Thursday, December 9, 2021


 

সম্পাদকের কথা 

চারদিকে এখন ধূসর রং। বৃদ্ধ ক্লান্ত পৃথিবীতে আবার আসতে চলেছে নতুন একটি বছর। 

কিন্তু অনাগত সেই আগামী কি আনবে কোনও নতুন বার্তা? আসবে কি সুদিন কখনও আবার ফিরে? 

উত্তর অজানাই সেই। তবু প্রত্যাশায় বেঁচে থাকা, কাটিয়ে দেওয়া একটা জীবন কোনোমতে!

হেমন্ত বোধহয় সে কথাই বলে! 

নবান্নের মাঠে ফসলের সম্ভার মনে করায় ধূসর রঙেই থাকে জীবনের ছায়া। 

আবার এই ফসল থেকেই সৃষ্টি হবে সৃষ্টির বীজ। 

প্রত্যাশা সেখানেও। কেননা বীজ মানেই প্রাণ। 

আগামীর বার্তা!  


মুজনাই সাহিত্য সংস্থা 

রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020

হসপিটাল রোড 

কোচবিহার 

৭৩৬১০১

ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)

- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)


প্রকাশক- রীনা সাহা 

সম্পাদনা,  প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়  

মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ  সংখ্যা




এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা 

রামাশীষ চৌধুরী, কুমকুম ঘোষ, চন্দন কুমার দাস, অলকানন্দা দে, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, 

অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, বুলবুল দে, মাথুর দাস, মহাজিস মণ্ডল, উৎপলেন্দু পাল, 

রীনা মজুমদার, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, মজনু মিয়া, রোমানুর রোমান, দেবর্ষি সরকার, 

গার্গী ঘোষ, ভাস্বতী রায়, অভিমন্যু, বিজয় বর্মন 




প্রবন্ধ 

আমি এই পৃথিবীর মেয়ে 

                                কুমকুম ঘোষ



 গ্রেটা থুনবার্গ ও   জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট(school strike for Climate)...

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে বসেছিল জাতিসংঘের (United Nations) পরিবেশ সংক্রান্ত অধিবেশন ( Climate Action Summit 2019) । সেখানে তখন উপস্থিত সারা বিশ্বের পরিবেশ কর্মীরা ও  মাননীয়  অতিথিবৃন্দ। মঞ্চে বক্তৃতা দিতে উঠলো এক ষোড়শী কিশোরী;  সে ইতিমধ্যেই বিখ্যাত পরিবেশ আন্দোলনের নবীন যোদ্ধা হিসেবে : সে এককভাবে স্টকহোম পার্লামেন্টের সামনে টানা তিন সপ্তাহ "পরিবেশের জন্য স্কুল ধর্মঘট" (school strike for Climate)  করেছে এবং হ্যাশট্যাগ ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার (#fridaysforfuture)   ; হ্যাশট্যাগ আপরুট দ্য সিস্টেম(#uproot the system)   নামের এক গণ আন্দোলন গড়ে তুলেছে ।যেখানে প্রাথমিক জড়তা ও হুমকি কাটিয়ে বিশ্বের  লক্ষ লক্ষ স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের  মধ্যে  জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ  ধ্বংসের বিরুদ্ধে তার একক প্রতিবাদকে প্রসারিত করে দিতে পেরেছে ।গ্রীনপিস (Greenpeace) নামের বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরাও তার সাথে যুক্ত হয়েছে, প্রতিবাদে সামিল হয়েছে;   নিজে ভেগান  (vegan/ কঠোরভাবে নিরামিষাশী ) হয়েছে।বাবা-মা সহ পরিবারের সদস্যদের "কার্বন-ফুটপ্রিন্ট" কমাতে বাধ্য করেছে  যার ফলশ্রুতিতে তার অপেরা গায়িকা মা' বিমান-ভ্রমণ পরিত্যাগ করেছেন  এবং নিজের পেশা থেকে বিরতি নিতে বাধ্য হয়েছেন কন্যাকে সহযোগিতা করবেন বলে। 
এই সম্মেলনে অংশ নিতে গ্রেটা নিজে বিমানের বদলে পালতোলা নৌকা য় এসে পৌঁছেছে সুইডেন থেকে আমেরিকায়।সেটাও বেশ হৈচৈ ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা।
সেদিনের মঞ্চে গ্রেটা বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ ধ্বংসের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া য় নিস্ক্রিয় থাকা "বড়োদের" (রাষ্ট্রনায়ক দের)  উদ্দেশ্যে তার ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল  এইভাবে   ......"How Dare You....You have stolen my dreams and my childhood with your empty words.We are in the beginning of a mass extinction and all you can talk about is money and fairy tales of eternal economic growth......How dare you."
গ্রেটা এক বিরল রোগের শিকার। তার রোগের নাম--Asperger syndrome। এটা একধরণের অটিজম। একগুঁয়েমি এবং চাঁচাছোলা ভাষায় কথা বলাই তার ধরণ বিশেষ করে পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই এর ক্ষেত্রে । গ্রেটা নিজের লেখা বই "No one is too small to make A Difference" -এ  জানিয়েছে ৮ বছর বয়সে সে প্রথম পরিবেশ কথাটি জানতে পারে আর ১১ বছর বয়স থেকে সে আ্যাসপারাগার সিনড্রোম(Asperger syndrome) এ আক্রান্ত হয়। প্রাথমিক ভাবে সে কথা বলা এবং খাওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু পরিবেশ সংক্রান্ত আলোচনা ও ভাবনা চিন্তা করার মধ্যে দিয়ে, (যেটা তার চিকিৎসার অন্তর্গত ছিল) সে ক্রমশঃ সুস্থ হয়ে ওঠে। স্টকহোমের এই রোগ সংক্রান্ত বিষয়ের অ্যামবাস্যাডার করা হয় তাকে।
কিন্তু একজন পঞ্চদশী বালিকা একদিন স্কুলে যাওয়ার বদলে "পরিবেশের জন্য স্কুল ধর্মঘট" প্ল্যাকার্ড হাতে সরাসরি দেশের পার্লামেন্টের সামনে বসে পড়বে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ বাঁচানোর ডাক দিয়ে  এবং তিন সপ্তাহ একা সেই কাজটা করে যাবে সেটা ছিল অভাবনীয় এক ঘটনা 
 সারা বিশ্বের পরিবেশ কর্মীদের কাছে  গ্রেটা থুনবার্গ  এক হার-না-মানা নবীন যোদ্ধা যে এই লড়াইতে অদম্য জিদ ও প্রতিজ্ঞা র প্রতীক হয়ে উঠেছে। 

গাছের জন্য কান্না ও মনিপুরী কন্যা ভ্যালেনটিনা................

২০১৯ সালে একটা ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়ে ওঠে।ভ্যালেনটিনা এলাংবাম(Valentina Elangbam) নামের পঞ্চম শ্রেণীর কন্যাটি অঝোর ধারায় কাঁদছে তার প্রিয় গাছ দুটি কেটে ফেলার জন্য।প্রথম শ্রেণীতে পড়ার সময় গ্রামের নদীর ধারে সে দুটো গুলমোহর গাছ লাগিয়েছিল। প্রতিদিন সে খুব যত্ন নিত তাদের। গাছ দুটো যত বেড়ে উঠলো তত ই তার পরম বন্ধু   হয়ে উঠলো। নদীর তীর মেরামতির কারণে গাছদুটো কাটা পড়েছিল আর সেকারণেই তার সেই অঝোর কান্না।  ভিডিওটি প্রথমে তার কাকা ফেসবুকে আপলোড করেন তারপর সেইসময়ের মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন. বিরেন .সিং  টুইট করেন সেটি। নিমেষে সেটি ভাইরাল হয়ে যায়।  গাছের প্রতি  ভালোবাসা , প্রকৃতির প্রতি একাত্মতার  জন্য ভ্যালেন্টিনাকে রাজ্যের গ্রিন অ্যাম্বাসাডার( green ambassador) ঘোষণা করা হয়।রাজ্যের যেখানেই পরিবেশ সংক্রান্ত কাজ হয় সেখানেই হাসিমুখে কিশোরী কন্যাটি অংশগ্রহণ করে।বয়স এখন তার মাত্র তেরো বছর।

  সৌরশক্তি চালিত ইস্তিরি( Solar Iron) ও বিনিশা উমাশংকর.............
 
তামিলনাড়ুর দশম শ্রেণীর ছাত্রী বিনিশা মা এর সাথে স্কুল ইউনিফর্ম ইস্তিরি করতে যেতো পাড়ার মোড়ে।  ইস্তিরিওয়ালা কয়লার উনুনে লোহার ইস্তিরি ব্যবহার করে কাজটি করতেন। আমাদের চারপাশে এইরকম দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে।  কিন্তু বিনিশার মাথায় আসে পরিবেশ দূষণের ভাবনাটি । কেননা কয়লার উনুন থেকে ( জীবাশ্ম জ্বালানি) ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতো পুরো এলাকাটা। সে তার নিজস্ব উদ্যোগে ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বানিয়ে ফেলেছে এক নতুন ধরণের "সোলার আয়রণ"।একটা ভ্যানের মাথায় সোলার প্যানেল বসিয়ে চলমান আয়রণ- যান তৈরী করে ফেলেছে । সৌরশক্তি চালিত এই গাড়ির নাম দিয়েছে "Iron-max"। তার উদ্ভাবিত এই পরিবেশ-বান্ধব আয়রণটি এবছর (২০২১) স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে( COP26) প্রিন্স উইলিয়ামের "আর্থশট" পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
আমন্ত্রিত অতিথি বক্তা হিসেবে এই নবীন উদ্ভাবকও পৃথিবী-নিয়ন্ত্রক "বড়োদের" প্রতি তার ক্ষোভ ব্যক্ত করেছে তার বক্তৃতায়--------"রাষ্ট্রনেতাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি তে আমাদের প্রজন্মের অনেকেই ক্ষুব্ধ।রাগ করার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু আমার সময় নেই। আমি কাজ করতে চাই। আমি শুধুমাত্র ভারতেরই মেয়ে নই , আমি এই পৃথিবীর মেয়ে।সবার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখেও আমি অনুরোধ করতে চাই যে -- দয়া করে জীবাশ্ম জ্বালানি, ধোঁয়া, দূষণে গড়া অর্থনীতিকে সমর্থন করবেন না"......।  

