Saturday, November 13, 2021


 

মুজনাই সাপ্তাহিক 

শিশু দিবস 

বিশেষ সংখ্যা 


সম্পাদকের কথা 

আমরা ঠিক কতটা ভাবি আমাদের শিশুদের নিয়ে? বোধহয় খুব কম! সত্যি বলতে শিশুদের নিয়ে আমাদের কোনও নির্দিষ্ট ভাবনা নেই। যেটুকু আছে সেটিও নিতান্ত ছন্নছাড়া। ফলে আমাদের শিশুরা, প্রতিভা থাকা স্বত্বেও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে তাদের অনেকের কপালে জোটে শ্রমিকের জীবন। 

শিশু দিবস আসে, যায়। কিছু ভাল কথা, সেমিনার, খানিক হৈ চৈ শেষে আবার স্তিমিত হয়ে যায় সব। শিশুরা যে তিমিরে ছিল, রয়ে যায় সেই তিমিরেই। 

মুজনাই চেষ্টা করে সামান্য হলেও কাজকে মর্যাদা দেওয়ার। চেষ্টা করে বড়দের দিয়ে শিশুদের জন্য কিছু করে নেওয়ার। খুব সামান্য হলেও সেই প্রচেষ্টা যদি শিশুদের বিকাশে কাজে লাগে, তবে মুজনাইয়ের শিশু দিবস পালন সার্থক হবে।



শিশু দিবসে বড়দের ভাবনা 


শিশু দিবসের  ভাবনা

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 


" ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে"। 

একটি   শিশু   বড়ো  হয়ে কেমন   হবে    তা বহুলাংশে   নির্ভর   করে   তার মা এবং বাবার জীবন   এবং  জীবন  দর্শনের   ওপর।   একটি  শিশু জন্মানোর পর নিজে থেকেই " মা "  ডাকটা শিখে নেয় ।  তার পর  থেকে  মৃত্যু  অবধি,  সে শুধুই   অনুকরণ   করতে  থাকে।  ধীরে ধীরে আপনা আপনিই  তার জগৎ তৈরী হতে থাকে।  শিশু জগৎ   বড়ই  মজার  এবং   বিস্ময়কর। সদা  ব্যস্ত  এই  জীবন ।  তার  মাঝে  এমন কিছু ঘটনা  ঘটে  যা  ভাবলে  অবাক হতে হয়।

বিশ্বব্যাপি  শিশুদের   সম্মান  জানানোর জন্য প্রথম  তুরস্কে  ২০ শে  নভেম্বর  দিনটি   শিশু দিবস  হিসাবে  পালিত  হয়।   বিভিন্ন   দেশে, বিভিন্ন   দিনে  শিশু  দিবস  পালিত   হলেও,  ১৯৫৬   সালের  পর  থেকে    ১৪ই   নভেম্বর  ভারতবর্ষের   প্রথম  প্রধানমন্ত্রী  পন্ডিত জওহরলাল  নেহেরুর  জন্মদিন  শিশু  দিবস হিসাবে  পালিত  হয়ে  আসছে। আজকের শিশু আগামীর   ভবিষ্যত,  তাই  শিশুদের  সঠিক ভাবে  সম্মান  করা, তাদেরকে  সঠিক  ভাবে বড়ো  করে  তোলা  অত্যন্ত  গুরুত্বপূর্ণ  একটা বিষয়।  শিশু  বড়  হয়ে  কেমন হবে,  তার জীবন জীবিকা,  চিন্তা  ভাবনার  জগৎ  বহুলাংশে নির্ভর  করে  তার  মা,   বাবা, দাদু, দিদিমা অন্যান্য পরিবারের সাথে  এবং   পরিবেশের উপর।   যৌথ  পরিবার  প্রথায়  বড়  হয়ে ওঠা এবং  নিউক্লিয়ার পরিবারে বেড়ে ওঠা  বাচ্চার ভিতর চিন্তা ভাবনার জগৎ এর তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। পরিবার  ভেঙে  যাবার  সাথে  সাথে পাড়া  ও সমাজের  ভাঙন  থেকে  সনাতনী  মূল্যবোধের অবক্ষয়  শুরু  হয়েছে।

আজকের  এই  বিশেষ  দিনটিতে  শিশুদের অনলাইন , অফলাইন এবং  বিভিন্ন মনিষীদের শৈশব নিয়ে আলোচনাসভা অত্যন্ত  জরুরি। সাথে সাথে  সঙ্গীত,  শিল্পকলার প্রচার ও প্রসার ঘটানো বিশেষ প্রয়োজন।



গড়ি ভবিষ্যৎ

অলকানন্দা দে


‘শিশু’ শব্দটি উচ্চারণে কোমলতা স্থান পায়। একটি সুন্দর মনকে খোলসে ভরে হয়তো বিধাতা পাঠান তাকে জ্যোৎস্নাময়ী পৃথিবী প্রান্তে, বিস্ময়ের আঁতুড়ঘরে! তাকে পেয়ে ভালোবাসা জাগে, মায়া জাগে! তার অকৃপণ বিলিয়ে যাওয়া তুষারশুভ্র হাসি সংখ্যাহীন সুখমুহুর্ত গড়ে দেয়! সে জানে না বিভেদকথা,প্রসারিত দুটি কোমল মুঠিতে আদর জড়ো করতে চায় শুধু! দিনমান যেন শুভ বিতরণই তার নির্ধারিত কাজ। আমরা উপভোগ করি প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয় দিয়ে একটি শিশুর নির্মল বোধের খেলা! সাজিয়ে দেয় মনকে সে স্নেহ-কুমকুমে!

