Saturday, November 13, 2021


 

মুজনাই সাপ্তাহিক 

শিশু দিবস 

বিশেষ সংখ্যা 


সম্পাদকের কথা 

আমরা ঠিক কতটা ভাবি আমাদের শিশুদের নিয়ে? বোধহয় খুব কম! সত্যি বলতে শিশুদের নিয়ে আমাদের কোনও নির্দিষ্ট ভাবনা নেই। যেটুকু আছে সেটিও নিতান্ত ছন্নছাড়া। ফলে আমাদের শিশুরা, প্রতিভা থাকা স্বত্বেও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে তাদের অনেকের কপালে জোটে শ্রমিকের জীবন। 

শিশু দিবস আসে, যায়। কিছু ভাল কথা, সেমিনার, খানিক হৈ চৈ শেষে আবার স্তিমিত হয়ে যায় সব। শিশুরা যে তিমিরে ছিল, রয়ে যায় সেই তিমিরেই। 

মুজনাই চেষ্টা করে সামান্য হলেও কাজকে মর্যাদা দেওয়ার। চেষ্টা করে বড়দের দিয়ে শিশুদের জন্য কিছু করে নেওয়ার। খুব সামান্য হলেও সেই প্রচেষ্টা যদি শিশুদের বিকাশে কাজে লাগে, তবে মুজনাইয়ের শিশু দিবস পালন সার্থক হবে।



শিশু দিবসে বড়দের ভাবনা 


শিশু দিবসের  ভাবনা

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 


" ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে"। 

একটি   শিশু   বড়ো  হয়ে কেমন   হবে    তা বহুলাংশে   নির্ভর   করে   তার মা এবং বাবার জীবন   এবং  জীবন  দর্শনের   ওপর।   একটি  শিশু জন্মানোর পর নিজে থেকেই " মা "  ডাকটা শিখে নেয় ।  তার পর  থেকে  মৃত্যু  অবধি,  সে শুধুই   অনুকরণ   করতে  থাকে।  ধীরে ধীরে আপনা আপনিই  তার জগৎ তৈরী হতে থাকে।  শিশু জগৎ   বড়ই  মজার  এবং   বিস্ময়কর। সদা  ব্যস্ত  এই  জীবন ।  তার  মাঝে  এমন কিছু ঘটনা  ঘটে  যা  ভাবলে  অবাক হতে হয়।

বিশ্বব্যাপি  শিশুদের   সম্মান  জানানোর জন্য প্রথম  তুরস্কে  ২০ শে  নভেম্বর  দিনটি   শিশু দিবস  হিসাবে  পালিত  হয়।   বিভিন্ন   দেশে, বিভিন্ন   দিনে  শিশু  দিবস  পালিত   হলেও,  ১৯৫৬   সালের  পর  থেকে    ১৪ই   নভেম্বর  ভারতবর্ষের   প্রথম  প্রধানমন্ত্রী  পন্ডিত জওহরলাল  নেহেরুর  জন্মদিন  শিশু  দিবস হিসাবে  পালিত  হয়ে  আসছে। আজকের শিশু আগামীর   ভবিষ্যত,  তাই  শিশুদের  সঠিক ভাবে  সম্মান  করা, তাদেরকে  সঠিক  ভাবে বড়ো  করে  তোলা  অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ  একটা বিষয়।  শিশু  বড়  হয়ে  কেমন হবে,  তার জীবন জীবিকা,  চিন্তা  ভাবনার  জগৎ  বহুলাংশে নির্ভর  করে  তার  মা,   বাবা, দাদু, দিদিমা অন্যান্য পরিবারের সাথে  এবং   পরিবেশের উপর।   যৌথ  পরিবার  প্রথায়  বড়  হয়ে ওঠা এবং  নিউক্লিয়ার পরিবারে বেড়ে ওঠা  বাচ্চার ভিতর চিন্তা ভাবনার জগৎ এর তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। পরিবার  ভেঙে  যাবার  সাথে  সাথে পাড়া  ও সমাজের  ভাঙন  থেকে  সনাতনী  মূল্যবোধের অবক্ষয়  শুরু  হয়েছে।

আজকের  এই  বিশেষ  দিনটিতে  শিশুদের অনলাইন , অফলাইন এবং  বিভিন্ন মনিষীদের শৈশব নিয়ে আলোচনাসভা অত্যন্ত  জরুরি। সাথে সাথে  সঙ্গীত,  শিল্পকলার প্রচার ও প্রসার ঘটানো বিশেষ প্রয়োজন।



গড়ি ভবিষ্যৎ

অলকানন্দা দে


‘শিশু’ শব্দটি উচ্চারণে কোমলতা স্থান পায়। একটি সুন্দর মনকে খোলসে ভরে হয়তো বিধাতা পাঠান তাকে জ্যোৎস্নাময়ী পৃথিবী প্রান্তে, বিস্ময়ের আঁতুড়ঘরে! তাকে পেয়ে ভালোবাসা জাগে, মায়া জাগে! তার অকৃপণ বিলিয়ে যাওয়া তুষারশুভ্র হাসি সংখ্যাহীন সুখমুহুর্ত গড়ে দেয়! সে জানে না বিভেদকথা,প্রসারিত দুটি কোমল মুঠিতে আদর জড়ো করতে চায় শুধু! দিনমান যেন শুভ বিতরণই তার নির্ধারিত কাজ। আমরা উপভোগ করি প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় দিয়ে একটি শিশুর নির্মল বোধের খেলা! সাজিয়ে দেয় মনকে সে স্নেহ-কুমকুমে!

অমূল্য সময় ছুটে যায় বৈশাখী ঝড়ের বেগে। শিশু বড় হয় রৌদ্র-হাওয়া-নীলের সাথে তাল রেখে। সমাজের সবুজ ময়দানে তাকে বিশ্বাসে দাঁড় করানো অভিভাবকদের কাছে এক অভিমানের কাজ। এ দায়িত্ব নিপুণভাবে পালনে শিশু সাফল্যের শিখর পায় খুঁজে। একটি শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে তার সামাজিক অবস্থানের সিংহভাগ। দূর-বয়স পর্যন্ত যা তার সঙ্গী হয়। মুখোমুখি বসে তাকে পাঠ দিতে হয় মানবিকতাবোধের। পারিবারিক শৃঙ্খলা তাকে সন্ধান দিতে পারে একটি শ্রেয় জীবনের। নবীন জীবনটি গোড়া থেকেই যেন ভালো কে আপন ও মন্দকে এড়িয়ে চলার ব্যক্তিত্বে অনড় থাকে। প্রাণের পাত্রটি যেন পূর্ণ থাকে শ্রদ্ধা মায়া কর্তব্য দায়িত্ব ও ভালোবাসার মতো সম্মানিত অনুভূতি দিয়ে। প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বও সে পালন করতে শিখবে সম মর্যাদায়। গাছপালা পশুপাখি প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার মোহ যেন তাকে ঘিরে থাকে প্রত্যয়ে প্রত্যহ। আগামীকালের প্রতি এই দায়বদ্ধতা যেন সে সানন্দে পালন করতে শেখে। একটি সুস্থ বিশ্বচিত্র যেন সর্বদা লালিত হয় তার মানসে। স্বার্থপর অস্বচ্ছ সুখে যে কোন মহত্ব নেই একথা সে জানবে স্বাভাবিক কর্মিষ্ঠ আবেগ দিয়ে। সর্বপরি তার অন্তরে জ্ঞানের পিপাসাকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার ইতিহাসের উদাহরণকে সঙ্গী করে। তার শুভবুদ্ধি তাকে যোগ্য জায়গা করে দেবে লেখাপড়ার বিশ্বে। দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান জানাবে সে প্রমায়ু।

বাধা ঠেলে লক্ষ্যে পৌঁছনো জীবনের ব্রত। এ কথার সাথে শিশু পরিচিত হবে ধীরে ধীরে।পথ এতো মসৃণ হয় না, চড়াই উৎরাই থেকে যায় নিজস্ব স্বভাবে। শিশু শিখবে ক্রমশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে আশু পথের লড়াইয়ে। সময়কে সারথি করে দ্বিধাশূন্য বেগে পৌঁছবে নিজস্ব গন্তব্যে। জীবনে জয় তো চাই! সমাজের প্রত্যেকটি শিশু যেন তার প্রাপ্য অধিকার পায় এবং জীবনগঠনে যত্নবান হয় সেই ঘোষণা প্রবল হোক। ভাবী সমাজের মেরুদন্ড দৃঢ়তর হোক ইষ্ট অধ্যবসায়ে।প্রগতিস্রোতে গা ভাসিয়ে নির্মাণ হবে নিখুঁত ভবিষ্যতের! শিশু দিবসের চাহিদা সেটাই।চেতনায় ধনী হলে প্রত্যেকটি শিশু, সমাজের সন্ধ্যা সকাল প্রতিভার আবেগে হবে গৌরবী! শিশু দিবস তেমনই আশা রাখে সভ্যতার কাছে।


শিশু মন

অভিমন্যু


শিশুর আচরণের শিক্ষা থাক

বলার অধিকার শিশুরা পাক

শিশুরা হলো ফুলের মতন

করতে হবে ওদের যতন।


সোহাগ করেই পড়াতে হবে

কে আসে নি ইস্কুলে কবে !

রাখতে হবে খেয়াল রোজ

শরীর স্বাস্থ্য কুশল খোঁজ।


ওরা খুশিতে ছবি আঁকবে

হাসি মজায় আনন্দে নাচবে

বন্ধু হবে সকল গুরুজন

বাসবে ভালো শিশুর মন।



শিশুদের জন্য বড়রা 


ছড়া 

সোনাই ও  হলুদ পাখি 

শ্রাবণী সেন


নাম না জানা ফলের গাছে সে এক হলুদ পাখি

কখন থেকে মিষ্টি সুরে করছে ডাকাডাকি 

ছোট্ট সোনাই দৌড়ে এসে মাকে ডেকে বলে

"তাড়াতাড়ি দেখবে এস, নয়তো যাবে চলে"

মা বলেছেন "এই তো এল ইষ্টিকুটুম পাখি

সকালবেলা মধুর বড় এদের ডাকাডাকি।"

সোনাই কখন ঘরে গেছে আনতে ড্রইং কপি

আঁকবে ছবি পাখির, তাকে খেতেও দেবে টফি।

লক্ষ্মী পাখি চুপটি করে বসে গাছের ডালে

অবাক চোখে দেখছে কাকে পাতার আবডালে



টম অ্যান্ড জেরি

  রীনা মজুমদার


নিঝুম রাতে খুশির ঝিলিক চোখে মুখে

একাকি ইঁদুর ছানা খেলছে মহা সুখে


একটুকরো খাবার যেই না মুখে পোরে

নিঃশব্দে হুলো এসে ঘাড়টি চেপে ধরে 


আঁহহ লাগছে.. বলছি শোন হুলো দাদা

গিন্নীমা রেখেছে মস্ত বড় রুইয়ের গাদা


আনন্দেতে মাছের লোভে ঘাড়টি ছাড়ে

হতচ্ছাড়া! দাঁড়া, পালাবি কোথা এবারে


গর্তে ঢুকে ইঁদুর ছানা হেসেই কুটিপাটি

বিশ্বাসে দিলি ফাঁকি ! নেংটি চুনোপুটি


 গাল দিও না বলছি, বাঘের মাসি বলে

দেমাক তোমার দেখছি বড্ড বেশি চলে !


 বেজায় চটে হুলো যেই না করে ঘুমের ভান

  ভাব জমাতে ইঁদুর দেয় লেজটি ধরে টান 


নিমেষে জাপটে হুলো বলে, বন্ধুত্ব থাকবে জারি

শিশুদের মনে থাকব আমরা 'টম অ্যান্ড জেরি'



দুটি ছড়া

রথীন পার্থ মণ্ডল 

১. রসময় মান্না 

রাশভারী লোক ছিল রসময় মান্না 

একদিন ভোজ খেয়ে কী ভীষণ কান্না! 

আজকাল ভোজবাড়ি তিনি আর যান না 

টিভি দেখে নানা পদ করে যান রান্না। 


হেসে বলেন, দেখেছেন চুনী আর পান্না ! 

রসময় গান শোনে, রফি আশা মান্না। 

খুশি ছাড়া জীবনে তিনি কিছু চান না 

হাসি খুশি মনে করে তিনি ঘরকন্না। 


ভোর হতে প্রাণায়াম হাসি রাশি বন্যা 

গাড়ি ছেড়ে পথে হাঁটে রসময় মান্না 

খেতে চান ভালো পদ অপদ হলে যান না

রসময় গুণ ধরে, করে বেশ রান্না। 


গান গায় গুণগুণ, ভুলে গেছে কান্না

হাসি মুখে মন জয় রসময় মান্না।


২. মা দুগ্গা

নীল আকাশে মায়ের পাশে

ঝলমলে এক রবি, 

তাই না দেখে ফুটলো মনে

মহালয়ার ছবি। 


মহালয়ায় আসেন মা

তারই বাপের বাড়ি,

সবার সাথে সবার তখন

হয়না কোনো আড়ি।


বাপের বাড়ি এসে মা

থাকেন কটা দিন, 

হইচই, হই হুল্লোড়

বাজাই শুধু বীণ। 


সবার শেষে যখন মায়ের

আসে যাবার পালা,

চোখের জলে বন্যা আসে

বুকে ধরে জ্বালা। 


আজ পুতুলের বিয়ে

অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী


বন্ধুরা সব অনেক দূরে স্কুলের নেই পাট

খেলার মাঠও ভুলে গেছি 

কুমির ডাঙ্গা,  কানামাছি, 

দোলনা দোলা,ছুট লাগানো, 

হাসি মজায় দিন কাটানো, 

টিফিন বেলার গন্ধমাখা, 

আড়ি ভাবের ছন্দে আঁকা

সেই সে খুশির হাট।। 


অনলাইনেই পড়া এখন, একলা ঘরেই খেলা

মায়ের সাথে খুনসুটিতে কাটছে সারাবেলা। 

আবদার তাই মায়ের কাছে 

ভাসিয়ে স্মৃতির ভেলা, 

পুতুল খেলায় দেখতে চাওয়া

মায়ের ছেলেবেলা।। 


দুজন মিলে যত্ন করে 

সাজিয়ে নিলাম পুতুলঘরে

খেলনাবাটি পুতুল যত 

ছিল আমার মনের মতো

আদর করে তাদের নিয়ে

বসলো খুশির মেলা।। 


জড়িপাড়ের রেশমি শাড়ি, 

পুতির মালা রংবাহারি, 

ঝুমকো দুলে, খোপার ফুলে 

হাজার খুশির ঝিলিক তুলে

কনে সেজে পুতুল আমার

আলো করলো বাড়ি।। 


বর পুতুলও নজরকাড়া 

সঙ্গীসাথী আরও যারা

টুকরো ধুতির বসন পরে, 

চন্দনটিপ কপাল জুড়ে

বাজনা বেজে, আলোর মাঝে

খেলনা গাড়ির সঙ্গে নেচে

হাজির হলো সবাই মিলে 

মাতিয়ে পুতুল পাড়া। 

ফুলকো লুচি, আলুর দমে, 

ছানার পায়েস আর চমচমে

খাওয়ার আসর উঠলো জমে

সাতটি পাকে বাঁধা পড়ে বিয়ে হলো সারা।। 


হঠাৎ দেখি পুতুল মেয়ের 

মুখটি যেন ম্লান

জল ছলছল চোখ জুড়ে তার

কীসের অভিমান!! 

কাঁপা ঠোঁটে থরথর

বলছে আমায় ডেকে

'পড়বো আমি, লিখবো আমি

থাকবোনা মুখ ঢেকে।

খেলার পুতুল থাকবেনা আর

একলা ঘরের কোণে

বিশ্বজয়ের মন্ত্র নিয়ে

স্বপ্ন নেব বুনে।'


অবাক আমি পুতুলমেয়ের 

মুখের পানে চেয়ে, 

মায়ের মুখের ছবিখানি

ভাসছে ও মুখ ছেয়ে।। 



ফ্যাশন

শ্রাবণী সেনগুপ্ত


কৈলাশ ধাম শশব্যস্ত

স্যুটকেস এক নেমেছে মস্ত।

দূর্গা মায়ের পিছে পিছে সব,

সারা ধাম জুড়ে কি যে কলরব।

কার জামাখানি বেশি ফ্যাশনের

এই নিয়ে চুলোচুলি দুজনের।

কাতু বলে -গোণু ,তোর হবেনা,

এই জামাটা আমারই পাওনা।

মোটাসোটা বলে লাজুক গণশা

ভাইয়ের কথাতে নাড়ল কানটা।

লক্ষী সরস্বতী করে হুড়োহুড়ি,

জিন্স শার্টে স্মার্ট পুরোপুরি।

দূর্গা বলেন -কর তাড়াতাড়ি,

ফ্যাশন করিস গিয়ে মামাবাড়ি।

ধুর ছাই, ওখানে এসব চলবে?

