চেনা পৃথিবী একটু একটু করে আবার ছন্দে ফিরছে। স্বাভাবিক হচ্ছে জীবনযাত্রা। এই মুহূর্তের সবচেয়ে খুশির কথা হল, শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন আবার শুরু হওয়া। সব শিক্ষার্থী এখনও বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় অনুমতি পায় নি ঠিকই, তবু আশা করা যেতে পারে, সেই অবস্থাও কেটে যাবে দ্রুত। অতিমারির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে শিশু-কিশোরদের ওপর। এভাবে ঘরবন্দি ও শ্রেণিকক্ষের পাঠবিহীন হয়ে থাকায় তাদের মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হল, তার থেকে তাদেরকে জীবনমুখাপেক্ষী করে তোলাই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষা আমাদের বড়দের সকলের। এবারের সরস্বতী পুজোর তাৎপর্য তাই আলাদা। বিদ্যার দেবীর কাছে আমাদের চাওয়া হোক আমরা সবাই যেন প্রকৃত মনুষ্যত্বের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারি, স্বাভাবিক-সুন্দর জীবনকে এগিয়ে নিয়েযেতে পারি।
রেজিস্ট্রেশন নম্বর- S0008775 OF 2019-2020
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৮
এই সংখ্যায় আছেন যাঁরা
অনিন্দ্য সাঁতরা, মাথুর দাস, চিত্রা পাল, স্বপন দত্ত, পার্থ বন্দোপাধ্যায়, গৌতম চক্রবর্তী,
বটু কৃষ্ণ হালদার, নারায়ণ ভৌমিক, প্রতিভা পাল, বিজয় বর্মন, রীনা মজুমদার,
প্রনব কুমার কুন্ডু (রুদ্র), সংগীতা মিশ্র, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, মৌসুমী চৌধুরী, মনোমিতা চক্রবর্তী, সাগরিকা কর্মকার, মজনু মিয়া, অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী, চন্দ্রানী চৌধুরী, সোমা দে, অলকানন্দা দে, দেবর্ষি সরকার, আকাশলীনা ঢোল, লক্ষ্মী বিশ্বাস, বিপ্লব গোস্বামী, অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত,
সারণ ভাদুড়ী, অনুস্মিতা বিশ্বাস, তানভি দাম, অদ্রিজা বোস
মুজনাই অনলাইন মাঘ সংখ্যা ১৪২৮
স্মরণ
বাঙালির অত্যন্ত জনপ্রিয় নাট্যশিল্প মাতৃহারা হল:_ প্রসঙ্গ শাঁওলি মিত্র
বটু কৃষ্ণ হালদার
অবশেষে কোমল হৃদয়ে পাথর চেপে,যে সংবাদ টা মেনে নেওয়া গেলো না, তা হলো নাট্য সম্রাজ্ঞী শাঁওলি মিত্রের জীবন অবসান।মঞ্চের শেষ আলো নেভার আগে যবনিকায় ছেদ পড়ে গেলো।এ যেন নাটকের মঞ্চ নাটক শুরু হওয়ার আগেই তাল কাটলো।অতি মারির বিধ্বংসী করাল গ্রাসে শুনশান শ্মশানে যেন কোলাহলের বন্যা।এক মহীরুহ নক্ষত্রের ছন্দপতন ঘটে গেল।বুঁজে যাওয়া খরস্রোতা নদীর বুকে,টিম টিম করে জ্বলতে থাকা লন্ডনের বাতিটা কেমন দপ করে নিভে গেলো। নাট্যজগতে একরাশ হতাশা শূন্যতার সৃষ্টি হল। চাইলেও এ শুন্যতা আর পূরণ হবার নয়।
শাঁওলি মিত্র একজন বাংলা থিয়েটার ও সিনেমার অভিনেত্রী।প্রখ্যাত অভিনেত্রী ও নাট্যকার
তিনি ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রে বঙ্গবালা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রের কন্যা এবং তার পিতামাতাও থিয়েটার ব্যক্তিত্ব ছিলেন।সেই সূত্র ধরেই এই পথে হাঁটা।তবে তিনি পিতা মাতার মতই একই গুণের অধিকারী ছিলেন।২০১১ সালে তিনি রবীন্দ্র সার্ধশত জন্মবর্ষ উদ্যাপন সমিতির একজন চেয়ারপার্সন ছিলেন।
২০২০ সালের নিজের ৭২ বছর বয়সে স্বজ্ঞানে তিনি তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে সরকারিভাবে শীলমোহর লাগান।যেন কোনওভাবে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে যেন হাসপাতালে ভর্তী করা না হয়,তাঁকে যেন আর কোনও কষ্ট দেওয়া না হয়।শেষ সময়টুকু বাড়িতেই শান্তিতে কাটাতে চান তিনি। নিজের শেষ ইচ্ছা পত্রে তিনি উল্লেখ করেই বলেছেন যে, "আমার শেষ ইচ্ছাটুকুও আমার পিতাকে অনুসরণ করেই। মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব আমার শরীরে সৎকার সম্পন্ন করা হয়। এই শরীরটির প্রদর্শন করার আমার যথেষ্ট সংকোচ, ফুলভারের কোনও প্রয়োজন নেই। অগোচরেই যেন শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়"এই শেষ ইচ্ছাপত্রে তিনি তাঁর প্রিয় দর্শকদের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখে গেছেন, প্রচুর মিথ্যাা আমার উদ্দেশ্যে বর্ষিত হওয়া সত্ত্বেও আমি আমার পাঠক, আমার দর্শকদের থেকে যথেষ্ট ভালোবাসা, অসীম শ্রদ্ধা পেয়েছি। আর তা পেয়েছি বলেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্ম করার প্রেরণা পেয়েছি। আমার অন্তরে সেই ভালোবাসা আমার একান্ত আপন। মৃত্যুর পরেও যদি কোনও পথ থাকে সেই পথ চলার পাথেয় এই ভালোবাসা।
তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী, ফুলে ফুলে সজ্জিত দেহ ভারী না করে সন্ধেতেই শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে।শেষ ইচ্ছাপত্রে তিনি বলেছিলেন,শেষকৃত্যের পরেই যেন সবাইকে খবর জানানো হয়।তাঁর শেষ ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়েছেন প্রিয়জনরা।বিকেল ৩.৪০-এ মৃত্যু হয় তাঁর।মৃত্যু কালীন বয়স হয়েছিল৭৪ বছর।শাঁওলি মিত্র বাবা শম্ভু মিত্রও একই ধরনের ইচ্ছাপত্র করে গিয়েছিলেন।তবে ডাকঘরে অভিনয় করা সেই ছোট্ট মেয়েটার তাঁর শেষ ইচ্ছেতেও যে বাবা শম্ভু মিত্রের সঙ্গে এতটা মিল থাকবে তা কেউ কখনও ভাবেনি।
যে তথ্য নাট্য জগতের অনেকের জানা,তবুও পাঠকদের নবাগত পাঠক দের উদ্দেশে এখানে নতুন করে নাটক পরিসরে কি তা একটু সংযোজন করলাম মাত্র।আমার স্বল্প পরিসরে তা দিয়ে পাঠক কে সন্তুষ্ট করার প্রয়াস মাত্র।তবে এর আক্ষরিক অর্থ অনেক বৃহৎ হতে পারে তবে সে বিষয়ে আমার জ্ঞান হয়ত ক্ষুদ্র হতে পারে।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে বিশ্ববাসীর বেশি সংখ্যক জনগণ কোন না কোন দেশের আওতায় পরাধীন ছিলেন। প্রয়োজনের তাগিদে সময়ের সাথে সাথে মানসিকতায় আসে পরিবর্তন।পরাধীনতা বন্ধন থেকে মুক্ত হতে চলতে থাকে মহাসংগ্রাম,লড়াই। অবশেষে দাসত্ব প্রথার অবলুপ্তি ঘটতে থাকে। আধুনিক সভ্যতার বিকাশ ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। এসময় ৮ ঘণ্টা কাজ ৮ ঘণ্টা বিনোদন ৮ ঘন্টা বিশ্রামের জন্য শুরু হয় লড়াই। দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে প্রতিবাদীদের রক্তের বিনিময়ে আসে ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিনোদন, ৮ ঘন্টা বিশ্রাম। একথা আজ আমরা সবাই ভুলে গেছি। ৮ ঘণ্টা বিনোদন এর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হল নাটক।
সাহিত্যের একটি বিশেষ ধরণ, বা নাটক হলো এক অভিনবত্ব শিল্প কলা। সাধারণত একটি লিখিত পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করে অভিনয় করে নাটক পরিবেশিত হয়ে থাকে।নাটকে স্থান, সময় ও পরিবেশের বর্ণনা ছাড়াও সংলাপ লেখা থাকে। ত্রিমাত্রিক আয়তনে দর্শকদের সামনে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাধ্যমে সমাজের কিছু ঘটনা বা কোন একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে যোগাযোগ মাধ্যম সৃষ্টি করা হয়,তাকে নাটক বলে।নাটক শুধু মাত্র অভিনয় নয়,এতে জীবন শৈলীর নানান চিত্র ফুটে ওঠে। মঞ্চে অভিনেতারা নানান অঙ্গভঙ্গিও অভিনয় করে একটা চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। কখনো হাসি কখনো কান্না ভরিয়ে তোলে পরিবেশ। মঞ্চের সামনে দর্শক মঞ্চস্থ অভিনয় দেখে কখনো উৎসাহিত হয়ে বা অশ্রু নয়নে হাততালি দিয়ে ওঠে। এই নাটকের শ্রেণীবিভাগ কোনো বিশেষ বিষয়কে ভিত্তি করে করা হয়নি। নানারকম বিষয়বস্তু অনুসারে নাটককে নানাভাবে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে। নাটকের শ্রেণীবিভাগগুলো এরকম:_ ভাব সংবেদনা রীতি অনুসারে ট্রাজেডি,কমেডি, ট্রাজি-কমেডি ,মেলোড্রামা, ও ফার্স।
বিষয়বস্তুর উৎসরীতি অনুসারে পৌরাণিক ঐতিহাসিক,ঐতিহাসিককল্প চরিত্রমূলক, সামাজিক ,পারিবারিক,উপকথাশ্রয়ী ও কাল্পনিক।
গ)বিষয়বস্তুর প্রকৃতি অনুসারে ধর্মমূলক, নীতিমূলক, আধ্যাত্মিক ,রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রেমমূলক, দেশপ্রেমমূলক,সমাজরীতিমূলক, ষড়যন্ত্রমূলক, রোমাঞ্চকর দুঃস্বাহসমূলক ও অপরাধ আবিষ্কারমূলক প্রভৃতি
ঘ) উপাদানযোজনা বৈশিষ্ট্য অনুসারেস গীতিনাট্য বা অপেরা, যাত্রা, নৃত্যনাট্য, নাটক বা ড্রামা
ঙ) আয়তন বা অঙ্কসংখ্যা অনুসারে, মহানাটক, নাটক,নাটিকা,একাঙ্কিকা
চ) গঠন রীতি অনুসারে,ক্লাসিক্যাল,রোমান্টিক ,দৃশ্যাবলী
ছ) রচনারীতি অনুসারে,পদ্যনাটক,গদ্যনাটক,গদ্য-পদ্যময় নাটক
জ) উপস্থাপনারীতি অনুসারে,বাস্তবিক নাটক, ভাবতান্ত্রিক নাটক,রূপক নাটক,সাংকেতিক নাটক ,এক্সপ্রেশানিস্টিক নাটক
ঝ) উদ্দেশ্য অনুসারে,ঘটনামূখ্য (মোলোড্রামা), চরিত্রমূখ্য (চরিত্রনাট্য),রসমূখ্য (রসনাট্য) ও, তত্ত্বমূখ্য (তত্ত্বনাটক)
নাটক কি বর্তমান সমাজে তা বোধ হয় বিশেষ করে বলার অপেক্ষা রাখে না । নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান এই অন্তর্নিহিত শব্দটির মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষকে বহুমাত্রিক গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত করেছে বিশ্বের দরবারে। ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষজনদের ভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেই অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব চরিত্র হলো নাটক। সাহিত্য রচনার একটি বিশেষ শ্রেণী হলো এই নাটক। প্রাচ্য ও নাট্যশাস্ত্র একই দৃশ্যকাব্য বলে অভিহিত করেছেন গ্রিক ভাষা থেকে আগত ড্রামা শব্দটির অর্থ হলো অ্যাকশন অথবা কিছু করে দেখানো।বাংলা নাটক নাট্য নট-নটী প্রভৃতি শব্দ থেকে।শব্দ উদ্ভূত হয়েছে নট ধাতু থেকে যার অর্থ নাড়াচাড়া করা নড়াচড়া করা অর্থাৎ নাটকের মধ্যে এক ধরনের গতিশীলতা রয়েছে যা একটি ত্রিমাত্রিক শিল্প কাঠামো গড়ে তোলে। এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য যে বর্তমান সময়ে নাটক পরিবেশন-এর জনপ্রিয় মাধ্যম টেলিভিশন হলেও মঞ্চস্থ নাটক এর প্রকৃত যথার্থ পরিবেশ স্থল। প্রকৃতপক্ষে নাটকের মধ্যে একটি সমষ্টিগত শিল্প প্রয়াস সম্প্রদায়ভুক্ত থাকে। এতে অভিনেতারা দর্শকদের উপস্থিতিতে মঞ্চে উপনীত হয়ে গতিময় মানব জীবনের কোনো এক বা একাধিক বিশেষ ঘটনার প্রতিচ্ছবি অভিনয় মাধ্যমে উপস্থাপনা করেন। সাধারণভাবে নাটক যে চারটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেয় তা হল কাহিনী বা প্লট, চরিত্র, সংলাপ এবং পরিপ্রেক্ষিত। কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং সহায়ক বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপ কে আশ্রয় করে উপস্থাপিত হবার প্রয়াস পায় নাটকে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নৃত্য গীত, আবহসংগীত, শব্দ সংযোজন, আলোকসজ্জা, মঞ্চকৌশল প্রভৃতি।
দুরন্ত সময়, প্রতিযোগিতার পাল্লা ঊর্ধ্বমুখী, বিশ্ব আজ তালুবন্দি, সময় কি আজ মানুষ লাগাম দিতে পারেনি কর্মমুখী ব্যস্ত জীবনে মানুষ হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের জীবনের বৈচিত্র পিছনে ফিরে তাকানোর অবকাশ নেই আজ কারো। ফেলে আসা শৈশব আজ পিছন থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। বৈচিত্র্যময় জীবন কাহিনীতে মানুষ মিথ্যা নাটক করতে করতে ভুলে গেছে সত্যি নাটকের দিনগুলো। ভিন্ন সম্প্রদায়ে দেশ ভারত বর্ষ, বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় সামাজিক উৎসব লেগে থাকে, বিশেষ করে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ, গ্রাম বাংলার আত্মার আত্মীয়ও হল। এই উৎসবকে ঘিরে লেগে থাকত উদ্দাম উদ্দীপনা উত্তেজনা। দূর-দূরান্তের মানুষজন জড়ো হতে উৎসবকে কেন্দ্র করে আপন জন বন্ধু বান্ধব একে অপরের আত্মিকতায় ভরিয়ে তুলতে মেলা প্রাঙ্গণ। সেই মেলায় হত নাটক, যাত্রাপালা, পুতুল নাচের গান আরো নানান সামাজিক অনুষ্ঠান। নাটকের মঞ্চ হল অভিনেতার প্রথম প্রতিফলন। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বহু নামীদামী শিল্পী যারা অভিনয় মঞ্চে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সাড়া বিশ্বে। একসময় কলকাতাও নাটক নিয়ে থেমে থাকেনি, বহু নামিদামি শিল্পীদের আনাগোনা ছিল নাটক পাড়ায়। বহু নামিদামি শিল্পীদের জীবন অতিবাহিত করার প্রধান উৎস ছিল নাটক। বহু শিল্পী জীবনের মূল পন্থা হিসেবে। অনেক নামীদামী শিল্পী তার জীবন অতিবাহিত করেছে এই নাটকের মধ্য দিয়ে। নাটকের উন্মাদনা কে ঘিরে তৈরি হয় কলকাতার বুকে অনেক বড় বড় মঞ্চ। শিশির মঞ্চ, তপন থিয়েটার হল, দাশুমতি ভবন, নন্দন, উৎপল দত্ত মঞ্চ, আরো অনেক বড় বড় মঞ্চ। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, আর সেই শিক্ষার প্রথম মঞ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়, তেমনই অভিনয় জগতের প্রথম ধাপ হলো নাটক। বইকে ঘিরে উন্মাদনা যেমন নেই বইপ্রেমীদের, আজ বই এর জন্যে বই মেলায় ভিড় লাগেনা। তেমনই বর্তমানে নাটক নিয়ে উন্মাদনা আর নেই নাটক পাড়ায়। মানব জীবন আটকে গেছে হাতের তালুর মধ্যে। বাস্তব জীবন ছেড়ে কৃত্রিম জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এর থেকে মুক্তির উপায় নিজেদের বের করতে হবে। এর জন্যে স্মার্ট ফোন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলে মনে হবে আদিম মানুষদের ভিড়। সবাই ঝুঁকে কি যেন খুঁজছে স্মার্ট ফোনের ভিতর। তাহলে বুঝবো পৃথিবীর আদিম মানব জীবনে ফিরে যেতে হয় তো কি আর বেশি দূরে নয় ?
