ফেরা
তপেন্দু নারায়ণ রায়
বাবা অজিতকারা নাকি কাল রওয়ানা হবে?তপন জানতে চায় সুধীরের কাছে।
--কাল
থেকে ওদের ভাটার শ্রমিকদের বাড়ি নিয়ে যাওয়া শুরু হবে।গাড়ি নাকি মাত্র
তিনটে।তিনটে গাড়িতে সব শ্রমিক একসঙ্গে যেতে পারবে না।প্রথমবারে অর্ধেক পরের
বার বাকি অর্ধেক শ্রমিক নিয়ে যাবে।অজিতের সাথে ফোনে কথা হল।ওদের নাকি
দ্বিতীয় ট্রিপে নিয়ে যাবে।তার মানে আরো তিন চারদিন পর অজিতেরা রওয়ানা
দেবে।ছেলেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে সুধীর।
--ওরা
তো তবু কয়েকদিন পর বাড়ি যাবে।ওদের ভাটা আমাদের ভাটার থেকে অনেক
ভালো।আমাদের ভাটায় গাড়ির তো কোনো খবরই নেই।অন্যান্য ভাটার লোকজন তো বাড়ি
চলে যাচ্ছে।আমরা যে কতদিন ভাটায় পড়ে থাকব!দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তপন।
--আসলে
এই ভাটার মুন্সী,ম্যানেজার ভালো নয়।এদের দয়া-মায়া কিচ্ছু নেই।এতগুলো
শ্রমিক এইভাবে মরা-বাঁচা হয়ে আছে,তবু এদের হেলদোল নেই।এতদিন হল একটা গাড়িও
জোগাড় করল না।তারপর দুয়েকটা কাঁচা গালিগালাজ করে সুধীর।সর্দার তো লকডাউনের
জন্য এখানে আসতে পারছে না।ও থাকলে ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলত।তবে তোর
বিরিনদাদু বলল সর্দার নাকি আমাদের ওখান থেকেই দুটো গাড়ি জোগাড় করেছে।গাড়ি
ভাটায় আনার জন্য নাকি বিডিও অফিসে গিয়ে অর্ডার নিতে হবে।সরকারি ব্যাপার
কবে কি হবে কে জানে?সুধীর আরো কিছু বলতে চাইছিল,কিন্তু কথা শেষ না হতেই ঘর
থেকে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে যায় তপন।
--এই ভরদুপুরে কোথায় যাস।
--বিরিনদাদুর পাতরা।
পাতরা মানে কলোনি।একটা ইট ভাটায় শ্রমিকদের কয়েকটি আলাদা আলাদা কলোনি বানিয়ে রাখা হয়।এই একেকটা কলোনি একেকটা পাতরা।
বিরিন
আর তপনেরা একই পাড়ার লোক।তায় আবার বিরিন হল সুধীরদের পেটি সর্দার।সর্দারের
অধীনে আরো কয়েকজন পেটি সর্দার থাকে।এরা সর্দারকে শ্রমিক জোগাড় করে দেয়।তার
বিনিময়ে কমিশন পায়।আবার নিজেরাও শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।পেটিদের কাছে আর
পাঁচটা সাধারণ শ্রমিকের তুলনায় তাই ভাটার খোঁজখবর বেশি থাকে।কিন্তু সুধীর
যা শুনিয়েছে বিরিনের মুখেও ওইটুকুই তথ্য পায় তপন।বড় আশা ছিল দাদু জানবে
কবে গাড়ি ছাড়বে।কিন্তু দাদুও জানেনা।একদুপুর রোদ মাথায় নিয়ে ভাটার খাঁ খাঁ
পরিবেশে কোনমতে সাইকেলে প্যাডেল করে তপন।খাঁচার পাখি জানে না কবে খাঁচা
থেকে মুক্তি মিলবে।বাড়ি থেকে দূর দেশে এনে কোনো এক দৈত্য বুঝি তাকে বন্দি
করে রেখেছে অচিনপুরীতে।হাজার চিৎকারেও যেন তার মুক্তি নেই!