খালি শাড়ি পর-সবাই বলবে।

ভাইদেরও ধুতি,গলায় পৈতে,

ক'দিন হবে এসবই সইতে।

বাবা ভালো আছ, তুমিতো যাবেনা,

ড্রেস ট্রেস নিয়ে নেইতো ভাবনা।

এবার ওখানে করব মিনতি,

পরবো হাল ফ্যাশনের জামাটি।



শিশু কথা

বিজয় বর্মন 


মাম্মি আমি বাড়ছি দেখ

কেমন একা একা,

পৃথিবী টা ঘরের কোণে,

হয়ে যাচ্ছি বোকা।


তোমার মুখে হাসি দেখি,

আমিও হাসতে চাই,

বন্ধ দুয়ার বন্ধ কোটর,

বন্ধু কোথায় পাই ?


তোমার মুখে গল্প শোনা,

ঠাকুরদাদা ঘোড়া,

আমি কেন একা ভাবি,

কেন একা চোরা।


ঠাকুমার নাকি গল্পের ঝুলি,

তাকেই দেখি না,

বাড়িতে শুধু একা বোকা,

বাড়ছে যন্ত্রণা।


ক্লান্ত আমি একা ছুটে,

বিদ্যা বোঝা লাগে,

চেঁচিয়ে বেড়াও সারা বাড়ি,

মাথা গরম রাগে।


সবুজ মাঠে খেলতে যাব,

রোদে ঘামে ভিজে,

আমি ছুটবো তুমিও পিছে,

মজা মজা কি যে।


সবার সাথে একটু কথা,

একটু হাসাহাসি।

রাগ করে না সোনা মা,

খোলা হাওয়ায় বাঁচি।


ইস্টিকুটুম

অমিতাভ সরকার


ইষ্টিকুটুম পাখি
তার যে দুটি আঁখি
গোল্লা গোল্লা পাকায়
আর ফল ঠুকরে খায়।
ইষ্টিকুটুম পাখি
আমায় দিবি নাকি,
দু-তিনটে ফল
বলনা আমায় বল।
ইষ্টিকুটুম পাখি
তোর এত্তো ডাকাডাকি,
শুনতে পাস না নাকি
আমার পরীক্ষা যে বাকি।
ইষ্টিকুটুম পাখি
আয়, খেলবি নাকি
তোর এখন যাবার তাড়া --
আছে বুঝি তোর পড়া ?
ইষ্টিকুটুম পাখি
আকাশ কি তোর সখি ?
পেতাম যদি ডানা
তবে হতো আমার ঠিকানা।
ইষ্টিকুটুম পাখি
আমায় নিবি নাকি
তোরই সাথে উড়ে
যাব মেঘরাজ্যে সুদূরে।


গল্প 

লক্ষীমন্ত

চিত্রা পাল 

      একটা ধমাস্‌ করা শব্দে ও চোখ বুজে ফেললো।  আর সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে ভেসে এলো ওর মায়ের চিৎকার,আবার কি  ফেললি, ভাঙ্গলি তুই?’ আলমারির ওপর থেকে বলটা পাড়তে গিয়েই এই বিপত্তি।ওপরে রাখা সুটকেশটা পড়ে গেছে। ‘এমন লক্ষী ছাড়া মেয়ে কারোর বাড়িতে নেই’বলে দৌড়ে এসে ওর চুল ধরে এক টান দেয়। তারওপরে চলে বকাবকি। কালকেই এনিয়ে খুব বকাবকি হয়েছে। পরে ওর বাবাও ওকে বুঝিয়েছে।       

     আজ সকাল সাতটার মধ্যেই  লক্ষী পড়তে বসে গেছে। কেননা ওর বাবা বলে দিয়েছে যে, রোজ তুই যদি পড়াশোনা না করিস্‌, তাহলে কিন্তু বিষয়ই ঠিকমতো তৈরি হবে না, আর ঠিকমতো তৈরি করতে হলে  রোজ নিয়ম করে পড়াশোনা করতে হবে। কথাটা বোঝা গেলো? লক্ষী বাবার সামনে টুকটুক করে ঘাড়   নাড়ে।সেদিন সকালে  ওর বাবা বাজারে যাবার ঠিক আগে ওকে ঘরে ডেকে একটা রুটিন ধরিয়ে দিয়ে বলে এই আমি রুটিন করে দিয়েছি। এখন এই রুটিন অনুযায়ী চলতে হবে।তাই সকাল সাতটাতেই ও পড়তে বসে যায়।   

  সবে কবিতাটা মুখস্ত করতে শুরু করেছে, এমন সময়ে ওর মোবাইলটা বেজে ঊঠলো,দেখে বিনির ফোন। পড়াশোনার সময়ে ফোন করা বারণ,এমনকি ধরাও। গত বছর করোনা কালে অন লাইন পড়া শোনা হতো বলে ওর পড়ার কাজের জন্যই ওর বাবা ওকে এই মোবাইলসেট কিনে দিয়েছে। এতে ওর খুব সুবিধে  হয়েছে। পড়াশোনার কাজ তো আছেই, এছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা গান শোনা এসবও চলতে থাকে। তবে সেখানেও বিধিনিষেধের পাহারা। ও যখন নিজে পড়বে তখন ফোন করা চলবে না। ফোন যাতে না আসে তাই ফোনটাকে বন্ধ করে রাখতে বলে। ও তবে ফোন বন্ধ করে রাখে না। কিন্তু কথা টথাও বলে না।

   আজ বিনির সঙ্গে সবে কথা বলা শেষ করেছে, বাবা এসে হাজির ওর কাছে।জিজ্ঞেস করলো কার  ফোন  রে?লক্ষী তখন কিছু বলতে যাচ্ছে,বিনি বললো, একবার কাকুকে দেতো। বাবা, ও তোমার সঙ্গে কথা বলবে, বলে ফোনটা দিয়ে দেয়।সব শুনে ওর বাবা বলে এখনি আসছি। লক্ষী কে বলে যেতে পারবি এখন?হ্যাঁ বলতেই দুজনে বাইক বের করে একেবারে ভোঁ দৌড়। শুধু একবার মুখ বাড়িয়ে ওর মাকে বলে গেলো, শুনছো, আজ বাজারে যেতে দেরি হবে,আমি আর লক্ষী একটু বেরোচ্ছি। ওর মা কি যেন বলতে যাচ্ছিলো,ততক্ষণে ওরা গেটের বাইরে।  

   লক্ষীর নাম লক্ষী রেখেছে ওর ঠামা। না, ঠিক লক্ষী নয়, উনি রেখেছিলেন লক্ষীমন্ত, সেটা কাটছাঁট করে সবাই ডাকে লক্ষী। তবে ওর ঠামি এখনোও আদর করে ওকে লক্ষীমন্ত বলেই ডাকেন। ওর মা অবশ্য বলে, এতো দস্যি মেয়েকে কি করে যে মা লক্ষীমন্ত বলে কে জানে বাবা,সারাদিন এটা ভাঙ্গছে,ওটা ছিঁড়ছে,এদিকে ছুটছে ওদিকে দৌড়োচ্ছে। এতো বড় হয়ে গেলো এখনোও দুরন্তপনা যায় না। তারওপরে আছে পশুপাখিপ্রীতি। কখনও কুকুরছানাকে এনে খাওয়াচ্ছে,কখনও বেড়ালছানা নিয়ে আসছে ব্যাগে করে, একদিন খুব যত্ন করে পাখীর ছানা নিয়ে এসেছিলো,বললো বাড়ির কাছের বটগাছের নিচে পড়েছিলো। তাকে এনে জল খাওয়ানো খাবার দেওয়া সবই করেছিলো, আর এসব কাজের সঙ্গী ওর বাবা। বাড়িতে থাকলে মেয়ের সঙ্গে সেও লেগে পড়ে। তাতে ওর উৎসাহ আরও বেড়ে যায়।এখন ওর মা ভাবছে, কিন্তু এখন হঠাত্‌ দুজনেই বেরিয়ে গেলো, কোথায় গেলো কিছুতো বলে গেলো না,আর সে সময়ই বা কোথায়,ফিরে এলে জানা যাবে।  

   আসলে বলার সময় ছিলো না। বিনি এতো তাড়া দিলো যে ওর বাবা আর সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের বাড়িতে পৌঁছতে চেষ্টা করলেন। এখানে এসে বুঝলেন তাড়াতাড়ি এসে ভালোই করেছেন। বিনি বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ওরা আসতেই ওদের নিয়ে গেলো বাড়ির পেছনের দিকে বাগানে, যেখানে একখানা নারকেল গাছ আছে,আর সেই গাছের একেবারে ওপরের ডালে ঝুলছে একটা পাখি। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন,ওটা একটা পেঁচা,কি করে যেন ঝুলছে ওখানে।কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। বিনি জানে ওর বাড়িতে বলে কিছু হবে না, কেউ গা করবে না, পাত্তা দেবে না। তাই লক্ষীর শরণাপন্ন।  

    লক্ষীর বাবা খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন যে, পেঁচাটা উড়তে পারছে না কারণ ও নারকেল  গাছের পাতার সঙ্গে ঝুলে আছে,আর কোনরকমে আর একটা ডানা দিয়ে ঠেকনা দিয়ে রেখেছে। ওদের দেখাদেখি আরও দু চারজন এলো ওই গাছের তলায়। এদিকে ওর কাছাকাছি দু,একটা কাক ও চলে  আসছে ওকে ঠুকরে দিতে। কিন্তু নীচে থেকে সবাই হুশহাশ করছে, শব্দ করছে বলে কাকও কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। লক্ষী প্রথমে ওর বাবাকে বলে ‘ওখানে কি যেন সুতো ঝুলছে মনে হয়,বাবা ভালো করে দ্যাখো। লক্ষী র কথাতে উনি ভালো করে লক্ষ্য দেখলেন,হ্যাঁ মনে হচ্ছে তাই। কিন্তু ওখানে ওই অত উচুঁতে সুতো ঝুলবে?ওখানে সুতো আসবে কি করে? 

   ওদিকে মানে নারকেল গাছের কাছেই একটা তালগাছ। সেই গাছের মাথায় একদম মগডালে খানিকটা রঙীন কাগজ ঝুলছে। গাছের মাথায় রোদ পড়েছে বলে সেই কাগজগুলো এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আর একটু ভালো করে দেখলে দেখা যায়, একটা ঘুড়ির কাঠামো ওই গাছে ঝুলে রয়েছে। তারই খানিকটা কাগজ ছিঁড়ে ওই মাথায় আটকে আছে। লক্ষী বুঝে গেলো,  বিশ্বকর্মা পুজোর সময় ঘুড়ি ওড়ায় সবাই।ঘূড়িতে ঘুড়িতে প্যাঁচ খেলে।সে রকম হয়তো কোন কাটা ঘুড়ির সুতো ওই গাছে আটকে আছে। পেঁচাটা উড়ে বসতে গিয়ে ওই সুতোয় ওর ডানা জড়িয়ে যায়।ও যা ভেবেছে ঠিক তাই। ওর বাবা ভালো করে দেখে বললো, ওখানে সুতো এলো কোথা থেকে? বোধ হয় ঘুড়ি ওড়ানোর সুতো ওখানেগাছের ডালে আটকে গেছে, সেই সুতো এখন ওর ডানায় জড়িয়ে গেছে। ও উড়তেও পারছে না, বসতেও পারছে না। ওদিকে আগে একটা কাক আসছিলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো ওর কাছে, এখন দুটো কাক ঘুরপাক খাচ্ছে ওকে ঘিরে। তার ভয়ে পেঁচাটা মাঝেমাঝেই চিত্‌কার করছে। এখান থেকে হুশহাশ শব্দ যতই করা হোক অতো উচুঁতে যে কিছুই করা যাচ্ছে না। 

   ওদের ওই বাগানে ওপরের দিকে তাকিয়ে কথাবার্তা বলতে দেখে আশপাশ থেকে আরও দুচারজন জড়ো হলো,কিন্তু কেউই পেঁচাটাকে ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করার কোন উপায় করতে পারছে না। তখন  লক্ষীর বাবা হঠাত্‌ বললেন,আচ্ছা, দমকলকে খবর দিলে হয় না?ওদের অনেক লম্বা মই থাকে বা ওরা কোন কিছু উপায় জানতে পারে, কিভাবে উদ্ধার করা যায়। কেননা,এইথেকে একটা কথামনে পড়ল, একবার হাওড়া ব্রীজের মাথায় এক পাগল উঠে পড়েছিলো, তাকে সাবধানে এই দমকলবাহিনীর লোকজনেরাই নামিয়ে ছিলো। ভাবনাটা আসামাত্রই মেয়েকে বাইকের পেছনে বসিয়ে একেবারে তুরন্তগতিতে দমকল অফিসে। 

    সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলাতে ওনারা পেঁচাটাকে উদ্ধার করতে আসতে রাজী হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একেবারে ঘন্টা বাজিয়ে লোকলস্কর নিয়ে দমকল বাহিনী এসে হাজির। ওরা এসে আগে সরেজমিনে সব পরীক্ষা করে দেখে নিলো। যে গাছে পেঁচাটা ঝুলছে, সেই নারকেল গাছের গুঁড়ির গা বেয়ে একখানা লম্বা মই লাগিয়ে দিলো। ওদিকে খড় চট এসব দিয়ে বেশ পুরু একখানা গদি বানিয়ে  রাখলো গাছেরতলায়।  এবার ওদের লোক লম্বা মই বেয়ে একেবারে শেষ অবধি ওপরে উঠে সেখান থেকে একখানা লম্বা লগির মাথায় চাকু লাগিয়ে খুবই কষ্ট করে পাতাটার গোড়া থেকে কাটতে শুরু করলো।নারকেল গাছের পাতা অন্য গাছের পাতার মতো সহজে ছেঁড়া যায় না। পাতার গোড়া বেশ শক্ত পোক্ত। একে কেটে নামানো সহজ  নয়।  বেশ খানিকখন চেষ্টার পরে গাছের পাতাটা খানিক নুয়ে এলো। পাতাটা কোনরকমে গাছ থেকে ঝুলে পড়তেই সেটা কে একেবারে টেনে নামিয়ে ওপর থেকে নীচে ফেলে দেয়। নীচে নরম বিছানা করা ছিলো  বলে পাখিটার লাগেনি।  

 এখন ওর ডানা থেকে সুতো খুলতে হলে পেঁচাটাকে ধরে থাকতে হবে। লক্ষী যেন ইতস্তত করছে,  একটু থতমতো খাচ্ছে,ঠিকমতো সাহস পাচ্ছে না এরকম দেখে ওর বাবা বললো, তুই ওকে ধরে থাক,আমি  সাবধানে পাকানো সুতোটাকে খুলতে চেষ্টা করি। ডানাটা ক্লিয়ার না করলে ও পাখা ঝাপটাতে পারছে না। লক্ষী যত্ন করে ধরে রইলো, আর ওর বাবা খুব ধীরে ধীরে সাবধানে সুতোটাকে খুলতে চেষ্টা করলেন। তা না হলে ডানা সুতোর ঘায়ে এমনি কেটে গেছে আরও কেটে যাবে। আর যাতে না কেটে যায়, সেটা দেখতে হবে যে।  

  সুতোটা খুলে যেতে ও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। একবার ডানা ঝাপটাবার চেষ্টা ও করলো। এবার ডানার কাটা জায়গাগুলোয় মলম লাগিয়ে দিতে বোধ হয় বেশ আরাম পেয়েছে। ও কিন্তু লক্ষী র কোলেই বসে  আছে।এবার ওকে কিছু খেতে দেওয়া হলো, জল দেওয়া হলো কাগজের গ্লাসে। ওগুলো ওর খাবার নয়,এরা দিয়েছে,তাই আর কি করে, ওই একটু মুখে দিয়েছে।   

    মোবাইলে অনেকগুলো ছবি তুলেছে ওর বাবা। এখনও কেমন যেন নেতিয়ে আছে,ওকে একটা জালের ঘেরাটোপে রাখা হয়েছে। দমকলবাহিনী বিদায় নেবার আগে বলে গেলো ওদের কাজ শেষ,তবে যাবার আগে ওদের মধ্যে একজন বোধ হয় সে একটু বেশি বুঝতে পারে, সে বললো লক্ষীর বাবাকে ডেকে যে এই প্রজাতির পেঁচা এখন খুব কমে গেছে। একে উদ্ধার করে ভালো করেছেন। ওকে বাঁচাতে  গেলে আপনারা ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, ওরাই ওকে ঠিক প্রসেসে নার্সিং দেবে। 

  ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ওরা ওকে থানায় নিয়ে আসতে বলে। লক্ষী আর ওর বাবা একটা জালের ব্যাগে করে থানায় নিয়ে আসে।এখন পেঁচাটা একটু নিশ্চিন্ত বিশ্রাম পেয়ে, একটু খাবার আর জলখেয়ে আগের চেয়ে চাঙ্গা হয়েছে মনে হলো। কিযেন সবাইকে ভালো করে দেখছে।বিশেষ করে  লক্ষীকে। লক্ষী ওর বাবাকে আস্তে আস্তে বলে,দ্যাখো ও ন্যায় আমাকেই দেখছে। ওর বাবা ওকে বলে, ওরও যে প্রাণ আছে রে। তুই ওকে প্রাণ দিয়ে রক্ষে করছিস্‌ যে সেটা ও ঠিক বুঝেছে,তাই বোধ হয় তোকেই অমন করে দেখছে।  ওরা ওর জন্য একখানা খাঁচা নিয়ে এসেছিলো, সেই খাঁচায় ভরে নিয়ে চলে গেল।   যাবার সময়ে বলে গেলো আমরা ওকে আগে সারিয়ে তুলি। ও ভালো হয়ে গেলে একবার দেখে যাবেন।  

  লক্ষী ওর বাবার সঙ্গে যখন বাড়িতে এলো,তখন অনেক খানি বেলা হয়ে গ্যাছে। ঠাকুমা ,মা সবাই  উদবিগ্নমুখে বাড়ির সামনে গেট ধরে দাঁড়িয়ে। লক্ষীর বাবা বললো ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে। ঠাকুমাও বললেন, হ্যাঁ, আগে তোরা চানটান করে খেয়েদেয়ে নে, তারপরে কথা। লক্ষী তো ভয়ে ভয়ে আছে, কি জানি মা হয়তো আজ আবার বকবে। ওর বাবা সব ঘটনা বললো আর মোবাইলে তোলা ছবিগুলো দেখালো। সবাই দেখলো, কি অসহায় করুণভাবে একটা পেঁচা বসে আছে লক্ষীর কোলে। ওর মা হাসিমুখে দ্যাখে, আর ঠাকুমা এসে লক্ষীকে আদর করে বলে, তাইতো আমি দিদিভাইএর নাম রেখেছি লক্ষীমন্ত।একেবারে ঠিক নাম তাহলে।।


নক্ষত্র গ্রাস
সুদীপা দেব

সাতসকালে খবরের কাগজ হাতে বাড়িময় হই হই করে বেড়াচ্ছেন মধুর ছোটকাকু
―সবাই দেখো দেখো আমাদের মধু কি কাণ্ড করে ফেলেছে! আর তোমরা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ!
বলে তিনি ড্রইংরুমে টিভিতে নিউজ চ্যানেল চালিয়ে দেন।
বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের ঘুম উড়ে গেছে। স্টিফেন হকিং মৃত্যুর আগে বারবার বলেছেন পৃথিবী আগামী একশ বছরের মধ্যে ধ্বংস হতে চলেছে। এরপরও বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। বিজ্ঞানীরা তাঁর কথা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। তাঁরা বহুদিন ধরে অন্তরীক্ষে বিকল্প বসবাসের ব্যবস্থা চেষ্টা করছেন কিন্তু তাদের এই খাটুনি খুব বেশি ফলপ্রসু হয়নি এখনো। এরইমধ্যে অন্য এক কারনে আমাদের মৃত্যু ঘন্টা বেজে উঠছে। বিশাল এক জাইগ্যান্টিক নক্ষত্র এমেডা ফিও ধেয়ে আসছে সৌরমণ্ডলের দিকে। বড়জোর আর ত্রিশ বছর। তারপরে সব শেষ। মৃত নক্ষত্রের তালিকায় যেতে বসেছে আমাদের সূর্য। সূর্যসহ গোটা সোলার সিস্টেম চলে যাবে ওর পেটে। প্রায় পনের লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে টেন টু দি পাওয়ার 4 km/s বেগে ধেয়ে আসছে সূর্যকে গ্রাস করতে। প্রায় আঠের কোটি বছর আগে অলিওলাই নামে নিতান্ত একটা সরল নক্ষত্র হঠাৎই তার চরিত্র পরিবর্তন করে। সাধারণত নক্ষত্র ক্রমাগত শক্তি ক্ষয় করতে করতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রচন্ড বেগে ধাবমান এই নক্ষত্র ফিমেরাস নামে আরো এক নক্ষত্রকে গ্রাস করে এবং প্রচন্ড শক্তি বৃদ্ধি করে এবার সূর্যের কক্ষতলে আসছে। যেহেতু পৃথিবী ছাড়া সৌরমণ্ডলের অন্য কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নেই তাই মানুষের ওপরই সৌরমন্ডলকে টিকিয়ে রাখার দায়ভার বর্তায়।
আজ রবিবার। এদিন বাড়ির সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করা বহুদিনের নিয়ম। ইদানিং মধুর দাদু অসুস্থ থাকেন। তাই আজকাল তিনি এই নিয়মের ছাড় পেয়েছেন ছোটকাকুকে মধু ছোটন বলে ডাকে। তিনি এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকেন রবিবারের জন্য। পুরো বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের হাল-হকিকত এক সপ্তাহে যতটা জোগাড় করা যায় তিনি জমা করেন। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বেশ রসিয়ে সেসব খবর পরিবেশন করেন। বাড়ির বড়রা খানিকটা কান থেকে মাথায় চালান করেন আর খানিকটা এক কান দিয়ে প্রবেশ করে অন্য কান দিয়ে বের করে দেন।
ছোটনের গল্প শুনতে মধু আর তার দিদির কিন্তু বেশ লাগে। পৃথিবী জুড়ে কত কাহিনী ওরা দেখে ছোটনের চোখ দিয়ে! ছোটন আজ পৃথিবী সহ গোটা সৌরমণ্ডলের অপমৃত্যুর কাহিনী শোনালেন। তবে এ কথা যেন কেউ খুব একটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। আসলে ছোটনের গল্পগুলো সবাই গল্প হিসাবে ধরে নেয় বেশির ভাগ সময়। সামনে পুজো আসছে। আজকের ব্রেকফাস্ট টেবিলের মুখ্য বিষয় ছুটিতে বেড়ানোর প্ল্যান। কিন্তু ছোট্ট মধুর মাথায় ঘুরছে ছোটনের মুখে শোনা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের অশনিসংকেত!
এদিকে হাতে সময় বড় কম। প্রায় কুড়ি বছর। দৈত্য নক্ষত্র চলে এসেছে সূর্যের অনেকটা কাছে। এই নক্ষত্র দ্বারা বিচ্ছুরিত কসমিক রে সৌরমন্ডলের সমস্ত গ্রহের রেডিওঅ্যাক্টিভ মৌলের রেডিওঅ্যাক্টিভিটি অতি উচ্চমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। এই তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে মানুষ সহ পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীরা সম্পূর্ণ নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। খুব অল্প সময়ে মারাও যাচ্ছে। ডাক্তাররা দিশাহারা। তাঁরা চিকিৎসা করা সুযোগটুকু পাচ্ছেনা। হঠাৎ আগত অসুখ নিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা নাজেহাল হয়ে উঠছে।
মধুমিতা রায় কাজ করছেন গবেষণাগার- ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রফিসিক্স, ব্যাঙ্গালোর। দিনরাত গবেষণামূলক পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
দিনের-পর-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আবিষ্কার হলো সুপার কন্ডাক্টিভ পাওয়ার জেনারেটর(SCPJ)। এই জেনারেটর তিনি স্থাপন করেন ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আট হাজার ফিট উচ্চতায়। লাদাখের পর্বতচূড়ায় বিশেষ এক কৌণিক ক্ষেত্রে। সুপার কন্ডাক্টিভ কয়েল থাকার ফলে তীব্র চুম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম এটি। ধেয়ে আসা নক্ষত্র থেকে বিকিরিত তীব্র তড়িৎ কণা যন্ত্রের চুম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রবেশ করা মাত্র সুপার কন্ডাক্টর জেনারেটরের জন্য সৌরমণ্ডলের কক্ষতলে প্রবেশের আগেই লরেঞ্জ বল অনুসারে তার গতিপথ পরিবর্তন করে। সবচেয়ে কম প্রায় সাড়ে 88 ডিগ্রী কৌণিক বেগের ঘুরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ আপাতত সোলার সিস্টেমের মুক্তি। গত এক মাস ধরে এই ট্রায়াল' হয়েছে এবং আজ ছিল শেষদিন। আজও এই পরীক্ষা সফল। আগামী তিনদিনের মধ্যেই এই যন্ত্রটি স্থায়ী স্থাপন হবে।
দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা ফোনে মেইল করে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মধুমিতা রায়কে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। অল সাইন্টিস্টস অফ অ্যাস্ট্রোনমি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিজ্ঞানীরা মধুমিতাকে রায়কে সম্মান জানিয়ে তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রের নাম দেন সুপার কন্ডাক্টিভ রে জেনারেটর (SCRJ)।




স্মৃতিকথা 

শিশুদিবসের সেই দিনটি

        বুলবুল দে


আজ চোদ্দ ই নভেম্বর, শিশু দিবস। শিশুদের নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান, আয়োজন,পরিকল্পনা,লেখালেখি

আরও কত কি হবে। এই দিনটা আসলেই সুমির মনটা সেই সময়ে চলে যায়।সে তখন খুব ছোট, নার্সারিতে পড়ে। বাবার চাকরির সূত্রে জলপাইগুড়িতে থাকত। ভাই তখনও হয়নি। তবে মাঝেমধ্যেই ছুটিছাটায় বা অন্য কোনও কারণেও ওরা কোচবিহারে চলে যেত কারণ সেখানেই তারবাবার পৈতৃক বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে ওর চার জেঠু তাদের ছেলে মেয়ে ,কয় কর্মচারী আরও নানা লোকজন নিয়ে বিশাল একান্নবর্তী পরিবার।সেখানে গেলেই খালি মজা,আনন্দ, খেলা আর হুটোপুটি। সেই বাড়িতে মাঝখানে একটা বিরাট উঠোন কে ঘিরে চারপাশে সব জেঠুদের আর ওদের আলাদা আলাদা ঘর। সেই কমন উঠনের দিকে যেমন সবার বাড়ির দরজা আর বারান্দাথাকত তেমনই প্রত্যেক বাড়ির পেছন দিকেও দরজা বারান্দা ,উঠোন আর বাইরে বেরোনোর গেট থাকত। প্রত্যেক বাড়ির সামনের আর পিছন দিককে সবাই বলত সামনের মুড়া আর পিছন মুড়া। বাড়ির ছোটরা এই মুড়া থেকে ঐ মুড়া ঐ মুড়া  থেকেসেই মুড়া হুড়োহুড়ি ছুটোছুটি করে বেড়াত।থাকার ঘর আলাদা হলেও একটাই কমন রান্নাঘর ছিল।সেই বিশাল লম্বা রান্নাঘরে সেই একান্নবর্তী পরিবারের রান্নার জন্য রোজ সকালে ধবধবে ফর্সা,লম্বা,টানটান চেহারা,থাকথাক চুলের এক বিহারী ব্রাহ্মণ ঠাকুর আসতেন।সদ্যস্নাত সেই ঠাকুরের পরনে থাকত ধবধবে সাদা ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবী, কপালে চন্দনের ফোঁটা।আর মজার ব্যাপার ছিলনিজে বিহারী হওয়া সত্ত্বেও সুমিকে সে বিহারী ভুত বলে ক্ষ্যাপাতো।কারণ সুমির মামা বাড়ি ছিল বিহারে। যাইহোক সেবার নভেম্বর মাসে সুমিরা কোচবিহারে এসেছিল।বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই প্রতিবারের মত সেবারও দাদা দিদিরা ''ছোট কাকা আসছে, ছোট কাকা আসছে'' বলে ছুটে এসে ওদের ঘিরে ধরেছিল। তার পর তো সুমিকে কে কোলে নেবে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। সুমি প্রত্যেক বার এগুলো খুব উপভোগ করত। সেবারও কোচবিহারে কটাদিন ভারি মজায় কাটতে কাটতে অবশেষে যাবার দিনটাও গুটি গুটি পায়ে চলে এল। তারপর যখন জামার ওপরে বাবার দেওয়া নতুন লাল টুকটকে কোটটা পরিয়ে মা তাকে যাবার জন্য প্রস্তুত করিয়ে দিলেন তখন তো সুমির চোখ ফেটে জল বেরোনোর উপক্রম। যখন রিকশায় উঠে বসেছে তখন হঠাৎই সুমির কোটের পকেটটা ঝনঝন করে উঠল। ওদেরকে ঘিরে থাকা দাদা দিদিদের মধ্যে একজন বলে উঠল, 'তোর পকেটে কি আছেরে সুমি'?

''এগুলো পয়সা' সুমি উত্তর দিয়েছিল। সত্যিই সে বাবার কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে দুই পকেট ভর্তি করে পয়সা জমিয়েছিল। হঠাৎ তার কি মনে হল, সে বলে উঠল ''তোমরা পয়সা নেবে'? অমনি সবাই হৈ হৈ করে বলে উঠল, ''হ্যাঁ হ্যাঁ আমাকে দে আমাকে দে''। ব্যাস সুমিও পকেট থেকে মুঠো করে পয়সা নিয়ে ওদের দেওয়া শুরু করে দিল। পয়সা নেওয়ার জন্য বাড়ির সব ছোট ছেলে মেয়েরা গেটের সামনে ভীর করে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল। এমনকি পাশের এক দুটো বাড়ির ছেলে মেয়েরাও সেই ভীরে সামিল হয়ে গেল। রাস্তার মধ্যে যেন শিশুদের হট্টমেলা বসে গেল। আর সুমিও যেন পয়সা গুলো সবাইকে বিলিয়ে দিতে দিতে এক অপার্থিব আনন্দে বেলুনের মত হাল্কা হয়ে ভেসে ভেসে উপরে উড়ে যেতে লাগল। আঃ কি আনন্দ! কি সুখানুভূতি! নিজেকে কেমন রাণী রাণী মনে হচ্ছিল। ঐ ছোট্ট বয়সেও ঐ অনুভূতি সে অনুভব করেছিল। এভাবে দু পকেট  ভর্তি পয়সা শেষ হয়ে এল। একটা দাদা সেখানে উপস্থিত ছিলনা সেও কার কাছে যেন খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল,''বুনু বুনু, আমাকেতো পয়সা দিলিনা।'' সুমির বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। যাঃ এখন কি হবে? সে আতি পাতি করে পকেট হাতরাতে লাগল। নেই,আর যে নেই! তাহলে কি করে দেবে? তবুও সে খুঁজে যাচ্ছে। হঠাৎ আঙ্গুলে কি যেন একটা ঠান্ডা মত ঠেকল। সেখানে ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে কাপড়ের ভাজে একটা পয়সা।বের করে দেখে একটা আটআনা। সেটা দাদাটাকে দিয়ে মনটা খুশিতে উছলে উঠল। মনে আছে সেই দাদাটা আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলছিল,''আগে গেলে বাঘে খায় পরে গেলে সোনা পায় ''। কারণ সুমির কোটের পকেটেতো সব পাঁচ, দশ,বিশ আর পঁচিশ প্য়সা ছিল। আর ঐএকটা মাত্রই আটআনা ছিল। সেই সময় ঐসব পয়সা দিয়ে লজেন্স,চানাচুর আরও অনেক কিছুই পাওয়া যেত। সব দেখেশুনে বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ''জানিসতো মা আজকে চোদ্দই নভেম্বর, শিশুদিবস। শিশুদের এই আনন্দ মেলায় শিশুদিবসটা আজকে সত্যিই সার্থক হল।


ছোটরা নিজেদের জন্য 

মনের সাধ

সোমশুভ্র চক্রবর্তী


মন রে আমার মন রে

কেনো চাস তুই পাখি হতে রে?

