মুজনাই সাপ্তাহিক
বর্ষপূর্তি সংখ্যা
সম্পাদকের কথা
তাঁকে নিয়েই ও তাঁর জন্যই আমাদের যাপন। তাঁর জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে কিছু বলতে পারা মানে ধন্য হওয়া। মুজনাই সেই সুযোগ কোনভাবেই নষ্ট করতে চায় না। তাই মুজনাইয়ের সাপ্তাহিক সংখ্যায় এবার শুধুমাত্র তিনি।
পাশাপাশি আর একটা কথা না বললেই নয়। মুজনাই সাপ্তাহিক এক বছরে পা দিল তাঁর জন্মদিনেই। গত শতকের আশির দশক থেকে বয়ে চলতে শুরু করেছিল যে ছোট্ট মুজনাই আজ তা পল্লবিত সারা বছর ধরে মুদ্রিত নানা সংখ্যায়, ফোল্ডারে, ট্যাবলয়েডে, অনলাইন মাসিক পত্রিকায়, এমনকি সাপ্তাহিকেও। এবাদেও, মুজনাইয়ের বন্ধুরা জানেন যে, বিশেষ বিশেষ দিনেও মুজনাইয়ের নানা কর্মকান্ড চলে। সকলের সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া কোনভাবেই এই বিপুল কর্মযজ্ঞ সম্ভব ছিল না। ধন্যবাদ তাই সবাইকে। আর এই বিশেষ দিনে প্রণাম প্রাণের মানুষটিকে।
যাঁরা আছেন এই সংখ্যায়
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী, শ্রাবণী সেন, গৌতম চক্রবর্তী, রীনা সাহা,
কবিতা বণিক, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ মাজি, রীনা মজুমদার,
পার্থ সারথি চক্রবর্তী, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, মৌসুমী চৌধুরী,
চন্দ্রাণী চৌধুরী, অশোক কুমার রায়, বিজয় বর্মন,
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত, উমা শঙ্কর রায়, রীতা মোদক,
সৌমেন দেবনাথ, মুহাম্মদ জাবেদ আলী, মজনু মিয়া,
অভ্রদীপ ঘোষ, রেবন্ত সেন, প্রসেনজিৎ দাস,
সোমনাথ বণিক, সম্প্রীত সরকার, দেবাঞ্জনা রুদ্র,
অনুস্মিতা বিশ্বাস, সম্পূর্ণা নন্দী, সৃজা রায়, নীলাদৃতা বর্মন
মুজনাই সাহিত্য সংস্থা
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রচ্ছদ- পরেশ সাগ্নিক বেরা
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন বৈশাখ সংখ্যা ১৪২৮
অভ্রদীপ ঘোষ
মননে রবীন্দ্রনাথ
একখানি পুরাতন গল্প
মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী
গ্রামের নাম কুসুমপুর । এই গ্রামে একটি ক্ষুদ্র পোস্ট অফিস ও একখানি প্রাইমারী ইস্কুল আছে । অদ্য পোস্টমাস্টারের নামে একখানি পোস্টকার্ড আসিয়াছে। তিনি বহুবার সেটি পাঠ করিবার পর এখন অন্যমনস্কভাবে উদাস হইয়া বসিয়া আছেন। তাঁহার সাহায্যকারী পাঁচু একবার উঁকি মারিয়া পত্রখানি পড়িয়া লইলো।
শ্রীচরণেষু দাদাবাবু ,
তুমি উলাপুর ছেড়ে যাবার পর খুব মন খারাপ লাগতো। নতুন দাদাবাবুর কাজ করতুম। তিনি দেবতার মতো একজন মানুষ। আমাকে লেখাপড়া শেখালেন, আশ্রয় দিলেন, যেহেতু আমার বাবা-মা নেই, তাই যাবার আগে নিজের টাকা-পয়সা খরচ করে আমাকে বিয়ে দিয়ে গেলেন! এখনও আমার খোঁজ নেন। শুনলাম তুমি কুসুমপুর গ্রামে পোস্টমাস্টার হয়ে এসেছো দাদাবাবু? পাশের গ্রামেই আমাদের বাড়ি, গ্রামের নাম মালিকাপুর! একদিন তোমার পায়ের ধুলো দিও আর খোকাকে আশীর্বাদ করে যেও। নিচে আমার ঠিকানা দিলুম । প্রণাম নিও ।
ইতি----
রতন । ( রতনমণি পাল )
প্রযত্নে : রাখাল পাল
পালপাড়া , মালিকাপুর , জেলা : রংপুর
এই সামান্য কথা কয়টি বুঝিবার জন্য পোস্টমাস্টারকে এই চিঠিখানি এতবার কেন পড়িতে হইল ইহা ভাবিয়া পাঁচু ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া গেল !
চেতনায় রবীন্দ্রনাথ
"বহিরাগত রবীন্দ্রনাথ"
রীনা সাহা
"মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক..." পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের প্রাক্কালে বহিরাগত এক অবাঙালি রাজনীতিক তার জনমোহিনী ভাষণে ভুলে ভরা রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত ক'রে তার রবীন্দ্রপ্রেম এবং সংস্কৃতিমনস্কতা জাহির করে ভোট বৈতরণী উতরে যেতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।অন্যদিকে বিশ্বভারতীর সর্বোচ্চ পদে আসীন, রবীন্দ্র শিক্ষায় পরিপুষ্ট এক বাঙালি শিক্ষাবিদের করা অদূরদর্শী মন্তব্যে বিশ্ববন্দিত জাতি হিসেবে বাঙালিকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে যাওয়া বিস্মৃতপ্রায় রবীন্দ্রনাথ এ যুগের সংস্কৃতিক্ষয়িষ্ণু শিশু-কিশোর-যুবসমাজের চোখে "বহিরাগত" হয়ে গেলেন। সে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে সার্ধশতবর্ষ পেরোনো রবীন্দ্র উৎসবে মেতে ওঠবার আগে , বাঙালির আনন্দযজ্ঞে রবীন্দ্রনাথকে সামিল করবার আগে নীচের প্রশ্ন দুটি অতি অবশ্যই আলোচনার দাবী রাখে---
কোন মানুষগুলির সঙ্গে মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বহিরাগত বলা হল ? তাদের কোন কাজের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ বহিরাগত ?
আলোকবর্ষ দূর থেকেও যাঁর কলমের প্রজ্ঞা ঝলসে দিতে পারে পরমাণুুসম পৃথিবীর মানুষের বোধ, বুদ্ধি এবং শিক্ষা---সেই তিনি,স্থিতধী তিনি, রবীন্দ্রনাথ তিনি, বিবেকহীন পরাকাষ্ঠায় সজ্জিত মননের "বহিরাগত" তকমায় সামান্য হলেও কলঙ্কিত । পৃথিবীর অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয় গুলির পাশে স্থান করে নেওয়া, তাঁর যাবতীয় জীবনসঞ্চয় এবং সুকৃতি ব্যয়ে নির্মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কি তবে এক বহিরাগতর স্বপ্ন ফানুস? শিক্ষাকে সংকীর্ণতার শেকলমুক্ত, শাশ্বত ফিনিক্স বানাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ঋণ জর্জরিত এক শিক্ষাব্রতী কি তবে সত্যিই বহিরাগত? বহিরাগত একজন মানুষের ছত্রছায়ায় লালিত কৃষ্টিশীল বাঙালি, কালের বিকাশ এবং প্রগতির জোয়ারে আত্মম্ভর রোবটীয় রূপান্তরে এক লহমায় ভুলে গেল "Our culture,their culture" ? সত্যিই কি তবে আমরা বাঙালি হয়েই থেকে গেলাম , রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষ হলাম না ?
