Saturday, June 27, 2020

আন্তর্জাতিক কবিতায় বাঁকবদল & বাংলা কবিতায় তার প্রভাব ও সমকালীন সময়ে রবীন্দ্রকাব্য
-------------------------------------------------------------------
মেশিন রচিত কবিতার সাপেক্ষে কবিতার শুরু, কবিতায় প্রযুক্তি (পর্ব - ৪)
:
:
বিগতো পর্বে, দেখা গিয়েছিলো যেকোনো ভাষার নেপথ্যে থাকা প্যাটার্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু আলোচনা।ঠিক এরকম প্যাটার্ন যদি কৃত্তিমভাবে তৈরি করা যায়, তাহলে ভাষা ও ব্যাকরণ : উভয়কেই কৃত্তিমভাবে সৃষ্টি করা যায়।কিন্তু 'মেশিন' প্রসঙ্গতে যাবার আগে, 'প্রযুক্তি' ধারনাটি সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন

প্রযুক্তি বিষয়টিকে যদি একলাইনে বলতে হয়, তা এভাবে বলা যেতেই পারে : "এমন একটি ব্যবস্থা, যা দুটি বস্তুর ভিতরে নূন্যতমো উপলব্ধ সহজ উপায়ে ও দ্রুততমো যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম"।একটু কি কঠিন লাগলো? তবে আসুন, কথাটিকে একটু সহজ করে বোঝা যাক।উদাঃ-১ : ধরা যাক গুহামানুষের কথা।সে জানতো না ছবি আঁকার কথা / অক্ষর কল্পনা থেকে ভাষার লিখিতো রূপ।সে কেবল অপরের সাথে যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের উদ্দেশ্যে, দৃশ্যকে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনীয়তা থেকে শিখে নিয়েছিলো স্বরধ্বনির ব্যবহার।ব্যবহৃত হয়েছিলো ধ্বনিভিত্তিক সংকেত।কারন, সংকেত হলো স্বল্পকায় এবং দ্রুতগতির যোগাযোগ বা অবস্থান নিশ্চিত করার প্রামাণ্য ডকুমেন্টেশন।আবার বিভিন্ন ছন্দভিত্তিক ভাবে, সেই স্বরধ্বনির পুনরাবৃত্তি থেকে জন্ম নিলো সুর এবং শ্রুতি।কিন্তু শুধুমাত্র ধ্বনিভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা সম্ভবতো, যোগাযোগ করতে চাওয়া চরিত্রগুলির একই সময়কালে অবস্থান এবং নিগর্ত ধ্বনির শ্রুতিসীমানায় চরিত্রগুলির শর্তসাপেক্ষ থাকা।এখোন, এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে গিয়েই হোক / নিজ অস্তিত্বকে বহু ভীড়ে খুঁজে নেবার তাগিদ থেকেই হোক : প্রয়োজন হলো, দৃশ্যকে কিছু চিহ্ন আঁকার মাধ্যমে প্রকাশিত করার প্রয়োজনীয়তা।গভীর পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে খোঁজা হলো, কঠিন মাধ্যমের আধার বা চিত্রধারক (আধূনিকতায় যা ক্যানভাস্)।খুঁজে নেওয়া হলো, উপযোগী ও উপযুক্ত লেখনী ধারকশৈলী অনুযায়ী।তারপর বর্ণ / রঙ।পরবর্তী পর্যায়ে : অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলার ইচ্ছে নিয়ে কাল্পনিকতার মিশেল সহযোগে ব্রহ্মাণ্ডের বিমূর্ত প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ করার প্রথম সার্থক প্রচেষ্টা।এবার আসি 'মেশিন' প্রসঙ্গটিতে।

