Monday, October 5, 2020


 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 UNLOCKDOWN এর পুরী-ভ্রমণ

                                      কুমকুম ঘোষ
 
 

 
 

।। জয় জগন্নাথ।।

চোখে দেখা যায়না এমন এক অদৃশ্য শত্রু কিভাবে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা ডিজিটাল-সোসাইটি কে কিভাবে গৃহবন্দী ও আতঙ্কগ্রস্ত করে দিতে পারে তার চেহারা আমরা সবাই দেখেছি পুরো Lockdown পর্বে। সেই আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠার একটা মরিয়া চেষ্টা চলছে। অতএব এই আনলকডাউন-৪ এ  একটা রোডট্রিপ করলে কেমন হয়? কোথায় যাওয়া হবে? বুকিং করে যাবো? রাস্তায় কিকি মেজার নেওয়া হবে ভাইরাস কে ঘুঁষি মেরে উড়িয়ে দিতে? এইসব হরেক প্রশ্ন করতে করতেই ছ-সাতমাসের করোনা-ক্লান্তি কাটিয়ে গত ২৭শে সেপ্টেম্বর ভোরবেলা পুরীর দিকেই রওয়ানা দিলাম "জয়-জগন্নাথ" বলতে বলতে। সঙ্গে আছে "গুগল ম্যাপ" ভয়টা আমার কি? 
 
 
 
 

 

।। দুইধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।।

   আধাশহরের বাসিন্দা হিসেবে এতো কাশফুল দেখার সৌভাগ্য এই প্রথমবার হলো। খড়গপুর থেকে কটক শহরের আগে পর্যন্ত দুরন্ত নীল আকাশ আর কাশফুল সঙ্গী হলো ; পথের পাঁচালী র সেই বিখ্যাত দৃশ্য যেন, শুধু অপু দুর্গা আর ট্রেনটাই অনুপস্থিত।   রোডট্রিপে ভোর ভোর বেড়িয়ে পরতে পারলে প্রাথমিক এনার্জি আর রাস্তার যানজট থেকে মুক্তি-- দুটোর স্বাদ ই পুরো এনজয় করা যায়। কলকাতা থেকে পুরী মোটামুটি ৫০০কিমির একটু বেশি ।সময় লাগে ৯ঘন্টা ৫২মিনিট( গুগল ম্যাপ)। আমরা তার আগেই পৌঁছেছি।ডানলপ আর ধূলাগড় এ টোলট্যাক্স দিয়ে সোজা দীঘার রাস্তায় কোলাঘাট পৌঁছে গেলাম ঘন্টাখানেক পরে ই। কোলাঘাট মোটামুটি জমজমাট কারণ দীঘা ও মন্দারমণিতে ট্যুরিস্ট যেতে শুরু করেছে।
দীঘার রাস্তা ছেড়ে NH 60 ধরে সোজা এগোনো। পেরিয়ে এলাম দাঁতন ও মোগলমারি যেখানে বৌদ্ধ স্তূপ খননে বহু নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে।এরপর ই উড়িষ্যা বর্ডার জলেশ্বর।
 
 

 


।।ঠান্ডা চা সহ স্যান্ডউইচ।।
উড়িষ্যার রাস্তার কন্ডিশন লঙ্ ড্রাইভের জন্য প্রায় পারফেক্ট ( ভাঙা রাস্তা দেখতে অভ্যস্ত চোখের ক্ষেত্রে)। অতএব যতটা পারা যায় এগিয়ে যাওয়া কিন্তু একবার ব্রেক না নিলে ই নয়।থামা হলো প্রায় ৫ঘন্টা পরে সঙ্গে থাকা চা (সকাল ছ'টায় বানানো) ও স্যান্ডুইচ খাবার জন্য।ও হরি চা' সম্পূর্ণ জল হয়ে গেছে ( যদিও ফ্লাস্কে ছিল।)। আশেপাশে কোনো দোকান থেকে কিনে খাবার সাহস ও নেই। ভাইরাস-পরবর্তী তথাকথিত নিও-নর্মাল জীবনে এসব মানিয়ে নিতে  হয়( নহিলে  আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বাড়ে)। 
বালাসোর, ভদ্রক পেরিয়ে এবার কটক শহরের দিকে গাড়ী ছুটলো। শহরকে পাশ কাটিয়ে মহাপ্রভু এক্সপ্রেস ধরলেই সোজা পুরী( গুগল ম্যাপ অনুযায়ী)। কিন্তু রাস্তার দিকনির্দেশনার যে বোর্ড থাকা দরকার সেটা খুঁজেই পাওয়া গেলনা ফলতঃ সামান্য ঘুরপাক খেয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম গন্তব্য--পুরী।
 