গ্রেটার ক্ষোভ , ভ্যালেনটিনার কান্না অথবা বিনিশা র অনুরোধ ও উদ্ভাবন প্রকৃতি ও পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই এর অঙ্গ। বহুবছর ধরে ধীরে ধীরে হলেও বিগত কয়েক দশকে (২০/৩০  বছরে) জলবায়ু যেভাবে দ্রুতহারে পাল্টে গিয়েছে বা যাচ্ছে   তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে  দ্রুত চলমান ও উন্নত টেকনোলজি সমৃদ্ধ সভ্যতার ওপরে।  দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে যাওয়া, উত্তর মেরুর প্রাচীনতম হিমবাহের গর্ত হয়ে যাওয়া,ইউরোপে অসহনীয় গরম ও কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে তাপপ্রবাহে মানুষের মৃত্যু , হিমালয়ের ভূমিধ্বস ও বন্যা,অস্ট্রেলিয়ার ফরেস্ট ফায়ার  , ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো , সাইক্লোনের ঘনঘন আক্রমণ এবং সমুদ্রতলের উষ্ণতা বৃদ্ধি-- এসব ই প্রকৃতির ওপর মানুষের দীর্ঘদিনের মাতব্বরির ফলস্বরূপ দেখা যাচ্ছে।
এতোদিন অরণ্য কেটে মানুষ সভ্যতার বিস্তার করেছে নির্বিচারে আজ প্রকৃতির প্রতিশোধের পালা শুরু হয়েছে। বাতাসে অতিমাত্রায় কার্বন ডাই অক্সাইড এর নিঃস্বরণ বন্ধ করতে না পারলে সামগ্রিক জলবায়ু পরিবর্তন এই দ্রুতগতির সভ্যতার ভিত যে নাড়িয়ে দেবে সেটা পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বারবার হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন বহুবছর ধরে। ঠিক সেই বার্তাটিই  এই নবীন প্রজন্মের পরিবেশকর্মীরা বারবার জানিয়ে দিচ্ছে  রাষ্ট্রনেতাদের । 
পরিতাপের বিষয় এই যে ২০২১ এর গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতাদের দীর্ঘ আলোচনায়  কিছু আপোষ রফা সূত্র ছাড়া আর বিশেষ কিছুই মেলেনি।      গ্রেটা  - ভ্যালেনটিনা - বিনিশা এবং সারা পৃথিবীর অগণিত নবীন প্রজন্মের কাছে   একদিন  জবাবদিহি করতেই হবে  তথাকথিত "বড়োদের" --  সে দিন প্রায় আসন্ন।




নিবন্ধ 

বাংলা ভাষা বোধ ও  বর্তমান পর্যায়
‌           চন্দন কুমার দাস 
                                

বাংলা ভাষার উৎপত্তি নিয়ে নানা জনের নানা মত আছে ।তবে বলা যায় বাংলা ভাষা বিশ্বের একটি মধুরতম ভাষা। ইউনেস্কো এর তত্ত্বাবধানে বিশ্বের  মধুরতম ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষাকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। তথাপি বাংলা ভাষা ভারতে এখনো ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পায়নি ।( তথ্য-  সৌপ্তিক পত্রিকা ২২পাতা)অত্যন্ত বেদনাদায়ক ।বাংলা ভাষার  লালনে  তাই আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে অধিকতর যত্নবান হতে হবে। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলা শব্দ ভান্ডার কে আরো সমৃদ্ধিশালী করতে হবে। বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন ,"বাংলা ভাষা  আত্মনির্ভরশীল নয় ""বিদেশি শব্দ থেকে বাংলা সাদরে কিছু শব্দ গ্রহণ করেছে কখনো কখনো বাংলা শব্দ বিদেশি প্রত্যয়, অনু অনুসর্গ প্রত্যয়  এর সঙ্গে  জুড়ে   গিয়ে নতুন শব্দ গঠন করেছে ।এখনও এই গঠনের প্রক্রিয়া চলছে যা বাংলা ব্যাকরণে নবগঠিত শব্দ নামে পরিচিত। একদিকে বাংলা ভাষার কিছু শব্দ যেমন নতুনভাবে গৃহীত হয়েছে তেমনি কিছু কিছু শব্দ বিবর্তিত হয়ে অর্থের উৎকর্ষতা লাভ করেছে  । ।তেমনি কিছু কিছু শব্দ  বিবর্তিত হয়ে অর্থের অপকর্ষতা লাভ করেছে ।এই ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা এগিয়ে চলেছে। তবে বাংলা ভাষার ইতর শব্দের প্রয়োগ যতটা সম্ভব কম হবে ততই বাংলা ভাষার পক্ষে মঙ্গলজনক ।।যেমন প্রায়ই শোনা যায়  হ্যাঁজানো ,মুরগি বানানো ইত্যাদি।এইভাবে  বাংলা ভাষা পৃথিবীর শৌর্যশালী ভাষায় পরিণত হয়েছে।পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিযেমন ইংল্যান্ডফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্র কানাডা জাপান চীন কোথায় এর চর্চা হয় না ? বহু  বিদেশি গবেষক বাংলা ভাষা চর্চা করে চলেছেন। বহু বিদেশি গবেষক বাংলা ভাষায় গবেষণা করছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা গান নিয়েও অনেক চর্চা চলে ।বিদেশি গবেষক       মারিয়া হেলেন বোরো  নজরুল সাহিত্যের উপরচর্চা করছেন । ভুল বানানও  ভাষার উৎকর্ষতা কে কমিয়ে দেয়।"উচ্চারণে ভুল আবার শব্দের অর্থকে বদলে দিতে পারে। যেমন-উদ্বায়ী ,উদ্বেগ ।শব্দের উচ্চারণ হবে উদ্/দেগ,উদ্/দায়ী।এখানে অন্তস্থ ব থাকায় ব এর উচ্চারণ  হয় না ।  গরু শব্দের উচ্চারণ কিন্ত গোরু হবে।আবার লিখিত রুপ হবে গরু। কারণ পূর্ব বর্ণ ব্যঞ্জন বর্ণ থাকলে এবং তার অব্যবহিত পরে হ্রস্ব ই বা  উ থাকলে ব্যঞ্জন বর্ণের উচ্চারণ হয় ও কার যুক্ত।
বাংলা বানানে  ই /ঈ কার,উ/ঊ কার ন/ণ ,শ/ষ,/স নিয়ে সমস্যা হয়                             ১.       
দ্বিরাবৃত শব্দে হ্রস্ব (ই/উ)কার প্রাধান্য পায়। যেমন...টুকটুকে, চুলোচুলি, ফিসফিস।                ২.কেউ কিছু ধারন করার অধিকারী বোঝাতে  ঈ কার বসে। যেমন- জ্ঞান ধারন করে য়ে--জ্ঞানী।   ধন ধারন করে য়ে ---ধনী  ইত্যাদি।৩.স্ত্রী লিঙ্গ জাত শব্দের শেষে ই উচ্চারণ থাকলে ঈ কার হয়। যেমন--- বাঘিনী , হস্তিনী, দেবী। তবে বিবি, দিদি,ঝি এসব ব্যাতিক্রম।
      উকার:খারাপ অর্থে দুর  উপসর্গ  বসে।  যেমন---দুর্নাম,দুশ্চরিত্র।    তদ্ভব শব্দে উ কার বসার প্রবনতা দেখা যায়। যেমন পুব।    ঊকার:  তৎসম শব্দে ূ পূর্ব।      
ন/ণ:  বিদেশী শব্দে ন ,দন্ত্য বর্নে ন এর ব্যবহার হয়।    ট বর্গের  উপর ন যুক্ত হলে তা ণ হয়। যেমন---বণ্টন,লন্ঠ্ন ইত্যাদি।

                  শ/ষ/স :   কৃশ, দৃশ্  প্রভৃতি ধাতুর পর শ বসে। যেমন----কৃপতা,দর্শন।
স্থ সংস্কৃত ধাতু থেকে তৈরি সব শব্দে স ব্যবহ্নত হয়।             
ঋ,র ,ঋ কার যুক্ত  শব্দের পর  ষ বসে। যেমন---কৃষক,কৃষি, বৃষ ইত্যাদি।




গদ্য প্রয়াস 

রেলযাত্রা
 অলকানন্দা দে

ট্রেনের জানালার কিনারে বসে যে ঝিম ধরে তাতে অনেক দূরের বহু যুগের কোন সে মায়ালোকের সুখচ্ছবি যে ছেঁচে তোলে মন, তা বলতে পারে না এই বিবশ আমি! স্মরণের কালবৈশাখী রোখে বলো সাধ্যি কার! অবিশ্বাস্য এক ভিড় জমে সুখার্দ্র স্মৃতির চলতে চলতে চারিদিকে। বহুকাল আগে বেঁচেছিলাম যে জীবনটা যেন আড়মোড়া ভাঙে দৃষ্টির দোরগোড়ায়। একটি অতীত, ঠিকানা ভুলে এসেছে কাছে সান্নিধ্যের সাধে। শিশিরধোয়া সহজ স্মৃতিরা ছড়িয়ে গিয়ে বিগতকে নিয়ে এসে দাঁড় করায় মনের মধ্যিখানে। দেখে আমি বলি তাদের, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকেও চাই আমার রাত্রিদিনের বাঁকে বাঁকে। সোনালি আমোদের দল মেঘনীল সামুদ্রিক পাখির মতো ভেসে বেড়ায় দিগন্ত ছোঁয়া চেতনার ঈশ্বর শুদ্ধ আকাশ জুড়ে। আলতোভাবে তাকিয়েছিলাম সেইসব দশকের সুফলা বেলাগুলির দিকে যার মাঝে আমিও আছি। আমাকেই দিলাম আমার এ দিনগুলি রোমন্থনে। ছুটছে ট্রেন, পাশে পাশে ছোটে সোনা ধানের সারি, বয়স্য গাছ। রোদ দুলছে ছড়াগানের সাথে সাথে!! বাতাসে বিশুদ্ধ মায়ার বন্যা। একে কি নয়নাভিরাম বলব নাকি তারও বেশি কিছু!! দূর মাঠের নীরব শান্তিতে স্নান করি। প্রত্যহের ঠেলে ঠেলে চলা পথকে ছুঁড়ে ফেলে দিই নিস্তরঙ্গ জলের অন্দরে। নিক্ষেপে নিপুণ হয়ে উঠেছি যেন আড়ম্বরের এই অভীষ্ট দূরপাল্লায়। এখন আমি কোন জড় ভাবনাকে প্রবেশের অধিকার দেব না, যা বৃথা করে সমস্ত ছুঁয়ে দেখাকে। জানালাটি একটি ফটোফ্রেমের মতোই আবেগে সাজে। স্বেচ্ছায় ক্যানভাসের বদল নির্মল খেলায় মাতে প্রতি মুহুর্তে। মন আজ পবনগতি!! নিজের দখলে থাকে না দু’দন্ড। চলেছি আমোদিত ধরিত্রীর সমতল বেয়ে দূর, অনেক দূর!!

