মধ্যবর্তী এক মুহূর্ত এখন। গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই, বর্ষার জল-যন্ত্রণা নেই, শীতের জবুথবু ভাবটাও নেই। উত্তর আকাশ এখন এত পরিষ্কার যে, বহু দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। উৎসবও সব শেষ। যদিও কোচবিহারে আর কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে প্রাণের ঠাকুর মদনমোহন জিউয়ের রাস উৎসব। সব মিলে এই ঋতু যেন স্থিতাবস্থার কাল। অবশ্য আমাদের জীবনে সেই অবস্থা ভাল না খারাপ সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কেননা তিন দশকের এক স্থিতাবস্থায় এই রাজ্যের বহু কিছু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তেমনি আর এক স্থিতাবস্থায় শেষ হতে চলেছে যেটুকু ছিল সেটাও! আমরা মুক্তি পাচ্ছি না এর থেকে। শুধু আমরা নই। সারা দেশেই এই অবস্থা। তাই আধুনিক এক রাষ্ট্রে ব্রিজ ভেঙে প্রাণ হারান শতাধিক, হড়কা বানে ভেসে যান অসহায় নাগরিক। প্রকৃতির স্থিতাবস্থা মানব মনে যদি বাসা বাঁধে তবে এমনটাই হয়। থমকে যায় প্রগতি, বাধা পায় চরৈবতি। হেমন্ত তাই স্বাগত। প্রকৃতির মতো মনেও হেমন্ত আসুক,, তবে থেমে থাকার নয়, এগিয়ে চলার।
হসপিটাল রোড
কোচবিহার
৭৩৬১০১
ইমেল- mujnaisahityopotrika@gmail.com (মাসিক অনলাইন)
- mujnaiweekly@gmail.com (সাপ্তাহিক)
প্রকাশক- রীনা সাহা
সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ছবি, অলংকরণ ও বিন্যাস- শৌভিক রায়
মুজনাই অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪২৯
এই সংখ্যায় রয়েছেন-
শৌভিক রায়, গৌতম চক্রবর্তী, শিবির রায়, বেলা দে, চিত্রা পাল,
রীতা মোদক, বিনয় বর্মন, শ্রাবণী সেনগুপ্ত, প্রশান্ত চক্রবর্তী, চম্পা বিশ্বাস,
বিপ্লব তালুকদার, স্বপন কুমার দত্ত,
পার্থ বন্দোপাধ্যায়, রীনা মজুমদার, রাণু সরকার, মাথুর দাস,
কুমার বিজয়, অলকানন্দা দে, রূপক রায়, আকাশলীনা ঢোল,
সীমা সাহা, সারণ ভাদুড়ী, মজনু মিয়া, সুজল সূত্রধর
মুজনাই অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪২৯
স্মরণ
ব্রজগোপাল ঘোষ, আমার চলমান ডুয়ার্স
তাঁর শেষ ফোন এসেছিল পয়লা সেপ্টেম্বর। ঠিক দু`মাস আগে। উত্তরবঙ্গ সংবাদের সম্পাদকীয় পাতায় সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে প্রকাশিত আমার একটি লেখার পরিপ্রেক্ষেতে তাঁর সেই ফোন। এতদিন পর সেই ফোনে তিনি আমাকে 'তুমি' সম্বোধন করলেন।
আজ
পয়লা নভেম্বরের এই অভিশপ্ত দিনে মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস জীবনের শেষ ফোনে তিনি আমার ইচ্ছেটা পূর্ণ করেছিলেন! তা না হলে খেদ রয়ে যেত আজীবন।
তিনি। তিনি ব্রজগোপাল ঘোষ। নামের আগে আর `শ্রী' বসাতে পারছি না। আজকের তারিখটাকে অভিশপ্ত বলছি তার কারণ হল ব্রজগোপালবাবু আর আমাদের মধ্যে নেই। আজ দুপুরে তিনি চলে গেছেন। ঠিক দুই বছর আগে আজকের এই দিনে হারিয়েছিলাম লক্ষ্মী নন্দী আর রঞ্জন ভট্টাচার্যকে। আজ সারাদিন যখন মন বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে লক্ষ্মীদি আর রঞ্জনদার জন্য, তখনই এই সংবাদ। এরপরেও যদি পয়লা নভেম্বরকে অভিশপ্ত না বলি তবে কোন দিনকে বলব!!
তাঁকে আমার চলমান ডুয়ার্স মনে হত। পূর্বের সংকোশ নদী থেকে পশ্চিমের তিস্তা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের ইতিহাস আর ভূগোল ছিল তাঁর নখদর্পনে। ডুয়ার্সের এনসাইক্লোপিডিয়া। আর চা-বাগানের? সে তো বলা বাহুল্য! আমার বিরাট সৌভাগ্য এই মানুষটির একটি লেখা 'মুজনাই'তে প্রকাশ করতে পেরেছি। সম্পাদক হিসেবে এটি আমার অন্যতম সেরা অনুভূতি। কী জানতেন না উনি ডুয়ার্স নিয়ে! ওঁর সংস্পর্শই একটা পাওনা। সৌভাগ্য আমার সেটা পেয়েছি। অবশ্য এর জন্য ঋণী থাকব শ্রী সুদীপ মজুমদারের কাছে।
ব্যক্তি জীবনে কী অসম্ভব কষ্ট পেয়েছেন মানুষটি! তিন সন্তানের মৃত্যু দেখেছেন। শেষ সময়ে চোখ কাজ করছিল না। প্রখ্যাত ডার্মাটোলজিস্ট ডঃ কৌশিক লাহিড়ীর মা শ্রীমতি সুছন্দা লাহিড়ী বর্ধমান থেকে ফোনে নানা বই পড়ে শোনাতেন। শ্রীমতি লাহিড়ী তাসাটি চা বাগানে বড় হয়েছেন। সেখানে তাঁর প্রতিবেশী ও শিক্ষক ছিলেন ব্রজবাবু।
গত বছর, কোচবিহার বইমেলার আগে, একবার ফোন করলেন। জানালেন প্রখ্যাত লেখক সুকান্ত নাহার `চা ডুবুরি' বইটি প্রকাশিত হচ্ছে। যদি আমি বইটি কিনে একবার পড়ি। খুব কুন্ঠিত স্বরে এটাও বললেন, 'পাগল সুকান্ত' তাঁকে এই বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র করেছেন। আমি আগেই জানতাম এই বইটির কথা। ধারাবাহিকভাবে পড়ছিলাম সুকান্তবাবুর লেখা। কিন্তু ব্রজবাবুর আনন্দটা অনুভব করতে পারছিলাম। `সব জানি' বলে সেই আনন্দকে নষ্ট করতে চাইনি সেদিন। `চা ডুবুরি` নিয়ে আমার নিজের কিছু কথা লিখেছিলাম। সেই লেখা পরম শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অর্ণব সেনের মাধ্যমে পৌঁছেছিল বর্ধমানে শ্রীমতি লাহিড়ীর কাছে। তিনি পড়ে শুনিয়েছিলেন ব্রজবাবুকে। শিশুর মতো আনন্দে আবার ফোন আমাকে। সেদিন বলা তাঁর কথাগুলি মনে পড়তেই চোখ ভিজে আসছে আজ।
ফালাকাটা শৌলমারির সাধুর কথা, চা বাগানের পুজোর কথা, ডুয়ার্সের বাঘের গল্প, রেল লাইন পাতবার কথা, চা বাগানের বদলে যাওয়ার খন্ডচিত্র ....কী না শুনেছি তাঁর কাছে! অধিকাংশটাই ফোনে, কখনও সাক্ষাতে। অত্যন্ত ভদ্র, মৃদুভাষী এবং সর্বোপরি আপাদমস্তক একজন ভালমানুষকে হারিয়ে শূন্যতা গ্রাস করছে তাই।
মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। জানি। কিন্তু কিছু মৃত্যু বড্ড নাড়া দিয়ে যায়। অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটি হয়ত কাল গুনছিলেন, হয়ত তাঁর নিজেরই বেঁচে থাকবার আর ইচ্ছে ছিল না। এসব কিছু জেনে ও মেনেও নিজেকে শান্ত করতে পারছি না। একটা অধ্যায় শেষ হলে তার রেশ তো থেকে যায় আজীবন। যেমন জলের দাগ লাগলে মোছা যায় না তা!
ভাল থাকুন স্যার। আমৃত্যু রইবে আপনার ঋণ। যা দিয়ে গেলেন তার মূল্যায়ণ হয় না।
হিমালয়ের কি কখনও পরিমাপ করা যায়?
ডুয়ার্স হিমালয়....বিদায়....