রাতের চেয়েও দুর্ভেদ্য এক অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নন এমন এক ব্যক্তির জন্মদিনে, তাঁর সৃষ্টিসুধায় ভিজে জয়ধ্বনির নিনাদে আকাশ-বাতাস মুখরিত করবার আগে, তাঁর আসমুদ্র-হিমাচল প্রমাণ সৃষ্টি এবং অবিনশ্বর আত্মার কালিমালিপ্ত হওয়ার বিষয়টি বড় ভাবনার এবং এ যুগের নিরিখে তাঁর গুরুত্ব অথবা প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা খতিয়ে দেখবার আবেদনেই এ বিষয়টির অবতারণা।
বাংলা বা ইংরেজি, কোনও মাধ্যমেই পড়াশোনা না করা রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের যে কোনও শাখা, বিজ্ঞান, ইংরেজি,চারুকলা, সঙ্গীত,ভাস্কর্য সব বিষয়ে বাগাড়ম্বর প্রদর্শনীর এ যুগের থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন , তা জানতে অতি বড় ডুবুরীও হাবুডুবু খেয়ে তলিয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। ঠিক এ জায়গাটিতেই আমাদের উচ্চমার্গীয় রবীন্দ্রানুরাগী ব্যক্তিত্বদের দায়বদ্ধতা থেকে যায় তাঁকে খুঁজে আনবার কিংবা যায় না। হাইটেক প্রজন্মের শিশু-কিশোর-যুবকদের চেতনার রাজ্যে রবীন্দ্রনাথকে পরিচিতি দেবার এবং জানাবার, নতুবা অতি কুরুচিকর "বহিরাগত" শব্দে ভূষিত করে তাঁকে পুরোপুরি ডিলিট করবার দায়ভারও তাই আমাদের। আমরা কোনটা করবো তা ভেবে দেখবার অনুরোধে এ বিষয়টির উপস্থাপনা।
Digitally, scientifically, technically nurtured and nourished যান্ত্রিক শিশুদের অযান্ত্রিক উৎকর্ষতা বাড়াতে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানমনস্কতা, অর্থনীতির জ্ঞান এবং জাতীয়তাবোধের সুস্পষ্ট ধারণা কতটা কাজের কিংবা অকাজের সেকথা আইনস্টাইন প্রসঙ্গে তাঁর লেখা article টিতে খানিকটা আন্দাজ করা যায়। আমরা আমাদের সন্তানদের সেটি পড়ে দেখতে বলবো কি না, অবশ্যই ভেবে দেখবার অবকাশ রয়েছে। আজকের মারিবিদ্ধস্ত পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ মানবসম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ । আগামীদিনে এদের শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রয়োজন আছে কি না , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলির অপরিহার্যতা থাকবে কি না , তৃতীয় বিশ্বের এই আমাদের গরীব দেশ , ভোগবাদী রাজনীতি এবং ধার্মিক কুসংস্কারে খোকলা এই আমাদের দেশ , চূড়ান্ত pandemonium পরিবৃত এই আমাদের দেশ এবং দেশের সুচতুর মাথারা কি ভাবছেন তা পুরোপুরি ধোঁয়াশায়। কচিকাঁচা শিক্ষার্থীদের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস boost up করতে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া বহিরাগত রবীন্দ্রনাথের উপমা আপাতত দেওয়া যায় কি না, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেবার কাজটি রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর পুণ্য লগ্নে মনে রাখবার জন্য এ বিষয়টির অবতারণা। জমিদার রবীন্দ্রনাথের যুগে আইফোন, ট্যাব , স্মার্টফোন ছিল না , ছিল না আরও অনেক প্রমোদবিলাস, না থাকার সে তালিকা দীর্ঘ। তবু ছিল কিছু। ছিল "চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে" দেখবার চোখ, তুলি হাতে তেপান্তরের মাঠ এবং পক্ষীরাজ ঘোড়া আঁকবার কিশলয় আঙ্গুল, "জল পড়ে পাতা নড়ে" বুঝবার বোধ, ভৃত্যদের সাহচর্য এবং পরিচর্যায় সাবালক হয়ে ওঠা "পুরাতন ভৃত্য" কবিতায় স্বনির্ভর অক্ষর জ্বালাবার স্পর্ধা। এতসব অলঙ্কার এবং অহংকার ভূষিত রবীন্দ্রনাথ কেন বলবেন আজ " ....আমি তোমাদেরই লোক"? কেন তাঁকে বলতে হবে "আমি শুচি আসন টেনে টেনে বেড়াব না বিধান মেনে/ যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারি ছাপ বক্ষে মাগি/ আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী "?
আজ থেকে শতবছর পরে কোনও এক E-Book পড়া কিশোর বা কিশোরী তাদের প্রপিতামহের ঘুণধরা কাঠের আলমারির তাকে অতি বৃদ্ধ, ন্যুব্জ, ন্যাবা রোগাক্রান্ত 'গীতবিতান' অথবা নোবেলজয়ী 'গীতাঞ্জলি' খুঁজে পেয়ে নিজেদের বাবা-মায়ের কাছে সমগ্রদুটির লেখক, আদিকথা এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে যদি জানতে চায় বা বুঝতে চায়? তবে তাকে জানানো বা বোঝানোর কাজটি রবীন্দ্রনাথের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সংশয়ে থাকা এই আমরা সার্থকভাবে করতে পারবো তো? যদি না পারি তবে? প্রযুক্তির আত্মম্ভরিতায় flatulent, তাঁকে স্বীকার বা অস্বীকার করবার দ্বিধায় দোদুল্যমান এই আমাদের দেখে "মহাবিশ্বে, মহাকাশে,মহাকাল..." থেকে দীর্ঘকেশী, শুভ্র শশ্রূগুম্ফ শোভিত, জোব্বা পরিহিত একাকী ভ্রাম্যমাণ এক "বহিরাগত" অতিমানব মুচকি হাসবেন নাকি বিষাদে মূহ্যমান হয়ে আমাদেরই অদূরদর্শিতায় বেড়ে ওঠা ধর্ম এবং মহামারী বিষে বিষাক্ত বিষবৃক্ষ এক দেশের সামনে নতশির হিমালয় হয়ে দাঁড়িয়ে বলবেন---
"... I bitterly wept and wished that I had had the heart to give thee my all" !!
নিবন্ধে রবীন্দ্রনাথ
রসময় রবি ঠাকুর
কবিতা বণিক
রবি ঠাকুরের রসবোধ ও তার তাৎক্ষণিক প্রয়োগ মানুষের মনে এক অনাবিল আনন্দ যোগাত। সে আনন্দ মানুষকে উৎসাহ দিত। অন্তরের কোন ঘাটতি যেন মূহুর্তে উড়ে যেত। মানুষের মনের মেঘ কেটে রবিকরোজ্জ্বল হয়ে উঠত। এমনি দু একটা ঘটনার উল্লেখ করছি।
একবার গ্রীষ্মকালে কবি শুয়ে আছেন। মহাদেবকে ডেকে বললেন " ওরে চাঁদ টা ঢেকে দে তো! ঘুম আসছে না।" মহাদেব ভেবে অস্হির। কবি বললেন " পারছিস না তো! আচ্ছা এক কাজ কর আমার মাথার কাছের জানলাটা বন্ধ করে দে।" মহাদেব কবির কথায় জানলা বন্ধ করতে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। কবি বললেন " কি রে? হল এবার? চাঁদ ঢাকা পড়ল?"