পাখি হলে নীল আকাশে

ডানা মেলে যাবো চলে।


আকাশ পাড়ে অনেক দূরে

মেঘের সাথে যাবো উড়ে।

যেথায় থাকেনা কোনো মানা

মন সেখানে নিয়ে যানা।

ও মন রে আমার মন রে

শুধু হতে চাই আমি পাখি রে ।


পাখি হলে ঝিমঝিম দুপুরে

ঝুপ করে পড়বো পুকুরে।

কাটবো মনের সুখে সাঁতার

মন ভরে ডুব দেবো বারবার।

তাই বলিরে আমি বলি রে

শুধু হতে চাই আমি পাখি রে।



শিল্পী- তানভী দাম 























শিল্পী- অনুস্মিতা বিশ্বাস





















মুজনাই সাপ্তাহিক 
সম্পাদনা, অলংকরণ ও প্রচ্ছদ ছবি- শৌভিক রায় 
শিশু দিবস বিশেষ সংখ্যা ২০২১



Wednesday, November 3, 2021


 মুজনাই 
অনলাইন বিশেষ দীপাবলি সংখ্যা  
কার্তিক ১৪২৮


 


সম্পাদকের কথা 

আলোর উৎসব। অশুভকে নিধন করে শুভ প্রতিষ্ঠার সন্ধিক্ষণ। 
কিন্তু কোথায় আলো? কোথায় বা শুভর জয়?
অসম্প্রীতি আর অসহিষ্ণুতার অন্ধকার গ্রাস করেছে আমাদের। প্রবল পরাক্রমী অশুভ শক্তি পরস্পর পরস্পরকে নিধন করতে ক্রমাগত উৎসাহ যুগিয়ে চলেছে। আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের বোধ, মনন, মানবতা। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও পৌঁছেও আমাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের অবিমৃষ্যকারিতা। ফল, সারা বিশ্ব জুড়ে মৌলবাদের দাপট আর তান্ডব। 
এই দুঃসময়ে তাই একটাই প্রার্থনা। অতিমারির সঙ্গে সঙ্গে মুছে যাক এই হানাহানি। আলো জ্বলুক প্রকৃত জ্ঞানের, প্রজ্ঞার ও প্রেমের। অন্ধকার থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হোক আলোর দিকে, মৃত্যু থেকে আমরা যে পৌঁছতে পারি অমৃতের পথে।  



মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়

প্রচ্ছদ- অঞ্জলি অধিকারী   

মুজনাই অনলাইন কার্তিক সংখ্যা



সূচি 

শ্যামলী সেনগুপ্ত, চিত্রা পাল, গৌতম চক্রবর্তী, নন্দিতা পাল, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, শ্রাবণী সেন, কৌশিক মিত্র, মিতা বিশ্বাস বসু, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, রীতা মোদক, রাজেশ প্রামানিক, মাথুর দাস, রীনা মজুমদার, মৌসুমী চৌধুরী, স্বপন কুমার চট্টোপাধ্যায়, আকাশলীনা ঢোল, উমা শঙ্কর রায়, অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত, অলকানন্দা দে, শতাব্দী সাহা, সুদীপ দাস, বিজয় বর্মন, নিত্য রঞ্জন মণ্ডল, কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণ, মজনু মিয়া, সৃজা রায়, অদ্রিজা বোস, তানভি দাম




দীপাবলি ভাবনা  

পাদপূরণ কে করবে?

শ্যামলী সেনগুপ্ত 


      পুজো বললেই মন উচাটন করা এক উঠোনের কথা মনে হয়।উঠোন মানে তাকে ঘিরে বারান্দা,ঘর।ঘর মানেই দরজা,জানালা,দেয়াল।দেয়ালে চুনকামের অবক্ষয়,ক্যালেন্ডার নতুন ও পুরনো।পুরনোর উপরে ক্রমাগত চাপিয়ে রাখা নতুন নতুন ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারে উইলস ফিল্টারের টানটান নায়ক আর জিভ বার করা দেবীর বরাভয় মূর্তি পাশাপাশি।একটি ইংরেজি,অপরটি বাংলা।অমাবস্যা,পুন্নিমা,একাদশী,ভূত চতুর্দশী,গিরি গোবর্ধন পুজো সবকিছুর ভার ও ভরে টিনের কাঠি থেকে খানিকটা ছিঁড়ে কাত হয়ে থাকে,দেবী কালিকার স্নেহময়ী দৃষ্টিও যেন একটু হেলে যায়।ছেড়ে যাওয়া চশমার মোটা কাঁচের এপার থেকে দেখতে পাই আলিশান কুঠির ছাদের পিলপেতে সার সার মাটির প্রদীপ।প্রদীপের গর্ভ ভরা রেড়ির তেল ও ফর্সা কাপড়ের পলতে।জ্বলে ওঠে দীপ,গরম হয় সংলগ্ন বাতাস, বাতাসে ঘূর্ণি লাগে।শিখা দপদপ করে তবু জ্বলে।হলুদ আলো ছড়িয়ে যায়।স্বর্ণাভ সেই আলোর আড়ালে ভেসে ওঠে ঝকঝকে দাঁত,লাল জিভ।ইসসস!কী ভুল করে ফেলেছি আর পাপারাৎজির চোখে ঠিক এই অবস্থায় ধরা পড়েগেলাম!আফশোস হয় দেবীর
        ধরা পড়েছ বলেই না তুমি আপার লেভেলে চলে গেলে!দশ হাত নেই,অস্ত্রের সম্ভার নেই। এক খাঁড়াই একশ। চুলের মুঠি ধরেছ আর ঘ্যাঁচাৎ। মা গো,অসুরদের ঘাড় কি খুব নরম,মুরগির মতো না কি তোমার খাঁড়ায় খুব ধার,শানদার বটে!শুভ আনতে অশুভদের,অমঙ্গলদের,বারবার কেটেছ,মেরেছ,ধড়মুণ্ডু আলাদা করে দিয়েছ।ব্রেন ওয়াশ করা যেত না কি!অশুভ মস্তিষ্কগুলোকে ব্রেন ওয়াশ করিয়ে করিয়ে 'সু' করে তোলা যেত হয়ত।অবশ্য তাহলে ধর্মের ধ্বজাটি আকাশের শূন্যতায় পত পত করে উড়ত না ।
মনুষ্য জাতির মনোবল দুমড়ে দেওয়া যেত না।না দুমড়োলে পুজো করবে কে, হে বরাভয়দায়িনী!
      সবাই যদি শান্ত থাকে, সুস্থিত থাকে,কালের চাকা থেমে যাবে যে!সুতরাং চলুক ঘর্ঘর,ঝণঝণ খর্পর,কাটুক বর্বর।
     আমরা জড়োসড়ো-------।





দীপাবলি নিবন্ধ 

আলোর উৎসবে

চিত্রা পাল                              

 এসে গেল আলোর উৎসব দীপাবলি।ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে তামসী জয় করবার উৎসবই দীপাবলি উৎসব।তার সঙ্গে যুক্ত হোক আপন অন্তরের আলো জ্বালারও উৎসব।জীবন সদাই আলোক অভিসারী। সেই কোন অতীতে বৈদিক যুগে মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে আমাদের প্রার্থনা ছিল অসতো মা সদ্‌গময়/তমসো মা জ্যোতির্গময় /মৃত্যোর্মামৃতং গময়।এ কোন সাধারণ কথা নয়, একেবারে মানব মনের অন্তরের কথা।  গতানুগতিক মানুষ সে আলোক অভিসারী হয় না,বরং প্রাত্যহিক জীবনের হিংসা, দ্বেষ, দ্বন্দ্ব আর কলুষতার আঁধারে হয় ক্লীন্ন,খিন্ন সম্বলহীন রিক্ত।আজকের দিনকাল যেন সেই বার্তাই বহন করে। সূর্যগ্রহণের অন্ধকারে ক্রমশঃ আচ্ছন্ন দিনের মতো আজ সারা পৃথিবী জুড়ে যেন চলেছে সেই অশুভ শক্তির ছায়া।সব মানুষই যেন উৎকন্ঠিত, ভীত এই করাল ছায়ায় যেখানে মনুষ্যত্ব হতেছে পীড়িত,অবনমিত দলিত।হিংসায় উন্মত্ত পৃথী আজ নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্বে জর্জরিত। সে অভিঘাতে আহত শিশু থেকে বৃদ্ধ সবমানবকুল।হিংসা,দ্বেষ,ঈর্ষা ধ্বংস করছে সমস্ত মানবিক গুণ,যা যুগ যুগ ধরে মানব  আহরণ করেছে,তার ঐকান্তিক চেষ্টায়,ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছে নিজেকে পৃথিবীর সব প্রাণীদের ওপরে। কারণ   মানুষ বুঝেছে সে আলোর পথযাত্রী,সে করবে অনাগত পুর্ণতাকে বাস্তবতর সত্য।লোভের চাঞ্চল্য সর্বত্রই পীড়ন করে চলেছে আমাদের সমাজকে  বিভিন্নভাবে। কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে মনের শক্তি যা মানুষের নিজস্ব হাতিয়ার।যুগে যুগে কখনো কখনো আমাদের মাঝে মানুষের বেশে মহামানবের আবির্ভাব হয়,যিনি এই সর্বব্যাপী অন্ধকারকে ছিন্ন করে আলোক বর্তিকা প্রজ্জ্বলন করেন দৃপ্ত প্রতাপে আপন  আন্তরিক শক্তিতে আপনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে, সে আলোক ছড়িয়ে যায় দেশ হতে দেশান্তরে কাল হতে কালান্তরে।হিংসা, দ্বেষ যেভাবে মানুষকে দুর্বল করে তার থেকে সহস্র গুণ শক্তি ধরে অহিংসা, প্রেম তার আপন ক্ষমতায়.।মানবের ইতিহাসে এই আলোকাভিসারই আমাদের  চিরস্থায়ী সম্পদ। দীপাবলী যেন আমাদের সেই আলোকের পথেই এগিয়ে দেয়।                                     

                                                              

 আলোর উৎসব দীপাবলি 

গৌতম চক্রবর্তী

কেউ বলেন চোদ্দ বছর বনবাস কাল কাটিয়ে যেদিন সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরেছিলেন, সেই আনন্দে গোটা অযোধ্যাতে আলোর বন্যা বয়ে গিয়েছিল। সরযু নদীতেওভেসেছিল প্রদীপের আলো সেই থেকেঅযোধ্যাতে পালিত হয় দেওয়ালি উৎসবরাজস্থানীরা কিন্তু প্রদীপ জ্বালায় রাজা বিক্রমাদিত্যের এই দিনে রাজ্যাভিষেক-এর কথা মনে রেখে দক্ষিণ ভারতের লোকেরা এই উৎসবকে বলে দীপাবলি তাদের প্রচলিত বিশ্বাস হল ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার হয়ে বলীকে নিধন করেন এই দিনটিতেই আবার কৃষ্ণের হাতে দেওয়ালির দিনে নরকাসুর বধ এর উপাখ্যানও চালু রয়েছেআসলে ভারতীয় সব ধর্মেই কার্তিকী অমাবস্যায় দেওয়ালি উৎসবের প্রথা চালু আছে। যদিও উপলক্ষ বিভিন্নএই দিনে বুদ্ধদেব গৃহত্যাগ করেছিলেন এবং তাঁর শিষ্য মহামোগলায়নের পরিনির্বাণ হয় বলে বৌদ্ধরা দীপ প্রজ্জ্বলন করে এই দিনে মহাবীরের নির্বাণ লাভ উপলক্ষে জৈনরা যেমন তাঁর স্মরণে প্রদীপ জ্বালায়, তেমনি শিখ গুরু স্বামী রামতীর্থের এই দিনে জন্ম এবং মৃত্যুদিন হওয়াতে শিখেরা বিভিন্ন গুরুদ্বার এবং বাড়িতে আলো জ্বালায়। কেউ কেউ মনে করেন এই দিনেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ লক্ষ্মী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন গীতা অনুযায়ী এদিন গোবর্ধন পর্বতকে আঙ্গুলে ধরে নিজ বাসভূমিকে ভয়াবহ বন্যার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ তাই এই আলো এবং বাজির আনন্দ উৎসববৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে দীপাবলীর তাৎপর্য অনেক গভীর কারণ এই দিনে সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেনদীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিনে নরক চতুর্দশীতে নরকাসুর বধ হয়েছিল এই নরকাসুরের রাজপাট ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর বা বর্তমান আসামে

 

পিতৃপক্ষেযমলোক থেকে পিতৃপুরুষের আত্মারা শ্রাদ্ধ গ্রহণের পরে তাদের প্রত্যাবর্তনের পথটি আলোকিত করার জন্য আলো জ্বালানোর একটি প্রথা ছিল আজকের দীপাবলীর উৎসসম্ভবত সেখান থেকেই হয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন আল-বেরুনীরভ্রমণকাহিনীতে অথবা আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে প্রাচীন ভারতের দীপাবলিউৎসবের বর্ণনা পাওয়াযায় এদেশের দীপাবলিতে চিরাচরিতমোম আর প্রদীপের আলোর উৎসবের সঙ্গে আতশবাজিও যুক্ত হয়ে যায় এখানকার দক্ষ বাজিকরেরাবাজি দিয়ে বানাতেন নানা ধরনের দেবীমূর্তি, গাছপালা এবং জন্তু জানোয়ার। কলকাতায় লাটুবাবু ছাতুবাবুর মত অনেকবাবুই নানান ধরনের বাজিপুড়িয়ে তাদের ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতা প্রদর্শন করে গেছেনজানবাজার,খিদিরপুর এবং উত্তর কলকাতার অনেক স্থানেই হত বাজি পোড়ানোর উৎসবসেইকালে বাজি তৈরি করার ব্যাপারে চীনাদের দারুণ দক্ষতা ছিলনানান ধরনের মূর্তি তাদের বাজিতে জীবন্ত হয়ে উঠত। কালক্রমে বৈদ্যুতিক আলোর রোশনাই আর ভেলকি এই দীপাবলিতেও চলে আসে

 

আশ্বিন মাসের অমাবস্যায়মহালয়ার মাধ্যমে মা দুর্গার আগমনের উৎসব সূচিত হয় অন্যদিকে কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে শ্যামা মায়ের আরাধনার মাধ্যমে আমরা পালন করি দীপাবলিউৎসব দীপাবলী আলোর উৎসব বাংলারপ্রাঙ্গণ জুড়ে আলোর উৎসবে মেতে ওঠেআট থেকে আশির আপামর মানুষ জন নিজেদের বাসগৃহ, দোকান এবং অফিস সুসজ্জিত হয় আলোকসজ্জায়। স্কেল,ফিতা এবং শব্দদূষণ যন্ত্র দিয়ে মাপামাপির নাটক হলেও বিধি-নিষেধকে থোড়াই পরোয়া করে শব্দ বাজির দাপট দেখা যায় শহরের আনাচে কানাচে। দীপাবলির ঠিক দু'দিন আগে থেকে ধনতেরাসউৎসব উদযাপনের মধ্য দিয়েদিপাবলীউৎসবের প্রকৃত সূচনা প্রথম দিন ধনতেরাস। পরের দিন যম দীপদান তথা নরক চতুর্দশী বা ছোট দেওয়ালি,তৃতীয় দিন দীপাবলীর প্রধান উৎসব এবং চতুর্থ দিন গোবর্ধন পূজা। ধনতেরাস হয় কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশ দিনে তাই এর অপর নাম ধন ত্রয়োদশী। ধন কথার অর্থ সম্পত্তি এবং ত্রয়োদশী কথাটির  অর্থ তের। অর্থাৎ ত্রয়োদশীতে সমৃদ্ধির দেবী মা লক্ষ্মীর আরাধনাচোদ্দপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের সংস্কার হিসেবে চোদ্দ শাক খাওয়া হয়এবংচোদ্দ প্রদীপ প্রজ্বলিত করা হয় দীপাবলীর বাংলাতে প্রত্যেক বাড়িতেবাড়িতে নিয়ম-রক্ষার মাটির প্রদীপের সঙ্গে বৈদ্যুতিক আলোর সংমিশ্রণে প্রজ্বলিতহয় দীপাবলীর আলোকএই আলোকসজ্জায় সজ্জিত শহর প্রাণোচ্ছল আনন্দ প্রকাশ এবং মানসিক সুস্থতার বিকাশের সহায়ক

 

জলপাইগুড়িতেকালীপুজোর বিশেষ ঐতিহ্য অথবা পরম্পরা হিসাবে আজও অম্লান কতদিন আগে জলপাইগুড়ির মানুষ পাহাড় বানিয়েছিল তার ইতিহাস বা উদ্দেশ্য গবেষণার বিষয় দাদু ঠাকুমাদের অনুসৃত পন্থাকে পাথেয় করে কচিকাঁচা নাতিপুতিরা একুশ শতকেও বানায় রকমারি পাহাড়পাহাড় আকৃতিতে ছোট হলেও    আধুনিক কিছু জিনিসপত্র বাজার থেকে কিনে পাহাড় সাজাতে হয় বলে যেখানে যত বড় পাহাড় সেখানে ততোই খরচ কিন্তু খরচ সত্ত্বেও নিষ্ঠার অভাব নেই কচিকাঁচাদেরপাহাড় বানানোর কলা-কৌশলে আসলে জৌলুসনয়,নিষ্ঠার প্রতি অবিচলতাই মানুষের ঐতিহ্য হওয়া উচিতউৎসব আর উৎসাহ শব্দদুটি যেভাবে আপামর বাঙালি তথা ভারতবাসীর সঙ্গে জড়িয়ে আছেতার সর্বোত্তম প্রকাশ শারদীয়া থেকে শুভ দীপাবলীর এই সুদীর্ঘ মরসুমেপ্রাদেশিকতার সীমারেখা লুপ্ত প্রায় বলেই দক্ষিণ ভারতীয়দের ধনতেরাসে সোনার কয়েন কেনা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। দুর্গাপুজোর মতোই দীপাবলীরও সর্বভারতীয় রূপ পূর্ণতা পায় যখন স্থান-কাল-পাত্রর বিভাজন ভুলে শুভশক্তির আগমনে অশুভ শক্তির বিনাশ এর ভাবনায় সমগ্র দেশবাসীসামিল হয় তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক উপাচার আর ধর্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করেবলাই বাহুল্য, শুধু দীপাবলি বা ভাইফোঁটা নয়ধনতেরাসকে ঘিরে বাঙালি বা আসমুদ্রহিমাচল আমজনতার উৎসাহ এবং উদ্দীপনা যেভাবে বাড়ছে তাতে বলা যায় ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাদেশিকতার মেলবন্ধন এবং বিশ্বাসের সঙ্গে শ্রদ্ধা এ যেন আক্ষরিক অর্থেই বিবিধের মাঝে মহামিলন

