Sunday, February 14, 2021

মুজনাই সাপ্তাহিক  









ডুয়ার্স : সামান্য আলোকপাত 
শৌভিক রায় 

আজকাল কথায় কথায় ডুয়ার্স শব্দটির ভীষণ প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। ডুয়ার্সে বেড়ানো নিয়ে হরেক কথা, নানা ধরণের  সূচী, পথের দু`পাশে 'ডুয়ার্সে স্বাগতম' জাতীয় বার্তা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুয়ার্স নিয়ে বহু গ্রূপ ইত্যাদি দেখে ধরে নেওয়া যায় যে, ডুয়ার্স সম্পর্কে সকলের কমবেশি জানা আছে। কিন্তু একটু বিশদে গেলে দেখা যায় যে, ডুয়ার্স ব্যাপারটি কি সে সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশেরই কোনো ধারণা নেই। আর এই দেখানদারির যুগে দার্জিলিং বা কার্শিয়াং পাহাড়ে গিয়ে ছবি তুলে 'ডুয়ার্সে বেড়ানো` শীর্ষক অ্যালবাম হরদম দেখে সত্যি হতাশ হই এই ভেবে যে, আমরা চিরদিন হুজুগেই মেতে রইলাম, কোনো কিছুর ভেতরে ঢুকবার চেষ্টা করলাম না। 

ডুয়ার্স আদতে কী ? কোথা থেকেই বা এল এই শব্দটি? এর জন্য একটু ভুগোল ও ইতিহাস জানা দরকার। 
ডুয়ার্স শব্দটি আসলে এসেছে ইংরেজি 'ডোর' (দরজা) বা হিন্দুস্থানী 'দ্বার`শব্দটি থেকে। ডোর বহুবচনে হয় 'ডোরস'। 'দ্বার`-এর সঙ্গেও 'এস' যোগ করে ইংরেজরা দিব্যি 'দ্বারস' বলে চালাতো। কালক্রমে সেই শব্দই ডুয়ার্স-এ পরিণত হয়। কিন্তু কিসের দ্বার বা দুয়ার? ভুটান থেকে সমতলে আসবার জন্য ভুটানিরা মোট ১৮টি গিরিপথ ব্যবহার করত। এই ১৮টি গিরিপথের মধ্যে কিছু ছিল বাংলায় আর বাকি আসামে। মোটামুটিভাবে তিস্তা নদীর পূর্ব থেকে আসামের ধানসিঁড়ি নদী পর্যন্ত এই দুয়ারগুলির বিস্তার ছিল। একটু দেখে নেওয়া যাক এই ১৮ দুয়ারের অবস্থান- 
১/ ডালিমকোট (বর্তমান কালিম্পঙ জেলায়), ২/ ময়নাগুড়ি বা জুমের কোর্ট (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলায়), ৩/ চামুর্চি (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলায়), ৪/ লক্ষী বা ল্যাককি (বর্তমান জলপাইগুড়ি জেলায়), ৫/ বক্সা বা পাশাখা (বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলায়), ৬/ ভল্কা বা ভুলকা (বর্তমান আলিপুদুয়ার জেলায়), ৭/ বরা (বর্তমান আসামের কোকরাঝাড় জেলায়), ৮/ গুমর ( বর্তমান আসামের কোকরাঝাড় জেলায়), ৯/ রিপো (বর্তমান আসামের কোকরাঝাড় জেলায়), ১০/ চেরাং ( বর্তমান আসামের কোকরাঝাড় জেলায়), ১১/ বাগ বা ছোট বিজনি (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১২/ বুড়িগুমা (বর্তমান আসামের দরং জেলায়), ১৩/ কালিং (বর্তমান আসামের দরং জেলায়), ১৪/ শুরকুল্লা (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১৫/ বংসকা (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১৬/ চাপাগুড়ি (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১৭/ চাপাঘামা (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়), ১৮/ বিজনি (বর্তমান আসামের কামরূপ জেলায়)। এখানে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রথম ১১টি স্থান ব্রিটিশ আমলে বেঙ্গল ডুয়ার্স ও বাকি ৭টি জায়গা আসাম ডুয়ার্স নাম পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ আর এভাবে ভাগ করা হয় না। বরং সংকোশ নদীকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বিভাজনকারী নদী হিসেবে ধরে নিয়ে সংকোশের পশ্চিম থেকে তিস্তা নদীর পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগকে ডুয়ার্স বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। 