 


।। ট্যুরিস্টশূন্য পুরী।।

শ্রীক্ষেত্র পুরীর জনসমাগম নিয়ে প্রশ্ন থাকার অবকাশ সারা বছর থাকেনা কিন্তু এমন জনশূন্যতা দেখে আমাদের  মতন নির্জনতাপ্রিয় মানুষ ও কেমন হতাশ হয়ে পরলো। সন্ধ্যেবেলায় যে সি-বিচ থিকথিকে মানুষের ভিড়ে আক্রান্ত থাকে, চারপাশে হরেকরকম ভাজাভুজি র দোকান,শঙ্খ বিক্রেতা, ফটোগ্রাফার,নুলিয়া এবং অজস্র ভ্রমণপিপাসু বাঙালি র চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়, একটা ফাঁকা চেয়ারে বসার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায় সেই সৈকত এখন স্তব্ধ: শুধু অবিরল ঢেউ আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। পা ভেজানোর জন্য সাকুল্যে পাঁচ ছয়জন দেখা যাচ্ছে আর কিছু স্থানীয় মানুষ,জেলেনৌকার মাঝি আর একটা দুটো চা' এর দোকান। সূর্য ডুবতে শুরু করেছিল তখন--"কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মত" বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেল।বিচ-রোডের আলোগুলো জ্বলে উঠছে কিন্তু সারি সারি অগনিত হোটেল অন্ধকারে ডুবে আছে। অনেক দূরে দু একটা খোলা জানলায় আলোর রেখা।এ এক অচেনা পুরী।প্রানচঞ্চল জগন্নাথ দর্শনের জন্য হাজার হাজার মানুষ আসেন এখানে।আজ সব নিস্তব্ধ।




।। দর্শন নাই---আসিবে কেন?।।

কথাটি বললেন চায়ের দোকানে দাঁড়ানো স্হানীয় এক ব্যক্তি। সূর্যোদয় দেখে আমরাও এসেছি গলা ভেজাতে। ক্ষুদ্র কাগজের কাপ ১০/- দাম। 
--এতো দাম কেন? 
--ট্যুরিস্ট নেই রোজগার নেই খাবো কি দাদা? 
চা-দোকানী দিদির সরল স্বীকারোক্তি। করোনা কালীন বেরোজগার,জিডিপির -২৩.৯% ছবিটা সরাসরি আমাদের সামনে।
পুরীতে এবছর রথযাত্রা উৎসব বন্ধ ছিল। ঐসময়ে রোজগারের একটা সুযোগ থাকে এবছর তাও বন্ধ। গতবছরের "ফণী" ঘূর্ণিঝড় তছনছ করে দিয়েছিল পুরীকে।সেই ক্ষত সামলাতে এবছর প্রয়োজন ছিল সুগম ব্যবসার। কিন্তু করোনা এসে আবার সব ধ্বংস করে দিল শ্রীক্ষেত্রর অর্থনৈতিক চলন।পুরী মন্দিরের অধিকাংশ কর্মকর্তা আক্রান্ত।মন্দির বন্ধ হয়েছে আগেই।ব্যারিকেডের বাইরে প্রসাদ দেওয়ার বন্দোবস্ত ছিল কিছুদিনের জন্য।সেও বন্ধ।বন্ধ কোনার্কের টিকিট কাউন্টার।বার-কোড স্ক্যান করে অনলাইনে পেমেন্ট করলে ঢোকার অনুমতি মেলে কিন্তু ট্যুরিস্ট কোথায়? এই লকডাউন পর্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ সেক্টর ট্যুরিজিম্।  অর্থাৎ একটা সুবৃহৎ চলমান অর্থনীতি উল্টো দিকে হাঁটা দিয়েছে আর সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে আঁধার নেমে এসেছে।
 
 

 

 দুদিন নিরিবিলি রিসর্টে বসে সময় কেটেছে সমুদ্র দেখতে দেখতে।  ফিরতি পথে বহুদূর থেকে জগন্নাথ মন্দিরের চূড়ো দর্শন করলাম আর মনে মনে প্রার্থনা করলাম --- হে প্রভু দূর করো এই মারণ ভাইরাস। পৃথিবী আবার চলমান গতিমান হোক। আতঙ্কের প্রহর শেষ হোক।


No comments:

Post a Comment