শান্তিনিকেতনে এক মহিলা রবি ঠাকুরকে পিঠে বানিয়ে খাওয়াতেন। একদিন সেই মহিলা রবি ঠাকুরকে বললেন পিঠে কেমন হয়েছে তার এক সার্টিফিকেট চাই। রবি ঠাকুর বললেন-
নেহাৎ যদি শুনতে চাও বলি
লোহা কঠিন পাথর কঠিন
তাহার কঠিন ইষ্টক
তাহার অধিক কঠিন কন্যে,
তোমার হাতের পিষ্টক।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটক বা উপন্যাস সর্বদা শান্তিনিকেতনে গুণীজনের সমাবেশে পড়ে শোনাতেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও এই আসরে আসতেন। একবার জুতো চুরির ঘটনা শুনে তিনি তাঁর নুতন জুতোজোড়া কাগজে মুড়ে বগল দাবা করে আসরে আসলেন। রবি ঠাকুর তাকে বললেন- " শরৎ তোমার বগলে এটা কি? পাদুকা পুরাণ?" এ কথা শুনে আসরের মধ্যে শুরু হল প্রচণ্ড হাসাহাসি।
এমন মহামানবের জীবনের এত ঘটনা, এত দিক আছে তার একাংশও তুলে ধরা খুবই কঠিন ব্যাপার। এমন রসালো মহাজীবনের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ প্রণাম।
রবীন্দ্রনাথের লোকসাহিত্য প্রীতি শ্রাবনী সেনগুপ্ত
রবীন্দ্রনাথ দেশ ও লোকসমাজ কে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।তাই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে,দেশের ভাষা ও ভাবকে,ব্রাত্যজনের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা না করলে,তাকে ভালো করে না জানলে দেশকে জানা যায়না।রবীন্দ্রনাথ বাংলার গ্রামসমাজকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন,সেখানকার লোকসমাজকে অন্তরঙ্গভাবে জেনেছিলেন।তাই তাঁর মনের মধ্যে এই উপলব্ধির জাগরণ ঘটেছিল।এই গ্রামসমাজকে তিনি ভালোবেসেছিলেন,দেশ অর্থে তিনি বুঝেছিলেন গ্রামীণ ভারতবর্ষকে।তাঁর সংবেদনশীল মন দিয়ে তিনি লোকসমাজের সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ গ্রাম গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে লোকমানসের পরিচয় পেলেন, তাদের মানসিক সম্পদের পরিচয় পেয়ে বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন।গ্রামীণ জীবনে উন্নত লোকসাহিত্যের পরিচয় পেয়ে তিনি সেগুলি সংগ্রহ করে নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতি তে বিশ্লষণ করলেন।তাঁর বিপুল সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে আমরা লোকঐতিহ্যের অসংখ্য উপাদান সংগ্রহ করতে পারি।তাঁর রক্তে-চিন্তায়-মননে শিশুকাল থেকে লৌকিক ভাবনা সক্রিয় ছিলো,যা পরবর্তীকালে গ্রামীণ মানুষের সাহচর্যে আরও বাস্তবায়িত হয়।
১৩১৪ সালের ২০শে ভাদ্র দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের 'ঠাকুরমার ঝুলি'গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন-'স্বদেশের দিদিমা কোম্পানি একেবারে দেউলে'।কোথায় গেল রাজপুত্র পাত্তরের পুত্র,কোথায় বেঙ্গমা,বেঙ্গমী,কোথায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের সাত রাজার ধন মাণিক।বিলাতের রূপকথায় সেদিনের শিশুদের মন ভরাতে হয় বলে তিনি দুঃখ করেছিলেন। ছেলেবেলার স্মৃতি উজ্জ্বল ছিল বলেই তিনি জানতেন যে,বাঙালি শিশুরা যখন রূপকথা শোনে,তখন শুধু গল্প শুনেই সে সুখী হয়না,সমস্ত বাংলাদেশের চিরন্তন স্নেহের সুর তার তরুণ চিত্তের মধ্যে প্রবেশ করে তাকে বাংলার রসে উজ্জীবিত করে।১৩৪৪ সালের আষাঢ় মাসে কবির লেখা 'বালক'কবিতায় কবি তাঁর ছেলেবেলার মানসিকতা প্রকাশ করেছেন।লোকসাহিত্য র ভাবনা এর মধ্যে বিধৃত রয়েছে।রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন সাত আট বছর,অন্যের মুখে শোনা ছড়া আওড়াতেন তার মধ্যে নিজের তৈরি দু 'একটি শব্দও জুড়ে দিতেন।১৩২৮ সালে র আশ্বিন মাসে 'রাজপুত্তুর'-এ লিখলেন-পৃথিবীতে আর সকলে টাকা খুঁজছে, নাম খুঁজছে,আরাম খুঁজছে-আর যে আমাদের রাজপুত্তুর সে দৈত্যপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছে।তুফান উঠলো,নৌকা মিলল না,তবু সে পথ খুঁজছে।এইটেই হচ্ছে মানুষের সব গোড়াকার রূপকথা আর সব শেষের।পৃথিবীতে যারা নতুন জন্মেছে দিদিমার কাছে তাদের এই চিরকালের খবরটি পাওয়া চাই যে,রাজকন্যা বন্দিনী,সমুদ্র দুর্গম,দৈত্য দুর্জয়,আর ছোট মানুষ টি একলা দাঁড়িয়ে পণ করছে-'বন্দিনীকে উদ্ধার করে আনব। 'ছিন্নপত্রাবলীর ১৮০ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ ছেলেবেলার এই অনুভূতির কথা আবার প্রকাশ করেছেন।জ্যোৎস্না রাতে যখন চরে বেরান,তখন তিনকড়ি দাসীর কথা তাঁর মনে পড়ে। "ছেলেবেলায় সেই রাত্রে তিনকড়ির এই একটি কথায় আমার মনটা ভারি চঞ্চল হয়ে উঠেছিল-প্রকাণ্ড মাঠ ধূ ধূ করছে,তারই মধ্যে ধবধবে জ্যোৎস্না হয়েছে, আর রাজপুত্র অনির্দেশ্য কারণে ঘোড়ায় চড়ে ভ্রমণে বেরিয়েছে-শুনে মনটা এমনি উতলা হয়েছিলো।"ছোটবেলায় যে ভালবাসা শোনার মধ্যে দিয়ে এতোদিন বয়ে এসেছিল,যা শুধু কল্পনার জগৎকেই গড়ে তুলেছিল,তার বাস্তব প্রকাশ ঘটল তাঁর বাইশ বছর বয়সে।১২৯০ সালের বৈশাখ মাসের 'ভারতী 'পত্রিকায় 'বাউলের গান 'নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।লোকসাহিত্য সম্পর্কে সচেতনভাবে লেখা এটাই তাঁর প্রথম প্রবন্ধ।এই প্রবন্ধে কবি একটি বিষয়ে যে মন্তব্য করেন তা তাঁর পরবর্তীকালের লোকসাহিত্য সংগ্রহ প্রীতির পূর্বাভাষ বলে মনে হয়-'বাঙ্গলা ভাব ও ভাবের ভাষা যতই সংগ্রহ করা যাইবে, ততই যে আমাদের সাহিত্যের উপকার হইবে তাহাতে আর সন্দেহ নাই।"লোকসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বৈজ্ঞানিক উপলব্ধিই তাঁকে এই বিশেষ ক্ষেত্রে অমর করে রাখবে।
রেবন্ত সেন
অতীতে ও বর্তমানে রবীন্দ্রনাথ
অবহেলার শিকার রবীন্দ্র স্মৃতিবিজরিত গৌরীপুর
ভবন
গৌতম চক্রবর্তী
রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য গৌরীপুর ভবনে
না,
নিছক বেড়ানো নয়। অভিমান আর অহংকার নিয়ে ইতিহাসের ভগ্নস্তূপে এসে পৌঁছলাম একটা
হেরিটেজ সফর এবং ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে। হেরিটেজ গৌরীপুর ভবন দিনে দিনে ভগ্নস্তূপে
পরিণত হচ্ছে। সরকার মাঝেমাঝে কিছু অনুদান দিলেও রাঘববোয়াল ঠিকাদারদের উদরস্থ হচ্ছে
তার সিংহ ভাগটাই। অথচ মানুষের কোন বাদ প্রতিবাদ নেই। তাই অবলুপ্ত ইতিহাসের
ধ্বংসাবশেষের অবশিষ্টাংশকে চর্মচক্ষে প্রত্যক্ষ করার মানসিক অনুপ্রেরণাতেই এই সফর।
কালিম্পংয়ে রায়চৌধুরি পরিবারের গ্রীষ্মকালীন আবাস গৌরীপুর হাউস রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের স্মৃতিধন্য৷ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই স্মৃতি আজ ধূলাচ্ছন্ন৷ আত্মবিস্মৃত