অমূল্য সময় ছুটে যায় বৈশাখী ঝড়ের বেগে। শিশু বড় হয় রৌদ্র-হাওয়া-নীলের সাথে তাল রেখে। সমাজের সবুজ ময়দানে তাকে বিশ্বাসে দাঁড় করানো অভিভাবকদের কাছে এক অভিমানের কাজ। এ দায়িত্ব নিপুণভাবে পালনে শিশু সাফল্যের শিখর পায় খুঁজে। একটি শিশুর নৈতিক চরিত্র গঠনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে তার সামাজিক অবস্থানের সিংহভাগ। দূর-বয়স পর্যন্ত যা তার সঙ্গী হয়। মুখোমুখি বসে তাকে পাঠ দিতে হয় মানবিকতাবোধের। পারিবারিক শৃঙ্খলা তাকে সন্ধান দিতে পারে একটি শ্রেয় জীবনের। নবীন জীবনটি গোড়া থেকেই যেন ভালো কে আপন ও মন্দকে এড়িয়ে চলার ব্যক্তিত্বে অনড় থাকে। প্রাণের পাত্রটি যেন পূর্ণ থাকে শ্রদ্ধা মায়া কর্তব্য দায়িত্ব ও ভালোবাসার মতো সম্মানিত অনুভূতি দিয়ে। প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বও সে পালন করতে শিখবে সম মর্যাদায়। গাছপালা পশুপাখি প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার মোহ যেন তাকে ঘিরে থাকে প্রত্যয়ে প্রত্যহ। আগামীকালের প্রতি এই দায়বদ্ধতা যেন সে সানন্দে পালন করতে শেখে। একটি সুস্থ বিশ্বচিত্র যেন সর্বদা লালিত হয় তার মানসে। স্বার্থপর অস্বচ্ছ সুখে যে কোন মহত্ব নেই একথা সে জানবে স্বাভাবিক কর্মিষ্ঠ আবেগ দিয়ে। সর্বপরি তার অন্তরে জ্ঞানের পিপাসাকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার ইতিহাসের উদাহরণকে সঙ্গী করে। তার শুভবুদ্ধি তাকে যোগ্য জায়গা করে দেবে লেখাপড়ার বিশ্বে। দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান জানাবে সে প্রমায়ু।

বাধা ঠেলে লক্ষ্যে পৌঁছনো জীবনের ব্রত। এ কথার সাথে শিশু পরিচিত হবে ধীরে ধীরে।পথ এতো মসৃণ হয় না, চড়াই উৎরাই থেকে যায় নিজস্ব স্বভাবে। শিশু শিখবে ক্রমশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে আশু পথের লড়াইয়ে। সময়কে সারথি করে দ্বিধাশূন্য বেগে পৌঁছবে নিজস্ব গন্তব্যে। জীবনে জয় তো চাই! সমাজের প্রত্যেকটি শিশু যেন তার প্রাপ্য অধিকার পায় এবং জীবনগঠনে যত্নবান হয় সেই ঘোষণা প্রবল হোক। ভাবী সমাজের মেরুদন্ড দৃঢ়তর হোক ইষ্ট অধ্যবসায়ে।প্রগতিস্রোতে গা ভাসিয়ে নির্মাণ হবে নিখুঁত ভবিষ্যতের! শিশু দিবসের চাহিদা সেটাই।চেতনায় ধনী হলে প্রত্যেকটি শিশু, সমাজের সন্ধ্যা সকাল প্রতিভার আবেগে হবে গৌরবী! শিশু দিবস তেমনই আশা রাখে সভ্যতার কাছে।


শিশু মন

অভিমন্যু


শিশুর আচরণের শিক্ষা থাক

বলার অধিকার শিশুরা পাক

শিশুরা হলো ফুলের মতন

করতে হবে ওদের যতন।


সোহাগ করেই পড়াতে হবে

কে আসে নি ইস্কুলে কবে !

রাখতে হবে খেয়াল রোজ

শরীর স্বাস্থ্য কুশল খোঁজ।


ওরা খুশিতে ছবি আঁকবে

হাসি মজায় আনন্দে নাচবে

বন্ধু হবে সকল গুরুজন

বাসবে ভালো শিশুর মন।



শিশুদের জন্য বড়রা 


ছড়া 

সোনাই ও  হলুদ পাখি 

শ্রাবণী সেন


নাম না জানা ফলের গাছে সে এক হলুদ পাখি

কখন থেকে মিষ্টি সুরে করছে ডাকাডাকি 

ছোট্ট সোনাই দৌড়ে এসে মাকে ডেকে বলে

"তাড়াতাড়ি দেখবে এস, নয়তো যাবে চলে"

মা বলেছেন "এই তো এল ইষ্টিকুটুম পাখি

সকালবেলা মধুর বড় এদের ডাকাডাকি।"

সোনাই কখন ঘরে গেছে আনতে ড্রইং কপি

আঁকবে ছবি পাখির, তাকে খেতেও দেবে টফি।

লক্ষ্মী পাখি চুপটি করে বসে গাছের ডালে

অবাক চোখে দেখছে কাকে পাতার আবডালে



টম অ্যান্ড জেরি

  রীনা মজুমদার


নিঝুম রাতে খুশির ঝিলিক চোখে মুখে

একাকি ইঁদুর ছানা খেলছে মহা সুখে


একটুকরো খাবার যেই না মুখে পোরে

নিঃশব্দে হুলো এসে ঘাড়টি চেপে ধরে 


আঁহহ লাগছে.. বলছি শোন হুলো দাদা

গিন্নীমা রেখেছে মস্ত বড় রুইয়ের গাদা


আনন্দেতে মাছের লোভে ঘাড়টি ছাড়ে

হতচ্ছাড়া! দাঁড়া, পালাবি কোথা এবারে


গর্তে ঢুকে ইঁদুর ছানা হেসেই কুটিপাটি

বিশ্বাসে দিলি ফাঁকি ! নেংটি চুনোপুটি


 গাল দিও না বলছি, বাঘের মাসি বলে

দেমাক তোমার দেখছি বড্ড বেশি চলে !


 বেজায় চটে হুলো যেই না করে ঘুমের ভান

  ভাব জমাতে ইঁদুর দেয় লেজটি ধরে টান 


নিমেষে জাপটে হুলো বলে, বন্ধুত্ব থাকবে জারি

শিশুদের মনে থাকব আমরা 'টম অ্যান্ড জেরি'



দুটি ছড়া

রথীন পার্থ মণ্ডল 

১. রসময় মান্না 

রাশভারী লোক ছিল রসময় মান্না 

একদিন ভোজ খেয়ে কী ভীষণ কান্না! 

আজকাল ভোজবাড়ি তিনি আর যান না 

টিভি দেখে নানা পদ করে যান রান্না। 


হেসে বলেন, দেখেছেন চুনী আর পান্না ! 

