মুজনাই সাপ্তাহিক
বিশেষ সংখ্যা
গান্ধীজি ও নোবেল
শঙ্খনাদ আচার্য
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, আসমুদ্রহিমাচলে 'গান্ধীজী' নামেই সুপরিচিত। কারো কারো কাছে তিনি আবার 'বাপুজি' নামে, আবার কারো কাছে 'মহাত্মা' নামেও পরিচিত। আমৃত্যু 'সত্যাগ্রহের' আদর্শে বিশ্বাসী যে তপস্বী ছিলেন বিংশ শতকের 'অহিংস' আন্দোলনের সবচেয়ে বড় প্রতীক তিনি কখনও 'নোবেল শান্তি পুরস্কার' পাননি, এর চাইতে লজ্জাকর ঘটনা ইতিহাসে আর কিইবা হতে পারে! যদিও নোবেলের ইতিহাস বলছে বেশ কয়েকবার এই পুরস্কারের জন্য তিনি মনোনীত হয়েছিলেন।
স্যার আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে নোবেল শান্তি পুরস্কার ১৯০১ সাল থেকে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি প্রদান করে আসছে। এই পুরস্কার স্টোর্টিং (নরওয়েজিয়ান সংসদ) কর্তৃক নিযুক্ত পাঁচজনের একটি কমিটি প্রদান করে। তবে আলফ্রেড নোবেল কেন নরওয়েজিয়ান কমিটি কর্তৃক শান্তির জন্য পুরস্কার প্রদান করা হবে এবং অন্য চারটি পুরস্কার সুইডিশ কমিটি দ্বারা পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে কোন ব্যাখ্যা দেননি।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য গান্ধীজি মনোনীত হয়েছিলেন পাঁচবার -১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭, এবং সর্বশেষ, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে তাঁর হত্যার মাত্র কিছুদিন আগে। ১৯৩৭, ১৯৩৮ ও ১৯৩৯ সালে গান্ধীজিকে মনোনীত করেছিলেন নরওয়েজিয়ান স্টর্টিংয়ের (সংসদ) লেবার পার্টি সদস্য ওলে কোবিওর্নসেন। অবশ্য প্রথম মনোনয়নের সময় গান্ধীজির পক্ষে প্রণোদনাটি রচনা করে দিয়েছিলেন 'ফ্রেন্ডস অভ ইন্ডিয়া'-র নরওয়েজিয়ান ব্রাঞ্চের এক নেত্রী। উল্লেখ্য, 'ফ্রেন্ডস অভ ইন্ডিয়া' নামক গান্ধীবাদী সংগঠনটি ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩০-র দশকের গোড়ার দিকে।
১৯৩৯ সালের পর গান্ধীজি পুনরায় নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ১৯৪৭ সালে। সে বছর তাকে মনোনীত করেছিলেন বি জি খের, জি ভি মাভালাঙ্কার এবং জি বি পান্থ। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হত্যা করা হয় মহাত্মা গান্ধীকে। এর মাত্র দুইদিন পরই ছিল সে বছরের নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন পেশের শেষ তারিখ। সেবার নোবেল কমিটি গান্ধীজিকে মনোনীত করা ছয়টি চিঠি পায়, যার মধ্যে ছিল প্রাক্তন নোবেল লরেট দ্য কোয়েকার্স এবং এমিলি গ্রিন বলচের চিঠিও। ইতিপূর্বে নোবেল শান্তি পুরস্কার 'মরণোত্তর' কাউকে দেয়া হয়নি। কিন্তু নোবেল ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সংবিধি মোতাবেক, কয়েকটি শর্ত মেনে মরণোত্তর নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া যেত। ফলে গান্ধীজিকে নোবেল দেবার রাস্তাও খোলা ছিল। কিন্তু তারপরও, নোবেল কমিটি সে বছর গান্ধীজিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেননি। এর পেছনে কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি বলেন, গান্ধীজি কোনো সংগঠনের অংশীদার ছিলেন না, তিনি কোনো সম্পদ রেখে যাননি, কোনো উইলও করে যাননি, ফলে তার পুরস্কার গ্রহণ করবার মতো কোনো যোগ্য উত্তরসূরী নেই। শেষ পর্যন্ত জন আবেগের কথা মাথায় রেখে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর তারা জানান, - "কোনো যোগ্য জীবিত প্রার্থী না থাকায় এ বছর কাউকে পুরস্কারটি প্রদান করা হবে না।"
২০১৯ সালে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির সেক্রেটারি গেইর লান্ডেস্ট্যাড বলেন, মহাত্মা গান্ধীর নোবেল না জেতার বিষয়টি তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল। সম্ভবত নোবেল কমিটির সদস্যদের তৎকালীন ইউরোপ-কেন্দ্রিক মানসিকতাই এর পেছনে দায়ী। সেই সঙ্গে তিনি আরো বলেন, "নোবেল পুরস্কার ছাড়াও চলে যায় গান্ধীজির। তবে গান্ধীজিকে ছাড়া নোবেল কমিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।"
আসলে 'গান্ধী' কোন ব্যক্তির নাম নয়, একটি আদর্শের নাম। তাই কোন ব্যক্তিকে পুরস্কারের মাপকাঠিতে মাপা গেলেও আদর্শকে মাপা যায় না। যেমনটা গান্ধীজীর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। কারণ, মহাত্মার আদর্শ অবিনশ্বর, তাঁকে হত্যা করা গেলেও তাঁর আদর্শকে হত্যা করা কখনোই সম্ভব নয়। তাই গান্ধীজীর এই নোবেল না পাওয়ার আক্ষেপ যতটা না ভারতবাসীর তার চাইতে ঢের বেশি নোবেল কমিটির, যা কোনদিনও ঘোচবার নয়।
তথ্যসূত্র:
১। মহাত্মা গান্ধীর নোবেল পুরস্কার না জেতার কারণ - জান্নাতুল নঈম পিয়েল। (রোর মিডিয়া ১৩/০৫/২০২০)
২। এই সময় (অনলাইন পোর্টাল ০২/১০/২০১৯)
৩। প্রহর (অনলাইন পোর্টাল ২০/১০/২০১৯)
No comments:
Post a Comment