Saturday, October 31, 2020


 

 

 

 

 

 

 

 

 

" ছোটগল্প "
আফতাব হোসেন



                                ( ১ )
“ছোট প্রাণ,ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা,নিতান্ত সহজ সরল”
----------------------------------------
আজকাল লিখতে পারি না,লিখতে গেলে কখনও কলম শুকোয় তো কখনো আবার বুক ধড়পড় করে ।আসলে মানুষ তো তাই বোধহয় মোশন পিকচার্স এর মত পরপর ইমোশনাল হিট দিতে পারি না ।ইমোশন কথাটা খুব ঠুনকো বুঝলেন, কথায় কথায় অভিমানী প্রেমিকার মত ঠোঁট ফুলিয়ে বোবা কান্নায় কাঁদে ।আমি আবার বোবা হতে পারি না,বোবা হলেই একগাদা দুঃখ চোখে এসে জমা হয়ে টল টল করে আর ঠিক তারপরেই হেসে ফেলি । কারন কাঁদার মত সৎসাহস আমার নেই ।

                                     (২)

“সহস্র বিস্মৃতিরাশি,প্রত্যহ যেতেছে ভাসি, তারই দু চারটি অশ্রুজল ”
----------------------------------------

অপালা কে অনেকদিন থেকেই চিনি । ওয়ার্কিং এস এ হোম মেকার । সাথে একগাদা বাচ্চার ছবি । নিজের ফেসবুক প্রোফাইলটা এইভাবেই প্রায় গত 2 মাস ধরে সাজাচ্ছে । কদিন আগেই বলছিল ; 
-ঠিক করে নিয়েছি বুঝলে মেয়ে হোক আর ছেলে ফেসবুকের প্রথম আপলোড টা আমিই করবো । এ নিয়ে রজত কে বলেও রেখেছি । তবে জানো তো রজত টা ইদানিং বড্ড খিটখিটে হয়ে গেছে । গতমাসে রেবার সাথে ব্যবহার টা ভালো করেনি গো । মেয়েটা কে কোন দোষ ছাড়াই যা তা বলে ছাড়িয়ে দিল । রেবা যাবার সময় খুব কাঁদছিল । আমাকে বোনের মতই স্নেহ করতো বুঝলে ,আমি প্রেগন্যান্ট বলে মুখ বুজে সারাদিন কাজ করে যেত । রজত যে ওকে তিন মাস বেতন দেয়নি এটা আমি জানতাম না গো। রেবাও কিছু বলে নি যে এ ব্যাপারে । ওদিন রজত ফালতু ফালতু রেবার উপর ছোটপাট করে ওকে কেন ছাড়াল আজ পর্যন্ত্য বুঝে উঠতে পারিনি বিশ্বাস কর । রজত কে জিজ্ঞাসা করলে রজত কাটিয়ে গেছে , বলে দূর আমার তো এখন ওয়ার্ক ফর্ম হোম চলছে । দু জনের এইটুকুন কাজ আমরাই করে নিতে পারবো ।তাছাড়া একটা প্রাইভেসি আর হাইজিন এর ও ব্যাপার আছে বলো । আর কথা বাড়ায় নি । মেয়েটা যাবার সময় খুব কাঁদছিল গো ।

- বললাম চাপ নিস না , কথা বলে দেখবোখন । তুই রেস্ট নে ।

                                    (৩)

“নাহি বর্ণনার ছটা,ঘটনার ঘনঘটা, নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ”
----------------------------------------


- ছেলেমেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করতে কত লাগে জানিস ? 
 - ওই সব ছাড় সিজারের চার্জ জানিস এখন ?
‘ দেখ রজত মোটামোটি ভাল করে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে লাম সাম ফরটি থাউসেন্ড ক্যাশ পার মান্থ চাইই চাই , না হলে দেখ ভাই ছেলেমেয়েগুলো রাস্তার কুকুর হয়ে ঘুরে বেড়ায় , তাই তো আমি আর নীলিমা বাচ্চাই নিই নি । আগে নিজেরা কিছু সেভিংস করি । তারপর ভাবব । একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামালো মিহির ।তারপর সিগারেটে সুখটান দিয়ে বললো চলি রে । কাল আবার লকডাউন । সালা ঘরে থেকেই সারাদিন ঘ্যানঘানানি শুনতে হবে ।
 রজতের ও ইদানিং ভয় হয় ।আসলে ভয়টা ওর জন্মগত । বাড়িতে গিয়ে একটু হিসেব টা নিয়ে বসতে হবে মনে হয় ।