একজন সহজ ফেরিওয়ালা ওঠে খাদ্যের আধার সাজিয়ে। যার সুবাসে ভাসে স্থানীয় বাতাস। মানুষটির সাথে কথার লেনদেন করি। জানতে চাই তাঁর ঘরের রৌদ্র ছায়ার গল্প, তাঁর বাণিজ্য ও ব্যবসায়ী পরিসর।

অনতিদূরের কোন কামরায় বাউল খুলেছে  সহজিয়া গানের দরজা। কান পেতে অপেক্ষায় আছি চাক্ষুষ করার। কেমন সহজে এগিয়ে চলে দিনটা। নিটোল গড়ন তার! জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি কত!! ধীরে ধীরে গাছতলার দুপুর বিকেলের কোলে ঝাঁপ দেয়। অভ্যাসে অপেক্ষা করে গোধূলি। অভিভূত হয়েও যেন আরও আছে বাকি!! পড়ন্ত বেলায় কোন এক স্টেশনের অদূরে দাঁড়ায় ট্রেন। দেখি সেই আমোদপ্রিয় সাদাসিধে ফেরিওয়ালা তাঁর শিসধ্বনিতে একটি চেনা গানের সুর তুলে নেমে যায় ব্যস্ততায়। টপকে টপকে সমান্তরাল লাইনের সারি একটি ফুলবিলাসী কৃষ্ণচূড়া  গাছের ছায়া ঘেঁষে চলে গেল সে আপন ঠিকানায়। যেন পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ! যেতে যেতে বলে যায়, “না পাওয়ার অসুখকে কি তোয়াক্কা করতে আছে গো!!” আপনজনের মতো করে নিরাশা ভাঙিয়ে দিলে!! রয়ে গেল রেশ! চারিদিকে আমার অনেক পরিপাটি মানুষের ভিড়। চেনে না কেউ, চিনি না কাউকেই। কিন্তু এই গ্রামভরা স্টেশনের আসন্ন সন্ধ্যার পরিচ্ছন্ন মঞ্চে এই পরশ্রমী প্রাণ যে জীবনশিক্ষা দিলে, তাতে উদ্বুদ্ধ হতে হয় সারাজীবনের মতো। অন্তরে মুখর হয়ে বলি, হে বাস্তব! বরঞ্চ বলো বোকাই আমাকে!!

সূর্য নেভার তীরে এক এক করে দেখা হল শত তারার সাথে। গড়ালো রাত ট্রেনের চাকায় চাকায় বিরাট দায়িত্ব নিয়ে। দেখাবে আমাকে মধ্যনিশির আপ্লুত চাঁদ! দিয়েছে প্রতিশ্রুতি আপন মেনে!

 

হৃদয়ে যাদের বিরাট সমুদ্র সেই সেকেলে স্মৃতির সাথে নির্ঝঞ্ঝাট এই রেলসফর বেঁধে ফেলে দিনটাকে মোহন আনন্দে। ফিরে এলে এই শহরের ঘরে, মৈত্রীতে হাত পাতি তার কাছে। বলি,পরাজিত দিনে মহাশ্বেতা জ্যোৎস্না হয়েই থেকো পাশে! প্রত্যহগুলি যেন আয়ত্তে থাকে এই স্মৃতির ঐশ্বর্য মেখে!!


    

