Sunday, December 6, 2020


 

সম্পাদকের কথা


বছর শেষেও আমরা অসহায় প্রকৃতির হাতে। কে জানতো একটি সুক্ষ ভাইরাস এভাবে স্তব্ধ করে দেবে গোটা বিশ্বকে! এই এক বছরে বদলে গেল কত কিছু। আমরা অবশ্য রয়ে গেলাম সেই একই তিমিরে। তবে কিছু দেশে টিকার প্রয়োগ হতে চলে অচিরেই। আশার কথা সেটাই। হয়ত আমাদের দেশেও সম্ভব হবে তা আর কিছুদিনের মধ্যে। 


এই অবস্থার পাশাপাশি দেশের অবস্থাও টালমাটাল। অন্নদাতা কৃষকেরা বিক্ষুব্ধ। তাঁদের আন্দোলন ক্রমশ গভীর হচ্ছে। আশা রাখি যে, সরকার তাঁদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, বিচার করবেন নতুন করে। 


এই বছর বহু বিখ্যাত মানুষকে আমরা হারিয়েছি। সব মৃত্যুই অত্যন্ত দুঃখজনক, তবু আলাদা করে উল্লেখ করছি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নাম। তাঁদের প্রয়াণ বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতে অবশ্যই বিরাট ক্ষতি।


আশায় বুক বেঁধে আছি এই ভেবে যে, নতুন বছরে নিশ্চয়ই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আবার আমরা ফিরে চেনা সেই পুরোনো পৃথিবীকে। 


 


 


মুজনাই অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৭




মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com

 

 প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায় 


মুজনাই সাহিত্য পত্রিকা অনলাইন অগ্রহায়ণ


 





শীতসফরে ডুয়ার্সের চার্চে 

গৌতম চক্রবর্তী



             (সেন্ট মেরিস ক্যাথলিক চার্চ, সাতালি)



খানিক গড়িমসি করে হলেও ডুয়ার্সে শীত এসে পড়েছে। শীতের সকালের মিষ্টি রোদে চারিদিক ঝলমল করছে। শীত মানেই আসছে বড়দিন। শহরের মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বড়দিন পালন করে কেক খেয়ে। যদিও সবাই গির্জাতে যায় না। ডিসেম্বরের এই শীতের মরশুমে পবিত্র বড়দিন পালন করার প্রাকমুহূর্তে চারিদিকেই থাকে উৎসবের মেজাজ। নানা ভাষা, নানা বর্ণের বিচিত্র সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যময় উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার জেলা। বর্ণময় ভাষা এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলা একটা মিনি ভারতবর্ষও ছিল বটে। এখন জেলা বিভক্ত। বন-জঙ্গল এবং পাহাড়ি সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অরণ্যের কোলে বিচরণ করে রয়েছে বিভিন্ন ভাষা সংস্কৃতির মানুষ যাদের মধ্যে অনেকেই খ্রীষ্টান ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্ত। সবুজে ঘেরা ডুয়ার্সে কোথায় কোথায় চার্চগুলি রয়েছে এবং কিভাবে তারা কাজ করে তা সরেজমিনে নিজের চোখে দেখার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। দ্বিশতাধিক ছোট বড়ো চার্চ। তাদের বহুবিচিত্র কার্যাবলী। খ্রীষ্টধর্ম প্রচার মুখ্য উদ্দেশ্য হলেও মানবসেবার দিকটিকে উপেক্ষা করা যায় না। একটা বিষয় খোলসা করে নেওয়া প্রথমেই প্রয়োজন। সেটা হল আমার এই লেখার অবতারণা কিন্তু পর্যটনের নিরিখেই। ডুয়ার্সের কোথায় কোথায় চার্চ আছে, চার্চগুলি কি ধরণের কাজ করে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে চার্চগুলির ভূমিকা, মানবসেবার দিকটি এখানে মুখ্য উপজীব্য। কে ধর্মান্তরকরণ করছে এবং কিভাবে করছে তার ইতিহাস লেখার মানসিক তাগিদ থাকলেও এবং প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করলেও এই যাত্রায় আমার লক্ষ্য চার্চগুলি কোথায় কোথায় আছে এবং সেখানে কিভাবে মানুষ পৌঁছাতে পারবেন তার সুলুক সন্ধান দেওয়া। বেছে নিলাম নির্দিষ্ট কয়েকটি সার্কিট।


 


                      (ব্যাপটিস্ট চার্চ, জয়গাঁও)




 

পর্যটন সার্কিট আলিপুরদুয়ার


এসে পৌঁছালাম আলিপুরদুয়ার জংশনে। ডুয়ার্সের চার্চ পরিক্রমার সুহানা সফরে। আমার সঙ্গী শিবুনদা। আগে থেকেই বলা ব্যাবস্থা অনুযায়ী বাইক নিয়ে স্টেশনে উপস্থিত। দ্বিচক্রযানের শরণাপন্ন হলাম। কারণ দ্বিচক্রযান ছাড়া ডুয়ার্সের আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনি, মাদারিহাট, মেন্দাবাড়ি, বীরপাড়া এবং জয়গাঁ পৌঁছাতেই পারব না। কারণ বেশিরভাগ চার্চ চা বাগান এবং জঙ্গলমহল অধ্যুষিত অঞ্চলের আদিবাসী এবং জনজাতি মহল্লায়। তাই গুগল ম্যাপ থেকে রুট প্ল্যানিং করে বেড়িয়ে পড়লাম সুহানা সফরে। বলে রাখি সময়াভাবে এবং সীমিত পরিসরে কেবলমাত্র আলিপুরদুয়ার এবং কালচিনি ব্লকের চার্চগুলির অবস্থান এবং স্বল্প পরিচয় প্রদান আমার এবারের লেখার বিষয়। বিস্তারিতভাবে পরবর্তীকালে ইস্যুভিত্তিক লিখব। জয়দূর্গা বলে বেড়িয়ে পড়লাম যন্ত্রদানবকে সাথী করে দুই সওয়ারী। কালজানি নদীর কোলে আলিপুরদুয়ার শহরটির টপোগ্রাফি অসাধারণ। ডুয়ার্স বেড়ানোর চাবিকাঠি হিসেবে ধরা যায় আলিপুরদুয়ারকে। কালজানি, নোনাই, ডিমা, গরম আরো কতো নদী জিলিপির প্যাঁচ এবং সরীসৃপের মতো জড়িয়ে পেঁচিয়ে আছে আলিপুরদুয়ারকে। আলিপুরদুয়ারে যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অনেক উন্নত। ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত অটো সার্ভিসে রাজাভাতখাওয়া যাওয়া যায়। তবে দমনপুরের আরণ্যক চিত্র আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মুঠোফোন, চ্যানেলে চ্যানেলে বিনোদন। দূর্গম বনভূমিতে ডিশ এন্টেনার সাহায্যে যাবতীয় আনন্দ উল্লাস হাতের মুঠোয়। শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনপ্রবাহ আর নেই। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর নতুন জেলা আলিপুরদুয়ার পাহাড়, অরণ্য, চা বাগান, নদী, কৃষি, বনবস্তি নিয়ে ডুয়ার্সের রানী হিসেবে পরিচিত।


 


            (মাদার মেরি ক্যাথলিক চার্চ, হাসিমারা)




 

আলিপুরদুয়ার চার্চ সার্কিট


আলিপুরদুয়ার শহরটি এখনো পুরোপুরি কংক্রিটের জঙ্গলে ঢাকা পড়েনি। আজও এই শহরে কোকিলের ডাক শোনা যায়, শোনা যায় স্তব্ধ দুপুরে ঘুঘু পাখির ডাক। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল, অমলতাস ফোটে, দেখা যায় চোখ জুড়ানো সবুজ মাঠ। আলিপুরদুয়ার থেকে দু পা বাড়ালেই সবুজের সমারোহ। কালজানি নদী পেরিয়ে গেলে গ্রাম্য জীবনে ধানের গন্ধ। ঘন সবুজ জঙ্গল, আদিবাসীদের ঘর গেরস্থালি। ছোটবড় খাল-বিল, বন জঙ্গল, পাহাড় সহ সব ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ আছে এখানে। আলিপুরদুয়ার রেলওয়ে জংশন থেকে ভোলারডাবরি শিবমন্দিরের পাশ দিয়ে চলে এলাম নেতাজি বিদ্যাপীঠ উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে। ১২ নম্বর রাজ্য সড়ক দিয়ে এগোতে এগোতে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ইন্স্যুরেন্সের ডানদিকে বাঁক নিয়ে আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে পূর্ব মাঝেরডাবরি চা বাগানের অন্তর্গত মাঝেরডাবরি গির্জাতে পৌঁছে মন ভরে গেল। যেমন পরিবেশ, তেমন সুন্দর গির্জা। মাঝেরডাবরি গির্জা দিয়ে শুরু হল আমার এই পর্বের ডুয়ার্সের চার্চের সন্ধানে পথচলা। মাঝেরডাবরি গির্জা থেকে বেরিয়ে এবারে যাব আলিপুরদুয়ার ব্যাপ্টিস্ট চার্চে। সোজা চলে এলাম চেচাখাতা পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার। এরপর রামকৃষ্ণ সারদা জুনিয়র স্কুলের পাশ দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার এগিয়ে এলাম। রেলওয়ে কমিউনিটি হলকে ডানদিকে রেখে লিচুতলা বাজার হয়ে নেতাজি বিদ্যাপীঠ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে পৌঁছে গেলাম আলিপুরদুয়ার ব্যাপ্টিস্ট চার্চ। মাঝেরডাবরি থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরত্ব। আলিপুরদুয়ার কোর্ট থেকে আলিপুরদুয়ার ব্যাপটিস্ট চার্চের দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। আলিপুরদুয়ারের পথে পথে রাস্তার দুপাশের গাছগুলি পথিকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। দু’পাশের গাছগুলো অতীতের ইতিহাসকে তুলে ধরে আমাদের সামনে। কাঠের কৌলিন্যের বিচারে শহরের রাজপথে মেহগনি গাছ ছিল কম করে পাঁচ ছয়টি। আসাম গেট থেকে শুরু করে ভাঙ্গাপুল, নেতাজি রোড, এবং শামুকতলা রোড এর সলসলাবাড়ি পর্যন্ত রাস্তার দুধারে ছিল শিরীষ বা রেইন ট্রি যা অর্ধশতকের বেশি প্রাচীন। হয়তো উন্নয়নের নিরিখে কাটা পড়ে গেছে। ভাঙাপুল থেকে নিউটাউন হয়ে কোর্টের দিকে এগিয়ে গেলে মাঘ ফাল্গুন এর আকাশটা কৃষ্ণচূড়াতে লালে লাল হয়ে থাকত যেরকমভাবে সেরকম আর চোখে পড়ে না। পি এইচ ই অফিস এবং জেলখানার মাঝবরাবর যে রাস্তা প্যারেড গ্রাউন্ডে পড়েছে তার দুধারে জারুল গাছ ছিল। জারুলকে ইংরেজিতে বলে কুইন অফ ফ্লাওয়ার। বর্ষাকালে নীলাভ ফুলে গাছগুলো ছেয়ে থাকত। আলিপুরদুয়ার ব্যাপটিস্ট চার্চ থেকে ১২(এ) নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে লিচুতলা বাজার হয়ে চলে এলাম আলিপুরদুয়ার ক্যালভারি চার্চে। চার্চটি চেচাখাতার আরপিএফ কলোনিতে অবস্থিত। ১৬ নম্বর জাতীয় সড়ক এবং ভোলারডাবরি রোড হয়ে পৌঁছে গেলাম ভোলারডাবরি মিশন কমপ্লেক্সে। একদম সাদামাঠা চার্চ। বাইরে থেকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না।


 



                          ( মাঝেরডাবরি চার্চ)



 

