির নিষ্ঠীবনের রাজত্বে আমাদের ব্যাককভার তেলতেলে হয়ে গেছে।
ভোঁ ভোঁ করে বাইক এসে হাজির।আমরা সবাই হেঁচকির মুখটা ডাস্টারে করে মুছে দিয়ে চক গুঁড়ি ছড়িয়ে অনুকূল পরিবেশ গড়াতেই হাত লাগালাম।
বসন্ত-ভ্রমণ
পলাশ--বসন্ত এবং.......
কুমকুম ঘোষ
অসাধারণ পলাশ ফুটেছিল সেবার বিহারীনাথের পথ জুড়ে। বিহারীনাথ বাঁকুড়া -পুরুলিয়া জেলার প্যায় সীমান্ত লাগোয়া আদিবাসী অধ্যুষিত এক গ্রাম।মালভূমি অঞ্চলের যেসব সাধারণ বৈশিষ্ট্য--লাল মাটির দেশে সেসব ই বিদ্যমান।উঁচুনিচু পাহাড় , রুক্ষ ভূমি ,প্রায় চাষবাসহীন অঞ্চল অথচ অঢেল পলাশ গাছ।ফাল্গুন মাসে আগুনরঙা পলাশ জ্বলতে থাকে দিগন্তজুড়ে।নাগরিক কোলাহল মুক্ত উদার আকাশের নীচে সে এক রক্তিম উচ্ছ্বাসের খুনখারাপি মাতামাতি।প্রতিবছর কিন্তু এতো পলাশ ফোটেনা, একথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় এক চা-দোকানি।রোজ ভোরে যাঁর দোকানে যেতাম গলা ভেজাতে।
এমন ই এক ভরা বসন্তদিনে বেড়িয়ে পড়েছিলাম ।কলকাতা থেকে ২২৫কিমি দূরে বিহারীনাথ(বাঁকুড়া)-বরন্তি(পুরু লিয়া) র উদ্দেশে। বালিব্রিজ পেরোনোর সময় ঘাড় ঘুরিয়ে দক্ষিণেশ্বরের মন্দির দেখাটা কেমন যেন অভ্যেস..পতিতপাবনী মা-গঙ্গার দেশের মানুষ আমি, খুব ধার্মিক না হলেও অন্তরে ঈশ্বরকে নিরন্তর অর্চনা করতে ভুলিনা। অজান্তে হাতটা মাথায় ঠেকাই।
সামনেই ধূলাগড় টোলপ্লাজা.. টোল দিয়েই সোজা তিনটে গাড়ি ধরলো দিল্লী রোড।প্রথম হল্ট শক্তিগড়ে, টিফিন--লুচি তরকারি ,চা এবং অবশ্যই বিখ্যাত ল্যাংচা ।এই রাস্তায় যাবো আর শক্তিগড়ের ল্যাংচা খাবোনা রসনাতৃপ্তিতে--তা কি হয়?
এরপর আর থামা নেই , সোজা পানাগড়ের দার্জিলিং মোড়(ডানদিকে বাঁকলেই ইলমবাজার-শান্তিনিকেতনের রাস্তা) পেরিয়ে রানীগঞ্জের দিকে গাড়ি ছুটলো।
বসন্ত-প্রকৃতিকে এতো নিবিড়ভাবে অনুভবের সুযোগ নগরজীবনে প্রায় ঘটেই না , দু একটা বিচ্ছিন্ন শিমূল আর কৃষ্ণচূড়ায়(উন্নয়নের নামে কেটে ফেলা সত্বেও) হয়তো ইতিউতি চোখে পড়ে, কিন্তু এভাবে উদ্দীপ্ত প্রাণের উদ্ভাসের মধ্যে বিচরণের সুযোগ থাকেনা।তাই "প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে" --দীপ্যমান উষ্ণ রক্তিমতার মাদকতায় কেটে গেল দুদিন অনায়াসে।
তৃতীয়দিনের গন্তব্য ১২কিমি দূরে বরন্তি নেচার রিসর্ট।সেদিন ছিল শিবরাত্রি, বিহারীনাথ সেদিন নানা পসরায় সেজে উঠেছিল, একের পর এক বাস থেকে তীর্থযাত্রীরা আসছিল বাবা বিহারীনাথ দর্শনে।ছোট ছোট দোকানে নানান মিষ্টি চুড়ো করে সাজানো--সে এক অন্য পরিবেশ।হই হট্টগোলে শান্ত জনপদ নিমেষে ভরপুর হয়ে উঠেছে--সেই সব কোলাহল পিছনে ফেলে পৌঁছে গেলাম বরন্তি, যেটি পুরুলিয়া জেলায়। এখানে এক দীর্ঘ পথের দুপাশে উদ্দাম পলাশের অবর্ণনীয় রাঙা উল্লাস--প্রকৃতি যেন দুহাত ভরে সিঁদুরের কৌটো পুরো উপুর করে দিয়েছে। এ পথ পলাশ-পথ, --এ পথ রাঙা হাসি রাশি রাশি পলাশের পথ।এবার আর পথ ভোা নয়...সোজা লালমাটির গ্রাম বরন্তি পৌঁছেছিলাম।
সেই আনন্দ বসন্ত সমাগমের অন্তিম রূপটি দেখলাম সেদিন বিকেলেই--সূর্যাস্তের লালিমায় ,যেন কামরাঙা লাল সূর্য ডুব দিয়েছে বরন্তির অন্যতম আকর্ষণ মুরাডি ড্যামের শান্ত নির্জন জলরাশির প্রতিবিম্বে।
এবং --এই রূপ দেখলে মন শুধু একথারই প্রতিধ্বনি শুনতে পায়---
"সকল প্রতাপ হলো প্রায় অবসিত
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের।"(শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
এভাবেই নাগরিক জীবনযাপনের একঘেয়ে ক্লান্তি দূরে ঠেলে শ্লাঘনীয় হয়ে ওঠে প্রতিদিনের যাপন--এক বসন্তে--আনন্দ-বসন্ত-সমাগমে।।
(ছবি: দেবাশিস ঘোষ)
বসন্ত-কোলাজ
শিল্পী: নিপা বিশ্বাস দাস
বসন্ত-গল্প
রোজ ডে
রবীন বসু
নতুন অফিসে আজ জয়েন করল সুবিমল l চাকরি পাওয়া থেকে সে নর্থবেঙ্গলে
ছিল l বার বছর পর এই প্রথম কলকাতায় এল ডিপিও হয়ে
l ডিস্ট্রিক্ট প্রজেক্ট অফিসার
l এর মধ্যে মা মারা গেছেন l বাবা তো চাকরি পাওয়ার
আগেই l বদলে গেছে কলকাতা অনেক l বন্ধু যারা
ছিল তারা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে l কত শপিং মল, বাইপাস, অ্যাপ্রোচ রোড, নিউ টাউন,
ইকো পার্ক l সময় কত দ্রুত হাঁটছে l শুধু সুবিমল যেন সেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে l চশমা-পরা দুটো চোখ, তাঁতের শাড়ি পরণে সেই লম্বা ছিপছিপে কলেজ
জীবনের স্মৃতি l দূরের নক্ষত্র হলেও জ্বল জ্বল করছে এখনও
l
[] []
নিজের চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে দেখে নেমপ্লেটটা
এখনও সরানো হয় নি l মিসেস স্বাতী নন্দী l আগের ডিপিও
l কিন্তু নাম পদবী সব তো এক l সুবিমল ভাবে অবাক
হওয়ার কী আছে ! পৃথিবীতে
কত মানুষ কত পদবী সব
কেমন মিলে যায় l
তখন সবে কলকাতার পার্কস্ট্রিটে আর্চিজ গ্যালারি
হয়েছে l কলেজে কলেজে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভ্যালেনটাইন ডে চালু হয়েছে l আর তার আগে এসেছে রোজ প্রপোজ চকোলেট টেডি প্রমিস কিস হাগ ডে l এতগুলো স্তর পেরিয়ে তবে ভ্যালেনটাইন ডে l বন্ধুরা তাতাল
l যদি মনে ধরে তো বলে ফ্যাল l এই সুযোগ,
গোলাপ দিয়ে শুরু কর্ l
নিউ মার্কেট থেকে টকটকে লাল গোলাপ কেনা হল l আর্চিজ
গ্যালারি থেকে কার্ড l সাহস সঞ্চয় করে হোস্টেল গেটে যাওয়াও হল,
কিন্তু দেওয়া আর হল না l অসুস্থ হয়ে স্বাতী তখন
বাড়ি চলে গেছে l
[] []
সুবিমল চেম্বারে ঢুকে দেখে বড় গোল টেবিলটার
উপর একটা লাল গোলাপের তাজা বোকে l পাশে স্টিকার “হ্যাপি রোজ ডে” l মিস নন্দী ঢুকলেন চেম্বারে
l সুবিমল দেখল, সেই তাঁতের শাড়ি, চশমা-পরা চোখ, রোজ ডের গোলাপ না-দিতে পারা মেয়ে l তারই অপেক্ষার স্বাতী l
—বসুন মিঃ বসাক, এবার আপনাকে চার্জ বোঝাই l
কাল তো আমাকে নর্থবেঙ্গলের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে হবে l
— সে তো হবে l কিন্তু এই গোলাপ, রোজ ডে এসব কার জন্য স্বাতী?
হাসছে স্বাতী l —যদি
বলি, আপনার জন্য l সেদিন তো গিয়েও দিতে
পারেন নি, তাই আজ আমি আপনাকে দিলাম l
—কিন্তু জান তো, রোজ ডের পর কী ডে?
—জানি তো প্রমিস ডে l
টেবিলের লাল গোলাপগুলো তখন বোধহয় আরও বেশি লাল হয়ে উঠল l
ফল্গুধারা
সোমা বোস
সেঁজুতির আজকের পারফর্ম্যান্স নিশ্চিতরূপে সকলকে যে মুগ্ধ করেছে, তার প্রমাণ সকলের সম্মিলিত করতালি। সম্পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ আজ করতালিতে ফেটে পড়ছে যেন। সাজঘরের দিকে এগোতেই সেখানে লাফিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো সেই আদি ও অকৃত্রিম ভাস্কর। তার একমাত্র কড়া সমালোচক। সারা দুনিয়ার লোক যেদিকে হাঁটবে, ওকে তার উল্টোদিকে হাঁটতেই হবে। নাহ্, একদম পছন্দ করে না সে ভাস্করকে। আবার ঠিক অগ্রাহ্যও করতে পারেনা। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে সে একেবারে এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালো “কিরে, সবার হাততালি পেয়ে বুঝি খুব দেমাক হল? আরে লোকে দু’ফোঁটা চোখের জল মার্কা অভিনয় পেলে আর কিছু চায় না। ওই তো প্যানপেনে কান্নাকাটির রোল করে সবাইকে মাতিয়ে দিলি আর ভাবলি না জানি কি অভিনয় করে এলি! ছোঃ”
-
ভালো যা। এতোই যদি খারাপ অভিনয় করি তো, তুই আসিস কেন দেখতে? কে তোকে বলে আসতে?