(নিচের ছবিটি তুলেছিলাম তাঁর গয়েরকাটা চা বাগান কোয়ার্টারে বছর তিন আগে)
* ডুয়ার্সের অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন প্রয়াত ব্রজগোপাল ঘোষ। চা-বাগানের একনিষ্ঠ কর্মী মহীরুহ সম মানুষটি সারা জীবন চা-বাগানে কাটিয়েছেন। চা ও চা বাগিচা সম্পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান সকলকে বিস্মিত করত। চা বাগানের কাজের পাশাপাশি গৃহ-শিক্ষকতা, পত্রিকা সম্পাদনা, অজস্র লেখালিখির কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন সবসময়। স্ত্রী ও দুই পুত্র ও এক কন্যার মৃত্যু যন্ত্রণা বেঁচে ছিলেন মানুষটি। তাঁর আর এক কন্যা বর্তমান। ডুয়ার্সকে চিনতেন নিজের মতো করে। ভালবাসতেন নদী মুজনাই ও সাহিত্য পত্রিকা মুজনাইকে। তাঁর লেখাও প্রকাশিত হয়েছে মুজনাইয়ের পাতায়। তাঁর প্রয়াণে আমরা মর্মাহত, শোকার্ত। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
হেমন্ত কাল
ছেলেবেলার হৈমন্তিক
শীত নস্টালজিক করে এখনও
গৌতম চক্রবর্তী
এক অদ্ভূত ধরনের আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে শারদোৎসব কাটল এই বছর। অস্বাভাবিক গরম,
হিউমিডিটি, নিম্নচাপের ভ্রুকুটি, ঘূর্ণাবর্তের প্রভাবে নিম্নচাপ দিয়ে কাটল আশ্বিনের
দেবীর বোধনপর্ব থেকে বিসর্জন। এমনকি হেমন্তের কালীপুজোতেও ছিল নিম্নচাপের প্রভাবে কালান্তক
যমের মতো ঝড়ের আগাম সতর্কতা। সে সবের মধ্য দিয়ে মালবাজারের হৃদয়বিদারক ঘটনাবলী ছাড়া
প্রাক হেমন্ত কেটে গেল আমবাঙ্গালীর কোনরকমে। ধীরে ধীরে হেমন্তও জাঁকিয়ে বসতে চলেছে।
সকালের প্রাতঃভ্রমণে আমার সঙ্গী এক বন্ধু প্রায় প্রত্যেকবছর ধনুকভাঙ্গা পণ করেন যে
ডুয়ার্সে সেই ধরণের শীত যেহেতু আর পড়ে না, তাই প্রাক শীতপর্বে অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তির
আগে হেমন্তকালীন শীতপর্ব কাটাবেন শীতবস্ত্র এক বারও গায়ে না চাপিয়ে। অবশ্যম্ভাবী
পরিণতি প্রতি শীতে অন্তত এক বার করে হাঁচি-কাশিতে নাকাল হয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের শরণাপন্ন
হওয়া। তাই ঝুঁকি না নিয়ে শীতকাল নয়, হেমন্তের হাল্কা শীতেই সকাল সাড়ে ছ’টায় হাল্কা
শীতবস্ত্রে গা মুড়িয়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দেখি জীবনসংগ্রামে জর্জরিত মানুষগুলো হেমন্তের
সেই সকালেই ছেঁড়া সস্তার সোয়েটার আর রোঁয়া-ওঠা মাঙ্কি ক্যাপ পরে তাঁদের চ্যালাকাঠ
আর জং-ধরা টিনের ডালাগুলি খোলে চায়ের জন্য। শুরু হয়ে যায় আদা পেষা অথবা খোসাসুদ্ধ
দাগী আলু কাটতে শুরু করা তরকারির জন্য। কোথাও আবার লিট্টি সেঁকার আগুনে জমে যাওয়া
হাত একটু গরম করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলে। ফুটপাতে এ সবের মধ্যেই চোখে পড়ে জরাজীর্ণ,
কাঠকুটো কার্ডবোর্ডের প্রাত্যহিক বেডরুম ভেঙে উঠে বসে ভুষো কম্বলে আপাদমস্তক মুড়ে সকালের
প্রথম বিড়িটি ধরায় শান্তিপাড়া বাসস্ত্যান্ডের কোণাতে আধপাগলা ভবঘুরে মানুষটি। মানুষের
মতো নিজেদের অভিব্যক্তি জানাবার ক্ষমতা গাছেদের নেই। কিন্তু টের পাওয়া যায় তাদেরও
বুক করে দুরুদুরু। হেমন্তকালীন প্রেক্ষিতে শীত আসন্ন বলে পাতা খসানোর খবর যথানিয়মে
পৌঁছে যায় তাদের কাছে। করলার পাড়ে যেতে গিয়ে দেখি হেমন্তের পড়ন্ত শীতের আবাহনের মরশুমে
ডুয়ার্সের শাল গাছের বড় বড় পাতা লাট খেয়ে খেয়ে খসে পড়তে শুরু করে। সেই দৃশ্য
দেখে মুগ্ধতা জাগে। কখনও ডুয়ার্সে না-আসা মানুষের কাছে এই দৃশ্যকল্প অপরিসীম বিস্ময়
বয়ে নিয়ে আসে।
ডুয়ার্সের হৈমন্তিক সন্ধেবেলাতে এখনও দেখি রঙিন কাগজের ঘেরাটোপে একটি মাটির
প্রদীপকে বাঁশের ডগায় বেঁধে উঁচুতে তুলে দেওয়া হয়। সে বড় সহজ কাজ নয়। প্রবীণ মানুষেরা
বলেন, দেবতারা এবং বিগত পূর্বপুরুষদের আত্মারা যাতে শূন্যমার্গে ঘন কুয়াশায় পথ হারিয়ে
না ফেলেন সে জন্য দীপটি তুলে ধরার প্রথা। তাই ডুয়ার্সের অনেক জায়গাতে এখনও আকাশপ্রদীপ
জ্বালানো যখন হয়, তখন তা দেখে সত্যি কথা বলতে কি মনে হয় হেমন্তের আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর
তাৎপর্য যা-ই হোক না কেন, সেটি একটি নয়নমনোহর দৃশ্য। হেমন্ত হল সম্পন্নতার ঋতু। এ
সময় বিস্তীর্ণ ডুয়ার্সের হাটেবাজারে ওঠে নতুন চাল, ছোট ছোট নাকফুল-কানফুলের মতো সাইজের
ফুলকপি, টেনিস বলের মতো বাঁধাকপি। তার পরতে পরতে ঢুকে থাকে হেমন্তের কুয়াশা আর শিশিরের
জল। কোকিলের ডাক শোনা যায়। আজও হাট-ফিরতি কিশোরের হাতের থেকে খাবারের ঠোঙা ছোঁ মেরে
নিয়ে যায় চিল। পেঁচা আর বাদুড়ও কিছুমাত্র অমিল নয়। মাঝরাতে ডেকে ওঠে তক্ষক। বিমনা
বিকেলে জানলার বাইরের শেফালি গাছে বসে থাকে নিশ্চুপ বুলবুলি। ডুয়ার্সে হেমন্তের যে
শীত তা এখনও বিশুদ্ধ। কখনও কখনও যেন নির্মম। কিন্তু ডুয়ার্সের শীত শরীরের প্রতিটি হাড়ে
কাঁপন তুলে দেয় আজও। পুরনো জাদুবিদ্যা সে আজও ভোলেনি। লহমায় সে আজও
চরাচর জুড়ে তার প্রবল মায়া বিস্তার করে দেয়। মানুষ সেই বশীকরণ মন্ত্রে আজও সম্ম্মোহিত
হয়। পূর্ণ যৌবনবতী সেই শীতের সঙ্গে মৃদুমন্দ পায়ে নেমে আসে গাঢ় কুয়াশার আস্তরণ।
হেমন্তে আমাদের দীপাবলি সারা দেশের দেওয়ালি। কী আশ্চর্য জীবন তাদের, ঠিক এই দীপাবলির
সময়েই সবুজ রঙের কাঁচপোকারা কোথা থেকে যেন চলে আসে। আগুন দেখলে পোকারা আর স্থির থাকতে
পারে না। তারা দূর থেকে ছুটে এসে আগুনে ঝাঁপ দেয় দলে দলে। পোকা মারবার জন্যই সারা
দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি প্রদীপ আর মোমবাতি জ্বালানো। আসলে কালী আরাধনার পিছনে
এক যেন এক বিরাট নিধনযজ্ঞ।
তখন আশির দশকের শুরুর
সময়কাল। হেমন্তেই সেই সময়ে শীতের তীব্রতা। শীতের সেই সময়কালে প্রথম কাকুর সঙ্গে ইডেনে
আমার টেস্ট ম্যাচ দেখা। বোধহয় সেভেন কি এইটে পড়ি। ইডেনে ভারত-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট
ম্যাচ। প্রথম দিন। মনে আছে
মাঠে যখন ঢুকেছিলাম হাইকোর্ট প্রান্ত থেকে বল করছিল এক বিশাল চেহারার
বোলার। কিছুক্ষণ পরে জেনেছিলাম তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুর্ধর্ষ বোলার ম্যালকম মার্শাল। দশাসই চেহারা।
ও প্রান্তে ব্যাট হাতে ছিল লিলিপুট, কিন্তু অসম সাহসের অধিকারী কিংবদন্তী ক্রিকেটার
সুনীল গাওস্কর। কমেন্ট্রি বক্স থেকে কারা যেন খেলার ধারাবিবরণী দিচ্ছিল। ভেসে আসছিল
এক অন্যধরনের মাদকতাময় সুরে খেলার বিবরণী “বল করতে
চলেছেন। খাটো লেংথের বল। আস্তে করে বল ঠেলে দিয়েছেন ডিপ স্কোয়্যার লেগে। সেখান থেকে
বল তুলে ফেরত পাঠানোর আগেই এক রান। ভারতের রান সংখ্যা ২১। পরের বল। ম্যালকম মার্শাল।
ও প্রান্তে মুখোমুখি গাভাসকার। গাভাসকারের ব্যাক্তিগত সংগ্রহ ৯। বল করেছেন”—আমরা গুছিয়ে বসতে
না বসতেই, তারস্বরে চিৎকার ‘হা-উ-জ দ্যাট’। তারপরেই শুনলাম বেতার তরঙ্গে ভেসে এল চিকন
গলায় ধারাভাষ্য “না, না, অজয়দা, জোরালো আপীল ছিল। কিন্তু আম্পায়ার নাকচ করে দিয়েছেন। ভারতের প্রথম উইকেটের পতন ঘটার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু না। অঘটন ঘটেনি”।
এই অননুকরণীয় বিবরণ ছিল প্রখ্যাত ধারাভাষ্যকার অজয় বসুর। সঙ্গে কমল
ভট্টাচার্য। আর তৃতীয় জন? তাঁরও বণর্না ছিল
অসাধারণ। সামনে ঘটে চলা প্রতিটি দৃশ্যের একটি
মুহুর্তও যেন বাদ দেওয়ার নয়। তিনি হলেন পুষ্পেন সরকার। এখনও কানে ভাসে... “ক্লাব হাউস প্রান্তে প্রস্তুত কপিলদেব। দৌড়
শুরু। উইকেটের গা ঘেঁষে ডেলিভারি... গুডলেন্থ বল। বাঁ পা বলের কাছে নিয়ে ব্যাটে-প্যাডে
এতটুকু ফাঁক না রেখে রক্ষণাত্মক ভঙ্গীতে খেললেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। বল চলে গেল কপিলের
কাছে। এ বলেও কোনও রান হল না। রান যা ছিল তাই। দুই উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান...।”
জলপাইগুড়ি তথা ডুয়ার্স আমার কর্মময় জীবনে বাসস্থান হলে কি হবে, আমার শৈশবের
প্রাথমিক স্তর কেটেছে মেদিনীপুরে। পঞ্চম-ষষ্ঠ ও তাই। ষষ্ঠের অর্ধাংশে কে যেন বগলদাবা
করে ছুড়ে ফেলল সটান উত্তরের রায়গঞ্জে। ব্যাস বাকি শৈশব, কৈশোর, যৌবন কখন যেন রায়গঞ্জ
আর আমি সমার্থক হয়ে গেলাম। একেবারে ছোটবেলার বন্ধু শৈবাল, সুকান্ত, ভবানন্দ, মৃত্যুঞ্জয়,
বিক্রমদের সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে। অশোকপল্লীতে যখন থাকতাম তখনকার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের
মধ্যে আবার নতুন করে খুজে পেয়েছি অতনুবন্ধু লাহিড়ীকে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। রায়গঞ্জে
এসে আমার প্রথম বাসস্থান শিলিগুড়ি মোড়ে। তারপর অশোকপল্লী। খেলতে যেতাম গীতাঞ্জলির পেছনে
লিচুবাগানের মাঠে। কোন কোন সময়ে অন্য কোন ধানক্ষেতের মাঝখানে বানানো হতো ক্রিকেট পিচ,
অথবা কোন কোন সময়ে পদ্মপুকুরের পাশের ফাঁকা জমি ছিল ছিল আমাদের ইডেন উদ্যান। জিগা
গাছের ডাল দিয়ে বানাতাম
সীমানা পতাকা। আমাদের থাকতো নরম মাটির পিচ। সোয়েটার
রেখে দেওয়া সেকেন্ড স্লিপ। যতই জোরে মারতাম না কেন, কিছুতেই ওভার বাউন্ডারি হত না। এদিকে ফিল্ডিং খাটার
সময়ে আলপথে আসা বল আবদুল কাদিরের
স্পিনের ভেলকি দেখিয়ে বোকা বানিয়ে চলে যেত অন্যদিকে। সঙ্গে
সঙ্গে দে ছুট। বাউন্ডারি হলে গালি দিয়ে ভুত ভাগিয়ে দেবে যে। মনে পরে ফসল কাটা মাঠে বিকেলে কুয়াশা নামত। মাথার
ওপর মশার ঝাঁক। অনেকক্ষণ ফিল্ডিং দিয়ে ব্যাটিং যখন পেতাম তখন সন্ধ্যে ছুঁই ছুঁই। কিছুই
দেখা যেত না। বল দেখা
যেতো না ভালো। আন্দাজে
ব্যাট চালাতাম।
অন্ধকারের মধ্যে বল হারিয়ে যেত কত। কখনো কখনো ফিল্ডারদের কারচুপিতেই হয়তো। পিঠে
গদার মত ব্যাট নিয়ে ফিরতাম
বাড়ির পথে। কত কত মুখ জাস্ট হারিয়ে গেল। স্কুলের
বন্ধুদের মুখগুলো আবছা হয়ে গেছে। আলাদা করে মনে না। পড়লেই
উষ্ণতা টের পাই। ধূসর অ্যালবাম থেকে ঝরে পড়ে সোনালী রোদ্দুর।
হেমন্ত যাপন
হেমন্তভাষিতানি
শিবির রায়
' হিমের রাতের ওই গগনে দীপগুলিরে/হেমন্তিকা করলো গোপন আঁচল ঘিরে ' -- ঋতুবদল, হেমন্তাগমে কবির মানসপটে প্রকাশ হৈমন্তী লক্ষ্মীর মনোরমা শ্রীরূপ, নিশীথ আকাশ সেজেছে লক্ষ তারার দীপমালায়, আহবান ঘরে ঘরে -- জ্বালাও আলো, ধূসর হেমন্তের সব অবসাদ দূরে সরে যাক, মনের আলোয় ঘুচাও কালিমা, সাজাও আকাশ মাটি প্রকৃতি, এসেছে হেমন্তিকা ধরায় ফলে ফুলে সোনালী ফসলে ভরা পূর্ণ শ্রীরূপময়ী, বাজাও সকলে শঙ্খধ্বনি মঙ্গলগীত, বরণ মালায় সাজাও জয়লক্ষ্মীকে, আসন পেতে প্রতিষ্ঠা, মায়ের আরাধনা.... কাটা হবে সোনালি ফসল মাঠে মাঠে, শূন্য গোলা এবার পূর্ণ হবে নবীন ধানে, ঘরে ঘরে আয়োজন নবান্ন উৎসবের., খুশির হাওয়ায় মাতে প্রাণ..... রবিকবির নিবিষ্ট অনুভূতি !