নোনাই এর তীরে কিছুক্ষণ


আমরা পৌঁছে গেলাম নোনাই নদীর কাছে। নীরবে নোনাই এর ক্যালিডোস্কোপ সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করলাম। সামনে সুবিস্তৃত সবুজ মাঠ এবং পিছনে আঁকাবাঁকা নোনাই নদী। গভীর জঙ্গলের ভিতর এঁকেবেঁকে নোনাই বয়ে চলেছে। চারপাশে ঘন হয়ে আছে জঙ্গল। নোনাই নদীর পাশেই গরম বনভূমি। অদূরে চারপাশ ভীষণ নির্জন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে হস্তী দর্শন হতেই পারে। হাতিরা দল বেঁধে আসা-যাওয়া করে আর দোকানঘর আর বনবস্তিগুলি ভাঙ্গে। নর্থ পয়েন্ট মাঝেরডাবরি চা বাগান পার হলেই দমনপুর। বসন্তের মাতাল সমীরণে এখানে এলে পাগলা হয়ে যেতে হয় জারুল ফুলের শোভায়। গাছ ভরে যায় বেগুনি রংয়ের জারুল ফুলে। সেই সঙ্গে কাঁচা হলুদ, ঝুমকো লতা, অমলতাস, শিমূল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া। নোনাইয়ের অদূরে সিকিয়াঝোরা এবং স্বর্গছেঁড়া। জায়গাটি পানিয়ালগুড়ি চেকো বিটের অধীনে। পূর্বে দমনপুর রেঞ্জ এবং পশ্চিমে বক্সা বাঘবনের অন্তর্ভুক্ত। সিকিয়াঝোরার দেখাশোনা, লাভ-লোকসান, উন্নতির বিষয়ে প্রখর দৃষ্টি দিচ্ছেন পানিয়ালগুড়ি গাঁয়ের মেয়েরা। পুরুষেরাও আছেন, তবে মহিলারাই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে। যেমন গাছ কাটা বন্ধ করা, প্লাস্টিক ব্যবহার না করা, পিকনিকের পরে জায়গাটিকে সাফসুতরো রাখা, ঝোরার জল যাতে দূষিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। ৩১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে চলে এলাম বক্সা ফরেস্টের অন্তর্গত কালকূট বস্তির ব্যাপ্টিস্ট চার্চে। মাঝেরডাবরি চা বাগানের ফুটবল গ্রাউন্ড এর পাশেই এনইএলসি চার্চটি অবস্থিত। চলে এলাম চার্চে। এই চার্চ থেকে এবার আমরা এলাম খৃষ্ট দ্য কিং চার্চ পূর্ব মাঝেরডাবরি চা বাগানে। ৩১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে উত্তর পশ্চিম দিকে মুখ করে ৫০০ মিটার যাওয়ার পর বাঁদিকে বাঁক নিয়ে কিলোমিটার দেড়েক যাওয়ার পরেই এই চার্চটি।


 


                 ( তালেশ্বরগুড়ি প্রেসবিটারিয়ান চার্চ)




 

গরম বিটের নির্জনতায়


এক কিলোমিটার যাবার পর জঙ্গলপথ শুরু। বেশ ঘন জঙ্গল। পিঁপড়ের সারির মতো মেয়ে মরদ মাথায় শুকনো খড়ি চাপিয়ে জঙ্গল থেকে ফিরছে। হঠাৎ দেখি রাস্তা অবরোধ। যেখানে সেখানে হাতির নাদি ছড়ানো। মস্ত বড় গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। ঠেলেঠুলে গাছটির ডালপালা সরালাম। ডানদিকে জঙ্গলের গহন পথ। গুহার মত তৈরী লতা তন্তুজালে সমাচ্ছন্ন। গা ছমছম করছে। শরীর কাঁটা দিচ্ছে। জঙ্গলে কত রকমের গাছপালা যে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। কারো সঙ্গে কারোর ঝগড়াঝাটি নাই। এক অদ্ভুত গন্ধ নাকে আসছে। মাঝেরডাবরি চা বাগান থেকে বেরিয়ে বক্সা অতিক্রম করে চলে এসেছি গরম বস্তিতে এনইএলসি চার্চে। মাঝেরডাবরি চা বাগান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরত্ব। গরম বস্তির চার্চ থেকে ৩১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সোজা চললাম নর্থ পোরো রাভা ব্যাপটিস্ট চার্চে। পোরোর এই চার্চটির দূরত্ব দমনপুরের গরম বস্তি থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার।


 


                             ( মহাকালগুড়ি)




 

 পক্ষী পর্যটনের নতুন ঠিকানা ইষ্টিকুটুম       


এবারে সোজা চলে গেলাম নিমতি দোমোহনী। নিমতিঝোড়া চা বাগান। দুপাশে কত ছায়া গাছ। কৃষ্ণচূড়া, জ্যাকারান্ডা, হলুদ অমলতাস, ঝুমকো লতার মতো ভূমিতলে পতিত। চোখ ছুটে যায় সবুজের হাতছানিতে। নিমতি নামে ঝোড়া বয়ে গেছে চা বাগানের বুক চিরে। তাই নাম নিমতিঝোড়া। দুপাশে অজস্র ছায়াগাছ। পাখিদের কলকূজন। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার রূপ অভূতপূর্ব। বারেবারে আমার চোখ ছুটে যাচ্ছে সবুজের হাতছানিতে। চা ফ্যাক্টরির সামনে অবাক চোখে অচেনা মানুষগুলি তাকিয়ে আছে। গ্রাম্য সাদাসিধা মানুষ আর চা এর গন্ধ নিয়ে নিমতিঝোড়া। নিমতিঝোড়া থেকে পাটকাপাড়া টি গার্ডেন সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার, দক্ষিণ বড়ঝাড় ফরেস্ট সাড়ে ছয় কিলোমিটার, ভাতখাওয়া চা বাগান সাড়ে আট কিলোমিটার, কালচিনি টি গার্ডেন সাড়ে ১১ কিলোমিটার, বক্সা ফরেস্ট ১৫ কিলোমিটার, মালঙ্গী চা বাগান ১৮ কিলোমিটার। নিমতি দোমোহনি থেকে ইষ্টিকুটুম অতিক্রম করে সোজা চলে আসতে থাকি পাটকাপাড়ার দিকে। তপসীখাতা গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস থেকে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে উত্তরবঙ্গ ক্ষেত্রীয় গ্রামীণ ব্যাংকের ডানদিক দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার আসার পর পৌঁছে গেলাম পাটকাপাড়া চা বাগানে অবস্থিত এনডব্লিউজিইএল চার্চে। পাশেই আরেকটি ছোট চার্চ। নাম পিজিটি চার্চ (বি এন)। পাটকাপাড়া চা বাগান এবং চা বাগান এর অন্তর্গত চার্চগুলি দেখে আজকের রাত্রি যাপন ইষ্টিকুটুমে।


                     (সাঁওতাল্লুর মিশন)


মেন্দাবারি জঙ্গলমহলের চার্চ


আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে চিলাপাতা রেঞ্জ অফিস। আমরা চললাম চিলাপাতা। উত্তরবঙ্গ সফরে কেউ যদি চিলাপাতার এই সার্কিটে আসেন তাহলে জঙ্গলের আউট লাইনের ধারে এইরকম নির্জন অঞ্চলে হোমস্টে অথবা বাংলোর বারান্দায় জমিয়ে বসলে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সময় কেটে যায়। নল রাজার গড়, কোদালবস্তির জঙ্গলে গাউরের অভিনব মহামিছিলের হাড় হিম করা রোমাঞ্চকর দৃশ্য, দূর্ধর্ষ ল্যান্ডস্কেপ, বানিয়া নদী, জঙ্গল, পাকা ধানক্ষেত আর দুপাশে সরু কাঁচা সড়ক, নীল দিগন্তে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ এই নিয়েই চিলাপাতার জঙ্গলে ঘেরা পর্যটন সুষমা। মেন্দাবাড়ি আর কোদালবস্তি এই অরণ্যের দুই অলংকার। সেখানকার দুটি ওয়াচ টাওয়ার থেকে রোমাঞ্চকর বন এবং বন্যপ্রাণী দর্শন করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো এখানকার জঙ্গলমহলের রাভা এবং মেচ জনজাতিদের আন্তরিকতাপূর্ণ সহজ সরল ব্যবহার, ভালোবাসা, অতিথিপরায়ণতা আর ডুয়ার্সের সোঁদা মাটির গন্ধ। ডুয়ার্সের সোঁদা মাটির গন্ধ পেতেই এসেছি বড়দিনের প্রাক্কালে মেন্দাবাড়ি এবং কোদাল বস্তির চার্চগুলিকে কেন্দ্র করে মানুষ কিভাবে বড়দিনের আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে তার সুলুক সন্ধান করতে। মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্প থেকে কোদালবস্তির দূরত্ব খুবই সামান্য। ৩১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্প কোদাল বস্তি মাত্র এক কিলোমিটার। একটু দূরেই মেন্দাবাড়ির জনজাতি অধ্যুষিত রাভা বস্তিতে লুথেরান চার্চটি যাকে রাভা বস্তি চার্চও বলা হয়। দক্ষিণ বড়ঝার ফরেস্টের অন্তর্গত বনবস্তি অঞ্চলের এই চার্চটি ছাড়াও মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পের আশেপাশেই তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে আছে দক্ষিণ মেন্দাবাড়ি চার্চ বা এন ই এল সি চার্চ অফ খ্রিস্ট। এছাড়াও আরেকটি জনপ্রিয় চার্চ মেন্দাবাড়ি বেথেলহেম প্রেয়ার হাউস।


 


              (বানিয়াপাড়া ব্যাপটিস্ট চার্চ)




 

আটিয়াবাড়ি থেকে চিনচুলা


নিমতি দোমোহনী থেকে খুব সকালেই বেরিয়ে পড়লাম কালচিনি এবং হ্যামিল্টনগঞ্জের চার্চগুলিতে। ১২-এ রাজ্য সড়ক ধরে আটিয়াবাড়ি নিমতি ডিপো রোড ধরে নিমতি রেঞ্জ অফিসের পাশ দিয়ে আরো তিন কিলোমিটার এগিয়ে বাঁ দিকে টার্ন নিয়ে প্রবেশ করলাম ভাতখাওয়া চা বাগানে। এখানেই যশপুর লাইন চার্চটি। নিমতি দোমোহনী থেকে চার্চটির দূরত্ব প্রায় আট কিলোমিটার। যশপুর লাইন চার্চ থেকে বেরিয়ে গারোপাড়া চা বাগান ছাড়িয়ে হেবরন স্কুলকে হাতের ডান দিকে রেখে চলতে লাগলাম মিনি ভারতবর্ষ কালচিনির দিকে। গারো, মেচ, রাভা, নেপালি, বিহারী, বাঙালির সহাবস্থান কালচিনিতে। এসে পড়লাম গাংগুটিয়া টি গার্ডেনে। বহু বছর আগে গাংগুটিয়াতে সনৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমি তখন দৈনিক বসুমতী পত্রিকায় লেখালেখি করতাম। সনৎদার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম গাংগুটিয়া চা বাগানের পথে পথে। পরবর্তীকালে এই বাগানের নাম হয়েছিল চিনচুলা। সনৎদার কাছ থেকে শুনতাম সাদরি এবং নেপালি ভাষায় লোকসংগীত। কবিতা এবং সংগীত ছিল তাঁর সহজাত। আপন খেয়ালে সনৎদা গাইতেন। এখানে অবস্থিত রোম্যান ক্যাথলিক চার্চটি খুবই সুন্দর। যশপুর লাইন চার্চ থেকে গাংগুটিয়া চা বাগানের রোমান ক্যাথলিক চার্চটির দূরত্ব প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে গাংগুটিয়া চা বাগানের টি এস্টেট এর কাছে রয়েছে সেন্ট মেরিজ ক্যাথলিক চার্চ। পাশেই জে. ই. এল চার্চ। এই চার্চের কাছেই চিনচুলা টি এস্টেট মনাস্টারি। অনতিদূরে চিনচুলা পানরিয়া বাজার এবং খেলার মাঠ। দুটি চার্চের মধ্যে দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না চিনচুলা চা-বাগানে খ্রিষ্টধর্মের মানুষের সংখ্যা কম নয় এবং ক্ষেত্রসমীক্ষা করে জানতে পারলাম এদের বেশিরভাগই তামাং সম্প্রদায়ভুক্ত। চার্চ লাগোয়া একটা কমিউনিটি হলও আছে।



                 ( পি আই সি চার্চ, সাতালি)



