সম্পাদকের কথা
১৪২৬-এর অগ্রহায়ণ মাস মুজনাইয়ের বয়ে চলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রইল। সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন আইন অনুসারে এখন থেকে মুজনাই সাহিত্য সংস্থার একটি প্রয়াস হিসেবে মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন ও মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হবে। সাহিত্যসেবার পাশাপাশি আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রেও পা রাখতে চলেছে ছোট্ট মুজনাই। আগামীতে ধীরে ধীরে সেসব জানানো হবে। ইতিমধ্যে ফেসবুকে মুজনাই সাহিত্য সংস্থার গ্ৰুপ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিবর্তে মুজনাই সাহিত্য সংস্থার ব্লগের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এখন থেকে সংস্থার ইমেলে (যা অপরিবর্তিত) যে কোনো সময় লেখা পাঠানো যাবে। উপদেষ্টামণ্ডলীর পরামর্শ অনুযায়ী সে লেখা ব্লগে প্রকাশিত হবে। গত শতকের আশির দশক থেকে বইতে শুরু করা মুজনাইয়ের কাছে এই সংখ্যাটির গুরুত্ব আলাদা কেননা এক বাঁক বদলের পর নতুম ভাবে চলতে শুরু করল মুজনাই। বেশ কিছু সংখ্যক লেখা এলেও সবাইকে স্থান দেওয়া গেল না। উপদেষ্টামণ্ডলীর পরামর্শে বাছাই করা লেখাগুলি জায়গা নিল এই সংখ্যা। একটি পর্বে সামগ্রিকভাবে থাকছে মুজনাইয়ের সদস্যদের লেখা এবং আলাদা আলাদা করে এক একটি পর্বে মুজনাইয়ের অন্যান্যদের লেখা।
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৬
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১
ইমেল ঠিকানা - mujnaisahityopotrika@gmail.com
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা- শৌভিক রায়
মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৬
তির্যক
রীনা সাহা
ধর্ষণ বিষয়ক খবর
টিন-এজ বয়স থেকেই টম-গার্ল স্বভাবের ব'লে সোজাসাপ্টা কথা বলি আর তার ফলস্বরূপ যে দু`চারখানা লিখি তাতেও প্রতিবাদী ভাবনার ছাপ থাকে। তখন থেকেই যে বিষয়টি আমাকে ভীষণ টানতো এবং ভাবাতো, তা হল "ধর্ষণ"। বাপের বাড়িতে বহুদিন বাদে টিভি এসেছিল বলে খবরের কাগজ পড়ে বিষয়টি সম্বন্ধে জেনে পোক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েসুলভ সংকোচে এ বিষয়ে কিছু লিখবার সাহস তখন হয় নি পাছে বাবা-দাদারা জেনে যায় "ধর্ষণ" মানে আমি বুঝি!
যাইহোক বিয়ের পর মেয়েবেলার সেই সংকোচ না থাকাতে খবরের কাগজ হাতে পেলেই ধর্ষণের খবরগুলো খুঁজে বের করে পড়েই পেপারটা ভাঁজ করে রেখে দিতাম। দিন কয়েক এরকম দেখবার পর আমার বরমশাই অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন---
----কি ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি সব খবর পড়া হয়ে গেল?
----না।
----তবে?
----আমি শুধু ধর্ষণের খবরগুলোই পড়ি।
----পার্ভার্টেড মানসিকতা কিন্তু এটা।
----হ`ক, তাতে কার কি?
----শুধু ওগুলো পড়ে কি হবে? দেশের হাল-হকিকত জানতে হবে না?
----দেশের হাল জেনে আমার কি হবে?তার চে' ধর্ষণের খবর অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং।
-----ইন্টারেস্টিং! কি বলছ!