-
তুই কি ভাবিস, তোর অভিনয় দেখতে আসি নাকি?
-
তাহলে কিসের জন্যে আসিস?
-
বাংলা থিয়েটারের হালচাল দেখতে আসি। তোদের জন্যে থিয়েটার শিল্পটা মাইরি মাঠে মারা যাবে, বুঝলি?
-
যা যা, মেলা ফ্যাচফ্যাচ করিস না। আমরা বাস্তব সমাজটাকে ফুটিয়ে তুলি, মেয়েদের সামাজিক অবস্থানকে সবার সামনে তুলে ধরি। তুই এসবের কি বুঝবি?
-
বাজে বকিস না। চারটে কেঁদেকেটে ওঁনারা মেয়েদের অবস্থা তুলে ধরছেন! কেন বে? মেয়েরা সবসময় কাঁদবে কেন? তোরা চোখে আগুন জ্বালতে পারিস না? শুধু জল বের করতে পারিস? এভাবে তোরা কিস্যু করতে পারবি না এসমাজের।
-
ঠিক আছে যা। পারবো কি পারবো না, তোকে সেটা ভাবতে হবে না। আমি টায়ার্ড, বাড়ি ফিরবো। আর বকাস না তো এখন। পরে এনিয়ে ঝগড়া আছে তোর সাথে।
-
ওই আমার সাথেই ঝগড়া করতে পারিস! আসল জায়গায় মানে প্রেজেন্টেশনের সময় যত্তো ন্যাকামি, কান্নাকাটি। আরে থিয়েটার হল একটা মিডিয়া, যার মাধ্যমে কিছু বার্তা দিতে হয়। পজিটিভ ভাইবস দিতে হয়। ধুর, ছাড়। তোদের মতো আলালের ঘরের দুলালীদের গোদা মাথায় এসব কিস্যু ঢুকবে না। বাই...।
-
এই, “বাই” মানে কি? আমায় বাড়ি পৌঁছে দিবি না?
-
কেন? তোকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার লোকের অভাব নাকি? তাছাড়া তোর এতো ফ্যানস...। কেউ না কেউ ঠিক পৌঁছে দেবে। চললাম, বাই...।
এইজন্যে,
ঠিক এইজন্যে ভাস্করটাকে এতো অসহ্য লাগে, তাতিয়ে দিয়ে কেটে পড়ে। আবার তার সবকিছু ঠিক ফেলেও দিতে পারে না।, আসলে এধরণের সমালোচনার দরকারও তো আছে। সবসময় স্তুতি পেতে থাকলে, তার কাজের মধ্যেকার অজানিত ভুল-ত্রুটিগুলো চিরকাল অজানাই থেকে যাবে। তা শুধরানোর সুযোগ আর পাওয়া যাবেনা। কিন্তু তা’বলে একটা মানুষ কোনসময়ই তার ভালোদিকটা তুলে ধরবে না, সেটাও কি ভালো লাগে কারও? কাউকে ভালোবাসলে কি তার এতো সমালোচনা করা যায়! এর থেকেই বোঝা যায় যে আসলে ও সেঁজুতিকে ভালোই বাসেনা। তো সেঁজুতিরও ওকে ভালোবাসতে ভারী বয়ে গেছে।
সেঁজুতি তার বাড়ির গাড়িতে করে ফিরতেই পারে। কিন্তু “আলালের ঘরের দুলালী” হওয়া সত্ত্বেও সে এই গ্রুপ থিয়েটার করে বেড়ায় বলে বাড়িতে তাকে “ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো” শ্রেণীর বলে উল্লেখ করা হয়। তার আরো কারণ সে পারতপক্ষে বাড়ির গাড়ি ব্যবহার করে না। আশা করেছিল ভাস্কর তাকে পৌঁছে দেবে। কিন্তু সে বাবু মেজাজ দেখিয়ে সত্যিই চলে যাবে ভাবেনি। কান্না পেয়ে গেলো তার, এই রাত্রে সত্যিই তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে পারলো সে! আফটার অল তার বন্ধু! তাকে এতো রাতে একাকী ফেলে যে চলে যেতে পারে, সে আর যাই হোক মোটেই ভালো বন্ধু নয়। এরপরে আর কথা বলতে ইচ্ছে করে এমন মানুষের সাথে!
রাগে মাথা বোঁ বোঁ করতে লাগলো। ভাস্করের বলা কথার প্রমাণ রাখতেই যেন সত্যিই অনেকে তাকে লিফট দিতে চাইছিলো নিজ নিজ গাড়িতে। কিন্তু সে তাদের গাড়িতে যাবে কেন? অগত্যা তখন ওলা বুক করতে বাধ্য হলো, অল্পক্ষণ পরে এসেও গেলো। ওলা-তে বসে আসতে আসতে তার ক্রমশ মনে হতে থাকলো যে ভাস্করের বক্তব্য তার অভিনয় নিয়ে যতটা না ছিল; তার চেয়ে বেশি ছিল নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে, সেখানে পজিটিভিটির অভাব নিয়ে। এসব কথা যত তার মনে হতে থাকলো, তত আস্তে আস্তে তার মাথার বোঁ বোঁ ভাবটা কমে আসলো।
বাড়িতে এসে দেখলো সেখানে তুলকালাম কান্ড! তাদের বাড়িতে সর্বক্ষণের যে জবামাসী থাকে, তার অত্যাচারী স্বামী মারধোর করে তাকে বাড়ি থেকে বিদায় করে দিয়েছে বলেই সবাই জানে। এমনকি তারপর থেকে তার আর কোনো খোঁজখবর নেয়নি এতোগুলো বছর। হঠাৎ করে আজ সন্ধ্যেয় সেই স্বামী তার স্বামীত্বের অধিকারে বউকে তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে হাজির। জবামাসীর আর তার স্বামীর মধ্যে এই ফেরত যাওয়া নিয়ে অনেকক্ষণ থেকেই নাকি টানাপোড়েন চলছে। সেঁজুতি খানিকক্ষণ দেখে যা বুঝলো, তার মা মনে মনে চাইছেন জবা যেন কিছুতেই ফেরত না যায়। জবা যেভাবে তার সংসারের হাল ধরে রেখেছে, তাতে সেরকমটি চাওয়াই স্বাভাবিক। তাছাড়া তার মতো বিশ্বস্ত লোক আজকালকার বাজারে আর কোথায় পাওয়া যাবে। কিন্তু মুখ ফুটে তো আর এসব কথা জনসমক্ষে বলা যায় না। তাই তিনি ঘটনার গতিবিধির ওপরে নজর রাখছেন। স্বামী-স্ত্রীর বাদানুবাদের ভেতরে প্রবেশ করছেন না। সেঁজুতির বাবা এসবের ধারেকাছেও নেই, তিনি তাঁর ঘরে নিজের কাজে ব্যস্ত। তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার দীর্ঘদিনের মান অভিমানের এই যাত্রাপালা শেষ হওয়ার কোনো নামগন্ধও নেই। তা যেন ক্রমশ কথার পৃষ্ঠে কথা টেনে টেনে বেড়েই চলেছে।
কিন্তু এভাবে তো চলবে না। একি সারারাত ধরে চলবে নাকি? একটা কিছু সিদ্ধান্তে তো আসতে হবে। নতুবা হাতে সময় নিয়ে আরেকদিন তাকে আসতে বলতে হবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে। তাছাড়া যে স্বামী একদিন তাকে অসহায় অবস্থায় বের করে দিয়ে নিজেও নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছিল, তাকে এখন এতো পাত্তা দেওয়ারই বা কি আছে? তাই জবামাসীকে সে বলতে বললো যেন তার স্বামীকে কাল বা পরশু বা তার সুবিধেমত অন্য কোনদিন আসতে বলে। আজ এ
ফয়সালা হওয়ার নয়। এ’কয়দিন বরং তারা নিজেরা আরো ভাবনাচিন্তা করুক এবিষয়ে। সেঁজুতির মায়েরও তাই মত হল। কিন্তু জবামাসীর স্বামী তা মানতে রাজী নয়। সে এখুনি ফয়সালা চায়। অগত্যা সেঁজুতিকে বাধ্য হয়ে কড়াভাষাতেই তাকে চলে যাওয়ার জন্যে বলতে হল। আচমকা ধমক খেয়ে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চলেই গেলো। কিন্তু সে চলে গেলে পরে অপ্রত্যাশিতভাবে জবামাসীর হাউহাউ কান্নায় হতচকিত হয়ে গেলো সকলে।
সবাই মিলে তাকে ধরাধরি করে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলে সে যেন আরো ফুলেফুলে কেঁদে উঠতে লাগলো। তার এত বছরের জমা অভিমান যেন বাঁধভাঙ্গা নদীর মত ফুলেফেঁপে বেরিয়ে যেতে চাইছে। একে থামায় কার সাধ্যি! থাক, ও কাঁদুক প্রাণভরে। সেঁজুতি ও তার মা আস্তে করে ওর ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে চলে এলো। ওকে একা ছেড়ে দিয়ে এসে সেঁজুতি নিজের ঘরে এসে চেঞ্জ করে নিলো। মা খেতে ডাকছে, খিদেও পেয়েছে। খাওয়াদাওয়া সেরে দেখলো জবামাসীও খেতে বসছে। নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় ছুঁড়ে দিলো সে। ভাবতে লাগলো, এতোদিন ধরে জবামাসীর মুখে ওই পাজি লোকটার প্রতি কতো রাগ ও
ঘৃণার অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখেছে সে। আজ এতবছর পর সেই লোকটা সামনে এসে দাঁড়াতে সেই বিপুল পরিমাণ রাগ ও ঘৃণাই যেন আছড়ে পড়লো তার ওপরে। কিন্তু লোকটা সামনে থেকে চলে যেতেই একলহমায় ভেতরের সব হিসেব বুঝি বা সব ওলটপালট হয়ে গেলো। রাগ ও
ঘৃণার আড়ালে ফল্গুধারার মতো জবামাসীর বুকে আজও যে এতো ভালোবাসা জমে ছিল, তা বোধহয় সে নিজেও কোনদিন টের পায়নি। মানুষ কি তাহলে আদৌ নিজেকেই নিজে ঠিক করে চেনে?
এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমে তার দু’চোখ লেগে গেছে। হঠাৎ টুংটাং আওয়াজে তাকিয়ে দেখে মোবাইলে আলো জ্বলছে। হাতে নিয়ে দেখলো ভাস্করের মেসেজ “তোকে তো আগেই বলেছিলাম স্পেনের জব পাওয়ার কথা। সেটাতে জয়েন করতে যাওয়ার কথা বলবো বলেই গিয়েছিলাম তোর অনুষ্ঠানে। কিন্তু তোর সাথে দেখা হলেই এতো ঝগড়া হয় যে আসল কথাটাই বলা হয় না। কাল ভোর পাঁচটার ফ্লাইটে চললাম রে, ভালো থ্যকিস। পরে আবার কথা হবে, বাই”। ডুকরে কেঁদে উঠলো সেঁজুতি, ঠিক যেন ওই জবামাসীর মতোই...।
অন্য বসন্ত
সপ্তক
ঘরময় কাগজপত্র কুটিকুটি করে ছেঁড়া, বইগুলো এদিক ওদিক মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে, কোনোটা দুটুকরো হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। কাল খবরটা শোনার পর সে উন্মত্ত হয়ে গিয়েছিল। যে শ্যামলী তাকে পরশুদিনই বলেছিল, "ওরা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে রে, আমি তোকে ছেড়ে কি করে থাকবো নয়ন?" সেই শ্যামলী এই পৃথিবী ছেড়ে, তার প্রিয় নয়নকে ছেড়ে চলে গেল!!! এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। নয়ন বলেছিল, পরীক্ষাটা যাক, একটা কিছু ভেবে বের করবেই, সেটুকু অপেক্ষা করতে পারলো না! এই দুদিন তাদের দেখা হয়নি, ওরা বাড়ি থেকে বেরোতে দেয়নি মেয়েটাকে, না জানি আরো কত অত্যাচার সয়েছে মেয়েটা, একটাবার নয়নের কাছে পালিয়ে আসতে পারলি না! সব দোষ ওর বাবা মায়ের। মেয়েটাকে মেরে তবে শান্তি হল! ওর বাবা মায়ের ওপর প্রচন্ড আক্রোশে, শ্যামলীকে একবার দেখার উদগ্র বাসনায় সে ছুটে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তার দাদারা, বৌদিরা, মা, বাবা কেউ তাকে বেরোতে দেয়নি। তাকে আটকে রেখেছিল ঘরে। সে চিৎকার করলেও শোনেনি। নিষ্ফল রাগে সে হাতের কাছে যা পেয়েছে ছিঁড়েছে, বাবার কিনে দেয়া বইগুলোকে আছড়ে ফেলেছে। তারপর সবাই মিলে তাকে খাটের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল, আজ সকালে খুলে দিয়ে গেছে, এখনো ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। পৃথিবীটা এত তেতো, বিষাক্ত মনে হয়নি কখনো। আর দুদিন পরেই দোল। কত কিছু ভেবে রেখেছিল সে! শ্যামলী আর সে হারিয়ে যাবে সবার থেকে দূরে, সবার ব্যঙ্গ বিদ্রূপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রঙের খেলায় মাতবে দুজনে। সে ওপরের তাকে বাক্সের পেছনে লুকিয়ে রাখা মোবাইলটা নামাল। শ্যামলীর মোবাইল কেড়ে নিয়েছিল ওরা। তার মোবাইলটাও কি কেড়ে নেবার চেষ্টা হয়নি? সে তো শ্যামলীর মত বোকা নয়, মোবাইলটা সুইচ অফ করে লুকিয়ে রাখতো সে। হাজার চেষ্টা করেও তার মোবাইলের হদিশ কেউ পায়নি। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে মোবাইল বের করে ছবি দেখত, তার আর শ্যামলীর কত সুন্দর মুহূর্তের ছবি রয়েছে এতে! কবে থেকে দুজনে দুজনকে এত ভালোবাসতে শুরু করেছিল আজ আর মনেও পড়ে না। দুজনে দুই বেণী ঝুলিয়ে স্কুলে যেত। সে যখন ক্লাস এইটে তখন শ্যামলী সিক্সে। একসঙ্গে খেলতে খেলতে বড় হয়ে ওঠা শ্যামলী তাকে নাম ধরেই ডাকতো। দুজনের বন্ধুত্ব দেখে লোকে বলত, দুই সখী তো নয়, যেন দুই বোন। শ্যামলীর মা সুরোবালা শ্যামলীকে তার কাছে ছেড়ে নিশ্চিন্ত হত। সে ছিল ক্লাসের সবচাইতে জেদীএকরোখা মেয়ে, নয়না বৈদ্য। একটু বড় হওয়ার পর থেকে নিজেকে মনে হতে থাকলো, মেয়ে নয়, সে ছেলে। ফ্রক, সালোয়ার কামিজের থেকে দাদাদের শার্ট প্যান্ট গুলোই বেশী পছন্দ হতে শুরু করলো। একদিন ছোটো করে চুল ছেঁটে এলো। তাই দেখে মায়ের কি রাগারাগি, "বিয়ের বয়স হয়ে এলো, এখন আবার এসব কি সাজ?" কিন্তু নয়না তো মেয়ে থাকতে চায় না, সে শ্যামলীকে বলে দিয়েছে, "তুই আমায় নয়ন বলে ডাকিস শ্যামলী"। শ্যামলীর সঙ্গে গল্প করতে, সময় কাটাতে যতটা ভালো লাগে আর কারো সঙ্গে ততটা লাগে না। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেলেও দুজনের কথা ফুরোয় না। পাড়ায় ফিসফাস শুরু হল। বাড়িতে শ্যামলীর ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা জারি হল। কিন্তু তবু শ্যামলী ফাঁক পেলেই চলে আসতো নয়নের কাছে। বলতো, "এতদিন বুঝিনি রে, তোর সাথে অনেকক্ষণ দেখা না হলে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা হয়।" শাসন তো তার ওপরেও হয়েছিল, কিন্তু নয়ন সেসব কোনোদিনই বিশেষ পাত্তা দেয়নি। সে শ্যামলীকে বলেছিল, " ডাক্তারের কাছে গিয়ে আমি একদিন ঠিক ছেলে হয়ে যাব দেখিস, তখন আমায় দেখে আর কেউ হাসবে না, কেউ বলবে না মেয়েটার কিরকম ছেলেদের মত গড়ন! আর তারপর আমরা দুজনে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করব।" আস্তে আস্তে তাদের নিয়ে টিটকিরি, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ শুরু হল পাড়ায়। হঠাৎ করে এক একদিন দুজনের বাইরে চলে যাওয়া, রাত করে বাড়ি ফেরা, পুকুর পাড়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটানো এসব দেখে পাড়ার লোকের মনে হল পাড়াটা অভদ্র হয়ে যাচ্ছে। দু বাড়িতেই পাড়ার লোক শাসিয়ে গেল। বাড়িতে দাদা, বাবা, বৌদিরা নয়নকে যাচ্ছেতাই বকাবকি করলো।শ্যামলীর বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল, মোবাইল কেড়ে নেয়া হলো, দূরের গ্রামের এক পাত্রের সঙ্গে শ্যামলীর বিয়েও প্রায় ঠিক হয়ে গেল। ইচ্ছে থাকলেও শ্যামলীর ওপর অত্যাচার বেড়ে যাবার ভয়ে নয়ন যোগাযোগ করতে পারেনি শ্যামলীর সঙ্গে। পরশুদিন কখন একটু সুযোগ পেয়ে শ্যামলী দৌড়ে এসেছিল নয়নের কাছে, কেঁদে ভাসিয়ে বলেছে, "তোকে ছাড়া আমি কি করে থাকবো নয়ন?ওরা সত্যি যদি আমার বিয়ে দিয়ে দেয়?" নয়ন বুঝিয়েছিল, বিএ ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হয়ে গেলেই সে একটা কিছু উপায় বের করবে। আজ তাদের সব কথা, সব প্রতিশ্রুতি এক লহমায় থামিয়ে দিয়ে শ্যামলী চলে যেতে পারলো! একটাবার নয়নের মুখটা মনে পড়লো না!!! সব, সব ওর বাবা মায়ের দোষ, না জানি কত কষ্টে, কত অসহায় হয়ে মেয়েটা চলে গেল তার সব ভালোলাগাটুকু ফেলে রেখে। নয়ন ছাড়বে না কোনদিন শ্যামলীর বাবা মাকে, আজ না হোক কাল সে মুখোমুখি হবেই।
শ্মশান যাত্রীরা ফিরে এসেছে। সামনের উঠোন থেকে ওদের কথার আওয়াজ আসছে। সুরবালার মাথায় কিছু যাচ্ছে না। একরত্তি মেয়েটা আর নেই, আর আসবে না কোনদিন ভাবলেই মনে হচ্ছে সব শেষ, সব অন্ধকার! পৃথিবীতে সব কিছুই চলছে, শুধু তার কোল শুণ্য হয়ে গেল!! মেয়েটা ছেলেপক্ষের সামনে আসতে চায়নি। বিয়ে করতে চায়নি, বেদম মেরেছিল সুরবালা। ভেবেছিল বিয়ে দিয়ে দিলে পাড়ার লোকের এত নিন্দা, এত কটুকথা শেষ হয়ে যাবে। কয়েকজন বসে আছে, কে যেন বললো, "টিভিটা চালা তো, সিরিয়ার খবরটা দেখাচ্ছে, কতশত বাচ্চাকে মেরে ফেলল!" তার মেয়েটাকে কে মারলো, কার দোষে চলে গেল মেয়েটা? ওই যে ওখানে বসে আছে নগেন জ্যাঠা, শ্যামলীর বাবাকে বলেছিল, "মেয়েটাকে সামলা হিতেন, নয়তো একঘরে হয়ে যাবি।" সুরেশকাকা বলেছিল, "ছি, ছি, লজ্জায় মাথা কাটা গেল। পাড়ার বাইরে বেরোতে পারিনা। এরপর এপাড়ার মেয়েদের জন্য ছেলে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।"
দুপুর পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ, সুরবালা আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো উঠোনে। হলুদগাঁদা ফুলগুলোতে এখনো মেয়েটার হাতের ছোঁয়া লেগে রয়েছে। দুদিন পরে দোল, মেয়েটা আবীর খেলতে বড় ভালোবাসতো। দূরের রাস্তা দিয়ে একঝাঁক মেয়ে হাসতে হাসতে চলেছে, শুধু তার মেয়েটা আর কোনদিন হাসবে না এইভাবে, কোথায় যেন বাজছে, "রাঙিয়ে দিয়ে যাও....।"
দুই জাদুকরের গল্প
পিনাকি
১
নিজের বিদ্যার উপর
অহংকার করা , বুদ্ধিমানের কাজ নয়
। যদি
কেউ বলেন - তুমি
এমন চমৎকার বিদ্যা আয়ত্ত করলে
কোত্থেকে ?