' আবছা কুয়াশা ঢাকা চারদিক /দূর থেকে বয়ে আসা ছাতিম ফুলের গন্ধ ' -- - বিষণ্ণতার কবি জীবনানন্দের মানসপটে হেমন্তের এক ধূসর মলিন রূপের ছায়াছবি দৃশ্যমান , তাঁর প্রিয় ঋতুটির বিচিত্র রূপকল্প কবিতার ছত্রে ছত্রে মূর্ত, কী এক মোহজালে আবিষ্ট...
' হিমঝুরিরাজ অশোকে দেবকাঞ্চনের বাহার /শিশিরভেজা ঘাসে ঘাসে হালকা কুয়াশা/ শীতের আগমনী ঘোষণা ' ---কবি নগ্ননির্জনতায় ধূসর হৈমন্তীরূপ উপভোগ করেন, শিশিরের শব্দ, শিশিরের ঘ্রাণে পূর্ণ শ্বাস টেনেছেন, হেমন্তসকালের কুয়াশামাখা রপে চোখ ডুবিয়েছেন, মাঠে মাঠে সোনালি ধানের বীজ ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাওয়া, কী অসাধারণ গ্রাম বাংলার রূপ... মুগ্ধ কবি লেখেন -- ' প্রথম ফসল গেছে ঘরে / হেমন্তের মাঠে মাঠে শিশিরের জল/অঘ্রাণে নদীটির শ্বাসে হিম হয়ে আসে / বাঁপাতা সবুজ ঘাসে আকাশের তারা, বরফের মতো চাঁদ /ঢালিছে জোছনা --- এক গভীর ব্যঞ্জনাময় রূপের দ্যোতনা,থেঁতলানো মেঠো ইদুঁর, রক্তছেড়ামুখ খসে পড়া ধানের খুদ কালো নিমপেঁচার থাবায় বিষাদঘন আবহ রচনা হয়েছে, যেন এক অমোঘ কাল সৃষ্টির কথা বলতে চাওয়া... বিষাদ আচ্ছন্ন রূপের প্রক্ষেপণ -- ' হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাড়ার থেকে /কোথাও বা সৃষ্টি অন্ধকার রহস্যের সাথে /বিজড়িত করেছে তারে..... আমি সুন্দরী দেখে লই, নুয়ে আছে নদীর এ পাড়ে/হেমন্তরৌদ্রের ফসলের স্তন, এ সবুজ দেশে ' ----
মিঠেকড়া কাব্যের কবি সুকান্তের কবিতায় হেমন্তাভাসের আরেক বাস্তব রূপের প্রতিভাস। '..... গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই /ছেড়ে গেছে বোন /পথে প্রান্তরে খামারে ৃরেছে যত পরিজন/তাদের হাতের জমি ধান বোনা /বৃথায় ধুলোতে ছড়িয়েছে সোনা ' --- আবার এসেছে হেমন্ত তার রূপ ঐশ্বর্যের ডালি ভ'রে। তবুও আশংকা,বিগত স্মৃতি ভুলে থাকা যায় না,এবারও কি সেই শুভক্ষণ আসবে কি কাস্তে হাতে ক্ষেতফসলের অতি ঘনিষ্ঠ জনের ভাগে্যে ! ' এই হেমন্তের ফসলেরা বলে,কোথায় আপন জন, তারা কি কেবল লুকানো থাকবে, অক্ষম তার গ্লানিকে ঢাকবে... এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ ? ' ----
হেমন্ত, ও হেমন্ত
বেলা দে
ভোরের আঙ্গিনায় শিউলি কুড়োতে কুড়োতে শিরশিরে এক অনুভূতি পিঠ বেয়ে, ভরন্ত গাছখানা ভিজে একসা বুঝতে বাকি রইলো না ষঢঋতুর চতুর্থ ঋতু দুয়ারে, চারপাশে কুয়াশার নীরব আহ্বান হেমন্ত ঘিরে নিয়েছে একান্ত আপন আমার গৃহকোণ
সঙ্গে দল বেঁধে এনেছে একরাশ সরল হাসিমাখা মরশুমি ফুল কামিনী, কাঞ্চন, জুই,গন্ধরাজ,বেলি হিমেল হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে চলছে তাদের জলকেলি। এতদিনের নম্রতামাখানো কচি ধান এসময় ভরামাসের গর্ভবতী, বাতাসের দোলনায় ঢলে ঢলে পড়ছে প্রসবের অপেক্ষায়। নীলাম্বরের মুঠো মুঠো আলোকমালা ঝলকে পড়ছে কৃষকগিন্নির তামাটে মুখের দর্পনে, গোবরনিকোনো
খোলানে কৃষকের ঘর্মাক্ত শরীর বেয়ে নামবে কনকবর্না ধানেরা। ওদের প্রাত্যহিক জীবনের রসদ ভরসার বারমাস্যা বছরভর অপেক্ষার একথালা গরম গরম ভাত। যা দিয়ে লক্ষ্মী মায়ের আবাহন, চিরায়ত পূজা পার্বণ, অতিথি আপ্যায়ন, পিঠেপুলির আস্বাদন গ্রাম বাংলার নবান্নের সংস্কার।
কার্তিকের নরম পেলব শরীর ছুঁয়েই আলোর উৎসব দীপাবলি, কালো মেয়ের অলক্তরঙীন পদতলে আলোর বিচ্ছুরণ। এই হেমন্ত নিয়েই কবির যত কাব্য গাঁথা, কবিগুরু হেমন্ত দিয়ে সাজিয়েছেন সৃষ্টির ডালি, শরতের উৎসব উদ্দীপনা স্থিমিত করে
নিভৃতচারী হেমন্ত ঢুকে পড়ে চুপিসারে অনন্য রূপের মাধুর্যে রানীর বেশে, কবিগুরু হেমন্তে বলেছেন -
কার্তিকের ধানের খেতে
ভিজে হাওয়া উঠলো মেতে,
সবুজ ঢেউয়ের পরে।
হেমন্ত
চিত্রা পাল
এখন হেমন্ত এসে হাজির আমাদের মাঝখানে। না না
আমরা কাউকে কিছু বলিনি। অবশ্য বলবার দরকারও পড়ে না। ও ঠিক সময় বুঝে আপনিই চলে আসে
আপন পশরা নিয়ে। তাতে কি নেই, আছে ফুল ফল
শাক সব্জি আর আছে গেরস্তর উঠোন ভরা ধান। ওর
চলার পথের একদিকে থাকে শরত্, আর এক দিকে শীত। শরত্কে পেছনে ফেলে ওএগিয়ে চলে
শীতের দিকে। আমাদের এই উত্তরবঙ্গে দু দশক তিন দশক আগে হেমন্তকে বেশি কাছেই পেতুম
না। এসেই ছটফট করতো কখন হুড়মুড় করে চলে যাবে শীতের কাছে। এখন ওর গতি হয়ে গেছে শ্লথ। খুব
গড়িমসি করে এখন। শীতের দিকে যেতেই চায় না। তবে হ্যাঁ, ওই মেঘ,বৃষ্টি বন্যা সব পেছনের দিকে ঠেলেদেয়। আজকাল সূর্য্যের সাথে ভাব
জমাতে চায়। কিন্তু ও আর এক চালাক, দেরি করে ওঠে আর বিকেল হতে না হতেই টুক করে চলে যায় দিগন্তের ওপারে। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার
পরে একটু ওদিক তাকাতে না তাকাতেই চারদিক
সব আঁধার হয়ে আসে।
আসলে মা দুর্গার চলে যাওয়ার আঁচল ধরেই আসে
হেমন্ত। সকাল দেরি করে হয়। ভোরের দিকে ঘুমের আমেজে চোখ খুলতেও অল্প স্বল্প দেরি।
আকাশ বেশ নীল নীল। বাজার ক্রমশঃ নতুন শাক সব্জীতে ভরপুর। নতুন মুলো, নতুন সীম
ফুলকপি নতুন দামও অহংকারী ধরণের।টপ করে নিয়ে নেওয়া যায় না। দরদাম করতে হয়। এর
মধ্যেই এসে যায় নবান্ন উত্সব।ঘরে ঘরে সুপক্ক শস্যের ঘ্রাণ সূচনা করে নবান্ন উত্সবের।
হেমন্তের এই ঘরোয়া উত্সব একেবারে নিজস্ব। আমাদের আপন সংস্কৃতির গন্ধ ভরা।সব নতুন
পাওয়া ঈশ্বরকে উত্সর্গকরা। এভাবেই ভরা প্রাচুর্য্য নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হেমন্ত। ফসল তোলার পরে
আদিগন্ত শূন্য মাঠ। মাঠের পরে সূর্য্য
নামে দিগন্তে। নরম হেমন্ত তখন গল্প বলে
তপ্ত অন্নের। সমন্বয় সাগরের বন্দরের মতো।
হেমন্তের রানী
রীতা মোদক
পাতলা কম্বলের নিচে আলস্য ঘুম। দূর থেকে ভেসে আসে নিয়মসেবা মাসের নগর কীর্তনের সুর।চারদিক নিস্তব্ধ থাকায় অনেক দূর থেকে সে আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়। বুঝতে বাকি নেই এই মধুর সুর আর ঘুমোতে দেবে না। আড়ষ্টতা কাটিয়ে আমি বিছানা থেকে নেমে যাই। চোখেমুখে জল দিয়ে দেখি ---রাজপথ দিয়ে 'রাই জাগো, রাই জাগো রে... ' বলে কিছু ভক্ত খোল-কর্তালের তালে তালে দুই হাত উপরে তুলে নেচে নেচে কীর্তন করছে। এই কীর্তনের সুর এক নিমিষেই মন ভালো করে দেয়।
কানের পাশ দিয়ে শিরশিরিয়ে হিমেল বাতাস বয়ে যায়। কচু পাতায় টুপ টুপ করে শিশির জমা হয়।খানিকটা দূরে এগিয়ে গেলে দেখা যায় মাঠের সোনার ফসল ধান্যভারে নুয়ে পড়ছে। চাষিরা কিছু ধান কেটে নিয়ে গেছে,কিছুটা বিছিয়ে রয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ধানের শীষ।আমি হেমন্তের অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখতে থাকি প্রাণ ভরে। খানিক বাদে মিষ্টি রোদের আলো ধানের ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়লে চারদিক সোনার মতো চকচক করতে থাকে।
ধীরে ধীরে চাষিরা কাস্তে হাতে মাঠে নামে।ধান কাটার ধুম লেগে যায়। মহিলারা শাড়ির উপরে ফুলহাতা শার্ট পড়ে ধানের আঁটি বেঁধে বোঝা মাথায় করে আঙ্গিনায় নিয়ে যায়। কৃষকের আঙিনায় জমা হতে থাকে পর্বত সম ধানের আঁটি। সব আঁটি জমা হলে মাড়াই ঝাড়াই শুরু হয়ে যাবে। আমি ধান্য অলংকার ছিড়ে কানের দুল বানাই,টিকলি বানিয়ে মাথায় লাগাই।আনন্দে লুটোপুটি খেলি ধানের সাথে।মনে মনে যেন নিজেই হেমন্তের রানী হয়ে যাই।
হেমন্ত গল্প
চিনার ছায়ায় হেমন্ত বেলায়
বিনয় বর্মন
দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকেই ভদ্রলোককে চোখে পড়েছিল l মাঝারি চেহারার মাঝ বয়স্ক বেশ সম্ভ্রান্ত ও সুদর্শন দেখতে ভদ্রলোক l শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নামার পরেই আরো একবার চোখাচোখি হয়ে গেল সায়নীর l আর ভদ্রলোকের চোখও স্থির হয়ে গেল l তবে তার দিকে তাকিয়ে নয় l তার পাশে দাঁড়ানো তার মা সুপর্ণার দিকে তাকিয়ে l তারপর মৃদু হেসে বললেন , " হোয়াট আ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ ! ভূস্বর্গে নামতে না নামতে অপ্সরা দর্শন ! আর ওই ইয়াং লেডি নিশ্চয়ই তোমার মেয়ে ? "
সুপর্ণা কোন রকমে বলল , " হ্যাঁ , আপনিও কি বেড়াতে এসেছেন ?"