বিজ্ঞানের বক্তব্য অনুযায়ী "যা বিশেষ কোনো চেতনায় জারিত হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো কাজ করতে সক্ষম, সেটাই মেশিন" এবং সভ্যতায় এর সর্বপ্রথম, আদিম ও উৎকৃষ্টতমো উদাহরণ হলো প্রাণীর শরীর।যেমন উদাহরণরূপে, ছবি আঁকার বিষয়টিতে : শরীরের অঙ্গ / লেখনী মাধ্যম / ইত্যাদি সবই মেশিন।আগে বলা বক্তব্য অনুযায়ী "নূন্যতমো উপলব্ধ সহজ উপায়ে ও দ্রুততমো যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম" কথাটিকে শর্ত হিসেবে মেনে নিলে, প্রযুক্তির ধারনাটিকে যতো উন্নতকরণ করা হয়েছে, মেশিন কথাটিরও বিবর্তন হয়েছে ততো (এখানে, কার্য বা কাজ বিষয়টিকে, বৃহদার্থে যোগাযোগব্যবস্থা বলে উল্লেখ করা হলো)।আমরাও, যতো কবিতার ইতিহাস প্রসঙ্গে প্রবেশ করবো, বিবর্তন বিষয়টির আড়ালে থাকা প্রযুক্তিটিও, ততো স্পষ্ট হবে আমাদের কাছে।এখানেও, শুরুবাদ পর্বে রাখা বক্তব্যনুযায়ী 'শিল্প' কথাটির পরিবর্তে 'কবিতা' কথাটি উল্লেখিতো হলো, বৃহদার্থের উদ্দেশ্যেই।তবে, "প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কবিতায় আপত্তি" কথাটির চেয়েও, অনেকের কাছে প্রকট বিষয়টি হলো : প্রযুক্তি ব্যবহারে নান্দনিকতা ধ্বংসের আপাত প্রবণতা।অর্থাৎ, এই প্রযুক্তির ধারনা কি কবিতাটিকে, কবিতাটির কাব্যধর্মীতা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে।অতএব, কবিতার নান্দনিকতা প্রসঙ্গে কিছু কথা এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন
:
:
যেকোনো নির্মাণ বিষয়ক ঘটনার পেছনে, কোনো না কোনো প্রযুক্তি কাজ করে।এটাই ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি।সেরকমই শিল্পচিন্তাও, এর বাইরে নয়।এখানে একথাও ঠিক, নিয়ম থাকার অর্থই হলো : নিয়মকে অস্বীকার করে নতুন পথ-সন্ধান।নতুন পথ খোঁজার প্রয়োজনীয়তা তখনোই পড়ে, যখোন সামনের পর্যায়ে সন্ধানটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।আসলে, জানা / শেখা / আত্তীকরণ / প্রয়োগ : প্রকৃতি বারবার অধ্যয়ন করতে বলে।আর এখান থেকেই চিন্তাশীল যাকিছু, সকলেই তার চিন্তার রসদ সংগ্রহ করে থাকে।এবার যদি একটি প্রশ্ন রাখা যায় : ধরা যাক, যে মানুষটি দৈনন্দিন লড়াই করে নিজের বেঁচে থাকাকে নিবৃত্ত করেন, অর্থাৎ ~ মানুষটির অবস্থান এমনই, যেখানে পায়ের তলায় মাটি নেই / মাথার ওপর ছাদ নেই / পেটে খাবার নেই ~ এই অবস্থায়, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না কী পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে ~ তথ্যটি তাকে কিভাবে বেঁচে থাকায় সহায়তা করবে। উত্তরে স্রেফ এটুকুই বলা যেতে পারে, দিনযাপন তাঁর বেঁচে থাকার কর্মক্ষেত্র হলে, রাতযাপন তাঁর কাজের প্রস্তুতিক্ষেত্র।কিন্তু, প্রয়োজনীয় একথা নয়, বরং গুরুত্বপূর্ণ হলো সেইকথাটি : তিনি টিকে আছেন কিভাবে।এখানে, টিকে থাকা' প্রয়োগটি সবচেয়ে অসহায়তমো মাধ্যমের পরিপূরক হিসেবে নূন্যতমো সম্ভাব্য রূপ।একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এখানেও তিনি কিন্তু তাঁর দৈনন্দিন যাপন সাপেক্ষে, প্রকৃতির সাথে যুঝে নেওয়ার মাধ্যমে, শিখে নিচ্ছেন তাঁর সাম্প্রতিকতমো প্রাসঙ্গিক পরিকল্পনা।আর এখানে তাঁর যাপনসঙ্গী হলো গভীর থেকে গভীরতমো পর্যবেক্ষণ।অনেকটাই এরকম যে : সংগৃহীত আহারকে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদে গ্রহন করার জন্য প্রয়োজনীয় ছাদ।আহার সংগৃহীত করার পরিকল্পনা থেকে বেঁচে থাকার জন্য, প্রয়োজনীয় শিক্ষা।এবং, শিক্ষা প্রয়োগকে সম্পূর্ণ করার তাগিদ থেকে যোগাযোগ, ইত্যাদি।এখানে যেমন, সেই টিকে থাকা মানুষটির জন্য : শিক্ষা / যোগাযোগ / প্রযুক্তি, তিনটি বিষয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।এবার, প্রযুক্তির ধারনা পাল্টাবার সাথেসাথেই, পাল্টাচ্ছে মানুষটির অবস্থান এবং তার সরাসরি প্রভাবে পারিপার্শ্বিকতা ও দেখার পদ্ধতি।কিভাবে, আসুন একটু বুঝে নিই বিস্তারিত।

