ডিটেনশান
মৌসুমী চৌধুরী
অসমের জাতীয় নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকায় নাম ছিল না আমাদের বেলামাসীর।
বেলারানী কর। আমাদের বাড়ির বহু দিনের রাঁধুনি। পাড়ার ডাকসাইটে ঝগড়ুটে। প্রথমে বিষয়টাকে মোটেও পাত্তা দেন নি তিনি। খচর খচর করে পান চিবোতে চিবোতে, রান্নায় ফোঁড়ন দিতে দিতে আপন মনেই বকবক করতেন,
---"অতই সস্তা রে! আমারে বিদেশী ঠাওরানো? আমারে চিনস না তো। আমি হইলাম গিয়া ত্রিপুরার কুমারঘাটের হরিমোহন সূত্রধর আর মঞ্জু সূত্রধরের মাইয়া। কাঠের মিস্তিরি হিসাবে আমার বাবার নাম আছিলো।"
বেলামাসীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অসমের গোয়ালপাড়ার মুদী দোকানী হরিশঙ্কর করের। কিন্তু তাঁর স্বামী অকালে মারা যান। তারপর বহু কষ্টে বাড়ি-বড়ি রান্না করে, বাসন মেজে, কাপড় কেচে ছেলেকে বড় করে তোলেন তিনি। যাইহোক, পাড়ার মুরুব্বীদের পরামর্শে ফরেনার্স ট্রাইবুন্যালে ১২০ দিনের মধ্যে নাগরিকত্ব দাবী করে আবেদন জানালেন বেলা মাসী।
কিন্তু আচমকাই ২০১৭ সালে বেলা মাসীর নামে ট্রাইবুন্যালের লোটিশ আসে। তাতে লেখা বেলারানী কর, স্বামীর নাম হরিমোহন কর। কিন্তু বেলারানী তো হরিমোহন করের স্ত্রী নন। এটা জানানোর পরই মাসীর রেহাই পাবার কথা ছিল । অথচ ট্রাইবুন্যাল তাঁকে বিদেশি ঘোষণা করে ডিটেনশান ক্যাম্পে পাঠালেন। কারণ বেশ গুরুতর। বেলামাসীর বাবার ১৯৭১ সালের জমির দলিলে দেখা যাচ্ছে বাবার নাম হরিহর সূত্রধর। কিন্তু আধার কার্ডে বাবার নাম হরিমোহন সূত্রধর, এটা দেখে ট্রাইবুন্যাল বাবা-মেয়ের সম্পর্ক মানতে চান নি।
ক্যাম্পে ঢোকার সময় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাঁউ মাউ করে কেঁদে ফেলছিলেন আমাদের জাঁদরেল, মুখরা বেলামাসী। তারপর মাসীকে ভারতীয় প্রমাণ করার জন্য দু'বছর ধরে বহু লড়াই চালায় তাঁর ছেলে টুবলু। হাই- কোর্টের দারস্থ হয় সে। হাইকোর্টের বিচারপতি মামলাটিকে ফের খতিয়ে দেখতে ট্রাইবুন্যালেই ফেরত পাঠান। নির্দেশ দেন, ট্রাইবুন্যাল যেন বেলামাসীর মা-মেয়ের সম্পর্কটাকে খতিয়ে দেখে।
বেলামাসীর মা, আমাদের মঞ্জু দিদা। মেয়ের বদলে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে রাঁধতে আসতেন। ট্রাইবুন্যালে দাঁড়িয়ে তিনি স্বীকোরক্তি দিলেন বেলারানী কর তাঁরই মেয়ে।তাঁর মেয়ের বাবার নাম মৃত হরিমোহন সূত্রধর। তারপরই ট্রাইবুন্যাল বেলামাসীকে ভারতীয় বলে মেনে নিয়ে ডিটেনশান ক্যাম্প থেকে মুক্তির নির্দেশ দেন। সরকারী নথিতে হরিমোহন সূত্রধর, হরিশঙ্কর কর, হরিহর সূত্রধর ইত্যাদি নাম-বিভ্রাটের ফাঁসে ততদিনে কেটে গিয়েছিল দু'বছর।
তারপরে মঞ্জু দিদা আর টুবলু ডিটেনশান ক্যাম্প থেকে মাসীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিল। কিন্তু সেই খচর খচর করে পান চিবুনি, ঝগড়ুটে বেলা মাসী তাঁদের মুখের দিকে কেমন যেন ফ্যাল ফ্যালে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। যেন এক পাথরের মূর্তি! ভারতীয় বলে প্রমাণিত হয়ে যেন অনেক বদলে গিয়েছেন আমাদের ঝগড়ুটে বেলা মাসী। ডিটেনশন ক্যাম্পের ডাক্তার জানিয়ে দিলেন মাসীর মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তার চিকিৎসাও চলছিল।
পাড়ার নিন্দুকেরা বলাবলি করতে লাগল, আসলে পরনিন্দা আর ঝগড়া করতে না পেরেই বুড়িটার মাথার ব্যামো হয়েছে।
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৬
রেজিস্ট্রেশন নাম্বার- S0008775 OF 2019-2020
ঠিকানা- হসপিটাল রোড, কোচবিহার, ৭৩৬১০১
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৬
No comments:
Post a Comment