কালচিনি এবং হ্যামিল্টনগঞ্জ


জে ই এল চার্চ থেকে বেরিয়ে চিনচুলা কমিউনিটি হল অতিক্রম করে বাঁদিকে চিনচুলা পানরিয়া বাজার এবং চিনচুলা চা বাগানের খেলার মাঠ অতিক্রম করে উত্তর লতাবারি দিয়ে প্রায় দেড় কিলোমিটার এগোনোর পর কালচিনি হসপিটাল লাইন অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম। কালচিনি এক নম্বর টি গার্ডেন প্রাইমারি স্কুলকে ডানদিকে রেখে চলে এলাম কালচিনি চৌপথিতে। কালচিনি চৌপথিকে বাঁ দিকে রেখে চলে এলাম ডিমা টি এস্টেট ক্যাথলিক চার্চের প্রান্তে। গাংগুটিয়ার জে ই এল চার্চ থেকে ডিমা টি এস্টেট ক্যাথলিক চার্চ এর দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার। কালচিনি চৌপথী থেকে অল্পদূরে কালচিনি স্টেশনের পাশেই ১২-এ রাজ্য সড়ক হয়ে পায়ে হাঁটা পথে কালচিনি ব্যাপ্টিস্ট চার্চ। কালচিনির পশ্চিমে হ্যামিল্টনগঞ্জ যা কালচিনির বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র। কালচিনি ব্যাপটিস্ট চার্চ থেকে হ্যামিল্টনগঞ্জ বাইপাস অতিক্রম হয়ে শ্রীকৃষ্ণ প্রনামী মন্দির রোড দিয়ে ১২-এ জাতীয় সড়কে উঠে হামিল্টনগঞ্জ গুরুদ্বোয়ারা অতিক্রম করে উত্তর লতাবাড়ি হিন্দি হাইস্কুলের কাছে অবস্থিত সেন্ট এমব্রোজ চার্চে চলে এলাম। রওনা দিলাম এবার ডুয়ার্সের সবুজ সমুদ্রে। বাঁ দিকে কালচিনি রেলস্টেশন এবং ডানদিকে চা বাগান। কোন একসময় কাঠের তৈরি একটা আস্ত শহর ছিল হ্যামিল্টনগঞ্জ। ম্যাকলয়েড গ্রুপের চা বাগান মেচপাড়া এবং চুয়াপাড়া ছিল বিখ্যাত। এখনো এগুলি সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে। ভাটপাড়া চা বাগানে আগে একটা এরোড্রাম ছিল। সপ্তাহে একবার করে ডাকোটা এরোপ্লেন নামত এখানকার চা বাগানের চা এর নমুনা নিয়ে কলকাতায় টি অকশন হাউস এর অফিসে পৌঁছে দেবার জন্য। আজকের মত তখন শিলিগুড়িতে কোন নিলাম কেন্দ্র ছিল না বলে এই ব্যবস্থা। মেচপাড়া এবং ভাটপাড়া চা বাগানেও আছে চার্চ। সেন্ট অ্যামব্রোজ চার্চ থেকে সোজা চলে এলাম ভাটপাড়া চা বাগানের ভাটপাড়া নিউলাইন চার্চে। এটা একটা ব্যাপটিস্ট চার্চ। ভাটপাড়া নিউলাইন চার্চ থেকে ভাটপাড়া ব্যাপ্টিস্ট চার্চ মাত্র এক কিলোমিটার। ভাটপাড়া চা বাগিচা হাসপাতালের পাশ দিয়ে এগিয়ে এসে প্রবেশ করলাম ভাটপাড়া ব্যাপটিস্ট চার্চটিতে। এখান থেকে মেচপাড়ার নিউ ইন্ডিয়া চার্চ অব গড এর দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার। পাশেই ইয়াং চেন চোয়েলিং মনাস্ট্রি। চুয়াপাড়া হসপিটাল অতিক্রম করে মেচপাড়া শিবমন্দির এর পাশ দিয়ে চলে এলাম মেচপাড়া চার্চে। চুয়াপারা, মেচপাড়া, ভাটপাড়া চা বাগান অতিক্রম করে রাস্তা গিয়ে থেমেছে ভুটান পাহাড়ের পাদদেশে। সেখানকার শেষ চা বাগান টাটা কোম্পানির মালিকানাধীন রাঙ্গামাটি চা বাগান। মেচপাড়া চার্চ দেখে শেষ করলাম কালচিনি এবং হ্যামিলটনগঞ্জের চার্চ সফর। আজ থাকবো হ্যামিল্টনগঞ্জ। আগামীকাল শুরু হবে জয়গাঁও হয়ে হাসিমারা সার্কিটের চার্চ দর্শন।



                    ( কার্তিকা চা-বাগানের চার্চ)



জয়গাঁও সার্কিট


চার্চ সফর শুরু করলাম জয়গাঁও থেকে। বাসস্ট্যান্ড থেকে ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক হয়ে এগিয়ে চললাম ইউনাইটেড পেন্টিকোস্টাল চার্চের দিকে। পাশেই মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে ব্যাপ্টিস্ট চার্চ মঙ্গলাবাড়ি বাজারে। ৩১৭(এ)নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে হোটেল গোদাবরীর বাঁ দিক দিয়ে পৌঁছে গেলাম মংলাবাড়ি বাজারের চার্চটিতে। মঙ্গলাবাড়ি বাজার থেকে আগাপে ইন্ডিপেন্ডেন্ট চার্চ ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। ব্যাপ্টিস্ট চার্চ থেকে ৩১৭(এ) নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে সামান্য এগিয়ে গিয়ে ধর্মা ট্যুর এন্ড ট্রাভেলস এর পাশ দিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিতেই পৌঁছে গেলাম চার্চে। ফেরার পথে এবারে ধর্মা টুর এন্ড ট্রাভেলস এর বাঁদিকে বাঁক নিয়ে পৌঁছে গেলাম জয়গাঁ প্রেসবিটারিয়ান চার্চে। দুটি চার্চেরই দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম। এবার আমরা যাব হিমালয়ান চার্চে। এটিও একদম পাশে। দূরত্ব এক কিলোমিটারও হবে না। মঙ্গলাবাড়ি বাজার থেকে ১২(এ) নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ডানদিক বাঁদিক করতে করতে মুহূর্তে পৌঁছে গেলাম হিমালয়ান চার্চে। বাসস্ট্যান্ড থেকে অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক পার হয়ে দুর্গা হুন্ডাই অতিক্রম করে বন্ধন ব্যাংক এর পাশ দিয়ে বেঙ্গল টায়ারস এবং হীরা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস এর বাঁদিকে অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম ইমানুয়েল পেন্টিকোস্টাল চার্চে। বাস স্ট্যান্ড থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার। এবার যাবো নবজ্যোতি চার্চে। আবার বেঙ্গল টায়ারস এবং হীরা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসকে ডান দিকে রেখে অঙ্কুশ হোটেল এর পাশ দিয়ে নীতেশ টেলিকম এর ডান দিক ধরে চলতে থাকলাম। ইন্দো ভুটান বর্ডার রোডে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে ঝর্ণা বস্তির বাঁ দিক দিয়ে ইন্দো ভুটান বর্ডার রোড ধরে সোজা চলতে চলতে এলাম নবজ্যোতি চার্চে। ইমানুয়েল পেন্টিকোস্টাল চার্চ থেকে এই চার্চটির দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। নবজ্যোতি চার্চ থেকে বেড়িয়ে আমরা যাব সেন্ট মাইকেল চার্চে। দূরত্ব দুই কিলোমিটারের সামান্য কম। ইন্দো ভুটান বর্ডার রোডে দক্ষিণ পূর্ব দিকে মুখ করে এগিয়ে ঝরনা বস্তির পাশ দিয়ে চলতে চলতে আমরা পৌঁছালাম সেন্ট মাইকেল চার্চে। সেন্ট মাইকেল চার্চ থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে হিমালয়ান পেন্টিকোস্টাল চার্চ। দূরত্ব এক কিলোমিটারের মত। সরাসরি ইন্দো ভুটান বর্ডার রোড এবং ৩১৭(এ)নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে চলে এলাম হিমালয়ান পেন্টিকোস্টাল চার্চে। আরজু জেনারেল স্টোর্স এবং কসমেটিকসের ডানদিক ধরে সামান্য এগোলে জয়গাঁও ক্রিশ্চিয়ান অ্যাসেম্বলি হল। ফিরতি পথে আরজু জেনারেল স্টোর এন্ড কসমেটিক এর পাশ দিয়ে জয়গাঁও দুই নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের পাশ দিয়ে এসে ড্রিম কনস্ট্রাকশন এর কাছে ডান দিকে বাঁক নিতেই ফিলাডেলফিয়া ফেলোশিপ চার্চ মিশন এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে। এই চার্চটির পাশেই এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে বেথলেহেম পেন্টিকোস্টাল চার্চ। এই চার্চ থেকে বেরিয়ে চলে এলাম এসডিএ চার্চে। দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। একদম পাশে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে মুখ করে এগিয়ে গেলে লামা বিল্ডিংয়ে বাঁ দিকে ঘুরে প্রশংসা ক্যালভারি চার্চ। এই চার্জ থেকে ৩১৭(এ) নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্বে পৌঁছে গেলাম মঙ্গলাবাড়ি প্রধান রোডে মামরে চার্চে। এই চার্চ থেকে ৩১৭(এ) নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে পৌঁছে গেলাম গোপীমোহন গ্রাউন্ডে কৃপা চার্চে। দূরত্ব এক কিলোমিটার এরও কম। কৃপা চার্চ থেকে বের হয়ে গোপীমোহন চা বাগানের খেলার মাঠের পাশ দিয়ে আমরা চলে এলাম কৃপা মন্ডলী চার্চে। ফিরতি পথে খেলার মাঠের পাশ দিয়ে ড্রাইভ করে ৩১৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের কাছে এসে মন্দিরকে ডানদিকে রেখে সোজা চলে এলাম খোকলা প্রেসবিটারিয়ান চার্চে। দুটি চার্চের মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় চার কিলোমিটার।



                          (জয়গাঁ চার্চ)




ডুয়ার্সের চার্চ হাসিমারা সার্কিট


যাব হাসিমারার নামকরা চার্চ মাদার মেরি ক্যাথলিক চার্চে। নীলপাড়া ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস হয়ে সুভাষিনী চা বাগানের পাশ দিয়ে সৌদামিনী চা বাগান অতিক্রম করে এয়ারফোর্স হসপিটালের সামনে দিয়ে পৌঁছালাম মাদার মেরি ক্যাথলিক চার্চে। অনতিদূরে বালাজী মন্দির এবং হাসিমারার অন্যতম দর্শনীয় গুরুদ্বারা। মাদার মেরি ক্যাথলিক চার্চ থেকে বেরিয়ে দর্শন করলাম বালাজী টেম্পল। এরপর হাসিমারা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় চিলড্রেনস পার্কের পাশ দিয়ে সোজা হনুমান মন্দির। ৩১৭(এ) নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে তারা সিং ধাবা অতিক্রম করে আরো প্রায় সোয়া কিলোমিটার যাবার পর বাঁদিকে বাঁক নিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সেন্ট মেরিজ ক্যাথলিক চার্চ পশ্চিম সাতালিতে। সেন্ট মেরিজ ক্যাথলিক চার্চ থেকে বেরিয়ে ফিরতি পথে আধা কিলোমিটারের মতো এগিয়ে এসে সেন্ট অ্যালোইজ প্রাইমারি স্কুল বাঁদিকে রেখে প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর পৌঁছে গেলাম সাতালি চার্চ অফ লর্ড জেসাস খ্রিস্টে। দেড় কিলোমিটার রাস্তা পৌঁছে গেলাম মাত্র দশ মিনিটে। চার্চ থেকে বেরিয়ে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে পশ্চিম সাতালিতে পিআইসি চার্চ পৌঁছে গেলাম দশ মিনিটে। পাশেই মিশন বানিয়াপাড়া এশিয়ান চার্চ দেখে চলে এলাম বানিয়াপাড়া ব্যাপটিস্ট চার্চ। এই চার্চটি হাসিমারার সবচেয়ে বড় চার্চ এবং লক্ষ্য করলাম সাতালি চা বাগানকে ঘিরেই বেশ অনেকগুলি চার্চ গড়ে উঠেছে এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মান্তরিতকরণ এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। এই চার্চগুলিকে কেন্দ্র করে আদিবাসী সম্প্রদায়ের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মানোন্নয়ন যে ঘটেছে সেকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। সরকারের জনকল্যাণকর নীতিগুলির ফাঁকফোকর ধরে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে বিদেশের টাকাকে কাজে লাগিয়ে যদি খৃষ্টান মিশনারীরা সমাজকল্যাণকর কাজ করে থাকে এবং তার বিনিময়ে হতদরিদ্র চা বাগান শ্রমিকেরা তাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মানের উন্নয়ন ঘটানোর নিরিখে যদি স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েই থাকে তাহলে তাকে দোষ দেওয়া যায় কি?


