সুদীপ কুমার বোস
উপলব্ধি
সুমিতা যথেষ্ট সুন্দরী। পড়াশোনায় ভাল ছিল। তাই পড়াশোনা শেষ হবার সাথে সাথেই ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে যায়। সে জন্য অহংকারও কম না। আশেপাশের লোকজনকে একটু অবজ্ঞার চোখেই দেখে। বাড়ি থেকে লোকাল ট্রেনে যেতে এক ঘন্টার মত লাগে। ট্রেনেই যাতায়াত করে, কিন্তু করোনার জন্য ট্রেন বন্ধ থাকায় বাসেই যাতায়াত করতে হচ্ছে। ও সাধারনত ভিড় এড়াতে খুব তাড়াতাড়ি বাস ডিপোতে চলে আসে। এসে যে বাসটা খালি, সেই বাসের জানালার ধারে বসে পরে। অবশ্যই বসার আগে সিট ভাল করে স্যানিটাইজ করতে ভোলে না।
সেদিন বাড়ি থেকে বেরোতে দেরি হয়ে যায়। কোন রকমে বাসে একটা মহিলা সিট পেয়ে যায় কিন্তু জানালার ধারে পেল না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসে পরে। যথারীতি সিটটা স্যানিটাইজ করে নেয়। বাসে প্রচন্ড ভীড়। ওর সিটের পাশেই একজন লোক দাড়িয়েছে। সুমিতা যতটা সম্ভব ছোঁয়া বাঁচিয়ে বসার চেষ্টা করছে। কিন্তু যখনই গাড়ি ব্রেক মারছে তখনই লোকটা হুমড়ি খেয়ে ওর শরীরের ওপর পরছে। ইচ্ছাকৃত কিনা ঠিক বুঝতে পারছে না। যতবারই পরছে ততবারই বিরক্তি আর ঘৃনার চোখে লোকটার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু লোকটা নির্বিকার। যা শুনেছিল তা ঠিকই। মেয়ে মানুষ দেখলেই পুরুষ গুলো ছুকছুক করতে থাকে।
গাড়ি গন্তব্যের দিকে ছুটছে, হটাৎ সামনের দিকে বাজি ফাটার মতো খুব জোরে একটা আওয়াজ হলো। বাসের সামনের লোকগুলো চেঁচিয়ে উঠল, সামনের চাকা ফেটে গেছে। বাসের মধ্যে হুড়াহুড়ি আর ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করেও বাসকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। যারা দাড়িয়ে ছিল তাদের মধ্যে অনেকেই চলন্ত বাস থেকে প্রান বাঁচাতে বাইরে লাফ দিল।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকেও দেখতে পাচ্ছে না। বাস একদিকে কাত হয়ে রাস্তা ছেড়ে ছুটতে শুরু করল। কিছুক্ষন ছোটার পর বাসটা একটা জলাশয়ে পরে গেল। সুমিতা কোনরকমে একটা জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে বাস থেকে বের হবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। বাস আস্তে আস্তে জলে তলিয়ে যাচ্ছে। জল সুমিতার গলা পর্যন্ত পৌছে গেছে। সামনে মৃত্যু জেনে সুমিতা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। হটাৎ অনুভব করে দুটো হাত জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে সূমিতাকে টেনে বার করছে। বের করে পাঁজাকোলা করে তুলে শুকনো জায়গায় এনে শুইয়ে দেয়। এতক্ষণে সুমিতা চোখ মেলে তাকায়। তাকিয়ে দেখে, সেই লোকটাই, যে বাসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে পাড়ে নামিয়ে দিয়েই লোকটা আবার ডুবন্ত বাসের দিকে দৌড়ে যায় অন্য যাত্রীদের বাঁচাতে।
সুমিতার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসে। সেটা প্রাণে বাঁচার জন্য নয়, নিজেকে চিনতে পারার জন্য। পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষই নোংরা হয়না, কিছু পুরুষের হাত দেবতার হাত হয়ে আর্ত মানুষের দিকে এগিয়ে আসে। আজ ওর সমস্ত অহংকার অশ্রু হয়ে দুচোখ বেয়ে নেমে আসে।
@মুজনাই অনলাইন পৌষ সংখ্যা ১৪২৭
No comments:
Post a Comment