এই বিস্তীর্ণ ভূভাগ কিন্তু একটা সময়ে গহন অরণ্যে ঘেরা ছিল। হিংস্র পশু, খরস্রোতা নদী, অবিরাম বৃষ্টি এবং প্রায় জনমানবহীন এই ভূখণ্ড নিয়ে ইংরেজদেরকে খুব কিছু মাথা ব্যথা ছিল না। তাই তারা তাদের এই অঞ্চলে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রথমদিকে সেভাবে মনোযোগী হয় নি। কিন্তু তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যের সূচনা হলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চল সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বাড়ে। কালিম্পঙ সে সময় সিকিমের অংশ ছিল এবং কালিম্পঙের মধ্যে দিয়ে তিব্বতে পৌঁছনো যেত। ১৭০৬ সালে ভুটান রাজ্ সিকিমের হাত থেকে কালিম্পঙকে ছিনিয়ে নেন। ভুটানের সঙ্গে যেহেতু তিব্বতের সুসম্পর্ক ছিল, তাই ব্রিটিশরা ভুটানকে চটাতে চায় নি নিজেদের স্বার্থে। এদিকে তিস্তা নদী থেকে  সংকোশ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগ কোচবিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, ধীরে ধীরে সেগুলিও ভুটান দখল করে। মাঝে কেটে যায় অনেকগুলি বছর। ইংরেজরা ক্রমশ কোচবিহারের গুরুত্ব বুঝতে পেরে কোচবিহারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং অবশেষে ১৮৬৫ সালে সিনচুলা সন্ধির মাধ্যমে ভুটানের হাত থেকে একটি বিরাট অঞ্চল নিজেদের দখলে নেয় যার মধ্যে ছিল কালিম্পঙ, রংপুর, কামরূপ জেলার সীমা অবধি অংশ। 

এই দখলে নেওয়ার পেছনে ইংরেজদেরকে ব্যবসা-বুদ্ধি কাজ করেছিল। সেটি কী তা জানতে হলে আর একটি দিকে আলোকপাত করতে হবে। কেননা যে ইংরেজরা ১৭৭৫ সালেও মনে করছে যে, এই অঞ্চল নিজেদের দখলে নেওয়া মানে বোকামি করা, সেই ইংরেজরা হঠাৎ করে ৫০/৬০ বছর যেতে না যেতে না যেতেই কেন এই অঞ্চল সম্পর্কে এত উৎসাহী হয়ে উঠল? শুধু কি তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্য একমাত্র লক্ষ্য ছিল? নাকি আরও কিছু? অনুসন্ধান করা যাক সেই কারণ। 

সবুজ সোনা বা চা একটা সময় ছিল শুধুমাত্র চিনের নিজস্ব উৎপাদন। চীন সম্রাট শেঙ যে পানীয় খেয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন তা ছিল চা। চতুর্দশ শতকে সমগ্র চিনে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।   সপ্তদশ শতকে ইউরোপিয়ান অভিযাত্রীদের হাত ধরে চা পৌঁছে যায় ইউরোপে। উষ্ণ এই পানীয়টি ইউরোপ অত্যন্ত সমাদর পায়। ইংল্যান্ডে চা প্রায় জাতীয় পানীয়ের পরিণত হয়েছিল। ১৮৩৩ অবধি ইংল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চিন থেকে ইউরোপে চা-চালানে একচেটিয়া রাজত্ব করত। কিন্তু এরপর ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানি এসে গেলে তাদেরকে কড়া মোকাবিলার সম্মুখীন হতে হয়। ইতিমধ্যেই কিন্তু ব্যবসায়ী ইংরেজরা ভাবতে শুরু করেছিল যে, যদি তাদের অধীনে চা-বাগান থাকত তবে তাদের মুনাফা নিয়ে ভাবনা থাকত না। সেসময় ইংরেজদের ভাগ্যলক্ষ্মীও সহায় ছিল।হয়ত সেই কারণেই, ১৮২৩ সালে মেজর রবার্ট ব্রুস আসামের জঙ্গলে চা-গাছ আবিষ্কার করেছিলেন। ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে, ধূর্ত ইংরেজরা ১৮২৫ সালে দ্রুত আসাম দখল করে চা-চাষে উদ্যোগী হয়। তাদের উদ্যোগ সফল হয় ১৮৩৮ সালে।  সে বছর লন্ডনের আন্তর্জাতিক নিলামে আসামের চা বিক্রি হয় এবং সুগন্ধের জন্য অচিরে সেই চা ইউরোপ সাড়া ফেলে। এর ফলে আসামের চায়ের এক নতুন দিগন্ত খুলে যায় ও দলে দলে ইংরেজ আসামে আসতে শুরু করে। আসাম তার চায়ের জন্য পৃথিবী-বিখ্যাত হয়ে ওঠে।  