গল্প 

প্রফুল্ল 

রামাশীষ চৌধুরী  

          বেঙ্গল ডুয়ার্স  রেলওয়ের অন্তর্গত রেলওয়ে অঞ্চল। প্রত্যন্ত এলাকা। মনোরম গ্রাম পরিবেষ্টিত। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রূপোলি তিস্তা। এক সময় বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। রেলের নিজস্ব বড় বড় অফিস। নিজস্ব পাওয়ার হাউস, লোকোশেড, প্রচুর রেলওয়ে কোয়াটার্স। প্রত্যেক কোয়াটার্সে রেলওয়ে কর্মীরা তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন। রেলওয়ে কর্মীদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার জন্য রয়েছে নিজস্ব স্কুল। রয়েছে রেলওয়ে কর্মী ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের চিকিৎসার জন্য রেলওয়ে হসপিটাল। 
          তবে ১৯৬৮ সালের বন্যা এই রেলওয়ে অঞ্চলের কাছে এক বিভীসিকা রূপে দেখা দেয়। 
এই এলাকা থেকে অন্য জায়গার সংযোগকারী রেলওয়ে লাইন স্থানে স্থানে বন্যার জলের তোড়ে ভেসে যায়। রেলওয়ে-অফিস সমূহের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেই সঙ্গে ব্রডগেজ রেল লাইনের সম্প্রসারণের দরুন ধীরে ধীরে এই রেল-অঞ্চলটির গুরুত্ব কমতে থাকে। সত্তুর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে রেল কর্তৃপক্ষ এই পকেট রেলওয়ে অঞ্চল থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নিতে সবে শুরু করেছে। ঠিক সেই সময়ে, এখানকার রেলওয়ে হসপিটাল-এ ট্রান্সফার হয়ে এলেন এক ডাক্তার। ভদ্রলোক সাউথ ইন্ডিয়ান। কিন্ত বাংলা বলেন খুব সুন্দর। থাকতেন তার জন্য বরাদ্দ বাংলাতে। থাকতেন একাই। না, একদম একা বললে ভুল হবে। ওনার সঙ্গে থাকতেন আর-ও একজন। তার নাম ভোলা। ভোলা পরিচারক, কুক-ও বটে। সেই সঙ্গে বাংলোর পাহাড়াদার। অর্থাৎ ভোলাই সব। 
          বিশাল বাংলোর একটা ঘর বরাদ্দ ছিল ভোলার জন্য। যখন যে ডাক্তার এই রেলওয়ে হসপিটাল-এ ট্রান্সফার হয়ে বা নতুন চাকরি নিয়ে আসতেন, ভোলাই তাদের প্রত্যেকের পরিচারক কাম কুক হিসাবে কাজ করত। সেইসঙ্গে অবশ্যই বাংলোর পাহাড়াদারিত্ব। 
          ভোলার বাড়ি ছিল রেলওয়ে এলাকার বাইরে, সিভিল এরিয়া-তে। গ্রামের ভিতরে। ভোলা সারাদিনে একবার বাড়িতে যেত। বাকি সময়টা ওর এই বাংলো-তে কাটত। রাত্রিবাস করতে হত এই বাংলো-তে। 
          বাংলোর ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছিন্ন রাখা থেকে জামা-কাপড় কাচা, ডাক্তারবাবুর জন্য রান্না করা-সব কাজ ভোলাই করত। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে ডাক্তারবাবুরা এখানে ট্রান্সফার হয়ে বা নতুন চাকরি নিয়ে আসতেন। কেউ উড়িয়া, কেউ তেলেগু, কেউ বা তামিল, আবার কেউ বা বাঙালি। কেউ বিবাহিত আবার কেউ বা অবিবাহিত। কেউ একাই থাকতেন। আবার কেউ কেউ পরিবার নিয়ে থাকতেন। বিভিন্ন প্রদেশের ডাক্তারদের সঙ্গে থাকতে থাকতে, ভোলা ভারতবর্ষের প্রায় সব রাজ্যের রান্না শিখে গিয়েছিল। 
          বর্তমান ডাক্তারবাবু বিবাহিত। কিন্ত এখানে একাই থাকতেন। উনি পরিবার নিয়ে আসেননি। তবে তার জন্য ওনার যে কোন অসুবিধা হচ্ছিল তা কিন্ত নয়। তার কারণ সর্বকার্যে পারদর্শী ভোলা। চন্ডিপাঠ থেকে জুতো সেলাই-সব কাজ ভোলাই করত।  ডাক্তারবাবু ব্যস্ত থাকতেন তার ডাক্তারি নিয়ে। 
          রেল এলাকার ভিতরে চারিদিকে ছড়িয়ে বিভিন্ন নামের এবং বিভিন্ন টাইপের রেলওয়ে কোয়াটার্স। রেলের হাসপাতালটি ছিল রেলওয়ে এলাকার মোটামুটি মাঝখানে, যাতে বিভিন্ন কোয়াটার্সে বসবাসকারী রেলওয়ে কর্মীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে এখানে আসতে সুবিধা হয়। হসপিটালের অদূরেই ছিল ডাক্তারবাবুর বাংলো।বাংলোর সামনে বিশাল মাঠ। বাংলোর সামনে থেকে একটা রাস্তা মাঠটাকে পাশে রেখে চলে গিয়েছে সামনের কোয়াটার্সগুলোর দিকে। 
          দিনে ডাক্তারখানা সামলানো, রাতে কোয়াটার্সে কোয়াটার্সে রোগী দেখা। কখন ডানদিকের কোয়াটার্সে তো কখন বাংলোর পিছনদিকে স্টেশন কোয়াটার্সে রোগী দেখতে যাওয়া। ডাক্তারবাবুর এতটুকু শিথিলতা, সামান্যতম ক্লান্তি নেই। 
          সেদিন, রাত ঠিক ন'টার সময়, ২৫-২৬ বছরের একটি ছেলে ডাক্তারবাবুর বাংলোয় এসে উপস্থিত। সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে একনাগাড়ে উদ্বিগ্ন গলায় 'ডাক্তারবাবু , ও ডাক্তারবাবু' বলে ডাকাডাকি শুরু করে। ডাক্তারবাবু দরজা খুলতেই,  ছেলেটি হাতজোড় করে বললে-ডাক্তারবাবু, বাবা খুব অসুস্থ। দয়া করে, একবার যদি একটু দেখে আসতেন। 
          কোন্ কোয়াটার্স তোমাদের ?
          ডাক্তারবাবু, এই সামনের কোয়াটার্সেই আমরা থাকি।  43 এর B।
          যাও, আমি আসছি। তবে, একটু দেরি হবে 
          স্টেথোটাকে গলায় ঝুলিয়ে ডাক্তারি সরঞ্জাম ভরা ব্যাগটাকে পাশে সোফার ওপর রাখলেন। এরপর জুতোর ফিতে বেঁধে মাথা তুলতেই ডাক্তারবাবু দেখেন, ভোলা সামনে দাঁড়িয়ে। ডাক্তারবাবু একটু অবাক হলেন, ভোলাকে এভাবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ডাক্তারবাবু কল-এ বেরিয়ে গেলে, সাধারণত ভোলা, পরে এসে দরজাটা আটকে দেয়। কিন্ত আজ বেরোনোর আগেই ভোলা সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে! ভোলার দিকে ভালো করে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু খেয়াল করলেন- ভোলার চোখে-মুখে একটা ভয় মিশ্রিত উৎকন্ঠার ছাপ। কিছু বলবে বলবে করেও বলছে না। 
          কিরে ভোলা, কিছু বলবি?-ডাক্তারবাবু ভোলার কাছে জানতে চান। 
          ভোলা কোন উত্তর না দিয়ে আগের মতোই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ।
          কি হল ভোলা হল, কিছু বলবি-ই-ই!
          ভোলা এবার ডাক্তারবাবুর জুতো-পরা পা-জোড়া দু-হাতে চেপে ধরে বলতে থাকে-না,ডাক্তারবাবু আজ আপনি কিছুতেই রোগী দেখতে যাবেন না।
          ডাক্তারবাবু যারপরনাই অবাক হলেন। প্রায় প্রতিদিনি-ই তো উনি রাতে, এমনকি মাঝরাতে রোগী দেখতে বেরোন, কই , ভোলা তো কোনোদিন ওনাকে রোগী দেখতে যেতে নিষেধ করে না। তাহলে, আজকে ও এরকম আচরণ করছে কেন?
          কেন ? আজ কী অসুবিধা ?-ডাক্তারবাবু ভোলাকে শুধোলেন।
          আজ আপনি যে পথে রোগী দেখতে যাবেন, সেই পথ ভালো নয় ডাক্তারবাবু।
          কেন,  পথ তো পথ-ই - তার আবার ভালো-মন্দের কি আছে ভোলা!
          যে রাস্তা দিয়ে আজ আপনি রোগী দেখতে সামনের কোয়াটার্সে যাবেন, সেটা 'প্রফুল্ল 'র মাঠ '-এর পাশ দিয়ে গিয়েছে।
          কোন্ মাঠের কথা তুমি বলছ?
          ঐ যে, এই বাংলোর সামনে যে বিরাট মাঠ, সেটির কথাই বলছি ডাক্তারবাবু। ঐ মাঠ এখন প্রফুল্ল 'র। রাত্রি দশটা বাজলেই প্রফুল্ল-র আত্মা এই মাঠে আসে। এই মাঠের শেষ প্রান্তে, বড় রাস্তার কাছাকাছি জায়গায় , ওর আত্মা শুয়ে ছটফট করে। মৃত্যু-যন্ত্রনায় কাৎরাতে কাৎরাতে 'বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও ' বলে চিৎকার করতে থাকে। এ আমি নিজে শুনেছি ডাক্তারবাবু। ওর মৃত্যু আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওর আত্মা এখনও মুক্তি পায় নি, ডাক্তারবাবু।
          ডাক্তারবাবু ভাবলেন, ভোলা গ্রামের মানুষ, যথেষ্ট বুদ্ধিমান হলেও লেখাপড়া একদম শেখেনি, ভূত-প্রেত আত্মা-প্রেতাত্মায় ওরা বিশ্বাসী হয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে কি দেখেছে, কি শুনেছে-আত্মার কাজ বলে ভেবে বসেছে। আবার নিজের কৌতুহলঽও চাপতে পারলেন না। বললেন- কে প্রফুল্ল? কি হয়েছিল ওর!
          সে অনেক কথা ডাক্তারবাবু-বলে ভোলা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। 
          বলো দেখি, শুনি, সে তোমার অনেক কথা!
          সে অনেক দিন আগে ডাক্তারবাবু। দেশভাগ তখনও হয়নি। ইংরেজরা আমাদের দেশ শাসন করছে। বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ের পত্তন হল। এই এলাকার ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটল বাংলাদেশের রংপুর পর্যন্ত। আর এই ট্রেনকেই মাল পরিবহনের মাধ্যম করে কিছু অবাঙালি ব্যবসায়ী ব্যবসা শুরু করল এই অঞ্চলে।
          প্লাস্টিকের তৈরী দ্রব্যের তখন প্রায় নামগন্ধও ছিল না। ব্যাগ, বস্তা-সবই তৈরী হত পাট থেকে। পাটজাত দ্রব্যের চাহিদাও তখন তুঙ্গে। বাংলার চটকলগুলোও চলছে রমরমিয়ে। লাভজনক বলে এই অঞ্চলের কৃষকরাও তাদের জমিতে ধানের সঙ্গে সমান তালে পাট চাষও করত। 
          একজন অবাঙালি ব্যবসায়ী, নাম বিনোদ আগরওয়াল, এখানে এসে রেল এলাকার ধারে সিভিল এরিয়া-তে আস্তানা তৈরী করল। ভদ্রলোকের বাড়ি ছিল রাজস্থানে। ওনার এখানে আস্তানা তৈরীর করার উদ্দেশ্য ছিল আশপাশের এলাকা থেকে কাঁচা পাট সংগ্রহ করে চটকলগুলোতে সরবরাহ করা। তৈরী করলেন বড় গুদাম। সেখানে আশপাশের এলাকা থেকে কাঁচা পাট সংগ্রহ করে রাখা হত। তারপর সেগুলো মেশিনের সাহায্যে গাঁট বেঁধে বাংলার বিভিন্ন চটকলগুলোতে সরবরাহ করত সেই ব্যবসায়ী।
          পাট লেনদেনের এই কেন্দ্রকে লোকে বলত 'গদি '। কেউ কেউ বলত 'পাটের গুদাম '। আবার কেউ কেউ এদের নাম দিয়েছিল'পাট গোলা '। 
          সে যাই হউক, ধীরে ধীরে আরও দু-জন অবাঙালি ব্যবসায়ী - বিনীত আগরওয়াল আর অনু আগরওয়াল, পুরনো গদির পাশে আরও দু-টি পাটের গদি তৈরী করল। গুদামের আকার আর সংগৃহীত পাটের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে অর্থাৎ আর্থিক লেনদেনের ওপর গদিগুলোর নাম হল-বড় গদি, মেজ গদি আর ছোট গদি। 
          ব্যবসার প্রয়োজনে বেশ ভালো পরিমাণে নগদ অর্থ প্রত্যেকটা গদি-তে রাখতে হত। তাই নিজেদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে তারা প্রত্যেকে নিরাপত্তারক্ষী রাখতেন। আর ছিল প্রত্যেক গদিওয়ালার দো-নলা বন্দুক। 
          একবার বড় গদি-তে ডাকাত পড়ল। অনেক কিছুর সঙ্গে ডাকাতরা নিয়ে গেল বড় গদি মালিকের দো-নলা বন্দুকটাও। সেটা ছিল এই সত্তুর দশকের মাঝামাঝি। অনেকে বলে এত বড় ডাকাতি নাকি এ তল্লাট-এ  এযাবৎ শোনা যায় নি। 
          থানা-পুলিশ অনেক হল। কিন্ত ঐ দো-নলা বন্দুকটি আর উদ্ধার হল না। 
          এরপর বহুদিন কেটে গেছে। শোনা যায়, ঐ বন্দুক নাকি ডাকাতদের হাত হয়ে, প্রফুল্ল 'র হাতে আসে। প্রফুল্ল'র বাবা রেলের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী ছিল। প্রফুল্ল ছোট থেকে প্রতিবন্ধী। হাতের তালু আর আঙ্গুলগুলো বেঁকে সব সময় পিছনের দিকে থাকত। হাঁটা চলার মধ্যেও স্বাভাবিকত্ব ছিল না। লেখাপড়া তেমন শেখেনি। বন্দুকটা বেচে দিতে পারলে তার কিছু অর্থ প্রাপ্তি ঘটবে-এই আশায় ও বন্দুকটা বেচার দায়িত্ব নিয়েছিল। ক্রেতাও পেয়ে গিয়েছিল। 
          ক্রেতা ছিল এক সুদখোর ব্যক্তি। সুদের ব্যবসা করতে গিয়ে শত্রু তৈরী হয়ে থাকতে পারে। হয়ত সেই কারণে নিজের নিরাপত্তার প্রয়োজনে একটা বন্দুক রাখার দরকার হয়ে পড়েছিল। ধুরন্ধর লোক ছিলেন এই সুদখোর মানুষটি। নাম ছিল নকুল সাহা। নকুল খবর পেয়ে যায় যে বড় গদির ডাকাতি হওয়া বন্দুকটা প্রফুল্ল 'র হেফাজতে রয়েছে। নকুল প্রফুল্ল 'র সঙ্গে যোগাযোগ করে। দু-জনের মধ্যে রফাও হয়ে যায়। বন্দুক হাতে পেলেই নকুল প্রফুল্ল-কে টাকা দিয়ে দেবে বলে ঠিক হয়। 
          ঠিক হয়, প্রফুল্ল রাত্রি দশটা-র সময় বন্দুক নিয়ে বাংলোর সামনের মাঠে উপস্থিত হবে। 
          এত গোপন জায়গা থাকতে বাংলোর সামনের মাঠ কেন!
          আসলে মাঠটা খুব বিস্তৃত। ফলে মাঠের মাঝে কিছু ঘটলে, অনেকের তা দৃষ্টির বাইরে হবে। মাঠের মাঝখানে অন্ধকার, ফলে বন্দুক হস্তান্তরের দৃশ্য কারু দৃষ্টিগোচর হওয়া সম্ভব নয়। 
          সেদিন আমি রাত্রি ঠিক দশটা-র সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে, এই মাঠের পাশ দিয়ে বাংলো-তে পৌঁছনোর যে রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে বাংলো-তে আসছিলাম। তখন রেলওয়ে হসপিটাল-এর ডাক্তার ছিলেন ডাঃ সেন। উনি তখন বাংলো-তে ছিলেন। 
          রাস্তা দিয়ে যখন মাঠের মোটামুটি মাঝখানে এসে উপস্থিত হয়েছি, ঠিক তখন-ই সেই আর্ত চিৎকার কানে আসল, "কে আছো, আমাকে বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলল। বাঁচাও আমাকে বাঁচাও!" চার ব্যাটারির টর্চ লাইটের আলো মাঠের মাঝখানে ফেলতেই ঘাবড়ে গেলাম। দেখি, তিন-চার জন লোক একটি লোককে গাছের ডাল জাতীয় কিছু দিয়ে অবিরত মেরে যাচ্ছে। যে মাঠে পড়ে থেকে মার খাচ্ছে, সে দু-হাত দিয়ে মাথাটাকে ঢাকার চেষ্টা করে কাতর স্বরে ওকে বাঁচানোর জন্য একনাগাড়ে চিৎকার করে চলেছে। টর্চের আলো পড়তেই যারা মারছিল, তারা হঠাৎ-ই থেমে গিয়ে আলোর উৎস খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি আর কাল বিলম্ব না করে বাংলোর দিকে দৌড়তে শুরু করলাম। ডাঃ সেনকে এই ঘটনার কথা জানায়নি। অন্য কাউকেও এদিনের অভিজ্ঞতার কথা কোনোদিন বলিনি 
          কেন বলোনি ?
          ভয়ে। পুলিশ আর মস্তানদের ভয়ে। 
          এই ঘটনার পর ঐ পথ দিয়ে বাড়ি থেকে বাংলোতে বার দু-এক এসেছি। প্রতিবারই ডাক্তারবাবু, ঐ এক-ই কাতর আর্তনাদ আমি শুনেছি-বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। এখন আর আসিনা ,ডাক্তারবাবু। আপনিও আর ঐ পথ দিয়ে যাবেন না। কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। প্রফুল্ল'র আত্মার আজ-ও মুক্তি ঘটে নাই। 
          ডাক্তারবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আমার কিছু হবে কেন, ভোলা! আমি তো প্রফুল্ল 'র কিছু করিনি!
          ডাক্তারবাবু সব শুনে এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, ভোলার এখন যেটা হচ্ছে- দ্যাট ইজ আ কেস অব visual and auditory hallucination 
          কিন্ত ভোলা, বন্দুক তো প্রফুল্ল নিয়ে এসেছিল, তাও ওকে মেরে ফেলা হল কেন?
          ডাক্তারবাবু, ঘটনা আমি সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিলাম ঠিকই, কিন্ত এরা কারা, কি কারণে ওরা সেদিন প্রফুল্ল-কে ওভাবে মারছিল এবং সেদিন ওরকম মার খেয়ে প্রফুল্ল'র যে মৃত্যু হয়েছিল-তা সব-ই আমি পরে লোকমুখে  শুনেছি। মূলতঃ প্রমাণ লোপাটের জন্য-ই নাকি নকুল ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলেছিল। বন্দুক বাবদ টাকাটাও আর প্রফুল্ল-কে দিতে হল না কৃপণ সুদখোর নকুল সাহাকে। কেউ কেউ আবার
 একথাও বলে প্রফুল্ল যে মরেই যাবে এটা নাকি ওরা বুঝতে পারে নি। 
          পুলিশ আসেনি?
          হ্যাঁ, এসেছিল। প্রফুল্ল যেখানে মরে পড়েছিল দারোগাবাবু সেখানে গিয়েছিল। চেয়ারে বসে একটা খাতায় অনেক কিছু লিখে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্ত শুনেছি, কিচ্ছু হয়নি ডাক্তারবাবু, কেউ ধরা পড়েনি, কারও কোন শাস্তি হয় নি। যারা প্রফুল্ল-কে মেরেছিল, তাদের নাকি অনেক ক্ষমতা। তাই কারা এই হত্যার পিছনে তা জানা সত্তেও নাকি প্রশাসন তাদের ধরার ব্যাপারে একেবারে উদাসীন ছিল। তবে ডাক্তারবাবু সব-ই আমার শোনা কথা। 
          আইন ওদের শাস্তি না দিলেও, ডাক্তারবাবু , কর্মফল ওরা পেয়েছিল ওদের মধ্যে যে আসল লোক তার মা-এর ও ছেলের পরপর মৃত্যু হয়। উনিও নাকি এরপর আর বেশিদিন টেকেননি।
          না ভোলা, ও ভাবে ভাবা ঠিক নয়। মা বা ছেলে তো কোন অন্যায় করেনি। তারা এর জন্য শাস্তি পাবে কেন!
          তা অবশ্য মন্দ বলেন নি। 
          সব-ই তো বুঝলাম ভোলা , কিন্ত একটা জিনিস কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না, তা হল, নকুল সাহা বন্দুক নেবে আর প্রফুল্ল বন্দুক বেচবে -এর মধ্যে এই মস্তানদের দল এল কি করে!
          লোকে বলে, এটা নাকি আগে থেকেই ঠিক করা। প্রফুল্ল'র সঙ্গে বন্দুকের দাম ঠিক করার পর, নকুল সাহা বুঝতে পারে-বন্দুক বিক্রেতাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। ও বেঁচে থাকলে এটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে যে নকুল সাহার বন্দুকটা আসলে বড়-গদির চুরি যাওয়া বন্দুক। এটা তার জীবনে কোন না কোনোদিন বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই প্রফুল্ল 'র কাছ থেকে ফিরে এসে নকুল সাহা পরিচিত তিন-চার জন মস্তানকে বন্দুক কেনার ব্যাপারটা জানায় এবং তাদের রাত্রি দশটা 'র সময় বন্দুক হস্তান্তরের স্থানে আসতে বলে। অবশ্যই যারা এসেছিল কেউ-ই স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। নেশার দ্রব্য নকুল সাহা-ই সরবরাহ করেছিল। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় কাজ হাসিল করাই লক্ষ ছিল নকুল সাহার এবং তাতে সে সফলও হয়। 
          সবকিছু শোনা শেষ হলে, ডাক্তারবাবু , ভোলাকে দরজা বন্ধ করে দিতে বলেন। নিজে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়েন রোগী দেখতে। 
          রাস্তায় যেতে যেতে, ডাক্তারবাবু, একটা জিনিস পরিস্কার হল ,তা হল, ভোলার একটু ট্রিটমেন্ট দরকার। যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও প্রত্যক্ষ করেছে, তার জন্য সে যে মানসিক আঘাত পেয়েছে ,তার থেকে আজও সে বেরিয়ে আসতে পারে নি। সেদিনের প্রফুল্ল-র করুন আর্তনাদ 'আমাকে বাঁচাও ', ওর মনকে এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে যা সে ঐ স্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে আজও সে ঐ শব্দগুলো শুনতে পায়। সর্বোপরি প্রফুল্ল-কে বাঁচাতে না পারার ব্যর্থতাও ভোলার মধ্যে একটা অপরাধ বোধের জন্ম দিয়েছে। নিদেনপক্ষে, একটা কাউন্সিলিং ভোলার জন্য করতেই হবে। 
          ডাক্তারবাবু রোগী দেখতে বেরিয়ে যাওয়ার পর ভোলা চার ব্যাটারির টর্চ হাতে ডাক্তারবাবুর পিছন পিছন বেরিয়ে পড়েছিল কিনা, তা অবশ্য জানা যায় নি। 