রসময় গান শোনে, রফি আশা মান্না। 

খুশি ছাড়া জীবনে তিনি কিছু চান না 

হাসি খুশি মনে করে তিনি ঘরকন্না। 


ভোর হতে প্রাণায়াম হাসি রাশি বন্যা 

গাড়ি ছেড়ে পথে হাঁটে রসময় মান্না 

খেতে চান ভালো পদ অপদ হলে যান না

রসময় গুণ ধরে, করে বেশ রান্না। 


গান গায় গুণগুণ, ভুলে গেছে কান্না

হাসি মুখে মন জয় রসময় মান্না।


২. মা দুগ্গা

নীল আকাশে মায়ের পাশে

ঝলমলে এক রবি, 

তাই না দেখে ফুটলো মনে

মহালয়ার ছবি। 


মহালয়ায় আসেন মা

তারই বাপের বাড়ি,

সবার সাথে সবার তখন

হয়না কোনো আড়ি।


বাপের বাড়ি এসে মা

থাকেন কটা দিন, 

হইচই, হই হুল্লোড়

বাজাই শুধু বীণ। 


সবার শেষে যখন মায়ের

আসে যাবার পালা,

চোখের জলে বন্যা আসে

বুকে ধরে জ্বালা। 


আজ পুতুলের বিয়ে

অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী


বন্ধুরা সব অনেক দূরে স্কুলের নেই পাট

খেলার মাঠও ভুলে গেছি 

কুমির ডাঙ্গা,  কানামাছি, 

দোলনা দোলা,ছুট লাগানো, 

হাসি মজায় দিন কাটানো, 

টিফিন বেলার গন্ধমাখা, 

আড়ি ভাবের ছন্দে আঁকা

সেই সে খুশির হাট।। 


অনলাইনেই পড়া এখন, একলা ঘরেই খেলা

মায়ের সাথে খুনসুটিতে কাটছে সারাবেলা। 

আবদার তাই মায়ের কাছে 

ভাসিয়ে স্মৃতির ভেলা, 

পুতুল খেলায় দেখতে চাওয়া

মায়ের ছেলেবেলা।। 


দুজন মিলে যত্ন করে 

সাজিয়ে নিলাম পুতুলঘরে

খেলনাবাটি পুতুল যত 

ছিল আমার মনের মতো

আদর করে তাদের নিয়ে

বসলো খুশির মেলা।। 


জড়িপাড়ের রেশমি শাড়ি, 

পুতির মালা রংবাহারি, 

ঝুমকো দুলে, খোপার ফুলে 

হাজার খুশির ঝিলিক তুলে

কনে সেজে পুতুল আমার

আলো করলো বাড়ি।। 


বর পুতুলও নজরকাড়া 

সঙ্গীসাথী আরও যারা

টুকরো ধুতির বসন পরে, 

চন্দনটিপ কপাল জুড়ে

বাজনা বেজে, আলোর মাঝে

খেলনা গাড়ির সঙ্গে নেচে

হাজির হলো সবাই মিলে 

মাতিয়ে পুতুল পাড়া। 

ফুলকো লুচি, আলুর দমে, 

ছানার পায়েস আর চমচমে

খাওয়ার আসর উঠলো জমে

সাতটি পাকে বাঁধা পড়ে বিয়ে হলো সারা।। 


হঠাৎ দেখি পুতুল মেয়ের 

মুখটি যেন ম্লান

জল ছলছল চোখ জুড়ে তার

কীসের অভিমান!! 

কাঁপা ঠোঁটে থরথর

বলছে আমায় ডেকে

'পড়বো আমি, লিখবো আমি

থাকবোনা মুখ ঢেকে।

খেলার পুতুল থাকবেনা আর

একলা ঘরের কোণে

বিশ্বজয়ের মন্ত্র নিয়ে

স্বপ্ন নেব বুনে।'


অবাক আমি পুতুলমেয়ের 

মুখের পানে চেয়ে, 

মায়ের মুখের ছবিখানি

ভাসছে ও মুখ ছেয়ে।। 



ফ্যাশন

শ্রাবণী সেনগুপ্ত


কৈলাশ ধাম শশব্যস্ত

স্যুটকেস এক নেমেছে মস্ত।

দূর্গা মায়ের পিছে পিছে সব,

সারা ধাম জুড়ে কি যে কলরব।

কার জামাখানি বেশি ফ্যাশনের

এই নিয়ে চুলোচুলি দুজনের।

কাতু বলে -গোণু ,তোর হবেনা,

এই জামাটা আমারই পাওনা।

মোটাসোটা বলে লাজুক গণশা

ভাইয়ের কথাতে নাড়ল কানটা।

লক্ষী সরস্বতী করে হুড়োহুড়ি,

জিন্স শার্টে স্মার্ট পুরোপুরি।

দূর্গা বলেন -কর তাড়াতাড়ি,

ফ্যাশন করিস গিয়ে মামাবাড়ি।

ধুর ছাই, ওখানে এসব চলবে?

খালি শাড়ি পর-সবাই বলবে।

ভাইদেরও ধুতি,গলায় পৈতে,

ক'দিন হবে এসবই সইতে।

বাবা ভালো আছ, তুমিতো যাবেনা,

ড্রেস ট্রেস নিয়ে নেইতো ভাবনা।

এবার ওখানে করব মিনতি,

পরবো হাল ফ্যাশনের জামাটি।



শিশু কথা

বিজয় বর্মন 


মাম্মি আমি বাড়ছি দেখ

কেমন একা একা,

পৃথিবী টা ঘরের কোণে,

হয়ে যাচ্ছি বোকা।


তোমার মুখে হাসি দেখি,

আমিও হাসতে চাই,

বন্ধ দুয়ার বন্ধ কোটর,

বন্ধু কোথায় পাই ?


তোমার মুখে গল্প শোনা,

ঠাকুরদাদা ঘোড়া,

আমি কেন একা ভাবি,

কেন একা চোরা।


ঠাকুমার নাকি গল্পের ঝুলি,

তাকেই দেখি না,

বাড়িতে শুধু একা বোকা,

বাড়ছে যন্ত্রণা।


ক্লান্ত আমি একা ছুটে,

বিদ্যা বোঝা লাগে,

চেঁচিয়ে বেড়াও সারা বাড়ি,

মাথা গরম রাগে।


সবুজ মাঠে খেলতে যাব,

রোদে ঘামে ভিজে,

আমি ছুটবো তুমিও পিছে,

মজা মজা কি যে।


সবার সাথে একটু কথা,

একটু হাসাহাসি।

রাগ করে না সোনা মা,

খোলা হাওয়ায় বাঁচি।


ইস্টিকুটুম

অমিতাভ সরকার


ইষ্টিকুটুম পাখি
তার যে দুটি আঁখি
গোল্লা গোল্লা পাকায়
আর ফল ঠুকরে খায়।
ইষ্টিকুটুম পাখি
আমায় দিবি নাকি,
দু-তিনটে ফল
বলনা আমায় বল।
ইষ্টিকুটুম পাখি
তোর এত্তো ডাকাডাকি,
শুনতে পাস না নাকি
আমার পরীক্ষা যে বাকি।
ইষ্টিকুটুম পাখি
আয়, খেলবি নাকি
তোর এখন যাবার তাড়া --
আছে বুঝি তোর পড়া ?
ইষ্টিকুটুম পাখি
আকাশ কি তোর সখি ?
পেতাম যদি ডানা
তবে হতো আমার ঠিকানা।
ইষ্টিকুটুম পাখি
আমায় নিবি নাকি
তোরই সাথে উড়ে
যাব মেঘরাজ্যে সুদূরে।