বিনয়ী ,
বিনম্র উত্তর হবে -
আপনাদের আশীর্বাদে ।
সত্যিকথা বলতে ,
স্রেফ আশীর্বাদে মনের বল
পাওয়া গেলেও , বিদ্যা পাওয়া
যায় না । বিদ্যা
আয়ত্ত করতে গেলে
অধ্যায়ন দরকার । তপস্যা দরকার
। আর এত
কিছু করে কেউ
যদি বিদ্যা রপ্ত করে
ফেলে , হাল্কা হলেও তার মনে
নিজের প্রতিভার উপর অতিরিক্ত
আস্থা জন্ম নেবেই । এই
অতিরিক্ত আস্থাই কি অহংকার
নয় ?
পর্ণাদ এইসব
কথা ভাবছিল । সে , সকলের
সামনে নিজের অহংকারকে
প্রকাশ করেনা । আবার সেই
অহংকারকে অপ্রকাশের চেষ্টাও করেনা । ফলত এই
নিরাসক্ত হাবভাব
দেখে , অনেকেই ভেবে
নিয়েছে --- নিজের
প্রতিভাকে জাহির করবার জন্যই
শুধু নয় , অন্যকে পাত্তা
না দিয়ে , তাকে অপমানিত করবার
এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য
তার চরিত্রে রয়েছে ।
এটা অনেকেই মেনে নিতে পারেনা ।
সবাই সব কিছু মানবে
এমনটা হতে পারেনা । তাই হয়ত
ইদানীং অনেকেই এড়িয়ে
যাচ্ছে । কেন যাচ্ছে ? একজন মানুষ কে
আরেকজন মানুষ এড়িয়ে যায় , তার কারণ কোন ভাবে
যদি সেই মানুষটি এমন একটা বিরক্তির পরিবেশ তৈরী করে
-- যেখানে উল্টো দিকের
ব্যক্তি কোন
প্রতিরোধের সুযোগ ছাড়াই অপমানিত হবে ।
এতে ভৃগু
বংশজাত পর্ণাদের জাত্যাভিমান
ভরা মনে এতটুকু
খোঁচা লাগেনি । সে এতটুকু
বুঝে গিয়েছে , ক্ষমতা
থাকলে যেমন তার
অপব্যবহার রুখতে পারাটা বেশ
শক্ত । তেমনই , তার জনপ্রিয়তা
অনেকের কাছে ঈর্ষার
কারণ ; সে চাইলেও এই পরিস্থিতির
পরিবর্তন করতে পারবে না।
আচমকাই
কোত্থেকে আরেকজন লোক
এসে তার সামনে প্রতিযোগিতার
লক্ষ্য রেখে দিল ! সেই দিন থেকেই
, নিজের
বিদ্যার প্রতি তার
বিশ্বাস খানিকটা হলেও নিজের
কাছে সন্দেহের ।
এক সকালে , জঙ্গলে
বড় গাছের তলায় বসে – বসে
, পর্ণাদ ভাবছিল । গাছের মাথা ভর্তি পাতার
ফাঁকে আলো ঝলমল করছে ।
এই জঙ্গলে দু’ বছর
আগেও মানুষ পা রাখতে
ভয় পেত । এখানকার জন্তুরা মানুষের
যাতায়াত পছন্দ করত না ।
কিছুটা দূরে আশ্রম তৈরী করা হয়েছে ।
সেখানে ব্রাক্ষ্মনরা তপ , পূজা যজ্ঞ করলেও ,
তাদের প্রাণে
ভয় ছিল ।
সে দু’ বছর আগের
কথা । এখন এই
আশ্রমকে কেন্দ্র করে
এক জনপদ সৃষ্টি
হয়েছে । এই যে পরিবর্তন , তার পিছনে পর্ণাদ
জাদু রয়েছে !
হ্যাঁ , সবাই
তাকে সমীহ করে । সে
নিজে দেখেছে তার
বন্ধুরা , যতটা সমীহ করে , তার চেয়েও বেশী হিংসা পুষেছে মনে । এর
প্রধান কারণ পর্ণাদের বয়স
মাত্র চল্লিশ , আর তাতেই তার
নাম ছড়িয়েছে ।
সাধারণ মানুষেরা দীক্ষা নিতে
আসছে । এই স্বীকৃতি এত অল্প সময়ের
মধ্যে অর্জন --- খুব
সহজ কাজ ছিল
না ।
কিন্তু তার কাছে
এমন কোন
ক্ষমতা আছে ?
২
খুব ছোটবেলা থেকেই
নিজের উপর বিশ্বাস
ছিল ।এই বিশ্বাসটা এমনিতে
আসেনি , পর্ণাদের তখন বয়স
মাত্র দশ । একদিন
স্নান করবে বলে
সহপাঠীদের নিয়ে , গভীর জঙ্গলের ভিতর হেঁটে
যাচ্ছিল । জঙ্গলের ভিতর খুব সুন্দর
পদ্মফুলে ভরা ঝিল
রয়েছে । সেখানে স্নান
করবে বলেই , তাদের এই পথে আসা
। এখনে সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে ,
মানুষখেকো ভল্লুক । একে বাগে আনতে পারাটা বেশ শক্ত
কাজ । এর আগে অনেকেই প্রাণ
দিয়েছে , ভল্লুকের থাবায় । মিত্রদের
কথায় , একফোঁটাও ভয় লাগল না ।
সবেমাত্র
কিছুটা এগিয়েছে , সামনের
ঝোপে কিছু নড়ছে !
পর্ণাদ কে সামনে রেখে
, পিছনে দাঁড়িয়ে ।
মুহূর্তে বেরিয়ে
এল সেই দানব
ভল্লুকটা ! মৃত্যু নিশ্চিত । কাঁপছিল সবাই
। পর্ণাদ জন্তুটির চোখের
দিকে তাকিয়ে রয়েছে । দেখে এতটুকু বুঝতে
পেরেছে - মৃত্যু অপেক্ষারত ; ভল্লুকটির
ক্ষুধার্ত মুখের হাসি
তাই বলছে । তার সাথিরা
এতটাই ভীত , তারা হাঁটু
মুড়ে বসে
পড়ল ।
পর্ণাদের সামনে
জন্তুটি এসে দাঁড়িয়েছে । তাকে দেখে
মনে হচ্ছে ,এই
প্রহর শেষ প্রহর। চোখের
দিকে তাকিয়ে হারিয়ে গেল সে ।
কতক্ষণ কেটেছে কেউ
জানেনা । তার
নিজের হুঁশ নেই ।
বন্ধুরা , তাকে ছুঁতেই
পর্ণাদ বুঝতে পারল সে দাঁড়িয়ে!
সাথীরা তাকে
জড়িয়ে ধরেছে । - তুমি আমাদের
বাঁচালে কোন জাদুমন্ত্রে ?
-কেন ?
-জন্তুটা
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে
কেমন যেন তেজহীন
হয়ে গিয়েছিল ! মাথা নামিয়ে সরে
গেল ।
পর্ণাদ সেইদিন
বুঝতে পারল , তার মধ্যে পশু সম্মোহনের এক
বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে ।
এই ক্ষমতাকে পুরোপুরি ব্যবহার
করতে হবে
। একমাত্র এই বিশেষ
গুনটিই তাকে অন্যদের
থেকে আলাদা করতে
পারে ।
সেইদিন থেকে আর
সময় নষ্ট
নয় । পর্ণাদ দীর্ঘ আঠাশ
বছর
এক গুপ্ত সাধনায় মগ্ন
থেকেছে । সে এই সময়ের
মধ্যেই , বন্য পশুপাখিকে বশ
করে নিজের ইচ্ছানুযায়ী , চালনা করতে
শিখেছে । তার এই বন্য প্রাণীদের
সাথে একাত্মটার গল্প
ছড়িয়ে পড়তে থাকে । বনে
থাকবার জন্য , সে
এতটুকু বুঝে গিয়েছে
- হিংস্র জন্তুদের বশে
আনতে হলে , তাদের প্রতিটি
অনুভূতি লক্ষ্য করতে হবে
। বুঝতে হবে
। এটা করতে
হলে দরকার পর্যবেক্ষণের । সে যদি প্রাণী হত্যা
না করে , প্রাণীর
মাংস ভক্ষণ না করে
--- বন্যপ্রাণীদের সাথে
মিশতে অসুবিধা হবে
না। এমন ভাবেই নিজের
ক্ষিধে কাবু করে
, যথাসম্ভব অল্প
শাক – পাতা গ্রহণ করে
দেশ পারদর্শী হয়ে
উঠেছে । এমন ভাবেই একটি
বনাঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু
করে । সেখানকার পশুদের নিকটবর্তী
জনপদে ব্যবহার করতে
থাকে । পর্ণাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে ।
এক অপরাহ্ণের শেষ
আলোয় , পর্ণাদ নিজের কৃতিত্বের
আনন্দ নিচ্ছিল , শাল গাছের
তলায় , নিরিবিলিতে । সে দেখল
সামনে এক জটাধারী । নোংরা
লোক দাঁড়িয়ে হাসছে ।
গায়ের রং অনুজ্জ্বল ।
আগন্তুককে দেখে , পর্ণাদ প্রথমে ভিক্ষুক
বলে পাত্তা দেয়নি । লোকটি গম্ভীর
গলায় বলল- আপনি ঋষি পর্ণাদ ?
ভিক্ষুকটির
মুখে নিজের নাম শুনতে মোটেই
ভালো লাগছিল না । পর্ণাদ বলল
-তুই কে ?
লোকটি হাসছে ।
-সে কথা পড়ে
বলব । আগে দেখি
আপনি কতটুকু জানেন ।
-মানে !
-শুনেছি আপনার অনেক
ক্ষমতা ।
-দ্যাখ , তোর
খাদ্যের দরকার হলে
, ফল নিয়ে
নিতে পারিস । এখানকার কোন পশু
ক্ষতি করবে না ।
-আপনি বুঝি ওদের
বশ করে
রেখেছেন ?
-তা রাখতেই
হবে । দরকারে ওদের
ব্যবহার করি । আমার
আশ্রম চলছে , ওদের
উপার্জিত অর্থে ।
-ওদের , বশ করে
নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন ! এই আপনার সাধুত্ব !
-দেখ এটা আমার
অলৌকিক শক্তি । কঠিন তপস্যার
ফল ।
এই কথা শুনে আগন্তুক
জোরে
হাসল ।
-এই হাসির কারণ ?
-আপনার মূর্খামি ।
আপনি জ্ঞানী হয়েও
সামান্য অশিক্ষিতের মতনই
কথা বলছেন ।
-মানে ?