-- হ্যাঁ তা একরকম l তা তোমরা কোথায় উঠেছ ,?
- ডালের পাশে l আমরা তো ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে এসেছি l রিসোর্ট ওদেরই ঠিক করা l আপনি ?
- আমি আপাতত নূরবাগে l বশির ভাইয়ের বাড়ি l তারপর ... তখনো বিস্মিত সায়নীর দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন , " আমি শোভন সামন্ত। তোমার নামটা ?
- সায়নী l
- বেশ বেশ l তা কি করা হয় ?
- এখন এমএসসি কমপ্লিট হল l পিএইচডির প্রিপারেশন নিচ্ছি l
বলতে বলতে এগিয়ে চলে ওরা l হাতে সুপর্ণাদের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সির প্রতিনিধি এসে ওদের স্বাগত জানায় l হাত নেরে বিদায় জানিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় সায়নীরা l
গাড়িতে উঠে সায়নী সুপর্ণা কে বলে, " মা উনি কে ? কিভাবে চেনো ?
- " অনেকদিন আগের পরিচয় l উনি মনে রেখেছেন l "সুপর্ণা দায়সারা ভাবে বলে l সায়নীও আর কথা বাড়ায় না l
এমএসসি শেষ হওয়ার পর ট্যুরে যাবে l আগেই আবদার করেছিল সায়নী বাবার কাছে। ব্যস্ত ব্যবসায়ী নিরজ নিজে সময় দিতে পারবেন না l তাই স্ত্রী ও মেয়ের জন্য ট্রাভেল এজেন্সির টিকিট বুক করে দিয়েছেন l
ট্রাভেল এজেন্সির ইটিনারী শ্রীনগরকে কেন্দ্র করে l সফরসূচিতে আছে শোনমার্গ , গুলমার্গ , পহেলগাঁও , আর স্থানীয় সাইটসিয়িং l সায়নী খুব মজা করলো কদিন l এজেন্সির আতিথিয়েতা ও ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো। বেরিয়ে , ছবি তুলে , শপিং করে কদিন দেখতে দেখতে কেটে গেল l সুপর্ণাও খুশি ছিল l কিন্তু মাঝেমধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল l সায়নী খেয়াল করলেও ভাবলো বাবার জন্য চিন্তা করছে বোধহয়।
পঞ্চম দিনে ওরা এলো পহেলগাঁও l এখানে দুইদিন থাকবে l এরকমই সফরসূচি l পহেলগাওয়ে এসেই মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগলো l বিশেষ করে যখন থেকে লিডারের দেখা পাওয়া গেল l পথের পাশে আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে স্বচ্ছতোয়া লিডার l ওদের থাকার ব্যবস্থা লিডারের পাশেই একটা বিলাসবহুল রিসোর্টে l সেখানে পৌঁছেই সুপর্ণা হঠাৎ একটা আবদার করলেন মেয়ের কাছে। এখানে তো দুদিন থাকবো এখান থেকে বেতাব ভ্যালি , আরু ভ্যালি , চন্দনওয়াড়ি , বৈশ্বানোর ...নানান সাইটসিয়িং নিয়ে যাবে l আমি তো ওগুলো দেখেছি l যদিও অনেক আগে l এবারে আর যাব না l তুই সবার সঙ্গে যা l আমি এই রিসোর্টএই থাকি l আশেপাশে হেঁটে দেখবো l শরীরটাও টায়ার্ড .... সায়নী একটু অবাক হলেও মায়ের কথায় রাজি হল l মাকে আর জোর করল না। " ঠিক আছে তুমি রুমে থাকো l ফোন তো আছেই। আর এদের ব্যবস্থাপনাও বেশ ভালো "
সারাদিন বেরিয়ে বিকেলে ফিরল সায়নী l মার সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হলেও তুই চিন্তা ছিল l কিন্তু এখন দেখলো মায়ের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল। নিজেই বললো , " জানিস শোভন বাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। একটু পার্কের দিকে বেরিয়েছিলাম ..."
- শোভন বাবু মানে ?
- আরে ওই যে এয়ারপোর্টে দেখা হল l
- হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে l
- এই বইটা দিলেন l ওর নিজের লেখা l একটা অন্যরকম ট্রাভেলগ l সারা ভারতের নানান জায়গার কথা আছে l এই কাশ্মীরের কথাও আছে l
- আচ্ছা
কৌতূহলবশত বইটা নিয়ে ব্লারবটা দেখল l লেখক পরিচিতও l লেখক এর বেশ কিছু প্রকাশনা রয়েছে l ভ্রামনিক বলা যেতে পারে l উৎসর্গটা ইন্টারেস্টিং l কোন এক
" চিনারবিলাসিনীকে " l
- বেশ বেশ l ঘরে বসে পড়ো আর মানস ভ্রমণ কর l
- আচ্ছা তুই কেমন ঘুরলি বল l
সায়নী ছবি দেখাতে লাগলো মোবাইলে l হঠাৎ সায়নী বলে উঠল , " আচ্ছা মা , ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার পরিচয় কিভাবে বললে না কিন্তু। তোমার ওল্ড ফ্লেম নাকি ?
সায়নী মায়ের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মেশে l যদিও সুপর্ণা কিছুটা রিজার্ভই থাকে l এখন সুপর্ণার মুখ আরক্ত হয়ে ওঠে l
- কি যে বলিস উল্টোপাল্টা l কালকের প্ল্যান বল।
পরদিন সায়নী দলের সঙ্গে বেরিয়ে গেলে সুপর্ণা স্নান জলখাবার সেরে প্রসাধনে বসে l অনেকদিন পর যত্ন করে সাজালো নিজেকে l তারপর রিসেপশনে বলে একটা গাড়ি বুক করালো আধা বেলার জন্য l ড্রাইভার এলে বলল চলো লিডার পার্কের দিকে l পার্ক পেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর একটা বড় প্রাচীন চিনার গাছের কাছে গাড়ি দাঁড় করালো l ড্রাইভারকে সেখানে দাঁড়াতে বলে এগিয়ে গেল নদীর কাছে l
সেই প্রাচীন চিনার গাছের ছায়ায় নদীর ধারে বসে ছিল শোভন সামন্ত l দুজনেই পরস্পরকে দেখে হাসলো l
- আমি জানতাম তুমি আসবে l
- হুম l কিন্তু কালকে রাস্তায় হঠাৎ দেখা না হলে কি করে আসতাম ?
- কখন ও না কখন ও তো আসতেই l কারণ পৃথিবীটা গোল l
- আর তুমি এখনো গোল গোল ঘুরে বেড়াচ্ছ ?
- আর কি ! পৃথিবীর নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াই। কিন্তু হেমন্ত এলে পহেলগাওয়ে না এসে থাকতে পারি না আমি l এই শান্ত নির্জন পরিবেশ l মৌন পাহাড়ের গাম্ভীর্য , চিনারের ছায়া l এটা মিস করতে চাই না l লিডারের স্নিগ্ধ প্রবাহ চিনারের পাতা ঝরা.. বসে বসে দেখতে দেখতে সময় দিব্যি কেটে যায় l
- হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যান ?
- কবিতা পড়ার অভ্যাস এখনো রেখেছো নাকি ?
- না না l পুরনো স্মৃতি l... বিয়ে করেছ ? কাল তাড়াহুরাতে জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছি l
- নাহ
- দেবদাস ?!
- আরে না না l ভয়ে l আমি যা কুড়ে আর paper skinned ... এডজাস্ট করতেই পারতাম না কারো সঙ্গে l ... সেদিকে তোমার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে ভালই হয়েছে ! বিয়ে মানেই প্রেমের মৃত্যু !
দুজনের নীরবতা ছাপিয়ে কল কল করে বয়ে যায় লিডার l চিরযৌবনা l পাহাড়ের পাদদেশে চিনার পাইনের ছায়ায় ধীরে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ সবুজাভ ফেনিল জলরাশি নিয়ে l শোভনের মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় পচিশ বছর আগের কথা l
রেলের চাকরি পাওয়ার পর ইন সার্ভিস ট্রেনিংয়ে পহেলগাঁওএ এসেছে l ছয় মাসের ট্রেনিং l চাকরি তার সঙ্গে ছয় মাসের ভূস্বর্গ বাস ! জীবনের সেরা সময়ে তখন শোভন 'যৌবনবেদনারসেউচ্ছল' l লিডার নদীর ধারে ছিল তাদের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট l ট্রেনিং এর ফাঁকে ছুটির দিনে লিডারের আশেপাশে ঘুরে বেরিয়ে দিন কেটে যেত l তখন পহেলগাঁওএ এত পর্যটকের আগমন ছিল না কলকাতার ভট্টাচার্য পরিবারের সবাই এসেছিল পূজা অবকাশ কাটাতে পহেলগাওএ l সেখানেই সুপর্ণার সঙ্গে আলাপ l শোভন উত্তরবঙ্গের সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে l সুপর্ণার বাবা কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী l বনেদি বাড়ি l রুচিশীল l পহেলগাঁও ছোট জায়গা l বাঙালি বলে তাদের সঙ্গে পরিচয় আর আলাপ জমে উঠতে সময় লাগেনি l সুপর্ণা তখন কলেজ পড়ুয়া l ওকে দেখেই শোভনের ভালো লেগে যায় l যাকে বলে 'লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট' l ভোরবেলা বা বিকেলে লিডারের ধারে ওরা বেড়াতে এলে শোভনও জুড়ে যেত। গল্প গান হাসি ঠাট্টায় বেশ কেটে গেল কদিন। পরিচয় আরো ঘনিষ্ট হয়েছে। ওরা ফিরে যাওয়ার দুই দিন আগে শোভন সাহস করে সরাসরি ওর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেল l ভদ্রলোক মন দিয়ে শুনলেন l তারপর শান্ত গলায় জানালেন এটা সম্ভব নয় l অসবর্ণ বিয়েতে তার আপত্তি আছে l তাছাড়াও তিনি তার বন্ধু পুত্রের সঙ্গে সুপর্ণার বিয়ে একপ্রকার ঠিক করেই রেখেছেন l
সেই বিকেলের পর থেকে সুপর্ণার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তখন মোবাইল স্মার্টফোন ছিল না l ল্যান্ড ফোন বা চিঠিতেও শোভন যোগাযোগের চেষ্টা করেনি l বিয়েও আর করলো না l বৌদি ভাইবউদের সঙ্গে মায়ের তিক্ততা দেখে মনে মনে বিয়ের উপরেই ভরসা উঠে গেছিল। বদলিযোগ্য চাকরি হওয়ায় প্রচুর ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল সারা দেশজুড়ে l চাকরি আর দেশ ভ্রমণের পাশাপাশি লেখালেখি নিয়েই ছিল l কুড়ি বছর চাকরি হওয়ার পরে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে এখন ভ্রমণ আর লেখালেখি নিয়েই আছে l যাকে বলে, ' গ্লোব ট্রটার ' l যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন লেখালেখির সঙ্গে সঙ্গে ভ্লগও লেখে l পেনশন রয়েলটি আর সঞ্চয় মিলিয়ে দিব্যি চলে যায়।
তবে সারা বছর যেখানেই থাকুক অক্টোবর থেকে নভেম্বরটা পহেলগাঁওএই কাটিয়ে যায় সে l প্রত্যেক বছর নিয়ম করে l
সুপর্ণার কথায় চমক ফেরে l
- কালকে আমাকে হঠাৎ দেখে অবাক হওনি ?