বাঙালি নিজের ইতিহাস, নিজের ঐতিহ্য আর গর্বকে যথাযোগ্য মর্যাদায় রক্ষণাবেক্ষণ করতে
জানে না৷ নয়ত কালিম্পংয়ের ঐতিহাসিক গৌরীপুর হাউস আজ পোড়ো বাড়ির চেহারা নিত না। সে
নিয়ে কারও কোনো দায় নেই, দায়িত্বও নেই৷ গৌরীপুর হাউসের যাঁরা মালিক, কলকাতার সেই
রায়চৌধুরী পরিবার কিন্তু বহুবার জানিয়েছেন, আজকের দিনে কালিম্পংয়ের মতো জায়গায়
প্রায় প্রাসাদতুল্য ওই দোতলা বাংলো বাড়ির সংস্কার বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে
তাঁরা অপারগ৷ সরকার যদি চায়, অথবা অন্য কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যদি আগ্রহী থাকে
গৌরীপুর হাউসকে একটি রবীন্দ্র সংগ্রহশালায় পরিণত করতে, তা হলে তাঁরা সাগ্রহে রাজি
আছেন৷ অথবা বাড়িটি একটি হেরিটেজ হোটেলেও রূপান্তরিত করা যায়৷ তা হলেও অন্তত রবীন্দ্রনাথের
স্মৃতি বিজড়িত ইমারতটি রক্ষা পায়। কিন্তু
কিছুই হয়নি৷ ইতিহাসের নির্মম রসিকতাই বলতে হবে, গৌরীপুর হাউসের গায়ে এক খণ্ড মর্মর
ফলকে বলা আছে – ‘‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ
১৩৪৫ সনে জন্মদিন কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন৷'' অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ
তাঁর ৭৮ তম জন্মদিন কাটিয়েছিলেন এই বাড়িতে এবং
তথ্য বলছে, নিজের লেখা জন্মদিন কবিতাটি তিনি টেলিফোনে আবৃত্তি করেছিলেন, যা সরাসরি
সম্প্রচার করে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কলকাতা দপ্তর ‘‘আকাশবাণী''৷ কালিম্পংয়ের সঙ্গে
কলকাতার টেলিফোন যোগাযোগেরও নাকি সূচনা হয়েছিল সেই সঙ্গে৷ সেই ইতিহাস, সেই গুরুত্ব
স্বীকৃতি পেয়েছে ধূলামলিন এক মর্মর ফলকে৷ দায়িত্ববোধের সেখানেই ইতি৷
ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ গৌরীপুর ভবনে
আপাতত
আমাদের গন্তব্য দূরপিনদাঁড়া রোড। মঙ্গলধাম পেরিয়ে অবশেষে রাস্তার এক প্রান্তে একটা
উতরাই দেখা গেল। কদিন আগে যে ঝড়বৃষ্টি হয়েছে, সেটা এবার বোঝা গেল ঢালের মুখে
দাঁড়িয়ে। কাদায় ছপ ছপ করছে এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা। গাড়ি থেকে নামলাম। একটা সরু
পায়েচলা পথ নেমে গেছে ঢাল বেয়ে। এই যে সরু রাস্তাটা সেটা কী এই সামনের এবড়োখেবড়ো
রাস্তাটাই? যেটার মুখে আমাদের কোয়ালিশ দাঁড়িয়ে গেল! তাইই হবে হয়তো। এখন এখান দিয়ে
গাড়ি নামবার কোনও উপায় নেই অথচ তখন প্রকাণ্ড মোটর নামত দিব্যি। তার মানে এখন যা
সরু, তার চেয়ে বেশ খানিক চওড়া ছিল তখন। অবশ্য রাস্তাটাকে দেখলেই মনে হবে, ডানদিকের
অংশটা ধ্বসে গেছে বহুদিন। সাবধানে নামছি। এবার দেখতে
পাচ্ছি প্রাসাদোপম অট্টালিকাকে। ইতিহাসের ভগ্নস্তূপ। অভিমান আর অহংকার একসাথে
প্রতিফলিত হচ্ছে সেখান থেকে। গৌরীপুর লজ। বিশাল এলাকা জুড়ে বাগান এবং তার
গাছগাছালির মাঝে অপরূপ বাড়িটিকে দূর থেকে পুরো ভূতের বাড়ির মতো মনে হয়৷ পিচ
বাঁধানো পাকা রাস্তা থেকে গৌরিপুর হাউস পর্যন্ত পৌঁছানোর রাস্তাটিও এবড়োখেবড়ো,
রাশি রাশি শুকনো পাতায় ঢাকা৷ চতুর্দিকে এমন আগাছা যে দিনের বেলাতেও সে রাস্তায়
হাঁটতে গা ছমছম করে৷ আর বাড়ির সামনে পৌঁছে তার চেহারা দেখলে চোখে জল আসার উপক্রম
হয়৷ সদর দরজা বন্ধ কিন্তু বাড়ির প্রায় সব জানালা হয় ভাঙা, নয় দু হাট করে খোলা৷
তার ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকি মারলে দেখা যায় একেবারে বেবাক খালি, আসবাবহীন, ধুলোয়
ঢাকা ঘর৷ রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কোনো সামগ্রী, কোনো আসবাবপত্র সেখানে থাকার
স্রেফ কোনো সম্ভাবনাই নেই। বাড়ির অনেকাংশই ভেঙে পড়েছে। ঘরের বেশিরভাগ জানলাতেই কাচ
নেই। যেগুলোতে আছে, সেগুলোও দেখলাম ভাঙা। অনায়াসে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। দেওয়াল মেঝের কিছু অংশে খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা।
রবীন্দ্র-গবেষক রতন বিশ্বাসের নিবন্ধ থেকে জেনেছি, একসময় নীচের দিকে ধাপ কেটে ৬৪টি
সিঁড়ি ছিল। সেসবই বা কোথায়? বাড়ির চত্বরেই চলছে
কনস্ট্রাকশনের কাজ। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপিত হবে সামনেই।
কনস্ট্রাকশনের কাজের কারণেই চারিদিকে আরও বেশি জলকাদা হয়ে জায়গাটা হাঁটার অযোগ্য
হয়ে গিয়েছে। আসলে ইতিহাসের সমাধি-খনন। কতবছর আর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কে
জানে! বাড়ির দুরবস্থা নিয়ে কাগজে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। সরকার
বা প্রশাসন কারোরই হেলদোল নেই।
গৌরীপুর হাউসের বর্তমান বাসিন্দা
বাড়ির
এখনকার বাসিন্দা এক মাঝবয়েসী মহিলা আর তাঁর তিনটি ফুটফুটে মেয়ে। ভাড়াটে। এছাড়া
রয়েছে কতকগুলো মোরগ-মুরগি। একতলার যে অংশটা এখন মাটিতে মিশে গিয়েছে, ঠিক তারই
ওপরের অংশে একটা ঘর নিয়ে থাকেন তিনি। নাম, সঞ্জিতা শর্মা। জলপাইগুড়ি থেকে এই
বাড়িটি নিয়ে লিখব বলে এসেছি শুনে একাধারে বিস্ময় এবং আনন্দের অভিব্যাক্তি ফুটে উঠল
তার চোখেমুখে। তাঁর মুখে জানলাম, এখানে তাঁরা রয়েছেন চার পুরুষ ধরে। তাঁর মাতামহ
এই বাড়ির চৌকিদার ছিলেন। তাঁর মা তখন খুব ছোট, সেসময়
রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছেন। মায়ের নাম ছিল কৃষ্ণা। ছোট্ট কৃষ্ণা নাকি দাড়িওয়ালা
বৃদ্ধকে রীতিমত ভয় পেতেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি এসে হাঁক দিতেন-‘বিটি, মিঠাই লে আ’।
পরবর্তীকালে সঞ্জিতার বাবা পদমলালও চৌকিদারি সামলেছেন। পদমলাল, কৃষ্ণা কেউই আর
বেঁচে নেই এখন। বাড়ির ভবিষ্যৎ নিয়ে সঞ্জিতার গলায় যথেষ্ট উৎকণ্ঠা। সন্দীপ রায়ের
‘যেখানে ভূতের ভয়’-এর ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-র শুটিং এ বাড়িতেই হয়েছিল। সঞ্জিতা
তখন সন্দীপকে অনুরোধ করেছিলেন, যদি বাড়িটার কিছু ব্যবস্থা করা যায়। ফল হয়নি। তাই
বাড়ির সাথে সাথে সঞ্জিতাও কেবল দিনই গোনেন। এই বুঝি বিপজ্জনক নোটিশ পড়ল বাড়িতে। প্রতিটা
ঘরেই ফায়ারপ্লেস। সাদা দেওয়ালে অনবরত শ্যাওলা জমে তা আর সাদার পর্যায়ে নেই।
স্থানীয় মানুষের কাছে এই বাড়ি ‘ভূতের বাড়ি’ বলেই বেশি পরিচিত। গৌরীপুর লজ বললে কেউই
বুঝবেন না। বেশ কসরত করে নেমে একতলার দিকটায় যেতে হয়। সব ঘরে তালা ঝুলছে। একটা
ফলক। ‘এই ভবনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করিতেন এবং ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ সনে
“জন্মদিন” কবিতা আকাশবাণীর মাধ্যমে আবৃত্তি করিয়াছিলেন’। কে করিয়েছিলেন, সেসব কিছু