----খুব ঠিক বলছি। ইচ্ছে আছে ধর্ষণ বিষয়ে কবিতা লিখে বই ছাপব।
আঁতকে উঠে হেসে কুটিপাটি উনি আর কখনোই পেপার পড়া নিয়ে আমাকে ঘাঁটান নি। তবে বরকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেবার পর সত্যি সত্যিই ধর্ষণ বিষয়ে কবিতা লিখে বই ছাপাবার প্রবল ইচ্ছে হ'ল। কেননা আমি জানি মেয়েমানুষের শরীর এমন এক লোভনীয় বস্তু যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আজ অবধি তন্দুর মাংসের মতোই সুস্বাদু এবং যেটি অদূর ভবিষ্যতেও জিভের স্বাদ কোরক থেকে টপাটপ জল ঝরিয়ে যাবে। আর এ বিষয় নিয়ে ছবি-সহ কবিতার বই প্রকাশ করতে পারলে তো কথাই নেই---রমরমিয়ে বেস্টসেলার।
জোরকদমে লেগে গেলাম লিখতে। খবরের কাগজ থেকে গোটা দেশের ধর্ষণ-যজ্ঞের ছবি-সহ কাটিং জমিয়ে প্রায় এক ট্রাঙ্ক ভর্তি(বিয়ের সময় পাওয়া) "মোস্ট ইম্পরট্যান্ট" আর "লেস ইম্পরট্যান্ট" রেপগুলো থেকে বাছাই করে "মোস্ট ইম্পরট্যান্ট" কিছু কেস কবিতার জন্য রেডি করে ফেললাম। এবারে প্রকাশের পালা।মুশকিল আসান তো একজনাই আছেন ঘরে, আর বড় কাজ হাসিলের ক্ষেত্রে লজ্জার কি আছে এই ভেবে টম-বউয়ের মতো মাথা উঁচু রেখে, চটাস চটাস চটির শব্দে বরের পড়ার ঘরের মেঝে মুখরিত করে শ্রীযুক্ত বরমশাইয়ের দুচোখের দ্বারস্থ হলাম। ওর কাছে কথাটা পারতেই নব্য কবি-স্ত্রীর ইচ্ছেকে হিমঘরে পাঠিয়ে বললেন---
-----মাথা-টাথা গ্যাছে নাকি? ধর্ষণ বিষয়ে কবিতার বই ছাপবে? ও বই মার্কেটে চলবে?
চরম রেগে বললাম---
----চলুক, না চলুক আমি এ বই ছাপবই। তুমি ব্যবস্থা কর।
চোখের তেজে ভ্যাবাচ্যাকা উনি ঘাবড়ে ঘেমে একসা তখন!
----ঠিক আছে, দাঁড়াও দেখছি কি করা যায়। তবে "মোস্ট ইম্পরট্যান্ট" আর "লেস ইম্পরট্যান্ট", এগুলো আবার কী ?
-----"মোস্ট ইম্পরট্যান্ট" রেপ হ'ল ধর্ষণ করবার পর ভিক্টিমকে মেরে ফেলা হয় আর "লেস ইম্পরট্যান্ট" ধর্ষণে ধর্ষণ করবার পর ধর্ষিতার কলজেতে ইনকামিং-আউগোয়িং ধর্ষণ-তুরীয় ফুরফুরে বাতাস রেখে ফেলে যাওয়া হয়---যেমন উন্নাও বা পার্ক স্ট্রিটের কেসগুলো। এরকম কেসে ধর্ষিতা বা তার পরিবারকে মোটা রকমের ক্ষতিপূরণ দিয়ে সরকারী বদারেশানগুলো মিটিয়ে নেওয়া হয়।আবার এরকম কেসও আছে,ক্ষতিপূরণ না নিয়ে পরবর্তীকালে হার না মানা কোনো ধর্ষিতা কোর্টের চক্কর কাটতে কাটতে হয় পাগল হয় নয়ত কোনো জটিল অসুখে মরে যায়।আরও বহু ভড়ংয়ের কেস আছে তুমি অতশত বুঝবে না। যা বলছি চুপচাপ করো। আপাতত রঙচঙে ছবিসহ খান পঞ্চাশেক কবিতা রেডি করেছি।প্রচ্ছদে আমারই আঁকা ছবি---ছাইকালো মেয়ের খুবলানো গা---মধ্যমা তুলে ভোটের কালি দেখাচ্ছে। তোমার পরিচিত কোনো প্রকাশকের সঙ্গে আজই কথা বলে খুব শিগ্গির ছাপাবার ব্যবস্থা করো।