- হ্যাঁ তা হয়েছি বটে l দেখা একদিন হতোই l আশাবাদী ছিলাম l বাট আই ওয়াজ আনপ্রিপেয়ার্ড ইয়েসটারডে l বইটা সঙ্গে থাকায় তোমাকে দিতে পেরেছি l কিন্তু তোমার জন্য যেটা এতদিন যত্ন করে রেখে দিয়েছি সেটাই দেওয়া হয়নি।
বলে ব্যাগ থেকে বের করল একটা ফাইল l তার ভিতর থেকে একটা ছবি l হাতে আঁকা l চিনার গাছের নিচে বসে আছে সুপর্ণা l তখন স্মার্ট ফোন ছিলনা l ক্যামেরা থাকলেও শোভনের হবি ছিল ছবি আঁকা l সুপর্ণাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে একেছিল l কিন্তু আর দেওয়া হয়নি l
সুপর্ণা সেটি হাতে নিয়ে বিহবল হয়ে বলল , " এত ভালবাসতে আমাকে ? তাহলে জোর করলে না কেন ? বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়েও বেরিয়ে আসতাম আমি l
- তুমিও তো সে অধিকার দাওনি তখন l আর জানোই তো আমি বরাবরই সেন্টিমেন্টাল l বলতে পারো সেন্টিমেন্টাল ফুল l বলে হাসে l
আবার নীরবতা l
- আচ্ছা তুমি কেমন আছো বলো ?
- ভালো l আমার হাজব্যান্ড মানুষটা ভালো l নিজের দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকেন l তবে পরিবার অন্তপ্রাণl বিয়ের পর সব মেয়েরই অ্যাডজাস্ট করতে একটু প্রবলেম হয় l আমারও হয়েছিল l তবে মানিয়ে নিয়েছি l হাসবেন্ডকে স্পেস দিয়েছি l তুমি যেমন ভাবো , সব বউই ঝগড়ুটে l আমি কিন্তু সেরকম হইনি।
' আরে না না l আমি মোটেই সেরকম বলতে চাইনি l
- জানো বিয়ের পরে প্রথম রাতেই হাজবেন্ড কি বলেছিল ? "দেখো আমার বাড়ির কে কেমন আমি জানি l আমি তোমার মুখে এটা শুনতে চাই না l" আমি ওটা মেনে চলেছি l সমস্যা হলেও নিজেরাই মিটিয়ে নিয়েছি l হাজবেন্ডের মা-বাবা বা পরিবারের কারো সঙ্গে আমার দ্বন্দ্বের মাঝখানে তাকে টানিনিl
- হুম l মেয়ে কোথায় পড়ছে ?
- কলকাতাতে l
- ওকে বলেছো আমার কথা ?
- হ্যাঁ l তবে সেরকম কিছু নয়।
এরপর আরো গল্প স্মৃতিচারণ আড্ডায় কি করে যেন কয়েক ঘন্টা সময় গড়িয়ে গেল l ড্রাইভার কুণ্ঠিতভাবে এসে দাঁড়ায় l" টাইম হো গয়া ম্যাডামজি l"
সুপর্ণা জানায় এবারে উঠতে হবে l " ইচ্ছে হলে যোগাযোগ রেখো l ফোন নম্বর তো রইলই l "
সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসে সায়নী l কলকলিয়ে সারাদিনের সফরের বিবরণী দেয় l আজকে শেষ রাত l রিসোর্ট এর লনে বন ফায়ার হচ্ছে l সুপর্ণা ঘরে শুয়েই শোভনের বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল।
সকালবেলা লাগেজ তোলা হয়েছে গাড়িতে l বাকিদের গোছগাছ চলছে l গাড়ি ছাড়তে আরেকটু দেরি আছে l সুপর্ণা আর একবার নদীর ধারে গেছে l সায়নী গাড়ির সিটে বসে আছে l মায়ের ব্যাগটা তার কাছেই। ফোন এসেছে। ব্যাগ খুলে বের করল l বাবার ফোন।
- "হ্যাঁ পহেলগাঁও থেকে বেরোচ্ছি l "
ফোনটা রাখতে গিয়েও হঠাৎ কৌতুহলে হোয়াটসঅ্যাপটা খুললো। মায়ের ফোন সে অতো ঘাটে না l মাও ঘাটে না l whatsapp টা তারই খুলে দেওয়া l
এটা করা ঠিক নয় জেনেও whatsapp টা খুললো l শোভন নামের একাউন্টে পাঠানো একটা মেসেজে চোখ আটকে গেল l
" ...তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমার কাছে ভালোবাসা মানে কি? ... আমি তো তোমার মত লেখক নেই। জীবনানন্দকে ধার করে বলছি :
কোন এক মানুষীর মনে
কোন এক মানুষের তরে
যে- জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে !-
নক্ষত্রের চেয়ে আরও নিঃশব্দ আসনে
কোন এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে!
........ ....... .........
মনে করোনা যে তুমি শুধু একাই আমাকে মিস করেছো , মিস আমিও অনেক করেছি l কিন্তু জীবনের নিয়মকে মেনে নিয়েছি l হয়তো আবার কখনো দেখা হবে , যদি আসি পহেলগাঁওএ l ... জানি তোমাকে পাবোই এখানে l প্রতি হেমন্তে ঝরা পাতার মরশুমে খুঁজে বেড়াবে তোমার ফেলে আসা যৌবনকে লিডার চিনার আর উইলোর মাঝে ... "
হেমন্ত ভ্রমণ
হঠাৎ সৈকতে
শ্রাবণী সেনগুপ্ত
সাধারণত আমরা পুজোর ছুটিতেই বেড়াতে যাবার চেষ্টা করি-লম্বা ছুটি পাই বলে।করোনার কারণে গত দুইবছর যাইনি,শেষ গিয়েছিলাম ২০১৮ সালের পুজোতে- সিটং,রঙ্গারুন।এইবারে কিছু নিজেদের ব্যস্ততা ,আর পারিবারিক অসুবিধার কারণে মনে মনে বাইরে যাবার টান অনুভব করলেও স্থান,কাল ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না।আমরা সাধারণত চেষ্টা করি দুর্গাপুজোর কয়টা দিন কাটিয়ে তারপর বাইরে যেতে।এই সময় পাড়ার প্যান্ডেলের পুজো হয়ে যায় আমাদের সকলের বাড়ির।এইবারে মনটা খুব খারাপই লাগছে।এদিকে ছুটিও ফুরিয়ে আসছে।হঠাৎ করেই সুযোগ এলো মন্দারমণি যাবার।পড়লাম বেরিয়ে আমরা দুইজন আর ডাববু।ও বেচারিরও স্কুল খুললেই পরীক্ষা,তার আগে একটু ঠাঁই নাড়া হওয়া,এই আরকি।ঠিক হল তিন রাত এর জন্য যাব।
রওনা দিলাম ধর্মতলা থেকে ভলভো বাসে দারুণ বসার ব্যবস্থা,রাজহংসের মতন চলন।অনেক সকালে বেরনো,তাই খাবার সঙ্গে ছিল।প্রথমে ডাববু,তারপর আমরা খেলাম।বাসে উঠেই ডাববু বই কিনেছিল,আমরা দুজনে কিছুটা পড়ার চেষ্টা করেও পারলাম না,আমাদের দুইজনেরই চলন্ত গাড়িতে বই পড়তে সমস্যা।আরো বেশ খানিকটা পথ চলে এলো কোলাঘাট।সেখানে একটি বড়ো হোটেলের সামনে গাড়িটি দাঁড়াল।আমরা বাস থেকে নেমে একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম।ঐখানে রাখা দোলনাতে একটু দুলে নিলাম,বয়স খানিক কমে গেল।মিনিট পনের পর বাস ছাড়ল।আরো কিছুটা চলার পর এলো আমাদের গন্তব্যস্থল- চাউলখোলা।
এইখানে নেমে অপেক্ষারত চন্দনের অটোতে করে পৌঁছলাম নির্দিষ্ট রিসর্টে।বেশ কয়েকবছর আগে যখন গিয়েছিলাম মন্দারমনি,তখন অটো ছিলনা,গাড়ি করে সমুদ্রের তটরেখা দিয়ে যেতে হত,পিছন দিকের রাস্তা তখনো তৈরী হয়নি-ভাঁটার সময় অনুযায়ী গাড়িতে উঠতে হত।যাবার পথে আগের মতই দুইপাশে চিংড়ির মীন চাষ হচ্ছে।
রিসর্টটি খুব সুন্দর।ছোট ছোট কটেজ,আর সামনে ডেক চেয়ার রাখা -সেখানে বসে সামনে আদিগন্ত জলরাশি।কটেজের পাশে পাশে সুন্দর কয়েকটি বাছাই করা ফুলের গাছ,সবই পরিচিত।এতো বড়ো বড়ো ফুল ফুটেছে নয়নতারা,মাধবীলতায় যে দেখে অবাক হতে হয়।যেদিন গেলাম,সেইদিনই রিসর্টে ব্যাগ রেখে সমুদ্র ছুঁতে গেলাম।রিসর্টের একদম গা ঘেঁষে রাস্তা সমুদ্রে যাবার।তখন ভাঁটা-জল বেশ পিছিয়ে।রিসর্ট থেকে বলে দেওয়া ছিল যাতে হাঁটু জলের বেশি না এগোই।ডাববু সদ্য সাঁতার শিখেছে,খুব ইচ্ছে সমুদ্রে নিজের পারদর্শিতা দেখাবার।তবুও সেতো বাধ্য ছেলে,তাই ঐ বিধিনিষেধ মেনেই যতটুকু হয় আরকি।সমুদ্র পাড়ের ভ্রাম্যমান ফটোগ্রাফার কে দিয়ে ফটো তোলা হল।সে কি পোজ!এরপর মধ্যাহ্ন ভোজনের পালা।খুব ভালো ঘরোয়া রান্না।আমাদের কটেজের সামনের চেয়ারে বসে রইলেন আমার কর্তা,আর ডাববু,আমি হলাম ডেক চেয়ারে আসীন।কিছুক্ষণ পরে একটু বিশ্রাম নিতে ঘরে ঢুকলাম।ডাব্বু যথারীতি ডেক চেয়ারেই বসে থাকল।বিকেলে আমি আর ডাববু হাঁটতে বেরোলাম সৈকতে।একটা মৃত মাছ দেখে ডাববু হঠাৎ বলল-এইটা স্টিংরে,দেখ বলে ফটো তুলল।কিছুক্ষণ কিছুক্ষণ পরে সূর্য সাগরপারে ডুব দিলে আমরা ফিরে এলাম। ডেক চেয়ারে বসে লোনা বাতাসের ঘ্রাণ নিতে নিতে স্বাদ নিলাম ভেজ পকোড়া,ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর,সাথে কফি।
পরের দিন উষালগ্নে ঘুম ভাঙল ডাব্বুর-যাকে ছুটির দিনে ঠেলে ঠেলে ঘুম থেকে উঠাতে হয়।আমিও উঠলাম,একটু শিরশিরে বাতাস তাই মাথা,কান ঢেকে বেরিয়ে পড়লাম।অপূর্ব এক মহাজাগতিক দৃশ্যের সাক্ষী হলাম।পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস উদিত হলেন দিগন্তপাড়ে।