ভিজিটিং কার্ড 

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় 

রোড  ষ্টেশনে  ওভারব্রীজের কাছে  ফেলে  দেওয়া  লেডিজ  ব্যাগটা  দেখে আঁতকে  উঠল  রজত।   কি নেই  সেই  মুখ  খোলা  ব্যাগে।  লিপষ্টিক,  আয়না,  কাজুর প্যাকেট,  এ টি এম হোল্ডার,  একগোছা  চাবি।  ব্যাগ  টাও কানপুর লেদার হাউসের। 

একটি স্মার্ট মেয়ে বলল কেউ ছিনতাই করে, টাকা টাই নিয়েছে হয়তো। কথায় কথায় পদাতিক এক্সপ্রেস সাই সাই করে ধুলো উড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকলো। 

জেনারেল টিকিট কাটা থাকলেও রজত মেয়েটির সাথে রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টে  উঠে  পড়ল।
বেশ  শান্ত স্বভাবের মেয়েটি।  কথাবার্তায় বেশ মিষ্টতা আর মুখে একটা মৃদু হাসি লেগেই আছে । এমন একটা বন্ধু থাকলে বেশ হয়। কখন কিভাবে সময় পার হয়ে গেল বোঝাই গেল না।  সব বিষয় এর ওপর অগাধ জ্ঞান,  বিশেষ করে করোনা অতিমারির অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে একজন ডাক্তারের চেয়ে কিছু কম জানে না।

রজত ইলেকট্রনিকস এর ওপর পড়াশোনা করে, ভালো একটা আই টি কোম্পানিতে কাজ করছে। একটু আধটু গান বাজনার শখ ছিলো ছাত্রাবস্থায়।  এখন সেটা আরও জাঁকিয়ে বসেছে। 

এক বন্ধুর বিয়েতে বাসর জাগতে গিয়ে গান বাজনার মধ্যে ভালো লেগে যায় সুমিতা কে। অসম্ভব ভালো তার গানের গলা। পরে কিভাবে, কিভাবে সুমিতা বসুর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে ফেলে। কতকটা মায়ের অমতেই বিয়ে করে সুমিতা কে।

সব মায়েরাই চায় তাদের পুত্রবধূকে নিজের হাতে দেখে শুনে পছন্দ করে ঘরে নিয়ে আসতে। সেখানে ছন্দপতন হলেই সব ওলট পালট হয়ে যায়।  রজত সুমিতার বিয়েতে আপত্তি করাতেই, সুমিতা রজতের মায়ের প্রতি একটু বেশি রকমের অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকে। রজতের মা শেষ মেশ  ছেলের মুখের দিকে চেয়ে  রাজি হলেও, একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সংসারে দানা বাঁধতে থাকে। 

সেই আগুনে ঘি পড়ে যখন নতুন  পুত্রবধু বিয়ের পরে  ঘরে ঢোকবার সময়, শ্বাশুড়ির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে অস্বীকার করে। 

কোনোভাবে হনিমুন সেরে ফেরার পর পর ই রজত তার ভুল বুঝতে পারে। সুমিতাও তার আপন রূপ ধারণ করে। বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই ঘটে যায়, জীবনের সবচেয়ে বড় অঘটন। 

পদাতিক এক্সপ্রেস ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে, আর রজতের মনে ভেসে উঠছে তার  ফেলে আসা জীবনের টুকরো টুকরো মুহূর্ত।  সুমিতা'র যদি ধন-দৌলত,  টাকা পয়সাই এত প্রিয়, তবে কেন তার জীবনে এসে সব কিছু ভেঙেচুরে শেষ করে দিল।
- আপনি কিছু চিন্তা করছেন,  মেয়েটি বলল।