লেখা নেই। তবে যিনিই করিয়ে থাকুন, ভারতীয় গণমাধ্যমের ইতিহাসে যে প্রথম লাইভ
টেলিকাস্টের ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল এই বাড়ি, অন্তত সেই স্বীকৃতিটুকুর লিখিত
খোদাইটি করিয়েছেন।
গৌরীপুর এস্টেটের নামে নামকরণ
প্রবাদপ্রতিম সেতারবাদক পণ্ডিত বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির হাত
ধরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের প্রতিষ্ঠা। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের
ওপর লেখা ‘ইন্ডিয়ান মিউজিক অ্যান্ড মিয়াঁ তানসেন’ তাঁর একটি সমৃদ্ধশালী কাজ। তানসেনের
কন্যা সরস্বতী দেবীর শেষ বংশধর মহম্মদ ওয়াজির খাঁয়ের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। বিলায়েত
খাঁয়ের পিতামহ ইমদাদ খাঁ, উস্তাদ আলাউদ্দিনের মতো মানুষ ছিলেন তাঁর গুরু। পণ্ডিত রবিশঙ্কর,
শ্যামাসঙ্গীতের পান্নালাল ঘোষ তাঁর
ছাত্র ছিলেন। বীরেন্দ্রকিশোরের বাবা ব্রজেন্দ্রকিশোরও ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড়
পৃষ্ঠপোষক। স্বদেশী আন্দোলনের অংশ হিসাবে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের পত্তন যখন
হয়, সেই কাজেও অর্থসাহায্য করেছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। এই সংস্থাই বেঙ্গল টেকনিক্যাল
ইনস্টিটিউট ও বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করে, পরবর্তীকালে যে দুটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান
একত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দিয়েছে। এই ব্রজেন্দ্র এবং বীরেন্দ্ররা ছিলেন
ময়মনসিংহের গৌরীপুর এস্টেটের জমিদার। সেখানে তাঁদের প্রাসাদোপম বাড়িটির নাম ছিল গৌরীপুর
হাউস। সেই অনুকরণেই কালিম্পঙের বাড়িটিরও এই নাম। এখানে ব্রজেন্দ্রের পরিবার গ্রীষ্মাবকাশ
যাপনে আসতেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২৬ সালে ময়মনসিংহের মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরির
নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে সেখানে গিয়েছিলেন, তখন রায়চৌধুরি পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয়তা
হয়। তবে কালিম্পঙে রায়চৌধুরিদের বাড়িটি কবে তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
বাড়ির মালিকানা বদলের চিত্রনাট্যটি কিন্তু বেশ মজার।
রবীন্দ্র স্মৃতি বিজরিত গৌরীপুর ভবনে
গৌরীপুর
ভবনের খোলা হাওয়ার পরিবেশ, চারিদিকের বাগান, নির্জনতা দেখে কবি প্রথম দর্শনেই
মুগ্ধ হয়ে যান। ব্রজেন্দ্রকিশোর বাগানের মালি বিষ্ণুলাল শর্মাকে দৈনন্দিন কাজের
ভার দিয়েছিলেন। এই বিষ্ণুলালই সম্ভবত সঞ্জিতার দাদু। সঞ্জিতার
সহায়তায় বাড়ির ভেতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয়েছিল। দোতলার যে ছোট বারান্দাটায় রবীন্দ্রনাথ
বিশ্রামের জন্য এসে বসতেন, একসময় সেখান থেকে দেখা যেত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর নাথুলা। এখন
বসতি হয়ে গেছে। দূষণের পর্দা ভেদ করে শুভ্র হিমশিখরের দৃশ্যমানতা আর সম্ভব হয় না।
তবে সামনের গাছ দুটি আজও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে থাকবে,
আরও কতদিন। এরকম ইতিহাসের স্মৃতি-বিজাড়িত জায়গায় এসে এই গাছেদের দেখে মনে হয়, যদি
ওরা কথা বলতে পারত, কোনোভাবে! গৌরীপুর লজ ‘আসবাবশূন্য নিরলঙ্কার। এখানে কেউ কোনো
দিন বাস করেছে বলে মনে হয় না। এখন মানুষ বাস করে। রবীন্দ্রনাথ এখানে এলে বেশ
অনেকগুলো ঘর ব্যবহার করতেন। সুবিশাল অট্টালিকায় ঘরের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না।
কিন্তু কোন ঘরগুলো ব্যবহার করতেন তিনি? প্রতিমা দেবীই বা কোন ঘরে থাকতেন? কবির
একটি আলাদা বসবার ঘর ছিল। মৈত্রেয়ী দেবীরা এলে সেই ঘরের পাশের ঘরে থাকতেন। সেগুলোই
বা কোনগুলো? সঞ্জিতা দেখাতে পারেননি। এজন্য তাঁকে দোষ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
এত খুঁটিনাটি কথা তাঁর জানার কথা নয়। যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়েরই ভেঙে পড়বার
উপক্রম, সেখানে একসময়ে রবীন্দ্রনাথ এসে কোন ঘরে থাকতেন, এসব জেনে তাঁর লাভ কী! কবির
সম্বন্ধে যতটুকু পড়েছি, তাতে জেনেছি, তাঁর দৃষ্টি চলে যেত বহুদূর। সুদূরের পিয়াসী
মানুষটি যে সুদূরকেও অতিক্রম করে গেছেন। শুধু সাদা চোখের দৃষ্টিতে নয়,
অন্তর্দৃষ্টিতেও। সামনের গাছ থেকে শুকনো পাতা ঝরে এসে পড়েছে বারান্দায়। আমার জুতোর
চাপে মর্মরধ্বনি উঠছে তাদের। যেন একটা দীর্ঘশ্বাসকে চাপা দিয়ে মারতে চাইছে কেউ।
সঞ্জিতার কথা আর কানে ঢুকছে না তখন। আমি যেন ফিরে গিয়েছি সেই অদেখা সময়ে। সময়টা যে
বড় প্রিয় আমার।
প্রসেনজিৎ দাস
গল্পে রবীন্দ্রনাথ
অন্তরতম
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
উলের কাটা জানান দিল কেক হয়ে এসেছে.. পায়েসও সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে প্রস্তুতির শেষ পর্বে। অদিতির 'জিয়ন কাঠি'র বাইরে একটি আলোকোজ্জ্বল মন ভালো করা সকাল। সব ঘরের দরজা জানলা গুলো একে একে খুলে দিল অদিতি। তারপর বসবার ঘরের টেবিলের ওপর রাখা ছবিটির সামনে এসে দাঁড়ালো। এই ঘরটা কাল রাতেই ওরা নিজেদের আঁকা ছবি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। সকালে বাগান থেকে নিজের হাতে ফুল তুলে এনেছে অদিতি। সেগুলো ফুলদানিতে রাখা হয়েছে, যথাস্থানে। ভাস্কর চলে যাওয়ার পর থেকে বড়ো ফাঁকা লাগতো এই বাড়িটা। একসময়ের একান্নবর্তী সংসারের কেউ কেউ গত হয়ে, কেউ চাকরি বা বিয়ের সূত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে অদিতি একটা সময় একেবারে একা হয়ে পড়েছিল। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেলো ছেলেও দেশের বাইরে।
কিচির মিচির করতে করতে একঝাঁক আনন্দ এসে ঘিরে ধরলো অদিতিকে। অদিতিই ওদের সাজিয়ে দিয়েছে আজ সুন্দর করে। কোনার দিকের ঘরটায় এতোক্ষণ এরা নাচ গানের শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চন্দনের ফোঁটায় সাজানো টেবিলের ছবিকে প্রণাম জানালো ওরা একে একে.. সকলের হাতেই অদিতির বাগানের কোনো না কোনো ফুল। ওদের ইচ্ছেমতোই গত কয়েকটা বছর ধরে এই দিনটি পালন করে অদিতি। ওদের শিশুমনের নির্ভেজাল আনন্দের সঙ্গী হতে ওরও মন চায়। একে একে কবিতায়, নাচে, গানে ওরা ভরে তুলল অদিতির সকালকে। এরপর অদিতির পালা। সকলের আবদারে গান গাইলো.. আবৃত্তি করলো সমস্বরে.......