সন্ধ্যায়
চায়ের আসর বসে ভাটার প্রত্যেক ঘরে।সেই সময় মোবাইলে করোনার খবর দেখে
তারা।সেই নিয়ে আলোচনা হয় নিজেদের মধ্যে।আর প্রত্যেকদিন আরো একটু বেশি করে
আতঙ্ক চেপে বসে তাদের মনে।ভয় কাটাতে খবরের চ্যানেল পরিবর্তন হয়।চলে বাংলা
সিরিয়াল,সিনেমা বা গান।এগুলোই তখন আতঙ্কে ডুবে যেতে থাকা মানুষগুলোর নতুন
করে বাঁচার রসদ।তপনরাও এই সন্ধ্যায় করোনার খবর শুনতে শুনতে ডুবে যাচ্ছে গাঢ়
অন্ধকারে।এইসময়ই বিরিন এসে হাজির হয় তপনদের ঘরে।বিরিনকে দেখামাত্রই ফুঁসে
ওঠে তপনের মা--আমাদের কি ভাটাতেই মারবেন!সব ভাটার লোক বাড়ি যাচ্ছে আর আমরা
পড়ে পড়ে মরছি।গাড়ি জোগাড় করতে এতদিন লাগে।
--আঃ,চুপ করো।বউকে থামিয়ে দেয় সুধীর।কাকাকে একটু চা বানিয়ে দাও।
তপনের
মা চা বানায়।একটাই ঘর।সেই ঘরেই থাকা-খাওয়া।ঘরের ছাদ টিনের ছাপড়া
দেওয়া।দেয়ালগুলো ইটের ওপর ইট সাজিয়ে তৈরি।তপনের মায়ের উদ্দেশ্যে বিরিন
বলে--আমিও কি আর ভাটায় শখ করে পড়ে আছি বৌমা।আমার বৌ-বাচ্চাও তো ভাটাতেই
আছে।করোনায় কি তোমরাই মরবে,আমরা মরব না!
--ওইসব বাদ দেও।গাড়ির কি খবর আছে বলো।সুধীর জানতে চায় বিরিনের কাছে।
--কাল নাকি সর্দার বিডিও অফিসে পারমিশন নিতে যাবে।তারপর খবর হবে।সরকারি ব্যাপার।কবে কি হয় বলা যাচ্ছে না।
সকলের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় ঘরের পরিবেশ।বিদায় নেয় বিরিন।
পরেরদিন
দুপুরে সুখবরটা আসে।বিডিওর অর্ডার মিলেছে।গাড়ি আজই ওখান থেকে
ছাড়বে।আগামীকালই শুরু হবে ঘরে ফেরা।পাঁচ পেটি সর্দার কে কে কবে যাবে সেই
নিয়ে আলোচনায় বসে।প্রথম দফা অর্থাৎ আগামীকালের যাত্রী হিসেবে তার পরিবার ও
তপনদের পরিবারের নাম মনোনীত করে।খবরটা পৌঁছে যায় সব পাতরায়।চির অন্ধকারের
দেশে কোথা থেকে যেন সহস্র জোনাকি উড়ে এসেছে।ভাটায় আজ আনন্দের রোশনাই।খুশীতে
উড়ছে তপন কাল যাত্রা শুরু।মনের আনন্দে গান ধরে সে।সন্ধ্যা নেমেছে।গতকালের
থেকে আজকের সন্ধ্যার কত পার্থক্য।পোটলা বাঁধে সুধীর আর তার বৌ।হাত লাগায়
তপনও।
অনেকদিন
ভালো করে ঘুম হয়নি সুধীরদের।আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছে তিনজনই।অনেকদিন
বাদে শান্তির ঘুম তিনজনের চোখেই।ভোর হয়ে এসেছে।ব্যথায় কাতরে ওঠে তপন।তপনের
চিৎকারে ঘুম ভাঙে সুধীরদের।বিছানাতেই পায়খানা করে তপন।তপনকে জল দেয়
সুধীর।তারস্বরে চিৎকার করছে তপন।সেই শব্দে আরো কয়েকজন এসে হাজির হয়েছে।বলতে
বলতে আরো একবার পায়খানা করে তপন।এরপর চোখ বন্ধ করে সে।সারা শরীর যেন ছেড়ে
দেয় শূন্যে।জোরে জোরে শ্বাস পড়তে থাকে তার।দেরি না করে ভাটার ইট টানার
একটা রিক্সাভ্যান জোগাড় করে তপনকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়
সুধীর এবং আরো দুয়েকজন।হাসপাতালে ডাক্তার জানায় তপন আর বেঁচে নেই।যে জোনাকি
পোকাগুলোর আলোয় উজ্জ্বল হয়েছিল সুধীরের মন,এক নিমেষেই তারা যেন কোথায় উধাও
হয়ে সুধীরকে একা অন্ধকারে ফেলে চলে গেল।
ভাটায়
খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে।তপনের মা জ্ঞান শূন্য।বারেবারে দাঁত কপাটি লাগছে
তার।সুধীরও ধাতস্থ নয়।তপনকে কোথায় দাহ করা হবে,সেই নিয়ে কথা চলে সবার।সুধীর
তপনকে
বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। বাড়ি ফেরার বড় তাড়া
ছিল তার।তাকে কি করে এখানে দাহ করা যায়!খুব তাড়াতাড়ি একখানা গাড়ি ছাড়ার
ব্যবস্থা করা হয়।অন্যান্য শ্রমিকেরা গাড়িতে উঠে পড়ে।সবশেষে তোলা সুধীর
আর তার বৌকে।তপনের কাঁথায় মোড়া দেহটা দেওয়া হয় তাদের কোলে।গাড়ি স্টার্ট
দেয়।সুধীর আর তার বৌ তারস্বরে কেঁদে ওঠে--চল্ বাবা,বাড়ি চল্।
No comments:
Post a Comment