পতিতালয়ের মাটি কিংবা পদ্মফুল ছাড়া যেমন দুর্গাপূজা হয় না, ঠিক তেমনই নাট্য সংস্কৃতির একমাত্র শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলেন শাঁওলি মিত্রের পিতা এবং মাতা শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র।যে তীর্থ ভূমির একটু দর্শন পাবার জন্য মানুষ লক্ষ মাইল পথ রক্ত পায়ে হেঁটে নির্দ্বিধায় চোখ বন্ধ করে পার হয়,সেই পূণ্য ভূমির নাম শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র।কয়েক লক্ষ শিষ্য তাঁদের দেখানো পথের দিশারী হয়ে জীবন যাপন করছে।এই সংস্কৃতি কে নিজেদের কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছে।যাঁরা বাংলার নাট্য সংস্কৃতি কে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে নিয়ে গেছেন,তাদের যোগ্য উত্তরসূরি শাওলি মিত্র সেই ধারাকে। এ যাবৎ বহন করে নিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও ধৈর্যের সাথেই।তাই শাওলি মিত্র কে স্মরণ করার সাথে তাঁর পিতা ও মাতা কে স্মরণ করা হলো গঙ্গা জলে দাঁড়িয়ে গঙ্গা পূজা করার লোভ টা সম্বরণ করতে পারলাম না।এক সঙ্গে ত্রয়ী কে স্মরণ করতে পারা টা আমার লেখনীর সার্থকতা।পাঠক কুল ও অনেক টা সমৃদ্ধ হতে পারবে আশা করা যায়।
শম্ভু মিত্রের জন্ম কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে মাতামহ ডাঃ আদিনাথ বসুর গৃহে। তাঁর পিতার নাম শরৎকুমার বসু ও মাতার নাম শতদলবাসিনী দেবী। শম্ভু মিত্রের পৈত্রিক নিবাস ছিল হুগলি জেলার কলাছাড়া গ্রামে। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে বিদ্যালয় শিক্ষা সমাপ্ত করে ভরতি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তবে কলেজের পাঠ সমাপ্ত করেননি। ১৯৩৯ সালে রংমহলে যোগদানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চে তাঁর পদার্পণ। পরে যোগ দিয়েছিলেন মিনার্ভায়। নাট্যনিকেতনে কালিন্দী নাটকে অভিনয়ের সূত্রে সে যুগের কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে আলাপ হয়। পরবর্তীকালে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর প্রযোজনায় আলমগীর নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন। কিন্তু এই সময় থেকেই শিশিরকুমারের থেকে আলাদা সম্পূর্ণ নিজস্ব এক নাট্যঘরানা তৈরিতে উদ্যোগী হন শম্ভু মিত্র।
১৯৪২ সালে ফ্যাসিবিরোধী সংঘের সঙ্গে পরিচিত হন শম্ভু মিত্র। ১৯৪৩ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশির অনুপ্রেরণায় যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে। ১৯৪৫ সালের ১০ ডিসেম্বর গণনাট্য সংঘে কাজ করার সময়ই প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন শম্ভু মিত্র।
শম্ভু মিত্র (২২ অগস্ট, ১৯১৫ – ১৯ মে, ১৯৯৭) ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যজগতের এক কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পী ও নাট্য ও চলচ্চিত্র অভিনেতা। ১৯৩৯ সালে বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চে যোগ দেন। পরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য হন। ১৯৪৮ সালে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন নাট্যসংস্থা বহুরূপী। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বহুরূপীর প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সফোক্লিস, হেনরিক ইবসেন, তুলসী লাহিড়ী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট নাট্যকারের রচনা তাঁর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। শম্ভু মিত্রের স্ত্রী তৃপ্তি মিত্র ও কন্যা শাঁওলী মিত্রও স্বনামধন্য মঞ্চাভিনেত্রী। শাঁওলি মিত্রের নাট্যসংস্থা পঞ্চম বৈদিকের সঙ্গে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন শম্ভু মিত্র। তাঁর পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল নবান্ন, দশচক্র, রক্তকরবী, রাজা অয়দিপাউস ইত্যাদি। তাঁর রচিত নাটকের মধ্যে চাঁদ বণিকের পালা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।
বহুরূপীর প্রযোজনায় শম্ভু মিত্র পরিচালিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল: নবান্ন, ছেঁড়া তার, পথিক, দশচক্র, চার অধ্যায়, রক্তকরবী, পুতুল খেলা, মুক্তধারা, কাঞ্চনরঙ্গ, বিসর্জন, রাজা অয়দিপাউস, রাজা, বাকি ইতিহাস, পাগলা ঘোড়া, চোপ আদালত চলছে ইত্যাদি। চাঁদ বণিকের পালা তাঁর রচিত একটি কালজয়ী নাটক। এই নাটকের প্রযোজনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি এই নাটক পাঠ করেছেন এবং রেকর্ডও করেছেন। তাঁর রচিত অন্যান্য নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: উলুখাগড়া, বিভাব, ঘূর্ণি, কাঞ্চনরঙ্গ ইত্যাদি। এ ছাড়া গর্ভবতী বর্তমান ও অতুলনীয় সংবাদ নামে দু’টি একাঙ্ক নাটকও রচনা করেন। নাট্যরচনা ছাড়াও শম্ভু মিত্র পাঁচটি ছোটগল্প ও একাধিক নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘কাকে বলে নাট্যকলা’ ও ‘প্রসঙ্গ: নাট্য’ দু’টি বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ।
শম্ভু মিত্র ছিলেন বাংলার এক স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পী। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের মধুবংশীর গলি কবিতাটি আবৃত্তি করে তিনি জনসমাজে বিশেষ সাড়া ফেলেছিলেন। রক্তকরবী, চার অধ্যায়, রাজা অয়দিপাউস, তাহার নামটি রঞ্জনা, ডাকঘর, চাঁদ বণিকের পালা ও অয়দিপাউসের গল্প তাঁর স্বকণ্ঠে রেকর্ড করা নাট্যপাঠ। এ ছাড়া শম্ভু মিত্র (কবিতা আবৃত্তি), রবীন্দ্রনাথের কবিতাপাঠ, দিনান্তের প্রণাম তাঁর প্রসিদ্ধ বাংলা কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড।
নাট্যাভিনয়ের সূত্রে চলচ্চিত্র জগতেও পা রেখেছিলেন শম্ভু মিত্র। খাজা আহমেদ আব্বাসের পরিচালনায় নির্মিত হিন্দি ছবি ধরতি কে লাল-এর সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি। অভিনয় করেছেন মানিক, শুভবিবাহ, ৪২, কাঞ্চনরঙ্গ, পথিক, বউ-ঠাকুরাণীর হাট প্রভৃতি চলচ্চিত্রে। অমিত মিত্রের সঙ্গে একদিন রাত্রে ও তাঁর হিন্দি জাগতে রহো-র কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনার কাজ করেন। রাজ কাপুর প্রয়োজিত ও অভিনীত জাগতে রহো ছবিটি গ্রাঁ পিঁ সম্মানে ভূষিত হয়েছিল।
১৯৭৬ সালে নাটক ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ম্যাগসায়সায় পুরস্কার ও ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করা হয়।
১৯৮৩ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধিতে সম্মানিত করে। যাদবপুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত করেছিল।
বাংলা নাট্যজগতের একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী তৃপ্তি ভাদুড়ী। তিনি ১৯২৫ সালের ২৫ শে অক্টোবর বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আশুতোষ ভাদুড়ী মাতার নাম শৈলবালা দেবী। শৈশবে তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে নাট্য সমিতি মঞ্চে শিশু শিল্পীর চরিত্রে অভিনয় করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালে ফ্যাসিবিরোধী লেখকশিল্পী সংঘের প্রথম নাটকের মহিলাশিল্পী না থাকায় তার মাসতুতো দাদা বিজন ভট্টাচার্যের 'আগুন' নাটকে তিনি অভিনয় করেন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসার পর তাঁর অভিনয়ের বিকাশ ও খ্যাতি বাড়তে থাকে। ১৮৪৫ সালে শম্ভূ মিত্রের সঙ্গে বিবাহ হওয়ার পর তাঁর নাম হয় তৃপ্তি মিত্র যে নামে তিনি বেশি পরিচিত। শম্ভূ মিত্র ছিলেন একজন খ্যাতনামা অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল 'বহুরূপী'। তৃপ্তি মিত্র স্বয়ং ছিলেন বহুরূপীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এবং এই নাট্যদলের বহু নাটকে তাঁর অভিনয় চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এছাড়া তিনি বহু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। তিনি বহু নাটকে নির্দেশকের ভূমিকাও পালন করেছেন। ১৯৮০ সালে সাংগঠনিক বিরোধের জন্য বহুরূপী ত্যাগ করে কিছু দিনের জন্য 'চেনামুখ' নাট্যদলে অভিনয় করেন। নতুন অভিনয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য তিনি 'আরব্ধ নাট্য বিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মঞ্চে অভিনীত নাটক গুলি হল সেতু, সচিব সখা, বিপ্রদাস, গৃহলক্ষ্মী, থানা থেকে আসছি, সওদাগর, বিরাজ বৌ, দ্বিধা, হাসি। তাঁর আবদ্ধ নাট্য বিদ্যালয়ে প্রযোজিত ও নির্দেশিত নাটক গুলি হল সরীসৃপ, হাজার চুরাশির মা, রক্তকরবী। তাঁর বহুরূপী নাট্যদলে নির্দেশিত নাটক গুলি হল ডাকঘর, অপরাজিত, কিংবদন্তি, গন্ডার, দুরাশা, ঘরে বাইরে, যদি আর একবার, পাখি, বলি প্রভৃতি। তাঁর অভিনয়ের জন্য তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল আকাডেমি পুরস্কার, পদ্মশ্রী, শান্তিনিকেতনে ভিজিটিং ফেলো। এছাড়াও তিনি বেতার, দূরদর্শনে দক্ষতার সঙ্গে বহু অভিনয় করেছেন। নাট্য মঞ্চের এক মহান অভিনেত্রী কে আমরা হারিয়ে ফেলি ১৯৮৯ সালে।
ভারত বর্ষ স্বাধীনতা লাভ করেছে সদ্য, সমগ্র ভারত জুড়ে উচ্ছ্বাসের ঢেউ। তার মধ্যেই বাংলা নাট্যজগতের দুই মহীরুহ শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রের কোল আলো করে জন্ম নিল শাঁওলি মিত্র। পিতা-মাতার কলাকৌশলী দেখতে দেখতেই তার শৈশব থেকে কৈশোর অতিক্রান্ত। ছোট থেকেই অভিনয় রে নেশা রক্তে মিশে আছে।তাঁর বাড়ির পরিবেশে ছিল পড়াশোনার শিল্প-সংস্কৃতির আঙ্গিনায় পরিপূর্ণ তাই স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে ঠিক করেন নাটক নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করবেন। যেমন কথা তার কি তেমনি কাজ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। প্রাথমিকভাবে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন তার নাম পঞ্চম বৈদিক। সে সময়ে নাথবতী অনাথবৎ,কথা অমৃতসমান এর মতো একের পর এক নাটকে অভিনয় করে গেছেন। তার অসাধারণ অভিনয় ক্ষমতায় সৃষ্টি হয়েছে ইতিহাস। শুধুমাত্র অভিনয় নয় পাশাপাশি প্রবন্ধকার হিসেবেও যথেষ্ট সুনাম করেছেন। পিতা শম্ভু মিত্রের অভিনয় জীবনের কথা নিয়ে লিখেছিলেন বিখ্যাত বই গণনাট্য ও নবনাট্য গণনাট্য শম্ভু মিত্র তে।
ডাকঘর’ নামক রবীন্দ্রনাটক যখন বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর দ্বারা প্রথম মঞ্চস্থ হয়, তখন বালিকা শাঁওলী করেছিলেন ‘অমল’- চরিত্রটি।
চরিত্রের দীর্ঘ সব সংলাপ,মর্মগ্রাহী নিপুণতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন স্বমহিমায়, ওই অতটুকু বয়স থেকে।অর্থাৎ বাল্যকাল থেকেই শাঁওলী মিত্রের অভিনয়-প্রতিভা সকলকেই মুগ্ধ করে এসেছে।
সাল টা ছিল ৮০_৮৩ সময়। তখন মহিলাদের অবমাননাকর বেশ কিছু ঘটনা ঘটছিল। যেটা হয়তো দ্রৌপদীর অপমানের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। সেই জন্যই হয়তো আমার মনে হয়েছিল দ্রৌপদীর চরিত্রটা নিয়েই আমি কাজ করব।”
যাত্রা ফুরোয়নি। ‘কথা অমৃতসমান’-এও তুলে এনেছেন দেশের বিপর্যয়ের কথা। এই নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৯০ সালের দিকে। তখনও বাবরি মসজিদের ঘটনা ঘটেনি। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরের পর যখন পুনরায় এই নাটকটি মঞ্চস্থ করা হল, তখন শাঁওলি দেখলেন পুরোনো সংলাপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না। তাই আবার নাটকের পুনর্নির্মাণ হল। শুরুর অংশে যোগ হল বাবরি মসজিদের ইতিহাস।