'ভয় হতে তব অভয় মাঝারে--
নূতন জনম দাও হে!
দীনতা হইতে অক্ষয় ধনে,
সংশয় হতে সত্য সদনে
জড়তা হইতে নবীন জীবনে
নূতন জনম দাও হে!.......
এদের সাথেই তো দিন কাটে অদিতির সারাটা বছর। এদের পড়াশোনা, আঁকা, হাতের কাজ, খেলাধুলোই তো বর্ণময় করে তোলে অদিতির নিঃসঙ্গ যাপনকে। আর অদিতি ওদের নিয়ে থাকে আরেকজনের আগলে নেওয়া দুহাতের আশ্রয়ে। সেই একজনই তো সঙ্গ দিয়ে চলেন অবিরত ওর মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে। ভাস্করের চলে যাওয়ার পরের ওর একলা থাকার দিনগুলোতে উনিই তো সাহস যুগিয়েছেন , এগিয়ে এসে হাত ধরেছেন অদিতির, এই বাড়িটিকে 'জিয়ন কাঠি' করে গড়ে তুলে বাপ মা হারা ছেলে মেয়ে গুলোকে ঠাঁই দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে।
ছেলে মেয়ে গুলোর হাতে হাত মিলিয়ে গরম কেক - এ ছুরি ডোবালো অদিতি। ছবিতে ওর প্রাণের মানুষ, ওর চিরসখা রবীন্দ্রনাথ উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। বড়ো সুন্দর, বড়ো আপনার সেই চেয়ে থাকা। সেই চেয়ে থাকায় যেন ধ্বনিত হচ্ছে.....
'জন্মদিন আসে বারে বারে
মনে করাবারে --
এ জীবন নিত্যই নতুন
প্রতি প্রাতে আলোকিত
পুলকিত
দিনের মতন '
বুকুনের সহজপাঠ
মৌসুমী চৌধুরী
ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে বুকুনের। একে একে খুব ধীরে ধীরে ছবিগুলো নেমে আসে বুকুনের খুব কাছা- কাছি...! আজ একমাস হয়ে গেল দাদাই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু সেই ছবিগুলো রয়ে গেছে বুকুনের বুকে।
যেদিন করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য প্রথম স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল অনির্দিষ্টকালের জন্য, সেইদিন ভারী মন খারাপ হয়েছিল বকু- নের। বুকের ভিতরটা কেমন খাঁ খাঁ করছিল। বাড়িতে থাকতে তার ভালোলাগে না। বাবা আর মা তো অনেক রাত্তির করে অফিস থেকে ফেরেন। সবসময় সে তো বীনামাসীর কাছেই থাকে। একদম ভালোলাগে না।
ছোট্ট বুকুনের সবে পাঁচ বছরের জন্মদিন পেরিয়েছে। কেজি-টুতে পড়ে সে। বন্ধুদের দেখতে পাবে না, তাদের সঙ্গে খেলতে পারবে না বলে খুব কান্নাকাটি করছিল। আর তখনই দাদাই এসে হাত রেখেছিলেন তার মাথায়। সেসময় কৃষ্ণনগর থেকে দাদাই এসে থাকছি -লেন তাদের বাড়িতে। সারাদিন ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে মোটা মোটা বই পড়তেন তিনি। দাদাই তাকে পড়তে দিয়েছিলেন বইটা — "সহজ পাঠ"।
— "এই বইটির সব ভাগগুলোই দিলাম তোমায়। পড়ে দেখ দাদুভাই। খুব আনন্দ পাবে।"
ব্যাজার মুখে পড়তে শুরু করেছিল বুকুন। প্রথম কয়েক পাতা পড়ার পর সত্যিই ভালোলেগেছিল তার। দাদাইয়ের মুখে শোনা তাঁর ছোটবেলার মাঠঘাট, হাট, নদী, পাড়া, হিজল গাছ, ফলসা বন, মৌচাক, জেলে ডিঙি সব যেন কেমন নেচে নেচে ছবি হয়ে ফুটে উঠছিল বুকুনের চোখের সামনে।
বুকুনের স্কুল আর খুলল না গোটা বছর। অন-লাইনেই ক্লাস চলতে লাগল। বাবা-মায়ের চলতে লাগল "ওয়ার্ক ফ্রম হোম"। তার ভিতরে -ই ঘটল দুর্ঘটনাটি। দ্বিতীয় ফেজে করোনা ভাই -রাস সংক্রমণের জেরে কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট হয়ে হঠাৎই মারা গেলেন দাদাই। তার পরপরই হঠাৎ বাবা আর মা দু'জনেই কোভিড-পজিটি -ভ হয়ে পড়লেন। বাবা আর মায়ের কাছাকাছি যেতে পারে না ছোট্ট বুকুন। তারা আইসোলে- শানে আছেন। বীনামাসীও তো কাজে আসছে না। এখন সারা দিন-রাত একা একা বুকুন নিজের ঘর আর বারান্দাটুকুতেই কাটায় সেই সহজপাঠ হাতে নিয়ে। তাঁদের আবাসনের প্রতিবেশীরা পালা করে তিনবেলা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন বুকুনদের। দড়ি দিয়ে বারান্দার গ্রিল থেকে ঝোলান আছে ব্যাগ, তাতেই তারা টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার রেখে যান। কখনও কখনও ব্যাগে টিফিন ক্যারিয়ার রেখে তাদের ওপরতলার বোস কাকীমা হাঁক পাড়েন,
—"বুকু-উ-উ-উ-ন কই গেলি বাবা...খাবারটা নিয়ে যা।"
ঠিক তখুনি কেন যেন বুকুনের মনেপড়ে,
— "ডাক পাড়ে ও ঔ/ভাত আনো বড়ো বৌ"।
নিস্তব্ধ দুপুরে যখন তাদের আবাসন চত্ত্বরটা ঝিমোয়, তখন দূরের রাস্তা থেকে একটা দুটো কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক ভেসে আসে। বুকের ভিতরে একটা ছন্দের ঢুলুনি লাগে বুকুনের,
—" হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ/ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ।"
সকালে বারান্দায় বসে আউট হাউসের দিকে চোখ গেলে বুকুন দেখে তাদের আবাসনের দারোয়ান কয়লার উনুনে চা বসিয়েছে পাকিয়ে
পাকিয়ে কালো ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে আকাশে। ছবিটা দোলা দেয় বুকুনের মনে,
"চরে বসে রাঁধে ঙ, /চোখে তার লাগে ধোঁয়া।"
সহজপাঠের পাতায় বুকুন সহজেই দেখ- তে পায় দাদাইয়ের মুখ। ওই দ্যাখো বুকুন,
— "মাছ জলে খেলা করে। /ডালে ডালে কাক ডাকে।/ খালে বক মাছ ধরে..."