নীলাকাশের একদিকে তখনো উঁকি দিচ্ছে আমাদের একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহটি।তট থেকে সমুদ্রের দিকে তাকালে দিগন্তরেখা-স্পষ্ট বোঝা যায় পৃথিবীর আকৃতি।তখনো জোয়ার-পায়ের পাতা ডুবিয়ে হেঁটে চলেছি দুইজন-মনে হচ্ছে এই চলা যেন কতকালের।মাঝে মাঝে ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ।সমুদ্রে পৌঁছনোর পথটিও বেশ।বোঝা যায় গভীর রাতে তার দখল নিয়েছিল সে,সবসময় ভিজে,আর কাঁকড়াদের তোলা মাটিতে ভর্তি।ডাববু খুব সন্তর্পনে তাদের ঘর বাঁচিয়ে চলল,আমি পারছিলাম না বলে বকা খেলাম।রিসর্টের সামনের রাস্তার ধারে পুকুরে শাপলা ফুল ফুটে আছে,পাড়ে মুলো শাক।রিসর্টে এসে পুরি সব্জি দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে আবার সমুদ্র দর্শন সেখান থেকেই।ডাববুর প্রশ্নের উত্তরে বোঝালাম জোয়ার ভাঁটা।ভূগোলের দিদিমণি হিসেবে ক্লাসঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে যা বোঝাই,তা প্রকৃতির সামনে বোঝবার মজাই আলাদা।বেলা বাড়লে ভাঁটা,তখন স্নানে যাওয়া।এইদিন অনেকটা সময় ধরে স্নান উপভোগ করলাম।আবার ফটো তোলা হল।ফিরে মধ্যাহ্নভোজন।এইখানে অবশ্য লালু ভালুর কথা না বললেই নয়-ডাব্বুর সঙ্গী হয়ে ওঠা দুটি সারমেয়।তাদের জন্য সামনের একমাত্র বিস্কুটের দোকান থেকে পার্লে জি কেনা হল।দুইবেলা তাদের দেওয়া হত।রিসর্টের কর্মচারীদের সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল-বিশেষ করে একটি উচ্চশিক্ষিত দরিদ্র ছেলে যে বাধ্য হয়ে এইখানে কাজ করছে তার সঙ্গে।সে ডাববুকে ডাকত ছোট স্যার বলে।পরের দিন চন্দনের অটোতে ঘুরতে গেলাম-তাজপুর,শঙ্করপুর।
তাজপুর আমাদের দুইজনের আগেই ঘোরা ছিল।সেখানেও যেখানে উঠেছিলাম,সেই ভদ্রলোক এবং তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে খুব আলাপ হয়ে গিয়েছিল।আসলে আমরা দুইজনেই-'পথে পথে বন্ধুজনায় 'বিশ্বাসী।তবে এইবার গিয়ে দেখলাম এতটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে-খুব চেষ্টা করেও চিনতে পারলাম না।উন্নয়নের আড়ালে সেই কাঁচা গন্ধ যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।শঙ্করপুরে গিয়েও দেখলাম যেন দীঘার ছোটরূপ।যে বিস্তীর্ণ তটরেখার স্মৃতি বহন করছিলাম,তা এখন অনেকটাই সঙ্কুচিত।মোহনায় গিয়ে খুব ভাল লাগল,দর্শন পেলাম সেই লাল কাঁকড়াদের।একদল সার বেঁধে সমুদ্রতীরে জল পান করছিল।পায়ের সামান্য শব্দ পেলেই তারা গর্তে সেঁধিয়ে যাচ্ছিল।এরা রোদে বেরোয়,কিন্তু শব্দ পেলেই পালায় নিরাপদ আশ্রয়ে।সেখানে দেখা হল ষষঠ শ্রেনীতে পড়া দেবশঙ্কর পালের সঙ্গে।বাবা তার জেলে,দুইদিন হল গেছে মাছ ধরতে।সে পড়ে কাছের ইস্কুলে।সে বালিতে একটু হাত ঢুকিয়ে একটা লাল কাঁকড়া বার করে আনল।সাদা চোখ বাইরে বেরিয়ে আছে অ্যান্টেনার মতন।আবার ছেড়ে দিতেই সে এক ছুট দিল তার নিরাপদ আশ্রয়ে।দেবশঙ্কর কে একটি চকোলেট দিলাম।রোদ ক্রমশঃ বাড়ছে,ফিরে এলাম রিসর্টে।অনেকটা বেলা বেড়ে যাওয়াতে সেদিন আর স্নানে যাওয়া হল না,যদিও তখন ভাঁটা।বিকেলে আবার সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটা।কখন আঁধার ঘনিয়েছে,আমি আর ডাববু কেউই টের পাইনি।
তটরেখা ধরে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি তখন,চারিপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে,রিসর্টে ফেরার পথ কেমন গুলিয়ে গেছে,আসলে সমুদ্র থেকে পর পর হোটেলগুলিতে ফেরার পথগুলি প্রায় একইরকম।নিকষকালো সমুদ্রতীর,কিছুটা পিছিয়ে আন্দাজে একটি পথ ধরে এগোলাম,হঠাৎ দেখি পিছনে লালু আর ভালু।নিশ্চিন্ত হলাম,ওরাই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল আমাদের।ফেরার দিন খুব জোয়ারের তীব্রতা,জল অনেক কাছে,তাই সকালের হাঁটা হল না ।জলের তীব্রতা যখন কমল ,তখন অনেক বেলা,তাই সেইদিনও আর সমুদ্রে অবগাহন হল না।ডাববুর মনটা একটু খারাপ হলেও মেনে নিল।ও আবার কয়েকটি পার্লে জি কিনে দিয়ে এলো যাতে কালু আর ভালুকে দেওয়া হয় ওর অনুপস্থিতিতে।আসার আগে বারবার বলে এলাম যাতে সবাই সাবধানে থাকেন কারণ সিত্রাং আসছে।চন্দন অটো করে পৌঁছে দিল বাসস্ট্যান্ড এ।সেখানে দেখে নিলাম মনসা মন্দির।বেশ বড়ো মন্দির,খুব পরিষ্কার,সামনে এমনভাবে জলের ব্যবস্থা করা,যাতে ওতে পা ধুয়ে মন্দিরের সিঁড়িতে পা দেওয়া যায়।ভলভো বাস এ উঠলাম।সে লোক কম হবার জন্য থেমে থেমে চলল,তাই বেশ সময় বেশী লাগল।রাত হয়ে গেল ফিরতে।খুব ভাল লাগল যে,মাঝখানে অটো চালক আবার খোঁজ নিল আমরা ঠিকমতন পৌঁছেছি কিনা।
এইভাবেই শেষ হল এইবারের হঠাৎ সমুদ্র দর্শন।
কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানিতেপ্রশান্ত চক্রবর্তী
' মনের আশা ঘুচাতে ভাই
তিনচুলে তে গেলাম তাই '
পুজোর ছুটিতে হুট করে প্ল্যান, সপরিবারে চললাম দার্জিলিঙের তিনচুলে। ১৪ তারিখ সকাল সকাল শিলিগুড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে পৌঁছে গেলাম তিনচুলের নরইয়াং হোমষ্টে তে। পৌঁছনোর পরপরই আমাদের দুপুরের খাবার পরিবেশিত হলো এবং তারই পাশাপাশি খাওয়া দাওয়া সেরে হোমষ্টের মালিক মৃনাল দা আমাদের তার মালিকানার অংশ ঘুরিয়ে দেখালেন। দেখলাম, চোখ ফেরানো যায় না এমন সৌন্দর্য, যা কিছু আমাদের খাওয়ালেন তার প্রায় সবটাই ওনারা নিজেদের জমিতেই চাষ করেন, এমনকি চা টা ও ওনার মায়ের বানানো। তা এসব দেখে আমরা এবার গেলাম সামনের ভিউ পয়েন্টে, সবে মাত্র দুপুরের আহার সেরে লেপ মুড়ি দিয়ে কাঞ্চনদা শুয়েছেন এমন সময় আমরা হাজির।
তা তাকে তেমন বিরক্ত না করে ভাবলাম পরদিন ভোরে দেখা করবো। সেই মতো আবার হোমষ্টে তে গিয়ে সন্ধ্যার চা এবং তারপর রাত্রের খাবার সেরে ৪.৩০ এর এলার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম। এলার্ম বাজার আগেই আমার মায়ের ডাকে আমার ঘুম ভাঙল, যথারীতি জানলা দিয়ে আকাশের রং দেখে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে চটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে পরলাম আবার কাঞ্চন দার সাথে দেখা করতে। দুরবিনদার ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা কে দেখে আমি আপ্লুত, এ দৃশ্য মনে ভরে রাখার। কাঞ্চনজঙ্ঘা কে যতই দেখি ততই আরো দেখার ইচ্ছা টা বেড়ে যায়, পাহাড়ের কোলে বসে কাঞ্চন দার সাথে বসে ডিমের পোচ খেতে খেতে একটাই কথা ভাবছিলাম যে- পোচ is লাভ, কাঞ্চনজঙ্ঘা is ভালোবাসা..সব শেষে সকালের খাবার খেয়ে আবার বাড়ি ফেরার পালা, সকলকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আবার নিজের শহরের উদ্দেশ্যে , চেনা ছন্দে ফিরবার তাগিদে।
সামথার
চম্পা বিশ্বাস
দীপাবলীর আনন্দ শেষ হয়েছে এক মাসও হয়নি। এরমধ্যেই বাইরে বেড়াতে যাবার জন্য মন খুব অস্থির হয়ে উঠেছে জয়ার। হেমন্তের এই মিঠেল রোদে বেড়াতে যাওয়া যে বড়োই পছন্দের জয়ার কাছে। সবাই বলে ওর পায়ের তলায় নাকি সর্ষে। তা হবে হয়তো। বেড়াতে যাওয়ার জন্য ওদের পাঁচ জনের একটা দল আছে। বিভিন্ন বয়সের ভ্রমণ পিপাসু মহিলা এই দলের সদস্যা।
মোবাইল হাতে নিয়ে সকল ভ্রমণ সঙ্গিনীকে ফোন করে সে। ঠিক হয় এবার এক রাতের একটা ছোট্ট ভ্রমণ হবে। সেইমতো নেট ঘেঁটে ঠিক হয় সামথার যাবার। কালিম্পঙ এর সামথার হল একটি অফবিট ঠিকানা ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য।
দুইদিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা করে ঠিক শনিবার সকাল আটটায় জলপাইগুড়ি থেকে একটা বোলেরো করে ওরা পাঁচজন সামথারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথে ওদলাবাড়িতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে , চা জলখাবার খেয়ে আবার রওনা হয় সামথারের উদ্দেশ্যে। যাত্রাপথে ওদলাবাড়ি, বাগরাকোটের চা বাগানের সবুজের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করে মন আনন্দে ভরে ওঠে ওদের । চলে প্রকৃতির প্রচুর ছবি তোলা , গান, গল্প। এই পথ ওদের খুবই চেনা , তাও জয়ার আজ বড়োই সুন্দর লাগে এই পথ ও তার আশপাশকে। ও একভাবে তাকিয়ে থাকে জানালা দিয়ে। এইভাবে ওদের গাড়ি এগিয়ে চলে করোনেশন ব্রীজ, কালিঝোরার ওপর দিয়ে। কালিঝোরা পেরিয়ে গাড়ি যত ওপরে ওঠে প্রকৃতি ততই যেন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে ওদের অপেক্ষায়। ওপর থেকে আঁকাবাঁকা তিস্তার অপরূপ সৌন্দর্য ওদের মনকে প্রশান্তি দেয়। সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সৌন্দর্য ওকে আরও আকৃষ্ট করে।