২০১৯ সালেও পাঠ-নাটকের আকারে উপস্থাপন করলেন আরও এক মহাকাব্যিক নাট্যচরিত্র। নাটক ‘সীতা কথা’। যে উপস্থাপনা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল গোটা সমাজকে। দর্শক-শ্রোতাদেরও ঠেলে দিয়েছিল লজ্জাবোধের দিকে।
১৯৭১ সালে বাদল সরকার রচিত ও শম্ভু মিত্র নির্দেশিত ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকে শাঁওলী মিত্র নিজের অভিনয় দ্বারা এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করেন যে, বাংলা রঙ্গমঞ্চে এক তরুণী, প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী এসে পড়েছেন। এই নাটকেও দেবতোষ ঘোষ ও শাঁওলী মিত্র দু’জনের উজ্জ্বল অভিনয় আজও পুরনো দর্শকদের মনে আছে।১৯৭২ সালের ১ মে, বহুরূপী-র পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে শম্ভু মিত্র নির্দেশিত আর এক রবীন্দ্রনাটক ‘রাজা’র মঞ্চস্থ হয়। তৃপ্তি মিত্র করেছিলেন রানি ‘সুদর্শনা’র চরিত্র, আর শাঁওলী ‘সুরঙ্গমা’ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সুদর্শনা-সুরঙ্গমার এই জোট বাঁধা অভিনয় এবং বহুরূপী-র অনন্য টিমওয়ার্ক সে দিন প্রযোজনাটিকে কত উচ্চমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল,তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি লেখায়।
তাঁর কন্ঠের জাদুতে বুঁদ বাঙালি, রেডিও-তে বহু শ্রুতিনাটক উপহার দিয়েছেন তিনি। শেষজীবনে শাঁওলি মিত্রের লেখা একাঙ্ক নাটক ‘সীতা' মুুগ্ধ করেছিল নাট্যপ্রেমীদের।
বঙ্গীয় আকাদেমির অভিধানের প্রসারে কাজ করেছেন তিনি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে করেছেন একাধিক মূল্যবান কাজ।
মহাশ্বেতা দেবীর মৃত্যুর পর ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শাঁওলি মিত্র। ২০১৮ র জানুয়ারিতে ইস্তফা দিলেও আবার জুলাই মাস নাগাদ ফিরে আসতে হয় তাঁকে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রধান হিসাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
১৯৯১ সালে ‘নাথবতী অনাথবৎ' বইটির জন্য আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন শাঁওলি মিত্র। দীর্ঘ কর্মজীবনে অজস্র স্বীকৃতি এসেছে তাঁর ঝুলিতে। ২০০৩ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন, ২০০৯ সালে ভারত সরকার এই নাট্য ব্যক্তিত্বকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে। মমতা সরকার ২০১৩ সালে বঙ্গ বিভূষণ খেতাব দেয় তাঁকে।
১৬ ই জানুয়ারি, ২০২২ এর রবিবাসরীয় বিকেলটা বঙ্গবাসী তথা শিল্প-সংস্কৃতির জগতের কাছে মোটেই সুখকর ছিল না। হঠাৎই এক অজানা ঢেউ তছনছ করে দিয়ে গেল সুসজ্জিত বাগান। আমাদের খুবই আপনজন বঙ্গ বালা, সুরঙ্গমা কিংবা সীতা, আর নেই। নাট্য সম্রাজ্ঞী শাঁওলি মিত্রের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই, চারিদিকে শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকেই শোকে বিহ্বল হয়ে চোখ মুছতে মুছতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভেঙে পড়েন। নাট্যজগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি ভেঙে পড়বেই না বা কেন, কারণ তিনি যখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন তার পাশে প্রতিবাদী শাঁওলি মিত্র কে পেয়েছিলেন। একদিকে তিনি নাটকের প্রাণ পুরোধা, নাটকের শিক্ষিকা অন্যদিকে প্রতিবাদী। নাট্যজগতের বহু ব্যক্তিত্বদের কাছে তিনি শুধুমাত্র নাট্যজগতের বিশেষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না,ছিলেন বহু নবাগত ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তিনি একটি বটবৃক্ষের মতো। নিজের হাতেই সুযোগ্য ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করেছেন।তিনি ছিলেন শিল্পী, তাই তিনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর।বহু ছাত্রছাত্রীকে নিজের হাতেই বেশভূষা পরিয়ে মঞ্চে তুলেছেন। একজন প্রকৃত শিক্ষক যখন হারিয়ে যায় প্রতিষ্ঠান থেকে তখন তার ছাত্রছাত্রীরা যে কতটা অভাব বোধ করে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তবে সময় আপন গতিপথ ধরে চলে। তাকে উপেক্ষা করার মতো সাহস আমাদের কারো নেই। জাগতিক নিয়মের কাছেই একে একে আমাদের সবাইকে ধরা দিতে হবে। এযাবত এই নীয়মের কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমাদের কাছের মানুষটি সেই নিয়ম এর উর্ধে নয়। তবে তিনি তাঁর আদর্শ দিয়ে,ছাত্র-ছাত্রীদের যে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পেরেছে, তার প্রতিফলন ঘটবে মঞ্চে। তাঁর হাতে গড়া ছাত্র ছাত্রীদের অভিনয় দেখে ভক্তকুল আবার চেঁচিয়ে বলবে, সাবাশ, কে বলল শাঁওলি মিত্র আর আমাদের মধ্যে নেই,তার অভিনয়,বাচনভঙ্গি আমরা তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। এইভাবে তিনি যুগের পর যুগ তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দিয়ে দর্শকদের মধ্যে শাঁওলি মিত্র নামের প্রাণসঞ্চার ঘটবে। তিনি এই ভাবে তার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবেন।তাই শাঁওলি মিত্রের মত সমাজ গড়ার কারিগরদের কখনোই মৃত্যু হয় না।এটার মধ্যে দিয়ে শাঁওলি মিত্রের নিরলস, নিষ্ঠা, সততা ,পরিশ্রমের সার্থকতা।
নাট্যজগতের বাহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বর্গ অনেকেই শাঁওলি মিত্রের অভিনয়ের বিচার-বিশ্লেষণের করার ক্ষমতা রাখতে পারেনি। আর আমরাই বা কে, যে তাকে নিয়ে বিশ্লেষণ করবো? না সে সাধ্য আমাদের নেই। তবে তাঁর চলে যাওয়া টা এখনো অনেকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি আর পারবেও না। নাট্যজগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তথা আপামর বাঙালি বিভিন্নভবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে চলেছে।আমরা নিজেদের মত কলমের মধ্যে দিয়ে স্মৃতি চারণ করব।
প্রবন্ধ
উত্তরের অরণ্যভূমির গজরাজদের গল্পস্বল্প
গৌতম চক্রবর্তী
রিটায়ারমেন্টের পর পেনশন পান সরকারি কর্মচারীরা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কর্মজীবনের ওপরই যবনিকা পড়ে যায়। বহুবছর একসঙ্গে কাজ করার পর অবসর গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে
যায়। অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারেন না। অবসর জীবনেও যদি পুরনো সতীর্থদের সঙ্গে থাকা যায় তাহলে আয়ু অনেকটা
যেন বেড়ে যায়। কর্মজীবন
শেষ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশেরই জীবনে নেমে আসে বিষাদের আবহ।। কিন্তু গজরাজ যদি পেনশন পান শুনে অবাক হবেন
না কিন্তু। যেমনটা হয়েছিল মেঘলালের। গরুমারার তৎকালীন বিট অফিসারের সৌজন্যে
দেখেছিলাম মেঘলালকে। মানুষের যেমন চাকরি
থেকে অবসর গ্রহণের বয়সের সীমারেখা বাধা থাকে, তেমনি গরুমারার কুনকি হাতিদেরও
কাজের বয়স বাঁধা রয়েছে মানুষের মতো।
গরুমারার কুনকি হাতিরাও ৬০ বছর বয়সের পর কাজ থেকে অবসর নিয়ে নেয়। তখন তাদের নিজের কাজটুকু ছাড়া আর কোনকিছুই করতে হয় না। মেঘলাল এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল মেঘলাল এর বয়স তখন ছিল ৬২ বছর। সরকারি
নিয়ম অনুসারে বছর দুয়েক আগেই অবসর নিয়ে নিয়েছিল সে। তবে
সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছেদ হয়নি। কর্মজীবন
থেকে অবসরগ্রহণ করলেও তার নিজের খাবার নিজেকেই সংগ্রহ করতে হত। তাই নিয়ম করে
প্রতিদিন জঙ্গলে যেতে হত বর্ষীয়ান এই কুনকিকে। নিজের
খাবার নিজে সংগ্রহ করলেও মেঘলাল এর সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছিল বনদপ্তর।
নয় এর দশকে গরুমারার
জঙ্গলে এসেছিল মেঘলাল। মূলত বেআইনি পাচার আটকাতে
গিয়ে মেঘলালকে পাওয়া গিয়েছিল। উত্তর
পূর্ব ভারত থেকে গাড়িতে করে এই পুরুষ হাতিটিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তার বৈধ কাগজ না থাকায় হাতিটিকে গরুমারার জঙ্গলে আটকে দেওয়া
হয়। তারপর সেখানে কিছুদিন রাখার পর তাকে কুনকি করে
তোলার তালিম দেওয়া শুরু হয়। মাত্র
এক বছরের মধ্যেই তালিম শেষ করে কুনকি হয়ে ওঠে মেঘলাল। তারপর
থেকেই দীর্ঘদিন গরুমারার অভিজ্ঞ কুনকির দায়িত্ব পালন করে সে। পিঠে
পর্যটককে নিয়ে জঙ্গল ঘোরানোর কাজ থেকে শুরু করে বন্যাবিধ্বস্ত এলাকায় মানুষকে
উদ্ধারের কাজ অথবা লোকালয়ে কোন বন্যপ্রাণী বেড়িয়ে পড়লে তাকে বাগে আনা সমস্ত
ক্ষেত্রেই ডাক পড়তো মেঘলালের। অবসর নিলেও মেঘলাল
অনেকদিন অতিথি ছিল বন্যপ্রাণ বিভাগের। ২০১৪ সালে কর্মজীবন
থেকে অবসর নেওয়ার পর অনেকগুলো বছর কেটে গেলেও সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত খাবার
যোগাড় করা, মূর্তি নদীতে স্নান করা থেকে শুরু করে দিনের অধিকাংশ সময় সহকর্মীদের
সঙ্গে কাটিয়েছিল গরুমারার সবচেয়ে বয়স্ক কুনকি মেঘলাল।
গরুমারার জঙ্গলের ভেতরে মেদলার পিলখানায় অবসর জীবন কাটিয়েছে মেঘলাল। জানিনা আজও আছে কিনা।
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন
জঙ্গলে হাতিদের গতিবিধি ইদানীংকালে খুব বিপদজনক হয়ে গেছে। বহুক্ষেত্রে
দাঁতাল হাতিরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে জঙ্গল লাগোয়া গ্রাম অথবা এলাকায় তাণ্ডব
চালাচ্ছে, ভাঙচুর করছে এবং অনেক
জায়গায় প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। এরকম ঘটনা সাম্প্রতিক নয়, অতীতেও ঘটেছিল। জঙ্গলের হাতিদের গতিবিধির ওপর কড়া নজরদারির
নির্দেশ এসেছিল নবান্ন থেকে।
প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কিভাবে কমানো যায় সেই বিষয়ে নজর দিতে বলা
হয়েছিল বনদপ্তরকে। তাই বনদপ্তরের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়
হাতির দলের নেতা অর্থাৎ বনদপ্তরের ভাষায় যাদেরকে হার্ড বলে তাদের ওপর নজরদারি
রাখতে হবে। তবেই একমাত্র এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব। জলদাপাড়া থেকে বক্সা পর্যন্ত এই এলাকায় একাধিক হাতির দল রয়েছে। এইরকমই একটা দুটো হাতির দলের ওপর নজরদারি করতে সুন্দরী এক হাতিকে
রেডিও কলার পরিয়ে জঙ্গলে ছাড়লো বনদপ্তর। হাতিটির
নাম সুকন্যা। বয়স ৩০ বছর। কারণ এই হাতিটির দিকে একাধিক পুরুষ হাতি আকৃষ্ট হত মাঝেমাঝেই।
জলদাপাড়া জঙ্গলের
শিসামারাতে বনদপ্তরের এক বিশেষ দল ঘুমপাড়ানি ইনজেকশন দিয়ে বশ করে সুকন্যাকে রেডিও
কলার পরিয়ে বিকেলের দিকে জঙ্গলের দিকে ছেড়ে দেয়।
বনদপ্তরের এই ধারণা কাজ করেছিল যে জঙ্গলে ওই হাতিটির দিকে যাবে অনেক পুরুষ হাতি
অথবা দাঁতাল। এই অবস্থায় হাতির দলের বাকিরাও সেদিকেই ছুটবে। তখন জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে মহিলা হাতিটি কোথায় যাচ্ছে এবং কোন
জঙ্গলে রাতে থাকছে অথবা কোথায় দিনের বেলায় থাকছে সেই বিষয়ে চব্বিশ ঘন্টা
নজরদারি করা সম্ভবপর হবে। এর ফলে অনায়াসেই সুন্দরী
সুকন্যাকে কেন্দ্র করে বাকি দাঁতাল এবং হাতির দলকে নজরদারিতে রাখা সম্ভবপর হবে। বনদপ্তরের এই পরিকল্পনা
কিন্তু সাফল্যমন্ডিত হয়েছিল। বনের
বখাটে দাঁতালদের বশে রাখতে সুন্দরী হস্তিনীদের কাজে লাগাতে বনদপ্তরের রেডিও কলার
পড়ানোর মাধ্যমে জলদাপাড়া সহ সংলগ্ন বনাঞ্চলে হাতিদের দলের ওপর নজরদারি চালানোর
সিদ্ধান্ত কিন্তু প্রথমবার নেওয়া হয়নি। এর আগে
মহানন্দা এবং গরুমারাতে বাছাই করা হাতিকে রেডিও কলার পড়ানো হয়েছিল শুধুমাত্র
