Monday, October 5, 2020


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

তামগ্নিবর্ণাং তমসা জ্বলন্তীং   -- রূপে ও অরূপে     মহিষাসুরমর্দিনী
                      ড. ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়    
 
ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ধারাটি হল  শক্তি উপাসনা বা দেবী ভাবনা ।দেবী ভাবনায় বিধৃত আছে দেবীর ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও বৈভবের  নানা বর্ণময় উপাখ্যান, লোকায়ত বিশ্বাস ,মিথ ও রূপকথার কাহিনী। আসলে এই মাতৃমূর্তি গুলি ভাগবৎ বিভূতির বিচিত্র প্রকাশের প্রতীক মাত্র।আর প্রতীক কল্পনা ভক্ত দের ধ্যান ও মননের সোপান বিশেষ।
     সমাজ তাত্ত্বিকেরা মনে করেন বৈদিক সমাজে ও বৈদিক ধারার পাশাপাশি প্রবহমান ছিল তান্ত্রিকী ধারা। বৈদিকী ও তান্ত্রিকী এই দুই ধারার যুগ্ম প্রভাবেই পৌরাণিক কালের দুই দেবী শক্তি দুর্গা ও কালীর উদ্ভব ঘটেছে বলে মনে করা হয়।
দুর্গা শব্দটির আভিধানিক অর্থ পরমা প্রকৃতি,শিবপত্নী আবার বিশেষ রাগিনী ও।দুর+ গম্ +আ = দুর্গা। দেবীর তত্ত্ব খুব ই দুর্গম অথবা তিনি বিপদ নাশ করেন তাই তিনি বিপত্তারিনী দুর্গা।দুর্গম নামক অসুর কে বধ করে ও তিনি দুর্গা নামে পরিচিত।
ঋগ্বেদে দেবী সূক্তে অম্ভৃণ ঋষি কন্যা বাক্ নিজেকে সর্বাত্মিকা শক্তি ও জগতের ঈশ্বরী বলে ঘোষণা করেছেন -   দুর্গার রূপকল্পের সূচনা এই মন্ত্রকে ধরে নেওয়া যেতে পারে
"অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্"
এখনো মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠানে এই মন্ত্র পাঠ করা হয়।
পরবর্তী সময়ে বাল্মীকির রামায়নে অকাল বোধনের  কোনো প্রসঙ্গ নেই, তবে কৃত্তিবাসী রামায়নে আছে। মহাভারতে দুইবার দেবীর মহিমার উল্লেখ পাওয়া যায়।
মহাদেবী বা দুর্গাশক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ লক্ষ্য করি মার্কন্ডেয় পুরাণ ও শ্রী শ্রী চন্ডী তে। দেবী দুর্গা মহা চন্ডী রূপে দেবতাদের দেওয়া অস্ত্র ও  সজ্জায় সজ্জিত হয়ে  ভীষণ যুদ্ধে মহিষাসুর কে বধ করেন।
এই মহাশক্তির উদ্বোধন ও পরম প্রকাশের জন্য দেবী দুর্গার  মর্ত্যে আগমন। ভিন্ন ভিন্ন রূপে, মূর্তি ও মাধুর্যে আরাধিত হন মানবমনে। মহাশক্তির আধার  দেবী দশভূজা সারা বিশ্বে নানা রূপে নিজেকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছেন --
       নিত্যৈব সা জগন্মূর্তি সর্বমিদং ততম্
তাঁর কোন রূপ শান্ত ,কোনটি প্রচন্ড,কোনটিতে বরাভয় কোন টি উগ্র কালী। তাঁর সবথেকে পরিচিত মূর্তি  বা রূপবৈচিত্র দেখি দশমহাবিদ্যা  মূর্তি তে, এই দশমহাবিদ্যা হলেন  --  কালী ,তারা,ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা,ধূমাবতী,বগলা,মাতঙ্গী ও কমলা ।
পৌরাণিক কাহিনী তে আছে  পিতা দক্ষরাজের  যজ্ঞে বিনা নিমন্ত্রণে যাবার জন্য সতী প্রস্তুত হলে মহাদেব বার বার বারণ করলেন। তাঁর অনুনয়ে শিব যখন রাজী হলেন না তখন সতী  তাঁর অনন্ত মায়াময়ী  লীলা দেখালেন, দেখালেন তাঁর দশ রূপ। শিবকে বললেন যে তিনি শিবের সামনে যে উগ্র দশনা রূপে দেখা দিচ্ছেন  তাই কালী রূপ , উর্দ্ধে মহাকাল রূপিনী তারা,ঈশান কোনে সমস্ত সৌন্দর্যের অধিকারী ষোড়শী,বামদিকে সৌম্য বরাভয়  ভুবনেশ্বরী রূপ,কাল ভৈরব শিবের অর্ধাঙ্গিনী তাই ভৈরবী, দক্ষিণ দিকে নিজের রক্ত পান কারী কর্তিত মুন্ড ভয়ংকর রূপ ধারণ করে ছিন্নমস্তা,অগ্নিকোনে বিধবা জরতী রূপে ধূমাবতী, পশ্চাতে দানব নাশিনী  বগলা, বায়ুকোনে মাতঙ্গী আর নৈঋত কোনে সর্ব ঐশ্বর্যের অধিকারিণী রূপে কমলা। তিনি মূলতঃ এক ও অদ্বিতীয় আদ্যাশক্তি  কিন্তু লীলাচ্ছলে তাঁর দশ রূপের প্রকাশ।