-আপনি যে শিক্ষা
দেখালেন , তা নেহাতই
বিদ্যা । আমিও এতে বেশ রপ্ত ।
এটাকে অলৌকিক বলে ,
নিজেকে হাস্যকর করবেন না ।
আমি এতটুকু জেনেছি , গোপনে
একান্তে চর্চা করেছেন ,
বেশ পরিশ্রমের কাজ । আপনি সফল । অবশ্য এই বিদ্যা
আমিও শিখেছি , তাই বনের পশু – পাখিকে আমি
ভয় পাইনা । আপনার বিদ্যা আমি জানলেও , আপনি আমার
বিদ্যারপ্ত করতে পারবেন
না।
-কেমন বিদ্যা ?
-এই দেখুন...
আগন্তুক মুহূর্তে
নিজের হাতের মাঝখানের আঙ্গুলে ,
ধারালো অস্ত্র দিয়ে
খোঁচা দিতেই , রক্তের
জায়গায় ছাই বেরোতে
শুরু করল !
পর্ণাদ অবাক হয়ে
তাকিয়ে দেখে বুঝল ব্যাক্তিটি
সাধারণ
ভিক্ষুক নন । এই
বিদ্যা শিখতে হলে ,
মানুষটিকে প্রসন্ন করতে হবে
।
হাত জোর করে
বলল – আপনি ক্ষমা করবেন । আমি আপনার
প্রতিভাকে বুঝতে পারিনি । অহেতুক অপমান করেছি ।
ক্ষমাপ্রার্থী । অনুগ্রহ করে
, পণ্ডিত নিজের
পরিচয় দেবেন ।
আগন্তুক বলল – আমি
কে ? কোত্থেকে এসেছি আর কেনই এলাম ! আজ নয়
, আগামী কাল বলব ।
এখানে নয় , সামনে পাহাড়ের পিছনে
আমার আস্তানা । তোমাকে
কাল সকালে আসতে
হবে । আমি এখন যাই ...
পর্ণাদ মনে - মনে
বলল - এই বিদ্যা
আয়ত্ত করতে পারলেই ,
তার কদর আরও বৃদ্ধি পাবে । সাথে
এই আগন্তুকের পরিচয়
জানতেই হবে ।
৩
ঢিবির সামনে দাঁড়িয়ে ,
পর্ণাদ আগন্তুকের কথা ভাবছিল । পিছনে বনভূমি ।
বনভূমির শুরুতে তার
জনপদ । শেষে , আগন্তুকের আস্তানা
। আকাশে সন্ধ্যার অন্তিম মুহূর্তের ছায়া –ছায়া অন্ধকার
রয়েছে ।
আগন্তুক ,
সামনেই । ধ্যানমগ্ন অবস্থা থেকে
কিছুটা জ্ঞান ফিরতেই
লোকটিকে , পর্ণাদ বলল -নমস্কার
প্রভু । আপনার বিদ্যা আমাকে
অবাক করে দিয়েছে ! অনুগ্রহ করে
আমাকে শিক্ষা দিন । এই জ্ঞান
দান করুন । আমি এমন
অদ্ভুত কৌশল শিখতে
চাই । আপনার শিষ্যত্ব
গ্রহণ করব ।
শান্ত চোখ দুটো দিয়ে
, মোলায়েম জ্যোতি
যেন ছড়িয়ে পড়ছে ! আগন্তুকের দিকে
তাকিয়ে , পর্ণাদ সব
কিছু ভুলে যাচ্ছে । একেই বোধহয় বলে
বাহ্যজ্ঞান লোপ পাওয়া । আগন্তুক বলল -আমি
এমন কিছুই জানিনা ,যা তোমাকে
দান করতে পারি ।
পর্ণাদ হাত জোর
করে বলল
-এমন অদ্ভুত তপস্যা
। রক্তের বদলে ছাই ! সাধারণ
মানুষ এটা করতে
পারবে না ।
আগন্তুক হাসতে –হাসতে বলল – আমি সাধারণ নই , আমি
অতিসাধারণ । তুমি ভাবো , রক্তের
বদলে ছাই ঝরতে
থাকে ? তোমার দেহে
রক্তের রং শুনেছি
সবুজ । এটা সত্যি ? আচ্ছা তোমার মনে
এমন কোন ধারণা
রয়েছে , তপস্যায় যা
সত্যি নয় তাই হতে পারে ?
-না । আমি শুধু
আমারটা বলতে পারি । আমার দেহের
রক্তের রং সবুজ , ওটা
আমার জাদু কৌশল ।
-ধরে নিতে পারো ,
আমারটাও তেমনই এক
কৌশল ।
-ঠিক বুঝলাম না ।
-এটা একটা বিশেষ
রকমের কৌশল , মানুষের চোখকে
ফাঁকি দিয়ে বিশ্বাস
করানো । এর মধ্যে বিজ্ঞান
লুকিয়ে রয়েছে । শুধু তাই
নয় , দেহের প্রতিটি পেশীর
চলাচল নিখুঁত হতে
হবে । আমি রক্তের বদলে
ছাই দেখাচ্ছি , কেবল খুব দ্রুততায়
তোমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ।
এই দর্শকের চোখকে
ধাঁধায় রাখবার কৌশল
হচ্ছে জাদু । তুমি আসলে
আমার জাদুর স্বীকার । আর জাদু কিন্তু
অলৌকিক কিছু নয় । আমি তোমায়
লৌকিক খেলা দেখিয়েছি ।
-অদ্ভুত ! আমাকে শিখিয়ে
দিন ।
- পর্ণাদ , তা না হয়
শেখালাম । শুধু বিদ্যা শিখলে হবে না
। এই শিক্ষার উপযুক্ত ব্যবহার করতে হবে ।
মনে রাখবে ,
অলৌকিক বলে কিছুই নেই ।
যে বিদ্যা মানুষের
সভ্যতার জন্য ব্যবহার
করা হয় তা বিজ্ঞান
হয়ে যায় । আর যে
বিজ্ঞান লুকিয়ে রেখে মানুষকে
বিনোদন দেওয়া হয় ,
তা জাদু বিদ্যা হয়ে
যায় । এর মধ্যে
কখনই ব্যক্তিগত লোভ থাকা
উচিত নয় বলে
আমি মনে করছি । তুমি
নিজের মতন চলতেই
পারো । পশুদের বশ করে
নেওয়ার কৌশল সভ্যতার
উন্নতির জন্য ব্যবহার
করা যেতেই পারে
। তুমি নিজেকে জাহির করবার
জন্য এই বিদ্যার
প্রয়োগ করলে , ফল ভয়ানক হবে । পশুদের বন্দী করে রাখাটা প্রকৃতি বিরুদ্ধ !
কিছুক্ষণ থেমে পর্ণাদ
বলল
-আমি চাই সকলে আমাকে
শ্রদ্ধা করবে । ভয় পাবে ।
- শ্রদ্ধা যাকে করে
, তাকে সবসময় ভয় নাও করতে পারে
। বিদ্যাকে অহংকারের
আঁচে ফেলে নষ্ট করে কিছু লাভ
নেই... তোমার একান্ত সাধনাকে
বাঁচিয়ে রাখো । মানুষের জন্য ব্যবহার করো ।
কিছুক্ষণ থেমে আবার
জটাধারী আগন্তুক , পর্ণাদের উদ্দেশ্যে
বলল – তুমি যে কৌশলটি রপ্ত করেছো , তা
নিঃস্বার্থ ভাবে ব্যবহার
করো । আমি কোন এক সময়ে এখানে
এসে , তোমাকে শিখিয়ে
দেব । শুধু
বিদ্যা শিখলেই দায়িত্ব
শেষ হয়ে যায় না। প্রয়োগ
শিখতে হয় । সেই প্রয়োগকে সুন্দর করে
তুলতে হবে । নতুন সভ্যতা তৈরী হচ্ছে । মানুষের জন্য
অলৌকিকতা শুধুই গল্পের বিষয় হয়ে থাকুক ।
পর্ণাদ আগন্তুকের পা’য়ে হাত
দিয়ে প্রণাম করল । চোখ দুটো জলে ভরে গিয়েছে । নিজেকে আগের
থেকে হাল্কা মনে হচ্ছে । এই জাদু কোন মন্ত্রে সম্ভব হল ! সে নিজেও জানেনা ।
খুব জানতে ইচ্ছা করছে , সামনের মানুষটির পরিচয় । পর্ণাদবলল –
আপনার পরিচয় ?
আগন্তুক হাসছে
। বলল – আমিও ভিনদেশী
জাদুকর । বরফ
রাজ্য হিমালয় থেকে এসেছি ... তোমার নাম
শুনেছিলাম । তাই দেখতে
এসেছি । আমি এতটুকু বুঝে গিয়েছিলাম
, তোমার বিদ্যার উপযুক্ত ব্যবহার তুমি করতে পারছ না । তাই তোমায় বিশ্বাস করালাম , এই
বিদ্যাই মানুষের কাছে
জাদুবিদ্যা নামে পরিচিত
হবে । আমরা যে অলৌকিক বিদ্যাকে গল্প কথায় বন্দী
করলাম , সে সব কিছুই বিজ্ঞানে মোড়া জাদু
কৌশল ।
জীবন প্রদীপ
মমিদুল মিঞা
পিদ্দিমের আলোটা আজ ক্রমশ নিভে যেতে চাইছে।
তবুও জোর করে তাকে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কয়েকজনে। আর ফেলছে মুহুর্মুহু
দীর্ঘশ্বাস!
অদূরে অঘোরপন্থীরা খেলছে, চলছে মাতলামো। কেউ কেউ
আবার বকাঝকা করছে তবুও থামাতে পারছে না মারামারি।
ওই যে অবুঝ শিশুদুটো, কাল উচ্চকণ্ঠে চিৎকার
করে খেলছিল পথের ধারে- তারাও আজ কেমন যেন নিরলস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কোন কথা নেই, তাদের নেই কোন আবদারের
তোরজোড় !
আজ চেনা-অচেনা অনেককেই চোখে পড়ছে। কিন্তু মনে হচ্ছে আলাপ করবার মত সময় তাদের কারো নেই।
কেউবা জানতে ব্যস্ত, কেউ আবার ভাবতে; কেউবা বলছে এরপর কি
হবে ??
পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম শ্বাসটা আর চলছে না; অখিল আর বেঁচে নাই!!
বসন্ত-কবিতা (অন্তিম পর্যায়)
শেষ পর্যন্ত
জয়ন্ত চ্যাটার্জী
জয়ন্ত চ্যাটার্জী
ভেসে বেড়ানো অক্ষর গুলো শব্দ হতে চেয়েছিলো,
আনন্দের এই বসন্তে পর্ণমোচীর শাখাগুলি দাবী রেখেছিলো
তোমার-আমার কাছে প্রাণ খোলা প্রশ্বাসের।
বসন্তবিলাপের আর্তি নিয়ে মেরুদণ্ডহীন দেহগুলি,
এযাবৎকাল যারা দারিদ্রতার চরমতায় পৌঁছেছে,
শ্মশানআলোয় জ্বলে উঠে মৃত্যুভয়কে তারাই পরাভূত করেছিলো।
তুরাইয়ের রঙ্গিন শুভেচ্ছা
পিয়াংকী মুখার্জী
পিয়াংকী মুখার্জী
জীবনের প্রচুর জটিলতা কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনের মতো , আমায় গ্রাস করতে চাইছে
ব্ল্যাকহোলের পরিবৃত্তে ,
ব্ল্যাকহোলের পরিবৃত্তে ,
শারীরিক চাহিদায় ঘেরা সম্পর্কগুলো এখন ভেজাল রংয়ের মতো পার্থিব এ দেহের আনাচে-কানাচে-অলিতে-গলিতে লেপ্টে দিয়েছে বিষ ,
তিন-চতুর্থাংশ দেহ-ই আজ অ্যালার্জির বশবর্তী !