প্রকৃতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, আপাতভাবে কোনো শূন্যস্থান তৈরি না হতে পারা।শূন্যস্থান পূরণ হলেই, সেখানে আশেপাশে থাকা পদার্থসমূহ প্রবেশ করে, শূন্যস্থানটিকে ভরাট করবে।একথা বলাই যায়, শূন্যস্থান হলো একটি চূড়ান্ত শক্তিশালী সবচেয়ে ভয়ংকর হাঁ মুখ করে রাখা শিকারি।যার খিদে, ভরাট না হওয়া পর্যন্ত মেটে না।একথা, যাপনপর্বেই প্রযোজ্য।কারন, চিন্তাশীল মস্তিষ্কটি কখনোই শূন্যস্থানে পরিণত হতে পারে না।প্রতিটি বিষয়ের বৈচিত্র্যের মধ্যে, চিন্তাশীল মস্তিষ্ক নতুন কিছু সম্ভাবনা খোঁজে / বপন করে সৃজনের বীজ।একঘেয়েমি থেকে বারংবার নিজেকে মুক্ত করতে, সে আশ্রয় নেয় প্রকৃতির অন্তর্গত গভীর পর্যবেক্ষণ-পাঠকে।সুতরাং, আদিম মানুষের ক্ষেত্রে যেমন নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনাগুলি শিল্পের মাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছিলো, আমাদের স্যাম্পল হিসেবে নেওয়া খেটে খাওয়া মানুষটির ক্ষেত্রেও তাই।অতএব, তাঁর খাদ্যভান্ডার মজুত নিশ্চিত হলেই (তা সে সাময়িক সময়ের জন্য হোক), তার বিষয় বৈচিত্র্যের দিকে ছুটে যাওয়ার প্রবণতা স্বাভাবিক।এই পর্বে, একথা বোঝাই যায় : প্রাণের খাদ্য শুধুমাত্র শারীরবৃত্তীয় কোষকলাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে নয়, নতুন সম্ভাবনাসমূহের প্রতি আকর্ষিত হওয়াটিও খাদ্য অন্তর্গত উৎসমৌল।অতএব, অভ্যস্ত মাধ্যমটির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হওয়ার সাথেসাথেই, মানুষটি যে মহাজাগতিক বিস্ময় নিয়ে কখনোই ভাববে না বা পূর্বকথিত "সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না কী পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে" তথ্যটি নিয়ে ভাববে না, একথা নির্দিষ্টভাবে কেউই বলতে পারবে না।আসলে, পিপাসার আয়তন তো আর সর্বক্ষেত্রে একক্ নয় যে তার নিরূপণ বিষয়টি স্থির করা যাবে।পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত হওয়া, সমকালীন সাপেক্ষে উন্নত মানের শিল্পকর্মগুলি যে ভয়ংকর যাপন ক্রাইসিস্ থেকে সৃষ্ট হয়েছে, প্রসঙ্গগত এর উদাহরণ অনেকটাই বেশি।