Thursday, February 6, 2020




অনন্য শান্তিনিকেতন অন্য শান্তিনিকেতন
                                      
কুমকুম ঘোষ
    

ছাতিমতলার দক্ষিণ গেটের উপরে লেখা আছে --"তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি"; বেলাশেষের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে পুরো চত্বর টা; শীতের হাওয়ায় কাঁপন লেগে কিছু পাতা ঝরে পড়েছে এই হেরিটেজ প্রাঙ্গণের পথের ধুলায়। মনে হয় যেন কবির সেই গানের প্রতিরূপ অনুরণিত হচ্ছে  -- "আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন"।

১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের ৭ই পৌষ এখানেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তিনিকেতন আশ্রম। রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ষোল আনার বিনিময়ে ২০ বিঘা জমি পাট্টা নেন মহর্ষি। ব্রাহ্মসমাজের নানান মানুষ যাতে নিভৃতে নির্জনে ধ্যান করতে পারেন তার জন্য ই প্রতিষ্ঠা করলেন এই আশ্রমস্হল, যাকে সার্বিক ও সার্থক রূপে এক বিশাল মহীরুহে পরিণত করলেন তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কনিষ্ঠ পুত্র। শান্তিনিকেতন তাই সবসময় বাঙালীর জীবনে এক অনন্য আবাসভূমি হয়ে রয়েছে।

কবির হাতে গড়া শান্তিনিকেতন ছাতিমতলা, শান্তিনিকেতন গৃহ( মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নির্মিত,১৮৬৪সাল), উপাসনা গৃহ( কাঁচঘর) ছাড়িয়ে পাঠভবন,কলাভবন, শিক্ষা সদন,গৌর প্রাঙ্গন,আম্রকুঞ্জ ছাড়িয়ে এখন আরও অনেকটাই বিস্তৃত। দেশ-বিদেশের ছাত্র-ছাত্রী মুখরিত শান্তিনিকেতন তাই দেশীয় ভাবনায় বিশ্বকে আহ্বান করে চলে।  প্রাচ্যের সাথে প্রতীচ্যের মিলনের বার্তা অনুভূত হয় এখানকার হাওয়ায় হাওয়ায়। প্রাণের সাথে প্রাণের মিলন যেন শান্তিনিকেতনের কোণে কোণে বিরাজ করে। এখানেই তার অনন্যতা। 

উত্তরায়ণ তো এককথায়  বিস্ময়কর এক স্হান।কত ঘটনার সাক্ষী এখানকার এক একটি গৃহ।  আর কি অপূর্ব তার নামকরণ : উদয়ন (কবি ব্যবহৃত ঘরটি তেমনি সজ্জিত), কোনার্ক, শ্যামলী (মাটির বাড়ী),উদিচী, পুনশ্চ।  প্রখ্যাত ভাষ্কর রামকিঙ্কর বেইজ এর অনবদ্য ভাষ্কর্য গুলি খোলা আকাশের নীচে উদাত্ত আহ্বানে জানান দিচ্ছে প্রাণময় এক জীবনপ্রবাহের চলমান চিত্ররূপ হিসেবে।  প্রবেশদ্বার-এর বামদিকে ই বিচিত্রা ভবন যেটি এখন মিউজিয়াম। এখানেই ছিল কবিগুরুর নোবেল পদকটি (কোন অর্বাচীন সেটি গলিয়ে ফেলেছে ভাবতেই ব্যথায় ভরে ওঠে মনটা)। দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ২০০১ সালে।এখন আছে নোবেল প্রাপ্তির মানপত্রটি। উৎসুক দর্শক দেখতে পাবেন গীতাঞ্জলির ১টাকার সংস্করণ।