হাতিদের গতিবিধির ওপর নজরদারির কথা মাথায় রেখে। জলদাপাড়া
সহ মাদারিহাট, কালচিনি, বীরপাড়া এলাকায় প্রায় শ’দুয়েক হাতি
একাধিক দলে ঘুরে বেড়ায় বিশেষ করে ধান পাকার সময়। জলদাপাড়াতে এই অতীত অভিজ্ঞতার
ভিত্তিতে সুকন্যাকে কাজে লাগিয়ে তার সহযোগিতায় হাতিদের গতিবিধিতে নজর রাখার
পরিকল্পনা কিন্তু ব্যাপকভাবে সাফল্যমন্ডিত হয়।
চম্পাকলির মাহুত ছিল রবি
বিশ্বকর্মা। জানিনা এখনও আছে কিনা। জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের হলং সেন্ট্রাল
পিলখানার কুনকি হাতি চম্পাকলি। অনাথ হস্তিশাবকদের মা। সেবার হলং বনবাংলোতে রবির সঙ্গে পিলখানাতে যখন গল্প করছিলাম তখন
দেখেছিলাম চম্পাকলিকে। পিলখানার ছবি তুলতে নিষেধ করেছিল রবি। জেনেছিলাম এক অদ্ভূত
মাতৃস্নেহের গল্প। পর্যটন এবং বন রক্ষার কাজে ব্যবহার করার জন্য ২০১৮ সালের এপ্রিল
মাসে কর্ণাটক থেকে আটটি হাতি আনা হয়েছিল জলদাপাড়াতে যেগুলির মধ্যে একটি হাতির
নাম ছিল মেরি। সে ছিল অন্তঃসত্ত্বা। ২০১৮
সালের জানুয়ারি মাসে মেরি একটি মেয়ে শাবকের জন্ম দেয়। কিন্তু
কিছুদিন পর মেরি মারা যাওয়ার ফলে শাবকটিকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে বনদপ্তর। জেনেছিলাম হস্তিশাবককে বড় করে তুলতে কমপক্ষে তিন বছর মায়ের দুধের
প্রয়োজন হয়। এর আগে অনাথ হস্তি শাবকদের দুধ খাইয়ে হস্তীশাবকদের
প্রাণ বাঁচানোতে রেকর্ড করেছে চম্পাকলি। ইতিমধ্যে
চম্পাকলিও একটি মেয়ে শাবকের জন্ম দেয়। যেহেতু
চম্পাকলি এর আগে একটি অনাথ শাবককে দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছিল সেই জন্য বনদপ্তর
নিশ্চিত ছিল এই শাবকটির ক্ষেত্রেও অন্যথা হবে না। কিন্তু
প্রথম দুবার চম্পাকলি ওই শাবকটিকে কাছে আসতে না দিতে চাইলে বনকর্তাদের উদ্বেগ
বেড়ে যায়। চম্পাকলির ব্যবহারে তারা অবাক হয়ে যায়। তখন
চম্পাকলির মাহুত রবি বিশ্বকর্মা বনকর্তাদের আশ্বস্ত করেন। বারে
বারে চেষ্টা চালানো হলে তৃতীয় বারের চেষ্টায় সমস্যার সমাধান হয়।
চম্পাকলি নিজের শাবকের পাশাপাশি ওই অনাথ শাবককেও কাছে টেনে নিলে স্বস্তির নিঃশ্বাস
ফেলে বনদপ্তর।
আসলে হাতিদের
চরিত্রবৈশিষ্ট ব্যাতিক্রমী। বিশিষ্ট হস্তিবিজ্ঞানী পার্বতী বড়ুয়ার লেখা থেকে পড়েছিলাম
আসলে হাতিদের চরিত্রে স্নেহপরায়ণ ঘটনা দেখা যায় যেটাকে বিরল বলা যায় না।
জলদাপাড়াতে ইতিপূর্বে মধুমালা নামে একটি মা হাতিও অনাথ শাবকদের নিজের দুধ দিয়েছে। তবে
এতগুলি অনাথ সন্তানকে অন্য কোনো মা হাতি নিজের দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে কিনা
সেটা বনদপ্তরেরই অনেকের জানা ছিল না। রবির কাছ থেকে শুনেছিলাম চম্পাকলি এর আগে ছটা
অনাথ শাবককে নিজের দুধ দিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে। মেরির
শাবকটিও চম্পাকলির স্নেহ এবং শাসনে বর্তমানে অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। চম্পাকলির
শাবকের সঙ্গে মেরির শাবকটি সারাদিন ধরে নাকি খুনসুটি করে।
এতক্ষণ তো শোনালাম
হাতির গল্প। এবার মাহাতির গল্প বলে শেষ করব। মাহাতি মুন্ডার সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য
পেয়েছিলাম একটি পত্রিকার সাংবাদিক বন্ধুর লেখা থেকে। বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের পানবাড়ি বনাঞ্চল লাগোয়া গ্রামের নব্বই বছরের
মাহাতির বাড়িতে আজ পর্যন্ত ঘরবাড়ি বা ফসলের কোন ক্ষতি করেনি হাতির দল। ৩৭ বছর ধরে নিয়মিত জঙ্গলের গরু চরাতে যায় সে। বহুবার
বুনো হাতির মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু
হাতিদের মাহাতি বিরক্ত করেনি অথবা ভয় পেয়ে পালিয়েও যায়নি। বরং
হাতিরাই অনেক সময় তাঁর যাওয়ার পথ ছেড়ে দিয়েছে। ডুয়ার্সের
জঙ্গল লাগোয়া এলাকায় ২৫-৩০ বছর
আগেও বুনো হাতিরা এভাবে ঘনঘন লোকালয়ে আসতো না। জঙ্গলে
হাতিদের খাবার নেই। মানুষই এতদিন ধরে হাতিদের বাসস্থান এবং খাবারের
উৎস নষ্ট করেছে। এখন হাতি সেটাই ফিরিয়ে দিচ্ছে। ওরাও ছিনিয়ে নিচ্ছে খাবার। মাহাতি
মুন্ডা বন জঙ্গল চেনেন হাতের তালুর মতো এবং হাতিদের মনস্তত্ব। তিনি যা বিশ্বাস করেন তা মেনেও চলেন। সেই
কারণেই তাঁর যেটুকু সামর্থ্য সেটুকু খাবার সে ক্ষেতের কিছুটা ফসল হোক বা গাছের কলা
বা কাঁঠাল অথবা বাগানের কিছু আনাজ তিনি রেখে দেন হাতিদের জন্য এবং বাকিটা ঘরে
তোলেন। ডুয়ার্সের গজরাজ কুলের হানা এখন রোজনামচা হয়ে
দাঁড়িয়েছে। হাতিদের খাওয়া নিয়ে মাহাতির চিন্তার অন্ত নেই বলে তাঁর মতে সকলেই যদি কিছু ফসল, আনাজ অথবা ফল হাতিদের জন্য রেখে দেয় তাহলে হাতিরা
এত দৌরাত্ম্য করত না। হাতিরা
যা করছে তা নিরুপায় হয়ে করছে। মাহাতি
এই যে তার মতো করে বন্যজন্তুদের ভালোবাসার পাঠ দিচ্ছে এর মূল্য কি টাকায় পরিমাপ
করা যায়?
কবিতা: প্রথম পর্যায়
ধৃষ্টতা
অনিন্দ্য সাঁতরা
ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে অভিমানে বন্ধ করি চোখ।
বিশ্বাস করো, তখনও তোমার মুখ মনে পড়ে।
আঙুলের মুদ্রা অথবা অমৃত ওষ্ঠ ছুঁয়ে
যে বাঁশিটি ঈষৎ নিম্নমুখী,
যার ভিতর দিয়ে বাতাসের গলিপথ
ক্রমে গিয়ে মিশেছে সুরের রাজপথে....
সেই পথের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকি অসহায়।
কুঞ্চিত কেশরাজির শীর্ষ ছুঁয়েছে যে পালক
নীল নীল হৃদয়ের আলপনা
একটু একটু প্রকাশিত হয়েছে যার গায়ে
সেই ময়ূরাভরণের সামনে হতে থাকি নিরাবরণ।
সত্যিই আর কিচ্ছুটি চাই না মুখ ফুটে
অন্ধ! শুধু অন্ধ হতে চাই এ জন্মের মতো।
বিশ্বাস করো তখনও তোমার মুখ মনে পড়ে।
মায়া কায়া
নারায়ণ ভৌমিক
স্বচ্ছতোয়া ভালোবাসা
পিজঁরউঠোন বৃষ্টিবাসা...
জলফড়িং আর পুকুরপাড়
সেই বাড়িটা তোমার-আমার...
জলছলাতের বৃষ্টিনুপুর
সালতামামি সারাদুপুর...
ভালোবাসার উঠোনপাড়ে
আমিও ভাঙি,তোমায় গড়ে...
ভালোবাসা স্বচ্ছতোয়া
সবই কেমন মায়ার কায়া
এসব কথা বলবো তাই
শব্দ জুড়ে মেঘ জমাই।
ছায়াপথ
প্রতিভা পাল
ব্রহ্মাণ্ডের কলঙ্কিত স্মৃতিচিহ্ন সব,
নীহারিকার পুঞ্জীভূত ক্ষোভ,
মেঘ জমিয়েছে আলোর উৎসবে!
আকাশগঙ্গার ধূলিকণায়, বাষ্পীভূত মন
আলোকবর্ষ দূরত্বের অজুহাতে,
সময় সাজায় অনুভবে!
কক্ষপথের বক্ররেখায়, অন্তরের প্রবল অভিসন্ধি!
কালপুরুষ জ্বলে, সাঁঝবাতির শিখায় !
গ্রহদের সহাবস্থান জীবনের গতি মাপে,
ছন্নছাড়া উদভ্রান্ত চোখ
আকাশ-কোণ খোঁজে অবেলায় !
ছায়াপথের কোল ঘেঁষে স্বপ্নালু চোখ
রোজ হেঁটে চলে তবু আশায়,
রোজ একটু একটু হারায়......
মাঘের আমন্ত্রণ
বিজয় বর্মন
পৌষালী হাওয়ায় শীতের চাদর,
কুয়াশার ছোঁয়ায়,
শীতল অনুভব,
আজ অপরাহ্নে,সাজাই হলুদ ফুল।
সবুজের মাঝে সোনালী আভা,
নজরে আলোড়ন,
যদিও,জানা আছে চাপা পড়া,
সব রঙের পরিনাম।
সঙ সাজা,সময় জানে,
নিত্য প্রবাহী,
পাতা ঝড়া কাল শীতঘুম ঘুম,
মাঘের আমন্ত্রণে,দাঁড়িয়ে পলাশ।
তুমি আসবে বলে,
সরিয়ে ফেলি সব ছাইপাশ,
ভীত হই আগুন রং দেখে,
কাঁটার পথ পেরিয়ে যেতে হবে বহুদূরে...!
বর্ষ তুমি কার? রীনা মজুমদার
ক্ষত মুছে, নিংড়ানো হৃদয়ে লালন
বর্ষে পদার্পণ গোল বারান্দায়
তোমাকে নিয়েই যাপন।
বর্ষ তুমি বারবার
মানুষে মানুষে প্রেম মহার্ঘ্য
অসমাপ্ত কাহিনী, জীবনের স্বরলিপি।
বর্ষ তুমি অঙ্গীকার
শৈশবে চিরকুটে গাঁথা পঙক্তি
কুশল বিনিময়ের কবিতার কুঁড়ি।
বর্ষ তুমি কার?
ঘুমন্ত মস্তিষ্কে ছায়াপথ ধরে
খুঁজে খুঁজে বের করে আনো
জীবনের যত যতিচিহ্ন ও আলো।
সব দিবস হোক মানবতার
বর্ষ তুমি সবার..
আসল
প্রনব কুমার কুন্ডু (রুদ্র)
রগড়ালে বিপদ
কঠিনতম পরীক্ষার আগে
গড়পড়তার পাঁকে ভগবান ভক্তি
আনন্দের নরকে পরমা সুন্দরী
মোকাবেলার সৌন্দর্যে ছাপোষা সংসার
কান্তি সভ্য দুঃখ দূষণ বাড়ায় সম্পর্কে
একমুঠো দানার মধ্যেই সুখী চড়াই পাখি
আরামের রং অনবরত পাল্টায় ওজন
দুনিয়ার চারপাশে সুযোগ পেলেই জুয়াচুরি চলে
অমায়িক মুখোশ রগড়ালে বের হয় আসল
উৎসব
সংগীতা মিশ্র
দেনা উৎসব
তোর উল্লাস
সবত্র ছড়িয়ে
তোর পুলকের স্পর্শে
থাকনা অভিধানের
অগনিত শব্দ
নিজ নিজ অর্থে
ভালোবাসায় জড়িয়ে
জোনাকিশ্রাবণী সেনগুপ্ত
জোনাকিরা ডানা মেলেছে
সারবেঁধে আলো জ্বলছে নিভছে।
শুকনো চোখে কালির প্রলেপ,
বুকের খাঁচায় রংয়ের সেলেব।
পদ্মিনীর অপমান মুছে যায়,
সস্তার সমবেদনায় ঢেকে যায়
এই সমকাল আর একাল সকাল
ভর করে কক্ষপথে সেই ক্রান্তিকাল।
সময়েরা সরে সরে যায়-
বৃদ্ধ পাকুড়ের ছায়ায় ছায়ায়।
উঠে আসে হাসিমুখে নবীন কিশোর
বাঁশির ছোঁয়ায় বাতাস মাতাল ঘনঘোর।
সৃষ্টির চরম অভিঘাত মুছে দেয় সব সন্তাপ।
ক্ষুদ্র সে আলো বুকে ভরে
জোনাকিরা সার বেঁধে ওড়ে-
এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জুড়ে
ময়নামতির মনকেমনের ঘরে।
বিশ-বাইশে
মাথুর দাস
বিশ-বাইশে দিস্ না শিসে উড়িয়ে সব,
অতিমারি প্রতিবারই আনছে নিত্য নতুন যে ঢেউ !
সামাল দিয়ে কামাল করা চাই কলরব,
বিশ-বাইশে ঘোড়্-সহিসে আনুক দিন জোর্-সে কেউ ।
পাক ফিরে সব কর্মহারা মানুষজনে কাজের হদিস,
মাথার উপর ছাদটুকু থাক ভরসা হয়ে ।
আঁধার-বাধার ডিঙোক পাহাড় বিকীর্ণ আলোর দিশ,
আসুক সুদিন পূবের আকাশ ফরসা হয়ে ।
বিশ-বাইশে অহর্নিশে সবাই থাকুক শান্তি সুখে,
বচ্ছরভর যেসব মানুষ অর্ধাহারেই কাটাল কাল
যেসব মানুষ কাজটি করে কষ্টে এবং নীরব মুখে
বিশ-বাইশে তাদের পাতে দিস্ রাইসে খানিক ডাল ।
গল্প
ট্রেন ডাকাত
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
সেবার তিস্তা তোর্ষাতে নিমতিতা স্টেশন এ একদল ডাকাতের মুখে পড়েছিলাম। এখন যেমন সন্ধ্যা আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে নিমতিতা ষ্টেশন পার হয়ে যায়, সেবার জঙ্গীপুরের লাইনের কাজ চলাতে, রাত পৌনে তিনটায় দুম দাম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।
ট্রেনের বডির পাত খোলার শব্দে যাত্রীরা আতংকিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। কে বা কারা নাকি স্মাগলড গুডস ট্রেনের মধ্যে করে পাচার করছে। অন্য একদল ডাকাত সে খবর পেয়ে, সেইসব জিনিস আত্মসাৎ করতে চাইছে।
ছোট বেলায় গ্রামে যে ডাকাতি হয়েছিল, তার সাথে এর কোন মিল নেই। গ্রামের সেই ডাকাতিতে গুলি চলেছিল, বোমা পড়েছিল, সুশীল ঘোষের দুই ছেলে জখম হয়েছিল। টাকা, সোনাদানা মিলে দু লাখ টাকা নিয়ে গিয়ে ছিল ডাকাত দল। সেই দলের এক ইনফরমার ধরা পড়লেও, ডাকাত বা ডাকাতির মাল, কিছুই পাওয়া যায় নি। ইনফরমারকে সুবীর সাহার বোম্বাই আম গাছের ডালে, ওপরে পা, নিচে মাথা করে দড়ি দিয়ে বেঁধে, পায়ে সুঁচ ফুটিয়ে ও কারো হদিস পাওয়া না গেলে, গাঙ্গুলি জেঠুর বকুনিতে পাড়ার দাদারা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। তা না হ'লে যে তার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটত, তা বলাই বাহুল্য।
আমার ছাত্রীর স্বামী, রেলের টিকিট পরীক্ষক ছিল। ছাত্রী এম এ পড়ত। পরীক্ষার আগে আমার মতো পাস কোর্সের গ্রাজুয়েটের কাছে,ইংরেজি শব্দের মানে উদ্ধার করত। ছাত্রীটির স্বামী অলক, মারা গেল। কি একটা অসুখ ছিল।
জলপাইগুড়ি, শিয়ালদাতে কখনও তিস্তায়, কখনও উত্তরবংগ এক্সপ্রেসে সে আমাকে মাংস ভাত খাওয়াত। ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক আমার অনুজ প্রতিম ভাই, এটা দেখে অনেক সহযাত্রীই ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ত।
আজকের যাত্রাতে, টিকিট পরীক্ষককে দেখে, বার বার অলকের কথা মনে এল। ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার সহকর্মী, টিকিট পরীক্ষক, অলক কর্মকার কে চিনতেন? ,
বিলক্ষণ, অলক আপনার কে হ'য়?