পরদিনই বরের বন্ধুর "ভাট প্রকাশনা সংস্থা"-র ছাপাখানায় ঢুকে গেল কবিতাগুলো।আশাকরি দিন দশেকের মধ্যেই রেডি হয়ে যাবে বইটা।খুব ইচ্ছে আছে আসছে বইমেলায় জমকালো একখানা "মিষ্টিমুখের অনুষ্ঠান" করে আপনাদের হাতে তুলে দিতে পারব আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তবে ভীষণ ধন্দে পড়েছি বইটার নামকরণ নিয়ে----"কবিতার ধর্ষণ" না "ধর্ষণের কবিতা", কোন নামটা বেশি ঠিক হবে আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকলাম।
পুনশ্চঃ----পরবর্তীকালে এই লেখকের কলমের তরফ থেকে আরও দু`খানা বই আপনাদের উপহার দেবার ইচ্ছে আছে---"ধর্ষণ বিষয়ক গল্পসমগ্র" এবং একটি ক্রিটিসিজম,"ঘন্টাখানেক ধর্ষণ---বুদ্ধিজীবীদের রায়"। যদি কখনও ধর্ষণ বিষয়ে গবেষণার কাজে ক্রিটিসিজমের বইটি কেনা হয় তবে নিজের জীবৎকালে না পেলেও আমার পরবর্তী প্রজন্ম গর্ব করবার মতো টাকার অংকের রয়্যালটি থেকে বঞ্চিত হবে না এটা হলফ করে বলতে পারি।
সাম্প্রতিক
কুমকুম ঘোষ
অধমের প্রয়াগ দর্শন ও নবনীতা দেবসেন
অধমের প্রয়াগ দর্শন ও নবনীতা দেবসেন
।। মহাকুম্ভ ও পুরাণকালীন বঞ্চনা-পর্ব।।
সমুদ্র মন্থনের কাজটা শুরুর আগে ভদ্রলোকের চুক্তি হয়েছিল দু'পক্ষের ই মধ্যে। সমুদ্র থেকে যা যা উঠবে সব ই সহমতের ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে নেওয়া হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল চুক্তি ভঙ্গ হয়ে গেল।যে কথা দেওয়া হয়েছিল তা মানতে রাজি নয় একপক্ষ ( অবশ্যই যারা বুদ্ধিতে পোক্ত)। চালাকির দ্বারা মহৎ কর্ম হয় না এসব আপ্তবাক্য পুরাণের যুগেও( এযুগের মত!!) অচল ছিল তবে!! শক্তি না হোক বুদ্ধি র(চালাকি) দ্বন্দ্বে দেবতারা চিরকাল অসুর বেচারাদের বঞ্চিত করেছে,এবারেও করলো । সমুদ্র মন্থনের ফলে সব শেষে অমৃতের ভান্ড নিয়ে উঠে এলেন দেবী। কিন্তু সেটি করায়ত্ত করলো দেবতারা একা!! ফল যুদ্ধ। ভান্ড নিয়ে সেই প্রবল যুদ্ধে র ফাঁকে "রাগবি" খেলোয়াড়দের মত ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত ছোঁ মেরে অমৃতের ভান্ড টি তুলে নিয়ে দে ছুট। অসুররাও ছাড়বে কেন? তারাও ছুটতে লাগলো পেছন পেছন( টিভিতে যেমন রাগবি খেলোয়াড়দের দেখায় আর কি)। কিন্তু নাগাল পেলনা তার। শুধু সেই পৌরাণিক দৌড়ের মাঝে চার জায়গায় ভান্ডটি সে রাখতে পেরেছিল তিন দিন পরপর--হরিদ্বার,প্রয়াগ, উজ্জয়িনী ও নাসিক।তখন ই ভান্ড থেকে কয়েক ফোঁটা করে "অমৃত" চলকে পড়েছিল চার জায়গায়। ফলতঃ ঐ চার জায়গা হয়ে উঠলো মহান- তীর্থ ক্ষেত্র।১২ বছর অন্তর( দেবতাদের ৩দিন মানুষের ১২ বছর) ঐ চার স্হানে মহা- কুম্ভ যোগ হয়।পৌষ সংক্রান্তির সময় মৌণী অমাবস্যা যোগের (খুবই বিরল যোগ) পুণ্য লগ্নে টুপ করে একটা ডুব দিলেই অক্ষয় স্বর্গবাস প্রায় হাতের মুঠোয় এসে যায় ।
