Friday, February 14, 2020


বিশ্ব ভালোবাসার দিবসে শহীদদের জন্য একটি গোলাপ রেখো হৃদয়ের স্তবকে

বটু কৃষ্ণ হালদার


কাশ্মীর শব্দটি প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং যাকে "Kasmira"নামে অভিহিত করা হয়।নীল মত পুরাণ অনুসারে সতী সরস নামক হৃদয়ের পানি থেকে এই উপত্যাকার উৎপত্তি ঘটে।অনিশ্চিত এক জনশ্রুতি অনুসারে কাশ্মীর শব্দের স্থানীয় ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো পানি থেকে উদ্ভূত ভূমি।আবার লোক কথা অনুযায়ী কাশ্মীর মানে হল শুষ্ক ভূমি।দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কলহনের লেখা কাশ্মীরের ইতিহাস রাস্তা রঙ্গিনী থেকে জানা যায় যে কাশ্মীর উপত্যকা পূর্বে একটি হ্রদ ছিল।হিন্দু পুরাণে বর্ণনা করা আছে সৃষ্টিদেবতা ব্রহ্মার পৌত্র মহর্ষি কশ্যপ বারামুলা পাহাড়ের একাংশ কেটে জল নিষ্কাশন করেন।কাশ্মীর সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পর কশ্যপ ব্রাহ্মণদের সেখানে বসতি স্থাপন করার জন্য আমন্ত্রণ করেন। এই কাহিনী স্থানীয় ঐতিহ্য আজও রয়ে গেছে।
আপেল সুন্দরী কাশ্মীরের কথা মনে পড়লে মনটা কেমন নেচে ওঠে। পাহাড়,ঝর্ণা এবং আপেলের সুন্দর যে বিমোহিত হয়ে ওঠে পর্যটকদের মন।
ভু _ স্বর্গ কাশ্মীর ভারত তথা বিশ্বের কাছে এক বিস্ময়কর নাম। বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুর মানুষগুলির চাহিদা পূরণ করে এসেছে কাশ্মীর। কাশ্মীর মানে সৌন্দর্যের এক আশ্চর্য লীলাভূমি।ডাল লেক, লাকুতি ডাল, গাগরিবাল, বড়া ডাল,হাউসবোট, নাগিন লেক,বোটানিক্যাল গার্ডেন, ইন্দিরা 
গান্ধী টিউলিপ গার্ডেন, নিশাত বাগ শালিমার বাঘ চাষাবাদ পরিমল হযরত বাল দরগাহ শঙ্করাচার্য ধাম,জলপ্রপাত, সহ আপেল বাগানের স্বাস্থ্যকর পরিবেশের এক পরিপূর্ণ জীবনের পীঠস্থান। কাশ্মীর কথাটির নাম শুনলেই হৃদয় হিল্লোলের প্রাণেের দোলা। যেন ঈশ্বরেের হাতে গড়া মনোরম আর নয়ন জুড়ানো ভুবনভোলানো দৃশ্যের সমাহার।
 দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাশ্মীর শব্দটি ভৌগোলিকভাবে শুধু এবং পিরপাঞ্জাল পর্বত মালার উপত্যকাকে নির্দেশ করা হতো।কিন্তু বর্তমানে কাশ্মীর বলতে বোঝায় একটি বিশাল অঞ্চল ভারতীয় শাসিত রাজ্য জম্মু-কাশ্মীর (এরমধ্যে বিভাগসমূহ রয়েছে কাশ্মীর উপত্যকা জম্মু এবং লাদাখ),পাকিস্তান শাসিত গিলগিত-বালতিস্তান এবং আজাদ কাশ্মীর প্রদেশে এবং চীন শাসিত আকসাই চীন এবং ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চল সমূহ নিয়ে গঠিত।প্রথম শতাব্দীর প্রথমার্ধে কাশ্মীর অঞ্চল হিন্দুধর্ম উপরে ভৌত ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে পড়ে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শাইভিবাদের উত্থান ঘটে।১৩৩৯সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলমান শাসক এবং সালতিন_ই_ কাশ্মীর বা শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। এর পরে ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১সাল পর্যন্ত এই কাশ্মীর মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮২০ সাল পর্যন্ত আফগান দুররানি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এই বছরেই পাঞ্জাব কেশরী রঞ্জিত সিং এর নেতৃত্বে শিখ রা কাশ্মীর দখল করেন।১৮৪৬সালে প্রথম ইঙ্গ শিখ যুদ্ধে শিখ রা পরাজিত হয় এবং জম্মুর রাজা গুলাব সিং অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই অঞ্চল ক্রয় করে কাশ্মীরের নতুন শাসক হন।
১৯২৫ সালে হরি সিং কাশ্মীরের রাজা হন।ভারত বর্ষ স্বাধীনতা পর্যন্ত তিনি ছিলেন কাশ্মিরের শাসক। তবে স্বাধীন কাশ্মীরের ইতিহাস জানতে গেলে ভারত ভাগের ইতিহাস তাও আমাদের জানা খুব দরকার।১৯৪৭সালে ভারত বিভাজনের অন্যতম শর্ত ছিল ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজা ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন অথবা তারা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসন কাজ চালাতে পারবেন। ১৯৪৭ সালের ২২ অক্টোবর পাকিস্তান সমর্থিত পশ্চিমাঞ্চলে জেলার বিদ্রোহী নাগরিক এবং পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উপজাতিরা কাশ্মীর আক্রমণ করে।