আমার বিশেষ পরিচিত।
তারপর নানা কথায় ডাকাতির প্রসঙ্গে এলাম। নিমততা স্টেশনের ডাকাতির কথা বলতে, বললেন, এখন তারা আর ডাকাতি করে না। তাদের ছেলে-মেয়েরা এখন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। ডাকাতরা এখন নেতা। আড়াই ভরির চেন, দুহাতে আটটা আংটি, স্করপিও গাড়ী, সেদিনই পাঞ্জাবি পরে ভাষন দিচ্ছিল। তিন ঘন্টায়, একটা ওয়াগন সাফ করে দিত। এখন আর ও সব কাজ করবে না।
টিকিট পরীক্ষক যখন এ সব বলছিলেন তখন আমার বগির সহ যাত্রিরা, মোবাইলের, "তেরে বিনা জিন্দেগী সে কয়ি.....সিকোয়া নেহী" গান বন্ধ করে, ' ডাকাত -কাহিনী' হাঁ করে গিলছিল।
ফারাক্কা আসাতে উনি বললেন, চলুন চা খেয়ে আসি। সকালে বেড়গুম থেকে ভারতী বৌদির দেওয়া মাছ ভাত নষ্ট হয়ে যাবে বলে নৈহাটিতেই সাবাড় করে দিয়েছি। পেটটা ভরা ভরা কিন্তু নিমতিতা থেকে জলপাইগুড়িতে পুতুলকে যখন জানালাম, রাতে আর খাব না। স্বভাব সিদ্ধ শাসনের সুরে বলল, "একদম উপোস করবে না, অবশ্যই মালদা থেকে খেয়ে নেবে।"
স্টেশনের স্টলে পৌছতেই দেখি চারটি প্লেটে ব্রেড-টোস্ট, ওমলেট, এক গ্লাস গরম কফি। আপত্তি জানানোর আগেই বললেন, "তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন, আমি এখানেই নেমে যাব। মালদা থেকে অন্য টিটি (সুভাষ বাবু) উঠবেন। নিউ জলপাইগুড়িতে উনি আপনাকে চা খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। "
ট্রেনে ওঠার সময় দেখলাম, এক ভদ্রলোক, হাসি মুখে ষ্টল মালিককে আমাদের বিলের বাবদ পাঁচ 'শ টাকা বাড়িয়ে দিলেন। নেতা গোছের এই ভদ্রলোকের সোনার চেন, হাতের আংটি দেখে, আমার কফি- ওমলেট গলায় ধাক্কা দিতে শুরু করল। তিস্তা - তোর্ষা তখন কোমর দুলিয়ে চলতে শুরু করেছে।
টেন্ডার
মৌসুমী চৌধুরী
পুরীর এই হোটেলটা স্বর্গদ্বার থেকে বেশ দূরে, একটু নির্জন এলাকায়। আগেও কয়েকবার এসে এখানেই উঠেছে জুঁই। একটা ঠান্ডা বাতাস সমুদ্রের বুক ছুঁয়ে হু হু করে ছুটে আসছে সামনের সী-ফেসিং জানালাটা দিয়ে। এলো -মেলো করে দিচ্ছে জুঁইয়ের হাইড- অ্যান্ড-সিক সিল্কি চুলের ঢাল। বাতাসটাও যেন পাগলপারা পুরুষের মতো মাথা কুটে মরতে চাইছে তার ক্লিভেজের মোহিনী ইশারায়। মনে মনে হেসে ওঠে জুঁই। বিছানায় আধশোয়া হয়ে নতুন কেনা দামী সেল ফোনটায় লাস্যময়ী শরীরী আবেদনমূলক কিছু সেল্ফি তুলছিল সে।ফেসবুকে আপলোড করতে হবে। আসলে তার এই প্রোফাইলটা একটা ফাঁদ। কত রথীমহারথী যে এইসব ছবি দেখে তার পায়ে লুটিয়ে পড়ে তার ইয়াত্তা নেই ! আর সেও ভরপুর মজা নেয় এ সবকিছুর। এসবে বড় নেশা লেগে গেছে। হাঃ হাঃ...
নতুন এই প্রজেক্টটা সাকসেসফুল করবার জন্য কোম্পানি তাকে এই নতুন ফোনটা দিয়েছে। টেন্ডারটা পেলে কোম্পানীর প্রফিট হবে পঞ্চাশ-ষাটকোটি টাকা আর সে পাবে এক কোটি। চকচক করে ওঠে জুঁইয়ের চোখ। আর তারপর তো চুটিয়ে মস্তি। আর এই জন্যই তো সেই ভিখিরির সংসার ছেড়ে এসেছে সে। আজ সারা রাত ধরে 'পাগোরিয়া গারমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোং'-এর এ.জি. এমকে খুশি করতে পারলেই তাদের কোম্পানির রাইভাল "আহুজা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানি"-র হাত থেকে টেন্ডারটা ছিনিয়ে আনতে পারবে সে। ইনফ্যাক্ট এভাবেই একের পর এক টেন্ডার সে কোম্পানিকে পাইয়ে দেয়। একটা আত্মবিশ্বাসী ও ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে জুঁইয়ের ঠোঁট জুড়ে। আর ঠিক তখনই বেজে ওঠে কলিংবেলটা। দরজা খুলতেই বিষ্ময়ে ফেটে পড়ে জুঁই!
— "একি! তুমি ?"
কথা শেষ হবার আগেই একটা ঠান্ডা হিসহিসে স্পর্শ কামড়ে ধরে তার ঠোঁট। নরম গদির মধ্যে সেঁদিয়ে যেতে যেতে দুই উরুর মাঝে সে অনু- ভব করে তপ্ত শলাকা-স্পর্শ।
পরদিন সকালে 'আহুজা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানি'-র পি.আর.ও তন্ময় দে হেড অফিসে ফোন করে জানায়,
— " উই হ্যাভ গট দ্য টেন্ডার।"
আর জুঁইকে পুরীর সমুদ্র আশ্রয় দেয় তার উত্তাল বুকে।
মাস্ক বিভ্রাট
মনোমিতা চক্রবর্তী
ধ্রুব তাড়া দেওয়াতে ধ্রুবর সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে এল কেকা। ধ্রুব_" চল তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।"
কেকা_" না না তুই যা ধ্রুব। আমি টোটো করে চলে যাব ।কাকীমার শরীরটাতো ভালো নেই ।তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। চিন্তা করিসনা,আমি ঠিক টোটো পেয়ে যাবো ।"
ধ্রুব চলে গেলে হাতঘড়িতে চোখ বোলাতেই চোখ ছানাবড়া কেকার। কখন রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে খেয়ালই করেনি সে। এত রাতে আর বাজারে গিয়ে কোন লাভ হবে না । দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। অথচ আজ বাজারে যাওয়াটা খুব দরকার ছিল কেকার ।কাল যে মায়ের জন্মদিন।কেক, চকলেট আর মায়ের পছন্দের রঙের শাড়িতে সকাল-সকাল মাকে চমকে দেওয়ার একটা পরিকল্পনা ছিল কেকার।কিন্তু কি আর করা যাবে ।অফিস থেকে বেরোতেই যে দেরি হয়ে গেল । বাজারে যাবার প্ল্যানটা ত্যাগ করতেই হল কেকার। মায়ের জন্য উপহার বরং কাল নিয়ে নেবে। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে।
মাঘ মাসের রাত, কুয়াশার চাদরে মুড়ে গেছে শহর । শীতের রাত বলে রাস্তাঘাটও খুব তাড়াতাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে। অফিসের সামনে টোটো না পাওয়ায় নতুন ব্রিজ হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাজবাড়ির মোড়ের দিকে এগোয় কেকা।
কারণ তাদের বাড়িটা শহর থেকে একটু বাইরে। রাজবাড়ির মোড় থেকে তাদের বাড়ি যাবার টোটো সহজেই পাওয়া যায়।আজও নিশ্চয়ই সে টোটো পেয়ে যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে কেকা ভাবে _মা নিশ্চয়ই খিচুড়ি করে রেখেছে ।আজ বাড়ি পৌঁছে ,ফ্রেশ হয়ে, সবার সাথে বসে জমিয়ে খিচুড়ি খাবে ডিম ভাজা দিয়ে। ছোটবেলায় এরকম শীতের রাতে প্রায় দিনই খিচুড়ি করতো মা। খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খেয়ে ঠাকুমার সাথে শুয়ে লেপের ওমে রাজপুত্রের গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তো কেকা।
ব্রিজ পেরিয়ে গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেকা হঠাৎ খেয়াল করে তার পিছু পিছু একটা লম্বা মতো লোক হেঁটে আসছে ।বার দুয়েক পেছন ফিরে দেখেছে কেকা। শীতের পোষাক পরা, টুপিও পরা তাতে আবার মুখে মাস্ক।"কে লোকটা?কেউ কি আমায় ফলো করছে?"মনে মনে ভাবে কেকা।
যেই গলি দিয়ে কেকা হেঁটে যাচ্ছিল সেই গলিটা আজ যেনো আরও বেশি ফাঁকা মনে হচ্ছে। একে শীতের রাত, ঘন কুয়াশা , তাতে আবার উত্তরে হওয়া বইছে। তাই কেকা যে গলিটা দিয়ে হাঁটছিল সেই গলির প্রত্যেকটা বাড়িরই লোকেরা জানালা দরজা সব বন্ধ করে যে যার ঘরে। কেকা পেছন ফিরে দেখে হ্যা লোকটা এখনও তার পেছন পেছন আসছে।
এবার ভয় পেয়ে যায় কেকা । ভয়ে ভয়ে কেকা ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে ভাইকে একটা ফোন করতে যায়।সর্বনাশ !মোবাইলে একফোঁটাও চার্জ নেই যে!মোবাইল তো সুইচ অফ হয়ে গিয়েছে ।এখন উপায়?
কিছুদিন আগে শহরে একটা মেয়ের সাথে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। রাতের দিকে মেয়েটিও নাকি একাই বাড়ি ফিরছিল ।কেকা মনে মনে ভাবল কি অবস্থা!আমাদের শহরটাও আর নিরাপদ নয় ।
একটা অজানা ভয়ে কেকার গলা শুকিয়ে আসছিল । এত রাতে রাস্তাঘাটে তেমন কাউকেই সে দেখতে পাচ্ছিলনা,টোটোও পাচ্ছিলনা , তাতে আবার ওই লোকটা পিছু নিয়েছে । কেকা বুঝে যায় আজ বিপদে পড়লে কারো সাহায্য পাওয়া অসম্ভব। কেকা মনে মনে ভাবে_ ধ্রুবর সাথে না গিয়ে বড়ো বোকামি করেছে সে।
কোনো উপায় না দেখে কেকা প্রায় দৌড়ে রাজবাড়ির মোড়ে গিয়ে ছোট একটা চায়ের দোকানের সামনে দাড়ায় । কিছুক্ষণ বাদে কেকা দেখলো ওই লোকটাও ঠিক তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ।কেকা ভয়ে ভয়ে আছে ঠিকই ,তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কেকা মনেমনে বলে -"আর যাই হোক, চায়ের দোকানটা তো খোলা আছে।তাতেই বাঁচোয়া বাবা।" কিন্তু পেছনে দাঁড়ানো লোকটার ফোনে কথা বলা শুনে কেকার বুুকটা এবার ভয়ে ঢিপঢিপ করতে লাগলো ।
লোকটা কাউকে ফোনের ওপারে বলছিল "থাক থাক গলা, হাত,-পা আজ তুই কিচ্ছু কাটবিনা। রেখে দে ।আজ আরও একটা পেয়েছি।আমার কাছেই আছে। কিছুক্ষণ পরে নিয়ে যাবো ।তারপর একসাথে দুুটোরই গলা ,হাত,পা কেটে দেবো বুঝলি ।এখন তুই রাখ ।আরে, বললাম তো সামনের টাকেও তুলে নেবো ।"
লোকটার কথা শুনে কেকা _"ও মাগো! বাবাগো !বাঁচাও বলে এক দৌড়ে সোজা চায়ের দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ল। চায়ের দোকানে যে জনা দুয়েক লোক ছিল তারাতো রীতিমত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলতে লাগলো _"কি হয়েছে?কি হয়েছে?"
এর মধ্যে ঐ লোকটাও দৌড়ে কেকার গাঘেষে দাঁড়িয়ে বলে_"কি হয়েছে দিদি ?আপনি এমন করছেন কেন?"
কেকা_" এমন করছি মানে? আপনি সেই তখন থেকে আমার পিছু নিয়েছেন। আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন ! আবার আমার গলা, হাত, পা কাটারও ফন্দি করছেন?আপনাকে তো এক্ষুনি পুলিশে দেওয়া উচিত।"
লোকটি কেকাকে বলল _"আরে দিদি আপনি ভুল করছেন। আমি আপনাদের পাড়াতে ভাড়া এসেছি ।ওখানে একটা দর্জির দোকান খুলেছি মাসখানেক আগে ।আপনি হয়তো আমাকে চেনেন না ,কিন্তু আমি আপনাকে রোজই অফিসে আসতে দেখি। আপনি একা একা হেঁটে আসছেন এত রাতে ।তাতে আবার শুনশান রাস্তা দিয়ে, তাই আমিও আপনার সাথে সাথে আসছিলাম। আমি তো আপনাকে দেখেই চিনেছি ।তাছাড়া ভাবলাম, আমাদের ওদিকটাতে যেতে রাতে যেহেতু সহজে টোটো পাওয়া যায় না, তাই দুজন প্যাসেঞ্জার দেখলে হয়তো টোটোওয়ালাও যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যাবেন। তাই আপনার পিছু পিছু আসছিলাম ।"
কেকা _"তাহলে আপনি আমায় ধরে নিয়ে গিয়ে হাত, পা ,গলা কাটার কথা কেন বলছিলেন ?"