গল্প 

লক্ষীমন্ত

চিত্রা পাল 

      একটা ধমাস্‌ করা শব্দে ও চোখ বুজে ফেললো।  আর সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে ভেসে এলো ওর মায়ের চিৎকার,আবার কি  ফেললি, ভাঙ্গলি তুই?’ আলমারির ওপর থেকে বলটা পাড়তে গিয়েই এই বিপত্তি।ওপরে রাখা সুটকেশটা পড়ে গেছে। ‘এমন লক্ষী ছাড়া মেয়ে কারোর বাড়িতে নেই’বলে দৌড়ে এসে ওর চুল ধরে এক টান দেয়। তারওপরে চলে বকাবকি। কালকেই এনিয়ে খুব বকাবকি হয়েছে। পরে ওর বাবাও ওকে বুঝিয়েছে।       

     আজ সকাল সাতটার মধ্যেই  লক্ষী পড়তে বসে গেছে। কেননা ওর বাবা বলে দিয়েছে যে, রোজ তুই যদি পড়াশোনা না করিস্‌, তাহলে কিন্তু বিষয়ই ঠিকমতো তৈরি হবে না, আর ঠিকমতো তৈরি করতে হলে  রোজ নিয়ম করে পড়াশোনা করতে হবে। কথাটা বোঝা গেলো? লক্ষী বাবার সামনে টুকটুক করে ঘাড়   নাড়ে।সেদিন সকালে  ওর বাবা বাজারে যাবার ঠিক আগে ওকে ঘরে ডেকে একটা রুটিন ধরিয়ে দিয়ে বলে এই আমি রুটিন করে দিয়েছি। এখন এই রুটিন অনুযায়ী চলতে হবে।তাই সকাল সাতটাতেই ও পড়তে বসে যায়।   

  সবে কবিতাটা মুখস্ত করতে শুরু করেছে, এমন সময়ে ওর মোবাইলটা বেজে ঊঠলো,দেখে বিনির ফোন। পড়াশোনার সময়ে ফোন করা বারণ,এমনকি ধরাও। গত বছর করোনা কালে অন লাইন পড়া শোনা হতো বলে ওর পড়ার কাজের জন্যই ওর বাবা ওকে এই মোবাইলসেট কিনে দিয়েছে। এতে ওর খুব সুবিধে  হয়েছে। পড়াশোনার কাজ তো আছেই, এছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা গান শোনা এসবও চলতে থাকে। তবে সেখানেও বিধিনিষেধের পাহারা। ও যখন নিজে পড়বে তখন ফোন করা চলবে না। ফোন যাতে না আসে তাই ফোনটাকে বন্ধ করে রাখতে বলে। ও তবে ফোন বন্ধ করে রাখে না। কিন্তু কথা টথাও বলে না।

   আজ বিনির সঙ্গে সবে কথা বলা শেষ করেছে, বাবা এসে হাজির ওর কাছে।জিজ্ঞেস করলো কার  ফোন  রে?লক্ষী তখন কিছু বলতে যাচ্ছে,বিনি বললো, একবার কাকুকে দেতো। বাবা, ও তোমার সঙ্গে কথা বলবে, বলে ফোনটা দিয়ে দেয়।সব শুনে ওর বাবা বলে এখনি আসছি। লক্ষী কে বলে যেতে পারবি এখন?হ্যাঁ বলতেই দুজনে বাইক বের করে একেবারে ভোঁ দৌড়। শুধু একবার মুখ বাড়িয়ে ওর মাকে বলে গেলো, শুনছো, আজ বাজারে যেতে দেরি হবে,আমি আর লক্ষী একটু বেরোচ্ছি। ওর মা কি যেন বলতে যাচ্ছিলো,ততক্ষণে ওরা গেটের বাইরে।  

   লক্ষীর নাম লক্ষী রেখেছে ওর ঠামা। না, ঠিক লক্ষী নয়, উনি রেখেছিলেন লক্ষীমন্ত, সেটা কাটছাঁট করে সবাই ডাকে লক্ষী। তবে ওর ঠামি এখনোও আদর করে ওকে লক্ষীমন্ত বলেই ডাকেন। ওর মা অবশ্য বলে, এতো দস্যি মেয়েকে কি করে যে মা লক্ষীমন্ত বলে কে জানে বাবা,সারাদিন এটা ভাঙ্গছে,ওটা ছিঁড়ছে,এদিকে ছুটছে ওদিকে দৌড়োচ্ছে। এতো বড় হয়ে গেলো এখনোও দুরন্তপনা যায় না। তারওপরে আছে পশুপাখিপ্রীতি। কখনও কুকুরছানাকে এনে খাওয়াচ্ছে,কখনও বেড়ালছানা নিয়ে আসছে ব্যাগে করে, একদিন খুব যত্ন করে পাখীর ছানা নিয়ে এসেছিলো,বললো বাড়ির কাছের বটগাছের নিচে পড়েছিলো। তাকে এনে জল খাওয়ানো খাবার দেওয়া সবই করেছিলো, আর এসব কাজের সঙ্গী ওর বাবা। বাড়িতে থাকলে মেয়ের সঙ্গে সেও লেগে পড়ে। তাতে ওর উৎসাহ আরও বেড়ে যায়।এখন ওর মা ভাবছে, কিন্তু এখন হঠাত্‌ দুজনেই বেরিয়ে গেলো, কোথায় গেলো কিছুতো বলে গেলো না,আর সে সময়ই বা কোথায়,ফিরে এলে জানা যাবে।  