সম্বিত ফিরে রজত বলল, "কই না তো, এমনই। "

রজত শুধু দুটি  মেয়েকে মেলাতে থাকল। দুজনেই   মুখোমুখি  জানলার পাশে বসে গল্প করতে করতে ফালাকাটা  স্টেশন  পার করল।    রজত ই   আগ বাড়িয়ে   মোবাইল  নম্বর চাইতে মেয়েটি  তার  ভিজিটিং  কার্ড দিল।

নীল কালিতে বাংলায় লেখা নীলাঞ্জনা সেন।   রজত   চোখ  বুলিয়ে  ঠিকানাটা দেখল  " দিন বাজার যৌনপল্লী "।  তলায় একটা মোবাইল  নম্বর। নিজের  চোখ কে  বিশ্বাস   করতে  পারল   না, রজত । আবারও   কার্ডে   চোখ  বুলিয়ে আগাপাশতলা৷ দেখে   নিলো নীলাঞ্জনা কে। 

হ্যাঁ,  সেখানকার স্বাস্থ্য  কর্মী,  নিলাঞ্জনা সেন।  এবার  গল্পে ভাঁটা  পড়ল। সব যেন কেমন ওলট পালট লাগতে লাগলো রজতের।

অনেক  ক্ষণ  নীরবতার  পর, কখনো   চলে  আসবেন,  বলে  বানেশ্বর  ষ্টেশনে  বেনী দুলিয়ে   নেমে  গেল, নীলাঞ্জনা।

ট্রেন   ছাড়তেই  রজত   জানলা দিয়ে দূরে  তাকিয়ে কি  যেন ভাবতে  ভাবতে  নিজের অজান্তেই,   তার বাঁ   হাতের ভিজিটিং  কার্ড টা  দলা পাকিয়ে  ট্রেনের   জানালা  দিয়ে ফেলে   দিল।




 যোগসূত্র
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী

                             একটানা হুইসেল বেজে ট্রেনের কামরাগুলো দুলে উঠতেই দ্রুত ট্রেনের জানলার কাচে হাত রেখে এগিয়ে যেতে থাকে পারমিতা। এতক্ষণ অলি দরজার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। হুইসেল বাজতেই ছুটে গেছে জানলার কাছে। জানলার কাচের ওপারে পারমিতার হাতের পাতা বরাবর অলির হাত, শত চেষ্টা করেও এই মুহূর্তে যাকে ছোঁয়া যাবেনা। গতি একটু বাড়তেই মেয়ের মনমরা মুখ কাচের গায়ে। পারমিতার হাত বাইরে থেকেই ছুঁয়ে নিতে চাইলো অলির মুখ। নিমেষেই এগিয়ে গেল ট্রেন ,সমস্ত মনকেমনকে উপেক্ষা করে। পিছুটান আর অপেক্ষা স্মৃতি ও অভিলাষ হয়ে থেকে গেল মেয়ে ও মায়ের অবাধ্য চোখের জলে। 
                   এবার বহুদিন পর আবার বেশ অনেকটা সময়ের জন্য কাছছাড়া হলো অলি। কোভিড পরিস্থিতিতে কলেজের পাঠক্রমের প্রায় অর্ধেক অনলাইনে হওয়ায় পড়াশোনা, পরীক্ষা, ঘরে বসে ছোটখাটো একটা চাকরির ব্যস্ততা অলিকে পারমিতার সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিল সেই আগের দিনগুলোর মতো।মাঝেসাঝে দুজন মিলে ছোটখাটো কিছু রান্নার রেসিপি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট,প্রায়ই এক থালায় একসঙ্গে খাওয়া, সময় সুযোগ হলে ঘরে বসেই সিনেমা, সিরিজ দেখা, টুকটাক প্রয়োজনে বা বিনা কারণেই একটু বেরিয়ে আসা,  সমস্ত কাজের শেষে রাতে শুয়ে শুয়ে গল্পের জাল বোনা ; সবমিলিয়ে অলিই ছিল পারমিতার শেষ ঠিকানা। অলি বিহীন শূন্য ঘরটার কথা ভেবে মনটা দিশেহারা হলো পারমিতার। প্রায় নির্জন প্ল্যাটফর্ম চত্বরে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে  দূরে দূরে সরে থাকা কুয়াশা মাখা স্টেশনের বাতিগুলোর আবছা মনখারাপের সঙ্গে একাত্ম হলো কোথাও। তারপর, পা বাড়ালো স্টেশনের বাইরের দিকে। 
                              লাগেজগুলোকে ঠিকঠাক সেট করে বেশ কিছুক্ষণ আগেই নিজের জায়গায় বসেছিল অলি। মায়ের বিষন্ন মুখটা চোখে ভাসছিল। কয়েকদিন আগে ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় বাবা এবার স্টেশনে আসতে পারেননি। শহর থেকে বেশ অনেকটাই দূরের এই স্টেশন থেকে মাকে একাই ফিরে যেতে হবে এতটা রাত করে এই প্রথমবার। মুঠোফোন জানান দিচ্ছে নেটওয়ার্কের অনুপস্থিতি। আরেকজনের অনুপস্থিতিতেও খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল অলির। কলেজের সেই শুরুর দিনগুলো থেকেই যাতায়াতের সময় উজ্জয়িনী বরাবর থেকেছে ওর সঙ্গে। এক কলেজ, এক স্ট্রিম,পিজিতে এক রুম, কলেজ- টিউশনে যাওয়া আসা সবটাই একসঙ্গে। ছুটির দিনে নন্দনে পছন্দের ছবি দেখবার, ময়দানে ছবি তুলবার, পুজোর আগে কুমোরটুলিতে গিয়ে ঠাকুর গড়া দেখা, রাস্তায় ফুচকার আনন্দ,  মনের কথাগুলো নির্দ্বিধায় ভাগ করে নেওয়া সবকিছুর সঙ্গীই ছিল উজ্জয়িনী। অলির মতো না হলেও যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করেও অনলাইন পরীক্ষার জেরে সবকিছু ওলটপালট হওয়ায় কলকাতার নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়বার সুযোগ হলোনা উজ্জয়িনীর। একরাশ মনখারাপে আবার নতুন করে আচ্ছন্ন হলো অলি। 
                                জনশূন্য রাস্তাটি ধরে টোটো এগিয়ে চলেছিল। নিরিবিলি এই অঞ্চলে অঘ্রাণের হিমেল রাত সময়ের অনেক আগেই নেমে এসেছে। কেমন একটু গা ছমছম করে উঠছিল পারমিতার থেকে থেকে। হঠাৎ একটি মহিলা কন্ঠ চমকে দিল তাকে.... 
'ভয় করছে আপনার? '
এবার সত্যিই ভয় পেল পারমিতা। বুঝে উঠতে সময় নিল কিছুটা। ততক্ষণে টোটো চালকের আসনে বসা মহিলা কন্ঠ একনাগাড়ে বলে চলেছে.... 
'আমার জীবনের পরিস্থিতি আমাকে আজ এই জায়গায় দাঁড় করিয়েছে। কয়েকবছর আগে দূরারোগ্য এক মারণব্যধি কেড়ে নেয় আমার স্বামীকে। তারপরই আমার পথে নামা। তবে এত রাতে এই রাস্তায় এই প্রথম। আপনাকে মেয়ে নিয়ে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে ছিলাম এখানেই। ছোট শহরে অনেকের মুখই চেনা হয়ে যায়। তাই আপনাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলাম। আপনি খুবই অন্যমনস্ক ছিলেন তখন। মেয়ে চলে যাওয়ায় কষ্টে ছিলেন। তাই জাম্পার ,মাস্ক সবকিছু চাপানো আমাকে খেয়াল করেননি। 

ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে মিশে কথাগুলো উড়ে উড়ে ভেসে আসছিল পারমিতার কানে। মুখে কথা সরছিলনা ওর। অদ্ভুত এক কষ্ট আর অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা দানা বাঁধছিল মনের মধ্যে। আরও ভালোলাগায় মন ছেয়ে গেল  বাকি অধ্যায়টুকু শুনে। 
মহিলা বলে চলেছিলেন.... 
'খুব অবাক হলেন তো? আমার মেয়েও আজ একই ট্রেনে কলকাতা গেল। ওকে পৌঁছোতেই এসেছিলাম।ও আমাদের কষ্টের মূল্য দিয়েছে সেই ছোট থেকেই।এবার বৃহত্তর জগতে ওর পরীক্ষার পালা।একটা স্কলারশিপও পেয়েছে ও।মোটামুটি শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের জীবনে চূড়ান্ত দারিদ্র্যের জন্য যা করে ওঠা হয়নি মেয়েকে নিয়ে তারই স্বপ্নপূরণের আশায় ওর বাবা চলে যাওয়ার পরেও সবরকম ভাবে ওর পাশে থাকবার চেষ্টা চালিয়েছি ।প্রিয়াঙ্কার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে আর কারোর কোনোরকম চলে যাওয়াই দেখতে পারিনা বলে মেয়েটার সঙ্গে প্ল্যাটফর্ম পর্যন্তও যাইনি আর....'
                             গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টটা বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে পারমিতা শুনতে পেল ওনার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা আর অলির ইউনিভার্সিটি, সাবজেক্ট সবই এক। আর একেবারে চমকে উঠলো এটা শুনে যে, ওনার এক আত্মীয় ওনার মেয়ের থাকবার জন্য যে পিজিটি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সেটা অলি যেখানে থাকে সেটাই। সবকিছু মিলিয়ে অফুরন্ত শ্রদ্ধায়, নিমেষে মন ভালো করা এক আবেগে মথিত হচ্ছিল পারমিতা। নিজের জীবনের নানা সময়ের নানা টানাপোড়েন, জীবনযুদ্ধের ঘাত প্রতিঘাত কোথাও গিয়ে একই বিন্দুতে মিলে যাচ্ছিল।অনেক কথা বলতে গিয়ে সব কথা কান্না হয়ে আটকে গেল গলার কাছে। ওর হাত অনেকটা বন্ধুত্বের উষ্ণতা নিয়ে পিঠ ছুঁলো জীবনযুদ্ধে ব্রতী এই সুন্দর মনের সাহসী মহিলার।
                             ঠিক সেই সময় রাতের নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে ছুটে চলা কলকাতাগামী এক ট্রেনের কামরা বাইরের সমস্ত আঁধার, নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে অলি আর প্রিয়াঙ্কার হাত ধরে এক উজ্জ্বল আলোমাখা ঝকঝকে বন্ধুত্বের ছবি এঁকে চলেছিল। 
                           সামনে অনেকটা পথচলা আরও বাকি.... বাকি,অনেকটা পথচেনা.... 