 

আশ্বিন মাসের অমাবস্যাতে কালীপুজোর অপর নাম দীপান্বিতা কালীপূজাপুরাকালে যে কালীপুজোর উল্লেখ পাওয়াযায় তার নাম চামুণ্ডাচর্চিতা কালী পূজাবাংলায় বর্তমান কালীমূর্তি এবং কালীপুজোর প্রবর্তক ছিলেন নবদ্বীপের পন্ডিত কৃষ্ণানন্দআগমবাগীশএই পুজোকেজনপ্রিয় করে তুলেছিলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রবর্তমান কালীমূর্তি প্রবর্তন এর আগে তামার পাত্রের উপর কালীর অস্ত্র এঁকে অথবা খোদাই করে কালীপুজোহত। কলকাতার কালীঘাটে এদিন কালীকে লক্ষ্মী রূপেও পূজা করা হয়অনেক জায়গাতেই মা কালীর সঙ্গে সাধক বামাক্ষ্যাপা এবং রামকৃষ্ণকেও পুজো করা হয়দীপাবলি উৎসব মূলত পাঁচদিনেরএর শুরু হয় ধনতেরাস দিয়ে এবং শেষ হয় ভাতৃদ্বিতীয়া উৎসব দিয়েভারতীয় তন্ত্র এবং পুরাণে শক্তির প্রতীক হিসেবে যে রাত্রি দেবীর কল্পনা করা হয়েছে তাইপরবর্তীকালে কালীর রূপ প্রকাশ বলে অনেকেই অনুমান করে কালিদাসের পরবর্তীকালে সংস্কৃত সাহিত্যে কৃষ্ণবর্ণা এক ভয়ংকরী উন্মাদিনী রক্তলোলুপা দেবীর উল্লেখ মাঝেমধ্যেই পাওয়া গেছে। মার্কন্ডেয়পুরাণে কালীর আবির্ভাব রহস্য বর্ণিত হয়ে মহাদেবী চন্ডীকার সঙ্গে তাঁকে যুক্ত করা হয়েছে অনুমান করা হয় সেই সময় থেকেই কালী ব্রাহ্মসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে

 

বিজয়া দশমীর পর বিষন্ন বাংলা আবার নতুন করে আলোর মালায় সেজে আনন্দে মেতে ওঠে কালীপুজো এবং দীপাবলিকেঘিরে হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী শুম্ভ-নিশুম্ভ নামক অসুরের অত্যাচারে দেবগণ যখন দেবী দুর্গার শরণাপন্ন হন, তখনই দেবী দুর্গার অঙ্গ থেকে জন্ম হয় কালীর তখন তার নাম ছিল কালভৈনাশিনী তিনি যুদ্ধে অসুর নিধন করেন কিন্তু হত্যার নেশায় মত্ত দেবী যুদ্ধ শেষ হবার পরেও সেই নেশায় বুঁদ হয়ে সামনে যাকে পান তাঁকে হত্যা করতে থাকেন এই অবস্থায় জীবজগতকে দেবীর কোপ থেকে রক্ষা করতে দেবীর যাত্রাপথে মাটিতে শুয়ে পড়েন দেবাদিদেব মহাদেব নর মুন্ডমালায় সজ্জিততাণ্ডবে মত্ত দেবী অজান্তে ইশিবের বুকে পা তুলে ফেলতেই সম্বিত ফিরে পান আর এই অপরাধের জন্য লজ্জা এবং ক্ষমা প্রার্থনায় নিজের জিভ বের করে ফেলেন। পরবর্তীকালে এইভাবেই দেবী কালীকে শত্রু বিনাশিনী হিসাবে পুজো করা শুরু হয়                    



অন্য দীপাবলি 

কুমড়ো তে দীপাবলি
নন্দিতা পাল

বাপরে বাপ, এই মিষ্টিকুমড়ো যে কড়াইতে পড়লে মুহূর্তে গলে যায়, সেই কুমড়ো কে নিয়ে কেটেকুটে একটা মুখের মত বানাতে গলদঘর্ম অবস্থা! আমেরিকার এক শহরে মেয়ে স্কুলে পড়ে, পরদিন হালোয়িন এ প্রতিযোগিতা কার বাবা মা কত তাড়াতাড়ি ভালো করে মুখের আকারের লন্ঠন বানাবে কুমড়ো থেকে। আগের দিন প্রায় সারদিন ধরে তার প্রস্তুতি চলছে। শুনেছি, বহু আগে যখন আমেরিকাতে অনেক লোক বিভিন্ন দেশ থেকে আসে থাকতে, ইংল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডের লোকেরা আমেরিকায় এসে যেখানে থাকতো সেখানে ওরা ওদের দেশে যেমন কুমড়ো দিয়ে লন্ঠন বানাত ঠিক শীত পড়বার আগ দিয়ে, ওরা এ দেশে এসেও সেটা বানাতে লাগল। আমেরিকাতেও প্রচুর কুমড়ো পাওয়া যেত আর ঐ উজ্জ্বল কমলা রঙের কুমড়োর ওপর কেটে কুটে মুখের মত বানিয়ে তারপর কুমড়োর ভেতর থেকে সবকিছু বের করে দিয়ে যে জায়গাটা হত তার মধ্যে বসিয়ে দিত মোমবাতি। এবারে অন্ধকার রাতে বাইরে বসিয়ে দিত কুমড়ো গুলোকে, একদম মনে হত কুমড়ো মুখগুলো যেন হাসছে! এত জনপ্রিয় হয়ে গেল এই কুমড়ো মুখ যে এখন সমার্থক প্রায় কুমড়ো মুখ আর হালোয়িন।

অয়াল মারট, মার্স, ক্রগার, কস্টকো সব দোকানে বোঝাই মিষ্টিকুমড়ো। অক্টোবর একত্রিশ মানে হালোয়িন, কিন্তু তার আগে পরে কদিন ধরেই চলতে থাকে হালোয়িনের উৎসব। বেশ বাছাই করে মেয়ের বাবা কয়েকটা কুমড়ো নিয়ে এসেছে। একদিন মেয়ের স্কুলে ট্রেনিং ও দিয়েছে আমাদের মানে আমরা যারা জীবনে এই কুমড়ো নিয়ে মুখ বানাইনি। কুমড়ো কাটার স্পেশাল কিট পাওয়া যায়, সেসব কেনা হয়েছে। মনে আছে যন্ত্র পাতি মানে ঐ কিটের সব কিছুর রঙ ও ছিল কুমড়োর রঙ মানে কমলা। আমার মাদারিহাটের বাড়ির খেতে ফসলের সময় কাক তারুয়ার কথা মাথায় আসছিল। কিন্তু এই হালোয়িন এল কোথা থেকে? বহু বহু বছর আগে ইউরোপের কিছু জায়গায় এই ফসলের সময় শেষ হয়ে যখন শীত আসত, যেহেতু ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় শীত মানে প্রচন্ড ঠান্ডা ও বরফপাত হয়, সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না অনেক দিন, শীত মানে মৃত্যু ও। গরমের মানে জীবনের শেষ আর শীত মানে মৃত্যুর আসা এই মাঝে দিনটা কে ভুত, নিজের বংশের পূর্বসুরি এবং আরো যারা মারা গিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। কুমড়ো তে মুখ বানিয়ে ভিতরে আলো জ্বালিয়ে সবাই বাড়ির বাইরে রাখবে, অনেকে খাবার ও মদ বাইরে রেখে দেয় এই বিস্বাসে যে মৃত দের আত্মা রা এসে খেয়ে যাবে এবং প্রান ভরে আশীর্বাদও করবে।

পরদিন স্কুলে প্রতিযোগিতা, কেউ কম যায় না। যেমন সেজেছে বাচ্চারা তেমনি বাবা মা য়েরা। ভুত পেত্নি ই বেশি সাজে, অনেকে জাহাজের পাইরেট, ম্যাজিসিয়ান, স্পাইডার ম্যান, রুপকথার চরিত্র সেজেছে। আমার মেয়ে সেজেছিল নীল পাখনায় পরী, হাতে ছিল পরির জাদুকাঠি। সেদিন, সবার চোখ ছিল ঐ মিস্টিকুমড়ো কাটার খেলাটায়। উফ কি সাংঘাতিক সেই জমজমাট খেলা। টেবিলে এক একটা পরিবার তাদের সামনে তাদের কুমড়ো। পাশে কমলা কিট। সময় শুরু হতেই কিট থেকে সব যন্ত্রপাতি বেড়িয়ে পড়ল। কুমড়োর চোখ মুখ আঁকা হল মার্কারে, এবার তাকে ফুটো করে আকৃতি তে আনা। চারদিকে অনেক লোক দেখছে আর হৈ হুলোড় তো রয়েইছে। আমাদের চোখ দুটো হল কাটা, এবার মুখ করতে গিয়ে গেল একপাশে একটু ভেঙ্গে, বেশি চাপ পড়ে গিয়েছে। কেন যে কুমড়ো না হয়ে লাউ হল না!  না না অসব ভাবলে হবে না, কুমড়োর মাথাটা সঙ্গে বোটা টা সমান করে কেটে নামিয়ে দেওয়া হল। ওটা পরে বসবে। তারপর কিটের থেকে যন্ত্র নিয়ে কুড়িয়ে কুমড়োর ভেতর থেকে সবকিছু বের করে আনা হল। সময় প্রায় শেষের দিকে, হাত চালাও। মেয়ে তো ঐ পরির ডানা পরে তখন খিল খিল হাসি মা বাবার ঐ কান্ড দেখে। যাক কুমড়োর ভিতরে সব পরিস্কার করা হল। এবার মোমবাতি জ্বালিয়ে কুমড়োর ভেতরে বসিয়ে দেওয়া হল। মাথার বোটা সহ যেটা কাটা হয়েছিল, তাকে আসতে বসিয়ে দেওয়া হল। আহা, জ্বলজ্বল করছে কুমড়ো। যেন প্রান পেল কুমড়ো। ইস, কিন্তু কুমড়োর মুখের হাসিটা একটু ভেঙ্গে গিয়েছে যে! দাড়াও দাড়াও, বলে আমি কুমড়োর ভেতর থেকে কাটা একটু টুকরো লাগিয়ে দিলাম। এবার দেখতে মনে হছে যেন জিভ কেটে হাসছে কুমড়ো। মেয়ে খুব খুশি তা দেখে। প্রথম তিনজনের মধ্যে আমরা পেয়ে গেলাম পুরস্কার, চাট্টি খানি কথা! হাসতে হাসতে বীরের মত ঐ কুমড়ো মুখ নিয়ে বাড়ি এলাম।

সেদিন রাতে অমাবস্যা না হলেও কৃষ্ণপক্ষ তো ছিলই। বরফ পড়া আরম্ভ হয়েছে, ভালো ঠাণ্ডা বাইরে। বাড়ির বাইরে কুমড়ো মুখকে রেখে দিয়েছিলাম। বাইরে বেড়িয়ে যখন গাড়িতে দেখতে বেড়িয়েছি হালোয়িন, সব বাড়ির সামনে কুমড়ো মুখের মধ্যে কত রঙের আলো। বাইরে বরফ পরছিল, তার মধ্যে যেদিকে তাকাই কুমড়ো মুখের সেই একগাল হাসি। চোদ্দ বাতি দিই যে আমরা বংশের পূর্ব সুরিদের আশীর্বাদের জন্য, কোথায় যেন মনে হল আলো তো সেই একই, এখানে কুমড়ো যেন সেই আলোকেই বুকে ধরেছে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য, কুমড়ো হাসিতে অনাবিল এক দীপাবলি।




দীপাবলির  আলোয়
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

"আমার   এবার  মা  তারার  ডিউটি   পড়েছে,  আমি   কোথাও   যেতে  পারব    না। "   এক নিশ্বাসে   কথা গুলো   বলে গেলেন   এক কাপালিক  সাধু,   ট্রেন তখন   হু হু  করে  ছুটে চলেছে।  কম্পার্টমেন্টে  উঠেই  যে  সিটে  টিকিট পরীক্ষকরা   ক্ষণিকের  জন্য  বিশ্রাম  করেন, সেই   সিটে বসে।  কপালে বড় একটা সিঁদুরের টিপ,   হাতে  বড় একটা    ত্রিশূল  আর,  লম্বা  রুদ্রাক্ষমালা।   বললেন, "সারাবছর  তো মন্দিরেই  পড়ে  থাকি,  আমার  ঘর টা' ই মায়ের আবাসস্থল,  আমার  ক্ষিদে  পেলে  নিজে খাই, মা'কে  খেতে  দিই,  মায়ের  গরম  লাগলে ফ্যান চালাই। 

ভালো  ভাবেই   আমাদের  সংসার  চলে  যায়, কিন্তু এখনই সমস্যা,  এখন দীপাবলি।  এখন  সমস্যার অন্ত নেই।  এখন মায়ের কোন ত্রুটি  রাখা  যাবে না।"  কথাগুলো  বলে  তার বড়ো বড়ো  চোখ  গুলো  দিয়ে  আমার  দিকে  তাকিয়ে বললেন , " তা  তোর বুঝি মন খারাপ?  স্ত্রী পুত্র ছেড়ে  আছিস? "

আমি   কি  বলব  বুঝতে  পারলাম  না। সন্ন্যাসী এত  কিছু  কিভাবে৷ জানল?  উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস  তখন  হেলতে   দুলতে  নিউ  ফারাক্কা ষ্টেশনে ঢুকছে।

মনে  পড়ল  মায়ের  কথা,   মা  বলতেন এই সব তান্ত্রিক  সাধুরা  মুখ  দেখে  সব  বলে  দিতে পারেন।  খুব  ভোরে  এঁরা তাদের  সাধনা শুরু করেন।   দীর্ঘদিনের  তন্ত্র  সাধনায় এরা অন্যের ভিতরটা  দেখতে  পেয়ে  থাকেন।  বিষয় টা  "কাকচরিত্র" বা  এমন  একটা  কিছু হবে। 

তিনি  যে  কথাগুলো   বললেন৷ সেটা এই রকম , " শিবের   স্ত্রী  হচ্ছেন  মাকালী,  তিনি  সৃষ্টিকর্তা, তিনিই  সংহারকারী।   দশদিকে  ভয়ংকরী  যে দশমূর্তি   তা  সবই  তিনি।  তিনিই দশমহাবিদ্যার একটি  রূপ।  বিভিন্ন  তন্ত্রশাস্ত্র কালীর বিভিন্ন রূপের কথা বলে থাকেন। যদিও সরূপগত ভাবে তারা একই। সাধকের প্রয়োজনে তার ভিন্ন ভিন্ন নাম ও রূপ। "

এই কথার অবশ্য সমর্থন মেলে মহানির্বানতন্ত্রে। বাঙালির কালীসাধনার বহুল প্রচারিত রূপটি অবশ্যই দক্ষিণা কালী।

প্রচলিত আছে ১৪ বছর রাম-সীতার বনবাসের পর যখন ফিরে আসেন, তখন প্রজারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে সমস্ত অযোধ্যা নগরী আলোয় সাজিয়ে তুলেছিলেন। সেই থেকেই দীপাবলি র উৎসব চলে আসছে।

চোখ ডলতে ডলতে কখন লোয়ার বার্থে এসে ঘুমিয়ে পড়েছি, বলতে পারব না। সকালে চা'ওয়ালার ডাকে এন,জে,পি'তে যখন ঘুম ভাঙালো, তখন হিমেল হাওয়ায় দূরের   কাঞ্চনজঙ্ঘা উল্লাসে   দুই  হাত তুলে আহবান জানাচ্ছে।



দীপাবলি বার্তা 

শুভ দীপাবলি
শ্রাবণী সেন

আকাশ এখন সানন্দিত। কুহেলিকা আচ্ছাদনে যদিও  হেমন্তকালীন আকাশে একটু অন্তরাল রচিত হয়  তবুও সেই শুভরাত্রি আগতপ্রায়, যে অন্ধিকায় তমসাচ্ছন্ন আকাশ সাজবে অগণন নক্ষত্রখচিত বরবেশে আর তার প্রিয়তমা বসুন্ধরা নবপরিণীতা বধূসজ্জায় সাজবে মৃৎপ্রদীপের স্নিগ্ধ আলোর অবগুণ্ঠনে, মধুত্থবর্তিকার মালিকায়, বিজলি আলোকের ললন্তিকায়। সেই রাত্রি দীপাবলির রাত্রি। 
তমসা জয় করে আলোকের আরাত্রিকা প্রজ্বলিত করার রাত্রি। এই রাত্রিই অশুভশক্তি বিনাশ করে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার রাত্রি। অবসাদ, বিষাদ দূরীভূত করার রাত্রি, আপন আলোয় উজ্জীবিত হবার রাত্রি, আত্মদীপ হবার রাত্রি।




আকাশে কার ব্যাকুলতা 

কৌশিক মিত্র                                    

মাথার ভিতর লাল হলুদ আগুনের ফুলকি, শরীরের প্রতিটি কোষে অপার আলস্য আর বিচ্ছিনতার বীজ। একটি কৃষ্ণ সর্প শ্লথ এবং বঙ্কিম ভঙ্গিমায় সত্তায় নিবেশিত হইতেছে। ইহা কুন্ডলিনীর চলনের ঋজুপথ নহে।

 

বিপুলা এ পৃথিবী গভীর সুষুপ্তিতে আচ্ছন্ন।

 

 -“অবসাদ তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?”

