Thursday, July 2, 2020

ভক্তের ভগবান
সুস্মিতা পাল কুন্ডু

আষাঢ় মাস শ্রীপতি-নয়নার সংযমের মাস ৷ সারাটা মাস পুজো আর্চা ও নিরামিশ আহারে মাস কাটে ৷  বর্ষা ঋতুর প্রথম মাস আষাঢ় ৷ আকাশে ঘনকালো মেঘের দলের আনাগোণা ...আর টুপটাপ  ঝরে পড়া বৃষ্টির গানে সবুজ হয়ে ওঠা পরিবেশ .... মনে ভরসা জোগায় ৷ হিন্দু শাস্ত্র মতে, এই মাসে ধরিত্রী রজঃস্বলা হয় ৷ অম্বুবাচী শেষে  নতুন করে হলকর্ষণ করার পর আমনধানের বীজ বপন করা হয় ৷ কৃষক পরিবারের মেয়ে নয়না ছোট্ট থেকে এইদেখেই বড়ো হয়েছে ...আর শ্রীপতির তো বড়ো হওয়া ভগবানের লীলাখেলার দেশে ৷ আজ রথযাত্রা ... শ্রীপতি-র ঘুম ভেঙ্গে গেল খুব সকালে ৷ নয়নাকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে সেও উঠে পড়ল ৷ ভাবল হয়তো বা বাগানে আছে  ৷ ধর্মশালার সামনে সুন্দর বাগানটি তীর্থযাত্রীদের অবসরে সময় কাটানোর একটা ভালো জায়গা ৷ একসময় শ্রীপতি নিয়মিত পরিচর্যা করত বাগানটির ৷ পায়ে পায়ে সারা বাগান ঘুরেও নয়নাকে কোথাও দেখতে পেল না ৷ আশেপাশে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ঘরে ফিরে এসে ঘুমন্ত ছেলের পাশটিতে বসে থাকল চুপ করে কিছুক্ষণ ৷ টুকুন শ্রীপতি আর নয়নার বেশি বয়সের সন্তান ৷ ত্রিশ বছর বয়সে শ্রীপতি নয়নাকে বিয়ে করে ..তখন নয়নার আটাশ ৷ আগে থেকে কোনো ঠিক ছিল না , হঠাৎ করেই  বিয়েটা হয় ৷ নয়না-র মা এসেছিল পুরীতে বাসে চেপে অন্য অনেকের সাথে মেদিনীপুর থেকে ৷  শ্রী শ্রী জগন্নাথদেবের মন্দিরে সবার সাথে পুজো দিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন এদিক সেদিক ৷  তারপর ফেরার সময় হঠাৎ করে ধেয়ে আসা সুপার সাইক্লোনের মধ্যে পড়ে যায় ৷ কয়েকদিন আটকে ছিল সবাই ধর্মশালায় ৷ সেখানেই কাজ করত শ্রীপতি ৷ হঠাৎ নয়না-র মা অসুস্থ হয়ে পড়ে ....শেষপর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় ৷ এর মধ্যে তীর্থযাত্রীদের নিয়ে বাস ফিরতে চাওয়ায় সমস্ত দায়িত্ব শ্রীপতি-র ঘাড়ে এসে পড়ে ৷ 
                     অবশ্য ঘাড়ে পড়েছে বললে ভুল বলা হবে ...স্নেহপরায়ণা বিধবা মহিলাটির প্রতি শ্রীপতি কেমন যেন মায়ার জড়িয়ে যাওয়ায় কিছুটা নিজে যেচেই দায়িত্ব নিয়ে নেয় ৷ কয়েকদিন পরে একটু সুস্থ হওয়ায় তাকে মেদিনীপুরের গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য সঙ্গে করে রওনা দেয় শ্রীপতি ৷ কিন্তু কোনোরকমে  বাড়ি পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে ৷ মৃত্যুর আগের দিন নয়নার মা নিজের একমাত্র মেয়েকে শ্রীপতির হাতে তুলে দিয়ে যান ৷ একান্নবর্তী পরিবারে কষ্টেসৃষ্টে বেড়ে ওঠা নয়না , বিধবা মায়ের শেষ ইচ্ছেটুকুকে সম্মান জানিয়ে শ্রীপতির হাত ধরে ...আর শ্রীপতি এত শান্ত - লক্ষীমন্ত একজনকে যে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাশে পাবে তা কখনো ভাবে নি ৷  মায়ের মৃত্যুর পর কাকারা নয়নার বাবার জমির ভাগটুকু  নয়নার নামে করে দেয় ৷ একফালি জমিতে নতুন করে ঘর তৈরি করে গড়ে ওঠে নয়না-শ্রীপতির সংসার ৷ আইসিডিএস কর্মী নয়নার চাকরিটা তখন সবেই পাকা হয়েছে ...তাই বউকে নিয়ে শ্রীপতির ফেরা আর হয়নি পুরীতে ৷ নিজেই এখানকার এক কাপড়ের দোকানে কাজ জুটিয়ে নেয় ৷ অবশ্য শ্রীপতির নিজের কোনো পিছুটান ছিল না ....কোনো এক সময়ে মা-বাপ মরা কিশোর শ্রীপতি উড়িষ্যার কোনো এক অখ্যাত গ্রাম থেকে মামার সঙ্গে পুরী এসেছিল ৷ মামা তাকে কাজে ঢুকিয়ে  সেই যে গেছে ...আর এমুখো হয়নি ৷ ধর্মশালায় চাকুরিরত সবাইকে নিয়েই বেশ কাটছিলো শ্রীপতির...কেটেও যেত দিন , এর মধ্যেই এই ঘটনা ৷ শ্রীপতি ভাবে সবই জগন্নাথ দেবের আশীর্বাদ ৷