লোকটি _"আরে না না দিদি। বললাম না আমি দর্জির কাজ করি। সালোয়ার কামিজের হাতা ,গলা ,কাটার কথা বলছিলাম আমার দোকানের ছেলেটিকে ।যাতে ও আগেই না কাটে ।আমি আরেকটা অর্ডারের কাপড় নিয়ে যাচ্ছি তো তাই।এই দেখুন দিদি।"বলে ব্যাগে রাখা কাপড় বের করে দেখাতে লাগলো।
কেকার মনে পড়ে গেল_ মা কিছু দিন আগেই তো বলেছিল পাড়ায় এক নতুন দর্জি এসেছে। খুব নাকি ভালো কাজ জানে লোকটা। তাছাড়া মজুরি টাও নাকি অনেক কম নেয় ।আর ব্যবহারটাও নাকি খুব ভালো লোকটার।
এরপর মুখের মাস্কটিও খুলে ফেললো লোকটা।
মাস্ক খুলতেই লোকটার মুখটা দেখেই কেকা মনে মনে বললো_"সর্বনাশ! কিছুদিন আগেই তো এই লোকটাই তার শাড়ীর ফলস ,পিকো করে পৌঁছে দিয়েছিল তাদের বাড়ীতে, মায়ের হাতে। অফিসে বেরোনোর তাড়াহুড়োর সময় একঝলক দেখেছিল তো কেকা এই মুখটাই!"
সোনার গোপাল চুরি
সাগরিকা কর্মকার
সকাল থেকে একটা হইচই কান্ড বিন্দি পিসির ঘরের দরজার সামনে| সে কি না দোর বন্ধ করে বসে কেঁদে চলছে আর বলেই চলছে " গোপাল ফিরে না পেলে জলও স্পর্শ করবো না|" ভট্টাচার্য বাড়িতে এরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি কর্তামা আত্ম প্রত্যয়র সঙ্গে বলেছিলেন |বিন্দি পিসি কে সেই ছোট্ট বেলায় তাঁর ঠাকুরমা এই সোনার গোপাল টি দিয়েছিলেন, ওঁনাদের বাড়ির পূর্ব পুরুষের সময় কার | গোপালটির চূড়ায় দুটি পান্না ও একটি নীলা পাথর রয়েছে| বর্তমান বাজারে যার মূল্য অনেক |বিশাল বড়ো বাড়ির বড় উঠোন, একটি মাত্র সিঁড়ি দু দিকে দুটি পরিবার একেবারে যেন অচেনা, এক মাত্র বিপদে-আপদে এ ওর মুখ দেখে | বিন্দি পিসির এক মাত্র মেয়ে পারমিতার বর অজয় বাবু বেশ হন্ত-দন্ত হয়ে আসলেন ঘটনা শুনে| সকলের মুখের দিকে এক বার তাকিয়ে বললেন " পুলিশের খবর দিতে হবে|" অপর দিকে পিসিমার এক মাত্র ভাস্তা প্রকাশ বাবু ঘর আপত্তি করেন| পারমিতাও মায়ের খবর পেয়ে ছুটে আসেন | অনেক অনুরোধ করে মা কে দরজা খোলান এবং কথা দেন যতক্ষণ না গোপাল খুঁজে পাওয়া যাবে ততক্ষণ এই বাড়িতে থাকবে| বিষয়টা বুঝে গোয়েন্দা বিভাগে ফোন করেন ওনারা মিসেস ইলোরা সেনের ফোন নম্বর দেন| মিসেস সেনকে ফোন করলে তিনি জানান আজ ব্যস্ত কাল সকালে আসবেন, ঠিকানাটা হোয়াটস্যাপ করে দিতে| পর দিন সকালে মিসেস সেন তাঁর আসিস্টান্ট সোহিনী কে নিয়ে সদর গেট খুলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন| বাড়িটাকে এক নজরে ভালো করে দেখে নিলেন মিসেস সেন| পারমিতা নিচে এসে ওঁনাদের মায়ের ঘরে নিয়ে গেলেন| বিন্দি পিসির আসল নাম বৃন্দদেবী মুখ্যেপাধ্যায়| ফর্সা লাল টকটকে চেহারা| কাজের মেয়েটি চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো| আগের কাজের মেয়েটিকে ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে নতুন রাখা হয়েছে মনিকে| কথায় কথায় জানতে পারে অজয় বাবু আগের মেয়ে টিকে ছাড়িয়ে দিয়েছে| অপর দিকে বিন্দি পিসির এক মাত্র ভাই রামেশ্বর বাবু বেশ কয়েক বছর হলো গত হয়েছেন| তাঁর পরিবারে তাঁর স্ত্রী কমলা দেবী তাঁর এক মাত্র পুত্র প্রকাশ বাবু ও পুত্রবধূ নীলিমা এবং নাতনি সাত বছরের স্নেহা কে নিয়ে থাকেন | মিসেস সেন সকলের সাথে কথা বললেন বাড়ির| প্রকাশ বাবুর অবস্থা বর্তমান যে সচ্ছল নয় বেশ বুঝতে পারলেন| সে দিনের মতো কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার সময় স্নেহা কিছু বলতে চাইছিলো, কিন্তু মায়ের ধমকেই চুপ করে গেলো| পর দিন সকাল সাতটায় মিসেস সেন চলে আসলেন ভট্টাচার্য বাড়িতে| পিসিমা স্নান সেরে ঘরে মালা জপছিলেন| কিন্তু ঘরের এক কোনে একটি প্রসাদের থালা মিসেস সেনের চোখে পড়লো, নোট করলেন| পিসিমার ঘরের জানালার ঠিক নিচেই বাগান ফুলের | বাগানটিকে দেখার নাম করে মিসেস সেন নিচে নেমে আসলেন এবং সেখানে জানালার ঠিক নিচে একটা দামি সিগরাটের অবশিষ্ট পেলেন| রেখে দিলেন| ওদিকে গিন্নিমা কারো সাথে চেঁচামেচি করছেন বাজারের হিসেবে নিয়ে| যে লোক টিকে আজই প্রথম দেখলেন মিসেস সেন| ভোলা এই বাড়ির পুরানো ভৃত্য| রাগে গজগজ করতে বাগানের এক কোনে এসে একটি দামি সিগারেট ধারালো| মিসেস সেন ভোলার সাথে পরিচয় হতে গিয়ে তাঁর মনের ভেতরের রাগ গুলো বেশ বুঝতে পারলেন | বেশ কয়েক মাস যাবত ও কাজের টাকা ঠিক মতো পাচ্ছে না| এদিকে অজয় বাবু দু দিনের জন্য জন্য বাইরে গিয়েছেন| পারমিতা সেদিন মিসেস সেনদের দুপুর বেলায় জোর করে খাওয়ালেন | এক দিন বাদে মিসেস সেন আবার আসলেন একেবারে প্রস্তুত হয়ে ও বাড়ির সবাইকে এক সাথে হতে বললেন | পিসিমাকে ডেকে বললেন " সোনার গোপাল আপনি সরিয়েছেন " পিসিমা চিৎকার করে বললেন "এ কখনো হতে পারে" | মিসেস সেন বললেন "নিশ্চই হতে পারে, আপনিই সরিয়েছেন জোড় দিয়ে বললেন |" সবাই একসাথে বললেন "তাহলে এতো নাটকের কি প্রয়োজন " | পারমিতার চোখে জল | পিসিমা কেঁদে ফেললেন " মা, আসল চোরকে ধরতে গিয়েই আমার এই নাটক, কিছু দিন থেকেই আমার সম্পত্তির দলিল সরাতে চায়, এমন কেউ আছে আমার সন্দেহ হচ্ছিলো এটাই আমার উদ্দেশ সন্দেহ ব্যক্তি কে ধরা| " অজয় বাবু ঘরের ভেতর প্রবেশ করেই বললেন " সমস্যা সমাধান তো হয়েই গেলো" বারে বেরিয়ে এসে নিশ্চিন্তে দামি সিগারেট ধরালেন| মিস সেনের বুঝতে আর অসুবিধে হলো না ১. প্রকাশ বাবু লোকডাউন এর জন্য দু মাস থেকে কাজ বন্ধ | ২. কমলা দেবীর " চোখর বালি " বিন্দি পিসি কারণ শশুর মশাইয়ের সম্পতি বিধবা মেয়ে কে সমান ভাগ করে দিয়েছিলেন | ৩. অজয় বাবু নেশাগ্রস্ত | ৪. এছাড়া পারমিতার সে দিন কাবার পরিবেশন করার সময় ওর হাতে কালচে দাগ মিসেস সেনের চোখে পরেছিল | ৫. স্নেহার কাছ থেকে জাতে পারে প্রকাশ বাবু বাড়িটিকে বাইরের কিছু লোককে এনে দেখাচ্ছিলেন এই নিয়ে পিসি ঠাম্মার সাথে কথা কাটাকাটি| যদিও প্রকাশ বাবু বাড়িটাকে প্রোমোটারের কাছে দিতে চেয়েছিলন পিসিমার দলিল চুরি করতে চাইনি কারণ সে খুব সৎ লোক। বাগানের অবশিষ্ট সিগারেট, ভোলার সিগারেট এবং অজয়বাবুর সিগারেট কিভাবে এক হলে সন্দেহ ব্যক্তি সামনেই| পারমিতা লজ্জায় ও ঘেন্নায় অজয়বাবুর দিকে তাকালেন|
মিসেস সেন সোনার গোপালকে প্রণাম করে সোহিনীকে নিয়ে পিসিমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন|
লোভের পরিণতি মজনু মিয়া
ধান ভাঙ্গানোর কাজ, রমিজ ধান ভাঙ্গায় প্রতিদিন সকাল থেকে তিনটে পর্যন্ত। প্রথমে ঘর খোলে তারপর ঘর ঝাড়ু দেয়,কয়েকটি ধাপাড় আছে তা খোলে, আগরবাতি জ্বালায় দোয়া কালাম পড়ে কাজ শুরু করে।
একটা দোয়েল পাখি,প্রতিদিন সকাল বেলা মেশিন ঘরের পাশের লেবু গাছে বসে বসে শিস দেয়,কখন ঘর খুলবে। দোয়েল পাখি মাকড়সা খায় তেলাপোকা খায়,এগুলো মেশিন ঘরের ভেতর অনেক থাকে। ঘর খোলার সাথে সাথে ধাপাড়ের নিচ দিয়ে ঘরে আসে। এমন অবস্থাতে দোয়েল এসে পৌঁছেছে যে দোয়েল এখন মানুষকেও খুব বেশি ভয় পায় না!
মেশিন চলছে ফিতাওয়ালা মেশিন, দোয়েল ফিতার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে মাকড়সা ও তেলাপোকা ধরে নিয়ে লেবুগাছে বসে খায় আবার আসে। বেশ কিছু দিন দেখলাম, হঠাৎ মনে হলো,পাখিটি বেশি লোভ করতেছে এটার বিপদ হবে! কয়েক দিন তাড়িয়ে দিলাম কিন্তু মানে না, অনেক খাবার মিলে এখানে তাই ফাঁকে যায় না।
আজ সকালে একই ভাবে মাকড়সা ধরার জন্য চালের উঁচুতে উড়ে গেলো, উড়ে গিয়ে মাকড়সা ধরে নিচের দিকে হঠাৎ ধপাৎ করে পড়ে গেলো! পড়েছে তো ফিতার উপরে ফিতা তো ঘুড়ছে দ্রুত! সাথে সাথে দোয়েল পাখিটি ছিটকানি দিয়ে দূরে গিয়ে পড়লো,কিছু সময় ছটপট করে মারা গেলো! যদিও ঘটনাটি দুঃখ জনক তবু আমার কিছু করার নেই। লোভ তার খাওয়ার প্রতি, বারণ মানলো না। জীবন দিয়ে বুঝালো অতি লোভ ক্ষতির কারণ!
তখন রমিজ কয়েক জন মানুষ কে একটা ঘটনা বললো, উত্তর বাড়ির রাসু বসু দুই জন আম পাড়ার জন্য গাছে গেছে সব আম পেড়েছে পুকুরের উপর একটা ডালে কয়েকটি আম আছে তা পাড়া খুব কষ্ট! বসু বললো,থাক্ পাড়ান লাগবে না। কিন্তু রাসু বললো, আমি পাড়ি তুই দেখ্।
গাছের ডালের মাঝে পোকায় খেয়েছে তা খেয়াল করেনি রাসু! বাঁকা হয়ে হাত বাড়িয়ে আম ধরার জন্য নিচু হতেই মড়মড় শব্দ করে ডাল ভেঙে পানিতে পড়লো! বসু ডাকাডাকি করে কাকা ভাই কে এনে রাসুকে উপরে উঠিয়ে ভালো করলো।
বেশি লোভ ভালো না, তখন বসু রাসুকে বললো। আর রাসু তখন বললো,ঠিক বলছস ভাই, আমি যদি শুকনো মাটিতে পড়তাম তা হলে মরে যেতাম নয়তো হাত পা ভাঙ্গতো!