মহা-তীর্থ ক্ষেত্র কুম্ভে কেউ পুজো দেয়না, ডুব দেয়,মাথা কামায়,শ্রাদ্ধ ও করে।
।। বিন্দাস স্নান ও স্নাতকোত্তর পর্ব।।
"আগচ্ছন্তু মে পিতর ইমং অপোঞ্জলিম্।
আব্রহ্মভুবনাল্লোকা দেবর্ষি পিতৃমানবাঃ ।।
তৃপ্ত হও হে আমার পূর্বপুরুষ সকল, হে পূজনীয় মাতৃ-পিতৃগণ! তিনভুবন জুড়ে তৃপ্ত হও তোমরা আমার ভালোবাসায় ।
"ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যন্তু ভুবনত্রয়ম্।"
(এমত মাহেন্দ্রক্ষণে ছন্দপতন!) "ওকি হচ্ছে? জুতো হাতে করে উদকাঞ্জলি?(এক ধমক)--"মাথাটাথা কি একেবারেই গেছে?----দিন জুতো আমাকে? নিন ডুব দিন চট করে ডুব দিন----এক, দুই----তাঁর ধমকের চোটে আর একদুই গোনার চাপে টুপটাপ আরো দুটো ডুব দিয়ে ফেলি।"
----ছি ছি ছি ছি ছি, নবনীতা! তোমার হাতে জলের সঙ্গে ওটা কী? এ্যাঁ! কিন্তু হে আমার পিতৃপুরুষগণ ---- আমি তো ইচ্ছে করে করিনি। তোমরা তো আমার দূরপর কেউ নয়, তোমরা তো আমারি পিতৃপুরুষ। তোমরা আমার দোষত্রুটি নিজগুণে ই মার্জনা করে নেবে। তোমাদের আহ্বান করা মাত্র তোমরাই তো আমাকে দেখিয়ে দিলে যে জুতোটা ভেসে যাচ্ছে!! একপক্ষে তোমরাই ওটা উদ্ধার করে দিলে। হে আমার পূজনীয় পিতৃপুরুষগণ , পরমহংস যেমন নীর বাদ দিয়ে ক্ষীরটুকু গ্রহণ করেন, তোমরাও তেমনি জুতোর কলঙ্কটুকু বাদ দিয়ে, হৃদয়- নিঃসৃত জলটুকুনি গ্রহন করো।""
............পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এ লেখা কার? সদ্যপ্রয়াত স্বনামধন্য লেখিকা,কবি, শিক্ষিকা নবনীতা দেবসেনের লেখা " করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে" ভ্রমণ-কাহিনীর অংশবিশেষ এটি। এই সূত্রে কালকূটের লেখা "অমৃত কুম্ভের সন্ধানে" ভ্রমণ-কাহিনী টি স্মরণীয় ; যেখানে লেখক পূর্ণ কুম্ভের সঙ্গমে যাত্রা র ও স্নানের এক মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে। তিনি খুঁজতে গিয়েছিলেন কোন সে অমোঘ আকর্ষণে লাখ লাখ মানুষ, ভারতের গ্রামীণ মানুষ পুণ্যলোভে বা পুণ্যলাভের আশায় জড়ো হয় এই মহামিলন ক্ষেত্রে। নবনীতা দেবসেনের লেখাটি সেদিক দিয়ে ভিন্ন ধর্মী ভাবনা বহন করলেও শেষকালে ঐ মহামিলনের ভাবসম্মিলনে অভিভূত হবার সংবাদেই শেষ হয়। লেখিকা নবনীতা এই গল্পে একক যাত্রী ছিলেন শুরু থেকেই। কিন্তু দিল্লি থেকে এলাহাবাদ বিমানে ওঠার পর থেকেই কিভাবে পথেই খুঁজে পেলেন সহৃদয় সহযাত্রীদের এবং একক মানুষ টি হয়ে উঠলেন ব্যপ্ত এক মস্ত ভিড়ের অংশ , এটি তার গল্প। পুণ্য লাভ ব্যক্তিগত প্রাপ্তি কিন্তু কুম্ভের সুহৃদরা আরও বৃহৎ যোগের