প্রকৃতির সৌন্দর্য এইভাবে উপভোগ করতে করতে ওরা এসে উপস্থিত হয় পানবুদারা ভিউ পয়েন্টে। গাড়ি থেকে নেমে ওরা ভিউ পয়েন্টে এসে দাঁড়ায়। ওপর থেকে তিস্তা নদীর গতিপথ আর করোনেশন ব্রীজের ছবি বেশ স্পষ্ট। ওরা বেশ কিছু দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে। ভিউ পয়েন্টের উল্টোদিকে একটি শিবমন্দির রয়েছে। ওরা পায়ে হেঁটে সম্পূর্ণ জায়গা ও মন্দির পরিদর্শন করে আবার রওনা হয় সামথারের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হোম কলিং সামথার নামক হোম স্টে তে পৌঁছে নিজেদের জন্য নির্ধারিত রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে নেয়। এরপর সকলে মিলে বেরিয়ে পরে গ্রামের শোভা উপভোগ করার জন্য। ছোট্ট গ্রাম্য জনপদে সহজ সরল মানুষের বসবাস। ছোট্ট অথচ পরিচ্ছন্ন গ্রামীণ হাসপাতাল, চার্চ ও আশপাশের প্রকৃতি দেখে ওরা খুুবই আনন্দিত হয়। কিছু টার্কিও ওদের চোখে পরে। এরপর ওরা হোম স্টে তে ফিরে চা পকোড়া সহ আড্ডায় বসে। চলে গান, স্বরচিত কবিতাপাঠ,গল্প। ডিনার শেষে পরদিন সকালে কাঞ্চনজঙঘা দেখার অপেক্ষা নিয়ে সকলে বিছানায় যায়।
সূর্যোদয়ের বেশ কিছুক্ষণ আগে উঠে গরম জামাকাপড় পরে ওরা সকলে বারান্দায় এসে বসে। এক মুহূর্ত সময়ও ওরা নষ্ট করতে রাজি নয়। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এ যেন এক অন্য সূর্যোদয়। চারিদিকে লাল আভা ছড়িয়ে পাহাড়ের ফাঁক থেকে যেন সূর্যের আগমন। সূর্যের আলোয় যখন চারিদিক আলোকিত হয় ঠিক তখনই ঝলমলে শুভ্রতা নিয়ে বহু প্রতীক্ষিত কাঞ্চনজঙ্ঘার আবির্ভাব ঘটে। কাঞ্চনজঙ্ঘার এই অপরূপ শোভায় সকলের মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সকলেই প্রাণ ভরে উপভোগ করে সেই দৃশ্য। লাঞ্চের আগ পর্যন্ত ওরা বারান্দায় অবস্থান করে। লাঞ্চ সেরে সকলে রওনা হয়ে পানবুদারা ভিউ পয়েন্টকে শেষ বারের মতো প্রত্যক্ষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় আর সাথে নিয়ে আসে এক বুক ভালোলাগা যা ওদের কর্মব্যস্ত জীবনে চলার
হেমন্ত স্মৃতি
বিজয়া সম্মিলনী
বিপ্লব তালুকদার
সেই আকাশে নীল পেঁজা তুলোর মেঘেদের আনাগোনা আর দুধসাদা কাশফুলের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিলো বাঙালী তথা আমাদের শারদোৎসব। ধীরে ধীরে তা শেষ পর্যায়ে এসেছে, শুরু হয়েছে পুজো শেষে বিজয়া উৎসব। হ্যাঁ উৎসবই বটে আমাদের কাছে। সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছি বিজয়া , দশমী শেষ হলেই শুরু হতো বাড়ির বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম,এরপর তা বাড়ি এবং পাড়ার সীমা ছাড়িয়ে সময়ে নিকটবর্তী দূরেও পৌঁছে যেতো। সঙ্গে ছিলো নাড়ু মোয়া তোক্তি ,যা কিছু হতো সবটাই বাড়ির তৈরি। তখনকার দিনে ঠাকুমা পিসি দিদা মা এনারাই বানাতেন । এবং যথারীতি যা হতো সময়ের আগেই সব শেষ। বেশিরভাগ টাই যেত আমাদের অর্থাৎ বাড়ির ছোটদের পেটে। তারজন্য অবশ্যই হালকা ধরনের একটা বকা ঝকা হতো।
পাড়ার বন্ধুদের বাড়িই হোক বা পাড়াতুতো আত্মীয় সবার বাড়িতে যে দুটো দিন অবশ্যই যেতাম তার একটা ছিলো বিজয়া দশমী আর একটা লক্ষী পুজো। এরপর ছিল বিজয়ার চিঠি চালাচালি, বাবাকে দেখতাম পোষ্ট অফিস থেকে পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড লেটার নিয়ে আসতে এবং সব আত্মীয়দের বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে চিঠি দেয়া। উত্তরও আসতো, একটু কয়েকদিন দেরি হলেই মা বলতেন দেখতো অমুকের চিঠি আজও এলো না। এখন এসব প্রায় উঠে যাবার অবস্থা, বেশিরভাগই এখন মোবাইলে বিজয়ার শুভেচ্ছা বা প্রণাম ভালোবাসা জানানোর রীতি । আর খাওয়া দাওয়া তা এখন কর্পোরেট পর্যায়ে। বেশিরভাগ দোকান থেকে কেনা আর একটু কায়দা করলে বড় রেস্টুরেন্টে বা হোটেলে ভোজন।
বিজয়া আসলেই আরেকটা জিনিস মনে পরে বিজয়া সম্মিলনী। আগে দেখতাম পাড়ার বড় ছোট মিলে হৈ হৈ করে একটা চটজলদি হাতে গরম অনুষ্ঠান করতো। সেখানে কোনো রাজনীতি থাকতো না কূটকাচালি থাকতো না যা থাকতো তা এক নিখাদ নির্ভেজাল আড্ডা। সঙ্গে গান বাজনা। এবং অবশ্যই খাওয়া দাওয়া। আজকাল সব যেন কেমন পাল্টে যাচ্ছে, বিজয়া সম্মিলনী হচ্ছে তা রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায়, সেখানে যত না ঘরোয়া অনুষ্ঠান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তত বেশি।
সব দেখে মনে হয় আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।
হেমন্ত রম্য রচনা
কৈলাশে ফিরে
স্বপন কুমার দত্ত
দশমীতে মা দুর্গা সপরিবারে ফিরে গেলেন কৈলাশে। রাস্তার যা অবস্থা তা আর কহতব্য নয়। রাস্তা না চষা ধানক্ষেত ঢাওর করা যাচ্ছিল না। হাড়গোড় সব ঠিকঠাক আছে কিনা একবার দেখিয়ে নিতেই হবে দেব বৈদ্য অশ্বিনীকুমার ভ্রাতৃদ্বয়কে।
কিন্তু বাড়ির অবস্থা দেখে উমার চক্ষু একেবারে ছানাবড়া। সাড়ে চারদিন মাত্র বাড়িতে নাই, ঘরদোর একেবারে যাচ্ছেতাই। ছন্নছাড়া স্বামী এই কয়েকদিন নন্দী ভৃঙ্গী গাঁজারু দুটোর সাথে নেশা ভাং করে একদম বুঁদ হয়েছিল। ইস কী নোংরারে বাবা! দুর্গা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে লেগে পড়লেন ঘর সাফাইয়ের কাজে। কৈলাসেও এখন মর্ত্যের মত কাজের লোকের অভাব। সবাই এখন মর্ত্যের মতো দু পয়সা হাতে পেয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। এখানেও নানা ভান্ডারের ছড়াছড়ি।
লক্ষী সরস্বতীও মার সাথে কাজে হাত লাগায় ,ব্যতিক্রম শুধু কাতো আর গনা। ওদের নাকি নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। জ্বর জ্বর লাগছে। ইতিমধ্যেই ভোলানাথ এসে হাজির। ছেলেদের অসুস্থতার খবর শুনে বলে উঠলেন, " তোমাদের মামার বাড়ির দেশে যে হারে ডেঙ্গু হচ্ছে, দেখো আবার সেই রোগ বাধিয়ে এলে কিনা? ওখানেতো স্বাস্থ্যব্যবস্থা কবেই ভেঙে পড়েছে। আবর্জনা পরিষ্কার করার কেউই নেই। সব গেছে মরে হেঁজে।" উমা মুখ ঝামটা দিয়ে বকে উঠলেন, " সবসময় আমার বাপের বাড়ির
দেশের নিন্দা। ডেঙ্গিতে ওদের লেঙি মারেনি। আসলে এবার আমার বাপের বাড়ি থাকার সময় লাগাতার বৃষ্টিতে ভিজে ওদের ঠান্ডা লেগে গেছে। একবার বরুণদেবকে দেখতে পেলে হয়। ওর পিঠে যদি চড়াম চড়াম করে ঢাক না বাজাই, তবে আমার নামও দুর্গা নয়।"
শিব একটু মুচকি হেসে বললেন, " তা কেমন ঘরে তোমরা ছিলে? উপরের ছাওনি দিয়ে কি জল পড়ছিল? ভালো পলিথিনও জোটেনি?"
সরস্বতী বলে উঠলেন, " বাবা সবাই ব্যস্ত শুধু থিম নিয়ে,লাইট নিয়ে আর কে কার আগে ফিতে কাটবে তাই নিয়ে। আমাদের দিকে দেখার তাদের সময় কই?" শিব বলে উঠলেন, " তাইতো বলি, মর্ত্যে যাওয়া আর মরতে যাওয়ার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। অনেকদিনতো যাওয়া হল, এবার ওসব ছাড়ো।কিন্তু কে শোনে কার কথা?"
দুর্গা এবার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন," বাইরে গেলে একটু আধটু অসুবিধা হতেই পারে। সব মানিয়ে নিতে হয়। একবার কি ভেবে দেখেছো, আমাদের বছরে একবার যাত্রার ফলে কত কোটি টাকার ব্যবসা হয়? এমনিতেই মর্ত্যধামে বেকারে বেকারে ছয়লাপ। তাদের কেউ চা বিক্রি করছে,কেউ কচুরিপানার পাতা দিয়ে ব্যাগ বানিয়ে বসে আছে ( বিক্রী হচ্ছেনা), কেউ চপ ঘুগনি বিক্রী করছে।এরা সবাই কিন্তু শিক্ষিত।
আমরা না গেলে কী হত এদের হাঁড়ির হাল?"
" ঠিক আছে, তোমার বাপের বাড়ি তুমি যাবে, আমার কী বলবার আছে! তা এবার ওখানে খাওয়া দাওয়া কেমন হলো"-- মহাদেব জিজ্ঞেষ করলেন। এবার গনেশ বলে উঠলো, " আর সেকথা বলনা বাবা। ওই গরু ছাগল পর্য্যন্ত যেই আতপ চাল খায়না, সেই চাল আর বিচি কলা খেতে খেতে আমার ভুঁড়ি শুকিয়ে আমসত্বের থেকেও পাতলা হয়ে গেছে।" শিব আহারে আহারে বলে গণেশকে আশ্বস্ত করেন।
পুত্র কন্যা সহ মহাদেব ঠিক করলেন,আগামী বছর যাওয়ার সময় চিন্তা ভাবনা করতে হবে। এতসব অসুবিধা নিয়ে যাত্রা হবে কিনা ভেবে দেখতে হবে। প্রয়োজনে নারদকে আগে পাঠিয়ে খোঁজ খবর নিতে হবে।
ভাগ্য ভালো,এই আলোচনার সময় দুর্গা ঘরে ছিলেননা, রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। দেখা যাক আগামী বছর কী হয়!