বুকুনের শোবার ঘরটা পুবমুখী। এখন নিজের ঘরে একাই ঘুমায় বুকুন। সকালে আবাসনের মাথায় সূর্য উঁকি দেবার সঙ্গে সঙ্গে আলোয় ভেসে যায় বিছানা। কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে,
"কালো রাতি গেল ঘুচে, /আলো তারে দিল মুছে।/পুব দিকে ঘুমভাঙা হাসে উষা চোখ- রাঙা।"
দাদাইয়ের হাত ধরে কৃষ্ণনগরে তাদের বাড়ির পাড়ার পথ ধরে হাঁটছে বুকুন। কত বড় বড় সবুজ ঝাঁকড়া গাছ, গভীর দিঘি এখানে! কী মিষ্টি ছায়ায় ঢাকা পথ,
—" ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি /আছে আমাদের পাড়াখানি। / দিঘি তার মাঝখানটিতে/ তালবন তারি চারি ভিতে।"
দাদাইয়ের সঙ্গে বৈশাখ মাসের নদীতে হাঁটুজল
ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছে বুকুন। দূরে কারা যেন গামছায় জল ভরে সেই জল গায়ে ঢালছে। আাঁচলে ছেঁকে ছোট ছোট মাছ ধরছে,
—" বু-কু-উ-উ-উ ন আর এগিও না সামনে ঘোর বর্ষার ঘোলা জল... বুকুন...বুকুন...
হঠাৎ ঘুম ভেঙে বুকুন দেখে সে শুয়ে আছে তার বিছানায়। বাইরে রোদ ঝলমল করছে। দরজদায় মা দুমদুম শব্দ করছেন,
—" বুকুন ওঠ। এখুনি অন-লাইন ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তোমার। ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেছেন সেন আঙ্কেলরা। খেতে নিয়ে পড়তে বস।"
বুকুন দেখে কোথায় নদী?... কোথায় ছায়ার ঘোমটা?... সে শুয়ে আছে ইঁট-কাঠ-পাথরের মাঝখানে ! কোথায় হারিয়ে গেল অত সুন্দর ছবিগুলো? ওই তো... ওই তো... সহজপাঠের পাতায়! ভারী মন খারাপ হয়ে গেল বুকুনের। খুব অভিমানও হল তাঁর ওপর। সব লেখা শুধু ওই বাচ্চাগুলোর জন্যই ? বুকুনদের মতো শহুরে বাচ্চাগুলোর জন্য কি কিছু লিখতে নেই? হঠাৎ মনে পড়ে যায় দাদাই পড়িয়েছিলে -ন,
—..."চেয়ে দেখি, ঠোকাঠুকি বরগা কড়িতে,/
কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।/ ইঁটে-গড়া গণ্ডার বাড়িগুলো সোজা/ চলিয়াছে দুদ্দাড় জানালা দরজা।/ রাস্তা চলেচে যত অজগর সাপ,/ পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপ্ ধাপ্..."
এক মুখ দাঁড়িওয়ালা তার দাদাই আর রবি ঠাকুর বুকুনের চোখে ধীরে ধীরে যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে।
সোমনাথ বনিক
কবিতায় রবীন্দ্রনাথ
চির সখা হে
শ্রাবণী সেন
হাওয়ায় ওড়ে কালো মেঘের দল
গোধূলি আলো ম্লান হয়নি বটে
তোমার চোখে আকাশ দেখা যায়
এমন শুধু ভাগ্য হলেই ঘটে।
হঠাৎ এলো কালবোশেখী ধেয়ে
ঝড়ের মুখে আড়াল রাখা দায়
বেণীতে বাঁধা বেলির মালাখানি
ডাক দিয়েছে এমনই সন্ধ্যায়।
আরকি মনে আগল রাখা চলে!
এবার মন দুয়ার খোলা থাক
আশিরনখ ভিজল আকাশজলে
ডাক দিল যে পঁচিশে বৈশাখ!
আমার ডালি ভরেছি ফুলে ফুলে
শিরিষ, বকুল, অমলতাসের গান
বেলি ফুলের গোড়ে মালায় সেজে
প্রাণের ঠাকুর, জুড়াও এবার প্রাণ!
পায়ের কাছে বসেছি এই এসে
গীতবিতান খোলা কোলের পরে
চোখের কাজল চোখের জলে মোছে
এবার এসো মনের বিজন ঘরে।
আজকে পথ আঁধার হয়ে আছে
প্রাণের প্রদীপ জ্বেলে নিজের হাতে
পরম প্রিয় এসো আমার ঘরে
বন্ধ দুয়ার খুলো আপন হাতে।
পথ কেটেছি হৃদয় বরাবর
শঙ্কা যত যাবেই দূরের পানে
আঁধার রাতে যদিই পাই ভয়
পরশমণি জ্বালিও আমার প্রাণে।
তুমি আছ
পার্থ সারথি চক্রবর্তী
কত পথ পার হয়েছি-
আর কত পথ গেলে তোমায় পাব
জানি না, তবে তোমার ছায়া আছে
যাপন জুড়ে আমার, আশৈশব
অশান্ত সময়, টালমাটাল মন-
বেদনায় নীল আকাশ-
তবু তুমি জ্বালবেই জানি
শান্তির প্রদীপ, জীবনে সবার
আশা আর নৈরাশ্যের দ্বন্দ্বে-
রুদ্রবীণা বাজাও তুমি,
ধ্বনিত হোক মানবতার জয়গান
পূণ্যতীর্থের সাগরতীরে, নির্মল প্রভাতে
তুমি আছ জানি, সমুদ্র থেকে হিমালয়
সকাল থেকে রাত, আত্মা থেকে হৃদয়
রবীন্দ্র জয়ন্তী চন্দ্রানী চৌধুরী
আমার অনুভূতির আকাশ জুড়ে
আজ জ্যোৎস্না প্লাবন
কায়াহীন অদৃশ্য দেবতার জন্মদিনে
কেবল জ্যোৎস্না কুড়োই আমি ।
রবির কিরণে হীরকদ্যুতি ছড়িয়ে
ভালবাসার বর্ণমালায় গাঁথি কুন্দহার।
আজ পঁচিশে বৈশাখ
ফুলের সাজে সেজে উঠেছে
রোদেলা স্বপ্ন সকাল
প্রকৃতি হয়েছে রঙিন
পাখিদের ঠোঁটে বেজে ওঠে
উল্লাসী কলতান
বাতাসে বহিছে প্রেম
মনের গহীনে উপচে পরা শব্দেরা
ছুঁতে চায় আরাধ্যকে
রজনীগন্ধাময় বৈশাখে
গানে গানে মুখরিত হয় দিন
বিশেষ দিনে গুরুদেবের ছায়ায়, তারই আলোতে,
বর্ণে,ছন্দে,সুরে,গীতিতে
বরণ করি হৃদয়দেবতাকেই ।
প্রাণের আরাম
অশোক কুমার রায়
রবিঠাকুর তোমার আলোয়
সারা পাড়া আনন্দময়
মন নিঃসঙ্গ নয় জানি,
সারাক্ষণ তোমার 'গীতবিতান 'পাশে !
বৈশাখী বৃষ্টি ফোঁটা ছাতিমপাতায় এখনও জমে,
পঁচিশে বৈশাখে নেচে উঠবে
আবার তালে আর ছন্দে!
'বকুলবীথি' তোমার পাঠের অপেক্ষায়!
শালবনিতে বসে,
এখনও গল্প হয়'বেলা শেষে'র!
ভয়ঙ্কর আর্তনাদের কণ্ঠ শুনে জেগে উঠে,
...তোমার ছবির পাশে বসি!
মন খারাপে 'সহজ পাঠ'এর এখনও পাতা উল্টাই,
'ছিন্নপত্র' পাশে রেখে খাতায় কত চিঠি কাটাকুটি করি,
একটা মুখ খুঁজতে খুঁজতে!
কবি এলেন রীনা মজুমদার
সব কবিতায় প্রাণ থাকে না
কোন কবিতায় থাকে, রক্ত ঝরায়
আপন করে ভালোবাসতে শেখায়।
সব কবিতা কী ছোঁয়া যায় ?
কবিতায় আসবে তীব্র বান, সে
বান সরে গেলে
জমা হবে উর্বর পলি,
কবিতার মাটি ভরে যাবে শব্দ-অক্ষরে
সময়ে আগাছা নিংড়ে দিয়ে
চারা গাছে হাত রেখো মাতৃস্নেহে
সন্তানসম কবিতারা প্রাণস্পর্শ নিয়ে
দেখবে একটু একটু করে
বড় হচ্ছে...