 






      ভিজে যাওয়া সেই চিঠিখানি ।।  

                      কুমকুম ঘোষ।।


নির্ঘুম নির্জনতায় তারাদের ডাকে:

অর্থহীন বিছানায় এলোমেলো

পরে থাকে : নিঃশব্দ হাহাকার ---

শিশির ভেজা পথে সুদূরের আহ্বান।


না-পাঠানো পুরনো চিঠি আবার ফেলা হয় লাল ডাকবাক্সে : ভাবা যাক্, ভাবা যাক্ -- সে চিঠি পৌঁছে যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে...

অনন্ত-নক্ষত্ররাজি সাক্ষী হবে সেই পোস্টম্যানের প্রতি গতায়াতে।এ এক কষ্ট কল্পনার নীল আকাশে বৃথা ওড়াওড়ি;তবু ট্রামলাইনে কে হাঁটে একাকী?

শোনেনি সে ট্রামের ঘন্টি?-- ঘটাং ঘটাং।

তারপর , তারপর --পৃথিবী তখন ব্যস্ত থাকে সফলতা শক্তির ভেতরে। 

আর সে, আর সে -- কমলালেবুর মতো রোদ গায়ে মেখে, গাঢ়তর বেদনার রক্ত ক্লেদ মেখে পড়ে থাকে পুকুরের ধারে ; যেন "পরণ-কথা"র গন্ধ লেগে আছে তার নরম শরীরে ;; নদী নক্ষত্রের তলে সেদিনো স্বপ্ন দেখতে থাকে, সে, শম্ভুনাথ পন্ডিতের রঙ- চটা বেডে।

.....................................................................


নির্বাসিত মেঘেরা সে চিঠি ফিরিয়ে দিয়ে

এসে দাঁড়িয়েছে জলপ্রপাতের পাশে।

আহা! ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা রামধনু যেন; 

অমরত্ব কামনা করে ।

প্রেমিক প্রবর কায়ক্লেশে হাত দেয়

ছেঁড়া পকেটে। একটা অচল পয়সা ছুঁড়ে 

তাকায় নীল আকাশের দিকে।

আর ঠিক তখনই ম্যাজিকের মত

মাটি ফুঁড়ে আবির্ভূত আরো তিনজন

তারপর, তারপর : তারপর-- খালাসিটোলায়

মাটির ভাঁড় এবং সত্যবন্ধ অভিমান। অমরত্ব ত্যাগ করে কবিতার শরীরে অবগাহন।

 যৌবনের স্পর্ধা দশক দশক ধরে, 

দিকশূন্যপুর অথবা----

অকিঞ্চিৎকর ফুটপাত ; করে চলে দৃপ্ত শাসন।

..............................................................

একটানা জলের শব্দ। আহা! কি ঝরঝর ধারায় ভিজিয়ে দিল শব্দ আখর। ভিজে যাওয়া সেই চিঠির প্রতিটা শব্দ এখন পবিত্র ও সুন্দর হয়ে উঠেছে। সংসারে জলের বিকল্প আর কিছুই হতে পারেনা।স্নান করো , পান করো, দান করো। পথের ধারে একটা বাঁশির সুর শোনা যায়, অপর্ণা ছুটে তোরঙ্গ খোলে; ঐতো পরে আছে রাসের মেলা থেকে কেনা যুবক স্বামীর আড়বাঁশি টা!

কে সুর তোলে তবে? ছাদের আলসেতে আনমনে খুলে রাখে খোঁপার কাঁটা গুলো।

.....................................................................


রেললাইন ধরে হেঁটে চলে দুই বন্ধু: অপূর্ব আর নীললোহিত ; সংসারে সবাই ওদের অপু আর নীলু বলে ডাকে।খুব গভীর আলোচনা করতে করতে ওরা রেললাইনের কাঠের স্লিপারের ওপর পা ফেলে ফেলে এগিয়ে চলেছে।

 হেমন্তের এই সময়ে বিকেলগুলো ছোট আর বিষণ্ন হয়ে পড়ে বড়ো দ্রুতবেগে।সূর্য ডুবে গেলেই ঝুপঝুপ আঁধার নেমে আসে কুয়াশার ওড়না নিয়ে। খানিকটা গিয়েই লাইনটা বাঁক নিয়েছে নদীর দিকে।কলকাতায় নদী মানেই গঙ্গা।সেই গঙ্গার দিকেই এগিয়ে যায় ওরা । দুটো অবয়ব আবছা হতে হতে একসময় ফ্রিজ শট্ হয়ে যায়।



( রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বর্ষা কবিদের ঋতু ; সময় বলে হেমন্ত বিচ্ছেদের ঋতু।

হেমন্তের বিভোর-বেদনায় কতকগুলো দিন তাই স্থায়ী হয়ে থাকলো।

জীবনানন্দ দাশ : মৃত্যু ২২শে অক্টোবর,১৯৫৪

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : মৃত্যু ২৩ শে অক্টোবর,২০১২

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যু : ১৫ ই নভেম্বর,২০২০)













 





স্মরণ

শ্রদ্ধাঞ্জলি 

অদিতি মুখার্জী (সেনগুপ্ত) 

"বেলা শেষে " নিভল যে "সাঁঝবাতি",
"হীরক রাজার দেশে" "সোনার  কেল্লা" তে এল যে "অশনি সংকেত"।
"পোস্ত"- এর "ফেলুদা" এখন হয়েছে "প্রাক্তন",
"বসন্ত বিলাস"- এ সকলের আঁখিতে আজ "শ্রাবণের ধারা"।।
'অরণ্যের দিন রাত্রি " তে "আকাশ-কুসুম" ভাবেন "গণদেবতা ",
তাঁর "স্বরলিপি" রবে "ঘরে-বাইরে "  "অপরাজিত"।
"কনি", "চারুলতা" সবাই এখন "সমান্তরাল",
"শাখা-প্রশাখা" বিস্তারিত হওয়ার আগেই হল "অভিযান" - এর "সমাপ্তি"।।





পিয়াস গোস্বামী





বেলা শেষের পারে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ,অভিভাবক হারা হলেন টালিগঞ্জ
বটু কৃষ্ণ হালদার