দোয়েল পাখিটিকে বুঝানো যাবে না কারণ,সে একটা পাখি তার অতটা বুঝার ক্ষমতা নেই। কিন্তু আমরা, মানুষ আমরা বুঝি,ছেলে-মেয়েদের কেও বুঝাবো, বেশি লোভ করা মোটেও ভালো না।
গদ্য প্রয়াস
আলো দাও.. আলো দাও
অর্পিতা মুখার্জী চক্রবর্তী
ভোরের আলো ফুটে উঠবার আগেই তাঁর যাত্রা শুরু প্রতীক্ষার,আরাধনার, অঞ্জলির, ভক্তির মায়াডোরের পথে আশীর্বচন হয়ে। আজকের এই তিথিতে শুধুই তিনি। তাঁর জন্যই যত আয়োজন। ঊষার তন্দ্রামেদুর আলোর আভা যেখানে এসে শেষরাতের আঁধারের হাত ধরে তার জাদুস্পর্শে দ্যুতি ছড়ায় দিকে দিকে,সেই আলো- আঁধারির সন্ধিক্ষণে হাওয়ায় পাল তুলে ভেসে আসে তাঁর নরম পালকের পাখার উড়োজাহাজখানি। গাছে গাছে উঁকি দেওয়া আমের মুকুলে, যবের শিষে, খাগড়ার বনে, গাঁদা-পলাশের আকুতিতে লেখা হয় তাঁরই নাম,তারই বরণের প্রত্যাশা। শ্বেত শুভ্র তাঁকে ঘিরে এক আশ্চর্য প্রশান্তি, মনোমুগ্ধকর প্রাপ্তির এক অনবদ্য আবেশ। সময়ের প্রবাহে তাঁকে ঘিরে আয়োজনে রঙের প্রলেপ গাঢ় হয়েছে হয়তো, হয়তো বা কৃত্রিমতার অনর্থক আবেগের প্রকাশভঙ্গিতে জৌলুসের কাছে হার মেনেছে নিমগ্নতা; তবুও তাঁর ব্রতীদের নব নব সৃজনশীলতার উত্তরণ ঘটেছে তাঁরই আশীর্বাদধন্য স্নেহস্পর্শে। তাঁর আগমনের মঙ্গল শঙ্খ ধ্বনিত হয়েছে সেকালে, একালে বারংবার।
চিরপরিচিত ভালোলাগা গুলোকে ছাপিয়ে আজ তাঁর মনে ছবি আঁকে অসুখের প্রগাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন এক অচেনা জগৎ। আলো ঝরানো যে দুয়ারগুলি দীর্ঘকাল ধরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে দুহাত বাড়িয়ে দিয়েছে, অসুখের এই মনমরা আবহে তাদের কপাটও আজ তাঁর জন্য আন্তরিকতার ছোঁয়া নিয়ে উন্মুক্ত হবে কিনা, জানা নেই তাঁর। যদিও বা প্রবেশের পথে বিঘ্ন না ঘটে তবুও বীণার সুরহীন মূর্ছনার মতোই রুদ্ধদ্বার শিক্ষায়তনগুলির কচিকাঁচাদের কলতানবিহীন অর্ঘ্যের উপাচার প্রাণহীন এক লোকাচার হয়েই থেকে যাবে শুধু।
গভীর অসুখ তো সমাজের সর্বস্তরে। মারণ ভাইরাসও অতি তুচ্ছ এই গভীর অন্ধকারের কাছে। অশিক্ষার অন্ধকার, অজ্ঞনতার অন্ধকার, কুসংস্কারের অন্ধকার, হিংসা, অমানবিকতা, হানাহানি,নৃশংসতা, লোভ, অহংকারের মতো ভয়াবহ রিপুর দাপটে পথ হারাচ্ছে আশার আলোয় পরিপূর্ণ সম্ভাবনাময় প্রত্যাশাদের ঠিকানা। শ্বেতপদ্মাসনা দেবীর অকুণ্ঠ বরদানও পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে এই অশুভ বোধগুলির কাছে। সুস্থ সংস্কৃতি, সুবিন্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত শিল্প তাই মাথা কুটে মরেছে বারংবার।
তবুও আবার তিনি এসেই বিদ্যা, ভক্তি, জ্ঞান ও শক্তির আলো হয়ে বিরাজ করেছেন তাঁর স্নিগ্ধ নয়নাভিরাম রূপটি নিয়ে। কারো আস্থার স্পর্শ যখন কচি একটি হাতকে শ্লেটের গায়ে 'অ','আ', 'ক', 'খ' - এর আবর্তে আশ্বাস জোগায়, গীতিকারের আলেখ্য যখন ভিন্ন মাত্রায় সেজে ওঠে, সাহিত্যিক যখন জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটি উপহার দেন তাঁর ভালোবাসার পাঠকদের, কবির ভিন্ন স্বাদের ভাবনা যখন গভীর অনুভূতির ঝড় তোলে, সুরকারের সৃষ্টিতে যখন যন্ত্রানুষঙ্গে ওঠে সুরের কলরোল, গায়কীতে শ্রোতার তৃপ্তি, এতসবের পরেও অসামান্য সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাতোয়ারা না হয়ে আত্মতুষ্টির অভাববোধ যখন প্রতিনিয়ত খুঁজে ফেরে উৎকর্ষের সেরাকে, উন্নতির শিখরে ওঠা নিরহংকার মন যখন বিনয়ে মাথা নত করে, এমন সত্তার কাছে, এমন সদিচ্ছার কাছে, এমন পরিশ্রমের কাছে, এমন বিশ্বাস ও ভরসার কাছে দেবীর আসন পাতা থাকে। অন্ধকার সে যতই কালো হোক ,তার আচ্ছন্নতাকে ফিকে হতেই হয় সেই ইচ্ছেশক্তি ও শুভবোধের কাছে।
সমস্ত তমসার শেষে শ্রীপঞ্চমী তার ঐতিহ্যে অটুট থাকুক। বুকভরা বিশ্বাসে দেবীকে প্রণাম জানিয়ে দেবী বন্দনার পরের সকালে বেলপাতায় লেখা দেবীর নাম প্রেরণা জোগাক নতুন সৃষ্টির, নতুন শপথের। আগামীদিনের নীরোগ পৃথিবীতে উৎসবের মুখরতায় একরাশ বাসন্তী খুশি হয়ে আবার ফিরে আসুক ছাত্র- ছাত্রীদের পরম আনন্দের এই ভালোবাসার দিনটি।
শীত - ছবি চন্দ্রানী চৌধুরী
স্মৃতিতে শীতছবি ভেসে উঠলে আজও আলোকজ্জ্বল বর্ণময় কিশোরীবেলা চোখের সামনে দেখতে পাই।আমাদের ছোটবেলায় এখনকার মতো এতো পরীক্ষার হিড়িক ছিল না । বছরে দুটো পরীক্ষা হত। পুজোর পর হত বার্ষিক পরীক্ষা। আর পরীক্ষা শেষে শুধু ছুটির মজা।
আমি ডুয়ার্সের মেয়ে শীতের কুয়াশা মাখা ভোরের অনেক স্মৃতি ক্যানভাসে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।
মায়ের হাতের আতপ চালের ভাত, আলু সেদ্ধ , ফুলকপির বড়া, ঘি বা মাখন এই ছিল পুরো শীতকাল জুড়ে আমাদের ব্রেকফাস্ট। আজও শীত এলেই সেই স্বাদ ফিরে পাবার চেষ্টা করি ।
শীতকাল আর কমলালেবু একে অন্যের পরিপূরক। বাবা কমলালেবু নিয়ে আসতেন । আমরা দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রোদ্দুর পিঠে নিয়ে সবাই মিলে কমলালেবু খেতাম ।
শীতের প্রসঙ্গ উঠলেই মনে পড়ে নলেন গুড়ের পিঠে পায়েসের কথা ।পাড়ার সবার ঘরে পিঠে খাবার নেমন্তন্ন থাকত। এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে বাটিতে করে পিঠে পায়েস দেওয়া নেওয়াও চলত। শহুরে জীবনে এই আন্তরিকতা আজ বিরল ।
শীতের দুপুরে পাড়ায় মা কাকিমারা সবাই একে অন্যের কাছ থেকে নানা রকম ডিজাইন শিখে রকমারী সোয়েটার বানাতেন । কেনা সোয়েটার পরার চল তখন ছিল না । ছোটদের উল বোনার হাতেখড়িও ওখান থেকেই হয়ে যেত । আজ ঘরে ঘরে রেডিমেড সোয়েটার কেনার চল ।হারিয়ে গেছে উল বোনার সেই দিন ।
তখনকার দিনে ক্রিকেটের এতো দাপট ছিল না । শীত পরলেই আমরা প্রত্যেকদিন বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতাম ।বড়রা রাতে লাইটের ব্যবস্থা করে খেলার আয়োজন করতেন । সে এক দারুন মজা ।
শীত পড়লেই স্কুল ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত । সব জায়গায় আমরা অংশগ্রহণ করতাম।পুরস্কার না পেলেও দুঃখ নেই - সারাদিন বন্ধুদের সাথে অনাবিল আনন্দে মাঠে দাপিয়ে বেড়াতাম ।
শীতে মাঝেমাঝেই পিকনিক হত । তবে সবচেয়ে ভালো লাগত ছোটরা সবাই চাল, আলু , ডিম ইত্যাদি নিজেদের বাড়ি থেকে এনে অপটু হাতে রান্না করে আধসেদ্ধ খাবারে পিকনিকের আয়োজন ।
শীত এলেই পাড়ায় পাড়ায় ছোট বড় সবাই মিলে আয়োজন করা হত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের । যেহেতু তখন সবার বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে যেত সেজন্য সবাই অংশগ্রহণ করতাম । নাচ, গান, আবৃত্তি ,নাটকে মুখরিত হয়ে উঠত শীতকালীন সন্ধ্যা ।
শীত এলেই আরো আরো অনেক স্মৃতি মনের কোণে ভীড় করে। শীতের শুরুতে মায়ের নাটাই ব্রত, শীত -কুয়াশায় মোড়া সকালে বন্ধুরা একসাথে টিউশন যাওয়া ,স্কুলের সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব পেয়ে হঠাৎ বড় হয়ে ওঠা এমন আরো কত কি.... আজকের অন্যরকম জীবনে যা কোনভাবেই কোথাও খুঁজে
পাই না ।
মন খারাপের মাঘ সকাল
সোমা দে
অদ্ভুত জীবন যাপন চলছে কিছু ধার করা সুখ প্রসাধনীর মতন চোখে মুখে লেপ্টে রাখছি আজকাল। প্রিয় মানুষটা শীতঘুমে গেছে প্রায় অনেক দিন হলো তবুও তার ফেলে যাওয়া শেষ স্পর্শগুলো জোর জবরদস্তি রোজ আমার মধ্যে জ্বলে ওঠে যেমনভাবে সকালবেলায় রাস্তার পাশের মাঘের ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাওয়া ভবঘুরে কুড়িয়ে আনা কুয়াশা ভেজা পাতাগুলোতে আগুন ধরাবার চেষ্টা করে একটু উষ্ণ হবার লোভে। ঘুম ভাঙা চোখে বাড়ির পাশের মাঠজুড়ে হলদে সর্ষে ক্ষেত এখন আর দেখতে ভালো লাগে না ভেতরটা মোচড় দিয়ে মনে করিয়ে দেয় হলুদ শাড়িটার কথা যার ভাঁজে ভাঁজে আজও ভালোবাসার প্রতিশ্রুতিগুলো অক্ষত হয়তো গায়ে জড়াতে নিলেই সেগুলো ঝরে যাবে পর্নমোচী বৃক্ষের পাতাগুলোর মতো আর হাওয়ার টানে কোন এক জায়গায় জড়ো হয়ে আবর্জনার স্তূপে পরিনত হবে । ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপটাও বেখেয়ালির সুযোগ নিয়ে কখন যে ফেটে যাওয়া ঠোঁট পুড়িয়ে আঘাতের পারদটা আরও একটু চড়িয়ে দেয় বুঝতে পারিনা! নাহ্ এবার সময় এসেছে ঐ শীতসিক্ত খেঁজুরের রস চেখে দেখবার শুনেছি খালি পেটে খেলে নাকি নেশা হয় সব ভুলে যাওয়া যায় , এই তাহলে মন খারাপের মোক্ষম দাওয়াই বেশ তবে তাই করা যাক সাথে অনুপমদার গানটাও থাক ..
" যত শুকনো পেঁয়াজকলি ফ্রিজের শীতে
আমি অবেলার ডালভাতে ফুরিয়ে গেছি
গেলাসের জলে ভাসবো না না না না না না ..."
আমাকে তবে আমার মতোই থাকতে দেওয়া হোক বিষন্নতার মাঘের সকালে ।
ভ্রমণ
অরণ্যের
সবুজ ছায়ায়
চিত্রা পাল
বেশ কিছুদিন পাহাড়ে পর্বতে ঘুরে বেড়ানোর পরে
এখানে মানে এই সমতলের সবুজ অরণ্যে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। সবুজ অরণ্য বলতে আমি
কাজিরাঙ্গা অরণ্যের কথাই বলছি। আসলে আমরা বেরিয়েছি অরুণাচল ভ্রমণে। ঘুরতে ঘুরতে
গেলাম তাওয়াং, সেখানে সব ঘুরে দেখে চলে এলাম দিরাং শহরে। দিরাং থেকে যাত্রা করে
আমরা চলে এলাম কাজিরাঙ্গা অরণ্যে। যাওয়া
আসার সময়ে পেরিয়ে এলাম মহানদ ব্রহ্মপুত্র। মস্ত নদী বিরাট,প্রশস্ত একেবারে একূল
থেকে ওকূল দেখা যায় না। আগে ফেরিবোটে করে পারাপার হতো, এখন ব্রীজ হয়ে যাওয়াতে মস্ত
সুবিধে গাড়িতে একেবারেই আসা যায়।
বিকেল বিকেলেই এসে পৌঁছে গেলাম
কাজিরাঙ্গায়। এখানে এখন দুরাতের অবস্থান। এখানে এসে মন ভালো হয়ে গেলো।তবে আগে কি
খারাপ ছিলো? না, ঠিক তা নয়। গৌহাটি থেকে আসামের সীমান্ত শহর ভালুকপং এলাম।প্রায়
তারপর থেকেই পার্বত্য প্রকৃতি শুরু।আর অরুণাচল একেবারে পার্বত্য অঞ্চলে।।বমডিলা তাওয়াং দিরাং সবই পাহাড়ি শহর।
তারপরে সমতলে নেমে এসে যখন এই অরণ্য অঞ্চলে এলাম, তখন একটা অন্যরকম ভালো লাগায়
মনভরে গেলো।এই সবুজের সমারোহ, কত রকমের পাখ্পাখালি,কত ঘাসবন, কত উচুঁ উচুঁ বড় বড়
গাছের লতাপাতার বনজঙ্গল এগুলো একেবারে অন্যরকমের।
আমরা পরদিন সকালে প্রাতঃরাশ সেরে চারপাশের
অঞ্চলটাকে দেখতে বেরোলাম। আমাদের অবস্থানের কাছাকাছি আছে পায়েহাঁটা দূরত্বে একটা
ছোট বাজারমতো। সেখানে থেকেই ঘুরে এলাম খানিক। চারদিকে নিবিড় সবুজ। খুব পাখির ডাক শোনা যায়। বাতাসে
কেমন একটা সবুজের, মাটির সোঁদা গন্ধ। বেলা তিনটে নাগাদ হুডখোলা জিপে রওনা দিলাম
আমরা অরণ্য দর্শনে।সবাই আমরা সচেতন এখানকার বসবাসকারি প্রাণীদের দেখবো বলে। তখন
কিছু একটা দেখলেই আমরা সবাই দারুণ উত্তেজিত।
হুডখোলা জিপ আমাদের নিয়ে চললো বড়বড় গাছের তলা
দিয়ে,ঝির্ঝিরে নদী নাকি নালা যাই হোক তাই পেরিয়ে, জল জঙ্গল মাড়িয়ে। বাবা,ওখানকার
প্রাণীরা,ওদের জায়গায় খুব প্রত্যয়ী। একদল হরিণ ছুটে চলেছে। দলে দলে গন্ডাররা সাহসী
পদক্ষেপে সপরিবারে বাচ্ছাকাছা নিয়ে জলায় এসেছে,জল খাবে বলে বোধ হয়।বাইসনরা মাথা
উঁচু করে দেখছে। বেশ মোটাসোটা বর্মচর্মপরা গন্ডার রাজকীয়ভঙ্গিতে চলে গেলো বনের
ভেতরে। আসলে এদের নিজেদের ভূমিতে এদের চালচলনই অন্যরকম। বুনো হাতিদের দেখলাম দূর
থেকে কিছুক্ষণের জন্য। এই বনাঞ্চলে প্রচুর পাখির বাস। দলে দলে উড়ে চলেছে এদিক থেকে
সেদিকে। অনেকক্ষণ ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় ফিরে এলাম আপন আশ্রয়ে।
পরেরদিন সকালে গেলাম এক অর্কিড ক্যাক্টাসের
বাগানে। অনেক দুষ্প্রাপ্য অর্কিড ওখানে রাখা আছে সযত্নে। সন্ধ্যায় দেখা হলো অসমীয়া
লোকনৃত্য। এই লোকনৃত্যের অনুষ্ঠান দেখা আমাদের পরম প্রাপ্তি।
এরপরে ঘরে ফেরার পালা। অরণ্যের শ্যামলতা, পাখির
কূজন, সব পেরিয়ে আবার নিজের সীমানায়। তবে ওরা আহ্বান জানাচ্ছে,আবার এসো বলে সেটাও
যে ভোলার নয়।
রম্য রচনা
আলু আর আমি
স্বপন দত্ত
কদিন থেকে গিন্নির খ্যাচ্খ্যাচানি ---- " কি গো আলু কবে আনবে ? আলু ছাড়া কিদিয়ে রান্না হবে?" আমি না শোনার ভান করে থাকি,উত্তর দেয়না। গিন্নি এবার সুর সপ্তমে তুলে বলে, " কি গো,তুমি কি বয়রা হয়ে গেছ? কখন থেকে বকে যাচ্ছি, কানে ঢোকেনা ?"