    দুর্গা কে আরো নয় টি রূপে পুজো করা হয়, এই নব দুর্গা হলেন -- শৈলপুত্রী,ব্রহ্মচারিণী,চন্ডঘন্টা,কুষ্মান্ডা ,স্কন্দমাতা,কাত্যায়নী,কালরাত্রি,মহাগৌরী ও সিদ্ধিদাত্রী ।
   শৈলরাজের ঘরে জন্ম তাই শৈলপুত্রী, তিনি ব্রহ্ম জ্ঞান দান করেন তাই ব্রহ্মচারিণী। চন্দ্রের মত নির্মল ঘন্টা তাই তিনি চন্ডঘন্টা। ত্রিবিধ তাপ যুক্ত সংসার যাঁর অন্ডে তিনি কুষ্মান্ডা।স্কন্দ বা কার্তিকের মা তাই স্কন্দমাতা। মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে তিনি অসুর নিধনের জন্য আবির্ভূতা তাই  নাম কাত্যায়নী  ।সর্ব বিনাশক কাল কেও তিনি নাশ করেন তিনি কালরাত্রি।  তপস্যায় উজ্জ্বল গৌর বর্ণ দেহ পেয়েছিলেন বলে তাঁর নাম মহাগৌরী। মুক্তিদাত্রী তাই তিনি সিদ্ধিদাত্রী।
শক্তি অনুসারে আরো তের টি রূপ --
জয়ন্তী,মঙ্গলা,কালী,ভদ্রকালী,কপালিণী,দুর্গা ,শিবা,ক্ষমা,ধাত্রী,স্বাহা এবং স্বধা । দুর্গা পুজা র অঞ্জলী র সময় প্রণাম করা হয় এই নাম গুলি দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে।
দেবীর প্রত্যেকটি নাম ও মূর্তির  সঙ্গে  সুন্দর পৌরাণিক কাহিনী সংযুক্ত।    
তিনি অজস্র রূপের মধ্যে থেকে ও অরূপ।'কে এই মহামায়া?'  - মেধস মুনি এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন  এই মহামায়া এই নিখিল ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টিকর্ত্রী,আদি জননী অন্নপূর্ণা প্রয়োজনে রণরঙ্গিনী।  শিব ও আদ্যা শক্তির সমন্বিত রূপ ই ব্রহ্মান্ড। 
মোহ মায়ায় আচ্ছন্ন  মানুষ তাঁর সন্ধান করে নানা রূপের মধ্যে  আসলে তিনি এক ও অদ্বিতীয়া মাতৃরূপা শক্তি। তবে আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে  তিনি যেন ঘরের মেয়ে  গিরি রাজ দুহিতা উমা, বছরে একবার তিন দিনের জন্য আসছেন বাপের বাড়ি সপরিবারে।শরতের রৌদ্র করোজ্জ্বল আবহে কাশের দোলায় ঢাকের শব্দে শিউলি র আলপনা য়  মন্ত্র,হোম, অঞ্জলী একশো আট নীলপদ্মে আন্তরিক ভক্তি দিয়ে আমরা আরাধনা করি। চোখের জলে দিই বিসর্জন।তার বরাভয় মূর্তি আমাদের দেয় আশ্বাস। মৃন্ময়ী দশভূজা তখন হয়ে যান প্রাণাত্মিকা চিন্ময়ী।তিনি ভক্তের মনে বাস করেন , শুভ ও অভিলষিত ফল দান করেন বলেই তার সর্বমঙ্গলা রূপ টি সার্থক --
সর্বানি হৃদয়স্থিতানি  মঙ্গলানি শুভানি চ
দদাতি ঈপ্সিতাল্লোকে তেন সা সর্বমঙ্গলা।
    এভাবেই যুগ যুগান্তর ধরে মানুষের মনে দেবীর অনন্য রূপ ও শক্তির সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা বহমান। 
তাঁর রূপ ও প্রতিমা কালের নিরীখে পরিবর্তিত হয়েছে এবং হচ্ছে ও। দেবীর ত্রাণ কারিণী ও সিদ্ধিদায়িকা রূপ বৈশিষ্ট্যের আদি যোগসূত্র টি তৈত্তরীয় আরণ্যকের এই ধ্যান মন্ত্রে ধরা আছে বলেই মনে করা হয়
তাং অগ্নিবর্ণাং তপসাজ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টম্ ।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরমে নমঃ।।
অর্থাৎ সূর্য বা অগ্নির কন্যা,তিনি কর্মফলের জন্য প্রার্থিত হন,এমন দুর্গা দেবীর আমি শরণাপন্ন হই ,হে সুন্দর রূপে ত্রানকারিণী তোমাকে নমস্কার।


No comments:

Post a Comment