এদিকে ১৮৪১ সালে ডঃ ক্যাম্পবেল দার্জিলিঙে নিজের বাড়িতে খানিকটা শখেই চা-গাছ পুঁতেছিলেন। সেই গাছ তরতরিয়ে বেড়ে ওঠায় ইংরেজরা বুঝেছিল যে, দার্জিলিঙের মাটি ও আবহাওয়া চা-চাষের অনুকূল। তাই দার্জিলিঙের সিভিল সার্জেন মেজর গ্রামলিনের হাত ধরে দার্জিলিঙে একের পার এক চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ডুয়ার্সের মাটিও যে চা-চাষের অনুকূল সেটা বুঝতে ইংরেজরা বুঝতে পারে নি বলে  ডুয়ার্স এইসব ব্যাপার থেকে তখনও অনেকটা দূরে ছিল। অবশেষে ১৮৭৪ সালে ডুয়ার্স অঞ্চলে যখন চা-চাষে সাফল্য এলো, তখন ডুয়ার্সের গভীর জঙ্গল কেটে শুরু হল চা-বাগান প্রতিষ্ঠার কাজ। মাত্র কয়েক বছরেই ডুয়ার্সের নানা অঞ্চলে গড়ে উঠলো ১৯টি জনপদ শুধুমাত্র চা-বাগানকে কেন্দ্র করে। আর চা-বাগান তৈরির কাজে ছোটনাগপুর, নেপাল ও সিকিম থেকে নিয়ে আসা হল শ্রমিকদের। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ডুয়ার্সের চা-শ্রমিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকেরা। বাকি ২০ শতাংশ শ্রমিক নেপাল ও সিকিম থেকে আনা হয়। অদ্ভুতভাবে ডুয়ার্সের নিজস্ব আদিবাসী  সম্প্রদায়ের মানুষেরা কিন্তু চা-শ্রমিকের কাজে নিযুক্ত হন নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চা-বাগানের ইতিহাসে সেখানকার স্থানীয় মানুষেরা যোগ দিচ্ছেন না এরকমটা কিন্তু দেখা যায় না। 

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ডুয়ার্সের ইতিহাস মূলতঃ চা-বাগান কেন্দ্রিক। একসময়ের ঘন অরণ্য যেমন চা-বাগান তৈরিতে কাটা হয়েছে, তেমনি বনজ সম্পদের লোভে বানিয়া ইংরেজরাও সেই অরণ্য বহুল অংশে নষ্ট করেছে। তবে এটা ঠিক যে, তাদের হাতে প`রেই ডুয়ার্স ভারত তথা পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা পেয়েছে। ডুয়ার্স সম্পর্কে  সাধারণ মানুষের আগ্রহও বেড়েছে। দেশবিভাগ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ সারা দেশের সঙ্গে ডুয়ার্সকেও নিতে হয়েছে। ফলে আরও কমেছে অরণ্যভূমি। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দূষণ বেড়েছে। ট্যুরিজমের নামেও কম নষ্ট হয় নি ডুয়ার্সের সৌন্দর্য ও সরলতা। চা-বাগানগুলির ধুঁকতে থাকা চেহারা ও তার সঙ্গে আদিবাসীদের দারিদ্র ও দুরাবস্থা ডুয়ার্সের অপূর্ব চিত্রের একদম বিপরীতে থাকা অসহায় এক ছবি। এখানকার জানা-অজানা অজস্র নদীও আজ নাব্যতা হারিয়ে বা বাঁধ নামক মনুষ্য-সৃষ্ট বাধায় স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে দিশেহারা। কমেছে বৃষ্টিপাতের পরিমান। আবার কখনও অতিবৃষ্টিতে বিপন্ন হচ্ছে ডুয়ার্সের জীবন। জঙ্গলে খাবারের অভাব হেতু পশুদের লোকালয়ে আগমন আজকাল প্রায় নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ডুয়ার্সের বিভিন্ন অরণ্যে আজ আর বাঘ নামক ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাণীটিকে দেখা যায় না। 

তবু ডুয়ার্স আমাদের গর্ব, আমাদের স্বপ্নের এক জায়গা যেন। কিন্তু যখন ডুয়ার্সের নাম করে না জানা তথ্য বা ঘটনা পরিবেশিত হতে দেখি তখন কষ্ট হয় বৈকি! উত্তর-সহ পশ্চিমবঙ্গের একটি বিরাট অঞ্চলের ফুসফুসের কাজ করা ডুয়ার্স যদি রক্ষা না পায়, তবে উত্তরের নীলপাহাড়, বেগবতী নদী, সবুজ অরণ্য আর সহজ-সরল মানুষের উত্তরবঙ্গ তার সবকিছুই হারাবে।        

No comments:

Post a Comment