২০২০ সালের শুরু থেকেই মানব সভ্যতার কাছে মোটেই সুখকর নয়। কোভি ড_১৯ শ্রেষ্ঠ সভ্যতার কাজে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেনা পৃথিবী,পরিবেশ মানুষজন সব অচেনা হয়েছে। কান পাতলেই শুনতে পাওয়া যায় পরিজন হারানোর আর্তনাদ। করোনার সাথে যুদ্ধ করতে করতে ইতিমধ্যে আমরা হারিয়েছি ডাক্তার নার্স পুলিশ স্বাস্থ্যকর্মীদের।না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের অনেক ই।তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যাঁকে ভালোবেসে অনেকেই ডাকতেন পুলু বলে। টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়া শোকস্তব্ধ।স্টুডিও পাড়া অভিভাবক কে হারালেন, এ কথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই এই মুহূর্তে। মৃত্যু চিরন্তন সত্য। এই তত্ত্ব কে সামনে রেখে জীবন যুদ্ধে হার মেনেছে তাঁর নশ্বর দেহ টা। কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাস্তব চিত্রায়নে দিয়ে গেছেন মহামূল্যবান স্বাক্ষর। যা আঁকড়ে তিনি যুগের পর যুগ বেঁচে থাকবেন তাঁর অনুগামীদের হৃদয়ে।
জনপ্রিয় অভিনেতা হওয়ার আগে পুলুর জীবন সম্বন্ধে টুকরো ঘটনা গুলো যা আমাদের হৃদয়ের সাড়া জাগায়। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারির ঘটনা। এই সময় পুলুর সঙ্গে আলাপ হয় বন্ধু অশোক পালিতের।ওই সময় তার পরনে ছিল খাঁকি হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট।শার্টের দুদিকে বুক পকেটের বাঁদিকে একটি ব্যাজ আটকানো ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা কিসের ব্যাজ?পুলু উত্তর দিয়েছিল "আই এন এ র"। কৃষ্ণনগরের নাকি বারাসাত, কোথায় যেন কোন এক আই এন এর সোলজার ওই পদক টা পুলু কে দিয়েছিল। আই এন এ মানে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ ফৌজ।এর থেকে আশা করা যায় তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সংস্পর্শে এসে ছিলেন। ভাবা যায়।
পড়ুয়া সৌমিত্র কলকাতায় থাকাকালীন বহু সময়ই নাটক ,সিনেমা দেখতে গিয়েছেন। ডেসিকার ফিল্ম দেখার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছেন।‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং চলছে তখন। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার শুটিং দেখতে আসেন অনেকেই। নাটকের অভিনেতারাও আসেন। এমনি একটি ছেলেকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন স্বয়ং পরিচালক। ঘরের মধ্যে তখন ছবি বিশ্বাস এবং সত্যজিৎ রায়। আগন্তুক ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় ছবি বিশ্বাসকে বললেন, ‘এই আমার পরবর্তী ছবির নায়ক’। ব্যাস্, এভাবেই হঠাৎ করে ঢুকে পড়া সিনেমার জগতে। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেল ‘অপুর সংসার’। তারপর এই ৬১ বছর ধরে একভাবে টলিউডের বুকে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।এমন এক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুবক 'অপু'র খোঁজ করতে গিয়ে আলাপ সত্যজিৎ রায়ের। ১৯৫৯ সালে 'অপুর সংসার' এর হাত ধরে একজন এমন বাঙালি ছাপোষা অথচ উজ্জবল চেহারার অভিনেতাকে সত্যজিৎ স্ক্রিনে ধরেছিলেন ,যাঁর ব্যক্তিত্বে বাঙালি বিভোর হয়েছে। ততদিনে বিভূতিভূষণের অপু সৌমিত্রের হাত ধরে যেন ঠিক পাশের বাড়ির ছেলে। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অপুকে যেভাবে বাঙালিবুকে জড়িয়েছে, তেমই ৭০ এমএম পর্দার ফেলুদাকে বাঙালি সৌমিত্রর চেহারাতেই চিনতে পেরেছে। সত্যজিৎ-সৌমিত্রর হাত ধরে এসেছে হীরক রাজার দেশের মাস্টার মশাইয়ের চরিত্র, এসেছে 'শাখা প্রশাখা' ,'অরণ্যের দিনরাত্রি'র মতো ছবি করেছেন।১৯৮৪ র 'কোনি',১৯৭৩ র 'বসন্ত বিলাপ',১৯৭২ এ উত্তম কুমারকে সমানে সমানে টক্কর দিয়ে 'স্ত্রী' বাঙালিকে আজও বিভোর করে। ১৯৬১ সালে একইভাবে বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে কাঁটায় কাঁটায় তাল মিলিয়ে সৌমিত্র অসামান্য অভিনয় উপহার দেন 'ঝিন্দের বন্দি' ছবিতে। ১৯৬৪ এর 'চারুলতা'য় মাধবী,শর্মিলার সঙ্গে ১৯৫৯, এ "অপুর সংসার',১৯৬০ এ 'দেবী', ১৯৬১ তে অপর্ণার সঙ্গে 'তিনকন্যা', যেন সৌমিত্রকে নায়কের থেকেও এক উঁচুস্তরে নিয়ে যায়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে 'তাহাদের কথা',পরবর্তীকালে ঋতুপর্ণের সঙ্গে ' অসুখ' এরপরের যুগে ' বেলা শেষে' সৌমিত্রকে যেন 'পরিচালকের অভিনেতা' করে তুলেছিল। যুগ, কাল,বয়সের উর্ধ্বে তিনি হয়েছিলেন 'অভিনেতা'।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্য়ায়ের লেখা বই'মানিক বাবুর সঙ্গে ' মুক্তি পাওয়ার আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী মূলক বই ছিল 'পরিচয় '।এছাড়াও ','চরিত্রের সন্ধানে' ,'শব্দরা আমার বাগানে', 'মধ্যরাতের সংকেত' সহ বহু বই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাঙালির কাছে আসে।তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছয়টি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছিল 'জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে'(১৯৭৫),।এরপরে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল "ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা(১৯৭৬),","শব্দরা আমার বাগানে"(১৯৮১),"পড়ে আছে চন্দনের চিতা"(১৯৮৩), "হায় চির জল"(১৯৯২),এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা(১৯৯৩)।
থিয়েটারের সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক ছিল।শিশুকাল থেকেই তিনি থিয়েটারে অভিনয় করে আসছেন।পুলুর বাবা ও বড় ভাই খুব ভালো অভিনয় করতেন।১৬ বছর বয়সে তিনি যখন কলকাতায় কলেজে ভর্তি হলেন,সেসময় শিশির ভাদুড়ীর অভিনীত একটি নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। সেই থেকেই তার মাথায় অভিনয় ভর করে বসে।১৯৬৩ সালে 'তাপসী' দিয়ে শুরু সৌমিত্র চট্টোাপাধ্যায়ের নাট্যজীবন। এরপর রাজকুমার, ফেরা, চন্দনপুরের চোর, নীলকন্ঠ, টিকটিকির মতো নাটক কখনও তাঁর অভিনয়ে কখনও বা তাঁর নির্দেশনায় সমৃদ্ধ হয়েছে।তবে তিনি বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিপ্লব ঘটালেন "নামজীবন" নাটক দিয়ে।সম্প্রতি তার নাটক টিকটিকি মঞ্চে দারুণভাবে সাড়া ফেলে দিয়েছিল।শেষে ৭৬ বছরের স্বপ্নপূরণ করলেন জীবনে প্রথম শেক্সপিয়ারের কিং লিয়ার চরিত্রে অভিনয় করে।অভিনয়ের টানে পুলু এন এম এ পরীক্ষায় বসেনি।সেই কয়েক মাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যদল নিয়ে দিল্লিতে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় গিয়েছিল। সেই প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ অভিনেতার শিরোপা তার মাথায় উঠেছিল। নাটকের টানে এম এ পড়া হলো না। কারণ ভাগ্যলক্ষী তাকে অন্যদিকে ডাকছে।১৯৫৮ তে ডাক পান অপুর সংসার ছবিতে। বাকিটা তো ইতিহাস হয়ে রইলো।
তিনি শুধু মহান অভিনেতা ছিলেন না। ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। অভিনয়ের পাশাপাশি,১৯৬০ সালে প্রথম প্রকাশিত "এক্ষণ" নামক পত্রিকার সম্পাদনা, সঙ্গী ছিলেন সহপাঠী কবি নির্মাল্য আচার্য,পরিচালক,চিত্রকর,গায়ক হিসেবে আমরা তাকে পাই।একজন দক্ষ কবি হিসেবেও আমরা তার দক্ষতার ছাপ পেয়েছি। অভিনয় জীবনে প্রথম প্রেম ছিল। কিন্তু পাশাপাশি লিখে গেছেন বহু কবিতা। শুধু তাই নয় তিনি একজন সমৃদ্ধ বাচিকশিল্পী ও বটে।তিনি স্বীকার করে গেছেন শিশুকাল থেকে কবিতা লিখতেন না। যখন তিনি ক্লাস টেনে পড়ে তখন থেকে কবিতা লিখতে শুরু করেছেন।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা লেখার প্রথম বাঁধানো খাতার প্রথম পাতায় যে কবিতাটা ছিল তার নাম সম্ভবত "দীপান্বিতা"। কবিতার শুরুতে ছিল এরকম একটা লাইন_"কে গো তুমি দীপান্বিতা"।কবিতার প্রতি ভালোবাসা ছিল বাড়ি থেকে। কারণ তার বাবা খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। শুধু তাই নয় মা কবিতা বলে তাকে ঘুম পাড়াতেন।তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় কলেজ ম্যাগাজিনে।তখন তিনি মাস্টার ডিগ্রী করছেন। এই সময়ে তার কলেজ বন্ধু সুধীর চক্রবর্তীর সম্পাদনায় একটা কাব্য সংকলন বার হয়েছিল। কাব্য সংকলন টি প্রথমে বেরিয়েছিল হাতে লিখে। তার নাম ছিল "অমৃত যন্ত্রণা"।সেটা এত খ্যাতি পেল যে বন্ধুবান্ধবরা টাকা দিয়ে প্রকাশ করল।সেটা প্রকাশ করেছিলেন প্রয়াত কবি তারাপদ রায়(১৩৬৩ সাল)।আশ্চর্যজনকভাবে মাত্র তিন মাসে তার ৫০০ কপি বিক্রি হয়ে গেল। কাগজে ভালো সমালোচনা বার হল।সেই কাব্য সংকল নে প্রকাশিত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার কয়েকটি লাইন দেওয়া হল।কবিতার নাম_"এই বাদাম গাছের ছায়ায়"_
লেখক_সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
এই বাদাম গাছের ছায়ায়
তোমায় আমি উপহার দেব একটি শোক
যেনো আজ এই চৈত্র দিনের সন্ধ্যায়
তার থেকে আপন
আর তোমার কেউ নেই।
এরপর কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা ছাপা হয়। তার কফি হাউসে কবি বন্ধু ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি।তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্বীকার করেছেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা গুলি তাকে অনুপ্রেরণা যোগাতে সাহায্য করত।তাঁর গভীর অন্দরে এক কবিসত্তা কবিতার জগতে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। তার মুখে আবৃত্তি গুলো আবৃত্তি প্রেমী মানুষ দের হৃদয়ে করাঘাত করে।
পারিবারিক সূত্রে বহু গুণে পরিবারের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় একটি লেখাতে স্বীকার করেছেন, তার অন্নপ্রাশন মুখে ভাতটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের কোলে বসিয়ে দিয়েছিলেন। উত্তম কুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বাঙ্গালীদের কাছে তর্জার বিষয় ছিল ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান এর মত।অথচ দুজনের পারস্পারিক সম্পর্ক ঠিক তেমন ছিল না। ঝিন্দের বন্দী সিনেমা তে উত্তম কুমারের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম অভিনয়। এই প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেছেন ব্যক্তিগতভাবে উত্তম কুমারের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল।তার ভগ্নিপতির বন্ধু ছিলেন উত্তম কুমার।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বোনের বিয়েতে বরযাত্রী হিসেবে এসেছিলেন তাদের বাড়িতে। এরপর থেকে সুসম্পর্কের শুরু হয়। উত্তম কুমারের নাতি গৌরবের অন্নপ্রাশনের সময় উত্তম কুমারের ছেলে গৌতম কুমার ও তরুণ কুমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে এসেছিলেন। এসময় তারা তরুণ কুমার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে বলেছিলেন, দাদা তো নেই, আপনাকে একটু দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখে নিতে হবে। এমনই ছিল উত্তম কুমারের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পারিবারিক সম্পর্ক। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলেজপাড়া কালিনী উত্তম কুমারের ফ্যান ছিলেন।সেসময় বলিউডে উত্তম কুমার সুচিত্রা জুটি ছিল বাঙালির হার্টথ্রব। একের পর এক হিট ছবিতে বাজিমাত করে চলেছে।তার সঙ্গে ঝিন্দের বন্দী তে অভিনয় করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরম তৃপ্তি লাভ করেছিলেন।বাংলা চলচ্চিত্র জগতের উত্তম কুমারের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছয় টি ছবিতে অভিনয় করেছেন।ছবি গুলির নাম হল ঝিন্দের বন্দী অপরিচিত স্ত্রীর প্রতিশোধ দর্প চূর্ণ দেবদাস।তার চোখে উত্তম কুমার মানেই অসামান্য ক্যারিশমাটিক রোমান্টিসিজম। একদিকে উত্তম কুমার সব সময় ধরে রাখতে চেষ্টা করেছেন নায়কসুলভ গ্ল্যামার। সে দিক থেকে সৌমিত্র বার বার চেনা সব ভেঙে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন চরিত্রে। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ র খুব প্রিয়।২৫ শে আগস্ট, ২০১৬ সালে দে'জ প্রকাশিত হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা গদ্য সংগ্রহ, যা নন্দনে প্রকাশ করেছিলেন মুম্বাইয়ের প্রখ্যাত অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ, সহ কবি শঙ্খ ঘোষ রঞ্জিত মল্লিক। সেই সময় একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছেন_"সৌমিত্রদা আমার কাছে একজন সেরিব্রাল অভিনেতা।তার বুদ্ধি,বিচার,বিশ্লেষণ ক্ষমতা,মেধা,মঞ্চ_ থিয়েটার নির্মাণ তার নির্দেশনা চরিত্রের রূপ নির্মাণ_ এক কথায় অসাধারণ। তিনি আরো জানিয়েছিলেন আলকাজি দুবের মত খুব শক্তিশালী নাট্য নির্দেশক সৌমিত্রদা। পাশাপাশি জর্জ বার্নাড শ, সেক্সপিয়র, ইসমত চুঘতাই,মন্টুর সঙ্গে তুলনা টানা যায় সৌমিত্রদার প্রতিভার। সত্যজিৎ রায়ের এক ডজন ছবিতে কাজ,তাঁর লেখা, তাঁর আঁকা,শিশির ভাদুড়ী ছাত্র, রবীন্দ্র অনুরাগী সৌমিত্রদার মত অনন্য প্রতিভার ভূ-ভারতে বিরল"।
অভিনয়জগতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক বলিষ্ঠ ও সাবলীল অভিনেতা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অপু ফেলুদা উদয়ন পন্ডিত আর অবশ্যই নরসিংহ সহ বহু কালজয়ী চরিত্র।তবে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অভিযান ছবিতে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার এর চরিত্র দর্শককে মুগ্ধ করেছিল। সিনেমা জগতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে আলাদাভাবে চিনতে শুরু করে। এই বাংলা সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অন্য এক কিংবদন্তির নাম। হয়তো সেদিন উত্তমকুমারকে এই চরিত্রে দেখা যেত। সময়টা ছিল ষাটের দশকের শুরু।প্রযোজক বিজয় চট্টোপাধ্যায় ঠিক করলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে একটি ছবি তৈরি করবেন। পরিচালনা করবে অভিযাত্রিক গোষ্ঠী। গল্পের মুখ্য চরিত্রে ছিলেন একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। এই ছবিতে অভিনয় করার জন্য পরিচালক ছুটে গেলেন মহানায়ক উত্তমকুমারের কাছে।কিন্তু এই চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে নায়ক সুলভ গ্ল্যামার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে এই কথা শুনেই না করে দিলেন উত্তম কুমার। পরিচালক বাধ্য হয়ে ছুটে গেলেন সত্যজিত্ রায়ের কাছে। সত্যজিৎ রায় হাসিমুখে পরিচালনার দায়িত্ব তুলে নিলে ন। তিনি বেছে নিলেন অপুর সংসার, দেবী খ্যাত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এক্ষেত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পরে বলেছিলেন"ভাগ্যিস উত্তমদা অভিনয় করতে রাজি হননি"।
সত্যজিৎ রায় তখনও পরিচালনার খাতা খুলতে পারেননি। ইতিমধ্যেই উত্তম কুমার সবার হৃদয় জয় করে বসে আছে। উত্তমকুমারকে যখন সত্যজিৎ রায় বড় পর্দায় দেখেন তখন তিনি মহানায়ক। পরিচালক নির্মল দের বসু পরিবার ছবিটি সত্যজিতের মন জয় করেছিল। তিনি অবাক হয়েছিলেন এটা দেখে একজন মঞ্চ অভিনেতা হয়েও সিনেমার অভিনয় কোন মঞ্চের ছাপ ছিল না। সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমারের রোমান্টিক জুটি তখন সারা বাংলা কাঁপিয়ে চলেছে।কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে উত্তম কুমারের দুটি ব্যতিক্রমী ছবি হল "নায়ক" ও "চিড়িয়াখানা"।১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত নায়ক গল্পের রচয়িতা সত্যজিৎ রায় নিজেই ছিলেন।এই কিংবদন্তি পরিচালকের সঙ্গে সর্বাধিক কাজ করা অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এসে একদিন সত্যজিৎ রায় কে জিজ্ঞাসা করলেন নায়ক সিনেমা তে আমাকে নিলেন না কেন? সত্যজিৎ রায় সৌমিত্র দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলেন তুমি কি উত্তম? নায়ক উত্তম কে দেখেই মনে হয়। ক্যারিজমা উত্তমকে দেখেই মনে হয়। প্রেমিক উত্তমকে দেখেই মনে হয়। তাই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিশ্চয়ই ভালো অভিনেতা ছিলেন। কিন্তু নতুনভাবে প্রেমে পড়ার লুক, ছোট ছোট দিক, যেটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে ছিল না।আর সেজন্যই নায়ক ছবির জন্য উত্তম কুমার কে বেছে নিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
তবে পঞ্চাশ ষাটের দশকে তখন বাংলা সিনেমা বলতে ছিল মূলত উত্তম কুমার সুচিত্রা সেন।বাজার, হাট, সেলুন, চায়ের দোকান,রাস্তার মোড়,গাছের তলায় আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল উত্তম কুমার। তার হাঁটার স্টাইল, চশমা,চুলের কাটিং,কথা বলার ধরন,জমা,প্যান্ট পরার ধরন, শব কিছু তাকে নকল করে চলছিল।নারী,পুরুষ উভয়ের লীপের ডগায় আলতো স্পর্শ হতো শুধু উত্তম কুমার।বর্তমান সমাজ প্রেক্ষাপটে বোঝা যায়, নারী রাত কতটা পরাধীন ছিল।সেই জায়গায় থেকে বাড়ির পরিজন,পাড়া প্রতিবেশীর চোখ এড়িয়ে কলেজ কাট মেরে সিনেমা হলে ছুটে গেছে শুধু উত্তম কুমারের টানে।অনেকে বাড়ির বড় দের থেকে বকুনি,কানমলা খেয়েছে তাতে ও কুছ পরোয়া নেহি।টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে উত্তম চরিত্র কেন্দ্রিক পত্রিকা কিনে নিজের ব্যাগে রাখা র মত মহা অপরাধ কে তুচ্ছ করেছে অনেকেই।টিফিন টাইমে বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে চুপি চুপি দেখা,দেখতে দেখতে হৃদয়ে ঢেউ তোলা সেই জমানার অলংকার ছিল।সেই বাঁধা ছক ভেঙে মহানায়ক উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তায় ব্রেক লাগানো মানুষটির নাম হলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ধীরে ধীরে সমস্ত জায়গায় উত্তম কুমারের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে লাগলো। শুরু হলো দুইজনকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে যাই হোক দুজনেই তাদের কাজের জায়গায় স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। তাই একজনের জায়গা অন্য কেউ নিতে পারে না। সমাজের মুখে দুজনেই আলাদা আলাদা সত্ত্বা হয়ে উঠলেন।সত্যি ভাবতে খুব অবাক লাগছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর নেই। কল্পনার অতীত, এভাবেই থমকে যাবে অপুর সংসার। কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে তোমাকে ঘরে-বাইরে খুঁজলেও আর কোনোদিন দেখতে পাবো না।তবে শ্রাবণের ধারার মতো প্রতিটি বিন্দুতে, সোনার কেল্লার প্রতিটা পাথরে, শাখা প্রশাখায়,সাঁঝবাতির প্রথম শিখায়, এমনকি জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে আমরা তাকে নতুন করে অনুভব করব। তিনি যেখানে গেছেন সুখে থাকুন। তাঁর আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।
 