"এ মণিহার আমায় নাহি সাজে"... নোবেল প্রাপ্তির পর কবির অনুভূতি ছিল ঠিক এমনই।  শান্তিনিকেতন সহ সমগ্র দেশ যখন এই নোবেল প্রাপ্তির আনন্দে উৎফুল্ল তখন কবি শুধুমাত্র "আশ্রমের কল্যাণচিন্তায় তদ্গত প্রাণ"।  প্রমথনাথ বিশী লিখছেন---- নোবেল প্রাইজ লাভের সংবাদ বহন করিয়া বোলপুরে যখন টেলিগ্রাম আসে তখন রবীন্দ্রনাথ নেপালবাবু প্রভৃতি আরো দু- একজন অধ্যাপকের সঙ্গে কাছেই কোথাও বেড়াইতে গিয়েছিলেন--সেখানে টেলিগ্রামখানা পাঠাইয়া দেওয়া হয়। তিনি নীরবে টেলিগ্রামখানা পড়িয়া নেপালবাবুর হাতে দিয়া বলিলেন "নিন নেপালবাবু আপনার ড্রেন তৈরী করবার টাকা।" তখন আশ্রমের টাকার টানাটানি চলিতেছিল। একটা পাকা নর্দমা অর্ধখনিত অবস্হায় পড়িয়াছিল।---------এই শান্তিনিকেতন তাই সবসময় বাঙালীর জীবনে এক "অনন্য" স্হান দখল করে আছে।

এই অনন্য শান্তিনিকেতনের পাশেই সময়ের সাথে সাথে বয়ে চলে আর এক শান্তিনিকেতন। সে এক অন্য শান্তিনিকেতন। সেখানে উদাসী হাওয়ার পথে পথে কুসুম ঝরে না।চিৎকৃত আধুনিকতা তার নখ- দন্ত নিয়ে গিলে খায় ভুবনডাঙার একলা আকাশ। প্রকৃতি নিধন করে লালমাটির রাস্তায় পুরু পিচের আস্তরণে আর রাঙামাটির পথ দেখা যায়না প্রান্তিক স্টেশন থেকে খোয়াই পর্যন্ত। আবার সেই অন্য শান্তিনিকেতনে( আশ্রম প্রাঙ্গণে র বাইরে যার অবস্হান) আছে শীর্ণ জলহীনপ্রায়  "কোপাই নদী"-- যাকে দেখে কবি একদা লিখেছিলেন "আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে"; (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁসুলী বাঁকের উপকথাও এই নদীকে কেন্দ্র করেই লেখা), আবার এই অন্য শান্তিনিকেতনেই  আছে "খোয়াই বনের অন্য হাট" বা "শনিবারের হাট"  ; যা এখন প্রতিদিন বসে।  (প্রায় দুই দশক আগে কলাভবনের প্রাক্তনী শ্যামলী খাস্তগীর গ্রামীণ শিল্পী দের শিল্প কীর্তি সকলের সামনে তুলে ধরার এই অনবদ্য প্রয়াসের সূচনা করেছিলেন), আছে আদিবাসী গ্রাম "বনের পুকুর" : যেখানে সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমা " আগন্তুক"-এর শুটিং হয়েছিল। আছে "আমার কুটীর"-এর মত সমবায়িকা নির্ভর স্বাধীন অর্থনীতির উন্মেষ ,যা রবীন্দ্রনাথের ভাবনাকে বাস্তবায়িত করেছে, আছে শ্রীনিকেতনের কৃষিকেন্দ্রীক ভাবনা ও শিক্ষা।

জোড়াসাঁকোর সরুগলি থেকে জীবন ও যাপনকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমকেন্দ্রীক প্রকৃতির মাঝখানে। মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ভেদাভেদ। চেয়েছিলেন পূর্ণ প্রাণের সন্ধান।"তাসের ঘরের" রাজপুত্রের মতো সব বাঁধ ভেঙে অন্য ও অনন্যকে মিলিয়ে দেওয়ার ডাক তিনিই দিয়ে গেছেন "পৌষ মেলা"য়, "বসন্তোৎসব" এর পলাশ- শিমূলের রঙে বা প্রকৃতির সাধনায় সূচনা করেছেন "বর্ষামঙ্গল", '"হলকর্ষন" প্রভৃতি অনুষ্ঠান। এই অন্য শান্তিনিকেতনও তাই  সমস্ত ক্ষুদ্রতা সমস্ত সীমাবদ্ধতা পরিহার করে "বৃহৎ বা ভূমা" র কাছেই আত্মসমর্পণ করে চিরকালের জন্য স্হায়ী হয়ে গেছে। মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে তার অন্য রূপ কবির হতে গড়া অনন্য শান্তিনিকেতনের উদার প্রাঙ্গণে।



মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৬

রেজিস্ট্রেশন নাম্বার- S0008775 OF 2019-2020
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১
প্রকাশক- রীনা সাহা 
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 

মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৬

No comments:

Post a Comment