   আসলে বলার সময় ছিলো না। বিনি এতো তাড়া দিলো যে ওর বাবা আর সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের বাড়িতে পৌঁছতে চেষ্টা করলেন। এখানে এসে বুঝলেন তাড়াতাড়ি এসে ভালোই করেছেন। বিনি বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ওরা আসতেই ওদের নিয়ে গেলো বাড়ির পেছনের দিকে বাগানে, যেখানে একখানা নারকেল গাছ আছে,আর সেই গাছের একেবারে ওপরের ডালে ঝুলছে একটা পাখি। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন,ওটা একটা পেঁচা,কি করে যেন ঝুলছে ওখানে।কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। বিনি জানে ওর বাড়িতে বলে কিছু হবে না, কেউ গা করবে না, পাত্তা দেবে না। তাই লক্ষীর শরণাপন্ন।  

    লক্ষীর বাবা খুব ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলেন যে, পেঁচাটা উড়তে পারছে না কারণ ও নারকেল  গাছের পাতার সঙ্গে ঝুলে আছে,আর কোনরকমে আর একটা ডানা দিয়ে ঠেকনা দিয়ে রেখেছে। ওদের দেখাদেখি আরও দু চারজন এলো ওই গাছের তলায়। এদিকে ওর কাছাকাছি দু,একটা কাক ও চলে  আসছে ওকে ঠুকরে দিতে। কিন্তু নীচে থেকে সবাই হুশহাশ করছে, শব্দ করছে বলে কাকও কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। লক্ষী প্রথমে ওর বাবাকে বলে ‘ওখানে কি যেন সুতো ঝুলছে মনে হয়,বাবা ভালো করে দ্যাখো। লক্ষী র কথাতে উনি ভালো করে লক্ষ্য দেখলেন,হ্যাঁ মনে হচ্ছে তাই। কিন্তু ওখানে ওই অত উচুঁতে সুতো ঝুলবে?ওখানে সুতো আসবে কি করে? 

   ওদিকে মানে নারকেল গাছের কাছেই একটা তালগাছ। সেই গাছের মাথায় একদম মগডালে খানিকটা রঙীন কাগজ ঝুলছে। গাছের মাথায় রোদ পড়েছে বলে সেই কাগজগুলো এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। আর একটু ভালো করে দেখলে দেখা যায়, একটা ঘুড়ির কাঠামো ওই গাছে ঝুলে রয়েছে। তারই খানিকটা কাগজ ছিঁড়ে ওই মাথায় আটকে আছে। লক্ষী বুঝে গেলো,  বিশ্বকর্মা পুজোর সময় ঘুড়ি ওড়ায় সবাই।ঘূড়িতে ঘুড়িতে প্যাঁচ খেলে।সে রকম হয়তো কোন কাটা ঘুড়ির সুতো ওই গাছে আটকে আছে। পেঁচাটা উড়ে বসতে গিয়ে ওই সুতোয় ওর ডানা জড়িয়ে যায়।ও যা ভেবেছে ঠিক তাই। ওর বাবা ভালো করে দেখে বললো, ওখানে সুতো এলো কোথা থেকে? বোধ হয় ঘুড়ি ওড়ানোর সুতো ওখানেগাছের ডালে আটকে গেছে, সেই সুতো এখন ওর ডানায় জড়িয়ে গেছে। ও উড়তেও পারছে না, বসতেও পারছে না। ওদিকে আগে একটা কাক আসছিলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো ওর কাছে, এখন দুটো কাক ঘুরপাক খাচ্ছে ওকে ঘিরে। তার ভয়ে পেঁচাটা মাঝেমাঝেই চিত্‌কার করছে। এখান থেকে হুশহাশ শব্দ যতই করা হোক অতো উচুঁতে যে কিছুই করা যাচ্ছে না। 

   ওদের ওই বাগানে ওপরের দিকে তাকিয়ে কথাবার্তা বলতে দেখে আশপাশ থেকে আরও দুচারজন জড়ো হলো,কিন্তু কেউই পেঁচাটাকে ওই বিপদ থেকে উদ্ধার করার কোন উপায় করতে পারছে না। তখন  লক্ষীর বাবা হঠাত্‌ বললেন,আচ্ছা, দমকলকে খবর দিলে হয় না?ওদের অনেক লম্বা মই থাকে বা ওরা কোন কিছু উপায় জানতে পারে, কিভাবে উদ্ধার করা যায়। কেননা,এইথেকে একটা কথামনে পড়ল, একবার হাওড়া ব্রীজের মাথায় এক পাগল উঠে পড়েছিলো, তাকে সাবধানে এই দমকলবাহিনীর লোকজনেরাই নামিয়ে ছিলো। ভাবনাটা আসামাত্রই মেয়েকে বাইকের পেছনে বসিয়ে একেবারে তুরন্তগতিতে দমকল অফিসে। 

    সব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলাতে ওনারা পেঁচাটাকে উদ্ধার করতে আসতে রাজী হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একেবারে ঘন্টা বাজিয়ে লোকলস্কর নিয়ে দমকল বাহিনী এসে হাজির। ওরা এসে আগে সরেজমিনে সব পরীক্ষা করে দেখে নিলো। যে গাছে পেঁচাটা ঝুলছে, সেই নারকেল গাছের গুঁড়ির গা বেয়ে একখানা লম্বা মই লাগিয়ে দিলো। ওদিকে খড় চট এসব দিয়ে বেশ পুরু একখানা গদি বানিয়ে  রাখলো গাছেরতলায়।  এবার ওদের লোক লম্বা মই বেয়ে একেবারে শেষ অবধি ওপরে উঠে সেখান থেকে একখানা লম্বা লগির মাথায় চাকু লাগিয়ে খুবই কষ্ট করে পাতাটার গোড়া থেকে কাটতে শুরু করলো।নারকেল গাছের পাতা অন্য গাছের পাতার মতো সহজে ছেঁড়া যায় না। পাতার গোড়া বেশ শক্ত পোক্ত। একে কেটে নামানো সহজ  নয়।  বেশ খানিকখন চেষ্টার পরে গাছের পাতাটা খানিক নুয়ে এলো। পাতাটা কোনরকমে গাছ থেকে ঝুলে পড়তেই সেটা কে একেবারে টেনে নামিয়ে ওপর থেকে নীচে ফেলে দেয়। নীচে নরম বিছানা করা ছিলো  বলে পাখিটার লাগেনি।  