-“তোমার পিতৃপুরুষের ক্রোমোজোম হইতে

 -“সুপ্ত থাকিতে পারিতে। না হয় বাহক হইতাম। কিন্তু আক্রমণ কেন?”

 -“যদি বলি বধার্থ। শব্দখানিতে রুচি হইবে কি? তোমার এ প্রশ্নখানি মূঢ়ের নায় সন্দেহের তিলমাত্র নাই। আমি তোমাতে উপগত হইয়াছি এক ভয়ানক সাধনার নিমিত্ত। তোমার চেতনা এবং আমার সত্তার মিলিত সাধনায় আমরা বিলীন হইব শূন্যতায়। আমি পুরুষ ,তুমি প্রকৃতি-এইরূপে নিজেকে কল্পনা করিও-শান্তি লাভ করিবে।

-“আমি কিছুই বুঝিতেছি না। এক করাল দংষ্ট্রাল তমিস্রা আমাকে গ্রাস করিয়া লইতেছে। তুমি আমাকে মুক্তি দাও অবসাদ

-“নির্বোধ বালক। মূঢ়ের ন্যায় আচরণে নিবৃত্ত হও। বহু জন্মের সাধনায় তুমি আমাকে লাভ করিয়াছ। হাজার বছর ধরিয়া আমি তোমার পিতৃপুরুষ দিগের জিনে ফিরিয়া আসিতেছি শুধুমাত্র আধারের সন্ধানে। মেলে নাই। ব্যর্থ সাধকের দল শমন সদনে প্রেরিত হইয়াছে। স্মরণে রাখিও এই সংসার কটাহে সকল প্রাণী মার উদ্দেশ্যে বলিপ্রদত্ত, অতএব বৃথা কালক্ষয় না করিয়া আমার শরণে আসিয়া শূন্যতার সাধনা কর। সাংখ্যের কথা ভুলিও না। এই সাধনায় নিবৃত্তি নাই আছে মুক্তি, হয় তুমি সিদ্ধ হইবে নয় পূর্বপুরুষদিগের ন্যায় কৃতান্ত সদনে প্রেরিত হইবে।

 

আমি ক্লান্ত, আজ মুক্তি দাও।

বেশ সাধনার্থ নিজেকে প্রস্তুত করিতে থাক! আমি পুনঃ আসিব। আমি বারংবার আসিয়াছি। তুমি চিনিতে পার নাই।”

 স্তব্ধতা খানখান হইয়া কক্ষে ছড়াইয়া পড়িল।

 

বিঃদ্রঃ- রামকৃষ্ণদেব বলতেন-"ওরে মোড় ঘুরিয়ে দে।" সত্যিই ত, ধ্বংসকামী শক্তিকে মাঙ্গলিক করে তোলার চেয়ে মহত্তর সাধনা এই মানবজন্মে আর কিছু আছে কি?



দীপাবলি গল্প 


ছোট্ট ছেলের দীপাবলি 
মিতা বিশ্বাস বসু

কাগজের মোড়কে একটা-একটা করে রংমশাল, তারাবাতি, চরকিগুলোকে তুলে রাখছে ছোট্ট ছেলেটা।রোজই বাজিগুলোকে রোদে মেলে দিয়ে ঠায় বসে থাকে।বাবা বলেছে - রোদে বাজি দিলে, ড্যাম্প লাগে না। যকের ধনের মতন আগলে রাখে, দেখে সব ঠিক আছে কি না!

রাতে শোবার সময় বালিশের পাশে বাজি-রা স্থান পায়। ঘুম থেকে উঠেই বাজিগুলো গুণতে বসে। খুব চিন্তায় থাকে, যদি দাদা বা কাকারা ওর অজান্তে বাজিতে হাত দেয়! নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায় প্রত্যেকবারই দীপাবলির সময়। 

স্কুল ছুটি, খুললেই পরীক্ষা। তাই ছেলেটা পড়তে বসে বাজির পোঁটলা সঙ্গে করে। ওর এই আচরণে সবাই মজা পায়,তাতে ওর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বাজি হারিয়ে গেলে চলে কান্নাকাটি আর মা-এর কাছে আস্ফালন।  

এ'কদিনেই বাজিরা ওর সঙ্গী-সাথী, ওদের সাথে চলে  কথাবার্তা, সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের গল্প। যে কথা কারুর সাথে বলেনা সে-সব গল্প। মনে মনে ওদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন হয়।

দীপাবলির দিন দুপুরে চোদ্দো শাক খায় বাজির পোঁটলা হাতেই। চোদ্দো-ভুতেতে ওর খুব ভয়। এরপর মায়ের বানানো মাটির প্রদীপগুলো শুকনো করা হয় রোদে,পাশে রোদ পোহায় বাজির-পোঁটলাও। 
সন্ধ্যায় ভাইবোনেরা প্রদীপ সাজায় , দিদি তেল, পলতে দিয়ে প্রদীপগুলো গুছিয়ে  আলো জ্বালে। সাথে লাল-নীল মোমবাতি। আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চারিধার। ছোট্ট ছেলেটার চোখ-মুখও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দীপাবলির আলোয়।হাতে ধরা ওর সেই বাজির পোঁটলা, একটাও পোড়াবে না ও...

 পাছে শেষ হয়ে যায়! 




ছবি: লেখক  

                                


 রং মশাল
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

লোক দুটোকে হঠাৎ আসতে দেখে কলাগাছের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো গুপি আর হারু। অগোছালো এই জংলা বাগানটায় প্রায় দিনই বেলা পড়লে ওরা খেলতে আসে একটু। রঘুদা এসময়টায় চায়ের ঠেলা নিয়ে পার্কের কাছে চলে যায়। আবার সন্ধেবেলা ওদের ডাক পড়ে দোকানে। পলেস্তারা খসা, রং চটা কত যুগ আগের একদিক প্রায় হেলে পড়া এই বিরাট দোতলা বাড়িটার পেছনের ভাঙা প্রাচির দিয়ে বাগানটায় খুব সহজেই ঢুকে পড়া যায়।অযত্নে ফোটা ফুলগুলোকে দেখে ওরা.. জংলি ফুলেরও কত বাহার এই সময়।সকালে সবুজ ঘাস আর কমলা শিউলি যেখানে শিশিরকে সাক্ষী রেখে প্রতিদিন নতুন করে বন্ধুত্ব করে, তার পাশ ধরে জঙ্গলে পা ডুবিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ওরা কামরাঙ্গা গাছটার দিকে। চোখ অবশ্য থেকে থেকে উঠে যায় পিছনের দিকের দোতলার জানলায়। গিন্নিমা দেখলে রক্ষা নেই আর। কালীদাসী তো আরও মারাত্মক। এমন চিৎকার জুড়বে যে গোটা পাড়ার লোক এক জায়গায় হয়ে যাবে। তারমধ্যে কামরাঙ্গা পাড়তে দেখলে তো কথাই নেই। লোকদুটো নালার ধারের প্রাচিরের ভাঙা জায়গাটা দিয়ে হঠাৎ করে আসায় চমকে গিয়েছিল ওরা। এদের মধ্যে একজন ওদের এই অঞ্চলের নামী প্রোমোটার.. দিগ্বিজয় রায়। পান চিবোয় আর বিচ্ছিরি করে হাসে। এই লোকটাকে বহুবার এই বাড়ির সামনের গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেছে গুপি।লোকেরা বলাবলি করে ছেলের বয়সী এই লোকটাকে খুব ভরসা করে গিন্নিমা।এর কিন্তু আসল ফন্দি এই বাড়িটা দখল করে ফ্ল্যাট বানানো।সহজ সরল গিন্নিমা ওর মতলব ধরতে পারেনি ।
রঘুদার দোকানে একদিন  এই লোকটা খুব শাসাচ্ছিল ওদের.. বলছিল,  'ওই ভাঙা বাড়িতে ঘুরঘুর করতে দেখলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব, মনে থাকে যেন।' রঘুদাকে বলছিল, 'এবার বস্তি থেকে খুব শিগগির উঠে যেতে হবে তোদের, রাস্তা দেখে নে যে যার মতো।' রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল গুপির। 
                                 বাগানে ঢুকে ফল পাকুড় চুরি করে খেলে, হুটোপুটি করে দৌরাত্ম্যি করলে ওপরের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যতই বকাঝকা করুক; গিন্নিমায়ের জন্য খুব মায়া হয় গুপির। বাবার কাছে শুনেছে একসময় নাকি দুর্গা প্রতিমার মতো দেখতে ছিল গিন্নিমাকে। খুব কম বয়সে বিয়ে হয়ে এসেছিল এই বিরাট বাড়িতে। বিয়ের কিছুদিন পরেই কর্তাবাবু নিখোঁজ হয়ে যান। কাচা পাকা চুলের সিঁথিতে টকটকে করে সিঁদুর পরে, আলতায় পা রাঙিয়ে, চওড়া পেড়ে শাড়ি পরে পুরোনো কাজের লোক কালীদাসীকে নিয়ে এই যক্ষপুরী আগলে জুবুথুবু শরীর নিয়েও রয়ে গেছেন এখনও। বাবা বলে, এটা অভিশপ্ত বাড়ি। গিন্নিমা আর কর্তাবাবুর সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের মেয়ে ছাড়া এ বংশের আর কেউ বেঁচে নেই। সেই দিদিটা নাকি কোথায় একটা খুব বড় জায়গায় ডাক্তারি পড়ে। 
                                     প্রোমোটারটা ফিসফিস করে কী যেন বলছে সঙ্গের লোকটাকে। হারুকে দাঁড়াতে বলে ঝোপের আড়াল দিয়ে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেল গুপি। সঙ্গের লোকটাকে এই প্রথম দেখলো ও। ব্যয়াম বীরের মতো পেটানো চেহারা। চোখগুলো কুতকুতে। বাড়িটার দিকে হাত তুলে এটা ওটা দেখাতে দেখাতে যে কথাগুলো বলছিল দিগ্বিজয় রায় ; তার কিছু কিছু অস্পষ্ট ভাবে গুপির কানে ভেসে আসায় কষ্টে, ভয়ে ওর হাত পা অসাড় হয়ে আসতে লাগলো। 
                               আলোঝরা দিপাবলীর রাত। শহরের সমস্ত বাড়িগুলো আলোর সাজে সেজে উঠেছে। প্রতি বছর এই দিনটিতে পাড়ার মস্ত মাঠটা জুড়ে জলসার আসর বসে। এবছরও করোনার সমস্ত বিধি মেনে খুব অল্প সময়ের জন্য ছোট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে পাড়ার ক্লাব থেকে। শহরের এক প্রান্তের এই ভাঙা বাড়িটাই আজ শুধু একবুক অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু ভেতর উঠোনের তুলসী তলায় নিভু নিভু করেও জ্বলে আছে একটি সন্ধ্যা প্রদীপ।
                               একেই লোডশেডিং, তার ওপর মাইকের জোরালো আওয়াজে অস্থির লাগছিল বিভাবতীর।একটা মোম পর্যন্ত ঘরে নেই আজ। কালীদাসী তো সন্ধ্যে থেকেই ঘুমে ঢুলতে থাকে। পেছনের বস্তির লোকগুলোকে খুব ভয় করে আজকাল। যখন তখন ছেলেপেলে গুলো বাড়ির পেছনে ঢুকে পড়ে। খেলার নামে কতসময় ভাঙা ফাঁকফোকর দিয়ে তার ঘরের সামনেও চলে এসেছে ওরা। গুপি না কী নাম ছেলেটার, ওটাকে কয়েকদিন ধরে খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে দেখছেন বাড়ির চারপাশে।জোনাইকেও ফোনে  বলেছেন ওদের কথা। ও হেসে উড়িয়ে দেয়..  বলে, 'বড়মা,  আমি গেলে ওরা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হবে, দেখো।' ওর পথ চেয়েই তো এই বাড়ি আগলে বসে থাকা। জোনাইয়ের স্বপ্ন ওর বাবা ঠাকুরদার এই ভিটে একদিন মস্ত এক হাসপাতাল হবে। বেশ কিছুদিন হলো ফোনও আসছেনা মেয়েটার। মনটাও তাই ভালো নেই বিভাবতীর। 
                                  গুপিরও মন ভালো নেই কয়েকদিন থেকে। শুধু চক্কর কাটে এই ভাঙা বাড়িটার চারপাশে। খুব রাতে উঠেও মাঝে মাঝে চলে আসে। হারু অবাক চোখে দেখে ওকে। 
                                    লোকটা ঢুকে প্রাথমিক কাজগুলো সতর্কতার সঙ্গে করে গেল। পেছনের নড়বড়ে দরজা এক ধাক্কায় খুলে ফেলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে মেইন সুইচ অফ করে অন্ধকার করলো গোটা বাড়ি। যন্ত্রপাতির ব্যাগটাকে নীচে এক জায়গায় রেখে লুকিয়ে রইল বাগানের এক কোণে। এরপর ফাংশন শুরু হবার অপেক্ষা।দুজন বয়স্ক মানুষকে প্রাণে মারতে একটুও হাত কাঁপবেনা বা সময় লাগবেনা এই পেশাদার ভাড়াটে গুন্ডার। মাইকের আওয়াজ জোরালো হতেই গুটি গুটি পায়ে ঝোপ থেকে বের হতে যেতেই মাথার পেছনে খুব ভারি কিছু একটার আঘাত। চোখের সামনে তখন শুধুই গাঢ় অন্ধকার। অচৈতন্য হতে হতেও বুঝতে পারলো অনেকগুলো লোক মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর ওপরে.... 
                            হঠাৎই অন্ধকার ফুঁড়ে সারে সারে কতগুলো ছায়ামূর্তি। সকলের হাতে প্রদীপ। ভাঙা বাড়িটার আনাচে কানাচে আলোর রোশনাই.. আলোর উৎসব যেন বিনা আমন্ত্রণেই হাজির হলো এই মানুষগুলোর হাত ধরে দুটি অসহায় মানুষের কাছে। বিমূঢ় বিভাবতী সেই অবাক করা আলোয় দেখতে পেলেন খুব পরিচিত কতগুলো মুখের ছবি। তাঁর বাড়ির পেছনের বস্তির মেয়ে, পুরুষ,  কিশোর,  কিশোরীদের চেনা মুখগুলো বড় আপন মনে হলো তার। আদিম এক অন্ধকারের ভয়াবহতা থেকে তিনি যেন জেগে উঠলেন। এরা যেন রক্ষাকবচ হয়ে আসলো ওনার কাছে। 
                                       ওরা সকলে ঘিরে বসে ছিল বিভাবতীকে মাইকের আওয়াজ থেমে গেছে কিছুক্ষণ হলো। বাড়ির বৈদ্যুতিক আলোগুলোও জ্বলে উঠেছে আবার। ল্যান্ড ফোনের টানা আওয়াজে ছেদ পড়লো সকলের কথায়। বিভাবতী ফোনের রিসিভার তুলে কানে নিতেই ও প্রান্তে জোনাইয়ের গলা ভেসে এল..  'বড়মা,আমি দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছি.. আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার জোনাই তোমার কাছে চলে আসছে সারাজীবনের মতো.. তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে এ ক'দিন ফোন করিনি.. কিন্তু আজ চারিদিকে এত আলো আর আমার বড়মা মনখারাপ করে থাকবে তা কী হয়? এবার আমাদের বাড়িও আলোয় আলোয় ভরে দেব.. '
উজ্জ্বল হয়ে উঠলো বিভাবতীর মুখ। ধরা গলায় বলে উঠলেন,  'আয় মা, তুই যে আমার আঁধার রাতের একলা প্রদীপের একমাত্র সলতে। 
তবে সারপ্রাইজ না কি যেন বললি, তা কিন্তু তোর জন্যও অপেক্ষা করছে। বাড়ির বাইরে এলেই তা টের পাবি। '
                  বহুযুগ পর এই বাড়িটায় আজ  আনন্দের সাড়া জেগেছে। সেই  খুশির আমেজকে জড়িয়ে বাইরে তখন উৎসবের হেমন্ত রাত হিমঝুরির গন্ধ  আর  শিশির মাখা সিক্ত স্নিগ্ধ বাতাসকে সঙ্গে নিয়ে প্রদীপের প্রজ্জ্বলিত আলোর  শিখায় শিখায় আলতো ঢেউ তুলে লিখে যাচ্ছে,  'শুভ দীপাবলি।'