ভালবাসার টান
   বুলবুল দে


'বৌদি ও বৌদি,তাড়াতাড়ি আস দেইখে যাও!'      রান্না  করতে করতে জবার চিৎকার শুনে একটু বিরক্ত হল তমা। জবার এই এক স্বভাব, সামান্য ব্যাপারেই হুলুস্থুলু করে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। প্রথম প্রথম ওর চেঁচামেচি শুনে ভয় পেয়ে তমা হাতের কাজ ফেলে ছুটে যেত তার পর গিয়ে দেখত ওর চিৎকারের কারণটা খুবই নগন্য। তাই তমা রান্নাঘর থেকেই জিজ্ঞেস করল,''কি হয়েছে বলবিতো?''
জবা চেঁচাল, ''হায় হায় গো বৌদি, তোমার আদরের সবুজ পালায়ে গেছে গো!''
''কি বলছিস কি!''বলে তমা বারান্দায় ছুটলো।
গিয়ে দেখে সত্যিই বারান্দায় ঝোলানো খাঁচাটার দরজা খোলা আর তার আদরের টিয়া সবুজ তাতে নেই।
''এ কিকরে হল?আমি তো দরজাটা ভাল করেই আটকে রেখেছিলাম, কি করে পালালো ও?'' বারান্দার চেয়ারটাতে ধপ্ করে বসে পড়ল তমা।
একটা দলা পাকানো কান্না ওর বুক ঠেলে গলায়
এসে আটকে গেল।
'বুঝলানা বৌদি, ও তুমি আকাশের পাখিকে যতই যত্ন আত্তি কর,দানাপানি খাওয়াও, ও কিছুতেই খাঁচায় বন্দি থাকবেনা।' বক বক করতে থাকে জবা।
কিন্ত তমা তো সখ করে কিনে এনে পাখিটাকে
খাঁচায় বন্দি করেনি,একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতে করতে বারান্দার কোণায়
তাকাতেই দেখেছিল একটা টিয়া জবুথবু হয়ে বসে
আছে।খুব সন্তর্পনে কাছে এগিয়ে গিয়েছিল তমা
কিন্ত পাখিটা তাও উড়ে পালায়নি। তমা তাড়তাড়ি ঘরে গিয়ে মুখ ধুয়ে আবার বারান্দায় এসে দেখেছিল পাখিটা একই ভাবে বসে আছে। সে বুঝেছিল পাখিটা নিশ্চয়ই অসুস্থ। পাখিটাকে একটু
জল খাইয়ে হাতে তুলে নিতেই দেখে ওর একটা ডানায় আঘাতের চিহ্ন। তার পর তমার প্রাণপন চেষ্টায় আদর যত্নে, চিকিৎসায়, পাখিটা সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সুস্থ হওয়ার পরও কিন্ত পাখিটা উড়ে যায়নি,বোধ হয় একটু দূর্বল ছিল, ঘরের মধ্যেই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াত।শেষে তমা একটা সুন্দর খাঁচা কিনে এনে ওর থাকার ব্যবস্থা করেছিল।ওর নাম রেখেছিল সবুজ। ওকে তো একটু একটু করে কথাও শেখাতে শুরু করেছিল। বেশ অনেক কথাই শিখে গিয়েছিল। কি ন্যাওটাই না হয়েছিল পাখিটা!
সেই সবুজ তাকে ছেড়ে এইভাবে চলে যাবে এটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।বুকটা তার হু হু
করে উঠল। কিছুতেই আর চেপে রাখতে না পেরে
সে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠল।
    ''বৌদি আর কাইন্দোনা গো কাইন্দোনা, দাঁড়াও
আমি দেখি আশেপাশে কোথাও আছে নাকি পাখিটা।''
তমাকে সান্তনা দিয়ে জবা পাখি খুঁজতে যায়। কিন্ত কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলে,''বৌদিগো আমি সব ঘর বারান্দা ,আশে পাশের গাছ গুলাতেও দেখলাম
কোত্থাও নাই।''
সারা দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসল,
সবুজ আর ফিরল না। তমার মনের ক্ষীণ আশা টুকু
ধীরে ধীরে নিভে গেল। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে ওর
বর সৌম্য সব শুনে ওকে সান্তনা দিয়ে বলল, ''দেখ এই নিয়ে তুমি আর কষ্ট পেও নাগো,আমি জানতাম একদিন না একদিন ও তোমাকে ছেড়ে যাবেই।''
  ''কিন্ত আমি তো সবুজ কে খুব ভাল বাসতাম!''
তমা আবার হাও হাও করে কেঁদে উঠল।'সবুজ কে 
পেয়ে আমি সন্তানের অভাবটাও ভুলে গেছিলাম। আমার সাথেই কেন এমনটা হয়?''
    এক বছর মাতৃত্বের সুখসাগরে ভাসিয়ে তমার একমাত্র সন্তান টুবাই তমাকে ছেড়ে চিরকালের জন্য পরপারে পাড়ি দিয়েছিল। দুঃখে শোকে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল তমা,তার পর সবুজ কে
পেয়ে সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে
আসছিল। তার কেন জানিনা মনে হত, টুবাই  ই বুঝি সবুজ হয়ে তার কাছে ফিরে এসেছে। সেই সবুজ ও তাকে ছেড়ে নিষ্ঠুরের মত চলে গেল!
এই আঘাত তমা সহ্য করতে পারলনা ,একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল। খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিল। ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল সৌম্য। আর বুঝি তমাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবেনা।
ডাক্তার, ওষুধ পত্র কোনও কিছুই আর কাজে লাগল না। তমা নিজেকে একেবারে ঘর বন্দি করে
ফেলল। জাগতিক সমস্ত কিছুই যেন তার কাছে মূল্য হীন হয়ে পড়ল। সৌম্য বুঝিয়ে সুঝিয়ে
অনেক চেষ্টা করল তমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়িয়ে  আসার কিন্ত সবটাই নিষ্ফল হল ।  সমস্ত বাড়িটাই যেন একটা ঘন অন্ধকারে ডুবে  গেল।     এই ভাবে প্রায় তিন সপ্তাহ কেটে গেছে, সৌম্য আজ সকালে একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। উঠেই রোজকার মত বিছানার সামনের জানলাটা খুলে দিতেই একফালি ঝকঝকে রোদ ঘরে ঢুকে পড়ল। বিছানার শুয়ে থাকা তমার চোখে মুখে
রোদ পড়তেই  বিরক্ত হয়ে তমা উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুলো।
সৌম্য তখন বাথরুমে, তমা একই ভাবে শুয়ে আছে
, হঠাৎ তমা চমকে উঠল,  কি! কি শুনল সে!
না না এ নিশ্চয়ই মনের ভুল। নাঃ আবার! এই তো স্পষ্ট শুনছে সে, সেই গলা, সেই ডাক ---
       ''খেতে দেনা, মা খেতে দে ''
            উদ্বেলিত তমা ঘুরে উঠতে গেল,
        ''এসেছিস তুই! সোনা আমার,'' আনন্দের অতিশয্যে হুরমুড়িয়ে উঠতে গিয়ে সে বিছানা থেকে
মাটিতে পড়ে পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেল। কিন্ত সেই আঘাত তো এখন তমার কাছে তুচ্ছ! একটা প্রচণ্ড আনন্দের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়েছে তার দেহে মনে! আবার একটা আশঙ্কাও জাগছে, সে যা ভাবছে সেটা ভুল নয় তো? অবশেষে সে যখন উঠে
দাঁড়িয়ে জানলার দিকে তাকাল তখন তার আশঙ্কা
উদ্বেলতা সমস্ত উধাও হয়ে মনটা এক  শান্ত স্নিগ্ধ সমাহিত সুখ স্রোতে ভরে গেল। "ওই তো সবুজ!আমার আদরের সবুজ! ফিরে এসেছিস তাহলে,
ভুলিস নি আমায়!" তমা দুই হাত দিয়ে সবুজ কে জাপটে ধরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল।
     সৌম্য তখন সেই ঘরে ফিরে এসেছে। পেছন থেকে সব দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল যাক
তার ধারণা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হল ।বনের পাখি সবসময় বনে ফিরে যায়না,সেও তাহলে
ভালবাসার  মূল্য বোঝে! তমার অকৃত্রিম ভালবাসার টান সে অবহেলা করতে পারলনা!



কবিতা 

রেখা

মাথুর দাস


বক্ররেখা বলে আদতে কিছুই নেই,

সরলরেখাগুলি জুড়ে জুড়ে

আমরাই বক্ররেখা বানাই ।

যে কথা সহজেই বলা যায় বোঝানো যায়

তাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জট পাকিয়ে

অকারণ তর্ক-ছুরি শানাই ।


বক্ররেখা বলে আদতে কিছুই নেই,

সরলরেখাও কি ততটা সরল,

যা আমরা ভাবি ?

আতসকাঁচে দ্যাখো,

সে-ও কেমন ভেঙে ভেঙে গেছে,

বিন্দুরা বসে আছে কখনও জোটবদ্ধ,

কখনও বা দূরে দূরে, ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে ।


বক্ররেখা বলে আদতে কিছুই নেই,

এমন কি সরলরেখাও ;

বিন্দুর অবস্থানে থেকে আমরাই

কখনও সরল কখনও বক্র হই ।




গল্পের পাতা
মহাজিস মণ্ডল

হেমন্তের ঘাসে ঘাসে মিশে থাকে শিশিরের স্বপ্ন
এবং জীবনের অনন্ত ভালবাসার রঙ
সবুজের জানালা ছুঁঁয়ে যায় আকাশের গান
শীতের ডানায় ডানায় পাখিরা অবিশ্রান্ত উড়ে
আলোর ঘাটে ঘাটে অনুক্ষণ প্রেমের নৌকা বয়
আর চারপাশে আনন্দের বাতাস গল্পের পাতা সাজায়... 