রজত চক্রবর্তী । একটা স্টার্ট আপ কোম্পানির পোগ্রামিং লিড । ছোট স্টার্ট আপ । বেতন খুব খারাপ না । গাদাগুচ্ছের কম্পিটিশন আর দুনিয়ার রিসেশন এর মার্কেটে চাকরি টা পেয়ে রজত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল । সেও হয়ে গেল 6 বছর আগের কথা । চাকরিটা পেয়েই টুক করে অপালাকে তুলে নিয়েছিল । হ্যাঁ ,তুলেই নিয়েছিল । না হলে ওর মত উদ্বাস্তুর সাথে কোন বাবা কি অপালাকে সঁপে দেবে ।
অপালাই বলতো দেখ না সব ঠিক হযে যাবে । তুমি শুধু নিজের ওপর ভরসা রাখ । ঠিক হচ্ছিলোও আস্তে আস্তে । 650 স্কোয়ারের ফ্ল্যাট টা অপালাই পছন্দ করেছিল । রেটটা একটু বেশি । কিন্তু সামনে একটা বড়সড় পার্ক আছে । রজত ই জোর করেছিল,,তা হ্যাঁ গো ,, এতবড় পার্কে কি আমাদের কেউ খেলবেনা ।
অপালাটা সারাজীবনই খুব লাজুক । উত্তর দিতে পারেনি কিছুই ।শুধুই লাল হয়েছিল । ঠিক সূর্য ওঠার আগে আকাশটা যেমন লাল হয়ে তেমনই ।

তবে লাল মনে হয় সুখের রঙ হতে পারে না ।সুখবর টা আসার কদিন পরেই টানা লকডাউন আর তার পরেই পিঙ্ক স্লিপ টা মেলে পেয়েই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল রজত । কর্পোরেটর রা ছাঁটাই নোটিসকে ভালোবেসে বলে পিঙ্ক স্লিপ । 
 বললো দাদা বাচ্চাটা আসার আগেই চাকরি গেল গো । অপালাকে কি মুখ দেখাবো বল । বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ কি রাস্তায় দাদা । 
দামড়ে বললাম ওরে দাঁড়া, অত ভাঙ্গিস না , অপালার কথা মাথায় রাখিস । তোকে শক্ত হতেই হবে বুঝলি । এগুলো প্যান্ডামিকের সাইড এফেক্ট । ধৈর্য ধর ।সময় সবসময় খারাপ যায় না ।

                                    ( ৪)


“অন্তরে অতৃপ্তি রবে , সাঙ্গ করি মনে হবে ”
------------------------------------

USG তে পলিসিস্টিক ওভারি রিপোর্টার পর থেকেই রজত বড্ড সাবধান হয়ে গেছিল । অপালাকেও গুগুল দেখে দেখে সব বুঝিয়েছে কি করা যাবে আর কি করা বারণ । অপালা অবশ্য এ ব্যাপারে রজতকে অক্ষরে অক্ষরে মেনেও চলে । স্বপ্নটা অপালার অনেকদিনের ।  সাত মাস বয়সে মা হারা অপালা । বাবাও আর বিয়ে করেননি । মায়ের স্বাদ আর মাতৃত্বের অহংকার একসাথে মিটিয়ে নিতে চায় ও । তাই অত্যাধিক সাবধানী । তার ওপর আবার এই সব মহামারী । নাহ এত টেনশন অপালা কোনদিনও নেয়নি । মাঝে রেবাটাও নেই । অসহায় লাগে নিজের । রজটটাও কেমন জানি না হয়ে যাচ্ছে । ডাক্তার বলেছেন স্ট্রেস নেবেন না । আসলে নর্মাল ডেলিভারিকে প্রচন্ড ভয় অপালার । ওর কেন জানি না মনে হয় যদি ব্যথা সহ্য করতে না পেরে ওর কিছু হয়ে যায় , পুঁচকে টার কি হবে । ওই তো পাশের ফ্ল্যাটের কুমুদ দি,, কদিন আগেই তো নর্মাল করতে গিয়ে যমে মানুষে টানাটানি । তবে কুমুদ দির খুব সাহস, অপালার মত ভীতু নয় । আর তো মাত্র কয়েকটা দিন । বুকে হাত দিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে অপালা ‘আল ইস অয়েল,অল ইজ অয়েল ।’