ক্ষেত্র নির্মাণ করে দিলেন। পথের মাঝেই খুঁজে পেলেন পিতৃতুল্য সহযাত্রী মিলিটারি ম্যান শার্দূল সিংকে ,ভাই লাল্লন সিং,মোটবাহক দুই বালক লালা ও গোঙা কে বা রেলের সেই ফোরম্যান সহ-স্নাত সুহৃদ "ভটচায্যি মশাইকে" কে যিনি চটিজুতো হাতে উদকাঞ্জলি রত নবনীতা কে দিলেন এক পেল্লায় ধমক, উপরন্তু তার হাত থেকে সেগুলো কেড়ে নিয়ে মুক্ত হস্তে স্নানের ও প্রার্থনার সুযোগ করে দিলেন। বাঙালি দাদু নাতনি নবনীতার মোটঘাট পাহারা দেন তিনি ঘন্টা, আবার আশ্রয় ও দেন নিজেদের তাঁবুতে।
এই যে মানুষে- মানুষে সহজ মানবিক যোগসূত্র সে পরিচয় যেন উন্মীলিত হয়ে ওঠে।
সুরসিকা লেখিকার কলমে প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। মহাভারতের অষ্টাদশ পর্বের মতো এই কাহিনী তে আছে ষোলটি পর্ব আর তার কি দারুন সব চমকপ্রদ নাম। "উদ্যোগ পর্ব( বাড়ি থেকে হায়দ্রাবাদে ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন সেমিনারে যোগ দেওয়া), আবু হোসেন পর্ব( সোফার সহ গাড়ি),সভাপর্ব, স্বর্গারোহন পর্ব( হায়দ্রাবাদ-দিল্লী-বারানসী ফ্লাইট ধরা), স্বর্গবাস পর্ব, স্নান পর্ব, স্নাতকোত্তর পর্ব (সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও ধরতাই টুকুই দিয়েছি এ লেখায়),স্বর্গ থেকে ফেরা( অবরোহণ পর্ব), শয়ন পর্ব( লেখিকার বিশ্রাম লাভ) ও সবশেষে "পুনর্মুষিক পর্ব ( বাড়ি ফেরা, কন্যাদের উচ্ছ্বাস ও মাতৃদেবী লেখিকা রাধারাণী দেবীর বকুনি ভুবনখ্যাত কন্যাকে)।
।। গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো পর্ব।।
গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজোর আকাঙ্খা জন্মালো নবনীতা দেবসেনের হঠাৎ প্রয়াণ( ৭ই নভেম্বর,২০১৯) এর পর।মনে এলো বহুদিন আগে পড়া "নব-নীতা" গ্রন্থের(মিত্র ও ঘোষ প্রকাশিত) এই অসামান্য ভ্রমণ-কাহিনীর কথা ও তাঁর অদম্য কুম্ভ-যাত্রার কথা। (প্রণাম জানাই লেখিকাকে)। মনে হলো এই তো পঁচিশ বছরের ব্যবধানে (১৯৯৪ এবং ২০১৯ এর ৯ই অক্টোবর) দুবার প্রয়াগে ঘুরে এলাম তো আমিও? কই হয়নি তো স্নান একবারও? সেবার তরুণী মা হিসেবে শিশুকন্যা , স্বামী ও সহ-বন্ধু দের সাথে নৌকায় দেখতে গিয়েছিলাম গঙ্গা- যমুনা-সরস্বতী(অন্তঃসলিলা) মিলনস্থল টি।মনে আছে বেশ দরদাম করে চল্লিশ টাকায় মাঝিদের রাজি করানো, নৌকার সাথে সাথে উড়ে চলা অজস্র পাখির কথা।দুই নদীর আলাদা রঙ( গঙ্গার ঘোলাটে গঙ্গা জল রঙ ও যমুনার নীল) বেশ পাশাপাশি বয়ে চলেছে। অনেকটাই গিয়ে একজায়গায় শিকল ধরে স্নান করছেন অনেকে। আমাদের বন্ধুরাও স্নান করলো সেই অক্টোবর মাসেই। পুণ্য কি শুধু পৌষ সংক্রান্তি আর মৌণী অমাবস্যার তিথিতেই প্রাপ্ত হয়? সারাবছর ই মানুষ এখানে আসেন অমৃত-স্পর্শ লাভের আশায়। কিন্তু সেবারেও আমার স্নান টি হয়নি।শুধু পুণ্য-জল টুকু স্পর্শ করতে পেরেছিলাম।