দীপাবলি 
 শ্রাবণী সেনগুপ্ত

ছোট্ট রাজুর বাবার বাজি তৈরির ব্যবসা।বেশ ভালোই রোজগার।আশপাশের পাঁচটা গাঁ ছাড়িয়ে তার বাবার তৈরি বাজির বেশ নামডাক হয়েছে শহরেও।বেশ কিছু নামি দোকান থেকে অর্ডার দেওয়া থাকে বাজি বানাবার।তাই তাদের সংসার স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে।কিন্তু এই সুখ তাদের বেশিদিন থাকল না।হঠাৎ এলো এক অজানা অসুখ।সব বন্ধ হয়ে  গেল।সে বছর পুজোতে বাজি বিক্রী হল না।যারা বাজি বানাতে বলেছিলেন তারা আর বাজি নিতে এলেন না,খুব ক্ষতি হয়ে গেল রাজুর বাবার।সে আগে থেকে মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে কাঁচামাল কিনে বাজি তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছিল।এখন কেউ সেই বাজি নিতে এলো না।এদিকে মহাজনের দেনা আর সংসারের ভার -চিন্তার শেষ নেই।মাথায় হাত বাড়িসুদ্ধু সবার।রাজুর দাদুর শরীর ভালো যায়না।আজ এটা কাল সেটা লেগেই থাকে।সারাবছর তার ওষুধের খরচ।এইসময় চাষের জমিটা থাকলে কাজে দিত, ভাবছিল রাজেশ ,রাজুর বাবা।বাজির ব্যবসা শুরু করার সময় সে জমিওতো বন্ধক রেখেছিল সে।ভেবেছিল-আর কটা দিন গেলে আরেকটু টাকা জমিয়ে জমিটা ছাড়িয়ে নেবে।এইভাবে যে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতন এমন মহামারীর সম্মুখীন হতে হবে হঠাৎ করে তা সে দুঃস্বপ্নতেও ভাবেনি।অন্যসময় যে দীপাবলি আনন্দ বয়ে আনে ,এখন তার আগমনে যেন আরও আঁধার ঘনিয়ে আসছে।
                                               ছোট্ট রাজু এত কিছু না বুঝলেও এবারে যে কালী পুজোর আগে বাড়ির পরিবেশটা অন্যরকম -সেটা বুঝতে পেরেছে।তাই সে এবার চুপচাপ,কোনো বায়না করছেনা।নাহলে এইসময় তাদের টিনের চাল সেজে ওঠে টুনিবাল্বে,মাটির প্রদীপ নিয়ে আসা হয় কুমোর কাকার বাড়ি থেকে।সবাই খুশিতে ভরপুর থাকে।কিন্তু এবারে যেন বাড়ির পরিবেশ থমথম করছে।বাবাকে খুব চিন্তিত আর অস্থির দেখাচ্ছে।মায়ের সঙ্গে আলোচনা করছিল-কি করা যায় এই নিয়ে।সেই বছর দীপাবলি ঐভাবে অমানিশার মধ্যেই কাটল।কেউ কোনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল না।রাজুর বাবার কারখানায় জঙ্গল।এই বছর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক ,কিন্তু বাজি কারখানা বন্ধ।রাজেশ  এখন অনেকটা পায়ে হেঁটে গঞ্জের দিকে গিয়ে কিছু দিনমজুরির কাজ জুটিয়েছে।যেভাবেই হোক বাড়ির মানুষদের মুখে কিছুতো তুলে দিতে হবে।এদিকে মহাজন ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছে।এই একবছরে তার চেহারাও খুব খারাপ হয়ে গেছে।রাজুর মায়ের দিকেতো তাকানোই যায় না।রাজুর দাদু বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাই হারিয়েছেন।এইভাবে এক হতাশা অনিশ্চয়তার দিকে তারা যেন এগিয়ে চলেছে-মুক্তির কোনো উপায় নেই।এই বছর ও দীপাবলির সময় এগিয়ে এলো।এই সময়টাতে যেন বিগত দিনগুলির কথা আরো বেশি করে মনে পড়ে।
                   এমনই একদিন সন্ধ্যেবেলা-সবে রাজেশ ফিরে হাত পা ধুচ্ছে,হঠাৎ -"রাজেশ বাড়ি আছ নাকিগো?"এক চেনা গলার হাঁক শুনে তাড়াতাড়ি উঠোনের দিকে গিয়ে দেখে শহরের বড় বাজির কারবারি দাসবাবু দাঁড়িয়ে ,সঙ্গে আরেকজন অপরিচিত ভদ্রলোক।দাসবাবু তার দিকে তাকিয়ে  বললেন-"একি অবস্থা হয়েছে গো তোমার,আর বাড়িঘরেরই বা কি হাল!" এতোদিন কষ্টে বুক ফেটে গেলেও সে কাউকে বুঝতে দেয়নি ,আজ দাশবাবুর সহানুভূতিমাখানো গলা শুনে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না।হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বললো-"বাবু গো ,সব্বহারা হয়ে গেছি।সব টাকাপয়সা ডুবে গেছে গো-আপনেরা তো আর বাজি নিতে এলেননি,ইদিকে মহাজনের ধার ,বাড়িতে অসুস্থ বাপ আর ছোট ছেলেটা।আমি যে কি করে সব দিক সামলাচ্ছি সে আমি জানি গো বাবু।" কান্নার আওয়াজে ততক্ষনে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে রাজু-হাঁ করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে এরকমভাবে তো সে কাঁদে মা মারলে-বাবাও যে কাঁদতে পারে এ তার কাছে অতি আশ্চর্য্যের।রাজেশের বউ,মা ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।কোনোরকমে রাজেশকে শান্ত করলেন দাসবাবু।বললেন-"কি করব বলো হঠাৎ করে সব কিছু বন্ধ হয়ে যেতে আমরাওতো নিরুপায় হয়ে গেলাম। আমারও প্রচুর ক্ষতি হয়ে গেছে।এখন পরিস্থিতি একটু ঠিক  হতে ছুটে এসেছি তোমার কাছে।চল দেখি তোমার কারখানার কি অবস্থা।""সেতো এখন আগাছায় ভর্তি হয়ে আছে বাবু।"তা বললে হবে,উঠে দাঁড়াতে হবে তো।সেইজন্যই তো তোমার কাছে আসা।আলাপ করিয়ে দিই- ইনি হলেন বরুণ রায়।তোমাকে কিছু বলবেন,মন দিয়ে শোন।"ইতিমধ্যে মাটির দাওয়ায় খেজুর পাতার চাটাই পেতে দিয়েছে রাজুর বউ,আর ঝকঝকে কাঁসার ঘটিতে জল ,থালায় বাতাসা।রাজেশের মা বললে-"বাবুরা এইখানে একটু জিরিয়ে নেন গো।এট্টু বাতাসা মুকে দে জলটা খেয়ে নেন,অনেকটা পথ পেইরে এলেন।"দাওয়ায় বসে জল বাতাসা মুখে দিয়ে শুরু করলেন রায়বাবু-"শোনো রাজেশ,এখন যা পরিস্থিতি তাতে সাধারণ বাজি আর চলবেনা,কিন্তু দূষণহীন বাজি ব্যবহার করার অনুমতি পাওয়া গেছে।সেই বাজি তৈরি আলাদা করে শিখতে হয়।আমি সেই বাজি তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছি।এখন তোমাদের মতন বাজি তৈরির ব্যবসায়ীদের সেই বাজি কিকরে তৈরি করতে হয় তা শেখাব।"দাসবাবু বললেন-"রায়বাবু শহরের বড় বড় বাজির দোকানগুলোতে  যোগাযোগ করেন,আমার কাছে আসার পর আমি তোর কাছে নিয়ে এলাম।তুই ওনার কাছে ঐ বাজি তৈরি শিখবি ।এখন যা লাগে আমি দিয়ে দেব,আর সরকারকেও অনুরোধ করা হচ্ছে কিছু সাহায্য করার জন্য।"রাজেশ হাতজোড় করে বলল-",বাবু আপনেরা মানুষ না দ্যাবতা ।"বরুণ বাবু বললেন-"সত্যি দাসবাবুরও
অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে,কিন্তু তাও সবাই মিলে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে হবে।।"দাসবাবু তাড়া দিলেন -"আর হা হুতাশ নয়,আজ থেকেই কাজ শুরু।"ঠিক হলো রাজেশ এখন ওনাদের সঙ্গে শহরে গিয়ে দিনকয়েক থেকে কাজ শিখবে,তারপর এখানে এসে বাজি বানাবে।ততদিনে বাড়ির লোকেরা কারখানা পরিষ্কার করিয়ে রাখবে।এবারে হয়তো অল্প লাভ হবে কিন্তু আগামীদিনের পথ হবে সুগম।ঘরে রাখা তালপাতার ভেঁপু নিয়ে এসে ফুঁ দিল রাজু।ছোট্ট রাজুর ঝলমলে মুখ
দেখে উপস্থিত সকলের মনে জ্বলে উঠলো আসন্ন দীপাবলির হাজার দীপ।
     এসো -হাতে ধরি হাত
     সবাইমিলে জয় করি এই মহামারী
     আবার আলোকমালায় সেজে উঠুক সব
      সার্থক হোক দীপাবলি,
      ঘুচে যাক অমানিশার যত আঁধার কালি।





ভাই ফোঁটা
রীতা মোদক

ঠক ঠক শব্দ কানে আসতেই লতা ধরপর করে বিছানা থেকে নামে l দরজা খুলে  শাশুড়িকে দেখে মনে পরল আজ  তো ভুত চতুর্দশী,শাশুড়ি- বউ মিলে চোদ্দশাক খুঁজতে যাওয়ার কথা l তাই বলে  ভোর পাঁচটায়? ঘুমে চোখ যে খুলতেই ইচ্ছে করছে না l আবার শাক খোঁজার বাহানায় বনে জঙ্গলে ঘোরার লোভটা ও লতা সামলাতে পারছে না। সবুজ ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু, ঘাসে ঘাসে  ঘাস ফড়িং  আর প্রজাপতির খেলা ,মাঠ ভরা  পাকা ধান--- কতদিন দেখা হয়নি l তাই দেরি না করে কোনোরকমে একটা শাড়ি পড়ে লতা বেরিয়ে পরলো তার প্রিয় ক্যামেরাটা নিয়ে l  শাশুড়ি চোদ্দ শাক খুঁজে বেড়ায় আর লতা অবাক চোখে দেখে --- কচু পাতায় জমে থাকা শিশিরের দিকে।রাস্তার পাশের দিঘিতে শালুক ফুটেছে  প্রচুর।
  দেখতে দেখতে কালী পূজা চলে এল।লতা  সান্ধায় শ্বাশুড়িকে নিয়ে কলা গাছের খোল দিয়ে  ডোঙ্গা বানিয়ে করে সুটুঙ্গার  জলে প্রদিপ ভাসিয়ে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় প্রদিপ জ্বালল।ননদকে কলা গাছের ডান্টায় তেল মাখিয়ে কাজল পাততে দেখে  লতার চোখ দিয়ে টপ টপ  করে জল পরছে।লতার বর বিষয়টা বুঝতে পেরে চুপচাপ সরে গেল।
ভাইফোঁটার দিন লতার বর আর ভাসুর পাঞ্জাবি পরে আসনে বসলো। ননদ সুন্দর করে দুই ভাইকে ফোঁটা দিল,উপহার পেল।লতা কেবল কেঁদে চলছে...। হঠাৎ  বরের ডাকে লতার চমক ভাঙলো,  -----
এই লতা শুনতে পারছ না?
--- অ তুমি?কিছু বলবে?
--- এই নাও।
কি আছে এতে?
লতা তো ঢাকনা তুলতেই অবাক---
একটা বাটার মধ্যে  ধান -দুব্বা, মিষ্টি ,নারকেল নাড়ু পাঞ্জাবী। কিন্তু কাকে ফোটা দেবে লতা? তার তো কোন ভাই বা দাদা নেই?
---কি ব্যাপার, আর কতক্ষণ  বসে থাকব বোন?
লতা আবার ও চমকে উঠে।
আরে বোন বলে কে ডাকলো?
----ভাসুর- টাসুর ভেবে আর লজ্জা পেতে হবে না।আজ থেকে আমি তোমার দাদা হলাম।
লতা বাটা নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোয়। হাতে ভাইফোটা দেয় আর মনে মনে বলে,
ভায়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা 
যমুনা দ্যায় জমকে ফোঁটা
আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা।
লতার দু'চোখ বেয়ে আমার জল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এ জল দুখের নয়,আনন্দের।





আলোর সন্ধানে 
রাজেশ  প্রামানিক

 চারিদিকে  আলোর  রোশনাই। আকাশে আতসবাজির খেলা চলছে, যেখানে একটা ছেড়ে একটা ম্যাজিক শো দেখানো হচ্ছে। অলিগলি ছোটরা হাতে ফুলঝুরি নিয়ে চারদিকে দৌড়াতে ব্যস্ত। কিন্তু আকাশ বারান্দাতে বসে তার কোন আলোর ছোঁয়া নেই। নাম তার আকাশ কিন্তু তার আকাশে কোন সূর্যের দেখা নেই, দেখা নেই কোন আলোর ছটার।সে জন্ম থেকেই অন্ধ। আজ তার  খুব মন খারাপ, সে অন্য ছেলে মেয়েদের মত আলোর রোশনাই দেখতে পায় না। সে ফানুস এর কথা শুনেছে কিন্তু চোখে কখনো দেখেনি আর কোনদিন দেখতে পাবে না। আকাশের খুব ইচ্ছা করে ফানুশের  সাথে আকাশে ভেসে বেড়াতে। আরো কত কি ভাবে সে। আকাশ ও আকাশ  খাবিনা ?  মায়ের ডাকে আকাশের জ্ঞান ফিরলো। আকাশ বলল হ্যাঁ। কিরে মন খারাপ নাকি,  মা বলল ।  কথাটা শুনে আকাশ চুপ করে রইলো। 
মা জানে আকাশের মন খারাপ,কারণ মন খারাপ হলেই সে চুপ করে থাকে । আর আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনা করেন। মা আবার বললেন কিরে কি হয়েছে বল। আকাশ যেন কি যেন ভেবে বলল আচ্ছা মা, কেন আমি দেখতে পারিনা, কেন আমি আতশবাজি পুড়াতে   তে  পারি না। মা আমার জীবনে তো কোনো আলোই নেই !  ছেলেদের মুখে এমন কথা শুনে মা কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো,তারপর বলল  আচ্ছা তুই কি সত্যিই আলোর দেখা পেতে  চাস। আকাশ বলল হ্যাঁ মা। মা বলল তাহলে তুই একটা কাজ কর তুইতো এবারে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে আর তোর তো দর্শন খুব ভালো লাগে। তাহলে এবারেে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা কর। এখানে বলে রাখা ভাল আকাশ ব্রেইন পদ্ধতি ও অডিও পদ্ধতিতে এবারের  উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। সে খুব ভালো পড়াশোনা করে। যা একবার শুনে তা কখনো ভোলেনা। আমি পড়াশোনা করে কি করবো, চোখে  তো দেখতে পাই না। আমার জীবন অন্ধকার, আমি আর পড়াশোনা করবো না। মা ছেলের কথা  শুনে বলল একটু আগে তুই বললি আলোর দেখা পেতে চাস। আকাশ আবারও বললো হ্যাঁ মা । মা বলল তাহলে পড়াশোনা কর তাহলে দেখবি ঠিক একদিন আলোর খোঁজ পাবি । এই বলে মা ছেলের মাথাতে সস্নেহে হাত বুলিয়ে ঘরে চলে গেল। আকাশ বসে ভাবতে লাগল সত্যিই আলোর খোঁজে পাবে। তাহলে তো তাকে পড়াশোনা করতেই হবে। এরপর সে খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করে  মাস্টার্স কমপ্লিট করল।এবং পি এইচ ডি  করল দর্শনের। আজ সে  ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। আর মাসে অন্তত তাকে একবার বিদেশে যেতেই হয় দর্শনের সব নতুন নতুন    থিওরি   নিয়ে বক্তৃতা দিতে। বইও লিখেছেন দর্শন সম্পর্কে।  আজ ও দীপাবলিই দিন, আকাশে মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। মা আর তার সাথে নেই কিন্তু মার দেখানো রাস্তাতে চলে  আজ সে  আলোর সন্ধান পেয়েছে। আজ তার জীবনে স্পেশাল  দিন কারণ আজ তাঁর লেখা বই 'আলোর সন্ধানে ' দর্শনের মনোবিজ্ঞান একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই  যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষাতে বিক্রি হচ্ছে। । যা বেস্ট  সেলার অফ দা ওয়ার্ল্ড খেতাব অর্জন করেছেন। আকাশ এই বইটি তার মাকে উৎসর্গ করেছিল।





দীপাবলি কবিতা 



দীপাবলি

মাথুর দাস


জ্বালিয়ে প্রদীপ চতুর্দিকে, জ্বালিয়ে  আলো বাতি,

হিন্দু পরিবার করে লক্ষ্মীপুজো নানা উপচারে ;