হেমন্ত কবিতা
হেমন্তিকা
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
সবুজ আলপথ বরাবর খন্ড খন্ড কুয়াশার মেঘ
যেন হিমশৈলের চুড়া হয়ে ভেসে বেড়ায়,
হিমের পরশ মাখা চাদর গায়ে জড়িয়ে নেয়
একফালি রঙিন ক্যানভাসের জলছবি।
কাঁচা পাকা ধানের শীষের উল্লাস চারিধারে,
অস্ফুটে গান শোনা যায় শেষ রবির রক্তছটায়,
দূরে নীল দিগন্ত জুড়ে যেন কোন অদৃশ্য হাত
রঙ তুলির ছোয়া বুলিয়ে দেয় সবার অজান্তে।
করলার নদীর গা ঘেঁষে কালচে সবুজ বনানী
হাতছানি ভেসে আসে, গান গেয়ে যায় নদী তীরে
আনমনা উদাস বাউল, সেই হেমন্তের চেনা গান
ছট ঘাট সেজে উঠেছে কিং সাহেব এর ঘাটজুড়ে
প্রেমরীনা মজুমদার
আকাশে শিশির ভেজা মেঘ
বাতাসে স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়া
মাঠ জুড়ে সবুজ আঁচল, কপালে রাঙা টিপ
আমি তাকে হেমন্তিকা বলে ডাকি..
সোনালী ধানের গন্ধে তার প্রেমে পড়ে যাই
প্রেম কি শুধু মানুষে মানুষেই হয়?
হেমন্ত নিজেই নিজেকে লেখে
মাটির বুকে আশাবাদী কবিতা
ডুয়ার্সের আকাশে পূর্ণ চাঁদ
নীচে নদী, ঘন অরণ্য
পাহাড়ে ঝলমলে আলো, হয় দৃষ্টি বিনিময়
ভাবি, আজ পর্যন্ত কত যে অজস্র বর্ষা
মাটি ছুঁয়ে চলে যায়!
হেমন্ত উল্লসিত! বলে, 'বর্ষা আমাকে প্রসূতি করেছে
প্রসূতি কি শুধু মানুষে মানুষেই হয়?
হেমন্ত নিজেই নিজেকে লেখে
নবান্নের গল্প ও গোলাভরা
সাদা ভাতের উপন্যাস....
যন্ত্রণামুক্তি
রাণু সরকার
নির্জনে ঘন অন্ধকারের আড়ালে শব্দহীন অনুদ্ধত মনের যন্ত্রণারা একা বসবাস করে,
আগুনের কণায় যন্ত্রণার ডানায় লাগে তাপ,
তাপ লাগাটা আনন্দ উৎপাদনকারী।
সূর্যরশ্মির মতো সোহাগ ছড়িয়ে পড়ে এক সুদৃশ্য রূপে,
চার পাশে করে বেষ্ঠন
যন্ত্রণা থেকে দেয় মুক্তি!
হেমন্তে
মাথুর দাস
শরৎ মেঘের পরত গেলে সরে
শান্ত আকাশ হয় যে নীলে নীল,
উড়তে থাকে শূন্য আকাশ ভরে
উদাস মনে একাকী শঙ্খচিল ।
সোনালী রঙের শোভা ধানখেতে,
কাশ নতমুখ শতধা শীর্ষে হায় !
ছাতিম ফুলের মদির সংকেতে
শিউলি অঝোর ঝরছে মূর্ছনায় ।
জল-কমা ওই পুকুর খাল বিলে
কী উল্লাস গ্রামের মানুষ জনের !
হুল্লোড়ে মাছ ধরছে সবাই মিলে,
তুলনা কোথায় সেই দৃশ্য-ক্ষণের !
প্রান্তর জুড়ে অলস সন্ধ্যা নামে,
শিশির বিন্দু মাখে রাতের ঘাস ;
হিম-শিহরণ আজ ঋতু-সংগ্রামে,
জানি হেমন্ত যে শীতের পূর্বাভাস ।
হৈমন্তী
কুমার বিজয়
তুমি যে বার্ষিক গতিতে ফিরে আসো,
সোনালী আভায়,
বুকের ভেতর বাসা বাঁধে মুগ্ধতা,
একটা শীত শীত গন্ধ অনুভূত,
তোমাকে ষোড়শী কিংবা অষ্টাদশী রূপে আঁকি,
প্রতিদিন গোধূলিতে হারিয়ে ফেলি জানো!
সব আনন্দ সমাপ্ত হলে,
দিগন্ত জুড়ে তোমাকে খুঁজে মরি,
তোমার আসা-যাওয়া বিষাদেেও আনন্দ,
তুমি জানো আমি শীত ঘুমে যাচ্ছি,
তোমাকে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন,
বেলি ফুলের মালা হাতে জড়িয়েছি,
পাতা খসানোর সময় হবে,
বসন্ত আসবে বলে,তোমাকে ভুলিনি,
দহনের পোড়া কাঠ সাক্ষী আছে।
অমৃত অন্নের মাঠ
অলকানন্দা দে
ঘন ফসল, ভরাট শিষের প্রাণ
সুখ উপচে ছড়ায় ভাতের গন্ধ
শত ছবি ভাসে চোখের সরোবরে
কথা গড়ে নেয় ঠোঁটের শব্দবন্ধ!
হেসে গড়ায় হৈমন্তী হাওয়া
যাযাবর পাখি আপন করেছে তাকে
সোহাগী রোদ ফসলী মাঠের পরে
গোধূলি বাসরে পুণ্য ছবি আঁকে!
হেমন্ত তুমি যখন-তখন ভালো
প্রমাণের দায় ছুঁড়ে ফেলে দাও তাই
আদর্শে ঠাসা সাবেকি জলবায়ু
স্মৃতি অভিযানে তোমার সঙ্গ চাই!
ঝাপসা হিমে মাধুকরী করে কাব্য
ভোরের রশ্মি অক্ষর জ্বালে বুকে
ছেঁড়াখোঁড়া বাঁচা মুলতুবি রেখে আজ
সংসার সাজে যেন ফুটফুটে সুখে!
তারার ঝলক এ-আকাশ ও-আকাশে
আলোর গুঁড়োয় কিসের গুঞ্জন!
জীবনানন্দ পড়ছে সন্ধ্যাতারা
বনলতা সেনে পড়ে আছে তার মন!
আশারা আজ ফসল হয়ে ফোটে
বুকভরা স্নেহে তাকিয়ে থাকো তুমি
আমি অপত্য আঁচল জড়িয়ে ধরি
বুকের পৃষ্ঠা নিভাঁজ জন্মভূমি!
সম্পর্ক
রূপক রায়
আবেগ গুলো লুকিয়ে রাখি একাকী
সম্পর্কের কংক্রিটে
একটা রাতের রহস্য
নদীর ঢেউয়ের মতো এগিয়ে চলে
ভীষণ গম্ভীর মন খারাপের খামখেয়ালি
বিধ্বংসী সাইক্লোন
সব উড়িয়ে গুড়িয়ে লণ্ডভণ্ড করে
হারিয়ে গেলো বাংলার মাঠে বনে জলে জঙ্গলে
অসমাপ্ত জীবনের মতো।
অনাড়ম্বর অসাড় জীবনের কী লাভ,
পিছুটান হীন হয়ে পাষাণ শিলার মতো
মেঘ হয়ে জমে ঝড়ে যাবো অবিরাম...
এখানে আকাশে একটিও তারা নেই
অন্ধকার ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার
আলো নেই,আলো নিভে গেছে,আলো জ্বলে না
লকলক করছে তার চোখ
ফিরবে না সে আর
ফিরবে না কোনোদিন।
হেমন্ত ঊষা
আকাশলীনা ঢোল
দীর্ঘ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে
হঠাৎ ডাক পাখির চিৎকার,
যেন আঁধারের বিরুদ্ধে তার ক্ষীণ প্রতিবাদ।
ঘন ধোঁয়াশা গ্রাস করেছে
কার্ত্তিকের এই ঊষালগ্নটিকে-
পূর্ব দিগন্তে লাল আলোর আভাস।
অন্ধকার আকাশের বুক চিরে
দু-একটা আকাশপ্রদীপ জ্বলছে তখনও-
অমানিশার রাতের দূর আকাশের
উজ্জ্বল তারার মতো।
তীব্র হর্ন বাজিয়ে রওনা হল
দিনের প্রথম ট্রেন,
তার আওয়াজ অনেকটা
ঘুম ভেঙে যাওয়া রাত্রির
আর্তনাদের মতো।
হিমেল হাওয়ার সঙ্গী হয়ে
দু-একটি পথচারীর আনাগোনা,
আরও দু-একটি পাখির
কোমল-কোমল শিষ,
আর পাতা ঝরে যাওয়া গাছের
নতুন পাতার অপেক্ষা।
উৎসব শেষের ভোরের অপেক্ষা
উৎসব শেষের রাতের,
হেমন্ত ঊষার অপেক্ষা হেমন্ত গোধূলির।
হেমন্তের বিকেল
সীমা সাহা
হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে
হলুদ শাড়িতে সেজেছে কিশোরী।
পায়ে তার নুপুর বাজে
পাহাড়ি ঝর্নার তালে।
সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমাকাশে,
রঙের ছটা ছড়িয়ে পড়ল
আকাশ জুড়ে।
পাহাড়ি নদীর ধার দিয়ে
হেঁটে চলেছে কৃষকের দল
মাথায় তাদের ধানের বোঝা,
শ্রান্ত তাদের মুখে,
হেমন্তের হিমেল হাওয়ায়
ডুবন্ত সূর্যের আলোতে
উজ্জ্বল হলো মুখ।
নদীর জল সূর্যের রঙে বদলে গেছে র়ঙ।
কিশোরী মেয়ে নদীর কুলে দাঁড়িয়ে,
সূর্য রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে
উজ্জ্বল হলো দেহ।
আমিও মেখে নিলাম
ডুবন্ত সূর্যের রঙের ছটা
মন যেন আমার ফিরে গেল
কিশোরী বেলায়।
হেমন্ত ফিরে আসেনি সারণ ভাদুড়ী
হেমন্ত এখনো আসেনি,
ফিরে আসেনি।
স্বপ্ন শুধুই থাকলো অধরা,
হৃদয় বনেতে কড়া নাড়ে কারা?
গন্তব্য এখনো দূর!
এখানে হেমন্ত তখনও আসেনি।
হলুদ পাতায় ভরে গেছে মন
ধান তবুও পাকেনি,
হেমন্ত এখনো আসেনি।
হয়তো এটাই তার সমাপ্তি!
কবির কলম তবু থামেনি কেন?
মাঝ দরিয়ায় মিশে যাই আমি
হাজার লোকের মাঝে ,
অপেক্ষা করি তখন আমি
হয়তো হেমন্ত আবার আসবে ফিরে।।
কার্তিকেমজনু মিয়া
খেতে খেতে ধান
কৃষকের গান
গোলা ভরে সোনা ধানে
খুশি অভিমান।
জুড়ায় এ প্রাণ
মিষ্টি যে ঘ্রাণ
গৃহিণীর মুখে হাসি
ভুলে যায় ত্রাণ।
শিশিরের বায়
শরীরের গায়
শীত শীত লাগে কিছু
আলো কি বা ছায়।
হেমন্ত ছবি
সুজল সূত্রধর
মুজনাই অনলাইন কার্তিক সংখ্যা ১৪২৯