তিন-চতুর্থাংশ দেহ-ই আজ অ্যালার্জির বশবর্তী !
বিনা স্পর্শানুভূতি , অদৃশ্য বন্ধন , এডিটিং করা প্রোফাইল পিকচার আর আনলিমিটেড চ্যাটিং...
দেহ-মনন আজ বড্ড বেশি মেকানিকাল ,,,
চাই একটু ভেষজ ভিটামিন !
দেহ-মনন আজ বড্ড বেশি মেকানিকাল ,,,
চাই একটু ভেষজ ভিটামিন !
আজ এ বসন্তে...
নিজেকে আরো একবার নতুন করে আবিষ্কার করবো ,
তোমার কুড়িয়ে আনা পলাশের রক্তাভ লালচে লিপস্টিকে !
নিজেকে আরো একবার নতুন করে আবিষ্কার করবো ,
তোমার কুড়িয়ে আনা পলাশের রক্তাভ লালচে লিপস্টিকে !
নিজহাতে তোমার সাজিয়ে দেওয়া হলুদ গাঁদার জাল-খোঁপায় বন্দী হবো আজ কুমকুম বসন্তে !
ঝুলবারান্দার গ্রিল ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে যে নীলকণ্ঠ ,
আমি জানি, ও তোমার হাতের ওম্ মাখে রোজ ,
আমার স্নানঘরের সুখের ঠিকানায় আজ ও দুলবে আদুরিয়া ভোর হয়ে !
আমি জানি, ও তোমার হাতের ওম্ মাখে রোজ ,
আমার স্নানঘরের সুখের ঠিকানায় আজ ও দুলবে আদুরিয়া ভোর হয়ে !
বীরভূমের লাল-মাটির দেশে মহুয়া ফলের মাদকতায় , আলটুসে রংয়ের ভালোবাসায় আজ স্নাত-সিক্ত হবো ,,,
মেহুলি হবো আজ এ বসন্তে...
কচি আমের মুকুলের গন্ধে ,
শিমুলিয়া-মাদারিয়া আগুনে ,
ঋতুরাজ হয়ে রাইকে আজ... বাসন্তীপ্রেমে আমৃত্যু বেঁধে নাও
তোমার ভালবাসার পৌনঃপুনিকে !!
শিমুলিয়া-মাদারিয়া আগুনে ,
ঋতুরাজ হয়ে রাইকে আজ... বাসন্তীপ্রেমে আমৃত্যু বেঁধে নাও
তোমার ভালবাসার পৌনঃপুনিকে !!
ফাগুন
নমিতা বসু
চিঠি এসেছে ফাগুনের
রঙ লেগেছে বনপুলকে
মহুয়ার নেশায় বুঁদ
হয়েছে দেহ মন।
আগুন রঙে সেজেছে
শিমূল পলাশ
ছড়িয়েছে তার রঙের দ্যূতি
হাওয়ায় ভাসিয়েছে তার
ভালবাসার পরশ।
আকাশে দেখ
ভালবাসার পূর্ণিমার চাঁদ
ফাগুন রঙে রাঙা
ফাগুনে মেতেছে বিশ্বভূবনে
ফাগুনে মেতেছি আমরা।
এ কোন বসন্ত
সব্যসাচী ঘোষ
খবরের কাগজ খুলতেই
খুন ,ধর্ষণ,রাজনৈতিক হিংসা...
দূষণের আকাশে নিষ্পাপ বাতাস
আর উকি মারেনা
ফাগুনের বসন্ত উৎসবে।
আর কোকিল গেছে
মানুষের মনের খুশিকে খুঁজতে..
ফিরে এলনাত আর..
ল্যান্ড মাইনের বিস্ফোরণে -
কেঁপে উঠছে এই দেশ এই সময়
তবু আশা ......
একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
হাওয়া আর ধুলো মেশানো
সে পরীক্ষার দিনগুলো
রুক্ষ সুক্ষ কিন্তু...
বসন্তের গন্ধ মাখা পরন্ত বিকেল
উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসা ..
অঙ্ক ভুল করে ফেলে আসা
ক্লাসরুমের দাদাদিদির প্লাস দিয়ে নাম লেখা বেঞ্চে.....
রোজ বিকেলে কোকিল সিটি মারতো মিঠু রন্তু বাঞ্ছারা...
ক্রিকেট খেলতে যাবো বলে।
সব হারিয়ে গেল ...
বসন্তের কোকিলের মতোই,
তবু আশা .............
একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
দেবারতি চক্রবর্তী
আরম্ভে পরিচিত হইনি
আঙুল নখ চুল অদেখা অচেনা
অনেক সময় পারে হয়েছে নিশ্বাসও অনুভূতি ছোঁয়নি
আজ হঠাত্ তোমায় শেষ হতে দেখলাম
অচেনাই ছিলে,তবুও শেষ ছোঁয়ায়
পুরোনো চেনা হয়ে রইলে
তুমি পুড়ে যাচ্ছিলে ধূসর আভার বৃদ্ধি হচ্ছিল
চারাদিক নির্জন নিস্তব্ধ
হারিয়ে গেলে একপলকে
তোমায় খুঁজি মাঠ পেরিয়ে জল ছুঁয়ে।
বসন্ত
জয়শ্রী চ্যাটার্জী
বসন্ত এসেছে ফিরে
শিমূলের রাঙা আভায়
প্রকৃতির মনে জ্বলে
অষ্টাদশীর আগুন।
চালশে ভুলে জিহীর্ষু
ব্রহ্মা স্বয়ং
বনসাই স্বপ্নে ভাসে
বুড়ো অশ্বত্থ বট।
কুয়াশা ঘেরা আকাশ
তবুও উজ্জ্বল নক্ষত্রের উপস্হিতি!
মিলন আবেশে তঞ্চিত
জ্যোৎস্না মাখা যামিনী
প্রভাত পাখীর কুজনে
জাগে অপভাষের রঙ...
অন্য বসন্ত
সুব্রত নন্দী
বছর ঘুরে বছর আসে,বসন্তের সমাগমে।
সুখদুঃখের স্মৃতিপট এঁকে যায় পাতায় পাতায়।
নবপ্রেরণা জাগিয়ে আবার অস্তমিত ঘোলা জলের অলিন্দে।
ঘোলা জলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ জানা নেই তার।
তবুও বসন্ত আসে ফিরেফিরে,যদি মলিন ক্যানভাস রঙিন হয়?
কৃষ্ণচূড়া,শিমূল,পলাশ ফিরে পায় স্বকীয়তা।
ফাগুনের উৎসবে মেতে ওঠে ধরার জীবকুল।
শুধু অভাগী তাকিয়ে থাকে অধীর অপেক্ষায়!
রঙিন বসন্ত কী পালটাতে পারে তার ক্ষতবিক্ষত মনের রঙ!
পলাশবনের আঁধার নামে জীবন্ত কৃষ্ণচূড়ার মাথায়।
মূল্যহীন শিমূল পলাশের রূপ রস গন্ধ!
ফাগুনের বসন্ত উৎসব বর্ণহীন তার জীবনপথে.....
তোমাতেই আমার অভিসার
তৃপ্তি মিত্র
বসন্ত তোমার মনে আছে
ভাঙ্গা সূর্য্য তার শেষ আবির আদর বুলিয়ে
শিমুল পলাশ কে ছুঁয়ে বিদায় নেবার কালে
তোমার আমার প্রথম দেখা
চোখে চোখে গোপন কথা
তোমার আমার হুঁস ছিল না
স্বপ্ন ডিঙ্গায় প্রেমের দোলা
ঠোঁটের কোনে প্রবল নেশা
মনের মধ্যে সাগর দোলা
একটু খানি আড়াল টেনে
লাল আবিরে রাঙিয়ে দেওয়া
বসন্ত সেদিনের সেই বিকেলের দিব্যি
আমি আজ ও সেই আবির ছোঁয়া
পড়ন্ত বিকেলের অপেক্ষায় ৷
হঠাৎ কেউ রুক্ষ গলায় --এই চলো
আমাদের ফিরতে হবে ৷
নিমেষে বাক্যরা শব্দহারা
ভাবনা গুলো অবশ অন্তর্লীন ৷৷
তৃপ্তি মিত্র
বসন্ত তোমার মনে আছে
ভাঙ্গা সূর্য্য তার শেষ আবির আদর বুলিয়ে
শিমুল পলাশ কে ছুঁয়ে বিদায় নেবার কালে
তোমার আমার প্রথম দেখা
চোখে চোখে গোপন কথা
তোমার আমার হুঁস ছিল না
স্বপ্ন ডিঙ্গায় প্রেমের দোলা
ঠোঁটের কোনে প্রবল নেশা
মনের মধ্যে সাগর দোলা
একটু খানি আড়াল টেনে
লাল আবিরে রাঙিয়ে দেওয়া
বসন্ত সেদিনের সেই বিকেলের দিব্যি
আমি আজ ও সেই আবির ছোঁয়া
পড়ন্ত বিকেলের অপেক্ষায় ৷
হঠাৎ কেউ রুক্ষ গলায় --এই চলো
আমাদের ফিরতে হবে ৷
নিমেষে বাক্যরা শব্দহারা
ভাবনা গুলো অবশ অন্তর্লীন ৷৷
বসন্ত
মহাজিস মণ্ডল
বাতাসের শব্দ পেরিয়ে
যে নদীটা দাঁড়িয়ে
তাকে একটু ছুঁয়ে দেখো
পাখি পাখি এই বিকেলটা
খুব একটা মন্দ না
সমস্ত মন খারাপ তুলে রাখো
আকাশের বারান্দায় আজ যে বসন্ত ।
যে নদীটা দাঁড়িয়ে
তাকে একটু ছুঁয়ে দেখো
পাখি পাখি এই বিকেলটা
খুব একটা মন্দ না
সমস্ত মন খারাপ তুলে রাখো
আকাশের বারান্দায় আজ যে বসন্ত ।
বিষন্ন বসন্ত
শর্মিষ্ঠা রায়চৌধুরী
এ শহরে বৃষ্টি যখন উস্কে দেয়
শেষবারের মত শীতের আমেজ,
ফাগুনবেলার বারিধারায় ধূলাময় ধরণী
স্নিগ্ধ - শীতলতায় ভরে ওঠে,
শিমুল - পলাশের আগুনরঙা মাদকতায়
প্রকৃতিরানী হয়ে ওঠে মোহময়ী ।
বৃষ্টিসুখের আনন্দে আঙ্গিনায় উচ্ছল বসন্ত,
কোকিলের কুহুতানে প্রেম খোজে নিরাপদ আশ্রয় !!