আর এবার শুধু মা-গঙ্গা কে দূর থেকে দেখেই ফিরতে হলো। নদীর তীর থেকে নৌকায় ওঠার পুরো রাস্তাটাই থকথকে কাদায়( নদীর পলিমাটি) ভরে আছে,এক সপ্তাহ আগের বন্যার চিহ্ন স্বরূপ। বন্যার চিহ্ন এলাহাবাদ ফোর্টের গায়েও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তার মধ্যেও কয়েকজন সাধু- মহারাজ পোশাক পরিবর্তন করে গামছা পরে নিচ্ছেন কাদা পার হয়ে নৌকায় উঠবেন বলে। এক যুবতী মা পার্কিং লটে রাখা টাটা সুমো থেকে স্টোভ নামিয়ে ওখানেই রান্নার তোরজোড় করছেন স্নান সেরে।মরদ পুরুষ টি হয়তো এদিক সেদিক আছে; দুটি শিশু কন্যা হুটোপুটি করছে। ওদিকে স্নান সেরে দেহাতী মানুষজন নাপিতের ক্ষুরের কাছে মস্তক সমর্পণ করেছে, হাতে তারও ধরা মুঠোফোন ( জিও নিশ্চয়ই!! ) ।গ্রামীণ ভারত আর ডিজিটাল ভারত একসাথে লেপ্টে আছে তাদের হাতে । চলমান অ্যাপ ক্যাবের আসা যাওয়ার মাঝে হঠাৎ একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ির ( ছবি নিয়েছি) আগমন ঘটলো দুই- ভারতের সাক্ষী হয়ে।
শেষ বিকেলের আলোয় আকবরের আমলের এলাহাবাদ ফোর্ট আর তার পাশে বড়া হনুমান মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি যেন বৈপরীত্যের মধ্যে ও এক অনির্বাণ সম্প্রীতির চিহ্ন রেখে যাচ্ছে। আমার উবের এসে গেছে ইতিমধ্যে। একবার শেষ বারের মতো ( তাই কি? ) ঘুরে দাঁড়ালাম পতিতপাবনী গঙ্গার দিকে।দূরে নৌকার সারি ; আমি যাই নি কাদা ভেঙে কিন্তু যাকে টান মেরেছে হৃদয়পুরে সে অবশ্যই কাদা পেড়িয়ে গেছে। পুণ্য-লাভ কি এতোই সোজা?
ফেরার সময় দেখি যে মাঠে কুম্ভমেলা র তাঁবু পড়ে , যেখানে প্রতি পৌষ সংক্রান্তি তে কোটি মানুষের সমাগম হয় সেখানে দু একটা দোকানে ইতিউতি ক্রেতা আর ডাঁই করা লোহার পাটাতন ও বয়া। এগুলো দিয়ে ই অস্থায়ী সেতু তৈরি হয় ফি বছর।
ভগীরথ গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন পিতৃপুরুষের উদ্ধারের জন্য, পুণ্য লোভাতুর ভারতবাসী ও আত্মার শুদ্ধি ও উদ্ধারের জন্য হাজার হাজার বছর ধরে হেঁটে চলেছেন সেই সঙ্গমের দিকে; মহামিলনের মহানক্ষেত্রে।এ এক দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা যা তাড়িয়ে নিয়ে আসছে তাদের যুগ যুগ ধরে। অস্তগামী লাল টকটকে সূর্য টাও যেন সাক্ষ্য দিচ্ছিল প্রয়াগ ফেরৎ অধমের এইসব এলোমেলো ভাবনায়।
একদিন প্রতিদিন
যাজ্ঞসেনী
তারপর
তারপর পৃথিবীর শেষ মেয়েটি উলঙ্গ হয়ে হাঁটতে লাগল। রে রে করে ছুটে এল ট্র্যাফিক পুলিশ।
মেয়েটি খুব শান্তভাবে বলল, শরীরের শত্রু শরীর। তাই না?
