Sunday, December 6, 2020


 






                   পুরনো প্রেম নতুন কষ্ট

                         কিশোর পণ্ডিত


 স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ডাক পিয়ন এসে একটি চিঠি দিল । একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই ভাবলাম বাড়ি গিয়ে পড়ব । রাতের খাবার খেয়ে চিঠিটা পড়তে বসলাম। । চিঠি পড়ে চমকে উঠলাম । বিন্দু লিখেছে ভারত থেকে । ২৮ বছর পর বিন্দু ! ওর দেওয়া বিরাট নামেই আমাকে সম্বোধন করেছে।সে লিখেছে সে নাকি আমার সম্পর্কে সব জানে । আমি শিক্ষকতা করি , আমার স্ত্রীর নাম দীপা , আমার এক মেয়ের নাম দিগন্তিকা । দ্বিতীয় সিজারে আমার এক মেয়ে মারা গেছে । এবার দীপার তৃতীয় সিজার । কিন্তু ওর সম্পর্কে কিছুই লিখেনি । 

বিন্দু আর আমি ক্লাস সিক্স থেকেই এক সঙ্গে পড়ে আসছিলাম । এইট থেকে ওর চোখে চেয়ে থাকতে ভালাে লাগে । লক্ষ্য করলাম ওর ভাবটাও আমারি মতন ।, ক্লাস টেনে ওঠে ওকে কিছু বলতে ইচ্ছে হল । একদিন সাহস করে কাছে গেলাম । কিন্তু সবকিছু গুলিয়ে গেল । অনেক চেষ্টা করেও মনের কথাগুলাে বলতে পারলাম না । আমার বন্ধু শহীদুল বুদ্ধি দিল সামনা সামনি যে কথাগুলি বলা যায় না সেগুলি চিঠিতে লিখে জানিয়ে দে । তার বুদ্ধিমত একদিন মনের সব কথা লিখে বিন্দুকে দিতে গেলাম । কিন্তু সে চিঠি নিল না । ভাবলাম তাহলে বিন্দু হয়ত আমায় ভালবাসে না । 


আশা ছাড়লাম না । হাতে চিঠি নেয়না বলে একদিন ডাকে চিঠিটা বিন্দুর ঠিকানায় দিয়ে দিলাম । ডাক পিয়ন চিঠিটা তার বাবার কাছে দিয়ে দিল । বিন্দুর নির্লজ্জ বাপ চিঠির বিস্তারিত পড়ে আমাকে শাসিয়ে গেল । বিন্দুর লেখাপড়া স্থগিত করে দিলেন । আমি মাধ্যমিক পাশ করে গেলে বিন্দু একবছর বিরতি দিয়ে মাধ্যমিক পাশ করে । তার পরের বছর বিন্দুরা তাদের গ্রাম বিলাসপুর ছেড়ে সপরিবারে ভারত চলে যায় । বিন্দুর বান্ধবী দিপালীর কাছ থেকে শুনেছিলাম সে নাকি আমাকে খুব ভালবাসত । বিন্দুর বড়বােন ভালবেসে ঘর ছেড়েছিল বলে তার বাবা তাকে দিব্যি দিয়েছিল । সে যদি কোনদিন এমনটি করে তবে সে আত্মহত্যা করবে । এ ভয়ে সে কোনদিন মুখ খােলেনি । নিরবে ভালবেসে গিয়েছে । 


আগষ্টের ১০ তারিখ ২০১৪ সালের সকালবেলা আমার শ্যালক সুজনের সাথে বিন্দু এসে হাজির । কপালে সিঁদুরের ফোটা ছিমছাম গায়ের রং এখনাে আগের মতই ফর্সা আছে । বয়স হলেও বয়সের ছাপ পড়েনি । কত আর বয়স ৪২ কিংবা ৪৩ হবে । বিন্দু আমার দিকে তাকিয়ে রইল । আমিও তার দিকে । আমি তাকে দীপার সাথে পরিচয় করে দিলাম । দীপা আগে থেকেই বিন্দু সম্পর্কে জানত । সে হাসিমুখে তাকে নিয়ে ঘরে গেল । 