 





সোনালি ফসলে নবান্নের আগমন 

অভ্রদীপ ঘোষ











আলো

 বিতান দাস









 





আনুগত্য

মৌসুমী চৌধুরী


দিনক্ষণ দেখে গণতন্ত্র উৎসবের খুঁটিপুজো।


পাখির চোখ স্পঞ্জি গদি,

ঠান্ডা ঘর, গাড়ির মাথায় লালবাতি।

দরকার জনতার অগুন্তি মাথা

আর আনুগত্য একশ ভাগ! 

তাঁরাও যান মেরুদন্ড বেঁকে গেলে

যেতে হয়... নচেৎ...

তাই, সার্কাস ফেটে পড়ে হাত তালিতে!


ময়লা-ছেঁড়া-ন্যাকড়া পরা বুড়িটার

আজ একটু অন্যরকম

আজ একটু ভালোমন্দ!

খুঁটিপুজোর উৎসব শেষে ভিখিরি ছেলেটা

উল্লাসে কাগজ কুড়োয়, প্লাস্টিক বোতল।


ঠান্ডা গাড়িগুলো চলে যায় ধুলো উড়িয়ে

আনুগত্য নব্বুই ডিগ্রী মাথা নোওয়ায়। 


 





মন্দ ভালবাসা

        অমিতাভ সরকার


ভালবাসা একটা পাপ

       পাপের বিষে শেষ হয়ে যায় 

                এক একটা দেবদাস, ডায়না।

রোমনগরী ধংস হয়ে

                 রয়ে যায় - ইতিহাসের পাতায়।


ভালবাসা একটা অভিশাপ

        তারই জেরে পরকীয়া,

                সাজানো সংসার শ্মশান ।

আত্ম আর ভ্রূণহত্যা,

                 আবেগ দংশায় বিবেকের গায় ।


ভালবাসা কর্মনাশা

        ছড়ার নেশা পড়ার খাতায়,

                 কাজের সময় কল্পনা।

ঘুম কেড়ে নেওয়া রাত্রি -

                 ধর্ম ভালবেসে, দাঙ্গা অবশেষে।


ভালবাসা সর্বনাশা -

       আঘাত-ই যার প্রতিদান।

                 পতঙ্গ মরে আগুন ভালবেসে,

আজীবন জ্বলে রাধা, আর -

                 তোমাকে ভালবেসে,

       কুমারী মা আমি শেষে ।


 





স্বপ্ন দেখায় চাঁদ


শ্রাবনী সেনগুপ্ত


হেমন্তের ভোর। আজ অনেকদিন পর মালতির ছোট্ট ঘরে পুরোনো ব্যস্ততার আঁচ। সক্কাল সক্কাল উঠোন নিকিয়ে দুটো মুড়ি দেবে মৃত্যুঞ্জয়কে। আজ সাত মাস পরে কাজে যাবে মানুষটা। আবার বাতের রোগে পঙ্গু শাশুড়ি হাঁক দিয়ে বলবে ' অ বৌ ! আমারে এট্টু বাইরে নে যা না , ছেলেটার খাওয়া দেখি'। আজ আর বিরক্ত হবে না মালতি , এককালের বিরক্তি উদ্রেক করা ডাক শোনার জন্য যে সে এতকাল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো। অথচ আগেও এমনটা ছিলোনা , মালতির এই ছোট্ট সংসার। স্বামী,শাশুড়ি, দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গড়ে ওঠা তার এই ছোট্ট সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলেও সুখের অভাব ছিল না। রোজ সকালে দুটো পান্তা খেয়ে মাঠে চলে যেত ক্ষেতমজুর মৃত্যুঞ্জয়। লক্ষ্মীর বেশ কয়েকটি মৃত সন্তান প্রসবের পর, অনেক ধর্ণা,হত্যে দেওয়া,মানত,তাবিজ -কবজ করে জন্ম এই ছেলের। তখন রায়বাড়ির গিন্নিমা বলেছিলেন -'ওরে লক্ষ্মী তোর ছেলের নাম রাখ মৃত্যুঞ্জয় ,তাহলেই দেখবি ও মৃত্যুকে জয় করেছে’ । না হলে তাদের মতো সংসারে কে আর এইধরণের নাম রাখার বিলাসিতা করে। তাই সেই ছেলে সকালে কাজে বেরোনোর আগে যখন খেতে বসতো, তখন পঙ্গু মায়ের রোজকার বায়না ছিল সেই সময় তাকে উঠোনে নিয়ে যাবার। শতেক কাজে ব্যস্ত মালতী মুখ ঝামটা দিলেও তাকে ধীরে ধীরে এনে উঠোনের এককোণে কাঁঠাল কাঠের পিঁড়িতে বসাতো। মৃত্যুঞ্জয় কাজে চলে গেলে বাকি সব কাজে হাত লাগতো মালতী।


শাশুড়িকে নাইয়ে- খাইয়ে,ছেলে-মেয়েদের সামলে নিয়ে , বাড়ির হাঁস দুটোকে পুকুরে নিয়ে যেত। ঘরের সামনের এক চিলতে জমিতে সবজি ফলাতো। এরপর নিজে নেয়ে-খেয়ে দুটো মুড়ি ভাজতে বসতো। রায় গিন্নিমার বরাত দেওয়া চালের মুড়ি। যাহোক কিছু আয় তো হতো এই দারিদ্র্যের সংসারে ! মৃত্যুঞ্জয় দুপুরে বাবুদের ওখানেই খেত।


মৃত্যুঞ্জয় ফিরত সন্ধ্যেবেলা , হাট থেকে চাল-ডাল-তেল -আলু নিয়ে।তারপর সন্ধ্যেবেলা সবাই মিলে খেতে বসতো কুপির আলোয়। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে কাজ সারতো মালতী। নাহলে কুপির তেল ফুরোবে। এই গ্রামে তাদের কয়েকঘরের ইলেকট্রিক আলো নেই। ভোটের আগে পঞ্চায়েতের বাবুরা প্রত্যেকবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, কিন্তু ভোট হয়ে গেলেই বাবুরা সব ভুলে যান। এতেও মালতির সুখের সংসারে কোনো ভাঁটা পড়েনি।


হঠাৎ করে সাতমাস আগে নেমে এলো করোনা নামের এক অলক্ষ্মীর কালো ছায়া। তার ধারালো অস্ত্রে খান খান হয়ে গেলো কতশত মালতীর সুখের সংসার। মৃত্যুঞ্জয়ের কাজ গেলো,বন্ধ হলো মালতীর মুড়ি বেচাও। এই সাতমাস কি করে যে তাদের চলেছে, তা শুধু মালতীই জানে।কোনোরকমে বাড়ির হাঁসের ডিম্ বেচে , শাকপাতা খেয়ে দিন কাটিয়েছে। ছেলে-মেয়ে দুটো আর পারছে না। গত একমাস ধরে শুধু পুকুরের গেঁড়িগুগলি আর শাকসবজি খেয়ে পেট ভরাতে হয়েছে। চাল কেনার পয়সা নেই। যাওবা খুদকুঁড়ো কিছু ঘরে ছিল, এখন আর তাও নেই। স্বামী, ছেলে-মেয়ে আর বুড়ি শাশুড়ির মুখের দিকে তাকাতে পারে না মালতী। মৃত্যুঞ্জয়ও যেন খুঁজে পায় না তার মালুকে। গরীবঘরের মেয়ে , বৌ, হয়েও তার মধ্যে ছিল এক ঢলঢলে ভাব , হাসলে কি মিষ্টি দেখাতো মুখখানা। এই ক'মাসে কি হতশ্রী চেহারা হয়েছে মেয়েটার, গালের হনু উঁচু হয়ে গেছে। মৃত্যুঞ্জয়ও কেমন যেন গুম মেরে গেছে। সে বলে - ' বৌ কি যে করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না রে। কোথাও কোনো কাজ নেই'।


কাল রাতে হঠাৎ করে বাবুদের বাড়ি থেকে ডাক এলো। পড়িমরি করে ছুটলো মৃত্যুঞ্জয়। গিয়ে দেখে কেষ্ট, কালী ওরাও জনাকয়েক এসেছে , সব দাঁড়িয়ে আছে দূরে দূরে। অন্ধকারের মধ্যে কয়েকটা কঙ্কালসার চেহারা। বড়বাবু সামনে আসেন নি , দোতলার জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে বললেন -' শোন্ , এখন ধান কাটার সময়, মাঠে লোক লাগবে,কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে তো সকলকে একসাথে জমিতে ডাকা যাবে না,কয়েকজন কালকে কাজ করবি, বাকিরা তার পরেরদিন , এইভাবে চলবে'।