আলোর ঝলক পলক ক্ষণে ঘোচায় আঁধার রাতি,

তারই মধ্যে হয়  কালীপূজা  পালিত আড়ম্বরে ।


ধনতেরাসে  শুরু  হয়ে  ভাইফোঁটাতে  শেষ,

পাঁচ দিনের এ আলোর উৎসব হলে হবে কি ;

আশ্বিন-কার্তিক জুড়েই থাকে যে তার রেশ,

স্বর্গবাতি  সারা রাতই  জ্বলতে থাকে  ঠিকই ।


দীপাবলি দীপ-আবলি, যা বলি তা তুচ্ছ নয়,

বিজয়ীর আখ্যান তো ধরেই রাখে শাস্ত্র পুরাণ ;

আলোয় আলোর রশ্মিচ্ছটা উদ্ভাসিত পুচ্ছময়,

মন-কালিমা দূরীভূত, উজ্জীবনের স্বপ্ন-উড়ান ।





মাতৃবন্দনা
     রীনা মজুমদার

 পোড়ো বাড়ি, জীর্ণ দশা তার মন্দির
 লতাপাতা ঢেকেছে মূর্তির সাজসজ্জা

   আঁধার ঘরে অন্ধ হয়ে
থাকিস কেমন করে মা তুই ?
 ঘুমিয়ে আছে মানবতা
    ঝরছে দেখ রক্তবৃষ্টি
 জেগে উঠেছে নির্মমতা

মুছে গেছে যে তোর ললাট লোচন !
তুলিকলায় আঁকতে শিখিনি মা
দিতে পারি নিজেরই একটি চোখ
মুন্ডুমালিনী, ত্রিশক্তি ত্রিনয়নী সেজে ওঠ

বেড়িয়ে আয় মা অন্ধকার থেকে
 জ্বালিয়েছি শুভ দীপের আলো 
 চোখ রাখ তুই ধর্ম বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে
 মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের মাঝারে

 হাত রাখ মা শ্বাশত সত্যের উপরে।




লাইট হাউস 
মৌসুমী চৌধুরী 

ভাপ উঠছে, আগুনের হলকা
কার্তিকের হিমেল বাতাসে হিসহিসিয়ে!   
অনন্ত বিশ্রামে তিনি 
শুয়ে আছেন শেষ আশ্রয়ে, শান্ত! 
একটু একটু করে গনগনে আঁচ
চপর চপ তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে, 
পুড়ে যাচ্ছে নগ্ন শরীরে লেখা বিগত ইতিহাস!
খাক হয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে 
 গোলাপি, সবুজ, নীলাভ মগজ... 


শুধু জ্বলছে না হৃদপিণ্ড-উপড়ে-বের-করা
অনুভূতি-মানবিক মূল্যবোধ-প্রেম...
বেয়াড়া কলমটি তাঁর পুড়ছে না যে! 
অবিচল বেঁচে আছে ঠেঁটে করে 
ঘাম, রক্ত আর এক টুকরো আলো !




দীপাবলী দাও
স্বপন কুমার চট্টোপাধ্যায়

একলা আমি ছিলাম বসে
দীপাবলীর অমাবস্যার রাতে
প্রদীপখানি নিভুনিভু 
ছিল আমার হাতে।
সলতে খানি উসকে দিয়ে
আড়াল করে ছিলাম ধরে
হয়তো কোন দামাল বাতাস
ঢুকবে এসে ঘরে।
হাজার প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে
বসলে তুমি আমার পাশে
আলোয় সে ঘর উঠলো ভোরে
ছিলাম যেন তোমার আসার আশে।
বলেছিলে আমায় তুমি ডেকে
কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর গভীর নিশায়
ফিরবে ঘরে হারিয়ে যাওয়া আপনজন
ফিরতে যারা চায় আলোর দিশায়।
আকাশ জুড়ে আলোর বাতি
চারিদিকে আলোর রোশনাই
সকল আঁধার আজকে যাবে ঘুচে
ঘরের লক্ষ্মী ফিরুক ঘরে এই টুকু চাই।




এক দীপান্বিতার রাতে 

আকাশলীনা ঢোল

 বাতাস জুড়ে পোড়া বারুদের

ঝাঁঝালো গন্ধ,

গৃহস্থের প্রাঙ্গণে দীপমালা-

মন্দিরে-মণ্ডপে কাঁসর-বাদ্য,

অমানিশার রাত, শক্তির আরাধনা।

এমনই এক দীপান্বিতার রাতে

হেঁটে দেখেছিলাম নগরের পথে পথে।

দেখেছিলাম, সেখানে মহামায়ার

মৃন্ময়ী রূপ পূজিত হয়-

চিন্ময়ী হয় অপসৃত।

একদিকে আদ্যাশক্তি-এলোকেশী,

তাঁর পায়ের তলায় আলোর নাচন,

আর অপরদিকে রুক্ষ চেহারার চিন্ময়ী-

তার কোলের কাছে অভুক্ত শিশুর ক্রন্দন।

একদিকে প্রার্থনা শ্যামার কাছে

আলোকোজ্জ্বল দিনের,

অপরদিকে রয়েছে, শ্যামাঙ্গীর

গহন আঁধারে তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য।

একদিকে দীপাবলির আলোর রোশনাই,

অপরদিকে, অমানিশার গাঢ় অন্ধকার।

একদিকে শিল্পীর হাতে গড়া

 আদ্যাশক্তির পূজার্চনা,

অপরদিকে, রক্ত-মাংসে গড়া দেবীর

চির অবহেলা । 

এমন কিছু দৃশ্যই দেখেছিলাম,

নগরের রাজপথে-

সে এক দীপান্বিতার রাতে।



দীপ জ্বেলে যাই

উমা শঙ্কর রায় 

একটু আলো চাই আলো, 
যার কোনো ছায়াসঙ্গী থাকবে না 
থাকবে না কোনো ঝলকানি ---

আলো আঁধারির চিরন্তন খেলা 
কুড়িয়ে পেয়ে হারিয়ে ফেলা! 

রোজ খুঁজে মরি আলো --
অরুণপ্রাতের অরুণাচলে
শ্রাবণী পূর্ণিমায়।

আলো আঁধারিতে কীটের রাজত্ব -
সলতে পোড়া গন্ধে বুক ভরে তুলি! 
একটা স্থির শাশ্বত দীপ 
জ্বালাবো মাধুরী -

জ্বলে যাবে যত আলো আঁধারির কীট
সার্থক হবে সলতে পোড়া। 

মুছে যাবে সলতে পোড়া গন্ধ--




দীপাবলি
 অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত 


জ্বালাও তুমি দীপাবলিতে নিজের অন্তরের যত নিভন্ত আলো, 
শোক ক্লেশ দুঃখ কষ্ট সকল তুমি যাও ভুলে। 
হিংসা দ্বেষ যাক এবার সব গলে, 
মোম ও দীপের আলোর শিখার অতলে। 
পুঞ্জীভূত যত রাগ ক্রোধ অন্যায় আক্রোশ, 
ধ্বংস করো তুমি কোষ হতে উপকোষ।
আতশবাজি করে যে দুষণে বায়ু বিষাক্ত, 
হবেই অনর্থ তুমি যদি হও অশক্ত। 
অমানবিকতা নাশকতার দিতে পারি যেন জলাঞ্জলি, 
আঁধারে ঢাকা চারিপাশ চলো উজ্জ্বলিত করি সকলে মিলি, 
শুভ করে তুলি সবাই মিলেমিশে আজকের এই দীপাবলি।।



হীরক রাত্রি


অলকানন্দা দে



খেয়ালের খেয়া বেয়ে

কেবল আকাশ দেখা,

সুহাসি উড়াল মেঘে

প্রাচীন গরিমা আঁকা!

 

হাস্যচপল হাওয়া

শারদীয়া মিতালি,

কোজাগরী সমাধায়

আলাদিন দীপালি!

 

দ্বিধাহীন দীপমালা

চৌদ্দটি প্রদীপে,

একমনে দেয় আলো

মরমের সমীপে!

 

পুরানো রাত্রি পরে

আতসবাজির হার,

হেমন্ত জানালায়

বিনিদ্র সংসার!

 

মেদুর আকাশকোণে

শুকতারা ধরে গান,

স্মৃতিপটে বেহিসেবী

শরতের সম্মান!

 

শেষহীন দীপাবলি

ভূলোকের উঠোনে,

গর্বের দিনকাল

ভালোবাসা গঠনে!

 

বিভেদের ছিঁড়ি জাল

একতার করি স্তব,

একান্ত মৈত্রীর






দীপাবলির অন্য কবিতা 

ভালোবেসে বেড়ানো
শতাব্দী সাহা


নিস্তব্ধের অতলান্ত গহ্বরে
শব্দ প্রস্ফুটনের আলোড়ন
যুগযুগান্ত হতে শোনা
ঘুমপাড়ানি গানের সুরে
চিরনতুন খুশির ঢেউ বয়ে বেড়ায়,
বেড়াতে ভালোবাসে।
আলো আঁধারে
খুলে রাখা ঝাঁপির মুখ উপচে
মান অভিমান
কুয়াশার ভোর
মাঠের দুপুর
শীতের সন্ধ্যে
খেলার সাথী
এক লম্বা তালিকা...
গোঁত্তা খাওয়া  ঘুড়ির সাথে ঘুরে বেড়ায়,
বেড়াতে ভালোবাসে।
খরচের খাতা থেকে
বেঁচে যাওয়া  দিনে
আবার কথার ডালি
থেকে নতুন গল্পের স্ফুলিঙ্গে
আলোর শামিয়ানা টানিয়ে নিয়ে,
দুঃখ বোঝাই বাক্সপ্যাঁটরা
রংবেরঙ ফানুস সাথে উড়ে বেড়ায়,
বেড়াতে  ভালোবাসে।



নেপথ্য
সুদীপ দাস

নি:শব্দ বৃষ্টি অবিরাম, কিন্তু
বাইরে না তাকালে বোঝা দায়
রাস্তা ভেজা, ভেজা গাছ,পাতা,ঘাস
আরও কত কি?
সেদিন আমারও চোখ ভেজা ছিল, আজ শুকিয়ে গেছে,
সেদিনের চৌচির হয়ে যাওয়া মনটা,
আজ বোধহয় শিরা উপশিরা গুলির
মেরামত করে উঠতে পেরেছে, কিংবা পারেনি!
তা আজ আমি আর পরখ্ করতে পারিনা।
সেদিন যখন মুষলধারা নেমেছিল
যখন তুমি আমার অশ্রুধারা দেখতে পাওনি
শুধু আরও সুন্দর এর নেশায় মেতে,
আমায় একলা ফেলে দিয়ে চলে গেলে
সেই আমি আজও বেঁচে আছি।
হ্যা, ক্ষনে ক্ষনে আমার আশা,
আমার বিশ্বাস এর মৃত্যু হতে আমি দেখেছি
কিন্তু দ্যাখো আমার মৃত্যু এখনও হয়নি,
আমি আজও বেঁচে আছি।
একসময় সাঁঝ আকাশে যখন চাঁদ উঠত,
আমি চাঁদ উদয়ের শব্দ পেতাম,
চাঁদের দেখা পেয়ে আমার কবিতার খাতায়
মন খুলে হিজিবিজি লিখতাম তোমার জন্য,
এখন নিঃশব্দে চাঁদ ওঠে ওই মুক্ত আকাশে
নিঃশব্দে নিশি রাতে জ্যোৎস্না বিলি করে,
আমি জানতেই পারি না, কিন্তু দ্যাখো
আজও আমি বেঁচে আছি,
আজ আর আমি হিজিবিজি লিখি না,
আর আমি শব্দ সাজাতে পারি না, আগের মতো করে,
আমার কবিতার খাতাটি এখন
নিস্তব্ধতা আর নিঃশব্দতায় ভরা এক জীর্ণ পান্ডুলিপি।
যেমন জীর্ণ পোষাকে আজ আমি ঘোরা ফেরা করি
একা একা হাসি, বিড় বিড় করি
আজকাল কাউকে চিনতে পারিনা,
হয়তো বা চেনার চেষ্টাও করি না আর,
দ্যাখো তবুও আমি বেঁচে আছি,
আমি আজ বুঝতে শিখেগেছি
সব ভুলে থেকেও বেঁচে থাকা যায়,
তোমাকেও ?
আমাকে সবাই এখন পাগল বলে ডাকে,
ওদের কী দোষ বলো?
আমি তবুও বেঁচে আছি।
রাস্তায় কত ভবঘুরে পাগল ঘুরে বেড়ায়
আমরা কী খোঁজ রাখি নেপথ্য?



উজ্জ্বল তুমি অমলিন
বিজয় বর্মন

অভিমানী গন্ডি পেরিয়ে ঐ যে তোমার বাড়ি,
আমি জেনে গেছি,
অনেক অনেক উঁচুতে ।

এই উচ্চ গতি প্রবাহে অনেক বহন ক্ষমতা তোমার,
অনন্ত পারাপারে,
তবু তুমি অমলিন, তবু তুমি উজ্জ্বল।

মধ্য গতিতে ভরাট বুক, পার ভাঙ্গা কান্নার রোল,
নাব্যতা মাপার ব্যর্থ প্রয়াস,
জীবন যেখানে, সবুজ নীলে আলোময়।

অস্থির শুধু এপার ওপার, কোনদিন সাক্ষাৎ হবে না,
তফাতটা বুঝে গেছি,
অনুসরণে বাধা নাই, অনুকরণ অসম্ভব।

দূর মোহনায়, আছড়ে পরে সমুদ্র জলোচ্ছ্বাস,
তোমার নির্লিপ্ত নীলাঞ্জন,
চাঁদের সাথে খেলা করে যায় জোয়ার ভাটা।

সুপ্রতিষ্ঠিত,উচ্চ অবস্থান থেকে বলতেই পারো,
আমি কতটা নিচে,
বলতেই পারো, বলতে পারে তোমার অবস্থান।




তোমার না থাকার যন্ত্রণা 

              নিত্য রঞ্জন মণ্ডল 



কি ভাবে কেমন করে এই জ্যোৎস্না রাতে আঁধারের কাছে
এই ভাবে এই ভরা নদীর জোয়ার মাখা শরীরে ;
রোগ যন্ত্রণা বড়ো যন্ত্রণা, রাত কাটে না গভীর অন্ধকার
মনের অন্ধকারে বাজে, এ সুর আমি কখনো চায়নি। 

কখনো চায়নি, আমি কখনো ত চায়নি
চৈত্রের দুপুর বেলা তোমার বুকের উপরে গীতবিতান খোলা
স্বপ্নখানি এলোমেলো ভয় ভরা শরীর
নীল শিখা ঘূর্ণিবাতাসে খেলা করে অজানা খেলা,
চলে গেলে বুঝতে পারি তার অনুপস্থিতি তার গভীরতা।  




 বাঁধন 

কুমার বিরাজেন্দ্র নারায়ণ

বাঁধলি জীবন মায়ার বাঁধনে,
তাইতো আছি এই সংসারে ।
দেখেছি ভুবনে  কত রঙ্গ রস,
 সবাই তো তোর মায়ার বস। 

শীত-বসন্ত ভরা এই ভুবন ,
হাসি কান্নায় কাটে জীবন। 
সবখানেতে ফুলের বাহার ,
সুখ দুঃখের এই সংসার । 

সবাই মিলে আছি এই ভুবনে,
 মায়ার বাঁধনে কষ্ট ভুলে ।
 রাজনীতির এই মায়ার জালে,
 সূর্য-চন্দ্র সব আস্তা  চলে ।

শাসন দখলে এই লড়াই,
 দুষ্কৃতীদের তীব্র বড়াই ।
জিতলেই হবে বিজয় উল্লাস ,
হারলেই হবে সর্বনাশ ।

জীবনের বাঁধন মায়ায় ভরা,
মাথায় ঝুলছে তীক্ষ্ণ খাড়া।
রেখেছো তুমি তবুও সংসারে,
মায়ার বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে ।



কবিতার খাতার পাতায় পাতায়
মজনু মিয়া 

ভাবতে থাকি যখন তোমায় ভেসে উঠো চোখে 
কান্নার ধ্বনি শুনি কানে ব্যাথা লাগে বুকে
লাইন ধরে লাইন লিখে খাতা ভরে রাখি
হঠাৎ করে শুনতে পাই হায়! পাখি দিছে ফাঁকি!

বিছনায় উঠি ঘুম আসে না, ছটপট ছটপট করি
হাতের কাছে পড়ে থাকা খাতাটা তুলে ধরি
স্মৃতির মিনার গড়ে গেছো প্রতি পাতায় পাতায়
চোখের জলে ভিজে যে যায় জল কবিতার খাতায়!

লেখাগুলো কভু যদি তোমার চোখে পড়ে
আমার লেখা পড়ে যদি একটু নয়ন ঝরে!




দীপাবলি চিত্র 





                                                       সৃজা রায় 





অদ্রিজা বোস 









তানভি দাম