এটাই বোধহয় বক্তব্যটিকে স্পষ্ট করে।অতএব তিনটি বিষয় পরিস্কার : "নান্দনিকতা হলো অনুভূতি উপলব্ধ একটি বিশেষ চিন্তার খাদ্য, যা একটি সরল বিন্দু থেকে শুরু করে জটিল চিত্রে রূপান্তরিত হবার প্রবণতাযুক্ত এবং এটি যাপনকৃত অভ্যস্ত মাধ্যমটির ওপর নির্ভরশীল, অথবা আত্তীকৃত তথ্যসুলভ কোনো আকৃতির ওপর এটির গড়ে ওঠে"।যদিও, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিষয়টিকে আরেকভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়।ধরা যাক কোনো একজনকে সামুদ্রিক গভীরতার চরিত্র ব্যাখ্যা করতে বলা হলো, যে কখনো সমুদ্র দেখে নি।নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এখানে তাঁর একমাত্র সহযোগী আশ্রয় উপাদান হলো কল্পনা, যেটি সে তার নান্দনিক বিষয়টি সম্পর্কিত আত্তীকৃত চেতনা থেকে প্রকাশ করবে।এবার তাকে, কিছু তথ্য দেওয়া হলো সমুদ্র সম্পর্কে।দেখা যাবে, তার তথ্য নির্ভর কল্পনা কিছুটা রূপান্তরিত হয়েছে।এবার তাঁকে দেখানো হলো অডিও এবং তারপর অডিও-ভিস্যুয়াল পর্ব।দেখা রূপান্তরকরণের প্রবণতা আরো ক্রমবর্ধমান।এবার, সবশেষে তাঁকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া গভীর সমুদ্রতলে।দেখা যাবে, তাঁর চেতনালব্ধ নন্দনতত্ত্বের চূড়ান্ত রূপান্তর।অর্থাৎ, অভ্যস্ত মাধ্যম ও তা থেকে প্রাপ্ত তথ্যশৈলীর প্যাটার্ন থেকে লব্ধ অনুভূতিসমূহের প্রকাশ (যাকে কিছুটা হলেও কল্পনা বলা যেতে পারে) ~ এসবই পরিবর্তনশীল, অস্থায়ী। 'কাল্পনিকতা' বিষয়টিকে বলতেই পারি : জানা এবং অজানার মধ্যে থাকা পারস্পরিক সম্পর্কের বাহ্যিক প্রকাশ (একটা অচেনা relation)।ভাষা / সংখ্যা / শূন্য / ইত্যাদি : যেকোনো কিছুতেই নান্দনিকতা বিষয়টি, অনেকটাই এরকম নয় কি?যেহেতু, এই বিষয়গুলি কবিতা বিবর্তনের পথে আমাদের সহযোগী হিসেবে হাঁটবে, তাই কিছুটা প্রাথমিক আলোচনা সেরে রাখা হলো।অতএব, প্রসঙ্গ আর দীর্ঘায়ত না করে, পরবর্তী পর্বের জন্য রাখা হলো নতুন বিষয় : "বিশ্বকবিতার শুরু ও সভ্যতার সাপেক্ষে তার মূল পর্যায় এবং কবিতার শুরুর দিনগুলি"


শব্দরূপ : রাহুল গাঙ্গুলী

No comments:

Post a Comment