কাশ্মীরের রাজা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলেও গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন এর কাছে সহায়তা চাইলেন কাশ্মীরের ভারতভুক্তি পক্ষে স্বাক্ষর করবেন এই শর্তে মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীর কে সাহায্য করতে রাজি হয়।১৯৪৭সালের ২৬ শে অক্টোবর হরি সিং ভারতভুক্তি চুক্তিতে সই করেন।২৭ শে অক্টোবর অনুমোদিত হয়।চুক্তি সই হওয়ার পর ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে প্রবেশ করে অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।ভারত বিষয়টি রাষ্ট্রসঙ্ঘের উত্থাপন করেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভারত ও পাকিস্তানের তাদের অধিকৃত এলাকা খালি করে দিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ভারত প্রথমে এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল।কিন্তু ১৯৫২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচিত গণপরিষদ ভারত ভুক্তির পক্ষে ভোট দিলে ভারত গণভোটের বিপক্ষে মত দেয়।ভারত ও পাকিস্তান  রাষ্ট্রসংঘের সামরিকপর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধবিরতি তত্ত্বাবধানে আসে। এই গোষ্ঠীর কাজ ছিল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা ও তদন্তের রিপোর্ট প্রত্যক্ষ পক্ষ ও রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব এর কাছে জমা দেওয়া।যুদ্ধ বিরোধী শক্তি হিসেবে কাজ থেকে উভয় পক্ষের সেনা প্রত্যাহার ও গণভোটের প্রস্তাব দেয়া হয়।কিন্তু ভারত গণভোটে অসম্মত হয় এবং এজন্য পাকিস্তান ও সেনা প্রত্যাহারের অসম্মত হয়।ভারত গণভোট আয়োজনের অসম্মত হয়,এজন্য যে এটা নিশ্চিত ছিল যে গণভোটে মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের বেশিরভাগ পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দান করবেন এবং কাশ্মীরে ভারত বিরোধী আন্দোলন আরো বেশি হবে। সেই থেকে আজও ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত বিদ্যমান।
১৪ ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ব ভালবাসা দিবস। সারা বিশ্বজুড়ে এই দিনে মানুষ হিংসা ছেড়ে সম্প্রীতি ও ভালবাসার বার্তা দেয়।২০১৯ সালে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বের মানুষ যখন ভালোবাসার আঙ্গিনায় একে অপরকে আবদ্ধ করার নেশায় মশগুল হয়ে উঠেছে ঠিক সে সময় কাশ্মীরের পুলওয়ামায় নিরাপত্তা কর্মীদের বহনকারী যানবহনে ঘটে গেল নৃশংস জঙ্গি হামলা। ভালোবাসার দিনে জওয়ানদের তাজা তাজা রক্তে রঙ্গিন হয়ে উঠলো আপেল সুন্দরীর শাড়ির আঁচল। প্রায় ৪০ এর বেশি তরতাজা প্রাণ ভারত মায়ের কোল ছেড়ে ফিরে গেলেন না ফেরার দেশে। এই নৃশংস ঘটনায় সারা বিশ্ব হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে ভালোবাসার মলিন রং। ওই দিনই ভারত মা হারিয়ে ফেলেন তার বীর সন্তানদের। কত মা হলেন সন্তান হারা, সন্তানরা বঞ্চিত হলেন পিতৃস্নেহ থেকে, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে স্ত্রীরা বঞ্চিত হলেন স্বামীর ভালোবাসা থেকে। এই হামলার দায় স্বীকার করেন পাকিস্তানের ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই মোহাম্মদ। আজও কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী,সিয়াচেন থেকে লাদাখ,শীত,গ্রীষ্ম,বর্ষা তুষার,মরু কে উপেক্ষা করে প্রহর গুনতে থাকে। যারা প্রতিনিয়ত মৃত্যুর গান শুনতে পায়। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যু তাদের শিওরে কড়া নাড়ে। সবকিছুকে উপেক্ষা করে দুর্গম,গিরি,কান্তর,মরু দুস্তর কে জয় করেছে আমাদের দেশের বীর সন্তানরা।"প্রশ্ন করি বাবা তোমার আমার ছোট্ট মুখে/ তুমি কেন রাত্রি জাগো সীমান্তের এই বুকে? দেশের বীর সন্তানরা কেন,ওই সুদূর সীমান্তের বুকে রাত্রি জাগে উত্তর প্রদেশ আমাদের সবার জানা আছে। দেশের প্রতি ভালোবাসার টানে আজও সন্তানরা হাসিমুখে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। সেই সন্তানরা সীমান্তের বুকে রাত্রি জাগে বলে, আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাই, সে সন্তানদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা আশা স্বপ্ন গুলোকে পদানত করে আমরা নিজেদে কে সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিই।বিশ্ব ভালোবাসার দিবসে সেই সন্তানের জন্য একটা গোলাপ রেখো হৃদয় স্তবকে।

No comments:

Post a Comment