আমার মেলা দর্শন 
উৎপলেন্দু পাল 

আজ মেলায় প্রচন্ড ভীড় 
আমি নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছি একা 
এগিয়ে যাবার সাহস হারিয়েছি একেবারেই , 

মুহুর্তের জন‍্য মনে হলো 
ভেসে যাচ্ছি বিশাল জনসমুদ্রে 
সমস্ত শক্তি সমস্ত অবলম্বন হারিয়ে ফেলে , 

ভীড় এগিয়ে চলেছে দ্রুত 
আমার অস্তিত্বকে উপেক্ষা করে  
ভরা কোটালের ফেনিল সমুদ্রস্রোতের মতো , 

আমি যতোই চেষ্টা করছি  
আমার অস্তিত্বকে একটু জানান দিতে 
আমায় উপেক্ষা করে ততোই এগিয়ে চলে ভীড় , 

এই জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে 
একটা প্রশ্নেই আজ এ হৃদয় তোলপাড় , 
পৃথিবীর সবাই কি আমার মতোই ভীড়ে একা ? 



স্কুলবাড়ি
        রীনা মজুমদার

ভিজে ওঠে দেওয়াল অবিরাম বর্ষণে
পড়ন্ত বিকেল সুখানুভূতির আঁচলে
 ঠায় দাঁড়িয়ে আছে একটিই বাড়ি, 
     ‌স্কুলবাড়ি !
যেন, খনির গভীর অন্ধকারে
  একখন্ড হীরক দ্যুতি! 
থাকে আজীবন অমলিন।
নিয়মানুবর্তিতার আদর্শ কারিগর
সময়ের প্রস্ফুটিত বিকাশের ঘর 
সে বাড়ি, স্কুলবাড়ি!
সবুজ মাঠে দলবেঁধে রৌদ্রস্নান
 বর্ষায় বৃষ্টি দিনের আহ্বান।

সব সাক্ষীর ওই বাড়ি, স্কুলবাড়ি!
ঋতু জুড়ে রং বদলায় স্বরলিপি 
কৃষ্ণচূড়া তার রাঙা পাপড়ির 
চিরকুট ঝরায় ! সে এক অন্য আলো
নবম শ্রেণী! প্রথম শাড়ি! 
প্রথম অনুভূতি! নিয়ম ভাঙার খেলা !
 একটু প্রেম! প্রথম হাসি, প্রথম কান্না
 যেন, প্রথম সবকিছুর প্রাণ পায় জীবন
       থেকে যায় অমলিন।

জীবন যেখানে শ্বাশত সুন্দর
রঙিন স্বাক্ষর আঁকে..
 একটিই সে বাড়ি, স্কুলবাড়ি।




 পিছুটান
শ্রাবণী সেনগুপ্ত

"ও ময়না,যাস কই মা?"
"অই হাসান চাচার বাড়ি গো ঠাম্মা-
কমলি গাইটা চরতে চরতে ওদিক পানেই গেল।"
"আরে যা যা দ্যাখ শিগগির-
ওদের ফুলগাছে মুখ দিলেই চিত্তির,
যদিও হাসান কিছুই বলেনা,
মানুষ হিসেবে নেইতো তুলনা-
তবুও শখের জিনিষ নষ্ট,
মনের মধ্যে হবে তো কষ্ট।"
ময়না ছুটল চাচার বাড়ি।
উঠোনে তখন চাটাই পেতে
মাসুদ ভাই বসেছিল মুড়ি খেতে।
ময়নাকে দেখে চাচী তাড়াতাড়ি
স্টিলের বাটিতে দিল গুড়মুড়ি,
সেই খেয়ে খেল এক গ্লাস জল।
"কমলি -এবার তাড়াতাড়ি চল
দেরি হলে পিঠে পড়বে দু'ঘা।"
চাচী বলে-"মাসুদ,তুইও যা না-
মেয়েটাকে একটু এগিয়ে দে না।"
গোধূলিবেলায় দু'জনে চলল,
শেষ আলোটুকু সঙ্গ ধরল-
এই ছবিখানিই ছিল ওইখানে
কাঁটাতার দিল যন্ত্রণা মনে।
দেশ ভাগ দূরে তাদের পাঠাল
একে অপরের সঙ্গ হারাল।
কিন্তু আজও গোধূলিবেলায়
পিছুটানের সে রেশ রয়ে যায়।



হেমন্তের পেটে নবান্ন 
মজনু মিয়া 

যখন যৌবন ছিল সবুজ কচি লকলকে
ফুলেফেঁপে ধীরে ধীরে যৌবন পূর্ণ হলো।
গর্ভবতী হয়ে মোটাতাজা রূপে শক্ত হয়ে-
ভিটামিন সংগ্রহ করে নিলো দাতা কৃষক। 

কার্তিক নিয়ে এলো হেমন্ত রূপ নিলো হলুদ-
সবুজের মিশেল, প্রসব শুরু হয়ে গেলো।
নবান্ন ঘর দোরের নিকটে এলো প্রসব শেষ, 
সোনালি রূপ নিয়ে হেমন্ত নবান্নে চলে গেলো।

সোনালি ধান এখন কৃষকের ঘরে নবান্নের পিঠা,
এ যেন চিরকালিন হেমন্তে নবান্নের রূপ।



প্রেম কয়েদী
রোমানুর রোমান


এটা মিথ‍্যে- ওটা সত‍্যি- ভুলভ্রান্তি,
কিছু বন্দি- নিরাপত্তা- আস্থার শান্তি।
কর্ম বিশ্বাসে অগাধ ভালোবাসা হয়ে থাকে,
কিন্তু অপরাধে শাস্তিসম প্রায়শ্চিত্তে ডাকে।

আমি অধিক প্রীতির কাঙ্গাল প্রিয় অনুরাগী,
একটু ভুলে বিরাম নয়- উপলব্ধিতে নিশি জাগি।
আমি বন্দি হতে  রাজি- শাস্তি পেতে রাজি,
সমর্পণে নিশ্চিত জানি- তুমি সাজা মওকুফে রাজি।

বুকের ভেতর বন্দি করে আগলে রেখো যদি,
তোমার খাঁচায় থাকবো চির- হয়ে প্রেম কয়েদী।



কখন যেন
দেবর্ষি সরকার

একটা গরম দীর্ঘশ্বাস এসে পড়লো পৃথিবীর মাটিতে।
ধেয়ে চলল মানব জীবনের গলিতে।
ঝড়ের নিনাদে মন উঠলো কেঁপে।
তাকে ব্যালেন্স করার জন্য, শুরু হলো অঝোরে কান্না।
গাছেরা ঔষধ পেল।
একদিন হঠাৎ কান্না থামল, কিন্তু রেখে গেল একটা নীল দাগ।
সাদা তুলো,
আকাশের নিচে আমি।
হাওয়া বইলো,
কিন্তু টের পেলাম না।
গাছেরা পাতা ঝরালো,
নিঃশব্দে।



মেকি - শহর
               গার্গী ঘোষ


এ শহর স্বপ্ন সাজায়  রোজ
ইঁটের ফাঁকের বট গাছটাও
করে জীবন সুখের খোঁজ।
হৃদয় ছোঁয়া প্রেমের মাঝে
ভালোবাসার স্বপ্ন সাজে ।
তবু সুখ খোঁজে সে দালান -ইমারতে 
জীবন চলে গোলকধাঁধার পথে।
বাস্তবতার গোপন আঁতাত
সম্পর্কের  ঘাত- প্রতিঘাত-
অবিশ্বাসের স্তূপের পরে
বিরহ বাঁশি বিষাদ সুরে।
অভিমানের মেঘ জমেছে
ইঁট, কাঠ , পাথরের খাঁজে।
দুটি হৃদয়ের অন্তঃপুরে-
হঠাৎ কখন ছেদ যে পড়ে!
অনুভূতিরা মৃতপ্রায় আজ
কেউ কি রাখে খোঁজ?
এ শহর শুধুই স্বপ্ন সাজায়  রোজ।



সুখটান
   ভাস্বতী রায়

হঠাৎ একটা মুহূর্ত
যেন ভীষণ আপন কারো স্পর্শ
কৌট ভরা বিষন্নতারা
ডানা মেলল নীল আকাশে
ব্যস্ত দুপুরের স্বস্তির নিঃশ্বাস 
আছড়ে পড়ল
উন্মুখ নদীর বুকে
বেসুরো তানপুরাটা হঠাৎই
বেজে উঠলো সুরের রিনিঝিনিতে
বিনিদ্র রাতেরা
ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল
নরম ঘাসের চাদরে
শুধু একটা ছোট্ট মুহূর্তে
আটকে থাকল সুখটান।।




একা
অভিমন্যু

অনুভবে আছো তুমি সারাক্ষণ
ভাবনার সমুদ্রে তরঙ্গরাশিতে মিশে,
নয়নতারায় স্বপ্নগুলোর প্রতিফলন হয়
বালুচরে হেঁটে হেঁটে চলেছে সময় একা...
নিস্তব্ধ ঝিকিমিকি জোছনায় ডুবে যায়
তারপর অনন্তের বুদ বুদ ওঠা ভালোলাগা
লিপি শব্দের আনাগোনা বক্ষ জুড়ে,
চেয়ে চেয়ে থাকা আনমনে অভিমানে
কখনো কি আঙুল ছুঁয়ে দেখেছো !

হারিয়ে যাওয়া এক ডিঙির খোঁজে
আজও পথে ঘাটে গোধূলির রাঙা হেমন্তে
বার বার অস্ফুট বলে উঠি কে আমি
ভালোবাসা শুধু বিদ্রুপ তীর্যক মন্তব্য করে !

কেন ? কেন ?
সম্পর্কের টানাপোড়েনে আজ দগ্ধ হৃদয়
কেন সহানুভূতি দূরে সরে যায় !




অগন মগনে
বিজয় বর্মন

শ্রাবণ হয়তো জানতো না,আমি যে, সেই,
আজ হেমন্তের সোনালী রঙ্গমঞ্চে,
আমিও সামিল হলুদ ঝলমলে।

সামলে রাখতে,দেওয়াল তুলেছি,
নিঃস্ব হয়েছি ক্ষতি কি !
আগামী কে বাঁচিয়ে রাখার দায় টুকু রেখে যাই,

প্রদীপের ইন্ধন জুগিয়ে দিও,
আলোয় উদ্ভাসিত হবে সুপ্ত উৎসব,
সলতা পুড়ে ছাই হবেই, তো।

পাতান উড়িয়ে দেখো,
সোনার দানা করছে চকচক,
একটু বাতাস দিও, সরে যাব নিঃশব্দে।

তুমি অভিমানী হও,
ক্ষতি নেই, আসন্ন শীতে খসে পড়ে যাব,
বসন্ত সাথে, তুমি থাকবে তো ?





ছবি- তানভী দাম






















মুজনাই অনলাইন অগ্রহায়ণ সংখ্যা ১৪২৮

No comments:

Post a Comment