হঠাৎ করে পিঙ্ক স্লিপ টা পাবার কারন টা বুঝে ওঠার আগেই রজতের কেমন জানি না মনে হল মাথাটা খালি ।অফিসে গিয়ে বুঝলো প্যান্ডামিকের  কো ল্যাটারল ড্যামেজ এর মধ্যে এটাও একটা । প্রফিডেন্ট ফান্ড আর epf মিলিয়ে লাখ সাতেক , সাথে বাড়ির লোন, সংসার খরচ, সন্তান এর ভরন পোষনের খরচ, নাহ মাথা খালি খালি লাগছিল । ব্যাস আবার সংঘর্ষ শুরু , প্রায় তিনমাস ধরে হাজারটা কোম্পানি ঢুঁ মেরে নট ভ্যাকেন্ট মার্কা ফিডব্যাক নিয়ে হিসেব করে রেবাকে তাড়ালো রজত। যদি কিছুটা বাঁচান যায়।

বাথরুমে ব্লেড নিয়ে প্রায় তিনবার চেষ্টা করেও এক বারও সাকসেস না পেয়ে বুঝলো ও খুব ভীতু খুউউউব । তারপর অনেক রাত না ঘুমিয়ে ভেবে মুকুলকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে সোজা রয় ক্লিনিকে । ডক্টর রয় এর অনেক অভিজ্ঞতা এই সব ব্যাপারে । উনি বুঝিয়েছেন এ ব্যাপারে অপালার কোন লাইফ রিস্ক নেই , ভবিষ্যতেও অসুবিধা হবার সম্ভাবনা কম । রাতে খাবার পর পর একটা করে ক্যাপসুল তিনদিন একটানা খাইয়ে দিলেই সব খালাস । 

অনেক রাত নিজের সাথে যুদ্ধ করে রজত বুঝেছে রজতের সন্তান রাস্তার পরিযায়ী হবে না । 
নিজে হাতে অপালাকে নতুন ক্যাপসুল টা খেতে দিয়েই নিজের মুখটা আয়নায় দেখলো রজত । প্রথমবার কোন খুনিকে এত কাছ থেকে দেখলো মনে হয় ।

                                    ( ৫ )

“শেষ হয়ে হইলো না শেষ”
----------------------

- বাচ্চাটা কবে থেকে নড়বে বলো তো । অপালা অস্থির , কাল থেকে পেটে খুব টান গো ।

রজত লাল চোখে উত্তর দেয়
- দূর সে তো এখন অনেক দেরি ,তুমি খাওয়া দাওয়া ঠিকঠাক করছো না বুঝলে । বেশি করে খাও । আর জল টা একটু বেশি খেও । দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে । আর তো মাত্র কটা দিন ।  
আর হ্যাঁ ওষুধ গুলো খেও ।
রাত্রে ঘুমোনোর আগের ওষুধ টা আবার ভুল না ।
পরপর তিনদিন.. তিনটে ডোস মাত্র। তারপর দেখবে অনেক হালকা লাগবে ।


কলিংবেলটা এর মাঝেই বাজলো ..
দরজায় রেবা ..
খলখলিয়ে বললো “ দিদিভাই আমি না তোমার মতো পোয়াতি গো ,আজকেই জানলাম, তোমাকেই প্রথম জানাতে এলুম ।”

রেবার খলবলানি হাসির মাঝেই ঘর থেকে রজতের উন্মাদ অট্টহাসির কবিতার আওয়াজ ভেসে আসলো

 " জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল
অকালের জীবন গুলো, অখ্যাত কীর্তির ধুলা
কত ভাব , কত ভয় ভুল "।

No comments:

Post a Comment