 এখন ওর ডানা থেকে সুতো খুলতে হলে পেঁচাটাকে ধরে থাকতে হবে। লক্ষী যেন ইতস্তত করছে,  একটু থতমতো খাচ্ছে,ঠিকমতো সাহস পাচ্ছে না এরকম দেখে ওর বাবা বললো, তুই ওকে ধরে থাক,আমি  সাবধানে পাকানো সুতোটাকে খুলতে চেষ্টা করি। ডানাটা ক্লিয়ার না করলে ও পাখা ঝাপটাতে পারছে না। লক্ষী যত্ন করে ধরে রইলো, আর ওর বাবা খুব ধীরে ধীরে সাবধানে সুতোটাকে খুলতে চেষ্টা করলেন। তা না হলে ডানা সুতোর ঘায়ে এমনি কেটে গেছে আরও কেটে যাবে। আর যাতে না কেটে যায়, সেটা দেখতে হবে যে।  

  সুতোটা খুলে যেতে ও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। একবার ডানা ঝাপটাবার চেষ্টা ও করলো। এবার ডানার কাটা জায়গাগুলোয় মলম লাগিয়ে দিতে বোধ হয় বেশ আরাম পেয়েছে। ও কিন্তু লক্ষী র কোলেই বসে  আছে।এবার ওকে কিছু খেতে দেওয়া হলো, জল দেওয়া হলো কাগজের গ্লাসে। ওগুলো ওর খাবার নয়,এরা দিয়েছে,তাই আর কি করে, ওই একটু মুখে দিয়েছে।   

    মোবাইলে অনেকগুলো ছবি তুলেছে ওর বাবা। এখনও কেমন যেন নেতিয়ে আছে,ওকে একটা জালের ঘেরাটোপে রাখা হয়েছে। দমকলবাহিনী বিদায় নেবার আগে বলে গেলো ওদের কাজ শেষ,তবে যাবার আগে ওদের মধ্যে একজন বোধ হয় সে একটু বেশি বুঝতে পারে, সে বললো লক্ষীর বাবাকে ডেকে যে এই প্রজাতির পেঁচা এখন খুব কমে গেছে। একে উদ্ধার করে ভালো করেছেন। ওকে বাঁচাতে  গেলে আপনারা ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, ওরাই ওকে ঠিক প্রসেসে নার্সিং দেবে। 

  ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ওরা ওকে থানায় নিয়ে আসতে বলে। লক্ষী আর ওর বাবা একটা জালের ব্যাগে করে থানায় নিয়ে আসে।এখন পেঁচাটা একটু নিশ্চিন্ত বিশ্রাম পেয়ে, একটু খাবার আর জলখেয়ে আগের চেয়ে চাঙ্গা হয়েছে মনে হলো। কিযেন সবাইকে ভালো করে দেখছে।বিশেষ করে  লক্ষীকে। লক্ষী ওর বাবাকে আস্তে আস্তে বলে,দ্যাখো ও ন্যায় আমাকেই দেখছে। ওর বাবা ওকে বলে, ওরও যে প্রাণ আছে রে। তুই ওকে প্রাণ দিয়ে রক্ষে করছিস্‌ যে সেটা ও ঠিক বুঝেছে,তাই বোধ হয় তোকেই অমন করে দেখছে।  ওরা ওর জন্য একখানা খাঁচা নিয়ে এসেছিলো, সেই খাঁচায় ভরে নিয়ে চলে গেল।   যাবার সময়ে বলে গেলো আমরা ওকে আগে সারিয়ে তুলি। ও ভালো হয়ে গেলে একবার দেখে যাবেন।  

  লক্ষী ওর বাবার সঙ্গে যখন বাড়িতে এলো,তখন অনেক খানি বেলা হয়ে গ্যাছে। ঠাকুমা ,মা সবাই  উদবিগ্নমুখে বাড়ির সামনে গেট ধরে দাঁড়িয়ে। লক্ষীর বাবা বললো ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে। ঠাকুমাও বললেন, হ্যাঁ, আগে তোরা চানটান করে খেয়েদেয়ে নে, তারপরে কথা। লক্ষী তো ভয়ে ভয়ে আছে, কি জানি মা হয়তো আজ আবার বকবে। ওর বাবা সব ঘটনা বললো আর মোবাইলে তোলা ছবিগুলো দেখালো। সবাই দেখলো, কি অসহায় করুণভাবে একটা পেঁচা বসে আছে লক্ষীর কোলে। ওর মা হাসিমুখে দ্যাখে, আর ঠাকুমা এসে লক্ষীকে আদর করে বলে, তাইতো আমি দিদিভাইএর নাম রেখেছি লক্ষীমন্ত।একেবারে ঠিক নাম তাহলে।।