কবির কলম রোমাঞ্চিত হয় সঠিক রসদে......
এদেশের গলি থেকে শহর যখন আবির রঙে
পালন করবে বসন্ত - উৎসব _______
অপরপ্রান্তে বহুদূরের এক দেশ তখন
কাঁপছে বোমা - বৃষ্টির আতঙ্কে !!
অন্ধ-ধর্মের নামে নাশকতায় আক্রান্ত
ওদেশের বিষাক্ত - বসন্ত !
ফুলের মত নিষ্পাপ শিশুদের আর্তনাদ,
শহরের আনাচ-কানাচে রক্তাক্ত নিথর
মানুষ,শিশুদেহের শবদেহ,,,,
বাতাস ভারী হয় পোড়ামাংসের গন্ধে ।
ঈশ্বর হানাহানি, মারনখেলার নিধনে
অবসান হোক মৃত্যুমিছিলের.......
আর কত নিরীহ জীবনের বলিদানে
খেলবে ওরা রক্তের হোলি ??
রক্তের কি কোন ধর্ম হয় ????
বসন্তের আবির বর্জনে মানবতার জয় হোক
কবির শায়িত কলম পালন করুক নীরবতা ।
বসন্তের কবিতা
সোনালী সিং
সোনালী সিং
বাউল গানের ছন্দে,উদাসী হাওয়ার বসন্তের আগমন -হৃদয়ে।
লাল,নীল,হলুদ সবুজ ফোয়ারা-রঙীন দিন পঞ্জিকায়।।
রঙ লাগিয়ে ঢেউ জাগিয়ে ফাল্গুনী চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।
অনুভূতিগুলি উত্যক্ত হয়ে সন্ধ্যারাতে ছুটে যাচ্ছে।।
নতুন ভোরের প্রথম আলোয় অথবা রাতের নিকশ অন্ধকারে দেখা হবে,ঠিক দেখা হবে-শুধু অপেক্ষা ভালোবেসো।
নিঃস্বতার মাঝে, নীরবে,নিঃশব্দে,অনন্ত গোপনে পারলে গায়ে একটু বসন্ত মেখে এসো।।
শতাব্দী জুড়ে তোমার দুষ্টু দুষ্টু ডাক,চোখের ভাষায় হাজার কথা।
সুখ লাগে, সুখ লাগে খুব- কখনও বা হৃদয় জুড়ে অবাক ব্যাথা।।
অজস্র অনুভবে সময়ের স্রোতে রচিত সে সমাধি বিশুদ্ধ ভালোবাসায়।
তুমি ফিরবে জানি,বহুদিন পরে,হয়তো হাজার বছর পরে- আমার অন্তরে, হৃদয়ে,শিরা-উপশিরায়,অস্হিমজ্জা য়।।
মনের পাতা থেকে কখনও কি মুছে যায় যৌবনের প্রথম বসন্ত?
আলো-আঁধারের দিনলিপি,সুখে-দুঃখে এলোমেলো অনুভবে সে তো অনন্ত।
লাল,নীল,হলুদ সবুজ ফোয়ারা-রঙীন দিন পঞ্জিকায়।।
রঙ লাগিয়ে ঢেউ জাগিয়ে ফাল্গুনী চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।
অনুভূতিগুলি উত্যক্ত হয়ে সন্ধ্যারাতে ছুটে যাচ্ছে।।
নতুন ভোরের প্রথম আলোয় অথবা রাতের নিকশ অন্ধকারে দেখা হবে,ঠিক দেখা হবে-শুধু অপেক্ষা ভালোবেসো।
নিঃস্বতার মাঝে, নীরবে,নিঃশব্দে,অনন্ত গোপনে পারলে গায়ে একটু বসন্ত মেখে এসো।।
শতাব্দী জুড়ে তোমার দুষ্টু দুষ্টু ডাক,চোখের ভাষায় হাজার কথা।
সুখ লাগে, সুখ লাগে খুব- কখনও বা হৃদয় জুড়ে অবাক ব্যাথা।।
অজস্র অনুভবে সময়ের স্রোতে রচিত সে সমাধি বিশুদ্ধ ভালোবাসায়।
তুমি ফিরবে জানি,বহুদিন পরে,হয়তো হাজার বছর পরে- আমার অন্তরে, হৃদয়ে,শিরা-উপশিরায়,অস্হিমজ্জা
মনের পাতা থেকে কখনও কি মুছে যায় যৌবনের প্রথম বসন্ত?
আলো-আঁধারের দিনলিপি,সুখে-দুঃখে এলোমেলো অনুভবে সে তো অনন্ত।
ফাগুন
শক্তিপ্রসাদ ঘোষ
শক্তিপ্রসাদ ঘোষ
সে দিন আকাশে
উড়ছিল স্মৃতিভরা মেঘ
রাধিকাপুরের বালা
ফুটেছিল লাল পলাশ,শিমূল
গোবিন্দপুরের কালা
উঠেছিল যমুনায় জোয়ার
স্রোতে ছিল বয়সের দোষ
বেঁজে ছিল বাঁশি
ধরে ছিল আগুন
রাধিকার বুকে ফাগুন
বাতাসে ছিল আবীরের
ঘ্রাণ
কালার আকাশ ভরা তারা
পালতোলা আকাশে
রাধিকার ডুব
অবশ বাতাস দরিয়ে দেখে
চারদিক নিশ্চুপ।
আজ বসন্ত
তাপস দাস
চুম্বনে ঘন রাত
আমিই ধোঁয়া - ধুলো সম্রাট
ফিরেছি...
বুকে টেবিল পেতে বসেছে ফুল লাল লাল
মদে মৌমাছি চোখের সকাল
পলাশ দেয়াল...
পাতায় শীতের কুড়েমি ঘোঁচেনি
ক্লোরোফিল বউ লাজুক ওড়নি
চোখে চোখে গ্রাম গল্প দুলুনি...
ক্লোরোফিল বউ লাজুক ওড়নি
চোখে চোখে গ্রাম গল্প দুলুনি...
বেশ ভালোবাসা এক প্রলেপে আসা
হলুদ রঙিন ফুল অতীত কুয়াশা মেশা
সমবেত উত্তর- জিজ্ঞাসা...
হলুদ রঙিন ফুল অতীত কুয়াশা মেশা
সমবেত উত্তর- জিজ্ঞাসা...
বাতাসে বালি ওড়ে তবু
চোখ লেখে ঈশ্বরে
সম্মুখ ঝড়ে...!
চোখ লেখে ঈশ্বরে
সম্মুখ ঝড়ে...!
তাজা বিষাদ
অনিমেষ সরকার
বসন্তের পূর্বাভাস এলে মনে পড়ে তোমার কথা মীরা,
মনে পড়ে কি তোমার?
ঝিরঝিরে হাওয়া পথচলতি যুগলের আবরণে ছাতার দিশা দিয়েছিলো পালটে!
উষ্ণতা বিনিময় নিবিড় ঘন সন্ধ্যেয় শিহরণ শরীর জুড়ে;
এক অশরীরী অসামান্য নদীর আকুলতা ব্যক্তিত্বে গিয়েছিলো ছাপ রেখে!
বিপরীতধর্মী হৃদয়ের বহমান ঋতুচক্রে প্রেমের মুকুল প্রস্ফুটিত লগ্নে অবচেতনে নির্জনতা ভেঙে আবেগ বর্জিত হয়েছিলো...
সংযমী বসন্তের এলোমেলো নিঃশ্বাসে বিশালায়তনে স্পর্শানুভাবে-
আমার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের অ্যাকাউন্টে
উঠেছিলো হীনমান্যতার ঝড়!
জানো মীরা -
যখনই কবিতা লিখি কেন জানিনা মনের মণিকোঠায়
কষ্টগুলো গুমরে গুমরে কাঁদে!
ভেজা বালিশের তুলোয় ড্যাম ধরে যায়;
আমার ঈশ্বর কবিতা জুড়ে হুটপাট চালায় অনবরত;
কোনোমতেই প্রেমের লেখা আসেনা!
হাতে হাত চেপে অশ্রুবিন্দু নিয়ে নতুন দিশার হয় উন্মোচন!
তোমার কথা মনে এলেও কলম লেখায় তাজা বিষাদপূর্ণ বসন্তের ঘন রক্তস্নান..
অনিমেষ সরকার
বসন্তের পূর্বাভাস এলে মনে পড়ে তোমার কথা মীরা,
মনে পড়ে কি তোমার?
ঝিরঝিরে হাওয়া পথচলতি যুগলের আবরণে ছাতার দিশা দিয়েছিলো পালটে!
উষ্ণতা বিনিময় নিবিড় ঘন সন্ধ্যেয় শিহরণ শরীর জুড়ে;
এক অশরীরী অসামান্য নদীর আকুলতা ব্যক্তিত্বে গিয়েছিলো ছাপ রেখে!
বিপরীতধর্মী হৃদয়ের বহমান ঋতুচক্রে প্রেমের মুকুল প্রস্ফুটিত লগ্নে অবচেতনে নির্জনতা ভেঙে আবেগ বর্জিত হয়েছিলো...
সংযমী বসন্তের এলোমেলো নিঃশ্বাসে বিশালায়তনে স্পর্শানুভাবে-
আমার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের অ্যাকাউন্টে
উঠেছিলো হীনমান্যতার ঝড়!
জানো মীরা -
যখনই কবিতা লিখি কেন জানিনা মনের মণিকোঠায়
কষ্টগুলো গুমরে গুমরে কাঁদে!
ভেজা বালিশের তুলোয় ড্যাম ধরে যায়;
আমার ঈশ্বর কবিতা জুড়ে হুটপাট চালায় অনবরত;
কোনোমতেই প্রেমের লেখা আসেনা!
হাতে হাত চেপে অশ্রুবিন্দু নিয়ে নতুন দিশার হয় উন্মোচন!
তোমার কথা মনে এলেও কলম লেখায় তাজা বিষাদপূর্ণ বসন্তের ঘন রক্তস্নান..