রাতে জিজ্ঞাসা করলাম কেমন আছাে বিন্দু ? সে বলল কেমন আর থাকবাে ঈশ্বর যেমন রেখেছেন । আমার সম্পর্কেতাে সব জানো এবার তােমার সম্পর্কে বলাে । বিন্দু বলতে থাকলাে , এদেশ থেকে চলে যাওয়ার পাঁচ বছর পর আমার বিয়ে হয় । ১৬ বছর ঘর করার পরও আমার কোন সম্ভান হয় না । আমার স্বামী রাগ করে নিরুদ্দেশ হয় । চার বছর তার জন্য অপেক্ষা করি । কিন্তু সে আসে না । পরে আমিও বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন তীর্থে সময় কাটাতে থাকি । একদিন বিকাল বেলা বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণের সেই প্রেম যমুনার ব্রীজের উপর দীর্ঘদেহী ব্রহ্মচারী সুজনের সাথে সাক্ষাত এবং পরিচয় । তার মুখ থেকে তােমার সম্পর্কে সব জানি । শেষে সাহস করে তারই সাথে এখানে আসা ।যেহেতু দীপা ৮ মাসের গর্ভবতী তাই বিন্দু সংসারের সকল কাজ একাই সামলিয়ে নিচ্ছিল । দীপার ডেলিভারি ডেট আসল । যেহেতু তৃতীয় সিজার তাই অভিজ্ঞ ডাক্তার এবং ভাল হাসপাতালে নেয়া হল । দীপা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে এ মায়ার সংসার ত্যাগ করল । 


বিন্দুবাসিনী ঐ সন্তানকে লালনপালন করতে লাগল । ধীরে ধীরে এ সংসারে তার মায়া বাড়ল । নতুন আশা জাগলো মনে ।পুরনাে প্রেমিককে আরাে কাছে পেতে চাইল । বহুদিনের পুরনো ভালোবাসার সঞ্চিত সম্মতি আর নতুন মায়ায় পুরনো প্রেমিকাকে কাছে পাওয়ার নিরব সম্মতির নিশ্চিত ভরসায় আমার আত্মীয়রা আমার সাথে বিন্দুর বিয়ের দিন ঠিক করল । 


বিয়ের একদিন আগে বিকালবেলা প্রায় ৫০ বছরের লম্বাটে শীর্ণকায় এক ভদ্রলােক এসে হাজির হল । নাম অবিনাশ । জানতে পারলাম সে বিন্দুর স্বামী । সে তাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছে । একরাত সে এখানে থাকলাে । প্রায় ৫ মাস ধরে বিন্দু এখানে এসেছে আমরা দুজনে আলাদা ঘরে থেকেছি । কিন্তু অবিনাশ বাবু আজ রাতে বিন্দুর ঘরেই থাকলাে । বুঝলাম সে তার অধিকার বলেই এ অধিকার দেখালো । কারণ বিশ বছর আগে কিছু বিবাহের মন্ত্র তাকে বিন্দুর সাথে একত্রে বসবাসের অধিকার দিয়েছিল ।মন্ত্রের অধিকার দূরত্বকেও হার মানালো। সেই ভারত থেকে আমার দেশে এসে আমার ঘরেই অধিকারের ক্ষমতা খাটাল ।সে রাতে আমার ঘুম হল না । জানি বিন্দুরও ঘুম হয়নি । পরদিন সকালবেলা বিন্দু আমার ছেলে শৈশবকে আমার কোলে তুলে দিয়ে বিদায় চাইল । আমি বিন্দুর মুখের দিকে তাকাবার সাহস পেলাম না । তবুও জোর করে তাকাতেই দেখলাম বিন্দুর অশ্রুসজল নয়ন । আমার বুকের বাম কোণায় সদ্য দীপাকে হারানোর ব্যথা আর বুকের ডান কোণায় পুরনো প্রেমিককে না পাওয়ার কষ্ট বুকের মধ্যখানে জমা হয়ে দুচোখ দিয়ে জল হয়ে প্রবল বেগে গড়াতে চাইল। কিন্তু পুরুষ বলে সে জল তরল হয়ে চোখ দিয়ে না ঝরে বরফ হয়ে বুকের পাঁজরে জমে রইল ।তারা সরষেফুলের মাঠের পাশ দিয়ে রেলষ্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছে , আমি তাদের গন্তব্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম।



No comments:

Post a Comment