নক্ষত্র গ্রাস
সুদীপা দেব

সাতসকালে খবরের কাগজ হাতে বাড়িময় হই হই করে বেড়াচ্ছেন মধুর ছোটকাকু
―সবাই দেখো দেখো আমাদের মধু কি কাণ্ড করে ফেলেছে! আর তোমরা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ!
বলে তিনি ড্রইংরুমে টিভিতে নিউজ চ্যানেল চালিয়ে দেন।
বিশ্বের তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের ঘুম উড়ে গেছে। স্টিফেন হকিং মৃত্যুর আগে বারবার বলেছেন পৃথিবী আগামী একশ বছরের মধ্যে ধ্বংস হতে চলেছে। এরপরও বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। বিজ্ঞানীরা তাঁর কথা যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। তাঁরা বহুদিন ধরে অন্তরীক্ষে বিকল্প বসবাসের ব্যবস্থা চেষ্টা করছেন কিন্তু তাদের এই খাটুনি খুব বেশি ফলপ্রসু হয়নি এখনো। এরইমধ্যে অন্য এক কারনে আমাদের মৃত্যু ঘন্টা বেজে উঠছে। বিশাল এক জাইগ্যান্টিক নক্ষত্র এমেডা ফিও ধেয়ে আসছে সৌরমণ্ডলের দিকে। বড়জোর আর ত্রিশ বছর। তারপরে সব শেষ। মৃত নক্ষত্রের তালিকায় যেতে বসেছে আমাদের সূর্য। সূর্যসহ গোটা সোলার সিস্টেম চলে যাবে ওর পেটে। প্রায় পনের লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে টেন টু দি পাওয়ার 4 km/s বেগে ধেয়ে আসছে সূর্যকে গ্রাস করতে। প্রায় আঠের কোটি বছর আগে অলিওলাই নামে নিতান্ত একটা সরল নক্ষত্র হঠাৎই তার চরিত্র পরিবর্তন করে। সাধারণত নক্ষত্র ক্রমাগত শক্তি ক্ষয় করতে করতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রচন্ড বেগে ধাবমান এই নক্ষত্র ফিমেরাস নামে আরো এক নক্ষত্রকে গ্রাস করে এবং প্রচন্ড শক্তি বৃদ্ধি করে এবার সূর্যের কক্ষতলে আসছে। যেহেতু পৃথিবী ছাড়া সৌরমণ্ডলের অন্য কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নেই তাই মানুষের ওপরই সৌরমন্ডলকে টিকিয়ে রাখার দায়ভার বর্তায়।
আজ রবিবার। এদিন বাড়ির সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করা বহুদিনের নিয়ম। ইদানিং মধুর দাদু অসুস্থ থাকেন। তাই আজকাল তিনি এই নিয়মের ছাড় পেয়েছেন ছোটকাকুকে মধু ছোটন বলে ডাকে। তিনি এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকেন রবিবারের জন্য। পুরো বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের হাল-হকিকত এক সপ্তাহে যতটা জোগাড় করা যায় তিনি জমা করেন। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে বেশ রসিয়ে সেসব খবর পরিবেশন করেন। বাড়ির বড়রা খানিকটা কান থেকে মাথায় চালান করেন আর খানিকটা এক কান দিয়ে প্রবেশ করে অন্য কান দিয়ে বের করে দেন।
ছোটনের গল্প শুনতে মধু আর তার দিদির কিন্তু বেশ লাগে। পৃথিবী জুড়ে কত কাহিনী ওরা দেখে ছোটনের চোখ দিয়ে! ছোটন আজ পৃথিবী সহ গোটা সৌরমণ্ডলের অপমৃত্যুর কাহিনী শোনালেন। তবে এ কথা যেন কেউ খুব একটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। আসলে ছোটনের গল্পগুলো সবাই গল্প হিসাবে ধরে নেয় বেশির ভাগ সময়। সামনে পুজো আসছে। আজকের ব্রেকফাস্ট টেবিলের মুখ্য বিষয় ছুটিতে বেড়ানোর প্ল্যান। কিন্তু ছোট্ট মধুর মাথায় ঘুরছে ছোটনের মুখে শোনা ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের অশনিসংকেত!
এদিকে হাতে সময় বড় কম। প্রায় কুড়ি বছর। দৈত্য নক্ষত্র চলে এসেছে সূর্যের অনেকটা কাছে। এই নক্ষত্র দ্বারা বিচ্ছুরিত কসমিক রে সৌরমন্ডলের সমস্ত গ্রহের রেডিওঅ্যাক্টিভ মৌলের রেডিওঅ্যাক্টিভিটি অতি উচ্চমাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। এই তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধির কারণে মানুষ সহ পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীরা সম্পূর্ণ নতুন নতুন উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। খুব অল্প সময়ে মারাও যাচ্ছে। ডাক্তাররা দিশাহারা। তাঁরা চিকিৎসা করা সুযোগটুকু পাচ্ছেনা। হঠাৎ আগত অসুখ নিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা নাজেহাল হয়ে উঠছে।
মধুমিতা রায় কাজ করছেন গবেষণাগার- ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রফিসিক্স, ব্যাঙ্গালোর। দিনরাত গবেষণামূলক পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।
দিনের-পর-দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আবিষ্কার হলো সুপার কন্ডাক্টিভ পাওয়ার জেনারেটর(SCPJ)। এই জেনারেটর তিনি স্থাপন করেন ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় আট হাজার ফিট উচ্চতায়। লাদাখের পর্বতচূড়ায় বিশেষ এক কৌণিক ক্ষেত্রে। সুপার কন্ডাক্টিভ কয়েল থাকার ফলে তীব্র চুম্বকীয় ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম এটি। ধেয়ে আসা নক্ষত্র থেকে বিকিরিত তীব্র তড়িৎ কণা যন্ত্রের চুম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রবেশ করা মাত্র সুপার কন্ডাক্টর জেনারেটরের জন্য সৌরমণ্ডলের কক্ষতলে প্রবেশের আগেই লরেঞ্জ বল অনুসারে তার গতিপথ পরিবর্তন করে। সবচেয়ে কম প্রায় সাড়ে 88 ডিগ্রী কৌণিক বেগের ঘুরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ আপাতত সোলার সিস্টেমের মুক্তি। গত এক মাস ধরে এই ট্রায়াল' হয়েছে এবং আজ ছিল শেষদিন। আজও এই পরীক্ষা সফল। আগামী তিনদিনের মধ্যেই এই যন্ত্রটি স্থায়ী স্থাপন হবে।
দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা ফোনে মেইল করে পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মধুমিতা রায়কে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। অল সাইন্টিস্টস অফ অ্যাস্ট্রোনমি অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিজ্ঞানীরা মধুমিতাকে রায়কে সম্মান জানিয়ে তাঁর আবিষ্কৃত যন্ত্রের নাম দেন সুপার কন্ডাক্টিভ রে জেনারেটর (SCRJ)।




স্মৃতিকথা 

শিশুদিবসের সেই দিনটি

        বুলবুল দে


আজ চোদ্দ ই নভেম্বর, শিশু দিবস। শিশুদের নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান, আয়োজন,পরিকল্পনা,লেখালেখি