তারপর পৃথিবীর শেষ গনিকাটি বিছানায় শুয়ে বাৎসায়ন না পড়েই কামকলা দেখাতে দেখাতে বলল, জন্মের উৎস যা, তাকে মৃত্যুর স্বাদ কেন দিস কুলাঙ্গার?
তারপর পৃথিবীর শেষ জননী তার পুত্রকে বলল, ধর্ষকরা ভুলে যায় যে, একটি মেয়ের অকালমৃত্যু মানে একদিন পৃথিবী মানবশূন্য হবে।
তারপর পৃথিবীর শেষ ধর্ষিতা বলল, ওরা আমার শরীর কেড়েছিল জোর করে। স্বেচ্ছায়, আমি দিলাম একদলা থুথু।
নিজস্ব ভাবনায়
রুদ্র সান্যাল
সিরিজ
উদয় সাহা
রুদ্র সান্যাল
কাউকেই আর দোষ দিই না!
কাউকেই আর দোষ দিই না।
কাকেই বা দেবো?
সময় ফুরিয়ে আসে খুব দ্রুত।
নীল আকাশের মাঝে খেলা করে সাদা মেঘ।
মাঝে মাঝে চেনা অচেনা পাখিদের
ডাক শোনা যায়।
জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে যাই,
সাদা মেঘেদের আনাগোনা।
সত্যিই কাউকেই আর দোষ দিই না।
সবুজ গাছেদের দল আর দেখি না আশেপাশে।
যা আছে, সেটুকুই বা আর কতটুকু!
শুকনো কংক্রিটের জঙ্গলে আর খেলা করেনা,
সেই সব ছোটবেলার চড়ুই পাখির দল।
সত্যিই কাউকেই আর দোষ দিই না।
দোষ দিয়েই বা কি হবে!
কারই বা কি যায় আসে তাতে।
কংক্রিটের জঙ্গলের মাঝে থেমে থাকে,
জমাট বাঁধা কালো অন্ধকার।
পচে যাওয়া সমাজের কাছে পরে থাকে,
অনেক চাওয়া পাওয়া।
সাথে থাকে অনেক হিসেব নিকেশ।
ধীরে ধীরে আগাছার মতো গজিয়ে ওঠে
বিপন্ন শৈশব।
সত্যি কাউকেই আর দোষ দিই না!
কারই বা কি যায় আসে।
বিপন্ন শৈশব বাড়ুক আরো দ্রুত।
মৃত সমাজ আরো দীর্ঘজীবী হোক।
সত্যি কাউকেই আর দোষ দিই না!
উদয় সাহা
জ্বরনামা
এক.
ক্রমশ শীর্ণকায় হয়ে আসছে বাড়ির কলের জল
আমরা মানিয়ে নিচ্ছি...
আমার মা শান্তশিষ্ট।
আমার গায়ে জ্বর...
দুই.
ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে থেকেই ট্যুরিস্ট গাইড বলছিলেন ----
এই পথ দিয়েই বয়ে যেত নদী... প্রাণোচ্ছল। বাঁধাহীন।
--' বাবা,চ'ল একটু পা ভিজিয়ে আসি'
ছেলেটি বাবার হাত ধরে হেঁটে যায় অবশিষ্ট নদীর পেটের দিকে।কুড়িয়ে নেয় কিছু পাথর। হাতের মুঠোয়।
--' বাবা দেখ, আমার কার্গোটাও ভেজেনি'
--' দাঁড়া তোর মাকে ডাকি। একটা সেল্ফি তুলি...
তিন.
আজকাল বৃষ্টি এলে আমি কষ্ট বুঝি না।
আমি খিদে বুঝি না। আমি তেষ্টা বুঝি না।
নামিয়ে রাখি জলপট্টি। কপাল থেকে।
আমি দেখি ---
বৃষ্টি ভিজিয়ে দিচ্ছে ফ্যাকাসে ফেস্টুনের রঙিন মেয়েটিকেও...