মৃত্যুঞ্জয়কে আজ মাঠে যেতে বলেছেন বাবু। তাই আজ মালতীর এত তাড়া। ঘরের এককোণে রাখা শূন্যপ্রায় মুড়ির টিন থেকে ঝেড়ে বেছে কয়েকটা মুড়ি বার করে দিয়েছে তার স্বামীকে। কাজে গেছে মৃত্যুঞ্জয়। ঘরে মালতী আশায় বুক বেঁধে ঘ্যান ঘ্যান করা মেয়েটাকে বললো-'এট্টুখানি সবুর কর মা,আজ তোকে ভাত দেব'। কচি মেয়ে তার মায়াময় মুখটা তুলে বললো -'সত্যি বলছো মা ?' শাশুড়ি ঘর থেকে বলে উঠলো - ' অ বৌমা, তার সাথে দুটো আলুসেদ্ধ দিস রে ,শাকপাতা সেদ্ধ খেয়ে মুখটা একেবারে মেরে এনেছে '। জানে মালতী কচি ছেলেটা এখনো বুকের দুধ খায়-- অনাহারে, অর্ধাহারে থাকা মালতীর যে তাতেও টান। আবার দুশ্চিন্তা হয় ,হাড় জিরজিরে মানুষটা আজ ঠিকমতো কাজ করতে পারবে তো? আবার ভেবে আনন্দ হয়, যাইহোক আজ দুটো খেতে তো পাবে। আস্তে আস্তে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো। আজ যেন সময় আর কাটে না। সে উদগ্রীব হয়ে আছে স্বামীর আসার আশায়।সামনে পূর্ণিমা, আকাশে ভরা চাঁদের আলো। মালতী দেখলো চাঁদের আলোয় ভরা পথ বেয়ে হেঁটে আসছে তার স্বামী , হাতে গামছা বাঁধা পোঁটলা। তার মনে হলো , হেমন্তলক্ষ্মী স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়ের রূপ ধরে আসছেন তাদের কুটীরে। তাড়াতাড়ি উঠোন থেকে নেমে এসে সে পুঁটলিটা হাতে নেয়। মেয়ে দৌড়ে আসে 'বাবা বাবা' বলে -। লক্ষ্মীর ডাক শোনা যায় ঘর থেকে - 'অ মিত্যু এলি বাবা'। মৃত্যুঞ্জয় মাথা-মুখের ঘাম মুছে বললো -'জানিস বৌ ,খুব কষ্ট হয়েছে আজ, তবে সব কষ্ট ভুলে গেলাম ঘরে এসে ,তোদের মুখ চেয়ে। আজ বেশ ভালো করে ভাত,ডাল,আলুসেদ্ধ রাঁধ দিকিনি। গামছার এককোণে একখান পেঁয়াজ আছে, আজ বাবুরা ছাতু দেছিলো, সঙ্গের কাঁচা পেঁয়াজটুক গামছায় বেঁধে নে এয়েচি,আলুসেদ্ধর সঙ্গে বেশ করে মেখে দিস অকণ'।মালতী বললো -'দেবো গো দেবো, আগে এট্টুস জিরিয়ে নাও দিকিনি ,সেই কোন সক্কালবেলা বেইরেছো'। মৃত্যুঞ্জয় দাওয়ায় বসে , বৌ তার জল এনে দেয় খাওয়ার জন্য। আর সে জল খেয়ে পুকুরে যায় হাত -পা ধুতে। 


বেশ কিছুক্ষণ পর- উঠোনে জ্বলছে কুপির আলো , মাটির উনুনে হাঁড়িতে ভাত ফুটছে টগবগ করে , চারিদিক তার সুবাসে ভরপুর। উঠোনে বসে আছে সবাই। ছেলে হামা টানছে। মালতী বসে আছে উনুনের ধরে, মুখে হাসি, চোখে জল। আজ অনেকদিন পর তার পরিপূর্ণ সংসারের ছবি উঠোন জুড়ে। দূরে কোথায় যেন কার ট্রাঞ্জিস্টারে বাজছে রবি ঠাকুরের গান -'চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে , উছলে পড়ে আলো /ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।'


জীর্ণ কুটীরে মালতী যেন কোথায় একাকার হয়ে যাচ্ছে এই গানের সাথে সাথে -- তার উঠোনে যেন আজ সত্যিই চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, চারিদিকে সুখের আলো উথলে পড়ছে। আর সে চাইছে যেন রজনীগন্ধার সৌরভ তার সংসারের অনাগত দিনগুলোকে ভরিয়ে তোলে , সব ঝড়- ঝঞ্জার হাত থেকে তারা যেন রক্ষা পায়। আজ কতদিন পর মৃত্যুঞ্জয় ফিরে পাচ্ছে তার 'মালু'কে -- তার সেই লাজুক মুখের হাসি একচিলতে কুপির আলোয় চাঁদের হাসির মতোই লাগছে। এইভাবেই হয়তো কবির কল্পনায় মালতীরা একাত্ম হয়ে যায়।


 





খড়ের-গাদা

    রীনা মজুমদার


 তোমার আমার দেখা হলো

  বহু বছর পর ! 

মায়ের রোদে দেওয়া কুল

লুকিয়ে মুঠো ভরে চুপটি করে,

   ঠিক তখনই সেখানটাতে !

বাবার মাথার ধানের আঁটি

ঘাম জড়িয়ে পড়ছে মাটির পর! 

তখন আমার কাঁপছে বুক

ভয় পাওয়া এক ছোট্ট পাখির মতো !


বাবা আমায় আদর করে কয়,

"মা, চুরি করেই তো আচার খেতে হয়!

 তোর চোখে দেখছি আমি

 আমার-ই ছেলেবেলার স্মৃতির ঘর।"


তার সাথে দেখা হলো

   বহু বছর পর !

ইচ্ছে করে আবার, লুকিয়ে থাকি

ইচ্ছে করে আবার, করি হুটোপুটি 


সে আমার ছেলেবেলার প্রাণস্পর্শ

 খেলার সাথী 'খড়ের-গাদা' ঘর।  

 


 







চেতনার রাত-দিন

প্রতিভা পাল সেন


তিলে-তিলে বিনষ্ট হওয়া ইচ্ছেগুলো রাত আঁকে মনে-

গভীর রাত; নিস্তব্ধতাও তখন বিকট শব্দে কানে বাজে;

দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া সময়ের লেলিহান চাহনি, ধ্বংসাবশেষ সাজায়;

স্তূপীকৃত-বিষাদের অন্তহীন অধ্যায়, লেখনীর আঁচড়ে মৃতপ্রায়!

রক্তাক্ত অবক্ষয়ের কালসিটে-দাগ উজ্জ্বলতা মাপে;

ভাবনার অসামাজিকতায় রিক্ত অবয়ব!


প্রতিবারই ঘুম ভাঙে আঁধারের, ভোরের অপেক্ষায়;

দুঃস্বপ্নের শিহরণ নিমেষে ভোলার চেষ্টায়, আরও গভীর! 

প্রখর সূর্য-কিরণের উষ্ণতায়, শুকিয়ে নেওয়া ক্ষত-

অস্পষ্ট দাগ ছেড়ে আগামীর জন্য আবার প্রস্তুত, অনেক সংযত! 

কলঙ্ক খোঁজা চোখ, আধখানা চাঁদেও সন্তুষ্ট! 

দুঃসময় শিখিয়ে যায় বোঝাপড়ায়, জীবনের বাস্তব!!



 





মৃত‍্যুর আগমুহূর্ত

তপেন্দু নারায়ণ রায়


দক্ষিণের জানালা দিয়ে মৃত‍্যু

ক্রমে অগ্রগামী

দূরের দিগন্তে কি এক মায়াখেলা

দুঃখ না অমোঘ সুখ!


ঝরে যাওয়ার আগে রহস‍্য আরো গাঢ়

জীবন যেন

খড়ের গাদায় লুকানো সূচ।


 





অন্তহীন 

স্বপন সাহা 


হঠাৎ তোমার সাথে দেখা সেদিন ।

প্রথম দর্শনেই হৃদয়ে উষ্ণতার ছোঁয়া। 

বুঝিনি সেদিন সেই উষ্ণতা স্ফুলিঙ্গের 

আকার নেবে তোমার প্রথম বার্তায়। 

কবে যেন হয়ে উঠেছি একে অপরের পরিপূরক,

পরস্পরের ভালবাসার ছোঁয়ায় ।

কত রাতে স্বপ্ন বুনেছি কত দুজনায় মিলে,

হারিয়ে গিয়েছি স্বর্গের পারিজাত বাগে,

মেঘের ভেলায় চড়ে ।

ভালবাসার কিরণ তার উচ্ছাস ছড়িয়েছে 

মেঘেদের ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে ।

সহসাই একদিন সেই শরতের মেঘ 

ঘোর বর্ষার করাল রূপে নেমে এল 

মহামারীর আকারে ।

তবুও তারা দূরে সরাতে পারেনি আমাদের,

ভালবাসার অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম দুজনেই ।

তবে কেন আজ দূরে যেতে চাও 

এই বন্ধন ছিন্ন করে ?

তুমি তো কখনো যাওনি সরে আমার হৃদয় থেকে;

একটি ক্ষুদ্র মূহুর্তে !


এই আমি, শুধুই তোমার জন্য, 

আছি হাজার বছর অপেক্ষায় !

হয়তো সেই অপেক্ষার অনুভূতির স্রোত,

বিন্দুমাত্র তোমার হৃদয় স্পর্শ করে না ।

তবুও আমি আছি নিশিদিন, ক্লান্তিহীন 

অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে এক অন্তহীন 

অপেক্ষায়, শুধুই তোমার জন্য। 


 





অঘ্রান

                 ‎ সুনন্দ মন্ডল


প্ৰতিটা অঘ্রান এলেই জাগে আঘ্রান

নবান্নের সুরে মাতে বাঙালি।

উৎসবের আমেজ ঘিরে প্রতি পল্লবে

আকাশে বাতাসে দেখো কথাকলি।


ভেজা গলায় আগামীর আঁচ

মাস জুড়ে ধানের গন্ধ।

চাষী থেকে গৃহস্থের আনন্দে

প্রকৃতিতেও নতুন ছন্দ।


সুরে গাঁথা মাসের প্রহর আর কত্থক

সত্যের সন্ধানে শীতল শুভেচ্ছা।

রৌদ্রের বিলাসিতার ছাপ মাটিতে

মানুষের শুধু বেঁচে থাকার ইচ্ছা।


 






ডাইনি

আফতাব হোসেন

আমাদের গ্রামে আজও বুধবার হাট বসে । গ্রামের হাট । বড় হাট । হাটের ঠিক পাশেই যেখানে বাঁশ ডালের ঝুড়ি গুলো নিয়ে কালো কালো পাথরের মত মেয়েগুলো বসে থাকে 20 টাকা জোড়া ঝুড়ি বিক্রি করার জন্য তার ঠিক পাশেই সালকু বসেছিল । দুটো মুরগি নিয়ে । দেশি মুরগি ।খুব টেস্ট । চোখ গুলো পাথরের মত করে একের পর এক খদ্দের কে ফিরিয়ে দিচ্ছিল । কয়েকজন খদ্দেরকে তো বলেও দিল ‘বিক্রি করবোক নাই ,মোর মর্জি ’। 

এই নিয়ে তিনদিন ।

            

                 ⁂⁂⁂⁂


" ভাদু আমার গরবিনী, 

ওগো আমার ভাদুমনি, 

মাথায় দিবো সোনার মুকুট, 

শাড়ি দিবো জামদানী........। "


নিজের মনেই গাইছিল বিহু । বিহু সরেন । সালকুর মেয়ে । ওই যে পুরুলিয়া শহর থেকে ট্রেনে চেপে মেদিনীপুরের আগের যে ছোট্ট একখানি স্টেশন , সরকার নাম দিয়েছে জঙ্গলমহল । আসল নামটা অবশ্য ভাদুতলা । কেউ বলে ভাদুরানী এখানেই জন্মেছিল আবার কেউ বলে ভাদুঠাকুরের আশীর্বাদ আছে জায়গাটার । ওই খানেই একটু দুরেই মোস্তাক চাচাদের যে পাথর খাদান টা যেখান থেকে জঙ্গল শুরু ঠিক সেখানেই বিহুদের ঘর । ঘরে থাকলে রোদটা যখন মাথায় ওঠে তখন সালকু হাঁক পাড়ে

— " বিহু বুড্ডি ঘরে আই লো ,কুছু খ্যাইয়ে লে " ।

 বাবার ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে পালাতে গিয়েও ‘লতা’আর ‘পাতার’ দিকে তাকিয়ে একবার চোখ নাচিয়ে ধমকে দেয় বিহু — 

‘দেখ লতা পাতা মোর মাথা খাবিক নাই, ফিরে আইস্যে যদি দেখতে পাই পুরাটা খাস নাই তালে কিন্তু খারাপ হুবে ’।


                   ⁂⁂⁂⁂



অনিতা বুড়ি চোখে খুব একটা দেখেনা আজকাল । শীতের শুরুটাতেই যখন কুয়াশার দাপট শুরু হয় তখনই বুড়ির হাঁপানির কাশি টা বড্ড জ্বালায় । ঘ্যানর ঘ্যানর আওয়াজে সালকুর বউ এর ঘুমটা মাঝরাতে যখন চটকে যায় ঠিক তখনই সালকুর সোহাগ জাগে । সিংহের হাতে পিষতে দিয়ে হরিণ হয়ে যখন সালকুর সিংহাসনের রানী হয় বিহুর মা তখন কানের সামনে এসে ফিসফিস করে বলে  

" বুড়ির একটো বডিস কিইনা দিস , উদোম গায়ে বুড়ি এই সালের ঠান্ডাটা পেরোতে লারবেক " ।


                  ⁂⁂⁂⁂


সুবল কে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে সালকু বলে 'ইবার একখান কাম দে সুবল , কুনু কাজ পাইনাই তো , তুই পঞ্চদের একজন বটে , বউ মেয়া নিয়া কি না খ্যায়ে মরবক '

সুবল মাঝিও দামড়ে উত্তর দেয় —

"তোরা মারলি কেনে ম্যায়াটাকে ? 