এবার উত্তর না দিলে বেধে যাবে দক্ষ যজ্ঞ।তাই বলি," না এখনো বয়রা হইনি, তবে খুব শিগগির হয়ে যাব। সব ওই আলুর দোষ।"
"বুঝলাম না,কি আবোল তাবোল বকছ।এখনতো দেখছি,শুধু কান টাই নয়, মাথাটাও গেছে " ---- বলে উঠলো গিন্নি।
আসলে বাজারে যাওয়ার নাম শুনলেই হয় পেট খারাপ,নয় মাথা খারাপ,নয় কান খারাপ লেগেই আছে। এমনিতেই লাগাম ছাড়া দর সব কিছুরই, তার উপর আবার আলু তো একেবারে উঠে গেছে জাতে। ৮ --১০ টাকা কিলো দরের আলু, এক্কে বারে হাফ সেঞ্চুরি। এসি রুমে ঢুকেছে তো ঢুকেছেই,বার হতেই চায়না।হিমঘরে যে কি মজা,কে জানে? আরে বাপু,এখনতো হালকা ঠান্ডা পড়ে গেছে, এখন কিভাবে ওখানে লটকে পড়ে আছিস।
ব্যাপারটা হল অন্য জায়গায়। ও খুব ভালভাবে জেনে গেছে যে ওর কোন বিকল্প নেই। আলুর বদলে চলবেনা কচু বা কাঁচকলা ও। তাই ও একমেবাদ্বিতিয়ম। যতই দেশে শতকরা আশিভাগ লোক আক্রান্ত মধুমেহে,কিন্তু আলু মোহে আকৃষ্ট লোকের সংখ্যা কমছে কই?
কি সে নেই আলু? ঝালে, ঝোলে, অম্বলে মাছে,মাংসে,চিপসে,ফুচকা য়,আলুকাবলিতে খাবলাখাবলি করে সেই আলু।তাই আলু সর্বত্রগামী। আলুর মুখে লাগাম দেবে সাধ্য কার ? তাই দর বেঁধেও নেই কোন লাভ। সুফল বাংলাই বলো, আর এনফোর্সমেন্ট ই বলো,সব সোর্স ই আলুতেই এসে কুপোকাত।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও গিন্নির কাছ থেকে একটা থলে নিয়ে রওনা দিই,বাজারের দিকে নেহাৎ
ব্যাজার মুখেই।যা আছে কপালে দেখা যাবে।আজ আলু নেবো ই।প্রয়োজনে আমার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত আলু খুলে যায় যাক,সেও ভি আচ্ছা,আলু আজ চাই!
প্রথমে পুরো গ্যাট গর্চা দিয়ে নিলাম, দুই কেজি আলু,গেল কর করে একটা একশর পাতি।এরপর পেঁয়াজ।সেও কম কিসে? ঝাঁজে সেও অস্থির।সেটা অবশ্য এক কেজিতে দিলাম ক্ষান্ত করে মনে মনে ভাবলাম,বাড়ি গিয়ে গিন্নিকে বলতে হবে,দুখানা লাগলে আধখানা দিয়ে কাজ চালাবে।অন্যথা হলে আমার পাঁজর খুলে নিতে পার,আর পেঁয়াজের পরত খুলতে
হবেনা।
যাক বাজার থেকে আমার বাড়ি বেশ দূরে নয়।মাত্র তো দুটো জিনিষ,থলেটা হাতে ধরে যাচ্ছি হনহন করে।কেউ ডাকলে শুধু বলছি, "দাদা কেটে যাচ্ছে,কিন্তু রক্ত বেরোচ্ছে না।" যাহোক বাড়ি পৌঁছে গিন্নির হাতে থলেটা বীর দর্পে তুলে দিয়ে বললাম, " আবার ১৫ দিন পর বাজারমুখী হতে বলো।তানাহলে, নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক। এক কাপ চা দিও।" এবার গিয়ে সবে মাত্র খবরের কাগজ টা নিয়ে বসেছি, এমন সময় রান্নাঘর থেকে চিল চিৎকার গিন্নির। " আলু কই গো ? মাত্র দুখানা আলু ! কি ব্যাপার দুজনে কি একটা একটা করেই খাব না নাড়াচাড়া করবো ?"
আমারতো অবাক হবার পালা।আরে দুকেজি আলু,দুখানা হবে কেন ? গিন্নিকে বলি," আরে ভাল করে দেখো। থাকবে থলের মধ্যেই,যাবে কোথায়?" গিন্নির উত্তর,"সব মেঝেতেই ঢেলে দিয়েছি।নিজে দেখে যাও। আলু কোথায়?"
আলু আলু করে একেবারে আলুথালু অবস্থা।গিন্নির তর্জনে গর্জনে শুধু আমার বাড়ি
নয়,সমস্ত পাড়ায় আলুরোষে আলোড়িত।
অগত্যা আলুর অবস্থান পরিদর্শনে যেতে হয় রান্নাঘরে।গিয়ে দেখি,সত্যি মাত্র দুখানা আলু! কি ব্যাপার, ভেল কি নাকী? এবার থলেটা খুলে দেখতে গিয়ে চোখ শুধু ছানা বড়া নয় তালের বড়া। থলের নীচে মস্ত বড় বড় দুখানা ছ্যাদা,নিশ্চয়ই গণপতির বাহনের কীর্তি! হা হতোস্মি! এতো মহার্ঘ্য আলু তল দিয়ে গড়িয়ে গেছে।
উপায় কি? আর একখানা অন্য ব্যাগ নিয়ে পটল তুলতে নয়,আলু কুড়োতে বাজার অভিমুখে দিলাম রওনা।দেখি একদল লোক সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা,বুম নিয়ে আসছে আমার
বাড়ির দিকেই। আমাকে দাঁড় করিয়ে নানা ভঙ্গিমার ছবি হতে লাগলো তোলা।এদিকে আমিতো আলুর শোকে পাগল পাগল অবস্থা। মুখে কিছু পারছিনা বলতে। ব্যুম হাতে ধরা ভদ্রলোক বললেন," দাদা, আপনার এই আন্দোলন যে পুরোপুরি অহিংস ছিল তা বোঝাই গেছে।আপনি এই মহার্ঘ্য আলু বাজার
থেকে কিনে ফেলতে ফেলতে এসেছেন। আমরা এটা সবটাই ভিডিও করে রেখেছি।"আমি যত তাদের বোঝাতে চেষ্টা করছি যে এটা আমার কোন প্রতিবাদ নয়,এটা নেহাতই থলে বিপর্যয়।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওনাদের বক্তব্য,"এটা টেলিভিশনে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। এবার যদি নেতা মন্ত্রীদের হয় নিদ্রাভঙ্গ।সত্যিইতো,আলু এখন আমজনতার নাগালের বাইরে।এবার দাদা
আপনি কিছু বলুন।"
আমারতো তখন বিপর্যস্ত অবস্থা।আমি কথা বলার অবস্থায় নেই।ঘটনার আকস্মিকতায় আমার কোঁচা খোলার অবস্থা।মনে মনে ভাবছি, গিন্নি যদি এসময় টিভিটা খুলে বসে থাকে তো সাড়ে সর্বনাশ।এত দরে আলু কিনে রাস্তায় ছড়িয়ে বিপ্লব করা হচ্ছিল। আমার আলুই বার করে দিবে। এ বয়সে আলুর দোষ, মানে গুষ্ঠির ষষ্ঠী পূজা দিয়ে ছাড়বে।ভয়ে ভয়ে বলি," দাদা আমার মানসিক অবস্থা এখন যা,তাতে আর বক্তব্য দেওয়ার ক্ষমতা নেই।আপনারা যা বোঝার বুঝে নিন,আমাকে ছেড়ে দিন।"
অগত্যা কিছু লোক আমার অপারগতা অনুধাবন করতে পেরে ভিড়ের মাঝে একটু রাস্তা করে দেওয়ায় আমি ছুটলাম বাজারের দিকে,যদি এখনো দু চারটে আলু মানিক্য পাওয়া যায়।
কবিতা দ্বিতীয় পর্যায়
পলাশ প্লাবন
অলকানন্দা দে
অমিয় সুখী নীল দিগন্ত পলাশ এল শাখে,চারিধারে গান উদাসীন প্রাণ সমারোহে তরু ডাকে।শরিক হব মহুয়ার গানে ছাপিয়ে হৃদয় মন,নির্ভুল প্রেমে,পূব পশ্চিমে আশীর্বাদি বন।কাতারে কাতারে লাল হলুদে আস্ফালিত সুখ,আঁচল পেতে কুড়িয়ে নেওয়া অভাবিত কৌতুক।শ্যামলা মানুষ সে দেশেরই আতিথেয়তায় রোদ,কানায় কানায় পূর্ণ সাজি ময়ূখ মায়া স্রোত।স্নিগ্ধ সন্ধ্যা,ওড়ে ভালোবাসা আবেশে কাঁপে তারা,দূরে দূরে শাল,দোদুল পিয়াল বসুধা আত্মহারা।নিরবধি ভাসি বনানীর ফাঁকে ক্লান্তিবিহীন আঁখি,খেয়ালের পথে পলাশের সাথে আছে বসন্ত পাখি।সোহাগমাখা খোলামাঠে সাজে ফাগুন বৌ,নৃত্যতালে আবাহনে মাতে পুরুলিয়ার ছৌ।অবকাশে শুনি পাহাড় ছায়ে মরমি সহজিয়া,প্রকৃতির ঋণ,রবে চিরদিন প্রিয়তমা পুরুলিয়া!
আজকাল
দেবর্ষি সরকার
এই শীতের দিনে,
মনে হয় বসি।
বসি সেই পাহাড়ের পাশে।
যেখানে জ্বালানো হয়েছে নিঃশেষের আগুন।
এখনো শোনা যায়নি কোকিলের ডাক।
দানা বাঁধা ওই কুয়াশা,
যাতে রোজ প্রতিবিম্ব পরে আমার।
একটুখানি উষ্ণতার খোঁজে,
চলি ওই পথ দিয়ে।
যেখানে এখনও সভ্যতা যায়নি।
অকাল বর্ষণে
আকাশলীনা ঢোল
অকাল বর্ষণে
ফলেছিল সোনার ফসল,
নরম মাটির কর্ষণে-
ডুবে গেল অথই জলে
হঠাৎ অকাল বর্ষণে।
উপকূলে দুর্যোগেতে,
বন্ধ বাড়ির মূল ফটক-
ব্যর্থ মনে তীর্থে ফেরে
পরিশ্রান্ত পর্যটক।
বসার ঘরে চেয়ার শূন্য,
শূন্য হয়েছে চায়ের কাপ-
মনের ভিতরে হতাশা যখন
বাইরে তখন নিম্নচাপ।
ভিজছে ডাহুক, ভিজছে চাতক,
কেবল ভেজার আকর্ষণে-
ভিজছে পরিযায়ীর ডানা
এমন অকাল বর্ষণে।
বসন্ত প্রেম
লক্ষ্মী বিশ্বাস
সেদিন ছিল গাছ ভর্তি আম্রমুকুল।
তৈরি হয়েছিল প্রেমের উপাখ্যান।
সম্পর্কে পড়েছিল সিলমোহর।
উপলব্ধি হয়েছিল-
এ সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বের নয়।
এ সম্পর্ক শুধু দেহের নয়।
এ সম্পর্ক শুধু মনের নয়।
এ সম্পর্ক আত্মার।
লোকচক্ষুর অন্তরালে-
যে সম্পর্কের বাড়বাড়ন্ত।
গোধূলি লগ্নে পূর্ণিমা তিথিতে-
আশীর্বাদী রূপে ঝরে পড়া আম্রমুকুল।
কোকিলের কুহুতানে-
বসন্তের ছোঁয়ায় দুটো মনের জড়াজড়ি।
প্রকৃতি প্রেম মিলেমিশে একাকার।
সবই রবে পড়ে
বিপ্লব গোস্বামী
ক্ষীণ হবে চোখের দৃষ্টি
পাকবে মাথার চুল,
কমবে যে দেহর বল
নড়বে মুখের বোল।
কানে লাগবে তালা
কমবে পায়ের বল,
ভাই বন্ধু ছাড়বে সঙ্গ
ঈশ্বর হবে সম্বল।
বাড়ি গাড়ি পয়সা কড়ি
সবই রবে পড়ে,
সমন এলে যেতেই হবে
সাধের দেহ ছেড়ে।
আমার বিবেক আমার আনন্দ -আমাদের বিবেকানন্দ
অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত
বীর সন্ন্যাসী স্বামীজী প্রণমি তোমারে,
হুঁকো টেনে ছোট্ট বিলে করল প্রমান,
জাতি ভেদাভেদ মিছে সবাই সমান,
জীব প্রেম সর্বোপরী বোঝালে সবারে।
চিকাগো ধর্ম সভায় বক্তব্য ভিতরে,
ভারত পৌঁছালো বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান,
সভাগৃহে গুঞ্জরিত সাম্যবাদী গান,
সম্মান পেলে সবার হৃদয় মাঝারে।।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের স্নেহের নরেন,
শৈশবে খেলার ছলে ধ্যান যে করেন।
ছিলে তুমি পারদর্শী সকল বিষয়,
গর্বিত ভারত পেয়ে এমন সন্তান,
এনেছিলে কর্ম দ্বারা ভারতের জয়,
তোমার সর্বদা যেন হয় শীর্ষে স্থান।।
শেষ যাত্রা
সারণ ভাদুড়ী
হ্যাঁ মা হ্যাঁ, জানি তুমি ফিরতে বলেছিলে আজই,
জানি মা জানি তুমি আনতে বলেছিলে
তোমার জন্য সেই কাজ করানো রাজস্থানী শাড়ি,
মনে আছে মা মনে আছে,
বাবাও বলেছিল সেই কড়া পাকের সন্দেশটা আনতে
ভাই না বাঁশি বাজাতে ভালোবাসে, এনেছি সেই বাঁশিও
জানি মা জানি বলেছিলে তিস্তা পার হলে, ফোন করতে
বাবা নিতে আসবে বলে।।
জানো মা, সবই চলছিল ঠিক,
কিন্তু দোমহানির পরই কি জানি হলো,
আমার কিছু মনে নেই, কানে বাজছিল শুধুই চিৎকার,
জানি মা জানি তুমি খবরটা হয়তো পেয়ে গেছো
জেনে গেছো হয়তো আমি আর আসবো না,
বাড়িতে এসে তোমার হাতের সেই পুলি খাওয়ায় খুব ইচ্ছে ছিলো, জানো?
জানি মা জানি খুব কাঁদছো তুমি,
আমিও কাঁদছি ভীষণ....
ছবি
অনুস্মিতা বিশ্বাস
তানভি দাম
অদ্রিজা বোস
No comments:
Post a Comment