স্বপ্নটা ভেঙে যায়, আমি চমকে উঠি
পরম মায়াময় তৃপ্তিতে।
বুকে রাখা আমার, রাতের
আধ খোলা সঞ্চয়িতা...
প্রাণের ঠাকুর
বিজয় বর্মন
(০১)
প্রতিদিন আমার এই খেলাঘর সাজে,
মান অভিমান,শত অনুভবে,
আপন আপনে কত গঞ্জনা।
একলা চলার গানে,
প্রেম বিরহ ভাসাই,তিস্তা তোর্ষার জলে,
কে আর বুঝিবে আমায়,
যতটা,বুঝেছো গো তুমি।
(০২)
এই মধুমাসে, ফুলের খবর পাই,
দুহাত ভরে ফুল যে কুড়াই,
সব ভালো হবে, আশায় আশায়,
একটি রেখেছি, শুধু তোমায় দেবার।
পাহাড় নদী বনে,
তোমার প্রেম কুঞ্জে আমি যে মাধবীলতা,
যতনে সাজি,তোমার আভরণে।
(০৩)
মৃদু বাতাসের ঢেউ খেলে,পাহাড়ের গায়,
গীতবিতানের সুরে,
সিঙ্কোনা বাগিচার নিরবতায় যেন,
ভাঙনের গান।
আঁকড়ে থাকা, এপার ওপার,
দহন সুখে, বৈশাখী আমন্ত্রণ,
দুহাত তুলে নৃত্য মালঞ্চে তোমার পদাবলী।
(০৪)
এ জীবন টিকিয়ে রাখে,
আম কাঁঠালের পথ ধরে গ্রাম ছেড়ে গ্রামান্তর,
রাঙ্গামাটির পথে তোমার সুবাসিত ভাবনা,
স্পর্শ করে মনের উদাস বাউল।
পথ ভুলে যাই পথিক বেশে,
এ মাথা ঠেকায় শান্তি নিকেতনে,
কোচরে ভরি সোনা ঝুড়ির মাটি,
লেপিয়া রাখিবো,পদ ধূলি রূপে আমার দূয়ারে।
আমার রবীন্দ্রনাথ
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত
আমার পরমারাধ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
কোলকাতা কিংবা শান্তিনিকেতন, ইংল্যান্ড কিংবা মংপু
সর্বত্রেই রয়েছে তোমার ছোঁয়া ভরপুর।
তুমিই আমার প্রাত্যহিক সকল কর্মের অনুপ্রেরণা,
তোমার সকল সৃষ্টির দ্বারা জাগে মনে-প্রাণে নতুন ভাবনা।।
উপনিষদের ঋষিসুলভ প্রত্যয় তোমার কবিতায় হয় উচ্চারিত,
তোমার সাহিত্য কর্ম করায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে পরিচিত।
কেবলই পঁচিশে বৈশাখে বা বাইশে শ্রাবণের আড়ম্বরে নয়,
তুমি সর্বদাই আছো বেঁচে, থাকবে বেঁচে, তুমি জ্যোতির্ময়।।
মধ্যাহ্নের রবি উমা শঙ্কর রায়
গঙ্গার পার ধরে পদ্মার পার আমি খুঁজি -
একদিকে আগ্রাসন আর একদিকে রূপান্তরি নেশা!
বাদ পড়ে নি জোড়াসাঁকো, বিশ্বভারতী
গীতবিতান -
কে বাঁধবে আজ সাত কোটি উত্তরসূরির হাতে
হলদে মৈত্রী সুতো
তোমার মিলন মন্ত্র সুরে বসন্ত রোদ্দুর!
মধ্যাহ্নের রবি আজ
মননে না চিন্তনে-
পঁচিশেই বেঁচে থাকো
ফুল মালা চন্দনে !
রবির সুর
রীতা মোদক
এসো শান্তি
এসো স্বস্তি
এসো আনন্দময় ২৫ শে বৈশাখ
কদম কেতকি ছড়িয়ে
ফুলের ডালি নিয়ে
দিকে দিকে বেজে উঠুক শাঁখ।
মনের যাতনা
যত দুঃখ বেদনা
দূরে যাক, বহুদুর.....
অমৃত সন্ধ্যানে
প্রানের টানে
বাতাসে ভাসে রবির সুর।
পঁচিশে বৈশাখ
অরবিন্দ মাজী
আজ বলতে খুব ইচ্ছে করছে
এসো,এসো হে বৈশাখ,
কিন্তু এখন আর চাইনা বলতে
ঐ কটা না বলাটাই থাক্।
ইতিমধ্যেই যে আসতে চলেছে
বৈশাখের সেই শুভ ক্ষনটি,
মাত্র একটাই দিন বাকি এখন
রবি ঠাকুরের জন্ম দিনটি।
ফুলের মালা, ধূপকাঠি ও শঙ্খ
রেখেছি এনে ঘরে সযতনে,
দিনটিকে পালন করবার তরে
কবির স্মরণ নিতে নিজ মনে।
সম্প্রীত সরকার
ছড়ায় রবীন্দ্রনাথ
আহ্বান পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
এস তুমি রবিদাদু আমাদের পাড়াতে,
আমাদের সাথে নিয়ে চল তুমি বেড়াতে।
ছড়া আর কবিতা যে সাথী সেই ভুবনে,
গল্পে জুড়াবে প্রাণ, কত কথা ও গানে।
ট্রয় ট্রেনে চড়ে মোরা উঠবো যে পাহাড়ে,
নৌকায় ভাসব যে, কতো ছবি দু'পাড়ে।
ঝকঝকে দিন গুলো বেছে নেব সেদিনে,
ছড়া অার কবিতা যে সাথী সেই ভুবনে।
এস এস রবি দাদু, আামাদের গাঁয়েতে,
তোমার সে কথা, ধ্বনি, একবার শোনাতে।
তোমাকে শোনাতে কতো কথা আছে এ প্রাণে,
বলবো তা সব খুলে , চুপিসারে সেখানে।
অরণ্যে বসবো গিয়ে, সবার যে গালে হাত,
তোমার গল্প শুনে, ভাত খাব পেড়ে পাত।
বনভোজনের শেষে, পথ যেথা থামবে ,
সোনার তরীর গাঁয়ে, আঁধার যে নামবে।
দিনের শেষেতে যাব ঘুমের সে দেশেতে,
একবার এস তুমি, আমাদের গাঁয়েতে ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মরণে
সৌমেন দেবনাথ
কলমের কি মহাশক্তি
শক্তি অবিশ্বাস্য,
যে শাখাতেই দিয়েছেন হাত
ফলেছে স্বর্ণ শস্য।
শব্দের পরে শব্দ গেঁথে
অপূর্ব সব সৃষ্টি,
এমন নির্ভীক শব্দ সৈনিক
কাড়েন বিশ্ব দৃষ্টি।
মনটা ভরা প্রেমময়তায়
কি মোহ সুর গানে,
গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস
হাতটা নাই কোনখানে?
পক্ব হাত নাটকে কিংবা
কবিতার ছন্দে ছন্দে,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপনি
সাহিত্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
সূরয ওঠে ।
বিশ্বকবির ছড়ামজনু মিয়া
বাংলা ভারত বাস করেছেন
কর্ম কাজের জন্য,
অসংখ্য গান গল্প ছড়া
কবিতাতে ধন্য।
কম অর্জনে হয়নি তিনি
বিশ্বকবি রবি,
ধ্যানে জ্ঞানে সর্বক্ষণে
ভালো লাগার ছবি।
আমাদের সেই ছোট নদী
পড়ালেখায় পাঠে,
শেষের কবিতার কথা তো
জানে রাখাল মাঠে।
ধন্য কবি ধন্য আপনি
মরেও অমর আজকে,
অবহেলা কখনো নয়
করেননি তো কাজ কে।
ছোটদের রবীন্দ্রনাথ
দেবাঞ্জনা রুদ্র
অনুস্মিতা বিশ্বাস
মুজনাই সাপ্তাহিক বর্ষপূর্তি সংখ্যা
No comments:
Post a Comment