তোদের কে সরকার বাড়ি দিল । কাম দিল । ফ্রি রেশন দিল তাও মারলি কেনে ম্যায়াটাকে ।

 সুবল তোতলিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে বলে ‘বুরাবাবার কসম ,তুই বিশ্বাস কর উহাকে আমরা মারি নাই , উকে ডাইনি খ্যায়েছে , পুরা পাড়া জানে উটাও ডাইনি ছিল বটে , লখখির ম্যায়াটাকে উটাই খ্যায়েছিল ,সুনীল এর সোমত্ত বউ টাকেও উই খ্যায়েছিল । আমরা কুছু বলার আগেই উ নিজেই পুড়েছে। 


'ওসব বলে কুছু হবে নারে , বিডিও বাবু নিজে কেস দেখছে । সব না মিটা মিটি হলে তোর গ্রামের কেউ কাজ পাবেক নাই ' সুবল বলে।


                 ⁂⁂⁂⁂


মোস্তাক চাচার নজর খানি বাদ দিলে লোকটা সালকুদের কাছে ভগবান । সালকুদের পুরা পাড়ার মেয়েরা চাচার পাথর খাদানে কাজ করে । বুড়োর বিয়ে থা হয়নি । উপোষী চোখে মেয়েগুলোকে গিললেও টাকা পয়সার ব্যাপারে ফাঁকি দেয় না । বলে ' আমাগো হল গিয়া মুসল্লিম ঈমান , বুঝলা , এখন চুরি করল্যা আল্লাগো কি মুখ দেখাবু ' । সালকুর বউ কে আবার মাঝে মাঝে দু চার পয়সা বেশি দেয় । বলে ' বুকা এগুলা আমাগো যাকাত বলে , নে নে আমার নেকি হবে বলে চোখ টা একবার বুকে বুলিয়ে নেয় । 


                   ⁂⁂⁂⁂


সকালের পান্তা আর লঙ্কা খাওয়ার পর কাজে যাবার আগে বিহুকে পই পই করে সংসারের সব খুঁটিনাটি বুঝিয়ে যায় সালকুর বউ ।

পুকুর পাড়ে স্নান করার সময় যেদিন নিজের শরীরে রক্ত দেখেছিল বিহু সেদিন থেকেই ও আর বাচ্চা নেই । সংসারে কত্ত কাজ । ঝাঁটা দেওয়া ,উঠোনে গোবর লেপা , তারপর বুড়িকে খাওয়ানো , বাসন ধোয়া , মায়ের জন্য খাবার পৌঁছান , বাপ রে বাপ । চাট্টিখানি কাজ । ভাগ্যিস লতা পাতা আছে । সব কাজেই পায়ে পায়ে ঘোরে ওরা । বিহু মাঝে মাঝে বকুনিও দেয় —

— 'কই রে লতা পাতা এই ঝাঁট দিলাম আর লংরা করিস নি রে তালে তোদের কেটে খাবো ' । 

— ' লতা পাতা খ্যাইলি ' । 

— 'লতা পাতা দেখতো বুড়ি কি করে ' । 

— 'লতা পাতা ঝগড়া করবিক নাই নিজেদের মাঝে তোরা দু বোন না । এইটুকুনি থ্যেকে তুদের পালছি । লড়বিনা একবারে ' ।



                ⁂⁂⁂⁂


আগের বুধবার থেকে মোস্তাক চাচার খাদান বন্ধ । চাচার নাকি করুণা হয়েছে । সবাই বলাবলি করছিল বুড়া আর বাঁচবেনি । আগের সপ্তাহ এর বেতন ও বাকি । কেউ আর ওমুখো হতে সাহস করছেনা । সব্বাই বলছে কাছে যে যাবে সেও মরবে । 

রাতে সালকুর বুকের ওম নিতে নিতে বিহুর মা ই বললো ' হ্যাগো পূজাই কুছু দিবেন না ম্যায়াটাকে , বড় হুছে , একখান বডিস ওর ল্যাগেও লাগবেক , কত্ত আশ কইরে আছে পূজায় লিবে '। সালকু বলে ' পয়সা কুথায় বউ , মোর তো কামই নাই , চাচাও তো দিল নাই কুছু , তবে তোর চিন্তা নাই ,কাল হাট বার , যেমন কইরে হোক সব লিয়ে আসবো '।


                ⁂⁂⁂⁂


তিনদিন চেষ্টা করেও সালকু বিক্রি করতে পারেনি লতা পাতাকে , শুধু বিহুর কথা মনে হয়েছে । আজ জোড়া 600 টাকার লোভ আর ছাড়েনি । 

সব কিনেছে হাট থেকে । সওওব । 

বিহুটা বড্ড খুশি হবে ।



                 ⁂⁂⁂⁂


বাইরে থেকে সুবল মাঝি জোরে জোরে ডাকাডাকি করছে —  

' কি রে সালকু আছিস নাকি , বি ডি ও বাবু নিজে এসেছে , বিহু কে দেখতে , কই রে , অনেক রিপোর্ট গেছে তোর পাড়ার , বের কর বিহুকে , তোদের কুনু চিন্তা নাই , সাহেবরা নিজে আইসেছে '। 


                 ⁂⁂⁂⁂


বিহুর আজ রক্তস্নানের দিন । এক নাগাড়ে রক্ত গঙ্গা বইছে দু পায়ের ফাঁকে । সাথে অনেক দিন না ঘুমানো লাল চোখ খুলে একনাগাড়ে বলেই চলেছে —


“ কই রে লতা পাতা খ্যাইলি, লতা পাতা দেখ তো বুড়ি কি করে , লতা পাতা লংরা করবিনা , তালে তোদের কেটে খাবো ”



ঝরঝর করে কেঁদে ওঠে সালকুর বউ —


“ মোদের ম্যায়াটা ডাইনি হয়ে গেল গো ”





 





সফর এবং শীতট্রেন... 

উদয় সাহা

'এইবার শীতে খুব ঠান্ডা পড়বে '... প্রতি বছর শীত আসবার প্রাক মুহূর্তে বাবা এই কথাটি বলে থাকেন৷ হেমন্তের হিমগর্ভের পরশটুকু পেতেই শুরু হয়ে যায় রাতের বেলা উষ্ণ জলে হাত ধোওয়ার রেওয়াজ। হাত ধোওয়া হয়ে গেলে হাতে পায়ে বোরোলিন মাখতে মাখতে অনেক গল্প করতেন বাবা৷ খাবারের পর একটা সিগারেট মাস্ট ছিল বাবার৷ একসময় খুব ভালো স্মোক রিং বানাতে দেখেছি বাবাকে৷ সে সব দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিন কানে ভেসে আসত নিউকুচবিহার স্টেশনে ট্রেন আসা যাওয়ার শব্দ। সেই ট্রেনের আওয়াজ বাবাকে নিজের শৈশবে নিয়ে যেত। তখন এত রিক্সা টোটো অটো ছিল না। ঠাকুরদার হাত ধরে কনকনে শীতে হাফ প্যান্ট পরে পায়ে হেঁটে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট বা নবদ্বীপধাম। সেখান থেকে হাওড়া কিংবা শিয়ালদহ। বাবার পৈতৃক ভিটে নবদ্বীপ। আর আমারো ট্রেনে করে কোচবিহার থেকে প্রথম বাইরে যাওয়া... ওই নবদ্বীপ৷ সেই সফর ছিল এরকমই এক শীতে৷ 


বাবা যখন বলেন পূর্বস্থলীর কথা, লক্ষীমপুরের কথা, পাটুলির কথা, অগ্রদ্বীপ স্টেশনের কথা, খাগড়াঘাটের কথা, বাজারসৌ স্টেশনের কথা, আমার তখন সেগুলো কেবল স্টেশনের নাম হিসেবেই মনে থাকে। কিন্তু বাবার? বাবার কাছে ছেলেবেলার কাদামাটি আর অতীত ধূসর পাথরকুচি। যাই হোক বাবা গল্প বলে চলেন আর আমি ভাবি ট্রেন মানে তো দূরে যাওয়া। ট্রেন মানে টিফিন কেরিয়ার, ফয়েল প্যাক, রুটি -পরোটা কিংবা লুচি-মাংস। মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙলে 'চায়ে গরম '। হাওয়ায় ফোলানো বালিশ। মশলামুড়িতে নাক উঁচু করা নারকেল একফালি। এই সবকিছু একসঙ্গে আমাকে জড়িয়ে রাখে ট্রেন চলে যাওয়ার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে। সেই শব্দ ঝিমোনোর সাথে সাথে ধীরেধীরে ফুরিয়ে আসত বাবার সেদিনের মত গল্পকথা। 


ট্রেন মানে শুধু দূরে যাওয়াই নয় দৌড়ে যাওয়াও বটে৷ এতগুলো শীত পেরিয়ে গেলেও সুযোগ পেলেই মনটা দৌঁড়ে চলে যায় ফেলে আসা ক্যালেন্ডারে।সহজ সরল গল্পকথার বাবার ছেলেবেলায়৷ ট্রেনে করে উল্টোডাঙা বাবার দূর সম্পর্কের মামাবাড়ি, নয়তো বেলেঘাটা পিসির বাড়ি৷ বাবা বলতেন বটে বিষ্ণুপ্রিয়া হল্টের কথা, কিন্তু আমার কাছে পরিষ্কার হত না। পরিষ্কার হল তখন যখন প্রথম বাবার আঙুল ধরে কোলকাতা যাবার উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে পাঁচ টাকার খয়েরী টিকিট কাটি। এসবই আমার শীতকালীন স্মৃতি৷ শীতকাল এলেই ঘুমের ঘোরে একটা স্বপ্ন-টিকিট পেয়ে গেলেই ব্যস! কু উ উ ঝিক ঝিক ঝিকঝিক... স্বপ্নে কোন ক্রসিং থাকে না। সোজা গন্তব্য। আমি, বাবা জানলার সিট আর খানেক বাদে বাদেই... অ্যাই, চা গরম! ... লেবু চা... ট্রেন থেমে যায় আমাদের বাড়ির উত্তরদিক থেকে আসা শেয়ালের হাঁকে। শীতের রাতে শেয়ালের ডাক অদ্ভুত শোনায়৷ মনে আছে যখন মা এর পাশে ঘুমোতাম। ভয়ে মা কে চেপে ধরতাম৷ মা বলতেন, ভয় নেই বাবা ঘুমো... 


এখন আর ঘুমিয়ে থাকা হয়না। ঘুমের ভেতর ভয় মিশে গেছে। ঘুমের ভেতর বরফ। সেই বরফের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে প্রতিদিন। পালকের টুকরোর মতো বরফ কুচি এসে পড়ছে জ্যাকেটে। ঝাড়ছি। তবু ঝড়ছে না। বাবা নিজেই এখন কাছে ডাকেন৷ পাশে বসি৷ আমি উষ্ণতা পাই৷ বরফের টুকরোর অক্ষর সাজিয়ে একটা শব্দ তৈরি করার চেষ্টা করি। বাবাকে বলি, আগামী শীতে আমরা পাহাড় যাব কিংবা মায়াপুরের নীল মন্দির... বাবা আরো একটু শক্ত করে ধরেন আমার হাতটা।