আরও কত কি হবে। এই দিনটা আসলেই সুমির মনটা সেই সময়ে চলে যায়।সে তখন খুব ছোট, নার্সারিতে পড়ে। বাবার চাকরির সূত্রে জলপাইগুড়িতে থাকত। ভাই তখনও হয়নি। তবে মাঝেমধ্যেই ছুটিছাটায় বা অন্য কোনও কারণেও ওরা কোচবিহারে চলে যেত কারণ সেখানেই তারবাবার পৈতৃক বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে ওর চার জেঠু তাদের ছেলে মেয়ে ,কয় কর্মচারী আরও নানা লোকজন নিয়ে বিশাল একান্নবর্তী পরিবার।সেখানে গেলেই খালি মজা,আনন্দ, খেলা আর হুটোপুটি। সেই বাড়িতে মাঝখানে একটা বিরাট উঠোন কে ঘিরে চারপাশে সব জেঠুদের আর ওদের আলাদা আলাদা ঘর। সেই কমন উঠনের দিকে যেমন সবার বাড়ির দরজা আর বারান্দাথাকত তেমনই প্রত্যেক বাড়ির পেছন দিকেও দরজা বারান্দা ,উঠোন আর বাইরে বেরোনোর গেট থাকত। প্রত্যেক বাড়ির সামনের আর পিছন দিককে সবাই বলত সামনের মুড়া আর পিছন মুড়া। বাড়ির ছোটরা এই মুড়া থেকে ঐ মুড়া ঐ মুড়া  থেকেসেই মুড়া হুড়োহুড়ি ছুটোছুটি করে বেড়াত।থাকার ঘর আলাদা হলেও একটাই কমন রান্নাঘর ছিল।সেই বিশাল লম্বা রান্নাঘরে সেই একান্নবর্তী পরিবারের রান্নার জন্য রোজ সকালে ধবধবে ফর্সা,লম্বা,টানটান চেহারা,থাকথাক চুলের এক বিহারী ব্রাহ্মণ ঠাকুর আসতেন।সদ্যস্নাত সেই ঠাকুরের পরনে থাকত ধবধবে সাদা ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবী, কপালে চন্দনের ফোঁটা।আর মজার ব্যাপার ছিলনিজে বিহারী হওয়া সত্ত্বেও সুমিকে সে বিহারী ভুত বলে ক্ষ্যাপাতো।কারণ সুমির মামা বাড়ি ছিল বিহারে। যাইহোক সেবার নভেম্বর মাসে সুমিরা কোচবিহারে এসেছিল।বাড়িতে পা দেওয়া মাত্রই প্রতিবারের মত সেবারও দাদা দিদিরা ''ছোট কাকা আসছে, ছোট কাকা আসছে'' বলে ছুটে এসে ওদের ঘিরে ধরেছিল। তার পর তো সুমিকে কে কোলে নেবে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। সুমি প্রত্যেক বার এগুলো খুব উপভোগ করত। সেবারও কোচবিহারে কটাদিন ভারি মজায় কাটতে কাটতে অবশেষে যাবার দিনটাও গুটি গুটি পায়ে চলে এল। তারপর যখন জামার ওপরে বাবার দেওয়া নতুন লাল টুকটকে কোটটা পরিয়ে মা তাকে যাবার জন্য প্রস্তুত করিয়ে দিলেন তখন তো সুমির চোখ ফেটে জল বেরোনোর উপক্রম। যখন রিকশায় উঠে বসেছে তখন হঠাৎই সুমির কোটের পকেটটা ঝনঝন করে উঠল। ওদেরকে ঘিরে থাকা দাদা দিদিদের মধ্যে একজন বলে উঠল, 'তোর পকেটে কি আছেরে সুমি'?

''এগুলো পয়সা' সুমি উত্তর দিয়েছিল। সত্যিই সে বাবার কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে দুই পকেট ভর্তি করে পয়সা জমিয়েছিল। হঠাৎ তার কি মনে হল, সে বলে উঠল ''তোমরা পয়সা নেবে'? অমনি সবাই হৈ হৈ করে বলে উঠল, ''হ্যাঁ হ্যাঁ আমাকে দে আমাকে দে''। ব্যাস সুমিও পকেট থেকে মুঠো করে পয়সা নিয়ে ওদের দেওয়া শুরু করে দিল। পয়সা নেওয়ার জন্য বাড়ির সব ছোট ছেলে মেয়েরা গেটের সামনে ভীর করে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিল। এমনকি পাশের এক দুটো বাড়ির ছেলে মেয়েরাও সেই ভীরে সামিল হয়ে গেল। রাস্তার মধ্যে যেন শিশুদের হট্টমেলা বসে গেল। আর সুমিও যেন পয়সা গুলো সবাইকে বিলিয়ে দিতে দিতে এক অপার্থিব আনন্দে বেলুনের মত হাল্কা হয়ে ভেসে ভেসে উপরে উড়ে যেতে লাগল। আঃ কি আনন্দ! কি সুখানুভূতি! নিজেকে কেমন রাণী রাণী মনে হচ্ছিল। ঐ ছোট্ট বয়সেও ঐ অনুভূতি সে অনুভব করেছিল। এভাবে দু পকেট  ভর্তি পয়সা শেষ হয়ে এল। একটা দাদা সেখানে উপস্থিত ছিলনা সেও কার কাছে যেন খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল,''বুনু বুনু, আমাকেতো পয়সা দিলিনা।'' সুমির বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। যাঃ এখন কি হবে? সে আতি পাতি করে পকেট হাতরাতে লাগল। নেই,আর যে নেই! তাহলে কি করে দেবে? তবুও সে খুঁজে যাচ্ছে। হঠাৎ আঙ্গুলে কি যেন একটা ঠান্ডা মত ঠেকল। সেখানে ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে কাপড়ের ভাজে একটা পয়সা।বের করে দেখে একটা আটআনা। সেটা দাদাটাকে দিয়ে মনটা খুশিতে উছলে উঠল। মনে আছে সেই দাদাটা আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলছিল,''আগে গেলে বাঘে খায় পরে গেলে সোনা পায় ''। কারণ সুমির কোটের পকেটেতো সব পাঁচ, দশ,বিশ আর পঁচিশ প্য়সা ছিল। আর ঐএকটা মাত্রই আটআনা ছিল। সেই সময় ঐসব পয়সা দিয়ে লজেন্স,চানাচুর আরও অনেক কিছুই পাওয়া যেত। সব দেখেশুনে বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ''জানিসতো মা আজকে চোদ্দই নভেম্বর, শিশুদিবস। শিশুদের এই আনন্দ মেলায় শিশুদিবসটা আজকে সত্যিই সার্থক হল।


ছোটরা নিজেদের জন্য 

মনের সাধ

সোমশুভ্র চক্রবর্তী


মন রে আমার মন রে

কেনো চাস তুই পাখি হতে রে?

পাখি হলে নীল আকাশে

ডানা মেলে যাবো চলে।


আকাশ পাড়ে অনেক দূরে

মেঘের সাথে যাবো উড়ে।

যেথায় থাকেনা কোনো মানা

মন সেখানে নিয়ে যানা।

ও মন রে আমার মন রে

শুধু হতে চাই আমি পাখি রে ।


পাখি হলে ঝিমঝিম দুপুরে

ঝুপ করে পড়বো পুকুরে।

কাটবো মনের সুখে সাঁতার

মন ভরে ডুব দেবো বারবার।

তাই বলিরে আমি বলি রে

শুধু হতে চাই আমি পাখি রে।



শিল্পী- তানভী দাম 























শিল্পী- অনুস্মিতা বিশ্বাস





















মুজনাই সাপ্তাহিক 
সম্পাদনা, অলংকরণ ও প্রচ্ছদ ছবি- শৌভিক রায় 
শিশু দিবস বিশেষ সংখ্যা ২০২১



No comments:

Post a Comment