অপদার্থ
সুপ্রীতি বর্মন
লাভার অগ্ন্যুৎপাতের লেলিহান শিখার সলতে প্রতিভা,
ভেতরে ছটফটানি ব্যগ্রতা তোমাকে প্রতিক্ষনে,
প্রেক্ষাপট দিতে সকলের হৃদয় জাগরনের আকুতি।
তুমি কি পারবে বাড়াতে হাত,
ঘরে ঘরে অঙ্কুরোদ্গমের বীজ থেকে মহীরূহ,
ছুটছে সকলে ইঁদুরের দৌড়ে।
তাকিয়ে দেখে ক্ষনকাল তিষ্ঠানো তোমাতেই আমার অনুক্ষন,
আমার জীবন।
পারবো কি দিতে প্রান তোমার ফুসফুসের প্রকোষ্ঠে,
দমচাপা দীর্ঘায়িত অবসাদ থেকে পাখা মেলে,
ফিরে পাওয়া নিষ্পাপ সদ্যোজাত শিশুর জনম।
না সকলের তর্জনীর অভিসম্পাতে ছি ছি এসব কি,
কি ছেলেই হয়েছে, কি বা তার প্রতিপালন।
মা বাবার এ কেমন শিক্ষা, কিছু হবে না, হতে পারেনা,
অকাল কুষ্মান্ড বাবার হোটেলে,
শুধু ভাতের ছড়াছড়ি কিংবা,
পকেটে রুমাল গুজে হাতে জুঁই মালার বন্ধন,
নতুন কোন ছমকছল্লো নারীর কোমর দোলানো,
কিংবা ঠোঁটে ঠোঁট উষ্ণ প্রনয়ালাপ,
রাতভোর নারীসঙ্গম পেট পুরে বাংলার বোতল।
না না এসব হবে আমার ছেলে, একদম না।
ভদ্রসমাজে মুখ দেখাই কি করে, যতই হোক আমি ছেলের বাপ।
ছেলের মনের দড়িতে বেঁধেছে ঘুড়ি,
ছাড়তে চায় নীলিমায় পেতে চায় পিতা তোমার হৃদয়ের আকাশ।
কেন দেখতে চাও আমায় তুমি অপরের চোখ ধার করে,
একবার একটু থাকো না স্বটানের আকর্ষনে।
দিনশেষে বোধের সঞ্চিত ক্ষুধা শুধু তুমি শুধু তুমি।
অজানা পথিক তুমি নিজেই জানো কি,
কোথায় তুমি যেতে চাও, কি তোমার ঠিকানা।
প্রতিভার অন্বেষণে কুঁজো বেঁধে পিঠে শুতে চাও চিত হয়ে।
পারবে কি কোনদিন হাত পা মেলে,
সংকোচন ছেড়ে স্বপ্নের আলিঙ্গনে,
চোখ খুলে পাওয়া খোলা দরজা।
আজ বসন্ত
কৌশিক কুমার রায়
লাল হলুদ সবুজের আবেশে ,
মেতেছে সকল পাড়া ।
সেজেছে রাজপথ ,
আটকে রাখার হীন ইচ্ছে ,
তবে দিলাম শেষে সাড়া ॥
ঘুম ভাঙার রঙ্গীন ভোর ।
বন্ধুদের আনাগোনা ,
বদ্ধ আমি বন্ধ ঘরে ,
রঙ ভুত বুঝি নাড়লো দোর ॥
রামধনুতে মাখামাখি ,
উন্মাদ চিত্তে ছন্দ নৃত্য ।
ভুলে সব উদ্বিগ্নতা ,
তালেগোলে মালিক আর ভৃত্য ॥
গোধূলির লাল আভায় , আবীরের গন্ধে ,
অস্ত অংশুমালী হাসছে ।
ফুটেছে ফুল , মেলেছে ডানা ভ্রমর ,
তাকিয়ে দেখো ! বসন্ত এসেছে ॥
কৌশিক কুমার রায়
লাল হলুদ সবুজের আবেশে ,
মেতেছে সকল পাড়া ।
সেজেছে রাজপথ ,
আটকে রাখার হীন ইচ্ছে ,
তবে দিলাম শেষে সাড়া ॥
ঘুম ভাঙার রঙ্গীন ভোর ।
বন্ধুদের আনাগোনা ,
বদ্ধ আমি বন্ধ ঘরে ,
রঙ ভুত বুঝি নাড়লো দোর ॥
রামধনুতে মাখামাখি ,
উন্মাদ চিত্তে ছন্দ নৃত্য ।
ভুলে সব উদ্বিগ্নতা ,
তালেগোলে মালিক আর ভৃত্য ॥
গোধূলির লাল আভায় , আবীরের গন্ধে ,
অস্ত অংশুমালী হাসছে ।
ফুটেছে ফুল , মেলেছে ডানা ভ্রমর ,
তাকিয়ে দেখো ! বসন্ত এসেছে ॥
নব
বসন্ত
সুকন্যা সামন্ত
নূতনকে করি স্বাগত –
ত্যাগ করে পুরাতন স্মৃতি যত,
পুষ্পে, পুষ্পে, পত্রে, পল্লবে,
উঠুক বিকশিত ,
আনন্দে ভরে উঠুক
প্রাণ –
গুঞ্জনে, গুঞ্জনে, ভরুক
হৃদয় ,
পুলকিত প্রাণে প্র্স্ফুটিত হোক ,
যৌবনের কুসুমখানি ।
অঙ্গে অঙ্গে বাজুক সুরধ্বনি ,
জীবন উঠুক ভরে –
সুরের ঝংকারে ।
না করে স্মৃতি রোমন্থন ,
অতীত হতে শিক্ষা লয়ে সর্বক্ষণ ,
করি অঙ্গীকার –
নূতন আকাঙ্খাকে করিবারে পুরণ ,
আজি এ নব বসন্তে ।।
বসন্তের সম্মুখে
শৌভিক কার্য্যী
আজ ফুটেছে ফুল ছড়ানো
আলোর মুক্ত কণার স্রোতে |
বিদীর্ণ হাওয়ায় ঝরা পাতা
খসেছে মনের অবসাদে |
কৃষ্ণ বাঁশি শুনছি দূরে
কোকিলের কুহুতানে |
ভয় কাটিয়ে গুটিয়ে নিয়েছি
ঘুণে কাটা অতীত অবসানে |
স্বপ্ন রঙে গা ভাসিয়ে প্রজাপতিরা
মেলেছে রঙিন দুটো ডানা |
ডিভোর্সী নারীরাও যে বেচে থাকে
সবটাই ছিল অজানা |
কয়েক বসন্ত পেরিয়ে হঠাৎ
আবারো আজ বসন্তের সম্মুখে |
মিথ্যে শপথ ভেঙে এগিয়েছি
নতুনের হাতে হাত রেখে |
বঞ্চিত প্রেম
সুপম রায়
আমার বুক থেকে আলো বেরোলেই
তুই লুকিয়ে পড়িস আড়ালে ।
বড্ড লাজুক গোছের মেয়ে, তুই ।
তুই লুকিয়ে পড়িস আড়ালে ।
বড্ড লাজুক গোছের মেয়ে, তুই ।
নিজের মাথার দিব্যি দিয়ে আমাকেও-তো
সেই কাপুরুষ বানিয়ে রাখলি ।
সেই কাপুরুষ বানিয়ে রাখলি ।
আমারও-তো ইচ্ছে হয় ছুঁতে তোকে,
চুম্বন রঙের নকশায় ঠোঁট কাঁপানোর সাধ হয় ।
বুকের ওপর বুক ফেলে
শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় সমস্ত ঋতুকাল ।
চুম্বন রঙের নকশায় ঠোঁট কাঁপানোর সাধ হয় ।
বুকের ওপর বুক ফেলে
শুয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় সমস্ত ঋতুকাল ।
সবাই এতো ঘুরে ঘুরে প্রেম করে,
পার্কে, মাল্টিপ্লেক্সে, সমুদ্রে, পাহাড়ে যায়,
হাতে হাত ধরে ছুটে পালায় অনেকদূর ।
তুই আর আমি শুধু এই সুখ থেকে বঞ্চিত হয় চিরকাল ।
পার্কে, মাল্টিপ্লেক্সে, সমুদ্রে, পাহাড়ে যায়,
হাতে হাত ধরে ছুটে পালায় অনেকদূর ।
তুই আর আমি শুধু এই সুখ থেকে বঞ্চিত হয় চিরকাল ।
এই জন্ম শেষ হয়ে যাক্ তাড়াতাড়ি,
পরজন্মে গাছ হয়ে জন্মাব দু'জনেই ।
পরজন্মে গাছ হয়ে জন্মাব দু'জনেই ।
আক্ষেপ
আবু আরশাদ আয়ুব
হে বিধাতা,
আমায় দিও ছাতি ভরা বেদনা,
আঁখিতে অনর্গল জল।
হৃদয়ে থাকে যেন দুঃস্বপন অফুরান
নিস্তব্ধ কান্না অবিরাম অবিচল
মনে অসীম চিন্তা, অসহ্য ভাবনা
বুক ফাটলে হয় না আওয়াজ
অবচেতন অন্তরাত্মা
তবুও ভয়ে কুপকাত।
কি জানি কি হয় হঠাৎ কেমন করে ওঠে বুকের ভিতর
নিও না কাড়ি কোনো আপনজন
অভাগারে কি আর দেবে পুরস্কার?
আমায় দিও আরও কষ্ট যত
তোমার গুদামে জমা,
নেব সব তুলে হৃদয় গহ্বরে শত
জনমের ব্যথা।
পাপের শাস্তি যত আছে সব
নেব মাথা পেতে,
জ্যান্ত দিও ফাঁসি,তবু ভালোবাসি
প্রাণ খুলে হাসতে।
দুঃখ যার নিত্যসাথী
পথের পর পথ কাঁটা,
সজল যার সর্বদা আঁখি
শুনেছ কি তার
ঠোঁট কাটা।
কবিতা তোমায় খুঁজি
ননীগোপাল সরকার
আঁধারের কণা খুঁটে খেয়ে বেঁচে আছে
আমার মনোপাখি।
মায়ের কোলে প্রথম চোখ খুলে দেখা
আলোটা যেন ম্লান হতে হতে
ঘুমিয়ে পড়েছে গোধূলির কোলে।
গাছের পাতা ঝরা শব্দে
খিলখিলিয়ে হেসে ওঠার আনন্দটা আজ
হারিয়ে গেছে ভাবনার কাশবনে।
না পাওয়ার ব্যথাটা বার্ধক্যজনিত
রোগের মতো হয়েছে আমরন সঙ্গী ।
মনটা পরিযায়ী পাখির মতো উড়তে চেয়েও
পারে না বিবেকের খাঁচায় বন্দি বলে ।
রাতের গভীরতার সঙ্গে সমানুপাতে
বেড়ে চলে কল্পনার পরিধি।
বালিশের উপর আছড়ে পড়া
জলপ্রপাতের ঘুর্ণিতে খুঁজে ফিরে
আমার হারিয়ে যাওয়া কবিতা।