       বিয়ের পর কয়েকবার নয়নাকে নিয়ে পুরী ঘুরে গিয়েছে শ্রীপতি ৷ এখানে  নিজের জায়গায় এসে ওঠে  ৷ সবাই নয়নাকে দেখে আর ওর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছে ৷ কিন্তু যখন অনেকদিন সন্তান হলো না ...তখন  যেন নয়না কেমন যেন মনমরা হয়ে থাকতে শুরু করে ৷ শ্রীপতি নয়নাকে অভয় দিয়েছে ....আর নয়না জগন্নাথদেবের কাছে বারবার মাথা কুটেছে ৷ অনেক ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করে হাল ছেড়ে দেওয়ার পর...বিয়ের দশবছর বাদে টুকুন এসেছে ৷ নয়না-র বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে জগন্নাথদেবের আশীষ না পেলে হত না ৷ তাই প্রতিবার রথের সময় পুরীতে জগন্নাথদেবের কাছে ছুটে আসে তারা ৷ কিন্তু এবছর পরিস্থিতি অন্যরকম ...করোনা আবহাওয়ায় দেশে লকডাউন চলছে ৷ আনলক ১ এ , কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে ৷ রথযাত্রা শেষ পর্যন্ত হবে কিনা এই নিয়ে দোলাচলে ভুগেছে ওরা ৷ কিন্তু যেই খবর পেয়েছে হবে ....তক্ষণাৎ মেদিনীপুরের জেলাশাসকের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে ছুটে এসেছে সন্তান নিয়ে দু'জনে ৷ জানে রথের দড়ি ছোঁয়ার অধিকার এবার একমাত্র সেবাইত দের ৷ তবুও মন মানে নি ....
       অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও নয়না না ফেরায় শ্রীপতি অস্থির হয়ে ওঠে ৷ ছেলেকে স্নান করিয়ে ...খাইয়ে ,নিজেও স্নান করে  ছেলে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে ধর্মশালা ছেড়ে এগিয়ে চলে মন্দিরের দিকে ৷ কিন্তু একসময় পুলিশের বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে আর এগোনো সম্ভব হয় না ৷ দূর থেকে দেখে পুরীর মহারাজা সোনার ঝাঁটা দিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছেন ৷ কিছু উৎসাহী তীর্থযাত্রীদের ভিড়ে নয়নাকে কোথাও দেখতে পায় না ৷  বেলা বাড়ছে  ..রথযাত্রা শুরু হয় ...প্রথমে বলরামদেবের রথ তালধব্জ ,সুভদ্রাদেবীর রথ দলদর্পণ সবশেষে জগন্নাথদেবের রথ নন্দীঘোষ মাসীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় ৷ নয়নার খোঁজে চোখ ....ভেতরে ভেতরে অস্থির শ্রীপতি ...একমনে ভগবানকে ডেকে চলে  ৷ সন্ধ্যা নেমে আসায় ধীরে ধীরে তীর্থযাত্রীদের ভিড় হালকা হতে থাকে ...আর তখনই চোখে পড়ে নয়নাকে ...নয়নাও দেখতে পায় শ্রীপতিকে ৷ লাল গরদের শাড়ি পড়া  নয়নার চোখেমুখে যেন যুদ্ধজয়ের হাসি ...ফুল প্রসাদের ডালাটা দু'হাতে চেপে এগিয়ে আসে ধীরে ধীরে শ্রীপতির দিকে ৷ শ্রীপতি তখন তার লক্ষীকে দেখতে পাওয়ার আনন্দে সজোরে চিৎকার করে বলে ওঠে , ' জয় জগন্নাথ ,জয় বলরাম ,জয় সুভদ্রা ' ....



বি.দ্র : সকল ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক ৷

(মুজনাই অনলাইন আষাঢ় সংখ্যা)

No comments:

Post a Comment