হেমন্ত
রীনা মজুমদার
প্রতিদিনের সকাল
সাত সকাল বলে - ট্রাফিক বিহীন
শিশির ভেজা রোড
খেলছে হেমন্তের রোদ
রাতের ক্লান্তি মুছে পাখিদের কলরব
দাঁড়িয়ে থাকা একটি-দুটি জীর্ণ গাছে,
পৃথিবীর আশা-নিরাশার খবর
ছুঁড়ে দেয় সাইকেল হকার,
সব্জিওয়ালার বাঁশি থামে
ফুটন্ত এককাপ পথ চায়ে l
ফুটপাত ঘিরে রাখা জনা-দশ নারী
কেঁদে ওঠে পৃথিবীর শিশুটি ..
আকাশ-ছোঁয়া ঘর থেকে
কোন সুগৃহিনী পুজো-পাঠ সেরে
সন্তান শুভকামনায় বাজায় শঙ্খধ্বনি -
আমার কবিতা শব্দের নয়
পরম নৈঃশব্দ্যে জীবনকে আঁকি।
স্বপ্ন
তৃপ্তি মিত্র
তৃপ্তি মিত্র
আজব ভাবনা
হতাম যদি ইচ্ছে পাখি কিংবা কোন পরি
মেঘবলাকা সঙ্গী করে দিতাম তবে পাড়ি।
বাঁধা নিষেধ নেই যেখানে যেমন খুশি চলা
নেই যেখানে বাঁধা নিষেধ মনের কথা বলা।
হিসেব কষা বারণ যেথা মিথ্যে অপবাদের
নেই সেখানে শাস্তি দেওয়া কঠিন অপরাধের।
ঘৃনার ভাব নেই যেখানে ভালোবাসায় পুণ্য
আঘাত দেওয়ার নেই তো বালাই মনটা করে চূর্ণ।
অনুশোচনার ধার ধারে না নেই তো দুঃখ কষ্ট
লাভ ক্ষতির হয় না হিসেব সেবাই হল শ্রেষ্ঠ।
থাক না যতই হতাশা জীবনে আশায় বাঁধে বুক
বিষন্নতার মাঝে খোঁজে আনন্দে ভরা মুখ।
বাঁধা নিষেধ নেই যেখানে যেমন খুশি চলা
নেই যেখানে বাঁধা নিষেধ মনের কথা বলা।
হিসেব কষা বারণ যেথা মিথ্যে অপবাদের
নেই সেখানে শাস্তি দেওয়া কঠিন অপরাধের।
ঘৃনার ভাব নেই যেখানে ভালোবাসায় পুণ্য
আঘাত দেওয়ার নেই তো বালাই মনটা করে চূর্ণ।
অনুশোচনার ধার ধারে না নেই তো দুঃখ কষ্ট
লাভ ক্ষতির হয় না হিসেব সেবাই হল শ্রেষ্ঠ।
থাক না যতই হতাশা জীবনে আশায় বাঁধে বুক
বিষন্নতার মাঝে খোঁজে আনন্দে ভরা মুখ।
শৌভিক রায়
নিজস্ব বৃদ্ধাবাস
১
শিল্যূটে ছায়া-শরীর
টুকরো জানালায় আকাশ উদার
স্তব্ধতার আকুল বীজগানে
সন্ধ্যা নামলে অনিঃশেষ,
বিমর্ষ, এই মহাজীবন,
নিজস্ব বৃদ্ধাবাস...
২
লালকমল আর নীলকমল
ঘোড়সওয়ার হিরণ্ময় রাতে
ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীও আসছে উড়ে
মুজনাই তীরে কাক-জ্যোৎস্নায়
ফিসফিস আজও বলো অলৌকিক গল্পসকল
শোনে বিষন্ন ঈশ্বর দেউলে ব'সে
৩
হাত ধরতে শিখিনি কেবল
শিখেছি যা কিছু আক্ষরিক
শিক ধরে থাকা
প্রাচীন ওই মুখে
লেগে থাকে তাই
উদাসীন যন্ত্রণা, হেরে যাওয়ার...
৪
প্রলম্বিত নিঃশ্বাসে সবুজ অতীত
নীলপাহাড়, দুদ্দাড় বৃষ্টি,
গুটিসুটি রাত, তীব্র দহন
চুপ কথা সব কবে কখন
আজকাল শুধুই অপেক্ষার
অহল্যাযাপন
No comments:
Post a Comment